এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  নাটক  শরৎ ২০২৩

  • আবোল তাবোল

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    নাটক | ১২ নভেম্বর ২০২৩ | ৬০৩ বার পঠিত
  • মেনকার মেয়ের মাগ্গদশ্শক  | যদি এই জীবনের বন্দরে নানাদেশী তরী এসে নোঙর করে | ঘোড়ামারা দ্বীপ | দ্বিষো জহি | কবি যখন পাহাড় হয়ে যায় | ট্রফি | ফকিরি | বাংলা ভাষার গঠন নিয়ে চর্চা ও কিছু প্রস্তাব | কাঠের মানুষ | তাজ ও মাহোল | কবিতাগুচ্ছ | কোন নাম নেই | টিফিনবেলার গান | সান্দ্র ধাতবসঙ্গীত | মশা-ই | গুনাহ! গুনাহ! | রেনেসাঁস থেকে রসগোল্লা সবই কলোনিয়াল | সু-পাত্রের সন্ধান দেবে অঙ্ক | যদি বল প্রেম | যশপতির একদিন | চোদ্দপিদিম | গভীর জল | লেখা-সাক্ষাৎ | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং - পর্ব ১ | কন্যাকুমারী | সিন্ধুতট | ট্যাঙ্কশংকর, লোকটা ও এক সম্ভাব্য/অসমাপ্ত মহাজাগতিক কিস্যা-১ | ট্যাঙ্কশংকর, লোকটা ও এক সম্ভাব্য/অসমাপ্ত মহাজাগতিক কিস্যা-২ | আনন্দ মঠ – ইতিহাসের সন্তান, ইতিহাসের জননী | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং -- পর্ব ২ | অর্গ্যাজম | কবি-কাহিনি | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং -- পর্ব ৩ | কমরেড গঙ্গাপদ | বিপজ্জনক খেলা | বেলার বেতার | গভীর অসুখে নিমজ্জিত মণিপুর | আবোল তাবোল | শিউলিরা | বিসর্জন | এক রাজা, দুই কবিরাজ | হাওয়া হাওয়া | ভোলবদল | ধৃতরাষ্ট্র ও দশরথঃ মহাকাব্যের দুই পিতা ও তাদের রাজধর্ম | মারীকথা | দামামা | হাওয়া মোরগের জীবন | পলায়নবাদীর সঞ্জীবনী বটিকা | নিত্যগতি | তিনটি কবিতা | চিত্রকর | যাবার কথা
    (সুকুমার রায়ের থেকে স্রেফ চুরি করে)

    ১ম দৃশ্য

    ছায়া ধরার জন্যে প্যাঁচার মুখোশ-পরা একজন একটা ধামা হাতে দোড়োদৌড়ি করছে।
    তার নাম হরু। মঞ্চে একটা আমড়া গাছ। তার নীচে শেষ পর্যন্ত সে ধামাটা চাপা দেয়।


    হরু। (হাসতে হাসতে) কী, কেমন! (প্রায়-ন্যাড়া অল্প চুলের একটি ছেলের উদয় হয় তৎক্ষণাৎ। সে মোহন।)

    মোহন। ব্যাপারটা কী! এত হাসাহাসি কিসের?

    হরু। ধরেছি, ঠিক ধরেছি ছায়াটাকে।

    মোহন। কার ছায়া?

    হরু। হুঁ বাবা, আমড়া গাছের।

    মোহন। তাতে এত লাফালাফির কী হলো? সে তো যে কেউ ধরতে পারে।

    হরু। পারে না। এটা যেমন-তেমন ছায়া নয়।

    মোহন। ছায়ার আবার যেমন-তেমন কী? তা-ও তো আমড়া গাছের ছায়া। একটা গাছ, যে নড়তে চড়তেও পারে না। তবু যদি হতো একটা বাঘ-সিঙ্গির ছায়া বা অন্তত বেড়ালের!

    হরু। হুঁ হুঁ বাবা, বোকারা তা-ই ভাবে।

    মোহন। তুমি বুঝি খুব চালাক? তা, কী চালাকিটা করলে এই ছায়াটা ধরতে?

    হরু। তিন দিন ধরে চেষ্টায় আছি, বুঝলে, তিন দিন। ধামায় করে নোংরা নিয়ে আসি, আর ততক্ষণে দেখি ছায়া উধাও। যে জায়গাটায় দাগ দিয়ে চিহ্ণ করে রেখেছিলুম, সেখান থেকে সরে গেছে।

    মোহন। তো, সরে সরে যেখানে যায় সেখানটায় চিহ্ণ করলেই পারো।

    হরু। হ্যাঁ, তোমার বুদ্ধিতে চললেই হয়েছে।

    মোহন। কেন, ভুলটা কী বললুম? ধরবে ছায়া, সে এখান থেকে ধরো, আর ওখান থেকে। তফাৎটা কী হলো?

    হরু। সে তো তুমি বলবেই, পড়াশোনা না করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াও, তোমার আর জ্ঞানবুদ্ধি হবে কী করে?

    মোহন। দেখো, জ্ঞানবুদ্ধি তুলে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি, আর যা-ই তোলো, জ্ঞানবুদ্ধি তুলবে না। যদি আমার হুলোর দিব্যি দাও তা হলেও কিছু বলব না। কিন্তু জ্ঞানবুদ্ধি একেবারেই নয়।

    হরু। তোমার হুলো? তোমার হুলো আছে নাকি?

    মোহন। আছে তো, তাতে তোমার কী?

    হরু। আমার অনেক কিছুই। তোমার হুলো কী খেতে ভালোবাসে?

    মোহন। প্যাঁচা। অন্য পাখিও চলতে পারে, কিন্তু প্যাঁচাই ওর পছন্দ।

    হরু। কাটলেট?

    মোহন। তা-ও খায়।

    হরু। লুচি?

    মোহন। পেলে ছাড়বে মনে হয় না।

    হরু। (রাগে গরগর করতে করতে) ছাড়বে মনে হয় না! পাঁচখানা কাটলেট, লুচি তিন গণ্ডা।

    মোহন। কী লুচি তিন গণ্ডা?

    হরু। কী লুচি তিন গণ্ডা! কী লুচি তিন গণ্ডা তুমি জানো না? আর কী খায়? আর কী খায় তোমার হুলো? জিবে গজা? মণ্ডা?

    মোহন। খায় বৈকি।

    হরু। (আরও রাগ) খায় বৈকি! গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা! আর? আর কী খায়? আলুভাজা? ঘুঙ্‌নি?

    মোহন। (হেসে) খুব ভালোবাসে। আমি জানি এবার তুমি কী বলবে! বুঝতেই পারছিলুম, এত রাগ যখন!

    হরু। কী বলবো, কী বলবো ভাবছিলে?

    মোহন। ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতখানা শূন্যি! তাই তো? কিন্তু জানো তো, এ সব ভালোবাসলেও প্যাঁচাই কিন্তু ওর সব থেকে বেশি পছন্দ।

    হরু। আমাকে বুঝি খ্যাপাবার চেষ্টা করছ? (মুখোশ খুলে) এই দেখো, আমি আসলে প্যাঁচাই নই।

    মোহন। তাই তো। তাহলে এত কিছু থাকতে প্যাঁচার মুখোশ কেন?

    হরু। ঘটে যদি কোন বুদ্ধি থাকে, তবে তো বুঝবে!

    মোহন। সে না হয় নেই, কিন্তু তোমার ছায়া ধরার ব্যাপারটা কী?

    হরু। ছায়ার ব্যাপারটা? ওটা ঠিক ঠিক সময়ে ধরতে হবে। একটু যদি এধার-ওধার দেরি করে ফেলো, দেখবে পেছন থেকে হয় আম গাছের ছায়াটা, আর নয়তো জামরুলেরটা, আমড়া গাছের ছায়াটাকে ঢেকে ফেলেছে। আজ তাই সূয্যি ওঠার আগে থেকেই ঠিক জায়গাটায় চিহ্ণ দিয়ে, এক ধামা নোংরা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলুম। যেই ছায়াটা একটু এগোতে শুরু করেছে, ঢালো ঢালো নোংরা! আজ আর পালাতে পারেনি।

    মোহন। ব্যাপারটা বুঝলুম না বাপু। ছায়া তো বুঝলুম, কিন্তু নোংরা ঢালাটা কী ব্যাপার?

    হরু। সত্যি সত্যি, তোমার বুদ্ধি দেখে বাঁচি না। যতই তুমি রাগ করো বাপু, তোমার জ্ঞান-বুদ্ধির কথাটাই বলতে হচ্ছে।

    মোহন। আবার জ্ঞান-বুদ্ধি!

    হরু। তা কিছুই যদি না বোঝ, তো বলবটা কী? এ-ও জানো না ̶


    আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে যদি খায়
    ল্যাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নেই তায়!


    মোহন। (চোখ খিমচিয়ে খানিকটা জল বের করে ফেলে) তুমি এত নিষ্ঠুর! ল্যাংড়া লোক! তুমি আমার পিতৃশোক উথলিয়ে দিচ্ছ!

    হরু। এ সব কী বলছো তুমি? আমি তো তোমার পিতাকে চিনিই না। তোমার যে কোন পিতা আছেন বা কোনকালে ছিলেন তা-ও তো জানিনা! তুমি আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াও, ইশকুল-টিশকুলে যাও না এটুকুই জানি।

    মোহন। আমি আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই সে খবর তুমি রাখো, অথচ কোন্‌ শোকে আমি ইশকুল যাওয়া ছেড়েছি, সে খবর তোমার কাছে নেই! ভাবা যায়!

    হরু। আচ্ছা আচ্ছা, অন্যায় হয়ে গেছে। কী হয়েছিলো তোমার পিতৃদেবের?

    মোহন। কী হয়েছিলো? কেন, খবরের কাগজ পড়ো না? দু কলাম ভর্তি লিখেছিল তো কাগজে।

    হরু। দু কলাম? তাহলে তো বেশ বড় খবর। কী লিখেছিল?

    মোহন। সে কি মুখস্থ করে রেখেছি?

    হরু। এই দেখো, এই দেখো, তুমি রাগছ কেন? তুমি না বললে আমি জানব কী করে বল?

    মোহন। পৌষ সংক্রান্তির দিন নানারকমের পিঠে আর ভাজাভুজি তৈরি হচ্ছে রান্নাঘরে, সেই গন্ধে গন্ধেই বোধ হয় সন্ধ্যের মুখটায় হাজির কুমড়োপটাশ। মুখে একগাল হাসি। বাবা দাঁড়িয়েছিলো রান্নাঘরের সামনেটায়। তা বইয়ে লেখা আছে ̶


    যদি কুমড়োপটাশ হাসে ̶
    থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে।


    বুঝতেই পারছো, রান্নাঘরের পাশে এক পায়ে খাড়া, এদিকে রান্নাঘরের ভিতর থেকে ছ্যাঁক-ছোঁক শব্দ আর খেজুর গুড়ের গন্ধ। এক-পায়ের আর কতো জোর বল! (ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে) বাবার পিঠেও খাওয়া হলো না, দাঁড়িয়ে থাকাও হলো না। সেই থেকে (আরও জোরে কাঁদতে কাঁদতে) আমার বাবা ̶ কী আর বলি, এক্কেবারে ল্যাংড়া!

    হরু। আহা, বেঁচে আছেন তো?

    মোহন। (এখনও কাঁদতে কাঁদতে) তুমি কী নিষ্ঠুর হরু, তুমি আমার বাবাকে মারতে চাও? ̶

    হরু। আরে রামোঃ, তুমি বড়ো আপসেট হয়ে আছো মোহন, তুমি আমার কাঁধে মাথা রেখে একটু কেঁদে নাও। (মোহন হরুর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে, হরু তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে আদর করে বলতে থাকে)


    ওরে মোহন, আয়রে আমার নোংরামুখো শুঁটকো রে,
    দেখ না ফিরে প্যাখনা ধরে হুতোম-হাসি মুখ করে।
    ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর-গেলা কোঁতকা রে,
    অন্ধবনের গন্ধ-গোকুল, ওরে আমার হোঁতকা রে!
    ওরে আমার বাদলা রোদে জষ্ঠি মাসের বিষ্টি রে।
    ওরে আমার হামান-ছেঁচা যষ্টিমধুর মিষ্টি রে
    ওরে আমার রান্না হাঁড়ির কান্না হাসির ফোড়নদার,
    ওরে আমার জোছনা হাওয়ার স্বপ্নঘোড়ার চড়নদার।
    ওরে আমার গোবরগণেশ ময়দাঠাসা নাদুসরে,
    ছিঁচকাঁদুনে ফোক্‌লা মোহন ফের যদি তুই কাঁদিসরে ̶


    মোহন। (রেগেমেগে) ছিঁচকাঁদুনে ফোক্‌লা মোহন? আমি ছিঁচকাঁদুনে? আমি ফোক্‌লা? ফের যদি কাঁদি তুই কী করবি?

    হরু। (এক গাল হেসে) আরে ওটা একটা কথার লব্‌জ। তুই ভাবিস কেন, তোর কান্না আমি বন্ধ করার ব্যবস্থা করছি।

    মোহন। কীভাবে?

    হরু। বল্‌ তো আমাদের এই শহরে কটা আমড়াতলা আছে?

    মোহন। বাইশটা।

    হরু। একটা কম বললি, তেইশটা।

    মোহন। তেইশটা? হ্যাঁ, তেইশটাই তো। এই যে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এটাও তো একটা আমড়াতলা।

    হরু। এটাই আদি ও অকৃত্রিম একমাত্র আমড়াতলা। যতদিন না সেটা প্রমাণ করা যাচ্ছে ততদিন এ শহরে মানুষের ঠ্যাং ভাঙা বন্ধ করা যাবে না।

    মোহন। মানে?

    হরু। এতো খবর রাখিস এই খবরটাই রাখিস না! এই তো সেদিন আদ্যানাথের মেসোর খোঁজ করছিলো একজন। জগমোহনের কাছে...

    মোহন। আবার!

    হরু। কী আবার?

    মোহন। আবার আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে যা-তা বলছিস! আমি আদ্যানাথের নামই শুনিনি, তার মেসোর খবর নিতে যাব কেন র‍্যা?

    হরু। তোর কথা এল কোত্থেকে?

    মোহন। এই যে বললি জগমোহন খোঁজ নিচ্ছিল আদ্যানাথের মেসোর।

    হরু। জগমোহন নয়, আরেক জন। জগমোহনের কাছে খোঁজ নিচ্ছিল। আদ্যানাথের। নিচ্ছিল তো। আলবাৎ নিচ্ছিল।

    মোহন। নিচ্ছিল? আমার কাছে?

    হরু। তোর কাছে কেন হবে?

    মোহন। তুইই তো বললি, জগমোহনের কাছে খোঁজ নিচ্ছিল আদ্যানাথের। মোহন কার নাম? মোহন আমার নাম তুই জানিস না?

    হরু। আমি তো জগমোহনের কথা বলছিলুম, মোহনের কথা তো বলিনি। তুই খামোকা চটছিস কেন?

    মোহন। বেশি চালাকি কোরো না। নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে কোরো না। জগ মানে জগৎ কি না?

    হরু। সে না হয় হলোই। তাতেই বা কী হলো?

    মোহন। তাতে কী হলো? জগমোহন মানে জগের মোহন, ষষ্ঠী তৎপুরুষ, মানে জগতের মোহন, মানে আমি। আর আমি আদ্যানাথ নামের কাউকে কোনদিন চিনিনি, চিনতে চাইও না।

    হরু। সেই কথাই তো বলেছে বইয়ে: আদ্যানাথের নাম শোননি, খগেনকে তো চেনো?


    শ্যাম বাগচি খগেনেরই মামাশ্বশুর জেনো।
    শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন, তার যে বাড়িওয়ালা ̶


    মোহন। দেখ্‌ হরু, তোর কপালে দুখ্যু আছে। কতকগুলো অচেনা-অজানা নাম পটাপট মুখস্থ বলে বিদ্যে জাহির করছিস।

    হরু। বিদ্যে জাহির? সে আমি না তুই? অ্যাঃ, ষষ্ঠী তৎপুরুষ! বেঙ্গলী গ্রামার! মনে করেছিস আমি ইংরিজি ব্যাকরণ কিছুই পড়িনি! ক্যান্‌ রে ব্যাটা ইস্টুপিড? ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট্‌।

    মোহন। (জামার আস্তিন গুটিয়ে)


    চোপরাও তুম স্পিকটি নট, মারব রেগে পটাপট ̶
    ফের যদি ট্যারাবি চোখ, কিম্বা আবার করবি রোখ,
    কিম্বা যদি অমনি করে মিথ্যেমিথ্যি চেঁচাস জোরে ̶
    আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি ̶ জানিস আমি স্যাণ্ডো করি?
    ফের লাফাচ্ছিস! অলরাইট, কামেন ফাইট! কামেন ফাইট!

    হরু।


    ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি, টেরটা পাবে আজ এখনি!
    আজকে যদি থাকত মামা, পিটিয়ে তোমায় করতো ঝামা।

    মোহন। মামা! দ্যাট রিমাইণ্ডস মী! তুই কার মামার কথা বলছিলি?

    হরু। মামা নয়, মামাশ্বশুর। ওয়াইফ্‌স্‌ মামা।

    মোহন। কার?

    হরু। খগেনের। খগেনের মামাশ্বশুরের নাম শ্যাম বাগচি। তার কেউ, তার আবার কেউ, তারও আবার কেউ, তারও কেউ, হলো গিয়ে আদ্যানাথ। এবার ঢুকেছে মগজে?

    মোহন। (কাঁদতে কাঁদতে) মামাশ্বশুর। মানে, মামাই তো হলো। মেজমামা?

    হরু। হতেও পারে। মনে পড়ছে?


    খগেনের মেজমামা সেও ছিল স্যায়না,
    যত বলি ভাল কথা কানে কিছু নেয় না।
    শেষকালে একদিন চান্নির বাজারে
    পড়ে গেল গাড়ি চাপা রাস্তার মাঝারে!

    মোহন। কোন্‌ চান্নি বল্‌ তো।

    হরু। কোন্‌ চান্নি বুঝতে পারছিস না? এই শহরে তিন মুখো তিন রাস্তা গেছে একটা মোড়ে। একটাই মোড়ে। কোন্‌ মোড়?

    মোহন। আমড়াতলার মোড়।

    হরু। রাইট। সেটাও অন্যতম আমড়াতলার মোড়। সেখানে একটা বাজার। বাজারের নাম?

    মোহন। ইউরেকা। চান্নি। চান্নির বাজার।

    হরু। সেই চান্নির বাজারে গাড়ি চাপা পড়লো খগেনের মামা, মেজমামা টু বি স্পেসিফিক। এবং তার ফলে?

    মোহন। মেজমামা হলো ল্যাংড়া মামা।

    হরু। রাইট। সেই শুরু। তারপর থেকে গত এক বছরে তিনশো একান্ন জন ল্যাংড়া হয়েছে ওই একই মোড়ে। কেন?

    মোহন। কেন?

    হরু। কেন? পড়নি, কিছুই পড়নি। বইয়ে লেখা আছে ̶ পষ্ট লেখা আছে ̶ আমড়াতলার ঐ মোড়টা গোলোকধাঁধাঁর মতো।

    মোহন। তাতে কী হলো?

    হরু। তাতে কী হলো? কী আকাট রে! তাতে কী হলো? বইয়ে কী লেখা আছে? বইয়ে লেখা আছে আমড়াতলার গোলোকধাঁধাঁয় খানিক ঘোরার পর লোকে কী করে। লেখা আছে ̶ কী লেখা আছে? ̶ সেখান থেকে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে, (লোকে) আবার ফেরে বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে। তখন কী হবে?

    মোহন। (একগাল হেসে) তবেই আবার পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে।

    হরু। ঠিক করে বল্‌। শুধুই মুখস্থবিদ্যে ঝাড়িসনি!

    মোহন। তুমি কী ঝাড়ছ? কী ঝাড়ছ এতক্ষণ ধরে?

    হরু। শোন্‌। মুখস্থবিদ্যে সত্যিকারের বিদ্যে হয় তখনই, যখন মাঝখানে একটা নিজের কথা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।

    মোহন। নিজের কথা! নিজের কথা ঢুকিয়ে তুমি তাহলে নিজেই শোনাও শুনি।

    হরু। তুই যেটা বললি, তবেই আবার পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে ̶ ওটা হলো বইয়ের কথা, আর নিজের কথা ঢোকালে হবে, পড়বে এসে আমড়াতলার গোলোকধাঁধাঁর মোড়ে। বুঝলি?

    মোহন। বুঝলুম।

    হরু। তখন কী হবে?

    মোহন। গোলোকধাঁধাঁর মোড়ে পাশ থেকে আসবে একটা গাড়ি, আর ̶

    হরু। আর, খগেনের মেজমামার মত ̶

    মোহন। পড়ে যাবে গাড়ি চাপা রাস্তার মাঝারে!

    হরু। ফল?

    মোহন। (কাঁদতে কাঁদতে) পতন ও ল্যাংড়া হওন।

    হরু। এইভাবে, (কাঁদতে কাঁদতে) এইভাবে, তিনশো একান্ন জন, প্লাস তোর বাবাকে ধরে তিনশো বাহান্ন জন, সৎ মানুষকে অনিবার্য ল্যাংড়া হওনের হাত থেকে বাঁচানো কি আমাদের পবিত্র কর্তব্য নয়?

    মোহন। নিশ্চয়ই কর্তব্য। কিন্তু উপায়?

    হরু। একটিই রাস্তা।

    মোহন। একটিই?

    হরু। তিনমুখো তিন নয়, একমুখো একটিই।

    মোহন। একমুখো একটিই?

    হরু। (আমড়া গাছের দিকে নির্দেশ করে) একমুখো এক রাস্তা আসে আমড়াতলার মোড়ে!

    মোহন। একমুখো এক রাস্তা আসে আমড়াতলার মোড়ে! তাতে কী হলো?

    হরু। তাতে এই-ই হলো যে, পাশ থেকে গাড়ি আসার কোন উপায় রইল না।

    মোহন। অতএব?

    হরু। অতএব, নো ধক্কন, নো পতন, অ্যাণ্ড ̶

    মোহন। নো ল্যাংড়া হওন?!

    হরু। নো ল্যাংড়া হওন। এবং তা-ই যদি চাও, তাহলে আজ থেকে আমাদের পবিত্র কর্তব্য হবে, এই আমড়াতলাকেই এ শহরের ল্যাণ্ডমার্ক তৈরি করা। কেউ যদি প্রশ্ন করে আমড়াতলা কোথায়, বিনা দ্বিধায় এই শহরের প্রতিটি নাগরিক নির্দেশ করবে এই আমড়াতলার দিকেই। রাজি?

    মোহন। রাজি। রাজি তো নিশ্চয়ই, কিন্তু কীভাবে এ অসম্ভব সম্ভব হবে ক্যাপটেন?

    হরু। হিটলার বলেছেন, অসম্ভব শব্দটা শুধুমাত্র বোকাদের অভিধানেই পাওয়া যায়।

    মোহন। কিন্তু হিটলার তো নয়, আমি যে জানতুম ওটা বলেছেন নেপো ̶

    হরু। ঠিকই বলেছো। নেপোরা এই বিখ্যাত উক্তি ভাঙিয়ে এযাবৎ অনেক দৈ খেয়েছে, কিন্তু আর নয়। আমাদের আন্দোলন আমরা আজ থেকেই শুরু করছি। সাথে যদি থাকতে চাও তো এসো। (হরু আমড়া গাছের যে দিকটা দেখা যাচ্ছে না সে দিকটায় এগিয়ে যায়, তার পিছন পিছন মোহন। সেখান থেকে রোল করা একটা কাগজ নিয়ে আসে সে, এবং রোলটা খুলে মোহনের দিকে ধরে। মোহন সেটা পড়তে শুরু করে)

    মোহন। সাবধান, সাবধান, সাবধান। নকল হইতে সাবধান। এই শহরের একমাত্র আদি ও অকৃত্রিম আমড়াতলাকে স্বীকৃতি দিন। তিন-মুখো-তিন রাস্তার গোলোকধাঁধাঁয় অবস্থিত আমড়াতলাটি সুস্থ মানুষকে ল্যাংড়া বানাইবার কল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অন্যপক্ষে একমুখো রাস্তার শেষে অবস্থিত আমড়াতলার নোংরা ছায়ায় ল্যাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাইতেছে। ইহা পরীক্ষিত সত্য। অতএব আসুন, সকল নগরবাসী মিলিয়া এই আমড়াতলাকেই আমাদের প্রকৃত আমড়াতলা বানাইবার আন্দোলন আমরা গড়িয়া তুলি।


    ।।দৃশ্যান্তর।।

    ২য় দৃশ্য
    আমড়া গাছের উপর দিকের একটা ডালে একটা প্যাঁচা বসে আছে, এখন দিনের
    বেলা, প্যাঁচাটা অতএব ঘুমোচ্ছে। এমন সময় তীর-ধনুক হাতে মোহনের প্রবেশ।

    মোহন। (প্যাঁচার দিকে তাকিয়ে) ঘুমোচ্ছে! এই সুযোগ! (তীরটা প্যাঁচার দিকে তাক করে)


    দেখ্‌ বাবাজি দেখবি নাকি, দেখ্‌ রে খেলা দেখ্‌ চালাকি
    ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকি, পড়্‌ পড়্‌ পড়্‌ পড়বি পাখি ̶ ধপ্‌!
    লাফ দিয়ে তাই তালটি ঠুকে তাক করে যাই তীর-ধনুকে,
    ছাড়ব সটান ঊর্ধ্বমুখে হুশ করে তোর লাগবে বুকে ̶ খপ্‌!

    হামাগুড়ি দিয়ে ধামা হাতে এক ব্যক্তির প্রবেশ, তার নাম গোষ্ঠ



    গোষ্ঠ।


    গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা, খাপ পেতেছেন গোষ্ঠ মামা।
    (উঠে দাঁড়িয়ে পাখিটার ঠিক নীচে ধামা হাতে তাক করে দাঁড়ায়)
    এগিয়ে আছেন বাগিয়ে ধামা, এইবার বাণ চিড়িয়া নামা ̶ চট!

    মোহন তীর ছোঁড়ে, তীরটি পাখির কাছাকাছিও যায় না, সোজা গিয়ে লাগে গোষ্ঠ মামার বুকে, মামা পড়ে যায়।

    মোহন।


    ঐ যা! গেল ফসকে যে সে ̶ হেই মামা তুই ক্ষেপলি শেষে?
    ঘ্যাঁচ করে তোর পাঁজর ঘেঁষে লাগল কি বাণ ছটকে এসে ̶ ফট?

    মামা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, আবার পড়ে যায়। মোহন দৌড়িয়ে আসে।

    মোহন। কী হলো? লাগল নাকি?

    মামা। উঃ উঃ, ডান দিকের ঠ্যাংটা ভেঙেছে মনে হচ্ছে। (হরুর প্রবেশ)

    হরু। কী হলো রে, কী হয়েছে?

    মোহন। ঠ্যাং ভেঙেছে মামার। (প্যাঁচাটা জানতেও পারেনি নীচে কী হচ্ছে, সে বসেই থাকে)

    হরু। ঠ্যাং ভেঙেছে? ভালোই হলো।

    মামা। ভালো হলো, কেমন ছেলে তুমি? ঠ্যাং ভেঙেছে আমার, আর তুমি খুশি।

    হরু। একটু অপেক্ষা করুন, ঠ্যাংটা ঠিক করে দেব এখনই, আপনিও খুশি হবেন।

    মামা। রসিকতা হচ্ছে? বাঁদর ছেলে, আমার একই ঠ্যাং দ্বিতীয়বার ভাঙলো, আর তুমি মশকরা করছো?

    হরু। একই ঠ্যাং? তো, আগের বার যখন ভাঙলো, কেমন করে সারালেন?

    মামা। কেমন করে আবার! ছ'টি মাস বিছানায়, ডাক্তার সাদা সিমেন্টের প্লাস্টার করে ফেলে রাখলো!

    হরু। ছ'টি মাস! এবার তো ছ' সেকেণ্ড-এ সারাবো!

    মামা। ইয়ার্কি মারবে না ছোকরা। এমনিতে আমি তোমার বাপের বয়েসি, তাছাড়াও শিক্ষকের মতো। এ পাড়ার বিনোদিনী ইশকুলে অঙ্ক আর সায়েন্স পড়াই। তুমি কোন্‌ ক্লাসে পড়?

    হরু। ক্লাস নাইন। তো, আগের বার কেমন করে আপনার ঠ্যাং ভাঙলো স্যর?

    মোহন। জানিস না? ইশকুলে ম্যাজিক শো হচ্ছিলো। আমার এই মামা, ইশকুলের গোষ্ঠবাবু স্যর, ম্যাজিশিয়নের সব ভেলকির রহস্য ফাঁস করে দিচ্ছিলেন। ম্যাজিশিয়ান একটা করে ভেলকি দেখায়, আর মামা চালাকিটা ধরে ফেলে। শেষ পর্যন্ত ম্যাজিশিয়ান হার মানলো, হাত জোর করে বললো, স্যর, কী করে আপনি সব ধরে ফেলছেন, স্যর? গোষ্ঠমামা পকেট থেকে বের করলো একটা নোটবুক।

    হরু। নোটবুক? সেই বিখ্যাত নোটবুক?


    ভালো কথা শুনি যেই চটপট লিখি তায়?
    ফড়িঙের কটা ঠ্যাং, আরশুলা কী কী খায়?
    আঙুলেতে আঠা দিলে কেন লাগে চটচট?
    কাতুকুতু দিলে গোরু কেন করে ছটফট?

    মোহন। আরে না না, সেটা তো সেই নাটক লেখার লোকটার নোটবুক। ওই যে অবাক জলপান নামে একটা নাটক লিখেছিলো, সুকুমার না কী যেন নাম, যেটা আমরা গরমের ছুটির আগের দিন ইশকুলে অভিনয় করেছিলুম। এটা অন্য নোটবুক। এটা সব সময় গোষ্ঠমামার পকেটে থাকে। তো, নোটবুক বের করে গোষ্ঠ মামা তো পড়তে শুরু করেছে


    সব লিখেছে এই কেতাবে দুনিয়ার সব খবর যত,
    সরকারী সব অফিসখানার কোন্‌ সাহেবের কদর কত।
    কেমন করে চাটনি বানায়, কেমন করে পোলাও করে...

    এদিকে হয়েছে কী, ম্যাজিশিয়ানটা তো কিছুক্ষণ আগেই একটা কাচের বয়ামে খানিকটা কাঁচা চাল ভরে, আচ্ছা করে নাড়িয়ে, ম্যাজিক দেখিয়ে কাঁচা চালকে পোলাও বানিয়ে হেডস্যরকে খাইয়ে দিয়েছে, তারপর আবার ভালোমানুষী করে ̶ কষ্ট হচ্ছে স্যর, খেতে কষ্ট হচ্ছে স্যর? ̶ বলে একটা ফাঁকা শিশিতে ̶ তাতে কোন আম-টাম ছিলো না ̶ কিন্তু খানিকটা সর্ষের তেল ভরে সেটা ঝাঁকিয়ে আমের চাটনি বের করে খাইয়েও দিয়ে দিলো খানিকটা, আর ঠিক তখনই গোষ্ঠ মামা ওই লাইনটা পড়ছে।

    হরু। কোন্‌ লাইনটা?

    মোহন। ওই যে বললুম, কেমন করে চাটনি বানায়, কেমন করে পোলাও করে...

    হরু। (হেসে) তাই? ম্যাজিশিয়ানটা রেগে আগুন?

    মোহন। আরে শোন্‌ না। ম্যাজিশিয়ানটা কোন রাগ দেখাল না। শুধু একটা বিরাট বড়ো চাদর বের করে, এক দিক নিজে ধরে, আর এক দিকে ওর অ্যাসিস্টেন্টকে ধরিয়ে, নাড়াতে শুরু করলো। চাদরের আড়াল থেকে কী বেরোলো জানিস?

    হরু। কী? বন্দুক হাতে একটা গুণ্ডা নাকি?

    মোহন। আরে না না, সে হলে তো সামলে দেওয়া যেত। বেরিয়ে এলো প্রকাণ্ড এক হাতি। দেখে কাঁদো কাঁদো মুখ করে গোষ্ঠ মামা শুধু বলতে পারলো,


    সব লিখেছে, কেবল দেখ পাচ্ছিনেকো লেখা কোথায়
    পাগলা হাতি করলে তাড়া কেমন করে ঠেকাব তায়!

    আর ঠেকাব! ততক্ষণে হাতি শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে মামাকে এক আছাড়! হাঁটু থেকে খুলে পা-টা যে বেরিয়ে আসেনি সেটাই ভাগ্য!

    হরু। এইজন্যেই তো বলি, সব সময় ষষ্ঠীদাদার সাথে যোগাযোগ রাখবি।

    মোহন। কোন্‌ ষষ্ঠীদাদা?

    হরু। ষষ্ঠীচরণদাদা। বেনেটোলার ষষ্ঠীচরণদাদা। তোদের ইশকুলে এই ঘটনাটা ঠিক হয়েছিল কবে বল্‌ তো।

    মামা। গত বছর জুন মাসে।

    হরু। ইশ্‌-ইশ্‌! ঠিক সেই সময়টাতেই! ঠিক সেই সময়টাতেই ষষ্ঠীদাদার দরকার ছিলো একটা হাতির।

    মামা। হাতির? কেন? তোমার এই ষষ্ঠীচরণদাদা সার্কাস চালান নাকি?

    হরু। সার্কাস কেন চালাবেন? আসলে গত বছর মে মাসে ষষ্ঠীদাদার হাতিটা মারা গেছে কিনা। তারপর তো কত কষ্ট করে, কত ঘোরাঘুরি-পয়সা খরচ করে, হাঙ্গামা পুইয়ে, শেষ পর্যন্ত জুলাই মাসের বর্ষার মধ্যে আসাম থেকে একটা হাতি আনালেন।

    মামা। তুমি বড় মিথ্যে কথা বল তো ছোকরা! এত বড় শহরে হাতি আনালেন? তোমার ষষ্ঠীচরণদাদা কত বড় জমিদার হে, যে এত বড় শহরে হাতিশাল ঘোড়াশাল রাখেন!

    হরু। তা নয় স্যর, আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। একটা অন্তত হাতি না থাকলে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ষষ্ঠীদাদার গা ম্যাজম্যাজ করাটা ঠিক কাটতে চায় না।

    মামা। মানে?

    হরু।


    খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ হস্তী লোফেন যখন তখন,
    দেহের ওজন উনিশটি মণ, শক্ত যেন লোহার গঠন।
    একদিন এক গুণ্ডা তাকে বাঁশ বাগিয়ে মারলো বেগে ̶
    ভাঙ্‌ল সে-বাঁশ শোলার মতো মট্‌ করে তাঁর কনুই লেগে।

    মামা। চোপ। একদম মিথ্যে কথা বলবে না। এই মোহন, এই সব বাঁদরগুলোর সঙ্গে মিশেই তুই এরকম গোল্লায় যাচ্ছিস!

    হরু। মিথ্যে কথা? ঠিক আছে, আপনি এখানে শুয়ে থাকুন। মোহন, মামাকে পাহারা দে। আমি ষষ্ঠীদাদাকে নিয়ে আসছি। যাব আর আসব। এখান থেকে কোত্থাও যাবিনা। মামাকে পাহারা দিবি। না হলে কখন আবার কর্পোরেশনের গাড়ি এসে বেওয়ারিশ বলে চালান দিয়ে দেবে।(প্রস্থান)

    মোহন। মামা, তুমি কি চেষ্টা করলে উপুড় হতে পারবে?

    মামা। এক চাঁটি মারব বাঁদর ছেলে কোথাকার। আমি বলে পা নাড়াতে পারছি না, আর উপুড় হব?

    মোহন। উপুড় না হলে কী হবে মামা? ভাঙা-পা জোড়া লাগবে কী করে?

    মামা। উপুড় হলেই পা জোড়া লাগবে! কে তোকে শেখাচ্ছে এসব আজগুবি কথা? যা, একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নিয়ে আয়। অ্যাম্বুলেন্সের লোকরাই ঠিক কায়দা করে তুলে নিয়ে যাবে আমাকে হাসপাতালে। (ষষ্ঠীর প্রবেশ, পিছনে হরু)

    ষষ্ঠী। কে অপমান করেছে আমার নাতিকে? (মামা ষষ্ঠীর আকৃতি দেখে অবাক ও ভীত)

    মামা। না না অপমান তো কেউ করেনি, (হরুকে দেখিয়ে) ও বুঝি আপনার নাতি হয়?

    ষষ্ঠী। ফেভারিট নাতি। তাই ওর কথায় খালি পিত্তিদমনটুকু করে এসে গেলাম।

    মামা। পিত্তিদমন?

    ষষ্ঠী। আরে গা ম্যাজম্যাজ করছিলো, সকাল বেলায় হাতিটাকে বলেছি ওর শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে একটু বুকে-পিঠে ম্যাসাজ করে দিতে। ম্যাসাজের পর একটু খিদে খিদে পেলো, সবে তিন ধামা পেস্তা মেওয়া দিয়ে একটু পিত্তিদমন করেছি কি করিনি, আমার এই হরু নাতিটা গিয়ে বলে কোন্‌ নাকি সায়েন্সের মাস্টার ওকে বাঁদর বলেছে, বলেছে ও মিথ্যে কথা বলে! এখনো চোদ্দ হাঁড়ি দৈ-মুড়কি খাওয়া বাকি ছিলো। কিন্তু কী করা যাবে, সকালে বসে বসে জলখাবার খাব, যখন আমার হরুদাদার অপমান হচ্ছে! কী করতে হবে হরুদাদা?

    হরু। কিছু না, শুধু স্যরকে একটু উপুড় করে দিতে হবে।

    ষষ্ঠী। ব্যস এই কথা! সে তো একটু টোকা মারলেই হয়ে যাবে! (মামার সামনে বসে পড়ে) দেখি বাবু, দেখি স্যর (গায়ে একটা টোকা মারে, মামা উপুড় হয়ে যায়)। ব্যস্‌, কাজ হয়ে গেলো তো হরুদাদা।

    হরু। না, ঐ মাটিটা একটু কামড়ে খাওয়াতে হবে।

    মামা। (ভীত) মাটি কামড়ে, ছি ছি!

    হরু। ও কিছু না স্যর, গাছের নীচে পুরো জায়গাটাতেই আমি নোংরা ঢেলে দিয়েছি।

    মামা। নোংরা?

    হরু। হ্যাঁ স্যর, বলছিলুম না? ̶


    আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে যদি খায়
    ল্যাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নেই তায়!

    যেখানটায় ছায়া পড়েছে সবটাই নোংরা। একটু কামড়ে খেয়ে নিন স্যর।

    মামা। নোংরা!......

    ষষ্ঠী। তাড়াতাড়ি করুন মামাবাবু, আমার আবার খিদে পেয়ে গেছে। ঐ চোদ্দ হাঁড়ি খারাপ হয়ে গেলে...

    মামা। ঠিক আছে, ঠিক আছে।

    ষষ্ঠী। ঠিক নেই, ঠিক নেই। মাথাটা নীচু করুন, মুখটা ঠেকান ঐ মাটিতে, একটুখানি কামড়িয়ে দেখুন। আমার হরুদাদা যখন বলেছে, ফল হবেই হবে।


    নির্দেশ মতো মাটিতে মুখ লাগিয়ে একটু মাটি মুখে তুলে নেয় গোষ্ঠ মামা, সবাই তাকিয়ে থাকে।

    মামা। পা নড়ছে, পা নড়ছে! আরে, ব্যথা কোথায়! ব্যথা উধাও!


    আস্তে আস্তে উলটিয়ে চিৎ হয়ে যায় মামা। উপস্থিত সবাই মিলে নাচতে থাকে, মামাও
    যোগ দেয় তাতে, আরও দুয়েকজন কোথা থেকে এসে যোগ দেয় এই সমবেত নৃত্যে।

    সমবেত গান ও নাচ।


    আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে যদি খায়
    ল্যাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নেই তায়!

    নাচতে নাচতে বেরিয়ে যায় নাচ-গানে অংশ নেওয়া এই লোকগুলো। পর্দা।

    ৩য় দৃশ্য
    আমড়াগাছের নীচে একটি সভা বসেছে। এখন মাঝ রাত্তির। সভায় উপস্থিত বকচ্ছপ, বিছাগল,
    হাঁসজারু, গিরগিটিয়া, হাতিমি, মোরগরু, সিংহরিণ। একটু উঁচু জায়গায় বসে আছে প্যাঁচানি, সে এই
    সভার সভাপতি। সকলেরই চোখে জল, সমবেত চাপা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এমন সময় হাত তুলে
    প্যাঁচানি উপস্থিত সবাইকে শান্ত হবার ইঙ্গিত দেয়, এক মুহূর্তে কান্নার শব্দ থেমে যায়, প্যাঁচানি হুট হুট শব্দে
    সকলের আচরণ অনুমোদন করে। এমন সময় ঘুম-ভেঙে-উঠে-আসা হরু চোখ কচলাতে কচলাতে প্রবেশ করে।

    হরু। (হাতে একটা প্যাঁচার মুখোশ, প্যাঁচানিকে দেখেই মুখোশটা পরে ফেলে, তারপর গান শুরু করে)


    ওরে পেঁচি পেঁচি রে,
    তুই বড় ঘেঁচি রে।
    যেই শুতে গেছি রে
    হঠাৎ শুনেছি রে,
    মা-পা-ধা-নি মা-পা-ধা-নি সুরে চেঁচামেচি রে।
    মাঝরাতে তাই শুনে বিছানা ছেড়েছি রে।

    প্যাঁচানি। (গানেই জবাব দেয়)


    মা-পা-ধা-নি হলো কই, শুনিসনি ওই তান
    যে পারতো গাইতে তা, তার তো গিয়েছে প্রাণ। (কান্না)
    চাপা পড়ে মরেছে সে, শোকাকুল সব্বাই
    চাপা আর মা-পা-ধা-নি মিলে চা-পা-ধা-নি গাই।
    চা-পা-ধা-নি চা-পা-ধা-নি ও শেয়াল ভাই রে,
    সকলেই বেঁচে আছে তুই শুধু নাই রে। (ফের কান্না)
    বিছাগল হাঁসজারু হাতিমি সিংহরিণ
    কেঁদে-কেটে শোকে-তাপে সবার কাটছে দিন। (উঠে দাঁড়ায় মোরগরু)

    মোরগরু। আমার একটা বক্তব্য আছে।

    প্যাঁচানি। হ্যাঁ মোরগরু, বলো।

    মোরগরু। এই অকাল মৃত্যু কিন্তু আমরা মেনে নেব না। আমরা প্রতিবিধান চাই।

    বিছাগল।


    ব্যা-ব্যা-ব্যা ব্যাই ব্যাই
    প্রতিবিধান চাই-ই চাই!

    সভাস্থ সকলেই শ্লোগান তোলে: প্রতিবিধান চাই-ই চাই! প্রতিবিধান চাই-ই চাই! প্রতিবিধান চাই-ই চাই!

    হরু। প্রতিবিধান তো চাই, কিন্তু তার আগে বলো, কীভাবে মরলো শেয়াল! (গিরগিটিয়া হাত তোলে)

    প্যাঁচানি। বলো গিরগিটিয়া, বলো তোমার কী বক্তব্য।

    গিরগিটিয়া। আমি একটাই কথা বলতে চাই, দেখো দেখো বন্ধুগণ, হাতে-নাতে ধরা পড়েছে আমাদের প্রতি মানুষের অবজ্ঞা।

    হরু। কোথায় অবজ্ঞা করলুম? (বকচ্ছপের হাত ওঠে)

    প্যাঁচানি। কী বকচ্ছপ, তুমি কিছু বলবে নাকি?

    বকচ্ছপ। হ্যাঁ, কোথায় অবজ্ঞা করলো সেটাই বলতে চাইছিলাম। এই শহরের নৈশ-নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে পণ্ডিত, আমাদের সকলের শিক্ষক, প্রখর বুদ্ধিধর, সুরগুরু মসৃণ-সুকণ্ঠ শ্রীযুক্ত ডঃ শৃগালের ̶

    হাতিমি। (বাঁ হাতের তর্জনী তুলে) এক মিনিট।

    প্যাঁচানি। হাতিমি, তুমি পরে বোলো। বকচ্ছপ বলছিলো, ওকে শেষ করতে দাও।

    হাতিমি। না না, বকচ্ছপই বলবে। ও যে ডঃ শৃগালের কথা বললো সে বিষয়ে আমি শুধু বলতে চাই যে ডঃ, মানে
    ডঃ শৃগাল, ভুয়ো ডিগ্রীধারী চিকিৎসক নয়, রীতিমতো সঙ্গীত ও হিসাবশাস্ত্রে পি-এচডি ̶

    বকচ্ছপ। ইয়েস! পি-এচডি এবং রীতিমতো শংসাপত্রপ্রাপ্ত! এই ডঃ শৃগালের অকালপ্রয়াণ কীভাবে ঘটলো তারই খবর রাখে না এই আত্মম্ভরি মানুষ...

    হরু। না না সেটা কথা নয়। তোমরা নিজেরাই তো বললে তোমরা শহরের নৈশ-নাগরিক। রাতের বেলা আমরা দিনের নাগরিকরা ঘুমোই তো, তাই রাতের সব খবর পাই না...

    প্যাঁচানি। এ কথার কিছু সারবত্তা আছে। আমিও দিনের বেলা ঘুমোই, তাই দিনের খবর সব সময় রাখতে পারি না। ঠিক আছে, তুমি তোমার বক্তব্য চালিয়ে যাও বকচ্ছপ।

    বকচ্ছপ। ধন্যবাদ শ্রীমতি সভাপতি। মানুষের প্রতিনিধি এই বিশ্ববকাটে বাঁ ̶ নাঃ, বাঁদরের অপমান চাই না ̶ বিশ্ববকাটে ছেলেটি ̶ এই মাত্র নিজেদের দিনের বেলার নাগরিক বলে প্রতিপন্ন করতে চাইল, কিন্তু ও কি খবর রাখে রাতের বেলার শহরকে ধীরে ধীরে ওরই সহ-নাগরিকরা কীভাবে দখল করে নেবার চেষ্টা করছে?

    বিছাগল। ব্যা-ব্যা-ব্যা-ব্যা-বি-বিশেষ করে ওরা যাদের সেলিব্রিটি বলে! ওরা যদি সেলিব্রিটি হয়,তাহলে বিছাগল কি সেলিব্রিটি হতে পারে না? আমার ব্যা-ব্যা-ব্যা-ব্যা-বু-বু-বুদ্ধিও আছে, আর ল্যাজে ব্যা-ব্যা-বি-বি-বিষও আছে। তক্কেও হারাতে পারি, প্রয়োজনে ব্যা-ব্যা-বি-বি-বিষপ্রয়োগ করে ও পারেও পাঠাতে পারি!

    হরু। ঠিক ঠিক, বিছাগল তুমিও সেলিব্রিটি নিশ্চয়ই হতে পারো। কিন্তু তোমরা তো বুঝতেই পারছো, যাদের তোমরা সেলিব্রিটি বলছিলে আমি তাদের মধ্যে নই। আমি তো এখনো স্কুলের ছাত্র, কী বলো হাঁসজারু?

    হাঁসজারু। ঠিক। স্কুলের ছাত্র। ঠিক।

    সিংহরিণ। স্কুলের ছাত্র কি সেলিব্রিটি হতে পারে না?

    হাতিমি। পারে। পারে, যদি আণ্ডার সেভেনটিন ওয়র্ল্ড-কাপের ফুটবলার হয়।

    হাঁসজারু। আরে না না, ও তো টিংটিঙে রোগা, ও কী ফুটবলার হবে!

    হাতিমি। ফুটবলার না হয়েও উপায় আছে।

    সিংহরিণ। কী উপায়?

    হাতিমি। আসলে, কাপটা ইণ্ডিয়ায় আসার চান্স কম। হরুর মতো টিংটিঙে রোগা থেকে শুরু করে ওদের ক্লাসের সবচেয়ে ঢ্যাবঢেবে মোটা পর্যন্ত ইণ্ডিয়ার সব ছেলেই ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছে। এরকম অবস্থায় ফুটবল সংক্রান্ত সেলিব্রিটি হতে গেলে এখন মন্ত্রী হতে হবে। কারণ, টূর্ণামেন্ট শুরু হওয়ার আগে এ দেশের মানুষকে লোভ দেখাবার জন্যে আর বোকা বানাবার জন্যে ওরা ওয়র্ল্ড কাপ ট্রোফির একটা নকল এ দেশে পাঠিয়ে দেবে, এবং সেটা জনসমক্ষে উদ্বোধন করবেন ক্রীড়ামন্ত্রী। অতএব, ক্রীড়ামন্ত্রী একজন সেলিব্রিটি।

    হাঁসজারু। কিন্তু মন্ত্রীরা তো এমনিতেই সেলিব্রিটি।

    হাতিমি। হ্যাঁ, মন্ত্রী তো সেলিব্রিটি বটেই। কিন্তু ফাঁকতালে আরও একজন সেলিব্রিটি বনে যেতে পারে। যেমন ধর, তুমি। অথবা, ওই ছোকরা, হরু না কী যেন নাম।

    হাঁসজারু। আমার কথা ছেড়ে দাও। হরু কীভাবে সেলিব্রিটি হতে পারে সেটা বলো।

    হাতিমি। কিছু না, ওকে শুধু ঐ ট্রোফিটা পালিশ করার কাজ জোগাড় করতে হবে। পালিশ করতে করতে ও ট্রোফিটা মন্ত্রীর হাতে দেবে। আর মন্ত্রী যখন ওটা উদ্বোধন করবেন, তখন মোবাইল ফোন খুলে, মন্ত্রীকে ফ্রেমে নিয়ে, সেলফি তুলে নেবে!

    গিরগিটিয়া। অ, বুঝলাম। তা, ফুটবল খেলা ওরা ছেড়ে দিয়েছে কেন? ওরা তাহলে কী খেলে এখন?

    হাতিমি। ওরা? ওরা ধুপ জ্বেলে, সিঁদুরের ফোঁটা কপালে লাগিয়ে, দুখানা মিনি জাতীয় পতাকা ক্রস করে টেলিভিশন সেটের সামনে রেখে, খেলা শুরু হওয়ার তিন মিনিট আগে উঠে দাঁড়িয়ে, নিজের ডান হাত দিয়ে বুকের বাঁ-দিকটা চেপে ধরে হিন্দী উচ্চারণে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে, খেলা দেখে খেলা দেখে, কিন্তু খেলে না! ওদের এখন শুধুই খেলা দেখার খেলা! (হঠাৎ একটি লোক নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে প্রবেশ করে)

    লোকটি।


    (আজ) খেলা দেখার খেলা খেলবি আয়
    ঘামের গ্লানি ভেঙে ফেলবি আয়
    মাঠে ছোটার আজ নিয়ম তো টুটবে
    টেলির ছবিতে আজ স্বপন তো ছুটবে।
    উধাও মনের পাখা মেলবি আয়। (সভায় উপস্থিত সবাই ঘাবড়িয়ে যায়)

    প্যাঁচানি। তুমি সভার মধ্যে ঢুকে পড়লে কার অনুমতিতে? (লোকটি কোন কথা বলে না, হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকে)

    হরু। আরে, আমি তো এই ভদ্রলোককে চিনি। (লোকটিকে) আপনিই না ভীষ্মলোচন শর্মা?

    ভীষ্ম। ঠিক বলেছো, গ্রীষ্মকালে গান গাইতুম, আমিই দিল্লী থেকে বর্মা-খ্যাত ভীষ্মলোচন।

    হরু। কিছু মনে করবেন না স্যর, সেই আকাশ কাঁপিয়ে দালান ফাটিয়ে আপনি যখন একবার গান গাইছিলেন ̶

    ভীষ্ম। দালান ফাটিয়ে মানে? দোষটা আমার হলো? মানে আমার গানের? তোমাদের বুড়ি যদি ওইরকম আঠা দিয়ে সেঁটে, সুতো দিয়ে বেঁধে, থুতু দিয়ে চেটে ঘর বানায়, সেটা ফেটে বা ভেঙে গেলে আমার দোষ হলো?

    হরু। না না স্যর। আমি দোষের কথা বলছি না।

    ভীষ্ম। বলছো না কী আবার! বলছো তো! এর আগেও তো একবার একই কাণ্ড হয়েছিলো, জানো না?


    ডাক দিলো ফেরিওয়ালা, হাঁক দিলো গাড়ি
    খসে পড়ে কড়িকাঠ ধসে পড়ে বাড়ি।
    বাঁকাচোরা ঘরদোর ফাঁকা ফাঁকা কত,
    ঝাঁট দিলে ঝরে পড়ে কাঠকুটো যত!

    একটা হাঁড়ি মাথায় নিয়ে এক বুড়োর প্রবেশ, হাঁড়ি থেকে বেরিয়ে আছে দুয়েকটা লম্বা কাঠের টুকরো

    বুড়ো। কাঠকুটো কাঠকুটো কাঠকুটো! কাঠ বলে কোন মান-সম্মান নেই নাকি! কাঠ বলে কি মানুষ নয়? কাঠ নিয়ে কথা বলছে কে?

    প্যাঁচানি। আরে, তুমি আবার কোথা থেকে এলে? এ তো মহা মুশকিল, হচ্ছিলো একটা মিটিং, তার মধ্যে কোথা থেকে সব উড়ে এসে জুড়ে বসলো!

    বুড়ো। (একটা কাঠ হাতে তুলে নিয়ে মারমুখো হয়ে বাগিয়ে ধরে) উড়ে এসে মানে? আমার উড়ে আসার জো আছে? রীতিমত হাঁটতে হাঁটতে, পথের দুপাশে যত গাছ আর কাঠ আছে দেখতে দেখতে পথ চলতে হয়। কাঠ আর গর্ত! আমি এ দুটোর বিশেষজ্ঞ তা জানো?


    কোন্‌ কাঠ পোষ মানে, কোন্‌ কাঠ শান্ত,
    কোন্‌ কাঠ টিমটিমে, কোন্‌টা বা জ্যান্ত।
    কোন্‌ কাঠে জ্ঞান নাই মিথ্যা কি সত্য,
    আমি জানি কোন্‌ কাঠে কেন থাকে গর্ত।

    এ স-অ-ব খবর আমার কাছে পাবে, বুঝলে?

    ভীষ্ম। হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝলুম, কিন্তু আমি যখন গান গাইছিলুম ঠিক তখনই এক পাগলা ছাগল শিং বাগিয়ে ̶

    বিছাগল। (কাঁদতে কাঁদতে) ব্যা ব্যা ব্যা ব্যা...

    প্যাঁচানি। কী হলো, বিছাগল, তুমি কাঁদছ কেন?

    বিছাগল। এই লোকটা আমাকে পাগলা বললো।

    ভীষ্ম। না না, তোমাকে কেন বলবো, তুমি তো (এবার ভালো করে বিছাগলকে দেখে) আরে, আশ্চর্য, তোমার... তোমার... তুমি কে! তোমার পিছনটা এরকম কেন?

    বিছাগল। আমার সামনেটা ছাগল, পিছনটা বিছে, মানে সাধু ভাষায় বিছা, আমি বিছাগল!

    ভীষ্ম। পিছনটা বিছা! বিষ আছে?


    নেপথ্যে সাপুড়ের বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়, সেই আওয়াজের মধ্যেই কাঁধে সাপের বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ে একজন সাপুড়ে

    সাপুড়ে। বিষ? আমার কোন সাপের বিষ নেই।


    শিং নেই নখ নেই,
    ছোটে না কি হাঁটে না
    কাউকে যে কাটে না,
    করেনাকো ফোঁসফাঁস,
    মারেনাকো ঢুঁশ ঢাঁশ।

    বিছাগল। আরে, তুমি আবার কে?

    সাপুড়ে। আমি বাবুরাম সাপুড়ে। বিষের কথা হচ্ছিলো তো, শুনতে পেয়ে ঢুকে পড়লুম। তোমরা হয়তো ভাবছ ̶ আমি সাপ খেলা দেখাই তো ̶ আমার কাছে বিষ আছে!

    গিরগিটিয়া। খামোকা এসব কথা ভাবতে যাব কেন? তোমাকে তো আমরা চিনিই না!

    সাপুড়ে। দেখো, চিনি না চিনি না বলে বারবার অপমান করার চেষ্টা করবে না। তোমরাই বা কে হে? তোমাদের কে চেনে? এক-একটা বডিতে দুজন-দুজন করে! এমন আশ্চর্য প্রাণীদেরই বা কে চেনে হে?

    প্যাঁচানি। কোয়ায়েট, কোয়ায়েট প্লীজ। আমি আর কোন গোলমাল চাই না। বলো বকচ্ছপ, তুমি কী বলছিলে বলে যাও।

    বকচ্ছপ। (হরুকে) ওহে ছোকরা, আমাদের এই শহরের বিখ্যাত আমড়াতলা তুমি চেনো?

    হরু। চিনি বৈকি। ঐ যেখানে তিন মুখো তিন রাস্তা গেছে?

    বকচ্ছপ। তিন মুখো তিন রাস্তা। আর জায়গাটা কীরকম?

    হরু। গোলোকধাঁধাঁর মতো।

    বকচ্ছপ। গোলোকধাঁধাঁয় কী হয়?

    হরু। লোকে ঘাবড়ে যায়। বুদ্ধিভ্রষ্টও হতে পারে।

    বকচ্ছপ। লোকে?

    হরু। না না, শুধু লোকে কেন? যে-কেউ। তোমরাও হতে পারো।

    বকচ্ছপ। আচ্ছা, ঐ আমড়াতলার আশে পাশে কী আছে?

    হরু। বাজার।

    বকচ্ছপ। বাজারের নাম?

    হরু। চান্নি। চান্নির বাজার।

    মোরগরু। অপদার্থ। অশিক্ষিত। চান্নি আবার কী?

    হরু। (উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে) চান্নি। চান্নি একটা জায়গার নাম, যেখানে বাজার বসে।

    প্যাঁচানি। তোমার সম্বন্ধে আমার উঁচু ধারণা ছিলো হরু। কথাটা চান্নি নয়, চাঁদনি। ব্যঞ্জনবর্ণ বিপর্যয় করে, শেষের দন্ত্য-ন এর প্রভাবে পূর্ববর্তী দ-কে ন করে দিয়ে তোমরা, মানে বোকা মানুষরা, চান্নি বলো। আমরা বলি না, বুঝলে? বলে যাও বকচ্ছপ কী বলছিলে, বলে যাও।

    বকচ্ছপ। চাঁদনি রাতে নৈশ-নাগরিকদের কোন্‌ ইচ্ছা সর্বাপেক্ষা প্রবল হয় জানো কী?

    বিছাগল। মানুষ তো, জানবে কী করে?

    মোরগরু। (মোরগের ডাকের মতো সুর করে) গ-গ-গানের।

    বকচ্ছপ। যথার্থ বলেছো। সঙ্গীতেচ্ছা। গত পূর্ণিমায়, রাত তখন আড়াইটে হবে, আমড়াতলার মোড়ে ডঃ শৃগাল আপন মনে তান ধরেছেন মা-পা-ধা-নি মা-পা-ধা-নি মা-পা-ধা-নি। তিন-মুখো তিন রাস্তার একটায় শেয়াল-গুরুর ল্যাজ, একটায় তাঁর দেহটি, আর একটার দিকে তাঁর একটি কান। এমন সময় বলা নেই-কওয়া নেই, একটা মোটরগাড়ি কোথা থেকে দৌড়িয়ে এসে (কাঁদতে কাঁদতে) সোজা গুরুদেবের ঠ্যাঙের উপর!

    হরু। ঠ্যাং ভাঙলো?

    বকচ্ছপ। ভাঙলো বলে ভাঙলো! হাঁটুর নীচের থেকে আধখানা নেই!

    হরু। কী করলে তোমরা?

    বকচ্ছপ। সবাই মিলে নিয়ে এলুম। বাঘমামা একটা অপারেশন করলো, কিছু হলো না, সেপসিস হয়ে (ক্রন্দন) মারা গেল!

    হরু। ইশ্‌, আমাকে বললে না!

    প্যাঁচানি। তোমাকে বললে কী হতো?

    হরু। কী হতো! ওই যে তুমি যেখানে বসে সভাপতিগিরি করছো, ওই জায়গাটায় দুপুর বেলা তাকিয়ে দেখেছ কোনদিন? থাক তো ওই আমড়াগাছটার ওপর, ওখানেই তো তোমার বাসা, দেখেছ কখনো নীচের দিকে তাকিয়ে?

    প্যাঁচানি। দেখিনি, কী হয় ওখানে?

    হরু। ছায়া পড়ে।

    প্যাঁচানি। তাতে কী হলো? রোদ্দুর থাকলে ছায়া তো পড়বেই।

    হরু। হ্যাঁ, ছায়াটা যেখানে পড়ে, ঠিক সেখানটায়, নীচের ওই মাটিটায়, আমি রাজ্যের নোংরা ঢেলে রেখেছি, বুঝলে!

    প্যাঁচানি। ও মা গো। কী ঘেন্না। কী ঘেন্না! নোংরা ঢালতে গেছ কেন?

    হরু। বাঃ, কী বুদ্ধি! ছায়াটা নোংরার উপর পড়লে, সেটা নোংরা ছায়া হবে না?

    প্যাঁচানি। হলেই বা!

    হরু। হলেই বা! কী বুদ্ধি! শোননি? ̶


    আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে যদি খায়
    ল্যাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নেই তায়।

    প্যাঁচানি। বলো কী!

    হরু। ঐ তো!

    হাতিমি। তাহলে তো আমরা ঠিকই ভেবেছি।

    হরু। কী ভেবেছো?

    হাতিমি। আমরা আন্দোলন করবো। চান্নির বাজারের কাছে তিন-মুখো তিন রাস্তাওয়ালা-আমড়াতলাকে অচল রাস্তা বলে নোটিশ দিতে হবে। তার বদলে, আমরা আজ যেখানে সমবেত হয়েছি, আমাদের সভাপতির বাসস্থানের ঠিক নীচের সেই আমড়াতলাকেই, এই শহরের একমাত্র আমড়াতলা বলে মেনে নিতে হবে।

    হরু। তোমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো? হাত মেলাও কমরেড।

    মোরগরু। কেন? হাত মেলাব কেন?

    হরু। কারণ, এ সিদ্ধান্ত আমরা আগেই নিয়েছি। আমাদের আন্দোলন আগেই শুরু হয়ে গেছে। সারা শহরে আমরা পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছি।

    বকচ্ছপ। আমরা মানে কারা?

    হরু। আমি। আমার বন্ধুরা। কলির ভীমসেন বেনিয়াটোলানিবাসী পালোয়ান ষষ্ঠীচরণ। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী গোষ্ঠমামা। এবং অন্যান্য।

    প্যাঁচানি। তাহলে আমাদেরও নিয়ে নাও। আর এই যাঁরা আজ এসেছেন, ভীষ্মলোচন শর্মা, বাবুরাম সাপুড়ে, আর আর (কাঠবুড়োর দিকে তাকিয়ে) ̶ আপনাকে কী নামে ডাকব স্যর?

    বুড়ো। কাঠবুড়ো। বৃদ্ধ হয়েছি, কাঠই আমার জীবন, আমি কাঠবুড়ো।

    প্যাঁচানি। ঠিক আছে। আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে নাও। আমরাও তোমাদের সঙ্গে আছি।

    বাকিরা (কাঠবুড়ো ছাড়া)। সঙ্গে আছি, সঙ্গে আছি।

    বুড়ো। দাঁড়াও। কোন মহৎ কাজ তাড়াহুড়ো করে হয় না। এই আমড়া গাছের নানা ফাটল পরীক্ষা করে, গন্ধ শুঁকে দেখতে হবে এ গাছের সেই যোগ্যতা আছে কিনা। তোমরা সরে যাও, আমি দেখব। (বুড়ো হনহন করে এগিয়ে যায়, সবাই সসম্মানে পথ ছেড়ে দেয়, প্যাচানি উঁচু জায়গা থেকে নেমে হরুর পাশে দাঁড়ায়। বুড়ো এক চোখ বুজে গাছের নানা গর্ত আর ফাটল পরীক্ষা করে, তারপর গন্ধ শোঁকে, তারপর প্যাঁচানির ছেড়ে-যাওয়া উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে শ্লোগান দেয়)

    বুড়ো। এগিয়ে চলো, সঙ্গে আছি। এগিয়ে চলো, সঙ্গে আছি। (বুড়ো নেমে এসে দাঁড়ায়, তার পিছনে লাইন করে ওরা এগিয়ে চলে, হরু ততক্ষণে লাইনের সবচেয়ে পিছনে প্যাঁচানির পাশে)

    প্যাঁচানি। তুই সব সময় প্যাঁচার মুখোশ পরে ঘুরিস কেন রে হরু?

    হরু। ̶ (গান)


    (তোর) সুরে সুরে কতো প্যাঁচ
    গিটকিরি ক্যাঁচ ক্যাঁচ!
    যত ভয় যত দুখ
    দুরু দুরু ধুক ধুক,
    তোর গানে পেঁচি রে
    সব ভুলে গেছি রে! ̶ তাই! (পেঁচি লজ্জিত মুখে হাসে। অন্ধকার হয়ে যায়। পর্দা)

    ৪র্থ দৃশ্য
    মূল মঞ্চ অপরিবর্তিতই থাকবে। মঞ্চ অন্ধকার থাকতে থাকতেই বোঝা যায় কয়েকজন মিলে একটা সিংহাসন টেনে
    নিয়ে আসছে, সেই অবস্থাতেই আলো জ্বলে যায়। যারা সিংহাসন টেনে আনছিলো, ধরা যাক তাদের নাম ১, ২ এবং ৩

    ১। একটা এতো বড়ো সিংহাসন রাস্তায় টেনে আনা! মানে হয়!

    ২। এই যে রাজসভাকে একেবারে রাস্তায় টেনে নামানো হচ্ছে, এটা কি দেশের পক্ষে ভালো?

    ৩। গণ্ডগোলটা তো রাস্তা নিয়েই। কাজেই রাজামশায় নিজে রাস্তায় এসে বসলে ক্ষতি কী? তিনি তো রাস্তায় এসে কারো বাড়ির রকে অথবা কোন চায়ের দোকানে বসছেন না। তিনি তাঁর সিংহাসনেই বসবেন, সেটা তো ভালোই। আমরা না হয় রাজসভায় চাকরি করি, আমাদের কথা আলাদা। কিন্তু ভেবে দেখ্‌ তো দেশের কতো মানুষ রাজামশায়কে কখনো চোখেই দেখেনি। তারা আজ একটা সুযোগ পাবে।

    ১। মানুষ কী রে, শুনছি নাকি বন-জঙ্গল থেকে পশুপাখিরাও আসবে। ভারি রগড় হবে কিন্তু তাহলে।


    সৈন্যদলের কুচকাওয়াজের যন্ত্রসঙ্গীতের মতো যন্ত্রসঙ্গীতের শব্দ শোনা যায়

    ২। রাজামশায় আসছেন।


    ১ ২ এবং ৩ তটস্থ হয়ে দাঁড়ায়, পুলিশের পোশাকে একজন প্রবেশ করে। লোকটি নগর কোটাল, যন্ত্রসঙ্গীত থেমে যায়।

    নগর কোটাল। রাজামশায় রওনা দিয়েছেন, সব ব্যবস্থা ঠিক আছে তো ?

    ৩। ব্যবস্থা আবার কী? সিংহাসন তো পেতে দেওয়া হয়েছে।

    নগর কোটাল। সেখানে তো রাজামশায় বসবেন, বাকিরা?


    হঠাৎ প্যাঁচানির কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়, কিন্তু তাকে দেখা যায় না।

    প্যাঁচানি। রাজামশায়, রাজামশায়। তিনি একাই পুরোটা, বাকি আবার কে?

    ১ ২ ও ৩। হ্যাঁ, বাকি আবার কে?

    নগর কোটাল। কে? কে কথা বললো?

    ১ ২ ও ৩। হ্যাঁ তাই তো, তাই তো, সত্যিই তো, কে কথা বললো?

    প্যাঁচানি। (নেপথ্যে হাসি) হা হা হা হা।

    নগর কোটাল। কে হাসছে? কে হাসছে? কোথায় তুমি? (সবাই মিলে খোঁজাখুজি করে, কাউকে দেখতে পায় না) ওরে বাবারে, কেউ নেই তবু হাসছে রে, ভুত ভুত, এই আমড়াতলায় ভুত আছে! (নগর কোটাল দৌড়িয়ে বেরিয়ে যায়)


    ঢাক-ঢোল-কাসির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, মন্ত্রীমশায় প্রবেশ করেন, তাঁর পিছন পিছন রাজা,
    ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে-রাখা আমসত্ত্ব ভাজা হাতে ধরে রাজাকে চাটাতে চাটাতে পেছনের দিকে
    হাঁটতে হাঁটতে (যেহেতু রাজা সামনের দিকে হাঁটছেন) একজন এবং রাজাকে তালপাতার পাখা
    দিয়ে হাওয়া করতে করতে আর একজন, এ ছাড়া আরও দুয়েকজন লোক – রাজার সভাসদই
    হবেন! – সবাই একসাথে মঞ্চে প্রবেশ করে। ঢাক-ঢোল-কাসি বাজতেই থাকে, রাজা ধীরে
    ধীরে সিংহাসনে বসেন। নেপথ্যে ঘোষকের গলা শোনা যায়।

    ঘোষক। সিংহাসনে বসলো রাজা বাজলো কাসর-ঘন্টা।

    রাজা। বোস, বোস মন্ত্রী, তোমরা সবাই বসে পড়।

    মন্ত্রী। কোথায় বসি, মহারাজ?

    প্যাঁচানি। (নেপথ্যে) কোথায় আবার, মাটিতে!

    রাজা। হ্যাঁ, কোথায় আবার, মাটিতে! (হঠাৎ মনে পড়ে যায় যে কথা বলছে তাকে দেখা যাচ্ছে না) আরে, কে কথা বললো? (ততক্ষণে সবাই মাটিতেই বসে পড়ে)

    প্যাঁচানি। (নেপথ্যে) আমি, মহারাজ!

    রাজা। কে আমি?

    প্যাঁচানি। (নেপথ্যে) মহারাজ, আমি প্যাঁচানি।

    রাজা। তুমি কোথা থেকে কথা বলছো?

    প্যাঁচানি। (নেপথ্যে) আপনি যেখানে বসে আছেন তার ঠিক উপরে, মহারাজ।


    রাজা উপরের দিকে তাকান, কিছুই দেখতে পান না।

    রাজা। উপরে তো শুধুই আমড়া গাছের পাতা, আর তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মন্ত্রী, বিজ্ঞানী কোথায়?


    বিজ্ঞানী উঠে দাঁড়ায়, তার হাতে নলের মতো একটা কিছু

    বিজ্ঞানী। এই যে আমি, মহারাজ।

    রাজা। ও, গূড! তুমি এসে গেছ! গূড! তোমার দূরবীনটা একটু দাও তো দেখি, প্যাঁচানিকে দেখতে পাওয়া যায় কিনা।

    বিজ্ঞানী। মহারাজ, এটা দূরবীন নয়।

    রাজা। দূরবীন নয়? তাহলে ওটা কী?

    বিজ্ঞানী। এটা ফুটোস্কোপ, মহারাজ।

    রাজা। ফুটো ̶ ফুটো ̶ কী বললে ̶ স্কোপ ̶ মানে, ফুটো দেখার যন্ত্র?

    বিজ্ঞানী। হ্যাঁ মহারাজ।

    রাজা। কোন্‌ ফুটো? কেমন ফুটো? কার ফুটো? কেনই-বা ফুটো?

    বিজ্ঞানী। সেটাই প্রশ্ন, মহারাজ। কোন কোন মাথায় অতি-ক্ষুদ্র, প্রায়-অদৃশ্য কিছু কিছু ফুটো থাকে। এ যন্ত্রের সাহায্যে
    তা-ই দেখা যায়, মহারাজ।

    রাজা। দেখা যায়? দেখে কী লাভ?

    বিজ্ঞানী। ওই যে বোঝা যায় ̶ কতখানি ভসভসে ঘিলু, কতখানি ঠকঠকে ফাঁপা!

    রাজা। ঠিক আছে বিজ্ঞানী, তুমি বোস। তোমার ফুটোস্কোপ পরে কাজে লাগবে। (উপরের দিকে তাকিয়ে) তাহলে প্যাঁচানি, কী হবে! তোমাকে তো ফুটোস্কোপ দিয়ে দেখা যাবে না।

    প্যাঁচানি। (নেপথ্যে) আমাকে দেখতে পাবার সবচেয়ে সহজ রাস্তাটা বাতলাবো মহারাজ?

    রাজা। বাতলাও।

    প্যাঁচানি। (নেপথ্যে) আমি আমার আমড়া গাছের বাসা থেকে নেমে সোজা রাজসভায় এসে বসে যাই।

    রাজা। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক, রাস্তায় বসাটাই তো সবচেয়ে সহজ রাস্তা। আমার মাথায় আগে এলো না কেন? চলে এসো।

    প্যাঁচানি। (প্রবেশ করতে করতে) জয় হোক মহারাজ।

    রাজা। আচ্ছা প্যাঁচানি, তুমি অত পাতার আড়ালে বাসা করেছো কেন?

    প্যাঁচানি। না মহারাজ, আগে আমার বাসা অনেক নীচের ডালেই ছিলো। আমি তো দিনের বেলায় ঘুমোই আর রাতে জেগে থাকি, তাই দিনের বেলা একটা দুষ্টু ছেলে একবার বাণ মেরে আমাকে নামাবার চেষ্টা করেছিলো, সেই থেকে আমি পাতার আড়ালে অনেক উপরে থাকি।

    রাজা। (রাগত) দুষ্টু ছেলে? কী নাম তার? মন্ত্রী ̶

    প্যাঁচানি। আপনি কিছু ভাববেন না মহারাজ। সে দুষ্টু, কিন্তু খারাপ নয়, তার নাম মোহন। সে এখন আমার খুবই বন্ধু।

    রাজা। তা, তোমার বন্ধুদেরই তো আসার কথা ছিলো আজ এই আমড়াতলার ব্যাপারে?

    প্যাঁচানি। হ্যাঁ মহারাজ, এই এলো বলে।


    হঠাৎ দৌড়োতে দৌড়োতে নগর কোটালের প্রবেশ, রাজাকে দেখে নার্ভাস মুখটা হাসি হাসি করার চেষ্টা করে।

    নগর কোটাল। (হাঁটু গেড়ে) নমস্কার মহারাজ, এসে গেছেন আপনি! (বলতে বলতে এদিক ওদিক তাকায়)

    রাজা। এসেছি তো, তা তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আর, এতো বেয়াদবির সাহস পেলে কোথায়! কথা বলছো আমার সাথে, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন?

    নগর কোটাল। না মানে, আমি সকালে এসেছিলুম...তা, মানে মহারাজ আপনি ঠিক আছেন তো...মানে ভুত-টুত!

    রাজা। ভুত মানে?

    নগর কোটাল। এই আমড়াতলায় ভুত আছে মহারাজ। আমি যখন সকালে এসেছিলুম আজ, একটা ভুত... উল্টোপাল্টা কথাবার্তা... অট্টহাসি......(কান্নাভরা গলায়) আমি আর বলতে পারছি না মহারাজ!

    রাজা। বিজ্ঞানী, তোমার ঐ ফুটোস্কোপ দিয়ে নগর-কোটালের মাথাটা একটু দেখ তো।

    বিজ্ঞানী। ওঁর মাথা? ওঁর মাথায় কী আছে?

    রাজা। সেটাই দেখো না, কতখানি ভসভসে ঘিলু, কতখানি ঠকঠকে ফাঁপা!

    বিজ্ঞানী। দেখা যাবে না মহারাজ।

    রাজা। দেখা যাবে না মানে?

    বিজ্ঞানী। মহারাজ, আপনিই বললেন উনি সাহসী। আপনার সাথে পর্যন্ত বেয়াদবি করার সাহস দেখান, তার ওপর আবার ভুত দেখেন, তাহলে বুঝতেই পারছেন উনি কতো বড় সাহসী কোটাল। ওঁর মাথায় কিচ্ছু পাওয়া যাবে না।

    রাজা। ভুত দেখলেই সাহসী?

    বিজ্ঞানী। হ্যাঁ মহারাজ, কোটালদের ক্ষেত্রে তাই। ভুত দেখলেই সাহসী।

    রাজা। তোমার কথা কিছু বুঝলাম না বিজ্ঞানী।

    বিজ্ঞানী। যখন ভয়ঙ্কর ডাকাত-গুণ্ডা-বদমায়েসরা গুলি-গোলা-বোমা ছোঁড়ে, তখন কোটালদের মধ্যে যারা সাহসী, তারা তাদের দেখতে পায় না, বোমা-টোমাগুলো ভুত ছুঁড়েছে মনে করে, মহারাজ।

    রাজা। তা হোক। তবু ওর মুণ্ডুটা ফুটোস্কোপ দিয়ে দেখতে তোমার কী অসুবিধে আছে?

    বিজ্ঞানী। ওঁর মুণ্ডুতে কোন ফুটো নেই মহারাজ। সাহসী কোটালদের থাকে না। মুণ্ডুই বা বলি কেন, সাহসীদের নাক-কান ̶ কোত্থাও কোন ফুটো নেই, ওঁরা গন্ধ বোঝেন না, শব্দ শোনেন না। সাহসী কোটালের সারা শরীরে শুধু দুটো ফুটো, একটা খাদ্য গ্রহণের, আর একটা নিষ্ক্রমণের।

    হাতে ব্রীফ-কেস নিয়ে হঠাৎ একটি লোক ঢোকে, এবং ব্রীফ-কেস হাতে ধরেই সাষ্টাঙ্গ শুয়ে পড়ে রাজার সামনে। লোকটির নাকের নীচে অসমান এক-জোড়া গোঁফ।

    লোকটি। ডাকাত, ডাকাত, রাজামশায়! বড়ো বড়ো চোর! আমাকে বাঁচান রাজামশায়।

    রাজা। কী হয়েছে তোমার? তুমি কে? থাক কোথায়? (লোকটি ভয়ে ভয়ে নগর কোটালকে দেখায়)

    নগর কোটাল। উনি আমার চেনা, মহারাজ। উনি আমাদের হেড অফিসের বড়ো বাবু।

    বড়ো বাবু। কী বলবো মহারাজ, নগর কোটাল অফিসের আমি বড়ো বাবু, আমাকেই সর্বস্বান্ত করে দিলো!

    রাজা। সর্বস্বান্ত! দিব্যি তো হাতে একটা ব্রীফ-কেস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ! সর্বস্বান্ত হলে কিসে?

    বড়ো বাবু। (নাকের নীচে হাত বুলিয়ে) মহারাজ, আমি নিজে বড়ো বাবু, তবুও একটা মিসিং ডায়েরী পর্যন্ত নিলো না!

    রাজা। কী মিসিং?

    বড়ো বাবু। গোঁফ, মহারাজ, গোঁফ জোড়া।

    রাজা। কার, তোমার? তোমার গোঁফ তো দিব্যি আছে!

    বড়ো বাবু। মহারাজ, অপরাধ নেবেন না, আপনিও শেষ পর্যন্ত ঐ কথাই বললেন!

    রাজা। ঐ কথা মানে?

    বড়ো বাবু। ছোট মুখে বড়ো কথা মহারাজ, দোষ ধরবেন না, গোঁফকে এত ছোট করে দেখবেন না মহারাজ।

    রাজা। তোমার কথা আমি কিছু বুঝছি না বাপু, গোঁফকে ছোট করে...মানে?

    বড়ো বাবু। (পকেট থেকে এক জোড়া গোঁফ বের করে) মহারাজ, এই যে গোঁফ, কেমন গোঁফ?

    রাজা। ভালো গোঁফ। দারুণ গোঁফ। জবরদস্ত্‌ গোঁফ।

    বড়ো বাবু। তাহলে বলুন মহারাজ, এই জবরদস্ত্‌ গোঁফ কি কখনো আমার হতে পারে?

    রাজা। তুমি রাখলেই হতে পারে।

    বড়ো বাবু। আমি রাখবার কে মহারাজ? এই গোঁফ যদি দয়া করে আমাকে রাখে তা হলে ̶ মানে, আমার গোঁফ তো নয় ̶ গোঁফেরই আমি হতে পারি।

    রাজা। (নিজের গোঁফে হাত দিয়ে) তার মানে, এই যে গোঁফ, এ আমার গোঁফ নয়, এই গোঁফেরই আমি?

    বড়ো বাবু। হ্যাঁ, মহারাজ।

    রাজা। (বিজ্ঞানীকে দেখিয়ে) ঐ যে বিজ্ঞানীর নাকের নীচে যে গোঁফ, সে গোঁফ ওঁর নয়, সেই গোঁফেরই উনি!

    বড়ো বাবু। একেবারে ঠিক বলেছেন মহারাজ।

    রাজা। তোমার নাকের নীচের জোড়াটাও তোমার নয়, তুমিই ওটার?

    বড়ো বাবু। (কেঁদে ফেলে) না মহারাজ, ঐ গোঁফের কথা বলবেন না দয়া করে:


    নোংরা ছাঁটা খ্যাংড়া ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা
    এমন গোঁফ তো রাখতো জানি শ্যামবাবুদের গয়লা!

    আমি ছিলুম যে গোঁফের, সে আজ সকাল থেকে নিখোঁজ। আমি একটু গভীর চিন্তা করতে করতে চোখ বুজে অফিসে বসে কাজ করছিলুম, সেই সুযোগে কোন ভুত আমার নাকের নীচে এই শ্যামবাবুদের গয়লার গোঁফটা লাগিয়ে দিয়ে গেলো!

    রাজা। ভুত! তুমি কী করে জানলে ভুত লাগিয়ে দিয়ে গেল?

    বড়ো বাবু। মহারাজ, অফিসে নগর কোটাল নিজেও বসেছিলেন। কোন মানুষ যদি এই দুঃসাহস দেখাতো, তাহলে উনি নিজেই তা দেখতে পেতেন। তা যখন পাননি, তাহলে এই দুর্বৃত্ত, এই অপরাধী, ভুত ছাড়া আর কে হতে পারে!

    রাজা। তুমি ঠিক বলছো না বড়ো বাবু, উনি সাহসী কোটাল। সাহসী কোটালরা ভুতদের ঠিক দেখতে পায়।


    হৈ হৈ করতে করতে কাঠবুড়ো, ভীষ্মলোচন, বাবুরাম সাপুড়ে, হরু, মোহন, গোষ্ঠ মামা, ষষ্ঠীচরণ আর হাঁসজারুদের দল সবাই মঞ্চে ঢোকে, ঢুকেই তারা নগর কোটালকে দেখতে পায়, এবং সবাই মিলে

    সমবেত। ঐ তো ভীতু কোটাল দাঁড়িয়ে!

    মন্ত্রী। ভীতু! মহারাজ, আমাদের কোটালবাবু ভীতু না সাহসী?

    রাজা। ওদের বলতে দাও। শোনা যাক কী ওদের বক্তব্য।

    হরু। মহারাজ, গত সপ্তাহে চাঁদনী রাতে এ শহরের নৈশ-নাগরিক সঙ্গীতগুরু ডঃ শৃগাল যখন আমড়াতলার মোড়ে গান গাইছিলেন, তখন বেআইনী গতিতে একটা মোটরগাড়ি শিল্পীকে চাপা দেয়। (হাঁসজারু ইত্যাদিদের দেখিয়ে) এঁরা, যাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা লক্ষ্য করেন এই কোটাল সেখানে তাঁর পল্টন নিয়ে দাঁড়িয়ে। কোটালকে এঁরা অনুরোধ করেন চালকসমত গাড়িটাকে ধরতে। কোটাল কিছুই-দেখেননি-কিছুই-শোনেননি মুখ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন।

    বিজ্ঞানী। এর থেকেই প্রমাণ হয় উনি সাহসী, ভীতু ন'ন।

    রাজা। আঃ, ওদের বলতে দাও বিজ্ঞানী।

    হরু। অনেকক্ষণ তর্কাতর্কির পর কোটাল সাহেব বলেন, যেহেতু গাড়িটা চালাচ্ছিলেন একজন সেলিব্রিটি, অতএব উনি কিছুই দেখেননি।

    হাঁসজারু। আমি একটু কথা বলব, মহারাজ?

    রাজা। বলো।

    হাঁসজারু। আমি তখন কোটাল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি এইমাত্র নিজের মুখে বললেন একজন সেলিব্রিটি চালাচ্ছিলেন গাড়িটা, এখন কেন বলছেন আপনি কিছুই দেখেননি? উনি বললেন, সেটাই নিয়ম। সেলিব্রিটিরা চালালে কাউকেই চালাতে দেখা যায় না।

    বিজ্ঞানী। এর থেকেই প্রমাণ হয়, উনি একজন সাহসী কোটাল। গাড়িটি চলছিলো, তা উনি দেখেছেন, এবং কেউ চালাচ্ছিলো না ̶ তা-ও উনি দেখেছেন। অর্থাৎ গাড়িটি চালাচ্ছিলো একটি ভুত!

    নগর কোটাল। মহারাজ, আমার একটা বক্তব্য আছে।

    রাজা। বলে ফেলো, শোনা যাক কী তোমার বক্তব্য।

    নগর কোটাল। এ দেশের রাস্তা ও যানবাহন সংক্রান্ত আইনের একুশ নম্বর ধারার বলে আমরা, এবং নাগরিকরা ̶ সে নৈশ বা দিবা যে নাগরিকই হোক ̶ রাস্তার দিকে সোজাসুজি, এবং শুধু সোজাসুজিই, তাকাতে পারি। কারণ আইন বলছে ̶


    চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়,
    এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়,
    রাজার কাছে খবর ছোটে,
    পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
    দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়
    একুশ হাতা জল গেলায়।

    যেদিনের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো সেদিন শেয়ালের মৃত্যু হয়েছিলো বলেই আমাদের পল্টন অত্যন্ত সহানুভূতির সাথে ঘটনাটা দেখে, এবং প্রত্যেককে একুশ হাতা জল গেলানো থেকে বিরত থাকে। সেটা অন্য কথা, এবার আসল কথায় আসি। একুশ নম্বর ধারার বলে যেহেতু আমরাও ডাইনে-বাঁয় তাকাতে পারি না, অতএব পাশ থেকে কোন গাড়ি এসে কাউকে ধাক্কা মেরেছে কিনা আমরা জানিনা। যদি কেউ মেরেও থাকে, তার চেহারা সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারণাই নেই। অতএব আমরা ধরে নেব, এই গাড়ির চালক একজন সেলিব্রিটি বা ভুত!

    রাজা। হুঁ, তাহলে বোঝা গেল, একুশে আইন-ই অসুবিধের আসল কারণ। এখন উপায়?

    প্যাঁচানি। আইন বদলে ফেলা হোক।

    রাজা। কঠিন প্রস্তাব। অনেক বাধা। অনেক কিছু আছে, আপার হাউজ, লোয়ার হাউজ, ইন্টারমিডিয়েট হাউজ, পোলিটিকাল হাউজি, আরও কতো কিছু!

    মন্ত্রী। তাহলে? (গোষ্ঠমামা হাত তোলে)

    গোষ্ঠমামা। মহারাজ, অনুমতি দিলে আমি একটা প্রস্তাব দিতে পারি।

    রাজা। অনুমতি? তা, তুমি কে? কী নাম?

    গোষ্ঠমামা। আমার নাম গোষ্ঠ। আমি একজন বিজ্ঞানী, মহারাজ।

    রাজা। আরও একজন বিজ্ঞানী! এ-রাজ্যে বিজ্ঞানের তাহলে জয়জয়কার বলো!

    প্রথম বিজ্ঞানী। না মহারাজ, উনি বিজ্ঞানী-টিজ্ঞানী তেমন ন'ন। উনি এই একটা স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক।

    রাজা। বিজ্ঞান শিক্ষক! তুমি বিজ্ঞানী আর উনি বিজ্ঞান শিক্ষক! তোমার শিক্ষক!

    প্রথম বিজ্ঞানী। আমার শিক্ষক না মহারাজ!

    রাজা। (প্রচণ্ড রেগে) চোপ্‌! নিজের শিক্ষককে সম্মান দিতে পারো না! (গোষ্ঠমামাকে) হ্যাঁ শিক্ষক, বলো কী তোমার প্রস্তাব।

    গোষ্ঠমামা। মহারাজ, এ দেশে মোটরচালিত গাড়ি নিষিদ্ধ করে দিলে কেমন হয়?

    রাজা। এ কী কথা বলো শিক্ষক! গাড়ি, মানে গতি! মানে, শুধু গতি নয়, প্রগতি! প্রগতি কি বন্ধ করা যায়!

    গোষ্ঠমামা। (ষষ্ঠীচরণকে দেখিয়ে) মহারাজ, ঐ যে পালোয়ান ষষ্ঠীবাবু আছেন, উনি হাতি-ঘোড়া নিয়ে যা-ইচ্ছে করতে পারেন। হাতি-ঘোড়ার সাহায্যে আমরা গতি এবং প্রগতি অক্ষুণ্ণ রাখব, এবং মোটর গাড়ি নিষিদ্ধ করে আমাদের পরিবেশকে আমরা দূষণমুক্ত রাখবো।

    রাজা। কী পালোয়ান, তুমি হাতিঘোড়াকে নিয়ে যা-ইচ্ছে করতে পারো?

    ষষ্ঠী। না মহারাজ, আমি ওদের নিয়ে লোফালুফি করি, একটু-আধটু খেলেধুলো করি।

    রাজা। বলো কী! তুমি তাহলে ওদের ফুটবল খেলা শেখাও, মানে সকার আর কী! সামনের ওয়র্ল্ড কাপে, মানে বড়দের ওয়র্ল্ড কাপে, আমরা ওদের পাঠাব! দেখি, কোন্‌ দেশ আমাদের হারাতে পারে! (প্যাঁচানিকে) তাহলে প্যাঁচানি, ওই একুশে-আইনেই আটকে গেলুম আমরা। আমড়াতলার সমস্যার সমাধান আর হলো না!


    ডিগবাজি খেতে খেতে হো হো করে হাসতে হাসতে হঠাৎ একজনের প্রবেশ। ডিগবাজির শেষে সে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়

    রাজা। তুমি কে?

    বাকি সবাই। তুমি কে?

    আগন্তুক। আমি আহ্লাদী।

    রাজা। তোমার কিসের আহ্লাদ? এত হাসছ কেন?

    আহ্লাদী। (নাচ ও গান)


    হাসছি দেখে চাঁদের কলা জোলার মাকু জেলের দাঁড়
    নৌকা ফানুস পিঁপড়ে মানুষ রেলের গাড়ি তেলের ভাঁড়।

    রাজা। এখানে চাঁদের কলা কোথায় হে? জোলার মাকু কিংবা জেলের দাঁড়, আর সব বাদবাকি যা যা তুমি বললে তার কোন কিছুই তো নেই এখানে। তাহলে হাসছ কেন?

    কাঠবুড়ো। পিঁপড়ে আছে, মহারাজ।

    রাজা। কোথায় পিঁপড়ে?

    কাঠবুড়ো। (আমড়া গাছটাকে দেখিয়ে) ঐ গাছে ফাটল দেখতে পাচ্ছি আমি, গর্তও দেখা যাচ্ছে। ওখানে পিঁপড়ে নিশ্চয়ই আছে।

    রাজা। থাকা সম্ভব। কিন্তু সে পিঁপড়ে তো আর ও দেখতে পাচ্ছে না।

    কাঠবুড়ো। আমি দেখব মহারাজ?

    রাজা। তুমি দেখে কী করবে? বেশি কথা! দাঁড়িয়ে থাক কান ধরে। (কাঠবুড়ো বেচারা মুখে কান ধরে দাঁড়ায়)

    প্যাঁচানি। কিন্তু মহারাজ, এখানে মানুষ তো আছে। ও তো শুধু পিঁপড়ে বলেনি, বলেছিলো নৌকো ফানুস পিঁপড়ে মানুষ...

    রাজা। (রেগেমেগে) মানুষ দেখে হাসছো! মানুষ তো আমিও! কোন্‌ মানুষকে দেখে হাসছো?


    আহ্লাদী কথা বলে না, ফিচেল হাসি হেসে নগর কোটালকে দেখায়। সবাই
    হো হো করে হেসে ওঠে, নগর কোটালের গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে যায়।

    আহ্লাদী। মহারাজ, ও আগে ছিলো রামগরুড়ের ছানা, হাসির কথা শুনলেই বলতো “হাসব না-না, না-না!”। নাম ভাঁড়িয়ে নগর কোটাল হয়েছে। আপনারা কেউ কখনও ওকে হাসতে দেখেছেন?

    সমবেত। না না।

    আহ্লাদী। মহারাজ, এখন নগর কোটাল, তার আগে রামগরুড়ের ছানা, তারও আগে ̶ মহারাজ ̶ ও ছিলো হুঁকোমুখো হ্যাংলা। ওর মুখে কেউ হাসি দেখেছে?

    রাজা। সে না হয় হলোই। কিন্তু ও না হাসলেই বা কী!

    আহ্লাদী। মহারাজ, আপনার নগর কোটাল তিন জন্মে হাসেনি! ভাবতে পারেন! ও হাসলেই দেখবেন দেশে কোন সমস্যাই নেই!

    রাজা। কিন্তু ওকে হাসাবে কে?

    আহ্লাদী। আছে মহারাজ, আছে আছে। বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি। যদি অনুমতি দেন...

    রাজা। ঠিক আছে, ডাকো। (আহ্লাদী ডিগবাজি দিয়ে বেরিয়ে যায়, একটু পর একটা লোককে সঙ্গে নিয়ে ঢোকে, লোকটির ঘাড়ের সাথে একটা যন্ত্রের মতো কিছু লাগানো)

    লোকটি। জয় হোক মহারাজ।

    রাজা। তুমি কে? কী নাম?

    লোকটি। মহারাজ, আমি যন্ত্রবিদ, আমার ভাইপোর নাম চণ্ডীদাস।

    রাজা। ভাইপোর নাম কে জিজ্ঞেস করেছে? তোমার নাম বল।

    লোকটি। নাম নেই মহারাজ, ভাইপোর নামেই আমার পরিচয়। আর পরিচয় আমার উদ্ভাবনী ক্ষমতায়। আমাকে কী নামে ডাকবেন? চণ্ডীদাসের খুড়ো বলুন না, তাতেই চলবে।

    রাজা। উদ্ভাবনী ক্ষমতা! তুমিও কি আর একজন বিজ্ঞানী নাকি?

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। না মহারাজ, বিজ্ঞানী নই। আমি শুধু উদ্ভাবক।

    রাজা। উদ্ভাবক? কী তোমার উদ্ভাবন?

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। (ঘাড়ে লাগানো যন্ত্রটিকে দেখিয়ে) এই যন্ত্র।

    রাজা। এ যন্ত্র কী করতে পারে?

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। বলছি মহারাজ। তার আগে বলুন রাজকর্মচারিদের মধ্যে প্রধানতম কে।

    রাজা। প্রধানতম! কঠিন প্রশ্ন! (একটু ভেবে) মন্ত্রী, মন্ত্রীই হবে নিশ্চয়।

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। মন্ত্রীমশায়, আপনার প্রিয়তম খাদ্য কী?

    মন্ত্রী। হজমিগুলি। গড়ে রোজ একাত্তর বার চোঁয়া ঢেঁকুর তুলি বাবা!

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। মহারাজ, মন্ত্রীমশায়ের পর দ্বিতীয় প্রধানতম কে? কোটাল সাহেব?

    রাজা। হুঁ, তা বলতে পারো।

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। কোটাল সাহেব! আপনার প্রিয় খাদ্য কী?

    কোটাল। কাটলেট।

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। কী কাটলেট?

    কোটাল। চিংড়ির। তাছাড়াও লুচি, না না ̶ রাধাবল্লভী! এ ছাড়া, মটন কষা, রাজভোগ, বোঁদে, পান্তুয়া আর আইসক্রিম।


    চণ্ডীদাসের খুড়ো তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে উক্ত খাদ্যগুলো একটা একটা করে বের করে, এবং একটা ঠোঙায় রাখে।

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। চিংড়ির কাটলেট, হুঁ রাধা ̶ বল্লভী। তারপর মটন কষা, রাজভোগ, বোঁদে, পান্তুয়া। অ্যাণ্ড আইসক্রিম।
    (লোভে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে কোটালের, মুখগহ্বর থেকে জিভও বেরোয় মাঝে মাঝে) চাই?

    কোটাল। (আনন্দে হাসি সামলিয়ে সে প্রায় কথা বলতে পারে না) হ্যাঁ হ্যাঁ ̶ হ্যাঁ হ্যাঁ!

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। (কথা না বলে নিজের ঘাড়ের যন্ত্রটা কোটালের ঘাড়ে লাগাতে থাকে) দেখি কোটাল বাবু, বেশ! (খাবারের ঠোঙাটায় একটা সুতো বেঁধে পেণ্ডুলামের মতো দোলাতে দোলাতে নিয়ে আসে, কোটালের মুখে হাসি চোখে লোভ) না না এখন নয়, এখন নয়, একটু সময় লাগবে সাহেব (যন্ত্রটার সামনের ডাণ্ডাটার সাথে সুতোটা বেঁধে দেয়, খাবারটা দুলতে থাকে) বাঃ ফার্স্ট ক্লাস! (হঠাৎ মোহনের দিকে চোখ পড়ে যায়) এই যে বাবা, কী নাম তোমার?

    মোহন। আমার নাম মোহন।

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। মোহন? বাঃ, বেড়ে নাম। তুমি মোহনভোগ ভালোবাসো?

    মোহন। (এক গাল হেসে) খুব।

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। বাসো? বাঃ বাঃ, ওটাও আছে আমার সাথে। (এক ঠোঙা মোহনভোগ বের করে) কী কোটাল সাহেব, চলবে নাকি?

    কোটাল। হেঁ হেঁ, হেঁ হেঁ!

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। (হঠাৎ সবাইকে সচকিত করে) অ্যাটেন্‌শন! (কোটাল অ্যাটেন্‌শনের ভঙ্গীতে দাঁড়ায়, খুড়ো খানিকটা দড়ি বের করে মোহনের উদ্দেশে বলে) এদিকে এসো তো মোহন, কোটাল সাহেবের হাতটা আমরা সোজা বেঁধে দিই। (অ্যাটেন্‌শনের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকা কোটালের হাত তার শরীরের সাথে বেঁধে দেওয়া হয়), আচ্ছা কোটাল সাহেব, এখান থেকে রাজবাড়ি কত দূর?

    কোটাল। দেড় মাইল।

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। যাতায়াতে কতক্ষণ লাগবে?

    কোটাল। ঘন্টাখানেক।

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। হুঁ! (সামনের ডাণ্ডায় ঝুলন্ত খাবারদাবার পেণ্ডুলামের মতো দুলিয়ে দেয়) মহারাজ, কোটাল সাহেবকে একটু যদি হুকুম করেন রাজবাড়ি থেকে ঘুরে আসতে...

    রাজা। কেন গো? রাজবাড়ি থেকে কেন?

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। ভেতরে ঢুকতে হবে না, উনি শুধু যাবেন আর সাথে সাথেই ফিরে আসবেন।

    রাজা। বলছো যখন, যাক। তোমার কাণ্ড-কারখানা কিছু বুঝি না বাপু। (কোটাল দৌড়োতে দৌড়োতে বেরিয়ে যায়)

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। কাণ্ড-কারখানা, রাজামশায়? এই কল ̶ (খুড়ো গান ধরে, ভীষ্মলোচন শর্মা এবং আরও দুয়েকজন যোগ দেয়)


    বলব কি আর কলের ফিকির বলতে না পাই ভাষা,
    ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা,
    সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যেরকম রুচি ̶
    মণ্ডা মিঠাই চপ কাটলেট খাজা কিংবা লুচি।
    মন বলে তায় 'খাব খাব', মুখ চলে তায় খেতে,
    মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে।
    এমনি করে লোভের টানে খাবার পানে চেয়ে,
    উৎসাহেতে হুঁস রবে না চলবে কেবল ধেয়ে।
    হেসে খেলে দু-দশ যোজন চলবে বিনা ক্লেশে,
    খাবার গন্ধে পাগল হয়ে জিভের জলে ভেসে। (খুড়ো থামে, বাকিরা সমস্বরে)

    বাকিরা।


    সবাই বলে সমস্বরে ছেলে জোয়ান বুড়ো,
    অতুল কীর্তি রাখলো ভবে চণ্ডীদাসের খুড়ো! (হাঁপাতে হাঁপাতে কোটালের পুনঃপ্রবেশ)

    রাজা। এসো এসো কোটাল, তুমি তো রেকর্ড করে ফেললে হে, ওহে খুড়ো, খাবারগুলো এবার কোটালকে খেতে দাও, ও তো পাঁচ মিনিটে এক ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে এল!

    চণ্ডীদাসের খুড়ো। নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই মহারাজ। (সামনের ডাণ্ডা থেকে খাবার খোলা হয়, কোটালের বাঁধা হাত খুলে দেওয়া হয়, কোটাল গোগ্রাসে খাবারগুলো খেতে থাকে)

    রাজা। শোন সবাই, আমার মনে হয় তোমরা সবাই খুশি হবে এমন একটা উপায় আমরা পেয়ে গেছি। আমাদের খুড়োমশাই ̶ শুধু চণ্ডীদাসের নয়, এখন আমাদের রাজ্যের খুড়োমশাই ̶ ভালো রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের। মন্ত্রী, তুমি বাণিজ্য মন্ত্রীকে বলে দিও, হাজার হাজার খুড়োর কল তৈরি হোক এ রাজ্যে। যে আমড়াতলায় আমরা বসে আছি, সেটাই এখন থেকে নাগরিকদের প্রধান রাস্তা হোক, একটা করে কল লাগিয়ে নিলে মোটরগাড়ির চেয়েও দ্রুতগতিতে আমাদের নাগরিকরা চলাফেরা করতে পারবে। একটাই সোজা রাস্তা, ডাইনে-বাঁয়ে তাকাবার দরকারই নেই। পুরোনো যে তিন-মুখো-তিন রাস্তার আমড়াতলা, সেটা এখন থেকে শহরের বাইরের বাইপাস, সেখান দিয়ে শুধু চলবে ধীরগতির গাড়ি, মানে ঠেলাগাড়ি, গোরুর গাড়ি, মোটরগাড়ি ইত্যাদি। আর দুপাশে তৈরি হবে একের পর এক বহুতল অট্টালিকা। বিজ্ঞান শিক্ষক চেয়েছিলেন এ-রাজ্য হোক দূষণমুক্ত, তো বায়ুদূষণও আমরা এখন অনেক কমিয়ে ফেলতে পারব। আর সবার চাইতে আনন্দের কথা আমাদের নগর কোটালকে এখন থেকে হাসি মুখেই দেখা যাবে। তোমাদের কী মনে হয়, এই সমাধান কি ভালো হলো?

    সমস্বরে সবাই। (গান)


    ভালো ভালো খুবই ভালো
    আমড়াতলা দুটোই ভালো
    এই দুনিয়ার সকল ভালো
    আসল ভালো নকল ভালো
    সস্তা ভালো দামীও ভালো
    তুমিও ভালো আমিও ভালো
    ময়লা ভালো ফর্সা ভালো
    পোলাও ভালো কোর্মা ভালো
    মাছপটোলের দোর্মা ভালো
    সোজাও ভালো বাঁকাও ভালো
    ঠেলা গাড়ি ঠেলতে ভালো
    খাস্তা লুচি বেলতে ভালো
    কিন্তু সবার চাইতে ভালো...

    যে লোকটি রাজার আমসত্ত্ব ভাজা নিয়ে এসেছিলো, সে হাত তুলে সবাইকে থামায়। আমরা তার নাম দিলাম আমসত্ত্ব।

    আমসত্ত্ব। আমসত্ত্ব ভাজা। (রাজা এগিয়ে আসেন)

    রাজা। চোপ! কিন্তু সবার চাইতে ভালো...


    সকলেই চুপ। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা। এমন সময় ̶

    রাজা। পাঁউরুটি আর...

    সমস্বরে। ঝোলা গুড়।


    সমবেত হাততালির মধ্যে পর্দা নেমে আসে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    মেনকার মেয়ের মাগ্গদশ্শক  | যদি এই জীবনের বন্দরে নানাদেশী তরী এসে নোঙর করে | ঘোড়ামারা দ্বীপ | দ্বিষো জহি | কবি যখন পাহাড় হয়ে যায় | ট্রফি | ফকিরি | বাংলা ভাষার গঠন নিয়ে চর্চা ও কিছু প্রস্তাব | কাঠের মানুষ | তাজ ও মাহোল | কবিতাগুচ্ছ | কোন নাম নেই | টিফিনবেলার গান | সান্দ্র ধাতবসঙ্গীত | মশা-ই | গুনাহ! গুনাহ! | রেনেসাঁস থেকে রসগোল্লা সবই কলোনিয়াল | সু-পাত্রের সন্ধান দেবে অঙ্ক | যদি বল প্রেম | যশপতির একদিন | চোদ্দপিদিম | গভীর জল | লেখা-সাক্ষাৎ | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং - পর্ব ১ | কন্যাকুমারী | সিন্ধুতট | ট্যাঙ্কশংকর, লোকটা ও এক সম্ভাব্য/অসমাপ্ত মহাজাগতিক কিস্যা-১ | ট্যাঙ্কশংকর, লোকটা ও এক সম্ভাব্য/অসমাপ্ত মহাজাগতিক কিস্যা-২ | আনন্দ মঠ – ইতিহাসের সন্তান, ইতিহাসের জননী | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং -- পর্ব ২ | অর্গ্যাজম | কবি-কাহিনি | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং -- পর্ব ৩ | কমরেড গঙ্গাপদ | বিপজ্জনক খেলা | বেলার বেতার | গভীর অসুখে নিমজ্জিত মণিপুর | আবোল তাবোল | শিউলিরা | বিসর্জন | এক রাজা, দুই কবিরাজ | হাওয়া হাওয়া | ভোলবদল | ধৃতরাষ্ট্র ও দশরথঃ মহাকাব্যের দুই পিতা ও তাদের রাজধর্ম | মারীকথা | দামামা | হাওয়া মোরগের জীবন | পলায়নবাদীর সঞ্জীবনী বটিকা | নিত্যগতি | তিনটি কবিতা | চিত্রকর | যাবার কথা
  • নাটক | ১২ নভেম্বর ২০২৩ | ৬০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৮526004
  • হা হা এটা খুব ভাল লাগল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন