এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ভ্রমণ কাহানি (৫) : উপল মুখোপাধ্যায়   

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১০ এপ্রিল ২০২৪ | ৩০৩ বার পঠিত
  • | | | |
    আমরা তিনজন কখন বেরোব ? প্রদীপ বলল ," রাতে জার্নি কর। সকাল সকাল পৌঁছে যাব রায়গঞ্জে।" বুবাই বলল ," রায়গঞ্জ নয় , একটু আগে,  জায়গাটার  নাম দুর্গাপুর।  ইরিগেশনের বাংলো আছে রাস্তার ওপর। " প্রদীপ বলল ," ওই হল,  রায়গঞ্জের কাছেই। কত আর দূর হবে।'' আমি বললাম ," পনেরো কিলোমিটারের মতো। ''
    ------- আগে না পরে ?
    ------- কিসের ?
    ------ রায়গঞ্জের ।
    ------- যাবার সময় আগেই পড়বে। ফেরার সময় রায়গঞ্জ ছাড়িয়ে।
    ------- সন্ধে বেলায় বেরো,  সকালের  মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিস ।
    ------বিনোদকে বলে দিচ্ছি ।
    ------ দাঁড়া।
    ------ কী  হল ?
    ------- তাড়াহুড়ো করিস না।
    ------- আচ্ছা।
    ------ রাতের জার্নি করতে হবে না ।
    ------ তাহলে সকাল সকাল বেরো ।রাতে দুর্গাপুর থেকে  পরদিন সকালে বেরিয়ে দুপুরের মধ্যে কার্শিয়ং ।
        তাই হল, কলকাতার পুজোর খোঁয়ারি গায়ে নিয়ে মাতালের উল্লাসে ভোর সাড়ে চারটেয়    আমরা বেরই । একাদশীর সকাল, প্রদীপকে বাগুইহাটি থেকে তোলার পর ও আব্দার ধরল চা খাবে ।আমি চালাচ্ছিলাম ,বিনোদ সামনে বসেছিল পাশে । আমি বললাম ," কৃষ্ণনগরের আগে থামব না। " কৃষ্ণনগরের পর চাটা খেয়ে পুরোটা বিনোদকে চালাতে দিলাম , এইভাবে সময় বাঁচিয়ে একাদশীর  বিসর্জনের ভিড়ভাট্টা শুরুর আগেই দুপুর আড়াইটের মধ্যে   রায়গঞ্জের আগে   দুর্গাপুর  ইরিগেশনের বাংলোতে ঢুকে যাই , খুব দ্রুত চালিয়ে ।দোতলা নতুন বাংলো, রাতের বেলা ওপরে একটা ঘরে আমি আর একটা ঘরে প্রদীপ আর বুবাই শুল । এক তলায় একটা ঘর দিয়েছিল বিনোদকে । পরদিন  কার্শিয়ং ট্যুরিস্ট লজে চেক ইন করেছি দেড়টা নাগাদ ।  
       কার্শিয়ং ট্যুরিস্ট লজের বসার ঘরটাতে আমাদের  সবাই বসেছিল কুর্সির ওপর।আমি সবাইকে লক্ষ্য করতে থাকি । গাড়িটা লজের সামনেই এন এইচ থার্টি  ওয়ানের ধারে রাখা আছে ।বিনোদ  আমাকে বলে ,” একটু জল কোথায় পাওয়া যায় , গাড়িটা ধোব ।‘’ আমি সিকিউরিটিকে বলে জলের ব্যবস্থা করলাম। তখন রিসেপশনে কেউ ছিল না।বুঝলাম  হয় ঘরে চলে গেছে নয় ,  বারে চলে গেছে। দুপুরে গরম লাগছিল,পাহাড়ে এরকমই হয়, কখন গরম হয় বোঝা যায় না অথচ ঠাণ্ডা ঠিকই বোঝা যাবে । আর  পুরনো কাঠের তৈরি   ট্যুরিস্ট লজে আলোরা নানান ভাবে কেবলি খেলা করে । পাহাড়ের ধাপ কেটে   এই  লজ তৈরি করা হচ্ছিল কলোনির যুগে ,  তখনই কিছু প্রাচীন আলোরা ভেতরে ঢুকে যায় তারা আর বেরতে পারছে না।  যেন বছরের পর বছর ঘুরে মরছে কাঠের ভেতর আর লুকিয়ে থাকার চেষ্টায় আছে ।মাঝে মাঝে তারা নেমে আসে । আমি দেখলাম আলোরা বসে আছে সব সারি সারি কুর্সিতে। এখানে ওরা, আলোরা এই ভাবে লুকিয়ে আছে দেখে কথা বলিনি। আমি শুধু ছায়া খুঁজছিলাম। রিসেপশনের পাশে অপূর্ব বসার ঘরের কাঠের তৈরি ছাদও কৌণিক হয়ে নেমে এসে আমাকে বলল,“ হ্যালো। " আমি তাকিয়ে  আলো কোথা থেকে আসে আর কোথায় লুকিয়ে থেকে যাচ্ছে এ সব দেখছিলাম। ওই ডাকে সম্বিত ফিরে এসেছিল,  দেখি রিসেপশন থেকে একজন হাসিহাসি মুখে ডাকছে। ভদ্রলোক  বললেন ,”আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বিমল তামাং। " আমি প্রদীপকে ডেকে দিলাম , ওর কাছে সব কাগজপত্র থাকে। ওই সব ম্যানেজ করবে।আমি বললাম ,” আমাদের ড্রাইভারের জন্য একটা ঘর হবে না ।“ উনি বললেন ,” ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন । ফোন নম্বর আছে তো?‘’  প্রদীপ বলে,” বুকিং য়ের সময় দিয়েছে ।‘’ ম্যানেজার ফোন ধরছে না । বিনোদ আমাদের ঘরেই লাগেজ রাখে ।এরপর আমরা খেতে গেলাম লজের রেস্তোরাঁতে,  সেখান থেকে যে পাহাড় দেখা যায় সে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তবে দেখা যাচ্ছিল না । মেঘ ছিল অল্প আর তাতেই পাহাড় ঢেকে আছে । বুবাই বলল ,” কিছুই দেখা যাচ্ছে না ।এই সময় আকাশ ঝাকঝকে থাকার কথা কিন্তু ।‘’
    ------অক্টোবর ভালো সময় । আকাশ পরিষ্কার থাকে , পাহাড় দেখা যায় ।
    ------ নভেম্বরও ভালো।
    ------  এখন মেঘ হচ্ছে কেন ?
    ------ হাওয়া  অফিস বলেছে বৃষ্টি হবে না ।
    ------ কিন্তু মেঘের কথা কি বলেছে মেট অফিস ?
    ------ বলে তো ।
    ------ দেখিস নি ?
    ------ না।
    ------ কেন ?
    ------ দেখি নি ।
    ------ কেন , দেখলে পারতিস ।
    ------ সব সময় দেখলে মুশকিল ।
    ------ জানা দরকার ।
    ------ সব জানলে বেরতেই পারবি না । তাছাড়া সব সময় মেলেও না ।
    ------ হাওয়া অফিসের কথা ?
    ------ হ্যাঁ ।
    ------ জি পি এসও মেলে না ।রাস্তা গুলিয়ে দেয় ।
    এইসময় মেঘ সরে গিয়ে খানিকটা পাহাড় দেখা গেল আর আমরা এর ওর ঘাড়ে পড়ে রেস্তোরাঁর জানলার ফাঁক দিয়ে পাহাড় দেখছিলাম । আমাদের খাবার দিয়ে গিয়েছিল চাইনিস ডিশ নিয়েছিলাম ।এখানে চাইনিসই  ভালো করে । তবে বিনোদ ভাত খেল ,আমাদের দিতে দেরি হয়েছিল আর ও খেয়ে উঠে যায় আগে । আমারা খাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এক টুকরো পাহাড় দেখে ফেললাম তাতে খাবারটাও আরও সুস্বাদু লেগেছে ।পাহাড়ও সুস্বাদু লেগেছিল বলে মনে হচ্ছিল কি ? বুবাই বলেই ফেলে ,” পাহাড় চুড়োয় আইসক্রিম।‘’
    ----- ছড়া । সুনীলের ছড়ার লাইন ।
    ----- আইসক্রিম বলল কেন ?
    ----- কল্পনা ।ছড়া তো, বাচ্চাদের ছড়া ।
    ----- অদ্ভুত ছড়া !
    ------ কেন ?
    -----  পাহাড়  দেখে হবে না ! খেয়ে দেখতে হবে ! আইসক্রিম বলে চুষতে হবে !
    ----- দেখে যদি আশ না মেটে ?
    ----- আশ মেটাতেই হবে ?
    ----- নিশ্চয়ই ।
      বিকেলে গাড়ি নিয়ে ডাও হিলের ওপাশটা ঘুরে এলাম । আর কোথা থেকে হাওয়া দিচ্ছে মালুম হচ্ছে না । কী  গন্ধ পেয়েছিলাম যেন ?  ওক আর পাইন গাছগুলো আরও লম্বা লম্বা লাগছে । এই কবছরে আরও লম্বা হয়েছে কি ? তবে আশ্চর্য কুয়াশা ছিল আগেও ,প্রচুর ছিল।শেষ কবে এলাম? এইসব ভাবতে ভাবতে বাজারে এসে মালের খোঁজ করতে করতে ট্যুরিস্ট লজের লাগোয়া মদের দোকানে ল্যান্ড করেছি ।বিকেলের আলো পড়তে না পড়তেই বেশ ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে আর বুবাই হুড় তুলেছে ,” আআআজ রাম খাব ।“ প্রদীপ কিছুতেই রাম খায় না । কারণটা আদ্ভুত , ওর বউ নাকি রামের গন্ধ মানতে পারে না । আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ,” মানতে পারেনা বলছিস কেন ?” বুবাই বলল ,” একটা নীতি ফিতির ব্যাপার মনে হচ্ছে ।পুলিশ ?“
    ----- পুলিশ কোথায় ?
    ------ মানা টানার কথা বলছিস ।
    ----- তবে কী  বলব ?
    ----- কিছু বলবি না ।
    ----- তা হয় না ।
    ------ রাম খেয়ে বউকে চুমু খেতে যাবি?
    ------ দুস, ওসব উঠে গেছে ।
    ----- কবে থেকে ?
       প্রদীপ আর বুবাইয়ের মধ্যে গোলতাল থামানর জন্য বলি ,” আসলে মানতে পারা টারা নয়, সহ্য করতে পারে না । তাই তো ?’’ প্রদীপ আপাতত চুপ করে যায় কিন্তু ওর জন্যই আমরা ইচ্ছে হলেই রাম খেতে পারিনা ।তবে সেদিন প্রদীপ কিছু আপত্তি করল না । করতেই পারত , বউ ছাড়াও অন্য  কোন  অজুহাত দেখিয়ে ,আটকাতে পারত কিন্তু করেনি ও । যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করল তারপর  চুপচাপ মালের দাম মিটিয়ে দিল প্রদীপ  । কেন কে জানে ? এমনিই হয়ত।বেড়াতে গেলে এইরকমই হাল্কা মেজাজে সব নিতে নিতে যেতে হয়,  যাকে বেড়ান বলে।
       কার্শিয়ং ট্যুরিস্ট লজে থাকার জায়গাটা তলায় । পাহাড়ের ধাপে তিনতলা বাড়ি ওপরটা রিসেপশান, রেস্তোরাঁ আর একটা ছোট্ট সুন্দর বার  তার নীচের দু তলায় থাকার ঘরগুলো ধাপ থেকে জেগে আছে । সরু কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে,  সে দিয়ে তলায় নেমেছি ।নামার সময় মনে হল ঝক ঝকে আলোর জগত ছেড়ে  আলো আঁধারির মধ্যে প্রবেশ করছি আর কাঠের মজবুত বাংলোটায় ভুল করে ঢুকে থাকা  পুরনো আলোরা চারদিক খেলা করে বেড়াচ্ছে নিস্তব্ধ নিচের তলায় আর  বেসমেন্টে । তারা সিঁড়ি দিয়ে নেমে সরু করিডোর জুড়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল ।  যেভাবেই হোক ওরা আমাদের পছন্দ করে ফেলেছে ।এরকম কি আলোরা সকলের সঙ্গেই করে থাকে ? নাকি আমাদের আলাদা করে পছন্দ করেছে ? আলাদা করে পছন্দ করার মতো কী আর অবশিষ্ট আছে আমাদের ? জীবন অনেকটা গড়িয়ে এসেছে এখন  এইখানে, এই মুহূর্তে । তখন যদি পছন্দ হয় সেটাতেই কিছু সন্দেহ করছিলাম আরকি । তারপর ঘরে ঢুকে সব জিনিসপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে ,  বাইরে জানলা দিয়ে তাকাতেই  অন্ধকার দিয়ে , পাহাড়ের ধাপের ওপর থেকে বুটি বুটি আলো দেখা যাচ্ছে কার্শিয়ং শহর জুড়ে , ইতস্তত সে আলোরা মালার মতো নয়-  ছড়ান  ছিটনো। হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় একে একে লেটকে গেলাম আমরা । ওপরদিকে তাকাতেই ছাদ। কাঠের ঘরের  ছাদটা কৌণিক তাই ওপরে তাকানো যায় না। তাকালে ছাদ ছোট হয়ে পড়তে থাকে, মনে হতে থাকে ক্রমশ নিচে নেমে আসছে কাঠের পেল্লায় ঝকঝকে কাঠামোটা ।তখন এক  ক্লাউস্ট্রোফোবিয়া  গ্রাস করে নেয়। মনে হয় চারপাশ থেকে সবকিছু চেপে ধরল বলে।  প্রদীপ বলল ," বারবার ম্যানেজারকে ফোন করছি ধরছে না। বিনোদটা শোবে কোথায় রাত্তিরে কে জানে !" বুবাই বলল , আমাকেই বলল ," তুই একবার চেষ্টা করে দেখ না ।“  আমি ফোন করাতেও কেউ ধরে না , ফোন বেজে যেতেই থাকে ।  ম্যানেজার কোথায় আছে বোঝা যাচ্ছে না, ম্যানেজার কোথায় আছেন বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। প্রদীপ বলে ,” একবার রিসেপশনে দেখে আসি। " এই বলে ও উঠতে যাবে এই সময় কী  ভাগ্গি আমার ফোনটা বেজে উঠল। দেখি ম্যানেজার কল ব্যাক করেছে । সে জন্য ফোন ধরেছি ,“ হ্যালো ম্যানেজার সাহেব।”
    —— গুড ইভনিং।
     —— গুড ইভনিং।
    ------- কথা ছিল । অনেকবার ফোন করেছি ।
    ------ শিলিগুড়ি ছিলাম,  সরি স্যার ।
    ------ না না ঠিক আছে ।
    ------ বলুন স্যার ।
    ------ বলছিলাম।
    ------ বলুন ।
    —— একটা ঘর কি  পাওয়া যাবে বিনোদের জন্য?
    —— বিনোদ?
    —— মানে যে ছেলেটি গাড়ি চালাচ্ছে। 
    —— ড্রাইভারের ঘর হবে না স্যার সে তো আগেই বলেছি। 
    —— নানা ড্রাইভারের ঘর নয়। 
    ----- তবে ?
    ------ গেস্ট ধরতে পারেন।
    --------- আপনিই তো ড্রাইভার বললেন স্যার।
    --------- ঠিক আছে  , বলেছি । তবে গেস্টও ধরতে পারেন।
    —— বলছি তো স্যার ড্রাইভারের ঘর দিতে পারব না। পুরো বুকিং আছে।
    -------- দেখুন না , প্লিজ।
    -------- কী  করা যায় বলছি স্যার।
    -------- না না সেটল করে দিন ম্যানেজার সাব।  কাল থেকে গাড়ি চালিয়ে আসছি।
    -------- ঠিক আছে ।
    ------ হ্যালো, হ্যাঁ ।শুনছি।  
    ------ গাড়িতে শুতে বলুন স্যার । 
    —— এই ঠাণ্ডায় গাড়িতে! 
    —— ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর গাড়ি রয়েছে স্যার।গাড়ির প্রটেকশনও হবে।
    ----- এই ঠাণ্ডায় !
    -----  গাড়িতে শুতে বলুন স্যার। ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে দিচ্ছি। 
    ——  ঘরে হবে না?
    —— সরি, হবে না স্যার। 
    —— তা হলে আমাদের ঘরেই এক রাত। 
    —— সেটা এ্যালাউ করতে পারব না স্যার। চারজন প্রটোকলে আটকাবে।
    ------- কিসে ?
    ------- প্রটোকলে স্যার , আমি ফেঁসে যাব। প্লিজ।
    —— ঠিক আছে। কম্বল কখন দেবেন। 
    —— এখনই দিয়ে দিচ্ছি স্যার। 
    বিনোদকে বললাম,“ তোমার ঠাণ্ডার ধাত নেই তো?”
    ও বলল,“ না।”
    ------ একটা রাত গাড়িতে শুতে হবে ।
    ----- ভালোই হবে ।
    ----- গাড়িতে ? এই ঠাণ্ডায় , অসুবিধে হবে না ?
    ----- কিসের ?
    ----- ঠাণ্ডায় ।
    ----- আমি চাদর এনেছি , শাল ।
    ----- এরা অবশ্য কম্বল দিচ্ছে ।
    ----- দিক না , ভালো ই হবে ।
    ----- দেখ ।
    ----- আমার জন্য ভাববেন না দাদা । আমার গাড়িতে শুতে ভালোই লাগে , কতবার শুয়েছি ।
    ----- তাই ?
    -----  হ্যাঁ  দাদা। খুব ভালো হয় ।
    ----- কিসে ?
    ----- গাড়ির সঙ্গে থাকলে ।
    ----- কেন ?
    ----- কথা হয় ।
    ----- কিসের কথা ।
    ----- ও থাক দাদা । আপনারা ভাববেন না একদম।
    বুঝলাম বিনোদ এড়িয়ে গেল । কে না জানে ও গাড়ির সঙ্গে কথা বলতে পারে । কী  কথা বলে জানান দেয়  না।  কিছুতেই দিতে চায় না তো কী আর করা যাবে। 
     আমরা সেদিন রাত্তিরে কার্শিয়ং ট্যুরিস্ট লজের জানলাটা খোলা রেখে রাম  খেতে বসেছিলাম। নানা সুস্বাদু খাবার দিয়ে যাচ্ছিল রেস্তোরাঁ থেকে , তার জন্য  ইন্টারকম থেকে বাইশ নম্বরে ফোন  করলেই হল।  কিছুক্ষণ  পর থেকে জানলা দিয়ে অনবরত পাহাড়ের , বাইরের আলো আর ঠাণ্ডারা কাঠের ঘরের মধ্যে ঢুকতে থাকে।  একটু একটু করে নেশা চড়ে যেতে , অনেক কিছু মনে পড়ে গেল।বুবাই বলল, “তোদের জ্যোতিদার কথা মনে আছে। জ্যোতিদারে, কার্শিয়ংয়ের স্কুলে পড়ায় না। "
    ------- জ্যোতিদা।?
    ------- শ্মশান কালীতলার জ্যোতিদা , আমি ইংলিশ পড়তাম।  
    ------- খুব ফিটফাট থাকত ?
    -------  হ্যাঁ , মাঝে মাঝে সুট টাই পরত।
    ------- ও, এবার মনে পড়ে গেছে।
    ------- হ্যাঁ , সব মনে পড়ে যাবে।
    ----- জ্যোতিদার বাবা পুরনো আমলের গেজেটেড অফিসার ছিল, মনে আছে ।
    ----- হ্যাঁ, মনে পড়ছে ।ঠিক ।
    ----- কার্শিয়ংয়ের স্কুলে চাকরি নিয়েছে , আমার সঙ্গে ফেস বুকে যোগাযোগ আছে তবে স্কুলটার নাম কিছুতেই মনে করতে পারছিনা ।
    ------ চেষ্টা কর ।
    ------ করছি ।
    ------ কর ।
    ------ এক কাজ করলে হয় না ।
    ------  কী ?
    -------- কাল গেলে হয়না ?
    -------- কোথায় ?
    -------- জ্যোতিদার স্কুলে ?
    -------- তোর ভালোই নেশা হয়েছে !
    -------- কেন ?
    -------- এখন  সব স্কুল বন্ধ।
    ------- কেন ?
    ------- পুজোর ছুটি।
    ------- কনভেন্ট স্কুলে পুজোর ছুটি দেয়  না।
    ------- কী সব বলছে।
    প্রদীপ বলল ," ওই জন্য আমি রাম খাইনা। দুম করে নেশা চড়ে যায়। " বুবাইকে থামানো যাচ্ছিল না ,সে প্রদীপকে ঠেসে ধরে , " একদম বাজে কথা হবে না। ওই জন্য তুমি রাম খাও না। তোমার বউ সহ্য করতে পারে না গন্ধ তাই খাও না।  গুল মাড়াচ্ছো।  গুল মারবে না একদম। “  আমি বললাম , " শোন বুবাই , একদম উল্টোপাল্টা করবি না। ইটিনেরারি চেঞ্জ করা যাবে না , রোড ট্রিপ। "
    ------ তো কী ?
    ------ সময় মেপে চলতে হবে।
    ------ মেপে ?  
    ------ কাল সকালে বেরিয়ে দার্জিলিং একচক্কর দিয়ে বিকেলের মধ্যে মংপং নেমে যাব।
    ------ নেমে যাব ?
    ------ হ্যাঁ।
    ------ দার্জিলিংটা না গেলে নয়।
    ------ না।
    ------ কেন ?
    ------ ঠিক করা আছে।
    ------ মারো গুলি। কাল জ্যোতিদাকে এক্সপ্লোর করব।
    ------ না।
    ------ বললেই হল।
    ------ দার্জিলিং মিস করা যাবে না।
    ------ কেন ?
    ------ বলছিতো না !
    ------ কী  বলছিস , কেন বলছিস , কেন ইটিনেরারি সাজালি , সব বলতে হবে।
    ------ শুনবি ?
    ------ বল।
    ------ আমাদের একটা জমি কিনেছিল।
    ------ কে ?
    ------ ঠাকুর্দা।
    ------ বাবার বাবা ?
    ------ হ্যাঁ , বাবার বাবা।
    ------ কোথায় ?
    ------ দার্জিলিং।
    ------ কী ?
    ------ দার্জিলিংয়ে জমি কিনেছিল ঠাকুর্দা।  বড় জ্যাঠার সঙ্গে দাদুর ছবি আছে , সুট টাই পরা।
    ------ ঠিক জ্যোতিদার মতো !
    ------ তারপর  সে জমি ধ্বসে যায় , আর পাওয়া যায় না।
    ------ তারপর ?
    ------ সে জমিটা খুঁজে দেখব।  পাহাড়ের ওপর একটা জমি ! ওফঃ ভাবতে পাচ্ছিস ! কী দারুণ  হবে ! একবার ভেবে দেখ প্রদীপ , বুবাই কী দারুণ  হবে যদি আমরা ……।
    ----- যদি আমরা ?
    ------ জমিটা খুঁজে পাই।
    সেদিন প্রদীপ , বুবাই আমার দিকে  হাঁ করে তাকিয়েছিল, কথা বলেনি । এরকম হয় রাম  খেলে ,দুম করে নেশা চড়ে যায়, যেমন বুবাইয়ের গিয়েছিল। আর আমার ? প্রদীপ বলেছিল ," নেশার ঘোরে কী সব আটভাট বকলি ! দার্জিলিংয়ে  জমি ! যত গল্প। " আমি বললাম," গল্প নয় ! মোটেই  নেশা হয়নি আমার।একটুও হয়নি। বললেই হল।  ''
     আমার যে একদমই নেশা টেশা চড়েনি এটা বুঝলাম কিছুক্ষণ পর।বেশি নেশা হলে প্রথমে  খালি গরম হয় , তারপর গরম- ঠাণ্ডার বোধ চলে যেতে থাকে। প্রদীপ আর বুবাইয়ের গিয়েছিল  কিন্তু আমার যায়নি।  আমি ঠিকই বুঝেছি  খোলা জানলা দিয়ে কুল কুল করে অক্টোবর শেষের পাহাড়ি  ঠাণ্ডা আসতে আসতে তখন ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে এসেছে ঘরের ভেতর , তাই জানলাটা বন্ধ করে দিলাম।অন্যরা খেয়ালও করেনি, আসলে নেশা হয়ে গিয়েছিল ওদের । প্রদীপ দেখলাম আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে । ওর কি গরম লাগছে ? আমি বললাম , “ আর ঠাণ্ডা আসবে না । খাবার দিয়ে দিতে বল ।“ প্রদীপ তখনো আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে বলছে , “ কিছুতেই মানবিনা !”
    ------ কী ?
    -------- দার্জিলিংয়ে কারুর জমি থাকা সম্ভব নয় !
    -------- আমাদের ছিল।
    -------- সে জমি কোথায় ? কেমন দেখতে ?
    -------- কী করে বলব ?
    -------- কেন ?
    --------  ধ্বসে গেছে।
    -------- তোদের জমিটাই ধ্বসে গেল ! আর সব জমি , সবার জমি ঠিকঠাক রইল !
    -------- থাকলে কী করব ?
    -------- কিছু করবি না?
    -------- তাবলে বলব না ?
    --------- যে জমি নেই তা নিয়ে কথা বলবি না , ভাববি না মোটেই !
    --------- আশ্চর্য ! কী  হবে ?
    -------- মারাত্মক ক্ষতি।
    -------- কার ?
    -------- তোর হবে।  আমাদের সবার হবে।  হতেই থাকবে।
    জানলাটা খোলা রাখলেই হতো।  হাওয়া লেগে নেশা কেটে যেত।  রামের নেশা , ওই জন্য কি প্রদীপ  খেতে চায়না কক্ষনো ? রাম নিতে পারে না বলে ? বুবাইও বাওয়াল টাওয়াল করে পাশবালিশ জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।  আমিই ইন্টারকমে ফোন করে আগেই  অর্ডার করা খাবার ঘরে দিতে বলেছি। ডেকে ডেকে খাওয়াতে হবে দুটোকে , উপায় নেই।

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | |
  • ধারাবাহিক | ১০ এপ্রিল ২০২৪ | ৩০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন