এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো  কুমুদির জন্য (খ)  kumudi

  • সময়-অভিযাত্রীদের কাণ্ডকারখানা

    অস্মি দাশগুপ্ত ও শরণ্যা মজুমদার
    গপ্পো | কুমুদির জন্য (খ) | ০৬ জুন ২০২৩ | ১৩৪২ বার পঠিত
  • অস্মি ১১+, শরণ্যা ১২+ দুজনই নবপল্লী যোগেন্দ্রনাথ বালিকা বিদ্যামন্দিরের ছাত্রী। এই লেখা শুরু হয়েছিল ১৮.০৬.২০২২-এ ক্লাস সিক্স-এ পড়াকালীন, স্কুলছুটির দিনগুলোতে, ফোন-কথোপকথন ও ডিকটেশনের মাধ্যমে। সে কথোপকথন দুই বাড়ির গার্জিয়ানদের শোনা নিষেধ ছিল। চরম গোপন এই রচনা শেষ হল ১৫.০১.২০২৩-এ ক্লাস সেভেন-এ উঠে। দুটি ছোটো বাঁধানো নোটবুক দেখে টাইপিং-এ কিছু বাড়তি সময় গেল। শরণ্যা প্রিন্ট আউট দেখে এবং অস্মি ল্যাপটপ দেখে চূড়ান্ত সংশোধনগুলো করে দেওয়ায় অবশেষে উপন্যাসোপম বড়গল্পটি পাঠানো গেল।

    — জনৈক পিতৃদেব
    ছবি - শরণ্যা কর ভৌমিক (সপ্তম শ্রেণী)


    ১ - সূচনা

    আমি সবে বইটার মধ্যে মনোনিবেশ করেছি এমন সময় তাপ্তী এসে হাজির। বলল, — “তোর্সা, বসে বসে কী করছিস?”
    — “এই তো, বুক অব নলেজ-টা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। ও কিছু না, কী হয়েছে?”
    — “আরে একটা দারুণ ব্যাপার।”
    — “কী?”
    — “আরে ঐ ডানাগুলোর পালক ঝরে যেত না, সেটা আমি ঠিক করতে পেরেছি।”
    — “বাঃ! এ তো দারুণ ব্যাপার।”
    এইখানে বলে রাখি, তাপ্তী আমার প্রিয় বন্ধু। আমরা কয়েকজন মিলে একটা সংঘ তৈরি করেছি, যার উদ্দেশ্য পরিবেশদূষণ রোধ করা — নাম ‘প্রকৃতি সংঘ’। আমরা যে-বস্তুটি নিয়ে আলোচনা করছি সেটি আসলে যান্ত্রিক ডানা—কাপড়, পাখির পালক ইত্যাদি দিয়ে তৈরি। সেটা দিয়ে বেশ ভালোই ওড়া যায়, এমনই আশ্চর্য আবিষ্কার আমাদের। এরপর তাপ্তী বলল, — “একবার উড়বি নাকি?”
    আমি বললাম, — “না, ওড়ার শখ নেই এখন আমার। তার চেয়ে বরং কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”
    — “কোথায় যাবি? এক কাজ করা যাক, চল অতীত থেকে ঘুরে আসা যাক!”
    — “অবশ্যই যাব! কিন্তু, টাইম মেশিন ঠিক আছে তো?”
    ও বলল, — “ঠিক তো থাকার কথা, কিছুক্ষণ আগেও দেখে এলাম ঠিকই তো মনে হল।”
    আমি চমকে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম, — “এখন কি সময় ভ্রমণ করে এলি নাকি?”
    — “হ্যাঁ একটু গেছিলাম, দু-এক বছর আগে থেকে ঘুরে এলাম।”
    — “অ্যাঁ?”
    — “অ্যাঁ নয় হ্যাঁ!”
    আমি দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললাম, — “এরপর কোন্‌ সময়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে?”
    — “এমন একটা সময়ে যখন মানুষ জন্মায় নি, তুষারযুগও শুরু হয়নি।”
    — “তার মানে দাঁড়ায় ডাইনোসরের যুগে যাচ্ছি! জুরাসিক কি?”
    — “হ্যাঁ। চল, আমাদের সবাইকে, মানে প্রকৃতি সংঘের সমস্ত সদস্যদের নিয়ে অতীত ভ্রমণ করে আসা যাক।”
    — “ঠিক আছে।”

    ~~~

    ২ - প্রাথমিক অভিযানপর্ব

    “দেখ, কী সুন্দর বন!” — কৃষ্ণা বলল।
    আমি বললাম, — “ধুৎ, বন কোথায়, এ তো অরণ্য!”
    “আমি মোটেও বিশ্বাস করি না এখানে কোনো ডাইনোসর আছে বা থাকতে পারে।” — তরুণ বলল।
    ঠিক এমন সময় একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল। সেটাকে শব্দ না-বলে গর্জন বলাই ভালো। সে-নিনাদে আমাদের সবার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে সেই গগনভেদী চিৎকার শেষ হলে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তৃষা বলল, — “ও-ওটা, ক-কী ছিল?”
    অজয় ও বিজয় একসঙ্গে বলে উঠল, — “ভূ-ভূত!”
    কৃষ্ণা বলে উঠল, — “যত্ত সব বাজে কথা। ভূত বলে কিছু হয় না। তার উপর আমরা এখন প্রাগৈতিহাসিক যুগে আছি, ভূত এখন জন্মায়ওনি!”
    শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম। হাসি থামলে তাপ্তী বলল, — “চল দেখে আসি এটা কী জন্তু। আমরা আটজন আছি, দুটো দল তৈরি করে নিই। একদল টাইম মেশিন পাহারা দেবে, অন্যরা জন্তুটার খোঁজে যাবে। প্রথম দল, যেটা মেশিন পাহারা দেবে, সেটায় থাকছে—তৃষা, তোর্সা, অজয় ও বিজয়। আর অন্যটায় থাকছি—আমি, কৃষ্ণা, কমল ও তরুণ।”
    এমন সময় তৃষা বলল, — “সে তো হল কিন্তু দল দুটোর লিডার কে-কে হবে?”
    কৃষ্ণা বলল, — “তোর্সা ওদের আর তাপ্তী আমাদের লিডার হলে কেমন হয়?”
    আমি বললাম, — “আমি! কিন্তু আমি তো আমাদের যাত্রার সমস্ত অভিজ্ঞতা লিখে রাখব। আমি যদি এখানে থাকি আমি লিখব কি করে?
    তাপ্তী বলল, — “ঠিক আছে, আমাদের সঙ্গে আসতে চাইলে আয়। কৃষ্ণা ওই দলে যাক, সে-ই ওই দলের লিডার হবে।”
    তখন আমি বললাম, — “তাহলে চল।”
    তারপর আমরা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। আমরা আস্তে আস্তে গভীরতর জঙ্গলে শব্দের উৎস-সন্ধানে রওনা দিলাম। এমন সময় আমরা একটা মড়মড় শব্দ শুনলাম। তার সাথে যেন মাটি কেঁপে উঠল। হঠাৎ এই নাম-না-জানা অরণ্যের আতঙ্কে আমাদের বুক কেঁপে উঠল।
    — “এটা আবার কিসের শব্দ?” তরুণ বলল, “এমন শব্দ তো আগে শুনিনি!”
    আমরা শব্দ অনুসরণ করে পা টিপে-টিপে এগোতে থাকলাম। আবার সেই শব্দ শোনা গেল ও মাটি কেঁপে উঠল। এমন সময় গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক অদ্ভুত বিশাল প্রাণীর দেখা পাওয়া গেল। তাকে দেখে আমি আর তাপ্তী ফিসফিস করে বলে উঠলাম, — “অরণ্যের আতঙ্ক—টি-রেক্স!”
    কমল আমাদের থেকে দুই বছরের ছোট, ও আমাদের কথা শুনেই চেঁচিয়ে উঠল, — “টি-রেক্স!”
    কমলের চিৎকার শোনামাত্রই সেই হিংস্র প্রাণীটার নজর আমাদের দিকে পড়ল আর আমরা সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে ছুটতে লাগলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর তরুণ হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। পিছন থেকে ডাইনোসরটা যখন তাকে আক্রমণ করতে যাবে, তখন হঠাৎই পাশের আরেকটা ঝোপ থেকে জুরাসিকের আরেক ভয়ঙ্কর অ্যালোসরাস, টি-রেক্সকে আক্রমণ করল। দুজনের মধ্যে শুরু হল এক বীভৎস যুদ্ধ। সেই ফাঁকে তাদের মাঝখান থেকে তাপ্তী, তরুণকে এক হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলে টানতে টানতে আমাদের দিকে নিয়ে আসতে লাগল। এমন সময় দুই ডাইনোসরের যুদ্ধে একটা গোটা গাছ আমাদের চারজনের মাঝখানে এসে পড়ল। তরুণকে যখন এদিকে আনার চেষ্টা হচ্ছে তখন আমি হঠাৎ আমার পকেটে একটা দড়ি আবিষ্কার করলাম। একটা পাথর ঐ দড়ির মাথায় বেঁধে আমি তরুণদের দিকে ছুড়ে দিলাম। সেটা পড়ে যাওয়া গাছের ওদিকের একটা ডালে আটকাল। তরুণ দড়ি বেয়ে সহজেই এদিকে চলে এল। কিন্তু তাপ্তী যখন দড়ির কাছে যেতে যাবে, তখন ভয়ংকর এক চিৎকারে আমরা সবাই চমকে গেলাম। দেখা গেল যে, টি-রেক্স অ্যালোসরাসকে ঘোরতর যুদ্ধে পরাজিত করেছে। তাপ্তী ততক্ষণে দড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। ডাইনোসরটা এবার তাপ্তীর দিকে এগোতে শুরু করল। তাপ্তী গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে এক হ্যাঁচকা টানে দড়িটা ছাড়িয়ে ছুট দিল। ডাইনোসরের কবল থেকে বেরিয়ে সে দৌড়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছোল। তরুণসহ আমরা তিনজন ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে এঁকেবেঁকে ডাইনোসরের চোখের আড়ালে বহুদূর চলে গেলাম।

    ~~~

    ৩ - মহাবিপদে অভিযাত্রী

    টাইম মেশিনের কাছে পৌঁছে দেখি কৃষ্ণা এবং তৃষা দুটো পাথরের উপর মুখ গোমড়া করে বসে আছে। বাকী দুজন কোথায় সেটা ওদের জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল আমরা যাত্রা করার একটু পর থেকেই অজয়কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরা তিনজন খোঁজাখুঁজি করে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে থেকে বিজয়কেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওদের মতে বিজয় ভাইকে খুঁজতে গেছে। শুনে আমাদের মাথায় হাত। অজয় বেরোতে গেল কেন খামোকা? বিজয়ের চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। তাই নিশ্চয় সে তাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল ওরা দুজন কোথায় গেল? তাদের কি কোনো বিপদ ঘটেছে? অজয় আর বিজয়কে খুঁজতে আমাদের আবার সেই বিপদসঙ্কুল গভীর অরণ্যে ঢুকতে হবে। যে-বনের গাছগাছালির আড়ালে লুকিয়ে থাকে ডাইনোসর। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত খেলে গেল। এ-যুগে ডাইনোসরেরা জল-স্থল-আকাশ সর্বত্র বিচরণ করে। আমরা চারজন দু-দলে ভাগ হয়ে গেলাম। দুইদল দুইদিকে রওনা দেবে। তাপ্তী ও তরুণ টাইম মেশিন পাহারা দেবে। একটা দলে আমি ও কৃষ্ণা, অন্য দলে কমল ও তৃষা। আমরা গেলাম ডানদিকে, তৃষারা গেল বামদিকে। কিছুদূর যাওয়ার পরে হঠাৎ মনে পড়ল টর্চটা তো আনা হয়নি! অগত্যা আবার ফিরে চললাম গুহায়। দেখলাম তৃষারাও এসে হাজির। সেই সময় আমরা তাপ্তীকে কোথাও দেখলুম না। তরুণকে জিজ্ঞাসা করতে ও বলল, — “তাপ্তী উধাও! কোথায় গেছে কী করছে জানি না!”
    যাই হোক, তাপ্তীর অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে বৃথা বাক্যব্যয় না-করে টর্চ বগলস্থ করে মহারণ্যে প্রবেশ করলাম আমরা তিনজন। তৃষাকে তরুণের দেখাশোনা করার জন্য রেখে আসতে হয়েছে। ফলে আমাদের তিনজনকে একসাথে যেতে হবে। আমরা তিনজনে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ কী যেন ঝুপ করে আমাদের মাঝখানে এসে পড়ল। কী যেন একটা শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে গেল কৃষ্ণাকে। তাকিয়ে দেখি কৃষ্ণাকে দুই থাবায় আঁকড়ে ধরে বিরাট ডানা মেলে উড়ে চলেছে আকাশের ভয়ংকর টেরোডাকটিল! আমরা যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি এমন সময় বনের ফাঁক দিয়ে যেন তাপ্তীকে দেখলাম। সে দৌড়োতে দৌড়োতে আমাদের দিকেই আসছে। সে আমাদের কাছে আসতেই আমি তার ঝোলা থেকে এক জোড়া ডানা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বিদ্যুৎবেগে পরে নিলাম। আর তাকে একটিও প্রশ্ন করার অবকাশ না-দিয়ে আকাশ পথে রওনা দিলাম কৃষ্ণাকে উদ্ধার করার জন্য। তাপ্তীও বিদ্যুৎ বেগে আরেক জোড়া ডানা পড়ে নিয়ে আমার পিছন পিছন উড়তে থাকল। ততক্ষণে আমি কৃষ্ণার অনেকটা কাছে চলে এসেছি। তাপ্তীও প্রায় আমার নাগাল ধরে ফেলেছে। এমন সময় টেরোডাকটিলটার নজর পড়লো আমাদের উপর। পরমুহূর্তে সে কৃষ্ণাকে ছেড়ে আমার দিকে ফিরে এক গগনভেদী চিৎকার করল। সেই চিৎকারে আমার কানে তালা লেগে গেল। আমি যখন হতভম্ব হয়ে বোকার মত তার সামনে উড্ডীন তখন হঠাৎ আমার কাঁধ ধরে কে যেন আমাকে তুলে ফেলল। তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই।

    ~~~

    ৪ - বন্দী অভিযাত্রী

    কিছুক্ষণ পরে আমার জ্ঞান হলে পর দেখি আমি এখনও টেরোডাকটিলের থাবায় বন্দী হয়ে আকাশপথে উড্ডীন। এতক্ষণে আমার মাথা গরম হল। হতচ্ছাড়া উড়ুক্কু জন্তু, জানিস আমি কে? আমি হচ্ছি টাইম ট্রাভেলার শ্রীমতি তোর্ষা দাশগুপ্ত। আমার পিছনে লাগা! তোমায় আমি আচ্ছা শিক্ষা না দিয়ে ছাড়বো ভেবেছো? এমন সময় আরেকটা ডাইমোরফোডন নিঃশব্দে উড়ে এসে এটাকে আক্রমণ করল, সম্ভবত শিকারের লোভেই। দুই ডাইনোসরের লড়াইতে প্রথম টেরোডাকটিলের থাবা আলগা হয়ে গিয়ে ৪-৫ ফুট পড়তে পড়তে খেয়াল হল আরে, আমার কাঁধে এখনও ডানাজোড়া আটকানো। সঙ্গে-সঙ্গে তাল সামলে নিয়ে উড়তে থাকলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি দৈত্য দুটোকে বেশ কিছুটা পিছনে ফেলে এসেছি। দুটোতে এখনও যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এগিয়ে চললাম তাপ্তী আর কৃষ্ণার খোঁজে। কিছুক্ষণ ওড়ার পর আমি হঠাৎ পায়ে একটা টান অনুভব করলাম। আবার কোনো টেরোডাকটিল নাকি? সঙ্গে সঙ্গে নীচে তাকিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। একটা দড়ি এর মধ্যে কখন আমার পায়ে জড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। এ আবার নতুন কি বিপদ?

    ~~~

    ৫ - মুক্তি ও মিলন

    আমি ভালো করে তাকাতে বুঝতে পারলাম, এ যে আমার দড়িটাই! আসছে আবার একটা ঝোপের পিছন থেকেই। কে টানে? আমি বুঝে গেছি পালাবার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। আমি নীচে নেমে আসতেই, কে যেন ধমকে উঠল, — “কি পাগলামি করছিলিস রে, তোর্সা! প্রাণটা খোয়াচ্ছিলিস একটু হলেই।”
    মনে হল এটা যেন কৃষ্ণার গলা। একটু পরেই আমার সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে ঝোপের পিছন থেকে কৃষ্ণা বেরিয়ে এল। মুখটুখ দেখেই বুঝে গেছি খুব চটে আছে। সে বলল, — “তুই করছিলিসটা কি?”
    — “এত রেগে যাওয়ার কি মানে হয়?” আমি বললাম।
    — “এতসব কান্ড ঘটার পরও বলছিস কেন? আমাকে ধরল তো ধরল ল্যাঠা চুকে গেল, তুই উঠলি কেন মরতে?”
    আমি ততক্ষণে চটে গেছি। বললাম, — “আচ্ছা। তাহলে এই ব্যাপার, এটা তোমার কথা। আমার কথা হল প্রকৃতি সংঘের একজন বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে আমার একটা কর্তব্য হলো আরেকজনের প্রাণকে ধ্বংস হওয়ার থেকে রক্ষা করা। সেই জন্যই গেছিলাম, নইলে তো পলায়নপূর্বক প্রাণ রক্ষা করতেই পারতাম। বুঝেছ?”
    এ-কথা বলার পরই একটা দৃশ্য নজরে পড়ায় আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে আমি কৃষ্ণার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় কৃষ্ণা উল্টে পড়ে গেল। এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের ঠিক গা-ঘেঁসে তীরবেগে বেরিয়ে গেল ভয়াবহ এক টেরোডাকটিল। টেরোডাকটিলটা তার ওই প্রচন্ড গতিতে আমাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার পরে কী বুঝে ফেলে গতি কমালো ফলে একটা প্রকাণ্ড গাছে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেল। তারপর শাঁ-করে উপরের দিকে উঠে গিয়ে দিগন্তহীন নীলিমায় অদৃশ্য হল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কৃষ্ণা এতক্ষণে মুখ খুলল। দুর্দান্ত অভিযাত্রী এতক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। বলল – “ও-ওটা কি ছিল?”
    আমি অকম্পিত কণ্ঠে বললাম, — “টেরোডাকটিল। জুরাসিক যুগের উড়ন্ত সরীসৃপদের মধ্যে অন্যতম। হিংস্র তো বটেই। এরকমই এক মূর্তিমান তোকে পাকড়াও করেছিল এবং তারপর আমাকে করে। এই হচ্ছে ব্যাপার। তা, তুই কীকরে এখানে এলি এবং আমার দড়িখানা কিভাবে হস্তগত করলি? আর তাপ্তী ও কমল কোথায়? অজয়-বিজয়কে দেখেছিস কিনা বল।”
    একসঙ্গে এত প্রশ্নের ঠেলায় বেচারা কৃষ্ণা নাজেহাল হয়ে গেল আর আমতা-আমতা করতে থাকলো। দেখে আমার মায়া হল। বললাম, — “তাপ্তী, কমল, অজয় আর বিজয়ের কথা বাদ দে, তুই এখানে কী করে এলি আর দড়িটা কোথা থেকে পেলি বল।”
    এবার কৃষ্ণা বলল, — “রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছি, ক্ষমা করে দে ভাই! আমি যখন হুড়মুড় করে পড়ছি তখন হঠাৎ চিলের মতো ছোঁ মেরে তাপ্তী আমাকে ধরে ফেলল। তারপর বলল, — ‘কৃষ্ণা, আমার পকেট থেকে দড়িটা বের করে নে।’ আমি তাই করলুম আর ও বলল, — ‘আমার কাঁধের ঝোলায় একজোড়া ডানা আছে সেটা পড়ে ফেল।’ তখন আমি কী আর করব, ওটা নিয়ে পড়ে ফেললাম আর তাপ্তী আমাকে ছেড়ে কোথাও উড়ে চলে গেল।”
    তারপর ও আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলুম বিকেল হয়ে আসছে কাজেই কৃষ্ণাকে বললুম, — “বাকিটা পরে শুনব, এখন শিগগির টাইম মেশিনের কাছে যেতে হবে; বিকাল হয়ে আসছে। সন্ধ্যা নেমে গেলে ডাইনোসরের পেটে যেতে হবে।”
    কিন্তু তারপরেই আবিষ্কার করলাম আমি উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম গুলিয়ে ফেলেছি। কৃষ্ণা ততক্ষণে আমার দড়ি থেকে আমাকে মুক্তি দিয়েছে এবং সেটাকে আমার হাতেই ধরিয়ে দিয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, — “টাইম মেশিনটা কোন্‌ দিকে মনে আছে?”
    — “না তো, গন্ডগোলে সব ভুলে গেছি। অ্যাঁ! তাই তো! এবার আমরা গুহায় ফিরব কি করে? আর ওরা যদি আমাদের ছেড়ে চলে যায় আমাদের নিজস্ব সময়ে, তাহলে কি হবে?”
    আমি বললাম, — “আমাদের বন্ধুরা নিশ্চয় এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।”
    কৃষ্ণা বলল, — “কিন্তু আমরা ফিরব কী করে টাইম মেশিনের কাছে?”
    আমি বললাম, — “আমাদের টাইম মেশিনটা কোন্‌ দিকে রাখা ছিল?”
    কৃষ্ণা বলল, — “উত্তরে। কিন্তু উত্তর দিকটা কোনটা সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
    আমি বললাম, — “মার দিয়া কেল্লা। সূর্য অস্ত যায় পশ্চিমদিকে, অর্থাৎ তার উল্টোদিকই হল পূর্বদিক। পূর্বদিককে ডানদিকে রেখে যেদিকে মুখ করে দাঁড়াব, সেটাই উত্তরদিক।”
    কৃষ্ণা ঘাড়-টাড় চুলকে বলল, — “তাই তো। গন্ডগোলে মাথাতেই ছিল না!”
    ডানা চালু করে আমরা সর্বোচ্চ গতিতে উত্তরদিকে উড়তে লাগলাম। যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা অল্পসল্প ফাকা জায়গায় কে যেন নীচে এদিক-ওদিক পায়চারি করছে। নীচে দেখলাম কী যেন একটা শাঁ-করে উত্তরদিকে উড়ে গেল। কৃষ্ণা বলল, — “ওটা কী? টেরোডাকটিল নাকি? তাহলে আমি ওখানে নামতে রাজি নই! আপাতত দুই বার উড়ুক্কু পাজিগুলোর মুখদর্শন করতে হয়েছে, আর না।”
    আমি বললাম, — “না, আমার অভিজ্ঞতা তোর থেকে বেশি আর করুণও বটে। আমি একবার না-দেখে ছাড়ছি না।”
    কৃষ্ণা কিন্তু-কিন্তু ভাব করে আমার সঙ্গে নেমে এল। নীচে নেমেই আমরা হতবাক। বিজয় গোমড়া মুখে একটা পাথরের ওপর বসে আছে। আমরা একসঙ্গে বলে উঠলাম, — “বিজয়! তুই এখানে!”
    বিজয় আমাদের দেখে লাফিয়ে উঠল। বলল, — “কৃষ্ণা, তোর্সা তোরা এখানে কী করছিস।”
    আমি বললাম, — “পরে হবে। অজয় কোথায়?”
    — “সব বলছি, দয়া করে আমাকে এবার টাইম মেশিনের কাছে নিয়ে চল।”
    তারপর আমরা তাড়াতাড়ি বিজয়কে নিয়ে টাইম মেশিনের কাছে উড়ে গেলাম। পৌঁছে বিজয়কে নামিয়ে দিয়ে দেখি শ্রীমান অজয় একটা পাথরের উপর বসে মহানন্দে আমাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে। ও একটু হলেই চেঁচিয়ে উঠছিল, কিন্তু আমি ওর দিকে কটমট করে তাকাতেই চুপ করে গেল। এবার খেয়াল করলাম আমাদের টাইম মেশিনকে ঠেলে একটা বড় গুহায় ঢোকানো হয়েছে। আমি তৃষাকে জিজ্ঞেস করলাম, — “তাপ্তী আর কমল কোথায়?”
    তৃষা বলল, — “জানি না।”
    আমি বললাম, — “অ্যাঁ!”
    তৃষা বলল, — “অ্যাঁ নয় হ্যাঁ।”
    — “তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? তাপ্তী যদি ওই বিভীষিকাময় জঙ্গলে হারিয়ে যায় কি হবে বলত? কমলটাও ছেলেমানুষ, ওকে আনাটাই আমার ভুল হয়েছে।”
    — “সর্বনাশ!” আমার মতোই ভীতসঙ্কিত হয়ে উঠল কৃষ্ণা।
    পরিস্থিতি ক্রমশ বিচ্ছিরি থমথমে হয়ে উঠছে সেটা আমারও পছন্দ হচ্ছে না। তৃষা পরিস্থিতি সহজ করার জন্য বলল, — “তোদের ওই প্রথমবারের অ্যাডভেঞ্চারের কী হয়েছিল তা জানার জন্য আমি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছি।”
    সবাই কথাটায় সায় দিল। আমি বললাম, — “ঠিক আছে কিন্তু দয়া করে কেউ জোরে আওয়াজ করবি না বা চেঁচাবি না। ঠিক আছে?”
    সবাই আস্তে ‘হ্যাঁ’ বললে আমি আদ্যপান্ত আমাদের অভিজ্ঞতা পুনরাবৃত্তি করে চললাম সেই একদম প্রথম থেকে শুরু করে। যতক্ষণ আমি ফিসফিসিয়ে সেই কিম্ভুত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করছিলাম কেউ টুঁ শব্দটি করেনি আর সবার মুখটা আস্তে আস্তে হাঁ হয়ে যেতে লাগল। কৃষ্ণারও। কৃষ্ণার সাথে মিলন আর বিজয়সহ টাইম মেশিন পর্যন্ত পৌঁছোনোর কথা বলে যখন থামলাম সবার মুখে একটা রসগোল্লা ঢুকে যেতে পারে এত বড় ফাঁক তৈরি হয়েছিল। এরপর বললাম, — “এবার বল অজয়-বিজয়, কেন তোরা হঠাৎ উধাও হয়ে গেছিলি?”
    “তার আগে বল তো, আমরা কি সত্যযুগে এসে পড়েছি?” অজয় বলল।
    কৃষ্ণা বলল, — “কেন? এখানে সত্যযুগের কথা এল কোথা থেকে?”
    অজয় বলল, — “এখানে তো সবকিছু বড়ো সুন্দর তাই আর কি!”
    শুনে আমি হাঁ। কৃষ্ণা চটে অস্থির। আমি বললাম, — “আমি যা দেখে এলাম তাতে তো সব ভয়াবহ লাগছে আমার, আর তোর সব সুন্দর লাগে কি করে? আর সত্যযুগের কথা এখানে আসছে না। তোদের কীর্তিকলাপটা একটু শুনি এবার।”
    শুনে অজয় বকবক শুরু করল, — “আমি তো প্রকৃতির অপরূপ নয়ন-মনোহর দৃশ্য দেখে একটু-একটু করে এগোচ্ছি। তারপর কখন বনে ঢুকে পড়েছি খেয়াল নেই। খেয়াল হলে ভেবে দেখলাম, এমন সুন্দর-সুন্দর দৃশ্য দেখেটেখে এখানে ফিরে এসব বর্ণনা তোমাদের শোনাব, ততক্ষণে তাপ্তী-তোর্সার দলটা ফিরে আসবে। ওদের সাত জোড়া চোখ এক্কেবারে চড়কগাছ করে ছাড়বো। দিব্যি নন্দনকাননের মতো সুন্দর বনানী। কিছুক্ষণ পরে দেখি আমার দাদাও এসে হাজির। প্রথমে অবশ্য জেরা করে-করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। তারপরে সেও প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে আমার সাথে জুড়ে গেল। একবার বলতে গিয়েছিল, — ‘কৃষ্ণাদের একা রেখে এলুম….’ তারপর আবার কী-বলে… ...”
    উপযুক্ত শব্দের অভাবে শ্রীমান অজয় চুপ করল। আমি বললাম, — “প্রকৃতি পড়ুয়ার কথা বলছিস?”
    — “হ্যাঁ হ্যাঁ, পেটে আসছিল মুখে আসছিল না।” বলে আবার শুরু করল স্টিমইঞ্জিন-স্পিডে, “প্রকৃতি পড়ুয়ার মতো আমার সাথে গাছপালা ফুলফল দেখতে শুরু করল। ছিলাম এক, হয়ে গেলাম দুই। এমন সময় একটা আর্ত চিৎকারে আমাদের মনঃসংযোগ ভেঙে খানখান হয়ে গেল। তারপরেই দেখি কী-যেন একটা বড়োসড়ো পাখি আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। সেটার পায়ের নখের থেকে কী যেন একটা ঝুলছিল। এমন সময় আমি একটা ঝোপের পাশে একটা বড়োসড়ো গোলগাল ডিম মতো কী-একটা দেখলাম। এমন সময় কে যেন একটা হ্যাঁচকা টানে আমাদের ঝোপের কাছ থেকে সরিয়ে আনল। তাকিয়ে দেখলাম তাপ্তী। ও বলল, — ‘তোরা এখানে বসে-বসে কি করছিস? সবাই তোদের খুঁজছে।’ — ‘তাপ্তী! কে, কী, কেন, কবে, কোথায়, কিভাবে?’ তাপ্তী একটু হেসে বলল, — ‘কে সেটা তো দেখতেই পাচ্ছিস। তোরা দুটোই বেশ ফাজিল হয়েছিস।’ আমার দাদা বলল, — ‘অজয় প্লিজ আমাকে একটা চিমটি কাট তো, স্বপ্ন দেখছি মনে হচ্ছে।’ তাপ্তী ধমকে উঠলো, — ‘খুব হয়েছে। তোদের দুটোর জন্য আমাদের আর পাঁচটা অভিযাত্রী নাকানিচোবানি খাচ্ছে, আর তোরা এখানে বসে-বসে উল্টোপাল্টা বকবক করছিস!’ আমরা দুজনে বললাম, — ‘অ্যাঁক!’ তাপ্তী বলল, — ‘তা নয় তো কি? দেখে এলাম কৃষ্ণা আর তোর্সা দুটোই টেরোডাকটিলের খপ্পরে পড়েছে। ওদের বাঁচাতে গিয়েই তো আমার নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেল। এবার তোদের আমি…’ বাক্যটা অসমাপ্ত রেখেই ও আমাকে ধরে টাইম মেশিনের কাছে নিয়ে এলো, এরপরের ব্যাপারস্যাপার দাদা-ই জানে।”
    এবার বিজয় শুরু করলো, — “অজয় তো চলে গেল। তাপ্তী ভালোমতোই বুঝেছিল অজয় না-গেলে আমি যাব না।”
    আমি তেড়েফুঁড়ে উঠলুম, — “তাপ্তী এসে অজয়কে দিয়ে গেল আর তোরা কেউ দেখতে পেলি না?”
    তরুণ বলল, — “অজয় যখন এল, তখন আমি আর তৃষা গুহার মধ্যে ছিলাম। অজয়ের ডাক শুনে আমরা যখন বাইরে আসি ওর সঙ্গে তাপ্তীকে দেখিনি।”
    আমি বললাম, — “ও! তার মানে তাপ্তী তোকে টাইম মেশিনের একটু দূরে ছেড়েছিল। তাই তো?”
    অজয় বলল, — “না। তাপ্তী আমাকে গুহার একদম সামনে পৌঁছে দিয়েছিল, কিন্তু এরা গুহা থেকে বেরোবার আগেই তাপ্তী উড়ে চলে গিয়েছিল।”
    আমি বললুম, — “তাপ্তী কোন্‌ দিকে উড়ে গেছে তুই কি দেখেছিলি?”
    অজয় বলল, — “আমাকে যে-দিক থেকে নিয়ে এলো সেদিকেই চলে গেল দেখলাম।”
    এমনসময় একটা চিল চিৎকারে অজয়ের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সবাই যে যার জায়গায় স্তম্ভিত। একটুপরে আমাদের সকলের সম্বিৎ ফিরে আসার পর আমি আর কৃষ্ণা লাফিয়ে উঠলাম। অজয়-তরুণ-তৃষা এখনও হাঁ। আমি বললাম, — “এটা টেরোডাকটিলের চিৎকার নয়। তাই না কৃষ্ণা?”
    কৃষ্ণা বলল, — “হতে পারে। তুই কী করে বুঝলি?”
    একটু হেসে বললাম, — “আমার কানের কাছে না-চ্যাঁচালে কি আমাকে ধরতে পারত? হাডুডু কাকে বলে শিখিয়ে ছাড়তাম ওটাকে। এটা অন্য কিছু।”
    “তাহলে বাইরে গিয়ে দেখা যাক” — তৃষা বলল।
    আমরা সবাই একসাথে গুহার বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকাতে যা-দেখলাম তাতে আমাদের সবার চক্ষু চড়কগাছ। অসীম আকাশে প্রকাণ্ড ডানা মেলে উড়ে চলেছে এক ডাইমোরফোডন। আর যা-দেখলাম তাতে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। সেই প্রকাণ্ড উড়ুক্কু বিভীষিকার থাবার থেকে ঝুলছে আমাদের প্রিয় কমল। তৃষা আর সহ্য করতে পারল না। সে কৃষ্ণার হাত থেকে তার ডানা জোড়া হস্তগত করে পরে ফেলে উড়তে শুরু করল। বেগতিক দেখে আমিও ডানা ঝেড়ে উড়তে শুরু করেছি। কৃষ্ণার কিছু করার নেই, ও ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা দুজনে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ডাইমোরফোডনটার খুব কাছে চলে এসেছি। তৃষাকে বললাম, — “কমলকে ছাড়া।”
    — “কীভাবে?”
    আমি জলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। ওকে বললাম, — “ডাইমোরফোডনটার পেটে সুড়সুড়ি দে। বাকিটা আমি দেখছি।”
    তৃষা আমার কথা মতো চুপিচুপি মুর্ছিত কমলের শরীরের পাশ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। বিরক্ত হয়ে ডাইমোরফোডনটা মুখ ফেরাতেই তৃষা লুকিয়ে পড়ল আর সঙ্গে-সঙ্গে ডাইমোরফোডনটার অন্যমনস্কতার সুযোগে তার দিকে একটা গুড়ুল ছুটে গেল আমার হাতের গুলতি থেকে এবং অব্যর্থ লক্ষে গিয়ে লাগল জুরাসিকের প্রকাণ্ড উড়ুক্কু বিভীষিকার মাথায়। সে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে মহারোষে আমার দিকে ফিরতেই তৃষা আবার সুড়সুড়ি দিয়েছে। আর মুখ ফেরাতেই আমি আরেকটা গুড়ুল তাক করে ছেড়েছি। আবার সে আমার দিকে ফিরতে তার নখ একটু আলগা হওয়ায় কমল প্রবল গতিতে নীচে পড়তে আরম্ভ করল। আমি গুলতি পকেটে পুরে নীচের দিকে নামতে থাকলাম। কমলকে ধরে কৃষ্ণার হাতে তুলে দিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখি, তৃষা বেচারা বেকায়দায় পড়েছে। ডাইমোরফোডনটা খুব সন্দেহজনকভাবে আবার তৃষার দিকে এগোচ্ছে। তৃষা ডানাটা নিয়ে খুব বিপদে পড়েছে। তার পালকে-পালকে জট পাকিয়ে গেছে। উড়ুক্কু সরীসৃপটার ভাবগতিক আমার সুবিধার ঠেকল না। হঠাৎ মনে হল, আরে! যদি একটু-একটু করে তৃষার দিকে এগিয়ে খুব কাছে চলে গিয়ে হঠাৎ তাড়া করে তাহলে তৃষা কী করবে? দুজনের মধ্যে ব্যবধান কমে আসছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার ডানাজোড়া আমার কাঁধে নেই। পরমুহূর্তে দেখি শ্রীমতি কৃষ্ণা আমার ডানাজোড়াসহ উড়ছে। আমার সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে কৃষ্ণা তীরবেগে মুহূর্তের মধ্যে তৃষার পিছনে গিয়ে পৌঁছোল। তারপর তাকে নিয়ে নীচে নামতে থাকল। ডাইমোরফোডনটাও পিছু নেওয়ার তোড়জোড় করতেই আমি পকেট থেকে গুলতি বার করলাম। সর্বনাশ! গুড়ুল শেষ! গুড়ুল কোথায় পাই এখন…? হঠাৎ দেখি মাটিতে অনেক পাথরের ঢেলা পরে আছে। ঝটপট একটাকে তুলে গুলতি বাগিয়ে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। তাড়া করলে তবেই মারব। দেখি হতচ্ছাড়াটা পিছু নিচ্ছে! খট্টাস শব্দে আমার গুলতি থেকে জুরাসিকের পাথরের ঢেলা গিয়ে লাগল সেটার মাথায়। চ্যাঁ চ্যাঁ করে বিকট চিৎকার করে উঠল সেটা। তারপর গোধূলির ম্লান আলোয় দেখলাম সে দ্রুত দক্ষিণ দিকে উড়ে গেল।

    ~~~

    ৬ - রাত্রিপর্ব

    ডাইমোরফোডনটাকে তাড়িয়ে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে গুলতিটা পকেটে ঢোকালাম। এবার কৃষ্ণা এবং তৃষার দিকে নজর দেওয়া উচিত। ওদের দিকে তাকিয়ে দেখি ওরা দুজনেই উবু হয়ে বসে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। বললাম, — “সবাই ঠিক আছিস? ব্যথাট্যাথা, খোঁচা-গুঁতো কারো লেগেছে? লেগে থাকলে বল। মেশিনের ভেতর ফার্স্ট এইড বক্স রয়েছে, মলম লাগিয়ে দেবো। লাগেনি তো কারোর? তাহলে ঠিক আছে।”
    কৃষ্ণা বলল, — “আমরা তো ঠিক আছি কমলটার যে কী হয়েছে সেটাই বুঝতে পারছি না।”
    “আমি ওকে দেখছি” — বলে কমলের দিকে এগিয়ে গেলাম। সে সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন। কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না। ওর চোখে-মুখে একটু জলের ছিটে না-দিলে কিছু বোঝা যাবে না।
    আমি নিচু গলায় ডাকলাম, — “তরুণ! টাইম মেশিনের মধ্যে দেখ তো, একটু জল দরকার এখন।”
    তরুণ জলের বোতলটা এগিয়ে দিল। আমি কমলের চোখে-মুখে জলের ছিটে দেওয়ার মিনিটখানেক পর ও চোখ খুলল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর বলল, — “আমি স্বপ্ন দেখছি। আর কিছু হতে পারে না।”
    বলে আবার চোখ বন্ধ করতেই কৃষ্ণা ধমকে উঠল, — “ঢের হয়েছে। এবার ওঠ, জাগ, হাত-পা তো প্রচুর ছড়েছে দেখছি। আয় একটু মলম লাগাই।”
    কমল আবার চোখ খুলল তারপর বলল, — “তাপ্তী কোথায়?”
    — “সেটা তো তুই বলবি। তাপ্তী কোথায়?”
    তরুণ বলল, — “সত্যি বলছিস এটা স্বপ্ন নয়?”
    আমি বললাম, — “না স্বপ্ন নয়। তাপ্তী কোথায়?”
    কৃষ্ণা আর তৃষা কমলের ছড়ে যাওয়ার জায়গাতে মলম লাগাতে শুরু করল। কমল আস্তে আস্তে ওর নিদারুণ অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বলতে শুরু করল, — “তুই তো কৃষ্ণাকে উদ্ধার করতে চলে গেলি। তাপ্তীও উড়তে শুরু করল। আমি চুপ করে ঠায় দু-চার মিনিট দাঁড়িয়ে ভাবলাম, এখানে ফিরে আসি। কিছুদূর অগ্রসরও হয়েছিলাম। হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। তাই সেটা কী দেখতে আবার উল্টোদিকে রওনা হয়েছিলাম। তারপরে দেখি একটা ঘাসজমি।”
    কৃষ্ণা প্রায় ভেংচে উঠল, — “যেখানে তুই দেখলি একপাল ডাইমোরফোডন চড়ে বেড়াচ্ছে, আর তার মধ্যে একটা তোকে ধরে নিয়ে এসেছে। তাইতো? যত্তসব!”
    কমল রেগে গেল। বলল, — “বেশ তো! তোর যদি মনে হয় তবে তুই ভেবেই বসে থাক। আমি তো বলছি, নাকি?”
    আমি বললাম, — “কৃষ্ণা, শুধু-শুধু গজগজ করছিস কেন? ও তো এখনও কথা শেষ করেনি।”
    কৃষ্ণার মুখটা থমথমে করুণ হয়ে গেল। বলল, — “আমার সাংঘাতিক খিদে পেয়েছে।”
    এবার আমাদের অবাক হওয়ার পালা। তরুণ বলল, — “এত কাণ্ডের পরও তোর খিদে পায়?”
    আমি বললাম, — “খিদে পেয়েছে তাতে হয়েছেটা কি? গল্পটা শোন, আর কৃষ্ণা তুই অপেক্ষা কর। টাইম মেশিনের ভেতরে সবার সিটের তলায় শুকনো খাবার ও জল রেখেছিলাম, আমি নিয়ে আসছি। ততক্ষণ সবুর কর লক্ষ্মীটি।”
    বলে কাউকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে একলাফে গুহার ভেতরে এবং তার পরবর্তী লাফে কৃষ্ণার সিটের তলার ড্রয়ার টেনে বের করে তার থেকে টিফিন বক্স ও ফ্লাক্স বের করে তৃতীয় লাফে টাইম মেশিনের বাইরে এবং চতুর্থ অর্থাৎ শেষ লাফে গুহার বাইরে এবং কৃষ্ণার হাতে ওই দুটো বস্তু ধরিয়ে দিয়ে একটা পাথরের ওপরে ধপ করে বসে পড়লাম। বললাম, — “কী রে ঘাসজমিতে কি দেখলি বলবি না?”
    কৃষ্ণা টিফিন বক্সের ঢাকনা খুলে খেতে শুরু করে দিয়েছে। কমল এবার বলতে শুরু করল, — “তো, কী বলছিলাম বলতো? কথার মাঝখানে তাল কেটে গেলে সব গুলিয়ে গ হয়ে যায়। এই তোর্সা, কৃষ্ণা, কতদূর বলেছিলাম বল।”
    তৃষা বললো, — “তুই বললি ঘাসজমিতে কিছু একটা হয়েছে।”
    কমল বলতে শুরু করল, — “হ্যাঁ যা বলছিলাম, তো সেই ঘাস ছবিতে আমি কি দেখলাম জানিস, দেখলাম একপাল জন্তু — তারা কি অবশ্য আমি জানিনা — চড়ে বেড়াচ্ছিল সেখানে আর সেগুলোর পিঠে একসার পাহাড়ের মত দেখতে কাঁটা! কী ওগুলো বলতে পারিস?”
    আমি বুঝতে পারছিলাম উত্তেজনায় আমার মুখ আস্তে আস্তে হাঁ হয়ে যাচ্ছে আর হাত-পা যেন ধীরে-ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে। বললাম, — “বানিয়ে বানিয়ে বলছিস নাকি?”
    — “বানিয়ে বলবো কেন শুধু শুধু?”
    আমি আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম, — “ওরে, তাহলে হিসেব মতো কি দাঁড়ায় বলতো?”
    — “কী?”
    — “তুই এক পাল স্টেগোসরাস দেখেছিস রে?”
    — “অ্যাঁ”!
    — “তবে আর বলছি কি! প্রাগৈতিহাসিক যুগের তৃণভোজী বিশালাকার প্রাণী!” কিন্তু তারপরেই প্রবল উচ্ছ্বাসকে ধামাচাপা দিয়ে আবার বিরক্তিকর গাম্ভীর্য নিয়ে বসলাম, “তো, তারপর কি হলো?”
    আমার হঠাৎ করে এমন নিরস হয়ে যাওয়া দেখে সবাই অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাতে থাকল। ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি তাড়া দিলাম, — “তারপর কি হল? তাড়াতাড়ি! সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এবার মশা থেকে ডাইনোসর সবাই আসবে। গুহার ভেতরে বসা যাক, চল! কিন্তু…কিন্তু আলো? আলোর কি হবে? আগুন জ্বালাতে হবে তো!”
    তৃষা বলল, — “টর্চ আছে তো, আগুনের কী দরকার?”
    আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম, — “টর্চ! সেগুলোর ব্যাটারি তো প্রায় শেষ! আর বাড়তি ব্যাটারি তো তাপ্তীর কাছে থাকার কথা। সে-ই তো নিরুদ্দেশ!”
    কৃষ্ণা হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠে গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমিও ওর পিছু নিলাম। সে টাইম মেশিনের মধ্যে ঢুকে পড়ে তাপ্তীর সিটের তলার ড্রয়ার টেনে বার করেই “ইউরেকা” বলে লাফিয়ে উঠল। আমিও উঁকি মেরে দেখি, অল্প কিছু দরকারি জিনিসপত্রের একপাশে, কাগজের একটা খামের গায়ে লেখা আছে ‘ব্যাটারি’। ফলে, নিরুদ্বেগ হয়ে দরকার মতো ব্যাটারি ভরে জ্বালানোর পরই টর্চগুলোর আলোয় গুহার ভেতরটা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল।
    মনে-মনে ভারি হাসি পেল। কোথায় এই প্রাগৈতিহাসিক জুরাসিক কোথায় ষড়বিংশ শতাব্দী! এখন কোথায় সভ্য মানুষ? আদিমতম মানব গোষ্ঠীর জন্মের বহু আগে যে কুখ্যাত বিখ্যাত সব বিশাল বিকটাকার কুমির গিরগিটিরা রাজত্ব করেছে কয়েক কোটি বছর, সেইখানে কয়েকটি দুঃসাহসী অভিযাত্রী গুহার মধ্যে টাইম মেশিন ঢুকিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে হাসছে। ভাবতে ভাবতেই আবার সিরিয়াস হয়ে পড়লুম। বাকিদের ভিতরে আসতে ডেকে আবার সাবধান করে দিলাম, — “কেউ জোরে কথা বলবি না কিন্তু।”
    কমল ঢুকে আবার একটা পাথরের উপর বসে পড়ল। একে তো সব থেকে ছোট ও, তার ওপরে ডাইমোরফোডনের থাবার দুলুনি খেতে হয়েছে। তাই ও একটু দুর্বল। আমরও অবশ্য তাই অবস্থা হওয়ার কথা কিন্তু অজয় বিজয় বা তৃষা কিংবা কৃষ্ণাকে বা কমলকে কাউকেই গোটা দলের ভার নিতে বলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে পারি না, কারণ আমিই এখন এখানে সবচেয়ে সিনিয়ার। তাপ্তী থাকলে অবশ্য অন্য ব্যাপার…কিন্তু আমি এসব কী ভাবছি? টেরোডাকটিলের হাতে পড়ে থুড়ি থাবায় পড়ে আমার কি এই বয়সে মতিভ্রম হচ্ছে নাকি? যতসব!
    কমল আমার দিকে তাকিয়ে যথারীতি পাথরের উপর বসে আছে প্রায় সর্বাঙ্গে কাটাছেঁড়াতে মলম লাগানো। ওকে এবার জিজ্ঞাস করলাম, — “কীরে, স্টেগোসরাসরা কি তাড়া করেছিল নাকি?”
    — “কি বলছ? স্টেগোসরাসরা তাড়াও করবে নাকি?” অজয় বলল।
    — “পিঠে কাঁটা থাকলে তুইও তাড়া করতিস।” তরুণের এক ধমকেই অজয় চুপ।
    — “তারপর? কমল, কী হল? তাপ্তী কোথায়?” আমি তাড়া দিলাম।
    — “ঐ তো আবার তাল কেটে গেল। কোথায় ছিলাম?”
    কৃষ্ণার খাওয়া শেষ। ও বলল, — “তুই স্টেগোসরাসের একটা দল দেখলি, তারপর?”
    আমাদের কৃষ্ণা আবার বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝার্ত বন্যাময়ী তেজস্বী স্রোতস্বিনী থেকে শান্ত তটিনী কৃষ্ণাতে পরিণত হয়েছে।
    — “ও, হ্যাঁ-তো, সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও ছিলাম। কি জানিস...খুব ভালো লাগছিল…কী আর বলব, মানে…”
    আমি বললাম, — “কমল তারপর কি হল? ওই স্টেগোসরাস দেখা পর্যন্তই থমকে আছিস। তারপর কী হলো সেটাই বোঝা গেল না। আমি চুপ করছি তুই বল।”
    — “ওই তো, তারপর আমি যেই-না ওদের দিকে এগোবো, হঠাৎ শোঁ-শোঁ শব্দ শুনতে পেলাম। পরমুহূর্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। দেখলাম যে, একটা বিশাল বড় পাখি, প্রবল গতিতে আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমি তখন কোনোক্রমে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে একলাফে কিছুটা দূরে সরে গেলাম। পাখিটা হঠাৎ পাক খেয়ে বেঁকে আমার দিকে আসতে থাকলো আর আমি ভয় পেয়ে দৌড়োতে থাকলাম। তার কুতকুতে চোখে ছিল আমার ওপর লোলুপ দৃষ্টি। যেন, আমাকে পেলে ছিঁড়ে খাবে। হঠাৎ চোখের উপর অমাবস্যার অন্ধকার ছেয়ে গেল, আর আমার চেতনা লুপ্ত হয়ে যেতে থাকল। মনে হল, কেউ যেন আমাকে এক টানে শূন্যে নিয়ে যেতে থাকল।”
    — “ব্যাস ব্যাস। আর বলতে হবে না, আমি বুঝে গেছি। ওই ডাইমোরফোডনটা তোকে শূন্যে তুলে নিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে”, কৃষ্ণা বলল, “কাউকে পথে দেখিসনি?”
    — “দেখব কি করে? জ্ঞান ছিল না তো!” কমল যেন রেগে গেল।
    আমি বললাম, — “আরে, এত চটবার কি আছে? ঢের হয়েছে থাম দুটো!”
    ওরা চুপচাপ বসে পড়ল।
    — “সে তো ঠিক আছে, কিন্তু আমার যে খিদে পেয়েছে!” অজয় বলল।
    আমি বললাম, — “তোরও খিদে পেয়েছে? আচ্ছা, একটু দাড়াও বৎস!”
    বলে আমি অজয়ের টিফিন বক্সটা ওকে দিয়ে আর আমার টিফিন বক্সটা হস্তগত করে বললাম, — “ওরে আমারও তো খিদে পেয়ে গেল। সবার সিটের তলায় নিজের নিজের টিফিন বক্স আছে। যার খিদে পাবে সে খেয়ে নেবে। তাপ্তীটা যে কোথায় গেল, ওরও তো খিদে পাবার কথা।”
    অমনি সবাই যে-যার টিফিন বক্স বের করে খেতে শুরু করল। আ-হা-হা-হা সে কী স্বর্গীয় দৃশ্য! খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে আমরা আলোচনায় বসলাম। প্রথমেই এই গুহার একটা নাম দেওয়া উচিত। নচেৎ কেবল টাইম মেশিনের গুহা বলে বারংবার উল্লেখ করা মুশকিল। ঠিক করা হল, গুহাটার নাম রাখব — অষ্টরথী। গুহার নাম রাখার পরে আমরা তাপ্তীকে খোঁজার ব্যাপারে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে গভীর আগ্রহের সাথে চিন্তাভাবনা শুরু করলাম ফিসফিসিয়ে (দীর্ঘ ক্লান্তিকর আলোচনা সভার উক্তি আর তুলে দিতে পারছি না)। ঠিক হল ঢের হয়েছে একদিনের মতো। রাতে আর অ্যাডভেঞ্চার নয়, কাল সকালে হবেখনে। এর কিছুক্ষণ পরে সবাই শুয়ে পড়লে আমি চুপচাপ বেরোতে যাব এমন সময় শুনতে পেলাম খসখস শব্দ। কী ওটা? ডাইনোসর? ঝটপট শুয়ে পড়লাম। গুহায় পিনড্রপ সাইলেন্স। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার খাতাটা। বেরিয়ে অগ্রসর হতে যাব, আবার সেই শব্দ। কী আপদ! কে হতে পারে? গুহার সবাই দিব্যি ঘুমাচ্ছে দেখে এসেছি, লুকিয়ে পড়লাম। একটু পরেই, গুহা থেকে বেরিয়ে এলো আদি এবং অকৃত্রিম তৃ…তৃষা! ও বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে জঙ্গলের দিকে অগ্রসর হতেই, আমি লাফ দিয়ে ওর একদম পাশে। চমকে উঠেছিল, কিন্তু চ্যাঁচালো না। বলল, — “তোর্সা কি করছিস এখানে?”
    — “সেটা তো আমি জিজ্ঞেস করছি!” আমি বললাম।
    — “ইয়ে, আসলে, আমি মানে…তাপ্তীকে খুঁজতে যাচ্ছি…।” ওর হাতে ওর ছোট্ট ব্যক্তিগত টর্চটা।
    — “অ্যাঁ! বলিস কীরে? আমিও তো সেইজন্যই…”
    — “আচ্ছা বুঝলাম। চল না, একসাথে যাই? হাতে ওটা কী? ও! তোর বিখ্যাত খাতা? বেশ, কিন্তু চিঠি লিখবি না?”
    — “কিসের চিঠি?”
    — “বা-রে, ওরা যদি আমাদের খুঁজতে আসে, তখন ওরাও তো হারিয়ে যাবে, তখন বিপদ হবে।”
    — “তা তুই ঠিকই বলেছিস।”
    একটুকরো কাগজে ঝটপট লিখে ফেললাম, — “বন্ধুগণ, তাপ্তীকে খুঁজতে আমি আর তৃষা চললাম। একজোড়া ডানা নিলাম। আশা করি কালই তাপ্তীসমেত আমরা ফিরে আসতে পারব। আর আমাদের খুঁজতে এসে অনর্থক গন্ডোগোল বাঁধাস না। ইতি, তোর্সা।”
    কাগজটা রেখে আমি আর তৃষা, একজোড়া ডানা হস্তগত করে রওয়ানা দিলাম বিজয়কে যেখান থেকে ধরে এনেছিলাম সেদিকে, হেড কোয়ার্টার ‘অষ্টরথী’ থেকে কতকটা দক্ষিণদিকে।
    আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তৃষা ও তরুণ গুহার ভেতরে থাকায়, তাপ্তীকে দেখতে পায়নি, সেই ফাঁকে সে অজয়কে নামিয়ে বিজয়কে আনতে গেছিল আকাশপথে। মাঝপথে ডানায় কোনও যান্ত্রিক গোলমাল হওয়ায় বা উড়ুক্কু শয়তানগুলোর আক্রমণে, যাইহোক, কোনও অজ্ঞাত কারণে তাপ্তী পড়ে যায়। এরপরে কী হতে পারে, তারও একটা কিম্ভূত কিন্তু বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা (বা আমার কল্পনা) আমার মানসপটে উদিত হয়েছে, এবং তা হল, হয় তাপ্তী জখম হয়েছে অথবা, হিংস্র জন্তুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
    এসব কথা তৃষাকে বলেছি। ও বলল, — “হতে পারে…কিছু বলা যায় না।”
    এসব কথা হয়েছিল অতি ফিসফিসিয়ে, যাতে জুরাসিকের হিংস্র শ্বাপদের কানে, আমাদের কথা না যায়। এরপর আমরা ধীরে ধীরে চন্দ্রকরোজ্জ্বল রজনীতে গহীন কান্তারে প্রবেশ করলাম।

    ~~~

    ৭ - চন্দ্রজ্যোতিতে নৈশ অভিযান

    বনের মধ্যে ঢোকার পর খেয়াল হল যে, কম্পাসটাই আনিনি। তাপ্তীর জন্য ভয়ে একেই আমাদের বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, তার ওপরে আবার এই! সে কোনো জুরাসিকের শ্বদন্তযুক্ত শ্বাপদের হাতে থুড়ি থাবায় পড়ে থাকে তাহলে তার যে কী হবে, তা ভাবতেই শিউরে উঠছি আমরা, শিহরিত হচ্ছে আমাদের সমস্ত লোমকূপ।
    এমন সময় আমাদের একটু দূরের একটা ঝোপ নড়ে উঠল। ওটা কী হতে পারে? এরপর আমরা একটু কাছে যেতেই হঠাৎ যে বেরিয়ে এল, তাকে দেখে আমরা একটু হলেই চেঁচিয়ে উঠতাম। কিন্তু সে আমাদের জাপটে ধরে বলল, — “ওরে থাম থাম...ও কী! চ্যাঁচাস না...টি-রেক্স! একটা-দুটো আশেপাশেই আছে। এসে ঘ্যাঁক করে...” ওর কথা শেষ না-হতেই, আমরা ওকে জাপটে ধরলাম। শেষমেশ তাপ্তীই প্রথম কথা বলল, — “ওরে, অনেক তো হল, এবার এখান থেকে কেটে পড়ি চল। আরে আরে, আমায় ফেলে চলে যাচ্ছিস নাকি? আমার পায়ে খুব জোর লেগেছে। ছুটতে পারবনা।”
    বাস্তবিক, তাপ্তী প্রথম থেকেই খোঁড়াচ্ছিল, উত্তেজনায় খেয়ালই করা হয়নি। আমি বললাম, — “এ তো আচ্ছা মুশকিল, তোকে ‘অষ্টরথী’-তে নিয়ে যাব কী করে?”
    তাপ্তী গুহার নামটা জানত না। সে বেশ চমকে গেল। “অষ্টরথী” আবার কী? অষ্টধাতুর তৈরী আংটি এমনকি মূর্তির কথা অবধি শুনেছি, ‘অষ্টরথী’ তো কোনোদিন শুনিনি! জিনিসটা কী?”
    তৃষা বলল, — “ওটা গুহার নাম। আর পরে সব বলব, এখন কী করে ফেরত যাওয়া যায়, বল দেখি!”
    এমন সময় আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বললাম, — “চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে পারি। এভাবে ঝুলতে আপত্তি আছে?”
    তাপ্তী হেসে ফেলল, — “যারা প্রাণের মায়া ছেড়ে জুরাসিক যুগে বেড়াতে আসে, তাদের যদি একটু চ্যাংদোলা হতে আপত্তি থাকে, তাহলে তাদের বাড়িতে বসে থাকা উচিত। আলবাৎ ঝুলব। এতে জিজ্ঞেস করার কী আছে?”
    আমি বললাম, — “ঝুলবি, সে তো বোঝাই যাচ্ছে, ডানাটা ঠিক থাকলেই হয়।”
    তাপ্তী বলল, — “বলিনি বুঝি? ডানাটা তো গেছে!”
    তাপ্তী আরোও কিছু বলতে গেলে, আমরা ওকে থমিয়ে দিয়ে ডানাটা নিয়ে পড়লাম। একটু পরে ও নিজেও যোগ দিল। এমন সময় হঠাৎ গহীন কান্তারের মধ্যদেশ থেকে একটা কানে-তালা লাগানো হুঙ্কার ভেসে এল। ঝোপঝাড়ের অন্তরাল ভেদ করে এক বিশালাকার প্রাণী বেরিয়ে এল। দেখলাম, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে জুরাসিকের বিশালাকার স্টেগোসরাস। তৃষা একটু হলেই হাত-পা সামলে দৌড় দিতে যাচ্ছিল, তাপ্তী খপাৎ করে তাকে ধরে ফেলল। তৃষার ভয়ে দাঁতকপাটি লেগে গেছিল। আমি বললাম, — “এত ভয় পাচ্ছিস কেন? এটা একটা তৃণভোজী। তবে তফাতে থাকাই ভালো, নইলে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবি।”
    শুনে তৃষার ভয় কেটে গেল, আর আমরা সবাই বেশ একটু হেসে নিলাম। ও বলল, — “তাপ্তী বল তো, তোর টি-রেক্সমশাই কই গেলেন? তাঁর টিকিটি অব্দি দেখতে পাচ্ছিনা। তুই কী ঘাস-সরাস না কী, ওই ওটাকে টি-রেক্স ভাবলি না কি? খিক খিক!”
    ঠিক তখনই বিকট চিৎকারে আকাশ-পাতাল বিদীর্ণ করে আমাদের সামনে আবির্ভূত হল — জুরাসিকের সম্রাট টির‍্যানোসরেস রেক্স! এবার তৃষা করল কি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকল, — “আমাকে ভয় দেখানোর মতলব? এটা আলবাত নিরামিশাষী! ওরে আমার মিষ্টি সোনা-রূপো, আয় আয়, তৃষাদিদিকে ভয় পাচ্ছ নাকি? আরে আরে হাঁ-করে আছিস কেন তোরা, এটা তো একটা ছানাপোনা, ভয় পাচ্ছিস কেন? আ আ ওরে আমার পুষুমিশু…”
    তাপ্তী এতক্ষণ তৃষার কান্ড দেখে রেগে তেলেবেগুনে হচ্ছিল, আর আমি অনিবার্য ভবিষ্যৎকে কল্পনা করে কাঁপছিলাম। এবার তাপ্তী বলল, — “ওরে ওটা একটা টি-রেক্স!”
    তৃষা বলল, — “হ্যাঁ হ্যাঁ জানি এটা টি-রেক্স — দাঁড়া দাঁড়া, অ্যাঁ! ওরে বাবা! সত্যিকারের টি-রেক্স! সর্বনাশ!” বলে প্রায় মূর্ছা যায় আর কি।
    তাপ্তী তাকে টেনে তুলে বলল, — “ওরে পাজি, ডানাটা পড়ে ফেল। ওটা হতভম্ভ ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই পালানো চাই।”
    আমি বললাম, — “তৃষা পালানোর অবস্থায় নেই। তুই ওর ডানাজোড়াটা পরে ফেল। ওকেই চ্যাংদোলা করে নিয়ে যেতে হবে।”
    ইতিমধ্যে তৃষা মূর্ছা গেছে। তাপ্তী ডানাটা পরে নিয়ে তৃষার হাত দু-খানা ধরেছে, আর আমি ওর পা দু-খানা যেই ধরেছি অমনি টি-রেক্সও বিকট চিৎকার করে আমাদের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আমরা আর কালক্ষেপ না করে তৃষাকে নিয়ে শূন্যপথে উড্ডীন হলাম এবং কিছু সময়ের মধ্যেই বেশ কিছুটা দূরে চলে গেলাম। দূর থেকে শোনা গেল তার ক্ষিপ্ত গর্জন। তক্ষুনি তৃষা চোখ মেলে বলল, — “গর্জনশীল মহামৃত্যু।”
    তাপ্তী বলল, — “এখন আর বিদ্যা জাহির করে লাভ নেই। ওটা তোর ওপরে সাংঘাতিক চটে গেছে। মূর্চ্ছা গেলি কেন?”
    আমি বললাম, — “শোন তৃষা, ভয় বড়ো সাংঘাতিক নয়, সবচেয়ে সাংঘাতিক ভয়ের ভয়। ঘাবড়ে যাবি না কখনও। খামোকা আত্মবিশ্বাস ভঙ্গ হয়ে ঘাবড়ে গেলে মাথা ঘুলিয়ে গিয়ে কাজটাই মাটি হয়।”
    আমি আরোও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ শুনতে পেলাম ডানার ঝটপট শব্দ। আমার কান খুব সজাগ। পিছন ফিরে দেখি, দিগন্তের কাছে কালো একটা ক্রমধাবমান বিন্দু। ওটা কী হতে পারে? ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না। তাপ্তী বলল, — “কী রে, কী হল? কী দেখছিস?”
    আমি বললাম, — “তাপ্তী সাবধান! দিগন্তের কাছাকাছি একটা কালো বিন্দু দেখতে পাচ্ছি।”
    তাপ্তী বলল, — “অ্যাঁ! সে কি? কোথায়, কোথায়?” বলে ফিরে তাকাল। তারপর বলল, “উড়ানক্ষমতাযুক্ত সরীসৃপ মনে হচ্ছে। এক কাজ করা যাক বৎসগণ, নীচে নেমে পড়ি চল।”
    তাপ্তীর কথা মতো আমরা নীচে নামতে শুরু করলাম। নীচে নামার কিছু পরেই আমরা দেখলাম, আমাদের তৈরী ডানা পড়ে কে যেন একটা আসছে। হঠাৎ মনে হল, আমাদের বানানো ডানা? তাহলে তো আমাদের দলেরই কেউ হবে! তাহলে ভয়ের কিছু নেই! একথা আমি তাপ্তীকে বলতেই তৃষা বলল, — “অ্যাঁ ! সে কি? ওরা তো তোর্সার চিঠি পেয়েছে! তবুও এল কেন?”
    তাপ্তী বলল, — “ওরে, ওরা কথা শুনবে কেন? চিঠি পেয়েও ইচ্ছা করেই এসেছে।”
    ইতিমধ্যে কৃষ্ণা নেমে এসেছে। আমরা সবাই ওকে দেখে অবাক হলাম। তৃষা আর আমি একসঙ্গে ঝাঁঝিয়ে উঠলাম, — “কৃষ্ণা, তোদের না আমরা আসতে বারণ করেছিলাম? চিঠি পাসনি নাকি?”
    কৃষ্ণা শান্তভাবেই বলল, — “পেয়েছি, পড়েওছি। সবাই মিলেই পড়েছি। আবার আমি একাই তোদের খুঁজতে বেরিয়েওছি। আমাদেরই হেড কোয়ার্টারের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া হচ্ছে, আর আমার ওপরেই চোটপাট?”
    তৃষা বলল, — “ধ্যাত! তখন থেকে কেবল গজগজ করে যাচ্ছে। ওরে, কাকে ধরে এনেছি দেখ একবার!”
    কৃষ্ণা এতক্ষণ তাপ্তীকে লক্ষ করেনি। ও বলল, — “কাকে?”
    তাপ্তী এতক্ষণে আত্মপ্রকাশ করল, — “ওরে আমি রে আমি।”
    কৃষ্ণা একটুও অবাক হল না। ও বলল, — “যাক খুঁজে পাওয়া গেছে, কাল আর ওর জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না।”
    আমি বললাম, — “বেশ, বৎসগণ, এবার বিনা বাক্যব্যায়ে ‘অষ্টরথী’-তে প্রত্যাবর্তন করা যাক।”
    এরপর আমরা ‘অষ্টরথী’-র দিকে রওনা দিলাম। ক্রমে ভোর হয়ে আসছিল।

    ~~~

    ৮ - প্রভাতালোকে মহাসংগ্রাম

    আমরা যখন গুহায় পৌঁছোলাম তখন সকাল হয়ে গেছে। দেখি সেখানে বেশ হুলুস্থুল বেঁধে গেছে। আমাদের দেখেই ওরা আমাদের দিকে ছুটে আসল। এরপর ওরা আমাদেরকে প্রশ্নে-প্রশ্নে অতিষ্ট করে তুলল। তাপ্তীর খাওয়া শেষ হলে হঠাৎই অজয় গুহার বাইরে টানতে টানতে নিয়ে এল আমাদের। তারপর বলল, — “চ, ওই ডিম দেখেছিলাম যেখানে, সেখানে চল।”
    তাপ্তী বলল, — “তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? এখন আবার ওখানে যাবি?”
    অজয় জোর করতে লাগল, — “চল না প্লিজ, দেখলে চক্ষু চড়কগাছ হবে!”
    কমল বলল, — “চল না। দেখি কেমন চক্ষু চড়কগাছ হয়!”
    সেইমতো অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমরা সবাই সেখানে যেতে বাধ্য হলাম। যেতে-যেতে দেখলাম, ঘন অরণ্যাণির মধ্যে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। অজয় প্রায় টানতে টানতে আমাদের জায়গাটায় নিয়ে গেল। “গন্তব্যে পৌঁছে গেছি” — অজয় বলল।
    কৃষ্ণা বলল, — “কিন্তু ডিমটিম বা হাট্টিমাটিমটিম কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।”
    কোথাও কোনো ডিম দেখতে না-পেয়ে তাপ্তী বলল, — “ছাতার মাথার ডিম। কোথায় ডিম! ডিম খেতে ইচ্ছে করছে তো মুরগি পুষে ডিম খা! যত্তসব! চল গুহায়।”
    অজয় চুপসে গেল। তবু সে তর্ক করতে ছাড়ল না, — “সত্যি বলছি ডিম এখানেই ছিল। তাহলে হয়তো ডিম কোথাও চলে গিয়েছে?”
    তৃষা ঝাঁঝিয়ে উঠল, — “ডিম! তখন থেকে ডিম-ডিম করে যাচ্ছিস, বলি, ডিমটা যদি থাকতই, এখন গেল কোথায়? আমাদের দেরি দেখে কি হাত-পা গজিয়ে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে বাড়ি চলে গেছে? এই বলতে চাস? যত্তসব…”
    আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, আমি থামিয়ে দিলাম। এতক্ষণ আমি একেবারে চুপ করে ছিলাম। এবার বললাম, — “হয়েছে, হয়েছে, তখন থেকে গজগজিয়ে মাথা ধরিয়ে দিবি নাকি? ওহ্‌ ডিম-ডিম করে খেপে গেল যে! বাড়ি চল একবার, একসপ্তা ধরে কেবল ডিমই খাওয়াব। ডিমের ওমলেট, সেদ্ধ…”
    তরুণ বলল, — “তুইও শুরু করলি! দরকার নেই। অত ডিম খেলে অজয়টারই পেট খারাপ হবে। চল তো সব, এবার ভালোয় ভালোয় বাড়ি যাবি চল। ঢের হল সময় অভিযান। মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেলে আমার করণীয় কিছু থাকবে না এই বলে দিলাম।”
    একটা তীব্র বাদানুবাদ শুরু হয়ে যেত তাপ্তী আর অজয়ের মধ্যে, হঠাৎ দেখি বিজয় একটু দূরে একটা ঝোপের কাছে গিয়ে কিছু একটা খুব মন দিয়ে দেখছে। কী ব্যাপার? কাছে গিয়ে দেখি ঝোপের মধ্যে কিছু একটাকে সে খুব নিবিষ্ট মনে নিরীক্ষণ করছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সে বলল, — “ও তোর্সা, দেখ দেখি, ডিম রহস্য সমাধান হয়ে গেল মনে হচ্ছে।”
    ও কি ডিমটিম কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলল নাকি? ঝোপের মধ্যে ঝুঁকে দেখি আরে! কিমাশ্চর্য! ডিম নয়, তার অবশেষ! কী করে হতে পারে! ডিমবাবাজি কি তবে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে তার দেহাবশেষ ঝোপে ফেলে অন্তর্ধান করেছেন? এ-ও কি সম্ভব?
    তখনি তরুণ এসে উপস্থিত হল। বলল, — “কী রে, কী হয়েছে এখানে? তোরা দুটোয় মিলে কী দেখছিস বলতো! ওদিকে ডিম নিয়ে ওখানে প্রায় কুরুক্ষেত্র হচ্ছে।’
    — “ডিম্বমশায়ের ভগ্নাবশেষ দেখছি”, বিজয় গম্ভীরভাবে বলল।
    তরুণ চোখ কপালে তুলে বলল, — “অ্যাঁ! সেকী? ওরে তাপ্তী, কৃষ্ণা, অজয়, কমল, তোরা সব আয় রে, এসে দেখ, কী আছে এখানে!”
    ওরা সবাই এসে পৌঁছোলে তরুণ বলল, — “অযথা বচসা করিস না। এই দেখ”, বলে ঝোপের ভেতরটা দেখিয়ে দিল। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
    ভাঙা ডিমের খোলা দেখে কোনোদিন কাউকে এত উচ্ছ্বসিত হতে দেখিনি যতটা হতে দেখলাম অজয়কে। প্রবল উল্লসিত হয়ে অজয় লাফাতে লাগল, — “কী বলেছিলাম? ডিম ছিল, আছে, থাকবে, থাকতেই হবে। না-থাকলে কথা ফেরত।”
    আমরা সকলে ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। তবে বিজয় বলল, — “ডিমটা নেই, ডিমের অবশেষ আছে।”
    — “তবু তো আছে”, কমল ফুট কাটল।
    কৃষ্ণা বলল, — “ভেতরের বস্তু কই?”
    তক্ষুনি এক ভয়াবহ গর্জন আমার কানে তালা ধরিয়ে দিল। কমল আবার ফোড়ন কাটল, — “ওই যে, ভেতরের বস্তুটি চেল্লাচ্ছে!”
    তাপ্তী ধমকে উঠল, — “অ্যাই কমল, এবার চুপ কর। তখন থেকে যথেষ্ট বকবক করেছিস। এবার চল। অযথা একটা ডিম নিয়ে মাথাব্যাথা করা বন্ধ করে সবাই এবার গুহায় ফেরত চল।”
    এরপর আমরা সবাই চুপচাপ টাইম মেশিনের গুহার দিকে রওনা দিলাম।
    আমরা যখন গুহার কাছাকাছি গেছি, সবার সামনে থাকা বিজয় হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে আমাদের থামতে ইশারা করল। তারপর পা টিপে-টিপে কিছুটা এগিয়ে কিছু একটা দেখতে থাকল। তারপরই হঠাৎ ঊর্ধ্বশ্বাসে আমাদের কাছে ছুটে এসে বলল, — “ওহ্‌, মাংসাশি ডাইনো একটা ওত পেতে আছে, আর টাইম মেশিনের মধ্যে একটা পুঁচকে ডাইনোসর। পালা।”
    অজয় আর তাপ্তী তার দু-হাত ধরে এবং বাকিরা পরস্পরের হাত ধরে ডান দিকে ছুট মারলাম। একটু পরে আমরা একজায়গায় থামলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে তৃষা বলল, — “ওঃ! গুহা থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছি। আরে তাপ্তী? তোর না পায়ে ব্যাথা?”
    তাপ্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, — “ওরে, আমার পা ব্যাথার থেকে তোদের সবার প্রাণের দাম অনেক বেশি। যদি ছুট না দিতাম, সব্বাইকে ধরে ও কচমচিয়ে খেত। ওঃ! তা যাই হোক গে, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। দেখ, আমরা প্রথমে চারটে দল করব। একটা দলে থাকবে তরুণ, সে কোনোভাবে মাংসাশীকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে, আর ওর কাছে থাকবে একজোড়া ডানা। তা দিয়ে বিপদে আত্মরক্ষা করবে।” (তাপ্তীর এ-কথা বলার কারণ হল, তরুণ আমাদের মধ্যে সবথেকে ভালো ছুটতে পারে।) “দ্বিতীয় দলে থাকবে, তোর্সা। ও উড়ে উড়ে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ করবে। আর যে ছ-জন থাকল, তারা দুটো দলে ভাগ হয়ে যাবে। একটা দলে থাকবে কমল, অজয়, বিজয়। তারা ছোটো ডাইনোসরকে নিয়ে উড়ে অন্য কোথাও রেখে আসবে। শেষ দলে থাকছি আমি, কৃষ্ণা, তৃষা, আমরা টাইম মেশিনের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকলে তা সারাব আর ইঞ্জিন চালু করে রাখব যাতে ঝটপট পাড়ি দেওয়ার জন্য তৈরী থাকে।”
    সবাই সম্মতি জানাল। হঠাৎ তরুণ বলে বসল, — “ওকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করব কী করে আমি?”
    তৃষা বলল, — “জ্বলজ্বলে কিছু, যেমন—টর্চ, দিয়ে কাজ হবে না?”
    তাপ্তী বলল, — “ব্রিলিয়ান্ট! খুব হবে। এই না হলে বুদ্ধি! কিন্তু এখন টর্চ পাই কোথায়?”
    তৃষা মুচকি হেসে পকেট থেকে টর্চটা বের করল। কমল বলল, — “কিন্তু এই সকাল বেলায় কি ও টর্চের আলো দেখতে পাবে?”
    এটাও একটা চিন্তার বিষয়। ভাবতে ভাবতে পকেট হাতড়াতে থাকলাম। হঠাৎ হাতটায় কিছু একটা ঠেকল। বের করে দেখি, এ-যে আমার গুলতিটা! গুলতিটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, এই গুলতিটা দিয়ে কিছু করা যেতে পারে না? হঠাৎ মনে হল, আরে! তাই তো! গুলতিটা দিয়ে টিপ করে মাংসাশীমশাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতেই পারে। একথা বলতেই তরুণ লাফিয়ে উঠল, — “দি আইডিয়া! ব্রাভো তোর্সা! ব্রাভো তোর আইডিয়া! গুড়ুল কি শেষ?”
    আমি বললাম, — “তা শেষ। কিন্তু মাটিতে প্রচুর পাথর আছে। ওগুলো গুড়ুলের মতোই কার্যকরী।”
    তৃষা বলল, — “তাহলে তরুণ, আর কিছু গুড়ুল যোগাড় করে রাখ। এই নে আমার রুমাল, এতে পুঁটলি করে রাখতে পারিস। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় আমাদের নিজেদের সময়ে ফিরে যাওয়া উচিত, তাই না?”
    কমল আবার প্রশ্ন করে বসল, — “আমাদের কাছে তো তিনটে মাত্তর ডানা। আমাদের ডানা লাগবে পাঁচটা। বাকি দুটো কই?”
    তাপ্তী বলল, — “তৃষার সিটের তলায়। আপাতত তোর্সা আর তরুণ এ-দুটো ডানা রাখ। আরেকটা ডানা কমল নিয়ে রাখ। টাইম মেশিনে পৌঁছে বাকি ডানা দুটো অজয় আর বিজয় পাবে। তোর্সা, তুই উড়তে শুরু করে দে। তুই আমাদের সিগনাল দিলে তবেই আমরা শুরু হয়ে যাব।”
    সেই কথা মত আমি উড়ে উড়ে বেশ কিছুটা উপরে চলে এলাম। এখান দিয়ে ঘন অরণ্যের সব কিছুই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যে ঘন সবুজ গাছপালাই বেশি। আর একটু নামতে হল। এখান থেকে গাছপালার নিতান্ত আড়ালে থাকা ছাড়া একটু খোলা জায়গার সবাইকে দেখা যাচ্ছে। একটু ঘোরাঘুরি করে নিলাম। একদিকে বেশ কিছুটা দূরে একটা চারণক্ষেত্র দেখতে পেলাম। আর কাছেই দেখতে পেলাম একটা বড়োসড়ো অ্যালোসরাস আমাদের টাইমমেশিনের দিকে আস্তে আস্তে যাচ্ছে। দেখামাত্রই ওদের সংকেত দিলাম, — “একটা অ্যালোসরাস গুহার দিকে যাচ্ছে। তোরা জলদি তৈরি হয়ে নে।”
    ওরা তৈরি হয়ে থাকল, তরুণও জানাল, সে তৈরি। এরপর তরুণকে সংকেত দিতেই সে একটু হাত-পা ছুড়ে দৌড় দিল টাইমমেশিনের দিকে। তারপর সে নিরাপদ দূরত্ব থেকে অ্যালোসরাসকে একটা পাথর ছুড়ে মারল। অ্যালোসরাসমশাই খেপে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকাল। তার দৃষ্টিতে ছিল নির্মম জিঘাংসা। তরুণ কালক্ষেপ না-করে তাকে আরেকটি পাথর উপহার দিয়ে উল্টোদিকে দৌড় মারল। ডাইনোসরটিও ক্ষিপ্ত হয়ে পাগলের মতো ওকে তাড়া করল।
    ওরা বেশ কিছুটা তফাতে যাওয়ার পর তাপ্তীদের জানালাম, এবার তারা কাজ শুরু করতে পারে। তাপ্তীকে ইশারা করা মাত্রই তারা সবাই ঝড়ের বেগে টাইমমেশিনের দিকে দৌড় মারল। পা ব্যাথা নিয়েও তাপ্তী যেভাবে দৌড়োচ্ছিল, তা দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়েছি।
    ওরা গুহায় ঢুকে পড়ার পর, তরুণকে অনুসরণ করতে-করতে ডাইনোসরটার ভাবগতিক লক্ষ করতে থাকলাম। সত্যিই তরুণ যেভাবে ছুটছিল, তাতে সে নির্ঘাত অলিম্পিকে সোনা পেত। আমি পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, তরুণের আপাতত সাহায্যের দরকার নেই। আমি পিছন ঘুরে আবার টাইম মেশিনের দিকে উড়তে থাকলাম।
    গুহায় পৌঁছে দেখলাম, ওরা সবাই ধরাধরি করে একটা স্টেগোসরাসের ছানা টাইমমেশিন থেকে বের করছে। ওটা যে কী করে টাইমমেশিনে ঢুকল তা ভগবান ছাড়া কেউ জানে না।
    কমলদের দলটা তৈরি হয়েছে। ওরা তিনজনে মিলে বহু কসরৎ করে ছানাটাকে তুলেছে গ্লাভস পরে। কেন, তা আন্দাজ করে আমার খুব হাসি পেতে থাকল। অজয় জানে, মানুষ অন্য কোনো প্রাণীর ছানাকে স্পর্শ করলে তার গায়ে মানুষের গন্ধ লেগে যায়, ফলে ছানার মা-বাবারা তাকে গ্রহণ করে না। এই নীতি অনুসারে তার ধারণা ডাইনোসরের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য। তাই সে নিজেও গ্লাভস পরেছে আর অন্যদেরও পরিয়েছে।
    এখানে এরাও ঠিক আছে দেখে এদের দলটার ওড়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। ছানাটা যথেষ্ট চ্যাঁচামেচি করছে। তৃষা বিরক্ত হয়ে ওটাকে ভালো করে বেঁধে রাখল। এরপর ওরাও উড়তে থাকল। আমার কাছে এসে পৌঁছোলে ওদের চারণক্ষেত্রের দিকটা দেখিয়ে দিলাম। বললাম, — “ওখানেই ছেড়ে দিয়ে আয়।”
    এরপর তরুণের কর্মক্ষেত্রে (বা দৌড়ক্ষেত্রের) দিকে উড়ে গেলাম। আমার এখন ওই কাজ। কেবল এদিকওদিক উড়ে উড়ে পর্যবেক্ষণ করে বেড়ানো।
    হঠাৎ দেখি কমলের দলটা আমাকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি ওদের কাছে পৌঁছে দেখি ওরা আবার দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে গেছে। এবার ওদের চারণক্ষেত্রের দিকটা দেখিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্তে থাকতে পারলাম না, ওদের সাথে সাথে চললাম। চারণক্ষেত্রের কিছুটা কাছাকাছি যাওয়ার পর বলে দিলাম, — “নাক বরাবর সোজা চলবি। আমি যাচ্ছি।”
    মিনিট পনেরো ধরে ওদের গাইড করতে হয়েছিল। একে ওরা ওই ছটফটানো আধমণি জিনিসটাকে বহন করছে, তাও আবার শূন্যপথে! এবার টাইম মেশিনে কী হচ্ছে দেখে নেওয়া জরুরি।
    অষ্টরথীতে গিয়ে দেখি অবস্থা গতিক সুবিধের নয়। তাপ্তী খুব রেগে গেছে। একটু নীচে নেমে ডাকলাম, — “তাপ্তী! তাপ্তী!”
    তাপ্তী গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এল। রেগে আছে প্রচণ্ড। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, — “কদ্দূর? টাইম মেশিনের কী অবস্থা?”
    তাপ্তী প্রায় কেঁদে ফেলল, — “অবস্থা শোচনীয়। হতভাগা পাজি ডাইনোসরটা সব ঘেঁটে ঘুঁটে তোলপাড় করে রেখেছে। সারাতে তো সময় লাগবে!”
    বললাম, — “আচ্ছা, আচ্ছা! সময় নে। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা কর! নইলে প্রেশার কুকার হয়ে যাবি যে!”
    তৃষা মুখ বাড়িয়ে বলল, — “ওঃ তাপ্তী, এত রেগে যাস না তো! প্রাথমিক সাজানো গোছানো সব হয়ে গেছে। যান্ত্রিক গণ্ডোগোল আছে কিনা চেক করছি।”
    আমি বললাম, — “তাপ্তী, ভয় পাইয়ে দিস কেন এত?”
    কৃষ্ণার গলা শোনা গেল, — “শ্রীমান স্টেগোসরাস মেশিনের ভেতরে ময়লা করেছে যথেষ্ট।”
    এই শুনে তাপ্তীর চোখ আবার বড়ো বড়ো হয়ে যাচ্ছে দেখে আমি বললাম, — “তাপ্তী, এত রেগে যাস না। একটু শান্ত হ।”
    তৃষা এবার তাপ্তীকে কী সব বোঝাতে থাকল। তাপ্তীর উত্তেজনা ছাড়া সবই কন্ট্রোলে। তাই আমি অযথা সময় নষ্ট না-করে তরুণের ব্যাপারটা দেখতে গেলাম। এতক্ষণ ছোটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তার কী অবস্থা হবে ভেবেই আমি যথেষ্ট চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু গুহা থেকে বেশি দূর যাওয়ার আগেই তাপ্তীর ডাক শুনতে পেলাম, — “তোর্সা! এদিকে আয় জলদি!”
    কিছু বিপদ হল নাকি? — আমি ভাবলাম। পিছন ফিরে টাইম মেশিনের দিকে যেতে থাকলাম। তাপ্তী আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বলল, — “তোর্সা, এই ওয়াকি টকি-টা রাখ। সারাতে আর বেশি সময় লাগবে না। মোটমাট পাঁচ-দশ মিনিট লাগবে সব মিলিয়ে। বাকিদের কী অবস্থা?”
    আমি বললাম, — “তরুণ আশা করি ভালোই চালাচ্ছে। কমলের দলটা চারণক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছে। তরুণের খবর নিতে আমি চললাম।”
    আমি তরুণের ব্যাপারটা দেখতে চললাম, পিছন থেকে তৃষা বলল, ‘দুগ্‌গা দুগ্‌গা!”
    কিছুক্ষণ আকাশে ওড়ার পর আমি তরুণকে দেখতে পেলাম। সে বনবাদাড় পেরিয়ে ছুটছে। গজদশেক পিছনে ছুটছে অ্যালোসরাস। আমি ওয়াকি-তে তাপ্তীকে জানালাম, — “তরুণ মোটামুটি ভালোই চালাচ্ছে। তোদের কাজ কদ্দূর?”
    তাপ্তী আমায় জানাল, — “তরুণ যদি ক্লান্ত হয়ে না-পড়ে থাকে, তাহলে অজয়দের খবর নিয়ে আয়। রজার। ওভার।”
    তরুণ মোটামুটি ভালোই দৌড়োচ্ছে দেখে আমি অজয়দের খোঁজ আনতে চলে গেলাম। সর্বোচ্চ গতিতে উড়ে চারণক্ষেত্রের কাছে যেতে আমার সময় লাগল দু-মিনিট। ফিরে দেখলাম, কমলরা চারণক্ষেত্র থেকে উঠে আসছে। অর্থাৎ স্টেগোসরাসের ছানা স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করেছে। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ওয়াকিতে তাপ্তীকে ধরলাম, — “হ্যালো তাপ্তী! কাজ কদ্দূর? অজয়রা ফিরছে।”
    তাপ্তী জানাল, — “কাজ প্রায় শেষ। তরুণ সমেত ফিরে আয়। রজার। ওভার।”
    এবার তরুণের দিকে উড়ে চললাম। তরুনের গতি খুব আস্তে আস্তে কমছে। এতক্ষণ ধরে প্রবল ছুটেছে। একটু সমান ফাঁকা জায়গায় এলে ওকে চেঁচিয়ে বললাম, — “কাজ কমপ্লিট তরুণ, ঝটপট ফেরত আয়।”
    তরুণ কী বুঝল জানিনা, কিন্তু সে দৌড়ের গতি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল। কিছু দূর এগিয়ে হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে গিয়ে ডানা দুটোকে এক ঝাড়া দিয়ে প্রশান্ত নীলিমায় উড্ডীন হল। এরপরে আমরা একসাথে টাইম মেশিনের দিকে যাত্রা করলাম।
    তরুণ বলল, — “ওহ্‌, একটুর জন্য বেঁচে গেছি। আর একটু দেরি হলেই আমি উলটে পড়ে যেতাম।”
    গুহায় পৌঁছোনোর পর দেখি, টাইম মেশিনের ইঞ্জিন চালু হবে-হবে। তাপ্তী ডাকল, — “ওরে তোরা জলদি আয়, টাইম মেশিন এক্ষুনি স্টার্ট হবে।”
    তরুণ আর আমি লাফ দিয়ে টাইম মেশিনে ঢুকে পড়লাম। তাপ্তী আর কমল আমাদের দুজনকে টেনে সিটে বসিয়ে দিল। ঠিক তার পরের মুহূর্তেই ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। ডাইনোসরের কণ্ঠে বিপুল এক গর্জনের মধ্যে দিয়ে যেন জুরাসিক যুগ আমাদের বিদায় জানাল।


    - সমাপ্ত -



    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ০৬ জুন ২০২৩ | ১৩৪২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2601:14a:502:e060:98a9:99fd:b437:2b38 | ০৬ জুন ২০২৩ ০৬:২৭520257
  • আরেব্বাস! ফোনে ফোনে এত বড় আর জটিল গল্প তৈরী হয়েছে? দারুণ তো! কল্পবিজ্ঞান আর অ্যাডভেঞ্চার দুইই টানটান, উত্তেজনায় ভরপুর। দুই লিখিয়েকেই অনেক প্রশংসা।

    ছবি অসম্ভব ভালো লাগলো। আঁকিয়ে শরণ্যার প্রতিভায় আমি হতবাক!
  • সুপর্ণা | 103.76.82.229 | ১২ জুন ২০২৩ ২৩:০০520389
  • অসাধারণ লাগলো এতো ছোটো দুজন স্টুডেন্ট এর এমন প্রতিভা সত্যি না পড়লে  জানতামই না। অ্যাডভেঞ্চার আর কল্পবিজ্ঞান দুই মিশে খুব সুন্দর লেখা,কি সুন্দর ভাষা তোমাদের কুর্নিশ।আগামী দিনে এমন অনেক লেখা পাঠক দের উপহার দাও তাই কামনা করি
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন