এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ১১ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ আগস্ট ২০২৩ | ৪১৭ বার পঠিত
  • লাইটহাউসে অনিমেষদের সিনেমা দেখতে যাওয়া এ সপ্তাহে হল না কারণ উৎপলের বাবা একটু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। যে কারণেই হোক মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। এক মিনিটের মতো অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। ডাক্তার হরিপদ মিত্র এসে তাকে সবরকম পরীক্ষা করে বললেন, ' ব্লাড প্রেসারটা একটু হাই আছে ... একটা ই সি জি করিয়ে নেওয়া ভাল ... পাঁচমাথার মোড়ে সাধনা ঔষধালয়ের  ওপরে একটা ক্লিনিক আছে ... ভালই করে। এখন থেকে প্রেসারের ওষুধ খেতে হবে ... লিখে দিয়েছি। সাতদিন পরে জানাবেন ... না না ভয়ের কিছু নেই ... এক সপ্তা রেস্ট নিন ... '
    উৎপলের কাকা ডাক্তারবাবুর ব্যাগটা ধরে তাকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

    অনিমেষদের লাইটহাউসে যাওয়াটা আপাতত আটকে গেল, তবে ইতিমধ্যে সিনেমার নামটা জেনে নিয়েছে উৎপল ...  দি ব্রিজ অন দা রিভার কোয়াই।  

    শ্যামবাজার মোড়ের কাছে রামদুলাল দাস-এর দোকান। দোকানটায় ঢুকলেই কেমন নতুন জামাকাপড়ের কোরা গন্ধ এসে স্নায়ুতে জড়িয়ে যায়। কেমন যেন পুজো পুজো গন্ধ। সন্ধেবেলায় নিতাইবাবু স্ত্রীর সঙ্গে দোকানে ঢুকলেন। উদ্দেশ্য নিতাইবাবুর জন্য একটা পপলিনের পাঞ্জাবী কেনা। নিতাইবাবুর 'এসব বাজে খরচ করার' ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অঞ্জলি বলল, ' লোকের জায়গায় যেতে গেলেও তো দু একটা জামা কাপড় লাগে ... '
    ----- ' আরে বাবা ...  যা আছে ওতেই হবে ... কে আমার জামাকাপড় দেখছে বল তো ? '
    ----- ' আছে আছে ... যারা দেখার ঠিক দেখবে ... তুমি তো বোঝ না এসব ... '
    সাদা ধবধবে একটা পপলিনের পাঞ্জাবী কেনা হল। বারো টাকা দাম পড়ে গেল। 
    ওখান থেকে বেরিয়ে নিতাইবাবু বললেন, ' তুমি কি একটা কিনবে বলছিলে ... '
    ----- ' একটা আটপৌরে শাড়ি কেনার দরকার ছিল ... এ মাসে থাক ... একমাসে এত খরচ টানা যাবে না  ... পরের মাসে নয় ... '
    ----- ' না না  ... ও ঠিক আছে ... আজকেই কিনে নাও .... ও ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। কোন দোকানে ... '
    ----- ' ওই ওপারে যশোদায় চল .... যশোদা স্টোর্স... সস্তা পড়বে .... '
    ওরা রাস্তা পার হয়ে ওদিকে গেল। যশোদার দিকে যেতে যেতে অঞ্জলি বলল, ' নিবারণবাবু কবে জমি দেখাতে নিয়ে যাবে ? '
    ----- ' এ রবিবারে তো যেতে পারল না ... বলেছে  তো সামনের রবিবার... দেখা যাক কি করে .... '
    যশোদা স্টোর্স থেকে অঞ্জলির শাড়ি কেনার পর্ব অবশ্য অত তাড়াতাড়ি মিটল না। চল্লিশ মিনিটের মতো লেগে গেল। শাড়ি পছন্দ হয় তো দামে পোষায় না, দামে পোষায় তো শাড়ির রঙ পছন্দ হয় না। জমির রঙ পছন্দ হয় তো আঁচল পছন্দ হয় না। জমি, আঁচল, দাম সবকিছু জুতসই হয়েও দুটো শাড়ি বহরে কম বলে ডিস্কোয়ালিফায়েড হয়ে গেল। তিতিবিরক্ত দোকানদারকে দিয়ে অঞ্জলি বান্ডিলের পর বান্ডিল নামাতে লাগল। নিতাইবাবু ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। দোকানদারের অপ্রসন্ন মুখ দেখে তার মনে হতে লাগল, যে কোন মুহুর্তে সে বিস্ফোরিত হবে। তাকে আরও খদ্দের সামলাতে হচ্ছে। যে কোন জায়গায় অপমানজনক কথাকে নিতাইবাবুর ভীষণ ভয়। এ সব কাঁটাভরা কথার তিনি কখনোই সপ্রতিভ মোকাবিলা করতে পারেন না। তাই সন্তর্পনে তার স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ' এ.. ই তো ... এটা একেবারে বেস্ট ... এটাই নিয়ে নাও ... আর মেলা ঘাঁটাঘাঁটি করো না ... বিরক্ত হচ্ছে ওরা ... '  
    অঞ্জলি নিতাইবাবুর দিকে ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল, ' কিসের বিরক্ত .... টাকা দিয়ে জিনিস কিনব ... দেখে নেব না ... আশ্চর্য কথা ! বিরক্ত হলে হবে ... তোমার যদি দাঁড়াতে অসুবিধে হয় ওখানে ওই  টুলটায় গিয়ে বোস না ... '
    যাই হোক, আরও মিনিট পাঁচেক পরে, মানে দোকানদার অগ্নুৎপাত ঘটাবার ঠিক পূর্বমুহুর্তে সৌভাগ্যক্রমে একটা সন্তোষজনক ফয়সালা হয়ে গেল। 
    একটা শাড়ির ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। যদিও আঁচলের ডিজাইন নিয়ে দোলাচলের মধ্যে ছিল অঞ্জলি। নিতাইবাবু নিজস্ব উদ্যোগে মধ্যস্থতা করে ব্যাপারটা সামলে দিলেন। বললেন, ' এই নক্শাটাই চলছে এখন ... বুঝলে ... ' 
    ------ ' ওঃ , তুমি যেন নক্শার কত বোঝ ... ' বলল অঞ্জলি।  যাই হোক ওই শাড়িটাই ফাইনাল হল শেষ পর্যন্ত। 
    এর পরও অবশ্য শাড়ির দাম নিয়ে দর কষাকষি চলল আরও খানিকক্ষণ। অঞ্জলি তার পাড়ার সুখ্যাত বারগেনার।  সহজে হার মানার পাত্রী নয়। সে কুড়ি টাকার শাড়ি ষোল টাকায় নামিয়ে ছাড়ল।
    দাম মিটিয়ে দিয়ে নিতাইবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। 
         
    দোকান থেকে রাস্তায় বেরিয়ে নিতাইবাবুর খুব ইচ্ছে হতে লাগল হরিদাস মোদকে গিয়ে ঢুকতে।
    কিন্তু তিনি লোভ সম্বরণ করলেন। অতগুলো টাকা এক ধাক্কায় বেরিয়ে গেল। ভাবলেন, একদিনে খর্চা আর না বাড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

    অঞ্জলি বলল, ' চল হাঁটি ... এ রাস্তাটায় হাঁটতে খুব ভাল লাগে। দুপাশ কেমন জমজমাট। দোকানপাট, কত সিনেমা হল ... স্টার থিয়েটার।
    নিতাইবাবু বৌয়ের প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হলেন।
    তারা দুজনে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে রূপবাণী সিনেমা হলের কাছে গিয়ে পৌঁছলেন। ওখানে  দীপ জ্বেলে যাই বলে একটা সিনেমা চলছে। হলের গেটের ওপরে বিরাট করে সুচিত্রা সেনের বেদনাতুর মুখ। ক্যানভাসের ওপর মুখের চারপাশে নীল সাদা স্লেট রঙের হাল্কা শেড। পিছন দিকে কোনাকুনি একটু আবছা শেডে নায়ককে দেখা যাচ্ছে। 
    অঞ্জলি 'একটু ফটোগুলো দেখে যাই ' বলে টিকিট কাউন্টারের ওখানে যে জায়গাটা সেখানে ঢুকে পড়ল । একপাশে  সিনেমার কিছু দৃশ্যের ফটো  লাগানো আছে । সেই ছবিগুলো হাঁ করে দেখতে লাগল। দেখা হয়ে গেলে বলল, ' নায়ক বোধহয় বসন্ত চৌধুরী .... নাও চল ... দেখতে হবে বইটা । ওদের বলতে হবে ... যদি আসে ... '
    'ওদের' মানে বিভূতিবাবু এবং অনিলবাবুর ঘরণী।
    রূপবাণীর পাশে ইস্টার্ন রেলের বুকিং কাউন্টার। তার সামনের চওড়া রোয়াক। গুচ্চের লোক অলসভাবে বসে আছে। বুড়োর সংখ্যাই বেশি। দুজন একমনে দাবা খেলে চলেছে। সামনে দিয়ে একটা দোতলা ২বি বাস গেল। পেছনে একটা ট্রাম আসছে টং টং করতে করতে। রোয়াকের সামনে  সুতো লাগিয়ে বিশ্বকর্মা পুজোর মাঞ্জা দেওয়া চলছে ফুটপাথের ওপর।
    নিতাইবাবুরা হাঁটতে হাঁটতে  বসন্ত কেবিনের সামনে এসে পড়লেন। ভিতর থেকে মোগলাই পরটা ভাজার মন মাতানো গন্ধ ভেসে আসছে। নিতাইবাবু ভেবে দেখলেন একটাকা চার আনা করে মোট আড়াই টাকা যাবে দুজনে খেতে গেলে। কিন্তু নিজের অজান্তেই নিতাইবাবুর চলা থেমে গেল বসন্ত কেবিনের দোরগোড়ায় এসে। এক মুহূর্তের জন্য দম্পতি একে অপরের দিকে তাকালেন, তারপর ঐকমত্যের ভিত্তিতে দুজনে ঢুকে পড়লেন রেস্টুরেন্টের মধ্যে ।

    ( চলবে )

    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২১ আগস্ট ২০২৩ ০৩:৪৬522759
  • ছবির পর ছবি।  আর গন্ধ। 
     
    আমি মুগ্ধ  , উড়ে গেছো,  ফিরে এসো চাকা।
  • Anjan Banerjee | ২২ আগস্ট ২০২৩ ১৬:৫৫522839
  • অজস্র ধন্যবাদ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন