ইতিহাস ঘেঁটে এই ফিকশন তৈরী। এখানে অনেক মশলা দেওয়ার চেষ্টা করবো। ... ...
অরিন্দম দেখে, মাওবাদী কমান্ডোদের জংলা পোশাক, কালো টুপি পরা এক যুবক কাঁধে এক সেল্ফ লোডেড রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই যুবকই সিংরাই মান্ডি ওরফে জয়ন্ত ওরফে ফড়িং! হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে অরিন্দম। কানে আসতে থাকে রাজ্য পুলিশের ডিজির কথা, ‘তিন রাজ্য মিলে খুন, নাশকতা সহ অন্তত ৫০ টি মামলা রয়েছে সিংরাইয়ের নামে। তাকে গ্রেফতারের জন্য বাংলা এবং ঝাড়খন্ড সরকার মিলিয়ে ৪০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এই রাজনীতির ভুল বুঝতে পেরেছে সে। তাই সে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে এসেছে...।’ ... ...
সুবল মান্ডি যখন মা আর ছেলেকে রাস্তায় বসিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে গিয়েছিল, তখন চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখে কী মনে হচ্ছিল দশ-এগারো বছরের ছেলেটার? ভাবার চেষ্টা করে অরিন্দম, ভাবতে পারে না। অরিন্দমের মনে পড়ে অরণ্যের দিনরাত্রি সিনেমার সেই দৃশ্যের কথা, শুভেন্দু বলছে, ‘এই সব জায়গায় এলে মানুষের আয়ু বেড়ে যায়!’ মনে মনে হেসে ওঠে অরিন্দম। মনে হয়, আমরা শহরের লোক, কত কম জানি নিজের রাজ্যটাকে! আদৌ কি জানি? ... ...
তামারবুন্ডু থেকে চান্ডিল ইতিমধ্যেই একটা দল কাজ করছে, নতুন কমরেডরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হবে। তারপর এই দুটো গ্রুপ চান্ডিল থেকে আলাদা হয়ে যাবে। একটা গ্রুপ চান্ডিল থেকে দলমা পাহাড় হয়ে পুরুলিয়ার বরাবাজার দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকবে। তারা বরাবাজার থেকে বলরামপুর, বান্দোয়ান এলাকায় কাজ করবে এবং সেফ করিডোর তৈরি করবে। অন্য গ্রুপটা চান্ডিল থেকে দলমা হয়ে ঘাটশিলা যাবে, সেখান থেকে কাঁকড়াঝোড় হয়ে বেলপাহাড়ি ঢুকবে। ... ...
সিংরাই দেখে বাচ্চাটা টানা চিৎকার করছে। চেষ্টা করছে পুলিশের হাত ছাড়ানোর, পারছে না। কান্না পেয়ে যায় তার। চেষ্টা করেও চোখের জল আটকাতে পারে না সিংরাই। বুঝতে পারে না, এই যে এখন চোখে জল এল তার কারণ কী? এমন তো আগে হয়নি কখনও, অন্য কারও কষ্ট দেখে কান্না পায়নি তো কোনওদিন! যেদিন নিজের বাড়ি ভাঙা হচ্ছিল, সেদিন তো চরম আক্রোশ, ঘৃণা নিয়ে সে তাকিয়েছিল পুলিশ, ফরেস্ট ডিপার্টমেণ্টের লোকগুলোর দিকে, আর আজ অন্যের বাড়ি ভাঙা, বাচ্চাটার চিৎকার শুনে চোখে জল এল কেন? উত্তর খুঁজে পায় না সিংরাই, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অবশ্য তার তো বয়স কম, অনেক বয়স হওয়া সব মানুষও কি আর বোঝে, যে তীব্রভাবে কাউকে ঘৃণা করতে পারে, একমাত্র সেই এমন ভালোবাসতে পারে, যে ভালোবাসা অচেনা কারও কষ্ট দেখলে চোখে জল নিয়ে আসে! কারণ, এও পদার্থ বিদ্যার সেই সূত্রের মতো, তীব্র ঘৃণার উল্টোদিকে আছে তীব্র ভালোবাসা! ... ...
‘এই বয়সেই মানুষ মারা শুরু করেছিস? সারেঙ্গায় খুনটা কে করেছে?’ এসডিপিও মির্জা’র প্রশ্নে কিছু বলে না সিংরাই। সে জানে সারেঙ্গায় সিপিএম নেতা খুন হয়েছে, কিন্তু সেটা এমসিসি নয়, করেছে জনযুদ্ধ। কিন্তু তা বলল না সে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘তুই নাকি এখানে কাজের খোঁজে এসেছিস, তা কী কাজ করবি এখানে?’ কথা বলতে বলতেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় এসডিপিও। এবারও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সিংরাই। ‘হাতের আঙুলগুলো টেবিলের ওপর পেতে রাখ।’ একটুও না নড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সিংরাই। ‘কী হল, হাতটা রাখ টেবিলে,’ চিৎকার করে ওঠে খাতরার এসডিপি। ভয়ে ভয়ে বাঁ হাতটা এগিয়ে হাতের চেটোটা ওপর দিকে করে টেবিলের ওপর রাখে সিংরাই। টেবিলের পাশে দাঁড় করানো লাঠিটা নিয়ে কালো টি শার্ট, নীল জিন্স এগিয়ে আসে। ওর হাতের পাতাটা উল্টে দেয়, তারপর লাঠিটা রাখে সিংরাইয়ের আঙুল চারটের ওপর। সিংরাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিংরাইয়ের কড়ে আঙুলটা উল্টে দেয় জোরে। মট করে একটা আওয়াজ হয় শুধু, পাট কাঠির মতো ভেঙে যায় সরু কড়ে আঙুলটা। আঃ করে চিৎকার করে ওঠে সিংরাই, যন্ত্রণাটা ছড়িয়ে পড়ে গোটা হাতে, হাত থেকে শরীরে। হাতটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। লাঠিটা শক্ত করে সিংরাইয়ের আঙুলের ওপর চেপে রেখেছে মির্জা। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে সিংরাইয়ের। ... ...
‘দিনের বেলা ঘর থেকে বেশি বেরনোর দরকার নেই, এদিকে হাওয়া ভালো না।’ মনোহরের কথায় চুপ করে থাকে সিংরাই। কাল রাতে ঘরে ঢোকার পর ধনঞ্জয় কাকাও একই কথা বলেছে। মাঝে মাঝেই সিপিএমের লোকজন নানা অছিলায় গ্রামে ঘুরছে, খোঁজ নিচ্ছে কারও ঘরে বাইরের কেউ এসে থাকছে কিনা। কারও বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে তারা কোথা থেকে এসেছে, কেমন আত্মীয়, নানা খোঁজ নিচ্ছে সিপিএমের লোকজন। মাস ছয়েক ধরে এই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। বিনপুর, রানিবাঁধ, খাতরায় এমসিসি’র আর গোয়ালতোড়, সারেঙ্গায় পিপলস ওয়্যার গ্রুপ বা জনযুদ্ধের গতিবিধি যত বাড়ছে, সংগঠন যত বাড়ছে ততই গ্রামে নজরদারি বৃদ্ধি করছে সিপিএম। ... ...
এতদিন ধরে যে দিনের জন্য অপেক্ষা করছিল, তা যখন সত্যিই এসে হাজির হয়েছে তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় সিংরাইয়ের। বাবা-মা’র মাঠ থেকে ফিরতে প্রায় তিনটে বেজে যাবে। বাড়ি ছাড়ার সময় ওদের সঙ্গে দেখা হবে না, প্রথম যখন ভাবনাটা মাথায় আসে মুহূর্তের জন্য একটু খারাপ লাগে সদ্য কৈশোরে পা রাখা ছেলেটার। কিন্তু তারপরই ওর মনে হয়, এর জন্য তো মানসিক প্রস্তুতি সে অনেকদিন ধরেই নিচ্ছে। আজ না হয় কাল তো চলেই যেত বনমালীর সঙ্গে। আজ যে বাড়ি ছাড়ার সময় দেখা হচ্ছে না বাবা-মা’র সঙ্গে তাতে কীই বা এসে যায়! বাড়ি ছাড়ার সময় দেখা হলেই বা কী এসে যেত! ... ...
তাকে থামিয়ে সুভাষ মাহাতো বলে ওঠে, ‘একটা কথা বলুন তো, এই এলাকার কথা উঠলেই আপনারা মাওবাদী সমস্যা বলেন কেন? মানুষের সমস্যা আছে বলেই তো মাওবাদী আছে। মাওবাদীরা সমস্যা হবে কেন?’ সুভাষ মাহাতোর প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অরিন্দম। কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে গিয়েও থেমে যায়, চুপ করে থাকে। ফের বলে ওঠে সুভাষ মাহাতো, ‘আসলে আপনাদের দোষ নেই, সরকার সব সময় বলে মাওবাদী সমস্যা, মাওবাদী সমস্যা, মিডিয়াও বলছে মাওবাদী সমস্যা। আপনারা মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, মানুষ মাওবাদীদের সমস্যা বলে মনে করে কিনা। যেদিন মানুষ মাওবাদীদের সমস্যা বলে মনে করবে, সেদিন সরকার, পুলিশ কিছু লাগবে না, খুন, সন্ত্রাস এমনিই থেমে যাবে। কিন্তু মানুষ যদি মাওবাদীদের সমস্যা বলে মনে না করে, তবে পুলিশ দিয়ে সরকার কিছু থামাতে পারবে না।’ ... ...
এরপর প্রায় এক মাস ধরে এই পরিবারগুলো কীভাবে আবার নিজেদের ঘর মেরামত করল, এই শীতের দিনে কীভাবে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরল সেই ঘটনা পুরো জানতে গেলে আজ কিছুক্ষণ আগে সহদেব সিংহ সর্দারের বাড়িতে যে মিটিং শুরু হয়েছে তা শেষ হয়ে যাবে। তাই এক মাস আগের ঘটনা ছেড়ে এবার আমাদের দ্রুত ফিরতে হবে বাঁশলাটা গ্রামে। এক মাসের পথ পেরোতে হবে এক নিমেষে। কারণ, এই মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত হল তা জানা না গেলে বোঝা যাবে না ঠিক কবে, কীভাবে চাকাডোবার এই শান্ত আদিবাসী গ্রামে পা ফেলল মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার বা এমসিসি। ... ...
কার ক্ষতি হল, কতটা? ক্ষতিপূরণে কার লাভ হবে? কতটা? ... ...
এই গরিব মানুষ যখন নিজের জমিতে, নিজের খাটনিতে ফলন হওয়া ফসল কেটে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়, তখন তাকে চুরি বলে না। তাকে বলে বড়লোকের দখল করে রাখা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, যা কাল রাতে এখানকার মানুষ করেছে। ... ...
‘তুমি বাজেয়াপ্ত শব্দের মানে জান?’ প্রশ্নটা করে লোকটা সোজা তাকিয়ে আছে তার দিকে, চোখ নামাতে পারল না সিংরাই। আশপাশে বসে থাকা সাত-আটজন পুরো চুপ, কারও মুখে কোনও কথা নেই। কিন্তু সিংরাই কী জবাব দেবে এই প্রশ্নের, শব্দটাই শোনেনি সে কোনও দিন। ... ...
পূর্বপুরুষের কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কি এভাবে করা যায়? নাকি সবটাই স্বপ্ন? ... ...
বীরেন শা'য়ের বাড়ীর দুইঘর ভাড়াটে নাকি গিয়ে সাতুদের দোতলায় উঠেছে। এদিকে দাদুদের গোয়ালঘরেও ভালই জল উঠেছে, প্রথমদিন তো লালি আর আকাইম্যা সারাদিনরাত দাঁড়িয়ে রইল। পরেরদিন ভোররাতে লালি কেমন অদ্ভুত আওয়াজ করে ডাকতে লাগল। তখন দাদু গিয়ে ওদের দড়ি ধরে এনে দাদুদের দিকের ভেতরের বারান্দায় তুলল। সে বেচারাদের কি ভয় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে, অর্ধেক সিঁড়ি তো জলে ডোবা, তড়বড় করে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আকাইম্যা একেবারে দাঁড়িয়ে গেল শক্ত হয়ে, কিছুতেই নড়েচড়ে না। দাদু শেষে ওকে পাঁজাকোলা করে বারান্দায় তুলে দিল। লালি বেচারীর শিগগিরই বাছুর হবে, পেটটা ফুলে একেবারে ঝুলে গেছে, প্রায় মাটি ছুঁইছুঁই। খুব কষ্ট করে বারান্দায় উঠল। বারান্দার কোণায় ছোট গামলা করে ওদের জাবনা দেবার ব্যবস্থা হল। লালি উঠেই সেই যে বসে পড়ল, সারাদিনে আর উঠে দাঁড়াল না। শেষে দাদু আর দিদা সন্ধ্যের আগে অনেকক্ষণ ধরে ছোবড়ার আগুন জ্বালিয়ে লালিকে সেঁক দেওয়ার পরে বেচারী একটু ধাতস্থ হয়ে জাবনায় মুখ দেয়। পরেরদিনটাও লালিরা বারান্দায়ই রইল, তার পরের দিন জল অনেক নেমে গেল; উঠোনে আধহাঁটু, গোয়ালে গোড়ালি ভেজে কি ভেজে না। লালি আর আকাইম্যা আবার গোয়ালে ফেরত গেল। বারান্দায় দুই বোতল ফিনাইল ঢেলে ধোয়া শুরু করল বড়মামীমা। লালির জন্য গোয়ালে একটা ভাঙা দরজা পেতে দেওয়া হল, যাতে শুকনো জায়গায় বসতে পারে। পাড়া থেকে কারা যেন জিটিরোডে গিয়ে ইলেকট্রিক অফিসে খবর দিয়ে এল। এই সময় শুরু হল উঠোনে মাছের আনাগোণা। এদিকে শ্রীপল্লীর মাঠের পেছনের অংশের পুকুরটা ভেসেছে, ওদিকে শ্রীদুর্গা মিলের পুকুর। এই শিউলি গাছের গোড়া বাটামাছের ঝাঁক তো নারকেল গাছের গোড়ায় কইমাছ কানে হাঁটছে। বাবু, সুবীর, রতন, বুম্বারা ছেঁড়া মশারি, গামছা আর মাটির হাঁড়ি নিয়ে হইহই করে সারাপাড়া জুড়ে মাছ ধরে বেড়াচ্ছে। বুড়ীর মা মাসি আজ কাজে এসেছে, পেয়ারাগাছের সামনে থেকে খপ করে একটা মাঝারি সাইজের শোলমাছ ধরে ফেলল। বড়মামীমা মাছ কাটতে কাটতে মা'কে বলে 'কালিয়া করব, ওদের জন্য দেব, আগেভাগেই ওদের ভাত খাইয়ে দিস না দিদি।' ভাই শুনতে পেয়ে মুখ বেজার করে, ও মাছ খেতে একদম ভালবাসে না। ছবিমাসি দিদাকে বলে ‘মাসিমা আফনে রান্ধেন, আফনের রান্ধা কালিয়ার সোয়াদ মুহঅ লাইগ্যা থাহে।' দিদা হাসিহাসিমুখে বলে ‘হ বৌমা তুমি অন্যটি দ্যাহ, মাছটা আমি দেখ্তাসি।' ... ...