এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ৪০

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৩৫১ বার পঠিত
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ৪০

    স্বর্গে প্রত্যাবর্তন?


    কাজিদার আহ্বান তো আর ব্যর্থ হবে না, কয়েকদিন পরেই চিঠি লিখে কলকাতায় হাজির হয় পিংলা। স্বদেশীয়ানা, দেশপ্রেম – এইসব উত্তেজনাকর শব্দগুলোর কী আবেদন কাজিদার কাছে, তা পিংলার চেয়ে বেশি কে-ই বা জানে! কিন্তু যে উত্তেজনায় শুরু, কিছুদিন বা কয়েকবছর সেই উত্তেজনার বেগেই এগিয়ে চলা আর তারপর হঠাৎই একদিন উত্তেজনাতেই শেষ! কাজিদা যখন বহরমপুরের জেল-এ, তখন তাকে একটা চিঠি লিখেছিল পিংলা – তার স্পষ্ট মনে আছে সে চিঠির কথা – তাতে সে অভিযোগ করে বলেছিল স্পষ্ট কোন রাজনৈতিক আদর্শ কাজিদার জন্যে নয়, সে কখনও বিপ্লববাদী কখনও গান্ধীবাদী; মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সঙ্গে থাকলে সে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের কথা চিন্তা করে, জেলে-চাষা-শ্রমিক-কৃষকের জয়ধ্বনি তখন তার কথাবার্তায়, মিটিং-মিছিলে আর গানে-কবিতায়। ইদানিং শোনা যাচ্ছে রাজনীতি থেকে সে শতযোজন দূরে! সে নাকি যোগাভ্যাস করছে আজকাল, আকাশ থেকে ক্ষরিত মধুর স্বাদ পেয়েছে সে! মধু মধু মধু ইদানিং তার মন্ত্র! যে বৃত্তে সে ঘোরাঘুরি করত এতদিন, সেই কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রাত্যহিক যোগাযোগের থেকে অনেক দূরে সে এখন!

    বেশ কিছুদিন হল কবিতা আর লিখছে না কাজিদা, লিখলেও তা প্রায় অন্যের মনজোগানো পদ্য। গান অবিশ্যি সে প্রচুর লেখে এখন; সুর দেয়, নিজে গায় এবং অন্যকেও তৈরি করে। কিন্তু যখন মূলত কবিতা লিখত সে, তার সেই সময়কার গানে যে দৃপ্ত ভঙ্গি, মানুষের এবং দেশের প্রতি যে ভালোবাসা এবং নির্ভরতা উচ্চারিত হত তখন, এখনকার গানে তা একেবারেই অনুপস্থিত। ঈশ্বরবিশ্বাসী কাজিদা চিরকালই; কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবিধানে নিজের আদর্শের, সংগঠনের এবং জাতির শৌর্যেই যার চিরকালের বিশ্বাস – নিজে লড়াই করে বাঁচতে চায় যে একমাত্র তারই হয়ে ঈশ্বর বা আল্লা বা গড লড়াই করতে নেমে পড়েন – এই যার চিরকালের মন্ত্র, সেই কাজিদা আজ বিশ্বের যাবতীয় অসাম্য এবং অন্যায়ের প্রতিকারের ভার কোন গুরুমন্ত্র বা ঈশ্বরকৃপার উপর ছেড়ে দিয়েছে, এ-কথা পিংলা ভাবতেও পারে না। এই যে জানুয়ারিতে মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি হল, কাজিদার কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না! অথচ উনিশশো তিরিশের ডিসেম্বরেও শহীদ যতীন দাসের স্মরণে কবিতা লেখা আর বাঘা যতীনদের বালেশ্বর লড়াইয়ের কথা মনে রেখে নব-ভারতের হলদিঘাট প্রকাশ করার অপরাধে কাজিদার প্রলয়শিখা কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছে!

    সেই-যে অ্যালবার্ট হল-এ “বিদ্রোহী কবি” কাজি নজরুল ইসলামকে বাংলার শ্রেষ্ঠ মানুষরা সবাই মিলে “জাতীয় কবি” অভিহিত করে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন, হলের একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে বুলবুলকে কাঁধে চড়িয়ে যে সম্বর্ধনার সাক্ষী হয়েছিল পিংলা নিজে, যেখানে সুভাষবাবু নিজে বলেছিলেন,“আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব – তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব”– সে-সব কথা কিছুদিন ধরেই মনে পড়ছিল পিংলার।

    শহীদুল্লা সাহেব আর কাজিদার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে তার প্রথম ভ্রমণের কথাও মনে পড়ে পিংলার। পতিসরে সে গিয়েছিল নিজে থেকে, অতুলবাবু স্যরকে ধরে; কাজিদাকে কিন্তু গুরুদেব নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে থেকে যাবার জন্যে। বলেছিলেন, কাজিদা দিনুবাবুর সঙ্গে গান গাইবে আর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছেলেদের ড্রিল করাবে। রাত্তিরে খাবার সময় আরও একবার গুরুদেব কাজিদাকে বললেন, আমি ভেবেছিলুম তুই দেশের কাজই করতে চাইবি। দেশের কাজই তো। গুরুদেবও চেয়েছিলেন, কাজিদাও করুক সে-কাজ। কিন্তু সেই সময়, দেশের কাজ বলতে কবি যা বুঝতেন, আর কাজিদা যা বুঝত, তার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। কবির ভাবনার সেই দেশের কাজে শেষ পর্যন্ত লেগে গেল পিংলা, আজও সে সেই কাজে টিকে আছে। কাজিদাও নিজের ভাবনার দেশের কাজ করতে করতে এখন যেখানে পৌঁছেছে, সেটা কি ঠিক দেশের কাজ? গুরুদেবের নির্দেশেই গোসাবায় ড্যানিয়েল সাহেবের কাজ দেখতে গিয়েছিল পিংলা। আর, যা দেখেছিল সেখানে গিয়ে, তার মনে হল কাজিদাকে জানাবে সে। যা দেখবে ভেবে সে গিয়েছিল, আর গিয়ে সত্যি-সত্যিই দেখল যা, তার মধ্যে ফারাক অনেক। ফারাক মানে খামতি নয়, অশেষ ধৈর্য নিয়ে আর নিজের বিশ্বাসে অটুট থেকে যে পদ্ধতিতে কাজ করছিলেন ড্যানিয়েল সাহেব, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। অনেক উচ্ছ্বাস তৈরি হচ্ছিল তার নিজের মধ্যে। সেই উচ্ছ্বাস কাজিদার সঙ্গে একটু ভাগ করে নেওয়া ওই চিঠিটা লিখে। মনে মনে হয়তো একটু আশাও ছিল তার, ওই চিঠি কাজিদার প্রেরণাও হতে পারে। হয়তো সত্যি-সত্যিই চিঠিটা তাকে দেশের কাজে ফিরিয়ে আনবে আবার।

    এ-ছাড়া আরও একটা কথা। সেই-যে কতদিন আগে অতুলবাবু স্যরের সঙ্গে সে গিয়ে পৌঁছল পতিসর নামে ঠাকুরবাবুদের জমিদারির একটা গ্রামে, তখন থেকেই সে শিক্ষানবিশ। কাজ করতে করতে শিখছে সে। কবি যখন মনে করলেন তাকে সুরুলে আসতে হবে, খবর পাঠালেন তাকে। সে এল। আবার শিক্ষার শুরু। পতিসরের মতো অত সহজ কাজ সুরুলে নয়। একেবারে গোড়া থেকে শিখতে শুরু করতে হল এখানে। ধাপে ধাপে কবির ভাবনার গ্রাম-স্বরাজের দিকে এগোনোর শিক্ষা। যে-কটি কাজের সঙ্গে তাকে যুক্ত করা হয়েছে সুরুলে – বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সংগঠিত গ্রামের সূচনা, ধর্মগোলা স্থাপন, ম্যালেরিয়া নিবারণ থেকে গ্রামসমাজের স্বাস্থ্যহীনতার দূরীকরণ, পণ্য হিসেবে গ্রামীণ শিল্পের প্রচার – এই সবই সে কাজ করতে করতেই শিখেছে। কিন্তু কবির ভাবনা তো শুধুই 'কেজো' নয় – গ্রাম সমাজের সাবেক ঐতিহ্য অনুসরণ করে অবসরের সময়ে পাঁচালী-পুরাণ-মহাকাব্যের পাঠ আর আলোচনাও – তা করবার শিক্ষাও সে পেয়েছে। ফলে, আজ সে মুখে মুখে কবিতা বা গান রচনা করতে ওস্তাদ; কেউ জানে না কিন্তু নিজস্ব একটা খাতাতে – শুধু নিজে পড়বার জন্যেই – গদ্যপদ্য কম লেখে না সে! এত কিছু যে সে করছে তাতে লাভ হয়েছে কার?

    নিজের দিকে তাকিয়ে পিংলা আজ স্পষ্টতই বুঝতে পারে এত-কিছুতে উপকার হয়েছে কার, কে উপকৃত। সে নিজে, উপকৃত একমাত্র সে-ই। এই শান্তিনিকেতনের সান্নিধ্য, যা আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের মানুষটারই সান্নিধ্য, তাকে নতুন করে গড়েছে। পিংলা-নামক কোন অর্বাচীনের সঙ্গে কবির যদি কখনও দেখা না-ও হত, তাঁর কিছু যেত-আসত না। যেত-আসত না শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন বা আশপাশের গ্রাম বা ঠাকুরবাড়ির কোন জমিদারিরও। যা গুরুদেব চাইতেন সে-কাজ করে অনুগৃহীত হবার লোকের অভাব পৃথিবীতে হত না। স্বয়ং এল্‌ম্‌হার্স্ট পিংলার কাছে গল্প করেছেন, এখানে আসবার জন্যে কী প্রচেষ্টাই না তাঁকে নিজেকে করতে হয়েছে। অবশেষে তাঁর এখানে এসে কাজ করতে হলে যে আর্থিক সংস্থানের প্রয়োজন, তাঁর তৎকালীন আমেরিকান বন্ধু শ্রীমতি ডরোথী স্ট্রেইটের আনুকূল্যে সেই সংস্থানের বন্দোবস্ত করেই শেষ পর্যন্ত এখানে এসে, এখানে থেকে, ব্রিটিশ নাগরিক এল্‌ম্‌হার্স্ট কাজ করবার সুযোগ পেয়েছেন। শ্রীনিকেতনের ডিসপেন্সারি চালাবার মতো দক্ষ এবং শিক্ষিত ইচ্ছুক মানুষ ঠিক সেই সময় এ-দেশে না পাওয়া গেলেও কী এমন অসুবিধে? কবির ডাকে এসে গেলেন গ্রেশেন গ্রীন নামক মহিলা, যিনি জীজী নামে প্রায় সারা বিশ্বে পরিচিত; প্রায় সীমাহীন এমন তাঁর যোগাযোগ যে স্বয়ং বাংলার গভর্নর লীটন সাহেব সুরুলের আশপাশের কুড়িটা গ্রামের প্রয়োজন মেটাতে গ্রেশেন গ্রীনের কথায় ঢাকা থেকে পাঠিয়ে দিলেন অত্যুৎকৃষ্ট এক ষাঁড়! একটাই শর্ত: ষাঁড়টির নাম দিতে হবে জীজী! আর শুধু তো ডিসপেন্সারির জন্যে গ্রেশেন গ্রীন ন'ন, রোগ নিরাময় আর প্রতিরোধের জন্যে ডাক্তারও তো চাই। অতএব সুদূর আমেরিকা থেকে সস্ত্রীক ডাক্তার হ্যারি টিম্বার্স নিজের উদ্যোগে তিন বছরের জন্যে এসে শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতনে থেকে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের কাজ করে গেলেন। কবির সান্নিধ্যের আকুলতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের মধ্যে এতই যে, কবির ইচ্ছাপূরণ করার মানুষের অভাব নেই পৃথিবীতে; পিংলা যে এই সান্নিধ্যে কাজ করতে পারছে, সে মনে করে, সেটা তার নিজেরই সৌভাগ্য।

    অর্থাৎ, এতদিন ধরে নানা যে কাজ শিখেছে পিংলা, তার প্রয়োগেও সে যে অংশ নিয়েছে সেটাও তার নিজের শিক্ষালয়েই, অর্থাৎ পতিসর শান্তিনিকেতন আর সুরুলেই। তাতে তো অবাক হবার কিছু নেই, সেটাই তো স্বাভাবিক। এবং তাতে সে তো ভালোই ছিল। এখানে সবাই তাকে ভালোই বাসে, তার মাইয়াও খুশি, কারণ মাইয়ার মতে সাহেবের ছেলে সাহেবের উপযুক্ত কাজই করছে!

    এমন সময় হঠাৎ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ তাকে একদিন পাঠিয়ে দিলেন ড্যানিয়েল সাহেবের গোসাবায়। কেন পাঠালেন কিছু বললেন না, কতদিনের জন্যে পাঠাচ্ছেন তা-ও না। স্পষ্ট করেই বললেন, তোকে কেন পাঠাচ্ছি আমি নিজেই জানিনা; অতএব, মনে রাখবি, আমার কোন নির্দেশ নেই। যতদিন ভালো লাগবে, থাকবি; না-লাগলে চলে আসবি। আবার ইচ্ছে হলে আবার যাবি, না ইচ্ছে হলে নয়।

    গোসাবায় গিয়ে ড্যানিয়েল সাহেবকে সে দেখেছে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। সাহেব তাকে বারবার বলেছেন, আমি কোন অসম্ভবকেই সম্ভব করছি না। আসলে সম্ভব-অসম্ভবের সংজ্ঞাটাকে একবার ফিরে দেখা দরকার। মানুষের সম্বন্ধে আমার স্থির বিশ্বাস যে প্রতিটি সাধারণ মানুষই অশেষ ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু সে কি তা জানে? তাকে জানাতে হবে শিক্ষা দিয়ে, তাকে দেখাতে হবে সৎ পরিশ্রমের পুরস্কার কী। সুন্দরবনের জঙ্গলের জমি সরকারের কাছ থেকে লীজ নিয়েই সেই জমিকে আবাদযোগ্য করে তোলবার প্রতিজ্ঞা ছিল তাঁর। বছর বছর বন্যা এসে যে জমিকে লবণাক্ত করে দেয় সেই জমির চাষযোগ্যতা বজায় রাখতে হলে বন্যার আক্রমণ বন্ধ করতে হয়। ড্যানিয়েল সাহেব এক প্রায়-অসম্ভব প্রকল্প নিলেন। ড্যাম তৈরি করবেন, মাটির ড্যাম। একশো তিরিশ মাইল দীর্ঘ ড্যাম। সে ড্যাম যতবার ভেঙেছে ততবার তাকে মেরামত করে আরও এগিয়ে যাওয়া চলেছেই। তিরিশ বছরও পেরিয়ে গেছে, থামেননি ড্যানিয়েল সাহেব। ড্যামের একটা ছোট অংশ, গোসাবা দ্বীপ থেকে যতটুকু দেখা যায়, দেখে এসেছে পিংলা। সাহেব বলেছেন আর দু-তিন বছরের মধ্যেই তিনি শেষ করে দিতে পারবেন এই ড্যামের কাজ। ততদিন যদি গোসাবাতেই থেকে যায় পিংলা, ড্যাম শেষ হবার উৎসবে তো সে যোগ দেবেই। আর নেহাৎই যদি সে থাকতে রাজি না হয় ততদিনেও, সাহেব তাহলে খবর দেবেন তাকে। যেখানেই সে থাকুক, মানুষের জয়ের উৎসবে তাকে আসতেই হবে, তাকে চাই-ই।

    গোসাবা থেকে ফিরেই, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ন'ন, অতুলবাবু স্যরের সঙ্গে প্রথম দেখা করেছে পিংলা। গোসাবায় সে কী দেখেছে তার প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে জানতে চেয়েছে, ক্যালিডোনিয়ন মানে কী? ক্যালিডোনিয়ন সমাধান বলতে কী বোঝায়?

    ক্যালিডোনিয়ন? – জিজ্ঞেস করেন স্যর – তোকে এই শব্দটা কে বলল? গোসাবার সাহেব নাকি?

    হ্যাঁ, ড্যানিয়েল সাহেবই বলেছেন, জবাব দেয় পিংলা, তিনি বলেছেন আমাদের দেশের প্রধান যে সমস্যা, ক্যালিডোনিয়ন সমাধানই তার সহজ সমাধান।

    হুঁ, বুঝলুম, বলেন স্যর, আসলে ওই ক্যালিডোনিয়া শব্দটা ল্যাটিন ভাষার। ওর মানে হচ্ছে প্রাচীন স্কটল্যান্ড। ক্যালিডোনিয়ন হল ওই ক্যালিডোনিয়ার অ্যাডজেক্টিভ, মানে, প্রাচীন স্কটল্যান্ডের মানুষকে আমরা ক্যালিডোনিয়ন মানুষ নামে পরিচয় দিতে পারি। অথবা প্রাচীন স্কটল্যান্ডের কোন ঘটনাকেও আমরা ক্যালিডোনিয়ন ঘটনা বলতে পারি। যেমন ধর, তোর ওই ক্যালিডোনিয়ন সমাধান – ওর অর্থ দাঁড়াবে, যে সমাধান প্রাচীন স্কটল্যান্ডে করা হয়েছিল বা করা যেতে পারত, সেই সমাধান।

    আমি জানি না, বলতে থাকেন অতুলবাবু স্যর, তোর সাহেব কতটা প্রাচীন স্কটল্যান্ডের কথা বলতে চেয়েছেন। নাকি সাহেবের আবেগই ওটা – গর্বিত স্কট্‌স্‌ম্যান – উনি যা বিশ্বাস করেন সেটা প্রাচীন যুগের স্কটল্যান্ডের জ্ঞানভাণ্ডারেরই ছোট্ট একটা অংশ, এবং সেই হিসেবে ক্যালিডোনিয়ন সমাধান! তুই যে টাকার নোট ছাপাবার প্রস্তাবের কথা শুনেছিস সাহেবের কাছে সেটার প্রসঙ্গে যদি ক্যালিডোনিয়ন সল্যুশনের কথা বলে থাকেন, তাহলে একটা মানে অবিশ্যি দাঁড়ায়। বৃটিশ রাজের যখন নোট ছাপাবার মোনোপলি সব ক'টা ব্রিটিশ আইল্যান্ড জুড়ে, মানে গত শতাব্দীরও আগে থেকেই, তার পরেও কিন্তু, মানে গত শতাব্দীতেও, স্কটল্যান্ডের স্থানীয় ব্যাঙ্কেরও অধিকার ছিল নোট ছাপাবার। অতএব নোটের জোগান বাড়াবার ক্ষমতা ওদের অনেকদিন অবধি ছিল, এবং, আমি ঠিক ঠিক জানিনা, হয়তো গত শতাব্দীর দুর্ভিক্ষের সময় ওরা নিজেদের এই অধিকার প্রয়োগ করে সাধারণ মানুষের হাতে কিছু বেশি টাকা তুলে দিয়েও থাকতে পারে।

    এমনটা করা যায়, স্যর? – পিংলা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে।

    যাবে না কেন? টাকা মানে তো নোট, হেসে বলেন স্যর, তোর পকেটে কি কিছু নোট আছে, ধর দশ টাকার অথবা একশো?

    একটা দশ টাকার নোট পকেট থেকে বের করে স্যরের হাতে দেয় পিংলা। স্যর বলেন, এগিয়ে আয়, দেখ কী লেখা আছে। পিংলা আরও কাছে এলে লেখাটা দেখান স্যর, I promise to pay the bearer a sum of ten rupees, কী বুঝলি – হেসে জিজ্ঞেস করেন স্যর?

    বোঝা যায় পিংলা ভালোভাবে কোন টাকার নোট কখনও লক্ষ্য করেনি, এখন দেখে বলে, প্রমিজ? মানে এটা শুধুই প্রমিজ? আসলে পেমেন্ট নয়?

    হ্যাঁ প্রমিজ, এটা টাকা নয়; টাকা দেবার প্রমিজ গ্যারান্টিড বাই দ্য গাভ্‌মেন্ট, আর আমরা যেহেতু ব্রিটিশ সাবজেক্ট, আমাদের ক্ষেত্রে এই প্রমিজ করবার অধিকারটা দ্য ব্রিটিশ কিংডম হ্যাজ ডেলিগেটেড টু দি ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অপারেটিং ইন ইন্ডিয়া। দেখ্‌, নোটে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের নাম। আর সাইন্‌ড্‌ বাই দ্য ব্যাঙ্কস গাভ্‌নার। ব্যাপারটা ভেবে দেখ্‌, বলতে থাকেন স্যর, যে বিয়ারার, অর্থাৎ যখন যার হাতে টাকাটা, তাকেই দেওয়া হচ্ছে পেমেন্টের গ্যারান্টি; আর, তাই যদি হয়, আমি যদি দশ টাকা মূল্যের কোন কিছু তোর কাছ থেকে কিনে থাকি, তাহলে মূল্য হিসেবে ওই গ্যারান্টিযুক্ত প্রমিসরি নোট তুই নিবি না কেন? নিবিই তো, কারণ তোর যদি কোন ব্যক্তিকে দশ টাকা দেবার প্রয়োজন হয় ব্যক্তিটি তাহলে হাসতে হাসতে আমার দেওয়া ওই প্রমিসরি নোট তোর কাছ থেকেও নিয়ে নেবে, কারণ সে-নিজেই তখন বিয়ারার অব দ্য নোট।

    বিস্ময়াহত পিংলা বলে, তাহলে কি স্যর নোট দেওয়া-নেওয়ার এই অর্থনীতিটা পুরোটাই ধাপ্পা?

    ধাপ্পা নয়, স্যর বলতে থাকেন, তা যদি হত আধুনিক সভ্যজগতে তাহলে এই নোট দেওয়া-নেওয়াটা এমন পাকাপোক্তভাবে সর্বত্রই চলত না। এটার ইকনমিক্‌সের মধ্যে পুরোপুরি না-গিয়েও তোকে শুধু এইটুকু জানাই যে, এই যে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য দেশে তাদের নিজের নিজের ব্যাঙ্ক তাদের নোটের আদানপ্রদানকে গ্যারান্টি দিচ্ছে, এর পেছনে সত্যি-সত্যিই মূল্যটা মিটিয়ে দেবার ক্ষমতা তাদের আছে বলেই তারা দিচ্ছে। কী ক্ষমতা সেটা? মোট যে পরিমাণ টাকা বাজারে ঘুরতে থাকে যে-কোন সময় তার সমমূল্যের অথবা বেশি মূল্যের কোন স্থায়ী সম্পদ – সোনা রূপো বা সকলের গ্রহণযোগ্য একটা-কিছু – ব্যাঙ্কের দখলে সুরক্ষিত আছে। কতো টাকা পর্যন্ত নোট একটা ব্যাঙ্ক বাজারে ছাড়তে পারে, সেটা ইকনমিক্‌সের একটা জটিল অঙ্ক, কারণ অনেক অজানা বা কম-জানা তথ্যকেও সে অঙ্কের মধ্যে ধরতে হয়। সে-অঙ্কের হিসেব যে আমি নিজেও পুরোপুরি জানি এমনটা ভাবিস না। তবে একটা উদাহরণ দিলে সুরক্ষার মাত্রাটা বুঝতে তোর সুবিধে হবে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়, মানে যে-সময়ে টাকার লেনদেনের প্রয়োজন হঠাৎ বেড়ে গেল, সেই সময়েও ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক ভারতে তাদের সুরক্ষিত সম্পদের কমবেশি মাত্র শতকরা চৌত্রিশ ভাগ টাকা বাজারে ছেড়েছিল। গুরুদেবের কাছে শুনেছি, ড্যানিয়েল হ্যামিলটন সাহেব তাঁকে বলেছেন, শত-শত টন যে অলস বন্দী সোনা-রূপো সরকারের আছে, তার একটনের মূল্যের ছোট-নোট বেছে বেছে কর্মঠ সৎ গরীব মানুষের হাতে যদি তুলে দেওয়া যায়, তা হলেই সেই নোটের আদানপ্রদানে নীচের তলার মানুষের উন্নতি একেবারে চোখে দেখা যাবে! সাহেব বলেছেন, আপনি দেখে নেবেন মিস্টার টেগোর, সরকারকে আমি একদিন-না-একদিন বোঝাতে পারবই, আর সেইদিন গোসাবাতে আমি আমার নিজের কারেন্সি বাজারে ছাড়বার অনুমতিও আদায় করে নেব।

    অতুলবাবু স্যরের পর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। তিনি সদা ব্যস্ত, ইচ্ছে করলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করা যায় না। কিন্তু কয়েকদিন পরে তিনি নিজেই পিংলাকে ডেকে পাঠালেন।

    কেমন লাগল গোসাবা? – পিংলার প্রণামের পর জিজ্ঞেস করেন গুরুদেব।

    লাগল তো ভালোই, মাথা নিচু করে বলে পিংলা।

    লাগল তো ভালোই, তো-এর উপর একটা ঝোঁক দিয়ে বলেন কবি, ভালোই লাগল আর ভালোই তো লাগল-র মধ্যে
    এই-যে তো-এর তফাৎটুকু, এটা কেন? তার মানে, তুই কি বলতে চাইছিস, লাগল তো ভালোই, কিন্তু...

    না, মানে, একটু আমতা আমতা করে পিংলা বলে, গোসাবায় যা সাহেব করতে চান সেটা খুবই ভালোভাবে হচ্ছে, যদিও ওখানকার কাজের সঙ্গে আর যে-কোন জায়গার কাজেরই অনেক পার্থক্য।

    কেমন পার্থক্য? – জিজ্ঞেস করেন গুরুদেব।

    সুন্দরবনের ওই সমস্ত অঞ্চলটাই – যা শুধু গোসাবা নামেই এখন পরিচিত – সবটাই সাহেবের নিজের হাতে তৈরি। ওখানকার মানুষ যারা, তারা তো মূলত ওখানকার মানুষ নয়, সাহেব নিজের পছন্দমতো বেছে বেছে, তাঁর দেওয়া শর্ত যারা মেনে চলবে বাইরে থেকে তাদের নিয়ে এসে একেবারেই নিজের পছন্দমাফিক কাজ করছেন। যা করছেন, একেবারে পার্ফেক্ট; যা তিনি করতে চান, যেভাবে করতে চান ঠিক সে ভাবেই কাজ হচ্ছে, ফল যা পেতে চান পাচ্ছেনও তাই। যেমন তাঁর পরিকল্পনা তেমনই প্রয়োগ। কাজেই তাঁর প্রজারা সবাই আপাতত খুশি আর সুখী। কিন্তু ঠিক এই একই পদ্ধতিতে অন্য কোথাও কাজ হওয়াও কি সম্ভব?

    অন্য কোথাও কী হওয়া সম্ভব সে প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? সাহেব তো অন্য কোথাও কাজ করতে যাচ্ছেন না। কিন্তু সেটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে যা দেখে এলি তার থেকে শেখার মতো কী পেলি আর শিখলিই বা কী?

    আমার মনে হল, যা সাহেব পেতে চান, ধাপে ধাপে ঠিক ঠিক কী কী করলে সেখানে পৌঁছনোটা নিশ্চিত হবে, একেবারে অঙ্ক কষার মতো করে সাহেব তা ভাবতে পেরেছেন। সেই ভাবনাটাই তাঁর কাছ থেকে প্রথমেই শেখবার। প্রথমে একদল মানুষ যারা অন্য কোথাও তথাকথিত ঋণের দায়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে, তাদের ঋণ নিজে শোধ করে গোসাবায় তাদের নিয়ে আসা। নতুন করে সাহেবের কাছে তাদের যে ঋণ হল, দীর্ঘমেয়াদি সেই ঋণ ধীরে ধীরে এখন শোধ হবে। ততদিনে তারা একটা সুস্থ পরিবেশে – স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কাজ শুরু করবার প্রাথমিক উপাদান – এসবের সাহায্যে নতুন করে জীবন শুরু করবার একটা সুযোগ পেল। পরের ধাপে তাদের নিয়েই কোঅপারেটিভ ঋণশোধ সংগঠন, তার পরের ধাপে উৎপাদিত শস্য বাজারজাত করার কোঅপারেটিভ সংগঠন, তার পর কনজ্যুমার্স কোঅপারেটিভ সংগঠন – এই ভাবে পরস্পরের বোঝাপড়া আর মিলেমিশে কাজ করতে করতে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে পৌঁছনো। আমার যেটা বিশেষ করে চোখে পড়েছে, তা হল ড্যানিয়েল সাহেবের বিশ্বাস যে খেটে-খাওয়া মানুষ সাধারণভাবে সৎ। সৎ ভাবে জীবনযাপনের একটা সুযোগ পেলে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার হবেই। এবং তাই, কোঅপারেটিভ জীবনযাত্রাই সাহেবের মুল মন্ত্র।

    গুরুদেব, এই ক'দিনে একটা কথা আমি বুঝে এসেছি যে এত কিছু শেখবার আছে সাহেবের কাছ থেকে, তা এককথায় বলতে পারা মুশকিল। যেটা ভাবেন, সেটা করবেনই। আর নিজের ভাবনার ওপর এমন বিশ্বাস, যে সাময়িক কোন ব্যর্থতায় হাল ছাড়েন না। সুন্দরবনের জঙ্গলে যখন প্রথম জমির লীজ নেন সাহেব, তখন তো ভাবাই যেত না যে গোসাবার মতো দ্বীপে যেখানে প্রত্যেক বছর বন্যার নোনা জল ঢুকে পড়ে, সেখানকার নোনা মাটিতে কখনও চাষ করা যাবে। ড্যানিয়েল সাহেব বললেন, আমি ড্যাম তৈরি করব। এমন ভাবে মাটির বাঁধ তৈরি করব যে জল ঢুকবেই না দ্বীপে। আপনি তো জানেন গুরুদেব, তিরিশ বছর পেরিয়ে গেছে, এখনো ড্যামের কাজ চলছেই। এর মধ্যে কতবার ভেঙেছে বাঁধ, সাহেব কিন্তু হাল ছাড়েননি। যেটুকু গোসাবা থেকে দেখা যায় আমি দেখে এসেছি। সাহেব আমাকে বলেছেন মোট একশো তিরিশ মাইল লম্বা এই বাঁধ এখন শেষের মুখে। আর বছর দুয়েকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে কাজ।

    হেসে বলেন রবীন্দ্রনাথ, তাহলে এত তাড়াতাড়ি তুই ফিরে এলি কেন? এত কিছু শেখার, থেকে গেলেই তো পারতিস।

    আবার যাব গুরুদেব, বলে পিংলা। আপনি আমাকে যখন পাঠালেন গোসাবায়, তখন বলেছিলেন তোকে যে গোসাবায় থেকেই যেতে হবে তার কোন মানে নেই। যতদিন ইচ্ছে থাকবি, ইচ্ছে হলে ফিরে আসবি, তারপর আবার ইচ্ছে হলে আবার যাবি গোসাবায়। এবারের এই প্রথমবারটায় আমি বুঝে এসেছি যে গোসাবা আমার স্থায়ী কাজের জায়গা কখনোই হবে না, আমাকে কাজ করতে হবে অন্য পরিবেশে; গোসাবার মডেলটা অন্য, ওটা ড্যানিয়েল সাহেবের নিজস্ব জমিদারি, উনি রাজাই ওখানকার, আমি কিন্তু রাজা হবার মানুষ নই সে যোগ্যতাও নেই, আমার কাজ অন্য জায়গায়। কিন্তু তবুও, এখন আমায় বেশ কয়েকবার গোসাবায় ফিরে যেতে হবে। অন্তত যতদিন সাহেব বাঁচবেন। ফিরে যেতে হবে শিক্ষার্থী হিসেবেই।

    কাজিদার চিঠিতে সঙ্গীত এবং আনুষঙ্গিক শিল্পে স্বদেশী পুঁজির অংশগ্রহণের প্রস্তাবের কথাটা পড়ে পিংলা চমকে উঠেছিল। যা পড়েছিল তাতে ও খুবই আশান্বিত। দেশের কথা বা স্বাদেশিকতার কথা তার এখনকার রচনায় – মূলত যা গান – আগের মতো আর স্পষ্ট নয়। করাচী থেকে কলকাতায় ফেরবার সময় থেকে প্রথম বছর দশেক, পিংলা ভালো মতই জানে, কাজিদার চিন্তা-ভাবনায় ছিল শুধুই দেশ আর জাতি। সে-সময় যা-ই সে করেছে, তা অত্যাচারিত পরাধীন দেশ আর জাতির মুক্তির লড়াইয়ের সৈনিক হিসেবে। চব্বিশ সালের তড়িঘড়ি বিয়ে করে ফেলা, তার দায়িত্ব, এবং পরের বছর-পাঁচেকের ঋণজর্জরিত নাকানিচোবানির জীবন থেকে অবশেষে একদিন ধনবাহী সঙ্গীতসমুদ্রের একরাশ অক্সিজেন তাকে সপরিবার বাঁচবার সুযোগ দিয়েছে। ডুবন্ত মানুষের প্রথম খাবি-খাওয়া অক্সিজেন তাকে শুধু বাঁচায়, তারপর শুশ্রূষা-চিকিৎসা-পুষ্টি তাকে প্রস্তুত করে আবার পৃথিবীর মানুষের মতো লড়াই-জয়-হার-বেদনা-আনন্দ-বিষাদ-উৎসবের সাধারণ মানুষে। স্বাধীনতার আন্দোলনের লড়াইয়ে নতুন করে দেশি-পুঁজির আয়ুধিকরণের প্রস্তাব পিংলাকে আশান্বিত করে, করে বিশেষ করে এই জন্যে যে, কাজিদার এই ভাবনার পিছনে অনেক দিনের গবেষণা প্রস্তুতি আর চিন্তার ছাপ সে চিঠিতেই দেখতে পেয়েছে।

    গোসাবায় সপ্তা' তিনেক থাকবার পর একদিন সে হঠাৎই পরের দিন ভোরেই ফিরে আসবার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ সেই মুহূর্তেই ওর মনে হয়েছিল যতটুকু অভিজ্ঞতা ওর গোসাবায় হয়েছে, নিজের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেবার পক্ষে সেটা যথেষ্ট। সেই রাত্তিরের অনেকটা সময় ধরে সে কাজিদাকে চিঠি লিখেছে। মনে মনে হয়তো একটু আশাও ছিল তার, ওই চিঠি কাজিদার প্রেরণাও হতে পারে। তবে আপাতত ও শান্তিনিকেতনেই ফিরবে, অতুলবাবু স্যর আর গুরুদেবের উপদেশ নেবে এবং নিজের কাজের ব্যাপারে পাকাপোক্ত একটা সিদ্ধান্ত নেবে। তারপর ও দেখা করবে কাজিদার সঙ্গে। কাজিদা – যার সঙ্গে ঘটনাচক্রে পরিচয়ের ফলে আজ ও যেখানে দাঁড়িয়ে সেই অবধি আসতে পেরেছে। কাজিদার সঙ্গে যদি করাচীতে ভাগ্য অন্বেষণে গিয়ে ওর দেখা না হয়ে যেত এবং দুজনের মধ্যে ওই প্রাথমিক পরিচয়েই অবাধ-সত্যের বিনিময় না ঘটত তাহলে আজ কোথায় থাকত পিংলা? এক বছর একসঙ্গে করাচীতে কাটাবার পর কাজিদা ওকে বলেছিল, তোর দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। কলকাতায় গিয়ে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বাড়িতে থাকব। তোর একটা ব্যবস্থা আমিই করে দেব, তুই কিচ্ছু ভাবিস না। দাঁড় করিয়ে দেব তোকে। সান্ধ্য-দৈনিক নবযুগের হাওড়া শহরের সোল সেলিং এজেন্টের কাজ ওকে পাইয়েও দিয়েছিল সে। ওকে দাঁড় করাচ্ছে কাজিদা, কিন্তু নিজে তখন সে কোথায় দাঁড়িয়ে? সাহিত্য সমিতির ভাড়া-বাড়িতে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের সুপারিশে শুধুমাত্র একখানা তক্তপোশে শোবার অনুমতিপ্রাপ্ত সে তখন। দৈনিক নবযুগের যতটুকু বেতন তাতে একজনের দুবেলা পেট ভরে না; তবুও, সাহিত্যকর্ম থেকে তার জীবনের প্রথম প্রাপ্ত পঞ্চাশ টাকা, যা মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর একজন, মঈনুদ্দিন হুসয়ন সাহেব, ব্যক্তিগতভাবে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সেই পুরো টাকাটাই সে পিংলার সোল সেলিং এজেন্সির জমানত হিসেবে দিয়ে দেয়!

    সেই কাজিদা তার চিঠির উত্তরে তাকে ডেকেছে। বলেছে, আমিই তোর আয়না। তোর ঠিকঠাক আয়না আমিই, আমার সামনে দাঁড়িয়ে সব কথা বল একবার, যেন নিজেকেই বলছিস, তার পর কান পাতলেই শুনতে পাবি আমার রিফ্লেকশন, তাতেই হবে তোর আত্মদর্শন, বুঝলি হাঁদা? শুধু তা-ই নয়, নিজের 'কলগীতি'র উদ্বোধনের জন্যে সারা পৃথিবীতে মাত্র একজনকেই খুঁজে পেয়েছে কাজিদা; লিখেছে, নিজের প্রতিশ্রুতিতে শতকরা একশো ভাগ সৎ আমার 'কলগীতি'র উদ্বোধনের জন্যে শতকরা একশো ভাগ সৎ আমার ছোট ভাই পিংলাকেই আমি চাই। এর পর তো আর কোন কথা ওঠে না। চিঠি লিখে কবে কোন ট্রেনে ও যাচ্ছে জানিয়ে দেয় কাজিকে।

    এবং পৌঁছিয়েই সামনে প্রথমেই পেয়ে যায় কাজিদার বন্ধু শৈলজাদাকে, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। সদ্য রানিগঞ্জের শুটিং শেষ করে তাঁরা ফিরেছেন, তাঁর চিন্তায় এখন শুধুই তাঁর নতুন উদ্যোগ, পাতালপুরী নামের সিনেমা। উচ্ছ্বসিত শৈলজানন্দ তাকে বলে শুটিঙের সঙ্গে সঙ্গেই নানা শ্রমিক বস্তিতে তাদের ঘোরাঘুরির গল্প; অসঙ্কোচে বলে কাজি সঙ্গে থেকে এবার অনেক নতুন অ্যাঙ্গল দিয়েছে শুটিঙে, ওর একার পরিচালনা না বলে কাজি আর ওর যুগ্ম পরিচালক হিসেবে এই সিনেমায় নাম থাকা উচিত। আমার কী মনে হল জানেন তো, বলতে থাকে শৈলজাদা, কাজি যদি সত্যি সত্যি চায় তা হলে খুবই ভালো সিনেমা ও নিজে-নিজেই তৈরি করতে পারে। সিনেমার পরিচালকের ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হল একজন বহুমুখী প্রতিভার মানুষ, অনেক ধরনের ক্রিয়েটিভ কাজ যে একসঙ্গে করতে পারে। জানেন তো, শৈলজা বলতে থাকে, ছেলেবেলায় আমি লিখতুম কবিতা, আর কাজি গল্প। একটু একটু বড় হতে হতে বুঝলুম, আমার কবিতা তেমন সাবলীল হচ্ছে না, আমি ঠিক ঠিক কবি-মেটিরিয়াল নই। ছেড়েই দিলুম কবিতা লেখা। আমার ছেড়ে-দেওয়া সাহিত্যকর্মটা ধরে ফেলল ও। তারপর কী সব বাঘা বাঘা কবিতা ও লিখেছে তা তো সব বাঙালিই জানে, সঙ্গে সঙ্গে গল্প-উপন্যাসটাও কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছে। আর সত্যি কথা এই যে, সেটাও কিন্তু মন্দ লিখছে না। তারপর ও এল গানের জগতে, বলতে বলতে হাতে-ধরা চায়ের কাপটায় শেষ চুমুকটা দেয় শৈলজা, তারপর বলে, ছেলেবেলায় ওর গানও তো কম শুনিনি, কিন্তু পল্টন থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই দেখলুম ওর গানে একটা নাটকীয় পরিবর্তন। শুনেছি – ওর মুখেই শুনেছি – করাচীতে গিয়ে নাকি ও সম্পূর্ণ অন্য রকমের একটা সাঙ্গীতিক পরিবেশ পেয়েছিল, তাতেই ওর গানের এই কোয়ালিটেটিভ পরিবর্তন। আমি শুধু ভাবি, যাদের পেয়ে ও বলছে একটা অন্য রকমের পরিবেশ পেয়েছিল তারাও তো ফিরে এসেছে পল্টন থেকে; কই, ওর মতো গান লিখতে তো পারেনি কেউ, গাইতেও পারেনি। আসলে ওর মধ্যে গানের যে প্রতিভা ছিল সেটা একটু নাড়াচাড়া খেয়েছিল করাচীতে, ফিরে এসে তাই গানের জগতেই তোলপাড় করে দিল ও। আপনাকে সত্যি কথা বলছি পিংলা, এর আগে তো কখনও সিনেমার শুটিঙে ও যায়নি, ধ্রুবতে নিজের রোলটুকুতে শুধু শুটিংটা যে কী সে ব্যাপারটা দেখেছে একটু, তাতেই এবার আমার সঙ্গে রানিগঞ্জে গিয়ে যেভাবে নতুন নতুন আইডিয়া দিল, আমি হলফ করে বলতে পারি, সিনেমা করলে সিনেমার জগতে ও নতুন একটা-কিছু করে দেখিয়ে দেবে!

    সামনে বসে-বসেই চা খাচ্ছিল কাজি, সে শৈলজার কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে বলে ওঠে, ওরে, তোকে আর বাড়াবাড়ি ইউলোজাইজ করতে হবে না, ও ওর চা-টাও শান্তিতে খেতে পারছে না; চা-টা শেষ হলেই আমরা কলগীতি ইনস্পেক্ট করতে যাব, তেমনই প্রোগ্রাম ঠিক করা আছে ওর সঙ্গে, তুই কি সঙ্গে যেতে চাস?

    যাব, নিশ্চয়ই যাব, আলবাৎ যাব, বলে শৈলজা, এতদিন পর দেখা হল পিংলার সঙ্গে, যাব না? নিন, পিংলা, চা-টা শেষ করে নিন, দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর।

    পিংলা কখনও এই-ধরণের দোকানে আগে যায়নি, সে সাহেবপাড়াতেই হোক বা কাজিদার ভাষায় পাড়ার তিন-মাথার মোড়েই হোক, কাজেই ঠিক কী দেখবে এ-বিষয়ে কোন কল্পনাই ছিল না ওর। দেখেশুনে ও শুধু বলল, ওব্বাবা, এ তো বিপুল ব্যাপার!

    হ্যাঁ, একটু বড়ই হয়ে গেল, খানিকটা কৈফিয়তের স্বরেই বলে কাজি, ওই যে তোকে বলেছিলুম গান-শোনাবার একটা ঘর থাকবে, যেখানে চা খেতে খেতে দোকানে যারা আসবে তারা নানা রেকর্ডের গান শুনতে পারবে, পাশের দোকানের একটা ছোট অংশ কিনে সেটাও জুড়তে হল তো, তাই আর-কি!

    শৈলজা এবার বাড়ি ফিরবে, যাবার আগে কাজিকে বলল, নিজের বাজেট প্রথমেই ছাড়িয়ে যেও না বন্ধু, তাহলে কিন্তু কূল পাবে না। ক্যাপিটালের একটুখানিক অন্তত ফিরে আসুক তারপর রি-ইনভেস্ট কোরো।

    বাড়ি ফিরতে ফিরতে পিংলা বলে, আমি তোমার চিঠিটা ঠিক বুঝিনি কাজিদা, তুমি যে এত টাকা লাগাবে এই দেশি পুঁজির লড়াইয়ে, মানে তোমার যে এত টাকা আছে, তা-ই আমি ভাবিনি। এখন কিন্তু, সত্যি কথাটা এই যে, আমার ভয় হচ্ছে। ধর, আসলে ব্যবসা তো – একটু আমতা-আমতা করে বলে পিংলা – ধর, লোকসানই হল, টাকাটা তোমার ডুবেই গেল, তখন কী করবে তুমি?

    ডুবে গেলে আবার আয় করব, গানের থেকেই আয় করে নেব আবার, সেটা কোন কথা নয়। কিন্তু, একটা কথা তোকে বুঝতে হবে, আমি তো ঠিক ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে যাব মনে করে এই ব্যবসাটায় নামছি না। এটা একটা আন্দোলন, আন্দোলনটা শুরু করতে চাইছি আমি। আর যথাসর্বস্বই যদি পণ না করি, তাহলে আমার কথা শুনবে কেন লোকে? তবে হ্যাঁ, এ-আন্দোলনটা একটা ব্যবসাও বটে, আর ব্যবসা ব্যাপারটার মুশকিলটাই হল এই যে ব্যবসাটা শুধুমাত্র টিকিয়ে রাখবার জন্যেই তাতে লাভও করতেই হয়, চিরকাল তো আর ভরতুকি দিয়ে কেউ বাঁচিয়ে রাখবে না তাকে। তুই ভাবিস না পিংলা, যখনই যে আন্দোলনে আমি নেমেছি যথাসর্বস্বই দিয়েছি। একটা আন্দোলনেও আজ পর্যন্ত ঠিকঠাক জিততে পারিনি ঠিকই, কিন্তু বেঁচে তো আছি। এটাতেও যদি মার খাই, মরতে মরতেও বেঁচে উঠবো আবার, তুই ভাবিস না কিছু।

    পরের দিন ভোরবেলাতেই ওরা রওনা দিল রাঁচির উদ্দেশে, পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে। পিংলা আগে কখনো আসেনি এসব জায়গায়, আসতে ভালোই লাগল ওর। বোঝা গেল রাঁচিতে কাজি এই প্রথম নয়, হিনু হাউজ নামে একটা বাড়িতে ড্রাইভারকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ও-ই। কলকাতা থেকেই হিনু হাউজ ভাড়া করে এসেছিল ও, বাড়ির মালিকরা ওর চেনা। পিংলা শুনেছে রাঁচি বিহার-প্রদেশের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী, কিন্তু বোঝা গেল এই অঞ্চলে বাঙালির সংখ্যা কম নয়। বাড়িটাতে একাধিক চাকর-বাকর আছে, তাদের মধ্যে একজনকে পিংলার সাঁওতাল বলে মনে হয়, নাম বলল সুরাই মাঝি, সে কিন্তু কথাবার্তা বাংলাতেই বলছিল। গোসাবাতেও কয়েকজন সাঁওতালকে সে দেখেছে, ড্যামের কাজ আর জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করার জন্যে এদের নিয়ে এসেছিলেন ড্যানিয়েল সাহেব। সাহেব ওদের চাষের জমি দিয়েছেন, দিয়েছেন বাসস্থানও। ওখানে বেশ কয়েকটা পরিবার থেকেই গেছে, এখন বাংলাতেই কথাবার্তা বলে, মনে হয় ভালোই আছে ওরা। রাঁচিতে টাটকা সব্জী আর মাছ পাওয়া যায়, দুধ খুব ভালো, আর চেঞ্জার বাঙালির প্রিয় খাদ্য মুরগি তো আছেই। বাজার এল, দুলি আর মাসিমা নেমে পড়লেন কাজে, জমে গেল রাতের খাওয়া।

    পরের দিন ভোর না হতেই পিংলাকে ডেকে-হেঁকে তুলে দেয় কাজি, চল্‌, নলিনীদাকে ধরে আনি।

    নলিনীদাকে? – খানিকটা যেন নিরুৎসাহ শোনায় পিংলার গলা, আমি তো ভেবেছিলুম আমার ভবিষ্যৎ প্ল্যান নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করব একটু, তা-ছাড়া, নলিনীদাকে এখানে – এই রাঁচিতে – কোথায় পাচ্ছ তুমি?

    আরে রাঁচিতে আছে খবর পেয়েছি বলেই তো বললুম ধরে আনি, হো হো করে হেসে ওঠে কাজি – দে গোরুর গা ধুইয়ে – তুই কি ভাবলি এখন কলকাতায় দৌড়ব?

    এখানে কোথায় গেলে পাবে?

    দুটো ঠিকানা আছে আমার কাছে, কাজি বলে, ওই দুটোর মধ্যে একটাতে পাবই পাব। সন্দেহ করছিস? ঠিক আছে, ওই দুটোর মধ্যে একটাতেও না-পাই যদি, তাহলে এবারটা রাঁচিতে আর খোঁজ করব না নলিনীদার। একা একা এসেছে, একা
    একাই ফিরবে।

    বোঝা গেল কাজির খবর ঠিকই ছিল, প্রথম ঠিকানাতেই পাওয়া গেল নলিনীদাকে। শুধুই নলিনীদা না, তাঁর স্ত্রী এবং কন্যাও।

    প্রথম দর্শনেই কাজি বলে, এই যে পিংলা এসেছে, ওর সঙ্গে তোমার আলাপ হয়নি কখনও। তোমার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে বেচারাকে অল দ্য ওয়ে রাঁচি পর্যন্ত আসতে হল। এখন কোন কথা নয়, বাক্স-প্যাটরা গোছাও, গাড়িতে তোল, চল আমাদের সঙ্গে।

    নলিনীদা, বোঝা গেল, একটু অস্বস্তিতে পড়েছে। বলল, আমার বাক্স-প্যাটরা আমার স্ত্রী এবং কন্যা। এ-বাড়ির মালিক আমার স্ত্রীর মেসোমশাই, তাঁরই আমন্ত্রণে এসেছি। এখন তিনি অনুমতি না দিলে যাই কীভাবে?

    কবে এসেছিস?

    দিন তিনেক হল।

    হুঁ, কাজি আপন মনে একটা শব্দ করে। তারপর বলে, বৌদিকে ডাক নলিনীদা, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।

    নলিনীর স্ত্রী বলে, গান যদি শোনান গোটা কয়েক তাহলে মেসো-মাসিমার অনুমতি আদায় করা যেতে পারে।

    ঘণ্টাখানেকের জলসা বসিয়ে অবশেষে নলিনীর পরিবারকে গাড়িতে তোলা গেল। দু'দিনের ছুটি।

    দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বসে ওরা। নজরুল বলে, তুই-ই মীমাংসা কর নলিনীদা। গোসাবা নামের এক স্বর্গরাজ্য থেকে ফিরেছে এই পিংলা। স্কটিশ সাহেব ড্যানিয়েল এই স্বর্গের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। তিনি নিজে ওকে পাকাপোক্ত পাসপোর্ট দিয়ে দিয়েছেন স্বর্গরাজ্যের। ওখান থেকে ফেরার আগের রাত্তিরে ওখানে বসেই আমাকে ও যে চিঠি লিখেছিল তাতে আমি বুঝেছিলুম, ও আমাদের সঙ্গে একবার বোধ হয় দেখা-টেখা করে আবার ফিরে যাবে সেখানে। এখন ইনি বায়না ধরেছেন, যাবেন আবার ঠিকই, কয়েকদিনের জন্যে যাবেন। কিন্তু ফিরে এসে এই মর্ত্যলোকেই থাকবেন পার্মানেন্টলি। কী করা যায় বল্‌তো?

    পিংলার সঙ্গে মুখোমুখি এই প্রথম আলাপ হলেও ওর সম্বন্ধে প্রায় সব কিছুই কাজির অন্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মতোই জানে নলিনীকান্তও। সে পিংলাকে বলল, আমি তো শুনেছিলুম আপনি সুরুলে ভালোই আছেন, রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট স্নেহ করেন আপনাকে।

    স্নেহ তো করেনই, কিন্তু আমি যে নতুন একটা জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। গুরুদেব নিজে গোসাবায় সাহেবের ডাকে গিয়ে দু-রাত্তির ছিলেন। ফিরে এসে আমাকে বললেন, ঘুরে আয় গোসাবা থেকে। ড্যানিয়েল সাহেবের এক্সপেরিমেন্টটা নিশ্চয়ই খানিকটা প্রভাব ফেলেছিল গুরুদেবের ওপর ওই দু'দিনেই। আমাকে বললেন, গিয়ে যদি তোর ওখানে থেকে যেতে ইচ্ছে করে থেকেই যাবি। যদি ফিরে আসতে ইচ্ছে করে, ফিরে আসবি। আবার যদি যেতে চাস, আবার যাবি। আমার ওখানে গিয়ে মনে হল, নিজের চোখে যা দেখেছেন গুরুদেব, আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের চোখ দিয়েও সেটা দেখবার চেষ্টা করছিলেন উনি। যাবার পর প্রথম তিনদিন সাহেব প্রায় সব সময়ই আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন, ওঁর গোসাবা প্রজেক্টের গোড়ার কথাটা আমাকে বলেছেন, এই কাজে ওঁর মোটিভেশন কী, কী পদ্ধতিতে কাজ করলে আশু এবং দীর্ঘস্থায়ী ফল পাওয়া যাবে, সব আমাকে বোঝালেন, আমার সব প্রশ্ন ধৈর্য ধরে শুনে তার জবাবও দিলেন। ওই তিন দিনের পর থেকে তিন সপ্তাহের বাকি সময়টা আমি ছিলুম সম্পূর্ণ স্বাধীন, প্রজেক্টের মধ্যে যেখানে ইচ্ছে গিয়েছি, যার সঙ্গে ইচ্ছে কথা বলেছি। শেষ পর্যন্ত আমি যেটা বুঝলুম তা হল এই যে, সমস্ত কাজটায় সাহেব একটা ক্রিয়েশনের আনন্দ পাচ্ছেন – ক্রিয়েশন এবং নিজের ক্রিয়েশনকে রক্ষা করার – আনন্দ। এবং সেই হিসেবে, ওই যে কাজিদা ওঁকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বলছে, উনি সত্যি সত্যিই তা-ই। ওঁর একটা পূর্ব-পরিকল্পিত ছক আছে, একটু একটু এবং একটা একটা করে সেই ছক হিসেবে কাজ করে চলেছেন সাহেব, যতদিন বাঁচবেন করেই যাবেন, কিন্তু অন্য কোন মানুষের কাজ করবার কোন সুযোগ ওখানে নেই।

    বলেন কী, অবাক হয়ে বলে নলিনী, এত রকমের কাজ, তার মধ্যে অন্য কোন সাধারণ মানুষের কাজ করবার কোন সুযোগই ওখানে নেই?

    নেই, বলতে থাকে পিংলা, কী করে থাকবে বলুন, সাহেব নিজেই কোন কাজ অন্যের উপর দিয়ে ভরসা করে থাকতে পারবেন না। পারবেন যে না, সেটাই স্বাভাবিক। যদিও ওখানে গিয়ে সাহেবের কাজ দেখে আমার খুবই ভালো লাগছিল, আমি নিশ্চিত, সাহেব যদি আমাকে কোন নির্দিষ্ট কাজ দেন, কয়েকদিন পরেই আমি হয় একঘেয়েমিতে ভুগতে শুরু করব, অথবা সব কিছু ভুলে গিয়ে সাহেবের খোশামুদিতে ব্যস্ত থাকব। উভয় ক্ষেত্রেই আমার যে অধঃপতন শুরু হবে, অনেকটা পতিত হবার আগে আমি তা জানতেও পারব না।

    অধঃপতন হবে এটা জানিস, নজরুল কথা বলে এবার, কিন্তু অনেকটা পতিত হবার আগে সেটা বুঝতেও পারবি না কেন বলছিস?

    তোমাকে উদাহরণ দিই, বলে পিংলা, তাহলে বোধ হয় আমি ঠিক কী বলতে চাইছি তোমরা বুঝতে পারবে। ধর, একেবারে গোড়ার কথায় ফিরে যাই। সাহেব যখন মানুষ খুঁজছেন – এক দল পরিশ্রমী অভাবী সৎ মানুষ – যারা গোসাবায় বসতি স্থাপন করবে। এটা তো মানবে, ঠিক সেই মানুষটা আমি নই। নতুন করে চাষা হবার জন্যে সাহেবের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নিয়ে গোসাবায় বাস করতে আসা – আমার পক্ষে এর কোন মানেই হয় না, ঠিক তো? তাহলে তার পরের ধাপ। এই মানুষগুলো গোসাবায় যখন প্রথম এল, সাহেব প্রথমেই নজর দিলেন তাদের স্বাস্থ্যের দিকে। দাতব্য চিকিৎসালয় আর ডিসপেন্সারি খোলা হল। আমি ডাক্তার নই, নই প্যারামেডিকও। তাহলে সেখানেও জুটবে না আমার কাজ। তাহলে? তার পরের ধাপে তৈরি হল প্রাথমিক স্কুল। এখানে হয়তো গোড়ার দিকে একটা-কিছু জুটে যেতে পারতোও আমার, কিন্তু সেখানেও আমার কোন কাজ জোটার সম্ভাবনা আপাতত দেখতে পারছি না কাজিদা। এরকম ভাবে প্রতিটি ধাপ আমি ভেবে দেখেছি কাজিদা, আমার কপালে শেষ অবধি পড়ে থাকে একমাত্র কোন একটা কোঅপারেটিভের খাতা লেখার – মানে কেরাণীর কাজ! আর, কেরাণীই যদি হব তাহলে স্বর্গভূমে গিয়ে লাভ কী বল, চিত্রগুপ্তর মতো হাই-এন্ড কেরাণী হতে গেলে নরকই আসল জায়গা, এটা তো মানবে?

    হেসে ফেলে কাজি আর নলিনী দুজনেই, তারপর কাজি বলে, তুই শুধু কেরাণীর কাজটাই দেখলি; কেন, ওখানকার সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের একটা ম্যানেজারের পোস্টই না হয় তৈরি করে দিল সাহেব তোর জন্যে!

    তুমি যতই প্লিড কর কাজিদা, নিজের হাতে তৈরি করা ব্যাঙ্কের এমন সর্বনাশ ঘটানোর মতো পাগল স্যর ড্যানিয়েল ন'ন। সে যাই হোক, আমি আপাতত কেন আবার গোসাবায় ফিরে যেতে চাইছি সেটা তোমাদের বলি। আগের বার গোসাবা থেকে ফিরে আসার আগের রাত্তিরে তোমাকে চিঠি লিখেছিলুম, পরে মনে পড়ল সাহেবের আর একটা উদ্যোগের কথা বেমালুম ভুলেছি তখন। সেটা বলি, তাহলে আমার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারবে।

    দেখ, বলতে থাকে পিংলা, গোসাবায় পাকাপাকি বাস করতে মানুষরা আসতে শুরু করেছে মোটামুটি উনিশশো নয়ের থেকে। যারা এসেছিল প্রথম দিকে এতদিনে তাদের পরের জেনারেশনও বড় হয়ে উঠছে। সাহেবদের নিজেদের দেশ হলে হয়তো তাদেরও আলাদা সংসার হত, খানিকটা করে জমি দিয়ে চাষের কাজেই তাদের লাগিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু আমাদের দেশে তো ঠিক সেরকম রেওয়াজ নয়, তারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকে। সাহেবের শিক্ষা ব্যবস্থায় মিড্‌ল্‌ ইংলিশ স্কুল পর্যন্ত তারা প্রায় সবাই-ই পড়েছে। কাজিদা, তোমাকে লেখা চিঠিটায় লিখেছিলুম, এইরকম যখন অবস্থা, তখন প্রতিটি গ্রামে স্কুল খোলা হল, স্কুলগুলোর সঙ্গে নাইট স্কুলও যোগ করা হল খানিকটা করে জমি সহ, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু যে কৃষিবিষয়ক আরও শিক্ষা পাবে তা-ই নয়, ওই জমিটুকুতে সেন্ট্রাল মডেল ফার্মের নানা পরীক্ষার ফল হাতে-কলমে করে দেখতে পারবে। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে শিক্ষা গোসাবার কর্মকাণ্ডে আরও বড় জায়গা করে নিল। আর সেই ব্যবস্থা সামলাবার জন্যে সাহেব কলকাতা থেকে নিয়ে এলেন কলকাতার সেন্ট মার্গারেট স্কুল থেকে শ্রীমতি হোয়াইটকে।
    যে-কথাটা তখন তোমাকে লিখতে ভুলেছি তা হল সদ্য-বড়-হয়ে-ওঠা ওখানকার ছেলেরা, যারা মিড্‌ল্‌ স্কুলের পাঠ তখনই শেষ করেছে, সাহেব তখন তাদের জন্যে কারিগরি শিক্ষার স্কুল চালু করার কথাও ভাবতে শুরু করেন। প্রথমেই তিনি খুললেন একটা উইভিং স্কুল।

    উইভিং স্কুল? – আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে নলিনী – এমন স্কুল আছে নাকি?

    গোসাবায় তো এখন নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তারও আগে থেকে আছে শ্রীরামপুরে। আমাদের হুগলির শ্রীরামপুর। সেখান থেকেই মাস্টারমশাই নিয়ে আসেন ড্যানিয়েল সাহেব, তাঁকে দিয়েই প্রথম এই স্কুল শুরু করেন তিনি।

    আগের বারে হোয়াইট ম্যাডামের সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা হয়নি আমার, ওঁকে তখন সব সময়ই ব্যস্ত দেখতুম, দেখতুম ওঁর অফিসে প্রায় সব সময়ই হয় সেন্ট্রাল মডেল ফার্মের লোকরা, নয়তো স্কুলের মাস্টারমশাইরা। ভাবছি, এবারটা গিয়ে সাহেবের এই শিক্ষাব্যবস্থাটা – মানে সাধারণ শিক্ষা ছাড়াও কৃষিবিদ্যা, কারিগরি বিদ্যা – এই সবের পুরো কর্মধারাটা ভালো ভাবে বুঝে আসব। শিক্ষা-পরিচালনার নানা দিক খানিকটা ম্যাডামের কাছ থেকে শিখতে শুরু করব।

    তা তো করবেন, এবার কথা বলে নলিনীদা, তাহলে শেষ পর্যন্ত গোসাবাতেই আপনার উপযোগী একটা কাজের দিশা পাওয়া যাচ্ছে।

    হ্যাঁ, স্বর্গ হইতে বিদায় তাহলে হয়তো শেষ পর্যন্ত নয়, বলে কাজি।



    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৩৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন