এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ময়ূরঝর্ণা - পর্ব ১৭ 

    বিতনু চট্টোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৮ মার্চ ২০২৪ | ১৮৭ বার পঠিত
  • ২৩-০১-২০১৬, ময়ূরঝর্ণায় অরিন্দম

    দুপুর প্রায় একটা, কিছুক্ষণ আগেও খিধেতে পেট যেন জ্বলে যাচ্ছিল অরিন্দমের। সেই সাত সকালে ঝাড়গ্রাম থেকে বেরিয়েছে চা-বিস্কুট খেয়ে, তারপর আর খাওয়া হয়নি। অরিন্দম ভেবেছিল, ময়ূরঝর্ণা পৌঁছে ধর্মার খোঁজ পেলে তাড়াতাড়ি কথা বলে ফিরে আসবে, ফেরার পথে বেলপাহাড়িতে খেয়ে নেবে। কিন্তু কোথায় কী! ধর্মার বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতেই প্রায় একটা বেজে গেল। আর ময়ূরঝর্ণায় কোথায় দোকান, কোথায় খাবার! গাড়িতে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল অরিন্দম। সিগারেটটা খাওয়ার পর এখন আর খিধে তত লাগছে না। হঠাৎ চলে যাওয়া খিধে, মুখে একটা বিস্বাদ ভাব, তেষ্টা, মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকা ধর্মাল মান্ডির কথাগুলো, সুবল মান্ডির চেহারা, ময়ূরঝর্ণা গ্রামের অভিজ্ঞতা, সব মিলে শরীরে, মাথায় যে তালগোল পাকানো পরিস্থিতিটা চলতে থাকে তার অনুভূতিটা ঠিক কেমন অরিন্দম বুঝতে পারে না। গাড়িতে উঠে বসে। ঠিক করে কাঁকড়াঝোড় হয়ে ফিরবে।
    আজ ঠান্ডাও পড়েছে খুব, জোরে একটা হাওয়া দিচ্ছে। গাড়িতে উঠে কাচ তুলে দেয় অরিন্দম। ড্রাইভারকে কাঁকড়াঝোড়ের রাস্তা দেখিয়ে সিটে হেলান দেয়। সেই সকালে ময়ূরঝর্ণা পৌঁছনোর পর থেকে এতক্ষণ যা দেখল, যা শুনল পরপর মনে পড়তে থাকে।
     
    অরণ্যের দিনরাত্রি সিনেমার একটা দৃশ্য মনে পড়ে যায় অরিন্দমের। পালামৌ জঙ্গলের ফরেস্ট বাংলোর বারান্দায় বসে আছে সৌমিত্র আর শুভেন্দু। শুভেন্দু বলে ওঠে, ‘এই সব জায়গায় এলে আয়ু বেড়ে যায়।’ সাধারণ কথাটার একটা জটিল জবাব দেয় সৌমিত্র, ‘আয়ুটা আদৌ বাড়ানোর প্রয়োজন আছে কিনা সেটা ভাবা দরকার।’ কিন্তু সৌমিত্রর না, শুভেন্দুর বলা কথাটা ভাবায় অরিন্দমকে। এই ধরনের কথা সে কলকাতাতেও অনেকের মুখে শুনেছে। জঙ্গলে গেলে, প্রকৃতির মধ্যে গেলে নাকি মানুষের আয়ু বেড়ে যায়। অরিন্দমের মনে পড়ে যায় ধর্মালের মা যমুনা মান্ডির কথা। আচ্ছা, জঙ্গলে গেলে যদি আয়ু বেড়েই যাবে, তবে সুবল মান্ডির বউকে এই বয়সে এভাবে মরতে হয় কেন?  ময়ূরঝর্ণা, জুজারধরা, কাঁকড়াঝোড়ের মতো জঙ্গলে ঘেরা এলাকার মানুষের আয়ু এত কম কেন? বাইরে থেকে এসে তিন দিন থাকলেই যদি আয়ু বেড়ে যাবে, তবে যারা এখানে জন্মেছে, সারাটা জীবন ধরে এখানে আছে, তারা এত কম দিন বাঁচে কেন? আরও পাঁচ-দশটা অজানা জিনিসের মতো এই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পায় না অরিন্দম। তার মনে হয়, এসবই শহরের উচ্চ এবং উচ্চমধ্যবিত্ত লোকের তৈরি করা এক ভিন্ন দুনিয়ার তত্ত্ব, যার সঙ্গে দেশের গ্রামে বাস করা কোটি কোটি মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই। আর সেই গ্রাম যদি হয় ময়ূরঝর্ণার মতো.....
    চাকাডোবা মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে কিছুটা এগিয়ে গাড়ি থামিয়েছিল অরিন্দম। একজনকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছেছিল ময়ূরঝর্ণা গ্রামে, কিন্তু এখানে ধর্মা মান্ডির বাড়ি কোথায়? দু’জন মহিলা হেঁটে আসছে দূর থেকে, গাড়ি থেকে নেমে পড়ে অরিন্দম। রাস্তার বাঁদিকে ঘন জঙ্গল, ডানদিকে ময়ূরঝর্ণা গ্রাম। গাড়ি থেকে নেমে পড়ে অরিন্দম। একটা সরু রাস্তা ঢুকে গিয়েছে গ্রামের ভেতর, সেই রাস্তার মুখে বাঁদিকে তিনটে ঘর। তারপর ঝোপঝাড় ভর্তি কিছুটা ফাঁকা জায়গা, আবার দুটো বাড়ি। সরু রাস্তাটা দিয়ে গ্রামে না ঢুকে অরিন্দম বাঁদিকে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উঠোনে একটা বাচ্চা বসে, পাশে মাটির উনোন। উনোনের ওপর একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি বসানো। অরিন্দম দেখল এক মহিলা মাটির ঘরটা থেকে কিছু কাঠ হাতে বেরিয়ে এল, সম্ভবত উনোন ধরাবে বলে। আর ঘর থেকে বেরিয়েই এক অচেনা শহুরে লোককে দেখে থমকে দাঁড়াল মহিলা। মাটির বাড়িটার বারান্দায় বসে একটা লোক মন দিয়ে মাছ ধরার জাল বুনছে।
     
    ‘এটা ময়ূরঝর্ণা তো?’ অরিন্দমের প্রশ্নে জাল থেকে মাথা তুলে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে লোকটা।
    ‘এখানে ধর্মা বলে কোনও ছেলে থাকে? পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স হবে।’ লোকটা এবার থমকে দাঁড়ানো মহিলার দিকে তাকায়। কে এই অচেনা আগন্তুক, ধর্মা আবার কী করল, লোকটা কেন এসেছে, নানান প্রশ্ন মিলে যে একটা বিভ্রান্ত ভাব তৈরি হয় জাল বুনতে থাকা লোকটা আর এই মহিলার মধ্যে, তা আন্দাজ করতে পারে অরিন্দম। কিন্তু এর কারণ বুঝতে পারে না। তারপর আবার জিজ্ঞেস করে, ‘এই ময়ূরঝর্ণা গ্রামে ধর্মা নামে কেউ থাকে? পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স হবে...।’ অরিন্দম বুঝতে পারে না, লোকটা আর মহিলার চেহারায় যে দ্বিধাগ্রস্ত ভাব তা আসলে ধর্মা নামটার সঙ্গে তারা অপরিচিত বলে নয়, ধর্মাকে তারা ভালোই চেনে। তাদের দ্বিধার কারণ, দু’জনই অরিন্দমকে পুলিশের লোক ভাবছে! আসলে অরিন্দমের জানা নেই, এই ময়ূরঝর্ণা গ্রামে ধর্মাদের বাড়িতে মাঝেমাঝেই পুলিশ আসে। গ্রামে ঢোকার মুখেই বাড়ি হওয়ায় তাদের নানা প্রশ্ন করে, গ্রামের লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তারপর আবার চলে যায়। ফের পুলিশের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়ে লোকটা আর এই মহিলা। অরিন্দম বুঝতে পারে না, এই আদিবাসী দম্পতি তাকে পুলিশ ভাবছে। সে তো কিছুক্ষণ বাদে প্রথম জানতে পারবে যে ধর্মার খোঁজে সে এসেছে, সে আসলে ওয়ান্টেড মাওয়িস্ট নেতা সিংরাই মান্ডির নিজের ভাই। যদিও এই লেখার পাঠক তা ইতিমধ্যেই জানেন।
    অরিন্দম পরপর দু’বার প্রশ্ন করা সত্ত্বেও লোকটা আর মহিলা কোনও জবাব দেয় না। তবে তাদের মধ্যেও কিছুটা সংশয় তৈরি হয় অরিন্দমকে নিয়ে। অরিন্দমের প্রশ্নের ধরন শুনে তাকে পুলিশ বলে মনে হয় না ময়ূরঝর্ণার এই আদিবাসী দম্পতির। কোন দিকে ধর্মাদের বাড়ি দেখিয়ে দেয় মহিলা। সেদিকে এগোয় অরিন্দম, তারপর আরও একজনকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছয় ধর্মা মান্ডির বাড়ির সামনে।
     
    মাটির বাড়ি, ওপরে খড়ের চাল। আদিবাসী বাড়ির সামনের উঠোন, বারান্দা যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে তেমন নয় একেবারেই। ঘরের চারদিকে একটা অগোছালো ভাব। উঠোনে দড়িতে দুটো গেঞ্জি ঝুলছে, মাটির বারান্দায় শীতে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে একজন বয়স্ক লোক। এই লোকটাই সুবল মান্ডি, এখন যার বয়স মাঝ পঞ্চাশ। সামনে থেকে দেখে মনে হবে সত্তর, অরিন্দমকে দেখে লোকটা চোখ তুলে তাকায়। সেই চাহনিতে স্পষ্ট প্রশ্ন, এই সকাল সকাল আবার কে এল? আর কত ভোগান্তি চলবে এই জীবনে? বাইরে অচেনা একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটি ছেলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
    ‘আপনার নাম ধর্মা?’
    ‘না, ধর্মাল। ধর্মাল মান্ডি।’
    ‘আমি কলকাতা থেকে আসছি। আমার হয়তো নামে একটু ভুল হয়েছে, আমি ধর্মা নামে একজনের খোঁজে এসেছি।’ অরিন্দমের কথায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা। অরিন্দম বুঝতে পারে, ধর্মা আর ধর্মাল একই লোক।
    ‘আমি এক পুলিশ অফিসারের কাছে আপনার একটা ঘটনা শুনেছিলাম। অনেক বছর আগের কথা। তখন আপনার দশ-এগার বছর বয়স ছিল, আপনি ঝাড়গ্রামে এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।’
    কোনও কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা, মনে করার চেষ্টা করে পনেরো-ষোল বছর আগের কথা। ধর্মালের মুখ দেখে অরিন্দম বুঝতে পারে না সেই ঘটনা ছেলেটার মনে পড়েছে কিনা!
    আস্তে আস্তে ময়ূরঝর্ণায় সুবল মান্ডির বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক হয়। বাবা-ছেলে দু’জনেরই মনে হতে থাকে বাড়ি ছেড়ে মাওবাদী দলে নাম লেখানো সিংরাইকে নিয়ে জেরা করতে কোনও পুলিশ আসেনি তাদের বাড়িতে। ঘর থেকে বের করে ধর্মাল একটা চেয়ার এগিয়ে দেয় অরিন্দমকে।
    ‘আপনি কী করেন?’
    ‘ট্রেকারে হেল্পারের কাজ করি।’
    ‘বাড়িতে আর কে আছে?’
    ‘আমি আর বাবা।’
    ধর্মাল মান্ডির সঙ্গে কথা শুরু হয় অরিন্দমের। অরিন্দমের তো বলার নেই বিশেষ কিছু, শুনতেই এসেছিল সে। আসলে এসেছিল দেখতে। অনিরুদ্ধদার কাছে ঘটনাটা শোনার পর থেকেই ছেলেটার মুখ, চেহারা তাড়া করছিল ওকে। অরিন্দম এসেছিল সেই তাড়া থেকে মুক্তি পেতে। আর সেই সঙ্গে ছিল কিছুটা কৌতূহল। কেমন ছিল এই যুবকের ছোটবেলা, কেমন ছিল এই এলাকার পরিস্থিতি, কীভাবে দিন কাটত তাদের, একের পর প্রশ্ন করতে থাকে অরিন্দম। কখনও থেমে, কখনও ভেবে ভেবে বলে যায় ধর্মাল। এই কথোপকথন প্রায় পুরোটাই একতরফা। ধর্মাল যা বলে তা মোটামুটি গুছিয়ে নিলে যা দাঁড়ায় তা অনেকটা এরকম, ‘দাদা একদিন হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, তখন আমার ন’বছর বয়স। বাড়ি ছাড়ার এক-দু’মাস পরে দাদা একবার এসেছিল, মা কয়েকবার বলেছিল ওদের সঙ্গে আর না যেতে। তারপর অনেক রাত করে দাদা কয়েকবার এসেছে কিছুক্ষণের জন্য। পরে আসা বন্ধই করে দিল। দাদা বাড়ি ছাড়ার এক বছর পর আমি পড়া ছেড়ে দিলাম, বাবার সঙ্গে কাজে যেতাম। কোনও ভাবে দিন চলত আমাদের। বাবার শরীর খারাপ হতে থাকায় অবস্থা আরও খারাপ হল। তারপর মা মারা গেল......’ পরপর বলে যায় ধর্মাল মান্ডি, চার হাত দূরে বসে শুনতে থাকে তার বাবা সুবল। ছোট ছেলের কোনও কথাতেই কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না তার। ধর্মালের কথা শুনতে থাকে অরিন্দম, শুনতেই তো এসেছিল সে!
     
    ‘মা কীভাবে মারা গেল? কী হয়েছিল?’
    ‘কী হয়েছিল জানতে পারিনি। দাদা বাড়ি ছাড়ার দু’তিন বছর পর হবে, একদিন মা’র জ্বর এল। টানা তিন-চার দিন জ্বর কমে না। তারপর একদিন দুপুর থেকে খুব শরীর খারাপ, মা বমি করতে শুরু করল। বাবা কাজে গিয়েছিল। মাকে কীভাবে হাসপাতালে নিয়ে যাব বুঝতে না পেরে আমি কাঁকড়াঝোড়ের দিকে দৌড় দিলাম। বোনকে বলে গেলাম মাকে দেখতে। আমাদের এখানে কোনও ট্রেকার চলত না। কাঁকড়াঝোড় থেকে বেলপাহাড়ির শেষ ট্রেকার ছাড়ত বিকেল চারটেয়। তখন তিনটে-সাড়ে তিনটে বাজে। দৌড়ে দৌড়ে কাঁকড়াঝোড় গিয়ে দেখি শেষ ট্রেকার ছেড়ে চলে গেছে। আর মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। আবার দৌড়ে বাড়ি ফিরলাম। গ্রামে কোনও গাড়ির ব্যবস্থা ছিল না। ভাবলাম বাবা ফিরলে কিছু একটা করব। বাবা বিকেলে মাঠ থেকে ফিরল। কিন্তু এখান থেকে বেলপাহাড়ি এতটা রাস্তা, কীভাবে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব? কোনও ব্যবস্থা করতে পারলাম না। বাবা বলল, পরদিন সকালে প্রথম ট্রেকারে হাসপাতালে যাব। কিন্তু সন্ধের পর থেকে মা’র শরীর আরও খারাপ হতে শুরু করল। বারবার বমি করতে শুরু করল মা। সেই সঙ্গে জ্বর বেড়ে গেল অনেক। বোন তখন ছোট, আমি আর বাবা বুঝে উঠতে পারলাম না কী করব। রাত ন’টা নাগাদ মা’র অবস্থা দেখে মনে হল, হাসপাতালে না গেলে মাকে আর বাঁচানো যাবে না।’ কথা বলতে বলতে শুকিয়ে আসে ধর্মাল মান্ডির গলা, একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে সে।
    ‘বাবা বলল, আর কিছু করার নেই, সাইকেলেই মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মাকে কোনও ভাবে সাইকেলের সিটে বসাল বাবা। তারপর বাবা সামনের হ্যান্ডেল ধরে হেঁটে সাইকেল টানতে টানতে নিয়ে চলল। আমি পিছন থেকে এক হাতে মাকে ধরে থাকলাম, অন্য হাতে সাইকেল ঠেলে এগোতে থাকলাম। এক বোতল জল সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে নিলাম, যদি জ্বর বেড়ে যায় মা’র মাথায় দেওয়ার জন্য। রাত প্রায় সাড়ে ন’টায় এভাবে আমরা চলতে শুরু করলাম বাড়ি থেকে। ভেবেছিলাম চার-পাঁচ ঘণ্টায় বেলপাহাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে যাব। মা সাইকেলের সিটে সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছিল না, পুরো শরীর কাঁপছিল। আমি মাকে শক্ত করে ধরেছিলাম। বাবা হেঁটে সাইকেল টেনে নিয়ে এগোচ্ছিল আস্তে আস্তে। মা ঠিক করে সিটে বসে থাকতে পারছিল না। অনেক কষ্ট করে আমরা কাঁকড়াঝোড় পৌঁছলাম। তারপর বাবা একটু থামল, বলল কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার যাবে। মাকে আস্তে করে সাইকেল থেকে নামাল বাবা। রাস্তার ধারে মাকে শুইয়ে মাথায় জল দিলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। সিটে মা বসে, সামনে থেকে সাইকেল টেনে বাবা এগোচ্ছে, পিছন থেকে মাকে ধরে আমি সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে যাচ্ছি। আরও এক-দেড় ঘণ্টা পর হবে, মা আর বসে থাকতে পারল না। মা’র শরীর পুরো ছেড়ে দিল, আমিও মা’র ওজন সামলাতে পারলাম না। মা সাইকেল থেকে পড়ে গেল। আমরা মা’কে ধরে রাস্তার ধারে বসালাম। বাবা আমাকে বলল মা’কে দেখতে, তারপর সাইকেল নিয়ে রওনা দিল বেলপাহাড়ির দিকে। যদি হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স বা গাড়ি পাওয়া যায়। আমি রাস্তার ধারে মা’কে নিয়ে বসে থাকলাম। আস্তে আস্তে মা শুয়ে পড়ল। মাথায়, মুখে জল দিলাম। বুঝতে পারিনি কখন মা অজ্ঞান হয়ে গেছে। অনেক পরে বাবা সাইকেল চালিয়ে ফিরল। হাসপাতালে কিছুই পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে মা মরে গেছে। আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর ভোর হলে মা’কে আবার সাইকেলে বসিয়ে টানতে টানতে বাবা আর আমি গ্রামে ফিরে এলাম। একদিন আগে যদি হাসপাতালে যেতাম, তবে হয়তো মা’কে বাঁচানো যেত।’
     
    এর পর অবিন্যস্ত গলায় আরও নানা কথা বলে যায় ধর্মাল নামের সেই যুবক, যে একদিন ঝাড়গ্রামের এসডিপিও অনিরুদ্ধ রায়ের বাড়িতে গিয়ে আপেল চিনতে পারেনি, পাশে বসে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুবল মান্ডি।
    ধর্মালের কথা শুনতে শুনতে ময়ূরঝর্ণা থেকে এক অন্য জগতে চলে চায় অরিন্দম, পরপর দেখতে থাকে দৃশ্যগুলো। মাঝবয়সী একটা লোক, যে নিজেই পিঠের ব্যথায় কাবু, সে তার মরণাপন্ন স্ত্রীকে সাইকেলের সিটে বসিয়ে হ্যান্ডেল ধরে হাঁটতে হাঁটতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সাইকেলটাকে। সেই মহিলা চারদিন ধরে জ্বরে এবং পরীক্ষা হয়নি বলে জানা নেই আর কোন কোন রোগে আক্রান্ত, শক্ত করে ধরে রেখেছে সাইকেলের হ্যান্ডেল্টা। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ কিলো ওজনের এক দুর্বল মহিলা কতটা শক্ত হাতে কতক্ষণই বা ধরে থাকতে পারে সাইকেলের হ্যান্ডেল! তাদের দশ-এগার বছরের ছেলে এক হাতে ধরেছে মা’কে, যাতে মা পড়ে না যায়, আর অন্য হাতে সাইলেকলটা ঠেলছে যাতে বাবার কষ্ট একটু কম হয়! চারদিকে ঘন জঙ্গল, রাতের অন্ধকারে এভাবে তারা যাবে ময়ূরঝর্ণা থেকে প্রপার বেলপাহাড়ি, প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা!
    অরিন্দম ভাবতে থাকে, ময়ূরঝর্ণার এই বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে কাঁকড়াঝোড়, সেখান থেকে বেলপাহাড়ির শেষ ট্রেকার ছাড়ে বিকেল চারটেয়! পরের ট্রেকার আবার পরদিন সকালে। তার মানে বিকেল চারটের পর কাঁকড়াঝোড় বা আশপাশের দশ-বিশটা গ্রামে মানুষের কিছু হলে পরদিনের আগে বাঁচা-মরা সব...... , আর ভাবতে পারে না অরিন্দম।
    সাড়ে বারোটা বাজে, কী বলবে বুঝতে পারে না অরিন্দম। চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ‘তুমি আজ কাজে যাবে না?’
    দু’দিকে ঘাড় নাড়ে ধর্মাল, ‘রোজ কাজ থাকে না।’
    আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে অরিন্দম। অগোছালো কিছু কথা হয় ধর্মালের সঙ্গে। অরিন্দম লক্ষ্য করে, এতক্ষণে বিশেষ কথা বলেনি সুবল মান্ডি। কথায় কথায় অরিন্দম জানতে পারে, গত কয়েক বছরে একবারও বাড়ি আসেনি সিংরাই। কিন্তু গত সাত-আট বছরে তার খোঁজে মাঝে মাঝেই পুলিশ এসেছে এই বাড়িতে। ধর্মাল এবং সুবলকে থানাতেও নিয়ে গিয়েছে কয়েকবার। প্রায় সারাদিন থানায় বসিয়ে নানা প্রশ্ন করে ছেড়ে দিয়েছে। সিংরাই কোথায় আছে, বেঁচে আছে কিনা তাও জানা নেই সুবল মান্ডি বা ধর্মালের।
     
    কাঁকড়াঝোড়ের মোড় থেকে বাঁদিকে ঘোরে অরিন্দমের গাড়ি। ওর মাথায় আবার ফিরে আসে দৃশ্যগুলো। এই রাস্তা ধরেই যমুনা মান্ডিকে সাইকেলে বসিয়ে বেলপাহাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল বাবা-ছেলে। কত দূর পর্যন্ত যেতে পেরেছিল ওরা? আর কতটা রাস্তা পেরোতে পারলে হাসপাতালে পৌঁছতে পারত? চল্লিশ না পেরনো যমুনা মান্ডি আর কতটা রাস্তা শক্ত হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে বসে থাকতে পারলে হয়তো বেঁচে যেত? সুবল মান্ডি যখন মা আর ছেলেকে রাস্তায় বসিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে গিয়েছিল, তখন চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখে কী মনে হচ্ছিল দশ-এগারো বছরের ছেলেটার? ভাবার চেষ্টা করে অরিন্দম, ভাবতে পারে না। অরিন্দমের মনে পড়ে অরণ্যের দিনরাত্রি সিনেমার সেই দৃশ্যের কথা, শুভেন্দু বলছে, ‘এই সব জায়গায় এলে মানুষের আয়ু বেড়ে যায়!’ মনে মনে হেসে ওঠে অরিন্দম। মনে হয়, আমরা শহরের লোক, কত কম জানি নিজের রাজ্যটাকে! আদৌ কি জানি?    

    ১২-০৭-২০০৩, বাংলায় মুক্তাঞ্চলের লক্ষ্যে

    তিন দিন আগে কাঁকড়াঝোড়ের আমলাশোলে শবর পাড়ায় টেন্ট ফেলেছে এমসিসি’র দুটো সেকশন। দুটো সেকশন মানে কুড়ি জন। প্রায় দশ মাস আগে ঝাড়খন্ডের সঙ্গে বাংলার করিডোর তৈরির যে কাজ তামারবুন্ডু থেকে শুরু হয়েছিল তা শেষ হয়েছে জুন মাসের শেষে। ২০০৩ সালের জুন মাসের আঠাশ তারিখ ঝাড়খন্ডের চার এমসিসি সদস্য সুনিয়াৎ, বুধিয়া, রঘুবীর, লক্ষ্মী, আর তাদের সঙ্গে বাংলার অনন্ত, সিংরাই, বানেশ্বর, বংশী, গীতা, বিমলা, মোট দশজন ঘাটশিলা পৌঁছয়। সেখানে পুরো দলটা দু’দিন থাকার পর বাংলা থেকে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিল বনমালী দেশোয়ালি, তার স্ত্রী শিবানী, দ্বিজেন হেমব্রম, সুধাংশু সর্দার, অর্জুন, শকুন্তলা, রানি, ধ্রুব এবং আরও কয়েকজন। সব মিলে কুড়িজনের দল তৈরি হয়। ঠিক হয়, তিন-চারদিনের মধ্যেই ঘাটশিলা থেকে কুড়ি জনের দলটা কাঁকড়াঝোড় দিয়ে বাংলায় ঢুকবে। প্রথম ক্যাম্প করার জন্য বেছে নেওয়া হয় ঝাড়খন্ড-বাংলা সীমানায় বেলপাহাড়ির আমলাশোল। ঝাড়খন্ডের সঙ্গে করিডোর তৈরিতে এরাজ্যে প্রথম ক্যাম্প করার জন্য আমলাশোলকে বেছে নেওয়ার কারণ একই সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং ভৌগলিক। বেলপাহাড়ির কাঁকড়াঝোড়ের প্রান্তিক গ্রাম আমলাশোল সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এবং দারিদ্রে এক্কেবারে প্রথম সারিতে। দিনে একবেলাও খাবার জোটে না এমন পরিবারও আছে আমলাশোলে। জল, স্কুল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র তো দূরস্থান, সরকার যে ঠিক কী ব্যাপার তাই জানে না এই গ্রামের মানুষ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গোটা জীবনে সরকারি কোনও লোককে চোখেই দেখেনি এমন মানুষও আছে আমলাশোলে। সরকারও কি চেনে আমলাশোলকে? এই একুশ শতকের গোড়ায় আমলাশোলও সরকারেরও ম্যাপের বাইরে। জঙ্গলে ঘেরা আমলাশোল থেকে বেলপাহাড়ির দূরত্ব খাতায়-কলমে প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার, যদিও সরকারি অফিসারদের কাছে এই দূরত্ব এক আলোকবর্ষের! 
     
    তো এই পিছিয়ে থাকা আমলাশোলের আবার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এলাকা গ্রামের এক্কেবারে শেষ প্রান্তের শবর পাড়া। এই শবর পাড়ায় জুলাই মাসের আট তারিখ পৌঁছল বনমালী, দ্বিজেনদের নেতৃত্বে কুড়ি জনের এমসিসি স্কোয়াড। শবর পাড়ায় নাথু শবরের বাড়িতে প্রথম মিটিং করল তারা। মিটিং মানে ছোট গ্রাম বৈঠক। সাত-আটটা শবর পরিবারকে নিয়ে সন্ধ্যায় বসল বনমালী, দ্বিজেনরা। শুনল তাদের কথা। চার-পাঁচজন শুরু করে দেয় টেন্ট তৈরির কাজ। ঠিক হয়, আপাতত কিছুদিন আমলাশোলেই থাকবে দলটা। আমলাশোলকে বেস করেই আগামী কিছুদিন বেলপাহাড়ির বিভিন্ন গ্রামে মিটিং করতে যাওয়া হবে।
    ২০০৩ সালের জুলাই মাসের আট তারিখ, যেদিন এমসিসি’র দুটো সেকশন ঝাড়খন্ড থেকে আমলাশোলে প্রবেশ করল, তারও প্রায় সওয়া এক বছর বাদে রাজ্য তো বটেই, দেশে বহু মানুষের আলোচনায় চলে আসবে এই গ্রামের নাম। ২০০৪ সালের নভেম্বরে আমলাশোলে শবর গোষ্ঠীর পাঁচ জনের মৃত্যু হবে দীর্ঘদিনের অপুষ্টি এবং অনাহারে। তাদের মৃত্যু শোরগোল ফেলে দেবে গোটা রাজ্যে। মাত্র পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরের বেলপাহাড়ি থেকে এত এত বছর ধরে যে সরকার আমলাশোলে পৌঁছে মানুষের খোঁজ নিতে পারেনি সেখানে কীভাবে দিন কাটে আদিবাসী পরিবারগুলোর, সেখানে রাতারাতি মেলা বসে যাবে আমলা থেকে সাংবাদিকদের।
    কিন্তু সেই ঘটনার দেরি আছে, আজ জুলাই মাসের বারো তারিখ, ২০০৩ সাল। কাল রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল কাঁকড়াঝোড়জুড়ে। আজ সকালে তা বাড়তে থাকে, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। সিংরাই, অনন্ত, বংশী, ধ্রুব আর অর্জুন যে টেণ্টে ছিল, প্রচণ্ড বৃষ্টি আর কয়েক মিনিটের ঝড়ে তার প্রায় লণ্ডভণ্ড অবস্থা হয় দুপুরের ঠিক আগে। ওদিকে আজ সন্ধ্যায় চাকাডোবার গিরুলিয়া গ্রামে মিটিং ডাকা আছে। পুরো গ্রামকে বলা আছে মিটিংয়ে আসতে। ঝড়, বৃষ্টিতে টেন্ট সামলাতে চূড়ান্ত ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় পুরো স্কোয়াডের। ঠিক ছিল সবাই যাবে গিরুলিয়া গ্রামে। বিকেলে বৃষ্টি থামার পর পরিকল্পনায় কিছুটা বদল হয়। টেন্ট মেরামতির জন্য কয়েকজন আমলাশোলেই থেকে যায়। সন্ধে ছ’টা নাগাদ বারোজন রওনা দেয় গিরুলিয়ার উদ্দেশে।
     
    ভূলাভেদা পঞ্চায়েতের গিরুলিয়া গ্রামটা একেবারেই ছোট। তিরিশ-বত্রিশটা ঘর। চারদিকে জঙ্গলে ঘেরা গিরুলিয়া গ্রামে দ্বিজেন, বনমালী, সিংরাই, অনন্তরা পৌঁছল সন্ধে সাতটা নাগাদ। গ্রামের পঞ্চান্ন-ষাট’জন মানুষকে নিয়ে মিটিংয়ে বসল তারা। গিরুলিয়ার সবচেয়ে পরিচিত লোক, গ্রামের মাঝি নিত্যলালকে বানানো হল মিটিংয়ের সভাপতি। বাংলায় সংগঠন গড়া এবং গ্রামে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস অর্জনের জন্য এও এমসিসি’র এক নতুন পন্থা। গ্রামে গিয়ে মানুষের কথা শোনা, তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া। সেই প্রশ্নের জবাবের মধ্যে দিয়ে তাদের রাজনীতি মানুষকে বোঝানো। মিটিংয়ের শুরুতেই উঠে দাঁড়ায় দ্বিজেন হেমব্রম, ‘আজ আমরা নিজেদের কথা বলতে আসিনি। আজ আমরা এসেছি আপনাদের কথা শুনতে। একে একে বেলপাহাড়ির সমস্ত গ্রামে যাব আমরা। গিরুলিয়াতে আমরা আগেও এসেছি। আপনারা অনেক বছর ধরেই আমাদের চেনেন, জানেন। আমরা কী বলি, কী করি তাও জানেন। এই গ্রামের সবচেয়ে পরিচিত মানুষ, গ্রামের মাঝি নিত্যলালবাবু। আজকের সভার সভাপতি তিনিই হবেন,’ এই কথা বলে দ্বিজেন এগিয়ে দেয় নিত্যলালকে। এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না নিত্যলাল।
    উঠে দাঁড়ায় মাঝবয়সী লোকটা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড। এভাবে কথা বলার অভ্যাস নেই তার, বুঝতে পারে না কী করবে। বুঝতে পারে না যা বলতে চায় তা কীভাবে বলবে!
    ‘আপনার যা বলার আছে, যা মনে আছে নির্ভয়ে বলুন। আজ আপনাদের কথা শুনতে এসেছি আমরা,’ নিত্যলালের ইতস্তত ভাব আঁচ করে বলে দ্বিজেন। দ্বিজেনের সাংগঠনিক শিক্ষা তাকে সতর্কবার্তা দেয়, মানুষকে বলার পরিবেশ না দিলে সে কখনই মনের কথা বলবে না। আর গরিব, খেটেখাওয়া মানুষই যদি মনের কথা খুলে না বলে তবে কে বলবে তাদের! এই নিত্যলালের মতো, আজ সন্ধ্যায় গিরুলিয়ায় জমা হওয়া শ’খানেক মানুষের মতো লাখ-লাখ মানুষই তো তাদের শ্রেণিবন্ধু। আর শ্রেণিবন্ধু এই মানুষই যদি নিজের কথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়, তবে সংগঠন এগোবে কোন পথে?
    নিত্যলালের দ্বিধাভাব কিছুটা কাটে, তার থেকেও বেশি কাটে ভয়। তারপর খানিকটা এলোমেলোভাবে বলতে শুরু করে, ‘আপনারা আমাদের গ্রামে এসেছেন, আপনারা যে কথাগুলো বলছেন তা ঠিকই আছে। আপনারা ঠিক কথাই বলছেন। আমরা কীভাবে বেঁচে আছি তা আমরাই জানি। সরকারের সময় নেই আমাদের কথা ভাবার। কিন্তু আপনারা এসেছেন এই খবর পেলেই পুলিশ গ্রামে আসবে, দমনপীড়ন করবে। আপনারা যে গ্রামে যাচ্ছেন, যেখানে মিটিং করছেন, সেই খবর চলে যাচ্ছে পুলিশের কাছে। তারপর পুলিশ গ্রামে এসে অত্যাচার করছে। ঘর বাড়ি ভেঙে দিচ্ছে। আপনারা আমাদের সমস্যার কথা বলছেন, আমাদের পাশে আছেন, সব ঠিক। কিন্তু আপনারা আসছেন বলে পুলিশ আমাদের ওপর অত্যাচার করছে। আপনাদের আন্দোলনের পর কেন্দু পাতার দাম বেড়েছে, রেশন মালিক চাল চুরি করতে ভয় পাচ্ছে, জমিদার মজুরি দিচ্ছে, সব ঠিক। আমরা আপনাদের সমর্থন করি, কিন্তু পুলিশ অত্যাচার করলে কোথায় যাব? আমরা গরিব মানুষ, একবার বাড়ি ভাঙলে কীভাবে বানাব তা......’,  টানা বলতে থাকে নিত্যলাল। বলতে থাকে তাদের সমস্যার কথা। বলতে বলতে এক সময় থেমে যায়, আর কথা যোগায় না তার মুখে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বোঝার চেষ্টা করে তার কথার কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বনপার্টির এই দলটার মধ্যে। নিত্যলাল যা বলতে পারে না তা হল, হয় আপনারা পুলিশের বিরুদ্ধে কিছু করুন, নয়তো আমাদের গ্রামে আসা বন্ধ করুন। কিন্তু বুঝতে পারে না একথা সরাসরি বলা ঠিক হবে কিনা।
     
    গিরুলিয়া গ্রামের মাঝি নিত্যলালের কথা এক নতুন জটিল সমস্যার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় রাজ্যে মাওয়িস্ট আন্দোলনের এই পর্যায়কে। ঝাড়খন্ডের সঙ্গে করিডোর তৈরির জন্য বেলপাহাড়ি থেকে রানিবাঁধের গ্রামে গ্রামে সংগঠন বানাতে হবে, প্রতিটা গ্রামে জনভিত্তি তৈরি করতে হবে, এই উদ্দেশ্য নিয়ে এত দিনের যে প্রস্তুতি তা থমকে দাঁড়ায় নিত্যলালের প্রশ্নের সামনে! এই প্রশ্ন তো শুধু গিরুলিয়া গ্রামের নয়, বনমালী, দ্বিজেনরা জানে এই প্রশ্ন আজ কাঁকড়াঝোড় থেকে বান্দোয়ান, বেলপাহাড়ি থেকে বারিকুল, রাইপুর থেকে সারেঙ্গা, সব জায়গার। যেখানেই তারা সংগঠন করতে যাচ্ছে, সেখানেই পুলিশের অভিযান শুরু হচ্ছে। কিন্তু জলে, জঙ্গলে বড় হওয়া দ্বিজেন হেমব্রম বা বনমালী দেশোয়ালিরা জানে, পাথরে ধাক্কা খেয়ে নদী যেমন দিক বদল করে, তেমনই রাজনৈতিক কর্মসূচি বা আন্দোলনও রাস্তা বদল করে গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে। কারণ, রাজনৈতিক আন্দোলন ভবিষ্যতে কোন পথে এগোবে তার কোনও লিখিত সিলেবাস নেই। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতাই এখানে প্রশ্নপত্র, আর এমন বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকে যে জবাব বেরিয়ে আসে, তাই ঠিক করে দেয় আন্দোলনের গতিপথ।
    উঠে দাঁড়ায় দ্বিজেন হেমব্রম। সে বুঝতে পারে, নিত্যলালের কথায় পুরো সমর্থন আছে গিরুলিয়ার সমস্ত মানুষের, যারা আজ সন্ধ্যায় এসেছে এই মিটিংয়ে। সবাই একটু ভয়ে ভয়ে তাকায় দ্বিজেনের দিকে। বুঝতে পারে না এই সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে কী জবাব দেবে বনপার্টির লোকজন। তারা আন্দাজও করতে পারে না, বনপার্টি আজ এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে।
    ‘আজ আপনাদের সব কথার জবাব দেবে কমরেড জয়ন্ত,’ বলে সিংরাইয়ের দিকে তাকায় দ্বিজেন হেমব্রম।
     
    ময়ূরঝর্ণা গ্রামের দিনমজুর সুবল মান্ডির বড় ছেলে, কেন্দিশোলের জোতদার যদু মন্ডলের জমিতে ধান কাটার রাতে যার রাজনীতিতে হাতেখড়ি, তার কয়েক মাস বাদে বাড়িছাড়া, খাতরায় গ্রেফতার, ঝাড়খন্ডে প্রশিক্ষণ, সেই সিংরাই মান্ডির নাম কবে জয়ন্ত হল তা জানা ছিল বনমালী, দ্বিজেন, সুধাংশু এবং বাকি এমসিসি সদস্যদের। কিন্তু জানা ছিল না সাধারণ মানুষের। আজ সাধারণ মানুষের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল কমরেড জয়ন্ত নামের এক তরুণ। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে সাড়ে ষোল বছর বয়সে নিজের নতুন নাম নিয়ে নিজের চেনা জায়গায় জীবনের আর এক পর্বে পা রাখল সিংরাই মান্ডি। আজ থেকে বেলপাহাড়ি, বান্দোয়ান, রাইপুর, খাতরা সহ জঙ্গলমহলের বিভিন্ন গ্রাম, এমসিসি এবং পিপলস ওয়ার গ্রুপের সমস্ত সদস্য তাকে চিনবে জয়ন্ত নামে। তবে বাঁশপাহাড়ির অনন্ত নিজেদের মধ্যে কথার সময় মাঝে মধ্যে সিংরাইকে ডাকত ফড়িং বলে। রোগাসোগা চেহারার সিংরাইয়ের চঞ্চল স্বভাবের জন্য তার নাম ফড়িং দিয়েছিল অনন্ত। এই নাম জানত বনমালীও। আজ থেকে সিংরাইয়ের নতুন পরিচয় হল জয়ন্ত ওরফে ফড়িং। ভবিষ্যতে রাজ্য পুলিশ অবশ্য তাকে জানবে জয়ন্ত নামেই। তবে সেদিনের অনেক দেরি আছে।
    দ্বিজেনের কথায় উঠে দাঁড়াল জয়ন্ত ওরফে সিংরাই মান্ডি, ‘মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টারের পক্ষ থেকে আপনাদের অভিনন্দন। লাল সেলাম।’
    গত কয়েক বছরে অনেক এমন গ্রাম বৈঠক করেছে, দেখেছে সিংরাই। কিন্তু আজ পার্টিতে তার যে নতুন জীবন শুরু হল তা বুঝতে পারে সে। সে বুঝতে পারে শুধু গিরুলিয়ার মানুষজন নয়, দলের নেতারাও শুনছে তার কথা। এই দিন যে কোনও দিন আসবে এমন ধারণাতেও ছিল না তার। অভিজ্ঞ নেতার মতোই সিংরাই বক্তৃতা শুরুর প্রস্তুতি নেয় মনে মনে।

    ক্রমশ... 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৮ মার্চ ২০২৪ | ১৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন