এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  খ্যাঁটন  খানা জানা-অজানা  খাই দাই ঘুরি ফিরি

  • রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ২৯

    স্মৃতি ভদ্র
    খ্যাঁটন | খানা জানা-অজানা | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ | ৮১১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি - লেখিকা

    মৌরি মুরগি: মৌরি বাটায় মুরগির লাল সালুন



    যমুনার টলটলে জলে আকাশের মেঘ ভেঙে পড়তেই যমুনা কেমন অচেনা হয়ে উঠেছে কয়েকদিন হল। ভোরের মিহি স্রোতের নদী আর সন্ধ্যার লাল আকাশের রঙ-মাখা উচ্ছল নদী – তা সবই বদলে গেছে। এখন শুধু পাড়ভাঙা নদীর গল্প। ঘর-ভাসানো জলের গল্প। তবে আগেই বলেছি, জলের সাথে এক অদ্ভুত আত্মীয়তা এই শহরের মানুষদের। তাই বান হোক কিংবা বর্ষা – সবকিছুই কীভাবে যেন মানুষগুলোর কাছে পার্বন হয়ে ওঠে।

    উঠোনের জল ঘরে ঊঠে এসেছে বেশ কয়েকদিন। কখনো কখনো জলের তলায় মাছেদের অবলীলায় আনাগোনাও হয় ঘরবাহিরে। আর মেঘ ভেঙে জল ঝরা – সে তো কোনো নিয়ম না মেনেই হয়ে চলেছে অনবরত। এসবের মাঝে আমার আনন্দ রহিম চাচার ভেলায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো। বৃষ্টি একটু ধরে এলেই, একাজ-ওকাজের ছুতোয় আমি চড়ে বসি রহিম চাচার ভেলায়। না না, সেসব কিন্তু আমার কাজ নয়। হয়তো মায়ের একটু অশোক গাছের ছাল লাগবে মৌলবী দাদুর বাড়ি থেকে কিংবা শিল্পী আপাদের বাড়ি থেকে পোয়াখানেক ডাল আনতে হবে, আমি তখন প্রয়োজন মেটাতে একপায়ে খাড়া। আসলে শিল্পী আপাদের বাঁধা চালডালের ব্যাবসা। কিন্তু জল উঠে তলিয়ে গেছে ওদের গোডাউন। তাই সবকিছু ঘরে এসে উঠেছে। এখন ঘর থেকেই হয় সেসবের গতি। পাড়ার সকলে এই জলঝড়ের মধ্যে আর কোথায় যাবে? তাই ভাঁড়ারে টান পড়লেই সবার ওই একই গন্তব্য শিল্পী আপাদের বাসা।

    তবে রহিম চাচার ভেলা যে আমাকে শুধু সে বাড়িতেই নিয়ে যায়, তা নয়। সত্যি বলতে কলার ভেলায় বসলেই জলের পথ আমার জন্য লম্বা হয়ে যায়। এই তো রাস্তা পেরিয়ে মসজিদের মাঠ তারপরেই শিল্পী আপাদের বাড়ি। কিন্তু রহিম চাচার ভেলা সে পথ ধরলে তো? জলের ভেতর ছপাৎ ছপাৎ আওয়াজ তুলে বৈঠা পথ আঁকে সোজা রহিম চাচার পেছন বাড়ি, এরপর ভাদুড়ি বাড়ির বাগান তারপর অচেনা কারো বাড়ির পতিত উঠোন, আরেকটু এগোয় মিলুদির নিঝুম বাড়ি। সেটা পেরিয়ে মসজিদের উল্টোদিক, আরও এগোলে পালপাড়া। আর সে পাড়ার ভেতর দিয়ে সোজা শিল্পী আপাদের পুকুরে গিয়ে পড়া। তারপরেই হাঁক,

    মিল্লাত ভাই, বাড়িত আছো?

    এই হাঁকের সাথে সাথেই আমি হারিয়ে ফেলি ভাসতে থাকা কচুরিপানা, জলের ওপরে ভেসে থাকা কদম গাছ, নিথর ডুবে থাকা ভাদুড়ি বাড়ির জংলা বাগান, ভেসে যাওয়া ডুমুরের ফুল আর জলের ছপাৎ ছপাৎ গান। তবে এসবকিছু হারালেও মুঠোয় ধরে রেখেছি ধুতরা ফুলগুলো। ভেসে যাওয়া ফুলগুলো রহিম চাচার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপিসাড়ে আমার হাতে এসে উঠেছে।

    শিল্পী আপার আব্বা ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য বাড়িতে না থাকলেও আমরা খালি হাতে ফিরি না। চৌকির উপর বসে থাকা সিমেন্টের বস্তায় ভরা নানারকম ডাল থেকে পোয়াখানেক ছোলার ডাল পড়ল মায়ের পাঠানো বাটিতে। রহিম চাচাও গামছায় ভরে নিল খানিক মসুরের ডাল। তাতেই অবশ্য রহিম চাচার ভাঁড়ারের ক্ষুধা মিটল না। ফেরার পথে ভাদুড়ি বাড়ির জলে প্রায় ডুবুডুবু বাগান থেকে নিয়ে নিলো বেশকিছু ডুমুর ফল, তবে সে ডুমুর ফল গামছায় বেঁধে আনন্দে বাড়িতে ফেরা হল না রহিম চাচার। আমাদের থামতে হল রাস্তাতেই। চাচী প্রায় কোমর-জলে দাঁড়িয়ে আছে চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা নিয়ে। এমনিতে চাচী খুব নিরীহ মানুষ। কখনোই চড়া গলায় কথা বলে না। আজ রাস্তাতেই কান্নাগলায় চেঁচিয়ে উঠল,

    চট করি আসেন, পানিত সব কুকড়া ভাসি গেল…

    জল নাকি এই ক-ঘণ্টায় আরও বেড়েছে। রহিম চাচার পালিত মুরগির ঘর গতকালকেই ঘরের ভেতর আনা হয়েছিল। মাচানের উপর রাখা ছিল সেই মুরগির ঘর। চাচা ভেবেছিল, অন্তত এই মাচান জলের তলায় যাবে না। কিন্তু তা হয়নি। জল বেড়ে মাচান ডুবে মুরগির ঘরেও জল ঢুকেছে। গলা ডুবডুব জলে ভেসে গেছে দুই একটা মুরগিও। এসব শুনে কি রহিম চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল? কথা বলতে গিয়ে গলাটাও কেঁপে উঠল,

    মানুষ খাতি পায় না আর কুকড়ার কথা কী ভাববো? খাতি দিতি পারি না কয়দিন হল কুকড়াগুলান, যাউকগা ভাসি যদি খাতি পায় কুথাও…

    চাচী যেন একটা ধাক্কা খেলো। দিনরাত যে পোষ্য নিয়ে রহিম চাচা ব্যতিব্যস্ত থাকত, আজ তাদের ভেসে যাবার খবরে সে ব্যস্ত হল না। ভেলা ঘুরিয়ে খুঁজতে বের হল না তাদের। তবে আমাকে বাসায় নামিয়ে ভেলার মুখ ঘুরাল মসজিদের মাঠের দিকে। কাজহীন এই সময়ে রহিম চাচা হাত লাগায় রিলিফ গোছানোর কাজে। এলাকার এ বাড়ি-ও বাড়ি থেকে তোলে পুরাতন জামাকাপড় অথবা টাকা। সব জমা হয় মসজিদে। ওখান থেকেই বিলানো হয় জলে সবকিছু ভেসে যাওয়া মানুষদের।

    জলে ভেসে ভেসে দিন ফুরাচ্ছে আমাদের। ফুরাচ্ছে বেলা। আর মেঘের তলায় সকাল লুকিয়ে দুপুর কখন আসে – তা কারো বোঝার সাধ্যি নেই আজকাল। মায়ের তাই অখণ্ড অবসর। এসব সময়ে মায়ের হাতে কখনো কাপড়ে ফুলতোলার সুঁই সুতো, আবার কখনো সদর লাইব্রেরির বই দেখা যায়। হ্যাঁ, শহরে আসার পরেই জানা গেছে মায়ের বই পড়ার নতুন শখের কথা।

    মাসে একটা করে বই তুলে আনে বাবা লাইব্রেরি থেকে। সে বই পড়া শেষ হলে ফিরিয়ে দিয়ে আবার নতুন বই নিয়ে আসে। তবে বই যত নতুনই আসুক, এতদিনে আমি মুখস্থ করে ফেলেছি একটি নাম। আর সেটা হল ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। মায়ের পড়া সব বইয়ে এই নামটিই থাকে।

    কিন্তু আজ মায়ের হাতে বই নেই। নেই সুঁই-সুতোও। ঘরের মেঝে বারান্দার জলে এর মধ্যেই স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। শীতলপাটি কিংবা মায়ের শখের সুজুনি পাতার অবকাশ নেই সেখানে। মা কেমন আনমনা হয়ে বসে আছে বিছানায়। কেরোসিনের স্টোভ ঘরে উঠেছে বেশ কয়েকদিন হল। সকালের চা আর সেদ্ধ ভাত ফুটিয়েই আজকাল পাত ওঠে সকালের খাবারের। আর দুপুরেও সেই তথৈবচ অবস্থাই। তাই আজকাল মা কেমন খালি খালি থাকে। তাই বিকাল পাঁচটা বাজতেই আমাদের ষোলো ইঞ্চির প্যানাসনিক বেশ হেসে গেয়ে ওঠে। আর সেখান থেকেই আমি শিখে নিয়েছি,

    তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথী হতে
    আজকের চেষ্টা আমার…

    বানের জলে প্যান্ট গুটিয়ে হেঁটে যাওয়া কতগুলো লোককে পাশ কাটিয়ে আমি দেখি খাবারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা বড় চোখের বাচ্চাগুলোকে। আচ্ছা ওদেরও কি রহিম চাচার মতো ঘরে চাল নেই? নাকি ওরাও মুসাদের মতো সব ফেলে স্কুলঘরে গিয়ে উঠেছে?

    তবে মুসাদের জন্য কিন্তু শুধু রাতটুকু বরাদ্দ স্কুলঘরে। বড়দাদীর আদেশে মুসার মা আর মুসা প্রতিদিন সকালে চলে আসে, এরপর সারাদিনের কাজ শেষ করে রাতে চলে যায় স্কুলঘরে। স্কুল বন্ধ, খেলার মাঠ জলে ডোবা, মসজিদের বারান্দা রিলিফের জিনিসে ভরা তাই মুসার দিন কাটে বড়দাদীর ছাদে। সেখানে পায়রাগুলোকে কখনো খুদ ছিটিয়ে দেয়, আবার কখনো হাততালি দিয়ে উড়ন্ত কবুতরের ডিগবাজি দেখে। আবার কখনো বড়দাদীর ফুটফরমাশ খাটার অজুহাতে পাড়ভাঙা নদীর জলে গা ডুবিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি করে। সেই সুযোগে গামছায় জল ছেঁকে তুলে আনে নদী ছেড়ে শহরের রাস্তায় ভেসে বেড়ানো পুঁটি কিংবা হাত ভরে শালুক ফল। সত্যি বলতে, বান যেন মুসার দুরন্তপনার প্রশ্রয় দিয়েছে আরও।

    তবে শুধু বানের জলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, বাবাহীন এই ছোট্ট ছেলেটাকে আরেকজন মানুষও অবলীলায় প্রশ্রয় দেয়। আর তিনি হলেন বড়দাদী। এই তো গামছায় জল ছেঁকে তুলে আনা দু-চারটি পুঁটি দিয়ে বড়দাদী শুধু মুসার জন্যই রান্না করে তেলপুঁটি, আবার রিলিফের খিচুড়ির স্বাদ ভোলাতে মুসার হাত ভরে দেয় মোরব্বায়। এসব প্রশ্রয় পেয়েই হয়তো মুসার যত আকাসকুসুম আবদার বড়দাদীর কাছে,

    গোশত খামু নানী… পানি হুকাইবো কবে? বাজার থিকি মোরগ আনি দিমু তোক…

    বড়দাদীর ঘরগুলো উঠোন থেকে বেশ উঁচু। অনেকগুলো সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে লম্বা বারান্দা, তারপর একসারি ঘর। সেসব ঘরের অধিকাংশ ফাঁকাই পড়ে আছে। এ বাড়ির কেউ দূরের শহরে তো আবার কেউ দূরের দেশে। মাঝেমাঝে ডাকপিয়নের হাঁক আর হঠাৎ বেজে ওঠা টেলিফোনের রিং-এ এখন সীমাবদ্ধ বড়দাদীর সকল আত্মীয়তা। তাই পাড়ার মানুষের সাথেই বড়দাদীর হৃদ্যতা। আর এমন অন্তরের মানুষ যখন মনের কোনো সাধ জানায়, তখন আকাশপাতাল এক করে বড়দাদী সেই ইচ্ছে মেটায়।

    কিন্তু এমন বানভাসা শহরে মুসার ইচ্ছেপূরণের ছড়ি এখন কই পায় বড়দাদী? না পাক ছড়ি, তা বলে অন্যের ইচ্ছে মেটানোর হাউস কীভাবে মন থেকে সরাবে বড়দাদী?

    না, সরাতে হবে না। এ পাড়ার সবার বিপদ উদ্ধারে যে মানুষটি দু-হাত বাড়িয়ে দেয়, সে মানুষটির হাত আজ খালি থাকবে কী করে,

    কুকরাগুলান না খাতি পারি মরি যাতিছে, নয় পানিত ভাসি যাতিছে। দুই একখান কুকরা ঝিমাইতেছে বড় আম্মা। আপনে নিলি ভালো হবিনি…

    জলের তোড়ে আর যাইহোক – বড়দাদীর অন্তর থেকে দয়া জিনিসটুকু ধুয়েমুছে নিতে পারেনি। তাই তো রহিম চাচার বাকি মুরগিগুলোর জায়গা হল বড়দাদীর বারান্দায়। আর সেখান থেকেই একটি পোষ্য বাছা হল বড়দাদীর হাউস মেটানোর উপায় হিসেবে। তবে সে উপায় শুধু মুসার জন্য নয়, আরও কারো কারো জন্যও উৎসব হয়ে উঠল আজ।

    আজ বড়দাদীর ছাদে চড়ুইভাতির আয়োজন। রহিম চাচার ভেলায় ভেসে শিখা দিদি এল মুষ্টিতোলা আতপ চাল নিয়ে। মায়ের কাছ থেকে গেলো সদ্য মিল্লাত চাচার বাড়ি থেকে আনা ডাল। আর বাকি তেল-লবণ সব বড়দাদী জোগালো। আসলে জল-বন্দি মানুষগুলো এখন খোঁজে অবসর কাটানোর ছুতো। তাই তো এ বাড়ি ও বাড়ি চেঁচিয়ে গল্প হোক, কিংবা সুঁইয়ের ফোড়ে সুতা সাজানো – সবকিছুর শেষে ওই এক কথা,

    বানের জল নামবে কবে?

    নয় নয় করেও সপ্তাহ হতে চললো যমুনা নদীর শহরে ঢুকে পড়া। আর তারও সপ্তাহখানেক আগে থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। তাই এই জলের জীবন একঘেয়ে হয়ে উঠছে সবার। আর এজন্যই আচমকা চড়ুইভাতির এই হাঁক সবাইকে বেশ উৎফুল্ল করে তুলেছে। অল্প সময়েই বড়দাদীর ছাদ হয়ে উঠলো জল-বন্দি মানুষগুলোর আনন্দ ঠিকানা। আজ উনুনে বলকাবে মৌরি মুরগি আর ছোলার ডালের খিচুড়ি। জোগাড়যান্তি হতেই যতটুকু সময় – উনুনে আঁচ পড়তেই হৈ হৈ করে শুরু হয়ে এক অদ্ভুত চড়ুইভাতির আনন্দযজ্ঞ।

    বড়দাদীর রান্নার স্বাদ এ পাড়ার সবার কাছেই অনন্য। আর বড়দাদী রাঁধেনও খুব যত্ন করে। সবার আগে উনুনে বসল একটা মাটির বড়মুখের হাঁড়ি। তাতে বড়দাদী ঢেলে দিল অনেকটা সর্ষের তেল। সেই তেলে ফোড়নে পড়ল তেজপাতা আর পাঁচফোড়ন। একটু নেড়েচেড়ে তাতে বড়দাদী মুঠো ভরে পেঁয়াজ কুচোনো দিয়ে দিল। এদেরকে লাল করে ভাজার ফাঁকে কতগুলো কাঁচামরিচও দিয়ে দিল বড়দাদী। পেঁয়াজের সাথে সাথে হাঁড়ির মরিচগুলোও রঙ বদলাতে শুরু করলো। বড়দাদী এবার আদা, রসুন বাটা দিয়ে দিল। একটু সময় পরেই তাতে পড়ল জিরাবাটা। সাথে লাল টকটকে শুকনো মরিচ বাটাও পড়ল খানিকটা। আর তাতে হলুদ গুঁড়ো, খানিক লবণ পড়তেই হাড়ির ভেতর ছড়িয়ে পড়ল রঙ, টকটকে লাল রঙ। মাটির খোলা হাঁড়ি থেকে ছাদের এলোমেলো বাতাসে এখন কাঁচা মশলার আর পাঁচফোড়নের ঘ্রাণ মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুঘ্রাণ আমার নাকে ধাক্কা দিল। এই ঘ্রাণ আমি শুধু গোলেনূর দাদীর উঠোনে পাই। আর তা-ও, কোনো পরবে।

    মেহেদিরঙা চুলের বড়দাদীর দিকে তাকাই আমি। তাঁর চোখ নিবিষ্ট উনুনের হাঁড়িতে। বড় মনোযোগ দিয়ে বড়দাদী রান্না করছে চড়ুইভাতির মৌরি মুরগি।




    এখন বড়দাদীকে আমার কেন যেন গোলেনূর দাদী মনে হচ্ছে। গোলেনূর দাদীও এভাবে নানা পরবে পান খেতে খেতে উনুনে আনন্দ বলকায়।

    হাঁড়ি থেকে এবার ভাসতে শুরু করেছে কষে আসা মশলার ঘ্রাণ। এবার খুব যত্ন করে বড়দাদী হাঁড়িতে দিয়ে দিল ধুয়ে রাখা মুরগির টুকরো। মসলায় মাংসগুলো নেড়েচেড়ে মিশিয়ে ঢাকনা পড়লো হাঁড়িতে। ওদিকে চাচী আরেক উনুনে বসিয়েছে বুটের ডালের খিচুড়ি। আতপের ঘ্রাণ জড়ানো সেই খিচুড়ি খানিক পরেই দমে বসবে।

    মুসা খানিক সময় পর পর এসে খবর নিচ্ছে রান্নার। কখনো বড়দাদীর আদর মেশানো উত্তর,
    আরেকটু পরেই খেতে দেবো…

    আবার কখনো মুসার মায়ের লজ্জা মেশানো অনুযোগ,
    এত বারবার কতি হয় নাকি আব্বা?

    মুসার অবশ্য এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে হয় হাঁড়ির উপর উপুড় হয়ে, নয়তো মায়ের গা ঘেঁষে সেই একই কথা,
    এ্যা মা, ভুখ লাগছে…

    বেলার গায়ে বারবেলার আঁচ পড়েছে। থম ধরে থাকা আকাশও রঙ বদলে জানান দিচ্ছে বেলা এগুচ্ছে পশ্চিমে।

    বড়দাদী মুরগির হাঁড়ি থেকে ঢাকনা তুলল। তেল ছেড়ে এসেছে। এবার অল্প একটু গরম জল দিলো বড়দাদী হাঁড়িতে। আবার ঢাকনা পড়ল। অল্প একটু অপেক্ষা। খানিক সময় পরেই হাঁড়ির ঢাকনা উঠে তাতে পড়বে রোদে মজা জলপাই আচারের তেল আর টেলে রাখা মৌরি গুঁড়ো।

    বুটের ডালের খিচুড়ি আর মৌরি মুরগি খেতে খেতে মুসার চোখে আনন্দ বলক দেবে। আর তা দেখে বড়দাদীর স্নেহাতুর স্বগতোক্তি হবে,
    অত গরম ঝোলে স্বাদ খোলে না মুসা, একটু জুড়াতে দে…

    সে ঝোল জুড়াতেই আমাদের চড়ুইভাতি ফুরিয়ে গেল। বেলা গিয়ে ঠেকলো বিকেলের ছায়ায়। প্যানাসনিক টিভি আবার গেয়ে উঠল,
    তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথী হতে
    আজকের চেষ্টা আমার…

    জল আর মানুষের মুখ ভুলে হঠাৎ আমার মনে ভেসে উঠলো ধুতরা ফুলের কথা। মুঠো খুলে কখন জলে ভেসে গেল সেই ফুলগুলো? নাকি মনের ভুলে কোথাও ফেলে রেখেছি আমি?

    উত্তর জানা নেই আমার। আমি শুধু ফাঁকা মুঠোয় অপলক তাকিয়ে থাকি, সেখানে এখন শুধুই ধুতরা ফুল হারানো এক পশলা শূন্যতা।



    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • খ্যাঁটন | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ | ৮১১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ২২:০২526426
  • এই লেখায় হালকা বিষন্নতা মিশে থাকেই। আজ আরেকটু গাঢ় হয়ে গেল।
  • Nirmalya Bachhar | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ২৩:৪০526796
  • বড় ভালো 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন