এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  নাটক  পুজো স্পেশাল ২০১১

  • অরক্ষিতা

    মাহবুব লীলেন
    নাটক | ০২ অক্টোবর ২০১১ | ৯৭৫ বার পঠিত
  • [মহাভারতে শুক্রাচার্যের মন্ত্র-হারানো আখ্যানের ভিন্নপাঠ]

    চরিত্র

    জয়দীপ : তরুণ কাঠুরে
    বৃত্তানন্দ : শুক্রের শিষ্য
    বৃষপর্ব : বঙ্গদ্বীপের রাজা
    শুক্রাচার্য : বঙ্গদ্বীপের রাজপুরোহিত
    কচ : শুক্রশিষ্য
    অবনি : মৌয়াল ও মাদক প্রস্তুতকারী
    শর্মিষ্ঠা : রাজকন্যা
    দেবযানী : শুক্রকন্যা
    পরিমল : পাচক। বৃহস্পতির চর
    অন্যান্য : ঘোষক, রাজ পরিষদ, দ্বীপায়ন সৈনিক, শত্রু সৈনিক, শুক্রের শিষ্যদল এবং বঙ্গদ্বীপের তরুণ ও জনতা



    দৃশ্য ০১

    [উৎফুল্ল দ্বীপবাসী বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে সম্মিলিত কণ্ঠে "ধনধান্য পুষ্প ভরা' গানটি গাইতে থাকে। তাদের কার্যক্রমগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ দ্বীপের সহজ সরল জীবন প্রকাশিত হয় কৃষিকাজ, নৌকা চালানো, খেলাধুলা, গেরস্থালি, উৎসব...। গান আর কার্যক্রমের মধ্যে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে তাদের সমৃদ্ধি আর সুখ-শান্তিতে বসবাসের চিহ্ন। গান গাইতে গাইতে সবাই বের হয়ে গেলে দেখা যায় এক জয়দীপ তার কয়েকটা অস্ত্রের মধ্যে একটা শান দিতে দিতে গানের একটা কলি গুনগুন করে গায়]

    জয় : আমার এই দেশেতে জন্ম যেন, এই দেশেতেই মরি...
    বৃত্ত : হা: হা: হা: অস্ত্র শান দিয়ে শান্তির গান! জগতে এর চেয়ে উদ্ভট দৃশ্য আর কী হতে পারে?

    [জয়দীপ কুড়াল বাগিয়ে বৃত্তকে তেড়ে যায়। কয়েকবার তাকে আক্রমণ করে। বৃত্ত কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে জোড় হাত করে]

    বৃত্ত : আমি একটু মাজা করছিলাম শুধু
    জয় : অস্ত্র হাতে শান্তির গান উদ্ভট?
    বৃত্ত : না না। আমি ওভাবে বলিনি। আমি...

    [বৃত্ত হঠাৎ একটা অস্ত্র কুড়িয়ে পাল্টা আক্রমণে জয়দীপকে থামিয়ে দেয়]

    বৃত্ত : পাগলামি করা ঠিক না জয়দীপ। তোমার মতো অস্ত্রবাজদের সাথে স্বাভাবিক একটা কথা বলাই মুশকিল
    জয় : অস্ত্র নামিয়ে রেখে কথাটা আরেকবার বলো তো দেখি?
    বৃত্ত : মাথা খারাপ। অস্ত্র ছাড়লে তুমি আমাকে মেরেও ফেলতে পারো
    জয় : তার মানে তোমার মতো শান্তিকামীরও হাতিয়ার লাগে?
    বৃত্ত : আত্মরক্ষার জন্য। তোমার মতো...

    [ঢোলের শব্দ শোনা যায়। দুজন শোনার চেষ্টা করে। একজন ঘোষক ঢোল বাজাতে বাজাতে প্রবেশ করে]

    ঘোষক : বঙ্গদ্বীপের বিচক্ষণ রাজা বৃষপর্বর আহ্বান আমাদের মাতৃভূমি আবার বহি:শত্রুর আক্রমণের সম্মুখীন। তাই শত্রু মোকাবেলার জন্য রাজা বৃষপর্ব দ্বীপ দেশের সকল তরুণ ও যুবককে প্রস্তুত হবার আহ্বান জানাচ্ছেন...। এসো হে দ্বীপায়ন যুবক ও তরুণ। এসো স্বদেশের ডাকে স্বদেশের নামে

    [ঘোষক চলে যায়। জয়দীপ বৃত্তের কাছ থেকে অস্ত্রটা নিয়ে নেয়]

    জয় : অস্ত্রটা আমার কাজে লাগবে বৃত্ত। তুমি বরং মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করো
    বৃত্ত : দেশই যদি আক্রান্ত হয় তবে মন্দির যে সুরক্ষিত থাকবে তার কি নিশ্চয়তা?

    [বৃত্ত মাটি থেকে জয়দীপের আরেকটা অস্ত্র কুড়িয়ে নেয়]

    বৃত্ত : চলো। আমিও তোমার সাথে যাব...

    দৃশ্য ০২

    [রাজা বৃষপর্বর নেতৃত্বে দ্বীপবাসীদের যুদ্ধের প্রস্তুতি। অস্ত্র হাতে সারি সারি দ্বীপায়ন সৈনিক ও তরুণদের ভেতর বৃত্ত আর জয়দীপও আছে]

    রাজা : যোদ্ধাগণ। প্রস্তুত?
    গণ : প্রস্তুত রাজা প্রস্তুত স্বদেশের জন্য শেষ রক্তবিন্দু উৎসর্গের প্রতিজ্ঞায়
    রাজা : শুধু উৎসর্গ নয় স্বদেশ চায় উৎসর্গের ফলাফল। যদি স্বদেশভূমি রক্ষা না করা যায় তবে তোমাদের রক্ত মন্দিরে বলি হওয়া পশুর রক্তের চেয়ে অধিক কোনো মূল্য বহন করবে না। তাই শুধু রক্ত বিসর্জন নয় প্রতিজ্ঞা করো শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শেষ প্রতিরোধ গড়ে তোলার
    গণ : আমরা প্রতিজ্ঞা করছি রাজা যতক্ষণ আমাদের শরীরে এক ফোঁটা রক্তবিন্দু বহমান থাকবে ততক্ষণ সক্রিয় থাকবে আমাদের অস্ত্র। শেষ নিশ্বাসের আগে শেষ আক্রমণ দিয়ে আমরা রক্ষা করব দেশের স্বাধীনতা

    [যুদ্ধের নাকাড়া বেজে উঠে। রাজা নিশানা উড়ান। রাজার সাথে অস্ত্র উঁচিয়ে যোদ্ধারা বের হয়ে যায়]



    দৃশ্য ০৩

    [শুক্রাচার্যের আশ্রম]

    শুক্র : যুদ্ধশান্তি-শান্তিযুদ্ধ। শান্তিযুদ্ধ-যুদ্ধশান্তি। শান্তি শান্তি শান্তি- যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ। যুদ্ধ যুদ্ধ - শান্তি শান্তি শান্তি। আহ... বড়োই মুশকিলের শব্দবন্ধ। কোনটা যে কোনটার আগে আর কোনটা যে কোনটার পরে কে বলতে পারে? কিন্তু আগে আর পরে কিংবা পরে আর আগে যেখানেই হোক শব্দ দুইটা ঠিক পাশাপাশি চলে। শান্তি মানে একখণ্ড নিজস্ব আকাশের নিচে নিজস্ব একটু মাটি। আর যুদ্ধ মানে অন্যের শান্তি ছিনিয়ে নিজের শান্তির সীমানা বিস্তার কিংবা অন্যের শান্তি হরণ করতে গিয়ে নিজের শান্তি হারানো কিংবা শান্তির নামে শান্তি বিসর্জন অথবা... যুদ্ধ মানে যুদ্ধ...যার বিরোধিতাও করা লাগে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে...বঙ্গদ্বীপ আজ আবার যুদ্ধ কবলিত। চিরশত্রু আর্যস্থলির অকস্মাৎ আক্রমণে বিপর্যস্ত দ্বীপদেশের উত্তর সীমান্ত। জয় আদি অধীশ্বর শিব শুক্রাচার্যের মনশ্চক্ষে তুমি দৃশ্যমান করো উত্তরের যুদ্ধক্ষেত্র ঠিক যেমনটি এই মুহূর্তে ঘটে চলেছে প্রতিটি সৈনিকের হাতের অস্ত্রে কিংবা রক্তের কণায়...

    [শুক্রাচার্যের মনশ্চক্ষে আস্তে আস্তে ভেসে উঠে উত্তরের যুদ্ধক্ষেত্র। প্রথমে ঝাপসা এবং শব্দহীন তারপর ধীরে ধীরে সশব্দ আর সুস্পষ্ট]

    শুক্র : আহা প্রিয় শিষ্য বৃত্তানন্দ তুমি নিহত? বাহ। এইতো। ভেড়ার পালের মতো কুঠার হাতে শত্রু সেনাদের তাড়িয়ে নিচ্ছে কাঠুরে যুবক জয়দীপ কিন্তু আহ। তোমাকেও ঝরে পড়তে হলো জয়দীপ? একী! অবনি স্বর্গ-মর্তের শ্রেষ্ঠতম মাদক প্রস্তুতকারী অবনি জারক তুমিও শুনেছ যুদ্ধের ডাক? তোমাকে দেখে কে বলবে যে গাঁজন পাচনে যার হাতে ফুল-ফল-শস্য-মধু থেকে তৈরি হয় তরল মাদক তার হাতেই ঝলকানি দেয় কঠিন বর্শা?... যথেষ্ট হয়েছে। পরাক্রমশালী শত্রুর বিরুদ্ধে তোমাদের যা করার তার যথেষ্টই করেছ তোমরা। ...এবার তবে শুরু হোক ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্যের যুদ্ধ শেষ করার যুদ্ধ

    [বিষণ্ন মনে রাজা প্রবেশ করেন]

    শুক্র : বঙ্গদ্বীপের বিচক্ষণ রাজা বৃষপর্ব কখনও তো আপনাকে এতটা বিষণ্ন দেখিনি?
    রাজা : বিষণ্নতা হতাশারই এক ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া আচার্য আপনাকে প্রণাম
    শুক্র : প্রণাম রাজা বৃষপর্ব। উত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে অধিকাংশ বীর মৃত্যুবরণ করেছে আমিও জানি। কিন্তু বঙ্গদ্বীপের রাজপুরোহিত ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্য এখনও জীবিত। ... আপনি কি আমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যেতে পারেন?
    রাজা : আপনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাবেন!
    শুক্র : হ্যঁ¡। এখন যুদ্ধে আমার অংশগ্রহণের সময়। এখন শুরু হবে ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্যের যুদ্ধ শেষ করার যুদ্ধ। ... শিষ্যগণ উত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হও শুক্রাচার্যের যুদ্ধ-সমাপনী যুদ্ধের উপচারসহ

    দৃশ্য ০৪

    [যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছে সৈনিকদের লাশ। রাজা আর শিষ্যদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে শুক্রাচার্য হাঁটতে থাকেন মৃত সৈনিকদের ভেতর। নিহতদের মুখ আর আঘাতের ক্ষত দেখে তিনি আর্তনাদ করে উঠেন]

    রাজা : ক্ষমা করবেন আচার্য। আমার মনে হয় না বিলাপ করে সময় নষ্ট করা আমাদের উচিত
    শুক্র : যুদ্ধের ক্ষয় দেখে রাজা কি শুক্রাচার্যের কাণ্ডজ্ঞানেও আস্থা হারিয়েছেন আজ?
    রাজা : আস্থা হারাইনি আচার্য। কিন্তু ধর্মমতে মৃতদেহের সৎকার করা ছাড়া এখন আপনার আর কীই বা করার আছে?
    শুক্র : আছে রাজা বৃষপর্ব। এই জগতে একমাত্র শুক্রাচার্যেরই এদের জন্য এখনও করার মতো কিছু আছে কেননা এরা সবাই এখনও অস্ত্রধারণে সক্ষম
    রাজা : সকলেই মৃত আচার্য। আপনি তাকিয়ে দেখুন সকলেই যুদ্ধে নিহত এরা
    শুক্র : আপনার কাছে তারা মৃত কিন্তু আমার কাছে মৃতের মতো মাত্র
    রাজা : মৃতের মতো?
    শুক্র : শিষ্যগণ উপচার প্রস্তুত?
    শিষ্য : প্রস্তুত গুরুদেব

    [উপচার সাজানো হলে শুক্রাচার্য তার মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র প্রয়োগের কৃত্য শুরু করেন]

    শুক্র : শান্তিপ্রিয় বঙ্গদ্বীপকে তুমি আশীর্বাদ করো হে আদি অধীশ্বর শিব। তোমার সাধনায় যে মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র আমি অর্জন করেছি বঙ্গদ্বীপকে সুরক্ষিত করতে আজ তা প্রয়োগে আমাকে আশীর্বাদ করো.... শোনো হে সৈনিক বঙ্গদ্বীপের সকল তরুণ। জাগো। দেশ মাতৃকার সংকটে শিবের কৃপায় জেগে উঠো শুক্রের মন্ত্রের বলে। পরলোকযাত্রা স্থগিত করে ফিরে এসো নিজ নিজ দেহে। জেগে উঠো... জাগো... জাগো সকল দ্বীপবাসী তরুণ যোদ্ধা বীর। জাগো। জাগো নিজের স্মৃতি আর প্রতিশ্রঞ্ছতি নিয়ে। জাগো.... জাগো...

    [শুক্রাচার্য আচার করতে থাকেন। একে একে প্রাণ ফিরে পেয়ে জেগে উঠে সৈনিকরা]

    শুক্র : জয় আদি অধীশ্বর শিব। ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্যের মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্রের ক্ষমতায় সকল দ্বীপায়ন সৈনিক অমর এবং অক্ষয়... যাও। নির্ভয়ে এগিয়ে যাও। মৃত্যু যদি আসে বীরের মতো বরণ করে নাও। মনে রাখবে দেশের জন্য যে প্রাণ উৎসর্গিত হবে শুক্রাচার্য বারবার তা ফিরিয়ে দেবেন নিজ নিজ দেহে...

    [সৈনিক আবার অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে শত্রুদের তাড়িয়ে নিয়ে যায়। যুদ্ধজয় আস্তে আস্তে দ্বীপজনতার উৎসবে পরিণত হয়]

    দৃশ্য ০৫

    [অন্ধকার বনে পথ ঠাহর করে করে কচ হাঁটছে। দূরে মশালের আলো দেখে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। মশালধারী অবনি আর জয়দীপ। অবনির হাতে মধু কাটার সরঞ্জাম আর জয়দীপের হাতে কুড়াল। হাঁটতে হাঁটতে জয়দীপ থমকে গিয়ে খুঁজতে থাকে]

    জয় : কীসের যেন শব্দ পেলাম?
    অবনি : পাখপাখালি কিছু হবে মনে হয়
    অবনি : বেশি খোঁজাখুঁজির দরকার নেই শেষে আবার বাঘভালুক খুঁজে বের করে ফেললে উল্টা বিপদে পড়তে হবে
    জয় : দেখি মশালটা দাও তো

    [কচ দৌড়ে ঝোপ বদলাতে গিয়ে জয়দীপের হাতে ধরা পড়ে যায়]

    জয় : যা সন্দেহ করেছিলাম তাই। মানুষ
    অবনি : চোর না ডাকাত সেটা এখন বোঝা দরকার
    কচ : আমি চোর ডাকাত না। আমি একজন বিদেশি
    জয় : ধরা পড়লে চোরডাকাতরা এরকম সাধুবাক্য দিয়েই নিজের পরিচয় শুরু করে। সঙ্গে আর কয়জন আছে?
    কচ : আমার সাথে আর কেউ নেই। আমি একা
    অবনি : এটাও তো চোর ডাকাতের মুখস্থ বুলি
    জয় : আমাদের দেখে লুকাচ্ছিলে কেন?
    কচ : ভয়ে। ভেবেছিলাম আপনারা বোধহয় ডাকাত টাকাত হবেন
    অবনি : এইটাতো নতুন পদ্ধতি। চোরায় তোমাকে ডাকাত ঠাউরায়
    কচ : আমাকে দেখে যদি আপনারা চোর-ডাকাত ভাবতে পারেন তাহলে কুড়াল-মশাল হাতে আপনাদেরকে আমার ডাকাত ভাবতে অন্যায় কোথায়?
    জয় : কিন্তু এই অন্ধকার বনে তুমি কী করছিলে?
    কচ : পথ খুঁজছিলাম
    অবনি : পথ খুঁজছিলে বুঝলাম কিন্তু যাবেটা কোথায়?
    কচ : আপনারা কি এই দেশেরই লোক?
    অবনি : এই দেশের লোক মানে? আমি অবনি জারক। ফুল-ফল-শস্য-মধু জারিত করে মদ তৈরি করি বলে এই দেশের রাজপুরোহিত শুক্রাচার্যের কাছ থেকে আমি এই জারক উপাধিটা পেয়েছি। আর ইনি...
    কচ : আপনার মুখে আচার্যশ্রেষ্ঠ শুক্রের নাম শুনে অনুমান করছি যে আমি হয়তো বঙ্গদ্বীপের খুব কাছাকাছিই আছি
    জয় : তুমি শুক্রাচার্যের কথা জানো?
    কচ : জগতের সকল বিদ্যার্থীই তার কথা জানে। তার আশ্রমে শিষ্যত্ব লাভের উদ্দেশ্যেই আমার এদেশে আগমন
    জয় : তুমি আমাদের সাথে এসো। ...কিন্তু গুরু শুক্রাচার্যের আশ্রম তো এই বন থেকে বহু দূর
    কচ : রাস্তা দেখিয়ে দিলে আমি নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারব
    জয় : তা হয় না। রাস্তা খুবই ভয়ংকর। এসব পথে একা একা চলাচল করে না কেউ। আজকে রাতে বরং তুমি আমার ঘরে চলো
    অবনি : সেটাই ভালো। বাড়িতে থাকার জায়গা থাকলে তোমাকে আমার বাড়িতেই যেতে বলতাম। আজ অনেকটা মধু তুলেছি আমি বরং তোমার জন্য কিছু মধু দিয়ে দেবো। মধুপানে শ্রম এবং ক্লান্তি দুটোই খুব তাড়াতাড়ি দূর হয়
    কচ : আহার কিংবা বিশ্রামের চেয়ে এই বিপজ্জনক বনে আপনাদের সাক্ষাত পাওয়াটাই আমার কাছে মহা সৌভাগ্যের মনে হচ্ছে
    জয় : কতটা কপালজোরে তুমি আমাদের দেখা পেয়েছ পরে বুঝবে। আমাদের আগেই বাঘভালুকের সাথে দেখা হয়ে গেলে অতক্ষণে তোমার হাড়ভাঙার কাজ তারা শেষ করে ফেলত



    দৃশ্য ০৬

    [খোলা আঙিনায় শুক্রাচার্যের অধিবেশন]

    শুক্র : ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায় না তাকে নিজের কাছে ডেকে আনতে হয়। নিজের অন্তরে তার বসতি স্থাপন করে তাকে আহ্বান করতে হয়। তিনি ভিন্ন ভিন্ন পথে এসে সাধকের অন্তরে অধিষ্ঠান করেন। ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব নারায়ণ এইসব তাকে ডেকে আনার ভিন্ন ভিন্ন নাম। ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাক শুনে ভিন্ন ভিন্ন পথে ব্রহ্মা যখন সাধকের অন্তরে এসে অধিষ্ঠান করেন তখনই সে হয়ে উঠে ব্রাহ্মণ যিনি তার নৈমিত্তিক পূজায় পরিচর্যা করেন নিজের অন্তরে স্থাপিত ঈশ্বরের বসতি কেননা অপরিশুদ্ধ আত্মায় ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হন [শুক্র উপদেশ দিচ্ছেন। কচ বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দেয়। শর্মিষ্ঠা শুক্রের কুটিরে ঢুকতে গিয়ে কচকে দেখে]

    শর্মী : এটা রাজপ্রাসাদ নয় আচার্য ব্রাহ্মণের কুটির। চুরি ডাকাতির উদ্দেশ্য থাকলে এ নিতান্তই এক ভুল ঠিকানা
    কচ : অপরিচিত বিদেশি মাত্রই মনে হয় এখানে চোর ডাকাত বলে গণ্য হয়?
    শর্মী : সম্পদ আছে বলেই আমরা চোর ডাকাতের কথা ভাবি। আমাদের দেশে চোর ডাকাত নেই। ভিনদেশিরাই এখানে চুরিচামারি করতে আসে
    কচ : তা হয়তো ঠিক। রাজকোষের সংবাদ জানি না। কিন্তু শুক্রাচার্যের কল্যাণে এই কুটিরটি মহাসম্পদশীল জানি বলেই একজন বিদ্যার্থী হিসেবে আমার এখানে আসা। আচ্ছা আপনি কি দেবযানী?
    শর্মী : পরিচয় দিচ্ছেন বিদ্যার্থীর অথচ সন্ধান করছেন দেবযানীর... কেন বলেন তো?
    কচ : না... আচার্যকন্যা দেবযানী সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে আপনার সাথে অনেক কিছু মিলে যায়...
    শর্মী : সেজন্যই কি আচার্যকে লুকিয়ে আচার্যকন্যা দর্শনের চেষ্টা হচ্ছিল?
    কচ : না ঠিক তা নয়... তবে
    শর্মী : চলুন। আপনাকে আচার্যের কাছে যাই। ...তবে শুক্রাচার্যের শিষত্বের চেয়ে আচার্যকন্যা দর্শন মুখ্য হয়ে উঠলে কিন্তু ভবিষ্যতে বিপদেই পড়বেন
    শুক্র : আমি চাই তোমরা প্রত্যেকে মনস্থির করো কী অর্জন করতে চাও? আগামী কাল সূর্যে?দয়ে প্রত্যেকে ধ্যানমগ্ন হয়ে নিজের অন্তরে প্রবেশ করে অনুসন্ধান করবে অন্তর কী চায়? অন্তরের কতটুকু স্থান আছে পরিশুদ্ধ আর কাক্সিক্ষত প্রাপ্তির জন্য কতটা পরিশুদ্ধ করতে হবে অন্তরের ঘর... [কচকে নিয়ে শর্মী অধিবেশনে উপস্থিত হয়]

    শর্মী : প্রণাম আচার্য
    শুক্র : রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা! মঙ্গল হোক তোমার
    শর্মী : আমি দেবযানীর সাথে সাক্ষাতের জন্য এসেছিলাম। পথিমধ্যে আপনার এই সাক্ষাতপ্রার্থীর সাথে দেখা
    শুক্র : কল্যাণ হোক রাজকন্যার [শর্মী ভেতরে চলে যায়। কচ নত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে]

    শুক্র : বালক। তোমার বৃত্তান্ত আর উদ্দেশ্য কি শুনতে পারি?
    কচ : আমি আপনার একজন শিষ্যত্ব প্রার্থী গুরুদেব
    শুক্র : সাধু উদ্দেশ্য। তোমার পরিচয়?
    কচ : আমার নাম কচ
    শুক্র : বৎস। নিজ নামে সুখ্যাত হয়ে উঠার আগে নিজের পরিচয় দেবার কিছু নিয়ম কানুন আছে। পিতৃনাম- দেশ- কখনও কখনও বংশ পরিচয়ও মানুষের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অন্যকে ধারণা দেয়... তোমার পিতা?
    কচ : পিতা বৃহস্পতি
    শুক্র : বৃহস্পতি? কিছুটা কি বিস্তৃত করা সম্ভব তোমার পিতৃপরিচয়?
    কচ : তিনি একজন ব্রাহ্মণ আচার্য
    শুক্র : আচার্য বৃহস্পতি? কোন রাজ্যের আচার্য তোমার পিতা? ....আশা করি তিনি অঙ্গিরাপুত্র আচার্য বৃহস্পতি নন?
    কচ : ঋষি অঙ্গিরা আমার পিতামহ গুরুদেব। আর্যস্থলি আমার দেশ
    শুক্র : অসম্ভব। শত্রুদেশ আর্যস্থলির রাজপুরোহিত বৃহস্পতির সন্তান বঙ্গদ্বীপে আমার আশ্রমে? ... তুমি কি আমার মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যার কথা জানো?
    কচ : পিতার মুখে শুনেছি গুরুদেব। শিব সাধনায় এই মন্ত্র আপনি অর্জন করেছেন যা প্রয়োগ করে যে কোনো মৃত মানুষকে পুনর্জীবন দান করতে পারেন। এই জগতে এই বিদ্যা আর কোনো মানুষের আয়ত্বে নেই
    শুক্র : আমি শাস্ত্রের যে সকল ব্যাখ্যা জানি তার সবটাই তোমার পিতা আচার্য বৃহস্পতি জানেন। তিনি শুধু জানেন না মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র। আমার কি ভাবনার কারণ নেই যে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র হস্তগত করে বঙ্গদ্বীপকে দুর্বল করে তুলতেই তিনি তোমাকে পাঠিয়েছেন?
    কচ : আপনি দান না করলে যে মন্ত্র কারো পক্ষে আয়ত্ব করা সম্ভব নয় তা আমি হস্তগত করতে চাইলেই কি তা সম্ভব গুরুদেব?
    শুক্র : তা সম্ভব নয় কিন্তু ভবিষ্যৎ চতুরতায় কে কাকে ছাড়িয়ে যায় কে জানে? আমার ধারণা আমাদের অস্ত্র হরণ করে আমাদেরকেই আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তুমি তোমার পিতা কর্তৃক এখানে প্রেরিত হয়েছ।... আমি তোমাকে শিষ্যত্বদানে অপারগ বালক
    কচ : পিতৃপরিচয় আর রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য আমি কি অভিযুক্ত হতে পারি গুরুদেব?
    শুক্র : পারো। পরিচয় এমনই এক বিষয় যার মাত্র সামান্য অংশ মানুষ নিজে অর্জন করে আর বাকিটা আরোপিত হয় ঐতিহ্য এবং প্রতিবেশ থেকে। তোমার দেশের সাথে বঙ্গদ্বীপের ইতিহাস তোমাকে চিহ্নিত করছে শত্রুসন্তান হিসেবে। বৎস এ বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই এবং উচিতও নয়
    কচ : আমি শুধু আপনার শিষ্যত্ব অর্জনের জন্যই এতটা পথ এসেছি গুরুদেব
    শুক্র : আমার সিদ্ধান্ত আমি জানিয়ে দিয়েছি বৎস। বহু দূর দেশ থেকে তুমি এখানে এসেছে। তুমি আমার আশ্রমে কিছুদিন বিশ্রাম করো। তারপর কায়ক্লেশ দূর হলে অন্য কোনো গুরুর সন্ধানে বঙ্গদ্বীপ ত্যাগ করে যাও। এটাই সবার জন্য মঙ্গলজনক...

    দৃশ্য ০৭

    [গান গেয়ে নাচে দেবযানী। একদিকে পা বাড়া তো ফিরে দেখে পেছনে একটি ফুল। অন্যদিকে ঘুরে দেখে সেখানেও ভিন্ন রংয়ের আরেকটি ফুল। ক্রমশই দেবযানীর চারপাশ ভরে উঠে বিভিন্ন রংয়ের ফুলে। প্রতিটা ফুল একটা থেকে আরেকটা আলাদা। দেবযানী একটা ছেড়ে আরেকটা ধরে। সব শেষে একটি খোঁপায় পরার জন্য তোলে]

    কচ : মাটিতে ঝরে পড়া যে ফুল পূজার নৈবেদ্যেও পায় না ঠাঁই সে ফুল কি মানাবে দেবযানীর খোঁপায়? [কচ আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। তার হাতেও একটা ফুল]

    দেবযানী : কে তুমি?
    কচ : সাধারণ এক মালী। যে নিজের হস্তরেখার থেকে বেশি চেনে ফুলেদের বৈশিষ্ট্য আর আচার-আচরণ
    দেবযানী : কিন্তু তোমাকে কোথাও দেখেছি বলে তো মনে হয় না?
    কচ : নবাগত বিদেশিকে কোথাও দেখার তো কথা নয় দেবযানী
    দেবযানী : নবাগতের মুখে নিজের নাম শুনে বেশ অবাক লাগছে আমার
    কচ : শুধু নাম কেন? পরিচয়ও জানি। আর আমার পরিচয় প্রমাণ করবে এই মাঠে ছড়িয়ে থাকা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি ও রংয়ের উনচল্লিশটি ফুল
    দেবযানী : ফুলগুলোর সংখ্যাও তুমি জানো?
    কচ : জানি সুকন্যা। আর এও জানি যে ফুলটি তুমি হাতে ধরে আছ সারা মাঠে ঠিক ওরকম আর কোনো ফুল নেই
    দেবযানী : মাঠে এরকম আরো ফুল আছে কি না জানি না। কিন্তু এই ফুলটা ভালো লাগল বলেই তো খোঁপায় গেঁথে রাখতে চাইলাম
    কচ : কিন্তু এই ফুল যে দেবযানীর খোঁপার যোগ্য ফুল নয়
    দেবযানী : ফুলেরও যোগ্যতা অযোগ্যতা থাকে তা তো কোনোদিন শুনিনি কোথাও
    কচ : মন্ত্র পড়তে পড়তে ব্রাহ্মণেরা মুঠোভরে ফুল ছুঁড়ে দেন দেবতার নামে তাকিয়েও দেখেন না কোন ফুলের কী রং কিংবা পাপড়ির কারুকাজ কিংবা কোন ফুলের কতটা গভীরে পৌঁছেছে ভোরের শিশির। আর যে দেবতাগণের নামে উৎসর্গিত হয়ে লক্ষ লক্ষ ফুল প্রতিদিন পূজার ডালিতেই শুকিয়ে যায় কোনো দেবতাই ভ্রক্টক্ষেপ করেন না সেসব ফুলের দিকে। কেননা দেবতাগণ ফুল নয় ফুলের নৈবেদ্য গ্রহণ করেন শুধু। তাই একই বৃক্ষ থেকে সংগ্রহ করা পূজার ফুলে কোনো জাতবিচার নেই বৈশিষ্ট্য বিচার করা লাগে কেশবতীর খোঁপায় যে একটি মাত্র ফুল শোভা পায় তার বেলায়
    দেবযানী : অভিনব তোমার পুষ্প বিশ্লেষণ। কিন্তু এখনও আমি বুঝতে অপারগ একই রং একই রূপ একই গন্ধ থেকেও কী করে একই বৃক্ষের একটি ফুল অন্য সকল ফুলের থেকে অনন্য হয়ে উঠে?
    কচ : একমাত্র কুমারী ফুলকেই মানায় দেবযানীর খোঁপায়
    দেবযানী : কুমারী ফুল?
    কচ : ফুটে উঠার পর যে ফুলের একবিন্দু পরাগরেণুও খসে পড়েনি কিংবা বাতাসে ভেসে কোনো বহিরাগত পরাগ এসে স্পর্শ করেনি যে শাখার ফুল এবং এখনও যে ফুলে মালী ছাড়া কোনো ভ্রমর কিংবা মধুখোর পক্ষীর স্পর্শ লাগেনি সেই ফুলই তোমার খোঁপায় পরার উপযুক্ত কুমারী ফুল দেবযানী... [কচ দেবযানীর দিকে ফুলটি বাড়িয়ে ধরে]

    কচ : যেমন অক্ষত হয়ে ফুটেছে এই ফুল তেমনি এখনও অক্ষত আছে
    দেবযানী : সেই শৈশব থেকেই ফুলের সাথে আমার বসবাস। প্রতিদিন পিতার পূজার ফুল তুলি। যখন ইচ্ছা হয় ফুল খোঁপায় পরি আবার যখন ইচ্ছা হয় ফেলে দেই। আমাকে জিজ্ঞেস করলে স্মরণ করতে পারব না কোন ফুল কতটা অনন্য ছিল অন্যগুলো থেকে। কিন্তু তোমার হাতে ধরা যে ফুল মনে হয় যেন পরজন্মেও আমি তার রং-রূপ গন্ধের অনন্যতা স্মরণ করে তাকে আবার ঠিক চিনে নিতে পারি। কোনোদিন ভেবেও দেখিনি একই চেহারার হাজারও ফুলের মাঝেও মাত্র একটা ফুল কী করে অত অনন্য হয়ে উঠতে পারে... লোভ হয় পৃথিবীর সকল ফুল থেকে আলাদা করে এই ফুল খোঁপায় তুলে রাখি। আবার শঙ্কা হয় অচেনা মানুষের এই ফুলে লুকিয়ে আছে কি না কোনো জাদু...
    কচ : নির্দ্বিধা হও দেবযানী। নিজস্ব অনন্যতার বাইরে এই কুমারী ফুলে আরোপিত হয়নি কোনো মন্ত্র কিংবা কোনো মানবিক গুণ [দেবযানী ধীরে কচের হাত থেকে ফুলটা নিয়ে খোঁপায় পরে]



    দৃশ্য ০৮

    [শুক্রাচার্য চোখ বন্ধ করে পদ্মাসনে বসে ধ্যান করাচ্ছেন। বৃত্ত এবং অন্য শিষ্যরা চোখ বন্ধ করে বৃক্ষাসনে দণ্ডায়মান। কারো জোড় হাত বুকের কাছে আর কারো জোড় হাত মাথার উপরে]

    শুক্র : অন্তরের গভীরে অনুসন্ধান করো বুকের উপরে রাখা তোমাদের জোড়হস্ত কোন মানবকল্যাণকে ধারণ করে আছে? অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হও মস্তকোপরে স্থাপিত তোমাদের হস্ত ঈশ্বরের কোন মহাশক্তির প্রতি ইঙ্গিতময় যা তুমি আকাক্সক্ষা করো মানবকল্যাণের নিমিত্তে [দেবযানী ফুল নিয়ে ঢুকে সবাইকে এই অবস্থায় দেখে সবার উপর ফুল ছিটিয়ে দেয়। ধাক্কা লেগে কয়েকজন পড়ে যায়। শব্দ শুনে শুক্র চিৎকার দিয়ে উঠেন]

    শুক্র : অর্বাচীন
    দেবযানী : হি: হি: হি:
    শুক্র : কন্যা। ধ্যানে বিঘ্ন ঘটানো অনুচিত
    দেবযানী : বিঘ্ন ঘটালাম কোথায়? ওরা গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে বলে আমি গাছের ডালে ফুল পরিয়ে দিলাম। ফুল ছাড়া গাছ ভাল্লাগে বলো?
    শুক্র : কিন্তু এখন তো পূজার সময় নয়। এত ফুল তুমি তুলেছ কেন?
    দেবযানী : ফুল কি শুধু পূজার জন্যই তুলতে হয়? ... এই দেখো সবাইকে এখন একেকটা ফুল গাছ মনে হচ্ছে
    শুক্র : কারো সৌন্দর্য অলংকারে কারো সৌন্দর্য অন্তরে। আমার এই শিক্ষার্থী ব্রাহ্মণদেরও তাই অন্তর পরিশুদ্ধ করাই কর্তব্য অলংকার নয় দেবযানী
    দেবযানী : ফুল দিয়ে পূজা করা গেলে ফুল পরে ধ্যান করা যাবে না কেন? দেখোতো তোমাকেও ফুলে কী চমৎকার লাগছে [দেবযানী শুক্রকেও ফুল পরিয়ে দেয়]

    শুক্র : হা: হা: হা: আমাকে তবে যুক্তি পরিত্যাগ করতে হবে এখন। কন্যার আবেগের কাছে পিতার শাস্ত্রব্যাখ্যা সম্পূর্ণ অচল। পুষ্পালংকার চর্চাই হোক তবে আজ... [দেবযানী বাকি সবাইকেও ফুল পরায়। শুক্র নিজেও দুয়েকটা ফুল পরেন]

    দেবযানী : পিতা। একটা অনুরোধ আছে। রাখবে?
    শুক্র : শুক্রাচার্য তার একমাত্র কন্যার আব্দার রক্ষা করেননি এমন ঘটনা কি ঘটেছে কোনোদিন?
    দেবযানী : আমাকে কথা দিতে হবে
    শুক্র : নিশ্চিত আমার প্রতিশ্রঞ্ছতি পেয়েছ তুমি। কেননা কন্যাকে না দেয়ার মতো শুক্রাচার্যের কিছু নেই

    দৃশ্য ০৯

    [মাথা নিচের দিকে দিয়ে দুই হাতের তালুর উপর শীরের ভর দিয়ে পা উপরে তুলে জ্ঞঅধোমুখ বৃক্ষাসনঞ্চ করছে কচ]

    শুক্র : বিস্ময় মানি! বিস্ময়। বিস্ময়। কতটুকু চতুর হলে তোমার মতো বালকের পক্ষে মাত্র এক দিনেই আবিষ্কার করা সম্ভব যে কন্যা দেবযানীর কোনো অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করব না আমি?
    কচ : মার্জনা করবেন গুরুদেব। বিদ্যাশিক্ষা ব্যতিরেকে আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই
    শুক্র : বিস্ময়। আমি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছি অথচ তুমি আমাকে বাধ্য করলে তোমাকে গ্রহণ করতে? দেবযানীকে সুপারিশ ধরলে তুমি?
    কচ : শুধুই আপনার শিষ্যত্বের জন্য এত দূর থেকে আমার বঙ্গদ্বীপে আগমন গুরুদেব
    শুক্র : কন্যা দেবযানীর কাছে দেয়া প্রতিশ্রঞ্ছতিমতো তুমি এখন শুক্রের শিষ্য। কিন্তু কূট কৌশলের আশ্রয় নেয়ার জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত তুমি এইভাবে অধোমুখ বৃক্ষাসনে দাঁড়িয়ে থাকবে
    কচ : যথাজ্ঞা গুরুদেব
    দেবযানী : কচ... [দেবযানী প্রবেশ করে কচকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়]

    দেবযানী : পিতা ওকে শাস্তি দিচ্ছ কেন? ...ওর কষ্ট হচ্ছে। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে চোখে রক্ত আসবে
    শুক্র : শাস্তি নয় কন্যা। এটা আশ্রমবাসের এক ধরনের আচার
    দেবযানী : আমি বিশ্বাস করি না। আমি দেখেছি কাউকে শাস্তি দিতে হলে তুমি এইভাবে উল্টো করে হাতের উপর দাঁড় করিয়ে রাখো। ও কী দোষ করেছে?
    শুক্র : ওর শুদ্ধি প্রয়োজন কন্যা। বিদ্যার্থীর চাতুরী মানায় না [দেবযানী ধাক্কা দিয়ে কচকে নামিয়ে দেয়। কচ আবার বৃক্ষাসনে ফিরে যায়]

    দেবযানী : এই তুমি যাও তো
    শুক্র : এটা ওর আশ্রমবাসের অংশ দেবযানী
    দেবযানী : না এটা শাস্তি আমি জানি। ... একী! তোমাকে না আমি নামিয়ে দিলাম?
    কচ : আমি এখন আচার্যের শিষ্য দেবযানী। আচার্যের নির্দেশ আমার অবশ্য পালনীয়
    শুক্র : এই শাস্তি ওকে চতুরতার অপরাধ থেকে পরিশুদ্ধ করবে কন্যা
    দেবযানী : কিসের চাতুরী? শাস্তি দিলে আমাকে দাও। আমার অনুরোধে ও শিষ্যত্ব পেয়েছে। দোষ তাহলে আমার
    শুক্র : না না না। তোমার দোষ হতে যাবে কেন?
    দেবযানী : আমারই দোষ। আমিই তো তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম... ঠিক আছে। আমিও এই শাস্তি ভোগ করব [দেবযানী কচকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজে পা উল্টো করে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। শুক্র দৌড়ে এসে তাকে তোলেন]

    শুক্র : আহা কন্যা। এমন করে না। কষ্ট পাবে
    দেবযানী : হোক কষ্ট। আমার জন্য যদি তুমি ওকে শাস্তি দাও তবে আমিও ওর মতো পা উপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকব
    শুক্র : এমন করে না কন্যা
    দেবযানী : তাহলে কচকেও করতে নিষেধ করো?
    শুক্র : যাও বৎস। দেবযানীর জন্য তুমি শুক্রাচার্যের ক্ষমা পেয়েছ [দেবযানী আর কচ বের হয়ে যায়। শুক্র বের হতে গেলে দেখেন বৃত্ত দাঁড়িয়ে]

    শুক্র : কোনো জিজ্ঞাসা?
    বৃত্ত : গুরুদেব... আর্যস্থলির রাজপুরোহিত বৃহস্পতি-সন্তানের এই শিষ্যত্ব গ্রহণ আমার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হচ্ছে
    শুক্র : বিভ্রান্তিকর হলেও সত্য যে আমি তাকে শিষ্যত্ব দান করেছি
    বৃত্ত : গুরুদেব। এমন কি আশঙ্কা হতে পারে না যে আচার্য বৃহস্পতি তাকে পাঠিয়েছেন মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র হরণ করার জন্য
    শুক্র : গুরুর সিদ্ধান্তকেও তুমি রাজনীতি দিয়ে বিশ্লেষণ করো? বৃক্ষাসন...
    বৃত্ত : গুরুদেব?
    শুক্র : আমার সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করার শাস্তি। বৃক্ষাসন
    বৃত্ত : যথাজ্ঞা গুরুদেব [বৃত্ত সাধারণ বৃক্ষাসনে দাঁড়ায়]

    শুক্র : অধোমুখ বৃক্ষাসন! [বৃত্ত এবার মাথা নিচে দিয়ে হাতের উপর ভর তুলে অধোমুখ বৃক্ষাসনে দাঁড়ায়]

    শুক্র : যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তুমি রাজনীতির পাঠ ভালোই রপ্ত করেছ যার ফলাফল গুরুর প্রতি তোমার এই আস্থাহীনতা। জেনে রেখো বৃত্তানন্দ শিব সাধনায় অর্জিত আমার এই মন্ত্র মৃত্যুর পর আমার আত্মার সাথেই স্বর্গে ফিরে যাবে তবু কারোপক্ষে তা হস্তগত করা অসম্ভব

    দৃশ্য ১০

    [কামধেনু-মালতী- মাধবী- জটায়ু- মীনাক্ষী... এরকম একেকটা নাম ধরে কচ ডাক দেয় আর বনের ভেতর থেকে একেকটা গরু হাম্বাস্বরে সাড়া দিয়ে তার চারপাশে এসে জড়ো হয়। তারপর কচ গরুগুলো নিয়ে বাড়ির পথ ধরতেই দেবযানীর নূপুরের শব্দ শোনা যায়]

    কচ : আচার্য কন্যা দেবযানী? এই সন্ধ্যাকালে বনের গভীরে?
    দেবযানী : বনে আসলে কারণ দর্শাতে হয় তা তো জানতাম না?
    কচ : কারণ দর্শানোর প্রয়োজন নেই গবাদিগুলো নিয়ে আমাকে আশ্রমে ফিরতে হবে। আমি কি জানতে পারি আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারি কি না? [গরুগুলো আস্তে আস্তে বের হয়ে যায়]

    দেবযানী : শুক্রের আশ্রমে জন্ম নেয়া গরুগুলোকে আশ্রমের পথ চেনাতে নিশ্চয়ই নবাগত কচের কোনো প্রয়োজন নেই?
    কচ : আমারও আশ্রমে ফেরা প্রয়োজন। সান্ধ্য-উপদেশের অধিবেশন সবার জন্য বাধ্যতামূলক
    দেবযানী : আমার জন্য নয়। তোমার প্রয়োজন থাকলে তুমি যাও
    কচ : কিন্তু তোমাকে এখানে একা ফেলে যাওয়াটা...
    দেবযানী : শুক্রাচার্য যে নবাগত শিষ্যের উপর কন্যার দায়িত্বও অর্পণ করেছেন তা তো জানতাম না
    কচ : আচার্যের সকল শিষ্যের মতো আমারও দায়িত্ব অধ্যয়ন এবং পশুচারণ। এর বাইরে কোনো অতিরিক্ত দায়িত্ব তিনি আমাকে অর্পণ করেননি
    দেবযানী : তার নমুনা দেখতেই পাচ্ছি। গরুগুলোকে একা ছেড়ে দিয়ে- বাধ্যতামূলক সান্ধ্য উপদেশে অনুপস্থিত থেকে দেবযানীর সাথে বনবিহারে অধ্যয়নের দায়িত্ব পালন করছেন শুক্রের নবাগত শিষ্য
    কচ : আশা করি বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে আচার্য আমাকে ক্ষমা করবেন
    দেবযানী : কন্যার দোহাই দিয়ে গুরুর কাছে সুবিধা নিতে চাচ্ছ মনে হয়?
    কচ : কিন্তু আমি কি জানতে পারি যে আশ্রমে আমার সকল কর্তব্য জেনেও কেন তুমি আমাকে এখানে আটকে রাখছ?
    দেবযানী : আমি কি শুক্রাচার্যের শিষ্য যে আশ্রমের কর্তব্য নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে?
    কচ : ঠিক আছে। কিছু ভাবতে হবে না তোমাকে। এখন কি জানতে পারি যে তোমার জন্য আমি কী করতে পারি?
    দেবযানী : যদি না বলি?
    কচ : না বললে আমিও এখানে বসে থাকব
    দেবযানী : আশ্রমবাসে অনিয়মের জন্য শুক্রাচার্যের শাস্তি কিন্তু ভয়ানক
    কচ : হোক। শাস্তি যা হবার অতক্ষণে তা প্রাপ্য হয়ে গেছে
    দেবযানী : কচ। এই সরোবরে আজকের পূর্ণিমায় ফোটা প্রথম পদ্মফুলটি আমাকে দেবে? ওই দেখো সরোবরের ঠিক মাঝখানে একটু একটু করে কুঁড়ি মেলছে যে রক্তপদ্মের পাপড়ি হয়তো ওটিই হবে এই রাতের প্রথম পদ্ম। কোনো ভ্রমর কিংবা দেবতার চোখে পড়ার আগে সরোবরের প্রথম পদ্মটি আমি চাই কচ
    কচ : এ বিশাল সরোবরে সহস্র পদ্মের কুঁড়িতে রাতের ডাক পৌঁছানোর মুহূর্তে তারা ফুটে উঠবে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে। আমার কী সাধ্য যে তার থেকে একটি মাত্র ফুলকে আলাদা করি সব ফুল থেকে অগ্রগামী বলে? [কচ সরোবরে নেমে সাঁতরাতে থাকে। পাড়ে ধীরে ধীরে নাচে দেবযানী]

    কচ : আমার সহায় হও সরোবরের জল সহায় হও রক্তপদ্মের অজস্র না ফোঁটা কলি। শৃঙ্খলিত হও তোমরা সুকন্যা দেবযানীর প্রত্যাশায়... ফুটে ওঠো পদ্মের কুড়ি। আমি আহ্বান করছি তোমাদের মধ্যে আজ যে ধন্য হতে চাও সে অগ্রগামী হও অন্যদের থেকে। ফুটে ওঠো [দেবযানী সরোবরের পাড়ে দাঁড়িয়ে নাচে। কচ সাঁতরায় জলে। অনেকগুলো ফুল একসাথে ফুটতে থাকে। কচ একটা ফুল থেকে আরেকটা ফুলের দিকে এগোয় কিন্তু সে সামনে যেতেই ফুলটি ফুটতে ফুটতে থেমে যায়। কচ অন্যদিকে তাকিয়ে দেখে অন্য আরেকটি ফুল ফুটছে। কচ সেদিকে সাঁতরে গেলে আবারও একই ঘটনা ঘটে। কচ সবগুলো ফুলের মাঝখানে সাঁতার কাটতে থাকে হতভম্বের মতো। সবগুলো কুড়ি একবার একসাথে কিছুদূর ফুটে আবার থেমে যায়। কচ সতর্কভাবে নজর রাখে সবগুলো ফুলের দিকে। কোন ফুলটি সবার আগে ফুটবে কোনোভাবেই নিশ্চিত হতে পারে না]

    কচ : যদি সহস্র ফুল একইসাথে ফোটে তবে নিশ্চিত জেনো আমি সবগুলো ফুলই তোমার জন্য তুলে আনব দেবযানী
    দেবযানী : আমি পূজারি নই কচ দেবতাও নই। সহস্র ফুল আমি চাই না। আমি শুধু আজ রাতের প্রথম পদ্মটি চাই
    কচ : সহায় হও পুষ্পেরা আমার। আমাকে অনুগ্রহ করো প্রথম ফুল চিহ্নিত করায় [দেবযানী নাচতে নাচতে হঠাৎ থেমে যায়। পদ্মকুঁড়িদের ফুটে ওঠাও স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর দেবযানী হঠাৎ হেসে উঠে। পদ্মকুঁড়িরাও একসাথে একধাপ ফুটে উঠে। দেবযানী সরোবরের একটা ফুলের দিকে ইশারা করে আবার হেসে উঠে। সবগুলো ফুল স্তব্ধ হয়ে থাকে শুধু এই একটি ফুল এবার ফুটে উঠতে থাকে দেবযানীর নাচের তালে তালে। দেবযানী নাচতে থাকে আর কচ ধীরে ধীরে সেই ফুল তুলে নিয়ে নিবেদন করে দেবযানীর হাতে]

    দৃশ্য ১১

    [মদ্যপানের আসরে শুক্রাচার্য আর রাজা বৃষপর্ব। রাজা শুক্রাচার্যকে মদ পরিবেশন করছেন। শুক্র গলগল করে খাচ্ছেন। কিন্তু রাজা মুখে নিচ্ছেন অতি অল্প]

    শুক্র : আচ্ছা রাজন আপনি কি বলতে পারেন এই জগতে বহুবিধ নেশাদ্রব্য থাকা সত্ত্বেও শাস্ত্রে শুধু সুরাকেই কেন রাজসিক নেশা বলে গণ্য করা হয়?
    রাজা : তা আমার কাছেও বিস্ময়। রাজকার্যে এর তেমন কোনো সংযোগ আবিষ্কার করতে পারিনি বলে মনে হয় এর নাম রাজসিক নেশা না হয়ে অন্য কিছু হলেই বরং উপযুক্ত হতো
    শুক্র : হতো না। রাজসিক মানে ইচ্ছাস্বাধীন। ঋষি- কাঠুরে- ব্রাহ্মণ সকলকেই মেনে চলতে হয় কঠোর আচার আর নিয়ম শৃঙ্খলা। তাদের আচরণে কোনো বৈচিত্র্যে নেই। শুধু রাজার পক্ষেই সম্ভব ইচ্ছাস্বাধীন বৈচিত্র্যময় আচরণ। এই সুরা মানুষকে ক্ষণিকের জন্য সেই ইচ্ছার স্বাধীনতা দেয়
    রাজা : মাদকশাস্ত্রে আমার অজ্ঞতা সত্ত্বেও সুরার প্রতি আচার্যের আসক্তি দেখে স্বীকার করতে আপত্তি নেই সুরা এক মহান পানীয়। কিন্তু রাজকার্য পরিচালনায় মাঝেমাঝে আরও কিছু বিষয় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে যার পরামর্শের জন্য আজ আচার্যের সম্মানে এই সুরাপানের আয়োজন
    শুক্র : শুক্রাচার্য যার সুরাপানের নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন তাকে তিনি নির্দ্বিধায় সকল কিছু আলোচনারও অধিকার দিয়েছেন
    রাজা : কিন্তু আমি আশঙ্কা করি আমরা যদি আলোচনায় ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারি তবে আচার্য হয়তো আমার উপর রুষ্ট হতে পারেন
    শুক্র : শপথ এই মদ ও মাংসের নামে। যদি কোনো বাক্যে একমত হতে পারি তবে সেটুকুই শুধু মনে রাখব আর যা কিছু দ্বিমতের তার সকল কিছুই এই মদ ও মাংসের সাথে হজম হয়ে যাবে শুক্রাচার্যের উদরে
    রাজা : আপনার আশ্বাসবাক্যে কৃতজ্ঞতা। ...যদিও আশ্রমের সকল কিছু আপনার একান্ত নিজস্ব অধিকার। তবু প্রশ্ন জাগে শিষ্যত্বের অনুমোদন দেবার আগে আচার্য কি সকল শিক্ষার্থীর পরিচয় নিশ্চিত থাকেন?
    শুক্র : রাজা বৃষপর্বের যদি কচের বিষয়ে কোনো জিজ্ঞাসা থাকে তবে তা সরাসরি করার অনুরোধ করি
    রাজা : ধন্যবাদ আপনার এই স্পষ্টবাদিতায়। আচ্ছা শত্রুদেশের রাজপুরোহিতের সন্তানকে বঙ্গদ্বীপে অবস্থান করতে দেয়া কি বিপজ্জনক নয়?
    শুক্র : রাজা বৃষপর্বও কি কচের দ্বারা মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা চুরির আশঙ্কা করেন?
    রাজা : আপনি তো জানেন আচার্য রাজা হিসেবে আমাকে জনগণের আশা এবং আশঙ্কার গুরুত্ব দিতে হয়। নগরের অনেকেই শঙ্কিত। সকলের ধারণা কচ আর্যস্থলির গুপ্তচর যার উদ্দেশ্য আমাদের মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র হরণ করে আমাদেরকে পদানত করা
    শুক্র : এরকম কথা আমিও শুনেছি। তবে আমার কিন্তু মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা বেদখল হবার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ আমি দান না করলে তা কারো হস্তগত হওয়া সম্ভব নয়
    রাজা : কিন্তু কচ যদি কোনো কৌশলে এই মন্ত্র হস্তগত করে আপনাকে শক্তিহীন করতে চায়?
    শুক্র : হা হা হা। রাজা বৃষপর্ব। শুক্রাচার্যকে বাধ্য করা দেবতাদেরও সাধ্যের অতীত আর এ তো বৃহস্পতির নাবালক সন্তান কচ
    রাজা : প্রজাদের আশঙ্কার কথা বিবেচনা করে... আমার মনে হয় কচকে আপনি আশ্রম ত্যাগের নির্দেশ দিলে রাজ্যে সকলেই স্বস্তি ফিরে পায়
    শুক্র : বিনা অপরাধে আমি কাউকে বহিষ্কার করতে পারি না রাজন। কচ একজন মেধাবী শিক্ষার্থী এবং আমার এক অন্যতম প্রিয় শিষ্য
    রাজা : আমি জানি আচার্য কচ আপনার কন্যারও অতি প্রিয়জন
    শুক্র : প্রত্যাশা করি রাজনৈতিক আলোচনায় আমার কন্যা প্রসঙ্গ এনে রাজা কোনো ইঙ্গিত করবেন না?
    রাজা : মার্জনা করবেন আচার্য। দেবযানী আমার কন্যা শর্মিষ্ঠার বান্ধব আমি তাকে কন্যাস্নেহেই দেখি
    শুক্র : রাজা বৃষপর্ব কি আলোচনায় উপসংহার টেনেছেন নাকি আরোও প্রসঙ্গ আছে?
    রাজা : প্রসঙ্গ নেই কিন্তু পুনরাবৃত্তি আছে আচার্য বৃহস্পতি-সূত কচকে আপনি বহিষ্কার করুন
    শুক্র : যদিও মাদকের নেশায় আমি কিছুটা বিভ্রান্ত। কিন্তু যা শুনলাম তাতে মনে হলো রাজা বোধহয় আচার্য শুক্রকে কোনো রাজকীয় আদেশ প্রদান করলেন?
    রাজা : আদেশ নয় আচার্য। এ আমার বিনীত অনুরোধ
    শুক্র : তাই যদি হয় তবে নিশ্চিন্ত থাকুন রাজা। মৃতসঞ্জীবনী আমার কাছে সুরক্ষিতই থাকবে। ...আর শুক্রাচার্যকে দুর্বলচিত্ত ভাবা মানে তাকে চূড়ান্ত অপমান করা যা কখনই বৃষপর্বের মতো রাজার বিচক্ষণতার লক্ষণ নয়

    দৃশ্য ১২

    [কচ গাছ থেকে ফুল তুলছে। শর্মিষ্ঠা প্রবেশ করে]

    শর্মী : আমি কি একটা ফুল পেতে পারি?
    কচ : রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা? নিশ্চয়ই। ফুল যত বেশি খোঁপায় কিংবা পূজায় ব্যবহৃত হয় পুষ্পমালীর আনন্দ তত বেশি
    শর্মী : আমি কি ওই ফুলটি পেতে পারি?
    কচ : তোমাকে আমি অন্য ফুল তুলে দেই?
    শর্মী : কিন্তু আমি যে এই ফুলটিই চাই?
    কচ : অন্যের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ফুল কি রাজকন্যার গ্রহণ করা উচিত?
    শর্মী : সরাসরি বললেই হয় যে ফুলটি দেবযানীর জন্য তোলা ওটি আমাকে দেয়া যাবে না
    কচ : রাজকন্যা শর্মিষ্ঠাও কি দেবযানীকে ঈর্ষা করেন?
    শর্মী : দেবযানীকে ঈর্ষা করার মতো যোগ্যতা কি আমার আছে? আমার পিতার তো আর মৃতসঞ্জীবনীর মতো অলৌকিক ক্ষমতা নেই যার সম্মানে কচ আমাকে গুরুত্ব দেবে?
    কচ : তুমি যদি সন্তুষ্ট হও তবে এই ফুলটা তোমাকে দিতে আমার আপত্তি নেই
    শর্মী : তুমি কিন্তু ফুলটা আমাকে দিয়ে করে প্রমাণ করে দিয়েছ যে দেবযানী এখন আর তোমার কাছে প্রথম গুরুত্বের নয় [কচকে ডাকতে ডাকতে দেবযানী প্রবেশ করে দেখে কচ শর্মীকে ফুলটা দিচ্ছে। দেবযানী থমকে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে বের হয়ে যায়। কচও তাকে ডাকতে ডাকতে বের হয়ে যায়]

    দৃশ্য ১৩

    [রাজপ্রাসাদের একটি কক্ষে রাজা- বৃত্ত আর জয়দীপ]

    রাজা : রাজকন্যা শর্মিষ্ঠার অনুমানে কচ হয় নিতান্তই দেবযানীর প্রেমিক যাকে সন্দেহ করা অবান্তর না হয় সে অতি ধূর্ত যার পরিকল্পনা বোঝা অসম্ভব
    বৃত্ত : ঠিক তাই রাজন। তার সাথে কথা বললে মনে হয় সে আশ্রম ত্যাগ করতেও রাজি কিন্তু দেবযানীকে ত্যাগ করা তার পক্ষে অসম্ভব
    জয় : তার মানে কিন্তু দাঁড়ায় সে বঙ্গদ্বীপ ছাড়তে রাজি নয় [শর্মী প্রবেশ করে]

    শর্মী : পিতা
    রাজা : এসো শর্মিষ্ঠা [শর্মী পেছন থেকে হুট করে ঢুকে পড়ে পাচক পরিমল]

    পরিমল : মার্জনা করবেন মহারাজ। অনুমতি ছাড়া প্রবেশের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু আপনার সাথে আমি সরাসরি আলোচনা করতে চাই বলে প্রহরীদের লুকিয়ে আসলাম
    রাজা : যে কোনো নাগরিক কিংবা অতিথির আমার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ উন্মুক্ত। প্রহরীদের বললেই তারা আমাকে সংবাদ দিতো। ...কোনো বিশেষ আবেদন কি আছে আপনার?
    পরিমল : আমি একজন রন্ধনশিল্পী
    শর্মী : রন্ধন শিল্পী?
    পরিমল : আমি সকল প্রকার রন্ধনকার্যে অতিশয় দক্ষ মা জননী। রাজকীয় অতিথি আপ্যায়ন- ব্রাহ্মণভোজ- আমিষ- নিরামিষ সকলপ্রকার রন্ধনকার্য জানি। আমার নাম পরিমল ঠাকুর। জাতে ব্রাহ্মণ
    শর্মী : আপনি আমের আচার তৈরি করতে পারেন?
    পরিমল : মা জননী... নিজের সম্পর্কে বাড়িয়ে বলা ঠিক নয় তবু বলি- আমার হাতে তৈরি আমের আচার একবার খেলে স্বর্গের দেবতারাও আর স্বর্গে ফিরতে চাইবেন কি না সন্দেহ
    রাজা : কিন্তু আমার কাছে আপনার কী প্রত্যাশা?
    পরিমল : আমি মহারাজের অতিথিশালায় রাঁধুনি বামুনের চাকুরি প্রত্যাশী
    রাজা : এই দেশে ভোজন-রসিক একজনই আছেন তিনি হচ্ছেন আমাদের রাজপুরোহিত শুক্রাচার্য। আপনি যদি নিজের রান্নায় তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারেন তবে অতিথিশালায় আপনার চাকুরি নিশ্চিত
    পরিমল : আমি নিশ্চিত রাজপুরোহিত আমার রান্না খেয়ে সন্তুষ্টই হবেন। আর রাজকন্যা যদি একবার আমের আচার খান...
    রাজা : আপাতত আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন। ইনাদের সাথে আলোচনার পর আপনার সাথে বিস্তারিত আলোচনা হবে
    পরিমল : যথাজ্ঞা মহারাজ [পরিমল বেরিয়ে যায়]

    রাজা : শর্মিষ্ঠা?
    শর্মী : দেবযানী কচ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে ভাবার কথাও ভাবতে পারছে না পিতা
    জয় : মহারাজ। বিষয়টা হচ্ছে মাত্র দুইজন মানুষ ছাড়া সবাই কচকে সন্দেহ করে
    রাজা : তা সত্য
    জয় : এখন আপনার একটা নির্দেশই জন্য যথেষ্ট
    রাজা : নির্দেশের জন্য তোমাদের ডাকিনি জয়দীপ। ডেকেছি পরামর্শের জন্য
    জয় : মহারাজের পরিষদবর্গ থাকতে আমাদের সাথে পরামর্শ?
    রাজা : তোমরা তিনজনই কচকে ঘনিষ্ঠভাবে জানো এবং তিনজনেরই রয়েছে আচার্য শুক্রের আশ্রমে যাতায়াত। আর পরিষদ-বর্গের সাথে আলোচনা না করার কারণ হচ্ছে কচ সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ এখনও প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত নয়। তাই এসকল আলোচনার সংবাদ শুক্রাচার্যের কানে গিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো তিক্ততা তৈরি হোক তা আমি চাই না
    বৃত্ত : কিন্তু রাজন এখন তবে আমাদের কর্মপন্থা কী হওয়া উচিত?
    রাজা : বৃত্তানন্দ। তুমি একজন ব্রাহ্মণ। তোমার পক্ষে কচের দেশে গমন সম্ভব ...ছদ্মবেশ নিয়ে তুমি সেখানে তীর্থযাত্রী ব্রাহ্মণের বেশে যাবে। সম্ভব বৃত্ত?
    বৃত্ত : সম্ভব রাজন
    রাজা : সেখান গিয়ে কচের বঙ্গদ্বীপে আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করতে হবে ...আর জয়দীপ। কচ যখন বনে গরু চরায় তখন গল্পচ্ছলে যুদ্ধের সময় কীভাবে তুমি তার দেশের সৈনিকদের হত্যা করেছ তার বর্ণনা দেবে। শুক্রাচার্যের মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যার কারণে কীভাবে পুনর্জীবন পেয়েছ তাও বলবে তাকে দেখবে তার প্রতিক্রিয়া কী?
    বৃত্ত : বুঝতে পারছ মহারাজের নির্দেশ? কাঠুরেগিরি বাদ দিয়ে এবার তোমাকে কূটনীতিবিদ হতে হবে
    রাজা : সৈনিকে সবকিছু হবার জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। ...শর্মিষ্ঠা আমি চাই কচ আর দেবযানীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হোক

    দৃশ্য ১৪

    [বেণুমতী নদীর তীরে দেবযানী কুকুর- বিড়াল- বাঘ- সিংহ- হাতি- ঘোড়া এরকম একেকটা প্রাণীর নাম বলে আর কচ সেই প্রাণীর মতো হাঁটে/লাফায় আর মুখ দিয়ে সেই প্রাণীর ডাক অনুকরণ করে। প্রতিবারই প্রাণীদের অভিনয় করতে করতে দেবযানীর কাছে চলে আসে। কখনও বাঘের মতো লাফ দিয়ে কাছে এসে দেবযানীকে ধরতে চায় তো কখনও ঘোড়া হয়ে দেবযানীর চারপাশে চক্কর দেয়। কখনও কুকুর হয়ে দেবযানীর কাছে এসে লেজ নাড়ে তো কখনও বিড়াল হয়ে দেবযানীর কোলে উঠতে চায়। দেবযানী প্রতিবারই কচের স্পর্শ বাঁচিয়ে হাসতে হাসতে দূরে গিয়ে অন্য পশুর নাম বলে আর কচ সেই পশুর অভিনয় করতে করতে আবার দেবযানীর কাছে চলে আসে]

    দেবযানী : তোমার পশুরা কি অন্যদিকে যাবার কোনো রাস্তা চেনে না?
    কচ : রাস্তা হয়তো চেনে কিন্তু অন্য কোনো গন্তব্য যে নেই
    দেবযানী : ব্যাং। দেখি এবার ব্যাং কী করে? [কচ ব্যাং হয়ে এদিক সেদিক কয়েকটা লাফ দিয়ে দেবযানীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়]

    দেবযানী : আশা করি তুমি বলবে না যে ব্যাং মানুষের কোলে উঠতে চায়?
    কচ : সামনে কোনোকিছু দেখলে কিন্তু ব্যাঙের তা লাফ দিয়ে পার হবার স্বভাব। আর যদি পার হতে না পারে তাহলে কিন্তু...
    দেবযানী : থাক থাক। ব্যাং থাক তাহলে। তাহলে সাপ?
    কচ : সাপ কিন্তু নাগপাশে বাঁধে দেবযানী
    দেবযানী : না না না। সাপ নয়। অন্য কোনো প্রাণী। ... আচ্ছা এবার তাহলে তুমি বেণুমতী নদীর মাছ হও। মাছ নিশ্চয়ই ডাঙায় এসে দেবযানীকে ছুঁয়ে দেখতে চাইবে না? [কচ নদীতে নেমে সাঁতরাতে থাকে। মাছের মতো ঘাই দিতে থাকে। দেবযানী পাড়ে দাঁড়িয়ে হাসে]

    দেবযানী : যতবার তুমি স্রোত ঠেলে কাছে আসতে চাইছ ততবার কিন্তু দূরে সরে যাচ্ছ। এখন কীভাবে তুমি দেবযানীকে স্পর্শ করবে কচ?
    কচ : আমি কি একটা অনুরোধ করতে পারি?
    দেবযানী : তোমার সাথে জলকেলি করার আব্দার ছাড়া অন্য যে কোনো অনুরোধ...
    কচ : তুমি যদি উজানের জলে একবার তোমার আঙুলের স্পর্শটুকু দাও তবে ভাঁটির জলে ডুব দিয়ে তোমার সে স্পর্শ আমি তুলে নিতে পারি
    দেবযানী : কৌশলে ব্যর্থ হয়ে এখন আবেদন? দেবযানীর স্পর্শ কি এতটাই আরাধ্য কচ?
    কচ : আরাধ্য নয় দেবযানী সাধনা। এরকম খরস্রোতা নদী সাঁতরে আমি প্রতিদিন দেবযানীর কাছে আসতে চাই কিন্তু দেবযানী হাত বাড়ায় না বলে খড়কুটার মতো ভেসে যাই সাগরের দিকে
    দেবযানী : এই ফুল তবে কচের কাছে পৌঁছে দিক দেবযানীর ছোঁয়া... [দেবযানী খোঁপা থেকে ফুল খুলে জলে ভাসিয়ে দেয়। কচ সাঁতরে সেই ফুল তুলে নেয়]

    দৃশ্য ১৫

    [বৃত্ত গরু নিয়ে বন থেকে ফিরছে। জয়দীপ হঠাৎ করে লাফিয়ে পড়ে তার গরুগুলোকে ভয় পাইয়ে দেয়]

    জয় : হা: হা: হা: ভেবেছিলে বুঝি বাঘে আক্রমণ করেছে?
    বৃত্ত : বাঘ না ভাবলেও হনূমান টনুমান কিছু একটা যে ভেবেছি তাতে সন্দেহ নেই
    জয় : হা: হা: হা: তুমি ফিরলে কবে?
    বৃত্ত : ফিরেছি গতকাল
    জয় : সংবাদ কিছু পেলে?
    বৃত্ত : সংবাদ পেয়েছি... [বৃত্ত আশপাশ দেখে নেয়। পরিমল দৌড় দিয়ে এসে পড়ে তাদের মাঝখানে]

    পরিমল : আমাকেও তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও। বনে জঙ্গলে একা চলতে খুব ভয় লাগে আমার
    জয় : পয়মাল ঠাকুর এখানে কী করে?
    পরিমল : পরিমল ঠাকুর না ডাকো পাচক ঠাকুর ডাকলেও কিন্তু হয়। তাই বলে পয়মাল ঠাকুর! ...কথায় বলে স্থানে মান অস্থানে অপমান। পেটের দায়ে যখন অস্থানে এসে পড়েছি... [জয়দীপ কুড়াল বাগিয়ে তেড়ে যায়]

    জয় : অস্থান? বঙ্গদ্বীপ তোমার জন্য অস্থান? এখানে গলা পর্যন্ত ভাত গিলে ভুঁড়ি বাড়াচ্ছ আবার বলছ অস্থান? দাঁড়াও তোমাকে তোমার সঠিক স্থানে পাঠানোর ব্যবস্থা করি [পরিমল গরু আর বৃত্তের আড়ালে লুকায়]

    পরিমল : দেখো দেখো আরে শাস্ত্র না জানলেও আমি একজন ব্রাহ্মণ
    জয় : অ্যা ব্রাহ্মণ! করে রান্ধাবাড়া- পদবি ব্রাহ্মণ! ব্রাহ্মণ হতে হলে বেটা আগে শুক্রাচার্যের মতো হ তারপর ব্রাহ্মণের পরিচয় দিবি
    পরিমল : দেখো দেখো এই গোঁয়ারের সাথে এখন তর্ক করবে কে?
    জয় : তর্ক পরে আগে তোমার স্বর্গযাত্রার ব্যবস্থা করি। সেখানে গিয়ে দেখো সেটা বঙ্গদ্বীপ থেকে কতটা ভালো?
    পরিমল : আমাকে মারলে কিন্তু রাজা তোর যাবজ্জীবন দেবেন। আরে মূর্খ আমি একজন রাজকর্মচারী তার উপর ব্রাহ্মণ সন্তান। তোর মতো নমশূদ্রের কাছ থেকে কিন্তু সব দিক দিয়ে আমার সম্মান পাওনা
    জয় : রান্নাবাড়ার জন্য তোকে ব্রাহ্মণ মানতে হলো তো তোর থেকে দশগুণ ভালো রান্না জানা আমার বৌকে সারাদিন ঠাকরুন ঠাকরুন করে পূজা করতে হবে
    পরিমল : এ হে হে কার সাথে কার তুলনা। আরে বেটা আচার্য শুক্র আমার রান্না খেয়ে আমার জন্য রাজকীয় চাকুরির সুপারিশ করেছেন
    জয় : রাজবাড়িতে তুই যেসকল মসলাপাতি দিয়ে রান্না করিস ওগুলো দিয়ে আমার বৌ রান্না করে খাওয়ালে তোর শুক্রাচার্য আশ্রম ছেড়ে আমার উঠানে বসে খাদ্য সাধনা করত
    পরিমল : মূর্খতার একটা সীমা আছে জয়দীপ। আচার্য শুক্রকে অপমান করা কিন্তু সীমা লঙ্ঘন। বৃত্তানন্দ। তুমি কিছু বলছ না দেখি। এই মূর্খ বেটা এখন কিন্তু তোমার গুরুদেবকে অপমান করছে
    বৃত্ত : ও কিন্তু গুরুদেবকে খুবই সম্মান করে। আশ্রমের সারা বছরের জ্বালানিকাঠ জয়দীপই সরবরাহ করে। ছাড়ো তো জয়দীপ। ... কিন্তু আপনি বনের মধ্যে কী করছিলেন?
    পরিমল : এসেছিলাম কিছু বনজ মসলা সংগ্রহ করতে। কিন্তু ওরে বাপরে ভয়ে এখনও আমার বুক ধড়ফড় করছে
    বৃত্ত : বৃত্তের জন্য বেঁচে গেলি পয়মাল। না হলে বঙ্গদ্বীপ সম্পর্কে যা বলেছিস তাতে অতক্ষণে তোর কলজে ঠান্ডা করে দিতাম
    পরিমল : এÉ¡ঁ আমার দেশপ্রেমিক বীর পুরুষ! একটা কথার কথা বললাম আর উনি তেড়ে আসলেন কুড়াল বাগিয়ে। বলি আমি তো কাজ করে খাই কিন্তু এই দেশের অন্নজল খেয়ে যে এই দেশেরই কলজে খাওয়ার ধান্দায় আছে সাহস থাকলে তার দিকে গিয়ে তোর কুড়ালটা ধর তো দেখি? ...সেটা তো পারবি না। কচের দিকে চোখ তুললে শুক্রাচার্য তোর কুড়াল গরম করে তোর ইয়েতেই ঢুকিয়ে দেবেন
    বৃত্ত : এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের আলোচনা করা ঠিক না ঠাকুর
    পরিমল : সারা দেশের লোক আলোচনা করে আর আমি বললেই দোষ
    জয় : দোষই তো। রান্ধুনির আবার রাজনীতির শখ কেন?
    পরিমল : না রাজনীতি তো তোর বাপের জমিদারি
    জয় : কী বললি শালা [জয় কুড়াল দিয়ে তাড়ায়। বৃত্ত আটকায়। গরু নিয়ে বের হয়ে যায় সবাই]

    দৃশ্য ১৬

    [সন্ধ্যা। বনের রাস্তায় সেজেগুজে দেবযানী অপেক্ষা করছে। কচের গরুগুলো ফিরে আসে]

    দেবযানী : আমি জানি তুমি গরুর পালের ভেতরে লুকিয়ে আছ। কোথায়...। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি খুঁজে বের করতে পারিনি। এবার বেরিয়ে আসো। ....আর খুঁজতে পারব না। ইচ্ছে হলে আসো না হলে নেই [একে একে সবগুলো গরু বের হয়ে গেলে শেষ গরুটাকে জিজ্ঞেস করে দেবযানী]

    দেবযানী : কচ আসেনি তোমাদের সাথে? [গরু একটা ডাক দিয়ে চলে যায়। শুক্রের অন্য এক শিষ্য তার গরু নিয়ে আশ্রমে ফেরে]

    দেবযানী : কচকে দেখেছ?
    শিক্ষার্থী : তার সংবাদ তো তোমারই জানবার কথা দেবযানী
    দেবযানী : কিন্তু কচের গবাদিগুলো সব ফিরে এসেছে। গাভিগুলোর সাথে তো তারও ফিরে আসার কথা
    শিক্ষার্থী : সেই নিয়মতো আমারাও জানি। কিন্তু সাধারণ নিয়ম তো আর কচের ক্ষেত্রে চলে না

    দৃশ্য ১৭

    [শুক্রাচার্য পানপাত্র নিয়ে বসেছেন। বৃত্তানন্দ তাকে পরিবেশন করছে]

    দেবযানী : পিতা। কচ এখনও আশ্রমে ফেরেনি
    শুক্র : ফিরবে নিশ্চয়ই
    দেবযানী : কচের সবগুলো গাভি ফিরে এসেছে। কিন্তু তাদের সাথে কচ নেই
    শুক্র : হয়তো পথিমধ্যে সরোবরের প্রথম পদ্ম ফুটে উঠবার অপেক্ষা করছে। হা হা হা... দেবতারাও এমন ভক্ত পান না যেমন পেয়েছে আমার কন্যা। শুক্রাচার্যের উপযুক্ত কন্যাই তুমি বটে
    দেবযানী : পিতা। আমি... আমি কোনো অমঙ্গলের আশঙ্কা করছি
    শুক্র : অমঙ্গল? অমঙ্গল আশঙ্কার কি প্রয়োজন?
    দেবযানী : কচকে বঙ্গদ্বীপের মানুষজন পছন্দ করে না। বলা যায় না হয়তো তাকে...
    শুক্র : এখন তো আমিও কিঞ্চিৎ চিন্তিত কন্যা... যুক্তিহীন জনতা প্রায়শই মূর্খের মতো আচরণ করে
    দেবযানী : তুমি কি তোমার মনশ্চক্ষে একবার অনুসন্ধান করে দেখবে কচ এখন কোথায়?
    শুক্র : কিন্তু কচ যদি সত্যি সত্যি মৃত্যুবরণ করে থাকে তবে সন্ধান করে শুধুই দু:খ বাড়ানো হবে কন্যা
    দেবযানী : দু:খ বাড়বে কেন? মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা দিয়ে কচকে তুমি আবার বাঁচিয়ে তুলবে?
    শুক্র : মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা মানবজাতির মঙ্গলের প্রয়োজনে অর্জিত কন্যা প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করার জন্য এর প্রয়োগ অনুচিত
    দেবযানী : পিতা আমি কচকে চাই
    শুক্র : ধৈর্য ধরো কন্যা। মাত্রাতিরিক্ত আবেগ শুভ লক্ষ্মণ নয়
    দেবযানী : ধৈর্য ধারণে আমি অপারগ পিতা। অন্তত ধ্যানে বসে তার সন্ধানটুকু আমাকে দাও
    শুক্র : শুক্রের শিষ্যকে হত্যার সাহস কারো থাকতে পারে বিশ্বাস হয় না আমার। তবুও কন্যার আশঙ্কা যে দূর করতে হয়। শিষ্য বৃত্তানন্দ তুমি কি আমার ধ্যানের আয়োজন করে দেবে?
    বৃত্ত : নিশ্চয়ই গুরুদেব [বৃত্ত উপচার সাজিয়ে দেয়। শুক্রাচার্য ধ্যানে বসে কচের অনুসন্ধান করে এক পর্যায়ে চমকে উঠেন]

    শুক্র : এ কী? অভিশাপ দেই তোকে
    দেবযানী : কোনো বিপদের কি আশঙ্কা পিতা?
    শুক্র : বনের পশুরা বড়োই মূর্খ। ব্রাহ্মণ- শূদ্র- মৃগ কিংবা বরাহ কিছুতেই তাদের যেমন অরুচি নেই তেমনি বিন্দুমাত্র ধারণা নেই শুক্রাচার্যের ক্ষমতায়
    দেবযানী : কচের কী হয়েছে পিতা?
    শুক্র : প্রিয় শিষ্য কচ আর জীবিত নেই কন্যা। মানুষ নয় নির্বে?ধ এক বাঘিনি মেরেছে তাকে
    দেবযানী : পিতা!
    শুক্র : দু:খ করো না কন্যা। মৃত্যু এক স্বাভাবিক নিয়তি। ব্রহ্মা- ইন্দ্র- চন্দ্র- সূর্য- বরুণ- শুক্রাচার্য কেউই মৃত্যুর ঊর্ধ্বে নয়
    দেবযানী : পিতা। কচকে ডাকো। কচকে বাঁচিয়ে তোলো পিতা
    শুক্র : তা উচিত নয় কন্যা
    দেবযানী : কচ যদি না বাঁচে তবে জেনে রেখো তোমার কন্যাও বেছে নেবে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ
    শুক্র : না না না। না। এমন অভিশাপ নেমে এলে কী মূল্য বহন করবে এই রাজপুরোহিতের পদ কিংবা মৃতসঞ্জীবনীর অহংকার? ...স্থির হও কন্যা। ...প্রিয় শিষ্য বৃত্তানন্দ। সতীর্থের পুনর্জীবন দানের জন্য এবার যে তোমাকে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের উপচার সাজাতে হয়...
    বৃত্ত : গুরুদেব...
    শুক্র : কোনো জিজ্ঞাসা?
    বৃত্ত : এর আগেও আমাদের তিন সতীর্থ বাঘের আক্রমণে প্রাণ দিয়েছেন। তাদের জন্য মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র প্রয়োগের উদাহরণ নেই গুরুদেব
    শুক্র : কী অর্থ এই কথার?
    বৃত্ত : আমি নিজেও এই মন্ত্রে একবার পুনর্জীবনপ্রাপ্ত। কিন্তু অনেক সৈনিকের সাথে আপনি আমাকে পুনর্জীবন দিয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের মহত্তম উদ্দেশ্যে। হয়তো আমার কথার অর্থ এই যে মহত্তম প্রয়োজন ছাড়া এই মন্ত্রের প্রয়োগ অভিপ্রেত নয়
    শুক্র : তুমি কি আমাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছ বৃত্তানন্দ?
    বৃত্ত : তা নয় গুরুদেব। আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন মদ্যপানরত অবস্থায় আপনাকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দেখলে যেন বিতর্ক দিয়ে যাচাই করে নেই
    শুক্র : ধন্য বৃত্তানন্দ। আমার উপযুক্ত শিষ্য তুমি। যদিও তোমার কথায় ইদানীং শাস্ত্রের চেয়ে রাজনৈতিক যুক্তির প্রাধান্যই বেশি তবুও তোমাকে আমি নিশ্চিত করছি যে মদ্যপান করলেও এখন আমি মাদকমত্ত নই। স্থির মস্তিষ্কেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কচকে পুনর্জীবন দানের। ... এখন গুরুর নির্দেশে তুমি মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগের উপচার সাজিয়ে দাও
    বৃত্ত : নিশ্চয়ই গুরুদেব [বৃত্ত উপচার সাজিয়ে দেয়। জয় শিব আদি অধীশ্বর বলে শুক্রাচার্য ধ্যানে বসেন। শুক্রের মনশ্চক্ষে দেখা যায় বাঘিনির শরীরে প্রবল আন্দোলন ঘটে। অস্থির হয়ে ছটফট করতে থাকে বাঘ]

    শুক্র : তুমি কি আমার ডাক শুনতে পাচ্ছ কচ?
    কচ : পাচ্ছি গুরুদেব
    শুক্র : তবে ফিরে এসো। পুনর্জীবন লাভ করো ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্যের মৃতসঞ্জীবনীর কৃপায় [বাঘিনির শরীর আন্দোলিত হতে হতে এক সময় ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তার পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে কচ]

    দৃশ্য ১৮

    [দেবযানী বনের পথে দৌড়ে যায়। অন্যদিক থেকে দৌড়ে আসে কচ]

    দেবযানী : কচ
    কচ : দেবযানী। আমি জানি আমার এই নতুন জন্ম যতটা না শুক্রের মন্ত্রে তার চেয়ে বেশি তোমার ইচ্ছায়
    দেবযানী : দেবযানীকে কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রয়োজন নেই কচ। কৃতজ্ঞতা ঘনিষ্ঠজনকে দূরে ঠেলে দেয়। এই দেখো দেবযানী তোমার কতটা নিকট
    কচ : দু:খ হচ্ছে সেই বাঘিনির জন্য যাকে আমার জন্য প্রাণ দিতে হলো
    দেবযানী : উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে তার। কচকে হত্যার সঠিক শাস্তি তার এই অকালে মৃত্যু
    কচ : না দেবযানী। বাঘিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমাকে হত্যা করেছে মানুষ
    দেবযানী : মানুষ?
    কচ : মানুষ। পোশাকে তাদের মুখ আবৃত ছিল বলে কাউকে চিনতে পারিনি। তারা আমাকে হত্যা করে বাঘিনির ভোগ দিয়েছিল
    দেবযানী : দস্যুর হাতে পড়েছিলে তুমি?
    কচ : না। তারা দস্যুও নয়। তারা এই দ্বীপেরই মানুষ। আমার আশঙ্কা গবাদি চরাতে গেলে তারা আবারো আমাকে আক্রমণ করবে
    দেবযানী : আর কখনও গরু চরাতে যাবে না তুমি। আর কখনও দেবযানীর চোখের আড়ালে কোথাও যাবে না তুমি
    কচ : সেই যেন হয় দেবযানী। বঙ্গদ্বীপ নয় দেবযানীর চোখই যেন হয় কচের নিবাস [দুজন নেচে উঠে গানের সাথে সাথে]

    দৃশ্য ১৯

    [রাজ দরবার। পরিষদবর্গের সাথে রাজা]

    রাজা : এবছর বৃষ্টি বিলম্ব হচ্ছে। বীজতলা তৈরির জন্য কৃষকরা যথেষ্ট জল পাচ্ছে না। তাই অবিলম্বে নদী ও সরোবর থেকে ছোট ছোট খালের মাধ্যমে চাষিদের জল সরবরাহ করা উচিত... [রাজ দরবারে প্রবেশ করেন শুক্রাচার্য। রাজাসহ সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করেন]

    রাজা : আচার্য শুক্র রাজদরবারে?
    শুক্র : এসেছি অতিষ্ঠ হয়ে। জানতে এসেছি অতবড়ো দু:সাহস কার যে শুক্রের শিষ্যকে হত্যার সাহস করতে পারে?
    রাজা : শান্ত হোন আচার্য। যেহেতু কচের বর্ণনা মতে তাদের সকলের মুখ আবৃত ছিল তাই অনুমান করি তারা দস্যুই হবে। কচের নিকট লুণ্ঠনের মতো সম্পদ না পেয়ে ক্রোধবশতই হয়তো তাকে না চিনেই হত্যা করেছে
    শুক্র : কচ তাদেরকে চিহ্নিত করতে না পারলেও নিশ্চিত করেছে যে তারা এ দেশেরই লোক এবং তাকে যথার্থই চেনে। ...মনে রাখবেন রাজা কচ একজন ব্রাহ্মণ সন্তান। প্রথম অপরাধ হিসেবে আমি ক্ষমা করে দেবো এই আচরণ। কিন্তু এর পরে কচের প্রতি যে কেনো আক্রমণকেই আমি শুক্রাচার্য এবং ব্রাহ্মণত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলেই বিবেচনা করব। আর তখন শুক্রের অভিশাপ থেকে রাজাপ্রজা এমনকি বঙ্গদ্বীপ কেউই রেহাই পাবে না [শুক্র বের হয়ে যান]

    রাজা : ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধা করা চলে কিন্তু বিশ্বাস করা অসম্ভব। শুক্রাচার্য পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন সকল কিছুর ঊর্ধ্বে ব্রাহ্মণের অবস্থান। শত্রু হোক আর প্রতিদ্বন্দ্বী হোক কচ আক্রান্ত হলে তার সমীকরণ হবে ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে ভূমিপুত্রের লড়াই। আর সেটা হলে অভিশাপ দিয়ে সমস্ত বঙ্গদ্বীপকেও ভস্ম করতে দ্বিধা করবেন না তিনি
    পারিষদ ১ : এটা হয়তো তিনি ক্ষোভের বশে বলেছেন। আমার মনে হয় না বঙ্গদ্বীপের কোনো অমঙ্গল করবেন তিনি
    রাজা : ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের দেশ বলতে কিছু নেই। কে কার শত্রু কে কার মিত্র কিছুই তাদের গণ্য নয়। তারা শুধু জানেন শাস্ত্রমতে সকলের কাছেই তারা সমান শ্রদ্ধার তাই সর্বত্রই গমনের অধিকার রয়েছে তাদের। ...এরকম স্বদেশহীন মানুষের কাছে দেশপ্রেম প্রত্যাশা করা অনর্থক
    পারিষদ ২ : কিন্তু এই বঙ্গদ্বীপের জন্য শুক্রাচার্যের অবদানও নেহাত তুচ্ছ নয় বরং আমরা আজ অহংকার করি আচার্যের বিদ্যার গৌরবে
    রাজা : সত্যি। সম্পূর্ণ সত্যি কথা। তার মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যার গৌরবেই আজ আমরা বহি:শত্রুর কাছে দুর্ভেদ্য...
    পারিষদ ১ : কিন্তু রাজপুরোহিত শুক্রাচার্য যেখানে বারবার আশ্বস্ত করছেন যে মন্ত্রটা কোনোভাবেই তার হাতছাড়া হবার আশঙ্কা নেই সেখানে আমাদের কি সত্যিই কোনো অমঙ্গলের আশঙ্কা আছে?
    রাজা : আছে। কচের দেশ থেকে যে সংবাদ আমি সংগ্রহ করেছি তাতে আমি নিশ্চিত- কচ বঙ্গদ্বীপে আছে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা হস্তগত করার লক্ষ্যে। কিন্তু শুক্রাচার্য কখনোই ভাবতে পারছেন না যে কূটকৌশলে কচ তার থেকেও উচ্চে উঠে যেতে পারে সেখানেই আমার ভয়
    পারিষদ১ : যে শুক্রাচার্যকে দেবতারাও সমীহ করে চলেন কচের উদ্দেশ্য যাই থাকুক আমার মনে হয় না সেই শুক্রাচার্যকে কচের পক্ষে মন্ত্রদানে বাধ্য করা সম্ভব
    রাজা : সম্ভব। কারণ আচার্য শুক্র একজন আত্মম্ভরি স্বেচ্ছাচারী ব্রাহ্মণ। সর্বোপরি মাদকের প্রতি রয়েছে তার সীমাহীন আসক্তি আর কন্যার প্রতি অকল্পনীয় আবেগ। মদ্যপান এবং কন্যাস্নেহ এ দুটো ক্ষেত্রেই আচার্য শুক্র হিতাহিত জ্ঞানশূন্য উন্মাদ হয়ে উঠেন আমার ধারণা কচ যে কোনো সময় এই সুযোগটাই গ্রহণ করতে পারে
    পারিষদ২ : তাই যদি হয় তবে এক্ষেত্রে আমাদেরই বা কী করণীয়?
    রাজা : দেশ রক্ষায় যা প্রয়োজন তা আমাদেরকেই ভাবতে হবে
    পারিষদ ১ : কিন্তু এতে যদি আচার্য রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেন?
    রাজা : সার্বভৌমত্ব হারানোর চেয়েও কি শুক্রাচার্যের অভিশাপ বেশি ভয়ানক? শুক্রের শাপে হয়তো বঙ্গদ্বীপ ছাই হয়ে মিশে যাবে সাগরের জলে। কিন্তু স্বাধীনতাহীন দাসত্বের জীবন থেকে কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া শ্রেয়তর নয়?

    দৃশ্য ২০

    [বৃত্ত কাঠ কাটছে। জয়দীপ বসে আছে মনমরা হয়ে। তার দুয়েকটা গরু চরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। পাচক প্রবেশ করে। তার হাতে কয়েকটা মশলাজাতীয় উদ্ভিদ]

    জয় : পয়মাল ঠাকুর আবার জঙ্গলে কী মনে করে? স্বর্গে যেতে চাইলে গাছটার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়াও। এক কোপে গাছের সাথে তোমাকেও স্বর্গে পাঠাই
    পরিমল : তুই সত্যি সত্যি আমাকে মারতে পারবি জয়দীপ?
    জয় : আমি কাঠুরে। যে গাছের ফল খাই চুলার খড়ি বানাবার জন্য তার গোড়ায়ও নির্দ্বিধায় কুড়াল চালাই। তোমার উপর কুড়াল চালাতেও হাত কাঁপবে না আমার
    পরিমল : সত্যি সত্যি মরতে পারলে খুব একটা খারাপ হতো না জয়দীপ। মনটা খুব খারাপ
    জয় : মন খারাপ কেন? রান্না পুড়িয়ে ফেলার জন্য মহারাজ ধমক লাগিয়েছেন নাকি?
    পরিমল : সে আমার হয় না জয়দীপ। মনটা খারাপ হয়ে আছে রাজার সাথে শুক্রাচার্যের দুর্ব্যবহার দেখে। রাজাকে এইভাবে অপমান করাটা...
    বৃত্ত : শুক্রাচার্য যাকে নির্দোষ মনে করেন তার ক্ষতি হলে তিনি রুষ্ট হবেন এটাই তো স্বাভাবিক
    পরিমল : আচার্য অনেক জ্ঞানী মানুষ কিন্তু মনে হয় না তিনি পুরো বিষয়টা অনুমান করতে পারছেন... আর যারাই কচকে হত্যা করুক না কেন ওগুলাও অকাট মূর্খ ছাড়া কিছু নয়
    জয় : পয়মাল ঠাকুর। বঙ্গদ্বীপের লোকজন সম্পর্কে বাজে কথা বললে কিন্তু সত্যি সত্যি তোমার উপর আমি কুড়াল চালাব
    পরিমল : চালা। চালা কুড়াল। আমার তো আর শুক্রাচার্য নেই যে পুনর্জীবন দেবেন। তাই আমাকে মারলে একেবারেই চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতি পারবি। কিন্তু যাকে শুক্রাচার্য বারবার বাঁচাবেন তাকে কুপিয়ে হত্যা করতে যাওয়া মূর্খতা নয় তো কী?
    জয় : অত তত্ত্ব কপচাতে হবে না তোমাকে তুমি তোমার রান্নাঘরে খুন্তি ঠেলো গে যাও
    পরিমল : আমি তো খুন্তিই ঠেলব। আমার তো আর নিজেকে তোদের মতো দেশপ্রেমিক দেখানোর শখ নেই। কিন্তু বলি... খালি অস্ত্র চালাতে জানলেই দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না বুদ্ধি থাকা লাগে
    জয় : তুমি যখন অত বুদ্ধিমান তখন নিজেই একটা বুদ্ধি দাও না দেখি। দেখি তোমার তেল-মশলা মাখানো বুদ্ধিতে কেমন করে শুক্রাচার্যকে পিছলানো যায়?
    পরিমল : অ্যাহ। আমি যেন বন থেকে বুদ্ধি কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি। আরে বেটা কুড়াল ঠুকলে বুদ্ধি বের হয় না কুড়াল রেখে গাছের মধ্যে মাথা ঠোক দেখবি বুদ্ধি ঠিকই বেরোবে...
    বৃত্ত : আমার ফিরতে হবে
    পরিমল : আমিও যাব
    বৃত্ত : জয়দীপ তুমি কি যাবে?
    জয় : হ্যা। আমিও ফিরব
    বৃত্ত : তুমি তাহলে ওদিকে এগিয়ে আমার গরুগুলো রাস্তায় নিয়ে আসো। আমি এদিকটায় যাচ্ছি

    দৃশ্য ২১

    [শুক্রের আশ্রমে কচ আর বৃত্ত। আশ্রমের বিভিন্ন জিনিস পরিচর্যা করছে তারা]

    বৃত্ত : সাধারণ ক্ষেত্রে গুরুদেব কাউকে পুনর্জীবন দেন না তোমার ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যতিক্রম করেছেন
    কচ : সেজন্য আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি তো তাকে পুনর্জীবনের জন্য অনুরোধ করিনি। তিনি তার কন্যার আব্দার রক্ষা করেছেন মাত্র
    বৃত্ত : এর আগে তুমি তাকে বাধ্য করেছ শিষ্যত্বদানে
    কচ : এক্ষেত্রেও তিনি আমাকে নয় বরং দেবযানীকেই গুরুত্ব দিয়েছেন
    বৃত্ত : তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ায়? নিয়ম ভঙ্গ করে গুরুদেব রক্ষা করছেন কন্যার আব্দার আর উপকৃত হচ্ছ তুমি। মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের বেলায়ও যদি এমনটি ঘটে?
    কচ : দেবযানী কখনোই গুরুদেবকে এই অনুরোধ করবে না। কারণ সেও জানে যে আচার্য এই মন্ত্র দান করবেন না। সে তার পিতার সম্মানকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। আর এও জানে যে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের জন্যই শুক্রাচার্য জগতে সকল আচার্য থেকে অনন্য
    বৃত্ত : অগ্রজ হিসেবে তোমাকে একটা পরামর্শ দেই কচ তুমি যথেষ্ট মেধাবী। জগতের যে কোনো গুরু তোমাকে শিষ্য হিসেবে সাদরে গ্রহণ করবেন। তুমি স্বেচ্ছায় বঙ্গদ্বীপ ছেড়ে চলে যাও
    কচ : হা অগ্রজ। তোমার মুখে এই প্রস্তাব শুনব কল্পনাও করিনি। তুমিও শুধু মন্ত্রটাকেই গুরুত্ব দিলে দেবযানীর কথা একবারও ভাবলে না তুমি? আমার বঙ্গদ্বীপ ছেড়ে যাওয়া মানে যে দেবযানীকেও ছেড়ে যাওয়া অন্তত তোমার তো এই বিষয়টা একবার ভাবা উচিত... [শুক্র প্রবেশ করেন]

    শুক্র : আগামীকাল রাজপুণ্য উৎসব। আগামীকাল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বঙ্গদ্বীপের মঙ্গল কামনায় আমি মৌনব্রত পালন করে সন্ধ্যায় প্রার্থনা করব। রাজপুণ্যের দিনে তোমরা সকলেই ইচ্ছা স্বাধীন। বৃত্ত তোমার সকল সতীর্থকে এই সংবাদ জানিয়ে দিও
    বৃত্ত : নিশ্চয়ই গুরুদেব [কচ প্রণাম করে বের হয়ে যায়। বৃত্ত দাঁড়িয়ে থাকে]

    শুক্র : বৃত্তানন্দ?
    বৃত্ত : আগামীকাল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আপনার সাথে মৌনব্রত পালনের অনুমতি প্রার্থনা করছি গুরুদেব
    শুক্র : অতি আনন্দের সাথে আমি তা অনুমোদন করছি বৃত্ত [শুক্র বের হয়ে যান। বৃত্ত তার কাজ করতে থাকে]

    দৃশ্য ২২

    [সাজি হাতে বিভিন্ন গাছে ঘুরে ঘুরে তরুণরা ফুল তুলছে। কচের সাজিতে বেশ কয়েক রংয়ের ফুল]

    কচ : আমার ধারণা ছিল আজ সকলের আগেই আমি এখানে পৌঁছে যাব। কিন্তু এখন দেখছি আমার আগেও অনেকে চলে এসেছে
    তরুণ ১ : রাজপুণ্য উৎসবে সবাই ফুল ছিটিয়ে রাজার মঙ্গল কামনা করবে। তাই বেশি বেশি ফুল পাওয়ার জন্য সকলেই ভোরবেলা চলে এসেছে
    কচ : আমার কিন্তু বেশি ফুলের প্রয়োজন নেই শুধু মানুষ পশুপক্ষী কিংবা ভ্রমর স্পর্শ করার আগে আরো কয়েক প্রজাতির ফুল হলেই হবে
    তরুণ ২ : রাজপুণ্য উৎসবে ভিন্ন ভিন্ন ফুলের কি বিশেষ কোনো মাহাত্ম্য আছে?
    কচ : কিছুটাতো আছেই। ফুলগুলো দেবযানীর জন্য
    তরুণ ১ : বুঝতে পেরেছি। রাজপুণ্য নয় দেবযানীপুণ্যের ফুল ওগুলো। এক ফুলে হবে দেবযানীর পায়ের নূপুর- অন্য ফুলে হবে কোমরের বিছা তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির ফুলে তৈরি হবে দেবযানীর হাতের চুড়ি আর অন্য রংয়ের হবে বাজুবন্দের ফুল। কানের দুল- গলার হার- নাকের নথ- মাথার টিকলি সব অলংকারই আলাদা আলাদা ফুলে। তাই না? আচ্ছা নাও। যত খুশি নাও... আমরা বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেবযানীপুণ্য দেখি

    দৃশ্য ২৩

    [রাজপুণ্য উৎসব। সবাই ফুল আর রঙিন পোশাক পরে নাচগান করছে। রথে চড়ে রাজা বের হয়েছেন শোভাযাত্রায়। জনগণ তার উপর ফুল ছিটাচ্ছে]

    জনতা : দীর্ঘজীবী হোন রাজা। মঙ্গল হোক রাজা বৃষপর্বের
    রাজা : মঙ্গল হোক সকলের। মঙ্গল হোক বঙ্গদ্বীপের [দেবযানী ভিড়ের ভেতর এদিক সেদিক দৌড়ে কচকে খুঁজছে। তার কোনো সাজ নেই]

    রাজা : মঙ্গল হোক ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর। রাজপুণ্যের দিনেও জননী যে বড়োই নিরাভরণ?
    দেবযানী : মঙ্গল হোক রাজার। এখনো ফুল সংগ্রহ হয়নি আমার [রাজা এগিয়ে যান। দেবযানী অবনির দিকে এগোয়]

    দেবযানী : আজ কি কচকে দেখেছ কোথাও?
    অবনি : কচ? সে তো রাজপুণ্য উৎসবে কোনোদিনও যোগ দেয় না
    দেবযানী : উৎসবের কথা নয় বনে কি তার সাথে সাক্ষাত হয়েছে তোমার?
    অবনি : না গো জননী। আজকে আর বাদাবনে যাইনি আমি। তাই বলতে পারব না [দেবযানী অন্যদিকে একদল তরুণের দিকে এগিয়ে যায়]

    দেবযানী : কচ কি আজ তোমাদের সাথে ফুল তুলতে গিয়েছিল?
    তরুণ : না তো। তাকে তো দেখিনি আজ [উৎসব চলছে। রাজ্যের এক স্থানে বড়ো বড়ো পাতিলে লোকজন রান্না করছে। একটা বিশাল কড়াইতে পরিমল মাংস ভুনা করছে। তার পাশে বসে আছে অবনি]

    পরিমল : এটাই জগতের নিয়ম অবনি কেউ দুধ বেচে খায় মদ আর কেউ মদ বেচে খায় দুধ
    অবনি : আর কেউ দুটাই মাগনা খায় যেমন শুক্রাচার্য। হি হি হি
    পরিমল : আচার্য সম্পর্কে বাজে কথা বলা ঠিক না অবনি। উনার জন্যই এই দেশটা অহংকার করে
    অবনি : ওরে বাপরে! এতো দেখি মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। তিনদিন হয় না বঙ্গদ্বীপে এসে উনি আমার থেকে বেশি আচার্য দরদি হয়ে গেছেন
    পরিমল : শ্রদ্ধা এবং স্নেহ এই দুইটা দিন গুনে হয় না মূর্খ হয় গুণ বিচারে। এই দেশে আসার প্রথমদিনেই আমি আচার্যের স্বীকৃতি আর আশীর্বাদ পেয়েছি
    অবনি : তা তো পেয়েছই। প্রথমদিনই শুক্রাচার্য তোমাকে নাম দিয়েছেন পয়মাল ঠাকুর
    পরিমল : ব্রাহ্মণে-ব্রাহ্মণে এরকম রসিকতা চলতেই পারে। তাই বলে তোমার অত চটাং চটাং করার কী আছে?
    অবনি : চটাং চটাং করব না মানে? হাজারবার করব। এই দেশে একজন মাত্র মানুষকে শুক্রাচার্য উপাধি দিয়েছেন। সেটা হচ্ছি আমি অবনি জারক। তিনি বলেন ফুল-ফল-শস্য-মধু জারিত করে জগতের শ্রেষ্ঠ মাদক তৈরি করে বলে আমি তাকে জারক উপাধি দিলাম। আর তোমাকে দিয়েছেন পয়মাল ঠাকুর... [খুঁজতে খুঁজতে দেবযানী এদিকটায় চলে আসে]

    পরিমল : জননী দেবযানী কি এদিকে একটু আসবে?
    দেবযানী : বিশেষ কোনো প্রয়োজন ঠাকুর?
    পরিমল : এই মাংসটি রাজপুণ্যের ব্রাহ্মণভোজ। সারাদিনের মৌনব্রত শেষে আজ সন্ধ্যায় এই ঘৃতভাজা মৃগমাংস ভোজন করবেন আচার্যশ্রেষ্ঠ শুক্র। জননী যদি একটু দেখো যে মাংসগুলো আরেকটু তাপে রাখা প্রয়োজন নাকি যা হয়েছে তাতে তোমার পিতা সন্তুষ্টই হবেন?
    অবনি : শুক্রাচার্যের পেটে অবনির তৈরি মদ পড়লে তোমার ওই মাংস ঘিয়ে ভাজা না জলে সিদ্ধ তিনি তাকিয়েও দেখবেন না [অবনি চলে যায় অন্যদিকে]

    দেবযানী : মাংসের ঘ্রাণে মনে হচ্ছে পিতা যেরকম পছন্দ করেন মাংসগুলো ঠিক সেরকমই হয়েছে [ফুলে ফুলে সাজা শর্মিষ্ঠা প্রবেশ করে]

    শর্মী : দেবযানী? তুমি সাজোনি?
    দেবযানী : আমার ফুল পাইনি শর্মিষ্ঠা
    শর্মী : রাজবাড়ির বাগানে এখনও যথেষ্ট ফুল আছে। চলো তোমাকে সাজিয়ে দেই
    দেবযানী : সেই ভোরবেলা কচ আমার ফুল তোলার জন্য গেছে। সে এখনও ফেরেনি
    শর্মী : বঙ্গদ্বীপের রাজপুণ্য উৎসবে কোনোদিনও কি কচ যোগ দিয়েছিল দেবযানী?
    দেবযানী : উৎসব তার ভালো লাগে না বলে সে উৎসব এড়িয়ে চলে। কিন্তু আজ আমার জন্য তার ফুল নিয়ে আসার কথা
    শর্মী : উৎসব ভালো লাগে না কথাটা ভুল। বলো বঙ্গদ্বীপের রাজার মঙ্গল কামনা তার ভালো লাগে না। কারণ এতে তার নিজের শরীরে জ্বলন শুরু হয়
    দেবযানী : এসব কথা এখন আমি শুনতে চাই না শর্মিষ্ঠা
    শর্মী : অত আবেগি হয়ো না দেবযানী। কাউকে বিশ্বাস করলেও চোখ খোলা রেখে করো
    দেবযানী : আচ্ছা শর্মিষ্ঠা তুমি কি বলতে পারো শুক্রাচার্যের মৃতসঞ্জীবনীর জন্য তোমরা কেন আমার আর কচের জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলছ?
    শর্মী : কারণ তুমিও জানো দেবযানী
    দেবযানী : শর্মিষ্ঠা তুমি দূর হও। তোমাকে আর বিশ্বাস করি না আমি
    শর্মী : ভালো থেকো দেবযানী... [শর্মী চলে যায়]

    পরিমল : অত বিচলিত হওয়ার কিছু নেই জননী। ঈশ্বর না করুন কচের কিছু হলে শুক্রাচার্যের ক্ষমতার কাছে তাকে ফিরিয়ে আনা মুহূর্তের বিষয় মাত্র...
    দেবযানী : কিন্তু পিতা মৌনব্রতে আছেন বলে আজ সারাদিন আমি তার সাহায্য পাচ্ছি না ঠাকুর
    পরিমল : আর তো মাত্র কিছুক্ষণ। মৌনব্রতের পর প্রার্থনা আর ব্রাহ্মণভোজ শেষ হলেই আচার্য সবাইকে আশীর্বাদ করবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত যদি কচের সংবাদ না পাওয়া যায় তবে নিশ্চয়ই তখন তুমি তুমি তার সাহায্য পাবে। ...তুমি বরং উদভ্রান্ত না হয়ে গৃহে ফিরে যাও জননী [দেবযানী চলে যায়। পরিমল রান্না করতে থাকে]

    দৃশ্য ২৪

    [শুক্রের আশ্রম। শুক্র আর বৃত্ত। রাজকীয় বাহকেরা বড়ো থালায় করে মাংস নিয়ে আসে। অবনি এসেছে মদের পিপা নিয়ে]

    রাজ প্রতিনিধি : মঙ্গল হোক আচার্য শ্রেষ্ঠ শুক্রের। বঙ্গদ্বীপের মঙ্গল কামনায় দিনব্যাপী মৌনব্রত সমাপনে এই মদ ও মাংস রাজা বৃষপর্বের পক্ষ থেকে রাজপুরোহিত শুক্রাচার্যের ব্রাহ্মণভোজের নিমিত্তে উপহার। রাজা প্রত্যাশা করেন তৃপ্তি সহকারে এই মদ্য পান ও মাংস আহার করে আচার্য রাজা বৃষপর্বের মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনায় আশীর্বাদ করবেন
    শুক্র : মঙ্গল হোক বঙ্গদ্বীপের। মঙ্গল হোক রাজা বৃষপর্বের। দীর্ঘায়ু হোক তার। ঘ্রাণ শুকেই আমি অনুমান করছি বনের শ্রেষ্ঠ মৃগের মাংসগুলো উত্তম গব্যঘৃতে ভাজা হয়েছে যা আমি বরাবরই পানীয়ের সাথে ভোজন করে তৃপ্তি পাই। আর এই সুরার সুবাস আমাকে বলে দিচ্ছে সাগর দ্বীপের শ্রেষ্ঠ জারক অবনির হাতে তৈরি সুরাই আমার জন্য উপঢৌকন পাঠিয়েছেন রাজা। মঙ্গল কামনা করি তার। হৃষ্টচিত্তে আমি এই উপহার গ্রহণ করলাম [পাচকেরা মদ আর মাংস পরিবেশন করে। শুক্রাচার্য গোগ্রাসে মাংস আর মদ গিলতে থাকেন]

    শুক্র : বহুদিন পরে এতো তৃপ্তি সহকারে ভোজন হলো। প্রশংসা করি পাচকের যার হাতে এই মাংস পরিপাক হয়েছে। মঙ্গল হোক তার। আর অবনি স্বর্গের ইন্দ্র-বরুণ যদি কোনোদিন তোমার হাতের মাদক পান করেন তবে আমি নিশ্চিত তারা তোমাকে সশরীরেই স্বর্গে নিয়ে যাবেন তাদের পানীয় তৈরির নিমিত্তে। ধন্য অবনি জারক ধন্য। ধন্যবাদ রাজা এই উপহারের জন্য [খাওয়া শেষে রাজপ্রতিনিধিরা বের হয়ে যায়। অবনি শেষ পানীয়টুকু শুক্রের পাত্রে ঢেলে পিপা নিয়ে বের হয়ে যায়। শুক্র মদ খেতে থাকেন]

    শুক্র : রাজা বৃষপর্ব যথার্থই ব্রাহ্মণ সেবা জানেন। এজন্যই তার পুরোহিত হয়ে বড়ো সুখ বৃত্তানন্দ। আশীর্বাদ করি দীর্ঘজীবী হোন রাজা বৃষপর্ব [দেবযানী প্রবেশ করে]

    দেবযানী : পিতা!
    শুক্র : রাজপুণ্য উৎসবের দিন কন্যা দেবযানীকে এমন বিস্ত্রস্ত বেশে দেখব সে যে আমার কল্পনারও অতীত
    দেবযানী : পিতা। কচকে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও
    শুক্র : পাওয়া যাচ্ছে না? শুক্রাচার্য সবাইকে সাবধান করে দেবার পরও কার অতবড়ো সাহস?
    দেবযানী : জানি না। হয়তো এবার সত্যি সত্যি বনের কোনো পশু আক্রমণ করেছে তাকে
    শুক্র : তা বটে। তা হতে পারে কারণ ঈশ্বর এই পশুশ্রেণীকে কোনোই জ্ঞান দান করেননি
    দেবযানী : পিতা। আমি প্রকৃতির নিয়ম কানুন বুঝি না আমি শুধু জানি তুমি কচকে বাঁচাতে পারো। আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না পিতা আমি কচকে চাই... কচের সন্ধান করো পিতা
    শুক্র : বৃত্তানন্দ। যাচাই করার প্রয়োজন নেই আমি মাদকমত্ত কি না। তুমি কি আমাকে ধ্যানে সাহায্য করবে?
    বৃত্ত : নিশ্চয়ই গুরুদেব [বৃত্ত উপচার সাজায়। শুক্রাচার্য ধ্যানে বসেন কচের সন্ধানে]

    শুক্র : কচ এতো কাছে?
    দেবযানী : কাছাকাছি? কচ তবে জীবিত?
    শুক্র : না। কোনো এক অর্বাচীন পশু ভক্ষণ করেছে তাকে
    দেবযানী : আবারও বাঘের হাতে পড়েছে কচ? কচ কোথায়?
    শুক্র : বাঘ নয়। অন্য কোনো প্রাণী [শুক্রাচার্য আবার ধ্যান করেন। ধ্যানে বসে তিনি কচকে ডাকেন]

    শুক্র : কচ তুমি কোথায়?
    কচ : গুরুদেব আমি গুরুগৃহে। আমি আপনার আশ্রমেই আছি
    শুক্র : আমার আশ্রমে তুমি পশুর পাকস্থলীতে! কোন সে শ্বাপদ যে শুক্রাচার্যের আশ্রমে তোমাকে উদরে ধারণ করে?
    কচ : গুরুদেব। স্বয়ং শুক্রাচার্যের উদরে আমি
    শুক্র : পুনরাবৃত্তি করো কচ। তুমি কোথায়?
    কচ : আমি আপনার পাকস্থলীতে পরিপাক হচ্ছি গুরুদেব [শুক্রের মনশ্চক্ষে দেখা যায় শুক্রাচার্যের পাকস্থলীতে ধীরে ধীরে পাক খাচ্ছে কচ]

    কচ : আজ সন্ধ্যায় ভ্রাহ্মণভোজে আপনি যে মাংস খেয়েছেন তা কোনো মৃগের মাংস নয় গুরুদেব সেই মাংস আপনার প্রিয় শিষ্য কচের। প্রভাতে দেবযানীর জন্য ফুল আনতে গেলে দ্বীপায়নরা হঠাৎ আমাকে আক্রমণ করে। আমাকে তারা টুকরো টুকরো করে কেটে ঘৃতের সাথে ভেজে আপনাকে ব্রাহ্মণভোজ দিয়েছে। যে মাংস খেয়ে আপনি সকলের মঙ্গল কামনা করেছেন সেই মাংস আমার গুরুদেব... [হতভম্ব হয়ে বসে থাকেন শুক্রাচার্য। কচ পাক খাচ্ছে শুক্রাচার্যের পেটে। দেবযানী অস্থির হয়ে উঠে]

    কচ : দেবযানী...
    দেবযানী : পিতা। কচকে বাঁচাও...
    শুক্র : কন্যা বন্ধু না পিতা কে তোমার কাছে বেশি প্রিয়?
    দেবযানী : কচের জীবন সংকটকালে এই প্রশ্ন কেন পিতা?
    শুক্র : কচকে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু কচ যখন আমার পাকস্থলী ভেদ করে বের হয়ে আসবে তখন মৃত্যুবরণ করতে হবে আমাকে
    দেবযানী : পিতা
    শুক্র : বৃত্তানন্দ...
    বৃত্ত : গুরুদেব
    শুক্র : এই পরিকল্পিত সংকট তুমি আগে থেকে জানো?
    বৃত্ত : অস্বীকার করব না গুরুদেব
    শুক্র : শুক্রাচার্যের অভিশাপকে ভয় করো না তুমি?
    বৃত্ত : মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা চুরির ভয় আমার বেশি গুরুদেব
    দেবযানী : ধিক তোমাকে হত্যাকারী। শুক্রের শিষ্য হয়ে তুমি নরহত্যার পরিকল্পনা করো?
    কচ : দেবযানী...
    দেবযানী : পিতা...
    শুক্র : দেবযানী। সিদ্ধান্ত নাও। পিতা না বন্ধু। কাকে তুমি চাও?
    দেবযানী : আমি দুজনকেই চাই
    শুক্র : যে কোনো একজনের মৃত্যু তোমাকে মেনে নিতে হবে কন্যা
    দেবযানী : আমি দুজনকেই চাই পিতা
    শুক্র : তা হয় না কন্যা। একজন বেঁচে থাকলে অন্যজনকে মরতে হবে এখন
    কচ : একটা উপায় আছে গুরুদেব
    শুক্র : উপায়! কী উপায়?
    কচ : গুরুদেব। মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্রটা যদি আপনি আমাকে শিখিয়ে দেন তবে পুনর্জীবন লাভ করে আমি আবার আপনাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারি
    শুক্র : অসম্ভব!
    দেবযানী : পিতা এটাই একমাত্র পথ দুজনের বেঁচে থাকার। কচকে তুমি মন্ত্রটা শিখিয়ে দাও
    বৃত্ত : নিজের অর্জিত মন্ত্রটা শত্রুর হাতে দিয়ে নিজেকে নি:স্ব করবেন না
    দেবযানী : ঘৃণ্য হত্যাকারীর কথায় কর্ণপাত করো না পিতা। কচকে মন্ত্রটা দাও
    শুক্র : মন্ত্রটা যে মাত্র একজনের হাতেই প্রয়োগ-উপযোগী দেবযানী। কচ মন্ত্রটা শিখে যখন আমাকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োগ করবে তখন থেকেই যে মন্ত্রটা পুরোপুরি কচের হয়ে যাবে? আমার যে আর কোনোদিনও এই মন্ত্রটা প্রয়োগের ক্ষমতা থাকবে না কন্যা?
    দেবযানী : তোমার না থাকলেও তোমার প্রয়োজনে কচ প্রয়োগ করবে এই মন্ত্র
    বৃত্ত : কচ আমাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রটা প্রয়োগ করবে দেবযানী আমাদের পক্ষে নয়
    দেবযানী : মন্ত্র পাবার পরও কচ বঙ্গদ্বীপেই থাকবে পিতা। তুমি মন্ত্রটা কচকে দাও
    বৃত্ত : মন্ত্র পাবার পর এক মুহূর্তও কচ বঙ্গদ্বীপে থাকবে না গুরুদেব। মন্ত্রটা রক্ষা করুন
    কচ : দেবযানী...
    দেবযানী : পিতা কচকে বাঁচাও। মন্ত্রটা তাকে দাও
    বৃত্ত : না। গুরুদেব না
    দেবযানী : হ্যঁ¡ পিতা
    শুক্র : কন্যার আব্দার রক্ষা করলে হাতছাড়া হয় শুক্রাচার্যের এক জন্ম সাধনায় আবিষ্কৃত বঙ্গদ্বীপের রক্ষাকবচ। আর মন্ত্র রক্ষা করলে মেনে নিতে হয় একমাত্র কন্যার স্বেচ্ছামৃত্যুর অভিশাপ...
    বৃত্ত : বৃহস্পতির অবর্তমানে এই কচই হবে আর্যস্থলির রাজপুরোহিত ভবিষ্যৎ শত্রুগুরুর হাত থেকে বঙ্গদ্বীপের প্রতিরক্ষাসূত্রটা রক্ষা করুন আচার্য
    দেবযানী : কচকে বাঁচিয়ে তোলো পিতা। রাজনীতির সাথে কচের কোনো সম্পর্ক নেই
    শুক্র : ব্রাহ্মণ সন্তান কচ যদি আমার উদরে পরিপাক হয় তবে যে ব্রাহ্মণ হত্যার দায় থেকে আমিও রক্ষা পাব না বৃত্তানন্দ?
    বৃত্ত : মন্ত্রটা তবে আমাকে শিখিয়ে দিন গুরুদেব। কচ জীবিত হবার পর আমি আপনাকে পুনর্জীবন দেবো
    দেবযানী : না পিতা না। মন্ত্র পেয়ে গেলে এই বিশ্বাসঘাতক কোনোদিনও তোমাকে বাঁচাবে না বরং তোমার মৃত্যুর পর কচকে সে আবারও হত্যা করবে
    বৃত্ত : মন্ত্রটা আমাকে শেখান গুরুদেব
    শুক্র : সম্পূর্ণ রাজনীতিবিদ হয়ে উঠা তোমাকে যে আমি আর বিশ্বাস করি না বৃত্তানন্দ
    বৃত্ত : গুরুদেব। কচ আপনার উদরে হজম হয়ে গেলে ব্রাহ্মণ হত্যার যে দায়ে আপনি অভিযুক্ত হবেন সে দায়টা না হয় আমাকে দিন
    দেবযানী : এই হত্যাকারীর পরামর্শে নিশ্চয়ই তুমি কন্যাকে হারাতে চাইবে না পিতা?
    পুরোহিত : না কন্যা। বেঁচে থাকবে তুমি। বেঁচে উঠুক কচ। আমিই বরং বেছে নিচ্ছি স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ...
    দেবযানী : না পিতা
    কচ : না গুরুদেব। যদি আমার জন্য আপনাকে মৃত্যুবরণ করতে হয় তবে যে আমি হবো ব্রাহ্মণ হত্যাকারী। এমন অভিশাপ আমি কল্পনাও করি না গুরুদেব [শুক্রাচার্যের পায়ে নতজানু হয়ে পড়ে দেবযানী। ধৈর্য হারান শুক্রাচার্য। হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠেন]

    শুক্র : বৃত্তানন্দ
    বৃত্ত : গুরুদেব
    শুক্র : পিতৃস্নেহ আর ব্রাহ্মণত্বের কাছে তোমার গুরুদেব পরাজিত বৃত্ত...তুমি কি আমাকে মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগের উপচার সাজিয়ে দেবে?
    বৃত্ত : কোনোদিন আপনার অবাধ্য হইনি আচার্য। কিন্তু কচকে বাঁচিয়ে তোলার প্রক্রিয়া থেকে অন্তত আমাকে মুক্তি দেয়ার প্রার্থনা করছি গুরুদেব
    শুক্র : তোমাকে মুক্তি দিলাম বৃত্তানন্দ। আমার সকল নির্দেশ পালনের বাধ্যবাধকতা এবং শিষ্যত্ব থেকে তোমাকে আজ মুক্তি দিলাম আমি। তুমি এখন স্বাধীন [শুক্রাচার্য উঠে নিজেই উপচার প্রস্তুত করতে লেগে যান]

    শুক্র : একটা কথা মনে রেখো বৃত্তানন্দ যদি কোনোদিন কোনো বিশেষ ক্ষমতা অর্জন করো তবে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করার জন্য সব রকম দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠে রুক্ষ-শুষ্ক-কাষ্ঠকঠিন জীবনযাপন বেছে নিও। যা আমি পারিনি শুক্রাচার্যের সংবেদনশীল এক দুর্বলতম স্থান হয়ে রয়ে গেছে এই কন্যা দেবযানী। আর যদি সব রকমের দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারো তবে সাধারণ মানুষ হয়ে থেকো ভুলেও কোনোদিন বিশেষ হতে যেও না... বিদায় প্রিয় শিষ্য আমার.... [শুক্রাচার্য নিজের গলা থেকে উত্তরীয় খুলে বৃত্তানন্দকে পরিয়ে দেন। শুক্রকে প্রণাম করে বৃত্ত বের হয়ে যায়। শুক্রাচার্য ধীর পায়ে বসেন ধ্যানে]

    শুক্র : শুনতে পাচ্ছ কচ?
    কচ : শুনতে পাচ্ছি গুরুদেব
    শুক্র : তুমি আমার অন্তরের দিকে এক ধ্যানে তাকাও। আমি ধ্যানে বসলে এই মন্ত্র আমার অন্তর থেকে তোমার অন্তরে প্রবাহিত হবে। মাত্র একবার তোমার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠবে এই মন্ত্র। দেখো কচ দেখো সেই মন্ত্রের অক্ষর। এই সেই সূত্র যা এই পৃথিবীতে একমাত্র আমিই অর্জন করেছিলাম আর নিজেকে নি:স্ব করে তোমাকে দান করতে যাচ্ছি এখন। এই সূত্রই অতদিন বঙ্গদ্বীপকে সুরক্ষা দিয়েছিল আর এখন করে তুলবে অসহায় এই সূত্রই সেই সূত্র যা এতদিন শুধু শুক্রাচার্যই প্রয়োগ ঘটাতেন আর আজকের পর থেকে তুমিই প্রয়োগ করবে শুধু। এই সেই গোপন সূত্র যা তোমাকে বাঁচানোর জন্য শেষবারের মতো প্রয়োগ করব আমি আর আর আমাকে বাঁচিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে হস্তগত হবে তোমার। দেখে নাও কচ। মনের মধ্যে গেঁথে রাখো
    কচ : মন্ত্রটা আমার মনশ্চক্ষে গাঁথা হয়ে গেছে গুরুদেব [শুক্রাচার্য আসন পরিবর্তন করে কচকে জীবিত করার জন্য মন্ত্র পড়তে থাকেন]

    শুক্র : এবার তবে আদি অধীশ্বর শিবের কৃপায় ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্যের মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের জোরে বেঁচে উঠো প্রিয় শিষ্য আমার। এসো কচ। গুরুর উদর ভেদ করে পূর্ণ মানুষ হয়ে আবার আবির্ভূত হও... [শুক্রের পাকস্থলীতে পাক খেতে খেতে কচ বেঁচে উঠে আর আস্তে আস্তে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন শুক্রাচার্য। কচ এগিয়ে গিয়ে আসন থেকে মৃত শুক্রাচার্যকে সরিয়ে নিজে উঠে বসে শুক্রাচার্যের আসনে]

    কচ : জেগে উঠুন আচার্যশ্রেষ্ঠ শুক্র। আপনারই মন্ত্র শিষ্য কচের প্রয়োগে নিজের দেহে আবার ফিরে আসুন গুরুদেব। আবার দেহ ধারণ করুন শিষ্য কচের ডাকে [শুক্র জেগে উঠে নিজের আসনে কচকে বসে থাকতে দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়েন]

    শুক্র : মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র তবে শুক্রাচার্যের হাতছাড়া আজ... কচের কৌশলের কাছে পরাজিত শুক্রের অহংকার? [কচ তাকে প্রণাম করতে এলে শুক্রাচার্য মুখ ঘুরিয়ে নেন। প্রচণ্ড কাঁদতে থাকেন তিনি। দেবযানী তাকে ধরে তোলে। কচ গুরুকে প্রণাম করে বের হয়ে যায়]

    শুক্র : ধিক শুক্রাচার্য ধিক। একটা জাতির ভরসার চেয়ে ব্যক্তিগত বাৎসল্যকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার জন্য তোমাকে ধিক্কার। অভিশাপ তোমাকে শুক্রাচার্য অভিশাপ সেইসব বিশেষ মানুষদের যারা ক্ষমতাময় হয়েও ব্যক্তিগত দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারেন না নিজেদের। ধিক ধিক শুক্রাচার্য ধিক....

    দৃশ্য ২৫

    [কচ পালাচ্ছে। সাবধানে দৌড়ে পালাচ্ছে সে। দেবযানী ঢুকে কচকে খুঁজতে থাকে। ডাকতে ডাকতে সেও দ্রুত বের হয়ে যায়। জয় আর বৃত্ত কচকে অনুসরণ করে দৌড়াচ্ছে। জয়ের হাতে কুড়াল বৃত্তের হাতে একটা ত্রিশূল। জয় আগে বৃত্ত পরে]

    জয় : তুমি এদিকে যাও আমি ওদিকটা ঘুরে যাচ্ছি [জয় বের হয়ে যায়। বৃত্তের পেছন থেকে একটা বটি দা হাতে পরিমল দৌড়ে আসে]

    বৃত্ত : ঠাকুর আপনি এদিকটা আটকান। আমি সামনে এগোচ্ছি [বৃত্ত পা বাড়াতে গেলে পরিমল তাকে ল্যাং মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। বৃত্ত লাফ দিয়ে উঠতে গেলে পরিমল বটি দিয়ে বৃত্তকে কোপ মারে]

    বৃত্ত : ঠাকুর কী করছেন আপনি?
    পরিমল : ক্ষমা করো বৃত্ত। কচকে নয় তোমাদেরকে আটকানোই আমার কাজ [পরিমল বৃত্তের ত্রিশূল পায়ে চেপে ধরে বটি দিয়ে কোপ মারতে গেলে বৃত্ত ত্রিশূল ছেড়ে লাফ দিয়ে সরে যায়]

    বৃত্ত : ঠাকুর আপনার মাথা কি খারাপ হয়ে গেলো?
    পরিমল : আমার মাথা ঠিকমতো কাজ না করলে মন্ত্রটা আজ কচের হস্তগত হতো না বৃত্ত
    বৃত্ত : জয়দীপ..... [পরিমল বটি নিয়ে বৃত্তকে আক্রমণ চালিয়ে যায়। বৃত্ত পড়ে যায়। জয়দীপ দৌড়ে ঢোকে]

    বৃত্ত : জয়দীপ একে আটকাও। এ বিশ্বাসঘাতক বৃহস্পতির চর [পরিমল জয়কে আক্রমণ করতে যায়। জয় কুড়াল বাগিয়ে ধরে। বৃত্ত মারা যায়]

    জয় : তোকে নরকে পাঠাচ্ছি তবে পয়মাল
    পরিমল : এসো জয়দীপ। এখন আমার নরকে যেতেও আপত্তি নেই। তোমার হাতে মরলেও নদীর ঘাটে পৌঁছাতে কচের যতক্ষণ সময় লাগবে আশা করি ততক্ষণ তোমাকে আমি ঠেকিয়ে রাখাতে পারব [দুজন দুজনকে আক্রমণ করে]

    জয় : শালা বেইমান। বঙ্গদ্বীপের খেয়ে তুমি বঙ্গদ্বীপের সাথে বেইমানি করো?.. [জয় পরিমলকে কুড়ালের নাগালে আনতে পারে না। প্রতিবারই পরিমল কৌশলে সরে যায়]

    জয় : পয়মাল শালা লড়াইও ভালো জানে দেখি। দেখ তবে
    পরিমল : খালি রান্নার জন্য আমি এখানে আসিনি মূর্খ। সব প্রস্তুতিই আমার আছে। দেখ তুই.. [পরিমল জয়কে আঘাত করে। জয় এড়াতে পারে না। জয় পাল্টা আক্রমণ করে। সমানে সমান লড়াই হয়। শেষে এক ঘায়ে জয়দীপ পরিমলকে ঘায়েল করে ফেলে তবুও খালি হাতে সে লড়তে থাকে]

    পরিমল : দেশের জন্য তোর টান প্রশ্নাতীত জয়দীপ। কিন্তু মনে রাখিস মূর্খ আমিও প্রাণ দিলাম আমার দেশের জন্য। তোরা মন্ত্রটা রক্ষা করছিলি অস্ত্র দিয়ে আর আমি তা বের করে নিলাম বুদ্ধি দিয়ে... [জয় পরিমলকে আরেকটা আঘাত করে]

    পরিমল : আহ। অতক্ষণে নিশ্চয়ই কচের নৌকা বেণুমতীর তীর ছাড়িয়ে গেছে। আমার স্বদেশ তবে আজ আবার বঙ্গদ্বীপের চেয়েও অধিক শক্তিমান

    দৃশ্য ২৬

    [নদীর ঘাটে কচ। দেবযানী দৌড়ে আসে ঘাটে]

    দেবযানী : কচ
    কচ : বিদায় দেবযানী
    দেবযানী : তুমি কি আমার সাথে হেঁয়ালি করছ কচ?
    কচ : হেঁয়ালি নয় দেবযানী। দিনের আলোর মতো এক পরিশুদ্ধ বিদায়ের লগ্ন এখন
    দেবযানী : সত্যি চলে যাবে?
    কচ : থাকার জন্য যেহেতু আসিনি সেহেতু ফিরে তো যেতেই হবে
    দেবযানী : কচ যেও না
    কচ : স্বদেশ আমার জন্য অপেক্ষা করছে দেবযানী
    দেবযানী : স্বদেশের জন্য তোমার প্রতিজ্ঞা আছে দেবযানীর জন্য কিছু নেই?
    কচ : তোমার কাছে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা দেবযানী
    দেবযানী : ভালোবাসার বিনিময়ে দেবযানীকে তুমি কৃতজ্ঞতা জানাও?
    কচ : বিদায় দেবযানী [কচ নৌকায় উঠে। নৌকা চলতে শুরু করে]

    কচ : বিদায় বঙ্গদ্বীপ
    দেবযানী : কচ.... [শরীর টেনে জয় প্রবেশ করে। কচ দূরে চলে যাচ্ছে। জয় কুড়াল ছুঁড়তে গিয়ে নিজে পড়ে যায়]

    দেবযানী : কচ....
    জয় : দেবযানী...দেশটারে কাঙাল বানিয়ে দিলি তুই? [জয় মারা যায়]

    দেবযানী : দেবযানী... হায় দেবযানী ভালোবাসার আঁচল বিছিয়ে সত্যিই তুমি তৈরি করে দিলে আগ্রাসনের পথ?... হায় দেবযানী হায়.... [করুণ সুরে শর্মীর গলায় "ভায়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ' এই অংশ থেকে সূচনার গানটি শোনা যায়। সে দেবযানীকে হাত ধরে তোলে। ধীরে ধীরে সবাই প্রবেশ করে গানে গলা মেলায়]

    ছবি: সুমেরু মুখোপাধ্যায়
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • নাটক | ০২ অক্টোবর ২০১১ | ৯৭৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন