এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ৯২

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১৯৪ বার পঠিত
  • | | | | | ৬  | ৭  | ৮  | ৯  | ১০  | ১১  | ১২  | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬  | ১৭  | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২  | ২৩  | ২৪  | ২৫  | ২৬ | ২৭ | ২৮  | ২৯  | ৩০ | ৩১  | ৩২  | ৩৩  | ৩৪ | ৩৫ | ৩৬  | ৩৭  | ৩৮  | ৩৯  | ৪০  | ৪২  | ৪৩  | ৪৪  | ৪৫  | ৪৬ | ৪৭  | ৪৮  | ৪৯  | ৫০  | ৫১  | ৫২ | ৫৩ | ৫৪ | ৫৫ | ৫৬ | ৫৭ | ৫৮ | ৫৯ | ৬০ | ৬১ | ৬২ | ৬৩ | ৬৪ | ৬৫ | ৬৬ | ৬৭ | ৬৮ | ৬৯ | ৭০ | ৭১ | ৭২ | ৭৩ | ৭৪ | ৭৫ | ৭৬ | ৭৭ | ৭৮ | ৭৯ | ৮০ | ৮১ | ৮২ | ৮৩ | ৮৪ | ৮৫ | ৮৬ | ৮৭ | ৮৮ | ৮৯ | ৯০ | ৯১ | ৯২ | ৯৩ | ৯৪ | ৯৫ | ৯৬ | ৯৭ | ৯৮ | ৯৯ | ১০০ | ১০১ | ১০২ | ১০৩ | ১০৫ | ১০৬ | ১০৭ | ১০৮ | ১০৯ | ১১০ | ১১২ | ১১৩ | ১১৪ | ১১৫ | ১১৬ | ১১৭ | ১১৮ | ১১৯ | ১২০ | ১২১ | ১২২ | ১২৩ | ১২৪ | ১২৫ | ১২৬ | ১২৭ | ১২৮ | ১২৯ | ১৩০ | ১৩১ | ১৩২ | ১৩৩ | ১৩৪ | ১৩৫ | ১৩৬ | ১৩৭ | ১৩৮ | ১৩৯ | ১৪০ | ১৪১ | ১৪২ | ১৪৩ | ১৪৪ | ১৪৫ | ১৪৬ | ১৪৭ | ১৪৮ | ১৫০ | ১৫১ | ১৫২ | ১৫৩ | ১৫৪ | ১৫৫ | ১৫৬ | ১৫৭ | ১৫৮ | ১৫৯ | ১৬০
    শশধরবাবু বললেন, ' তা তোমার পরিবার ভাল আছে তো ? '
    বিভূতিবাবু বললেন, ' আপনাদের আশীর্বাদে টেনে নিয়ে যাচ্ছি আর কি জ্যাঠামশাই... '
    ----- ' আর কি ... টেনে নিয়ে যেতে পারলেই হল ... দেশের অবস্থা কিরকম বুঝছ ? চালাতে পারছে এরা ? '
    ------ ' কি আর বলব জ্যাঠামশাই ... আমরা তখনও ভাল ছিলাম না , আপনারা তো কত ফাইট করেছেন , অনেকে প্রাণ দিয়েছেন , আর এখনও ভাল নেই ...   এখন আর কার সঙ্গে আমরা ফাইট করব বলুন ... এখন নিজেরাই নিজেদের মারছি ...'
    ----- ' তাই তো ... এখন তো আর ব্রিটিশরা নেই... কমিউনাল রায়টও নেই,  তবু কত অশান্তি চারিদিকে ... নীরদ চৌধুরী মশাই যখন বলেছিল, এরা দেশ চালাতে পারবে না , তখন তো তাকে সবাই এই মারে তো , সেই মারে ... আর এখন কি দেখছ বল ... '
    শশধরবাবু আর্মচেয়ার থেকে উঠে বললেন , ' তুমি একটু বস ... আসছি আমি ... ' বলে কারো সাহায্য ছাড়াই বাইরের দিকে হেঁটে গেলেন । বিভূতিবাবুর মনে হল, খুব সম্ভবত কলঘরে যাচ্ছেন উনি ।
    বললেন, ' আমি একটু ধরব নাকি জ্যাঠা ? '
    ----- ' না না দরকার নেই ... ইঞ্জিনে এখনও তেল আছে । ফুরোলে তখন ধ'র একটু ... ' 
    কলঘর থেকে ফিরে এসে শশধর আবার তার আর্মচেয়ারে আসীন হলেন ।
    বললেন, ' ক'দিন আগে ডাফ স্ট্রিটে কি একটা গন্ডগোল হয়েছিল শুনলাম ... বিমল চক্রবর্তীর বাড়িতে নাকি ... কি সব হ্যারাসমেন্ট ... বিমলের বাবার সঙ্গে আমার ভাল খাতির ছিল । বিমল তো প্রফেসর হয়েছে নাকি ? '
    ----- ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... '
    ----- ' তা ব্যাপারটা কি হয়েছিল কি ... শুনলাম নাকি বোমা টোমা পড়েছে ... '
    ----- ' হ্যাঁ ... ভাগ্যিস সাগর ছিল , নইলে শয়তানগুলো বিমলবাবুর ঘাড়ে চেপে বসত ... '
    ----- ' অ ... এসব গুন্ডা বদমাশরা আজকাল বড্ড বাড় বেড়েছে । দেশটা যে কাদের হাতে পড়েছে ... মানুষ খুব ... খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে । তা ... ওই  কার নাম যেন বললে বাবা ... সাগর , না কে বললে ...  সেটা কে ? ' , শশধরবাবু বিভূতিবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। 
    বিভূতিবাবু কিভাবে সাগরের পরিচয় দেবেন ঠিক করতে পারছিলেন না ।
    ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত বললেন, ' ও একজন সমাজসেবক । লোকে বিপদে পড়লে তাদের পাশে দাঁড়ায় । ওর লোকজনও আছে অনেক ... বেশ ডাকাবুকো ধরণের ... '
    শশধরবাবু কি বুঝলেন কে জানে , বিভূতিবাবুর  মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে শেষে বললেন, ' অ ... তা ভাল , তা ভাল ... আগে অনুশীলন সমিতিতেও এরকম সব ছেলেরা ছিল .... দরকার হলে লাঠিসোঁটাও ধরতে পারত ... জান তো ... '
    ----- ' হ্যাঁ হ্যাঁ জ্যাঠামশাই ... শুনেছি । অনেকটা সেই রকমই আর কি ... '
    ----- ' তা বেশ , তা বেশ ... বিমলকে রক্ষা তো করল ... আলাপ করার ইচ্ছে রইল  ... '
    ----- ' কার সঙ্গে জ্যাঠামশাই  ? '
    ----- ' কেন , ওই  সাগরের সঙ্গে ।  হয় না ? '
    বিভূতিবাবু এবার প্রমাদ গনলেন ।
    তিনি বললেন , ' হ্যাঁ মানে ... তা হতে পারে হয়ত । কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে ... আমার সঙ্গে তো তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই  তাই ... তবে আপনি বললেন যখন আমি দেখব দেখব ... নিশ্চয়ই দেখব  ... '
    ------ ' হ্যাঁ , দেখ না একটু ... লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে খুব ... আর কদিনই বা কথা বলার সুযোগ পাব ... অঢেল সময় তো বয়ে গেল ... '
    দুজনেই একটু চুপ করে রইলেন। 
    তারপর বিভূতিবাবু বললেন, ' সংসারনাথ তো গতবছর পুজোর পর মারা গেল । আমার থেকে কত ছোট । বড় ভাল ছেলে ছিল । বাঙালদের একদম পছন্দ করত না , এটা ওর একটা রোগ ছিল বলতে পার ... ওটা বাদ দিলে ও কিন্তু খুবই সজ্জন ছিল ... '
    ------ ' নিঃসন্দেহে নিঃসন্দেহে... ' , বিভূতিবাবু ঘাড় নাড়তে থাকেন ।
    বিভূতিবাবু ভাবলেন , সাগরের প্রসঙ্গটা এখন আর না উঠলেই ভাল, নইলে শশধর হয়ত আবার সাগরের সাক্ষাৎ বাসনা প্রকাশ করবেন ।
    তিনি কথা ঘোরানোর জন্য বললেন, ' জ্যাঠামশাই... আজকাল আর বাইরে একদম বেরোন না , না ? '
    ------ ' বেরোতে তো চাই ... কিন্তু আমার কেয়ারটেকারদের অতি যত্নে আমার আর বেরোন হয়ে ওঠে না । বুঝতে পারে না , আমার ইঞ্জিনে এখনও অনেক ফুয়েল আছে । আমি এখনও এক মাইল হাঁটতে পারি । সেদিন অবশ্য , ওই যে মেয়েটা দেখলে ... দুর্গা , ও পরশুদিন আমাকে হেদুয়ায় ঘুরিয়ে এনেছে দু পাক , তাও সময় মেপে আধা ঘন্টার মতো ... যেন বাড়ির কুকুরকে পার্কে পাক খাওয়াতে নিয়ে এসেছে .... হ্যাঃ ... '
    বিভূতিবাবু অত্যন্ত বিব্রত হয়ে বললেন, ' না না , ছি ছি ... এ কি বলছেন জ্যাঠামশাই ! আপনার পরিবার আপনাকে এত ভালোবাসে বলেই তো এত যত্ন করে ... '
    ----- ' সে তো বটেই,  কিন্তু যত্নের ঠেলায় আমার যে প্রাণ ওষ্ঠাগত ... এই এখানে বসে বসে জানলা দিয়ে রাস্তার লোকজন দেখি আর কি ... '
    বিভূতিবাবু ভাবলেন মানুষের জীবনে যে কত রকমের সমস্যা তার ঠিক নেই । এ বুড়োর যেমন , সুখে থাকতে ভূতের কিলোচ্ছে ।

    বললেন,  ' আপনাকে একদিন আমার বাড়িতে নিয়ে যাব জ্যাঠামশাই ... সেই কবে একবার গিয়েছিলেন ... '
    শশধরবাবুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল । ফোকলা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ' হ্যাঁ, মনে আছে ... তোর বাবা ছিল তখন । তখনও তোদের তিনতলাটা হয়নি ... ভেতরের উঠোনটায় উনুনে আঁচ ধরানো হয়েছিল । ওখানে একটা বড় খাঁচায় একটা টিয়াপাখি ছিল, সেটা ডাকছিল ।  একতলার ঘরে একজন বসে হারমোনিয়াম    বাজিয়ে 'বাবুল মোরা' গাইছিল, বোধহয় তোদের আগের ভাড়াটে গগনচাঁদ  ... তা গেলে হয় , কবে নিয়ে যাবে । আমি অসীমের সঙ্গে কথা কয়ে রাখব ... ওনাদের পারমিশান ছাড়া আমি তো এখন হাঁচতে কাশতেও অপারগ ... বুঝলে কিনা ... হ্যাঃ হ্যাঃ ... '
    বিভূতিবাবু শশধরের স্মৃতিশক্তি দেখে মুগ্ধ হলেন,  তবে এ ব্যাপারে তার ধারণা ছিল । তাই তেমন অবাক হলেন না । পরের দিকের কথাগুলো শুনে ভাবলেন, এ..ই বুড়ো আবার শুরু করল ...
    বললেন, ' কালই চলুন না জ্যাঠামশাই ... কখন গেলে সুবিধে হবে বলুন । আমি এসে নিয়ে যাব ... '
    ----- ' আচ্ছা , ঠিক আছে ... বড় নাতি অসীমের  সঙ্গে কথা কয়েক দেখি, ও-ই তো এখন আমার অলিখিত গার্জেন , বুঝলে কিনা  ... '
    তারপর কি ভেবে শশধরবাবু হঠাৎ বললেন, ' আর একটা যুগ বিদায় নিতে চলেছে । পঞ্চাশের দশক শেষ হতে চলল ... তাই  তো ? '
    বিভূতিবাবু একটা গভীর শ্বাস ফেলে বললেন,
    ' হমম্ ... '
    শশধর এবং বিভূতি দুজনের চোখেই সাঁঝের ঘোর লাগল । অশ্রুত ধ্বনিতে কোথায় যেন বেজে উঠল ... ধূসর জীবনের গোধূলিতে .... ক্লান্ত ছায়া, ম্লান ছবি ...
         

        তার পরের দিন সকালে রাত্রি আবার সাগরের বাড়ি গেছে । পরিচর্যা শেষ হবার পর বলল, ' আর বোধহয় আমার আসার দরকার নেই  । সামনের সোমবার হাসপাতালে গিয়ে সেলাই কাটা বা অন্যান্য কাজ করে আসতে হবে । ওগুলো তো আমি করতে পারব না ... '
    সাগরের হঠাৎ মন খারাপ লাগতে লাগল । এ ক'দিনের ঘটনাগুলো অবাস্তব স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল ।
    নিঃসহায় কোন বালকের মতো সে বলল, ' কিন্তু হাসপাতালে ... এসব ব্যাপার তো কানুরা ভাল বোঝে না ... '
    কানু বলল, ' সেটাই  তো ... সেটাই তো ... সেটাই তো পবলেম... '
    রাত্রি হেসে বলল, ' না না ... পবলেম তেমন কিছু হবে না ... আমিও তো ওখানে থাকব রে বাবা ... নইলে সেলাই কাটতে গিয়ে কি কেটে যায় কে জানে ... '
    সরযূদেবী কি জানি কি ভেবে বললেন, ' হ্যাঁ ... তা যা বলেছ মা ... '

       
        পুজো এগিয়ে আসছে দেখ দেখ করে । এই দশকের শেষ পুজো । রামদুলালের অনেকের, বিশেষ করে বিভূতিবাবুর মনে গতবারে এই সময়ের সুখস্মৃতি জেগে আছে । বিভূতিবাবুর ঘরে তখন হৈ হৈ করে অসিত পরিচালিত সরীসৃপ নাটকের রিহার্সাল চলছে । কি আনন্দে কেটেছিল মাস দুয়েক ।
    বিভূতিবাবু ভাবলেন , এবারেই বা হতে অসুবিধে কোথায় । টাকা পয়সা জোগাড় করার দায়িত্ব না  হয়  তিনিই নিলেন । অসিতের সঙ্গে যোগাযোগ করে কথাটা একবার তোলা যেতে পারে । ছোকরার কিন্তু এলেম আছে স্বীকার করতে হবে । কলেজের পড়াশোনা নিয়ে  ইদানীং ব্যস্ত আছে শুনেছেন বিভূতিবাবু । যাক , তবু পুজোর আগে পরে কিছুটা অবসর বার করতে পারবে বলে মনে হয় । এই সময়ে তো পড়ার চাপ আলগা থাকে বলে জানেন বিভূতিবাবু ।
    বিভূতিবাবু এদিকে নবতিপর বৃদ্ধ শশধর আওনকে একদিন তার বাড়িতে নিয়ে আসার কথা বলে এসেছেন । পঁচানব্বই বছরের যুবক শশধরবাবু তার বাড়িতে পা রাখলে তার খুব ভাল লাগবে । সেই ছোটবেলা থেকে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে । তার বাবার সঙ্গে কথা বলতেন উনি ওই বৈকুন্ঠ বুকহাউসের ওখানটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । তখন অবশ্য ওই বইয়ের দোকানটা হয়নি । শশধরবাবুর সারা গায়ে যেন ইতিহাসের গন্ধ । কোন দূর সাগরের হাওয়া এসে যেন মনের তট ধরে এলোমেলো বয়ে যায় । এখন দেখা যাক তার বড় নাতি অসীমের পারমিশান কবে আদায় হয় । মশলাপাতির ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে । অসীমরা এখন লাখপতি । ব্যস্ততার শেষ নেই।  স্বরাজ , স্বাধীনতা এসব বেশ অবান্তর কথা মনে হয় । অত ভাবার সময়ও নেই,  পুরণো কাসুন্দি ঘাঁটার শখও নেই এদের ।   এসব দেখলে  বিভূতিবাবুর হাসি পায় । পরিবারের মূল্যবান প্রত্ন সামগ্রীর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যখচিত  প্রাচীন শশধরকে ঝেড়ে মুছে আবার শো কেসে তুলে রাখার ব্যাপারে তারা পরম যত্নশীল । শুধু বাড়িতে উল্লেখযোগ্য কোন অতিথির পদার্পণ ঘটলে তাকে শো কেস থেকে বার করে দেখানো চাই । তাতে অবশ্য মশলার ব্যবসার কোন শ্রীবৃদ্ধি ঘটে কিনা জানা নেই  বিভূতিবাবুর । এই মানুষই এক সময়ে একজন দৃঢ়সংকল্প নির্ভীক স্বাধীনতাসংগ্রামী ছিলেন ভাবতে কেমন লাগে তার।

        বিভূতিবাবু নীচে নেমে রাত আটটা নাগাদ একবার নিতাইবাবুর ঘরে ঢুকলেন । ভাবলেন, এখান থেকে হয়ত অসিতের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে । 
    নিতাইবাবু চা খাচ্ছিলেন । বিভূতিবাবুকে দেখে বললেন, ' আরে ... দত্তবাবু যে , আসুন আসুন ... চা খাবেন নাকি ? '
    ----- ' তা ... এক কাপ হলে হয় ... '
    অঞ্জলি বলল, ' একটু বসুন, বসাচ্ছি ... আমিও খাব ... '
    নিতাইবাবু বললেন, ' তারপর ...  বলুন দত্তদা ... কি খবর ? পুজো তো এসে গেল প্রায় ... গতবার কি হৈ হৈ করে কেটেছিল বলুন ওঃ ... নাটকের রিহার্সাল হত বাড়িতে ... কত লোকজন আসত যেত ... '
    ----- ' অ্যাই হ্যাঁ ... এটাই বলতে যাচ্ছিলাম । আবার ওরকম একটা হতে অসুবিধে কি ? ' বিভূতিবাবু কথাটা ধরিয়ে দিলেন। 
    ----- ' বটেই তো ... তেমন অসুবিধে কি ? টাকার ব্যাপারটা অবশ্য ... '
    ----- ' ওটা নয় আমি দেখে নেব'খন । সেটা না ... কথা হল ডিরক্টরেরই তো খোঁজ নেই অনেকদিন । আগে তবু এ পাড়ায় আসত মাঝে মাঝে ... '
    নিতাইবাবু বললেন, ' অসিতের কথা বলছেন ? '
    ----- ' হ্যাঁ ... ওকে ছাড়া তো কিছু হবে না ... ওর সঙ্গে কথা বলার দরকার ... '
    ----- ' তাই তো ... অসিতকেই তো আগে দরকার ...'
    নিতাইবাবু একমত হন । অনিমেষ বাড়ি নেই।  সে থাকলে এ ব্যাপারে হয়ত আলোকপাত করতে পারত । কিন্তু সে এখন বাড়ি নেই ।  বোধহয় কোথাও আড্ডায় ব্যস্ত ।
    পাশের ঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে কে যেন ঈষৎ বিড়ম্বিত কন্ঠে বলল, ' ও এখানে নেই ... খড়গপুরে গেছে পিসীর বাড়ি ... '
    বিভূতিবাবু এবং নিতাইবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে শ্রীলেখা ।
    বিভূতিবাবু বললেন , ' অ ... তাই  নাকি ...  তা কবে ফিরবে জানিস কিছু ? '
    শ্রীলেখা মৃদু কন্ঠে বলল, ' ঠিক জানিনা ... বোধহয় পরশু... ' , বলে ঘরের ভিতর ঢুকে গেল । নিশ্চয়ই কোন পাটিগণিত অর্ধসমাপ্ত রেখে উঠে এসেছিল ।
         অঞ্জলি দুকাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল । কেউই শ্রীলেখাকে জিজ্ঞেস করল না ---- তুই  কি করে জানলি ?
    বিভূতিবাবু বললেন, ' যাক তবু একটা হদিশ পাওয়া গেল । ঠিক আছে ... অসিত ফিরুক আগে ... তারপর নয় ... আমার খুব ইচ্ছে শশধর জ্যাঠামশাইকে একটা ছোট রোল দিয়ে স্টেজে তোলা । শশধরবাবুকে চেনেন তো ? '
    ----- ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... ওই স্বাধীনতা সংগ্রামী তো ? তেনার তো অনেক বয়েস হয়েছে ... '
    ---- ' হ্যাঁ ... তা হয়েছে । তবে তিনি এখনও রীতিমতো তরতাজা । আমার বাড়িতে আসবার কথা দু একদিনের মধ্যে ... '
    ----- ' তাই  নাকি ? ভাল ভাল ... ' নিতাইবাবু সন্তোষ প্রকাশ করেন । বিভূতিবাবু মৌজ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন । বললেন, ' ঠিক আছে ... অসিত ফিরে আসুক , তারপর কথা বলা যাবে । দেখি কি নাটক জোগাড় করে এবার । আগেরবার তো খাসা প্লে নামিয়েছিল একখানা । খুব সুখ্যাত হয়েছিল । কিন্তু হ্যাঁ ... নিতাইবাবু , অসিত ফিরলে জানা যাবে কি করে ? আমরা তো ... '
    পাশের ঘর থেকে আবার শ্রীলেখার গলা শোনা গেল , ' দাদা ওর বাড়ি চেনে ... '
    শ্রীলেখার অঙ্কে মনঃসংযোগ বোধহয় বারবার ব্যহত হচ্ছে ।
    বিভূতিবাবু পরম উৎসাহে বললেন, ' বাঃ ... তা'লে তো হয়েই গেল । অনিমেষ গিয়ে যদি একটু খবর নেয় ... '
    নিতাইবাবু বললেন, ' বলব বলব ... ওই পরশুদিন তা'লে ... '
    ----- ' আচ্ছা , ঠিক আছে  ... '
    আরও মিনিট দশেক গল্পগুজব করার পর বিভূতিবাবু বললেন , ' আমি তা'লে উঠি এখন ... ওই কথাই রইল ... দেখা যাক কদ্দুর কি হয় ... কাল সকালে একবার আওন বাড়িতে খোঁজ নিতে হবে শশধরবাবু কবে আসবেন আমার বাড়িতে ... '
    ----- ' হ্যাঁ ... তা দেখুন না ... দেখুন না ... '

         রাত্রে কালীপদ শশধরবাবুর ঘরে শোয় । বয়স্ক মানুষ , রাত বিয়েতে কি হয় না হয় ... বাড়ির কচি গার্জেনরা রাত্রে তাকে একা রাখতে ভরসা পায় না । কালীপুজোর এ বাড়ির অনেকদিনের লোক ।  বারান্দায় পড়ে থাকা একটা ক্যাম্পখাট কালীপদ এ ঘরে ঢুকিয়ে নেয় রাত দশটার পর । প্রায় পাঁচবছর ধরে এই  নির্ঘন্ট বজায় আছে ।
    শশধরবাবু তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে যান কিন্তু ঘুম সহজে আসে না । কালী যখন শুতে আসে শশধর তখনও জেগে থাকেন । কালীর সঙ্গে টুকিটাকি কথা বলেন । কালীপদ রোজ এ বাড়ির বাজার করে । শশধর তার কাছে বিভিন্ন মাছের , লাউয়ের, পটলের , ঝিঙের,  উচ্ছের সেদিনকার বাজারদর জিজ্ঞাসা করেন । কালীও প্রতিদিন তাকে দোকান বাজারের বেচাকেনা সংক্রান্ত খবর দিতে থাকে । এ ছাড়া শশধর প্রায় প্রতিদিনই উড়িষ্যায় কালীপদর দেশ গাঁ , আত্মীয় পরিজনদের খবরাখবর জিজ্ঞাসা করেন । রোজ রাতের  আঁধারে প্রায় একই ধরনের টুকরো টুকরো কথা একান্তে বাজতে থাকে ঘরের মধ্যে ।
    এই সব প্রাত্যহিক পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত অকিঞ্চিৎকর কথার টুকরোগুলো শশধরের বুকের ভিতর এ পৃথিবীর মাটি জল আকাশের  প্রাণস্পন্দন জাগিয়ে রাখে ।
    ধীরে ধীরে ঘুমের ভোমরা গুনগুন করতে থাকে শশধরবাবুর চোখের তারার কাছে । চোখের পাতা
    জুড়ে আসে । তার প্রাণস্পন্দন নির্গত হতে থাকে মৃদু নাসিকাগর্জনের মধ্য দিয়ে । কালীপদ নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শোয়।
    ভোর পাঁচটায় উঠে আবার কাজে লাগতে হবে ।
    বাবামশাইয়ের ঘুম ভাঙে ছ'টা নাগাদ । কিন্তু তিনি চোখ বুজে শুয়ে ঘুমের আবেশ উপভোগ করেন । কালীপদ সাড়ে ছ'টা নাগাদ এসে শশধরকে বুকে হাত দিয়ে ডাকে বিছানা ছাড়ার জন্য , ' বাবামশাই, ও বাবামশাই ... '
    আজকেও একইভাবে কালীপদ সাড়ে ছ'টার সময় শশধরবাবুর বিছানার ধারে এসে দাঁড়াল ।
    ----- ' বাবামশাই ... ও বাবামশাই  ... '

          ( চলবে )
    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | ৬  | ৭  | ৮  | ৯  | ১০  | ১১  | ১২  | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬  | ১৭  | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২  | ২৩  | ২৪  | ২৫  | ২৬ | ২৭ | ২৮  | ২৯  | ৩০ | ৩১  | ৩২  | ৩৩  | ৩৪ | ৩৫ | ৩৬  | ৩৭  | ৩৮  | ৩৯  | ৪০  | ৪২  | ৪৩  | ৪৪  | ৪৫  | ৪৬ | ৪৭  | ৪৮  | ৪৯  | ৫০  | ৫১  | ৫২ | ৫৩ | ৫৪ | ৫৫ | ৫৬ | ৫৭ | ৫৮ | ৫৯ | ৬০ | ৬১ | ৬২ | ৬৩ | ৬৪ | ৬৫ | ৬৬ | ৬৭ | ৬৮ | ৬৯ | ৭০ | ৭১ | ৭২ | ৭৩ | ৭৪ | ৭৫ | ৭৬ | ৭৭ | ৭৮ | ৭৯ | ৮০ | ৮১ | ৮২ | ৮৩ | ৮৪ | ৮৫ | ৮৬ | ৮৭ | ৮৮ | ৮৯ | ৯০ | ৯১ | ৯২ | ৯৩ | ৯৪ | ৯৫ | ৯৬ | ৯৭ | ৯৮ | ৯৯ | ১০০ | ১০১ | ১০২ | ১০৩ | ১০৫ | ১০৬ | ১০৭ | ১০৮ | ১০৯ | ১১০ | ১১২ | ১১৩ | ১১৪ | ১১৫ | ১১৬ | ১১৭ | ১১৮ | ১১৯ | ১২০ | ১২১ | ১২২ | ১২৩ | ১২৪ | ১২৫ | ১২৬ | ১২৭ | ১২৮ | ১২৯ | ১৩০ | ১৩১ | ১৩২ | ১৩৩ | ১৩৪ | ১৩৫ | ১৩৬ | ১৩৭ | ১৩৮ | ১৩৯ | ১৪০ | ১৪১ | ১৪২ | ১৪৩ | ১৪৪ | ১৪৫ | ১৪৬ | ১৪৭ | ১৪৮ | ১৫০ | ১৫১ | ১৫২ | ১৫৩ | ১৫৪ | ১৫৫ | ১৫৬ | ১৫৭ | ১৫৮ | ১৫৯ | ১৬০
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন