এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ৮ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ আগস্ট ২০২৩ | ৩০৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • আজ কাবেরী কলেজে আসেনি । কালই বলছিল শরীরটা ভাল নেই , জ্বর জ্বর লাগছে । দেড়টা বাজে । একটা অফ পিরিয়ড আছে এখন । ক্লাসের দু তিনজন গেটের বাইরে এসে  ঘুগনিওয়ালার কাছ থেকে ছোট ছোট গোল গোল আলুর দম কিনে খেতে লাগল । সুপর্ণা বলল, ' ঝোলটার কি টেস্ট ... না ? আর একটু দাও তো ... '
    ওর দেখাদেখি দীপালিও শালপাতার পুরিয়াটা বাড়িয়ে ধরে .... ' এই যে .... আমাকেও একটু ... '
    ঘুগনিওয়ালা তিনজনকেই একটু একটু দেয় ।
    আজ আকাশ বেশ মেঘলা । চারপাশে বাদলের
    ছায়া ছেয়ে আছে । রাধাচূড়ার হলুদ ফুলে ভরে আছে বেথুন কলেজের সামনের ফুটপাথ । সুমনা বাইরে বেরিয়ে এল । আজ কাবেরী আসেনি , তার কি জানি কেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল।
    সে উল্টোদিকে হেদুয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।  রোজকার দেখা হেদুয়া পার্ক তাকে যেন নতুন করে  টানতে লাগল । 
    আলুর দম খাওয়া শেষ করে সুপর্ণারা এদিকে আসছিল । সুমনাকে একলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুপর্ণা বলল, ' ভাল মেয়ে একা একা কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে ?  দেখিস আবার এদিক ওদিক চলে যাস না যেন ... দিদিরা রাগ করবে ... '
    দীপালি আর অঞ্জনা হি হি হি ... করে হেসে উঠল ।
    সুমনা শুধু হাসিমুখে বলল,  ' তোদের তো আর অমন দিদি নেই ....কি আর বুঝবি তোরা ... '
    দীপালিরা আর কথা বাড়াল না । গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল ।
    সুমনা আস্তে আস্তে হেঁটে বিডন স্ট্রিট পর্যন্ত গেল ।
    ওখানে গিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়াল।  কি সব চিন্তা করতে লাগল । সে আর কিসের চিন্তা করবে ! তার জীবনে কোন সমস্যাই নেই , এটাই তার একমাত্র সমস্যা । তার মা এবং দুই দিদি তাকে কচি মেয়েটির মতো আগলে রেখেছে । পড়াশোনার ব্যাপারেও তার তেমন সমস্যা নেই । জিনগত কারণে সব ঠিকঠাক হয়ে যায় , তেমন কসরত না করেই । তার বাবা অবশ্য নানা কাজে সর্বদাই ব্যস্ত । তিনি নিজের জগতে থাকেন । মেয়েদের খোঁজখবর রাখার তেমন সময় পান না তিনি । এমনকি তার মেয়েরা কি পড়ে , কোথায় পড়ে সেটাও ঠিকমতো জানেন কিনা সন্দেহ  । সুমনার মা একদিন , কি একটা ব্যাপারে তার দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাকে বললেন , 'মেয়েদের নামগুলো জানা আছে তো তোমার ? ' 
    বিমলেন্দুবাবু অবিচলিতভাবে বললেন , ' তোমার তো জানা আছে ... তা'লেই হবে । একজন জানলেই যথেষ্ট ... '
    তিন মেয়ের মা সবসময়ে উৎকন্ঠার মধ্যে থাকেন । রাস্তাঘাটে বদ ছোঁড়াদের তো অভাব নেই । একটু দেখতে শুনতে ভাল মেয়ে দেখলেই হল ... । সুমনার মায়ের ভাবনার শেষ নেই । মেয়েরা পাত্রস্থ হবার পরও মেয়েদের নিয়ে তার নানাপ্রকারের দুশ্চিন্তা প্রশমিত হবে বলে মনে হয় না ।
    সে যাক, সুমনার হাতে এখনও আধঘন্টার মতো সময় আছে । সে আবার কলেজের গেটের দিকে ফিরতে লাগল । আবার গেটের সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে হেদোর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল , তারপর কলেজে ঢুকে গেল । 

       বিশ্বকর্মা এগিয়ে আসছে । ঘুড়ি ওড়ানোর মরসুম । এই মেঘলা দিনেও ঘুড়ি উড়ছে ইতিউতি হেদুয়ার আশপাশের আকাশে এই ভর দুপুরবেলায় । কোথা থেকে যেন আওয়াজ এল, ভো ... ও ...  মা...ড়া .... । কোথাও কারো ঘুড়ি নিশ্চয়ই কেটে গেল । 
    উকিল অনিল ঘোষ ব্যাগে কাগজপত্তর গুছিয়ে নিয়ে রওয়ানা দিলেন । আজ তার মক্কেলের হিয়ারিং-এর ডেট পড়েছে । বিভূতিবাবু মৌরলা মাছের টক দিয়ে ভাত খেয়ে উঠে আ...আঃ ... বলে এইমাত্র আঁচাতে গেলেন । টং টং টং করতে করতে শ্যামবাজার ডিপো থেকে ধর্মতলার ট্রাম এসে থামল রামদুলালের মুখে । লোক ঠাসা । মোহনবাগানের খেলা আছে আজ  । কতকগুলো কাক সমানে ডাকাডাকি করছে হেদুয়ার রাস্তার ধারের গাছগুলো থেকে । একটা মোটা মতো ধুতি পাঞ্জাবী পরা লোক হেদোর বেঞ্চে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে । রোদ্দুর নেই,  আকাশ পাঁশুটে । কেমন বাদলের  ছায়ামাখা চারপাশ । বেথুনের দেয়াল ঘেঁসে দুটো লোক খালি গায়ে বসে মন দিয়ে লুডো খেলছে ।  

        দুপুর দুটো । মাণিকলাল চাটুজ্জের বাড়িতে  ঘড়িবাবু নরেন পাল এসে হাজির হল । এ বাড়ির দোতলার বারান্দায় সাবেক আমলের একটা দেয়াল ঘড়ি লাগানো আছে কতকাল ধরে । ধুতি আর রঙীন ফুলশার্ট পরা নরেন পাল এসে একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ঘড়িতে দম দেয় সপ্তাহে একদিন করে । প্রতিবারই চাবিটা পকেটে পুরে টুল থেকে নেমে বলে , ' আর বেশিদিন পারব না বুঝলেন ছোটবাবু ... অঢেল বয়েস হয়ে গেল ... সেই বড়বাবুর আমল থেকে দম দিচ্ছি ঘড়িটায় ... ঘড়িটাও আমার মতো বুড়ো হয়ে গেছে । এখনও চালিয়ে তো যাচ্ছে নিয়ম ধরে । দুজনে বোধহয় একই সঙ্গে যাব । আর তো ক'টা  দিন .... '
    মাণিক চাটুজ্জে বলেন, ' আরে ... কি যে বলেন নরেনকাকা .... আপনি চলে গেলে আমরা অনাথ হয়ে যাব ... ও কথা মুখেও আনবেন না ... '
    মানিকলাল বাবুর বয়স বাষট্টি বছর । নরেন  পালের আশি । মাণিকবাবুর মা সৌদামিনী এখনও বেঁচে আছেন । তিনি বললেন, ' বালাই ষাট ...  ' । তারপর প্রতিবারের মতো আজকেও বললেন , ' অনেক বেলা হয়ে গেছে ... তুমি দুটো খেয়ে যেও নরেন ... ' ।
    ----- ' আ...বার কেন ... একেবারে নয় বাড়ি গিয়ে....'
    ----- ' না না ... খেয়ে যেও ... খেয়ে যেও  ... '
    ----- ' আ... চ্ছা ... ঠিক আছে জেঠিমা ... বলছেন যখন .... ' নরেন লাজুক মুখে বলে ।
    মানুষ মায়ার টান কাটাতে পারে না । ঘড়ি হোক কিংবা মানুষ হোক যত বাসি হয় মায়া ততই আরো ঘন হয়ে জড়িয়ে ধরতে থাকে ।
    এই যে মান্ধাতার আমলের একটা দেয়াল ঘড়ি , যার বাস্তবিক কোন আবশ্যকতা নেই এ যুগে,  তার নিয়মিত পরিচর্যা, সময় মতো আদর করে প্রাচীন এক ঘড়িবাবুকে দিয়ে দম খাওয়ানো এসব ঐকান্তিকতা ওই মায়ার ঝর্ণা থেকে উৎসারিত । আর কিছু না ।

         বিকেলবেলায় তিন মেয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরলে চন্দনা, বন্দনা আর সুমনার মায়ের ধড়ে প্রাণ এল । অন্তত আজকের মতো ঝঞ্ঝাট মিটল । খুব তাড়াতাড়িই একে একে তিনজনকেই পাত্রস্থ   করবেন এ ব্যাপারে তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন । তিনি লক্ষ করলেন , ছোট মেয়ের মুখটা যেন একটু শুকনো শুকনো লাগছে । তিনি ফের চিন্তায় পড়লেন । তিনি সুমনার কপালে হাত দিয়ে বললেন, ' হ্যারে .... জ্বর টর আসেনি তো ... মুখটা কেমন যেন ... '
    ----- ' না মা... কিচ্ছু হয়নি গো ... মুখটা কি হয়েছে? তুমি মিছিমিছি .... '
    সুমনার মায়ের হঠাৎ কি মনে হল, তিনি বললেন ,
    ' কাবেরী এসেছিল কলেজে ? '
    ----- ' না ... ওর জ্বর হয়েছে বোধহয় ... '
    ভদ্রমহিলা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ।
    বললেন, ' ও .... এবারে বুঝেছি মন খারাপের কারণ কি ... ' ।

          নিবারণ সাহা ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ঠিক এসে হাজির রাত আটটা নাগাদ । 
    ----- ' নিতাইবাবু আছেন নাকি ? ' বাইরে থেকে হাঁক পাড়ল ।
    ------ ' কে ... এ ... এ ... ' ভিতর থেকে নিতাইবাবু প্রত্যুত্তর দিলেন চা খেতে খেতে ।
    ----- ' আজ্ঞে আমি নিবারণ সাহা । ডাফ স্ট্রিটের দেবেন পাল মশায় আমাকে পাঠিয়েছেন ... ' ।

    ( চলবে )

    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন