এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    বিপ্লবের আগুন - পর্ব পাঁচ - কিশোর ঘোষাল | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়৫গতকাল সারা দিন ও রাত একটানা হেঁটেছে ভল্লা। একে তো তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। যন্ত্রণা এবং ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে তার শরীর। তবু সে হেঁটেছে অবিরাম। আজ রাত্রির আট প্রহরে সে এসে পৌঁছল বিশাল এক সরোবরের পাশে। বীজপুর চটির জনাই তাকে দিক নির্দেশ করে বলেছিল, এই পথ ধরে একদম নাক বরাবর গেলে ডানদিকে একটা সরোবর পাবি। ওই সরোবরটা ছোট্ট একটা পাহাড়ের কোলে। ওখান থেকে নিচের দিকে তাকালে দেখতে পাবি – যতদূর চোখ যায় – ছোটছোট ঝাড়ি আর কাঁটাঝোপের জঙ্গলে ভরা ঢালু জমি। তার মানে তুই নোনাপুর গ্রামের চৌহদ্দিতে পৌঁছে গেলি। ভল্লার মনে হল এটাই সেই সরোবর। জনাই আরও বলেছিল, ওই সরোবরের পশ্চিম পাড়ে দাঁড়ালেই তোর ডানদিকে দেখতে পাবি একটা পায়েচলা সরুপথ নেমে গেছে সাপের মতো এঁকেবেঁকে। ওই রাস্তা ধরে, খুব বেশি না, আধক্রোশেরও কম, হাঁটলেই পেয়ে যাবি, নোনাপুরের গ্রামপ্রধানের বাসা। নাম জুজাক। এমনিতে লোক খারাপ না, তবে বড্ডো বদরাগী। একবার রেগে গেলে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তবে ওর বউটা খুব ভালো। মনে খুব মায়া-মমতা।জনাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল জুজাকের দু-দুটো ছেলে – ছোটবেলাতেই একসঙ্গে মারা গিয়েছিল।কৌতূহলে ভল্লা জিজ্ঞাসা করেছিল, “সে কি? কী করে?”“কী আর বলব? সে কথা মনে পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই ওই জায়গাটা অফসলী। বৃষ্টি কম। সামান্য কিছু আবাদি জমি আছে, সেখানে সামান্য কিছু ভুট্টা, জোয়ার-টোয়ার হয়। তাতে সম্বৎসরের খোরাক হয় কি না হয়। তোরা তো এদিককার লোক নোস, জানবি না। বছর দশেক আগে, এদিকে পরপর চার বছর খরা হয়ে – জমি-জঙ্গল একেবারে ঝলসে গিয়েছিল। খিদের জ্বালা সবচে বড়ো জ্বালা রে, ভল্লা। সে জ্বালা যে কোনদিন ভোগ করেনি – সে বুঝতে পারবে না। দুই ভাই মিলে, বছর দশ আর আটের দুই ছেলে, কন্দ খুঁজতে ঢুকেছিল পাশের জঙ্গলে। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে”।জনাই আবার চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, বলল, “সেই থেকেই জুজাক কেমন যেন বদমেজাজি হয়ে গেল। আর ওর বউটা হল উলটো”। সরোবরের পশ্চিম পাড়ে বসে থাকা ভল্লার ঝিমধরা মাথায় এই সব কথাই ভনভন করছিল মাছির মতো। পুব আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। অজস্র পাখিদের কলকাকলিতে ভরে উঠছে বিশ্বচরাচর। ভল্লা ডানদিকে সরু সেই পায়েচলা পথটাও দেখতে পেল, জনাই যেমনটি বলেছিল। ওই পথ ধরেই তাকে পৌঁছতে হবে নোনাপুরে। সে জানে না, সেখানে কী অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে। তবে সে সব কথা সে এখন ভাবছেও না। সে ভাবছে তার সঙ্গের এই বিপুল বোঝাটাকে টেনে টেনে কী করে পৌঁছবে আধক্রোশ দূরের ওই গ্রামে। নিজের শরীর নিয়ে বড় গর্ব ছিল ভল্লার – চিতার মতো সর্বদাই টগবগে আর চনমনে তাজা। অথচ গতকাল সেই শরীরটাকেই বইতে চাইছিল না তার পাদুটো। যদি ফেলে আসা যেত কোথাও – কিছুটা হাল্কা হওয়া যেত। আর এই মাথাটা - দুই হাতে ধরে যেটাকে সে এখন সামলাচ্ছে? অসহ্য যন্ত্রণায় দপদপ করছে সর্বক্ষণ। সেটাই বা কম কি? এখন ইচ্ছে হচ্ছে এই নিরিবিলি সরোবরের পাড়ে, ভোরের নরম মায়াবী আলোমাখা প্রান্তরে নিজের শরীরটাকেও ঘাসে বিছিয়ে দিতে। চুলোয় যাক তার কাজ, চুলোয় যাক তার শরীরের সকল যাতনা। ভল্লা সত্যি সত্যিই দুই হাত-পা মেলে নিজেকে ছড়িয়ে দিল মাটিতে। নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল ভল্লা, তার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে… উদাসীন। তার চোখের ওপরে প্রতি ক্ষণে বদলে যাচ্ছিল আকাশের রঙ… নতুন দিনের ভোর এগিয়ে চলেছে নবীন সকালের দিকে। তার চোখ বুজে এল। চিকা তার কর্তব্যে কোন অবহেলা করেনি, সূর্যোদয়ের অনেক আগেই সে ভল্লাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। তার গায়ে হাত রেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বলেছিল, “তুই যাবি কী করে ভল্লা? এতটা পথ। জ্বরে যে তোর গা পুড়ে যাচ্ছে। একটা দিন অন্ততঃ থেকে যা। আমি কিছু জড়িবুটির ব্যবস্থা করি – একটা দিন বিশ্রাম নে, কাল বেরোবি”। ভল্লা সে কথায় কান দেয়নি। দ্রুত নিত্যকর্ম সেরে রওনা হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। চিকা বলেছিল, “তাহলে তুই যাবিই”? ভল্লা সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেছিল, “আমার রণপা”? রণপা আর চিকার দেওয়া পুঁটলিতে বাঁধা কিছু খাবার নিয়ে ভল্লা রওনা হয়েছিল জনাইয়ের চটির দিকে। জনাইয়ের চটিতে পৌঁছতে ভল্লার বেশ দেরিই হয়েছিল, প্রায় মধ্য রাত্রি। দরজা খুলে জনাই বেশ বিরক্ত হয়েই বলেছিল “কি রে? এত দেরি করলি?” তারপর প্রদীপের আলোয় তার চেহারা দেখে চমকে উঠেছিল জনাই, “শরীরের এই অবস্থায় রণপা নিয়ে তুই এতটা পথ এলি কী করে? চিকার চটিতেই একটা দিন বিশ্রাম করতে পারলি না? একটা দিনে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত শুনি? হতভাগা, পথে-ঘাটে মরে পড়ে থাকলে – কেউ জানতে পারত? শেয়ালে-শকুনে ছিঁড়ে খেত। তখন কে করত তোর কাজ?”ভল্লা জনাইয়ের কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিল, “একটু শোবার জায়গা করে দিবি? ঘুমোব”। জনাই খাবার এনে দিয়েছিল, ভল্লা খেতে পারেনি। খেতে ভালো লাগছিল না। খড়ের গদির ওপর চাদর বিছিয়ে, বেশ ভালই বিছানা করে দিয়েছিল, জনাই। ভল্লা ভেবেছিল একবার শুতে পারলে ঘুম আর ঠেকায় কে? কিন্তু আশ্চর্য, ঘুম এলই না। যখনই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়, একএকটা ছবি ভেসে উঠছিল চোখের সামনে…তন্দ্রা টুটে যাচ্ছিল। ভল্লা পাশ ফিরে শুল। আবারও তন্দ্রা এল, চোখের সামনে ভেসে উঠল অন্য এক ছবি…। আধো জাগরণ, আধো তন্দ্রায়, এভাবেই এক প্রহর কাল কাটিয়ে সে উঠে বসল। তার পাশের বিছানায় ঘুমোচ্ছে জনাই। জনাইকে ডেকে তুলে জিজ্ঞাসা করল “নোনাপুর গ্রামটা কোনদিকে রে?”জনাইয়ের দেওয়া খাবারের পুঁটলি নিয়ে বিদায়ের সময় ভল্লা জিজ্ঞাসা করেছিল, “হ্যারে, রণপা জোড়া দে না, এতটা পথ পায়ে হেঁটে যাওয়ার থেকে – অনেক তাড়াতাড়ি…”।জনাই কঠিন মুখে বলল, “তোকে তো বারবার বললাম, একটা দিন থেকে যা। শুনলি না। তুই জানিস না? ওপরের নির্দেশ, বাকি পথটা তোকে পায়ে হেঁটেই যেতে হবে! তোর আসল পরিচয় গোপন রাখতে সেটা জরুরি”! ভল্লা চকিতে উঠে বসল, তার সামনে সরোবরের জলে আকাশের ছায়া, ঈষৎ সবজে। আকাশে সকালের আলো, পূর্ব দিগন্তটা লাল হয়ে উঠেছে। সূর্যোদয় হতে দেরি নেই। জলের কাছে নেমে মুখচোখে জল দিল, মাথাটাও ভিজিয়ে নিল। স্নিগ্ধ শীতল জলের স্পর্শে কিছুটা আরাম পেল। গামছায় মুখ হাত মুছে, সেটা মাথায় বাঁধল শক্ত করে, মাথার দপদপানি কিছুটা কমল। তারপর পাড়ে উঠে হাঁটতে শুরু করল। জনাই বলেছিল, খুব বেশি না, আধক্রোশ মত হবে…শালা, জানোয়ারের বাচ্চা জনাই, সরু সরু দুটো মাত্র পায়ে ভর দিয়ে এই ভারি শরীর আর মাথাটাকে আধক্রোশ টেনে নিয়ে যাওয়াটা, তোর কাছে ছেলেখেলা না? কোন ধারণা আছে তোর, সুস্থ সবল একটা শরীর কখন নিজের কাছেই অবাঞ্ছিত মনে হয়? নামতে নামতে সে একবার পড়ে গেল, ঢালু রাস্তায় গড়িয়ে নেমে এল বেশ কিছুটা।ভল্লা কোনরকমে উঠে দাঁড়াল, আবার হাঁটতে লাগল। একটা পা মাটি থেকে তুলে সেটাকে সামনে এগিয়ে রাখতে এত যে কষ্ট হয়, ভল্লা এর আগে কোনদিন টের পায়নি। তার সারা শরীর কাঁপছে। তার পিছনের পা কাঁপছে থরথর করে। তবু ভল্লা এগিয়ে চলল। গুয়োর ব্যাটারা, এতদিন খাওয়ালাম, পরালাম, এখন এই আধক্রোশ পথ পার হতে হেদিয়ে মরছিস? তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। সামনে পড়ে থাকা মেটে রঙের মাদুরের মতো বিছানো পথ। তার দুপাশে একঘেয়ে সবুজ পর্দার মতো ঝোপঝাড়। কোন কিছুই তার চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ছে না। পাখিদের প্রভাতী ব্যস্ততা, তাদের অজস্র ওড়াউড়ি, সে কিছুই দেখছে না। এমনকি অজস্র পাখিদের ব্যস্ত-কাকলিও তার কানে আসছে না। তার কানে আসছে শুধু তার নিজেরই বুকের শব্দ। ধক ধক – ধক ধক। তার সমস্ত চেতনা জুড়ে এখন ওই একটাই আওয়াজ। কতক্ষণ ভল্লা জানে না। তার মনে হল, হয়তো মাসাধিক কাল, কিংবা কয়েক বছর ধরে চলছে তার এই পথ চলা। একসময় তার নজরে এল পথের ডানদিকের সবুজ পর্দাটা আর নেই… ছোট্ট পাতায় ছাওয়া বাড়ি, তার সামনে কাঠের খুঁটির বেড়া দেওয়া প্রশস্ত অঙ্গন। ঘটিতে জল নিয়ে এক রমণী দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে, অবাক চোখ মেলে তাকেই দেখছে। ভল্লার দুই পা এবার জলস্রোতে নদীর পাড়ভাঙার মতো ধ্বসে পড়ল। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে ভল্লা অস্ফুট স্বরে ডাকল, “মা…”। তার চেতনা থেকে সকালের স্নিগ্ধ আলোটুকু নিভে গেল। সে ডুব দিল নিশ্চিন্ত অন্ধকারে। ক্রমশ...
    বাংলা থেকেও বুরুডির - নরেশ জানা | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়বাংলা থেকেও বুরুডিরবুরুডি ছাড়তে সন্ধ্যা ছ'টা বাজল। আবার আকাশে মেঘ ভেঙে পড়ার উপক্রম। বন্ধু আশিস মিশ্র বলেছিলেন, বুরুডির কোল বেয়ে পেছন দিকের একটা গ্রামে গিয়েছিলেন বন্ধুদের সাথে। পথটা আমার চেনা। ওই রাস্তায় সাত কিলোমিটার গেলেই ধারা জলপ্রপাত। অসাধারন সেই দৃশ্য, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কিন্তু এই দুর্যোগ আর এই সময়ে সেই পথে যাওয়া চলেনা। অন্তত দু কিলোমিটার পথ ট্রেকিং করতে হবে কিন্তু বাকী পাঁচ কিলোমিটার পথও এই গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবেনা। এ যাত্রায় আমার আফসোস বর্ষায় ধারা প্রপাত দেখা হবেনা। রুষতি রিয়ানদের গুলি মুরগির ঝোল খাওয়া ছাড়াও অবশ্য আরও কিছু আফসোস যে থেকে যাচ্ছে তা বুঝতে পারলাম পরের দিন। তার অন্যতম হল পাথরের গহনা কেনা হলনা। ধারাগিরি জলপ্রপাত অধরা রেখেই আমরা হোটেলে ফিরছি, শুরুর দিনের যাত্রা শেষ করে এই প্রথম হোটেলে যাব আমরা। সেই পথেই বরং বলে নেওয়া যাক আমার কুড়ি বছর আগের ধারা জলপ্রপাত ও বুরুডি দর্শনের কাহিনী। যাঁরা বাংলা থেকে সরাসরি বুরুডি আসতে চান তাঁদের জন্য এই রুটটাও যথেষ্ট মনোরমের।সে প্রায় দু'দশক আগের কথা! কাঁকড়াঝোরে গোপীনাথ মাহাতর বাড়ির উঠোনে দড়ির খাটিয়ায় বসে অক্টোবরের রোদ মাখছিলাম গায়ে। এখনকার সাবেক সরকারি বনবাংলোটির তলায় গোপীনাথ মাহাতোর দোতলা টালির চাল দেওয়া কোঠাবাড়ি। সরকারি বনবাংলো লাগোয়া ইএফআর বাহিনীর ছোট তাঁবু। নতুন একটা বিশাল সরকারি বনবাংলো তৈরি হচ্ছে। কাঁকড়াঝোর আসার সহজ রাস্তা দুটোর একটাও তখনও হয়নি। বেলপাহাড়ি থেকে ভুলাভেদা হয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার রাস্তা। গাডরাসিনি পাহাড়কে বাঁদিকে রেখে দলদলির ওপর বরবার এই পথ। এই পথেই ফরেস্ট রেঞ্জারদের গাড়ি ছুটত হামেশাই, ফলে যাওয়ার সমস্যা ছিলনা। বাঁদিকে মস্ত খাদ আর ডান দিকে পাহাড়ের কোল সামলে চললেই হল। ২০০৪ সালে এই রাস্তার ওপরেই মাইন পেতে একটা গাড়ি সহ ৪ জন ইএফআর জওয়ান কে উড়িয়ে দেয় মাওবাদীরা। বাংলায় সেই প্রথম মাওাদীদের সফল বিস্ফোরন। সেই ভয়ংকর ঘটনা আমাকে কভার করতে যেতে হয়। এতদিনের চেনা একটি অপরূপ সৌন্দর্য্যময় রাস্তায়, পরিচিত মহুল গাছ গুলোর মাথায় কোনও এক জাওয়ানের ভারী বুট পরা ঝুলে থাকা একটা পা আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল বহুদিন। প্রায় ২৫ ফুট ওপরে ঝুলে থাকা পা থেকে তখনও রক্ত পড়ছিল চুঁইয়ে চুঁইয়ে। ২০০৪ সালেই মাওবাদীরা কাঁকড়াঝোরের দুটি বাংলোই মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারপরই বিকল্প রাস্তার খোঁজ শুরু হয়। এখন কাঁকড়াঝোর যাওয়ার দুটো রাস্তা। বেলপাহাড়ি থেকে চিড়াকুঠি হয়ে বুড়িঝোর গ্রামের পাশ দিয়ে। অন্য রাস্তাটি বেলপাহাড়ি থেকে চাকাডোবা হয়ে।গোপীনাথ মাহাতোর নিজের মত করে তৈরি করা হোম-স্টে 'মাহাত লজ' এর সামনে বসেছিলাম সেই ভয়াবহ ঘটনার দু'বছর আগে। গোপীনাথ মাহাতকে যারা চেনেননা তাঁদের জন্য বলা যে চারমূর্তি সিনেমায় টেনিদা রুপী চিন্ময় রায় গরুরগাড়ির যে গাড়োয়ানের পাকানো চেহারা আর ঝকঝকে দাঁতের হাসি দেখে ভুত ভেবে অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন গোপীনাথ সেই ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। দক্ষিণবঙ্গকে প্রথম হোম-স্টের রাস্তা দেখানো গোপীনাথ মাহাতো প্রয়াত হয়েছেন বেশ কযেকবছর আগে। তাঁর উঠোনে সেদিন খান দুয়েক মযুর চরে বেড়াচ্ছিল। অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এখানে প্রায় ঘরে ঘরে ময়ুর। বর্ষার পরে পাহাড়ের খাঁজ থেকে ময়ুরীর ডিম সংগ্রহ করে মুরগির তা দিয়ে ফোটায় এরা। সে ময়ুর চরে বেড়ায়, উঠোনে, রাস্তায়। পাহাড়ি চিতি, কালাচ গৃহস্থের উঠোনে ঢুকতে সাহস পায়না। গোপীনাথ আমাকে দুখানা ডিম দিতে চেয়েছিল কিন্তু লাভ নেই। ময়ুর বন্যপ্রাণী। পোষা নিষিদ্ধ। এঁদের অবশ্য কিছু বলেনা ফরেস্টের লোকজন। এরা ময়ুরের সংখ্যা বাড়ায়, ময়ুর শিকার বা খায়না।সেই মযুর গুলোকে পাশ কাটিয়ে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিলেন আদিবাসী বেশ কয়েকজন তরুণ তরুণী। গ্রীবা উঁচু করে ময়ুর গুলো তাদের দিকে তাকায়। বেশ সাজগোজ তাঁদের। হলুদ চেক ধুতি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা তরুণদের কয়েকজনের হাতে বাঁশি, মেয়েদের কোমরে বেড়ে দেওয়া নতুন শাড়ির আঁচল, খোঁপায় গোঁজা ফুল। দুলতে দুলতে তারা উঠে যাচ্ছিল পাহাড়ের পথে। হাঁড়িয়া কিংবা মহুলের নেশা ধরেছে ওদের। তাকিয়ে ছিলাম একদৃষ্টিতে। তাই দেখে গোপীনাথ বলেছিলেন, ' উরা বিন্দা মেলায় যাচ্ছে। পাহাড়ের উপাশে, ঝাড়খন্ডের বুরুডিতে।' আমি আদিবাসীদের বড় মেলা কানাইসর দেখেছি কিন্তু বিন্দা মেলার নাম এই প্রথম শুনলাম। ইচ্ছাটা চাগাড় দিল বটে কিন্ত গোপীনাথ বললেন, ই পথে ভুটভুটি যেতে লারবেক।' ভুটভুটি মানে মোটর বাইক। ৫০ টাকায় বড় কাঁসার বাটি উপচে পড়া কুঁকড়া রং ঝোল আর লাল স্বর্ণ চালের ভাত খাইয়ে পথ বাতলে দিলেন গোপীনাথই। কাঁকড়াঝোর থেকে আমলাশোল, আমঝর্না হয়ে ময়ুরঝর্না পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে ঝাঁটিঝর্না, ফুলঝোর কাশিডাঙা হয়ে লাখাইসিনি পাহাড়ের কোল বেয়ে নামার পথে চমকে গেলাম ঝরঝর গড়গড় শব্দে! লাখাইসিনির গা বেয়ে নামছে এক সুন্দরী ঝর্না, সেই প্রথম নাম শুনলাম, ধারাগিরি-র। মাথায় উঠল বিন্দা মেলা, ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম ঘন্টা খানেক। আনন্দে তিরতির করে কাঁপছিলাম আমি, বাংলার শহুরে মানুষের হয়ে এ পথ আমার প্রথম আবিষ্কার! কিন্তু আশ্চর্য যেন আরও অপেক্ষা করছিল। সে আশ্চর্যের নাম বুরুডি, সে আশ্চর্যের নাম বিন্দা মেলা। সেই বুরুডিও আমার কাছে প্রথম আর বিন্দা মেলাও।শেষ হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে বু্রুডির ভেতর গড়ে যখন পৌঁছলাম তখন মেলা তুঙ্গে উঠেছে। ভীড় উপচে পড়ে গড়িয়ে পড়বে নীল হ্রদের ভেতরে। ঝুটা মতির গয়নার দোকান সার দিয়ে বসে। ওদিকেই ভীড়টা বেশী বটে কিন্তু পাথরের গয়না, ডোকরাও রয়েছে। সংখ্যায় কম হলেও মধুবনি আর ওড়লি ঘরানার ছাপা শাড়ি। এক সদ্য গোঁফ ওঠা তরুনের হাত ধরে বউ টানছে ওদিকে। বসেছে অসাধারণ বাঁশ আর বেতের ঝুড়ি, ঠাকা, কুলা, মান তো আছেই আর আছে পাথরের বাসন কোসন। কোনও এক পাশ থেকে সাঁওতালি যাত্রার ঘোষনা করা হচ্ছে। মেলা থেকে একটু দুরে হাঁড়িয়া বিক্রি করতে বসেছেন মধ্য বয়সী মহিলার দল। হাঁড়ির মুখে গামছা বেঁধে বাসি ভাত ঘষেই চলেছে তাঁরা। সন্ধ্যা গড়ালেই বাড়বে বিক্রি বাটা। জুয়ার চরকি ঘুরছে বনবন। হাব্বাডাব্বার কৌটায় নড়ছে ঝান্ডি, মুন্ডি, চিড়িয়া আর কাফান। সন্ধ্যা নামবে বলে কোনও কোনও দোকানদার হ্যাজাক আর ডে লাইট পরিষ্কার করে কেরোসিন তেল ভরছে, পাম্প দিচ্ছে। কথাটা মনে পড়তেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। রাতে থাকব কোথায়? যে পথে এসেছি সেই পথে ফেরার তো প্রশ্নই ওঠেনা আর রাতে রাস্তা চিনতেও পারবনা। তখনও আমার কাছে সেলফোন এসে পৌঁছায়নি। মেলাটা ঘুরে ঘুরে দেখছি বটে কিন্তু মনটা খচখচ করছে। একটা জিলিপি আর পাকুড়া ভাজার দোকানের পাশে বাইকটা গছিয়ে দিয়ে এসেছি। খড়গপুরের ছেলে হিসেবে হিন্দিটা মোটামুটি চলে। 'ডিবটি হ্যায়, বাইক এঁহি রহেগা।' বলে হ্যান্ডেল লক করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই লোকটা 'জী সরকার' বলে সম্মতি দিল। খড়গপুরের বহু আরপিএফ কে আমি ডিউটির বদলে ডিবটি বলতে শুনেছি, ব এর উচ্চারন অর্ধেক হয়। বুলিটা চালিয়ে দিলাম, লোকটা নির্ঘাৎ আমাকে প্লেন ক্লথের পুলিশ ভেবে সরকার সম্বোধন করে বসল। সুতরাং বাইক নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা রাতের আশ্রয় নিয়ে।মেলার ঢালু ফাঁকা একটা অংশে গরুর গাড়ি আর মহিষের গাড়ি। মহিষের গাড়িতে বলদের বদলে জুতে দেওয়া হয় কাঁড়া বা খোজা করা পুরুষ মহিষ। সেই গাড়িতে করে ঘাটশিলা, মহুলিয়া, নরসিংহগড় প্রভৃতি জায়গা থেকে এসেছেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা। বয়স্কা বিধবা, যুবতী গৃহবধূ, ভীরু কিশোরী। ষন্ডাগন্ডা গাড়োয়ান ছাড়াও এঁদের সাথে দু'একজন করে পুরুষ আছেন। গাড়োয়ানরা গাড়িতে জুড়ছে বলদ, কাঁড়া। সঙ্গে থাকা পুরুষরা শেষ বেলায় মিলিয়ে নিচ্ছে খরিদ করা সমস্ত জিনিস ঠিকঠাক গাড়িতে উঠল কিনা। সন্ধ্যার মুখে বাড়ি ফেরার পালা। এরা সব ফিরে যাবে, থেকে যাবে শুধু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষরা। রাত ভর যাত্রা, মহুল-হাঁড়িয়া, মাদলের দ্রিম দ্রিম, আকুল বাঁশি মেলাময় খুঁজে বেড়াবে প্রিয় নারীটিকে। হাত ধরে জোড়ায় জোড়ায় নেমে যাবে বাহির গড়ের দিকে, হ্রদের ঢালু তে। দুজনের দুজন দুজনকে পছন্দ হয়ে ঘর বাঁধবে সারাজীবনের জন্য। না পোষালে যে যার ঘরে ফিরে যাবে, কেউ কাউকে ঠকাবেনা। বিন্দা মেলা এক সময় শুরু করেছিলেন ধলভূমগড়ের রাজারা। মুসাবনী, মৌভান্ডার, জাদুগাড়া, মহুলিয়া থেকে আজকের বাংলার জামবনী, গিধনী, চিল্কিগড় অবধি সে রাজ্যের বিস্তৃতি। ঘাটশিলা তার রাজ ধানী। এখন এই মেলা সাঁওতাল, খেড়িয়া, মুন্ডা ইত্যাদিদের। রাত যত বাড়ে মেলা জমে ওঠে, রাত ছাড়া সময় কোথায়? সূর্য উঠলেই কাজ আর কাজ। সম্ভ্রান্তের জমি জিরেতে, পাহাড়ে খনিতে, খাদানে খালে শুধু ওরাই। রাতটাই যে ওদের শুধু নিজস্ব।গাড়ি গুলো যত ফাঁকা হচ্ছিল মনের মধ্যে উৎকন্ঠা বাড়ছিল ততই। কেমন একটা অসহায় মনে হচ্ছিল। এখানে কেউ আমার চেনা নয়, না আদিবাসী না অ-আদিবাসী। তবুও ওরা চলে যাচ্ছে দেখে এমনটা মনে হচ্ছে কেন? ততক্ষণে হ্যাজাক, ডে-লাইট, কেরোসিনের কূপী জ্বলে উঠেছে, আলো ঘিরে থাকা মেলাটা অনেকটা ছোট মনে হয়। ঝলমলে আলোয় আদিবাসী তরুণীদের গলায়, কানে, হাতে থাকা ঝুটামতির গয়না ঝলমলিয়ে উঠছে। তারা তরুণদের আরও ঘন, আরও সন্নিবিষ্ট। আমার অস্বস্তি হয়। আমি সরে যাই মেলার সেই অংশে যেদিকে পাথরের থালা বাটি বাসন কোসন বিক্রি হচ্ছে। ওদের দিকটা এখন হালকা, দোকানের ঝাঁপ অর্ধেক গুটিয়ে রাতের খাবার অথবা ঘুমিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি। দোকান খোলা থাকে সারারাতই তারই মধ্যে কেউ কেউ পালা করে ঘুমিয়ে নেওয়া। পাথরের থালা বাসন দেখে এগিয়ে যাই, মনের মধ্যে কোথাও একটু আশা জেগে ওঠে আর ঠিক কেউ যেন ডেকে ওঠে, 'হেই নরেশদা। ইদিকে যে বড়!' ঘুরে তাকিয়ে দেখি একটা দোকান থেকে উঁকি দিচ্ছে শিমুলপালের মদন মিস্ত্রি! হাতে চাঁদ পেয়ে যাই। মদন মিস্ত্রি কে যাঁরা চেনেননা তাঁদের জন্য বলি, বেলপাহাড়ির ঠাকুরান পাহাড়ের গায়ে শিমুলপাল গ্রামে বাড়ি মদনের। শিমুলপাল, বীরমাদল আর ঢাঙিকুসুম এই তিনটি গ্রামের কিছু বাসিন্দা পাথরের বাসন কোসন বানানোর কাজ করেন। বাঁকুড়ার ছাড়া এই কাজ আর কোথাও হয়না। সাংবাদিকতার সুবাদে এঁদের সাথে আলাপ। পরে সমাজকর্মী ঝরনা আচার্য্যর অনুরোধে এঁদের কিছু সরকারি সুযোগ সুবিধা, দাবি দাওয়া নিয়ে বিডিও, ডিএম প্রভৃতির সঙ্গে কথাবার্তা বলে কিছুটা সুরাহা করতে পেরেছিলাম। সেই থেকে মাথায় করে রাখেন এঁরা। মদনের সঙ্গে তার ভাই তারাপদও এসেছিল। তাঁদের দোকানেই থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। চপ, জিলিপি, পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কায় পেট ভরে ডিনার।এবার ফেরার রাস্তা বাতলালো মদন। বুরুডি থেকে ঘাটশিলামুখী হয়ে সামান্য নামলেই ধনওয়ানি। সেখান থেকে বাঁদিক ধরে সোজা পূর্ব দক্ষিণে গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে বাইক ছুটল ফুলপাল, দুধপুশি, মহিষাধারা, নুয়াগাঁও। এ অবধি রাস্তা মোটামুটি সমতল। এরপর পাকুড়িয়াশোল থেকে ফের ধীরে ধীরে উঁচুতে ওঠা। পাকুড়িয়াশোল ঝাড়খন্ডের শেষ গ্রাম। পশ্চিমবাংলা শুরু হচ্ছে জামাইমারি গ্রাম দিয়ে। বড় অদ্ভুত জায়গাটা। একই রাস্তার ওপাশের বাড়ি গুলি পাকুড়িয়াশোল, ঝাড়খন্ড আর ওপাশের বাড়ি গুলি জামাইমারি, পশ্চিম বাংলা। বাংলার গিন্নি বিকালে গা ধুয়ে ঝাড়খন্ডের গিন্নির সাথে গল্প করতে যায়। রাতে বাংলার দাওয়ায় বসে দুই রাজ্যের কর্তারা তাস পেটায়। অনেকেই আজকাল শখ করে ঘাটশিলা থেকে দুই রাজ্যের সীমান্ত হুলুং বেড়াতে আসেন। আমি বলব, বাংলার গ্রাম জামাইমারি অবধি উঠে আসুন। তারপর শাঁখাভাঙা, পাথরচাকড়ি, লাবনী হয়ে শিমুলপালে আসুন। দেখে যান কী অনুপম শিল্প নৈপুণ্য নিয়ে পাথরের থালা বাটি, চাকতি বেলনি, ধুনোদান ইত্যাদি বানায় এই পাহাড়ি গ্রাম। আপনি চাইলে পাথরচাকড়ি থেকে বাঁদিকে বেঁকে ধরতে পারেন বীরমাদল পাহাড়ের পথ। আপনাকে একটা ছোট ঝর্না ধারা পেরুতে হবে এবং তার অনায়াসে পেরুনো যাবে। আমি বাইক নিয়ে পেরিয়ে গেছি। এরনাম কেটকিঝর্না। আপনি আদর করে কেতকী ঝর্নাও বলতে পারেন।বীরমাদলের পথে পাহাড়টার মাথায় মাথায় গাড়ী ছুটবে দিব্যি, রাস্তার ডানদিকে বাড়ি গুলি। যে পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাওয়া তার নাম নাচনিডুংরি। বীরমাদল গ্রামে ঢোকার মুখে দাঁড়ান। গাড়ি থেকে নেমে ডানদিকে দেখুন। দেখবেন অপূর্বদৃশ্য! দেখবেন ঠাকুরান পাহাড়ের কোলে একটি গ্রাম, তার নামই শিমুলপাল। কিন্তু এখন আমরা শিমুলপালের পথ ছেড়ে বীরমাদল গ্রাম ছাড়িয়ে বাংলার অন্যতম সেরা একটি পাহাড়ে গ্রামে যাচ্ছি যার নাম ঢাঙিকুসুম! একটা কুসুম যেমন চারদিকে ডিমের খোলসের শক্ত আবরনে ঢাকা থাকে ঢাঙিকুসুম গ্রামটাও তেমন চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। ছবির মত একটা গ্রাম। বীরমাদলের কোল ছেড়ে ধীরে ধীরে নেমে যান সেই পাহাড় ঘেরা গ্রামে। না! হলফ নিয়ে বলতে পারি কলকাতার এত কাছে এই পাহাড় ঘেরা গ্রাম একটাও পাবেননা। কলকাতা থেকে মেরে কেটে আড়াইশো কিলোমিটার। ঝাড়গ্রাম থেকে বেলপাহাড়ি হয়ে চিড়াকুঠি থেকে বাঁয়ে নেমে পাহাড় টপকে টুক করে গ্রামে নেমে পড়ুন। আমরা অবশ্য নেমেছি বীরমাদলের কোল ঘেঁষে, অন্যপথে। তবে এখন শুনেছি চিড়াকুঠি থেকে যাওয়ার পথের পাহাড়টা কেটে সরকার একটা প্রশস্ত রাস্তা করে দিয়েছে। আমার মতে মারাত্মক গর্হিত একটা কাজ। আমি ২০ বছর আগে ওই পাহাড় টপকেছি সামান্য মারুতি ভ্যান নিয়ে, কোনও অসুবিধা হয়নি। মাঝখান থেকে গ্রামটার সৌন্দর্য্য হানি হল। এই গ্রামে এখন হোম-স্টে হয়েছে। চাইলে থাকতে পারেন অথবা ঝাড়গ্রামে রাত্রিবাস। পাথরের বাসন কোসন তৈরি করে এখানকার কিছু মানুষ। সেই সব মস্ত খাদান তো দেখতেই পারেন কিন্ত গ্রামের পশ্চিমের পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেলে আপনি পাবেন আরও সুন্দর একটা জিনিস। টুয়ারডুংরি ফলস্! কলকলিয়ে জল নামছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ওকে ডান দিকে এবার আপনাকে উঠতে হবে পাহাড়ের চূড়ায়। পশ্চিম পাটে সূর্য নেমে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনার চোখ চলে যাবে সেই বুরুডির দিকেই। নিজের মনেই বলে উঠবেন, ‘আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না৷’ হ্যাঁ, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নায়ক নবকুমার-এর সেই বিখ্যাত উক্তিটি।আমি কিন্তু এই বেলা পাথরচাকড়ির পথ ছেড়ে বাঁয়ে মুড়িনি। বরং আমি লাবনী, শাঁখাভাঙা হয়ে শিমুলপালে নেমে গেছি। ফেরার পথে দেখে এসেছি নামের সঙ্গে কী অদ্ভুত মিল ওই শাঁখাভাঙা গ্রামের। পাহাড়ের মাথায় থাকা গ্রামটা যেন এয়োতির শাঁখার মতই গোল হয়ে একটা জায়গায় তোবড়ানো। শিমুলপাল ঢোকার মুখে জঙ্গলটার নাম চৌকিশাল। ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে আরও একবার যেতে হয়েছিল আমাকে। মাওবাদীরা আইইডি বিছিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল একটি অ্যাম্বুলেন্স! ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ডাঃ ধানীরাম মান্ডি, নার্স ভারতী মাঝি আর চালক প্রনয় মিশিরের শরীর। ২২ বছরের ভারতী সেই মাত্র বিয়ের ছুটি কাটিয়ে জয়েন করেছিলেন। একটা লাইগেশন ক্যাম্পের প্রস্তুতি নিয়ে ফিরছিলেন তাঁরা। ওই পথে ওই নির্দিষ্ট দিনে এবং ওই নির্দিষ্ট টাটা সুমোতেই তাঁরা যাতায়ত করতেন। ঘটনাটি ঘটেছিল দিনের আলোতে। সুতরাং ইচ্ছা করেই এই নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছিল মাওবাদীরা। বাংলার সেই জঘন্য অধ্যায়ের সেই দিনটি ছিল সর্বাধিক কলঙ্কিত। রাজনৈতিক ঘৃণ্যতার নিকৃষ্টতম রূপ। যাইহোক ওই পর্ব শেষ। আপাতত: এই গোটা পথে নরাধমরা নেই। সেবার খড়গপু্র ফিরেছিলাম শিমুলপাল, বালিচুয়া, বেলপাহাড়ি হয়ে। বালিচুয়া থেকে বেলপাহাড়ি পথটিও খুব সুন্দর! ডাঁয়ে বাঁয়ে ছোটবড় ডুংরি বা পাহাড়, টিলাগুলিকে রেখে মসৃণ পথ। টিলা গুলির নামও খুব সুন্দর। যেমন হাতির মত দেখতে বলে একটির নাম গজডুংরি। চাইলে এর মাথায় চড়তে পারেন। পরের পথ তো সবারই জানা, বেলপাহাড়ি থেকে ঝাড়গ্রাম হয়ে হাওড়া- মুম্বাই জাতীয় সড়ক। ক্রমশ...
    রঙের জীবন, জলের জীবন - জগন্নাথদেব মণ্ডল | বাড়িতে কেউ না থাকলে, না থাকার ছায়া ধরে থাকে উঠোন। শোক ও আনন্দ মেশানো একটুখানি মৃদু আলো এসে পড়ে গাছপালাদের মাথায়। হিমসাগর গাছের নীচে এমনই অর্ধেক আলো অর্ধেক ছায়ায় বসে আছে কোমল রঙের এক ছেলে। নাম - গোলাপি প্রমাণিক। ত্রিশের কোঠায় বয়স, গাল ঢুকে যাওয়া ও নীচু কপাল, একদা ইস্কুল পাশ করেছিল। সন্ধের দিকে ওঁর বর্ণান্ধ চোখের নীচে কালো কালো দাগ ফুটে ওঠে। ওর মনে হয় এ দাগ যে শুধু ম্লান অভাব-অনটনের তা কিন্তু নয়, একান্ত করে মানুষের স্পর্শ না পেলে, কেউ কাছে ডেকে না দিলে, নিজের বুকে শক্ত হাতে জড়িয়ে না ধরলে এমন নষ্ট-দাগ পড়ে, যেন পাকাফলের ত্বক জল লেগে লেগে পচে গেছে। সে আসলে ঘরপোড়া মেয়ে-গোরু। একেকজন মানুষকে দেখে নিজস্ব ঘর ভেবেছে যতবার, ততবারই সব অনলে পুড়িয়া গেল। মাঝে মাঝে মনে পড়ে, কতবার দুধের ফেনায় ভরে গেছে মুখ। ভালোবেসে মুখ গুঁজে দেওয়া এবং ধীরে ধীরে বিদায়ের চাবি আঁচলে বেঁধে সরে আসা। সেই যে এক তছনছ কষ্ট – রাত জেগে থাকা –কিছুতে উপশম নেই। নিজেকে একটু একটু করে ক্ষয় করে ফেলা। অভাবের সংসারে ও বাড়তি কেউ। মনে মনে ও খালি গায়ে উদোম হয়ে শুয়ে নাভিতে একটা মোমবাতি বসায়। চোখে শুকিয়ে যাওয়া জলদাগ। তিরতির শিখা কাঁপছে বাতাস লেগে। গলে গলে নামছে মোম। ছ্যাত শব্দ। গলা মোম নাভিতে ভাস্কর্য তৈরি করছে নরম। নিজেকে মনে হচ্ছে হারমোনিয়াম, কে যে বাজাতে বাজাতে উঠে গেছে, যে চলে গেছে ছায়া-ছায়া বনমাঝে সে আর ফিরবে না... ফিরবে না কোনোদিন। অনবরত আল ধরে ধরে হাঁটা। জনবসতির চিহ্ন যেখানে মুছে গেছে সেখানে মাথা পেতে শুয়ে পড়া। ঘাসে একটু ওম। পোকামাকড়ের কিরকির শব্দ। কুয়োর নীচ থেকে দ্যাখা আকাশ। কতো লেজচেরা কালো কালো পাখি। চোখে জড়িয়ে আসছে ঘুমের আঠায়। এই মাঠ, ধানজমি, পাখি, পুকুর, আকাশ, অস্তরাগের মেঘ এই সমস্তটাই আমার সমাধি, নাভিতে মোম বসানো ছেলে বিড়বিড় করে এইসব ভাবে। হাঁটতে হাঁটতে ছেলে ভাবে, কেউ না থাকা বাড়িতে কড়াইয়ে সময় নিয়ে নিয়ে সে জল ফোটাবে। তারপর পাত্রে ঢেলে হাতের শিরাটা কুচ করে কেটে চুবিয়ে বসে থাকবে। আস্তে আস্তে মৃত্যু এসে বাথরুমের পাশটা থেকে ওঁকে দেখবে। মৃত্যুর পায়ে লাল পিঁপড়ে কামড়ালে ডান পায়ের মোটা নখ দিয়ে বাঁ পা চুলকে নেবে। করুণ গোলাপি ছেলের চোখে যখন জড়িয়ে আসবে শেষ ঘুম, ব্যথায় একটু একটু শীত করবে, তখন মনে পড়বে পড়াশোনা করেও ওঁর কাজ জোটেনি, ছোটবেলা থেকে শখ ছিল পড়াবে তা পূর্ণ হয়নি, বিয়ে থা না করে ভেবেছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সবটুকু উজাড় করে শেখাবে, শেষের দিকে চোখ ঘোলা হয়ে আসছিল ও মুখে তিতো থুতু। মরে যাওয়া ছাড়া পথ ছিল নাকো। শ্বাস বন্ধ হলেই, মৃত্যু ওঁকে সাইকেলে চাপাবে পিছনের সিটে। চলতে শুরু করবে সাইকেল। ঝোপঝাড়, বনপথ, প্রাইমারী ইস্কুল সব সরে সরে যাবে। খয়েরি চাদর জড়ানো মৃত্যুর শিরদাঁড়ায় ঠোঁট ঘষতে ঘষতে গোলাপি ছেলে বলবে - আমি কিছু পারিনি, আমি কিছু পারিনি, আমাকে তুমি নাও, পুরোটা নাও। এইসব অলীক রূপকথা হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেও ও আত্মহত্যা করতে পারবে না। আসলে ও ভীতু। খুব ভয় পায়। এইসব নরম-ভীতু মানুষদের খুব মরণ। হয়তো ছেলেটি উবু হয়ে কলমি তুলছে। একজন এসে বলল - চুষে দিবি আমারটা একটু? কিংবা বাতাস কেটে সাইকেল চালাতে চালাতে যেন কিছুই জানে না এমন স্বরে আপনমনে বলল - অ্যাই! মেয়েলি ইটভাঁটায় যাবি? অপমানে কান জ্বালা করে। ও কিছু বলতে পারত না। একদিন ও রুখে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে কেটে কেটে বলে হিসহিসিয়ে - তোর বউ আর মায়ের পারমিশন নিয়ে আয় চুতমারানির পো তারপর যাব, গিয়ে ইঁট দিয়ে তোর বিচি থেঁতো করে দেব। বাঁশপাতার মতো কাঁপা গোলাপি ছেলে যে এভাবে রুখে দাঁড়াতে পারে তা ছেলের নিজেরই জানা ছিল না। সেদিন থেকে ও একটু একটু আস্থা পেল বেঁচে থাকার। বাপ পিতামহর ব্যবসা শিখে সেলুন দিল বাজারের কাছে। শস্তা সেলুন। বড়ো আয়না, চুল কাটার সরঞ্জাম। দেয়ালে গৌর নিতাইয়ের ছবি। কার ঘাড়ে পাউডার ছোঁয়ালে সন্তানস্নেহের শিহরণ, কোন খদ্দরের কপালে হাত রাখলে প্রথম পুরুষ স্পর্শের আবেশ বা চিরুনি বুলিয়ে দিতে গেলে কেঁপে উঠছে হৃদি সে সব জানা যায় না। গৌর ওই নিঃসঙ্গ মানুষটির মঙ্গল করেছে। মরে যাওয়া থেকে ফিরিয়ে এনেছে। একা একা বেঁচে থাকার আঠা, নিয়ত কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে বেঁচে থাকার অনেক অনেক অর্থ চোখের সামনে খুলে গেছে। গোলাপি যখন পুকুরে চান করতে নামে মাঝে মাঝে জলের নীচে ডুব দিয়ে বসে হাতদুটো জল থেকে তুলে রাখে। জলের নীচে সবুজনীল দমবন্ধ অন্ধকার। হাতে পৃথিবীর বাতাস এসে লাগছে। মাঝে মাঝে মনে হয় হাতে শাঁখা পলা পরানো। বুকের কাছটা আনন্দে শিরশির করে।
  • হরিদাস পালেরা...
    ভোটুৎসবে ভাট - অন্তিম গণনা ?  - সমরেশ মুখার্জী | আমার হপা‌র পাতায় ভোটুৎসবে ভাট সিরিজে নামিয়ে যাচ্ছি নানা বিক্ষিপ্ত, অসংলগ্ন হ‍্যাজ। ডাইভার্সনের জন‍্য। এমতাবস্থায় গুরুর মূল ভাটে চোখে পড়লো এটা:  তার একটু আগে শুনছি‌লাম বহুবার শোনা একটি ঝকাস গান। উপরোক্ত “থান কতা” দেখে বহু‌বার শোনা গানটি‌র কথাগুলো অন‍্যরকম লাগতে শুরু করলো মনে : We're living together,Why bid farewell to others?And invite the doom for usWho can tell?HE is leaving the normsBut whom to blame?'Cause all are sameWill things ever be the same again?It's the final countdown.Oh! The final countdownWe're heading for NadirSo we need to stand tallElse HE will crush us allAnd send us to hell, yeah.Many hurdles to crossTo set right the grossElse we will lose IT soonIt's the final countdownThe final countdownThe final countdown…কেন যতো‌ই এসকেপিস্টের মতো এড়িয়ে থাকতে চাই অনেক কিছু তবু কিছু হানা দেয় মনে অজান্তে?অরিজিনাল লিরিকটাও র‌ইলো:We're leaving together,But still it's farewell.And maybe we'll come backTo earth, who can tell?I guess there is no one to blameWe're leaving ground.Will things ever be the same again?It's the final countdown.Oh! The final countdownWe're heading for VenusAnd still we stand tall'Cause maybe they've seen usAnd welcome us all, yeah.With so many light years to goAnd things to be found I'm sure that we'll all miss her so.It's the final countdownThe final countdownThe final countdown… 
    বৈঠকি আড্ডায় ১৬ - হীরেন সিংহরায় | লাল নীল হলুদের খেলা ১ RISE TO VOTE SIR  রাত্তির নটা বাজে । আমাদের পাশের গ্রাম  ব্রুকউডের কনট এভিনিউর  বাড়িতে বাড়িতে বেল বাজিয়ে চলেছি  গৃহ কর্তা বা গৃহ কর্ত্রী ভোট দিয়েছেন কিনা জানতে ।  বহু  কাল আগে পড়া শরৎচন্দ্র পণ্ডিত বা দাদা ঠাকুরের সেই বিখ্যাত প্যালিনড্রমটি মনে পড়ল -রাইজ টু ভোট সার! উলটো দিক থেকে পড়লেও সেটা রাইজ টু ভোট সার থেকে যায় ! সকাল সাতটায় পোলিং স্টেশনের দরোজা খুলেছে , আমাদের ন্যাপহিল পাড়ার বুথে  যে কাজটা দিয়ে শুভ মহরত করে এসেছি তার নাম টেলিং। মতদান করে ভোটার যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, প্রতিটি দলের প্রতিনিধির অধিকার আছে সেই ভোটারের লিস্ট নম্বর জেনে নথিবদ্ধ করবার। প্রায় সকলেই সেটা জানিয়ে দেন , অনেকে তাঁদের ভোটার  কার্ডটাও আমাদের হাতে দিয়ে দেন ।  ন্যাপহিলে আমি সকাল সাতটায় হাজির হয়েছি;  প্রিসাইডিঙ অফিসার একটা প্লাস্টিকের থলি দিয়ে গেলেন, সেই কার্ড সংগ্রহ করে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের সুবিধার্থে।  এখন সন্ধ্যে বা রাত নটা বাজে, বুথ বন্ধ হতে আর মাত্র এক ঘণ্টা বাকি; পথ ঘাট  অন্ধকার, সুনসান।  এমতাবস্থায়  কাউকে ঠিক রাইজ টু ভোট বলা যায় না , অন্তত চোদ্দ ঘণ্টা আগে এঁরা  সপরিবারে রাইজ করেছেন, দিনের কাজ সম্পন্ন করে এখন একটু আরাম করে টেলিভিশনে ব্রিটেন হ্যাজ গট ট্যালেন্ট দেখছেন , ফেসবুকে লাইক দিচ্ছেন অথবা গভীর মনোযোগ সহকারে   হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেদিনের হোম ওয়ার্ক করছেন।  এমন সময়ে তাঁদের নাগরিক কর্তব্য বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা যে খুব ফলপ্রসূ হবে ভাবার কোন সঙ্গত কারণ হয়ত  নেই।  কিন্তু আমাদের ইলেকশন ড্রাইভের নেত্রী লুইজার বিচারে আরেকটি ধাক্কা  / ফাইনাল পুশ দেওয়া প্রয়োজন- অলস , কুঁড়ে , আনডিসাইডেড ভোটারকে ঘরছাড়া করে পোলিং স্টেশনের  দিকে ভাগানো দরকার, আধমরাদের আরেকটা ঘা মারা। । একটা বিপরীত সম্ভাবনাকেও যে ঠিক  উড়িয়ে দেওয়া যায় না সে কথাটা লুইজাকে বলে গেলো না- এই সন্ধ্যে রাতে   লিবারাল ডেমোক্র্যাট দলের এশিয়ান চেহারার এক দাড়ি ওলা লোক পার্টির হলুদ ঝাণ্ডা দেখিয়ে কড়া নেড়ে তাঁর শান্তি  বিঘ্নিত করেছে  বলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়ি থেকে দু পা হেঁটে পোলিং বুথে ভোটের বাকসোয় কনজারভেটিভ দলের পক্ষে ভোট দিয়ে আসতেই  পারেন।  লুইজা,  পাভ ও আমার এই সান্ধ্য অভিযানের সম্মুখীন হয়ে প্রায় সকলেই  বললেন ভোট দিয়ে এসেছেন ।  এমন কাউকে পেলাম না যিনি কাচু মাচু মুখে বললেন ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধানে প্রদত্ত এই মহান নাগরিক অধিকারটির সম্যক প্রয়োগ করেন নি বলে তিনি  যারপরনাই লজ্জিত বোধ করছেন এবং আমাদের আশ্বাস দিচ্ছেন তৎক্ষণাৎ  গায়ে জামা গলিয়ে  ভোট দেবার জন্য পথে বেরুবেন।  কেউ যদি তা বলতেন, লুইজার পরবর্তী আদেশ হতো  ,  চলো গলির  মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখি  লোকটা বেরুলো কিনা , নাহলে  আবার বেল বাজাও! সাড়ে নটায় লুইজা রণে  ভঙ্গ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে। পার্টি লিফলেট  উওকিং কাউনসিলে দশটি ওয়ার্ড (বাইফ্লিট ও ওয়েস্ট বাইফ্লিট ,কানাল সাইড, গোল্ডসওয়ারথ পার্ক, হিথল্যান্ডস, হো ভ্যালি, হরসেল ,ন্যাপহিল, মাউনট হারমন,  পিরফোরড ,সেন্ট জনস)  মোট ভোটার সংখ্যা সব ওয়ার্ডে প্রায় সমান , টোটাল আশি হাজার ; তিরিশ জন পৌরপিতা ও মাতা , প্রতি বছর দশজন করে নির্বাচিত হন। চার বছরের কার্যকাল,  চতুর্থ বছরে ভোট হয় না।  যদিও কারো বাড়ি থেকে মতদান কেন্দ্র ৫০০ মিটারের বেশি দূরে নয় , শতকরা চল্লিশ জন কষ্ট করে পোলিং স্টেশনে আসেন কিনা সন্দেহ ।  ইউরোপের একমাত্র এই দেশ যেখানে  ভোট হয় কাজের দিনে, বৃহস্পতিবারে। কাগুজে ক্যান্ডিডেট হিসেবে পার্টি মায়াকে দাঁড় করিয়েছে আমাদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে দূরের কেন্দ্রে ছ মাইল পশ্চিমে  বাইফ্লিট ও ওয়েস্ট বাইফ্লিটে।  সেখানে তার একমাত্র কাজ ভোট ভাঙ্গানো -  কনজারভেটিভ প্রার্থীকে হারিয়ে আমাদের  সমর্থিত এক নির্দলীয় প্রার্থীকে জেতানো । দু বছর আগে আমাদের ওয়ার্ড ন্যাপহিলে মায়া সাফল্যের সঙ্গে ঠিক এই কাণ্ডটি করে নাম কামিয়েছে ।  আমি তাকে  বললাম , তোমার জেতার কোন আশংকা নেই জানি তবু সৌজন্যের খাতিরে এই ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিছু ইস্তেহার বিলি, ভোটারদের সঙ্গে বাক্যালাপ করাটাও উচিত । ন্যাপহিলে বড়ো হয়েছ,  চেনা পাড়া, দু বছর আগে সেখানে তোমার পুরনো স্কুলের ছেলে মেয়েরা  কিছু ভোট দিয়েছে।  এখানে দেবে কে ? মায়াকে সঠিক পথে চালনা করার দায়িত্ব নিলেন অশীতিপর এক মহিলা , অ্যান রবার্টস । এক সময়ে বাইফ্লিট ও ওয়েস্ট বাইফ্লিটের প্রতিনিধি ছিলেন, দু বার ডেপুটি মেয়র । আশ্চর্য তাঁর উদ্যোগ ও কর্মশক্তি; অত্যন্ত কড়া ডিসিপ্লিন আরোপ করেন। কানাডা , নিউ জিল্যানড,  দক্ষিণ আফ্রিকা , মালায়েসিয়াতে একদা বসবাস করেছেন ,ট্রাভেল এজেন্টের কাজে দুনিয়া ঘুরেছেন ,তিনটে ভাষায় সমান স্বচ্ছন্দ । ষাট বছর এ পাড়ায় আছেন , নানান অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ভাণ্ডার । অ্যান আমাদের নিয়ে ঘুরলেন লিফলেট বিলির কাজে ।  দিনের বেলায় কেউ বাড়ি থাকেন না , ড্রাইভে গাড়ি পার্ক করা আছে দেখে উৎসাহিত হবার কোন কারণ নেই;  তাঁরা সরকারি পরিবহনে অফিস কাছারি  গেছেন । এই পরিক্রমায়  লক্ষ করলাম , প্রায় নব্বুই শতাংশ বাড়ির দরোজার  লেটার বকসের আকার প্রকার একই রকম,  তার ভেতরে চিঠি গুঁজতে গেলে ব্রাশের মতন কিছু একটা বাধা দেয়। কোন কোন বাড়িতে লেটার বকসের অবস্থান এতো নিচুতে যে সেখান দিয়ে লিফলেট ঢোকাতে পিঠে ব্যথা হয়ে যায়। দরোজায় ওয়েলকাম লেখা মাদুরের চল উঠে গেছে বললেই হয়। লিবারাল ডেমোক্র্যাট পার্টির জাতীয় নেতা সার এড ডেভি এলেন দলের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে । একটি লেজার সেন্টারের রেস্তোরাঁয় দাঁড়িয়ে বললেন একশ বছরের টু পার্টি সিস্টেম মেনে নিতে মানুষ আর রাজি নয়, তাঁরা বিকল্প খোঁজেন।  উদাহরণ উওকিং কাউনসিল , কয়েক দশক ধরে ছিল কনজারভেটিভ পার্টির হাতে, এখন আমাদের দলের মেজরিটি,  এই নির্বাচনে চাই ক্লিন সুইপ !   ছবি - সার ডেভি, ফয়জল মুমতাজ উইল ফরস্টার এবং অন্যান্যরা  এবারের ভোটে দশজন প্রার্থী এবং উওকিঙ্গের পারলামেনটারি ক্যান্ডিডেট উইল ফরস্টার  দাঁড়িয়ে আছেন সার ডেভিকে ঘিরে। শুভেচ্ছা জানিয়ে সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন সার ডেভি।  অন্য প্রার্থীদের গড়পড়তা বয়েস অন্তত পঞ্চাশ সেখানে সদ্য কলেজের গণ্ডী পেরুনো মায়াকে দেখে তিনি খানিকটা বিভ্রান্ত হলেন মনে হলো । শঙ্কিত মুখে মায়ার  দিকে চাইলাম - কেন যে রাজি হয়েছিলাম? এই নেতা কি জানেন মায়া  নামেই ক্যান্ডিডেট , তার কোন চান্স নেই ? লন্ডনের কিংস কলেজ তাকে দয়া করে মাষ্টারস করবার সুযোগ দিয়েছে , সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্লাস শুরু!  মায়ার মিশন সম্পূর্ণ আলাদা । উইল ফরস্টার কি তাঁকে বুঝিয়েছে সে সব ? বেশির ভাগ প্রার্থীর পিতা মাতা এ ধরণের অনুষ্ঠান কেন ধরা ধামেই  হয়তো উপস্থিত থাকেন না ; সম্ভবত  সার ডেভির মনে বল সঞ্চারের প্রয়াসে উইল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো , মিট মায়া’স ড্যাড ! সার ডেভি বললেন আসুন আপনার সঙ্গেও করমর্দন করি। সার ডেভির সঙ্গে   এই উষ্ণ অভ্যর্থনার ফলটি পেলাম হাতে হাতে। উওকিঙ্গের কানালসাইড ওয়ার্ডে অধিক সংখ্যক এশিয়ান মানুষের বাস। সেখানে আমাদের লড়াই  কনজারভেটিভ নয় , লেবার পার্টির বিরুদ্ধে।  তিরিশ বছর যাবত লেবার জিতেছে । ঐতিহাসিক ভাবে ব্রিটেনে ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি মূলের মানুষ লেবারকে ভোট দিয়ে এসেছেন – মনে করেছেন সে দল আছে মাটির কাছাকাছি,  কনজারভেটিভ বড়ো লোকেদের পার্টি ।  এটি একটি দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ধারণা মাত্র, আদতে টোনি ব্লেয়ারের আমল থেকেই ( ১৯৯৭)  লেবার অন্য দিকে মোড় নিয়েছে , যেখান থেকে তার জন্ম, তার পার্টির নাম সেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে লেবারের যোগসূত্র আজ বিচ্ছিন্ন। আমার মতে আমেরিকায় রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাট এবং ব্রিটেনের লেবার ও টোরি পার্টির কোন মৌলিক ব্যবধান নেই,তফাৎ কেবল তাদের পতাকার রঙে । লর্ড কর্নওয়ালিস যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে পূর্ব ভারতে জমি জমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন চালু করছেন (১৭৯৩) ঠিক সেই সময়ে সারের ওয়েব্রিজ থেকে হ্যাম্পশায়ারের বেসিংস্টোক শহর অবধি তিরিশ মাইলের একটি কানাল খোঁড়া হয়। সেটি  ওয়ে নদীকে টেমসের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে মাল বহনের কাজটা সহজ করে ( রেললাইন আসতে আরও চল্লিশ বছর কেটে যাবে) সেই কানালের অংশবিশেষ উওকিং শহরের ভেতর দিয়ে যায় , তাই এই ওয়ার্ডের নাম কানালসাইড। লেবার প্রার্থী আজিজ তাহির সেথা জিতছেন দশ বছর যাবত,  এবারের প্রতিদ্বন্দ্বী  আমাদের ফয়জল মুমতাজ । এখানে জনসংযোগ  করতে গেলে উপ মহাদেশের ভাষাগুলি কাজে লাগে।  এমন জব ডেসক্রিপশনের সঙ্গে মানানসই কর্মী লিব ডেম উওকিঙ্গে বিরল ।  অনুরোধটা এলো আমার মেয়ের কাছ থেকেই । মায়া বললে  আমি তো ভোটের তিনদিন আগেই  ইস্টার পরবে মায়ের সঙ্গে রোমানিয়া যাব ।  এখন তুমি ফয়জলকে একটু সাহায্য করতে পারো না?  বাংলা তোমার ভাষা । হিন্দি  জানো আর তুমিই তো বলেছ সেটা জানলে উর্দুতে চালিয়ে দেওয়া যায় । কতো দেশে উবার  ড্রাইভারের সঙ্গে তোমাকে গালগল্প করতে দেখেছি ! এখন হিন্দি উর্দু বাংলা দিয়ে দু দিন ক্যানভাসিং করো ! তোমার সঙ্গে সাইমন থাকবে ঘাঁতঘোত গুলো সেই বুঝিয়ে দেবে । এই প্রথম জানলাম  নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ইনফরমেশন টেকনোলজি কোন লেভেল পৌঁছে গেছে ! লিব ডেমের তৎপর স্টিভ জবেরা একটি অ্যাপ বানিয়েছেন তার নাম মিনিভ্যান , যা খুললেই পাওয়া যাবে ওয়ার্ড অনুযায়ী প্রত্যেক রেজিস্টার্ড ভোটারের নাম।  এর সঙ্গে আছে একটি প্রশ্ন তালিকা – কি কি জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, তার ডিগ্রি মাপ করা  আছে – ইনি কি সফট টোরি বা লেবার ? এটা লোকাল কাউন্সিল ভোট কিন্তু কাল যদি দেশের সাধারণ নির্বাচন হয়,  ভোট কোন দলকে দেবেন , গতবারে কাকে দিয়েছিলেন,  এমনি প্রায় পনেরোটা হিন্ট।  বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সামনে  কতজন এই প্রশ্নোত্তরের সম্মুখীন হতে চাইবেন ? আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় দেখলাম অতি সামান্য । তবে ভোটারের নাম তালিকা দেখে সেই গৃহকর্তার দ্যাশ কোথায় ছিল অগ্রিম  অনুমান করে নিতে কোন অসুবিধে হয় না , গল্পের সূত্র মেলে সহজেই। একজনের পদবি শ্রেষ্ঠা, তিনি অবাক ও একই সঙ্গে প্রসন্ন হলেন যখন  জিজ্ঞেস করলাম নেপালের কোন শহরে তাঁর আদি বাড়ি (ব্রিটিশ আর্মির দুটি ছাউনি অলডারশট ও ক্যাম্বারলি আমাদের প্রতিবেশী শহর, অনেক গুর্খা সৈন্য ও তাদের পরিবার এসেছিলেন এবং থেকে গেছেন)। সিলেট রাওয়ালপিণ্ডির জনতার পাশেই পেলাম একজনকে যার প্রথম নাম উইজডম । বাহাদুরি দেখানোর  চান্স ছাড়া যায় না , টকিং পয়েন্ট পেয়ে গেছি ।  জিম্বাবোয়ের কোথায় আপনার বাড়ি ( আফ্রিকার এই একটি দেশ চিনি যেখানে ছেলে মেয়ের নাম রাখা হয় কোন চারিত্রিক গুণ অনুযায়ী ) ?  জানালেন তাঁর বাড়ি বুলওইয়াও (আক্ষরিক অর্থ  ‘  মৃত্যু ভূমি ,’ ‘কিলিং ফিল্ড ‘ ) । শনিবারের বিকেল , অর্ধেক গেরস্থালী  জনমানব শূন্য ।  মুখের ওপরে কেউ দরোজা বন্ধ করেন নি , যারা খুললেন  তাঁরা কিছু সমস্যার  কথা জানালেন , মৎ কৃত অনুবাদ শুনে নিয়ে সাইমন তৎক্ষণাৎ অ্যাপের ভেতরে সেই সব জবাব সাজিয়ে ফেলে। আমাদের ক্যান্ডিডেট  ফয়জল জিতলে  অবশ্যই আমরা দেখব ( সারা দুনিয়াতে ভোটের জন্যে এই গুল দেওয়া হয়ে থাকে, হম দেখেঙ্গে , সোচেঙ্গে )। একটি মাত্র  বেয়াড়া অভিজ্ঞতা হলো সেদিন : বেল শুনে ভেতর থেকেই এক মহিলা ( নামটা পর্তুগিজ, রিবেরা) প্রশ্ন করে জেনে নিলেন কোন দল , বললেন বাক্যালাপের  কোন প্রয়োজন নেই, আমি টোরি পার্টিকে ভোট দিই । এক  সময়ে লক্ষ করলাম এই মিনিভ্যান অ্যাপে যদিও সব ভোটারের নাম পাতা লেখা আছে , আমরা  সব বাড়ির বেল বাজাচ্ছি  না , মাঝে মধ্যে একটা দুটো দরোজা বাদ। সাইমন বললে আমাদের সার্ভে মাফিক এঁরা লিব ডেমকে সমর্থন করেন না , তাই কড়া নাড়া বেকার। ভাবলাম বলি তবু কথা কওয়া  যায় না কি ? এমন বুঝিয়ে দেবো , শুনে হয়তো বলবেন, ভুল করেছিনু,  ভুল ভেঙ্গেছে ! লাভ নেই। আমার ভূমিকা পার্টি ক্যাডারের , মার্গ দর্শকের নয় ! ফেলে রেখে আমাকে বন্ধনে ভোটের তিন দিন আগে  মেয়ে  গেলো মাতুলালয়ে , ইস্টার পরবে, প্রভুর পুনরুথানে।  লিব ডেম প্রার্থীরা সবাই একসাথেক্রমশ
    ভোটুৎসবে ভাট - সাদা ঘুঁটে - পুনশ্চ  - সমরেশ মুখার্জী | প্রাককথন:  পুনশ্চ‌র প্রাককথন! সেটা আবার কী মশায়? গেঞ্জির বুকপকেট? নাকি বাইকের সীটবেল্ট? আহা ব‍্যঙ্গ করেন কেন? মানছি সাধারণত তা হয় না। তবু করতে হচ্ছে। কারণ -  পুনশ্চ সচরাচর মূল লেখার থেকে বড় হয় না। তবে যা সচরাচর হয় না তাও তো কখনো হতে পারে। তাই তো বারো হাত কাঁকুড়ে‌র তেরোহাত … বা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় গোছের প্রবাদ চালু বাজারে।ছয় ইঞ্জিন - তিনশো ওয়াগন - সাড়ে তিন কিমি লম্বা সুপার বাসুকি মালগাড়ির মতো আপনার দীর্ঘ পুনশ্চ পড়বো‌ই বা কেন? কী লাভ? তা অবশ‍্য ঠিক, তবে বিগত ৭৭ বছর ধরে এতোবার লাইন দিয়ে তর্জনীতে কালি লাগিয়ে‌‌ই বা কী লাভ হয়েছে?  যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ (অথবা পূতানা) মেগা সিরিয়াল তো হয়ে‌ই চলছে। তবু তো অনেকে যায় আঙ্গুলে কালি লাগাতে। উঠতি লেখক‌কে উৎসাহ দিতে না হয় দেখলেন একটু পড়ে। ভালো লাগলে এগোবেন। না হলে ছেড়ে দেবেন।হিমশৈলের দশ শতাংশ দৃশ‍্যমান, নব্বই শতাংশ অদৃশ‍্য। ধ্রুপদী প্রতীকী রচনা এই গোত্রের। কিছু পাতি উপমা ছাড়া প্রতীক, ট্রতীক আমার মাথায় আসে না। আমি গাছ, মাছ, বেড়াল, কুকুর নিয়ে যা লিখি তা ওল্টানো হিমশৈল। তবু অদৃশ‍্য দশ শতাংশে অনুক্ত কিছু তাৎপর্য খুঁজে পেলে সে কৃতিত্ব পাঠকের। শরতের নীলাম্বরে শোনপাপড়ি‌র মতো ভেসে বেড়ানো ফিনফিনে মেঘ উত্তমের শ‍্যাম্পূ‌করা ফাঁপানো চুলের মতো নিছক দৃষ্টি‌লোভন। তাতে না আছে জল না ছায়া। এ‌ই পুনশ্চ‌টি‌‌ও তেমনি। হাওয়া বালিশের মতো ‘মূঢ়মুড়ে’ প‍্যাকেট। খাদ‍্যগুণ নেই তবে খেতে মন্দ নয়। এর ব্র‍্যান্ড এ্যামবাসাডর হাস‍্যমুখী বিগতযৌবনা বলিতারকা জেসমিন কফিওলা। এর টুকরো বারো বার চিবিয়ে‌ও বোঝা যায় না কি দিয়ে তৈরি। সোশ‍্যাল মিডিয়া গবেষণা মতে - কিছুটা প্লাস্টিক দিয়ে। তবু পাবলিক খাচ্ছে। ভাঁড়ে মা ভবানী রেলদপ্তর নানা বিচিত্র উপায়ে রোজগার বাড়াতে চালু করেছে কয়েকটি ‘মূঢ়মুড়ে এক্সপ্রেস’। গোটা ট্রেনের দুপাশে চিপকানো প‍্যাকেট হাতে জেসমিনের পোস্টার। এসব যদি হতে পারে দীর্ঘ পুনশ্চ হতে পারে না?        ****************************************মূল প্রসঙ্গ ১৬.৫.২৪ পোষ্টানো - সাদা ঘুঁটে। সেদিন আটসকালে বৌমণির ঝঙ্কৃত সম্ভাষণে মটকা মারা ঘুম চটকে মন ম‍্যাজম‍্যাজ করছিল। চারটে সাদা ঘুঁটে সাঁটিয়ে, তার মহিমায় কাব‍্যচর্চা করে চোখ প‍্যাঁ-প‍্যাঁ করতে শুরু করলো। তাই বারোটা নাগাদ বডি ফেললাম ডাইনিং হলের খাটে যার বৈশিষ্ট্য‌ বর্ণিত হয়েছে - ১৪.৫.২৪ - “কে তুমি তন্দ্রাহরণী” লেখা‌য়। পূনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। ঐ বারোয়ারী খাটে একটি বালিশ মন্দিরের সামনে দানপেটির মতো পাতা থাকে। চোখ প‍্যাঁ প‍্যাঁ করলে ওতেই মাথা পাতি। চোখে ডলার ছাপ তিরিশ টাকার আইপ‍্যাড দিলে ভরদুপুরে‌ও অমাবস‍্যা। পয়সা‌কড়ি পাওয়ার স্বপ্ন বোনাস। একাকী ভ্রমণে এটা আমার অবশ‍্যসঙ্গী। ট্রেনে গভীর রাতে‌ আলো জ্বললে বা দুপুরে কোনো পার্কে গাছের ছায়ায় প্লাস্টিক বিছিয়ে ঝপকি নিতে কোনো অসুবিধা নেই।ঘুমোলেই আমি স্বপ্ন দেখি। নয়তো তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় নানা চিন্তা মনে আইস-বাইস খেলে বেড়ায়। বিশ্রামান্তে কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা, বিশেষ স্বপ্ন চলভাষে দানা বাঁধে। নিঃসঙ্গ শিশু যেমন মেঝেতে খেলনা ছড়িয়ে একা একা খেলে তেমনি দ্বিতীয় শৈশবে আমায় মজিয়ে রাখে অবান্তর শব্দক্রীড়া।সেদিন ঐ খাটে শুয়ে দিবাস্বপ্নে বসে ছিলাম স্বর্গের উদ‍্যানে। সবুজ লনে বিশাল শিরীষের ছায়ায় কয়েকটি বেঞ্চ। সেখানে অতীতের কিছু মহান সাহিত‍্যিক গল্প করছেন। এই রম‍্য পুনশ্চে তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় নেই। তবু ভেবে নিলাম চারটি কল্পিত চরিত্র। আলোচনা হচ্ছিল নিম্নরূপ:    *********************************মধ‍্য পঞ্চাশের বক্রেন্দু চক্রবর্তী পায়চারি করতে করতে গম্ভীর স্বরে স্বগোতোক্তি করেন, এযুগে মর্তের কিছু মূঢ় মানবের মনোবাসনা অনুধাবন দূর্বোধ‍্য হ‌ইয়া উঠিতেছে।তাঁর থেকে তিন বছর পরে মর্তে ল‍্যান্ড করে মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে নন্দনকাননে মাইগ্ৰেট করেছেন ফাজিল যুবক তারাপ্রসন্ন সিনহা। তিনি বক্রেন্দু বাবু‌কে বলেন, বাঁকাদা, এখানে‌ও সাধুভাষায় কথা না বললে‌ই নয়? এখানে সুন্দরী অপ্সরাদের মুখে‌ও অনর্গল দেবভাষা শুনে কান পচে গেছে। একটু বিশ্রম্ভালাপ করবো তার‌ উপায় নেই। মর্তে সহজ ভাষায় সংস্কৃত মহাকাব‍্য অনুবাদের উদ‍্যোগ নিলেও দেবভাষায় সিডাকশনের ফান্ডা আমার অজানা। আপনি নীচে জজগিরির অবসরে‌ই যা লিখে এসেছেন তার গুঁতোতে‌‌ই কিছু ডেন্টিস্ট করে খেয়েছে। সোজাসুজি বলুন না দাদা, চাপটা কিসের?আপদলম্বিত আলখাল্লা পরে পায়চারী করছিলেন দীর্ঘদেহী আচার্য‌সদৃশ সৌম‍্য বৃদ্ধ - সূর্যনারায়ন শর্বদেব। আবক্ষ বিস্তৃত শ্মশ্রুতে হাত বুলিয়ে তিনি বক্রেন্দুবাবুকে বলেন, আসিয়া মোরা উরধ গগনে ত‍্যাগিয়া ধরায় সকল দ্বেষহেথায় হেরিয়া অসীম শান্তি ছিলেম ভুলিয়া সকল ক্লেশএখন এ কোন তুচ্ছ পীড়ায়তব মনে ছায় বিষাদ রেশ?যুবক (স্বর্গে আসার পর কারুর আর বয়স বাড়ে না, সেটা‌ই দস্তূর) তারাপ্রসন্ন হাঁসফাঁস করে বলেন, সূর্য‌দাদু, তোমার সাধারণ কথাও হাজিরকাব‍্য করে বলার চিরকেলে অভ‍্যাস। এসো না আমরা মর্তের স্বকীয় সাহিত‍্যচর্চার ভাষা ছেড়ে এখানে সোজা সাপটা ভাষায় কথা বলি।শ্মশ্রুগুম্ফহীন ধারালো মুখ, একমাথা পক্ককেশ, রেলস্টেশনে সাঁটা সময়সারণীর মতো মুখভাবে স্থায়ী বিষন্নতা। নাম তাঁর শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়। তূষের চাদর গায়ে চুপ করে বসেছিলেন। অনেক ওপরে বলে স্বর্গে ঝকঝকে সকালে‌ও বারোমাস শীত। জীবদ্দশায় তিনি‌ সহজ ভাষায় গদ‍্যচর্চা করেছেন। তিনি তারুর কথায় সায় দিতে বাকি দুজনে‌ও সম্মতি জানালেন। উৎফুল্ল মুখে তারু বলেন, এবার বলুন তো বাঁকাদা, কেস‌টা কি?তবলার বিড়ের মতো ডোরাকাটা পাগড়ি‌টা একটু হেলে গেছিল। সেটা ঠিক করে বক্রেন্দুবাবু বলেন, তারু তোমায় কতোবার বলেছি আমায় বাঁকাদা বলবে না, এই শেষবার বলছি,  নাহলে কিন্তু...তারু লজ্জিত হয়ে বলেন, আচ্ছা, এবার থেকে ইন্দুদা বলবো। কিন্তু “নাহলে কিন্তু” বলে কি বলতে চাইছিলেন? নীচে ব্রিটিশ আমলে তো পান থেকে চূণ খসলে জজ ম‍্যাজিস্ট্রেটরা লোকজনকে জেলে পাঠাতো। এখানে‌‌ও কি আপনি আদালত‌হীন বিচারক অবমাননার দায়ে আমায় শাস্তি দেবেন?আরে না, না, সে যুগ‌ আর নেই। এখন তো নীচে সর্বোচ্চ আদালতের রায়‌ও পছন্দ না হলে লোকজন প্রখর সমালোচনা করে। ব্রিটিশ‌রাজে জজগিরির গুমোর আর নেই। আমি বলতে চাইছিলাম নাহলে কিন্তু আমি আর তোমার সাথে কথাই বলবো না।আচ্ছা ঠিক আছে, রাগ করবেন না। এখন বলুন না, হয়েছেটা কি?জানো তারু, একদা আমি মর্তে সাধুভাষায় এক বিশেষ বাংলা গদ‍্যরীতি‌র প্রচলন করেছিলাম। মানছি আমার আঙ্গিক ছিল আলংকারিক‌। আমার লেখা এখন আর অনেকেই পড়ে না। তবু কিছু প্রকৃত সাহিত‍্যরসিক আমায় বাংলা উপন‍্যাসের জনক বলে মানে। কিন্তু কার্তিক নামক এক অর্বাচীন, শখের লেখালেখি করে। সে‌ও দেখি সাধুভাষায় আমার শৈলী অনুকরন করতে গেছে। আর তা ক‍রতে গিয়ে, প্রকৃত জ্ঞান না থাকলে যা হয়, তাই হয়েছে। অজগরের মতো লম্বা প‍্যাঁচালো বাক‍্যবিন‍্যাস করেছে। আমি এই ঐতিহ্য রেখে এলাম মর্তে? এহেন ধৃষ্টতা কি সহ‍্য করা যায়? অর্বাচীন কার্তিকের ধৃষ্টতায় মর্মাহত ইন্দুবাবুর হাঁচি, কাশি, হেঁচকি, হাই, দীর্ঘশ্বাস, ঢেঁকুর উপর্যুপরি হতে, উঠতে বা পড়তে লাগলো। তারু দ্রুত তাম্রপাত্রে জল এনে (ইন্দ্রের ফরমানে স্বর্গে প্লাস্টিক অচল) ইন্দুদাকে দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন, জল খান, জল খান।ইন্দুবাবু কিঞ্চিৎ সুস্থ বোধ করতে সূর্যবাবু বলেন, আপনার আঙ্গিকে আজকের দিনে রচনা সহজ নয়। কার্তিকের মতো অর্বাচীন ছেলে ছোকড়া তার একটু হনুকরন করতে পারে মাত্র। এতে মর্মপীড়ার কোনো কারণ দেখি না। উপেক্ষা‌ই এক্ষেত্রে কাম‍্য।সূর্য‌বাবু, কার্তিক ছোকড়া নয়, প্রবীণ। ছাত্রজীবনে সে ব‍্যাকরণ পড়েনি। বাংলায় পেয়েছে ৩৭%, আর সে কিনা শখ করে আমায় নকল করতে যায়। অমন শখের ক‍্যাঁতায় আগুন।মর্তে তাঁর নামের আগে ঋষি লেখা হতো। কিন্তু মর্মপীড়ায় তাঁর ভাষ‍্যে প্রাকৃত ভঙ্গিতে প্রকৃত মর্মবেদনা ফুটে বেরিয়েছে। পরক্ষণেই কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ‌ হয়ে সামলে নিয়েছেন।  সূর্য‌বাবু বলেন, শান্ত হোন। বৃথা কষ্ট পাবেন না। এসব‌ কালের অমোঘ লিখন। যুগধর্ম। আমার কথাই ধরুন। এখানে চলে আসার পর আমার সব রচনা সরকার সাতাশ খন্ডে আঠারো হাজার ছশো পাতায় ছাপলেন। কিন্ত কী লাভ হলো? ছৌ মুখোশের মতো ঘর সাজাতে সূর্য রচনাবলী‌ও সংস্কৃতিমনস্কতার পরিচায়ক। তাই ড্রয়িং‌রুমে বুককেসে শোভা পায়। কিন্তু পড়ে কজন? তাই তো আমি মর্তে‌ই লিখেছিলাম:যখন পড়বে না মোর গল্প গাথা কেউ পরেতবে জন্ম দিনে আসবে তারা ছল করে সেথায় গাইবে নানা সূর্য‌গীতি ভুল সুরেআমার স্থাপিত তালপুর ‘প্রশান্তি নিলয়’ আশ্রম মহাবিদ্যালয়ের কিছু লবঙ্গ‌লতিকা‌সদৃশ মেয়ে আজ‌ও আমার ‘অন্তিম পদ‍্য’ অনুসরণে সুমিতকে ‘সুমিতো’ উচ্চারণ করে দয়িতকে প্রেম নিবেদন করে। তবে ওসব ঐ তালপুরে‌ই চলে। কলকাতার কালচার অন‍্য। তুই তোকারি করা -  বীয়ার হাগ দেওয়া -  হটপ‍্যান্ট পরে বিড়িফোঁকা মেয়েরা ওসব বলে না। তবে যখন দেখি রাত্রিবেলা‌ও মঞ্চে কালোচশমা পরে, ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে, AK47 এর মতো গীটার নাচিয়ে, স্ট‍্যান্ড থেকে মাইক্রোফোন উপড়ে আমার‌ গান জগঝম্প স্টাইলে গাইছে তখন অদ্ভুত লাগে। শুনলাম এমন রক শৈলী‌র Gunকে নাকি বলে ‘সূর্যালো ফিউসন’। বেশ অর্থবহ নাম। মূল থেকে সরা সুর, উজ্জ্বল নাচুনে আলো, উদ্দাম চিৎকার - মনে হয় রক‌ ছোঁড়াছুঁড়ি‌ই হচ্ছে। ফিউশন টিউশন আমাদের কালে ছিল না বলে বুঝি‌ না। ওপর থেকে দেখে লাগলো - টোটাল কনফিউশন‌। তবু আমি কিছু মনে করি না। কেন জানেন? এসব যুগধর্ম। কেউ খন্ডাতে পারবে না।ইন্দুবাবু বললেন, আপনি এক জীবনে অতলান্তিক সাহিত্য‌চর্চা ছাড়াও আরো এতো কিছু করেছেন যা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। মর্তের মানুষ আজ‌ও আপনার টাইম ম‍্যানেজমেন্ট নিয়ে গবেষণা করে। বার্মিংহাম অফ দ‍্য ইস্টের নানা নামী কারখানা যখন একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন‌ও আপনি বাংলায় ‘ওয়ান ম‍্যান ইন্ডাস্ট্রি’। বহু মানুষ আপনাকে ভাঙ্গিয়ে খাচ্ছে। এমন ডিউরেবল ব্র‍্যান্ড বাঙালি সহজে ভুলবে না নিজে‌র গরজে। সূদুর ভবিষ্যতে‌ও মর্তে আপনার আসন পাকা।  যদি কিছু মনে না করেন তো একটা ব‍্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুলি? সূর্যবাবু বলেন, বিখ‍্যাত মানুষের ব‍্যক্তিগত বলে কিছু হয় না। প্রিয়জনের সাথে নিভৃত আলাপচারিতা বা চিঠিপত্রে প্রকাশিত মনোভাব‌ও সূর্য‌গবেষকরা প‍্যাঁটরা হাঁটকে, সাক্ষাৎ‌কার নিয়ে খুঁজে বার করেছে।  তা নিয়ে কাগজে, পত্রিকায়, গ্ৰন্থে, টিভিতে, সমাজমাধ‍্যমে কাটাছেঁড়া করেছে। এসব খ‍্যাতি‌র বিড়ম্বনা। মর্তে রবি ঠাকুরের একটি গান মনে পড়ছে। গান তো নয়, যেন হৃদ‍য় নিংড়ানো আকুতি, একটু গাইবো? ইন্দু‌বাবু বোঝেন সূর্য‌বাবু একটু আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছে‌ন, তাই সাগ্ৰহে বললেন, নিশ্চ‌ই গান না, আমরাও শুনি।সূর্য‌বাবু চোখ বুঁজে তন্ময় ভাবে ধরলেন:নিভৃত প্রাণের দেবতা  যেখানে জাগেন একা,ভক্ত, সেথায় খোলো দ্বার আজ লব তাঁর দেখা।সারাদিন শুধু বাহিরে ঘুরে ঘুরে কারে চাহি রে,সন্ধ্যা‌বেলার আরতি হয় নি আমার শেখা।তব জীবনের আলোতে জীবনপ্রদীপ জ্বালিহে পূজারি, আজ নিভৃতে সাজাব আমার থালি।যেথা নিখিলের সাধনা পূজালোক করে রচনাসেথায় আমি‌ও ধরিব একটি জ‍্যোতির রেখা।সেই প্রার্থনা সংগীতের কথা, সুর, গায়কী‌র মাধূর্যে স্বর্গের মনোরম সকালে‌ও সবাই স্তব্ধ‌বাক। লঘুচিত্তের তারুর চোখ দিয়ে‌ও গড়িয়ে পড়ছে  অশ্রু। শরদিন্দু‌বাবু চাদরে চোখ মুছছেন। ইন্দুবাবু তাকিয়ে আকাশপানে। সূর্য‌বাবু মর্তে প্রিয় সন্তান‌কে শ্মশানে দাহ করে এসে‌ পূর্বনির্ধারিত সভায় যোগ দিয়ে বক্তব‍্য রেখেছেন। মর্তে তাঁর কর্তব্যজ্ঞান ও নশ্বরতাবোধের দার্শনিক প্রজ্ঞায় লালিত নির্লিপ্ততা কিংবদন্তি‌প্রায়। স্বর্গে সেই মুখোশ পরার প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই কখনো একটু আবেগের প্রকাশ হয়ে যায়। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলেন, আচ্ছা  আপনি কি বলছি‌লেন যেন?আপনার বৌদি ভারতী দেবী সম্পর্কে। আমরা শুনেছি আপনাদের মধ‍্যে প্রীতির সম্পর্ক ছিল। তাঁর আত্মহত্যার কারণ যাই হোক, সেটা আপনাদের পারিবারিক ব‍্যাপার। তবু মনোরঞ্জন বটব‍্যাল নামক এক চলচ্চিত্র সমালোচক কাম টিভি সঞ্চালক ঐ প্রসঙ্গে ‘ভারতী দেবীর শেষ পত্র’ শিরোনামে একটি ব‌ই লিখে তাতে নানা কাল্পনিক মেলোড্রামাটিক গালগল্প ফাঁদলেন কেন? ঋষিসূলভ অবিচলতায় সূর্য‌বাবু বলেন, প্রসঙ্গটি স্পর্শকাতর। তবু সত‍্যভাষন করছি। দেখুন নারী পুরুষের সম্পর্ক জটিল দৈবিক রসায়ন। তার চর্চা আপনার উপন্যাসে‌ও এসেছে। এই সম্পর্ক যে কোনো নিয়ম, নীতি, হিসাবের গণ্ডিতে বাঁধা থাকে না তা আমরা এখানে দেবতাদের মধ‍্যেও দেখছি। বৌদিকে আমি খুব ভালোবাসতাম। তিনি তার যোগ‍্যা। আমার থেকে মাত্র দু বছরের বড়। তাই সখার মত‌ সম্পর্ক ছিল আমাদের।  আমার লেখার প্রথম পাঠিকা ছিলেন তিনি। তাঁর কাছে পেয়েছি নানা পরামর্শ, সৃজনশীল অনুপ্রেরণা। লেখকের কাছে বৌদ্ধিক পাঠকের সুচিন্তিত মতামতের গুরুত্ব আপনি‌ও লেখক হিসেবে নিশ্চিত বোঝেন। ইন্দুবাবু নীরবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।কাব‍্যচর্চা‌র মোহে তখন আমার মন মানব সম্পর্কে‌র নানা আলোছায়াময় প্রাঙ্গনে আবিস্কারের নেশায় ঘোরাফেরা করছে। তখন ওনার নারীত্বের মাধূর্য, আচরণের কমনীয়‌তা, স্বামী সঙ্গহীনতার একাকীত্ব, অনায়াস নৈকট‍্য, আমার চব্বিশ বসন্তের বয়সধর্ম - এহেন নানা অণুঘটক প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে কিভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলেছে তা আমরা সজ্ঞানে অনুধাবন করতে পারিনি। আমার বিবাহের অনতিপরে উনি আত্মঘাতী হতে আমি‌ নিদারুণ মানসিক আঘাত পেয়েছিলাম। আমি জানিনা কি কারণে  উনি ঐ চরম পথ বেছে নিলেন। আমার বিবাহের ফলে ওনাকে আগের মতো সাহচর্য দিতে পারিনি। ক্রমশ বহির্জগতে আমার ক্রমবর্ধমান পদার্পনের ফলে উনি পুনরায় নিঃসঙ্গ বোধ ক‍রতে শুরু করেছিলেন। তখন তাঁর একটি সন্তান থাকলে হয়তো মাতৃত্বের আনন্দে খুঁজে পেতেন বেঁচে থাকার সার্থকতা। তাহলে হয়তো তিনি ঐ চরমপন্থা অবলম্বন করতেন না।লেখিকা আনাই নিন তাঁর অতি অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা, অনুভূতি প্রকাশ করে বলেছিলেন "The role of a writer is not to say what we all can say, but what we are unable to say." এটা ওনার অভিমত। আমার অভিমত, কেউ নিজে প্রকাশ করতে না চাইলে, কারুর একান্ত ব‍্যক্তিগত প্রসঙ্গ, অনুভব বিপণন‌যোগ‍্য নয়। তাই বৌদির যে চিঠি, ডায়েরি‌ পাওয়া যায়নি সেই নাম দিয়ে একটি ব‌ই লিখে তাতে উপন‍্যাসের আঙ্গিকে কল্পনার জাল বোনা আমার অমানবিক লেগেছে। মৃত মানুষের সম্মান রক্ষার্থে এমন কল্পিত আখ‍্যান না লেখা‌ই উচিত ছিল।সেই তুলনায় দূর্বলভাবে আপনার আঙ্গিক অনুকরণ করে কার্তিকের সাধু ভাষায় কিছু লিখতে চাওয়া নির্দোষ প্রয়াস। তার জন‍্য আপনার বিমর্ষ হ‌ওয়া উচিত নয়। তাহলে আমার জায়গায় থাকলে আপনার কেমন লাগতো?তারু‌ বলেন, ইন্দুদা আপনাকে কেউ নকল করতে চাইছে মানে তো লোকে আপনাকে মনে রেখেছে। এতে তো আপনার কিছু মনে করা উচিত নয়। আমাকে‌‌ দেখুন। আমি ‘তোতাপাখির তামাশা’ নামে কথ‍্য ভাষায় - বলচে, কচ্চে, করে কিছু নকশাবাজি করেছিলাম। এখন কী আর কেউ ওভাবে লেখে? আমি আপনার থেকে প্রায় সিকি শতাব্দী আগে এখানে চলে না এসে মর্তে আরো অনেকদিন থাকলে হয়তো আপনার প্রভাবে আমি‌ও সাধু ভাষায় লিখতে যেতাম।ইন্দু‌বাবু বললেন, না হে তারু, সাহিত‍্যচর্চা করতে সবাইকে যে এক‌ই ঘাটে জল খেতে হবে তার কোনো মানে নেই। যে যার মতো লিখবে। নাহলে তো সবাই ঝাঁকের ক‌ই হয়ে যাবে। তাতে বৈচিত্র্য থাকবে না। দীর্ঘজীবী হলে‌ই যে সাহিত্য‌চর্চার মান‌ বাড়বে তার‌ কোনো মানে নেই। অনেকের‌ লেখাতে পরে বয়সের ছাপ পড়ে যায়। শ্রীকুমার মাত্র ছত্রিশ বছরে এখানে চলে এলো। কিন্তু ঐটুকু সময়ে যে অনন‍্য ধারার সাহিত‍্যসৃষ্টি সে করে এলো, তার আবেদন আজ‌ও অমলিন।তারু প্রফুল্ল মনে বলে, সত‍্যি বলতে কি ইন্দু‌দা এতো তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়েছিল বলে তখন বেশ  খারাপ‌ই লেগেছিল। আর কিছুদিন বাঁচলে মর্তে আর একটু তামাশা করা যেতো। কিন্তু আজ আপনার সাট্টিপিটি পেয়ে বেশ লাগলো। আমাদের শরদিন্দুবাবুকে‌ই দেখুন। আজ না হয় মর্তে "আমি‌ও" আন্দোলন করে নানা হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু অতীতেও তো মেয়েদের ওপর অনেক অত‍্যাচার, অবিচার হয়েছিল। তবু তখন তাদের এমন আন্দোলন করার উপায় ছিল‌না। তখন শরদিন্দু‌দা পথের দাবী মিটিয়ে, চরিত্রে কলঙ্কের পরোয়া না করে অসহায় নারীদের চোখের জল তাঁর লেখার কাগজে মুছেছেন। আজ তা‍ঁর লেখা‌ও বিশেষ কেউ পড়ে বলে মনে হয় না। যাদের কথা এতো লিখেছেন সেই মেয়েরা‌ও বোধহয় না।স্বর্গের ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্টের ঘন্টা পড়লো। রম্ভা, মেনকা, উর্বশী‌ প্রসাধন করে, রেশমি ঘাগরা, চূমকী বসানো কাঁচূলী পরে, খোঁপায় পারিজাত গুঁজে সবাইকে রিনরিনে কণ্ঠে খেতে ডাকছে। সেদিকে তাকিয়ে তারু বয়সধর্মে একটু উচাটন হয়ে পড়লো। তার আর সাহিত্য আলোচনা‌য় মন নেই। তবে নানা সভায় সভাপতি‌ত্ব করে, আশ্রমে আচার্য‌গিরি করে সূর্যনারায়ন শর্বদেব আলোচনা অসমাপ্ত রেখে খেতে যাওয়ার পক্ষপাতী নন। তিনি গলা খাঁকড়ে তারুর মনযোগ পুনরায় এদিকে আকর্ষণ করে ছোট্ট সমাপ্তি ভাষণ দিলেন।বললেন, আজ সকালে‌ আমাদের আলোচনা শুরু হয়েছিল ইন্দু‌বাবুর মৃদু ক্ষুব্ধ মন্তব্য দিয়ে। পরে নানা আলোচনা‌য় আমরা অনুধাবন করলাম সাহিত‍্যসৃষ্টি নিয়ে আমাদের যত‌ই আত্মগরিমা থাকুক, কালের নিয়মে তার অভিঘাত অধিকাংশের কাছে ক্ষীণ হয়ে যেতেই পারে। তাতে মর্মাহত হ‌ওয়া‌র কিছু নেই। ধীমান মানুষ চিরকাল সংখ্যালঘু। তবু তাদের চর্চার মাধ‍্যমে‌ই ললিতকলা বেঁচে থাকে। তার সাথে যদি কার্তিকের মতো কিছু অর্বাচীন‌ মাতৃভাষা চর্চার আনন্দে ইন্দু‌বাবুর শৈলী অনুকরণের অক্ষম প্রয়াস করে - তাতে ক্ষতি কী? অধিকাংশ মর্তের মানুষের যখন আজকাল প্রয়োজন ছাড়া লেখার অভ‍্যাস চলে যাচ্ছে তখন প্রকৃত জ্ঞানী লেখকের সাথে কার্তিকের মতো কেউ যদি শখের লেখালেখি‌ও করে, তাতে‌ তো আমাদের খুশি হবার‌ই কথা। তাই না? সূর্য‌বাবুর এহেন গোছালো বক্তব‍্যে তিনজন একবাক‍্যে সম্মত হলেন। তার‌পর সবাই চললেন প্রাতরাশ করতে। আমি‌ও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শোনা সেই আলোচনা খাট থেকে উঠে, মুখেচোখে জল দিয়ে, ভুলে যাওয়ায় আগে লিখে ফেললাম।
  • জনতার খেরোর খাতা...
    একদিন, বৈজয়ন্তী  - Aritra De | একদিন, বৈজয়ন্তী- - - - - - - - -৩১-০১-২০২৪যাবতীয় বৃক্ষের কাছে ফিরে এসেছি খালি হাতেফুলফল অথবা বীজ নয়, অন্য কোনো প্রত্যাশায় বৈজয়ন্তী, একদিন তোমার চোখের কাছে নিচু হয়েবসে থাকবো সারাটা দিন আর হাওয়ায় উড়ে যাবেতোমার চুলনখঠোঁটকানবৃষ্টির শেষে তোমাকে ডেকে নেব ঘন মেঘের ভিতরএরপর চূড়ান্ত বাষ্পের মতোফুরিয়ে যাবে আমাদের সময়আমাদের নিজস্ব নদী ফুরিয়ে যাবেএইসব জগঝম্প শেষ হলেগানের স্কুলের শেষে উঠবে নিচু চাঁদ একদিন হলুদ ট্যাক্সিআমাদেরকে আর কোথাও নামিয়ে দিয়ে যাবে না একদিন মাথায় ভায়োলিন বেঁধে শুয়ে থাকবো আমি একদিন, বৈজয়ন্তী, তোমার চোখের কাছে নিচু হয়ে...
    জীবন তরঙ্গ  পর্ব ৩৫ - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ  পর্ব ৩৫নয়নের কোলকাতাতেই পোস্টিং। জয়েন করার জন্য কোন সময় লেখা ছিল না। নয়ন বাবার সাথেই   খাওয়া দাওয়া করে ট্রেন ধরল। দশটা বাজার কিছু আগেই অফিসে পৌঁছে গেল। সরকারি দফতর হলেও মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। লোকজন তখনো আসেনি। মেন গেট থেকে একটু ভেতরে ঢুকে দেখে একজন মেঝে মুছছে। নয়নকে দেখে এগিয়ে এসে জানতে চাইল কি চায়। নয়ন নতুন জয়েন করবে শুনে সামনে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল—আপনি এখানে একটু বসুন, আমি এই দিকটা  মুছে নিয়ে আসছি।কাজ শেষ হলে  নয়নের সামনে এসে বলল—আমার নাম রত্নাকর সাহু, আমি এখানে সুইপারের কাজ করি। চলুন, আপনাকে হরেন বাবু যেখানে বসেন নিয়ে যাই। উনিই নতুন জয়েনের কেসগুলো দেখেন।রত্নাকর নয়নকে দোতলায় হরেনবাবুর টেবিলের সামনে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল—এখানে  বসুন, উনি একটু বাদেই এসে যাবেন।  দশটা দশ নাগাদ এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক নয়নের সামনের টেবিলে এসে বসলেন।নয়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—কি চাই?নয়ন বিনয়ের সঙ্গে বলল—আজ্ঞে আমি এই অফিসে জয়েন করতে এসেছি।--ক্লেরিকাল না সাবোর্ডিনেট স্টাফ?--আমি ডবলিউ বি সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছি।লোকটার হাবভাবই পাল্টে গেল।--কিছু মনে করবেন না ভাই। আসলে আমাদের এই অফিসে এখন বেশ কিছু নতুন ক্লেরিকাল আর সাাবোর্ডিনেট স্টাফ জয়েন করছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।--নানা মনে করার কি আছে।--আপনি মিস্টার নয়ন দে?--আজ্ঞে হ্যাঁ।নয়ন নিয়োগপত্রটা হরেন বাবুর দিকে এগিয়ে দিল। এর মধ্যে নয়নের জন্য চা এসে গেল। দু একটা কাগজপত্রে সই সাবুদ করাবার পর, হরেন বাবু নয়নকে নিয়ে তিন তলায় যে  ডিপার্টমেন্টে ওর জয়েন করার কথা, সেখানে পৌঁছে দিয়ে এলেন।ডিপার্টমেন্টের বস অভিজিৎ সামন্ত ঘরে  ছিলেন না।হরেন বাবু নয়নকে সামন্ত স্যারের চেম্বারে বসিয়ে বললেন—স্যার মনে হয় অন্য কোন ডিপার্টমেন্টে গেছেন। আপনি এখানে বসুন।একটু পরে বছর পঁয়তাল্লিশের দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে নয়নের সামনে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। নয়ন আন্দাজ করে উঠে দাঁড়িয়েছিল।গম্ভীর গলা ভেসে এল—বস। নয়ন দে, তাই ত?--আজ্ঞে হ্যাঁ।--কোথায় থাকা হয়?--আজ্ঞে রহড়ায়।-- এই ফর্মগুলো এক এক করে ভরো। কাছে পেন আছে?--আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।--তিনবার হয়ে গেছে, আর ব্যবহার না করলেই খুশি হব।--কি স্যার?--‘আজ্ঞে’ শব্দটা।  বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া করে এসেছ, নাকি প্রথম দিন বলে না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছ?--ভাত খেয়ে এসেছি স্যার। -গুড।নয়ন ফর্ম ভরা শুরু করল। অনেক কটা ছিল, একটু সময় লাগল।  লেখালিখি শেষ হওয়ার পর ওগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে অভিজিৎ সামন্ত অফিসের কাজকর্মের ধরণ ধারণ নিয়ে  মুল্যবান কিছু পরামর্শ দিলেন। ইতিমধ্যে চা এসে গেছে। নয়ন এত ঘন ঘন চা খায় না, কিন্তু না করার সাধ্য নেই। চা খাওয়ার পর সামন্ত স্যার নয়নকে সাথে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে ডিপার্টমেন্টে এলেন।  মোটামুটি বড় ঘর, দশ বার জনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তখন ভরা অফিস। দু একটা বাদে সব টেবিলেই লোক রয়েছে।সামন্ত স্যার গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন—ইনি নয়ন দে, এই  ডিপার্টমেন্টের জুনিয়ার অফিসার, আজকেই জয়েন করেছেন। রমেনবাবু, আপনি এঁকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।কথাগুলো শেষ করে সামন্ত স্যার নিজের চেম্বারে ফিরে গেলেন। রমেন বাবু নিজের পরিচয় সেরে নিয়ে এক এক করে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্ব সারা হলে আমাকে আমার বসার জায়গায় নিয়ে এলেন। রমেন বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে নয়ন নিজের চেয়ারে এসে বসল।  গদি লাগান চেয়ার, বিরাট টেবিল, টেবিলের ওপর টেলিফোন,  সে এক অনির্বচনীয় তৃপ্তি। টেবিলে বসেই নয়নের মনে পড়ল ঈজার খচ্চর মামাটার কথাগুলো....বেকার, ভ্যাগাবন্ড, জেনারাল লাইনে পড়ে কিচ্ছু হবে না। কোনদিন দেখতে পেলে বলবে—আয় শালা দেখে যা, কিছু হয়েছি কিনা। শকুনের সাপে গরু মরে নারে শালা।  রমেনবাবু মানুষটা ভাল। অনেক সিনিয়র। কাজকর্ম সব একটু একটু করে কয়েকদিনে বুঝিয়ে  দিলেন। ওনার কাছেই নয়ন জানল যে, ডিপার্টমেন্টে অভিজিৎ সামন্ত  আর ও, এই দুজন  অফিসার।  এখানে আগে একজন ছিলেন, তিনি অন্যত্র  বদলি হয়ে যাওয়ার পর মাস দুয়েক টেবিলটা ফাঁকাই ছিল।সামন্ত স্যারকে  প্রথমদিকে রাগী ধরণের অফিসার মনে হত। চাকরিতে জুনিয়ার অফিসার হিসেবে জয়েন করার কয়েক  মাস পরেই একদিন নয়নকে চেম্বারে ডেকে আদেশ দিলেন- কাল থেকে তুমি ডিপার্টমেন্টের অ্যাটেন্ডেন্সটা দেখবে।নয়ন আমতা আমতা করে বলল- স্যার, আমি তো নতুন, এ কাজটা আমি না করলেই নয়!--অফিসার হয়ে ঢুকেছ, দায়িত্ব নিতে শেখ।অগত্যা সব থেকে অপ্রিয় আর অশান্তির কাজটা নয়নের ঘাড়ে চাপল। দু এক দিনের মধ্যেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল। একটা সময়ের পরে লেট মারকিং করতে হত। সেদিনও করেছে। কিছু নিত্য লেটকামারের সাথে ট্রেনের গণ্ডগোলের জন্য অশেষেরও অফিসে আসতে দেরী হয়েছিল। ও রোজই সময়ে আসে। খাতায় দাগ দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে নয়নের সাথে কথা বলল। নয়ন  ওকে সামন্ত স্যারের সাথে দেখা করতে বললে ও কোন কথা না শুনে হনহন করে অফিস থেকে বেরিয়ে চলে গেল। সময়ের সাথে সাথে নয়ন অফিসের হাল হকিকতের সঙ্গে ধীরে  ধীরে পরিচিত হয়ে গেল। শিখল কোন পরিস্থিতি কিভাবে সামলাতে হবে, কোন সমস্যা কিভাবে মেটাতে হবে। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের পর্বে সামন্ত স্যারই ছিলেন নয়নের পথপ্রদর্শক।    ঘটনার দু এক দিন পরে ওর সেদিনের আচরণের জন্য অশেষ নয়নের কাছে এসে দুঃখপ্রকাশ করেছিল। সেদিন থেকেই অশেষের সাথে একটা মধুর  সম্পর্ক গড়ে ওঠে।  কাজ করতে করতে ব্যবহারের গুণে কেবল অশেষই নয়, অন্য সহকর্মীদের সাথেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠল।অফিসে জয়েন করার ঠিক বারো দিনের মাথায় ঘটল নয়নের জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনা।  সেদিন অফিসে আসার কিছুটা পরে নয়ন দেখে, ঈজার মামা ওদের অফিসে ঢুকে কোনার দিকে  একটা টেবিলে গিয়ে বসল। নয়নকে তখনো দেখতে পাইনি। লোকটাকে দেখিয়ে নয়ন অশেষকে জিজ্ঞেস করল—উনি কি কারো সাথে দেখা করতে  এসেছেন?অশেষ হেসে বলল—নানা, উনি কুণাল বাবু। কয়েক দিন ছুটিতে ছিলেন, আজ জয়েন করেছে্ন।জিজ্ঞেস করলাম—লোকটা কেমন?-- ব্যাচেলার লোক। বিয়ে থা না করলে সাধারণত যেমন হয়, রসকষহীন। দাঁড়ান, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।অশেষ পরিচয় করাবার সময় কুণাল নয়নকে দেখে চমকে উঠল। অশেষের নজর এড়ায়নি।জিজ্ঞেস করল—কুণাল বাবু বাবু কি স্যারকে চেনেন নাকি?-- হ্যাঁ, না মানে হঠাৎ  মনে হয়েছিল।  কোন রকমে পরিচয় সেরেই কুণাল চলে গেল। একেই বলে বিধাতার পরিহাস। যাকে নিজের চাকরির আভিজাত্য দেখিয়ে সবথেকে বেশী তৃপ্তি পাবে, সেই আজ নয়নের অধস্তন কর্মচারী।   দুপুরবেলা কুণাল কতগুলো ফাইল নয়নকে দেখাতে এল। আশেপাশে কেউ নেই দেখে খুব  আস্তে করে জিজ্ঞেস করল—ভাল আছ ভাই?নয়ন  বেশ রুঢ়ভাবে বলল—আপনার অপমানকর কথাগুলো আমি ভুলিনি। চেষ্টা থাকলে জেনারাল লাইনে পড়াশোনা করেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। একটা কথা আপনাকে পরিষ্কার করে জানিয়ে রাখছি। অফিসে যে সম্পর্ক আমাদের  দুজনের চেয়ারের মধ্যে হওয়া  উচিৎ সেটা মেন্টেন করার চেষ্টা করবেন। আগে যা করেছেন করেছেন, এখন থেকে আমার ব্যক্তিগত জীবনে সামান্যতম উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। আর অফিসের কাজ ছাড়া অন্য কোন কথা আমার সাথে বলার চেষ্টা করবেন না। সেই বেকার, ভ্যাগাবন্ড, কিন্তু এখন আপনার অফিসার এটা সবসময় মনে রাখবেন।সবটা শোনার পর, কোন উত্তর না দিয়ে, কুণাল  মাথা নিচু করে চলে গেল।  মনের মত করে  অনেকটা  উগরোতে পেরে নয়নের ভেতরটা জুড়িয়ে গেল। এর পর থেকে কুণাল খুব গুটিয়ে থাকত আর নয়নের নির্দেশগুলোও যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করত।  চলবে
    জীবন তরঙ্গ  পর্ব ৩৪  - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ  পর্ব ৩৪বুড়োদার চায়ের দোকানে দুজন মাঝবয়সী লোক মাঝে মাঝে এসে বসত। একজন কানু দা আর  অন্যজন হলেন হরিদা। কিছু কিছু লোককে অনেক সময় পরিচিতজনেরা সন্তর্পণে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। সব সময় না হলেও বিশেষ কিছু সময়ে তো বটেই। এঁরা হলেন সেই ক্যাটাগরির লোক। কানুদাকে ভাল মানুষ আখ্যা দেওয়া না গেলেও হরিদা কিন্তু নিপাট ভাল মানুষ ছিল। তবু কেন জানিনা পরিচিত জনের কাছে এরা দুজনেই ছিলেন অপয়া।  কাকতালীয় ভাবে হয়ত কোন সময় কোথাও এদের আসার পর কোন অঘটন ঘটেছে। একবার অপয়া ছাপ পড়ে গেলে সকলেই একটু সমঝে চলে।এক বৃদ্ধার এখন তখন অবস্থা। ডাক্তার মাসখানেক আগেই জবাব দিয়ে গেছে। প্রস্থান বিন্দুতে দাঁড়িয়ে কেটে যাচ্ছে একটার পর একটা দিন। খবর পেয়ে কানুদা মাসিকে একবার দেখতে  এসেছে।  ঘরে ঢুকে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রায় কোমায় থাকা বৃদ্ধা অস্ফুট স্বরে একবার ‘কানু” বলে ডেকেই নেতিয়ে পড়লেন। বৃদ্ধা যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি পেলেন, বাড়ির লোকেরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যা হল তা ভালই হল। কিন্তু খবরটা কানে কানে চারিদিকে ছড়িয়ে যেতে, রুগী আছে এমন বাড়িতে কানুদার ‘নোএন্ট্রি’ হয়ে গেল। অবশ্য এর  পরেও তাঁর উপস্থিতিতে ঘটেছে নানান বিচিত্র ঘটনা।কমল সোদপুরে থাকলেও ছুটি ছাটার দিনে নয়নদের আড্ডায় আসে। কমল আর জগাই ট্রামে   চেপে  অফিস যাচ্ছে। দুজনেরই অফিস বিবাদী  বাগে। ট্রাম যখন বৌবাজার পার হচ্ছে ওরা  দেখল যে  কানুদাও ওই একই ট্রামে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কমলের একটু খেঞ্জুরে আলাপ করার স্বভাব আছে।  জগাই বার বার  নিষেধ করা সত্ত্বেও  কমল হাঁক দিল—কানুদা  কেমন আছেন? -- আরে কমল যে, কতদিন পর দেখা।আর কথা এগোয়নি। কলেজ স্ট্রিট ক্রসিংটা পার হয়েই নিজের লাইন হেলায় ত্যাগ করে ট্রামের ফার্স্ট ক্লাস ততক্ষণে ফুটপাথে উঠে গেছে। অগত্যা নিষেধ অমান্য করার জন্য বন্ধুর গালমন্দ শুনতে শুনতে বাকি পথটা কমলকে হেঁটেই অফিস  যেতে হল।ঘটনার ধারাবাহিকতা দীর্ঘদিন বজায় থাকায়  এ ব্যাপারে কানুদার কৌলীন্য ছিল সর্বজন স্বীকৃত। হরিদারও এ ব্যাপারে বেশ নাম ছিল। মানুষ হিসেবে কানুদার থেকে ঢের ভাল তবু ছোট, বড়, মাঝারি, নানা ঘটনার পরম্পরায় তাঁকেও অনেকে একটু অন্য চোখে দেখত।   মানুষটা খেলা ভালবাসত। রহড়া সংঘের ফুটবল বা ক্রিকেট যে খেলাই থাক না  কেন খুব কাজ না থাকলে মাঠে চলে যেতেন। কয়েক বার এমন হয়েছে যে উনি মাঠে ঢোকা মাত্র রহড়া  সংঘ গোল খেল বা ক্রিকেট হলে উইকেট পড়ল। অত দর্শকের মধ্যে কে কখন আসছে যাচ্ছে নজরে পড়ার কথাই নয়। হরিদার দুর্ভাগ্য, তা কারো কারো নজরে পড়ে গেছে। উনি খেলা  দেখলে  যে রহড়া সংঘ কখনো জিতত না এমনটা নয়, তবু উনি মাঠে ঢুকলেই একটা আতঙ্ক  ছড়িয়ে পড়ত। বাজারে একবার নাম ফাটলে তা কোন বিশেষ ক্ষেত্রে আবদ্ধ থাকে না, অচিরেই সর্বব্যাপী হয়ে যায়। ফলে পরে কেবল  আর খেলার মাঠ নয়, যে কোন দরকারি কাজে  যাওয়ার সময় হরিদা সামনে পড়ে গেলে অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়ে যেত। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিন। মুনি বাবার সাথে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। গাড়ি আসছে কিনা দেখতে গিয়ে মুনির বাবা দেখে হরিদা আসছে, আর ওদের দিকেই। হয়ে গেল।  লোকটা আর সময় পেল না, একেবারে প্রথম দিনেই। মেজাজটা খিঁচরে গেল। কাছে এসে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে শুনে  মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে গেল। মেয়ে অবশ্য হরিদার  নাম যশের ব্যাপারে কিছু জানত না, তা না হলে বিপদ বাড়ত। অনেক দুশ্চিন্তা নিয়ে ভদ্রলোক মেয়েকে পরীক্ষার সেন্টারে দিয়ে এলেন। বিকেলে মেয়েকে স্কুল থেকে হাসিমুখে বেরোতে দেখে পিতৃদেব নিশ্চিন্ত হলেন। অন্তত একজনের মন থেকে দূর হল এক নিরীহ ভাল মানুষ সম্পর্কে গড়ে ওঠা কিছু বিচিত্র ধারণা। মজার ব্যাপার, পরীক্ষার পরের ক’দিন মুনির বাবা রওনা হবার  আগে মনে মনে একবার হরিদাকে দেখতে চাইতেন।পাড়ায় কেউ মারা গেলে আর কেউ যাক বা না যাক কচিদার মত  হরিদাকে পাওয়া যাবেই। শুধু যাওয়াই নয়, যাওয়া থেকে ফেরা পর্যন্ত সব কাজ সামলে দিতেন। তখন কাঠের চুল্লী,  শবদাহের কাজও নিজের হাতেই করতেন  আর এই ব্যাপারে শ্মশান কর্মীরাও  ওঁকে গুরু মানত। অন্য সময় লোকে পাশ কাটালেও এই সময় অবশ্য হরিদার মত মানুষ হয় না। নয়নদের গ্রুপটা কানুদাকে একেবারেই পছন্দ করত না।  কিন্তু একটু মজা মস্করা করলেও হরিদা ওদের কাছের মানুষ ছিলেন।এম এ পরীক্ষা থাকার জন্য ভালমত প্রিপারেশন নেওয়া হয়নি। তাই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা পার করার পর মেন পরীক্ষাও যে একবারে উৎরে যাবে এটা নয়ন ভাবতে পারেনি। বাকি কেবল পার্সোনালিটি টেস্ট। চৌধুরী পাড়ায় একজন সদ্য চাকরিতে ঢোকা আই এ এস অফিসার ছিলেন। নয়নের খুব পরিচিত। উনি নয়নকে আগ্রহ নিয়ে গাইড করলেন, এ ছাড়া  বইপত্র তো ছিলই। মেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর নয়নের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। ঐ আই এ এস ভদ্রলোক তাতে আর একটু মাত্রা যোগ করে দিলেন।ইন্টারভিউ বোর্ডে চারজন ছিলেন। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে গল্পের স্টাইলে ইন্টারভিউ হল। প্রথমেই ওর নিজের বিষয় ইতিহাসের ওপর কিছু প্রশ্ন হল।  দেশে ও বিদেশে ঘটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা জিজ্ঞাসা করা হল, জানতে চাওয়া হল ওর দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণ। কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নও ছিল। সবকটা প্রশ্নই নয়ন ঠিকমত ব্যাটে বলে করেছিল, অন্তত ও নিজে সন্তুষ্ট ছিল।  ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরল। বিকেলবেলা দীর্ঘ বিরতির পর আড্ডায় যোগ দিল। শোভন খুব উৎসাহের সঙ্গে জানাল—জানিস তো, রজতরা অফিসে বাঁশ খেয়েছে।নয়ন বলল- বন্ধু বাঁশ খেয়েছে, আর তুই সেটা মজা করে বলছিস!--রজত একা নয়, পুরো অফিস খেয়েছে।রজত পাশেই বসেছিল। নয়ন জিজ্ঞেস করল—কি হয়েছে রে?  রজত মজা করে বলতে শুরু করল-- অফিসে খুব দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া চলছে। যাতায়াতের স্বাধীনতা পুরোটাই হরণ করা হয়েছে। একেবারে পুরো দশটা পাঁচটা অফিসে থাকতে হচ্ছে। একটু এদিক ওদিক হলেই বিপদ।নয়ন একটু আশ্চর্য হয়ে বলল—তোর অফিসে এমনটাতো হওয়ার কথা নয়।জানা গেল  নন্দন কাননে এ হেন বিপর্যয়ের কারণ এক গামছাওয়ালা। মাসের প্রথমে ভরা অফিস টাইমে একদিন লোকটি এল গামছা বিক্রি করতে। সেইবারই প্রথম নয়, আগেও অনেকবার  এসেছে। মানুষজন, পরিবেশ, পরিস্থিতি, সব তার চেনা। সামনের বড় বাড়ির  একতলার একটা বড় হলঘরের কোনার দিকে একটা টেবিলে গামছাগুলো সাজিয়ে রেখেছে।  দেখেশুনে দরদাম করে  কর্মচারীরা কিনছে, তাই ওখানটায় একটু জটলা মত হয়ে আছে। হঠাৎ কয়েকটা লোক ওই ঘরে ঢুকল। অপরিচিত  মুখ দেখতে পেয়ে বেচা কেনা একটু  থমকে গেল। কিন্তু সেই লোকগুলো সকলকে আশ্বস্ত  করে নিজেরাও গামছা দেখতে শুরু করায়, আবার ফিরে এল  স্বাভাবিক পরিবেশ। এরপর একজন চিত্রগ্রাহক ঘরে ঢুকে কয়েকটি ছবি  তোলার পর লোকগুলো চলে গেল। আসলে তারা এসেছিল রেল মন্ত্রক থেকে অফিস পরিদর্শনে। ছবিগুলো উর্ধতন  কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছোতেই নেমে এসেছে এই আঘাত। তবে অফিসের সিনিয়রেরা নিশ্চিত যে, এই অশান্তি সাময়িক। অচিরেই এই দুর্যোগ কেটে গিয়ে ফিরে আসবে অফিসের স্বাভাবিক ছন্দ।বেশ কিছুদিন পর নয়ন প্রাণখুলে আড্ডা মারল।প্রায় মাস খানেক পর নয়নদের বাড়িতে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি এল। ব্রাউন রঙের বড় একটা খাম। বাড়িতে তখন আহেলি একাই ছিল। খামের ওপর পাবলিক সার্ভিস কমিশন দেখেই আহেলি আনন্দে লাফিয়ে উঠল। সন্তর্পণে খামটা খুলল। ওয়েস্ট বেঙ্গল ফুড অ্যান্ড সাপ্লায়েস বিভাগে জুনিয়ার অফিসারের নিয়োগপত্র। আনন্দের সাথে আহেলির ছেলের জন্য একটু গর্বও হল। ছেলে এখন গেজেটেড অফিসার। নয়নের বাবাকে অফিসে ফোন করে আনন্দের খবরটা জানিয়ে দিল। নয়ন কোন একটা কাজে কোলকাতায় গিয়েছিল। বিকেলে বাড়ি ফিরে খবরটা জানার পর আনন্দে মাকে তুলে কয়েক  পাক ঘুরে নিল।রাতে এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে গিয়ে হিতাকাঙ্ক্ষী আই এ এস দাদাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এল। আড্ডায় খবরটা পৌঁছতেই হৈ হৈ পড়ে গেল। বুড়োদার দোকানে গিয়ে বড়দের প্রণাম করল। ওখানে শিবুদাও তখন গল্প করছিলেন। শৈশবের হেড মাস্টার শিবুদা ছাত্রের এ হেন সাফল্যে কয়েকশ টাকার মিষ্টি আনিয়ে সকলের মধ্যে বিতরণ করলেন। চাকরির খাওয়াটা  কবজি ডুবিয়ে বড় করে নয়নদের বাড়ির ছাদে হয়েছিল।   চলবে
  • ভাট...
    commentঅরিন | গার্ডিয়ানে নতুন কিছুই সেভাবে অতুলবাবু লেখেননি, অমিত শাহ সম্বন্ধে এই কথাগুলো লোকে জানে। প্রবন্ধ প্রকাশের সময়টি ইন্টারেস্টিং।
    অনেকদিন টর তড়িপার কথাটা শোনা গেল। 
    comment:|: | আহা, একবার অমন হয়ে গেছে উজ্জেতনায় :) আদতে মোটামুটি একই লোক। কনফুশনের জন্য সরি চাই। 
    সত্যি বলতে কি টাইপোটি বুঝতেই পারিনি। আপনি বলার পর খেয়াল করলুম। না: চোখ আরও খারাপ হবার আগে নামটি বদলে নেওয়া দরকার। ধন্যবাদ বুঝিয়া লইবেন বাইশটি একান্ন। 
    commentরমিত চট্টোপাধ্যায় | @দ দি, ফাটাফাটি লিখেছে গার্ডিয়ানে। অতুল দেবের এই পিস টা যদি একটুও দম থাকে আবাপ বা এই সময়ের উচিত গার্ডিয়ানের থেকে পারমিশন নিয়ে বাংলায় পাবলিশ করা। যেভাবে গেঁথেছে পুরো লেখাটা, কুর্নিশ করার মতো।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত