এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ৭ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১১ আগস্ট ২০২৩ | ৩৩৯ বার পঠিত
  • হরিপদ ঘোষ রাজারহাটের এক গ্রাম থেকে সাইকেল চালিয়ে আসে শ্যামবাজার বাগবাজারে দুধ বিক্রী করতে। রাজাবাজারে ক' বিঘে ধানজমি আছে হরিপদর। তবু জাত ব্যবসা ছাড়ে নি সে।  রামকান্ত বোস স্ট্রিটে বিভূতিবাবুর শ্বশুরবাড়িতেও সে দুধ দেয়। ওখানে সবাই বলে হরিপদ দুধে জল মেশায় না, জলে দুধে মেশায়। হরিপদ একটা টিনের কৌটো ভরা দুধ দেখিয়ে বলে, 'এটা একদিন খেয়ে দেখুন না ... দুধ কাকে বলে বুঝতে পারবেন। এই দেখুন ... ' , বলে একফোঁটা দুধ নিজের হাতের উল্টোদিকে ফেলে বলে, 'দেখুন দেখুন ... একেবারে বটের আঠার মতো ... পয়সা খরচ করবেন না তার কি হবে ... '।
     
    বাড়ির কারোরই অবশ্য হরিপদর এই দামী দুধের সঙ্গেও বটের আঠার কোন সাদৃশ্য কোনোদিন চোখে পড়ে নি। এই একই ঘটনা, একই সংলাপ চলছে কত বছর ধরে। হরিপদর দুধ যেমনই হোক, তার এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দেওয়া, মানে তার দুধ নেওয়া বন্ধ করে দেবার কথা কেউ কল্পনাও করে না। প্রতিদিন তার কিছুক্ষণের উপস্থিতি, রাজারহাটের আমবাগান, ধানজমি, পুকুরের মাছের গল্পগাছা বেশ লাগে বিভূতিবাবুর শ্বশুর প্রফুল্লবাবুর। তিনি যেন তার অতীতের হাসনাবাদ অঞ্চলের গ্রাম্য জীবন ফিরে পান। হরিপদ প্রফুল্লবাবুকে প্রায়ই বলে, 'আমাদের গ্রামে একদিন চলেন না .... পুকুরের মাছ  খাওয়াব...ক্ষেতের ঝিঙে বেগুন ... '
    ----- ' হ্যাঁ .... যাব যাব ... সময় সুযোগ পেলেই যাব ..... '
    সে সময় বা সুযোগ অবশ্য প্রফুল্লবাবু এখনও করে উঠতে পারেন নি ।

    বিকেল পাঁচটা বাজে। নিতাইবাবু সেভেনটি নাইন সি বাসে করে শ্যামবাজার খালপারে এসে নামলেন। তিনি টাকির দিকে গিয়েছিলেন পৈত্রিক ধানজমির তদারকি করতে। এভাবে যাতায়াত আর করা করা যাবে না বেশিদিন। জমি বিক্রীর ব্যবস্থা করতে হবে। নিতাইবাবুর আরও তিন ভাই আছে। তারা  নড়েও বসে না এই জমিজমার তদারকির ব্যাপারে। কিন্তু নিতাইবাবু জানেন বিক্রিবাটা হয়ে গেলে টাকার ভাগ নিতে কেউ ভুলবে না।

    নিতাইবাবু সেই কখন ভাত খেয়েছেন কার্তিক মন্ডলের বাড়ি। খালপারে বাস থেকে নামার পর খুব ক্ষিধে পেতে লাগল তার। শ্যামবাজার মোড়ের দিকে হাঁটতে লাগলেন। ঠিক করলেন হরিদাস মোদকের দোকানে গিয়ে লুচি খাবেন। কলাপাতার ওপর গরম গরম লুচি তরকারি পড়ল। লুচি তরকারি মুখে পুরতেই পরমানন্দে বিভোর হয়ে তার যাবতীয় দুশ্চিন্তা উবে যেতে লাগল। ছ খানা খাবার পর আরও ক'খানা গরম লুচি নেবার ইচ্ছে হল নিতাই ভটচাজের। তিনি হিসেব করে দেখলেন তার পকেটে এখনও পাঁচ টাকার মতো আছে। তিনি ভেবেচিন্তে আরও চারটে লুচি নিলেন। এরপর পান্তুয়া না খেলে চলে না। দুটো বড় বড় পান্তুয়া নিলেন।

    পয়সা মিটিয়ে হরিদাস মোদক থেকে বেরিয়ে পাশে ইকোনমিক্যাল টি ওয়ার্ল্ড-এর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলেন, এখান থেকে এক কাপ চা খেয়ে গেলে বেশ হয় ... বেশ খাসা চা এখানকার। দোনামোনা করতে করতে শেষে দোকানে ঢুকেই পড়লেন। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে তার প্রাণ একেবারে জুড়িয়ে গেল। মানে তার বৈকালিক ভোজনের ষোল কলা পূর্ণ হল। তিনি দেখলেন অনেকেই মরিচ গুঁড়ো ছড়ানো বাটার টোস্ট আর মামলেটে ডুবে আছে। নিতাইবাবু ভরপেটেও তীব্র আকর্ষণ বোধ করতে লাগলেন। কোনরকমে নিজের লোভ সম্বরণ করলেন। দোকান থেকে বেরিয়ে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন বাড়ি ফেরার ট্রাম ধরার জন্য।
     
    রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে নেমে কি জানি কেন হেদুয়ায় ঢেকে পড়লেন। ভাবলেন, একটা রাউন্ড মেরে যাই।  রাউন্ড মারতে মারতে স্কটিশ চার্চের ওখানটায় পৌঁছেছেন, পালবাবুর মুখোমুখি পড়ে গেলেন। মানে, দেবেন্দ্রনাথ পাল। পালবাবু ডাফ স্ট্রিটে থাকেন। গতবছরে রিটায়ার করেছেন। এখন নাকি ডায়াবেটিসে ধরছে। তাই ডাক্তারের পরামর্শে ধুতি পাঞ্জাবীর সঙ্গে পায়ে কেডস জুতো পরে হনহন করে হেদোর চারদিকে পাক মারেন। নিতাইবাবুর সঙ্গে পরিচয় অনেকদিনের। তাকে দেখে পালবাবু বললেন, 'আ..রে ... নিতাই যে ... কি খবর ... আজকাল দেখাই হয় না ... তা আছ কেমন ... আমি রিটায়ার করেছি জান তো ...  তারপরই তো ব্লাড সুগার ... '।
    ----- ' হ্যাঁ শুনেছি ... তা বাড়ি টাড়ি করার কথা ভাবছেন নাকি কিছু ? '
    -----  ' আর বল কেন ... ভাবছি তো অনেকদিন ধরে। বাড়িওয়ালা তো মাঝে মাঝেই হুড়কো দিচ্ছে। আমরা উঠে গেলে বাঁচে। আমরা উঠে গেলে ওর ছেলে, ছেলের বউ দখল নেবে একতলাটার আর কি ...  ওদেরও অসুবিধে হচ্ছে বুঝতে পারছি ... কিন্তু আমি এই তো সবে মেয়ের বিয়ে দিয়ে উঠলাম ... এখন কি আর হাতে কিছু আছে ....হাতে কিছু না জমলে, কি করে এক্ষুণি .... বুইলে না ... তা জামাই আমার হীরের টুকরো ছেলে ... কি বলব ... সরমা অনেক ভাগ্য করে ... কি বলে ... যেটা সত্যি সেটা স্বীকার করতেই হবে ... বুইলে না ... '।
    নিতাইবাবুর হরিদাস মোদকের লুচি খাওয়ার আমেজ চটকে যেতে লাগল। তিনি প্রসঙ্গটা একটু অন্যদিকে ঘোরাবার চেষ্টা করলেন।
    ----- ' পালবাবু.... এখনও কি ট্রেকিং-এ যান নাকি ? '
    ----- ' অ্যাঁ ... ট্রেকিং? নাঃ ... ওসব বন্ধ এখন ... বয়েস হচ্ছে ... বাড়ি থেকে ছাড়তে চায় না, ভয় পায় ... লাস্ট গিয়েছিলাম ওই ... কি বলে ...  গারুদা পিক ... প্রায় ছ হাজার মিটার হাইট... বাপ রে বাপ ... ওঃ ... মিন্টু দাঁ ইয়াং গান , সেও তো একেবারে ... '
    ----- ' ও আচ্ছা আচ্ছা ... মারাত্মক ব্যাপার। আচ্ছা দেবেনদা .... আপনার সন্ধানে কোন জমি থাকলে বলবেন তো ... একটু বাইরের দিকে হলেও চলবে ... এই দেড় কাঠার মতো ... '
    ----- ' জমি ? ও আচ্ছা ... বাড়ি করার চিন্তাভাবনা করছ ... '
    ----- ' হ্যাঁ, মানে উপায় নেই।  আমারও আপনার মতোই কন্ডিশান। বাড়িওয়ালা ... '
    ----- ' কিছু বলেছে নাকি? '
    ----- ' না মুখে কিছু বলেনি এখনও ... তবে বোঝাই যায় যে ঠিক ... '
    ----- ' হ্যাঁ বুঝেছি বুঝেছি .... জমি মানে ... দালাল আছে ,আমার খুব জানাশোনা । বল তো তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। কোন সময়ে তোমার সুবিধে হবে বল ... আমি বলব নিবারণকে ... ভাল লোক ... '
    ------ ' আচ্ছা, ঠিক আছে পালদা। সন্ধের দিকে এলে কথাবার্তা বলার সুবিধে হবে ... '
    ---- ' তাই বলব ... নিবারণের সঙ্গে রবিবার দেখা হবে জোড়াসাঁকোয়। একটা ভাড়াবাড়ি দেখাবে ... বলব বলব ... আসি এখন ... '
    দেবেন পাল মশায় কেডস জুতো পায়ে আবার হনহন করে হাঁটতে লাগলেন।

    দেখা গেল, সেই বুড়োদের মতো চশমা পরা স্কটিশের সেই ফিজিক্সে অনার্সের ছেলেটা কোলের ওপর একটা বই নিয়ে হেদুয়ার জলের দিকে তাকিয়ে আনমনে কি ভেবে চলেছে। সন্ধে হয়ে আসছে।
           
    ( চলবে )

    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ১১ আগস্ট ২০২৩ ২২:৪৩522348
  • চলুক। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন