এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ৪৯ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ নভেম্বর ২০২৩ | ২৯১ বার পঠিত
  • পরভরিশ দেখার পরিকল্পনা শ্রাবণীর আন্তরিক সহায়তায় নিখুঁতভাবে রূপায়িত হল। গন্ডগোল কিছু হয়নি, যদিও জোড়ের পাখিদের বুকে দর্পণার ভিতরে বা দর্পণার বাইরে সারাক্ষণ ধুকপুকুনি বজায় ছিল। এই ধুকপুকুনিটাই বোধহয় আসল রোমাঞ্চ। এটা উবে গেলে ব্যাপারটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
    শ্রাবণীই সুমনাকে বাড়ি পৌঁছে দিল। সুমনার স্বার্থে একটা ডাহা মিথ্যে কথা বলল বাসন্তীদেবীকে ---- 'কয়েকটা কঠিন প্রবলেম ছিল মাসীমা ... তাই সলভ করতে দেরি হয়ে গেল .... '
    বাসন্তীদেবী তার অভিজ্ঞ চোখে দুজনকে আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে বললেন, ' হমম্ ... তা সলভ হল ? '
    ----- ' হ্যাঁ মাসীমা ... ভালভাবেই হয়েছে ... বেশ জটিল অঙ্ক ছিল ... '
    শ্রাবণীর বিশ্বস্ততা এবং অভিনয় দক্ষতা দেখে সুমনা মুগ্ধ হল। কৃতজ্ঞও থাকল।
    বাসন্তীদেবী বললেন, ' অ ... তা ভাল। তবে এমনিধারার জটিল সমস্যা ঘড়ি ঘড়ি হলেই তো হয়েছে .... '
    শ্রাবণী সপ্রতিভভাবে বলল, ' না মাসীমা ... এসব কি আর ঘন ঘন হয় ... এই ন মাসে ছ মাসে হতে পারে। মাসীমা ... আমি তা'লে আসি এখন ... '
    ----- ' হ্যাঁ, কি আর বলব ... সময় নিয়ে এস আর একদিন ... এখানে বসেই অঙ্ক কষতে পারবে ... সাবধানে যেও ... দিনকাল ভাল না ... '
    এই 'দিনকাল ভাল না ' কথাটা বাসন্তীদেবীর কথার মাত্রা।
    শ্রাবণী বলল, ' হ্যাঁ মাসীমা .... আসছি ... '

    সুমনা পাশের ঘরে গিয়ে দেখল তার বড়দি চন্দনা মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। সুমনাকে দেখে বলল, ' কিরে ... কোথায় গিয়েছিলি ? '
    ----- ' এই ... এক বন্ধুর বাড়ি ... কয়েকটা প্রবলেম সলভ করতে পারছিল না ... তাই আমাকে যেতে বলল ... '
    ------ ' ও ... প্রবলেমটা তোর নয় তো ? দেখিস বাবা ... ঝামেলা বাঁধাস না ... '
    সুমনা চমকে উঠল। ভাবল, দিদি কিছু গন্ধ পেল নাকি ! অসম্ভব কিছু না ... ওর যা ব্রেন। তবে সামলে নিল এক লহমায়।
    ----- ' না না .... কি যে বলিস ... আমার প্রবলেম হলে তো তোরাই আছিস ... '
    ----- ' হ্যাঁ ... সেটাই... '
    সুমনা এবার প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল।
    ------ ' বড়দি তুই হঠাৎ এরকম অ্যাডামেন্ট হয়ে গেলি কেন ? '
    ------ ' মানে ? '
    ----- ' মানে ... ওই বিয়ের ব্যাপারে ... '
    ----- ' অ্যাডামেন্ট তো হইনি। সিম্পলি .... সামনে পরীক্ষার জন্য এখন পুরোপুরি কনসেনট্রেট করতে চাই। পাত্রপক্ষের ওইসব দেখাদেখির ব্যাপার আমি এখন নিতে পারব না। পরীক্ষার রেজাল্টটা আমার কাছে এই মুহুর্তে সবচেয়ে ইম্পর্টান্ট ব্যাপার ... '
    সুমনা হাল ছাড়ল না। বলল, ' ব্যাস... এইটুকুই ? কোন প্রবলেম থাকলে বাপিকে বলনা ... বাপি তো সব ব্যাপারে ফ্রি অ্যান্ড ফ্র্যাঙ্ক ... '
    চন্দনা ভ্রু ওপরে তুলে সুমনার দিকে তাকাল ----
    ----- ' এ ব্যাপারে তোর অভিজ্ঞতা হয়েছে মনে হচ্ছে ... '
    ----- ' সে আবার কি কথা ! আমার আবার কি অভিজ্ঞতা হবে ? বাপির খোলামেলা লিবারেল স্বভাবের কথা তো সবাই জানে ... '
    ------ ' হ্যাঁ ... তা ঠিক। তবে আমার কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে আমাদের ফুচা আর ছোট নেই। বড় হতে শুরু করেছে ... '
    ------ ' মানে ? '
    ----- ' মানে, এই ... বইয়ের একটা পাতা খুলে, পাতার দিকে তাকিয়ে থেকে একমনে কি ভেবে যাওয়া বা কলেজে অফ পিরিয়ডে কোথায় উধাও হয়ে যাওয়া, যে আগে কলেজের গেটের বাইরেই পা রাখত না ... এই সব আর কি ... '
    সুমনার বুকের ভিতর গুড়গুড় করতে লাগল। কিন্তু সে মচকাল না। নিজেকে ধরে রাখল।
    ------ ' এসব কি বলছিস ... আমি তো রোজ কলেজের মধ্যেই থাকি ... '
    ------ ' থাকলেই ভাল। তবে, মাঝে মাঝেই দেখতে পাই না ... সেটাই আর কি। শুধু একটাই কথা ... যা করবি অনেক ভেবেচিন্তে করবি। এটা বইয়ের ক্যালকুলাস না .... জীবনের ক্যালকুলাস। একবার ঘেঁটে গেলে আর সলভ করা যায় না ... '
    সুমনা ভাবল, তার দিদি শার্লক হোমস নাকি। তার ঘাড়, কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। কি ভাবে এই কথাগুলোর মোকাবিলা করা যায় তাই ভাবছে।
    এই সময়ে তার দিদিই তাকে মুক্তি দিল আপাতত।
    ----- ' তুই এখন যা ... আমাকে পড়তে হবে। আর হ্যাঁ, একটা কথা বলে দিই ... আমার ব্যাপারে কোন গবেষণা করার দরকার নেই... আমার জীবনে কোন গোপন গল্প নেই ... একেবারে ওপেন বুক ... '

    সুমনা ' হ্যাঁ বুঝেছি ... আমি আসি ... ' বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

    ওদিকে নয়া রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে রাজবল্লভ পাড়া থেকে মেডিক্যাল কলেজের দিকে। জায়গাটার চিত্রপট অনেক বদলে গেছে ইদানীং। কুমোরটুলি থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত যাওয়া আসার এখন আর অসুবিধে নেই।

    সুরেশ্বরবাবু একটা রিক্সা ধরে দর্জিপাড়ায় এসে দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটের মুখে এসে নামলেন। অন্তত পঁচিশ বছরের অভ্যেস। ছাড়তে পারছেন না কিছুতেই। সপ্তাহে অন্তত তিনদিন না আসলে চলে না। পুরণো নেশার টান আর কি। তার ঘরণী এ নেশা ছাড়াতে পারল না হাজার চেষ্টা করেও। অনেকদিন যুদ্ধ করার পর হাল ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে বলে, ' এখন তো বুড়ো হয়ে গেছ ... এবার ছাড় না এসব '। সুরেশ্বর প্রতিবারই বলে, ' এই ... আজকেই শেষবার ... '। কিন্তু শেষের সে বার এখনও এল না। ডানদিকের গলিতে ঢোকার পর প্রতিবারই যাদের সঙ্গে দেখা হয়, এ পাড়ায় অনেকদিন ধরে আসার সুবাদে তাদের মুখ চেনা হয়ে গেছে। অনেকেই হাতজোড় করে কিংবা একহাত ওপরে তুলে মাথায় ঠেকায়। সুরেশ্বরবাবুও পাল্টা হাত তোলেন। তিনি এখনও পুরণো যুগকে সঙ্গে নিয়ে চলেছেন আগাপাস্তলা। সেই গিলে করা পাঞ্জাবী, সেই ধাক্কাপাড় চুনোট করা ধুতি আর ভুরভুরে আতরের গন্ধ। এখন শীতকালে অবশ্য গায়ে শাল রয়েছে। দামী কাশ্মীরি শাল। তিনি যেন বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিককার জীবন্ত ছবি। ব্যাকব্রাশ করা ঢেউ খেলানো চুল, ফর্সা ফোলা মুখে নিখুঁত কেয়ারি করা সরু গোঁফ। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা।
    একেবারে যেন ইতিহাসের বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র। পুরো ছবি। তার কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ। তাতে দুটো বোতল আছে। নিজের বিলিতি পানীয়ের ব্যবস্থা তিনি নিজেই করে নিয়ে বিশাখার ঘরে ঢোকেন। অবশ্য শুধু বিশাখা নয়, তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিন্নি আর ফরিদার ঘরেও যান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। স্রেফ পৈত্রিক সম্পত্তি ভাঙিয়ে তার খরচা চলে। রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের বাড়িটা ছাড়াও পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া আরও দুটো বাড়ি আছে তার। একটা সুকিয়া স্ট্রিটে আর একটা বাগবাজারে গোপীমোহন দত্ত লেনে। দুটোরই জরাজীর্ণ অবস্থা।
    দোতলায় পাঁচ নম্বর ঘরটা বিশাখার। সুরেশ্বর সেখানে ব্যাগ থেকে বোতল দুটো বার করে টেবিলের ওপর রেখে খাটের ওপর পা তুলে বসলেন।
    বিশাখা বলল, ' এখন থেকে এত ঘন ঘন আসবেন না বাবু ... একটু রয়ে সয়ে আসুন ... '
    ----- ' কেন...কি হলটা কি ? পুলিশে ছাপা মারছে ? চিন্তা কোর না ... ও ম্যানেজ হয়ে যাবে ... '
    ------ ' আরে না না পুলিশে ছাপা মারলে তো ঠিক আছে ... সাগর মন্ডল এসে টহল মারছে মাঝে মাঝে .... তুমি তো হেদোর ওদিকে থাক। তোমায় চেনে নিশ্চই ... '
    ----- ' অ্যাঁ ... বলিস কিরে ! '

    ( চলবে )

    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যোষিতা | ০৯ নভেম্বর ২০২৩ ০১:১৫525751
  • সোনাগাছিতে সাগর মণ্ডল? cool
  • Anjan Banerjee | ০৯ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৬525775
  • দেখুন কি হয়
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন