এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    উত্তরের আলোয় অচেনা ইউরোপ এবং পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি - কিশোর ঘোষাল | গ্রন্থ পরিচয় – উত্তরের আলোয় অচেনা ইউরোপ এবং পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি দীর্ঘদিন আমরা ইংরেজদের দাসত্বে থাকলেও, আমাদের বাল্যে বিলেত অর্থাৎ ইংল্যাণ্ড সম্বন্ধে বেশ সমীহ জাগানো একটা ধারণা তৈরি করেছিলেন, আমাদের বিলেত-ফেরত ডাক্তার ও ব্যারিষ্টাররা। তাছাড়া ইউরোপের যে কটি দেশ সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল ছিল, সেগুলি হল, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি, স্পেন, গ্রীস ইত্যাদি। আরও কিছু দেশ যেমন, পোল্যাণ্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়াকে চিনতাম সে দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহের সুবাদে। এখনও মনে আছে, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্পগুলি, ইংল্যাণ্ডের “মহারাণি” মার্কা একঘেয়ে স্ট্যাম্পগুলির তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক ছিল। আরেকটা দেশের নামও মনে আছে - “নিশীথ সূর্যের দেশ” নরওয়ে! আলোচ্য গ্রন্থদুটি পড়া শেষ করে মনে হল, লেখকের হাত ধরে ইউরোপের ওই অচেনা-অজানা-অস্পষ্ট দেশগুলি থেকে এইমাত্র যেন ঘুরে এলাম। প্রথম গ্রন্থঃ উত্তরের আলোয় অচেনা ইউরোপ লেখকঃ হীরেন সিংহ রায়প্রকাশকঃ দে পাবলিকেশন্‌সপ্রাপ্তিস্থানঃ আদি দে বুক স্টোর, দে বুক স্টোর, দে’জ পাবলিশিং, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩এই গ্রন্থে তিনি নর্ডিক দেশগুলি - ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, আইসল্যাণ্ড, ফিনল্যাণ্ড এবং বাল্টিক দেশসমূহ এস্টোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় গ্রন্থঃ পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি (প্রথম খণ্ড)লেখকঃ হীরেন সিংহরায়প্রকাশকঃ গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনপ্রাপ্তিস্থানঃ এই গ্রন্থে পূর্ব ইউরোপের যে কটি দেশের কথা তিনি শুনিয়েছেন, সেগুলি হল, পোল্যাণ্ড, পূর্ব জার্মানি, রাশিয়া।* * *লেখকের ইউরোপের প্রবাস-জীবন শুরু হয়েছিল স্টেট ব্যাংক অফ ইণ্ডিয়ার ফ্রাঙ্কফুর্ট অফিসে। সেখানে বছর তিনেক থাকার পর, যখন এসবিআই থেকে ঘরে ফেরার ডাকের প্রতীক্ষায় তিনি দিন গুনছেন। সেই সময়ে তাঁর জেগে উঠল মধ্যবিত্ত বাঙালীর চিরন্তন আশঙ্কা – পরে আবার ইউরোপ আসা হয় কি না হয়, এই দেশগুলি কী অচেনা অজানাই রয়ে যাবে চিরকাল? অতএব অনতিবিলম্বে ছোট একটি ব্যাগ, দিনগত পাপক্ষয় করার মতো কিছু মার্ক আর সুলভে উত্তর ইউরোপ ভ্রমণের “নর্ডিক পাস” পকেটে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। সেই নর্ডিক পাস দেখিয়ে ট্রেন, জাহাজ, নৌকা কিংবা বাসে যথেচ্ছা চড়া যেত। তদুপরি ওই দেশগুলিতে ভারতীয় পাসপোর্টের জন্যে ছিল ভিসাহীন অবারিত দ্বার। সালটা ১৯৮০। আজকের দিনে সেসব স্বপ্নবৎ। এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত আধুনিক ট্যুর প্যাকেজ “একুশ দিনে ইউরোপ ভ্রমণ”-এর সঙ্গে একেবারেই মিলবে না। কারণ লেখক কোপেনহেগেন ঘুরেছেন সাইকেলে – যে সাইকেলে সে সময় ব্রেক থাকত না। তিনি ট্রেনে ফিনল্যাণ্ড থেকে কেমি হয়ে সুইডেন যাওয়ার পথে, হোটেলের খরচ বাঁচিয়ে রাত্রে নিখরচায় শান্তিতে ঘুমোনর জন্যে কেমি-কক্কলা-কক্কলা-কেমি জার্নি করেছিলেন। এবং কক্কলা স্টেশনের বন্ধ ওয়েটিং রুমে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলেন, স্টেশন মাস্টারের অনুমতি নিয়ে। দরিদ্র ভারতীয় সেই ছোকরা অভিযাত্রীর এমন আবদার স্টেশন মাস্টাররা মেনে নিয়েছিলেন সানন্দে, এবং বলেছিলেন, বিরল এই আবদারের কথা আজীবন তাঁরা শোনাবেন তাঁদের বন্ধু-বান্ধব ও পরিজনের কাছে! এই ভ্রমণের বেশ কয়েক বছর পরে লেখক এই দেশগুলিতে বারবার ফিরে গিয়েছেন, তাঁর ব্যাঙ্কের কর্মসূত্রে। সেই সব যাত্রায় তিনি উড়োজাহাজে উড়েছেন, থেকেছেন বিলাসী হোটেলে, যত্রতত্র ঘুরেছেন বহুমূল্য বাহনে। তাঁর সঙ্গী হয়েছেন কর্মসূত্রে পরিচিত ঘনিষ্ঠ বিদেশী বন্ধুরা। যদিচ তাঁর মনে আর দৃষ্টিতে রয়ে গিয়েছিল সেই ছোকরা অভিযাত্রীর মতোই অকুণ্ঠ কৌতূহল ও সংবেদন। কর্মসূত্রে এইধরনের ভ্রমণকে বাংলায় “রথদেখা-কলাবেচা” বলে। তিনি রথও যেমন দেখেছেন, তেমনি কলাও বেচেছেন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে। ব্যবসায়িক কর্মের নানান অভিজ্ঞতার সঙ্গে তিনি বর্ণনা করেছেন প্রত্যেকটি দেশের অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের কথা এবং বিশ্লেষণ করেছেন তার পিছনে নানান অসঙ্গতি অথবা দুর্নীতির কথা। ব্যাংকিং ব্যবসা এবং অর্থনীতিতে আমাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞানগম্যি না থাকলেও, কিছু আসে যায় না, তিনি অনায়াসে আমাদের পৌঁছে দিতে পারেন আপাত-অগম্য ধারণার কাছাকাছি। ভলভো কারখানায় তিনি “ভলভো ৯৬০” মডেলের কার, টেস্ট ড্রাইভ করেছেন, সে কোম্পানির জনৈক বড়ো সায়েব ক্লাউসের সঙ্গে। বরফ ঢাকা পশ্চিম সুইডেনের নির্জন রাস্তায় ১০০ কিমি/ ঘণ্টা গতিবেগে চলতে থাকা গাড়িতে আচমকা ব্রেক কষেছেন, গাড়ির এবিএস - নিরাপত্তা চেক করার জন্যে। বিশ্বে সেই প্রথম এবিএস (এন্টি ব্রেকিং সিস্টেম) চালু করেছিল ভলভো। এরপর ওই কারখানাতেই তিনি ভলভো ট্রাক চালিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন, টেস্ট ট্র্যাকের সর্বেসর্বা স্টিগ। আশ্চর্য এই মানুষ স্টিগের সঙ্গে পরিচয়ে মুগ্ধ হয়েছেন লেখক এবং তাঁর সঙ্গে আমরাও।হেলসিঙ্কির সরকারি অফিসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পিরকো হলাপ্পার। তাঁর গ্রামের বাড়ি উত্তর ফিনল্যাণ্ডে, গ্রামের নাম পুওলাঙ্কা। পিরকো তাঁকে চিনিয়েছিলেন গ্রামীণ ফিনল্যাণ্ডের সংস্কৃতি আর পরিবেশ। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ আর গাছের সারিতে সাজানো শান্ত নিরিবিলি পুওলাঙ্কা গ্রাম। ফিনরা বাইরে জুতো ছেড়ে নিজেদের ঘরে ঢোকে! আপাত-তুচ্ছ এক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি একাত্ম হয়ে পড়েন – কারণ এটি সনাতনী ভারতীয় সংস্কৃতিও বটে! অতি সভ্য ফরাসী, ইংরেজ, জার্মানদের সঙ্গে যা একেবারেই মেলে না। পরে আরেকবার তিনি পিরকোর সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লেন ফিনল্যাণ্ডের উত্তর প্রান্তের দিকে – যেখানে আরও দুটি দেশের সঙ্গে তার মিলন ঘটেছে – রাশিয়া আর নরওয়ে। পৃথিবীর উত্তরতম বন্দর শহর রাশিয়ার মুরমানস্ক যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যায় নরওয়ের দক্ষিণ সীমান্তের শেষ গ্রাম নাইডেন, আর উত্তর ফিনল্যাণ্ডের শেষ গ্রাম নাতামো। জনবিরল সেই যাত্রাপথের দুধারে তাঁদের সঙ্গী ছিল, অজস্র হ্রদ এবং নিরবচ্ছিন্ন সবুজ গাছের মিছিল...। তাঁর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে আমরা এমনই অজস্র অভিজ্ঞতায় যেমন আশ্চর্য হই, ঋদ্ধ হই, তেমনই তিনি পরিচয় করিয়ে দেন প্রত্যেকটি দেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। দুর্বল দেশগুলির উপর সবল দেশগুলির, সহস্রাধিক বছরের অহংকারী আধিপত্য, সনাতন সংস্কৃতি ও সুপ্রাচীন ধর্মের বিলুপ্তি সাধন, প্রশাসনিক শোষণ...।যাঁরা ইউরোপকে কাছ থেকে দেখেছেন এবং আমার মতো যাঁরা ইউরোপের সান্নিধ্যে কোনদিন না গিয়েও ইউরোপ সম্বন্ধে সবিশেষ কৌতূহলী, উভয়ের পক্ষেই এই গ্রন্থদুটি অবশ্যপাঠ্য। নিছক দেশ ভ্রমণ নয়, বরং প্রতিটি দেশের সঙ্গে আমাদের সার্বিক পরিচয় গড়ে তুলতে হীরেনবাবুর জাদু লেখনীর কোন বিকল্প নেই।
    সমষ্টি থেকে ব্যষ্টি - ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসি! - যদুবাবু | ১) ঊনবিংশ শতকের একদম শেষের দিকে, ১৮৯৭ সালে, এমিল ডার্কহেইম আত্মহত্যার বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে প্রামাণ্য একটি বই লেখেন – ‘সুইসাইড’, যার অনেক পর্যবেক্ষণের মধ্যে অন্যতম একটি এই—যে, সেই সময়ের ইয়োরোপে, প্রোটেস্টান্ট দেশগুলির আত্মহত্যার হার ক্যাথোলিক দেশগুলির থেকে বেশি। ডার্কহেইম ও তার পরবর্তী গবেষকরা এর থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছন, যে, একজন ব্যক্তি মানুষের জন্যও, অতএব, প্রোটেস্টান্ট অথবা ক্যাথোলিক – এই ধর্মাচরণের প্রকৃতি ছাপ ফেলে তার আত্মহননের সম্ভাবনায়। ডার্কহেইমের সময়ে আমাদের প্রচলিত ‘মেথডোলজি’র অর্থাৎ রাশিবিজ্ঞানের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় কিছুই ছিল না, যেমন কোরিলেশন কোয়েফিশিয়েন্ট—যা দিয়ে আমরা দুটি জিনিসের মধ্যে সম্পর্ক মাপি—সেও সদ্য-আবিষ্কৃত, অন্যান্য শাখায় প্রচলিত হতে কিছু দেরি আছে। তবু, যে কথা দেশের জন্য সত্যি, সে কথা সেই দেশের যে কোনো একজনের জন্য কতটুকু সত্যি? ২) এক লাফে চলে যাই ১৯৭৫ সালে। এক-ই রকম বিপত্তি! প্রোফেসর ক্যারোলের গবেষণাপত্র “Experimental evidence of dietary factors and hormone-dependent cancers”-এ দাবি—যে সব দেশে খাদ্যের প্রধান উপকরণ চর্বি বা স্নেহজাত পদার্থ (ফ্যাট), সেই সব দেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারে মৃত্যুহার-ও বেশি, অতএব, ইনডিভিজুয়াল লেভেলে দেখলে ডায়েটারি ফ্যাট ব্রেস্ট ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। বলা যায়? ৩) আরো অর্ধ-শতক ডিঙোই—এই সময়কার আমেরিকা, উত্তর-পূর্ব আর পশ্চিম উপকূলের বেশ কিছু ‘রিচ স্টেটের’ বেশির ভাগ-ই যেন পাকাপাকি লিবেরাল, ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকে, সেখানে রিপাব্লিকানদের দিল্লি দূর অস্ত, আর দক্ষিণের দিকে আর দুই উপকূলের মাঝের অপেক্ষাকৃত গরীব স্টেট ভোট করে রিপাব্লিকানদের। বিখ্যাত কমেন্টেটর ডেভিড ব্রুকস যেমন বলেছিলেন, “Like upscale areas everywhere, from Silicon Valley to Chicago’s North Shore to suburban Connecticut, Montgomery County supported the Democratic ticket in last year’s presidential election, by a margin of 63 percent to 34 percent.” অথচ কী আশ্চর্য, এও প্রায় সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার, যে — বেশির ভাগ বিত্তবান মানুষ সমর্থন করেন গ্র্যাণ্ড ওল্ড পার্টি (জিওপি) অর্থাৎ রিপাবলিকান পার্টিকে কারণ তারা ব্যবসা-বান্ধব দল হিসেবে পরিচিত – যেমন পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১২ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বিত্তশালী মানুষের প্রতি ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান সমর্থকদের মনোভাব পুরো বিপরীত – ডেমোক্র্যাটদের ৬৫% মনে করেন ধনী মাত্রেই লোভী, আর রিপাবলিকানদের ক্ষেত্রে সেই শতাংশ মাত্র ৪২%। আবার উল্টোদিকে, ৫৫% রিপাবলিকান সমর্থক মনে করেন ধনী মানে খুব-ই পরিশ্রমী, “হার্ড-ওয়ার্কিং”, এক-ই কথা বলেন ডেমোক্র্যাটদের মাত্র ৩৩%। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তুলনামূলকভাবে সাধারণ মানুষ—অ্যাভারেজ আমেরিকান— সমর্থন করেন ডেমোক্রাটদের। তাহলে? এই ধরণের ঘটনা, যেখানে সমষ্টির উপর ধারণা থেকে ব্যক্তিবিশেষে কেমন, কী হবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় – তাকে বলে ‘ইকোলজিক্যাল ইনফারেন্স’। কিন্তু ধর্মাচরণ আর আত্মহত্যার প্রবণতার যে সম্পর্ক অথবা ডায়েটারি ফ্যাট ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের যে সরলরৈখিক সম্পর্ক দেশ-বিশেষে সত্যি – সে কি ব্যক্তির জন্যে খাটে? এক যদি না জানা যায়, যে, ঐ দেশগুলির সমাজ একেবারেই সমসত্ত্ব গোছের—মানে প্রোটেস্টান্ট দেশে সবাই প্রোটেস্টান্ট—বা এক এক দেশের সব মানুষ একেবারেই এক-ই ডায়েট ফলো করেন? তবুও কখনো কখনো ব্যক্তির আচরণ আর সমষ্টির ব্যবহার এক-ই হয়, কখনো হয় এক্কেবারে উলটো। সেই গণ্ডগোলের নাম “ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসি”। কিন্তু কখন উল্টোয়? উল্টোয় তো আদৌ? আজ থেকে প্রায় বাহাত্তর বছর আগে, ১৯৫০ সালে, প্রোফেসর উইলিয়ম এস রবিনসন একটি যুগান্তকারী পেপারে (“Ecological Correlations and the Behavior of Individuals”) প্রমাণ করে দেখান, যে, দুটি রাশির মধ্যে সম্পর্ক (অর্থাৎ কোরিলেশন) সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা দুরকম হতেই পারে, যদি একটি মাপা হয় সমষ্টির জন্য (অর্থাৎ এগ্রিগেট লেভেল) আর একটি ব্যক্তির পর্যায়ে (অর্থাৎ ইন্ডিভিজুয়াল লেভেলে)। রবিনসনের পেপারে ১৯৩০ সালের আমেরিকান জনগণনার—অর্থাৎ সেন্সাসের—ডেটা অ্যানালাইজ করে দেখানো হয়, যে ঐ সময়ের ৪৮টি স্টেটে যদি বিদেশে-জন্মানো (ফরেন-বর্ন) শতাংশ এবং সাক্ষর জনতার (আমেরিকান ইংলিশে সাক্ষর) শতাংশের মধ্যে কোরিলেশন পজিটিভ: ০.৫৩। এর থেকে ধারণা হতে পারে—যে রাজ্যে যত বিদেশ থেকে আসা লোক, সে রাজ্যে তত কম নিরক্ষর মানুষের শতাংশ, অথবা, তত বেশি সাক্ষরতার হার। আর একটু এগিয়ে ব্যক্তি-স্তরে নিয়ে গেলে, এমন মনে হতে পারে—যে, বিদেশে-জন্মানো মানুষের (আমেরিকান ইংলিশে) সাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা দেশে-জন্মানোদের থেকে বেশি। কিন্তু, এই সম্পর্ক-ই যদি ব্যক্তির স্তরে দেখেন, ঐ দুই রাশি—বিদেশে জন্ম আর সাক্ষরতা—এবার কিন্তু কোরিলেশন নেগেটিভ: —০.১১, অর্থাৎ সমষ্টি থেকে ব্যষ্টি-স্তরে আসতেই সম্পর্ক উল্টে গেলো। প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্যক্তির জন্য যদি বিদেশে জন্মানো আর আমেরিকান-ইংলিশ-জ্ঞান উল্টোপানে ছোটে, তাদের কোরিলেশন রাজ্যভিত্তিক ডেটায় পজিটিভ কেন? বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী ডেভিড ফ্রিডম্যানের মতে, এর কারণ ফরেন-বর্ন বা অভিবাসী মানুষ নিশ্চয়ই এমন রাজ্যে বেশি সংখ্যায় থাকেন যে রাজ্যের নেটিভ-বর্নরা অপেক্ষাকৃত বেশি সাক্ষর। এখন অবশ্য আমরা জানি যে, রবিনসনের গণনায় সামান্য কিছু বিচ্যুতি ছিল, যেমন: ঐ প্রথম কোরিলেশন-টা আসলে ০.৪৬ হবে; তবে এই অপেক্ষাকৃত সাধারণ একটা পর্যবেক্ষণ যেন একটা পর্দা তুলে দিল চোখের সামনে থেকে। রবিনসনের এই পাথ-ব্রেকিং পেপারটির আগেও সমষ্টি থেকে ব্যষ্টির ধারণা নিত্ত-নৈমিত্তিক ছিল সমাজবিজ্ঞানের চর্চায়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাতে যে সামান্য রাশ টানা গেল—তা ওঁর অবদান বললে ভুল বলা হয় না। রবিনসন অবশ্য সেই পেপারে এও বলেন, যে, সমাজ-বিজ্ঞানের গবেষণায়, অতএব, ব্যক্তি-পর্যায়ের উপাত্ত ছাড়া বাকি সব বেকার—সেটা আজকাল পুরোপুরি অভ্রান্ত বলে মনে করা হয় না। “ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসি” শব্দবন্ধ অবিশ্যি রবিনসনের দেওয়া নাম নয়, সেটির আবির্ভাব কিছুদিন পর সেলভিনের ১৯৫৮ সালের পেপারে – ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসির সংজ্ঞা পেলাম আমরাঃ ‘the invalid transfer of aggregate results to individuals’! তবু, ইকোলজিক্যাল কোরিলেশন বা ফ্যালাসি যাই বলুন, সে কোত্থাও যাচ্ছে না, কারণ “রেজোলিউশন” যত বেশি – ডেটা বা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা তত কঠিন। মানে, গ্রুপ-লেভেল বা এগ্রিগেট-লেভেলে ডেটা যত সহজে পাওয়া যায়, একেবারে ব্যক্তি-পর্যায়ে মোট্টে অত সোজা নয়। কোটিকে গুটিক বাই টু। তবে, দুয়ের-ই দাম আছে। ঐ তিন নম্বর উদাহরণের প্যাটার্নের সুন্দর আলোচনা আছে গেলম্যান এট অলের “Rich State, Poor State, Red State, Blue State” পেপারে বা বইতে—যার নির্যাস সহজ করে বলতে গেলে এই—যে, এক এক স্তরে ভোটিং প্যাটার্ন এক একটি ছবি দেখায়—গোটা দেশের জন্য এক রকম, আবার রাজ্যভিত্তিক এক রকম, রাজ্যের মধ্যে আবার কাউন্টি-ভিত্তিক ছবি আরেক রকম আর ব্যক্তি-পর্যায়ে আরো এক। রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম মাল্টি-লেভেল মডেলিং। এই যেমন, অপেক্ষাকৃত ধনী রাজ্যের ভোটার-রা হয়তো বেশি বাঁদিক ঘেঁষে থাকেন, অথচ, যে কোনো রাজ্য দেখলে তার মধ্যে যত ইনডিভিজুয়াল ইনকাম বাড়ছে রিপাব্লিকানদের জন্য অর্থাৎ ডানদিকে ভোট করার প্রবণতাও বাড়ছে। আবার, গড় আয় দেখলে এও অসম্ভব নয় যে হয়তো রাজ্যের বেশিরভাগ গরীব, কয়েকজন অসম্ভব বড়লোক? আবার এও অসম্ভব নয়, যে স্বচ্ছলতা মাপার আসল উপায় হয়তো ইনকাম নয়, সেটা হয়তো সেলফ-পারসিভড, নিজের যেমন মনে হয় তাই-ই। আপনার প্রতিবেশীর থেকে আপনার পকেটে দু-টাকা বেশি হলে (মানে আপনি-ই সেই বড়োলোকের বিটি লো হলে) হয়তো ভোট করবেন কিঞ্চিৎ ডাইনে-ঘেঁষে, আর প্রতিবেশীদের বেশি হলে হয়তো ডেমোক্রেট? গেলম্যানদের পেপারের অনেক সম্ভাবনার মধ্যে একটি এও যে, “state average income” হয়তো আসলে “a proxy for secularism or some kind of cosmopolitanism.” কে জানে? এত কথা লিখে ফেললাম অবশ্য জ্ঞান দেওয়ার জন্য শুধু নয়। এই আজকেই, তেসরা ডিসেম্বর, আমেরিকা থেকে অর্ধেক পৃথিবী দূরে ভারতে, কয়েকটি রাজ্যে – রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় – বিজেপি হইহই করে জিতল। হিন্দি-বলয়ের (নাকি গো-বলয়ের) বেশিরভাগ রাজ্যে যেখানে সাধারণত শিক্ষার—অর্থাৎ সাক্ষরতার—হার কম, আবার দারিদ্র্যও বেশি, নারী-সুরক্ষা কম, হিন্দি-ভাষার আগ্রাসন ব্যাপক, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন-ও বেশিই, সেখানে ভোটের সিংহভাগ নিয়ে যায় বিজেপিই। মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক যে হয় না তা নয়, কিন্তু রাজ্যভিত্তিক ফল দেখলে মোটের উপর কোরিলেশন নেগেটিভ: —০.১৯। নিচে একটা ম্যাপ আর একটা প্লট দিলাম দেখুন। ২০১৯ সালের বিজেপির ভোটশেয়ার আর ২০১১ সালের সেন্সাসের ভিত্তিতে সাক্ষরতার হার। ম্যাপের জন্য ভোট-শেয়ার আর সাক্ষরতা - দুয়ের-ই তিনটে তিনটে করে কোয়ান্টাইল বের করে সেই অনুযায়ী এক-এক রাজ্যের রঙ দেওয়া - শুধু লাল মানে - ভোট শেয়ারে উপরের তৃতীয়াংশ আর সাক্ষরতায় নীচের, আর শুধু নীল মানে সাক্ষরতায় টপ থার্ড কোয়ান্টাইল-ভোট শেয়ারে বটম। এইবার কথা হচ্ছে, এই দেখে কি ইচ্ছে হচ্ছে হা-হুতাশ করে (বা আনন্দের আতিশয্যে) দাবি করতে—ঐ তো, সব নিরক্ষর লোকেই বিজেপিকে বেশি ভোট দেয়? শিক্ষার অভাব-ই দক্ষিণপন্থার দিকে কার্নিক দিচ্ছে ক্রমাগত? দিচ্ছে তো বটেই, সকাল থেকে দিকে-দিকে সেই সব পোস্ট চোখে পড়ছে, ঐ জনগণ যেমন তার সরকার তেমন, ইত্যাদি। সেই কথাটা অল্প মেনে নিয়েও বলি, ধীরে রাজনী(তিক), ধীরে… একজন মানুষের প্রথাগত শিক্ষাদীক্ষা বা ডিগ্রি যত বাড়ে, তার দক্ষিণপন্থী হওয়ার সম্ভাবনা তত কমে—এই মর্মে কনজেকচার ছুঁড়ে দেওয়ার আগে, ২০১৯ সালের ইণ্ডিয়া-টুডে আর অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া-র একটি পোস্ট-পোল সার্ভের ডেটা থেকে তৈরি একটি টেবিল দেখুন নীচে (যদিও এ একেবারে ধ্রুবসত্য—এমন ভাববেন না)। কিন্তু এই টেবিল বা ফিগার যদি সত্যি হয়, তবে, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট—অর্থাৎ যারা সবথেকে বেশি পড়াশুনো করে ফেলেছেন—তাঁদের মধ্যে বিজেপির ভোট-শেয়ার সবচাইতে বেশি: ৫০%। তার পরে পরেই গ্র্যাজুয়েট: ৪৮%। আর নিরক্ষর অংশে? ৩৯%। কাজেই ব্যক্তি-হিসেবে একজন পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীর কি বিজেপিকে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা কম? একজন তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষের চাইতে? মনে তো লয় না [1]। হয়তো এখানে বলে দেওয়া উচিত, যে সব মিলিয়ে দেখলে এই সার্ভের পপুলেশনে বিজেপির ভোট শেয়ার ৪৫%, আর আশ্চর্য কিনা জানি না, প্রফেশনাল ডিগ্রি—অর্থাৎ বি-ই, বি-টেক, এম-বি-বি-এস—ইত্যাদিতে সবথেকে কম: ৩০%। স্বীকার করতে বাধা নেই, এই লেখাটার জন্য তথ্য খুঁজতে বসে এই টেবল দেখে একটু চমকে উঠেছি আমিও। আজ থেকে যদ্দিন না আবার এইরকম পোস্ট-পোল সার্ভের ডেটা পাচ্ছি, ইঞ্জিনিয়ারদের আর গাল দেবো না প্রমিস, বরং দেখলে সেধে লাস্ট কাউন্টার অফার করতে পারি, বলা যায় না। তবে কি না সেও ঐ এক-ই ফ্যালাসি। তথ্য-উপাত্ত-সূত্র: Freedman, David A. "Ecological inference and the ecological fallacy." International Encyclopedia of the social & Behavioral sciences 6, no. 4027-4030 (1999): 1-7. ( লিংক ) Subramanian, Subu V., Kelvyn Jones, Afamia Kaddour, and Nancy Krieger. "Revisiting Robinson: the perils of individualistic and ecologic fallacy." International journal of epidemiology 38, no. 2 (2009): 342-360. ( লিংক ) Gelman, Andrew, Boris Shor, Joseph Bafumi, and David Park. "Rich state, poor state, red state, blue state: What's the matter with Connecticut?." Poor State, Red State, Blue State: What's the Matter with Connecticut (2005). ( লিংক ) Selvin, Hanan C. "Durkheim's suicide and problems of empirical research." American journal of sociology 63, no. 6 (1958): 607-619. Robinson, William S. "Ecological correlations and the behavior of individuals." International journal of epidemiology 38, no. 2 (2009): 337-341. Parker, Kim. "Yes, the rich are different." Pew Research Center 27 (2012). লিংক ) https://www.indiatoday.in/diu/story/how-india-voted-2019-lok-sabha-election-india-today-axis-my-india-poll-1539617-2019-05-31 https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_Indian_states_and_union_territories_by_literacy_rate https://en.wikipedia.org/wiki/2019_Indian_general_election[1] এখানে এটাও অবশ্য মনে করানো দরকার যে কণ্ডিশনাল প্রোবাবিলিটির ব্যাপার চলে আসে অল্প - অর্থাৎ এই সার্ভে থেকে পাওয়া যায়ঃ P(বিজেপিকে ভোট | পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট) = ০.৫ আর P(বিজেপিকে ভোট | নিরক্ষর) = ০.৩৯ ইত্যাদি। উল্টোদিক অর্থাৎ, P(পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট | বিজেপিকে ভোট) আর P(নিরক্ষর | বিজেপিকে ভোট) গণনা করতে হলে সার্ভে পপুলেশনে কত শতাংশ পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট আর কত নিরক্ষর সেই হিসেব লাগবে। এবং সেই দুয়ের মধ্যে কে বেশি কে কম, না জেনে বলা মুশকিল। আর এই দুয়ের মধ্যে গুলিয়ে ফেলার নাম? প্রসিকিউটর'স ফ্যালাসি।
    কাদামাটির হাফলাইফ - ইট পাথরের জীবন - ইমানুল হক | নামাঙ্কনঃ ইমানুল হক। ছবিঃ র২হকথা - ৯আহা রে আহারে মিলল সিঁদল। আসাম থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলন ও সংস্কৃতি সংগঠক দীপক সেনগুপ্ত সিঁদল শুঁটকি এনেছেন। এলেই নিয়ে আসেন। আমার খুব প্রিয়। অথচ ২০১১-র আগে কখনও এটা খাইনি। হাইলাকান্দিতে গিয়ে খাই। ২০১০-এ ট্রেনে দুর্ঘটনায় আমি প্রচণ্ড আহত হই। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা। চারটি পাঁজর ভাঙ্গা। মেরুদণ্ডে চোট। আঙ্গুল ভাঙ্গা। অপারেশন হয়েছে। আমাদের ভাষায়, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক চলছে মাসাধিককাল ধরে। (কড়া অ্যান্টিবায়োটিক শুনলেই ডাক্তার ক্ষেত্রমাধব দাস চেঁচিয়ে উঠবেন, কড়া আবার কী?) মুখ বিস্বাদ। পেট খারাপ লেগেই আছে। খেতে ইচ্ছে করে না। খেয়ে সুখ পাই না। এমন সময় আসামে এক সর্বভারতীয় আলোচনাসভায় যেতে হয় নীতীশ ভট্টাচার্যের আমন্ত্রণে। সেখানেই এক অধ্যাপক বাড়ি থেকে সিঁদল শুঁটকি (হিঁদল) এনে খাওয়ান। তারপর অতিথিশালাতেও জোটে। আসার সময় আমাকে এক বাটি সিঁদল দেন কাচের কৌটায়। আমি ২৫ দিন ধরে আঙ্গুলে একটু একটু করে লাগিয়ে খাই। এরপর ত্রিপুরায় খাই। লিখতে লিখতে মনে পড়ল, শিলিগুড়িতে আমার এক ডাক্তার বন্ধুর ত্রিপুরী শাশুড়ি খাইয়েছিলেন শুঁটকি। তখন এটা যে সিঁদল জানতাম না। অনেকেই অবাক হবেন জেনে, আমাদের গ্রাম বাংলার বহু এলাকাতেই শুঁটকি খাওয়া হয়। বেশ খাওয়া হয়। বর্ধমান বীরভূম মুর্শিদাবাদ সর্বত্র।কিন্তু সে-সব চিংড়ি শুঁটকি, পুঁটি শুঁটকি, বিমলা শুঁটকি, নোনা ইলিশ।বিমলা এখন বুঝি লটে শুঁটকি। আর ছিল ফ্যাঁসা মাছের শুঁটকি। মাথায় করে গ্রামে বেচতে আসতেন শুঁটকিওয়ালা। একজন আসতেন সাইকেল করে। সাইকেল তখন মহার্ঘ বস্তু। বিয়েতে লোকে পণ হিসেবে নেয়। তাঁর কাছে নোনা ইলিশ মিলতো। পেঁয়াজ ভাজা ভাজা করে কষা নোনা ইলিশ যে কী দারুন।পৃথিবীর সব মা-ই তাঁর ছেলের কাছে সেরা রাঁধুনি। আমার মায়ের নোনা ইলিশ শুঁটকি ছিল অপূর্ব। আরেকটি ছিল ফলুই মাছের রোস্ট। ফলুই মাছকে নোড়া দিয়ে কুঁচে ভেতরের কাটা সমেত মাংস বের করে কাঁটা বেছে বেছে বাদ দিয়ে আদা জিরে ধনে নুন সামান্য লঙ্কা দিয়ে মাখিয়ে ভেতরে পুরে পেট সেলাই করে এপাশ ওপাশ হালকা করে তেল দিয়ে সেঁকে সেঁকে গোটা ফলুই মাছ পরিবেশন। আমার অকালপ্রয়াত বড়দিও এটি করতেন। আমি তাঁর বাড়ি গেলেই দিদি খোঁজ করতেন ফলুই মাছের। আমার দিদি বোনেরা সবাই রন্ধন পটিয়সি। মায়ের প্রভাবে গরম মশলা কম, গোটা জিরে শিলে বাটার রাজত্ব কড়াইয়ে।এই রান্না প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, একবার, বোধহয় ১৯৭৭/৭৮, পাশের গ্রাম ধারানে ফুটবল ম্যাচ খেলা। সেমিফাইনাল। আমাদের গ্রামের হোমটিম বেশ ভালো ছিল। কিন্তু সেমিফাইনালে গিয়েই আটকে যেত। এইজন্য বাইরে থেকে খেলি/ খেলোয়াড় হায়ার করে আনা হয়েছে। বর্ধমান শহর থেকে একদল। সঙ্গে এলাকার প্রসিদ্ধ খেলোয়াড় জিন্না। একমাথা কোঁকড়া চুল। ফর্সা রঙ। বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে যেত। তখনকার দিনে ৫০ টাকা প্রতি ম্যাচ। আমাদের গ্রামকে টাকা দিতে হয়নি। গ্রামে বোনের বিয়ে হয়েছে।কী করে টাকা নেয়!গোলকিপারের নাম যতদূর মনে পড়ে রামু। বর্ধমানের খ্যাতিমান খেলোয়াড়। দাদা তখন রাজ কলেজের জিএস। তাঁর সুবাদে এসেছে। পয়সা লাগেনি। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার মোচ্ছব। আমাদের বৈঠকখানায় উঠেছে। গর্বে বুক ফুলে উঠছে। একবার খেলোয়াড়দের দেখছি আরেকবার ছুটছি চুলোশালে।পুকুরে জাল ফেলে বড় বড় মাছ ধরা হয়েছে। অন্যবার ভাজা মাছ জোটে পাতি করে। এবার সব বাইরের জন্য।কিন্তু এক বিরাট হাঁড়িতে লম্বা লম্বা আলু আর টমেটো দিয়ে মাছের ঝোল হয়েছে। লালচে রঙ। মনে পড়তেই খিদে পেয়ে গেল, তাহলে তখন কী অবস্থা হয়েছিল ভাবুন।ভাবছি, জুটবে!আমার মা মাছের ঝোল তরকারি করলে মাছ ভাজতেন না। এতে স্বাদ দারুন খুলতো।কিন্তু দুঃখের কথা কী আর বলি, খেতে বসে দেখলাম, সে-সব আমাদের জন্য নয়।বাবার কড়া হুকুম, খেলিদের খাবার, খেলিরাই খাবে।বিপুল ভোজনের পর তিন কিলোমিটার মাঠে মাঠে হেঁটে চললেন তাঁরা। আমরাও ।কেউ কি সাইকেলে করে নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের, মনে নেই।যাক, খেলার আগে একটু দৌড়ঝাঁপ। আপ্লুত। গোলি/ গোলকিপারকে মনে হল লেভ ইয়াসিন। কিন্তু খেলা যত এগোতে লাগল, বিপক্ষ দলের দাপট বাড়ল। হায়ারি খেলিরা পা বাঁচিয়ে খেলতে লাগল। সেমিফাইনাল হাতছাড়া। লোকে বলল, হোম টিম হলে জান লড়িয়ে খেলত, হারতো না।আগের অধ্যায়ে লিখেছি প্রমোদ দাশগুপ্তের কথা। মনে পড়ল প্রমোদ দাশগুপ্ত দলকে বিপ্লবী পার্টি থেকে বিপ্লবী গণপার্টি করে তোলেন। এই নিয়ে আসানসোলের প্রবাদপ্রতিম শ্রমিক নেতা হারাধন রায়ের আক্ষেপ শুনেছি।হারাধন বাবুর কথা সবিস্তারে লিখতে হবে পরে। আপাতত, এটুকু বলা যাক, নীলরঙা চাইনিজ শার্ট। শুতেন একটা তক্তাপোশ জাতীয় চৌকিতে। তাতে একটা পাতলা চাদর। থাকতেন পার্টি অফিসেই। একবার তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে কয়লাখনি এলাকায় যাচ্ছি। একজায়গায় জিপ থামিয়ে একজন কানে কানে একটা খবর দিলেন। এক স্থানীয় পার্টিনেতা খুনের খবর। হারাধন রায় আক্ষেপ করলেন, বিপ্লবী পার্টিকে বিপ্লবী গণপার্টি বানিয়ে প্রমোদবাবু যে ক্ষতি করলেন, তার খেসারত দিচ্ছি।পরে বুঝলাম, অন্তর্দলীয় খুন। সেটা ১৯৯০।প্রমোদ দাশগুপ্তের স্মরণসভা হয়েছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে।সুবিশাল সমাবেশ।জ্যোতি বসু, সরোজ মুখোপাধ্যায়, ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ বক্তা। ছিলেন জনতা দলের প্রফুল্লচন্দ্র সেন, ইন্দিরা কংগ্রেসের গোপালদাস নাগ। ইন্দিরা গান্ধী তখন কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত। দুবার বিতাড়িত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কংগ্রেস থেকে।১৯৭০-এর দশকে কংগ্রেস দুটো। আদি কংগ্রেস নব কংগ্রেস।১৯৮০-র দশকেও দুটো।মূল দল কংগ্রেস (আর)। আর বিপক্ষে কংগ্রেস (ইন্দিরা)।জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি তখন দেবরাজ আর্স। তিনি দায়িত্ব নিয়ে পরাজয়ের পর ইন্দিরাকে দল থেকে তাড়িয়ে সভাপতি হয়ে রয়েছেন। সেই দলের প্রতিনিধি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। সিপিএমের লোকজন তাঁকে গুন্ডা বলত। প্রিয়-সুব্রত তখন জুটি। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন। কিন্তু বক্তা নন।বক্তৃতা করেন প্রিয় দাশমুন্সি।সবার শেষে বলতে দেওয়া হল। বলার আগে বলা হল, সংক্ষেপে ভাষণ দেবেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি।মাত্র সাত মিনিট বলেন।অনুপ্রাস আর ভাষার ছটায় কাব্যিক বাচনভঙ্গিতে মাতিয়ে দিলেন সভা।এতক্ষণ যে বক্তৃতা হয়েছে সব ম্লান। জ্যোতি বসুর চেয়েও সেদিন ভাষণ দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে গেলেন প্রিয় দাশমুন্সি।সবাই বললেন, বক্তা বটে।রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রমোদ দাশগুপ্তের ভূয়সী প্রশংসা করে বললেন, রাজনৈতিক শিষ্টাচার শিখতে হবে প্রমোদ দাশগুপ্তের কাছে।লোকে বলল, বক্তৃতা করা শিখতে হবে প্রিয়র কাছে।(ক্রমশঃ)
  • হরিদাস পালেরা...
    তোয়ালে  - upal mukhopadhyay | না পেতে খুবই অসুবিধে হচ্ছে। কাল ছিল। আজ ব্যায়াম করার সময় খেয়াল করলাম নেই। অনেক কাজে লাগে। ব্যায়াম করতেও। ঘাড়ের ব্যায়াম, ঘাড়ের তলায় গুটিয়ে চাপ দিতে হয়। না করলে মাথা ঘোরে। সেদিন দেখলাম পাখাটা সারা ঘর ঘুরছে। হয়ত পুরো ঘরটাই ঘুরছিল। তোয়ালেটা যে এত কাজের ভাবিনি। ব্যায়াম করতেও কাজে লাগে। ঘাড়ের ব্যায়াম করতে হয়,  না হলে মাথা ঘোরে। কাজল বলেছে তোয়ালেটা কুকুরে টেনে নিয়ে গেছে। বলেছে বাইরে তোয়ালে না টাঙ্গাতে। না শুখোতে। বলেছে তোয়ালে না থাকার থেকে বাইরে না টাঙ্গান ভালো। কাজল বলল তোয়ালে দেখেছে। আমিও দেখতে বেরলাম কারণ কুকুরে টেনে নিয়ে গেছে। দেখলাম তোয়ালে পড়ে আছে। পাশে কুকুর বসেছিল সে বলল,“ নাও। ”
    ছয় ডিসেম্বর -- না, বাবরি নয়, একান্ত ব্যক্তিগত  - Partha Banerjee | অন্যরকম কথা একটু বলি। অনেকেই জানতে চায়।   আমার অতীত ইতিহাস যারা জানে, তারা জানে কী প্রচণ্ডভাবে আমি আরএসএস করেছি -- সেই ছ বছরের শিশু থেকে প্রায় পঁচিশ বছরের যুবক পর্যন্ত।  ট্রাকের ওপর উঠে মিছিলে যাচ্ছি। দিল্লি যাচ্ছি ওদের প্রতিনিধি হয়ে। এয়ারপোর্টে যাবার পথে আওয়াজ উঠেছে, তোমার প্রিয় আমার প্রিয় পার্থদা যুগ যুগ জীও। প্রিয়দা নয়, পার্থদা। প্রতিদিন নিয়ম করে সেই শাখায় যাওয়া। নকশাল আমলে যখন ভয়ে কেউ আসেনা মাঠে, তখন মাসের পর মাস একা একা কাজ চালিয়ে যাওয়া। জরুরী অবস্থার সময়ে আত্মগোপন করে প্রচার চালিয়ে যাওয়া।  সবই সত্যি। যারা জানে, তাদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন।  কিন্তু, "আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস, যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এলো, অশুভ ইঙ্গিতে ঘোষণা করলো দিনের অন্তিমকাল," তখন পিছন ফিরে দেখি, আর মনে হয়, একটা ফ্যাসিস্ট, প্রাগৈতিহাসিক সংগঠনে জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট করলাম? একটাই তো জীবন। বাংলার মাটির গন্ধ বুকে না মেখে, বাংলার আকাশের আলোর ঠিকানা না খুঁজে সেই গুপ্ত গহ্বরের পশু হয়ে এই একটামাত্র জীবনের এতো মূল্যবান দিনগুলো হারালাম? ঈশ্বরের দেওয়া সেই দিনগুলো আর তো কখনো ফিরে আসবে না!_________ এসব কথা শুনে প্রশ্ন করেন শুভানুধ্যায়ীরা।  প্রশ্ন করেন "বার বার আপনি বলেন আপনি আরএসএস করেছেন। আমার প্রশ্ন তখন কি ওদের নীতি ভালো ছিল? কোনো শিক্ষিত, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ওদের কর্মী হতে পারে ভাবতেই পারিনা!" এক কথায় উত্তর দেওয়া মুশকিল। কেন আরএসএস ছেড়ে বেরিয়ে চলে এলাম তার উত্তরও এক কথায় দেওয়া যাবেনা। অনেক লিখেছি অনেক আলোচনা করেছি এই নিয়ে।  আমি তো নীতি জানতাম না। বাবা জিতেন্দ্রনাথ আরএসএসের বিরাট নেতা। সর্বত্যাগী প্রচারক। বাজপেয়ী আদভানির কাছের মানুষ। গোলওয়ালকার দেওরাস নানাজী দেশমুখ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। স্নেহ করেন। কী বিরাট প্রভাব সেই ছোটবেলা থেকে! তার থেকে বেরিয়ে আসা যে কী কঠিন, আপনারা ভাবতেই পারবেন না।  একটা বাঙালি পরিবারে বাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ছত্রছায়ায় সর্বত্র যাওয়া। পাঁচ বছর বয়স থেকে জনসংঘের মিটিঙে বাবা নিয়ে গেছেন। সেই ছবি এখনো আমার কাছে আছে। সবাই জানতো এই ছেলেটা বাঁচলে পরে একটা কিছু হবে। হতামও।  ভাগ্যিল হইনি!  তবে তখন ওদের লোকেরা (বিশেষ করে বিজেপি-জনসঙ্ঘ) এখনকার মতো এতো অসৎ, মিথ্যাচারী আর লোভী হয়ে যায়নি। অনেক অন্যরকম ছিল।  অনেক লিখেছি সেসব দিন নিয়ে। যাঁরা সাত্যিই জানতে চান তাঁরা আমার স্মৃতিকথা ঘটিকাহিনি পড়ুন। বুঝতে পারবেন সেসব দিন কেমন ছিল। এই আরএসএস বিজেপি আর সেই আরএসএস?  অকল্পনীয়!  ভালো থাকুন সবাই। যতদিন পারেন। 
    ভাদিয়াকুন্ড - ১ - সমরেশ মুখার্জী | বাতিল হোলো পূর্ব পরিকল্পনাসেদিন ১২ই জানুয়ারি ২০২০ রবিবার। বাড়ি থেকে বেরোনোর পর পঞ্চম দিন। হোম‌ওয়ার্ক অনুযায়ী প্ল‍্যান-এ ছিল সুরয়ায়া গড়ি থেকে শিবপুরীর দিকে ১২কিমি দুরে ঘসারাইতে মোহনী মহারাজ আশ্রমে রাতটা কাটাবো। ওখানে রণজিৎ হনুমান মন্দিরে অখন্ড রামনাম সংকীর্তন হয়। তার মাত্রা কেমন অজানা। করেরা মন্দিরে রাত চারটে অবধি উদ্দাম সুন্দর‌কাণ্ড পাঠের অভিজ্ঞতা তাজা। বয়স হয়েছে, সারাদিন হাঁটাহাঁটি‌র পর রাতের ঘুমটা ঠিকঠাক না হলে পরদিন ক্লান্ত লাগে। তবে মোহনী মহারাজ আশ্রমটা বড়। কোনো এক কোনে কোথাও বডি ফেলার জায়গা পেলে কানে তুলো গুঁজে ম‍্যানেজ হতে পারে। গত মে-জুনে একাকী উত্তরাখন্ড ভ্রমণে একটা টেন্ট ছিল সাথে। এবার সেটা থাকলে এসব জায়গায় কাজে আসতো। আশ্রমে জায়গা না পেলে প্ল‍্যান-বি ছিল সোয়া কিমি দুরে বাঁকড়ে হনুমান মন্দির। কিন্তু শর্মনের শলা‌ শুনে ঘসারাই থেকে পাঁচ কিমি এগিয়ে ভাদিয়াকুন্ড যাওয়া‌ই ঠিক করি। অর্থাৎ প্ল‍্যান-সি ফাইনাল। প্রগতজীর ধাবায় মিনিট দশেক অপেক্ষা করতেই এলো শিবপুরী‌র লোকাল বাস। দুটো স‍্যাক নিয়ে চলন্ত বাসে আমার টলোমলো অবস্থা দেখে একটি কিশোর পিছনে‌র সীট থেকে উঠে বলে, আঙ্কল, আপ বৈঠিয়ে। এমন বিরল সহবতে মন দ্রবীভূত হয়। এক মধ‍্যবয়স্ক সহযাত্রীকে বলি, আমি আগে এদিকে আসিনি, ভাদিয়াকুন্ড যাবো, কোথায় নামতে হবে, মেহেরবানী করে যদি একটু আগে বলে দেন, ভালো হয়। দুজন নিজেদের মধ‍্যে আলোচনা করে, বাস কোথা দিয়ে যাবে কন্ডাক্টর‌কে জিজ্ঞাসা ক‍রে আমায় বলে, আপ কো কারবালা চক উতারনা হ‍্যায়। উঁহাসে ভাদিয়াকুন্ড পয়দল সিরফ্ পাঁচ সাত মিনট কা রাস্তা, বেফিকর রহিয়ে বাবুজী, হাম বাতা দেঙ্গে। একাকী ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় দেখেছি গ্ৰামেগঞ্জে স্থানীয়রা শহুরে হাবভাব দেখলে গুটিয়ে যায়। সহজভাবে কথা বললে আন্তরিক‌ভাবে সাহায্য করতে চায়। যাক নিশ্চিন্ত হ‌ওয়া গেল। কিন্তু কারবালা চৌরাস্তা‌টা কী ব‍্যাপার? ইরাকের কারবালা প্রান্তরে হজরত মহম্মদের দৌহিত্র হোসেন ইবন আলী দেড়শো সাথী নিয়ে ইয়াজিদের চারহাজার সৈন‍্যের সাথে প্রতিবাদের লড়াইয়ে শহীদ হন। দিনটা ছিল ১০ই অক্টোবর ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দ। সেই উপলক্ষে পালিত হয় শোকের উৎসব মহরম। কিন্তু এখানে কারবালা চকের কী তাৎপর্য? জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওখানে একটি তালাও‌তে মহরমের তাজিয়া‌ বিসর্জন দেওয়া হয়, তাই নাম কারবালা চক। কারবালা চকে নেমে আধা কিমি উত্তরে হেঁটে পৌঁছ‌ই মধ‍্যপ্রদেশ পর্যটনের ট‍্যুরিস্ট ভিলেজ রিসর্টের গেটে। আনুমানিক ২০০x১০০মিটার জায়গা‌ নিয়ে বিলাসবহুল পর্যটকাবাস। বিয়ের পার্টি‌ও হয় ওখানে। সুন্দর সাজানো পার্ক। রিসর্টের দক্ষিণে কিছুটা নীচে বিস্তৃত সখ‍্যাসাগর লেক। রিসর্টের নিজস্ব ছোট্ট বোটিং জেটি‌ও রয়েছে। রিসর্টের সীমানা থেকেই শুরু মাধব ন‍্যাশানাল পার্ক। যে রাস্তায় এলাম তা রিসর্টের গেট থেকে বাঁদিকে চলে গেছে বাণগঙ্গা ধামের দিকে। সিন্ধিয়া ছত্রী পরিসর ছুঁয়ে তা গিয়ে মিলেছে শিবপুরী রিং রোডে। রিসর্টে একটি রাত্রি‌বাসের নূন‍্যতম দক্ষিণা মাত্র তিন হাজার - অর্থাৎ আমার ঝোলাপিঠে ভ্রমণের আট দশ দিনের খরচ। ওসবে আমি নেই। তাই ট‍্যূরিস্ট ভিলেজকে নমো করে সবুজ লনে উদাসীন দৃষ্টি বুলিয়ে ডান দিকে দক্ষিণ-পূর্ব দিশায় শখানেক মিটার দুরে ভাদিয়াকুন্ডের পথ ধরি। সপ্তাহে সাতদিন‌ই সকাল আটটা থেকে রাত দশটা অবধি খোলা। তবে সন্ধ‍্যা‌র প‍র আলোআঁধারে, মশার কামড়ে ভাদিয়াকুন্ড ঝর্না ও সংলগ্ন সখ‍্যাসাগর লেক মোটেও উপভোগ্য নয়। বোটিংয়ের তো তখন প্রশ্ন‌ই নেই। লেকের পাশে সংলগ্ন উদ‍্যানে হয়েছে লেকভিউ কাফে। শিবপুরী শহরের কেন্দ্র থেকে ভাদিয়াকুন্ড প্রায় সাত কিমি। তবু সন্ধ্যার পরেও নির্জনতা সন্ধানী‌রা সেখানে যায়। তাই রাত দশটা অবধি গেট খোলা থাকে। দশ টাকার টিকিট কেটে খাড়া সিঁড়ি দিয়ে ফুট চল্লিশেক নীচে নামি। ঐ টিকিটে চব্বিশ ঘন্টায় যতবার খুশি আসা যাওয়া করা যায়। ২৫মি চ‌ওড়া পাথর বাঁধানো চত্বর। বসার বেঞ্চ। মাঝে বাঁধানো লম্বাটে অগভীর জলাশয়ের ওপর রেলিং দেওয়া পারাপারের খেলনা সেতু। জলাশয়‌টি সোয়াশো মিটার পূবে গিয়ে মিশেছে সখ‍্যাসাগর লেকে। বেশ কিছু বড় বড় পত্রময় প্রাচীন বৃক্ষের ফলে জায়গাটা বেশ ছায়াময়। অনেক লালমুখো বাঁদরের দাপাদাপি। এসব তো ওদের‌ই জায়গা। আমরাই অবাঞ্ছিত। তবু ওরা থাকে ওদের মতো। বিরক্ত না করলে বা সামনে দিয়ে হাতে খাবারের ঝোলা ঝুলিয়ে না গেলে ওরা‌ দর্শকদের কিছু বলে না। চারপাশে চোখ বুলিয়ে তৃপ্তি হয়। পশ্চিমে ফুট চল্লিশের খাড়া পাথরের দেওয়াল। একটু জায়গা ছেড়ে বারোটা খিলান‌ওয়ালা ইংরেজি S অক্ষরের আকারের চাতাল। ভিতরে শঙ্কর ভগবানের স্থান। চাতালের পাথরের ঢালু ছাদ বেয়ে চুঁইয়ে নামছে জলধারা। তাতে নাকি আছে উপকারী খনিজ পদার্থ। ভিতরে মহাদেবের স্থানের দুপাশে চারটি পাথরের গোমুখ দিয়ে বেরোনো জল নাকি তার উপকারী‌তার জন‍্য একদা রপ্তানি হোতো। চাতালের ধার বরাবর ইংরেজি S অক্ষরের মতো‌ই কয়েক ধাপ সিঁড়ি - আসলে স্টেপ রিটেনিং ওয়াল - চাতালটা ধরে রাখার জন‍্য। জল পড়ে সিঁড়িতে শ‍্যাওলা ধরেছে। সিঁড়ির শেষে একটা ২৫x১৫মিটার কুন্ড - সেটা‌ই ভাদিয়াকুন্ড। জনশ্রুতি বিবাহের পূর্বে বা পরে মনোমালিন্যে‌র কারণে সম্পর্ক পানসে হয়ে এলে যুগলে এই কুন্ডে স্নান করলে নাকি তা পুনরুজ্জীবিত হয়। তবে যতো যুগল ওই কুন্ডে স্নান করতে আসে তাদের সবার‌ই যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে গেছে তা না‌ও হতে পারে। কেউ হয়তো আসে না জেনেই, স্রেফ কুন্ডে স্নানের আনন্দ নিতে। কেউ বা আসে জেনে, সুসম্পর্ক থাকলেও, তা বজায় রাখতে। কুন্ডে‌র জল খেলনা সেতুর তলা দিয়ে আর‌ও কয়েকটি খেলনা জলাশয় হয়ে অবশেষে গিয়ে পড়ছে পূব দিকে সখ‍্যাসাগর লেকে। ওখানে দিনের বেলা বোটিং হয়। চত্বরের উত্তরে খাড়া পাথরের ফুট পঞ্চাশেক দেওয়া‌ল। তার উপরেই রিসর্ট। নীচে চত্বরে‌র ফুট পাঁচেক উপরে সেই পাথরের দেওয়ালে একটি পাইপ লাগানো। সেখান দিয়ে বারোমাস দিবারাত্রি বেরিয়ে আসছে পরিস্কার জল। স্থানীয়দের মতে সেই জল‌ও শরীরের পক্ষে খুব ভালো। লোকে নির্দ্বিধায় আঁজলা ভরে পান‌ও করছে। আমি ওখানে দুদিন থাকাকালীন ঐ জল‌ই পান করেছি। তবে শহুরে মনে সংশয়ে‌র কারণে বোতলে ভরে ক্লোরিন ট‍্যাবলেট দিয়ে। জানুয়ারি‌তে ভাদিয়াকুন্ড ঝর্ণা‌য় জলের ধারা শীর্ণ ও স্বচ্ছ। বর্ষা‌য় ওখান দিয়েই লাফিয়ে নামে মাটি ধোয়া লালচে জলের বিশাল ধারা। তখন এ ঝর্ণার রূপ দর্শনীয়। লোকজন তখন‌ই বেশি আসে এখানে। নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে প্রকৃতির সমীহ উদ্রেককারী শক্তি‌র প্রকাশ মানুষ‌কে চিরকাল আকর্ষণ করে এসেছে। বিদ্ধংসী ঘূর্ণিঝড়, মহাপ্লাবন, ভয়াবহ সুনামী, আগ্নেয়গিরির‌র অগ্নুৎপাত - প্রকৃতির এহেন সব রুদ্রলীলার ভিডিও তাই মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখে। রাত্রি‌বাসের সন্ধানেচত্বরের দক্ষিণে রয়েছে একটি ছোট মন্দির। গেরুয়া শিখর। পাশে দুটি ঘর সমেত লম্বাটে টানা বারান্দা। ওটাই কী রঘুবীর পুরী মহারাজের আশ্রম? একজন বয়স্ক সিকিউরিটি গার্ড পাইপের জলে চান করার আগে উর্দি খুলে গায়ে তেল মাখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাকে‌ই জিজ্ঞাসা করে জানলাম আমার অনুমান সঠিক। তবে মহারাজ কদিনের জন‍্য গেছেন হরিয়ানা। মন্দিরের সেবক হিসেবে এখন আছেন তাঁর সঙ্গী রাধেশ্বর পুরী মহারাজ। তবে তিনি‌ও তখন সেখানে নেই। কাছেই কোথাও ভান্ডারা হচ্ছে, গেছেন সেখানে। আসবেন তিনটে নাগাদ। আশ্রমে তখন কেউ নেই। মন্দিরের বাঁদিকে একটি দরজায় হুড়কো টানা। তালা নেই। জুতো খুলে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকি। ছোট চৌকোনা একটা খিড়কিহীন জায়গা। বড় লোহার ট্রাঙ্ক, ড্রাম, কিছু বস্তা রাখা। মনে হয় ভাঁড়ার ঘর। বাঁদিকে কয়েক ধাপ নেমে প্রশস্ত একটা ঘর। বেসমেন্টে‌র মতো। লাল মেঝে। মাঝে আসন পাতা। দেওয়ালে কিছু ভগবানের ও মহারাজের বাঁধানো ফটো। তাতে মালা পরানো। এক পাশে একটি একানে চারপাই। মনে হয় এটাই মহারাজের শয়ন কাম সাধনকক্ষ। বাইরে টানা ঢাকা বারান্দা। ভাবি ঘরে থাকতে না পেলে ঐ বারান্দাতেই রাতটা কাটিয়ে দেবো। রাতে বাঁদরের বাঁদরামি‌র ভয় নেই। সাথে মশারী আছে। মেঝেতে পাতার একটা পাতলা ফোমম‍্যাট আছে। একটা খাপি কম্বল কিনেছি করেরায়। সুরয়ায়া‌র আশ্রমের মতো এখানে‌ও নিশ্চ‌ই দু একটা কম্বল পেয়ে যাবো। তাহলে আর চিন্তা কিসের? পিঠের বড় স‍্যাকটা ভাঁড়ার ঘরের এক কোনে রেখে বেরিয়ে আসি। তৈলমর্দনরত গার্ডকে বলি, দেখুন, আমি রাতে আশ্রমে থাকবো ভেবে সুরয়ায়া রামজানকী মন্দির থেকে এসেছি। মহারাজের সাথে তো দেখা হোলো না। এখন বারোটা বাজে। আমি বাঁকড়ে হনুমান মন্দির থেকে ঘুরে আসছি। আপনি তো এখানে পাঁচটা অবধি থাকবেন বললেন, মহারাজ এলে দয়া করে একটু বলে দেবেন ওনাকে যে কলকাতা থেকে একজন এসে ঐ স‍্যাকটা রেখে গেছে। নয়তো চিন্তায় পড়ে যাবেন, কে আবার ওখানে ব‍্যাগ রেখে গেলো ভেবে। স‍্যাকের ওপর আমার নাম ও মোবাইল নম্বর লেখা আছে। চাইলে আমায় যোগাযোগ‌ও করতে পারেন উনি। কোনো অসুবিধা নেই তো? উনি বলেন, কোনো অসুবিধা নেই। আপনার সামান সলামত থাকবে। আপনি ঘুরে আসুন। মহারাজ এলে আমি আপনার কথা বলে দেবো। তবে রাতে এখানে থাকতে পারবেন কিনা সেটা কিন্তু উনি‌ই বলবেন। সে ব‍্যাপারে আমি কোনো আশ্বাস দিতে পারবো না। বলি, সে তো বটেই। আপনি কেবল ওনাকে আমার কথা বলে দিলেই হবে। বাকি কথা আমি এসে ওনার সাথে বলবো। বিরসবদন বাবাভাদিয়াকুন্ডের আশ্রমটা দেখে‌ মহারাজের সাথে দেখা না হয়েও মনে হোলো এখানে একটা কিছু ব‍্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। অনিশ্চয়তাবোধ চলে গেল। একাকী ভ্রমণে বেশ কয়েকবার আমি ষষ্ঠেন্দ্রিয়র এমন বার্তা পেয়েছি, যেমন - ওখানে না যাওয়াই ভালো, এখানেই হয়তো হয়ে যাবে, আর একটু দেখা দরকার - ইত‍্যাদি। এযাবৎ তা সঠিক প্রতিপন্ন হয়েছে। তাই হালকা হয়ে চললুম ফেলে আসা সুরয়ায়া‌র পথে। রিসর্টের কাছে আসতে দেখি জলের ক‍্যানের পাঁজা নিয়ে যাচ্ছে একটা তিন চাকার পুঁচকে ভ‍্যান। মিনারেল ওয়াটার সাপ্লায়ার। হাত দেখাতে দাঁড়িয়ে যায়। বলি, মোহনী বাবা আশ্রম যাবো, আপনি তো ওদিকে‌ই যাচ্ছেন, একটু ছেড়ে দেবেন? চালক কেবিনের দরজা খুলে বলেন, আসুন। আপনাকে হাইওয়েতে ছেড়ে দিয়ে আমি ডানদিকে চলে যাবো। ওখান থেকে বাস‌ পেয়ে যাবেন। ভাদিয়াকুন্ড থেকে মোহনী‌বাবা আশ্রম পাঁচ কিমি। ২৭নম্বর জাতীয় সড়কে আমায় ছেড়ে দিয়ে ভ‍্যান চলে যায় ডানদিকে। বাঁদিকে একটু দুরে দেখি একটা বাস থেকে লোক নামছে। যাবে করেরা‌র দিকে। দৌড়ে যাই। কন্ডাক্টর আমায় খেয়াল করেনি। বাসটা চলে যায়। পিছনে‌ই আসছিল একটি বাইক। হাত দেখাতে সে দাঁড়িয়ে যায়। বলি, মোহনী‌বাবা আশ্রমের কাছে ছেড়ে দেবেন? ছেলেটি বলে বসুন, আমি‌ ওদিকে‌ই যাচ্ছি, ভাগোড়া। স্থানীয় ছেলেটি সরলমতির। ওটুকু পথেই সে ওর অনেক কথা বলে। আশ্রম প্রাঙ্গণে তিন জটাধারী রোদ পোয়াচ্ছিলেন। ভাদিয়াকুন্ডে হয়তো থাকার ব‍্যবস্থা হয়ে যাবে তবু আমার স্বভাব প্ল‍্যান-বি ছকে রাখা। এক্ষেত্রে তো এটাই ছিল প্ল‍্যান-এ। এক বাবার কথাবার্তা খুব মার্জিত, আন্তরিক। অন‍্যজন রয়েছেন ভাবের ঘোরে। তৃতীয়‌ বাবার চিরতা চিবোনো মুখভাব সুবিধার লাগলো না। হাবভাব দেখে মনে হোলো তিনি‌ই ওনাদের মধ‍্যে মূখ‍্য। তিনি জানালেন ওনাদের কোনো একটা উৎসব চলছে তাই আশ্রমের গোটাকতক অতিরিক্ত ঘরে এখন কয়েকজন বহিরাগত সাধু রয়েছেন। তাই ঘর পাওয়া যাবে না। আমি আগেই আশ্রমটা এক চক্কর ঘুরে দেখে নিয়েছি। ওখানে আছে একটা পাকা ছাদের বড় যজ্ঞমন্ডপ। তার চারপাশে গ্ৰীলের দেওয়াল এখন ঠান্ডার জন‍্য মোটা প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা। পরিস্কার সিমেন্টের মেঝেতে কয়েকটি বিছানা পাতা। মানে ওখানে কেউ এখন থাকছেন। তবে এখনও জনা ছয়েক লোক আরামসে শুতে পারে। উল্টো দিকে একটু দুরে আর একটি মন্ডপে জনা তিনেক ভক্ত খোল, কত্তা‌ল, হারমোনিয়াম ছাড়া নিম্নস্বরে নিবেদিত ভঙ্গিতে রামনাম জপছেন। ওটা‌ই অখন্ড সংকীর্তন। ঝলমলে দিনে‌র বেলায় যদি এমন ঝিম ধরা ব‍্যাপার হয় তাহলে রাতের প্রবল ঠান্ডায় তার মাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা কম। তাই বলি, আমার ঘর না হলেও চলবে। ঐ মন্ডপে‌র মেঝেতে কি আজ রাতটা শুতে পারি? বিছানাপত্র‌ও কিছু চাই না। ওসব আছে আমার কাছে। আমার চেহারা, পোষাক, হাবভাবে প্রথাগত ভক্তসূলভ ছাপ নেই। হয়তো সে জন্য‌ই মুখ‍্যবাবা জানতে চান, এভাবে কষ্ট করে আশ্রমে থাকতে চান কেন? সুরয়ায়া‌তে লাল্লুকে দেখানো বেড়ালটা আবার ঝোলা থেকে বার করি। এমন যাত্রায় সেটাকে অনেকবার বার করতে হয়েছে। তবে বেড়াল দেখে‌‌‌ও বাবা লাল্লুর মতো প্রভাবিত হলেন না। বাবার মুখভাব ক্রনিক আমাশা রুগী‌র মতো অপ্রসন্ন। তবু স্বরে কয়েক আউন্স সেন্টিমেন্ট মাখিয়ে বলি, যদি রাতটা এখানে কাটাতে আসি, মোহনী মহারাজের কৃপা থেকে বঞ্চিত হবো না তো? মূখ‍্যবাবা হয়তো এমন ছিনে জোঁকের পাল্লায় আগে পড়েন নি। নিস্তার নেই দেখে নিমরাজি ভঙ্গিতে অস্পষ্ট ভাবে মাথা নাড়েন। সেটাই আমি ভিসা অন এ্যারাইভালের প্রতিশ্রুতি ধরে নি। প্ল‍্যান-এ বস্তির টাইমকলের লাইনে বালতি রাখার মতো আশ্রমের যজ্ঞশালার বুড়ি ছুঁয়ে থাকে। আমি জোড়হস্তে নমস্কার করে বিদায় নিই। হোবো শৈলী‌তে ঘুরতে হলে গাত্রচর্মটা নাসিকাশৃঙ্গী প্রাণী গোত্রের ভাবলে কোনো সমস্যা হয় না। শ্বেত পাথরের ফলকআশ্রম থেকে পূব দিকে ভাঙাচোরা রাস্তায় হাঁটতে থাকি। যাবো বাঁকড়ে হনুমান মন্দিরে। রাস্তা পূনর্নিমানের কাজ চলছে। বাঁদিকে মাধব জাতীয় উদ‍্যানে‌র তারকাঁটার বেড়া। আধা কিমি যেতে বাঁদিকে চোখে পড়ে একটা চ‌ওড়া কাঁচা রাস্তা চলে গেছে জাতীয় উদ‍্যানে‌র দিকে। সেই রাস্তার মোড়ে দেখি একটা প্রাচীন মাইলস্টোন। ইঁটের গাঁথুনি করে শ্বেতপাথরের ফলক লাগানো। তাতে খোদাই করে লেখা BANKREY HANUMAN ROAD. Furlong 8-3. মাইল, ফার্লং ছিল ব্রিটিশ জমানায় দূরত্বের ইম্পিরিয়াল ইউনিট। এক ফার্লং মানে এক মাইলের আটভাগের একভাগ যা মেট্রিক ইউনিটে ২০১.১৬৮ মিটার। বাঁকড়ে হনুমান মন্দির এখান থেকে মোটে ছশো মিটার। তারপর এই রাস্তা কোটা, হাতোদ হয়ে অর্জুনগাঁও থেকে বাঁদিকে ঘুরে ১৭কিমি দুরে শিবপুরী গোয়ালিয়র জাতীয় সড়কে গিয়ে মিলেছে। কিন্তু ৮-৩ ফার্লং মানে তো ১৬৭০ মিটার। অর্থাৎ এই মাইলফলকটি মন্দিরের দূরত্ব‌সূচক নয়, যে সময়ে এই মেঠো পথটি ঝাঁসি শিবপুরী সড়ক থেকে সোয়া দু কিমি গিয়ে‌ই শেষ হয়ে গেছি‌ল - সেই পথের দৈর্ঘ্য‌সূচক। তার মানে এই মাইলফলকটি শতাব্দী প্রাচীন হেরিটেজ আইটেম! তখন ঐ রাস্তা যতটা গিয়ে শেষ হয়ে গেছি‌ল হয়তো সেখান থেকেই তখন‌ও অক্ষত ছিল শিবপুরী‌র বিখ‍্যাত জঙ্গল। অবশ‍্য তখন এই এলাকা ছিল নরোয়র জেলার অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান জেলা সদর শিবপুরী তখন ছিল শিপড়ি নামক ছোট জনপদ। এই বাঁকড়ে, কোটা, পরাসরি, বলারপুর বা আরো পূবে সুরয়ায়া বরং সে তুলনায় তখন ছিল বর্ধিষ্ণু জনপদ। বিপর্যস্ত হালুমঅতীতের শিপড়ি‌র বিস্তৃত অরণ‍্য ছিল মোগল, মারাঠা, সিন্ধিয়াদের রাজকীয় মৃগয়াভূমি। এখান থেকে‌ই ১৫৬৪ সালে আকবরের বাহিনী মান্ডু থেকে আগ্ৰা যাওয়ার পথে ধরে নিয়ে যায় বেশ কিছু হাতি। তারপরেও অনেক‌বার আকবরের হাতিশালের জন‍্য শিপড়ি‌র জঙ্গল থেকে হাতি ধরা হয়েছে। লর্ড কার্জনের পর ১৯০৫ সালে ষাট বছর বয়সে ভাইসরয় হলেন লর্ড মিন্টো। দাম্ভিক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মিন্টো গোয়ালিয়র পরিদর্শনে এসে এই শিবপুরী‌র জঙ্গলে‌ই মেরেছিলেন উনিশটি বাঘ। পরবর্তী ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ‌‌ও কম যান না। ১৯১৬ সালে এ‌ই জঙ্গলে একদিনে‌‌ই তিনি ভবলীলা সাঙ্গ করেন আটটি হালুমের। এভাবে যথেচ্ছ শিকারের ফলে শিবপুরী‌র জঙ্গলে ক্রমশ কমতে থাকে বাঘ। জঙ্গল কেটে বসতি, চাষজমি তৈরির ফলে সংকুচিত হতে থাকে অরণ‍্য। অবশেষে ১৯৫৯ সালে ৩৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মহারাজা মাধো রাও সিন্ধিয়া‌র স্মৃতি‌তে মাধব জাতীয় উদ‍্যান ঘোষণা করে শুরু হয় অরণ‍্য ও বন‍্যপ্রাণ সংরক্ষণের উদ‍্যোগ। জাতীয় উদ‍্যানে‌র আওতায় আসায় বাঁকড়ে ও অর্জুনগাঁও জনপদ পরিত্যক্ত হয়। তবে ততদিনে ক্ষতি যা হ‌ওয়ার হয়ে গেছে। তাই ১৯৭০ সালের পর এখানে আর বাঘের দেখা পাওয়া যায় নি।তাহলে রাজদর্শনের উপায়?জোমাটো এ্যাপে নিমেষে ফাস্টফুড আনানোর মতো চাইলে‌ই বাঘ দেখতে হলে এখন যেতে হবে জুলজিকাল পার্কে। তারজালির ঘেরাটোপে‌ সীমিত পরিসরে মনূষ‍্য নির্মিত আরণ‍্যক পরিবেশ। বিভিন্ন কোটা‌য় সংরক্ষিত সরকারি চাকরির মতো এখনো সেখানে সংরক্ষিত আছে কিছু বাঘ। সংখ্যা‌য় তারা সামান‍্য। তাদের শিকার করার ঝক্কি নেই। সরকারি মাংস খেয়ে বেড়েছে ভুঁড়ি। আদুরে বেড়ালের মতো তারা গাছের ছায়ায় পড়ে পড়ে ঘুমোয়। রোববার বিকেলে ভাতঘুম দিয়ে ওঠা কেরানী যেমন অলস হাই তুলে গিন্নি‌কে ডাকে - ক‌ই গো চা দাও, এরাও তেমনি বিকেলে ক্ষিধে পেলে চনমন করে তাকায়, মৃদু হাঁক পাড়ে। রক্ত জল করা হালুমের বদলে তা এখন জোরালো মিঁয়াও সদৃশ। কিছু ডাকাবুকো ডোরাকাটা‌ও আছে। তাদের অন‍্য কোনো জঙ্গলে‌র নিকটবর্তী গ্ৰামাঞ্চলে দুষ্টুমি‌ করার জন‍্য এখানে কয়েদ করা হয়েছে। অবাধ অরণ‍্যচারণায় বাধা পড়ার দুঃখে, ফেলে আসা জঙ্গলের কথা ভেবে কখনো অস্থির‌চিত্তে তারা একনাগাড়ে এপাশ ওপাশ পায়চারি করে যায়। যে বাঘ জন্মেছে এই ঘেরাটোপে‌ তার নেই উন্মুক্ত জঙ্গলে‌র অভিজ্ঞতা, তাই নেই কোনো অস্থিরতা‌ও। সে এই সীমিত পরিসরে‌ই অভ‍্যস্থ হয়ে গেছে। পেল্লায় গতর আর বাহারি ডোরাকাটা আলখাল্লা ছাড়া তার চরিত্রে বাঘত্ব‌ আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই। মাধব জাতীয় উদ‍্যানে গাড়িতে জাঙ্গল সাফারি‌তে এখন চিতল, নীলগাই বা শেয়াল দেখতে পেলেই উল্লসিত হয় পর্যটক‌রা - যাক তবু কিছু "ওয়াইল্ড লাইফ" দেখা হোলো। ফেসবুকে পোষ্ট করা যাবে। ট‍্যূর গাইডের মুখে বিগতদিনের বাঘের গল্প শুনে‌‌ই হতে হয় সন্তুষ্ট। ভাগ‍্যে থাকলে এখন‌ও টিকে থাকা কিছু লেপার্ডের চকিত দর্শনে দুধের স্বাদ কিছুটা মিটতে পারে ঘোলে। পাউচের দুধের স্বাদ পেতে সারিস্কা বা শিবপুরীতে রূপান্তরিত হ‌ওয়ার আগে‌ যাওয়া যেতে পারে রণথম্বোর বা বান্ধবগড়। বাঘ চাইলে ছুটে এসে হাইজাম্প মেরে হাতির পিঠে‌ও উঠে পড়তে পারে। তবে ওখানে‌ রাস্তার ধারে বাঘ দেখতে পেয়ে খোলা জিপসি‌র ফ্রেমে ভর দিয়ে দুম্বো ক‍্যামেরা নিয়ে হামলে পড়া দেশি বিদেশি পর্যটকদের নিত‍্য আদেখলাপনা দেখে দেখে বাঘের‌ও চোখ পচে গেছে। তাই তারা সাফারি পথের পাশ দিয়ে‌‌ পর্যটকদের টেরিয়ে দেখতে দেখতে পথকুকুরের মতোই নির্বিকার ভাবে চলে যায়। তাই বলেছি প‍্যাকেটের দুধ। তবে মালাই না মারা সদ‍্য দোয়া দুধের স্বাদ পেতে গাড়ি রাস্তা ছেড়ে এলিফ্যান্ট সাফারিতে কানহা, করবেট, কাজিরাঙা বা মানস অভয়ারণ‍্যে গেলে এখন‌ও প্রকৃত জংলী পরিবেশে আপন বিচরণ ক্ষেত্রে রাজকীয় মহিমায় দর্শন পাওয়া যায় বনের রাজার। তবে পর্যটকদের নিত‍্য আনাগোনা বাঘের মতো একান্তচারী প্রাণী‌র পক্ষে অত‍্যাচার বিশেষ। তাই বাফার জোনে চললেও কোর জোনে টাইগার সাফারি‌ নিষিদ্ধ হ‌ওয়া উচিত। গভীর জঙ্গলে তাদের থাকতে দেওয়া হোক নিজের মতো। কোর এরিয়া‌য় যাওয়ার অধিকার থাকুক কেবল বনকর্মী, ব‍্যাঘ্র বিষয়ে গবেষকদের। দক্ষ চিত্র গ্ৰাহকের‌ও সেখানে যাওয়ার অনুমতি থাকুক‍। তারা গভীর অধ‍্যবসায়ে তুলে আনবেন বাঘের গতিবিধি‌র কিছু উচ্চমানের ভিডিও। টাইগার রিজার্ভ প্রাঙ্গণের প্রেক্ষাগৃহে বড় স্ক্রিনে দেখা‌নো হোক সেই ভিডিও। সেখানে আধ ঘন্টায় পর্যটক‌রা যা দেখবে তা হয়তো কয়েক মাসের পরিশ্রমের ফসল। সেই ভিডিও অন্তর্জালে প্রকাশিত না হোক, তা কেবল ওখানে গিয়ে টিকিট কেটে‌ই দেখা যাবে। তাহলে পর্যটকদের চোখের ক্ষিধে মিটবে। পার্কের‌‌ দুপয়সা রোজগার হবে। বনের রাজা রাণী ও তাদের ছানাপোনা‌রাও থাকবে শান্তি‌তে। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশংসনীয় উদ‍্যোগউত্তর-পশ্চিম ভারতে মধ‍্যপ্রদেশ, গুজরাত ও রাজস্থানের ২ লক্ষ ৬৭ হাজার বর্গকিমি এলাকা জুড়ে আছে কাথিয়াবাড় গির শুস্ক পর্ণমোচি বনাঞ্চল। এখানেই আছে ভারতের প্রাচীন‌তম পর্বতমালা - আরাবল্লী। মাউন্ট আবু যার শিরোমণি। এই বিস্তৃত অঞ্চলে আছে ১৮টি স্বীকৃত অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ‍্যান। এশিয়া‌টিক সিংহর শেষ বাসস্থান গির‌ অরণ‍্য‌ও এই বনাঞ্চলে। মাধব জাতীয় উদ‍্যানের অবস্থান‌ও এই ভৌগোলিক পরিমন্ডলে। দোষে গুণে‌ই মানুষ। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী‌ নিজ স্বার্থে দেশে জরুরী অবস্থা জারি করে দেশবাসীর কাছে হয়েছে‌ন কলঙ্কিত। তবে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজের জন‍্য তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা‌‌ও প্রাপ‍্য। যেমন আমেরিকার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সামরিক সাহায্য করে বাংলাদেশের সৃষ্টি বা অপারেশন ব্লুস্টার দিয়ে খালিস্থান আন্দোলন খতমের সূত্রপাত। তবে সেগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। অরাজনৈতিক প্রেক্ষিতে মূলত তাঁর‌ই উদ‍্যোগে ১৯৭২ সালে লাগু হয় বন‍্যপ্রাণী সংরক্ষণ আই‌ন। সেটা‌ ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। ১৯০০ সালে সারা পৃথিবীতে বন‍্য বাঘের সংখ‍্যা ছিল আনুমানিক এক লক্ষ যার অধিকাংশ‌ই ছিল অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে। রাজন‍্য, অমাত‍্য ও উচ্চশ্রেণীর মানুষের অবাধ মৃগয়া চলেছে ১৯৬৮ সাল অবধি। সাথে ছিল চোরা শিকারের দৌরাত্ম্য। ফলে বন‍্য বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। অনেক দেরী হয়ে গেলেও এ‌ই প্রেক্ষাপটে ইন্দিরা‌জী পরের বছর নিলেন আর একটি অত‍্যন্ত জরুরী ও প্রসংশনীয় উদ‍্যোগ - প্রোজেক্ট টাইগার - যার ফল ভবিষ্যতে হবে সূদুরপ্রসারী। ১৯৫৬ সাল থেকে বাঘ বাঁচাতে মরীয়া আবেদন করে আসছিলেন রাজস্থান বনদপ্তরের এক অফিসার‌ কৈলাস সঙ্খলা। তিনি পরে হয়েছিলেন রাজস্থানের চিফ ওয়াইল্ড‌লাইফ ওয়ার্ডে‌ন। অর্থাৎ বণ‍্যপ্রাণের ব‍্যাপার‌টা তিনি ভালো‌ই বোঝেন। ইন্দিরা‌জী তাঁকেই প্রোজেক্ট টাইগারের প্রথম অধিকর্তা মনোনীত করে সবাই‌কে বুঝি‌য়ে দিলেন এটা নিছক একটা সরকারি ঢক্কানিনাদ নয়, তিনি এ ব‍্যাপারে যথেষ্ট সীরিয়াস। কৈলাসজী তখন ছিলেন দিল্লী জুলজিক‍্যাল পার্কের অধিকর্তা। পয়লা এপ্রিল ১৯৭৩ সালে করবেট জাতীয় উদ‍্যানে‌র ধিকালা রেঞ্জে যখন এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় তখন সারা ভারতে ৯টি টাইগার রিজার্ভে বাঘের সংখ‍্যা কমে দাঁড়িয়ে‌ছে মাত্র ২৬৮তে। বনকর্মী, সহযোগী গ্ৰামবাসী, সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, সাংবাদিক, আমলা, মন্ত্রী, সরকারি দপ্তর সবার মিলিত প্রয়াসে ৪৫ বছর পরে ২০১৮ সালে ১৮টি রাজ‍্যে ৫০টি টাইগার রিজার্ভে সর্বশেষ ব‍্যাঘ্রসূমারীতে বাঘের সংখ‍্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় তিন হাজার। ১৯৯৪ সালে কৈলাসজী‌ চলে গেছেন অনন্তলোকে। তাঁর দক্ষ সতীর্থ - রাজস্থানের রণথম্বোর টাইগার রিজার্ভে বাঘের পূনর্বাসনের একনিষ্ঠ কারিগর - ব‍্যাঘ্রবিশেষজ্ঞ ফতে সিং রাঠোর‌ও বৈকুন্ঠধামে চলে গেছেন ২০১১ সালে। বন‍্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ মহলে তাঁরা Tiger Man of India হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেমন সেলিম আলী পরিচিত ছিলেন Birdman of India হিসেবে। আশা করা যায় তাঁদের মতো দক্ষ ও নিষ্ঠাবান প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ‌দের নির্দেশিত পথে প্রোজেক্ট টাইগার ভবিষ্যতে‌ও সঠিক দিশায় চলবে। বজায় থাকবে এই উদ‍্যোগের সাথে সংযুক্ত সবার নিষ্ঠা। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলছে বন‍্য বাঘের সংখ‍্যা এখন বছরে ৬% হারে বাড়ছে। খুব‌ই সন্তোষজনক এক তথ‍্য। এভাবে চললে ধরাধাম থেকে এই সুন্দর, ঐশ্বর্য‌মন্ডিত প্রাণী‌টি হয়তো বিলুপ্ত হ‌য়ে যাবে না। সেদিন একটি প্রাচীন শ্বেতপাথরে‌র মাইলফলক অতীতের কিছু শ্বেত চর্মের ও তাদের অনুগত বাদামী বর্ণের রাজন‍্যদের অপরিণামদর্শী দৌরাত্ম‍্য মনে করিয়ে দিয়েছিল। টাইগার কান্ট্রিতেই বনের রাজার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা‌য় মন ভারী হয়ে গেছি‌ল। বাড়ি ফিরে প্রোজেক্ট টাইগার সম্পর্কে এসব কথা জেনে তবু একটু ভালো লাগলো। সিংহের মতো বাঘ গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাণী নয়। বাঘ একান্ত‌চারী। সে শিকার‌ও করে একা। তার সচ্ছন্দ বিচরণ ও শিকারের জন‍্য প্রয়োজন অন্তত শখানেক বর্গকিমির বিস্তৃত অরণ‍্য। প্রোজেক্ট টাইগার সমীক্ষায় ভারতে ৩২টি মূখ‍্য টাইগার করিডর নথিভুক্ত হয় যে পথে শিকারের খোঁজে বা অন‍্য কারণে‌ও বাঘ ইচ্ছে মতো এক অরণ‍্য থেকে নিকটবর্তী অরণ‍্যে যাতায়াত করে। রাজস্থানের রণথম্বোর থেকে মধ‍্যপ্রদেশের পালপুর কুনো হয়ে মাধব জাতীয় উদ‍্যান অবধি প্রায় ১৪০ কিমি ব‍্যাপী অরণ‍্যপথটি‌ও তেমন একটি টাইগার করিডর। এই করিডর চিরে চলে গেছে ব‍্যস্ত মুম্বাই-আগ্ৰা জাতীয় সড়ক। তবু গভীর নির্জন রাতের আঁধারে অরণ‍্যচারীরা মানুষের রাজপথ পার হয়ে চলে যায়। ১৯৭০ সালে মাধব উদ‍্যান থেকে বাঘ বেপাত্তা হয়ে গেলেও হয়তো সংরক্ষণ উদ‍্যোগে‌র ফলে ২০০৭ সালে ওখানে আবার দেখা গেছে এক পরিযায়ী ব‍্যাঘ্র জুটি‌কে। ওখানে আছে অনেক হরিণ, সখ‍্যাসাগর লেকে পর্যাপ্ত জল। জায়গা‌টা ভালো লেগে গিয়ে তারা ওখানে ডেরা‌ বেঁধেছে কিনা জানা নেই। জংলী বাঘের আয়ু দশ পনেরো বছর। হয়তো সেই জুটি এতোদিনে ইহলোক ত‍্যাগ করেছে। তাদের ডোরাকাটা ছানাপোনা হয়ে থাকলে খবর হয়ে যেতো। তা যখন হয়নি তখন ধরে নেওয়া যায় মাধব জাতীয় উদ‍্যানে এখন আর বড় মিঞা‌ নেই। তবে ওখানে এখনও আছে কিছু ছোটে মিঞা - অর্থাৎ লেপার্ড‌। বাঁকড়ে হনুমান মন্দিরসেই শ্বেতপাথরে‌র মাইলফলক থেকে ছশো মিটার দুরে মন্দিরের গেট। প্রায় দশ বিঘা এলাকা নিয়ে মন্দির। মন্দির চত্বরে আলাপ হোলো মন্দির কমিটির প্রধান ডঃ গিরিশ মহারাজের সাথে। তিনি এখানে নিয়মিত ভাগবত পাঠ ও ব‍্যাখ‍্যা করেন। মূলত তাঁর উদ‍্যোগে‌ই এখানে সবকিছু সুষ্ঠুভাবে চলছে। জানতে চাই বাঁকড়ে শব্দের অর্থ কী। উনি বলেন বাঁকড়ে হোলো মহারাষ্ট্রের একটি ব্রাহ্মণ‍্য গোত্র। জানান এই মন্দিরে হনুমান‌জীর মূর্তি‌র প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় ৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে। এখান থেকে পাওয়া প্রাচীন কিছু মূর্তি গোয়ালিয়র কেল্লা‌র নীচে গুজারিমহল সংগ্ৰহালয়ে সংরক্ষিত আছে। সিন্ধিয়া রাজবংশ অতীতে কয়েকবার এই মন্দিরের জীর্ণোদ্ধার বা মেরামত করেন। বছর পঞ্চাশেক আগে গীতা প্রেস গোরক্ষপুর সমিতি সারা ভারতের প্রাচীন মান‍্যতাপ্রাপ্ত হনুমান মন্দিরের যে সমীক্ষা করে তাতে এই মন্দিরের বিশেষ উল্লেখ আছে। বর্তমান মন্দিরের যে রূপ তা ১৯৯১ সালে সর্বশেষ মেরামতের পর। বাঁকড়ে হনুমান মন্দিরে বহুদিন ধরে ধার্মিক অনুষ্ঠান, ভাগবত পাঠ, ভান্ডারা, বিদাই সমারোহ এসব হয়ে আসছে। অতীতে মহারাজ মাধো রাও মঙ্গলবার শিবপুরী‌তে এলে মন্দিরে সোয়া মন রুটি‌র ভোগ চড়তো। রাজ পরিবারের সদস‍্যরা আসতেন মন্দিরে। এখন‌ও প্রতি মঙ্গলবার এখানে অনেক ভক্ত‌সমাগম হয়। গিরিশ‌জী বলেন আমায় একটু শিবপুরী যেতে হচ্ছে কিন্তু আপনি এতদুর থেকে এসেছেন অবশ‍্য‌ই দুপুরে খেয়ে যাবেন। ইচ্ছে হলে রাতে এখানে থাকতেও পারেন। নমস্কার করে চলে যান সজ্জন পন্ডিত‌জী। একটু আগে মোনী‌বাবা আশ্রমের বিপরীত অভিজ্ঞতা হোলো এখানে। এ যেন ঠিক ধনঞ্জয় !!!পন্ডিত‌জীর এক সহকারী আমায় মন্দিরের উত্তর পূর্ব কোনে রান্নাঘরে নিয়ে যায়। এগিয়ে আসে মুকেশ কুশ‌ওয়াহা। তরুণটি মন্দিরের রান্নার দায়িত্বে আছে। সহকারী ওকে বলে, বাবুজী কলকাতা থেকে এসেছেন। পন্ডিতজী এনাকে দুপুরে এখানে খেয়ে যেতে বলেছেন। ইনি আমাদের মেহমান, যত্ন করে খাওয়াবি। পন্ডিত‌জীর সহকারী ছেলেটি নমস্কার করে চলে যায়। তখন বেলা দেড়টা। মুকেশ কাঠের উনুনে বসানো বড় লোহার কড়ায় গরম জল দেখি‌য়ে বলে, বাবুজী আপনি চান করে নিন। ডাল আছে। আটা মেখে গরম গরম রুটি করে দেব। সঙ্গে গামছা নেই। মাথায় জড়ানো বৌয়ের একটা বাতিল উড়নি আছে। সেটা দিয়ে চান করে গা মাথা মুছে নেওয়া যাবে। কিন্তু পিছনের খোলা চাতালে পাতলুন খুলে অন্তর্বাস পড়ে চান করতে হবে ভেবে চানের ইচ্ছে উপে গেল। কারণ অদূরে কিছু লোকজনের সাথে কয়েকটি মহিলা‌ও রয়েছেন। মুকেশ নাছোড়, দুপুরে চান না করলে আরাম হয় না। একটা চাদর দিয়ে বলে এটা জড়িয়ে নিন। অগত‍্যা ওর চাদর জড়িয়ে এক বালতি গরম জল নিয়ে পিছনের চাতালে যাই। কয়েকটা তৃষ্ণার্ত গরু বালতি দেখে সাগ্ৰহে এগিয়ে আসে। গরম জলে‌ই মুখ দিতে যায়। হাত নাড়িয়ে তাড়াই তাদের। বালতি‌টা একপাশে সরিয়ে রেখে কল খুলে নালির পাশে পা দিয়ে দাঁড়া‌ই। চাতালে খানিক‌টা জল দাঁড়িয়ে যায়। গরুগুলো বুঝতে পারে আমার উদ্দেশ্য। বালতি ছেড়ে চাতালে মুখ নামিয়ে চোঁক চোঁক ক‍রে খানিক জল খায়। খুব তেষ্টা পেয়েছিল ওদের। তৃষ্ণা মিটিয়ে চলে যায় ওরা। আমি‌ও চান করে বারান্দায় পাতা চাটাইয়ে এসে বসি।কাঠের আগুনে সেঁকা, দেশী ঘি মাখা‌নো মোটা মোটা গরম রুটি ও অড়হড় ডাল। শুধু খিদের মুখে বলেই নয়, সত‍্যি‌ই লাগে অমৃত। অমন রুটি দুটি খেলেই ছ ঘন্টার জন‍্য নিশ্চিন্তি। মুকেশ আরো দুটো গছাতে চায়। আঁতকে উঠে বারণ করি। খাওয়া‌র পর মুকেশ বলে, বাবুজী, তাড়া নেই তো? বলি, কেন? ও বলে তাহলে ঐ প্রবচন হলে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পারেন। আমার ফোন নাম্বার রাখুন। আশেপাশে‌ই থাকবো। বিশ্রাম করে উঠে ফোন করবেন, চা করে দেব। এ তো জামা‌ই আদর! অভিভূত হয়ে যাই। মুকেশ আমার নিয়ে যায় দোতলার হলে। একপাশে মেঝেতে ম‍্যাট পেতে দেয়। জানলার পর্দা সরিয়ে দেয়। ফুরফুরে হাওয়ায় সাথে শীতের মিঠে রোদ এসে হামা দেয় মেঝেতে। পূবে দিগন্তবিস্তারি চাষের ক্ষেত। উত্তরে যতদূর চোখ যায় মাধব জাতীয় উদ‍্যানের অরণ‍্য। শরীরে ক্লান্তি মজুদ ছিল। ঠিকই বলেছিল মুকেশ, চান করে বেশ আরাম হয়েছে। তার ওপরে ভরপেট খাওয়া। ন‍্যাপস‍্যাকে মাথা দিয়ে ম‍্যাটে বডি ফেলতে‌ই ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসে। সাড়ে তিনটে নাগাদ নীচে নামতে‌ মন্দির চত্বরে মুকেশের সাথে দেখা হয়। বলে, বিশ্রাম করে ভালো লাগছে না? মাথা নেড়ে সায় দিই। সত্যি, বেশ ফ্রেশ লাগছে। ও বলে, চলুন তাহলে চা করে দি‌ই। ঠিক যেন 'গল্প হলেও সত‍্যি' সিনেমায় বাবুর্চি ধনঞ্জয়ের চরিত্রে রবি ঘোষ। তেমনি হাস‍্যময় সরল মুখ। ছিপছিপে শরীর। চটপটে কাজকর্ম। কাগজের কাপে স্বাদু চা হাতে ওর সামান্য জীবনকথা শুনি। পড়াশোনা বিশেষ করেনি মুকেশ। রান্না ছাড়া আর কিছু বিশেষ জানে না। গ্ৰাম থেকে কয়েক বছর আগে পেটের দায়ে ভাগ‍্য অন্বেষনে বেরিয়েছিল। এই মন্দিরে এসে সজ্জন পন্ডিত‌জীর কৃপায় রান্নার কাজ পেয়ে রয়ে গেছে। থাকতে খেতে পায়। অল্প মাইনে‌ও পায়। ভান্ডারা লাগলে কিছু বকশিশ মেলে। তাতেই চলে যায় ওর। ভেবে লাভ নেই বলে ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে না ও। চলে আসার আগে কিছু বখশিশ দিই। পন্ডিতজীর অতিথি বলে নিতে চাইছি‌ল না। অভাবী প্রান্তিক মানুষ‌গুলি হৃদয়ের এমন ঐশ্বর্য কীভাবে পায় বুঝি না! টাকাটা ওর পকেটে গুঁজে দিয়ে র‌ওনা হ‌ই। ধনঞ্জয় বলে, ফির আইয়েগা বাবুজী। ক্ষণিকের জন‍্য ভুলে‌ই গেছি‌লাম - ও তো মুকেশ!লালকেল্লার ঐতিহাসিক বিচার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মালয়ের (মালয়েশিয়া) যুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা জাপানি সৈন‍্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ‍্য হয়। তাদের এনে রাখা হয় সিঙ্গাপুরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত থেকে জাপানে চলে গিয়ে রাসবিহারী বসু ততদিনে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্ৰামে জাপানি সহযোগিতা‌র ভিত তৈরি করে ফেলে‌ছেন। তাঁর উদ‍্যোগে সিঙ্গাপুরে ভারতীয় বংশোদ্ভুত যুদ্ধ‌বন্দী‌ সৈন‍্যদের নিয়ে ১৯৪২ সালের আগষ্টে তৈরি হয় ইন্ডিয়ান ন‍্যাশানাল আর্মি বা INA. সাম্রাজ্য‌বাদী ব্রিটিশ শাসন থেকে পরাধীন ভারতকে মুক্ত করতে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে INA কে সামরিক সাহায্য করতে‌ রাজি হয় জাপান। INA এর সামরিক নেতৃত্বের দায়িত্ব পান মোহন সিং। তবে জাপানের সাথে মতবিরোধে ডিসেম্বরে‌ই ভেঙে যায় অঙ্কুরিত INA. অতঃপর জার্মানি থেকে জাপান হয়ে ১৯৪৩ সালের মে মাসে সিঙ্গাপুরে এসে দ্বিতীয় দফায় আজাদ বাহিনীর হাল ধরেন সুভাষচন্দ্র। সেই দল‌ই ইম্ফল ও কোহিমায় ব্রিটিশ‌দের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়ে‌ জমি ছিনিয়ে নিয়ে‌ছিল ১৯৪৪ সালের এপ্রিলে। বার্মা‌ যুদ্ধ‌ক্ষেত্রে আজাদ হিন্দ বাহিনীর একটি দল সামান্য উপকরণে বিশাল ব্রিটিশ‌ বাহিনীর বিরুদ্ধে‌‌ মরীয়া লড়াই করে‌ও শেষরক্ষা করতে পারে না। ১৯৪৫ সালের ১৭ই মে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে তারা যুদ্ধ‌বন্দী হিসেবে ধরা পড়ে। ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে জার্মানির পতনের সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ৫ নভেম্বর ১৯৪৫ এ দিল্লী‌র লাল কেল্লা‌য় শুরু হয় সেই বিদ্রোহী সেনা অফিসার‌দের কোর্ট মার্শাল - INA Trial - চলে ১৯৪৬ এর মে অবধি। কর্ণেল গুরবক্স সিং ধিঁলো, কর্ণেল প্রেম কুমার সাহগল ও মেজর জেনারেল শাহ ন‌ওয়াজ খানের বিরুদ্ধে আনা হয় সবথেকে গুরুতর অভিযোগ - ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এই বিচারের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের দেশব্যাপী অসহযোগ, আইন অমান‍্য বিক্ষোভের সাথে করাচি থেকে কলকাতা‌য় শুরু হয়ে যায় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ। জব্বলপুরে সেনাবাহিনী‌র এক ইউনিটের বিদ্রোহ বলপূর্বক দমন করা হয়। ভারতীয় সৈন‍্যরা ক্ষোভে ফুটতে থাকে। মাদ্রাজ, পুনে রেজিমেন্টে ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশ অফিসারদের নির্দেশ অমান্য করতে শুরু করে। লালকেল্লা বিচারের তিন বছর আগে ৯ই আগস্ট ১৯৪২এ গান্ধীজী গোয়ালিয়রে "করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে" ডাক দিয়ে "ভারত ছাড়ো" আন্দোলনের সূচনা করতে তার পরদিনই ব্রিটিশ সরকার নেহরু, বল্লভভাই, আসফ আলী, আজাদ সহ কংগ্রেসের বারোজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে আহমেদনগর কেল্লা‌য় কয়েদ করে। তবু নেতৃত্বহীন স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ অহিংস, সংহিস, চোরাগোপ্তা নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। লর্ড লিনলিথগোর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গুরুত্ব ও বিস্তৃতির দিক থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সাথে তুলনীয়। লালকেল্লা বিচারের সময় পরিস্থিতি আর‌ও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। জনগণের হুংকার ওঠে: লাল কিলে সে আয়ি আওয়াজ,ধীলন, সাহগল, শাহ নওয়াজ।ইন তিনো কি হো উমর দরাজ।(long live you three)লাল কিলা তোড় দো,আজাদ হিন্দ ফৌজী কো ছোড় দো।বিচার প্রক্রিয়ায় জাতীয় কংগ্ৰেসের তরফে গঠিত হয় এক ডিফেন্স কাউন্সিল। তাতে ছিলেন তখনকার কিছু বিশিষ্ট উকিল ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব - ভুলাভাই দেশাই, স‍্যার তেজবাহাদুর সপ্রু, কৈলাস নাথ কাটজু। সেই দলে যোগ দেন আহমেদ‌নগর কেল্লা থেকে সদ‍্য (এপ্রিলে) মুক্তি পাওয়া আসফ আলী ও নেহরু। হিন্দু, শিখ, মুসলিম - তিন ধর্মের তিন বিদ্রোহী সেনা অফিসারের মুক্তি‌র জন‍্য চলে জটিল আইনি লড়াই। এই ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ ও জাতীয় কংগ্রেস এক সুরে গলা মেলায়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লীমেন্ট এ্যাটলী পরে স্বীকার করেন সুভাষ বোসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় আজাদ হিন্দ বাহিনী ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতীয় সৈন‍্যবাহিনীতে ভারতীয় সৈন‍্যের ব্রিটিশ আনুগত্যের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে এযাবৎ কুটিল বিভেদ নীতি‌ ও সৈন‍্যবলে নানান ব্রিটিশ কলোনি শাসনে অভ‍্যস্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য‌বাদের শীর্ষ‌নেতৃত্ব ইংল‍্যান্ডে নড়েচড়ে বসে মানতে বাধ‍্য হয় - ভারতে ব্রিটিশ রাজের মৃত‍্যুঘন্টা বাজতে শুরু করেছে। লালকেল্লা বিচারের রায় প্রকাশিত হোলো ১৯৪৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। বিচারে তিনজনকেই দোষী সাব্যস্ত করে রাষ্ট্রদ্রোহী‌তার অপরাধে ফাঁসি‌র সাজা দেওয়া হোলো। তবে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের প্রবল বিক্ষোভ ও সৈন‍্যবাহিনীর প্রকাশ‍্য অসন্তোষ উপলব্ধি করে তদানীন্তন ব্রিটিশ সেনাপ্রধান সে সাজা কার্যকর করতে চাইলে‌ন না। তাঁর মনে হয়েছিল তাহলে হয়তো দেশে বিক্ষোভের এমন আগুন জ্বলে উঠতে পারে যা সামাল দেওয়া প্রবল পরাক্রমী ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে‌ও সম্ভব হয়ে উঠবে না। তাই মান বাঁচাতে তিন অভিযুক্ত‌কে‌ই চাকরী থেকে বরখাস্ত করে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁরা মর্যাদা পান 'জিন্দা শহীদ' হিসেবে, কারণ ফাঁসি তো হয়েই যাচ্ছি‌ল প্রায়। এর এক বছর সাড়ে আট মাস বাদেই ভারত থেকে পাকাপাকি পাততাড়ি গুটোতে বাধ‍্য হয় ব্রিটিশ‌রাজ। স্বাধীন হয় ভারত। সফল হয় সুভাষ‌চন্দ্রের পূর্ণ স্বরাজের স্বপ্ন এবং আরো অনেকের সাথে অধিকাংশ দেশবাসীর।কিন্তু কেন এই শিবের গাজন?সেটা আসবে ২য় পর্বে …. নাহলে এক‌ই পর্বে ৯২০০ শব্দের লেখা পড়তে ধৈর্য্য‌চ‍্যূতি ঘটতে পারে।চিত্রাবলী:-ভাদিয়াকুন্ড থেকে সখ‍্যাসাগর লেক - বাঁদিকে ট‍্যূরিস্ট রিসর্টে‌র বোটিং পয়েন্টভাদিয়াকুন্ড (লাল তীর) - শীতে ঝর্ণার ধারা শীর্ণকায় (সবুজ তীর)তবে বর্ষা‌য় জলধারা ভালো‌ থাকে (ছবি-আন্তর্জাল)ভাদিয়াকুন্ডের পাশে হনুমান মন্দির (লাল তীর) - যেখানে ছিলাম (সবুজ তীর) এবং এ দুয়ের মাঝে সব মিলিয়ে রঘুবীর পুরী মহারাজের আশ্রমপ্রথমে ঢুঁ মারলুম মোহনী মহারাজ আশ্রমেহেরিটেজ পথনির্দেশ (লাল ও সবুজ তীরের প্রসঙ্গ আসবে পরবর্তী পর্বে)বাঁকড়ে হনুমান মন্দির
  • জনতার খেরোর খাতা...
    হিজড়ায়েল। - Sobuj Chatterjee | আরও কত ভন্ডামি আছে আস্তিনে আগামীরা গান গাবে কেবল অস্ত্রে; আগুন পাখী উড়ছে আকাশ চিনেবন্ধুরা মারা গেছে গতকাল রাত্রে!!
    হেদুয়ার ধারে - ৬৩  - Anjan Banerjee | দুজনে বৈকুন্ঠ বুক হাউসের দিকে কোণের গেট দিয়ে ঢুকে ধীর পায়ে উত্তর দিকে আসতে লাগল চুপচাপ। দূর থেকেই দেখা গেল প্রতিবিম্ব শিরিষ গাছের নীচে বেঞ্চে বসে একটা লম্বা খাতায় চোখ বোলাচ্ছে।কাবেরী নতুন কোন রোমাঞ্চের আভাস পেয়ে নীচু গলায় বলল, ' ওই দেখ ... এসেছে ... চিনতে পেরেছিস তো ... 'সুমনা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল ----- ' তাই তো দেখছি। হ্যাঁ হ্যাঁ ... মনে আছে। হাঁদাটাকে একবার দেখলেই ঠিক মনে থাকে .... '----- ' কি করা যায় বল তো ? ওর সামনে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যাবি ... নাকি ... ' কাবেরী বেশ রাগসিক্ত।----- ' না না ... হেঁটে বেরিয়ে যাব কেন ? ওখানে থামব ... মুখোমুখি হব। পাশে বসতেও পারি ... কথাও বলতে পারি ... '----- ' বলিস কিরে ! তুই এত স্মার্ট হয়ে গেলি কি করে ... পাশে বসবি ... কথা বলবি ....অবাক কান্ড ! পারবি তুই ? '----- ' না পেরে উপায় কি ? প্রাণের দায় বলে কথা। '----- ' তার মানে ... তোর আবার কিসের দায় ? মরছি তো আমি ... ' কাবেরী বলল।----- ' সেটাই তো ... তোকে বাঁচাতেই তো আমি এত মরীয়া ... 'কাবেরী কোন উত্তর দিল না। মানে, কথাটার উত্তর ঠিক কি হতে পারে ভাবতে লাগল বোধহয়।হাঁটতে হাঁটতে দুজনে প্রতিবিম্বর সামনে এসে পড়ল। প্রতিবিম্ব খাতা থেকে মুখ তুলে দেখে দুই বন্ধু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটে উঠল। একবার কাবেরীর দিকে তাকায়, একবার সুমনার দিকে।সুমনা ফিক করে হেসে ধপ করে বসে পড়ল প্রতিবিম্বর ডানপাশে।। কাবেরীর মনে বিস্ময়ের বিদ্যুচ্চমক লাগল। সে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় তার স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা গুলিয়ে যাচ্ছে।সুমনা হঠাৎ বলল, ' আয় ... বস না ... দাঁড়িয়ে আছিস কেন ... 'হতবাক কাবেরীও বসে পড়ল। তবে, প্রতিবিম্বর পাশে না, সুমনার ডানপাশে।সুমনা প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে বলল, ' এই যে ... এ হল কাবেরী .... আমার ক্লাসমেট। আমার বুজম ফ্রেন্ডও বলতে পার। তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ও খুব আগ্রহী ছিল। অনেকদিন ধরে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব বলে ভাবছিলাম। হয়ে ওঠেনি ... আজ হয়ে গেল কেমন ... 'প্রতিবিম্ব কি বলবে ভেবে না পেয়ে আনাড়ির মতো দাঁত বার করে হেসে বলল, ' ও আচ্ছা ... খুব ভাল লাগল। আবার আসবেন ... 'খুব সম্ভবত হেদুয়ায় আসবার কথা বলল।সুমনা বলল, ' আমি অবশ্য আমাদের ব্যাপারটা ওকে তেমনভাবে বলিনি। এটা আমারই দোষ। আগে বললে ... নিশ্চয়ই আরো আগে পরিচয় হত তোমার সঙ্গে ... তাই না ? 'প্রতিবিম্ব এবং কাবেরী দুজনই কোন কথা বলল না। সুমনাই বলতে লাগল, ' আসলে আমার তো তেমন তাল জ্ঞান নেই .... তাই কখন কি করার দরকার বুঝতে পারি না।'কাবেরী অকস্মাৎ সম্পূর্ণ অন্য অবতারে অবতীর্ণ হল।সুমনার বাহুতে একটা চিমটি কেটে কৌতুকভরা স্বরে সপ্রতিভ ভঙ্গীমায় বলে উঠল, ' পাজি, শয়তান , বেল্লিক... তোর তাল জ্ঞান আমি ঘোচাচ্ছি ... চল একবার কলেজে .... 'সুমনা বলতে থাকে , ' উঃ ... ছাড় ছাড় লাগছে ... হি হি হি হি .... '----- ' লা..গছে ! লাগার জন্যেই তো চিমটিটা কাটা। আর কখনও আমার কাছে লুকোবি কিছু ... বল ... বল ... আমি কি এতই খারাপ রে ... এখনও চিনলি না ! 'কাবেরীর কথার শেষের দিকে হেমন্তের সাঁঝবেলার সুর লাগল।সুমনা নীরবে গভীর মরমী স্পর্শ ভরা একটা হাত রাখল কাবেরীর হাতে।প্রতিবিম্ব ওদের দিকে তাকিয়ে গোলোকধাঁধাটার রহস্য বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।ওই শিয়ালদার মেসের পরিবেশ দীনবন্ধুর তেমন পছন্দ হল না। ওখানকার লোকগুলোও যেন কেমন ধারা। কারণে অকারণে ঝগড়া করা, নিজেদের মধ্যে খিটিমিটি বাঁধানো, ভাত ডাল তরকারি মাছের ঝোল তাদের কথায় 'মুখে দেওয়া যায় না' রান্না নিয়ে গন্ডগোল পাকানো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এই এক মাসের মধ্যেই জনা তিনেক বোর্ডার তার কাছে 'সামনের বুধবার দিয়ে দেব ... দশটা টাকা হবে ...খুব আরজেন্ট দরকার ' গোছের কিছু বলে টাকা ধার চেয়েছে তার কাছে। দীনবন্ধু প্রথমে একজনকে দিয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছে টাকাটা ফেরত পাওয়ার আশা ক্ষীণ। মানে, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। দুটো বুধবার বেরিয়ে গেল , সে ভদ্রলোক উচ্চবাচ্যই করেন না। দীনুর এসব তাগাদা টাকাটা দেওয়ার অভ্যাস নেই। সে বেচারা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু হা হতোষ্মি ...। একদিন সে আমতা আমতা করে বলেছিল, ' বলছিলাম যে অনেকদিন হয়ে গেল ... দরকার ছিল ... '। সে ভদ্রলোক, নিত্যানন্দ না কি যেন নাম, চান করতে যাবার আগে গামছা পরে নাভিতে সর্ষের তেল লাগাচ্ছিলেন, অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ' কি বলুন তো ... 'দীনবন্ধুই যেন চোরের দায়ে ধরা পড়েছে। সে ফের অনভ্যস্ত এবং সলজ্জ গলায় বলল, ' না মানে ... ওই যে দশ টাকা দিয়েছিলাম ... 'ভদ্রলোক আঙুলে তেল নিয়ে নাকে দিয়ে দুবার টানলেন। টানতে টানতে বললেন, ' ও..ও..ও .. তাই বলুন ... আমি ভাবলাম কি না কি ...। আরে বাবা আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি ... দিয়ে দেব দিয়ে দেব ... ভদ্রলোকের এক কথা ...অত অস্থির হচ্ছেন কেন ? আপনি মশাই ব্যাচেলর লোক। অত টাকার দরকার কি শুনি। ফূর্তি মারানোর ওব্যেস নেই নিশ্চই ... হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ ... আচ্ছা ঠিক আছে ... চান করে আসি। কলতলা খালি হয়েছে ... ওই কথা রইল তা'লে... 'কি কথা রইল দীনবন্ধুর মাথায় ঢুকল না কিছুই।সে অবশ্য বুদ্ধি করে পরের দুজন ঋণ প্রার্থীকে এড়িয়ে গেছে। তারা আবার দীনবন্ধুর নামে তার আড়ালে নানারকম উল্টোপাল্টা 'পাঁচা' করতে লেগেছে। সেটা আবার মেসের জনৈক সদস্য(বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর হবে হয়ত) দীনবন্ধুর কানে তুলে দিয়ে গেল। এগুলোই বোধহয় এদের দৈনন্দিন মনোরঞ্জনের উপাদান।সে যাই হোক এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে দীনুর। ভাবল, মেসটা বদলানোর দরকার। পিসেমশাই বলেছিলেন যে তাদের বাড়িওয়ালা বিভূতি জেঠুর জানাশোনা মেস আছে শ্যামবাজারে। ওখানে ব্যবস্থা হতে পারে।দীনবন্ধু শুক্রবার অফিস ছুটির পর অঞ্জলি পিসীর বাড়িতে গেল। গিয়ে এক ফাঁকে মেস সমস্যার কথাটা তুলল।নিতাইবাবু সব শুনে টুনে বললেন, ' দাঁড়া দত্তবাবুকে বলছি। ওর ভাল খাতির আছে শ্যামবাজারের মেসে। যদি সিট খালি থাকে ... দেখছি দেখছি ...। তুই মালপত্র নিয়ে এখানে চলে আয়। এ ক'দিন এখান থেকেই অফিসে যাতায়াত কর। '( চলবে )********************************************
    শাজাহানের স্বপ্ন  ও জাহানারার বার্ন কেস - upal mukhopadhyay | কদিন ধরে একটা ভাবনা শাহেনশাহ শাজাহানের মনে খচখচ করছে, রাতের বেলা স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন বেগম মুমতাজ মহল। তিনি যমুনার জল থেকে সরাসরি উঠে এসেছেন, তাঁর সারা গায়ে জলের ফোঁটারা টপটপ করে ঝরছে কিন্তু বিশাল যমুনার দিগন্ত বিস্তারি খাতে কোথাও এক ফোঁটা জল নেই। শুধু বালি, ধু ধু করছে বালির চড়া তার ওপর দুটো চখাচখি বসে। তারা কি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাতলা জলের যে অবশেষ আছে তার ওপর ওপর? কিন্তু শাহেনশাহ তো কই জল দেখতে পাচ্ছেন না! শুধুই বালি। জলের খোঁজে খোঁজে চখাচখির সঙ্গে সঙ্গে কি ঘুরে বেড়াবেন হিন্দুস্থানের বাদশাহ? লোক লস্কর নিলে যদি পাখিরা পালায়, তাই ঘুমের গভীরে সন্তর্পনে এগোতে থাকেন শাহেনশাহ। সেই সময় পাখিরা ডেকে উঠেছে, ঠিক উড়বার আগের মুহূর্তে ডেকে ওঠে চখাচখি আর তারা বেগমকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঠোঁট তুলে তুলে বলছে, “ মালিকা এ হিন্দ, মালিকা এ হিন্দ ”। শাহেনশাহ ঠিক করতে পারেন না কোনটা দেখবেন – সদ্য স্নাতা মুমতাজকে নাকি যমুনার চরে বসে থাকা কথা বলা পাখিদের। এই করতে করতে পাখিরা উড়ে যায়। যেমন জোড়ায় আসে তেমনই জোড়ায় উড়ে যেতে দেখা গেল তাদের আর এর পর আর বেগমকেও দেখতে পেলেননা শাজাহান। তাঁকে বিছানায় অসহায় ফেলে সবাই চলে যাচ্ছে বেগম ও পাখির জোড়। এই অবস্থায় বাদশাহের কাছে থাকার মতো, তাঁর অশান্ত মনকে সান্ত্বনা দিয়ে আসবেন কে? মায়ের অবর্তমানে তা করতে পারতেন একমাত্র শাহাজাদী জাহানারা, শুধু শাজাহান কেন? ঔরঙ্গজেবকেও প্রায়ই দেখা যায় তাঁর কাছে যত অভিমান আর অভিযোগ নিয়ে যাচ্ছেন। এমনই খাহার এ বুজুর্গ - বড় বোন, শেষ আশ্রয়স্থল হলেন শাহাজাদী জাহানারা।এরপরই ষোলোশো চুয়াল্লিশের ছাব্বিশে মার্চ আগ্রায় এত্তেলা পাঠাচ্ছেন বাদশাহ শাজাহান। এত্তেলা যাচ্ছে শাহাজাদী জাহানারার কাছে। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে, জাহানারার নিজের মহলের আঁকাবাঁকা ঘুরপথে, আগ্রার কেল্লায় বেলে পাথরের দেওয়ালে মশালচিরা প্রতিটা কোন আলোকিত করে তুলেছে, কোথাও যাতে অন্ধকার না থাকে সেটা দেখা তাদের কর্তব্য। কিন্তু মশাল জ্বালাতে আগুন লাগে আর তার থেকে প্রবল তাপ উৎপন্ন হয়, হতেই থাকে। সে তাপ মানুষকে বাঁচাল আবার মারলোও বটে। তড়িঘড়ি করে আব্বুজানের কাছে পৌঁছতে চাইছিলেন শাহাজাদী জাহানারা। দেখে আরেক শাহাজাদী রোশেনারা বলে উঠেছিলেন, " জলদবাজি? " জাহানারা উত্তর করেন নি। শুধু তাড়াহুড়োয় পানের বাটাটা আনার কথা ভুলে গেলেন, দীর্ঘ অলিন্দে দ্রুত পায়ে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল – পান ছাড়া তাঁর চলবে না যে! ঘাড় ঘুরিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন সহচরীকে, সে ছুটলো পানের বাটা আনতে। সেটা ছিল মাঝ রাস্তায় একটা বাঁক আর তাতে জ্বলছে মশাল, গনগনে হয়ে উঠেছে তার তাপ। সেই তাপ শাহজাদীর মসলিনের ওড়না টেনে নিল আগুনের মধ্যে, সারা শরীর আগুন ছড়িয়ে যেতে চাইছে আর সময় নেই এখুনি ছড়িয়ে যাবে। আতর মাখানো থাকে শাহজাদীর শরীরে, আতর থাকে তার আওতায় থাকা সব সহচরীর, একটা আতরের অঞ্চল তৈরি হয়ে যায়। সেই আতরও আগুন পছন্দ করে ফেলল। সারা গা আগুন হয়ে যাবে জাহানারার? প্রাণপণে দু হাত দিয়ে ওড়না খোলার চেষ্টা করছেন তিনি। সে দেখে চার চারজন সহচরী ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচাতে চাইছে শাহজাদীকে, তাদের কারুর গায়েও আগুন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে, তাপ বর্ষাচ্ছে কিন্তু মেঘের দেখা নেই। পানের বাটা আনতে গিয়েছিল যে তার চিৎকারে খোজা প্রহরীরা ছুটে এসেছে, সবাই জানে তাদের অসাধ্য কিছু নেই তাই জাহানারা রক্ষে পেলেন। কিন্তু ভালো রকম পুড়ে গেছে তাঁর শরীরের নানা জায়গা পিছন থেকে আগুন লাগায় পিঠ আর আগুন থামানোর চেষ্টায় হাতের অনেকটা।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত