এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ৫০ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ২৬১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • রাত বারোটার সময় বিশাখার ঘর থেকে আলুথালু অবস্থায় আন্ডারওয়্যার পরে খালি পায়ে বেরিয়ে এলেন সুরেশ্বর মল্লিক। এসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিশাখা শায়া আর বোতাম খোলা ব্রাউজ পরে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এল। আর সব ঘরের দরজা বন্ধ। সেখানে বোধহয় সারারাতের অতিথি রয়েছে। পাশের ঘর থেকে টুকরো টুকরো কথা আর খিলখিল হাসির আওয়াজ আসছে মাঝেমাঝে। বারান্দায় একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে।
    বিশাখা বেরিয়ে এসে বলল, ' আরে, কি করেন ! এইভাবে কেউ বেরোয় নাকি ... চলেন ভিতরে চলেন ... এইভাবে যায় নাকি ? '
    সুরেশ্বরবাবু অতিরিক্ত চড়িয়ে ফেলেছেন। হয়ত তার ফলেই তিনি অতিরিক্ত ভাবালু হয়ে পড়লেন। ভারি চেহারার সুরেশ্বরকে ভূপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করে জাপটে ধরে কোনরকমে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল বিশাখা। কারণসুধার প্রভাবে সুরেশ্বরের এখন ভাব জেগেছে। তিনি বিজড়িত স্বরে বলতে লাগলেন, ' ছাড় ছাড় .... আমি বাড়ি যাব ... ভেবেছ কি! আমার কি ঘরসংসার ,পরিবার নেই নাকি ... আমার কি কোন দায়িত্বজ্ঞান নেই .... '
    বিশাখা তাকে রোজকার মতো বুঝিয়ে বলতে লাগল , ' নিশ্চই ... নিশ্চই... আপনার পরিবার নেই তো কার পরিবার আছে ... কিন্তু মল্লিকবাড়ির ছেলে এভাবে বাড়ি গেলে পরিবার কি বলবে ? তারা তো আমাদেরই দুষবে ... '
    বিশাখা কোনরকমে সুরেশ্বরকে ঘরে ঢুকিয়ে আনল। যাই হোক, এইভাবে তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। তারপর বড় এক গ্লাস লেবুর জল খাওয়াল মুখে গ্লাস চেপে ধরে। তাতে সুরেশ্বর মল্লিকের নেশা কিছুটা কাটল। চশমাটা পাঞ্জাবীর পকেটে রইল।
    মল্লিকবাবু একটু দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থায় এসেছেন। সেই সুযোগে বিশাখা যা হোক করে ধুতিটা পরিয়ে দিল সুরেশ্বরকে। পায়ে জুতোটাও গলিয়ে দিল কায়দা করে। বলল, দেখুন ... যেতে পারবেন তো ? বাইরে যদি রিক্শা না থাকে গলির মুখে রাস্তায় কেউ না কেউ আছে ... '
    ----- ' হুঁ .... ঠিক আছে ... রিক্শা না থাকলে হেঁটেই যাব ... আমার কি বাড়ি ঘর নেই নাকি ... এখানে পড়ে থাকলেই চলবে ? '
    বিশাখা বুঝতে পারল, ধুমকি এখনও পুরোপুরি কাটেনি।
    সে বলল, ' হ্যাঁ তা তো বটেই ... কিন্তু বাড়িঘর ঠিকমতো চিনতে পারবেন তো ? যান ... সাবধানে যান ... '
    সুরেশ্বর টলমল করতে করতে সিঁড়ির কাঠের নড়বড়ে রেলিং ধরে ধরে নীচে নেমে এলেন। বাইরে পা দিয়েই দেখলেন, একটা রিক্শা দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সব পাড়া নিশুত হয়ে গেলেও এ পাড়া এখন যুবতী। দোকানগুলোয় আলো জ্বলছে। লোকজন ভিড় করে আছে। বেশির ভাগই পান জর্দা আর সিগারেটের দোকান। দুটো বাংলা মদের দোকান আছে। আতরের দোকানগুলোও বেশ প্রাণবন্ত এই সময়ে। আলোয় ঝিলমিল করছে। ঠিক উল্টোদিকের জর্দা পানের দোকানটা প্রায় ফাঁকাই বলা যায়। তার কারণ বোধহয় সেখানে বসে আছে একটা লোক যাকে এ তল্লাটে সবাই চেনে। সে দোকানের বাইরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
    সুরেশ্বরবাবু বাইরে আসতেই রিক্শাওয়ালাটা তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এল। নিশ্চয়ই বিশাখার বাঁধা রিক্শাওয়ালা, সুরেশ্বরের অপেক্ষাতেই বসে ছিল। ' আইয়ে বাবু ' বলে রিক্শাওয়ালাটা তার হাত ধরতে সুরেশ্বর জড়িত স্বরে বললেন , ' এই যে নিমাইচাঁদ ... কোথায় ছিলে বাওয়া এতক্ষণ ... কতক্ষণ ধরে পথ চেয়ে বসে আছি ... '
    রিক্শাচালক কৃতার্থ স্বরে বলল, ' হাঁ ... বাবু ... সামালকে ... আইয়ে আইয়ে ... '
    সে সুরেশ্বরকে ধরে যতবার রিক্শায় তোলার চেষ্টা করতে লাগল , মল্লিকমশাই ততবারই হড়কে নীচে
    নীচে নেমে আসতে লাগলেন।
    এই সময়ে সামনের দোকানে বসে থাকা লোকটা এক বালতি জল নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে হাজির হল।
    রিক্শাওয়ালাকে বলল, ' সর সর ... ছেড়ে দে .... ',
    বলে বালতির জল হুড়হুড় করে উল্টে দিল সুরেশ্বরের মাথায়।
    সুরেশ্বর বলে উঠল, ' অ্যাই অ্যাই... কে রে শালা , হারামজাদা ... চাবকে ছাল ছাড়িয়ে নেব ... আমার সঙ্গে মাজাকি ... '
    সাগরের একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মল্লিকমশায়ের বাঁ গালে। থাপ্পড় খেয়ে সুরেশ্বর আচমকা সম্বিত ফিরে পেলেন। ভ্যাবলা চোখে তাকিয়ে রইলেন সাগরের দিকে এবং তাকে চিনতে পারলেন। এরকম অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে পড়ে তার বাক রুদ্ধ হয়ে গেল।
    ----- ' শালা পীরিতের নাগর ... কখন থেকে এখানে বসে আছি জান ? ' সাগরের চোখ কিন্তু যথারীতি শান্ত।
    সুরেশ্বর কোন উত্তর দেবার ঝুঁকি নিলেন না। তিনি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
    ------ ' তুমি শালা এখানে বসে ফূর্তি মাড়াচ্ছ .... ওদিকে তোমার বড় মেয়ে হাসপাতালে অপারেশনের টেবিলে ... জান কি ... সন্ধেবেলায় অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা উঠল ... ভাগ্যিস পঞ্চমীর মা খবর দিল তাই ... বাড়িতে তো বৌদি ছাড়া আর কেউ নেই ... এদিকে তুমি শালা হারামজাদা এদিকে ... খুব রস হয়েছে। সব রস নিংড়ে বার করছি তোমার। ওঠ রিক্শায় ওঠ... '
    সুরেশ্বরের নেশা কেটে গেছে পুরোপুরি। তিনি বাধ্য ছেলের মতো রিক্শায় উঠলেন। সাগর মন্ডলও রিক্শায় উঠে বসল তার পাশে।
    সাগর বলল, ' নে চালা ... '। রাত সাড়ে বারোটা বাজল।
    রিক্শায় কোন কথা বলল না সাগর। পরিচিত রিক্শাচালক ২২ বি নম্বর বাড়িটার সামনে এসে রিক্শা নামাল।
    সাগর বলল, ' নাও নাম ... রসের নাগর ... বাড়ি এসে গেছে ... '
    রিক্শাওয়ালা ধরে নামাতে যাচ্ছিল। সাগর বলল, ' ব্যাস ব্যাস .... তুই ছাড় ... ও নিজেই নামতে পারবে ... '
    তা মল্লিকবাবু স্ব প্রচেষ্টাতেই রিক্শা থেকে অবতরণ করলেন। পাড়া শুনশান ... শীতের রাতে দুয়ার এঁটে লেপ কম্বলের তলায় এই মাঝরাতে।
    সুরেশ্বরবাবুর স্ত্রী ওদের আওয়াজ পেয়ে দোতলা থেকে হাঁচোড় পাঁচোড় করে নেমে এলেন। সঙ্গে তার ছোট মেয়ে শর্বরীও নেমে এল।
    ------ ' তুমি কি গো ... মেয়েটার হাসপাতালে অপারেশন হচ্ছে ... আর তুমি কিনা .... সাগরবাবু না থাকলে কি হত ... তোমার সঙ্গে তো পাড়ার কেউ মেশে না ... ভাগ্যিস পঞ্চমীর মার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল , ওই তো সাগরবাবুকে খবর পাঠাল ... নইলে তে মেয়েটা বেঘোরে... '
    সুরেশ্বরবাবু একদিকে নেশার ঘোর, সন্তানের আকস্মিক গুরুতর অসুস্থতার সংবাদ, আর একদিকে সাগর মন্ডলের ভীতিজনক উপস্থিতি এই সবের মিলিত প্রভাবে দিশেহারা বোধ করতে লাগলেন।
    অসংলগ্নভাবে বললেন, ' আমি তো কিছু ... মানে ... এই বিকেল পর্যন্ত ... '
    সাগর মুখ ভেংচে বলল, ' তুমি বুঝবে কি করে ... রসের নাগর আমার ... ফের যদি ও পাড়ায় দেখি মেরে ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেব ....'
    তারপর সুরেশ্বরের স্ত্রী সরমার দিকে তাকিয়ে বলল, ' বৌদি কিছু মনে করবেন না ... আপনার ভালর জন্যই বলা। যে, যে ভাষা বোঝে তাকে সেই ভাষাই বলতে হয়। যাক, আপনি চিন্তা করবেন না ... আর জি কর-এ আমার লোক আছে ... সব দেখে নেবে। আমি সকালে যাব। চিন্তা করবেন না ... '। শর্বরী বিভ্রান্ত চোখে একবার এর মুখের দিকে , একবার ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। গুন্ডা সাগর মন্ডলকে তার মসীহা মনে হতে লাগল।
    গভীর রাতে বেথুন কলেজের ভিতরের গাছগুলোয় বাদুড় সড়সড় করছে। সুরেশ্বর মল্লিকের মাথার চুল এবং জামাকাপড় প্রায় শুকিয়ে এসেছে। গায়ের শালটা বোধহয় বিশাখার ঘরেই ফেলে এসেছেন।

    ( চলবে )

    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন