এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    সীমানা - ৪৬ - শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ছবি: সুনন্দ পাত্র ৪৬চেনা নজরুল, অচেনা নজরুলউনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের নতুন প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী বাংলা প্রদেশের প্রথম নির্বাচনের ফল নিয়ে নানা অঙ্ক নানা দর-কষাকষির পর কৃষক-প্রজা পার্টির ফজলুল হককে প্রধান মন্ত্রী, আর মুসলিম লীগের সেই সময়ের বাংলার নেতা সারাওয়র্দি-নাজিমউদ্দিনদের নানা মন্ত্রীত্বের পদ দিয়ে অবশেষে কৃষক-প্রজা পার্টি আর লীগের যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠিত হল সাঁইত্রিশের পয়লা এপ্রিল অল-ফূল্‌স্‌ ডে'র সন্ধ্যেবেলায়। প্রথম যে ছ'জন সর্বসম্মতিক্রমে মন্ত্রী হলেন, প্রধান মন্ত্রী ফজলুল হককে নিয়ে তাঁরা হলেন নলিনীরঞ্জন সরকার, স্যর নাজিমউদ্দিন, স্যর হবিবুল্লাহ্‌, স্যর বি-পি সিংহ আর ব্যারিস্টার সারাওয়র্দি। এরপর মুসলমানদের মধ্যে আরও দুজন আর হিন্দুদের তিনজন। নৌসের আলি আর সামসুদ্দিন মুসলমানদের, হিন্দুদের মধ্যে মহারাজ শ্রীশকুমার নন্দী, মুকুন্দবিহারী মল্লিক আর রায়কত। শ্যামাপ্রসাদ প্রায় মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছিলেন ছোটলাট অ্যাণ্ডারসন সাহেবের প্রভাবে, বাদ সাধলেন লীগের নেতারা। ঠারেঠোরে শ্যামাপ্রসাদের পিছনে হুমায়ুন কবিরদের সমর্থনের কথা ছোটলাট জানালেও পিছু হটলেন না নাজিমউদ্দিন-সারাওয়র্দিদের দল। অবশেষে মহারাজ শ্রীশকুমার নন্দীই হলেন কম্প্রোমাইজ চয়েস। আর জাত-ধর্মের দাঁড়িপাল্লাও দাঁড়াল যেমনটা অভিপ্রেত। রাজবংশীদের প্রতিনিধি রায়কত আর মুকুন্দবিহারী নমশূদ্রদের।সেই সাঁইত্রিশের এপ্রিলে সারা দেশের চটকল শ্রমিকরাও ধর্মঘট করল। বিপ্লবী সাম্যবাদী দল বা Revolutionary Communist Party (RCPI) সংগঠিত করলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই সৌম্যেন্দ্রনাথ যাঁর সঙ্গে কৃষ্ণনগর সম্মেলনে প্রথম পরিচয় নজরুলের। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের তিনি পৌত্র, নজরুলের তিনি কমরেড বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক পার্টিতে। ওই কৃষক-শ্রমিক পার্টিরই নজরুল পরিচালিত পত্রিকা লাঙলেই সৌম্যেন্দ্র-অনূদিত কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রথম প্রকাশিত হয়। আর ওই সাঁইত্রিশেই কিছুদিন আগে League against Fascism and War-এর সভাপতি হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। আন্দামান রাজবন্দীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলের জনসভাতেও যোগ দিয়েছেন তিনি।অথচ ঠিক সেই সময়টায় – এবং খানিকটা আগে থেকেই হয়তো – জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন রাজনীতিতেই নজরুলের কোন মতামত বা উৎসাহ নজরে পড়ে না। তার সময় কেটে যায় গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে, যে জায়গাটা তার অর্থস্বাচ্ছন্দ্যের উৎসভূমি! তখনো নজরুলের বিদ্রোহী কবি বা জাতীয় কবির পরিচয় মূলত তার কবিতার জোরে, কিন্তু কবিতা তার আর্থিক প্রয়োজনে তেমন কোন কাজে এসেছে কি? বিদ্রোহী শিরোনামে নজরুলের যে কবিতা – শুধুমাত্র একটি কবিতাই যা হাজারে হাজারে লাখে লাখে মানুষ পড়েছে নানা পত্র-পত্রিকায় পুনর্পুনর্মুদ্রণের সুযোগে – কবির কাছে তার অর্থমূল্য পৌঁচেছে কতটুকু? একটার পর একটা কাব্যগ্রন্থ বেআইনী ঘোষিত হয়েছে, খোলা বাজারের বাইরে হয়েছে তার মুদ্রণ – সে মুদ্রণ আইনী হোক বা বে-আইনীই – পুলিশের চোখের আড়ালে তার অভূতপূর্ব বিক্রিতে কোন অর্থলাভ তো হয়নি অন্তত কবির নিজের! বস্তুত, নজরুলের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর একটাও কি জীবিকা অর্জনে তাকে তেমন কিছু সাহায্য করতে পেরেছে? চালচুলো-জমিজায়গীর নজরুলের নেই একেবারেই, প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে খাদ্যবাসস্থানের সংস্থান কয়েকবছরের, আর নিম্নবর্গীয় ভারতীয় সৈনিকের যেটুকু বেতন বছর দু-তিন সে আয় করেছিল – এর বাইরে কোন অর্থসম্পদ নেই যে কবির, সে-আমলে যখন সৃষ্টিশীল রচনার অর্থমূল্য ছিল একেবারেই নগণ্য, তখন শুধুমাত্র লেখার জোরে তার জীবনধারণ সম্ভব ছিল কি? আমরা দেখেছি তার জীবনের প্রায় প্রথম ত্রিশ-বত্রিশ বছর কেটেছে কী নিদারুণ দারিদ্রে, কী অর্থকষ্টে, এবং দারিদ্রজাত কী শারীরিক অসুস্থতায়! এ-কথা তো ঠিকই, যে গ্রামোফোন কম্পানীর অর্থানুকূল্য নজরুলের পারিবারিক জীবনের মান অনেকটাই বদলিয়ে দিল! নিজের সৃষ্টিশীলতার দ্রুত রূপান্তর তখন সে ঘটিয়েছে নিশ্চিত অর্থপ্রাপ্তির শিল্পে। শ্যামাসঙ্গীত ইসলামি গান আর গজলের জনপ্রিয়তা তাকে অর্থ দিয়েছে। হতদরিদ্র নজরুলের তো অর্থের প্রয়োজন, প্রচুর অর্থের, এবং, এখন সে জানে প্রচুর অর্থ আয় করার উপায়টা তার প্রায় হাতের মুঠোয়! সে আয় করবে তার প্রতিভার বিনিময়ে, তাতে লজ্জা কোথায়!নজরুলের মনে পড়ে বিদ্রোহী কবিতা লেখার পরে আফজালের সঙ্গে তার বৌবাজারের ভীম নাগের দোকানে যাওয়ার দিনটা। কবিতাটা আফজাল ছাপাতে চেয়েছিল, সে বলেছিল, আপনাকে আজ মিষ্টি খাওয়াব, পেট ভরে। ভীম নাগের দোকানে বসেই সে কবিতাটা নকল করে দিয়েছিল আফজলকে। কাগজ কিনে এনেছিল আফজাল, নিজের ফাউন্টেন পেনটাও দিয়েছিল তাকে লেখবার জন্যে; কবিতাটা নকল করা হয়ে গেলে ফাউন্টেন পেনটা সে আর ফেরৎ নিতে চায়নি। নজরুল নেয়নি কিন্তু কলমটা, বলেছিল, তার মাথায় একটা বিশেষ আমেরিকান কলম আছে, সেটাই হবে তার প্রথম নিজস্ব কলম। অবাক হয়েছিল আফজাল, একটা দামী নাম করা আমেরিকান কলমের শখ যে নজরুলেরও থাকতে পারে, সে তা ভাবতেই পারে না। নজরুলকে সে ভীম নাগের দোকানে নিয়ে এসেছিল পেট ভরে সন্দেশ খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, এইমাত্র চোখের সামনে সেই পরম উপাদেয় দৈ-সন্দেশ সে শুধু পেট-ভরে নয়, আকণ্ঠ খেয়েছে! নিজের চোখে সেই দৃশ্য দেখার পর দ্ব্যর্থহীন ভাষা আর ভঙ্গিতে আফজাল প্রকাশও করে তার বিস্ময়: আপনার কি নামী দামী সবরকমের জিনিষেরই শখ আছে?নিশ্চয়ই, বলে নজরুল, বড়লোক হবার শখ আছে বৈকি। পাঁচিল-ঘেরা গেটওয়ালা বাড়ি, সামনে দারোয়ান, গ্যারেজে বিরাট বড় গাড়ি, এ সব শখ আছে তো। আপনি দেখবেন, এক দিন এ সবই হবে আমার।নজরুল। কাজি নজরুল ইসলাম। মাত্র কয়েকদিন আগেই যার কাছ থেকে মাত্র একশো টাকার বিনিময়ে তার প্রথম গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি অনায়াসেই কিনেছিল সে, সেই অপ্রস্তুত আফজল বলেই ফেলে, আপনাকে খুব ভালোভাবে চিনি, এরকম একটা অহঙ্কার আমার ছিল। আজ দেখছি চেনার অনেক বাকি আছে!আর আজ যখন সেই সমস্ত শখ নজরুলের সঙ্গীত-সৃষ্টির ক্ষমতায় এবং গ্রামোফোন কম্পানীর দৌলতে সহজেই আয়ত্ত, তখন ঠিক কোথায় থামতে হবে, সেই শখ মেটাবার জন্যে কত প্রিয় বস্তু আর অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, তার হিসেব করার আর প্রয়োজনও হয় না নজরুলের। সারাদিনের জন্যে বাড়ি থেকে নিয়ে-আসা খিলি খিলি পান আর কাপের-পর-কাপ শুধুমাত্র তরল চায়ের পুষ্টির উপর নির্ভর করে ক্লান্তিহীন সে রচনা করে চলে গানের পর গান; একই সঙ্গে সুরসংযোগ, আর চলে অনুজ গায়ক-যশপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রেকর্ডিঙের জন্যে তৈরি করে দেওয়া! মনের সূক্ষ্মকোন-একটা স্তরে মনের-মতো কাব্যরচনা করতে না-পারার অবদমিত বেদনাকে নীরব শাসনে রাতের পর রাতঘুমিয়ে-পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মাসিমা গিরিবালা, স্ত্রী প্রমীলা আর পালিতা কন্যা খুকুর সঙ্গে অর্থহীন তাস পেটাপিটিতেই কেটে যায় নজরুলের! জীবন ধারণের এই চক্রব্যূহ তৈরি করে নিয়েছে নজরুল স্বেচ্ছায়, সেখান থেকে মুক্তির কথা আর কি সে ভাবে?ভাবেই না বোধ হয়। অথবা হয়তো ভাবেও। তাই সুযোগ পেলেই সে নিজের অক্ষমতার কথায় ঘুরে ফিরে আসে বারবার। “...কোনো সাহিত্যিক উৎসবে আমার আমন্ত্রণ অপরাধ, হয়তো তার চেয়েও বেশি। কেননা আমি ধর্মভ্রষ্ট, সাহিত্য সমাজের পতিত। যখন সাদর আমন্ত্রণ আসে এই কবর থেকে উঠে ফেলে-আসা আনন্দ নিকেতনে ফিরে যাওয়ার, তখন খুব কষ্ট হয়, বড়ো বেদনা পাই। আমার মৃত সাহিত্যদেহকে যথেষ্টরও অধিক মাটি চাপা দিতে কসুর করিনি, তবু তাকে নিয়ে আমার বন্ধুরা টানাটানি করেন, কেউ কেউ দয়া করে আঘাতও করেন। উপায় নেই। মৃত লোক নাকি মিডিয়াম ছাড়া কথা বলতে পারে না। আজ যে কথা বলছি তা মিডিয়ামের মারফতই বলে মনে করবেন। অপরিমাণ শ্রদ্ধা নিয়ে সাহিত্যকে আমি বিসর্জন দিয়ে এসেছি। সেই বিসর্জনের ঘাটে এই প্রেতলোকচারীকে ডেকে যেন বেদনা না দেন, আজ বলবার অবকাশ পেয়ে বন্ধুদের কাছে সেই নিবেদন জানিয়ে রাখি।”এমনকি বুলবুলের মৃত্যুর পরও জীবনযাত্রার এই নতুন ছকটা – সকাল বেলাতেই রিহার্স্যাল রূমে হাজিরা দেওয়া, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা শুধুমাত্র কাপের পর কাপ চা আর খিলির পর খিলি পানের পুষ্টিতেই শরীরধারণ করে সঙ্গীতরচনা, সুরসংযোজন আর প্রশিক্ষণেই নিজেকে ব্যস্ত রেখে গভীর রাত পর্যন্ত – না, তাস খেলা আর নয় – এখন তার বদলে যুক্ত হয়েছে গুরুদেব বরদাচরণের নির্দেশে যোগাভ্যাস ও যোগসাধন – ছকটা কিন্তু বদলায়নি। যে যাই বলুন, লক্ষ্মীছাড়া উদ্দাম উদাসীন নজরুলের এখনকার জীবনযাত্রা কিন্তু বিবাহিত পারিবারিক জীবনের দাবির বিষয়ে সম্যক দায়িত্বপালনের একটা ছবিও ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে। বুলবুলের কনিষ্ঠ আরও দুটি – সব্যসাচী আর অনিরুদ্ধ – তার অবশিষ্ট এই দুটি পুত্রসন্তানকে মানুষ করে তোলবার দায় তো নজরুলের নিজেরই, সে তো তা অস্বীকার করেনি। আর এই দায় পালনে অর্থের ভূমিকা কি অস্বীকার করা যায়? এত কাজ তো তাদেরই জন্যে।গত কয়েক বছর ধরে যে বিষয়কে সে স্পষ্টতই অস্বীকার করে এসেছে – অন্তত স্বীকার করবার কোন প্রমাণকাগজে-কলমে রাখেনি সে – তা হল তার কৈশোর আর প্রথম-যৌবনের স্বঘোষিত আবেগ, যা কিছু আছে তার, দেশ আর জাতির জন্যে সবই বাজি রাখা। সেই যে উনিশশো উনত্রিশের ডিসেম্বরে তাকে জাতীয় কবি নামে সম্বর্ধিত করেছিলেন দেশের প্রধান প্রধান মানুষরা, সেই সময় সুভাষবাবু তার সম্বন্ধে বলেছিলেন, কবি নজরুল নিজে বন্দুক ঘাড়ে করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, কাজেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সব কথা লিখেছেন। এতেই বুঝা যায় যে নজরুল একটা জীবন্ত মানুষ। তিনি আরও বলেছিলেন, নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। এতেও বুঝা যায় যে, তিনি একটা জ্যান্ত মানুষ। সুভাষ বলেছিলেন, আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব – তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব। সুভাষ বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় নানা কবির রচিত জাতীয় সঙ্গীত শোনবার নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরুর মতো প্রাণ-মাতানো গান অন্য কোথাও শুনেছেন বলে মনে করতে পারেন না।কিন্তু, দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরুর মতো প্রাণ-মাতানো গান তার পরে আর একটাও লিখতে পারল না কেন নজরুল?নজরুলের মাঝে মাঝে কি মনে পড়ে সুভাষের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা? রবীন্দ্রনাথের ষষ্টীতম জন্মোৎসব সেদিন পালিত হচ্ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। প্রথম আলাপের কিছুক্ষণের মধ্যেই নজরুলকে সেদিন সুভাষ বাংলায় কংগ্রেস-প্রস্তাবিত দৈনিকের দায়িত্ব দিতে চাইল। শুধু তা-ই নয়, যখনই কথায় কথায় নজরুলের সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শোনে সুভাষ, তখনই তাকে কংগ্রেস ভলান্টিয়ার বাহিনীর একটা দায়িত্বও সে দিতে চায়। কিছুদিনের মধ্যেই নজরুলের কুমিল্লায় যাবার কথা, পবিত্রর মুখে সে কথা শুনে সুভাষ ভলান্টিয়ার বাহিনীর প্রস্তাবকে সেই সময়ের জন্যে মুলতুবী রেখে সতেরই নভেম্বর ব্রিটিশ যুবরাজের বোম্বাইয়ে পদার্পণের প্রতিবাদে দেশব্যাপী ধর্মঘটে কুমিল্লায় সাফল্যের দায়িত্ব নজরুলকে দিয়ে ওখানকার স্থানীয় কংগ্রেস নেতা বসন্ত মজুমদারকে চিঠিও লিখে দেয় একটা।কিন্তু বড়ই তাড়াতাড়ি ইতিহাস হয়ে গেল এইসব। উনতিরিশ সালে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-হেমন্ত সরকার-ফিলিপ স্প্রাট-আবদুল হালীমদের সঙ্গে বঙ্গীয় কৃষক লীগ স্থাপনের উদ্দেশে কুষ্ঠিয়ার সম্মেলনে তিন-চার দিনের জন্যে যোগ দেওয়া, সেখান থেকে ফিরে এসে হাওড়ায় শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিতে শ্রমিক বস্তিতে গান শোনাতে যাওয়া আরধাঙড়-মেথরদের সংগঠনে অংশ নেওয়াই নজরুলের শেষ সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। সে বছরেরই মার্চের শেষের দিকে মীরাট কম্যুনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত মুজফ্‌ফর গ্রেপ্তার হয়ে যায়। নজরুলের এতদিনের চলার পথটা ধীরে ধীরে এখানে এসে একটা গলিপথে শেষ হয়ে গেল। পানবাগান লেনের ভাড়া-বাড়িতে অনুজ-বন্ধু শান্তিপদ সিংহের সহায়তায় তখন তার বাস। বন্ধু নলিনী সরকারের যোগাযোগেই তখন গ্রামোফোন কম্পানীতে যাতায়াত-কাজকর্ম শুরু করেছে সে। সঙ্গীতই যে তার ভবিষ্যৎ, এ-কথা ততদিনে বুঝে গেছে নজরুল, পানবাগানের বাড়িতে তখন সে গ্রামোফোন কম্পানীর ট্রেইনার ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁ-য়ের নিয়মিত শাগরেদী করছে, খাঁ-সাহেবকে ওস্তাদ মেনে এই প্রিয়-শিষ্য ঠুংরি খেয়াল কাজরি শিখছে তাঁর কাছে।এই সময়ের পত্রপত্রিকায় নজরুল যে লেখে না তা নয়, কিন্তু যা সে লেখে মূলত সবই গান, যা দিনে দু-চারটে লিখতে সময়ই লাগে না তার। গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমের বাইরে সে যে কখনোই যায় না এমনও নয়। সারা বাংলার নানা জায়গা থেকে অনবরতই তার নিমন্ত্রণ আসে, বর্ষীয়ান সম্পাদক সওগাতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, নজরুলেরপ্রায়-অভিভাবকই তো তিনি, তিনি তো নানা আমন্ত্রণ-চিঠিপত্রের চাপে নজরুলের সেক্রেটারির দায়িত্বই নিয়ে নিয়েছেন প্রায়! যেখানে নজরুল যায়, সে শুধু গানই গায়, গান গাইতে গাইতে সময়ের ঠিক থাকে না, তবুও তার শ্রোতাদের চাওয়ার শেষ নেই!স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা আর কোন সভায় বলে না কবি, গান গায়। সারা ভারতের প্রায় সমস্ত প্রদেশে তখন পর্যন্ত যত কৃষক-শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথমটাই তো নজরুলের নিজের হাতে তৈরি, কৃষ্ণনগরের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময়। এবার সব প্রদেশের সংগঠন মিলিয়ে যে All India Workers and Peasants Party-র অধিবেশন হল কলকাতার অ্যালবার্ট হলে, তাতে তো নজরুল স্বাভাবিকভাবেই আমন্ত্রিত ছিল।আমন্ত্রিত 'বাঙালির কাজিদা' সেদিন কিন্তু সেখানে শুধু উদ্বোধন সঙ্গীতই গাইল। উদ্বোধন সঙ্গীত। ব্যস। আর-কিছু নয়।উনিশশো তিরিশের মে-মাসে মৃত্যু হল বুলবুলের। যে বাড়িতে এতদিন বাস করেছে নজরুল-পরিবার, সে বাড়ির সর্বত্র বুলবুলের স্মৃতি। সেখানে থাকা অসহ হয়ে পড়েছিল তাদের পক্ষে। তীব্র শোকে মুহ্যমান নজরুল প্রথমে বন্ধু নলিনী সরকারের গৃহে, পরে ওই অঞ্চলেই ঠিকানা-বদল করে আবার ফিরে গেল তার পুরোনো অভ্যাসে। সকাল থেকেই গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূম। এবার নলিনীর যোগাযোগে যোগগুরু বরদাচরণ মজুমদারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে সে, অতএব মাঝরাতে আর তাস নয়, এখন যোগাভ্যাস। এখনও ঘনঘন সারা বাংলা থেকে আমন্ত্রণ আসে নজরুলের। সে যায়, গানও গায় সে, এবং, ঠিক এই সময় থেকেই তার গানের সঙ্গে বোধ হয় আধ্যাত্মিকতা আর যোগের সূত্রে প্রাপ্ত নতুন এক রহস্যময়তাও শোনা যায় তার কণ্ঠে।এই রহস্যময়তাই কি নজরুলের নতুন অসুখ?আফজালুল হকের নতুন-কেনা লাইন-টানা কাগজে বিদ্রোহী কবিতা নকল করতে করতে কথায় কথায় তার কয়েকটা “শখ”-এর কথা নজরুল বলেছিল আফজালকে। বিশেষ কোন ব্র্যাণ্ডের একটা আমেরিকান ফাউন্টেন পেন ছাড়াও তারশখ-এর মধ্যে ছিল পাঁচিল-ঘেরা গেটওয়ালা একটা বড় বাড়ি, সামনে দারোয়ান, গ্যারেজে বিরাট বড় গাড়ি। দারোয়ান যে সে রেখেছিল একজন, সবাই জানে তা। বড় একটা ক্রাইসলার গাড়িও ছিল তার। বালিগঞ্জে জমি কিনেছিল নজরুল, ক্যাশ টাকার অভাব ছিল না তার গ্রামোফোন কম্পানীতে কপিরাইটের সূত্রে। অতএব অভিজাত এলাকায় পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি একটা তার নিশ্চয়ই হতে পারত। যে কলমটা সে নিয়মিত ব্যবহার করত তা ওই নির্দিষ্ট ব্র্যাণ্ডের আমেরিকান কলমই ছিল কিনা তা জানা যায় না, তবে সে যে প্রসাধনপ্রিয় ছিল, তার পালিতা কন্যার ভাষায় নিয়মিত স্নো-পাউডারের ব্যবহার এবং তাম্বুলচর্চাজনিত দন্তোষ্ঠকলঙ্ক নিবারণার্থে আমেরিকান মাউথওয়শও যে ব্যবহার করত সে, তা তো অনেকেই জানে। গত কয়েকবছরে অবিশ্যি যে-কথা সে একবারও উচ্চারণ করেনি, তা হল দেশ আর জাতিকে নিয়ে সেই সময় কী তার ভাবনা। এই দেশ এবং জাতিকে নিয়ে তার কী আবেগ, এক সময় নজরুল বারবার বুঝিয়েছে তা। এর পর গজল-গানের সাফল্যই তার জন্যে খুলে দিল গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমের দরজা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সন্ধান মিলে গেল তার; এবং সেই থেকে প্রায় ধর্মীয় গোঁড়ামির মতো অন্ধ-নিরুপায়তায় সে দেশ এবং জাতির বিষয়ে সবরকমের আলোচনা অনেক দিনের জন্যে এড়িয়ে গেছে।যখন বোঝা গেল, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থাগম হয়েছে, তখন নতুন করে হঠাৎ পুরোনো স্বাদেশিকতার ঝোঁক ফিরে এল তার। সে বহু অর্থ ব্যয় করল কলগীতির জন্যে। এত বিপুল অর্থব্যয় দেখে সঙ্কুচিত পিংলা তাকে জিজ্ঞেস করে, ধর, ব্যবসা তো, লোকসানই হল এতে, টাকাটা তোমার ডুবেই গেল, তখন কী করবে তুমি?ডুবে গেলে আবার আয় করব, গানের থেকেই আয় করে নেব আবার; সেটা কোন কথা নয়, বলেছিল নজরুল; কিন্তু, একটা কথা তোকে বুঝতে হবে, আমি তো ঠিক ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে যাব মনে করে এই ব্যবসাটায় নামছি না। এটা একটা আন্দোলন, আন্দোলনটা শুরু করতে চাইছি আমি। আর যথাসর্বস্বই যদি পণ না করি, তাহলে আমার কথা শুনবে কেন লোকে?এই যথাসর্বস্ব খোয়ানোর পরেও গ্রামোফোন রেকর্ডের কপিরাইটজনিত ক্রমবর্ধমান অর্থে আবার সে হয়তো ফিরিয়ে আনতে পারত তার পুরোনো আর্থিক অবস্থা – যা সে যথেষ্ট জোর দিয়ে বলেওছিল পিংলাকে – কিন্তু সবকিছু বদলিয়ে গেল প্রমীলার অসুস্থতায়। ক্যাশ প্রায় শেষ, গাড়ি ফেরৎ চলে গেছে, বরদাচরণের সলিসিটর-শিষ্য অসীমকুমার দত্তর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অতি দ্রুতগতিতে নজরুলের কপিরাইটের সমস্ত টাকা গিলে নিচ্ছে। অখ্যাত-অর্ধখ্যাত শিল্পী যশঃপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ বাবদ গ্রামোফোন কম্পানীর সামান্য মাসোহারা আর রেডিও কম্পানীর প্রোগ্রামভিত্তিক পারিশ্রমিক ছাড়া বস্তুত অর্থাগমের কোন রাস্তাই যখন নেই, তখন বোধ হয় আরেকবার বাইরের জগতের দিকে তাকিয়ে দেখল নজরুল। বরদাচরণের প্রভাবে ততদিনে দৃষ্টি অনেকটাই ঘোলাটে হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই সময়ের তোলপাড়-করা একটা ঘটনা ধীরে ধীরে তার চোখ খোলাতে শুরু করে। সুভাষবাবু য়্যোরোপ থেকে ফিরে এসেছেন সাঁইত্রিশে, তারপর বেশ কিছু দিন সরকার-জনতার টাগ-অব-ওয়রের পর অবশেষে মুক্তি মিলেছে তাঁর, এবং সেই বছরেই কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিশ্ব-জোড়া যুদ্ধের প্রস্তুতির মুখে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনোত্তর ভারতের গঠনমূলক প্রস্তুতির কাজ অতি বেগে শুরু করে দিয়েছেন সুভাষ। তাঁর প্রায়-অমানুষিক উদ্যম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নানা উদ্যোগ, বাম-ঘেঁসা সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের ধারণা আর ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় সরকারের তথাকথিত ফেডারেশনের কৌশলের প্রকাশ্য বিরোধীতা গান্ধীসহ দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসীদের কাছে সুভাষকে জাতিভ্রষ্ট – প্রায় অচ্ছুত – করে তুলল। আটত্রিশের সভাপতি সুভাষের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে অন্য কোন বামপন্থী নেতার অভাবে যখন দ্বিতীয়বার – উনচল্লিশেও – সুভাষ সভাপতির পদে নির্বাচিত হলেন, তখন কোনরকম লাজলজ্জার তোয়াক্কা না করে নির্বাচিত সুভাষের প্রকাশ্য বিরোধীতা শুরু করলেন মহাত্মা। দিব্যদৃষ্টিতে নয়, পাকিয়ে-ওঠা মহাযুদ্ধের পটভূমিতে ভারতের স্বাধীনতা আর যে বেশি দূরে নয় তা খোলা চোখে দেখতে পেয়ে এবং বুঝতে পেরে পদত্যাগী সুভাষ কংগ্রেস-সভাপতিত্ব ছেড়ে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ফিরে এসে প্রত্যক্ষ লড়াইতে প্রায় নেমে পড়লেন। সিরাজদ্দৌলা দিবস পালন এবং হলওয়েল মনুমেন্টের অপসারণের দাবি সুভাষের মাস্টারস্ট্রোক – একই দিনে ফরওয়র্ড ব্লকের হিন্দু কংগ্রেসী আর মুসলিম লীগের মুসলমান ছাত্রের দল হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ দিয়ে নেমে পড়ল লড়াইয়ে।এতদিন পর নজরুলের মনে পড়ে যায় বছর দশেক আগের এক শীতের দুপুরে রাজশাহিতে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মশায়ের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা। বোয়ালিয়া থানার লাগোয়া অক্ষয়কুমারের লোহার পিলার দেওয়া বাড়িতে নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হল। তখন বৃদ্ধ হয়েছেন মৈত্রেয় মশাই, সত্তর ছুঁই ছুঁই – অশক্ত শরীর। নজরুলের মনে আছে, প্রায়-তিরিশের যুবা নজরুলকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেছিলেন, আমরা অস্তমিত সূর্য, তুমি নতুন উদিত সূর্যের দীপ্তি নিয়ে এসেছ। আমি কল্পনা করিনি যে জীবনসায়াহ্নে তোমাকে এত কাছাকাছি কখনো পাব। প্রণাম করে নজরুল বলেছিল, যিনি অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন, যিনি সত্যকে সমাদৃত করতে পারেন তিনি মরতে পারেন না। দোয়া করুন আপনার চিন্তা ও চেতনাকে আমি যেন আমার কাব্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারি।সেই স্মৃতি তো ভুলতেই বসেছিল নজরুল। আজ সুভাষ নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন সে কথা। এবং সেই-কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে সুভাষের প্রস্তাবিত সিরাজদ্দৌলা দিবসের সমর্থনে মুসলিম লীগ-আকরম খাঁ-য়ের আজাদ পত্রিকায় বিবৃতি দিল। তার তখন আবার মনে পড়ে যায় সদ্য-যৌবনে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সে তার শৈশবের স্বপ্নের বিপ্লবের সন্ধানে মাষ্টারমশাই নিবারণচন্দ্র ঘটকের নির্দেশে ময়মনসিংহ হয়ে কুমিল্লায় পৌঁছিয়ে গান্ধীর আহ্বানে কী ভাবে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। সেই অসহযোগ আন্দোলন, যা ঘোষণা করবার আগে গান্ধী মাত্র এক বছরেই স্বাধীনতা এনে-দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এমনকি যুগান্তর-অনুশীলনের ছেলেদেরও তাঁর আন্দোলনে নিয়ে এসেছিলেন। অথচ চৌরিচৌরার একটা ঘটনাতেই এই বিশাল জননেতা একাই এতদিনের এতজনের এত কৃচ্ছসাধনকে তুচ্ছ করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা করে দিলেন! এবার অনেক অনেক বছর পর তেইশে ডিসেম্বর কলকাতার মুসলিম ইনস্টিট্যুট হল-এ ছাত্র-সমাবেশে নজরুলের বক্তৃতায় সেই স্মৃতি উচ্চারিত হল: “...জরার প্রধান ধর্ম হল – অতি সাবধানে পা টিপে টিপে বিচার করতে করতে চলা। এই অতি সাবধানীরা (ভীরু না-ই বললাম) অগ্রগমনের পথ পরিষ্কার না করে পশ্চাতে 'রিট্রিট' করার পথ উন্মুক্ত রাখতে চান। আগে-চলো-মারো-জোয়ান-হেঁইও বলে এগুতে এগুতে যেই এসে পড়ল চৌরিচৌরার দুটো খুনোখুনি, অমনি সেনাপতির কণ্ঠে ক্রন্দন ধ্বনিত হল – 'পিছু হটো, পিছু হটো।' গণ-ঐরাবতের পায়ে কাপাস-তুলো চরকাকাটা সুতোর পুঁটুলি বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও তার বিপুল আয়তনের জন্য দুটো চারটে লোক মারা গেল এইটাই সেনাপতির চোখে পড়ল – আর (ভারতের কথা ছেড়ে দিলাম) এই বাংলাদেশে যে কালাজ্বর আর ম্যালেরিয়ায় বছরে বছরে এগার লক্ষ করে লোক cold blooded murdered হচ্ছে সেদিকে একচক্ষু সেনাপতির দৃষ্টি পড়ল না।”উদ্দীপ্ত এই ভাষণের সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল নজরুলের নতুন অভ্যাসজাত রহস্যময়তাও: “মৃত্যুর ভয় যার হয়তো নিজের গেছে – কিন্তু অন্যের মৃত্যু দেখলে যার মৃত্যুযন্ত্রণা হয় ভয়ে কূর্ম-অবতার হয়ে যান – তিনি আর যাই করুন অমৃতসাগরের তীরে নিয়ে যাওয়ার সাধনা তাঁর নিষ্ফল হয়েছে। সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারের মধ্যে যিনি পরম নিত্যম, নিত্য পূর্ণম্‌ – তাঁকে যিনি উপলব্ধি করলেন না, তাঁর সংহারের রূপকে যিনি অস্বীকার করলেন, ভয়ের পশ্চাতে অভয়কে দেখলেন না, তিনি আর যাই পান – পূর্ণকে পাননি। তবু কাঠ পুড়ছে বলে, যে শুধু কাঠের ধ্বংসই দেখল, আগুনের সৃষ্টি দেখল না, তার দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন নয়। এঁর এক চোখে দৃষ্টি আছে আর বাকি যারা তারা একেবারে দৃষ্টিহীন অন্ধ। এঁরা হাতে বড়ো বড়ো মশাল জ্বেলে চলেছেন – কিন্তু অন্ধের হাতে মশাল যত না আলো দেয় তার চেয়ে ঘর পোড়ায় বেশি।”উনিশশো পঁয়ত্রিশের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সাঁইত্রিশের নির্বাচনের ফলে যখন হকসাহেবের প্রধানমন্ত্রীত্বে বাংলায় লীগ-হক মন্ত্রীসভার শাসন এল, বাংলার মুসলিম লীগ দলের পক্ষে সারা ভারতের নিরিখে সেই নির্বাচনের ফলই ছিল উজ্জ্বলতম, যদিও শুধুমাত্র নিজেদের বিজয়ী প্রার্থীদের জোরে মন্ত্রীসভা গঠনের মতো নয়। যে প্রদেশগুলোয় মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক বেশি নির্বাচিত হয়েছে, সেখানেও নির্বাচিত মুসলমানরা প্রায় সবাই জিতেছে কংগ্রেস-প্রার্থী হিসেবে, কংগ্রেসের টিকিটে; মুসলিম লীগ বা অন্য কোন মুসলিম সংগঠনের প্রার্থী হিসেবে নয়। কংগ্রেস আর হকসাহেবের কৃষকপ্রজা দলের মিলিত মন্ত্রীসভা গঠনের জোর গুজব তখন চলছিল বাজারে, শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস পিছিয়ে যাওয়ায়লীগ-হকের সমন্বয়।এমন অবস্থায়, মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌কে যদি সারা ভারতের প্রধানতম মুসলিম নেতা হয়ে উঠতেই হয়, তাহলে যে চার প্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যাই প্রধান – বাংলা, পঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত – পুরোপুরি সেই চার প্রদেশই না হোক, অন্তত বাংলা আর পঞ্জাবে জিন্নাহ্‌র প্রধান নেতা হয়ে ওঠা বড়ই প্রয়োজন। অথচ বাঙালি-মুসলমান-প্রধান বাংলায় সেই সময় একচ্ছত্র মুসলিম নেতা তো ফজলুল হক, আর সেই নেতৃত্ব তো দুয়েকদিনে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক শেষ হবার পর, সেই উনিশশো বত্রিশ সালে, বিলেতেই থেকে গিয়েছিলেন জিন্নাহ্‌ সাহেব, নতুন করে একটা পোলিটিকাল কেরিয়ার তৈরি করতে চাইছিলেন তিনি বিলেতে, চেষ্টা করে দেখছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টেই কোন আসন পাওয়া যায় কিনা।আর ফজলুল হক? পটুয়াখালির বড় জমিদার এবং প্রতিষ্ঠিত উকিলের তিনি পুত্র, কলকাতার শিক্ষিত সমাজে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব এবং পরিচয়। প্রেসিডেন্সিতে বিজ্ঞান পড়েছেন চার বছর, স্যর পি-সি রায়ের তিনি প্রিয় ছাত্র, কেমিস্ট্রির সঙ্গে সঙ্গে স্যরের মতো শেক্‌স্‌পীয়রও আবৃত্তি করতে পারেন অবিরাম, স্যর আশুতোষের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন হাই কোর্টে। বাংলা বলেন বরিশালের ভাষায় আর টানে, ইংরিজি আই-সি-এসদের মতো। আর সেই উনিশশো বত্রিশেই মুসলিম জমিদার, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আর কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের নিয়ে শুধুই নিখিল বঙ্গ মুসলিম সম্মিলনই করলেন না হকসাহেব, বৃহত্তর কলকাতা আর আশপাশের জেলাগুলোয় হরেকরকমের মুসলিম-প্রধান পেশায় নিযুক্ত যারা – দর্জি, কসাই, জাহাজের লশকর, ছোট-বড় দোকানদার – সবাইকে নিয়ে নিয়মিত মীটিং করতে লাগলেন। এর আগে দু'দফায় তিনি নবযুগ দৈনিক চালিয়েছেন, প্রথম দফায় তাঁর মূল সহযোগী ছিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ আর নজরুল, দ্বিতীয় দফায় মুজফ্‌ফর না-থাকলেও নজরুল তো তখনও ছিলেন কিছুদিন। কাজেই নানাসূত্রে বহুরকম মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। স্পষ্টতই স্বতন্ত্রভাবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আসন তৈরি করে যখন খানিকটা জমি ছাড়তে প্রস্তুত ব্রিটিশরাজ, তখন হকসাহেবই বাঙালি মুসলমানদের প্রথম জানালেন, এই প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে কিছু মর্যাদা তাদের প্রাপ্য। আর প্রাপ্য ঘোষণা করলেই কোন প্রাপ্তি যে হবে না, তা-ও স্পষ্ট করলেন হকসাহেব; আদায় করে নিতে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে। তেত্রিশ সালের অক্টোবরের বার তারিখে স্টেট্‌স্‌ম্যান-এ হকসাহেব লিখলেন, যে কোন বিচারকের সামনে যদি আমি প্রমাণ না-করতে পারি যে বাঙালি হিন্দুরা হল মূর্তিমান সাম্প্রদায়িকতা আর তার ভিত হল এই হিন্দুদের চূড়ান্ত স্বার্থপরতা – তাহলে আমি ফাঁসি যেতেও রাজি আছি।বহুদিন কংগ্রেসের সভ্যও ছিলেন হকসাহেব, আর মুসলিম লীগেরও তো বটেই। অর্থাৎ সে-সময়ের মুসলিম-রাজনীতিতে হকসাহেবকে এড়িয়ে যাওয়া চলতই না। এমনকি অত বড় যে কট্টর লীগপন্থী ব্যারিস্টার সারাওয়র্দি, তাঁকেও বাংলায় নেতৃত্বের সুযোগ তো হাতে-ধরে করে দিয়েছিলেন হকসাহেবই। মেদনীপুরের বাঙালি হলে কী হয়, বাংলা তো বলতেই পারতেন না সারাওয়র্দি সাহেব, অন্তত প্রকাশ্যে বলতেন না কখনও। সেই সারাওয়র্দিকে কলকাতায় খিদিরপুর ডকের বাঙালি লশকরদের ইউনিয়নের কাজে প্রায় হাতে-ধরে বসিয়ে দিয়েছিলেন হকসাহেব। আলিপুর কোর্টের উকিল মহম্মদ দাউদ তখন তার আদালতের যোগাযোগের জোরে কলকাতায় ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের বড় পাণ্ডা, অকংগ্রেসী অখিলাফতি দাউদ হকসাহেবেরও চেলা। ডক অঞ্চলের নানা বস্তিতে নতুন-গজিয়ে-ওঠা একদল দুষ্কৃতির দাপটে তখন কলকাতায়-নতুন-আসা জাহাজী লশকরদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ওকালতি ক্ষমতার জোরে এই দুষ্কৃতিদের শায়েস্তা করেছে দাউদ। এখন সে জাহাজ-শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করায় ব্যস্ত, ট্রামের শ্রমিকদেরও সে জোট বাঁধতে শেখাচ্ছে। হকসাহেবের অনুরোধে সারাওয়র্দিকেও ডক-অঞ্চলে জায়গা করে দিল দাউদ।ফলত একরকমের বাধ্যই হন অল-ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌ ফজলুল হককে সব সময়ই সামনে, অর্থাৎ নেতার আসনে, রাখতে। চল্লিশ সালের চব্বিশে মার্চ ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে মুসলিম লীগের সম্মেলনে প্রস্তাব দেওয়ানো হল হকসাহেবকে দিয়ে, আর আঠাশে মার্চ তাঁরই সরকারের তৈরি কলকাতা ম্যুনিসিপাল আইন (সংশোধন)-এর আওতায় ভোট হল কর্পোরেশনের। এই ভোটের সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস (সুভাষপন্থী)-র সঙ্গে সমঝোতা হল মুসলিম লীগের!আবার চল্লিশের ডিসেম্বরের প্রথম দিনেই, ১-লা ডিসেম্বর, ভেঙে গেল হক-লীগ মন্ত্রীসভা। ৪-ঠা ডিসেম্বর, ১৯৪০, হকসাহেব নতুন-করে-তৈরি-হওয়া প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির নেতা হিসেবে নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের দাবি জানান, যার দাবিদারদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদও আছেন, আবার আছেন সুভাষপন্থীরাও! অনেক টালবাহানা করে ব্যাপারটাকে ঠেকিয়ে রাখলেন ছোটলাটসাহেব হার্বার্ট যতদিন পর্যন্ত না লীগের নেতারা কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারেন। মুশকিলটা হচ্ছে, সুভাষবাবুর সমর্থনে আবার এদিকে কর্পোরেশনে রাজত্ব চালাচ্ছে লীগ!ব্যাপারটা যখন এরকমই, তারই মধ্যে মাঝে-মাঝেই লীগের নেতৃত্ব এমন একটা অবস্থা তৈরি করে যে সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে যায়, তখন নতুন একটা মতলব আসে হকসাহেবের মাথায়। মুসলিম-প্রধান বাংলায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুরাই বেশি, কিন্তু জনসংখ্যায় প্রধান মুসলমানরাই। এ-অবস্থায় মাথা-ঠাণ্ডা রেখে মুসলমানদের প্রাপ্য অধিকারের ব্যাপারটা সংখ্যালঘু হিন্দুদের যতদূর সম্ভব অসন্তুষ্ট না-করেও সামলাতে হলে, সূক্ষ্ম কূটনীতির প্রয়োগ প্রয়োজন।হকসাহেব লক্ষ্য করেছেন, সবরকমের পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যেও মুসলিম লীগ – বিশেষত ওই মুসলিম লীগের বাঙালি তরুণ নেতাকর্মীরা – সুভাষের বিশেষ অনুরাগী। এই তরুণ দলের উপর নজরুলের প্রভাবও যে কতটা তা-ও হকসাহেব জানেন ভালোমতই। নিজের নেতৃত্ব আর ভাবমূর্তি বজায় রাখবার জন্যে একটা খবরের কাগজের কথা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন হকসাহেব। নজরুলের কথা মাথায় আসবার পর আর একটু গভীর চিন্তা করেন তিনি। নজরুল নিজে প্রায় কট্টর সুভাষপন্থী। সুভাষের অত্যাশ্চর্য বেপরোয়া নিষ্ক্রমণের পর যখন বিড্‌ন্‌ স্কোয়্যারে সুভাষ দিবস পালন করল সুভাষপন্থী কংগ্রেস, অর্থাৎ ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা, সেই সময় সুভাষের নিজের পরিবারের ভয়-পেয়ে-যাওয়া সদস্যরা অনুপস্থিত থাকলেও অসুস্থ শরীর নিয়েও নজরুল কিন্তু এসেছিলেন সেই সুভাষ দিবস পালন করতে। হকসাহেব নিজেও সুভাষকে পছন্দই করেন, সে তো তাঁর কলেজের প্রাক্তনীও!হক সাহেব শুনেছেন, আর্থিকভাবে আজকাল একটু অসুবিধের মধ্যেই আছে নজরুল। হিন্দু-মুসলমান – বিশেষ করে দুই সম্প্রদায়েরই তরুণরা, তরুণরা অন্তত – তার বিশেষ অনুরক্ত। প্রধান সম্পাদক হিসেবে নজরুলের পরিচালনায় একটা কাগজ নিজের হাতে থাকলে জনসাধারণের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগটাও থাকে। আর নজরুল তো তাঁর পুরোনো বন্ধু। এর আগে – যত কম সময়ের জন্যেই হোক – দু-দুবার নবযুগ চালিয়েছেন তিনি। দুবারই নজরুল তাঁর সঙ্গে ছিল, যদিও কাগজে পরিচালক হিসেবে তাঁর নামই থাকত। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। আবার তিনি নবযুগ বের করবেন। এবার আর এক-পাতার কাগজ নয়। বাজারের আর-পাঁচটা কাগজের মতোই কাগজ হবে এবার। কাগজে-কলমেও প্রধান সম্পাদক এবার হবে কাজি নজরুল ইসলাম।দেরি করেন না হকসাহেব। উনিশশো একচল্লিশের অক্টোবরে নতুন করে প্রকাশিত হল দৈনিক নবযুগ, প্রধান সম্পাদক কাজি নজরুল ইসলাম। বেতন সাড়ে তিনশো টাকা, রেডিও আর গ্রামোফোন কম্পানীর কাজও প্রয়োজন মত চালিয়ে যাবার অনুমতিও দেওয়া হল তাকে।প্রথম দিন অফিসে এসেই একটা পোস্টকার্ডে পিংলাকে চিঠি লিখতে বসে নজরুল, “ভাই পিংলা, শেষ যেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলি, রোজ রোজ যত পারি বাংলা কবিতা লিখতে বলে গিয়েছিলি তুই। লেখা হয়নি, আর তোর উপদেশ মতো রেডিওতে কবিতার আসরের জন্যে দরবারও করা হয়নি। আজ থেকে হকসাহেবের নতুন দৈনিক নবযুগে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলুম। মনে করিস না সেই টার্ণার স্ট্রীটের দোতলা বাড়ির একতলার একটা ছোট্ট অংশে গোটা কয়েক চেয়ার-টেবিল-টুল-আলমারির অফিস। লোয়ার সার্কুলার রোডে শেয়ালদা স্টেশনের কাছাকাছি একটা বড়সড়ো গোটা বাড়ি যোগাড় করেছেন হকসাহেব। হক সাহেবকে বলে দিয়েছি, প্রত্যেক দিনই এই কাগজে আমার একটা কবিতা বেরোবে, যেদিন অন্য কবিতার মূড আসবে না সেদিন কোন একটা সম্পাদকীয় লিখব কবিতায়; বেশ হবে, না? এখানে বেশ গোছানো সম্পাদকীয় দপ্তর, মনে হচ্ছে কাজ করে আরাম পাব। তবে একটাই দুশ্চিন্তা, হকসাহেব কাজের স্বাধীনতা কতটা দেবেন। আমার মনে হয়, আমার সঙ্গে মুসলিম লীগের যুবকদের আর ছাত্র লীগের নেতাদের যে সম্পর্ক তারই জোরে এই চাকরিটা পেলুম, খোয়াতে কতদিন লাগবে জানিনা।শ্যামপুরে তোর কাজ তো ভালোই এগোচ্ছে খবর পেলুম। ভাবছিস, খবরটা পেলুম কোথা থেকে? তুই তো জানিসই, আমাকে যিনি খবর দেবেন তিনি দুনিয়ার সব খবরই রাখেন, আমার সঙ্গে তো তাঁর বন্ধুত্ব। আমার বন্ধু অবিশ্যি তোর সঙ্গেও বন্ধুত্ব করতে ব্যগ্র, কিন্তু কতদিনে তাঁর ডাক তুই শুনতে পাবি তা তো জানি না। যেদিন পাবি তার অপেক্ষায় আছি। ভালো থাকিস। –কাজিদাচিঠিটা প্রথমেই দুবার পড়ে ফেলল পিংলা, তারপর শেষ প্যারাগ্রাফটা বেশ কয়েকবার। ঘটনাটা কী যে ঘটছে কাজিদার মনে, বুঝতে পারে না সে। চিঠিটা পড়ে মন খারাপই হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চিঠি লিখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না সে। কাজিদাকে সে বলেনি, কিন্তু এখনও এধার-ওধার কাজিদার যেসব কবিতা-টবিতা ছাপা হয়, সুধাকান্তদাদার সহযোগিতায় সেগুলো পড়ে সে, যত পড়ে ততই মন খারাপ হয় তার। অগ্রনায়ক নামে তার সাম্প্রতিক একটা কবিতা তাকে দিয়েছিলেন সুধাকান্তদাদা, এ-কবিতা পড়ে কি সেই কাজিদাকে চেনা যায়? কোথায় সেই 'বিদ্রোহী' কবি, সেই যার কলম থেকে বেরত নতুন পথের যাত্রা পথিক             চালাও অভিযান উচ্চকণ্ঠে উচ্চার আজ              'মানুষ মহীয়ান।' চার দিকে আজ ভীরুর মেলা,         খেলবি কে আয় নতুন খেলা, জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা          বাইবি কি উজান? পাতাল ফেড়ে চলবি মাতাল          স্বর্গে দিবি টান। আঁধার ঘোরে আত্মঘাতী              যাত্রাপথিক সব এ উহারে হানছে আঘাত              করছে কলরব। অভিযানের বীর সেনাদল             জ্বালাও মশাল চল্‌ আগে চল্‌ কুচকাওয়াজের বাজাও মাদল          গাও প্রভাতের গান। ঊষার দ্বারে পৌঁছে গাবি              'জয় নব উত্থান।'?অথচ আজকের অগ্রনায়কের কবি লিখছে, অন্তরে যদি বিপ্লব নাহি আসে বৈশাখী ঝড় আসে নাকো ভৈরব-প্রলয়োল্লাসে। বক্তৃতা দিয়া মিছিল করিয়া ধুলি উড়াইয়া ভাবি: তুফান উঠেছে, এবার মিটিবে যত বিপ্লবী দাবি। বাঁকা তলোয়ার বাঁকা চোখে হাসে তেমনি পথের বাঁকে।... মৃত্যুশঙ্কা আসিলেই সব ডঙ্কা থামিয়া যায়; মুখের কথায় লঙ্কাকাণ্ড সকলে করিতে চায়। ****** সে-ই আল্লার শক্তি লভিয়া নিত্য শক্তিমান তারি মুখ দিয়া উদ্‌গত হয় আল্লার ফরমান। অন্তরে তার বহে দুরন্ত সদা বিপ্লব-ঝড়; বাহিরে থাকে সে শান্ত, করিয়া আল্লাতে নির্ভর। তিনিই ইমাম তিনিই অগ্রনায়ক সারথি তিনি জাগাইয়া ভূমিকম্প পাষাণে চেতনা জাগান যিনি। সর্বযুদ্ধে জয়ী হন ইনি আল্লার শক্তিতে এঁর সৈন্যরা সমবেত হয় প্রেম আর ভক্তিতে।নিজেকেই সান্ত্বনা দেয় পিংলা, এ হয়তো একটা সাময়িক অবস্থা, গত কয়েকবছর ধরে কাজিদার জীবনে তো কমঝড়-ঝাপটা গেল না! তবুও বুলবুলের মৃত্যুটাও সামলিয়ে নিয়েছিল সে, কিন্তু একই সঙ্গে বৌদির এমন একটা অসুখ, আর এমন আর্থিক অবস্থা! সব-কিছু কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে গেল। যা-ই হোক, নতুন চাকরিটা হয়ে ভালোই হয়েছে মনে হয়। রেডিও আর গ্রামোফোনের কাজও চলতে পারে – চাকরির এই শর্তটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক; আশা করা যায় কিছুদিনের মধ্যে আবার পুরনো কাজিদাকে ফিরে পাওয়া যাবে।চাকরিটা ভালোই, কিন্তু যে ব্যাপারটা আগে ভাবেইনি নজরুল তা হল, নবযুগকে কেন্দ্র করে যে আড্ডাটা গড়ে উঠেছিল প্রথমবারের নবযুগের সময়, সে আড্ডাটা তো এখানে নেই। কাজেই, বাইরে থেকে যতই বেশ গোছানো বলে মনে হোক দপ্তরটাকে, সেখানে মন লাগাতে সময় তো খানিকটা লাগবেই। অবিশ্যি নতুন নতুন যাদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে তারা সবাই কাজিদাকে পেয়ে খুশি। কাজিদার খ্যাতি এবং গত পনের-ষোল বছর ধরে সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীতের জগতে তার নানারকমের কাজ আর সাফল্যের কথা তো জানেই সবাই, তার সঙ্গে কাজ করতে পাওয়ার সুযোগ অনেকের কাছেই একটা অভাবনীয় পাওনা বলেই মনে হয়। তবুও আকুল হয়ে বন্ধুদেরই যেন ডাকে নজরুল: কবি ও শিল্পী হওয়া এই দেশে দুর্ভাগ্যের কথা, বেনে মাড়োয়ারি-ভুক্ত এদেশে বাঁচে না মাধবীলতা। জানি সংবাদপত্রের যারা মালিক তাহারা বেনে, অর্থের লোভে তারাই এ বিদ্বেষ আনিয়াছে টেনে।তাহাদেরই মেনে চলতে হবে কি? ঐ রাক্ষুসে লোভেদেশের জাতির অকল্যাণের কারণ হব কি সবে?...******পলাতক ছিনু ধরিয়া এনেছে নবযুগ পুনঃ মোরেতোমরা না এলে নবযুগ পুনঃ আসিবে কেমন করে?...আনন্দধাম বাংলায় কেন ভূত প্রেত এসে নাচে?দেশী পরদেশী ভূতেরা ভেবেছে বাঙালি মরিয়া আছে! এ ভূত তাড়াব; পাষাণ নাড়াব, চেতনা জাগাব সেথা,ভায়ের বক্ষে কাঁদিবে আবার এক জননীর ব্যথা।তোমরা বন্ধু কেহ অগ্রজ অনুজ সোদরসমপ্রার্থনা করি ভাঙিয়া দিও না মিলনের সেতু মম। এই সেতু আমি বাঁধিব আমার সারা জীবনের সাধ,বন্ধুরা এসো ভেঙে দিব যত বিদেশীর বাঁধা বাঁধ।এই কবিতার আহ্বানেও খুব বেশি পুরোন বন্ধু নবযুগে আড্ডা জমাতে এল না। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই কোন-কিছুই তো ফাঁকা থাকতে পারে না, এই সময় নজরুলের যারা প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াল, তাদের মধ্যে একজন হল নবযুগের সেই-সময়কার সহকারী সম্পাদক পূর্বতন বিপ্লবী অমলেন্দু দাশগুপ্ত। নজরুলের ঘনিষ্ঠ-সান্নিধ্যে অমলেন্দুও তখন একজন যোগশিক্ষার্থী। এ-ছাড়া ওই নবযুগেরই ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি আর কালীপদ গুহ। কালীপদ গুহর সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয় বহরমপুরের জেলে। সেই সময় নজরুলের লেখা একটা উচ্চকিত-কণ্ঠ কবিতা জেলখানার এক গার্ডের কাছে লুকোতে গিয়ে গোটা কাগজটাই নিমেষে গিলে ফেলেছিল কালীপদ। আজ এতদিন পর তার সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভারি খুশি নজরুল। এ ছাড়াও, নজরুলেরই প্রায় সমবয়েসী জুলফিকার হায়দার এবং তার স্ত্রী রাবেয়ার সঙ্গেও নজরুলের খুবই ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে সেই সময়ে। জুলফিকারও নজরুলের মতই স্কুলের শেষ পরীক্ষা না-দিয়ে যুদ্ধে চলে যায় উনিশশো সতেরয়। সেনাদলের প্রশিক্ষণের জন্যে নজরুলকে যেতে হয়েছিল পেশোয়ারে, আর জুলফিকার গিয়েছিল বোম্বাই। যুদ্ধ শেষ হলে ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জী কম্পানীতে জুলফিকার চাকরি করতে ঢোকে, আর সেই সুবাদে পৃথিবীর অনেক দেশেই যাবার সুযোগ হয়েছিল তার। কবিতাও লিখত জুলফিকার, সেই কবিতায় নজরুলের প্রভাব কম ছিল না।ধীরে ধীরে নবযুগে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল নজরুল। সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নানা খবরের পরিবেশন এবং বিশ্লেষণ ছাড়াও নতুন নতুন উৎসাহী পাঠক তৈরিতে বেশ খানিকটা সফল হল সে। মননে, বয়েসে, শিক্ষায়, পেশায়, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর পাঠকদের জন্যে তৈরি হল নির্দিষ্ট আলাদা-আলাদা বিভাগ। প্রতিদিনের কাগজের অষ্টম পৃষ্ঠা এই বিশেষ বিভাগগুলোর জন্যে নির্দিষ্ট। সোমবার ছোটদের পাতা, প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিল খোশরোজের মেলা, পরিচালনায় আতশবাজ। বেশিদিন এ-নাম ভালো লাগল না কবির নিজেরই, নাম বদলিয়ে করা হল “আগুনের ফুলকি,” সভ্যদের বলা হত ফুলকি, সঙ্গে থাকত সংখ্যা। অর্থাৎ যে-সব ছেলেমেয়েরা “আগুনের ফুলকি”র সভ্য হত, তাদের পরিচয় ফুলকি ১, ফুলকি ২ ইত্যাদি। নতুন নাম ঘোষণা করা হল নতুন কবিতার সঙ্গে; কবিতার নাম আগুনের ফুলকি ছুটে, লেখক কাজি নজরুল ইসলাম: আগুনের ফুলকি ছুটে       ফুলকি ছুটে! আগুনের ফুলকি ফুটে       নবযুগ-পত্রপুটে আগুনের ফুল কি ফুটে? ইত্যাদি।মঙ্গলবার মহিলাদের জন্যে নির্দিষ্ট বিভাগ, “মহিলা আসর,” পরিচালিকা শিরী।বুধে “লাঙ্গল ও হাতুড়ি,” শ্রমজীবীদের আসর, পরিচালক শ্রমসুন্দর।বৃহস্পতিবার “ব্যবসা ও বাণিজ্য,” পরিচালক সওদাগর।শুক্কুর বারে “বিশ্ব মুসলিম,” পরিচালক এব্‌নে খল্‌দুন।শনিবারে মঞ্চ ও ছায়াছবির জগৎ নিয়ে বিশেষ বিভাগ “রূপ ও ছন্দ,” সম্পাদক রূপকার।আর, অষ্টম পৃষ্ঠায় প্রতি রবিবার সাহিত্যবাসর “রসের জলসা।” স্বয়ং নজরুল ইসলাম যে পত্রিকার সম্পাদক, তাতে কি আর সাহিত্যবাসরে আলাদা করে কোন সম্পাদক লাগে?পয়লা ডিসেম্বর বিরাট খবর নবযুগে, আকর্ষক হেডলাইন: হক মন্ত্রিসভার পদত্যাগ: বাঙ্গলার মন্ত্রি-সঙ্কটের অনিবার্য্য পরিণতি/ সোমবার দ্বি-প্রহরে লাট-ভবন হইতে ইশ্‌তাহার/ গভর্ণরের সিদ্ধান্তসাপেক্ষে মন্ত্রিদিগকে স্ব স্ব কর্তব্য পালনের নির্দেশ/ বাঙ্গলার নূতন মন্ত্রিসভা গঠন সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা/ প্রগ্রেসিভ এ্যাসেম্বলী পার্টির সেক্রেটারীর বিবৃতি।এর পরের দিন স্পষ্টতই হক সাহেবের সমর্থনে সম্পাদকীয়। দায়ী কে? – এই শিরোনামে বেশ দীর্ঘ এই সম্পাদকীয়, তারই কয়েকটা লাইন: “......মন্ত্রিসভার যে কলহ বাধিয়াছিল, তার জন্যও হক সাহেব দায়ী ন'ন, এবং পরিণামে হক মন্ত্রিসভার যে পদত্যাগ করিতে হইল, তার জন্যও হক সাহেব দায়ী ন'ন। মন্ত্রিসভায় কলহ বাধিল কেন? যে-কোয়ালিশন চার বছর ধরিয়া ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণভাবে হক-মন্ত্রিসভার প্রত্যেক মন্ত্রীকে সমর্থন করিয়া আসিয়াছিলেন, সেই কোয়ালিশনের একটা বিরাট দল, যে-কোন কারণেই হোক, বলিলেন যে, অমুক মন্ত্রীর প্রতি তাঁদের আস্থা নাই, তিনি মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব সুষ্ঠুরূপে পালন করিতে পারিতেছেন না; কাজেই তিনি পদত্যাগ করুন। ভদ্রলোক যদি মন্ত্রিত্বের গদি কামড়াইয়া পড়িয়া না থাকিতেন, তিনি যদি কোয়ালিশনের ঐ বিরাট অংশের মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাইয়া মন্ত্রিত্বের লোভ ত্যাগ করিতেন, তবে পরের দিনই কোয়ালিশন দলের ঐক্য ও মুসলিম-সংহতি কায়েম হইয়া যাইত।“স্বার্থত্যাগ করিয়া মুসলিম সংহতি রক্ষার দরুণ উক্ত পদত্যাগী মন্ত্রী মুসলিম জনগণের চোখে ঊর্দ্ধে উঠিয়া যাইতেন। মুসলিম বাঙ্‌লার সামনে একটা ত্যাগের আদর্শও স্থাপিত হইত।“কিন্তু তিনি এই সব কিছুই করিলেন না। “মুসলিম সংহতি চুলায় যাউক, আমার মন্ত্রিত্ব থাকিলেই হইল” বলিয়া তিনি ছিনা-জোঁকের মত মন্ত্রীত্বের গদিতে মরণ-কামড় মারিয়া পড়িয়া থাকিলেন। অথচ হক সাহেব প্রধান মন্ত্রী হিসাবে কোয়ালিশনের লিডার হিসাবে ও গণনেতা হিসাবে কোয়ালিশনের ৪৭ জন সদস্যের সমবেত অভিমত উপেক্ষাও করিতে পারিলেন না। তিনিও, কাজেই, উক্ত মন্ত্রীকে পদত্যাগের জন্য প্রথমে অনুরোধ ও অবশেষে আদেশ করিলেন...।“...তাই দল বাঁধিয়া তাঁরা পদত্যাগ করিলেন। এতেই হক মন্ত্রিসভার পতন হইল।” এবং এই সম্পাদকীয়র শেষে নজরুলের 'আল্লা পরম প্রিয়তম মোর' শিরোনামে নাতিক্ষুদ্র এক কবিতা! এবং এটাই এখন নজরুলের সিগনেচার-ছাপ!আসলে, সাম্প্রতিক মুসলিম রাজনীতি ঠিকঠাক বুঝতে পারে না নজরুল। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি রক্ষার ব্যাপারে দেশবন্ধু, এবং তাঁর অকালমৃত্যুর পর সুভাষবাবু, যে উদারতার সঙ্গে সম্প্রদায়গত বিভেদের মোকাবিলা করবার চেষ্টা করেছেন, এমনটা আর কেউ করেছেন বলে নজরুলের জানা নেই। ছাব্বিশ সালের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময় নজরুল কৃষ্ণনগরে। সে বছর সে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির সভ্যও নির্বাচিত হয়েছিল। এই সম্মেলনের তিন বছর আগে চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ পার্টির নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জের অধিবেশনে যে হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট অনুমোদিত হয়েছিল, ছাব্বিশের সম্মেলনে, যখন চিত্তরঞ্জন আর নেই আর সুভাষ জেলবন্দী, তখন 'কংগ্রেস কর্মীসঙ্ঘ' নাম দিয়ে কংগ্রেসের এক শক্তিশালী উপদল প্যাক্ট ভেঙে দেবার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছিল কৃষ্ণনগরে। ওই প্যাক্ট আর তখন বাঁচিয়ে রাখার কোন উপায়ই ছিল না; দেখেশুনে নজরুল মজা করেই লিখেছিল বদ্‌না-গাড়ুতে গলাগলি করে, নব প্যাক্টের আশনাই, মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই!জল অনেকটা গড়িয়ে উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের নতুন প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী যখন সাঁইত্রিশে বিভিন্ন রাজ্যে প্রাদেশিক নির্বাচন হয় – জওহরলাল নেহ্‌রু যখন কংগ্রেস-সভাপতি – সেই নির্বাচনে, শুধুমাত্র শিডিউল্‌ড্‌ কাস্ট হিন্দুই নয়, মুসলমানদের জন্যেও সংরক্ষিত আসন থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস আশাতীত ভালো ফল করে। এমনকি নির্বাচিত মুসলমানদেরও একটা বড় অংশ – মুসলিম লীগ নয় – কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে জয়লাভ করে। সেই সময় জওহরলাল মন্তব্য করেন, ভারতের ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে পক্ষ কেবলমাত্র দুটিই, কংগ্রেস আর ব্রিটেন, অন্য কোন তৃতীয় পক্ষই নেই! জিন্নাহ্‌, সেই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, সারা ভারতে মুসলিম জনসংযোগ শুরু করলেন উলেমাদের সাহায্য নিয়ে। এর আগেই আলিগড় য়্যুনিভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষকদের একটা আন্দোলন তৈরি হচ্ছিল – সেটা অবিশ্যি অভিজাত মুসলমানদের আন্দোলন, একটু এলিটিস্ট। সাধারণ মুসলমানদের এড়িয়েই চলত তারা! কিন্তু উলেমাদের যোগদানের পর সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও খানিকটা অস্পষ্ট একটা মুসলিম নেশনহূডের ধারণা তৈরি হতে শুরু করল। উনিশশো উনচল্লিশের মধ্যেই মুসলিম লীগের সভ্যসংখ্যা ছাড়িয়ে গেল তিরিশ লক্ষ!উনচল্লিশে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিটিশরাজ ভারতের হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে অনেকেই, যেমন জওহরলাল, রাজাগোপালাচারি, মৌলানা আজাদ ইত্যাদি, আদর্শগত ভাবে এই যুদ্ধে ব্রিটেনেরই সমর্থক ছিলেন, কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে এমনকি পরামর্শও না-করে তাদেরই হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করার প্রতিবাদে কংগ্রেস সমস্ত মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করল। এই সুযোগ, নেহ্‌রুর 'কোন তৃতীয় পক্ষই নেই'-এর জবাব দিয়ে দিলেন জিন্নাহ্‌, এই আপৎকালীন অবস্থায় আমরা সরকারের পক্ষে আছি। তিনপক্ষের এক পক্ষ আমরা! ওয়ান আপন থ্রী! এখন কোন বিষয়ে আলোচনা-সিদ্ধান্ত আমাদের বাদ দিয়ে করা চলবে না; কংগ্রেসের বড়দাগিরি আমরা মানি না, আমরা কংগ্রেসের পদত্যাগে ডেলিভারেন্স ডে পালন করছি, মুক্তি দিবস!বাংলার প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব কখনো কখনো লীগ, কখনো তিনি কৃষক-প্রজা, কিছুদিন পর অবিশ্যি লীগে তাঁর সভ্যপদও কেড়ে নেবেন জিন্নাহ্‌, কিন্তু পরের কথা পরে! সে সময় বাংলায় মুসলিম লীগ প্রধানত অবাঙালি মুসলিমদের দল: আর তাই যদি হয়, তাহলে কোন্‌ নেশনভুক্ত বাঙালি মুসলমানরা? বাঙালি নেশন না মুসলিম নেশন?এই নেশনহূডের তোলপাড় যখন চলছে, তখন নজরুল রাজনীতি বা শাসন ব্যবস্থা তো নয়ই – এমনকি কবিতা নিয়েই বা কতটুকু মাথা ঘামায়? সে তখন হয়তো নভোচারী – মহাকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত কোন কল্পিত মধুর তিয়াস তার তখন!অনেক দিন আগে, করাচি থেকে কলকাতায় এসে নজরুল যখন নবযুগে কাজ করতে গিয়েছিল, তখন তো নবযুগ ছিল মুজফ্‌ফর আর তাদের নিজেদের আদর্শ প্রচারের মাধ্যম। দেশের ব্যাপারে, মানুষের ব্যাপারে, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদের একটা অস্ত্র। ফজলুল হক সাহেব তো নিজেই একটা পত্রিকা প্রকাশ করে ওদের সেখানে কাজ করতে ডাকেননি, তখন প্রয়োজনটা ছিল ওদের নিজেদেরই। ওরাই হক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে, নিজেদের যোগ্যতার বিষয়ে তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্বাস উৎপাদন করিয়ে তাঁকে দিয়ে নবযুগ চালু করালো। মাসিক বেতন কতো পাবে হক সাহেবের থেকে, তা নিয়ে মাথাই ঘামায়নি ওরা। যে-লেখা নজরুল তখন লিখেছে সেই নবযুগে, তা পড়ার জন্যে কলকাতার রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত মানুষ, হকার আসতে-না-আসতেই সব পত্রিকা বেমালুম ফাঁকা।আজ সাড়ে তিনশো টাকা বেতনের চাকর নজরুল সম্পাদকীয় লেখে মূলত হক সাহেবকে সন্তুষ্ট করার জন্যে। তার মানে এই নয় যে যা সে লেখে, সে নিজেই তাতে বিশ্বাস করে না। তার নিজের মনে হয় দেশের এবং মুসলমানের স্বার্থরক্ষার জন্যেই হক সাহেব কাজ করছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে লীগ যা বলছে তা শুনলে কেমন যেন সবকিছু ঘুলিয়ে যায় তার। তাই মাঝে-মাঝেই আল্লাহ্‌ বা ঈশ্বরের প্রশস্তি করে কবিতা লেখে নজরুল। যদি সে ভুল করে থাকে কোথাও, আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ্‌ তো ভালবাসেন নজরুলকে!উনচল্লিশের এই যুদ্ধ এতদিন চলছিল য়্যোরোপে, খানিকটা উত্তর আফ্রিকায়। এবার এশিয়ায় এমন যুদ্ধে নেমে পড়ল জাপান যে তোলপাড় হয়ে গেল সারা পৃথিবীতে। সাতুই ডিসেম্বর জাপান শুধুই যে ঘোষিতভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ঢুকে পড়লতা-ই নয়, সরাসরি আক্রমণ করে বসল আমেরিকার বন্দর ও সেনাবাস, পার্ল হার্বার। পনেরই ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ব্রিটিশ রাজশক্তির জাপানের কাছে আত্মসমর্পণ, পলায়ন বর্মা থেকে, আর সিঙ্গাপুরের পতন!সুভাষের সেই জানুয়ারি মাসের নিষ্ক্রমণের পর তাঁর আর কোন খবর নেই সাধারণ ভারতবাসীর কাছে। সুভাষ কোথায়? – কেউ জানে না। কলকাতায় জোর গুজব, সুভাষের বদলে এবার শরৎ বোসকেই গ্রেপ্তার করবে ব্রিটিশ সরকার। পয়লা ডিসেম্বরে লীগ-হক মন্ত্রীসভার পতনের খবর তো বেরিয়েই গেছে নবযুগে। তারপর প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পার্টির নেতা হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করে মন্ত্রীসভা গঠন করার প্রস্তাবও হক সাহেব দিয়েছেন ছোটলাট হার্বার্টকে। হার্বার্ট সাহেব – সম্ভবত লীগের নেতাদের পরামর্শেই – টালবাহানা করেই চলেছেন। এমন সময় হঠাৎ দিল্লী থেকে ভাইসরয় লিনলিদগোর জরুরি বার্তা আসে ছোটলাটের কাছে: এই মুহূর্তেই হককে মন্ত্রীসভা গঠন করতে বল। জাপানের থাপ্পড় ব্রিটেনের গালে লাগবার পর বর্মা-সিঙ্গাপুর থেকে দলে দলে উদ্বাস্তুরা আসবে এবার। জেনে রেখ, জন্মগতভাবে যারা ভারতীয় এবং বর্মী, পবিত্র ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিষয়ে কোনই আবেগ নেই তাদের। খুব সম্ভবত এদের মধ্যেই মিশে থাকবে পঞ্চম বাহিনীও। অনেকেই এরা বর্মার জঙ্গল পেরিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতিদের এলাকার মধ্যে দিয়ে মূল ভারতে আসবার চেষ্টা করবে। এখন আমাদের অস্ত্র হবে পোড়ামাটি নীতি; নৌকো-জাহাজ-সাইকেল-গাড়ি সব ধ্বংস করতে হবে, ধ্বংস করতে হবে যাবতীয় খাদ্যশস্য। কাজেই তোমার প্রয়োজন এখন একটা মন্ত্রীসভা, সেই মন্ত্রীসভাকে কাজে লাগিয়েই করা যাবেএ-সব। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর নয়, পারলে আজই মন্ত্রীসভা চাই!ছোটলাটের কাছ থেকে জরুরি খবর পেয়ে হক সাহেব আসেন। মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান পেয়ে তিন জনের নাম লিখে তিনি তৎক্ষণাৎ সাহেবের কাছে দেন: তাঁর নিজের নাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, এ-ছাড়া শ্যামাপ্রসাদ আর শরৎ বোস।শরৎ বোস? – আতঙ্ক ছোটলাটের গলায়। ওকে অ্যারেস্ট করার জন্যেই তো এত তাড়াতাড়ি! ও তো জাপানের গুপ্তচর। এক কাজ করুন, ছোটলাট বলেন, আপাতত আপনি একাই শপথ নিন, ওকে অ্যারেস্ট করুন, বাকি কাজ তারপর।হকসাহেব রাজি হলেন না, ফিরে গেলেন তিনি। ফিরে আসবার আগে সাহেবকে বললেন, ওই অ্যারেস্টের কাজটুকু আপনি নিজে করিয়ে, তারপর আমায় খবর দেবেন। তারপর মন্ত্রীসভা!শেষ পর্যন্ত এগারই ডিসেম্বর হকসাহেবের নেতৃত্বে প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পার্টির মন্ত্রীসভা – যা পরে শ্যামাহক মন্ত্রীসভা নামে পরিচিত হয়েছিল – শপথ নেয়। সেদিনই সকালে ঊডবার্ণ পার্কের বাড়ি থেকে শরৎকে ভারত রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, পাঠিয়ে দেয় দক্ষিণ ভারতে। (নিষ্ক্রমণের পর যখন সারা ভারতবর্ষ সুভাষের হালহকিকত নিয়ে চিন্তিত, সেই সময় কিছুদিনের মধ্যেই শরতের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে ফেলেন সুভাষ। একচল্লিশের ৩১শে মার্চ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে ভগৎ রাম নামে একজন কলকাতায় শরতের পুত্র শিশিরের সঙ্গে দেখা করে সুভাষের চিঠি এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে যায়। শান্তিময় গাঙ্গুলি নামে একজন বিপ্লবীর সঙ্গে ভগৎ রামের যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয় সেই দিনই। পরে অবিশ্যি নানা কারণে এই যোগাযোগ ছিন্ন করতে হয়।সুভাষ সেই সময় বার্লিনে ছিলেন। কলকাতার জাপানী দূতাবাস এবং টোকিওকে কাজে লাগিয়ে শরতের সঙ্গে সুভাষের যোগাযোগের ব্যবস্থা হয়। কলকাতার জাপানী কনসাল-জেনারাল কাতসুও ওকাজাকিকে গাড়ি চালিয়ে রিষড়ায় ওঁদের বাগান-বাড়িতে নিয়ে আসতেন শিশির, এভাবেই থাকত যোগাযোগ। ওকাজাকি বদলি হয়ে যাবার পর ওতা নামের আরেকজন আসেন তাঁর জায়গায়। ওতার স্ত্রী শাড়ি পরতে ভালোবাসতেন। এই শাড়ি-পরিহিতা স্ত্রীকে নিয়ে ওতাও বহুবার শিশিরের গাড়িতে রিষড়ায় এসেছেন। শাড়ি-পরা জাপানী মহিলা, সকলের তো চোখে পড়বেই! পুলিশও নিশ্চয়ই জানত এই সব ব্যাপার-স্যাপার, হয়তো চেষ্টাও করত কিছু-একটা করবার, কিন্তু প্রমাণের অভাবে করা যেত না কিছুই। কিন্তু একেবারেই অকস্মাৎ বার্লিনে জাপানের রাজদূতকে পাঠানো শরৎ-সুভাষের উনিশশো একচল্লিশের পয়লা সেপ্টেম্বরের কোন বার্তার উল্লেখ-করা জাপান-বিদেশ-মন্ত্রীর একটা টেলিগ্রাম ব্রিটিশ গোয়েন্দারা – যাকে বলে ইন্টারসেপ্ট – তা-ই করে ফেলে। এই টেলিগ্রাম সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখে পৌঁছোয় একেবারে চার্চিলের টেবিলে! হাতে-নাতে প্রমাণ, অতএব সেই পাঁচুই সেপ্টেম্বর থেকে যে-কোনদিনই শরৎকে গ্রেপ্তার করা চলত!)শরতের গ্রেপ্তার, এশিয়ায় জাপানের হাতে ব্রিটেনের উত্তমমধ্যম, উত্তর-পূর্ব ভারতে পোড়ামাটি নীতি প্রয়োগের পরিকল্পনা, রকমারি এইসব বিষয়ে খানিকটা যখন পর্যুদস্ত ব্রিটেন ফেব্রুয়ারির গোড়ায় তখন আর এক এশীয় দেশ – জাপান-আক্রান্ত চীন সরকারের! – প্রধানকে ভারত পরিদর্শনে ভারতস্থ ব্রিটিশ সরকার আহ্বান করেন। সস্ত্রীক মার্শাল চিয়াংকাইশেককে সংবর্ধনা দেওয়া হয় কলকাতায়। এই উপলক্ষে গ্রামোফোন কম্পানী নজরুলকে তাঁদের সম্বর্ধনার উপযুক্ত কোন গান লিখে সুরসংযোগ করবার দায়িত্ব দেয়। ইনিয়ে বিনিয়ে চীন-ভারত-ব্রিটেনের সখ্য নিয়ে গান গাইবেন নজরুল, এ-ই বোধ হয় ধারণা ছিল গ্রামোফোন কম্পানীর। তার বদলে নজরুল লিখলেন: চীন ও ভারতে মিলেছি আবার মোরা শত কোটি লোকচীন ভারতের জয় হোকঐক্যের জয় হোক সাম্যের জয় হোক।ধরার অর্ধ নরনারী মোরা রহি এই দুই দেশেকেন আমাদের এত দুর্ভোগ নিত্য দৈন্য ক্লেশে,সহিব না আর এই অবিচার খুলিয়াছি আজ চোখ।। প্রাচীন চীনের প্রাচীর ও মহাভারতের হিমালয়এই কথা যেন কয়মোরা সভ্যতা শিখায়েছি পৃথিবীরেইহা কি সত্য নয়?হইব সর্বজয়ী আমরাই সর্বহারার দলসুন্দর হবে, শান্তি লভিবে নিপীড়িত ধরাতল।আমরা আনিব অভেদ ধর্ম নব বেদগাথা শ্লোক।। আর গ্রামোফোন কম্পানীতে নজরুলের পরিচিতি তো নতুন নয়, কয়েকজন নতুন শিল্পীকে শিখিয়ে-পড়িয়ে তাদের গাওয়া এই গান অতি দ্রুত রেকর্ডও করিয়ে দিলেন নজরুল।এবং, গ্রামোফোন কম্পানীর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক শেষ হল এই ভাবেই!শরতের গ্রেপ্তারের পাঁচ মাস পর, উনিশশো বিয়াল্লিশের উনিশে ফেব্রুয়ারি, সুভাষের নিষ্ক্রমণের পর এই প্রথম অপ্রস্তুত ভারতবাসী শুনল সুভাষের কণ্ঠস্বর, রেডিওয়: সুভাষ বলছি – This is Subhas Chandra Bose speaking to you over the Azad Hind (Free India) Radio!সারা ভারতের রাস্তাঘাটে, অফিসেবন্দরে, বাসেট্রেইনে, স্কুলেকলেজে, সেদিন একজনকে নিয়েই আলোচনা আর উত্তেজনা: সুভাষচন্দ্র। নবযুগের সম্পাদকীয় অফিসেও যে একই উত্তেজনা তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নানা আলোচনায় যে যে-খবর বেরিয়ে এল তার সারাংশ করলে দাঁড়ায় এইরকম: সুভাষ তাঁর পূর্বপরিচয় বদলিয়ে নামে এবং বেশে মহম্মদ জিয়াউদ্দীন হিসেবে কলকাতা ছেড়ে প্রথমে পেশোয়ার, তারপর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ছাড়িয়ে কাবুল হয়ে নানা জায়গা এবং বহু বিঘ্ন অতিক্রম করে অবশেষে ওর্লাণ্ডো মাজোতা ছদ্মনামে ইতালিয় পাসপোর্টের সাহায্যে য়্যোরোপ পৌঁছোন। প্রধানত ইতালি এবং জর্মনিতে এইসব দেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে, বিশেষ করে মুসোলিনির সহায়তায়,ভারতীয়-জন্মের ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দীদের একত্র করে ইণ্ডিয়ান লীজিয়ন বা ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠনের কাজে তিনি আপাতত নিযুক্ত আছেন। য়্যোরোপে পৌঁছবার পর আজই প্রথম ওর্লাণ্ডো মাজোতা তাঁর ছদ্মনামের বদলে নিজেকে সুভাষ নামে পরিচয় দিলেন।আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে সুভাষ বলেন, জাপানের হাতে সিঙ্গাপুরের পতন স্পষ্টতই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ধ্বংস সূচিত করছে। অস্তমান ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অর্থই হল উদীয়মান স্বাধীন ভারতবর্ষ, ভারতের ইতিহাসে নবসূর্যোদয়। এবং এখান থেকেই শুরু হতে চলেছে এশিয়া তথা সমস্ত পৃথিবীর স্বাধীন মানুষ এবং মনুষ্যত্বের জয়যাত্রা। সুভাষ আরও বলেন, স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর দায়িত্ব এখন আরও বেড়ে গেল।উনিশে ফেব্রুয়ারিতে সুভাষের এই বক্তৃতা সব ভারতবাসীর মতো নজরুলের মনেও প্রবল উত্তেজনা তৈরি করে। সাধারণত যে-সময় সে অফিস যায় এখন সেই সময়টা এগিয়ে আসে, এবং অফিস থেকে বেরোবার সময়ও যায় পিছিয়ে।আড্ডা-আলোচনা – সবই যেন এখন এই একটাই বিষয়কে কেন্দ্র করে। গান্ধী ভারত-ছাড় ডাক তখনও দিতে পারেননি, কংগ্রেসে নানারকমের তর্ক-বিতর্ক চলছে; কে যেন সেদিন বলল, গান্ধী এখন বলছেন, উনচল্লিশে সুভাষের বক্তব্য তিনি নিজে ঠিক বুঝতে পারেননি। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিবর্তিত অবস্থা স্পষ্টই দেখিয়ে দিচ্ছে সুভাষের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি অনেকের, এমনকি তাঁর নিজের চেয়েও, অনেক তীক্ষ্ণ। যদিও খানিকটা দেরি হয়ে গেছে, এখন তিনি আর অপেক্ষা করতে রাজি ন'ন। এখনই ইংরেজকে তাড়ানো দরকার। তাড়াতেই হবে। গান্ধীর গলার সুর শুনে কেউ কেউ এমনটাও বলল যে, হিংসা-অহিংসা এখন আর গান্ধীর কাছে তেমন কিছু বড় ব্যাপার নয়!আজকাল বাড়ি ফেরার পরও নজরুল উত্তেজনা প্রায় ধরে রাখতে পারে না। গত কয়েকদিন রাতে তার যোগাভ্যাসেও ঠিকমতো মনোনিবেশ করতে পারছিল না সে। অফিসে এসেও কাজে মন লাগে না।যোগাভ্যাসে অনিয়ম হলে কেমন যেন শরীর খারাপ লাগে নজরুলের। সুভাষবাবুর বক্তৃতা শোনা গেল এখন থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে। তার পর থেকে ঘুমেও অসুবিধে হচ্ছে। এর আগেও কখনও কখনও এমনটা হয়েছে নজরুলের। ও দেখেছে, দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটিতে গিয়ে একা-একা চুপচাপ বসে থাকলে ও একটু শান্তি পায়।আজ নজরুল একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। তার দপ্তরে সে-ই তো প্রধান, কারোকে কিছু বলার প্রয়োজন হল না তার। দক্ষিণেশ্বরে যাবে সে।পরের দিন দুপুরে নজরুলের পুত্র সব্যসাচী হাজির নবযুগের অফিসে। বাবা কাল অফিস থেকে বাড়ি ফেরেনি। গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে, রেডিওতে, কলকাতার নানা থিয়েটারে, সওগাতের অফিসে, কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। নজরুলকে পাওয়া যাচ্ছে না – খবরটা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। শেষ পর্যন্ত হক সাহেবের কানেও উঠল খবরটা। তিনি স্বরাষ্ট্র-দপ্তরকে জানালেন, নজরুলকে পাওয়া যাচ্ছে না, খুঁজে বের কর তাকে।চব্বিশ ঘন্টারও বেশি অতিক্রান্ত হবার পর বেলঘরিয়া থানা থেকে খবর পাওয়া গেল, গত দু-দিন যাবৎ ওই থানাতেই তিনি আছেন, নিজের পরিচয় দেননি, এখনও একটা ঘোরের মধ্যেই আছেন তিনি। এখন নজরুলের খোঁজ শুরু হবার পর থানারই একজন কর্মচারি তাঁকে নজরুল বলে শনাক্ত করেছেন।থানার অফিসাররা বললেন, বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁরা জানতে পেরেছেন, দু-দিন আগে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির চত্বরে আসেন। সেখানে একটা গাছের নীচে একাই বসে ছিলেন, বিশেষ কেউ তাঁকে লক্ষ্য করেনি। বসে থাকতে থাকতে এক সময় ওই গাছের নীচেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝ-রাত্তিরে – ঠিক কত রাত্তিরে তা বোঝা যাচ্ছেনা – তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর তিনি মনে করার চেষ্টা করেন, কেন ওই গাছের নীচে তিনি বসেছিলেন, কিন্তু ঠিক ঠিক মনে করতে পারেননি।পুলিশ যখন তাঁকে রাস্তায় প্রথম দেখতে পায় তখন ভোর হয়ে আসছে। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ব্যারাকপুরের দিক থেকে কলকাতার দিকে তিনি আসছিলেন হেঁটে হেঁটে। এখন যুদ্ধের সময়, বড় বড় মিলিটারি ট্রাক রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে আসা-যাওয়া করছে। নজরুলের চলার ভঙ্গি খানিকটা মাতালের পদক্ষেপের মতো ছিল। যে-কনস্টেব্‌ল্‌ প্রথম তাঁকে দেখে, সে একজন মাতাল বলেই মনে করেছিল তাঁকে, এবং লোকটা যখন-তখন লরির ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কাতেই তাঁকে থামিয়েছিল। কথাবার্তা এতই অসংলগ্ন যে, কিছুই না-বুঝতে পেরে, আরও দুয়েকজনের সাহায্যে সে তাঁকে থানায় নিয়ে আসে।এই দু'দিন ধরে কথাবার্তার পর পুলিশ যা বুঝতে পেরেছে তা হল, প্রথমত, মাতাল তিনি ছিলেন না। যদিও ব্যারাকপুরের দিক থেকে তিনি আসছিলেন কলকাতার দিকে, প্রথমে নজরুল এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরেই, গাছের তলায় বসে বসে ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙার অনেকটা পরে তাঁর মনে পড়ে অরবিন্দ নামের কোন একজন মানুষের সঙ্গে তাঁর কিছু জরুরি কাজ আছে, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁকে অরবিন্দর কাছে পৌঁছোতে হবে। দক্ষিণেশ্বরের থেকে বেরিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করেন, এবং ব্যারাকপুরের কাছে এসে তাঁর মনে হয় তিনি রাস্তাটা ঠিক ঠিক চিনতে পারছেন না, এবং আবার উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেন। পুলিশের যে কন্‌স্টেব্‌ল্‌ তাঁকে থানায় এনেছে সে ওই অবস্থাতেই তাঁকে প্রথম দেখে।অরবিন্দ কোথায় থাকে? – পুলিশের এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে তিনি ঠিকঠাক কিছুই বলতে পারেননি। পরে মাঝে মাঝে বলেছেন পণ্ডিচেরি। এই পণ্ডিচেরি নাম শুনে পুলিশ ঘাবড়িয়ে যায়। পণ্ডিচেরি তো অনেক দূর। মাদ্রাজ-ফাদ্রাজ ছাড়িয়ে। হেঁটে হেঁটে সেখানে যাওয়া যায় নাকি! লোকটার কি মাথা খারাপ? নাকি, অন্য কোন পণ্ডিচেরির কথা বলতে চাইছিল সে? সে আবার বলছে, সেখানে নাকি দিলীপ নামেরও কেউ থাকে, তার ডাক-নাম মন্টু, সে এই নজরুলের বন্ধু। নজরুল বলেছেন, এই দিলীপ শুধু নজরুলেরই নয়, কোন এক সুভাষবাবুরও বন্ধু।সুভাষবাবু? সুভাষ নামটার সঙ্গে বাঙালি পুলিশ পরিচিত। কিন্তু কোন্‌ সুভাষের কথা বলছে এই পাগলটা? যে-সুভাষের নাম পুলিশ ভালোভাবেই জানে সে তো পুলিশকে বোকা বানিয়ে নিজের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে! তার সঙ্গে এই পাগলের যোগাযোগ? পুলিশরা নিজেদের কানকেও বিশ্বাস করে না। থানায় বসে বসে এই দু'দিনের মধ্যেও একা-একাই এই পাগল ভদ্রলোক গলা-ফাটিয়ে চিৎকার করে অরবিন্দর সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করছিলেন, এবং সফল না হতে পেরে খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। আরো একটা কথা ইনি বলছিলেন বারবার। সুভাষবাবুর কাছে এখন এক অরবিন্দই যেতে পারেন, আর যেতে তাঁকে হবেই। তা না হলে সব কিছুই নাকি ভেস্তে যাবে। কোন্‌ সুভাষ বাবুর কথা বলছেন? – জিজ্ঞেস করায় উনি কোন উত্তর দেননি, এবং মনে হল খুবই বিরক্ত হয়েছেন।পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হল, প্রথম প্রথম না-বুঝতে পারলেও কিছুক্ষণের কথাবার্তার পর পুলিশ বুঝতে পেরেছে যে উনি একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক, ওদেরই মধ্যে একজন তো কবি হিসেবেও নজরুলকে শনাক্ত করেছিল, হয়তো কোন পারিবারিক কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে একটু অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। নিজের নাম নিজের মুখে কিছুতেই বলছেন না। আর বলছেন না নিজের ঠিকানাও। এখন খাওয়া-দাওয়া করেছেন, শরীরও ভালো আছে। একা-একা বসে মাঝে মাঝে ধ্যানের মতো কিছু করছেনও।পুলিশের গাড়িতেই নজরুলকে ফিরিয়ে নিয়ে এল সব্যসাচী, কালীপদ গুহ আর জুলফিকার হায়দার। সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি সে। বাড়িতে ঢুকেই সব্যসাচীকে জড়িয়ে ধরে নজরুল, হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, যোগের শিক্ষা কিছুই হয়নি আমার। সেবার তো শ্রীঅরবিন্দ সূক্ষ্মদেহে প্রায় আধঘন্টা বসে থাকলেন আমার কাছে, কত কথা হল! এবার আর কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছি না তাঁর সঙ্গে। অথচ দেশের পক্ষে তো এখন জীবন-মরণ সমস্যা। সুভাষবাবু একা-একা বিদেশে, সেখানে তাঁকে সুরক্ষা দেবে কে? অরবিন্দ ছাড়া আর তো সুভাষবাবুর কাছে কেউ যেতে পারবে না! একমাত্র তিনিই পারেন সূক্ষ্মদেহে যেখানে-খুশি যেতে!ক্রমশ...
    ক্যালিডোস্কোপে দেখি - দিনের শেষে - অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়আমার জন্ম বাঁকুড়ায় হলেও সচেতন স্মৃতিতে প্রথম বাসাটিকে খুঁজে পাই দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির একতলার দুটি ঘরে। একটি ঘরে আমি আর মেজ ভাই ঠাকুমার সাথে একটি চৌকিতে আর অন্য ঘরটিতে মা-বার সাথে আরেক চৌকিতে ছোট ভাই–এই ছিল নিত্য বন্দোবস্ত। অসুস্থ হলে মাঝে মাঝে ঠাঁই বদল হওয়ার সু্যোগ ঘটত। সেই কারণেই কি আমি মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তাম? এখন আমার হাসি পেলেও সেই সময় এই বিষয়টা আমার বা আমাদের কারোর জন্যই হাসির ছিল না। আমি অসুখে পড়তাম একটু বেশিই।কর্মক্ষেত্রে বাবার উন্নতির লেখচিত্র যখন ঊর্ধমুখী সেইরকম সময়ে আমার এই দুনিয়ায় আগমন। তাই জীবনের অন্তত প্রথম দশটি বছর আমাদের পরিবারকে আর্থিক অভাবের মধ্যে পড়তে দেখিনি আমি। কিন্তু তাই বলে আমায় নিয়ে মায়ের দুর্যোগ-দুর্ভোগের কোন কমতি ছিল না। মায়ের কাছে শুনেছি যে যথেষ্ট সুস্বাস্থ্য নিয়ে জন্মেও কয়েক মাস পর থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় সত্বর ধরাধাম থেকে বিদায় নেওয়ার ব্যবস্থা আমার প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। তারপর চিকিৎসক এবং চিকিৎসাপদ্ধতির বদল ঘটিয়ে মা যে আমায় জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল আমার যুবক বয়সেও সেই গল্প বলতে গিয়ে মায়ের গলা ভারী হয়ে যেত। আর খুব ছোটবেলা থেকে সেই গল্প আমার মনে যে আবেশ, যে নিশ্চিন্ততা সৃষ্টি করে রেখেছিল তা আমায় অজস্র কঠিন দিন, অন্ধকার রাত অনায়াসে পার করে দিয়েছে! প্রবল অসুস্থতা, চূড়ান্ত অস্থিরতায় মা কিছুক্ষণ মাথার কাছে বসে কপালে কি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়েছি, শ্রান্তি কাটিয়ে, সুস্থ হয়ে জেগে উঠেছি। তাই বলে মাঝে মাঝে অভিমান কি আর হয়নি! ছোট ভাইটা কি আমাদের বাকি দু’ভাইয়ের তুলনার মাকে বেশি দখল করে রাখেনি! কে জানে আমরা দু’ভাই আসলেই মায়ের ছেলে কিনা! এই যে মা হাসপাতাল থেকে একদিন ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছিল, আমাদের দু’ভাইকেও ত অমনি করেই নিয়ে এসেছিল। কে জানে সেখানে আমাদের কেউ বদলে দিয়েছিল কিনা! আমার মা আসলেই আমার মা, না কি অন্য কারো মা! না, না, সে হতে পারে না। মা আমাদের তিনজনেরই নিজের মা। তিন ভাইকেই আদর করে ত, অনেক করে। শিশুর মন কত যে সম্ভব-অসম্ভবের আনন্দ-শঙ্কার গলি-ঘুঁজিতে ঘুরে বেড়ায়! মাকে নিয়ে আমার যে নানা অনুভূতির দোলা আর দ্বন্দ্ব চলত, একটু বড় হয়ে এক আশ্চর্য বইয়ের পাতায় পাতায় তার প্রকাশ দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। আজো সেই বইয়ের ‘অন্য মা’ পড়তে গিয়ে চোখ না ভিজিয়ে পড়া শেষ করতে পারি না। স্মৃতির গহীনে আলো ফেলে দেখি আমি কোন কিছু চাইবার আগেই আমার বড় হওয়ার যা যা উপকরণ আমার বাবা দেখতে পেত, তার বিবেচনায় তাদের সেরাটি সে আমার জন্য কিনে নিয়ে আসত। আমার প্রথম বইয়ের সংগ্রহের মধ্যে ছিল যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সুখলতা রাও, এঁদের ছড়ার বই। ছিঁড়বেনা এমন চমৎকার কাগজে রঙিন ছবি আর ছড়ার সমাহার। আর ছিল একটি গল্পের বই, সেটি একেবারেই অন্য রকম। সাদা-কালো বই। অজস্র ছোট ছোট গল্পের সংগ্রহ-কথামালা। ঈশপের গল্পগুলিকে সেই বইয়ে বাংলাভাষায় নিয়ে এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আমি একটু একটু করে পড়তাম। সে বইয়ের অনেক গল্প বুঝতে না পারলেও তারা আমায় কল্পনার নানা জগতে নিয়ে যেত। ছোটবেলার এই সব পছন্দের বইগুলি অনেককাল আমার সাথে থাকলেও একে একে তারা হারিয়ে গিয়েছিল।একটি বই হারিয়ে যায়নি, কিন্তু বহু ব্যবহারে তাকে আমি এত জীর্ণ করে ফেলেছিলাম যে বারে বারে সারিয়েও এক সময় তাকে বিদায় জানিয়ে তার হাল আমলের সংস্করণ কিনে নিতে হয়েছিল। সেই বইয়ের কথায় যাওয়ার আগে ক্যালিডোস্কোপ্টা একটু ঘুরিয়ে নি।কুচবিহারে বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠে চতুর্থ শ্রেণীতে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল। হঠাৎ একদিন, সম্ভবত মধ্যাহ্ন বিরতির সময় একজন মাস্টারমশাই, তাঁদের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটি বড় বই থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদ আর একটি কবিতা পড়তে বললেন। পড়লাম। পড়া শেষে ওনার কথা মত বিবেকানন্দ রচনাবলীর ঐ খন্ডটি থেকে পড়া অংশগুলো দুটো কাগজে টুকে নিলাম। প্রতিলিপি করার সেটাই উপায় তখন। ভাল করে মুখস্ত করে ফেলতে হল ঐ লেখাগুলো। তারপর বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দিন, রামকৃষ্ণ মিশনের সভাঘরে, মঞ্চের একধারে, মাইক্রোফোনের সামনে, মাস্টারমশাই কিংবা কোন মহারাজের কথামত, মনে পড়ছেনা এখন, বিবেকানন্দর ছবিতে যেমন দেখেছি তেমন করে, দুই হাত বুকের কাছে জড়ো করে আবৃত্তি করলাম–“হে ভারত ভুলিও না … …” পরিবেশ তৈরিই ছিল, হাততালি সহজে থামেনি। আরো কয়েকজন আবৃত্তি করেছিল। প্রথম হওয়া প্রতিযোগী হিসেবে নাম ঘোষণার পর জানলাম যে আমিও একজন প্রতিযোগী ছিলাম। পুরস্কার জুটল বেশ কিছু বই। একসাথে করে রঙিন ফিতে দিয়ে বাঁধা। আনন্দ হয়েছিল খুব। এর আগে নাটক করে এসেছি। আবৃত্তির সেই শুরু। ভাল লেগে গিয়েছিল নিজেকে প্রকাশ করার, পারস্পরিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটিকে। প্রথাগত শিক্ষা পাওয়া হয়নি, নিজের বোধ আর বড়দের কারো কারো পরামর্শ, এই সম্বল ছিল। তবে যতদিন না স্মরণশক্তির অবনতি হয়েছে আবৃত্তি করার দাবী বা অনুরোধ পেলে করতে দ্বিধা করিনি।এই আবৃত্তির ঝোঁককে এগিয়ে দিতে, কয়েকবছর বাদে জন্মদিনে বাবা উপহার দিল অনেক পাতার এক বই, কবিতা সংকলন–সঞ্চয়িতা। পরবর্তী কালে দেখেছি, যে সব বন্ধুদের পরিবারের বড়রা নিজেদের বাংলার সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন বলে ভাবতেন বা পরিচয় দিতে ভালবাসতেন তাদের প্রায় সকলের বাড়িতে এই বইটির উপস্থিতি ছিল নিশ্চিত। এই বইয়ের হাত ধরে আমার প্রবেশ ঘটল তাঁর রাজ্যে। পাতার পর পাতা উল্টিয়ে যে অনুভূতি হয়েছিল তাকে ভাষায় প্রকাশ করা আমার সাধ্যের বাইরে। আয়তনে বেশ বড় সেই বই–শুধুই কবিতার! আর কি অনায়াস ছন্দে সে সব কবিতাদের পড়ে যাওয়া যায়, কি সহজে তাদের ভিতরে ঢুকে যেতে পারছি! আবৃত্তি করতে গেলে কবিতা মুখস্ত করতে হয়, সহজে পারি না অনেক সময়। এই সব কবিতা ত আপনিই মনে গেঁথে যাচ্ছে! আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। তার পর ধীরে ধীরে, সে বই পড়তে পড়তে, আনন্দ ছাপিয়ে যে মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে গেলাম তা আর কাটল না। সব শব্দের অর্থ জানা থাকত না। বাড়িতে আমার জন্মের আগে থেকে দুটি বই ছিল, বাবার অত্যন্ত প্রিয় তারা। দুটি অভিধান। বাংলা থেকে ইংরেজি, এবং উল্টোটি। ফলে আটকে যাওয়া শব্দটির অর্থ জানতে আমি প্রথমে ইংরেজিতে যেতাম, সেখান থেকে বাংলায় ফিরতাম। কখনো কখনো একাধিকবার যাতায়াতে মূল কথাটি এবং তাকে ঘিরে আরো কিছু কথা জানা হয়ে যেত। শব্দরাজির এক বিপুল জগতের সাথে এই করে পরিচয় ঘটেছিল। আজ তাদের বেশির ভাগই ভুলে গেছি। তবে গুগল অনুবাদকের সাহায্যে বিভিন্ন ভাষায় ছোট ছোট অংশ পড়া বা লেখায় বারে বারে সেতু পারাপারের এই পদ্ধতির অভিজ্ঞতা এবং তার প্রয়োগ এখনো বেশ কাজে দেয়।কবিতা সংকলনটির পাতায় পাতায় কত রকমের যে অনুভূতির মুখোমুখি হলাম, কত যে অচেনা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ালাম, ভাবলে অবাক লাগে। এই বইয়ের জগতে যখন ঢুকছি তখন আমি পার হয়ে এসেছি ছড়া-ছবির দুনিয়া থেকে শুরু করে ঠাকুমার ঝুলি, কথামালা এমনকি বঙ্কিমের আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী। কিন্তু এরা কেউ আমার জন্য বড়দের বই ছিল না। আমার প্রথম বড়দের বই এই সঞ্চয়িতা, যেখানে মন আর শরীর পরস্পরের গলা জড়িয়ে শিহরিত হয়, মুখর হয়, চূর্ণ হয়, পূর্ণ হয়!স্থানীয় পাঠাগার থেকে হাতে এল গল্পগুচ্ছ। এও সম্ভব, এত এত গল্প, এত চমৎকার গল্প! আমার কিশোর মনটা একেবারে নাকানিচোবানি খেতে থাকত গল্পের ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে। আজ আর তাদের বেশীরভাগকেই মনে নেই, পরবর্ত্তী পঠনে অনেক গল্পের আবেদন-ও অতটা আর তীব্র লাগে নি। কিন্তু, সেই সময়ে ঐ গল্পগুলি পড়ার যে আচ্ছন্নতার বোধ তা আজও দূরের মনে হয় না।একটা সময় ঢুকলাম তাঁর প্রবন্ধ আর নাটকের দেশে। নাটকগুলি যখন পড়ছি, চারপাশে তখন গ্রুপ-থিয়েটারের জোয়ার চলছে। সেখানে বক্তব্য আসছে সমসাময়িক, অনেক প্রাবল্যের সাথে, সেই গতিপ্রবাহে রবীন্দ্রনাটকগুলির আস্বাদ সেই সময়ে ততটা নেওয়া হয়নি, যতটা নিয়েছি পরবর্ত্তী কালে। আর, প্রবন্ধগুলি তুলে ধরেছিল হরেক রকম চিন্তা-চেতনার সম্ভার। সেগুলিও আজকাল আরও বেশি করে উপভোগ করি। অন্য আর এক সময় মেতে উঠেছিলাম তাঁর মত করে কাটাকুটি, আঁকিবুঁকি দিয়ে ছবি বানানোয়। ছবি আঁকায় পারদর্শী হতে পারি নি, সে আর কী করা যাবে, কিন্তু ঐ সব ছবিগুলো আঁকায় যে মজা পেয়েছিলাম সেটা দুরন্ত ছিল।সঞ্চয়িতা ছাড়া তাঁর বাকি যে বইগুলি আমার কাছে আছে তাদের অবস্থা অতটা জীর্ণ হয়নি। দুঃখের কথা যে তাঁর সমগ্র রচনাবলী সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। আর সুখের কথা যে সেটি এখন অনলাইনে পাওয়া যায়, বিনামূল্যে, বিনা লগিনে, সবসময়। ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১০-এ কলকাতা পুস্তকমেলা উপলক্ষ্যে সেই যে এই অনলাইন রবীন্দ্র-রচনাবলী পাঠকসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল আজও সেই পরিষেবা একই ভাবে বহাল আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি এবং বৈদ্যুতিন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের এই মহৎ কাজটির জন্য কোন প্রশংসা বা ধন্যবাদ যথেষ্ট বলে মনে হয় না আমার।এমন একটা দিন যায় না যেদিন অন্তত একবার তাঁর গানের কোন কলি, কবিতার কোন পংক্তি, নাটকের কোন সংলাপ বা কোন চিত্রকর্মের কথা স্মরণ করা হয়নি। অথচ এমন ত নয়, তাঁর বিপুল সৃষ্টির এক কুচির বেশী কিছু পড়া হয়েছে আমার! আবার তাঁকে বাদ দিয়ে আর কিছুই পড়িনি, শুনিনি, দেখিনি এমনও ত নয়! তবু তাঁর কাছে না এসে উপায় থাকে না।তবে তাঁর যে সৃষ্টি সেই শৈশব-কৈশোর-প্রথম যৌবনে আদৌ সেভাবে বুঝিনি তা হচ্ছে তাঁর গান। যত দিন গেছে, জীবন যত পাক খেয়েছে, তলিয়ে গেছে, আর ভেসে উঠেছে, তত বেশী করে আমার আশ্রয় মিলেছে তাঁর গানে। ছোট বেলায় গানের চরণগুলি আসত-যেত, হাওয়া যেমন আসে, যায়, সহজ-সরল, সাবলীল, একান্তই পরিচিত। যত দিন গেল, গানগুলি বয়ে আনতে লাগল অনাঘ্রাত সুগন্ধ, অশ্রুত বাণী, অদেখা রূপ। একেক বিকেলে, সন্ধ্যায়, মোহন সিংয়ের কন্ঠে যখন অমৃত-বাণী ছড়িয়ে পড়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার চেতনা, আমার শরীর বসে থাকে চুপটি করে, আর অঝোর ধারে কোথা হতে উপচে আসে শ্রাবণ, বন্ধ দু চোখ বেয়ে। নাই থাকল আমার কোন জীবনদেবতা। আমার নিজস্ব বেদনা আরও কোন বৃহত্তর বেদনায় মিলেমিশে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাগসঙ্গীতে দক্ষ জীবনসঙ্গিনী যখন সমস্ত আর্তি মিশিয়ে তাঁর গান গাইতে থাকেন, তখন যে তীব্রমধুর আবেশে আমার চরাচর ডুবে যায়, সে কি কোন বাস্তব! আসলেই সে কোন মায়ার খেলা! ছোটবেলায় সারা বছরের সেরা দিনটা ছিল ২৫শে বৈশাখ। বাড়ির সামনে ছিল খোলা বারান্দা। সেখানে একটা চেয়ার কি নীচু টেবিলে ঢাকনা বিছানো। মা অথবা আমার সেলাইয়ের কারুকাজ করা, সারা বছর তুলে রাখা, দু-একটি বাছাই করা দিনের জন্য। টেবিলে কবির ছবি, প্রথম দিকের বছরগুলোতে কার্ডবোর্ডে আটকানো কাগজে, পরে ফটো-বাঁধাই। ছবিতে মালা, ফুলদানিতে রজনীগন্ধা, সামনে পাতাবাহারের কয়েকটি পাতা, কৃষ্ণচূড়া। মা-বাবা-ঠাকুমা-আমরা তিন ভাই, দুই কাকিমা, ছোট ছোট খুড়তুত ভাইবোনেরা, সবাই পরিস্কার জামা-কাপড় পড়ে গোল হয়ে বসেছি। ধূপ জ্বলছে। ভাই-বোনেরা একটার পর একটা কবিতা পড়া চলেছি, চলছে গান গাওয়া। কনিষ্ঠতম সহোদর ভ্রাতার খোলা গলা। মা, কাকিমারা ও ভাল গাইত। নিজের সম্বন্ধে আমার সেই যুগে খুব উঁচু ধারণা ছিল। সুর-তাল-লয়ের কি বিপর্যয় ঘটাচ্ছি সেটা বুঝতাম না। তাই মহানন্দে গেয়ে যেতাম। বেশি গান-ই হত সমবেত গলায়, ফলে আমার ত্রুটি ঢাকা পড়ে যেত অনেকটা। বয়সের সাথে সাথে নিজের অক্ষমতাকে ধরতে পেরেছি। আমার অসুরপনাকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলি। ছোটবেলার মানুষগুলিও দূরে দূরে, মা-বাবা, দুই কাকু-কাকিমা সবাই সব দূরত্ব অতিক্রম করে কেবলই স্মৃতিতে। এখন আমার সকল গান গীত হয় নিঃশব্দ উচ্চারণে। এখন ২৫শে বৈশাখ আর দশটা সাধারণ দিনের মত, রবির কিরণ ছোঁয়া।এবং তাঁর থেকে বহু যোজন দূরের। একবার, জীবনের এক বিশেষ দিন সেটি, জ্বালানী ভরা শেষ করে গাড়িতে উঠতে যাব, আমার গাড়ির পরেই যে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল সেটির চালকের আসন থেকে নেমে এসে ভিক্ষা চাইলেন এক মহিলা-তাঁর গাড়িটিতেও জ্বালানী ভরে দিতে হবে, এক গ্যালন-দু’ গ্যালন যতটুকু পারি। জ্বালানীর দাম আমার পক্ষে কম নয়। যখন ভরে দিতে শুরু করলাম, আরো দেওয়ার সম্ভাবনাকে খারিজ করে আমি ওনাকে দু’ গ্যালন জ্বালানীই মাত্র ভরে দিলাম। কিন্তু মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকল–বড্ড কৃপণতা হয়ে গেল কি? নিজের গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে মনের মধ্যে বেজে যেতে থাকল একসময়ের নানা আসরে উচ্চারিত স্বরকম্পন “তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে”। জানি, ইনি কোন রাজাধিরাজ নন, আর এ যুগের রাজাধিরাজরা আমাদের কাছে ভোট ছাড়া আর কিছু ভিক্ষা করেননা, তবু আরো কয়েক গ্যালন জ্বালানি হয়ত দেওয়া যেত। কিন্তু ভাবালুতা আর কতক্ষণ থাকে! চলে এলাম। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বাসের মানুষ। সংশয়ের নানা পথে হেঁটেও তাঁর জীবনবোধ তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসে স্থিত ছিল। আমি কেবল সংশয়ে স্থির, কোন বিশ্বাসেই আস্থাবান নই। কোন পারানির কড়ি নেই। দিনের শেষে আমার খেয়া, যেমনটি চেয়েছি, কোথাও যাবে না, ঘাটেই বাঁধা থেকে জীর্ণ হয়ে মিলিয়ে যাবে।ক্রমশ...
    বিপ্লবের আগুন - পর্ব চার - কিশোর ঘোষাল | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়৪রাজধানী শহর থেকে প্রায় পঁচিশ যোজন দূরের অনন্তপুর চটিতে ভল্লা যখন পৌঁছল, রাত্রি তখন প্রথম প্রহর পেরিয়ে গেছে। রাজধানী থেকে সে রওনা হয়েছিল শেষ রাত্রে। তারপর একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে এতদূরে আসা। অবশ্য মাঝে জঙ্গলের মধ্যে এক সরোবরের ধারে গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিল। বিশ্রাম দিয়েছিল তার ঘোড়াটাকেও। সরোবরের তীরে প্রচুর সবুজ আর সতেজ ঘাসের সন্ধান পেয়ে, ঘোড়াটা তার সদ্ব্যবহার করতে বিলম্ব করেনি। ওই অবসরে সেও দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছিল। পুঁটলিতে বাঁধা চিঁড়ে সরোবরের জলে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে মেখে সপাসপ মেরে দিয়েছিল। তারপর গামছা পেতে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম। ঘুম নয়, বিশ্রামই। প্রথম কথা ঘোড়াটাকে চোখে চোখে রাখতে হচ্ছিল। দ্বিতীয় কথা বিগত রাত্রিতে সে একবিন্দুও ঘুমোতে পারেনি, তার ওপর এই দীর্ঘ পথশ্রম। চোখের পাতা একবার বন্ধ করলেই, সে নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়বে – সেক্ষেত্রে তার যাত্রাভঙ্গ হবে। যে চটিতে আজই রাত্রে তার পৌঁছনোর কথা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। অতএব অর্ধ প্রহর বিশ্রামের পর সে ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে শুরু করেছিল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।দূর থেকে চটির দীপস্তম্ভের আলো চোখে পড়তেই সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেছিল। চটির আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু জনবসতি আছে। ভল্লা চায় না, সেই জনবসতির লোকদের সচকিত করে এই রাত্রে তাদের কৌতূহলী করে তুলতে। চটির সদর দরজা খোলাই ছিল, সে পথে না গিয়ে, আরও কিছুটা এগিয়ে একটি বন্ধ দরজার কাঠের পাল্লায় সে সন্তর্পণে আওয়াজ করল। সে আওয়াজের বিশেষ এক ছন্দ আছে – দ্রুত টকটক – কিছুটা বিরতি – বিলম্বিতে তিনবার – আবার বিরতি - তারপর আবার দ্রুত দুবার।ভেতর থেকে দরজাটা দ্রুত খুলে যেতেই ভল্লা ঘোড়া সমেত ঢুকে গেল চটির প্রাঙ্গণে। এদিকটা চটির পিছনের দিক। এদিকে আলোর তেমন ব্যবস্থা নেই। চটির অতিথিশালায় এবং সামনের দিকে কয়েকটা মশাল জ্বলছে, তার আভাসটুকু এখানে পাওয়া যায়। কারণ এদিকের অনেকটা জুড়ে আছে পশুশালা। বণিকদের গাধা, ঘোড়া, বলদদের জন্য রাত্রির আবাস। আর পশুশালা পার হয়ে, ওপাশে আছে চটির কর্মীদের আবাস।ভল্লার ঘোড়ার লাগাম নিজের হাতে ধরে – যে দরজা খুলে দিয়েছিল, সে জিজ্ঞাসা করল, “ভল্লা?”“হুঁ”। “কী চেহারা করেছিস, চুল-দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে – চেনাই যাচ্ছে না। তুই ঘরে চ, আমি ঘোড়াটার একটা ব্যবস্থা করেই আসছি”। এই চটিতে ভল্লা বহুবার থেকেছে, কাজেই অন্ধকারেও ঘর চিনে ঢুকতে তার অসুবিধে হল না। ঘোড়ার ব্যবস্থা করে লোকটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে এসে ঢুকল, বলল, “অন্ধকারে ভূতের মতো কী করছিস, প্রদীপটা জ্বালাসনি কেন? কোথায় তুই?” আপাততঃ নিশ্চিন্ত ও বিশ্বস্ত একটা আশ্রয় পেয়ে, ভল্লা দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেয় বসে পড়েছিল। তার সমস্ত শরীর ক্লান্তিতে ও যন্ত্রণায় অবসন্ন। বলল, “এই তো এখানে, বসে আছি”। চটির লোকটি চকমকি ঠুকে একটা প্রদীপ জ্বালতে ঘরের অন্ধকার একটু ফিকে হল। প্রদীপটা কুলুঙ্গিতে রেখে ঘুরে দাঁড়াল, তাকাল মেঝেয় বসে থাকা ভল্লার দিকে। চমকে উঠল, “কী হয়েছে তোর? মুখ চোখ অত ফুলেছে কেন? চোখের নিচে কালশিটে। মারামারি করেছিস? কার সঙ্গে?”“বলছি, সব বলব। আগে একটু জল খাওয়া না, চিকা। সেই দুপুরে জল খেয়েছিলাম, তারপর আর...তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে”। “আনছি”। বলেই চিকা দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল, অল্প সময়ের মধ্যেই কাঁসার ঘটিতে আনল খাবার জল। ভল্লার হাতে তুলে দিল কয়েকটা বাতাসা আর ঘটিটা। লোভীর মতো বাতাসাগুলো মুখে পুরে নিয়ে চিবোতে গিয়েই শিউরে উঠল ভল্লা, চোয়ালে হাত রাখল। যন্ত্রণায় তার মুখ বেঁকে গেল। চিকার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তারপর গলায় ঘটির জল ঢালতে ঢালতে ইশারায় চিকাকে বসতে বলল। চিকা মেঝেয় বসল ভল্লার সামনে। ভল্লার জল খাওয়া শেষ হতে ঘটিটা মেঝেয় রেখে হাসির চেষ্টায় মুখ ব্যাঁকাল, বলল, “কাল দুপুরে উদোম ক্যালানি খেয়েছি রে, শালা। গোটা শরীরে তার তাড়স”।“কারা মারল? কী করেছিলি”?“রাজার শ্যালকের দিকে বল্লম ছুঁড়েছিলাম। বল্লমটা লোকটার গলার দু-তিন আঙুল দূর দিয়ে ছুটে গিয়ে, তার রথের আসনে গিঁথে গেল। তুই তো জানিস আমার হাতের বল্লম কখনো ফস্কায় না। এবার ফস্কাতে হল, আধিকারিকদের আদেশ। তারপর আর কি, নগররক্ষীরা ধরে ফেলল। মারধোর করে নিয়ে গেলে কারাগারে”। “তুই বলতে চাইছিস, সবটাই নাটক?”“নাটক তো বটেই। অন্য শহর থেকে তিনজন ছোকরা আর পাঁচজন সুন্দরী বারবনিতাকে বানজারা সাজিয়ে রাজধানীতে আনা হয়েছিল, যাতে তারা রাজশ্যালক রতিকান্তর চোখে পড়ে। সেই দলে আমিও ছিলাম। রতিকান্ত সেই ফাঁদেই পা দিল। দলটা রাজপথে নাচ-গান করতে করতে যখন যাচ্ছিল, সেই সময়েই এসে পড়ল রতিকান্তর রথ। দলের সুন্দরী মেয়েগুলোকে দেখেই হতভাগা রতিকান্তর লোভ চেগে উঠল। দেহরক্ষীদের বলল, “ধরে আন মেয়েগুলোকে”। দেহরক্ষীদের সঙ্গে ওই মেয়েদের দলটার বচসা শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যেই সেখানে হাজির হল কয়েকজন নগররক্ষী। রক্ষীরা সকলে মিলে যখন মেয়েগুলোকে ধরার জন্যে ঝাঁপিয়েছে, আমি বল্লমটা ছুঁড়লাম রতিকান্তর দিকে। ব্যস, রক্ষীরা সব্বাই আমাকে নিয়ে পড়ল”। “আর মেয়েগুলোর কী হল?”“তাদের আর কী? তারা পালিয়ে গিয়ে উঠল, আগে থেকেই ঠিক করা গোপন এক আড্ডায়। সেখানে বানজারার পোষাক বদলে, সাধারণ চাষীঘরের বউ-মেয়ে সেজে সরে পড়ল মাঠের আলপথ ধরে”।“বুঝলাম। কিন্তু তুই কারাগার থেকে ছাড়া পেলি কী করে?”“ওই যে বললাম আধিকারিকদের নির্দেশ। মাঝরাত্রে এসে আমাকে একটা ঘোড়া দিয়ে বলল, এখনই বেরিয়ে যাও। পথে কোথাও দাঁড়াবে না। রাতটা কাটাবে এই চটিতে। কিন্তু গোপনে”। চিকা মৃদু হাসল, বলল, “হুঁ। গতকাল সকালে। তার মানে, তখনো তুই রতিকান্তর দিকে বল্লম ছুঁড়িসনি। আমার কাছে সেই নির্দেশ এসে গেছে। তোর ঘোড়া আমি রেখে দেব। আর তোকে একজোড়া রণপা দিয়ে রাত পোয়ানোর আগেই রওনা করিয়ে দেব। কিন্তু তুই যাবি কী করে, শরীরের এই অবস্থায়?”“রাজার আদেশ ভাই, যেতে তো হবেই। নির্দেশ আছে আমার এই ক্ষতবিক্ষত মুখ আর শরীর নিয়েই আমাকে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। তাতে আমার কাজের নাকি সুবিধে হবে”।অবাক হয়ে চিকা জিজ্ঞাসা করল, “তোর গন্তব্য কোথায়? কাজটা কি?”ভল্লা চিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেটা তো বলা যাবে না, ভাই। যদি বেঁচে থাকি, ফেরার সময় তোকে নিশ্চয় বলে যাবো…”। চিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলাম। তুই মুখ হাত ধুয়ে নে, আমি তোর খাবার নিয়ে আসছি। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। রাত্রি শেষ প্রহরে তোকে ডেকে রওনা করিয়ে দেব”। ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    নির্বাচন - প্যালারাম | আজ ৬ই মে, ২০২৪। ইউক্রেনে এখনো যুদ্ধ চালু। মণিপুরে এখনো আগুন জ্বলছে। গাজ়ায় পরিকল্পিত নরহত্যা আর মানব-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের দ্রুত নিষ্পত্তি হবে—এমন কোনো চিহ্ন নেই। বরং প্যালেস্তাইনের সমর্থনে/বিপক্ষে গোলযোগ বেঁধেছে আমেরিকায় (এক্ষুনি খবর পেলাম: নেতানিয়াহু ইজ়রায়েলে আল জাজ়িরার সব লোকাল অফিস বন্ধ করে দিয়েছে)।দেশে চলছে নির্বাচন। রাজ্যে রাজ্যে তার আলাদা রূপ। আমার রাজ্যে, বিজেপি তার গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে ফেলে পুরো ঘৃণা-বাণিজ্যের জামা পরে ফেলেছে, সিপিয়েম কোনো এক লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল দিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখে কথা বসাচ্ছে, তৃণমূল চুরি করেছে কিনা কেউ জিজ্ঞেস করছে না—শুধু প্রশ্ন, চুরি কতটা? পুকুর, দীঘি, না পুরো সমুদ্দুর!পাড়ায় পাড়ায় গুন্ডার দল—যারা আজ তৃণমূলের—প্ল্যান ছকছে: রেজাল্ট ঠিক কেমন হলে দলবদল করবে। বিজেপি তার ওয়াশিং মেশিন চালিয়ে সেই সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত করছে। কিছু বামপন্থী, যাঁরা নিজেদের মার্ক্সিস্ট মনে করে অনুভূতিতে প্লাবিত হন, এখনো বুঝে  উঠতে পারেননি, যে দিবারাত্র ফেসবুকে তক্কো আর হ্যা হ্যা করতে করতে তাঁরা আসলে ট্রোল-এ পরিণত হয়েছেন, তাই যেসব যুবনেতা-নেত্রীর ছবি শেয়ার করে তাঁরা উদ্বেল, তাঁদের কাজে লাগার বদলে ক্ষতিই করছেন বেশি।মানুষ তিক্ত, দেশগুলি যুযুধান, পৃথিবী উষ্ণতর।আত্মবিস্মৃত। আবার কি একটা প্যানডেমিক দরকার এই অলক্ষুণেদের মনে করাতে – যে রক্তের গ্রুপ হয়, ধর্ম না? অক্সিজেনের রঙ নেই, ঝান্ডার আছে? প্রিয়জনের মৃত্যুর সময়ে তার পাশে না থাকতে পারার চেয়ে বড় যন্ত্রণা কিছুতে নেই—সে তার রাজনৈতিক আদর্শ যা-ই হোক না কেন? যে সমস্ত ভয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অসূয়া, অসহিষ্ণুতা আমাদের 'পৃথক' করে, আসলে তা বিশ্বব্যাপী? সেসবই আমাদের 'মানুষ' বানায়?কবে বুঝবে গড্ডল, যে, বিজ্ঞান আর নৈতিকতার মিশেলে আসে প্রগতি? কোনো মোদি, দিদি বা নেতানিয়াহুর হাত ধরে নয়? কবে সভ্যতা তার উত্তেজনা সীমাবদ্ধ রাখবে দার্শনিক তর্কের প্রাঙ্গনে—দেশ, জমি, পাড়া, চাকরিদখলের পেশিপ্রদর্শন করবে না? নিজের অপ্রাপ্তির ভার অনলাইনে ষোল বছরের শিশুর সাফল্যের খবরের নীচে উগরোবে না? শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজো গুলিয়ে, আজ অনুকূল ঠাকুর, কাল মেঘনাদ সাহার ছবিতে মাল্যদান করবে না? কবে দূরদর্শী হবে ভারতীয়? কবে 'সত্যমেব জয়তে'-র বিকল্প হিসেবে 'ধন্দা হি সব কুছ হ্যায়' বসানোর নির্বুদ্ধিতা খেয়াল করবে?নির্বাচন এসেছে। মতের সমর্থন, বিরুদ্ধাচরণ করুন। ক্ষমতাবানেদের প্রশ্ন করুন। প্রতিবেশীর, সহকর্মীর, সহযাত্রীর সঙ্গে লড়বেন না। তাঁদের চোর, চাড্ডি, পাপ্পু, মাকুর বাচ্চা, চটিচাটা বলে থুতু ছুঁড়বেন না। কাল যখন আপনার পরিবারের কেউ অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকবে, ওঁরাই আসবেন, পাশে দাঁড়াবেন। সকলেই ভীত – আমরা সব্বাই রক্তভরা ক্ষয়িষ্ণু চামড়ার ব্যাগ। রাগবেন না। ভালো থাকুন। সকলেরই সন্তান দুধে ভাতে থাকুক। 
    ভোটুৎসবে ভাট - কর্ণায়ু সূত্র - পুলির ফালতু ফান্ডা - সমরেশ মুখার্জী | জুনের মেঘলা দুপুরে লাঞ্চের পর সৌমেন, মৌমিতা ও পৌলমী সৌমেন‌দের ফ্ল‍্যাটে আড্ডা দিচ্ছে। সৌমেন ওর একমাত্র শ‍্যালিকা পৌলমীকে আদর করে পুলি বলে ডাকে। আড্ডা‌র মাঝে একসময় পুলি বলে, জানেন সৌম‍্যদা, শুনেছি যাদের কান ছোট হয় তারা নাকি স্বল্পায়ু হয়। বালাই ষাট, দিদিভাই‌য়ের কান দুটো যেন ছোট‌ই মনে হচ্ছে। আপনার কান কিন্তু স্বাভাবিক।  মৌ বলে, তাহলে তো ভালো‌ই, এমনি‌তে আমার থাইরয়েড, প্রেশার আর সুগার আছে। ছোট কানের দৌলতে আমি বেশ ওর আগেই চলে যাবো। ও আমার আগে গেলে মুশকিল। সৌমেন বলে, তুমি আগে চলে গেলে আমার কী হবে? মৌ বলে, কী আবার হবে। কিছুদিন খারাপ লাগবে। যত‌ই হোক এতদিনের অভ‍্যাস। তার‌পর সেই অভাব‌‌বোধও ক্রমশ অভ‍্যাস হয়ে যাবে। রাঁধুনী, কাজের লোক রাখবে। না হয় কোনো বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবে। তোমার জগৎ তো আমার থেকে বিস্তৃত তাই আমার অবর্তমানে তোমার খুব একটা অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। অমোঘ পরিণতি নির্মোহভাবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা‌ও তোমার আছে। সংসারে তোমার বাঁধন‌‌ও আলগা। তাই দীর্ঘ দিন মহানন্দে একা একা ঘুরে বেড়াও। তখন কদাচিৎ আমায় ফোন করো। সৌমেন বলে, তার মানে বলতে চাইছো আমি খুব আত্মকেন্দ্রিক, তাই তো?মৌ বলে, খুব না হলেও কিছুটা তো বটেই - তুমি নিজের দুনিয়ায় থাকতে ভালো‌বাসো। তাই বেশ আত্মমগ্ন‌ও বটে। কারুর প্রতি তোমার টান আন্তরিক হলেও আকুল‌তা কম। এটা যে খারাপ‌, তা বলছি না। মহাজনরা তো বলেন‌ই - মায়া‌র বাঁধনেই কষ্ট বেশি। তাই বেড়ানো, ব‌ই পড়া, লেখালেখি এসব নিয়ে আমার অবর্তমানে‌ও তোমার জীবন মোটামুটি ভালো‌ই কেটে যাবে। কিন্তু আমার জগৎ‌ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ‌কে নিয়ে। তুমি, নীলু, মা, বাপী, পুলি, ওর বর, মেয়ে এইসব। নীলু বড় হয়ে কাজে কর্মে ব‍্যস্ত হয়ে পড়বে। হয়তো দু্রে চলে যাবে। তখন তুমিই আমার সঙ্গী। আমি বুড়ি হয়ে গিয়ে গুটগুট করে হাঁটবো, তুমি আমায় হাত ধরে রাস্তা পার করাবে। জ্বরজারি হলে তোমার হাতে সেবা খাবো। তাই তুমি না থাকলে আমি খুব একলা হয়ে যাবো। কী নিয়ে থাকবো? তাই ভেবে দ‍্যাখো, আমার আগে চলে যাওয়াই ভালো।  সৌমেন মুখ ঝামটা দেয়, সেবা খাবো, গুটগুট করে হাঁটবো, হুঁঃ, আদিখ‍্যেতা আর ধরছে না। পুলির ঢপের ফান্ডা শুনে এমন ভাবে বলছো যেন ট্রেনে‌র টিকিট, হোটেল বুকিং‌ করা‌ই আছে এবার নির্দিষ্ট দিনে ট্রেনে উঠলেই হয়। দ‍্যাখো, কে, কার আগে যাবে তা অনিশ্চিত। ছোট থেকে ঘরে বদরাগী বাবা বা বাইরে তিরিক্ষে শিক্ষকদের কানমলা খেয়ে লম্বকর্ণ বিটলে‌ও পরে পুলিশের গুলিতে অকালে টপকে যেতে পারে। তার বেলা? আমার হাতের আয়ুরেখা‌ও অসমাপ্ত। জ‍্যোতি‌ষ মতে এর অর্থ ষাটের পর যে কোনো সময় অপঘাতে মৃত‍্যু। ৫৮ হতে চললো, মানে ক‍্যালেন্ডারের বাকি পাতা ফুরোলো বলে। তাহলে? তোমার ছোট কান না আমার থমকানো আয়ুরেখা - কোন ফান্ডা আগে ফলবে কে বলতে পারে? তাই এসব ফালতু কথা না ভেবে যতদিন মানুষ বাঁচবে যে যার মতো চেষ্টা করবে জীবনকে  উপভোগ করতে, এটাই সার কথা। মরতে একদিন সবাই‌কে হবে। বিদেশে জীবদ্দশাতেই কবরখানায় পছন্দ‌মাফিক জায়গা বুক করে রাখে। সে ঠিক আছে - preparation for the inevitable - তবে যাওয়া নিয়ে অবান্তর প্রসঙ্গে ভাবলে থাকার আনন্দ‌ই মাটি হয়।    সেদিন আড্ডায় ওখানেই ইতি হয়। দু বোন লাঞ্চের পর যায় হাওড়ায় বাপের বাড়ি। কয়েকদিন থাকবে ওখানে। নীলু আছে কর্ণাটকে কলেজ হোস্টেলে। সৌমেন থেকে যায় ছিমছাম উপনগরী‌তে ওদের আটতলার ফ্ল‍্যাটে। যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, কুসংস্কার‌মুক্ত - প্রকাশ‍্যে পরে থাকা এহেন সব আলখাল্লা থেকে পুলির কথায় নির্জন ঘরে উঁকি মারে কিঞ্চিৎ ভাবিত সত্তা। মুঠোফোনে‌র জ্ঞানসমুদ্রে খোঁজে পুলি যা বলে গেলো তার কোনো ভিত্তি আছে কিনা। আন্তর্জালে পুলির ফান্ডার - অর্থাৎ ছোট কানের সাথে অকালমৃত‍্যুর সম্ভাবনা - এমন কোনো যোগসূত্র পাওয়া গেল না। বরং জানা গেল বয়েসে‌র সাথে শারীরিক সামর্থ‍্য, রূপে‌র জৌলুস কমলেও বাড়তে থাকে কানের দৈর্ঘ্য। হয়তো মাধ‍্যাকর্ষণের আকর্ষণে। তবে সে বৃদ্ধির হার খুবই সামান্য। এক যুগে হয়তো দু মিলিমিটার।  পরদিন সকালে সৌমেন বাজারে যায়। ফুটপাথে একটা সাদা ছাগল ল‍্যাম্পপোষ্টে বাঁধা রয়েছে। আগেও বেশ কয়েকবার ওখানে দেখেছে ওকে। মিষ্টি দেখতে। নিরীহ ভাবভঙ্গি। সেদিন বছর চারেকের একটা বাচ্চা ছেলে তার গলা জড়িয়ে কপালে হাত বুলোচ্ছে। ছাগলটা মাথা নীচু করে আদর খাচ্ছে। সুন্দর দৃশ‍্য। সৌমেন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে। শিশুটি একটু বাদে ওকে ছেড়ে রাস্তার উল্টোদিকে কয়েকটি বাচ্চার সাথে খেলতে চলে যায়। আর তখনই সৌমেনের চোখে পড়ে ছাগলটির কান দুটো। অস্বাভাবিক লম্বা! খরগোশের কান যে বড় হয় তা সবাই জানে।  সেদিন একটা ডকুতে কিছু লম্বা কানের প্রাণী দেখাচ্ছিল। আফ্রিকা, এশিয়ার মরু অঞ্চলের এক প্রকার মাইক্রো ক‍্যাঙারুর মতো পুঁচকে ইঁদুর দেখালো - লাফিয়ে লাফিয়ে চলে - নাম তার জারবোয়া (Jerboa) - তার ইয়াব্বড় বড় কানের দৈর্ঘ্য নাকি তার শরীরের দুই তৃতীয়াংশ। দেখালো মরুশেয়াল ফেনেক ফক্স (Fennec fox)  - শিয়ালকুলের পুঁচকে সদস‍্য - সেও মরু অঞ্চলের বাসিন্দা।  কিন্তু কোনো ছাগলের যে নেকটাইয়ের মতো এতো দীর্ঘ, প্রায় বুক অবধি ঝোলা কান হয়, তা আজ অবধি দেখে নি সৌমেন। আগেও কয়েকবার দেখেছে ছাগলটাকে এখানে, কিন্তু ওর কানের দিকে এভাবে নজর পড়ে নি। তাহলে আজ কেন পড়লো? পুলির কথা শুনে ওর‌ও কি মানসিক দৌর্বল‍্য দেখা দিলো? পুলির ঐ ফর্মুলা কি ছাগলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? তাহলে এ‌ও হয়তো দীর্ঘায়ু হবে! যাঃ, কী সব ভাবছে পাগলের মতো। আপন মনে হেসে সৌমেন এগিয়ে যায় বাজারে‌র দিকে।   একা মানুষের রোজ বাজারে যাওয়া‌র দরকার পড়ে না। দুদিন পর আবার বাজারে যায় ও। সেদিন ল‍্যাম্পপোষ্টে বাঁধা সেই ছাগলটিকে দেখতে পায় না। বরং সেখানে চেয়ার পেতে বসে আছে একটি বয়স্ক লোক। নিরীহ কৌতূহলে তাকেই জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, এখানে কয়েকদিন ধরে বড় কান‌ওয়ালা একটা সাদা ছাগল বাঁধা থাকতো, কোথায় গেল সেটা?    ওদিকে বেশ কয়েক ঘর মুসলিম পরিবারের বাস। যাকে জিজ্ঞাসা করলো সৌমেন, সেও এক চাচা। তিনি বলেন গতকাল বকরিদ ছিল তো, তাই …. চাচা নিজের গলায় হাতের পাঞ্জা টেনে হালালের ইংগিত করেন। এবার বোঝে সৌমেন। তাই ওকে তোয়াজ করে পাতা টাতা খাইয়ে জি‌ইয়ে রাখা হয়েছিল এতোদিন।    এক্ষেত্রেও কানের দৈর্ঘ্যের সাথে আয়ুর যোগসূত্র‌ ধোপে টিকলো না। তাহলে পুলির ফান্ডা ঢপের‌ই হবে। একটু হালকা বোধ করে বাজারে‌র দিকে এগিয়ে যায় সৌমেন। 
    রাম্মিডিয়া - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | বিখ্যাত ঐতিহাসিক রঙ্গনা রানাকৌতের মতে, মিডিয়া আবিষ্কার হয় ভারত স্বাধীন হবার কুড়ি বছর আগে। তার আগে ছিল প্রস্তরযুগ। লোকে শিকার করে আমিষ খেত। ইন্টারনেট এবং কেবল টিভি আবিষ্কার করার উদ্দেশ্য ছিল, এই অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোর দিকে নিয়ে আসা। কিন্তু তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের অপদার্থতার ফলে, কাজটা করা যায়নি। ইন্টারনেট আবিষ্কারের পরও দেখা যায় মানুষকে কষ্ট করে ভেবে-ভেবে গুগল সার্চ করতে হচ্ছে। এমনকি টিভি চালালেও উঠে উঠে চ্যানেল বদলাতে হচ্ছে। বনে বনে ঘুরে শিকার করার থেকে কাজটা কম কষ্টের নয়।সেই সময়ের সরকার এই কষ্ট লাঘবে একেবারেই আগ্রহী ছিলনা। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মার্কিন দেশে জুকু নামে এক মহাপুরুষের জন্ম হয় এই সময়। তিনি ভারতের গুজরাতে এসে এক গভীর জঙ্গলে বোধিবৃক্ষের তলায় বসে সাধন করছিলেন। এমন সময় তাঁর মাথায়  জ্ঞানবৃক্ষের এক আধখাওয়া আপেল এসে পড়ে এবং তিনি সোশাল মিডিয়া, হোয়াটস্যাপ এইসব জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেন। তারপরই পৃথিবী বদলে যায়। দেখা যায়, মানুষকে কষ্ট করে আর কিছু খুঁজতে হচ্ছেনা। সবই ফিড নামে নাকের ডগায় এসে হচ্ছে। কষ্ট করে মত দিতে হচ্ছেনা, লাইক নামক এক যাদুদৈত্য সেই কাজ করে দিতে হাজির। পৃথিবীতে বিপ্লব হয়ে যায়, লোকে এতদিন কী ভ্যান্তরা করছিলাম ভেবে কেন্দ্রীয় সরকারকে গাল দিতে থাকে। সেই থেকে জংগলটার নামই হয়ে যায় ভ্যান্তারা। এখন সেটা একটা আশ্রম। সেখানে হাতি, ঘোড়া, খচ্চোর ইত্যাদিদের চিকিৎসা হয়।এই সময়, ওই গুজরাতেই জন্মান ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা সাধক, যাঁর নাম উনিজি। জীবনের গোড়ায় তাঁকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাঁর সঙ্গে অস্পৃশ্যের মতো আচরণ করা হয়েছে। একবার  আমেরিকায় ঢুকতে চেয়েছিলেন বলে ঘাড়ধাক্ক দিয়ে বার করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে তিনি দমেননি। ওই গুজরাতের জঙ্গলে বসেই তিনি বুঝতে পারেন, জুকুর আবিষ্কারের মাহাত্ম্য। এবং ওখানেই তিনি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা করেন, যা পরে ভূভারতে ছড়িয়ে যাবে, যার নাম হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটি।কিন্তু এসব একদিনে হয়নি। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে ওই জঙ্গল থেকে বেরোতে দিতনা। ফলে কূটকৌশল নিয়ে দেশবাসীকে পারহেড ১৫ লক্ষ টাকা দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেন এবং ভারতবর্ষকে স্বাধীন কর ফেলেন। সেখানেই শেষ নয়, স্বাধীন হবার পরেও তাঁর কাজ শেষ হয়নি। একমাত্র তিনিই বোঝেন, যে, জুকুর আবিষ্কার খুব বড়ো হলেও, মানুষকে এখনও পরিশ্রম কর চলতে হচ্ছে। ইন্টারনেটে হয়তো চাপ কিছুটা কমেছে, কিন্তু টিভিতে তাদের এখনও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চ্যানেল বদলাতে হচ্ছে। তাতে কারো হাতে ব্যথা হচ্ছে। কারো পক্ষাঘাত। এছাড়াও এক এক জায়গায় এক এক রকম খবর। এই সমস্যার সমাধানে উনিজি নিজেই এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেন, যার নাম গোদীমিডিয়া। এই মিডিয়ার দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। এক, এখানে অনেক চ্যানেল থাকলেও সর্বত্রই এক জিনিস দেখানো হয়। ফলে দর্শকদের পরিশ্রম বাঁচে, তাঁরা পক্ষাঘাত এবং মাথা-ঘামানো এই দুই ব্যামো থেকেই মুক্ত থাকেন। দুই, সঞ্চালকরা একাই কথা বলেন এবং ভীষণ জোরে চেঁচান। এর সুবিধেটা হল, আলাদা করে টিভি চালানোরও দরকার পড়েনা। পাড়ায় একটা বাড়িতে টিভি চললেই বাজার পর্যন্ত সবই শোনা যায়। পরিশ্রমের সঙ্গে ইলেকট্রিসিটির খরচও বাঁচে। এই অতিরিক্র বিদ্যুৎ দিয়ে মোবাইল চার্জ করা হয়, যাতে হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির পড়াশুনোয় লোকে মন দিতে পারে। এই আবিষ্কারের পর জগতে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। কিন্তু পৃথিবীতে কোনো কিছুই নিখুঁত নয়। কিছুদিন পরে দেখা যায়, গোদী মিডিয়াতেও  কিছু সমস্যা আছে। লোকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, তারা আরও দেখতে চাইছে, কিন্তু ভালো খবরের জোগান তেমন নেই।এই ম্যাদামারা জীবনে আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমস্যা না থাকলেও, কালে-কালে দেখা যায়, রোজ হেরোইন নিয়ে হঠাৎ বন্ধ করে দিলে যেমন হয়, তেমনই বহু লোকে উইথড্রয়াল সিম্পটমে ভুগছেন। তাঁদের রিহ্যাবে নিয়ে যেতে হচ্ছে। ব্যাপার ক্রমশ গুরুতর আকার ধারণ করে। ইসরো থেকে ইসকন, নানা জায়গার বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করেও কিছু বার করতে পারেননি। কিন্তু উনিজি হাল ছেড়ে দেবার লোক নন। উৎসাহ দিয়েই চলেন। গুজরাত থেকে বঙ্গাল পর্যন্ত, সর্বত্র। বঙ্গালকে অবশ্য খরচার খাতায়ই ধরা  হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের ভূমিকা খুব খারাপ, তাছাড়া ওরা একদম কর্মপটুও না। কিন্তু কী আশ্চর্য, হঠাৎ করে সমাধান চলে আসে সেই বঙ্গাল থেকেই। বাপন নামক এক বাঙালি বিজ্ঞানী  হঠাৎই আবিষ্কার করেন, যে, খবর দেখাতে গেলে কিছু ঘটার আদৌ দরকারই নেই। শুট করে নিলেই হয়। এমনকি বাজেট কম থাকলে স্রেফ মুখে বলে দিলেও হয়। শুটিং এবং ডাবিং সেই মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি, ফলে ব্যবহার না করার কোনো কারণ নেই। ব্যাপারটা শুনে এখন খুবই সহজ মনে হলেও, ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এতকাল ধরে কারো মাথায় আসেনি। মহৎ আবিষ্কারে অবশ্য এরকমই হয়। শূন্য সবাই দেখতে পায়, কিন্তু বেদে 'শূন্যস্থানে ভয়েবচ' মন্ত্র পড়ার আগে কেউ জানতই না, শূন্য ব্যাপারটা কী।যাহোক, এই একদম সাম্প্রতিক আবিষ্কারের  পর পৃথিবীতে হইচই পড়ে গেছে। উনিজির অনুপ্রেরণায় এই বৃহৎ প্রচেষ্টার প্রথম ধাপ সাফল্যের মুখ দেখেছে। এ তো শুধু খবর নয়, খবরের চেয়েও বড়। এ তো শুধু মিডিয়া নয়, মিডিয়ার চেয়েও বড়। বাংলায় বড়কে বলা হয় রাম। সবচেয়ে বড় দেবতা, রাম। সবচেয়ে বড় ছাগল রামছাগল। সেই প্রথা অনুসরণ করে এই মিডিয়াকে অনেকে বলছেন রাম্মিডিয়া। কিন্তু নামটা এখনও পাকা হয়নি। কী হবে জানতে গেলে আমাদের সঙ্গে থাকুন। প্রসঙ্গত আপনারা এতক্ষণ শুনলেন রাম্মিডিয়ার সম্প্রচার। ব্যাপারটা কী দারুণ নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন। এবার ঝপ করে উপরের 'অনুসরণ করুন'  বাটনটা টিপে ফেলুন। খবরের জন্য অন্য কোথাও যেতেই হবেনা। ডিং ডং।সঙ্গের ছবিঃ যদুবাবু (আপলোড করা গেলনা। লিংক এখানেঃ https://imgur.com/a/7PyI7Nh ) 
  • জনতার খেরোর খাতা...
    জীবন তরঙ্গ পর্ব ৫  - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ  পর্ব –৫রজতদের আদি বাড়ি মদনপুরে। ওখানেই ওদের কয়েক পুরুষের বাস। রজত যখন খুব ছোট তখন ওর বাবা বিকাশ পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে রহড়ায় চলে আসে। বিকাশ গুপ্ত  তখন ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপক। কিছুটা কর্মস্থলে যাতায়াতের সুবিধা আর অনেকটাই ছেলেকে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াবার বাসনায় রহড়ার মিশন পাড়ায় বাসা ভাড়া নেয়। কলেজের এক সহকর্মী রহড়ার নন্দন কাননে থাকতেন, উনিই মিশন পাড়ার  বাড়িটায় ভাড়া থাকার ব্যবস্থা করে দেন। বাড়িওয়ালা ভাল মানুষ। কোলকাতায় চাকরি করে।  বিপত্নীক, বছর দুয়েক আগে স্ত্রী মারা গেছে। একটিমাত্র ছেলে, বিকাশেরই কলেজে পড়ে। বাড়িওয়ালা দোতলায় থাকে আর বিকাশরা একতলায়। দিনের বেলা এক এক করে যে যার কাজে বেরিয়ে যায়। কাজের বৌ চলে যাওয়ার পর বাণী সারাদিন ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে  একাই থাকে। রজত ভয়ানক রকম ডানপিটে ছেলে ছিল। সুযোগ পেলেই বাড়ি   থেকে বেরিয়ে পড়ত। ওর গুণের কথা সকলে জানত বলে পাড়া প্রতিবেশীদের নজর এড়িয়ে বেশিদূর   যেতে পারত না। কোন রকম বিপদে পড়ার আগে কারো না কারো চোখে পড়ে গেছে। রজতের তখন পাঁচ বছর বয়স।  সামনের মুদির দোকানের বিপুল ওকে ড্রেনের থেকে উদ্ধার করে  বাড়িতে জমা দিল। রজত তখন পাঁকের পুঁটলি।  সর্বাঙ্গ দিয়ে টপটপ করে নোংরা জল ঝরছে। বিপুলেরও হাঁটু অব্দি পাঁকে মাখামাখি হয়ে আছে।বাণী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে—তোমাদের একি অবস্থা বিপুল?   --আর বলবেন না বৌদি। হঠাৎ ও দেখি রাস্তায় একা ঘুরছে। ডাক দিতেই ছুট দিল। আমিও দোকান ফেলে ওর পিছনে ছুটলাম। ছুটে পালাতে পারবে না বুঝতে পেরে যাতে আমি ধরতে না পারি  তার জন্য ড্রেনের মধ্যে নেমে পড়ল। বাধ্য হয়ে আমাকেও নামতে হল। এখন বাড়ি গিয়ে আগে চান করি তারপর অন্য কিছু। দোকানদারি আমার লাটে উঠল।--কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ দেব ভাই! একা থাকি, কতক্ষণ চোখে চোখে রাখব বল? দেখ তো না দেখ কিছু না কিছু গন্ডগোল পাকাচ্ছে। ছেলেটাকে নিয়ে কি যে করি!--অত চিন্তা করবেন না, আমরা সকলে আছি। বাড়ির বাইরে এলে কারো না কারো চোখে পড়বেই। তবে যা দুরন্ত ছেলে,  বাইরের দরজা সব সময় বন্ধ করে রাখবেন।-- ওর ভয়ে সব সময় দরজা বন্ধ করে রাখি। দুধওয়ালা এসেছিল, দুধটা নিয়ে ভেতরে রাখতে গেছি, সেই ফাঁকে বেরিয়ে গেছে।যাকে নিয়ে এত আলোচনা সে তখন নির্বিকার। চুপটি করে দাঁড়িয়ে দুজনের কথোপকথন শুনছে। ওই অবস্থায় যাতে বিছানায় না উঠে পড়ে তার জন্য ওর একটা হাত তখন জমা রয়েছে মায়ের শক্ত মুঠোয়।   সেদিন একটা প্রায় গোটা সাবান লেগেছিল রজতের গায়ের ময়লা তুলতে।একবার তো রজত পাচার হতে হতে বেঁচে গেছে। সেদিন বাণীর শরীরটা ভাল ছিল না। বাড়ির কাজকর্ম সংক্ষেপে সেরে বিছানায় শুয়ে ছিল। রজত বাধ্য ছেলের মত বিছানায় মায়ের গা ঘেঁসে চুপচাপ বসে ছিল। কাজের বৌ কিছুক্ষণ আগে কাজ করে চলে গেছে।  হঠাৎ ডুগডুগির আওয়াজ কানে যেতে রজত নড়ে চড়ে বসল। আওয়াজ দীর্ঘস্থায়ী হতে ওর পক্ষে আর বিছানায় বসে থাকা সম্ভব হল না। বিছানা থেকে আস্তে করে নেমে এসে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল। কাজের বৌ চলে যাওয়ার পরে দরজা বন্ধ করা হয়নি। বাণীর তখন চোখটা একটু লেগে গেছে। দরজা খোলা পেয়ে রজত নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। রাস্তার ওধারে বাঁদরের খেলা হচ্ছে। শিশু রজত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে একমনে বাঁদর খেলা দেখছিল। পয়সা কড়ি তেমন না পাওয়ায়  লোকটা একটু পরে বাঁদর দুটো নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিল। রজতই বা দাঁড়িয়ে থাকে কি করে! শিশু রজতও বাঁদরের পিছনে পিছনে হাঁটতে শুরু করল। বাচ্চাকে একা একা হাঁটতে দেখে শীতলা বাড়ির সামনে থেকে এক প্রৌঢ়া এসে ওর হাত ধরল। রজতও মহানন্দে ওর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল। একটু এগিয়েই বাঁদর ওয়ালাটা পাশে একটা গলির মধ্যে ঢুকে গেল। রজতও ওই দিকেই ঘুরতে চাইছিল, কিন্তু সঙ্গের মহিলা ওকে কিছুর  লোভ দেখিয়ে  ধাপার রাস্তা ধরে টিটাগড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। বাঁদর ছেড়ে  অন্যদিকে যাওয়ার ইচ্ছে রজতের একেবারেই ছিল না।  কিছুটা গিয়েই বিদ্রোহ ঘোষণা করে ‘আমি বাড়ি যাব’ বলে বেশ জোরে চেঁচিয়ে ওঠে। ওই রাস্তায় লোকজন খুব কম চলাচল করে। কপাল ভাল  মিশন পাড়ার নিমাই সরকার তখন ওই রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছিল। বাচ্চার ‘আমি বাড়ি যাব’ কথাটা কানে যেতেই ওর কেমন সন্দেহ হল। ঘুরে ওদের সামনে গিয়ে চমকে ওঠে, এ তো পাড়ার বিকাশদার ছেলে। ও কাছে যেতেই মহিলা বিপদ বুঝে পালাতে যাচ্ছিল। নিমাই দৌড়ে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরে চিৎকার করে লোক জড় করল। ছেলেধরা নিশ্চিত হওয়ার পর থানায় খবর দেওয়া হল। খড়দা থানা থেকে পুলিশ এসে মহিলাকে ধরে নিয়ে গেল। তার আগে অবশ্য গণ ধোলাই খেয়ে ওর আধমরা অবস্থা হয়ে গেছে। ঘটনায় সকলেই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল,  কারণ এই অঞ্চলে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।এদিকে বাণী একটু বাদে চোখ খুলে দেখে পাশে ছেলে নেই। সামনে বাইরে যাওয়ার দরজা খোলা। ছেলেকে ঘরে কোথাও দেখতে না পেয়ে ওই অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে এসে পাগলের মত কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বাড়ির সামনে চেনা অচেনা বহু লোকের  ভিড় জমে গেল। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারছে না। পুলিশে খবর দেওয়া হল। থানা থেকে আশ্বাস পাওয়া গেল যে  ছেলে অক্ষত আছে। সাথে এল ছেলেকে সামলে না রাখতে পারার জন্য কড়া ধমক। একটু বাদে রিক্সয় চেপে নিমাই সরকারের সাথে রজত বাড়ি এল।ছেলেকে যথাস্থানে জমা করে নিমাই বলল—বৌদি খুব কপাল ভাল যে ছেলেকে আজ ফিরে  পেলেন।এরপর ওর উপস্থিতিতে যা যা ঘটেছে বাণী এবং কৌতূহলী জনতাকে জানাল। পাড়ার লোকজন বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল কারণ, কাগজে পড়া ঘটনা যে পাড়াতেও ঘটতে পারে তা কখনো কেউ ভাবেনি।  রজতের কাছ থেকে বাঁদর নাচ ছাড়া তেমন কোন তথ্য বার করা গেল না। বাঁদর নাচের কথা শুনেই দু একজন উত্তেজিত হয়ে জানাল যে বাঁদরওয়ালাটা আজ এসেছিল বটে। তার মানে ও ব্যাটাই এর মূলে আছে। পরের দিন এলে ওটাকেও পুলিশে দিতে হবে। বিকাশ বাড়ি এসে ছেলের ঘটনা শুনে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল।--ওকে পাহারা দেওয়ার জন্য তো দেখছি লোক রাখতে হবে। কাজের বৌকে বলে দেখ যদি একটা শক্তপোক্ত মহিলা পাওয়া যায়।বাবার কাছে ছেলে তার মতো করে সকালের আরো কিছু তথ্য দিল  যাতে আন্দাজ করা গেল  যে বাঁদরওয়ালা নয়  সাদা শাড়ি পরা দিদাই আসল অপরাধী। রজতের বয়ান নেওয়ার জন্য একদিন পুলিশ ওদের বাড়িতেও এসেছিল। প্রথমে মৌনি বাবা হয়ে থাকলেও পরে সেদিনের অনেক কথাই পুলিশকে জানিয়েছিল ছোট্ট রজত।পাহারাদার আর রাখা হয়নি। নিরাপত্তার স্বার্থে বাউন্ডারি ওয়ালের গ্রিলের গেটে সব সময় তালা  দিয়ে রাখার ব্যবস্থা হল। ফলে গেট খোলা থাকার সম্ভাবনা আর থাকল না বললেই চলে। বাড়িওয়ালাদের যাতায়াতের রাস্তা সম্পূর্ণ আলাদা ছিল, ফলে কোন সমস্যা হয়নি। এর বছর খানেক বাদেই রজত মিশনের স্কুলে ঢুকে যায়। মিশনের শিবু স্যারের কড়া শাসনের কারণেই  হোক বা  বিকাশ আর বাণীর ভাগ্যের জোরেই হোক স্কুলে ঢোকার পর থেকে রজতের গতিবিধি ধীরে ধীরে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসে।      অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে রজত ক্লাস ওয়ানে রহড়া মিশনে পড়ার সুযোগ পায়। ইচ্ছা পূরণ হওয়ায় রজতের মা বাবা খুব খুশি। মদনপুরের ভিটে ছেড়ে রহড়ায় আসা সার্থক হল।  থাকতে থাকতে বিকাশ আর বাণী দুজনেরই রহড়ার পরিবেশ ভাল লেগে যায়। পাকাপাকি ভাবে রহড়ায় থাকার   ভাবনা চিন্তা শুরু করে। তখন কলেজের অধ্যাপকদের মাইনে খুব একটা ভাল ছিল না। কেবলমাত্র কলেজের মাইনের ওপর নির্ভর করে ওই ভাবনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব ছিল না। রামকৃষ্ণ মিশন থাকার কারণে এলাকায় টিউশনির ভাল চাহিদা ছিল। বিকাশ চুটিয়ে টিউশনি  করা শুরু করল। কয়েক বছর বাদে সঞ্চয়ের পরিমাণ কিছুটা স্ফীত হল।   কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে চৌধুরী পাড়ায় তিন কাঠা জমি কিনল। এরপর বেশ কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে মোটামুটি বাস করার মত একটা বাড়ি বানিয়ে মিশন পাড়ার বাসা ছেড়ে নিজের বাড়িতে চলে এল। পরবর্তীকালে বাড়িটা উচ্চতা আর আয়তনে আরো অনেকটা প্রসারিত হয়েছে। বছর দশেক হল বিকাশ ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের চাকরি ছেড়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন  করেছে।  তারপর থেকে রজত বাড়িতে বহু সময় একাই থাকত। রজতের মা কিছু সময় ওখানে আর কিছু  সময়  ছেলের কাছে থাকত। লক্ষ্মীর মা বহুদিন ধরে ওদের বাড়িতে কাজ করছে। ওই রান্নাবান্না থেকে আরম্ভ করে বাড়ির সব কাজ করে দিত। ওর ভরসাতেই ছেলেকে রেখে বাণী উত্তরবঙ্গে যেত। অবশ্য রজত নিজেও যথেষ্ট স্বাবলম্বী ছিল। রান্নাবান্না থেকে আরম্ভ করে ঘর গৃহস্থালির সব  কাজই অল্পস্বল্প পারত।চলবে
    জীবন তরঙ্গ পর্ব ৪  - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ  পর্ব –৪   পাহারার প্রথম পর্বে পাড়াটা একবার প্রদক্ষিণ করে একদিন তেমাথার মোড়ে সকলে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ দেখা  গেল বাজারের দিক থেকে একটা লোক ছুটে আসছে। ডিফেন্স পার্টির এতগুলো লোক,  একজনকে আটকানোয় কোন রিস্ক  নেই। বীর দর্পে এগিয়ে গিয়ে সকলে ওকে ঘিরে ধরল। ও তার মধ্যে থেকেও ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। সন্দেহ বাড়ল, ব্যাটা নির্ঘাত চুরি করে পালাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরে ছটফট করতে করতে  বলল, “আমি রান্নার লোক, লাইনের ওপারের অনুষ্ঠান বাড়িতে কাজ ছিল।  ছেড়ে দাও আমার হাতে মোটে সময় নেই।”   --রান্নার লোকজন তো সব একসাথে দল বেঁধে ফেরে, তুমি একা কেন?--বাকিরা সব পিছনে আসছে। আমাকে আটকিও না, বিপদে পড়ে যাব।দু এক কথার পর বোঝা গেল যে ওর এখন তখন অবস্থা, অসময়ে বেগ এসেছে। তবু পুরোপুরি  ছাড়া হল না। বলা হল পুকুরের পাশে ঝোপের ধারে গিয়ে কাজ সারতে। আর কোন উপায় নেই  দেখে ও তাই গেল। কয়েকজন ওর  দিকে  নজর রাখল। এতদিনে একটা সন্দেহজনক কেস পাওয়া গেছে, চট করে ছাড়া চলবে না। একটু বাদে ওর দলের বাকি লোকজনেরা আসতে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে ও ওদেরই লোক।  ইতিমধ্যে প্রথম জন কাজ সেরে তৃপ্ত মুখে হাতে একটা ডিম নিয়ে ফিরে এসেছে।একগাল হেসে বলল, “এখানে বসে লাভ হল। পুকুর ধারে ডিমটা পেলাম।”  পুকুরে তখন সাঁতরে বেড়াচ্ছে ঘরে না ফেরা দলছুট দুটো হাঁস। ডিমটা ওদেরই কারো প্রোডাক্ট।  সেদিন চা বিরতির পরে একটা রাউন্ড দেওয়ার সময় দেখা গেল বাজারের দিক থেকে বিপ্লব  আসছে। বক্র রেখায় দু পা  আগে তো  এক পা পিছে করতে করতে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে আর  দুটো কুকুর ওর পিছু নিয়েছে। মনে হল উভয় পক্ষে কিছু কথোপকথন হচ্ছে। বিপ্লব সকলের চেনা লোক।  চেনা লোক চেনা রূপে নির্ধারিত সময়ে রাস্তায় ঘুরছে, প্রশ্ন করার কোন প্রশ্নই নেই। একটু কাছে আসতে পশু আর মানুষের কথোপকথন শোনা গেল । কুকুর দুটো গরর গরর করতে করতে ওর পিছু পিছু আসছে। টলতে টলতে দু চার পা এগিয়েই নৃত্যের ভঙ্গিমায়  হঠাৎ পিছনে ফিরে আঙুল তুলে বেশ শাসিয়ে কুকুর  দুটিকে বিপ্লব বলছে, “মাইন্ড  ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ।   তোরা কার সাথে মুখ লাগাচ্ছিস জানিস? আই অ্যাম বিপ্লব, মাইন্ড ইট।” একটু বাদে কুকুর  দুটো দূরত্ব কমিয়ে আর সাউন্ড বাড়িয়ে   প্রায় গায়ের কাছে চলে আসতেই বিপ্লব  ‘বাবা গো’ বলে লাফ দিয়ে বাকিদের কাছে সরে  এল। লোক বেশি দেখে সারমেয় দুটি অচিরেই  রণে ভঙ্গ  দিল। বিপ্লব ওদের কাস্টডিতে থাকতে থাকতেই উল্টো  দিক থেকে মন্টুদা  হাজির হল। দুজনেই   নিজের নিজের লাইনে তখন এলাকায় এক নম্বর।  মন্টুদার মত অত রঙ বাহারি পাগল চট করে দেখা যায় না। স্বাভাবিক ভাবে কথা বললে বোঝাই যাবে না যে জিনিসটায় কোন গণ্ডগোল আছে কিন্তু একবার খিস্তি শুরু হলে আর রক্ষে নেই। নয়নের সাথে মন্টুদার সম্পর্ক বেশ মধুর ছিল। সম্পর্কের  এই মাধুর্যের কারণে অনেক সময় নয়নকে রাস্তা ঘাটে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে  হয়েছে। মন্টুদা  নয়নের সামনে এসে গম্ভীরভাবে বলল, “তরে তো ভদ্র ঘরের পোলা বইলাই  ভাবতাম।”  নয়ন জিজ্ঞেস করল, “তা ভাবনাটা পাল্টালে কেন?”  উত্তর এল, “এত রাইতে কোন ভদ্রলোক রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে না। আর ঘুরতাছস একটা পাঁড় মাতালের লগে। লোকে দেখলে ভাববটা কি?নয়নের উত্তর দেওয়ার আগেই বিপ্লব গর্জে উঠল, “চোপ রাও,  পাগল কোথাকার। জানিস, এই এই  দিস বিপ্লব  রাতে পাহারা দেয় বলে এই পুরো এলাকায়  কোন চুরির কেস নেই।”একপাক ঘুরে পুরো এলাকাটা হাত দিয়ে দেখাতে গিয়ে দেহের ভারসাম্য হারিয়ে বিপ্লব মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।হাসতে হাসতে মন্টুদা বলল, “দেখ, কার লগে দাঁড়ায়ে ছিলিস একবার তাকায়ে দেখ। যা যা,   পাঁচজনে তরে এই অবস্থায় দেখার আগে বাড়ি গিয়া ঘুমায়ে পড়।”    এবার নয়ন মন্টুদাকে জিজ্ঞেস করল, “তা তুমি কি মনে করে রাত দুটোর সময় রাস্তায়  বেরিয়েছ?”--ফার্স্ট ট্রেন ধরুম।--সে তো সাড়ে চারটেয়, এখনো আড়াই ঘন্টা দেরী। স্টেশনে পৌঁছোতে তো দশ মিনিটও লাগবে না।--কইলকাতায় ইম্পরট্যান্ট কাম আসে, তাই হাতে একটু সময় রাইখ্যা  বাইর হইসি যাতে ট্রেন  মিস না হয়।--কোথায়? কি কাজ?--সব কি তোরে কইতে হইব না কি? আর কথা বাড়াইস না, বাড়ি গিয়া শুইয়া পড়।বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফার্স্ট ট্রেন ধরার জন্য মন্টুদা   হাঁটা দিল।    পাহারাদারেরা  এক আধবার সমাজ সেবার কাজেও লেগেছে। পাহারার গ্যাপে পাড়ার মাঝখানের মাচায় বসে   গল্প হচ্ছে, এমন সময় একজন প্রৌঢ়া ঊদভ্রান্তের মত ছুটতে ছুটতে এসে বললেন, “আমার স্বামীর শরীরটা হঠাৎ খুব  খারাপ হয়েছে। বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। নতুন ভাড়া এসেছি আশেপাশে কাউকে চিনি না, একটু আসবেন ভাই?  কয়েকজন দৌড়ে ওনার বাড়িতে গিয়ে দেখে ভদ্রলোক খুব কষ্ট পাচ্ছেন। অত রাতে ডাক্তার  পাওয়া সমস্যা। পরিচিত এক ডাক্তারকে প্রায় জোর করেই ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসা হল।   তিনি দেখে  বললেন, “মনে হচ্ছে হার্ট  অ্যাটাক হয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।”  অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে নয়ন দু একজনকে সাথে নিয়ে ভদ্রলোককে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাল।   সকালে ডাক্তারের সাথে দেখা করে রুগীর হাল হকিকত জেনে তারপর বাড়ি ফিরেছিল। তিন চার দিন রাতে জাগতে হয়েছিল। সেখানেও ওই পরিবারের ওরাই ভরসা।  প্রথম রাতে নয়ন আর রজত থাকবে ঠিক হল।  চৌধুরী পাড়ারই গৌতম বলে একটা ছেলে   থাকতে চাইল। গৌতম ছেলে খারাপ নয় তবে একটু ছিটেল প্রকৃতির। সেদিন যেহেতু দুজন থাকছে  তাই ওকে অন্যদিন থাকার কথা বলা হল, কিছুতেই শুনল না। ও আসলে নয়নের  চেলা, নয়ন থাকছে জানতে পেরেই ও ওদের পিছু নিল।  একটু রাত হতে নয়ন আর রজত একটা পাশে  চাদর বিছিয়ে শুল। গৌতম তখন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বালিশ ছাড়া ঘুমোবার অভ্যাস নেই, তাই ওরা একবার এপাশ একবার ওপাশ ফিরছে। কিছুক্ষণ পরে গৌতম একটা বালিশ এনে নয়নের মাথার নিচে দিয়ে  “হাবুদা, এবার একটু আরাম করে ঘুমোও” বলে আবার কোথায় চলে গেল। নয়ন স্বর্গ পেল। আরাম পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে   ঘুমিয়ে পড়ল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই কানের কাছে হঠাৎ “ও মশাই শুনছেন” ডাকে  ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখে সামনে একজন অচেনা লোক দাঁড়িয়ে। নয়ন চোখ খুলতে বলল,  “মরা মানুষের বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমচ্ছেন মশাই!” ঘুম মাথায় উঠল। বালিশটা  একেবারে নতুন, কোন রকম নোংরা লেগে নেই। “এইমাত্র একটা বডি বেরল। ওদেরই একজন এই বালিশ আর একটা চাদর ওইধারে ফেলে দিয়েছিল”, কথাগুলো বলে লোকটা চলে গেল। কতরকমের লোক থাকে। ঘুম চটকে তোর কি লাভ হল রে শালা! মড়ার বালিশ এটা না জানালে কি চলছিল না। একবার কানে যাওয়ার পর আর ওটা মাথায় দেওয়ার কোন প্রশ্নই নেই।   রাগে নয়নের  পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। আসুক ব্যাটা গৌতম। একটা মড়ার বালিশ মাথায় গুঁজে দিয়ে গেল। একটু বাদে গৌতমকে দেখতে পেয়ে স্টকে যা ছিল উজাড় করে গালমন্দ করল। সবটা হজম করে গৌতম বলল—কার বালিশ তাতো জানি না। নতুন বালিশ, দেওয়ালের ধারে রাখা ছিল, একটু আরাম করে ঘুমোতে পারবে বলে তোমার মাথার নিচে দিয়ে গেলাম। সময়ে ভর্তি হওয়ার ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ভদ্রলোক বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। প্রৌঢ় দম্পতীর কাছে নয়নরা পেয়েছিল প্রাণ ভরা আশীর্বাদ।   চলবে
    জীবন তরঙ্গ  পর্ব  ৩  - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ—পর্ব ৩ আড্ডায় তপন নামে একটি নতুন ছেলে একদিন যোগ দিল। ওর সাথে কোন সূত্রে  রজতের পরিচয় ছিল, ওই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। তপনের বাড়ি কৃষ্ণনগরে।  ও  মাসকয়েক আগে  কোলকাতায় চাকরি  পেয়েছে। কয়েক মাস বাড়ি থেকেই যাতায়াত করেছে। অত দূর  থেকে যাতায়াতে কষ্ট হয় বলে  এখানে বাড়ি ভাড়া করেছে। রজতই চৌধুরী পাড়ায় ওর বাড়ির  কাছাকাছি তপনের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।  তপন ছোট গ্রুপের অনেকের থেকেই বয়সে কিছুটা বড় ছিল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই  সকলের সাথে বন্ধুর মত মিশে গিয়েছিল। আড্ডাস্থল  থেকে একটু এগিয়ে একটা পুজো মন্ডপ আছে। ওখানে বেশ বড়সড় একটা জগদ্ধাত্রী পুজো হত। হত বলা ভুল হল, এখনো বেশ বড় করেই হয়। পিন্টু তখন কোলকাতা মাঠে বেশ নাম করেছে। খেলার সুবাদে অনেক কেউকেটার সাথে চেনাজানাও হয়েছে। পুজোটা আগে ছোট করে হত, পিন্টুর চেষ্টাতেই পুজোর  ওজন বাড়ে। ওর উদ্যোগেই পুজোর সময় বড় বড় শিল্পীরা এসে গান গেয়ে যেত। পুজোর সময় আর একটা বড় আকর্ষণ ছিল তুবড়ি প্রতিযোগিতা। মন্ডপের পাশেই একটা মাঠে ওই প্রতিযোগিতা হত। তুবড়ির উচ্চতা মাপার জন্য মোটা থেকে সরু অনেকগুলি বাঁশ পরপর বেঁধে মাঠের মাঝে পুঁতে চারিদিকে দড়ির টানা দিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড় করান হত। সেও ছিল একটা দেখার মত ব্যাপার। পুজোর কটা দিন ছোটদের আড্ডা বন্ধ। রজত, নয়ন, স্বরাজ, বাচ্চু, গালু, দোদো, শোভন, নিতাই সকলে লেগে পড়ত  পুজোর কাজে। এমনকি নতুন আসা তপনও অফিস ছুটি নিয়ে ওদের সাথে থাকত। স্বরাজ আর বাচ্চু অল্প বয়স থেকেই প্রেম করত। পুজোর দিনগুলোয় ওদের প্রণয়লীলা বন্ধ  রাখতে হত।  এর কয়েক বছর আগের কথা। পিন্টুর তখন সবে কোলকাতা মাঠে খেলছে। ছোট একটা ক্লাবে খেলে, তেমন নাম হয়নি। খাওয়ার ব্যাপারে পিন্টুর খুব নামডাক ছিল। মিষ্টি হলে তো কথাই নেই। একবার কাছেই একটা বাড়িতে মেয়ের বিয়ে। পিন্টু আর অরূপ বাড়ির হয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা  করতে যাবে। অরুপও ফুটবল খেলত। উপহার বাবদ মেয়ের হাতে দেওয়ার জন্য দুজনের বাড়ি থেকেই সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। তখন দুজনের কেউই চাকরি করে না। টাকার অঙ্কটা কম হলেও দুজন বেকার ছেলের কাছে তা অনেক। আরাম সে তিন চারটে সিনেমা দেখা হয়ে যাবে। খুব  স্বাভাবিক কারণেই উপহারের টাকাটা ওরা আত্মস্থ করার সিদ্ধান্ত নিল। বিয়ে বাড়িতে ঢুকে একটু এগোতেই  মেয়ের বাবার সাথে দেখা হল।  বিয়ে তখনো আরম্ভ হয়নি। মেয়ের বাবা অতিথিদের আপ্যায়ন করছিলেন। সন্তানতুল্য অরূপ আর পিন্টুর কাছেও মিঠে সূরে ওদের বাড়ির খবরাখবর নিলেন। এরপর আর সময় নষ্ট না করে ওরা খেতে বসে গেল। তখন আজকালকার মত এত কেত কায়দার আইটেম ছিল না, আর কি পাতে পড়তে চলেছে তা আগাম জানার জন্য কোন  মেনু কার্ডও ছিল না। ছোলার ডাল, আলুর দম আর বেগুন ভাজা দিয়ে বেশ কয়েকটা লুচি পেটে চালান করে দিয়ে ওরা আরো ক’টা   লুচি রেখে দিল মাংসের জন্য। পরিবেশন একটু এগোতেই বুঝতে পারল যে খাদ্য তালিকায় মাংসের ঠাঁই হয়নি।  আমিষ  হিসাবে পাতে পড়ল চারার থেকে একটু বড় পোনা মাছের টুকরো। ওই দিয়েই ওরা কাজ চালিয়ে নিয়ে বসে রইল মিষ্টির অপেক্ষায়। মিষ্টি আসছে, লাইন ধরে  ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। প্রথমে মাখা সন্দেশ তারপরে পান্তুয়া। পনের বিশটা ওদের কাছে কোন ব্যাপারই নয়। জুলজুল করে তাকিয়ে রইল মিষ্টির দিকে। মেয়ের বাবাও খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করতে করতে এগোচ্ছেন।  পিন্টুদের সামনে এসে থেমে গেলেন। উনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অরূপ বলল, “জেঠু খুব ভাল রান্না হয়েছে।”জেঠু মিষ্টি হেসে বলল--তাই!  ইতিমধ্যে মিষ্টি ওদের সামনে চলে এসেছে। পাতে পড়ার আগেই মেয়ের বাবা ইশারায় ওদের দুজনকে মিষ্টি দিতে নিষেধ করে দিলেন। যে ছেলে দুটো  মিষ্টি দিচ্ছিল তারা ওদের বন্ধুর মত,  কিন্তু কোন উপায় নেই। গৃহকর্তার নিষেধ তাই ওরা মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। পিন্টুরা বুঝতে পারল ওরা যে উপহার না দিয়েই খেতে বসেছে তা মেয়ের বাবা লক্ষ্য করেছে, সেই জন্যই এই সাজা। মনটা ভেঙে গেল। ওই বাড়ির সেজ ছেলে নিজে খেলাধুলা করত বলে পিন্টুদের ভালবাসত। পিন্টুদের যে মিষ্টি দেওয়া হয়নি সেটা ওর নজরে পড়েছে। খেয়ে ওঠার পর কনের ওই দাদা ওদের বাড়ির বাইরে একটু অপেক্ষা করতে বলল। একটু পরে গামছায় বেঁধে বেশ  খানিকটা মাখা সন্দেশ এনে ওদের দিয়ে বলল,  “আমাদের বাড়ির থেকে একটু দূরে গিয়ে খাস কিন্তু। এখানে বাবা দেখতে পেলে সমস্যা হবে।”ওরা মহানন্দে মিষ্টির পুঁটলি নিয়ে সোজা হাঁড়ি পুকুরের ঘাটে চলে এল। এখনকার মত তখন এত ঘন ঘন স্ট্রিট লাইট ছিল না। রাত হয়ে গেছে, জায়গাটা তখন বেশ অন্ধকার। চাতালে গামছাটা খুলে ওরা খাওয়া শুরু করল। অপরজন যদি বেশি খেয়ে নেয় এই আশংকায় দুজনেই যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণ নিয়ে এক একবারে মুখে ঢোকাচ্ছে। কথা বলার কোন অবকাশ নেই। দুগাল খাওয়ার পরেই পিন্টু হড়হড় করে বমি করে দিল। অরূপ ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল—কি হল রে?একটু সামলাবার পর পিন্টু বলল- অন্ধকারে বুঝতে পারিনি, সন্দেশের ভেতরে উচ্চিংড়ে ছিল, চিবিয়ে ফেলেছি।  নয়ন ছিল রজতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই কলেজের একই ইয়ারে পড়ে তবে কলেজ আলাদা। দুজনেই মা বাবার একমাত্র সন্তান। বন্ধুত্বের খাতিরেই সাঁতরা পাড়ায়   থাকলেও রজতদের চৌধুরী পাড়ার ডিফেন্স পার্টিতে নয়ন রজতের সাথে পাহারা দিত।ওদের পাহারার দলটি ছিল দশ বারো জনের। তাতে তরুণ, যুবক, প্রৌঢ়, সব বয়সের  লোকই ছিল। বয়সের ভিন্নতা থাকলেও একটা ব্যাপারে সকলের মানসিকতা অভিন্ন ছিল, তা হল এই কাজে ঘোরতর অনীহা। কাজে অনীহা থাকলে ফাঁকির প্রবণতাও বাড়ে। পাহারা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত সময় ছিল রাত বারোটা থেকে ভোর চারটে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে সকলে হাঁড়ি পুকুরের চাতালে এসে জড় হত।  প্রথম দু এক দিন বারোটার মধ্যেই সকলে এসে গেল। এরপর সময়টা পিছোতে পিছোতে সাড়ে বারোটা হয়ে গেল। ওদের মধ্যে লালটুদা একটু সিরিয়াস ছিল,  সময়ে চলে আসার চেষ্টা করত। ও একদিন সকলকে একটু আগে আসার জন্য বলতেই ওর বন্ধু স্বপনদা ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “দেখছিস তো রাস্তা ভর্তি লোক, চোর এত লোকের মাঝে কখনো রিস্ক নেবে না। লাস্ট ট্রেন না যাওয়া পর্যন্ত রাস্তায় লোক থাকে। তোর ইচ্ছে হয় তুই আগে এসে মশার কামড় খা, আমরা এই সময়েই আসব।” জনমত স্বপনদার  পক্ষেই গেল। আসা এবং যাওয়া দুই সময়েই বিলম্ব হওয়া কাম্য নয়। বাড়ি ফেরার সময়টা তাই প্রথমে চারটে থেকে তিনটে এবং কিছুদিন পরে আড়াইটে  হয়ে গিয়েছিল। কচিদার মতে  আড়াইটের পরে আর পাহারার তেমন একটা দরকার নেই কারণ, এরপর প্রায় সব বাড়িতেই   ঘুরে ফিরে কেউ না কেউ টয়লেটে যাবেই। বাড়িতে লোক জেগে  থাকলে ওদের কষ্ট করে রাস্তায় জেগে থাকার কোন অর্থ হয় না। একদিন ঘুরে ঘুরে পরখ করে দেখা গেল ঐ সময় অনেক বাড়িতেই বাথরুমের আলো জ্বলছে। ফলে সময়টা এগিয়ে আনার স্বপক্ষে কচিদার  যুক্তিটা ফেলে  দেওয়া যায় নি। এর মধ্যে আবার  একটা থেকে একটা পনের ছিল চা বিরতি। পাহারা দেওয়ার সময় খানিক ঘোরাঘুরির পর একটু করে বসে সকলে আড্ডা দিত। পুরো পাড়ায় দলের সকলে একসাথে বসে আড্ডা দেওয়ার মত তিনটে জায়গা ছিল। প্রথমটা স্টার্টিং পয়েন্ট হাঁড়ি পুকুরের চাতাল, দ্বিতীয়টা পাড়ার মাঝে ডিফেন্স পার্টির বসার জন্যেই তৈরি বাঁশের মাচা আর তৃতীয়টা রহড়া সংঘ ক্লাবের সামনে চওড়া সিমেন্টের বেঞ্চ। তবে কোনখানেই বেশিক্ষণ বসে থেকে গল্পগুজব হত না, একটু বসেই আবার চক্কর লাগান শুরু হত। চক্করটা যত না দায়িত্ববোধ থেকে তার থেকে অনেক বেশি মশার তাড়নায়। মশার জ্বালায় এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকার উপায় ছিল না। চলবে
  • ভাট...
    commentr2h | তো, অসুবিধে একেবারেই নেই। চমৎকার আইডিয়া, চমৎকার ইমেজারি, আমার কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য। তবে অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য না, সেইটা জানি। যাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য না, তাঁদের হিসেবের বাইরে রাখাটা বিপজ্জনক (পুণরাবৃত্তি করে ফেললাম)।
    commentkk | বিজেপির ভোটের বিজ্ঞাপন -- খুব ডিস্টার্বিং লাগছে। এই ধর্মীয় র‌্যামিফিকেশন যে আজকাল সব স্তরেই হচ্ছে জানি। চোখ বুজে থাকি তাও না। কিন্তু এইভাবে ভোটের প্রচারে? মানুষ কোথায় যাচ্ছে?
    commentr2h | আহা উস্কানী টুস্কানী কিছু না। আনন্দমঠের বড় এজেন্ডা যবনের বিরুদ্ধে লড়াই। আর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পৌত্তলিকতায় বারন আছে (আরও অন্যান্য ধর্মেও আছে, তবে সে হিসেবে গিয়ে কাজ নেই)। এই তো ব্যাপার। সবাই ভারতমাতার চরণে প্রণত হলে আমার কী, আমি অ্যাগনস্টিক লোক, বিমূর্ত ধারনার মূর্ত রূপ নিয়ে আমার কিছু আসে যায় না। প্রণাম ঠুকতেও আপত্তি নেই, দোল দুর্গোত্সবে তো আমি হামেশাই ঠাকুর নমো করে থাকি। কিন্তু সবাই প্রণত না, আর যারা প্রণত না, তাদের হিসেবের বাইরে বের করে দেওয়াটা বিপজ্জনক।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত