এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    সীমানা - ৪৬ - শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ছবি: সুনন্দ পাত্র ৪৬চেনা নজরুল, অচেনা নজরুলউনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের নতুন প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী বাংলা প্রদেশের প্রথম নির্বাচনের ফল নিয়ে নানা অঙ্ক নানা দর-কষাকষির পর কৃষক-প্রজা পার্টির ফজলুল হককে প্রধান মন্ত্রী, আর মুসলিম লীগের সেই সময়ের বাংলার নেতা সারাওয়র্দি-নাজিমউদ্দিনদের নানা মন্ত্রীত্বের পদ দিয়ে অবশেষে কৃষক-প্রজা পার্টি আর লীগের যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠিত হল সাঁইত্রিশের পয়লা এপ্রিল অল-ফূল্‌স্‌ ডে'র সন্ধ্যেবেলায়। প্রথম যে ছ'জন সর্বসম্মতিক্রমে মন্ত্রী হলেন, প্রধান মন্ত্রী ফজলুল হককে নিয়ে তাঁরা হলেন নলিনীরঞ্জন সরকার, স্যর নাজিমউদ্দিন, স্যর হবিবুল্লাহ্‌, স্যর বি-পি সিংহ আর ব্যারিস্টার সারাওয়র্দি। এরপর মুসলমানদের মধ্যে আরও দুজন আর হিন্দুদের তিনজন। নৌসের আলি আর সামসুদ্দিন মুসলমানদের, হিন্দুদের মধ্যে মহারাজ শ্রীশকুমার নন্দী, মুকুন্দবিহারী মল্লিক আর রায়কত। শ্যামাপ্রসাদ প্রায় মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছিলেন ছোটলাট অ্যাণ্ডারসন সাহেবের প্রভাবে, বাদ সাধলেন লীগের নেতারা। ঠারেঠোরে শ্যামাপ্রসাদের পিছনে হুমায়ুন কবিরদের সমর্থনের কথা ছোটলাট জানালেও পিছু হটলেন না নাজিমউদ্দিন-সারাওয়র্দিদের দল। অবশেষে মহারাজ শ্রীশকুমার নন্দীই হলেন কম্প্রোমাইজ চয়েস। আর জাত-ধর্মের দাঁড়িপাল্লাও দাঁড়াল যেমনটা অভিপ্রেত। রাজবংশীদের প্রতিনিধি রায়কত আর মুকুন্দবিহারী নমশূদ্রদের।সেই সাঁইত্রিশের এপ্রিলে সারা দেশের চটকল শ্রমিকরাও ধর্মঘট করল। বিপ্লবী সাম্যবাদী দল বা Revolutionary Communist Party (RCPI) সংগঠিত করলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই সৌম্যেন্দ্রনাথ যাঁর সঙ্গে কৃষ্ণনগর সম্মেলনে প্রথম পরিচয় নজরুলের। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের তিনি পৌত্র, নজরুলের তিনি কমরেড বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক পার্টিতে। ওই কৃষক-শ্রমিক পার্টিরই নজরুল পরিচালিত পত্রিকা লাঙলেই সৌম্যেন্দ্র-অনূদিত কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রথম প্রকাশিত হয়। আর ওই সাঁইত্রিশেই কিছুদিন আগে League against Fascism and War-এর সভাপতি হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। আন্দামান রাজবন্দীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলের জনসভাতেও যোগ দিয়েছেন তিনি।অথচ ঠিক সেই সময়টায় – এবং খানিকটা আগে থেকেই হয়তো – জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন রাজনীতিতেই নজরুলের কোন মতামত বা উৎসাহ নজরে পড়ে না। তার সময় কেটে যায় গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে, যে জায়গাটা তার অর্থস্বাচ্ছন্দ্যের উৎসভূমি! তখনো নজরুলের বিদ্রোহী কবি বা জাতীয় কবির পরিচয় মূলত তার কবিতার জোরে, কিন্তু কবিতা তার আর্থিক প্রয়োজনে তেমন কোন কাজে এসেছে কি? বিদ্রোহী শিরোনামে নজরুলের যে কবিতা – শুধুমাত্র একটি কবিতাই যা হাজারে হাজারে লাখে লাখে মানুষ পড়েছে নানা পত্র-পত্রিকায় পুনর্পুনর্মুদ্রণের সুযোগে – কবির কাছে তার অর্থমূল্য পৌঁচেছে কতটুকু? একটার পর একটা কাব্যগ্রন্থ বেআইনী ঘোষিত হয়েছে, খোলা বাজারের বাইরে হয়েছে তার মুদ্রণ – সে মুদ্রণ আইনী হোক বা বে-আইনীই – পুলিশের চোখের আড়ালে তার অভূতপূর্ব বিক্রিতে কোন অর্থলাভ তো হয়নি অন্তত কবির নিজের! বস্তুত, নজরুলের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর একটাও কি জীবিকা অর্জনে তাকে তেমন কিছু সাহায্য করতে পেরেছে? চালচুলো-জমিজায়গীর নজরুলের নেই একেবারেই, প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে খাদ্যবাসস্থানের সংস্থান কয়েকবছরের, আর নিম্নবর্গীয় ভারতীয় সৈনিকের যেটুকু বেতন বছর দু-তিন সে আয় করেছিল – এর বাইরে কোন অর্থসম্পদ নেই যে কবির, সে-আমলে যখন সৃষ্টিশীল রচনার অর্থমূল্য ছিল একেবারেই নগণ্য, তখন শুধুমাত্র লেখার জোরে তার জীবনধারণ সম্ভব ছিল কি? আমরা দেখেছি তার জীবনের প্রায় প্রথম ত্রিশ-বত্রিশ বছর কেটেছে কী নিদারুণ দারিদ্রে, কী অর্থকষ্টে, এবং দারিদ্রজাত কী শারীরিক অসুস্থতায়! এ-কথা তো ঠিকই, যে গ্রামোফোন কম্পানীর অর্থানুকূল্য নজরুলের পারিবারিক জীবনের মান অনেকটাই বদলিয়ে দিল! নিজের সৃষ্টিশীলতার দ্রুত রূপান্তর তখন সে ঘটিয়েছে নিশ্চিত অর্থপ্রাপ্তির শিল্পে। শ্যামাসঙ্গীত ইসলামি গান আর গজলের জনপ্রিয়তা তাকে অর্থ দিয়েছে। হতদরিদ্র নজরুলের তো অর্থের প্রয়োজন, প্রচুর অর্থের, এবং, এখন সে জানে প্রচুর অর্থ আয় করার উপায়টা তার প্রায় হাতের মুঠোয়! সে আয় করবে তার প্রতিভার বিনিময়ে, তাতে লজ্জা কোথায়!নজরুলের মনে পড়ে বিদ্রোহী কবিতা লেখার পরে আফজালের সঙ্গে তার বৌবাজারের ভীম নাগের দোকানে যাওয়ার দিনটা। কবিতাটা আফজাল ছাপাতে চেয়েছিল, সে বলেছিল, আপনাকে আজ মিষ্টি খাওয়াব, পেট ভরে। ভীম নাগের দোকানে বসেই সে কবিতাটা নকল করে দিয়েছিল আফজলকে। কাগজ কিনে এনেছিল আফজাল, নিজের ফাউন্টেন পেনটাও দিয়েছিল তাকে লেখবার জন্যে; কবিতাটা নকল করা হয়ে গেলে ফাউন্টেন পেনটা সে আর ফেরৎ নিতে চায়নি। নজরুল নেয়নি কিন্তু কলমটা, বলেছিল, তার মাথায় একটা বিশেষ আমেরিকান কলম আছে, সেটাই হবে তার প্রথম নিজস্ব কলম। অবাক হয়েছিল আফজাল, একটা দামী নাম করা আমেরিকান কলমের শখ যে নজরুলেরও থাকতে পারে, সে তা ভাবতেই পারে না। নজরুলকে সে ভীম নাগের দোকানে নিয়ে এসেছিল পেট ভরে সন্দেশ খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, এইমাত্র চোখের সামনে সেই পরম উপাদেয় দৈ-সন্দেশ সে শুধু পেট-ভরে নয়, আকণ্ঠ খেয়েছে! নিজের চোখে সেই দৃশ্য দেখার পর দ্ব্যর্থহীন ভাষা আর ভঙ্গিতে আফজাল প্রকাশও করে তার বিস্ময়: আপনার কি নামী দামী সবরকমের জিনিষেরই শখ আছে?নিশ্চয়ই, বলে নজরুল, বড়লোক হবার শখ আছে বৈকি। পাঁচিল-ঘেরা গেটওয়ালা বাড়ি, সামনে দারোয়ান, গ্যারেজে বিরাট বড় গাড়ি, এ সব শখ আছে তো। আপনি দেখবেন, এক দিন এ সবই হবে আমার।নজরুল। কাজি নজরুল ইসলাম। মাত্র কয়েকদিন আগেই যার কাছ থেকে মাত্র একশো টাকার বিনিময়ে তার প্রথম গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি অনায়াসেই কিনেছিল সে, সেই অপ্রস্তুত আফজল বলেই ফেলে, আপনাকে খুব ভালোভাবে চিনি, এরকম একটা অহঙ্কার আমার ছিল। আজ দেখছি চেনার অনেক বাকি আছে!আর আজ যখন সেই সমস্ত শখ নজরুলের সঙ্গীত-সৃষ্টির ক্ষমতায় এবং গ্রামোফোন কম্পানীর দৌলতে সহজেই আয়ত্ত, তখন ঠিক কোথায় থামতে হবে, সেই শখ মেটাবার জন্যে কত প্রিয় বস্তু আর অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, তার হিসেব করার আর প্রয়োজনও হয় না নজরুলের। সারাদিনের জন্যে বাড়ি থেকে নিয়ে-আসা খিলি খিলি পান আর কাপের-পর-কাপ শুধুমাত্র তরল চায়ের পুষ্টির উপর নির্ভর করে ক্লান্তিহীন সে রচনা করে চলে গানের পর গান; একই সঙ্গে সুরসংযোগ, আর চলে অনুজ গায়ক-যশপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রেকর্ডিঙের জন্যে তৈরি করে দেওয়া! মনের সূক্ষ্মকোন-একটা স্তরে মনের-মতো কাব্যরচনা করতে না-পারার অবদমিত বেদনাকে নীরব শাসনে রাতের পর রাতঘুমিয়ে-পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মাসিমা গিরিবালা, স্ত্রী প্রমীলা আর পালিতা কন্যা খুকুর সঙ্গে অর্থহীন তাস পেটাপিটিতেই কেটে যায় নজরুলের! জীবন ধারণের এই চক্রব্যূহ তৈরি করে নিয়েছে নজরুল স্বেচ্ছায়, সেখান থেকে মুক্তির কথা আর কি সে ভাবে?ভাবেই না বোধ হয়। অথবা হয়তো ভাবেও। তাই সুযোগ পেলেই সে নিজের অক্ষমতার কথায় ঘুরে ফিরে আসে বারবার। “...কোনো সাহিত্যিক উৎসবে আমার আমন্ত্রণ অপরাধ, হয়তো তার চেয়েও বেশি। কেননা আমি ধর্মভ্রষ্ট, সাহিত্য সমাজের পতিত। যখন সাদর আমন্ত্রণ আসে এই কবর থেকে উঠে ফেলে-আসা আনন্দ নিকেতনে ফিরে যাওয়ার, তখন খুব কষ্ট হয়, বড়ো বেদনা পাই। আমার মৃত সাহিত্যদেহকে যথেষ্টরও অধিক মাটি চাপা দিতে কসুর করিনি, তবু তাকে নিয়ে আমার বন্ধুরা টানাটানি করেন, কেউ কেউ দয়া করে আঘাতও করেন। উপায় নেই। মৃত লোক নাকি মিডিয়াম ছাড়া কথা বলতে পারে না। আজ যে কথা বলছি তা মিডিয়ামের মারফতই বলে মনে করবেন। অপরিমাণ শ্রদ্ধা নিয়ে সাহিত্যকে আমি বিসর্জন দিয়ে এসেছি। সেই বিসর্জনের ঘাটে এই প্রেতলোকচারীকে ডেকে যেন বেদনা না দেন, আজ বলবার অবকাশ পেয়ে বন্ধুদের কাছে সেই নিবেদন জানিয়ে রাখি।”এমনকি বুলবুলের মৃত্যুর পরও জীবনযাত্রার এই নতুন ছকটা – সকাল বেলাতেই রিহার্স্যাল রূমে হাজিরা দেওয়া, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা শুধুমাত্র কাপের পর কাপ চা আর খিলির পর খিলি পানের পুষ্টিতেই শরীরধারণ করে সঙ্গীতরচনা, সুরসংযোজন আর প্রশিক্ষণেই নিজেকে ব্যস্ত রেখে গভীর রাত পর্যন্ত – না, তাস খেলা আর নয় – এখন তার বদলে যুক্ত হয়েছে গুরুদেব বরদাচরণের নির্দেশে যোগাভ্যাস ও যোগসাধন – ছকটা কিন্তু বদলায়নি। যে যাই বলুন, লক্ষ্মীছাড়া উদ্দাম উদাসীন নজরুলের এখনকার জীবনযাত্রা কিন্তু বিবাহিত পারিবারিক জীবনের দাবির বিষয়ে সম্যক দায়িত্বপালনের একটা ছবিও ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে। বুলবুলের কনিষ্ঠ আরও দুটি – সব্যসাচী আর অনিরুদ্ধ – তার অবশিষ্ট এই দুটি পুত্রসন্তানকে মানুষ করে তোলবার দায় তো নজরুলের নিজেরই, সে তো তা অস্বীকার করেনি। আর এই দায় পালনে অর্থের ভূমিকা কি অস্বীকার করা যায়? এত কাজ তো তাদেরই জন্যে।গত কয়েক বছর ধরে যে বিষয়কে সে স্পষ্টতই অস্বীকার করে এসেছে – অন্তত স্বীকার করবার কোন প্রমাণকাগজে-কলমে রাখেনি সে – তা হল তার কৈশোর আর প্রথম-যৌবনের স্বঘোষিত আবেগ, যা কিছু আছে তার, দেশ আর জাতির জন্যে সবই বাজি রাখা। সেই যে উনিশশো উনত্রিশের ডিসেম্বরে তাকে জাতীয় কবি নামে সম্বর্ধিত করেছিলেন দেশের প্রধান প্রধান মানুষরা, সেই সময় সুভাষবাবু তার সম্বন্ধে বলেছিলেন, কবি নজরুল নিজে বন্দুক ঘাড়ে করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, কাজেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সব কথা লিখেছেন। এতেই বুঝা যায় যে নজরুল একটা জীবন্ত মানুষ। তিনি আরও বলেছিলেন, নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। এতেও বুঝা যায় যে, তিনি একটা জ্যান্ত মানুষ। সুভাষ বলেছিলেন, আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব – তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব। সুভাষ বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় নানা কবির রচিত জাতীয় সঙ্গীত শোনবার নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরুর মতো প্রাণ-মাতানো গান অন্য কোথাও শুনেছেন বলে মনে করতে পারেন না।কিন্তু, দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরুর মতো প্রাণ-মাতানো গান তার পরে আর একটাও লিখতে পারল না কেন নজরুল?নজরুলের মাঝে মাঝে কি মনে পড়ে সুভাষের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা? রবীন্দ্রনাথের ষষ্টীতম জন্মোৎসব সেদিন পালিত হচ্ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। প্রথম আলাপের কিছুক্ষণের মধ্যেই নজরুলকে সেদিন সুভাষ বাংলায় কংগ্রেস-প্রস্তাবিত দৈনিকের দায়িত্ব দিতে চাইল। শুধু তা-ই নয়, যখনই কথায় কথায় নজরুলের সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শোনে সুভাষ, তখনই তাকে কংগ্রেস ভলান্টিয়ার বাহিনীর একটা দায়িত্বও সে দিতে চায়। কিছুদিনের মধ্যেই নজরুলের কুমিল্লায় যাবার কথা, পবিত্রর মুখে সে কথা শুনে সুভাষ ভলান্টিয়ার বাহিনীর প্রস্তাবকে সেই সময়ের জন্যে মুলতুবী রেখে সতেরই নভেম্বর ব্রিটিশ যুবরাজের বোম্বাইয়ে পদার্পণের প্রতিবাদে দেশব্যাপী ধর্মঘটে কুমিল্লায় সাফল্যের দায়িত্ব নজরুলকে দিয়ে ওখানকার স্থানীয় কংগ্রেস নেতা বসন্ত মজুমদারকে চিঠিও লিখে দেয় একটা।কিন্তু বড়ই তাড়াতাড়ি ইতিহাস হয়ে গেল এইসব। উনতিরিশ সালে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-হেমন্ত সরকার-ফিলিপ স্প্রাট-আবদুল হালীমদের সঙ্গে বঙ্গীয় কৃষক লীগ স্থাপনের উদ্দেশে কুষ্ঠিয়ার সম্মেলনে তিন-চার দিনের জন্যে যোগ দেওয়া, সেখান থেকে ফিরে এসে হাওড়ায় শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিতে শ্রমিক বস্তিতে গান শোনাতে যাওয়া আরধাঙড়-মেথরদের সংগঠনে অংশ নেওয়াই নজরুলের শেষ সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। সে বছরেরই মার্চের শেষের দিকে মীরাট কম্যুনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত মুজফ্‌ফর গ্রেপ্তার হয়ে যায়। নজরুলের এতদিনের চলার পথটা ধীরে ধীরে এখানে এসে একটা গলিপথে শেষ হয়ে গেল। পানবাগান লেনের ভাড়া-বাড়িতে অনুজ-বন্ধু শান্তিপদ সিংহের সহায়তায় তখন তার বাস। বন্ধু নলিনী সরকারের যোগাযোগেই তখন গ্রামোফোন কম্পানীতে যাতায়াত-কাজকর্ম শুরু করেছে সে। সঙ্গীতই যে তার ভবিষ্যৎ, এ-কথা ততদিনে বুঝে গেছে নজরুল, পানবাগানের বাড়িতে তখন সে গ্রামোফোন কম্পানীর ট্রেইনার ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁ-য়ের নিয়মিত শাগরেদী করছে, খাঁ-সাহেবকে ওস্তাদ মেনে এই প্রিয়-শিষ্য ঠুংরি খেয়াল কাজরি শিখছে তাঁর কাছে।এই সময়ের পত্রপত্রিকায় নজরুল যে লেখে না তা নয়, কিন্তু যা সে লেখে মূলত সবই গান, যা দিনে দু-চারটে লিখতে সময়ই লাগে না তার। গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমের বাইরে সে যে কখনোই যায় না এমনও নয়। সারা বাংলার নানা জায়গা থেকে অনবরতই তার নিমন্ত্রণ আসে, বর্ষীয়ান সম্পাদক সওগাতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, নজরুলেরপ্রায়-অভিভাবকই তো তিনি, তিনি তো নানা আমন্ত্রণ-চিঠিপত্রের চাপে নজরুলের সেক্রেটারির দায়িত্বই নিয়ে নিয়েছেন প্রায়! যেখানে নজরুল যায়, সে শুধু গানই গায়, গান গাইতে গাইতে সময়ের ঠিক থাকে না, তবুও তার শ্রোতাদের চাওয়ার শেষ নেই!স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা আর কোন সভায় বলে না কবি, গান গায়। সারা ভারতের প্রায় সমস্ত প্রদেশে তখন পর্যন্ত যত কৃষক-শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথমটাই তো নজরুলের নিজের হাতে তৈরি, কৃষ্ণনগরের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময়। এবার সব প্রদেশের সংগঠন মিলিয়ে যে All India Workers and Peasants Party-র অধিবেশন হল কলকাতার অ্যালবার্ট হলে, তাতে তো নজরুল স্বাভাবিকভাবেই আমন্ত্রিত ছিল।আমন্ত্রিত 'বাঙালির কাজিদা' সেদিন কিন্তু সেখানে শুধু উদ্বোধন সঙ্গীতই গাইল। উদ্বোধন সঙ্গীত। ব্যস। আর-কিছু নয়।উনিশশো তিরিশের মে-মাসে মৃত্যু হল বুলবুলের। যে বাড়িতে এতদিন বাস করেছে নজরুল-পরিবার, সে বাড়ির সর্বত্র বুলবুলের স্মৃতি। সেখানে থাকা অসহ হয়ে পড়েছিল তাদের পক্ষে। তীব্র শোকে মুহ্যমান নজরুল প্রথমে বন্ধু নলিনী সরকারের গৃহে, পরে ওই অঞ্চলেই ঠিকানা-বদল করে আবার ফিরে গেল তার পুরোনো অভ্যাসে। সকাল থেকেই গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূম। এবার নলিনীর যোগাযোগে যোগগুরু বরদাচরণ মজুমদারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে সে, অতএব মাঝরাতে আর তাস নয়, এখন যোগাভ্যাস। এখনও ঘনঘন সারা বাংলা থেকে আমন্ত্রণ আসে নজরুলের। সে যায়, গানও গায় সে, এবং, ঠিক এই সময় থেকেই তার গানের সঙ্গে বোধ হয় আধ্যাত্মিকতা আর যোগের সূত্রে প্রাপ্ত নতুন এক রহস্যময়তাও শোনা যায় তার কণ্ঠে।এই রহস্যময়তাই কি নজরুলের নতুন অসুখ?আফজালুল হকের নতুন-কেনা লাইন-টানা কাগজে বিদ্রোহী কবিতা নকল করতে করতে কথায় কথায় তার কয়েকটা “শখ”-এর কথা নজরুল বলেছিল আফজালকে। বিশেষ কোন ব্র্যাণ্ডের একটা আমেরিকান ফাউন্টেন পেন ছাড়াও তারশখ-এর মধ্যে ছিল পাঁচিল-ঘেরা গেটওয়ালা একটা বড় বাড়ি, সামনে দারোয়ান, গ্যারেজে বিরাট বড় গাড়ি। দারোয়ান যে সে রেখেছিল একজন, সবাই জানে তা। বড় একটা ক্রাইসলার গাড়িও ছিল তার। বালিগঞ্জে জমি কিনেছিল নজরুল, ক্যাশ টাকার অভাব ছিল না তার গ্রামোফোন কম্পানীতে কপিরাইটের সূত্রে। অতএব অভিজাত এলাকায় পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি একটা তার নিশ্চয়ই হতে পারত। যে কলমটা সে নিয়মিত ব্যবহার করত তা ওই নির্দিষ্ট ব্র্যাণ্ডের আমেরিকান কলমই ছিল কিনা তা জানা যায় না, তবে সে যে প্রসাধনপ্রিয় ছিল, তার পালিতা কন্যার ভাষায় নিয়মিত স্নো-পাউডারের ব্যবহার এবং তাম্বুলচর্চাজনিত দন্তোষ্ঠকলঙ্ক নিবারণার্থে আমেরিকান মাউথওয়শও যে ব্যবহার করত সে, তা তো অনেকেই জানে। গত কয়েকবছরে অবিশ্যি যে-কথা সে একবারও উচ্চারণ করেনি, তা হল দেশ আর জাতিকে নিয়ে সেই সময় কী তার ভাবনা। এই দেশ এবং জাতিকে নিয়ে তার কী আবেগ, এক সময় নজরুল বারবার বুঝিয়েছে তা। এর পর গজল-গানের সাফল্যই তার জন্যে খুলে দিল গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমের দরজা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সন্ধান মিলে গেল তার; এবং সেই থেকে প্রায় ধর্মীয় গোঁড়ামির মতো অন্ধ-নিরুপায়তায় সে দেশ এবং জাতির বিষয়ে সবরকমের আলোচনা অনেক দিনের জন্যে এড়িয়ে গেছে।যখন বোঝা গেল, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থাগম হয়েছে, তখন নতুন করে হঠাৎ পুরোনো স্বাদেশিকতার ঝোঁক ফিরে এল তার। সে বহু অর্থ ব্যয় করল কলগীতির জন্যে। এত বিপুল অর্থব্যয় দেখে সঙ্কুচিত পিংলা তাকে জিজ্ঞেস করে, ধর, ব্যবসা তো, লোকসানই হল এতে, টাকাটা তোমার ডুবেই গেল, তখন কী করবে তুমি?ডুবে গেলে আবার আয় করব, গানের থেকেই আয় করে নেব আবার; সেটা কোন কথা নয়, বলেছিল নজরুল; কিন্তু, একটা কথা তোকে বুঝতে হবে, আমি তো ঠিক ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে যাব মনে করে এই ব্যবসাটায় নামছি না। এটা একটা আন্দোলন, আন্দোলনটা শুরু করতে চাইছি আমি। আর যথাসর্বস্বই যদি পণ না করি, তাহলে আমার কথা শুনবে কেন লোকে?এই যথাসর্বস্ব খোয়ানোর পরেও গ্রামোফোন রেকর্ডের কপিরাইটজনিত ক্রমবর্ধমান অর্থে আবার সে হয়তো ফিরিয়ে আনতে পারত তার পুরোনো আর্থিক অবস্থা – যা সে যথেষ্ট জোর দিয়ে বলেওছিল পিংলাকে – কিন্তু সবকিছু বদলিয়ে গেল প্রমীলার অসুস্থতায়। ক্যাশ প্রায় শেষ, গাড়ি ফেরৎ চলে গেছে, বরদাচরণের সলিসিটর-শিষ্য অসীমকুমার দত্তর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অতি দ্রুতগতিতে নজরুলের কপিরাইটের সমস্ত টাকা গিলে নিচ্ছে। অখ্যাত-অর্ধখ্যাত শিল্পী যশঃপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ বাবদ গ্রামোফোন কম্পানীর সামান্য মাসোহারা আর রেডিও কম্পানীর প্রোগ্রামভিত্তিক পারিশ্রমিক ছাড়া বস্তুত অর্থাগমের কোন রাস্তাই যখন নেই, তখন বোধ হয় আরেকবার বাইরের জগতের দিকে তাকিয়ে দেখল নজরুল। বরদাচরণের প্রভাবে ততদিনে দৃষ্টি অনেকটাই ঘোলাটে হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই সময়ের তোলপাড়-করা একটা ঘটনা ধীরে ধীরে তার চোখ খোলাতে শুরু করে। সুভাষবাবু য়্যোরোপ থেকে ফিরে এসেছেন সাঁইত্রিশে, তারপর বেশ কিছু দিন সরকার-জনতার টাগ-অব-ওয়রের পর অবশেষে মুক্তি মিলেছে তাঁর, এবং সেই বছরেই কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিশ্ব-জোড়া যুদ্ধের প্রস্তুতির মুখে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনোত্তর ভারতের গঠনমূলক প্রস্তুতির কাজ অতি বেগে শুরু করে দিয়েছেন সুভাষ। তাঁর প্রায়-অমানুষিক উদ্যম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নানা উদ্যোগ, বাম-ঘেঁসা সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের ধারণা আর ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় সরকারের তথাকথিত ফেডারেশনের কৌশলের প্রকাশ্য বিরোধীতা গান্ধীসহ দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসীদের কাছে সুভাষকে জাতিভ্রষ্ট – প্রায় অচ্ছুত – করে তুলল। আটত্রিশের সভাপতি সুভাষের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে অন্য কোন বামপন্থী নেতার অভাবে যখন দ্বিতীয়বার – উনচল্লিশেও – সুভাষ সভাপতির পদে নির্বাচিত হলেন, তখন কোনরকম লাজলজ্জার তোয়াক্কা না করে নির্বাচিত সুভাষের প্রকাশ্য বিরোধীতা শুরু করলেন মহাত্মা। দিব্যদৃষ্টিতে নয়, পাকিয়ে-ওঠা মহাযুদ্ধের পটভূমিতে ভারতের স্বাধীনতা আর যে বেশি দূরে নয় তা খোলা চোখে দেখতে পেয়ে এবং বুঝতে পেরে পদত্যাগী সুভাষ কংগ্রেস-সভাপতিত্ব ছেড়ে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ফিরে এসে প্রত্যক্ষ লড়াইতে প্রায় নেমে পড়লেন। সিরাজদ্দৌলা দিবস পালন এবং হলওয়েল মনুমেন্টের অপসারণের দাবি সুভাষের মাস্টারস্ট্রোক – একই দিনে ফরওয়র্ড ব্লকের হিন্দু কংগ্রেসী আর মুসলিম লীগের মুসলমান ছাত্রের দল হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ দিয়ে নেমে পড়ল লড়াইয়ে।এতদিন পর নজরুলের মনে পড়ে যায় বছর দশেক আগের এক শীতের দুপুরে রাজশাহিতে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মশায়ের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা। বোয়ালিয়া থানার লাগোয়া অক্ষয়কুমারের লোহার পিলার দেওয়া বাড়িতে নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হল। তখন বৃদ্ধ হয়েছেন মৈত্রেয় মশাই, সত্তর ছুঁই ছুঁই – অশক্ত শরীর। নজরুলের মনে আছে, প্রায়-তিরিশের যুবা নজরুলকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেছিলেন, আমরা অস্তমিত সূর্য, তুমি নতুন উদিত সূর্যের দীপ্তি নিয়ে এসেছ। আমি কল্পনা করিনি যে জীবনসায়াহ্নে তোমাকে এত কাছাকাছি কখনো পাব। প্রণাম করে নজরুল বলেছিল, যিনি অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন, যিনি সত্যকে সমাদৃত করতে পারেন তিনি মরতে পারেন না। দোয়া করুন আপনার চিন্তা ও চেতনাকে আমি যেন আমার কাব্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারি।সেই স্মৃতি তো ভুলতেই বসেছিল নজরুল। আজ সুভাষ নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন সে কথা। এবং সেই-কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে সুভাষের প্রস্তাবিত সিরাজদ্দৌলা দিবসের সমর্থনে মুসলিম লীগ-আকরম খাঁ-য়ের আজাদ পত্রিকায় বিবৃতি দিল। তার তখন আবার মনে পড়ে যায় সদ্য-যৌবনে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সে তার শৈশবের স্বপ্নের বিপ্লবের সন্ধানে মাষ্টারমশাই নিবারণচন্দ্র ঘটকের নির্দেশে ময়মনসিংহ হয়ে কুমিল্লায় পৌঁছিয়ে গান্ধীর আহ্বানে কী ভাবে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। সেই অসহযোগ আন্দোলন, যা ঘোষণা করবার আগে গান্ধী মাত্র এক বছরেই স্বাধীনতা এনে-দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এমনকি যুগান্তর-অনুশীলনের ছেলেদেরও তাঁর আন্দোলনে নিয়ে এসেছিলেন। অথচ চৌরিচৌরার একটা ঘটনাতেই এই বিশাল জননেতা একাই এতদিনের এতজনের এত কৃচ্ছসাধনকে তুচ্ছ করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা করে দিলেন! এবার অনেক অনেক বছর পর তেইশে ডিসেম্বর কলকাতার মুসলিম ইনস্টিট্যুট হল-এ ছাত্র-সমাবেশে নজরুলের বক্তৃতায় সেই স্মৃতি উচ্চারিত হল: “...জরার প্রধান ধর্ম হল – অতি সাবধানে পা টিপে টিপে বিচার করতে করতে চলা। এই অতি সাবধানীরা (ভীরু না-ই বললাম) অগ্রগমনের পথ পরিষ্কার না করে পশ্চাতে 'রিট্রিট' করার পথ উন্মুক্ত রাখতে চান। আগে-চলো-মারো-জোয়ান-হেঁইও বলে এগুতে এগুতে যেই এসে পড়ল চৌরিচৌরার দুটো খুনোখুনি, অমনি সেনাপতির কণ্ঠে ক্রন্দন ধ্বনিত হল – 'পিছু হটো, পিছু হটো।' গণ-ঐরাবতের পায়ে কাপাস-তুলো চরকাকাটা সুতোর পুঁটুলি বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও তার বিপুল আয়তনের জন্য দুটো চারটে লোক মারা গেল এইটাই সেনাপতির চোখে পড়ল – আর (ভারতের কথা ছেড়ে দিলাম) এই বাংলাদেশে যে কালাজ্বর আর ম্যালেরিয়ায় বছরে বছরে এগার লক্ষ করে লোক cold blooded murdered হচ্ছে সেদিকে একচক্ষু সেনাপতির দৃষ্টি পড়ল না।”উদ্দীপ্ত এই ভাষণের সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল নজরুলের নতুন অভ্যাসজাত রহস্যময়তাও: “মৃত্যুর ভয় যার হয়তো নিজের গেছে – কিন্তু অন্যের মৃত্যু দেখলে যার মৃত্যুযন্ত্রণা হয় ভয়ে কূর্ম-অবতার হয়ে যান – তিনি আর যাই করুন অমৃতসাগরের তীরে নিয়ে যাওয়ার সাধনা তাঁর নিষ্ফল হয়েছে। সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারের মধ্যে যিনি পরম নিত্যম, নিত্য পূর্ণম্‌ – তাঁকে যিনি উপলব্ধি করলেন না, তাঁর সংহারের রূপকে যিনি অস্বীকার করলেন, ভয়ের পশ্চাতে অভয়কে দেখলেন না, তিনি আর যাই পান – পূর্ণকে পাননি। তবু কাঠ পুড়ছে বলে, যে শুধু কাঠের ধ্বংসই দেখল, আগুনের সৃষ্টি দেখল না, তার দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন নয়। এঁর এক চোখে দৃষ্টি আছে আর বাকি যারা তারা একেবারে দৃষ্টিহীন অন্ধ। এঁরা হাতে বড়ো বড়ো মশাল জ্বেলে চলেছেন – কিন্তু অন্ধের হাতে মশাল যত না আলো দেয় তার চেয়ে ঘর পোড়ায় বেশি।”উনিশশো পঁয়ত্রিশের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সাঁইত্রিশের নির্বাচনের ফলে যখন হকসাহেবের প্রধানমন্ত্রীত্বে বাংলায় লীগ-হক মন্ত্রীসভার শাসন এল, বাংলার মুসলিম লীগ দলের পক্ষে সারা ভারতের নিরিখে সেই নির্বাচনের ফলই ছিল উজ্জ্বলতম, যদিও শুধুমাত্র নিজেদের বিজয়ী প্রার্থীদের জোরে মন্ত্রীসভা গঠনের মতো নয়। যে প্রদেশগুলোয় মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক বেশি নির্বাচিত হয়েছে, সেখানেও নির্বাচিত মুসলমানরা প্রায় সবাই জিতেছে কংগ্রেস-প্রার্থী হিসেবে, কংগ্রেসের টিকিটে; মুসলিম লীগ বা অন্য কোন মুসলিম সংগঠনের প্রার্থী হিসেবে নয়। কংগ্রেস আর হকসাহেবের কৃষকপ্রজা দলের মিলিত মন্ত্রীসভা গঠনের জোর গুজব তখন চলছিল বাজারে, শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস পিছিয়ে যাওয়ায়লীগ-হকের সমন্বয়।এমন অবস্থায়, মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌কে যদি সারা ভারতের প্রধানতম মুসলিম নেতা হয়ে উঠতেই হয়, তাহলে যে চার প্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যাই প্রধান – বাংলা, পঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত – পুরোপুরি সেই চার প্রদেশই না হোক, অন্তত বাংলা আর পঞ্জাবে জিন্নাহ্‌র প্রধান নেতা হয়ে ওঠা বড়ই প্রয়োজন। অথচ বাঙালি-মুসলমান-প্রধান বাংলায় সেই সময় একচ্ছত্র মুসলিম নেতা তো ফজলুল হক, আর সেই নেতৃত্ব তো দুয়েকদিনে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক শেষ হবার পর, সেই উনিশশো বত্রিশ সালে, বিলেতেই থেকে গিয়েছিলেন জিন্নাহ্‌ সাহেব, নতুন করে একটা পোলিটিকাল কেরিয়ার তৈরি করতে চাইছিলেন তিনি বিলেতে, চেষ্টা করে দেখছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টেই কোন আসন পাওয়া যায় কিনা।আর ফজলুল হক? পটুয়াখালির বড় জমিদার এবং প্রতিষ্ঠিত উকিলের তিনি পুত্র, কলকাতার শিক্ষিত সমাজে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব এবং পরিচয়। প্রেসিডেন্সিতে বিজ্ঞান পড়েছেন চার বছর, স্যর পি-সি রায়ের তিনি প্রিয় ছাত্র, কেমিস্ট্রির সঙ্গে সঙ্গে স্যরের মতো শেক্‌স্‌পীয়রও আবৃত্তি করতে পারেন অবিরাম, স্যর আশুতোষের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন হাই কোর্টে। বাংলা বলেন বরিশালের ভাষায় আর টানে, ইংরিজি আই-সি-এসদের মতো। আর সেই উনিশশো বত্রিশেই মুসলিম জমিদার, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আর কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের নিয়ে শুধুই নিখিল বঙ্গ মুসলিম সম্মিলনই করলেন না হকসাহেব, বৃহত্তর কলকাতা আর আশপাশের জেলাগুলোয় হরেকরকমের মুসলিম-প্রধান পেশায় নিযুক্ত যারা – দর্জি, কসাই, জাহাজের লশকর, ছোট-বড় দোকানদার – সবাইকে নিয়ে নিয়মিত মীটিং করতে লাগলেন। এর আগে দু'দফায় তিনি নবযুগ দৈনিক চালিয়েছেন, প্রথম দফায় তাঁর মূল সহযোগী ছিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ আর নজরুল, দ্বিতীয় দফায় মুজফ্‌ফর না-থাকলেও নজরুল তো তখনও ছিলেন কিছুদিন। কাজেই নানাসূত্রে বহুরকম মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। স্পষ্টতই স্বতন্ত্রভাবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আসন তৈরি করে যখন খানিকটা জমি ছাড়তে প্রস্তুত ব্রিটিশরাজ, তখন হকসাহেবই বাঙালি মুসলমানদের প্রথম জানালেন, এই প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে কিছু মর্যাদা তাদের প্রাপ্য। আর প্রাপ্য ঘোষণা করলেই কোন প্রাপ্তি যে হবে না, তা-ও স্পষ্ট করলেন হকসাহেব; আদায় করে নিতে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে। তেত্রিশ সালের অক্টোবরের বার তারিখে স্টেট্‌স্‌ম্যান-এ হকসাহেব লিখলেন, যে কোন বিচারকের সামনে যদি আমি প্রমাণ না-করতে পারি যে বাঙালি হিন্দুরা হল মূর্তিমান সাম্প্রদায়িকতা আর তার ভিত হল এই হিন্দুদের চূড়ান্ত স্বার্থপরতা – তাহলে আমি ফাঁসি যেতেও রাজি আছি।বহুদিন কংগ্রেসের সভ্যও ছিলেন হকসাহেব, আর মুসলিম লীগেরও তো বটেই। অর্থাৎ সে-সময়ের মুসলিম-রাজনীতিতে হকসাহেবকে এড়িয়ে যাওয়া চলতই না। এমনকি অত বড় যে কট্টর লীগপন্থী ব্যারিস্টার সারাওয়র্দি, তাঁকেও বাংলায় নেতৃত্বের সুযোগ তো হাতে-ধরে করে দিয়েছিলেন হকসাহেবই। মেদনীপুরের বাঙালি হলে কী হয়, বাংলা তো বলতেই পারতেন না সারাওয়র্দি সাহেব, অন্তত প্রকাশ্যে বলতেন না কখনও। সেই সারাওয়র্দিকে কলকাতায় খিদিরপুর ডকের বাঙালি লশকরদের ইউনিয়নের কাজে প্রায় হাতে-ধরে বসিয়ে দিয়েছিলেন হকসাহেব। আলিপুর কোর্টের উকিল মহম্মদ দাউদ তখন তার আদালতের যোগাযোগের জোরে কলকাতায় ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের বড় পাণ্ডা, অকংগ্রেসী অখিলাফতি দাউদ হকসাহেবেরও চেলা। ডক অঞ্চলের নানা বস্তিতে নতুন-গজিয়ে-ওঠা একদল দুষ্কৃতির দাপটে তখন কলকাতায়-নতুন-আসা জাহাজী লশকরদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ওকালতি ক্ষমতার জোরে এই দুষ্কৃতিদের শায়েস্তা করেছে দাউদ। এখন সে জাহাজ-শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করায় ব্যস্ত, ট্রামের শ্রমিকদেরও সে জোট বাঁধতে শেখাচ্ছে। হকসাহেবের অনুরোধে সারাওয়র্দিকেও ডক-অঞ্চলে জায়গা করে দিল দাউদ।ফলত একরকমের বাধ্যই হন অল-ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌ ফজলুল হককে সব সময়ই সামনে, অর্থাৎ নেতার আসনে, রাখতে। চল্লিশ সালের চব্বিশে মার্চ ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে মুসলিম লীগের সম্মেলনে প্রস্তাব দেওয়ানো হল হকসাহেবকে দিয়ে, আর আঠাশে মার্চ তাঁরই সরকারের তৈরি কলকাতা ম্যুনিসিপাল আইন (সংশোধন)-এর আওতায় ভোট হল কর্পোরেশনের। এই ভোটের সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস (সুভাষপন্থী)-র সঙ্গে সমঝোতা হল মুসলিম লীগের!আবার চল্লিশের ডিসেম্বরের প্রথম দিনেই, ১-লা ডিসেম্বর, ভেঙে গেল হক-লীগ মন্ত্রীসভা। ৪-ঠা ডিসেম্বর, ১৯৪০, হকসাহেব নতুন-করে-তৈরি-হওয়া প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির নেতা হিসেবে নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের দাবি জানান, যার দাবিদারদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদও আছেন, আবার আছেন সুভাষপন্থীরাও! অনেক টালবাহানা করে ব্যাপারটাকে ঠেকিয়ে রাখলেন ছোটলাটসাহেব হার্বার্ট যতদিন পর্যন্ত না লীগের নেতারা কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারেন। মুশকিলটা হচ্ছে, সুভাষবাবুর সমর্থনে আবার এদিকে কর্পোরেশনে রাজত্ব চালাচ্ছে লীগ!ব্যাপারটা যখন এরকমই, তারই মধ্যে মাঝে-মাঝেই লীগের নেতৃত্ব এমন একটা অবস্থা তৈরি করে যে সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে যায়, তখন নতুন একটা মতলব আসে হকসাহেবের মাথায়। মুসলিম-প্রধান বাংলায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুরাই বেশি, কিন্তু জনসংখ্যায় প্রধান মুসলমানরাই। এ-অবস্থায় মাথা-ঠাণ্ডা রেখে মুসলমানদের প্রাপ্য অধিকারের ব্যাপারটা সংখ্যালঘু হিন্দুদের যতদূর সম্ভব অসন্তুষ্ট না-করেও সামলাতে হলে, সূক্ষ্ম কূটনীতির প্রয়োগ প্রয়োজন।হকসাহেব লক্ষ্য করেছেন, সবরকমের পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যেও মুসলিম লীগ – বিশেষত ওই মুসলিম লীগের বাঙালি তরুণ নেতাকর্মীরা – সুভাষের বিশেষ অনুরাগী। এই তরুণ দলের উপর নজরুলের প্রভাবও যে কতটা তা-ও হকসাহেব জানেন ভালোমতই। নিজের নেতৃত্ব আর ভাবমূর্তি বজায় রাখবার জন্যে একটা খবরের কাগজের কথা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন হকসাহেব। নজরুলের কথা মাথায় আসবার পর আর একটু গভীর চিন্তা করেন তিনি। নজরুল নিজে প্রায় কট্টর সুভাষপন্থী। সুভাষের অত্যাশ্চর্য বেপরোয়া নিষ্ক্রমণের পর যখন বিড্‌ন্‌ স্কোয়্যারে সুভাষ দিবস পালন করল সুভাষপন্থী কংগ্রেস, অর্থাৎ ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা, সেই সময় সুভাষের নিজের পরিবারের ভয়-পেয়ে-যাওয়া সদস্যরা অনুপস্থিত থাকলেও অসুস্থ শরীর নিয়েও নজরুল কিন্তু এসেছিলেন সেই সুভাষ দিবস পালন করতে। হকসাহেব নিজেও সুভাষকে পছন্দই করেন, সে তো তাঁর কলেজের প্রাক্তনীও!হক সাহেব শুনেছেন, আর্থিকভাবে আজকাল একটু অসুবিধের মধ্যেই আছে নজরুল। হিন্দু-মুসলমান – বিশেষ করে দুই সম্প্রদায়েরই তরুণরা, তরুণরা অন্তত – তার বিশেষ অনুরক্ত। প্রধান সম্পাদক হিসেবে নজরুলের পরিচালনায় একটা কাগজ নিজের হাতে থাকলে জনসাধারণের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগটাও থাকে। আর নজরুল তো তাঁর পুরোনো বন্ধু। এর আগে – যত কম সময়ের জন্যেই হোক – দু-দুবার নবযুগ চালিয়েছেন তিনি। দুবারই নজরুল তাঁর সঙ্গে ছিল, যদিও কাগজে পরিচালক হিসেবে তাঁর নামই থাকত। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। আবার তিনি নবযুগ বের করবেন। এবার আর এক-পাতার কাগজ নয়। বাজারের আর-পাঁচটা কাগজের মতোই কাগজ হবে এবার। কাগজে-কলমেও প্রধান সম্পাদক এবার হবে কাজি নজরুল ইসলাম।দেরি করেন না হকসাহেব। উনিশশো একচল্লিশের অক্টোবরে নতুন করে প্রকাশিত হল দৈনিক নবযুগ, প্রধান সম্পাদক কাজি নজরুল ইসলাম। বেতন সাড়ে তিনশো টাকা, রেডিও আর গ্রামোফোন কম্পানীর কাজও প্রয়োজন মত চালিয়ে যাবার অনুমতিও দেওয়া হল তাকে।প্রথম দিন অফিসে এসেই একটা পোস্টকার্ডে পিংলাকে চিঠি লিখতে বসে নজরুল, “ভাই পিংলা, শেষ যেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলি, রোজ রোজ যত পারি বাংলা কবিতা লিখতে বলে গিয়েছিলি তুই। লেখা হয়নি, আর তোর উপদেশ মতো রেডিওতে কবিতার আসরের জন্যে দরবারও করা হয়নি। আজ থেকে হকসাহেবের নতুন দৈনিক নবযুগে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলুম। মনে করিস না সেই টার্ণার স্ট্রীটের দোতলা বাড়ির একতলার একটা ছোট্ট অংশে গোটা কয়েক চেয়ার-টেবিল-টুল-আলমারির অফিস। লোয়ার সার্কুলার রোডে শেয়ালদা স্টেশনের কাছাকাছি একটা বড়সড়ো গোটা বাড়ি যোগাড় করেছেন হকসাহেব। হক সাহেবকে বলে দিয়েছি, প্রত্যেক দিনই এই কাগজে আমার একটা কবিতা বেরোবে, যেদিন অন্য কবিতার মূড আসবে না সেদিন কোন একটা সম্পাদকীয় লিখব কবিতায়; বেশ হবে, না? এখানে বেশ গোছানো সম্পাদকীয় দপ্তর, মনে হচ্ছে কাজ করে আরাম পাব। তবে একটাই দুশ্চিন্তা, হকসাহেব কাজের স্বাধীনতা কতটা দেবেন। আমার মনে হয়, আমার সঙ্গে মুসলিম লীগের যুবকদের আর ছাত্র লীগের নেতাদের যে সম্পর্ক তারই জোরে এই চাকরিটা পেলুম, খোয়াতে কতদিন লাগবে জানিনা।শ্যামপুরে তোর কাজ তো ভালোই এগোচ্ছে খবর পেলুম। ভাবছিস, খবরটা পেলুম কোথা থেকে? তুই তো জানিসই, আমাকে যিনি খবর দেবেন তিনি দুনিয়ার সব খবরই রাখেন, আমার সঙ্গে তো তাঁর বন্ধুত্ব। আমার বন্ধু অবিশ্যি তোর সঙ্গেও বন্ধুত্ব করতে ব্যগ্র, কিন্তু কতদিনে তাঁর ডাক তুই শুনতে পাবি তা তো জানি না। যেদিন পাবি তার অপেক্ষায় আছি। ভালো থাকিস। –কাজিদাচিঠিটা প্রথমেই দুবার পড়ে ফেলল পিংলা, তারপর শেষ প্যারাগ্রাফটা বেশ কয়েকবার। ঘটনাটা কী যে ঘটছে কাজিদার মনে, বুঝতে পারে না সে। চিঠিটা পড়ে মন খারাপই হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চিঠি লিখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না সে। কাজিদাকে সে বলেনি, কিন্তু এখনও এধার-ওধার কাজিদার যেসব কবিতা-টবিতা ছাপা হয়, সুধাকান্তদাদার সহযোগিতায় সেগুলো পড়ে সে, যত পড়ে ততই মন খারাপ হয় তার। অগ্রনায়ক নামে তার সাম্প্রতিক একটা কবিতা তাকে দিয়েছিলেন সুধাকান্তদাদা, এ-কবিতা পড়ে কি সেই কাজিদাকে চেনা যায়? কোথায় সেই 'বিদ্রোহী' কবি, সেই যার কলম থেকে বেরত নতুন পথের যাত্রা পথিক             চালাও অভিযান উচ্চকণ্ঠে উচ্চার আজ              'মানুষ মহীয়ান।' চার দিকে আজ ভীরুর মেলা,         খেলবি কে আয় নতুন খেলা, জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা          বাইবি কি উজান? পাতাল ফেড়ে চলবি মাতাল          স্বর্গে দিবি টান। আঁধার ঘোরে আত্মঘাতী              যাত্রাপথিক সব এ উহারে হানছে আঘাত              করছে কলরব। অভিযানের বীর সেনাদল             জ্বালাও মশাল চল্‌ আগে চল্‌ কুচকাওয়াজের বাজাও মাদল          গাও প্রভাতের গান। ঊষার দ্বারে পৌঁছে গাবি              'জয় নব উত্থান।'?অথচ আজকের অগ্রনায়কের কবি লিখছে, অন্তরে যদি বিপ্লব নাহি আসে বৈশাখী ঝড় আসে নাকো ভৈরব-প্রলয়োল্লাসে। বক্তৃতা দিয়া মিছিল করিয়া ধুলি উড়াইয়া ভাবি: তুফান উঠেছে, এবার মিটিবে যত বিপ্লবী দাবি। বাঁকা তলোয়ার বাঁকা চোখে হাসে তেমনি পথের বাঁকে।... মৃত্যুশঙ্কা আসিলেই সব ডঙ্কা থামিয়া যায়; মুখের কথায় লঙ্কাকাণ্ড সকলে করিতে চায়। ****** সে-ই আল্লার শক্তি লভিয়া নিত্য শক্তিমান তারি মুখ দিয়া উদ্‌গত হয় আল্লার ফরমান। অন্তরে তার বহে দুরন্ত সদা বিপ্লব-ঝড়; বাহিরে থাকে সে শান্ত, করিয়া আল্লাতে নির্ভর। তিনিই ইমাম তিনিই অগ্রনায়ক সারথি তিনি জাগাইয়া ভূমিকম্প পাষাণে চেতনা জাগান যিনি। সর্বযুদ্ধে জয়ী হন ইনি আল্লার শক্তিতে এঁর সৈন্যরা সমবেত হয় প্রেম আর ভক্তিতে।নিজেকেই সান্ত্বনা দেয় পিংলা, এ হয়তো একটা সাময়িক অবস্থা, গত কয়েকবছর ধরে কাজিদার জীবনে তো কমঝড়-ঝাপটা গেল না! তবুও বুলবুলের মৃত্যুটাও সামলিয়ে নিয়েছিল সে, কিন্তু একই সঙ্গে বৌদির এমন একটা অসুখ, আর এমন আর্থিক অবস্থা! সব-কিছু কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে গেল। যা-ই হোক, নতুন চাকরিটা হয়ে ভালোই হয়েছে মনে হয়। রেডিও আর গ্রামোফোনের কাজও চলতে পারে – চাকরির এই শর্তটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক; আশা করা যায় কিছুদিনের মধ্যে আবার পুরনো কাজিদাকে ফিরে পাওয়া যাবে।চাকরিটা ভালোই, কিন্তু যে ব্যাপারটা আগে ভাবেইনি নজরুল তা হল, নবযুগকে কেন্দ্র করে যে আড্ডাটা গড়ে উঠেছিল প্রথমবারের নবযুগের সময়, সে আড্ডাটা তো এখানে নেই। কাজেই, বাইরে থেকে যতই বেশ গোছানো বলে মনে হোক দপ্তরটাকে, সেখানে মন লাগাতে সময় তো খানিকটা লাগবেই। অবিশ্যি নতুন নতুন যাদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে তারা সবাই কাজিদাকে পেয়ে খুশি। কাজিদার খ্যাতি এবং গত পনের-ষোল বছর ধরে সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীতের জগতে তার নানারকমের কাজ আর সাফল্যের কথা তো জানেই সবাই, তার সঙ্গে কাজ করতে পাওয়ার সুযোগ অনেকের কাছেই একটা অভাবনীয় পাওনা বলেই মনে হয়। তবুও আকুল হয়ে বন্ধুদেরই যেন ডাকে নজরুল: কবি ও শিল্পী হওয়া এই দেশে দুর্ভাগ্যের কথা, বেনে মাড়োয়ারি-ভুক্ত এদেশে বাঁচে না মাধবীলতা। জানি সংবাদপত্রের যারা মালিক তাহারা বেনে, অর্থের লোভে তারাই এ বিদ্বেষ আনিয়াছে টেনে।তাহাদেরই মেনে চলতে হবে কি? ঐ রাক্ষুসে লোভেদেশের জাতির অকল্যাণের কারণ হব কি সবে?...******পলাতক ছিনু ধরিয়া এনেছে নবযুগ পুনঃ মোরেতোমরা না এলে নবযুগ পুনঃ আসিবে কেমন করে?...আনন্দধাম বাংলায় কেন ভূত প্রেত এসে নাচে?দেশী পরদেশী ভূতেরা ভেবেছে বাঙালি মরিয়া আছে! এ ভূত তাড়াব; পাষাণ নাড়াব, চেতনা জাগাব সেথা,ভায়ের বক্ষে কাঁদিবে আবার এক জননীর ব্যথা।তোমরা বন্ধু কেহ অগ্রজ অনুজ সোদরসমপ্রার্থনা করি ভাঙিয়া দিও না মিলনের সেতু মম। এই সেতু আমি বাঁধিব আমার সারা জীবনের সাধ,বন্ধুরা এসো ভেঙে দিব যত বিদেশীর বাঁধা বাঁধ।এই কবিতার আহ্বানেও খুব বেশি পুরোন বন্ধু নবযুগে আড্ডা জমাতে এল না। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই কোন-কিছুই তো ফাঁকা থাকতে পারে না, এই সময় নজরুলের যারা প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াল, তাদের মধ্যে একজন হল নবযুগের সেই-সময়কার সহকারী সম্পাদক পূর্বতন বিপ্লবী অমলেন্দু দাশগুপ্ত। নজরুলের ঘনিষ্ঠ-সান্নিধ্যে অমলেন্দুও তখন একজন যোগশিক্ষার্থী। এ-ছাড়া ওই নবযুগেরই ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি আর কালীপদ গুহ। কালীপদ গুহর সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয় বহরমপুরের জেলে। সেই সময় নজরুলের লেখা একটা উচ্চকিত-কণ্ঠ কবিতা জেলখানার এক গার্ডের কাছে লুকোতে গিয়ে গোটা কাগজটাই নিমেষে গিলে ফেলেছিল কালীপদ। আজ এতদিন পর তার সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভারি খুশি নজরুল। এ ছাড়াও, নজরুলেরই প্রায় সমবয়েসী জুলফিকার হায়দার এবং তার স্ত্রী রাবেয়ার সঙ্গেও নজরুলের খুবই ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে সেই সময়ে। জুলফিকারও নজরুলের মতই স্কুলের শেষ পরীক্ষা না-দিয়ে যুদ্ধে চলে যায় উনিশশো সতেরয়। সেনাদলের প্রশিক্ষণের জন্যে নজরুলকে যেতে হয়েছিল পেশোয়ারে, আর জুলফিকার গিয়েছিল বোম্বাই। যুদ্ধ শেষ হলে ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জী কম্পানীতে জুলফিকার চাকরি করতে ঢোকে, আর সেই সুবাদে পৃথিবীর অনেক দেশেই যাবার সুযোগ হয়েছিল তার। কবিতাও লিখত জুলফিকার, সেই কবিতায় নজরুলের প্রভাব কম ছিল না।ধীরে ধীরে নবযুগে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল নজরুল। সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নানা খবরের পরিবেশন এবং বিশ্লেষণ ছাড়াও নতুন নতুন উৎসাহী পাঠক তৈরিতে বেশ খানিকটা সফল হল সে। মননে, বয়েসে, শিক্ষায়, পেশায়, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর পাঠকদের জন্যে তৈরি হল নির্দিষ্ট আলাদা-আলাদা বিভাগ। প্রতিদিনের কাগজের অষ্টম পৃষ্ঠা এই বিশেষ বিভাগগুলোর জন্যে নির্দিষ্ট। সোমবার ছোটদের পাতা, প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিল খোশরোজের মেলা, পরিচালনায় আতশবাজ। বেশিদিন এ-নাম ভালো লাগল না কবির নিজেরই, নাম বদলিয়ে করা হল “আগুনের ফুলকি,” সভ্যদের বলা হত ফুলকি, সঙ্গে থাকত সংখ্যা। অর্থাৎ যে-সব ছেলেমেয়েরা “আগুনের ফুলকি”র সভ্য হত, তাদের পরিচয় ফুলকি ১, ফুলকি ২ ইত্যাদি। নতুন নাম ঘোষণা করা হল নতুন কবিতার সঙ্গে; কবিতার নাম আগুনের ফুলকি ছুটে, লেখক কাজি নজরুল ইসলাম: আগুনের ফুলকি ছুটে       ফুলকি ছুটে! আগুনের ফুলকি ফুটে       নবযুগ-পত্রপুটে আগুনের ফুল কি ফুটে? ইত্যাদি।মঙ্গলবার মহিলাদের জন্যে নির্দিষ্ট বিভাগ, “মহিলা আসর,” পরিচালিকা শিরী।বুধে “লাঙ্গল ও হাতুড়ি,” শ্রমজীবীদের আসর, পরিচালক শ্রমসুন্দর।বৃহস্পতিবার “ব্যবসা ও বাণিজ্য,” পরিচালক সওদাগর।শুক্কুর বারে “বিশ্ব মুসলিম,” পরিচালক এব্‌নে খল্‌দুন।শনিবারে মঞ্চ ও ছায়াছবির জগৎ নিয়ে বিশেষ বিভাগ “রূপ ও ছন্দ,” সম্পাদক রূপকার।আর, অষ্টম পৃষ্ঠায় প্রতি রবিবার সাহিত্যবাসর “রসের জলসা।” স্বয়ং নজরুল ইসলাম যে পত্রিকার সম্পাদক, তাতে কি আর সাহিত্যবাসরে আলাদা করে কোন সম্পাদক লাগে?পয়লা ডিসেম্বর বিরাট খবর নবযুগে, আকর্ষক হেডলাইন: হক মন্ত্রিসভার পদত্যাগ: বাঙ্গলার মন্ত্রি-সঙ্কটের অনিবার্য্য পরিণতি/ সোমবার দ্বি-প্রহরে লাট-ভবন হইতে ইশ্‌তাহার/ গভর্ণরের সিদ্ধান্তসাপেক্ষে মন্ত্রিদিগকে স্ব স্ব কর্তব্য পালনের নির্দেশ/ বাঙ্গলার নূতন মন্ত্রিসভা গঠন সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা/ প্রগ্রেসিভ এ্যাসেম্বলী পার্টির সেক্রেটারীর বিবৃতি।এর পরের দিন স্পষ্টতই হক সাহেবের সমর্থনে সম্পাদকীয়। দায়ী কে? – এই শিরোনামে বেশ দীর্ঘ এই সম্পাদকীয়, তারই কয়েকটা লাইন: “......মন্ত্রিসভার যে কলহ বাধিয়াছিল, তার জন্যও হক সাহেব দায়ী ন'ন, এবং পরিণামে হক মন্ত্রিসভার যে পদত্যাগ করিতে হইল, তার জন্যও হক সাহেব দায়ী ন'ন। মন্ত্রিসভায় কলহ বাধিল কেন? যে-কোয়ালিশন চার বছর ধরিয়া ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণভাবে হক-মন্ত্রিসভার প্রত্যেক মন্ত্রীকে সমর্থন করিয়া আসিয়াছিলেন, সেই কোয়ালিশনের একটা বিরাট দল, যে-কোন কারণেই হোক, বলিলেন যে, অমুক মন্ত্রীর প্রতি তাঁদের আস্থা নাই, তিনি মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব সুষ্ঠুরূপে পালন করিতে পারিতেছেন না; কাজেই তিনি পদত্যাগ করুন। ভদ্রলোক যদি মন্ত্রিত্বের গদি কামড়াইয়া পড়িয়া না থাকিতেন, তিনি যদি কোয়ালিশনের ঐ বিরাট অংশের মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাইয়া মন্ত্রিত্বের লোভ ত্যাগ করিতেন, তবে পরের দিনই কোয়ালিশন দলের ঐক্য ও মুসলিম-সংহতি কায়েম হইয়া যাইত।“স্বার্থত্যাগ করিয়া মুসলিম সংহতি রক্ষার দরুণ উক্ত পদত্যাগী মন্ত্রী মুসলিম জনগণের চোখে ঊর্দ্ধে উঠিয়া যাইতেন। মুসলিম বাঙ্‌লার সামনে একটা ত্যাগের আদর্শও স্থাপিত হইত।“কিন্তু তিনি এই সব কিছুই করিলেন না। “মুসলিম সংহতি চুলায় যাউক, আমার মন্ত্রিত্ব থাকিলেই হইল” বলিয়া তিনি ছিনা-জোঁকের মত মন্ত্রীত্বের গদিতে মরণ-কামড় মারিয়া পড়িয়া থাকিলেন। অথচ হক সাহেব প্রধান মন্ত্রী হিসাবে কোয়ালিশনের লিডার হিসাবে ও গণনেতা হিসাবে কোয়ালিশনের ৪৭ জন সদস্যের সমবেত অভিমত উপেক্ষাও করিতে পারিলেন না। তিনিও, কাজেই, উক্ত মন্ত্রীকে পদত্যাগের জন্য প্রথমে অনুরোধ ও অবশেষে আদেশ করিলেন...।“...তাই দল বাঁধিয়া তাঁরা পদত্যাগ করিলেন। এতেই হক মন্ত্রিসভার পতন হইল।” এবং এই সম্পাদকীয়র শেষে নজরুলের 'আল্লা পরম প্রিয়তম মোর' শিরোনামে নাতিক্ষুদ্র এক কবিতা! এবং এটাই এখন নজরুলের সিগনেচার-ছাপ!আসলে, সাম্প্রতিক মুসলিম রাজনীতি ঠিকঠাক বুঝতে পারে না নজরুল। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি রক্ষার ব্যাপারে দেশবন্ধু, এবং তাঁর অকালমৃত্যুর পর সুভাষবাবু, যে উদারতার সঙ্গে সম্প্রদায়গত বিভেদের মোকাবিলা করবার চেষ্টা করেছেন, এমনটা আর কেউ করেছেন বলে নজরুলের জানা নেই। ছাব্বিশ সালের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময় নজরুল কৃষ্ণনগরে। সে বছর সে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির সভ্যও নির্বাচিত হয়েছিল। এই সম্মেলনের তিন বছর আগে চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ পার্টির নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জের অধিবেশনে যে হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট অনুমোদিত হয়েছিল, ছাব্বিশের সম্মেলনে, যখন চিত্তরঞ্জন আর নেই আর সুভাষ জেলবন্দী, তখন 'কংগ্রেস কর্মীসঙ্ঘ' নাম দিয়ে কংগ্রেসের এক শক্তিশালী উপদল প্যাক্ট ভেঙে দেবার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছিল কৃষ্ণনগরে। ওই প্যাক্ট আর তখন বাঁচিয়ে রাখার কোন উপায়ই ছিল না; দেখেশুনে নজরুল মজা করেই লিখেছিল বদ্‌না-গাড়ুতে গলাগলি করে, নব প্যাক্টের আশনাই, মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই!জল অনেকটা গড়িয়ে উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের নতুন প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী যখন সাঁইত্রিশে বিভিন্ন রাজ্যে প্রাদেশিক নির্বাচন হয় – জওহরলাল নেহ্‌রু যখন কংগ্রেস-সভাপতি – সেই নির্বাচনে, শুধুমাত্র শিডিউল্‌ড্‌ কাস্ট হিন্দুই নয়, মুসলমানদের জন্যেও সংরক্ষিত আসন থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস আশাতীত ভালো ফল করে। এমনকি নির্বাচিত মুসলমানদেরও একটা বড় অংশ – মুসলিম লীগ নয় – কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে জয়লাভ করে। সেই সময় জওহরলাল মন্তব্য করেন, ভারতের ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে পক্ষ কেবলমাত্র দুটিই, কংগ্রেস আর ব্রিটেন, অন্য কোন তৃতীয় পক্ষই নেই! জিন্নাহ্‌, সেই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, সারা ভারতে মুসলিম জনসংযোগ শুরু করলেন উলেমাদের সাহায্য নিয়ে। এর আগেই আলিগড় য়্যুনিভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষকদের একটা আন্দোলন তৈরি হচ্ছিল – সেটা অবিশ্যি অভিজাত মুসলমানদের আন্দোলন, একটু এলিটিস্ট। সাধারণ মুসলমানদের এড়িয়েই চলত তারা! কিন্তু উলেমাদের যোগদানের পর সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও খানিকটা অস্পষ্ট একটা মুসলিম নেশনহূডের ধারণা তৈরি হতে শুরু করল। উনিশশো উনচল্লিশের মধ্যেই মুসলিম লীগের সভ্যসংখ্যা ছাড়িয়ে গেল তিরিশ লক্ষ!উনচল্লিশে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিটিশরাজ ভারতের হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে অনেকেই, যেমন জওহরলাল, রাজাগোপালাচারি, মৌলানা আজাদ ইত্যাদি, আদর্শগত ভাবে এই যুদ্ধে ব্রিটেনেরই সমর্থক ছিলেন, কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে এমনকি পরামর্শও না-করে তাদেরই হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করার প্রতিবাদে কংগ্রেস সমস্ত মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করল। এই সুযোগ, নেহ্‌রুর 'কোন তৃতীয় পক্ষই নেই'-এর জবাব দিয়ে দিলেন জিন্নাহ্‌, এই আপৎকালীন অবস্থায় আমরা সরকারের পক্ষে আছি। তিনপক্ষের এক পক্ষ আমরা! ওয়ান আপন থ্রী! এখন কোন বিষয়ে আলোচনা-সিদ্ধান্ত আমাদের বাদ দিয়ে করা চলবে না; কংগ্রেসের বড়দাগিরি আমরা মানি না, আমরা কংগ্রেসের পদত্যাগে ডেলিভারেন্স ডে পালন করছি, মুক্তি দিবস!বাংলার প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব কখনো কখনো লীগ, কখনো তিনি কৃষক-প্রজা, কিছুদিন পর অবিশ্যি লীগে তাঁর সভ্যপদও কেড়ে নেবেন জিন্নাহ্‌, কিন্তু পরের কথা পরে! সে সময় বাংলায় মুসলিম লীগ প্রধানত অবাঙালি মুসলিমদের দল: আর তাই যদি হয়, তাহলে কোন্‌ নেশনভুক্ত বাঙালি মুসলমানরা? বাঙালি নেশন না মুসলিম নেশন?এই নেশনহূডের তোলপাড় যখন চলছে, তখন নজরুল রাজনীতি বা শাসন ব্যবস্থা তো নয়ই – এমনকি কবিতা নিয়েই বা কতটুকু মাথা ঘামায়? সে তখন হয়তো নভোচারী – মহাকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত কোন কল্পিত মধুর তিয়াস তার তখন!অনেক দিন আগে, করাচি থেকে কলকাতায় এসে নজরুল যখন নবযুগে কাজ করতে গিয়েছিল, তখন তো নবযুগ ছিল মুজফ্‌ফর আর তাদের নিজেদের আদর্শ প্রচারের মাধ্যম। দেশের ব্যাপারে, মানুষের ব্যাপারে, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদের একটা অস্ত্র। ফজলুল হক সাহেব তো নিজেই একটা পত্রিকা প্রকাশ করে ওদের সেখানে কাজ করতে ডাকেননি, তখন প্রয়োজনটা ছিল ওদের নিজেদেরই। ওরাই হক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে, নিজেদের যোগ্যতার বিষয়ে তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্বাস উৎপাদন করিয়ে তাঁকে দিয়ে নবযুগ চালু করালো। মাসিক বেতন কতো পাবে হক সাহেবের থেকে, তা নিয়ে মাথাই ঘামায়নি ওরা। যে-লেখা নজরুল তখন লিখেছে সেই নবযুগে, তা পড়ার জন্যে কলকাতার রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত মানুষ, হকার আসতে-না-আসতেই সব পত্রিকা বেমালুম ফাঁকা।আজ সাড়ে তিনশো টাকা বেতনের চাকর নজরুল সম্পাদকীয় লেখে মূলত হক সাহেবকে সন্তুষ্ট করার জন্যে। তার মানে এই নয় যে যা সে লেখে, সে নিজেই তাতে বিশ্বাস করে না। তার নিজের মনে হয় দেশের এবং মুসলমানের স্বার্থরক্ষার জন্যেই হক সাহেব কাজ করছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে লীগ যা বলছে তা শুনলে কেমন যেন সবকিছু ঘুলিয়ে যায় তার। তাই মাঝে-মাঝেই আল্লাহ্‌ বা ঈশ্বরের প্রশস্তি করে কবিতা লেখে নজরুল। যদি সে ভুল করে থাকে কোথাও, আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ্‌ তো ভালবাসেন নজরুলকে!উনচল্লিশের এই যুদ্ধ এতদিন চলছিল য়্যোরোপে, খানিকটা উত্তর আফ্রিকায়। এবার এশিয়ায় এমন যুদ্ধে নেমে পড়ল জাপান যে তোলপাড় হয়ে গেল সারা পৃথিবীতে। সাতুই ডিসেম্বর জাপান শুধুই যে ঘোষিতভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ঢুকে পড়লতা-ই নয়, সরাসরি আক্রমণ করে বসল আমেরিকার বন্দর ও সেনাবাস, পার্ল হার্বার। পনেরই ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ব্রিটিশ রাজশক্তির জাপানের কাছে আত্মসমর্পণ, পলায়ন বর্মা থেকে, আর সিঙ্গাপুরের পতন!সুভাষের সেই জানুয়ারি মাসের নিষ্ক্রমণের পর তাঁর আর কোন খবর নেই সাধারণ ভারতবাসীর কাছে। সুভাষ কোথায়? – কেউ জানে না। কলকাতায় জোর গুজব, সুভাষের বদলে এবার শরৎ বোসকেই গ্রেপ্তার করবে ব্রিটিশ সরকার। পয়লা ডিসেম্বরে লীগ-হক মন্ত্রীসভার পতনের খবর তো বেরিয়েই গেছে নবযুগে। তারপর প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পার্টির নেতা হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করে মন্ত্রীসভা গঠন করার প্রস্তাবও হক সাহেব দিয়েছেন ছোটলাট হার্বার্টকে। হার্বার্ট সাহেব – সম্ভবত লীগের নেতাদের পরামর্শেই – টালবাহানা করেই চলেছেন। এমন সময় হঠাৎ দিল্লী থেকে ভাইসরয় লিনলিদগোর জরুরি বার্তা আসে ছোটলাটের কাছে: এই মুহূর্তেই হককে মন্ত্রীসভা গঠন করতে বল। জাপানের থাপ্পড় ব্রিটেনের গালে লাগবার পর বর্মা-সিঙ্গাপুর থেকে দলে দলে উদ্বাস্তুরা আসবে এবার। জেনে রেখ, জন্মগতভাবে যারা ভারতীয় এবং বর্মী, পবিত্র ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিষয়ে কোনই আবেগ নেই তাদের। খুব সম্ভবত এদের মধ্যেই মিশে থাকবে পঞ্চম বাহিনীও। অনেকেই এরা বর্মার জঙ্গল পেরিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতিদের এলাকার মধ্যে দিয়ে মূল ভারতে আসবার চেষ্টা করবে। এখন আমাদের অস্ত্র হবে পোড়ামাটি নীতি; নৌকো-জাহাজ-সাইকেল-গাড়ি সব ধ্বংস করতে হবে, ধ্বংস করতে হবে যাবতীয় খাদ্যশস্য। কাজেই তোমার প্রয়োজন এখন একটা মন্ত্রীসভা, সেই মন্ত্রীসভাকে কাজে লাগিয়েই করা যাবেএ-সব। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর নয়, পারলে আজই মন্ত্রীসভা চাই!ছোটলাটের কাছ থেকে জরুরি খবর পেয়ে হক সাহেব আসেন। মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান পেয়ে তিন জনের নাম লিখে তিনি তৎক্ষণাৎ সাহেবের কাছে দেন: তাঁর নিজের নাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, এ-ছাড়া শ্যামাপ্রসাদ আর শরৎ বোস।শরৎ বোস? – আতঙ্ক ছোটলাটের গলায়। ওকে অ্যারেস্ট করার জন্যেই তো এত তাড়াতাড়ি! ও তো জাপানের গুপ্তচর। এক কাজ করুন, ছোটলাট বলেন, আপাতত আপনি একাই শপথ নিন, ওকে অ্যারেস্ট করুন, বাকি কাজ তারপর।হকসাহেব রাজি হলেন না, ফিরে গেলেন তিনি। ফিরে আসবার আগে সাহেবকে বললেন, ওই অ্যারেস্টের কাজটুকু আপনি নিজে করিয়ে, তারপর আমায় খবর দেবেন। তারপর মন্ত্রীসভা!শেষ পর্যন্ত এগারই ডিসেম্বর হকসাহেবের নেতৃত্বে প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পার্টির মন্ত্রীসভা – যা পরে শ্যামাহক মন্ত্রীসভা নামে পরিচিত হয়েছিল – শপথ নেয়। সেদিনই সকালে ঊডবার্ণ পার্কের বাড়ি থেকে শরৎকে ভারত রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, পাঠিয়ে দেয় দক্ষিণ ভারতে। (নিষ্ক্রমণের পর যখন সারা ভারতবর্ষ সুভাষের হালহকিকত নিয়ে চিন্তিত, সেই সময় কিছুদিনের মধ্যেই শরতের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে ফেলেন সুভাষ। একচল্লিশের ৩১শে মার্চ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে ভগৎ রাম নামে একজন কলকাতায় শরতের পুত্র শিশিরের সঙ্গে দেখা করে সুভাষের চিঠি এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে যায়। শান্তিময় গাঙ্গুলি নামে একজন বিপ্লবীর সঙ্গে ভগৎ রামের যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয় সেই দিনই। পরে অবিশ্যি নানা কারণে এই যোগাযোগ ছিন্ন করতে হয়।সুভাষ সেই সময় বার্লিনে ছিলেন। কলকাতার জাপানী দূতাবাস এবং টোকিওকে কাজে লাগিয়ে শরতের সঙ্গে সুভাষের যোগাযোগের ব্যবস্থা হয়। কলকাতার জাপানী কনসাল-জেনারাল কাতসুও ওকাজাকিকে গাড়ি চালিয়ে রিষড়ায় ওঁদের বাগান-বাড়িতে নিয়ে আসতেন শিশির, এভাবেই থাকত যোগাযোগ। ওকাজাকি বদলি হয়ে যাবার পর ওতা নামের আরেকজন আসেন তাঁর জায়গায়। ওতার স্ত্রী শাড়ি পরতে ভালোবাসতেন। এই শাড়ি-পরিহিতা স্ত্রীকে নিয়ে ওতাও বহুবার শিশিরের গাড়িতে রিষড়ায় এসেছেন। শাড়ি-পরা জাপানী মহিলা, সকলের তো চোখে পড়বেই! পুলিশও নিশ্চয়ই জানত এই সব ব্যাপার-স্যাপার, হয়তো চেষ্টাও করত কিছু-একটা করবার, কিন্তু প্রমাণের অভাবে করা যেত না কিছুই। কিন্তু একেবারেই অকস্মাৎ বার্লিনে জাপানের রাজদূতকে পাঠানো শরৎ-সুভাষের উনিশশো একচল্লিশের পয়লা সেপ্টেম্বরের কোন বার্তার উল্লেখ-করা জাপান-বিদেশ-মন্ত্রীর একটা টেলিগ্রাম ব্রিটিশ গোয়েন্দারা – যাকে বলে ইন্টারসেপ্ট – তা-ই করে ফেলে। এই টেলিগ্রাম সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখে পৌঁছোয় একেবারে চার্চিলের টেবিলে! হাতে-নাতে প্রমাণ, অতএব সেই পাঁচুই সেপ্টেম্বর থেকে যে-কোনদিনই শরৎকে গ্রেপ্তার করা চলত!)শরতের গ্রেপ্তার, এশিয়ায় জাপানের হাতে ব্রিটেনের উত্তমমধ্যম, উত্তর-পূর্ব ভারতে পোড়ামাটি নীতি প্রয়োগের পরিকল্পনা, রকমারি এইসব বিষয়ে খানিকটা যখন পর্যুদস্ত ব্রিটেন ফেব্রুয়ারির গোড়ায় তখন আর এক এশীয় দেশ – জাপান-আক্রান্ত চীন সরকারের! – প্রধানকে ভারত পরিদর্শনে ভারতস্থ ব্রিটিশ সরকার আহ্বান করেন। সস্ত্রীক মার্শাল চিয়াংকাইশেককে সংবর্ধনা দেওয়া হয় কলকাতায়। এই উপলক্ষে গ্রামোফোন কম্পানী নজরুলকে তাঁদের সম্বর্ধনার উপযুক্ত কোন গান লিখে সুরসংযোগ করবার দায়িত্ব দেয়। ইনিয়ে বিনিয়ে চীন-ভারত-ব্রিটেনের সখ্য নিয়ে গান গাইবেন নজরুল, এ-ই বোধ হয় ধারণা ছিল গ্রামোফোন কম্পানীর। তার বদলে নজরুল লিখলেন: চীন ও ভারতে মিলেছি আবার মোরা শত কোটি লোকচীন ভারতের জয় হোকঐক্যের জয় হোক সাম্যের জয় হোক।ধরার অর্ধ নরনারী মোরা রহি এই দুই দেশেকেন আমাদের এত দুর্ভোগ নিত্য দৈন্য ক্লেশে,সহিব না আর এই অবিচার খুলিয়াছি আজ চোখ।। প্রাচীন চীনের প্রাচীর ও মহাভারতের হিমালয়এই কথা যেন কয়মোরা সভ্যতা শিখায়েছি পৃথিবীরেইহা কি সত্য নয়?হইব সর্বজয়ী আমরাই সর্বহারার দলসুন্দর হবে, শান্তি লভিবে নিপীড়িত ধরাতল।আমরা আনিব অভেদ ধর্ম নব বেদগাথা শ্লোক।। আর গ্রামোফোন কম্পানীতে নজরুলের পরিচিতি তো নতুন নয়, কয়েকজন নতুন শিল্পীকে শিখিয়ে-পড়িয়ে তাদের গাওয়া এই গান অতি দ্রুত রেকর্ডও করিয়ে দিলেন নজরুল।এবং, গ্রামোফোন কম্পানীর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক শেষ হল এই ভাবেই!শরতের গ্রেপ্তারের পাঁচ মাস পর, উনিশশো বিয়াল্লিশের উনিশে ফেব্রুয়ারি, সুভাষের নিষ্ক্রমণের পর এই প্রথম অপ্রস্তুত ভারতবাসী শুনল সুভাষের কণ্ঠস্বর, রেডিওয়: সুভাষ বলছি – This is Subhas Chandra Bose speaking to you over the Azad Hind (Free India) Radio!সারা ভারতের রাস্তাঘাটে, অফিসেবন্দরে, বাসেট্রেইনে, স্কুলেকলেজে, সেদিন একজনকে নিয়েই আলোচনা আর উত্তেজনা: সুভাষচন্দ্র। নবযুগের সম্পাদকীয় অফিসেও যে একই উত্তেজনা তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নানা আলোচনায় যে যে-খবর বেরিয়ে এল তার সারাংশ করলে দাঁড়ায় এইরকম: সুভাষ তাঁর পূর্বপরিচয় বদলিয়ে নামে এবং বেশে মহম্মদ জিয়াউদ্দীন হিসেবে কলকাতা ছেড়ে প্রথমে পেশোয়ার, তারপর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ছাড়িয়ে কাবুল হয়ে নানা জায়গা এবং বহু বিঘ্ন অতিক্রম করে অবশেষে ওর্লাণ্ডো মাজোতা ছদ্মনামে ইতালিয় পাসপোর্টের সাহায্যে য়্যোরোপ পৌঁছোন। প্রধানত ইতালি এবং জর্মনিতে এইসব দেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে, বিশেষ করে মুসোলিনির সহায়তায়,ভারতীয়-জন্মের ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দীদের একত্র করে ইণ্ডিয়ান লীজিয়ন বা ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠনের কাজে তিনি আপাতত নিযুক্ত আছেন। য়্যোরোপে পৌঁছবার পর আজই প্রথম ওর্লাণ্ডো মাজোতা তাঁর ছদ্মনামের বদলে নিজেকে সুভাষ নামে পরিচয় দিলেন।আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে সুভাষ বলেন, জাপানের হাতে সিঙ্গাপুরের পতন স্পষ্টতই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ধ্বংস সূচিত করছে। অস্তমান ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অর্থই হল উদীয়মান স্বাধীন ভারতবর্ষ, ভারতের ইতিহাসে নবসূর্যোদয়। এবং এখান থেকেই শুরু হতে চলেছে এশিয়া তথা সমস্ত পৃথিবীর স্বাধীন মানুষ এবং মনুষ্যত্বের জয়যাত্রা। সুভাষ আরও বলেন, স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর দায়িত্ব এখন আরও বেড়ে গেল।উনিশে ফেব্রুয়ারিতে সুভাষের এই বক্তৃতা সব ভারতবাসীর মতো নজরুলের মনেও প্রবল উত্তেজনা তৈরি করে। সাধারণত যে-সময় সে অফিস যায় এখন সেই সময়টা এগিয়ে আসে, এবং অফিস থেকে বেরোবার সময়ও যায় পিছিয়ে।আড্ডা-আলোচনা – সবই যেন এখন এই একটাই বিষয়কে কেন্দ্র করে। গান্ধী ভারত-ছাড় ডাক তখনও দিতে পারেননি, কংগ্রেসে নানারকমের তর্ক-বিতর্ক চলছে; কে যেন সেদিন বলল, গান্ধী এখন বলছেন, উনচল্লিশে সুভাষের বক্তব্য তিনি নিজে ঠিক বুঝতে পারেননি। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিবর্তিত অবস্থা স্পষ্টই দেখিয়ে দিচ্ছে সুভাষের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি অনেকের, এমনকি তাঁর নিজের চেয়েও, অনেক তীক্ষ্ণ। যদিও খানিকটা দেরি হয়ে গেছে, এখন তিনি আর অপেক্ষা করতে রাজি ন'ন। এখনই ইংরেজকে তাড়ানো দরকার। তাড়াতেই হবে। গান্ধীর গলার সুর শুনে কেউ কেউ এমনটাও বলল যে, হিংসা-অহিংসা এখন আর গান্ধীর কাছে তেমন কিছু বড় ব্যাপার নয়!আজকাল বাড়ি ফেরার পরও নজরুল উত্তেজনা প্রায় ধরে রাখতে পারে না। গত কয়েকদিন রাতে তার যোগাভ্যাসেও ঠিকমতো মনোনিবেশ করতে পারছিল না সে। অফিসে এসেও কাজে মন লাগে না।যোগাভ্যাসে অনিয়ম হলে কেমন যেন শরীর খারাপ লাগে নজরুলের। সুভাষবাবুর বক্তৃতা শোনা গেল এখন থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে। তার পর থেকে ঘুমেও অসুবিধে হচ্ছে। এর আগেও কখনও কখনও এমনটা হয়েছে নজরুলের। ও দেখেছে, দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটিতে গিয়ে একা-একা চুপচাপ বসে থাকলে ও একটু শান্তি পায়।আজ নজরুল একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। তার দপ্তরে সে-ই তো প্রধান, কারোকে কিছু বলার প্রয়োজন হল না তার। দক্ষিণেশ্বরে যাবে সে।পরের দিন দুপুরে নজরুলের পুত্র সব্যসাচী হাজির নবযুগের অফিসে। বাবা কাল অফিস থেকে বাড়ি ফেরেনি। গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে, রেডিওতে, কলকাতার নানা থিয়েটারে, সওগাতের অফিসে, কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। নজরুলকে পাওয়া যাচ্ছে না – খবরটা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। শেষ পর্যন্ত হক সাহেবের কানেও উঠল খবরটা। তিনি স্বরাষ্ট্র-দপ্তরকে জানালেন, নজরুলকে পাওয়া যাচ্ছে না, খুঁজে বের কর তাকে।চব্বিশ ঘন্টারও বেশি অতিক্রান্ত হবার পর বেলঘরিয়া থানা থেকে খবর পাওয়া গেল, গত দু-দিন যাবৎ ওই থানাতেই তিনি আছেন, নিজের পরিচয় দেননি, এখনও একটা ঘোরের মধ্যেই আছেন তিনি। এখন নজরুলের খোঁজ শুরু হবার পর থানারই একজন কর্মচারি তাঁকে নজরুল বলে শনাক্ত করেছেন।থানার অফিসাররা বললেন, বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁরা জানতে পেরেছেন, দু-দিন আগে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির চত্বরে আসেন। সেখানে একটা গাছের নীচে একাই বসে ছিলেন, বিশেষ কেউ তাঁকে লক্ষ্য করেনি। বসে থাকতে থাকতে এক সময় ওই গাছের নীচেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝ-রাত্তিরে – ঠিক কত রাত্তিরে তা বোঝা যাচ্ছেনা – তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর তিনি মনে করার চেষ্টা করেন, কেন ওই গাছের নীচে তিনি বসেছিলেন, কিন্তু ঠিক ঠিক মনে করতে পারেননি।পুলিশ যখন তাঁকে রাস্তায় প্রথম দেখতে পায় তখন ভোর হয়ে আসছে। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ব্যারাকপুরের দিক থেকে কলকাতার দিকে তিনি আসছিলেন হেঁটে হেঁটে। এখন যুদ্ধের সময়, বড় বড় মিলিটারি ট্রাক রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে আসা-যাওয়া করছে। নজরুলের চলার ভঙ্গি খানিকটা মাতালের পদক্ষেপের মতো ছিল। যে-কনস্টেব্‌ল্‌ প্রথম তাঁকে দেখে, সে একজন মাতাল বলেই মনে করেছিল তাঁকে, এবং লোকটা যখন-তখন লরির ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কাতেই তাঁকে থামিয়েছিল। কথাবার্তা এতই অসংলগ্ন যে, কিছুই না-বুঝতে পেরে, আরও দুয়েকজনের সাহায্যে সে তাঁকে থানায় নিয়ে আসে।এই দু'দিন ধরে কথাবার্তার পর পুলিশ যা বুঝতে পেরেছে তা হল, প্রথমত, মাতাল তিনি ছিলেন না। যদিও ব্যারাকপুরের দিক থেকে তিনি আসছিলেন কলকাতার দিকে, প্রথমে নজরুল এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরেই, গাছের তলায় বসে বসে ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙার অনেকটা পরে তাঁর মনে পড়ে অরবিন্দ নামের কোন একজন মানুষের সঙ্গে তাঁর কিছু জরুরি কাজ আছে, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁকে অরবিন্দর কাছে পৌঁছোতে হবে। দক্ষিণেশ্বরের থেকে বেরিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করেন, এবং ব্যারাকপুরের কাছে এসে তাঁর মনে হয় তিনি রাস্তাটা ঠিক ঠিক চিনতে পারছেন না, এবং আবার উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেন। পুলিশের যে কন্‌স্টেব্‌ল্‌ তাঁকে থানায় এনেছে সে ওই অবস্থাতেই তাঁকে প্রথম দেখে।অরবিন্দ কোথায় থাকে? – পুলিশের এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে তিনি ঠিকঠাক কিছুই বলতে পারেননি। পরে মাঝে মাঝে বলেছেন পণ্ডিচেরি। এই পণ্ডিচেরি নাম শুনে পুলিশ ঘাবড়িয়ে যায়। পণ্ডিচেরি তো অনেক দূর। মাদ্রাজ-ফাদ্রাজ ছাড়িয়ে। হেঁটে হেঁটে সেখানে যাওয়া যায় নাকি! লোকটার কি মাথা খারাপ? নাকি, অন্য কোন পণ্ডিচেরির কথা বলতে চাইছিল সে? সে আবার বলছে, সেখানে নাকি দিলীপ নামেরও কেউ থাকে, তার ডাক-নাম মন্টু, সে এই নজরুলের বন্ধু। নজরুল বলেছেন, এই দিলীপ শুধু নজরুলেরই নয়, কোন এক সুভাষবাবুরও বন্ধু।সুভাষবাবু? সুভাষ নামটার সঙ্গে বাঙালি পুলিশ পরিচিত। কিন্তু কোন্‌ সুভাষের কথা বলছে এই পাগলটা? যে-সুভাষের নাম পুলিশ ভালোভাবেই জানে সে তো পুলিশকে বোকা বানিয়ে নিজের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে! তার সঙ্গে এই পাগলের যোগাযোগ? পুলিশরা নিজেদের কানকেও বিশ্বাস করে না। থানায় বসে বসে এই দু'দিনের মধ্যেও একা-একাই এই পাগল ভদ্রলোক গলা-ফাটিয়ে চিৎকার করে অরবিন্দর সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করছিলেন, এবং সফল না হতে পেরে খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। আরো একটা কথা ইনি বলছিলেন বারবার। সুভাষবাবুর কাছে এখন এক অরবিন্দই যেতে পারেন, আর যেতে তাঁকে হবেই। তা না হলে সব কিছুই নাকি ভেস্তে যাবে। কোন্‌ সুভাষ বাবুর কথা বলছেন? – জিজ্ঞেস করায় উনি কোন উত্তর দেননি, এবং মনে হল খুবই বিরক্ত হয়েছেন।পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হল, প্রথম প্রথম না-বুঝতে পারলেও কিছুক্ষণের কথাবার্তার পর পুলিশ বুঝতে পেরেছে যে উনি একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক, ওদেরই মধ্যে একজন তো কবি হিসেবেও নজরুলকে শনাক্ত করেছিল, হয়তো কোন পারিবারিক কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে একটু অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। নিজের নাম নিজের মুখে কিছুতেই বলছেন না। আর বলছেন না নিজের ঠিকানাও। এখন খাওয়া-দাওয়া করেছেন, শরীরও ভালো আছে। একা-একা বসে মাঝে মাঝে ধ্যানের মতো কিছু করছেনও।পুলিশের গাড়িতেই নজরুলকে ফিরিয়ে নিয়ে এল সব্যসাচী, কালীপদ গুহ আর জুলফিকার হায়দার। সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি সে। বাড়িতে ঢুকেই সব্যসাচীকে জড়িয়ে ধরে নজরুল, হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, যোগের শিক্ষা কিছুই হয়নি আমার। সেবার তো শ্রীঅরবিন্দ সূক্ষ্মদেহে প্রায় আধঘন্টা বসে থাকলেন আমার কাছে, কত কথা হল! এবার আর কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছি না তাঁর সঙ্গে। অথচ দেশের পক্ষে তো এখন জীবন-মরণ সমস্যা। সুভাষবাবু একা-একা বিদেশে, সেখানে তাঁকে সুরক্ষা দেবে কে? অরবিন্দ ছাড়া আর তো সুভাষবাবুর কাছে কেউ যেতে পারবে না! একমাত্র তিনিই পারেন সূক্ষ্মদেহে যেখানে-খুশি যেতে!ক্রমশ...
    ক্যালিডোস্কোপে দেখি - দিনের শেষে - অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়আমার জন্ম বাঁকুড়ায় হলেও সচেতন স্মৃতিতে প্রথম বাসাটিকে খুঁজে পাই দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির একতলার দুটি ঘরে। একটি ঘরে আমি আর মেজ ভাই ঠাকুমার সাথে একটি চৌকিতে আর অন্য ঘরটিতে মা-বার সাথে আরেক চৌকিতে ছোট ভাই–এই ছিল নিত্য বন্দোবস্ত। অসুস্থ হলে মাঝে মাঝে ঠাঁই বদল হওয়ার সু্যোগ ঘটত। সেই কারণেই কি আমি মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তাম? এখন আমার হাসি পেলেও সেই সময় এই বিষয়টা আমার বা আমাদের কারোর জন্যই হাসির ছিল না। আমি অসুখে পড়তাম একটু বেশিই।কর্মক্ষেত্রে বাবার উন্নতির লেখচিত্র যখন ঊর্ধমুখী সেইরকম সময়ে আমার এই দুনিয়ায় আগমন। তাই জীবনের অন্তত প্রথম দশটি বছর আমাদের পরিবারকে আর্থিক অভাবের মধ্যে পড়তে দেখিনি আমি। কিন্তু তাই বলে আমায় নিয়ে মায়ের দুর্যোগ-দুর্ভোগের কোন কমতি ছিল না। মায়ের কাছে শুনেছি যে যথেষ্ট সুস্বাস্থ্য নিয়ে জন্মেও কয়েক মাস পর থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় সত্বর ধরাধাম থেকে বিদায় নেওয়ার ব্যবস্থা আমার প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। তারপর চিকিৎসক এবং চিকিৎসাপদ্ধতির বদল ঘটিয়ে মা যে আমায় জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল আমার যুবক বয়সেও সেই গল্প বলতে গিয়ে মায়ের গলা ভারী হয়ে যেত। আর খুব ছোটবেলা থেকে সেই গল্প আমার মনে যে আবেশ, যে নিশ্চিন্ততা সৃষ্টি করে রেখেছিল তা আমায় অজস্র কঠিন দিন, অন্ধকার রাত অনায়াসে পার করে দিয়েছে! প্রবল অসুস্থতা, চূড়ান্ত অস্থিরতায় মা কিছুক্ষণ মাথার কাছে বসে কপালে কি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়েছি, শ্রান্তি কাটিয়ে, সুস্থ হয়ে জেগে উঠেছি। তাই বলে মাঝে মাঝে অভিমান কি আর হয়নি! ছোট ভাইটা কি আমাদের বাকি দু’ভাইয়ের তুলনার মাকে বেশি দখল করে রাখেনি! কে জানে আমরা দু’ভাই আসলেই মায়ের ছেলে কিনা! এই যে মা হাসপাতাল থেকে একদিন ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছিল, আমাদের দু’ভাইকেও ত অমনি করেই নিয়ে এসেছিল। কে জানে সেখানে আমাদের কেউ বদলে দিয়েছিল কিনা! আমার মা আসলেই আমার মা, না কি অন্য কারো মা! না, না, সে হতে পারে না। মা আমাদের তিনজনেরই নিজের মা। তিন ভাইকেই আদর করে ত, অনেক করে। শিশুর মন কত যে সম্ভব-অসম্ভবের আনন্দ-শঙ্কার গলি-ঘুঁজিতে ঘুরে বেড়ায়! মাকে নিয়ে আমার যে নানা অনুভূতির দোলা আর দ্বন্দ্ব চলত, একটু বড় হয়ে এক আশ্চর্য বইয়ের পাতায় পাতায় তার প্রকাশ দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। আজো সেই বইয়ের ‘অন্য মা’ পড়তে গিয়ে চোখ না ভিজিয়ে পড়া শেষ করতে পারি না। স্মৃতির গহীনে আলো ফেলে দেখি আমি কোন কিছু চাইবার আগেই আমার বড় হওয়ার যা যা উপকরণ আমার বাবা দেখতে পেত, তার বিবেচনায় তাদের সেরাটি সে আমার জন্য কিনে নিয়ে আসত। আমার প্রথম বইয়ের সংগ্রহের মধ্যে ছিল যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সুখলতা রাও, এঁদের ছড়ার বই। ছিঁড়বেনা এমন চমৎকার কাগজে রঙিন ছবি আর ছড়ার সমাহার। আর ছিল একটি গল্পের বই, সেটি একেবারেই অন্য রকম। সাদা-কালো বই। অজস্র ছোট ছোট গল্পের সংগ্রহ-কথামালা। ঈশপের গল্পগুলিকে সেই বইয়ে বাংলাভাষায় নিয়ে এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আমি একটু একটু করে পড়তাম। সে বইয়ের অনেক গল্প বুঝতে না পারলেও তারা আমায় কল্পনার নানা জগতে নিয়ে যেত। ছোটবেলার এই সব পছন্দের বইগুলি অনেককাল আমার সাথে থাকলেও একে একে তারা হারিয়ে গিয়েছিল।একটি বই হারিয়ে যায়নি, কিন্তু বহু ব্যবহারে তাকে আমি এত জীর্ণ করে ফেলেছিলাম যে বারে বারে সারিয়েও এক সময় তাকে বিদায় জানিয়ে তার হাল আমলের সংস্করণ কিনে নিতে হয়েছিল। সেই বইয়ের কথায় যাওয়ার আগে ক্যালিডোস্কোপ্টা একটু ঘুরিয়ে নি।কুচবিহারে বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠে চতুর্থ শ্রেণীতে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল। হঠাৎ একদিন, সম্ভবত মধ্যাহ্ন বিরতির সময় একজন মাস্টারমশাই, তাঁদের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটি বড় বই থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদ আর একটি কবিতা পড়তে বললেন। পড়লাম। পড়া শেষে ওনার কথা মত বিবেকানন্দ রচনাবলীর ঐ খন্ডটি থেকে পড়া অংশগুলো দুটো কাগজে টুকে নিলাম। প্রতিলিপি করার সেটাই উপায় তখন। ভাল করে মুখস্ত করে ফেলতে হল ঐ লেখাগুলো। তারপর বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দিন, রামকৃষ্ণ মিশনের সভাঘরে, মঞ্চের একধারে, মাইক্রোফোনের সামনে, মাস্টারমশাই কিংবা কোন মহারাজের কথামত, মনে পড়ছেনা এখন, বিবেকানন্দর ছবিতে যেমন দেখেছি তেমন করে, দুই হাত বুকের কাছে জড়ো করে আবৃত্তি করলাম–“হে ভারত ভুলিও না … …” পরিবেশ তৈরিই ছিল, হাততালি সহজে থামেনি। আরো কয়েকজন আবৃত্তি করেছিল। প্রথম হওয়া প্রতিযোগী হিসেবে নাম ঘোষণার পর জানলাম যে আমিও একজন প্রতিযোগী ছিলাম। পুরস্কার জুটল বেশ কিছু বই। একসাথে করে রঙিন ফিতে দিয়ে বাঁধা। আনন্দ হয়েছিল খুব। এর আগে নাটক করে এসেছি। আবৃত্তির সেই শুরু। ভাল লেগে গিয়েছিল নিজেকে প্রকাশ করার, পারস্পরিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটিকে। প্রথাগত শিক্ষা পাওয়া হয়নি, নিজের বোধ আর বড়দের কারো কারো পরামর্শ, এই সম্বল ছিল। তবে যতদিন না স্মরণশক্তির অবনতি হয়েছে আবৃত্তি করার দাবী বা অনুরোধ পেলে করতে দ্বিধা করিনি।এই আবৃত্তির ঝোঁককে এগিয়ে দিতে, কয়েকবছর বাদে জন্মদিনে বাবা উপহার দিল অনেক পাতার এক বই, কবিতা সংকলন–সঞ্চয়িতা। পরবর্তী কালে দেখেছি, যে সব বন্ধুদের পরিবারের বড়রা নিজেদের বাংলার সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন বলে ভাবতেন বা পরিচয় দিতে ভালবাসতেন তাদের প্রায় সকলের বাড়িতে এই বইটির উপস্থিতি ছিল নিশ্চিত। এই বইয়ের হাত ধরে আমার প্রবেশ ঘটল তাঁর রাজ্যে। পাতার পর পাতা উল্টিয়ে যে অনুভূতি হয়েছিল তাকে ভাষায় প্রকাশ করা আমার সাধ্যের বাইরে। আয়তনে বেশ বড় সেই বই–শুধুই কবিতার! আর কি অনায়াস ছন্দে সে সব কবিতাদের পড়ে যাওয়া যায়, কি সহজে তাদের ভিতরে ঢুকে যেতে পারছি! আবৃত্তি করতে গেলে কবিতা মুখস্ত করতে হয়, সহজে পারি না অনেক সময়। এই সব কবিতা ত আপনিই মনে গেঁথে যাচ্ছে! আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। তার পর ধীরে ধীরে, সে বই পড়তে পড়তে, আনন্দ ছাপিয়ে যে মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে গেলাম তা আর কাটল না। সব শব্দের অর্থ জানা থাকত না। বাড়িতে আমার জন্মের আগে থেকে দুটি বই ছিল, বাবার অত্যন্ত প্রিয় তারা। দুটি অভিধান। বাংলা থেকে ইংরেজি, এবং উল্টোটি। ফলে আটকে যাওয়া শব্দটির অর্থ জানতে আমি প্রথমে ইংরেজিতে যেতাম, সেখান থেকে বাংলায় ফিরতাম। কখনো কখনো একাধিকবার যাতায়াতে মূল কথাটি এবং তাকে ঘিরে আরো কিছু কথা জানা হয়ে যেত। শব্দরাজির এক বিপুল জগতের সাথে এই করে পরিচয় ঘটেছিল। আজ তাদের বেশির ভাগই ভুলে গেছি। তবে গুগল অনুবাদকের সাহায্যে বিভিন্ন ভাষায় ছোট ছোট অংশ পড়া বা লেখায় বারে বারে সেতু পারাপারের এই পদ্ধতির অভিজ্ঞতা এবং তার প্রয়োগ এখনো বেশ কাজে দেয়।কবিতা সংকলনটির পাতায় পাতায় কত রকমের যে অনুভূতির মুখোমুখি হলাম, কত যে অচেনা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ালাম, ভাবলে অবাক লাগে। এই বইয়ের জগতে যখন ঢুকছি তখন আমি পার হয়ে এসেছি ছড়া-ছবির দুনিয়া থেকে শুরু করে ঠাকুমার ঝুলি, কথামালা এমনকি বঙ্কিমের আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী। কিন্তু এরা কেউ আমার জন্য বড়দের বই ছিল না। আমার প্রথম বড়দের বই এই সঞ্চয়িতা, যেখানে মন আর শরীর পরস্পরের গলা জড়িয়ে শিহরিত হয়, মুখর হয়, চূর্ণ হয়, পূর্ণ হয়!স্থানীয় পাঠাগার থেকে হাতে এল গল্পগুচ্ছ। এও সম্ভব, এত এত গল্প, এত চমৎকার গল্প! আমার কিশোর মনটা একেবারে নাকানিচোবানি খেতে থাকত গল্পের ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে। আজ আর তাদের বেশীরভাগকেই মনে নেই, পরবর্ত্তী পঠনে অনেক গল্পের আবেদন-ও অতটা আর তীব্র লাগে নি। কিন্তু, সেই সময়ে ঐ গল্পগুলি পড়ার যে আচ্ছন্নতার বোধ তা আজও দূরের মনে হয় না।একটা সময় ঢুকলাম তাঁর প্রবন্ধ আর নাটকের দেশে। নাটকগুলি যখন পড়ছি, চারপাশে তখন গ্রুপ-থিয়েটারের জোয়ার চলছে। সেখানে বক্তব্য আসছে সমসাময়িক, অনেক প্রাবল্যের সাথে, সেই গতিপ্রবাহে রবীন্দ্রনাটকগুলির আস্বাদ সেই সময়ে ততটা নেওয়া হয়নি, যতটা নিয়েছি পরবর্ত্তী কালে। আর, প্রবন্ধগুলি তুলে ধরেছিল হরেক রকম চিন্তা-চেতনার সম্ভার। সেগুলিও আজকাল আরও বেশি করে উপভোগ করি। অন্য আর এক সময় মেতে উঠেছিলাম তাঁর মত করে কাটাকুটি, আঁকিবুঁকি দিয়ে ছবি বানানোয়। ছবি আঁকায় পারদর্শী হতে পারি নি, সে আর কী করা যাবে, কিন্তু ঐ সব ছবিগুলো আঁকায় যে মজা পেয়েছিলাম সেটা দুরন্ত ছিল।সঞ্চয়িতা ছাড়া তাঁর বাকি যে বইগুলি আমার কাছে আছে তাদের অবস্থা অতটা জীর্ণ হয়নি। দুঃখের কথা যে তাঁর সমগ্র রচনাবলী সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। আর সুখের কথা যে সেটি এখন অনলাইনে পাওয়া যায়, বিনামূল্যে, বিনা লগিনে, সবসময়। ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১০-এ কলকাতা পুস্তকমেলা উপলক্ষ্যে সেই যে এই অনলাইন রবীন্দ্র-রচনাবলী পাঠকসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল আজও সেই পরিষেবা একই ভাবে বহাল আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি এবং বৈদ্যুতিন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের এই মহৎ কাজটির জন্য কোন প্রশংসা বা ধন্যবাদ যথেষ্ট বলে মনে হয় না আমার।এমন একটা দিন যায় না যেদিন অন্তত একবার তাঁর গানের কোন কলি, কবিতার কোন পংক্তি, নাটকের কোন সংলাপ বা কোন চিত্রকর্মের কথা স্মরণ করা হয়নি। অথচ এমন ত নয়, তাঁর বিপুল সৃষ্টির এক কুচির বেশী কিছু পড়া হয়েছে আমার! আবার তাঁকে বাদ দিয়ে আর কিছুই পড়িনি, শুনিনি, দেখিনি এমনও ত নয়! তবু তাঁর কাছে না এসে উপায় থাকে না।তবে তাঁর যে সৃষ্টি সেই শৈশব-কৈশোর-প্রথম যৌবনে আদৌ সেভাবে বুঝিনি তা হচ্ছে তাঁর গান। যত দিন গেছে, জীবন যত পাক খেয়েছে, তলিয়ে গেছে, আর ভেসে উঠেছে, তত বেশী করে আমার আশ্রয় মিলেছে তাঁর গানে। ছোট বেলায় গানের চরণগুলি আসত-যেত, হাওয়া যেমন আসে, যায়, সহজ-সরল, সাবলীল, একান্তই পরিচিত। যত দিন গেল, গানগুলি বয়ে আনতে লাগল অনাঘ্রাত সুগন্ধ, অশ্রুত বাণী, অদেখা রূপ। একেক বিকেলে, সন্ধ্যায়, মোহন সিংয়ের কন্ঠে যখন অমৃত-বাণী ছড়িয়ে পড়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার চেতনা, আমার শরীর বসে থাকে চুপটি করে, আর অঝোর ধারে কোথা হতে উপচে আসে শ্রাবণ, বন্ধ দু চোখ বেয়ে। নাই থাকল আমার কোন জীবনদেবতা। আমার নিজস্ব বেদনা আরও কোন বৃহত্তর বেদনায় মিলেমিশে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাগসঙ্গীতে দক্ষ জীবনসঙ্গিনী যখন সমস্ত আর্তি মিশিয়ে তাঁর গান গাইতে থাকেন, তখন যে তীব্রমধুর আবেশে আমার চরাচর ডুবে যায়, সে কি কোন বাস্তব! আসলেই সে কোন মায়ার খেলা! ছোটবেলায় সারা বছরের সেরা দিনটা ছিল ২৫শে বৈশাখ। বাড়ির সামনে ছিল খোলা বারান্দা। সেখানে একটা চেয়ার কি নীচু টেবিলে ঢাকনা বিছানো। মা অথবা আমার সেলাইয়ের কারুকাজ করা, সারা বছর তুলে রাখা, দু-একটি বাছাই করা দিনের জন্য। টেবিলে কবির ছবি, প্রথম দিকের বছরগুলোতে কার্ডবোর্ডে আটকানো কাগজে, পরে ফটো-বাঁধাই। ছবিতে মালা, ফুলদানিতে রজনীগন্ধা, সামনে পাতাবাহারের কয়েকটি পাতা, কৃষ্ণচূড়া। মা-বাবা-ঠাকুমা-আমরা তিন ভাই, দুই কাকিমা, ছোট ছোট খুড়তুত ভাইবোনেরা, সবাই পরিস্কার জামা-কাপড় পড়ে গোল হয়ে বসেছি। ধূপ জ্বলছে। ভাই-বোনেরা একটার পর একটা কবিতা পড়া চলেছি, চলছে গান গাওয়া। কনিষ্ঠতম সহোদর ভ্রাতার খোলা গলা। মা, কাকিমারা ও ভাল গাইত। নিজের সম্বন্ধে আমার সেই যুগে খুব উঁচু ধারণা ছিল। সুর-তাল-লয়ের কি বিপর্যয় ঘটাচ্ছি সেটা বুঝতাম না। তাই মহানন্দে গেয়ে যেতাম। বেশি গান-ই হত সমবেত গলায়, ফলে আমার ত্রুটি ঢাকা পড়ে যেত অনেকটা। বয়সের সাথে সাথে নিজের অক্ষমতাকে ধরতে পেরেছি। আমার অসুরপনাকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলি। ছোটবেলার মানুষগুলিও দূরে দূরে, মা-বাবা, দুই কাকু-কাকিমা সবাই সব দূরত্ব অতিক্রম করে কেবলই স্মৃতিতে। এখন আমার সকল গান গীত হয় নিঃশব্দ উচ্চারণে। এখন ২৫শে বৈশাখ আর দশটা সাধারণ দিনের মত, রবির কিরণ ছোঁয়া।এবং তাঁর থেকে বহু যোজন দূরের। একবার, জীবনের এক বিশেষ দিন সেটি, জ্বালানী ভরা শেষ করে গাড়িতে উঠতে যাব, আমার গাড়ির পরেই যে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল সেটির চালকের আসন থেকে নেমে এসে ভিক্ষা চাইলেন এক মহিলা-তাঁর গাড়িটিতেও জ্বালানী ভরে দিতে হবে, এক গ্যালন-দু’ গ্যালন যতটুকু পারি। জ্বালানীর দাম আমার পক্ষে কম নয়। যখন ভরে দিতে শুরু করলাম, আরো দেওয়ার সম্ভাবনাকে খারিজ করে আমি ওনাকে দু’ গ্যালন জ্বালানীই মাত্র ভরে দিলাম। কিন্তু মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকল–বড্ড কৃপণতা হয়ে গেল কি? নিজের গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে মনের মধ্যে বেজে যেতে থাকল একসময়ের নানা আসরে উচ্চারিত স্বরকম্পন “তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে”। জানি, ইনি কোন রাজাধিরাজ নন, আর এ যুগের রাজাধিরাজরা আমাদের কাছে ভোট ছাড়া আর কিছু ভিক্ষা করেননা, তবু আরো কয়েক গ্যালন জ্বালানি হয়ত দেওয়া যেত। কিন্তু ভাবালুতা আর কতক্ষণ থাকে! চলে এলাম। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বাসের মানুষ। সংশয়ের নানা পথে হেঁটেও তাঁর জীবনবোধ তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসে স্থিত ছিল। আমি কেবল সংশয়ে স্থির, কোন বিশ্বাসেই আস্থাবান নই। কোন পারানির কড়ি নেই। দিনের শেষে আমার খেয়া, যেমনটি চেয়েছি, কোথাও যাবে না, ঘাটেই বাঁধা থেকে জীর্ণ হয়ে মিলিয়ে যাবে।ক্রমশ...
    বিপ্লবের আগুন - পর্ব চার - কিশোর ঘোষাল | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়৪রাজধানী শহর থেকে প্রায় পঁচিশ যোজন দূরের অনন্তপুর চটিতে ভল্লা যখন পৌঁছল, রাত্রি তখন প্রথম প্রহর পেরিয়ে গেছে। রাজধানী থেকে সে রওনা হয়েছিল শেষ রাত্রে। তারপর একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে এতদূরে আসা। অবশ্য মাঝে জঙ্গলের মধ্যে এক সরোবরের ধারে গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিল। বিশ্রাম দিয়েছিল তার ঘোড়াটাকেও। সরোবরের তীরে প্রচুর সবুজ আর সতেজ ঘাসের সন্ধান পেয়ে, ঘোড়াটা তার সদ্ব্যবহার করতে বিলম্ব করেনি। ওই অবসরে সেও দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছিল। পুঁটলিতে বাঁধা চিঁড়ে সরোবরের জলে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে মেখে সপাসপ মেরে দিয়েছিল। তারপর গামছা পেতে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম। ঘুম নয়, বিশ্রামই। প্রথম কথা ঘোড়াটাকে চোখে চোখে রাখতে হচ্ছিল। দ্বিতীয় কথা বিগত রাত্রিতে সে একবিন্দুও ঘুমোতে পারেনি, তার ওপর এই দীর্ঘ পথশ্রম। চোখের পাতা একবার বন্ধ করলেই, সে নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়বে – সেক্ষেত্রে তার যাত্রাভঙ্গ হবে। যে চটিতে আজই রাত্রে তার পৌঁছনোর কথা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। অতএব অর্ধ প্রহর বিশ্রামের পর সে ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে শুরু করেছিল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।দূর থেকে চটির দীপস্তম্ভের আলো চোখে পড়তেই সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেছিল। চটির আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু জনবসতি আছে। ভল্লা চায় না, সেই জনবসতির লোকদের সচকিত করে এই রাত্রে তাদের কৌতূহলী করে তুলতে। চটির সদর দরজা খোলাই ছিল, সে পথে না গিয়ে, আরও কিছুটা এগিয়ে একটি বন্ধ দরজার কাঠের পাল্লায় সে সন্তর্পণে আওয়াজ করল। সে আওয়াজের বিশেষ এক ছন্দ আছে – দ্রুত টকটক – কিছুটা বিরতি – বিলম্বিতে তিনবার – আবার বিরতি - তারপর আবার দ্রুত দুবার।ভেতর থেকে দরজাটা দ্রুত খুলে যেতেই ভল্লা ঘোড়া সমেত ঢুকে গেল চটির প্রাঙ্গণে। এদিকটা চটির পিছনের দিক। এদিকে আলোর তেমন ব্যবস্থা নেই। চটির অতিথিশালায় এবং সামনের দিকে কয়েকটা মশাল জ্বলছে, তার আভাসটুকু এখানে পাওয়া যায়। কারণ এদিকের অনেকটা জুড়ে আছে পশুশালা। বণিকদের গাধা, ঘোড়া, বলদদের জন্য রাত্রির আবাস। আর পশুশালা পার হয়ে, ওপাশে আছে চটির কর্মীদের আবাস।ভল্লার ঘোড়ার লাগাম নিজের হাতে ধরে – যে দরজা খুলে দিয়েছিল, সে জিজ্ঞাসা করল, “ভল্লা?”“হুঁ”। “কী চেহারা করেছিস, চুল-দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে – চেনাই যাচ্ছে না। তুই ঘরে চ, আমি ঘোড়াটার একটা ব্যবস্থা করেই আসছি”। এই চটিতে ভল্লা বহুবার থেকেছে, কাজেই অন্ধকারেও ঘর চিনে ঢুকতে তার অসুবিধে হল না। ঘোড়ার ব্যবস্থা করে লোকটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে এসে ঢুকল, বলল, “অন্ধকারে ভূতের মতো কী করছিস, প্রদীপটা জ্বালাসনি কেন? কোথায় তুই?” আপাততঃ নিশ্চিন্ত ও বিশ্বস্ত একটা আশ্রয় পেয়ে, ভল্লা দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেয় বসে পড়েছিল। তার সমস্ত শরীর ক্লান্তিতে ও যন্ত্রণায় অবসন্ন। বলল, “এই তো এখানে, বসে আছি”। চটির লোকটি চকমকি ঠুকে একটা প্রদীপ জ্বালতে ঘরের অন্ধকার একটু ফিকে হল। প্রদীপটা কুলুঙ্গিতে রেখে ঘুরে দাঁড়াল, তাকাল মেঝেয় বসে থাকা ভল্লার দিকে। চমকে উঠল, “কী হয়েছে তোর? মুখ চোখ অত ফুলেছে কেন? চোখের নিচে কালশিটে। মারামারি করেছিস? কার সঙ্গে?”“বলছি, সব বলব। আগে একটু জল খাওয়া না, চিকা। সেই দুপুরে জল খেয়েছিলাম, তারপর আর...তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে”। “আনছি”। বলেই চিকা দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল, অল্প সময়ের মধ্যেই কাঁসার ঘটিতে আনল খাবার জল। ভল্লার হাতে তুলে দিল কয়েকটা বাতাসা আর ঘটিটা। লোভীর মতো বাতাসাগুলো মুখে পুরে নিয়ে চিবোতে গিয়েই শিউরে উঠল ভল্লা, চোয়ালে হাত রাখল। যন্ত্রণায় তার মুখ বেঁকে গেল। চিকার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তারপর গলায় ঘটির জল ঢালতে ঢালতে ইশারায় চিকাকে বসতে বলল। চিকা মেঝেয় বসল ভল্লার সামনে। ভল্লার জল খাওয়া শেষ হতে ঘটিটা মেঝেয় রেখে হাসির চেষ্টায় মুখ ব্যাঁকাল, বলল, “কাল দুপুরে উদোম ক্যালানি খেয়েছি রে, শালা। গোটা শরীরে তার তাড়স”।“কারা মারল? কী করেছিলি”?“রাজার শ্যালকের দিকে বল্লম ছুঁড়েছিলাম। বল্লমটা লোকটার গলার দু-তিন আঙুল দূর দিয়ে ছুটে গিয়ে, তার রথের আসনে গিঁথে গেল। তুই তো জানিস আমার হাতের বল্লম কখনো ফস্কায় না। এবার ফস্কাতে হল, আধিকারিকদের আদেশ। তারপর আর কি, নগররক্ষীরা ধরে ফেলল। মারধোর করে নিয়ে গেলে কারাগারে”। “তুই বলতে চাইছিস, সবটাই নাটক?”“নাটক তো বটেই। অন্য শহর থেকে তিনজন ছোকরা আর পাঁচজন সুন্দরী বারবনিতাকে বানজারা সাজিয়ে রাজধানীতে আনা হয়েছিল, যাতে তারা রাজশ্যালক রতিকান্তর চোখে পড়ে। সেই দলে আমিও ছিলাম। রতিকান্ত সেই ফাঁদেই পা দিল। দলটা রাজপথে নাচ-গান করতে করতে যখন যাচ্ছিল, সেই সময়েই এসে পড়ল রতিকান্তর রথ। দলের সুন্দরী মেয়েগুলোকে দেখেই হতভাগা রতিকান্তর লোভ চেগে উঠল। দেহরক্ষীদের বলল, “ধরে আন মেয়েগুলোকে”। দেহরক্ষীদের সঙ্গে ওই মেয়েদের দলটার বচসা শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যেই সেখানে হাজির হল কয়েকজন নগররক্ষী। রক্ষীরা সকলে মিলে যখন মেয়েগুলোকে ধরার জন্যে ঝাঁপিয়েছে, আমি বল্লমটা ছুঁড়লাম রতিকান্তর দিকে। ব্যস, রক্ষীরা সব্বাই আমাকে নিয়ে পড়ল”। “আর মেয়েগুলোর কী হল?”“তাদের আর কী? তারা পালিয়ে গিয়ে উঠল, আগে থেকেই ঠিক করা গোপন এক আড্ডায়। সেখানে বানজারার পোষাক বদলে, সাধারণ চাষীঘরের বউ-মেয়ে সেজে সরে পড়ল মাঠের আলপথ ধরে”।“বুঝলাম। কিন্তু তুই কারাগার থেকে ছাড়া পেলি কী করে?”“ওই যে বললাম আধিকারিকদের নির্দেশ। মাঝরাত্রে এসে আমাকে একটা ঘোড়া দিয়ে বলল, এখনই বেরিয়ে যাও। পথে কোথাও দাঁড়াবে না। রাতটা কাটাবে এই চটিতে। কিন্তু গোপনে”। চিকা মৃদু হাসল, বলল, “হুঁ। গতকাল সকালে। তার মানে, তখনো তুই রতিকান্তর দিকে বল্লম ছুঁড়িসনি। আমার কাছে সেই নির্দেশ এসে গেছে। তোর ঘোড়া আমি রেখে দেব। আর তোকে একজোড়া রণপা দিয়ে রাত পোয়ানোর আগেই রওনা করিয়ে দেব। কিন্তু তুই যাবি কী করে, শরীরের এই অবস্থায়?”“রাজার আদেশ ভাই, যেতে তো হবেই। নির্দেশ আছে আমার এই ক্ষতবিক্ষত মুখ আর শরীর নিয়েই আমাকে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। তাতে আমার কাজের নাকি সুবিধে হবে”।অবাক হয়ে চিকা জিজ্ঞাসা করল, “তোর গন্তব্য কোথায়? কাজটা কি?”ভল্লা চিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেটা তো বলা যাবে না, ভাই। যদি বেঁচে থাকি, ফেরার সময় তোকে নিশ্চয় বলে যাবো…”। চিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলাম। তুই মুখ হাত ধুয়ে নে, আমি তোর খাবার নিয়ে আসছি। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। রাত্রি শেষ প্রহরে তোকে ডেকে রওনা করিয়ে দেব”। ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    দিশেহারা  'লাপাতা লেডিজ' - সৈয়দ তৌশিফ আহমেদ | দীপু আর ফুল চড়ে বসল ‘বেলপুর–কাটারিয়া’ এক্সপ্রেসে। ট্রেন আসছে বেলপুর থেকে, যাবে কাটারিয়া অবধি। এই যাত্রাপথের প্রথমে আসবে ‘মুর্তি’,  যে ষ্টেশন থেকে বাস রাস্তায় ফুলের শ্বশুর বাড়ি পড়ে। যদিও  ঘটনাক্রমে অদলাবদলি হয়ে মুর্তি ষ্টেশনে ফুলের বদলে দীপুর সাথে নামবে জয়া। তাদেরকে নামিয়ে ‘বেলপুর–কাটারিয়া’ এক্সপ্রেস ছুটবে পাটিলার দিকে। কিছু পরে সেখানে প্রদীপ আর ফুলকে নামতে দেখা যাবে। ট্রেন আবারো ছুটবে তার শেষ গন্তব্য কাটারিয়ার উদ্দেশ্যে। তাহলে ষ্টেশনের ক্রমটা দাঁড়াল:  মূর্তি – পাটিলা – কাটারিয়া। সহজ হিসেব, এর মধ্যে কোন গোলযোগ হওয়ারই কথা নয়। এবার বোঝার সুবিধার জন্য, ধরে নিলাম এই ট্রেন এগোচ্ছে পশ্চিমের দিকে। আসছে পূব থেকে। যে কোন দুটো বিপরীত দিক নিয়েই বিষয়টা ভাবা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ফুল যখন শ্বশুর বাড়ি ফিরবে তখন তার গন্তব্য হবে পূর্ব দিক , কারণ সে আসছে পশ্চিম থেকে। আবার দীপু যখন পাটিলা যাবে তাকে ধরতে হবে পশ্চিম মুখো ট্রেন। পুবমুখো নয় কিন্তু। যাই হোক, একসময় পোস্টার ছড়িয়ে পড়ল ষ্টেশনে-ষ্টেশনে। জানা গেল ফুলের শ্বশুর বাড়ি মুর্তি স্টেশন থেকে এগিয়ে সূর্যমুখী নামের এক গ্রামে। ষ্টেশন-মাস্টার বললেন , প্ল্যাটফর্মে এখনো ‘আমরেলি- কাটারিয়া’ এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে। দশ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে। ওতে উঠে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।একটু ভুল হল এখানে। প্রথমত , ট্রেনটা আমরেলি - কাটারিয়া এক্সপ্রেস কী করে হয় ? কারণ যদি ঐ ট্রেনের গন্তব্য হয় কাটারিয়া , সেক্ষেত্রে ফুল চলে যাবে আরও পশ্চিমমুখো। কিন্তু তার তো পুবে আসার কথা। হাওড়া-বর্ধমান লোকাল, আর বর্ধমান-হাওড়া লোকাল নিশ্চয় এক জিনিস নয়। কাজেই ট্রেনের নাম হওয়া উচিৎ ছিল ‘কাটারিয়া -আমরেলি’ এক্সপ্রেস। অর্থাৎ শেষ গন্তব্য আমরেলি, আর আসছে কাটারিয়া থেকে। সেক্ষেত্রে ষ্টেশন-মাস্টারই ভুল বলেছেন। একজন রেলকর্মীর পক্ষে এটা গ্রস মিসটেক, তাও না হয় তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া গেল।দ্বিতীয়ত ফুল যখন এই ট্রেনে উঠছে তখন দেখা যাচ্ছে এই ট্রেনেরই S2 স্লিপারের গায়ে জ্বলজ্বল করছে ‘বেলপুর- কাটারিয়া’র বোর্ড। ভালো ছবি বানাতে হলে এ ধরণের লজিক্যাল এরর এড়াতে হবেই। কন্টিনিউইটির বিষয়টাও দেখতে হবে খতিয়ে, কারণ এর দ্বিতীয় কোনো বিকল্প হয় না , পরে শুধরে নেবারও সুযোগ নেই।এবার শেষ দৃশ্য। ইন্সপেক্টর মোবাইলে জানতে পারেন, পাটিলা ষ্টেশনে রয়েছে দীপকের বউ ফুল। দীপক পড়ি কি মরি করে সাইকেল ছোটায় মূর্তি ষ্টেশনের দিকে। ষ্টেশনে ঢোকার মুখে সে দেখে একটা ট্রেন ঢুকছে ( যে ট্রেনে আপাতত চড়ে আছে ফুল , এই নামলো বলে )। ট্রেন আসছে পশ্চিম থেকে , যাচ্ছে পুবমুখো। দীপু তাতেও ছোটে , ঠিক ওই ট্রেনটাই ধরবে বলে। ভারী আশ্চর্য তো ! চার বন্ধু সাইকেল চালিয়ে আসছে। অথচ কেউ বলছে না , ভাই পাটিলা তো পশ্চিমমুখো। তুই পূবে যাওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করছিস যে বড় !আমরা যে ভুল ভাবছি না , বা দিক গুলিয়ে ফেলছি না, তার প্রথম প্রমাণ হল :  ষ্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যাবার মুহূর্তে ফ্ল্যাগম্যান বা স্টেশন মাস্টারকে দীপু জিজ্ঞেস করে , এটা কি পাটিলা যাবে ? উনি বলেন, পাটিলার ট্রেন বেরিয়ে গেছে সেই কখন। এ ট্রেন যাচ্ছে আমরেলি। অর্থাৎ পুবমুখো। আর দ্বিতীয় প্রমাণ : এই ট্রেন থেকেই মূর্তি ষ্টেশনে সদ্য নেমেছে ফুল। ঠিক ওই প্ল্যাটফর্মেই সে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভিড়ের একদম শেষ মাথায়। সে আসছে পশ্চিমের পাটিলা থেকে, ট্রেন বাবাজীবন তাকে রেখে ছুটে যাচ্ছে পুবমুখো। সুতরাং প্রশ্ন হল, দীপু তার অভিপ্রেত গন্তব্যের উল্টোদিকে যেতে চাইছে কেন! তাছাড়া ,দীপুর যে ট্রেন চড়ার অভ্যেস রয়েছে তার প্রমাণ কিন্তু আমরা আগেই পেয়েছি। বৌকে নিয়ে ফেরার পথে, ওই রাতবিরেতেও সে ষ্টেশন চিনতে ভুল করে নি। 'আর কত দূর ' কিংবা ' আর কটা স্টেশন' - এসব প্রশ্ন করে সহযাত্রীদের উত্যক্ত করতেও দেখা যায় নি তাকে। বেশ নিশ্চিন্তেই ঝিমচ্ছিল সে। কাজেই মোটের উপর ট্রেনের রুট সম্পর্কে সে একেবারে অজ্ঞ নয়। তাছাড়া, দীপু সে রাত্রে ষ্টেশনের যেদিকটা দিয়ে বেরিয়ে বাস ধরেছিল, পরের বার সাইকেল থেকে সেদিকটা দিয়েই ঢুকবে। প্রমাণ স্বরূপ – ষ্টেশনের মধ্যেই একটা ছিটাবেড়ার টঙকে দুবারই দুটো আলাদা দৃশ্যে দেখা যাবে। Netflix টাইম ষ্ট্যাম্প যথাক্রমে 00:09:02 , 01:51:48।  সুতরাং আমরা যে দিক গুলিয়ে ফেলছি না , সেটা বেশ জোরের সাথেই বলা যায়।প্রশ্ন আরও হল, ফ্ল্যাগম্যান বা ষ্টেশন মাস্টারের কাছে দীপু যখন জানতে চাইল, এই ট্রেন পাটিলা যাচ্ছে কিনা; এর উত্তরে তিনি বললেন, পাটিলার ট্রেন অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে , এটা যাচ্ছে আমরেলি। একবারও  বললেন না যে,  পাটিলার ট্রেন উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে আসবে। উত্তরটা এমন , যেন আপ এবং ডাউন দুদিকের সমস্ত ট্রেনই এই প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়েই যায়। তাহলে কি ষ্টেশনে একটাই ট্র্যাক? না! তাও নয়। কারণ সে রাত্রে মুরতি ষ্টেশনে জয়াকে নিয়ে দীপু যখন নামছে ট্রেন থেকে, ঠিক তার পাশের ট্র্যাকেই বিপরীত দিকে ছুটে যাচ্ছিল আরেকটা ট্রেন। ডাবল-ট্র্যাক রেলওয়েতে সেটাই তো স্বাভাবিক।তাহলে কি একটাই ষ্টেশন? পাশের লাইনটা ফাউ? না, তাও নয়। উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মের নীলাভ শেড দেখা যাচ্ছে দিব্য। Netflix টাইম ষ্ট্যাম্প – 01:51:51ব্যতিক্রম হিসেবে ও শর্ত সাপেক্ষে আপ প্ল্যাটফর্মে ডাউনের ট্রেন বা ডাউন প্ল্যাটফর্মে আপের ট্রেন যেতেই পারে, কিন্তু চরিত্রদের সংলাপ এবং দৃশ্যাবলীর সামঞ্জস্যতা দিয়ে সেই বিষয়টাকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ভালো ছবি এভাবেই তার সীমাবদ্ধতা এবং প্রতিবন্ধকতাকে কোণঠাসা করে। যদিও এক্ষেত্রে তা না হয়ে , পরিচালকের দিক বিভ্রান্তির বিষয়টাকেই যেন প্রকট করেছে আরও। ‘লাপাতা লেডিজ’ ভালো ছবি কিনা, সে নিয়ে তর্কের অনেক আগে আলোচনা হওয়া উচিৎ, দিক নিয়ে একটা ছবিতে অসঙ্গতির কারণ কী । অবহেলা, অসাবধানতা, নাকি বাধ্যবাধকতা?  স্বেচ্ছায় ১৮০ ডিগ্রি রুল ব্রেক করা, আর কার্ডিনাল ডিরেকশন ঘেঁটে ফেলা, এই দুটো মোটেই এক জিনিস নয়। মানছি, রেলগাড়িকে শুটিংয়ের অন্তর্ভুক্ত করাটা বেশ ঝক্কির, কিন্তু আরেকটু বুদ্ধিদীপ্ততা দিয়ে এই ত্রুটিগুলো কি এড়ানো যেত না? হয়তো যেত। পরিচালক প্রতিশ্রুতিবান হলে, দর্শকের সমর্থন যেমন জরুরী, তেমনি তাকে অন্যায্য মার্কস দিয়ে সমালোচনার কপাটকে ঠাস করে বন্ধ না করাটাও সমান জরুরী। তবেই ভালো ছবি হওয়ার জমিটা তৈরি হতে থাকে। তাছাড়া আমার ভালো লাগছে মানেই সেটাতে অন্যের সমালোচনা সপাটে ব্যান হয়ে যায় কি ?    নেটফ্লিক্স টাইম স্ট্যাম্প - 05:14, 01:36:02, 01:36:14, 01:51:34, 01:51:55
    ডুয়াল টাইম জোন - সমরেশ মুখার্জী | ডঃ অনিরুদ্ব বসু কলকাতা ছেড়েছে‌ন কুড়ি বছর আগে। বর্তমানে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ‍্য দর্শনের খ‍্যাতনামা গবেষক। প্রায়ই তার ইউ-পেন, ব্রাউন, হার্ভার্ড ইত‍্যাদি আইভি লিগ ইউনি থেকে বক্তৃতার ডাক পড়ে। স্ত্রী শ্রাবণী ও বছর এগারোর একমাত্র কন‍্যা রুমাকে নিয়ে তিনি নিউ হেভেন, কনেকটিকাটে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসেই থাকেন। অনিরুদ্ধ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বছর তিনেক আগে মা মারা যেতে বাবা প্রবীর বসু একা হয়ে পড়লেন। পরের বছর কলকাতা‌য় এসে অনিরুদ্ধ নিঃসঙ্গ, বিপত্নীক পিতাকে চিকিৎসা, সাহচর্য, নিরাপত্তার কথা ভেবেই কলকাতার নিউ টাউনে একটি বিলাসবহুল, প্রফেশন‍্যালি ম‍্যানেজড্ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলেন। প্রবীরবাবু খুব লজিক্যাল মনের মানুষ। তাই ছেলের প্রস্তাবে ভুল কিছু দেখেন নি। যে সংস্থা‌টি ঐ বৃদ্ধা‌শ্রম চালাচ্ছে তারা অবশ‍্য তাদের ‘ফেসিলিটি’ কে Old Age Home গোছের ওল্ড ফ‍্যাশনড্ ধারণা‌য় সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। তাই তার নাম দিয়েছেন বাংলায় - “স্নেহলতা” - অর্থাৎ  অর্থের বিনিময়ে হলেও, সেখানে দুর প্রবাসে বসবাস‌কারী কৃতি সন্তানের পিতামাতাকে স্বদেশে প্রফেশনাল কেয়ারগিভাররা লতার মতো স্নেহ মমতা‌য় জড়িয়ে রাখবে। সংস্থা‌র মিশন স্টেটমেন্ট ইংরেজি‌তে। সেটা বেশ সমীহ‌ উদ্রেককারী - A luxurious Assisted Senior Citizen Living Facility.বাবার বয়স সবে সত্তর পেরিয়ে‌ছে কিন্তু এখন থেকেই একটু ভুলো মনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। হয়তো মা চলে গিয়ে একাকী হয়ে যাওয়ার ফলে। সময় অসময় নেই অনিরুদ্ধ বা পূত্রবধু শ্রাবণীকে ফোন করে ফেলেন। তখন হয়তো অনিরুদ্ধ ইউনিতে লেকচার দিচ্ছে - ফোন সাইলেন্ট থাকে, তাই শোনা যায় না। শ্রাবণী একটা ল ফার্মে কাজ করে, সেও সপ্তাহের দিনে ব‍্যস্ততায় থাকে। বাবার ফোন মিস হয়ে যায়। প্রবীরবাবু ছেলেমানুষের মতো অভিমান করেন।এই মানবিক সমস‍্যা এড়াতে এবার ক্রিশমাসের ছুটিতে দেশে আসার সময় অনিরূদ্ধ বাবার জন‍্য একটা Dual Time Zone Timex ঘড়ি কিনে এনেছে। ওটা Made in USA. দোকানে গিয়ে উদ্দেশ্য‌টা বলতেই দেখালো। অনেক ছেলেমেয়ে যারা আমেরিকা‌য় এসে অন‍্য টাইম জোনে সেটলড্ হয়ে গেছে, তাদের দেশের প্রিয়জনের কথা ভেবেই হয়তো তৈরী এ ঘড়ি। অনিরুদ্ধ কলকাতার ফাইভস্টার  ফেসিলিটি‌ স্নেহলতা‌য় এসে বাবাকে ঘড়ি‌টা হাতে পরিয়ে দিতে প্রবীরবাবু বলেন, “এ আবার কী ঘড়ি আনলি রে অনি, দু দুটো ডায়াল?”অনিরুদ্ধ বলেন, “বাবা, ডান দিকে বড় ডায়ালটা কলকাতার সময় মানে IST তে সেট করে দিয়েছি। বাঁদিকেরটা কনেকটিকটে‌র সময়ে সেট করা আছে। ওখান‌কার সময় কলকাতা থেকে সাড়ে ন ঘন্টা পিছিয়ে। আন্দাজ দশ‌ই ধরে নাও। আমাদেরকে সপ্তাহের দিনে ওখানকার হিসেবে  সকাল সাতটা‌র আগে বা সন্ধ‍্যা আটটার পরে ফোন করলে ভালো হয়। তার মানে ধরো এখান‌কার হিসেবে বিকেল পাঁচটার আগে বা সকাল ছটার পরে।”প্রবীরবাবু বিড়বিড় করে বলেন, “এখন আমার মাথা ভালো কাজ করে না রে অনি। এখানকার সময়ের সাথে এসব যোগ বিয়োগের হিসেব মনে থাকলে হয়। এতোই যখন ভাবলো ওরা, তাহলে ওদেশের ডায়ালের নীচে একটা AM/PM ডিসপ্লে রেখে দিলেও তো পারতো। সরাসরি ওটা দেখেই বুঝতে পারতাম কখন ফোন করলে তোদের কথা বলার সুবিধা হয়।”বিখ্যাত গবেষক ডক্টর অনিরুদ্ধ বাসু উপলব্ধি করেন, ভুলো মনের হয়ে গেলেও বাবার স্বাভাবিক বুদ্ধি এখনো বেশ প্রখর।।
    মহাবিশ্বের রহস্য - অনির্বাণ কুণ্ডু | রাতের তারা ঝলমলে আকাশ তো সবাই দেখেছো। অতি প্রাচীনকালেও মানুষ দেখতো, দেখে মুগ্ধ হতো, আর এই জ্যোতিষ্কদের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করতো। জ্যোতির্বিদ্যা মানুষের প্রথম বিজ্ঞান। আমাদের সেই গুহাবাসী কিংবা সদ্য কৃষিকাজ শেখা পূর্বপুরুষদের খালি চোখে আকাশ দেখার দিন থেকে আমরা অনেক এগিয়ে এসেছি। বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে, যন্ত্রের উন্নতি হয়েছে, আমাদের দেখার এবং বোঝার ক্ষমতা অকল্পনীয়ভাবে বেড়েছে। তার সঙ্গে বেড়েছে নতুন নতুন উত্তর-না-জানা প্রশ্নের দল। ভাগ্যিস বেড়েছে, কারণ প্রশ্ন না থাকলে—সবই জানা হয়ে গেলে—বিজ্ঞানের তো আর কোনো আকর্ষণই থাকত না! আজ তোমাদের অল্প করে এরকম কয়েকটা উত্তর-না-জানা প্রশ্নের কথাই বলব। পৃথিবীর বহু বিজ্ঞানী এসব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করে চলেছেন, মানুষের সভ্যতার এ এক অনন্য অ্যাডভেঞ্চার। আশা করব, একদিন তোমরাও এই অ্যাডভেঞ্চারে যোগ দেবে।তোমরা জানো, আমরা খালি চোখে যে সব তারা দেখতে পাই, সবাই একটি তারকাপুঞ্জ বা নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে আছে। এই তারকাপুঞ্জ বা গ্যালাক্সির নাম মিল্কি ওয়ে, বাংলায় ছায়াপথ। আমাদের সূর্য ছায়াপথের এক ধারে পড়ে থাকা একেবারেই সাধারণ একটি তারা। সূর্যের চেয়ে বহুগুণ উজ্জ্বল, বহুগুণ বড়, আর বহুগুণ গরম তারা যেমন আছে, তেমনি সূর্যের চেয়ে ছোট এবং নিষ্প্রভ তারাও নেহাৎ কম নেই। ছায়াপথে যে কত তারা আছে, তা আমরা আজও ঠিকভাবে গুনে উঠতে পারিনি, তবে সংখ্যাটা বিশাল, দশ হাজার কোটি (অর্থাৎ একের পিঠে এগারোটা শূন্য, ১০১১) থেকে চল্লিশ হাজার কোটির মধ্যে কিছু একটা। বুঝতেই পারছ, এর অতি সামান্য সংখ্যক তারাই আমাদের খালি চোখে ধরা পড়ে।এইমাত্র একটা বিরাট বড় সংখ্যা পেলাম, কিন্তু ঘাবড়ে গেলে চলবে না—আকাশ এবং মহাবিশ্ব নিয়ে কথা বলতে গেলে এরকম বিরাট বিরাট সংখ্যারা মাঝেমধ্যেই উঁকি দেবে। দূরত্ব মাপার একক দিয়েই শুরু করি। আলো মহাশূন্যে এক সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার যায়, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে প্রায় আট মিনিট লাগে। এক বছরে আলো যতটা পথ পাড়ি দেয়, তাকে বলে এক আলোকবর্ষ। মহাবিশ্বের হিসেবে এটা নিতান্তই চুনোপুঁটি দূরত্ব, আমাদের সবচেয়ে কাছের তারাও চার আলোকবর্ষের বেশি দূরে। বিজ্ঞানীরা আর একটা একক ব্যবহার করেন, পার্সেক—এক পার্সেক প্রায় সোয়া তিন আলোকবর্ষের সমান। ১০০০ পার্সেকে এক কিলোপার্সেক, আর দশ লক্ষ পার্সেকে এক মেগাপার্সেক। মেগাপার্সেক দূরত্বের বৃহত্তম একক, এক মেগাপার্সেক যেতে আলোরও প্রায় সাড়ে বত্রিশ লক্ষ বছর লাগে।ছায়াপথ কিছু একমাত্র গ্যালাক্সি নয়। এর ধারেকাছে আরো অনেকগুলো গ্যালাক্সি আছে, যেমন বড় ও ছোট ম্যাগেলানিক মেঘ, বা অ্যান্ড্রোমিডা। এরকম মোট কত গ্যালাক্সি আছে? বিজ্ঞানীদের অনুমান, প্রায় দশ হাজার কোটি। এটা হল যতটুকু মহাবিশ্ব আমরা দেখতে পাই, তার হিসেব, এর বাইরে মহাবিশ্বের আরো বিরাট অংশ হয়তো পড়ে আছে যা আমরা দেখতেই পাই না। কেন পাই না? কারণ সেখান থেকে আলো এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছতেই পারেনি। মহাবিশ্বের বয়েস প্রায় চোদ্দশো কোটি বছর (এই হিসেবটাও বিজ্ঞানীরা খুব নিখুঁতভাবে বের করেছেন), সুতরাং দু হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি থেকে তো আলো এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছবে না। ছবি – ১: আমাদের প্রতিবেশী গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রোমিডা। ছায়াপথের মত এটিও একটি প্যাঁচ খাওয়া বা স্পাইরাল গ্যালাক্সি। মাঝে একটা ভারি অংশ, যার চারদিকে আছে কয়েকটি স্পাইরাল বাহু। ছায়াপথের এরকম একটি স্পাইরাল বাহুর মধ্যে আছে আমাদের সূর্য এবং সৌরজগৎ, ধীরে ধীরে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। (সূত্র: David Dayag)আলোর কথা বললামই যখন, একটু মনে করিয়ে দিই – আলো হল তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ, আর দৃশ্যমান আলোর বাইরেও এক বিরাট বর্ণালী পড়ে আছে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়ালে পাব অবলোহিত (যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন লাল-উজানি আলো), তারপর মাইক্রোওয়েভ, রেডিওতরঙ্গ। কমের দিকে অতিবেগুনি, এক্সরশ্মি, গামারশ্মি। এদের সবাইকেই আমরা আলো বলব। মহাকাশ থেকে সব রকম আলোই আসে, কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে শোষিত হয়ে যায় (না হলে প্রাণের সৃষ্টিই হত না), কাজেই সেই সব আলো ধরতে গেলে পৃথিবীর কক্ষপথে, বায়ুমণ্ডলের বাইরে, দূরবীন বসাতে হয়। হাবল্‌ স্পেস টেলিস্কোপ হল কক্ষপথে বসানো প্রথম দূরবীন, মহাবিশ্বের কত খবর যে আমরা হাবল্‌ টেলিস্কোপের থেকে পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবলের নামে এই টেলিস্কোপ, তাঁর কথায় একটু পরেই আমরা আসব। ছবি – ২: হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। ১৯৯০ সালে একে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করা হয়, তিরিশ বছর ধরে মহাবিশ্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি পাঠিয়ে চলেছে। (সূত্র: Ruffnax (Crew of STS-125))তোমরা সবাই জানো, মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক হল পরমাণু। এক সময় বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, পরমাণু অবিভাজ্য, তাকে আর ভাঙা যায় না, কিন্তু পরে টমসন, এবং রাদারফোর্ড ও তাঁর সহযোগীরা দেখালেন যে পরমাণুকে ভাঙা যায়। পরমাণুর মূল উপাদান তিনটে – কেন্দ্রে ধনাত্মক তড়িৎবাহী প্রোটন এবং তড়িৎনিরপেক্ষ নিউট্রন, আর বাইরে ঋণাত্মক তড়িৎবাহী ইলেকট্রন। সবচেয়ে সহজ পরমাণু হল হাইড্রোজেন গ্যাসের, এর কেন্দ্রে থাকে শুধু একটা প্রোটন, আর বাইরে একটা ইলেকট্রন। হিলিয়ামের কেন্দ্রে আছে দুটো করে প্রোটন আর নিউট্রন। যে কোন মৌলের পরিচয় তার কেন্দ্রে প্রোটনের সংখ্যা দিয়ে ঠিক হয়, নিউট্রনের সংখ্যার একটু এদিক ওদিক হতে পারে, হলে একই মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপ পাওয়া যায়।বিজ্ঞানীরা বলেন, এক প্রচণ্ড শক্তিশালী বিস্ফোরণে মহাবিশ্বের সৃষ্টি। এই মহাবিস্ফোরণের চলতি নাম হল বিগ ব্যাং। আমরা যে সমস্ত পদার্থ চারপাশে দেখতে পাই, মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্তেই তারা মোটেই তৈরি হয়নি। প্রথম হাইড্রোজেন পরমাণু পেতে আমাদের প্রায় চার লক্ষ বছর অপেক্ষা করতে হবে। নক্ষত্র সৃষ্টি হতে তখনো ঢের দেরি। মহাবিশ্বে আমরা যত পরমাণু দেখতে পাই (বা আছে বলে অনুমান করতে পারি), তার মোট ভরের চুয়াত্তর শতাংশই হাইড্রোজেন। আর চব্বিশ শতাংশ হিলিয়াম। তিন নম্বরে অক্সিজেন, এক শতাংশের সামান্য বেশি। বাকিরা নেহাৎই নগণ্য। এর পরের সাতটা স্থানে আছে কার্বন, নিয়ন, লোহা, নাইট্রোজেন, সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম, আর সালফার, তাদের মোট অবদান আধ শতাংশও হয় কিনা সন্দেহ। এখানে বলে রাখা ভালো, হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম ছাড়া বাকি যে সব মৌলের নাম করলাম, সবাই তৈরি হয়েছে কোনো না কোনো নক্ষত্রের ভেতরে। অর্থাৎ, আমরা সবাই বহুকাল আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো তারার ধ্বংসাবশেষ।দুইয়ের পিঠে তিরিশটা শূন্য বসালে যা হয় (২ X ১০৩০), সূর্যের ভর প্রায় অত কিলোগ্রাম। আগেই বলেছি, মহাবিশ্বে সুর্য নিতান্তই গড় মাপের একটি তারা, আর মোট তারা আছে প্রায় একের পিঠে বাইশটা শূন্য। তাহলে যা পাওয়া গেল, সেটাই কি মহাবিশ্বের মোট ভর? উত্তর, একেবারেই না। সব পরমাণুর অতি সামান্য একটা অংশই তারাদের মধ্যে থাকে, বাকিটা ছড়িয়ে থাকে বিভিন্ন গ্যালাক্সির মধ্যে, মহাজাগতিক ধূলিকণা বা মেঘ হিসেবে। এই মেঘের ঘনত্ব হিসেব করে মহাবিশ্বের সমস্ত পরমাণুর মোট ভর বিজ্ঞানীরা বের করেছেন --- একের পিঠে তিপ্পান্নটা শূন্য বসালে যত হয় (১০৫৩),  প্রায় তত কিলোগ্রাম। বললাম না, আমাদের অনেক বড় বড় সংখ্যা নিয়ে কাজ করতে হবে? সে যাই হোক, এই সংখ্যাটাকে আমরা বলব দৃশ্যমান ভর। অদৃশ্য ভরও আছে। এই অদৃশ্য ভর থেকেই আমাদের গল্পটা শুরু হল। আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে একশো বছরেরও বেশি আগে, ১৯১৪ সালে, যখন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মহাকর্ষ সম্বন্ধে তাঁর তত্ত্ব উপস্থাপিত করেন। এই তত্ত্বের নাম সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ, ইংরেজিতে জেনারেল রিলেটিভিটি। এর জটিল অঙ্ক আলোচনার কোন জায়গাই এখানে নেই, সে সব তোমরা বড় হয়ে পড়বে। কিন্তু মূল কথাটা একটু বুঝে নেওয়া যাক।এর আগে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ বা স্পেশাল রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বের একটা অনুসিদ্ধান্ত হল, মহাশূন্যে আলোর চেয়ে বেশি বেগে কেউ যেতে পারে না (মহাশূন্যে কথাটা গুরুত্বপূর্ণ; জলের মধ্যে আলোর যা বেগ, তাকে দ্রুতগামী ইলেকট্রন হার মানাতে পারে), অর্থাৎ বহুদূরের খবর আনার জন্যে আলোর চেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম আর কেউ নেই। আরেকটা বড় অনুসিদ্ধান্ত তোমরা সবাই জানো, যাকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করে যায়: E = mc2. এর মানে হল, ভরকে শক্তিতে বা শক্তিকে ভরে রূপান্তরিত করা যায়। পরমাণু বোমা বা পরমাণু চুল্লি যে শক্তি উৎপাদন করে, তা ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম জাতীয় তেজস্ক্রিয় পদার্থের খুব সামান্য কিছু ভরের শক্তিতে রূপান্তরের ফল। সূর্যের আলো ও তাপের পেছনেও এই সমীকরণ। নক্ষত্রের মধ্যে চারটে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস (অর্থাৎ প্রোটন) জুড়ে হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস বা আলফা কণা তৈরি হয়। এতে সামান্য যে ভরের ঘাটতি পড়ে, সেটাই শক্তি হয়ে বেরিয়ে আসে। অত সামান্য ভর থেকে অত বিপুল শক্তি কোত্থেকে আসে? ওই যে আলোর বেগের বর্গ বা c2  দিয়ে গুণ করা আছে।কিন্তু বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের আসল জিনিসটাই তো বলা হয়নি। আমরা ছোট থেকে শিখে আসি – দেশ বা স্থানের তিনটে মাত্রা, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, আর উচ্চতা; আর কাল বা সময়ের একটাই মাত্রা, যাকে ঘড়ি দিয়ে মাপি। আইনস্টাইন দেখালেন, যে, দেশ আর কালকে এভাবে আলাদা করা যায় না, আমাদের মোট চার মাত্রার দেশকালের কথা বলা উচিত। এই যে দেশ আর কালের মাত্রা মিলেমিশে গেল – এটা ধরা পড়বে, যদি কোনো বস্তুর বেগ আলোর বেগের কাছাকাছি হয়, তবেই। দৈনন্দিন জীবনে দেশ আর কাল সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের ঘোরাই বলি, বা সৌরজগৎ, বা গ্যালাক্সিদের মহাশূন্যে ঘুরে বেড়ানো, মহাবিশ্বের আসল চালিকাশক্তি হল মহাকর্ষ বল। এই বল কীভাবে কাজ করে, বহুদিন আগেই আইজাক নিউটন তা বলে গেছেন --- দুটি বস্তুর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক, আর তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে এই সূত্রের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে, যেমন একেবারে নির্ভুলভাবে গ্রহণের সময় বা গ্রহদের কক্ষপথের গণনা।আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে বললেন, মহাকর্ষ আসলে কোনো বলই নয়। তাহলে কী? আইনস্টাইন বললেন, মহাকর্ষ আসলে চার মাত্রার এই দেশকালের জ্যামিতির খেলা। কাগজের ওপর দু-মাত্রার ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি আমরা সবাই স্কুলে করেছি, তোমরা কেউ কেউ হয়তো তিন মাত্রার জ্যামিতিও করেছ। চার মাত্রার জ্যামিতি, স্বভাবতই, আরো একটু জটিল।  ছবি - ৩: টান করে রাখা চাদরের ওপর ভারি একটা বস্তু রাখার ফলে চাদরের বিকৃতি, যেটা বোঝা যাচ্ছে কাটাকুটি লাইনগুলো বেঁকে যাওয়া থেকে। বস্তুটা যত ভারি হবে, বিকৃতি তত বেশি হবে। আবার বস্তুটা থেকে যত দূরে চলে যাব, বিকৃতিও কমে আসবে, আবার সমতল জ্যামিতি ফিরে পাব।আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন, কোনো জায়গার জ্যামিতি নির্ভর করে – সেখানে কী পরিমাণ বস্তু (বা শক্তি) আছে—তার  ওপর। যদি কিছুই না থাকে, তাহলে জ্যামিতি হয় সমতল, টানটান করে পেতে রাখা একটা চাদরের মত। বস্তু থাকলে এই জ্যামিতিটা আর সমতল থাকে না, দুমড়ে যায়, যেমন টানটান করে রাখা চাদরের মধ্যে একটা ইট ফেললে সেখানে চাদরটা একটু নেমে যায়। বস্তু যত ভারি হয়, এই দোমড়ানো বা বিকৃতির পরিমাণ তত বেশি হয়, ৩ নং ছবি দেখো। দেশকালের এই বিকৃতিই মহাকর্ষের প্রভাব হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেয়। কতটা বস্তু থাকলে কীরকম বিকৃতি হবে, সেটাই সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের বা আধুনিক মহাকর্ষ তত্ত্বের মূল সমীকরণ, যাকে আইনস্টাইনের সমীকরণও বলা হয়। সমীকরণটি যথেষ্ট জটিল, আর সবক্ষেত্রে এর সমাধানও, অন্তত কম্পিউটার ব্যবহার না করে শুধু কাগজে কলমে—সম্ভব নয়। শুধু বলে রাখা উচিত, বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া নিউটনের তত্ত্ব ও আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে পাওয়া ফল একদম অভিন্ন।আইনস্টাইন প্রথম যখন এই সমীকরণটি লেখেন, তখনো সকলের ধারণা ছিল মহাবিশ্ব স্থির, অর্থাৎ গ্যালাক্সিরা চিরকাল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মুশকিল হল, মহাবিশ্ব স্থির ধরে নিলে আইনস্টাইনের সমীকরণে একটা বড় ধরণের অসঙ্গতি থেকে যায়। সেটা কাটানোর জন্যে আইনস্টাইন করলেন কি—তিনি ওই জ্যামিতির হিসেবের মধ্যে হাতে করে আরো একটা জিনিস ঢুকিয়ে দিলেন—যার একমাত্র উদ্দেশ্য ওই অসঙ্গতিটা দূর করা। এই গা-জোয়ারি করে ঢোকানো জিনিসটার নাম তিনি দিলেন কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট, আর একে গ্রিক অক্ষর Λ (বড় হাতের ল্যামডা) দিয়ে চিহ্নিত করলেন।মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল্‌ দেখালেন, মহাবিশ্ব মোটেই স্থির নয়। বরং সব গ্যালাক্সি একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে – যে গ্যালাক্সি আমাদের থেকে যত দূরে আছে, তার সরে যাওয়ার বেগ তত বেশি। তার মানে এই নয়, যে, আমরা মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আছি। ব্যাপারটা কীরকম জানো? মনে কর, একটা বেলুনের ওপর কয়েকটা ফুটকি কাটা আছে। এবার তুমি বেলুন যত ফোলাবে, প্রত্যেক ফুটকি একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাবে। বিজ্ঞানীরা বললেন, মহাবিশ্বও এইরকম ফুলছে, তার ফলে গ্যালাক্সিরা একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব স্থির নয়, প্রসারণশীল। ছবি - ৪: মহাবিশ্বের প্রসারণ। সূত্র: Eugenio Bianchi, Carlo Rovelli & Rocky Kolbমহাবিশ্বের এই বেড়ে চলা হিসেবে নিলে একটা ম্যাজিকের মত ব্যাপার ঘটে। আইনস্টাইনের সমীকরণে ওই অসঙ্গতিটা আর থাকে না, তার ফলে Λ জিনিসটার আর কোনো প্রয়োজনও থাকে না। আইনস্টাইন বললেন, তাঁর নিজেরই নিজের সমীকরণের ওপর আরেকটু ভরসা থাকা উচিত ছিল, তাহলে তিনি নিজেই বলতে পারতেন মহাবিশ্ব স্থির থাকতে পারে না। বিজ্ঞানীরা Λ-কে নির্বাসন দিলেন। আইনস্টাইন বললেন, আমার হিমালয়প্রমাণ ভ্রান্তি। সত্যিই কি তাই? বোধহয় না, কিন্তু সেখানে যাবার জন্যে আমাদের আরো পঁচাত্তর বছর অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে আরো একটা গল্প আছে।১৯৩৩ সালে ফ্রিৎজ জুইকি নামে এক বিজ্ঞানী দেখালেন, মোট পরমাণুর হিসেব থেকে ছায়াপথের ভর বের করতে গেলে একটা গোলমাল হচ্ছে। ছায়াপথের স্পাইরাল বাহুতে যে সমস্ত নক্ষত্র আছে, তারা সকলেই ছায়াপথের কেন্দ্রের চারদিকে আস্তে আস্তে ঘুরছে। ছায়াপথের দৃশ্যমান ভরের প্রায় পুরোটাই এই কেন্দ্র অঞ্চলে অবস্থিত (কেন্দ্রের গল্পটা সংক্ষেপে বলেছি শেষের দিকে। সেখানে যে ঠিক কী আছে, তা দেখানোর জন্যে এই বছর, ২০২০ সালে, রাইনহার্ট গেঞ্জেল এবং আন্দ্রেয়া গেজ নামে দুই বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন)। কিন্তু তাহলে ওই নক্ষত্রদের ঘোরার বেগ যত হওয়া উচিত, পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। জুইকি বললেন, এর একমাত্র ব্যাখ্যা মহাবিশ্বের সব ভরই দৃশ্যমান নয়। অনেকটা জিনিস আছে যা আমরা চোখে (অর্থাৎ যন্ত্রপাতি দিয়ে) দেখতে পাই না, শুধু তার মহাকর্ষীয় টান অনুভব করতে পারি। এর নাম দিলেন ডার্ক ম্যাটার বা কৃষ্ণবস্তু।কৃষ্ণ কেন? আমরা যা দেখি, সবই কোনো না কোনো রকম আলো দিয়ে দেখি, সে রেডিও তরঙ্গ বা গামারশ্মি যাই হোক না কেন। গাছের পাতার ওপর আলো পড়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের চোখে এসে পৌঁছলে পাতাটাকে দেখতে পাই। কৃষ্ণবস্তু হল অন্ধের চোখের মত, সেখানে আলো কোনো সাড়া ফেলে না, তাই আলো দিয়ে তাকে দেখা যায় না। কিন্তু তার ভর আছে বলে মহাকর্ষীয় টান অনুভব করা যায়। তার মানে, কৃষ্ণবস্তু মোটেই সাধারণ পরমাণু দিয়ে তৈরি নয়। কী দিয়ে যে তৈরি, তা এখনো আমরা জানি না—বিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেশ কিছু গবেষণাগার কৃষ্ণবস্তুর চিহ্ন ধরার পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। যেটুকু জানি, তা এই যে আমাদের গ্রহ তারা মহাজাগতিক মেঘ গ্যালাক্সি নিয়ে এই দৃশ্যমান জগৎ কৃষ্ণবস্তুর সমুদ্রে ডুবে আছে। মহাবিশ্বে কৃষ্ণবস্তুর মোট ভর দৃশ্যমান ভরের প্রায় পাঁচ গুণ। অর্থাৎ, বেশিটাই অজানা।কী অদ্ভুত, তাই না? কৃষ্ণবস্তু যে কোথা থেকে এলো, কী দিয়ে তৈরি, কিছুই আমরা জানি না। শুধু তারা যে মহাকর্ষীয় বলের নিয়ম মেনে চলে, সেটুকু জানি। গল্পের এখানেও শেষ নয়। এর চেয়েও অদ্ভুত জিনিস আছে।এডউইন হাবলের কথা বলছিলাম। তিনি দেখিয়েছিলেন, গ্যালাক্সিরা একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কোনো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে যত দূরে আছে, তার সরে যাওয়ার বেগ সেই দূরত্বের সঙ্গে সমানুপাতিক। গ্যালাক্সি থেকে যে আলো আসে, তার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে সরে যাওয়ার বেগ মাপা যায়। তোমরা অনেকে হয়তো ডপলার ক্রিয়ার কথা পড়েছ, মূল নীতি সেই ডপলার ক্রিয়া। এখন যন্ত্রপাতি অনেক উন্নত হয়েছে, মাপার নতুন নতুন পদ্ধতি বেরিয়েছে, ফলে হাবল যতদূর পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিলেন, আমরা তার চেয়ে বহু বহুগুণ বেশি দূর পর্যন্ত দেখতে পাই। অতিদূরের এইসব গ্যালাক্সির বেগ মাপতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা একটা ধাক্কা খেলেন।আগে বলেছি, প্রায় চোদ্দশো কোটি বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণে মহাবিশ্বের সৃষ্টি। সেই বিস্ফোরণের ধাক্কায় সব কিছুই একে অন্যের থেকে দূরে ছিটকে পড়েছিল, ছিটকে যাবার সে দৌড় এখনো চলছে। কিন্তু দৌড়ের বেগ কমে আসতে বাধ্য, কারণ মহাকর্ষের টান। বেগ কতটা কমবে, তা নির্ভর করে মহাবিশ্বে মোট কতটা ভর (এবং শক্তি) আছে তার ওপরে। প্রায় পঁচিশ বছর আগে দু-দল বিজ্ঞানী দেখলেন, বহুদূরের (কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার মেগাপার্সেক পর্যন্ত) গ্যালাক্সিগুলোর দৌড়ের বেগ কমছে তো না-ই, বরং আরো যেন বেড়ে যাচ্ছে। যেন কেউ তাদের আরো জোরে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।এরকম তো হবার কথা ছিল না? মহাকর্ষ বল আকর্ষক, দুটো বস্তুকে একে অন্যের দিকে টেনে আনে, বিকর্ষণ তো ঘটায় না? তার মানে, এখানে কি অন্য কোনো একটা বল কাজ করছে? ঠিক কি যে হচ্ছে বোঝা না গেলেও, বিকর্ষণ যে ঘটছে এ বিষয়ে দু-দল বিজ্ঞানীই নিঃসন্দেহ হলেন। এটা সম্পূর্ণ অভাবনীয়, আমাদের সব প্রচলিত ভাবনাচিন্তার বাইরে। কিন্তু সেটাই তো বিজ্ঞানের মজা। এই আবিষ্কারের জন্যে ২০১১ সালে এঁরা নোবেল পুরস্কার পান।যা বোঝা গেল, মহাবিশ্বে এক অদ্ভুত রকমের শক্তির ভাণ্ডার আছে, সেই শক্তিই গ্যালাক্সিদের বেশি জোরে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এই শক্তি কোথা থেকে এল, কী এর উৎস, এর ধর্মই বা কী, কিছুরই স্পষ্ট কোনো উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ডার্ক এনার্জি বা কৃষ্ণশক্তি (কৃষ্ণবস্তুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু)।মহাবিশ্বের মোট ভর ও শক্তির তাহলে তিনটে অংশ হল। এক, দৃশ্যমান, বিভিন্ন অণু-পরমাণু, আলো, এই সব মিলিয়ে। দুই, কৃষ্ণবস্তু, যার মহাকর্ষের টান আছে, কিন্তু সাধারণ অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি নয়। তিন, কৃষ্ণশক্তি, যা শুধু আছে বলে জানি, তার চেয়ে বেশি কিছুই প্রায় জানি না। এখন মোট ভর ও শক্তির প্রায় ৫ শতাংশ দৃশ্যমান, প্রায় ২৫ শতাংশ কৃষ্ণবস্তু, আর প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষ্ণশক্তি! ভেবে দেখ, মহাবিশ্বের ৯৫ শতাংশই কী দিয়ে তৈরি, সে সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণাই নেই।মহাবিশ্ব যখন তার যাত্রা শুরু করেছিল, তখন কিন্তু প্রায় পুরোটাই ছিল দৃশ্যমান বস্তু ও কৃষ্ণবস্তু, কৃষ্ণশক্তির অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না। যত দিন যাচ্ছে, কৃষ্ণশক্তির পরিমাণ বাড়ছে, আরো কয়েকশো কোটি বছর পরে কৃষ্ণশক্তিই মহাবিশ্বকে পুরো কব্জা করে নেবে, আর তার প্রসারণের বেগও হু হু করে বেড়ে চলবে। আমরা কেউই অবশ্য সে সব দিন দেখার জন্যে থাকব না।কৃষ্ণশক্তি যে কী—সেটা আমরা জানি না, কিন্তু আমাদের চেনা একটা জিনিস আছে যেখান থেকে কৃষ্ণশক্তি আসতে পারে। সে হল বহুকাল আগে ফেলে দেওয়া আইনস্টাইনের সেই হিমালয়প্রমাণ ভ্রান্তি, কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট Λ, যার কথা প্রায় পঁচাত্তর বছর বিজ্ঞানীদের মনেই পড়েনি। দেখানো যায়, যে Λ যদি শূন্য না হয়, তাহলে মহাবিশ্বের এইরকম অদ্ভুত প্রসারণ সম্ভব। এই ব্যাখ্যাটার মধ্যেও কিছু অসঙ্গতি আছে (নইলে তো বলতামই যে কৃষ্ণশক্তি কী আমরা বুঝে ফেলেছি), কিন্তু আপাতত এর চেয়ে ভালো ব্যাখ্যা আমাদের হাতে আর নেই। শেষ যে জিনিসটার কথা বলব, তার নাম তোমরা অনেকেই শুনেছ, হয়তো কাগজে বা টিভিতে ছবিও দেখেছ। এর নাম ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। নামে মিল থাকলেও এটা অত রহস্যময় কিছু নয়, অন্তত এর বিজ্ঞান আমরা অনেকটাই জানি।আইনস্টাইনের সমীকরণের কথা আগে বলেছি। প্রথম যে সব বিজ্ঞানী এর সমাধান করেছিলেন, তাঁদের একজন হলেন কার্ল শোয়ার্ৎসশিল্ট। একটা ফুটবলের মত গোল ভর স্থির রেখে দিলে তার চারপাশে জ্যামিতি কতটা বিকৃত হবে, সেটা তিনি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন। তাঁর হিসেব মত, এই গোলকটার ঘনত্ব যত বাড়বে, বিকৃতিও তত বাড়তে থাকবে। অর্থাৎ, পৃথিবীর ভর ঠিক রেখে যদি কেউ তাকে চেপে ছোট করে দিতে পারত, তাহলে পৃথিবীর চারপাশে জ্যামিতির বিকৃতিও বেড়ে যেত। আরেকটু সোজা ভাষায় বললে, অভিকর্ষজ ত্বরণের মান বেড়ে যেত। ভর ঠিক রেখে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ কমালে যে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান বাড়বে, এটা তো তোমরা সবাই জানো। এখন পৃথিবীর টান কাটাতে হলে কোনো জিনিসকে সেকেন্ডে প্রায় ১১ কিলোমিটার গতিতে  ছুঁড়তে হয়, তখন আরও অনেক বেশি গতিতে ছুঁড়তে হবে।  তাহলে এবার একটা প্রশ্ন করাই যায় – পৃথিবীকে চেপে কি এত ছোট করে দেওয়া সম্ভব, যে আলোও বেরিয়ে যেতে পারবে না? আলোর বেগ মহাশূন্যে সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার, এর চেয়ে বেশি বেগে কেউই ছুটতে পারে না, সুতরাং আলো না বেরোতে পারলে আর কারও পক্ষেই বেরোনো সম্ভব নয়। এর উত্তর হল, হ্যাঁ; পৃথিবীর ব্যাসার্ধ যদি একটা মার্বেলের গুলির মত করে দেওয়া যেত, সবটুকু ভর অটুট রেখে, তাহলে সেই বামন পৃথিবীর থেকে আলোও বেরোতে পারতো না।সেই পৃথিবীকে কি আমরা দেখতে পেতাম, মঙ্গল বা বৃহস্পতি, বা আরও দূরের কোথাও বসে? পেতাম না, কারণ আলো দিয়েই তো দেখি, আলো যদি না বেরোতে পারে, তাহলে সেই অদ্ভুত জিনিসের খবর কে নিয়ে আসবে? শুধু একটা চিহ্ন রয়ে যাবে – ঐ বিরাট ঘনত্বের ফলে বাইরের জ্যামিতি দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যাওয়া। একেই বলে কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল।এটা খুব কষ্টকল্পনার মত শোনাচ্ছে, কিন্তু শোয়ার্ৎসশিল্ট দেখিয়েছিলেন, যে আইনস্টাইন সমীকরণের সত্যিই এরকম একটা সমাধান সম্ভব, যেখানে দেশকালের বিকৃতি অসীম হয়ে যেতে পারে। দেশকালের জ্যামিতিতে সেরকম বিন্দুর অস্তিত্ব আমরা কেউই চাই না, কারণ প্রকৃতিতে তো আর অসীম বলে কিছু হয় না, কিন্তু অঙ্ক বলছে এরকম বিন্দু থাকতে পারে। এদের বলে ব্যতিক্রমী বিন্দু বা সিংগুলারিটি, y=1/x সমীকরণ সমাধান করে x=0 বিন্দুতে y-এর মান বের করতে গেলে যেরকম হবে আর কি। ভাগ্যক্রমে, এই ব্যতিক্রমী বিন্দু আমরা দেখতে পাই না, কারণ তা থাকে এক অদৃশ্য আবরণের পেছনে। ছবি - ৫: M-৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত কৃষ্ণগহ্বর। বাইরে থেকে যে সব বস্তু কৃষ্ণগহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তাদের বিকীর্ণ আলোর বলয় দেখা যাচ্ছে ইভেন্ট হরাইজনের বাইরে। এই কৃষ্ণগহ্বরটি নিজের অক্ষের চারদিকে পাক খাচ্ছে বলে আলোকবলয় সর্বত্র সমান উজ্জ্বল নয়। (সূত্র: EHT Collaboration)এই আবরণটিকে বলে ইভেন্ট হরাইজন। কোনো বস্তু যতক্ষণ ইভেন্ট হরাইজন পার করেনি, ততক্ষণই তার থেকে আলো এসে আমাদের কাছে পৌঁছতে পারে, একবার ইভেন্ট হরাইজন পেরিয়ে গেলে আলোরও সাধ্য নেই সেই ভয়ঙ্কর আকর্ষণ কাটিয়ে বেরোয়। কৃষ্ণগহ্বর থাকে এই ইভেন্ট হরাইজনের ভেতরে, ব্যতিক্রমী বিন্দু সমেত, সুতরাং কৃষ্ণগহ্বরের সাইজ কীরকম সে আমরা কোনোদিনই জানতে পারব না, একমাত্র ইভেন্ট হরাইজনের সাইজ জানা সম্ভব। তোমরা কৃষ্ণগহ্বরের যে ছবি দেখেছ (৪ নং ছবি), একটা গোল কালো বৃত্তের মত, ঐটাই ইভেন্ট হরাইজন।আইনস্টাইনের সমীকরণে ব্যতিক্রমী বিন্দুর অস্তিত্ব কি অবধারিত? আইনস্টাইনের মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে, ১৯৫৫ সালে, এই বিষয়ে বিজ্ঞানের বিখ্যাত পত্রিকা ফিজিক্যাল রিভিউ-তে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ব্যতিক্রমী বিন্দু বিষয়ে যাবতীয় গবেষণার ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে এই প্রবন্ধটিকে ধরা যেতে পারে। এর লেখক সদ্য ত্রিশোর্ধ্ব এক বাঙালি বৈজ্ঞানিক, পরবর্তী জীবনে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক অমলকুমার রায়চৌধুরী। এই কাজটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক গবেষণা বলে মনে করি। অমলকুমার দেখান, যে দেশকালের মধ্যে দিয়ে কোনো বস্তুকণার গতিপথ যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে ব্যতিক্রমী বিন্দুর দেখা পাওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, অমলকুমার কৃষ্ণগহ্বর সম্বন্ধে কিছু বলেননি, তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে ছিল মহাবিশ্বতত্ত্ব বা কসমোলজি। বস্তুকণার গতিপথের এই সমীকরণটি রায়চৌধুরি সমীকরণ নামে পরিচিত। দশ বছর পরে এই কাজটিকেই আরো অনেক এগিয়ে নিয়ে যান রজার পেনরোজ (যিনি এ বছর [২০২০] নোবেল পেয়েছেন), এবং স্টিফেন হকিং।   বেশিরভাগ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অতি বিশাল এক কৃষ্ণগহ্বর আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বরের ছবি কিছুদিন আগেই মিডিয়ার কল্যাণে সকলের কাছে পৌঁছেছিল (ছবি-৪)। আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির কেন্দ্র আকাশে ধনুরাশি বা স্যাজিটারিয়াস নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে। এখানেও এরকম সুবিশাল এক কৃষ্ণগহ্বর আছে বলে বিজ্ঞানীরা অনুমান করতেন। কৃষ্ণগহ্বর থেকে তো আর আলো বেরোয় না, কিন্তু আশপাশের তারা থেকে কৃষ্ণগহ্বর যখন তার মহাকর্ষের টানে জিনিসপত্র লুঠ করতে থাকে, সেই লুঠ হওয়া জিনিসপত্র কৃষ্ণগহ্বরে মিলিয়ে যাবার আগে আলোর চিহ্ন পাঠিয়ে যায়। মুশকিল হল, পৃথিবীতে বসে সেই আলো দেখাও ভারি শক্ত, কারণ ছায়াপথের কেন্দ্র আর আমাদের মধ্যে আছে বিশাল মহাজাগতিক ধূলিকণা ও গ্যাসের মেঘ, তারা প্রায় সব আলোটুকুই শুষে নেয়।আর একটা রাস্তা আছে, এই কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে যে তারাগুলো পাক খায়, তাদের আবর্তনকাল মেপে কেপলারের সূত্রের সাহায্যে কৃষ্ণগহ্বরের ভর নির্ণয় করা। এটাও যথেষ্ট কঠিন কাজ, কিন্তু বিজ্ঞানীরা সফলভাবেই করেছেন। এই রকম দুটি পর্যবেক্ষক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন এ বছর পেনরোজের সঙ্গে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নেওয়া রাইনহার্ট গেঞ্জেল ও আন্দ্রেয়া গেজ। মনে রেখো, নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের একটা বড় ভূমিকা আছে, শুধুমাত্র তত্ত্বের ভিত্তিতে নোবেল দেওয়া হয় না—আইনস্টাইনও তাঁর মহাকর্ষের তত্ত্বের জন্যে নোবেল পাননি।বিজ্ঞানীরা মাপজোখ করে যা পেয়েছেন, তা সংক্ষেপে এইরকম – ছায়াপথের কেন্দ্রে যে বস্তুটি আছে (এর পোশাকি নাম Sagittarius A*), তার ভর সূর্যের ভরের প্রায় ছত্রিশ লক্ষ গুণ, কিন্তু ব্যাস মাত্র ছ-কোটি কিলোমিটার (পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় পনেরো কোটি কিলোমিটার)। পুরোটা যদি কৃষ্ণগহ্বর না-ও হয়, এর কেন্দ্রে যে এক দানব কৃষ্ণগহ্বর বসে আছে—অন্যান্য গ্যালাক্সির মতই—সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু এ তো আমাদের নিজেদের ঘরের ব্যাপার, পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব মাত্রই ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ, সুতরাং ভবিষ্যতে এর থেকে যে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর খবর পাওয়া যাবে—গেঞ্জেল ও গেজের নোবেল পুরস্কার যেন আরেকবার সেটাই মনে করিয়ে দিল।আগামী কয়েক দশক, আশা করা যায়, মহাবিশ্ব সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানকে অনেকখানি এগিয়ে দেবে। ঠিক কোন পথে যে এগোবে, তা আমরা এখনো জানি না। যে কটা প্রশ্নের কথা এখানে বললাম, তার বাইরে আরো বহু প্রশ্ন আছে, এমনকি আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারণা চুরমার হয়ে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনাও আছে বৈকি। সেইজন্যেই তো গোড়াতেই বললাম, ভেবে দেখো—এই অ্যাডভেঞ্চারে যোগ দেবে কিনা।
  • জনতার খেরোর খাতা...
    নিষিদ্ধ - পাগলা গণেশ | এই কদিন যখনই হাত চলে যায় পেছনদিকে,প্যান্টের ভেতর,আমি পরিষ্কার একটা বাড়তি প্রবর্ধকের অস্তিত্ব বুঝতে পারি।প্রথম যেদিন আবিষ্কার করি,বেশ চমকে উঠেছিলাম।অনুভূতির যে ধারা বয়ে গিয়েছিল,তাতে ভয়ের অনুপাত ছিল সবচেয়ে বেশি।তারপর থেকে ধীরে ধীরে মেনে নিতে আরম্ভ করি।আয়নায় দেখার চেষ্টা করেছি কয়েকবার,একবারও দেখতে পাইনি।ভালোই হয়েছে।নইলে লন মোয়ারদের পিয়ার প্রেসারে পড়ে হাস্যাম্পদ হতে হতো।তবে আলোর অভাব হলে কিংবা পোষাকের আড়ালে-ভালোই জানান দেয়,"আমি আছি।"আমিও এখন উপভোগ করি লাঙ্গুলের সাথে আঙুলের ছোঁয়াছুঁয়ি,লুকোচুরি।আমার বাঁদরামি বেড়ে গেছে;বুঝতে পারছি আমি।খুব যে খারাপ লাগছে তা নয়!তবু ধরা পড়ে অপদস্থ হতে হয় পাছে,তাই কাউকে জানাইনি।আমি জানতাম কেও জানে না এসব!সেদিন নারদ এসে বলল,"তোমার কী ব্যাপার বলতো!"
    রেজাল্ট - আফতাব হোসেন | - " আমাদের গুলোর হবেনি কিছু ..."লোকাল গাড়িতে চারজন মাস্টার গাদাগাদি করে স্কুলের পথে । একজনের নতুন রেডমি ফোন । ফাইভ জি । আনন্দ তে রেজাল্ট এর আনন্দের খবর মুহূর্তে মুহূর্তে । কোচবিহারের চারজন , বোলপুরের দু জন , পশ্চিম মেদিনীপুরে তিনজন এখনো পর্যন্ত । পাশের হার নাকি আই পি এল এর স্কোর বোঝা দায় । তার মাঝেই ফুট কাটলো এক সহযাত্রী হেসে -" আপনাদের স্কুলে কিছু হয়নি " ?চার মাস্টারের মুখ চাওয়া চাওয়ি , দীর্ঘশ্বাসে উত্তর । মাঝখানে খবর এলো মণ্ডল বাবুর ছেলের বিরাশি পার্সেন্ট । মন্ডল বাবু কাঁদো কাঁদো মুখে ফোন করলেন ,-  আরো একটু বাড়ত বুঝলেন , ইতিহাসের আগে সিজনাল এলার্জি ভোগালো বেচারাকে , তাও সব লেটার মার্কস , ফিজিক্স বালায় অনেক দেরীতে ভর্তি করলাম বুঝলেন ,সান্যাল বাবুর ছেলে সেই শেষ পরীক্ষার দিন থেকেই নিট বাস্কেটে পড়ছে জানেন , তাও ছেলেকে বলেছি ছুটতে ,বাংলার যা অবস্থা এখানে কিছু হবে না বুঝলেন ...স্কুলে ঢোকার মুখে ইতিউতি ভিড় অল্প স্বল্প । হেডস্যারের ব্যাগের দিকে নজর সব্বার । একে একে রেজাল্ট নিল প্রায় সব্বাই । দুরদার করে প্রনামের ঘটাও বাড়লো খানিক । হেড স্যার ব্যস্ত বোঝাতে সকলকে , - "হ্যাঁরে সব্বাই স্কুল ছাড়বিনি ,দু একটা বাদে সব মাস্টার আছে এখন , এখানেই ভর্তি হোস বাপরা সব "...সব গুছিয়ে বেরোনোর সময় হাঁফাতে হাঁফাতে দুজন এলো । মার্কশিট নিতে । আমার সেই কালো কুচকুচে রত্ন । সাথে বন্ধু , একই ক্লাসের । এতক্ষনে তাড়াহুড়ো তে কারোরই রেজাল্ট ঠিক দেখা হয়নি  । দেরি কেন বলতে উত্তর দিল , - " স্যার ,গেদে গরম  দুপুরে , ধানগুলা মাঠেই শ্যাস হবে কেনে,তাই সকাল রাত মিলে কাটছি , বন্ধুকে দেখিয়ে বললো - উ আমাদের মাঠের মুনিশ , আমি উদের মাঠের ।বলেই ফ্যালফ্যাল হাসি । যাবার সময় দেখি দু বন্ধু গেটে দাঁড়িয়ে । জিজ্ঞাসা করতে বললো - স্যার , সায়েন্স লিয়ে পড়বো ,বই থাকলে দেবেন , আমাদের দিয়ে হবে তো ?মুখ দিয়ে বেরোতে যাচ্ছিল , এত দেরিতে শুরু করলে হবে কি করে , বুঝতে পেরে গলা বাড়িয়ে আগে ভাগেই হেড মাস্টার শুরু করলেন - হবে নি মানে ? 'মনে রাখবি আমাদের গুলোর  কিছু  নাও হতে পারে , কিন্তু তোদের না হলে কারুরি হবেনি ...#বাচ্চাগুলোর নাম বললাম না , নামে লোকে জাত খোঁজে , তার চেয়ে নম্বর বলি একজন সাতাশি পার্সেন্ট , একজন চুরাশি পার্সেন্ট ।মন্ডল বাবুর ছেলের চেয়ে দু তিন পার্সেন্ট বেশি ।তাও পরীক্ষার সিজিন টা আলুর ছিল তাই , নাইলে আরো বাড়ত ...
    ঘাসফুলের দরজা  - Rimel Sarker | ছোট বেলায় যখন বাবার কাছে চিঠি আসতো, সিদ্ধার্থের মনে হতো যেনো এক মেঘপিয়ন এক দিস্তা কাগজ জুড়ে লিখে পাঠিয়েছে “কেমন আছো, সিদ্ধার্থ?”। ওর এমন মনে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক, ওকে কেউ কখনো জিজ্ঞেসই করে নি ও কেমন আছে কিংবা ও আছে তো? আসলে ওর উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি কখনোই কাউকে ভাবায় নি। জন্মের পর বাবা কে দেখেছে শুধু বড় বড় ফিল্ম বানাতে, টেলিভিশনে বুদ্ধিজীবিদের মতন বোধের বাণী শুনাতে, অথচ বাড়ি এলে কীভাবে সেই বোধের বাণী কর্পুরের মতন নিদারুণ ভাবে মিলিয়ে যায়, তাও দেখেছে ও। জন্মের পর ৬ বছর মাতৃস্নেহে লালিত, পালিত সিদ্ধার্থ  খেলা শেষে ফিরে এসে দেখেছে রক্তাক্ত মায়ের মরদেহ। আজো ওর আবছা আবছা সেই স্মৃতি মনে পড়ে। বিকেলের পড়ন্ত রোদে, সহসা খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে দেখে, মায়ের দেহ নগ্ন, তখনো বুঝে উঠতে পারে নি যে, এক হায়েনা ছিড়ে খেয়েছে তার মাতৃদেহ। এটুকু বয়সে কী কোনো ছেলে বা মেয়ে বুঝবে এসব? সারা মেঝে তে রক্ত, মায়ের মাথা, বুক, যোনী থেকে রক্ত অনবরত পড়েই যাচ্ছে, কিছু বুঝে উঠতেই পারছে কী হলো, কীভাবে হলো। ছোট্ট ছেলে টা তার বাবা কে ডাকতে ডাকতে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে, বাবা এলেন, দরজা আটকালেন আর বললেন ঈশ্বরের সাথে বাবার যুদ্ধতে বাবা হেরে গিয়েছেন, তাই হেরে যাওয়ার ফলস্বরূপ ঈশ্বর নাকি কেড়ে নিয়েছেন মা কে। বোকা সিদ্ধার্থ জানেও না ঈশ্বর ঘুমিয়ে আছেন, ঘুমকাতুরে ঈশ্বর কিছু জানেন না, তিনি জানেন না কিসের যুদ্ধ, জানেন না তিনি। সিদ্ধার্থের আজো মনে পড়ে, মায়ের ঘরের জানালা দিয়ে সোনালী সূর্য কেমন আলো দিচ্ছিলো , মনে হচ্ছিলো যেনো মায়ের মৃতদেহ থিয়েটারের স্পটলাইটের নিচে, আর রক্ত গুলো সূর্যের কান্না। জানালার দিকে তাকাতেই সিদ্ধার্থ একটা বাচ্চা মেয়ের অবয়ব দেখতে পেয়েছিল মিত্রদের বাড়িতে। মিত্রদের বাড়ির একটা ঘর আর ওর মায়ের ঘর একদম মুখোমুখি। সিদ্ধার্থ মেয়েটির পরিচয় জানার জন্য আকুল হয়ে বসেছিলো সেদিন, মনে প্রশ্ন জমে আছে;ও কি সব দেখেছে? কী হয়েছিলো আমার মায়ের সাথে? সিদ্ধার্থের বাবা বলেছিলো মা নাকি অনন্ত কালের রথে চড়ে বিদেয় নিয়েছেন, আর বলে গিয়েছেন ও ঘরে যেনো কেউ না ঢোকে। সিদ্ধার্থে বাবা লাশ সমেত সেই ঘর তালা বন্ধ করে দেন। আশ্চর্যের বিষয়, লাশ পঁচে গিয়ে তো দুর্গন্ধ বের হবার কথা, কিন্তু দুর্গন্ধ কখনোই বের হয় নি, বরং সিদ্ধার্থ পেয়েছে হাসনা হেনা এর সুবাস। কত শত চিঠি আসতো, আর সিদ্ধার্থ ভাবতো ওর মা চিঠি পাঠিয়েছে, কিংবা কেউ ওর কথা জিজ্ঞেস করে লিখেছে। মা এর মৃত্যুর পর  সিদ্ধার্থ ভয়ানকভাবে একা, নিরপরাধ ঈশ্বরকে শত্রু ভেবে বড় হয়ে ওঠে। বাবা মানুষটা ওর খোঁজ না নিলেও সিদ্ধার্থ খুব ভালোবাসতো বাবাকে। আস্তে আস্তে এমন একাকিত্বকে বন্ধু করে বেড়ে ওঠা সিদ্ধার্থ চলে যায় কলকাতায় দর্শন নিয়ে পড়তে।  ছোট বেলায় একবার সেনেকার “অন দ্যা শর্টনেস অফ লাইফ” পড়েছিলো, সেই থেকে দর্শন কে বড়ো ভালোবাসে। ম্যনিফেস্টোও পড়া হয়েছিলো তার। আসলে সিদ্ধার্থ বড়ো অদ্ভুত, একই সাথে মলয় ও শঙ্খকে ভালোবেসেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন ওর এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। মেয়েটির নাম সিদ্ধা, কেমন যেনো মিল দুজনের নামে। পুরুষের স্বভাব, তার চোখ যদি একবার কোনো নারীকে নিস্পলকভাবে একাধারে দেখতেই থাকে, হৃদয় দূর্বল হয়ে যায় তার অজান্তেই। সিদ্ধার্থও এর ব্যতিক্রম নয়, সিদ্ধাকে ও প্রথম দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী তে, মেয়েটা ওর প্রিয় সেই ছোটবেলায় পড়া বইটিই খুঁজছিলো কিন্তু পাচ্ছিলো না। সিদ্ধার্থ মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো আর জিজ্ঞেস করলো তুমি কি সেনেকার সেই বইটা খুঁজছো? কোন বইটা? সিদ্ধা পালটা প্রশ্ন করলো। অন দ্যা শর্টনেস অফ লাইফ? সিদ্ধার্থের এই প্রশ্নে অবাক হয়ে গেলো সিদ্ধা, আর মনে মনে ভাবতে লাগ্লো,সিদ্ধার্থ কীভাবে বুঝতে পারলো ও এই বইটিই খুঁজছে। সিদ্ধার্থ আবার বললো, আমি যেভাবেই বুঝতে পারি, এই নাও বইটি, এটা আমার মা আমায় দিয়েছিলো, আমার শেষ জন্মদিনে।  সিদ্ধা বইটি নেয়, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না, কারণ প্রশ্ন করেই বা কী লাভ? এই লাইব্রেরীতে দুই চাতক পাখির প্রশ্ন আর উত্তর পর্বে কী পৃথিবী কান দিচ্ছে? না দিচ্ছে না, সময় এমনিতেই তার পেটের মধ্যে আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে, তাই সময় কে নষ্ট করে কী লাভ? নষ্ট করার প্রতিশোধে সময় যদি আরো দ্রুত পেটের মধ্যে গ্রাস করে নেয়? যদি গলিয়ে ফেলে পেটে থাকা হাইড্রোকলিক এসিডে? তবে সব প্রশ্ন-উত্তর যদি সময় নষ্ট হতো পৃথিবীতে প্রেম বলে হয়তো কিছু হতো না। একটা মৃদু হাসি দিয়ে “ধন্যবাদ আপনাকে” বলে মৃদু মন্দ বাতাসের মতন বয়ে গেলো সিদ্ধা, সিদ্ধার্থের থেকে দূরে। তবে সিদ্ধার্থ বুঝেছিলো ও প্রেমে পড়েছে সিদ্ধার। নইলে মায়ের দেয়া প্রথম ও শেষ স্মৃতি, বইটি দিয়ে দিতে পারতো না। সিদ্ধাও কেমন, বইটি কবে ফিরিয়ে দেবে, বা সিদ্ধার্থের কবে প্রয়োজন একটি বার জিজ্ঞেসও করলো না। সিদ্ধার্থ তো বলল যে বইটা ওর শেষ জন্মদিনে পাওয়া। সিদ্ধা একবারও প্রয়োজন বোধ করল না সিদ্ধার্থকে জিজ্ঞেস করার, যে ওর জন্মদিন কবে ছিল? সিদ্ধার্থ ওর মা বেঁচে থাকাকালীন শেষ জন্মদিনকেই জীবনের শেষ জন্মদিন হিসেবে ধরে নেয়।ওর জন্ম ও মৃত্যুর খেলা, ওর মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ। যে মাকে সিদ্ধার্থের এমন ভয়াবহ আত্মমৃতের মতন মনে পড়ে, সেই মায়ের দেওয়া শেষ স্মৃতিটুকু কী অবলীলায় বিলিয়ে দিলো সিদ্ধার কাছে! এই কি তবে প্রেম? না কি শুধুই মোহ? মোহ বোধ হয় নয়। মোহ হলে বই দিতো না, সেই তো ছোট বেলা থেকে বইকে বন্ধু হিসেবে ভেবে বড় হয়েছে। আর এই পৃথিবীতে চিরচিরায়ত ভাবে দেখা গিয়েছে প্রেমের ফলে বন্ধুও হারিয়ে যায়, প্রেমিকা হয়ে ওঠে সব থেকে বড় বন্ধু। সিন্ধু নদীকে বড় ভালোবাসে সিদ্ধার্থ, সিদ্ধাকে দেখার পরেই ওর মনে হয়েছিলো সিদ্ধা আর ও সিন্ধু নদীর পাড়ে বসে আছে, গান গাইছে; ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে। সিদ্ধার্থ খুব ভালো গান গাইতো, সিদ্ধাও খুব ভালো গান গায় তবে রবি বাবুর গান একটু বেশিই ভালো লাগে ওর গলায়। এই ভ্রম থেকে সিদ্ধার্থ বেড়িয়ে আসে অপভ্রংশের মতন, ইতি টানে সমস্ত অমনিবাসের। সিদ্ধার সাথে ওর পরের দিন গঙ্গার পাড়ে দেখা হয়, মরা শুয়োরের পঁচা গন্ধ, কি এক বিভৎস পরিবেশ। সিদ্ধার্থ একটু বেশিই অবাক হয়ে যায় আর ভাবে  সিদ্ধা এখানে কী করছে? এই মরা গঙ্গার ধারে ওর মতন মলিনা, শুভ্র,সুন্দর যৌবন রসে পরিপূর্ণ এক নারী তো এই পরিবেশের সাথে মানায় না। এই স্থান যে শুধুই বিপ্লবীদের, যে মরা গঙ্গায় ভেসে যায় লাশ, পঁচা গন্ধ সেখানে তো এই ঈশ্বরীর থাকা সাজে না। সিদ্ধার্থ সিদ্ধাকে গিয়ে বলে, কী মনে পড়ে আমায়? সিদ্ধা জবাবে বলে, “আপনার কথাই ভাবছিলাম”। সিদ্ধার্থ অবাক হয়ে বলে, “কী! তাই নাকি?!” সিদ্ধা বলে, “কেনো? কাল তো খুব মন পড়তে পারলেন আজ পারলেন না যে?” সিদ্ধার্থ কী উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে বলে “কাল একটু ঘোরে ছিলাম”। সিদ্ধা আর জিজ্ঞেস করে না কীসের ঘোর। বেচারা সিদ্ধার্থ ভাবে, “এ জীবনে যা কিছু চেয়েছি সেই কলহে ভীত ঘুমকাতুরে ঘুমন্ত ঈশ্বর তা কাড়িয়ে নিয়েছেন তার নামের বড়াত দিয়ে, সিদ্ধাকেও কি কেড়ে নেবেন তিনি?” ঠিক সেই মূহুর্তেই সিদ্ধা বলে , “চলুন, আজ আমি আর আপনি একসাথে মাতাল হবো, কলেজ স্ট্রীট এ একটা গোপন বার আছে শুনেছি, যাবেন নাকি?” । সিদ্ধার্থ  এই আকস্মিক প্রস্তাবে একটু অবাক হয়, আর ভাবে “ভালো করে চেনা জানাই হলো না, আর একসাথে মাতাল হবো? আমি তো ওর প্রতি এমনিই মাতাল, ও কি সেটা জানে না?”। বোকা সিদ্ধার্থ  জানেও না অবয়ব কী এবং তার স্মৃতিশক্তি সিদ্ধার থেকে কত দূর্বল, সিদ্ধা যে তাকে কাল প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছিলো, তাই আর কোনো প্রশ্ন করে নি , সেটা সিদ্ধার্থ এখনো ধরতে পারে নি। বারে দুজনে উন্মাদের মতন মদ্যপান করে, সিদ্ধা হুশ এ থাকলেও সিদ্ধার্থের বাঁধ ভেঙে যায়। সিদ্ধার্থ কে সিদ্ধা ওর ফ্ল্যাটে পৌছে দিতে আসে। কিন্তু দুজনেই আজ মাতাল, হৃদয়ের ভেঙেছে বাঁধ, সিদ্ধার্থ সিদ্ধাকে টেনে নিয়ে চুমু তে লিপ্ত হয়ে পড়ে। দুজনে আজ দেহের সকল জরা জীর্ণতা কে সময়ের বালুর নিচে চাপা দিয়ে মিলিত হয়। সিদ্ধা আর সিদ্ধার্থ, দুজনেরই প্রথম বৈপরীত্য এর ছোয়া পাওয়া। পুরো রাত ভরে সিদ্ধার্থ চলে যেতে থাকলো সিদ্ধার তরমুজ আঙরাখার ভেতরে, মাথায় মলয়ের কবিতার লাইন :                    “সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর০0                    আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে                      আর আমি পার্ছি না অজস্র কাচ                                ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে”শুভ্র সকালে, সিদ্ধার্থ অনুভব করে তার কপালের উপর ঝুলছে সিদ্ধার সাদা শুভ্র স্তন, স্তনে মাঝে একটা নীল রঙের লকেট। পৃথিবীর কোনো প্রেমই এমন কাব্যিক যৌনতা দিয়ে শুরু হয় কিনা সিদ্ধার্থ তা জানে না। তবে তার প্রেম এভাবেই শুরু হয়েছে, কালের বরপুত্র হবার ফসল হয়তোবা। ছোট বেলা থেকে ঘুণপোকার সিংহাসনে বসে, উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করা ছেলেটা যখণ হাবিজাবি নিয়ে ভাবতে ভাবতে উন্মাদ হয়ে যায়, অন্তর টনিকেও কাজ হয় না, তখন সে যেতে চায় সাজানো বাগানের পরের স্টপেযে, আর সেই স্টপেজ হয়েই ধরা দেয় সিদ্ধা। একাকিত্ব কে সাথী করে বড় হয়ে ওঠা সিদ্ধার্থ এবার সিদ্ধাকে সাথী করে নেয়। সিদ্ধার্থ একা হলেও নিস্বঙ্গ ছিলো না, ওকে স্বঙ্গ দিতো বিড়ালের চোখ, লক্ষ্মী প্যাঁচার চাহনি,  শিশিরের জলে ভেজা চালতা ফুলের সুবাস। তবে এবার সেই সাথে সঙ্গ দিচ্ছে হাসনা হেনা হয়ে আসা সিদ্ধা।  মধুর প্রেম এভাবে গড়াতে থাকে, ঠিক বছর খানেকের মাথায় সিদ্ধার্থ সিদ্ধাকে কোনো একটি শোভাযাত্রায় দেখে এক অপরিচিত ছেলের হাত ধরে নাচতে, খুব অভিমান হয় সিদ্ধার্থের, ছোট বেলা থেকে কিছু না পেয়ে আসা মানুষটা যখন কাউকে আকড়ে ধরে বট গাছের শেকড়ের মতনই হয়তো আঁকড়ে ধরে। সেই আঁকড়ে ধরার ফল যে কী ভয়াবহ অভিমানের জন্ম দেয় সিদ্ধার্থ তা ভালো বুঝেছে এবার। সিদ্ধার ওপর অভিমান হয় নি ওর, আক্রোশ ও ক্ষোভ হয়েছে ঈশ্বরের প্রতি। এবার ক্ষীপ্ত হয়ে গিয়ে সিদ্ধার্থ এক চিঠি লেখে ঈশ্বরের কাছে,“ অন্তরীক্ষ ভেদ করে দেখি, দেখবার বদলে শুনতে পাই সহস্র ঘোর বিভিষীকা। যতদূর শুনি, শুনতে পাই প্রভুর যবনিকা। কেন? কেন এই বৈপরীত্য? আমি কি তোমার আঁতে খুব ঘা দিয়ে খুব বড় ভুল করে ফেলেছি? অমনিবাসের ইতি টেনে পাপের ক্যাফেতে বসে কালো গায়িকার ব্লুজ শুনতে তোমার কী খুব ভালো লাগে ঈশ্বর? তুমি কি কামাচ্ছন ওই কালো গায়িকার প্রতি? একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে শব্দ কে জমা রাখবো, বাকশক্তিও কি জমা রাখা প্রয়োজন নয়? নইলে তোমার বিরুদ্ধে বার বার বলে উঠছি যে! সহস্র বৈদূর্যমণি ভেদ করে দূরে-দূরে  এণ্ড্রোমেডো আর মিল্কিওয়ের চুম্বন দেখবে তুমি। আর সেই মৃত্যুজ্বালায় শত শত ঘাস্ফুল না ফড়িং হয়ে যায়! ব্যবিলিয়নের মতন আমি গুড়িয়ে দেবো তোমার প্রতি আমার নৈবেদ্যের থালা। তোমার যাকে দেখলে যৌনাকাঙ্খা বেড়ে যায়, সমুদ্রের বোন সেই কালোগায়িকা। কালো গায়িকার দেহের গন্ধে তুমি কেমন মোহাচ্ছন্ন, নইলে ওতো গুলো প্রাণ ঝড়ে গেলো তুমি কিছুই করতে পারলে না। ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দোষে ভুগছো। কেমন করে সেই এক জোড়া চোখ তাকিয়ে রইলো,অথচ তুমি ক্ষমাশীল হতে পারলে না ! ওহ তুমি তো শুধু জানো তোমার দোহাই দিয়ে কতগুলো প্রাণ কাড়িয়ে নিতে। বিশ্বাস করো মনে হচ্ছে ছুড়ি বেছানো কোনো বাগানে আমি উদ্ভ্রান্তের মতন শুয়ে আছি, শয্যাশায়ী। ঈশ্বর তুমি বড় নির্দয়, অবশ্য ঘুমিয়ে থাকা কোনো কিছুর হৃদয় কাজ করে না, নইলে যে পাখিকে ভালোবেসে ফেলে দিয়েছিলাম সকল জীর্ণতাকে আজ তারই উদ্দেশ্যে মহাশুন্যের দিকে তাকিয়ে বলতে হলো, ‘ পাখি, তোমায় ছাড়া কেমন করে কাটলো আমার বেলা, নিশীথ নিঝুম, কোথাও কেউ নেই, আমার মনে আপন কোণে হৃদয় বীণায় কী বিষাদ কণ্ঠস্বর বাজে, এর থেকেও বেদনা বিধুর নিদারুণ সুন্দর কিছু হতে পারে? বিট রুটের পাখি তুমি যে এত তাড়াতাড়ি ইউক্যালিপ্টাস এর চুড়োয় উঠে যাবে কেই বা জানতো? তোমার কথা যে আমি পিষে ফেলতাম না, পুষে রাখতাম…’ ঈশ্বর কি সুন্দর একটা অভিশাপ আমায় দিলে আবার, অবশ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠে আর কীই বা করতে পারো তুমি! তোমার পোদে যদি একশো খানা লাথি মারতে পারতাম মনে বড় শান্তি পেতাম। তুমি ঘুম থেকে আর উঠো না, তুমি জেগে থাকলেই আরেক চাতক তার চাতক পাখিকে হারাবে, ঝড়ে যাবে কোনো বিপ্লবীর প্রাণ, পুঁজিবাদি পিতা তার সন্তান কে শেখাবে কীভাবে প্রেমের কারেন্সী চুমু থেকে মুদ্রাতে রুপান্তর করা যায়, কীভাবে নিজ চামড়ায় ত্বকের বিপরীতে মুদ্রাকে বসাতে হয়, তুমি শক্ত করে  বন্ধ করো নিজেকে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে।” এই চিঠি লেখার পর সিদ্ধার্থ সিদ্ধার থেকে অনেক দূরে চলে আসে। ১ মাস পর সিদ্ধা যায় সিদ্ধার্থের কাছে, ক্ষমা চায় তার এই ঠকবাজির জন্যে। ছোটবেলা থেকে একাকিত্ব কে আপন করে বেড়ে ওঠেছে সিদ্ধার্থ, কিন্তু সিদ্ধার অনুপস্থিতি ওকে যে ভয়াবহভাবে একলা করে দেবে ও সেটা বোঝে নি। না বুঝোক, ক্ষমাও করেনি। তবে সিদ্ধা যাওয়ার আগে কিছু সত্য উন্মচন করে যায়, আসলে সিদ্ধাই সেই অবয়ব যা সিদ্ধার্থ দেখেছিলো মাতৃ মৃত্যু কালে। সিদ্ধা আজ বলে গেল্‌ তার বাবা তার মাকে হিংস্র নেকড়ের মতন ধর্ষণ করে কামড়ে কামড়ে খেয়েছে,কিন্তু কেনো খাবে, নিজ স্ত্রীকে? আসলে ওর বাবা আদিম কালের নেকড়ে, নেকড়ের ছেলে হিসেবে ও জন্মেছে ফড়িং হয়ে, ওর মায়ের মতন। সিদ্ধার্থ চোখ বন্ধ করতেই সেই বিভিষিকাময় দৃশ্য ওর চোখের সামনে ভেসে আসে। সিদ্ধা কাঁদছে আর বলছে তোমায় খুব মনে পড়বে, আমায় একটি বার ক্ষমা করো না?! সিদ্ধার্থ জোসেফ স্ট্যালিন। তবে সিদ্ধার প্রস্থান কালে  ও একটি কথা বলে, “কখনো যদি আমায় মনে পড়ে, ঘাস্ফুলের দরজায় ঠক ঠক করো, যদি সত্যি ভালোবাসো সাড়া দেবো”সিদ্ধা আর কথা বাড়ায় নি, ভাবতে ভাবতে চলে যায়, আর কথা বাড়িয়েই বা কী লাভ? পৃথিবী কি কান দিচ্ছে? সেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়তে থাকে সিদ্ধার। লাভ নেই, সময় প্রেম কে গ্রাস করে নিয়েছে। সিদ্ধার্থ এবার ফিরে যায় তার সেই বাড়িতে, বাবা কে দেখে এতো ঘৃণা হয় ওর, ঈশ্বরকেও এত ঘৃণা করে নি ও। ও ঠিক করে এবার মা আর ওর তরফ থেকে বাবাকে চিঠি পাঠাবে ডাকবাক্সে, সেই চিঠি বাবার কাছে পৌছেও যায়, আর সেই চিঠি পড়ে আত্মহত্যা করে ওর বাবা, চিঠিতে কী লেখা ছিলো তা সিদ্ধার্থ না জানিয়েছে কাউকে, না ওর বাবা। বাবার আত্মহত্যার পর, সিদ্ধার্থ ওর মায়ের ঘরের তালা ভাঙে, ভেতরে ঢুকে দেখে সেই রক্ত কে জল হিসেবে ব্যবহার করে মায়ের হাড়োর উপরে গজিয়ে উঠেছে ঘাস্ফুল, জানালার ধারে নীলকণ্ঠ, পায়ের কাছে হাসনা হেনা। সিদ্ধার্থ ঠিক করে নিজেকেও বন্দি করে ফেলবে ঘাস্ফুলের ঘরে, সিদ্ধার মনে বড় রকমের ঝড় বইছে, মনে হচ্ছে সিদ্ধার্থ ওর থেকে খুব খুব দূরে মহাকালের রথে চড়ে অন্তরীক্ষ ভেদ করে চলে যাচ্ছে, সিদ্ধা পাগলের মতন দৌড়ে ছুটে চলে যায় সিদ্ধার্থের বাড়ি, ততক্ষণে খুব দেরী হয়ে গিয়েছে। সিদ্ধার্থ নিজেকে বন্ধ করে নিয়েছে ওর মায়ের ঘরে। সিদ্ধা সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজে, কিন্তু কোথাও সিদ্ধার্থ নেই, সবশেষে মায়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়, দেখে তালা নেই দরজায়, ভেতর থেকে বন্ধ। সিদ্ধার্থের কথাটা ওর মনে পড়ে,  “কখনো যদি আমায় মনে পড়ে, ঘাস্ফুলের দরজায় ঠক ঠক করো, যদি সত্যি ভালোবাসো সাড়া দেবো”সিদ্ধা দেখে ঘড়ের দরজা দিয়ে ঘাস্ফুল বের হয়ে আছে, ও ঠক ঠক করে কিন্তু কোনো সাড়া আসে না, সিদ্ধার্থকে আর দেখেনি পৃথিবী, কেঁদেছে অনেক।এতকিছুর পরও ওঁ পৃথিবীকে দেখছে সেই ঘর থেকে মায়ের কোলে শুয়ে।
  • ভাট...
    commentb |
    দ , এইটা বোধ হয় ঠিক নয়। যদ্দুর জানি (রঞ্জন বোধ হয় বলতে পারবেন ভালোভাবে ), বিয়ে দুরকম ভাবে রেজিস্ট্রি করা যায়, সিভিল ম্যারেজ আর হিন্দু (বা যে  কোনো ধর্মীয়)   হিসেবে। । শাঁখা সিঁদুর মালাবদল অগ্নিসাক্ষী সাতপা লাজাঞ্জলি সারাদিন উপোস  ইত্যাদি  করে বিয়ে করলেও আপনি সিভিল ম্যারেজ হিসেবে রেজিস্ট্রি করতে পারেন। আবার এসব কিস্যু না করেও সিভিল ম্যারেজ রেজিস্ট্রি করতে পারেন। কিন্তু হিন্দু ম্যারেজ হিসেবে রেজিস্ট্রি করতে গেলে তার আগের ঐ অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলকঃ এটাই মনে হচ্ছে কোর্টের রায় ।
    কিন্তু ইউসিসি এলে এসবের কি হবে ? সাকশেশন আইনগুলোরই বা কি হবে ? 
    commentসমরেশ মুখার্জী | ডিসি‌র দেওয়া নিম্নোক্ত খবরটা দেখে মনে হোলো: 
     
    একে কি বলা যায়?  Doctrine of Unnatural Justice! sad  
    comment | হিন্দদুরাষ্ট্র হুঁ হুঁ বাবা! 
     
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত