এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ১৭ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ আগস্ট ২০২৩ | ৩৯২ বার পঠিত
  • বিয়ের ঘটক কানাই সিকদার ক'দিন পরে এসে হাজির দুপুর বারোটা নাগাদ। বাড়িতে কাজের লোক জগন্নাথ ছাড়া বাসন্তীদেবী এখন একা। বেশ গরম পড়েছে আজ। মাথার ওপর বড় বড় তিন পাখনার ডি সি ফ্যান ঘুরছে গিটগিট করে। কানাই রুমাল বার করে মুখের, গলার ঘাম মুছতে লাগল।
    বাসন্তীদেবী এসে ঘরে ঢুকলেন।
    ----- ' বল কানাই ... কি খবর ... '
    ----- ' হ্যাঁ দিদি ... কথাবার্তা কয়ে এসেছি। ভবানীপুরে বাড়ি ... বনেদী সম্পন্ন পরিবার। বাবা হাইকোর্টের ফৌজদারি উকিল। ভাল উপায় করে ... '
    ----- ' আর ছেলে? .... ও জগন্নাথ ... এক কাপ চা খাওয়াবি নাকি কানাইকে .... হ্যাঁ ছেলে কি করে? '
    ----- ' টাটা স্টুয়ার্ট অ্যান্ড লয়েড-এ আছে। ভাল পোস্টেই আছে। সম্বন্ধ ঠিক হয়ে গেলে খোঁজখবর করে নিতে হবে আর কি ... রোজগার ভাল ... রোজগার ভাল ... '
    ----- ' ছবি দিতে হবে তো নাকি? '
    ----- ' না না .... বলেছে একেবারে মেয়ে দেখতে আসবে ... ছবির দরকার নেই ... ওসব অত কি ... মেয়ে কি আমাদের ফেলনা নাকি? ছেলে বোধহয় নিজে আসবে। একবারই দেখবে। নিপাট ভদ্র পরিবার ... দেখলেই বুঝবে ... '
    ----- ' অ ... তাই নাকি? তা ভাল। তা কবে আসবে তা'লে?
    ----- ' আমি গিয়ে খবর দিচ্ছি। তা ধরুন ... সামনের রবিবারে যদি আসে অসুবিধে হবে? শুভস্য শীঘ্রম ... '
    ----- ' আচ্ছা ঠিক আছে। রবিবারেই আসুক। আমি তোমার জামাইবাবুর সঙ্গে কথা বলে রাখব।' বাসন্তীদেবী তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।

    রবিবারে বিকেল চারটে নাগাদ সুমনার বড়দি চন্দনাকে ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে এল। কানাই যেরকম বলেছিল, ছেলে নিজেই এল। সুন্দর সুঠাম চেহারার যুবক। চোখের দৃষ্টিতে আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ, কিন্তু শান্ত সরল। সঙ্গে এসেছেন আরও দুজন। ছেলের মা এবং এবং মামা। মা ছেলের দিকে দেখিয়ে বললেন ওর নাম শঙ্খ।
    চন্দনা সামান্য প্রসাধন করে ওদের মুখোমুখি একটা কাউচে বসল। সুমনা তার দিদির সঙ্গে এঁটুলি পোকার মতো সেঁটে রইল পাশে বসে। চন্দনাকে সযত্নে আগলে রাখাটা যেন তার কাজ।
    ভবানীপুরের পরিবারটি খুবই পরিশীলিত বলেই মনে হল বাসন্তীদেবী এবং তার স্বামীর। চন্দনাকে সামান্য দুচার কথা জিজ্ঞাসা করলেন ওরা। ছেলের মা মনে মনে একটা সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন বোধহয়। নকুড়ের মিষ্টি আনানো হল একগাদা যার কিছুই প্রায় খেলেন না ওরা।
    পঁয়ত্রিশ মিনিটের মতো ছিল শঙ্খরা। বিদায় নেবার সময়ে সৌজন্য বিনিময়ের বহর দেখে মনে হল ছেলের মা এবং মামার চন্দনাকে বেশ মনে ধরেছে। ছেলের চোখমুখ দেখে অবশ্য তার মনের কথা ঠিক পড়া গেল না। একবার শুধু চন্দনার পাশে বসে থাকা সুমনার দিকে তাকিয়ে বলল, ' তিন বোনই একই কলেজে একই সাবজেক্টে অনার্স ... ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড ইয়ারে ... বেশ ইউনিক ব্যাপার ... '। সুমনা মাথা নীচু করে মৃদু হাসল।
    কানাই সিকদার ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগল। শঙ্খর মা একবার ওপর দিকে ঘুরে সুমনার মা বাবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। সব লক্ষণই বেশ আশাপ্রদ মনে হচ্ছে।

    নিবারণ সাহা আজ আবার নিতাইবাবুকে জমি দেখাতে নিয়ে গেলেন। দমদমের ভিতরদিকে কালিন্দীতে। এখানেও জমির কাঠা হাজারের আশেপাশে। জায়গা দেখে হেদুয়ার ধারে থাকা কোন বাসিন্দার মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। নিতাইবাবুরও তাই হল। নিবারণ সেই ভবিষ্যতে উন্নতির গল্প শোনাতে লাগল। বললেন, 'পানিহাটি সোদপুরেও অনেক প্লট আছে। সব দেখিয়ে দেব। তাড়াহুড়োর দরকার নেই। আমি কাউকে তাড়াহুড়ো করতে বলি না। বিশ্বাসটাই আসল, বুঝলেন নিতাইবাবু .... '। নিতাইবাবু বললেন , ' তা তো বটেই ... দেখি ফ্যামিলির সঙ্গে আলোচনা করে দেখি।

    গাড়িভাড়া, চা খাওয়া এসব গাঁটগচ্চা নিতাইবাবুরই যাচ্ছে। এটা নিয়ে অবশ্য চিন্তা করছেন না নিতাইবাবু। আসল কাজটা ঠিকমতো হলে হয়। নিবারণবাবু লোক খারাপ না। দায়িত্বজ্ঞান আছে। নিতাইবাবু বাসে বসে ভাবতে লাগলেন , দোতলার ভাড়াটে অনিল ঘোষের তো পয়সাকড়ির অভাব নেই। কোথায় একটা নাকি পৈত্রিক বাড়ি আছে। সে কি ও বাড়ি ছাড়ার কথা চিন্তা করছে। কি জানি কি করবে। বিভূতিবাবু তো তাকে ভাড়া বাড়াতে বলেছে। তাকে অবশ্য তেমন কিছু বলেনি। বললে তিনি কি বলবেন , সেই কথা ভাবতে লাগলেন নিতাইবাবু। বাস শ্যামবাজারে পৌঁছলে নিবারণবাবু বললেন , ' আপনি তা'লে যান ... আমি একটু এখানে নামছি, শঙ্কর ফার্মেসি থেকে কিছু ওষুধ কিনতে হবে ... '। নিবারণবাবু নেমে গেলেন।

    এর দিন তিনেক বাদে কাবেরী আবার ডুব মারল। আগেই বলেছিল অবশ্য পিসতুতো দিদির বিয়ে আছে হালিশহরে। ওখানে যাবে।
    সুমনা একা একা বেথুনের গেট দিয়ে বাইরে বেরোল। দুপুর আড়াইটে। গেটের একপাশে ঘুগনি আলুরদমওয়ালা। মেয়েরা ইতিউতি চাক বেঁধেছে আইসক্রিম আর বুড়ির চুল, হজমি গুলি, লালচে নুন ঝাল ছেটানো বিলিতি আমড়াওয়ালার সামনে।
    সুমনা ধীর পায়ে রাস্তা পার হয়ে ওদিকে গেল। রামদুলালের দিকে কোণের গেটটা দিয়ে অলস পায়ে হেদুয়ায় ঢুকল মাথা নীচু করে আপনমনে কি সব ভাবতে ভাবতে। একদল চোদ্দ পনের বছরের ছেলে হৈ হৈ করে কি নিয়ে কথা বলতে বলতে তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। একজনকে বলতে শোনা গেল, 'দেশবন্ধু পার্কে বরানগর ইউনাইটেড নামছে আজকে ... চারটে ফার্স্ট ডিভিশনের প্লেয়ার নিয়েছে ... দেখবি কেমন নাচায় ... '

    মহা উত্তেজিত কিশোর বাহিনী বেরিয়ে যেতে সুমনা সামনে মুখ তুলে তাকাল। দু পা এগোতেই সে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসা আর একজনের সামনা সামনি পড়ে গেল। চোখে কালো রঙের মোটা ফ্রেমের দাদু মার্কা চশমা। কাঁধে কলেজ পড়ুয়ার ঝোলা ব্যাগ। অকারণেই তার বুক ধড়াস করে উঠল। সে পথিক তাকে খেয়ালই করল না। দ্রুতপায়ে তার পাশ দিয়ে বৈকুন্ঠ বুক হাউসের দিকে তাকাতে তাকাতে হেঁটে চলে গেল। সুমনা খুব সন্তর্পনে পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল প্রতিবিম্ব রাস্তা পার হয়ে ওদিকে যাচ্ছে বোধহয় কোন জরুরী দরকারে।

    বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। শরতের বেলা ছোট হয়ে এসেছে। আকাশের আলোয় ঘুম ঘুম ভাব। এক একটা বাড়ি থেকে পুরনারীদের তিনবার করে শঙ্খধ্বনির কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। মৃদুল সন্ধ্যা নেমে আসছে রাস্তাঘাটে , বাড়ির নিঝুম ছাদে।

    বাসন্তীদেবীর তিন মেয়ে এখনও বাড়ি ফেরেনি। বাসন্তীদেবী রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। এই সময়ে হঠাৎ কানাই সিকদার এসে হাজির।
    ------ ' আরে ... কানাই যে , কি খবর? '
    ------ ' না , মানে ... খবর কিছু খারাপ না ... তবে একটু অন্যরকম ... ' কানাইয়ের মুখটা কেমন কাঁচুমাচু দেখাচ্ছে।
    ----- ' অন্যরকম ... মানে? চন্দনাকে কি ওদের পছন্দ হয়নি? '
    -----' না না ... ছি ছি, ও কথা বোল না দিদি ... চন্দনার জন্য ওরকম আরও একশ সম্বন্ধ নিয়ে আসতে পারি ... গ্যারান্টি দিচ্ছি ... '
    ----- ' তা তো বুঝলাম। কিন্তু এখানে সমস্যাটা কি হল? '
    ------ ' সমস্যা বলতে ... পছন্দটা একটু অন্য জায়গায় গিয়ে পড়েছে। ছেলে , মানে ওই শঙ্খ ধনুক ভাঙা পণ করেছে। তার বাড়ির লোকেরা বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি ... '
    ------ ' অ ... তা ধনুক ভাঙা পণটা কি? '
    ----- ' পাত্র বলছে যে ... '
    ----- ' কি ... কি বলছে? '
    ----- ' এ..ই বলছে যে ইয়ে ... হয় সে সুমনাকে বিয়ে করবে, নইলে সে এ জীবনে আর বিয়েই করবে না ... ', কানাই কাঁচুমাচু মুখে বসে রইল।

    বাসন্তীদেবীর মুখ দিয়ে শুধু একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসল ---- ' আঁ ! ! .... '

    ( চলবে )

    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন