এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ডেভিড লিভিংস্টোনের খোঁজে-১৩৯ - হেনরি মর্টন স্ট্যানলে | ১৩ ই মার্চ। লিভিংস্টোনের সাথে আমার থাকার শেষ দিন চলে এল আর পেরিয়েও গেল। শেষ রাতে আমরা একসঙ্গে থাকব, পরের দিনটাকে তো আর এড়ানো যাবে না! যদিও আমার মনে হচ্ছে, যে-ভাগ্য আমাকে তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে সেই ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি। মিনিটগুলো দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে, জমে জমে ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দরজা বন্ধ, আমরা দুজনেই নিজের নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। তিনি কি ভাবছেন জানি না। আমারগুলো দুঃখের। আমার দিনগুলো যেন স্বর্গসুখে কেটেছে; নাহলে কেনই বা আমি বিদায়ের ঘণ্টার এগিয়ে আসতে এত গভীর কষ্ট পাব? আমি কি পরের পর জ্বরে ভুগি নি, ইদানীংকালে দিনের পর দিন কাতর হয়ে শুয়ে থাকিনি ? আমি কি পাগলের মতন ছুটে বেড়াইনি? আমি কি রাগে হাতের মুঠো পাকাইনি, আর প্রলাপের ঘোরে হতাশার বুনো শক্তির সঙ্গে লড়াই করিনি? তবুও, বহু আয়াসে পাওয়া এই মানুষটির সংসর্গে যে আনন্দ অনুভব করেছি তাকে ফেলে আসতে দুঃখ পাচ্ছি। সময়ের এগিয়ে চলাকে তো আর ঠেকাতে পারব না, এই রাতে সময় যেন আমাকে উপহাস করতেই উড়ে চলছে, আর আমার কষ্ট দেখে আনন্দ পাচ্ছে! তাই হোক তবে! বন্ধুদের বিচ্ছেদবেদনা আগেও কি অনেকবার সহ্য করিনি! আরও কিছু ক্ষণ দেরি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অনিবার্যতাকে এড়ানো যাবে না - আমাদের সুসময় ফুরিয়ে এসেছে। একই অনুশোচনার অনুভূতি, শুধু এ যেন আরও মর্মস্পর্শী, যে হয়ত এই বিদায় চিরকালের জন্য! চিরতরে? চিরকালের জন্য? কথাগুলো সকাতর ফিসফিসানি হয়ে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল।আজ রাতে তিনি যা যা বলেছেন সব আমি লিখে নিয়েছি; কিন্তু সেসব শুধুই আমার! পাঠকের সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়া যাবে না। তিনি নিজেও যেমন নিজের রোজনামচাটিকে ঈর্ষা করেন, তেমনটা ঠিক আমার মনে হচ্ছে। আমি নিজেই গোটা গোটা হরফে জার্মান ভাষায় রোজনামচার দুপাশে আর তার জলরোধী ক্যানভাস কভারের উপর লিখেছি যে, "কখনোই খোলা যাবে না;" আর তাতে তিনি সই করেছেন। তাঁর বন্ধু ও সন্তানদের সুষম ভাবে কৌতূহল মেটানোর জন্য তিনি যা যা বলেছেন, তার প্রতিটা শব্দ আমি স্টেনোগ্রাফ করেছি। আর সেই সঙ্গে তিনি "তাঁর প্রিয় পুরানো বন্ধু স্যার রডরিক মার্চিসন" সম্পর্কে তাঁর শেষ ইচ্ছার কথাও জানিয়েছেন। উগান্ডায় খবরের কাগজ হাতে পেয়ে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে বৃদ্ধ মানুষটি প্যারালাইটিক স্ট্রোকে শয্যাশায়ী, তখন থেকেই তিনি তাঁর সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন। আমি এডেন পৌঁছে তাঁকে অবশ্যই খবর পাঠাবো; প্রতিশ্রুতিও দিয়েছি যে আফ্রিকার অন্দরে খবর যত গতিতে যায়, তিনি আমার বার্তাটি তাদের সকলের থেকে দ্রুততর পাবেন।‘‘কাল রাতে, ডাক্তার, আপনি একা!’’‘‘হ্যাঁ ; মনে হবে বাড়িটাতে যেন কেউ মারা গেছে। বৃষ্টি এখন কাছেই এসে গেছে, সেটা শেষ না হওয়া অবধি আপনি অপেক্ষা করলে ভাল হত।’’‘‘ঈশ্বর! যদি তাই পারতাম তো থেকেই যেতাম, আমার প্রিয় ডাক্তার। তবে প্রত্যেকটা দিন যখন আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকব, আপনিও আপনার কাজ ও বাড়ির থেকে ততদিন দূরে থাকবেন।’’‘‘জানি; তবে আপনার স্বাস্থ্যের কথাও তো ভাবতে হবে - এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য আপনি প্রস্তুত নন। হয়েছেন কি? আর মাত্র কটা সপ্তাহ। আপনি এখন যতটা দ্রুত যাবেন, বৃষ্টি থেমে গেলে রওনা দিলেও ততটাই তাড়াতাড়ি উপকূলে পৌঁছাবেন। এই জায়গা আর উপকূলের মধ্যেটা পুরো বন্যায় ডুবে যাবে।’’‘‘আপনি তাই ভাবছেন; তবে আমি চল্লিশ দিনের মধ্যে উপকূলে পৌঁছাব; চল্লিশের মধ্যে না হলেও, পঞ্চাশ দিনে তো নিশ্চিত। আপনার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগছি এই চিন্তা আমাকে উত্সাহিত করবে।’’১৪ ই মার্চ।ভোরবেলা উঠে পড়লাম, বোঁচকা-বুঁচকি মালপত্র বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হল, লোকজন ঘরে ফেরার পথে পা বাড়ানোর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছিল।একসঙ্গে একটা বিষণ্ণ ব্রেকফাস্ট করলাম। খেতেও পারিনি, বুকটা টনটন করছে; আমার সঙ্গীরও বিশেষ ক্ষুধা আছে বলে মনে হয় না। এমন একটা ছুতো খুঁজছিলাম যাতে আরও কিছুক্ষণ একসঙ্গে থাকতে পারি। আটটার সময়ও আমি যাইনি, আর আমি কিনা ভেবেছিলাম সকাল পাঁচটায় রওনা দেব! ‘‘ডাক্তার,’’ আমি বললাম, ‘‘আপনার সঙ্গে দুজন লোক রেখে যাব। তারা আজ আর আগামীকাল আপনার সঙ্গে থাকবে, কারণ এমনও হতে পারে যে আপনি আমার বেরোনোর তাড়ায় কিছু হয়ত ভুলে গেলেন। আপনার শেষ কথা ও শেষ ইচ্ছা জানার জন্য আমি উন্যামওয়েজির সীমান্তে, তুরায় একদিন থামব। আর এবার তাহলে চলি - আর তো কোন উপায় নেই। বিদায়।’’‘‘ওহ, চলুন আপনার সঙ্গে একটু যাই । কিছুটা এগিয়ে দিই আপনাকে।’’‘‘ধন্যবাদ। এবার, এই যে সকলে, চল বাড়ি চল! কিরানগোজি, পতাকা তোল, আর হাঁটা শুরু করো !’’বাড়িটাকে একদম ফাঁকা দেখাচ্ছিল — আস্তে আস্তে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। পুরানো সময়ের কথা, আমার জলন্ত আশা-আকাঙ্খার স্মৃতি মনকে ভারি করছিল। চারপাশের পুরানো পাহাড়গুলো, যেগুলোকে একসময় তুচ্ছ, মাটো-মাটো মনে হত, সেগুলোর সঙ্গে এখন ইতিহাস ও স্মৃতি জড়িয়ে গেছে। ওই বুরজানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি, স্বপ্ন দেখেছি, আশাজাল বুনেছি, কত না দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। ওই গিরিখাঁজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ হতে আর তাবোরা ধ্বংস হতে দেখেছি। এই ছাদের নীচে আমি অসুস্থ হয়েছি, ভুলভাল বকেছি, আর ভাগ্য বিপর্যয়ে নিজের লক্ষ্যকে প্রায় তলিয়ে নষ্ট যেতে দেখে শিশুর মতো চিৎকার করে কেঁদেছি। এই বটগাছের নিচে আমার মৃত কমরেড শুয়ে আছে—বেচারা শ! এই সময়ে তাকে আমার পাশে পাওয়ার জন্য আমি সাত রাজার ধনও দিয়ে দিতে পারতাম! এই বাড়ি থেকে আমি উজিজির দিকে যাত্রা শুরু করি; তার কাছে আবার ফিরে এসেছি যেভাবে লোকে একজন বন্ধুর কাছে ফিরে আসে , সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম একজন নতুন, প্রিয়তর সহচরকে; আর এখন আমি সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ইতিমধ্যেই কেমন যেন একটা অদ্ভুত স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিলাম; দলের লোকেরা জোরে গান গাইছিল। লিভিংস্টোনের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়েছিলাম, তাঁর চেহারা যেন আমার স্মৃতিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধরা থাকে।‘‘ব্যাপারটা এই যে, ডাক্তার, আমি যতদূর বুঝেছি যে নীল নদের উৎস সম্পর্কে আপনি নিজে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আপনি বাড়ি ফেরার কথা ভাববেন না। নিজে সন্তুষ্ট হলে তবেই আপনি বাড়িতে ফিরবেন আর অন্যদের সন্তুষ্ট করবেন। তাই না?’’‘‘ঠিক তাই। আপনার লোকেরা চলে এলেই আমি উফিপার উদ্দেশে যাত্রা করব; তারপর, রুংওয়া নদী পেরিয়ে, আমি দক্ষিণ দিকে যাব আর টাঙ্গানিকার শেষ প্রান্ত ছুঁয়ে একটা দক্ষিণ-পূর্ব মুখো পথ ধরে যাব চিকুম্বির কাছে। লুয়াপুলা নদীর ধারটিতে চিকুম্বি । লুয়াপুলা পার হয়ে, আমি সিধে পশ্চিমে যাব, সেখানে কাটাঙ্গায় তামার খনি আছে। এখানকার লোকেরা বলে কাটাঙ্গার থেকে দক্ষিণে আট দিনের পথ পেরোলে নীল নদের উৎস ঝর্ণার দেখা মেলে। সেটা খুঁজে পেলে আমি কাটাঙ্গা হয়ে রুয়ার মাটির নিচের আস্তানায় ফিরে যাব। গুহার থেকে, দশ দিন উত্তর-পূর্বে গিয়ে কামোলোন্ডো হ্রদে পৌঁছাবো। সেই হ্রদ থেকে, আপনার নৌকাটি বেয়ে চলে যাব লুফিরা নদীর উজানে। এই ভাবে লিংকন হ্রদে পৌঁছে যেতে পারব। তারপরে, আবার ফিরে এসে, আমি উত্তরে, লুয়ালাবা নদী ধরে, চার নম্বর হ্রদে যেতে পারি- মনে হয়, এইভাবে পুরো সমস্যাটা ব্যাখ্যা করা যাবে; আর সম্ভবত দেখা যাবে যে এটা হয় চৌয়াম্বে (বেকারের হ্রদ), বা পিয়াজ্জিয়া হ্রদ।’’‘‘আর এই ছোট্ট যাত্রাপথে কত সময় লাগবে বলে আপনার মনে হয়?’’‘‘ইউন্যানয়েম্বে থেকে রওনা হওয়ার পরে খুব বেশি হলেও দেড় বছর।’’‘‘আপনি যা বলছেন, ধরা যাক দুই বছরই লাগল। আপনি তো জানেনই, কতরকমের ঝুটঝামেলা আসতে পারে। এই নতুন লোকদের দু বছরের জন্য নিয়োগ করাই ঠিক হবে; তারা উন্যানেম্বেতে আসার পর থেকেই কাজের দিন গোণা শুরু হবে।’’“হ্যাঁ, চমৎকার, চলবে।’’‘‘এবার, আমার প্রিয় ডাক্তার, শ্রেষ্ঠতম বন্ধুদের থেকেও একসময় দূরে সরে যেতে হয়! আপনি অনেকটা চলে এসেছেন, আপনার দোহাই, এবার আপনি ফিরে যান।’’‘‘ঠিক আছে, যাওয়ার আগে একটা কথা বলি : আপনি যা করলেন তা খুব কম লোকই করতে পারবে - এমনকি আমার জানা কিছু মহান অভিযাত্রীর চেয়েও অনেক ভালভাবে আপনি কাজটা করেছেন। আর আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। ঈশ্বর আপনাকে নিরাপদে গৃহে ফিরিয়ে নিয়ে যান, ও আপনাকে আশীর্বাদ করুন, বন্ধু আমার।’’‘‘আর ঈশ্বর আপনাকে আমাদের সকলের কাছে নিরাপদে ফিরিয়ে আনুন, প্রিয় বন্ধু। বিদায়!’’‘‘বিদায় !’’আমরা একে অপরের হাত ধরে ঝাঁকালাম, আর নিজেকে মুক্ত করার আগে আমি যেন নিজেকে টেনেছিঁড়ে নিয়ে এলাম; কিন্তু আমি পুরোপুরি চলে যাওয়ার আগে সুসি, চুমাহ ও হামোয়দাহ প্রমুখ ডাক্তারের বিশ্বস্ত সহকর্মীরা অবশ্যই আমার সঙ্গে করমর্দন করে হাতে চুমু খাবে । আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না!‘‘বিদায়, ডাক্তার - প্রিয় বন্ধু!’’‘‘বিদায়!’’‘‘চলো! তোমরা থামলে কেন? হাঁটো হাঁটো! বাড়ি যাবে না তোমরা?’’ হাতের কাছের দলের লোকদের খেদাতে শুরু করলাম। আর আমার দুর্বলতা নেই। ওদের এমন হাঁটা দেখাব যে সারাজীবনেও আমাকে ওরা ভুলতে পারবে না। চল্লিশ দিনে সেই পথ পেরোব যা পেরোতে আগে পেরোতে আমারই তিনমাস লেগেছে।হে পাঠকবন্ধু, এই উপরে বর্ণিত নির্যাসঅংশ প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার ডায়েরিতে লিখেছিলাম। ছ' মাস কেটে গেছে, আমি এখন সেই লেখা দেখছি ; তবুও এ জন্য লজ্জিত নই; সেই বিদায় ক্ষণের স্মৃতিতে এখনও চোখ সামান্য ঝাপসা হয়ে আসছে। আমার অনুভূতি এখনও গভীর, যা লিখেছিলাম তাকে মুছে দিতে বা সংশোধন করতে সাহস হয়নি। ঈশ্বর করুন যেন আপনি যদি কখনও আফ্রিকায় অভিযানে যান তবে আপনি ডেভিড লিভিংস্টোনের মতো একজন মহৎ ও সাচ্চা মানুষকে সঙ্গী হিসেবে পান। যে চার মাস চার দিন আমি তাঁর সঙ্গে একই বাড়িতে বা একই নৌকায় বা একই তাঁবুতে বসবাস করেছি , তার মধ্যে আমি তাঁর কোন দোষ খুঁজে পাইনি। আমার নিজের রগচটা স্বভাব, আর অভয় দিলে বলি যে প্রায়শই যথেষ্ট কারণ ছাড়াই আমি বন্ধুত্ব ছিন্ন করে থাকি; কিন্তু লিভিংস্টোন আমাকে কখনও বিরক্তির কোন বিন্দুমাত্র কারণ দেননি , বরং তাঁর সঙ্গে প্রতিদিনের জীবন যাপন তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধ প্রশংসা বাড়িয়েছে।উপকূলের দিকে যাত্রা করার সময়ে আমাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করা ছাড়া, পাঠকের সামনে আর একই অভিযানের পুনরাবৃত্তি করছি না।(ক্রমশ…)
    দলমার কোলে কোলে - জাদুগোড়া - নরেশ জানা | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়জাদুগোড়াআমরা এই তথাকথিত ভদ্রলোকেরা যেমন কেন্দাডি পাহাড়টার মাথায় একটা শিবের মন্দির গড়ে তার নাম সিদ্ধেশ্বর পাহাড় করে দিয়েছি তেমনি জাদুগুড়া কিংবা জাদুগড়াকে জাদুগোড়া করে দিয়েছি। এক সময় এই জাদুগুড়া ছিল বন্য হাতিদের আদি বাসস্থান। হাতিদের বাসস্থান অর্থেই জায়গাটার নাম জাদুগুড়া। এই জাদুগুড়া আসলে ঝাড়খণ্ডের যাকে বলে সোনার খনি। আমরা যখন কলকাতার দিক থেকে ঝাড়খণ্ডে প্রবেশ করছি তখন বহড়াগুড়ার কাছাকাছি এলাকা থেকে প্রথমে বাঁহাতি তারপর ডানহাতি দুটি পাহাড়শ্রেণী দেখতে পাই। আসলে এই গোটাটাই দলমা পাহাড়শ্রেণী বা দলমা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। ঝাড়খন্ড প্রবেশের মুখটায় এই দলমা যেন অনেকটা হাঁ করে আমাদের প্রবেশের জায়গা করে দিচ্ছে। ধলভূমগড় থেকে আমরা সেই হাঁ-এর ভেতর ঢুকে যাচ্ছি। ঘাটশিলা থেকে গালুডি হয়ে জামসেদপুর আমরা সেই হাঁ-এর ভেতরেই থাকছি। ডানদিকের ঠোঁটটা উঁচু হয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোকে ধরে রেখেছে আর বাঁদিকের পাহাড়গুলো নিচের ঠোঁটের মতই একটু ঝুলে পড়া। আমাদের এতক্ষন বর্ণিত এলাকাগুলি যার মধ্যে এই জাদুগুড়াও রয়েছে তা ওই নিচের অংশে। এই অংশটি নিচু কিন্তু সর্বাধিক খনি সমৃদ্ধ আর জাদুগুড়াকে ঘিরেই রয়েছে সেই সব একের পর এক খনি। ঝাড়খণ্ডের সমৃদ্ধশালী খনিজ ভান্ডার। এই খনিজ সম্পদকে ঘিরেই এখানে মানুষজনের বাড়বাড়ন্ত হতে লাগল। বন্য হাতিরা তখন সরে গেল উত্তরের উঁচু পাহাড়ে, দলমার উতুঙ্গু শিখরে আরও গভীরতর জঙ্গলে।এটাও যেমন একটা ট্রাজেডি তেমন আরও একটা ট্র্যাজেডি আছে। গুনগুন আমাদের যে কথাটা বলেছিল সেই হাই রেডিয়েশনের কথাটা অনেকাংশেই সত্যি। সরকার একথা যদিও স্বীকার করেনা কিন্তু বহু প্রতিষ্ঠান দাবি করে আসছে ভটিন এবং নারোয়া পাহাড় থেকে উত্তোলিত ইউরেনিয়াম শোধনের পর যে বর্জ্য 'টেইলিং পন্ডে' সংরক্ষিত হয় তার মাশুল দিতে হচ্ছে এলাকার সাধারণ মানুষকে। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে এমনটা দাবি করা হয়। সরকার অস্বীকার করলেও ইউরেনিয়াম বিচ্ছুরনের প্রভাবকে অস্বীকার করব কী করে? সব মিলিয়ে এটাই জাদুগুড়ার ট্রাজেডি।যাইহোক আদার ব্যাপারী জাহাজের ব্যাপারে নাক গলাই কেন? বেড়ানোর কথাই বলি, দুপুর দুটো পনের নাগাদ নারোয়া ছেড়েছিলাম ঘটাশিলার ফুলডুংরি মোড়ে পৌঁছালম প্রায় তিনটা। পেটে ছুঁচোর লম্বা দৌড় শুরু হয়েছে। অতদুপুরে হোটেলে খাবার খুঁজে পেতে একসা হতে হল। এদিক ওদিক খানিকটা তেল পুড়ল গাড়ির। অবশেষে হোটেল মিলল। যে যার মত রুটি, ভাত ইত্যাদি খেয়ে নিলাম। গাড়িতে আমরা প্রায় ১৫ লিটার জল নিয়েছিলাম। সেটা এখন শেষের মুখে। এবার গন্তব্য বুরুডি। এখানে বলে রাখা ভালো, যদি কেউ চান তবে জাতীয় সড়কের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলডুংরি টিলায় চড়তে পারেন। এখান থেকে শুয়ে থাকা সুবর্ণরেখা নদী সহ পুরো ঘাটশিলা শহরটা দেখা যায়, মায় গালুডি ড্যাম অবধি। আমরা আর উঠলাম না, নারোয়া থেকে ফেরার পথে যে বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছিল তা এখনও ধরাই আছে বটে কিন্তু ঈশানে ঘনিয়ে আসছে আরও একটা মেঘ। মনে হচ্ছে এখুনি ঘাড়ে এসে পড়বে। সুতরাং আর দেরি না করে রওনা দিলাম বুরুডির পথে। পাহাড়ে চড়ার একটা প্ল্যান আমার ছকাই আছে সেটা কারুরই কাছে ভাঙলামনা। ফুলডুংরি থেকে জাতীয় সড়কের রিলিফ রোড ধরে একটু এগিয়ে কাশিদা থেকে গাড়ি বাঁয়ে মুড়ল। ঝিলমিল গুগল ট্র্যাকিংয়ে চোখ রেখে জানালো যে হোটেলটায় আমরা খেলাম সেই 'ধাবা রেন বাসেরা'র গা দিয়েই বুরুডি যাওয়ার একটা রাস্তা ছিল কিন্তু আমরা কাশিদার মোড় থেকেই বাঁয়ে মোড় নিলাম। মহালিডি আর চেংগজোড়া পেরিয়ে পূর্ণাপানির কাছে সেই রাস্তাটা আমাদের রাস্তায় মিশে গেল। ধনওয়ানী পেরিয়ে বুরুডি পৌঁছানো অবধি মাথার ওপর মস্ত মেঘটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলল, ভারী না হলেও সে কিন্তু মাঝে মধ্যেই জল ঝরাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্য ঠিক ভিতরগড় বা বুরুডি ঢোকার মুখে মেঘটা ফেটে সরে গেল! এই রাস্তাটা মাত্র বাইশ তেইশ মিনিটের হওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু বৃষ্টি আর সেই গাড়িটা আমাদের ডোবালো সাড়ে সাত কিলোমিটারের রাস্তা খেয়ে নিল প্রায় ৪০ মিনিট। বুরুডি লেকের কাছে এসেও জোর ধাক্কা খেলাম! সার সার দিয়ে সুদৃশ্য টেন্ট টাঙিয়ে, চেয়ার টেবিল বিছিয়ে লেকের পাড়েই লাঞ্চ, টিফিন আর ডিনারের মস্ত আয়োজন। অন্ততঃ গোটা দশেক টেন্ট। কমল হোটেল, গণেশ হোটেল, কুর্মি এন্ড কুর্বি চিকেন, নায়েক হোটেল, মুরাহির ক্যাফেটেরিয়া, গণপতি রেস্টুরেন্ট। দেখে শুনে রুষতি হায় হায় করে উঠলেন, "ইস্, এখানেই তো খেতে পারতাম আমরা! কী সুন্দর গুলি মুরগীর ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া যেত!" খড়গপুর ছাড়িয়ে গুপ্তমনির যে ধাবায় আমরা খেয়েছিলাম সেই ধাবার খাটিয়ার নীচে বেশ কয়েকটা দেশি মোরগ দেখেছিলাম। বললে ওরা রান্না করে দেয়, ২২০টাকা প্লেট, ৬ পিস! সেই থেকে গুলি মুরগি যেন পেয়ে বসেছে ওঁকে। কিন্তু এখন আমাদের কিছু করার নেই। 'ধাবা রেন বাসেরা'র তন্দুরি রোটি, চিকেন, মিক্সড ভেজ আর চায়ে আমাদের পেট ঠাসা। তাছাড়া বছর ২০ আগে আমি যখন বুরুডি এসেছিলাম তখন এখানে মাথা খুঁড়েও খাবার জায়গা পাইনি। এখানে যে এত খাবার জায়গা গজিয়েছে জানব কী করে?যদিও গুলি মুরগীর ঝোল খাওয়ার ইচ্ছাটা শুধু যে রুষতিরই এমনটা নয়। পূর্ণাপানি পেরিয়ে যে সঙ্কীর্ণ রাস্তায় আমাদের গাড়িটা পাক খেল তার পাশের ক্ষেতে চরে বেড়াচ্ছিল বেশ কয়েকটা মোরগ। রিয়ান বলছিল, 'দাদা, একটাকে ধরে ফেলুন তো!' গ্রাম বলেই নয়, এখানে মোরগ যেন সর্বত্রই। 'ধাবা রেন বাসেরা'র আগে আমরা প্রথম যে হোটেলটায় খেতে নেমেছিলাম জাতীয় সড়কের গা ঘেঁষে সেই হোটেলটাও যথেষ্ট অভিজাত বলেই মনে হয়েছিল। হোটেলটার নাম সম্ভবতঃ 'ধোসা ধাবা', খাবার পাইনি বটে কিন্তু তার চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বেশ কয়েকটা মোরগ। এখানকার মোরগ গুলো একটু অদ্ভুত, লেজ গুলো নিচের দিকে নামানো। রুষতি বললেন, বন মোরগের জাত। না, বন মোরগ এখানে মেলেনা। আমি জানি তার রহস্য, দু'দশক আগে সে মোরগ আমাকে খাইয়েছিলেন গোপীনাথ মাহাত। দলমার ওপারে কাঁকড়াঝোরের গোপীনাথ মাহাত আজ বেঁচে থাকলে নিশ্চিত তাঁর মাহাত হোটেলে রুষতি, রিয়ানদের বনমোরগ খাওয়াতে পারতাম। কিন্ত সে কথা এখন থাক।বুরুডি ছুঁলাম পাক্কা বিকাল পাঁচটায়। ওপরে মেঘের চাদর থাকলেও দিনের আলো পাওয়া গেল যথেষ্ট। গাড়ি থেকে তরতরিয়ে নিচের দিকে নামলাম। হঠাৎ দেখলাম শতদল নেই। এই ক'দিন বৃষ্টি হলেও আদতে চলতি মরসুমে সবমিলিয়ে বৃষ্টির পরিমান যথেষ্ট কম। হ্রদের ভেতর জলের পরিমান ১০ ভাগের এক ভাগ। যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন যে এটি একটি কৃত্তিম হ্রদ। সামনের দিকটা বুরুডি, পেছনে বাঘমুড়ি। সেই বাঘমুড়ি পাহাড়ের তলদেশে হ্রদটা। বাঘমুড়ি পাহাড়টা যেন দুহাত আঁকড় করে হ্রদটাকে ধরে রেখেছে। একসময় জমা হওয়া জলরাশি বাঘমুড়ির সেই আঁকড় করা দুটি হাতের ডান হাতটির তলা দিয়ে গলে গিয়ে বুরুডিকে পাক খেয়ে নিচে নামত। কিন্তু সেই সঙ্কীর্ণ জায়গাটি বর্তমানে বেঁধে ফেলা হয়েছে কংক্রিটের মস্ত একটা বাঁধ তৈরি করে। কাজটা করা হয়েছিল ইংরেজ আমলে। প্রায় ৫০ ফুট উঁচুতে হ্রদের জল উঠলে সেই জল গড়িয়ে নামে বুরুডির গা বেয়ে। এছাড়া একটি মাত্র স্লুইস গেট রয়েছে যেখান থেকে প্রয়োজন মত চাষের জন্য জল ছাড়া যায়। শতদলকে শেষ অবধি পাওয়া গেল। বুরুডির ডানদিক ঘেঁষে কেঁদডাঙ্গার গা ঘেঁষে হ্রদে নেমে আসছিল সে। হাতে স্নাইফারের মতই ক্যামেরা, ক্লিক ক্লিক শব্দ উঠছিল। তার ক্যামেরায় ধরা পড়ল এক শীর্ণ কীর্ণ কায়া। ট্যুরিষ্টদের ছায়া এড়িয়ে অতি সন্তর্পণে বঁড়শি এড়ে বসে রয়েছে সে। ছিপের চেয়েও যেন রোগাসেই বৃদ্ধের চেহারা। সারা বিশ্ব নিয়ে যেন কোনও মাথা ব্যাথাই নেই তার। তাবৎ আগ্রহ তার ফাৎনার দিকে। সেদিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। আমার মনে পড়ে গেল বানোয়ারি লাল পাটোয়ারীর কথা। লবটুলিয়া বইহারের ইজারাদারের কর্মচারী সত্যচরনকে কী এরই কাছ থেকে মাছ জোগাড় করে দিত পাটোয়ারী?রিয়ান দু'মাস আগেই আরন্যক পড়েছে। তার স্মৃতিতে ঝকঝক করছে লবটুলিয়া বইহার। জাদুগুড়া থেকে বুরুডি সে যেন লাবটুলিয়াকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমার ঠিক পেছনেই বসেছিল সে। রাস্তার দুধারে লাগানো নতুন আম জাম কাঁঠালের চারায় সে পাচ্ছিল যুগলপ্রসাদের ছবি। চেংজোড়ার ক্ষেতের পাশে বৃষ্টির মধ্যেও এক বৃদ্ধ গরু চড়াচ্ছিলেন। রিয়ান বলে উঠল, ওই দেখুন দাদা দবরু পান্না! আমি হেসে উঠলাম। ধনওয়ানীতে আমাদের রাস্তা পেরিয়ে গেল দুটি মস্ত মোষ, রিয়ান যেন আপন মনে বলে উঠলো, টাঁড় বাড়ো !' আরন্যক স্রষ্ঠা যাদের বলেছেন, বুনো মহিষের দেবতা। সবমিলয়ে আমার, সাগরিকার সবারই মনে বোধহয় সংক্রমিত হয়ে গেছে লবটুলিয়া। শতদলের তোলা ছবির সেই রোগা লিকলিকে বৃদ্ধও যেন লবটুলিয়া বইহারের কোনও হত দরিদ্র প্রজা। এ এলাকায় প্রায় সব কিছুর এলাকার পাশেই একটা করে ডি থাকে। যার অর্থ ডিহি বা উঁচু জায়গা। সেই অর্থে বুরুডি হল দেবতাদের ডিহি বা বাসস্থান। সাঁওতালি ভাষায় বুরু অর্থ দেবতা। ওঁদের সবচেয়ে বড় দেবতা মারাংবুরু। শুনে রিয়ান বলল, ঠিক বলেছেন দাদা, বুরুডি হল সেই হ্রদ যেখানে দেবতারা চান করতে আসে। আমি বুঝলাম রিয়ান সরস্বতী কুণ্ডীর কথা বলছে। যেখানে মায়াবিনী বনদেবীরা গভীর রাত্রে জ্যোৎস্নারাতে হ্রদের জলে জলকেলি করতে নামে। মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের আমিন রঘুবর প্রসাদ সত্যচরনকে সরস্বতী কুণ্ডীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিল, 'ওটা আসলে মায়ার কুণ্ডী, ওখানে রাত্রে হুরী-পরীরা নামে; জ্যোৎস্নারাত্রে তারা কাপড় খুলে রাখে ডাঙায় ঐ সব পাথরের উপর, রেখে জলে নামে। সে-সময় যে তাদের দেখতে পায়, তাকে ভুলিয়ে জলে নামিয়ে ডুবিয়ে মারে।' আমার সব কিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। রুষতি এরই মধ্যে বুরুডি ড্যামের স্লুইসগেটের সামনের উঁচু পৈঠাটায় উঠে দাঁড়িয়েছেন। পৈঠাটা বিপজ্জনক ভাবে ড্যামের নিচে ঝুলে রয়েছে। ওর যেন খেয়াল নেই ওদিকে। বুরুডির সৌন্দর্য ভুলিয়ে দিয়েছে বিপদের কথা। হলুদ ডোরাকাটা বাঘের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত মযুরী যেমন তারই দিকে এগিয়ে আসা খাদক বাঘের থেকে আসা বিপদ ভুলে যায়। রুষতি হ্রদের ছবি তুলছেন। ঠিক তখুনি বাঁদিকের পাহাড়টার মাথায় মেঘ ছিঁড়ে সূর্য উঁকি দিল। হঠাৎ আমার নজরে পড়ল বাঘমুড়ি পাহাড়টার ছায়া পড়েছে হ্রদের জলে। পাহাড় ও জলের ছায়া মিলে তৈরি হয়েছে একটা পুরুষ্টু ঠোঁট! ঝিলমিল আর রাগিনী হেঁটে যাচ্ছিল ডানদিক ঘেঁষে। রাগিনীকে দেখে মনে হল দোবরু পান্না বীরবর্দীর সূর্যবংশীয় কন্যা হেঁটে যাচ্ছে। গ্রীবা উঁচু করে উঁচু করে বুরুডির ভিতর গড়ে পেরিয়ে যাচ্ছে রাজকন্যা ভানুমতি। বিভূতিভূষণ এই অঞ্চলকে নিয়েই আরন্যক লিখেছিলেন কিনা জানার প্রয়োজন মনে করিনা। আমি যেখানে দোবরু পান্না, ভানুমতি, যুগলপ্রসাদ আর টাঁড়বাড়োকে খুঁজে পাই সেই আমার আরন্যক, সেই আমার লাবটুলিয়া বইহার। তাছাড়া লাবটুলিয়া থেকে দোবরু পান্নার রাজত্বে যাওয়ার পথে বিভূতিভূষন এক জায়গায় বলছেন, "দুইটি বন্য গ্রাম ছাড়াইয়া আসিয়াছি-একটার নাম কুলপাল, একটার নাম বুরুডি!"বুরুডি ছাড়তে সন্ধ্যা ছ'টা বাজল। আবার আকাশে মেঘ ভেঙে পড়ার উপক্রম। বন্ধু আশিস মিশ্র বলেছিলেন, বুরুডির কোল বেয়ে পেছন দিকের একটা গ্রামে গিয়েছিলেন বন্ধুদের সাথে। পথটা আমার চেনা। ওই রাস্তায় সাত কিলোমিটার গেলেই ধারা জলপ্রপাত। অসাধারন সেই দৃশ্য, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কিন্তু এই দুর্যোগ আর এই সময়ে সেই পথে যাওয়া চলেনা। অন্তত দু কিলোমিটার পথ ট্রেকিং করতে হবে কিন্তু বাকী পাঁচ কিলোমিটার পথও এই গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবেনা। এ যাত্রায় আমার আফসোস বর্ষায় ধারা প্রপাত দেখা হবেনা। সাগরিকা বিপাশাদের গুলি মুরগির ঝোল খাওয়া ছাড়াও অবশ্য আরও কিছু আফসোস যে থেকে যাচ্ছে তা বুঝতে পারলাম পরের দিন। তার অন্যতম হল পাথরের গহনা কেনা হলনা। ধারাগিরি জলপ্রপাত অধরা রেখেই আমরা হোটেলে ফিরছি, শুরুর দিনের যাত্রা শেষ করে এই প্রথম হোটেলে যাব আমরা। সেই পথেই বরং বলে নেওয়া যাক আমার কুড়ি বছর আগের ধারা জলপ্রপাত ও বুরুডি দর্শনের কাহিনী। যাঁরা বাংলা থেকে সরাসরি বুরুডি আসতে চান তাঁদের জন্য এই রুটটাও যথেষ্ট মনোরমের।ক্রমশ...
    রবীন্দ্রনাথ - বেবী সাউ | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়অথচ, সেভাবে পাওয়া হলো না আপনাকে! যৌবন যখন শৈশব থেকে কৈশোরে ছুটে গেলপ্রৌঢ়ত্বের আকাশে ঘনিয়ে এলগোধূলি এগোতে এগোতে এক দীর্ঘ গভীর আফসোসের রেখা টানতে টানতে আপনার দিকে ছুটে গেছি বারবার...প্রেমে প্রত্যাখানে বিচ্ছেদেআদরে শিক্ষায় অশিক্ষায় কলঙ্কে অপমানে সম্মানেঅসম্মানে রাতের কান্নায় সকালের ঘাসফুলেসুন্দর যখন সুন্দরের চেয়েও সুন্দরএবং যাপন যখন একাকী অজান্তে, আপনি থেকে কখন যে তুমি'তুমি' হয়ে গেছ!কখন যে এ মন, এ সত্ত্বাএই অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব বোধ তোমাকে উপাস্য ভেবে সখা ভেবে আনন্দ ভেবে আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া পতঙ্গের মতো জড়িয়ে ধরেছে মুক্ত করেছে আকাশের দিকে শেকল ছিঁড়ে মাটির উপরভেসে গেছে বাতাসের মতো সহস্র অপমানেও সহজ থাকতে থাকতেমরতে মরতে মরতে মরতেবাঁচিয়ে দিয়েছ তুমি চোখের জলে ধুয়ে নিয়ে শিখিয়েছ আবার চোখের জলে ধন্য হতে আমার শ্রান্তি, ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছ বিচ্ছেদ, বিরহ আমি শূন্য হয়ে গেছিশুরুর থেকেই শুরু করেছি শেষ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি শেষে তোমার জন্য ঠাকুরসাহেবমুখ তুলে চেয়েছি আজযেমন প্রথম শিশুর চোখমুখ তুলে দাঁড়িয়ে একাকীত্বময় জীবনের একেকটি অন্দরমহল খুঁজতে গিয়েখুঁজে পেয়েছি নির্জন এক সৈকতআমার হাতের পোড়া দাগে চোখের নীচে বিষাদের অন্ধকারে উপাখ্যানের কাছে লোককথার মতোনত হয়ে আছি শুধুপ্রেমে কেননা, এত দুঃখের ভেতর দিয়ে না পুড়লে আমার মনকিছুতেই তোমাকে পেত না কিছুতেই তোমার গানের কাছে বাড়িয়ে দিত না সাহস কিছুতেই বুঝতে পারত না অতীত এবং আগামীকে ছেড়েক্ষণিকের জন্যও কীভাবে বেঁচে নেওয়া যায়! কীভাবে অসংখ্য কবরস্থান সরিয়ে শ্মশানের ছাই ঘেঁটে বের করে আনা যায় স্নিগ্ধ মধুর এক জ্যোতিকেআলোয় আলোয় ভরে যায়রাতের বালিশ অপমানের ছুরি আমার কাটা দাগনোনা ঘামুগ্ধ চোখে তোমাকে ভাবিতোমাকে দেখিচেয়ে থাকিআর ভাবিএবং ভাবি... কেন চেয়ে আছ গো মা ! নিপুণ তুমি নিষ্ঠুরনিজেকে সরিয়ে নিলে আমার কাছ থেকে স্পর্শসুখ থেকে রাতের গভীর একাকীত্ব থেকে... এই কান্নাএই বোধ এই সৌন্দর্যএই প্রেম আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ? শুধু, শূন্য এক খেয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে শূন্য হয়ে যাওয়া ছাড়া! কীভাবে পূর্ণ হবযদি এভাবে অপূর্ণ না-ই হই?
  • হরিদাস পালেরা...
    বাংলাদেশের যাদুকর - মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২০২১ সাল, মে মাস। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় উথালপাতাল সারা দেশ। লকডাউন মাত্রই শিথিল হয়েছে। একটি প্রায় বিরান মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মী। মার্কেটটি একটি নামকরা স্কুলের পাশে গড়ে উঠেছে। স্কুলের বাচ্চাদের প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি অভিভাবকদের প্রয়োজন পূরণেও চোখ ছিল মার্কেট নির্মাতাদের। অভিভাবকরা যখন বাচ্চাদের ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকবে, তখন যেন তাদের মাঠের গরম ও ভীড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়, বরং মার্কেটের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিপণী বিতানগুলিতে ইচ্ছেমত ঢুঁ মারতে পারে, সেদিকে ছিল তাদের অসাধারণ দূরদৃষ্টি! বলতে কী, ছাত্র-কেন্দ্রিক দোকানের থেকে অভিভাবক-কেন্দ্রিক দোকানের সংখ্যাই ছিল বেশী। আর কথিত ঐ কর্মীরা এমনি একটি দোকানে এসেছিল দল বেঁধে, এক নারী ঋণখেলাপির খোঁজে।সেই  নারী ঋণখেলাপি একটি টেইলার্স শপ খুলে বসেছিল মার্কেটটিতে। প্রথম দিকে সে মাত্র একজন সহকারীকে নিয়ে অভিভাবকদের কিনে আনা সিট কাপড়গুলিকে সায়া, ব্লাউজ, সলোয়ার, কামিজে রূপ দিত। পরে তার নিপুণ হাতের কাজের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে স্কুলের বাচ্চাদের মায়েরা হামলে পড়তে লাগল। অর্ডারের চাপে হিমশিম খেতে থাকা সেই নারী উদ্যোক্তা লোকবল বাড়াল। কিন্তু মানুষের হাতে কুলোচ্ছিল না, তাই যন্ত্রের আবশ্যকতা দেখা দিল। এবং এটা সেই সময়, যখন সে প্রথমবারের মত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুসজ্জিত অফিসে প্রবেশ করল। সেখানকার লোন অফিসার তার ব্যবসা পরিদর্শন করে এতটাই খুশী হলেন যে, মাত্রই এক সপ্তাহে তার জন্য ঋণ মঞ্জুরীপত্র বের করেন আনলেন হেড অফিস থেকে। নতুন সব মেশিনে ঝক্‌ঝক্‌ তক্‌তক্‌ করতে লাগল সেই নারী উদ্যোক্তার দোকানটি। কিন্তু সে মাত্রই মাসখানেকের জন্য। কারণ তারপরেই দেশজুড়ে জারি হল লকডাউন, এমন একটি জিনিস যা আগে কখনোই দেখেনি দেশটির কেউ। দেশের সব স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গেল সবার আগে, তারপর একে একে অন্য সব অফিস আদালত। আবার এক সময় লক ডাউন শিথিল হতে থাকলে অফিস আদালত চালু হলেও স্কুল-কলেজ কিন্তু খুলল না। ইউনেস্কোর একটি হিসেবে প্রায় ৫৪৩ দিন একটানা বন্ধ ছিল বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ, যা একটি রেকর্ড বিশ্বের জন্যই। এদিকে যতদিন স্কুল বন্ধ থাকল, ততদিন স্কুলকেন্দ্রিক সেই নারী উদ্যোক্তার ব্যবসাও বন্ধ থাকল। কিন্তু বন্ধ থাকল না তার ঋণের দায় ও সুদ আরোপের হিসেবটা। হ্যাঁ, সরকার থেকে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল, এবং বারংবার এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঋন তো মওকুফ হয়নি, আর তাই পরিশোধের বর্ধিত সময় পার হয়ে গেলেও সেই নারী উদ্যোক্তার পক্ষে সম্ভব হয়নি ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসার। হ্যাঁ, সরকার থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছিল ক্ষুদ্র ও মধ্যম (এসএমই)  উদ্যোক্তাদের জন্য করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বৃহৎ শিল্পপতিদের জন্য প্রাথমিক বরাদ্দ ৩০ হাজার কোটি টাকার করোনা প্রণোদণার কোটা দ্রুতই পূরণ করে ফেলতে পারলেও এসএমই সেক্টরের কোটা পূরণে বিপুল সমস্যার সন্মুখীন হল। মজার ব্যাপার হল, প্রাথমিক বিতরন-সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের ঋণ-লক্ষ্যমাত্রা ধাপে ধাপে তিরিশ হাজার কোটি টাকা থেকে এক লক্ষ তিন হাজার কোটি টাকায় উপনীত হয়, কিন্তু প্রথম দেয়া ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে পরে আর এ খাতের ঋণ বিতরন করা যায়নি খুব বেশী; মাত্র ৪৬ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরন হয়েছে গত অক্টোবর পর্যন্ত। ওদিকে এসএমই  খাতের ঋণ-লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে  ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬০ হাজার কোটিতে উন্নীত হয়, এবং গত অক্টোবার পর্যন্ত বিতরন হয়েছে ৩১ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা।তার মানে,  আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রথমে উদ্বিগ্ন থাকলেও ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ও মাঝারী খাতে নজর দিয়েছিল। যেমন, এই নারী উদ্যোক্তাকে এক পর্যায়ে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল করোনা প্রণোদনা প্যাকেজের অধীনে ঋণ নেয়ার জন্য। কিন্তু সেই নারী উদ্যোক্তার পক্ষে সম্পত্তির দলিল জমা রাখা প্রায় অসাধ্য ছিল।  সে ভাড়া বাসায় থেকে ভাড়া দোকানে ব্যবসা করত। নিজ গ্রামের যৎসামান্য ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত  কাগজপত্রবিহীন সামান্য যে গ্রামীন কৃষিজমি তার ছিল, তা জামানত হিসেবে প্রস্তাব করার সাহস তার ছিল না।  ফলে আরো লাখো লাখো ক্ষুদ্র ও মধ্যম উদ্যোক্তার মত আমাদের এই নারী উদ্যোক্তাও থেকে গেল করোনা প্রণোদনাবিহীন, যাদের হয়ত সব থেকে বেশী প্রয়োজন ছিল এই প্রণোদনার পিল। আর তারই অমোঘ পরিণতি হল আমাদের আলোচিত উদ্যোক্তার দোকানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তাগাদা বাহিনীর ধর্ণা, লকডাউনের এই দ্বিতীয় গ্রহণকালে, এই ঘোর খরার মার্কেটে।  আমাদের এই নারী উদ্যোক্তা যে শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছেই দেনাদার ছিল, তা নয়। ঋণের টাকা দিয়ে তো সে মেশিন কিনল। কিন্তু বড় বড়  অর্ডারকে পূরণ করার জন্য যে সে গাদা গাদা কাপড় এনেছিল হোলসেল কাপড় সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে, তাদের দেনা পরিশোধেও ছিল উপুর্যুপুরি আর ধারালো চাপ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আইন-সমর্থিত চাপ সামলাতে পারলেও ঐ নারী উদ্যোক্তা সরবারহকারীদের আইন-অসমর্থিত চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়েছিল, যার অবশ্যম্ভাবী ফল নতুন ক্রয় করা সেলাই মেশিনগুলোর অধিকাংশ নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়া কাপড়ের স্টকের সাথে সাথে। এভাবে করোনার করাল গ্রাস সেই সাপ্লাইয়ারদের অস্বাভাবিক মুনাফা এনে দিলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ঋণের কোন টাকাই উদ্ধার করতে পারল না। ফলশ্রুতিতে তারা আইনি পদক্ষেপ শুরু করলে,  আমাদের আলোচ্য নারী উদ্যোক্তা মান-সন্মান বাঁচাতে মহাজনদের দ্বারস্থ হল, যারা প্রচলিত সুদের প্রায় চার-পাঁচ গুণ হারে ঋণ দিয়ে থাকে, আর ঋণ আদায়ে তাদের থাকে আলাদা গুন্ডা বাহিনী। ফলে করোনা অস্বাভাবিক মুনাফা এনে দিল টাকার এই আদিম কারবারীদেরও!‘’উধাও হল কালো ধোঁয়াফুটল শহর আলোয় ধোয়াকরোনার করাল ছোঁয়াঅসভ্যতা সব টুটে যাওয়া’’করোনার মর্ত্যধামে আগমনের শুরুতে নিবন্ধকার লিখিত লাইনগুলিতে নিছকই বালখিল্য আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, না হলে অসভ্যতা পৃথিবী থেকে তো টুটে যাওয়ার নয়!  প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন টাকার করোনা প্যাকেজ যা কিনা জিডিপির ৪.৪%, তাতে কিন্তু উপকারভোগীর সংখ্যা ছিল মাত্রই  ৫.৮০ লাখ। করোনায় ক্ষুদ্র ও মধ্যম খাতের ব্যবসায়ীরা পথে বসেছে, আর একটি শ্রেণী আখের গুছিয়েছে, যেভাবে চিরকাল যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা দুর্বিপাকের সুযোগ নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে একটি বাহিনী। যেখানে একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়ে রাতে ইজি বাইক ও দিনে দারোয়ানের চাকরি নিয়ে কোনমতে পেট চালাচ্ছে, সেখানে প্রণোদনার টাকা নিয়ে অনেকে জমি ও সম্পত্তি করেছে দেশে-বিদেশে। এগুলো শুধু কথার কথা নয়, এগুলোর জন্য নথিবদ্ধ প্রমাণ রয়েছে, আর সেগুলো এসেছে খোদ সরকারী দপ্তরের তদন্ত থেকেই। এমনি একটি তদন্তে বের হয়ে এসেছে, একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় তের কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা প্রণোদনার ঋণ গ্রহণ করে তাদের চলতি হিসেবে (ব্যাংক একাউন্ট) রেখে দেয়, পরে তা উঠিয়ে অন্য ব্যাংকে জমা করে রাখে। তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে তারা এই অর্থ ব্যবহার করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।বর্তমানে  দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ভঙ্গুর ও অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে। মুডি সহ অন্যান্য রেটিং এজেন্সি দেশে সার্বভৌম রেটিং চালু হওয়ার পর প্রথমবারের মত অবনমন করেছে একে। মুডি এ বছর আমাদের দেশের দীর্ঘমেয়াদী ঋণপরিশোধ রেটিং বিএ৩ থেকে নামিয়ে বি১ করেছে, আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ পরিশোধ সামর্থ্যকে নামিয়ে ‘নট প্রাইম’ করেছে। রিজার্ভ ঠেকেছে তলানিতে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী রিজার্ভ এখন প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালের আগস্টে যা ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এসবের দায়ভার দেয়া হচ্ছে সব ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে। আশ্চর্য হল, করোনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হলেও কেউ কথা বলছে না শব্দটি নিয়ে আর। আসলে করোনা মোকাবেলায় সফল হয়েছি আমরা, সারা বিশ্বে আমরা উদাহরণ সৃষ্টি করেছি, এসব তথ্যের জন্য এখন আর করোনাকে দোষ দেয়া যাচ্ছে না! করোনায় টিকা সরবারহে সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ এবং প্রাণহানি কম ঘটেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থনীতির টিকায় কতটুকু সফল হয়েছে, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তির বেড়াজাল।স্টিভেন ই ল্যান্ডসবার্গ তার ‘দ্য আর্মচেয়ার ইকোনোমিস্ট’ গ্রন্থে ‘হাউ স্ট্যাটিকস লাই’ প্রবন্ধে বলেন,  ‘’There are always plenty of people around to observe a crowd. There is nobody around to observe a vacuum.’’  করোনায় বাংলাদেশ খুব ভাল পারফর্মেন্স করেছে তার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হচ্ছে জিডিপির হারকে। হ্যাঁ, করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের জিডিপি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ প্রজেকশানকে হার মানিয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৫.৪৭%। অথচ আইএমএফ-এর ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুক ভবিষ্যৎবাণী করেছিল প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৮%।আমাদের জিডিপি ক্যালকুলেশান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গুঞ্জন রয়েছে, তাকে গোণায় না ধরেও বলা যায়, বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডে অনুপাতটা বেশি ছিল বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু তার পেছনের নেপথ্য কারণগুলো কী ছিল? যেকোন পর্যবেক্ষক তার নিরপেক্ষ চোখখানা মেললেই দেখতে পাবেন, আগের বছরে যা ধরা হয়নি হিসেবে, সেসব নাম্বারের তেলেসেমাতি ছাড়াও আছে লকডাউন পরবর্তী ভোগব্যয়ের হঠাৎ কিন্তু সাময়িক উল্লম্ফনের ঘটনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, রপ্তানিতে ২০২০-২১ এ অর্জিত ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার প্রায় ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করছে। তবে তা ২০১৮-২০১৯ এর রপ্তানিমূল্য ৪০.৫০ বিলিয়ন ডলারকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। উপরন্তু, ২০১৯-২০২০ এর থেমে যাওয়া রপ্তানিগুলো এই সময় যুক্ত হয়েছিল। এছাড়া এক্সপোর্ট প্রমোশান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ফেব্রিকস ও ইয়ার্নের  উচ্চ খরচের কারণে গার্মেন্টসের মূল্য বিদেশী ক্রেতারা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।  এদিকে আমদানী প্রায় ১৭% বাড়লেও তা মূলত আগের অর্থবছরের জের টানার ফল; মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বরং ৩.২৮% হ্রাস পেয়ে ৩.২৪ বিলিয়ন  ডলারে দাঁড়িয়েছিল। একটি বিখ্যাত শিল্প গ্রুপের  ব্যবস্থাপনা পরিচালক  বলেন যে, কভিডের মধ্যেব্যবসায় সফলতার পেছনে একাধিক বিষয়কাজ করেছে, একক কোনো কারণ নেই।প্রথমত,  কভিডের কারণে কয়েকমাস ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ সময়অনেক ছোট ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।যারা টিকে ছিল, তারা মনোযোগ দিয়েছে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে এতে সার্বিকভাবে দক্ষতাঅনেক বেড়েছে। রফতানিমুখী অনেকউৎপাদনকারী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় রফতানিপ্রবৃদ্ধিতেও কিছুটা সুবিধা হয়েছে।   বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দারিদ্র্য হার ২০১৬ এর ২৪.৩ শতাংশ থেকে নেমে ১৮.৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মানে, দারিদ্র্য মোকাবেলায় আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে গিনি কোএফিশিয়েন্ট (অর্থনৈতিক অসাম্য পরিমাপের সূচক)  কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, করোনায় আমাদের অর্থনীতি কতটা বেগ হারিয়েছে, অসুখ ঢুকেছে কত গভীরে! কোন দেশের অর্থনৈতিক অসাম্য উচ্চমাত্রায় আছে বলে ধরা হয়, যদি তার গিনি কোএফিশিয়েন্ট সূচক ০.৫০ মানকে স্পর্শ করে। ২০১০ সালে আমাদের গিনি কোএফিশিয়েন্ট ছিল ০.৪৫৮, ২০১৬ সনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ০.৪৮২ তে, আর ২০২২ এ তা আরো উঁচুতে উঠে অবস্থান করছে ০.৪৯৯ মানে। তার মানে, উচ্চ মাত্রার ধন-বৈষম্যের ক্লাবে ঢোকা আমাদের জন্য এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এ বছর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য এই অসাম্যই এখন বড় বাঁধা। তার মতে, দরিদ্র জনসংখ্যার আয় বেড়েছে, কিন্তু ধনী লোকের আয় আরও বেড়েছে, যা আয় বৈষম্যকে প্রকট করে তুলছে। আর এ কারণেই হয়ত আয়ের সমতার রাষ্ট্রীয় স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করেছে।  করোনায় আমাদের অর্থনীতির তলা কতটা ফুটো হয়েছে, তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে ব্যাংক কুঋণের হিসেবের দিকেও, যা দিন দিন শুধু বাড়ছেই, সরকারী প্রণোদনার সাথে পাল্লা দিয়ে। সেপ্টেম্বর ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ৯.৪% খারাপ ঋণ নিয়ে দক্ষিন এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, শুধু দেউলিয়া ঘোষিত শ্রীলংকা রয়েছে আমাদের উপরে ১০.৯% ঋণ নিয়ে।মনু সংহিতায় একটি শ্লোক আছে,  “ যঃ অর্থ সূচি, সঃ শুচিঃ”, মানে অর্থের বিশুদ্ধাতেই শুচিতা নিশ্চিত হয়। আজ প্রশ্ন উঠছে, করোনার টাকাগুলো তাহলে গেল কই? কেন ফেরত আসছে না জনগনের কষ্টার্জিত টাকা? অনেক টাকা বিদেশ থেকে এলেও সেও তো বাংলাদেশের মানুষকেই পরিশোধ করতে হবে। তো সেই টাকাগুলো কই? একটি হিসেবে দেখা গেছে, অফশোর ব্যাংকগুলিতে (দেশের বাইরে বিনিয়োগের নিরাপদ স্বর্গ) বাংলাদেশীদের টাকা বেড়ে গিয়েছে। এছাড়া আরো একটি তথ্যে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশীরা শীর্ষে রয়েছে নির্মাণ খাতের বিনিয়োগে।বাংলাদেশের বৈদিশিক মুদ্রার মজুদ এখন বিপদজনক ঝুলে আছে, যেকোন সময় তলা ক্ষয় হয়ে যেতে পারে বলে অনেকে আশংকা করছেন। বাংলাদেশ কি তবে শ্রীলংকা হতে যাচ্ছে? উত্তর হচ্ছে, না হয়ত। চার্লস ডিকেন্সের উক্তি এখানে স্মরণ করা যেতে পারেঃ ‘’There are dark shadows in the earth, but its lights are stronger in the contrast.’’সমাধান হয়ত করে দেবে অভিশাপ রুপে পরিগণিত বাংলাদেশের সেই পচা-কালো-রোগা জনগনই যারা মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিগুলোতে নামমাত্র মূল্যে শ্রম বেচে, আর তাদের মা-বোনেরা নামমাত্র মূল্যে শ্রম বেচে আধুনিক বাংলাদেশের নীলকর সদৃশ  গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে। তাদের সৃষ্ট প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় খাতে অনুকূল বাতাস বইতে শুরু করেছে বলে সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ। বাংলাদেশটা এ যাত্রা আবারো বেঁচে যাবে হয়ত এদের হাত ধরেই। আগের বার গুলোতেও বাঁচিয়েছে এরাই, মধ্যস্বত্বভোগী লুটেরা বাহিনীর তৈরী করা শত মরনফাঁদ সত্বেও।সত্যি বলতে কী, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি খাতের শ্রমিকেরাই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃত যাদুকর। আমাদের আলোচ্য নারী উদ্যোক্তা এই যাদুকরদের একই পরিবারভূক্ত। এরাই হচ্ছে সেই বাংলাদেশ মিরাক্যল, যা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ক্লাসগুলোতে ইদানিং আলোচিত হয়। এদের হাতেই রয়েছে বাংলাদেশের আগামী দিনের জীয়নকাঠি। কিন্তু যাদু দেখানোর জন্য খুব সামান্য হলেও কিছুটা স্থানের প্রয়োজন পড়ে; আমাদের যাদুকরদের জন্য সাময়িক স্বার্থত্যাগ করে সেইটুকু স্থান কি আমরা ছেড়ে দিতে পারি না?   (সমাপ্ত) 
    সৎ পাত্র  - ARUPRATAN MUKHERJEE | সৎ পাত্র: রাজনীতি এতো নীচে বোধহয় কখনো নামেনি।আপনি অদৃশ্য। তুইতোকারি চলছে। তুই চোর তো তোর বাবা চোর।কুর্তাও পরাচ্ছে আবার কাঁকড়ের লাড্ডুও খাওয়াচ্ছে।পাবলিকের চড় খাচ্ছে  তবুও খিলখিল করে হাসছে। চড় খাওয়ায় তো কেউকেউ হ্যাট্রিকই করে ফেললো।যোগ্যতা? ঐ সুকুমার রায় যা বলেছিলেন, '১৯টি বার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামলো শেষে'।আর বিষয়-আসয় ? প্রায়  সবাই কয়েক- কোটিপতি। কারুর কারুর আবার কিটব্যাগে  ক্রিমিনাল রেকর্ড। জেলখাটাতো এখন এক্সট্রা কোয়ালিফিকেশন।সবাই প্রধানমন্ত্রী  হবার যোগ্য ! উপপ্রধান, সহপ্রধান নৈব নৈব চ। সবারই মন্ত্রী লগ্নে জন্ম !জনগণের সেবা করার প্রবল আকুতিতে কারুর নাক ফেটে রক্ত পড়ছে তো কারুর জামার হাতা উড়ে যাচ্ছে। তাতে কি? কুছ পরোয়া নেই। উঠেই আবার ছুট। আম জনতার সেবায় 'আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান তারি লাগি তাড়াতাড়ি '।জনতাই জনার্দন !আদর্শ ফাদর্শ লোপাট ! এখন শুধুই পাটিগণিত। কতোর সঙ্গে কতো যোগ করলে কতো হয়। কতো হলে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা যায়। উপসী জনগণের সেবা করতে হবে না! এই সৎ পাত্রের দল শুধু হিসেব নিপুনই নয়, হিসেব নির্মমও ! পাটিগণিত কষে এরা একে অপরের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, সুযোগ বুঝে পরস্পরের পিঠ চুলকে দিচ্ছে, কখনো নখ কেটে কখনো নখ না কেটে !!
    তোমার বাস কোথা যে… - Nirmalya Nag | নির্মাল্য নাগ  ।। এক ।।  [ মাঝের কথা ] সরু একটা পাহাড়ি পথ দিয়ে হাঁটছে বিনীতা। তার ডান দিকে বরফ আর কুয়াসায় মোড়া উঁচু পাহাড় উঠে গেছে সোজা আকাশের দিকে, আর বাঁ দিকে অতলস্পর্শী খাদ। খুব সাবধানে পা ফেলছে বিনীতা, তবুও পাথরে মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে তার আট বছর বয়সী মেয়ে রঙিন দিব্যি আসছে, কোনও অসুবিধেই নেই, যেন রাজপথে হাঁটছে। হঠাৎই বিনীতা দেখল খাদটা চলে এসেছে ডানদিকে আর পাহাড়টা বাঁদিকে। মেয়েকে সাবধান করতে ঘুরে দেখে তার কোনও হেলদোল নেই। যেমন আসছিল তেমনি আসছে। এদিকে খাদ ফের ফিরে গেছে বাঁদিকে -  কি যে হচ্ছে বুঝতে পারছে না বিনীতা। ক্রমশঃ সরু হচ্ছে রাস্তা। একটা হোঁচট খেয়ে পাহাড়ের গায়ে ডান হাত রেখে টাল সামলাতে গেল বিনীতা। ততক্ষণে পাহাড় চলে এসেছে বাঁদিকে। ব্যালান্স হারিয়ে খাদে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে বিনীতা দেখতে পেল মেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর মেয়ের পিছনে যেন একজন কেউ এসে দাঁড়াল, ওর হাতটা ধরল।…ঘুমটা ভেঙ্গে গেল বিনীতার। কি বিশ্রী স্বপ্ন। দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সকাল পাঁচটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ডবল বেড খাটের ও পাশটা খালি। অসুস্থ স্বামী শুয়ে ছিল ওখানে, বিছানা আর বালিশে তার পরিস্কার ছাপ। অ্যাটাচড টয়লেটের দিকে তাকিয়ে বিনীতা দেখল দরজা বন্ধ। আবার একা একা বাথরুমে গেছে, ডাকেনি ওকে। বিরক্ত হল বিনীতা; বারণ করলেও শোনে না। খাট ছেড়ে উঠে বারান্দার দিকের জানলার পর্দাটা সরিয়ে দিল সে। সেপ্টেম্বর গোড়ার দিকের ভোরবেলার আলো ঘরে ঢুকে এল। আর ক’দিন পরে এই সময়ে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগবে। বাইরে সোজা তাকালে যেদিকটা চোখে পড়ে, সেদিকে তিন কিলোমিটার মত গেলেই কুসুমবনি কয়লা খনি, তার কাজ-পাগল স্বামী অরুণাভ দাস যেখানকার অ্যাসিসটান্ট ম্যানেজার। আর ডানদিকে তের-চোদ্দ কিলোমিটার দূরে বোকারো শহর। সেখানকার হাসপাতালে কিছু দিন আগে অপারেশন হয়েছে অরুণাভর।মোবাইল ফোনটা চার্জে দেওয়া ছিল; সেটার সুইচ বন্ধ করল বিনীতা। বেডরুম থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের ভেজানো দরজায় ঠেলা দিল। সে ঘরে খাটের ওপর ঘুমোচ্ছে রঙিন, আর মাটিতে বিছানা করে শুয়ে আছে কাজের মহিলা বিসপাতিয়া।“উঠে পড়ো, বিসপাতিয়া। ছ’টা বাজে।” কাজের লোককে ডেকে দিয়ে ওপাশের ওয়াশরুমের দিকে চলে যায় বিনীতা। ফেরার পথে দেখল বিছানা তুলছে বিসপাতিয়া। বেডরুমে ঢুকে দেখে তখনও টয়লেটের দরজা বন্ধ। বারান্দার দরজা যেমন বন্ধ ছিল তেমনি আছে, মানে অরুণাভ টয়লেটেই আছে।এতক্ষণ তো থাকে না বাথরুমে। বিনীতা ভ্রু কুঁচকে মাথা নেড়ে দরজার সামনে যায়।“আবার একা একা বাথরুমে গেছ?” জিজ্ঞাসা করে বিনীতা; কোন সাড়া পায় না ভেতর থেকে। ফের জিজ্ঞাসা করে, “দেরি হবে?”তাও কোনও উত্তর নেই। কী ব্যাপার? দরজায় হালকা চাপ দিয়ে বিনীতা বুঝল সেটা ভেতর থেকে বন্ধ নেই; যাক, এই কথাটা অন্তত শুনেছে। আর একটু চাপ দিতে দরজাটা পুরো খুলে গেল। ভেতরে কেউ নেই। বিস্মিত বিনীতা দ্রুত পায়ে ঘরের বাইরে গিয়ে গেস্টরুম, ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম, কিচেন সব ঘুরে দেখে। কোথাও নেই অরুণাভ। কী ভেবে ফের যায় মেয়ের ঘরে, সেখানে রঙিন ঘুমোচ্ছে, আর কেউ নেই।বাইরের ঘরের দিকে ছুটে যাওয়ার পথে ঝাড়ু হাতে বিসপাতিয়াকে দেখা যায়। “সাব-জীকে দেখেছ?”মালকিনের এমন প্রশ্নে অবাক হয় বিসপাতিয়া। “না তো, কেন ঘরে নেই?”উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যায় বিনীতা, বিসপাতিয়াও আসে পেছন পেছন। সদর দরজার পাল্লা ভেজানো রয়েছে, আগেরবার যখন এই ঘরে এসেছিল তখন এটা খেয়াল করেনি। দরজা খুলে দেখল বাগানেও নেই অরুণাভ। বাইরের গেটের কাছে এসে এদিক ওদিক তাকায় বিনীতা, একটু দূরে মিস্টার আর মিসেস আগরওয়াল মর্নিং ওয়াক করছেন, আর অন্য দিকটায় একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে, তবে সে কখনই অরুণাভ নয়। গ্যারাজে গিয়ে দেখল গাড়িটা রয়েছে।“ভাবি, একটা ফোন করে দেখ,” বিসপাতিয়া বলে, সেও বুঝে গেছে সাব-জী বাড়িতে নেই।ঠিকই বলেছে, ভাবে বিনীতা। তবে মোবাইল তো শোয়ার ঘরে। ড্রইং রুম থেকেই ল্যান্ডলাইনে অরুণাভর মোবাইলে ফোন করে। সঙ্গে সঙ্গে সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে একটা গোঁগোঁ শব্দ পাওয়া যায়। ভাইব্রেশন মোডে রাখা মোবাইলের আওয়াজ।“এই যে,” আঙুল দিয়ে দেখায় বিসপাতিয়া, “এই খানে।” ধীরে ধীরে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ওদিকে তাকায় বিনীতা। তিন-চারটে বই-এর আড়ালে রয়েছে মোবাইলটা, এইবার দেখতে পায় সে। আর সেই সঙ্গে চোখে পড়ে আরও একটা জিনিস।পাওলো কোয়েলহো-র ‘দ্য জাহির’ বইটা থেকে উঁকি মারছে একটা সাদা কাগজের খানিকটা অংশ। কী ওটা? কাঁপা হাতে বইটা তুলে অর্ধেক ভাঁজ করা কাগজটা বার করে সে… একটা চিঠি… তাকে লেখা অরুণাভর চিঠি। খুব বড় চিঠি নয়, পড়ে ফেলতে সময় লাগে না। সোফার ওপর বসে পড়ে বিনীতা। ফের চোখ বোলায় হাতের কাগজটার দিকে।বিসপাতিয়া জিজ্ঞেস করে, “কী ওটা? সাব-জীর চিঠি?”উত্তর দেয় না বিনীতা, দ্রুত চিন্তা করতে থাকে সে। এখন কী করনীয়? তার ভাবার জন্য সময় চাই, পরামর্শ চাই। মনস্থির করে ফেলে সে।“রঙিনকে ডাকো, বিসপাতিয়া। স্কুলের জন্য রেডি করো,” সোফা থেকে উঠে পড়ে বিনীতা। শোওয়ার ঘরের দিকে এগোয়।“ভাবি… সাবজী?…”বিসপাতিয়ার প্রশ্নে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায় বিনীতা। “বেরিয়ে গেছে… অফিসের কাজে। রঙিনকে ডাকো; ছটা বেজে গেছে, দেরি হয়ে যাবে।”বেড রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েও করে না সে। মোবাইলটা খুলে নেয় প্লাগ থেকে। একটা ফোন করে, কিছুক্ষণ সময় লাগে ওপারের লোকের ফোনটা ধরতে।“সরি, ভোরবেলা ঘুম ভাঙালাম… একটা ব্যাপার হয়েছে... না, শরীর না। ও নেই... মানে কোথাও চলে গেছে, বোধহয় ভোর রাতে, একটা চিঠি রেখে গেছে... সে সব কিছু লেখেনি, একবার আসা যাবে?... স্কুলে পাঠাচ্ছি… ঠিক আছে।” ফোন শেষ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বিনীতা। চট করে বিছানাটা তুলতে গিয়ে দেখতে পায় তোষকের নিচে অরুণাভর ওয়ালেটটা নেই। পাশের ছোট টেবিলের ওপর ওষুধপত্রগুলো সবই রাখা আছে। নিশ্বাস ফেলে মেয়ের ঘরের দিকে এগোয় সে, ওকে রেডি করতে হবে। বিসপাতিয়া বরং ওর খাবারের ব্যাপারটা দেখুক। এই সবের জন্য আজ একটু দেরিই হয়ে গেছে।কিছুক্ষণ পরে স্কুল ড্রেস পড়া রঙিন আর বিনীতা বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে। রঙিনের পিঠে ব্যাগ, কাঁধে জলের বোতল। বাসের জন্য অপেক্ষা চলছে। বাসটা কি আজ দেরি করছে আসতে?“বাবা এত সকালে কোথায় গেল?” জিজ্ঞাসা করল রঙিন।“বললাম যে আজ সকাল সকাল কাজে বেড়িয়েছে।... ওই তো বাস আসছে... যাও… টা টা,” বলল বিনীতা।মা-কে টা টা করে বাসে উঠে পড়ে রঙিন। বিনীতা দরজার কাছ থেকে ফিরে সোফায় বসে। আজ সকালে চা খাওয়া হয়নি। এখন চা-বিস্কুট এনে দেয় বিসপাতিয়া। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভাবিকে তার কিছু জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সাহস হল না।রান্নাঘরে ফিরে গেল সে; চায়ে চুমুক দিল। ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছে তার মোটা বুদ্ধিতে কোনও ব্যাখ্যাই পাচ্ছে না সে। রঙিন যখন এইটুকু ছিল, তখন থেকে এই বাড়িতে কাজ করছে সে। গায়ত্রী ভাবি তাকে এনে দিয়েছিল এখানে। সাব-জী এত সকালে কোনও দিন বেরিয়ে যান না; এটাও পরিস্কার যে ভাবি জানত না উনি বেরোবেন। ভাবির ঘুম খুব গাঢ়, বুঝতে পারেনি কখন উনি চলে গেছেন। ওই কাগজটা নিশ্চয় চিঠি; কিন্তু চিঠি লিখলেন কেন? মোবাইল নিয়ে যাননি কেন? গাড়িটাও রয়েছে কেন? সাব-জীর অফিস যাওয়ার ব্যাগটাও যে যথা স্থানেই রয়েছে সেটাও চোখ এড়ায়নি তার। ভাবি সত্যি কথা বলছে না। সাব-জী তো সারাক্ষণই অফিসের কাজ নিয়ে থাকেন; তবে এখন তিনি কাজে যাননি, এটা নিশ্চিত। কোথায় গেলেন অসুস্থ মানুষটা? এই তো ক’দিন আগে হাসপাতাল থেকে বাড়ি এলেন। ফিরবেন তো?বাইরের ঘরে বিনীতার কাপ নিতে এসে বিসপাতিয়া দেখল এক চুমুকও খাওয়া হয়নি তার থেকে, ঠান্ডা হয়ে গেছে লাল চা। মিইয়ে গেছে বিস্কুট। ভাবি যেমন বসেছিল তেমন ভাবেই জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বয়সে নিজের চেয়ে কিছুটা ছোট ভাবির জন্য খারাপ লাগল বিসপাতিয়ার। ওকে দেখেই তাড়াতাড়ি কাপের দিকে হাত বাড়াল বিনীতা।“ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার করে এনে দিচ্ছি। একটু দাঁড়াও।” বিসপাতিয়া কাপ তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে।“বিসপাতিয়া।” ভাবির ডাকে দাঁড়িয়ে গেল সে। “সাব-জী আজ ভোর বেলা চলে গেছেন। কোথায় গেছেন জানি না, বলে যাননি কিছু। রঙিনকে কিছু বলার দরকার নেই। যা বলার আমিই বলব।” কথাগুলো সোজা সামনে তাকিয়েই বলল বিনীতা, বিসপাতিয়ার দিকে না তাকিয়েই।“কবে ফিরবেন?”“জানি না,” একটু সময় চুপ করে থাকল বিনীতা, এবার দিরে তাকাল ওর দিকে। “চা দেবে বললে যে।” কাপ ডিশ নিয়ে রান্নাঘরে ফিরল বিসপাতিয়া। যা ভেবেছিল তাই, বড় ব্যাপার কিছু একটা হয়েছে।বাইরের ঘরে বিনীতার মোবাইল বেজে উঠল। ফোন ধরল সে, ওপাশের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, “কতক্ষণ লাগবে? ... আচ্ছা, ঠিক আছে।”ফোনটা সেন্টার টেবিলে রাখতে গিয়ে অরুণাভর মোবাইলটা দেখতে পেল বিনীতা। তারপরই সেই ‘দ্য জাহির’ বইটা যার মধ্যে চিঠিটা ছিল। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে চিঠিটা রেখেছে সে। স্বামীর কাছ থেকে প্রথম, আর হয়তো বা শেষ, চিঠি। বইটা তুলে ফরফর করে পাতাগুলো উলটে গেল বিনীতা। আর কিছু নেই বই-এর ভেতরে। তবে বিনীতার মনের ভেতরে ভাংচুর হচ্ছে অনেক কিছু। (ক্রমশঃ)
  • জনতার খেরোর খাতা...
    দেবেশ রায়ের শেষ উপন্যাস  - পাপাঙ্গুল |  "গল্প লেখা বা বলার দেবতা বলল - তা হলে তুমি একটা চির -অতীতের গল্প লেখো বা বলো না কেন?"এই বাক্য দিয়ে , পৃথিবীর একটি প্রাচীনতম আখ্যান ভিত্তি করে এই বই শুরু হয়। ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পগুলো তৈরি হয়েছিল ১২০০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথকের জিভে ও উচ্চারণে , প্রাচীন হিব্রু বা আরমাইক এ। ৭০ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম ধ্বংসের পর ওল্ড টেস্টামেন্টের সব পাণ্ডুলিপিই প্রায় লুপ্ত , ইহুদি ধর্মজ্ঞরা স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে [ বেদ / শ্রুতির মত, একটা তফাৎ আছে - রামায়ণ মহাভারতের ভাষা কখনো ধ্বংস হয়নি] মাসোরেটিক কপি তৈরী করেন। পরে একাদশ খ্রিস্টাব্দে তৈরী ও লেনিনগ্রাদে রক্ষিত এক পাণ্ডুলিপি থেকে মাসোরেটিক  পাণ্ডুলিপির প্রামাণিক সংস্করণ তৈরী হয়। শুধু অংকের হিসেবে দশ হাজার বছরের পুরোনো এই আখ্যান পাঁচশো খ্রিষ্টাব্দে ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে কোরান শরীফে এসেছে। এই আখ্যানের চির অতীতে সব ঘটেই আছে। বাইবেলের পৃথিবী - গ্যালিলির সমুদ্র , জর্ডান নদী , তেতোজলের হ্রদ , সুয়েজের উপসাগর , আকোয়াবার  উপসাগর , লাল জলের সমুদ্র। এই সবের ওপর দিয়ে বয়ে যায় লেভিয়াথান (পূব বায়ু)। বাআআল নামে সমুদ্রিক দেবের সঙ্গে লেভিয়াথানের কয়েক ঋতু ধরে প্রবল যুদ্ধে কয়েক বছরের হাওয়া মেঘ ও জল তছনছ হয়ে যায়। লেভান্ট ভূমি হয়ে দাঁড়ায় সৈকত আর মরুভূমির মাঝের সাঁকো। ইয়ুসুফ অন্যের স্বপ্নের ভেতর ঢুকতে পারে। স্বপ্নে কি ঘটছে আর কি ইশারা আছে সব সে দেখতে ও বুঝতে পারে। তার প্রপিতামহ আব্রাহামের সঙ্গে ঈশ্বরের কথাবার্তা হয়েছিল যিনি আব্রাহামকে আদেশ করেছিলেন তার প্রতি বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে নিজের পুত্রকে হত্যা করতে। ঈশ্বর যে ঈশ্বর , তা প্রমাণের জন্য তারপর ঈশ্বরকে সেই শিশুর পুনর্জীবন ঘটাতে হয়েছিল। জন্মানোরও আগে ইয়ুসুফ তৈমুসের রাজকন্যা জুলেখার , এক কিশোরী থেকে নারী হয়ে ওঠার সময়ের তিনখানা স্বপ্নে প্রবেশ করে ক্রমান্বয়ে বলেছিল -১। আমি এখনো জন্মাইনি , জন্মাব ২। আমিই তোমার স্বপ্নপুরুষ ৩। আমি আজিজ মিশির সেই স্বপ্ন দেখে জুলেখা কানান থেকে খুঁজতে খুঁজতে মিশরে এসে সম্রাট আজিজ মিশিরকে দেখতে পায় , কিন্তু তার সঙ্গে তার স্বপ্নপুরুষের মুখ মেলে না। জুলেখার সঙ্গে আজিজ মিশিরের বিয়ে হয়ে যায়। নৃপতি আদেশ কৈল বাজিতে বাজন। সৈন্য সেনাপতি মোর করউ সাজন।। দুন্দুভির শব্দে পুরিল দিগন্তর। ঢাক ঢোল দন্ডি কাঁসি বাজয়ে সুস্বর।। [ সম্ভবত মধ্যযুগের বাংলার শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা 'ইউসুফ-জুলেখা' থেকে এরকম অনেকগুলো পয়ার লেখার মাঝে মাঝে দেবেশ রায় উদ্ধৃত করেছেন ]মিশরের রাজা দুটো জিনিসকেই একমাত্র জিনিস বলে ভাবে - বিড়াল আর ফুল। দেবতাদের চাইতেও মন্দিরে প্রধান হচ্ছে বিড়াল। পৃথিবীতে যত রং আছে ও দুটি রঙের মধ্যে যতরকম তফাৎ থাকতে পারে সবরকম রঙের বিড়াল মিশরের শহরের মানুষদের পায়ে পায়ে ঘোরে। ঘন লাল রঙের বিড়াল পাওয়া যায়না বলে রাজা সেই খামতি ঘন লাল রঙের ফুলে মিটিয়ে দিয়েছেন। ওদিকে জন্মানোর পর বালক ইয়ুসুফকে কারা এক কুয়োর ভেতর ঠেলে ফেলে দেয়। কুয়োর ওপরে আঁধার পাখিদের পাক খেতে দেখে  যাযাবর বণিক তাকে উদ্ধার করে , বাঁচিয়ে তোলে ও  নিজের কাফেলার সঙ্গী করে নেয়। সেসময় মিশরের আর এক নাম মিজরেইম। যাযাবর বণিকদের মুলুককে মিদিয়ানও বলে। সারা বছরই এরা পূব দিক থেকে দুই নদীর দেশ [মেসোপটেমিয়া]র মধ্যে যাতায়াত করত। তারা নানা মেলায় তারা  মিশরের কাপড় , কুশদেশের ধূপকাঠি , জর্ডনের কাঁচের বাসন , লোহিত সমুদ্রের দ্বীপ থেকে আনা শুকনো মাছ , সমুদ্রের ভেতরের শাকসবজির পসরা সাজিয়ে বসে। কাফেলার ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইয়ুসুফের লোফা ভাজার গরম গন্ধ। 'এলে সেমথ' বা এক্সডাসের বিপরীত পথে সিনাই থেকে কানান হয়ে মিশরে এসে বণিক পুরো রাজকোষের বিনিময়ে ইয়ুসুফকে বিক্রি করে দেয় আজিজ মিশিরের কাছে।"পশুর মত শুধু বেঁচে থাকা আর মানুষের শারীরিক লজ্জাবোধের সমপরিমাণ আত্মচেতনা দিয়ে তৈরী হয় দাস। ইয়ুসুফের মনে হয় সে এই পরিধির কেন্দ্র। ইউসুফের মনে হতে থাকে কেন্দ্রই তাকে পরিধি করে তুলেছে। একমাত্র দাসই পারে একই সঙ্গে কেন্দ্র ও পরিধি হতে। ইয়ুসুফ সেই দাস। সেইই দুনিয়ার মালিক , সেইই পারে দুনিয়াকে বদলে নিতে। "উদ্ধার করার পর থেকে এতদিন স্বঘোষিত ক্রীতদাস ইয়ুসুফ হয়ে যায় আজিজ মিশিরের দাস। জুলেখা তাকে চিনতে পারলেও ইয়ুসুফ পারে না ও সে জুলেখার থেকে পালায়। মাঝখানে বালির দেশে সে ভাবে অনন্তকাল আগে প্রোথিত নরসিংহ তাকে চিরবিখ্যাত তিনটি প্রশ্ন করতে পারেন নাও পারেন। প্রশ্নগুলো একই থাকে , উত্তরগুলো বারবার ভুল হয়ে যায়। বণিক তাকে বলেছিল মিশর ছাড়াও সিরিয়া , ফিনিসিয়া , মাইসিনিয়াতেও স্ফিঙ্কস আছে। একসময় ঠিকই বালিতে সমগ্র দেহ নিয়ে ডুবে থাকা স্ফিঙ্কস উঠে আসে। স্ফিঙ্কস তাকে থিবসের জেলে পাঠায় - যতদিন না ইউসুফ তার দেওয়া যে 'আমি তোমার স্বপ্নপুরুষ' বলে স্বপ্ন জুলেখাকে দেখিয়েছিল - তা মনে না করতে পারছে। অন্য কাউকে স্বপ্ন দিয়ে নিজে সে স্বপ্ন ভুলে যাওয়া অপরাধ। জেলে গিয়ে ইয়ুসুফ আবার নিজের জন্য এক কুয়ো বানায়। সে বুঝতে পারে "আমি স্বপ্নস্রষ্টা নই , স্বপ্নবাহক মাত্র"। স্বপ্ন ঈশ্বরের সংকেত। ইয়ুসুফ নিজে থেকে কাউকে স্বপ্ন দেখাতে পারে না। ঈশ্বর চাইলে তাঁর প্রয়োজনে কাউকে ইয়ুসুফকে দেখাতে পারেন। কুয়োর মধ্যে একসময় জুলেখা তাকে খুঁজে পায় এবং তারা বাইরে বেরিয়ে দেখে প্রলয় চলছে। স্ফিঙ্কস আবার তাদের রাস্তা আটকায় এবং পরামর্শ দেয় "ফ্যারাও এক স্বপ্ন দেখেছেন এবং তার মানে ইয়ুসুফ করতে পারলে এই প্রলয় থেমে যাবে। " ইয়ুসুফ ও জুলেখা ফ্যারাওয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এখানেই সাড়ে তিনশো পাতার উপন্যাসটি অতর্কিত শেষ , দেবেশ রায় পুরোটা লিখে যেতে পারেননি।  এই প্রাচীন আখ্যানের পুনর্নির্মাণের মাঝে মাঝে গল্পের দেবতার সঙ্গে 'ডিসকোর্সে' , ইতিহাস ভূগোল নিয়ে বইতে নানারকম তত্ত্ব আছে যা দেবেশ রায়ের লেখায় খুঁজে পাওয়া স্বাভাবিক। উপন্যাসের দুটি স্বতন্ত্র অংশ সম্ভবত আগে কোনো কোনো পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়েছিল -'স্বপ্নপুরুষ' ও 'দাসপুরুষ' নামে। এরকম সমসাময়িক বিষয় /ভৌগলিক অঞ্চল নিয়ে আর একটিই উপন্যাস বাংলায় পড়েছি - আবুল বাশারের 'মরুস্বর্গ'।  স্বপ্নপুরুষের খোঁজে জুলেখাদেবেশ রায়  / আজকাল  https://en.wikipedia.org/wiki/Canaan
    জীবন তরঙ্গ - ২০ - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ - পর্ব ২০দুজনেরই বেশ কয়েকদিন অফিস কামাই হয়ে গেল। রণজয়ের ছুটি পাওনা আছে, তেমন একটা সমস্যা নেই। রাশির চাকরি তো এক বছরও হয়নি। বসেরা ভাল, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে ছুটি মঞ্জুর করে দিয়েছে। বাবা বাড়ি চলে এসেছে, আর অযথা কামাই করার কোন অর্থ হয় না। দুজনে একসাথেই অফিসে বেরোয়, ফেরে আলাদা আলাদা সময়ে। অফিস যাওয়ার পথে বাবার খবর নিতে রাশিকে নিয়ে রণজয় নিজেদের বাড়িতে গেল। কণিকা জানালেন যে কত্তাবাবু ঠিকঠাকই আছেন আর ছেলেকে অতিশীঘ্র তাঁর সাথে দেখা করতে বলেছেন। একটা কিছু নাকি হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।রণজয় জিজ্ঞেস করল—বেশ তো ছিল, আবার কি হল?-- সে তোদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার, এলেই জানতে পারবি।মায়ের হাসি হাসি মুখ দেখে রণজয়ের মনে হল না তেমন কোন সিরিয়াস ব্যাপার।-- দিদিরা কি চলে গেছে?-- হ্যাঁ, একদম সকালেই চলে গেছে।দেরি হয়ে যাচ্ছে, মাকে টাটা করে দুজনে স্টেশনের দিকে পা বাড়াল।কণিকা ওষুধ খাওয়াতে ঘরে ঢুকতেই দিগ্বিজয় জিজ্ঞেস করলেন—ছেলেকে এখানে আসার জন্য খবর দিয়েছ?-- দিয়েছি।-- তাও রাসকেলটা এল না!-- ভুলে যেওনা, ওরা দুজনেই চাকরি করে। তোমার শরীর খারাপের জন্য অনেকদিন অফিস কামাই করেছে। আজ জয়েন করবে। অফিস থেকে ফিরে হয়ত আসবে।-- আবার হয়ত কেন?-- কখন ফেরে তার ওপর নির্ভর করছে। ফিরতে বেশিদেরি হলে কাল আসবে। অত ব্যস্ত হবার কিছু নেই, আসবে যখন বলেছে, ঠিক আসবে।রাত নটার কিছু পরে রণজয় এল।-- কিরে খোকা, এত রাত করে এলি?-- এই তো একটু আগে অফিস থেকে ফিরলাম। ক’দিন যাইনি, প্রচুর কাজ জমে ছিল।-- রাশি এল না?-- রাশির কথা তো তুমি বলনি। তুমি বললে বাবা কিছু একটা হেস্তনেস্ত করবে। বাপ ব্যাটার এই হেস্তনেস্তর মাঝে ওই মেয়েটাকে এনে আর কষ্ট দিই কেন।-- সেই একরোখা মানুষটা এখন অনেক পাল্টে গেছে রে। কথা বললেই বুঝতে পারবি। অনেকবার তুই এসেছিস কিনা জিজ্ঞেস করেছে। যা, দেখা করে আয়।-- বাবার রাতের খাওয়া হয়ে গেছে?-- এই একটু আগে হল।-- একটু আগে কেন? ডাক্তার তো রাতে আটটার মধ্যে খেয়ে নিতে বলেছে।-- অনেক আগে থেকেই খাওয়ার জন্য বলছি, খেলে তো। বলছে, “এখন টিফিন করার সময়। সন্ধেবেলা কেউ ডিনার করে!”-- না না, এখন নিজের মর্জি মত চললে হবে না। ডাক্তার যেমন বলেছে তেমন ভাবেই চলতে হবে। ওদিকে গিয়ে দেখি কি জন্য ডাক পড়েছে। বাবার কাছে যেতেই ভয় লাগছে। অসুস্থ মানুষ, হেস্তনেস্ত করতে গিয়ে ক্ষেপে উঠলে আবার শরীরটা খারাপ হবে।-- খোকা নিশ্চিন্তে যা। আমি বলছি, কোন ভয় নেই।মা আশ্বাস দিলেও একটু ভয়ে ভয়েই রণজয় বাবার ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল—বাবা কেমন আছ?-- বস। আসতে এত দেরি হল?-- অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়েছে।-- ক’দিন তোমাদের বিশেষ করে তোমায়, খুব ঝামেলায় ফেলেছিলাম। শুনলাম দিনরাত নার্সিং হোমেই কাটাতে। তার মানে খাওয়া দাওয়া তো কিছুই হত না!-- না না, নার্সিং হোমে ভাল ক্যান্টিন আছে, ওখানেই খেতাম।-- তোমাদের চেষ্টায় আরো কিছুদিন রয়ে গেলাম। মনে হয় প্রস্থানের সময় এখনও হয়নি। কতদিন বাদে তোমার দর্শন পেলাম। তোমার মায়ের কাছে শুনলাম যে, তোমাকে দেখলে যদি আমি রেগে যাই, এই ভয়ে নাকি তুমি আমার সাথে দেখা করনি। বড্ড তালেবর হয়ে গেছ। লেখাপড়াই শিখেছ, বোধ বুদ্ধির কোন বিকাশ হয়নি। মা বাপের কাছে সন্তানের থেকে বড় পৃথিবীতে আর কিছু নেই। সন্তানের জন্য মা বাবার চিন্তা ভাবনায় ভুল ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু তা সব সময় সন্তানের মঙ্গল কামনাই করে। নার্সিং হোমে ভিজিটিং আওয়ারে তোমাকে দেখার জন্য হাঁ করে বসে থাকতাম। ভাবতাম, যতই রাগ, দুঃখ বা অভিমান থাক, অসুস্থ বাবাকে দেখতে ছেলে আমার ঠিক আসবে। তুমি আসনি,আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।-- সরি বাবা, আমার অনুমানে ভুল ছিল।-- এবার যে কারণে তোমাদের ডেকেছি সেটা বলি। তার আগে বৌমাকে ডাক, ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে।-- সে তো আসেনি। আসার কথাও নয়, তোমার আদেশে তার তো এই বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ।-- কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়াই সে এই বাড়িতে এসেছিল। শুধু এসেছে যে তাই নয়, যতদূর জানি, কয়েকদিন থেকেও গেছে।-- বিশেষ প্রয়োজনে থাকতে হয়েছে।-- এ ব্যাপারে আমি তোমার সাথে কোন কথা বলব না, বৌমার সাথে কথা বলতে চাই। কাল রবিবার অফিস যাওয়ার ব্যাপার নেই। সকালবেলা বৌমাকে সাথে করে আমার কাছে নিয়ে আসবে। এখন রাত হয়ে গেছে, বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া কর।বেরোবার আগে রনজয় মার সাথে দেখা করল।-- কি রে খোকা, বাবা কি বলল?-- এমনি তো সব ঠিকঠাকই বলছিল কিন্তু কথা শুনে মনে হল, রাশির এই বাড়িতে থাকাটা বোধহয় বাবার পছন্দ হয়নি। রাশিকে কাল আনতে বলে বলল যে, এই ব্যাপারে ওর সাথে কথা বলবে।-- তুই নিশ্চিন্তে বাড়ি যা। আর শোন, সকালে এখানে এসে জলখাবার খাবি।রণজয় বাসায় গিয়ে রাশিকে বাবার এত্তেলার কথা জানাল। রাশি শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।-- একথা ঠিক যে বাবার অনুমতি ছাড়া আমার তোমাদের বাড়িতে ঢোকা উচিৎ হয়নি। কিন্তু আমি তো গিয়েছিলাম মাকে একটু সঙ্গ দিতে। এতে যদি বাবা আমার ওপর রাগ করে থাকেন, ক্ষমা চেয়ে নেব।-- তোমার অত চিন্তার কিছু নেই। আমি তো সঙ্গে থাকব।ছুটির দিন, ঘুম থেকে উঠতে একটু বেলা হয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে দুজনে রওনা হল দিগ্বিজয় ধামের উদ্দেশ্যে।দিগ্বিজয় বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। দোতলা থেকে ছেলে আর বৌমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে খুব আনন্দ হল।শাশুড়ির কাছে গিয়ে রাশি জিজ্ঞেস করল—মা, বাবা কি আমার ওপর খুব রেগে আছেন?কণিকা মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন যে মেয়েটা বেশ ঘাবড়ে রয়েছে।ব্যাপারটা সাসপেন্সে রেখে বৌমাকে আদর করে বললেন—চলো আমার সাথে, দেখাই যাক না কি বলে মানুষটা।কণিকা রাশিকে নিয়ে দিগ্বিজয়্বের ঘরের দিকে গেলেন, রণজয়ও পিছন পিছন গেল। দিগ্বিজয় তখনো বারান্দাতেই বসে ছিলেন। রাশি গিয়ে শ্বশুর মশাইকে প্রনাম করল। দিগ্বিজয় আশীর্বাদ করে পাশে চেয়ারে বসতে বললেন। মেয়েটাকে দেখে মন ভরে গেল। কি মিষ্টি লক্ষ্মীমন্ত চেহারা। ভেতরের অনুভুতি ক্ষণিকের জন্য চেপে রেখে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন—আমার অনুপস্থিতিতে তুমি এই বাড়িতে এসে ছিলে?-- হ্যাঁ বাবা। মা বড় ভেঙে পড়েছিলেন। বাড়িতে একা থাকবেন, তাই ওনাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ছিলাম। কোন অপরাধ করে থাকলে মার্জনা করবেন।-- থাকার কারণ আমি জানতে চাইনি। কারণ যাই হোক না কেন, আমার নিষেধ অমান্য করেছ, এটাই বড় কথা। এর জন্য তুমি আমার কাছে কি আশা কর?রণজয় দেখতে পাচ্ছে বাবা আবার তাঁর পুরনো স্বভাবে ফিরে যাচ্ছেন। গত কালের আচরণের সাথে এখনকার আচরণের বিস্তর ফারাক। সকলেই চুপ।একটু সময় নিয়ে রাশি বলল— আপনি যা বলবেন তাই মেনে নেব।-- মানতে তোমাকে হবেই, এটা আমার আদেশ।রণজয়ের আর ধৈর্য থাকছে না, অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছে। এভাবে চললে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা সম্ভব হবে না।-- বলুন আমাকে কি করতে হবে?-- কালকে বা সম্ভব হলে আজকেই, তুমি, তোমার ওই তালেবর বরটিকে নিয়ে এই বাড়িতে পাকাপাকিভাবে চলে আসবে।রাশি ছলছল চোখে বলল—বাবা তার মানে আপনি আমাদের মার্জনা করে দিয়েছেন?-- মার্জনা করবার জন্য আমি তোমায় ডাকিনি। তোমরা কোন অপরাধ করনি, ভুল আমি করেছি। আমার কৃতকর্মের জন্য তোমরা অনেক ব্যথা পেয়েছ, দুঃখ প্রকাশের আমার কোন ভাষা নেই। পারলে বুড়ো বাপটাকেদিগ্বিজয় মাথা নিচু করে বসে রইলেন।রাশি দিগ্বিজয়ের পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল—বাবা, আপনি গুরুজন, ওভাবে বলবেন না। আমার খুব খারাপ লাগছে।এবার রণজয় নিশ্চিত হল যে, বাবা সত্যিই পাল্টে গেছে।দিগ্বিজয় নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন—তাহলে ওই কথাই রইল, কালকেই ভাড়া বাড়ির পাট চুকিয়ে নিজের বাড়িতে চলে আসবে।-- বাবা, বাড়িওয়ালাকে দশ মাসের অ্যাডভানস দেওয়া আছে। এখনই বাড়ি ছেড়ে দিলে টাকাটা মার যাবে।-- মার যায় যাক। টাকার জন্য খুব যদি কষ্ট হয় তাহলে এখনই বাড়ি ছেড় না। জিনিসপত্র যেমন আছে থাক, তোমরা চলে এস। মাঝে মাঝে লোক নিয়ে গিয়ে বাড়িটা একটু ঝাড়পোঁছ করিয়ে নিও। কাল সকালেই আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব, সঙ্গে করে যদি কিছু জিনিস আনার থাকে নিয়ে এস।রণজয় আর রাশির কাছে এ বড় কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। রজতের মামার বাড়ির সংখ্যা আবার একে ফিরে এল। চলবে
    জীবন তরঙ্গ - ১৯  - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ - পর্ব ১৯রাতে শোয়াটা এখনো একঘরেই আছে। পরিবর্তিত পরিবেশ, পরিস্থিতির প্রভাব দৈনন্দিন যাপনের অনেক ক্ষেত্রে পড়লেও বিছানা এখোনো একটাই আছে। বেডরুমের লাগোয়া একটা অ্যান্টি চেম্বারের মত আছে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রোজ প্রায় ঘন্টা খানেক দিগ্বিজয় ওই ঘরে বসে ওকালতির কাজকর্ম করেন। কণিকা খাওয়ার পর টুকটাক কাজকর্ম সেরে, একটু টিভি দেখে তারপর ঘরে আসেন। দুজনে প্রায় একই সময়ে শুতে যান। সেদিন টিভি দেখতে ইচ্ছে করছিল না। নির্ধারিত সময়ের অনেকটা আগেই শুতে এসে কণিকা দেখেন যে ঘরে বড় আলো নেভান, রাতের আলো জ্বলছে। তাঁর স্বামী ইতিমধ্যেই শুয়ে পড়েছেন। এমনটা সচরাচর হয় না। ভাবলেন হয়ত খুব ক্লান্ত হয়ে আছেন বা হয়ত কাল কোর্টে তেমন একটা কাজ নেই। উনিও শুয়ে পড়লেন। মাঝরাতে একটা গোঙানির আওয়াজে কণিকার ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে দেখেন ওনার স্বামী বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন। কণিকার মনে হল হয়ত কোন দুঃস্বপ্ন দেখে অমন করেছেন। গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—কিগো, ওরকম করছ কেন, কি হয়েছে?-- আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, ডাক্তারকে খবর দাও।কণিকা খুব নার্ভাস হয়ে পড়লেন। রাতে ওনাদের বাড়িতে একজন পাহারাদার থাকে। এ ছাড়াও দিনরাতের কাজের একটা মেয়েও থাকত। কণিকা দুজনকেই ঘুম থেকে তুলে ছেলেকে ডেকে আনতে বলল। রণজয়ের বাড়ি ওখান থেকে মিনিট পাঁচেকের মত হাঁটা পথ। এত রাতে মা যখন ডেকে পাঠিয়েছে তখন বাবার শরীর নিশ্চই বেশিরকমের খারাপ। দৌড়ে গিয়ে ওদের হাউস ফিজিসিয়ান সরকার কাকুকে বগলদাবা করে নিয়ে এল। দরকার হতে পারে তাই রণজয় দুজন বন্ধুকেও সাথে আনল। ডাক্তার সরকার সব দেখে শুনে জানালেন যে, বাড়িতে রাখার কেস নয়। একটা ওষুধ তখনই কিনে এনে খাইয়ে দিতে বললেন। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। কপাল ভাল, বাড়ির সামনের ওষুধের দোকানটা খোলা ছিল। ওষুধ খাওয়াবার পর সকলে ধরাধরি করে দিগ্বিজয়কে বাড়ির গাড়িতে এনে শুইয়ে দিল। রণজয় গাড়ি চালাতে পারত, কালক্ষেপ না করে রওনা দিল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রণজয় গাড়ি ভালই চালাতে পারে, কিন্তু এত জোরে কখনো ড্রাইভ করেনি। মধ্য রাত, রাস্তা ফাঁকা ছিল, অসুবিধে হয়নি। গড়িয়াহাট অঞ্চলের একটা বড় নারসিং হোমে দিগ্বিজয়কে ভর্তি করা হল। সারা রাত রণজয় আর তার দুই বন্ধু নারসিং হোমেই কাটাল। সকালবেলা বড় ডাক্তারবাবু জানালেন—পেশেন্টের মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এখন আইসিসিইউ তে অবজারবেশনের জন্য রাখা হয়েছে, কন্ডিশন স্টেবল। আপাতত ভয়ের কিছু নেই। ঠিক সময়ে এখানে এসেছেন, বেশি দেরি করলে বিপদ বাড়ত। আপনাদের লোকাল ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ ধাক্কাটা অনেকটাই সামলে দিয়েছে। ওরা বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসতে পারে কি না জিজ্ঞেস করাতে ডাক্তারবাবু বললেন-স্বচ্ছন্দে পারেন, এখন আপনাদের থাকার প্রয়োজন নেই। যাওয়ার আগে অফিসে গিয়ে যোগাযোগের জন্য আপনাদের একটা ফোন নম্বর দিয়ে যাবেন।রণজয় কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে এল। বাড়ি ফিরে রাশিকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের বাড়ি গেল। হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে শোনা আশ্বাস মাকে শুনিয়ে আশ্বস্ত করল। রাশিকে দেখেই কণিকা ওকে কাছে টেনে নিলেন। রণজয় মাকে জানিয়ে দিল যে বাবা যতদিন বাড়ি না ফেরে রাশি তাঁর কাছেই থাকবে। রাশি ক’দিন অফিস যাবে না। কণিকা রাশিকে জড়িয়ে ধরে বললেন—এটাই তোর নিজের জায়গা মা। আমি বলছি, একদিন তুই নিজের জোরেই মাথা উঁচু করে এই বাড়িতে আসবি। আর হ্যাঁরে খোকা, তুই এখানে থাকবি না।-- অনুমতি করলে থাকতে অসুবিধে নেই, তবে বাবা বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত। বাবা ফিরে এলে সব আবার সে আগের মতন। আর একটা কথা তোমায় জানিয়ে রাখি। এই মুহূর্তে বাবার সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন কিছু হওয়াটা একেবারেই কাম্য নয়। আমাকে সামনে দেখলে বাবার কি রকম প্রতিক্রিয়া হবে আমি জানি না। তাই আমি রোজই হাসপাতালে যাব কিন্তু বাবার সামনে যাব না। বাবার কাছে তুমি বা দিদি যাবে।-- তোকে যদি দেখতে চায়, তখন কি হবে?-- আমাকে দেখতে চাইলে দেখা করব।বাবার শরীর খারাপের খবর পেয়ে বাণী রজতের সাথে পরের দিনই চলে এসেছিল। দিন দুয়েক বাদে বিকাশও শিলিগুড়ি থেকে চলে এসেছিল। দ্বিতীয় দিন রণজয় বোন আর মাকে নার্সিং হোমে নিয়ে গেল। দিগ্বিজয় তখন অনেকটাই সামলে উঠেছেন। আইসিসিইউ থেকে বার করে কেবিনে রাখা হয়েছে। আর কেউ এসেছে কিনা জানতে চাইলেন। কণিকা বুঝতে পারলেন যে, ঘুরিয়ে ছেলের কথা জিজ্ঞেস করছে। কণিকা ছেলের কথায় মিথ্যে বলেছিলেন। একদিন রজতও দাদুকে দেখতে এসেছিল। নাতিকে দেখে দাদু আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। পাঁচ দিন বাদে দিগ্বিজয়ের হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে গেল। ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে লেখা ছিল তবু রণজয় ডাক্তারের কাছে গিয়ে সবকিছু আর একবার ভাল করে জেনে নিল। রণজয়ের সাথে বিকাশ, বাণী আর দুজন বন্ধু এসেছিল। বাড়ির দুটো গাড়িই নার্সিং হোমে আনা হয়েছিল। দিগ্বিজয়ের গাড়ি চালাবে বাড়ির ড্রাইভার, সঙ্গে থাকবে বিকাশ আর বাণী। অন্য গাড়িটা রণজয় চালাবে, সাথে থাকবে দুই বন্ধু। নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেয়ে দিগ্বিজয়্বর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। আরো ভাল লাগছে দূরে সরে যাওয়া অতি আপনারজনদের কাছে ফিরে পেয়ে। গাড়িতে মেয়ে আর জামাইয়ের সাথে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। বাণী নিজের বাবাকে ঠিক মেলাতে পারছে না। এতদিন মানুষটাকে একজন গম্ভীর, স্বল্পবাক, ডিক্টেটর হিসেবেই দেখে এসেছে। আজ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। বিকাশ ডাক্তারের নিষেধের কথা জানিয়ে শ্বশুর মাশাইকে কম কথা বলতে বলল। কত্তাবাবু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে সকলেই খুশি, সবথেকে বেশিখুশি কত্তাবাবু নিজে। দিগ্বিজয়ের ঘরে মেয়ে, জামাই, নাতি, বৌ, সকলে বসে গল্প করছে। মাঝেমাঝে ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে দিগ্বিজয়ও তাতে যোগ দিচ্ছেন। এই বাড়িতে এমন ছবি আগে কেউ কখনো দেখেনি।রাতে একান্তে কনিকাকে বললেন—আমার কাছের মানুষেরা সকলেই এল, প্রতিদিন নার্সিং হোমে গিয়ে খোঁজ খবর নিল, কেবল আমার সব থেকে কাছের মানুষটাই নার্সিং হোমে পৌঁছে দেওয়ার পর আর একবারও খোঁজ নিতে এল না।-- তুমি কার কথা বলছ?-- তোমার ওই রাসকেল ছেলেটার কথা বলছি।-- অমন ছেলে লোকে ভাগ্য করে পায়, কেবল তুমিই ওকে চিনলে না। ও প্রতিদিন নার্সিং হোমে গেছে। নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাদিন থেকেছে। ডাক্তারের সাথে আলাপ আলোচনা করেছে। প্রথম দুটো রাতও নার্সিং হোমে কাটিয়েছে। এই সময় কোন রকম উত্তেজনা তোমার শরীরের পক্ষে ভাল নয়। ওকে দেখলে যদি তুমি রেগে যাও তাই ও তোমার সামনে যায়নি।-- ভিজিটিং আওয়ার্সে ছেলেটাকে একটু দেখতে পাওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। অন্যদের সাথে কথা বলার ফাঁকে চোখ চলে যেত দরজার দিকে, এই বোধহয় খোকা এল। অপেক্ষাই সার হল, বুঝতে পারলাম, বাপের ওপর থেকে অভিমান তার এখনও যায়নি। অসুস্থ বাপটার ওপরে তখনো অভিমান করে আছে মনে হতে খুব কষ্ট হয়েছিল। গাধাটা কিনা আমি রাগ করব বলে সামনে এল না। এই বুদ্ধি নিয়ে ও আলাদা হয়ে সংসার করবে।-- আর একটা কথাও তোমাকে জানিয়ে রাখি। তুমি যে কটা দিন নার্সিং হোমে ছিলে, আমাকে আগলে রেখেছিল আমার বৌমা। কিচ্ছুটি করতে দেয়নি। রান্না করা থেকে আমাকে খাওয়ানো সব কিছু নিজে করেছে। কেবল আমাকেই নয়, তোমার মেয়ে জামাইকেও সাধ্যমত সেবাযত্ন করেছে। জানি না, অনুমতি ছাড়া এ বাড়িতে ক’দিন ছিল বলে তোমার আবার মেজাজ বিগড়বে কিনা।-- গিন্নি, অসুস্থ মানুষটাকে আর রগড়িও না। ভুল মানুষ মাত্রেরই হয়। আমিও করেছি, আমার মাত্রাটা হয়ত একটু বেশি। একমাত্র খোকা ছাড়া আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমরা কখনো যাওনি। আমার মতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে বা করলে বরদাস্ত করতে পারতাম না। খোকার বিয়ের ঘটনার পর থেকে আমার মেয়ে, জামাই,‌ তুমি, এমনকি নাতিটাও আমাকে মনের থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দেয়। মানসিকভাবে আপনজনেদের কাছে একঘরে হওয়াটা আমার জীবনে একটা বড় ধাক্কা। এই মানসিক আঘাতে আমার “যা করেছি ঠিক করেছি” ধরণের অনুভুতিটা ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। এখন বুঝতে পারি ওটা ছিল একটা ব্যাধি। আমার এই শারীরিক ব্যাধি ওই মানসিক ব্যাধিকে প্রায় নির্মূল করে দিয়ে গেছে আর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে দূরে সরে যাওয়া কাছের মানুষগুলোকে। সব খারাপেরই তো কিছু ভাল থাকে। তুমি বৌমাকে একটু ডাক না। শ্বশুর হয়ে ক্ষমা চাইতে না পারি, দুঃখপ্রকাশ তো করতে পারব। আর হ্যাঁ, বলে দিও ওরা যেন এ বাড়ি থেকে আর কোথাও না যায়। -- তুমি ফেরার পরেই রাশি চলে গেছে। ওরও তো নিজের ঘর সংসার আছে।-- খোকাকে কালই আমার সাথে দেখা করতে বল। অনেকদিন পালিয়ে পালিয়ে থেকেছে, এবার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।চলবে
  • ভাট...
    commentযদুবাবু | @পাপাঙ্গুল | ০৯ মে ২০২৪ ১১:৫৮523861 Secret History পড়েছেন? ডনা টার্ট? দুর্ধর্ষ বই বললেও কম বলা হয়। তবে অনেকদিন আগের লেখা, হয়তো আপনার পড়া। উনি দশ বছরে একটা করে বই লেখেন। কোথায় যেন বলেছিলেন, ওঁর কাছে একটা বই লেখা যেন একটা বিশাল ক্যানভাসে একটা আইল্যাশের সাইজ়ের তুলি দিয়ে পেইন্ট করার মত ব্যাপার।   
    (আমার আবার মেমরি আবার খুব সিলেক্টিভলি খারাপ, খুব তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিষ মনে থাকে, কবে কোথায় কি পেপারে কোন রেজ়াল্ট পড়েছি প্রায় ছবির মত মনে থাকে, ছোটবেলায় পড়া ছড়া আর নাটকের সংলাপ মনে থাকে, কিন্তু সকালে কার সাথে কী কথা হয়েছিল, অথবা গতকাল কী খেয়েছি, আগে কারুর সাথে দেখা হয়েছিলো কি না সব ভুলে যাই। কাজেই আগেও এই বইটা এখানেই একবার রেকো করেছি কি না ভুলে গেছি।)   
    commentযদুবাবু | r2h | 208.127.71.8 | ০৯ মে ২০২৪ ১৯:৩৫ -  "সামান্য" নয়, সেটাও বোঝা গেল। তবে এইসব সমস্যা ছিলোই, সারফেসের নিচেই ছিলো। এখন সম্পূর্ণ নর্ম্যালাইজ়ড।  যাই হোক, এলেবেলের পোস্টগুলো থেকে কিছু নতুন জিনিষ শিখলাম। আমার সাথে ওঁর প্রকাশ্যে না হলেও মতপার্থক্য আছে, কিন্তু ওঁর বই বা বিভিন্ন পোস্ট পড়ে যে বিভিন্ন ব্যাপারে একাধিক দিক থেকে ভাবতে শিখেছি সেটা অনস্বীকার্য।  তক্কো করার টেনাসিটি নেই (এটা অবশ্য আমি ad nauseum বলেই যাব), কিন্তু যত্তরকমের লজিক্যাল ফ্যালাসি একটা আর্গুমেন্টে আসা সম্ভব - সব-ই এসে গেছে। এই যেমন অ্যাড পপুলাম, যেমন মোরাল ইক্যুইভ্যালেন্স,ইত্যাদি প্রভৃতি।  লজিক্যাল ফ্যালাসি বলতে মনে পড়লো, প্যালারামের বাড়ির কোনো একটা দরজায় এই পোস্টার-টা টাঙানো দেখেছিলাম। একটা যোগাড় করে আমাকেও কোথাও টাঙাতে হবে। 
    commentঅরিন | lcm, আপনার বন্ধুর সিনেমা হল নিয়ে ক্লাসিফিকেশনটা "মনে হয়", ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অ্যাকিউরেট, মানে আমরা নিজেরাও অনেকে ঐরকম ভাবতাম। তারপর কিরকম সব তালগোল পাকিয়ে গেল। ধরুণ এখন যেমন মনে হয় নিউ এমপায়ার আর নেই, মেট্রো উঠে গেছে, গ্লোব ও মনে হয় নেই, নিউমারকেট চত্বরে থাকার মধ্যে মনে হয় রিগাল (যদি ঠিক নাম বলি)। 
    প্রিয়ার বা নবীনার এখনকার স্ট্যাটাস কিন্তু বেশ ভাল মনে হয়। পূর্ণ উঠে গেছে, পূর্ণয় যাবার একটা আকর্ষণ ছিল সাঙ্গুভ্যালিতে ফিশ ফ্রাই, সেটাও মনে হয় আর নেই , এইসব আর কি,:-)
    আপনাদের আদিগঙ্গায় নৌকো ভেড়ানোর সময় উল্টোনোর গল্পটা দারুণ। 
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত