এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    এক্সিট পোল - রমিত চট্টোপাধ্যায় | অলংকরণ : রমিত চট্টোপাধ্যায় এক্সিট পোলরমিত চট্টোপাধ্যায়ভাবলাম দিই চারশো লিখেইউনিজির কথা মেলাতে,প্রচার প্রণামী জুটবে ভালোইকাটবে দুদিন রেলাতে।তারপর ভাবি এত বেশি দিলেসকলে গালিবে চাড্ডি,তাই শেষমেশ ফেলে নিশ্বেসকুড়িখানা সিট বাদ দি।মালিক কহিলো রিপাব্লিকেওএত বেশি নাকি কয় নি,বাদ দিতে পারো আরো খানকুড়িচাগরি যাবেনা ভয় নি।তাই নিয়ে গিয়ে হাসিটা চাপিয়েকালো কোট পরে জ্ঞান দি,টিভি পর্দায় সেই ফল দেখেভক্ত বিলায় ক্যান্ডি।ইনিয়ে বিনিয়ে বিশেষজ্ঞরাবলে ঠিকই, এতো ফলবে,কাঁড়ি কাঁড়ি ডেটা, ততোধিক গ্রাফমিছে কথা কেন বলবে?দুটিদিন ধরে এ নিয়ে নাচবেহোয়া ইউনির ছাত্র,ফল বেরোলেই বলে দেব হেসেভুল হয় মানুষ মাত্র!
    লেজ, বেড়াল, তপস্বী এবং ভণ্ড - বেবী সাউ | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়একটা বিড়াল। আর তপস্বী।  বিড়ালের রং সাদা, তাই পয়া। দুধটি, কলাটি বেশ জোটে। চুকচুক করে খেয়ে আসছে এতকাল। কিছু প্রাপ্তি ঘটলেই দুনিয়া সুন্দর মনে হয়। সেও ভাবল, মানুষ ভালো এবং সুন্দর। তপস্বী সাদা না। কিন্তু তার গোঁফ এবং দাড়ি সাদা। যদিও তার চুলের অর্ধাংশ ছিল কালো। একটা কারসাজি করে সাদা করা হল। পারফেক্ট লুক চাই। চুল হল পরগাছা। এত কারসাজি সহ্য করতে না পেরে গেল উঠে। এই উপমহাদেশ ততদিনে জেনে গেছে, তপস্বী মানে সর্বশক্তিমান! অযোনিসম্ভূত! দমবার পাত্র তো নয়ই। খালি মাথা তো আর রাখা যায় না।সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে লেজ কেটে চিপকানো হল মাথায়। বেড়ালের লেজ মাথায় দেখে, উপমহাদেশ ভাবল মিরাক্কেল! অলৌকিক ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত বিশ্বাস পাওয়া যায় না জনগণের। পেছনের লেজ মাথায় দেখে জনগণ আচম্বিত। কিন্তু ভালো যত মন্দ তত! ভক্তের সঙ্গে ছুটল বিরোধীও। তদন্ত হলো, লেজ কার! কিন্তু তপস্বী ততদিনে ঢুকে পড়েছেন মায়ামোহময়ে। যাইহোক, তপস্বী চললেন বিড়াল থেকে বেরোতে। খোঁজ খোঁজ... কোথায় পাওয়া যাবে সেই পুণ্যভূমি! বিরোধী-পাপ থেকে মুক্তি পেতে হবে। এবং যেখানে জড়িয়ে থাকবেন দেশের মহাত্মারা... শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। নির্জন তটভূমি! অকুতোভয় তপস্বী ততদিনে সাক্ষাৎ অবতার। অখণ্ড পুরাণ বলছে— তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ! সঙ্গে সঙ্গে গুণমুগ্ধ ভক্তের হাততালি। আর দোষযুক্ত শত্রুর দলকে কব্জা করছে আইটি সেল। তটভূমি। পাশেই আবার নিরক্ষরেখা। 'এই গরমে তপস্যা!' তপস্বী ধ্যানে নিবিষ্ট হতে পারছেন না। ফলে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। সিকিউরিটি? কেননা, দোষযুক্ত বিরোধীপক্ষ। আর চোখ পিটপিট তাকানো? আরে বাবা! বেড়ালের ম্যাও...ম্যাও... সর্বগুণযুক্ত, সর্বদোষমুক্ত বলে কি আর বেড়ালের গল্প শুনবে না!কিন্তু প্রশ্ন, তপস্যারত তাও সামনে ক্যামেরা! লেজ যার যায়, সেই বোঝে...
    বিপ্লবের আগুন - পর্ব সাত - কিশোর ঘোষাল | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়৭পরের দিন খুব ভোরবেলাতেই ভল্লার ঘুম ভেঙে গেল। আজ বেশ সুস্থ বোধ করছে সে। শরীরের ব্যথা, বেদনা – গ্লানি নেই বললেই চলে। বিছানায় উঠে বসল, তারপর ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে এল। ভোরের আলো সবে ফুটেছে, বাইরের গাছপালার ডালে ডালে পাখিদের ব্যস্ততা টের পাওয়া যাচ্ছে তাদের কলকাকলিতে। হাওয়ায় সামান্য শিরশিরে ভাব। বিছানায় ফিরে গিয়ে সে গায়ের চাদরটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়াল। দড়ি থেকে টেনে নিল গামছাটা – কষে বেঁধে নিল মাথায়। তারপর প্রশস্ত অঙ্গন পেরিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে চলল পথের দিকে। কঞ্চি দিয়ে বানানো, বেড়ার পাল্লা খুলে সবে পথে নামতে যাবে, কমলি ডাক দিল, “অ্যাই, এই কাক ভোরে কোথায় চললি রে? পালাবার ফিকির বুঝি? এখনো তোর শরীর পুরোপুরি সারেনি…”। কমলির হাতে জলভরা ঘটি। ভল্লা ঠোঁটে আঙুল রেখে কমলিকে ফিসফিস করে বলল, “প্রধানমশাই শুনতে পেলে এখনই হৈচৈ বাধাবে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শরীরে এবার ঘুণ ধরে যাবে। একটু ঘুরেঘেরে আসি…গাঁয়ের লোকদের সঙ্গে চেনা পরিচয় করে আসি…। আমি পালাইনি রে, মা। প্রধানমশাইকে আমি ভয় পাই নাকি? ভয় করি তোকে। তুই না তাড়ালে, আমি এ বাড়ি ছেড়ে, এই গ্রাম ছেড়ে সহজে নড়ছি না…এই বলে দিলাম, মা”।ভল্লার চোখের দিকে তাকিয়ে কমলির চোখ ছলছল করে উঠল। বছর দশেক আগে তাঁর হারিয়ে যাওয়া দুই ছেলের বড়টি যেন ফিরে এসেছে তাঁর কাছে। কমলির প্রৌঢ় দুই পয়োধর আচমকাই যেন ভারি হয়ে ব্যথিয়ে উঠল। অস্ফুট স্বরে বললেন, “তার নাম ছিল বুকা – সে আজ থাকলে ঠিক তোর মতই হত…”ভল্লা বলল, “আমিই তো সেই…নিজের ছেলেকে চিনতে পারিস না, কেমন মা তুই?” চোখ আর নাক কুঁচকে ভল্লা হাসল। কমলি চোখের জল এড়াতে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “একটু দাঁড়া, নাচ দুয়োরে জলছড়া দিই, তারপর বেরোস…নইলে অমঙ্গল হয়…বেশি দেরি করিস না ফিরতে…”। পথে নেমে ভল্লার মনে পড়ল, সে এই গাঁয়ে ঢুকেছিল বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে। অতএব গাঁয়ে যেতে গেলে নিশ্চয়ই ডাইনে যেতে হবে। সে ডানদিকেই হাঁটা দিল ধীরে সুস্থে। পথের পাশে একটা বাবলা গাছ পেল। খুব সাবধানে কাঁটা সামলে ছোট্ট একটা ডাল ভেঙে, মুখে নিয়ে চিবোতে লাগল। নিমের ডালের থেকে তার বাবলার ডালই পছন্দ। মন্থর পায়ে চলতে চলতে সে দেখল পথের দুপাশেই বাড়ি – তবে একটানা লাগাতার নয়। দুই বাড়ির মাঝখানে কোথাও খালি জমি – কোথাও পুকুর। বাড়িগুলি খুবই সাধারণ। বাঁশের বাতায় পুরু করে মাটি লেপে দেওয়াল। কাঠের কাঠামোর ওপর শালপাতার ছাউনি। ঝড়ঝাপটা, বৃষ্টি-বাদলায় এসব বাড়ি মোটেই নিরাপদ নিশ্চিন্ত আশ্রয় হতে পারে না। বেশ কিছু বাড়িতে ছাগলের খামার রয়েছে। সকাল বেলা সব বাড়ি থেকেই বেরিয়ে আসছে ছাগলের দল। কারো কম – চারপাঁচটা, কারো কারো বেশি পনের-বিশটা। দুটো ছোঁড়া হাতে পাঁচন বাড়ি নিয়ে তাদের জড়ো করছে। তারপর খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারণ জমির দিকে। ভল্লা ছোঁড়াদুটোকে জিজ্ঞাসা করল, “শুধুই ছাগল, গরুবাছুর নেই?”ছোঁড়াদুটো কথা বলল না, শুধু ঘাড় নেড়ে বলল, না। “গ্রাম থেকে কতদূরে, রে? যেখানে এদের চড়াতে নিয়ে যাস?” ছোঁড়াদুটোর একজন হাত তুলে দেখাল, বলল, “হোই তো হোথা”। অন্যজন জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কমলিমায়ের বাড়ি এসেছ না? কোথা থেকে এসছ? যাবে কোথায়?”ভল্লা ওদের মাথায় হাত রেখে বলল, “অনেকদূরের শহর থেকে এসেছি...তোদের সঙ্গে দেখা করতে, এখানে থাকতে...এখন আর কোত্থাও যাবো না আমি”।ওদের তাড়া আছে, ভল্লার নেই। ছেলেদুটো ছাগলের পাল নিয়ে এগিয়ে গেল। ভল্লা দাঁতন চিবোতে চিবোতে বুঝতে লাগল, গ্রামের পরিস্থিতি। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে সে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। এখনও পর্যন্ত কোন বাড়িতেই সে শস্যের গোলা দেখতে পেল না। এমনকি গ্রামপ্রধান জুজাকের বাড়িতেও সে শস্যগোলা দেখেনি। জুজাকের বাড়ির যে ঘরে রয়েছে, সে ঘরেরই এক কোণায় রাখা তিনটে বড় মাটির জালায় ভুট্টা আর জোয়ারের দানা দেখেছে। সে দিয়ে সারাবছরের খোরাক হয়ে যায়? জুজাক আর কমলিমায়ের মাত্র দুজনের সংসার…তাতেও সারাবছর চলতে পারে না। তাছাড়া শুধু পেটে খেলেও তো হয় না। তেল, নুন, কিছু কিছু মশলা, ধুতিশাড়ি, শীতের চাদর, কাঁথা-কম্বল সে সব কিনতেও তো ভরসা ওই শস্যদানাই! তার ওপর আছে শখ আহ্লাদ, পালা-পার্বণ, দায়-দৈব…। রাজধানী শহরের বিত্তবান মানুষের কাছে শস্যদানা থাকে না। তাদের থাকে কড়ি, রূপোর মুদ্রা, সোনার মুদ্রা। সেই মুদ্রা দিয়ে জগতের সব কিছু কিনে ফেলা যায় – ঘরবাড়ি, মূল্যবান কাপড়চোপড়, গয়না-অলংকার, বিলাসব্যসন, সুরা… কি নয়? ভল্লার মনে পড়ল রাজশ্যালক রতিকান্তর কথা। রাজার অনুগ্রহে প্রতিপালিত নিষ্কর্মা, লম্পট লোকটা কত অর্থের অনর্থক অপচয় করে চলেছে প্রত্যেকদিন। অথচ এইখানে এই গ্রামে কী নিদারুণ কঠিন পরিস্থিতি।হাঁটতে হাঁটতে ভল্লা গিয়ে পৌঁছল অনেকটা উন্মুক্ত এক জমিতে। বাঁদিকে বিশাল এক জলাশয়। জলাশয়ের তিনদিকে ঘন গাছপালার সারি আর ঝোপঝাড়। আর সামনেই পাথরে বাঁধানো ঘাট। সেই ঘাট থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন এক অশ্বত্থ গাছ। শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে নিবিড় ছায়াময় করে তুলেছে বৃক্ষতল। সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে পাথর বিছানো বসার জায়গা। ভল্লার মনে হল, পাথরের ওই আসনগুলি গ্রামের মাতব্বর পুরুষদের বিশ্রম্ভালাপের জায়গা। অপরাহ্ণে হয়তো অনেকেই আসে - কথাবার্তা, শলা-পরামর্শ, পরনিন্দা-পরচর্চা সবই চলে। গ্রামের পালা-পার্বণে উন্মুক্ত এই জমিতেই হয়তো গ্রামবাসীরা সমবেত হয়। হইহুল্লোড়, নাচ-গান করে। ভল্লা সেই জলাশয়ের ঘাটে গিয়ে দাঁড়াল। স্বচ্ছ নির্মল জলের ওপর ছায়া পড়েছে তিনপাশের গাছপালা আর মাথার ওপরের সুনীল আকাশের। জলাশয়ের বিস্তার এতই বড়ো, জলের উপরে তিরতিরে তরঙ্গ উঠছে, প্রভাতী বাতাসের স্পর্শে। ভল্লা ঘাটে নেমে জলস্পর্শ করল, মুখ ধুয়ে, মুখে চোখে জল দিল। কিছুটা জল পানও করল। চাদরে মুখ মুছে ঘাটেই বসল।কিছুক্ষণ আগেই সূর্যোদয় হয়েছে তার সামনে, কিছুটা ডানদিকে। ওদিকে ছোট্ট টিলা আছে একটা। ভল্লার মনে পড়ল, এই গ্রামে ঢোকার মুখে সে একটা সরোবরের সামনে দাঁড়িয়েছিল। তার যতদূর ধারণা সেই সরোবরটা রয়েছে ওই টিলার কোলেই। ওখান থেকে আধক্রোশ মত পথ নেমে সে গ্রামে ঢুকেছিল। তার মানে সে এখন যে দীঘির সামনে বসে আছে, তার ওপারের ঝোপঝাড় বেয়ে ওই টিলার পায়ের কাছেই পাওয়া যাবে রাজপথ। কিন্তু ভল্লার মনে হল, সরোবরের পাড় ধরে যে পথে সে নেমে এসেছিল, সে পথ নেহাতই পায়ে চলা পথ। ও পথে গোরু কিংবা ঘোড়ার গাড়ির পক্ষে ওঠা-নামা সম্ভব নয়। অবশ্য দক্ষ অশ্বারোহী ওপথে যাওয়া আসা করতে পারবে। তাহলে এই গ্রামে ঢোকার জন্যে সদর রাস্তাটি কোনদিকে? ভল্লাকে সেটা জানতে হবে। নোনাপুর গ্রাম এই রাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রাম। অর্থাৎ এই গ্রামের পশ্চিম দিকে রয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যের সীমানা। সেই সীমানা এই গ্রাম থেকে কতদূরে? সাধারণতঃ কোন রাজ্যেরই সীমান্ত বরাবর কোন বসতি থাকে না। প্রতিবেশী দুই রাজ্যই জনহীন দূরত্ব বজায় রাখে। অতএব সেই অঞ্চলটি বনাকীর্ণ এবং হয়তো দুর্গম। যদিও ভল্লা জানে, প্রশাসনিক অনুমোদন না থাকলেও সাধারণ জনগণের কিছু অংশ এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাতায়াত করে থাকে। দৈনিক শ্রমের বিনিময়ে কিছু উপার্জনের আশায়। এবং নিয়ম বহির্ভূত কিছু বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। নোনাপুরের কথা সে যেমন শুনেছে এবং আজ সকালে গ্রামের পরিস্থিতি যতটুকু সে উপলব্ধি করেছে – তাতে পড়শি রাজ্যের সঙ্গে এই গ্রামের যোগাযোগ থাকা খুবই স্বাভাবিক।“এই যে ছোকরা…”। পিছন থেকে পুরুষ কণ্ঠের আচমকা ডাকে ভল্লার ভাবনা সূত্র ছিন্ন হল। পিছন ফিরে দেখল, ঘাটের প্রথম ধাপে জনৈক মধ্যবয়সী পুরুষ তাকে ডাকছে, “সেই থেকে ঘাটে বসে কী করছ হে? জান না, সকালে গ্রামের মেয়েরা ঘাটে আসে নানান কাজে…”। মধ্যবয়সী পুরুষের পিছনে চার-পাঁচজন নারী, মাটির কলসি কাঁখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকলেরই মুখভাবে বিরক্তি। ভল্লা দ্রুত উঠে এল ঘাট থেকে, করজোড়ে বিনীত স্বরে বলল, “আমাকে মার্জনা করবেন, আমার অন্যায় হয়েছে। আসলে বিগত কয়েকদিন আমার জীবনের ওপর দিয়ে যে প্রবল ঝড় বয়ে গেল, সেই সব কথাই ভাবছিলাম…এই জায়গাটা এতই নিরিবিলি আর সুন্দর…”। মধ্যবয়সী পুরুষ বলল, “তোমাকে তো বিদেশী মনে হচ্ছে…তুমিই কী সেই যুবক যে ভয়ংকর অসুস্থ অবস্থায় গ্রামপ্রধান জুজাকের বাড়িতে এসেছ?”ভল্লা আগের মতোই সবিনয়ে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ আমিই সেই হতভাগ্য যুবক”। মধ্যবয়সী সেই পুরুষ ভল্লার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোমার কথা অনেক শুনেছি। এস, আজ তোমার সঙ্গে আমাদের পরিচয়টা সেরে নেওয়া যাক”। মধ্যবয়সী সেই পুরুষের পিছনে পিছনে ভল্লা উপস্থিত হল প্রাচীন সেই অশ্বত্থ গাছের কাছে। ভল্লা দেখল সেখানে আরও তিনজন মধ্যবয়সী এবং দুজন প্রায় বৃদ্ধ পুরুষ বসে আছে। সকলেরই কৌতূহলী দৃষ্টি ভল্লার দিকে। ভল্লার সঙ্গী পুরুষ পাথরের আসনে বসতে বসতে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই সেই যুবক, মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় জুজাকের ঘরে যে আশ্রয় নিয়েছিল। কবিরাজমশাইয়ের চিকিৎসায় এখন মনে হয় সুস্থ হয়ে উঠেছে”।বৃদ্ধদের মধ্যে একজন বলল, “তা তোমার নামটি কি হে?”ভল্লা মাটিতে উবু হয়ে বসে বলল, “আজ্ঞে আমার নাম ভল্লা”। মধ্যবয়সীদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করল, “বলি ভল্ল-টল্ল ছুঁড়তে পারো? নাকি শুধু নামই সার”?খুব বিনীত স্বরে ভল্লা বলল, “আজ্ঞে, একটু আধটু পারি, তবে সে বলার মতো কিছু নয়...”।আরেকজন মধ্যবয়সী বলল, “তা তুমি পাথরের আসন ছেড়ে মাটিতে বসলে কেন?”“ছি ছি, আপনারা এই গ্রামের গুরুজন, আপনাদের সঙ্গে একাসনে বসাটা আমার মতো সামান্য জনের পক্ষে ন্যায্য হতে পারে না”।“তা কোথা থেকে আসা হচ্ছে”? “আজ্ঞে সেই সুদূর কদম্বপুর থেকে। তবে আমার বাড়ি কদম্বপুর থেকে দূরের এক গ্রামে। রাজধানীতে বাস করি কর্মসূত্রে”। “তা রাজধানীতে কী রাজকার্য করা হয়?” একজন কিছুটা বিদ্রূপের সুরেই জিজ্ঞাসা করল।লাজুক হেসে ভল্লা বলল, “আজ্ঞে রাজকার্য করার মতো বিচার-বুদ্ধি কিংবা বিদ্যা কি আর আমার আছে? গায়েগতরে কিছু বল আছে...সেই সুবাদে রাজধানীর অজস্র নগররক্ষীর মধ্যে আমিও একজন”। ভল্লাকে যে ডেকে এনেছিল, সে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার কথা বিশ্বাস করা গেল না, হে। নগররক্ষীই যদি হবে – তবে চোরের মার খেয়ে রাজধানী থেকে পালিয়ে এখানে এসে উপস্থিত হলে কেন?”কয়েকজন মাথা নেড়ে সায় দিল, দুজন বলল, “ঠিক কথা। সত্যি কথা বল, না হলে এই গ্রাম থেকে তোমাকে আজই বিদেয় করা হবে...”। ভল্লা বিনীত সুরে কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল, “আজ্ঞে, শুধু এই গ্রাম নয়, এই রাজ্য থেকেই আমার বিদেয় হওয়ার কথা”। উপস্থিত সকলেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, “তার মানে? নির্বাসন দণ্ড? তুমি অপরাধী?”“আজ্ঞে হ্যাঁ। নির্বাসন দণ্ড। কিন্তু আমি অপরাধী এ কথা আমি স্বীকার করব না। আমার মনে হয়, আমার কথা শুনলে আপনাদের বিচারে আপনারাও আমাকে অপরাধী বলতে পারবেন না”।কৌতূহলী ছয় পুরুষ নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল, তারপর এক বৃদ্ধ বলল, “আমাদের বিচারে কী আসে যায়? আমরা তো প্রশাসনিক রায়ের ঊর্ধে নই। অতএব তোমার নির্বাসন দণ্ডের নিরসন আমরা করতে পারব না। কিন্তু তোমার কথা শোনার কৌতূহলও হচ্ছে। আমরা রাজধানী থেকে বহুদূরের বাসিন্দা – রাজধানীর পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। প্রত্যেক বছর কর আদায়ের জন্য যে করাধ্যক্ষ আমাদের অঞ্চলে দু-তিনমাসের অস্থায়ী শিবির স্থাপনা করে - তার থেকে এবং তার অধস্তন কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু সংবাদ পাই। তুমি বল হে ছোকরা। সত্যি মিথ্যে কিছু তো সংবাদ আমরা শুনতে পাবো”।মাথা নীচু করে ভল্লা কিছুক্ষণ বসে রইল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকালেও অনুভব করল, তার পিছনেও অনেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং তার অনুমান তাদের অধিকাংশই তার সমবয়স্ক যুবক এবং তরুণ। নচেৎ তারাও সামনে আসত এবং হয়ত বয়স্কদের পাশে বসত কিংবা দাঁড়াত। এই অনুভবে ভল্লা নিশ্চিন্ত হল। এরকম আসরে তার বিবরণ শোনাতে পারলে, তাকে একই কাহিনী বারবার বলে কালক্ষয় করতে হবে না। সে নিশ্চিত তার ঘটনার কথা অচিরেই এই গ্রামে তো বটেই – আশেপাশের গ্রামগুলিতেও প্রচার হয়ে যাবে। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে, ভল্লা তার বিবরণ বলতে শুরু করল। সেদিনের মধ্যাহ্নের রাজপথে সেই বানজারা রমণীদের কথা। তাদের সঙ্গে রাজশ্যালক লম্পট রতিকান্তর দুরাচারের কথা। নগররক্ষী হয়ে তার দায়িত্বের কথা। এবং ক্রুদ্ধ হয়ে রাজশ্যালকের দিকে ভল্ল ছোঁড়ার কথা, সবই বলল। বর্ণনার শেষে বলল, “বিশ্বাস করুন, রাজশ্যালককে বিদ্ধ করে ওই স্থানেই আমি নিধন করতে পারতাম। করিনি, ভীরু কাপুরুষ লম্পট রাজশ্যালককে আমি শুধু ভয় পাইয়ে নিরস্ত করতে চেয়েছিলাম। রাজশ্যালকের দেহরক্ষীরা আমাকে বন্দী করল। নির্মম অত্যাচার করে উপনগরকোটালের কাছে আমায় সঁপে দিল। আমার প্রতি উপনগরকোটাল কিছুটা স্নেহাসক্ত ছিলেন, রাত্রের অন্ধকারে তিনিই আমাকে রাজ্যত্যাগ করতে আদেশ করলেন। নচেৎ পরেরদিন আমার হয়তো প্রাণদণ্ডও হতে পারত। প্রশাসনিক বিচারে আমার নির্বাসন দণ্ড হয়েছে। সে দুর্ভাগ্য আমাকে মাথা পেতে স্বীকার করে নিতে হয়েছে। কিন্তু এ কথা চিন্তা করে আনন্দও পাচ্ছি যে, লম্পট রাজশ্যালক যে শিক্ষা পেয়েছে, অন্ততঃ কিছুদিনের জন্যে সে নিজেকে সংযত রাখবে। আর ওই বানজারা রমণীদের মতোই আরও অনেক কুলনারী, কুমারী কন্যারাও ওই লম্পটের গ্রাসমুক্ত থাকবে”।অন্য এক বৃদ্ধ মন্তব্য করল, “ওই রাজশ্যালকের চরিত্রহীনতার কথা আমাদের কানেও এসে পৌঁচেছে। কিন্তু আমাদের রাজা তো মহান। বিচক্ষণ, প্রজারঞ্জক, দূরদর্শী। তিনি তাঁর এই শ্যালকটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না?”ভল্লা বিনয়ে হাতজোড় করে বলল, “অনেক কথাই কানে আসে। কিন্তু আপনারা প্রাজ্ঞ-গুরুজন, আমি অতি নগণ্য এক রাজকর্মী। আপনাদের সামনে আমার মতো ছোট মানুষের মুখে বড়ো কথা মানায় না। আমাকে ক্ষমা করবেন”।পিছন থেকে কেউ একজন বলল, “আপনার আর ভয় কি? আমাদের এই গ্রাম শেষেই এক প্রহরের হাঁটাপথে এ রাজ্যের সীমানা। তার ওপারে গেলেই তো অন্য রাজ্য। আপনি নির্বাসনের দোরগোড়ায় পৌঁছেই গিয়েছেন। আপনি বলুন। আমরা শুনব”।ভল্লা ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকাল, দেখল তার পিছনে অন্ততঃ পনের জন যুবক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সঙ্গে আছে বেশ কিছু কিশোর ও বালক! ভল্লা ঘুরে বসল, যাতে দুপক্ষকেই দেখা যায়। তার বাঁদিকে পাথরের আসনে বসা প্রাজ্ঞজনেরা, আর ডানদিকে অর্বাচীন যুবক-কিশোরের দল। তার কাছে অর্বাচীন যুবক-কিশোররাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ – তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলাই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য।ভল্লা প্রাজ্ঞজনদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের অনুমোদন ছাড়া সব কথা প্রকাশ্যে আনা উচিৎ হবে কি?”যে বৃদ্ধ রাজশ্যালক সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনিই বললেন, “আমরা সত্য সংবাদ শুনতে চাই...তুমি বলো”।ভল্লা এবার যুবকদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, ভাই? বসো না। নয়তো আমাকেই উঠে দাঁড়াতে হবে”। ভল্লার অনুরোধে সকলেই বসল। কৌতূহলী মুখে তারা তাকিয়ে রইল ভল্লার মুখের দিকে। ভল্লা বলল, “দেখুন, আমি নগররক্ষী বটি, কিন্তু বিশেষ নগররক্ষীদের মধ্যে একজন। এই বিশেষ ব্যাপারটি বুঝতে গেলে, রাজশ্যালকের চরিতামৃতকথাও জানতে হবে। আগে সেই কথাটিই সেরে নিই। দুর্গ প্রাকারের মধ্যেই রাজশ্যালকের নিজস্ব একটি মহল আছে। কিন্তু সে মহলে তিনি রাত্রিযাপন করেন না। কারণ তাঁর রাত্রিযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যে বিপুল আয়োজন, তাতে দুর্গের প্রশাসনিক বিধিবিধান ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। অতএব দুর্গের বাইরে ক্রোশ দুয়েক দূরে, রাজপথের ধারেই তাঁর নিজস্ব একটি প্রমোদভবন নির্মিত হয়েছে। তা প্রায় বছর ছয়েক তো হতে চলল। এবং বলা বাহুল্য, সে প্রমোদভবন নির্মাণ হয়েছে মহামান্য রাজার অনুমোদনেই!সেই প্রমোদভবনের সম্মুখে আছে বিবিধ ফুল ও ফলের বিস্তৃত উদ্যান। বিচিত্র ফুলের প্রচুর লতাবিতান ও লীলাকুঞ্জ। বেশ কয়েকটি কৃত্রিম প্রস্রবণ। প্রমোদভবনে ঢোকার সিঁড়ির দুপাশে, অলিন্দে সাজানো আছে অজস্র নগ্নিকা মূর্তি। গৃহের অন্দরে কী আছে, জানি না, কারণ সেখানে আমাদের প্রবেশের অনুমতি নেই। ওই সমস্ত নগ্নিকা মূর্তির দুহাতে রাখা থাকে পেতলের দীপ। সন্ধ্যার পর সেই নগ্নিকা-মূর্তিদের করকমলের প্রতিটি দীপ যখন জ্বলে ওঠে সে প্রমোদভবনকে ঊর্বশী-রম্ভার নাচঘর মনে হয়। সুসজ্জিত সেই প্রমোদভবনে রাজশ্যালক প্রতিদিন সন্ধ্যায় যান। সারারাত্তির সুরা ও নারীতে ডুবে থাকেন। খুব সম্ভবতঃ সূর্যোদয়ের পর দেড় প্রহরে তাঁর ঘুম ভাঙে এবং মোটামুটি দ্বিপ্রহরে তাঁর নিজস্ব ঘোড়ার গাড়িতে দুর্গ প্রাকারের ভিতর নিজের মহলে ফিরে যান। এই হচ্ছে তাঁর প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কোন ঋতুতেই তাঁর এই অভিসার যাত্রার কোন ব্যত্যয় হয় না – কারণ তাঁর কাছে সম্বৎসরে একটিই ঋতু – মধুর মধুঋতু! নিত্যনৈমিত্তিক একই ভোগে সুরসিক রাজশ্যালকের সন্তুষ্টি হয় না। তিনি সর্বদা নিত্য-নতুন রমণী সম্ভোগের কামনা করেন। এবং কুলবধূদের কুলনাশ করে তিনি যে আনন্দ পান, বারবধূ সম্ভোগ তার তুলনায় কিছুই নয়। অতএব যাওয়া-আসার পথে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর থাকে, যে কোন যুবতী রমণী – সে সধবা কিংবা বিধবা। অধবা তরুণী কিংবা বালিকা। তাদের কেউ যদি সুন্দরী হয়, তবে রাজশ্যালকের গ্রাস থেকে সেই অভাগীদের পরিত্রাণের উপায় থাকে যৎসামান্য। মহানুভব রাজার এই বিষয়টি অগোচরে ছিল না। রাজশ্যালকের এই দুরাচারের প্রতিকার চিন্তা করে তিনি আমাদের মতো বিশেষ কিছু রক্ষীকে নিযুক্ত করলেন। আমাদের কাজ রাজশ্যালকের যাত্রাকালে, তাঁর যাত্রাপথে কোনভাবেই যেন কোন রমণী তাঁর দৃষ্টিপথে না আসে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা। এক কথায় ওই সময়ে সকল রমণী যেন গৃহের ভিতরে থাকে। কেউ যেন কোনভাবেই রাজপথে, নিজ গৃহের সামনে প্রকাশ্যে না আসে”।সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভল্লা একটু বিরাম নিল, কিছুক্ষণ পর বলল, “মহানুভাব রাজা জেনেশুনেই এই ক্ষুধার্ত হায়নাকে রাজপথে অবারিত চলাচলের অনুমতি দিলেন। কিন্তু নিরীহ সাধারণ নগরবাসীকে পরামর্শ দিলেন ঘরের দরজায় খিল এঁটে থাক। আর আমাদের নির্দেশ দিলেন, সকলে দরজায় ঠিকঠাক খিল এঁটেছে কিনা সেদিকে নজর দিতে। স্বাধীন হায়নাটাকে জব্দ করার নির্দেশ তিনি দিতে পারলেন না!”কথা থামিয়ে হঠাৎই ভল্লা যেন শিউরে উঠল, বলল, “ছি ছি। রাজার অন্নে প্রতিপালিত হয়ে আমি রাজ-সমালোচনা করে ফেললাম? আমার কর্তব্য বিনা বিবেচনায় রাজার নির্দেশ পালন করা। সেখানে বিবেকের তো কোন স্থান নেই! এ আমি, এ আমি কী বলে ফেললাম? ছিঃ”। মাথা নীচু করে ভল্লা মাটির দিকে তাকিয়ে বসে রইল চুপ করে।উপস্থিত কেউই কোন কথা বলল না। সকলেই তাকিয়ে রইল ভল্লার দিকে। সকলেই যেন মনে মনে ভল্লার বক্তব্যের ভাল-মন্দ বিচার করে দেখছে। নির্বিচারে রাজাদেশ মান্য করাই উচিৎ নাকি কখনো কখনো বিবেকের নির্দেশকেও সমীহ করা বিধেয়?সেই বৃদ্ধ আবার বললেন, “তুমি বলো ভল্লা। আমরা জানি তোমার বিচার এবং দণ্ডবিধান হয়ে গেছে। তার পরিবর্তন আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু তুমি বলো, আমরা শুনব”। বৃদ্ধকে সমর্থন করে বেশ কিছু যুবক বলে উঠল, “হ্যাঁ, ভল্লাদা বলো”। ভল্লা মাথা তুলে সকলের মুখের দিকে তাকাল। তার মনে হল, যুবকদের মধ্যে কয়েকজনের চোখে যেন ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ। ভল্লা বিলম্ব না করে বলল, “সেদিনের ঘটনার কথা আপনাদের আগেই বলেছি। বিবেকের তাড়নায় আমি ওই কাজ করেছিলাম। কিন্তু হত্যা তো করিনি, চরিত্রহীন লোকটার মনে ভয় ধরাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সর্বশক্তিমান মহানুভব রাজা কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তাঁর ওই লম্পট শ্যালককে? লোকটা দিনের পর দিন অপরাধ করেও যে দিব্য স্ফূর্তিতে রয়েছে, সে কি রাজার প্রশ্রয়ে নয়? ওই গর্ভস্রাব লোকটি প্রত্যেক রাত্রে অজস্র অর্থের যে অপচয় করে চলেছে, সে অর্থ কি তার নিজের উপার্জিত নাকি রাজকোষের? অর্থ উপার্জনের মতো কোন যোগ্যতাই যে তার নেই – সে কথা আমরা সকলেই জানি। আপনাদের মতো লক্ষ লক্ষ প্রজার ঘাম-ঝরানো পরিশ্রমের শুল্ক থেকে ভরে ওঠা রাজকোষের অর্থ, কোন অধিকারে ওই লোকটি এভাবে অপচয় করে চলেছে সে প্রশ্ন আপনারা করবেন না?”বয়স্ক মানুষরা ভল্লার এই কথায় চমকে উঠলেন। জনৈক বৃদ্ধ বললেন, “উত্তেজনার বশে এ সব বলা তোমার সমীচীন নয় ভল্লা। তুমি রাজার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছ? সরাসরি আমাদের রাজাকেই তুমি অভিযুক্ত করছ? এ তো বিদ্রোহের কথা?”“কিন্তু প্রশ্নগুলো তো অবান্তর নয়, জ্যাঠামশাই” যুবকদের মধ্যে জনৈক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “ভল্লাদা, তুমি জান না, আমাদের এই রুক্ষ বৃষ্টি-বঞ্চিত অঞ্চলে আমরা কী কঠোর পরিশ্রম করি এবং কত সামান্য ফসল ঘরে তুলতে পারি। সেই ফসলেরও রাজকর দিতে হয় এক-তৃতীয়াংশ! সারা বছর আমরা কী খাব, কী পরব। সে কথা রাজা তো চিন্তা করেন না। আর তাঁর শালা রাজধানীতে বসে নিত্য মোচ্ছব চালিয়ে যাচ্ছে?”বয়স্ক মানুষরা শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। কথায় কথায় ছেলে ছোকরার দল উত্তেজিত হয়ে উঠছে। এরপর আর সামলানো যাবে না। এসব আলোচনার কথা রাজকর্মচারীদের কানে গেলে অশান্তি শুরু হবে। এই প্রসঙ্গ এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। সেই বৃদ্ধ মানুষটি আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল হে, চলো বাড়ি যাওয়া যাক – স্নান খাওয়া সারতে অবেলা হয়ে যাবে”।ভল্লাও উঠে দাঁড়াল। সকলকে নত হয়ে প্রণাম করে বলল, “হ্যাঁ তাইতো, বেলা অনেক হল। আর দেরি হলে ওদিকে কমলি-মা আমার পিঠ ফাটাবে। ছোটমুখে অন্যায্য কিছু কথা যদি বলে ফেলে থাকি, ক্ষমাঘেন্না করে নেবেন”।ভল্লা গ্রামের ছোকরাদের আচরণে আশ্বস্ত হল। নিশ্চিন্ত হল। ছেলেগুলো একেবারে মিয়োনো নয়, ভেতরে আগুন আছে। ভল্লা তাড়াহুড়ো করবে না, ধৈর্য ধরে সে আগুনকে উস্কে নিতে পারবে। উত্তেজিত যুবকটির চোখে চোখ রেখে সে কিছুক্ষণ দাঁড়াল, তারপর একটু চাপা স্বরে বলল, “বাড়ি যাও ভাইয়েরা, পরে আরও কথা হবে”।ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    বর্তমানে বাঁচা - সমরেশ মুখার্জী |  Life is precious. Live every moment of it. Never waste it looking back. Never procrastinate in the future. Do whatever you wish to do NOW, because tomorrow may not come. PAST is history, FUTURE is mystery, SO LIVE IN THE PRESENT - it's a gift,  that's why it's called PRESENT….   এযাবৎ নানা প্রতিষ্ঠিত, বিখ্যাত মানুষের নানা বক্তব্যের মাঝে এহেন সারাৎসার‌ও বহু‌বার টের পেয়েছি। যেমন অমিতাভ বচ্চন একবার বলেছিলেন - I never look back - I always look ahead. তিনি নমস‍্য। কিন্তু আমার এসব কথা ভেতরে ঢোকে না। আমি অতীতচারী। চঞ্চলা (transient) বর্তমান পিছল পাঁকাল মাছের মতো - তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায় না। তা করতে গেলে প্রয়োজন যাপিত অতীত - অনাগত ভবিষ্যত। তবে যদি কারুর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার তাগিদ‌ই না থাকে, যদি চিবিয়ে, চুষে, চেটে, গিলে এগিয়ে চলা‌ই হয় কারুর জীবনদর্শন, তাহলে তার এসব না ভাবলেও চলে।    আমরা চোখ দিয়ে দেখি না, কান দিয়েও শুনি না - ওগুলো নিছক গ্ৰাহক মাত্র (receptor) - দেখা, শোনার অভিজ্ঞতা হয় মগজে, আর কিছু অভিজ্ঞতা‌র বিশেষ উপলব্ধি হয় মনে। বহমান বর্তমানের কিছু বিশেষ অভিজ্ঞতা - অতীত সঞ্চয়ের খাতা সমৃদ্ধ করে - ভবিষ্যতে‌ ভাঙিয়ে খাওয়া‌র জন‍্য। স্মৃতি‌র রোদে জারিত পুরোনো আচারের মতো অতিবাহিত জীবনের স্বাদ বড় সুস্বাদু। স্মৃতি বিভ্রম না হলে কাঠের পাঁজায় শুয়ে পাঁজরে ছ‍্যাঁকা লাগা তক সে আচার ফুরোবে না। এই যে আমার বাঁজা লেখালেখি - অধিকাংশ‌ই ঐ আচার ভাঙিয়ে। বর্তমান তো সোডার বোতল - খুললে‌ই ফুউউউস।  আর ভবিষ্যত নারকেল গাছ। লাগিয়ে বসে থাকো ফলের আশায়। তবে সে আশা অনির্দিষ্ট, অনিশ্চিত, অদৃষ্ট। লাগতে পারে তাতে পোকা, ঝরতে পারে ঝড়ে। যে লোকটা সকালে অফিস গেলো সে সন্ধ‍্যা‌য় বাড়ি ফিরবে কিনা ঠিক নেই। তবু এই মায়াময় জগতে মানুষের বর্তমানে কতো না লাফঝাঁপ। ভবিষ্যতের অস্তিত্ব কষা থাকে পরিকল্পনা‌বিদের ছকে - ঐ খানে পৌঁছাবো - ঐ ফান্ডের মূল‍্য বেড়ে এ্যাতো হবে -  তখন অমন বাড়িতে থাকবো - অমুকামুক স্থানে বেড়াতে যাবো…। অথবা ভবিষ্যতের আভাসমাত্র থাকে আমার মতো অবাস্তব‌বাদী মানুষের কল্পনায়। তা নিয়ে‌ও আফিমখোরের মতো মজে থাকা যায় মৌতাতে।   অবশ‍্য Live for the moment - আমি‌ও অনুভব করি, আমার মতো করে -  Vicariously. যেমন কোনো পছন্দের উপন‍্যাস পড়তে গিয়ে বর্তমানে দারুণভাবে উপভোগ করি সুলিখিত অতীত - পূত্র পিতাকে - অলৌকিক জলযান - অরণ‍্যে‌র দিনরাত্রি - যাও পাখি - মানবজমিন … ইপ্র। দীর্ঘ সময়ের পটভূমিতে লেখা সেসব সুবিশাল উপন্যাস বেশ কয়েক দিন ধরে পড়তে গিয়ে সে’কদিন ঘোরের মধ‍্যে কাটে চরিত্র‌গুলি‌র সাথে ঘোরাঘুরি করে তাদের যাপিত জীবনে। তেমন বর্তমানে বাঁচা‌ ভারি আনন্দের। নাহলে মাঝেমধ্যে ব‍্যতিক্রম ব‍্যতীত অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবে‌র বর্তমান নিছক নিত‍্যযাপনের একঘেয়ে নামতা। তাই কঠিন বিষয়ের ওপর জ্ঞানবর্ধ্বক  প্রবন্ধ, চমক দেওয়া প্রতীকী ছোটগল্প এসবের থেকে আমায় সুদীর্ঘ উপন‍্যাস বেশী টানে। ফাস্টফুড নয় - ঢিমে আঁচে বানানো বিরিয়ানী‌র ভক্ত আমি।  সেরকম কোনো পছন্দের ব‌ই পড়ে পাওয়া সেই সময়ের আনন্দ‌, যা লেগেছিল Bliss @ present - তাও পড়া হলে চলে যায় অতীতের গর্ভে। দীর্ঘদিন বাদে সে উপন্যাসের অনেককিছু মনে থাকে না - শুধু মনে থাকে - অমুক ব‌ইটা পড়ে তখন খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। মানুষের অতীত এবং ভবিষ্যত দুটোই finite - তার জীবনকাল। অতীত জ্ঞাত - ভবিষ্যত অজ্ঞাত। গাড়ির ফুয়েল মিটারের মতো বোঝা যায় না আর কতোটা তেল পড়ে আছে ট‍্যাংকে। জ্ঞান হ‌ওয়া ইস্তক অতীতের সঞ্চয় বাড়তে থাকে - ভবিষ্যতে‌র আয়ু কমতে থাকে। বর্তমান নিছক ঘুরে যাওয়া চাকা - যা বাড়ায় অতীতের সঞ্চয়।  এমন সব পেঁজা তুলোর মতো ছেঁড়া কথা মনে এলো উপরের ছবিটা দেখে। মোবাইলে এমন সব ছবি আসে Wallpaper Carousel App থেকে। তার কিছু কিছু বেশ চমকে দেয়। হয়তো সে ছবির ক‍্যাপশন, পরিপ্রেক্ষিত অন‍্য কিন্তু আমার মনে ওঠে অন‍্য তরঙ্গ।   এই ছবিটা‌য় ছোট্ট কিন্তু Prominent REAR VIEW MIRROR টাই এই আবোলতাবোল ভাবনার ট্রিগার। গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন বড় হয় - ভবিষ্যতে‌র দিশায় দ্রুত ধাবমান চালককে সবকিছু, সবদিক দেখে চালাতে হবে যে! তুলনায় ফেলে আসা পথের মতো অতীতে যাপিত জীবনের ভূমিকা বর্তমানে বাঁচতে চাওয়া মানুষের কাছে তুচ্ছ। তবু তা মাঝে মধ‍্যে একটু না দেখেও থাকা যায় না। তাই থাকে একটা চুনকি RVM. আমার মতো অতীতচারী, স্মৃতিবিলাসী মানুষের গাড়ির RVM অবশ‍্য উইন্ডস্ক্রীনের মতোই বড়। সে গাড়ি তাই মিউজিয়াম আইটেম - ব‍্যস্ত সড়কে চলার উপযোগী নয়।পুনশ্চঃ - ৬০২ শব্দের এই খাজা ভাবনাটি লিপিবদ্ধ করেছি‌লাম ডিজিটাল ডায়েরি‌তে - চার বছর আগে -  ১৮.০২.২১ - মনিপালে থাকতে। আজ ভাটের পাতায় চোখ বুলোতে গিয়ে kk - &/ - dc লিখিত তিনটি মন্তব্যে চোখ পড়লো। তার মধ‍্যে কেকের মন্তব্যের শেষটা বেশ বিমূর্ত - কিছু অনুক্ত অনুভবের আভাসমাত্র রয়েছে তাতে। ঐ তিনটি ভাট মন্তব্যের অনুরণন হিসেবে হপা‌র পাতায় থাকলো অতীতের ডিজিটাল ডায়েরির পাতাটি। পাতা-১৭৩৬৬- kk- ২.৬.২৪- ০১:৪৯আমি কোনোদিন কোত্থাও ফিরতে চাইনা। যেসব দিন চলে গেছে তারা চলে গেছে বলেই তাদের মধ্যে রোম্যান্টিকতা আছে বলে আমার মনে হয়। সেই দিনগুলোই আবার ফিরে এলে আমার আর ভালো লাগেনা। তখন তাদের চটা ওঠা, ফুটোফাটা দিকগুলো কটকট করে তাকাতে থাকে। আমি অতীতের কোনোকিছু ফিরে পেতে চাইনা। ভবিষ্যতেরও না। যেসব দিন আসবে তাদের কথা ভাবতে আমার একটুও ভালো লাগেনা। আজকের এই দিনটা, এই ঘন্টাটার বাইরে কোনো জীবনের কথা ভাবতে আমার ভালো লাগেনা। হাইপার অ্যাক্টিভ অ্যামিগডালা, ভয়ানক সব ফ্ল্যাশব্যাক আর ক্যাটাস্ট্রোফাইজিং অ্যাংজাইটির দুটো মস্ত ঘর্ঘরে চাকার মধ্যিখানের একটুকু ফাঁকে, আজকের এই একটা ঘন্টার এক চিলতে কার্নিশে আমি আঁকড়ে পাকড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এর বাইরে আমার আর কোথাও যাবার নেই কিচ্ছু করার নেই।পাতা-১৭৩৬৬- &/- ২.৬.২৪ - ০৪:০৯এই ব্যাপারটা আমাকে খুব ভাবাল। এইরকম সংকীর্ণ বর্তমানে কি সত্যিই বসবাস করা যায়? আলোছায়াময় অতীতস্মৃতি আর প্রসারিত ভবিষ্যৎকল্পনা ছাড়া মনকে আঁটানো যায় ছোট্টো বর্তমানের খোপে? এই ধরো, আগামীকাল বাজারে গিয়ে এই এই কিনতে হবে, দুপুরে এই এই রাঁধতে হবে, আহ কী চমৎকার স্বাদ হবে — এইসব তো যাকে বলে নিত্যকর্মের মতন করতে হয় আমাদের। তারপরে ধরো ফোড়ন দেবার সঙ্গে সঙ্গে একটা চমৎকার গন্ধ পাওয়া মাত্রই মনে পড়ে গেল সে‌ইইই কতকাল আগে বন্ধুর সঙ্গে চড়ুইভাতির রান্না, বাগানে ইঁট দিয়ে উনুন সাজিয়ে ভেতরে শুকনো পাতার জ্বালানি... এইসব ব্যাপারগুলো তো অহরহ চলতে থাকে। আমি তো মনকে কিছুতেই আঁটাতে পারি না অল্প কালখন্ডে, ও এদিক ওদিক লাফিয়ে বেড়ায়, অতীতে আর ভবিষ্যতে।পাতা-১৭৩৬৬- dc- ২.৬.২৪ - ০৭:২৩ছোটবেলায় আমরা যেভাবে দেখি, বড়ো হলে সেই দেখাটা পাল্টে যায়। তার চেয়ে বরং মনের মধ্যে সেই স্মৃতি থেকে যাওয়া ভালো। 
    আমরা কি মাঙ্গলিক?  - Mani Sankar Biswas | কোনো কোনো বিজ্ঞানীর ধারণা যে মঙ্গল গ্রহ থেকেই পৃথিবীতে উল্কাবাহিত হয়ে প্রথম প্রাণের রেণু এসে পড়েছিল। হাইপোথিসিসটি কয়েকটি দৃঢ়বদ্ধ যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে: যে পলিমারগুলির উপর ভিত্তি করে প্রাণের উদ্ভব, প্রোটিন, আরএনএ এবং ডিএনএ, সেগুলি তৈরি হতে গেলে, যা থেকে এটা তৈরি হয়েছে, সেটাকে ডিহাইড্রেটেড হতেই হবে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে হাইড্রোজেন আয়ন (H+) এবং হাইড্রক্সিল (OH−) আয়ন বা জল বেরিয়ে না গেলে প্রোটিন তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।এর মানে হল যে অন্তত কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া যা প্রাণ বা জটিল যৌগগুলিকে প্রাণের উদ্ভবের দিকে পরিচালিত করেছিল, তা অবশ্যই শুকনো জমিতে ঘটেছে।কিন্তু আমরা যতদূর জানি, শুরুর দিকে পৃথিবীর সবটাই ছিল জলে টইটম্বুর। সুতরাং ধারণা করা যায় এই রকম পলিমারগুলি প্রথম এমন একটা জায়গায় তৈরি হয়েছিল, যেখানে জল-স্থল উভয়ই পাশাপাশি ছিল। সত্যি বলতে কী, এরকম পরিবেশ ছিল মঙ্গলগ্রহেই, পৃথিবীতে নয়। এই বিষয়ে পথিকৃৎ গবেষক অধ্যাপক স্টিভেন বেনার (Steven Benner) বলেন: “শুধুমাত্র মলিবডেনাম যখন উচ্চমাত্রায় অক্সিডাইজড হয়ে যায় তখনই তা প্রথম দিকে যে ভাবে জীবন সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।”মলিবডেনামের এই অতি উচ্চমাত্রায় অক্সিডাজড রূপটি পৃথিবীতে সম্ভবই ছিল না, কারণ তিন বিলিয়ন বছর আগে, পৃথিবীতে অক্সিজেন ছিল না বললেই চলে, কিন্তু মঙ্গলে ছিল।হাইপোথিসিসটি প্রমাণের এটি আরেকটি অংশ যা ইঙ্গিত করে এই গ্রহে পৃথিবীতে প্রাণ আসার আগে, প্রাণের আবির্ভাব হয় মঙ্গলগ্রহে।অধ্যাপক বেনার আরও বলেন যে, বোরন এবং মলিবডেনাম ধারণকারী খনিজপদার্থগুলিই ছিল এক্ষেত্রে চাবিকাঠি, বিভিন্ন প্রকারের অণুগুলিকে একত্রিত করে ‘প্রাণশক্তি’-পূর্ণ পলিমারগুলি তৈরিতে।পৃথিবীতে যেভাবে যেরকম জীবন শুরু হয়েছিল তার জন্য এটাও একটা জটিলতর সমস্যা তৈরি করে, কেননা সেই ৩/৩.৫ বিলিয়ন বছর আগের আদিম পৃথিবীতে এরকম রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বোরন এবং মলিবডেনাম সমৃদ্ধ খনিজপদার্থ ছিল না।এই সব তথ্য ও উপাত্ত ‘প্রমাণ’ করে মঙ্গল গ্রহ থেকে ছিটকে আসা দু’একটা উল্কা, উল্কাবাহিত আদিম প্রাণ বা ‘প্রাণবীজ’ অনেক পথ অতিক্রম করে হয়ত পৃথিবীতে এসে পড়েছিল এবং পৃথিবীতে আসা পর্যন্ত জীবিত ছিল।সুতরাং পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব যদি সত্যি এরকম ভাবে হয় তাহলে সেটা আমাদের সকলকে একরকম মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা প্রাণের বংশধর করে তুলবে।এবং অনেকেই জানেন, বিজ্ঞানীরা মানব সভ্যতাকে আবার মঙ্গলে নিয়ে যেতে চাইছেন। তাহলে পুরো বিষয়টা দাঁড়াল এরকম, যে মঙ্গল থেকে কিছু পলিমার উল্কাবাহিত হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়েছিল এবং সেখান থেকে তৈরি হল প্রথম প্রোক্যারিওটিক সেল। বা প্রথম লাইফ ফর্ম। আর আজ তার অনন্ত গুণ জটিল হয়ে প্রাণ আবার ফিরে যাচ্ছে মঙ্গল গ্রহেই!এই ভাবনার প্রতিটা পরত এতটাই অলৌকিক, প্রাণের প্রতিটি উল্লম্ফন এতটাই বিস্ময়কর, যে এটা ভেবে যে পাগল পাগল বোধ করবে না, সে আসলে বিষয়টি কিছুই বোঝেননি। সোর্স:https://www.space.com/22577-earth-life-from-mars-theory.htmlhttps://www.bbc.com/news/science-environment-23872765
    স্মৃতির রাজ্য শুধুই শ্লোগানময়-২ - প্রবুদ্ধ বাগচী | স্মৃতির রাজ্য শুধুই শ্লোগানময়-২প্রবুদ্ধ বাগচী       আশির দশকের একেবারে শেষপর্বে এসে রাজ্যের ও দেশের রাজনীতির ইস্যুগুলোই পাল্টে যায়। বোফর্স কামান কেনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রাজীবের নাম যুক্ত হয়ে যাওয়া যদি একটা পর্ব হয় তবে আরেকটা প্রান্ত হল মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে দেশে দলিত ও পিছড়েবর্গ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নতুন এক ভোট রাজনীতি। দুটো বিষয়ই সামনে এনে সেই সময় মিডিয়ার নজর কেড়ে নিয়েছিলেন রাজীব মন্ত্রীসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মণ্ডার রাজা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ওরফে ভিপি। কার্যত “পিছড়েবর্গ” এই শব্দটা তখন দেশের রাজনীতিতে নতুন পরিভাষা হিসেবে উঠে এল। আরও দুটো বিষয় এখানে বলতে হবে। একটা হল এই মণ্ডল রাজনীতি-র মূল কেন্দ্র ছিল দেশের তফশিলী জাতি ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণি যারা উচ্চবর্ণের হিন্দুজনগোষ্ঠীর বাইরের মানুষ। এই শ্রেণির দ্রুত মূল রাজনীতির স্রোতে উঠে আসা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দল হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টি সুনজরে দেখেনি। প্রধানত হিন্দি বলয়ে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক রক্ষার জন্য তাঁরা সরাসরি এই মণ্ডল রাজনীতির বিরোধিতা করে সংরক্ষণ-বিরোধী অবস্থান নিলেন —- খবরের কাগজের ভাষায় এর নাম হল ‘কমণ্ডলু’ রাজনীতি, যার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি ও তার কিছু বাছাই সহযোগী যাদের আর দু-তিন বছরের মধ্যেই আমরা দেখতে পাব আরও আরও হিংস্র ভূমিকায়। এদের উস্কানিতে কিছু বর্ণহিন্দু ছাত্র নিজেদের গায়ে আগুন দিয়ে বিষয়টাকে আরও তীব্রতর করে। তবে সবথেকে কুৎসিত ও অপমানজনক ঘটনা হল এদেরই ছাত্রযুব সংগঠনের কর্মীরা পিছিয়ে পড়া মানুষকে সংরক্ষণের আওতায় আনার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাস্তায় জুতো পালিশ ও জুতো সারাই করতে বসে যান চর্মকার-সম্প্রদায়কে বিদ্রূপ করে। আজকে সারাদেশেই যখন পিছিয়ে পড়া জাতির মানুষকে সামাজিক শারীরিক ও আর্থিক হিংসার শিকার হতে দেখি আমরা তখন হয়তো মিলিয়ে নেওয়া যায় আসলে তার শিকড় কোন গভীরে ঢুকে বসে আছে।       রাজ্যের রাজনীতিতে এই মন্ডল-প্রসঙ্গ ততটা উচ্চকিত হতে পারেনি কারণ বামফ্রন্টের আমলে মনে করা হত এরাজ্যে জাতের বিচার তেমন কিছু একটা বিষয় নয়, এখানে শ্রেণির অবস্থানই প্রধান। কিন্তু ‘কমণ্ডলু’র রাজনীতি যে একটা দুর্যোগের আশঙ্কা ডেকে আনছে এটা কুশলী বামনেতৃত্ব কেউ কেউ বুঝেছিলেন। তা নিয়ে কিছু দেওয়াল লিখন যে হয়নি তা নয় । তাদের  আহ্বান  ছিল,  ‘বিজেপির  সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাস্ত করুন’ এই ধরনের —-- নিজেদের আদর্শগত কাজ কেন তাঁরা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছিলেন তা অবশ্য খুব স্পষ্ট ছিল না। বরং তাদের সামনে অন্য একটা ঘোর বিপর্যয় এসে পড়ল সোভিয়েতের পতন ও তার প্রতিক্রিয়ায় তথাকথিত সোস্যালিস্ট ব্লক ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, দেশের ও রাজ্যের তাবড় তাবড় বাম তাত্ত্বিক নেতারা ওই দেশগুলির ভিতরের প্রকৃত ‘খবর’ রাখতেন না। দলীয় সফরে সোভিয়েট বা অন্য দেশে এঁরা অনেকেই গেছেন কিন্তু যেহেতু তাদের অনেকটাই ‘সাজানো বাগান’ দেখানো হয়েছিল তাই অন্দরের বার্তা তাঁরা পড়তে পারেননি। এই কথাটা বলছি আরও এই কারণে, এই সময়েই কিন্তু আমরা শহরের নানা জায়গায় দেওয়ালের লিখন দেখেছি — ‘মার্কসবাদ সত্য কারণ এটি একটি বিজ্ঞান’ বা ‘পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ সমাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্রই শেষ কথা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা ঠিক, সোভিয়েতের ‘পতন’ হওয়ার সঙ্গে মার্কসবাদ ‘অসত্য’ প্রতিপন্ন হওয়ার কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু পূর্ব ইউরোপের একেকটি দেশের করুণ বিপর্যয় দেখে বামমহলে একটু আড়ষ্ট কানাকানিও চলছিল —- আসলে ওই দেশগুলিতে বোধহয় প্রকৃত অর্থে সোশ্যালিজম ছিল না ! তাহলে তাঁরা দুনিয়ার তিনভাগের একভাগ ‘সমাজতন্ত্রের দখলে’ বলে দেওয়াল লিখেছিলেন কেন, এর জবাব তাঁরাই দিতে পারেন।          কথায় বলে বিপদ কখনো একা আসে না। রাজ্যের তথা দেশের বামপন্থীদের সামনে ঠিক এর পরের দশকের গোড়াতেই মুখোমুখি হতে হল, দুটো নির্দিষ্ট বিষয়ে যার জন্য তাঁরা কতটা প্রস্তুত ছিলেন জানা নেই।  শরিক দলগুলির নিজেদের অন্তঃকলহে কেন্দ্রের স্বল্পস্থায়ী জোট সরকারের পতন প্রায় অনিবার্য ছিল, ভিপি সিং সরকারের ওপর যে বিজেপি সমর্থন তুলে নেবে সামগ্রিক পরিস্থিতি সেদিকেই ইঙ্গিত করছিল, ঘটলও তাই। এর পরে লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই ঘটে গেল রাজীব গান্ধির মর্মান্তিক হত্যাকান্ড। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস দল স্থায়ী সরকারের সমর্থনে প্রচুর দেওয়াল লিখেছিলেন — ‘কেন্দ্রে স্থায়ী সরকার গড়তে কংগ্রেসকে ভোট দিন’, দেওয়ালে নতুন এক শব্দের জন্ম দেখলাম আমরা — ‘খিচুড়ি সরকার’ ।  তাঁরা  রাজীবজির  ফিরে আসা ও নতুন সরকার গড়ার স্বপ্নও দেখিয়েছিল —-- হায়, তাঁরা জানতেন না অমন তরতাজা মানুষটা কীভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন মানববোমার আঘাতে। জনগণেশের ইচ্ছেয় সেবার অবশ্য প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিনহা রাওয়ের নেতৃত্বে সরকার গড়লেন কংগ্রেস দল, তবে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার জন্য বাইরের কিছু সমর্থন অবশ্য দরকার হয়েছিল। তখন দেশে উঠে আসছে নতুন বিরোধী শক্তি ভাজপা, বাবরের নামাঙ্কিত মসজিদের জায়গাতেই তাঁরা নতুন রামমন্দির তৈরি করার নামে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে দেশের। আর একই সঙ্গে দেশের নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিনহা ঠিক সেই সময়েই দেশের অর্থনীতিকে ভাসিয়ে দিলেন খোলা হাওয়ায়। সাবেকি পরিকল্পিত অর্থনীতির ‘নেহেরু মডেল’ সেই প্রথম ধ্বস্ত হল এক শিখ প্রৌঢ়ের হাতে। এ এমন সর্বনেশে হাওয়া যা আমূল বদলে দিতে লাগল এতদিনের চেনা অবয়ব।      রাজ্যের দেওয়ালে দেওয়ালে গর্জে উঠলেন বামপন্থীরা। নতুন স্লোগান এল ‘খোলা বাজারি অর্থনীতি মানছি না, মানব না’, বলা হল ‘সরকারি ক্ষেত্রে ঢালাও বেসরকারিকরণ রুখতে হবে’, ‘লাভজনক সরকারি সংস্থার হস্তান্তর চলবে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রতিটি দাবিই ছিল ন্যায্য, কিন্তু রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার তখন কেন্দ্রের শরিক নন ফলে সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করার মতো অবস্থায় তাঁরা ছিলেন না। অন্যদিকে ধীরে ধীরে বাম- রাজনীতির পাশে পাশে ইতিউতি দেখা যেতে লাগল ‘কমল’ চিহ্নের পায়চারি। সম্ভবত, আদবানি ‘রাম-রথ’ তৈরি করে দেশ পরিভ্রমণে বেরোলেন এর কাছাকাছি সময়েই। ইতিমধ্যে বিজেপি উত্তরপ্রদেশের বিধানসভায় ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে। ‘রাম রাজনীতির’ হাত ধরে উঠে এল কিছু নতুন শব্দ আর স্লোগান —- ‘রাম-শিলা’, ‘ করসেবা’ এবং খুব ব্যঞ্জনাবহ ‘সিউডো সেকিউলার’ বা ‘মেকি ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ ।  দেওয়ালের  দখল তাঁরা যে খুব একটা নিতে পেরেছিলেন এমন নয় তবে ‘মন্দির ওহি বানায়ঙ্গে’র মতো হিন্দিভাষী স্লোগান সেই প্রথম ঢুকে পড়ল বাংলা বাজারে পরে যাকে আরো স্তরে স্তরে বিকশিত হতে দেখব আমরা। একই সঙ্গে ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ নামক এক শব্দও খুব কায়দা করে ভাসিয়ে দেওয়া হল দেশভাগের প্রত্যক্ষ শিকার এই রাজ্যে। বামপন্থীরা যে নীরব ছিলেন তা নয়। তাঁরা আওয়াজ তুলছিলেন ‘সাম্প্রদায়িক বিজেপি বাংলা থেকে দূর হঠো’ বা  কবি সুকান্তের কবিতাংশ ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি/ বুঝে নিক দুর্বৃত্ত’। এই সময় কার্যত দুটো ফ্রন্টেই লড়ার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা — নতুন অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে একদিকে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত —- তখন তাঁরা দুই পক্ষ থেকেই সমদূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। কেন্দ্রীয় ‘সর্বনাশা’ আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে তাঁরা কত যে বনধ ডেকেছেন তা আর বলার নয় —- এইসব হরতালের পক্ষে প্রচারে ছিল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিনহার আদ্যশ্রাদ্ধ। তাঁরা একরকম নামই দিয়েছিলেন ‘মনমোহিনী অর্থনীতি’, তাঁকে ‘বিশ্বব্যাঙ্কের দালাল’, ‘মার্কিন পুঁজির চৌকিদার’ ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়েছে বারবার, এমনকি নিজেদের স্বার্থেই আই এম এফ যে তাঁকে দেশের অর্থমন্ত্রী করেছেন এই অপবাদও দেওয়া হয়েছে। এগুলির সত্যাসত্য বিচার করার কোনো পরিসর এখানে নেই। কিন্তু এইসবের মধ্যেই আদবানির ‘রামরথ’ এসে পড়ল রাজ্যের সীমানায়। প্রচারমাধ্যমের বিপুল আলো এবং দাঙ্গার উস্কানির সামনে কিছু স্লোগান তৈরি হল উভয়পক্ষেরই। স্বভাবত ভাজপার স্লোগানে ছিল উগ্র ঝাঁঝ —- ‘এক ধাক্কা আউর দো/ উস ধাঁচা কো তোড় দো’ র আড়ালে ছিল বাবরের নামাঙ্কিত মসজিদ ভেঙে ফেলার প্ররোচনা। রাজ্যের বামফ্রন্ট সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার আহ্বানে দেওয়াল লিখলেন, স্লোগান দিলেন, মিছিল করলেন, তৈরি করলেন মানববন্ধন। তবে আদবানির রথ-কে, যাকে ডাকা হত ‘দাঙ্গা রথ’ বলে, কিন্তু এই রাজ্যে ঠেকানো গেল না —-- তিনি গড়িয়াহাটার মোড় দিয়ে রথ নিয়ে সভা করতে করতে এগোলেন আসানসোল পেরিয়ে বিহারের দিকে। আর পিছড়েবর্গের প্রতিনিধি হিসেবে যে লালুপ্রসাদ যাদব কে উচ্চবর্ণ ‘লালু লালু’ বলে ব্যঙ্গ করত,  বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েও সেই তিনিই আদবানির রথ আটকে তাঁকে বন্দি করে পাঠিয়ে দিলেন সরকারি অতিথিশালায়। এটা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে একটা বড় রাজনৈতিক ইভেন্ট। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু মনে করেছিলেন রথ আটকালে বিজেপি বেশি প্রচার পেয়ে আরও গোলমাল করবে, সত্যিই তেমন কোনো বড় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ রাজ্যে হয়নি, তার কৃতিত্ব নিশ্চয়ই বামপন্থীদের প্রাপ্য।      তবে এখানে এটাও বলা দরকার, এর পরের পর্বে যখন ‘রামমন্দির আন্দোলন’ আরও তুঙ্গে উঠল তখন কিন্তু রাজ্যের উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর একটা অংশ তাদের এতদিনের বামপন্থী অবস্থান পরিবর্তন করে কিছুটা হলেও ‘রামপন্থী’দের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। এটা দেখা গেল যখন ‘রামশিলা’ নামক ইট নিয়ে দলে দলে মানুষ ছুটলেন অযোধ্যায়। এই ‘করসেবা’র আহ্বানে কিছু দেওয়াল লেখাও চোখে এসেছিল সেই সময়। অবশেষে, বিরানব্বই এর ডিসেম্বরে ভারতের ইতিহাসের সব থেকে কলঙ্কিত অধ্যায়টির সূচনা হল পাঁচশো বছরের পুরোন মসজিদ ভেঙে ফেলার মধ্যে দিয়ে। দেশের প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও রইলেন নীরব দর্শক আর উত্তরপ্রদেশের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই ধ্বংসলীলায় উৎসাহ দিলেন —- একই ছবির ফ্রেমে দেখা গেল আদবানি, মুরলি মনোহর জোশি, উমা ভারতী প্রমুখ উগ্রবাদী ষড়যন্ত্রীদের। এই আগুন নিয়ে খেলার পরেই ঘোষিত হল তাদের নতুন স্লোগান : ইহে তো কেবল ঝাঁকি হ্যায়/ কাশি মথুরা বাকি হ্যায়। এই অসম্ভব এক উত্তেজনার মুহূর্তে কলকাতা শহরেও যখন ফুলকি ছড়াচ্ছে আগুনের, রাজধানীতে শুরু হয়েছে সেনার রুট মার্চ — ঠিক তখনই উঠে এসেছিল কিছু নিজস্ব স্লোগান। বামপন্থীরা সেই সঙ্কট মুহূর্তে হয়তো দেওয়াল লেখেননি কিন্তু স্লোগান তুলেছিলেন : ‘মানুষ আগে ধর্ম পরে / ধর্ম কেন মানুষ মারে ?’ —- বাস্তবিকই সারাদেশ তখন জতুগৃহ যার আগুনে লাশ গুণে গুণে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছেন হিন্দুত্ববাদীরা। এই সময়েই জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কর্মী ও কবি সজল রায়চৌধুরীর একটি গানের কিছু অংশ : ‘হাতে হাত রেখে পার হব এই বিষের বিষাদসিন্ধু/ দুশমনদের ফাঁদে কেন বলো পড়ব’। এরই পাশাপাশি লালনের সুবিখ্যাত গান ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত, সংসারে/ লালন বলে, জেতের কী রূপ দেখলেম না এই নজরে’ বা রবীন্দ্রনাথের পরিচিত কবিতার লাইন ‘ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে’ সংহতির মিছিলে নতুন করে প্রাসঙ্গিক হতে থাকে। এইটাই বোধহয় বাঙালির সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য যে জাতির কঠিন সময়ে কান্ডারী হয়ে এগিয়ে আসে আমাদের কবিতা গান নাটক ছবির সুমহান ঐতিহ্য। আজও যারা বাংলার বুকে মন্দির-মসজিদ আর হিন্দু-মুসলমান করছেন তাদের নিরেট মগজে এই সত্যিটা যদি একবারও প্রতিফলিত হত !     স্থায়ী সরকারের ধুয়ো তুলে কংগ্রেস কেন্দ্রের ক্ষমতায় এলেও তাঁদের প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও ছিলেন ভীরু ও দুর্বলচিত্ত। ফলে নব্বই দশকের মাঝামাঝি যে নির্বাচন হল তাতে খুব স্পষ্ট রায় তাঁদের পক্ষে গেল না। আবার সেই মিলিজুলি সরকারের হাতে চলে গেল দেশ। প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে রেষারেষি এল প্রকাশ্যে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী  জ্যোতিবাবুর কাছে প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব এল এবং তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। বামফ্রন্টের সঙ্গে তখনও কংগ্রেসের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায় ফলে রাজ্যের ভোটে সেবারও হই হই করে জিতে গেল বামেরা। কিন্তু এই ডামাডোলের বাজারে আসলে গোকুলে বেড়ে উঠছিল বিজেপি আর পোক্তভাবে কেন্দ্রের সরকারে আসতে গেলে যে কিছু ‘বন্ধুদল’ জুটিয়ে নেওয়া দরকার সেটাও তাঁরা বুঝেছিলেন। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বর্ণহিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে কলকে পাওয়া যাবে না। তাই তৈরি হল এন ডি এ — যার মুখ হলেন তুলনায় ‘নরম হিন্দু’ বাজপেয়ি আর শরীর হলেন উগ্রহিন্দুত্বের ‘পোস্টারবয়’ আদবানি। দেশের রাজনীতি ধীরে ধীরে সরে আসতে লাগল একটা অন্যমেরুতে , রাজ্যের পরিস্থিতিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। নিজের তীব্র ‘বাম-বিরোধী’ ইমেজ নিয়ে রাজ্য কংগ্রেসের সঙ্গে এতদিন তীব্র সংঘাতের মধ্যে দিয়ে যিনি চলছিলেন সেই যুব নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে গঠন করলেন তৃণমূল কংগ্রেস। নব্বই সালের আগস্ট মাসে ভবানীপুর থানার সামনে তার শারীরিক নিগ্রহ ঘটিয়ে বামেদের অতি উগ্র সমর্থকরা মমতার পালে হাওয়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন, তার বছর পাঁচের মধ্যে রাজ্যের নানা জায়গায় তার মেঠো আন্দোলন এবং কংগ্রেস হাইকম্যান্ড বা প্রদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর বিবাদ ছিল খবরের কাগজের নিত্যদিনের খোরাক। খুব সুচতুরভাবে তিনি তাঁর একটা ‘ফায়ার ব্র্যান্ড’  মূর্তি আলাদা করে নির্মাণ করে কংগ্রেস দলের নিবেদিত সমর্থকদের মধ্যে একটা পাল্টা ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করছিলেন। তিরানব্বই সালের একুশে জুলাই তৎকালীন যুব কংগ্রেসের আয়োজনে গণহিস্টিরিয়ার মতো তাঁর ‘রাইটার্স দখল অভিযান’  কলকাতা শহরের বুকে কয়েকটা তাজা প্রাণ কেড়ে নেয় ।  রাজ্যের পুলিশের নিশ্চয়ই উচিত ছিল গুলিচালনার আগে আরও সংযত থেকে মারমুখী জনতাকে শান্ত করা, কিন্তু ওইদিন ঘটনাস্থলের খুব কাছে থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম কীভাবে জড়ো হওয়া মানুষকে নেতানেত্রীরা উস্কানি দিয়ে খেপিয়ে তুলছেন। গুলি চালনার পরে ছত্রভঙ্গ ও ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সমর্থকদের পাশে কিন্তু কেউ ছিলেন না, স্বয়ং মমতা গিয়ে ‘নাকি’ কোনো বেসরকারি নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছিলেন, বেশ কিছুদিন আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।    তবে নব্বই দশকের প্রথমাংশ জুড়ে যেহেতু রাজ্যের প্রধান যুযুধান দুইপক্ষ ছিল বাম আর কংগ্রেস তাঁদের মধ্যে দেওয়াল দখলের যুদ্ধ আর স্লোগানের আড়াআড়ি তো ছিলই। কংগ্রেসের আর্থিক নীতি এবং বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দুইই বিদ্ধ হয়েছে তাঁদের তিরে। কংগ্রেস দলও চেষ্টা করেছে শাসক দলকে নানা অভিযোগ তুলে বেকায়দায় ফেলতে —-- বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি, মাটি কেলেঙ্কারি, ট্রেজারি কেলেঙ্কারি এইসব নানা ইস্যু বারবার উঠেছে জনপরিসরে, সংবাদমাধ্যম খবর করেছে ।  কিন্তু এগুলির খুব পাথুরে প্রমাণ কিছু ছিল না ফলে সাময়িক আলোড়নের বুদবুদ তুলে এগুলো মিলিয়েও গেছে নিজের নিয়মে। মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র চন্দন বসুও কখনো কখনো শিরোনামে এসেছেন, প্রশ্ন উঠেছে তার সম্পত্তি নিয়ে —-- কংগ্রেস দেওয়াল লিখেছে ‘বামফ্রন্টের দুটি অবদান নন্দন আর চন্দন’।  জ্যোতিবাবুর মতো প্রবল ব্যক্তিত্বের জন্যও বরাদ্দ হয়েছে বেঙ্গল ল্যাম্প ‘কেলেঙ্কারি’ নিয়ে কার্টুন, প্রশান্ত শূরের সঙ্গে মিশেছে জমি ‘কেলেঙ্কারি’ আর একদা জ্যোতিবাবুর আপ্ত সহায়ক তথা আলিপুরের বিধায়ক অশোক বসুকে যুক্ত করা হয়েছে ‘ট্রেজারি কেলেঙ্কারি’ র সঙ্গে। তবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল অভিযোগ ছিল প্রদেশ কংগ্রেসের মাথারা সিপিএমের সরকারের প্রতি ‘নরম’ —- কথাটা একদম ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। সম্প্রতি উত্তর কলকাতার গৌরিবাড়ি এলাকার একদা প্রতাপান্বিত কংগ্রেস বাহুবলী হেমেন মণ্ডল বলেছেন ওই সময়ে প্রদেশ কংগ্রেস ছিল সিপিএমের ‘রক্ষিতা’। এর ফলাফলে আর যাই হোক মমতা একটা নতুন প্ল্যাটফর্ম পেয়ে যাচ্ছিলেন সেটাকেই তিনি ব্যবহার করে গড়ে নিলেন তার নতুন দল। এবং অচিরেই কংগ্রেসের ডি এন এ নিয়ে তিনি হাত ধরলেন বিজেপির—- এন ডি এ নামক যে জোট ১৯৯৮ সালে নির্বাচনে গেল ও জিতে নিল লোকসভা সেখানে তার দল হল প্রধান শরিক এবং মমতা নিজে হাই-প্রোফাইল মন্ত্রী।        কার্যত, এখান থেকেই নব্বই দশক দেখা দিল রাজনৈতিক বিচারে রাজ্য রাজনীতির নতুন নিদর্শ হিসেবে। সেই প্রথম ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’ স্লোগান দিয়ে মমতার দল বেশ কিছু আসন পেলেন এবং সিপিএমের দুর্গ বলে পরিচিত কিছু এলাকায় বিজেপি নিজেদের সাংসদকে জিতিয়ে নিতে পারল ও কেন্দ্রে মন্ত্রীও করল। জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, মমতার সব থেকে বড় অপরাধ খাল কেটে কুমির আনা (অর্থাৎ বিজেপিকে বাংলায় ডেকে আনা) —-- আজকের মাটিতে দাঁড়িয়ে যখন দেখা যাচ্ছে বিজেপির মতো বিভেদকামী শক্তি বাংলার মাটিতে পোক্ত ভিত গড়েছে তখন এই সমালোচনা ভুল ছিল বলে মনে হয় না। এটাও ঠিক মমতার সাংগঠনিক সাহায্য ও রাজনৈতিক মদত ছাড়া বিজেপি এখানে তাঁদের ঘাঁটি শক্ত করতে পারত না। তবে পাশাপাশি এটাও ঠিক মতাদর্শের দিক দিয়ে একেবারে বিপরীতপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বামপন্থীরা নিজেদের সদস্য সমর্থকদের অন্তরমহলে যদি উদার মনোভাবের চেতনা জাগরূক করে রাখতেন তাহলে দক্ষিণপন্থার এতটা উত্থান হতে পারত না, সবটাই মমতার দিকে দায় চাপিয়ে তাঁরা তাঁদের ভূমিকা উপেক্ষা করতে পারেন না। নব্বইয়ের প্রান্তভাগে যখন শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে তখন রাজ্যের কংগ্রেস প্রায় স্তিমিত, প্রবল বামপন্থা কিছু শিথিল ও বামফ্রন্ট সরকারও রাজ্যে কুড়ি বছর রাজত্ব করে ফেলেছে। কট্টর বাম-বিরোধী কংগ্রেসিরা ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে মমতার দলে ভিড়েছেন ও এন ডি এ-র নৌকায় চেপে তাঁর রাজনীতির  দুর্বার গতি একটা বার্তা দিতে পারল। মূল কংগ্রেসি স্রোতের বাইরে স্বতন্ত্র দল করে রাজ্যে রাজ্যে অন্য গোষ্ঠীগুলি যখন হতোদ্যম তখন বাংলায় কংগ্রেস-ছুট হিসেবে তিনি সফল। আগামী শতকে এই দিক বদল ধীরে ধীরে নির্ণায়ক হবে বাংলার রাজনীতির। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আশঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে বাম ও কংগ্রেস কেন্দ্রীয় স্তরে ক্রমশ কাছে আসছে, যদিও রাজ্যে তার প্রত্যক্ষ ছাপ আবছায়া কারণ বাংলায় কংগ্রেসের সব আলো শুষে নিয়েছেন মমতা, তার ছায়া লম্বা হচ্ছে। শতাব্দী শেষ হল দেওয়ালে আদবানি বাজপেয়ীর ছবির পাশে ততদিনে ‘দিদি’ হয়ে ওঠা মমতার ছবি দিয়ে, প্রকাশ্য হল তীব্র বাম বিরোধী স্লোগান। জ্যোতি বসু রাজ্যের রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন। বাংলার রাজনীতি বাংলার দেওয়াল সেজে উঠল নতুন নতুন শব্দে বিচিত্র অক্ষরে পাঁচমিশেলি বার্তায়। 
  • জনতার খেরোর খাতা...
    ভোট ও “সমস্যার” ভোটকর্মী - Aditi Dasgupta |  জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নির্বাচন গতকাল.....?.... সাঙ্গ হলো। রাজনৈতিক দল ও ভোট দানকারী র তুলনায় অনেকটাই ফ্যাকাশে আলোয় ভোট কর্মীরা যাঁদের অমানুষিক পরিশ্রম ছাড়া এই রঙ্গ সম্ভবই হতনা। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ মহিলা। পিঠে নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যাগ,সাথে ভারী ভারী ভোট মেশিন ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে এদের হেঁটে যেতে দেখা গেছে, অপেক্ষা করতে দেখা গেছে, খবরের কাগজের ছবিতে খুব ছোট্ট করে।খবর তেমন কিছু তেমন চোখে পড়লো কই?কোনো প্রতিবেদনতো দূরের কথা! সমতার দাবী যারা করে তাদের সম পরিস্থিতিতে, বা অনেক সময় আরো খারাপ পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়ে এসিড টেস্ট নেবার মনোবৃত্তি তো রন্ধ্রে রন্ধ্রে! তাই মেয়েদের বিশেষ চাহিদাগুলি তো দূর অস্ত, একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণ সরকারী দায়িত্ব পালনের উপযোগী ন্যূনতম আরামটুকু দূর অস্ত -- বরং বলা যায় অমানবিক একটা পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া হলো! মিডিয়া কেবল ভোট বিশ্লেষণ এ ব্যস্ত থাকলো, ভোটে দাঁড়ানো প্রার্থীর উপর আলো পড়লো, আলোর নিচে অন্ধকার পড়ে থাকা ভোট কর্মীগুলি রাতের অন্ধকারে বা ভোর রাতে ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফিরে লুটিয়ে পড়ল বিছানায়! দৃশ্যটায় গ্ল্যামার এতটুকু নেইকো! পাশাপাশি কিছু অধিকার বোধ সচেতন নাগরিক, ঝামেলার ব্যাপারে, থাকবেননা ভেবে, শান্তিপূর্ণ ভোট কেন্দ্রেও ভোট দিতে গেলেন না। তাঁদের কথা তাঁরা বুঝুন। ভোট কর্মীরাই এখানে আমাদের মনোযোগের বিষয়। কিছু জন ভালো পরিস্থিতি পেয়েছেন। কিন্তু সেটা সেই কেন্দ্রের দায়িত্ব যাঁদের তাঁদের সুবিবেচনার ফল। আসলে এই শ্রম, যা মানসিক, কায়িক, মনস্তাত্ত্বিক --- সব কিচ্ছু মিলে একটা বিপুল অংকের বিনিময় মূল্যের দাবীদার তাকে খুব একটা সামনে না আনাই ভালো, বরং চোখের আড়ালে রেখে ভিক্ষে দেওয়ার মত একটা মজুরি দিয়ে মিটিয়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ বলে তাঁরা বিবেচনা করেন! তাই DC RC থেকে ভারী জিনিস গুলি তাঁদের ই টানতে টানতে গাড়ীতে উঠতে হয়, ভোট কেন্দ্রে পৌঁছে নানান জরুরী কাজ সারতে হয় হয়তোবা মিটমিটে আলোয়, পাখা থাকবে, এমন গ্যারান্টি কমিশন দেয়নি, বাথরুম এর বিষয়টি স্কুল বা ক্লাব এর মানবিকতার উপর ছেড়ে দিলে খরচা কম। আমার বাড়ির রজস্বলা মেয়েটি তাই বাথরুম যেতে পারেনা, আরশুলা,বিছে,জলের অপ্রতুলতার কারণে। রাতে শুয়েছে হয়তো এক দু ঘন্টা, বেঞ্চ জোড়া দিয়ে। সকাল থেকে আর কিছু খায়না সে।ভয়ে,জাস্ট ORS সারাদিন! হাঁটু মুড়ে বসতে না পারা রাঙ্গা কাকিমা সরু বেঞ্চে অতগুলি কাগজে সই করতে গিয়ে নাজেহাল।কোনো ক্রমে একটা চাপা দেবার ইট খুঁজে পেয়ে সব পেয়েছির আনন্দে ডগমগ হন। ভোর হলে দোর খুলে ৫. ৩০ এ মক পোল। তার আগে সব মেশিন গুলি চেক করা, হয়তো কোনোটিতে গন্ডগোল, সেক্টর অফিসার কে ফোন, চালু করে আবার এক দফা সিল, সই সাবুদ। এর মধ্যেই বাইরে জনতা। পোলিং এজেন্ট বা সেক্টর অফিসার এর সহযোগিতার মধ্যে অনেক সময় পারোক্ষ তাচ্ছিল্য, অথচ এই সমস্যা পাশের অন্য পুরুষ চালিত বুথ থেকেও আসছে, সেখানে মানুষ মেশিন কে দোষ দিয়ে দাঁড়িয়ে। দোষ কাকে দেওয়া হবে সেটাও অনেক সময় পূর্ব নির্দিষ্ট। ‘ফুল’ দের বর রা ভুল করে ‘ফুল’ দের ট্রেনে ফেলে অন্যের বৌ নিয়ে বাড়ি ফিরলেও তার দোষ ফুলদের ই তো হয়!অন্য সময় তারা লা পাতা, দোষ দেবার সময় কেমন সহজেই সামনে এসে হাজির হয়! তাই সামনেই অনেক সময় লিঙ্গবৈষম্য মূলক উক্তি। সংসার অফিস এক যোগে সামলানো মেয়েরা নির্বিকার, কারণ, কোন পরিস্থিতি তে কোন টা আগে সেই বোধ শিশু কাল থেকেই তাদের আয়ত্বে। যাই হোক সন্ধ্যে বেলা ভোট শেষ হয়, আবার এক দফা সিল, সই, গাড়ি তে উঠে RC, সেখান থেকে মুক্তি মিললে নিজ দায়িত্বে বাড়ি। মাঝরাত বা ভোরে বাড়ি ফেরা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার জন্য তখন অবশ্য তেমন কেউ মুখিয়ে থাকেনা, কারণ সেটুকু নজর করলে আরো অনেক কিছু মেনে নিতে হয় যে! তাকে, তার যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলা হয়। এই স্বীকৃতির আশায় তাই তারা বসেও থাকেনা, কারণ প্রতিটি মেয়েই সবার মধ্যে বাস করেও, নিজের সাথে একা একা একটা উপভোগের একটা জায়গা আগে থেকেই করে রাখে।
    হেদুয়ার ধারে - ১৩৯ - Anjan Banerjee | রাত্রি বেশ তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিল। বাড়িতে বাবা একা আছে। রান্নাও কিছু করতে হবে। অমল তো আশা করা যায় নিখিল স্যারের সঙ্গে দেখা করে কথাবার্তা বলবে। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই তো সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছন যাবে। সাগরের বাড়িতে প্রত্যেক রবিবারই যায় রাত্রি। এই রবিবার যাওয়া হল না বাড়িতে লোক আসায়। এক মাসতুতো ভাই এসেছিল সস্ত্রীক। অনেকদিন পর ওদের সঙ্গে যোগাযোগ হল। ছোটবেলার পুরণো দিনের অনেক কথা হল। ভীষণ ভাল লাগছিল ওদের সবার। ভাইয়ের বৌটিও হয়েছে খুব মিশুকে, সাদাসিধে ধরণের।সকাল থেকে দিনটা বেশ ভাল কাটল। ওরা গেল বিকেল চারটে নাগাদ।রাত্রি গ্রে স্ট্রিট ট্রামলাইনের কাছাকাছি এসে গেল। রাস্তা পার হয়ে হরি ঘোষ স্ট্রিটে ঢুকবে। ক'টা গাড়ি গেল পরপর। গাড়িগুলো চলে যাবার পর রাত্রি রাস্তা পার হয়ে হরি ঘোষ স্ট্রিটের মুখে এল। তারপর সোজা হাঁটতে লাগল, বাঁদিকে ঘুরে একটু গিয়ে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট পেরিয়ে রূপবাণীর মোড়ে পৌঁছবে। সে বাঁদিকে ঘুরতে যাচ্ছে, এই সময়ে পিছনের লোক দুটো জোর পায়ে হেঁটে রাত্রির পাশাপাশি দুজন দুদিকে চলে এল।পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে একজন জিজ্ঞাসা করল, ' দিদিমনি ক'টা বেজেছে ? 'হঠাৎ কোথা থেকে একটা লোক তার পাশে হাজির হয়ে সময় জিজ্ঞাসা করায় রাত্রি চমকে উঠল।সে ঘাবড়ে গিয়ে কি একটা বলতে যাচ্ছিল হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে।এই সময়ে কে একজন তাদের বাঁ পাশ থেকে বলল, ' ম্যাডাম আপনি যান ... টাইমটা আমি বলে দিচ্ছি ... 'রাত্রি দেখল সন্তোষ দাস বিড়ি খেতে খেতে তাদের পাশাপাশি হাঁটছে। রাত্রি তার দিকে ঘাড় ঘোরাতে সন্তোষ বিড়িটা ফেলে দিল শেষ টানটা মেরে। তারপর বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে একগাল হেসে বলল, ' আমি সন্তোষ ম্যাডাম ... সেই যে একবার ... গোয়াবাগানে ... বলছি যে আপনি যান ... টাইমটা বরং আমিই জানিয়ে দিচ্ছি ওকে ... যদিও আমার হাতে ঘড়ি নেই ... ঘড়ির কেনার পয়সা কোথায় ... হ্যাঃ হ্যাঃ ... 'রাত্রি তাড়াতাড়ি বলল, ' হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে ... পরে কথা হবে ... আমি আসছি ... '----- ' আচ্ছা ঠিক আছে ম্যাডাম... সাগরদাকে বলবেন ... '---- ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... 'রাত্রি তাড়াতাড়ি পা চালাল।ওই লোকদুটো এত চমকে গেল সন্তোষের রকম সকম দেখে যে চমক কাটার আগেই রাত্রি তাদের হাতের বাইরে চলে গেল।এবার লোকটা ক্ষেপে লাল হয়ে গেল।সন্তোষ জিজ্ঞেস করল, ' টাইম জানতে চাইছিলিস না ? তা ক'টা হলে সুবিধা হবে তোর ? 'এতে আগুনে ঘি পড়ল। সঙ্গের লোকটা দাঁতমুখ খিচিয়ে ' শালা হারামী .. ' বলে সন্তোষের বুকের জামা খামচে ধরল।প্রথম লোকটা পিছন থেকে ডান হাত দিয়ে সন্তোষের গলার কাছে পেঁচিয়ে ধরল। রাস্তার মাঝখানে পথনাটিকা শুরু হয়ে গেল। দুপাশে লোকজন জমছে।সন্তোষ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ' ওরে মিন্টু, গদাই ... কোথায় ... হাত লাগা ... 'দুজন পেটানো চেহারার যুবক, একজন লম্বা একজন বেঁটে, কোথা থেকে ভুঁইফোঁড় হয়ে এসে হাজির হল। বোধহয় একপাশের চায়ের দোকানে ভাড়ে করে চা খাচ্ছিল।' আসছি ... ' বলে চায়ের ভাঁড়ে সড়াৎ সড়াৎ করে দুটো চুমুক মেরে ভাঁড় দুটো ফেলে দিয়ে বিদ্যুৎবেগে অকুস্থলে আবির্ভূত হল।তারা অভ্যস্ত হাতে অনায়াসে লোক দুটোর কাছ থেকে সন্তোষকে ছাড়িয়ে নিল। সন্তোষ ধুলো ঝাড়ার ভঙ্গীতে তার জামাটা ঝেড়ে নিয়ে বলল, ' সাইডে নিয়ে আয়। আলাপ করতে হবে ... '।মিন্টু আর গদাই, সন্তোষের পুরণো সাগরেদ। এই চায়ের দোকানেই ঠেক। এরা দরকারে একে অপরকে সাহায্য করে থাকে। সন্তোষ সাগরের সঙ্গে ভিড়েছে জেনে তাকে একটু উঁচু নজরে দেখতে আরম্ভ করেছে এরা। সন্তোষের একটা আন্দাজ ছিল খাঁড়ার লোক কাউকে টার্গেট করতে পারে। কাজেই মিন্টু আর গদাইকে ফিট করা ছিল। তবে রাত্রি কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের দিক দিয়ে গেলে কি হত বলা মুশ্কিল। ভাগ্য ভাল, রাত্রি এই রাস্তাটা ধরেছিল রাত্রি।মিন্টু আর গদাইয়ের শারীরিক শক্তি যথেষ্ট। বলতে গেলে এই শক্তিমত্তাই তাদের একমাত্র মূলধন। সন্তোষের মতো মস্তিষ্ক এবং চাতুর্য তাদের নেই। সেই কারণে সন্তোষকে খুব মানে ওরা।মিন্টু আর গদাই লোকদুটোর কলার ধরে ঠেলা মারতে মারতে 'সাইড' -এ, মানে চায়ের দোকানের দিকে নিয়ে এল।সন্তোষ বলল, ' বস বস ... '।গদাই মিন্টু লোকদুটোকে ফুটপাথে পাতা বেঞ্চে চেপে বসিয়ে দিল। ওদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ পড়েছে।----- ' কি ... কি করলাম আমরা ? শুধু টাইমটা জিজ্ঞেস করেছি ... ' একজন বলল।সন্তোষ মুখ বেঁকিয়ে বলল, ' তাই নাকি ? তা, টাইম জিজ্ঞেস করার আর লোক পেলি না রাস্তায় ? আসল কথাটা বল ... ফলো করছিলিস কেন? '----- ' না না ... আমরা হারগিজ ফলো করিনি ... ফলো করতে যাব কেন .... আমাদের কি আছে ... আমরা তো ওই রাস্তাতেই আসছিলাম ... '----- ' ওসব বাজে কথা ছাড়। তোদের কে পাঠিয়েছে ? ঠিক ঠিক বল ... নইলে কিন্তু কপালে দুঃখ আছে। অন্য কারো চামচাগিরি করতে গিয়ে নিজের সংসারের কেন ক্ষতি করবি? '----- ' মানে ? '----- ' মানে, পঙ্গু হয়ে হোল লাইফ বিছানায় পড়ে থাকলে ফ্যামিলির ক্ষতি হবে না ? বিয়ে শাদি করেছিস তো ? 'লোকদুটো চুপচাপ মাথা নীচু করে বসে রইল। আরও তিন চারটে ছেলে ঘিরে ধরেছে ওদের। মিন্টুদের জিগরি দোস্ত টোস্ত হবে হয়ত।সন্তোষ আবার বলল, ' একটা ফালতু লোকের জন্য তোরা এত রিস্ক নিতে যাচ্ছিল কেন ? আমি তোদের শেল্টারের ব্যবস্থা করব। চিন্তা করছিস কেন? ওসব চুনোপুঁটিকে নিয়ে অত ভাবছিস কেন ? 'এইখানে লোকটার মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে গেল, ' কে চুনোপুঁটি ? চুনোপুঁটিটা কে ? খাঁড়াবাবুকে তো চেন না ... বাপের বিয়ে দেখিয়ে ছেড়ে দেবে ... 'নিজের অজান্তে বলে ফেলেই সে গুটিয়ে গেল একেবারে।সন্তোষ চোখ বড় বড় করে বলল, ' ও ... আচ্ছা ...এতক্ষণে বুঝলাম। বোঝ কারবার। তা, ম্যাডামকে কি করতে চাইছিলিস তোরা ? '----- ' কিছু না ... মানে ... '----- ' কিছু না মানে ? ম্যাডামের সঙ্গে কি ভাব জমাতে চাইছিলিস নাকি ? '----- ' কি সব বলছ ... ওসব কি আমাদের জিনিস ...----- ' তা'লে বল খাঁড়া তোদের কি করতে পাঠিয়েছে ? ' সন্তোষ চূড়ান্ত ঘা মারে।মুখ দিয়ে আলটপকা কথা বেরিয়ে যাওয়ায় টসকে গিয়ে লোক দুটো মুখ গোঁজ করে বসে থাকল।সন্তোষ দুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল।বলল, ' কিরে বলবি, না অন্য ব্যবস্থা দেখব ? 'একটা লোক মুখ তুলে দেখল সন্তোষ তার দিকে আগুনে চোখে তাকিয়ে আছে।সে মনে হয় বেশ ভয় পেয়ে গেল।----- ' কিন্তু আমাদের তো মেরে দেবে ... '----- ' আমি ওয়াদা করছি তোদের প্রোটেকশানের ব্যবস্থা করব। সন্তোষ দাস কখনও ফাঁকা আওয়াজ দেয় না ... 'লোকটা চারদিক তাকিয়ে আবার মাথা নীচু করে নিল।সন্তোষ ডানদিক বাঁদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে তার ছেলেগুলোকে বলল,' তোরা একটু সাইডে যা তো ... 'মিন্টু, গদাই সহ তিন চারটে ছেলে একটু তফাতে সরে গেল।সন্তোষ বলল, ' হ্যাঁ ... বল এবার ... '----- ' বলেছিল একটু ভড়কাতে হবে। যাতে ভয় পায়। কেন ভয় পাওয়াতে হবে কিছু বলে নি আমাদের ... '------ ' কাকে, ম্যাডামকে ? '------ ' হ্যাঁ ... '----- ' ম্যাডাম কে তা জানিস ? '----- ' না ওসব কিছু জানিনা... একদিন হেদুয়ার ওখানে দূর থেকে চিনিয়ে দেওয়া হয়েছিল শুধু। আর কিছু বলেনি।'সন্তোষের মনে হল লোকটা সত্যি কথাই বলছে।----- ' হুমম্ ...বুঝতে পেরেছি ... 'সন্তোষ কি একটা চিন্তা করতে লাগল। তারপর বলল ' তোদের নাম কি ? '----- ' বাবলু আর মজিদ। আমার নাম বাবলু ... ওর নাম মজিদ। খুব গরীব আমরা ... '----- ' হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি ... গরীব না হলে কি আর ... যাকগে ... 'বলে সন্তোষ সরাসরি চাঁচাছোলা জিজ্ঞাসাবাদে গেল।----- ' খাঁড়ার কি কাউকে মারার প্ল্যান আছে ? '----- ' আমরা অত জানলে তো হয়েই গেসল... 'এটাও সন্তোষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হল।সে বলল, ' খবর লাগা। আমাদের হয়ে কাজ কর। তোদের ফুল প্রোটেকশানের দায়িত্ব আমার। পুলিশের প্রোটেকশানের দায়িত্বও আমাদের। ওয়াদা করছি আমার মায়ের নামে। তোদের আজকেই সাগরদার কাছে নিয়ে যাব। একদম পাক্কা ... 'মজিদ আর বাবলু তাকিয়ে রইল আবেগ উত্তপ্ত সন্তোষ দাসের মুখের দিকে।( চলবে )********************************************
    জাল - সুষুপ্ত পাঠক | অনেক বিয়ার গেলা হয়েছিল। ফলে যা হয় সবাই খুব হাসছিলাম। হাসতে হাসতে মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। একটা পুরোনো বাড়ির অন্ধকাচ্ছন্ন ঘরে বিয়ারের আড্ডা। আমি ছাড়া বাকীদের তেমন চিনি না। একজন ছোলা ব্যবসায়ী ছিলেন এবছর যিনি ছোলা ডাবল দামে বিক্রি করে লাল হয়ে গেছেন। একজন মানুষের মাংস বিক্রেতা, ডাক্তার, প্রকৌশলী আর রাজনীতিবিদ। আলাদা আলাদা টেবিলে বিয়ার খেতে খেতে কি করে যেন একটা টেবিলে কখন এসে গেছি জানি না। দেখি সবাই ইয়ার দোস্তের মত হাসছি। ঠাট্টা করছি। অশ্লিল গালি দিচ্ছি। পায়ের জুতো খুলে মারার ভান করছি। সবই ঠাট্টার ছলে।আমাদের মাঝে একজন লেখক আছেন। আমাকে দেখিয়ে রাজনীতিবিদ বললেন অন্যদের। তার চোখে কী রকম একটা বজ্জাতি ছিল। ছোলা ব্যবসায়ী ঠোট দিয়ে ফড়ফড় শব্দ করল বাতাস ছেড়ে অবজ্ঞা প্রকাশ করতে।মানুষের মাংস বিক্রেতা তখন বলল, তাহলে একটা খেলা হয়ে যাক। পরীক্ষা হয়ে যাবে কে কাপুরুষ। কার কত সাহস আছে।সবাই হাসতে লাগল। আমিও। তবু ওরা পাঁচজন যেন কোথাও কোনভাবে একটা দলে। আমি একা। এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম। ওরা পূর্ব থেকেই একজোট। আমি জানতাম না।আমি রাজি। ডাক্তার বলল।আমিও। প্রকৌশলী হাত তুলে বলল।এসব তো আমাদের প্রাক্টিস আছে। জীবন নিয়ে জুয়া। আমি রাজি। রাজনীতিবিদ বললেন।ছোলা ব্যবসায়ী খুবই কনফিডেন্সের সঙ্গে বলল, আমি রাজি।সবাই আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার না করার কোন উপায় নেই। বললাম, রাজি আছি...তখন রাজনীতিবিদ তার কোমরে গোঁজা একটা দেশী পিস্তল বের করে টেবিলে রাখলেন। এখানে মাত্র একটা গুলি আছে। চেম্বারটা ঘুরিয়ে দিবো লটারির মত। যার কপালে থাকবে তার মাথায় গিয়ে ঢুকবে গুলিটা। এর মানে হচ্ছে আমাদের মধ্যে একজন আজ নিশ্চিত মারা যাচ্ছে!পাঁচজন শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগলা। কেবল আমি মুখের ঘাম মুছতে লাগলাম। তারা এমন কনফিডেন্সের সঙ্গে হাসছিল যে আমি ভড়কে গেলাম।তাহলে প্রথমে লেখককে দিয়েই শুরু হোক! মানুষের মাংস বিক্রেতা প্রস্তাব রাখলো। ইয়েস ইয়েস বলে বাকী চারজন পুরো ঘরটা কাঁপিয়ে দিলো। যেন কাঙ্খিত কারোর ফাঁসির রায়ে তারা উল্লাস করছে!আমার নেশা কেটে গিয়েছিল। ঘামছিলাম। সবাই আমার দিকে চেয়ে দেখছিল কৌতুকের চোখে। টেবিল থেকে পিস্তলটা তুলে নিলাম। মাথার বাম পাশে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে একটু সময় নিলাম। ঘরে পিনপতন নিরবতা। কেবল কয়েকটা ধূর্ত নিঃশ্বাসের উঠানামা শুনতে পাচ্ছিলাম। শেষবারের মত কিছু ভাবতে চাইলাম। আর  মাত্র একটা সেকেন্ড, এরপর আমি বেঁচে থাকবো নয়ত মারা যাবো। এরকমই একটা অনিশ্চিত জীবন সবাই কাটাই আজ যেন তার আস্তর ছাড়া নাট্যরূপ চিত্রায়িত হচ্ছে। নাহ্, শেষ সময়ে এসে এমন কিছু মনে এলো না, এমন কিছু যা চেতনা চিরতরে নিভে যাবার আগে আমি ভাবতে ভালো বাসব। কেবল বেঁচে থাকা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তবু সেই বেঁচে থাকার জন্যই এখন আমাকে টিগার চাপতে হবে। ভাগ্যচক্রে পার পেয়ে গেলে আমার জীবন নিশ্চিত। সেই জীবনের লোভেই আমি টিগার চেপে দিলাম...।খট্ করে একটা শব্দ হলো। বুলেট বের হয়নি! পিস্তল টেবিলে রেখে আমি হাঁফ ছেড়ে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিলাম।তখন ঘর জুড়ো পাঁচজনের অট্টহাসিতে সরগরম হয়ে গেলো। তারা হাসছে। যেন খুব মজার একটা নাটক দেখছে তারা।ফূর্তির সঙ্গে মানুষের মাংস বিক্রেতা পিস্তল হাতে নিয়ে বলল, এবার আমার পালা...। একটুও দেরি না করে সে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে টিগার চেপে দিলো। খুট্ করে শব্দ হলো। বুলেট বের হয়নি।হাসি আর কারোর থামছে না। রাজনীতিবিদ পিস্তল হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে টিগার চেপে দিলো।  পিস্তল টেবিলে রেখে দিলো হাসতে হাসতে। যেন তারা এই খেলায় অভ্যস্ত। যেন তারা জানে এরপর কি হবে। তেমন করে ডাক্তার প্রকৌশলী পিস্তল নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে টিগার চেযে দিলো আর অবজ্ঞায় পিস্তলটা টেবিলে শব্দ করে রাখছিল খিকখিক করে হাসতে হাসতে।ছোলা বিক্রেতা ছয় নাম্বারে। বেচারার নিশ্চিত মৃত্যু। অবধারিতভাবে এটা এখন হবেই। চেম্বার ঘুরে ঘুরে এবার একমাত্র বুলেটটি তার মাথায় বিঁধতে রেডি হয়ে আছে। ছোলা বিক্রেতার সে দিকে কোন হুঁশ নেই। সে অন্যদের গায়ের উপর হাসতে হাসতে পড়ছিল। যেন মৃত্যু খুবই কৌতুকর একটা বিষয়।ছোলা বিক্রেতা পিস্তল হাতে তুলে নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে টিগার চেপে দিলো।...খট্...কোন বুলেট বের হলো না। ঘর কাঁপিয়ে ওরা পাঁচজন হাসতে লাগলো আমার দিকে চেয়ে।অসম্ভব এটা হতেই পারে না! চিত্কার করে উঠলাম আমি।খুব সম্ভব। রাজনীতিবিদ বললেন। আমাদের দেশী অস্ত্রে এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে।কিন্তু... বাক্য শেষ করতে পারলাম না। কিছু ভেবে পেলাম না কি বলবো।কিন্তু আবার কী? মানুষের মাংস বিক্রেতা বলল, খেলার নিয়ম অনুযায়ী এবার আপনার পালা। প্রথমবার বেঁচে গেছেন বলে খেলা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। এটা চলতেই থাকবে যতক্ষণ না এখান থেকে একটা বুলেট বের হচ্ছে!কিন্তু এটা জোচ্চুরি! বললাম আমি। আমি ধরে ফেলেছি! সব চালাকি আমি ধরে ফেলেছি! এই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এই মানুষের মাংস ব্যবসায়ী, এই ছোলা ব্যবসায়ী, এই লিডার সবাই একটা সিন্ডিকেট! জোচ্চোর! সব জোচ্চোর!বেশ তাহলে খেলা ছেড়ে আপনি উঠে যান। চলে যান এখান থেকে...। রাজনীতিবিদ বললেন চিবিয়ে চিবিয়ে।হতাশায় চারদিক চেয়ে দেখলাম। সবাই আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি জানি সব পথ বন্ধ হয়ে দুটো পথই এখন আমার জন্য খোলা। হয় খেলা থেকে উঠে গিয়ে কাপুরুষ ভীতু হিসেবে সকলের চোখে বেঁচে থাকা। না হয় মৃত্যু। এর বাইরে আর কোন পথ তারা খোলা রাখেনি। তারা উল্লসিত এর যে কোন একটি আমাকে করে দেখাতে হবেই! এটাই আমার নিয়তি। এরকম নিয়তি পিস্তলের চেম্বারে অনেক আগেই তারা আমার জন্য সেট করে রেখেছে। তাদের চক্রান্ত আমি ধরে ফেলেছি... লেখক:সুষুপ্ত পাঠক
  • ভাট...
    commentঅন্য মত  | 'দেখা যাক' একটা ভিডিও দিয়েছেন মিস করে গিয়েছিলাম! 
    commentঅন্য মত  |
    আচ্ছা, মেনস্ট্রিম মিডিয়ার প্রেডিকশান নিয়ে এত হইচই, মোদীজি গদিতে বসে গেলেন বলে - আপনারা কেউ অলটার্নেট মিডিয়া ফলো করেন না? কেউ কিছু বলছেন না? জয়দীপ ভার্মার প্রেডিকশান তো খুবই আলাদা! আরো অনেকের। গুরুতে এসব দেখছি না, একটু আশ্চর্য হলাম। এমনকি সাট্টা বাজার নিয়ে আনন্দবাজারের তথ্যও অন্য মিডিয়া, ইউটিউব - এসবের থেকে আলাদা! 
    commenta | এইখানে একটা ছোট গল্পের অনুবাদ পড়েছিলাম যেখানে এক মহান দেবতা সৌর জগতের তৃতীয় গ্রহের লোকেদের পারমনবিক যুদ্ধ নিয়ে খুব আস্চর্য হলেন। খুব বিখ্যাত গল্প, কিচুতেই নামটা মনে পড়ছে না। এনি হেল্প? 
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত