ধরা যাক আমি একজন দাস। সারা জীবন মন দিয়ে সেবা করতে লাগলাম এবং আমার ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদেরও উপদেশ দিয়ে গেলাম, আমার মতো সেবা করতে থাক, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের আবার স্বর্গে দেখা হবে। স্বর্গে গিয়ে দেখা হচ্ছিল কিনা জানার কোন উপায় নেই, কিন্তু এই বিশ্বাসে বিভোর দাসেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাসই থেকে যাবে! তারা অন্য আর কিছু হয়ে ওঠার চেষ্টাই করবে না। এটাই মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়া। আর এখানেই ব্রাহ্মণ্য দর্শনের সঙ্গে লোকায়ত দর্শনের সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব। এবং বলা বাহুল্য এই দ্বন্দ্ব উচ্চস্তরীয় পরমমোক্ষ লাভের জন্যে নয়, খুবই নিচুস্তরের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। ... ...
এই লেখার শুরুর আগে শুরুর গল্প বলে কিছু নেই। কিংবা আছে, কে জানে! পাই বলল একটা নিয়মিত কলাম লিখতে। ব্যাপারটা একটু ভীতপ্রদ, কারণ নিয়মমাফিক লেখা চাপ। আর তাছাড়া আজকাল গুরুতে অন্য বাকি সব লেখা বা কলামের সমাজচেতনা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অ্যানালিসিসের তীব্রতা – এর সবকটাই আমার নাগালের বাইরে। কিন্তু পাই-য়ের রিকোয়েষ্ট ফেলা চাপের – তো যেটা ঠিক হল, আমার যা খুশী লেখার লাইসেন্স থাকবে। এটুকু বলার, যাদের ব্রেন সারাদিন জটিলতার চাপ না নিয়ে রাতের বেলা রেষ্ট নিতে পারে না – যাদের ব্রেন তত্ত্ব এবং তথ্যের ভারে নিমজ্জিত না হলে হা-হুতাশের ফীডব্যাক লুপে ঢুকে করে – তাঁরা স্বচ্ছন্দে এই লেখা এড়িয়ে যেতে পারেন। এই কলামের অনেক লেখা হয়ত মায়ের কাছে মাসির গল্পের মত হয়ে যাবে – তাঁরা আমাকে নাদান এবং চাষার ছেলে বলে অ্যাডজাষ্ট করে নেবেন। তো কি দিয়ে শুরু করা যায়? ঠাকুমা বলত শুভ দিনে নাকি মাছ পয়া জিনিস – ছোটবেলায় পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট হলে তার পিছনে পুকুরের কাতলা মাছের অবদান যে অর্ধেকের বেশী সেই বিষয়ে ঠাকুমা আমার পুরো কনভিন্সড ছিল। তাই মাছের গল্প দিয়েই শুরু হোক। লেখা ভালো লাগলে, বেল আইকনে চাপ দেবেন। ও, এখানে তো আবার বেল আইকন নেই! বাট ইউ নো, হোয়াট আই মিন। কিছু একটাতে চাপ দেবেন। ... ...
যজ্ঞের সমস্ত উপচার, অনার্য দাসেরাই সংগ্রহ করে দেয়। যজ্ঞের বেদী নির্মাণ, বিপুল সমিধসম্ভার, তৈজসপত্র, ঘি, দুধ, শস্য, ফল-মূল সর্বত্র তাদেরই হাতের স্পর্শ। যজ্ঞ শেষে পুরোহিতরা দক্ষিণা হিসাবে তাদের ঘরে নিয়ে যায় যে বিপুল সম্পদ – সোনা, রূপো, সবৎসা-গাভী, অজস্র শস্য সম্ভার, ধাতব কিংবা মাটির পাত্র – সে সবই অনার্য বৈশ্য ও শূদ্রদের পরিশ্রমের উৎপাদন। অথচ তারা বুঝতেই পারে না, দেবতারা কারা। পুরোহিতরা কাদের জন্যে যজ্ঞ করছেন। যে মন্ত্র তাঁরা বলছেন, তার মধ্যে কোথাও কী আছে বিপুল এই অনার্য শ্রমের সামান্যতম স্বীকৃতি? কঠোর শ্রমের পরিবর্তে অসহায় তাৎপর্যহীন এই জীবন তাদের ঠেলে দিতে লাগল আরও নিরাশার দিকে। মনে মনে আকুল প্রার্থনায় তারা আরও বেশি করে মাথা কুটতে লাগল তাদের নিজস্ব দেবতাদের পায়ে। ... ...
পিওর মালবেরী সিল্ক ছাড়াও আজকালকার গরদ শাড়ির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ভেলভেট পাড় - সামনের দিকে জেল্লাদার, উল্টোদিকে সামান্য ম্যাট ফিনিশ। এইরকম পাড় বুনতে গেলে ব্যবহার করতে হয় ৪*১ ট্যুইল টেকনিক। মজার কথা হল কোভিড পূর্ব সময়ে যা আমার এবং আরও অনেক মেয়ের প্রায় জাতীয় পোশাক ছিল অর্থাৎ ডেনিম জিন্স- তা বোনা হয় এই ট্যুইল পদ্ধতিতে; আবার পুজোর সময় যখন হাজার আলসেমি অনায়াসে কাটিয়ে আলমারিতে মা-জেঠিমার গরদের দিকে চোখ যায়- সেখানেও এই একই বয়নপদ্ধতির ছোঁয়া! ... ...
কৈশোরে গড়ের মাঠে (তখন মনুমেন্ট ময়দান নয়, গড়ের মাঠই বলা হত) ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়ে মাউন্টেড পুলিশের তাড়া খেয়ে (ঘোড়সওয়ার পুলিশ) গ্যালারিতে বসার পর টের পেলাম — এটা ঘটিদের, থুড়ি মোহনবাগান সাপোর্টারদের এলাকা। মুখে কুলুপ এঁটে ওদের কথোপকথন শুনতে গিয়ে জানলাম — খেলার মাঠে বাঙালদের কোড নেম ‘জার্মান’! কেন? কে জানে! ... ...
জানুয়ারীর শেষের দিকের সেই ঠান্ডাকে পাতলা জামাটা বাগে আনতে পারছিল না, আমি ক্রমশঃ কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। কাঁধের গামছাটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলাম যতটা ঢাকা যায়। ফাঁকা জায়গায় কাঁচা বাঁশের চৌদল্লা ছুঁয়ে বসে আছি অনেকক্ষণ – গঙ্গার হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য উঠে এসে একটু আড়াল পানে যাব তার উপায় নেই। কারণ আমাকে নাকি ছুঁয়ে থাকতেই হবে! পদা-কাকার অবশ্য শীত করার কথা নয়, তবুও সাদা কাপড়টা ভালো করে টেনেটুনে দিলাম। চন্দনের গন্ধ আছে, আছে রজনীগন্ধার আর নতুন কাপড়ের। মাথায় গোড়ায় তখনও জ্বেলে রাখা ধূপ গোছার থেকে ধোঁয়া পায়ের গোড়ায় আমার দিকেই ভাসিয়ে দিচ্ছে গঙ্গার হাওয়া। গাছের পাতা দেখা যায় না অন্ধকারে, ওরা অনেক দূরে – তাই ধোঁয়া দেখেই বুঝতে পারি বাতাসও মাঝে মাঝে আনমনা হয়! এতদূরে বাল্বের আলোও এসে ওঠে নি ঠিকঠাক – প্রায় অন্ধকারই – যেটুকু আবছায়া তাও ওই হ্যারিকেনের আলোয়। পদাকাকুর মুখটা দেখতে পাচ্ছি না পায়ের দিকে বসে, যেন মনে হচ্ছে শুধু সাদা তুলো আভাস পাচ্ছি মুখের আশেপাশে। কতই বা বয়স আমার তখন! মনে হয় সেই প্রথম একাকীত্বের অনুভব – আনমনা ভাবতে থাকি, আসলেই এই ভাবেই সবাই একদিন একা হয়ে যাব – তখনও হয়ত অন্য কেউ চন্দনের গন্ধ পাবে – প্রিয়জন, প্রতিবেশী, অচেনা? উত্তর তো জানা নেই আমার! ... ...
জন্মের দুশো বছর পরেও, বিদ্যাসাগরকে ঘিরে ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির চিরাচরিত চর্বিতচর্বণ চলতে থাকুক। লুঠেরা উপনিবেশের প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, অব্যাহত থাকুক তাঁদের। শুধু অগণন অন্ত্যজ হিন্দু ও দরিদ্র মুসলমান এবং আর্ত ও অসহায় নারী, সেই দাসত্বের দোসর হবেন না। সুকৌশলে তাঁদের চিরদিন অপাঙ্ক্তেয়, প্রান্তিক, বঞ্চিত করে রাখার দিন শেষ। তাই, তাঁরা তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করবেন বিদ্যাসাগরকে। তাতে যদি তিলে তিলে গড়ে তোলা সযত্ন ‘নির্মাণ’ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে, তবুও তাঁদের প্রতিস্পর্ধী দৃপ্ত উচ্চারণ থমকে যাবে না এক মুহূর্তের জন্যও। কারণ তাঁদের কথা কেউ বলেনি এতদিন, পরেও বলবে না। তাঁরা যে ‘ছোটলোক’! ... ...
মন্দিরে মসজিদে না থাকুন, ঈশ্বর আছেন আমাদের মননে, চিন্তায়, দৃষ্টিতে, অনুভবে। সে উপলব্ধি আমাদের অন্তরে আসে অহরহ। তিনি আছেন, শরতের নির্মল আকাশ ও সোনালী রোদ্দুরে। তীব্র গ্রীষ্মের পর ঘন বর্ষার প্রভাতে। শীতের শুকনো-ঝরাপাতা বওয়া হিমেল হাওয়ায়। বসন্তের পলাশ-রাঙা অরণ্যের অভিলাষে। সমুদ্রের ব্যাপ্তিতে, পর্বতের মহিমায়। প্রতিটি শিশুর দৃষ্টি ও হাসিতে। নিরন্ন মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তিতে। মায়ের মমতায়, পিতার হাত ধরে উৎসবের মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানোয়। ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ায় কপালে দিদি বা বোনের অনামিকার স্পর্শে, প্রিয়ার মুখ চুম্বনে। ... ...
আমি কেন আই-ফোন কিনলাম? এই প্রশ্নের উত্তর খুবই সোজা, অমৃতার চাপে পড়ে! প্রশ্ন উঠতে পারে, অমৃতা তাহলে আই-ফোন কিনল কেন? পরিপার্শ্বের চাপে পরে? পিয়ার প্রেসার? স্টেটাস সিম্বল? – হতে পারে এর অনেকগুলোই কিছু কিছু সত্যি। শুধু অমৃতা নয়, একটু ভেবে দেখেছেন কি আই-ফোনে কি ভাবে ‘দ্যা মোবাইল’ হয়ে উঠল বা আজকাল আমজনতা কেন যে দামেই আই-ফোন বেরুচ্ছে সেই দামেই কেনার জন্য অগ্রীম অর্ডার দিচ্ছে বা রাত জেগে লাইন লাগাচ্ছে? তাই আসল প্রশ্ন অমৃতা কেন আই-ফোন কিনল সেটা নয় – প্রশ্ন হল, কিভাবে অসংখ্য অমৃতা-দের মনে হতে শুরু করল যে আই-ফোন-ই সেই মোবাইল যা তাদের চাই? আর এই যে আমি গুচ্ছ আঁতেল - এতো কিছু জেনেও তাহলে আমি আই-ফোন কিনলাম সত্যিই কি শুধু অমৃতার চাপে পড়ে? নাকি তার বাইরেও কিছু আছে? এই সব নিয়ে গভীরে ঢোকার আগে একটা গল্প শুনে নেওয়া যাক - কালো মুক্ত-র (ব্ল্যাক পার্ল) গল্প। ১৯৭৩ সাল নাগাদ একবার দক্ষিণ ফ্রান্সের কাছে সমুদ্রে নিজের ইয়াট-এ করে ছুটি কাটাতে গিয়ে সালভাদর এর সাথে আলাপ হয়ে গেল বরুইলে নামের এক স্টাইলিশ ফ্রেঞ্চ ব্যবসায়ীর সাথে। মুক্ত প্রসঙ্গে উঠতে বরুইলে জানালেন তিনি এক অদ্ভূত জিনিসে সন্ধান পেয়েছেন – এমনিতে তিনি এক তাহিতি কন্যার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি ওদিকে ঘোরার সময় লক্ষ্য করেছেন যে দক্ষিন প্রশান্ত মহাসগারে তাহিতির কাছেকাছি ওদিকেটা একধরণের কালো-মুখো ঝিনুকে ভর্তি – আর সেই সেই ঝিনুক থেকে নাকি বেরিয়ে আসে এক বিষ্ময়কর বস্তু ‘কালো মুক্তো’ ... ...
মেয়েদের হেঁসেল ঠ্যালার গল্প কি সারা পৃথিবী জুড়েই এক, এমন কি আজকের দিনেও? পাপুয়া নিউ গিনি-র কাছে একটা দ্বীপ আছে যার নাম ‘ভানাটিনাই’ – তো এই দ্বীপটা অনেক অ্যান্থ্রোপলজিষ্ট-দের আগ্রহের বিষয় হয়েছে ইদানিং কালে কারণ এদের সমাজে মেয়েদের যে সম্মান তা নাকি পৃথিবীতে বিরল – এমনকি চরম আধুনিক পশ্চিমা সমাজেও। এদের সমাজে এমন কোন ধারণার বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায় নি যেখান থেকে পুরুষেরা মেয়েদের থেকে শ্রেষ্ঠ তার ইঙ্গিত পায়। মেয়ে এবং ছেলেরা সমভাবেই সব কর্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারে – তা সে উৎসবের আয়োজনই হোক, বা নৌকা নিয়ে শিকারে বেরোনোই হোক – বা পশুপালন, চাষআবাদ, যুদ্ধ, জমির উত্তরাধিকার, কোথায় বাড়ি বসতি গড়ে তোলা হবে তার সিদ্ধান্ত, কি বাণিজ্য হবে তা ঠিক করা – সবেতেই। মহিলা এবং পুরুষ যে কেউ নিজেদের দক্ষতায় সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদা লাভ করতে পারত। গার্হস্থ্য হিংসা এবং মারপিট প্রায় নেই বললেই চলে – নিজেদের কাজের ব্যালেন্স নিয়েও খুব বোঝাপড়া সেখানকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে। কে কেমন ভাবে সময় কাটাবে তা ঠিক করার স্বাধীনতা আছে সবার – মানে যাকে বলে এক স্বর্গরাজ্য লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে। যদি জানতে চাই এবার - আপনার কি মনে হয় সেই ভানাটিনাই সমাজে বাড়ির রান্না কে করত! ... ...
কলম্বাস বাবু শুধু ভারতকে নিয়েই কনফিউশনে ভোগেন নি – ক্যারাবিয়ান দ্বীপে পৌঁছেও বেশ ছড়িয়ে ছিলেন, ছড়ানোর মধ্যে এক অন্যতম উদাহরণ হছে চিলি-এর সাথে পেপার-কে ঘুলিয়ে ফেলা! ক্যারাবিয়ান দ্বীপ সান সালভাদরে (আজকের দিনের ওয়াটলিং দ্বীপ) পৌঁছে ঝাল ঝাল খাবার খেয়ে তিনি মনস্থির করে নিলেন যে যা থেকে ঝালের স্বাদ আসচে তাহাই ব্ল্যাক পেপার! কালো মরিচের স্বপ্নে তাঁর মন আচ্ছন্ন ছিল তখনো! যতক্ষণে তিনি বুঝতে পারলেন যে সেই ঝাল কালো মরিচ থেকে নয় বরং ছোট কুঁড়ি জাতীয় ফল এর জন্য এর জন্য দায়ী – ততক্ষণে বড় দেরী হয়ে গেছে। স্প্যানিশরা এই ছোট কুঁড়ি ফলকে পেপার বলে ডাকতে শুরু করে দেয় – সেই থেকে নামটা প্রচলন হয়ে গেছে! ... ...
আসন্ন ভূত-চতুর্দশী, মাকালীর আরাধনা ও দীপাবলির অগ্রিম প্রীতি, শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই সকলকে। ভূত-চতুর্দশীতে ভূতেরা সত্যিই কী চতুর হয়ে ওঠে? এবং সেই কারণে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে তিথিটাকে ভূত-চতুর্দশী বলাটা ঠিক হয় কি? এই গল্পটি পড়ার পর আপনাদের এ বিষয়ে একটু ভেবে দেখতে অনুরোধ করবো। শব্দহীন হোন। আলোকময় হোন - খুব ভালো থাকবেন, প্লিজ। ... ...