এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  ইদের কড়চা  ইদের কড়চা

  • শাহানার দেবর সংক্রান্ত জটিলতা

    আনোয়ার সাদাত শিমুল
    ইস্পেশাল | ইদের কড়চা | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ | ১১৬৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৪ জন)
  • ইদের কড়চা | বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় | সুতনু হালদার | ষষ্ঠ পাণ্ডব | আনোয়ার সাদাত শিমুল | শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় | উপল মুখোপাধ্যায় | মোঃ আব্দুল উকিল | দীপ্তেন | সোমনাথ রায় | ফরিদা | মোহাম্মদ কাজী মামুন | সুদীপ্ত গাঙ্গুলী | কৌশিক বাজারী | সুকান্ত ঘোষ | এস এস অরুন্ধতী | মণিশংকর বিশ্বাস | তনুজ | অরিত্র চ্যাটার্জি | তারেক নূরুল হাসান | স্বাতী ভট্টাচার্য | সৈয়দ কওসর জামাল | তন্ময় ভট্টাচার্য | দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় | পার্থজিৎ চন্দ | অত্রি ভট্টাচার্য | অর্ণব সাহা | চিরশ্রী দেবনাথ | শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ইমানুল হক | একক | অনিন্দিতা গোস্বামী | নিরমাল্লো | দেবনাথ সুকান্ত | বেবী সাউ | অনুরাধা কুন্ডা | দোলনচাঁপা চক্রবর্তী | সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়


    -১-
    লোকটি শাহানার দেবর।
    তাকে আমি প্রথম দেখি শাহানার বৌভাতে। খাওয়ার টেবিলে আমাকে খুব সমাদর করছিল। যে বিষয়টি অন্য সবার থেকে লোকটিকে আলাদা করে তোলে তা হচ্ছে তার অদ্ভুত হাসি। তার হাসিতে কিছু একটা ছিল। রহস্যময়। দেখে মনে হয় বলছে – আমি সব জানি। জানি না কেন, আমার খুব অস্বস্তি লেগেছিল। লোকটির নাম আমার মনে নেই। মাহমুদ, মাসুদ কিংবা মাহতাব হতে পারে। তবে কেউ একজন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, লোকটি শাহানার দেবর। শাহানার শ্বশুরবাড়িতে ঐবারই আমার প্রথম এবং শেষ যাওয়া হতে পারতো, হয়নি।

    বিয়ে বাড়িতে এতো ভীড়, এতো লোক। এর মাঝে শাহানার দেবরকে আলাদা করে মনে রাখার বিশেষ কোনো কারণ ছিল না। তবে, লোকটি আমাকে দেখে একটা হাসি দিয়েছিল। সে হাসি সাদামাটা কোনো হাসি ছিল না। ওরকম হাসির নানানরকম অর্থ হতে পারে। আমার মাথায় খুব বেশি ব্যাখ্যা আসেনি। প্রথম ঝলকেই মনে হয়েছে, এর অর্থ – “আমি সব জানি”!

    আমার জীবনে পাপের, অনুতাপের, ঘটনা খুব বেশি নেই। সামান্য যা কিছু আছে তা আমাকে খুব পীড়া দেয়, আক্রান্ত করে। পাপের সাগরে সাতাঁর কাটলে অনুতাপের ঢেউগুলো হয়তো আমাকে স্পর্শ করতো না। কিন্তু, সামান্য কিছু অস্বস্তিকর এবং অপ্রীতিকর ব্যক্তিগত পাপবোধ মাঝে মাঝে আমাকে অ্যাকুরিয়ামের অভিশপ্ত মাছের মতো নিরুপায় করে দেয়, স্থীর স্বচ্ছ পানি আর চারপাশে অদ্ভুত এক কাঁচের দেয়ালে বন্দী মনে হয় নিজেকে। মাথায় ভেতর সুনির্দিষ্ট কিছু শব্দ ঘড়ির কাটার মতো টিক টিক টিক করতে থাকে।

    শাহানার বৌভাতে প্রথম আলাপে লোকটি যখন অদ্ভুত হাসি দেয়, আমার মনে হয় – সে আমার সব অস্বস্তির হদিস জানে। সে মুহূর্তে আমার দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমার সমস্ত অস্বস্তি, অনুতাপ, এবং পাপবোধের সঙ্গে শাহানা জড়িত। আমি নিশ্চিত, শাহানা সব গোপন রেখেছে। আমাদের দু’জনের মধ্যে ঘটে যাওয়া ব্যক্তিগত গোপন ঘটনাগুলো লোকজনকে বলে বেড়ানোর মতো বোকা শাহানা নয়।

    -২-
    মানব মনের গতি প্রকৃতি নিয়ে আমার খুব জ্ঞান নেই।
    মনোবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম না কখনো। যতো মানুষের সঙ্গে মিশেছি তাতে আমার একটা ধারণা খুব পাকাপোক্ত হয়েছে যে মেয়েরা কথা গোপন রাখতে পারে না। গোপনীয়তার নীতিমালায় তারা যতোটা সচেতন, গোপনীয়তা ভঙ্গ করতে তারা ততো বেশি পারঙ্গম। এসব বিবেচেনায় শাহানারও কোনো কিছু গোপন রাখার কথা নয়। খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের কাছে কোনো এক একান্ত আলাপচারিতায় শাহানার হয়তো বলে দেয়ার কথা – আমি তাকে আমাদের ছাদের চিলেকোঠায় হ্যাঁচকা টানে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলাম। একটা উঠতি বয়সে কিশোর কিশোরী বা তরুণ তরুণীদের মাঝে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। আপাতঃ নিষিদ্ধ এসব ঘটনা সুনিঃশ্চিতভাবে রোমাঞ্চের জন্ম দেয়। এবং এ রোমাঞ্চের অনুভূতি থেকে যায় অনেকদিন। স্মৃতি যেমন মানুষকে তাড়না দেয়, আনন্দ কিংবা বেদনার স্পর্শ দিয়ে যায়, ঠিক তেমনি এসব টুকরো এবং স্পর্শজনিত ঘটনা কিশোর-তরুণমনকে পুলকিত করে। এ পুলক দ্বিগুণ হয় যদি নিষিদ্ধ এবং গোপন সে আনন্দের কথা অন্যকে গোপনে বলা যায়।

    শাহানাও হয়তো সুযোগ পেলে একান্ত কোনো বান্ধবীকে আমাদের ছাদের চিলেকোঠার ঘটনার কথা বলতে পারতো। কিন্তু, আমি নিশ্চিত শাহানা এসব কাউকেই বলেনি। কারণ, শাহানার সঙ্গে আমার ঐ বিকেল চুমুতে থেমে থাকেনি কিংবা শেষ হয়নি। শাহানা এবং আমি – দুজনেই সেই ঘটনার পরে অনুতাপে ভুগেছি, অপরাধী হয়েছি। তবে অস্বীকার করবো না – আমার অনুতাপ বিলীন হয়ে যায় অল্প কিছুদিনেই, এরপর ঐ অভিজ্ঞতার কাছে বারবার ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সুতীব্র হয়েছে। শাহানার কেমন অনুভূতি হয়েছে আমি জানি না। সে কেবল আমাকে তার অপরাধবোধের কথা বলেছে। আর বলেছে, “এসব মনে রাখার দরকার নাই”। আমি শাহানাকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, এসব কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? জিজ্ঞেস করা হয়নি। কারণ, শাহানা এরপর আমাকে আর ধরা দেয়নি। পরের সপ্তাহেই ফুপা এসে শাহানাকে খুলনা নিয়ে যান। এইচ এস সি পরীক্ষা শেষে ঢাকায় মামা বাড়িতে শাহানার এক মাস বেড়ানোর ওখানেই সমাপ্তি ঘটে।

    এরপর শাহানা আর ঢাকা আসেনি। খবর পেয়েছি – উপজেলা সদরে আলহাজ্ব রাহমান আবসার মেমোরিয়াল কলেজে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে অনার্সে ভর্তি হয়েছে সে। ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন যখন মানুষের হাতে হাতে এসে গেছে – তখন শাহানা নিজেকে আড়াল করার খুব বেশি সুযোগ পায়নি। কারণ, শাহানা আমার ফেসবুকে বন্ধু তালিকায় আছে। আমি প্রায়শই তার ফেসবুক ওয়ালে উঁকি মেরে আসি। দেখি তার ছবি – কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে গান গাইছে; ছবিতে অনেকে লাইক দিচ্ছে, মন্তব্যের ঘরে ভক্ত অনুরাগীরা মুগ্ধতা ও ভালোবাসা জানাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করছিল, কমেন্টে কিছু লিখি। কিন্তু চিলেকোঠায় সৃষ্ট অপরাধবোধ আমাকে লিখতে দেয় না। মনে হয় – শাহানার ছবিতে আমার মন্তব্যের প্রতিটি শব্দ আমাকে বিদ্রুপ করবে। এ বিদ্রুপ সামাল দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই। তবে এ কথা অস্বীকার করবো না – শাহানার ফেসবুকে তার বন্ধু-ভক্ত-অনুসারীদের প্রশংসাসুলভ মন্তব্য এবং প্রতিউত্তরে শাহানার ধন্যবাদ জ্ঞাপন আমাকে ঈর্ষান্বিত করে, যন্ত্রণা দেয়। এ বেদনার ভার, ঘটনা পরম্পরায়, বাড়তে থাকলে এবং কোনো এক ক্ষণে অসহ্য মনে হলে, আমি শাহানার ইনবক্সে মেসেজ পাঠাই – “তোমার গানের প্রশংসায় ফেসবুক ভেসে যাচ্ছে। আগামীবার ঢাকা এলে আমাকে গান শোনাবে? আমাদের ছাদের চিলেকোঠায় – শুধু তুমি আর আমি…”
    শাহানা উত্তরে লিখেছিল – “আমার গান তোমার ভালো লাগবে না”।
    এ শুষ্ক নিরুত্তাপ জবাবে আমার নিজেকে প্রত্যাখ্যাত মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, আমি এতোটাই ক্ষুদ্র! শাহানা কী অবলীলায় আমাকে তুচ্ছ করে দিতে পারে!

    অনলাইনে ব্যক্তিগত না থেকে জনসমক্ষে শাহানা এভাবে বললে অপমান লাগতো খুব। তাই, অপমানের চেয়ে অভিমান হলো বেশি। কিছু নিজস্ব সঙ্গোপন বেদনা বুঝি অভিমানের মাত্রা তীব্র করে বারবার। অভিমানে-আত্মগ্লানিতে আমি শাহানাকে আর মেসেজ দিইনি। ফেসবুকের নিউজফিডে শাহানার নতুন ছবি দেখেছি। একদল বন্ধুর সঙ্গে কলেজের পিকনিকে কক্সবাজার গিয়েছে সে। নানান ভঙ্গিতে সুর্যোদয় এবং সুর্যাস্তের ছবি তুলেছে সে। দলবেধে পানিতে নেমেছে, সমুদ্রের তীব্র ঢেউ শাহানার হলুদ কামিজ-কালো পায়জামা ভিজিয়ে দিয়েছে। সমুদ্রের ঢেউ এবং তীব্র বাতাসে শাহানার কি একবারও আমার কথা মনে পড়েছে? হয়তো পড়েনি। মনে পড়লে, শাহানা নিশ্চয় ফোন করতো আমাকে। আমার ঈর্ষা বাড়ে। সমুদ্র ভ্রমণে সন্ধ্যায় গানের আসরে শাহানা কি সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে দেয়ার সুর তুলেছিল? এর উত্তর আমার জানা হয়না। কারণ, শাহানার ফেসবুকে কোনো গানের আসরের ছবি বা ভিডিও আসেনি। বিভিন্ন সময়ে সে মমিনা মুস্তাহসানের গান, রান্নার রেসিপি, এবং বিপদ থেকে বাঁচার দোয়া শেয়ার করেছে। এরপর একদিন শাহানার ফেসবুক ওয়ালে তার বন্ধুরা দলে দলে অভিনন্দন জানায়। প্রতিমন্তব্যে শাহানা কেবল মুচকি হাসির ইমোজি দিয়েছে। বুঝতে পারিনি কীসের অভিনন্দন।

    দু’দিন পরে আম্মা আমাকে জানায় – ফুপা ফোন করেছিল।
    শাহানার বিয়ে ঠিক হয়েছে। প্রবাসী পাত্র। ছেলের ইতালীতে বিজনেস আছে। তবে সেটা কাপড়ের নাকি কাঁচা ফুলের দোকান; আম্মা স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না। বরং শাহানার প্রবাসী স্বামী একদিন শাহানাকে কাগজপত্র ঠিক করে ইতালী নিয়ে যাবে – শাহানার জীবন প্রবাসে সুন্দর ও নিরাপদ হবে – ফুপার এমন প্রত্যাশার সঙ্গে আম্মা সহমত প্রকাশ করেছেন। দেশে নিরাপত্তা নেই, কোনো ভবিষ্যৎ নেই – এসব আলাপে শাহানার অনাগত ইউরোপ জীবন নিয়ে আমার মনে আবারও ঈর্ষা জাগে। সে রাতে শাহানার ফেসবুক ওয়াল খুব অচেনা লাগে আমার কাছে। তার সব অ্যালবাম উধাও হয়ে গেছে। প্রোফাইল ছবিতে বাম হাতের অনামিকায় আংটি। সর্বশেষ স্ট্যাটাস – “আলহামদুলিল্লাহ ফর এভরিথিং”। আমি এসবে যোগসুত্র খুঁজে পাই। বুঝতে পারি – তার বন্ধুদের অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছাবাণীর প্রেক্ষাপট।

    রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখি – বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে শাহানা ঢাকা চলে এসেছে। আমি গলির মোড়ে রাজুর টি-স্টলে চা খাচ্ছিলাম। শাহানার আমার হাত থেকে চায়ের কাপ কেড়ে নিয়ে বলে – তুমি আমাকে বাঁচাও। এরপর শাহানাকে নিয়ে আমি বাসার পথে হাঁটি। আমাদের দোতলার সিঁড়ি বেয়ে যখন উঠছি তখন আমাদের পায়ের তলা থেকে সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। শাহানা সকাতরে আমাকে মিনতি করছে – প্লিজ আমাকে বাঁচাও। আমি যতোবার সিঁড়ির ওপরের ধাপে উঠছি, ততোই সিঁড়ি খসে পড়ে যাচ্ছে। এ যেন এক অনন্ত অসীম সংগ্রাম। আমি হাঁফিয়ে উঠেছি। নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে মারা যাবো। তখন বুক ধড়পড় করে – ঘুম ভেঙে যায়। কিছুটা সময় নিয়ে স্থির হয়ে শাহানাকে ফেসবুকে মেসেজ দিই, “তিলোত্তমা, তুমি ইতালী চলে যাচ্ছো?”

    -৩-
    বৌভাতের আপ্যায়ন পর্বে শাহানার দেবর আমার দিকে তাকিয়ে “আমি-সব-জানি” সম্বলিত যে হাসি দিয়েছিল, তাতে খুব বিব্রত হচ্ছিলাম। আমার বারবার ব্যক্তিগত অপরাধবোধ ও অনুতাপের কথা মনে পড়ছিল। মাহমুদ, মাসুদ কিংবা মাহতাব নামের লোকটি আমার প্লেটে এক্সট্রা চিকেন রোস্ট তুলে দিচ্ছিল। শত শত মেহমানের ভীড়ে কেবল আমাকেই বিশেষ আপ্যায়নের জন্য এ লোককে দায়িত্ব দিলো কে, কেন? এ প্রশ্ন-উত্তরে বারবার দ্বিধান্বিত হই।

    শাহানার বিয়ের আগের রাতে আম্মাকে নিয়ে ঢাকা থেকে খুলনা এসেছি। বিয়ে বাড়ীর চিরায়ত হই-হল্লায় সে রাতে ঘুম হয়নি। পরদিন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে শাহানাদের সারা বাড়ীময় পোলাও-মাংসের একটা শীতল ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সে বাতাসে আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিয়ে বাড়ির সুবিশাল হাঁড়িতে বেচে যাওয়া মাংস পোলাওয়ের মতো আমার নিজেকে বাড়তি এবং পরিত্যক্ত মনে হয়। শাহানা আমাকে অগ্রাহ্য করেছে। আমার শেষ মেসেজের জবাব দেয়নি। এরকম খুব ব্যক্তিগত এবং সঙ্গোপন বেদনা নিয়ে শাহানার বিয়েতে আমার উপস্থিতি মোটেও যৌক্তিক কিছু নয়। অথচ, আব্বার শরীর ভালো না, তাই আম্মাকে নিয়ে খুলনায় শাহানার বিয়েতে আমাকেই আসতে হলো। দেখতে হলো শাহানার বিয়ে, আয়োজন, উচ্ছ্বাস এবং উৎসব। যেহেতু কনে বাড়ির অন্দর মহলে নারীদের সমাগম বেশি, বহিরাগত পুরুষ হিসেবে নারীদের ভীড় ঠেলে শাহানার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি।

    বিয়ের দিন শেষ বিকেলে শাহানাকে যখন বরপক্ষের হাতে সমর্পন করা হচ্ছে, তখন শাহানার কর্কশ কান্নার সুর আমার কানে এসেছে। সে কান্নার হাহাকার আমাকে স্পর্শ করেনি। মনে হয়েছে এ কান্না কেবলই আনুষ্ঠানিকতা, লৌকিকতা। ঘন্টাকয়েক পরেই শাহানা নিজেকে ইতালী ফেরত পুরুষটির কাছে সমর্পন করবে। আমি কল্পনায় দেখতে পাই এই সমর্পন প্রক্রিয়া নিয়ে শাহানার যথেষ্ঠ ব্যক্তিগত প্রস্তুতি ছিল। চিলেকোঠার সে বিকেলে কি শাহানার কোনো প্রস্তুতি ছিল? আমার মনে পড়েনা। এসব ভেবে ভেবে আমার আবার ঈর্ষা জাগে। শাহানার চেহারা ভাবতে বা দেখতে ইচ্ছে করে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনো একবার ঘোমটায় মুখ ঢাকা শাহানাকে এক ঝলক দেখেছি বলে মনে হলো। সে আমাকে দেখলো কিনা জানি না। খুব রাগ লাগে নিজের ওপর। কেন এলাম এ অসহ্য আয়োজনে? পোলাও মাংসের শীতল ঘ্রাণ ভেসে বেড়ানো রাতে খুব ভালো ঘুম হলো না। কোনো স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন দেখলাম কীনা মনে পড়লো না। ঘাটতি ঘুমে কাটলো আরো এক রাত।
    বৌভাতের আসরে তাই আমার শরীর ভেঙে পড়ছিল। শাহানার দেবর যখন আমার প্লেটে এক্সট্রা রোস্ট তুলে দিচ্ছিল – আমি বারবার নিষেধ করছিলাম। ঘুমের ঘাটতিতে বোধ হয় খিদে চড়ে যায়। আমি গোগ্রাসে খেলাম।

    খাওয়া শেষে শাহানার শ্বশুরবাড়ির সামনে বিশেষ আয়োজনে অতিথিদের জন্য তৈরি শামিয়ানা টাঙানো ছায়ায় গিয়ে বসি। দু’চোখ বুঁজে আসছিল ঘুমে। ধুমপানের তীব্র ইচ্ছা জাগে। হয়তো খানিকটা তন্দ্রাভাব এসেছিল। কাঁধে কোনো একজনের স্পর্শ পেয়ে জেগে উঠলাম। শাহানার দেবর; একটি সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে বলছে – “আপত্তি নেই তো?” আমি সানন্দে গ্রহণ করলাম। তিনি সমাদরে, সিগারেটে লাইটার জ্বালিয়ে দিতে দিতে, আমাকে বললেন – “খুব আরাম পাবেন কিনা জানি না। এ আমাদের মফস্বলের বাংলা ফাইভ। আপনারা শহরের মানুষ নিশ্চয় দামী সিগারেট খান?”

    আমি মাত্র ধোঁয়া টেনে বুকে জমিয়ে নিয়েছি।
    একটু আয়েশ করে নাক মুখ দিয়ে ছাড়বো। এই ফাঁকে তড়িৎ মাথা নেড়ে ঠোঁটের কোণায় হাসি রেখে শরীরি ভাষায় আপত্তি করছিলাম, যার অর্থ – “না, না, এ সিগারেটই ঠিক আছে”।
    অথচ মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার আগেই মাহমুদ, মাসুদ কিংবা মাহতাব নামের লোকটি আমাকে বলে, “আপনারা ঢাকাবাসী, তিলোত্তমা নগরের নাগরিক…” – শুনে আমার বুক ধক করে ওঠে। নাক মুখ দিয়ে বের হয়ে আসা সিগারেটের ধোয়ার সঙ্গে তীব্র কাশি আসে।
    এ লোকটি কেন তিলোত্তমা শব্দটি বললো?
    সে কি জানে আমি শাহানাকে ভালোবেসে তিলোত্তমা ডাকতাম?
    তীব্র উৎকন্ঠায় আমি যখন লোকটির দিকে তাকিয়ে আছি, তখন দেখি তার চোখে মুখে আবারও সেই রহস্যময় হাসি – আমি-সবই-জানি!

    -৪-
    শাহানা আগেও ঢাকা এসেছে।
    আমাদের বাসায় থেকেছে। তবে এইচএসসি পরীক্ষার পরে শাহানার ঢাকায় থাকা অন্যবারের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিল। টানা একমাস আমাদের বাসায় ছিল সে। এখন লেখাপড়া নেই, কিছুদিন বেড়িয়ে যাক; ফুপা রেখে গেছেন এই বলে। এর আগ পর্যন্ত শাহানা স্রেফ আমার কাজিনই ছিল। আমরা বয়সে কাছাকাছি, পড়ালেখায় সহপাঠী। কিন্তু সেবার তার অফুরান অবসরের সঙ্গে আমার অসীম আগ্রহ তৈরি হয়েছিল শাহানাকে নিয়ে। শাহানার মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম। আমার মানসিক পরিবর্তনগুলো কি শাহানা টের পাচ্ছিল? বয়েজ স্কুল-কলেজ পেরিয়ে এইচএসসি পরবর্তী অবসরে আমাদের বাসায় শাহানার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি আমার শিরা উপশিরায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। শাহানাকে ঐ প্রথমবার আমি কাজিনের বাইরে অন্য কিছু ভাবতে চেষ্টা করি। শাহানা আমার আশেপাশে এলেই এক বিশেষ ঘ্রাণ টের পাই নাকে। সে কি বিশেষ কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করে? নাকি ওটা তার একান্ত নিজস্ব ঘ্রাণ; সকাল-দুপুর-বিকেল কিংবা গোসলের পরেও শাহানার গায়ে অমন ঘ্রাণ থাকে? এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসার সাহস আমার নেই, তাই উত্তরও জানা হয় না। তবুও আমরা কথা বলি। হিন্দি সিনেমা, হুমায়ূন আহমেদ, হিমু এবং মিসির আলি নিয়ে আলাপ করি। শাহানা তাদের উপজেলা সদরে স্থানীয় কলেজে ভর্তি হবে; এ সিদ্ধান্ত নেয়া আছে। কেবল এইচএসসিতে পাশ করা নিয়ে তার যাবতীয় অনিশ্চয়তা। অন্যদিকে আমার ফলাফল সংক্রান্ত উদ্বেগ নেই। উৎকন্ঠা কেবল পরবর্তী ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে – বুয়েট, মেডিক্যাল, ঢাবি নাকি জাবি। তাই ছাদের চিলেকোঠা রুমে আমি দিনরাত পড়ালেখা করি। শাহানা আমাকে সাহস দেয় – “তোমার ভালো কিছুই হবে”।

    শাহানার দেয়া সাহসে আমি সাহসী হই।
    ভালো কিছু হোক – আমিও চাই। কিন্তু তারও আগে একদিন আমার হঠাৎ করে শাহানাকে আবিষ্কারের নেশা জাগে। আমির খানের থ্রি ইডিয়টস আর তালাশ পেরিয়ে হিমুর মধ্যদুপুরে যখন হিমু এবং মিসির আলি মুখোমুখি – শাহানা বলছে হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্মের কথা; তখন আমার সারা শরীরে কখনো-ঘটেনি-এমন স্রোত বয়ে যায়। দুপুরের খাবারের পরে নীচতলায় আম্মা ভাতঘুমে কাতর, তখন ছাদের চিলেকোঠায় শাহানার নিজস্ব ঘ্রাণ আমাকে মাতাল করে দেয়। আমি আচমকা এক ঝাপটায় শাহানার কোমর দু’হাতে জড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নিই। ওর গলায় আমার নাক গুঁজে দিই, ঘ্রাণ নিই, চুমু খাই চোখে-কপালে। শুনতে পাই শাহানার ভারী নিঃশ্বাস। সেই অদ্ভুত ঘ্রাণ আরো তীব্র হয়ে আসে।
    শাহানা আমার কানে ফিসফিস করে বলে – “দরজা খোলা”।

    শাহানার সম্মতি আমাকে অবাক করে না।
    দরজা বন্ধ করে আমি জ্যাকব রজারভিনের মতো করে, অজানা অথচ মায়াময়, শাহানা আইল্যান্ডের নেভল অব দ্য ওয়ার্ল্ড উন্মোচন করি। শাহানার বুকের মাঝ বরাবর অদ্ভুত সমান্তরাল তিনটি তিল দেখে আমি অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকি। আলতো স্পর্শে আঙুল বুলাই। শাহানা এতোক্ষণ চোখ বুঁজে ছিল। আমার অপ্রত্যাশিত ধীরতায় সে চোখ খোলে, জিজ্ঞেস করে – “কী দেখছো?”
    আমি বলি – “তিলোত্তমা”।
    শাহানা চাপাস্বরে হেসে ওঠে।
    এ হাসিতে শুরু হয় আমার জীবনের অন্যতম অপরাধবোধ এবং অনুতাপের আখ্যান, যার সমাপনী বক্তব্য ছিল, “এসব মনে রাখার দরকার নেই”।

    আমি পরে অসংখ্যবার ভেবেছি – শাহানার সঙ্গে চিলেকোঠার ঘটনাটি তো দৈনিক পত্রিকার মাঝের কোনো পাতার বিজ্ঞাপন নয় যে দ্রুত ভুলে যাবো। এ আমার ব্যক্তিগত সংবাদ পত্রের বিশেষ দিনের বিশেষ সংস্করণের একমাত্র শিরোনাম – তিলোত্তমা রহস্য; সমগ্র পৃষ্ঠাজুড়ে যার বিস্তারিত বিবরণ।

    -৫-
    শাহানার দেবর কীভাবে আমার একান্ত নিজস্ব এবং ভীষণ গোপনীয় তিলোত্তমা শব্দটি জেনে গেল – এ ভাবনায় আমি একুল ওকুল করি। লোকটির অদ্ভুত হাসির সঙ্গে তিলোত্তমা রহস্যের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা সেটা ভাবি। শাহানাকে আমার মোটেও অমন কোনো বোকা মেয়ে মনে হয়নি যে চিলেকোঠার ঘটনাটি কাউকে বলবে আর সেটা তার দেবরের কানে আসবে। সব জেনে বিয়ের পরদিন তার দেবর আমাকে শত অতিথির মাঝে আলাদা করে প্লেটে এক্সট্রা রোস্ট তুলে দেবে অথবা সিগারেটে আগুন ধরাতে ধরাতে তিলোত্তমা নামক বোমাটি আমার বুকে ছুঁড়ে দেবে – এসবই কল্পনাতীত। মাহমুদ, মাসুদ কিংবা মাহতাব নামক লোকটি যদি সত্যি সত্যিই আমার এবং শাহানার ভীষণ গোপন বিকেলটির কথা জেনে যেতো, তাহলে কি শাহানার বিয়ে অমন নির্ঝঞ্ঝাটভাবে শেষ হতো?

    অন্যদিকে নিজের সঙ্গে যুক্তি তর্কে আমি আরো ভাবি – একজন সাধারণ মানুষ কি সাদামাটা সামাজিক আলাপে ঢাকাকে তিলোত্তমা বলবে? তিলোত্তমা ঢাকা গড়ার অঙ্গীকার করেন রাজনীতিবিদেরা, ভোটের আগে। শাহানার দেবর যিনি সম্ভবতঃ আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় হবেন, সারা জীবন খুলনার মফস্বলে কাটিয়েছেন, তিনি রাজধানী ঢাকা, প্রাণকেন্দ্র ঢাকা, মসজিদের কিংবা টাকার শহর ঢাকা বাদ দিয়ে তিলোত্তমা ঢাকা বলবেন কেন?

    শাহানার বিয়ে-বৌভাত শেষে সে রাতেই আমি আর আম্মা ঢাকাগামী স্বদেশ পরিবহনের নাইট কোচে চড়লাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে উঠে বসতেই, বাস চালু হওয়ার আগে, আমি ঘুমে ডুবে যাই। কতো ঘন্টা ঘুমিয়েছি মনে নেই।

    সকালে ঢাকা নেমে দেখি বৃষ্টিতে সারা শহর ভেসে গেছে।
    ট্যাক্সি ডেকে ব্যাগ নিয়ে উঠে বসতেই আমার আবছা আবছা মনে পড়ে রাতে বাসে ঘুমে দেখা এক স্বপ্নের কথা – শাহানাদের বাড়ির পুকুর ঘাটে বসে আছি। শাহানা পুকুরের অন্য পাড় থেকে সাঁতার কেটে আমার দিকে আসছে। এসে বলছে – “জানো, আমার দেবর আমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড জেনে গেছে!”
    এ স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই আমার বুকটা ধুক করে ওঠে। ফেসবুকে শাহানার কাছে তিলোত্তমা সম্বোধনে একাধিক আবেগাশ্রিত মেসেজের কথা মনে পড়ে।

    ট্যাক্সি জ্যামে আঁটকে আছে।
    রাস্তার পাশে ঝোলানো নির্বাচনী ব্যানারে চোখ পড়ে আমার – তিলোত্তমা ঢাকা গড়ার প্রত্যয়ে মাহবুব ভাইকে জয়যুক্ত করুন। আমার চারপাশ অসহ্য লেগে ওঠে। মাহমুদ, মাসুদ কিংবা মাহতাব নামের, শাহানার দেবর, লোকটিকে খুন করতে ইচ্ছে করে।

    -৬-
    শাহানার বিয়ে হয়েছে।
    স্বামীর সঙ্গে সে সিলেটে হানিমুনে গেছে। কিছুদিন পরে তার স্বামী ইতালী ফিরে যাবে। পাসপোর্ট ভিসা হলে শাহানাও ইতালীতে উড়াল দেবে। এই ফাঁকে শাহানা তার পড়ালেখা শেষ করবে। শ্বশুরবাড়িতেই থাকবে।

    শাহানা সংক্রান্ত আমার যাবতীয় মানসিক জটিলতার ওখানেই শেষ হতে পারতো। কারণ, এরপরের মাসগুলোতে এরপর আমি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হতে শিখেছি। স্মৃতিরা আগের মতো হানা দেয় না। শাহানাকে হারিয়ে ফেলেছি; এই চূড়ান্ত পরিণতিতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি নিজের অজান্তে। শাহানার ফেসবুকে উঁকি দেয়ার ইচ্ছাটিও কখন মরে গেছে টের পাইনি। অনুমান করি, শাহানা ফেসবুকে এখন ইতালিয়ান পাস্তার রেসিপি শেয়ার করে। হিন্দি সিনেমার বদলে রোমান হলিডে দেখে। হয়তো তার স্বামীকে সকাল বিকেল মি-মান-কি এবং তি-আমো মেসেজ পাঠায়।

    এরকম আরো সপ্তাহ মাস পার হলে শাহানা বিষয়ক নতুন কোনো খবর আমার কানে না এলে নির্ভার হই। শাহানার দেবরের হাসি, আতিথেয়তা কিংবা তিলোত্তমা নিছক কাকতাল অথবা আমার মনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যাখ্যা বলে মনে হয়।

    -৭-
    তারপর কতো কিছুই তো ঘটে।
    পরের বছর আব্বার শরীর খারাপ হতে থাকে। কয়েক দফায় হাসপাতালের জরুরী বিভাগ, বাসা, আবার হাসপাতাল, আইসিইউ, সিসিইউ করে এক ভোরে আব্বার কপালে হাত রেখে আম্মা বুক-ধক-করানো শীতল অনুভূতি টের পান। তারপর কয়েক দফায় ডাকাডাকির পরে সাড়া না পেয়ে, এবং সবচে’ খারাপ সম্ভাবনাটি সত্য হয়ে উঠলে, আম্মার তীব্র বিলাপ শুনে আমি দৌড়ে তাদের রুমে যাই। সেই সকালের পরে আমার বয়স বেড়ে যায়, দায়িত্ব বেড়ে যায়। মনে কোন গহীন কোণে যেন বিশাল এক পাথর এসে পড়লো। সেই পাথরের চাপে অনেক কিছু থেকে আমার মনোযোগ সরে গেল। অনেক দিন পরে টের পেয়েছিলাম ঘুমানোর আগে শাহানা সংক্রান্ত কোনো ভাবনা আমার মনে আসে না। ঘুম থেকে উঠে আমার মনে পড়ে আজ বাসার বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে, বাজার করতে হবে, কিংবা পানির লাইনের সমস্যার জন্য মিস্ত্রী ডাকতে হবে। সারাদিন ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে আম্মাকে নিয়মিত সময় দেয়া, টিভিতে রাতের সংবাদ দেখে ভাত খাওয়া আমাদের নতুন জীবনের ধরাবাধা নিয়ম হয়ে গেল। সে নিয়মের অভ্যস্ততায় আমরা দু’জন টের পেলাম না কখন মাঝে কতোগুলো ঈদ পার হলো নিরানন্দে নিঃসঙ্গতায়; ফুটবলের পরে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময়ও হয়ে এলো।

    এরপর উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত ঘটনা ঘটলো – বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল রেজাল্টের আগেই চাকরিতে যোগ দিলাম। রোববারটি আরো দুটি কারণে আমার মনে থাকবে; সেদিন দেশের কুখ্যাত এক অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয় এবং জনপ্রিয় এক টিভি মডেল আত্মহত্যা করেন। নতুন চাকরি, অপরাধীর বিচার, এবং সেলিব্রিটির আত্মহনন; তিনটি সম্পর্কহীন ঘটনার দিনে আমার আব্বাকে মনে পড়ে। মনের কোণে চেপে বসা পাথরের ভারে বারবার দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। হয়তো এটাই জীবন, কারো জন্য কিছু থেমে থাকে না। আব্বাহীন অন্যরকম এক জীবন আমি এবং আম্মা যাপন করে যাচ্ছি। আব্বার অনুপস্থিতি পৃথিবীতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির জীবনে কোনো প্রভাব ফেললো বলে আমার মনে হলো না।

    সে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে ট্রাফিক সিগন্যালে রিকশায় আমি শাহানাকে দেখতে পাই। আলো আঁধারির মিশেলে, রিক্সার টুংটাং, গাড়ির হর্ণ আর ভ্রাম্যমান হকারের কর্কশ ডাকাডাকির ভীড়ে বাসের বামে দাঁড়ানো রিক্সায় ছাই রঙা জামা আর কোলে ব্যাগ নিয়ে শাহানা বসে আছে। নাম ধরে ডাক দেবো, এমন সময় আমার গলাটা চেপে আসে। কে যেন আমাকে তড়িৎ বলে দেয় – যাকে দেখছি সে শাহানা নয়; কারণ, সে এখন ঢাকায় থাকার কথা না। শাহানা এখন ইতালী অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোনো দেশে, তীব্র তুষারপাতের কোনো শহরে, থাকার কথা। দেশে ফিরলে শাহানা একা রিকশায় এভাবে সাদামাটা পোশাকে, সস্তা ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে বসে থাকবে না। এ আমার দেখার ভুল। সোডিয়াম আলো যেমন জামার রং পালটে দেয়, তেমনি হয়তো মানুষের চেহারাও বদলে যায়। অচেনা কাউকে হঠাৎ তাই শাহানা বলে মনে হয়। নিজের সঙ্গে কয়েক মিনিটের এরকম তীব্র বোঝাপড়া শেষে নিজেকে সামলে নিই। ভাবি, একটি ঘটনাবহুল দিনে এভাবে শাহানার দেখা পাওয়া নিতান্তই বিভ্রম। মনে পড়ে, বহুকাল আগে নির্বাচনী পোস্টারে কে যেন ঢাকাকে তিলোত্তমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; ঢাকা তিলোত্তমা হয়নি। জ্যামের শহরে, ভীড় বাসে, ঘামে ভিজতে ভিজতে আমি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, না-পাওয়া-প্রতিশ্রুতি এবং ভুলে যাওয়া তিলোত্তমাকে স্মরণ করি। বাস চলতে শুরু করলে জানালা দিয়ে ঘাঁড় ফিরিয়ে বামে পেছনে তাকাই। শাহানা কিংবা শাহানার মতো কেউ বসে থাকা রিকশা চোখে পড়ে না। তখন হঠাৎ করে শাহানার দেবরের চেহারা আমার চোখে ভেসে আসে। তার রহস্যময় আমি-সব-জানি হাসি মনে পড়ে। সকাল থেকে অন্যরকম ভালোলাগা দিনটির শেষভাগ অনাকাঙ্ক্ষিত তিক্ত অনুভূতিতে ডুবতে থাকে।

    -৮-
    কাঙ্ক্ষিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিতের মাঝামাঝিও অনেক কিছু ঘটে।
    এই যেমন চার বছরের বেশি সময় পরে আমি হঠাৎ করে শাহানাকে ফেসবুকে খুঁজবো, এবং তাকে ফেসবুকে না পেয়ে নতুনভাবে শাহানাহীনতায় আক্রান্ত হবো – সেটা কাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনোটাই ছিল না, হয়তো ছিল আকাঙ্ক্ষার অনাবিষ্কৃত ব্যাখ্যায়। প্রথমে ভেবেছিলাম শাহানা আমাকে ফেসবুকের বন্ধু তালিকা থেকে সরিয়ে দিয়েছে কিংবা ব্লক করেছে। কিন্তু, আমার কোনো-এক-সময় কোনো-এক-বিশেষ-কারণে খোলা ছদ্মনামের ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট দিয়ে তালাশ করেও যখন শাহানার হদিস পেলাম না, তখন আমার গা-হাত শিরশির করে। শাহানা কি ফেসবুক থেকে উধাও হয়ে গেছে? নাকি নতুন কোনো ইতালিয়ান নাম, হতে পারে সাবাতিনি, সাচ্চিনি কিংবা রিগোলিনি নিয়ে ফেসবুকে কফি হাতে হাসিমুখে ক্যাফে ডি রোমায় চেক ইন দিচ্ছে। হয়তো সেইন্ট পিটার্স স্কয়ারে স্বামীর হাত ধরে সে লরা পজিনির মতো করে গুনগুন করে গাইছে “ইয়্যূ উইল নেভার ফাইন্ড, নো ম্যাটার হোয়্যার ইয়্যূ সার্চ”। কোনো উইকেন্ডে সিনে হলে পপকর্ণে নিঃশব্দ কামড় বসাতে বসাতে শাহানা কি নিঃশব্দ কান্নায় ঢুঁকরে উঠেছিল ‘বাংলা’ সিনেমার নায়ক ফাইমের জন্য। ছবির শেষ দৃশ্যে ইতালী বনাম লন্ডনের মতো কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি যখন ফাইম, তখন শাহানার কি আলহাজ্ব রাহমান আবসার মেমোরিয়াল কলেজের সবুজ ক্যাম্পাসে ফিরতে মন চেয়েছে? মনে কি পড়েছে আমাকে কিংবা আমাদের চিলেকোঠাকে? এরকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর আমার জানা হয় না ঘুমহীন রাতে। হয়তো শাহানাকে ফেসবুকে খুঁজে পেলে, তার সুখের জীবন যাপনের ছবি দেখলে, আমার অমন অস্থির অস্থির লাগতো না। শাহানার প্রতি আমার কল্পিত আকাঙ্ক্ষার বালিঘর অনায়াসে ধ্বসে যেতো। অথচ, কিছুই হলো না!

    জুলাইয়ের রোববারে সন্ধ্যায় শাহানার মতো কোনো একজনকে রিক্সায় দেখার পর থেকে শাহানা বিষয়ক অনুভূতিগুলো–অভিমানগুলো নতুন এক মাত্রা নিয়ে আমার মনোজগতে হাজির হয়। কাজের ফাঁকে, ভীড় বাসে, হুটহাট শাহানার কথা মনে পড়ে। তখন অন্য কিছু আর খেয়াল থাকে না। সেরকমই কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে অফিসে থেকে ফেরার পথে আমার মোবাইল ফোন খোয়া গেল। সিমকার্ড তুলতে গেল আরো তিনদিন।

    এরপর শুক্রবার বসুন্ধরা সিটি গিয়েছিলাম নতুন ফোন কিনতে।
    ছুটির দিনে মানুষের ভীড়ে গমগম করছে ফ্লোর। পাঁচতলার শো রুম থেকে নতুন ফোন সেট কিনে ফুডকোর্টে গিয়ে বসলাম। গরমে পিপাসা পেয়েছিল খুব। এক গ্লাস লাচ্ছি হাতে নতুন ফোনে সিমকার্ড সেট করে কন্টাক্ট ব্যাক আপ নিচ্ছিলাম। অ্যাপগুলো আপডেট হচ্ছিল। তখন শাহানা এসে হাজির হয় আমার সামনে। না, কল্পনায় নয় – চোখের সামনে। সামনের টেবিলেই চটপটি-ফুচকা কিংবা দোসার প্লেট নিয়ে বসেছে শাহানা। সঙ্গী লোকটির চোখে চোখ রেখে হাত নেড়ে কী কী যেনো বলছে। আবার সেই বুক-ধড়াস এবং যুগপৎ হাত-পা-ঠান্ডা হয়ে আসা অনুভূতি আমাকে গ্রাস করে। অদৃশ্য কোনো মিউট বাটনের চাপে চারপাশের সমস্ত কোলাহল হৈচৈ যেন থেমে গেছে। অথবা আমার মাথার ভেতরের রক্ত-মাংশ গলে কানের কাছে চলে এসেছে। একটু পরেই সব দু’কানের ফুটো বেয়ে গলে গলে পড়বে। বিষ্ময়কর সে ঘটনা ঘটার আগে আমি উঠে দাঁড়াই। ব্যক্তিগত অস্বস্তি, অনুতাপ এবং পাপবোধের সেই চিলেকোঠা দুপুরের পরে, দ্বিতীয়বারের মতো আমি শাহানা সম্পর্কিত বিষয়ে সাহসী হয়ে উঠি। ধীর পায়ে শাহানার টেবিলের দিকে আগাই। শাহানার বাম পাশে রাখা খালি চেয়ারে বসি। আমাকে দেখে শাহানা কতোটা চমকালো জানি না। কারণ, দুই কানে তালা লাগার পাশাপাশি আমার দুই চোখ যেন ঝলসে গেল শাহানার মুখোমুখি বসা লোকটিকে দেখে। লোকটি শাহানার দেবর – মাহমুদ, মাসুদ কিংবা মাহতাব। লোকটির চেহারায় অদ্ভুত সেই হাসি – আমি-সবই-জানি!

    -৯-
    রাতে খাবার টেবিলে টুকটাক কথার ফাঁকে আম্মাকে জিজ্ঞেস করি – “শাহানার কোনো খবর জানো?” কিছুক্ষণ চুপ থেকে আম্মা গ্লাসের পানিতে চুমুক দিলেন, তারপর বললেন – “শুনি তো অনেক কিছুই, কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা বোঝার উপায় নাই”।
    জিজ্ঞেস করলাম – “কী রকম?”
    আম্মা জানালেন, শাহানার মায়ের সঙ্গে মাঝে ফোনে কথা হয়েছে দুয়েকবার। বড়মামা এবং ছোটখালাও একই বিষয়ে ফোন করেছিলেন দুই-তিনমাস আগে। পুরো কেলেঙ্কারি ব্যাপার। নিজেদের নিকট আত্মীয় নিয়ে এসব আলাপ করাও বিব্রতকর। কী মেয়ে কী হয়ে গেল!

    শেষ কথাগুলো আমার কানে লাগলো খুব। শাহানার সঙ্গে আজ দেখা হয়েছিল – কথাটি মুখে এনেও গিলে ফেললাম। বললাম, “কেলেঙ্কারিটা কী রকম?”

    আম্মা তার সহজাত ভঙ্গিতে যা বললেন, তা হলো – শাহানার স্বামী বিয়ের পর ইতালী ফিরে গিয়েছিল, বলেছিল – কয়েক মাসের মধ্যেই শাহানার জন্য কাগজপত্র রেডি হবে। কিন্তু, সেই কাগজ হয়নি কী যেন এক জটিলতায়। নিয়মিত কলেজে এবং ঘনঘন বাবার বাড়িতে যাওয়ার কারণে শ্বশুর শাশুড়ীর সঙ্গে শাহানার দূরত্ব বাড়তে থাকে। মানসিক দূরত্ব বাড়ে প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে; কারণ, দ্বিপাক্ষিক সংকটে নিজের বাবা-মায়ের পক্ষেই থাকে শাহানার স্বামী। অন্যদিকে শাহানার বাবা-মাও শাহানাকে জোর করে শ্বশুরবাড়ি পাঠায়; বলে, সংসার করতে হলে স্বামীর ঘরেই থাকতে হবে, বাবা-মায়ের বাড়িতে নয়। শাহানার অভিযোগ ছিল, যেখানে স্বামী নেই সেখানে কীসের সংসার! এরপরেও শাহানাকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরতে হয়েছিল। তবে বছর পেরিয়ে নতুন সংকট দেখা দেয়, গুজব ওঠে – দেবরের সঙ্গে শাহানার বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মফস্বলের সামাজিক ঘনত্বের মাঝে শাহানার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে ওঠার কথাও শোনা যায়। এরপর সমস্ত রটনাকে সত্যি করে দিয়ে গত বছর কোনো এক সময়ে শাহানা তার দেবরের সঙ্গে খুলনা ছেড়ে ঢাকা এসে বাসা ভাড়া নিয়েছে। দু’জনেই কোথায় যেন চাকরি করছে এখন। এই নিয়ে চারপাশে ছিঃ ছিঃ শুরু হয়েছে।
    এর বেশি কিছু আম্মা আর বললেন না। আমি আর ভাত নেবো কিনা জিজ্ঞেস করে ডালের বাটি ফ্রিজে তুলে রাখলেন।

    আমার মনে হাজার জিজ্ঞাসা।
    আম্মার দেয়া বিবরণটুকু থ্রিলার উপন্যাসের ব্যাক কাভারের মতো মনে হয়। বিস্তারিত জানতে হলে পড়তে হবে, যেতে হবে ঘটনা এবং ঘটনার পেছনের ঘটনায়। কিন্তু, যে ঘটনার আপাতঃ সমাপ্তি ছিঃ ছিঃ তে গিয়ে থেমেছে, সেখানে নতুন করে জিজ্ঞাসা কিংবা আগ্রহ দেখানোর সুযোগ আমি পেলাম না।

    বিছানায় শুয়ে এক ডজনের বেশি প্রশ্নের তালিকা করলাম মনে মনে। বিকেলে বসুন্ধরা সিটির ফুডকোর্টের ঘটনাগুলো আবার ভাবার চেষ্টা করি। যোগসুত্র মেলানোর চেষ্টা করি আম্মার দেয়া বিবরণের সঙ্গে। জুলাইয়ের রোববারে ট্রাফিক জ্যামে রিক্সার তরুণীটি হয়তো শাহানাই ছিল। কারণ, শাহানা এখন ঢাকায়, সঙ্গে তার দেবর আছে – এ সবই সত্য। তাদের সন্তান আছে কীনা আমার জানা নেই। তারা কেমন আছে – কোথায় আছে সে প্রশ্নও আমি তাদের করিনি। শাহানার দেবরের হাসিতে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পরে – আমার আর কিছু বলার ছিল না। শাহানাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি কেমন আছি। বলেছিলাম, ভালো আছি। শাহানার দেবর আমাকে তাদের সঙ্গে চটপটি-ফুচকা কিংবা দোসা খেতে আহবান করেছিল। শাহানা আমার হাতে মোবাইল ফোন দেখে জিজ্ঞেস করেছিল – এখনো শেষে ট্রিপল নাইনের জিপি নম্বর চালু আছে কীনা। উত্তরে বলেছিলাম, হ্যাঁ সেই নম্বরেই আছি। তারপর দ্রুত বিদায় নিয়ে ফেরার সময় একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছিলাম তাদের দুজনের চোখ আমার দিকে। শাহানার দেবরের মুখে জঘন্য সেই হাসি।

    ভাবনার জটিলতার ভীড়ে হঠাৎ আমার একটু ভালো লেগে ওঠে এই ভেবে যে শাহানা আমার মোবাইল নম্বর মনে রেখেছে, অন্ততঃ নাম্বারটি জিপির এবং শেষে ট্রিপল নাইন; এটুকু তার মাথায় আছে। শাহানা আমাকে একেবারে ভুলে যায়নি। আবার এ কথাও ভাবি, শাহানা আমাকে মনে রাখলেই কী? সে আমাকে প্রত্যাখান করেছে অনেক আগে। এরপর বিয়ে করেছে এবং স্বামীকে তুচ্ছ করে এখন দেবরের সঙ্গে জীবন যাপন করছে। আচ্ছা, শাহানা কি স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে? কিংবা সে কি দেবরকে কাগজে কলমে বিয়ে করেছে? বিয়ে করুক বা না করুক, এই অসহ্য লোকটির সঙ্গে শাহানা থাকছে ভাবতেই আমার রাগে গা ঘিনঘিন করতে থাকে। অনেকদিন পরে মাহমুদ, মাসুদ কিংবা মাহতাব নামের লোকটিকে খুন করতে ইচ্ছে করে।

    -১০-
    খুন আমি করিনি।
    তবে শাহানার দেবর মারা গেছে। কীভাবে মারা গেছে সে প্রশ্নের উত্তর শাহানা আমাকে দেয় না। বসুন্ধরা সিটিতে দেখা হওয়ার তিন অথবা চার মাস পরে এক শুক্রবার ভোর রাতে অচেনা নম্বর থেকে আসা ফোনে আমার ঘুম ভাঙ্গে। ফোনে ওপাশে শাহানা, নিজের পরিচয় দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। একটি কথাই আমাকে বারবার বলে সে, “ও মারা গেছে, তুমি একটু আসো, ঢাকা মেডিকেল, হেল্প করো আমাকে”।
    আমি জিজ্ঞেস করি, “কে মারা গেছে?”
    কান্নার চাপে ভারী হয়ে আসা কন্ঠে শাহানা বলে – “মোজাম্মেল মারা গেছে, তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেদিন”।

    আমার মাথার ভেতরের অনেকগুলো সংকেত বাতি জ্বলে ওঠে। শাহানার দেবর মারা গেছে। শাহানা কাতর স্বরে আমার সাহায্য কামনা করছে, আমাকে যেতে হবে।
    গায়ে দ্রুত জামা কাপড় চাপিয়ে, স্যান্ডেল পরে, মোবাইল-মানিব্যাগ-হাতঘড়ি আছে কিনা চেক করে আমি বাসা থেকে বের হই।

    বাইরে তখনো আলো ফোটেনি।
    গলির মোড়ে খালি সিএনজি ট্যাক্সি পেলাম। গন্তব্য – ঢাকা মেডিকেল। বউনি প্যাসেঞ্জার বলে দরদাম করলো না, মিটারেই চলবে। সকালের শীত শীত বাতাস ভেদ করে প্রায় ফাঁকা রাস্তায় সিএনজি ছুটে চলেছে। দূরের কোনো মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। আমি মোবাইল ফোন বের করে শাহানার নম্বরে কল করি। কোনো সাড়া এলো না। হঠাৎ মনে হলো, এই আমি – এই সিএনজি ট্যাক্সি – এই যাত্রা; এসব কি সত্যি নাকি স্বপ্ন, নাকি কোনো ভ্রম? শাহানার বিয়ের সংবাদে, বিয়ের পরে অথবা অন্য সময়ের মতো এ কি দীর্ঘতর কোনো স্বপ্ন?

    ঢাকা মেডিকেলের প্রবেশ পথে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলো ম্লান হয়ে আসছে। জরুরী বিভাগের সামনে কিছু লোক গুটিসুটি মেরে বসে আছে। সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া দিতেই কোত্থেকে শাহানা এসে আমার শার্টের হাতা ধরে টান দেয় – “তুমি এসেছো?”

    এরপর শাহানা আমার বুকে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদতে থাকে। অনেক-অনেক বছর পরে শাহানার স্পর্শ পেয়ে আমার যে রকম অনুভূতি হওয়ার কথা ছিল সেরকম কিছু হলো না। টের পেলাম শাহানা একা নয়; আশেপাশে আরও চারজন পুরুষ – নানান পরামর্শ নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে চায়। ডেডবডি ছাড়াতে হলে কী করতে হবে, ডেডবডি কীভাবে ফ্রিজার ভ্যানে নিতে হবে – কতো টাকা লাগবে, আগে আগে রওনা দিলে কীভাবে আসরের আগে দাফন করা যাবে এসব নানান কথায় তারা আমাকে অস্থির করে তুললো।

    আমার ইচ্ছে করছিলো – শাহানার সঙ্গে নিরিবিলি বসি; জিজ্ঞেস করি তার দেবর, অথবা স্বামী, লোকটি কীভাবে মারা গেল? কী হয়েছিল? তাদের বাসা কোথায়? শাহানার ইতালী প্রবাসী স্বামী কি এসব জানে? অথচ, কিছুই জিজ্ঞেস করা হলো না। বরং শাহানাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কাছে টাকা আছে?”
    “কতো লাগবে?”
    “বিশ হাজার বা তিরিশ হাজার?”

    বিশ হাজার এবং তিরিশ হাজারের মাঝে দশ হাজার টাকার পার্থক্য; তাহলে, কতো টাকা দরকার? শোকে বিধ্বস্ত শাহানাকে বাড়তি প্রশ্নে বিরক্ত না করে আমি ডাচ-বাংলার এটিএম বুথের সন্ধানে গেলাম। চল্লিশ হাজার টাকা তুলে আবার জরুরী বিভাগে ফিরলাম। শাহানার হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে বললাম, “হাসপাতালের বিল ক্লিয়ার করে এসো”।
    শাহানা বললো, “তুমিও এসো”।

    লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় জরুরী বিভাগের হর্তাকর্তা আচরণের হাড্ডিসার শরীরের মানুষটি শাহানাকে কোনো পাত্তা দিলো না। আমার সঙ্গেই সব কথা বললো। মৃত ব্যক্তির আত্মীয় হিসেবে আমাকেই সব কাগজে স্বাক্ষর করতে হলো। এই স্বাক্ষরের পর ঘটনাস্থলে আমার ভূমিকা এবং দায়িত্ব দুটোই বেড়ে যায়। তিন দালালের সঙ্গে দরদাম করে মাসুমা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যান ভাড়া নিলাম পনেরো হাজার টাকায়।

    আধা ঘন্টার মধ্যে ডেডবডি তোলা হলো গাড়িতে।
    যাত্রা শুরুর আগে ড্রাইভার আমাকে ডেকে বললো, স্লাইডার খুলে লাশের মুখটা একবার দেখে নেন। আমার বুকের ভেতর শক্ত এক মোচড় দিয়ে উঠলো। এই লোকটির হাসি সব সময় আমার অসহ্য লেগেছে। জীবিত অবস্থায় শাহানার দেবর আমাকে নানানভাবে যন্ত্রণা দিয়ে গেছে। এখন তার মৃত চেহারা দেখার সাহস আমার নেই। আমি শাহানাকে বললাম, “তুমিই দেখে এসো”। শাহানা আমার হাত ধরে বললো, “দেখতে হবে না, ওঠো”।
    ড্রাইভারের পাশে আমি, আর শাহানা জানালার পাশে বসলো।

    ঘড়িতে সকাল সাতটা দশ।
    রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ক্রমশঃ তেঁতে ওঠা রোদ গলিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে। যাত্রাবাড়ীতে হাল্কা জ্যামে পড়লাম। ড্রাইভার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার টুপি নাই”?
    আমি মাথা নাড়লাম।
    বুক পকেট থেকে ন্যাতানো কাপড়ের টুপি বের করে আমার হাতে দিলো। আমি মাথায় পরলাম। দেখলাম, শাহানাও নিজের মাথায় ওড়না তুলে দিলো। যাত্রাবাড়ী পার হতেই শাহানা ফোঁসফোঁস কান্নায় ভেঙে পড়লো। আমি ঠিক কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি কি শাহানার মাথায় হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেবো? নাকি হাতে হাত রাখবো? কিছু বলবো নাকি চুপ থাকবো?
    কিছুই করা হলো না।

    মাওয়া ফেরি ঘাটে ড্রাইভার বললো, “আপনারা বসেন – আমি আসতেছি”।
    কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এলো। মনে হলো, চোখে মুখে পানি দিয়ে এসেছে। আমিও নামলাম, ব্লাডারে চাপ লেগেছে।
    মুখে কয়েক ঝাপ্টা পানি দিতেই খুব ফ্রেশ লাগতে শুরু করলো। ক্ষুধাও পেলো।
    ছয়টা কলা আর বড় এক প্যাকেট পাউরুটি কিনলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে শাহানাকে দিলাম, ড্রাইভারকে বললাম, “আপনিও খান”। ড্রাইভার দুইটা কলা আর দুই পিস পাউরুটি নিলো। শাহানা বললো, “আমি খাবো না”।
    বললাম, “রাখো”।
    শাহানা করুণ চোখে আমার দিকে তাকালো। তার চোখ ফোলা, চেহারায় কীসের এক ভয় যেন চেপে বসেছে।

    বাম পাশের গাড়ির সাইড মিররে নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠলাম। ময়লা জীর্ণ টুপি মাথায় অন্যরকম লাগছে আমার নিজেকে।
    খেয়াল করলাম, আশেপাশের মানুষের উৎসাহ লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানের দিকে। ছয় সাত জন জিজ্ঞেস করলো – “এইটা কই যাবে? বয়স কতো? ক্যামনে মারা গেল?”
    এসবের উত্তর আমার জানা নেই।
    খুলনার কোথায় এ লাশ যাবে শাহানাই লিখে দিয়েছে মাসুমা অ্যাম্বুলেস সার্ভিসের ক্যাশ মেমোতে।
    সেই মেমো আমার বুক পকেটে। হাত দিয়ে দেখলাম আরো একটা মোটা কাগজ – শাহানার দেবরের ডেথ সার্টিফিকেট।

    গাড়ি ফেরি থেকে নামবে। আমি আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। শাহানার হাতে কলা পাউরুটি। আমি একটা কলা ছিলে নিজের মুখে দিলাম। শাহানা পাউরুটি বাড়িয়ে দিলো, ইশারায় না করলাম।

    নিজের সঙ্গে নিজে আলাপ করছিলাম আর ভাবছিলাম – শাহানার সংসার জীবন অস্থিতিশীল, তার স্বামী ইতালীতে। দেবর অথবা প্রেমিক অথবা দ্বিতীয় স্বামী মারা গেছে আজ। শাহানা খুলনা ফিরে যাচ্ছে লাশ নিয়ে। এখানে আমি কে? আমি কেন যাচ্ছি? কোন নিয়তির টানে বুক পকেটে বইছি শাহানার দেবরের ডেথ সার্টিফিকেট?

    উত্তরহীন প্রশ্নের জটিলতায়, হঠাৎ পাওয়া ক্লান্তিতে, গাড়ির ঝাঁকুনিতে, চোখে ঘুম নেমে এলো। কতক্ষণ ঘুমালাম জানি না, কয়েকবার মনে হলো শাহানা কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। মাঝে মাঝে গিয়ার শিফটারের ধাক্কা লাগছিল আমার হাঁটুতে।

    কাঁধে শাহানার ধাক্কায় ঘুম ভাঙলো।
    পেট্রোল পাম্পে গাড়ি থেমেছে। শাহানা বললো, “আমি একটু বাথরুমে যাবো”।
    আমিও নামলাম।
    খুব সিগারেটের তেষ্টা পেলো। শাহানার বৌভাতের দিনের সেই দুপুরের কথা মনে পড়লো। মন খারাপ ছিল, ঘুমহীন শরীরে ক্লান্তি ছিল, সিগারেটে লাইটার জ্বালাতে জ্বালাতে শাহানার দেবর আমাকে বলেছিল “আপনারা ঢাকাবাসী, তিলোত্তমা নগরের নাগরিক…”।

    পেট্রোল পাম্পের ক্যাশ কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সবার উপরে আরবীতে কলেমা তৈয়ব লেখা। হাতের গামছা দিয়ে ভ্যানের গা থেকে ধুলো ঝাড়ছে ড্রাইভার। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সে। ভাবছিলাম, তার কাছে সিগারেট চাইবো। তখনি আমার চোখ গেল পাশের দেয়ালে বড় করে লাল রঙে লেখা – “ধুমপান নিষেদ”।
    শাহানা বেরিয়ে এসেছে। চোখে মুখে পানি দিয়েছে; ওড়না দিয়ে মুখ মুছছে সে। আমি বললাম, “কিছু খাও”।
    আমার অনুরোধকে অগ্রাহ্য করে শাহানা বললো, “চলো”।

    -১১-
    উপজেলা সদরের ডানে মোড় নেয়ার পর শাহানাই ড্রাইভারকে পথ দেখাচ্ছিল; “ডানে-বামে, সামনে আবার ডানে, সোজা যান, বামে দেইখেন ডোবা আছে, সাবধানে…”

    অবশেষে শাহানার শ্বশুরবাড়ি পৌঁছালাম।
    আগে থেকে খবর পেয়েছে তারা। উঠানে শামিয়ানা টাঙানো, খাঁটিয়া রাখা আছে। গাড়ি থেকে নেমেই হাউমাউ কান্নায় শাহানা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। একদল মহিলা এসে শাহানাকে পাঁজাকোলে করে ঘরে নিয়ে গেল।

    কতিপয় পুরুষ দায়িত্ব নিলো ভ্যান থেকে লাশ খাটিয়ায় রাখার।
    বাতাসে আগরবাতির গন্ধ ভেসে এলো। লাশের দু’পাশে বসা তিনজন বৃদ্ধ এবং একজন কিশোর সুর করে কোরআন তেলওয়াত করেছে। হঠাৎ হঠাৎ কান্নার সুর বাড়ছে। কেউ একজন মুর্ছা গেল বলে ডাক্তার আনতে গেল আরেকজন।

    শোক-কান্না-কোলাহলের মাঝে আমি সব শুনছি, দেখছি; কিন্তু আমি কে? আমার পরিচয় কী? আমি কেন এসেছি? আমি এখন কী করবো?
    লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানের ড্রাইভার এসে বললো, “টাকাটা দেন, চলে যাই”।
    বললাম, “আমিও যাবো – মাটি দেয়া পর্যন্ত থাকেন”।
    “ওয়েটিং চার্জ দিতে হবে ভাই”।
    আশ্বস্ত করলাম, টাকা দেবো, সমস্যা নেই।
    সে বোধ হয় খুব আস্থা পেলো না। বললো, “আপনার নম্বরটা দেন”।
    সঙ্গে সঙ্গে সে আমার নম্বরে মিসড কল দিলো।
    বললাম, “আপনার নাম বলেন – সেইভ করে রাখি”।
    “নামের দরকার নাই, নম্বরের শেষে দুইশ নয়, মনে রাখবেন”।
    তবুও নাম্বার সেইভ করলাম – ড্রাইভার এলএফভি। লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যান।

    শাহানার শ্বশুরবাড়ির সামনে বিশাল দীঘি।
    দীঘির ঘাটে বসে আছি। লাশ দেখতে আসা কেউ কেউ অজু করে যাচ্ছে। তারা নিজেদের নিয়ে কথা বলছে। আমি ভেবেছিলাম, তারা হয়তো শাহানার দেবরকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করবে; বলবে, সে খুব ভালো লোক ছিল। আমি হয়তো এই প্রথম বারের মতো শাহানার দেবর প্রসঙ্গে কিছু জনমত পাবো। অথচ টুকটাক কথা বলা মানুষগুলো কেবল জানাজার নামাজের সময় নিয়েই একে অপরকে প্রশ্ন করলো। বাদ আসর জানাজা হবে, এরপর দাফন; এ ব্যাপারে আমিও নিশ্চিত হলাম।

    কোত্থেকে আম গাছের চিকন কচি ডাল ভেঙে দাঁত মাজছে ড্রাইভার।
    আমাকে দেখে কাছে এসে বললো, “ভাই খাওয়া দাওয়া কিছু পাওয়া যাবে?”
    অন্য সময় হলে আমি রাগে ওর পাছায় লাত্থি মারতাম। বলতাম, “মরা বাড়িতে ভাত খাইতে আসছো? ফাউল।”
    বললাম না। কারণ, আমার নিজেরও খুব ক্ষুধা লেগেছে। ভাতের ক্ষুধা। তবে তার আগে সব জামা কাপড় খুলে এই পড়ন্ত বিকেলে দীঘির শীতল জলে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলে ভালো হতো।
    ড্রাইভারকে বললাম, “থাকেন, ভিতরে খবর নিয়ে দেখি”।

    বাড়ির ভেতরে যাওয়ার আগে দীঘির ঘাটে নেমে হাত-মুখ-পা ভালো করে ধুয়ে নিলাম। চুলে পানি দিতে গিয়ে পুরো মাথাটাই ধুয়ে ফেললাম। মাথায় টুপি দিলাম।

    বাড়ির ভেতরে যেতেই কে যেন আমাকে বললো, আসেন আসেন আপনি আসেন। এরপর খাটিয়ার পাশে রাখা চেয়ারে আমাকে বসিয়ে হাতে পবিত্র কোরআনুল কারীম ১৮তম পারা বইটি ধরিয়ে দিয়ে বললো, “আপনি একটু পড়েন – মাটি খোড়া কদ্দুর হলো দেখে আসি”।

    বইটির পাতা মেলে তাকিয়ে থাকি।
    আগরবাতির ধোঁয়া আমার নাকে মুখে লাগছে। এখনো একটু পরপর কেউ আসছে লাশের মুখ দেখতে, কান্নায় গুমরে উঠছে কিংবা ভেঙে পড়ছে। আমার ওদিকে তাকানোর সাহস নেই। আগরবাতির ধোঁয়ার ঝাঁঝে চোখে পানি আসছে আমার। অনেক অনেক বছর আরবী পড়িনি, তাই কালো হরফগুলো দূর্বোধ্য লাগছিল, ওগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে; একটা হরফ আরেকটা হরফের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। বই বন্ধ করে হাতে চোখ ঢেকে বসে রইলাম।

    ড্রাইভার বলেছিল ভাতের কথা। সে কথা মুখে আনার সাহস পেলাম না। আমার ক্ষুধাও যেন মরে গেল। তারপর হঠাৎ নাকে কীসের গন্ধ এলো। লাশের গন্ধ! মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। অসুস্থ বোধ করছি। মনে হচ্ছে পেটের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে আসবে। চেয়ার থেকে দ্রুত উঠে উঠানের অন্য কোণায় পেয়ারা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। পেট থেকে হড়হড় করে বমি বেরিয়ে এলো। তাকিয়ে দেখলাম, কলা হজম হয়নি।
    কালো পাঞ্জাবী পরা এক যুবক আমাকে এসে ধরে বললো – এদিকে আসেন, এদিকে।
    বাম পাশে বৈঠকখানা জাতীয় এক ঘরের বারান্দায় আমাকে বসিয়ে দিলো।
    ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে মহিলাদের কান্না আর সকরুণ সুরে কোরআন তেলোয়াতের শব্দ। শোকের শব্দময় জগতে আমার চোখ বুঁজে এলো। বারান্দার টুলে শুয়ে গেলাম। আধো ঘুম আধো জাগরণে ছিলাম।
    হঠাৎ সেই কালো পাঞ্জাবীর যুবক এসে ডাক দিলো, “দাফন হবে – উঠেন, আসেন আসেন”।

    -১২-
    কালো পাঞ্জাবীর যুবকটির ডাক শুনে সম্মোহিতের মতো করে আমি জনা পঞ্চাশেক মানুষের সঙ্গে পায়ে পায়ে চলি। শাহানার শ্বশুরবাড়ির সামনের দীঘির উত্তর পাড়ে জামে মসজিদ। মসজিদে আসরের নামাজের জামাত হলো। আমার সমস্ত বোধ এবং চিন্তা যেন তখন আমার আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। সম্বিৎ ফিরে পেলাম মসজিদে জামাতে নামাজের প্রথম রাকাতে; চারপাশের সমস্বরে আল্লাহু আকবরে সামিল হতে গিয়ে টের পেলাম – নামাজের আগে অজু করিনি। আমার সামনে-পেছনে-ডানে-বামে নামাজীর সারি, বের হওয়ার উপায় নেই। নিরুপায় হয়ে বাদবাকী নামাজের সেজদা-রুকু-মোনাজাত পর্যন্ত অন্যদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নিলাম।

    নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে এসে লম্বা লম্বা শ্বাস নিলাম।
    মাথা ঝিমঝিম করছে, ভেতরটা যেন একেবারে হাল্কা হয়ে গেছে। আমি জানি এ অনুভূতির নাম ব্ল্যাক আউট; এমন হয়েছে আমার একাধিকবার, অনেক আগে। নিজেকে নিজে বলি, একটু নিরিবিলি জায়গায় কিছুক্ষণ বসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
    দেখছি, মসজিদের পূর্ব পাশে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে স্থানীয় কবরস্থান।
    হঠাৎ সাদা চাপদাড়ির এক শক্ত সামর্থ্য মানুষ এসে আমার হাত ধরে বললেন, “আপনাকেই খুঁজছিলাম, আসেন – আপনিই আসেন”।
    হাঁটছি, আমার নিজের কোনো অনুভূতি – ইচ্ছা নেই।

    আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো খুঁড়ে রাখা কবরের কাছে। বসুন্ধরা সিটির ফুডকোর্টে শাহানা এবং তার দেবরকে দেখার মুহূর্তে যে অদৃশ্য মিউট বাটন চারপাশের সব শব্দ থামিয়ে দিয়েছিল, ঠিক সেরকম পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হলো। কেবল কে যেন চাপাস্বরে বললো, ঢাকা থেকে আসা বন্ধু।

    কবরে লাশ নামানো হচ্ছে।
    আমি মাথার দিকে ধরেছি; কেউ একজন চিৎকার করে বললো, সবাই ক্বিবলামূখী থাকেন। জীবনে প্রথমবারের মতো লাশ কবরে নামাচ্ছি, অথচ আমার কোনো ভয় নেই, সংশয় নেই। খুব বেশি আনুষ্ঠানিকতা হলো না। লাশের মাথার দিক থেকে গিট খুলে মাথাও ক্বিবলামূখী করে দেয়া হলো।
    তারপর উপরে উঠে এলাম।
    সবাই একমুঠো দু’মুঠো করে মাটি ফেলছে।
    আমি যেন এক নির্বাক চলচ্চিত্রের দর্শক, খানিকটা কুশীলবও।
    কোনো শব্দ শুনছি না।

    আমার সারা শরীর ভেঙে পড়ছে।
    মসজিদের সামনের খোলা জায়গা থেকে স্যান্ডেল খুঁজে নিলাম।
    কে যেন আমাকে পাশ থেকে বললো, “প্যান্টে ধুলা লেগে গেছে, ধুয়ে নেন”।
    পাশের নলকুপ চেপে আবার হাতমুখ ধুয়ে নিলাম।

    কবরস্থানে লোকজন কমে যাচ্ছে।
    মসজিদের ডানে এক এবড়োথেবড়ো কাঠের গুড়িতে বসে আছি। হাল্কা বাতাসটা ভালো লাগছে। শহরের চেয়ে হয়তো গ্রামে আগে আগে শীত নামে। শীত শীত ঘ্রাণ পাচ্ছি নাকে। দু’চোখ খোলা রাখতে পারছি না। তীব্র ঘুম চেপে আসছে। তবুও বসে আছি, জানি না কতোক্ষণ, সবাই চলে গেছে। চারপাশ এক শুন্যতায় ডুবে যাচ্ছে গোধূলি আলোর মতো।

    হঠাৎ দেখলাম এলএফভি ড্রাইভার হনহন করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
    রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে – “আপনারে এতক্ষণ খুঁজতেছি, এইখানে বইসা আছেন? ফোনও বন্ধ রাখছেন?”
    পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে দেখলাম, ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে।
    উঠে দাঁড়ালাম।
    ব্ল্যাক আউট কেটে গেছে; কিছুটা স্বস্তি পেলাম – ফোনের ব্যাটারির মতো দিনটাও ফুরালো।

    লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানে উঠে বসলাম।
    ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো – “কিছু খাইছেন?”
    আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম।
    একটা ঠোঙা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে বললো, “নেন ডালপুরি-পরোটা আছে খান”।
    দেখলাম, সকালে কেনা পাউরুটি কলা এখনো পড়ে আছে আমার সীটের পাশে।

    গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
    শাহানার শ্বশুরবাড়ির পাশের রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় এক নারীর বুক ফাটা কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। আমি নিশ্চিত – এ কান্না শাহানার; বিয়ের দিন বিকেলে ঠিক এ স্বরেই কেঁদেছিল সে।

    গ্রামের ধু-ধু বিস্তীর্ণ মাঠের ওপাশে লাল সূর্য ডুবে যাচ্ছে।
    ধুলো উড়িয়ে আমাদের লাশহীন ফ্রিজার ভ্যান চলছে।
    মসজিদের মাইকে ঘোষিত হচ্ছে – প্রার্থনার জন্য আসো, কল্যাণের জন্য আসো।
    হঠাৎ আমার বুকের বাম পাশে তীব্র ব্যথা শুরু হয়।
    সেখানে হাত রাখতেই টের পেলাম আমার পকেটে শাহানার দেবর মাহমুদ, মাসুদ, মাহতাব কিংবা মোজাম্মেলের ডেথ সার্টিফিকেট।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    ইদের কড়চা | বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় | সুতনু হালদার | ষষ্ঠ পাণ্ডব | আনোয়ার সাদাত শিমুল | শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় | উপল মুখোপাধ্যায় | মোঃ আব্দুল উকিল | দীপ্তেন | সোমনাথ রায় | ফরিদা | মোহাম্মদ কাজী মামুন | সুদীপ্ত গাঙ্গুলী | কৌশিক বাজারী | সুকান্ত ঘোষ | এস এস অরুন্ধতী | মণিশংকর বিশ্বাস | তনুজ | অরিত্র চ্যাটার্জি | তারেক নূরুল হাসান | স্বাতী ভট্টাচার্য | সৈয়দ কওসর জামাল | তন্ময় ভট্টাচার্য | দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় | পার্থজিৎ চন্দ | অত্রি ভট্টাচার্য | অর্ণব সাহা | চিরশ্রী দেবনাথ | শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ইমানুল হক | একক | অনিন্দিতা গোস্বামী | নিরমাল্লো | দেবনাথ সুকান্ত | বেবী সাউ | অনুরাধা কুন্ডা | দোলনচাঁপা চক্রবর্তী | সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
  • ইস্পেশাল | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ | ১১৬৩ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ঘন্টাঘর - একক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Nirmalya Bachhar | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:৪৫518934
  • বড্ড ভালো
  • | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:১৮518936
  • আরে শিমুল কতদিন বাদে! 
    ভাল লাগল গল্পটা। লেখার স্টাইলে সামান্য পরিবর্তন এসেছে মনে হয়।  
  • ষষ্ঠ পাণ্ডব | 103.220.204.68 | ২৫ এপ্রিল ২০২৩ ০০:১৯518963
  • গল্পটার প্রথমার্ধ এক রকমের অনুভূতি দিলো, আর দ্বিতীয়ার্ধ অন্য রকম। দ্বিতীয়ার্ধ পড়তে পড়তে মাহবুব লীলেনের 'বৈরাত' গল্পটির কথা মনে পড়লো, যদিও দুটো গল্পে কোনো মিল নেই। যাই হোক বহু কাল পরে শিমুলের গল্প পড়তে পেয়ে ভালো লেগেছে।
  • তারেক নূরুল হাসান | ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৩৮519184
  • গুরুচন্ডা৯-র 'ইদের কড়চা'র কল্যাণে অনেকদিন পরে আনোয়ার সাদাত শিমুলের একটা গল্প পড়া হলো। পড়তে গিয়ে তাই অনেক রকম অনুভূতির সামনে পড়লাম। 

    সাম্প্রতিক বিষয়গুলো সবসময়েই তাঁর গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে থাকে, এটাও তার ব্যতিক্রম নয়। এ গল্পেও তাই 'বাংলা' নামক সিনেমার নায়ক ফাইম-কে দেখতে পাই। ফেসবুক মেসেজে ভালবাসার বার্তা বা তার পাসওয়ার্ডের নাজুকতার প্রসঙ্গ আসে। এই গল্পে আরও যুক্ত হয়েছে কিছু মানুষের অতীত থেকে বর্তমান আর সেখান থেকে আবার অতীতে আসা যাওয়ার গল্প। শাহানাকে খুঁজতে গিয়ে তার দেবর, যার নাম মাসুদ, মাহমুদ বা মাহতাব, তাকে নিয়ে যেসব জটিলতার সামনে আমরা পড়ি, সেসবের রহস্য উদঘাটন গোয়েন্দাগিরির চেয়ে কোনো অংশে কম নয় আসলে। 

    গল্পটা এক টানা পড়ে শেষ করার পরে বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসেছিলাম। গল্পের কথক আমার বেশি পরিচিত, নাকি শাহানার দেবর, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকলাম দীর্ঘ সময়।
  • বিপ্লব রহমান | ০৬ মে ২০২৩ ০৬:১৬519467
  • অনেক দিন পর আনোয়ার সাদাতের লেখা পড়লাম। 
     
    দেড় দশকে লেখা আরও শানিত, রিপোর্টাজ স্টাইলে অনর্গল। 
     
    ব্রাভো heart
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন