এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ২৮

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২০ মে ২০২৩ | ১৫৭৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ২৮

    নজরুলের সংসার – ২



    ফরিদপুরেই কেমন যেন কাহিল দেখাচ্ছিল দেশবন্ধুকে, এবার তাঁর নিজেরই মনে হল কয়েকদিনের বিশ্রামের প্রয়োজন। একটু বিশ্রামের বাসনায় ছুটি নিলেন তিনি, গেলেন দার্জিলিঙে। শরীর সেরেই আসছিল; কয়েকদিনের জন্যে গান্ধীজিও এলেন সেখানে, গান্ধীজির জোরাজুরিতে তাঁরই নেতৃত্বে চরকায় সুতো কাটাও শেখা হল; বেশ ভালোই কাটল দিন কয়েক গল্পগুজব আর শিক্ষানবিশীতে। দেশবন্ধুর কাছ থেকে নিয়মিত সুতো-কাটার প্রতিশ্রুতি নিয়ে গান্ধী ফিরে গেলেন তাঁর পুব-বাংলা পরিক্রমায়, তারপর হঠাৎ এক দিন সবাইকে হতবাক করে সব শেষ!

    দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল দেশবন্ধুর মৃত্যুসংবাদ। গান্ধী তখনও পুব-বাংলায়। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি কলকাতায় ফিরলেন তিনি। মরদেহ নৈহাটি হয়ে কলকাতায় ফিরল যখন তখন গান্ধীর নেতৃত্বে মৌন কলকাতাবাসী চোখের জলে সৎকার করল তাঁর।

    কাজির কাছে দেশবন্ধুর মৃত্যুর এ-খবর তো পিতৃহারা হবার মতো। নৈহাটিতে অপেক্ষমান বিশাল জনতা ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিল শবাধার, আর পুষ্পস্তবকের সঙ্গে গেঁথে নিবেদন করল শোকার্ত কাজির স্বহস্তলিখিত কয়েকটি লাইন:



    হায় চির ভোলা হিমালয় হতে অমৃত আনিতে গিয়া
    ফিরিয়া এলে যে নীলকণ্ঠের মৃত্যুগরল পিয়া।
    কেন এত ভালোবেসেছিলে তুমি এই ধরণীর ধূলি
    দেবতারা তাই দামামা বাজায়ে স্বর্গে লইল তুলি।



    দেশবন্ধুর অকালমৃত্যুর অপ্রস্তুত ঝড় কাজির কবিমনের স্থৈত্যে আঘাত হানে উথালপাথাল, সৃষ্টির উৎসমুখকে যেন টেনে বের করে আনে জনসাধারণ্যে, একের পর এক সঙ্গীত ও কবিতার সৃষ্টি হয়। এক সপ্তাহ পরেই আত্মশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত হল ইন্দ্রপতন। যাঁর মৃত্যুসংবাদে নজরুলের প্রথম প্রতিক্রিয়া, “কেন এত ভালোবেসেছিলে তুমি এই ধরণীর ধূলি/দেবতারা তাই দামামা বাজায়ে স্বর্গে লইল তুলি” সেই চিত্তরঞ্জনকে স্মরণ করতে ইন্দ্রপতন কবিতায় নজরুলের মনে পড়ে বুদ্ধের কথা, নিমাইয়ের কথা, দধিচী-হরিশচন্দ্র-দাতা কর্ণের কথা এবং অবশ্যই ইবরাহিম এবং নবীর কথাও:



    পয়গম্বর ও অবতার-যুগে জন্মিনি মোরা কেহ,
    দেখিনিকো মোরা তাঁদের, দেখিনি দেবের জ্যোতির্দেহ।
    বুদ্ধের ত্যাগ শুনেছি মহান, দেখিনিকো চোখে তাহে,
    নাহি আফ্‌শোস, দেখেছি আমরা ত্যাগের শাহান্‌শাহে।
    নিমাই লইল সন্ন্যাস প্রেমে, দিইনিকো তাঁরে ভেট,
    দেখিয়াছি মোরা 'রাজা-সন্ন্যাসী' প্রেমের জগৎশেঠ।
    শুনি, পরার্থে প্রাণ দিয়া দিল অস্থি বনের ঋষি;
    হিমালয় জানে, দেখেছি দধিচী গৃহে বসে দিবানিশি!
    হে নবযুগের হরিশচন্দ্র। সাড়া দাও, সাড়া দাও!
    কাঁদিছে শ্মশানে সুত-কোলে সতী, রাজর্ষি ফিরে চাও!
    রাজকুলমান পুত্র-পত্নী সকল বিসর্জিয়া
    চণ্ডালবেশে ভারতশ্মশানে ছিলে একা আগুলিয়া!
    এসো সন্ন্যাসী, এসো সম্রাট, আজি সে শ্মশানমাঝে।
    ঐ শোনো তব পুণ্যে জীবন-শিশুর কাঁদন বাজে!
    দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যূপে ফেলে
    ত্যাগের করাতে কাটিয়াছ বীর বারেবারে অবহেলে!
    ইবরাহিমের মতো বাচ্চার গলে খঞ্জর দিয়া
    কোরবানি দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবী-হিয়া!
    ফেরেশ্‌তা সব করিছে সালাম, দেবতা নোয়ায় মাথা,
    ভগবান-বুকে মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা!


    ইসলামের স্বনিযুক্ত মৌলবাদী অভিভাবকদের এ-বিলাপ না-পসন্দ, যদিও তাদের হুমকিকে বিশেষ গ্রাহ্য করার সময় ছিল না নজরুলের, ততদিনে গো-হত্যা উপলক্ষে কলকাতায় শুরু হয়ে গেছে দাঙ্গা। তিন বছর আগে, সিরাজগঞ্জের প্রাদেশিক সম্মেলনে, চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে কংগ্রেসের অন্তর্গত স্বরাজ্য পার্টি হিন্দু-মুসলিম প্যাক্টের প্রস্তাব অনুমোদন করিয়েছিল। সেই প্যাক্টের ফলে সাধারণভাবে হিন্দুরা অসন্তুষ্টই ছিল, কারণ, এতে ছিল চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের বিশেষ সুযোগ দেবার প্রস্তাব। দেশবন্ধু-শিষ্য সুভাষবাবু তো কলকাতা পৌরসভার চীফ এক্সেক্যুটিভ অফিসার হিসেবে হিন্দুদের অসন্তুষ্ট করেও অনেক বেশি মুসলমানদের চাকরি দিয়েছিলেন। সেই সময়, এমনকি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরাও – যাঁদের মধ্যে প্রায় সকলেই হিন্দু – এই প্যাক্টের বিরুদ্ধে কংগ্রেস কর্মীসঙ্ঘ নামে এক সংগঠন তৈরি করেছিলেন শুধুমাত্র প্যাক্ট-বিরোধীতার জন্যেই। মুসলমানরা তখন দেশবন্ধুর উপর ভারী খুশি। সেই মুসলমানরাই এখন দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর সম্বন্ধে নজরুলের উচ্ছ্বাস – সে যদি একটু বাড়াবাড়িও হয়ে থাকে – তাতে এত বিরক্ত! নজরুলের উদ্দেশে কোন পত্রিকায় লেখা হল “...... এ কি স্বেচ্ছাচারিতা! নজরুল! তোমায় জিজ্ঞাসা করি, কোন সাহসে তুমি এ হেন অগৌরবে আল্লার নবীর উপর বাণী প্রয়োগ করিয়াছ! ইসলামের শোণিত বিন্দুমাত্র কি তোমার শিরায় নাই – তোমার প্রাণে কি একটুকুও ভয় নাই। তুমি শ্রীযুক্ত দাসের মধ্যে এমন কি গুণ দেখিলে যে, একেবারে ধর্মভাববিবর্জিত ঘোর আপত্তিকর ছন্দে দাস মহাশয়ের প্রশংসায় মাতিয়ে গেলে।” কেউ আবার “ইসলাম-বৈরী মুসলমান কবি” উপাধি দিয়ে দিল তার!

    খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার পর হিন্দু-মুসলমানের উদ্বায়ী প্রীতিভাব এখন ক্রমহ্রাসমান, মালাবারে নায়ার জমিদার হত্যা এবং ধর্মান্তরকরণের খবর আসছে, এই সময় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের সংক্রমণ রোধ করাই সবচেয়ে জরুরী। ডাক পড়েছে বাঁকুড়ায়। সেখানে ক্রীশ্চান কলেজের খদ্দরপরিহিত অধ্যক্ষ সস্ত্রীক ব্রাউন সাহেব বিপুল-সংখ্যক ছাত্রদের সঙ্গে রেলস্টেশনে এসে অভ্যর্থনা জানালেন কাজিকে। ছাত্রদের অভ্যর্থনাজনিত চন্দনচর্চিত নজরুল কামালপাশা আবৃত্তি করে হৃদয় জয় করল তাদের। তারপর গঙ্গাজলঘাঁটি। এখানকার জাতীয় বিদ্যালয়ের অমর নামের এক স্বেচ্ছাসেবকের স্মৃতিতে অমর-কানন নামে এক আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, নজরুল উদ্বোধন করল সেই আশ্রমের। ছাত্রদের সঙ্গে তো নজরুলের স্বাভাবিক বন্ধুত্ব, মন খুলে অনেক কথা সহজেই সে বলে ছাত্রদের। সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়, আলোচনা হয় সে-সময়ের রাজনীতিতে নজরুলের অবস্থান নিয়েও। গান্ধীর বিষয়ে তার মোহ কেটেছে, কংগ্রেসের রাজনীতিও সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে নয়। খেতে যারা পায় না, হাড়-ভাঙা খাটুনির মূল্য যারা পেল না কোনদিন, তাদের বাদ দিয়ে স্বরাজের আন্দোলনের কোন অর্থই নেই। স্বরাজ এলেই এ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে যারা বলে তারা গাড়ির সামনে নয়, পেছনে ঘোড়া জুড়তে চায়। বাঁকুড়া থেকে ফিরতে ফিরতেই তার লেখা হয়ে যায় আমার কৈফিয়ৎ:



    “বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই 'নবী'।
    কবি ও অকবি যাহা বল মোরে মুখ বুজে তাই সই সবি!
    …………………
    সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা কন, 'আড়ি, চাচা।'
    যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি নাড়ি কাছা!
    মৌ-লোভী যত মৌলবি আর 'মোল্‌-লা'রা কন হাত নেড়ে,
    'দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।
    ফতেয়া দিলাম – কাফের কাজি ও,
    যদিও শহীদ হইতে রাজি ও!
    'আমপারা'-পড়া হাম্‌বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!'
    হিন্দুরা ভাবে, পার্শী শব্দে কবিতা লেখে, ও পাত-নেড়ে!
    …………………
    ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন।
    বেলা বয়ে যায়, খায়নিকো বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন!
    …………………
    প্রার্থনা করো – যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
    যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ!”


    দেশবন্ধু নেই, সুভাষবাবু মান্দালয়ের জেলে, গান্ধীর উপর ভরসা প্রায় চলেই গেছে কাজির; হুগলিতে ফিরে পরিচিত মহলে আর রাজনীতির নানা রঙের কর্মীদের সঙ্গে নতুন কিছু একটা করবার সঙ্কল্প নিয়ে আলোচনা চলে। নিপীড়িত শ্রমজীবী যারা; মূলত কৃষক, কল-কারখানার শ্রমিক, দিন-আনা-দিন-খাওয়া অন্য মানুষরা যেমন মাছ-ধরা জেলে, এদের সংগঠিত করার কথা ওঠে। আলোচনায় সুভাষবন্ধু হেমন্ত সরকার বলেন, এদের নিয়েই মূলত কাজ করব আমরা, কিন্তু এখনই কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কংগ্রেস একটা ব্রিটিশ সরকার বিরোধী স্থায়ী এবং পরিচিত মঞ্চ, কংগ্রেসের সদস্য এবং সমর্থকের সংখ্যা প্রচুর, এদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা বিরোধিতার না-হওয়াই ভালো; আমাদের চেষ্টা করতে হবে বর্তমান কংগ্রেসের সদস্যদের যত বেশি পারা যায় আমাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা। হেমন্তবাবু তাই প্রস্তাব দিলেন, আমরা একটা আলাদা দল তৈরি করব, কিন্তু তার নাম দেব The Labour Swaraj Party of the Indian National Congress বা কংগ্রেস অন্তর্ভুক্ত লেবার স্বরাজ পার্টি। অল্পবিস্তর তর্কাতর্কির পর এই মতটাই গৃহীত হল। কয়েকদিনের চেষ্টায় কলকাতার হ্যারিসন রোডে রাস্তার ওপর দুখানা সংলগ্ন ঘরও পাওয়া গেল দলের অফিসের জন্যে। সাঁইত্রিশ নম্বর বাড়ি। ঘর দুখানা দোতলায় উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে। ঠিক হল দলের পত্রিকার নাম হবে লাঙল।

    এদিকে সংসারে চালও বাড়ন্ত; দোকান-বাজারে, হুগলির বন্ধু-ভক্তদের কাছে, দেনা বেড়েই চলেছে। এত কবিতা-গান ছাপা হচ্ছে নানা পত্রপত্রিকায়, বিষের বাঁশী-ভাঙার গানের পর আরও তো বই ছাপা হল, কাজির হাতে পয়সা আসে না। ঋণ, কিছু অর্থপ্রাপ্তি ও ঋণশোধ, তারপর আবার ঋণ – এই দুষ্টচক্রই যখন ভাগ্যদেবতা হয়ে ওঠে তখন কাজির মতো ভাগ্যের-হাতে-নিজেকে-ছেড়ে-দেওয়া মানুষও নিদ্রাহীন রাত কাটায়। এরই মধ্যে বসিরহাটের একটা উপনির্বাচনে কাজি-মুজফ্‌ফরের প্রিয়বন্ধু কুত্‌বুদ্দিন আহ্‌মদ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন, সেখানে প্রচারের জন্যে দিন দশ-পনের আবদুল হালীমের সঙ্গে কাটিয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে ফিরল কাজি। বাঁচে-কি-না-বাঁচে অবস্থা! প্রতিদিন রাতে শেয়ালদা থেকে নৈহাটি পর্যন্ত ট্রেনে ডাব বরফ আর অন্যান্য পথ্যাদি নিয়ে আসে হালীম, আবার ফিরে যায়। গিরিবালা আর প্রমীলার একান্ত সেবাযত্ন কোনরকমে প্রায়-মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনে কাজিকে।

    এই ঘোরতর অসুস্থতার মধ্যেও কাজির একমাত্র ধ্যানজ্ঞান লেবার স্বরাজ পার্টি আর পার্টির পত্রিকা, লাঙল। পঁচিশে নভেম্বর একটু জ্বর কমলে কালিকলমের সম্পাদক মুরলীধর বসুকে লেখে সে: “......'লাঙলে'র ফাল আমার হাতে – লাঙলের শুধু বা কাঠেরটাই বেরোয় প্রথমবার। শুধু একটা 'কৃষাণের গান' দিয়েছি। নলিনীদাও (নলিনীকান্ত সরকার) নাকি চিদানন্দকে স্মরণ করেছেন – জ্বরে চিৎ। অফিসটা বোধহয় চিৎপুরে উঠিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অফিসের দোরে একটা আস্ত লাঙল টাঙিয়ে দিতে বলেছি। ঐ হবে সাইন বোর্ড। বেশ হবে, না?...

    “হ্যাঁ, তোমাকে লিখতে হবে কিন্তু 'লাঙলে'। প্রথম বারই দিতে হবে। সকলে মিলে কাঁধ দেওয়া যাক। শৈলজা, প্রেমেন, অচিন্ত্যকে তাড়া দিও লেখার জন্য।.....”

    উনিশশো পঁচিশের পঁচিশে ডিসেম্বর বেরোল লাঙলের প্রথম সংখ্যা; প্রধান পরিচালক কাজি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক কাজির পল্টনের সহকর্মী ও বন্ধু মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। সদ্য শারীরিক অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছে কাজি, কিন্তু মাথার উপর তার পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা। হেমন্ত সরকার প্রস্তাব দিলেন, কাজি হগলি ছেড়ে চলে আসুক কৃষ্ণনগরে, সেখানে তাঁর পিতৃনামাঙ্কিত মদন সরকারের গলিতে তাঁদেরই সাবেক বাড়িতে সে সপরিবার থাকতে পারবে, পাশেই থাকেন হেমন্ত, তিনিই হবেন কাজির নিকটতম প্রতিবেশী। ওঁদের পরিবার কৃষ্ণনগরের অনেকদিনের বাসিন্দা, যথেষ্ট প্রতিপত্তি আছে, কাজির কোনই অসুবিধে হবে না।

    জানুয়ারির তিন তারিখে হুগলি থেকে কৃষ্ণনগরে, সপরিবার সব জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে পৌঁছয় কাজি। খানিকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। বাড়ি ভাড়ার টাকা দেবার প্রয়োজন হবে না আপাতত, হুগলির ধার শোধ করারও একটা ব্যবস্থা হয়েছে। গোলাপটি – কৃষ্ণনগরের যে এলাকায় বাস করতে এল সে – সেই এলাকার কলেজ ছাত্ররা এবং স্থানীয় মানুষরা কাজির মতো একজন মানুষকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে ভারী খুশি। একটা সম্বর্ধনারও ব্যবস্থা হল স্থানীয় একটা খোলা মাঠে। এখন শীতের সময়, বৃষ্টির ভয় নেই, খোলা মাঠে একরাশ রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে কাজি শুনল টাউন কংগ্রেসের সম্পাদক গোবিন্দপদ দত্তর অভিনন্দন পাঠ, উত্তরে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা ছাড়াও জাতের নামে বজ্জাতি নিজকণ্ঠে গেয়ে শুনিয়েও দিল সে সভাশেষে।

    রোদ্দুর তখনও পুরোপুরি পড়ে যায়নি, শীতের বিকেলের ঠাণ্ডা হাওয়ার আমেজ, সদর দরজার কড়া নড়ে উঠল হঠাৎ সশব্দ। খাটো একটা ধুতি-পরা, চাদর মোড়া আষ্টেপৃষ্ঠে, কাজি খুলে দেয় দরজা। বাইরে দাঁড়িয়ে তিনজন। এদের মধ্যে দুজন মুখচেনা, আজই সম্বর্ধনার সময় তাদের দেখেছে কাজি। তৃতীয় জন একটু বয়স্ক, সাহেবী পোশাকে। মুখচেনা দুজনেরই হাতে একটা করে পাতাচাপা চেঙারি। ওদের মধ্যে, দেখে সবার চাইতে বয়েসে ছোট বলে মনে হয় যাকে, সে-ই প্রথম কথা বলে। বলে, আমার নাম প্রমোদ সেনগুপ্ত, সকালে আমাকে দেখেছেন হয়তো আপনি। আমি এখানকার কলেজে পড়ি। তার ডানদিকে দাঁড়ানো লোকটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় প্রমোদ, ইনি তারক বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার বন্ধু। আজ আপনার সম্বর্ধনা সভায় আমরা কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মিষ্টি – কিছু সরপুরিয়া আর সরভাজা – আপনাকে খাওয়াতে চেয়েছিলাম। যেখানে অর্ডার দেওয়া হয়েছিল তারা সেই সময় ডেলিভারি দিতে পারেনি। তাই এখন আমরা নিয়ে এসেছি। শশব্যস্ত হয়ে কাজি দরজাটা দু হাত দিয়ে বড় করে খুলে দেয়, আরে আরে আপনারা ভেতরে আসুন। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সাহেবী পোশাকের ভদ্রলোক বলেন, আমি ডক্টর জে-এন-দে। আমাকে হেমন্তবাবু আপনার চিকিৎসার দায়িত্ব দিয়েছেন। এরা আসছিল, আমি বললাম, চল, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই।

    আরে, হেমন্তদা যে কী করেন, বলতে বলতে ঘরের এক কোণে রাখা চৌকিটা হাত দিয়ে ঝাড়তে থাকে কাজি; বলে, আপনারা বসুন। তারপর প্রায় দৌড়িয়ে সে চলে যায় বাড়ির ভিতরে, একটা টুল নিয়ে আসে হাতে করে, প্রমোদ আর তারকের কাছ থেকে চেঙারি দুটো নিয়ে টুলটাকে একটা দেয়ালের সঙ্গে ঘেঁসে দাঁড় করিয়ে, দেয়ালে হেলান দিয়ে চেঙারি দুটোকে রাখে তার ওপর।

    অগোছালো ঘরে কাজির বিব্রত অবস্থা দেখে মনে হয় একটু মজাই পেয়েছেন ডক্টর দে। তিনি হেসে বলেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না। একটা শিফটিং কি চাট্টিখানি ব্যাপার নাকি? সদ্য এসেছেন, আপনি গুছিয়ে বসবার আগেই আমরা এসে ব্যস্ত করছি আপনাকে।

    কাজি বলে, না না ব্যস্ত নয়। কিন্তু এত মিষ্টি এনেছে, দু' চেঙারি। আমরা আর কত খাব? আপনারাও যদি না খান তাহলে মিষ্টি তো নষ্ট হবে।

    নষ্ট হবে? কেন?– বলেন ডাক্তার, এ জায়গাটা কেষ্টনগর, শীত তো পড়েই গেছে জাঁকিয়ে, সাত-দশদিন রেখে খাবেন, কিচ্ছুটি হবে না। ঠিক আছে, আপনার অস্বস্তি হচ্ছে, নিয়ে আসুন জল; আমি একটা খাব, যে-কোন একটা। আমাকে এখন যেতে হবে, তবে তার আগে একটু এগজামিন করব আপনাকে। ওই ছেলেরা বসবে, ওদেরই খাইয়ে দেবেন বেশি করে।

    বাড়ির ভেতরে ঢুকে কাঁসার গেলাসে জল নিয়ে আসে কাজি; ওর হাত থেকে গেলাসটা নিতে নিতে প্রমোদকে বলেন ডাক্তার, একটা চেঙারি খোল তো হে, একখানা মিষ্টি খাব আমি; বলতে বলতে গেলাসটা নিয়ে বাইরে যান ডাক্তার, বোঝা যায় গেলাসের অনেকটা জল দিয়ে উনি হাত ধুলেন। ডাক্তার ফিরতে ফিরতে একটা চেঙারি খুলে রাখে প্রমোদ, ডাক্তারের সামনে ধরে চেঙারিটা, সন্তর্পণে একটা সরভাজা তুলে নিয়ে ডাক্তার মুখে ফেলেন, আলগোছে গেলাসটা থেকে জল খান খানিকটা, আবার বাইরে বেরিয়ে হাত ধুয়ে গেলাসটা মেঝের এক কোণে রেখে রুমাল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে কাজিকে জিজ্ঞেস করেন, চাদরের নীচে কী আছে আপনার, জামা?

    কিছুই নেই, বলে কাজি।

    ব্যাগ খুলে স্টেথোস্কোপ বের করেন ডাক্তার। চাদরের উপর দিয়েই পরীক্ষা করেন কাজিকে, তারপর বলেন, বুক আপনার পরিষ্কার নেই, এই কেষ্টনগরের ঠাণ্ডায় খালিগায়ে চাদর চলবে না, গরম জামা পরতে হবে চাদরের নীচেও। কাল সকালে একটা ছেলে আসবে আপনার কাছে, আটটা-সাড়ে আটটায়। ঘুম থেকে ওঠবার পর কিছু খাবেন না সে পর্যন্ত, সে খালিপেটে রক্ত নেবে আপনার। সেটা এগজামিন করে তারপর আপনাকে খবর পাঠাব, ঠিক আছে? আর সময়ের অপব্যয় নয়, ব্যাগটা তুলে দরজা খুলে বেরিয়ে যান তিনি।

    ডাক্তার বেরিয়ে যেতে গম্ভীর মুখে কিন্তু চোখ নাচিয়ে প্রমোদ বলে, বিলেত ফেরত, এমনিতে হাসিখুশি, কিন্তু কেমন যেন ভয়-ভয় করে। যা বলবে কথা শুনবেন কিন্তু। হঠাৎ ঘরের মধ্যে এতক্ষণ-জমে-থাকা আস্তে-আস্তে-কথা-বলা থমথমে পরিবেশটা কেটে যায়। হো হো করে দেয়াল ফাটিয়ে হেসে ওঠে কাজি – দে গোরুর গা ধুইয়ে – আমাকে দেখতে বিলেত-ফেরত ডাক্তার! চেঙারিদুটো এখন টুল ছেড়ে আবার প্রমোদের কোলে, টুলটা সেই সুযোগে টেনে নেয় কাজি, বসে পড়ে সেটার ওপর, তারপর হেসে বলে, তা, তোমরাও কি বিলেত-টিলেত ঘুরে এলে নাকি?

    প্রমোদ নয়, উত্তর দেয় তারক, প্রমোদের বন্ধু। সে বলে, ঠিক বিলেত ঘুরে যে এলাম তা নয়, তবে ওখান থেকে এসেছে যারা তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠাবার তালে আছি। সে ঠেঙিয়েই হোক বা – ওই যে আপনি ধূমকেতুতে লিখেছিলেন না – বোঁচকা পুটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দেওয়ানো, তা সে যা-ই হোক যে ভাবেই হোক – সেই চেষ্টাতেই আছি।

    সে চেষ্টাটা ঠিক কী কী করলে ফলপ্রসূ হবে সে তো ঠিক হবে সামনের মাসে, ফেব্রুয়ারিতে, বলে প্রমোদ, ছ' তারিখের নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মিলনীর মীটিঙে, কিন্তু তার আগে আপনার শরীরটা তো ঠিক মতো সারানো চাই। সে ব্যাপারে কয়েকটা প্রস্তাব নিয়ে আমরা এসেছি আজ। আপনার শরীরের দায়িত্ব যেমন ডাক্তারবাবু নিয়েছেন, আমরা ঠিক করেছি আপনার সংসারের দায়িত্ব আপাতত আমাদের। সেই ব্যাপারেই আলোচনা করতে এলাম আমরা।
    সে-আলোচনায়, আমরা মনে করি না, আপনার বিশেষ কিছু বক্তব্য থাকবে, কিন্তু বৌদি এবং – আমরা শুনেছি জ্যাঠাইমা, মানে বৌদির মা-ও এখানে আছেন – তাঁদের সঙ্গেই আমাদের মূল আলোচনা। আপনাকে আমরা শ্রোতা হিসেবে এই সভায় থাকতে অ্যালাউ করব, তবে ওই পর্যন্তই; কথা বলবার কোন অধিকার আপনার থাকবে না, বোঝা গেল?

    কাজি কিছু জবাব দেবার আগেই উঠে দাঁড়ায় তারক, বলে, তাহলে ডেকে আনি জ্যাঠাইমা আর বৌদিকে। কাজিও দাঁড়ায়, প্রমোদও। প্রমোদ বলে, কাজিদা, আপনি যেখানে বসে ছিলেন সেখানেই বসুন আপাতত। এই বাড়ি হেমন্তদার বাবার আমলের, এর প্রতিটি ঘর, সিঁড়ি, বারান্দা, আমাদের চেনা। জ্যাঠাইমা আর বৌদিকে ধরে আনবার পক্ষে ও একাই যথেষ্ট, আপনাকে আর অসুস্থ শরীর নিয়ে ছোটাছুটি করতে হবে না।

    প্রমোদের কথা শেষ হবার আগেই বাড়ির ভেতর থেকে তারকের উচ্চকিত কণ্ঠে বার-দুয়েক 'বৌদি জ্যাঠাইমা-জ্যাঠাইমা বৌদি' ধ্বনি শোনা যায়। একটু পরেই একটা ভাঁজ-করা কম্বল বগলে হাসিমুখে ফিরতে দেখা যায় তারককে, সে ঘরে ঢুকেই মেঝেতে কম্বলটা দেয় বিছিয়ে, তার পেছনেই হাসিমুখে দেখা যায় গিরিবালা আর দুলিকে। দুলির হাতে কয়েকটা রেকাবি, গিরিবালার হাতে একটা জলভরা ঘটি। প্রমোদেরই পাশে চৌকিটায় বসে তারক, দুলি আর গিরিবালা কম্বলের ওপর, কাজি যে টুলটাতে বসেছিল সেখানেই বসে থাকে।

    সবার আগে পেটায় নমঃ, বলে প্রমোদ।

    দুলি উঠে এসে খোলা চেঙারি থেকে কয়েকখানা সরভাজা বের করে প্রমোদ আর তারককে দেয়, তারপর কাজিকেও। প্রমোদ বলে, আপনাদের?

    আপনারা আগে খেয়ে নিন, তারপর আমরা নেব, বলে দুলি।

    ওসব নিয়ম বদলে গেছে আজ থেকে। প্রথমে জ্যাঠাইমা আর আপনি খাবেন, তারপর আমরা, বলে তারক। গিরিবালা হেসে বলেন, তক্কো করিসনা দুলি, ওরা কথা শোনবার ছেলে নয়। আয়, আমরা খেতে শুরু করি, তোমরাও খাও বাবা।সবাই মিলে হৈ হৈ করে খাওয়া হয়। যে চেঙারিটা খোলা হয়নি সেটা সেই অবস্থাতেই থাকে; খোলা যেটা তার অর্ধেকও শেষ হয়নি। প্রমোদ বলে, এই মিষ্টিগুলো তুলে রাখুন বৌদি, শীতের সময়, ভালোই থাকবে। গিরিবালা জিজ্ঞেস করেন, তোমরা চা খাও?

    ওরা জবাব দেবার আগেই কাজি বলে, চা সবাই খায়, পেলেই খাবে। দুলি চা তৈরি করে আনে।

    চা খেতে খেতে তারক বলে, আমার একটা দোকান আছে বৌদি, কয়লার। এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে, আজ আর হবে না। কাল সকালে ন'টা নাগাদ একজন এসে এক বস্তা কয়লা দিয়ে যাবে, খানিকটা কেরোসিন তেল আর ঘুঁটেও। এখন তো এ-সবই লাগবে, শুধু চায়ের জল ফোটালেই তো আর চলবে না! কাল সকালে আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ ডাক্তারবাবু একজনকে পাঠাবেন কাজিদার রক্ত নেবার জন্যে। সেই সময়েই আরও একজন আসবে, তার হাতে একটা লিস্ট দিয়ে দেবেন। এখনই কী কী প্রয়োজন ভেবেচিন্তে লিস্টটা তৈরি করে রাখবেন, সে নিয়ে আসবে সব।

    টাকাপয়সা তাকেই দেব তো?– জিজ্ঞেস করে কাজি।

    টাকাপয়সার কথাতেই আসছিলাম কাজিদা, বলে তারক। আমার দোকানে আপনার নামে একটা খাতা থাকবে। সেই খাতায় সারাদিনে যা যা কেনা হল সেই লিস্ট এবং কতো খরচ হল লিখে রাখা হবে রোজ। আপনার নিজের সুবিধেমতো যেদিন কিছু টাকা দিতে চাইবেন, দিয়ে দেবেন। সেটাও লিখে রাখা হবে খাতায়। আপাতত এরকমভাবেই চলুক। টাকাপয়সার অসুবিধে থাকলেও কোন সঙ্কোচ করবেন না। যখন যা পারবেন তখন তা-ই দেবেন। চা-টা ভারী ভালো হয়েছিল। আর একবার পাওয়া যাবে, বৌদি?

    কাজি কি খুশি হল? সে জানে না। শুভার্থীদের আনুকূল্য এবং দয়ায় তার সংসার চলবে, এটা কি খুব খুশি হবার কথা? অথচ, এখন যে অবস্থায় সে পড়েছে তার তো অন্য কোন উপায়ও নেই। কাজি নিজেকে জিজ্ঞেস করে, তার নিজের পরিচিত বা ভালোবাসার অন্য কারও যদি ওর মতো এই অবস্থা হত, ও নিজেও কি যথাসাধ্য হাত বাড়িয়ে দিত না? তাহলে, আজ ওর এই সর্বাঙ্গীণ করুণ অবস্থায় ওর সত্যিকারের বন্ধু আর শুভার্থী যারা তারা হাত বাড়িয়ে দিলে সে হাত ধরতে লজ্জা কিসের?

    ডক্টর দে-র নির্দেশে দু'দিন পর বিকেলবেলা তাঁর ডিসপেন্সারিতে প্রমোদের সঙ্গে আসতে হল কাজিকে। আপনার ম্যালেরিয়া কিন্তু পুরোপুরি সারেনি, বলেন ডাক্তার, আপাতত ডরম্যান্ট আছে আপনি ভাবছেন সেরে গেছেন। আমি নতুন করে পুরিয়া তৈরি করে দিলাম, দিনে তিনবার নিয়ম করে খাবেন। দশদিন পর আবার রক্ত-পরীক্ষা করে দেখব। বুকেও আপনার সর্দি বসে গেছে, তার জন্যে এই বোতলের ওষুধটা। দু-দাগ করে চলবে রোজ। আর
    প্রোটিন-রিচ ডায়েট। ভাববেন না, সামনের মাসে আপনাদের মীটিং শুরু হবার আগেই দাঁড় করিয়ে দেব আপনাকে, দৌড়-ঝাঁপ সবই করতে পারবেন। তবে এখনও আপনার শুয়ে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। নিজেকে রোগী ভাববেন না, শরীর যতটুকু পারমিট করবে ততটুকু কাজকর্ম স্বচ্ছন্দে করতে পারেন। আর হ্যাঁ, ঠাণ্ডা লাগাবেন না। এই যে টুপি আর মাফ্‌লার ছাড়া এসেছেন, এটা ঠিক হয়নি।

    বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে যায় প্রমোদ; দুলিকে বলে যায়, কাল আবার আসব, বৌদি। আজকাল রোজই আসে ওরা। শুধু দুজনেই নয়, ওদের সঙ্গে আসে আরও চার-পাঁচজন, মনে হয় স্কুল কলেজের ছাত্রই হবে। বাড়িতে আবার অনবরত হৈ-হল্লা, কাজির 'চালাও পানসি বেলঘরিয়া' ঘোষণার বাড়ি-কাঁপানো ঝঙ্কার, হারমোনিয়মের শব্দ, সমবেত গান আর আবৃত্তি; সারা পাড়া মুখরিত। এরই মধ্যে একদিন পোস্ট-অফিসের পোস্টম্যান চার-পাঁচখানা চিঠি হাতে আলাপ করে গেল। কাজির নামের সঙ্গে মদন সরকারের গলি মেলাতে পারেনি ওরা। এ বাড়ি তো সরকারবাবুদের। যাই হোক, এখন থেকে আর অসুবিধে হবে না।

    এরই মধ্যে খবর পেয়ে গেছে হতভাগারা, ঠিকানা সমেত,– খুশি-খুশি গলায় কৃত্রিম বিরক্তি এনে ঘোষণা করে কাজি। চিঠি লিখেছে ঢাকা থেকে শিখা পত্রিকার তিনজন; আবুল ফজল, কাজি আবদুল ওদুদ আর মোতাহার হোসেন – আলাদা আলাদা চিঠি কিন্তু একই অনুরোধ – উনিশে জানুয়ারি ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠা উৎসবে আসতেই হবে। চিঠি এসেছে ময়মনসিংহ থেকে, নামে-চেনে-না লিখেছেন এমন একজন, ফেব্রুয়ারিতে কৃষ্ণনগরে নিখিল বঙ্গ প্রজাসম্মিলনীর আগেই ময়মনসিংহের জেলা সম্মিলনীতে যোগ দেবার আহ্বান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজি, আর একবার ময়মনসিংহে সুযোগ পেলেই সে যেত, তার কৈশোরের যে-বছরটি ওখানে কেটেছে তা সে ভুলতে পারবে না কোনদিন। আর একবার হাঁটত কাজির শিমলা দরিরামপুরের রাস্তা ধরে, পুকুরের কোল ঘেঁসে, কাঠালতলায় বিচুতিয়া ব্যাপারির বাড়ির সামনে শুকনো পাতায় নিজের পদধ্বনি শুনতে শুনতে পৌঁছে যেত সেই আমগাছের নীচে যেখানে বসে বাঁশি বাজাত সে, আর সামনের পুকুরে সন্ধ্যেবেলায় যেখানে বেড়াতে বেড়াতে এক দল কিশোরীর কলধ্বনির মাঝে আড়চোখে তাকানো কোন একজোড়া চোখ; চোখ আর সেই যত্ন করে রেখেও হারিয়ে যাওয়া মাথার কাঁটা......

    কী তিথি আজ তার খবর রাখে না কাজি, কিন্তু চাঁদের আলোয় ভরে উঠেছে মদন সরকারের গলির ঘরখানা। পুরোনো আমলের বাড়ি, বড় বড় শার্সি-খড়খড়ি দেওয়া জানলা। শীতের রাতেও খড়খড়ি বন্ধ করে না কাজি, শার্সিটা বন্ধ করে রাখলে সোজা ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকতে পারে না ঘরে, কিন্তু চাঁদের রহস্যময়ী রূপোলী আলো সবকিছুর রঙ কেমন যেন বদলিয়ে দেয়। নিজের ঘরে শুয়ে আছি বিশ্বাসই হয়না, মনে হয় বিশ্বজগতের বাইরে অদ্ভুত এই নিরালা রঙে সারারাত ক্লান্তিহীন জেগে থাকা যায়! একটু গড়িয়ে একেবারে কাজির বুক-ঘেঁসে মাঝরাত্তিরে তার দিকে পাশ-ফিরে শোয় দুলি; বলে, তোমাকে আজ থেকে কাজিদা বলে আবার ডাকব।

    কাজিদা? কেন?

    তুমি যখন কাজিদা তখন তুমি অন্যরকমের মানুষ। তোমার পিঠে তখন গুম গুম কিল মারা যায়, হাতের সামনে একমুঠো আবির পেলে মনে হয় তুমি যেখানেই থাক সেখানে গিয়ে তোমার মাথা ভর্তি চুল এলোমেলো করে দেওয়া যায় রাঙিয়ে। দুবছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে, তারপর থেকে যখনই তুমি বাড়িতে, দেখে মনে হয় তোমার কোন আনন্দ নেই, শুধু আছে দুশ্চিন্তা। রাতে ভালো ঘুমোতে পারনা, ছটফট কর বিছানায়। আমি লক্ষ্য করি, আর বুঝতে পারি সকাল হলেই বাড়িভাড়া শাকসব্জি চালডাল – সংসারের এই নানান চাহিদা নানা বিড়ম্বনা তোমার জীবনটাকে শেষ করে দিচ্ছে একেবারে। কেমন ভয় হয়, কেমন যেন মনে হয় আমাকে আর তুমি ভালোবাস না, বাসতেই পার না, চাইলেও নয়। অথচ একটু পরেই তোমাকে যখনই কেউ ডেকে নিয়ে যায়, তুমি আবার কাজিদা হয়ে যাও, কতদিন ফেরই না বাড়িতে, যখন ফের অবশেষে, দেখলেই বোঝা যায় এতদিন তু্মি ভালো ছিলে, এই চালডালের দুনিয়া তোমাকে কিছুতেই ভালো থাকতে দেবে না।

    নিথর হয়ে যায় কাজি। মনের কোন্‌ অতল থেকে কথা বলছে দুলি, বোঝবার চেষ্টা করে সে। অতটুকু মেয়ে নীরবে কী কষ্ট কী যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গত দুটো বছর কাটিয়েছে নিজেকে সে বোঝাতে চেষ্টা করে। দুলির দিকে ফিরেই সে শুয়েছিল, ভালো করে তার দিকে তাকিয়ে সে বোঝে এই দু'বছরে কী রোগা হয়েছে সে। দুলির পিঠের তলা দিয়ে নিজের বাঁ-হাতটা তার পিঠে রাখে কাজি, তারপর শরীরের সামান্য উদ্যমে তাকে তুলে আনে একেবারে নিজের বুকের ওপরে। তারপর বলে, ভুল হয়ে গেছে দুলি, আমাকে তুমি ক্ষমা কর। তোমাকে পাবার জন্যে যে যোগ্যতা আমার অর্জন করা উচিত ছিল, তা না করেই, অতি সহজেই, অযোগ্য আমি তোমাকে পেয়ে গিয়েছিলুম। আর তার খেসারত দিয়েছ তুমি, অথচ দেবার কথা আমার।

    দুলির চোখ বোজা, সে কথা বলে না, তার চোখের অনর্গল জলে ভেসে যায় কাজির বুক। দুলির পিঠে আবার হাত রাখে কাজি, একটুখানি পাশ ফিরে বিছানায় আবার শুইয়ে দেয় তাকে ঠিক মায়ের মতো যত্নে, তারপর নিজের মুখ দুলির ভেজা মুখে ভেজাতে ভেজাতে প্রায় ফিসফিস করে বলে, ভগবান আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন দুলি, আর একটা সুযোগ দিয়েছেন আমাকে, হেমন্তদাকে দূত করে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবার। তুমি একটু ধৈর্য ধর, যদিও যোগ্য আমি নই তবুও বিশ্বাস রাখ আমার ওপর, আর একটা সুযোগ আমাকে দাও।

    তুমি এমন করে বোলো না, বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে দুলি।

    আর কোন কথা নয়, গভীর ভালোবাসায় দুজনের চোখের জলের অতলে ডুবে যায় ওরা।



    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২০ মে ২০২৩ | ১৫৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন