অষ্টমশ্রেণীতে সবচেয়ে বড় সমস্যা শুরু হল অঙ্ক নিয়ে। সপ্তম পর্যন্ত পাটীগণিত নিজে নিজেই পারতাম। পঞ্চম আর ষষ্ঠশ্রেণীতে দাদু যা শিখিয়েছিল তাতেই হয়ে যেত। খুব সামান্য কিছু কখনও হয়ত দাদুকে জিগ্যেস করতাম, সেও নিজে তো জানিই একবার দাদুকে বলে নেওয়া। বীজগণিত শুরু হয়েছিল সপ্তম শ্রেণীতে, সে শুরুর দিকে অসুবিধে হলেও মোটামুটি পেরে গেছি। দাদু বীজগণিত দেখাতে চাইত না, আর হাফ ইয়ার্লির আগেই ছোটমামার বিয়ের দিনে দাদু সেই যে পড়ে গেল, আর তো কোন অঙ্কই দেখাতে পারল না। কিন্তু এখন তো বীজগণিত বেশ কঠিন লাগে, এমনকি পাটীগণিতেও মাঝে মাঝেই আটকে যাই। অঞ্জলীদি কতগুলো বাড়ীর কাজ দিয়ে রাখেন, না করে নিয়ে গেলে খুব বকেন তো বটেই, মা'কে বলেও দেন। মা ভাবে আমি মন দিয়ে করার চেষ্টা করি না, কখনও ঠাঁই ঠাঁই করে দুটো থাপ্পড় দেয়, কখনও আমার দ্বারা যে কিস্যু হবে না সেটুকু বলে নিজের কপালের দোষ দেয়। একদিন ভয়ে ভয়ে বড়মামার কাছে নিয়ে গেলাম অঙ্কের বই আর খাতা। বড়মামা খানিকক্ষণ দেখে করেও দিল অঙ্কটা, খানিকটা বুঝিয়েও দিল। তাতে বাকী অধ্যায়টা নিজে নিজেই করে ফেলতে পারলাম। সেই থেকে মাঝে মাঝেই অঙ্ক নিয়ে যেতে লাগলাম বড়মামার কাছে। বড়মামাকে এমনিতে আমার একটু ভয় ভয় লাগে, খুব একটা বেশী কথা বলে না। কোনোকারণে বড়মামার ভুরুদুটো প্রায় সবসময়ই অল্প কুঁচকে থাকে। বড়্মামা ওঠে খুব ভোরে, প্রায় দিদার সঙ্গে সঙ্গেই। সাড়ে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যায়, হেঁটে হেঁটে আটটার আগেই পৌঁছে যায় রিষড়ার অ্যালকালি। অ্যালকালির ভোঁ আমাদের বাড়ী থেকে শোনা যায় না, বেশ অনেকটা দূর। বেলা দশটা নাগাদ টিফিনওলা, একটা রোগা ছেলে সাইকেলের দুইদিকে অনেকগুলো টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলিয়ে এসে দাঁড়ায়। বড়মাইমা কিম্বা দিদা গিয়ে একটা ভাত, ডাল, মাছের ঝোল ভরা হিন্ডালিয়ামের তিনথাক টিফিন ক্যারিয়ার দেয় তাকে, সে শোঁও করে সাইকেল বেঁকিয়ে চলে যায়। একটা দেড়টা নাগাদ এসে খালি টিফিনকারিটা ফেরত দিয়ে যায়। কোনও একটা বাড়ীর টিফিনকারি থাকে ওর কাছে, যার মাঝখানের আর ওপরের বাটিদুটো টোল খাওয়া, ওপরের বাটিটার টোলের পাশে কালো কালো দানা দানা মত, দেখে কেমন বিশ্রী লাগে। আরেকটা টিফিনকারি আছে তামার তৈরী বোধহয়, টাট, কোশাকুশির মত ঝলমল করে। বাটিগুলো একটু ছোট, ফলে পুরো টিফিনকারিটাই অন্যগুলোর থেকে কম লম্বা। আমার খুব পছন্দ ওটা, যতক্ষণ টিফিনওলা অপেক্ষা করে, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। ... ...
আবার সেই গাদাগাদা অচেনা লোক, সেই একগাদা হাবিজাবি মন্ত্র আর বারবার করে 'প্রেত প্রেত' করতে লাগল ঠাকুরমশাই। আবার আমার ইচ্ছে করে এই ঠাকুরমশাই নামের লোকটাকে ধাঁইধাঁই করে মারতে। মীনামার মত ভালমানুষ যে কাউকে কোনোদিন একটু জোরে বকে নি, সবসময় হাসিহাসি মুখে থাকত, তাকেই এই পাজী লোকটা 'প্রেত প্রেত' বলছে! আমাকে যারা যারা ভালবাসত তাদেরকে এই ঠাকুরমশাইরা 'প্রেত' বলে ডাকে আর তারপর একগাদা কাপড়চোপড়, বাসনপত্র, খাবারদাবার এমনকি বিছানা বালিশ, ছাতা পর্যন্ত পোঁটলা বেঁধে নিয়ে চলে যায়!! এই নামাবলি জড়ানো একটু কুঁজোমত লোকগুলোর প্রতি এক তীব্র বিতৃষ্ণা, প্রায় বিদ্বেষ জন্ম নিতে থাকে আমার মনে। ... ...
ঝলমলে সোশ্যাল মিডিয়া আর স্মার্টসিটির বাইরে কবে থেকে যেন হেঁটেই চলেছে আরেকটা ভারত। এতদিনে তাদের অন্তত নামটুকু নথিবদ্ধ থাকার কথা ছিল সরকারের কাছে। কথা ছিল, কিন্তু নেই আসলে, আর সেজন্য আমরা ন্যুনতম লজ্জিতও নই, প্রশ্নও করি না কেন অভিবাসী শ্রমিকদের তালিকা নেই সরকারের কাছে? কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও গ্রামীণ মেয়েদের এত হাঁটতে হবে শুধুমাত্র জলের জন্য? বইটা আমাদের জ্বলন্ত এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় ‘সুনাগরিক’এর দায়িত্ব পালন করি নি আমরাও। ... ...
মেঠোবই – বাঙলার জীববৈচিত্র্য পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদ ... ...
পরপর দুটি স্মৃতিকথা পড়া হয়। প্রথম বাশারাত পীর লিখিত ‘কার্ফ্যিউড নাইট’ এবং সেই সূত্রে রেফারেন্স পেয়েই বিপ্রতীপের আখ্যান রাহুল পন্ডিতা লিখিত ‘আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস’। পীরের লেখা আমাকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। আফস্পা নামক আইনটি এবং সেই রক্ষাকবচের আড়ালে কাশ্মীর বা মণিপুরে ভারতীয় সেনার দানবীয় রূপের কিছু কিছু কথা জানা ছিল, জানা ছিল না এই ভয়াবহ অত্যাচার আর অবিশ্বাসের আবহাওয়ার। জানা ছিল না সরকার তথা সেনাবাহিনী অথবা সন্ত্রাসবাদী তথা স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর এই দুই পক্ষের মধ্যে কোন একটির আওতায় থাকতে বাধ্য প্রতিটি মানুষ। জানা ছিল না এমনকি পক্ষাবলম্বনের পরেও সেই পক্ষের মধ্যে থাকতে পারে অজস্র ছোট পক্ষ যাদের মধ্যের বাদানুবাদে যেকোন মুহূর্তে বিপন্ন হতে পারে মানুষের সর্বস্ব। প্রায় নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে পীর লিখে গেছেন কাশ্মীরের অসহায় বিপন্ন দিনরাতের জ্বলেপুড়ে যাওয়ার কাহিনী। পন্ডিতা নিজে কাশ্মিরী পন্ডিত, লেখা সত্যি বলতে কি বড় বেশী পার্টিজান, খুব যে ভাল লেগেছে পড়তে তা নয়, কিন্তু এ বইও আমার জন্য আই ওপনার। কাশ্মীরি পন্ডিতদের আতঙ্ক ও অসহায় পলায়ন ঠিক এভাবে জানা ছিল না। ... ...
বীরেন শা'য়ের বাড়ীর দুইঘর ভাড়াটে নাকি গিয়ে সাতুদের দোতলায় উঠেছে। এদিকে দাদুদের গোয়ালঘরেও ভালই জল উঠেছে, প্রথমদিন তো লালি আর আকাইম্যা সারাদিনরাত দাঁড়িয়ে রইল। পরেরদিন ভোররাতে লালি কেমন অদ্ভুত আওয়াজ করে ডাকতে লাগল। তখন দাদু গিয়ে ওদের দড়ি ধরে এনে দাদুদের দিকের ভেতরের বারান্দায় তুলল। সে বেচারাদের কি ভয় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে, অর্ধেক সিঁড়ি তো জলে ডোবা, তড়বড় করে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আকাইম্যা একেবারে দাঁড়িয়ে গেল শক্ত হয়ে, কিছুতেই নড়েচড়ে না। দাদু শেষে ওকে পাঁজাকোলা করে বারান্দায় তুলে দিল। লালি বেচারীর শিগগিরই বাছুর হবে, পেটটা ফুলে একেবারে ঝুলে গেছে, প্রায় মাটি ছুঁইছুঁই। খুব কষ্ট করে বারান্দায় উঠল। বারান্দার কোণায় ছোট গামলা করে ওদের জাবনা দেবার ব্যবস্থা হল। লালি উঠেই সেই যে বসে পড়ল, সারাদিনে আর উঠে দাঁড়াল না। শেষে দাদু আর দিদা সন্ধ্যের আগে অনেকক্ষণ ধরে ছোবড়ার আগুন জ্বালিয়ে লালিকে সেঁক দেওয়ার পরে বেচারী একটু ধাতস্থ হয়ে জাবনায় মুখ দেয়। পরেরদিনটাও লালিরা বারান্দায়ই রইল, তার পরের দিন জল অনেক নেমে গেল; উঠোনে আধহাঁটু, গোয়ালে গোড়ালি ভেজে কি ভেজে না। লালি আর আকাইম্যা আবার গোয়ালে ফেরত গেল। বারান্দায় দুই বোতল ফিনাইল ঢেলে ধোয়া শুরু করল বড়মামীমা। লালির জন্য গোয়ালে একটা ভাঙা দরজা পেতে দেওয়া হল, যাতে শুকনো জায়গায় বসতে পারে। পাড়া থেকে কারা যেন জিটিরোডে গিয়ে ইলেকট্রিক অফিসে খবর দিয়ে এল। এই সময় শুরু হল উঠোনে মাছের আনাগোণা। এদিকে শ্রীপল্লীর মাঠের পেছনের অংশের পুকুরটা ভেসেছে, ওদিকে শ্রীদুর্গা মিলের পুকুর। এই শিউলি গাছের গোড়া বাটামাছের ঝাঁক তো নারকেল গাছের গোড়ায় কইমাছ কানে হাঁটছে। বাবু, সুবীর, রতন, বুম্বারা ছেঁড়া মশারি, গামছা আর মাটির হাঁড়ি নিয়ে হইহই করে সারাপাড়া জুড়ে মাছ ধরে বেড়াচ্ছে। বুড়ীর মা মাসি আজ কাজে এসেছে, পেয়ারাগাছের সামনে থেকে খপ করে একটা মাঝারি সাইজের শোলমাছ ধরে ফেলল। বড়মামীমা মাছ কাটতে কাটতে মা'কে বলে 'কালিয়া করব, ওদের জন্য দেব, আগেভাগেই ওদের ভাত খাইয়ে দিস না দিদি।' ভাই শুনতে পেয়ে মুখ বেজার করে, ও মাছ খেতে একদম ভালবাসে না। ছবিমাসি দিদাকে বলে ‘মাসিমা আফনে রান্ধেন, আফনের রান্ধা কালিয়ার সোয়াদ মুহঅ লাইগ্যা থাহে।' দিদা হাসিহাসিমুখে বলে ‘হ বৌমা তুমি অন্যটি দ্যাহ, মাছটা আমি দেখ্তাসি।' ... ...
হাইস্কুলের মণীষাদি খুবই মারকুটে ছিলেন, তিনিও আর বেত মারেন না, তবে অদ্ভুত অপমানজক শাস্তি উদ্ভাবনে এঁর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। ক্লাসে কথা বলায় দুজনকে দোতলার বারান্দায় নিয়ে একে অপরের কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ও পাশে মিনুদিকে পাহারাদার হিসাবে বসিয়ে রাখা, অঙ্ক না পারলে জুতো হাতে নিয়ে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, দুজন ছাত্রীর মধ্যে ঝগড়া ও মারামারির অভিযোগ পেয়ে নিজের নিজের জুতো দিয়ে একে অপরের গালে মারতে বাধ্য করা ইত্যাদি ছিল তাঁর উদ্ভাবন। ... ...