এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    কী আমাদের জাত আর ধর্মই বা কী! - প্রতিভা সরকার | এটি কোনো বইয়ের বিজ্ঞাপন নয়তথাকথিত নীচু জাতের নারীর সঙ্গে তথাকথিত উঁচু জাতের পুরুষের বিয়ে হলে তাদের সন্তানের জাত কী হবে সুপ্রিম কোর্টে এইরকম একটি কেস উঠেছিল(civil appeal no 654 of 2012, decided o January 18, 2012)সুপ্রিম কোর্টের অবজারভেশনের একটি অনুবাদ নীচে রইল।ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ যদি আদিবাসী এবং অ-আদিবাসীর মধ্যে হয়, তাহলে ধরে নেওয়া হয়, সন্তান পিতার কাস্টেই পরিচিত হবে।১ এই ধরে নেওয়াটা জোরদার হয়, যদি এইরকম বিয়েতে পুরুষটি উঁচু জাতের হয়। কিন্তু এই ধরে নেওয়া সিদ্ধান্ত হিসেবে কখনই অপরিবর্তনীয় নয়। এইরকম বিয়ের সন্তানের প্রমাণ করার স্বাধীনতা থাকবে যে সে শিডিউল কাস্ট/ ট্রাইবের মায়ের দ্বারা আজন্ম পোষিত হয়েছে। উঁচু জাতের পিতার সন্তান হয়ে সে জীবনে কোনো সুযোগ সুবিধেই পায়নি, উপরন্তু বঞ্চনা, অমর্যাদা, অপমান এবং বাধার সম্মুখীন হয়েছে, যেমনটি তার মায়ের কাস্টের লোকেরা হয়ে থাকে। তাছাড়াও সন্তানটি মায়ের কাস্টের লোকেদের দ্বারা তাদেরই একজন বলে বিবেচিত হয়েছে এবং সেই কাস্টের বাইরের লোকেরাও তার সম্বন্ধে একইরকম ভেবেছে।এই কেসে এপেল্যান্টের ট্রাইবাল সার্টিফিকেট কেড়ে নেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র সে ক্ষত্রিয় পিতার ঔরসজাত বলে।এই কারণে হাই কোর্টের এবং স্ক্রুটিনি কমিটির রায় যুক্তিযুক্ত নয়। এইজন্য স্ক্রুটিনি কমিটির কাছে দু পক্ষের প্রমাণ খতিয়ে দেখে নতুন সিদ্ধান্তের (fresh decision) জন্য কেসটি আবার পাঠানো হল।এক মেধাবী ছেলে, মাথায় ইঁট বয়ে, রাজমিস্ত্রির কাজ করে জেনেরাল কোটায় সুযোগ পেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছিল। মনুবাদী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বিরোধ বাঁধায় তাকে এবং আরও দুজনকে সাতমাস ধরে স্টাইপেন্ড বন্ধ করে রাখা হয়, যা ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। শুধু তাই নয়, হস্টেল থেকেও বিতাড়িত করা হয়েছিল তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছতলায় ধরনায় বসেছিল তারা অনেকদিন। কেউ ফিরেও দেখেনি।এত অপমান আর কষ্ট যে কারও জীবনকে অর্থহীন করে দেয়। মেধাবী ছেলেটি আত্মহত্যা করে। তার সুইসাইড নোট সবাই পড়েছে। যে হতে চেয়েছিল নক্ষত্রের সন্তান, তাকে হতে হয় অর্থহীন ভষ্ম। ছেলেটির মা ছিল দলিত সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র। সন্তানদের জন্ম দিয়েই খালাস ওবিসি পিতা তাকে ত্যাগ করে। ছেলেটির মা সিংগল মাদার হয়ে দলিত গ্রামে বাচ্চাটিকে বড় করে। জেলা প্রশাসন দলিতের সার্টিফিকেট দেয়। আজ আদালতের রায়ে বলা হচ্ছে ছেলেটি দলিত ছিল না। তখনকার ভিসি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সবাই বেকসুর খালাস! কংগ্রেস আমলে এই রায় বার হওয়া খুবই বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। দলিতরা বিরুদ্ধে চলে যাবে। কিন্তু এ মামলা আজকের নয়। সাত বছর ধরে চলেছে, কিন্তু রায় বেরোয়নি। আজ চার পাঁচমাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে গেল।২ রোহিত ভেমুলা নাকি দলিতই ছিল না। জাল সার্টিফিকেট যোগাড় করে সে পড়াশুনা করেছিল, তাই ভয়ে আত্মহত্যা করেছিল! সে যে জেনেরাল কোটায় সর্বত্র সুযোগ পেত, তার কাস্ট সার্টিফিকেটের দরকার পড়েনি, এটাও মহামান্য আদালত নিশ্চয়ই বিবেচনা করেছেন। তার মৃত্যুর আগে যেসব তার ওপর যেসব অত্যাচার হয়েছিল, (তখন কেউ কাস্টের কথাই তোলেনি) তাও বিবেচিত হয়েছে নিশ্চয়ই। যারা বলে দলিত না হলে দলিতদের নিয়ে লেখালেখি করা যাবে না, তাদের জয় হোক! বিচার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের জয় হোক!১ https://bit.ly/44yTUfN২ https://bit.ly/3QBdhz4
    সীমানা - ৪৬ - শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ছবি: সুনন্দ পাত্র ৪৬চেনা নজরুল, অচেনা নজরুলউনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের নতুন প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী বাংলা প্রদেশের প্রথম নির্বাচনের ফল নিয়ে নানা অঙ্ক নানা দর-কষাকষির পর কৃষক-প্রজা পার্টির ফজলুল হককে প্রধান মন্ত্রী, আর মুসলিম লীগের সেই সময়ের বাংলার নেতা সারাওয়র্দি-নাজিমউদ্দিনদের নানা মন্ত্রীত্বের পদ দিয়ে অবশেষে কৃষক-প্রজা পার্টি আর লীগের যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠিত হল সাঁইত্রিশের পয়লা এপ্রিল অল-ফূল্‌স্‌ ডে'র সন্ধ্যেবেলায়। প্রথম যে ছ'জন সর্বসম্মতিক্রমে মন্ত্রী হলেন, প্রধান মন্ত্রী ফজলুল হককে নিয়ে তাঁরা হলেন নলিনীরঞ্জন সরকার, স্যর নাজিমউদ্দিন, স্যর হবিবুল্লাহ্‌, স্যর বি-পি সিংহ আর ব্যারিস্টার সারাওয়র্দি। এরপর মুসলমানদের মধ্যে আরও দুজন আর হিন্দুদের তিনজন। নৌসের আলি আর সামসুদ্দিন মুসলমানদের, হিন্দুদের মধ্যে মহারাজ শ্রীশকুমার নন্দী, মুকুন্দবিহারী মল্লিক আর রায়কত। শ্যামাপ্রসাদ প্রায় মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছিলেন ছোটলাট অ্যাণ্ডারসন সাহেবের প্রভাবে, বাদ সাধলেন লীগের নেতারা। ঠারেঠোরে শ্যামাপ্রসাদের পিছনে হুমায়ুন কবিরদের সমর্থনের কথা ছোটলাট জানালেও পিছু হটলেন না নাজিমউদ্দিন-সারাওয়র্দিদের দল। অবশেষে মহারাজ শ্রীশকুমার নন্দীই হলেন কম্প্রোমাইজ চয়েস। আর জাত-ধর্মের দাঁড়িপাল্লাও দাঁড়াল যেমনটা অভিপ্রেত। রাজবংশীদের প্রতিনিধি রায়কত আর মুকুন্দবিহারী নমশূদ্রদের।সেই সাঁইত্রিশের এপ্রিলে সারা দেশের চটকল শ্রমিকরাও ধর্মঘট করল। বিপ্লবী সাম্যবাদী দল বা Revolutionary Communist Party (RCPI) সংগঠিত করলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই সৌম্যেন্দ্রনাথ যাঁর সঙ্গে কৃষ্ণনগর সম্মেলনে প্রথম পরিচয় নজরুলের। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের তিনি পৌত্র, নজরুলের তিনি কমরেড বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক পার্টিতে। ওই কৃষক-শ্রমিক পার্টিরই নজরুল পরিচালিত পত্রিকা লাঙলেই সৌম্যেন্দ্র-অনূদিত কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রথম প্রকাশিত হয়। আর ওই সাঁইত্রিশেই কিছুদিন আগে League against Fascism and War-এর সভাপতি হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। আন্দামান রাজবন্দীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলের জনসভাতেও যোগ দিয়েছেন তিনি।অথচ ঠিক সেই সময়টায় – এবং খানিকটা আগে থেকেই হয়তো – জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন রাজনীতিতেই নজরুলের কোন মতামত বা উৎসাহ নজরে পড়ে না। তার সময় কেটে যায় গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে, যে জায়গাটা তার অর্থস্বাচ্ছন্দ্যের উৎসভূমি! তখনো নজরুলের বিদ্রোহী কবি বা জাতীয় কবির পরিচয় মূলত তার কবিতার জোরে, কিন্তু কবিতা তার আর্থিক প্রয়োজনে তেমন কোন কাজে এসেছে কি? বিদ্রোহী শিরোনামে নজরুলের যে কবিতা – শুধুমাত্র একটি কবিতাই যা হাজারে হাজারে লাখে লাখে মানুষ পড়েছে নানা পত্র-পত্রিকায় পুনর্পুনর্মুদ্রণের সুযোগে – কবির কাছে তার অর্থমূল্য পৌঁচেছে কতটুকু? একটার পর একটা কাব্যগ্রন্থ বেআইনী ঘোষিত হয়েছে, খোলা বাজারের বাইরে হয়েছে তার মুদ্রণ – সে মুদ্রণ আইনী হোক বা বে-আইনীই – পুলিশের চোখের আড়ালে তার অভূতপূর্ব বিক্রিতে কোন অর্থলাভ তো হয়নি অন্তত কবির নিজের! বস্তুত, নজরুলের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর একটাও কি জীবিকা অর্জনে তাকে তেমন কিছু সাহায্য করতে পেরেছে? চালচুলো-জমিজায়গীর নজরুলের নেই একেবারেই, প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে খাদ্যবাসস্থানের সংস্থান কয়েকবছরের, আর নিম্নবর্গীয় ভারতীয় সৈনিকের যেটুকু বেতন বছর দু-তিন সে আয় করেছিল – এর বাইরে কোন অর্থসম্পদ নেই যে কবির, সে-আমলে যখন সৃষ্টিশীল রচনার অর্থমূল্য ছিল একেবারেই নগণ্য, তখন শুধুমাত্র লেখার জোরে তার জীবনধারণ সম্ভব ছিল কি? আমরা দেখেছি তার জীবনের প্রায় প্রথম ত্রিশ-বত্রিশ বছর কেটেছে কী নিদারুণ দারিদ্রে, কী অর্থকষ্টে, এবং দারিদ্রজাত কী শারীরিক অসুস্থতায়! এ-কথা তো ঠিকই, যে গ্রামোফোন কম্পানীর অর্থানুকূল্য নজরুলের পারিবারিক জীবনের মান অনেকটাই বদলিয়ে দিল! নিজের সৃষ্টিশীলতার দ্রুত রূপান্তর তখন সে ঘটিয়েছে নিশ্চিত অর্থপ্রাপ্তির শিল্পে। শ্যামাসঙ্গীত ইসলামি গান আর গজলের জনপ্রিয়তা তাকে অর্থ দিয়েছে। হতদরিদ্র নজরুলের তো অর্থের প্রয়োজন, প্রচুর অর্থের, এবং, এখন সে জানে প্রচুর অর্থ আয় করার উপায়টা তার প্রায় হাতের মুঠোয়! সে আয় করবে তার প্রতিভার বিনিময়ে, তাতে লজ্জা কোথায়!নজরুলের মনে পড়ে বিদ্রোহী কবিতা লেখার পরে আফজালের সঙ্গে তার বৌবাজারের ভীম নাগের দোকানে যাওয়ার দিনটা। কবিতাটা আফজাল ছাপাতে চেয়েছিল, সে বলেছিল, আপনাকে আজ মিষ্টি খাওয়াব, পেট ভরে। ভীম নাগের দোকানে বসেই সে কবিতাটা নকল করে দিয়েছিল আফজলকে। কাগজ কিনে এনেছিল আফজাল, নিজের ফাউন্টেন পেনটাও দিয়েছিল তাকে লেখবার জন্যে; কবিতাটা নকল করা হয়ে গেলে ফাউন্টেন পেনটা সে আর ফেরৎ নিতে চায়নি। নজরুল নেয়নি কিন্তু কলমটা, বলেছিল, তার মাথায় একটা বিশেষ আমেরিকান কলম আছে, সেটাই হবে তার প্রথম নিজস্ব কলম। অবাক হয়েছিল আফজাল, একটা দামী নাম করা আমেরিকান কলমের শখ যে নজরুলেরও থাকতে পারে, সে তা ভাবতেই পারে না। নজরুলকে সে ভীম নাগের দোকানে নিয়ে এসেছিল পেট ভরে সন্দেশ খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, এইমাত্র চোখের সামনে সেই পরম উপাদেয় দৈ-সন্দেশ সে শুধু পেট-ভরে নয়, আকণ্ঠ খেয়েছে! নিজের চোখে সেই দৃশ্য দেখার পর দ্ব্যর্থহীন ভাষা আর ভঙ্গিতে আফজাল প্রকাশও করে তার বিস্ময়: আপনার কি নামী দামী সবরকমের জিনিষেরই শখ আছে?নিশ্চয়ই, বলে নজরুল, বড়লোক হবার শখ আছে বৈকি। পাঁচিল-ঘেরা গেটওয়ালা বাড়ি, সামনে দারোয়ান, গ্যারেজে বিরাট বড় গাড়ি, এ সব শখ আছে তো। আপনি দেখবেন, এক দিন এ সবই হবে আমার।নজরুল। কাজি নজরুল ইসলাম। মাত্র কয়েকদিন আগেই যার কাছ থেকে মাত্র একশো টাকার বিনিময়ে তার প্রথম গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি অনায়াসেই কিনেছিল সে, সেই অপ্রস্তুত আফজল বলেই ফেলে, আপনাকে খুব ভালোভাবে চিনি, এরকম একটা অহঙ্কার আমার ছিল। আজ দেখছি চেনার অনেক বাকি আছে!আর আজ যখন সেই সমস্ত শখ নজরুলের সঙ্গীত-সৃষ্টির ক্ষমতায় এবং গ্রামোফোন কম্পানীর দৌলতে সহজেই আয়ত্ত, তখন ঠিক কোথায় থামতে হবে, সেই শখ মেটাবার জন্যে কত প্রিয় বস্তু আর অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, তার হিসেব করার আর প্রয়োজনও হয় না নজরুলের। সারাদিনের জন্যে বাড়ি থেকে নিয়ে-আসা খিলি খিলি পান আর কাপের-পর-কাপ শুধুমাত্র তরল চায়ের পুষ্টির উপর নির্ভর করে ক্লান্তিহীন সে রচনা করে চলে গানের পর গান; একই সঙ্গে সুরসংযোগ, আর চলে অনুজ গায়ক-যশপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রেকর্ডিঙের জন্যে তৈরি করে দেওয়া! মনের সূক্ষ্মকোন-একটা স্তরে মনের-মতো কাব্যরচনা করতে না-পারার অবদমিত বেদনাকে নীরব শাসনে রাতের পর রাতঘুমিয়ে-পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মাসিমা গিরিবালা, স্ত্রী প্রমীলা আর পালিতা কন্যা খুকুর সঙ্গে অর্থহীন তাস পেটাপিটিতেই কেটে যায় নজরুলের! জীবন ধারণের এই চক্রব্যূহ তৈরি করে নিয়েছে নজরুল স্বেচ্ছায়, সেখান থেকে মুক্তির কথা আর কি সে ভাবে?ভাবেই না বোধ হয়। অথবা হয়তো ভাবেও। তাই সুযোগ পেলেই সে নিজের অক্ষমতার কথায় ঘুরে ফিরে আসে বারবার। “...কোনো সাহিত্যিক উৎসবে আমার আমন্ত্রণ অপরাধ, হয়তো তার চেয়েও বেশি। কেননা আমি ধর্মভ্রষ্ট, সাহিত্য সমাজের পতিত। যখন সাদর আমন্ত্রণ আসে এই কবর থেকে উঠে ফেলে-আসা আনন্দ নিকেতনে ফিরে যাওয়ার, তখন খুব কষ্ট হয়, বড়ো বেদনা পাই। আমার মৃত সাহিত্যদেহকে যথেষ্টরও অধিক মাটি চাপা দিতে কসুর করিনি, তবু তাকে নিয়ে আমার বন্ধুরা টানাটানি করেন, কেউ কেউ দয়া করে আঘাতও করেন। উপায় নেই। মৃত লোক নাকি মিডিয়াম ছাড়া কথা বলতে পারে না। আজ যে কথা বলছি তা মিডিয়ামের মারফতই বলে মনে করবেন। অপরিমাণ শ্রদ্ধা নিয়ে সাহিত্যকে আমি বিসর্জন দিয়ে এসেছি। সেই বিসর্জনের ঘাটে এই প্রেতলোকচারীকে ডেকে যেন বেদনা না দেন, আজ বলবার অবকাশ পেয়ে বন্ধুদের কাছে সেই নিবেদন জানিয়ে রাখি।”এমনকি বুলবুলের মৃত্যুর পরও জীবনযাত্রার এই নতুন ছকটা – সকাল বেলাতেই রিহার্স্যাল রূমে হাজিরা দেওয়া, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা শুধুমাত্র কাপের পর কাপ চা আর খিলির পর খিলি পানের পুষ্টিতেই শরীরধারণ করে সঙ্গীতরচনা, সুরসংযোজন আর প্রশিক্ষণেই নিজেকে ব্যস্ত রেখে গভীর রাত পর্যন্ত – না, তাস খেলা আর নয় – এখন তার বদলে যুক্ত হয়েছে গুরুদেব বরদাচরণের নির্দেশে যোগাভ্যাস ও যোগসাধন – ছকটা কিন্তু বদলায়নি। যে যাই বলুন, লক্ষ্মীছাড়া উদ্দাম উদাসীন নজরুলের এখনকার জীবনযাত্রা কিন্তু বিবাহিত পারিবারিক জীবনের দাবির বিষয়ে সম্যক দায়িত্বপালনের একটা ছবিও ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে। বুলবুলের কনিষ্ঠ আরও দুটি – সব্যসাচী আর অনিরুদ্ধ – তার অবশিষ্ট এই দুটি পুত্রসন্তানকে মানুষ করে তোলবার দায় তো নজরুলের নিজেরই, সে তো তা অস্বীকার করেনি। আর এই দায় পালনে অর্থের ভূমিকা কি অস্বীকার করা যায়? এত কাজ তো তাদেরই জন্যে।গত কয়েক বছর ধরে যে বিষয়কে সে স্পষ্টতই অস্বীকার করে এসেছে – অন্তত স্বীকার করবার কোন প্রমাণকাগজে-কলমে রাখেনি সে – তা হল তার কৈশোর আর প্রথম-যৌবনের স্বঘোষিত আবেগ, যা কিছু আছে তার, দেশ আর জাতির জন্যে সবই বাজি রাখা। সেই যে উনিশশো উনত্রিশের ডিসেম্বরে তাকে জাতীয় কবি নামে সম্বর্ধিত করেছিলেন দেশের প্রধান প্রধান মানুষরা, সেই সময় সুভাষবাবু তার সম্বন্ধে বলেছিলেন, কবি নজরুল নিজে বন্দুক ঘাড়ে করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, কাজেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সব কথা লিখেছেন। এতেই বুঝা যায় যে নজরুল একটা জীবন্ত মানুষ। তিনি আরও বলেছিলেন, নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। এতেও বুঝা যায় যে, তিনি একটা জ্যান্ত মানুষ। সুভাষ বলেছিলেন, আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব – তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব। সুভাষ বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় নানা কবির রচিত জাতীয় সঙ্গীত শোনবার নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরুর মতো প্রাণ-মাতানো গান অন্য কোথাও শুনেছেন বলে মনে করতে পারেন না।কিন্তু, দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরুর মতো প্রাণ-মাতানো গান তার পরে আর একটাও লিখতে পারল না কেন নজরুল?নজরুলের মাঝে মাঝে কি মনে পড়ে সুভাষের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা? রবীন্দ্রনাথের ষষ্টীতম জন্মোৎসব সেদিন পালিত হচ্ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। প্রথম আলাপের কিছুক্ষণের মধ্যেই নজরুলকে সেদিন সুভাষ বাংলায় কংগ্রেস-প্রস্তাবিত দৈনিকের দায়িত্ব দিতে চাইল। শুধু তা-ই নয়, যখনই কথায় কথায় নজরুলের সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শোনে সুভাষ, তখনই তাকে কংগ্রেস ভলান্টিয়ার বাহিনীর একটা দায়িত্বও সে দিতে চায়। কিছুদিনের মধ্যেই নজরুলের কুমিল্লায় যাবার কথা, পবিত্রর মুখে সে কথা শুনে সুভাষ ভলান্টিয়ার বাহিনীর প্রস্তাবকে সেই সময়ের জন্যে মুলতুবী রেখে সতেরই নভেম্বর ব্রিটিশ যুবরাজের বোম্বাইয়ে পদার্পণের প্রতিবাদে দেশব্যাপী ধর্মঘটে কুমিল্লায় সাফল্যের দায়িত্ব নজরুলকে দিয়ে ওখানকার স্থানীয় কংগ্রেস নেতা বসন্ত মজুমদারকে চিঠিও লিখে দেয় একটা।কিন্তু বড়ই তাড়াতাড়ি ইতিহাস হয়ে গেল এইসব। উনতিরিশ সালে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-হেমন্ত সরকার-ফিলিপ স্প্রাট-আবদুল হালীমদের সঙ্গে বঙ্গীয় কৃষক লীগ স্থাপনের উদ্দেশে কুষ্ঠিয়ার সম্মেলনে তিন-চার দিনের জন্যে যোগ দেওয়া, সেখান থেকে ফিরে এসে হাওড়ায় শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিতে শ্রমিক বস্তিতে গান শোনাতে যাওয়া আরধাঙড়-মেথরদের সংগঠনে অংশ নেওয়াই নজরুলের শেষ সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। সে বছরেরই মার্চের শেষের দিকে মীরাট কম্যুনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত মুজফ্‌ফর গ্রেপ্তার হয়ে যায়। নজরুলের এতদিনের চলার পথটা ধীরে ধীরে এখানে এসে একটা গলিপথে শেষ হয়ে গেল। পানবাগান লেনের ভাড়া-বাড়িতে অনুজ-বন্ধু শান্তিপদ সিংহের সহায়তায় তখন তার বাস। বন্ধু নলিনী সরকারের যোগাযোগেই তখন গ্রামোফোন কম্পানীতে যাতায়াত-কাজকর্ম শুরু করেছে সে। সঙ্গীতই যে তার ভবিষ্যৎ, এ-কথা ততদিনে বুঝে গেছে নজরুল, পানবাগানের বাড়িতে তখন সে গ্রামোফোন কম্পানীর ট্রেইনার ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁ-য়ের নিয়মিত শাগরেদী করছে, খাঁ-সাহেবকে ওস্তাদ মেনে এই প্রিয়-শিষ্য ঠুংরি খেয়াল কাজরি শিখছে তাঁর কাছে।এই সময়ের পত্রপত্রিকায় নজরুল যে লেখে না তা নয়, কিন্তু যা সে লেখে মূলত সবই গান, যা দিনে দু-চারটে লিখতে সময়ই লাগে না তার। গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমের বাইরে সে যে কখনোই যায় না এমনও নয়। সারা বাংলার নানা জায়গা থেকে অনবরতই তার নিমন্ত্রণ আসে, বর্ষীয়ান সম্পাদক সওগাতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, নজরুলেরপ্রায়-অভিভাবকই তো তিনি, তিনি তো নানা আমন্ত্রণ-চিঠিপত্রের চাপে নজরুলের সেক্রেটারির দায়িত্বই নিয়ে নিয়েছেন প্রায়! যেখানে নজরুল যায়, সে শুধু গানই গায়, গান গাইতে গাইতে সময়ের ঠিক থাকে না, তবুও তার শ্রোতাদের চাওয়ার শেষ নেই!স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা আর কোন সভায় বলে না কবি, গান গায়। সারা ভারতের প্রায় সমস্ত প্রদেশে তখন পর্যন্ত যত কৃষক-শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথমটাই তো নজরুলের নিজের হাতে তৈরি, কৃষ্ণনগরের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময়। এবার সব প্রদেশের সংগঠন মিলিয়ে যে All India Workers and Peasants Party-র অধিবেশন হল কলকাতার অ্যালবার্ট হলে, তাতে তো নজরুল স্বাভাবিকভাবেই আমন্ত্রিত ছিল।আমন্ত্রিত 'বাঙালির কাজিদা' সেদিন কিন্তু সেখানে শুধু উদ্বোধন সঙ্গীতই গাইল। উদ্বোধন সঙ্গীত। ব্যস। আর-কিছু নয়।উনিশশো তিরিশের মে-মাসে মৃত্যু হল বুলবুলের। যে বাড়িতে এতদিন বাস করেছে নজরুল-পরিবার, সে বাড়ির সর্বত্র বুলবুলের স্মৃতি। সেখানে থাকা অসহ হয়ে পড়েছিল তাদের পক্ষে। তীব্র শোকে মুহ্যমান নজরুল প্রথমে বন্ধু নলিনী সরকারের গৃহে, পরে ওই অঞ্চলেই ঠিকানা-বদল করে আবার ফিরে গেল তার পুরোনো অভ্যাসে। সকাল থেকেই গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূম। এবার নলিনীর যোগাযোগে যোগগুরু বরদাচরণ মজুমদারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে সে, অতএব মাঝরাতে আর তাস নয়, এখন যোগাভ্যাস। এখনও ঘনঘন সারা বাংলা থেকে আমন্ত্রণ আসে নজরুলের। সে যায়, গানও গায় সে, এবং, ঠিক এই সময় থেকেই তার গানের সঙ্গে বোধ হয় আধ্যাত্মিকতা আর যোগের সূত্রে প্রাপ্ত নতুন এক রহস্যময়তাও শোনা যায় তার কণ্ঠে।এই রহস্যময়তাই কি নজরুলের নতুন অসুখ?আফজালুল হকের নতুন-কেনা লাইন-টানা কাগজে বিদ্রোহী কবিতা নকল করতে করতে কথায় কথায় তার কয়েকটা “শখ”-এর কথা নজরুল বলেছিল আফজালকে। বিশেষ কোন ব্র্যাণ্ডের একটা আমেরিকান ফাউন্টেন পেন ছাড়াও তারশখ-এর মধ্যে ছিল পাঁচিল-ঘেরা গেটওয়ালা একটা বড় বাড়ি, সামনে দারোয়ান, গ্যারেজে বিরাট বড় গাড়ি। দারোয়ান যে সে রেখেছিল একজন, সবাই জানে তা। বড় একটা ক্রাইসলার গাড়িও ছিল তার। বালিগঞ্জে জমি কিনেছিল নজরুল, ক্যাশ টাকার অভাব ছিল না তার গ্রামোফোন কম্পানীতে কপিরাইটের সূত্রে। অতএব অভিজাত এলাকায় পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি একটা তার নিশ্চয়ই হতে পারত। যে কলমটা সে নিয়মিত ব্যবহার করত তা ওই নির্দিষ্ট ব্র্যাণ্ডের আমেরিকান কলমই ছিল কিনা তা জানা যায় না, তবে সে যে প্রসাধনপ্রিয় ছিল, তার পালিতা কন্যার ভাষায় নিয়মিত স্নো-পাউডারের ব্যবহার এবং তাম্বুলচর্চাজনিত দন্তোষ্ঠকলঙ্ক নিবারণার্থে আমেরিকান মাউথওয়শও যে ব্যবহার করত সে, তা তো অনেকেই জানে। গত কয়েকবছরে অবিশ্যি যে-কথা সে একবারও উচ্চারণ করেনি, তা হল দেশ আর জাতিকে নিয়ে সেই সময় কী তার ভাবনা। এই দেশ এবং জাতিকে নিয়ে তার কী আবেগ, এক সময় নজরুল বারবার বুঝিয়েছে তা। এর পর গজল-গানের সাফল্যই তার জন্যে খুলে দিল গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমের দরজা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সন্ধান মিলে গেল তার; এবং সেই থেকে প্রায় ধর্মীয় গোঁড়ামির মতো অন্ধ-নিরুপায়তায় সে দেশ এবং জাতির বিষয়ে সবরকমের আলোচনা অনেক দিনের জন্যে এড়িয়ে গেছে।যখন বোঝা গেল, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থাগম হয়েছে, তখন নতুন করে হঠাৎ পুরোনো স্বাদেশিকতার ঝোঁক ফিরে এল তার। সে বহু অর্থ ব্যয় করল কলগীতির জন্যে। এত বিপুল অর্থব্যয় দেখে সঙ্কুচিত পিংলা তাকে জিজ্ঞেস করে, ধর, ব্যবসা তো, লোকসানই হল এতে, টাকাটা তোমার ডুবেই গেল, তখন কী করবে তুমি?ডুবে গেলে আবার আয় করব, গানের থেকেই আয় করে নেব আবার; সেটা কোন কথা নয়, বলেছিল নজরুল; কিন্তু, একটা কথা তোকে বুঝতে হবে, আমি তো ঠিক ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে যাব মনে করে এই ব্যবসাটায় নামছি না। এটা একটা আন্দোলন, আন্দোলনটা শুরু করতে চাইছি আমি। আর যথাসর্বস্বই যদি পণ না করি, তাহলে আমার কথা শুনবে কেন লোকে?এই যথাসর্বস্ব খোয়ানোর পরেও গ্রামোফোন রেকর্ডের কপিরাইটজনিত ক্রমবর্ধমান অর্থে আবার সে হয়তো ফিরিয়ে আনতে পারত তার পুরোনো আর্থিক অবস্থা – যা সে যথেষ্ট জোর দিয়ে বলেওছিল পিংলাকে – কিন্তু সবকিছু বদলিয়ে গেল প্রমীলার অসুস্থতায়। ক্যাশ প্রায় শেষ, গাড়ি ফেরৎ চলে গেছে, বরদাচরণের সলিসিটর-শিষ্য অসীমকুমার দত্তর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অতি দ্রুতগতিতে নজরুলের কপিরাইটের সমস্ত টাকা গিলে নিচ্ছে। অখ্যাত-অর্ধখ্যাত শিল্পী যশঃপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ বাবদ গ্রামোফোন কম্পানীর সামান্য মাসোহারা আর রেডিও কম্পানীর প্রোগ্রামভিত্তিক পারিশ্রমিক ছাড়া বস্তুত অর্থাগমের কোন রাস্তাই যখন নেই, তখন বোধ হয় আরেকবার বাইরের জগতের দিকে তাকিয়ে দেখল নজরুল। বরদাচরণের প্রভাবে ততদিনে দৃষ্টি অনেকটাই ঘোলাটে হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই সময়ের তোলপাড়-করা একটা ঘটনা ধীরে ধীরে তার চোখ খোলাতে শুরু করে। সুভাষবাবু য়্যোরোপ থেকে ফিরে এসেছেন সাঁইত্রিশে, তারপর বেশ কিছু দিন সরকার-জনতার টাগ-অব-ওয়রের পর অবশেষে মুক্তি মিলেছে তাঁর, এবং সেই বছরেই কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিশ্ব-জোড়া যুদ্ধের প্রস্তুতির মুখে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনোত্তর ভারতের গঠনমূলক প্রস্তুতির কাজ অতি বেগে শুরু করে দিয়েছেন সুভাষ। তাঁর প্রায়-অমানুষিক উদ্যম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নানা উদ্যোগ, বাম-ঘেঁসা সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের ধারণা আর ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় সরকারের তথাকথিত ফেডারেশনের কৌশলের প্রকাশ্য বিরোধীতা গান্ধীসহ দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসীদের কাছে সুভাষকে জাতিভ্রষ্ট – প্রায় অচ্ছুত – করে তুলল। আটত্রিশের সভাপতি সুভাষের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে অন্য কোন বামপন্থী নেতার অভাবে যখন দ্বিতীয়বার – উনচল্লিশেও – সুভাষ সভাপতির পদে নির্বাচিত হলেন, তখন কোনরকম লাজলজ্জার তোয়াক্কা না করে নির্বাচিত সুভাষের প্রকাশ্য বিরোধীতা শুরু করলেন মহাত্মা। দিব্যদৃষ্টিতে নয়, পাকিয়ে-ওঠা মহাযুদ্ধের পটভূমিতে ভারতের স্বাধীনতা আর যে বেশি দূরে নয় তা খোলা চোখে দেখতে পেয়ে এবং বুঝতে পেরে পদত্যাগী সুভাষ কংগ্রেস-সভাপতিত্ব ছেড়ে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ফিরে এসে প্রত্যক্ষ লড়াইতে প্রায় নেমে পড়লেন। সিরাজদ্দৌলা দিবস পালন এবং হলওয়েল মনুমেন্টের অপসারণের দাবি সুভাষের মাস্টারস্ট্রোক – একই দিনে ফরওয়র্ড ব্লকের হিন্দু কংগ্রেসী আর মুসলিম লীগের মুসলমান ছাত্রের দল হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ দিয়ে নেমে পড়ল লড়াইয়ে।এতদিন পর নজরুলের মনে পড়ে যায় বছর দশেক আগের এক শীতের দুপুরে রাজশাহিতে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মশায়ের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা। বোয়ালিয়া থানার লাগোয়া অক্ষয়কুমারের লোহার পিলার দেওয়া বাড়িতে নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হল। তখন বৃদ্ধ হয়েছেন মৈত্রেয় মশাই, সত্তর ছুঁই ছুঁই – অশক্ত শরীর। নজরুলের মনে আছে, প্রায়-তিরিশের যুবা নজরুলকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেছিলেন, আমরা অস্তমিত সূর্য, তুমি নতুন উদিত সূর্যের দীপ্তি নিয়ে এসেছ। আমি কল্পনা করিনি যে জীবনসায়াহ্নে তোমাকে এত কাছাকাছি কখনো পাব। প্রণাম করে নজরুল বলেছিল, যিনি অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন, যিনি সত্যকে সমাদৃত করতে পারেন তিনি মরতে পারেন না। দোয়া করুন আপনার চিন্তা ও চেতনাকে আমি যেন আমার কাব্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারি।সেই স্মৃতি তো ভুলতেই বসেছিল নজরুল। আজ সুভাষ নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন সে কথা। এবং সেই-কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে সুভাষের প্রস্তাবিত সিরাজদ্দৌলা দিবসের সমর্থনে মুসলিম লীগ-আকরম খাঁ-য়ের আজাদ পত্রিকায় বিবৃতি দিল। তার তখন আবার মনে পড়ে যায় সদ্য-যৌবনে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সে তার শৈশবের স্বপ্নের বিপ্লবের সন্ধানে মাষ্টারমশাই নিবারণচন্দ্র ঘটকের নির্দেশে ময়মনসিংহ হয়ে কুমিল্লায় পৌঁছিয়ে গান্ধীর আহ্বানে কী ভাবে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। সেই অসহযোগ আন্দোলন, যা ঘোষণা করবার আগে গান্ধী মাত্র এক বছরেই স্বাধীনতা এনে-দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এমনকি যুগান্তর-অনুশীলনের ছেলেদেরও তাঁর আন্দোলনে নিয়ে এসেছিলেন। অথচ চৌরিচৌরার একটা ঘটনাতেই এই বিশাল জননেতা একাই এতদিনের এতজনের এত কৃচ্ছসাধনকে তুচ্ছ করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা করে দিলেন! এবার অনেক অনেক বছর পর তেইশে ডিসেম্বর কলকাতার মুসলিম ইনস্টিট্যুট হল-এ ছাত্র-সমাবেশে নজরুলের বক্তৃতায় সেই স্মৃতি উচ্চারিত হল: “...জরার প্রধান ধর্ম হল – অতি সাবধানে পা টিপে টিপে বিচার করতে করতে চলা। এই অতি সাবধানীরা (ভীরু না-ই বললাম) অগ্রগমনের পথ পরিষ্কার না করে পশ্চাতে 'রিট্রিট' করার পথ উন্মুক্ত রাখতে চান। আগে-চলো-মারো-জোয়ান-হেঁইও বলে এগুতে এগুতে যেই এসে পড়ল চৌরিচৌরার দুটো খুনোখুনি, অমনি সেনাপতির কণ্ঠে ক্রন্দন ধ্বনিত হল – 'পিছু হটো, পিছু হটো।' গণ-ঐরাবতের পায়ে কাপাস-তুলো চরকাকাটা সুতোর পুঁটুলি বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও তার বিপুল আয়তনের জন্য দুটো চারটে লোক মারা গেল এইটাই সেনাপতির চোখে পড়ল – আর (ভারতের কথা ছেড়ে দিলাম) এই বাংলাদেশে যে কালাজ্বর আর ম্যালেরিয়ায় বছরে বছরে এগার লক্ষ করে লোক cold blooded murdered হচ্ছে সেদিকে একচক্ষু সেনাপতির দৃষ্টি পড়ল না।”উদ্দীপ্ত এই ভাষণের সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল নজরুলের নতুন অভ্যাসজাত রহস্যময়তাও: “মৃত্যুর ভয় যার হয়তো নিজের গেছে – কিন্তু অন্যের মৃত্যু দেখলে যার মৃত্যুযন্ত্রণা হয় ভয়ে কূর্ম-অবতার হয়ে যান – তিনি আর যাই করুন অমৃতসাগরের তীরে নিয়ে যাওয়ার সাধনা তাঁর নিষ্ফল হয়েছে। সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারের মধ্যে যিনি পরম নিত্যম, নিত্য পূর্ণম্‌ – তাঁকে যিনি উপলব্ধি করলেন না, তাঁর সংহারের রূপকে যিনি অস্বীকার করলেন, ভয়ের পশ্চাতে অভয়কে দেখলেন না, তিনি আর যাই পান – পূর্ণকে পাননি। তবু কাঠ পুড়ছে বলে, যে শুধু কাঠের ধ্বংসই দেখল, আগুনের সৃষ্টি দেখল না, তার দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন নয়। এঁর এক চোখে দৃষ্টি আছে আর বাকি যারা তারা একেবারে দৃষ্টিহীন অন্ধ। এঁরা হাতে বড়ো বড়ো মশাল জ্বেলে চলেছেন – কিন্তু অন্ধের হাতে মশাল যত না আলো দেয় তার চেয়ে ঘর পোড়ায় বেশি।”উনিশশো পঁয়ত্রিশের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সাঁইত্রিশের নির্বাচনের ফলে যখন হকসাহেবের প্রধানমন্ত্রীত্বে বাংলায় লীগ-হক মন্ত্রীসভার শাসন এল, বাংলার মুসলিম লীগ দলের পক্ষে সারা ভারতের নিরিখে সেই নির্বাচনের ফলই ছিল উজ্জ্বলতম, যদিও শুধুমাত্র নিজেদের বিজয়ী প্রার্থীদের জোরে মন্ত্রীসভা গঠনের মতো নয়। যে প্রদেশগুলোয় মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক বেশি নির্বাচিত হয়েছে, সেখানেও নির্বাচিত মুসলমানরা প্রায় সবাই জিতেছে কংগ্রেস-প্রার্থী হিসেবে, কংগ্রেসের টিকিটে; মুসলিম লীগ বা অন্য কোন মুসলিম সংগঠনের প্রার্থী হিসেবে নয়। কংগ্রেস আর হকসাহেবের কৃষকপ্রজা দলের মিলিত মন্ত্রীসভা গঠনের জোর গুজব তখন চলছিল বাজারে, শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস পিছিয়ে যাওয়ায়লীগ-হকের সমন্বয়।এমন অবস্থায়, মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌কে যদি সারা ভারতের প্রধানতম মুসলিম নেতা হয়ে উঠতেই হয়, তাহলে যে চার প্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যাই প্রধান – বাংলা, পঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত – পুরোপুরি সেই চার প্রদেশই না হোক, অন্তত বাংলা আর পঞ্জাবে জিন্নাহ্‌র প্রধান নেতা হয়ে ওঠা বড়ই প্রয়োজন। অথচ বাঙালি-মুসলমান-প্রধান বাংলায় সেই সময় একচ্ছত্র মুসলিম নেতা তো ফজলুল হক, আর সেই নেতৃত্ব তো দুয়েকদিনে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক শেষ হবার পর, সেই উনিশশো বত্রিশ সালে, বিলেতেই থেকে গিয়েছিলেন জিন্নাহ্‌ সাহেব, নতুন করে একটা পোলিটিকাল কেরিয়ার তৈরি করতে চাইছিলেন তিনি বিলেতে, চেষ্টা করে দেখছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টেই কোন আসন পাওয়া যায় কিনা।আর ফজলুল হক? পটুয়াখালির বড় জমিদার এবং প্রতিষ্ঠিত উকিলের তিনি পুত্র, কলকাতার শিক্ষিত সমাজে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব এবং পরিচয়। প্রেসিডেন্সিতে বিজ্ঞান পড়েছেন চার বছর, স্যর পি-সি রায়ের তিনি প্রিয় ছাত্র, কেমিস্ট্রির সঙ্গে সঙ্গে স্যরের মতো শেক্‌স্‌পীয়রও আবৃত্তি করতে পারেন অবিরাম, স্যর আশুতোষের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন হাই কোর্টে। বাংলা বলেন বরিশালের ভাষায় আর টানে, ইংরিজি আই-সি-এসদের মতো। আর সেই উনিশশো বত্রিশেই মুসলিম জমিদার, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আর কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের নিয়ে শুধুই নিখিল বঙ্গ মুসলিম সম্মিলনই করলেন না হকসাহেব, বৃহত্তর কলকাতা আর আশপাশের জেলাগুলোয় হরেকরকমের মুসলিম-প্রধান পেশায় নিযুক্ত যারা – দর্জি, কসাই, জাহাজের লশকর, ছোট-বড় দোকানদার – সবাইকে নিয়ে নিয়মিত মীটিং করতে লাগলেন। এর আগে দু'দফায় তিনি নবযুগ দৈনিক চালিয়েছেন, প্রথম দফায় তাঁর মূল সহযোগী ছিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ আর নজরুল, দ্বিতীয় দফায় মুজফ্‌ফর না-থাকলেও নজরুল তো তখনও ছিলেন কিছুদিন। কাজেই নানাসূত্রে বহুরকম মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। স্পষ্টতই স্বতন্ত্রভাবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আসন তৈরি করে যখন খানিকটা জমি ছাড়তে প্রস্তুত ব্রিটিশরাজ, তখন হকসাহেবই বাঙালি মুসলমানদের প্রথম জানালেন, এই প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে কিছু মর্যাদা তাদের প্রাপ্য। আর প্রাপ্য ঘোষণা করলেই কোন প্রাপ্তি যে হবে না, তা-ও স্পষ্ট করলেন হকসাহেব; আদায় করে নিতে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে। তেত্রিশ সালের অক্টোবরের বার তারিখে স্টেট্‌স্‌ম্যান-এ হকসাহেব লিখলেন, যে কোন বিচারকের সামনে যদি আমি প্রমাণ না-করতে পারি যে বাঙালি হিন্দুরা হল মূর্তিমান সাম্প্রদায়িকতা আর তার ভিত হল এই হিন্দুদের চূড়ান্ত স্বার্থপরতা – তাহলে আমি ফাঁসি যেতেও রাজি আছি।বহুদিন কংগ্রেসের সভ্যও ছিলেন হকসাহেব, আর মুসলিম লীগেরও তো বটেই। অর্থাৎ সে-সময়ের মুসলিম-রাজনীতিতে হকসাহেবকে এড়িয়ে যাওয়া চলতই না। এমনকি অত বড় যে কট্টর লীগপন্থী ব্যারিস্টার সারাওয়র্দি, তাঁকেও বাংলায় নেতৃত্বের সুযোগ তো হাতে-ধরে করে দিয়েছিলেন হকসাহেবই। মেদনীপুরের বাঙালি হলে কী হয়, বাংলা তো বলতেই পারতেন না সারাওয়র্দি সাহেব, অন্তত প্রকাশ্যে বলতেন না কখনও। সেই সারাওয়র্দিকে কলকাতায় খিদিরপুর ডকের বাঙালি লশকরদের ইউনিয়নের কাজে প্রায় হাতে-ধরে বসিয়ে দিয়েছিলেন হকসাহেব। আলিপুর কোর্টের উকিল মহম্মদ দাউদ তখন তার আদালতের যোগাযোগের জোরে কলকাতায় ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের বড় পাণ্ডা, অকংগ্রেসী অখিলাফতি দাউদ হকসাহেবেরও চেলা। ডক অঞ্চলের নানা বস্তিতে নতুন-গজিয়ে-ওঠা একদল দুষ্কৃতির দাপটে তখন কলকাতায়-নতুন-আসা জাহাজী লশকরদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ওকালতি ক্ষমতার জোরে এই দুষ্কৃতিদের শায়েস্তা করেছে দাউদ। এখন সে জাহাজ-শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করায় ব্যস্ত, ট্রামের শ্রমিকদেরও সে জোট বাঁধতে শেখাচ্ছে। হকসাহেবের অনুরোধে সারাওয়র্দিকেও ডক-অঞ্চলে জায়গা করে দিল দাউদ।ফলত একরকমের বাধ্যই হন অল-ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌ ফজলুল হককে সব সময়ই সামনে, অর্থাৎ নেতার আসনে, রাখতে। চল্লিশ সালের চব্বিশে মার্চ ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে মুসলিম লীগের সম্মেলনে প্রস্তাব দেওয়ানো হল হকসাহেবকে দিয়ে, আর আঠাশে মার্চ তাঁরই সরকারের তৈরি কলকাতা ম্যুনিসিপাল আইন (সংশোধন)-এর আওতায় ভোট হল কর্পোরেশনের। এই ভোটের সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস (সুভাষপন্থী)-র সঙ্গে সমঝোতা হল মুসলিম লীগের!আবার চল্লিশের ডিসেম্বরের প্রথম দিনেই, ১-লা ডিসেম্বর, ভেঙে গেল হক-লীগ মন্ত্রীসভা। ৪-ঠা ডিসেম্বর, ১৯৪০, হকসাহেব নতুন-করে-তৈরি-হওয়া প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির নেতা হিসেবে নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের দাবি জানান, যার দাবিদারদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদও আছেন, আবার আছেন সুভাষপন্থীরাও! অনেক টালবাহানা করে ব্যাপারটাকে ঠেকিয়ে রাখলেন ছোটলাটসাহেব হার্বার্ট যতদিন পর্যন্ত না লীগের নেতারা কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারেন। মুশকিলটা হচ্ছে, সুভাষবাবুর সমর্থনে আবার এদিকে কর্পোরেশনে রাজত্ব চালাচ্ছে লীগ!ব্যাপারটা যখন এরকমই, তারই মধ্যে মাঝে-মাঝেই লীগের নেতৃত্ব এমন একটা অবস্থা তৈরি করে যে সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে যায়, তখন নতুন একটা মতলব আসে হকসাহেবের মাথায়। মুসলিম-প্রধান বাংলায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুরাই বেশি, কিন্তু জনসংখ্যায় প্রধান মুসলমানরাই। এ-অবস্থায় মাথা-ঠাণ্ডা রেখে মুসলমানদের প্রাপ্য অধিকারের ব্যাপারটা সংখ্যালঘু হিন্দুদের যতদূর সম্ভব অসন্তুষ্ট না-করেও সামলাতে হলে, সূক্ষ্ম কূটনীতির প্রয়োগ প্রয়োজন।হকসাহেব লক্ষ্য করেছেন, সবরকমের পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যেও মুসলিম লীগ – বিশেষত ওই মুসলিম লীগের বাঙালি তরুণ নেতাকর্মীরা – সুভাষের বিশেষ অনুরাগী। এই তরুণ দলের উপর নজরুলের প্রভাবও যে কতটা তা-ও হকসাহেব জানেন ভালোমতই। নিজের নেতৃত্ব আর ভাবমূর্তি বজায় রাখবার জন্যে একটা খবরের কাগজের কথা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন হকসাহেব। নজরুলের কথা মাথায় আসবার পর আর একটু গভীর চিন্তা করেন তিনি। নজরুল নিজে প্রায় কট্টর সুভাষপন্থী। সুভাষের অত্যাশ্চর্য বেপরোয়া নিষ্ক্রমণের পর যখন বিড্‌ন্‌ স্কোয়্যারে সুভাষ দিবস পালন করল সুভাষপন্থী কংগ্রেস, অর্থাৎ ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা, সেই সময় সুভাষের নিজের পরিবারের ভয়-পেয়ে-যাওয়া সদস্যরা অনুপস্থিত থাকলেও অসুস্থ শরীর নিয়েও নজরুল কিন্তু এসেছিলেন সেই সুভাষ দিবস পালন করতে। হকসাহেব নিজেও সুভাষকে পছন্দই করেন, সে তো তাঁর কলেজের প্রাক্তনীও!হক সাহেব শুনেছেন, আর্থিকভাবে আজকাল একটু অসুবিধের মধ্যেই আছে নজরুল। হিন্দু-মুসলমান – বিশেষ করে দুই সম্প্রদায়েরই তরুণরা, তরুণরা অন্তত – তার বিশেষ অনুরক্ত। প্রধান সম্পাদক হিসেবে নজরুলের পরিচালনায় একটা কাগজ নিজের হাতে থাকলে জনসাধারণের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগটাও থাকে। আর নজরুল তো তাঁর পুরোনো বন্ধু। এর আগে – যত কম সময়ের জন্যেই হোক – দু-দুবার নবযুগ চালিয়েছেন তিনি। দুবারই নজরুল তাঁর সঙ্গে ছিল, যদিও কাগজে পরিচালক হিসেবে তাঁর নামই থাকত। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। আবার তিনি নবযুগ বের করবেন। এবার আর এক-পাতার কাগজ নয়। বাজারের আর-পাঁচটা কাগজের মতোই কাগজ হবে এবার। কাগজে-কলমেও প্রধান সম্পাদক এবার হবে কাজি নজরুল ইসলাম।দেরি করেন না হকসাহেব। উনিশশো একচল্লিশের অক্টোবরে নতুন করে প্রকাশিত হল দৈনিক নবযুগ, প্রধান সম্পাদক কাজি নজরুল ইসলাম। বেতন সাড়ে তিনশো টাকা, রেডিও আর গ্রামোফোন কম্পানীর কাজও প্রয়োজন মত চালিয়ে যাবার অনুমতিও দেওয়া হল তাকে।প্রথম দিন অফিসে এসেই একটা পোস্টকার্ডে পিংলাকে চিঠি লিখতে বসে নজরুল, “ভাই পিংলা, শেষ যেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলি, রোজ রোজ যত পারি বাংলা কবিতা লিখতে বলে গিয়েছিলি তুই। লেখা হয়নি, আর তোর উপদেশ মতো রেডিওতে কবিতার আসরের জন্যে দরবারও করা হয়নি। আজ থেকে হকসাহেবের নতুন দৈনিক নবযুগে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলুম। মনে করিস না সেই টার্ণার স্ট্রীটের দোতলা বাড়ির একতলার একটা ছোট্ট অংশে গোটা কয়েক চেয়ার-টেবিল-টুল-আলমারির অফিস। লোয়ার সার্কুলার রোডে শেয়ালদা স্টেশনের কাছাকাছি একটা বড়সড়ো গোটা বাড়ি যোগাড় করেছেন হকসাহেব। হক সাহেবকে বলে দিয়েছি, প্রত্যেক দিনই এই কাগজে আমার একটা কবিতা বেরোবে, যেদিন অন্য কবিতার মূড আসবে না সেদিন কোন একটা সম্পাদকীয় লিখব কবিতায়; বেশ হবে, না? এখানে বেশ গোছানো সম্পাদকীয় দপ্তর, মনে হচ্ছে কাজ করে আরাম পাব। তবে একটাই দুশ্চিন্তা, হকসাহেব কাজের স্বাধীনতা কতটা দেবেন। আমার মনে হয়, আমার সঙ্গে মুসলিম লীগের যুবকদের আর ছাত্র লীগের নেতাদের যে সম্পর্ক তারই জোরে এই চাকরিটা পেলুম, খোয়াতে কতদিন লাগবে জানিনা।শ্যামপুরে তোর কাজ তো ভালোই এগোচ্ছে খবর পেলুম। ভাবছিস, খবরটা পেলুম কোথা থেকে? তুই তো জানিসই, আমাকে যিনি খবর দেবেন তিনি দুনিয়ার সব খবরই রাখেন, আমার সঙ্গে তো তাঁর বন্ধুত্ব। আমার বন্ধু অবিশ্যি তোর সঙ্গেও বন্ধুত্ব করতে ব্যগ্র, কিন্তু কতদিনে তাঁর ডাক তুই শুনতে পাবি তা তো জানি না। যেদিন পাবি তার অপেক্ষায় আছি। ভালো থাকিস। –কাজিদাচিঠিটা প্রথমেই দুবার পড়ে ফেলল পিংলা, তারপর শেষ প্যারাগ্রাফটা বেশ কয়েকবার। ঘটনাটা কী যে ঘটছে কাজিদার মনে, বুঝতে পারে না সে। চিঠিটা পড়ে মন খারাপই হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চিঠি লিখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না সে। কাজিদাকে সে বলেনি, কিন্তু এখনও এধার-ওধার কাজিদার যেসব কবিতা-টবিতা ছাপা হয়, সুধাকান্তদাদার সহযোগিতায় সেগুলো পড়ে সে, যত পড়ে ততই মন খারাপ হয় তার। অগ্রনায়ক নামে তার সাম্প্রতিক একটা কবিতা তাকে দিয়েছিলেন সুধাকান্তদাদা, এ-কবিতা পড়ে কি সেই কাজিদাকে চেনা যায়? কোথায় সেই 'বিদ্রোহী' কবি, সেই যার কলম থেকে বেরত নতুন পথের যাত্রা পথিক             চালাও অভিযান উচ্চকণ্ঠে উচ্চার আজ              'মানুষ মহীয়ান।' চার দিকে আজ ভীরুর মেলা,         খেলবি কে আয় নতুন খেলা, জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা          বাইবি কি উজান? পাতাল ফেড়ে চলবি মাতাল          স্বর্গে দিবি টান। আঁধার ঘোরে আত্মঘাতী              যাত্রাপথিক সব এ উহারে হানছে আঘাত              করছে কলরব। অভিযানের বীর সেনাদল             জ্বালাও মশাল চল্‌ আগে চল্‌ কুচকাওয়াজের বাজাও মাদল          গাও প্রভাতের গান। ঊষার দ্বারে পৌঁছে গাবি              'জয় নব উত্থান।'?অথচ আজকের অগ্রনায়কের কবি লিখছে, অন্তরে যদি বিপ্লব নাহি আসে বৈশাখী ঝড় আসে নাকো ভৈরব-প্রলয়োল্লাসে। বক্তৃতা দিয়া মিছিল করিয়া ধুলি উড়াইয়া ভাবি: তুফান উঠেছে, এবার মিটিবে যত বিপ্লবী দাবি। বাঁকা তলোয়ার বাঁকা চোখে হাসে তেমনি পথের বাঁকে।... মৃত্যুশঙ্কা আসিলেই সব ডঙ্কা থামিয়া যায়; মুখের কথায় লঙ্কাকাণ্ড সকলে করিতে চায়। ****** সে-ই আল্লার শক্তি লভিয়া নিত্য শক্তিমান তারি মুখ দিয়া উদ্‌গত হয় আল্লার ফরমান। অন্তরে তার বহে দুরন্ত সদা বিপ্লব-ঝড়; বাহিরে থাকে সে শান্ত, করিয়া আল্লাতে নির্ভর। তিনিই ইমাম তিনিই অগ্রনায়ক সারথি তিনি জাগাইয়া ভূমিকম্প পাষাণে চেতনা জাগান যিনি। সর্বযুদ্ধে জয়ী হন ইনি আল্লার শক্তিতে এঁর সৈন্যরা সমবেত হয় প্রেম আর ভক্তিতে।নিজেকেই সান্ত্বনা দেয় পিংলা, এ হয়তো একটা সাময়িক অবস্থা, গত কয়েকবছর ধরে কাজিদার জীবনে তো কমঝড়-ঝাপটা গেল না! তবুও বুলবুলের মৃত্যুটাও সামলিয়ে নিয়েছিল সে, কিন্তু একই সঙ্গে বৌদির এমন একটা অসুখ, আর এমন আর্থিক অবস্থা! সব-কিছু কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে গেল। যা-ই হোক, নতুন চাকরিটা হয়ে ভালোই হয়েছে মনে হয়। রেডিও আর গ্রামোফোনের কাজও চলতে পারে – চাকরির এই শর্তটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক; আশা করা যায় কিছুদিনের মধ্যে আবার পুরনো কাজিদাকে ফিরে পাওয়া যাবে।চাকরিটা ভালোই, কিন্তু যে ব্যাপারটা আগে ভাবেইনি নজরুল তা হল, নবযুগকে কেন্দ্র করে যে আড্ডাটা গড়ে উঠেছিল প্রথমবারের নবযুগের সময়, সে আড্ডাটা তো এখানে নেই। কাজেই, বাইরে থেকে যতই বেশ গোছানো বলে মনে হোক দপ্তরটাকে, সেখানে মন লাগাতে সময় তো খানিকটা লাগবেই। অবিশ্যি নতুন নতুন যাদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে তারা সবাই কাজিদাকে পেয়ে খুশি। কাজিদার খ্যাতি এবং গত পনের-ষোল বছর ধরে সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীতের জগতে তার নানারকমের কাজ আর সাফল্যের কথা তো জানেই সবাই, তার সঙ্গে কাজ করতে পাওয়ার সুযোগ অনেকের কাছেই একটা অভাবনীয় পাওনা বলেই মনে হয়। তবুও আকুল হয়ে বন্ধুদেরই যেন ডাকে নজরুল: কবি ও শিল্পী হওয়া এই দেশে দুর্ভাগ্যের কথা, বেনে মাড়োয়ারি-ভুক্ত এদেশে বাঁচে না মাধবীলতা। জানি সংবাদপত্রের যারা মালিক তাহারা বেনে, অর্থের লোভে তারাই এ বিদ্বেষ আনিয়াছে টেনে।তাহাদেরই মেনে চলতে হবে কি? ঐ রাক্ষুসে লোভেদেশের জাতির অকল্যাণের কারণ হব কি সবে?...******পলাতক ছিনু ধরিয়া এনেছে নবযুগ পুনঃ মোরেতোমরা না এলে নবযুগ পুনঃ আসিবে কেমন করে?...আনন্দধাম বাংলায় কেন ভূত প্রেত এসে নাচে?দেশী পরদেশী ভূতেরা ভেবেছে বাঙালি মরিয়া আছে! এ ভূত তাড়াব; পাষাণ নাড়াব, চেতনা জাগাব সেথা,ভায়ের বক্ষে কাঁদিবে আবার এক জননীর ব্যথা।তোমরা বন্ধু কেহ অগ্রজ অনুজ সোদরসমপ্রার্থনা করি ভাঙিয়া দিও না মিলনের সেতু মম। এই সেতু আমি বাঁধিব আমার সারা জীবনের সাধ,বন্ধুরা এসো ভেঙে দিব যত বিদেশীর বাঁধা বাঁধ।এই কবিতার আহ্বানেও খুব বেশি পুরোন বন্ধু নবযুগে আড্ডা জমাতে এল না। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই কোন-কিছুই তো ফাঁকা থাকতে পারে না, এই সময় নজরুলের যারা প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াল, তাদের মধ্যে একজন হল নবযুগের সেই-সময়কার সহকারী সম্পাদক পূর্বতন বিপ্লবী অমলেন্দু দাশগুপ্ত। নজরুলের ঘনিষ্ঠ-সান্নিধ্যে অমলেন্দুও তখন একজন যোগশিক্ষার্থী। এ-ছাড়া ওই নবযুগেরই ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি আর কালীপদ গুহ। কালীপদ গুহর সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয় বহরমপুরের জেলে। সেই সময় নজরুলের লেখা একটা উচ্চকিত-কণ্ঠ কবিতা জেলখানার এক গার্ডের কাছে লুকোতে গিয়ে গোটা কাগজটাই নিমেষে গিলে ফেলেছিল কালীপদ। আজ এতদিন পর তার সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভারি খুশি নজরুল। এ ছাড়াও, নজরুলেরই প্রায় সমবয়েসী জুলফিকার হায়দার এবং তার স্ত্রী রাবেয়ার সঙ্গেও নজরুলের খুবই ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে সেই সময়ে। জুলফিকারও নজরুলের মতই স্কুলের শেষ পরীক্ষা না-দিয়ে যুদ্ধে চলে যায় উনিশশো সতেরয়। সেনাদলের প্রশিক্ষণের জন্যে নজরুলকে যেতে হয়েছিল পেশোয়ারে, আর জুলফিকার গিয়েছিল বোম্বাই। যুদ্ধ শেষ হলে ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জী কম্পানীতে জুলফিকার চাকরি করতে ঢোকে, আর সেই সুবাদে পৃথিবীর অনেক দেশেই যাবার সুযোগ হয়েছিল তার। কবিতাও লিখত জুলফিকার, সেই কবিতায় নজরুলের প্রভাব কম ছিল না।ধীরে ধীরে নবযুগে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল নজরুল। সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নানা খবরের পরিবেশন এবং বিশ্লেষণ ছাড়াও নতুন নতুন উৎসাহী পাঠক তৈরিতে বেশ খানিকটা সফল হল সে। মননে, বয়েসে, শিক্ষায়, পেশায়, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর পাঠকদের জন্যে তৈরি হল নির্দিষ্ট আলাদা-আলাদা বিভাগ। প্রতিদিনের কাগজের অষ্টম পৃষ্ঠা এই বিশেষ বিভাগগুলোর জন্যে নির্দিষ্ট। সোমবার ছোটদের পাতা, প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিল খোশরোজের মেলা, পরিচালনায় আতশবাজ। বেশিদিন এ-নাম ভালো লাগল না কবির নিজেরই, নাম বদলিয়ে করা হল “আগুনের ফুলকি,” সভ্যদের বলা হত ফুলকি, সঙ্গে থাকত সংখ্যা। অর্থাৎ যে-সব ছেলেমেয়েরা “আগুনের ফুলকি”র সভ্য হত, তাদের পরিচয় ফুলকি ১, ফুলকি ২ ইত্যাদি। নতুন নাম ঘোষণা করা হল নতুন কবিতার সঙ্গে; কবিতার নাম আগুনের ফুলকি ছুটে, লেখক কাজি নজরুল ইসলাম: আগুনের ফুলকি ছুটে       ফুলকি ছুটে! আগুনের ফুলকি ফুটে       নবযুগ-পত্রপুটে আগুনের ফুল কি ফুটে? ইত্যাদি।মঙ্গলবার মহিলাদের জন্যে নির্দিষ্ট বিভাগ, “মহিলা আসর,” পরিচালিকা শিরী।বুধে “লাঙ্গল ও হাতুড়ি,” শ্রমজীবীদের আসর, পরিচালক শ্রমসুন্দর।বৃহস্পতিবার “ব্যবসা ও বাণিজ্য,” পরিচালক সওদাগর।শুক্কুর বারে “বিশ্ব মুসলিম,” পরিচালক এব্‌নে খল্‌দুন।শনিবারে মঞ্চ ও ছায়াছবির জগৎ নিয়ে বিশেষ বিভাগ “রূপ ও ছন্দ,” সম্পাদক রূপকার।আর, অষ্টম পৃষ্ঠায় প্রতি রবিবার সাহিত্যবাসর “রসের জলসা।” স্বয়ং নজরুল ইসলাম যে পত্রিকার সম্পাদক, তাতে কি আর সাহিত্যবাসরে আলাদা করে কোন সম্পাদক লাগে?পয়লা ডিসেম্বর বিরাট খবর নবযুগে, আকর্ষক হেডলাইন: হক মন্ত্রিসভার পদত্যাগ: বাঙ্গলার মন্ত্রি-সঙ্কটের অনিবার্য্য পরিণতি/ সোমবার দ্বি-প্রহরে লাট-ভবন হইতে ইশ্‌তাহার/ গভর্ণরের সিদ্ধান্তসাপেক্ষে মন্ত্রিদিগকে স্ব স্ব কর্তব্য পালনের নির্দেশ/ বাঙ্গলার নূতন মন্ত্রিসভা গঠন সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা/ প্রগ্রেসিভ এ্যাসেম্বলী পার্টির সেক্রেটারীর বিবৃতি।এর পরের দিন স্পষ্টতই হক সাহেবের সমর্থনে সম্পাদকীয়। দায়ী কে? – এই শিরোনামে বেশ দীর্ঘ এই সম্পাদকীয়, তারই কয়েকটা লাইন: “......মন্ত্রিসভার যে কলহ বাধিয়াছিল, তার জন্যও হক সাহেব দায়ী ন'ন, এবং পরিণামে হক মন্ত্রিসভার যে পদত্যাগ করিতে হইল, তার জন্যও হক সাহেব দায়ী ন'ন। মন্ত্রিসভায় কলহ বাধিল কেন? যে-কোয়ালিশন চার বছর ধরিয়া ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণভাবে হক-মন্ত্রিসভার প্রত্যেক মন্ত্রীকে সমর্থন করিয়া আসিয়াছিলেন, সেই কোয়ালিশনের একটা বিরাট দল, যে-কোন কারণেই হোক, বলিলেন যে, অমুক মন্ত্রীর প্রতি তাঁদের আস্থা নাই, তিনি মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব সুষ্ঠুরূপে পালন করিতে পারিতেছেন না; কাজেই তিনি পদত্যাগ করুন। ভদ্রলোক যদি মন্ত্রিত্বের গদি কামড়াইয়া পড়িয়া না থাকিতেন, তিনি যদি কোয়ালিশনের ঐ বিরাট অংশের মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাইয়া মন্ত্রিত্বের লোভ ত্যাগ করিতেন, তবে পরের দিনই কোয়ালিশন দলের ঐক্য ও মুসলিম-সংহতি কায়েম হইয়া যাইত।“স্বার্থত্যাগ করিয়া মুসলিম সংহতি রক্ষার দরুণ উক্ত পদত্যাগী মন্ত্রী মুসলিম জনগণের চোখে ঊর্দ্ধে উঠিয়া যাইতেন। মুসলিম বাঙ্‌লার সামনে একটা ত্যাগের আদর্শও স্থাপিত হইত।“কিন্তু তিনি এই সব কিছুই করিলেন না। “মুসলিম সংহতি চুলায় যাউক, আমার মন্ত্রিত্ব থাকিলেই হইল” বলিয়া তিনি ছিনা-জোঁকের মত মন্ত্রীত্বের গদিতে মরণ-কামড় মারিয়া পড়িয়া থাকিলেন। অথচ হক সাহেব প্রধান মন্ত্রী হিসাবে কোয়ালিশনের লিডার হিসাবে ও গণনেতা হিসাবে কোয়ালিশনের ৪৭ জন সদস্যের সমবেত অভিমত উপেক্ষাও করিতে পারিলেন না। তিনিও, কাজেই, উক্ত মন্ত্রীকে পদত্যাগের জন্য প্রথমে অনুরোধ ও অবশেষে আদেশ করিলেন...।“...তাই দল বাঁধিয়া তাঁরা পদত্যাগ করিলেন। এতেই হক মন্ত্রিসভার পতন হইল।” এবং এই সম্পাদকীয়র শেষে নজরুলের 'আল্লা পরম প্রিয়তম মোর' শিরোনামে নাতিক্ষুদ্র এক কবিতা! এবং এটাই এখন নজরুলের সিগনেচার-ছাপ!আসলে, সাম্প্রতিক মুসলিম রাজনীতি ঠিকঠাক বুঝতে পারে না নজরুল। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি রক্ষার ব্যাপারে দেশবন্ধু, এবং তাঁর অকালমৃত্যুর পর সুভাষবাবু, যে উদারতার সঙ্গে সম্প্রদায়গত বিভেদের মোকাবিলা করবার চেষ্টা করেছেন, এমনটা আর কেউ করেছেন বলে নজরুলের জানা নেই। ছাব্বিশ সালের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময় নজরুল কৃষ্ণনগরে। সে বছর সে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির সভ্যও নির্বাচিত হয়েছিল। এই সম্মেলনের তিন বছর আগে চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ পার্টির নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জের অধিবেশনে যে হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট অনুমোদিত হয়েছিল, ছাব্বিশের সম্মেলনে, যখন চিত্তরঞ্জন আর নেই আর সুভাষ জেলবন্দী, তখন 'কংগ্রেস কর্মীসঙ্ঘ' নাম দিয়ে কংগ্রেসের এক শক্তিশালী উপদল প্যাক্ট ভেঙে দেবার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছিল কৃষ্ণনগরে। ওই প্যাক্ট আর তখন বাঁচিয়ে রাখার কোন উপায়ই ছিল না; দেখেশুনে নজরুল মজা করেই লিখেছিল বদ্‌না-গাড়ুতে গলাগলি করে, নব প্যাক্টের আশনাই, মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই!জল অনেকটা গড়িয়ে উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের নতুন প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী যখন সাঁইত্রিশে বিভিন্ন রাজ্যে প্রাদেশিক নির্বাচন হয় – জওহরলাল নেহ্‌রু যখন কংগ্রেস-সভাপতি – সেই নির্বাচনে, শুধুমাত্র শিডিউল্‌ড্‌ কাস্ট হিন্দুই নয়, মুসলমানদের জন্যেও সংরক্ষিত আসন থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস আশাতীত ভালো ফল করে। এমনকি নির্বাচিত মুসলমানদেরও একটা বড় অংশ – মুসলিম লীগ নয় – কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে জয়লাভ করে। সেই সময় জওহরলাল মন্তব্য করেন, ভারতের ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে পক্ষ কেবলমাত্র দুটিই, কংগ্রেস আর ব্রিটেন, অন্য কোন তৃতীয় পক্ষই নেই! জিন্নাহ্‌, সেই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, সারা ভারতে মুসলিম জনসংযোগ শুরু করলেন উলেমাদের সাহায্য নিয়ে। এর আগেই আলিগড় য়্যুনিভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষকদের একটা আন্দোলন তৈরি হচ্ছিল – সেটা অবিশ্যি অভিজাত মুসলমানদের আন্দোলন, একটু এলিটিস্ট। সাধারণ মুসলমানদের এড়িয়েই চলত তারা! কিন্তু উলেমাদের যোগদানের পর সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও খানিকটা অস্পষ্ট একটা মুসলিম নেশনহূডের ধারণা তৈরি হতে শুরু করল। উনিশশো উনচল্লিশের মধ্যেই মুসলিম লীগের সভ্যসংখ্যা ছাড়িয়ে গেল তিরিশ লক্ষ!উনচল্লিশে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিটিশরাজ ভারতের হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে অনেকেই, যেমন জওহরলাল, রাজাগোপালাচারি, মৌলানা আজাদ ইত্যাদি, আদর্শগত ভাবে এই যুদ্ধে ব্রিটেনেরই সমর্থক ছিলেন, কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে এমনকি পরামর্শও না-করে তাদেরই হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করার প্রতিবাদে কংগ্রেস সমস্ত মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করল। এই সুযোগ, নেহ্‌রুর 'কোন তৃতীয় পক্ষই নেই'-এর জবাব দিয়ে দিলেন জিন্নাহ্‌, এই আপৎকালীন অবস্থায় আমরা সরকারের পক্ষে আছি। তিনপক্ষের এক পক্ষ আমরা! ওয়ান আপন থ্রী! এখন কোন বিষয়ে আলোচনা-সিদ্ধান্ত আমাদের বাদ দিয়ে করা চলবে না; কংগ্রেসের বড়দাগিরি আমরা মানি না, আমরা কংগ্রেসের পদত্যাগে ডেলিভারেন্স ডে পালন করছি, মুক্তি দিবস!বাংলার প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব কখনো কখনো লীগ, কখনো তিনি কৃষক-প্রজা, কিছুদিন পর অবিশ্যি লীগে তাঁর সভ্যপদও কেড়ে নেবেন জিন্নাহ্‌, কিন্তু পরের কথা পরে! সে সময় বাংলায় মুসলিম লীগ প্রধানত অবাঙালি মুসলিমদের দল: আর তাই যদি হয়, তাহলে কোন্‌ নেশনভুক্ত বাঙালি মুসলমানরা? বাঙালি নেশন না মুসলিম নেশন?এই নেশনহূডের তোলপাড় যখন চলছে, তখন নজরুল রাজনীতি বা শাসন ব্যবস্থা তো নয়ই – এমনকি কবিতা নিয়েই বা কতটুকু মাথা ঘামায়? সে তখন হয়তো নভোচারী – মহাকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত কোন কল্পিত মধুর তিয়াস তার তখন!অনেক দিন আগে, করাচি থেকে কলকাতায় এসে নজরুল যখন নবযুগে কাজ করতে গিয়েছিল, তখন তো নবযুগ ছিল মুজফ্‌ফর আর তাদের নিজেদের আদর্শ প্রচারের মাধ্যম। দেশের ব্যাপারে, মানুষের ব্যাপারে, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদের একটা অস্ত্র। ফজলুল হক সাহেব তো নিজেই একটা পত্রিকা প্রকাশ করে ওদের সেখানে কাজ করতে ডাকেননি, তখন প্রয়োজনটা ছিল ওদের নিজেদেরই। ওরাই হক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে, নিজেদের যোগ্যতার বিষয়ে তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্বাস উৎপাদন করিয়ে তাঁকে দিয়ে নবযুগ চালু করালো। মাসিক বেতন কতো পাবে হক সাহেবের থেকে, তা নিয়ে মাথাই ঘামায়নি ওরা। যে-লেখা নজরুল তখন লিখেছে সেই নবযুগে, তা পড়ার জন্যে কলকাতার রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত মানুষ, হকার আসতে-না-আসতেই সব পত্রিকা বেমালুম ফাঁকা।আজ সাড়ে তিনশো টাকা বেতনের চাকর নজরুল সম্পাদকীয় লেখে মূলত হক সাহেবকে সন্তুষ্ট করার জন্যে। তার মানে এই নয় যে যা সে লেখে, সে নিজেই তাতে বিশ্বাস করে না। তার নিজের মনে হয় দেশের এবং মুসলমানের স্বার্থরক্ষার জন্যেই হক সাহেব কাজ করছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে লীগ যা বলছে তা শুনলে কেমন যেন সবকিছু ঘুলিয়ে যায় তার। তাই মাঝে-মাঝেই আল্লাহ্‌ বা ঈশ্বরের প্রশস্তি করে কবিতা লেখে নজরুল। যদি সে ভুল করে থাকে কোথাও, আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ্‌ তো ভালবাসেন নজরুলকে!উনচল্লিশের এই যুদ্ধ এতদিন চলছিল য়্যোরোপে, খানিকটা উত্তর আফ্রিকায়। এবার এশিয়ায় এমন যুদ্ধে নেমে পড়ল জাপান যে তোলপাড় হয়ে গেল সারা পৃথিবীতে। সাতুই ডিসেম্বর জাপান শুধুই যে ঘোষিতভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ঢুকে পড়লতা-ই নয়, সরাসরি আক্রমণ করে বসল আমেরিকার বন্দর ও সেনাবাস, পার্ল হার্বার। পনেরই ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ব্রিটিশ রাজশক্তির জাপানের কাছে আত্মসমর্পণ, পলায়ন বর্মা থেকে, আর সিঙ্গাপুরের পতন!সুভাষের সেই জানুয়ারি মাসের নিষ্ক্রমণের পর তাঁর আর কোন খবর নেই সাধারণ ভারতবাসীর কাছে। সুভাষ কোথায়? – কেউ জানে না। কলকাতায় জোর গুজব, সুভাষের বদলে এবার শরৎ বোসকেই গ্রেপ্তার করবে ব্রিটিশ সরকার। পয়লা ডিসেম্বরে লীগ-হক মন্ত্রীসভার পতনের খবর তো বেরিয়েই গেছে নবযুগে। তারপর প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পার্টির নেতা হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করে মন্ত্রীসভা গঠন করার প্রস্তাবও হক সাহেব দিয়েছেন ছোটলাট হার্বার্টকে। হার্বার্ট সাহেব – সম্ভবত লীগের নেতাদের পরামর্শেই – টালবাহানা করেই চলেছেন। এমন সময় হঠাৎ দিল্লী থেকে ভাইসরয় লিনলিদগোর জরুরি বার্তা আসে ছোটলাটের কাছে: এই মুহূর্তেই হককে মন্ত্রীসভা গঠন করতে বল। জাপানের থাপ্পড় ব্রিটেনের গালে লাগবার পর বর্মা-সিঙ্গাপুর থেকে দলে দলে উদ্বাস্তুরা আসবে এবার। জেনে রেখ, জন্মগতভাবে যারা ভারতীয় এবং বর্মী, পবিত্র ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিষয়ে কোনই আবেগ নেই তাদের। খুব সম্ভবত এদের মধ্যেই মিশে থাকবে পঞ্চম বাহিনীও। অনেকেই এরা বর্মার জঙ্গল পেরিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতিদের এলাকার মধ্যে দিয়ে মূল ভারতে আসবার চেষ্টা করবে। এখন আমাদের অস্ত্র হবে পোড়ামাটি নীতি; নৌকো-জাহাজ-সাইকেল-গাড়ি সব ধ্বংস করতে হবে, ধ্বংস করতে হবে যাবতীয় খাদ্যশস্য। কাজেই তোমার প্রয়োজন এখন একটা মন্ত্রীসভা, সেই মন্ত্রীসভাকে কাজে লাগিয়েই করা যাবেএ-সব। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর নয়, পারলে আজই মন্ত্রীসভা চাই!ছোটলাটের কাছ থেকে জরুরি খবর পেয়ে হক সাহেব আসেন। মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান পেয়ে তিন জনের নাম লিখে তিনি তৎক্ষণাৎ সাহেবের কাছে দেন: তাঁর নিজের নাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, এ-ছাড়া শ্যামাপ্রসাদ আর শরৎ বোস।শরৎ বোস? – আতঙ্ক ছোটলাটের গলায়। ওকে অ্যারেস্ট করার জন্যেই তো এত তাড়াতাড়ি! ও তো জাপানের গুপ্তচর। এক কাজ করুন, ছোটলাট বলেন, আপাতত আপনি একাই শপথ নিন, ওকে অ্যারেস্ট করুন, বাকি কাজ তারপর।হকসাহেব রাজি হলেন না, ফিরে গেলেন তিনি। ফিরে আসবার আগে সাহেবকে বললেন, ওই অ্যারেস্টের কাজটুকু আপনি নিজে করিয়ে, তারপর আমায় খবর দেবেন। তারপর মন্ত্রীসভা!শেষ পর্যন্ত এগারই ডিসেম্বর হকসাহেবের নেতৃত্বে প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পার্টির মন্ত্রীসভা – যা পরে শ্যামাহক মন্ত্রীসভা নামে পরিচিত হয়েছিল – শপথ নেয়। সেদিনই সকালে ঊডবার্ণ পার্কের বাড়ি থেকে শরৎকে ভারত রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, পাঠিয়ে দেয় দক্ষিণ ভারতে। (নিষ্ক্রমণের পর যখন সারা ভারতবর্ষ সুভাষের হালহকিকত নিয়ে চিন্তিত, সেই সময় কিছুদিনের মধ্যেই শরতের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে ফেলেন সুভাষ। একচল্লিশের ৩১শে মার্চ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে ভগৎ রাম নামে একজন কলকাতায় শরতের পুত্র শিশিরের সঙ্গে দেখা করে সুভাষের চিঠি এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে যায়। শান্তিময় গাঙ্গুলি নামে একজন বিপ্লবীর সঙ্গে ভগৎ রামের যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয় সেই দিনই। পরে অবিশ্যি নানা কারণে এই যোগাযোগ ছিন্ন করতে হয়।সুভাষ সেই সময় বার্লিনে ছিলেন। কলকাতার জাপানী দূতাবাস এবং টোকিওকে কাজে লাগিয়ে শরতের সঙ্গে সুভাষের যোগাযোগের ব্যবস্থা হয়। কলকাতার জাপানী কনসাল-জেনারাল কাতসুও ওকাজাকিকে গাড়ি চালিয়ে রিষড়ায় ওঁদের বাগান-বাড়িতে নিয়ে আসতেন শিশির, এভাবেই থাকত যোগাযোগ। ওকাজাকি বদলি হয়ে যাবার পর ওতা নামের আরেকজন আসেন তাঁর জায়গায়। ওতার স্ত্রী শাড়ি পরতে ভালোবাসতেন। এই শাড়ি-পরিহিতা স্ত্রীকে নিয়ে ওতাও বহুবার শিশিরের গাড়িতে রিষড়ায় এসেছেন। শাড়ি-পরা জাপানী মহিলা, সকলের তো চোখে পড়বেই! পুলিশও নিশ্চয়ই জানত এই সব ব্যাপার-স্যাপার, হয়তো চেষ্টাও করত কিছু-একটা করবার, কিন্তু প্রমাণের অভাবে করা যেত না কিছুই। কিন্তু একেবারেই অকস্মাৎ বার্লিনে জাপানের রাজদূতকে পাঠানো শরৎ-সুভাষের উনিশশো একচল্লিশের পয়লা সেপ্টেম্বরের কোন বার্তার উল্লেখ-করা জাপান-বিদেশ-মন্ত্রীর একটা টেলিগ্রাম ব্রিটিশ গোয়েন্দারা – যাকে বলে ইন্টারসেপ্ট – তা-ই করে ফেলে। এই টেলিগ্রাম সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখে পৌঁছোয় একেবারে চার্চিলের টেবিলে! হাতে-নাতে প্রমাণ, অতএব সেই পাঁচুই সেপ্টেম্বর থেকে যে-কোনদিনই শরৎকে গ্রেপ্তার করা চলত!)শরতের গ্রেপ্তার, এশিয়ায় জাপানের হাতে ব্রিটেনের উত্তমমধ্যম, উত্তর-পূর্ব ভারতে পোড়ামাটি নীতি প্রয়োগের পরিকল্পনা, রকমারি এইসব বিষয়ে খানিকটা যখন পর্যুদস্ত ব্রিটেন ফেব্রুয়ারির গোড়ায় তখন আর এক এশীয় দেশ – জাপান-আক্রান্ত চীন সরকারের! – প্রধানকে ভারত পরিদর্শনে ভারতস্থ ব্রিটিশ সরকার আহ্বান করেন। সস্ত্রীক মার্শাল চিয়াংকাইশেককে সংবর্ধনা দেওয়া হয় কলকাতায়। এই উপলক্ষে গ্রামোফোন কম্পানী নজরুলকে তাঁদের সম্বর্ধনার উপযুক্ত কোন গান লিখে সুরসংযোগ করবার দায়িত্ব দেয়। ইনিয়ে বিনিয়ে চীন-ভারত-ব্রিটেনের সখ্য নিয়ে গান গাইবেন নজরুল, এ-ই বোধ হয় ধারণা ছিল গ্রামোফোন কম্পানীর। তার বদলে নজরুল লিখলেন: চীন ও ভারতে মিলেছি আবার মোরা শত কোটি লোকচীন ভারতের জয় হোকঐক্যের জয় হোক সাম্যের জয় হোক।ধরার অর্ধ নরনারী মোরা রহি এই দুই দেশেকেন আমাদের এত দুর্ভোগ নিত্য দৈন্য ক্লেশে,সহিব না আর এই অবিচার খুলিয়াছি আজ চোখ।। প্রাচীন চীনের প্রাচীর ও মহাভারতের হিমালয়এই কথা যেন কয়মোরা সভ্যতা শিখায়েছি পৃথিবীরেইহা কি সত্য নয়?হইব সর্বজয়ী আমরাই সর্বহারার দলসুন্দর হবে, শান্তি লভিবে নিপীড়িত ধরাতল।আমরা আনিব অভেদ ধর্ম নব বেদগাথা শ্লোক।। আর গ্রামোফোন কম্পানীতে নজরুলের পরিচিতি তো নতুন নয়, কয়েকজন নতুন শিল্পীকে শিখিয়ে-পড়িয়ে তাদের গাওয়া এই গান অতি দ্রুত রেকর্ডও করিয়ে দিলেন নজরুল।এবং, গ্রামোফোন কম্পানীর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক শেষ হল এই ভাবেই!শরতের গ্রেপ্তারের পাঁচ মাস পর, উনিশশো বিয়াল্লিশের উনিশে ফেব্রুয়ারি, সুভাষের নিষ্ক্রমণের পর এই প্রথম অপ্রস্তুত ভারতবাসী শুনল সুভাষের কণ্ঠস্বর, রেডিওয়: সুভাষ বলছি – This is Subhas Chandra Bose speaking to you over the Azad Hind (Free India) Radio!সারা ভারতের রাস্তাঘাটে, অফিসেবন্দরে, বাসেট্রেইনে, স্কুলেকলেজে, সেদিন একজনকে নিয়েই আলোচনা আর উত্তেজনা: সুভাষচন্দ্র। নবযুগের সম্পাদকীয় অফিসেও যে একই উত্তেজনা তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নানা আলোচনায় যে যে-খবর বেরিয়ে এল তার সারাংশ করলে দাঁড়ায় এইরকম: সুভাষ তাঁর পূর্বপরিচয় বদলিয়ে নামে এবং বেশে মহম্মদ জিয়াউদ্দীন হিসেবে কলকাতা ছেড়ে প্রথমে পেশোয়ার, তারপর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ছাড়িয়ে কাবুল হয়ে নানা জায়গা এবং বহু বিঘ্ন অতিক্রম করে অবশেষে ওর্লাণ্ডো মাজোতা ছদ্মনামে ইতালিয় পাসপোর্টের সাহায্যে য়্যোরোপ পৌঁছোন। প্রধানত ইতালি এবং জর্মনিতে এইসব দেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে, বিশেষ করে মুসোলিনির সহায়তায়,ভারতীয়-জন্মের ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দীদের একত্র করে ইণ্ডিয়ান লীজিয়ন বা ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠনের কাজে তিনি আপাতত নিযুক্ত আছেন। য়্যোরোপে পৌঁছবার পর আজই প্রথম ওর্লাণ্ডো মাজোতা তাঁর ছদ্মনামের বদলে নিজেকে সুভাষ নামে পরিচয় দিলেন।আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে সুভাষ বলেন, জাপানের হাতে সিঙ্গাপুরের পতন স্পষ্টতই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ধ্বংস সূচিত করছে। অস্তমান ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অর্থই হল উদীয়মান স্বাধীন ভারতবর্ষ, ভারতের ইতিহাসে নবসূর্যোদয়। এবং এখান থেকেই শুরু হতে চলেছে এশিয়া তথা সমস্ত পৃথিবীর স্বাধীন মানুষ এবং মনুষ্যত্বের জয়যাত্রা। সুভাষ আরও বলেন, স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর দায়িত্ব এখন আরও বেড়ে গেল।উনিশে ফেব্রুয়ারিতে সুভাষের এই বক্তৃতা সব ভারতবাসীর মতো নজরুলের মনেও প্রবল উত্তেজনা তৈরি করে। সাধারণত যে-সময় সে অফিস যায় এখন সেই সময়টা এগিয়ে আসে, এবং অফিস থেকে বেরোবার সময়ও যায় পিছিয়ে।আড্ডা-আলোচনা – সবই যেন এখন এই একটাই বিষয়কে কেন্দ্র করে। গান্ধী ভারত-ছাড় ডাক তখনও দিতে পারেননি, কংগ্রেসে নানারকমের তর্ক-বিতর্ক চলছে; কে যেন সেদিন বলল, গান্ধী এখন বলছেন, উনচল্লিশে সুভাষের বক্তব্য তিনি নিজে ঠিক বুঝতে পারেননি। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিবর্তিত অবস্থা স্পষ্টই দেখিয়ে দিচ্ছে সুভাষের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি অনেকের, এমনকি তাঁর নিজের চেয়েও, অনেক তীক্ষ্ণ। যদিও খানিকটা দেরি হয়ে গেছে, এখন তিনি আর অপেক্ষা করতে রাজি ন'ন। এখনই ইংরেজকে তাড়ানো দরকার। তাড়াতেই হবে। গান্ধীর গলার সুর শুনে কেউ কেউ এমনটাও বলল যে, হিংসা-অহিংসা এখন আর গান্ধীর কাছে তেমন কিছু বড় ব্যাপার নয়!আজকাল বাড়ি ফেরার পরও নজরুল উত্তেজনা প্রায় ধরে রাখতে পারে না। গত কয়েকদিন রাতে তার যোগাভ্যাসেও ঠিকমতো মনোনিবেশ করতে পারছিল না সে। অফিসে এসেও কাজে মন লাগে না।যোগাভ্যাসে অনিয়ম হলে কেমন যেন শরীর খারাপ লাগে নজরুলের। সুভাষবাবুর বক্তৃতা শোনা গেল এখন থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে। তার পর থেকে ঘুমেও অসুবিধে হচ্ছে। এর আগেও কখনও কখনও এমনটা হয়েছে নজরুলের। ও দেখেছে, দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটিতে গিয়ে একা-একা চুপচাপ বসে থাকলে ও একটু শান্তি পায়।আজ নজরুল একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। তার দপ্তরে সে-ই তো প্রধান, কারোকে কিছু বলার প্রয়োজন হল না তার। দক্ষিণেশ্বরে যাবে সে।পরের দিন দুপুরে নজরুলের পুত্র সব্যসাচী হাজির নবযুগের অফিসে। বাবা কাল অফিস থেকে বাড়ি ফেরেনি। গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে, রেডিওতে, কলকাতার নানা থিয়েটারে, সওগাতের অফিসে, কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। নজরুলকে পাওয়া যাচ্ছে না – খবরটা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। শেষ পর্যন্ত হক সাহেবের কানেও উঠল খবরটা। তিনি স্বরাষ্ট্র-দপ্তরকে জানালেন, নজরুলকে পাওয়া যাচ্ছে না, খুঁজে বের কর তাকে।চব্বিশ ঘন্টারও বেশি অতিক্রান্ত হবার পর বেলঘরিয়া থানা থেকে খবর পাওয়া গেল, গত দু-দিন যাবৎ ওই থানাতেই তিনি আছেন, নিজের পরিচয় দেননি, এখনও একটা ঘোরের মধ্যেই আছেন তিনি। এখন নজরুলের খোঁজ শুরু হবার পর থানারই একজন কর্মচারি তাঁকে নজরুল বলে শনাক্ত করেছেন।থানার অফিসাররা বললেন, বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁরা জানতে পেরেছেন, দু-দিন আগে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির চত্বরে আসেন। সেখানে একটা গাছের নীচে একাই বসে ছিলেন, বিশেষ কেউ তাঁকে লক্ষ্য করেনি। বসে থাকতে থাকতে এক সময় ওই গাছের নীচেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝ-রাত্তিরে – ঠিক কত রাত্তিরে তা বোঝা যাচ্ছেনা – তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর তিনি মনে করার চেষ্টা করেন, কেন ওই গাছের নীচে তিনি বসেছিলেন, কিন্তু ঠিক ঠিক মনে করতে পারেননি।পুলিশ যখন তাঁকে রাস্তায় প্রথম দেখতে পায় তখন ভোর হয়ে আসছে। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ব্যারাকপুরের দিক থেকে কলকাতার দিকে তিনি আসছিলেন হেঁটে হেঁটে। এখন যুদ্ধের সময়, বড় বড় মিলিটারি ট্রাক রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে আসা-যাওয়া করছে। নজরুলের চলার ভঙ্গি খানিকটা মাতালের পদক্ষেপের মতো ছিল। যে-কনস্টেব্‌ল্‌ প্রথম তাঁকে দেখে, সে একজন মাতাল বলেই মনে করেছিল তাঁকে, এবং লোকটা যখন-তখন লরির ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কাতেই তাঁকে থামিয়েছিল। কথাবার্তা এতই অসংলগ্ন যে, কিছুই না-বুঝতে পেরে, আরও দুয়েকজনের সাহায্যে সে তাঁকে থানায় নিয়ে আসে।এই দু'দিন ধরে কথাবার্তার পর পুলিশ যা বুঝতে পেরেছে তা হল, প্রথমত, মাতাল তিনি ছিলেন না। যদিও ব্যারাকপুরের দিক থেকে তিনি আসছিলেন কলকাতার দিকে, প্রথমে নজরুল এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরেই, গাছের তলায় বসে বসে ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙার অনেকটা পরে তাঁর মনে পড়ে অরবিন্দ নামের কোন একজন মানুষের সঙ্গে তাঁর কিছু জরুরি কাজ আছে, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁকে অরবিন্দর কাছে পৌঁছোতে হবে। দক্ষিণেশ্বরের থেকে বেরিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করেন, এবং ব্যারাকপুরের কাছে এসে তাঁর মনে হয় তিনি রাস্তাটা ঠিক ঠিক চিনতে পারছেন না, এবং আবার উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেন। পুলিশের যে কন্‌স্টেব্‌ল্‌ তাঁকে থানায় এনেছে সে ওই অবস্থাতেই তাঁকে প্রথম দেখে।অরবিন্দ কোথায় থাকে? – পুলিশের এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে তিনি ঠিকঠাক কিছুই বলতে পারেননি। পরে মাঝে মাঝে বলেছেন পণ্ডিচেরি। এই পণ্ডিচেরি নাম শুনে পুলিশ ঘাবড়িয়ে যায়। পণ্ডিচেরি তো অনেক দূর। মাদ্রাজ-ফাদ্রাজ ছাড়িয়ে। হেঁটে হেঁটে সেখানে যাওয়া যায় নাকি! লোকটার কি মাথা খারাপ? নাকি, অন্য কোন পণ্ডিচেরির কথা বলতে চাইছিল সে? সে আবার বলছে, সেখানে নাকি দিলীপ নামেরও কেউ থাকে, তার ডাক-নাম মন্টু, সে এই নজরুলের বন্ধু। নজরুল বলেছেন, এই দিলীপ শুধু নজরুলেরই নয়, কোন এক সুভাষবাবুরও বন্ধু।সুভাষবাবু? সুভাষ নামটার সঙ্গে বাঙালি পুলিশ পরিচিত। কিন্তু কোন্‌ সুভাষের কথা বলছে এই পাগলটা? যে-সুভাষের নাম পুলিশ ভালোভাবেই জানে সে তো পুলিশকে বোকা বানিয়ে নিজের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে! তার সঙ্গে এই পাগলের যোগাযোগ? পুলিশরা নিজেদের কানকেও বিশ্বাস করে না। থানায় বসে বসে এই দু'দিনের মধ্যেও একা-একাই এই পাগল ভদ্রলোক গলা-ফাটিয়ে চিৎকার করে অরবিন্দর সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করছিলেন, এবং সফল না হতে পেরে খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। আরো একটা কথা ইনি বলছিলেন বারবার। সুভাষবাবুর কাছে এখন এক অরবিন্দই যেতে পারেন, আর যেতে তাঁকে হবেই। তা না হলে সব কিছুই নাকি ভেস্তে যাবে। কোন্‌ সুভাষ বাবুর কথা বলছেন? – জিজ্ঞেস করায় উনি কোন উত্তর দেননি, এবং মনে হল খুবই বিরক্ত হয়েছেন।পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হল, প্রথম প্রথম না-বুঝতে পারলেও কিছুক্ষণের কথাবার্তার পর পুলিশ বুঝতে পেরেছে যে উনি একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক, ওদেরই মধ্যে একজন তো কবি হিসেবেও নজরুলকে শনাক্ত করেছিল, হয়তো কোন পারিবারিক কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে একটু অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। নিজের নাম নিজের মুখে কিছুতেই বলছেন না। আর বলছেন না নিজের ঠিকানাও। এখন খাওয়া-দাওয়া করেছেন, শরীরও ভালো আছে। একা-একা বসে মাঝে মাঝে ধ্যানের মতো কিছু করছেনও।পুলিশের গাড়িতেই নজরুলকে ফিরিয়ে নিয়ে এল সব্যসাচী, কালীপদ গুহ আর জুলফিকার হায়দার। সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি সে। বাড়িতে ঢুকেই সব্যসাচীকে জড়িয়ে ধরে নজরুল, হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, যোগের শিক্ষা কিছুই হয়নি আমার। সেবার তো শ্রীঅরবিন্দ সূক্ষ্মদেহে প্রায় আধঘন্টা বসে থাকলেন আমার কাছে, কত কথা হল! এবার আর কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছি না তাঁর সঙ্গে। অথচ দেশের পক্ষে তো এখন জীবন-মরণ সমস্যা। সুভাষবাবু একা-একা বিদেশে, সেখানে তাঁকে সুরক্ষা দেবে কে? অরবিন্দ ছাড়া আর তো সুভাষবাবুর কাছে কেউ যেতে পারবে না! একমাত্র তিনিই পারেন সূক্ষ্মদেহে যেখানে-খুশি যেতে!ক্রমশ...
    ক্যালিডোস্কোপে দেখি - দিনের শেষে - অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়আমার জন্ম বাঁকুড়ায় হলেও সচেতন স্মৃতিতে প্রথম বাসাটিকে খুঁজে পাই দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির একতলার দুটি ঘরে। একটি ঘরে আমি আর মেজ ভাই ঠাকুমার সাথে একটি চৌকিতে আর অন্য ঘরটিতে মা-বার সাথে আরেক চৌকিতে ছোট ভাই–এই ছিল নিত্য বন্দোবস্ত। অসুস্থ হলে মাঝে মাঝে ঠাঁই বদল হওয়ার সু্যোগ ঘটত। সেই কারণেই কি আমি মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তাম? এখন আমার হাসি পেলেও সেই সময় এই বিষয়টা আমার বা আমাদের কারোর জন্যই হাসির ছিল না। আমি অসুখে পড়তাম একটু বেশিই।কর্মক্ষেত্রে বাবার উন্নতির লেখচিত্র যখন ঊর্ধমুখী সেইরকম সময়ে আমার এই দুনিয়ায় আগমন। তাই জীবনের অন্তত প্রথম দশটি বছর আমাদের পরিবারকে আর্থিক অভাবের মধ্যে পড়তে দেখিনি আমি। কিন্তু তাই বলে আমায় নিয়ে মায়ের দুর্যোগ-দুর্ভোগের কোন কমতি ছিল না। মায়ের কাছে শুনেছি যে যথেষ্ট সুস্বাস্থ্য নিয়ে জন্মেও কয়েক মাস পর থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় সত্বর ধরাধাম থেকে বিদায় নেওয়ার ব্যবস্থা আমার প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। তারপর চিকিৎসক এবং চিকিৎসাপদ্ধতির বদল ঘটিয়ে মা যে আমায় জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল আমার যুবক বয়সেও সেই গল্প বলতে গিয়ে মায়ের গলা ভারী হয়ে যেত। আর খুব ছোটবেলা থেকে সেই গল্প আমার মনে যে আবেশ, যে নিশ্চিন্ততা সৃষ্টি করে রেখেছিল তা আমায় অজস্র কঠিন দিন, অন্ধকার রাত অনায়াসে পার করে দিয়েছে! প্রবল অসুস্থতা, চূড়ান্ত অস্থিরতায় মা কিছুক্ষণ মাথার কাছে বসে কপালে কি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়েছি, শ্রান্তি কাটিয়ে, সুস্থ হয়ে জেগে উঠেছি। তাই বলে মাঝে মাঝে অভিমান কি আর হয়নি! ছোট ভাইটা কি আমাদের বাকি দু’ভাইয়ের তুলনার মাকে বেশি দখল করে রাখেনি! কে জানে আমরা দু’ভাই আসলেই মায়ের ছেলে কিনা! এই যে মা হাসপাতাল থেকে একদিন ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছিল, আমাদের দু’ভাইকেও ত অমনি করেই নিয়ে এসেছিল। কে জানে সেখানে আমাদের কেউ বদলে দিয়েছিল কিনা! আমার মা আসলেই আমার মা, না কি অন্য কারো মা! না, না, সে হতে পারে না। মা আমাদের তিনজনেরই নিজের মা। তিন ভাইকেই আদর করে ত, অনেক করে। শিশুর মন কত যে সম্ভব-অসম্ভবের আনন্দ-শঙ্কার গলি-ঘুঁজিতে ঘুরে বেড়ায়! মাকে নিয়ে আমার যে নানা অনুভূতির দোলা আর দ্বন্দ্ব চলত, একটু বড় হয়ে এক আশ্চর্য বইয়ের পাতায় পাতায় তার প্রকাশ দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। আজো সেই বইয়ের ‘অন্য মা’ পড়তে গিয়ে চোখ না ভিজিয়ে পড়া শেষ করতে পারি না। স্মৃতির গহীনে আলো ফেলে দেখি আমি কোন কিছু চাইবার আগেই আমার বড় হওয়ার যা যা উপকরণ আমার বাবা দেখতে পেত, তার বিবেচনায় তাদের সেরাটি সে আমার জন্য কিনে নিয়ে আসত। আমার প্রথম বইয়ের সংগ্রহের মধ্যে ছিল যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সুখলতা রাও, এঁদের ছড়ার বই। ছিঁড়বেনা এমন চমৎকার কাগজে রঙিন ছবি আর ছড়ার সমাহার। আর ছিল একটি গল্পের বই, সেটি একেবারেই অন্য রকম। সাদা-কালো বই। অজস্র ছোট ছোট গল্পের সংগ্রহ-কথামালা। ঈশপের গল্পগুলিকে সেই বইয়ে বাংলাভাষায় নিয়ে এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আমি একটু একটু করে পড়তাম। সে বইয়ের অনেক গল্প বুঝতে না পারলেও তারা আমায় কল্পনার নানা জগতে নিয়ে যেত। ছোটবেলার এই সব পছন্দের বইগুলি অনেককাল আমার সাথে থাকলেও একে একে তারা হারিয়ে গিয়েছিল।একটি বই হারিয়ে যায়নি, কিন্তু বহু ব্যবহারে তাকে আমি এত জীর্ণ করে ফেলেছিলাম যে বারে বারে সারিয়েও এক সময় তাকে বিদায় জানিয়ে তার হাল আমলের সংস্করণ কিনে নিতে হয়েছিল। সেই বইয়ের কথায় যাওয়ার আগে ক্যালিডোস্কোপ্টা একটু ঘুরিয়ে নি।কুচবিহারে বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠে চতুর্থ শ্রেণীতে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল। হঠাৎ একদিন, সম্ভবত মধ্যাহ্ন বিরতির সময় একজন মাস্টারমশাই, তাঁদের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটি বড় বই থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদ আর একটি কবিতা পড়তে বললেন। পড়লাম। পড়া শেষে ওনার কথা মত বিবেকানন্দ রচনাবলীর ঐ খন্ডটি থেকে পড়া অংশগুলো দুটো কাগজে টুকে নিলাম। প্রতিলিপি করার সেটাই উপায় তখন। ভাল করে মুখস্ত করে ফেলতে হল ঐ লেখাগুলো। তারপর বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দিন, রামকৃষ্ণ মিশনের সভাঘরে, মঞ্চের একধারে, মাইক্রোফোনের সামনে, মাস্টারমশাই কিংবা কোন মহারাজের কথামত, মনে পড়ছেনা এখন, বিবেকানন্দর ছবিতে যেমন দেখেছি তেমন করে, দুই হাত বুকের কাছে জড়ো করে আবৃত্তি করলাম–“হে ভারত ভুলিও না … …” পরিবেশ তৈরিই ছিল, হাততালি সহজে থামেনি। আরো কয়েকজন আবৃত্তি করেছিল। প্রথম হওয়া প্রতিযোগী হিসেবে নাম ঘোষণার পর জানলাম যে আমিও একজন প্রতিযোগী ছিলাম। পুরস্কার জুটল বেশ কিছু বই। একসাথে করে রঙিন ফিতে দিয়ে বাঁধা। আনন্দ হয়েছিল খুব। এর আগে নাটক করে এসেছি। আবৃত্তির সেই শুরু। ভাল লেগে গিয়েছিল নিজেকে প্রকাশ করার, পারস্পরিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটিকে। প্রথাগত শিক্ষা পাওয়া হয়নি, নিজের বোধ আর বড়দের কারো কারো পরামর্শ, এই সম্বল ছিল। তবে যতদিন না স্মরণশক্তির অবনতি হয়েছে আবৃত্তি করার দাবী বা অনুরোধ পেলে করতে দ্বিধা করিনি।এই আবৃত্তির ঝোঁককে এগিয়ে দিতে, কয়েকবছর বাদে জন্মদিনে বাবা উপহার দিল অনেক পাতার এক বই, কবিতা সংকলন–সঞ্চয়িতা। পরবর্তী কালে দেখেছি, যে সব বন্ধুদের পরিবারের বড়রা নিজেদের বাংলার সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন বলে ভাবতেন বা পরিচয় দিতে ভালবাসতেন তাদের প্রায় সকলের বাড়িতে এই বইটির উপস্থিতি ছিল নিশ্চিত। এই বইয়ের হাত ধরে আমার প্রবেশ ঘটল তাঁর রাজ্যে। পাতার পর পাতা উল্টিয়ে যে অনুভূতি হয়েছিল তাকে ভাষায় প্রকাশ করা আমার সাধ্যের বাইরে। আয়তনে বেশ বড় সেই বই–শুধুই কবিতার! আর কি অনায়াস ছন্দে সে সব কবিতাদের পড়ে যাওয়া যায়, কি সহজে তাদের ভিতরে ঢুকে যেতে পারছি! আবৃত্তি করতে গেলে কবিতা মুখস্ত করতে হয়, সহজে পারি না অনেক সময়। এই সব কবিতা ত আপনিই মনে গেঁথে যাচ্ছে! আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। তার পর ধীরে ধীরে, সে বই পড়তে পড়তে, আনন্দ ছাপিয়ে যে মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে গেলাম তা আর কাটল না। সব শব্দের অর্থ জানা থাকত না। বাড়িতে আমার জন্মের আগে থেকে দুটি বই ছিল, বাবার অত্যন্ত প্রিয় তারা। দুটি অভিধান। বাংলা থেকে ইংরেজি, এবং উল্টোটি। ফলে আটকে যাওয়া শব্দটির অর্থ জানতে আমি প্রথমে ইংরেজিতে যেতাম, সেখান থেকে বাংলায় ফিরতাম। কখনো কখনো একাধিকবার যাতায়াতে মূল কথাটি এবং তাকে ঘিরে আরো কিছু কথা জানা হয়ে যেত। শব্দরাজির এক বিপুল জগতের সাথে এই করে পরিচয় ঘটেছিল। আজ তাদের বেশির ভাগই ভুলে গেছি। তবে গুগল অনুবাদকের সাহায্যে বিভিন্ন ভাষায় ছোট ছোট অংশ পড়া বা লেখায় বারে বারে সেতু পারাপারের এই পদ্ধতির অভিজ্ঞতা এবং তার প্রয়োগ এখনো বেশ কাজে দেয়।কবিতা সংকলনটির পাতায় পাতায় কত রকমের যে অনুভূতির মুখোমুখি হলাম, কত যে অচেনা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ালাম, ভাবলে অবাক লাগে। এই বইয়ের জগতে যখন ঢুকছি তখন আমি পার হয়ে এসেছি ছড়া-ছবির দুনিয়া থেকে শুরু করে ঠাকুমার ঝুলি, কথামালা এমনকি বঙ্কিমের আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী। কিন্তু এরা কেউ আমার জন্য বড়দের বই ছিল না। আমার প্রথম বড়দের বই এই সঞ্চয়িতা, যেখানে মন আর শরীর পরস্পরের গলা জড়িয়ে শিহরিত হয়, মুখর হয়, চূর্ণ হয়, পূর্ণ হয়!স্থানীয় পাঠাগার থেকে হাতে এল গল্পগুচ্ছ। এও সম্ভব, এত এত গল্প, এত চমৎকার গল্প! আমার কিশোর মনটা একেবারে নাকানিচোবানি খেতে থাকত গল্পের ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে। আজ আর তাদের বেশীরভাগকেই মনে নেই, পরবর্ত্তী পঠনে অনেক গল্পের আবেদন-ও অতটা আর তীব্র লাগে নি। কিন্তু, সেই সময়ে ঐ গল্পগুলি পড়ার যে আচ্ছন্নতার বোধ তা আজও দূরের মনে হয় না।একটা সময় ঢুকলাম তাঁর প্রবন্ধ আর নাটকের দেশে। নাটকগুলি যখন পড়ছি, চারপাশে তখন গ্রুপ-থিয়েটারের জোয়ার চলছে। সেখানে বক্তব্য আসছে সমসাময়িক, অনেক প্রাবল্যের সাথে, সেই গতিপ্রবাহে রবীন্দ্রনাটকগুলির আস্বাদ সেই সময়ে ততটা নেওয়া হয়নি, যতটা নিয়েছি পরবর্ত্তী কালে। আর, প্রবন্ধগুলি তুলে ধরেছিল হরেক রকম চিন্তা-চেতনার সম্ভার। সেগুলিও আজকাল আরও বেশি করে উপভোগ করি। অন্য আর এক সময় মেতে উঠেছিলাম তাঁর মত করে কাটাকুটি, আঁকিবুঁকি দিয়ে ছবি বানানোয়। ছবি আঁকায় পারদর্শী হতে পারি নি, সে আর কী করা যাবে, কিন্তু ঐ সব ছবিগুলো আঁকায় যে মজা পেয়েছিলাম সেটা দুরন্ত ছিল।সঞ্চয়িতা ছাড়া তাঁর বাকি যে বইগুলি আমার কাছে আছে তাদের অবস্থা অতটা জীর্ণ হয়নি। দুঃখের কথা যে তাঁর সমগ্র রচনাবলী সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। আর সুখের কথা যে সেটি এখন অনলাইনে পাওয়া যায়, বিনামূল্যে, বিনা লগিনে, সবসময়। ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১০-এ কলকাতা পুস্তকমেলা উপলক্ষ্যে সেই যে এই অনলাইন রবীন্দ্র-রচনাবলী পাঠকসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল আজও সেই পরিষেবা একই ভাবে বহাল আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি এবং বৈদ্যুতিন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের এই মহৎ কাজটির জন্য কোন প্রশংসা বা ধন্যবাদ যথেষ্ট বলে মনে হয় না আমার।এমন একটা দিন যায় না যেদিন অন্তত একবার তাঁর গানের কোন কলি, কবিতার কোন পংক্তি, নাটকের কোন সংলাপ বা কোন চিত্রকর্মের কথা স্মরণ করা হয়নি। অথচ এমন ত নয়, তাঁর বিপুল সৃষ্টির এক কুচির বেশী কিছু পড়া হয়েছে আমার! আবার তাঁকে বাদ দিয়ে আর কিছুই পড়িনি, শুনিনি, দেখিনি এমনও ত নয়! তবু তাঁর কাছে না এসে উপায় থাকে না।তবে তাঁর যে সৃষ্টি সেই শৈশব-কৈশোর-প্রথম যৌবনে আদৌ সেভাবে বুঝিনি তা হচ্ছে তাঁর গান। যত দিন গেছে, জীবন যত পাক খেয়েছে, তলিয়ে গেছে, আর ভেসে উঠেছে, তত বেশী করে আমার আশ্রয় মিলেছে তাঁর গানে। ছোট বেলায় গানের চরণগুলি আসত-যেত, হাওয়া যেমন আসে, যায়, সহজ-সরল, সাবলীল, একান্তই পরিচিত। যত দিন গেল, গানগুলি বয়ে আনতে লাগল অনাঘ্রাত সুগন্ধ, অশ্রুত বাণী, অদেখা রূপ। একেক বিকেলে, সন্ধ্যায়, মোহন সিংয়ের কন্ঠে যখন অমৃত-বাণী ছড়িয়ে পড়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার চেতনা, আমার শরীর বসে থাকে চুপটি করে, আর অঝোর ধারে কোথা হতে উপচে আসে শ্রাবণ, বন্ধ দু চোখ বেয়ে। নাই থাকল আমার কোন জীবনদেবতা। আমার নিজস্ব বেদনা আরও কোন বৃহত্তর বেদনায় মিলেমিশে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাগসঙ্গীতে দক্ষ জীবনসঙ্গিনী যখন সমস্ত আর্তি মিশিয়ে তাঁর গান গাইতে থাকেন, তখন যে তীব্রমধুর আবেশে আমার চরাচর ডুবে যায়, সে কি কোন বাস্তব! আসলেই সে কোন মায়ার খেলা! ছোটবেলায় সারা বছরের সেরা দিনটা ছিল ২৫শে বৈশাখ। বাড়ির সামনে ছিল খোলা বারান্দা। সেখানে একটা চেয়ার কি নীচু টেবিলে ঢাকনা বিছানো। মা অথবা আমার সেলাইয়ের কারুকাজ করা, সারা বছর তুলে রাখা, দু-একটি বাছাই করা দিনের জন্য। টেবিলে কবির ছবি, প্রথম দিকের বছরগুলোতে কার্ডবোর্ডে আটকানো কাগজে, পরে ফটো-বাঁধাই। ছবিতে মালা, ফুলদানিতে রজনীগন্ধা, সামনে পাতাবাহারের কয়েকটি পাতা, কৃষ্ণচূড়া। মা-বাবা-ঠাকুমা-আমরা তিন ভাই, দুই কাকিমা, ছোট ছোট খুড়তুত ভাইবোনেরা, সবাই পরিস্কার জামা-কাপড় পড়ে গোল হয়ে বসেছি। ধূপ জ্বলছে। ভাই-বোনেরা একটার পর একটা কবিতা পড়া চলেছি, চলছে গান গাওয়া। কনিষ্ঠতম সহোদর ভ্রাতার খোলা গলা। মা, কাকিমারা ও ভাল গাইত। নিজের সম্বন্ধে আমার সেই যুগে খুব উঁচু ধারণা ছিল। সুর-তাল-লয়ের কি বিপর্যয় ঘটাচ্ছি সেটা বুঝতাম না। তাই মহানন্দে গেয়ে যেতাম। বেশি গান-ই হত সমবেত গলায়, ফলে আমার ত্রুটি ঢাকা পড়ে যেত অনেকটা। বয়সের সাথে সাথে নিজের অক্ষমতাকে ধরতে পেরেছি। আমার অসুরপনাকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলি। ছোটবেলার মানুষগুলিও দূরে দূরে, মা-বাবা, দুই কাকু-কাকিমা সবাই সব দূরত্ব অতিক্রম করে কেবলই স্মৃতিতে। এখন আমার সকল গান গীত হয় নিঃশব্দ উচ্চারণে। এখন ২৫শে বৈশাখ আর দশটা সাধারণ দিনের মত, রবির কিরণ ছোঁয়া।এবং তাঁর থেকে বহু যোজন দূরের। একবার, জীবনের এক বিশেষ দিন সেটি, জ্বালানী ভরা শেষ করে গাড়িতে উঠতে যাব, আমার গাড়ির পরেই যে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল সেটির চালকের আসন থেকে নেমে এসে ভিক্ষা চাইলেন এক মহিলা-তাঁর গাড়িটিতেও জ্বালানী ভরে দিতে হবে, এক গ্যালন-দু’ গ্যালন যতটুকু পারি। জ্বালানীর দাম আমার পক্ষে কম নয়। যখন ভরে দিতে শুরু করলাম, আরো দেওয়ার সম্ভাবনাকে খারিজ করে আমি ওনাকে দু’ গ্যালন জ্বালানীই মাত্র ভরে দিলাম। কিন্তু মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকল–বড্ড কৃপণতা হয়ে গেল কি? নিজের গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে মনের মধ্যে বেজে যেতে থাকল একসময়ের নানা আসরে উচ্চারিত স্বরকম্পন “তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে”। জানি, ইনি কোন রাজাধিরাজ নন, আর এ যুগের রাজাধিরাজরা আমাদের কাছে ভোট ছাড়া আর কিছু ভিক্ষা করেননা, তবু আরো কয়েক গ্যালন জ্বালানি হয়ত দেওয়া যেত। কিন্তু ভাবালুতা আর কতক্ষণ থাকে! চলে এলাম। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বাসের মানুষ। সংশয়ের নানা পথে হেঁটেও তাঁর জীবনবোধ তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসে স্থিত ছিল। আমি কেবল সংশয়ে স্থির, কোন বিশ্বাসেই আস্থাবান নই। কোন পারানির কড়ি নেই। দিনের শেষে আমার খেয়া, যেমনটি চেয়েছি, কোথাও যাবে না, ঘাটেই বাঁধা থেকে জীর্ণ হয়ে মিলিয়ে যাবে।ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    একটি গরুর রচনা  - Naresh Jana |                            (এক) নেহাৎই মজা করেই কথাটা বলেছিল অনুপ। কিন্তু দেবায়ন যে এমন রি-আ্যক্ট করবে ভাবতে পারেনি। নাই নাই করে পনের বছরের বন্ধুত্ব দু'জনের। যেমন তেমন বন্ধুত্ব নয়, রীতিমতো যাকে বলে বুজুম ফ্রেন্ড। সেই হিসেবে অনুপ জানে যে দেবায়ন এমন রি-আ্যক্ট করার ছেলে নয়। কাগজে দু'জনে মিলেই পড়েছিল খবরটা। চোদ্দই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করার পরিবর্তে দেশবাসীকে গো-আলিঙ্গন দিবস’ পালন করার আর্জি জানিয়েছে ভারত সরকারের প্রাণী কল্যাণ বোর্ড।  প্রাণী কল্যাণ বোর্ডের যুক্তি, পশ্চিমি সংস্কৃতির অগ্রগতির কারণে বৈদিক ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে। গরুকে আলিঙ্গন করলে মানসিক সমৃদ্ধি আসবে। খবরটা পড়ে দু'জনই কার্যত হেসে গড়াগড়ি খেয়েছে। ঘটনাটা হয়ত তারই রেশ ছিল, দিন কয়েক পরের ঘটনা সেটা। হাইকোর্ট চত্বরে ল'ক্লার্কদের অফিস লাগোয়া চায়ের দোকানে দেবায়নের সাথে আড্ডা মারতে মারতে অনুপ বলেই ফেলল, তুই বরং একটা গরু কিনে ফেল। মাঝে মধ্যে গরুকে হাগ করিস। দেখবি টেনশন রিলিজ হচ্ছে।  দেবায়ন রায় হাইকোর্টের নবীন প্র্যাকটিসনার, অনুপ মুখার্জী ব্যাঙ্কশাল কোর্টে। অনুপের বাড়ি হাওড়া হওয়ার সুবাদে হাওড়া কোর্টেও খানিকটা পশার জমিয়েছে। দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, মাঝে মধ্যেই আড্ডা চলে হাইকোর্ট অথবা ব্যাঙ্কশাল চত্বরে। অনুপের বিয়ে হয়েছে সাত বছর কিন্তু দেবায়নের হয়নি। মেয়ে দেখা হয়, ম্যাট্রিমনি ডটকমও। যদিও শেষ অবধি দেবায়ন পিছিয়ে আসে। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা। দেবায়নের ভয় বিয়ের পর যদি বউ বাবা-মাকে না দেখে! যদি আলাদা থাকতে চায়! ভয়টা খুব অমূলক নয়, বিয়ের পর বৌদিকে নিয়ে দাদার আলাদা হয়ে যাওয়াটাও হয়ত সেই আশংকার উৎস। ফলে পাত্রী দেখা হয় কিন্তু দেবায়ন শেষ অবধি পিছিয়ে আসে। বিয়ের উদ্যোগ সব চেয়ে বেশি নিতে হয়েছে অনুপকেই, কারন দেবায়নের মায়ের অনুরোধ, "যেমন করে হোক বাঁধতে হবে ছেলেটাকে তাতে আমাদের যা'হয় হোক,আমরা তো আর চিরকাল থাকছিনা।" সেই ধারাবাহিকতা মেনেই দেবায়ন সপ্তম পাত্রীটিও বাতিল করার পরই ওই গরু কেনার কথাটা অনুপ বলেছিল। অনুপ মজা করেই বলেছিল, "রাস্তাঘাটে তো আর গরুকে জড়িয়ে ধরতে পারবিনা। তার চেয়ে একটা গরুই কিনে ফেল। সরকার বলছে, গরুকে জড়িয়ে ধরলে ট্রেস রিলিজ হয়।" আর তখনই দেবায়ন বলে ফেলল কথাটা। "বলল, চল তা'হলে দুজনে মিলেই কিনি। কে জানে কখনও সখনও তোরও ভালোবাসায় ক্লান্তি এলে তুইও জড়াতে পারিস।" খোঁচাটা হজম করেছিল অনুপ। মাঝে মধ্যে রিয়ার সংগে খিটমিট হলে সে আড্ডায় এসে চুপচাপ বসে থাকে বটে কিন্তু সেটা যে দেবায়ন এত কালচার করে এটা অনুপ এতদিন খেয়াল করেনি। খেয়াল করল দেবায়নের দ্বিতীয় কথাটায় যখন সে বলল, "শুধু তুই আমার বিয়ে না করা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় রে, আমিও তোকে নিয়ে যথেষ্ঠ উদ্বিগ্ন।" অনুপ জানে দেবায়ন একটা ফ্যালাসির ডিফেন্স তৈরি করছে বিয়ে না করার যুক্তিটাকে জোরালো করার জন্য। ওই যে কথায় বলে দিল্লি কা লাড্ডু....।  অনুপ একটু চিন্তিত হল। তা'হলে কী দেবায়ন মনস্থির করে ফেলেছে যে বিয়ে সে করবেই না? কিন্তু তাই যদি হয় তবে সে পাত্রীর খোঁজ করছে কেন? দেবায়ন এবার যেন বিষয়টা হালকা করার জন্যই হেসে বলল, "গরু কিন্তু সত্যিই উপকারী জন্তু জানিস। সেদিন একটা জার্নালে দেখলাম গরুর উপকারিতা নিয়ে বেশ বড়সড় আর্টিকেল লিখেছে। বলছে, নেদারল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড, আমেরিকা সহ বিশ্বের নানা দেশে নাকি গরু জড়িয়ে ধরে মানসিক চাপ কমানোর থেরাপি চালু আছে। গরুকে আদর করে, পিঠে ভাল করে হাত বুলিয়ে তারপর কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকলে নাকি শরীরের হ্যাপি হরমোনগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনুপ বলল, "আরে ধুর! ওটা নির্ঘাৎ নাগপুরিয়া জার্নাল কারন শুধু গরু নয়, ঘোড়া, ছাগল এমনকি খামারে পোষা শুয়োরকে আদর করেও ওই একই ফল পাওয়া যায়। নেদারল্যান্ডে গোট-যোগার চলও আছে। রীতিমত ট্যাঁক খসিয়ে ছাগল খামারে গিয়ে গোট-যোগা করতে হয়।"ছোটবেলায় গরুর রচনা পড়তে গিয়ে অনুপও পড়েছিল যে গরু একটি গৃহপালিত পশু। আর জেনেছিল গরুর দুধের উপকারিতা। এটা সেই সময়ের কথা যখন দুধকে সুষম খাদ্য বলা হত। এখন অবশ্য বিজ্ঞান বলছে দুধ সুষম খাদ্য নয়। কারন দুধে ভিটামিন, প্রোটিন, খনিজ ইত্যাদি প্রায় সব রকম উপাদান থাকলেও ভিটামিন সি আর আয়রন নেই বললেই চলে। দুধ তাই আদর্শ খাদ্য হলেও সেটাকে সুষম খাদ্য বলা চলেনা। পাঠ্যপুস্তক গরুর দুধের উপকারিতা জানিয়েই থেমে যায়, তার মাংসের উপকারিতা অবধি এগুতে পারেনা। ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে গরুর মাংসের উপকারিতা বোঝালে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। অনুপের অবশ্য গরুর দুধ বা মাংস কোনও কিছু নিয়েই মাথা ব্যাথা ছিলনা। আর পাঁচ জনের মত সেও গরুর দুধকে ক্লাস ফোরের পাতাতেই ফেলে এসেছিল। অনেক দিন আগে সে যখন তার ছ'মাসের ছেলেকে গরুর দুধ খাওয়ানো যাবে কিনা, চিকিৎসকে প্রশ্ন করেছিল উত্তরে ডঃ দ্বৈপায়ন সেন,পেড্রিয়াটিক প্রশ্নটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "ধুর মশাই! গরু কী আপনার বাচ্চার জন্য দুধ দেয়? সে দুধ দেয় বাছুরের জন্য, বাছুর মানুষের বাচ্চার চেয়ে বড় তাই গরুর দুধও বেশি। ওই দুধ নিয়ে আপনার কী? ব্যাস! গরুর পর্ব ওই অবধিই ছিল। কিন্তু হাতেমপুরের ঘটনাটা আবার তাদের দু'জনকে গরুতেই ফিরিয়ে আনল।                                                                          দুই অনুপ প্রথমটায় হাতেমপুর থানার সেন্ট্রির কথায় মারাত্মক রেগে গিয়েছিল বটে কিন্তু রাগটা থিতু হলে আবারও সেই গরুর বিষয়টা তাকে হন্ট করল। সেদিন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ দেবায়নের গাড়িটা হেতমপুর থানায় ঢুকল। গাড়িটার কোথাও একটা ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস আওয়াজ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু গাড়িটা গড়াচ্ছে। গাড়ির ডানপাশের পেছনের দরজাটা দুমড়ে গিয়ে গাড়ির মধ্যেই বসে গিয়েছে। সামনেটা অবশ্য ঠিকঠাকই আছে, দেখে বোঝার উপায় নেই যে গাড়িটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল। কিন্তু থানার সেন্ট্রির চোখ বলে কথা! সে পুরো গাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখল এবং দুমড়ে যাওয়া বডিটার দিকে অভিজ্ঞ চোখে তাকিয়ে বলল, 'অ,গরুর কেস!'দেবায়ন তখনও ট্রমাটা সামলে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ! একটু আগেই সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে তারা । একচল্লিশ নম্বর জাতীয় সড়কে একটি সিগন্যালে দাঁড়িয়েছিল ওদের গাড়িটা। পেছন থেকে একটা লরি এসে গাড়িটাকে ধাক্কা মারে। ডান দিকের পেছনের কিছুটা অংশ সহ দরজাটা দুমড়ে গেছে। প্রথমে সেন্ট্রির কথাটা শুনেও যেন শুনেনি দেবায়ন এমন ভাব করল। মৃত্যু ভয়টা একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু এবার তার সামনে ফুটে উঠছে গাড়ির দুমড়ানো অংশটার ছবি। একটা অসম্ভব রাগ তাকে পেয়ে বসছে। তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। সে ভাবেই সে তাকালো সেন্ট্রির দিকে। সেন্ট্রি কী বুঝল কে জানে। তার নিজের সঙ্গে কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়া থ্রি-নট-থ্রির ডগাটা ধরে সে নিজেও সোজা হল। আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলল, 'ওই ঘরটায় ডিউটি অফিসার আছেন।'  দেবায়নের পরে গাড়ি থেকে নামল অনুপও। তাকেও নামতে হল বাঁদিকের দরজা দিয়েই। ড্রাইভার গাড়িটাকে থানার মুখ বরাবর দাঁড় করিয়েছিল। সেন্ট্রির নির্দেশ মত এক পাশে সরিয়ে নিয়ে গেল। দেবায়ন ডিউটি অফিসারের ঘরটার দিকে যাচ্ছিল। পেছন পেছন অনুপও। অনুপ একটু থমকে গিয়ে সেন্ট্রিকে বলল, 'গরুর কেস মানে?' সেন্ট্রি থমকে গিয়ে বলল, 'না মানে গাড়িটাকে গরু ধাক্কা দিয়েছে কিনা?' অনুপ একটু একরোখা গলায় বলল, 'কে বলল গরু ধাক্কা দিয়েছে? আপনি কি ওখানে ছিলেন? সেন্ট্রি বুঝল, পার্টি বেশ জাঁদরেল আছে। সে কথা না বাড়িয়ে বলল, 'আসলে স্যার এখানে গরুর কেসই বেশি আসে।'                                                                         ঘটনাটা শুনেই হুংকার দিয়ে উঠলেন থানার সেকেন্ড অফিসার বা মেজোবাবু। বাজখাঁই গলায় ডাক পাড়লেন, "চক্রবর্তী!" সংসারের মেজো ছেলেদের মতই থানায় মেজো বাবুদের একটু বেশি দাপট থাকে। তাঁর ভয়ে গোটা থানা তটস্থ। যদিও এই মানুষটিকে দেখে প্রথমে ঠিক তেমনটা মনে হয়নি। অদ্ভুত এক প্রশান্তি তাঁর চোখে মুখে। পাট করে আঁচড়ানো চুল। তাঁর চোখ সেন্ট্রির থেকে শতগুণ অভিজ্ঞের। কেতাদুরস্ত দুজনকে দেখেই বিনীত ভাবে সামনের চেয়ার দুটোয় বসতে বললেন। দেবায়ন কাঁপা কাঁপা গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিল। মেজোবাবু তাকে থামতে ইশারা করে বললেন, "আগে একটু চা খান। আমারও অনেকক্ষন চা খাওয়া হয়নি।" দেবায়ন থমকে গেল। মেজোবাবু বেল টিপে একজনকে ডেকে তিন কাপ চা আনতে বললেন। তারপর অনুপের দিকে তাকিয়ে বললেন, "বলুন।" মেজোবাবু স্পষ্টত বুঝেছিলেন, কোনও একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেবায়ন। তাই অনুপকেই বিষয়টা জানাতে বললেন। অনুপ ঘটনাটা জানালো। সঙ্গে বিশেষ ভাবে এটাও জানালো যে মুহুর্তের মধ্যেই সেই লরির ড্রাইভার ট্রাফিক পুলিশের সাথে কথা বলে লরিটি নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। তারা আটকাতে চেয়েও আটকাতে পারেনি কারন ঘটনার সাথে সাথেই চার পাঁচজন যুবক এসে রীতিমত তাদেরকে ধমকে লরিটাকে চলে যেতে সাহায্য করে। তারপরই মেজোবাবু চক্রবর্তী বলে হাঁক পাড়লেন। চক্রবর্তী মানে সেই সিড়িঙ্গি চেহারার পুলিশটি বিনীত ভাবে এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষন। ইনিই ডিউটি অফিসারের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। অনুপরা প্রথমে তাঁর কাছেই গেছিল। অনুপদের উকিলি পরিচয় পাওয়ায় এই চক্রবর্তীই তাদেরকে মেজোবাবুর টেবিলে রেফার করেন। মেজোবাবু চক্রবর্তী নামক সেই অধঃস্তন পুলিশ আধিকারিকটির দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন, "ট্রাফিক কি আজকাল লোকাল গুনসদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছ চক্রবর্তী?" পুলিশ আধিকারিকটি বিনীত ভাবে হাত কচলায়। মেজোবাবু আবার বললেন, "একটা লরি এঁদের গাড়িটাকে ধাক্কা মারল। সেই লরিটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল কয়েকটা গুন্ডা আর তোমার ট্রাফিক কনস্টেবল নাকি সেই গুন্ডাদের সাথে হাত মিলিয়ে লরিটাকে যেতে সাহায্য করেছে? তা কুন্দ্রা মোড়ে এখন কার ডিউটি?" "আমরা স্যার লরিটার ছবি তুলে রেখেছি, নম্বর প্লেট সহ।" এতক্ষণে দেবায়ন যেন একটু স্বাভাবিক হয়েছে। মেজোবাবু একটু নরম হয়ে বললেন, " সে আপনারা না তুললেও আমরা পেয়ে যাব। আমাদের সিসি ক্যামেরা বসানো আছে। কোর্টে এভিডেন্স হিসাবে বরং ওটা অনেক বেশি অথেনটিক। ওই ক্যামেরাতেই ওই সব গুন্ডা ফুন্ডা সব দেখা যাবে।" এরপর আবার সেই চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, "ক্যামেরা গুলো কাজ করছে তো ? নাকি সেগুলোরও বারোটা বাজিয়ে বসে আছ?" চক্রবর্তী বিনীত ভাবে বলল, "করছে স্যার। আমফানের পর প্রায় আড়াইশ ক্যামেরা খারাপ হয়েছিল। একশ তিরিশটা রিপ্লেস করা হয়েছে। তার মধ্যে কুন্দ্রা মোড়ও আছে।'মেজোবাবু তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, "কৃতার্থ করেছ! এখন দেখো ওখানে কে ডিউটিতে আছে। ওই লরি কোথায় আছ এখুনি খোঁজ নাও। দু'ঘণ্টার‌ মধ্যেই ওই লরি যেন থানায় ঢোকে সেটা দেখ আর ওই ট্রাফিক কনস্টেবলকে কিন্তু ক্লোজ করা হবে। আমি বড়বাবুকে বলছি। কালই আমাকে একটা রিপোর্ট দাও।" তারপর দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বললেন, "একটু বেটার ফিল করছেন?"  মেজোবাবু ততক্ষণে জেনে গিয়েছেন যে অনুপ হাওড়ায় থাকে দেবায়ন কলকাতায়। অনুপ ক্রিমিনাল আর দেবায়ন সিভিল লইয়ার। একজন কলকাতা হাইকোর্ট, অন্যজন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে প্র্যাকটিস করে। দু'জনে মিলে একটি মামলার কাজে হলদিয়ায় এসেছিল। ফেরার পথে এই ঘটনা। দেবায়ন মেজোবাবুর প্রতি ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো যে, সে আগের তুলনায় এখন বেটার ফিল করছে। মেজোবাবু বললেন,  " ওই লরি আমি দু'ঘন্টার মধ্যে থানায় ঢোকাবো। ওই প্রত্যেকটা গুনস আর লরির চালককে আমি হাজতে পুরব। আপনার গাড়ির ড্যামারেজের পাই টু পাই কমপেনসেশন আমি ওই লরির মালিককে দেওয়াবই।  ট্রাফিক কনস্টেবলের কী ব্যবস্থা হচ্ছে আপনাদের সামনেই বললাম কিন্তু একটা কথা ভাবুন তো যদি আপনাদের কিছু হয়ে যেত আমার কী করার ছিল?" তারপর দেবায়নকে যেন পরামর্শ দেওয়ার মত করে বলেন, "এত উত্তেজিত হয়ে যান কেন?"    মেজোবাবু এমন ভাবে কথা বলছিলেন যে দেবায়ন আর অনুপের মনে হল লোকটা পুলিশ অফিসার নয় যেন কোনও মনরোগ বিশেষজ্ঞ। মেজোবাবু  দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, "আমি কিন্তু শুরুতেই বুঝতে পারছিলাম গাড়ির মালিক আপনিই কারন আপনি প্রচন্ড টেনস ছিলেন। শুধু টেনস নয় একটা ভীতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন আপনি। সেই অবস্থায় আপনার কাছ থেকে ঘটনাটা শুনতে হলে আপনাকে ঘটনাটা রি-কল করতে হত তাতে আপনিই আরও ট্রমায় চলে যেতেন। তাই অনুপবাবুকেই ঘটনাটা বলতে বললাম। আসলে আপনার ট্রমাটা অদ্ভুত ধরনের। দুর্ঘটনার পর আপনি অক্ষতই আছেন কিন্তু ঘটনাটা কত ভয়ঙ্কর হতে পারত এটা ভেবেই আপনি ট্রমার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলেন।"  একটু থেমে মেজোবাবু বললেন, "আপনাদের আমি আমার এক পরিচিত জনের কথা বলি তাহলে বুঝতে পারবেন এই ধরনের ট্রমা কত মারাত্মক হতে পারে। ওই ভদ্রলোক রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লী যাচ্ছিলেন একটা কাজে। মুঘলসরাই, মানে হালে যার নাম হয়েছে দীন দয়াল উপাধ্যায় নগর জংশন পেরিয়ে একটি প্রচন্ড ঝাঁকুনি নিয়ে ট্রেনটি থেমে যায়। ভদ্রলোক অনেক পেছনের দিকে কামরায় ছিলেন। ঝাঁকুনিটা তিনিও অনুভব করেন কিন্তু তাঁর কোনও আঘাতই লাগেনি। ঘন্টা তিনেক বাদে ফের ট্রেন চলতে শুরু করে। পরে টিকিট চেকারের কাছ থেকে ওই ভদ্রলোক জানতে পারেন যে ট্রেনের সামনের একটি কামরা ডি-রেল হয়েছিল। ঘটনাটি জানার পর ভদ্রলোক চুপচাপ হয়ে যান। দু'ঘন্টা পরে ভদ্রলোকের ট্রেনেই স্ট্রোক হয়। প্রায় ৮ মাস প্যারালাইজড হয়ে ছিলেন তিনি। তারপর স্বাভাবিক হয়ে যান বটে কিন্তু আর কোনও দিন ট্রেনে ওঠেননি। বলতে পারেন এটা হল একধরনের আফটার শক্। "                                                               তিন দেবায়নের বুকটা কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। সত্যি মেজোবাবু তাকে রক্ষা করছেন আরও একটা বড় একটা দুর্ঘটনা থেকে। এই সব কথাবার্তা চলার মধ্যেই একটা সাদা কাগজে চোস্ত ইংরেজিতে কমপ্লেইনটা লিখছিল অনুপ। মেজবাবুর কথা শুনতে শুনতেই সেই কমপ্লেইন লিখলেও কোথাও একটু সঙ্গতি হারায়নি সে। সামান্যতম কাটাকুটি বা রি-রাইট নেই কমপ্লেইনে। একদম শেষে অনুপ একটা আপিল জুড়ে দিয়ে লিখল, যেন এই অভিযোগটাকেই এফ আই আর হিসাবে গণ্য করা হয়। মেজোবাবু হাত বাড়িয়ে কমপ্লেইনটা নিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলেন লেখাটা। গোটা ঘটনার নিখুঁত বিবরণের সাথে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা, গুন্ডা গুলোর কথা সবই উল্লেখ রয়েছে। পুলিশের সেই অধঃস্তন আধিকারিকটি বিদায় নিয়েছিল। মেজোবাবু তাকে ফের ডেকে পাঠালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, "কে আছে কুন্দ্রা মোড়ে?" আধিকারিকটি বললেন, "বানেশ্বর ঘোষ, স্যার।" মেজোবাবু তার উদ্দেশ্যে কমপ্লেইন কপিটা নাড়িয়ে বললেন, " উকিলবাবু এই যে কমপ্লেইনটা লিখেছেন তাতে শুধু তোমার বানেশ্বরই নয়, তোমাকেও ডিপার্টমেন্টাল ইনভেস্টিগেশনের মুখে পড়তে হতে পারে। কারন তুমিই তো ট্রাফিক ইনচার্জ।" জুনিয়ার অফিসারটি কিন্তু কিন্তু করে বলল, " স্যার ট্রাফিক অবস্ট্রাকশন হচ্ছিল তাই বানেশ্বর লরিটাকে সাইড করে রাখতে বলেছিল কিন্তু ড্রাইভার লরি নিয়ে পালায়।" মেজোবাবু অনুপের দিকে তাকিয়ে বললেন, " কী বুঝলেন? শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল।" অনুপ অবাক হয়ে ভাবে এই ধরনের পুলিশ আফিসার থাকার পরও পুলিশের এত বদনাম কেন?                                                      মেজবাবু কমপ্লেইনের কপিটা দেবায়নের দিকে বাড়িয়ে বললেন, "নিন, আপনি সই করে দিন। আর আপনি অনুপবাবু কমপ্লেইনের ধারে ভাঁজ করা রুলের পোরসানে নিজের নাম ঠিকানা লিখে দিন। মানে জানেনই তো রাইটারকে পাশে এটা লিখতে হয়। আপনিই আমাদের সাক্ষী হবেন।" এরপর অনেকটা রিল্যাক্স হয়ে শরীরটাকে পিছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে বললেন, " আমি জানি আপনারা, মানে উকিলবাবুরা পুলিশকে খুব একটা ভাল চোখে দেখেননা। আসলে পরিস্থিতিটাই এমন হয়ে গেছে যে, আমাদের মধ্যে সবসময় একটা রাইভালরি চলে কিন্তু বিশ্বাস করুন আমাদেরও ঠিকঠাক কাজ করতে ইচ্ছা করে। আফটার অল আমরাও আপনাদের মত আইনসেবী কিন্তু আমাদের লিমিটেশন এতটাই বেশি যে সবসময় সবটা পেরে উঠিনা। চোদ্দচুয়াড়ি কাজ মশাই। তারমধ্যে পেপার ওয়ার্কিং দিনের দশ আনা সময় কেড়ে নেয়। কোনও থানায় মানে আমাদের মত থানা যেখানে স্টাফ বেস কম সেখানে যদি একদিনে পাঁচজন আ্যরেষ্ট হয় তো আমাদের নাওয়া খাওয়া উঠে যায়। মেডিকেল করতে হবে, পেপার রেডি কর, কোর্ট প্রোডাকশন করতে হবে, পেপার রেডি কর, কেস ডায়েরি, সিজার লিস্ট সব মিলিয়ে একটা যুদ্ধ আর তারমধ্যে রয়েছে গুচ্ছের কারবার। এই চক্রবর্তীর কথাই ধরুন, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর কিন্তু আমাদের স্টাফ কম ফলে ওকে ডিউটি অফিসারের টেবিল সামলাতে হচ্ছে।" মেজোবাবু দম নেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, " তবে বুঝলেন অনেক দিন পরে একটা জাঁদরেল কেস পেলাম। সব ব্যাটাকে টাইট দিয়ে ছাড়ব। এই ধরনের কেস দাঁড় করাতে একটু ঝামেলা হয় ঠিকই কিন্তু এবার মনে হয় দাঁড়াবে। হ্যাঁ, ওই কনস্টেবলটাও একটু ফাঁসবে। তা ফাঁসুক, ব্যাটারা সরকারের বেতনও নেবে আবার ঘুষও খাবে বুঝলেন। এদের জন্যই আজ ডিপার্টমেন্টের এত বদনাম। যাইহোক ফিরবেন কিসে?" দেবায়ন সই করে অনুপের দিকে কমপ্লেইন কপিটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, " গাড়িটা চলছে তো স্যার। ওটাতেই চলে যাব। ওই মোড় থেকে দিব্যি চলে এলাম। ড্রাইভারও আছে।"    মেজবাবু হেসে বললেন, " না, না ওকথা নয়, গাড়িটা আমাদের সিজ করতে হবে দেবায়নবাবু। আইন অনুযায়ী আমাদের দুটো গাড়িই সিজ করে কোর্টে দিতে হবে কিনা। মানে গাড়িটা থানাতেই থাকবে। কাগজপত্র কোর্টে জমা দিতে হবে। দিন পনেরোর মধ্যেই আশাকরি গাড়ি পেয়ে যাবেন।" দেবায়নের মুখটা হাঁ হয়ে যায়। সে তাকায় অনুপের দিকে। মেজোবাবু দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলেন, না না চিন্তা করবেননা। এখানে অনেকেই গাড়ি ভাড়া দেয়। আমাদের চেনাজানা, বেশ রিজনেবল। এখন স্টার্ট করলে দু'ঘন্টায় কলকাতা ঢুকিয়ে দেবে।" দেবায়নের অবস্থা বুঝতে পেরে অনুপ মেজবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, "ওর স্যার দুটো গাড়ির মধ্যে একটা অলরেডি গ্যারেজে আছে এটাও যদি... মানে ওর বাবা মা দুজনেই বয়স্ক। বাবার আবার হার্টের সমস্যা। যদি হাসপাতাল, নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হয়।" দেবায়ন আগ্রহ ভরে তাকাল মেজোবাবুর দিকে।মেজোবাবু এবার যেন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ কী সব ভাবতে লাগলেন। তারপর পাশে দাঁড়ানো সেই পুলিশ আধিকারিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, " চক্রবর্তী কী করা বলা যায় বলত?"  এতক্ষণ কাঁচুমাচু হয়ে থাকা চক্রবর্তী এবার যেন তার সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে এল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, "ইয়ে স্যার যদি উকিল বাবুদের গাড়ির ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্স থাকে.." মেজোবাবু যেন একটু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, " ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্স থাকলে কী?" চক্রবর্তী বলেন, " তা'হলে স্যার উকিলবাবুরা প্লেইন একটা ডায়রি করবেন যে ঘটনাটা গরুর ধাক্কায়  মানে কাউ ড্যাসিং স্যার। তাতে ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম পেয়ে যাবেন। আর ডায়রি করলে স্যার গাড়িটা সিজ না করলেও চলে।" মেজোবাবু দেবায়নদের দিকে তাকিয়ে বলেন, "চক্রবর্তী কথাটা খুব খারাপ কিছু বলেনি, কী বলেন? আপনাদের তো ড্যামারেজ পাওয়া নিয়ে কথা। আর সত্যি কথা বলতে কি, বলছি বটে পনের দিনের মধ্যে গাড়ি পেয়ে যাবেন কিন্ত মামলার কথা কে বলতে পারে? আপনারা আইনজীবী, জানেনই তো একেকটা মামলা কতদিন গড়ায়। কত গাড়ি পচে খত হয়ে গেল মশাই। আমাদের তো সিজ করা গাড়ি রাখার জায়গাই নেই। ওই যে থানায় ঢোকার মুখেই ডানদিকে সারি দিয়ে রাখা গাড়ির কঙ্কাল দেখে এলেন, সব সিজ করা। একেকটা দশ পনের বছর ধরে পড়ে রয়েছে। তার চেয়ে ভালো ঘরের গাড়ি ঘরে নিয়ে যান।" "কিন্তু মেজোবাবু ওই গুন্ডা গুলো?"  অনুপ মরীয়া হয়ে বলে ওঠে। " ও আমি দেখে নেব মশাই। পালাবে কোথায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে সব গুলোকেই গাঁথব। লরির ড্রাইভারও পার পাবেনা। অন্য মামলায় ঠিক গেঁথে দেব। অনুপবাবু আপনি বরং একটু কষ্ট করে আরেকটা কমপ্লেইন লিখে ফেলুন।" বলেই মেজোবাবু চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, " চক্রবর্তী, কমপ্লেইনটা কিভাবে করা হবে তুমি বলে দাও কারণ ইন্সুরেন্সওয়ালারা আবার ফাঁক খুঁজে বেড়ায়।" "আমি স্যার তা'হলে একটু গাড়িটা দেখে আসি। মানে কোথায় কী রকম ড্যামেজ হয়েছে।" চক্রবর্তী বেরিয়ে যায়।আরও আধঘন্টা পরে থানা থেকে বেরিয়ে আসে অনুপ আর দেবায়ন। থানার চত্বরটা আলোয় ঝলমল করছে। দেবায়ন গাড়িটার দিকে এগিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলে। গাড়ি ঘুরতে থাকে। অনুপ দেখতে পায় সেই সেন্ট্রি কনস্টেবল খইনি দলতে দলতে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। অনুপ দ্রুত গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তার মনে হ'ল সেন্ট্রি তাকে জিজ্ঞেস করতে আসছে, "কেসটা তা'হলে গরুরই ছিল স্যার?"
    দারুণ হুপপ্লবের দিনে  - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | উনিজি, মোটাভাই, রাম্মিডিয়া আর ভক্তদের এক্সিকিউটিভ কমিটির মিটিং। একটা নতুন স্লোগান চাই। আচ্ছেদিন তো আর নেই, এবার অন্য কিছু দরকার। মোটাভাইকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল, নতুন স্লোগান হোক, যাচ্ছে দিন। বেশ মিল আছে।  আরএক মহাপ্রভু বলে, ওরা করেছিল খেলা হবে, আমরা দিই খেলা শেষ? এদের বুদ্ধি দেখলে উনিজির গা জ্বলে যায়। খেলা শেষ আর বেলা শেষ এর মধ্যে কী তফাত? এইজন্যই উনিজি সৃজনশীল কাজে এদের ডাকেননা। শুধু রাম্মিডিয়ার উপর ভরসা করেন। কিন্তু এখানে তারাও ফেল। জিজ্ঞাসা করতে তাদের প্রতিনিধিও মাথা-চুলকে বলে, আমরা তো অজ্জিনাল কিছু করিনা স্যার।উনিজি খুব চটে গিয়ে বললেন - তবে কর টা কী? ছোকরা খুব আমতা আমতা করে বলল, ওই দেখেননা, বিদেশী শো টুকে ক্রোড়পতি-টোড়পতি হচ্ছে। আমরা খবরেও তাইই করি। এখানেও সেরকম একটা কিছু করব স্যার? উনিজি পরীক্ষা করার জন্য  বললেন, কর দেখি। ছোকরা এবার একটু উৎসাহ পেয়ে বলল, মাকুদের অনেক জবরদস্ত স্লোগান ছিল। গরম গরম। ওদেরটা টুকব? উনিজি কিছু বললেননা। দৌড় মাপছেন। ছোকরা তাতে আরও উৎসাহ পেয়ে বলল, ওদের একটা স্লোগান ছিল, আমার নাম, তোমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম। ওটাকে বদলে করব, আমার নাম তোমার নাম / জয় শ্রীরাম জয় শ্রীরাম। এরপর আর চুপ থাকা সম্ভব না। উনিজি বললেন, চোপ। এটা কি মামারবাড়ি? সবার নামই রাম হলে আমি কী হব শুনি? ছোকরা শুনে একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, তাহলে মুলোদের ট্রাই করি স্যার? দৌড় কতদূর দেখতে উনিজি বললেন, কর।- ওদের একটা ছিল, কেশপুরকে শেষপুর করে দেব। বেশ জিঘাংসু ব্যাপার আছে একটা। ওটাই ঝেড়ে দিই। আমরা বলব, ফেসবুককে শেষবুক করে দেব। এটা কেমন হবে স্যার? কেমন আর হবে। ফেসবুককে শেষ করে দেবে বলছে, কোনদিন বলবে হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটি ব্যান। উনিজি গম্ভীর ভাবে বললেন, আরেকটা বল। এটাই তোমার শেষ সুযোগ। দেখি কী পার।ছেলেটা একটু হাত কচলে বলল, তাহলে একটা সোজা ট্রাই করি স্যার। ধুপধাপ  ফুলে ছাপ। এট খুব হিট হয়েছিল। আমরা তো সবই জোরে-সোরে করি, তাই ওটা ধুপধাপ করে দিয়েছি। উনিজি এবার প্রচণ্ড রেগে বললেন, ওরে মর্কট, এতে কোন ফুল বোঝা যাবে কীকরে। হিন্দুত্বের ব্যাপারটাই তো নেই। পয়সা দিয়ে যাদেরকে পুষেছি, তারা হয়তো জোড়াফুলে মেরে দিয়ে এল। তখন? রাম্মিডিয়ার ছেলেটার মুখে আর কথা সরে না। উনিজি বললেন, তোদের আইডিয়া খারাপ না, জানিস তো। কিন্তু কোনো ফিনিশিং নেই। ধুপধাপ নয়। ওটা করে দে হুপহাপ ফুলে ছাপ। যেমন কথা তেমন কাজ। পরের দিন রাম্মিডিয়ায় হই হই পড়ে গেল। নতুন স্লোগান "হুপহাপ ফুলে ছাপ"। হেডলাইন হল, "উনিজির মাস্টার স্ট্রোক"। সঞ্চালকরা স্কুপ-নিউজের নাম দিয়ে দিলেন হুপ নিউজ। "ব্রেকিং" এর বদলে পর্দায় লেখা শুরু হল "হুপ"। শিল্পমহলেও নাড়াচাড়া পড়ে গেল। এক বিখ্যাত শিল্পপতি তাঁর ছেলের বিয়ের একশএগারো দিন আগের অনুষ্ঠানে হলিউড থেকে নিয়ে এলেন হুপি গোল্ডবার্গকে। শিল্পসংস্কৃতিতেও তুলকালাম। রূপকলা কেন্দ্রের নাম হয়ে গেল হুপকলা কেন্দ্র। এক হনুমান কলা খাচ্ছে, এই হল তার প্রতীক। রাম্মিডিয়ায় জানা গেল বাংলার বৈষ্ণব আন্দোলনের নেতার আসল নাম ছিল হুপ সনাতন। সেই নিয়ে টিভিতে ঝড় উঠল। বাচ্চারা রুপকথার বদলে পড়তে লাগল হুপকথা, তাদের জন্য তৈরি হল কমিক্স, "ছোটো হুপ"।ধর্মের জগতে যা হল, তা তো অকল্পনীয়। নতুন এক পরব চালু হয়ে গেল, যার নাম হুপচতুর্দশী। এতদিন পর্যন্ত বিধর্মীরা তেড়ে লাভ-জিহাদ চালিয়ে যাচ্ছিল, এবার পাল্টা হিসেবে হুপচতুর্দশীতে তাদের ধর্মস্থানের সামনে লাফালাফি শুরু হল। এর নাম দেওয়া হল লাফ-জিহাদ। আর যারা লাফ দেয়, তাদের নাম হল ল্যাজোদ্ধা। সব চেয়ে বড় ব্যাপার হল হুগলীতে। বলাগড়ের কাছে গুপ্তিপাড়া বলে এক জায়গায় পুরোনো ভাঙা মসজিদের নিচে পাওয়া গেল এক হনুমানের ল্যাজ। হনুমানকে মেরেই ওই মসজিদ তৈরি হয়, জানার পর তৎক্ষণাৎ মসজিদ ভেঙে ফেলা হল। স্বয়ং উনিজি হাজির হয়ে গুপ্তিপাড়ার নাম বদলে করে দিলেন হুপ্তিপাড়া। সেখানে তৈরি হল এক বিরাট হুপমন্দির। পুজোর  নতুন নাম হল হুপাসনা। রাম্মিডিয়ায় দেখানো হল দলে দলে লোকে ল্যাজ লাগিয়ে হুপাসনা করছে। কেউ পড়ছে হুপ চালিসা। কেউ হুপঙ্কর মন্ত্র। পিছনে মন্ত্রপাঠ হচ্ছে, "জয় জগদীশ হরে /  কারো ল্যাজ স্থির থাকে কারো ল্যাজ নড়ে"।রাষ্ট্রনেতারাও পিছিয়ে রইলেননা। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এক এলাকায় লাভ-জিহাদের উপদ্রব দেখা দিলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পাঠিয়ে দিলেন পূর্বতন স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপকে। ততদিনে অবশ্য তার নাম বদলে করে দেওয়া হয়েছে স্পেশাল প্রোটেকশন হুপ। তারা হেলিকপ্টার,  ড্রোন, ইউএফও ইত্যাদি চড়ে হুপ-হুপ ধ্বনি করে পরমানু বোমা উদ্ধারে নেমে পড়ল। রাম্মিডিয়ায় দেখা গেল, আকাশ থেকে নেমে আসছে গাদা-গাদা রোবট। প্রত্যেকের হাতে তাগা-তাবিজ। মুখে একটাই কথা। হুপ। সঞ্চালক খুব উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন, পশ্চিমবঙ্গের বুকে আজ কেবল শোনা যাচ্ছে হুপিং কাশির শব্দ। এতদিন যা উপদ্রব ছিল, আজ তার শেষ, আজ থেকে কেবল হুপদ্রব।সব মিলিয়ে দেশে হুপপ্লব দেখা দিল। উনিজি কি এতটা ভেবেই স্লোগান ঠিক করেছিলেন? জানার আর কোনো উপায় নেই। কারণ প্রশ্ন করলে তিনি এখন আর কোনো উত্তর দেন না। শুধু বলেন, হুপ।  চিত্রঃ যদুবাবু 
    নির্বাচন - প্যালারাম | আজ ৬ই মে, ২০২৪। ইউক্রেনে এখনো যুদ্ধ চালু। মণিপুরে এখনো আগুন জ্বলছে। গাজ়ায় পরিকল্পিত নরহত্যা আর মানব-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের দ্রুত নিষ্পত্তি হবে—এমন কোনো চিহ্ন নেই। বরং প্যালেস্তাইনের সমর্থনে/বিপক্ষে গোলযোগ বেঁধেছে আমেরিকায় (এক্ষুনি খবর পেলাম: নেতানিয়াহু ইজ়রায়েলে আল জাজ়িরার সব লোকাল অফিস বন্ধ করে দিয়েছে)।দেশে চলছে নির্বাচন। রাজ্যে রাজ্যে তার আলাদা রূপ। আমার রাজ্যে, বিজেপি তার গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে ফেলে পুরো ঘৃণা-বাণিজ্যের জামা পরে ফেলেছে, সিপিয়েম কোনো এক লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল দিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখে কথা বসাচ্ছে, তৃণমূল চুরি করেছে কিনা কেউ জিজ্ঞেস করছে না—শুধু প্রশ্ন, চুরি কতটা? পুকুর, দীঘি, না পুরো সমুদ্দুর!পাড়ায় পাড়ায় গুন্ডার দল—যারা আজ তৃণমূলের—প্ল্যান ছকছে: রেজাল্ট ঠিক কেমন হলে দলবদল করবে। বিজেপি তার ওয়াশিং মেশিন চালিয়ে সেই সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত করছে। কিছু বামপন্থী, যাঁরা নিজেদের মার্ক্সিস্ট মনে করে অনুভূতিতে প্লাবিত হন, এখনো বুঝে  উঠতে পারেননি, যে দিবারাত্র ফেসবুকে তক্কো আর হ্যা হ্যা করতে করতে তাঁরা আসলে ট্রোল-এ পরিণত হয়েছেন, তাই যেসব যুবনেতা-নেত্রীর ছবি শেয়ার করে তাঁরা উদ্বেল, তাঁদের কাজে লাগার বদলে ক্ষতিই করছেন বেশি।মানুষ তিক্ত, দেশগুলি যুযুধান, পৃথিবী উষ্ণতর।আত্মবিস্মৃত। আবার কি একটা প্যানডেমিক দরকার এই অলক্ষুণেদের মনে করাতে – যে রক্তের গ্রুপ হয়, ধর্ম না? অক্সিজেনের রঙ নেই, ঝান্ডার আছে? প্রিয়জনের মৃত্যুর সময়ে তার পাশে না থাকতে পারার চেয়ে বড় যন্ত্রণা কিছুতে নেই—সে তার রাজনৈতিক আদর্শ যা-ই হোক না কেন? যে সমস্ত ভয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অসূয়া, অসহিষ্ণুতা আমাদের 'পৃথক' করে, আসলে তা বিশ্বব্যাপী? সেসবই আমাদের 'মানুষ' বানায়?কবে বুঝবে গড্ডল, যে, বিজ্ঞান আর নৈতিকতার মিশেলে আসে প্রগতি? কোনো মোদি, দিদি বা নেতানিয়াহুর হাত ধরে নয়? কবে সভ্যতা তার উত্তেজনা সীমাবদ্ধ রাখবে দার্শনিক তর্কের প্রাঙ্গনে—দেশ, জমি, পাড়া, চাকরিদখলের পেশিপ্রদর্শন করবে না? নিজের অপ্রাপ্তির ভার অনলাইনে ষোল বছরের শিশুর সাফল্যের খবরের নীচে উগরোবে না? শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজো গুলিয়ে, আজ অনুকূল ঠাকুর, কাল মেঘনাদ সাহার ছবিতে মাল্যদান করবে না? কবে দূরদর্শী হবে ভারতীয়? কবে 'সত্যমেব জয়তে'-র বিকল্প হিসেবে 'ধন্দা হি সব কুছ হ্যায়' বসানোর নির্বুদ্ধিতা খেয়াল করবে?নির্বাচন এসেছে। মতের সমর্থন, বিরুদ্ধাচরণ করুন। ক্ষমতাবানেদের প্রশ্ন করুন। প্রতিবেশীর, সহকর্মীর, সহযাত্রীর সঙ্গে লড়বেন না। তাঁদের চোর, চাড্ডি, পাপ্পু, মাকুর বাচ্চা, চটিচাটা বলে থুতু ছুঁড়বেন না। কাল যখন আপনার পরিবারের কেউ অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকবে, ওঁরাই আসবেন, পাশে দাঁড়াবেন। সকলেই ভীত – আমরা সব্বাই রক্তভরা ক্ষয়িষ্ণু চামড়ার ব্যাগ। রাগবেন না। ভালো থাকুন। সকলেরই সন্তান দুধে ভাতে থাকুক। 
  • জনতার খেরোর খাতা...
    জীবন তরঙ্গ - ১০ - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ - পর্ব ১০নয়নের ছোটমামা আগ্রহী শ্রোতাদের কাছে ধীরে ধীরে মেলে ধরল কোলকাতার উন্নয়নে ব্যয় করা অর্থের উৎসের কাহিনী। -- তোমরা আশাকরি লর্ড ওয়েলেসলির নাম শুনেছ। আঠার শতকের একেবারে শেষ দিকে ওয়েলেসলি ভারতে বড়লাট হয়ে আসেন। বছর সাতেক ভারত অধীশ্বর হয়ে এই শহরে ছিলেন। এই শহরটা ছিল তখন ভারতের রাজধানী। তাঁর আমলেই কোলকাতাকে একটা রাজকীয় শহর করার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। ওয়েলেসলি ছিলেন দক্ষ প্রশাসক। তিনি বুঝেছিলেন যে শহরের রাস্তাঘাট, যানবাহন, আইন শৃঙ্খলা, এগুলোকে ঠিকঠাক করতে না পারলে মনের মত করে রাজ্যপাট সামলান যাবে না। তিনি শহরকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য অনেক রকম চিন্তা ভাবনা করলেন। চিন্তা ভবনা অনুযায়ী প্ল্যান ছকা হল। পরিকল্পনা মত কাজও শুরু হল। কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল বিশাল টাকার দরকার। সরকারে ভাঁড়ারে অত টাকা নেই। ইংল্যান্ডে অনেকদিন থেকেই লটারি বেশ জনপ্রিয়। সে দেশের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ লটারির উদ্বৃত্ত টাকায় হয়েছে। এখানকার কর্তাব্যক্তিরা প্রথম দিকে একটু চিন্তায় পড়লেও বড় কাজকর্মের জন্য টাকা যোগাড় করতে, নিজেদের দেশের চেনা পথটাই বেছে নিয়েছিল। আঠার শতকের শেষ দশক থেকে উনিশ শতকের তিনের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত লাটারিই ছিল শহরের যাবতীয় উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন। ধারাবাহিকভাবে লটারি করার জন্য তৈরি হয় লটারি কমিটি। বিভিন্ন কাজের জন্য হতে থাকল একের পর এক লটারি। সেগুলোর উদ্বৃত্ত টাকা থেকে লটারি কমিটি কোলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে তৈরি করে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, উড স্ট্রিট। গঙ্গার গা ঘেঁসে তৈরি হল স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোড। ডিঙ্গাভাঙ্গা খাল বুজিয়ে তৈরি হল ক্রিক রো।১৮১৭ থেকে ১৮৩৬ এর মধ্যে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কিড স্ট্রিট, কলুটোলা স্ট্রিট, আমহারস্ট স্ট্রিট, মির্জাপুর স্ট্রিট, ক্যানাল স্ট্রিট, ময়রা স্ট্রিট, হ্যাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিট, লাউডন স্ট্রিট, রডন স্ট্রিট, হেস্টিন্স স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, ম্যাঙ্গো লেনের এর মত বহু রাস্তা তৈরি হয়েছে, চওড়া হয়েছে বা পাকা হয়েছে। শহরে জলের জোগান বাড়াবার জন্য ওয়েলিংটন স্কয়ার ছাড়াও কর্নওয়ালিস স্কয়ার, কলেজ স্কয়ার, ওয়েলেসলি স্কয়ারের মত বেশ কয়েকটা পুকুর খোঁড়া হল। রাস্তাঘাটের উন্নয়নের পাশাপাশি শহরের জঞ্জাল সরান আর নর্দমা সংস্কারের ব্যাপারেও লটারি কমিটির যথেষ্ট অবদান ছিল।শুনলে তোমরা আশ্চর্য হবে যে ১৮০৫ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে লটারি থেকে আয় করা ২৫ লাখ টাকা শহরের উন্নয়নে খরচ করা হয়েছিল। এখন শুনতে খুব বেশিমনে না হলেও সেকালের হিসেবে ২৫ লাখ ছিল বিশাল টাকা। তবে লটারি কমিটির যা কিছু উন্নয়নমূলক কাজকর্ম সব চৌরঙ্গীতে এসে থেমে গেছে, তার দক্ষিণে তেমন কিছু হয়নি। ভন্টে, এর কারণটা বলতে পারবি?ভন্টে মামার কথায় দু পাশে মাথা নাড়ল।-- কারণটা হল, আজকের শহরের দক্ষিণ অঞ্চলটা ছিল আদি কোলকাতার সীমানার বাইরে। ভন্টে কোলকাতায় টাউন হল দেখেছিস?নয়ন জানাল যে দেখেছে।-- ওটাও লটারির পয়সায় হয়েছে। বেশ কয়েকবার লটারি করার পর তার টাকায় তৈরি হয়েছে ঐ সুন্দর বাড়ি। তৈরি হতে সেই সময়েই খরচ হয়েছে সাত লাখ।একটা প্রশ্ন রমেন তোমাদের মনে নিশ্চই উঁকি মারছে। পর পর যে এত লটারি হত, তার টিকিট কারা কিনত? সময়ের হিসেবে টিকিটের দাম যথেষ্ট ছিল।রমেন সম্মতি জানিয়ে বলল— তুমি আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিলে। এখুনি সেই কথাটাই ভাবছিলাম। তখন স্থানীয় বাসিন্দারা অধিকাংশই তো খেটে খাওয়া গরিব মানুষ।-- ভাবছ, তাহলে শুধু সাহেবরাই কি এত লটারির টিকিট কিনত! এটা ঠিক যে সাহেবরা অনেক টিকিট কিনত, কিন্তু শুধুমাত্র তাদের ভরসাতেই এতগুলো লটারি উৎরে যায়নি। স্থানীয় মানুষদেরও এই লটারিতে অনেক অবদান আছে। সেকালের পয়সাওয়ালা বাবুরা সখ আহ্লাদ মেটাতে নানাভাবে লাখ লাখ টাকা খরচ করত। সাহেবরা ছিল আমাদের বাবুদের বাবু। নিজেদের স্বার্থে সাহেব বাবুদের খুশি রাখতে আমাদের বাবুরা যে কোন কাজে সব সময় তাদের পাশে থাকত। লটারির সময়েও ছিল। তারাও কাটত অনেক টিকিট। এখানেই শেষ নয়, অসংখ্য দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ লোভে পড়ে ভাগ্য ফেরাতে লটারিতে গুঁজে দিয়েছে তাদের আয়ের সিংহভাগ টাকা।ছোটমামা কোলকাতা ছাড়াও আরো অনেক বিষয় নিয়ে গল্প করত, তবে নয়নের পুরনো কোলকাতার গল্প শুনতে বেশি ভাল লাগত। মামার কাছে ইতিহাসের গল্প শুনতে শুনতেই ও ইতিহাসের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল, হয়ত সেই কারণেই কলেজে ইতিহাসকেই বেছে নিয়েছিল।নয়ন বাবা বা মা কোনো দিকেরই দাদু বা দিদাকে চোখে দেখেনি। দুর্ভাগ্যবশত চারজনই নয়ন আসার আগেই চলে গিয়েছেন। মায়ের বাবা আর মাকে তো রমেনও দেখেনি। আহেলির বিয়ের আগেই তাঁরা একে একে গত হয়েছেন। তবে নয়নের সেই অভাব অনেকটা পুষিয়ে দিয়েছেন অবনি দাদু আর শান্তি দিদা। অবনি দাদু আর শান্তি দিদা ছিলেন নয়নের মার ছোটকাকা আর কাকিমা। দুজনেই খুব ভাল মানুষ। আহেলির অল্প বয়সে বিয়ে হয়, স্বাভাবিক ভাবেই ওর দাদাদেরও তখন বয়স বেশী নয়। এই কাকা আর কাকিমা নিজের মা বাবার মত আহেলির বিয়ের সব দিক সামলেছিলেন।অনেক সময় ওপরওয়ালার বিচারে একটু ফাঁক থেকে যায়। তা না হলে অমন ভাল মানুষের জীবনে ভালর এত অভাব হবে কেন! শিবানী ছিল ওনাদের একমাত্র সন্তান। একটু বড় হতেই বোঝা গেল যে মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী। ভাগ্যের এই বিড়ম্বনাকে হজম করতে শিবানীর মা বাবার কিছুটা সময় লেগেছিল। নয়নের মায়ের থেকে শিবানী বছর খানেকের মত ছোট ছিল। ছোটবেলায় আহেলি একসাথেই খেলাধুলো করত। বোনের সমস্যাটা জানত বলে ছোট থেকেই আহেলি ওকে একটু আগলে রাখত। বেশি সঙ্গ পেত বলে নন্দাও টিনা দিদিকে খুব ভালবাসত। নন্দার কথা ছিল আধো আধো আর অস্পষ্ট। প্রথম শুনলে অনেক কথাই বোঝা যাবে না। মা বাবা আর টিনা দিদি ওর সব কথাই বুঝতে পারত। টিনা দিদি যা করবে, পারুক বা না পারুক, ওরও সেটা করা চাই। ছোটবেলায় টিনা দিদি স্কুলে যাচ্ছে দেখে নন্দাও স্কুলে যাওয়ার জন্য বায়না ধরল। আহেলির বাবার অনেক চেনা জানা ছিল। ঊনিই খোঁজ খবর নিয়ে ভাইঝিকে ওর উপযুক্ত একটা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। শিশু নন্দার তখন সে কি আনন্দ। স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিন নিজের মত করে মাকে শোনাত স্কুলের সব ঘটনা। কোনদিন মেয়ের মুখ গোমরা হয়ে থাকলে শান্তি বুঝতে পারতেন কারো সাথে ঝগড়া হয়েছে বা স্কুলে এমন কিছু হয়েছে যা ওর পছন্দ নয়। বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবার সাথেও সারাদিনের জমে থাকা অনেক কথা বলত, তার মধ্যে মাঝে মাঝে মার বিরুদ্ধে নালিশও থাকত। এই ধরনের ছেলেমেয়েরা সাধারণত ছটফটে হয়না, কিন্তু নন্দা বেশ দুরন্ত ছিল। বাড়িতে সারাক্ষণ এদিক ওদিক ছুটে বেড়াত। আছাড় খেলে খানিক কান্নাকাটি করে নিজেই চুপ করে যেত। কেটে গিয়ে রক্ত পড়লে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে এসে বলত—মাম্মা, কেতে অক্ত পোচ্ছে, ওউধ দাও।শান্তি একটু বকে দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিলেই থেমে যেত কান্না।নন্দাদের বসার ঘরে ছোট একটা আলমারির মাথায় মারফি কোম্পানির একটা মাঝারি রেডিও ছিল। বুঝুগ আর না বুঝুগ রেডিওটা যখন চলত নন্দা চুপ করে বসে শুনত। রেডিও থেকে এক এক সময়ে এক এক রকনের গলার আওয়াজ শুনে ও খুব বিস্মিত হত। ভেবে পেত না যে এটা কি করে সম্ভব। একদিন কাজকর্ম সেরে শান্তি একা বসে শান্তিতে অনুরোধের আসর শুনছিলেন। নন্দা আশপাশেই কোথাও ছিল, রেডিওর আওয়াজ কানে যেতেই গুটিগুটি পায়ে এসে মায়ের পাশে বসে পড়ল। শুধু বসলে তো সমস্যা ছিল না, শুরু হল একের পর এক প্রশ্ন।-- মাম্মা, ওতুকুনি বাতকের বেতর কত্তো লোক।শান্তি কোন উত্তর না দিয়ে আপন মনে অনুরোধের আসরের গান শুনতে থাকলেন।এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। উত্তর না পেয়ে মাকে ঝাঁকুনি দিয়ে আবার শুধল—মাম্মা ছোন না।শান্তি বিরক্ত হয়ে বললেন—শান্তিতে একটু গান শোনারও উপায় নেই। কি বলছিস?-- ওত্তুকুনি বাতকের বেতর অত্তো লোক কি করে তাকে?শান্তি খানিক বোঝাবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে রেডিও বন্ধ করে উঠে গেল। পরে একসময় টিনা দিদি ওকে ব্যাপারটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। সেও আর এক জ্বালা। মা রেডিও খুলে বসতেই শুরু হল মাকে বোঝান।-- মাম্মা তুমি কিত্তু জান না। আমায় তিনা দিদি বলেতে, বাতকের বেতর কেউ নেই। বাতক তেকে খালি আওয়াজ আতে।শান্তি মেয়ের কাছে নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করে সেদিনের মত নিষ্কৃতি পেল।চলবে
    জীবন তরঙ্গ - ৯    - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ - পর্ব ৯ অল্প বিরতির পর চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে ছোট মামা আবার শোনাতে শুরু করল শহরের সেকালের কাহিনী।-- বর্গিরা ছিল দস্যুর দল। এই হানাদারেরা কাছেপিঠের কেউ নয়, আসত সেই মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে। যেখানে আসত সেখানকার সব কিছু লুট করে নিয়ে যেত। লোকেদের ওপর চরম অত্যাচার করত, কখনো কখনো প্রাণেও মেরে ফেলত। তবে ওই দস্যুরা ঘোড়ায় চড়ে আসত বলে গঙ্গা পার হয়ে এদিকে আসেনি। যা কিছু বদমায়েশি সব গঙ্গার পশ্চিম পারেই করেছে। কিন্তু তাই বলে তো চুপ করে বসে থাকা চলে না। যদি চলে আসে তখন কি হবে! বিবাদি বাগের লাল দিঘির পাশে তখন একটা কেল্লা ছিল। তবে নামেই কেল্লা, মাটির গাঁথনির নড়বড়ে বাড়ি। শহরকে এই দস্যুদের হাত থেকে কিভাবে বাঁচান যায় তা ঠিক করতে সাহেবরা আলোচনায় বসল। ওদের লোকজন শহরময় বিস্তর ঘোরাঘুরি করে এসে জানাল যে ওই দস্যুদের আটকাবার মত ব্যবস্থা শহরে নেই। যা সৈন্য আছে তা দিয়ে বর্গিদের আটকান যাবে না। সকলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। গঙ্গার ধারে কয়েকটা কামান বসান হল। কিন্তু দস্যুরা যদি উলটো দিক দিয়ে আসে তখন কি হবে? অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হল যে শহর ঘিরে কাটা হবে চওড়া একটা খাদ। বাগবাজার থেকে শুরু হয়ে পূব দিক ঘুরে সেই খাদ শেষ হবে গোবিন্দপুরে। এখনকার হেস্টিংস এলাকার তখন নাম ছিল গোবিন্দপুর। কাজ শুরু হল। শয়ে শয়ে লোক কোদাল, বেলচা নিয়ে কাজে লেগে গেল। টানা ছয় মাস কাজ চলার পর খবর এল যে সমস্যার কিছু একটা সুরাহা হয়েছে। খাদ কাটার কাজ বন্ধ হল। ততদিনে তিন মাইল খাদ কাটা হয়ে গেছে। এখনকার যে এন্টালি অঞ্চল, ওই পর্যন্ত খাদ কাটা হয়েছিল। ওই খাদকে বলা হত ‘মারাঠা ডিচ।’ মারাঠা দস্যুরা কখনো কোলকাতার বুকে পা দেয়নি। ভাগ্য ভাল যে দেয়নি কারণ, এর চোদ্দ পনের বছর পরে সিরাজউদৌলা ড্যাং ড্যাং করে সৈন্য সামন্ত নিয়ে ওই খাদ টপকে কোলকাতায় ঢুকে পড়েছিল। বর্গিরা না এলেও ওই ‘মারাঠা ডিচ’ এর জন্য কোলকাতার লোকেদের নাম হয়ে গেল ‘ডিচার’। সেই কাটা খাদ অনেকদিন ঐ অবস্থাতেই পড়ে রইল।এরপর বহুদিন বাদে সেই খাদ বুঝিয়ে তৈরি হল কোলকাতার প্রথম চওড়া পাকা রাস্তা। তবে পাকা মানে এখনকার মত পিচের পাকা রাস্তা নয়, সে ছিল খোয়া দিয়ে বাঁধান পাকা রাস্তা। বলত দেখি সেই রাস্তাটার নাম।নয়ন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।-- পারলি না তো। খুব চেনা রাস্তা। তখন নাম ছিল সার্কুলার রোড। এখন রাস্তাটার উত্তর দিকের নাম আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রোড আর দক্ষিণ দিকের নাম আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোড। এই রাস্তার ভেতরের অঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিম দিকে গঙ্গা পর্যন্ত অঞ্চলটা হল আদি কোলকাতা। অবশ্য এটা যেন ভাবিস না যে এই আদি কোলকাতার সবখানেই জনবসতি ছিল। আজকের চৌরঙ্গীর সাহেবপাড়া, গড়ের মাঠ এ সব এলাকায় ছিল ঘন জঙ্গল। চিৎপুর থেকে ওই ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কালিঘাট পর্যন্ত একটা রাস্তা ছিল। এখান দিয়ে তীর্থ যাত্রীরা যেত বলে সাহেবরা রাস্তাটির নাম দিয়েছিল ‘রোড টু পিলগ্রিম।’ জন্তু জানোয়ার আর ডাকাতের ভয়ে তীর্থ যাত্রীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে দল বেঁধে মায়ের মন্দিরে যাতায়াত করত। এককালে এই শহরের দোরগোড়া থেকে সুন্দরবন শুরু হত। তবে আজ থেকে তিন চারশ বছর আগেও আমাদের এই বাগবাজার, শোভাবাজার, এইসব এলাকাগুলোয় অনেক নামী দামী লোকেদের বাস ছিল। আগের অনেক কিছুপাল্টে গেলেও মারাঠা ডিচের সাক্ষী হয়ে বাগবাজারে আজও রয়ে গেছে একফালি রাস্তা, মারাঠা ডিচ লেন। ভন্টে একদিন আমার সাথে গিয়ে দেখে আসবি, যদিও কয়েকটা বাড়িঘর ছাড়া সেখানে আলাদা ভাবে আজ আর দেখার কিছু নেই।আর একদিন কোলকাতার রাস্তা নিয়ে কথা হচ্ছিল।-- বুঝলি ভন্টে, কিছু কিছু রাস্তার নামের সাথে না তখনকার কিছু ঘটনা জড়িয়ে আছে। সেকালে ইংরেজ রাজপুরুষদের মধ্যে তর্ক বাঁধলে মুখে যদি মিটে গেল ভাল, তা না হলে বন্দুক বা তরোয়াল নিয়ে লড়তে নেমে যেত। একে বলা হত ডুয়েল। আলিপুরে একটা রাস্তায় সাহেবদের দুই বড়কর্তা ওয়ারেন হেস্টিংস আর ফিলিপ ফ্রান্সিস ডুয়েল লড়েছিলেন। সেই থেকে রাস্তাটার নাম হয়ে গেল ‘ডুয়েল অ্যাভিনিউ”।রাজভবন দেখেছিস তো ?নয়ন একাধিকবার দেখেছে তাই মামার কথায় সম্মতি জানায়।-- রাজভবনের উলটো দিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে। বড় বাহারি নাম ছিল তার, ‘ফ্যান্সি লেন।’ ছিল বললাম কারণ এখন সেই নাম আর নেই। এখন রাস্তাটার নাম হয়েছে, পান্নালাল ব্যানার্জী স্ট্রিট। ফ্যান্সি মানে সৌখিন বা সুন্দর কিছু ভাবছিস তো! ব্যাপারটা কিন্তু একেবারেই উল্টো। এখানে দিনের আলোয় সকলের সামনে ফাঁসি দেওয়া হত। ফাঁসি শব্দটা সাহেবদের মুখে উচ্চারণ দোষে হয়ে যায় ফ্যান্সি।দুশ আড়াইশ বছর আগে গঙ্গা থেকে একটা শাখা চাঁদপাল ঘাটের পাশ থেকে বেরিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের গা ঘেঁসে বেলেঘাটা হয়ে লবন হ্রদে গিয়ে পড়ত। কারো কারো মতে ওটা সুন্দরবন পর্যন্ত গিয়েছিল। ১৯৩৭ সালে একবার চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। ঐ সময় ওই খালে অনেক নৌকো ডুবে গিয়ে প্রচুর মানুষ মারা যায়। সেই থেকে খালটার নাম হল ডিঙ্গা ভাঙা খাল। এই খালের ধারে একটা বড় গাছ ছিল। সামান্য দোষে, কখনো বা বিনা দোষে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে লোক জড় করে ওই গাছেতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হত স্থানীয় গরিব মানুষদের। একবার ব্রজকিশোর নামে একটা লোককে ২৫ টাকা দামের একটা ঘড়ি চুরির অপরাধে ওই গাছে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কত লোককে যে এখানে মারা হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ওই খাল বুজিয়ে পরে তৈরি হয় ফ্যন্সি লেন, কিরণ শঙ্কর রায় রোড আর ক্রিক রো।ছোটমামা ছুটিছাটা পড়লে মাঝে মাঝে রহড়ায় এসে থাকত। তখন নয়নের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। সামনে অখন্ড অবসর। সামনের দুমাস পড়াশোনার সাথে কোন লেনাদেনা নেই। হাঁড়ি পুকুরের চাতালের আড্ডায় সবে অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে জয়েন করেছে। হঠাৎ একদিন মামার আগমন। জানাল, কয়েকদিন থাকবে। নয়নের তো খুব আনন্দ। মামা এলে নয়ন মামার সাথেই বেশিরভাগ সময় কাটাত। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি, আড্ডা, তখন সব সাময়িকভাবে বন্ধ থাকত। একদিন মামাকে নিজের স্কুল দেখিয়ে নিয়ে এল। সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছে, বাইরে লোকজন খুব কম। নয়নের বাবাও শালার অনারে অফিস কামাই করেছে। বিকেলবেলা তেলেভাজা, মুড়ি আর চা এর সঙ্গতে গুছিয়ে আড্ডা বসেছে। টেবিলে দুটো লটারির টিকিট দেখে নন্দ বোনকে জিজ্ঞেস করল—টিনা, লটারির টিকিট কে কাটে?-- ওই তোমার ভাগনেকে কেউ গছিয়ে দিয়েছে।নয়ন একটু লজ্জা পেয়ে বলল—আমার এক পরিচিত ছেলে বিক্রি করছিল। এমনভাবে বলল যে না করতে পারলাম না।-- এতে সংকোচের কিছু নেই। শোন ভাল থাকতে কে না চায়। কেউ যদি একটু ভাল থেকেও থাকে তবু আর একটু ভাল থাকতে পারলে মন্দ লাগার কথা নয়। কি রমেন ঠিক বলছি তো?-- এ নিয়ে কোন সন্দেহ আছে নাকি!-- এই আর একটু ভাল থাকতে গেলে লাগে বিদ্যা, বুদ্ধি, একাগ্রতার মত কিছু গুণ আর সাথে খানিক ভাগ্য। আবার কেঊ কেউ শুধু ভাগ্যের জোরেই পেয়ে গেছে অনেক কিছু। তাই একটু সভ্য হওয়ার পর থেকেই মানুষ ভাগ্যের গোড়ায় সার দিতে লেগে পড়েছে। সেকালের পাশা খেলা থেকে আজকের লটারি সবেতেই মানুষ মেতেছে চট জলদি ভাগ্য ফেরাবার তাগিদে। এ তো গেল মানুষের কথা। কিন্তু একটা গোটা শহরের অবস্থাও কি লটারি ফেরাতে পারে? তোমরা কি বল?কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে নন্দদুলাল এক এক করে সকলের মুখের দিকে তাকাল। সবাই ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে নন্দ আবার বলতে শুরু করল—পারে, আলবৎ পারে। পারে কেন, পেরেছে। আমাদের এই প্রাণের শহর কোলকাতার বেশ কিছুটা গড়ে উঠেছে, পুষ্ট হয়েছে বা মসৃণ হয়েছে লটারির কল্যাণে। রমেন কি জান, তুমি বাসে, ট্রামে বা হেঁটে যে রাস্তা দিয়েই অফিস যাও না কেন তার কোনটা না কোনটাতে লটারির ছোঁয়া লেগে আছে। এমনকি মিটিং বা সমাবেশের জন্য মাঝে মাঝে লোকে যে সব জায়গায় জড় হয়,সেই পার্কগুলোর বেশ কয়েকটা লটারির দাক্ষিণ্যে তৈরি হয়ছে।রমেন একটু অবাক হয়ে বলল—ওগুলো তো কর্পোরেশন বানিয়েছে। ওর সাথে লটারির কি সম্পর্ক?-- আছে বলেই তো বলছি। প্রশাসন বানিয়েছে একথা সবাই জানে, কিন্তু অত টাকা এল কোথা থেকে? তবে শোন সেই টাকার উৎসের কাহিনী। চলবে
    জীবন তরঙ্গ - ৮     - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ - পর্ব ৮ ২৪ পরগণা সেই সময় একটাই ছিল, উত্তর আর দক্ষিণে ভাগ হয়নি। শেয়ালদা দক্ষিণ লাইনে বারুইপুর তখনো শহরের তকমা পায়নি। অঞ্চলটা একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। দিগ্বিজয় মিত্র ছিলেন ওই গ্রামের একজন প্রভাবশালী লোক। দিগ্বিজয় আলীপুর কোর্টে ওকালতি করতেন। ভাল পসার ছিল, ফলে পয়সাও প্রচুর ছিল। অনেকটা জমি জায়গা সমেত বেশ বড় বাড়ি ছিল। দিগ্বিজয়্বর এক ছেলে এক মেয়ে। রজতের মা বাণী বড়, ছেলে রণজয় দিদির থেকে অনেকটা ছোট। ছোটবেলায় রজতের মামার বাড়িতে আসতে খুব ভাল লাগত। বাড়ি লাগোয়া বিশাল বাগান, আম, জাম কাঁঠাল, আরো কত কি। গাছ থেকে পেড়ে ফল খাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে। বাগানেই কেটে যেত অনেকটা সময়। মামা কলেজ থেকে ফিরেই ভাগ্নেকে সাইকেলে চাপিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যেত। সে বড় আনন্দের দিন ছিল, কোন আবদার অপূর্ণ থাকত না। দাদুকে সকলে সমীহ করে চলত। দাদু যা বলতেন তার ওপর কোন কথা চলত না, একেবারে ডিক্টেটর। বাণীও নিজের বাবার সাথে একটু কিন্তু কিন্তু করেই কথা বলত। একে জামাই তায় আবার অধ্যাপক তাই একমাত্র বিকাশকে দিগ্বিজয় বেশ খাতির করতেন। তবে নাতি সামনে গেলে দাদু মানুষটাই পালটে যেত। অমন ঘমন্ডি মানুষ একেবারে শিশুর মত হয়ে যেতেন। বিত্তের কারণে এলাকায় দিগ্বিজয়ের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল বটে, কিন্তু মানুষ হিসাবে তাঁর মোটেই সুনাম ছিল না। উকিল হওয়ার সুবাদে নানা অছিলায় এলাকার কিছু লোককে কেসে ফাঁসিয়ে আত্মসাৎ করেছেন বেশ কিছু স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি। কিছু স্তাবক বাদ দিলে অন্যেরা তাঁর কাছে খুব একটা ঘেঁষত না। অবশ্য তিনিও বাচবিচার না করে যাকে তাকে তাঁর কাছে ঘেঁসতে দিতেন না। ছেলে রণজয় ছিল একেবারে বিপরীত চরিত্রের। দিলখোলা সিধে সরল মানুষ। অনেকটা ওর মায়ের মত। সকলের সাথে হেসে কথা বলত, প্রয়োজনে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করত। এমন মানুষকে তো সকলেই কাছে চায়। রণজয়কে তার আচরণের জন্য গ্রামের প্রায় সকলেই খুব পছন্দ করত। প্রায় সকলে বললাম কারণ, কিছু লোক তাকে অপছন্দও করত। দিগ্বিজয় তাঁর ছেলেকে কোন দিক থেকেই নিজের মত করে গড়ে তুলতে পারেননি। তাঁর ছেলে হয়ে রণজয় যার তার সাথে মিশছে, তাদের বাড়ি যাচ্ছে, বিপদে নিজের কাজকর্ম ফেলে তাদের পাশে থাকছে, এগুলো হজম করা তাঁর পক্ষে কঠিন। ছেলেকে নরমে গরমে অনেকভাবে বুঝিয়েছেন কিন্তু কোন কাজ হয়নি। লেখাপড়াটাও তাঁর পছন্দমত করল না। তাঁর একান্ত ইচ্ছে ছিল ছেলে আইন নিয়ে পড়ুক। হাতে কলমে কাজ শিখিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছে দিতে পারবেন। অবাধ্য ছেলে তাও করল না, কলেজে ভর্তি হল অংকে অনার্স নিয়ে। এমন বেআদব ছেলেকে কোন বাবা পছন্দ করবে! চিরাচরিত প্রথা মেনে দিগ্বিজয়ের স্তাবকেরা নিজ স্বার্থে তার এই অপছন্দে ধুনো দিত। যদিও বাবার অনুপস্থিতিতে রনজয়ের সাথে দেখা হলে তাদের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন হত। ছোটবেলায় রজতের এসব ব্যাপার জানা বা বোঝার কথা নয়। তাই বড়দের সমস্যাগুলো ছিল একান্তই বড়দের, তার কোন ছায়া কখনো ওকে স্পর্শ করেনি। একটা সময় পর্যন্ত মামার বাড়ি মানেই ওর কাছে ছিল এক আনন্দ নিকেতন।নয়নের মামার বাড়ি বাগবাজারে। শরিকি আঁচড়ে টুকরো টুকরো হওয়া বাড়ির একটা টুকরো ওর মামাদের ভাগে পড়েছিল। মামাদের অংশে একতলায় আর দোতলায় দেড়খানা করে ঘর আর টয়লেট ছিল। এছাড়া ছিল কিছুটা দালান, যেটা বসার এবং খাওয়ার ঘর হিসাবে ব্যবহার করা হত। ব্যবহারে মিল থাকলেও ওই একটুকরো জায়গাকে ড্রইং কাম ডাইনিং বলাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ওপরে ওঠার সিঁড়িটা ছিল কমন। দোতলায় রাস্তার দিকে একটা ঝুল বারান্দা ছিল। ওটাই ছিল ওই বাড়ির একমাত্র খোলা জায়গা। নয়নের দুই মামা, দুজনেই মায়ের দাদা। বড়জন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, নামী কোম্পানিতে আছে। এছাড়া নিজেও আলাদা ভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানের হিসেবপত্র পরীক্ষা করে। বড় মামা মায়ের থেকে অনেকটা বড় হলেও বিয়ে হয়েছে মায়ের পরে। বড় মামার একটাই মেয়ে, নয়নের থেকে বছর তিনেকের ছোট। দাদু আর দিদা অনেক আগেই গত হয়েছেন। ছোটবেলায় নয়নের এই একটাই মামার বাড়ি ছিল, পরে তা বেড়ে দুটো হয়েছে। মেয়েটার যখন বছর পাঁচেক বয়স, বড়মামা প্রলয় ধর ওরফে ঝন্টু দমদমে ফ্ল্যাট কিনে চলে যায়। বড়মামা নিরুপায় হয়েই বাড়ি ছেড়েছিল। বড় পদে কাজ করে, নানা প্রয়োজনে বাড়িতে লোকজন আসত। প্রফেশনাল পরামর্শ নিতেও লোকজন আসে। এইটুকু জায়গায় খুব সমস্যা হত, কয়েকজন লোক একসাথে এলে বসতে দেওয়ার মত জায়গা হত না। ছোটভাই নন্দদুলাল বিয়ে করেনি বলে কোন রকমে হয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটা বড় হওয়ার পর ওর পড়াশোনার জন্য একটা ঘর দরকার, তাই বাধ্য হয়ে যেতেই হল। দমদমে প্রলয়ের ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। দুহাজার স্কয়ার ফিটের তিন কামরার বিশাল ফ্ল্যাট। অর্থ আছে তাই আয়েশ কিনতে কোন অসুবিধে হয়নি।ছোটবেলায় নয়ন বেশিরভাগ সময় মায়ের সাথেই মামার বাড়িতে আসত। বাবা এলেও রাতে খুব কমই থাকত। বাবা এখানে এলে মায়ের ছোট কাকাদের ঘরে থাকত। আহেলিকে তাঁরা নিজের মেয়ের মত ভালবাসতেন। তাঁদের আদর যত্নে রমেন নিজের শ্বশুর শাশুড়ির অভাব কখনো বুঝতে পারেনি। কাকা-কাকিমার কথায় পরে আসছি। নয়নের যতদূর মনে পড়ে দুই মামা যখন এই বাড়িতে একসাথে ছিল তখন দুর্গা পুজোর সময় বাবা দুবার থেকেছে। নয়নের বেশ মনে আছে সকলে মিলে হৈ হৈ করে ঠাকুর দেখতে বেরোন হত। সে কি মজা, কি আনন্দ! প্রথমবার তো বোন ঝিমলি একেবারে পুচকে বাচ্চা। ঝিমলিও নেহার মত নয়নকে নিজের দাদার মতই ভালোবাসে, একটু মান খাতিরও করে। বড়মামা দমদমে চলে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম নয়নের খুব খারাপ লাগত। মায়ের সাথে দুই মামার বাড়িতেই মাঝে মাঝে যেত, কিন্তু আগের সেই আনন্দটা আর পেত না। মায়ের মত নয়নেরও একা থাকে বলে ছোট মামাটার জন্য কষ্ট হত। নন্দদুলালকে যদিও এ নিয়ে কোনদিন হতাশা প্রকাশ করতে কেউ শোনেনি। মনের ভেতরটা অবশ্য উঁকি দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। তবে ও নিজের মত করে ভালই থাকত।দমদমে বড় মামার বাড়ি অনেক বড় আর ঝাঁ চকচকে হলেও নয়নের পছন্দের জায়গা ছিল বাগবাজারের বাড়িটা। এখানে ওর ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বড়মামার ভালবাসায় কোন খামতি ছিল না, কিন্তু পেশার ব্যস্ততার কারণে বাড়িতে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারত না। সেই অভাব পুষিয়ে দিত ছোটমামা। মামার বাড়িতে সকলে আদর করে নয়নকে ভন্টে বলে ডাকত। ছোটমামা ইতিহাসের শিক্ষক, ভবানীপুরে একটা স্কুলে পড়াত। নয়নরা যখন থাকত তখন স্কুলের সময়টুকু ছাড়া সারাক্ষণই ওদের সঙ্গে কাটাত। ছোটমামা গল্পের মত করে কি সুন্দর পুরনো কোলকাতার কাহিনী শোনাত। একটু বড় হওয়ার পর নয়ন মুগ্ধ হয়ে শুনত মহানগরের সেকালের গল্প। নিজেদের এলাকা বাগবাজার নিয়ে মামার খুব গর্ব ছিল।মামা মাঝে মাঝেই বলত, “বাগবাজার হল আদি কোলকাতা।”একদিন ঐ কথা শোনার পর নয়ন বলেই ফেলল—ছোটমামা,তুমি বারে বারে বল যে বাগবাজার হল আদি কোলকাতা। তার মানে অনেক আগে কোলকাতা বলতে শুধু এই বাগবাজারকেই বোঝাত?-- দূর বোকা, আমি কি তাই বলেছি নাকি? আজ যে বিশাল শহরটাকে দেখছিস তার বেশিটাই ছিল তোদের রহড়ার মত মফঃস্বল। যত সময় গড়িয়েছে এগুলো এক এক করে শহরের সাথে জুড়ে গেছে। শোন তবে শহরের একটু গোড়ার দিকের কথা বলি। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগের কথা। দিল্লীর বাদশাহকে তুষ্ট করে সাহেবরা তখন ধীরে ধীরে আমাদের এই শহরে গুছিয়ে বসতে শুরু করেছে। কোলকাতা তাদের বড়ই পছন্দের শহর। কিন্তু একটা উৎপাত তাদের কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। শুধু সাহেবরাই নয়, কোলকাতার যারা বড়লোক মানুষ, তাদেরও চিন্তার শেষ নেই। যদিও সেই উৎপাত তখনো শহরে আসেনি, কিন্তু আসতে কতক্ষণ! বাংলার মানুষের তখন খুব খারাপ সময় চলছে। সব সময়েই ভয়ে ভয়ে দিন কাটে, এই বুঝি তারা এল। কাদের জন্য এই ভয় জানিস?”নয়ন নেতিবাচক মাথা নাড়ে। নয়ন ফিরে দেখে পুরনো কোলকাতার গল্প শোনার জন্য ওর মাও পাশে এসে বসেছে।-- টিনা বলতে পারবি, কাদের ভয়ে তখন বাংলা কাঁপছে?-- বর্গি? -- ঠিক ধরেছিস। এই না হলে আমার বোন। ওদের নিয়ে এই ছড়াটা এখনো লোকের মুখে মুখে ঘোরে- “খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে। ধান ফুরোলো পান ফুরোলো খাজনার উপায় কি?আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।”হানাদারদের গল্প শুরুর আগে টিনা একটু কড়া করে চা বানিয়ে আন।চলবে
  • ভাট...
    commentপাপাঙ্গুল | এই বইটা ? ভাল ?
     
    commentযোষিতা | ইংরিজিতে India নামক দেশটিও স্ত্রীলিঙ্গ।
    commentr2h |
    • &/ | ০৮ মে ২০২৪ ০১:৩০
    • হুতেন্দ্র , অবন ঠাকুরের ভারতমাতা নিয়ে আপত্তি নেই বলছিলেন আগে ,সেটাও তো রূপকল্প ।তবে ?
     
    আমার তো কোনকিছুতেই আপত্তি নেই। কাল ভারতপিসেমশাই আমদানি হলেও আমার আপত্তি হবে না।কিন্তু চন্দ্র সূর্য তো আমাকে ঘিরে পাক খায় না, আমার আপত্তি না থাকায় কী আসে যায়! অনেকের আপত্তি আছে, তারা 'সকল' বর্গের বাইরে না। 
     
    আর এই ধরনের ব্যাপার স্যাপার ডারুইনিজম বা পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মত জরুরি জিনিস না, নিতান্তই ব্যক্তিনির্ভর। তো ভারতমাতাকে প্রণাম করলে একা করবো, সমবেত প্রণাম করে সবাই প্রণাম করছি ভাববো নাঃ)  
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত