সেই যে বুলবুলের মৃত্যুর খবর পেয়ে কলকাতায় নজরুলের বাড়ি এসেছিল পিংলা, তারপর থেকে বহুদিন তার খবর নেই কোন। বাইরের থেকে যারা দেখছে তারা জানে নজরুলের কাজকর্ম চলছেই পূর্ববৎ, এমনকি হয়তো কাজের চাপ সে আগের তুলনায় বাড়িয়েওছে অনেকটা। সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে, পুরোনো ছোট গাড়ির জায়গায় নতুন ক্রাইসলার, সদর দরজায় দারোয়ান। মঞ্চে এতদিন নজরুলের গানেরই জয়যাত্রা চলছিল, এবার সে ধ্রুব নামের বাংলা সিনেমায় শুধুই সঙ্গীত-পরিচালক নয়, অভিনয়ও করেছে নারদের চরিত্রে। বাংলা যাত্রাপালা এবং মঞ্চে এতদিন নারদ নামে বোঝা যেত শ্বেতশ্মশ্রুধারী এক সাধক-বাউল জাতীয় উপস্থিতি; নজরুল আমূল বদলিয়ে দিল সেই ধারণা, সে তরুণ নারদ হিসেবে অবতীর্ণ হল এই সিনেমায়। এই নিয়ে যখন হৈ-হল্লা, নজরুল তখন তার অননুকরণীয় ভঙ্গিতে প্রশ্ন তুলল, নারদের বয়েসের উল্লেখ কোথায় আছে? আর যদি ইঙ্গিতেও তার বয়েসের বার্ধক্যের কথা থাকেও কোন পুরাণে; চেহারায় গোঁফ-দাড়িতে তার বয়েসের ছাপ যে ফেলতেই হবে, তার কী মানে? মনের দিক থেকে তো সে চিরতরুণই, তা না হলে অনবরত স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আর মর্ত্য থেকে স্বর্গে যাতায়াত করে এর-কথা-ওকে-ওর-কথা-তাকে সে চালায় কীভাবে? চলচ্চিত্রে তাই তরুণ নারদেরই উপস্থিতি সার্থক হবে।
বাংলা সিনেমা এখন একেবারেই প্রাথমিক স্তরে; গ্রামোফোনের গান, মঞ্চের নাটক বা মঞ্চবিহীন নানারকমের যাত্রাপালা বা লোকনাট্যই এখনও ছাপা-বইয়ের বাইরে বাংলায় বিনোদনের প্রধান মাধ্যম, যদিও সবাক এবং নির্বাক বিদেশী সিনেমার আকর্ষণও বোঝা যাচ্ছে একটু একটু। সিনেমা যে সম্পূর্ণ নতুন একটা মাধ্যম এবং ভাষা, এবং প্রতিভাবান শিল্পীর হাতে সে মাধ্যমের ভবিষ্যত যে অত্যুজ্জ্বল সে-কথা রবীন্দ্রনাথও বলেছেন। রাশিয়ায় গিয়ে তিনি আইজেনস্টাইনের ব্যাট্ল্শিপ পোটেমকিন দেখে এসেছেন। এমনকি তাঁর নৃত্যনাট্য নটীর পূজার একটা চলচ্চিত্র-সংস্করণও তিনি প্রযোজনার চেষ্টা করেছিলেন যদিও সে প্রযোজনা তাঁর নিজেরই পছন্দ হয়নি। নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র-শৈলজানন্দ এই নতুন মাধ্যমকে ভালো করে বোঝবার চেষ্টা করছে। সিনেমা-সংক্রান্ত পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। কবিতা রচনায় ভাঁটা-পড়া নজরুল তো তার গানের সুবাদে শুধু মঞ্চে নয়, সিনেমার শিল্পীদেরও কাছাকাছি। এই অবস্থায় সিনেমায় তার উৎসাহ স্বাভাবিক ভাবেই হতে পারত। এমন সময় হঠাৎ পিংলার একটা চিঠি পৌঁছল তার কাছে, সম্পূর্ণ নতুন একটা সম্ভাবনার কথা জানিয়ে:
গোসাবা, সুন্দরবন, ১লা বৈশাখ, ১৩৪১
প্রিয় কাজিদা,
শিবপুরের সেই 'ভীমদার তেলেভাজা'র ভীমদাকে মনে আছে? ভীমদা বলেছিল, স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের ডাকে মেদনীপুর থেকে সপরিবার তার বাবা এসে বাসা বেঁধেছিল গোসাবায়। যতীন দাদার Young Bengal Zamindari Urban Cooperative ছিল ওই গোসাবাতেই সাহেবের কাছ থেকে লীজ নেওয়া জমিতে। আজ এতদিন পর আমি সশরীরে সেই গোসাবায়। অবাক হচ্ছ? ব্যাপারটা খুলে বলি।
ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের সম্বন্ধে ভীমদা যতটুকু বলেছিল, সেটা সামান্যই। সাহেব পাক্কা স্কটিশ, আঠের শতকের স্কটিশ কোঅপারেটিভ আন্দোলনের উত্তরসুরী সে। ভারতের জনসাধারণের আর্থিক-সামাজিক অবস্থা বদলাতে হলে, সে মনে করতো, ক্যালিডোনিয়ন সমাধানই একমাত্র রাস্তা।
এখানে একটা সত্যি কথা তোমাকে বলে রাখি। ক্যালিডোনিয়ন শব্দটার অর্থ, সাহেব যখন বলেছিল, তখন আমি একেবারেই বুঝিনি। এখনও যে পুরোপুরি বুঝেছি এমনটা নয়। এতদিনে, একটু একটু এই কথাটা বুঝতে পারি যে, স্কটল্যাণ্ডের অর্থনৈতিক বিপদের দিনে সে দেশের সমস্যা এবং আমাদের সমস্যার একটা মিল দেখেন সাহেব, অতএব সমস্যার সমাধানের একটা মিলের কথাও ভাবেন তিনি। নতুন করে নোট ছাপিয়ে – যা বোধ হয় সরকারি ছাপা নোটের হিসেবের বাইরেই থাকবে – তাকে বাজারে চালু করিয়ে দেবার একটা কায়দা সাহেবের মাথায় আছে বলে মনে হয়। এখন শান্তিনিকেতনে ফিরে, আমার স্যর অতুলবাবুকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো শুধু ইংরিজি থেকে বাংলা অর্থ নয়, ব্যাপারটা আসলে কী, এবং স্কটল্যাণ্ড আর বাংলার সমস্যার আর সম্ভাব্য সমাধানের মিলটা কোথায় খানিকটা তিনিই বুঝিয়ে দিতে পারবেন। সাহেব নিজেও বুঝিয়েছিলেন, কিন্তু স্যরের কথাই আলাদা! সে কথায় পরে আসছি।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের আদেশে, অতুলবাবু স্যরের নির্দেশ এবং উপদেশে, আর প্রথমে এল্ম্হার্স্ট সাহেবের আর এখন পর্যন্ত কালীমোহন ঘোষ স্যরের ছকে-দেওয়া কাজ করতে করতে পতিসর সুরুল এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলে এতদিন ধরে গ্রামোন্নয়নের কাজ যথাসাধ্য করছি। যে-সব জায়গায় কাজ করেছি এতদিন, সেগুলো প্রতিষ্ঠিত গ্রাম। হয় ঠাকুরবাড়ির অথবা অন্য কোন জমিদারির অন্তর্গত। জমিদারি তো শুধু জমি দিয়েই হয় না, সেই জমিতে বসবাসকারী এবং উৎপাদনকারী নানা রকমের মানুষ, আর তাদের নানা সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না দিয়েই গড়ে ওঠে এক-একটা গ্রাম, একটা অঞ্চল এবং সে অঞ্চলের এক বা একাধিক জমিদারি। জমিদার যখন জমিদারি বংশপরম্পরায় অর্জন করে, তখন জমিদারির অন্তর্গত মানুষগুলোর অর্থাৎ প্রজাদের বহুদিনের সঞ্চিত সংস্কার, আদর্শ, উদারতা, আলস্য, পরশ্রীকাতরতা, দয়ামায়া – সবই, না-চাইলেও জমিদারের অর্জন। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের যাবতীয় গ্রামোন্নয়নের কাজ এই প্রজাদের সঙ্গে নিয়ে, তাদের উৎসাহিত করেই করতে হয়েছে।
ড্যানিয়েল সাহেবের সঙ্গে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের অনেক দিন ধরেই চলছিল। বোধ হয় বর্ধমান শহরে কোঅপারেটিভ আন্দোলনের বিষয়ে একটা সেমিনারে তাঁদের কিছুক্ষণ মুখোমুখি কথাবার্তাও হয়। শুনেছি শান্তিনিকেতনেও সাহেব এসেছিলেন, তবে সেই সময়ে যে-কোন কারণেই হোক আমি ছিলুম না। উনিশশো বত্তিরিশের তিরিশে ডিসেম্বর শেষ পর্যন্ত সাহেবের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ গোসাবায় দু'রাত্তির কাটিয়েও আসেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে তিনি গোসাবায় কী দেখে এলেন প্রায় দিন-দশেক সে-বিষয়ে অন্তত আমার পরিচিত কারো সঙ্গে কোন আলোচনাই করেননি। কিছুদিন আগে কবি রাশিয়া থেকেও তাঁর এজন্মের তীর্থদর্শন অসমাপ্ত না-রেখে ফিরেছেন গভীরভাবে আপ্লুত হৃদয় নিয়ে। মাসখানেক আগে কবি একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন; বললেন, গোসাবা থেকে ঘুরে আয়। কেন তোকে ঘুরে আসতে বলছি আমি নিজে জানিনা; অতএব, ধরে নিতে পারিস, আমার কোন নির্দেশ নেই। কতদিনের জন্যে যাবি তা-ও বলছি না, যতদিন ভালো লাগে, থাকবি। ভালো না লাগলে ফিরে আসবি, আবার যেতে ইচ্ছে হলে আবারও যাবি। ড্যানিয়েল সাহেবকে বলা আছে, তোর জন্যে ব্যবস্থা থাকবে। কবে যেতে পারবি?
বললুম, আমার তো কোন বিশেষ কাজ নেই এখন, আপনি যেদিন বলবেন সেদিনই যাব। কাল বললে কালই রওনা হতে পারি।
তোর সঙ্গে টাকাপয়সা কত আছে?
শ'দুয়েক টাকা আছে আমার, বললুম আমি।
দুশো? ঠিক আছে, বললেন গুরুদেব। আমি কিন্তু তোকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে বলছি না। শান্তিনিকেতনে তুই কারো দয়ায় থাকিস না, এখানে থাকার অধিকার তোর স্বোপার্জিত। আমি শুধু তোকে নিজের চোখে, অন্যের প্রভাব ছাড়া, সম্পূর্ণ নিজের দৃষ্টিতে জায়গাটা দেখতে পাঠাচ্ছি। যতদিন ভালো লাগে, থাকবি। ফিরে আসতে ইচ্ছে না করে যদি, আসবি না। যদি ইচ্ছে করে ফিরে আসতে, কারোকে জিজ্ঞেস করবার দরকার নেই। এখানে তোর নির্দিষ্ট কাজ তো আছেই।
পরের দিন সকালে যখন বোলপুর স্টেশন থেকে হাওড়ার ট্রেন ধরলুম, মনটা কেমন জানি ভারি হয়ে উঠল। শান্তিনিকেতনে প্রথম এসেছি, সে তো দশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল। প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় গ্রামোন্নয়নের কাজ করতে পতিসরে যেতে চেয়েছিলুম, কবি আমাকে বলেছিলেন, অতুলবাবু যদি পতিসরের ব্রতীবালক সংগঠনের কাজে তোমাকে লাগিয়ে দেন, তাহলে কিন্তু তুমি একজন ব্রতীই। ধর্মীয় ব্রত পালনের মতোই এই ব্রতও ব্রতীর কাছ থেকে প্রধানত কষ্টসহিষ্ণুতাই দাবি করে। এই কষ্টের মধ্যে প্রাপ্তি এক ধরণের আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ওইটুকু প্রাপ্তিই যে সব, এই কথাটা ব্রতীকে অহরহই মনে রাখতে হয়। জবাবে আমি বলেছিলুম, আমি মনে রাখব গুরুদেব। সেই থেকে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ, অতুলবাবু স্যর আর কালীমোহন স্যর যা শিখিয়েছেন, শিখেছি; যা বলেছেন, করেছি; এখান থেকে চলে যাবার কথা কখনও ভাবিইনি। শান্তিনিকেতনকে যদি একটা পরিবার মনে কর কাজিদা, তাহলে নিজের অজান্তেই সেই পরিবারের একজন সভ্য – যত নগণ্যই হই – যে আমিও এর মধ্যে হয়ে গেছি সে-বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। আমার কি তাহলে নির্বাসন হচ্ছে?
ক্যানিং থেকে বিদ্যাধরী নদীর পাড়ে গোসাবায় যেতে দু'জায়গায় নৌকো বদলাতে হল। লোককে জিজ্ঞেস করে যেতে অসুবিধে হল না, বুঝতে পারলুম ও-অঞ্চলের লোকদের মধ্যে গোসাবা অপরিচিত জায়গা একেবারেই নয়। আমার পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল শেষ হয়ে প্রায় সন্ধ্যের গোধূলি। পৌঁছিয়ে বোঝা গেল, বোলপুর-শান্তিনিকেতন থেকে কোন একজনের যে-কোনদিনই এখানে আসবার কথা জানতেন সাহেব, কিন্তু ঠিক কবে কেউ আসবে তাঁর জানা ছিল না। সাহেব তাঁর বাংলোতেই ছিলেন, প্রথমেই আমার খাবারদাবারের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। আমার খাওয়া শেষ হতে হতে যে-ঘরে গুরুদেব কাটিয়েছিলেন দু-রাত্তির, পরিষ্কার করে সেই ঘরেই আমার রাত কাটাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন সাহেব। বললেন, এ-যাত্রায় যে-ক'দিন তুমি থাকবে, এই ঘরেই তোমার ব্যবস্থা। তোমার যদি গোসাবা ভালো লেগে যায়, আর এখানেই স্থায়ীভাবে থাকার কথা ভাব, তখন কী ব্যবস্থা হবে সেই সময়েই ভেবে দেখব। আজ আর বাইরে বেরিও না, কাল সকাল থেকে শুরু হোক তোমার পর্যটন।
সাহেব চলে গেলে আমি সন্তর্পণে একটা-দুটো চাদর কবির ব্যবহৃত শয্যা থেকে তুলে নিয়ে মেঝেতে পাতলুম। গুরুদেব নিজে যেখানে শুয়েছিলেন সেই শয্যায় শুতে সাহস হল না। ক্লান্তি ছিল, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
পরের দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর যখন বাংলোর বাইরের জমিতে খানিকটা হাঁটাচলা করছি, একজন এসে আমাকে বলল, সাহেব ডাকছেন। দেখলুম, সাহেব বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকেই লক্ষ্য করছেন, চোখাচোখি হতে বললেন, গূড মর্ণিং, টী?
বাংলোর বারান্দাতেই চায়ের বন্দোবস্ত ছিল, খেতে খেতে আমাকে সাহেব বললেন, এত জায়গা থাকতে আমি গোসাবাকেই আমার কাজের জায়গা হিসেবে কেন বেছে নিলুম, তোমার জানতে কৌতূহল হচ্ছে? কৌতূহল তো ছিলই, সে-কথা জানাবার পর সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি করে তৈরি হয়ে জলখাবার খেয়ে নাও। আজ থেকে তিন দিন আমি চব্বিশ ঘন্টা তোমার সঙ্গে থাকব। তোমাকে নিয়ে ঘুরব, তোমার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেব। তিন দিনের মধ্যে এখানকার অনেকের সঙ্গেই তোমার পরিচয় হয়ে যাবে। আমি আশা করব তুমি সবায়ের সঙ্গে মেলামেশা করবে। এই মেলামেশা থেকেই তোমার গোসাবা প্রজেক্টের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ধারণা তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত।
সেই যে ধারণা তৈরি হল, তাই নিয়েই আমার এই গল্প।
ভীমদা আমাদের ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জী নামের এক জাহাজ-কম্পানীর কথা বলেছিল, মনে আছে? বলেছিল, স্যর ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন কলকাতার এই কম্পানীর কর্তা ছিলেন। এই যে ম্যাকিনন, যে-নামটা মনে হচ্ছে সাহেবের নামের মধ্য-অংশ, এটা আসলে সাহেবের মায়ের বংশের নাম। অর্থাৎ জাহাজী এই ব্যবসাটা সাহেবের খানিকটা উত্তরাধিকারও। আঠেরোশো আশি সালে সাহেব প্রথম ভারতে আসেন। প্রথমে বোম্বাই, কিছুদিন পরেই কম্পানীর প্রধান কার্যালয় কলকাতায়। কলকাতায় তখন স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল হাওয়া। সেই আন্দোলনের প্রভাব সাহেবের উপর কতটা পড়েছিল সাহেব আমাকে বলেননি, কিন্তু সাধারণ পল্লীবাসী ভারতীয়র দারিদ্র সেই সময় থেকেই তাঁর কাছে বড়ই পীড়াদায়ক মনে হয়। সাহেব আমাকে বলেছেন ষোল শতকে স্কটল্যাণ্ডে একবার খুব বড় দুর্ভিক্ষ হয়। সেখান থেকে কোনমতে সামলিয়ে ওঠার পর আঠের শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আবার একবার ভয়ঙ্কর অর্থসঙ্কটে পড়ে স্কটল্যাণ্ড। এমনিতে, সাহেবের মতে, স্কটল্যাণ্ডের মানুষ সাধারণভাবে সৎ, মিথ্যে কথা প্রায় বলেই না তারা। এমনও নয় যে তারা অলস। কিন্তু সারাদিন ধরে প্রবল পরিশ্রম করেও যথেষ্ট অর্থাগম না হয় যদি, তাহলে সেই পরিশ্রম তো প্রায় নিষ্ফলাই। এক-একজনের পরিশ্রমের ফলে উপার্জিত ধন যদি অন্যের পরিশ্রমের উপার্জনের ফসল সঠিক মূল্যে না-ই কিনতে পারে, তাহলে সার্বিক অর্থোন্নতি হবে কীভাবে? সেই সময় স্কটিশ সমাজের যাঁরা নেতা তাঁদের মাথায় এক অভিনব বুদ্ধি আসে; কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক কিছুদিন অন্তর ছেঁড়া-পুরোনো-প্রায়-নষ্ট-হয়ে-যাওয়া যেসব নোট পুড়িয়ে দেয় বা ধ্বংস করে ফেলে, সেগুলোকে বাঁচিয়ে তার থেকে বেছে বেছে কিছু কিছু এক-পাউণ্ডের নোট দিয়ে শ্রমিকের উপার্জিত ধনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যায় না? ফেলে-দেওয়া নোট বাঁচিয়েই হোক বা ব্যাঙ্কের আলাদা-করে ছাপানো বাড়তি নোটই হোক, বাজারে সেগুলো আসায় প্রত্যাশিত ফলও পাওয়া গেল। কেনাবেচা বাড়ল, চাহিদা থাকায় এবং চাহিদা অনুযায়ী ক্রয়ের সঙ্গতি বেড়ে যাওয়ায় তার প্রভাব পাওয়া গেল হাতেনাতে। সাহেব আমাকে বলেছেন, পাউণ্ড যে-কাজ করেছিল স্কটল্যাণ্ডে, এক টাকার নোটই সেই কাজ করতে পারবে ভারতে। প্রয়োজন শুধু কাজ করতে ইচ্ছুক সৎ শ্রমিকের, মানুষের সঙ্গে মানুষের একটা সুঠাম সামাজিক সম্পর্ক, এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা।
ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জী কম্পানীর পেনিনস্যুলার অ্যাণ্ড ওরিয়েন্টাল স্টীম নেভিগেশন লাইনের জাহাজে সব শ্রেণীর যাত্রী এবং কর্মচারির জন্যে দু'বেলা অতি আকর্ষক খাদ্য পরিবেশনের রেওয়াজ ছিল। একুশ পদের ভোজ, প্রায় যথেচ্ছ মাছ-মাংস-সব্জী-ফলমূল রোজ। কোথা থেকে এত খাদ্য আসে? সাহেব খোঁজ নিয়ে জানলেন কম্পানীর নিজস্ব কয়েকটা খামার আছে, তার মধ্যে একটা কলকাতার কাছেই; ক্যানিং অঞ্চলে, সুন্দরবনে। সেই থেকে সুন্দরবন সম্বন্ধে সাহেবের কৌতূহল আর আগ্রহ।
আগেই বলেছি, কোঅপারেটিভ আন্দোলন সম্বন্ধে ড্যানিয়েল সাহেবের আগ্রহ অগাধ। কলকাতায় আসার পর থেকেই সাহেব নিজের এই আগ্রহ এবং বিশ্বাস নিয়ে লেখালিখি শুরু করেন। জাহাজী ব্যবসার সাফল্যে তাঁর তো টাকাপয়সার কোন অভাবই নেই, ভারতবাসী ইংরেজদের মধ্যে তিনি অর্থকৌলিন্যে প্রধানদের একজন, তার উপর তখনকার ভাইসরয় লর্ড কার্জনের তিনি সমবয়েসী, বন্ধুস্থানীয় এবং তাঁর কাউন্সিলের একজন সভ্য। কমবেশি দশ হাজার একর জঙ্গল-সমুদ্র-দ্বীপের জমি তিনি লীজ নিলেন সরকারের কাছ থেকে, মূলত গোসাবা ব-দ্বীপ এবং সুন্দরবন জঙ্গলের একশো তেতাল্লিশ আর একশো উনপঞ্চাশ নম্বর দ্বীপগুচ্ছ। জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদী এবং বাসযোগ্য জমি তৈরি করা তাঁর প্রতিশ্রুতি, সরকারের প্রতিশ্রুতি সে ক্ষেত্রে দশ বছরের জন্যে জমির নিষ্করতা। এই দশ হাজার একর ক্রমে প্রায় দেড়লক্ষ একরে পৌঁছবে। জনহীন এই জঙ্গলের জমিতে সাহেব তৈরি করবেন বসতি, যা হবে জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। সাহেব আমাকে বলেইছিলেন তখন তাঁর প্রয়োজন ছিল শুধু কাজ করতে ইচ্ছুক সৎ শ্রমিকের, আর মানুষের সঙ্গে মানুষের একটা সুঠাম সামাজিক সম্পর্ক এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা। যারা থাকতে আসবে এখানে, পারিবারিক জাত-ধর্ম-বর্ণ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েই আসতে হবে তাদের, পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতেই শুরু হবে তাদের নতুন জীবন। প্রথম থেকেই সাহেব এখানে সুদখোর মহাজন, দালাল জাতীয় মানুষ আর পরোপজীবীদের প্রবেশ সাধ্যমতো প্রতিহত করেছেন। এখানে বলে রাখি কাজিদা, ড্যানিয়েল সাহেব নিজে ধর্মভীরু চার্চগামী ক্রিশ্চান হয়েও ক্রিশ্চানদের জন্যেও কোন বিশেষ সুবিধের কথা ভাবেননি, গোসাবায় কোন ধর্ম-প্রচারকের খ্রীষ্টিয় বা অন্য কোন ধর্মের প্রচার বরদাস্ত করেননি। গোসাবাতে সাহেব তৈরি করতে চেয়েছেন এমন এক মনুষ্যগোষ্ঠী যাদের ধর্ম পরিশ্রম করা এবং পরিশ্রমের ফসল উপভোগ করা; বিশ্বাস শুধু পরস্পরকে; আর বল শুধুমাত্র মিলিত শক্তিতে – কোঅপারেশন যার নাম।
জমি তো পাওয়া গেল, এখন জঙ্গল পরিষ্কার করে বাস-আবাদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রথমেই চাই একদল সাহেবের-ভেবে-রাখা মনের মতো মানুষ। ভূমিহীন পরিশ্রমী মানুষের সন্ধান করতে লাগলেন সাহেব নানা জায়গায়, সুন্দরবন-সংলগ্ন মেদনীপুর-খুলনা থেকে শুরু করে বাংলার বাইরে বিহার-যুক্তপ্রদেশ এমনকি মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত। তোমার মনে পড়ে কাজিদা, ভীমদার বাবা পাণ্ডু লস্করের কথা? সাহেবের ডাকে মেদনীপুরের বাসস্থান ছেড়ে স্ত্রী আর পাঁচ পুত্রকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করেছিল যে গোসাবায়? তারই মতো আরও মানুষ এল; কেউ একা, কেউ সপরিবার, কাজ শুরু করবার জন্য যত মানুষের প্রয়োজন ধীরে ধীরে এই জনবহুল দেশে তাদের অভাব হল না। কিন্তু এসে তারা থাকবে কোথায়, খাবে কী? সাহেবের প্ল্যানমাফিক কুমির-ব্যাঘ্রসঙ্কুল সুন্দরবনের বড় বড় গাছের ওপর বাঁশের সঙ্গে দড়ি বেঁধে শক্তপোক্ত কাঠের তক্তায় শোয়ার ব্যবস্থা করা হল। এখানকার রয়্যাল বেঙ্গল আবার গাছে চড়তেও পটু, কাজেই গাছের নীচে আগুন জ্বালিয়ে রাতে শোওয়া। খাবার-দাবারের মালমশলা বাইরের থেকে এনে রান্না করে খাওয়া চলতে পারে, কিন্তু খাবার জল? চারিদিকে জল থৈ থৈ, কিন্তু খাবার জল কৈ? সমুদ্রের লোনা জলকে পরিষ্কার করার এক মেশিন কেনা হল প্রথমেই, তা-ছাড়াও মসজিদবাটী নামে খানিকটা দূরের এক বসতির মিষ্টি জলের পুকুর থেকে খাবার জল আনবার বন্দোবস্ত হল। যার পুকুর, তার পুরস্কার পঞ্চাশ বিঘে জমি। এ তো গেল তখনকার মতো কাজ চালাবার ব্যবস্থা। কিন্তু জলের সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান না-হলে বসতি তো গড়ে তোলা যাবে না। গভীর জলের পুকুর কাটানো শুরু হল, সেই পুকুর ঘিরে বড় বড় গাছ। জঙ্গল পরিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল মাটি দিয়ে ড্যাম তৈরির কাজও। পাঁচ বছর একটানা পরিশ্রমের পর গোসাবা আর বাঁশঘেরিয়ায় বেশ খানিকটা উঁচু-জমি তৈরি হল, ড্যামের যতটুকু হলে আপাতত কাজ চলতে পারে, তা-ও শেষ। এই ক-বছরের বৃষ্টিতে জমির উপরিভাগের নুন গেছে ধুয়ে, ফলত জমি এখন আবাদযোগ্য।
স্বপ্ন-দেখা মানুষ তার নিজের পরিকল্পনায় কাজ করে। প্রকৃতি চলে নিজের খেয়ালে। শহরের মানুষের পক্ষে সুন্দরবনের খেয়াল বোঝা মুশকিল। উনিশশো সাত সালে সাহেব যখন বেশ খানিকটা আবাদযোগ্য জমি আর মিষ্টি জলের ব্যবস্থায় খুশি হয়ে আসল কাজে নামবেন, ঠিক সেই সময়েই এল প্রবল ঝড়-বৃষ্টি আর বন্যা। ততদিনে এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ন'শো, তার মধ্যে ছ'শোজনই শ্রমিকের কাজ করেছে এখানে। এ-ছাড়াও আছে কিছু লোক যাদের বলা চলতে পারে সুপারভাইজরি ওয়র্কার, অর্থাৎ এই শ্রমিকদের উপরওয়ালা। আর আছে সাহেবের জমিদারির নানা কাজের কর্মচারি। বাকি মানুষ যারা তারা কিন্তু কোন নির্দিষ্ট কাজ নিয়ে আসেনি, সাহেবের ডাকে তারা বাস করতে এসেছে এখানে। তাদের একমাত্র মূলধন তাদের পরিশ্রম অর্থাৎ তারা নিজেরাই। সুযোগ পেলেই তারা শ্রম দেবে, ফসল ফলাবে। ঝড়-বৃষ্টি-বন্যায় এদিকে ক্ষতি হয়েছে অনেক; জমির ওপর নুনের স্তর আবার, ড্যামে ভাঙন। আশাহত হলেও দমলেন না সাহেব। লণ্ডন মিশনারি সোসাইটির থেকে প্রফেসর লোকেইন নামের নামে একজনকে নিয়ে আসা হয়েছিল বাধা-বিপত্তির মধ্যেও লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যাবার জন্যে। পারলেন না ভদ্রলোক, বিদায় নিলেন কয়েকদিনের মধ্যে। এবার স্থানীয় মানুষের বিদ্যেবুদ্ধি প্রতিভা সাহস আর জেদের ওপর ভরসা করতে চাইলেন সাহেব, এলেন নলিনী চন্দ্র মিত্র নামে আর একজন। ড্যাম মেরামতের কাজ শুরু হল আবার, ভালোই হল মেরামত, মানুষের জেদে নুনও গললো।
নিজের পরিকল্পনাকে সফল করতে এবার সাহেবের চাই আরও মানুষ, গোসাবায় নতুন করে জীবন শুরু করবে যারা, যাদের নিয়ে ভরে উঠবে সাহেবের এই জমিদারির সংসার, সেই মানুষ। সুন্দরবন অঞ্চলে যেখানে যেখানে মনুষ্যবসতি তখনই ছিল, সেই সব অঞ্চলে বড় বড় জমিদার-মহাজনদের রাজত্ব। এই গরীব ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের কপালে যা হয়ে এসেছে বরাবর, এই সব রাজত্বের মানুষদেরও সেই অবস্থাই – প্রায় সবাই বিপুল ভাবে ঋণবদ্ধ; সারা বছর ধরে ঋণ শোধ করেও বছরের শেষে অনেকেই শোনে আসল ঋণ তো শোধ হয়নি এক পয়সাও, এমনকি যে টাকা তারা ঋণ শোধ করছে মনে করে ফেরৎ দিয়েছে, তাতে তাদের আসল ঋণের সুদটুকুও শোধ হয়নি সব; ফলে সম্পূর্ণ ঋণশোধের আদৌ কোন সম্ভাবনা না-থাকায় জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগকেই। আর একটা সুযোগ পেলে নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে চায় তাদের মধ্যে অনেকেই। ড্যানিয়েল সাহেব তখন এমন এক কাণ্ড ঘটালেন যাকে এক কথায় বলা চলে যুগান্তকারী। প্রায় রূপকথা। এক দিন, মাত্র এক দিনের একটি বিকেলে, এই মহাজনদের সঙ্গে বসে ঋণবদ্ধ মানুষদের যাবতীয় ঋণ পরিশোধ করলেন তিনি। তিনি, মানে তাঁর জমিদারির অর্থভাণ্ডার। অতএব, দলে দলে মুক্ত মানুষ, নতুন সূর্যোদয় ঘটাবে যে মানুষ, যাদের মূলধন বা পুঁজি তারা নিজেরাই, তারা গোসাবায় বাস করতে এল। তাদের ঋণশোধের জন্যে সাহেবের জমিদারি যা খরচ করেছে, সেই টাকা দীর্ঘমেয়াদী ঋণ হিসেবে ধরা হবে। মানুষের উপর অগাধ বিশ্বাস আর নিজের আদর্শের উপর ভরসা করে ড্যানিয়েল সাহেব যে-খেলায় নামলেন তাকে তিনি জুয়োখেলা বলে মানতে কোনমতেই রাজি ন'ন। তিনি নিশ্চিত, এই মানুষদের নিয়ে যে কোঅপারেটিভ সংগঠন তিনি তৈরি করবেন তা মানুষের মধ্যে, যাকে তিনি বলেন সত্যিকারের কোঅপারেটিভ স্পিরিট, তা-ই তৈরি করবে।
প্রথম দফায় আসা এই যে মানুষজন, এদের জন্যে প্রথমেই ব্যবস্থা হল ডাক্তারের। হাতুড়ে নয়, রীতিমতো শিক্ষাপ্রাপ্ত একজন ডাক্তার আর তাঁর সহকারী একজন কম্পাউণ্ডার। জমিদারি তহবিল থেকে এঁদের বেতনের ব্যবস্থা। আর তা-ছাড়াও, সাড়ে দশ বিঘে জমির ফলনের উপর ডাক্তারবাবুর অধিকার। দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি হল। এ ছাড়াও ডাক্তার বাড়ি বাড়ি যাবেন, প্রত্যেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন, যাদের যা অসুখ আছে অসুখ-অনুযায়ী তাদের চিকিৎসা এবং ওষুধ – সবই বিনামূল্যে দেওয়া হবে দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে। স্বাস্থ্যর পরেই শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার একটিমাত্র স্কুল দিয়ে শুরু, ক্রমে সেই স্কুল হবে উচ্চ প্রাথমিক, তখনকার দিনে যাকে বলা হত মিড্ল্ ইংলিশ স্কুল বা মধ্য-ইংরিজি বিদ্যালয়।
তোমার মনে আছে কাজিদা, ভীমদা বলেছিল বাঘা যতীনের ইয়াং বেঙ্গল জমিনদারি আরবান কোঅপারেটিভের শেষ-দুপুরের ঘন্টা দুয়েকের স্কুলের কথা, যেখানে ভীমদা নিজে ভর্তি হয়েছিল? এই স্কুল কিন্তু সাহেবের তৈরি স্কুল নয়, ভীমদার বাবা যে পাণ্ডু লস্করকে সাহেব আরবান কোঅপারেটিভের মানুষজনের উপর নজরদারির দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তার মুখে এই স্কুলের খবর পেয়ে সাহেব নিজে বাঘা যতীনের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন। তাঁর জমিদারি আর ইয়াং বেঙ্গলের জমিদারি তো ঠিক এক নয়। ইয়াং বেঙ্গলও, সত্যি কথা বলতে, তাঁর প্রজাই এক ধরণের। সাহেব যেমন সরকারের কাছ থেকে দশ হাজার একর জমি লীজ নিয়ে জমিদারি পত্তন করেছেন, ঠিক সেরকমই সাহেবের কাছ থেকে জঙ্গল পরিষ্কার করা আবাদী এবং বাসযোগ্য খানিকটা জমি লীজ নিয়ে জমিদারি পত্তন করেছিল যতীন দাদার আরবান কোঅপারেটিভ। সাহেব প্রাথমিক স্কুল তৈরি করল তার নিজের জমিদারিতে, বড়দের জন্যে নাইট স্কুল ছিল না তার। পাণ্ডু লস্করের মুখে ইয়ং বেঙ্গল জমিদারির শেষ-দুপুরের নাইট স্কুল এবং সেই স্কুলের ছাত্রসংখ্যার কথা শুনে নিজের চোখে স্কুল দেখে গেল সাহেব, আর পাণ্ডুকেও অনুমতি দিল তার ছেলেদের ওই স্কুলে ভর্তি করতে। সাহেবের নিজস্ব গোসাবাতেই আরও একটা কোঅপারেটিভ সংগঠন চাষবাস-পড়াশোনার কাজ ঠিকমতো চালাচ্ছে দেখে সাহেব মহাখুশি। সে তো কোঅপারেটিভ আন্দোলনই এ-দেশের মুক্তির রাস্তা বলে বিশ্বাস করে। এখানকার শিক্ষিত ছেলেরা যদি এই আন্দোলন গড়ে তুলতে চায় তাদের সাহায্য করতে সে সব সময়েই প্রস্তুত। সত্যি সত্যিই কিছুদিন পর সাহেব কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রদের জন্যে এক বার্ষিক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে। কোঅপারেটিভ আন্দোলনের বিষয়ে ছাত্রদের প্রবন্ধ লিখতে হবে। সেরা প্রবন্ধের লেখককে প্রতি বছর পুরস্কার দেওয়া হবে। সাহেব একটা উত্তেজনার, কো অপারেটিভ আন্দোলনের মতো নতুন একটা বিষয়ে আলোচনার, একটা পরিবেশ তৈরি করতে চাইছিল। সেই পরিবেশ থেকেই হয়তো আন্দোলনের নতুন নতুন মুখ জন্ম নেবে।
প্রথম দফায় সুন্দরবন অঞ্চলের নানা জায়গা থেকে গোসাবায় সাহেবের জমিতে যারা বাস করতে আসে, ঋণের হাত থেকে তাদের মুক্তির খবর সুন্দরবনে যেখানে যেখানে বসতি আছে সে-সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে আরও ভূমিহীন মানুষরা আসতে থাকে গোসাবায়। সাহেবের স্পষ্ট কথা, মানুষে মানুষে বিভেদ ঘটাতে পারে যে-সব অভ্যাস এবং যে-পদ্ধতির জীবনযাপন – নিজে পরিশ্রম না করে গরীব মানুষকে ঋণ দিয়ে তার থেকে সুদ আদায় করা এবং নানা রকমের ধর্মপালন ও আলোচনা – এই দুটি পুরোনো জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ত্যাগ করেই গোসাবার নতুন সমাজে আসতে হবে। জমিদারিতে ততদিনে বেশ কয়েকটা কাছারিবাড়ি তৈরি হয়েছে, এ-ছাড়া কেন্দ্রীয় কাছারিবাড়ি তো আছেই; সেখান থেকে প্রত্যেক নবাগতকে, যে-কাজ যে করতে চায় তা শুরু করার জন্যে, প্রাথমিক প্রয়োজনীয় অর্থ দীর্ঘমেয়াদী নিঃশুল্ক – সুদহীন – ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। পরিশ্রম ছাড়া, জমিতে কাজ অথবা অন্য কোন রকমের উৎপাদনের কাজ করা ছাড়া, গোসাবার নতুন নাগরিক হওয়া চলবে না। এই নিঃশুল্ক ঋণদানের ফলে প্রথম থেকেই, যারা সুদ খাটিয়ে অথবা ধর্মের আড়ালে অন্যের শ্রম ভাঙিয়ে জীবনযাপন করতে চাইবে, তাদের একটা বার্তা তো নিশ্চয়ই দেওয়া গেল!
কাজিদা, এই পর্যন্ত পড়ে তোমার হয়তো একটু একটু অস্বস্তি হচ্ছে। তোমার নানা রকমের পরিচয় নানা জনের কাছে; ধর্মান্ধরা, বিশেষ করে হিন্দু আর মুসলমানদের গোঁড়া অংশ বরাবরই হেনস্থা করেছে তোমায়, যদিও আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না কতটা তুমি ধর্মবিশ্বাসী আর কতটা বিশ্বাসী সর্বধর্মসমন্বয়ের ধারণায়। এ-নিয়ে আমরা মুখোমুখি আলোচনা করতেই পারি। একটা কথাই শুধু বলি তোমাকে। ড্যানিয়েল সাহেব নিজে কিন্তু গভীরভাবে খ্রীষ্টিয় ধর্মে বিশ্বাসী, তবে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস। প্রকাশ্যে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে তাঁকে কেউ কখনও দেখেনি। আর এটাও মনে রাখতে হবে যে, গোসাবায় নিজের জমিদারিতে সাহেব কোনদিনও এমনকি একটাও গীর্জা তৈরির কথাও কখনও ভাবেননি। ধর্মবিশ্বাস, সাহেব মনে করেন, একেবারেই মানুষের ব্যক্তিগত। কেউ যদি এককভাবে, কারোকে ডেকে না-এনে কোন ধর্মীয় নিয়ম বাড়িতে বসে পালন করতে চায়, সেটা তার ব্যক্তিগত অধিকার। সেই অধিকার পালনের সঙ্গে “শঙ্করাকে ডাকা” গোসাবায় নিয়মবিরুদ্ধ!
আর এই যে সমস্ত নবাগতকে ছোট ছোট ঋণ প্রত্যেকের নিজস্ব জন্মগত ক্ষমতার সম্পূরক বা অনুপূরক হিসেবে দেওয়া হল, যার ফলে এই নবাগতদের জীবনযাত্রার মান এত কম সময়ে যথেষ্ট উন্নীত হয়ে এত সহজে এত মানুষের চরিত্রের একটা উজ্জ্বল দিক এমনভাবে প্রকট করল, যে সাহেব এই সুযোগে তাঁর কোঅপারেটিভ আন্দোলনকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দিতে পারলেন। বলা হয়েছিল, জমিদারির তহবিল থেকে যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেওয়া হয়েছে, সেই ঋণের অবশিষ্টাংশ তহবিলকেই ফিরিয়ে দিতে হবে। উনিশশো পনের নাগাদ সাহেব বললেন, আমরা এবার একটা কোঅপারেটিভ ঋণদান বা ঋণশোধ সমিতি তৈরি করব। আগে দেওয়া ঋণের বাকি অংশ শোধ করতে হবে – জমিদারি তহবিলে নয় – নতুন এই কোঅপারেটিভ ঋণদান সমিতিকে। সমিতির যারা সভ্য হবে, বছরের শেষে সমিতির যে লাভ/লোকসান হবে, তার অংশ পাবে তারা। যেহেতু ঋণদান সমিতি – লোককে প্রয়োজনে অর্থসাহায্য করাই যে-সমিতির কাজ – অতএব সমিতিটা যাতে ঠিকঠাক চলে, চালাবার জন্যে কারো কাছে যাতে হাত না পাততে হয়, লোকসান যাতে না হয়, তাই ঋণের ওপর খানিকটা সুদও নেওয়া হবে। কোঅপারেটিভ সমিতির সদস্যরাই যেহেতু এর মালিক, অতএব বার্ষিক সুদের থেকে যেটুকু লাভ হবে, সমিতি পরিচালনার খরচ বাদ দিয়ে উদ্বৃত্ব সেই লভ্যাংশ সকলের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ সুদ নেওয়া হচ্ছে যার কাছ থেকে, সে যদি নিজেও কোঅপারেটিভের সদস্য হয় তাহলে নিজের দেওয়া সুদের লভ্যাংশ পাবে সে নিজেও! এমন আশ্চর্য খবর কেউ শুনেছে কখনও?
যাই হোক, তবুও, একেবারে প্রথমেই সমিতির সদস্য হতে উৎসাহী হল না বেশি মানুষ। মাত্র পনের জন সভ্যকে নিয়ে শুরু হল প্রথম কোঅপারেটিভ ঋণদান সমিতি। মূলধন পাঁচশো টাকা সাহেব নিজেই দিলেন। এর পর ধীরে ধীরে গোসাবা প্রজেক্টের উনিশটা অঞ্চলে (তুমি উনিশটা গ্রামও বলতে পার) এই কোঅপারেটিভ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। আর সমিতি নয়, কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক এক-একটা। শুনতে তোমার অবিশ্বাস্য লাগবে কাজিদা, উনিশশো চব্বিশ সালে এই ব্যাঙ্কগুলো পরিচিত হল গ্রামীণ ব্যাঙ্ক হিসেবে, আর তৈরি হল এদের মিলিত সংগঠন – সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক, যার সদস্যসংখ্যা পনের থেকে বেড়ে তখন ছ'শো আঠাশ, আর পাঁচশো টাকার মূলধন ততদিনে বাড়তে বাড়তে এগার হাজার আটশো তিরিশ টাকা!
এবং এতদিনে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে এখন কাজ করবার মূলধন বা সাময়িক খরচ হিসেবে যে আগাম অর্থের প্রয়োজন, তা নিয়ে সাহেবকে অথবা তাঁর জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজারদের সরাসরি মাথা ঘামাতেই হয় না। গ্রামের মানুষদের মধ্যে নির্বাচন করে প্রতিটি গ্রামে তৈরি হয়েছে একটা করে পঞ্চায়েত, এবং এই পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা করে কার কতো ঋণের প্রয়োজন, কে নিয়মিত ঋণশোধ করে, কার প্রয়োজন জরুরি, কে হয়তো বা অপেক্ষা করতেও পারে কয়েকদিন, এসব স্থির করে। পতিসরে যাবার পরে পরেই গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ এবং অতুলবাবু স্যরের পরিচালনায় পতিসরের হিতৈষী সভা দেখে তোমাকে চিঠি লিখেছিলুম, তোমার মনে আছে? এখানে ড্যানিয়েল সাহেবের সঙ্গে কথা বলার পর, বা নিজে নিজে ঘুরে ঘুরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে, গোসাবায় যখন-যা দেখেছি, প্রতি রাতে একটা নোটবইয়ে তা লিখে রাখতুম। তাতে দেখছি, এই যে ভোটের কথা বললুম, এটা ঠিক কীভাবে পরিচালিত হত তার উল্লেখ নেই, কিন্তু পঞ্চায়েত কথাটা আছে। রবীন্দ্রনাথের আমলে ঠাকুরবাবুদের জমিদারিগুলো কিন্তু নানা পরগণায় ভাগ করা থাকত, এবং প্রতিটি ভাগের মধ্যেও থাকত একাধিক বিভাগ। যে পতিসরে আমি প্রথম গিয়েছিলুম সেটা ছিল কালীগ্রাম পরগণার তিনটে বিভাগের মধ্যে একটা বিভাগ। বাকি দুটো বিভাগের নাম রামতা আর রাতোয়াল। এই প্রত্যেকটা বিভাগের প্রতিটি গ্রামের মানুষরা তাঁদের নিজেদের গ্রামের একজনকে গ্রামপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত করতেন। এই নির্বাচিত গ্রামপ্রধানদের নিয়ে তৈরি হ্ত পাঁচজনের নেতৃত্বে একটা বিভাগীয় হিতৈষী সভা। এই পাঁচজন হচ্ছে পরগণার পঞ্চ প্রধান। আমি তো নিজে পতিসরে থাকবার সময় এই পঞ্চ প্রধানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। নানা বিষয়ে কীভাবে তাদের মতামত নিয়ে কাজ করা হয় তা দেখেওছি। এখানে এসে যখন সাহেবের কোঅপারেটিভের ব্যবস্থাটার কথা শুনলুম, সত্যি কথা বলছি তোমায় কাজিদা, একটা অদ্ভুত আনন্দ তৈরি হল আমার মধ্যে। কেমন জানি মনে হল, এই সাহেব আমার কত দিনের চেনা!
তোমার মনে আছে কাজিদা, বাঘা যতীনের বন্দুক-সংগ্রহের কথা বলতে গিয়ে নূর খাঁ নামের কোন একজন ভ্রাম্যমাণ ব্যাপারীর কথা আমাদের বলেছিল ভীমদা? বাঘা যতীনের প্রখর দৃষ্টি এই ভ্রাম্যমাণ মানুষদের গোসাবায় যাতায়াত লক্ষ্য করেছিল। মানুষের নানা প্রয়োজনে এরকম অনেক মানুষ যাতায়াত করত গোসাবায়। বাইরে থেকে নানা ব্যবহার্য এরা নিয়ে আসত সেখানে, আর সেখানকার উৎপাদন – মাছ শাক-সব্জি ধান – কিনে নিয়ে যেত নানা জায়গায়। এদেরই একজনের, মানে নূর খাঁ-র, সাহায্যে বন্দুক আমদানি করে যতীন দাদা তার নিজের উদ্দিষ্ট কাজ হয়তো করেছিলেন। ড্যানিয়েল সাহেব কিন্তু ব্যাপারটাকে দেখলেন অন্য ভাবে। উনিশশো আঠেরোয় তিনি গোসাবার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করলেন কোঅপারেটিভ কনজ্যুমার্স স্টোর্স। যা গোসাবায় পাওয়া যায় না, কিন্তু গোসাবার মানুষের প্রয়োজন হয়, এ-সব জিনিস পাইকারি দরে বাইরে থেকে কিনে এনে বিক্রি করা শুরু হল এই কোঅপারেটিভ কনজ্যুমার্স স্টোর্স থেকে। এর ফলে, এতদিন যে-দামে এই সব ব্যবহার্য কিনত মানুষ, তা গোসাবাতে বসে বসেই পাওয়া গেল অনেক কম দামে। শুধু তা-ই নয়, সারা বছর যারা এই কনজ্যুমার্স স্টোর্স থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনবে, তাদের জন্যে বছরের শেষে, যে যত মোট অর্থ ব্যয় করে এখান থেকে নানা জিনিস কিনেছে, তার ভিত্তিতে হল একটা আর্থিক বোনাস দেবারও ব্যবস্থা! আর ততদিনে কোঅপারেটিভের সভ্য হবার সুবিধে বুঝে গেছে মানুষ। তাই, বছর-শেষে স্টোর্সের যে মুনাফা, যখন পাওয়া গেল তারও অংশ, সে তো উপরি আর একটা বোনাস!
শুধু জিনিস কেনার কোঅপারেটিভ নয়, জিনিস বেচার কোঅপারেটিভও হল এবার: কোঅপারেটিভ প্যাডি-সেলিং সোসাইটি। আগে যে-সব ব্যাপারীরা ধান নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত বাইরে, আর ক্রেতা আর বিক্রেতা দু'দলের থেকেই বিপুল লাভ করত আলাদা করে, সাহেবের কথায় তাদের বদলে প্যাডি-সেলিং সোসাইটিকে এবার ধান বিক্রি করল গোসাবার প্রায় সব উৎপাদনকারীই। খোঁজ পাওয়া গেল, কলকাতার উল্টোডাঙায় ধানের সবার চাইতে বড় বাজার, আর সেখানে দামও পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। নিজেদের নৌকো কিনে সেই নৌকোতে ধান নিয়ে চলল গোসাবার কোঅপারেটিভ। ধান বেচে যে কত লাভ, এবার বুঝল গোসাবার মানুষ। শুধু তা-ই নয়, এই উল্টোডাঙার বাজারে ধান বিক্রি করার আর-একটা সুফল দেখা গেল প্রায় হাতে-হাতেই। তা হল, গোসাবার ধান এবং নামও, ছড়িয়ে পড়ল ভারতের শুধু নানা জায়গায় নয়, এমনকি বিদেশেও।
এই বিদেশের কথাটা তুলছি বলেই একটুখানি পিছিয়ে গিয়ে আর একটা কথা এখানে বলে রাখি কাজিদা। তোমাকে বলেছিলুম প্রথম দফার গোসাবাবাসীদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্যে সাহেবের একটা অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা। এ-ও বলেছিলুম যতীন দাদার শেষ-দুপুরের নাইট স্কুল দেখে সাহেব কতটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এর মধ্যে গোসাবায় মানুষও বেড়েছে অনেক। প্রতিটি গ্রামে তৈরি হয়েছে অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল। এর পর প্রত্যেক স্কুলের সঙ্গে তৈরি হল বড়দের জন্যে নাইট স্কুলও। এবং নাইট মানে নাইটই। দিনের স্কুলের মাষ্টারমশাইদেরই দায়িত্ব দেওয়া হল এই নতুন নাইট স্কুলও চালাবার। কেরোসিনের আলোর ব্যবস্থা হল জমিদারির তহবিল থেকেই। আর প্রতিটি স্কুলের সঙ্গে আলাদা করে জুড়ল সাড়ে তিন বিঘে জমি, যেখানে স্কুলের পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলবে চাষবাসের আলোচনা এবং শিক্ষা। মাষ্টারমশাইদের মাইনে যে হাতে হাতে বেড়ে গেল তা নয়; তবে প্রত্যেক মাষ্টারমশাই, যতদিন স্কুলে পড়াবেন, পদাধিকার-বলে বা ex-officio দশ বিঘে জমির মালিকানা পেলেন। অর্থাৎ, ছোট একটা প্রাইমারি স্কুল দিয়ে যে-কাজ শুরু হয়েছিল তা এখন আর তেমন ছোটটি নেই, অনেক স্কুলের নানা কার্যক্রম মিলিয়ে সেটা একটা বড়সড় ব্যাপার এতদিনে। তা হলে এই ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চালানো যাবে কীভাবে? পুরো ব্যাপারটা পরিচালনার জন্যে যে-মাথা, যে-পার্সোনালিটি দরকার, গোসাবার জমিদারির ভেতর তা পাওয়া মুশকিল। কলকাতার সেন্ট মার্গারেট স্কুল থেকে তখন শ্রীমতি হোয়াইট নামের এক অভিজ্ঞা মহিলাকে আনালেন সাহেব গোসাবার শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রধান হিসেবে। বহুদিন কলকাতায় থেকে ভালোই বাংলা শিখেছিলেন মেমসাহেব, গোসাবায় কাজ চালাতে তাঁর বিশেষ অসুবিধে হল না।
ঠিক এই সময়েই ড্যানিয়েল সাহেব এমন আর একটা কাজ করলেন যা ভাবলে অবাক হতে হয়। খানিকটা কৃষিযোগ্য জমি আলাদা করে সেন্ট্রাল মডেল ফার্ম নাম দিয়ে তৈরি করলেন ফল আর সব্জীর এক বাগান। তোমাকে তো আগেই বলেছি, সুন্দরবনে এসে কাজ করবার প্রেরণা সাহেব পেয়েছিলেন খানিকটা ক্যানিং অঞ্চলের সেই খামার থেকে, যেখান থেকে তাঁর জাহাজের কম্পানীতে আসত নানা ফল-সব্জী-মাছ-মাংস। এখন সেন্ট্রাল মডেল ফার্মের এই বাগানে ফলানো হবে নানারকমের ফল আর সব্জী, আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে নানা জাতের ধান নিয়ে। একটু আগেই বলেছি তোমায়, নাইট স্কুল তৈরি করার সময়েই প্রতিটা স্কুলে খানিকটা করে জমি রাখা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের কৃষিশিক্ষার জন্যে; আসলে সেন্ট্রাল ফার্মের জন্যে “ছড়ানো-ছেটানো সাধারণ চাষীর পরীক্ষাগার”-ও হবে এই জমিগুলো। ফার্মের কাজ যখন শুরু হয়, তখন সাধারণ ভাবে প্রতি বিঘেতে ধান ফলতো মোটামুটি ছ' মন। কলকাতার চেতলার হাট থেকে নানা জাতের ধানের বীজ এনে পরীক্ষা শুরু হল। শেষ পর্যন্ত এমন একটা বীজ তৈরি হল যা প্রতি বিঘেতে ফলন দেবে বার মণ। শুধু তা-ই নয়, স্কুল-সংলগ্ন জমিগুলোতে বারবার ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করে সাধারণ চাষীদের দিয়ে চাষ করিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে এই ধান খরা এবং নানা রোগ প্রতিরোধ করেও মোটামুটি ওই বার মণের ফলনই দেবে।
মূল যে ধানের বীজ থেকে তৈরি হল এই বীজ – ওই চেতলার হাট থেকে যেটা কেনা – সেটা ছিল একটা ভালো পাটনাই বীজ। এখানকার গবেষণায় উন্নত এই বীজের এখন নাম দেওয়া হল গোসাবা ২৩ পাটনাই। বাংলা সরকারের রাইস রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট সে-বছরের কৃষি-প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার দিল গোসাবা ২৩ পাটনাইকে। দেশ-বিদেশে কদর এবং চাহিদা – দুটোই তৈরি হল গোসাবা ২৩ পাটনাইয়ের। আমাকে সাহেব বলেছেন, এই একটিমাত্র নতুন আবিষ্কারই গোসাবার কৃষকের আর্থিক পরিস্থিতি বদলিয়ে দিল একেবারে। এ-ছাড়াও শাক-সব্জী। সেন্ট্রাল মডেল ফার্মে ফলানো নানা শাক-সব্জীর বীজও দেওয়া হল নাইট স্কুলের ছাত্র-চাষীদের। তাদের “ছড়ানো-ছেটানো সাধারণ চাষীর পরীক্ষাগার”-এ এই সব বীজ থেকে যে পরিমাণ শাক-সব্জী ফললো যে, ছাত্র নয় যারা, তাদেরও শেষ পর্যন্ত দিতে হল এই সব বীজ! প্রয়োজনমতো গোসাবার সব উৎপাদনই নগদ টাকা দিয়ে কেনবার ক্ষমতা যাতে গোসাবাবাসীর হয়, তা-ই তো ছিল সাহেবের লক্ষ্য!
এদিকে শুধু উল্টোডাঙার ধানের বাজারের লাভেই ড্যানিয়েল সাহেব খুশি হয়ে বসে রইলেন না, তাঁর মনে হল আরও কিছু করার আছে। ধান নয়, চাল চাই, চাল। মানুষ ধান খায় না; চাল ফুটিয়ে ভাত খায়, চাল গুঁড়িয়ে পিঠে খায়। সাধারণ মানুষ ধান কিনতে বাজারে আসে না, সে কিনতে আসে চাল। সেই চালের দাম, স্বাভাবিক ভাবেই, ধানের চেয়ে অনেক বেশি। চাল তৈরি করতে হবে। অতএব, যামিনী রাইস মিল তৈরি হল গোসাবায় উনিশশো সাতাশে। আর তার পরেই গোসাবার প্যাডি-সেলিং সোসাইটি কলকাতাতেও জানান দিল তার উপস্থিতি, কলকাতায় সোসাইটি তৈরি করল সেন্ট্রাল রাইস-ক্রপ সেলিং সেন্টার।
গোসাবার নাইট স্কুলের ছাত্র, পেশায় চাষী একজন, আমাকে এই রাইস-ক্রপ সেলিং সেন্টারের কর্মপদ্ধতি বিশদে বুঝিয়ে দিয়েছে। হেমন্তে যখন পাকা ধানে ভরাট গোসাবার ক্ষেত, এবার মাঠে নামতে হবে ধান কাটতে, ঠিক তখনই প্যাডি-সেলিং সোসাইটি করতে বসে কতকগুলো নানা ধাপের অঙ্ক। প্রতিটি গ্রামের কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক আর রাইস বায়িং সেন্টারের কাছে কোন্ চাষির কতটুকু শোধযোগ্য ঋণ আছে তার একটা হিসেব নিয়ে পঞ্চায়েত একটা লিস্ট তৈরি করে। এই লিস্টের একটা করে কপি তখন সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক আর রাইস-ক্রপ সেলিং সেন্টারে পাঠিয়ে দেয় পঞ্চায়েত। একই সময়ে, কোনো কোনো চাষীর যদি জমিদারি এস্টেটে খাজনা দেওয়া বাকি থাকে, এস্টেটও ওই সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক আর রাইস-ক্রপ সেলিং সেন্টারেই তারও একটা লিস্ট পাঠিয়ে দেয়। এবার চাল বিক্রি করার পর যে মুনাফা হয় সেই মুনাফার কতটা কোন্ চাষির প্রাপ্য ক্রপ সেলিং সেন্টার তা হিসেব করে। এবার ঋণের লিস্টের সঙ্গে মিলিয়ে ঋণ শোধ করার পর এক-একজন চাষীর প্রত্যেকের প্রাপ্য হিসেব তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেকের নিজের নিজের প্রাপ্য টাকা তার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টেই থাকে, প্রয়োজন মত সেই টাকা চাষী তুলতে পারে। আমি সেই চাষীকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনারা এই ব্যবস্থায় খুশি? আপনাদের দারিদ্র কি কমেছে? সে চাষী প্রায় দার্শনিকের ভঙ্গীতে বলল, কোন মানুষ কি কোন ব্যবস্থায় পুরোপুরি খুশি হয় দাদা? তবে, যখন যেটুকু প্রয়োজন, এই নতুন ধান আর ধান-ভাঙা কল তৈরির পর থেকে, ব্যাঙ্ক থেকে তো প্রায়ই পেয়ে যাই। কোথাও হাত পাততেও হয়না, রান্নাঘরে হাঁড়ি চড়বে কিনা সে চিন্তাও নেই!
দেখ কাজিদা, গোসাবায় ড্যানিয়েল সাহেবের সাফল্য নিয়ে পাতার পর পাতা আমি এখনও লিখতে পারি, তোমার পড়বার সময় হবে কিনা জানিনা। গোসাবায় প্রথম তিন দিন সারা সময়টাই সাহেবের সঙ্গে কাটিয়েছি। মোট তিন সপ্তাহ থেকেছি ওখানে, তিন দিনের পর বাকি সময়টা ঘুরে বেরিয়েছি স্বাধীনভাবে, যার সঙ্গে দেখা হয়েছে তারই সঙ্গে কথা বলেছি, সে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে কৃষক, মাষ্টারমশাই, জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার বা অন্য কর্মচারি – যে-ই হোক না কেন। যা জেনেছি, যা শুনেছি, প্রতি রাতে ঘুমোবার আগে একটা খাতায় তা লিখে রাখতুম, তোমাকে বলেইছি সে-কথা। সেই খাতাটা পড়তে গিয়ে মনে হল আর একটা ঘটনার কথা অন্তত তোমাকে বলি।
গোসাবায় সাহেবের সঙ্গে আমার রোজই তো একবার-না-একবার দেখা হতই, আর যখনই দেখা হত, আমার কথাবার্তায় সাহেব তাঁর কাজ আর পদ্ধতির বিষয়ে আমার উচ্ছ্বাস বুঝতে পারতেন, আর মাথা নেড়ে বলতেন, এ আর কী দেখছো, এখনও তো ক্যালিডোনিয়ন সলিউশন ঠিকঠাক প্রয়োগ করতেই পারলুম না। এখনও এমন একটা অর্থব্যবস্থাই চালু করতে পারলুম না যেখানে প্রতিটি মানুষের পরিশ্রমের ফলনের কেনা এবং বেচার মতো যথেষ্ট টাকা-পয়সা প্রতিটি মানুষের হাতেই আসে। এ-দেশে টাকা যাদের হাতে, টাকা তৈরিতে তাদের কোন পরিশ্রমের অবদানই নেই। যা চাই তা করতে আমার শুধু দুটো জিনিসের দরকার, বিশ্বাসযোগ্য মানুষ আর তাদের পরিচালনা করবার মতো বিশ্বাসযোগ্য সংগঠন। তোমার যদি ইচ্ছে হয়, এসে কাজ করতে পার এখানে। বেঁচে যদি থাকি, এ আমি করে দেখাবই।
আমি এখানে এসে কাজ করি আর না-ই করি, সাহেবের কথার জবাবে আমি বলি, আপনি যা করতে চাইবেন, তা আপনি যে করবেন এ বিশ্বাস আমার এখন ভরপুর। কিন্তু একটা বিষয়ে আমার কৌতূহল হচ্ছে, আপনাকে সেটা জিজ্ঞেস করতে চাই।
বল, কী কৌতূহল। জানা থাকলে নিশ্চয়ই উত্তর দেব, বলেন সাহেব।
এই যে বিপুল কাজ আপনি এর মধ্যেই করে ফেলেছেন, এত প্রতিষ্ঠান, বলি আমি, আমি অবাক হয়ে দেখছি, সেখানে কোথাও আপনি নিজের নাম রাখেননি। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, গোসাবা সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক, পঞ্চায়েত, গোসাবা কনজ্যুমার্স কোঅপারেটিভ স্টোর্স, সেন্ট্রাল মডেল ফার্ম, রাইস ক্রপ সেলিং সেন্টার – কত আর বলব! সংস্থার নামেই তার কাজের পরিচয়। অথচ আপনার এই ধান ভাঙার কলের ক্ষেত্রে, যদিও এটাও একটা কোঅপারেটিভ সংস্থা, এটার নাম আপনি দিলেন শুধুই যামিনী রাইস মিল, এমনকি আপনার প্রিয় কোঅপারেটিভ শব্দটাও বাদ দিলেন। কেন? জানতে কৌতূহল হয়।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকলেন সাহেব। তারপর আমাকে বারান্দায় বসিয়ে তাঁর বাংলোর ভেতরে ঢুকে গিয়ে হাতে একটা চামড়ায় বাঁধানো বই-গোছের কিছু নিয়ে ফিরে এলেন তিনি। বসলেন। বসে, আমাকে বললেন, তুমি এখানে যখন প্রথম এলে, তোমাকে আমি তিনদিন নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গ দিয়েছি। সেই সময়েই তোমাকে আমি বলেছি, কলকাতায় এসে আর তারপর এই সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, আমার মনে হয়েছিল – তোমাকে আমি কথাটা বলেওছি আগে বারবার – ক্যালিডোনিয়ন সলিউশনই ভারতের, অন্তত বেঙ্গলের, যাবতীয় সমস্যার প্রধান সমাধান। যে করেই হোক, এখানকার সৎ এবং পরিশ্রমী মানুষের কাছে যথাযোগ্য কারেন্সি নোট পৌঁছিয়ে দিতে হবে। তুমি তো জানই, আমি নিজে কোঅপারেটিভ ব্যবস্থার একজন ঘোর সমর্থক। এই কোঅপারেটিভ আন্দোলনের সাফল্যও কিন্তু নির্ভর করে একদল মানুষের সততার ওপর। আদতে তো যে-কোন কারেন্সী নোটই কাগজ একটা, কাগজের বেশি কিছুই নয়, কিন্তু ওর দাম কেন জান? ওই সততা। যে-কোন নোটেরই মূলধন ওই সততাই, কিন্তু অত আলোচনায় আমি যেতে চাইছি না এখন।
তুমি জানতে চেয়েছ, সাহেব বলতে থাকেন, আমাদের রাইস মিলের নাম কেন আমি যামিনী রাইস মিল রাখলাম। তুমি তো জানই, উনিশশো তিন-এ আমি প্রথম সুন্দরবনের নদী-সমুদ্র-জঙ্গল ঘেরা হাজার দশেক একর জমির লীজ পাই। তারপর একটানা পাঁচ বছরের চেষ্টায় সেই জমিকে বাসযোগ্য এবং কৃষিযোগ্য করে তুলি। সে বছরই আবার বিপুল বন্যায় আমাদের কাজের অনেকটাই নষ্ট হয়, বন্যার জল অনেক নুন নিয়ে আসে জমিতে, অনেক দিনের চেষ্টায় তৈরি-করা ড্যামেরও ক্ষতি হয় বিপুল। সেই সময় নলিনী চন্দ্র মিত্র নামে একজন মানুষ প্রবল সাহস আর আদর্শের জোরে এই জমি পুনরুদ্ধার করে কৃষিযোগ্য করে তোলেন; ড্যামের প্রয়োজনীয় সংস্কার যে করেন শুধু তা-ই নয়, তার সম্প্রসারণের কাজও আবার চালু করে দেন। সে-কাজ চলছে এখনও। আর তারপরেই তো মোটামুটি উনিশশো ন' সালে আমরা এখানকার জনসংখ্যা আবার বাড়াতে পারলুম, আজ যা-দেখছ তা তৈরি হল।
সাহেব যথেষ্ট উত্তেজিত, খানিকটা জল খান এবার। তারপর আবার শুরু করেন, এই-যে উনিশশো তিন থেকে উনিশশো নয় – আমি তখনও ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জী থেকে রিটায়ার করিনি – আমি নানা জায়গায়, এমনকি সরকারি নানা দপ্তর আর প্রতিষ্ঠানেও আমার কোঅপারেটিভের ধারণা নিয়ে লেখালিখি শুরু করি, ভবিষ্যতে গোসাবায় কারেন্সী নোটের প্রবর্তনের বিষয়ে আমার ধারণার কথাও বলতে থাকি। তা নিয়ে সরকারী মহলে প্রথমে খানিকটা আলোচনা, মৃদু প্রতিবাদ, পরে হাসাহাসিও শুরু হয়। সেই সময়ে বাংলা প্রদেশের রেজিস্ট্রার অব কোঅপারেটিভ সোসাইটিজ ছিলেন – যাঁর কথা তুমি তুললে বলে এতগুলো কথা উঠল – সেই যামিনী মোহন মিত্র। একমাত্র তিনিই আমার প্রস্তাবটা ঠিক ঠিক বুঝেছিলেন, সততার প্রশ্নটাও বুঝেছিলেন। উনিশশো নয়ের এক রিপোর্টে তিনি যা লিখেছেন তাতে বোঝা যায়, মানুষের সততার প্রতি আমার বিশ্বাসে ভরসা করেই তিনি তাঁর রিপোর্ট লিখছিলেন।
এই কথা বলতে বলতে উত্তেজিত ড্যানিয়েল সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে ওই চামড়া-বাঁধানো বই বা খাতা যা-ই বল, সেটা উল্টোতে থাকেন। তারপর আমার সামনে নিয়ে আসেন বইখানা, মেলে ধরেন সেটা। আমি দেখলুম, ইংরিজিতে ছাপা কয়েকটা লাইন একটা সাদা কাগজের সঙ্গে আঠা দিয়ে জোড়া, সেই ছাপা কাগজের লেখাটুকু আমি নীচে তুলে দিচ্ছি:
“The scheme has limitless possibilities, but to begin with the society will confine its attention strictly to zemindary business. It is a practical and business-like proposition and cannot fail of success granted the two conditions of a very active and energetic Managing Committee, and, above all thoroughly reliable members. Slackness or half-heartedness in either will be fatal.” (Co-operative Societies: Bengal, 1909).
সাহেব বসেন আবার, বলেন, এই যামিনীবাবু একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অফিসার ছিলেন, তাঁর প্রতিটি মন্তব্যের অত্যন্ত গুরুত্ব ছিল। তাঁর এই রিপোর্টের পর দেখা গেল, সরকারি অনেক অফিসারই আমার এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছে। সবাই যে প্রস্তাবের পক্ষেই বলছে এমনটা নয়, বেশির ভাগই তখনো বিরোধী, কিন্তু সরকারি মহলে হাসাহাসিটা তো অন্তত বন্ধ হল। আমি তখন যামিনীবাবুকে কোন কৃতজ্ঞতা জানাতে যাইনি, শুধু আমার সে বছরের ডায়েরিতে যত্ন করে যেটুকু তোমাকে দেখালুম, সেটা সেঁটে রেখেছিলুম। ভবিষ্যতের অতি প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক দলিল!
সাহেব বলতে থাকেন, অনেক পর, একটার পর একটা কাজ যখন সাফল্যের সঙ্গে শেষ করলুম আমরা, আমার মনে হল প্রকাশ্যে যামিনীবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানাবার সময় এসেছে এখন; আমাদের ধান-ভাঙা কল হল, কলের নাম দেওয়া হল যামিনী রাইস মিল। যত যা-ই করি না কেন, আমি নিশ্চিতভাবে জানি, গোসাবার এনটারপ্রাইজ যদি সফল হয় একদিন, তা হবে ধান আর চালের উৎপাদনের জোরে। যামিনী রাইস মিল সেদিন গোসাবার আইকন হিসেবে পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।
সাহেব বসে পড়লেন। তাঁর আবেগের প্রাবল্য একটু কমতে, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলুম, যামিনী মোহন মিত্রর ওই লেখাটুকু – যেটাকে আপনি সঙ্গতভাবেই একটা ঐতিহাসিক দলিল বললেন – আমি কি আমার খাতায় লিখে নিতে পারি? সাহেব অনুমতি দিলে খাতায় যামিনী মোহনের মন্তব্যটা লিখতে লিখতে আমার অদ্ভুত একটা কৌতূহল হল। লেখাটা শেষ করে সাহেবকে আমি জিজ্ঞেস করলুম, আচ্ছা, আপনি আমাকে আর একজনের কথাও বলেছেন, গোসাবার আজকের এই সাফল্যের পেছনে তাঁর অবদানও কম নয়। নলিনী চন্দ্র মিত্র। আচ্ছা, এঁদের মধ্যে কি কোন আত্মীয়তা ছিল?
সাহেব উঠে দাঁড়ালেন আবার। রাগতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, এ প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? বললুম, দুজনের নামে মিল আছে, যামিনী আর নলিনী, তা ছাড়াও দুজনের পদবীও এক; মানে দুজনেই মিত্র, তাই ভাবছিলুম...
আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে সাহেব উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, তাই একটা জাতের মিল খুঁজছিলে? তোমাদের যাবতীয় দুর্দশার যা কারণ, তার থেকে বেরিয়ে আসতে কবে তোমরা শিখবে? সম্রাট অশোকের দেশের মানুষ তোমরা, সেই অশোক যিনি তাঁর যাবতীয় জাত-মান-ধন-ঐশ্বর্য ত্যাগ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুর জীবনযাপন বেছে নিয়েছিলেন। আজও সব সাফল্যের পিছনে তোমরা জাত খুঁজে বেড়াও? জাতের বড়াই?
কাজিদা, জাত নিয়ে যে কোন বড়াই আমার অন্তত থাকতে পারে না, তা তোমার চেয়ে বেশি কে জানে? আমি কিন্তু কিছুই বলতে পারলুম না সাহেবকে; সাহেব ঠিকই বলেছে আমি জানি, আমিও যদি কপালক্রমে মিত্রবংশের সন্তান হতুম তাহলে – কে জানে – হয়তো ঐ বড়াইটাই জেগে উঠত আমার চিন্তায়। সেদিন, সেই মুহূর্তে, শুধু আমার দু'চোখ ফেটে শাশ্বত ভারতের পাপ ধারা হয়ে নামল।
একটু থতমত খেয়ে গেল সাহেব। বলল, সরি, আমি তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি। এ-দেশে এসে অবধি – মানে এই সুন্দরবনের মানুষের মধ্যে বাস করতে শুরু করার আগে পর্যন্ত – যত ভারতীয়র সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, তারা সবাই কোন-না-কোন ছলে তারা যে উচ্চবংশজাত তা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে। তাদের স্বদেশবাসীদের বেশির ভাগই যে অসহায় দিন কাটায় সে ব্যাপারে তাদের মনে হয় কিছুই আসে যায় না।
ড্যানিয়েল সাহেবকে প্রণাম করে আমি বললুম, সাহেব, আমার চোখের জল দেখে মনে কোর না ব্যক্তিগতভাবে আমি দুঃখ পেয়েছি। আমার চোখে কেন জল এল সে হয়তো একদিন তুমি বুঝবে, না বুঝলেও ক্ষতি নেই। আমার তিন সপ্তাহ হয়ে গেল এখানে, কাল ভোরেই আমি বেরিয়ে পড়ব, ফিরে যাব। কী কী শিখলুম এখানে, নিজের মুখোমুখি হয়ে তা বিচার করতে হবে। আবার আমি ফিরে আসব, তখন হয়তো তুমি বুঝবে আমার শিক্ষাটা কতদূর হয়েছিল।
ভালো থেক।
পিংলা
পুঃ - এই চিঠিটা এইমাত্র শেষ করলুম। কাল যতটা সকাল সকাল পারি, বেরিয়ে যাব। ভেবেছিলুম, ফেরার পথে একবার মাইয়ার সঙ্গে দেখা করে যাব। এখন মন বদলিয়েছি। তোমার চিঠিটা তোমার বাড়ির ঠিকানায় পোস্ট করে দেব শেয়ালদা থেকে। হ্যাঁ, তোমার একেবারে হালের ঠিকানাটা আমার কাছে আছে, জোগাড় করে রেখেছি। শান্তিনিকেতনেই ফিরব সোজা। অতুলবাবু স্যরের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি পারি কথা বলতে হবে।