এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ৬৯ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২৫ বার পঠিত
  • প্রাচীন দেয়াল ঘড়ির মৃতদেহ সযত্নে রাখা হয়েছে একটা কাঁচের আলমারির মধ্যে। শুইয়ে নয়, দাঁড় করিয়ে। সে এক প্রাজ্ঞ অভিভাবকের মতো তাকিয়ে আছে সৌদামিনীর সংসারের দিকে। মাণিকলালবাবু মাঝে মাঝে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভাবেন, মৃতদেহে যদি আবার বিচিত্র কোন উপায়ে প্রাণ ফিরে আসে, নিশ্চল কাঁটা দুটোয় আবার স্পন্দন ফিরে আসে ...। ঘন্টায় ঘন্টায় সময় জানিয়ে দিতে থাকে আবার দিনে রাতে, অতন্দ্র কর্ত্তব্যপরায়ণতায় যেভাবে যুগের পর যুগ করে এসেছে।
    সৌদামিনী সেদিন বললেন, ' কি হয়ে গেল বলতো ... কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সেই কবে থেকে শুনে এসেছি ঘন্টায় ঘন্টায় সময় জানিয়ে দেওয়া মিষ্টি ঘন্টা। মনটা বড় খারাপ লাগে রে খোকা ... আমাদের পরিবারের সঙ্গে এতদিন জড়িয়ে ছিল ... মনটা বড় কু গাইছে ... কি যে করি ... '
    ----- ' তুমি এত ভেঙে পড় না মা .... দেখছি কি ব্যবস্থা করা যায় ... '
    ----- ' কি আর করবি ... আর একটা ঘড়ি কিনবি, এই তো ? এ বাড়িতে সেটার উপস্থিতি ওর আত্মা মেনে নিতে পারবে তো ? '
    ----- ' তুমি এসব কি বলছ ! হতে পারে ঘড়িটা আমাদের আপনজনের মতো হয়ে গিয়েছিল। আমারও ভীষণ খারাপ লাগছে। তা বলে ঘড়ির আবার আত্মা টাত্মা আছে নাকি ... কি যে বল ... যন্ত্র তো যন্ত্রই ... '
    ----- ' নারে খোকা ... ও কথা বলিস না ... মানুষের মনের সঙ্গে সবকিছু জড়িয়ে আছে। মনই সবকিছুকে টেনে ধরে। '
    মাণিকবাবু চুপ করে গেলেন। সৌদামিনী দেবীর শেষ কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

    একতলায় মাণিকবাবুর খুড়তুতো ভাই আর তার স্ত্রী থাকে। তারা কানপুরে চলে গিয়েছিল ছেলে, ছেলে বউয়ের সঙ্গে থাকবে বলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানে মন টিকল না। আবার ফিরে এসেছে, এই মাস চারেক হবে,রামদুলাল সরকারের বাড়িতে। খুড়তুতো ভাইয়ের নাম কাঞ্চন। সে ওপরে এল একটা রাউন্ড মারতে।
    সে বলল, ' জেঠিমা মন খারাপ করবেন না। এ পৃথিবীতে সবকিছুই মরণশীল। যন্ত্রেরও একসময়ে ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়। সে কাজ থেকে অবসর নেয়।'
    সৌদামিনী কথাটা ধরে নিয়ে বললেন, ' সেটাই তো বলছি ... ও অবসর নিয়েছে। মৃত্যু হবে কেন ? ও কখনও আমাদের ছেড়ে যেতে পারে না ... '
    সংসার অভিজ্ঞা, স্থিতধী,বাস্তববুদ্ধিসম্পন্না জ্যাঠাইমার কাছ থেকে এরকম অবাস্তব আবেগসম্পন্ন কথাবার্তা শুনে কাঞ্চনের বেশ আশ্চর্য লাগছে। কিছুটা বিরক্তও লাগছে। সে চুপ করে রইল। বেলা এগারোটা বাজে। একটু পরে ঘড়িবাবু নরেন পাল এলেন।
    তাকে দেখে সৌদামিনী দেবী যেন বুকে বল পেলেন, যেন তার একজন প্রকৃত সহমর্মীর দেখা পেলেন। তিনি এবার তাকে আঁকড়ে ধরলেন।
    ----- ' এই যে নরেন ... কোথায় ছিলে এতদিন ? '
    ----- ' এতদিন কোথায় গিন্নীমা ... এই তো বৃহস্পতিবার ঘুরে গেলাম... '
    ----- ' তাই নাকি ? ও, তা হবে ... কিছু খেয়াল থাকে না আজকাল ... '
    ----- ' কেন, কি হয়েছে আপনার গিন্নীমা ? '
    ----- ' ঘড়িটা খারাপ হওয়ার পর থেকে আমার মনটা একদম ভাল নেই গো নরেন ... কি বলব ... কেমন যেন অস্থির লাগে সবসময় ... খেতেও ভাল লাগে না ... '
    নরেন পাল বললেন, ' মাণিকবাবু... গিন্নীমাকে একবার আপনাদের ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে নিন না। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ওনার তো কখনও শরীর খারাপ হতে দেখিনি ... '
    কাঞ্চনও বলল, ' হ্যাঁ দাদা, তুই কালীময় ভটচাজকে একবার খবর দে ... একবার দেখিয়ে নে ... '
    সৌদামিনী বললেন, ' আরে না না ... ডাক্তার দেখাতে হবে কেন ? কি হয়েছে কি আমার ? '
    নরেন পাল বলে উঠলেন, ' না না ... হবে আবার কি ... আপনি ঘড়িটা নিয়ে এত চিন্তা করবেন না তো ... ওটার জন্য তো আমারও খুব মন খারাপ ... আমাদের এত দিনের পুরণো সঙ্গী। কিন্তু কি আর করা যাবে ... সকলকেই তো একদিন অবসর নিতে হয় ... কত যুগ ধরে সার্ভিস দিল বলুন ... '
    সৌদামিনী কোন কথা না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিঃসরণ করলেন।
    মাণিকলালবাবু বললেন, ' পালকাকা ... বলছিলাম যে, ওখানে নতুন একটা ঘড়ি লাগালে হয় না ... '
    ----- ' হ্যাঁ ... তা লাগানো যেতে পারে। তবে, ওই জাতের ঘড়ি তো আর এখন তৈরি হয় না। অ্যাংলোসুইস তো করেই না। সে সব পাট চুকে গেছে। এখন আর আমাদের ঘড়িবাবুদের কোন কাজ নেই... '
    পালবাবুর কথাগুলোয় যেন সাঁঝবেলায় পূরবীর বিষণ্ণ তান লাগল।
    মাণিকলাল বললেন, ' হ্যাঁ, সে তো জানি ... তবু ওই জায়গাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, তাই... নেই মামার চেয়ে কানাই মামা ভাল এই আর কি ...'
    ------ ' তা ভাল ...তা ভাল ... লাগিয়ে দাও দাও ... '
    ঘড়িবাবু নরেন পাল সায় দিলেন।
    সৌদামিনী উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ' তোরা করছিস কর ... আমার কিন্তু মোটে ভাল লাগছে না। মনটা কেমন কেমন করছে। ওর জায়গায় আর একজন .... ও সহ্য করতে পারবে তো ... '
    কাঞ্চন আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, ' তুমি এসব আজগুবি কথা বোল না তো জেঠিমা ... কোন মানে হয় না। একটা ঘড়ি খারাপ হওয়া নিয়ে তোমরা এমন কান্ড করছ যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। এই বয়সে এসব বেশিক্ষণ নেওয়া যায় না ... '
    সৌদামিনী কাঞ্চনের কথার কোন জোরাল প্রতিবাদ করলেন না। মৃদু কন্ঠে বললেন, ' কি করে বোঝাব ... আমার কেমন ভয় ভয় করছে ... '
    কাঞ্চন চাঁচাছোলাভাবে বলল, 'সেজন্যই তো দাদাকে বললাম কালীময় ভটচাজকে একবার দেখিয়ে নিতে ... নিশ্চই মানসিক কোন সমস্যা হয়েছে ... আমি আসছি, অনেক কাজ পড়ে আছে...'
    নরেন পাল বললেন, ' আমিও এবার উঠব ... শেফালিকে বলে দিন না এক কাপ চা দিতে ... '
    সৌদামিনী গলা চড়িয়ে ডাকলেন, ' এই শেফালি ... '

    সেদিন রাত দুটোর সময় যে যার ঘরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সৌদামিনী তার ঘরে একাই শোন।
    কর্ত্তা চলে যাওয়ার পর থেকে একাই থাকেন ঘরে। বয়সজনিত কারণে তার ঘুম খুব কমে গেছে। বিছানায় দীর্ঘক্ষণ ধরে এপার ওপাশ করার পর রাত দেড়টা দুটো নাগাদ একটু তন্দ্রা আসে। আজকেও তাই এল। কিন্তু তন্দ্রা আসা মাত্র তা ছুটে গেল।

    তিনি শুনতে পেলেন পাশের বসবার বড় ঘরে ঢং ঢং করে দুটো ঘন্টা বাজল। এ আওয়াজ অ্যাংলোসুইস কোম্পানির গ্র্যান্ডফাদার ক্লক ছাড়া আর কোন ঘড়ি থেকে বেরোয় না। সৌদামিনী দেবী খাট থেকে উঠে টলতে টলতে পাশের ঘরে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন দেয়াল ফাঁকা। সেখানে কোন ঘড়ি নেই। ঘরে মৃদু নীলাভ আলো জ্বলছে। সৌদামিনী কাঁচের আলমারিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন, সেখানে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে সারা গায়ে যুগ যুগান্তের আঁকিবুকি কাটা মহাপ্রবীন গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। তার সেকেন্ডের কাঁটাটা ঘুরছে টিক টিক টিক টিক ...
    ঘোর লাগা চোখে সেদিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে আছেন সৌদামিনী।

    ( চলবে )
    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যোষিতা | ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:৩০527105
  • ভালো হচ্ছে
  • Anjan Banerjee | ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ২০:৫০527107
  • ধন্যবাদ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন