বৃদ্ধা এক গাল হেসে, এক অদ্ভুত অকুন্ঠ এবং তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, আমার তখন ২ বছর বয়েস যখন আমার বাবা ওকে নিয়ে আসে এই বাড়িতে। আমি ওকে কোনোদিন পছন্দ করতাম না। ও আসার পর থেকেই বাড়িতে নানা অশান্তি শুরু হয়। ওর যখন ৬ বছর বয়েস তখন থেকেই ওকে আমার বাবা প্রায়ই ওপরের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে সন্ধ্যে বেলা দরজা বন্ধ করে দিত। ও চিৎকার করলে ওর মুখ বেঁধে দিত। আমিও তখন ছোট। তেমন কিছু বুঝতাম না। কিন্তু ওর চিৎকার করলে আমার ভালো লাগতো। আমার যখন ৯ বছর বয়েস তখন আমার মা মারা যায়। বাবা আবার বিয়ে করে। সেই বছরই। আর সেই বছরই, ওর তখন নয় কি দশ হবে, ও আমাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।" একটা অদ্ভুত নিষ্ঠুর হাসির রেখা ফুটে ওঠে বৃদ্ধার মুখে, চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে। ... ...
প্যারিস, ১৮০৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধ। বিখ্যাত ফরাসি গণিতজ্ঞ এড্রিয়ান-মারি লেজানড্রার (Adrien-Marie Legendre) বাড়িতে তাঁর সাথে দেখা করতে এলেন অপরিচিত এক ব্যক্তি। লেজানড্রার হাতে একটা বই ধরিয়ে দিয়ে আগন্তুক বললেন, ‘বইটা যদি একবার পড়ে দ্যাখেন’। খানিক অবাক হয়ে লেজানড্রা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি বই এটা?’ সসংকোচে আগন্তুক জানালেন, ‘আজ্ঞে, কাল্পনিক সংখ্যার (Imaginary number) উপর ... আমার নিজের কিছু মতামত’। ‘কাল্পনিক সংখ্যা!’ হালকা চমক লাগে লেজানড্রার। ‘বলে কি লোকটা! ... ...
জানলাটার কাঠের ফ্রেমটা এবড়ো-খেবড়ো, কোনওকালে রং চড়েছিল তার গায়ে, আজ রং-চটা। ফ্রেমের সঙ্গে লাগানো কাচটাও নোংরা। খুবই নোংরা। গভীর কালচে ছোপ ধরেছে। জানলার একটা পাল্লা খোলা। অন্য পাল্লাটা আঁটা। খোলা যায় না। বন্ধ পাল্লার কাচের উপর এসে বসেছে একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের বোলতা। তার থেকে খানিকটা নীচে অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে একটা প্রজাপতি। ধূসর রংয়ের একটা বড় ছিটে। আর দুয়ের থেকে প্রায় সমদূরত্বে উড়ে এসে বসল একটা চকচকে সবুজ স্বচ্ছ-ডানার ফড়িং। নীলি সকৌতূহলে এই রঙ্গিন ত্রিভুজ দেখছিল। কান ছিল রেহানার কথার দিকে। রেহানা এসেছে ঘরের পাশের দিকটা দিয়ে। রেহানা আর নীলির মাঝখানে জানলার ওপারের একফালি ঘাসের জঙ্গল। তারপর সার দিয়ে রাংচিতার ঝোপ। সেই ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলছে রেহানা। ইস্কুলের গল্প। ... ...
মাঝে মাঝে এই এক দুদিনের জন্য ঝটিকা সফরে গিয়ে অন্য সব শহরে পাঁচতারা হোটেলগুলোতে থাকা অচিনের বিশেষ পোষায় না। তবু পরিচালক হিসেবে তার নিজেরই বানানো ছবি আর ওয়েব সিরিজের প্রচারের দায়িত্ব ফেলে দেওয়াও যায় না, তাই সেগুলো মুক্তির কয়েক সপ্তাহ আগে সময়মতন প্রযোজকদের অফিস থেকে ফোন পেলে ছোট কেবিন ব্যাগটা নিয়ে তাকে বেরিয়ে পড়তে হয়। সব ব্যবস্থা তারাই করে রাখে , অচিনকে শুধু তাল মেলাতে হয়। ... ...
ছোট্ট বেলা থেকে বাচ্চাগুলোকে ভূগোলের নামে পড়ানো হয় জেলার নাম। আঁকানো হয় লাল দগদগে আন্তর্জাতিক সীমারেখা। যে মেয়ে নিজের উঠোনের থেকে লাফ মেরে প্রাচীর ডিঙিয়ে পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছে দোল খায়, সে কী করে খুঁজে পাবে দাগ, প্লট! অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশর খোপ খোপ অংশগুলো তো তার কাছে কিতকিত কিম্বা এক্কাদোক্কা খেলার কোর্ট। তবুও সে পড়ায় স্বাধীনতা উত্তর ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যের বন্টন, তবুও তাকে চেনাতে হয় মাটির বুক চিরে চিরে খন্ড খন্ড করে তৈরি হওয়া দেশ। কারণ সে তো একজন সামান্য দিদিমণি। ... ...
ওই পুরোনো খবরটাতেই জানতে পারি মাণিক্যপুরে থাকতো দুরকম মানুষ, আঁখি আর নয়ন| প্রথমে সবাই বেশ মিলে মিশেই থাকতো, তারপর তাদের ধর্ম আলাদা হলো, এলো বিচ্ছেদরেখা | সেকি বাইরের মানুষের জন্য? কে জানে? আঁখি চা চাষ করে, নয়ন ধান। আঁখি ভেড়া পোষে, নয়ন গরু। আঁখি গাঁজা খায় তো নয়ন তামাক| রাত্রে নিজেদের বানানো নেশাটুকু খেয়ে আঁখি নাচ গান করে, নয়নও | আর তাদের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে| সীমানা নিয়ে লড়াই, ধর্ম নিয়ে লড়াই,চাষের জমি, জল, মাণিক্যপুরে নতুন কি হবে সব কিছু নিয়ে লড়াই| ... ...
একদিন খাবার টেবিলে আলাপ হল পেটার এবং ডাগমারের সঙ্গে, তারা হামবুর্গ থেকে এসেছে। এমনি ছুটিতে কতজনের সঙ্গেই তো পরিচয় হয় কিন্তু এরা একটু অন্য রকম। ডিনারে পেটার আসে স্যুট পরে, ডাগমার ককটেল ড্রেসে। পরে দেখা গেলো বিচেও তারা রীতিমত ব্রানডেড পোশাক পরে। যুদ্ধের পরে ইয়েন্সের বাবা মা প্রায় এক বস্ত্রে লাইপজিগ থেকে মিউনিক আসেন, অনেক কষ্টে সৃষ্টে একমাত্র ছেলেকে পালন পোষণ করেছেন। ইয়েন্স আঠার বছর বয়েসে ব্যাঙ্কে শিক্ষানবিশি (আউসবিলদুং), তারপর ব্যাঙ্কে কাজ। ইয়েন্স কাজের বাইরে কদাচিৎ স্যুট পরে -মনে প্রশ্ন জাগল এখানে এই ক্রোয়েশিয়ার রেসরটে পেটার স্যুট পরে কেন? আনেলিজে লক্ষ্য করেছে তাদের কথা বার্তার স্টাইল উঁচু মাপের, কেতা দুরুস্ত। সকলকে আপনি বলে, করমর্দন করার কালে ঠিকমত মাথাটি ঝুঁকিয়ে দেয়। ... ...
দেশের রাজার ভারী অসুখ করেছে। মুখে হাসি নেই, চোখের তলায় কালি, মাঝেমাঝেই কাতরে কাতরে ওঠে আর বলে, ‘ও হো হো, আমি আর বাঁচব না।’ আমেরিকা থেকে সাহেব ডাক্তার এল। টিপেটুপে দেখে বলল, ‘মহারাজ, বেদনাটা চিনচিন না ঝনঝন, উপর থেকে নীচে, না পাশ থেকে মাঝে?’ রাজা রেগে গিয়ে বলল, ‘সবই আমি বলে দিলে তোমাকে হাওয়াই জাহাজের টিকিট কেটে আনা হল কেন হে?’ ... ...
অনেকক্ষণ ধরে জল ফোটায় শিউলি। চাপাতা। দুধ। চিনি। সব ফুটলে একটা আরামের গন্ধ পাওয়া যায়। পায়ের পাতা টনটনায়। কড়া হয়ে গেছে পা। ফাটা জায়গাগুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে চায়ের ঘ্রাণ নেয়। এইসময়টা তার একেবারে নিজের। মোতি বা পার্বতী থাকতে পারে। রচনা থাকতে পারে। কিন্তু তারা যেন নিজের মনে কথা বলে যায়। শিউলি জবাব দিল কি না দিল, কিছুই এসে যায় না। ... ...
১৪৩০ এর শারদপ্রাতে এই সব হ্যান্ডবিলে লেখা থাকছে- কুমুদি পুরস্কার - নবীনদের বাংলা গল্প লেখার আহ্বান। ... ...
সারাদিন অপেক্ষা করে নওশাদ, কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে নওশাদের মনে পড়ে তার কী করা উচিত, সে রেডিওর ডায়াল ঘুরিয়ে ১২০ কিলোহার্টজ বেছে নেয়। তারপর কয়েকবার “নওশাদ বলছি” বলে। ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে রেডিও প্রাণ পায়। বেলার কন্ঠ, “আপনি সেন্ট্রাল রোডের পেছনের বাড়িগুলির মধ্য দিয়ে কাঁটাবন পার হবেন। আজিমপুর দিয়ে লালবাগে ঢুকবেন। নদী আপনাকে সাঁতরে পার হতে হবে রাতে।” নওশাদ রুদ্ধশ্বাসে বলে, “তারপর?” আবার সারাদিন নিস্তব্ধতা। সন্ধ্যায় নওশাদ ৮০ কিলোহার্টজে বার্তা পাঠায়, “নদীর ওপাড়ে কি প্রতিরোধ কমিটির কেউ থাকবে?” ভোরে বেলার কন্ঠ ভেসে আসে, “না আপনাকে ধলেশ্বরী পর্যন্ত হেঁটে আসতে হবে, আমি সেখানেই আছি।” ... ...
শোভাবাজার রাজবাড়ির পিছনের গেটের কাছে ইন্দুর চেহারা, অবয়ব একটু একটু করে পরিস্ফুট হচ্ছিল শৌভিকের। যেন কিছুটা উৎকণ্ঠা, কিছুটা সতর্কতা নিয়ে জোরকদমে হাঁটছে সে। কাঁধে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ। বোঝাই যাচ্ছে সে পিছুটান ফেলে রেখে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে আজ। উল্টোদিকে শৌভিকের সঙ্গে কিন্তু কোনও ব্যাগ নেই। এমনকী পকেটে পার্সও নেই। আসলে শৌভিকের এমনিতেও কোনও পিছুটান নেই। মাঝেমধ্যেই সে রাতেরবেলা পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়ে কলকাতার রাস্তায়, রাতের জীবন দেখবে বলে। একাধিকবার ফুটপাতে শুয়ে থেকেছে সারারাত। ভিখারি-চোর-মাতাল-কাগজকুড়ুনিদের সঙ্গে। এরকমই এক রাতে, তার মনে আছে, এক স্বল্পবয়সি ভিখারিনি, যার মরদ একসপ্তাহ অন্য মেয়ের ডেরায় কাটিয়ে ফিরে এসেছে, লোকটাকে চ্যালাকাঠ হাতে শাসিয়েছিল—“আর কোনওখানে নয়। তোর ঠিকি ওইখানটায় মারব। মর্দানি জন্মের মতো ঘুচে যাবে, বাঞ্চোত”। ... ...
হপ্তা দুয়েক আগে বাজারে নিতাইয়ের দোকানে বেলাবেলি বসে গঙ্গাপদ এক কাপ চা আয়েস করে খাচ্ছিল। হোক শালপাতা ফোটানো জলে এক চিমটে চা-পাতার চা। শীতটা যেরকম জমিয়ে পড়েছে তাতে নিতাইয়ের ওই যমের অরুচি চাও ভাল লাগছে। ত্যারচা করে রোদ এসে পড়েছে গায়ে। কতকগুলো শালিক তুরুক-তুরুক করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। গঙ্গাপদর মনে হল দিনটা বড় ভাল। মনে হতে হতেই দেখে বাজারের এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে একটা টেম্পো ঢুকছে। টেম্পোর আগমন তাদের বাজারে সুলভ নয়। সবাই হাঁ করে চেয়ে রইলে টেম্পোর দিকে। টেম্পোর পেছনে দুটো আলিসান আর পেল্লায় সিন্দুক নাচতে নাচতে বাজার পেরিয়ে ঢুকে পড়ল মধু পালের বাড়িতে। নিতাই বলল, "মধু পালের টাকা রাখার আর জায়গা হচ্ছে না গো। নতুন সিন্দুক কিনতে হল।" গঙ্গাপদ মনে মনে বলল, "ভাল, ভাল। দিনটা বড় ভাল।" ... ...
ট্যাঙ্কশংকর শংকর ভগমান রূপে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিলেন কিনা তা এই কাহিনীর উপজীব্য নয়। ট্যাঙ্কশংকরের ভর হয়েছিলো, এমন একটা কথা এসেছে। এখন, রেট্রোস্পেক্টিভ বিশ্লেষণে মনে হয়, যেটাকে ভর বলা হচ্ছে সেটা আসলে বাইপোলারের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিম্বা রোদ লেগে বায়ু চড়ে গিয়েছিলো, পিত্ত প্রকুপিত হয়েছিলো, এসবও হতে পারে। মোদ্দা, ট্যাঙ্কশংকর শংকর ভগমান রূপে আবির্ভুত হয়ে লুঙ্গি কোমরে তুলে অর্থাৎ নিচের যন্ত্রপাতি বার করে কতক্ষণ নেচেছিলেন সে সব উদলা প্রসঙ্গে এ কহানি বিলকুল ঢুকবে না। হতে পারে, তিনি এখনো নাচিতেছেন। ... ...
একটা ঢিল ছোড়া যাক। ঢিলটা কাক-ওড়া সরলরেখা ধরে যেতে থাক। যদিও কাকেরা সরলরেখায় ওড়ে, বিষয়টা এমন, মানে, প্রামাণ্য নয়। বিষয়টা কাক নয় ঢিল, ঢিলটা মহাজাগতিক দ্রুতগতিতে সাঁই সাঁই ধাবমান, সরলরেখা কিম্বা প্যারাবোলায়। সরলরেখা, প্যারাবোলা বা নেহায়েৎ ছাপোষা বক্ররেখা ধরে যেতে যেতে ঢিল টাল খেতে বা লড়খড়াতে পারে, নাও পারে। বিষয়টা সেটা নয়। মানে, ঢিলটা কি আদৌ আছে? থাকলেও সেটা কি দৌড়োচ্ছে? আরো মোদ্দা কথা যেটা, সেটা কি ছোড়া হয়েছে? এ সব প্রশ্নের মীমাংসা ধীরে ধীরে হবে, কিম্বা আদৌ, কখনোই হবে না। ... ...
সমুদ্রের দিক থেকে প্রবল হাওয়া উড়ে আসছিল। ঋষির মাথায় অবিন্যস্ত চুলগুলো এলোমেলো উড়ছিল সেই হাওয়ায়। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশে একবার ভাল মতো চোখ বুলিয়ে নিয়ে ও বলল ‘এক্সেলেন্ট।’ মাঝারি মাপের একটা জমির ওপর হোমস্টে-টা। তিনদিকে ছোট ছোট ঘর। মাঝখানে একটুকরো ঘাসে ঢাকা লনমতো। বসে বিশ্রাম নেবার জন্য বা সময় কাটানোর জন্য গোল খড়ের চালায় ছাওয়া জায়গা। হোমস্টের পেছনে বড় বড় কেওড়া গাছের জঙ্গল। গড়ান গাছও আছে। এই হোম স্টে থেকে বিশ/পঁচিশ মিটারের মধ্যেই সমুদ্র। সবসময়ই সামুদ্রিক হাওয়া বয়ে যাচ্ছে এই হোমস্টে-এর গা ছুঁয়ে। এমন হাওয়ায় অবিন্যস্ত এলোমেলো হয়ে যেতে খুব ভাল লাগে। চতুর্দিকে সবুজের পাহারাও খুব সুন্দর। ... ...
আমি সপ্তাহে দু-দিন উপোস রাখি—মঙ্গলবার বজরংবলির উপোস, শনিবার শংকর ভগবানের। তবে এই সব উপোসে চা এবং ফল খাওয়া যায়; অন্ন, মানে ভাত-রুটি-তরকারি, না খেলেই হল। সাধারণতঃ আমি কাঠগোড়া বাসস্ট্যান্ডে সিন্ধি ভদ্রলোকের একটা বড় ফলের দোকান থেকেই কিছু কলা, আপেল, সফেদা ও মুসম্বি কিনে নেই। আজ সেটা হতে পারে নি। ওখানে বিলাসপুর কোরবার বাস অন্ততঃ দশ মিনিট দাঁড়ায়। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, খালাসিরা চা-জলখাবার খায়। কিছু যাত্রীও বাদ যায় না। ফলের দোকানের পাশেই গুপ্তা হোটেল। সেখানে চা খেয়ে সবাই পাশের গলিতে যায় তলপেটের চাপ হালকা করতে। ... ...
শীতের রাতে আগুনে তিনজোড়া হাত উপুড় হয়ে আছে। উত্তুরে হাওয়ায় চাদরমুড়ি দেওয়া তিনটে শরীর আগলে থাকে আগুনকে। তিনজোড়া চোখে তার ছায়া কাঁপে। কাঠ ফাটার পট পট শব্দ। জমা খড়কুটো থেকে অল্প তুলে আগুনে দিলে চিড়বিড়িয়ে ওঠে। দূর হাইওয়ে ধরে শব্দ করে ছুটে যাচ্ছে ট্রাক। তাদের ব্রেক কষার আওয়াজে মিলন পিয়াসি হস্তিনীর ডাক ভ্রম হয়। ধীরেই কথা বলে তারা। ফিসফিস হাসি। রাত গভীর হু হু নীরব। জোরে শব্দ উঠলেই একটা স্থির ভেঙে টুকরো হয় বুঝি। শীত আর আগুন ঘেঁষাঘেঁষি থাকলে শরীর-কথায় ওম চায়। কেউ বলে ওঠে, - একজন করে আমাদের গোপন গল্পগুলো বলি চল আজ। শর্ত হলো, যে গল্প এর আগে কোথাও করিনি। অবসর পাইনি, অথবা তুমুল সংসারী, শান্তি বিঘ্ন হোক চাইনি, কিংবা বেমালুম ভুলেই ছিলাম,মনে করতে চাইনি। আগুনে কুটো পড়ে কিছু। হাইওয়ে ভেঙে আরও কয়েকটি ট্রাকের গর্জন দূরে মিলায়। একজন কেউ তার গল্পটা শুরু করবে এখন। ... ...
মিষ্টির ক্ষেত্রে বঙ্গ ও কলিঙ্গদেশ বাকি উপমহাদেশের তুলনায় আলাদা। এই দুই জাতি ছাড়া ভারতের আর কেউ বড়ো একটা (বা আদপেই) মিঠাইতে ছানার ব্যবহার করে না। আমাদের জিভে সঞ্চারিত রসের ওপর যদি ঐকান্তিক বিশ্বাস রাখা যায় তাহলে মানব সভ্যতার ইতিহাসের অনেক সত্য আপনি উন্মোচিত হতে পারে। কারণ রসনা এমন এক জায়গা যেখানে আমি আপনি সম্পূর্ণ নগ্ন। এই শিল্প আস্বাদনের ক্ষেত্রে কোন ভন্ডামি চলে না। আপনি লুচি, আলুর দম আর রসগোল্লা খেয়ে খাঁটি বাঙালিয়ানার ঢেঁকুর তুলবেন ভাবলেন – তা হবে না। আপনার বাঙালিয়ানার উদগারের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াবে পর্তুগীজ আর ওলন্দাজরা। রসগোল্লা আবিষ্কার নিয়ে এই যে উড়িষ্যা আর পশ্চিমবঙ্গের এত লড়াই ঝগড়া – অথচ তার মূল উপাদান এসেছে ইউরোপের ভিয়ান থেকে। খাঁটি দেশজ কালচার হিসেবে আর যারাই দাবী তুলুক, বাংলার অত্যন্ত গর্বের মিষ্টি চর্চা সেই অঙ্গীকার করতে পারে না। কারণ মিষ্টিতে বাঙালি তার স্বাতন্ত্র্যের জন্যে ইউরোপের কাছে ঋণী। (বাকি রেনেসাঁস থেকে কমিউনিজম – ভিনদেশী না বাঙালি বলেই সম্ভব তা বিদ্বজ্জনেরা বলবেন।) ... ...
প্রথম প্রথম পরীক্ষা শেষে ঘটনাটা ঘটলেও, এক সময় এর ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ল। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও মামার সাথে ঘুমোতে যাবার আবদার থাকতো মোরসালিনের! তবে লিটন নামের এই যুবকটি কিন্তু তার আপন মামা ছিল না। মায়ের এত দূর সম্পর্কের ভাই ছিল যে, মোরসালিন মনে রাখত পারত না ক্রমটা। লিটন মামা একটা বইয়ের দোকনে চাকরি করত, আর থাকত পুরনো ঢাকার একটি স্যাঁতসেতে মেসে, যার দোতলায় উঠতে উঠতে পিচ-কালো নোনা-ধরা দেয়াল, কড়িবর্গায় রাজত্ব করা ধুলোর পুরু আস্তর, আর পলেস্তরা খসে শ্যাওলা গজানো ইটের কংকালে উঁকি মারা অবশ্য দ্রষ্টব্য ছিল যে কোন পরিদর্শকের জন্য। এছাড়া রয়েছে কাঁথা বালিশের ম্যাড়মেড়ে বাসী গন্ধ। একটা পুরনো দিনের এলিয়ে পড়া আলনা, আর হাঁটু-ভাঙা রঙ-উঠা চৌকির তলা চেপে ধরা একটা ফেটে পড়া বিরস-বিবর্ণ ট্রাঙ্ক। সব মিলিয়ে দমবন্ধ অবস্থা! ... ...