এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  ইদের কড়চা  ইদের কড়চা

  • ছেলেটা হাসছে না

    তারেক নূরুল হাসান
    ইস্পেশাল | ইদের কড়চা | ৩০ এপ্রিল ২০২৩ | ১২৯৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • ইদের কড়চা | বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় | সুতনু হালদার | ষষ্ঠ পাণ্ডব | আনোয়ার সাদাত শিমুল | শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় | উপল মুখোপাধ্যায় | মোঃ আব্দুল উকিল | দীপ্তেন | সোমনাথ রায় | ফরিদা | মোহাম্মদ কাজী মামুন | সুদীপ্ত গাঙ্গুলী | কৌশিক বাজারী | সুকান্ত ঘোষ | এস এস অরুন্ধতী | মণিশংকর বিশ্বাস | তনুজ | অরিত্র চ্যাটার্জি | তারেক নূরুল হাসান | স্বাতী ভট্টাচার্য | সৈয়দ কওসর জামাল | তন্ময় ভট্টাচার্য | দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় | পার্থজিৎ চন্দ | অত্রি ভট্টাচার্য | অর্ণব সাহা | চিরশ্রী দেবনাথ | শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ইমানুল হক | একক | অনিন্দিতা গোস্বামী | নিরমাল্লো | দেবনাথ সুকান্ত | বেবী সাউ | অনুরাধা কুন্ডা | দোলনচাঁপা চক্রবর্তী | সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়



    ডেস্কের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা কী যেন বলছে, তবে রিয়া-র সেটা কানে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। হাতে ধরা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে সে এক মনে, আর সমানে পা নাড়াচ্ছে। জামিল এখনও ফোন করেনি, অথচ দুপুর পার হয়ে গেছে! আজ একটা ভেন্যু দেখতে যাওয়ার কথা দুজনের এক সাথে। ওদের বিয়ের রিসেপশান যেখানে হবে, সেই ভেন্যু।
    ‘চল, চল,’ সামনে থেকে আরেকবার তাড়া দিলো অ্যাঞ্জি। প্রায় প্রতিদিন ওরা এক সাথে লাঞ্চ খেতে যায়, অনেক দিনের অভ্যাস।
    রিয়া মুখ তুলে তাকাল এবার। না, এবারও শোনেনি অ্যাঞ্জি কী বলেছে। তবে বুঝে গেছে, লাঞ্চের কথাই বলছে নিশ্চয়ই।
    ‘আজ মনে হয় যাওয়া হবে না, অ্যাঞ্জি।’
    ‘কেন? কী হল?’
    ‘জামিলের কল করার কথা এতক্ষণে,’ রিয়া বললো, ‘আজ আমাকে আগে আগে বের হতে হবে হয়ত। মানে, ও যদি আসে আর কী।’
    ‘যাচ্ছ কোথাও তোমরা?’ অ্যাঞ্জি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে।
    রিয়া কাঁধ ঝাঁকায় একটু, ‘দেখা যাক’।
    অ্যাঞ্জি চলে যায় একাই। রিয়া লম্বা শ্বাস নেয় দু’বার, হাতের ফোনটা মুঠোর ভেতর শক্ত করে চেপে ধরে । উল্টে নিয়ে ফোনটাকেই এবার দেখে সে। খুব সুন্দর একটা নোকিয়া সেট। ৬৬২০। একেবারেই নতুন মডেল, রঙিন স্ক্রিনের। জামিলেরই দেয়া গিফট এটা, রিয়া কিছুতেই নিতে চায়নি।
    জামিল এখনও পিএইচডি করছে, সেই টাকাতেই চলে সে। সাথে অবশ্য কয়েকটা টিউটোরিয়াল ক্লাস নেয়, সেখান থেকেও কিছু খরচ উঠে আসে। কিন্তু সব মিলিয়ে খুব বেশি কিছু না। দু’জনের মধ্যে রিয়া-ই যাকে বলে ‘প্রপার জব’ করছে। আর দু’জনেই ওরা বিয়ের খরচ সামলাতে টাকা জমাচ্ছে এর মধ্যেই। রিয়ার বাবা-মা যদিও মেলবোর্নেই থাকেন, কিন্তু জামিলের বাবা-মা থাকেন ঢাকায়। বিয়ের সময় ওদেরকে নিয়ে আসতে হবে এখানে। ভিসা খরচ লাগবে, প্লেনের টিকেট, মেডিকেল ইনস্যুরেন্স। এখানকার ভেন্যু আর অনুষ্ঠানের খরচও রয়েছে। এ সবের মধ্যে এই নতুন ফোন রিয়া চায়নি। ওর বেশ অপরাধ বোধও হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ওর জন্মদিনটা কেন যে রিসেপশানের আগে আগে পড়ল! বছরের শেষে হলে জামিলকে এখন এই খরচটা করতে হত না।
    পনের তলা দালানের ভেতরে দুপুরের ব্যস্ত অফিসে বসে রিয়ার হঠাৎ করে জামিলের জন্যে অদ্ভুত মায়া হলো। জানালার পাশেই ওর বসার ডেস্ক। ছোট্ট একটা রোদের টুকরো এসে ডেস্কের উপরে রাখা কী-বোর্ডের উপরে পড়েছে। একটা আঙুল সেখানে বসিয়ে খানিকটা উষ্ণতা নিলো সে। অনামিকায় পরা ছোট্ট স্বর্ণের আঙটিটা রোদের আলোয় মিশে যেতে চাইল যেন। আরেকবার ডায়াল করে ফোন কানের কাছে তুলে নিয়ে বিড়বিড় করল রিয়া, ‘পিক আপ, জামিল। ফোনটা ধরো। প্লিজ, পিক আপ।’

    ~*~



    টিউটোরিয়াল সেশানটা শেষ হতে আরও কিছু সময় বাকি। টেবিলের উপরে রাখা কাগজগুলো গোছাতে গোছাতেই জামিল টের পেল, পকেটের ভেতরে রাখা মোবাইল ফোনটা আবারও ভাইব্রেট করতে শুরু করেছে। রিয়া-ই হবে নিশ্চয়ই, জামিল ভাবল। কিন্তু বের করে দেখার উপায় নেই, ক্লাসটা শেষ হোক আগে। গত সেমেস্টারে কেউ একজন ফিডব্যাক সার্ভেতে লিখেছে, জামিল নাকি এক ক্লাসে ঊনিশবার ফোন চেক করেছে। ওর নাম বোল্ড এবং আন্ডারলাইন করে লেখা ছিল। কোর্স কো-অর্ডিনেটর কঠিন কিছু বলেননি, শুধু ওকে ফরোয়ার্ড করে দিয়েছিলেন সার্ভেটা। জামিল নিজেই খুব বিব্রত বোধ করেছিল আসলে। ওর ক্লাসের ছেলেমেয়েদের তো আসলে জানার কোনও উপায় নেই যে ওই সময়টাতেই সে আর রিয়া তাদের বাবা-মাকে বিয়ের কথা কীভাবে বলবে এই নিয়ে দিন-রাত এক করে ফেলছে!
    এখন অবশ্য আর সেই ঝামেলাটা নেই। বিয়ের কথা বলা, রাজি করানো, অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, সব আপাতত শেষ। তবে ক্লাসে বসে আর কিছুতেই ফোন চেক করা যাবে না, নিজের জন্যে এরকম একটা শক্ত নিয়ম সে তৈরি করে ফেলেছে।
    ক্লাস শেষে একে একে সবাই বের হয়ে গেলে পকেট থেকে ফোন বের করে জামিল। নয়টা মিসড কল! সবগুলোই রিয়ার। জামিল সাথে সাথেই কল করলো রিয়াকে। রিং হচ্ছে, কিন্তু রিয়া ধরল না। একটু হতাশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো সে। ঘড়িতে এখন একটা বেজে দশ। নামাজের সময় হয়ে গেছে প্রায়। মসজিদ অবশ্য ওর ইউনি থেকে বেশি দূরে নয়। গাড়িতে গেলে দুই মিনিটের ড্রাইভ। অবশ্য আজ গাড়ি সাথে নেই ওর। মেকানিকের কাছে দিতে হয়েছে সার্ভিসিং এর জন্যে। সুতরাং হেঁটেই যাবে সে।
    আরেকবার চেষ্টা করল জামিল, ফোনে, রিয়াকে যদি পায়!
    নাহ, এবারও ধরলো না রিয়া। জামিল এবারে কাঁধে ব্যাগ ফেলে হালকা পায়ে দৌড়াতে শুরু করল মসজিদের দিকে। তখুনি ফোনে টোন বেজে উঠল। দৌড়ের মধ্যেই ফোন বের করল জামিল।
    রিয়া টেক্সট পাঠিয়েছে। ‘আমি মিটিং-এ ঢুকে গেছি। তুমি আসছ তো?’
    ও দাঁড়িয়ে গিয়ে চট করে টাইপ করল মেসেজ। ‘অবশ্যই। ৩ টার দিকে চলে আসব। মসজিদে যাই এখন। ট্রেনে উঠে কল দিব আবার।’
    হাঁটতে হাঁটতে মসজিদের কাছে চলে এসেছে সে। প্রতি শুক্রবারে, ঠিক নামাজের আগে আগে, এই ছোট্ট রাস্তাটা খুব ব্যস্ত হয়ে যায়। এমনিতে এই এলাকাটা বেশ নির্জন। মেলবোর্নের মূল শহরের বাইরে ছোট্ট একটা শহরতলী এটা।
    মসজিদের ঠিক বাইরেই বেশ কয়েকজন কমবয়েসী ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ভলান্টিয়ার। নামাজ পড়তে আসা সবাইকে অনুরোধ করছে যেন খুব বেশি আওয়াজ না করে। আশেপাশের বাড়ির মানুষেরা সিটি কাউন্সিলে অভিযোগ করে দিতে পারে তাহলে। এটা ইদানীং বেশ একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে এখন নামাজীদের ভিড় আরও বাড়ছে দিনে দিনে।
    হাঁটতে হাঁটতেই একটা হলুদ রঙের ট্যাক্সিক্যাবকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল জামিল। সেটা পাশের বাড়ির ড্রাইভওয়ের ঠিক সামনে পার্ক করা। ভেতর থেকে কেউ গাড়ি বের করতে পারবে না দরকার হলে, এমনভাবে পথ আটকে আছে সেটা। সেই ছেলেগুলোর একজন এসে ক্যাবি-কে অনুরোধ করছে এখান থেকে গাড়ি সরিয়ে নিতে। বিশালদেশী ক্যাবি পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হলো না জামিলের। এই অনুরোধে খুশিও নয় সে একদমই। গোঁয়ারের মত কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে বলল, ‘দেখ ব্রাদার। আমি অর্ধেক জায়গা রেখে পার্ক করেছি গাড়ি। কেউ চাইলে ওখান দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে।’
    ‘ব্রাদার,’ আকুতি বের হয়ে এল ভলান্টিয়ারের গলা দিয়ে। ‘ওরা আবার কমপ্লেইন করবে আমাদের নামে। মসজিদের নামে। কাউন্সিল পরে মসজিদ বন্ধ করে দিলে? এটাই চাও তুমি?’
    ‘কিন্তু আর কোথাও কোনো পার্কিং খালি নেই! সব ভরে গেছে। দেখ তুমি একবার।’
    ‘ব্রাদার, প্লিজ, পরের স্ট্রিটে গিয়ে দেখ। নিশ্চয়ই কিছু খালি পাবে ওখানে। আমি শিওর।’
    ‘নাই ব্রাদার। আমি ওখানে আগে দেখেই এখানে এসেছি। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে!’
    ‘প্লিজ, ব্রাদার।’ আবারও আকুতি সেই ছেলের গলায়।
    ‘আরে, এত চিন্তা করো না ব্রাদার। এই দশ মিনিটে কিছু হবে না। আমি নামাজ শেষ করেই বের হয়ে যাব!’
    ঝকঝকে অনেকগুলো সাদা দাঁত বের করে হাসি দিলো একটা ক্যাবি, তারপরে গাড়ি রেখে বের হয়ে এল। কিন্তু সেই হাসি ছেলেটাকে গলাতে পারল না, ও হতাশায় কাঁধ ঝাঁকাল। মনে অন্য চিন্তা। প্রতিবেশী যদি সত্যিই কাউন্সিলে অভিযোগ করে দেয়, তাহলে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে মসজিদ কমিটিকে।
    জামিল তাড়াহুড়ো করে মসজিদের ভেতরে ঢুকতে যেতেই দরজার ঠিক পাশেই রাখা একটা বড় ব্যাগের সাথে ধাক্কা খেল আচমকা। তাকিয়ে দেখল, ছিপছিপে দেখতে এক তরুণ সেই কালো ব্যাগ শক্ত করে ধরে বসে আছে। সাদা রঙের একটা ফুল-হাতা শার্ট পরনে তার। মুখ তুলে তাকাল সে জামিলের দিকে, চোখে রাজ্যের বিরক্তি। জামিল কোনও শব্দ না করে ঠোঁট নেড়ে ‘স্যরি’ বলল তাকে, মুখ হাসি হাসি। কিন্তু ছেলেটা তবুও হাসল না। বরং কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
    ছোট্ট মসজিদ ঘরটা এর মধ্যেই পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এই বাড়িটা আসলে ঠিক মসজিদ হিসেবে বানানো হয়নি। একটা সাধারণ বাড়িই ছিল এটা, আকারে বেশ বড়। মসজিদ কমিটি এটা কিনে নিয়ে ভেতরের দেয়ালগুলো সব সরিয়ে ফেলেছে। এখন প্রায় শ’খানেকের মত লোকের জায়গা হয়ে যায় ভেতরে, নামাজের জন্যে।
    আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে জামিল দুইজন মানুষের ফাঁকে চেপেচুপে জায়গা করে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগল কিছুক্ষণ। ডান পাশের জন ওর দিকে তাকিয়ে আন্তরিক হাসি দিলো একটা, একটু সরে বসে জায়গা করে দিলো ওকে।
    ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন সবার সামনে। মাইক নেই, খালি গলায়ই তিনি খুতবা পড়ছেন। তবে তাঁকে আজ বেশ বিচলিত শোনাল। পড়ার চেয়ে কথা বলছেন বেশি। বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই জামিল ‘রাজনীতি, ‘বৈষ্যম্য’, ‘জিহাদ’, ‘টেররিস্ট’, এই কথাগুলো কয়েকবার শুনে ফেলল।
    ‘উনি কীসের কথা বলছেন?’ জামিল ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল ওর ডান পাশের জনকে।
    ‘মাদ্রিদের ট্রেনে বোমা হামলা হয়েছে যে, সেটা,’ লোকটা উত্তর দিলো। ‘অনেকেই বলছে এটা নাকি আসলে দেশের ভেতরের রাজনৈতিক গন্ডগোল।’
    ‘তাই? কিন্তু আমি যে শুনলাম আল-কায়েদা নাকি অলরেডি ক্লেইম করেছে সেটা?’ জামিল অবাক হয়ে বলল।
    ‘হ্যাঁ, তা করেছে।’
    ‘তাহলে?’
    ‘কে জানে!’ শ্রাগ করল লোকটা এবারে। ‘সবাই খালি একে-তাকে দোষ দিয়ে বেড়ায় শুধু। ব্লেম গেম।’
    পকেটের ভেতরে ফোনটা আবার নড়ে উঠল। মসজিদের ভেতরে ফোন ধরা ঠিক হবে না। ও একবার বের হবার দরজার দিকে ফিরে তাকাল। বাইরে যাবে ফোন ধরতে? দরজা পর্যন্ত যেতে বহু মানুষকে বিরক্ত করতে হবে। সেই ব্যাগওয়ালা ছেলেটাকেও। জামিল ফোন ধরবে না বলেই ঠিক করল শেষমেশ। তবে বেশ খারাপ লাগছে ওর। কাল রাতের পর থেকে রিয়া-র সাথে আর কথা বলার সুযোগ হয়নি, বার বার মিস হয়ে যাচ্ছে।
    নামাজ শেষ হতেই আবারও একটা হুড়োহুড়ি শুরু হল মসজিদের ভেতরে। সবাই পারলে এক সাথে বের হতে চায়। ভলান্টিয়াররা ইতিমধ্যেই বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে সবাইকে আবারও অনুরোধ করছে কম শব্দ করার জন্যে। কিন্তু বরাবরের মতই সেটা কোনও কাজে আসছে না, মসজিদের ভেতর থেকেই জামিল টের পেল সেটা।

    ট্রেন স্টেশান এখান থেকে ত্রিশ মিনিটের মত হাঁটা পথ। একটা ক্যাব ডাকবে নাকি? জামিল ভাবল একবার। তখুনি হাতের এনগেজমেন্ট রিঙটা নজরে পড়ল ওর। মাথা নেড়ে চিন্তাটা বের করে দিলো সে। হাতের ঘড়িটা আরেকবার দেখে নিলো। যদি একটু দ্রুত হাঁটতে পারে, মোটামুটি পঁচিশ মিনিটে পৌঁছে যেতে পারবে স্টেশানে। তাহলেই শহরমুখী পরের ট্রেন ধরে ফেলতে পারবে সে। এই লাইনে নিয়মিত যাওয়া-আসা করে জামিল, ট্রেনের টাইমটেবল ওর প্রায় মুখস্ত।
    আর বেশি না ভেবে ও রওনা দিয়ে দিলো স্টেশানের উদ্দেশ্যে।
    ফুটপাত ধরে মিনিট পাঁচেকের মত হাঁটতেই হঠাৎ করেই ওর পাশে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল একটা ইয়েলো ক্যাব। জামিল অনেকটাই চমকে গিয়ে তাকাল সেদিকে।
    জানালার কাঁচ নেমে যেতেই মসজিদের সামনে দেখা সেই ক্যাবি-র হাসিমুখ দেখতে পায় জামিল।
    ‘ব্রাদার, কোথায় যাচ্ছ তুমি? চলে এসো আমার গাড়িতে, নামিয়ে দিচ্ছি আমি তোমাকে।’ উদাত্ত আহবান জানাল ড্রাইভার।
    ‘না, না, ঠিক আছে। আমি বেশিদূর যাচ্ছি না। ফুটসক্রে স্টেশান। হেঁটেই যেতে পারব।’ জামিল রাজি হল না।
    ‘আরে উঠে পড় ব্রাদার। পয়সা দিতে হবে না তোমাকে। আমি ঐ দিকেই যাচ্ছি। উঠে পড়।’
    আরও কিছুক্ষণ কথা চালাচালির পরে জামিল আর না বলতে পারল না। লোকটা যে বেশ নাছোড়বান্দা, সেটা ঐ পার্কিং এর সময়েই বুঝেছিল ও। জামিল উঠে পড়ল ক্যাবে।
    ‘শুধু শুধু ঝামেলা করলে তুমি, আসলেই কোনও দরকার ছিল না। তবু, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।’
    ‘আরে, নো ওয়ারিজ ব্রাদার। আমরা মুসলিম। এক ভাই যদি আরেক ভাইকে না দেখে তো কে দেখবে?’
    ড্যাশবোর্ডে রাখা আইডি কার্ডটা চোখে পড়ল জামিলের। বাকো আবদেলরহমান ওর নাম। তবে ছবিতে অনেক কমবয়েসী লাগছে বাকো-কে। বেশ আগে তোলা বোঝা যায়।
    বাকো কথা বলতে বেশ ভালবাসে। মিনিট খানেকের মধ্যেই যত রকম প্রশ্ন করা সম্ভব সব করে ফেলল সে জামিলকে। জামিল কী কাজ করে, বিয়ে করেছে কিনা, দেশে কে কে আছে, এখানে কোথায় থাকে। জামিল খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল এসব প্রশ্নে। ব্যক্তিগত তথ্য বলে বেড়াতে পছন্দ করে না সে একদম। আর পাল্টা প্রশ্ন করার অভ্যেসও নেই তেমন ওর। স্বাধারণত এই স্বভাবের কারণে কারও সাথেই ওর আলাপ খুব একটা দীর্ঘ হয় না। কিন্তু বাকো-র মুখ মনে হচ্ছে রেলের ইঞ্জিন, থামছেই না!
    বিনা পয়সার উপকারেরও লুকানো একটা মূল্য ধরা থাকে, ভাবল সে।
    স্টেশানে পৌঁছল তারা অবশেষে। ক্যাব থেকে বের হতে হতেই জামিল ওকে ভাড়া দিতে চাইল। কিন্তু বাকো সজোরে মাথা নেড়ে মানা করতে লাগল ভাড়ার কথা শুনে।
    ‘ভাড়া লাগবে না ব্রাদার। তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করো। আর তোমার বিয়ের জন্যে অনেক শুভকামনা,’ বলে গাড়ি টান দিয়ে চলে গেল সে।
    পরের ট্রেনের আরও মিনিট পনের বাকি। মাত্রই দু’টার মত বাজে। ভর দুপুরের ট্রেন স্টেশানকে বেশ নির্জন মনে হল ওর কাছে। অল্প কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বেঞ্চের ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে একটা এমএক্স পত্রিকা তুলে নিলো সে। ষোল পাতার একটা ট্যাবলয়েড এটা। সিটি-র স্টেশানগুলোয় যাত্রীদের হাতে হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়, ফ্রি। মনে হয় সিটি থেকে কেউ বয়ে এনেছে এটা, পড়া শেষ করে বেঞ্চে ফেলে দিয়ে চলে গেছে।
    সবুজ রঙের বেঞ্চটায় বসে ও রিয়াকে একটা টেক্সট পাঠাল, মিটিং শেষ হলেই যেন কল দেয় ওকে।
    এখন আর কিছু করার নেই, শুধু ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা। কিছুটা সুস্থির হয়ে চারপাশে দেখতে থাকল জামিল। প্ল্যাটফর্মের অন্য পাশটায় দু’টা টিনএজার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সাথে, পরনে স্কুলড্রেস। একজনের মাথায় সোনালী রঙের চুল, অন্যজনের কালো। স্কুল ছুটির সময় হয়নি এখনও, নিশ্চয়ই ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছে, ভাবল জামিল। কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে দুই জনে। ওদের পাশের বেঞ্চেই একজন তরুণী বসে আছে। এক হাতে ধরা একটা প্র্যাম, যেভাবে দোলাচ্ছে সেটা, সম্ভবত তাতে কোনো বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। তরুণীর অন্য হাতে একটা বই ধরা, খুব রঙিন প্রচ্ছদ সেটার। মন দিয়ে পড়ছে সে।
    জামিল ওখানে বসেই চোখ ছোট ছোট করে বইয়ের নামটা পড়ার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। তবে ভাল করে দেখতে পেল না। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা শোভনীয় হবে না ভেবে ক্ষান্ত দিলো সে। তবে নামটা জানতে পারল না ভেবে মনের ভেতরে খুতখুত করতে লাগল তার।
    ওদের বেশ কাছেই এক উদ্বাস্তু লোক বসে আছে প্ল্যাটফর্মের ওপরে। এ দেশে হোমলেস বলে ডাকা হয় ওদের। নিজের সাথে এক মনে কথা বলে চলেছে লোকটা। কিছুটা যেন নেশাগ্রস্ত মনে হল তাকে।
    জামিল ভেবেছিল ক্যাবে করে চলে আসায় হয়ত আগের ট্রেনটাই ধরতে পারবে সে। কিন্তু তেমন লাভ হয়নি তাতে, আগে আর কোনো ট্রেন নেই। অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই কোনো।
    হাতের এমএক্স পত্রিকা খুলে বসল জামিল। মাদ্রিদের ট্রেন বোম্বিং এর খবরটাই পুরো পাতা জুড়ে। বড় বড় ফন্টে ছাপা। আর সাথে অনেকগুলো ছবি। উদ্ধারকাজে ব্যস্ত ইমার্জেন্সি সার্ভিসের কর্মীদের ছবি। সাথে অনেকগুলো আহত মানুষের বিষণ্ণ মুখ। বুকপকেট থেকে মাথার টুপিটা বের করে ব্যাগে ভরে রাখল সে। লোকটা একটা সাধারণ ব্যাকপ্যাকে করে বোমা নিয়ে উঠেছিল সেই ট্রেনে। কেউ বুঝতে পারেনি।
    ট্রেন এল অবশেষে। থামার পরে ঠিক সামনের কামরাটাতেই ঢুকে গেল সে। ভেতরে প্রায় সবগুলো সিটই ফাঁকা পড়ে আছে। জামিল খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করল কোন সিটে বসবে। সকালের ট্রেনে উঠে এই বিলাসিতা কল্পনাও করা যায় না!
    প্র্যামসহ সেই তরুণী মা ঢুকল ওর কামরাতেই। জামিলের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে একবার হাসল মেয়েটা। জামিলও হাসি ফিরিয়ে দিলো তাকে।
    এই কামরার দরজা যখন প্রায় লেগে যাচ্ছিল, ঠিক তখুনি সেটা আটকে ধরে সেখান দিয়ে ঢুকল হোমলেস মানুষটা। আগের মতই নিজের সাথে কথা বলে চলেছে সে। কেউ খুব একটা মনোযোগ দিলো না তার দিকে।
    জামিল ফোন বের করে আরেকবার তাকাল স্ক্রিনের দিকে। রিয়া কিছুই জানায়নি এখনও। খুব ব্যস্ত দিন যাচ্ছে ওর, বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু একবার কথা বলতে পারলে ভালো লাগত জামিলের।
    ট্রেন চলা শুরু করেছে। ট্রেনের শব্দ বাড়তে থাকলে সেটার সাথে তাল মিলিয়ে হোমলেস লোকটাও নিজের গলার আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো। জামিল শোনার চেষ্টা করল একবার, কী বলছে সে। খানিক চেষ্টার পরে জড়ানো কথাগুলো বুঝতে পারল জামিল। ট্রেন কেন এত ধীরে চলছে এই নিয়ে অভিযোগ লোকটার।
    তরুণীটি একবার তাকাল লোকটার দিকে। হাতের খোলা বইটা বন্ধ করে পাশে রেখে প্র্যামটাকে টেনে আরেকটু কাছে নিয়ে নিলো সে। লোকটা একটা খালি প্লাস্টিকের বোতল ধরে বন্ধ দরজার গায়ে ছুঁড়ে দিলো শব্দ করে। প্র্যামের ভেতর থেকে একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল তখন। জামিল উঠে দাঁড়াল এবার। পরের কামরায় গিয়ে বসবে সে, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সেদিকের দরজার দিকে হাঁটা দিলো জামিল।
    দি কলোরাডো কিড, বইটার নাম। মেয়েটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সিটের ওপরে রাখা বইটার দিকে তাকিয়ে পড়তে পারল এবার জামিল। স্টিফেন কিং এর লেখা। মেয়েটার সাথে আরেকবার চোখাচোখি হল জামিলের। মেয়েটা হাসল না এবারে।
    পরের কামরায় যেতেই সেই স্কুলের পোশাক পরা মেয়ে দুটিকে দেখতে পেল জামিল। ডান দিকের সিটগুলোর দুটিতে বসেছে ওরা। এখনও হাসছে দু’জনে, আর অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। জামিলকে পাত্তাই দিলো না ওরা। ও কিছু না বলে সামনের দিকে পা বাড়াল।
    কামরার মাঝামাঝি একটা থ্রি-সিটারে মসজিদে দেখা সেই কমবয়েসী ছেলেটাকে বসে থাকতে দেখল জামিল। একা।
    পাশের ফাঁকা সিটটায় সেই কালো রঙের ব্যাগটা রাখা। শক্ত করে সেটা এক হাতে ধরে আছে সে, এখনও।
    জামিল ওর দিকে তাকিয়ে একটা চেনা হাসি দিলো এবার। মসজিদে ওর ব্যাগে ধাক্কা দেয়ার বিরক্তি এতক্ষণে ভুলে গেছে নিশ্চয়ই ছেলেটা, আশা করল ও। কিন্তু ছেলেটা কিছু বলল না এবারেও। বরং চট করে জানালার বাইরে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। জামিল খেয়াল করল, কপালে আর গলার কাছটায় খুব ঘামছে ছেলেটা। মার্চের এই শীতের মধ্যেও।
    আরও দুই সারি সামনে গিয়ে এদিকে মুখ করে বসল জামিল। সিলিং-এ লাগানো স্ক্রিনে পরের স্টেশানের নাম দেখা যাচ্ছে। নর্থ মেলবোর্ন, তার কিছু পরেই স্পেনসার স্ট্রিট। তার মানে আর সাত মিনিটের মত লাগবে ফ্লিনডার্স স্ট্রিট স্টেশানে পৌঁছাতে। জামিল হিসেব করল মনে মনে।
    তখুনি দুই কামরার মাঝের দরজাটা হঠাৎ করে খুলে গেল। আর সেই হোমলেস লোকটা কথা বলতে বলতে ঢুকল এই কামরায়। মুহূর্তের মধ্যেই এখানকার নীরবতা ছিঁড়ে গেল যেন, লোকটা সবার মনোযোগ কেড়ে নিলো।
    ‘আ-এম হাঙরি!’ যেন ঘোষণাই দিলো লোকটা।
    ট্রেন এখন দ্রুত ছুটে যাচ্ছে শহরের দিকে। জানালা দিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে শহরতলীর চেনা পথ ঘাট।
    লোকটা মাঝের আইল ধরে একবার সামনে হেঁটে যাচ্ছে, আরেকবার পেছনে।
    হঠাৎ করে মেয়ে দুটোর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।
    ‘তোমাদের কাছে খাবার আছে কোনও?’ জিজ্ঞেস করলো লোকটা মেয়েগুলিকে।
    ওরা একটু ভয় পেয়েছে বলে মনে হল জামিলের। কালো চুলের মেয়েটা তবু সুন্দর করে হাসল তাকিয়ে। মাথা নেড়ে জানাল, কোনও খাবার নেই ওদের কাছে।
    ‘সত্যি? কিচ্ছু নেই ওগুলোর ভেতর?’ আঙুল উঁচিয়ে ওদের ব্যাগের দিকে নির্দেশ করল লোকটা।
    মেয়েটা এবারে আর কোনও কথা বলল না। শুধু দু’পাশে মাথা নাড়ল কয়েকবার।
    তবে লোকটাকে সন্তুষ্ট মনে হল না এই উত্তরে। সে হাত বাড়িয়ে ব্যাগ ধরে টান দিল মেয়েটার। ‘দেখি, কী আছে এর মধ্যে?’
    এবারে মেয়ে দুটি সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। লোকটা ব্যাগ ধরে আরেকবার টান দিতেই এক লাফে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দু’জন। তারপরে চিৎকার করে সোজা দরজার কাছে দৌড়ে চলে গেল। ভয়ে কাঁপছে দু’জনেই।
    জামিল বুঝতে পারছিল না কী করবে। ওর কি এখন পুলিশে কল করা উচিত? নাকি ট্রেন ড্রাইভারকে কল দিবে ইন্টারকম দিয়ে? নাকি অপেক্ষা করবে আরেকটু?
    প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল এই দেশে ওর। আর কিছুদিন পরেই এটা ওর ‘নিজের দেশ’ হয়ে যাবে। তবু এখনও এখানকার ‘কালচার’ নিয়ে অনিশ্চিত সে।
    কিন্তু হোমলেস মানুষটা আর ঘাঁটালোনা মেয়েদের। এবারে সে কমবয়েসী সেই ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল টলমল পায়ে।
    ‘এই, তোমার ব্যাগে কী আছে? খাবার?’ লোকটা জিজ্ঞেস করল তাকে।
    ছেলেটা চমকে গেছে এ কথায়, মুখ দেখেই বোঝা গেল। এতক্ষণ দেখছিল সে মেয়েগুলোর সাথে লোকটার কাণ্ডকীর্তি। ও চট করে পাশ থেকে ব্যাগটা তুলে কোলের ওপর নিয়ে রাখল। শক্ত করে ধরে আছে ব্যাগটা।
    ‘কিছু নেই। ভাগো এখান থেকে,’ বলল সে লোকটাকে। এই প্রথম জামিল ওর গলা শুনতে পেল। কেমন কাঁপা কাঁপা অনিশ্চিত কণ্ঠ ছেলেটার।
    লোকটা তাতে দমলো না একটুও। আরেকটু কাছে এগিয়ে গেল সে ছেলেটার। তারপরে আচমকা ব্যাগ ধরে টান দিলো সে। ‘কী আছে ভেতরে? এত ভারী কেন এটা?’
    এ কথা বলতে বলতেই আরও জোরে ব্যাগ ধরে টান দিলো সে। সেই টানে কোল থেকে ব্যাগটা নিচে গড়িয়ে পড়ল ছেলেটার। বেশ জোরে একটা শব্দ হল তাতে।
    এবারে প্রচন্ড বিরক্ত হল ছেলেটা। ‘হেই, ভাগো তো! খবরদার, ব্যাগ ধরবে না আমার!’ চিৎকার করে উঠে লোকটার বুকে জোরে একটা ধাক্কা দিলো সে।
    ধাক্কার চোটে ছিটকে গিয়ে সামনের সিটে পড়ল লোকটা। হাত তুলে বুকে বোলাতে লাগল, ব্যথা পেয়েছে অনেক। ছেলেটা তখনও রাগী চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
    জামিলসহ বাকি সবাই একদম চুপ করে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়। ও খেয়াল করে দেখল, সোনালী চুলের মেয়েটার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
    হোমলেস লোকটা এবার জামিলের দিকে তাকাল। চোখে অবাক দৃষ্টি তার, আর কিছুটা অভিমান। ‘কী আছে ওর ব্যাগে বলো তো? তুমি জানো?’
    কী আশ্চর্য, ঠিক ঐ মুহূর্তে এই কথাটাই ভাবছিল জামিল। কী আছে ঐ ব্যাগে? কেন এমন শক্ত করে ব্যাগটা ধরে বসে আছে সে?
    জামিল ভাল করে তাকাল এবারে ছেলেটার দিকে। ওর মনে পড়ল, মসজিদে বসে থাকার সময়ও এভাবেই শক্ত করে ব্যাগটা ধরে রেখেছিল সে শরীরের সাথে। চোখের দৃষ্টিতে কেমন দিশেহারা একটা ভাব, কোথাও স্থির হতে পারছে না যেন। আর খুব ঘামছে ছেলেটা, এখনও।
    কী আছে ওর ব্যাগে?
    জামিলের হঠাৎ খুব আতঙ্ক বোধ হল। হোমলেস লোকটার মতই ওরও তখন মনে হল, ট্রেনটা সত্যিই খুব ধীরে চলছে যেন আজ!
    সেই ছেলেটা নিজেকে সামলে নিলো এবার। ব্যাগ তুলে নিয়ে আবার সিটে বসে পড়ল সে। লোকটাও সেখান থেকে উঠে গিয়ে দরজার কাছে গিয়ে বসে পড়ল এবার। মেয়ে দুটি তাকাচ্ছে না কারও দিকে, বাইরে তাকিয়ে আছে ওরা দু’জনেই।
    ছেলেটা এবারে জামিলের দিকে তাকাল মুখ তুলে।
    জামিল তখনও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে মনে হিসাব করছে সে। ব্যাগটা বেশ বড়। আর ভারিও, লোকটা যেমন বলল। কিন্তু কেন? ছেলেটা বিড়বিড় করে কী যেন বলছে এখন। জামিল শুনতে পেল না এত দূর থেকে। কী বলছে সে? ও কান খাঁড়া করল শোনার জন্যে।
    জামিলের ফোন বেজে উঠল তখুনি! রিয়া কল করেছে নিশ্চয়ই। ও জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল। শহরের বহুতল দালানগুলো দেখা যাচ্ছে এখন জানালা দিয়ে, ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে তারা। সেগুলোরই কোনও একটাতে বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে এখন রিয়া।
    সিলিং-এর স্ক্রিনে পরের স্টেশানের নাম ভেসে উঠল।
    ছেলেটাও তখন তাকাল সেই স্ক্রিনের দিকে। তারপর চট করে কব্জি উল্টে একবার সময় দেখে নিলো। জামিলের পিঠ বেয়ে ঠান্ডা ঘাম নেমে এল হঠাৎ করেই।
    ফোনের রিং থেমে গেছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই রিয়ার টেক্সট এল। ‘মিটিং শেষ। তোমার আর কতক্ষণ?’
    জামিল উত্তর দিলো না কোনও। ও জানেনা, আর কতক্ষণ।
    ছেলেটার দিকে আবার তাকাল জামিল। আর ছেলেটা এবারে ঘাড় ঘুরিয়ে সেই লোকটাকে দেখল একবার। দূরে বসে আছে দেখে মনে হল স্বস্তি পেল সে, তারপর জামিলের দিকে চোখ ফেরাল। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ব্যাগের চেইনটা খুলতে শুরু করল ছেলেটা।
    রিয়া কল দিয়েছে আবার। রিং বেজে উঠল। হাতের ফোনে ভেসে ওঠা রিয়ার নামটার ওপরে আঙুল বোলাল একবার জামিল। তারপর তাকাল ছেলেটার দিকে। অবাক হয়ে দেখল, ছেলেটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে, হাসছে।
    ট্রেনের স্পিকারে তখুনি পরের স্টেশানের নাম ঘোষণা হতে লাগল। ফোনের সবুজ বোতামের ওপর আঙুল রাখল জামিল। এত শব্দ চারদিকে, রিয়া কি শুনতে পাবে ওকে?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    ইদের কড়চা | বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় | সুতনু হালদার | ষষ্ঠ পাণ্ডব | আনোয়ার সাদাত শিমুল | শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় | উপল মুখোপাধ্যায় | মোঃ আব্দুল উকিল | দীপ্তেন | সোমনাথ রায় | ফরিদা | মোহাম্মদ কাজী মামুন | সুদীপ্ত গাঙ্গুলী | কৌশিক বাজারী | সুকান্ত ঘোষ | এস এস অরুন্ধতী | মণিশংকর বিশ্বাস | তনুজ | অরিত্র চ্যাটার্জি | তারেক নূরুল হাসান | স্বাতী ভট্টাচার্য | সৈয়দ কওসর জামাল | তন্ময় ভট্টাচার্য | দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় | পার্থজিৎ চন্দ | অত্রি ভট্টাচার্য | অর্ণব সাহা | চিরশ্রী দেবনাথ | শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ইমানুল হক | একক | অনিন্দিতা গোস্বামী | নিরমাল্লো | দেবনাথ সুকান্ত | বেবী সাউ | অনুরাধা কুন্ডা | দোলনচাঁপা চক্রবর্তী | সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
  • ইস্পেশাল | ৩০ এপ্রিল ২০২৩ | ১২৯৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ঘন্টাঘর - একক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৫৮519215
  • চমৎকার, অতি চমৎকার। টেনশানটা বেশ আস্তে আস্তে তৈরী হয়ে শেষ পর্যন্ত রয়ে গেল। 
  • দীমু | 14.143.72.170 | ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৪০519233
  • বেশ yes প্রায় কুড়ি বছর আগেকার সেই ঘটনা আর সময় যেন এই গল্পটার মধ্যে জমে আছে ফসিলের মত।  
  • ষষ্ঠ পাণ্ডব | 103.220.204.68 | ০২ মে ২০২৩ ২২:৩৯519339
  • শেষটা চমৎকার। গল্পের গড়ে ওঠাটা দুর্দান্ত। 
    আচ্ছা, মেলবোর্নে মার্চে কি খুব শীত পড়ে?
  • তারেক নূরুল হাসান | ০৮ মে ২০২৩ ১৮:০০519563
  • ধন্যবাদ পড়ার জন্যে, দমুদি এবং দীমু। 
     
    পাণ্ডবদা, মেলবোর্নের আবহাওয়ার বদনাম আছে অনেক। এ দেশে অফিসিয়ালি শীতকাল শুরু হয় জুন থেকে। কিন্তু আদতে এই শহরে নভেম্বর থেকে জানুয়ারির সময়টা বাদে সারা বছরই শীত থাকে। জুন জুলাইয়ে মেলবোর্ন থেকে ৩/৪ ঘণ্টার দূরত্বে বরফও পড়ে। আবার মার্চ বা এপ্রিলের কোনো কোনো রাতে বরফ না পড়লেও তাপমাত্রা নেমে যায় ২ বা ৩ ডিগ্রি, মেলবোর্নেই। এই ২০২৩ এ এসে গ্রীষ্মকে খানিকটা দীর্ঘ হতে দেখছি, প্রায় এপ্রিল ছুঁয়ে ফেলছে ইদানীং। কিন্তু ২০০৪ এর দিকে ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই ঠান্ডা পড়ে যেত। সেই ঠাণ্ডায় বরফ নামত না। তবে মার্চ-এর মাঝামাঝি গিয়ে সেটা কোনো কোনো দিন 'খুব শীত' হয়ে যেত। 
  • ষষ্ঠ পাণ্ডব | 103.98.204.123 | ১৩ মে ২০২৩ ১৭:২২519764
  • তারেক নূরুল হাসান:
    বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবার জন্য ধন্যবাদ। মেলবোর্নের আবহাওয়ার এতো বৈচিত্র্য সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিলো না। বেশ আগ্রহোদ্দীপক। একটু পড়াশোনা করতে হবে দেখছি।
  • যদুবাবু | ১৫ মে ২০২৩ ০৫:৫৫519823
  • এই গল্পটা অনেকদিন আগেই পড়েছিলাম। খুব-ই ভালো লেগেছিলো। চমৎকার টানটান ভাব। একটুও স্ল্যাক নেই। আপনার আরও অনেক লেখা পড়ার ইচ্ছে জানালাম। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন