আমাদের যেতে হবে আরও দু’কোশ পথ। এর মধ্যে যত গাঁয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছি সেখান থেকে ভিড় এসে মিছিলে পা মেলাচ্ছে। কেউ কেউ চালির উপরে ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে। কাল রাত্তিরে বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় একটু কাদা। এখন মেঘলা আকাশের ফাঁক দিয়ে কড়া রোদ্দূর । আমাদের পিঠে কপালে চিট চিট করছে ঘাম। কিন্তু আমরা তোয়াক্কা করছি না । এখনও অনেক পথ বাকি। আমার চোখে জল নেই। আমি জানি যে রমেনের আর কিছু চাওয়ার ছিল না । ... ...
এদিকে সংগঠনের মধ্যে অন্য চিন্তা দানা বাঁধছে। সবাই টের পাচ্ছে যে একটি সর্বভারতীয় পার্টি ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে। তাহলে আমরা কি বাদ পড়ে যাব? এরা, মানে মিথিলেশ, দীপক, সুকান্ত রমেন ও আরও কয়েকটি ইউনিট বলতে শুরু করল যে আমরা ডাকাতিতে বিশ্বাস করি না । ক্যাল-আপে বিশ্বাস করি না । আমাদের একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক লাইন চাই। আমরা সশস্ত্র গণ -সংগঠন গড়তে চাই । আমরা অবিনাশের বা ওল্ড গার্ডের সঙ্গে মুখোমুখি বসতে চাই । ... ...
আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী ১৯৬৮র শীতের শেষে ময়দানে মুক্তমেলার আয়োজন করলেন। এক রোববার। জানা গেল কোথায় তুষার রায় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতা ""ব্যান্ড মাস্টার'' পড়ছেন। সমরেশ বসু গান শোনাচ্ছেন দেখে সুনীল গাঙ্গুলী বলছেন আমিও গান গাইব। পাবলিক উৎসাহ দিচ্ছে—চালিয়ে যাও মহারাজ! কোথাও একটি আলাদা ভীড়ের সামনে কোন বাউল পল্লীগীতি গাইছে। কোথাও থিয়েটার ক্যাম্প বলে একটি নাটকের দল ভিয়েৎনাম নিয়ে নাটক করছে। ... ...
ফেরারি ফৌজের রোল কল? ডেকচিতে ফুটন্ত ভাত উথলে উঠেছে। বিজনদা উঠে গিয়ে ঢাকনা তুলে দুটো ভাত টিপে আবার চাপা দিল। --আর দু-তিন মিনিট; তার পরেই নামিয়ে দেব। ... ...
“শুয়োরের বাচ্চা জনগণ, / বছর বছর নির্বাচন?” --সব তো হল। বোমা বাঁধা, কামানের গোলা, এক ঘুসিতে একটা ছেলের ঠোঁট ফাটিয়ে দেওয়া, বই পোড়ানো, স্যারের হাত থেকে বেত কেড়ে নেওয়া; আর কিছু বলার নেই? ... ...
বেড়ালের মুখে সুকান্ত আর চারুদার কথা? হাত বাঁধা হলে কি হয়, পা তো খোলা। আর বেড়ালটা বেশ কাছে ঘেঁষে এসেছে। সজোরে চালানো লাথিটা খাটের লোহার পায়ায় একটু ছুঁয়ে গেল। না, বেশি ব্যথা লাগে নি। কারণ লাথিটা--মনে মনে যেমনই ভেবে থাকি না কেন-- 'সজোরে' চলে নি। পায়ে কোমরের পাওয়ার হাউস থেকে সেই শক্তিটা এল না। আর বেড়ালটা জানলার তাকে উঠে গা-জ্বালানো মুচকি হাসি হাসতে লাগল। বলল-- লক্ষ্মীছেলে! ... ...
বেড়ালটা আবার এসেছিল।কাল রাত্তিরে। জানলা দিয়ে দিব্যি গলে চলে এল। আমার খাটের পাশে ওষুধপত্তর ও নার্সের চার্ট রাখা ছোট সাদামত বিধবা টেবিলটার ওপর কেমন যেন অলস ভঙ্গিতে উঠে বসল। আমাকে দেখতে লাগল। পিত্তি-হলুদ চোখ। আমি হাত নেড়ে তাড়া দেব, সে সুযোগ নেই।হাত জোড়া আছে খাটের পাশে স্ট্যান্ড থেকে ঝোলানো রক্তের বোতলে। ব্লাড ট্রানসফিউশন। আগের কেমো হয়ে যাওয়ার পর প্লেটলেট কাউন্ট নাকি কমে গেছে ... ...
দুদিন পরে শংকর এসে হাজির হল আমার অস্থায়ী ডেরায়। আমার হাতের তৈরি কালো চা খেয়ে মুখ ভেটকে বলল -- সামান্য চা টাও ঠিক করে বানাতে পারিস না। তোকে নন্দিতাবৌদি আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছিল। পরে বুঝেছে যে এমন অপদার্থ লোককে মাথায় রাখলে বোঝা বাড়ে, তাই নামিয়ে দিয়েছে। আমি মুচকি হাসি। কিন্তু কোথায় যেন খচ্ করে লাগে ... ...
অমন হাইটের শংকর, কিন্তু ওর বাবা বীরেশবাবু ছিলেন মেরেকেটে পাঁচ দুই। তাই ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়তেন না। একদিন লম্বু অরবিন্দনগরের আড্ডায় অনুযোগ করল--রমেন, তোর ব্যবহারে বাবা দুঃখ পেয়েছে রে! বলেছে রমেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগ্রেট খায়, আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু আমাকে দেখে একটু আড়াল করলেও তো পারে! লুকোনোর চেষ্টাও নেই, ফুকফুক করে ধোঁয়া ছেড়েই চলে। ... ...
বাগানের নারকোল গাছগুলো নেই। ওদের শেকড়ের চোরাগোপ্তা আক্রমণে নাকি পাঁচিলটা পড়ে গিয়েছিল। আছে সুপুরিগাছগুলো। তাতে সুপুরির গোছা ঝুলছে গলগন্ডের মত। বাগানে গোলাপগাছের সংখ্যা কিছু কমেছে। কোথায় সেই লতানে গোলাপগুলো এবং সাদা-হলুদ গোলাপের দল? আর বাঁশদ্রোণী বাজার থেকে কেনা চৌ এন-লাই গোলাপ! চৌ এবং তাঁর নামে রাখা গোলাপ সবই কবে বিবর্ণ হয়ে ঝরে গেছে। ... ...