এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ১

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৪ আগস্ট ২০২৩ | ৫৬৫ বার পঠিত
  • হেদুয়া পার্কের একপাশে রামদুলাল সরকার স্ট্রীট। কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের বুকের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি বেরিয়ে গেছে ওদিকে দর্জিপাড়ার দিকে। ওই রাস্তাতেই মোড়ের মাথায় বইয়ের দোকান বৈকুন্ঠ বুক হাউস। খানকয়েক বাড়ির পরে নিতাইবাবুর মানে, নিতাইচন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়ি। ভাড়াবাড়ি আর কি। নিতাইবাবু পরিবার নিয়ে একতলায় থাকেন। রেল অফিসে চাকরি করেন। দোতলাতেও আর এক ঘর ভাড়াটে আছে। অনিল ঘোষ সেখানে তার পরিবার নিয়ে থাকেন। বাড়িওয়ালা বিভূতিবাবু, বিভূতিভূষণ দত্ত সপরিবারে তিনতলায় থাকেন। তার বয়স প্রায় ষাট বছর। বায়োস্কোপ দেখার খুব শখ। একা একাই দেখেন। তার স্ত্রী যান তার দুই জায়ের সঙ্গে। মাঝে মাঝে নিতাইবাবু আর অনিলবাবুর স্ত্রী অঞ্জলি এবং গৌরীদেবীর সঙ্গেও যান রূপবাণী, উত্তরা বা চিত্রা হলে। বিভূতিবাবু একা একাই শ্যামবাজার, হাতিবাগান চত্বরে সিনেমা হলগুলোয় নতুন বই লাগলেই পাঁচসিকে দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়েন। এই তো কাল ইভনিং শোয়ে চন্দ্রনাথ দেখে এলেন।

    ছেলে বড়, মেয়ে ছোট। বছর আড়াই হল ছেলের বিয়ে হয়েছে। বাচ্চা কাচ্চা আসেনি এখনও। তার ঘরণী বাসন্তীদেবীর এই নিয়ে একটা অস্বস্তি এবং ঘ্যানঘ্যানানি আছে। সুযোগ পেলেই বিভূতিবাবুর সামনে ঘ্যানঘ্যান করেন। বিরক্ত লাগে বিভূতিবাবুর। এ ব্যাপারটা নিয়ে বাসন্তীর যে এত মাথা ঘামাবার কি আছে কে জানে। যাদের ব্যাপার তাদের বুঝতে দাও না। তার মন এখন বিডন স্ট্রিটে পড়ে আছে। ওই মিনার্ভা থিয়েটারে।

    সামনের বৃহস্পতিবার সাজাহান নামবে। ছবি বিশ্বাস  সাজাহান করবে। রাধিকানন্দ মুখার্জি ঔরঙ্গজেব। সরযূবালা জাহানারা। নীতিশ মুখার্জি দারা। আজ সোমবার। বিভূতিবাবু এখন থেকেই উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছেন। কাল সকাল আটটায় টিকিট কাউন্টার খুলবে। নিমেষে হাউসফুল হয়ে যাবে। কত সকালে গিয়ে লাইন মারলে টিকিট পাওয়া যেতে পারে সেই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে আছে বিভূতিবাবুর মন।

    একতলার ভাড়াটে নিতাই ভটচাজের মেয়ে শ্রীলেখা বড় হচ্ছে। ষোল বছরে পড়ল। পিঠোপিঠি এক ভাই আছে। ভয়ানক ডাকাবুকো, মারকুটে টাইপের। ভাল নাম অনিমেষ। ডাকনাম বাবু।
    শ্রীলেখার চোখে মুখে শ্রী লেগে আছে। নিঃসন্দেহে শ্রীময়ী, নাহলে এত ছেলের চোখ টানবে কেন। একতলায় রাস্তার ধারে ঘরের জানলা। দু চারটে উঠতি বয়সের ছেলে জানলা ঘেঁষে যাতায়াত করে।
    যদি এক ঝলক শ্রী দর্শন হয়। এছাড়া স্কুল টাইমে সকাল বিকেল রাস্তার মোড়ে বৈকুন্ঠ বুক হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তো আছেই।

    দোতলার বাসিন্দা অনিল ঘোষ ইনকাম ট্যাক্সের উকিল। আবার মনীন্দ্র কলেজে পার্ট টাইম ইকনমিক্সের প্রফেসারি করেন। চুয়াল্লিশ পঁয়তাল্লিশের মতো বয়স। তারও এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে বড়, মেয়ে ছোট। ছেলে ক্লাস নাইনে আর মেয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ে।

    সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ বিভূতিবাবু কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিলেন। হঠাৎই এক খবরের কাগজের হকার ব্যস্তভাবে টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম হাঁক পাড়তে পাড়তে বিবেকানন্দ রোডের দিকে হেঁটে গেল। বিভূতিবাবু জানেন ওতে কি আছে। নিশ্চিতভাবে নতুন করে নেতাজির সন্ধান প্রাপ্তি সংক্রান্ত কোন উড়ো খবর আছে। ভর সন্ধেবেলায় এরকম ছোট খবরের কাগজ মাসে অন্তত একদিন বেরোবেই। পাশের দোকানের সামনে জনা পাঁচ ছয় লোক ওকে ঘিরে ধরে টেলিগ্রাম কিনছে।
    ধুতি পাঞ্জাবী পরা নিতাইবাবু ট্রাম থেকে নামলেন।
    নেমেই দেখেন বিভূতিবাবু দাঁড়িয়ে আছেন।
    ----- ‘কি ... আপিস থেকে? ’
    ----- ‘হ্যাঁ ... বিধানবাবুকে দেখলাম একটু আগে ... রাইটার্স থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠছিলেন... ’
    ----- ‘অ .... আচ্ছা আচ্ছা ... ’
    বিভূতিবাবু বিশেষ আগ্রহ দেখালেন না। তিনি নেতা বা পলিটিশিয়ানদের ব্যাপারে বিশেষ কৌতূহলী নন।
    বিভূতিবাবু বেশিদূর লেখাপড়া করেননি। কোনদিন আপিসেও যাননি। বাবার করে যাওয়া বাড়ি ভাড়া দিয়ে তিনি দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন। ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। থিয়েটার আর বায়োস্কোপ তার মূল সঞ্জীবনী শক্তি।

    বাগবাজারের ওখান থেকে একটা ব্রীজ তৈরি হচ্ছে। ওটা হয়ে গেলে সোজাসুজি সিঁথি, বরানগরের দিকে যাওয়া যাবে। কাশীপুর দিয়ে ঘুরে যেতে হবে না। বাগবাজারের রামকান্ত বোস স্ট্রিটে বিভূতিবাবুর শ্বশুরবাড়ি। তিনি প্রায় প্রতিদিন বেলা বারোটা নাগাদ রামকান্ত বোস স্ট্রিটে যান। চা খান, খবরের কাগজ উল্টোন, খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আগডুম বাগডুম কি সব চিন্তা করেন, তারপর, ‘আসলাম’ .... বলে ছাতাটা বগলে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পাশের ঘর থেকে তার বৃদ্ধ শ্বশুর ক্ষীণকন্ঠে বলেন ---- ‘এস বাবা ... সাবধানে যেও ... ’। এ হল মোটামুটি রোজকার রুটিন।

    সেদিন ভোরবেলায়.... হেদুয়ার গেট দিয়ে ছেলে পুলেরা ঢুকছে সাঁতার কাটার জন্য। আজ পনেরই আগস্ট .... দেখতে দেখতে এগারো বছর হয়ে গেল ভারত স্বাধীন হয়েছে। নিতাইবাবুর আজ আপিস ছুটি। তিনি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে হেদুয়ার চারপাশে পাক মারতে লাগলেন। কোথা থেকে যেন ‘শুভ্র নব শঙ্খ তব গগন ভরি বাজে’ গানটা ভেসে এসে বাতাস নির্মল করে তুলতে লাগল।

    প্রভাতফেরি বেরিয়েছে। তারা গাইছে, ‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত অম্বর মাঝে ... ’ হোসপাইপের জলে রাস্তা ধোয়া হচ্ছে।

    দোতলা থেকে অনিল ঘোষের দুজন মক্কেল নামল। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ট্রামলাইনের দিকে এগোতে লাগল। রাস্তা পার হয়ে মানিকতলার দিকে যাচ্ছে। অনিল ঘোষের পশার ভালই। পাড়ার লোকে বলে, দুনম্বরী লোক। ওর মক্কেলরাও নাকি দুনম্বরী। একতলার ঘরে চেতলা থেকে নিতাইবাবুর ভায়রা আর তার বৌ এসেছে বিকেলবেলায়। নকুড়ের দোকান থেকে সন্দেশ কিনতে বেরোলেন নিতাইবাবু। নির্মল চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা ওখানে। মালিকের মেজভাই ঝন্টুবাবু তার বন্ধু। দোকানে বসে তার সঙ্গে গল্প করছিলেন নির্মলবাবু। নিতাইবাবুকে দেখে তার সঙ্গেও গল্প জুড়লেন তিনি। কথায় কথায় একসময়ে উকিল অনিল ঘোষের কথা উঠল। নির্মল চক্রবর্তী চাপা গলায় বললেন, ‘যত্ত দুনম্বরী কারবার .... আরে দাদা আমি সব জানি ... ইনকাম ট্যাক্স না ছাই .... জাল দলিল তৈরি করে ... সব জানি। পয়সা কি আর এমনি হয়েছে .... ’
    নিতাইবাবু সহমত হলেন। বললেন, ‘অথচ দেখুন .... সেই পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়াতেই চালিয়ে যাচ্ছে এখনও .... বিভূতিবাবুও তেমনি। কিছু বলেও না .... ’
    ঝন্টুবাবু বললেন, ‘আরে বাবা.... দরকার পড়লে ঠিকই বলবে ... আমাদের দরকার কি ওসবে। অনিলবাবু এমনিতে মানুষ তো খারাপ না ... খুব ভদ্র ব্যবহার ... ’
    নিতাইবাবু বললেন, ‘আচ্ছা আসি আমি ... বসে আছে আবার সব ... ’

    বেথুন কলেজের ওপাশে পঁচিশের বি তে যারা আছে সব বাঙাল ... বছর দশেক হল এসেছে। এ পাড়ার অনেকে বলে, পাকিস্তান থেকে ... উড়ে এসে জুড়ে বসেছে .... রাতদিন হৈ চৈ চেঁচামেচি, ঝগড়া ... ওঃ ... অসহ্য ---- এই গোছের কথা এ তল্লাটে খুব শোনা যায়। বৃদ্ধ সংসারনাথ চ্যাটার্জির কথার মাত্রা হল, ‘বাঙাল কায়েত' ... ব্যাটাচ্ছেলেরা হাড়মাস আলাদা করে দিল রে ভাই ... ’
    অর্থাৎ জীবনের যতরকম বিপত্তি তার সবকিছুর মূলে আছে বাঙালরা।
    ভেঙ্কটেশ, ধনরাজ, আপ্পারাওরা পঞ্চপান্ডব মিলে পরপর পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন করল ইস্টবেঙ্গলকে।
    ওপার থেকে আসা লোকেদের মুখ চকচক করতে লাগল এ পাড়ায়, ও পাড়ায়। চোখেমুখে খুশি উছলে পড়ছে। যে ক'ঘর বাঙাল আছে এ রাস্তায়, তাদের বাড়িতে বাড়িতে ইলিশ রান্নার ধুম। দেশভাগ হয়ে গৃহহারা, ভূমিহারা, স্বজনহারা হবার জ্বালা যন্ত্রণা যেন জুড়িয়ে গেল এক নিমেষে।
    সংসারনাথবাবু চরম বিরক্তিতে মুখ ভেংচে বললেন, ‘যত্ত আদিখ্যেতা ... যেন সাত রাজার ধন পেয়েছে .... কি বলে ... ইয়েতে নেই চাম, মুখে হরেকৃষ্ণ নাম ... হুঁ : ’

    বিকেল ঘনিয়ে আসছে। কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের মোড়ে ফুটপাথ ঘেঁষে হাতে ঠেলা গাড়ি নিয়ে একটা আইসক্রিমওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। কাঠির ওপরে মিস্টি লাল হলুদ রঙ লাগানো বরফের চাপড়া চুষছে কটা স্কুল ফেরতা বালক। আইসক্রিমের রঙ লেপে গেল তাদের ঠোঁটে মুখে জিভে।
    একটু পিছনে দাঁড়িয়ে আছে হরিপ্রিয় দে বাবুর অস্টিন গাড়ি। পেছনটা কেমন চ্যাপ্টা মতো। হরিপ্রিয় দের কোথায় কোথায় যেন দু তিনটে সিনেমা হল আছে। শিয়ালদার হলটায় যাবেন বলে তিনি গাড়িতে এসে বসলেন। ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ল।
    ওদিকে সবে কলেজে পা রাখা কাশী বোস লেনের অসিত ঘোষাল নিতাই ভটচাজের একতলার রাস্তার ধারের ঘরের জানলা গলিয়ে একটা চারভাঁজ করা চিঠি ফেলে দিল শ্রীলেখার জন্য। রাস্তায় এখন তখন শ্রীলেখার সাক্ষাৎ মিললেও হাতে চিঠি ধরাবার বুকের পাটা হয়নি অসিতের। শ্রীলেখা ইচ্ছে অনিচ্ছের দোলাচলে দুলতে দুলতে দুরুদুরু বুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে তুলে নিল চিরকুটটা।

    শ্যামবাজারের মোহনলাল স্ট্রিটে নিতাইবাবুর এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। পরিবার সুদ্ধু নেমন্তন্ন। বাড়ির ছাদে ম্যারাপ পড়েছে। মাটিতে চ্যাটাই পাতা। সামনে কলাপাতায় লেবু,নুন, পোস্ত লাগানো পালং শাক ভাজা। লম্বা করে কাটা বেগুন ভাজার ফালি পড়েছে পাতে। ছাদের একপাশ থেকে নানা খাবারের মিশেল গন্ধ ভেসে আসছে থেকে থেকে। চারপাশ ম ম করছে। নিতাইবাবু সপরিবারে খেতে বসলেন। উল্টোদিকে ফুট ছয়েক দূরে আর এক সারি চ্যাটাই কলাপাতা পড়েছে। কি কান্ড, ওখানে ঠিক শ্রীলেখার মুখোমুখি লাজুক মুখে এসে বসল অসিত। তার দুপাশে দুই বন্ধু। এদের জানাশোনা কেউ হবে হয়ত। নিতাইবাবু গাওয়া ঘি-এ ভাজা ধবধবে সাদা লুচির মধ্যে বেগুন ভাজা পুরে মুখে পুরলেন। তার স্ত্রী কিন্তু কিছু একটা আঁচ করে নিলেন। তিনি ছোঁড়াটাকে বাড়ির সামনে বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন। এসব ব্যাপারে মেয়ের মায়েদের অনুমান ক্ষমতা ভীষণ তীব্র। তিনি পরিষ্কার চোখাচোখি লক্ষ করলেন দুজনের মধ্যে এবং তার মেয়ের ঠোঁটের এবং চোখের এক পলকের ঝিলিক তার নজর এড়াল না। তিনি তার মেয়ের পিঠে বেশ জোরে একটা চাপড় মারলেন। নিতাইবাবু পাশ থেকে লুচি মুখে বললেন, ‘অ... অঃ ... কি হলটা কি ... সব জায়গায় অশান্তি ... ’
    অঞ্জলিদেবী নীচু গলায় বললেন, ‘খাচ্ছ খাও না ... বাড়ি ফিরে শুনবে সব ... ’
    নিতাইবাবু আর একবার ছোলার ডাল আর দুটো লুচি নিলেন। মাছ আর পোলাও এর পর লাইনে আছে।
    করবী আর রীতার সঙ্গে বাগবাজারে হরি সাহা বাড়ির ঝুলন দেখতে যাওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করতে লাগল শ্রীলেখা। কিন্তু অঞ্জলি একেবারে অনড়। কোনমতেই রাজি নন। তিনি তো আর নিতাইবাবুর মতো তালকানা নন। কিসের থেকে কি হয় সে রসায়নটা তিনি ভালই বোঝেন।
    বললেন, ‘ওই চালতাবাগানের লোহাপট্টিতেই তো দারুণ ঝুলন সাজিয়েছে ... দেখে আয় না গিয়ে ...’
    শ্রীলেখা সঙ্গে সঙ্গে নেচে উঠল, ‘হ্যাঁ ... তাই যাই বরং ... চল চল ... ’
    ------ ‘দাঁড়া দাঁড়া ... বাবুকে ডাকি ... ও সঙ্গে যাক.... ’
    শ্রীলেখার মুখ ব্যাজার হয়ে গেল।
    ----- ‘বা..বু যা... বে ? কেন আমাদের সঙ্গে ও গিয়ে কি করবে ? ও ওর বন্ধুদের সঙ্গে যাক না ... ’
    ----- ‘কেন গেলে ক্ষতি কি ? ভাইবোনে একসঙ্গে যায় না ? ’
    ------ ‘আমরা বন্ধুরা ঘুরব ...ও ওখানে কি করবে ?’
    ----- ‘কিছুই করবে না .... তোদের সঙ্গে থাকবে... একজন পুরুষ সঙ্গে থাকা ভাল ... ছোট হলেও পুরুষ তো বটে ... ’
    অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটির পর শেষ পর্যন্ত শ্রীলেখা ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ঝুলন দেখতে যেতে রাজি হল।

    বছর দশ বারো আগে খুব দাঙ্গা হয়েছিল সুকিয়া স্ট্রিটের ওদিকটায়। লোকে এখন ভুলে গেছে সব। বেশ কিছুদিন ধরে শিয়ালদার ওদিকটায় যেতে চাইত না লোকে। বিভূতিবাবু ওসব অত খবর রাখতেন না। তিনি কোথায় কাননবালা আর অশোককুমারের চন্দ্রশেখর ছবিটা লেগেছে সেটা খোঁজ করতে ব্যস্ত ছিলেন। কম বয়স থেকেই তার বায়োস্কোপের নেশা।

    নিতাইবাবু শস্তায় জমির খোঁজ করছেন। তার স্ত্রী এই একতলার ঘরে আর থাকতে চাইছে না। মেয়ে বড় হচ্ছে। নানান অসুবিধে আছে। জানলায় কি সবসময়ে পর্দা টেনে রাখা যায়।
    বিধানবাবু ওই পাতিপুকুরের পুবদিকে নোনা জলা ভরাট করে প্রচুর জমি বার করেছেন। চারদিকে ধু ধু মরুভূমির মতো এখন। 'কোনখানে জনমানব নাই’। কবে হবে তার কোন ঠিকানা নেই। তবে এখন ওখানে জলের দরে জমি বিকোচ্ছে। এই সময়ে কাঠা দুই কিনে রাখতে পারলে আখেরে লাভ হবে হয়ত। অঞ্জলি তো দুবেলা তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রেল অফিসে চাকরি করে আর কটা টাকাই বা রোজগার হয়। রাতারাতি কিছু করা কি সম্ভব। মহা আতান্তরে পড়েছেন নিতাই ভটচাজ। সিঁথির দিকে অনেকটা ভিতরে একটা জমির খোঁজ পেয়েছেন দালাল মারফত। দু একদিনের মধ্যে দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছে সে ভদ্রলোক। দেখা যাক কি হয়, এইরকম নানা চিন্তা ভাবনা করতে লাগলেন নিতাইবাবু।

    ল্যান্ডলর্ড বিভূতিবাবু সেদিন সকালের দিকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এটা ওটা দুচার কথা বলতে বলতে উকিল অনিল ঘোষের সঙ্গে সদর দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিভূতিবাবু তেমন হিসেবী লোক নন। তাই কথাটা কিভাবে পাড়বেন ঠিক করতে পারছিলেন না। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পেড়ে ফেললেন।

    ------ ‘এই বলছিলাম যে ... মাগগী গন্ডার বাজার ... চালানো খুব মুশ্কিল। ভাড়াটা চল্লিশ করুন সামনের মাস থেকে ... নইলে মুশ্কিল হয়ে যাচ্ছে ... বুঝলেন কিনা ... ’
    অনিলবাবু বেশি সময় নিলেন না। বললেন, ‘এ বছরে তো একদম পারব না বিভূতিদা। নতুন বছর পড়ুক তারপর দেখা যাবে। আমার কি আছে .... নেহাত লোকেশানটা ভাল ... মক্কেলদের পক্ষে যাতায়াতের সুবিধে তাই ... নইলে আমার তো পৈত্রিক বাড়ি রয়েইছে বেলেঘাটায়। দরকার বুঝলে ওখানে শিফট করে যাব। ঠিক আছে ... দেখছি ... দেখছি ... আসি এখন ... একটু মানিকতলা বাজারে যাব ... ’
    দেখছি দেখছি মানে, অনিলবাবু কি দেখবেন ঠিক বোঝা গেল না।

    (চলবে)

    ******************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যোষিতা | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ০৯:২৫522134
  • চিত্রা সিনেমাহল ও পাড়ায় ছিল বলে শুনিনি। সুকিয়াস স্ট্রীট হবে। অনেকেই ভুল করে সুকিয়া স্ট্রীট বলে থাকে। 
    ১৯৫৮ সালের দিকে উত্তম কুমারের বই খুব চলত। পুরোন নায়কদের যুগ ছিল আরো বেশ কিছু বছর আগে।
    ঐ সময়ে সপরিবারে একই পঙ্কতিতে পুরুষ ও মহিলারা খেতে বসতেন না নেমন্তন্ন বাড়িতে। ঘটি বাড়িতেতো নেভারই নয়। এই ডিটেইলস গুলো একটু খেয়াল রাখবেন। ঐসব পাড়ায় জন্মেছি বড়ো হয়েছি। সেজন্য খুঁটিনাটি মোটামুটি জানা।
  • ar | 108.26.161.231 | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ০৯:৫৬522139
  • চিত্রা না মিত্রা??
    শ্যামবাজার থেকে হেদুয়া যেতে প্রথমে টকীশো হাউস, তারপর দর্পনা, মিত্রা, মিনার, শ্রী, উত্তরা, রাধা শেষে রূপবাণী। এর কটা এখনো টিকে আছে জনিনা!!
  • যোষিতা | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১০:০৪522140
  • সব মৃত
  • যোষিতা | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১০:০৫522141
  • টকি শো হাউজ তো ফড়েপুকুরের গলির মধ্যে।
    মিত্রা নয়, মিনার।
  • যোষিতা | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১০:০৯522142
  • গ্রে স্ট্রীটের মোড়ে ছিল স্টার থিয়েটার।
    তারপরে গোয়াবাগান চত্বরে এক ধারসে থিয়েটারহল। রংমহল, বিশ্বরূপা, রঙ্গনা। 
    পূর্ণশ্রী সিনেমাহলও গোয়াবাগানের মধ্যে বড়তলা থানার পাশে। 
    পরে তৈরী হলো সারকারিনা এবং বয়েজওন হল।
  • যোষিতা | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১০:১৩522143
  • আরও দক্ষিণে গেলে বিদ্যাসাগর কলেজের কাছে ছিল একটা সিনেমাহল। সেইটে কি মিত্রা? ঠনঠনে কালিবাড়ীর দিকটায়?
  • যোষিতা | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১০:১৬522144
  • আরও আছে। মিনার্ভায় তখন কল্লোল, অঙ্গার, এইসব নাটক হচ্ছে।
  • যোষিতা | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১০:১৮522145
  • উঁহু, ঠনঠনে কালীবাড়ির কাছের সিনেমাহলটা মিত্রা নয়, বীনা। ওটা অবশ্য মধ্য কোলকাতা।
  • যোষিতা | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১০:২৩522146
  • সারকুলার রোডের ওপর মাত্র গোটাকতক সিনেমাহল ছিল। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে শেয়ালদার মধ্যে সবকটাই ডানহাতে। খান্না, বিধুশ্রী (একটু ভেতরে), ছায়া, প্রাচী।
  • :|: | 174.251.160.133 | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১১:৪৯522147
  • এসব খুঁটিনাটি ছাড়াও "ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন।" মেয়ের জন্য পাত্রী খোঁজাটা সেকালের পক্ষে একটু বেশীই যাকে বলে এডভান্স হয়ে গেলো। 
    আর যদ্দুর মনে হয় প্রসার থেকে আসা কথাটি পসার। শ নয়। 
    লেখাটা ভালো লাগছে। 
  • জয় | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১১:৫৮522149
  • আপনার দুটি লেখাই বেশ লাগল পড়তে। আরো লিখুন  প্লীজ। 
  • Anjan Banerjee | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১২:২৪522153
  • মিনার সিনেমার ঠিক উল্টো দিকে মিত্রা সিনেমা । ওটারই একসময়ে নাম  ছিল চিত্রা । বিদ্যাসাগর কলেজের কাছে যেটা সেটা 'বীণা' সিনেমা । 
    ' বিয়ের জন্য পাত্রী ... ' , এটা টাইপো । ঠিক করে দিচ্ছি । পশারটাও তাই । 
  • Anjan Banerjee | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১২:২৬522155
  • জয়, 
         অনেক ধন্যবাদ।  সঙ্গে থাকুন ।
  • Anjan Banerjee | ০৬ আগস্ট ২০২৩ ১২:৩২522156
  • উত্তমকুমার তখন প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু যারা একটু বয়স্ক তারা তো তাদের সময়ের স্মৃতি ধরে থাকতে চাইবেই।  
  • Amit Sengupta | 49.207.52.60 | ০৯ আগস্ট ২০২৩ ২০:৫৮522314
  • শ্যামবাজার থেকে হেদুয়া যেতে প্রথমে টকীশো হাউস (ফড়িয়াপুকুরের ভেতরে সার্কুলার রোডের দিকে বেশি কাছে) , তারপর বাঁদিকে পড়বে দর্পনা, মিত্রা (আগে নাম ছিল চিত্রা) ও রূপবাণী, ডানদিক আসবে মিনার, শ্রী, উত্তরা, রাধা শেষে। বিদ্যাসাগর কলেজের কাছে শংকর ঘোষ লেনের উল্টোদিকে বীণা সিনেমা। 
  • Ranjan Roy | ১১ আগস্ট ২০২৩ ২২:১৯522343
  • ভাল লেগেছে।
    অঙ্গার নাটক মিনার্ভা থিয়েটারে 1959 সালে, এবং কল্লোল 1965 সালে অভিনীত হয়।
    সে হিসেবে 1958 সাল ঠিকই হয়েছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন