এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  রাজনীতি

  • কিষেণজি মৃত্যু রহস্য - পর্ব ১১ 

    বিতনু চট্টোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | রাজনীতি | ৩১ মে ২০২৪ | ৩৯০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • জামবনির বাসু ভকত, মোহিনী ষড়ঙ্গী এবং তিন বনাম ছ’ইঞ্চি টাঙি 

    ‘কনকদুর্গা মন্দির দেখেননি? যান, দেখে আসুন একবার।’
    ‘কিন্তু আমি তো পুজো দিই না, ভক্তিও নেই তেমন।’
    ‘পুজো দেওয়ার কী দরকার? স্রেফ ঘুরে আসুন। ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের ক্লান্তিহীন রক্তাক্ত সংঘর্ষের যে ইতিহাস, তার এপিসেন্টার হচ্ছে জামবনি এবং বেলপাহাড়ি। আর এই ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কনকদুর্গা মন্দির। এই মন্দিরের পুজো, পুরোহিত, ট্রাস্টি বোর্ড সব কিছুই জড়িয়ে রয়েছে ঝাড়খন্ড পার্টির এবং সিপিআইএমের সংঘর্ষের সঙ্গে।’
     
    যাঁর সঙ্গে আমার এই কথা হচ্ছিল তাঁর নাম, পরিচয় এই লেখায় উল্লেখ করতে পারলে ভালো হোত। কিন্তু তিনি রাজি নন। কড়া শর্ত, তাঁর নাম কোনওভাবে উল্লেখ করা যাবে না। কারণ, তিনি সরকারি চাকরি করেন। চাকরি সূত্রে বহু বছর ধরে রয়েছেন ঝাড়গ্রামে। সেই নয়ের দশকের শুরু থেকে। চোখের সামনে দেখেছেন বহু ঘটনা। শুধু এটুকুই বলতে পারি, তিনি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে চাকরি করেন। তিনি যেভাবে আমাকে জঙ্গলমহলে তাঁর চাকরি জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, হুবহু সেভাবেই সেই ইতিহাস লিখব। কিষেণজি মৃত্যু রহস্য মামলায় আমার পরের সাক্ষী, নাম লেখা যাবে না এমন এক পুলিশ অফিসার।
    ‘জামবনি, বেলপাহাড়ির একদিকে বিহার। তখনও ঝাড়খন্ড রাজ্য তৈরি হয়নি। কিন্তু আলাদা রাজ্যের সেই দাবি ছিল অনেক পুরনো। আটের দশকের একদম শুরু থেকে শিবু সোরেন আলাদা রাজ্যের জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করলেন। আদিবাসী সমাজের ‘‘গুরুজি’’ শিবু সোরেন খুব তাড়তাড়ি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন এ’রাজ্যের আদিবাসীদের মধ্যেও। বিনপুরে এসে মিটিংও করলেন তিনি। মাত্র কয়েক বছর আগে রাজ্যে সিপিআইএম সরকার হয়েছে। সিপিআইএম তখন ঝাড়গ্রাম মহকুমায় দ্রুত প্রভাব, প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে মন দিয়েছে। পুরো রাজ্যের মতোই ঝাড়গ্রামেও কোনঠাসা হতে শুরু করেছে কংগ্রেস। কিন্তু বাকি রাজ্যের থেকে এখানে অবস্থাটা ছিল অনেকটাই আলাদা। শিবু সোরেন এখানে এসে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুরের খড়গপুর পর্যন্ত এলাকাকে পৃথক ঝাড়খন্ড রাজ্যে অর্ন্তভূক্তির যে দাবি তুললেন, তা বিনপুর, বেলপাহাড়ি, জামবনির আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলল। নরেন হাঁসদা ছিলেন বিনপুরের ঝাড়খন্ডি নেতা। তিনিও বাড়তি জোর পেলেন গুরুজির আন্দোলনের জেরে। এই সুযোগেরই যেন অপেক্ষায় ছিল কংগ্রেস। নড়বড়ে, দুর্বল কংগ্রেস জড়ানো লতার মতো আঁকড়ে ধরল ঝাড়খন্ড পার্টিকে। রাজ্যে দীর্ঘদিন সরকার চালানো কংগ্রেসের নিচুতলায় একটা জনভিত্তি ছিলই, আর ছিল জোতদার, জমিদারদের সরাসরি সমর্থন। কিন্তু ১৯৭৭ সাল থেকে সিপিআইএমের জমি আন্দোলন রাজ্যজুড়ে গরিব, প্রান্তিক মানুষের মধ্যে যে গণ উন্মাদনা তৈরি করেছিল, তা মোকাবিলার কোনও রাস্তা কংগ্রেসের জানা ছিল না। এই রাস্তারই হদিশ কিন্তু কংগ্রেস পেয়ে গেল ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। নির্দিষ্টভাবে বললে জামবনি, বেলপাহাড়ি, বিনপুরে। কারণ এই এলাকাগুলোতে গরিব আদিবাসীদের মধ্যে ঝাড়খন্ড পার্টি তখন ব্যাপক প্রভাব তৈরি করে ফেলেছে। আটের দশকের শুরু থেকে সরাসরি ঝাড়খন্ডিদের হাত ধরে ঝাড়গ্রাম মহকুমার দু’তিনটে ব্লকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল রাজ্যে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হতে বসা কংগ্রেসের। জোট হল ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের। বলতে গেলে রাজ্যে সিপিআইমের বিরুদ্ধে প্রথম কোনও রাজনৈতিক এবং নির্বাচনী সমঝোতার পরীক্ষাগারের নাম জামবনি, বিনপুর এবং বেলপাহাড়ি। এরপর তা আস্তে আস্তে ছড়াল আরও কিছু ব্লকে।
     
    স্বাভাবিকভাবেই ১৯৭৭ সালের পর থেকে ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সংগঠন বৃদ্ধিতে সিপিআইএম সবচেয়ে বড় বাধা পেল জামবনি, বেলপাহাড়ি এবং বিনপুরে। এবং এই বাধা ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠল রাজ্যের শাসক দল। সিপিআইএমের তখন জামবনির নেতা বাসুদেব ভকত। জামবনির চুটিয়া গ্রামে বাড়ি। মোটামুটি আটের দশকের শুরু থেকেই ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের তীব্র সংঘর্ষ শুরু হল জামবনিকে কেন্দ্র করে বেলপাহাড়ি, বিনপুরে। রোজ মারপিট, রোজ বাড়ি জ্বালানো। লাইন দিয়ে পরপর ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থক গরিব মানুষের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া ছিল সিপিআইএমের মূল মোডাস অপারেন্ডি। নাম বলব না, কিন্তু পরে সিপিআইএমের এক বড় নেতাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘আপনারা বিরোধীদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন কেন? এই জিনিস তো আগে কখনও ছিল না। রাজনৈতিক মারপিট, খুনোখুনি দেখেছি, শুনেছি, কিন্তু লাইন দিয়ে গরিবের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কারণটা কী?’’
    ওই সিপিআইএম নেতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। বলেছিলেন, ‘‘গরিব মানুষের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে সে নিজে থেকে আর তা তৈরি করতে পারবে না। সাহায্যের জন্য তাকে যেতে হবে পঞ্চায়েত অফিসে। আর পঞ্চায়েত তো চলে আমাদের পার্টি অফিস থেকে। বাড়ি বানানোর জন্য পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা দিত পার্টি, কিংবা অন্য কোনওভাবে সাহায্য করত। তার বদলে শর্ত একটাই, ঝাড়খন্ড পার্টি করা যাবে না। সিপিআইএম করতে হবে।’’
     
    শাসক দলের এই কৌশল শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি বিরোধীদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া সমর্থন আদায়ের কোনও ট্যাকটিকাল লাইনও হতে পারে।’ টানা বলে থামলেন ওই অফিসার। 
    সাংবাদিকতার সূত্রে বাংলার বহু গ্রামে গিয়েছি ১৯৯৮ সাল থেকে। অনেক নির্বাচন নিজের চোখে দেখেছি। দেখেছি রাজনৈতিক একাধিপত্য কাকে বলে। দেখেছি বিরোধী শূন্য নির্বাচন কিংবা বিরোধী এজেন্টহীন শয়ে শয়ে বুথের ভেতরের ছবিও। সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস, দুই জমানাতেই। রাজনৈতিক মারপিট, সংঘর্ষ, খুনোখুনির ঘটনাতেও গিয়েছি অনেক। কিন্তু রাজনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, বিরোধী মনোভাবাপন্ন গরিব মানুষকে নিজের দলে টানতে শাসক দলের কৌশলের যে বিবরণ মেদিনীপুরে দীর্ঘ দিন কাজ করা এক পুলিশ অফিসার আমাকে দিলেন, তা আমার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। অথচ বিরোধীদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা তো রাজ্যের বহু জায়গায় আমি দেখেছি, নন্দীগ্রামেও দেখেছি। কিন্তু এই মডেলের আঁতুড়ঘর কোথায়, কবে, কীভাবে, তার কোনও আইডিয়াই ছিল না আমার। কোনওদিন ভাবতে পারিনি এমন কৌশলও মানুষের মাথা থেকে বেরোতে পারে! অবশ্য মানব সমাজেই তো এমন রাজত্ব চলে, যাকে বৈধতা দিতে আমরা তার একটা নামও দিয়েছি, ‘জঙ্গলের রাজত্ব’৷ যদিও এলাকা দখলের জন্য এমন নৃশংস হিংসা-প্রতিহিংসা জন্তু, জানোয়াররা প্র্যাকটিস করে না। 
    ওই পুলিশ অফিসারের কথা শুনে ভাবছিলাম, এ তো এক অদ্ভুত মডেল। গরিব মানুষকে বিপদে ফেলে, সর্বস্বান্ত করে, আবার তাকেই কিছু পাইয়ে দেওয়া। আর এই পাইয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে দিন দিন ধরে একটা সিলেক্টিভ বেনিফিশিয়ারি শ্রেণি তৈরি করা। মোদ্দা কথা, মানুষকে সব সময় পার্টির ওপর নির্ভরশীল রাখতে হবে। কখনও বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা দিতে হবে। বার্ধক্য ভাতা, জব কার্ড, বেকার ভাতা, একশো দিনের কাজের তালিকা, আরও কত কী…। হাসপাতালে ভর্তি থেকে স্কুলে অ্যাডমিশন, মানে পার্টি অফিস। এগুলো কিন্তু একদম বেসিক। এর পরের ধাপ চাকরিতে পার্টির সুপারিশ। তারও পরের ধাপ নিজের লোককে সরকারি প্রকল্পের কাজে ঠিকাদারি পাইয়ে দেওয়া। এই যে নানান শ্রেণির মানুষের হাড়ে-মজ্জায় কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি করে একটা আপাদমস্তক সুবিধেভোগী সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করার মডেলের উৎস সন্ধানে বহু ভেবেছি। ভেবেছি, কবে, কীভাবে শুরু হয়েছিল এই ব্যবস্থার, যেখানে অধিকাংশ মানুষ মনে করতে শুরু করেছিলেন, প্রশাসন তুচ্ছ। পার্টিই সব। পার্টির সঙ্গে থাকলে সব মিলবে। বদলে নিঃশর্ত আনুগত্য ছাড়া পার্টি চাইবেও না কিছু। আটের দশকের মাঝামাঝি জামবনি কিংবা বিনপুরের গরিব ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থকের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে তারই জন্য ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন সিপিআইএমের যে জেলা নেতারা, তাঁরা নিশ্চই ভাবেননি, এই সিলেক্টিভ বেনিফিশিয়ারি নীতি কীভাবে রাজ্যজুড়ে ব্যুমেরাং হয়ে উঠবে উদার অর্থনীতি চালুর দেড় দশক বাদে। কিন্তু ভাবেননি তো আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারাও! তাঁরা তখন রাজ্যজুড়ে শক্তিবৃদ্ধির চিন্তায় মশগুল। কীভাবে হবে শক্তিবৃদ্ধি, কোন পথে হবে, তা ভাবার মতো কষ্টসাধ্য কাজ করার সময় তখন মুজফফর আহমেদ ভবনের নেতাদের ছিল না। সরকার হয়েছে আট-দশ বছর! তাকে অন্তত ৩৪ বছর ছোটাতেই হবে। জামবনি, বেলপাহাড়িতে একের পর এক বিরোধীকে নিকেষ করে সিপিআইএম যখন সর্বশক্তিমান এক ভাবমূর্তি গড়ায় ব্যস্ত রাজ্যজুড়ে, তখন তো আর কেউ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে গিয়ে সাবধান বানী শুনিয়ে আসেননি, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে…।
     
    হ্যাঁ, আটের দশকের মাঝামাঝি কিংবা শেষদিক থেকে মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম প্রান্তে গোকুলেই বাড়ছিল মাওবাদীরা। কিন্তু শাসক দল সিপিআইএমের সঙ্গে ঝাড়খন্ডিদের লড়াইটা শেষমেশ একুশ শতকের গোঁড়ায় এসে কীভাবে মাওবাদীদের সঙ্গে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পার্মানেন্ট লড়াইয়ে কনভার্ট করে গেল, সেই ঘটনায় আসব পরে। আপাতত কথা হচ্ছিল সেই পুলিশ অফিসারের সঙ্গে, যিনি ২০১৭ সালের মাঝামাঝি শোনাচ্ছিলেন নয়ের দশকে তাঁর ঝাড়গ্রামে কাজের অভিজ্ঞতা। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাসুদেব ভকতের মৃত্যুর ঘটনা, ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষের ইতিহাস তো শুনলাম। কিন্তু এই যে ২০০৩ পঞ্চায়েত ভোটের দিন বাসু ভকত খুন হয়ে গেলেন, এর সলতে পাকানোটা স্পেসিফিক কবে, কীভাবে শুরু হয়েছিল? বাসু ভকতকে এই দলবদ্ধভাবে খুন তো ছোটখাট ব্যাপার ছিল না একটা। এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা বোঝার মতো বোধবুদ্ধি নিশ্চয় ছিল ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা এবং জামবনির সিপিআইএম বিরোধী মানুষের!’
    ‘দেখুন, সিপিআইএমের লড়াইটা শুরু হয়েছিল জোতদারদের সিলিং বহির্ভূত জমি দখলকে কেন্দ্র করে। সেখান থেকে ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের জোট এবং জমির সংঘর্ষটা ছিলই। সেটাই আস্তে আস্তে রাজনৈতিক জমি দখলের সংঘর্ষ টার্ন করে গেল। নয়ের দশকের শুরু থেকে বলা যায় এই সমস্ত এলাকায় নির্বাচন বলে কিছু হোত না। মূলত পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের লড়ার ওপর মোটামুটি নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছিল সিপিআইএম। জামবনিতে বাসু ভকতের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মূল কথাই ছিল, বিরোধী দল, মানে ঝাড়খন্ড পার্টি করা যাবে না। সিপিআইএম করলে সব মিলবে। বাসু ভকত নিজে দাঁড়িয়ে অনেক গরিবের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কেউ পড়তে পারছে না টাকার অভাবে, বাসু ভকত টাকা জোগাড় করে পড়িয়েছেন এমন উদাহারণ জামবনিতে প্রচুর। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি সমস্ত সাহায্য পাওয়ার একমাত্র মাপকাঠি ছিল সিপিআইএমের সঙ্গে যুক্ত থাকা। সরাসরি সিপিআইএম না করলেও চলত, কিন্তু ঝাড়খন্ড পার্টি করা যাবে না কিছুতেই। মনে আছে, নয়ের দশকের শুরুতে পঞ্চায়েত ভোটে জামবনির ১০টা অঞ্চলে বিরোধীরা কোনও প্রার্থী দিতে পারেনি। একটা মাত্র সিটে ঝাড়খন্ড পার্টির হয়ে একজন দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর ওই প্রার্থী আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। রাস্তাতেই খুন হয়ে যান। এমনই বীভৎস অবস্থা ছিল সেই সময় এই সমস্ত এলাকায়।
     
    ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির পর অবস্থা সাময়িকভাবে কিছুটা পাল্টাল। গোটা রাজ্যে তো বটেই, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল মেদিনীপুর জেলায়। জামবনি, বেলপাহাড়ি থেকে শুরু করে কেশপুর, গড়বেতা, শালবনি, পিংলা, পাঁশকুড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সিপিআইএমের বিরুদ্ধে একটা বহুদলীয় জোট তৈরি হল। রাজ্য বা জাতীয় স্তরে কোন দলের সঙ্গে কার জোট হচ্ছিল সেটা তখন বড় কথা ছিল না এই জেলায়। একেবারে গ্রাম স্তরে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, ঝাড়খন্ডি, বিজেপি সমস্ত দলের সমর্থক এবং ভোটার মোটামুটি এক হয়ে গেল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে। যেখানে যার যা শক্তি ছিল সেখানে তারা সেভাবে ঐক্যবদ্ধ লড়াই শুরু করল। শাসক দল বিরোধী এই জোট শক্তিশালী হতে শুরু করল মূলত ১৯৯৮ এর পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোটের পর থেকে। যেখানে যেখানে নিচুতলায় বিরোধীদের পায়ের তলার জমি শক্ত ছিল, সেখানেই মারাত্মক সংঘর্ষ হল। আর গোটা মেদিনীপুরের মধ্যে একমাত্র ঝাড়গ্রাম মহকুমাতেই বিরোধী দলের পেছনে সাধারণ গরিব মানুষের সমর্থন সবচেয়ে বেশি ছিল। আর কিছুটা ছিল কেশপুরে। ২০০০ সালের শুরু কিংবা মাঝামাঝি থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম, সিপিআইএম যেভাবে শক্তি সংহত করছে কেশপুর, গড়বেতা কিংবা পিংলায় বিরোধীরা বেশিদিন লড়াই করতে পারবে না। পারলও না একটা সময়ের পর। কিন্তু ঝাড়গ্রামের জামবনি, বেলপাহাড়ি, বিনপুরে গরিব আদিবাসীদের মধ্যে ঝাড়খন্ডিদের প্রভাব ছিল সর্বাত্মক। তাই ২০০১ বিধানসভা ভোটে বিরোধী জোট পুরো মেদিনীপুর জেলা এবং রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়লেও, ঝাড়গ্রাম মহকুমায় কিন্তু তা হল না। আর সেই কারণেই ২০০১ বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআইএম সরকার প্রতিষ্ঠার পর মেদিনীপুর এবং পুরো রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, হিংসা বন্ধ হলেও, জামবনি, বেলপাহাড়িতে তা থামার কোনও লক্ষ্ণণ দেখা যাচ্ছিল না। সিপিআইএমও বুঝতে পারছিল, পুরো জেলা দখল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জঙ্গলমহল তাদের পলিটকাল ম্যাপের বাইরে থেকে গিয়েছে। তাই ২০০১ বিধানসভা ভোটের পরও ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষ ছিল প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। খুন-পালটা খুন, হিংসা-পাল্টা হিংসা। আর নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে জঙ্গলমহলের রাজনৈতিক সংঘর্ষে আমদানি হল আগ্নেয়াস্ত্রের। আদিবাসীরা এমনিতে লড়াই করত তীর, ধনুক আর টাঙি দিয়ে। ওদের ট্র্যাডিশনাল অস্ত্র। 
    কিন্তু বিহার লাগোয়া একটা এলাকায় যদি দিন-রাত সংঘর্ষ, খুনোখুনি চলতে থেকে তবে বন্দুকের ব্যবহার আর কতদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে। বিহার থেকে আসতে শুরু করল বন্দুক। টাঙি, তির, ধনুকের লড়াইয়ে সিপিআইএম বাহিনী ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে খুব একটা এঁটে উঠতে পারত না। 
     
    এই তীব্র লড়াই, সংঘর্ষের মধ্যেই এগিয়ে আসছিল পঞ্চায়েত ভোট, ২০০৩। গ্রাম বাংলায় আপনি দেখবেন লোকসভা কিংবা বিধানসভার থেকেও পঞ্চায়েত ভোটে উত্তেজনা বেশি থাকে। পঞ্চায়েতগুলোর হাতে প্রচুর টাকা আসার পর থেকে এই প্রবণতাটা শুরু হয়েছে। সবাই জানত, পঞ্চায়েত দখল করতে পারলে প্রচুর কাজের, কাজ পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ। কারণ, গ্রাম পঞ্চায়েতই তখন প্রকৃত অর্থে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। আর যেখানে রাজনৈতিক শক্তি সমানে-সমানে, সেখানে পঞ্চায়েত দখল করতে ক্ষমতার একমাত্র উৎস অস্ত্র। 
    সেদিন ছিল ২০০২ সালের ২৬ অক্টোবর। একদম সকাল সকাল একটা খুন হল জামবনির জামুই গ্রামে। দিবাকর মালাকার নামে এক স্থানীয় সিপিআইএম নেতা তাঁর দুই সঙ্গী মানিক শতপথী এবং হেনা শতপথীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে যাচ্ছিলেন। সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে। দিবাকর মালাকার ছিলেন বাসু ভকতের অনুগামী এবং এলাকায় যথেষ্ট প্রভাবশালী নেতা। অত সকালে আক্রমণ হতে পারে ভাবতে পারেননি। খুব কাছ থেকে দিবাকর মালাকারকে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল দিবাকর মালাকারের। কিন্তু তাঁর দুই সঙ্গীর কিচ্ছু হয়নি। তাঁদের আক্রমণও করেনি দুষ্কৃতীরা। মানিক এবং হেনা পালিয়ে গেলেন মোটরসাইকেলে চেপে। দিবাকর রাস্তায় পড়ে থাকলেন জখম অবস্থায়। দলীয় অফিসে গিয়ে দিবাকর মালাকারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দিলেন মানিক এবং হেনা। পরে জানা যায়, ঝাড়খন্ডিরাই খুন করেছিল দিবাকর মালাকারকে।’ টানা বলে থামলেন ওই পুলিশ অফিসার। থামলেন, কারণ আমিই থামালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আপনি কনকদুর্গা মন্দিরে যেতে বললেন কেন? কনকদুর্গা মন্দিরের সঙ্গে কী সম্পর্ক বাসু ভকতের খুনের? 
    ‘দেখুন সম্পর্ক হয়তো সরাসরি নেই, কিন্তু আছেও। আসলে জামবনির একটা প্রাচীন ইতিহাস আছে। যে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কনকদুর্গা মন্দির, সেখানকার পুজো, পুরোহিত। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এখানকার আদি মানুষের লড়াই-সংগ্রাম। আপনি তো ডুলুং নদী দেখেছেন। বহু বহু বছর আগে এখানকার সমস্ত এলাকা দুটো রাজ পরিবারের অধীনে ছিল। ডুলুং নদীর পূর্ব প্রান্ত ছিল ঝাড়গ্রামের মল্লদেব রাজাদের অধীনে আর পশ্চিম প্রান্ত ছিল ধলভূমগড়ের রাজা ধবলদেবদের অধীনে। এখনকার যে জামবনি এলাকা তা ছিল প্রাক ব্রিটিশ যুগে রাজা ধবলদেবদের অধীনে। রাজা ধবলদেবরাই প্রায় তিনশো বছর আগে চিল্কিগড়ে এই কনকদুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাস চর্চায় যাব না বেশি। রাজা ধবলদেবরা ব্রিটিশদের বশ্যতা স্বীকার তো করেনইনি, বরং শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়েছিলেন। এখানেই অষ্টাদশ শতকের শেষে, উনবিংশ শতকের শুরুতে রানি শিরোমনির নেতৃত্বে চুঁয়ার বিদ্রোহ হয়। এই সব ইতিহাসের কথা। জামবনির এই কনকদুর্গা মন্দিরে পুজো করতেন এক ষড়ঙ্গী পরিবার। জামবনির দুবরা গ্রামে বাড়ি। পুরনো পরিবার। ধলভূমগড়ের রাজাদের আমলের জমিদার ছিলেন ষড়ঙ্গীরা। অনেক সম্পত্তি ছিল। আমি নিজে দেখিনি, শুনেছি ছয়-সাতের দশকে এই পরিবারের এক কর্তা শম্ভুনাথ ষড়ঙ্গী কনকদুর্গা মন্দিরে এমন চন্ডি পাঠ করতেন, গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ত তা শোনার জন্য। দুবরার ষড়ঙ্গীরা ছিলেন আদি কংগ্রেসি পরিবার। স্বাধীনতার আগে থেকেই। আর স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস আমলে এই পরিবারের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল জামবনিতে। অনেক জমি-জায়গা ছিল। সেই আমলে বড় বাড়ি ছিল অনেকগুলো। ষড়ঙ্গীরা যেহেতু কংগ্রেস করতেন, ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের সঙ্গেও তাঁদের যোগাযোগ ছিল যথেষ্টই। 
    তো সেই ২৬ অক্টোবর দিবাকর মালাকার খুনের পর তাঁর দুই সঙ্গী মানিক এবং হেনা সিপিআইএম পার্টি অফিসে গিয়ে খবর দিলেন। তারপর লোক জমায়েত হতে যতক্ষণ, দাবানলের মতো জামবনিজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল বাসু ভকতের বাহিনী। বছর শেষ হলেই পঞ্চায়েত ভোট। তার আগে সক্কাল সক্কাল দিবাকর মালাকারের মতো ওজনদার নেতার খুন সিপিআইএমের কাছে যত বড় না সাংগঠনিক ধাক্কা, তার থেকেও বড় ছিল পার্টির শক্তিশালী ইমেজকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। সিপিআইএম জানত, জামবনিসহ জঙ্গলমহলের রাজনীতিতে দুর্বলের কোনও জায়গা নেই। একটা খুন করে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে ঝাড়খন্ডি-কংগ্রেস জোট। সুদে-আসলে তার বদলা না নিলে এলাকায় সর্বশক্তিমান ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এই ক্ষতির মূল্য চোকাতে হবে জামবনির একাধিপত্য হাতছাড়া করে। তাছাড়া সদ্য গড়ে ওঠা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম প্রান্তের ঝাড়গ্রাম মহকুমায় তখন সিপিআইএমের ট্যাকটিকাল লাইন তা অনুমোদনও করে না। অর্থাৎ, পালটা খুন। হিংসার বদলে হিংসা। ছাড়া যাবে না এক ইঞ্চি জমিও। 
     
    সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ জামুইয়ে দিবাকর মালাকার খুন হলেন। এক থেকে দেড় ঘন্টা লাগল সিপিআইএমের রেডি হতে। প্রথম টার্গেট তিন কিলোমিটার দূরের দুবরা গ্রাম। দুবরা বেছে নেওয়ার কারণ, এখানেই প্রভাবশালী এবং সমৃদ্ধ কংগ্রেস পরিবার ষড়ঙ্গীদের বাড়ি। সিপিআইএমের ৩০-৪০ জনের একটা বাহিনী সকাল সাড়ে নটা নাগাদ ঢুকল দুবরায়। সবাই সশস্ত্র। শুরু হল বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। দিবাকর মালাকারের সম্ভাব্য খুনির খোঁজে। ঠিক সেই সময় চাষের জমি থেকে বাড়ি ফিরছিলেন ষড়ঙ্গী পরিবারের এক কর্তা মোহিনীমোহন ষড়ঙ্গী। তখন তাঁর বয়স ৭২ বছর।’
    এর পরের ঘটনাও বলেছিলেন ওই পুলিশ অফিসার। কিন্তু সেই ঘটনা আমি লিখব মোহিনীমোহনের ছেলে প্রসূন ষড়ঙ্গীর মুখে। ওই পুলিশ অফিসার এবং প্রসূন ষড়ঙ্গীর বর্ণনায় বিশেষ কিছু অমিল নেই। প্রায় এক। কিন্তু জামবনিসহ ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সিপিআইএমের সঙ্গে ঝাড়খন্ডি এবং কংগ্রেসের দীর্ধ লড়াইয়ে প্রসূন ষড়ঙ্গীও এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাই এই লেখায় প্রসূন ষড়ঙ্গীর এন্ট্রি জরুরি। সেদিন কী ঘটেছিল জামবনিতে তা এবার শুনব প্রসূন ষড়ঙ্গীর মুখে। তিনি এই জামবনির ইতিহাস চর্চায় আর এক সাক্ষী।
     
    ‘সেদিন আমি ঝাড়গ্রাম শহরে। গ্রামের বাড়িতে থাকলে এতদিন আর বেঁচে থাকতাম না। সেদিনই খুন হয়ে যেতাম। বাসু ভকতের বাহিনী দুবরা গ্রামকে টার্গেট করে মূলত আমাদের ফ্যামিলির জন্যই। বাবা সরাসরি কংগ্রেস করতেন। পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের সিটে কংগ্রেসের হয়ে লড়েছিলেনও। আমিও তখন কংগ্রেস করতাম। তার আগে করতাম ছাত্র পরিষদ। ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ছটা কলেজ ছিল তখন। সবকটাতেই ছাত্র পরিষদের জোরদার সংগঠন ছিল। 
    সেদিন সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী যখন গ্রামে ঢোকে তখন বাবা বাড়ি ছিলেন না। রোজ চাষের জমি দেখতে যেতেন একদম সকালে। তারপর রোদ বাড়লে মাঠ থেকে ফিরতেন। সেদিনও জমি থেকে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির একটু আগে সিপিআইএম বাহিনী বাবাকে দেখতে পায়। বাবার তখন যথেষ্টই বয়স হয়েছে। পালানোও সম্ভব ছিল না। প্রথমে পিছন থেকে একজন বাবার পিঠে গুলি করে। বাবা সাইকেল থেকে পড়ে যান। আর উঠতে পারেননি। এরপর আরও তিন-চারটে গুলি করে ওরা। চপার দিয়ে কোপায় ৭২ বছরের মানুষটাকে। তারপর ওরা মাটিতে হিঁচড়ে টানতে টানতে মৃতপ্রায় বাবাকে বাড়ির সামনে নিয়ে যায়। বাড়ির সামনে উঠোনে খড়ের গাদা ছিল। ধানের গোলা ছিল। গ্রামের সব বাড়িতে যেমন থাকে। সেই খড়ের মধ্যে রক্তাক্ত বাবাকে ফেলে দেয় বাসু ভকতের লোকজন। তখনও বাবা বেঁচে। এরপর…এরপর খড়ের গাদায় কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বাসু ভকতের বাহিনী। জীবিত অবস্থায় পুড়ে মৃত্যু হয় বাবার। অপরাধ, সিপিআইএম জমানায় জামবনিতে কংগ্রেস করা।’
    প্রসূন ষড়ঙ্গী বলছেন, আর আমি তা শুনে শিউরে শিউরে উঠছি। এমন নৃশংস খুনও হয়? একই কথা বলেছিলেন ওই পুলিশ অফিসারও। বলেছিলেন, ‘দুপুরের পর আমরা পুরো ফোর্স নিয়ে দুবরায় যেতে পেরেছিলাম। তখনও ষড়ঙ্গীদের বাড়ি ধিক ধিক করে জ্বলছে। খড়ের গাদা থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে। আর মাংস পোড়ার বীভৎস গন্ধ। এমন ভয়াবহ খুন আমার চাকরি জীবনে দেখিনি আগে।’ 
    আবার বলতে শুরু করলেন প্রসূন ষড়ঙ্গী। ‘বাবাকে খড়ের গাদায় ফেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর আমাদের বাড়িতে ঢোকে বাসু ভকতের বাহিনী। বাড়ির পেছনে একটা বড় নালা ছিল। বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মা সেই নালায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমাদের পুরো বাড়ি লুঠপাট করে জ্বালিয়ে দেয় সিপিআইএম বাহিনী। এরপর পাশেই কাকাদের বাড়িতে আক্রমণ করে তারা। পুরো পরিবার মিলে আমাদের তিনখানা বাড়ি। সবকটাই লুঠ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরেই থাকত আরও একটা সক্রিয় কংগ্রেসি পরিবার। সেই পরিবারের কর্তা শিশির শতপথী বাবার সঙ্গে কংগ্রেস করতেন। তখন প্রায় ৮২ বছর বয়েস। শিশির জেঠু বাড়িতে ছিলেন। আমাদের বাড়িতে লুঠতরাজ চালিয়ে সিপিআইএম বাহিনী তাঁদের বাড়িতে হানা দেয়। শিশির জেঠু কিছু বোঝার আগেই তাঁকে গুলি করে। তারপর চপার দিয়ে কোপায়। বাড়ির পাশেই পুকুরে স্নান করতে গেছিলেন শিশির জেঠুর স্ত্রী শিবানী শতপথী। প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধা। স্বামীর চিৎকার শুনে তিনি দৌড়ে আসেন পুকুর ধার থেকে। তাঁকেও রেয়াত করেনি বাসু ভকত বাহিনী। শিবানী শতপথীকে গুলি করে চপার দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটে তারা।
    প্রায় দু’ঘন্টা ধরে দুবরা এবং আশপাশের গ্রামে তাণ্ডব চালায় সিপিআইএমের লোকজন। ভয়ঙ্কর, বীভৎস তাণ্ডব। বেছে বেছে ঝাড়খন্ড এবং কংগ্রেস পরিবারগুলোর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। পুলিশ আসেনি, কেউ প্রতিরোধ করতে পারেনি। আমি তখন ঝাড়গ্রাম শহরে। অনেক বেলায় খবর পেয়েছিলাম, বাসু ভকতের বাহিনী আমাদের বাড়ি অ্যাটাক করেছে। তখনও জানতে পারিনি কী বীভৎসভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে খুন করেছে আমার বৃদ্ধ বাবাকে। খুন করেছে বৃদ্ধ দম্পতি শিশির শতপথী, শিবানী শতপথীকে। সেদিন সারাদিন বাড়ি ফিরতে পারিনি সিপিআইএমের ভয়ে। ফিরলে যদি সিপিআইএম বাহিনী মেরে ফেলে। তখন সবংয়ের এমএলএ আমাদের মানস ভুঁইয়া। বারবার তাঁকে ফোন করছি। ঝাড়গ্রামে বসে বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে, কে সাহায্য করতে পারে। কীভাবে বাসু ভকত বাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করতে পারে বাবা-মাকে। পুলিশ অনেক বেলায়, দুপুরের পর আমাদের গ্রামে গিয়েছিল। ততক্ষণে সব শেষ।’
     
    প্রসূন ষড়ঙ্গীর কথা শুনে ভাবছিলাম কী ভয়ঙ্কর ছিল ঝাড়গ্রাম মহকুমায় রাজনীতির চেহারাটা। খুন, বদলা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কোনও শব্দই যথেষ্ট নয় এক কথায় এই রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করার জন্যও। কখনও কখনও মনে হয়েছে বর্বরতাও যথেষ্ট লঘু শব্দ ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সিপিআইএম, ঝাড়খন্ডি এবং মাওবাদীদের কিছু আচরণকে বোঝানোর জন্য। 
    একজন দিবাকর মালাকার খুন হলেন সকালে। দলীয় সঙ্গীর মোটরসাইকেলের পেছনে বসে পার্টির কাজে যাওয়ার সময়। আর তার বদলায় তিন তিনজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা খুন! আর খুন তো যেমন-তেমন নয়। গুলি করে, চপার দিয়ে কেটে একেবারে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা। যাতে মৃতদেহ চিনতে পর্যন্ত না পারা না যায়। এই খুনের মধ্যে তো স্রেফ রাজনৈতিক বদলা নেই। পরতে পরতে বুঝিয়ে দেওয়া আছে, সর্বশক্তিমান শাসক দলের গায়ে হাত পড়লে কী হতে পারে তার প্রতিক্রিয়া! গোটা এলাকায় দু’-আড়াই ঘন্টার ভয়াবহ, বর্বর তাণ্ডবের মধ্যে দিয়ে বিরোধী মনোভাবাপন্ন সাধারণ মানুষজনের মধ্যে একটা ফিয়ার সাইকোসিস তৈরি করা। যে বদলার কাহিনী মুখে মুখে ঘুরবে এদিক-ওদিক। গ্রামের পর গ্রাম লোকে বুঝে যাবে, বাসু ভকত রেগে গেলে কী হয়! তিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে পালটা খুনের মধ্যে দিয়ে সমস্ত শাসক বিরোধী মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া আছে, সামনের বছর পঞ্চায়েত ভোট। আর একজন সিপিআইএম নেতা-কর্মীও খুন হলে তার প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। কংগ্রেসি, ঝাড়খন্ডিদের মৃতদেহ শনাক্ত করারও লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। 
    এবার ফিরতে হবে সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে। বাসু ভকতের মৃত্যু আসলে ক্রিয়া না প্রতিক্রিয়া? এই প্রশ্ন নিয়ে আবার ফিরলাম সেই পুলিশ অফিসারের কাছে। ‘মোহিনীমোহন ষড়ঙ্গীর মতো না হলেও বাসুদেব ভকতের খুনটাও তো কম ভয়াবহ কিছু নয়!’
    ‘নয় তো। টাঙি, বল্লম দিয়ে কুপিয়ে, কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল তাঁকে। তারপর একাধিক তীর ছোঁড়া হয়েছে তাঁর শরীরে। মোহিনী ষড়ঙ্গীদের খুনের কয়েক মাসের মধ্যের ঘটনা এটা। বাসুদেব ভকতের মৃতদেহ ঝাড়গ্রামে এনে ভালোভাবে দেখি আমরা। পুরো শরীরে বীভৎস প্রতিহিংসার চিহ্ন। আসলে একটা সময়ের পর আমরা বুঝতে পারছিলাম, বাসুদেব ভকত বাহিনীর এই অত্যাচার জামবনিতে কোনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। মানুষের তীব্র রাগ জমা হচ্ছিল বাসু ভকতের ওপর। সিপিআইএমের ওপর। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারত না। সিপিআইএম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি ছিল প্রচণ্ড। দেখুন, বাসু ভকতকে নৃশংসভাবে হত্যা ক্রিয়া না প্রতিক্রিয়া তা এক কথায় বলা অসম্ভব। কিন্তু এটা বলা যায়, ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ব্যক্তি হত্যার রাজনীতির যে নৃশংস পরম্পরা চালু হয়েছিল, তার একটা স্পেশাল কেস স্টাডি বাসু ভকতের খুন। এমন কেস স্টাডি ওখানে আরও অনেক আছে। বাসু ভকত শাসক দলের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন বলে তাঁর মৃত্যুর প্রচারটা বেশি হয়েছিল। তবে একটা কথা বলতে পারি, বাসু ভকতের নৃশংস হত্যা হয়তো কখনও না কখনও হওয়ারই ছিল। 

    ক্রমশ।.. 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ৩১ মে ২০২৪ | ৩৯০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    গূঢ়  - Nahid Ul Islam
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ৩১ মে ২০২৪ ২১:০৩532541
  • সিপিএম এসবের জন্য নিশ্চয়ই ন্যনতম দু:খপ্রকাশও করে নি? আচ্ছা এই যে সিপিএম কংগ্রেসের হাত ধরাধরি চলছে ক'বছর ধরে সেখানে এই ষড়ঙ্গী পরিবার শতপথী পরিবার বা এলাকার নানুষের প্রতিক্রিয়া কী? 
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ জুন ২০২৪ ১৯:৪১532734
  • চোখের বদলে চোখ নিতে নিতে একদিন সবাই বোধহয় অন্ধ হয়ে যাবে। 
     
    নৃশংসতার বর্ণনাগুলো পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এপারে পাহাড়ে বছরের পর বছর ধরে চলছে এমন জাতিগত ঘৃণ্য বর্বরতা; যা পাকিস্তানি সেনা বর্বরতাকেও হার মানায়!...
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন