সুভাষদা, সুভাষ গাঙ্গুলিকে নিয়ে লিখতে গেলে এখন এই বয়সে এসে ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতি ধূসর পাণ্ডুলিপির মত ভেসে চলে যায়। এই তো সেদিন এপিডিআরের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে সাক্ষাতকার নিতে গেছিলাম সুভাষদা-ভারতীদির ফ্ল্যাটে। সেদিনও সেই প্রথমদিনের মত উষ্ণ গলায় সাদর ডাক। সেদিনও সেই প্রথমদিনের মত খাদির পাঞ্জাবী আর বড় ফাদের পাজামা। সেই প্রথমদিনের মত কদমছাঁট চুল, নাঃ সেবার ছিলো একমাথা কালো এবার পাক ধরেছে তাতে। সেই একই রকম ছিপছিপে অবয়ব, কালো ফ্রেমের চশমা। ... ...
যদিও উপরে বলা এইসব ভাল ভাল জিনিসের আমাদের অভাব ছিল, তবু আমাদের কাছেও লবণে-জারানো জিরাফ ও জেব্রার জিভের আচার ছিল; হালিমাহের বানানো উগালি ছিল; এছাড়া মিষ্টি আলু, চা, কফি, ড্যাম্পার বা স্ল্যাপজ্যাকও ছিল; কিন্তু সেসব খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পড়ে গিয়েছিল। আমার দুর্বল পেট, বিভিন্ন ওষুধ, ইপিকাপ, কোলোসিন্থ, টারটার-এমেরিক, কুইনাইন এইসব খেয়ে খেয়ে বিরক্ত, কাতর। এইসব হাবিজাবি খাবারের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ করছিল। "ওহ, একটা গমের রুটি!" আমার মন কাঁদছিল। "একটা রুটির জন্য পাঁচশ ডলারও দিতে পারি!" ... ...
পাতালপুরী আর রানিগঞ্জ শব্দদুটো কাছাকাছি দেখে আন্দাজ করতে পারছিস সিনেমার গল্পটা কী বিষয়ে? কয়লাখনি। সেই কতদিন আগে হক সাহেবের নবযুগ পত্রিকায় – আরে, হক সাহেব বলছি কেন? তুই তো নিজেই ওই পত্রিকার সোল সেলিং এজেন্ট ছিলি, মনে নেই? – কয়লাখনির শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছিলুম একটা। এখন আবার এসেছি ওদের সঙ্গে মিশতে; সারা দিনের ডিউটির পর ওদের বস্তিতে গিয়ে ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে, কী ধরণের অবসর ওরা কাটায় তাই বুঝতে। এই সব বুঝে তারপর গান লিখব, সুর দেব তাতে। আরও কয়েকটা কাজ করব, শৈলজাকে বলা আছে। ... ...
প্রমোদ দাশগুপ্তের চুরুট খাওয়া তখন খুব বিখ্যাত গল্প। আমি এগার ক্লাসে পড়তে পড়তেই সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত মারা গেলেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর সঙ্গে চীন গিয়েছিলেন। চীনেই মারা যান। তাঁর মরদেহ দেখবো বলে কলকাতা চলে এলাম। মৌলালিতে মাসতুতো দাদাদের কাছে থাকা। ওখানেই থাকতে এলেন খণ্ডঘোষের লড়াকু নেতা মহফুজ ভাই। বিরাট বিরাট লাইন পেরিয়ে প্রমোদ দাশগুপ্তকে দেখলাম।শেষযাত্রার মিছিলে হাঁটলাম। তারপর ব্রিগেডে শোকসভা। ... ...
বড়দাদীর রান্নার স্বাদ এ পাড়ার সবার কাছেই অনন্য। আর বড়দাদী রাঁধেনও খুব যত্ন করে। সবার আগে উনুনে বসল একটা মাটির বড়মুখের হাঁড়ি। তাতে বড়দাদী ঢেলে দিল অনেকটা সর্ষের তেল। সেই তেলে ফোড়নে পড়ল তেজপাতা আর পাঁচফোড়ন। একটু নেড়েচেড়ে তাতে বড়দাদী মুঠো ভরে পেঁয়াজ কুচোনো দিয়ে দিল। এদেরকে লাল করে ভাজার ফাঁকে কতগুলো কাঁচামরিচও দিয়ে দিল বড়দাদী। পেঁয়াজের সাথে সাথে হাঁড়ির মরিচগুলোও রঙ বদলাতে শুরু করলো। বড়দাদী এবার আদা, রসুন বাটা দিয়ে দিল। একটু সময় পরেই তাতে পড়ল জিরাবাটা। সাথে লাল টকটকে শুকনো মরিচ বাটাও পড়ল খানিকটা। ... ...
সামনের ডান পায়ের খুর থেকে তার মাথার উপর প্রান্ত অবধি জিরাফটা মাপে ১৬ ফুট ৯ ইঞ্চি। এই গোত্রের সবচেয়ে বড় আকারের গুলোর মধ্যের একটা। যদিও এক একটা ১৭ ফুটের বেশি মাপেরও পাওয়া গেছে। সারা গায়ে বড় কালো, প্রায় গোল গোল দাগ। খামিসিকে মৃত জন্তুর দায়িত্ব দিয়ে আমি শিবিরে ফিরে গেলাম। সেখান থেকে লোক পাঠাতে হবে জিরাফ কাটা ও আমাদের গ্রামে মাংস বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু খামিসি সিংহের ভয়ে একটা গাছে উঠে বসেছিল আর সেই ফাঁকে শকুনের দল জিরাফের উপর এসে বসেছিল। ... ...
সেই যে ফিলিস্তিন বা প্যালেস্তাইন নামকরণ হয়েছিল ১৩৪ সাল নাগাদ, সেই নাম সরকারিভাবে ব্যবহার হয়েছে রোমের পতনের এক হাজার বছর পরেও। রোমানরা যে বিভিন্ন প্রদেশের রাজনৈতিক সীমানা তৈরি করেছিল সেই সীমানাগুলো রোমের পতনের পরও ব্যবহার হয়েছে- কিছু অদলবদল করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে, তারপর খিলাফত সাম্রাজ্যে আর মামলুক সাম্রাজ্যেও। ... ...
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী তখনও ক্ষমতায় আসেননি, সারা দেশে তখন একটাই শ্লোগান ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, নিজেও চুরি করবো না, অন্যকেও চুরি করতে দেবো না। সারা দেশের সমস্ত মানুষ তখন একযোগে একটাই কথা বলছেন, একমাত্র নরেন্দ্র মোদীই পারবেন, দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে। মানুষের মনে তখন অনেক আশা, গত সত্তর বছর ধরে, কংগ্রেস এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো যেভাবে চুরি করে, দেশটাকে ফোঁপড়া করে দিয়েছে, তাতে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদীই এখন একমাত্র পারেন দেশকে রক্ষা করতে। তাই শ্লোগান উঠেছিল, ‘আব কি বার, মোদী সরকার’, অর্থাৎ এবার চাই মোদী সরকার। কিন্তু আজকে যখন আমরা ২০২৪ সালের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি, তখন কি মনে হচ্ছে, দুর্নীতি কমেছে? ... ...
ঈশ্বর এক্সেল ফাইল খুলে জায়গা জমির চৌহদ্দি আব্রাহামকে দেখিয়ে দিলেন। সেখানে অন্য মানুষজন বাস করছে দীর্ঘদিন- এখন মা কা বা ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে আব্রাহাম এই বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে পারেন না। তাঁর লোকবল নেই। ত্রিকালজ্ঞ মুনির মতন ঈশ্বর জানালেন এসব জমি এমনি এমনি পাওয়া যাবে না, লড়কে লেনা হ্যায়। এখন সরজমিন তদন্ত করে যাও, তবে আমি লিখে রেখেছি এ তোমাদের হবে একদিন। তোমার বংশধর লড়াই হত্যা ধ্বংস করে এই কানান দখল করবে, সেটা তোমার একার কাজ নয়। ... ...
জানলাটার কাঠের ফ্রেমটা এবড়ো-খেবড়ো, কোনওকালে রং চড়েছিল তার গায়ে, আজ রং-চটা। ফ্রেমের সঙ্গে লাগানো কাচটাও নোংরা। খুবই নোংরা। গভীর কালচে ছোপ ধরেছে। জানলার একটা পাল্লা খোলা। অন্য পাল্লাটা আঁটা। খোলা যায় না। বন্ধ পাল্লার কাচের উপর এসে বসেছে একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের বোলতা। তার থেকে খানিকটা নীচে অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে একটা প্রজাপতি। ধূসর রংয়ের একটা বড় ছিটে। আর দুয়ের থেকে প্রায় সমদূরত্বে উড়ে এসে বসল একটা চকচকে সবুজ স্বচ্ছ-ডানার ফড়িং। নীলি সকৌতূহলে এই রঙ্গিন ত্রিভুজ দেখছিল। কান ছিল রেহানার কথার দিকে। রেহানা এসেছে ঘরের পাশের দিকটা দিয়ে। রেহানা আর নীলির মাঝখানে জানলার ওপারের একফালি ঘাসের জঙ্গল। তারপর সার দিয়ে রাংচিতার ঝোপ। সেই ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলছে রেহানা। ইস্কুলের গল্প। ... ...
রিনকিন বলেন তাঁর গভীর মানসিক দ্বন্দ্ব বা Moral Dilemmaই নানাভাবে হানা দিচ্ছে তাঁর দুঃস্বপ্নে। সাদা পবিত্রতার প্রতীক। যেহেতু তিনি তাঁর ধর্মবিশ্বাস, স্কাউটিংয়ের শপথ, গীর্জায় নেওয়া বিবাহ শপথের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারেন নি তাই তাঁর হারানো পবিত্রতাবোধ প্রতিশোধ নিতে স্বপ্নে শ্বেত-কঙ্কাল হয়ে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। র-বাবু বলেন, যদি স্ত্রীকে ত্যাগ না করি - ফ-মণিকেও বিয়ে না করি - তবে স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ তলানিতে ঠেকেছে বলে ফ-মণির সাথে মেলামশা করে নিছক আনন্দ পেতে চাই - কেমন হয়? রিনকিন বললেন, এভাবে দু নৌকায় পা দিয়ে চলা শক্ত তবু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যদি দুই মহিলাই, বিশেষ করে আপনার স্ত্রী, তা মেনে নেন তো ভালোই। তবে আমার পরামর্শ এখন কিছুদিন কার্টুন আঁকা থেকে বিশ্রাম নিন, ফ-মণি থেকেও দুরে থাকুন, দেখুন তাও ঐ দুঃস্বপ্ন ফিরে আসছে কিনা। ... ...
মাঝে মাঝে এই এক দুদিনের জন্য ঝটিকা সফরে গিয়ে অন্য সব শহরে পাঁচতারা হোটেলগুলোতে থাকা অচিনের বিশেষ পোষায় না। তবু পরিচালক হিসেবে তার নিজেরই বানানো ছবি আর ওয়েব সিরিজের প্রচারের দায়িত্ব ফেলে দেওয়াও যায় না, তাই সেগুলো মুক্তির কয়েক সপ্তাহ আগে সময়মতন প্রযোজকদের অফিস থেকে ফোন পেলে ছোট কেবিন ব্যাগটা নিয়ে তাকে বেরিয়ে পড়তে হয়। সব ব্যবস্থা তারাই করে রাখে , অচিনকে শুধু তাল মেলাতে হয়। ... ...
ছোট্ট বেলা থেকে বাচ্চাগুলোকে ভূগোলের নামে পড়ানো হয় জেলার নাম। আঁকানো হয় লাল দগদগে আন্তর্জাতিক সীমারেখা। যে মেয়ে নিজের উঠোনের থেকে লাফ মেরে প্রাচীর ডিঙিয়ে পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছে দোল খায়, সে কী করে খুঁজে পাবে দাগ, প্লট! অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশর খোপ খোপ অংশগুলো তো তার কাছে কিতকিত কিম্বা এক্কাদোক্কা খেলার কোর্ট। তবুও সে পড়ায় স্বাধীনতা উত্তর ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যের বন্টন, তবুও তাকে চেনাতে হয় মাটির বুক চিরে চিরে খন্ড খন্ড করে তৈরি হওয়া দেশ। কারণ সে তো একজন সামান্য দিদিমণি। ... ...
ওই পুরোনো খবরটাতেই জানতে পারি মাণিক্যপুরে থাকতো দুরকম মানুষ, আঁখি আর নয়ন| প্রথমে সবাই বেশ মিলে মিশেই থাকতো, তারপর তাদের ধর্ম আলাদা হলো, এলো বিচ্ছেদরেখা | সেকি বাইরের মানুষের জন্য? কে জানে? আঁখি চা চাষ করে, নয়ন ধান। আঁখি ভেড়া পোষে, নয়ন গরু। আঁখি গাঁজা খায় তো নয়ন তামাক| রাত্রে নিজেদের বানানো নেশাটুকু খেয়ে আঁখি নাচ গান করে, নয়নও | আর তাদের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে| সীমানা নিয়ে লড়াই, ধর্ম নিয়ে লড়াই,চাষের জমি, জল, মাণিক্যপুরে নতুন কি হবে সব কিছু নিয়ে লড়াই| ... ...
আবার মহাকালের রথে চেপে আমরা যদি অতীততর ধূসরতায় প্রবেশ করি, তাহলে সেই পাশা উলটে যাওয়ার দিনে কৈকেয়ীর কাছে নির্মম সত্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দশরথ যতই ঘন ঘন জ্ঞান হারান, বুকে করাঘাত করে বিলাপ করুন, কৈকেয়ীকে অভিসম্পাত দিন,কৌশল্যার প্রতি হঠাৎ উদবেলে হাহাকার করে উঠুনএমনকী তাঁকে বন্ধন করে রাজ্যভার গ্রহণ করতে রামকে পরামর্শ দিন না কেন, রাম যদি পিতৃসত্য না রক্ষা করতেন, তাহলেই কি দশরথের মান থাকত? অত দুঃখের মধ্যেও দশরথের দার্শনিক সত্ত্বাটির নাগাল রাম নিশ্চিত পেয়েছিলেন। দুই পিতার চোখের মণি দুই পুত্র দুই মহাকাব্যের পথ ধরে গিয়েছেন দুই সম্পূর্ণ বিপরীত রাস্তায়। কার শেষে আলো, কার শেষে অন্ধকার, সে জানে রসিক – হৃদয়; পাঠক-সত্ত্বা। ... ...
দেখি দেখি চেনা চেনা লাগে। কী রে ব্যাটা বমকে গেছিস? চিনতে পারছিস না? ন্না মানে এই রকম দেখতে একজনকে চিনতাম, স্কুলে পড়তো। কিন্তু সে তো শুনছি, বিদেশে থাকে? নাম কী? ভোলা। ওরে ব্যাটা, আমিই সেই। এই দেখ ঘাড়ে লাল জরুল। সব নকল করলেও জরুল তো নকল হবে না। ঠিক ঠিক-- বলতেই হয়। ... ...
একদিন খাবার টেবিলে আলাপ হল পেটার এবং ডাগমারের সঙ্গে, তারা হামবুর্গ থেকে এসেছে। এমনি ছুটিতে কতজনের সঙ্গেই তো পরিচয় হয় কিন্তু এরা একটু অন্য রকম। ডিনারে পেটার আসে স্যুট পরে, ডাগমার ককটেল ড্রেসে। পরে দেখা গেলো বিচেও তারা রীতিমত ব্রানডেড পোশাক পরে। যুদ্ধের পরে ইয়েন্সের বাবা মা প্রায় এক বস্ত্রে লাইপজিগ থেকে মিউনিক আসেন, অনেক কষ্টে সৃষ্টে একমাত্র ছেলেকে পালন পোষণ করেছেন। ইয়েন্স আঠার বছর বয়েসে ব্যাঙ্কে শিক্ষানবিশি (আউসবিলদুং), তারপর ব্যাঙ্কে কাজ। ইয়েন্স কাজের বাইরে কদাচিৎ স্যুট পরে -মনে প্রশ্ন জাগল এখানে এই ক্রোয়েশিয়ার রেসরটে পেটার স্যুট পরে কেন? আনেলিজে লক্ষ্য করেছে তাদের কথা বার্তার স্টাইল উঁচু মাপের, কেতা দুরুস্ত। সকলকে আপনি বলে, করমর্দন করার কালে ঠিকমত মাথাটি ঝুঁকিয়ে দেয়। ... ...