এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো  পুজো স্পেশাল ২০১১

  • উইদাউট আ প্রিফেস

    ইন্দ্রাণী
    গপ্পো | ০২ অক্টোবর ২০১১ | ৮৪৪ বার পঠিত




  • আঙুলের ছোঁয়া লাগছিল মুখে, কখনও চোখ, কখনও নাকের পাশে। আলগোছে। হাল্কা ছোঁয়া। অথচ শিরশির করছিল শরীর। সমস্ত শরীর। আঙুলের নখ ছুঁয়ে যাচ্ছিল কানের পাশের গাল। আলতো। চন্দনের ঘ্রাণ আসছিল। চোখ বুজে আসছিল কপালে ঈষৎ সূচালো কিছুর স্পর্শে । সে স্পর্শ যেন অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের মত কপালকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে। ও চোখ খুলতে চাইল। চোখের পাতা ভারি ঠেকল। সামনে দেখল হালকা কচি কলাপাতা রং, লাল পাড়ে ঘেরা। দৃষ্টি ঈষৎ নামিয়ে নিজেকে দেখতে চাইল এবারে। লাল বেনারসীতে দেখল নিজেকে। গভীর বিস্ময়ে। দেখল কনেচন্দন পরানো হচ্ছে তাকে। কচি কলাপাতাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেল সে। হাওয়ায় তালাস করে ফিরল তার হাত। ভারি হয়ে এল তারপর। হাত। সর্বশরীর। কোন এক বিপুল উচ্চতা থেকে পতন হতে থাকল। সে পড়ছে তো পড়ছেই। আতংকে দমবন্ধ হয়ে এল যেন। মুহূর্তকাল।

    ধড়মড়িয়ে উঠে দেখল পাশে ঘুমন্ত সুদীপ। দেখল হাল্কা রাত আলো। দেখল তার খাট বিছানা। তার ঘরদোর। বিনবিনে ঘাম হচ্ছিল তার । কম্বল সরিয়ে বাথরুম গেল। জল খেল। জানালার ব্লাইন্ড সরিয়ে দেখল সাইডওয়াকে জমা বরফ । নিষ্পত্র গাছ। স্ট্রীটলাইট । গত বিশ বছরের চেনা দৃশ্য। ও বিছানায় ফিরে গেল। কম্বলের তলায়। ঈষৎ পা ঘষল। ঘুমন্ত সুদীপের পিঠে হাত রাখল আলগোছে। তারপর ভাবতে চাইল কে চন্দন পরাচ্ছিল তাকে। কচি কলাপাতা শাড়ি। লাল পাড়। ভাবতে চাইছিল। সমস্ত স্বপ্নটাকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছিল মনে মনে। সুদীপ জড়ানো গলায় কিছু বলল। কাশল। ও ঘুমে ডুবে গেল আবার।

    ওর ঘুম ভাঙল ঘড়ির অ্যালার্মে। ভোর পাঁচটায়। সুদীপ তখনও ঘুমোচ্ছে। চোখ খুলেই মনে হ'ল-ওর নতুন চাকরি, আজ প্রথম দিন। কম্বল সরালো, বালিশ থেকে মাথা তুলল ও। সুদীপ ওর হাত ধরল তখনই।

    -এখনও রেগে আছ?

    -দেরি হয়ে যাচ্ছে। ছাড়ো। উঠতে দাও।

    - দপদপাইয়া হাঁটে নারী/ চোখ পাকাইয়া চায় - ঘুম থেকে উঠছ না পেনাল্টি কিক মারছ? শোনো, না চাইলে যেও না। ফোন করে দিও। পরে ফরমাল একটা চিঠি দিয়ে দিও - চাকরিতে জয়েন করছ না তুমি ডিউ টু-যা ইচ্ছে লিখে দিও।

    - ইন্টার্ভিউ দিয়েছি। অফার অ্যাকসেপ্ট করেছি। তুমিই জোর করলে চাকরির জন্য। এখন এসব কথার মানে হয় না। ছাড়ো।
    সুদীপ আবার কাশে। হাত ছাড়ে। পাশ ফিরে শোয়। সিংহের কেশরের মত চুল ওর। অনেকটাই রূপোলী। চওড়া কাঁধ। পিঠ। স্বাতী হাত রাখে সুদীপের চুলে। বিছানা ছেড়ে ওঠে।

    ও বেশ লম্বা। বাঙালী মেয়ের গড় উচ্চতা ছাড়িয়ে পাঁচ পাঁচ হবে। আজকাল রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ওর মনে হয় ও যেন আর তত লম্বা নয়-বেঁটে হয়ে যাচ্ছে যেন। সুদীপ হাসে। বলে-আত্মবিশ্বাসের অভাব, স্বাতী। স্রেফ ল্যাক অফ কনফিডেন্স।

    স্বাতী পায়ের আঙুলে ভর দেয় , গোড়ালি উঁচু করে। একবার দুবার তিনবার। দু হাত তোলে শূন্যে। সামান্য হাঁফায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সুদীপ হাসছে। রাগ নাকি অভিমান ফণা তোলে। দুপ দুপ করে হেঁটে বাথরুমে ঢোকে ও।

    আর এক ঘন্টা পরে স্বাতী যখন রেল স্টেশনে ওর গাড়ি পার্ক করবে, টিকিট কাউন্টারে গিয়ে মানথলি রেল পাস চাইবে, সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে ট্রেনের অপেক্ষা করবে তখন ওর আর মনে পড়ছে না স্বপ্নের কথা। নতুন চাকরি। একটা সুপারমার্কেটের মার্চেন্ডাইস সেকশনের সেলসের কাজ। স্বাতীর একটু ভয় হয়-পারবে তো ও? কোনদিন চাকরি করে নি এ দেশে আসা পর্যন্ত। গত ছয় মাস সুদীপ জেদ করেছে প্রবল। এরকম জেদ করতে স্বাতী দেখেনি আগে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেষ , অন্য শহরে নিজের মত থাকে তারা। এখন তুমি কি করবে স্বাতী? এভাবে বাড়িতে বসে থেকে কি করবে তুমি? কোনদিন চাকরি কর নি। ছোটো থেকে শুরু করো, একটু কনফিডেন্স আসুক তারপর তোমার যোগ্যতা , তোমার পছন্দ মত কাজ খুঁজে নিও।

    স্বাতী তর্ক করেছে। ঝগড়া। রাগ। অবশেষে মেনে তো নিল। কেন যে মেনে নিল নিজেও জানে না। গত ছ মাসের পুরোনো কথা মনে আসছিল ট্রেনে বসে, ভুরু কুঁচকে যাচ্ছিল নিজের অজান্তেই। কপালে ভাঁজ পড়ছিল। ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল কপালে আলতো আঙুলের ছোঁয়া, চন্দনের ঘ্রাণ-রাতের স্বপ্ন। সময় হিসেব করে দেখল কস্তুরীর এখন বিকেল হয়ে এসেছে। অফিসে ব্যস্ত হয়তো। তবু কথা বলতে তীব্র ইচ্ছে হল স্বাতীর। সেই মুহূর্তেই ট্রেনটা টানেলে ঢুকল। নো সিগনাল। লম্বা টানেল পেরিয়ে স্টেশনে ঢুকছে ট্রেন। এবারে নামতে হবে স্বাতীকে। টানেল আসবার সময়টা আন্দাজ করে নিল ঘড়ি মিলিয়ে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর-কাঁচ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই শিরশিরে একটা কাঁপুনি এল শরীরে। একটা এস এম এস করল কস্তুরীকে - শুরু করলাম। সুদীপকে ফোন করে বললো - পৌঁছে গেছি।

    সেদিন কস্তুরী যখন ওর অফিস থেকে বেরোলো, তখন সন্ধ্যা নেমেছে। বাহাদুর গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। বেশ অনেকক্ষণ এসেছে। নীল মারুতি ভ্যানের ওপর খানিক আগের আঁধির ধুলো। হাল্কা পরত। ঝড়ের শুকনো পাতা বৃষ্টির হাল্কা ছাঁটে আটকে আছে। বাহাদুর লাল ঝাড়ন দিয়ে মুছছে গাড়ি।

    গাড়িতে উঠে বসল কস্তুরী। ব্যাগ নামালো কাঁধ থেকে। বাঁহাঁটুটা সামান্য খচ করে উঠল। রোজ যেমন হয় গাড়িতে ওঠার সময়টায়। ড্রাইভারের আয়নায় নিজেকে দেখল ও। গোল মুখ, কপালে বয়সের ভাঁজ। দু এক গুচ্ছ পাকা চুল। ও আলতো আঙুল চালালো চুলে। বাহান্ন হ'ল।

    মোবাইলটা বাজল তখনই। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে গিয়ে হাত ফস্কে গাড়ির মেঝেয়। মোবাইলে এখনও অনভ্যস্ত কস্তুরী। রিং হচ্ছিল তখনও। তার মানে স্বাতী। আর কেউ না।

    কী রে, ব্যস্ত? এতক্ষণ লাগল ফোন ধরতে?

    - আমার কান্ড! ধরতে যাবো। হাত ফস্কে মাটিতে। না না ভাঙেনি। এই তো ফিরছি অফিস থেকে। এই তো পাঁচ মিনিট। হ্যাঁ আজ একটু আগে। বাজার করার আছে। মাছ টাছ। তোর কাজ কেমন চলছে আগে বলবি তো।

    -ভালো। ভীষণ ভালো লাগছে।

    স্বাতী এইখানে বেশ উত্তেজিত হয়ে জোরে জোরে ওর ভালো লাগার কথা বলতে থাকে। আটলান্টিক পেরিয়ে সেই ভালো লাগা, ওর উত্তেজনা পৌঁছে যেতে থাকে কস্তুরীর কানে। খুশি হবে কি না ভাবতে হয় কস্তুরীর। মার্চেন্ডাইস গুছিয়ে রাখা, কাস্টমারকে সাহায্য করা -এই কাজে আনন্দ পাচ্ছে স্বাতী।

    -স্বাতী তুই এতদিন কোন চাকরি করলি না, বলতি কোনদিন করবি না, এখন এই চাকরিই এত ভালো লাগছে তোর?

    -সুদীপ খুব জোর করছিল। বলেছি না? কিন্তু এখন মনে হছে জোর করেই ঠিক করেছে। ভীষণ ভালো লাগছে আমার।

    অবিশ্রান্ত কথা বলে চলে স্বাতী। ওর কোলিগ, ওর বস, এক খ্যাপা ক্রেতা, বোনাস, ওর রোজকার রুটিন। স্বাতীর প্রবল উচ্ছ্বাসে সামিল হতে না পারার জন্য মনে মনে কুঁকড়ে যেতে থাকে কস্তুরী। ব্যাগের গায়ের আঙুল রাখে, তোলে, নামায়। অন্য হাতে কুঁচি ঠিক করে শাড়ির। লাইন কেটে যায় আচমকাই। আটলান্টিকের ওপারে স্বাতীর ট্রেন টানেলে ঢুকেছে।

    কস্তুরী যখন ওদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল, গাড়ি পার্ক করছে বাহাদুর, পূর্ণেন্দু ড্রয়িংরুমে টিভি দেখছে। কস্তুরী ড্রয়িং রুম পেরিয়ে শোবার ঘরে এল। তারপর কিচেনে ঢুকে ঠান্ডা খাবার বের করে রাখল। মাইক্রো ওয়েভে গরম করবে। বাহাদুর বাজারের ব্যাগ আর গাড়ির চাবি দিয়ে গিয়েছিল। ঘরে আলো জ্বালা ছিল। মাইক্রো ওয়েভে ঘূর্ণায়মান নৈশাহারের সুগন্ধ ভাসছিল। টিভির ভল্যুম লো অথবা মিউট করা ছিল। নৈ:শব্দ্যের কি নিজস্ব গন্ধ আছে কিম্বা আয়তন? এই মাইক্রোওয়েভের গোঁ গোঁ আওয়াজ, মুরগীর মাংসের গন্ধ এই সব উপাদানে গঠিত হচ্ছিল নৈ:শব্দ্যের অবয়ব, এই সতেরোশো স্কোয়ার ফিটে। যেমন হয়ে থাকে। যেমন হয়ে এসেছে গত পঁচিশ বছর।

    অন্য কোথাও, পৃথিবীর অন্য কোনও প্রান্তে তখন ভোর হচ্ছিল। স্বাতীর উচ্ছ্বাস তখনও ফুরোচ্ছিল না। সুদীপকে অজস্র চুমু খাচ্ছিল ও। সুদীপের কপাল চন্দনের ফোঁটার মত ভরে যাচ্ছিল চুমুতে। ঠোঁট ভিজে যাচ্ছিল অবিশ্রান্ত। নরনারী মিলিত হবে এখন। স্বাতীর ধূসর চুলে আঙুল বোলাচ্ছিল সুদীপ।

    -বেড়াতে যাবে? অনেকদিন কোথাও যাই নি আমরা ...

    ...সুদীপের ছোটোবেলার শহর প্রথমে- উঁচু নিচু পথ, উপত্যকা, ছোটো টিলার ওপর কলেজ, জঙ্গল, ভাঙা রাজবাড়ি, না কাটা দাড়ি আর ডায়বেটিসে কিছু চেনা মানুষ, এখনও- পুরোনো ওষুধের দোকান, ধানক্ষেতের পাশে শ্মশান। তারপর বালি, কেল্লা, উট- ওদের মধুচন্দ্রিমার শহর। সেই সব গলি, এক পাশে বিশাল কড়াইতে দুধ উথলাচ্ছে-কেশর বাদামবাটা দুধ এ'গেলাস থেকে সে গেলাস আলম্ব নামছে-এ পাত্র থেকে সে পাত্র, সে পাত্র থেকে এ পাত্র, অন্য পাশে কড়াইতে তেল, বেসন, সুবৃহৎ লঙ্কাভাজা, বালির বুক চিরে মসৃণ কালো পিচ রাস্তা, স্যান্ডিউন, উটেদের সারি। প্রাচীন জলাশয়ের ধারে - আজও আকাশ ভরে পাখি উড়ছিল ইতস্তত:- আসন্ন সূর্যাস্তের কমলা আলোয় প্রাচীন ছত্রীর কালচে শিল্যুএট- তার পাশে আবৃতমুখ বৃদ্ধ- সাদা কাপড়ের শিরস্ত্রাণ। বাঁ হাতে যন্ত্র। ডান হাতে ছড়। ছড় চলেছে মসৃণ, সমান্তরাল.... কেশরুয়া বালমা। পাখি উড়ছে। উড়ে বসছে। সারিন্দায় বেজে চলছে কেশরুয়া বালমা...

    তখন মধ্যরাত। কস্তুরীর সেলফোনে স্বাতীর মেসেজ আসে - ও চলে গেল এই মাত্র। ম্যাসিভ অ্যাটাক। কিচ্ছু করতে পারলাম না।



    রেজিগনেশন দিয়েছিল স্বাতী। ভালো লাগছিল না আর। সময় কেটে যাচ্ছিল -এটা ঠিক । কাজু আর মিঠি বারণ করেছিল-ছেড়ো না বলেছিল। বলেছিল-বাবা খুশি হোতো না। আর সমস্তদিন একা একা কি করবে? স্বাতীও জানে না কি করবে ও। একটা অ্যাড দেখছিল। কমিউনিটি কলেজে টাউন প্ল্যানিং পড়ানোর লোক খুঁজছে। অ্যাপ্লাই করবে ভাবছিল। বাড়িটা বিক্রি করে কাছেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে স্বাতী। সেখানেই আছে।

    কিছুদিন যাবৎ একটা খেলা খেলত ওরা । সুদীপ আর ও। ওকে ভেবে নিতে হত সুদীপ নেই, সুদীপ ভাবত স্বাতী নেই। মৃতদেহ কল্পনা করে নিতে হত দুজনের। খেলতে খেলতে কেঁদেছে স্বাতী। পাগলের মত কেঁদেছে। প্রস্তুত ভেবেছিল নিজেকে। অথচ খেলাটা এতটুকুও হেল্প করছে না এলন।

    স্বাতী ভাবতে চেষ্টা করছিল অন্য ঘরে আছে সুদীপ। পাশের ঘরে। এ ঘরে আসছে না তাই দেখা হচ্ছে না। ভাবছিল হয়ত। কিম্বা সম্পূর্ণ শূন্য ছিল ওর মন।

    জানলার কাঁচে ঘনীভূত বাষ্প জল হয়ে গড়িয়ে নামছিল। বাতাসে জলকণা ছিল পর্যাপ্ত। রান্নার ঊষ্ণ বাষ্প মিশেছিল তাতে। ছোট তোয়ালে দিয়ে জানলার কাঁচ মুছছিল স্বাতী। জলকণাগুলি একত্র হয়ে নেমে আসছিল, তোয়ালে শুষে নিচ্ছিল তা। জানলার বাইরের বড় গাছ, উল্টোদিকের বড় বাড়ি- স্বাতীর চোখে পড়ছিল আবার পড়ছিলও না। ওর হাত চলছিল যান্ত্রিক। মন কখনও সুদীপ, কখনও কস্তুরী কখনও উল্টোদিকের ব্যালকনির বাহারি গাছে ছিল। হাত নেমে আসছিল, চক্রাকারে ঘুরছিল। কাঁচ শুকিয়ে আসছিল দ্রুত। ভেজা তোয়ালে নিয়ে কিচেনে ঢুকল স্বাতী। ঈষৎ অন্যমনস্ক। স্রেফ ভাত আর ডাল রান্না করেছিল ও। ভাতের মাড় ভাতেই মরে গিয়েছিল। ডাল ফুটে উপচে পড়েছিল স্টোভটপে। এখন শুকিয়ে গেছে। ভেজা তোয়ালে দিয়ে আলতো ঘষল ও । তারপর ক্লিনিং সল্যুশন স্প্রে করল স্টোভটপে। কিছু আগে হটপ্লেট অন ছিল ।তখনও গরম। রাসায়নিকের সামান্য কয়েক ফোঁটা অদ্ভূত এক বাসের জন্ম দিল। না ফেলা ট্র্যাশব্যাগের ঈষৎ টক গন্ধ, সারারাতের আটকে থাকা বাসি বাতাসের গন্ধ, সব ছাপিয়ে উঠল আশ্চর্য এক গন্ধ। কিসের গন্ধ জানে না স্বাতী। ওর বুক উথাল পাথাল হল আচমকা। দৌড়ে অন্যঘরে এল। এক টানে খুলল সুদীপের ওয়ার্ডরোব। সুদীপের শার্ট,টি শার্ট, ট্রাউজার্স, ব্লেজার। হ্যাঙ্গার থেকে খুলে নিল শার্ট। বের করে আনল আয়রনিং বোর্ড, আয়রন। ইস্ত্রি করতে লাগল সুদীপের শার্ট, নীল সাদা চৌখুপি, সবুজ পিন স্ট্রাইপ, বাটার ইয়েলো-উত্তাপে বেরিয়ে এলো ব্যবহৃত পারফিউমের অবশিষ্ট বাস। ঘোরে পাওয়া মানুষের মত ইস্ত্রি করে চলছিল স্বাতী। জোরে জোরে ঘষছিল সুদীপের বুক পকেট, কলার, কাঁধ। ওর হাত ব্যথা করছিল।

    বাস উঠে আসছিল। পুরোনো সব বাস। ওকে বেষ্টন করছিল।

    আচমকা কলিং বেল বাজে এই সময়। স্বাতী চমকে উঠে দরজার কাছে যায়। কি হোলে চোখ রাখে। দরজা খোলে।

    পুলিশ অফিসারটি বয়সে তরুণ। কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে আই ডি কার্ডটি স্বাতীকে দেখিয়ে পকেটে রাখে।

    -ইভ্যাকুয়েট করতে হবে ম্যাডাম। ইমিডিএটলি। যে অবস্থায় আছেন। আপনার ওপরের অ্যাপার্টমেন্টে একসপ্লোসিভ পাওয়া গেছে। বম্ব ডিসপোজাল আসছে। ওরা গ্রীন সিগনাল দিলে তবে ফেরত আসতে পারবেন। বাট এভ্যাকুয়েট, নাউ। ইমিডিয়েটলি। স্বাতী ইস্ত্রি আনপ্লাগ করে, গায়ে চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে আসে।

    বাইরে ততক্ষণে বেশ লোক । পুলিশ অফিসারটি, দু তিনজন চাইনিজ তরুণী-ইউনিভার্সিটির ছাত্রী-স্বাতী দেখেছে আগে-সিঁড়িতে, লবিতে। এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে বয়স্ক মানুষ কজন। এক্‌জনের মাথায় বেসবল ক্যাপ,কানে মোবাইল, উত্তেজিত হয়ে কথা বলছেন। মুখ চেনা একজন,বাকি দুজনকে দেখে নি স্বাতী। অফিসারটি স্বাতীর কাছে এসে খাতা খোলে। ওর নাম, মোবাইল নম্বর লিখে নেয়। স্বাতী কিছুটা অগোছালো ঘুরতে থাকে কমপ্লেক্সে। বেসবল ক্যাপ এবারে মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে এগিয়ে আসেন।

    - আপনাদের খুব অসুবিধে করলাম। এক্সট্রিমলি সরি। আপনার ওপরের অ্যাপার্টমেন্টটা আমার মা-র। জানেন তো?

    -ঠিক জানি না। আমি খুব বেশিদিন আসি নি এই অ্যাপার্টমেন্টে। তবে দেখেছি মাঝে মাঝে ব্যালকনির টবে জল দিচ্ছেন এক বৃদ্ধা। তিনি-ই তবে আপনার মা।

    -মা গত সপ্তাহে আমার কাছে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই থেকে নার্সিং হোমে। আমি আজ এসেছিলাম অ্যাপার্টমেন্ট ভ্যাকুয়াম করতে, গাছে জল দিতে। অগোছালো হয়ে আছে সব। পুরোনো একটা বাক্স ছিল। আমার বাবার। আজ এসে দেখি সেইটা সামনের ঘরে। খুললাম। পুরোনো ফোটো। পুরোনো চিঠির তাড়া আর তার তলায় চার চারটে গ্রেনেড । ভাবুন একবার। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে আর এমার্জেন্সি কল করলাম। তারপর তো দেখতেই পাচ্ছেন। এক্সট্রিমলি সরি। থ্যান্‌ক গড যে বৃষ্টি ফৃষ্টি হচ্ছে না।

    -আপনার বাবা কি আর্মিতে ছিলেন? হয়তো মেমেন্টো রেখে দিতে চেয়েছিলেন।

    -হ্যাঁ বাবা আর্মিতে ছিলেন। ওয়ার্ল্ড ওয়ারের ভেটের‌্যান। মেমেন্টৈ বটে। বাবা , মা কিচ্ছু ফেলতেন না। সব আছে , জানেন? আমার ছোটো বোনের খেলনা, পুতুল এমনকি ঝুমঝুমিটাও। আমার বেসবল ব্যাট, সাইকেলের পাম্প। উফ। এখন কি ঝামেলা হ'ল বলুন তো। আপনাদের কাছে কী বলে যে ক্ষমা চাইবো..

    - আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে কিন্তু।

    -বলছেন? পুলিশের ঝামেলাটা মিটে যাক, একটু ওপরে আসবেন। মা র কফির শখ ছিল। ভালো কফি আছে। মরোক্কোর। কফি খেয়ে যাবেন প্লীজ।

    আমি পিটার।

    -আমি স্বাতী। এস ডাবলিউ এ টি আই।

    বম্ব ডিজপোজালের লোক আসে। ফায়ার ব্রিগেড। সাইরেন। পুলিশের গাড়ি।ভীড় বাড়ে। স্বাতী একলা দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ আগের সেই সব গন্ধ ওকে ছেড়ে গেছে ততক্ষণে। বেবাক ফাঁকা মাথা। ফাঁকা মন। বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করতে থাকে ও। এভাবে বেলা বাড়ে। ভীড় হাল্কা হয়। হলুদ বেষ্টনী তুলে নেওয়া হয়। অফিসারটি গলা তুলে বলে ওঠেন-বিল্ডিং সম্পূর্ণ নিরাপদ। আপনারা ভেতরে ঢুকতে পারেন। একসপ্লোসিভগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

    স্বাতী গায়ের চাদরটা গুছিয়ে নেয়। অ্যাপার্টমেন্টে ফেরে। আয়রনিং বোর্ড, বোর্ডের ওপর সুদীপের শার্ট, ইস্ত্রিটা। স্বাতী বাথরুমে ঢোকে দ্রুত। আবার বেল বাজে। পিটার।

    - ফ্রী আছেন? আসুন একটু, কফি খেয়ে যাবেন।

    ওপরের অ্যাপার্টমেন্টটির বিন্যাস স্বাতীর আস্তানার মতই। শুধু সর্বাঙ্গে প্রাচীন ছাপ । দেওয়ালে রং ওঠা ওয়াল পেপার, ছত্রাকের কালচে ছোপ, বিবর্ণ কার্পেট-রোঁয়া ওঠা। অদ্ভূত সোঁদা গন্ধ। পুরোনো বইয়ের। পুরোনো কাগজের। সোফার ওপর কার্ডবোর্ডের বাক্স। বাক্স ভরা গ্রামোফোনের প্রাচীন চাকতি। সেভেন্টি এইট , ফর্টি ফাইভ, থার্টি থ্রী আর পি এম। পুরোনো সব গান। ডাঁই করা বই। স্বাতী বই ঘাঁটে। কিচেনে কফি বানায় পিটার আর অবিশ্রান্ত বকে যায়। শিরদাঁড়াভাঙা জীর্ণ বই, পোকায় কাটা, হলদে দাগ। স্বাতী বই ঘাঁটে, রেকর্ড ঘাঁটে। বইটি হাতে উঠে আসে এই সময়। হার্ডবাউন্ড বই ছিল, এখন মলাট থেকে খুলে এসেছে।

    -শোনো পিটার, এই যে বইটা- লেটার্স অফ অ্যান ইন্ডিয়ান জাজ টু অ্যান ইংলিশ জেনটলউওম্যান। পড়েছ?

    -না:।

    -পাবলিশারের নোটে কি লেখা আছে শুনবে? লেখা আছে,These letters were not written with a view to publication. They are now printed with the author's permission, but for obvious reasons no name appears on the title page.

    পিটার,বইটা নিতে পারি?

    -অফ কোর্স। ইনটারেস্টিং লাগলো?

    -খুব।

    - শুধুই পাবলিশারের নোট পড়লে তো !

    -পিটার, দিস বুক ইজ পাবলিশড উইদাউট আ প্রিফেস।

    -রিয়ালি! কেন?

    - বলছে, since it seemed best to allow the letters to speak for themselves.



    মেইল চেক করছিল কস্তুরী। রবিবার। পূর্ণেন্দু যথারীতি ড্রয়িং রুমে। টিভি চলছে। কিচেনে ঢুকে আভেনে প্যাটিস গরম করতে দিল কস্তুরী।

    -অনুপম আসবে বলেছিল। এল না তো।

    -আসবে। বলেছে যখন আসবে।

    -শীতের বেলা, এক্ষুণি অন্ধকার হয়ে যাবে।

    পূর্ণেন্দু টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিল এই সময়। পা তুলে দিল কফি টেবলে।

    অনুপম হন্তদন্ত হয়ে এল বেশ কিছু পরে। হই হই করে বলল,
    -প্যাটিস পরে হবে। হেব্বি শীত। চলুন ব্যাডমিন্টন খেলে আসি একহাত। বৌদি, সোনাই রূপাইএর র‌্যাকেটদুটো আছে? পিন্টুদা, পাজামা ছাড়ো তো। প্যান্ট পরো। অন্ধকার হওয়ার আগে খেলে নি চলো।

    ওদের হাউজিং কমপ্লেক্সের কোর্টে তখন শীতের বিকেল। আলো মরে আসছে দ্রুত। একপাশে শীর্ণ জবাগাছ। শুকনো ভঙ্গুর পাতা। কোমরে আঁচল গুঁজল কস্তুরী। ওদিকে অনুপম। শাটল কক উড়ছে। এদিক থেকে ওদিক। ওদিক থেকে এদিক। হাল্কাচালে খেলা। কস্তুরী কোমরে হাত দিয়ে দম নিল সামান্য। অনুপমও।

    -পিন্টুদা, দাঁড়িয়ে দেখলে হবে?

    - আর তো র‌্যাকেট নেই।

    -আমারটা নাও। আমি একটু ইয়ে ফুঁকে আসি।

    কস্তুরীকে আশ্চর্য করে পূর্ণেন্দু হাতে র‌্যাকেট নেয়। এক পা পিছনে নিয়ে ঈষৎ ঝুঁকে সার্ভ করে। এলোমেলো সার্ভ। শাটল মাটিতে পড়ে। কস্তুরী শাটল তোলে, আলতো আঙুল বোলায় । তর্জনীর নখের পাশের শুকনো চামড়ায় সাদা দাগ পড়ে। সার্ভ করে কস্তুরী। চাবুক চালানো স্ম্যাশ করে পূর্ণেন্দু। সপাটে ফেরত পাঠায় কস্তুরী। এক পা পিছিয়ে বাতাসে র‌্যাকেট চালায় পূর্ণেন্দু। কক উড়ে আসে তৎক্ষণাৎ। কস্তুরী তুলে দেয় আলতো। পূর্ণেন্দু আবার স্ম্যাশ করে। কস্তুরী ফেরত পাঠায়। পূর্ণেন্দু ওকে ছুটিয়ে বেড়ায়। নিজেও ছোটে। মাটিতে পড়ে না শাটল। পূর্ণেন্দু কোর্টে দাপিয়ে বেড়ায়। খ্যাপার মত দেখায় ওকে। শাটল কক শুকনো ঠান্ডা হাওয়া কেটে সাঁই সাঁই উড়তে থাকে। মাটি পায় না। কস্তুরীর বিনবিনে ঘাম শুরু হয়। বাঁ হাঁটু কমজোরি ঠেকে। অনুপম ফিরে আসে এই সময়।

    -পিন্টুদা ঢিলে দাও, বৌদির টায়ার্ড লাগছে বোধ হয়।

    পূর্ণেন্দুর র‌্যাকেটে শাটল ছোঁয়ার শব্দ। তারপর বাতাস কাটার আওয়াজ ওঠে। সাদা পালক কটি একত্রিত-ভেসে আসতে থাকে কস্তুরীর দিকে। কস্তুরী চোখ সরায় না। ধূসর আকাশ, পাক খাওয়া কালচে মশার ঝাঁক পেরিয়ে আসতে থাকে শাটল কক,নিষ্পত্র বৃক্ষশাখের ব্যাকগ্রাউন্ডে শুভ্র পালকগুচ্ছ। সে মুহূর্তে পূর্ণেন্দুর মুখ দেখতে বড় সাধ হয় কস্তুরীর। সে চোখ সরায়। শাটল কক র‌্যাকেট না ছুঁয়ে মাটিতে পড়ে ফলত:। পূর্ণেন্দু র‌্যাকেট ছুঁড়ে দেয় শূন্যে।

    -ভাল্লাগছে না। ভেতরে চল্‌।

    অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে কস্তুরী দেখে -বাইরের ঘরে টিভি চলছে তখনও-অন্ধকার ঘরে টিভির নীল আলো শুধু-টিভি চলছে-আলো কখনও কম কখনও বেশি-- পূর্ণেন্দু পাজামা নামিয়ে দু ঊরুর মাঝে হাত ঢুকিয়ে গোঙাচ্ছে। কস্তুরী লুকিয়ে ফিরে আসে। বালিশে মুখ ঢুকিয়ে হা হা কাঁদে। মৃত্যুকামনা করে । পূর্ণেন্দুর। অথবা নিজের।

    ঠিক সেই সময়ে আটলান্টিকের ওপারে প্রাচীন বইটি খুলছে স্বাতী। বাতাস বইছিল না। নিষ্পত্র বৃক্ষরাজি, জনবিহীন সাইডওয়াক, একলা স্ট্রীটলাইট যেন কিছুর প্রতীক্ষায় ছিল। আকাশ ঘোলাটে। স্বাতীর দুহাতের মধ্যে প্রাচীন বই। শিরদাঁড়া ভাঙা। মলিন পাতা, ছত্রাকজন্মের কালচে ছোপ। একগুচ্ছ চিঠি। কবে খুব ভিজেছিল যেন। বিবর্ণমলাটদ্বয় যেন এতদিন তার জন্যই আগলে রেখেছিল এই সব চিঠি। যেন ওর পাতা ওল্টানো শেষ হলেই ছিঁড়ে খুঁড়ে যাবে সব।

    'You must excuse a letter from somebody you may this morning not even remember. It is the lonely young man with the black face beside the door-to whom you were so kind last night.' নিচে সই- অরবিন্দ নেহরা। চিঠি এক। একলা মানুষের নির্জন কথন শুরু হয়ে যায় । প্রথমে একটি তুলোটে আঁশ স্বাতীকে ছোঁয় যেন। আলতো। ফ্যাকাশে। ক্রমশ: অজস্র কথা, অবিশ্রান্ত কথা গাঢ়, ঘন হয়ে স্বাতীকে ছুঁতে থাকে অঝোর এবং তুমুল। সাদাটে তুলোর আঁশে ঢেকে যেতে থাকে সে । চিঠি দুই, চিঠি তিন, চিঠি চার চিঠি দশ...

    'Please, if ever you have any time to spare, will you remember again the lonely young man beside the door...?' স্বাতী পড়ে - অখন্ড মনোযোগে পড়ে চলে । এলোমেলো বাতাস বয়। প্রাচীন ভাষা, প্রাচীন সময় ওড়ে-স্বাতীর দুহাতের মাঝখানে এসে থামে। 'It is only the hand that holds friendship which in time one does not need to shake away.'। একলা মানুষের দৈনন্দিন জানছেন এক অসম্পর্কিত শ্বেতাঙ্গিনী-অরবিন্দ নেহরার লেডি সাহিব। তারিখবিহীন চিঠি সব। বিচিত্র। আচ্ছন্নকারী। প্রাচীন সময়, প্রাচীন রীতি - রাজনীতি-বর্ণবিদ্বেষ-সন্তানের অকালমৃত্যু- গান্ধী- অসহযোগ, গো ব্যাক সাইমন-স্ত্রী সর্বক্ষণ পুজোর ঘরে। 'So then, I came home, and here I am, reading over your last kind letter, and trying to forget my anxiety by writing to you...' স্বাতীর দুহাতের মাঝে এখন বার্মা মুলুক, শিলং পাহাড়, কলকাতা, মালাবার হিলস । এলোমেলো উড়ছে অজস্র তুলোর আঁশ। ঝরে পড়ছে। চিঠি কুড়ি তিরিশ, চল্লিশ...সাদা তুলোর আঁশে ভরে যাচ্ছে ওর ঘরদোর, খাটবিছানা, কিচেন, স্টোভটপ , ওর আয়রনিং বোর্ড, কাঁচের জানালা , পাশের বাড়ির বাহারি গাছ । স্ট্রীটওয়াক, ল্যাম্পপোস্ট সাদা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ: ।

    'Like the threads that go to make the pattern in a carpet, we are all mixed up with one another, black men, white men, yellow men. ...I like to think that through my pattern there runs a small golden thread, that makes it really quite smart, and that is your kindness to me, and your understanding, and your understanding, and our friendship and all that it has meant.' আকাশ বলে আর কিছু নেই তখন। ঘন কুয়াশার মত তুলোর আঁশ সবখানে। চিঠি পঁয়তাল্লিশ, চিঠি পঞ্চাশ ...

    ' There is no one in my own small world to one I can talk of it with any certainty of being understood...' বালিঘড়িতে সময় ঝরছিল-স্যান্ড ডিউন বেয়ে উটের সারি যাচ্ছিল কোথাও - সারিন্দায় ছড়ের চলন শুনছিল স্বাতী - 'The shadows fall, Lady Sahib. The shadows fall. I must wait until I hear upon the stairs the feet of one come to light my lamp...'

    - কতদিন কথা বলি নি সুদীপ, কত দিন ...

    প্রাচীন ধুলো, মৃত মথ, ঝুরো পাতা ওর কোলে । কাগজকলম নিল ও ।

    সুদীপ,
    আজ এই শীতের প্রথম বরফ পড়ল। চারদিক একদম সাদা ...



    স্বাতীর ফোনটা যখন এল, কস্তুরীর তখন সকাল হয়েছে। সূর্য উঠছিল ওর বাঁদিকে। ওর ডানদিক থেকে একটা প্লেন উড়ান দিয়েছিল। মাথার ওপর প্লেন আর সামনে সূর্য নিয়ে ও হাঁটছিল। বাঁ হাঁটু খচ খচ করছিল সামান্য। তবু ও হাঁটছিল। যেন ওকে হেঁটে যেতেই হবে। যেন ওর হাঁটা ছাড়া গতি নেই। এই সময় ফোন বাজতেই একটু দাঁড়িয়ে পড়ল ও। কথা শুরু করল কস্তুরীই।

    -কী রে তুই এই সময়? কাল তোকে ফোন করলাম। বেজে গেল। মেইল-ও নেই।

    -কলেজে বেশ অনেকটা সময় দিচ্ছি আজকাল। ফিরেছি, দেরিতে, টায়ার্ড লাগছিল। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরে দেখি তোর ফোন এসেছিল।যখন দেখলাম, তুই তখন ঘুমোচ্ছিস।

    -কেমন লাগছে পড়াতে? এতদিন পরে?

    বহুদিন পরে অসম্ভব উচ্ছ্বসিত হল স্বাতী।

    -ভীষণ ভালো লাগছে রে। ভীষণ ভালো। চ্যালেঞ্জিং। বাড়ি ফিরে রোজ ওকেও তাই লিখছি। স্টুডেন্টদের কথা, কোলিগদের গল্প। আজ এই হল, ঐ হল।

    -রোজ লিখিস তুই সুদীপকে?

    -প্রতিদিন। একটা করে চিঠি। লম্বা চিঠি। সব লিখি তাতে। সব। সারাদিন কাজের মধ্যেই ভেবে যাই আজ এই লিখব। এই কথা লিখতে হবে। ঐ কথাটা বলা হয় নি। আজকাল মনে হয়, ওকে লেখার জন্যই এত কাজ করি। সত্যি।

    -কী করিস চিঠিগুলোকে?

    -ফাইলে রেখে দিচ্ছি। থাক। কোনদিন এই অ্যাপার্টমেন্ট খালি করতে এলে কাজুরা পাবে।

    -এবছরে আসার দিন ঠিক করলি কিছু? কবে আসছিস? কাল এই কথাটাই জানতে ফোন করেছিলাম।

    -ঐ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। যেমন আসি। এবারে কেটে নেব টিকিট। তুই পেলি বইটা?

    -না, দোকানে পেলাম না। ক্রসওয়ার্ডে খুঁজলাম। অক্সফোর্ডেও। ইন্টারনেটে অর্ডার করে দেব। কাল ইন্টারনেটে বইটা নিয়ে অনেক কিছু পড়ে ফেল্লাম। চিঠিগুলো সত্যিকারের নয় বোধ হয়।

    -জানি।.....এই কস্তুরী, শোন, এখন রাখি। কে যেন বেল বাজাচ্ছে।

    কি হোলে চোখ রেখে দেখে পিটার।

    -কেমন আছ দেখতে এলাম।

    -পিটার! এসেছ তোমরা টের পেয়েছি। মাথার ওপর খুটুর খাটুর। তোমার মা কেমন আছেন?

    -এখন কিছুদিন রিহ্যাব সেন্টারে থাকতে হবে। তারপর ওল্ড এজে হোমে থাকবেন। অ্যাপার্টমেন্টটা বিক্রি করে দেব। জিনিসপত্র গোছগাছ করছি। পুরোনো বেশ কিছু ফার্নিচার তো ফেলেও দিলাম আজ ফুটপাথে। কাল কাউন্সিলের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে। এখনও গোছাচ্ছি। কোনটা ফেলে দেব, কোনটা থাকবে। তারপর রং করিয়ে বিক্রি করে দেব। কি বলব তোমাকে-কী যে জমিয়েছে আর কী যে জমায় নি বুড়ি... আজও কত কি বের করলাম। এক কাজ করো না ডিনারে এসো ওপরে। সব দেখাবো। অনেক রেকর্ড পেয়েছি। চিঠি বই। দেখাবো তোমাকে। মারিয়াও আছে। কাল তো শনিবার। তুমি সাতটায় চলে এস।

    দরজা বন্ধ করে ঘড়ি দেখে স্বাতী। বেশি সময় নেই। কি ভেবে ভ্যাকুয়াম করে ঘর। আবার ঘড়ি দেখে। কস্তুরীর নম্বর ডায়াল করে।

    -এই তখন ছেড়ে দিতে হল, পিটার এসেছিল।

    -কী বলছে?

    -ডিনারে ডাকল। আরো অনেক পুরোনো জিনিস পেয়েছে, দেখাবে।

    -দারুণ তো। ঘুরে আয়। দ্যাখ, ইন্টারেস্টিং কিছু পাস যদি। হয়তো পুরোনো চিঠি পেলি এক গোছা আর দেখলি পিটারের ঠাকুমাই আসলে অরবিন্দ নেহরার সেই মেমসাহেব। হতেও তো পারে।

    -গল্পে এমন হয়।

    -আর বাস্তবে?

    -ভাব্‌ তুই। আপাতত বাস্তব হল আমাকে একটু বেরোতে হবে - ফুল আর ওয়াইন নিয়ে আসি চট করে তারপর ওপরে যাব।

    - এখন বেরোবি? ওয়েদার কেমন? বৃষ্টি পড়ছে? অবশ্য গাড়ি নিয়েই তো যাবি।

    -না গাড়ি নেব না। একটু প্রবলেম করছে, সার্ভিসিং করাতে হবে। হেঁটেই যাব। এই তো দশ মিনিট।

    -হাঁটবি? বলছিলি যে তোর হাঁটুও আমার মতই ঝামেলা করছে।

    -সেরম কিছু না। রাখি এখন? রাতে মেইল করব।

    স্টেশনের পাশে ছোটো দোকান - চিনে দম্পতির। সেখান থেকে ফুল নিল স্বাতী। সে দোকানের একপাশে বুচার, অন্যপাশে ওয়াইন শপ তখনও খোলা ছিল। রেড ওয়াইন নিল স্বাতী। একহাতে ফুল , অন্য হাতে কাগজে মোড়া ওয়াইনের বোতল। প্রায় নিঝুম পাড়া। গৃহস্থের আঙিনায়, সিঁড়িতে মৃদু আলো। কুকুর ডাকছিল। বাঁদিকের দোতলা বাড়ির দোতলায় ঝমঝম পিয়ানো বাজছিল। এমন সময়ে খুব জোরে বৃষ্টি এল। ভিজছিল স্বাতী। চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেল। ওর একহাতে ফুল, অন্য হাতে ওয়াইন। এই রাউন্ড অ্যাবাউটটা পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা পেরোলেই ওর অ্যাপার্টমেন্ট। অ্যাপার্টমেন্টের আলো দেখা যাচ্ছিল। ফুটপাথে ডাঁই করা বাক্স, পুরোনো টেলিভিশন, রেডিও, আয়না। কাল কাউন্সিলের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল সব। এক দৌড়ে পৌঁছে যেতে চাইল স্বাতী। ওর হাঁটু অবশ হয়ে এল এই সময় আচমকা । স্টীল গ্রে ফোর্ডের ঈষৎ মাতাল ড্রাইভার যখন টার্ণ নিচ্ছিল প্রচন্ড জোরে, সে দেখতে পেল লং কোট, শাড়ি, একহাতে ফুল, হাঁটুমুড়ে বসে পড়ছে রাস্তায়। থামতে চাইল সে। ফোর্ডের চাকা স্কিড করল ভেজা অ্যাসফল্টে ।



    ড্রয়িং রুমে টিভি চলছিল যথারীতি। মাইক্রোওয়েভে রাতের খাবার গরম হচ্ছিল। দেওয়াল জুড়ে প্রাচীন সব ছায়া। নৈ:শব্দের অবয়ব স্পষ্ট।

    কস্তুরী চিঠি লিখছিল।

    স্বাতী,
    এখানে গরম পড়ে গেছে,জানিস?

    বইটা অর্ডার করেছিলাম অ্যামাজনে। এসে গেছে। ডিটেইলে লিখব। আজ হবে না। অনুপম আসবে এখনই। তোকে অনেক কিছু বলার আছে ...

    সবুজ ফাইলটা পাশেই রাখা ছিল। ফাইল খুলল ও । দড়ি বাঁধা পুরোনো সবুজ ফাইল। সবুজ ওর প্রিয় রং। চিঠিটা ফাইলে ঢুকিয়ে আলতো গিঁট দিল কস্তুরী।

    ছবি: সুমেরু মুখোপাধ্যায়
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ০২ অক্টোবর ২০১১ | ৮৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন