এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    কাদামাটির হাফলাইফ - ইট পাথরের জীবন - ইমানুল হক | নামাঙ্কনঃ ইমানুল হক। ছবিঃ র২হকথা - ২৮বিকেল বেলায় সূর্যের তাপ মরে এলে লোকে বলত, ধূপছায়া আলো। এই ধূপছায়া আলো পড়তেই বাড়ির মহিলারা 'গড়ান' ছেড়ে উঠতেন। গরম কালে কেউ শুতেন খেজুর পাতার তালাইয়ে, কেউ কেউ মাদুরে। সে-সময় তো মহিলারা বাড়িতে ব্লাউজ পরতেন না। ব্লাউজ নয়, নাম ছিল গায়ের জামা। এক শান্তি চক্রবর্তী মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রী ছিলেন শহরের মেয়ে। তিনি ব্যতিক্রম। পরে ইস্কুল কলেজের শিক্ষা দীক্ষার চল বাড়ল। ব্লাউজ ঘরেও চড়ল সবার গায়ে। আজকের আধুনিকরা যদি মাত্র ৪০-৪৫ বছর আগের গ্রাম দেখতেন, এই শরীর দেখিয়ে রিলস বানানোর খেলাটাই জমতো না। স্বাভাবিকভাবেই মহিলারা ব্লাউজ ছাড়াই ঘরের কাজ করতেন। গরিব ঘরের মহিলারা ব্লাউজ ছাড়াই বাইরে বের হতেন। বয়স্ক গুরুজনদের দেখলে গায়ে কাপড়টা জড়িয়ে নিতেন বড়জোর।আদৌ বিকেলেরটা ঘুম নয়, ছিল গড়িয়ে নেওয়া। আজকের ভাষায় ন্যাপ। একটু গড়িয়ে হাতের কাজ সেরে চুল বাঁধতে বসতেন মেয়েরা। নিজেদের বাড়ির মেয়েরা ছাড়াও পাশের বাড়ির মেয়েরাও আসতো। ভালো চুল বাঁধতে পারা মেয়েদের কদর ছিল আলাদা। বয়স্করা ছোটদের দিয়ে মাথার পাকা চুল বাছাতেন। তারপর দুপুরের তরকারি গরম করে ভাত বসিয়ে একটু ভালো শাড়ি ব্লাউজ বের করে হিন্দু মুসলমান সব বাড়ির মহিলারা তৈরি হতেন সত্যপীরের পালা শুনতে। আমাদের খুব আক্ষেপ ছিল, মা কোনদিন যেতেন না।কেন?মনে হয়, বাবা এইসব নিয়ে ব্যস্ত। নিজে যুক্ত হলে সংসার 'উড়েপুড়ে' যাবে।এটা ছিল মেয়েদের বাঁধা লব্জ।উড়িয়ে পুড়িয়ে দিলে গা।এই মেয়েদের একটা বড় অংশের বিনোদন ছিল একসঙ্গে বসে বিকেলবেলায় আড্ডা। অনূঢ়া মেয়েদের দল মাঠের ধারে আলে বসত ধরনের সময়।ধরন মানে বৃষ্টি বাদলা নাই।আর বিবাহিত মহিলারা একসঙ্গে বসে পান চিবোতেন বা কেউ তাস খেলতেন।বামুনপাড়ায় বকুলতলায় বসতো তাস ও পানের আড্ডা। বারোয়ারি তলায় বেনে বউদের গপ্পোগাছার আসর। মাঝের পাড়া উত্তরপাড়া মুসলিম অধ্যুষিত। সেখানে নিজেদের মধ্যে আড্ডা। পনের বিশ দিন অন্তর একবার পাড়া বেড়ানো।এ-বাড়ি সে-বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নেওয়া। বিয়ে হওয়া মেয়েরা গ্রামে ফিরলে বোন ভাইঝিদের নিয়ে পাড়া বেড়ানো অবশ্য কর্তব্য।আর মহিলারা তক্কে তক্কে থাকতেন কবে সত্যপীর বা রামযাত্রার আসর বসছে। সত্যপীরের আসরই বেশি বসতো।বারোয়ারি তলায় কম। বাড়ি বাড়ি বেশি। কারও মানত থাকলে দুয়েকবার। বেশি হতো মুসলমানদের বাড়িতে ছেলেদের সুন্নত তথা লিঙ্গচ্ছেদ তথা হাজামিতে। একে মুসলমানিই সাধারণভাবে বলা হতো।যে বাড়িতে সত্যপীরের পালা, সে বাড়ির ছেলে মেয়েরা লোকেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসতো।সত্যপীরের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করতেন তাঁর হাতে থাকতো একটা বিরাট সাদা চামর। সেটা মাথায় বুলিয়ে তিনি আশির্বাদ করতেন। হিন্দু মুসলমান সবাই সেই আশির্বাদ নিতেন। ১০-২০ পয়সা করে দিতেন মায়েরা‌ সত্যপীরের পালায়। কিশোর ঘোষালদা লিখেছেন, ১৯৮০ র মাঝামাঝি সত্যপীর সত্যনারায়ণ হয়ে গেল।তা, সত্যপীরের পালায় হিন্দু মুসলমান একতার কথা থাকতো।আর থাকতো সমাজশোধন প্রচেষ্টা। গাঁয়ে কেউ অন্যায় করলে সত্যপীর ঠারে ঠোরে তার ইঙ্গিত দিয়ে দিতেন। অনেকটা গ্রিক নাটকের আদি পর্বের মতো ছিল বিষয়টি।পরে এর জায়গায় মূলত প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে বেশি বলা হতে থাকে।কেউ একজন একটা/দুটো টাকা সেফটিপিন দিয়ে বুকে গেঁথে বা হাতে গুঁজে দিয়ে বলতো, অমুক কেন ... পাড়া দিয়ে সেজেগুজে ঘনঘন যায়।এখন যদি তুমি ভায়া আমায় না থামাও/ সবকিছু জেনে যাবে গোটা পাড়া গাঁও।অমনি যার উদ্দেশে বলা সে বেচারা তড়িঘড়ি আরও কিছু বেশি পয়সা দিয়ে মুখ বন্ধ করে ভিন্ন কথা বলতো।এখনকার পশ্চিমবঙ্গের আদর্শ পরিস্থিতি বোঝা যেত সত্যপীরের আসরে।নব্বই দশকের ইট পূজা, রামমন্দির বাবরি মসজিদ লড়াই এবং পরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস --- বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্র অনেকটাই বদলে দিল।এরসঙ্গে যুক্ত হল, বিদ্যুৎ‌ এবং টেলিভিশনের আগমন।তারপর এল টেলিফোন। সেটা ১৯৯৬ পরবর্তী ঘটনা।২০০৪ এর পর মোবাইল একটু সহজলভ্য হতেই গোটা বিষয়টি গেল বদলে।আর পরে নেট এসে গিয়ে সংস্কৃতি খেলাধুলা আড্ডা রাজনীতি সব আলাদা ধরনের হয়ে গেল।তবু এরমধ্যে দেখেছি, বারোয়ারিতলায় বয়স্ক মহিলাদের সঙ্গে অল্পবয়সী বউদের গল্পগাছা।পাড়া বেড়ানো কমেছে।সত্যপীরের আসর‌‌‌ শেষ কবে বসেছে, মনে নেই কারও।রামযাত্রা কেষ্টযাত্রাও অতীত।যদিও রাম নিয়ে রাজনীতির প্রভাব বেশ পড়েছে গ্রামজীবনেও।(ক্রমশঃ)
    সীমানা - ৪৮ - শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ছবি: সুনন্দ পাত্র ৪৮সীমানা ছাড়ায়েকুইট ইণ্ডিয়া!অথবা হয়তো ওই একই অর্থের অন্য শব্দসমষ্টি গান্ধীজি প্রথম উচ্চারণ করেন, যেদিন স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর।কুইট ইণ্ডিয়া। ভারত ছাড়। ছেড়ে চলে যাও। যত তাড়াতাড়ি পার, চলে যাও। পারলে, পরের প্লেনেই। লালবাতি জ্বলবার অপেক্ষায় আছে যে ব্যাঙ্ক, সেই ব্যাঙ্কের একটা পোস্ট-ডেটেড চেক দিতে এসেছ আমাদের? পরাধীনতার বদলে নামের রকমফের? ডোমিনিয়ন স্টেটাস? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তোমাদের কী স্টেটাস আজ?স্যর স্ট্র্যাফোর্ড আর দ্বিতীয়বার দেখা করেননি গান্ধীর সঙ্গে, করে লাভ ছিল না। তিনি অবিশ্যি সত্যি-সত্যিই ভারতের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন, সেরকমই পরিকল্পনা ছিল তাঁর, কিন্তু সেই পরিকল্পনার ধার ধারতেন না তাঁর বস, উইনস্টন চার্চিল। সেই সময়কার ভাইসরয় লিনলিদগোও চার্চিলেরই দলে। ক্রিপ্‌সের মতো অনেক সোশ্যালিস্ট দেখা আছে তাঁদের। হামবাগ সব! জওহরলাল আর সেই সময়কার কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি মৌলানা আজাদ অবিশ্যি ক্রিপসের সঙ্গে একমতই ছিলেন, ছিলেন এমনকি রাজাগোপালাচারিও, যদিও লীগের ব্যাপারে কংগ্রেসের অবস্থানের প্রতিবাদে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন রাজাগোপালাচারি নিজে। এখন গান্ধী একাই বিরোধীপক্ষ, যদিও নিজে গান্ধী মনে করেন না তা। তিনি মনে করেন সমস্ত দেশবাসী তাঁর পক্ষে। তিনি একবার সঙ্কেত দিলেই প্রায় প্রতিটি ভারতবাসী নেমে পড়বে রাস্তায়, তাদের মুখে থাকবে একটাই কথা, ভারত-ছাড়! যদি নিজে থেকে না ছাড়, আমরাই ছাড়াব তোমাদের। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে!ব্রিটিশ-খেদানোর পক্ষে এক্কেবারে উপযুক্ত এইরকম পরিস্থিতি একবার ছেড়ে দিলে তার ফল হবে সারাজীবনের জন্যে পায়ে শিকল। যুদ্ধের শেষে কোনরকমে যদি জয়ীদের দলে দাঁড়াতে পারে ব্রিটেন, এ-শিকল কাটার আর উপায় থাকবে না কখনও, বড় জোর শিকলের নাম হবে ডোমিনিয়ন স্টেটাস।নবযুগের অফিস থেকে নিয়ে-আসা হরিজন পত্রিকাগুলো দু' দিন ধরে পড়ল নজরুল, আর পাতায় পাতায় আবিষ্কার করল গান্ধীর লেখনীতে সুভাষের কণ্ঠস্বর। তিন বছর আগে যে অবস্থা ছিল ব্রিটিশরাজের, আজ, এই তিন বছর পর, তার সঙ্গে শুধু যোগ হয়েছে জাপানের হাতে ব্রিটিশের নাস্তানাবুদ হবার ঘটনাটুকু। ওটুকু না থাকলে ঠিক যেমনটি বলেছিলেন সুভাষ তিন বছর আগে, সেই উনিশশো উনচল্লিশেই, তা-ই যেন আবার ফিরিয়ে বলছেন গান্ধী। বলছেন যেন সুভাষেরই গলায়। সুভাষেরই ভাষায় যেন গান্ধী বলছেন, ভারতের নতুন সীমারেখা তৈরি করছে এখন আর্চিবল্ড ওয়ভেল; যুদ্ধের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওয়ভেলের ভাষায় ভারতের পূর্ব সীমা এখন হংকং আর পশ্চিম সীমা সুয়েজ খাল। যুদ্ধে লিপ্ত ভারত তো ব্রিটিশ ভারত! সেই ভারতের ওয়ভেল-কথিত এই সীমা রক্ষা করতে এখন হাসতে হাসতে প্রাণ দেবে ভারতের ছেলেরা, শাবাশ জওয়ান! জবাবে, সুভাষের হাসিই হাসলেন গান্ধী, সুভাষের কণ্ঠস্বরেই বলে উঠলেন, যুগ-যুগান্ত ধরে ভারতেরপুব-পশ্চিম যা ছিল বরাবর, আজও আছে তাই। থাকবেও। স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে ভারতীয় সেনা নিয়োগ করে এতদিন ভারতীয়দের বাধ্য করেছ ভারতের বাইরের যুদ্ধে, তোমাদের যুদ্ধে, প্রাণ দিতে। এখন নিজেদের জান-মাল বাঁচাতে আজ সেই যুদ্ধটাকেই সশরীরে ঢোকাতে চাও ভারতে? এটা ভারতবাসীর সীমান্ত রক্ষার যুদ্ধ?তোমরা ভারত ছাড় এখন, আমাদের সীমা আমরাই সামলাব! তোমরা গেলেই মুক্তি আমাদের, জাপানের সঙ্গে বোঝাপড়া আমরা করে নেব, বলছেন গান্ধীজি। এ তো সুভাষেরই ভাষা, তিন বছর আগেই যদি গান্ধী এটা বুঝতেন!নজরুলের মনে পড়ে সুভাষবাবুর এ-বছরের উনিশে ফেব্রুয়ারির সেই বক্তৃতার কথা, সেই দৃপ্ত কণ্ঠের ঘোষণা, সিঙ্গাপুরের পতনের অর্থই হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন, বহুদিনের এক দুর্বৃত্তরাজের পতন। এবং সেই পতনই ভারত-ইতিহাসে এক নবসূর্যোদয়ের সূচনা। এই সূর্যোদয় শুধুই যে ভারতের মুক্তি সূচিত করল তা নয়, সমস্ত এশিয়ায় ভেসে এল এক ঝলক পরম সূর্যকরোজ্জ্বল বাতাস।বার্লিন থেকে ভেসে আসছিল সুভাষের গলা – কতো শত যোজন দূর থেকে আসছে তাঁর কণ্ঠস্বর – দেশমাতৃকার লজ্জাদমনের লড়াইয়ে ওই বিদেশে সুভাষ কি একা? পরম উত্তেজনার সঙ্গে একটু বুঝি বা উৎকণ্ঠা নজরুলের, সে তো কয়েকদিন আগেই ঋষি অরবিন্দর সন্ধানে বেরিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সে জানে, এক ঋষি অরবিন্দই সূক্ষ্মদেহে যেতে পারেন যেখানে খুশি। তাই সুদূর জার্মানিতে সুভাষের সুরক্ষা একমাত্র অরবিন্দই দিতে পারতেন। এখন, এই হরিজন পড়ে নজরুল বুঝল, সুভাষ আর একা নয়, সুভাষের সঙ্গে – ভারতে থাকলেও – আছেন গান্ধীজি স্বয়ং!কিন্তু, সেদিন নবযুগের অফিসে তার কাছে হক সাহেব ঠিক কী চাইলেন, বুঝতে পারে না নজরুল। হরিজন পড়ে গান্ধীর এখনকার অবস্থানটা ঠিকই বুঝেছেন হক সাহেব। তিন বছর আগেই সুভাষের নেতৃত্বে যা হতে পারত, সে-ই কাজটাই এখন করতে চান গান্ধী। এখনও দেরি হয়নি, তাছাড়া সুভাষবাবুও তো আর বিদেশে এমনি-এমনি যাননি। কিন্তু এর সঙ্গে বাঙালি-মুসলমান অবাঙালি-মুসলমানের কী সম্পর্ক! বছর দশেক হল, রাজনীতি বা স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে আর মাথা ঘামায় না নজরুল। যখন ঘামাত, হিন্দু-মুসলমান নিয়ে একেবারেই কখনও মাথা ঘামায়নি সে। তার মনে পড়ে, সেই কতদিন আগে, তখন বোধ হয় তালতলায় থাকে ওরা, মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ একবার বলেছিল ওকে, এ পর্যন্ত যত মানুষ আমি দেখেছি – খুব কম যে দেখেছি তা তো নয় – তাদের মধ্যে সম্ভবত তুমিই একমাত্র মানুষ যাকে যদি বলা হয় একটুও না ভেবে একটি মাত্র স্বতঃস্ফূর্ত শব্দে নিজের পরিচয় দিতে, তা হলে যে শব্দটি তুমি নির্ঘাৎ উচ্চারণ করবে তা হল – বাঙালি। বাঙালি, বাঙালি-মুসলমান নয়, নয় বাঙালি-হিন্দুও। মুজফ্‌ফর বলেছিল, তুমি চুরুলিয়ার ফকির আহ্‌মদ সাহেবের পুত্র নজরুল ইসলাম যেমন, ঠিক তেমনই তোমার মায়ের প্রিয়তম ডাকের তুমি তারাখ্যাপাও। তাই, এমনকি ত্বম হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণীতেও তোমার অসুবিধে নেই। মুজফ্‌ফর আরও বলেছিল, ধর, একটা কাগজে দাগ কেটে পাশাপাশি দু' রঙে দুটো আলাদা ভাগ করলাম, একটা ভাগে ইসলাম আর একটায় হিন্দু ধর্ম। ওই দাগটাই দুটো ধর্মের সীমানা। তুমি কোথায় জান? ঠিক ওই দাগটার মাঝখানে। ডাইনে-বাঁয়ে যেদিকেই যাও তুমি সমান স্বচ্ছন্দ। তুমি হিন্দুও মুসলমানও, তুমি না-মুসলমান না-হিন্দুও। তুমি বাঙালি।এবং কাজি জানে, খুব সচেতন এবং দৃঢ়ভাবে জানে, তার সম্বন্ধে মুজফ্‌ফরের মূল্যায়ন সেদিন যতটা ঠিক ছিল, আজও ঠিক ততটাই। এবং, সেটাই তো হবার কথা। এই ভারতে শুধু তো হিন্দু আর মুসলমানই নয়, অজস্র ছোট বড় নানা সম্প্রদায় পাশাপাশি থেকেছে হাজার হাজার বছর। নিজেদের মধ্যে কখনও কোন গণ্ডগোল হয়নি তা তো নয়, কিন্তু সব কিছুর পরেও পাশাপাশি ভারতীয় হিসেবেই থেকেছে তারা। যে ইংরেজরা লুটপাট করতে এদেশে এসে শেষ পর্যন্ত দেশের শাসক হয়ে বসল, অথচ স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে থাকল না কোনদিন; সাংস্কৃতিক শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে – এমনকিউইক-এণ্ডের বিশেষ রসনাতৃপ্তির জন্যেও – তাকিয়ে থাকল সমুদ্রপারের 'হোম'-এর দিকে চিরকাল, নিজেদের ভারতীয় বলে ভাবতেই পারল না, তারাই নিজেদের স্বার্থে দেশের সবচেয়ে বড় দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় – হিন্দু আর মুসলমানকে – দিল লড়িয়ে!নজরুল বুঝতে পারে না, যে স্বাধীনতার জন্যে লড়াই আজ, তা কি ভারতীয়র? না কি ভারতীয়-মুসলমানের বাভারতীয়-হিন্দুর? যে ভারতীয়ত্বের মধ্যে মিশে আছে অসংখ্য ছোট-বড় সম্প্রদায় – তা ধর্মীয়ই হোক বা হোক ভাষাভিত্তিক, সেখানে স্বাধীনতার মতো একটা প্রাথমিক অধিকার কিভাবে দু'টুকরো হয়ে শেষ অবধি দাঁড়িয়ে যায় হিন্দুজাতির আর মুসলমানজাতির স্বাধীনতায়? হক সাহেব সেদিন ওর সাহায্য চাইছিলেন কাদের জন্যে? মুসলমানের জন্যে না বাঙালি মুসলমানের জন্যে? তাহলে কি বাঙালি-মুসলমান আর বাঙালি-হিন্দু দুটো আলাদা জাতি হয়ে গেল? বাঙালি বা পঞ্জাবি বা মালয়ালি বা আর কোন জাতি রইল না? ভারতীয় নেশনের কথা তো আর বলে না কেউই, শেষ পর্যন্ত টুকরো টুকরো হয়ে বাঙালি-হিন্দু বাঙালি-মুসলমান বা মালয়ালি-হিন্দু অথবা মালয়ালি-মুসলমানের স্বাধীনতার আলাদা আলাদা ন্যাশনাল লড়াই? অনেক দিন পর আজ মুজফ্‌ফরকে মনে পড়ে যায় কাজির। বুলবুলের মৃত্যুর খবর পেয়ে জেল থেকে চিঠি লিখেছিল সে। এখন বহুদিন আর কোন খবর নেই ওর। কোন্‌ জেলে কীভাবে আছে, কে জানে। না কি গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! ওর সঙ্গে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়। দুঃসংবাদের বদল হয়ে তা যে সুসংবাদ হয়ে যায় ঠিক তা নয়, কিন্তু মন-খারাপ-করা সব কিছুকে পেরিয়ে কোথাও একটা মন-ভালো করার শেষ-বার্তা থাকে মুজফ্‌ফরের সঙ্গে সব আড্ডায়!মুজফ্‌ফরের অভাবে আবার নবযুগেই যায় নজরুল, হক সাহেবের সঙ্গে কথা বলার দরকার তার।নিজের ঘরেই ছিলেন হকসাহেব, নজরুলকে দেখে খুশিই মনে হল। বললেন, কই, রেডিওয় তোমার ওই হারামণির প্রোগাম তো চালু হল না এখনও।সে চালু হয়ে যাবে, নজরুল বলে, কিন্তু আমি একটা ধন্দে পড়ে এলুম আপনার কাছে।কও।আপনি সেদিন কথায় কথায় গান্ধীজির এখনকার অবস্থানের কথা বলতে গিয়ে বললেন, বাঙালি মুসলমানকে যদি বাঁচাতে চাও, আর নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নাই। মানে, আপনি যা বলতে চাইছিলেন বলে আমি বুঝলুম, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে গান্ধী যা বলেছেন, অনেকটা সেই রকমই। তার মানে হচ্ছে, আমি এখন দেশবাসীকে নিয়ে ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামব, যুদ্ধের যা অবস্থা তাতে তোমরা ইংরেজরা তো একেবারেই ল্যাজে-গোবরে হয়ে আছ, আমরা ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামলে তোমাদের আর রক্ষে নেই, একটা এসপার-ওসপার এখন হবেই, স্বাধীনতা আমাদের যে-কোন দিন আসবে, তাই তো?ঠিকই তো বুঝেছ, বলেন হক সাহেব।তাহলে আপনি বাঙালি মুসলমানের কথা বলছেন কেন, স্বাধীনতা এলে তো দেশের সবায়ের জন্যেই আসবে, মুসলমান হিন্দু ক্রিশ্চান বাঙালি মাদ্রাজি; তার উপর আবার বাঙালি-মুসলমান, বিহারী-মুসলমান, এমন করে ভাববার কী আছে?হক সাহেব নীরবে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন কাজির দিকে, তারপর বলেন, দেশ তো একখান, তার ভাগীদার যে হাজার হাজার, লাখ লাখ, সেডা বুঝ? এখন, এই দেশমাতৃকা যখন স্বাধীন হব, আমার অংশ আমার বুঝ্যা নিতে লাগব না? এখনই তো ভাইয়ে ভাইয়ে কাজিয়ার সময়। আর এই যে কাজিয়া লাগসে একবার, এর শ্যাষ নাই। ঝালকাঠির কীর্তিপাশা গ্রামের জমিদারনন্দন এক, আমার বন্ধু। কংগ্রেসী। হ্যায় কী কয়, শুন। যতদিন না হগ্যলের সব্বোনাশ হয় ততদিন এই কাজিয়া চলতে থাকব। এ হল গিয়া বিপরীত বুদ্ধি। হয় কহন জানো? বিনাশকালে।রেডিওয় আবার হারামণির অনুষ্ঠান শুরু করেছে নজরুল। শুধুই হারামণি নয়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণর বিশেষ আগ্রহে ছোটদের জন্যেও একটা অনুষ্ঠান। সপ্তাহে তিন দিন। প্রথমে ঠিক হল, বিকেল পাঁচটায় ছোটদের অনুষ্ঠান। নজরুল বলল, তখন তো ছোটদের খেলার সময়। দু'ঘন্টা পিছিয়ে দে। খেলাশেষে বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে যখন পড়বার সময় শুরু, সেখান থেকে আধ-ঘন্টা কেটে নিয়ে হোক ছোটদের আড্ডা। খেলার সময় কি কাটা যায়?রেডিওতে আবার আসতে শুরু করে আর একটা সুবিধে হয়েছে কাজির। গান্ধীজির হরিজন তো সাপ্তাহিক পত্রিকা। কলকাতায় আসতে তার লেগে যায় দু'দিন। কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় গান্ধীর আশ্রম থেকে যে বুলেটিন বেরোয়, গান্ধীর নিজের অথবা কোন আপ্ত-সহায়কের লেখা সেই বুলেটিন রেডিওতে টেলিপ্রিন্টারে আসে রোজ। অতএব রেডিওয় থাকলে গান্ধীজির প্রতিদিনের ভাবনা সেদিনই পড়া যায়।পাঁচুই জুলাই থেকে কংগ্রেসের ওয়র্কিং কমিটির মীটিং শুরু। কিন্তু এই মীটিঙ শুরু হবার আগেই, গান্ধীর সঙ্গে ক্রিপসের দেখা হবার পর থেকেই, লিনলিদগো তার নিজস্ব প্রশাসনিক প্রস্তুতি শুরু করে দিল। তার কাছে বিকল্প বিশেষ কিছুই নেই। রাস্তাঘাটে বেরোনো, জমায়েত, ধর্মঘট, সবকিছুই বেআইনী ঘোষণা করতে হবে। ওয়র্কিং কমিটি থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত সব কংগ্রেসি নেতাকে গ্রেপ্তার করা দরকার। মুশকিলটা হচ্ছে গান্ধীকে নিয়ে। তিনি কী করবেন প্রায় সবই অনুমান করা যায়, কিন্তু জেনেও বিশেষ কিছু করা যায় না। হয়তো অনশন শুরু করবেন, তাঁকে জেলে ভরলে সে অনশনগণ-অনশনে পর্যবসিত হবে কিনা – এবং জেলের বাইরে থাকলে অহিংস গান্ধীর সমর্থক-দেশবাসীরা হিংসার কোন স্তরে থাকবে – তা আন্দাজ করার অসুবিধে নেই, অসুবিধে সামলানোর। এর মধ্যে জাপানীরা বা ব্রিটিশদ্রোহী অন্যান্যরাও নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে থাকবে না। এদিকে কংগ্রেসের ওয়র্কিং কমিটি তো নামেই, কারণ সেই কমিটির সভ্যদের মধ্যে বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ বা কৃপালনীর গান্ধীর সঙ্গে কখনোই মতান্তর হয় না। আসলে আলোচনা শুরু হলে যে তিনজনের সঙ্গে মতভেদ হবার সম্ভাবনা গান্ধীর, তাঁরা হলেন জওহরলাল মৌলানা আজাদ আর সি-আর বা চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারির। যে হুমকি গান্ধী দিয়েছেন – প্রয়োজন হলে একাই তিনি দেশবাসীকে নিয়ে নেমে পড়বেন – তাতে জওহরলাল আজাদ আর সি-আরের বিরোধীতা কতটুকু টিকবে কে জানে! গান্ধীজির আশ্রমের চার তারিখের বুলেটিন থেকে বোঝা গেল, গান্ধী তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়, এবং মীটিঙের সময়-সংক্ষেপ করার জন্যে তিনি এরই মধ্যে তাঁর লিখিত প্রস্তাব ওয়র্কিং কমিটিকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। যেভাবে কংগ্রেসে সুভাষবাবুর বিতারণ হয়েছিল, তা মনে পড়ে যায় নজরুলের। এই ওয়র্কিং কমিটির সকলেই সেদিন যে সুভাষের বিরোধীতা করেছিল তা তো কেউ ভোলেনি নিশ্চয়ই।চার-আনার-সদস্যপদত্যাগী গান্ধীর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস – কারো, এমনকি বেটাবাবু জহরলালেরও – যে সেদিন হয়নি সে তো ভোলবার নয়। কাজেই মনে মনে নজরুল আশান্বিত যে এই প্রস্তাবও শেষ পর্যন্ত ওয়র্কিং কমিটির অনুমোদন পাবে। সুভাষবাবু দেশের বাইরে থেকেও যদি জানতে পারেন সে কথা, তাহলে তাঁর এতদিনের লড়াই সার্থক হবে বুঝে খুশি হবেন। তাই ভারী খুশি নজরুলও। খুশি মনেই সে তার ছোটদের অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশন শুরু করল আজই।পাঁচ তারিখ একটু বেশি রাতে কাজি যখন বেরোচ্ছে রেডিওর অফিস থেকে, তখন গান্ধীজির আশ্রমের সেই দিনের বুলেটিন সদ্য পৌঁছল। কোন ঐকমত্যে পৌঁছন যায়নি সেদিনও। কেন? বুলেটিনে কারণটা খুব স্পষ্ট নয়। নজরুল অস্বস্তি বোধ করে। এই যে স্ট্র্যাফোর্ড ক্রিপসের সঙ্গে গান্ধীজির সাক্ষাৎকার হল, এর পর থেকেই গত-দশ-বছর-ধরে-ভুলে-যাওয়া স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন করে আবার আগ্রহ বেড়েছে নজরুলের। যে-আন্দোলনের কথা বলেছেন গান্ধী, সেই আন্দোলন আপামর ভারতবাসীকে স্বাধীনতার সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এবং তা যদি হয়, জয় তো সামনেই খাড়া। সুভাষ দেশে নেই, কেমন জানি নজরুলের মনে হয় সে নিজেই এখন সুভাষের প্রতিনিধি। প্রতিটি পদক্ষেপে এই লড়াইয়ের জয়ের খবর সুভাষকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব যেন তাকেই দেওয়া হয়েছে!সাত তারিখে, জানা গেল, বিরক্ত গান্ধী স্বহস্তলিখিত একটা চিরকুটে আজাদ সাহেবকে জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে গান্ধীর চিন্তা আর যুক্তির কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গান্ধী নিজে তো কংগ্রেসের কোন সদস্যপদে নেই আর, এ অবস্থায় মৌলানার নিজেরই বোধ হয় পদত্যাগ করা উচিত।মৌলানার পদত্যাগ? – ভাবে নজরুল, তার মানে কি আবার কংগ্রেসের নির্বাচন, নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ, এবং সাংগঠনিক অন্যান্য কাজ! তাহলে এই আন্দোলনের কী হবে?ধ্বস্ত চেহারা নিয়ে সে রাতে বাড়ি ফেরে নজরুল, তার নৈশ ধ্যানে মন দিতে পারে না সে, রাতেও অনিদ্রা!আট তারিখ বিকেলে যে বুলেটিন আসে তার থেকে জানা যায়, গান্ধী মৌলানা সাহেবের কাছ থেকে তাঁর চিরকুট ফেরত নিয়েছেন সর্দার প্যাটেলের সনির্বন্ধ অনুরোধে। মৌলানা পদত্যাগ করলে একই নৈতিক কারণে জওহরলালেরও পদত্যাগ করা উচিত। এবং শেষ পর্যন্ত তা-ই যদি হয়, দুজনেই যদি একসঙ্গে পদত্যাগ করেন, দেশের মানুষের তাহলে আর কংগ্রেসের ওপর বিশ্বাস থাকবে না।সেইদিন আবার হারামণির অনুষ্ঠান ছিল। রাগ অরুণ ভৈরব। এই রাগ নিয়ে অনুষ্ঠান বছরখানেক আগেও নজরুল করেছিল একবার। সঙ্গে গান ছিল, জাগো অরুণ ভৈরব জাগো শিবানী। নির্বিঘ্নেই হয়ে গেল অনুষ্ঠান। পরের দিন ছোটদের অনুষ্ঠান হবার কথা। নজরুল জানাল, ছোটদের অনুষ্ঠান নিয়ে বিশেষ চিন্তা করেনি সে। তার পরের দিন, মানে ন' তারিখে,নয়ই জুলাই, তার আসতে একটু দেরি হতে পারে। সে নিজের সঙ্গে অনুষ্ঠানের একটা মোটামুটি স্কেচ বাড়ি থেকে তৈরি করেই নিয়ে আসবে।রেডিওতে ঢুকতে ঢুকতেই পরের দিন নজরুলের প্রথম প্রশ্ন, আজ কী খবর এল ওয়ার্ধা থেকে?খবর এখনো আসেনি কিছু, মনে হচ্ছে গান্ধীজি সবাইকে অথবা সবাই-মিলে গান্ধীজিকে বোঝাবার চেষ্টা চলছেই, একমত হতে পারছে না দু'পক্ষ, জবাব দেন সুরেশ চক্রবর্তী।আজ সন্ধ্যেবেলার ছোটদের প্রোগ্রামের একটা প্ল্যান করে নিয়ে আসবার কথা ছিল নজরুলের, দেখা গেল তার ব্যাগ থেকে বেরোলো শুধুই সাদা কাগজ, তাতে লেখা হয়নি কিছু। অতএব সে বসল একটা আলাদা ঘরে কাগজ-কলম নিয়ে, যা বলবে সন্ধ্যেবেলার ছোটদের অনুষ্ঠানে, সংক্ষেপে তার খানিকটা লিখে ফেলতে হবে।প্রায় আধ ঘন্টা পর এক হাতে নিজের কাপ আর অন্য হাতে আর একটা কাপে চা নিয়ে নৃপেন ঢোকে যে-ঘরে বসে নজরুল কাজ করছিল সেখানে। দেখে, কাগজের সামনে নজরুল বসে; কাগজ সাদা, কোন আঁচড় পড়েনি তাতে; নজরুলের চোখে এক আশ্চর্য দৃষ্টি, কোন দিকেই যেন তাকিয়ে নেই সে, শুধু তার দু-গাল বেয়ে নামছে ধারা।কী ব্যাপার কাজিদা, কিছুই তো লেখনি এখনো, কী হল? – চায়ের কাপটা নজরুলের টেবিলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে নৃপেন, মাথায় আসছে না কিছু?অশ্রুসিক্ত সম্পূর্ণই অনিবদ্ধ চোখ দুটো – যে চোখ সম্বন্ধে মোহিতলাল একবার বলেছিলেন চপল-হরিণী-চোখ-উইদ-আ-লিট্‌ল্‌-লাল-আভা – নৃপেনের অস্তিত্বকে প্রায় অবজ্ঞা করে উঠে দাঁড়ায়, তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। নিজের হাতের কাপটা টেবিলে রেখে নৃপেনও পিছু নেয় নজরুলের। নজরুলকে সোজা বাথরূমে ঢুকতে দেখে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে নৃপেন। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে আসে নজরুল, তাকে এখন একটু স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, সে নৃপেনকে বলে, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?তুমি চা খাবে না? – জিজ্ঞেস করে নৃপেন।হ্যাঁ, খাব তো।আবার ঘরে ঢোকে ওরা। নজরুল বসে টেবিলের পেছনে। কাপ দুটো তুলে নেয় নৃপেন, বলে, দাঁড়াও, একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, বদলে নিয়ে আসি।আবার চা নিয়ে যখন ফেরে নৃপেন তখন কাগজের মার্জিনে ছোট ছোট ছবি আঁকছে নজরুল, নৃপেনের হাত থেকে একটা কাপ নিয়ে চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বলে, লিখতে পারছি না।দরকার কী আছে, নৃপেন বলে, এক্সটেমপোর বলবে, ছোটদের আসরে না হয় পুরোনো একটা ছড়া-ই বলে দিও। তোমার কাছে এটা কোন ব্যাপার নাকি? চা খাবে আর এক কাপ? বলতে বলতে আবার যখন বেরিয়ে আসছে নৃপেন, পেছন থেকে কাজিদা ডাকল ওকে, এই নৃপেন, টেলিপ্রিন্টারের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস কর তো ওয়ার্ধা থেকে কোন খবর এল কিনা।কোন খবর আসেনি, টেলিপ্রিন্টারের ছেলেটা বলে, মনে হয় আজ বুলেটিন আসতে সময় লাগবে। বোধ হয় একটানাই মীটিং চলছে সকাল থেকে। বুলেটিনটা লিখবে কে এখন?নজরুলকে খবরটা দেবার জন্যে যখন ঘরে ঢুকল নৃপেন, সেখানে নজরুলকে দেখতে পাওয়া গেল না। নৃপেন লক্ষ্য করে, বাথরূমের দরজাটা আবার ভেতর থেকে বন্ধ। আবার! কাজিদা কি অসুস্থই হয়ে পড়ল?ছোটদের অনুষ্ঠানের শুরু সাতটায়। কিছু একটা কাজিদার হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে। যে অদ্ভুত দৃষ্টিতে সে আজ তাকাল নৃপেনের দিকে, ওর ভয় করছিল। তাকিয়ে আছে একটা মানুষ, কাজিদার মতো মানুষ, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে, আর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত মুখ। এ অভিজ্ঞতা ও বোঝাতেও পারবে না কারোকে। টেবিলের ওপর সাদা কাগজটা পড়ে আছে, মার্জিনের কোণের দিকে এলোমেলো কয়েকটা ছোট ছোট ছবি আঁকা। কাজিদার মতো মানুষ, লিখতে বসে কিছুই লিখতে পারল না!ঘরে নৃপেন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই কাজিদা বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। নৃপেনের দিকে তাকালও না একবারও, সাদা কাগজে আঁকা একটা ছবির ওপর আবার কিছু আঁকতে শুরু করল সে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে নৃপেন, তারপর বলে, সাতটায় তোমার প্রোগ্রাম কাজিদা, ভেবেছ কী বলবে?বসে বসেই মুখটা একটু তুলে বলে কাজি, কিছু না।কিছুই বলবে না? – নৃপেন বলে – কতো ছেলেমেয়ে তোমার অনুষ্ঠান শোনবার জন্যে রেডিও খুলে বসে থাকবে, তুমি কিছুই বলবে না?কাজি আবার মুখ তোলে, এবার বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নৃপেনের মুখের দিকে। তাকিয়েই থাকে, অপলক। প্রায় মিনিটখানেক। তারপর বলে, গান্ধীজি কি তাহলে সত্যিই রিজাইন করলেন? তাহলে কী হবে? স্বাধীনতার?এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না নৃপেন, সে বলে, আর একবার চা খাবে কাজিদা? কিন্তু উত্তরের অপেক্ষায় থাকেও না সে, চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ক্যান্টিনের একটা ছেলে নীরবে এক কাপ চা, গোটাকয়েক বিস্কুট, আর আরেকটা ডিশে চার খিলি পান যে টেবিলের সামনে বসে আছে কাজি সেখানে রেখে চলে যায়।সাড়ে ছটায় ঘরে ঢোকে নৃপেন, এবং অবাক আর খুশি হয়ে দেখে, চা-বিস্কুট শেষ, ডিশের পানগুলোও উধাও, কাজির বাঁ দিকের গালটা ফুলে আছে, পান মুখে।বাঃ, এই তো সব খেয়ে নিয়েছ, বলে নৃপেন, এবার আজকের প্রোগ্রামটা নিয়ে একটা কথা বলি তোমাকে। তোমার মনে আছে, কয়েকমাস আগে তুমি কুমিল্লায় কীভাবে তোমার কাঠবেড়ালী কবিতাটা লেখা হল, সেই গল্প বলছিলে? আজ আমি ঘোষণা করে দেব সেই গল্পটাই তুমি আজকের অনুষ্ঠানে বলবে, ঠিক আছে?জিজ্ঞাসার চিহ্ণসহ 'ঠিক আছে?'– এই শব্দযুগল তো একটা প্রশ্ন, নৃপেন কিন্তু তার এই প্রশ্নের উত্তরে কাজি কী বলল, বা আদৌ কিছু বলল কিনা লক্ষ্য না করেই হনহন করে বেরিয়ে গেল।অনুষ্ঠান শুরু হতে আর যখন মিনিট দশেক, যেখানে কাজি বসেছিল সেখানে গিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দেয় নৃপেন। ওর হাত ধরে উঠে আসে কাজি, এবং যে স্টুডিও থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রসারণের কথা সেই স্টুডিওতে প্রবেশ করে দুজন। পাশাপাশি দুখানা চেয়ারের একটাতে বসে কাজি, কাজিকে বসিয়ে রেখে ঘোষক এবং একজন টেকনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বসে আছে যেখানে সেখানে গিয়ে নৃপেন কিছুক্ষণ কথা বলে। ওর হাতে-ধরা ব্যাগ থেকে কয়েকটা রেকর্ড বের করে টেকনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্টের হাতে সেগুলো দিয়ে আবার ফিরে আসে কাজিদার কাছে।এত কিছু ঘটনা যে চোখের সামনে ঘটছে, কাজিকে দেখে তার কিছুই বোঝার কোন উপায় নেই। সে বসে আছে, নীরবে, এবং তার চোখ দেখে মনে হয় অনেক দূরের কিছু সে দেখছে। সেই দেখার মধ্যেও কোন ঐকান্তিকতা আছে বলে মনে হয় না; প্রায় প্রাণহীন এক জোড়া চোখ – কাজি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত চোখজোড়া – চারিদিক বন্ধ স্টুডিওর মধ্যে বসেও – এবং সেই চোখজোড়া খোলা থাকা সত্ত্বেও – কোন কিছুতেই নিবদ্ধ নয়!ঘোষককে হাত তুলে নীরবে নির্দেশ দেয় নৃপেন, ঘোষক ঘোষণা করে, এখন অনুষ্ঠিত হবে কিশোর জগতের বিশেষ অনুষ্ঠান কবি কাজি নজরুল ইসলামের কণ্ঠে এবং পরিচালনায়। কবির সঙ্গে সহযোগী হিসেবে থাকবেন শ্রীনৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়।আমাদের আদরের কিশোর বন্ধুরা, নৃপেন বলতে থাকে, আজকের আসরে তোমাদের একটা গল্প বলবেন তোমাদের- আমাদের-সবায়ের-কাজিদা। তোমরা সবাই তো ছোটদের জন্যে লেখা কবির কবিতা কাঠবেড়ালী পড়েছ, এখন এই কবিতা ঠিক কীভাবে লেখা হয়েছিল কুমিল্লা শহরে, সেই গল্পটা আমাদের শোনাবেন কাজিদা।কাজির দিকে তাকায় নৃপেন, কাজি সেই একই ভঙ্গিতে অনির্দিষ্ট দৃষ্টিতে বসে আছে তার চেয়ারে, কোন কিছু যে ঘোষণা করা হয়েছে তার কোন অবয়ব দেখে তা বোঝা যাচ্ছে না।কিছুই-যেন-হয়নি এমন কণ্ঠস্বরে নৃপেন বলে, শুরু করে দিন কাজিদা, সবাই প্রবল কৌতূহল নিয়ে বসে আছে নিজের নিজের রেডিও সেটের সামনে।কাজির মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা যায় না, সে একই ভঙ্গিতে চুপ করে বসে থাকে তার চেয়ারে।নৃপেন ঘোষকের দিকে একবার তাকায়, তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে, দেখ সবাই কাণ্ড, কাজিদা তো তোমাদের সবায়েরই বন্ধু, উনি মনে করেছেন উনি এখনো তোমাদেরই বয়েসী। নিজের চশমাটা সঙ্গে আনতে ভুলে গেছেন, কিংবা কে জানে, হয়তো মনে করেছিলেন, চশমা ছাড়াই উনি পড়তে পারবেন! তা হলে? এবার একটু থামে নৃপেন, বলে, তোমরা হয়তো ভাবছ, গল্প তো বলতে হবে। তাতে চশমার কী দরকার? যদি ভাবো, তাহলে ভুল কিছু ভাবছ না। কিন্তু, রেডিওর প্রোগাম তো, হাতের কাছে কবিতাটা না থাকলে কি চলে? ধর, বলতে বলতে কবিতাটারই একটা-দুটো লাইন ভুলে গেলেন কাজিদা, তখন কী হবে? তাই চশমাটা ঠিকই দরকার। তাহলে, এখন কী করা যায়? ঠিক আছে, আজ কাজিদার এই গল্প-বলাটা আমরা স্থগিত রাখছি। তার বদলে তোমরা শোন গ্রামোফোন রেকর্ডে কাজিদার নিজের গলায় গান। শুরু হোক দুর্গম গিরি কান্তার মরু দিয়ে। টেকনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্টকে হাত তুলে সে ইঙ্গিত দেয়, তারপর কাজিদার হাত ধরে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এসে, যে-ঘরে কাজিদা বসেছিলেন আগে, সেখানেই নিয়ে এসে বসিয়ে দেয়। কোন উত্তেজনা নেই, কোন নালিশ নেই নৃপেনের গলায়, সে বলে, কাজিদা, চল, তোমাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি। তুমি কি যাবার আগে একবার বাথরূমে যাবে?উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করে না নৃপেন, আবার হাত ধরে কাজিদাকে দাঁড় করায়, তারপর ওই হাতটা ধরেই বাথরূমের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। এবার দ্রুতপদে নৃপেন যায় টেলিপ্রিন্টারের ছেলেটার কাছে, খবর পায় ওয়ার্ধা থেকে বুলেটিন এসে গেছে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা পড়ে নৃপেন, আর দারোয়ানকে বলে, ড্রাইভারকে গাড়িটা বের করতে বল।বাথরুমের সামনে সে দাঁড়ায়, কাজিদা বেরোলে সে আর দারোয়ান, দুজনে ধরাধরি করে কাজিদাকে বসিয়ে দেয় গাড়িতে। নৃপেন নিজেও তারপর বসে তার পাশে, ঘাড় ফিরিয়ে কাজিদার মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে সে বলে, আজ ওয়ার্ধায় ভারত ছাড় প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। যে কাজি এতক্ষণ কোন কথা বুঝতে পারছিল কিনা তার কোন ইঙ্গিত দেয়নি, সে এখন একবার তাকায় নৃপেনের দিকে, তার চোখ এখনও ভাষাহীন, সেই ভাষাহীন চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝে না নৃপেন, তারপর কাজির চোখ বুজে আসে ধীরে ধীরে। প্রায় পরের মুহূর্তেই বন্ধ চক্ষুদ্বয়ের প্রায়-সংলগ্ন নাক এবং মুখ থেকে শোনা যায় নিদ্রাজাত শব্দরাজি।কাজির বাড়িতে পৌঁছিয়ে দারোয়ান ড্রাইভার আর নৃপেন ধরাধরি করে ঘুমন্ত কাজিদাকে তোলে দোতলায়, দরজাটা খুলে দিয়ে একপাশে দাঁড়ালেন গিরিবালা, তিনি ক্রন্দনরতা, নীরব। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন কালীপদ গুহ, সবাই মিলে ধরাধরি করে যে-ঘরে শুয়ে আছে প্রমীলা সেখানেই নিয়ে যায় কাজিকে, প্রমীলার তক্তপোশের মুখোমুখি একটা বিছানায় শুইয়ে দেয় তাকে। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, তবুও চেষ্টার্জিত হাসি মুখে এনে প্রমীলা বলে, ঘুমিয়ে পড়ল? গাড়িতেই? তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর একবার কাজির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, একটাও তো কথা বলল না, আমরা রেডিওর সামনেই ছিলাম। আজ যাবার সময়েও শরীর ভালো ছিল না, আমাদেরও ভয় ছিল শেষ পর্যন্ত রেডিওতেও কথা বলতে পারবে না।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নৃপেন বলে, এখন যাই। কাল সকালে একবার আসব। তখন কথা হবে।গিরিবালা বলেন, হ্যাঁ বাবা, আজ চা খেতে বলে তোমাদের দেরি করিয়ে দেব না। সকাল থেকেই গঙ্গার ওপার থেকে বোমা-গুলির আওয়াজ আসছে। আমাদের কাজের মেয়েটা বলল, ওপারে পিলখানা আর সালকিয়ায় দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। এখন যুদ্ধের বাজারে এমনিতেই রাস্তাঘাটে লোকজন কম, রাত্তিরে টিম টিম করে একটা আলো জ্বলে রাস্তায়,দোকান-বাজার তো খোলেই না সন্ধ্যের পর, এমন সময় হিন্দু-মুসলমানে লাগলে কী যে হবে!পরের দিন নৃপেন এল যখন তখন এগারটা বেজে গেছে। নৃপেন সোজা দোতলায় উঠে এসেছে, দরজাটা খোলাই ছিল। তাকে দেখে খুকু বলে, বসুন কাকু, মেসো নীচে গেল, বাথরূমে, সকাল থেকে এই নিয়ে তিন বার।খুকুর গলা শুনে এল কালীপদও। নৃপেন বলল, কালও বার চারেক বাথরূমে গেছে রেডিওর অফিসেই, ডায়ারিয়া হল নাকি?ডায়ারিয়া মনে হয় না, বলে কালীপদ, বারবার যাচ্ছেন, কিন্তু কোন অসুখ-অসুবিধের কথা বলছেন না। আজ সকালে, ওপরের ডাক্তার বাড়িওয়ালা, ডক্টর ডি-এল সরকার, নিজেই এসেছিলেন। কাল রাতে আপনারা যখন এলেন, উনি ওপর থেকে লক্ষ্য করেছিলেন। সকালে উনি এলেন যখন, কাজিদা ঘুমোচ্ছিলেন তখনও। কাজেই দেখতে পারেননি ঠিক মতো। ডায়ারিয়ার কথাটা আমরাও বললুম। তা ছাড়া, গতকাল দুপুরে রেডিওতে যাবার আগে খুব কম কথা বলছিলেন, কথা বলতে গেলে জিভটা কেমন যেন আটকে আটকে যাচ্ছিল, সে-কথাও বলা হল। সে-সব শুনে বললেন, নার্ভাসনেস থেকেও বারবার বাথরূমে যায় মানুষ। জিভ আটকে যাওয়াও একই কারণে হতে পারে। উনি আবার আসবেন বলেছেন, মনে হয় আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবেন, ভালো করে দেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন বললেন।একটু পরেই কাজি উঠে এল ওপরে। একাই। নৃপেনকে দেখে থমকে দাঁড়াবার মতো দাঁড়াল একবার, কথা বলল না। সোজা হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। শুতেই গেল বোধ হয়।ডক্টর সরকার বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথ। তিনি এলেন আধঘন্টাটাক পরে। কবি এবং সাঙ্গীতিক হিসেবে নজরুলের নাম-ডাক, তার বর্তমান আর্থিক সঙ্কট, স্ত্রীর অসুখ, গুরুভক্তি, অনেক কিছুই তাঁর অজানা নয়। প্রমীলার দিকে একবার চেয়ে তিনি বললেন, আমার তো পক্ষাঘাতের কেস মনে হচ্ছে, তবে রোগ বেশি দূর এগিয়েছে মনে হয় না। নৃপেন বিশেষ করে লক্ষ্য করে অসুস্থ অবস্থাতেও কাজিদা মন দিয়ে ডাক্তারের কথা শুনছে, বুঝতে চেষ্টা করছে, এমনকি অনেক প্রশ্নের উত্তর এবং নিজের মতামতও – যদিও জিভ তার আরষ্ট এবং ভাঙা-ভাঙা শব্দের অনেক কথাই বোঝা যাচ্ছে না – তবুও, নিজের মতামতও, দিচ্ছে মাঝে মাঝেই। এ ব্যাপারটা উৎসাহব্যঞ্জক, মনে মনে ভাবে নৃপেন। বেরিয়ে আসবার আগে কালীপদকে সে বলে, আজই একবার হক সাহেবকে জানাবেন কাজিদার অবস্থাটা। দৈনিক নবযুগের উনি কিন্তু কর্মচারি একজন।কয়েকদিন পর শোনা গেল, অর্থমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদকে হক সাহেব পাঠিয়েছিলেন নজরুলের ব্যাপারে দায়িত্ব দিয়ে। নজরুলের বাড়িওয়ালা ডক্টর সরকারের নিজেরই একটা বাড়ি আছে মধুপুরে। সপরিবার নজরুল এবং ডক্টর সরকার মধুপুরেই গেছেন, তার যাবতীয় ব্যবস্থা শ্যামাপ্রসাদই করেছেন। দৈনিক নবযুগ এবং স্থানীয় পত্রপত্রিকায় নজরুলের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ছোটখাটো খবর বেরিয়েছে। নজরুল নাকি ভালোই আছে, আর দিন দিন উন্নতিও হচ্ছে তার।নয়ই জুলাই, গত মাসের ন' তারিখ থেকে, নজরুল অসুস্থ। গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে নয়ই আগস্ট। সে খবর নজরুল জানে কিনা বোঝা যায় না। ডক্টর সরকার মধুপুরেও তার জন্যে প্রত্যেকদিন সকালে খবরের কাগজের ব্যবস্থা করেছেন, সে কাগজ তাকে সকালে পড়তেও দেখা যায়। কিন্তু কাগজে যা পড়ে তা নিয়ে কারো সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না সে। এখনো সারা ভারতে আন্দোলনের জোর একই রকমের নয়। যেসব প্রদেশে আন্দোলন সবচেয়ে জোরদার তার মধ্যে আছে বিহার এবং যুক্ত প্রদেশের পুব-অঞ্চল। বাংলার সমুদ্র-উপকুলবর্তী জেলা মেদনীপুরেও আন্দোলন উত্তাল। এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যেবেলা, ডক্টর সরকার এসেছেন কাজির ঘরে, তাকে দেখতে; তাঁকে জিজ্ঞেস করল কাজি, পুলিশ চলে গেল?পুলিশ? – ডক্টর সরকার খানিকটা অবাক, পুলিশ এল কখন?আসেনি শেষ পর্যন্ত? – খানিকটা যেন আশ্বস্ত কাজি, বলে, বন্ধু অবিশ্যি তা-ই বলেছিলেন।বন্ধু? কোন বন্ধু? কার? – অবাক ডাক্তার।নজরুল পাশ ফিরে শুল।সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মধুপুর থেকে ফিরে এল ওরা সবাই, ডাক্তার বললেন, এ মানসিক। একেবারেই মানসিক অসুখ।এ-রোগের কোন চিকিৎসা নেই হোমিওপ্যাথিতে।হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসা নেই তো যাতে আছে সেই চিকিৎসাই করাতে হবে, কালীপদর কাছ থেকে সব শুনে শ্যামাপ্রসাদকে বলেন হক সাহেব। হিন্দু মুসলমান, সকলেরই প্রিয় কবি, আর বয়েসও তো কিছুই নয়। আমাদেরও একটা দায়িত্ব নিশ্চয়ই আছে।মেডিকাল কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলুন না, শ্যামাপ্রসাদ বলেন, উনি কী পরামর্শ দেন শোনা যাক।প্রিন্সিপাল বললেন, রাঁচিতে পাঠিয়ে দিন। কলকাতায় মানসিক রোগের ভালো ডাক্তার কোথায়? পেশেন্টদের আত্মীয়রা পঞ্জিকা-টঞ্জিকার বিজ্ঞাপন দেখেই চিকিৎসার ব্যবস্থা নেন, শিক্ষিত বাড়িতেও। এখনও কবরেজ-হেকিম-তুকতাকের ওঝারাই মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ! এ-ছাড়াও গুরু-ঠাকুররা আছেন, জাগ্রত দেবতারা আছেন; আমাদের মতো সর্দিকাশি পেটখারাপের ডাক্তাররা কারো অসুখের কথা জেনে গেলে মুখে মুখে খবরটা ছড়িয়ে পড়বে না? বাড়িতে পাগল আছে বদনাম হয়ে যাবে না? এইসব অসুখ হলে এমনকি পাড়ার ডাক্তার বা ফ্যামিলি ফিজিশিয়নের কাছেও সে-কথা চেপেই যায় সবাই। রাঁচিতেই পাঠান, ওখানে চিকিৎসাও ভালো হয়, প্রাইম মিনিস্টারের লেটারহেডে একটা স্পেশাল চিঠি গেলে – ওখানে ছোট ছোট কটেজ আছে – বাড়ির লোকরাও কেউ কেউ থাকতে পারবে।শ্যামাপ্রসাদ নিজেই এসেছিলেন নজরুলের শ্যামবাজার স্ট্রীটের ভাড়া বাড়িতে, জানালেন যে নজরুলের জন্যে একটা ফাণ্ড তৈরি করার চেষ্টা করছেন তিনি। বিখ্যাত বিখ্যাত সব সাহিত্যিক এবং অধ্যাপকদের নিয়ে একটা বোর্ড তৈরি করে, প্রতি মাসে অন্তত শ' দুয়েক টাকাও যদি তোলা যায়, আর্থিক দিক দিয়ে অন্তত খানিকটা তো সুরাহা হবে।এর পর রাঁচির কথাটা তুললেন শ্যামাপ্রসাদ। বললেন, মেডিকাল কলেজের প্রিন্সিপাল বলেছেন অতো ভালো চিকিৎসা আর কোথাও হবেনা।প্রমীলার মুখ শুকিয়ে গেল। রাঁচি? শেষ পর্যন্ত রাঁচি?শ্যামাপ্রসাদ গুরুগম্ভীর মানুষ, তার ওপর আবার য়্যুনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন। এখন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। তাঁর চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায় না। তবুও, বেশ ভয়ে ভয়েই বলে প্রমীলা, চার বছর আগে পক্ষাঘাতে আমার শরীরের নীচের অংশটা শুকিয়ে গেছে; তবুও, এই মানুষটা আমার হাতে রান্না ছাড়া খেতে পারে না, আমার কাছ থেকে ছাড়া অন্য কারো সেবা নিতেই পারে না। ওকে অতো দূরে একা-একা ফেলে রাখলে ও বাঁচবে না স্যর।রাঁচি আর এমন কী দূর? – বলেন শ্যামাপ্রসাদ – আর তা ছাড়া তোমার থেকে দূরে থাকবেই বা কেন? তুমিও তো গিয়ে থাকতে পার ওখানে। হক সাহেব চিঠি লিখে দিলেই ওখানে কটেজ পাওয়া যাবে বলে শুনেছি। তুমি না-হয় কাজিকে নিয়ে থেকেই যাবে ওখানে, তোমার হাতের রান্নাই খাইও।আর কিছু বলতে পারে না প্রমীলা শ্যামাপ্রসাদের মুখের ওপর, শ্যামাপ্রসাদ চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে গিরিবালাকে বলে, তুমি কেন চুপ করে রইলে মা? তুমি রাঁচির পাগলা গারদের নাম শোননি? ওখান থেকে ভালো হয়ে কেউ ফিরে আসে নাকি? শুনেছ কখনো? মাথায় যাদের গণ্ডগোল হয় তাদের গারদ করে রেখে দেওয়া হয় ওখানে, তুমি শোননি?শুধুমাত্র বাপ-হারা এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঘর-সংসার ধর্ম-অধর্ম কুলশীল ছেড়ে – নিজের পুত্রসন্তান নেই – এই নুরুকে আপন সন্তান করে নিয়েছেন গিরিবালা – তাঁর চোখের জলও বাধা মানল না, তিনি বললেন, তোর কপাল মা, কপাল আমারও, কিন্তু যে যা-ই বলুক নুরুকে আমরা রাঁচিতে পাঠাব না, বিকেলে কালীপদ আসুক, ওর সঙ্গে পরামর্শ করে একটা কিছু করা যাবে।সেই যে নবযুগের কাজের ব্যাপারে নজরুলকে সাহায্য করার জন্যে কালীপদ নজরুলের বাড়িতেই থাকতে শুরু করেছিল, মধুপুরে ওরা যাবার পর থেকেই আবার নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে সে। এখন নজরুল ফিরে এসেছে খবর পেয়েছে কালীপদ। বিকেলে তার এখানেই আসার কথা। গিরিবালা ভেবে রেখেছেন, চিকিৎসার ব্যাপারে তার পরামর্শ নেবেন।কালীপদ বলল, হক সাহেব আর শ্যামাপ্রসাদ খবর রাখেন না, আসলে মানসিক রোগের চিকিৎসা কলেজ স্ট্রীটের পুরোনো মেডিকাল কলেজে তো হয় না, তাই ওখানকার প্রিন্সিপালেরও বোধ হয় এ ব্যাপারে ততটা জানা নেই; এই চিকিৎসা হয় আমাদের বেলগাছিয়ার মেডিকাল কলেজে। ওই ডিপার্টমেন্টের প্রফেসরের নাম গিরীন্দ্রশেখর বসু। একটা বহির্বিভাগও আছে, মানে পেশেন্টরা হাসপাতালে ভর্তি না হয়েও ডাক্তার দেখিয়ে সেইদিনই বাড়ি ফিরে আসতে পারে। আমি শুনেছি ওই ডাক্তারবাবু নিজের একটা ছোট হাসপাতালও খুলেছেন। শুধুই মনের চিকিৎসার জন্যে। কোথায় আমি ঠিক জানিনা, খবর নেব।খবর নেবার জন্যে শেষ পর্যন্ত বেলগাছিয়ার মেডিকাল কলেজেই যায় কালীপদ, গিরীন্দ্রশেখরের সঙ্গে সে দেখাও করে। ডাক্তারবাবু তাকে রোগীকে মেডিকাল কলেজেই নিয়ে আসবার পরামর্শ দেন। কালীপদ বলে, এই রোগী একজন বিখ্যাত মানুষ, তাঁকে সে হাসপাতালে সবায়ের মধ্যে নিয়ে আসতে চায় না। রোগীর নাম শোনবার পর, কলকাতার পূর্ব সীমানার রেললাইন পেরিয়ে তিলজলায় তাঁর হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে দিলেন গিরীন্দ্রশেখর। বললেন, হাসপাতালের নাম লুম্বিনী, নাম এবং হাসপাতালের জমি – দুটোই তাঁর বিখ্যাত মেজদা রাজশেখর বসুর দেওয়া। ওখানে রোগীদের প্রাথমিক পরীক্ষা করে ভর্তি করে নেওয়া হয় প্রতিদিন সকালে, কিন্তু গিরীন্দ্রশেখর নিজে তখন সেখানে থাকেন না, যদিও রোজই সময় করে রোগীদের তিনি দেখে আসেন। ভর্তি করার সময় যাঁরা থাকেন তাঁরা ওই হাসপাতালেরই ডাক্তার, সর্বক্ষণের চিকিৎসক। গিরীন্দ্রশেখর বললেন, কাজি নজরুল ইসলামের নাম নিশ্চয়ই আমাদের হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরাও শুনেছেন, ভর্তিতে অসুবিধে হবে না।মধুপুর থেকে ফেরার পর কাজিকে বাড়িতে রেখে দিতে পারলেই খুশি হত প্রমীলা। গিরিবালাও। সেই সময় শুধু কালীপদ নয়, জুলফিকার হায়দার নামে নজরুলের পরম ভক্ত এক কবিও নজরুলের বাড়িতে প্রায় সর্বক্ষণের বাসা বাঁধলেন। এই জুলফিকার হায়দার উনিশশো বত্তিরিশে নজরুলের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করেন, তাঁর কবিতার ওপর নজরুলের কবিতার প্রভাব স্পষ্ট। এঁর স্ত্রীও নজরুলের পরম ভক্ত। বত্তিরিশ সালে প্রথম আলাপের দিনই এই ভদ্রলোক নিজের এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নজরুলের বাড়িতে আসেন এবং দিবাভোজে অংশ নেন। নজরুলের সংসারের হিন্দুপনায় তাঁর যে অস্বস্তি হয় তা তিনি আমৃত্যু কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু তবুও, নজরুলের এই দুর্দিনে সমস্ত রকমের অস্বস্তি অতিক্রম করে তিনি নজরুলের পরিবারকে সঙ্গদানের মানসে প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে ওঠেন ওই পরিবারের। জুলফিকারও কালীপদর সঙ্গে নজরুলের লুম্বিনীতে চিকিৎসার বিষয়ে একমত। কবির পালিতা কন্যা খুকুর অগ্রজ, বছর পনের-ষোলর বিজয় দাশগুপ্ত – ওরফে খোকাকে সঙ্গে নিয়ে কালীপদ এবং জুলফিকার অক্টোবরের পঁচিশ তারিখে লুম্বিনীতে নজরুলকে ভর্তি করে দিয়ে এলেন।ক্রমে হাসপাতাল, নজরুল এবং নজরুলের পরিবারের মধ্যে এই খোকাই একমাত্র যোগাযোগ হয়ে দাঁড়াল। কিছুদিন পরেই বোঝা গেল চিকিৎসায় কোন উন্নতি তো হচ্ছেই না, যে চিকিৎসা করা হচ্ছে তা শারীরিক ক্লেশপূর্ণ, রোগীর ঘেরাটোপ থেকে ক্রোধ এবং চিৎকৃত প্রায়-অমানুষিক হাহাকারের শব্দ প্রতিদিনই বর্ধমান, এবং বাড়িতে ফিরে যাবার জন্যে ব্যগ্রতায় সে শব্দ ভরপুর।বাড়িতে ফিরিয়ে আনার অর্থ তো বিনা চিকিৎসায় রাখা, সে সিদ্ধান্ত নেবে কে?এমন সময় ডিসেম্বরের শেষে হঠাৎ একদিন জসীম উদ্দীনের উদয়। সে গোড়ার দিকে নজরুলের এই অসুস্থতার কথা শোনেনি, এখন খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। তার ছাত্রাবস্থা থেকেই সে নজরুলের পরিবারে পরিচিত, প্রমীলা আর গিরিবালা পছন্দই করেন তাকে।আনু্পূর্বিক বিবরণ শুনে সে প্রথম প্রশ্ন করল, কবি-ভাইয়ের খুবই ঘনিষ্ঠ সেই ভদ্রলোক যিনি করাচির সেনা-ব্যারাকে ছিলেন, তারপর ফিরে এসে ঠাকুরবাড়ির জমিদারিতে গ্রামোন্নয়নের কাজ করতেন, তিনি খবর পেয়েছেন?কে, পিংলা ঠাকুরপো? – প্রশ্ন করে প্রমীলা, তারপর বলে, তাকে তো খবরই দেওয়া যায়নি। পিংলা ঠাকুরপো যখন আসত নিজেই আসত, তারপর ফিরে গিয়ে শান্তিনিকেতনেই তো থাকত। না কি অন্য কোথাও, কে জানে! আমরা তো জানিই না কোথায় কোথায়। সেই একবার তিন-চার দিনের জন্যে আমাদের সঙ্গে রাঁচি গেল, সে সেই কলগীতির সময়। তখন শুনলুম, সেখান থেকে ফিরে সুন্দরবনে কোথায় নাকি গিয়ে থাকবে। শেষ অবধিও তো শুনেছিলুম শান্তিনিকেতনেই থাকত, এখন রবীন্দ্রনাথের পর কী হয়েছে জানি না।জসীম বলেন, কী আর হবে রবীন্দ্রনাথের পর? শান্তিনিকেতন কি উঠে যাবে নাকি? আমার মনে হয় শান্তিনিকেতনে গেলেই ওই ভদ্রলোককে খুঁজে পাওয়া যাবে। এবং, কবি-ভাইয়ের ব্যাপারে যে-কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ওঁকেই চাই। আপনারা আর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ছাড়া ওঁর চাইতে বেশি কবি-ভাইয়ের আপন জন আর কেউ নেই। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে তো চাইলেই পাওয়া যাবে না, উনি কখন কোথায় থাকেন বোঝা মুশকিল, তা ছাড়া এর মধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে, আপনারা আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দিন, আমি কালই শান্তিনিকেতনে যাব। সকালের ট্রেইনটাই ধরতে হবে।এত অচেনা-মুখ শান্তিনিকেতনে জসীম আশঙ্কা করেনি। পরে অবিশ্যি তার মনে পড়ল সে বোধ হয় কয়েক যুগ পর এল শান্তিনিকেতনে। শেষ যেবার এসেছিল, নিশিকান্তর প্ররোচনা আর উৎসাহে ও শান্তিনিকেতনের স্কুলে একটা চাকরি প্রায় নিয়েই নিচ্ছিল। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথও খুবই উৎসাহী ছিলেন। জসীম তখন কলকাতায় এম-এ পড়ে, তাই একটু ইতস্তত করছিল। গুরুদেব বললেন, এম-এ নিয়ে তুই ভাবিস না। আমি তোর প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু তবুও, কাজটা ও নিতে পারেনি। দীনেশবাবুর – দীনেশচন্দ্র সেনের – নির্দেশে ও তখন কিছু গ্রাম্য সাহিত্য-সঙ্গীত সংগ্রহের কাজ করছিল, রীতিমতন ফীল্ড ওয়র্ক – উনি বারণ করলেন।পিংলার খোঁজ নিতে গিয়ে প্রথম প্রথম খুবই অসুবিধেয় পড়ল জসীম। পরে একজন বলল, সুধাকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা করুন না। জসীমের তখন সুধাকান্তবাবুকে মনে পড়ল, গুরুদেবের সেক্রেটারি ছিলেন। এবং জসীমের নিজের প্রিয় বন্ধু কবি নিশিকান্ত – রবীন্দ্রনাথ যাকে আদর করে চাঁদকবি নামে ডাকতেন – যে এখন পণ্ডিচেরীতে চলে গেছে – সুধাকান্তবাবু তারই দাদা।সুধাকান্ত জসীমকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেননি, পরে নিশিকান্তর নাম বলায় মনে করতে পারলেন। আরও বললেন, পিংলার খবর উনি ভালোমতই জানেন। সে তো কিছুদিন আগে পর্যন্তও শান্তিনিকেতনেই মূলত থাকত। হাওড়া জেলায় বাগনান স্টেশনের কাছাকাছি শ্যামপুর নামের এক গ্রামে ও কৃষিবিদ্যার একটা স্কুল খুলেছিল, সেখানকার চাষী আর তাদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। প্রথম প্রথম শান্তিনিকেতন থেকেই যাতায়াত করত, শেষের দিকে স্কুলে এত সময় দিতে হত যে, ওখানেই অতুলবাবু ওর একটা থাকবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। অতুলবাবুর নামটা যদিও জসীমের চেনা লাগল, তবুও ঠিক ঠিক মনে করতে পারল না। কিন্তু সেটা নিয়ে আর কথাও বাড়াল না ও। ও যে পিংলার খোঁজ করছে নজরুলের অসুখের ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্যে, সে কথা শুনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করলেন সুধাকান্ত। তারপর বললেন, তুমি চলে যাও শ্যামপুরে, পিংলাকে পেয়ে যাবে। আর পাও যদি, ওকে নিয়ে একবার এখানে চলে এস। যাঁর হাসপাতালে নজরুল আছে, সেই গিরীন্দ্রশেখরকে আমি চিনি। গুরুদেবের কাছে উনি ওঁর মেজদা রাজশেখরের সঙ্গে এসেছেনও এখানে। আমি যতদূর মনে করতে পারি – উনিশশো বত্রিশ-তেত্রিশে হবে – একবার রোমান হরফে বাংলা লেখা চালু করার একটা প্রস্তাব নিয়ে সুনীতিকুমার আর রাজশেখর বসু কবির সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছিলেন, বেশ কয়েকদিন থাকলেন ওঁরা, সেই সময় গিরীন্দ্রশেখরও এসেছিলেন ওঁদের সঙ্গে। আমার বেশ মনে আছে সুরুলে তখন এক আমেরিকান ডাক্তার ম্যালেরিয়া প্রশমনের কাজ করছিলেন, ডাক্তার হ্যারি টিম্বার্স। টিম্বার্সের সঙ্গে গিরীন্দ্রশেখরের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল, সেই সূত্রে গিরীন্দ্রশেখরও কয়েকদিন সুরুলের ডিসপেন্সারিতে গ্রামের লোকের মানসিক চিকিৎসা করলেন।জসীম বলল, আমি তাহলে এখনই বেরিয়ে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যে হাওড়ার একটা গাড়ি পাওয়া যাবে। বাগনানে নেমে পড়ে পিংলাবাবুর সঙ্গে আমি আজই যোগাযোগ করে নেব।সুধাকান্ত বললেন, তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। বোলপুর থেকে হাওড়া যাবার পথে কোনদিন বাগনান পড়বে না, বাগনান স্টেশন দেখেছ কখনো? বোলপুরের গাড়ি ঈস্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ের, বাগনান বি-এন-আরের। পরে হাওড়ায় ফিরে আবারবি-এন-আর লাইনের বাগনানে যেও। এ অবস্থায়, কাজে কাজেই, বুদ্ধিমানের কাজ হবে এখানে খাওয়াদাওয়া করে, বিশ্রাম নিয়ে, তারপর যাওয়া। পিংলার সঙ্গে দেখা হলে বোলো, তোমার সঙ্গে নজরুলের কাছে যাবার আগে একবার যেন এখানে আসে। তোমরা তো নিশ্চয়ই গিরীন্দ্রশেখর ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইবে। আমি ওঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে রাখব। তোমাদের হয়তো সুবিধে হবে তাতে।বাগনানে নেমে শ্যামপুরে যাওয়াটা অসুবিধের নয়, কিন্তু শ্যামপুরে পিংলার স্কুল বা সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের দেখা পাওয়াটা সহজ হল না। ওখান থেকে খানিকটা দূরে রূপনারায়ণ পেরোলেই মেদনীপুর। এবং মেদনীপুরের এই অঞ্চলটা, তমলুক সাব-ডিভিশনের অংশ যেটা, সেই সময় তা ভারত ছাড় আন্দোলনের সাফল্যে মুক্তাঞ্চল। এখন সেখানে ব্রিটিশ সরকার নয়, নভেম্বর থেকে রাজত্ব করছে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। আসলে এপ্রিল-টেপ্রিল থেকেই, যখন পুব-বাংলায় ডিনায়াল পলিসি রূপায়নের সময় ব্রিটিশ সরকার হাজার হাজার নৌকো এবং স্থানীয় যানবাহন ধ্বংস করেছে, সেই একই সময়ে সমুদ্র-উপকুলবর্তী মেদনীপুরও ছাড় পায়নি। আঠের হাজারেরও বেশি নৌকো ধ্বংস করা হয়েছে এই অঞ্চলে। হাওড়া জেলার অংশ হলেও শ্যামপুরও পেয়েছে একই দাওয়াই। শুধু যে আর্থিক ক্ষতি এবং চাষবাসের ক্ষতি হয়েছে তা-ই নয়, নদীর এপার-ওপারে মানুষের যে আত্মীয়তা-বন্ধুত্ব তারই জেরে পিংলার ইশকুলের কমবয়েসী ছেলেরাও এখন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সংগ্রামের যোদ্ধা। পিংলা স্যর বা পিংলাদাদাকেও এই ছেলেরা নিয়ে গেছে সঙ্গে। পিংলার স্কুল আপাতত সাময়িকভাবে বন্ধ। সাধারণত রাতেও পিংলা ফেরে না আজকাল। তবে, জসীমকে আশ্বস্ত করল শ্যামপুরের মানুষরা, পিংলাকে ডেকে আনানো যাবে। খবর পেলেই সে আসবে নিশ্চয়ই। পিংলা যে-বাড়িতে থাকছিল ইদানিং, সেটা খুলে দিল স্থানীয় মানুষ জসীমের জন্যে। এত আদরের আহ্বান ফেরাতে পারল না জসীম।পিংলার সঙ্গে জসীম উদ্দীনের মুখোমুখি আলাপ ছিল না আগে, যদিও জসীমের কথা সে শুনেছে, তার কবিতাও পড়েছে। এখন সব শুনে সেই মুহূর্তেই সে কলকাতায় যেতে চায়। কলকাতায় আমরা যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়িই ফিরব, জসীম বলে, কিন্তু অন্য কিছু করার আগে তাড়াতাড়ি আমাদের পৌঁছতে হবে শান্তিনিকেতনে। সুধাকান্তদাদা বলেছেন তিনি গিরীন্দ্রশেখর ডাক্তারের সঙ্গে নিজে কথা বলে রাখবেন, সেই আলোচনার ফীডব্যাকটা তাঁর কাছ থেকে না নিয়ে আমাদের যাওয়াটা বোধ হয় ঠিক হবে না।শান্তিনিকেতনে যাবার পর সুধাকান্তদাদা বললেন, টেলিফোনে কথা বললুম গিরীন্দ্রশেখরের সঙ্গে, তাঁর বাড়িতে। নজরুলের ব্যাপারে খুব একটা আশার কথা যে বললেন তা নয়। যতটুকু পারেন, নজরুলের সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়েই তিনি তার চিকিৎসা শুরু করেছিলেন, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উনি মনে করেন, অনেক আগেই এই চিকিৎসা শুরু করা উচিত ছিল, এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তিন দিন পর, সামনের শনিবার, ওঁর বাড়িতে উনি তোদের ডেকেছেন। এই তিনদিন নজরুলের ব্যাকগ্রাউণ্ড নিয়ে উনি আর একটু পড়াশোনা করতে চান। ওঁদের বাড়িটা চিনিস? – জিজ্ঞেস করেন সুধাকান্ত।পিংলা মাথা নাড়ে, জসীম মুখেই বলে, না, চিনি না তো।সায়েন্স কলেজ চিনিস? সায়েন্স কলেজের উত্তর দিকের যে পাঁচিল, সেই পাঁচিল ঘেঁষে একটা গলি, সার্কুলার রোডে দাঁড়িয়ে যখন দেখবি গলি বলেই মনে হবে। আসলে কিন্তু ততটা সরু রাস্তা নয়, দিব্যি গাড়ি চলাচল করে। রাস্তাটার নাম পার্শিবাগান লেন। সেই পার্শিবাগানে ঢুকে ডান দিকে চোখ রেখে হাঁটতে থাকবি। চোদ্দ নম্বর বাড়ি। চোদ্দ নম্বর পার্শিবাগান লেন। সোজা ঢুকে যাবি। বাড়িতে ইণ্ডিয়ান সাইকোঅ্যানালিটিক সোসাইটির একটা সাইন-বোর্ড আছে। সাইন-বোর্ডটা দেখলেই নিশ্চিত বুঝবি ঠিক জায়গায় এসেছিস। উনি তোদের জন্যে অপেক্ষা করবেন।কলকাতায় ফিরে জসীম উদ্দীন কিন্তু থাকতে পারল না আর। ওর ছুটি ফুরিয়েছে, ঢাকায় ফিরতে হবে। পিংলার কাছে নিজের ঠিকানা-লেখা একটা কাগজ দিল ও, আর ঢাকা য়্যুনিভার্সিটির বাংলা ডিপার্টমেন্টের টেলিফোন নম্বর। তেমন জরুরি প্রয়োজন হলে টেলিফোনে ওকে খবর দিলেই ও যোগাযোগ করে নেবে।সুধাকান্তদাদা বলে দিয়েছিলেন গিরীন্দ্রশেখর সময় দিয়েছেন সকাল ন'টা – ঠিক সময়ে যাস। চন্দ্রশেখর বসুর এই ছেলেরা পোশাক-আশাকে কথাবার্তায় খাঁটি বাঙালি, কিন্তু শৃঙ্খলায় এক্কেবারে সাহেব। ন'টা মানে ন'টাই।চোদ্দ নম্বর পার্শিবাগানে পৌঁছিয়ে নজরুলের নাম উল্লেখ করে পিংলা বলে, আমার আজ ন'টার সময় আসবার কথা ছিল।হ্যাঁ, আসুন আসুন, বসুন, একটা ফাইল ওলটাতে ওলটাতে গিরীন্দ্রশেখর বলেন, হুঁ, কাজি নজরুল ইসলাম। আচ্ছা, এই পেশেন্টকে ভর্তি করলেন কেন বলুন তো?ভর্তি, মানে হাসপাতালে ভর্তির কথা বলছেন? খানিকটা থতমত খেয়ে যায় পিংলা, অসুস্থ মানুষ...ভর্তি করার সময় আপনি আসেননি বুঝি? আমাদের ডাক্তাররা লিখেছেন এখানে, তাঁরা নিতে চাননি প্রথমে, ঘন্টাখানেক অবজার্ভ করে বলেছিলেন, ভর্তির পক্ষে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে।এবার খানিকটা ধাতস্থ হয় পিংলা, বলে, আসলে যাঁরা নিয়ে এসেছিলেন ভর্তি করবার জন্যে, তাঁরা বোধ হয় ভেবেছিলেন... মানে, আপনারাও যদি না নিতে চান তার অর্থ হল বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা। সেই ঝুঁকিটা বোধ হয় নিতে চাননি তাঁরা।সে তো বুঝলাম, বলেন গিরীন্দ্রশেখর, কিন্তু আমার অস্বস্তি হচ্ছে এই কথা ভেবে যে, বার বার খবর পাঠানো সত্ত্বেও যাঁরা ভর্তি করতে এসেছিলেন তাঁরা আর যোগাযোগই করলেন না। এই ফাইলে আমাদের রেসিডেন্ট মন্তব্য করেছেন, দি ওনলি গার্ডিয়ান অব দ্য পেশেন্ট অ্যাপিয়ার্স টু বী আ টীন-এজ-বয়। হী রেস্পেক্টফুলী লিস্‌ন্‌স টু অল কমেন্টস, শোজ নো রিঅ্যাকশন, গিভ্‌স নো রিপ্লাই অ্যাণ্ড ব্রিংস নো ফীডবাক! আপনি কে? আপনার সঙ্গে নজরুলের কী সম্পর্ক?আমাকে ছোট ভাই ভাবতে পারেন, পিংলা বলে, ব্লাড-রিলেশন নই, আমি ওঁকে কাজিদা নামে ডাকি।পেশেন্টের ছেলেবেলা কেমন কেটেছে আপনার ধারণা আছে?অনেক ছোট অবস্থায় বাবা মারা গিয়েছিলেন শুনেছি, তিনি বোধ হয় গ্রামের মসজিদ দেখাশোনার কাজ করতেন। আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না, কারণ বাবার মৃত্যুর পর গ্রামের মক্তবের পড়াশোনাও কাজিদাকে ছেড়ে দিতে হয়, এবং অত্যন্ত অল্প বয়েসে – মানে প্রায় শিশুকালেই – রোজগারের ধান্দা শুরু। মসজিদে আজান দেওয়া, খাদেমের কাজ করা, শুনেছি এমনকি নিজের বয়েসী ছেলেদেরও পড়ানোর কাজ করেছেন। অনেক পরে, তখন কাজিদা লেখক এবং সাংবাদিক হিসেবে প্রায় প্রতিষ্ঠিত, ওঁদের পাশের গ্রামের ওঁর এক পাড়াতুতো দাদা – এখন তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রফেসর – তাঁর কাছে শুনেছি ওই শিশু বয়েসেই ওঁদের নিজেদের এবং আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মধ্যে উনি লোটো নামের একধরণের গ্রাম্য থিয়েট্রিকাল পার্ফর্মেন্সে লেখক এবং পার্ফর্মার হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন।মা?মায়ের কথা কাজিদা বিশেষ বলেন না। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগও একেবারেই রাখেন না। শুনেছি, বাবার মৃত্যুর পর বাবারই কোন কাজিনের সঙ্গে ওঁর মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। হয়তো প্রবল দারিদ্রই এর কারণ।শুনুন ভাই, গিরীন্দ্রশেখর বললেন, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমাদের এখনকার আলোচনায় আমরা কোন ব্যাপারেই কোন মতামত দেব না, কোন সাইড নেব না, কারোকে ডিফেণ্ডও করব না। শুধু স্টেটমেন্ট অব বেয়ার ফ্যাক্টস।ঠিক। হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। আচ্ছা, একটা রিলেটেড ফ্যাক্ট বলব?বলুন।আমি লক্ষ্য করেছি, বয়েসে খানিকটা বড় যে কোন মহিলাই – তিনি যদি একটুও স্নেহের সঙ্গে কথা বলেন, কাজিদা তাঁর শুধু যে ভক্তই হয়ে যান তা-ই নয়, সহজেই তাঁকে মা বলে সম্বোধন করতে শুরু করেন। এবং এরকম একাধিকপাতানো-মা কাজিদার নানা জায়গায় আছেন। ধূমকেতু মামলায় কাজিদার যে জেল হয়েছিল সে খবর আপনারা শুনেছেন কিনা জানি না, কিন্তু জেলে কয়েদীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে কাজিদা প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করেছিলেন। সারা দেশে হৈ হৈ। ওঁর মা খবর পেয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে জেলে এসেছিলেন। কাজিদা তাঁর সঙ্গে দেখাই করেননি। কিন্তু কুমিল্লায় ওঁর পরিচিত এক পরিবারের বিরজাসুন্দরী নামের এক মহিলাকে উনি মা বলে ডাকতেন। তিনিও জেলে আসেন, এবং এই পাতানো ছেলেকে অনশনভঙ্গের হুকুম দেন। রবীন্দ্রনাথ দেশবন্ধু এবং অন্যান্য অনেক দেশনেতা – এঁদের অনুরোধ যে কাজিদা প্রত্যাখ্যান করেছেন বারবার – সেই তিনিই কিন্তু বিরজাসুন্দরীর হুকুম সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিয়ে তাঁরই হাতে লেবুর জল খেয়ে অনশন ভঙ্গ করেন।মনে হল গিরীন্দ্রশেখর খুবই মন দিয়ে শুনছিলেন পিংলার কথা। তিনি বললেন, আচ্ছা, মায়ের কথা তো বললেন। অন্য মহিলাদের সঙ্গে সাধারণভাবে ওঁর কীরকম সম্পর্ক? মানে, আমি অনাত্মীয় মহিলাদের কথা বলছি।আমার নিজের তেমন কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। উনি যাঁদের মা ভাবতেন তাঁদের কথা বললাম। কিন্তু অনেকের কাছে এ-ও শুনেছি যে একাধিক মহিলার সঙ্গে কাজিদার নানা সময়ে নানারকমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, মোর ইনটিমেসি দ্যান জাস্ট ফ্রেণ্ডশিপ।বিয়ের আগে না পরেও?দেখুন, কাজিদা কিন্তু বিয়ের অনেকটা আগে থেকেই নানা কারণে – বিশেষ করে ওঁর কবিতা আর সঙ্গীতরচনার গুণের জন্যে – বিখ্যাত হয়ে যান। এবং সাধারণ বাঙালির তুলনায় ওঁর স্বাস্থ্য আর চেহারাও অনেক বেশি আকর্ষণীয়। এমন মানুষদের নিয়ে নানারকমের গল্পগুজব নানা প্রচার তো চলেই। তার কতটা সত্যি আর কতটা বাড়িয়ে বলা তা তো বলা মুশকিল, তবে ওঁর বিয়ে নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছিল সেও তো প্রায় গল্পের মতো।কী ঘটেছিল?মহাত্মা গান্ধীর ডাকে এবং ওঁর স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষকমশাইদের প্রত্যক্ষ মদতে একুশ সালে কাজিদা কুমিল্লায় যান অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিতে। কুমিল্লাতে – ওই যে বিরজাসুন্দরীর কথা বললাম, কাজিদার মা? – ওঁদের বাড়িতেই কাজিদার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে ওঁর পূর্বপরিচিত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ওঁর দেখা হয়ে যায়। ভদ্রলোকের নিজের বাড়ি ওখান থেকে বেশি দূর নয়, মাইল দশেকের মধ্যেই হবে। ভদ্রলোকের অনুরোধে কাজিদা তাদের বাড়িতে বেড়াতে যান, তাদের অনুরোধে কয়েকদিন সেখানে থাকেন, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ভদ্রলোকের অবিবাহিতাষোল-সতের বছরের ভাগ্নীর প্রতি আকর্ষিত হন। যত তাড়াতাড়ি ওঁদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয় – বিশেষ করে ওঁর আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রায় সুযোগ না দিয়েই – তা প্রায় অবিশ্বাস্য। ইসলামি বিয়ের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের যে কন্ট্র্যাক্ট তৈরি হয়, বিয়ের সময় সেই কন্ট্র্যাক্টের ভাষা কাজিদার কাছে আপত্তিকর মনে হওয়ায় সেই রাতেই তিনি বিয়ের বাসর থেকে অসুস্থ শরীরে ফিরে আসেন।অসুস্থ? মানে, বিয়েটা অসুস্থতার মধ্যেই হচ্ছিল? – প্রশ্ন করেন গিরীন্দ্রশেখর।আমার মনে হয়, পিংলা বলে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে এরকম একটা অভাবিত অবাঞ্ছিত ঘটনার জেরেই কাজিদা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বিয়ে শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত তাঁর কোন অসুস্থতার কথা কেউ শোনেনি। বিরজাসুন্দরী, এবং তাঁর পরিবারের প্রায় সবাই এই বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে গিয়েছিলেন। তাঁদের জানিয়েই কাজিদা তাঁদেরই বাড়িতে ফিরে এসে শয্যা নেন। পরে এই বিরজাসুন্দরী মা এবং তাঁর বিধবা জা-য়ের চোদ্দ বছর বয়েসের মেয়ের সেবাযত্নে কাজিদা সুস্থ হয়ে ওঠেন। বছরখানেকের মধ্যেই এই মেয়ের সঙ্গে কাজিদার একটা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হতে হতেই কাজিদা ধূমকেতু মামলায় গ্রেপ্তার হন। জেল থেকে মুক্তির দু-তিন মাসের মধ্যেই এঁদের বিয়ে হয়ে যায়। তখনকার সেই বালিকাই এখন কাজিদার স্ত্রী।তাঁর সঙ্গে এখন সম্পর্ক কেমন?মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে যেমনটা হবার। খ্যাতনামা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর চূড়ান্ত সশ্রদ্ধ গর্বিত ভালোবাসা। স্ত্রীর ওপর স্বামীরও সম্পূর্ণ নির্ভরতা। আপনি জানেন কিনা জানি না, বৌদি এখন খুবই অসুস্থ। তাঁর শরীরের নিম্নাংশ এখন পক্ষাঘাতে প্রায় পঙ্গু, দিবারাত্র তিনি শয্যাগত। এমন অবস্থাতেও কিন্তু তিনি কাজিদার জন্যে সহস্তে রান্না করেন নিয়মিত, এবং সংসার পরিচালনা করেন। কাজিদার এক্সট্রা-ম্যারিটাল যে-দুয়েকটা অন্যের-মুখে-শোনা ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করেছি, অত্যন্ত বুদ্ধিমতী বৌদি তাঁর সহজাত ট্যাক্ট দিয়েই সেগুলো ম্যানেজ করেন বলেই আমার ধারণা। ওঁদের পরিবারে আমি অনেক সময় কাটিয়েছি। ওই পরিবারের সব সভ্যদেরই পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা এবং সহমর্মিতা চোখে পড়বার মতো।আচ্ছা, নজরুল সাহেবের মানসিক কিছু অসঙ্গতি আপনারা – বিশেষ করে আপনি – আগে লক্ষ্য করেছেন কখনও?আমি লক্ষ্য করিনি তেমন, তবে বৌদির অসুখটার গোড়ার দিকে কাজিদাকে খুব উদ্‌ভ্রান্ত মনে হত। যে ডাক্তারের কাছে প্রথমে গিয়েছিলেন, তিনি কলকাতায় বেশ নাম-করা ডাক্তার। আমার কেমন জানি মনে হয়েছিল তাঁকে চিকিৎসা করার তেমন কোন সুযোগও দেওয়া হল না। আমি জানি না এ ব্যাপারে বিশদে কিছু আপনাকে জানানো হয়েছে কিনা।আপনাদের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়নি। তবে উনি বিখ্যাত মানুষ তো, ওঁর সম্বন্ধে অনেক কিছুই অন্যান্য সূত্রে জানা যায়। এই যে উনি ভর্তি হয়েছেন আমাদের হাসপাতালে, এরই মধ্যে ওঁকে মোটামুটি ঘনিষ্ঠভাবে জানেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আমাদের কিছু কিছু কথাবার্তা হয়েছে। এঁদের মধ্যে একজন আমাকে বলেছেন ওঁর স্ত্রীর একটাবেড-সোর জাতীয় কোন কিছু খুব দ্রুত নিরাময় করেছিলেন একজন প্র্যাকটিসিং ভূতের ওঝা! তারপর থেকে ওই ভূতের ওঝাকে দিয়েই উনি স্ত্রীর চিকিৎসা করাচ্ছেন! এই ওঝা নাকি তাঁর চিকিৎসায় সত্যি-সত্যিই ভূতের স্বহস্তনির্মিত ওষুধ ব্যবহার করেন! এখন তো শুনেছি এই ওঝার সঙ্গে যোগ হয়েছেন একজন যোগীপুরুষ! ওঝার ওষুধ আর যোগীর আশীর্বাদ!এই যে যোগী পুরুষের সঙ্গে কাজিদার সম্পর্ক, পিংলা বলে, এ কিন্তু বৌদির অসুখের পর নয়। এঁর সংসর্গে কাজিদা প্রথমে এসেছিলেন ছেলে বুলবুলের মৃত্যুর পর; সে তিরিশ সাল, মে মাস। খুব প্রতিভাবান ছেলে, ওইটুকু বয়েসেই হারমোনিয়মে এক লাইন শুনেই রাগের নাম বলতে পারত, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। কাজিদাকে যেবার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র আর সুভাষ বোসের উদ্যোগে অ্যালবার্ট হলে জাতীয় কবির সম্মান দেওয়া হল, তখন সেখানে বুলবুলকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। অতটুকু বুলবুলের কথাবার্তা শুনে স্যর পি-সি রায় খুবই ইমপ্রেস্‌ড্‌। বলেছিলেন, বড় হলে ওকে কেমিস্ট্রি পড়াতে হবে।সেই বুলবুল মাত্র তিন-সাড়ে তিন বছর বয়েসে মাসখানেক বসন্ত রোগে ভুগে মারা গেল। কাজিদা খুবই কষ্ট পেয়েছিল, এই একমাস ধরে প্রত্যেক দিন রাত্তিরে ছেলের শিয়রে সে নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছে, শুনেছি হাফিজ অনুবাদ করেছে সারা রাত। কিন্তু তখন বয়েস অল্প, যতই কষ্ট পাক, ঘরে বসে হা-হুতাশ করা ছাড়াও অন্য অনেক কিছু করার ছিল তার। কাজিদার গানের প্লাবনে সারা বাংলা ভেসে যাচ্ছে তখন, প্রায় প্রতি মাসেই নতুন নতুন রেকর্ড বেরোচ্ছে। দুহাতে তখন টাকা আয় করছে কাজিদা, বড় গাড়ি কিনেছে – সবই সত্যি – কিন্তু তবুও, বুলবুলের মৃত্যুশোকও সম্পূর্ণ ভুলতে পারছে না। এমন সময় তার এক বন্ধুর সুবাদে এই যোগীপুরুষ বরদাচরণ মজুমদারের সঙ্গে কাজিদার যোগাযোগ হয়। তাঁর কাছে কাজিদার একটাই প্রার্থনা, একবার – একবার অন্তত – মৃত পুত্রের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিন! বরদাচরণ কাজিদাকে প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁর সঙ্গে বুলবুলের দেখা করিয়ে দেবেন। শর্ত শুধু এই যে, তার সঙ্গে কথা বলা বা তাকে স্পর্শ করা চলবে না।আমি শুনেছি, বলতে থাকে পিংলা, কাজিদা নাকি সত্যি-সত্যিই বুলবুলের দেখা পেয়েছিল। সে ছোট ছোট পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে ঢুকে তার জামাকাপড়-খেলনায়-ভরা নিজের আলমারি খুলে সব কিছু নেড়েচেড়ে দেখে বাবার মুখের দিকে চেয়ে এক পলকের জন্যে হেসে চলে গেল। আমি এ-ব্যাপারে কখনও কাজিদার সঙ্গে কোন কথা বলিনি। এই অসম্ভব তো সম্ভব হয়েছে তাঁর নিজের মনে, এ-নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ কী?গিরীন্দ্রশেখর বলেন, এই বরদা মজুমদারের নিজের লেখা একটা বই আছে – পথহারার পথ। এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন নজরুল ইসলাম নিজে।আমি জানি, বলে পিংলা। আমি অবিশ্বাসী, এই অপরাধে এই বইয়ের একটা কপি আমার কাছে এমনকি বিক্রি করতেও রাজি হয়নি কাজিদা, তার মনে হয়েছে তাতে তার ঈশ্বরে-রূপান্তরিত-গুরুদেবের অসম্মান হবে।কিন্তু আমি পড়েছি এই বই, নজরুল ইসলামের চিকিৎসা করার প্রয়োজনেই পড়েছি আমি, সে-ব্যাপারে পরে আসছি, এখন আপনাকে অন্য একটা প্রশ্ন করি।পিংলা প্রশ্ন শোনবার জন্যে মানসিক ভাবে তৈরি হয়।গিরীন্দ্রশেখর বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত দুটো ঘটনা আলোচনা করলাম। এক, নজরুলের স্ত্রীর পক্ষাঘাতজনিত অসুস্থতা। আপনি বললেন, কলকাতার একজন মোটামুটি নাম-করা ডাক্তারের চিকিৎসাধীন থাকবার সময়েই নজরুল একজন ভূতের ওঝাকে দিয়ে স্ত্রীকে পরীক্ষা করান। খেয়াল করবেন, ভূতের ওঝা! এই ওঝা ভদ্রলোককে নজরুল পেলেন কোথায়? আপনার নিজের অ্যাসেসমেন্ট বা মত অনুযায়ী ডাক্তার ভদ্রলোক – যদিও তিনি সম্ভবত যোগ্য ব্যক্তিই ছিলেন – তাঁকে প্রায় সুযোগই দেওয়া হল না। এমন হয়ে থাকতেই পারে যে বেড-সোরের তেমন কোন উন্নতি যতদিন এই ডাক্তার দেখেছেন তার মধ্যে হয়নি। অধৈর্য নজরুল নিজে তখন হয়তো পরিচিতদের কাছে তাঁর অসন্তুষ্টি বা অসহায়তা প্রকাশ করছেন – কীসের যে বড় ডাক্তার, বেড-সোরের কষ্টটারও তো কিছু লাঘব হল না! – ইত্যাদি ইত্যাদি!হয়তো ঠিক সেই সময়েই পরিচিত একজন বলেছেন, আমি একজন ওঝাকে জানি; কাছেই থাকেন, উনি কিন্তু ভূতের নিজের হাতে তৈরি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করেন, যাবেন নাকি একবার? আপনি নিজেই লক্ষ্য করেছেন স্ত্রীর অসুখে নজরুল তখন একেবারেই উদ্‌ভ্রান্ত। অতএব তিনি ওঝার কাছে গেলেন, এবং ভূতের স্বহস্তনির্মিত ওষুধে ফলপ্রাপ্তি হল! অন্তত বেড-সোরের থেকে আরাম তো হলই! তাতে তো ভুল নেই! উল্লসিত নজরুল তখন রীজনেব্‌লী কম্পিটেন্ট কলকাতার-নাম-করা একজন ডাক্তারকে কিন্তু খারিজ করে দিলেন। ফল? এখনো আসল অসুখের কোন আরাম বা নিরাময় হল না!এই যে কেসটা নিয়ে আমরা কথা বলছি, গিরীন্দ্রশেখর বলতে থাকেন, এটা দ্বিতীয় কেসটা। প্রথম কেসটা কিন্তু অপেক্ষাকৃত সরল। আজও পর্যন্ত বসন্ত প্লেগ কালাজ্বর ইত্যাদি অসুখ বাড়িতে কারো হলে চূড়ান্ত অবস্থার জন্যে মানুষ প্রস্তুত থাকে। নজরুলও, আপনি যা বলেছেন, প্রস্তুত ছিলেন। খানিকটা সামলিয়েও নিয়েছিলেন। কিন্তু, এবার যেটা হল সেটা তাঁর একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মৃত পুত্রকে তিনি একটিবারের জন্যে হলেও দেখতে চান। এবং এবারও, নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একজন সেই ব্যক্তির সন্ধান জানেন যিনি মৃত পুত্রকেও হাজির করাতে পারেন! অতএব, এন্টার্স বরদা মজুমদার!এই যে দুটো ঘটনা আমরা আলোচনা করলাম, বলেন গিরীন্দ্রশেখর, এদের মধ্যে একটা সাধারণ ধর্ম, কমন্যালিটি, আছে। দুটোর কোনটাই সোজা রাস্তা নয়। সোজা তো নয়ই, এমনকি ইহলোকের রাস্তাও নয়। এই রাস্তায় যাঁরা হাঁটাচলা করেন, তাঁরা আপনার-আমার মতো সাধারণ মানুষ ন'ন; এই রাস্তায় হাঁটেন দেবতারা, অপদেবতারা আর তাঁদের ভক্তরা। যদিও সাধারণ রাস্তা নয়, সাধারণ মানুষ কিন্তু এই রাস্তা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, ছেলেবেলা থেকেই শুনেছেন। অনেকেই একে আধ্যাত্মিক রাস্তাও বলে থাকেন। এবং, অনেক সাধারণ মানুষেরও এই আধ্যাত্মিক রাস্তার ওপর টান থাকে, আকর্ষণ থাকে। নজরুলেরও কি সেই আকর্ষণ? এটা কি তাঁর চরিত্রেরই একটা অংশ? একেবারে ছেলেবেলায় তাঁকে ভালোভাবে চিনতেন এমন কোন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলে এই বিষয়টা আমি আলোচনা করতাম।আপনি শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের নাম শুনেছেন? – জিজ্ঞেস করে পিংলা।গল্প-উপন্যাস লেখেন সেই শৈলজানন্দ?হ্যাঁ, তিনিই। ইনি কাজিদার একেবারে শৈশবের বন্ধু। কাজি নজরুল মুসলমান, শৈলেন ঘোষ ক্রীশ্চান, শৈলজানন্দ হিন্দু ব্রাহ্মণসন্তান – থ্রী মাসকেটিয়ার্স। শৈলজাদার কাছে শোনা একটা গল্প আপনাকে বলতে পারি, এর মধ্যেও আধ্যাত্মিকব্যাপার-স্যাপার আছে কিনা আপনি বুঝবেন।বলুন।আপনাকে বলেইছি শৈশবে পিতার মৃত্যুর ফলে কাজিদাকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। অনেক রকমের কাজ সে করেছে সেই শৈশবেই। অনেক চেষ্টা করে, অনেককে ধরাধরি করে, কখনও কখনও আজ এই ইশকুল তো কাল ওই ইশকু্লে পড়বার চেষ্টা করত। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণীতে ওঠবার সময় কাজিদা খবর পায় শিয়ারশোলের রাজাদের ইশকু্লে সপ্তম শ্রেণীতে একজন গরীব ছাত্রকে নেওয়া হবে, মাসিক বেতন তো লাগবেই না, এমনকি ইশকু্লের হোস্টেলে থাকা খাওয়ারও বন্দোবস্ত। ফ্রী! কাজিদার এক আত্মীয় তখন ওই ইশকু্লেই পড়ত। কাজিদা ইশকু্লে ভর্তি হবার বাসনায় তার সঙ্গে দেখা করতে গেল, কিন্তু পেল না তাকে। তার নামে একটা চিঠি লিখে রেখে সে ফিরে এল।কিন্তু এই ইশকু্লে তো ভর্তি হতেই হবে তাকে। শৈলজার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ওই অঞ্চলে তখন এক সাধু ডেরা বেঁধেছে, দারুণ তার ক্ষমতা, সে যদি চায় সবারই সব ইচ্ছে পূরণ করার ব্যবস্থা করতে পারে সে। সাধুর ডেরার কাছাকাছি এক পাঁচিলে বসে সারাদিন ধরে সাধুকে লক্ষ্য করা চলল। বোঝা গেল, সাধুর প্রিয় নেশা গাঁজা। কলকেসহ গাঁজা জোগাড় করে উপহার দেওয়া গেল সাধুকে, তার কেরামতিতে যদি ভর্তি হওয়া যায় ওই ইশকু্লে!ভর্তি হওয়া গেল?গেল। কিন্তু কীভাবে গেল সেটা একটু বলি। কাজিদার যে আত্মীয় পড়ত ওই ইশকু্লে, সে ফিরে এসে চিঠিটা পেয়ে, সেটা পাঠিয়ে দিল হেডমাস্টার মশায়ের কাছে। তিনি পড়লেন চিঠিখানা। সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হতে চায় যে ছেলে, তার চিঠি পড়ে মাষ্টারমশাই অবাক। ভাষার ওপর এমন দখল! ছেলেটিকে তিনি খবর পাঠালেন এবং ভর্তি করে নিলেন ইশকু্লে। পরের বছর এই ছেলেটিকে সপ্তম শ্রেণী থেকে সোজা নবম শ্রেণীতে তুলে দেওয়া হয়! ডবল প্রমোশন!পিংলা এবার হেসে ফেলে, বলে, ঝড়ে ঘর পড়ে ফকিরের কেরামতি বাড়ে!হাসেন গিরীন্দ্রশেখরও, বলেন, ফকিরের ভক্তদের তাতে কিন্তু কিছু যায়-আসে না, তারা ফকিরের এবং তাঁর প্রভুর অপার মহিমা দেখবার জন্যে প্রথম থেকেই প্রস্তুত।সবই সত্যি, এই সব ফকিররা ঠকিয়েই বেড়ায়, কিন্তু কাজিদার ক্ষেত্রে যদি বুলবুলকে ফিরিয়ে-আনানোর এই মনের ভুলটা না ঘটত? – প্রায় নিজেকেই প্রশ্ন করে পিংলা।না-ঘটার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। ফকিরের কেরামতিতে অন্ধবিশ্বাস যার নেই, সে কখনোই এই আবদারই করবে না – আমার মৃত পুত্র যাকে আমি নিজের হাতে কবর দিয়েছি, যার দেহ মাটির তলায় পচে গলে গেছে, তাকে একবার দেখতে চাই। এ আবদার যে করবে, তার – বিশ্বাসে মিলায় বস্তুর সেই ধারণা – তার জোরে – যাকে ইংরিজিতে বলে অটোসাজেশচন, তারই সাহায্যে – ঠিকই মৃতপুত্রকে যে দেখাবার সে দেখিয়ে দেবে।আর ধরুন, বলতে থাকেন গিরীন্দ্রশেখর, যদি শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক বুদ্ধি ফিরে আসতও নজরুলের, মৃত সন্তানের পক্ষে দেখা দেওয়া সম্ভব একেবারেই নয় এটা যদি বুঝতে পারতও সে, তাহলে কী হতে পারত? সে হয়তো আর ফিরে যেত না বরদা মজুমদারের কাছে। যেত না তো যেত না। নজরুলের বদলে আসতো অন্য একজন শিষ্য। এদেশে শিষ্যের অভাব কখনও কোন গুরুর হয়েছে? কিন্তু আমরা তো আমাদের নজরুলকে সুস্থই ফিরে পেতাম!যাই হোক, কী হতে পারত ভেবে লাভ নেই, এ ক্ষেত্রে নজরুলের স্বাভাবিক বুদ্ধি ফিরল না। অতএব সে প্রায় কেনা হয়ে গেল বরদাচরণের। তার যাবতীয় আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণা বন্ধক হয়ে পড়ে রইল বরদাচরণের পদতলে। এই পর্যন্ত বলে টেবিলের আর এক প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যান গিরীন্দ্রশেখর, হাতে তুলে নেন পথহারার পথ বইখানা। এবার শুনুন, বলেন তিনি, নজরুলের লেখা ভূমিকা থেকে পড়ি। বই খোলেন গিরীন্দ্রশেখর, বলেন, মনে রাখতে হবে, ভূমিকা লেখার সময় নজরুল বরদাচরণের পুরোনো শাগরেদ, অতএব বরদাকে এখন তিনি সাধারণ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করছেন না, করছেন ভগবান হিসেবেই, প্রলয়সুন্দর সারথি নামে। তিনি লিখছেন, বই থেকে পড়েন গিরীন্দ্রশেখর, “কিছুদিন পরে যখন আমি আমার পথ খুঁজিতেছি, তখন আমার প্রিয়তম পুত্রটি সেই পথের ইঙ্গিত দেখাইয়া আমার হাত পিছলাইয়া মৃত্যুর সাগরে হারাইয়া গেল। মৃত্যু এই প্রথম আমায় ধর্মরাজ-রূপে দেখা দিলেন। সেই মৃত্যুর পশ্চাতে আমার অন্তরাত্মা নিশিদিন ঘুরিয়া ফিরিতে লাগিল।.....ধর্মরাজ আমার পুত্রকে শেষবার দেখাইয়া হাসিয়া চলিয়া গেলেন। তাঁহারই চরণতলে বসিয়া যিনি আমার চিরকালের ধ্যেয়, তাঁহার জ্যোতিঃরূপ দেখিলাম। তিনি আমার হাতে দিলেন যে অনির্বাণ দীপশিখা, সেই দীপশিখা হাতে লইয়া আজ বারো বৎসর ধরিয়া পথ চলিতেছি – আর অগ্রে চলিতেছেন তিনি পার্থসারথিরূপে।“আজ আমার বলিতে দ্বিধা নাই, তাঁহারই পথে চলিয়া আজ আমি আমাকে চিনিয়াছি। আমার ব্রহ্ম-ক্ষুধা আজও মিটে নাই, কিন্তু সে ক্ষুধা এই জীবনেই মিটিবে, সে বিশ্বাসে স্থিত হইতে পারিয়াছি। আমি আমার আনন্দ-রসঘন স্বরূপকে দেখিয়াছি। কী দেখিয়াছি, কী পাইয়াছি, আজও তাহা বলিবার আদেশ পাই নাই। হয়তো আজ তাহা গুছাইয়া বলিতেও পারিব না; তবুও কেবল মনে হইতেছে – আমি ধন্য হইলাম, আমি বাঁচিয়া গেলাম। আমি অসত্য হইতে সত্যে আসিলাম, তিমির হইতে জ্যোতিতে আসিলাম, মৃত্যু হইতে অমৃতে আসিলাম।”রবীন্দ্রনাথ গল্পের ছলে বলেছেন, গিরীন্দ্রশেখর বলতে থাকেন, মানুষের একটিই মাত্র প্রার্থনা আছে, অসতো মা সদ্‌গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতং গময়, এবং, সারাজীবন, আমৃত্যু, এই প্রার্থনাই করেছেন তিনি: অসত্য থেকে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও; অন্ধকার থেকে নিয়ে যাও আলোকে; হে অমৃত, নিরন্তর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও, আমাকে রাস্তা দেখাও। নজরুলের ক্ষেত্রে অবিশ্যি আর “নিয়ে যাও”-এর কোন কথাই নেই। তিনি এসে গেছেন! রাস্তা তাঁর চেনা! “আজ বারো বৎসর ধরিয়া পথ চলিতেছি” – এই লিখিত ঘোষণার পর নজরুল স্পষ্ট ভাষায় বলেন “আমি অসত্য হইতে সত্যে আসিলাম, তিমির হইতে জ্যোতিতে আসিলাম, মৃত্যু হইতে অমৃতে আসিলাম।”আসিলাম আসিলাম আসিলাম!আমি বারবার বলেছি নজরুলকে মানসিক চিকিৎসালয়ে আনতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এটাই এখন ব্যাখ্যা করব আপনার কাছে, কেন দেরি হয়ে যাবার কথা বলছি বারবার। বোঝবার চেষ্টা করবার আগে একটু সময় নেব। নেব, আমাদের, মানে ডাক্তারদের, কাজটা কেমন সে কথাটা একটু বলে। ধরুন আপনার চেনা কারো কয়েকদিন ধরেই খুব জ্বর হচ্ছে। মাঝে-মাঝেই অনেক জ্বর; দারুণ কষ্ট, মুখে রুচি নেই, খেতে ইচ্ছে করছে না, অতএব দুর্বলও হয়ে যাচ্ছে রোগী। কয়েকদিন মেয়েলি ওষুধ, বিজ্ঞজনদের পরামর্শ এসবের পর ডাক্তারবাবুকে খবর দেওয়া গেল। ডাক্তারবাবু এসে চোখ দেখলেন, নাড়ি দেখলেন, জিভ দেখলেন, স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুকের অভ্যন্তরীণ শব্দ শুনলেন, দুয়েকটা প্রশ্ন করলেন, বা এমনকি রোগীকে হয়তো উপুড় করে শুইয়ে তার পিঠে-বুকে নানা জায়গায় টোকা দিয়ে দিয়ে শব্দও শুনলেন – এই প্রক্রিয়াগুলোকে ডাক্তাররা বলেন প্যালপেশন – এবং – এখন তো থার্মোমিটার পাওয়া যায় – বললেন, রোজ কয়েকটা নির্দিষ্ট সময়ে রোগীর জ্বর দেখে সময় অনুযায়ী সেগুলো লিখে একটা চার্টের মতো তৈরি করতে হবে। ডাক্তারবাবুর নিজের ডাক্তারখানায় আজকাল মাইক্রোস্কোপ এসেছে, বললেন রক্ত এবং বর্জ্য পরীক্ষাও করতে হবে। ডাক্তারবাবুর সহকারি – যাঁকে বাঙালিরা সাধারণত কম্পাউণ্ডারবাবু নামে ডাকেন – যদিও কম্পাউণ্ডিঙের বাইরেও অনেক কিছুই করেন তিনি – তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি সব ব্যবস্থা করবেন।ডাক্তারবাবু যা ভেবেছিলেন, নানা পরীক্ষার পর দেখা গেল সেটাই ঠিক। রোগীর টাইফয়েড। এই হল ডাক্তারবাবুর প্রথম কাজ, অসুখটা কী সেটা বোঝা। মানে ডায়াগনোসিস। ডায়াগনোসিসের পর এবার চিকিৎসা। যে মারাত্মক জীবাণুর খোঁজ পাওয়া গেছে, রক্ত এবং বর্জ্য পরীক্ষা করে, এবং রোগীর জ্বর ইত্যাদি নানা লক্ষণ লক্ষ্য করে, তার জন্যে যে চিকিৎসা, তার বিধান দিলেন ডাক্তারবাবু। ডায়াগনোসিসের পর এই হল তাঁর দ্বিতীয় কাজ, চিকিৎসা বা ট্রীটমেন্ট। আছে আরও একটা কাজ। চিকিৎসা তো করবেন তিনি, কিন্তু চিকিৎসার সম্ভাব্য ভালো এবং খারাপ ফল রোগীকে, রোগীর আত্মীয়স্বজন আর কাছের মানুষদের, বোঝানো: – যে ক্যাপসূলটা দিচ্ছি, অনেক সময় সেটা খেলে পেটের অস্বস্তি বেড়ে যায়। তেমন যদি হয় জানাবেন আমাকে। আর একটা ওষুধ দিয়ে দেব। আর হয়েছে তো টাইফয়েড, এমন কিছু নয়। আজকাল কত ভালো ভালো ওষুধ বেরিয়ে গেছে। ঠিক ঠিক চিকিৎসা এবং পথ্যে রোগীর ঠিক হয়ে যাবারই কথা। একে বলে প্রগনোসিস। ভালো হয়ে যাবার সম্ভাবনার আন্দাজ। ধরুন ডায়াগনোসিসেই দেরি হয়ে গেল, ফলে চিকিৎসা শুরুই হল না ঠিক সময়ে। যখন শুরু হল তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। অন্য আরও নানাবিধ জটিলতাও দেখা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কিন্তু প্রগনোসিস ভালো না-ও হতে পারে।ডাক্তারের তিনটে প্রধান দায়িত্ব – ডায়াগনোসিস ট্রীটমেন্ট আর প্রগনোসিস আমরা বুঝলাম। শেষ দায়িত্ব প্রিভেনশন। এই একই অসুখ যাতে আবার রোগীর না হয় সেই বিষয়ে ডাক্তার রোগীকে উপদেশ দেবেন। টাইফয়েডে একবার ভুগলেন যিনি তাঁকে নিশ্চয়ই বুঝতে হবে ভবিষ্যতে কোথায় কী ধরণের জল এবং খাদ্য তিনি খাচ্ছেন, কতটা দৌড়োদৌড়ি করছেন কতটা বিশ্রাম নিচ্ছেন সে ব্যাপারেও তাঁকে সতর্ক থাকতে হবে।ডাক্তার আর রোগীর পারস্পরিক সম্পর্ক, কথোপকথন আর যে কোন ইনটারেকশনের মূল প্রোটোকলই এই যে চারটি নির্দিষ্ট ক্রিয়ার কথা বললাম তারই ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ডাক্তার হলেও, মানসিক অসুখের চিকিৎসা করেন যিনি তাঁর পক্ষে এই ধরণের সর্বসম্মত নিয়মনীতি বা প্রোটোকল মেনে কাজ করা প্রায়শই সম্ভব নয়। টাইফয়েড বা ম্যালেরিয়া বা নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে যে ভাবে ডায়াগনোসিসের কাজ করতে পারেন ডাক্তার, মানসিক রোগের ক্ষেত্রে ঠিক অত সহজে ডায়াগনোসিস হয় না।কেন হয় না? টাইফয়েড বা ম্যালেরিয়া বা নিউমোনিয়ার মতো অসুখ হবার জন্যে কে দায়ী? এক বা একাধিক দৃষ্টিযোগ্য স্পর্শযোগ্য বা অন্য কোন পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়াযোগ্য কোন পদার্থ। সেই সুযোগে এই ধরণের দায়ী পদার্থকে সহজেই চিহ্ণিত করা যায় এবং অসুখের ডায়াগনোসিসও সহজেই হয়ে যায়। ডায়াগনোসিস হলে ট্রীটমেন্টও।এই যে আপনাকে বারবার বলছি ডায়াগনোসিস হলে ট্রীটমেন্টও হয়ে যাবে, সেটা বলছি কেন? কারণ অসুখের জন্যে দায়ী দৃষ্টি, স্পর্শ বা বিক্রিয়াযোগ্য পদার্থটিকে চেনা গেলেই সেই পদার্থকে নিষ্ক্রিয় করার জন্যে অন্য একটি পদার্থ বা এমন কোন পদ্ধতি আবিষ্কার করা সহজ হয়ে যায় যা আক্রমক পদার্থটিকে হয়তো নিষ্ক্রিয় অথবা নিরর্থক করে তুলতে পারবে। ধরুন, কারো হাতের মাস্‌লে বিষ্ফোটক একটা কিছু হয়েছে। যেটা হয়েছে তার জন্যে দায়ী সম্ভবত অতি ক্ষুদ্র যে পদার্থ, তাকে চেনা যাচ্ছে না। চেনা যাচ্ছে না মানেই এই নয় যে আক্রমক পদার্থ নেই-ই কিছু। কিছু একটা হয়তো আছে, কিন্তু তার সম্পূর্ণ পরিচয় এখনো জানা যায়নি। জানা যদি যেত, তাহলে সহজেই সেটাকে নিষ্ক্রিয় বা নির্মূল করার ব্যবস্থা হত। কিন্তু তা যখন নেই বিজ্ঞ ডাক্তার তখনও হয়তো রোগীকে নিরাময় করবার বিকল্প একটা চেষ্টা করতে পারেন। ছোট্ট একটা সার্জিকাল অপারেশন। হাতের মাস্‌লের ওই অংশটুকু শল্য চিকিৎসক যথেষ্ট মার্জিনসহ বাদ দিয়ে দিতে পারেন। অনেক সময় এই ধরণের ট্রীটমেন্টও খুবই কাজের হয়। অনেক সময় বলছি এই জন্যে যে সব সময়ই এই চিকিৎসার ফল ভালো না-ও হতে পারে। তবু আমাদের এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আক্রমক পদার্থটাকে ঠিক মতো ডায়াগনোজ না-করেও তো চিকিৎসাটা হল!কিন্তু মানসিক অসুখের ক্ষেত্রে, গিরীন্দ্রশেখর বলতে থাকেন, এই ধরণের পদার্থ যা চোখে দেখা যায় বা হাতে ছোঁয়া যায় বা নাকে শোঁকা যায়, সাধারণত তা আপনি পাবেন না। এ ক্ষেত্রে ডায়াগনোসিসের জন্যে আপনাকে নির্ভর করতে হবে বাহ্যত রোগীকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে, তার সম্বন্ধে অন্যের মন্তব্য শুনেও হয়তো। নজরুল সাহেবকে যখন আমাদের হাসপাতালে প্রথম নিয়ে আসা হয়, উনি নাকি আসতেই চাইছিলেন না। যাঁরা এনেছিলেন তাঁরা বলেছিলেন অনেকটা জোরাজুরি করেই তাঁকে আনতে হয়েছিল। যে রেসিডেন্ট ওঁকে ভর্তি করেছিলেন তিনি বলেছেন ওঁর এসকর্টরা যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণই উনি ভর্তিতে বাধা দিয়েছেন। কথা ভালো বলতে পারছিলেন না, জিভ জড়িয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্তও উনি ভর্তি না-হবার চেষ্টা করছিলেন। আমি ওঁকে প্রথম দেখি সেদিনই বিকেলবেলা, কারমাইকেল হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে। প্রথম দিনই কথায় কথায় আমি বললুম, আমি নিজে ওঁর কবিতার একজন ভক্ত। উনি জিজ্ঞেস করলেন, গানের? আমি বললুম আপনার গানও খুবই ভালো, কিন্তু বাংলা কবিতায় সম্পূর্ণ নতুন কথা আপনি আমাদের শুনিয়েছেন, নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন। বিদ্রোহী কবিতার থেকে আমি খানিকটা আবৃত্তি করে শুনিয়েও দিলুম: আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ, আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর-মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি! আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি অবসান নিশাবসান। আমি ইন্দ্রানী-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য, মম এক-হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য। আমি কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির। আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর। বল বীর – চির-উন্নত মম শির।আমারই ভুল হয়তো, গিরীন্দ্রশেখর বললেন, কিন্তু আমার কেমন মনে হল এক মুহূর্তের জন্যে ওঁর চোখ জ্বলে উঠল। তারপর মুখ গম্ভীর করে বললেন, ও আমার লেখা নয়।আপনার লেখা নয়? কী বলছেন?না, জোরের সঙ্গে বললেন, আমার প্রলয়সুন্দর সারথি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর নিজের প্রয়োজন ছিল।আপনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল কবে? কোথায়?তিনি আমাকে চিনতেন, আমার সম্বন্ধে সব কিছুই জানতেন, অনেক আগের থেকেই। আমি তা জানতুম না। অনেক পরে আমি তাঁকে দেখেছি। তবে দেখেই আমি চিনেছি।তিনি কি এখনও আপনাকে দিয়ে কবিতা লেখান?কবিতা আর লেখান না, ছাই-ভস্ম যা লিখি সে আমি নিজে।আর গান?কখনো কখনো। আর মাঝে মাঝে বলেন, তুমিই লেখ কাজিভায়া, তুমিই লেখ, ভালোই হবে।ওঁর কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছিল, বলতে থাকেন গিরীন্দ্রশেখর, জিভ জড়িয়ে আসছিল মাঝে-মাঝেই, সব কথা স্পষ্ট করে বলতে পারছিলেন না, তারই মধ্যে জোর করে বলতে গিয়ে কষ্টও পাচ্ছিলেন মাঝে মাঝে। কিন্তু কথা বলানোই আমার কাজ, কথা শুনতে শুনতেই হয়তো একটা ক্লু পাব।বললুম, দুর্গম গিরি কান্তার মরুও কি উনি বলে দিয়েছিলেন?একটু রেগেই গেলেন মনে হল, বললেন উনি অমন ভাবে কিছুই বলে দেন না। যখন উনি মনে করেন, আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেন।আমি বললাম, কিন্তু, যখন বলেন, কাজিভায়া, তুমি নিজেই লেখ, তখন?তখন কী?ওই যে আপনি বললেন না, গান কখনো কখনো আপনাকে নিজেকেই লিখতে বলেন। বলেন, তুমিই লেখ কাজিভায়া, তুমিই লেখ। ভালোই হবে। তখন? তখন কী করেন?মনে হল হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন নজরুল। ওঁর চোখ স্বাভাবিক ভাবেই খানিকটা লাল। দেখলাম, লালের মাত্রাটা বাড়ল। কিছু একটা বলবার চেষ্টা করছিলেন; একেই জিভের জড়তা, তার ওপর অনেক কথা একসঙ্গে বলার প্রয়াসেসে-কথাও আটকিয়ে গিয়ে একটা গর্জনের মতো শব্দ গলা থেকে বেরোতে লাগল। আমার সঙ্গে যে ডাক্তার ছিল একটা ট্র্যাঙ্কুইলাইজার দেবার উপদেশ তাকে দিয়ে আমি আমার ঘরে গিয়ে বসলাম। পরে শুনলাম আরও দু-তিনজনের সাহায্য নিয়ে জোর করে চেপে ধরে নজরুলকে ট্র্যাঙ্কুইলাইজার ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়েছে।তার মানে, বলেন গিরীন্দ্রশেখর, আপনি বুঝতেই পারছেন, প্রথম দিনেই আমি অসফল হলাম।আমাদের হাসপাতালের ডাক্তাররা নজরুলকে ভর্তি করতেই চাননি, কিন্তু পাকেচক্রে তিনি ভর্তি হয়ে গেছেন, কাজেই আমার খানিকটা জেদই হল, কথা বলাতেই হবে ওঁকে দিয়ে। কথা – যা তিনি বলতেই চাইছেন না – তাঁকে দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা বলাতে পারলেই তাঁর অবচেতনের পর্দাটা হয়তো খানিকটা সরবে, ফলে মানসিক আরাম-বোধও খানিকটা আসবে এবং ধীরে ধীরে রোগী হয়তো তাঁর মনের গভীর কষ্টের দরজা আমাদের সামনে খুলে দেবেন।পরের দিন আমি আবার নজরুল সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। সামান্য একটুখানি ভূমিকার পর সরাসরি তাঁকে বললাম, গতকাল আপনি আমায় নিজের কবিতার সম্বন্ধে বললেন, ছাই-ভস্ম। বললেন, ছাই-ভস্ম যা লিখি সে আমি নিজে। আপনি এত বড় কবি, আপনার অগণিত ভক্ত পাঠক, আপনি হয়তো বিনয় দেখিয়েই বলছেন আপনার কবিতা ছাই-ভস্ম লেখা। কিন্তু আপনি যদি সত্যিই মনে করেন যা আপনি লিখেছেন তা যতটা ভালো হতে পারত তেমন হয়নি, তাহলে আপনার পক্ষে সেগুলো একটু-আধটু সংশোধন করা কী এমন ব্যাপার?নজরুল আমাকে বললেন, আপনি বড় বেশি কথা বলছেন। আমার কবিতা, সংশোধন করব কি করব না সেটা আমিই ঠিক করব। বলেই চুপ। আমি ভাবলাম উত্তেজনার ক্লান্তি। চুপ করে বসে রইলাম।কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পর হঠাৎ উঠে বসলেন নজরুল, চক্ষুনির্গত অশ্রু যেন ঝলকে ঝলকে বলকে বলকে তাঁর সারা মুখ ধুইয়ে দিচ্ছে। দুয়েকবার কিছু বলার চেষ্টা করলেন, জিভ সহযোগিতা করল না। তারপর আবার শুয়ে মিনিট পাঁচেক চুপচাপ রইলেন। এবার থেমে থেমে ধরা-গলায় বললেন, কবিতা লিখে লাভ? লিখলেই তো বাজেয়াপ্ত করবে সরকার, তারপর লুকিয়ে-লুকিয়ে ছাপবে কেউ-না-কেউ, চোরাবাজারের মালের মতো দশগুণ দামে কিনবে পাঠক। কবির পকেট কিন্তু শূন্য। বিদ্রোহী কবিতা তো পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। নজরুলকে গালাগালি না-দিয়ে এক ঢোক জলও গিলত না যে সজনীকান্ত-মোহিতলাল-প্রবাসীর দল, তাদের মধ্যে কে বিনা অনুমতিতে হাজার হাজার কপি ছাপেনি? কবিকে পয়সা দিয়েছে কেউ? একটা কবিতা লিখতে যে-সময় দিতে হয় সেই সময়ে বিশটা গান লিখতে পারি। ভালো হোক তত ভালো না-হোক সব রেকর্ড-কম্পানীতে বিকোয়। কোন কোন বন্ধু প্রকাশ্যে বিলিতি-কুকুর বলতেও ছাড়েননি। কী এসে গেছে বাঙালির? ভিখিরি নজরুলকে ভিখিরি দেখতেই ভালো লাগে বন্ধুদের। লিখব না কবিতা, যা করতে পারেন করে নিন।একটু সময় নিলেন গিরীন্দ্রশেখর। জল খেলেন একটু, তারপর বললেন, একটা সময় ছিল যখন স্নায়ুরোগ ও মনোরোগের বিশেষজ্ঞরা রোগীকে হিপনোটাইজ করবার জন্যে বিশেষ কায়দা-কানুন শিখতেন, এবং সেই শিক্ষার প্রয়োগেকথা-বলতে-অনিচ্ছুক রোগীর কাছ থেকে ভাসা ভাসা খানিকটা কথা বের করে এনে তার বিশ্লেষণ করে রোগীর মনের গভীরে ঢোকার চেষ্টা করতেন। ক্রমে অনিচ্ছুক রোগীর কাছ থেকে ভাসা-ভাসা প্রায়-অর্ধসত্যের বদলে রোগীকে অনেকটা আরামদায়ক এবং স্বাভাবিক পরিবেশে বিশ্রামের সুযোগ করে দিয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময়যাপন করে তাঁকে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে মন থেকে উৎসারিত কিছু কিছু কথা উদ্ধারের রীতি চালু হল। এই পদ্ধতিকে বলা হয় free association বা অবাধ ভাবানুষঙ্গ।পিংলা এতক্ষণ নিজেই প্রায় সম্মোহিত বা হিপনোটাইজড অবস্থায় গিরীন্দ্রশেখরের কথা শুনছিল। এবার বলল, স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার সুযোগটা বুঝতে পারলাম না। পরিবেশ যতই আরামদায়ক হোক-না-কেন কথা বলার ইচ্ছেটা যতক্ষণ না রোগীর মনে আসবে, সে কথা বলবে কেন?আপনি যা ভাবছেন অবাধ ভাবানুষঙ্গের প্র্যাকটিশনাররাও সেরকমই ভাবেন। কাজেই, রোগীকে জোর-করা নয়, নরম আলোর ঠাণ্ডা একটা আরামদায়ক ঘরে রোগীকে শোয়ানো হয়। একজন ডাক্তার থাকেন, কিন্তু বেশি কথা বলা তাঁর কাজ নয়। রোগী কথা বললে তিনিও ছোট ছোট জবাব দেন, রোগীর মন যাতে বিক্ষিপ্ত না হয় সেটা দেখাও তাঁরই দায়িত্ব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় একটু একটু করে নানা বিষয়ে রোগী কথা বলছে। পারদর্শী সাইকোঅ্যানালিস্ট-ডাক্তারকে এই সময় খুব দায়িত্ব নিয়ে বুদ্ধি প্রয়োগ করে অবস্থাটা নিজের সম্পূর্ণ আয়ত্তে নিতে হয়। রোগীর নানা কথার উত্তরে যথাসম্ভব ছোট অথচ এমন উত্তর দিতে হয় যাতে রোগী তার ট্র্যাকে থাকে, বিপথে চালিত না হয়, যে-বিষয়ে সে কথা বলছে তার থেকে কোনমতেই যেন বেরিয়ে না যায়।এবং এই ধরনের কথা, গিরীন্দ্রশেখর বলতে থাকেন, অনেক সময় বহুক্ষণ পর্যন্ত চলে। রোগী ঘুমিয়ে পড়ে অনেক সময়। প্রায়ই সেই ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হয় না, একটু পরেই হয়তো ভেঙে গেল, রইল খানিকটা আধঘুমের অবস্থায়। সেই অবস্থাতেই ছোট ছোট বাক্য কোন কোন রোগী বলে। সাইকোঅ্যানালিস্ট বোঝবার চেষ্টা করেন এই বাক্যগুলো কোন খবর তাঁকে দিতে পারছে কিনা। যদি মনে হয় বাক্যগুলো হয়তো খানিকটা কাজের, তখন তিনি সেগুলোকে নোট করেন, হয়তো পরের বারে কাজে লাগান। এরপর গভীর ঘুম এলে সেদিনের মতো এক্সারসাইজ বন্ধ।নজরুল সাহেবকে নিয়ে এই এক্সারসাইজও আমি কয়েকবার করেছি। ব্যর্থ প্রয়াস। বেশির ভাগ সময় উনি এত উত্তেজিত থাকেন যে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকতেও পারেন না, ঘুমোতেও পারেন না। ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে লাভ নেই, সে-ঘুম শান্তির ঘুম হয় না। তখন আমি নতুন ইনপুট আরও কিছু পাওয়া যায় কিনা, সেই আশায় নজরুল সাহেবের কিছু কিছু লেখা আবার নতুন করে পড়তে শুরু করলাম। খোঁজ করে করে পড়লাম তাঁর শেষ গদ্য লেখাও। আপনি পড়েছেন? – পিংলাকে জিজ্ঞেস করেন গিরীন্দ্রশেখর।কাজিদার কোন্‌ লেখাটা একেবারে শেষের তা তো আমি জানিনা। ইদানিং কাজিদা গানই বেশি লিখত, কিন্তু তা-ও কমে এসেছিল। কেন কমেছিল জানেন? গুরুদেব বরদাচরণের উপদেশে তার যাবতীয় লেখা এবং গানের কপিরাইট অসীমকৃষ্ণ দত্ত নামে একজন সলিসিটারের কাছে বন্ধক রেখে সামান্য কিছু টাকা ধার করার পর থেকে। যা-ই লিখত তার কপিরাইটের টাকা সোজা পৌঁছিয়ে যেত অসীমকৃষ্ণের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। আমি একবার কাজিদাকে বললুম, যা তুমি বন্ধক রেখেছ সলিসিটারের নামে, সেগুলো হচ্ছে কন্ট্র্যাক্টের সময়ে যে যে কপিরাইট তোমার ছিল। কন্ট্র্যাক্টের পরের কপিরাইট তো বন্ধক দেওয়া হয়নি। সেই কপিরাইটের টাকা তো তোমারই, অসীমবাবুর অ্যাকাউন্টে তা যাবে কেন? কাজিদা মনে করল আমি তাঁর গুরুদেব – বা বন্ধু – বা ভগবান – বা যে-নামে ডেকেই উনি শান্তি পান – তাঁকেই অপমান করছি!এ-বিষয়ে কথা বলা বন্ধই করল আমার সঙ্গে।নয়ই জুলাই অসুস্থ হলেন নজরুল সাহেব, বলেন গিরীন্দ্রশেখর, তার পর তো আর অফিসে যাননি। জুন মাসেরই একটা নবযুগে বেরিয়েছে তাঁর শেষ লেখা গদ্য, আমার সুন্দর। আগেও পড়েছিলাম, সেটাই আরেকবার পড়লাম। এই সুন্দর শব্দটা মনে হয় তাঁর শেষ আহৃত শব্দ, এত অদ্ভুত অদ্ভুত প্রয়োগ! শক্তিসুন্দর প্রকাশসুন্দর যৌবনসুন্দর প্রেমসুন্দর শোকসুন্দর স্নেহসুন্দর শিশুসুন্দর প্রলয়সুন্দর সংহারসুন্দর ধ্যানসুন্দর স্বর্ণসুন্দর আবার স্বর্ণজ্যোতিসুন্দর! আরো কত! কিন্তু এবার পড়ে আমার নতুন চৈতন্যোদয় হল। আগে যতবার পড়েছি, এরকম করে ভাবিনি। আমার মনে হল নজরুল সাহেবের নিজের চিন্তাতেও মাঝে-মাঝে একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল। যে কল্পিত শক্তির কাছে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন বলে নিজেই মনে করছিলেন, মাঝে মাঝে কি সেই প্রলয়সুন্দর সম্বন্ধেও তাঁর নিজেরই সন্দেহ হচ্ছিল? তিনি লিখেছেন, প্রাণপণে তাঁর প্রলয়সুন্দরকে ডেকে অবশেষে স্বপ্নে তিনি তাঁকে দেখলেন। স্বপ্নে প্রলয়সুন্দর তাঁর কাছে যেন নিজের পরিচয় দিচ্ছেন নজরুলেরই পূর্বচেতনা বা প্রিকন্‌শাসনেস হিসেবে। এরপর গোপনে নজরুল কোরান বেদান্ত ইত্যাদি পাঠ শুরু করলেন। গোপনে কেন? আর যে-কথাটা এই প্রবন্ধেও বলেননি, তা হল তিনি গোপনে ফ্রয়েড-প্যাভলভ-এমিল ক্যূয়েও পড়তে শুরু করেছিলেন বলেই আমার ধারণা। গোপনে! সম্ভবত নিজের সংবিত সম্বন্ধেও তাঁর নিজেরও সেই সন্দেহ শুরু হয়েছিল, যা তিনি কারোকেই বলতে পারছিলেন না। নিজেদের মনোবিশ্লেষণের অভিপ্রায়ে শিক্ষিত যুবকরা অনেকেই আজকাল ফ্রয়েড-প্যাভলভ-এমিল ক্যূয়ে পড়ে, নিজেকে নিয়ে বিব্রত নজরুলই বা পড়বেন না কেন? তবে পড়লেও, হয়তো নজরুল সাহেব বোঝেননি সব ঠিক মতো, অনেকটাই ঘুলিয়ে গেছে মনে হল, যদিও এই প্রিকন্‌শাসনেস কথাটা তাঁর প্রবন্ধে হঠাৎ এসে গেছে এই ফ্রয়েড-টয়েড পড়বার প্রভাবেই!এই পর্যন্ত বলার পর গিরীন্দ্রশেখর পিংলাকে হঠাৎ বলেন, দেখুন, এত মনোবিশ্লেষণের কথা হচ্ছে, কিন্তু আপনার ক্ষুধাবিশ্লেষণ? সেই কতো সকালে আপনি বেরিয়েছেন ন'টার সময় এখানে পৌঁছবার জন্যে, এতক্ষণ তো না-খেয়েই আছেন। বলতে বলতেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে যান তিনি, খানিকটা পরে ঘরে ঢুকে চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলেন, বুদ্ধদেব বসু নামে কাউকে চেনেন?ঠিক মনে করতে পারছি না, বলে পিংলা।রিপন কলেজের ইংরিজির প্রফেসর। আমার মেজদা রাজশেখর বসুর নাম শুনেছেন তো? তাঁরই কাছে মাঝে মাঝে বুদ্ধদেববাবু আসেন সংস্কৃত সাহিত্য আলোচনা করার জন্যে। কয়েকদিন আগে এসেছিলেন, বললেন, নজরুলকে উনি খুবই ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন, সেই ঢাকায় কলেজে পড়বার সময় থেকেই। বললেন, বছর দুয়েক আগে ঢাকা রেডিও সেন্টারের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে সস্ত্রীক উনি ঢাকায় যাচ্ছিলেন। সেই একই অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্যে যাচ্ছিলেন নজরুল সাহেবও। স্টীমারে নজরুলের সঙ্গে ওঁদের দেখা। নজরুলের শুধু চেহারার চটক নয়, তাঁর ব্যক্তিত্বেরই একটা অসাধারণ টান আছে। পরিচিত মানুষরা তাঁকে দেখতে পেলে ছুটে গিয়ে আলাপ করবেন এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবারটা তাঁর মুখে যেন ক্লান্তির ছায়া, চোখমুখ গম্ভীর, সেই পরিচিত হাসির উচ্ছ্বাস আর নেই। কথায় কথায় বললেন, যোগসাধনা করে তাঁর গায়ের রং তপ্ত কাঞ্চনের মতো হয়েছিল। বললেন, I am the greatest Yogi in India, একবার শ্রীঅরবিন্দ সূক্ষ্মদেহে তাঁর কাছে এসে আধ ঘন্টা বসেছিলেন – এরকম নানা কথা। মনটা খারাপ হয়ে গেল, বুদ্ধদেব বলছিলেন, ভাবলুম কোন মনোবিদকে দিয়ে কি ওঁর চিকিৎসা করানো যায়?কথায় কথায় বুদ্ধদেব বললেন, রেডিওর অনুষ্ঠানের পর উনি ঢাকা য়্যুনিভার্সিটিতে পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতেও গিয়েছিলেন। নজরুলকেও ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনেকে। য়্যুনিভার্সিটিতে কবি জসীম উদ্দীনের সঙ্গেও বুদ্ধদেবের দেখা হয়। জসীম ওঁকে বলেন, নজরুল সাহেবও এখানে এসেছিলেন, সলিমুল্লাহ্‌ আর ফজলুল হক হল-এ। ছাত্রদের সঙ্গে খুব খোলামেলা কথা হল তাঁর। এইরকমের কথাবার্তার মধ্যেই উনি একবার বললেন, “আমি আল্লাকে দেখেছি। কিন্তু সে সব বলবার সময় এখনো আসে নাই। সে সব বলবার অনুমতি যেদিন পাব, সে দিন আবার আপনাদের সামনে আসব।” আপনি খেয়াল করবেন, মোটামুটি একই দিনে একই সময়ে বুদ্ধদেবকে উনি বলছেন সূক্ষ্মদেহে অরবিন্দর সঙ্গে দেখা হবার কথা, কিন্তু ঢাকার ছাত্রদের বলছেন আল্লাহ্‌কে উনি দেখেছেন!এই কথা চলতে চলতেই দুটো প্লেটে যথেষ্ট-সংখ্যক মিষ্টান্ন এবং অন্যান্য জলখাবার পৌঁছল। পানীয় জল এবং চা-ও। একটা প্লেট পিংলার দিকে ঠেলে দিয়ে অন্যটা নিজের জন্যে টেনে নিলেন গিরীন্দ্রশেখর। বললেন, খেতে শুরু করুন, খেতে খেতেই এবার কথা চালিয়ে যাব আমরা।পিংলা বলল, আপনি প্রথম থেকেই একটা কথা বলছেন, আমরা দেরি করে ফেলেছি, আরও আগে কাজিদাকে এখানে আনা উচিত ছিল। আপনাদের রেসিডেন্ট ডাক্তারবাবুরাও সে-ই কথাই বলেছেন। আপনি কি এখনও তা-ই মনে করেন?আমি মনে করি না একথা বলব না, গিরীন্দ্রশেখর বলেন, বিশেষ করে বুদ্ধদেবের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে। আপনি খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, বুদ্ধদেবকে উনি বলেছেন উনি ভারতের greatest Yogi, ওঁর কাছে সূক্ষ্মদেহে এসে আধঘন্টা বসেছিলেন অরবিন্দ। ঢাকার ছাত্রদের কিন্তু বলেছেন ওঁর সঙ্গে আল্লাহ্‌-র দেখা হয়েছে! তখন আর অরবিন্দর কথা নয়, এমনকি সূক্ষ্ম দেহর কথাও নয়!দেখুন, বলতে থাকেন গিরীন্দ্রশেখর, আপনিই আমাকে নজরুলের লোটো গানের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলছিলেন। মুসলিম পরিবারে জন্ম হলেও নজরুল সাহেবের মেলামেশা অনেকটাই হিন্দু-সংস্কৃতির পরিবেশে, রামায়ণ-মহাভারত এবং নানান পুরাণের গল্প পড়ে অথবা শুনে। তার ফলে তাঁর ক্রিয়েটিভ রচনাতেও হিন্দু-সংস্কৃতির ছাপ অনেক বেশি। আমি যতটুকু খবর পেয়েছি, মুসলিম সমাজের বহু মানুষ, বিশেষ করে ধর্মব্যবসায়ের সঙ্গে যাঁদের যোগ তাঁরা এই সব উদাহরণ দিয়ে প্রায়শই ওঁর বিরোধিতা করেন। 'কাফের' – এই বদনামে নজরুল সাহেব প্রায় অভ্যস্তই হয়ে গেছেন। একজন আমাকে বললেন, উনি নাকি একবার ইলেকশনেও দাঁড়িয়েছিলেন। মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে। যাঁরা ওঁকে পছন্দও করতেন, তথাকথিত কাফের হওয়ায় তাঁরাও ওঁকে ভোট দেননি! এসবের একটা প্রভাবও তো ওঁর অসুস্থতায় থাকতেই পারে। এদিকে আবার হিন্দু লেখক-সমালোচকদেরও বোধ হয় ওঁর বিষয়ে খানিকটা উন্নাসিকতা এবং তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল। কারো কারো ঈর্ষাও যে ছিল এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। সজনীকান্ত-প্রবাসী-মোহিতলালদের কথা অনেকেই আমরা জানি। শুনেছি প্রমথনাথ বিশী ওঁকে অলস বলেছেন ছাপার অক্ষরে, অনেক ভালো কবিতাকেই নাকি উনি আলস্যে মাটি করে ফেলেন। আমার ধারণা নজরুল সাহেব একজন আবেগপ্রবণ মানুষ। ওঁরই এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, এমনকি সজনীকান্ত দাসের মতো মানুষ, যাঁর প্রধান কাজের মধ্যে একটি ছিল নজরুলকে একটু চিমটি কাটবার সুযোগ করে নেওয়া, তাঁরও সঙ্গে এক বন্ধুর দৌত্যে নজরুল বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন! এবং এক ফুর্তির আসরে নাকি কোন বিরূপ সমালোচনায় – প্রায় মোহ্যমান নজরুল সাহেব – তাঁরই কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। নজরুল সাহেবের বন্ধুটি আমাকে বলেছেন, সজনীকান্ত চোখের-পলক-না-ফেলে বললেন, কেন, মুসলমানদের মধ্যে তুমিই তো শ্রেষ্ঠ কবি!নজরুল সাহেবকে নিয়ে আমি একটা ফাইল গোছের তৈরি করছিলাম। আমি তাঁর যত লেখা পড়লাম, তাঁর সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে যা যা জানতে পারলাম, সেগুলোর ছোট ছোট করে 'নোট' রাখছিলাম। সেখানে একটা এন্ট্রি আছে, নয়ই জুলাইয়ের কিছুদিন পর তখন তিনি মধুপুরে, কোন একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের চিকিৎসায়। সেখান থেকে তিনি চিঠি লিখেছেন নবযুগ দৈনিকের একজন সহসম্পাদক ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরিকে। তার একটা ছোট্ট অংশ পড়ছি, খুব ইন্টারেস্টিং: “প্রিয় ব্রজেন, কাল থেকে...সে...তুমি editotrial লিখবে। “আমি” অক্টোবরের মধ্যেই ভাল হয়ে যাব। ফাল্গুন থেকে নব-বসন্তের মত তেজ পাব। আমার “বন্ধু”র দেহ হয়ে যাব, “বন্ধু” বলেছেন। তোমাদের বৌদি ভাল হয়ে যাবেন। বন্ধু বলেছেন,...কদিন ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগছে ও কয়দিন বিশ্রাম করুক। ফাল্গুন মাস থেকে তোমাদের মাইনে বেড়ে যাবে। ফাল্গুন মাস থেকে মনসুর আসবে ওর মাইনে ৩০০ টাকা হয়ে যাবে।...” ধর্মব্যবসায়ীদের যেসব ম্যাজিকে তিনি ছেলেবেলায় বিশ্বাস করতে শিখেছিলেন, সেগুলোর থেকে মনে হয় আর বেরতে পারছিলেন না। হয়তো বেরতে চাইছিলেনও না। তাই সবায়ের জন্যেই ভালো ভালো খবর দিচ্ছিলেন তিনি, ভগবান মঙ্গলময়। আর, একই সঙ্গে, আল্লাহ্‌ বা আল্লাহ্‌র সাক্ষাৎ-সুহৃদদের সঙ্গে তাঁর নিজের যোগাযোগের কথাটাও বলতে চাইছিলেন বোধ হয়। শয্যাশায়ী মনোরোগী নজরুল সাহেবের এক বন্ধু আমাকে বলেছেন, একদিন নজরুল তাঁকে বললেন, তোমরা আমাকে আজও কবি মনে কর, কিন্তু দেখে রেখ এমন একদিন আসবে যেদিন আমাকে তোমরা কবি বলবে না, বলবে দরবেশ।যে-খাবার পাঠানো হয়েছিল অন্দরমহল থেকে তা এতক্ষণে দুজনেরই শেষ। টি-পট থেকে নিজের এবং পিংলার কাপে চা ঢালতে ঢালতে এবার গিরীন্দ্রশেখর বলেন, আমি জানি না সকাল থেকে এতক্ষণ সময় আপনার শুধুই নষ্ট করলাম কিনা। এতক্ষণে তো আপনি বুঝেছেন আমাদের হাসপাতালে এতদিন কাজিসাহেবের প্রায় কোন চিকিৎসাই হয়নি। আমি এতক্ষণ ধরে আপনাকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম যে নজরুল সাহেবের ক্ষেত্রে আমরা তাঁর অসুখটা ডায়াগনোজই করতে পারিনি। কাজেই ট্রীটমেন্টের প্রশ্নই আসে না। তাঁর সাধারণ ব্যবহার লক্ষ্য করলে মাঝে মাঝেই তাঁর অসুখটাকে ম্যানিক ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার বলেই মনে হয়। এই রোগের প্রধান লক্ষণ অবসাদ বা বিষাদগ্রস্ততা – বেশির ভাগ সময়েই যার বহিঃপ্রকাশ হয় কথা কম অথবা একেবারেই না-বলায়, কখনো নিদ্রাহীনতা কখনো অতিরিক্ত ঘুম, খাদ্যগ্রহণে সাধারণভাবে অনীহা কিন্তু মাঝে মাঝে কোন কোন খাদ্য মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে ফেলা, অকারণ অসংযত ব্যবহার, এবং মাঝে-মাঝেই উচ্ছ্বাসপ্রবণতা। তখন রোগী কথাও বেশি বলে। কারো কারো ক্ষেত্রে আত্মহত্যাপ্রবণতাও দেখা যায়। আজকাল এই রোগের কিছু কিছু ওষুধও বেরিয়েছে, কিন্তু একই ওষুধ যে সবায়েরই কাজ করে তা নয়। ওষুধ ছাড়াও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। আপনি নাম শুনেছেন? ই-সি-টি।দেখুন, ডাক্তারির ব্যাপারে কোনই ধারণা নেই আমার, বলে পিংলা, আমার জীবনের অনেকটা সময় আমি কাটিয়েছি সুরুলে, যেখানে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে আর নেতৃত্বে গ্রামোন্নয়নের কাজ হত। ওখানে ডিসপেন্সারিও ছিল, দেশি-বিদেশি অনেক ডাক্তারবাবুরাও আসতেন। অসুখ-বিসুখে তাঁদেরই সাহায্য পেতুম। আপনি নিজে বিখ্যাত চিকিৎসক, আপনাকে বলতে লজ্জা করে, কিন্তু নাগালের মধ্যে গুরুদেব নিজে থাকলে আমরা তাঁর হাতে চিকিৎসার জন্যে লালায়িত থাকতুম। হোমিওপ্যাথিক আর বায়োকেমিক ওষুধ দিতেন তিনি নিজের হাতে, খেলেই কাজ হত।হেসে ফেলেন গিরীন্দ্রশেখর। তিনি যে নিজেও কয়েকদিন সুরুলের ডিসপেন্সারিতে মানসিক রোগের চিকিৎসা করেছেনসে-কথা চেপে গিয়ে বললেন, কাজ যে হত তা আর বলতে! অমন জোরদার প্লেসিবো এফেক্ট!কী এফেক্ট? প্লেসিবো? সেটা কী?আবার হাসেন গিরীন্দ্রশেখর, বলেন, সে-কথা আজ থাক। আবার যদি কখনো আসেন, বলব। তবে নজরুল সাহেবকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন, উনি বোধ হয় জানেন। আমার ধারণা ফ্রয়েড-প্যাভলভের সঙ্গে উনি এমিল ক্যূয়েও পড়েছেন। প্লেসিবো এফেক্ট নিয়ে এমিল ক্যূয়ের খুব ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। যাই হোক, তাহলে বোঝা গেল, ই-সি-টি সম্বন্ধে আপনার ধারণাই নেই। ই-সি-টি হল ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি। মাথার বাইরে থেকে মস্তিষ্কে খুব মৃদু তড়িৎচালনা করা হয়, মস্তিষ্কবাহিত সেই তড়িতের পেশীতে ক্রিয়াশীল না-হবার ব্যবস্থা আছে, যার ফলে রোগীর হাত-পা বা শরীরের অন্য কোন জায়গায় কোন অবাঞ্ছিত কম্পন বা টান – ফিটের রোগীর মতো – না হয়। ব্যাপারটা মুহূর্তের কাজ। ধরুন, এক থেকে দেড় সেকেণ্ডের বেশি নয়। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে ই-সি-টি ম্যানিক ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে কাজ দেয়, ডায়াগনোস্টিক টূল হিসেবেও দক্ষ চিকিৎসক ব্যবহার করতে পারেন।আমি একেবারেই সম্পূর্ণ নিরাময়হীন নজরুল সাহেবকে ছেড়ে দিতে চাইছিলাম না, বলতে থাকেন গিরীন্দ্রশেখর,ই-সি-টিতে আমার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ আমার এক বন্ধুকে নিয়ে এলাম লুম্বিনীতে, নজরুল সাহেবের ই-সি-টির জন্যে। নজরুল সাহেব কিন্তু দেখা গেল মাথায় ইলেকট্রিক শক দিয়ে চিকিৎসার কথা শুনেছেন। অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আমাকে বললেন, আমি কি উদম পাগল হয়ে গেছি যে আমাকে শক দেবেন?আমরা নজরুল সাহেবকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, উদম পাগল হননি বলেই আমরা তাঁর পরীক্ষা করবার চেষ্টা করছি।যদি এই পরীক্ষায় কিছু না বোঝা যায় আমরা তাঁকে ছেড়ে দেব। তাঁকে এ-ও বোঝানো হল, বিদ্যুতের ব্যবহারে ভয় পাবার কিছুই নেই। তিনি কিছু বুঝতে পারবার আগেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তবুও, শেষ পর্যন্ত তাঁর ঘোরতর আপত্তি দেখে আমার বন্ধু বললেন, রোগীর নিজের ইচ্ছাবিরুদ্ধ এই চিকিৎসা থেকে আমাদের বিরত থাকাই ভালো।এর পর থেকে কাজি নজরুল ইসলাম আমাদের হাসপাতালে আছেন আমাদের অতিথি হিসেবে। আমরা তাঁর চিকিৎসার চেষ্টা থেকে বিরতি নিয়েছি। তাঁকে যতদূর সম্ভব আরামে, যথাযথ সম্মান দিয়ে, যদি তিনি কিছু লিখতে চান এই কথা ভেবে আমরা খাতা-কলমও দিয়েছি তাঁকে, আর পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যে তাঁকে তাঁর পরিবারে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করছি। রোজই হাসপাতালে আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তিনি হাসেন। এরই মধ্যে আমাকে একদিন নজরুল সাহেব বললেন, ডাক্তারবাবু, আমার ওপর রাগ করেছেন? আমি বললাম, কেন, রাগ করব কেন? উনি বললেন, আমি জানি, করেছেন। আমি যে ওই ইলেক্ট্রিকের শক নিতে রাজি হলাম না, তাই। তাহলে আপনি করেই নিন পরীক্ষাটা। আমি হেসে বললাম, নাঃ, ওই পরীক্ষা আর করব না। তা ছাড়া, আপনি তো ভালোই আছেন। উনি বললেন, ভালো নেই ডাক্তারবাবু, ভালো নেই। এ-দেশে কেউ ভালো নেই, থাকতেই পারে না। ভেবে দেখুন, এতদিনের স্বাধীনতা আন্দোলন, সবাই জানে আর কিছুদিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, তবু এখনই, ঠিক এখনই, দেশের সব মানুষ দেশটাকে টুকরো টুকরো করার জন্যে ক্ষেপে উঠেছে, সবাই নাকি এখন সম্পত্তির ভাগ চায়!কিছুক্ষণ কোন কথা না বলে চুপ করে বসে থাকেন গিরীন্দ্রশেখর। এক গ্লাস জল খান, তারপর পিংলাকে বলেন, এতদিন আমাদের হাসপাতালে রইলেন নজরুল সাহেব, আমরা কিন্তু তাঁর কোন চিকিৎসা শুরুই করতে পারলাম না। আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। আপনি কি ওঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন?আপনি যত বিশদে যা বললেন, তার পর কাজিদাকে এখানে রেখে যাবার আর কোন মানেই তো হয় না। রেখে যাওয়া মানে তো নির্বাসন দেওয়া। আপনারা যত্ন করে, সম্মান দিয়ে তাকে রেখেছেন, আমাদের তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আমি শুধু ভাবছি, এখন কাজিদাকে নিয়ে যাব কোথায়? কার কাছে রাখব তাকে? যাই হোক, পিংলা বলে, সেটা আমার সমস্যা, সমাধানটা আমাকেই করতে হবে। আমি কি আজই কাজিদাকে নিয়ে যেতে পারি?পারেন, বলেন গিরীন্দ্রশেখর। সে ক্ষেত্রে আপনি আমাকে আধ-ঘন্টা সময় দিন।কেন? আমাকে আপনি আপনাদের হাসপাতালে যাবার ডিরেকশনটা একটু দিয়ে দিলে আমি এখনই চলে যেতুম।উঁহুঁ, তা হয় না, বলেন গিরীন্দ্রশেখর।কেন?আপনাকে কে হাসপাতালে চেনে, যে আপনি চাইলেই ওঁকে আপনার জিম্মায় দিয়ে দেবে? আপনি তো ভর্তি করার সময়েও আসেননি।সেটা ঠিক, বলে পিংলা, তা হলে?আমি আপনার সঙ্গে থাকলে কেউ আর আপত্তি করতে পারবে না। আমিই সই করে রিলিজ করে দেব ওঁকে। আধ ঘন্টা সময় চাইলাম এইজন্যেই। আমি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করছি। সেই গাড়িতেই আপনি নজরুলকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।গাড়িতে যেতে যেতে পিংলা বলে, আমার এতক্ষণ একটা কথা বলতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। কিন্তু বলতে তো হবেই।উঁহুঁ, বলতে হবে না, বলেন গিরীন্দ্রশেখর। সেট্‌ল্‌মেন্ট অব ডিউজ, তাই তো? কোন ডিউজ নেই।সেটা কীরকম? – বলে পিংলা – এতদিন হাসপাতালে থাকল।থাকল তো কী হল? হাসপাতাল তো কোন সার্ভিস দেয়নি, চিকিৎসা শুরু পর্যন্ত করতে পারেনি।হাসপাতালে পিংলাকে দেখে ভারী খুশি নজরুল, বলল, এতদিনে তোর আমার কথা মনে পড়ল?আমি অনেক কাজে ব্যস্ত ছিলাম কাজিদা, সে তোমাকে পরে বলব। আমি তো তোমার অসুখের খবর পাইই-নি।এই যে আজ এলি, আবার কতদিনে কাজিদার কথা মনে পড়বে?আবার কবে কী বলছ, আজই তো তোমাকে নিয়ে যাব।প্রায় লাফিয়ে ওঠে নজরুল, আমার ছুটি হয়ে গেল?ঘরের এক কোণায় বসে ছিলেন গিরীন্দ্রশেখর, তিনি বললেন, হ্যাঁ, ছুটি। আপনাকে এতদিন বন্দী করে রেখেছিলাম আমরা। আপনার ছোটভাই আপনাকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে এসেছে।সত্যি? নজরুলের আর তর সয় না, সে উঠে দাঁড়ায়, যা দুয়েকটা জামাকাপড় সঙ্গে ছিল, একটা ব্যাগে পোরে। তারপর ওর বিছানার সঙ্গে লাগানো ছোট টেবিলটা থেকে একটা খাতা আর কলম তুলে নেয়, গিরীন্দ্রশেখরের দিকে ফিরে বলে, ডাক্তারবাবু, আপনার খাতা আর কলমটা নিয়ে যাচ্ছি। যদি আবার কখনো লিখি কিছু, আপনাকে পাঠিয়ে দেব।তিনজনে বেরিয়ে আসে হাসপাতালের ভেতর থেকে। গাড়িটা বাইরে অপেক্ষা করছে। হাসপাতালের দুজন রেসিডেন্ট ডাক্তারও গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে। তা-ছাড়াও দুচারজন কর্মচারি। পিংলা গাড়িটাকে আঙুল দিয়ে দেখায়, বলে ওটাতে ওঠ, ডাক্তারবাবু ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।নজরুল গাড়িটার দিকে একবার তাকায়। বলে, কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?কোথায় যেতে চাও?কোত্থাও না, চোয়াল শক্ত নজরুলের, বলে, পৃথিবীতে ঘেন্না ধরে গেছে। এতদিন পরে আজ যখন দেশে স্বাধীনতা আসবে, সবাই মিলে নিজের নিজের সম্পত্তির ভাগ খুঁজছে, দেশকে টুকরো টুকরো করবে সব। হানাহানি করতে করতে মরবে সব কটা। আমি এদের সঙ্গে থাকব না আর। এরা সব মৃত। মৃতদের স্তুপ থেকে আমায় নিয়ে যা পিংলা!তারপরেই হঠাৎ কণ্ঠস্বর নেমে আসে নজরুলের, বলে, পিংলা, তোর মনে আছে আমাকে বহরমপুরের জেলে একটা চিঠি লিখেছিলি তুই? একটা প্রেসকৃপশন দিয়েছিলি তুই, মনে আছে তোর? কবির সেই প্রেসকৃপশন, প্রথম যখন তুই-আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলুম। কবি আমাকে বলেছিলেন, তোর জন্যে আমি কাজ ভেবে রেখেছি। তুই দীনুর সঙ্গে গান গাইবি আর ছেলেদের ড্রিল করাবি। এখানকার এইসব মৃত স্বার্থপরদের থেকে আমাকে দূরে নিয়ে যাবি পিংলা? গুরুদেবের গানের একটা লাইন আছে, জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, এখানকার এই মরণের দেশ থেকে আমাকে নিয়ে যাবি পিংলা যেখানে শুধু জীবন আছে? মরণের সীমানা ছাড়ায়ে সেখানে আমি দীনুদার সঙ্গে গান গাইব আর ছেলেদের ড্রিল করাব!সমাপ্ত
    নজরুল এসেছিলেন নিতান্ত এক দগ্ধ সময়ে - সৈয়দ তৌশিফ আহমেদ | তীক্ষ্ণ, রুক্ষ , বিক্ষুব্ধ — এভাবেই হয়ত মনে রাখব তাঁকে। বদ্ধ ঘরের জানালা খুলে দেওয়ার অনিবার্যতা, নতুবা বৈশাখী ঝড়ের আকস্মিকতায় — আপাদমস্তক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েও তিনি ফিরে আসবেন চর্চায়। পোকায় কাটা কাব্যগ্রন্থের ভাঁজ খুলে ধুলো ঝেড়ে কুড়িয়ে নিতে হবে একটা দুটো স্পর্ধা। দুর্গম অরণ্য, গভীর সমুদ্র, নির্জন পাহাড় — এসব ধ্যানগম্য ছবি বড় একটা আঁকা হয় নি তাঁর কবিতায়। সেখানে বরং বিক্ষুব্ধ মিছিলে হেঁটেছিল উলোঝুলো প্রতিবাদী। ঘাম শ্লেষ্মা রক্তে লেখা অল্প পরিসরের মহাকাব্যে জায়গা করে নিয়েছিল গুটিকতক নিষিদ্ধ ইশতেহার। নজরুল এসেছিলেন একবারই। উত্তপ্ত নিশ্বাস, রক্তচক্ষু, আর বাঁধ না মানা তেজ নিয়ে। যেভাবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসে উন্মত্ত ঝর্ণা, যেভাবে কক্ষপথ ছেড়ে ধেয়ে আসে উল্কা, কিংবা কামানের শরীর ঝাঁকিয়ে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে নিক্ষিপ্ত গোলা। জ্যৈষ্ঠের নিদাঘে এসেও শ্রাবণের মহাপ্লাবনই ছিল তাঁর ভবিতব্য। আগুন ডানায় পাক খেতে খেতে তীক্ষ্ণ চিলের মতই নেমে এলেন তিনি। ঔদ্ধত্য, স্পর্ধা আর রুক্ষতার মিশেলে। সভ্যতার আকাশে এভাবেই তো আসেন ধূমকেতুরা। পুরো একটা জাতির শিরদাঁড়া তিনি। যন্ত্রণার ধারাবাহিকতার মধ্যেও বাজারী চাহিদাকে রদ্দা মেরে, সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যের পিঠোপিঠি পঙক্তি সাজিয়ে চলা এক মগ্ন কারিগর। ব্যক্তি বয়ানকে পিছনে ঠেলে ধারালো থুতনি উঁচু করে থাকা এক বিরাট সমষ্টির কণ্ঠ। গতিশীল জনপ্রিয়তা আর দার্শনিক কৌলীন্য এই দুইয়ের একটাকেও অর্জন করার দিকে, কী আশ্চর্য, তিনি ঝুঁকলেনই না মোটে! সব বিতর্ক পেরিয়ে , যাবতীয় বিবাদ বাঁচিয়ে তাঁর যেমন জনপ্রিয় হওয়ার দায় ছিল না কোনও, তেমনই বিনম্র হৃদয়ের বাবুটি বনাতেও ঝোঁক ছিল না বিশেষ। বরং তাঁর রক্তকণিকায় ফুটছিল বেপরোয়া আর বাউণ্ডুলে হওয়ার উপকরণ। কোন মহল কোন শিবিরে তাঁর সৃষ্টি বিরূপ প্রতিচ্ছবি ফেলছে, কেই বা তাঁকে টেনে তুলছে পরিণতি বোধের দাঁড়িপাল্লায়, এসব আলোচনায় তাঁর হাই উঠল বরাবর , শরীর মুচড়ে আড়মোড়া ভাঙলেন কবি। জনপ্রিয়তাকে ধাওয়া করলেন না, তবুও তিনি লোকপ্রিয় হলেন।প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা যেভাবে প্রত্যাঘাত করেছে, সেটাকেই নজরুল শব্দের স্বচ্ছন্দ গতিতে রূপান্তর ঘটিয়ে গেছেন বরাবর, কিছুটা একবগগা এবং ছেলেমানুষের মতই। গূঢ় দর্শন তাঁর লেখার বাঁধনহারা উচ্ছলতায় খাদ মেশায় নি কখনও, তেমনই পুনরাবৃত্তিও পিছু ছাড়েনি। নজরুল ঠিক এখানেই স্বেচ্ছাচারী অসংযমী অসচেতন, এবং তাঁর সৃষ্টির অনেকাংশই গভীর ভাবলোকে অনুত্তীর্ণ। তবে ওই ঐচ্ছিক খামতিগুলোই কি তাঁকে অনন্য করেনি? তিনি তো একাই হয়ে উঠেছেন একটা ঘরানার আদি ও অন্ত। পূর্ব ও উত্তরসূরি না থাকা এক অদ্বিতীয় ধারা। এমনই এক তেজস্ক্রিয়তা, অর্ধ জীবনকালের সূত্র মেনে যার ফুরিয়ে যাওয়াটা নির্ধারিত। সেই ফুরিয়ে যাওয়াতেও অবশ্য তাঁর মস্ত সাফল্য। নেহাত উত্যক্ত করতে চাওয়া ঘোর সমালোচকরাও তাঁকে লুকিয়ে পড়ার সময়ও গায়ে কাঁটা খেতেন, শিরদাঁড়ায় চমক খেয়ে সোজা হয়ে বসে চেটে নিতেন শুকনো দু-ঠোঁট। তারপর শনিবারের চিঠিতে খ্যামটা নেচে বিষ ঢালতেন নিয়মমাফিক, হয়ত কিছুটা সাম্প্রদায়িক ঝাল থেকেই। কবির কানে উঠত সবই , তবে মনে দানা বাঁধত না নতুন কোনও উষ্মা। পুরনো কোনও তিক্ততাকেও পুষে রাখতেন না অনর্থক। কবি জানতেন অশালীন রুঢ়তা মোটের উপর ক্লীবতার সূচক , তা কখনই দৃঢ়তার প্রতীক হতে পারে না। এমন কি নজরুল তাঁর জীবনের সেরা, তথা বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যদৃষ্টান্ত ‘বিদ্রোহী’ লেখার পরেও তাঁকে সমস্ত দিক থেকে অপদস্থ করার করার কাজটা প্রবল উদ্যম ও উৎসাহে চলেছিল। তাঁর সেই কালজয়ী কবিতাও কিনা হয়ে উঠেছিল নিদারুণ মস্করার খোরাক। শুধুই কি অশালীন ভাষায় বিরুদ্ধ শিবিরের গাজোয়ারি সমালোচনা, কট্টর নজরুল ভক্তরাও কি তাঁর কীর্তি ও কৃতিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে নি! স্বাচ্ছন্দ্যের ঘেরাটোপ এবং পরিস্থিতির অনুকূলতা এলে তাঁর আরও একঝাঁক সৃষ্টি কালোত্তীর্ণ হতে পারত — একথা যারা বলে , তারা কবি ও তাঁর কাজকে অনুভব তো করেই নি, বরং অবমূল্যায়ন করেছে। খুব সম্ভবত সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়িই তাদের এই ‘কী হত যদি’-র অনুপ্রেরণা। নজরুল সৃষ্টির রসাস্বাদন না করে , তাঁর এক বিবর্ধিত মনগড়া প্রতিচ্ছবি দাঁড় করিয়ে রবীন্দ্র সৃজনের সাথে তুলনা করাটা নেহাতই বালখিল্য ঈর্ষাপরায়ণতা — একথা আর কবে বুঝবেন তারা। দারিদ্র্য, নজরুলের কাব্য প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটায় নি, এই চলতি ধারণার কোনও চিন্তাসুলভ ভিত্তি নেই। অনেকেরই হয়ত জানা নেই , একটা সময়ে নজরুল কলকাতার সবচেয়ে ব্যয়বহুল মোটর গাড়ি চড়তেন, তাঁর সদর পাহারা দিত নেপালি দারোয়ান, প্রথম শ্রেণীর কামরা রিজার্ভ করে দু একবার ভ্রমণেও গিয়েছেন সপরিবারে। এই স্বাচ্ছন্দ্য দীর্ঘমেয়াদী না হলেও, ঠিক এই সময়টাতে সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে তিনি ছিলেন তুলনামূলক অনুর্বর। সৃষ্টির ধ্রুপদীআনা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা এক স্বেচ্ছা নির্বাসিত। যতটুকু যা আঁচড় কেটেছেন তা অন্যান্য সৃষ্টির তুলনায় রয়ে গেছে নেহাতই খেলো, তুচ্ছ , নগণ্য হয়ে। বরং একথা বললে বাড়াবাড়ি হয় না যে, অপ্রতুলতার সাথে তুমুল সংঘর্ষই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল এক অপ্রত্যাশিত উচ্চতায়। কবি ছুঁয়ে ছিলেন সৃজনশীলতার অনুল্লেখিত অস্পর্শিত বিন্দুকে। অসংকুলানের স্রোতধারাকে তিনি ক্রমাগত চালিত করলেন সৃষ্টির অবিশ্বাস্য উদ্যানে। ব্যক্তি যন্ত্রণাকে ক্যানভাসে আঁকলে হতে পারত বড়জোর একখান তৈলচিত্র, নজরুল জানতেন — সমষ্টির ঐক্যেই তা হয়ে উঠবে প্রকাণ্ড এক ফ্রেস্কো , তাতেই নিজেকে সঁপে দিলেন। যন্ত্রণার ফরমায়েশে লিখতে বসেও মানুষের আনন্দঘন জয়গান দিয়ে শেষ করলেন। শুধুই নালিশ জানানো নয়, মানুষকে উদযাপনও করলেন সমান একাগ্রতায়। বিক্ষোভের ভিড়েও পুঁতে দিলেন রোমান্সের ঝাণ্ডা। নজরুল প্রতিভা সমতলে নেমে এসে স্থিতধী লাভ করেনি কখনো, ছন্দের চপলতা ঘন হয় নি জীবন দর্শনের গভীরতায়। পাহাড়ি খাতের উচ্ছলতায় শুরু করেছেন, শেষও হয়েছে সেখানেই। তবেই না, আর্তের অভিযোগ তাঁর কাব্যে রূপান্তরিত হয়েছে প্রতিবাদে, আর ক্ষোভ জমাট বেঁধেছে বিপ্লবে। নিরুপদ্রব নিরাপদ পরিবেশে থাকার মত মানুষ তিনি ছিলেন না। বরাবরই তিনি ছিন্ন শিকড়, মুক্তবিহঙ্গ , পিছুটানহীন। সব চুরমার করার স্পর্ধা ছিল বলেই গাঁটছড়া বাঁধেন নি স্থিতিশীলতার সাথে এ ব্যাপারে তিনি স্বভাব নিরুপায়। চারদিকে যা ঘটছে , যা তাকে বিব্রত ,বিক্ষুব্ধ করে তুলছে, তার সবটা অবহেলা করে নিজের কাজ চালিয়ে গেলে তিনি উৎকর্ষতার পরাকাষ্ঠাকে ছুঁতে পারতেন কী? স্রেফ কাব্যচর্চার উন্মাদনায় তিনি লিখতে বসেন নি । কবিতা তাঁর কাছে ছিল আর্থসামাজিক বক্তব্যের একটা জোরালো মাধ্যম, আর সেটাতেই ওঁর উৎকর্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়, প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। বোঝাই যায়, সচ্ছলতা কোনোভাবেই ইন্ধন হত না তাঁর বিক্ষুব্ধ সত্তার, বরং হিতে বিপরীত হয়ে আগুনকে নিভিয়ে দিতে পারত আরও দ্রুত। প্রত্যেক সৃষ্টিশীলতার কিছু উৎস মুখ থাকে, থাকে কিছু অন্তর্নিহিত অনুপ্রেরণা। নজরুল তাঁর সমস্ত উদ্দীপনা খুঁজে পেতেন অপ্রতুলতা এবং অপ্রাচুর্যের সাথে লড়াই করে। জীবন নিয়ে দার্শনিক মতাদর্শ রচনায় তাঁর আগ্রহ ছিল না বিশেষ। আর ঠিক সেই ছিদ্রটা দিয়েই কাতারে কাতারে ঢুকে পড়া সমালোচকরা নজরুলকে প্রবল উৎসাহে আক্রমণ চালিয়ে কোণঠাসা করে আজও। তাদের অবশ্য উপলব্ধিতে আসেনা যে, ব্যক্তিগত অনুভূতির স্পর্শকাতর চত্বরে কবি একটানা সময় ব্যয় করেন নি — এ ছিল তাঁর সিদ্ধান্ত , সীমাবদ্ধতা নয়। আর এমনিতেও পৃথিবীর সব বিপ্লবী খুব অল্প দিনেই জনমানসে একঘেয়ে হয়ে ওঠেন। কাজেই দোষটা বিপ্লবীর নয় , জনমানবে বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতায়। নজরুলের হুহুঙ্কারের মেয়াদ অবশ্য ছিল মাত্র কয়েকটা বছর। পূর্ণচ্ছেদ পড়েছিল অচিরেই। তবে বক্তব্যের আয়তন যতটুকুই হোক,ওজন ছিল যথেষ্ট, তারপর আর কোনও কথা চলে না, বলে যাওয়া শব্দের নাছোড় প্রতিধ্বনিরাই লক্ষ্যভেদে কেবল বুলেটের মতো ছুটে যায়। প্রচলিত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সংশ্রব ছাড়াও দুখু মিয়ার নজরুল হয়ে ওঠার এই অবিশ্বাস্য জার্নি কী সহজে বিস্মৃতির পাতালে চলে গেল ! তিনি নির্বিবাদে চাপা পড়ে রইলেন অবহেলার আস্তাকুঁড়ে। বিভ্রান্তি আর সংশয়ের পাহাড়প্রমাণ জঞ্জালের আড়ালে। যে শিরদাঁড়া এককালে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সটান খাড়া ছিল, যে কণ্ঠ ক্ষমতাকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার স্পর্ধা জাগাল, যে কলম তরতরিয়ে এগোল মানুষকে সচেতন করবে বলে, হালের এই সম্প্রদায়সর্বস্ব হিড়িকেও তাঁর সে বক্তব্য তাৎপর্যহীন হয়ে গেল! তিনিই বা অবলুপ্ত হলেন কী করে! এ শুধু আশ্চর্যেরই নয়, বিপদ সংকেতেরও বটে।
  • হরিদাস পালেরা...
    হাটুয়া সাধু ভোটুয়া ফকির  - Naresh Jana | বলেছিলাম, বাবা সবই রাজনীতি! তো সাধুবাবা মানতে নারাজ! বলেন, নেহি বেটা আত্মা অউর পরমাত্মাকে বীচ রাজনীতি উজনীতি কুছু নাই। সিরেফ পিরেম আছে। সেই সাধুবাবা এবার রাস্তায় হাঁটছেন!...... তবে হাতে মোমবাতি ছিল না! না'হলে লোকে হয় বলত 'সাধু বুদ্ধিজীবী' অথবা 'বুদ্ধিজীবী সাধু।' না, কেউ রাগ করবেন না প্লিজ। বিষয়টা ভাবার চেষ্টা করুন। একে কলি কাল তায় পশ্চিমবঙ্গ! এখানে এখন লোকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা বুদ্ধিজীবীরা কি আদৌ সাধু? এবার থেকে এও প্রশ্ন করবে, আচ্ছা ভাই সাধুরা কি বুদ্ধিজীবী আছে? অমনি চিৎকার শুরু হবে, কেন আমাদের অমুকানন্দ, ওদের তমুকানন্দ, তারপর হল গিয়ে তাদের প্রভুজী ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরও বলছ সাধুদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী নেই?  আমি কিন্তু সে কথা বলছিনা। বলছি বুদ্ধিমত্তা বা পান্ডিত্য হয়ত কোন কোন সাধুর মধ্যে আছে কিন্তু সেই সাধুরা তো বুদ্ধি কে জীবিকা করেনা। তাহলে তাঁদের অন্ততঃ বুদ্ধিজীবী তো বলা যায়না। সেই অর্থে বলছিলাম তেলে জলে মেলেনা। কিন্তু ওই যে বললাম একে বঙ্গ তায় কলি কাল সুতরাং মেলাবেন তিনি মেলাবেন। হুঁ হুঁ বাবা, বুদ্ধিজীবীরা মুখ লুকিয়েছে বলে কী ফায়দা মিছিল হবেনা? সাধুরা নেই? সুতরাং পরাও সাধুর পোশাক, পরাও। ওদের হাতে মোমবাতি তো এদের হাতে ত্রিশূল, লাঠি। আরে দাঁড়াও দাঁড়াও! কে যেন বলেছিলেন, “সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদিগকে ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠাইয়াছেন। ত্রিশূল ও গৈরিক বসন দেখিলে হিন্দু মাত্রেই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়া, ধর্মকে কলুষিত করিয়া হিন্দু মহাসভা রাজনীতি ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। হিন্দু মাত্রেরই তাদের নিন্দা করা কর্তব্য।” কে বলেছিলেন? সুভাষ চন্দ্র বসু । তাইনা? সেই ১৯৪০ সালে। বাব্বা! তখন থেকেই সাধুরা হাঁটছেন?      ২০০৭ সালে সাধু আর বুদ্ধিজীবীরা একসাথে হেঁটেছিলেন। এবার বুদ্ধিজীবীরা 'নি রিপ্লেসমেন্ট' সেন্টারের লাইনে তাই সাধু একাই হাঁটছে। দুড়দাড় হুড়হাড় সাধু হাঁটছে! এ যে একেবারে ত্রহ্ স্পর্শ যোগ! ছ'য়ের মাথায় পা দিয়ে সাতের মাথায় যা। এই-ই হল মাহেন্দ্রক্ষণ! এই বেলা ডুব দে। পঁচিশ আর এক। ব্যাস্ ভুট শেষ। চারে খেলা হবে। একদম চার কিংবা ছয় রানে খেল্ মাইজী-বাবাজী-গুরুজীর ব্যাটারা...দেখ্ ক্যামন লাগে। ঘি মাখন খাওয়া, রোটি লিট্টি খাওয়া, ছাতু তুতু খাওয়া বড় মেজো সেজো ছোট সাধু বাবারা হাঁটো।ধুর! আপনি বড় ক্যাচাল করেণ তো মশাই, আমি এক কথা বলি তো আপনি উল্টো বোঝেন। আমি কী বলেছি যে ভোটের ষষ্ঠ দফা সপ্তম দফার কথা? আমি বলেছি ছ’য়ের মাথায় পা দিয়ে সাতের মাথায় যা! এর মধ্যে সাত পাঁচ ভাবার কী আছে? তোমরা হলে ফকিরের দল আর এদেশে ফকিরের বাজারই ভালো। ওই যে দেশের সবচেয়ে বড় ফকিরের কথাই ধর , ‘মেরা ক্যায়া? ম্যায় তো ফকির আদমি হুঁ। ঝোলা লেকে লৌট পড়ুঙ্গা।’ সে যাও বাবা কিন্তু ১.৬ লাখের জার্মান মে-বেচ সানগ্লাস, ১.৩ লাখের মোভাদো হাতঘড়ি, ১.৩০ মন্টব্লান্স পেন টেন রেখে যাবে তো? আর আপনার হাতের ওই ৪৫ গ্রাম করে চারটে আংটির দাম এখন তো ১কোটি ৭৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে তাইনা? না না, আপনি ফকির মানুষ, সাধুবাবা আপনি ১২ কোটির মার্সিডিজ চড়বেন, সাড়ে চার হাজার কোটির বিমান চড়বেন বলেই তো সাধুবাবারা হাঁটছে। হাঁটুন, সাধু বাবারা হাঁটুন….. তবে একটা কথা মনে রাখুন, নিজেদের সাধুসম্মানে টান পড়েছে বলে কলকাতায় হাঁটছেন, আপনাদের বিজেপি বলে গালাগালি করেছে বলে হাঁটছেন ঠিক আছে কিন্তু দেশের বড় ফকির মানে মহাসাধুর কুর্তা পাঞ্জাবি আর রুসগুল্লা এই কলকাতা থেকেই যায় ফি বছর। হ্যাঁ যিনি আপনাদের গালাগালি করেছে তিনিই পাঠান। তাঁর সংগে ফকিরের যোগ আত্মা পরমাত্মার মতই। না’হলে ভাইপো কী জেলের বাইরে….যা! এইবেলা রাজনীতি থাক। বরং হাঁটা যাক, হাঁটা বাবা পার করে গা, ট্রেডিং মিল পার করে গা.. হাঁটা খালি পায়ে কিন্তু লড়াই ধরে রাখতে হবে ‘হাওয়াই চটি আর নাঙ্গা পা’য়ের মধ্যে। নাঙ্গা বলা এই কারণে যে বড় ফকিরের  জুতোর পরিমাণ এত যে মূল্য নির্ধারণ করা মুশকিল। অতএব আত্মা হাঁটে পরমাত্মার মাথায় জল ঢালতে, ভোট বাড়ে ফকির-ফকিরানীর।।।
    ভোটুৎসবে ভাট - এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমি   - সমরেশ মুখার্জী | বঙ্গদেশে সুধীসমাজে একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে। ন‍্যাকা - বোকা - বিজ্ঞ - সাহসী - ভীতু - রোমান্টিক - শুষ্ক‌ং-কাষ্ঠং - কর্মবীর - বিনদাস - রসিক - বেরসিক - উদার - সংকীর্ণ - অনসূয়া - পরশ্রীকাতর - উদ্ধত - বিনীত - শালীন - অশালীন … ইত‍্যাদি - প্রভৃতি … যত ধরণের চরিত্রে‌র বাঙ্গালী‌‌ই হোক না কেন - জীবনের বিভিন্ন পর্বে, অবস্থায়, ঋতুতে তাদের নানা মনোভাব অতীতের এক শ্মশ্রুগুম্ফময়, দীর্ঘ‌দেহী, আপাদলম্বিত আলখাল্লা পরা, নিয়মিত নিমের শরবৎ পান করা, ঋষি‌প্রতিম মানুষের গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে।লেখক শংকর তাই বলেছেন - “রবীন্দ্রনাথের গানেই তো আমাদের মুক্তি। কালের ওপার থেকে বেদ উপনিষদের যে শব্দ ধ্বনিত হয় সে তো কোন সুদূর প্রান্তের বাণী, সংস্কৃতের প্রায়ান্ধকার অরণ্যের মধ্যে সে যে সম্পূর্ণ ধরা দেয় না। তাকে ভালবাসার আগেই আগাম বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ! দুঃখী বাঙালীর ক্ষুদ্র গৃহকোণে অমৃতপুত্র তুমি, বিধাতার কোন ইচ্ছা পূরণের জন্য আবির্ভূত হলে? তোমার গানেই যে আমাদের আনন্দ, আমাদের মুক্তি, আমাদের নিশিযাপন। তুমি আমাদের প্রেমে, বিরহে, মিলনে, বিচ্ছেদে, আনন্দে, বেদনায়, অপমানে, অবহেলায় সদাসঙ্গী।” রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এইভাবেই দেখেছেন শংকর। ৪২% প্রেক্ষাপটে‌র ভিত্তি‌তে ৬৩ শীত পার করেও আমার লেখ‍্যভঙ্গিতে লঘু রম‍্যরসময়তার প্রবণতা গেল না। অথচ ঐ রস উচ্চমার্গীয় আঙ্গিকে পেশ করার যোগ্য‌তাও নেই। তাই ওসব ধ্রুপদী পাঠকের ঋদ্ধরুচির উপযোগী নয়। ফলে তাঁদের রুচিশীল মন্তব্যে শালীন বিশেষণে অল্পাধিক উষ্মা, বিরক্তির প্রকাশ হয়ে পড়ে - যেমন “ঘাসবিচালি টাইপ রসিকতা”। তাতে অবশ‍্য আমি বিশেষ বিচলিত হ‌ই না। বিড়ম্বিতবোধ‌ও করি না।  বরং তা নিয়ে‌ও আবার “খেলো টাইপস” রসিকতা করে ফেলি - এই যেমন এখন করছি।  আমি লজ্জার মস্তক ভোজন করা, দুকান কাটা বিকর্ণ। তাই আমার মনে পড়ে শোলের দুহাত কাটা ঠাকুরসাহেবের মোক্ষম সংলাপ - “লোহে লোহে কো কাটতা হ‍্যায়।” মনে পড়ে সেই প্রাজ্ঞ ঋষি‌র কথা‌ও - মনে গুনগন করে ওঠে "এই ছড়াটি মনে রেখো‌…"কোন ছড়াটি?  ভূমিকা।  কবে লেখা? এই ভবলোক ত‍্যাগ করার তিন বছর আগে - সাতাত্তর বছর বয়সে! যে বয়সে মানুষটি আইনস্টাইনের সাথে - বস্তুর অস্তিত্ব‌ শুধুমাত্র মানুষের চেতনায় - এহেন ভাববাদীমার্গে গভীর  তত্ত্বালোচনা করেছেন, যা তিনবার পড়েও আমার মাথার তিন হাত ওপর দিয়ে চলে গেছে, সেই তিনি‌ই লিখে গেছেন এমন ছড়া!  ভাবা যায় !!! জমি‌দার বংশের "বাড়ি থেকে পালানো" এক চরিত্রে‌র যাপনে‌ও পাওয়া যায় আশ্চর্য উদাসীন সরলতা। তাঁর নিরাড়ম্বর জীবন যাপনে তিনি‌ও এক ঋষি‌প্রতিম মানুষ। তাই তিনি সহাস‍্যে বলতে পারেন - "মুক্তারামের তক্তারামে শুক্তারামে" -  দিব‍্যি কেটে যাচ্ছে। কেউ - "কেমন আছেন?" জানতে চাইলে‌ই বলতেন, "বেশ আছি"। মৃত‍্যুশয‍্যায় হাসপাতালে‌‌ও ফাইনালি চলে যাওয়ার আগে তাইই বলে গেলেন -"বেশ আছি"।দারিদ্র্য সত্ত্বেও কারুর কাছে তিনি হাত পাতার মানুষ নন। প্রায়‌ই কফি‌হাউসে এক কোনে চুপ করে  কিছুক্ষণ এককাপ কফি নিয়ে বসে থাকতেন। খাবার কেনার পয়সা নেই। অক্সফোর্ডে‌র ডক্টরেট, পরবর্তীতে ওখানে‌ই ভারতীয় সভ‍্যতা ও ইতিহাসের অধ‍্যাপক তপন রায়চৌধুরী তখন যুবক। স্কটিশের ছাত্র। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন কফিহাউসে। নামে দুই ভগবান সত্ত্বেও দরিদ্র লেখককে একা এক কাপ কফি নিয়ে বসে থাকতে দেখে তাঁরা কয়েকজন কাছে গিয়ে পালা করে প্রায়‌ই তাঁকে কিছু খাবার কিনে দিতেন।  লেখক সংকোচের সাথে একদিন বলেন, তোমরা এভাবে রোজ রোজ আমায় খাওয়া‌ও, আমার খারাপ লাগে, আমি তো তোমাদের কিছু খাওয়াতে পারি না। তপনরা বলেন, আপনি আপনার লেখার মাধ‍্যমে আমাদের কতো আনন্দ দেন। তার তো প্রতিদান হয় না। তবে আপনাকে সামান‍্য কিছু খাইয়ে যদি আমাদের আনন্দ হয়, অনুগ্ৰহ করে তার জন‍্য কিছু মনে করবেন না। আশা করবো সেই আনন্দ থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে কফিহাউসে আসা বন্ধ করবেন না।  তপনদের থেকে দু দশকের‌ও বেশী অগ্ৰজ লেখক ওদের কথা শুনে আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েন। এটা লিখতে গিয়ে আমি‌ও হয়ে পড়লাম। কারণ এমন সহবৎবোধ এখন ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। গুরুর মতো ওপেন ফোরামে এখন মতের, পছন্দের অমিল হলে ক্রুদ্ধ, অশ্লীলতার প্রকাশ‌ই প্রত‍্যাশিত।রবীন্দ্রনাথের হাজির‌ জবাব রসিকতার অর্থাৎ “Ready Wit” এর কিছু নমুনা জানা ছিল। জালসাগরে‌ জানা গেল Ready Wit শব্দ‌বন্ধটি এ্যারিস্টটলের মস্তিষ্ক‌প্রসূত যার রাণীর ভাষ‍্যে নির্গলিতার্থ হচ্ছে the type of instant jokes laced with truth, intelligence and keen understanding of human nature. রবীন্দ্রনাথের হাজির জবাবের তিনটি নমুনা এখানে রাখছি:১. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানান সংস্কার কমিটি পুরনো রীতির বদলে নতুন বানানরীতি চালু করতে গিয়ে ‘গরু’ বানান নিয়ে সমস্যায় পড়ে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে নিরীহ প্রাণীটি অনেকদিন ধরে‌ই নানা সমস্যার মূলে - বানান - মেরুকরণ - নির্বাচন ..। কমিটির মত ‘গরু’ না লিখে ‘গোরু’ লেখা উচিত। কারণ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃতের ‘গো’ শব্দ থেকে। আদিতে  ‘ও’ কার থাকায় চলিত বাংলা‌য় ‘গোরু’ উচিত। কিন্তু প্রায় সব বাংলাভাষী লেখক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক গরু লেখেন। কী করা যায়! কমিটির সিদ্ধান্ত হলো, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মত নেয়া দরকার। দেখা যাক, উনি কী বলেন।  বোঝো কাণ্ড! যে লোকটা ফর্মালি স্কুল কলেজে পড়াশোনা‌ই করেননি তাঁর সাথে শলা করতে শান্তিনিকেতনে চললো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার কমিটি যার প্রধান ছিলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়! কবিকে তাঁরা আগমনের হেতু জানি‌য়ে বললেন,  এ বিষয়ে আমরা আপনার মত জানতে এসেছি। রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বললেন, 'তা তোমাদের ও-কার দিয়ে গরু লেখার ব্যাপারে অন্তত একটা সুবিধাই হবে যে, আমাদের দেশের জীর্ণকায় হাড় জিরজিরে গরুগুলোকে অন্ততঃ কাগজে কলমে একটু মোটা দেখাবে!'২. একবার এক ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের কাছে কলম ধার চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এই কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা জানেন? প্রথম লাইনটা হচ্ছে ‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী'।রবীন্দ্রনাথ কলমটা দিয়ে বললেন, 'নিশ্চয়ই জানি। লাইন দুটো দাঁড়াল এ রকম : ‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী। সবাই কলম ধার চেয়ে নেয়, আমিই শুধু কলম কিনি!'৩. জীবনের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে লিখতেন। একদিন তাঁকে ওভাবে উবু হয়ে লিখতে দেখে তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলল, ‘আপনার নিশ্চয় ওভাবে উপুড় হয়ে লিখতে কষ্ট হচ্ছে। বাজারে এখন এ রকম অনেক চেয়ার আছে যেগুলোতে আপনি হেলান দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে লিখতে পারেন। ওরকম একটা আনিয়ে নিলেই তো পারেন।’ লোকটির দিকে একটু তাকিয়ে থেকে রবীন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, ‘তা তো পারি। তবে কি জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে কি আর লেখা বেরোয়! পাত্রের জল কমে তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।’বার্ধক্যে‌ও আমার‌‌‌ স্বভাবে, লেখনী‌তে কৈশরের হালকা চাপল‍্য, প্রাকযৌবনের মেদুর লঘুতা হয়তো চলতেই থাকবে। হয়তো প্রাজ্ঞতার অভাবে গাম্ভীর্যের আলখাল্লা এ জীবনে আর আমার মননে চাপবে না। কেউ যখন তাচ্ছিল্য করবে আমার মনে গুনগুন করবে - "আমার রম‍্য রসের ধারা, বহিছে, মোর লেখা‌তে … তাতে হোক না ওরা দিশেহারা, আমার…।"   ভূমিকাধূমকেতু মাঝে মাঝে হাসির ঝাঁটায়দ্যুলোক ঝাঁটিয়ে নিয়ে কৌতুক পাঠায়বিস্মিত সূর্যের সভা ত্বরিতে পারায়ে--পরিহাসচ্ছটা ফেলে সুদূরে হারায়ে,সৌর বিদূষক পায় ছুটি।আমার জীবনকক্ষে জানি না কী হেতু,মাঝে মাঝে এসে পড়ে খ্যাপা ধূমকেতু--তুচ্ছ প্রলাপের পুচ্ছ শূন্যে দেয় মেলি,ক্ষণতরে কৌতুকের ছেলেখেলা খেলিনেড়ে দেয় গম্ভীরের ঝুঁটি।এ জগৎ মাঝে মাঝে কোন্‌ অবকাশেকখনো বা মৃদুস্মিত কভু উচ্চহাসেহেসে ওঠে, দেখা যায় আলোকে ঝলকে--তারা কেহ ধ্রুব নয়, পলকে পলকেচিহ্ন তার নিয়ে যায় মুছে।তিমির-আসনে যবে ধ্যানমগ্ন রাতিউল্কাবরিষনকর্তা করে মাতামাতি--দুই হাতে মুঠা মুঠা কৌতুকের কণাছড়ায় হরির লুঠ, নাহি যায় গনা,প্রহর-কয়েক যায় ঘুচে।অনেক অদ্ভুত আছে এ বিশ্বসৃষ্টিতে,বিধাতার স্নেহ তাহে সহাস্য দৃষ্টিতে।তেমনি হালকা হাসি দেবতার দানেরয়েছে খচিত হয়ে আমার সম্মানে--মূল্য তার মনে মনে জানি।এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমিহাসি-তামাশারে যবে কব ছ্যাব্‌লামি।এ নিয়ে প্রবীণ যদি করে রাগারাগিবিধাতার সাথে তারে করি ভাগাভাগিহাসিতে হাসিতে লব মানি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  (শ্যামলী, শান্তিনিকেতন, পৌষ, ১৩৪৫) চারিপাশে দেখি বহু রাশভারী মুখ রসেবসে রয়ে আমি পাই বেশ সুখ হেজুবুড়ো - ২৫.৫.২৪ 
    দ্য নজরুল ফাইলস - সৈয়দ তৌশিফ আহমেদ | নজরুলের অবশ্য সাপের ছুঁচো গেলা কেত্তন।অগ্রজরা নাক কুঁচকে বলল, কোথাকার কোন পল্টনফেরত হাবিল, বাংলার মনোজ্ঞ মহলে ওঠাবসা নেই, রবীন্দ্রবলয়ে ঘোরাফেরা নেই, প্রকাশকের দোরে দোরে হাত কচলানিও নেই, নেই বন্ধুমহলে নিরলস অধ্যবসায়ের দীর্ঘ বিজ্ঞাপন —এত ‘নেই’ নিয়েও কিনা উড়ে এসে জুড়ে বসে জনপ্রিয়তায় সবাইকে টেক্কা দেবে — না না, এ লোক কবিতার কিস্যু বুঝতেই পারে না! ব্যাটা আস্ত চাঁড়াল একটা।শনিবারের চিঠিতে সজনীকান্ত ঘোমটা-ঠোঁটে খেমটা নাচতেই ঘরের দুয়োর দিয়ে তাবৎ কবিদের সে কী হর্ষধ্বনি! বেলাভর নেচেকুদে হেদিয়ে গেলেন সক্কলে। কবিতা মাথায় উঠল, চড়া পড়ল দোয়াতে, আগে হোক নিকেশ নজরুল, তারপর না হয় কাব্যকুল।অনুজরা অনেক ভেবে মাথা নাড়ল, — ঠিকই তো! কবিতা কুস্তির আখড়া, নাকি আতশবাজির সলতে, কাব্যের সুর এত উঁচু তারে বাঁধবে কেন, চলনই বা হবে কেন সর্বক্ষণ দ্রুতলয়ে, তাছাড়া ভাবাবেগ কি ফুটন্ত দুধ যে কথায় কথায় উথলে উঠল, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে এ লোক অনাগ্রহী, জীবন জিজ্ঞাসায় অনুৎসাহী, কোথায় সেই ঋষিসুলভ ব্যক্তিত্ব, ভাবনা মদির চাউনি। এ লোক বড়জোর ‘আধলা’ কবি হতে পারে, তবে ‘গোটা’ কবি নয়।বন্ধুবৎসলরাও সুযোগ পেয়ে আওয়াজ দিল, — হক কথা। জ্ঞানপিপাসার হাতছানিটাই নেই। তাছাড়া, এ লোক গভীর দর্শনে বিকলাঙ্গ, অন্তরের প্রেম থেকে মুখ ফেরানো, গুরুচণ্ডালীতে আক্রান্ত।প্রকাশক চোখে চশমা আঁটলেন, — হুম, কথাটার সারবত্তা আছে। লোকটার নান্দনিকতা তলানিতে, শিল্পবেত্তা পাতালে, আর বোধ-বুদ্ধি তো চিরকালই রসাতলে। সবেতেই গলাবাজি আর গর্জন, কবিতা কি স্লোগান নাকি! কোথায় দেখতে পাবো নান্দনিক সুষমা, পেলব লাবণ্য, তা না কেবল হট্টগোল! ছন্দ নিয়ে কারসাজি। কবিতা তো আর পাটিগণিত নয় রে বাবা! না! এ লোক খাঁটি কবি হিসেবে উৎরোয় না, এ ছিল নেহাতই যুগের হুজুগ, ইদানীং যা তামাদি। অভিজাত ঘরের বৈঠকখানায় রাখা যায় না এঁর কাব্যগ্রন্থ, তবে ছাপাব আরও হাজার পাঁচেক। লোকটা ব্যবসা দেয় না মন্দ।বাঙালি মুসলমান অতশত জানে না। সে খায় ঘুমোয়, স্বপ্ন দেখে বখতিয়ার খলজির, জাবর কাটে আরব্য রজনীর। দিগ্বিদিকে কবির নামটা শোনে, কপালে কোঁচ ফেলে নামাজে উপুড় হয়ে নিত্য গজরায়, — কবি! হুঁ! দিনরাত জিভে শুধু দেব আর দেবী। আবার ঘরে তুলেছে প্রমীলা — ইম্পোরটেড ফ্রম সুদূর কুমিল্লা। আল্লাহ এক, কেউ শেখায়নি নাকি! আজাব নামল বলে। ধ্বংস তোমার অনিবার্য।হিন্দু বাঙালিও কাতরায়, —ঘোর কলি ! প্রমীলা নাকি ঘর করছে কবির। এ কী অনাসৃষ্টি। আরবি-ফার্সি-তুর্কি শব্দের ছড়াছড়ি। প্রমীলা রে, ও যে নেড়ে কবি!ইংরেজ তলায় তলায় সব খবরই রাখে , তক্কে তক্কে থাকে। রাগে গোঁফ মুচড়ে তাকায়,— এ লোক ঘোড়েল , আস্ত এক শয়তান। কবিতার নামে লোক খ্যাপায়। ব্যাটাকে জেলের ভাত এবার না খাওয়ালেই নয়। বলা মাত্রই দিশি আর্দালি জানায়, — সে নাকি কবিতা ছেড়েছে নতুন। শুনেই সাহেব সিং উঁচিয়ে দৌড় লাগায়।নজরুলের বুকের কলিজা প্রমীলা রাঁধে, ভাত বাড়ে, কবির অপেক্ষায় সাজানো থালার দিকে চেয়ে চোখের জল মোছে। না চাইতেও দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে, — কবি, জানি তুমি ছিন্ন শিকড়, পিছুটানহীন, মুক্তবিহঙ্গ। কিন্তু চাল যে বাড়ন্ত।অহিংস আন্দোলনের ঝাণ্ডা জানায়, — গোপন সূত্রে খবর এসেছে, সহিংসদের সাথে কবির একেবারে হরিহর আত্মা, ইয়ারবকশি, তুই-তোকারি অতি প্রাচীন। এ লোককে আর যাই হোক, বিশ্বাস করা নয় সমীচীন।শুনেই সশস্ত্র বন্দুকের নল উঁচিয়ে ধমকায়, —ছাড়ো তো! আছে কি ওর ওই ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া। অকর্মার ঢেঁকি, একটি নির্বিষ অষ্টরম্ভা। এই মানুষ অহিংস না হয়ে যায় কোথা।গ্রামোফোন বলে , - ওসব তর্কে কাজ কী ! লোকে যখন খাচ্ছে, দাও না যদু মধুর গান ওঁর নামে চালিয়ে। তাতে কবির মান পড়ে পড়ুক। আমরা অত ভাবব কেন, নিই না দু হাতে কামিয়ে!কবি নির্বাক হতেই বঙ্গীয় বিশারদ আক্ষেপের সুরে কোঁত পাড়ে, —লোকটার আবেগ ছিল সন্দেহ নেই। তবে কোথায় থামতে হবে জানল না। কেবলই হৈ চৈ। সম্পদ ছিল, তবে তার ব্যবহারটাই শিখল না। অতি ভাবালুতার মলাটে, অনর্গল অবচেতন বাক্য-বিন্যাসে ঘোলাটে।শিক্ষামন্ত্রক শোনে, নোটিশ জারি করে, —বাতিল করো একে। উঁচু ক্লাসের সিলেবাস থেকে হটাও তো বাবরি চুলকে। থাকুক ব্যাটা বালখিল্যের ফাইভে আর সেভেন এইটের কিশোরসুলভ নাইভে।শুনেটুনে ফের মুষড়ে পড়ে পশ্চিমের মুসলমান বাঙালি। এ অত্যন্ত অন্যায়। উপুড় হয়ে সে নামাজে কাঁদে, — হুজুর কাণ্ড দেখেছেন! নজরুলকে করেছে বাতিল। কিছু একটা বাতলে দিন উপায়।হুজুর তাজ্জব, — যাব্বাবা! তোরাই তো এককালে চেল্লালি, এ লোক আমাদের স্বজাতি নয়। দেবদেবীদের নাম এনেছে মুখে। করেছে হিন্দু বিয়ে। তবে এখন কিসের এত ইয়ে ?পশ্চিমের মুসলমান বাঙালি আলজিভ কাটে, — জাহাঁপনা, সে তো আগে। ভেবেছিলাম আরও দু চারটে খাঁটি মুসলমান উঠবে লম্ফ দিয়ে। তারপর সব পগারপাড় করল পূবে। রইল পড়ে সব খুদকুঁড়ো আর নেহাতই এলেবেলে।বাংলাদেশ ভাবে, — এই সেই সুবর্ণ সুযোগ। এবার নিতে হয় কবিকে দত্তক। মানুষকে সান্ত্বনা দেব আর কাঁহাতক। এপারে আইকনের যা আকাল, তাতে ওই আধেক হিঁদু আধেক মুসলমানও পার না করলে বৈতরণী, হতে হবে নাকাল।নির্বাচন আসে নির্বাচন যায়। রাজ্য পরের বারের ঘুঁটি সাজায়, — কবির নামে একটি সরণি করে যুক্ত, পাঁচ খণ্ডের সমগ্র, তাহলেই আমাদের দায়িত্ব খালাস, ঝামেলা থেকে মুক্ত।কেন্দ্র আঁতকে উঠে পাল্টা চালে, খ্যালখ্যাল হাসে, — হ্যাহ! শেষকালে এই - সরণি। ওই দ্যাখো বিমানবন্দরে, কবির নাম আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে হতে টেক অফ করবে বিদেশবিভূঁইয়ের অন্দরে ।বাংলা ক্যালেন্ডার হাঁকে, — মনে রেখো! তারিখটা কিন্তু ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দে। কবিকে ভুললেও ক্ষতি কিছু নেই, মাঝেমধ্যে যদি লাগে শব্দজব্দে।রাগে গ্রেগরিয়ানের শক্ত হয় চোয়াল, — রাখো তোমার কাওতাল। ডেটটা ২৪ শে মে, ইয়ার 1899। এটাই ফুল এন্ড ফাইনাল।জেন-জেড হাই তোলে , — খামোখা সময় নষ্ট। ও লোক তো এমনিতেই ফসিলস। কী লাভ বিলুপ্তের জন্মবৃত্তান্ত। মিছামিছি এই কষ্ট।চুরুলিয়া এই ফাঁকে হাত তোলে, কবির জন্ম কিন্তু এদিকেই। এদিকের জল মাটি পেয়েই … কাজেই আমরাই খাঁটি নজরুলী — দাবি শুধু এই ।ঢাকা সশব্দে হেসে ওঠে, — বোকা! জীবন মিথ্যা, মৃত্যু সত্যি। মৃত্যুই জীবনের একমাত্র সত্য, এবং তা অবধারিত। কাজেই কবির আত্মা এদিকেই ঘোরে ফেরে আজও।দিন যায়। গড় বাঙালির মনে কবি একটু করে বিস্মৃত হয়। নজরুল সন্ধ্যায় স্রোতারা শুনতে এসে নাগাড়ে ঢোলে। অবহেলার আস্তাকুঁড় থেকে কবিকে উঠিয়ে আনা হোক - এই মর্মে তাও দু একজন মুখ খোলে। অবশ্য নজরুল প্রেমীরাও একে একে ধরাধামের পাঠ চুকিয়ে আলবিদা জানাবে। কবির সমগ্র কেটে পোকামাকড়ের আত্মীয়রা জোর পিকনিক মানাবে।তারপর একদিন এ-আর রহমান খবরে আসেন। তিনি বরাত পেয়ে কাশেন, — কারার ঐ লৌহকপাট! মন্দ নয়, তবে লোহার জায়গায় এলুমিনিয়াম, আর কপাটের জায়গায় জানালা করতে কী বাধা। কারাগার বদলে পাঠাগার করলেও খুব কি অসুবিধা!শুনেই খলবলিয়ে ওঠে খোরাকসর্বস্ব বাঙালি ফেসবুক। পুরনো একটা লাইন ঝেড়ে দেয়াল লেখে, — কবিতা তো নয়, যেন আস্ত এক একটা বন্দুক।দেখেশুনে আসরে নামে সাংবাদিক আস্তিন গুটিয়ে। এডিটর বলে, — যাবার আগে তিনটে কবিতা আর পাঁচটা গানের প্রথম লাইন কিন্তু টুকে নিও, হিড়িক যা পড়েছে তাতে ভুলভাল বললে লাল করে দেবে শুঁটিয়ে ।কাওতালি জমেছে দেখে প্রকাশক বলে, — বাজার গরম, মস্তি চরম। অন্তত হাজার দুয়েক ছাপতেই হয় এক ঝাঁকিতে ,নইলে দিনের শেষে আবার না হয় পড়তে হবে ফাঁকিতে।কবি তখন স্বর্গীয় নরকের দ্বারে বসে ভাঁজছেন মুগুর, কথাটা শুনে থমকে যান, ভাবনা আসে স্মৃতি-মেদুর। পরক্ষণেই অবশ্য মুগুরখানা হাতের কব্জিতে , শক্ত করে চেপে ধরেন চটজলদিতে — ফাঁকিতে! ব্যাটা এদিক পানে আসিস। ফাঁকিতে ! এইটা দিয়ে আ্যইসা দাবনা দেব না, বুঝবি তখন যন্ত্রণা শুধু আমার বুকেই নয়, লুকিয়ে থাকে তোরও মালায় চাকিতে। ফাঁকিতে !
  • জনতার খেরোর খাতা...
    হেদুয়ার ধারে - ১৩৬  - Anjan Banerjee | বেশ শীত পড়েছে আজকে। সকালবেলায় গায়ে চাদর জড়িয়ে বসে চায়ের কাপ নিয়ে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল অমল। পাতাগুলো একটু উল্টেপাল্টে দেখে একপাশে সরিয়ে রাখল। তাদের অফিস থেকে ছাব্বিশে জানুয়ারি একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করা হয়েছে কল্যাণীর ওদিকে এক জায়গায়। অফিস কর্মীরা যদি চায় আরও দু একজন পরিচিত বা পরিজনকে সঙ্গে নিতে পারবে। মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা করে লাগবে। প্রায় সবাই দু তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। অমল ভাবল, সে কাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। মা, বাবা, কাকা, কাকীমা, সঞ্চারী, ওর ভাই বুকুন এবং আরও অনেকের নাম তার মনে আনাগোনা করতে লাগল। কিন্তু কাউকেই সঙ্গে নেবার তেমন তাগিদ অনুভব করল না। পিকনিকের কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ রাত্রির মুখটা ভেসে উঠল অমলের মনে। তার মনে হল, পিকনিক স্পটে দলছুট হয়ে সে আর রাত্রি ঘুরে বেড়াচ্ছে এক জঙ্গলে ঘন বনস্পতির মধ্য দিয়ে। সেখান থেকে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে তারা এসে পৌঁছল এক নদীর ধারে। নির্জন নদীতীরে তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল। হাওয়া দিচ্ছে উল্টোপাল্টা। রাত্রির শাড়ির আঁচল পতপত করে উড়ে অমলের পিঠে এসে ঝটকা মারছে। দুজনে আকুল হয়ে নদীর ও কূলের দিকে তাকিয়ে রইল। সবুজ গাছপালা, আবছা লোকজন দেখা যাচ্ছে। শীতের নরম রূপোলী আলো পড়ছে ওপারের জল, পাখি, গাছপালা, গাঁয়ের মানুষের ওপর। পাশে দাঁড়ানো রাত্রির শরীরের স্নিগ্ধ আবেশ লাগছে অমলের দেহে মনে। এসব কি ভাবছে সে পাগলের মতো। তাড়াতাড়ি চায়ের কাপে চুমুক দিল সে। খবরের কাগজে মন নামিয়ে আনল। জওহরলাল নেহেরু হৃদযন্ত্রঘটিত সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন হঠাৎ। তা, চিন ভারতের ক'দিনের যুদ্ধে যা ধকল গেল এনাদের ওপর দিয়ে। তাছাড়া এ যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয়ও পন্ডিতজির ভেঙে পড়ার একটা কারণ হতে পারে, অমল ভাবল। নিখিল স্যার অবশ্য চিন ভারতের যুদ্ধ নিয়ে বিশেষ কিছু বললেন না। শুধু বললেন, ' কে প্রলেটারিয়েট, কে বুর্জোয়িস, কে সোশ্যালিস্ট, কে ডেমোক্রেটিক সেটা মূল ব্যাপার নয়, মূল ব্যাপার হল সোশ্যাল ইকোয়্যালিটি, হোলিস্টিক এমপ্যাথি অ্যান্ড জাস্টিস ডেলিভারি সিস্টেম। মূল ব্যাপার হল যে পদ্ধতিতেই হোক ক্ষমতা দখলের পর প্রলেটারিয়টরা যেন বুর্জোয়িসদের মতো আচরণ না করে। উই আর নট কনভেনশনাল রয়্যাডিক্যালিস্ট বাট রয়্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট। হিউম্যানিসম ইজ আওয়ার কোর অবজেক্টিভ, নো আদার ইজম ইজ ইমপর্ট্যান্ট টু আস ... 'নিখিল স্যার স্নেহাংশু, সুনির্মলদের আরও বললেন, ' সিকিউরিটির কথা বলছ ? ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কারো কোন সিকিউরিটি নেই। কে দেবে সুরক্ষা ? আমাদের প্রত্যেকের নিজেরাই নিজেদেরকে সুরক্ষা দিতে হবে। পারলে অন্য আরও দু একজনকে। এইভাবে সংগঠনগত সুরক্ষা গড়ে উঠবে। নিজের ওপর সে দৃঢ়তা এবং বিশ্বাস না থাকলে আমরা সংগঠনের শক্তি বাড়াতে পারব না। অবশ্য শুরুতে কোন ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক কাজ আমি কাউকে করতে বলব না। আর যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কবে দেশের সব ধরণের মানুষ আমাদের সহযোগিতা করবে সেই অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না। যাদের আবেগ নাড়া খাবে তারা নিজে থেকেই আসবে। আর একটা কথা, রয়্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্টদের মতো আমরা কিন্তু অহিংস নই, দরকার হলে অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে ... 'অমিতাভ কৌতূহলবশত বলল, ' কিন্তু অস্ত্র আসবে কোথা থেকে স্যার ... '----- ' সেটা এখনই চিন্তা করার দরকার নেই তোমাদের ... আমাকে ভাবতে দাও। আমাদের সংগঠনে ডেডিকেশানই শেষ কথা এটা সবাই মনে রেখ ... ' পিকনিকের দল ট্রেনে করে কল্যানী সীমান্ত স্টেশনে এসে নামল সদলবলে। ফাঁকা ফাঁকা কুয়াশা মাখা স্টেশন। জনাকয়েক লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে গায়ে চাদর টাদর জড়িয়ে কিংবা অপরিপাটি সোয়েটার পরে। আরও দুটো পিকনিক পার্টি নামল ট্রেন থেকে। গাছপালায় ঘেরা পিকনিকের জায়গাটা খুবই মনোরম। বসবার, বিশ্রাম নেবার কিংবা প্রাকৃতিক কাজের জন্য একটা ছোট্ট বাংলো ধরণের বাড়ি আছে। মহিলারা অনেকে সেখানে গিয়ে ঢুকল। ছেলেপিলেরা এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়ল। অমল ছাড়া অফিসের সব সহকর্মীর সঙ্গেই একাধিক সঙ্গী বা সঙ্গীনি আছে। ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের সুপ্রিয় চৌধুরীর সঙ্গে তার মাসীমা, মেসোমশাই এবং তার বছর চব্বিশ বয়সী এক মেয়ে গেছে। সুপ্রিয়বাবু অমলের থেকে অনেকটাই সিনিয়র। তার বাবা মা দুজনেই দেহ রেখেছেন কয়েক বছর আগে। এই মাসীমা এবং মেসোমশাই বর্তমানে তার সত্যিকারের আপনজন। এই তৃণা ছাড়া এনাদের আর এক মেয়ে এষাকে গত বছরে পাত্রস্থ করেছেন এনারা। তা এই তৃণা নামের মেয়েটি বেশ উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত প্রকৃতির। দেখে মনেই হচ্ছে না যে এদের সঙ্গে তৃণার এই প্রথম পরিচয়। আশপাশে নানা জায়গা টহল মেরে এসে এখানে একটা গাছের নীচে একটা বাঁধানো বেদীতে তার মা বাবার পাশে এসে বসে পড়ল। লাবণ্যময় হাসিতে মুখ ভরিয়ে তৃণা বলে উঠল, ' কি দারুণ জায়গা ওপাশটা... গিয়ে দেখে এস না একবার ... 'সুপ্রিয় আর অমল ওই মাসীমা মেসোমশাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে টুকটাক কথাবার্তা বলছিল। তার মধ্যে তাদের ডিপার্টমেন্টের দু একজন সহকর্মীর মুন্ডপাতও চলছিল রীতিমাফিক অফিস রাজনীতির স্টাইলে। সুপ্রিয় তৃণাকে বলল, ' দাঁড়া আগে ব্রেকফাস্টের পেটপুজোটা করে নিই তারপর দৃশ্য দেখতে বেরব... খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে ... 'মেসোমশাই শঙ্করীপ্রসাদবাবু বললেন, ' হ্যাঁ ... সেই ভাল ... 'সুপ্রিয়র মাসীমা অমলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ' তুমি কি একাই এসেছ বাবা ? 'অমল বলল, ' হ্যাঁ ... মাসীমা। কাকে আর আনব ?'---- ' এখনও বিয়ে থা করনি বুঝি ? '---- ' না ... এখনও হয়ে ওঠেনি মাসীমা ... '---- ' আচ্ছা আচ্ছা ... কিই বা বয়েস তোমার ? '----- ' তা কোথায় থাকা হয় ? '----- ' কলকাতায় ... হাতীবাগান এরিয়ায়। '----- ' ও আচ্ছা ... একেবারে খাস জায়গায় ... 'অমল মৃদু হেসে বলল, ' তা বলতে পারেন ... ঠাকুর্দার করা বাড়ি ... আমরা কি আর আজকের দিনে ওখানে বাড়ি করতে পারতাম ? '----- ' আমরা কিন্তু গ্রামেরই লোক বলতে পার। মধ্যমগ্রামে থাকি। এসব জিজ্ঞাসা করছি বলে কিছু মনে করছ না তো বাবা ? '----- ' না না ... বিন্দুমাত্র না ... আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ্য মানুষ ... '----- ' হ্যাঁ ... সেই আর কি ... তা বাড়িতে কে কে আছে ? 'বলে মাসীমা ভারতীদেবী আবার বললেন, ' কিছু মনে কোর না যেন .... জান তো মেয়েদের কৌতূহল একটু বেশি ... 'মেসোমশাই শঙ্করীপ্রসাদবাবু বললেন, ' খাঁটি কথা ... 'ভারতীদেবী কথাটাকে কোন গুরুত্ব দিলেন না। তিনি চালিয়ে যেতে লাগলেন, ' ঈশ্বরের কৃপায় আশা করি তোমার মা বাবা বর্তমান আছেন ... '----- হ্যাঁ মাসীমা ... '----- ' বেশ বেশ। মা বাবা হল মাথার ওপর একটা ছাতার মতো ... রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। শঙ্করীপ্রসাদ বললেন, ' হ্যাঁ ... তা ঠিক। 'ভারতীদেবী প্রশ্নোত্তর পর্ব অব্যহত রাখলেন। ----- ' তা ... ভাই বোন ক'টি ? '----- ' আমার এক দিদি আছে। তার বিয়ে হয়ে গেছে বছর পাঁচেক আগে ... '----- ' ও আচ্ছা আচ্ছা .... তা বেশ। তোমার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল। তোমার মা বাবাকেও দেখার ইচ্ছে রইল। ছেলে যখন এমন, তার বাবা মা-ও নিঃসন্দেহে ভাল হবে ... 'একটু থামলেন ভারতীদেবী। তারপর তৃণার দিকে দেখিয়ে বললেন, ' আমার দুটি মেয়ে। বড়টির বিয়ে হয়ে গেছে। এটি আমার ছোট মেয়ে। এখনও ছেলেমানুষের মতো ছটফটে ... হিঃ হিঃ... 'সুপ্রিয় চৌধুরীর মেসোমশাই তৃণার পিঠে একটা আদরের চাপড় মেরে বললেন, ' একদম একদম .... 'অমল তৃণার দিকে তাকাল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায়। ছটফটে তৃণা কৌতুকভরা চোখে অমলের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল লাজুক বালিকার মতো ... 'শঙ্করীপ্রসাদ মেয়ের পিঠে আর একটা আদরের চাপড় মেরে বললেন, ' মেয়ে আমার বড্ড লাজুক ... হেঁ হেঁ ... ' ( চলবে )********************************************
    ঈশ্বরের ব্যাপারে - পাগলা গণেশ | হয়তো আমি এখনো ঈশ্বরের কাছে যেতে পারিনি,চেষ্টাই করিনি তো!প্রতিদিন ঈশ্বরের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও আমি মোক্ষ নিইনি হাত পেতে,ঈশ্বরের ইগো বড্ড বেশি,তাই সে আমাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও মুক্তির অমৃত দেয়নি।ভালোবাসে সে আমায় সন্দেহ নেই,কিন্তু অধোশির চায় আমায়,আমি জানিও না তার এই মনোকামনা,তাই আমি মাথা ঝুঁকাইনি কোনোদিন।মুখে বলেনি;কিন্তু কাগজে লিখে,অন্যের মুখ দিয়ে বলিয়েছে বারবার,আমি আমল দিইনি,কাগজে কিংবা লোকমুখে কি সেই আবেগ থাকে?তাই আমি মুক্তি পাইনি।সবাই আমাকে নাস্তিক বলে।কিন্তু ওরা আমার মনোজগতে উঁকি মেরে দেখার শ্রমটুকু করে না।আমিও তো বিশ্বাস করতে চাই,পিচ্ছিল এই ধরায় আমিও খুঁটি চাই,চাই এক টুকরো ঘাসে ঢাকা ডাঙ্গা।কিন্তু চারিদিকে যদি ভাসমান দ্বীপ থাকে,আমি আশ্রয় নিয়ে প্রতিবার,যদি নিজেকে প্রতারিত অনুভব করি,তবে কি করে আমি বিশ্বাস করব আবার?ভিত বলে কিছু আছে তাই বা কি করে মানব,যখন আমি দেখিইনি কখনো তা! 
    মমতার আগ বাড়িয়ে বলা কথা - upal mukhopadhyay | লোকসভা ভোটের বাজারে মমতার দুটো আগ বাডিয়ে বলা কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রথমটা হল বাইরে থেকে ইন্ডিয়া জোটের সরকারকে সমর্থন করার কথা। দ্বিতীয়টা কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে আনা সরাসরি রেজিনগরে দাঙ্গার অভিযোগ আর রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘের বিরুদ্ধে দিল্লীর চাপে বিজেপির হয়ে নির্বাচনী প্রচারে প্রত্যক্ষ ভাবে হাওয়া দেওয়ার অভিযোগ। ক্রনোলজি মেনে দুটি কথা রাখলাম। যদিও গুরুত্ব বিচারে পরেরটা নিয়ে আগে আলোচনা করব।আমি বেশ কয়েকবার ভারত সেবাশ্রমের বালিগঞ্জ কার্যালয়ে ত্রাণের জিনিসপত্র দিয়ে এসেছি। কোন দুর্যোগ হলেই বাঙালি সমাজে সেবার কালচার আছে। সকলে সরাসরি দুর্যোগ পীড়িতদের কাছে যেতে পারে না। তখন সর্বজনমান্য সমাজ সেবার প্রতিষ্ঠান ভারত সেবাশ্রমে ত্রাণের জিনিস দেওয়া হয় আর ওনারা সে সব নেনও। তার মানে এই নয় আমি ওই সংস্থার ভক্ত টক্ত। তবে আমার আত্মীয়রা কেউ কেউ ওই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আর তাদের সঙ্গে আমার বেশ মাখোমাখো সম্পর্ক । একইভাবে ভাবে নিজের ফাঁকিবাজ ছেলেকে রামকৃষ্ণ মিশনের ইস্কুলে ভর্তি করার কথা ভেবেছি কিন্তু হয়ে ওঠেনি। বড্ড শক্ত পরীক্ষা কিনা! তবে ছেলের জন্ম হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে।এই কথাগুলো বললাম এই কারণে যে বাঙালি সমাজ বেশ আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে এই দুটো প্রতিষ্ঠান, এই কথা একবার নিজের আয়নায় দেখার জন্য। কিন্তু এখানে একটা অন্য গল্প আছে। সেটা হল কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারগুলোর সঙ্গে এই দুই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক আছে। দুটোই সরকারী আইনে এনজিও। সে কারণে সরকারী পলিসি অনুযায়ী দিল্লী আর নবান্ন সরকারের প্রচুর টাকা পায় এরা হাসপাতাল, মেডিক্যাল-নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি চালানোর জন্য। আমাদের সরকারগুলোকে এখনো সরকার বাহাদুর বলা হয় ।এসব বলার অভ্যাস মোঘল আমল থেকে চলছে । ব্রিটিশরাও এসব লব্জ মেনে নিজেদের বাহাদুরি জাহির করতে অভ্যস্থ ছিল ।সে সময় তারা কিছু তল্পিবাহককে মোঘল ঢঙ্গে সাহেব, বাহাদুর এইসব বলত । সবচেয়ে বড় কথা দেশে গণতন্ত্র এলেও আমরা এখনও সরকারকে যে নির্বাচিত করি এসব ভুলে তল্পিবাহক হয়ে লালা ঝরাই ।ওইজন্য সরকারও ঘাড়ে চেপে বসে ।যে সরকারের যত ক্ষমতা তত ঘাড়ে চাপে ।সে হিসেবে কেন্দ্রের সরকারের হম্বিতম্বিই বেশি হওয়ার কথা।রামকৃষ্ণ মিশন আর ভারত সেবাশ্রমের মহারাজরাও ভালোই জানেন যে সরকারের ঘর থেকে টাকা বের করতে কত হম্বিতম্বি সহ্য করতে হয়। সরকার টাকা দিলে শর্ত চাপাবে আর সেটা সরকারকে রাজনৈতিক সমর্থনের শর্ত কিনা সেটাই প্রশ্ন। মমতা এই অভিযোগটাই করেছেন। প্রমান হিসেবে তিনি ওই দুই প্রতিষ্ঠানের দীক্ষিতদের কিছু হোয়াটস্যাপ গ্ৰুপে বিজেপির হয়ে প্রচারের কথা বলেছেন। রামকৃষ্ণ মিশন নীতিগত ভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নেয় না, এই বলে তারা প্রতিবাদও করেছে। ভারত সেবাশ্রম সংঘের এরকম কোন ঘোষিত অবস্থান আছে কিনা জানি না। তবে তাদের কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে তো সরাসরি আইন ভাঙার অভিযোগ, অবশ্য সে অভিযোগকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে উকিলের চিঠি দিয়েছেন অভিযুক্ত সন্ন্যাসী ।একটা যুক্তিতে, মুখ্যমন্ত্রী নিজে পুলিশ দেখেন তাই তাঁর কথাই পুলিশের কথা ধরে নেওয়া যেতে পারে। সাধারণ কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ থাকলে তাকে টানতে টানতে জেলে পোরা হতো। তবে প্রত্যক্ষ প্রমান থাকলে মমতার পুলিশ এক্ষেত্রে তা করছে না কেন? সন্ন্যাসীদের নৈতিক রক্ষাকবচ থাকলেও, কোন আইনি রক্ষাকবচ আছে কি? আসলে এই আইনি ব্যবস্থা না নিতে পারা অথচ সর্বসমক্ষে অভিযোগ করা, উভয়পক্ষের মধ্যে একটা জটিল সমীকরণের আভাস। সবাই জানে রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘ যথাযথ কারণেই মমতার রাজ্য সরকারের অনুদান পায়। মমতা যাকেই যথাযথ কারণে টাকা পয়সা দেন, তাকে "আমার" বলে সস্নেহে সম্বোধন করেন, যেমন "আমার কর্মচারী", "আমার পুলিশ" ইত্যাদি। তিনি হয়ত "আমার রামকৃষ্ণ মিশন" বা "আমার ভারত সেবাশ্রম সংঘ" বলে মনে করেন। আমার ছেলে যদি বিগড়োয়, আমি তো খেপবোই! তবে এই দুই সংস্থা সম্পর্কে মমতার ক্ষোভ কী ''নুন খাবে অথচ গুণ গাইবেনা" - এ জাতীয় মনোভাবের প্রকাশ? মমতার উক্তিতে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন আরও বড় সরকার বাহাদুরের প্রধান মোদিজি। তাঁর অভিযোগ সন্ন্যাসীদের আক্রমণ করে টিএমসি সরকার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি কলকাতায় এক ভুঁইফোড় সংগঠনের সন্ন্যাসী মিছিলে মোদীজির কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল। সেখানে কার্তিক মহারাজ উপস্থিত থেকে মমতার ভোটব্যাংক রাজনীতির সমালোচনায় বেশ এক রাজনৈতিক ভাষণও দিলেন। প্রথমে মমতা ওই অভিযুক্ত মহারাজকে সরাসরি রাজনীতিতে নামার কথা বলছিলেন, তিনি যখন সত্যি সত্যি তা করার কিছু নমুনা পেশ করলেন তখন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন সন্ন্যাসীদের পুজো টুজো নিয়ে থাকাই ভালো অর্থাৎ এমন নয় তো যে কার্তিক মহারাজ মুর্শিদাবাদেই সীমাবদ্ধ থাকলে তাঁর সঙ্গে নরমে গরমে ডিল করতে সুবিধে হবে? এইরকমই অভিযোগ অধীর চৌধুরীর কারণ হয়ত এমন যে এইবার মুর্শিদাবাদের ভোটে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রত্যক্ষ বলি হতে পারেন তিনিই। সত্যিই এই সন্ন্যাসী মিছিলের কী এরকমই ভয়ংকর বার্তা যে, কাল যা মুর্শিদাবাদে ঘটেছে পরশু তা দক্ষিণবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে রাজ্য জুড়ে নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটাবে ?আমার ব্যক্তিগত মত হল ধর্মের থেকেও দলীয় সাম্প্রদায়িকতাই পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিপদ। ধর্মীয় অনুভব পার্টি অনুভবের সঙ্গে বিচিত্র ভঙ্গিতে মিশিয়ে দেবার খেলাটাই আজ সুভাষ, মুজাফ্ফর, বিধান, জ্যোতি এমনকি চারু মজুমদারের বাংলার ট্র্যাজেডি। তাই মমতা বা মোদিভালোই জানেন এই ভয়ংকর ন্যারেটিভ আর তার কাউন্টার ন্যারেটিভের কথা বলার খেলা কী ভাবে খেলতে হয়। মমতা আগ বাড়িয়ে সংঘ দুটি এবং সন্ন্যাসীদের আক্রমণ করার এজেন্ডা এনে তারই সূচনা করলেন আর তা দক্ষিণবঙ্গের ভোটের ঠিক আগেই। বিজেপি সেটা ছাড়ে কেন !এবার মমতার আগ বাড়িয়ে বলা আরেক কথায় আসা যাক । ভোটের ফলাফল জানার আগেই তিনি সম্ভাব্য ইন্ডিয়া জোটের সরকারে তাঁর বাইরে থেকে সমর্থনের কথা বলে বিশেষ করে সিপিআইএমের সমালোচনা আর অধীরের উষ্মা বাড়িয়েছেন। এই এজেন্ডায়ও তিনিই কি এগিয়ে গেলেন না ? সিপিএময়ের মমতা সমালোচনার কতটা ভিত্তি আছে ? তাদের নিজেদেরই তো কেন্দ্রে কোন জোট সরকারের শরিক হওয়ার উদাহরণ নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে এরকম বাস্তবতা কোথায় ? আর অধীর আগ বাড়িয়ে বলায়, হাই কম্যান্ডের ধমক ও পিঠ চাপড়ানি দুই পেয়েছেন। তার মধ্যে ধমকের সুরটাই কি বেশি কানে বাজে নি?এইভাবে মমতা তাঁর নিজের ভঙ্গিতেই আগ বাড়িয়ে কথা বলে নানা ন্যারেটিভের এজেন্ডা সামনে আনছেন, যাতে তাঁকে ঘিরেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আবর্তিত হয়। বাস্তবে কতটা হল তা অবশ্য ভোটের ফলাফল আর তার পরের পরিস্থিতি দেখেই বোঝা যাবে।
  • ভাট...
    commentগোবু | Zee গ্রুপ (যাতে wion ও পড়ে) সুভাষ চন্দ্রার মালিকানা। উনি বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ ছিলেন। কাজেই মৌপিয়া কার হয়ে গলা ফাটাতে পারে সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। তবে সেটিং মাথায় রেখে যথেষ্ট সৈন্ধব লবণ সহযোগে ভাবতে হবে, এই আর কি!!
    commentরমিত চট্টোপাধ্যায় | দেখলাম, কি অবস্থা হচ্ছে দিনকে দিন লোকটার। কোন পর্যায়ে নামিয়ে আনছে নিজেকে। আমি zee 24 ঘন্টা দেখি না, তাই মৌপিয়া কার হয়ে আদৌ গলা ফাটায় ঠিক জানিনা, কিন্তু  অভিজিৎ বাবু যেভাবে একটা প্রশ্নও করতে না দিয়ে ক্রমাগত অভব্যতা করে গেলেন, জাস্ট চোখে দেখা যায়না। একজন লোক রাজনীতিতে যোগ দিয়েই কি করে এতটা বদলে যেতে পারে কে জানে। তবে এটা পরিষ্কার যে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার মতো পরিপক্কতা ওনার এখনো আসেনি।
    commentr2h | সাংবাদিক দেখলে গুরুর গায়ে কম্প দেয়, তাই ভক্তচরনেরওঃ)
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত