এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    নরেন্দ্র মোদীর গুজরাট মডেল - দ্বিতীয় পর্ব - প্রদীপ দত্ত | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়টাটার ন্যানো কারখানা২০০৮ সালের ৭ অক্টোবর ন্যানো মোটরগাড়ি তৈরির কারখানা গুজরাটের সানন্দে সরিয়ে আনার খবর বিপুল প্রচার পেয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে জমির ক্ষতিপূরণ নিয়ে দু’বছর ধরে বিক্ষোভের পর ওই বছর ৩ অক্টোবর রতন টাটা ঘোষণা করেন যে, ন্যানো তৈরির কারখানা তিনি পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। ন্যানো প্রকল্প যখন গুজরাটে এলো, উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদ থেকে মোদী নিজেকে নতুন ব্যবসায়ী বন্ধু এবং উন্নয়নকামী নেতা হিসাবে তুলে ধরলেন। ভাষণ দিতে গিয়ে পরে মোদী বারবার বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ন্যানো কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্তের কথা জেনেই “আমি টাটাকে একটা এসএমএস পাঠালাম, ওয়েলকাম টু গুজরাট, ব্যাপারটা এমনই সোজা”। বাস্তবে ব্যাপারটা তেমন সোজা ছিল না। টাটা মোটরস যখন পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্প প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল, মোদী একটি নিখুঁত পাবলিক রিলেশনস অপারেশন করেন। টাটাদের অভূতপূর্ব নানা ছাড়ের প্রস্তাবের মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছিল। তা এমন চুক্তি ছিল যে একাধিক আরটিআই আবেদন সত্ত্বেও গুজরাট সরকার প্রকাশ করতে চায়নি। সরকার বলেছিল যে সে তথ্য প্রকাশযোগ্য নয়, কারণ তাতে টাটা মোটরসের বাণিজ্যিক গোপনীয়তা রয়েছে। পরে সেই তথ্য ফাঁস হয়। পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ হলে চারটি রাজ্য ন্যানো কারখানা করার জন্য টাটার সঙ্গে দরবার করেছিল। কিন্তু মোদী সবচেয়ে সুবিধাজনক শর্তে দ্রুত ব্যবস্থা নেন। টাটা তাই গুজরাটেই মনস্থির করেন। দশদিনের মধ্যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। অন্যান্য রাজ্যের ইচ্ছে থাকলেও টাটা মোটর্সকে জমি দেওয়ার আগে তাদের অনেক কিছু নির্ধারণ করা বাকি ছিল। মোদীর প্রস্তাব ছিল খুবই উদার। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম ২০ বছরের বকেয়া রাজস্ব টাটা মোটর্স কোম্পানিকে ধার দেওয়া হয়েছে বলে ধরা হবে।v ২০ বছর পর ০.১ শতাংশ সুদ সহ তারা ওই ধার মেটাতে শুরু করবে। ধার মেটানো শুরু হবে ২০২৮ সাল থেকে। আটটি সমান বার্ষিক কিস্তিতে জমির মূল্য পরিশোধ করবে। এছাড়া বিদ্যুতের শুল্ক হ্রাস, ভর্তুকিতে বিক্রি হওয়া ১,১০০ একর জমির রেজিস্ট্রেশনের জন্য স্ট্যাম্প শুল্ক ছাড় ছাড়াও গুজরাট সরকার ন্যানো প্ল্যান্টকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাটে স্থানান্তরের খরচ বহন করতে সম্মত হয়েছিল। এইসব সুবিধা বাদে সরকার বলেছিল, তাদের চার লেনের সড়ক সংযোগ দেবে, একটি বর্জ্য নিষ্পত্তি কেন্দ্রও স্থাপন করবে, পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করবে এবং টাটার টাউনশিপের জন্য আহমেদাবাদের কাছে ১০০ একর জমি দেবে ।viবিজেপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুরেশ মেহতা ২০১৭ সালে ‘দ্য ওয়্যার’-কে বলেছেন, গুজরাট কীভাবে পুঁজিপতিদের পক্ষ নিয়েছে তার উদাহরণ হলো টাটার ন্যানো প্রকল্প। রতন টাটা শর্ত দিয়েছিলেন যে, রাজ্য সরকার ঋণ দিলে তবেই তারা প্রকল্পটি রাজ্যে নিয়ে আসবে। সরকার ন্যানো প্রকল্পকে প্রচুর কর ছাড়, সস্তায় জমি এবং বিদ্যু‍তে ভর্তুকি দিয়েছে। টাটারা ৩৩,০০০ কোটি টাকা ঋণ হিসাবে চেয়েছিল। সরকার সুদহীন ১১,০০০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেvii এই টাকা তারা ২০ বছর পর থেকে বেশ কিছু সমান কিস্তিতে শোধ করবে। টাটাদের রাজ্যের কর্মসংস্থান নীতি না মানার অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল। অথচ রাজ্যের কর্মসংস্থান নীতি অনুযায়ী যেখানে কারখানা স্থাপন করা হবে সেই অঞ্চল থেকেই ৮৫ শতাংশ কর্মশক্তি তৈরি করে নেওয়ার কথা ছিল। টাটার দাবি ছিল, কারখানার ঠিক পাশেই হাইওয়ে থাকতে হবে। অথচ প্রস্তাবিত কারখানা হাইওয়ের মাঝে অনেকটা কৃষি জমি পড়ে ছিল। সেখানে কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা রাভুবা বাঘেলার জমি ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি অন্য কৃষকদের হয়েও কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন। মোদী এবং টাটা যৌথভাবে কারখানা স্থাপনের কথা ঘোষণা করার আগের দিন জিআইডিসির (গুজরাত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) সেক্রেটারির সঙ্গে আলোচনায় জমির দাম নিয়ে অচলাবস্থা দেখা দেয়। সময় গড়িয়ে চললেও রাভুবা কম দামে জমি দিতে রাজী ছিলেন না। জিআইডিসি তখনও বলেনি যে তারা টাটার জন্য জমি কিনছে। রাত দশটা নাগাদ আলোচনা ভেস্তে যেতে বসলে, জিআইডিসির সেক্রেটারি বললেন, ন্যানো কারখানার জন্য জমি নেওয়া হচ্ছে, কাল আমেদাবাদে রতন টাটা আসছেন, তাদের যেন সমস্যায় না ফেলা হয়। ওই কথা শুনে রাভুবা বাঘেলা সহ বাকি কৃষকদের মন আনন্দে নেচে ওঠে। এক ঘণ্টার মধ্যে জমির আশাতীত মূল্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে রাবুভা সাংবাদিক বিনোদ জোসকে বলেন, গুজরাটিদের জমির সঙ্গে খুব বেশি আবেগ জড়িয়ে নেই, এখানেই গুজরাটিদের সঙ্গে অন্যদের তফাৎ। তারা হিসাব করে দেখে তাদের জমি বিক্রি পাশের জমির জন্য কতটা লাভজনক হবে। রাবুভা টাটা মোটর্সের জমির কাছে ৩০ একর জমি বেচার পরই, মোদীর অফিস থেকে ডাক পেলেন। তাঁদের সাক্ষাৎ পরেরদিন টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় খবরের হেডলাইন হলো-- ওয়েলদিয়েস্ট ম্যান ইন সানন্দ জাস্ট গট রিচার। সানন্দে ন্যানো ফ্যাক্টরির জন্য যে চুক্তি হয়েছিল তা পৃথিবীর নজর কেড়েছিল। ২০১০ সালের জুন মাসে কারখানা উদ্বোধনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফোর্ড ও পাশোট (peugeot) গুজরাটে কারখানা করবে বলে জমি চায়। জিআইডিসি তাদের প্রয়োজন মত মোট ২২০০ একর জমি জোগাড় করে দেয়। সঙ্গে টাটাকে যেমন আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছিল সেইরকম যথেচ্ছ সুবিধা। সেখানেও জমির মালিক বাজার মূল্যের দশগুণ অর্থ পেয়েছে। টাটা গুজরাটে আসার আগে এক একর জমির দাম ছিল ৩ লক্ষ টাকা, জিআইডিসি কৃষকদের দিয়েছে একর প্রতি ৩০ লক্ষ টাকা। জমি বিক্রেতারা সাতদিনের মধ্যে চেক পেয়েছে। মোদী এই অঞ্চলটিকে অটো হাবে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। গাড়ি নির্মাতা মারুতি সুজুকও মেহসানা জেলার বেচারাজিতে কারখানা স্থাপন করেছে। বিপুল সরকারি ভর্তুকির বিনিময়ে হলেও সানন্দায় মোদীর সফলতার গল্প উন্নয়নের গুরু হিসাবে তাঁর সুনাম বাড়াল। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই ভোটার বা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে তিনি ওই উন্নয়নের কথা বলতেন। তবে গুজরাট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হলেও সব কলকারখানা কিন্তু মসৃণভাবে চলেনি। ন্যানো প্রকল্পটি যেখানে ছিল সেই সানন্দের নির্বাচকমণ্ডলী ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের বিধায়ক নির্বাচিত করে ন্যানো প্রকল্পের বিরুদ্ধে মত দিয়েছিল। ভাইব্রেন্ট গুজরাটতবে মনে রাখতে হবে, ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হলেন তিনি উত্তরাধিকার সূত্রেই ভাইব্রেন্ট বা স্পন্দনশীল গুজরাট পেয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে গুজরাট ১মে গুজরাট তৈরি হওয়ার পর থেকে দুই দশক (১৯৬০-১৯৮০) রাজ্যের গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) ছিল ৪.৪ শতাংশ, যেখানে দেশের ছিল ৩.৩ শতাংশ। পরের দুই দশকে গুজরাটের অর্থনীতি বেড়েছিল ১৪.৫ শতাংশ হারে, যেখানে দেশের বৃদ্ধি ছিল ৫.৫ শতাংশ। গুজরাট তৈরি হওয়ার পর থেকে চার দশক ধরে রাজ্যটি দেশের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ছিল চালিকা শক্তি। এরপর ২০০২ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত জিডিপির বৃদ্ধি ছিল ৯.৫ শতাংশ এবং ২০১৪ থেকে ২০১৮ ছিল ৮.৬ শতাংশ। ওই দুই সময়কালে দেশের বৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৭.৫ ও ৬.৮ শতাংশ। মোদীর রাজ্যপাটের প্রায় পুরো সময় গুজরাটের জিডিপি বৃদ্ধি দেশের বৃদ্ধির চেয়ে বেশি ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে তা কিছুটা স্বাভাবিক, কারণ বহুকাল ধরেই গুজরাট শিল্পোন্নত রাজ্য। তবে মোদীর আমলে বৃদ্ধির হার আগের দুই দশকের চেয়ে মোটেই তেমন বেশি ছিল না। অথচ এমন ভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয় যেন ফরেন ডায়রেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) আনার ক্ষেত্রে গুজরাটই দেশকে নেতৃত্ব দেয়। এফডিআই-এর মাপকাঠিতে ২০০০ থেকে ২০০৯ সালে গুজরাট দেশের মধ্যে ছিল চতুর্থ, ২০১১ সালে ষষ্ঠ। ২০১১-তে মহারাষ্ট্রের এফডিআই ছিল গুজরাটের ন’গুণ বেশি।২০০৩ সাল থেকে মোদী প্রতি দু’বছর অন্তর ভাইব্রেন্ট গুজরাট গ্লোবাল সামিট চালু করেন। ভাইব্রেন্ট গুজরাট প্রকল্প বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য তৈরি করা হয়। নবরাত্রির সময় সেপ্টেম্বর মাসে সরকার সংগঠিত বিনিয়োগকারীদের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অসংখ্য দেশী-বিদেশী বাণিজ্য প্রতিনিধি সেখানে যোগ দিয়েছেন। সবাই জানত, ওই সম্মেলন ছিল গুজরাট দাঙ্গায় অভিযুক্ত মোদীর নতুন ইমেজ তৈরি করার করার উপায়, -- মোদীকে বিকাশ পুরুষ বা উন্নয়নের জন্য মাস্টার হিসাবে প্রমাণ করা। তিনি দাঙ্গার প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ইমেজ মুছে ফেলার জন্য অক্লান্তভাবে চেষ্টা করেছেন। ওই সম্মেলন বিনিয়োগ টানার উদাহরণ হিসাবে পরিচিত হয়। ১২ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মোদী নিজেকে শিল্প-বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসাবে তুলে ধরেন। গুজরাটিদের উদ্যোগী প্রকৃতির স্বীকৃতি হিসাবে ‘ভাইব্রেন্ট গুজরাট’ কথাটা ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনের সাথে প্রতিশ্রুতিগুলি আরও বড় হয়েছে। এই ধরনের অসামান্য সভা আয়োজন করার জন্য রাজকোষের খরচ বছরের পর বছর ধরে বেড়েছে।viii ধীরে ধীরে মোদী শিল্পপতিদের প্রিয় হয়ে ওঠেন। গুজরাটে বেশ কিছু বিনিয়োগের প্রস্তাব আসার সাথে সাথে, ২০০৯ থেকে শিল্পপতিদের একাংশ মোদীকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে স্বাগত জানাতে শুরু করে। ওদিকে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনের পর সরকার জানিয়েছিল যে, ১২ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য ৩,৯৪৭টি সমঝোতা পত্র (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে ।ix ২০১১ সাল থেকে মোদী সক্রিয় ভাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা শুরু করলে ভাইব্রেন্ট গুজরাট আরও বড় ঘটনা হয়ে ওঠে। শীর্ষ সম্মেলনের জন্য গান্ধীনগরে ‘মহাত্মা মন্দির’ নামে ১৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পনেরো ১৫ মানুষ উপস্থিত থাকার ক্ষমতাসম্পন্ন কনভেনশন সেন্টার স্থাপন করা হয়। মোদী, তিনবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে, ভারতীয় জনতা পার্টিকে তাঁর উন্নয়নের ট্র্যাক রেকর্ড এবং বিপুল প্রচারিত ‘গুজরাট মডেল’x -এর ভিত্তিতে লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।xi ২০১১ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে একশোটি দেশের দশ হাজার ব্যবসায়ী-শিল্পপতি পঞ্চম দ্বিবার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে ৮,৩৮০টি সমঝোতা পত্র স্বাক্ষরিত হয়, ২০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের দাবি করা হয়। বলা হয় যে ওই বিনিয়োগ ৫২ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। কিন্তু সিএমআইআই-র (সেন্টার ফর মিডিয়া অ্যান্ড ইন্সট্রাকশনাল ইনোভেশন, ইয়েল) গবেষণায় ওইসব সমঝোতা পত্র এবং প্রকল্পের বিবরণ পাওয়া যায়নি। তারা জানায়, প্রাথমিক তথ্যের অভাবে আগের শীর্ষ সম্মেলনের মতো এক্ষেত্রেও প্রকল্পগুলি পৃথক করে শনাক্ত করার জন্য কোম্পানির নাম, অবস্থান, পণ্য ইত্যাদির বিশদ বিবরণ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়নি।২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত যে পাঁচটি সম্মেলন হয়েছে তাতে ৪০ লক্ষ কোটি টাকার মৌ (মেমোর‍্যান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং) স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছিল, তবে বাস্তবে বিনিয়োগ হয়েছে তার শতকরা ২৫ ভাগের কম। ২০০৩ সালে যতগুলো মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে তার ৭৩ শতাংশ প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে বা রূপায়নের কাজ চলছিল। ২০১১ সালে সেই ভাগ ছিল ১৩ শতাংশ। দশের দশকের শেষ ভাগ থেকে গুজরাটে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি দুইই কমেছে। কারণ বিনিয়োগের পর কতটা লাভ হতে পারে তা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা সন্দিহান ছিলেন।গুজরাট সরকারের ডায়রেক্টরেট অফ ইকোনমিক্স অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স প্রকাশিত গুজরাটের আর্থ-সামাজিক রিপোর্ট (২০১৭-২০১৮) অনুসারে, ভাইব্রেন্ট গুজরাট গ্লোবাল ইনভেস্টরস সামিট থেকে উদ্ভূত প্রতি এক কোটি টাকার বিনিয়োগে চারজনের জন্য চাকরি হয়েছে। ২০০৩ সালে থেকে ২০১৭ পর্যন্ত, ৭৬,৫১২টি প্রকল্পের জন্য মৌ স্বাক্ষর করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত গৃহীত প্রকল্পগুলি থেকে মোট প্রায় ১৭ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬,২৫১টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিল, যেখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২,৭৫,৮৮০ কোটি টাকা। ৪,২৮০টি প্রকল্পের কাজ তখনও চলছিল, যা শেষ হলে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হবে ৯,৯৬,৪৫৮ কোটি টাকা।xii আমেদাবাদ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে ধোলেরাতে শিল্প শহর গঠনের কথা আগেই বলা হয়েছিল। গুজরাট স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন অ্যাক্ট ২০০৯, কার্যকর হওয়ার পর ধোলেরা স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন (এসআইআর) প্রকল্পের জন্য ২০০৯ সালের ভাইব্রেন্ট গুজরাট সামিটে মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। দশ বছর পরে, ২০১৯ সালের সম্মেলনে যখন গুজরাট সরকার ধোলেরা এসআইআর-কে বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসাবে দেখায়, বাস্তবে ২০০৯ সালে স্বাক্ষরিত বেশিরভাগ প্রকল্পই তখনও চালু হয়নি। ধোলেরা এসআইআর-এর জন্য ঘোষিত প্রকল্পগুলির মধ্যে ছিল একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আমেদাবাদ শহরের সাথে ধোলেরা সংযোগকারী এক্সপ্রেসওয়ে এবং একটি ৫০০০-মেগাওয়াট সোলার পার্ক৷ এছাড়া ২০১১ ভাইব্রেন্ট গুজরাট সামিটে স্বাক্ষরিত অনাবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ী প্রসূন মুখার্জির ইউনিভার্সাল সাকসেস এন্টারপ্রাইজের টাউনশিপ, একটি ১০,০০০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, একটি বন্দর। ধোলেরার কাছে ওয়াটার সিটির জন্য হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ৪০,০০০ কোটি টাকার সমঝোতার কাজ কিছুই এগোয়নি। ১১,০০০ কোটি টাকার জিন্দাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, প্রায় ১১,৫০০ টাকার গুজরাট ভিট্টাল ইনোভেশন সিটির কাজ শুরুই হয়নি। এসআইআর প্রকল্পগুলির জন্য ৮০,০০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব ২০১৯ সালেও অচল অবস্থায় ছিল। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) তথ্য দেখায় যে, ২০০৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত, গুজরাটে এই ধরনের বিনিয়োগকারী সম্মেলনগুলিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতির মাত্র ২৫ শতাংশ দিনের আলো দেখেছিল৷ অনেক বিজেপি শাসিত রাজ্য একে মডেল হিসাবে গ্রহণ করেছে। যেমন -- হ্যাপেনিং হরিয়ানা, মোমেন্টাম ঝাড়খণ্ড, রিসার্জেন্ট রাজস্থান ইত্যাদি। উত্তরপ্রদেশ (ইউপি ইনভেস্টর সামিট), পশ্চিমবঙ্গ (বেঙ্গল গ্লোবাল সামিট), ঝাড়খন্ড এবং ওড়িশাও বিনিয়োগের উপযুক্ত গন্তব্য হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার জন্য ভাইব্রেন্ট গুজরাট সামিটের অনুরূপ সংস্করণ আয়োজন করেছে। কিন্তু সব জায়গাতেই একই কান্ড– বড় বড় ঘোষণার কিছুকাল পর দেখানোর মতো কিছু নেই। ইভেন্টের সময় যে মৌ (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়, খুব কমই প্রকৃত বিনিয়োগ হয়, কারণ মৌগুলির কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। এই জাতীয় শোগুলির পর বলার মতো কর্মসংস্থান যে হয় এমন কোনও বিশ্বাসযোগ্য তথ্যও নেই। অনেক বিশেষজ্ঞই বলেন, মোদীর শাসনে গুজরাটে উন্নয়নের ধারণা ভুল। ২০১২ সালে ইকোনমিক টাইমসের বিনয় প্রভাকর ও মিতুল ঠক্করকে আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের (আইআইএমএ) অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র ত্রিপাঠী বলেছিলেনঃ ঐতিহাসিকভাবে গুজরাট তার ১,৬০০ কিলোমিটার উপকূলরেখার জন্য সুবিধা ভোগ করেছে, গুজরাটের মাটিও অর্থকরী ফসলের জন্য ভাল। সুরাত ছিল ভারতের প্রথম বড় বন্দরগুলির অন্যতম। ওদিকে প্রাক-স্বাধীন যুগে মুম্বাইয়ের পরে আহমেদাবাদেই একটি টেক্সটাইল মিল চালু হয়েছিল। প্রতিটি গুজরাটির রক্তে উদ্যোক্তা এবং ব্যবসা রয়েছে। কিন্তু আজকাল গুজরাটের কথা বলার সময় এই দিকটি বাদ দেওয়া হয়। অতীতেও রাজ্যটি দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় উচ্চতর বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত উত্পাদনে। গুজরাটের বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে বেশ ভালো, কিন্তু অলৌকিক নয়। অন্যান্য রাজ্য গুজরাটকে কিছু ক্ষেত্রে ছাড়িয়েও যেতে পারে। যেমন, বিহার, দিল্লি এবং পুদুচেরি হল দেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল রাজ্য এবং গুজরাট পরপর দ্বিতীয় বছরের জন্য শীর্ষ পাঁচে স্থান পায়নি।অনেক সমালোচক মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাটের উন্নয়নকে অতিরঞ্জিত করার জন্য অভিযুক্ত করে বলেন যে, বাস্তবে গুজরাটের বৃদ্ধির হার অর্থনৈতিকভাবে উন্নত মহারাষ্ট্রের মতো। তাঁরা আরও বলেন যে, গুজরাট ঐতিহাসিক সুবিধাগুলি থেকে উপকৃত হয়েছে -- একটি উদ্যোক্তা শ্রেণী, অপেক্ষাকৃত ভাল পরিকাঠামো এবং একটি বিস্তৃত উপকূলরেখা। মোদীর নেতৃত্বে থাকুক বা না থাকুক তা বেড়ে উঠত। দক্ষ প্রচারের সাহায্যে মোদী নিজেকে প্রাণবন্ত গুজরাটের মুখ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শক্তিশালী মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপন জগতের মহাশক্তিশালী ‘অ্যাপকো ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ মোদী ও তাঁর সাফল্যের কথা পৃথিবীময় প্রচার করেছে (কয়েকটি দেশের ডিক্টেটর-সহ বিশ্বের বড় বড় বিনিয়োগকারী কোম্পানি যাদের ক্লায়েন্ট)। আদিত্য নিগম এবং বিনয় প্রভাকর তাদের প্রবন্ধে জানিয়েছেন, যে কর্তৃত্ববাদী আচরণে ‘গুজরাটের উন্নয়ন’ সম্ভব হয়েছে তা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং নিচু জাতির বিরুদ্ধে আজ দেশব্যাপী যে ফ্যাসিবাদী হিংসা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে তা থেকে আলাদা নয়। নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে যে কর্পোরেটমুখী, বিনিয়োগ-বন্ধু শাসন শুরু হয়েছিল তা কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দৃঢ় করেছে এবং অসাম্য মেনে নেওয়ার বাতাবরণ তৈরি করেছে। কাফিলায় শিপ্রা নিগমের প্রবন্ধ এবং অতুল সুদ সম্পাদিত গবেষণা পত্রের সংকলন (পভার্টি অ্যামিডস্ট প্রস্পারিটিঃ এসেস অন দ্য ট্রাজেক্টরি অফ ডেভেলপমেন্ট ইন গুজরাট) থেকে জানা যায়, গুজরাটের ২০০৯ সালের শিল্পনীতি অনুযায়ী কেন্দ্রের দিল্লী-মুম্বাই ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল করিডোর (ডিএমআইসি) তৈরি করতে উপকূলের কাছাকাছি অঞ্চল ও ভৌগলিক অবস্থানকে কাজে লাগানো হয়। ডিএমআইসি পরিকল্পনায় ধার, পুনে, অলওয়ার, সুরাট, রেওয়ারি, মুজফফরনগরের গ্রিনফিল্ড অঞ্চলে শিল্প ও পরিকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। যেখানে প্রয়োজন সেই গ্রিনফিল্ড অঞ্চলের পরিকাঠামো মজবুত না করে অন্যত্র উন্নয়নের এনক্লেভ তৈরি করা হয়েছে। জনবসতিকে অবজ্ঞা করার জন্য মানুষ ও পরিবেশের উপর তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। যেমন, ভূগর্ভস্থ জল নিয়ে ডিএমআইসি পরিকল্পনা থেকে বোঝা যায় রাজ্যে কৃষি ও গৃহস্থালির কাজে জলের ব্যবহার কমিয়ে শিল্পের কাজে দেওয়া হবে। পরিকল্পনায় কোথাও বলা হয়নি যে কিভাবে জল বণ্টন করা হবে, শহরে জলের বিপুল চাহিদা কিভাবে মিটবে, কে তার মূল্য দেবে। অর্থনীতির গবেষক ইন্দিরা হিরোয়ে জানিয়েছেন, গুজরাট মডেলে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন-- রাস্তা, বিমানবন্দর, এবং ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া সরকার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কর্পোরেট সেক্টরের বিনিয়োগে ইনসেন্টিভ এবং ভর্তুকি অভূতপূর্ব ভাবে বাড়িয়েছিল। সেই কারণে সাধারণ মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং কর্মসংস্থানের বাজেট সীমিত হয়ে গিয়েছিল। কর্পোরেট বিনিয়োগের ইনসেন্টিভের মধ্যে প্রধানত ২০০৬-০৭ পর্যন্ত ছিল বিক্রয় কর ভর্তুকি (কেন্দ্র তা নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত)। বিক্রয় কর থেকে রাজস্বের (যা রাজ্য সরকারে আয়ের প্রধান উত্স) চল্লিশ শতাংশ বাদ দেওয়া হয়েছিল। এরপর, সরকার মূলধন, সুদ, পরিকাঠামোতে ভর্তুকি দেওয়ার পাশাপাশি জমি, জল সরবরাহ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপরও অনেক ভর্তুকি চালু করে (যেমন, টাটা-ন্যানো মোট প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি পেয়েছে)। সরকার গোচারণ ভূমি, ডিনোটিফাইড সংরক্ষিত এলাকা, জাতীয় উদ্যান এবং সেচযুক্ত উর্বর জমিও অধিগ্রহণ করেছিল। শিল্পপতিদের একর প্রতি ১ টাকা মূল্যেও জমি দেওয়া হয়েছিল (আদানির ক্ষেত্রে জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে হেক্টর প্রতি ওই মূল্যে)। গুজরাট মডেলের শেষ বছরগুলিতে জমির দাম বেশি নেওয়া হলেও বাজার মূল্যের চেয়ে কম ছিল।২০১২ সালের ২ অক্টোবর গুজরাট বিধানসভায় পেশ করা কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রিপোর্ট থেকে জানা যায়, আইন ভেঙ্গে কর্পোরেট কোম্পানিকে অনুচিত সুবিধা দেওয়ার জন্য রাজকোষের ৫৮০ কোটি টাকা ক্ষতিতে মোদী সরকার এবং রাজ্যের পাবলিক সেক্টর উদ্যোগ দায়ী। সিএজি জানিয়েছে, যারা সেই সুবিধা পেয়েছে সেই রকম বড় কোম্পানি হল—রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড (আরআইএল), এসার স্টিল ক্যারিবিয়ান লিমিটেড (ইএসসিএল) এবং আদানি পাওয়ার লিমিটেড (এপিএল)। আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সরকার গাড়ি প্রস্তুতকারক ফোর্ড ইন্ডিয়া এবং লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোকে জমি দিয়েও রাজস্বের ক্ষতি করেছে। অভিযোগ ওঠে, মোদী সরকারের সঙ্গে কর্পোরেট হাউসের অশুভ আঁতাত আছে বলেই কর্পোরেটরা অনুচিত সুবিধার বিনিময়ে মোদী সরকারের প্রশংসা করে। গুজরাটে বিনিয়োগকারীরা শুধু সম্পদই জোগায়নি, উন্নয়নে কোন বিষয় জোড় পাবে তাও ঠিক করেছে। উন্নয়নের জন্য কোন কাজ গুরুত্ব পাওয়া দরকার তা সরকার বা অর্থনীতিবিদদের কোনও পরিকল্পনাকারী কমিটি ঠিক করেনি। ঠিক করেছে বিনিয়োগকারী, আর্থিক সংস্থা এবং কর্পোরেট ফার্ম। এক কথায় গুজরাটের অর্থনীতি কর্পোরেটদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা বিনিয়োগ করে, তারাই ওই উন্নয়ন মডেলের প্রশংসা করে। এই কারণেই তা কতটা টেকসই এবং আদৌ ঠিক কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সব ক্ষেত্রেই বেসরকারি শিল্পপতিদের আকর্ষণ করার জন্য তাঁদের বিপুল ছাড়, ভর্তুকি, এমনকি সরাসরি আয় এবং রাজস্ব নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি ক্ষেত্রকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল্য ও শুল্ক নির্ধারণ করার মতো আইন পরিবর্তন করে নানা সুবিধা দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ এসেছে। তবে ২০১১ সাল পর্যন্ত যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে তার বেশিটাই এসেছে বেসরকারি শিল্পে ক্যাপ্টিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের দৌলতে। বিদ্যুতের ট্যারিফ কাঠামো কৃষি ক্ষেত্রের চেয়ে বাণিজ্য ও শিল্পে সুবিধা দেয় বেশি (জাতীয় গড়ের তুলনায়)। আগে যে সমস্ত মূল সেক্টরগুলো সরকারের হাতে থাকতো— বন্দর, রাস্তা, রেল, বিদ্যুৎ-- সবই কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওইসব প্রকল্পে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ সরকার ছেড়ে দিয়েছে। আর কোনও রাজ্যের অর্থনীতি এইভাবে পুরোপুরি কর্পোরেট ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগকারীর জন্য জমি জোগাড় করে দিয়ে মুনাফার জন্য দু-তিন দশক ধরে সব কিছুতে ছাড় দেওয়া হয়েছে। যেমন, বন্দর উন্নয়নের বুট নীতি (বিল্ড ওন অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার) অনুযায়ী ডেভেলপারকে রয়্যালটি দিতেই হবে না। তারাই নানান চার্জ এবং টোল ঠিক করবে। সরকার বিনিয়োগকারীদের কর প্রক্রিয়া ও শুল্কে অনেক ছাড় দিয়েছে। সরকারের ভূমিকা খর্ব করে ন্যূনতম করা হয়েছে। এই কারণেই বন্দর উন্নয়নে গুজরাটে যে বিনিয়োগ এসেছে তা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। একই ভাবে রাস্তা ও রেল তৈরির ক্ষেত্রে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) কাজ হয়েছে। যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য রাজ্যের সিংহভাগ বিনিয়োগই হয়েছে নতুন বন্দর, স্পেশাল ইকনোমিক জোন (এসইজেড), স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিওনের (এসআইআর) সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে। পরিকাঠামোয় বেসরকারি বিনিয়োগ যেন কেবলমাত্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোরের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য। রাস্তা ও রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যও এসইজেড এবং বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। স্থানীয় মানুষের তাতে কতটা সুবিধা হবে বলা মুশকিল। একইভাবে ৬৩০ কিলোমিটার রেল ন্যারো গেজ থেকে ব্রড গেজ করতে যে খরচ হয়েছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বন্দরের যোগাযোগ উন্নত করা, বসতি বা লোকালয়ের নয়। মানুষের বসতি অঞ্চলের যোগাযোগ বাড়ানোর কাজ যেটুকু হয়েছে, সে টাকা এসেছে কেন্দ্রের কাছ থেকে (পিএমজিএসওয়াই)। ২০১১ সালের ইকনোমিক সার্ভেতে শ্রমিক অসন্তোষের বিচারে গুজরাটের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ ছিল। অথচ একই সময় বাকি দেশে তা কমেছে। স্ট্রাইক, লকআউট ও অন্যান্য নানা ধরণের অসন্তোষ সবচেয়ে বেশি ছিল বলে মারুতি কি টাটা-- বিনিয়োগকারী ও শিল্পপতিরা তাদের উৎপাদন কেন্দ্র ও কাজকর্ম গুজরাটের অন্যত্র সরিয়ে নিতে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। সেই অবস্থায় শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে, মোদী সরকারের আইনের রাজত্ব স্থাপনের উপর শিল্পের ক্রমবর্ধমান আস্থা মোদী শাসনব্যবস্থার সর্বগ্রাসী চেহারার কথা বলে।জনসংযোগের সুপরিকল্পিত প্রচারে মোদীকে অর্থনীতির অলৌকিক অগ্রগতির নায়ক হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। মিথ্যা ইমেজ তৈরি করা হয়েছে। গুজরাট সরকার স্পেশাল ইকনোমিক জোন, স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন ও প্রাইভেট ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনের জন্য জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে কৃষকদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ পুলিশ দিয়ে দমন করেছে, মিথ্যা ফৌজদারি মামলা করেছে। পুলিশ, বনদপ্তর ও রাজস্ব বিভাগকে কাজে লাগিয়ে জোর করে গুজরাটের বিরোধী দল, সমাজকর্মী, ট্রেড ইউনিয়ন লিডার, শিক্ষাবিদ, সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসীদের কণ্ঠরোধ করেছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যে গণতান্ত্রিক সুযোগ আছে বিধানসভার সেশনের সময় কমিয়ে দিয়ে সরকারি দল তাও সঙ্কুচিত করেছিল। এছাড়া বিরোধী বিধায়কদের সামান্য ছুতোয় সাসপেন্ড করে, বিধানসভায় শেষ মুহূর্তে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রিপোর্ট পেশ করে তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ না দিয়ে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করেছিল। আজ দেশের উন্নতি নিয়ে যে ঢাক পেটানো হচ্ছে, সাম্প্রতিক অতীতে ‘গুজরাট মডেল’ নিয়ে একই ভাবে বুক বাজানো হয়েছে। শুধু দেশেই নয়, অনেক অর্থের বিনিময়ে মার্কিন লবিং কোম্পানি বিশ্ব জুড়ে সেই প্রচার করেছে। শেষে অর্থনীতির বহু গবেষক ও সাংবাদিক মোদীর রাজত্বে গুজরাটের অগ্রগতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে অজস্র লেখা ও গবেষণাপত্রে আসল চিত্র প্রকাশ করার পর গুজরাট মডেলের নিয়ে কথা বন্ধ হয়েছে, বোঝা গেছে তা কোনও অনুকরণযোগ্য মডেলই নয়।প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুরেশ মেহতার বক্তব্যগুজরাতের পাঁচ বারের বিধায়ক ও প্রাক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী (২১ অক্টোবর ১৯৯৫ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬) সুরেশ মেহতার রাজনৈতিক কর্মজীবন ২০০২ সালে শেষ হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও তিনি রাজ্যের অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৭ সালে নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করে তিনি বিজেপি দল ছেড়ে দেন। ২০০১৭ সালের অক্টোবর মাসে দ্য ওয়্যারের অজয় আশীর্বাদ মহাপ্রশস্তকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে এক দশক ধরে গুজরাট সরকারের ব্যর্থতার কথা বলেছেন। গুজরাট মডেল নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন যে, তা শুধু ধনীদের সেবায় কাজে লাগে। গুজরাট মডেল কথার ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই নয়, গুজরাটের কঠিন বাস্তব অন্য কথা বলে। সরকার রাজ্যটিকে ক্রমাগত ঋণের ফাঁদের দিকে ঠেলে দিয়েছে৷ তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে সিএজি (কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল) গুজরাটের আর্থিক সংস্থান পরীক্ষা করে। সেই সময়ে, রাজ্যের ঋণ ছিল ৪,০০০ থেকে ৬,০০০ কোটি টাকার মধ্যে। তাই গুজরাটকে স্থায়ীভাবে ঋণের ফাঁদে আটকে পড়া রাজ্যে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য সিএজি কিছু আর্থিক শৃঙ্খলা মানার জন্য সতর্ক করেছিল। সরকার সিএজির পর্যবেক্ষণ উপেক্ষা করে।xiii সিএজি বলে, সরকারের ঘোষণা অনুসারে, ৩১ মার্চ, ২০১৬ পর্যন্ত ২৫,৮৬৬.৭৮ কোটি টাকার কর (ট্যাক্স রেভিনিউ) উত্থাপিত হলেও আদায় হয়নি। তার আগের বছরে এই অংক ছিল প্রায় ১৮,০০০ কোটি টাকা। প্রতি বছর, এই অংক প্রায় ৭-৮ হাজার কোটি বৃদ্ধি পায়। তাই রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বকেয়া কর সংগ্রহ করতে বাধা কোথায়? এটি সরকারের দুর্নীতির ইঙ্গিতও হতে পারে।সুরেশ মেহতা বলেন, গুজরাট সরকারের অগ্রাধিকার কোথায় রয়েছে খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়। ২০০৬-০৭ সাল থেকে কৃষি ভর্তুকি (যা থেকে কৃষকরা উপকৃত হন) ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে তা ছিল ১৯৫ কোটি টাকা, ২০০৭-০৮ সালে বেড়ে হয়েছিল ৪০৮ কোটি, ২০১৬-১৭ সালে তা কমে হয় ৮০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, আদানি ও আম্বানি পরিচালিত শক্তি এবং পেট্রোকেমিক্যাল সেক্টরে দেওয়া ভর্তুকির সাথে এর তুলনা করলে অবাক লাগবে। ২০০৬-০৭ সালে এই ভর্তুকি ছিল ১,৮৭৩ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ সালে তা বেড়ে ৪,৪৭১ কোটি টাকা। অথচ দরিদ্র মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও নাগরিক সরবরাহের ব্যয় একই সময়কালে ১৩০ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৫২ কোটি টাকা। তিনি জানান, গুজরাটের নির্বাচনের বছরে, ২০০৭ সালে, মোদী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার উন্নতির ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক ধুমধাম করে বনবন্ধু কল্যাণ যোজনা চালু করেছিলেন। তিনি এই স্কিমের জন্য ১৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন, যা 'হর এক কো ঘর, হর এক কো স্বাস্থ্য' (সবার জন্য ঘর, সবার জন্য স্বাস্থ্য) দিয়ে শুরু হয়েছিল। পাশাপাশি, তিনি আদিবাসীদের জন্য পাঁচ লক্ষ দক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় পাকা রাস্তা নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সরকারের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, তার ৫ শতাংশও অর্জিত হয়নি। একইভাবে, ২০০৭ সালের ৬ জুলাই, মোদি উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য ‘সাগর খেদু সর্বাঙ্গী বিকাশ যোজনা’ নামে আরেকটি প্রকল্প চালু করেছিলেন। রাজ্যের উপকূলীয় বেল্টের ১,৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৩০০টি গ্রাম এবং ৩৮টি তালুকে বাস করা ৬০ লক্ষ লোকের জন্য ১১,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। মোদি বলেছিলেন যে, উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুরা খুবই প্রতিভাবান, তাই তাদের প্রশিক্ষণের জন্য তিনি একটি কলেজ খুলবেন, যেন তাদের ভারতীয় নৌবাহিনীতে নিয়োগ করা যায়। ২০১২ সালের ২১ মার্চ সরকার পক্ষ বিধানসভায় এক প্রশ্নের উত্তর জানায় যে, উপকূলীয় অঞ্চল থেকে একটি শিশুকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নৌবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়নি। মোদি বলেছিলেন যে উপকূলের ৩০০টি গ্রামের প্রতিটিতে নোনা জলের সমস্যা মোকাবিলা করতে একটি করে আরও প্ল্যান্ট বসানো হবে। কিন্তু একটি গ্রামেও সেই প্ল্যান্ট বসেনি। তাঁর প্রশ্ন, কিন্তু ওই প্রকল্পের অত টাকা গেল কোথায়? মোদি ঘোষণা করেছিলেন যে, স্ট্যাচু অফ ইউনিটি (সর্দার সরোবর বাঁধে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি) বিশ্বের বৃহত্তম মূর্তি হবে। এও বলেছিলেন যে, এর জন্য সরকারি কোষাগারের বোঝা বাড়বে না। তিনি বলেছিলেন, তিনি জনগণের কাছ থেকে তহবিল তুলবেন। কিছুটা টাকা ওঠার পর ওই তহবিল বন্ধ হয়ে যায়। পরে গুজরাটের অর্থমন্ত্রী বিধানসভায় বলেন যে, ওই মূর্তি তৈরি করতে তিন বছরে নর্মদা প্রকল্পের তহবিল থেকে ৩,০০০ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, সরকার কীভাবে সেচ ও কৃষকদের খাতের টাকা মূর্ত্তি তৈরির জন্য বরাদ্দ করে?গুজরাটে যক্ষার প্রকোপঅর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক লিখেছেন, গুজরাট হল কর্পোরেট নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন মডেলের এক চিরায়ত উদাহরণ যেখানে ধনীদের সমৃদ্ধি বাড়ে কিন্তু ব্যাপক জনসাধারণের খুব একটা উন্নতি হয় না। জঁ দ্রেজা বলেছিলেন, গুজরাটের চারপাশে ঘুরে বেরালে ভাল রাস্তা, অসংখ্য কলকারখানা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ যে কারো চোখে পড়তে বাধ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার হাল কী? কিরণ কুম্ভর ২০১৭ সালে দ্য ওয়্যার-এ লিখেছেন, ভারত সরকারের টিবি (যক্ষ্মা) পরিসংখ্যান দেখায় যে, সাধারণ গুজরাটিদের জীবনযাত্রার হাল সবসময়ই ‘মডেল’ থেকে দূরে ছিল, গত দশকে তা আরও খারাপ হয়েছে। অনেকের মনে হতে পারে জীবনযাত্রার মান বোঝার জন্য টিবি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? আসলে এই রোগটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণগুলির সাথে এতটাই জড়িত যে টিবির সফল নিয়ন্ত্রণকে একটি অঞ্চলের সামগ্রিক অগ্রগতির পরিমাপ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। নানা রোগের মধ্যে, টিবি রোগটিই সম্ভবত একটি অঞ্চলের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির সবচেয়ে সঠিক প্রতিনিধিত্বকারী সূচক বা পরোক্ষ সূচক (প্রক্সি সূচক), যেখানে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিকব্যবস্থা দুইই প্রতিফলিত হয়। টিবির হার যেখানে বেশি তা দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অবহেলিত শাসনের প্রমাণ। কোনও জাতি বা রাজ্য কতটা উন্নত এবং স্থিতিশীল বুঝতে হলে তাদের টিবি সংখ্যার দিকে তাকালেই চলে। তিনি জানান, ২০১৭ সালে ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডু ‘ইন্ডিয়া স্টেট-লেভেল ডিজিস বারডেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। ওই বিস্তৃত প্রতিবেদনটি ভারতের মিনিস্ট্রি অফ হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ারের সহযোগিতায় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর), পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া (পিএইচএফআই) এবং ইউএস-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন (আইএইচএমই)-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে। পরিসংখ্যানগুলি গত পচিশ বছরে ভারতের সমস্ত শনাক্তযোগ্য মহামারী সংক্রান্ত তথ্যের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পাওয়া। ওই রিপোর্ট গুজরাটের অনুন্নয়ন এবং খারাপ জনস্বাস্থ্যের অস্বস্তিকর ছবি এঁকেছে। ভারতে প্রতি বছর যক্ষ্মায় আক্রান্ত মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাট রয়েছে এক নম্বরে। ১০১৬ সালে প্রতি এক লক্ষ গুজরাটির মধ্যে টিবি হয়েছে ৩৫৬ জনের। শুধুমাত্র ওই রাজ্যেই প্রায় ২,৪০,০০ মানুষের যক্ষ্মা ধরা পড়েছে৷ অর্থাৎ, প্রতি ঘন্টায় ২৫ জন গুজরাটি টিবি রোগে আক্রান্ত হয়। কেরালা এবং পশ্চিমবঙ্গের সাথে তুলনা করলে (বিজেপি যে দুটি রাজ্যকে আইনহীন এবং অনুন্নত বলে) দেখা যায়, ওই বছর পশ্চিমবঙ্গে যক্ষ্মা হয়েছিল ১৩৯ জনের এবং কেরালায় ৫৯ জনের। টিবি নিয়ন্ত্রণে গুজরাট এতটাই ব্যর্থ যে উত্তরপ্রদেশ ছাড়া একমাত্র ওই রাজ্যেই এক দশকে টিবির প্রকোপ প্রবল বেড়েছে। প্রতি এক লাখ মানুষের যক্ষ্মায় মৃত্যুর অনুপাতে গুজরাট আসামের সাথে রয়েছে ৩ নম্বরে। ২০১৬ সালে প্রতি এক লাখ গুজরাটির মধ্যে ৪২ জন টিবিতে মারা গেলেও, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালার ক্ষেত্রে ওই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৯ এবং ৮। এক দশক আগেও গুজরাট এবং মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাড়ুর মতো বড় রাজ্যগুলির মধ্যে পার্থক্য তেমন বেশি ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে টিবিতে মৃত্যুর সংখ্যা ওই তিনটি রাজ্যে ছিল ৮০ থেকে ৯০-এর মধ্যে। মোদি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার এক বছর পর, ২০০২ সালে গুজরাটে ওই সংখ্যা ছিল ৬২, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতে যথাক্রমে ৫১ এবং ৪৩। সম্প্রতি তামিলনাড়ু এবং মহারাষ্ট্র দুই রাজ্যেই যক্ষ্মাজনিত মৃত্যু প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে, মোদীর গুজরাট মডেলে কমেছে মাত্র ৩২ শতাংশ (তিনটি রাজ্যের পরিসংখ্যান যথাক্রমে ২৪, ২৪ এবং ৪২)। গত এক দশক ধরে উত্তরপ্রদেশ ছাড়া গুজরাটেই টিবি-র প্রকোপ বেশি। গুজরাটের বাস্তবমোদীর শাসন সম্পর্কে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে অমর্ত্য সেনও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে গুজরাত উন্নয়নের মডেল সম্পর্কে বলেছিলেন, সামাজিক দিকে ওই মডেলের দুর্বলতা রয়েছে, তাই তাকে সফল বলা যায় না। অথচ বছরের পর বছর ধরে আমরা শুনে আসছি, গুজরাট মডেল হল অর্থনৈতিক উন্নয়নের অতুলনীয় উদাহরণ।নানা গবেষণায় দেখা গেছে যে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ে গুজরাট দেশের মধ্যে উঁচুতে থাকলেও সামাজিক সূচকে নীচুতে ছিল। তাই গুজরাত মডেল ব্যাপক মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদী আর্থিক উন্নয়নে গুজরাট মডেলের ঢাক পিটিয়েছেন, দ্বিতীয়বার ২০১৯ সালে কিন্তু তা করেননি। কারণ, ততদিনে ভাইব্রেন্ট গুজরাট যে আসলে জুমলা তা নিয়ে অর্থনীতির গবেষক ও সাংবাদিকদের অনেক আলোচনা প্রকাশ্যে এসেছে। কেউ কেউ বলেছেন, গুজরাট শুধু স্থবিরই নয়, সে রাজ্যের পশ্চাদ্গতি শুরু হয়েছে। ২০০৬-০৭ থেকে ২০১০-১১-র মধ্যে, এমনকি উড়িষ্যা, বিহার, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা এবং ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যগুলির বৃদ্ধির হারও উঁচু ছিল। তাই গুজরাটের ৯.৩ শতাংশ বৃদ্ধি উঁচু হলেও চোখ ধাঁধানো ছিল না। সমৃদ্ধির আখ্যানের আড়ালে জানা গেছে যে, অনেক সামাজিক সূচকেই গুজরাটের অবস্থান খারাপ। পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ৭০ শতাংশ ভুগছে রক্তাল্পতায়। পরিকল্পনা কমিশন (কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পর লুপ্ত) প্রকাশিত ২০১১ সালের ইন্ডিয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুসারে, মানব উন্নয়ন সূচকে গুজরাট দেশের মধ্যে ১১তম স্থানে রয়েছে। ওই সূচকে ১৯৯৬ সালে ছিল পঞ্চম স্থানে। ২০০৬ সালে ছিল নবম স্থানে, ২০১৭ সালে ফের ১১তম। গুজরাটে পাঁচ বছরের নীচে ৪৭ শতাংশ শিশু, ২৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, ৬৩ শতাংশ মহিলা অপুষ্টিতে ভোগে, যা উত্তরপ্রদেশের অবস্থার চেয়েও খারাপ। প্রসবের সময় মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েছে। ২০১৪ সালে প্ল্যানিং কমিশনের (ভেঙ্গে দেওয়ার আগে) তথ্য অনুযায়ী, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি স্বত্বেও দারিদ্র মোচনে গুজরাট ছিল বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের পিছনে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের রিপোর্ট অনুসারে, গুজরাট ক্ষুধার সূচকে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। রাজ্যের মাত্র ৪৩ শতাংশ শিশুর ওজন স্বাভাবিক।কর্পোরেটদের বিপুল পরিমান প্রণোদনা (ইনসেন্টিভ) দেওয়ার পরে, সাধারণ মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং কর্মসংস্থানের জন্য গুজরাট সরকারের তহবিল সীমিত হয়ে যায়। গুজরাট তার আয়ের ২ শতাংশের কম শিক্ষায় ব্যয় করে (আদর্শ ৫-৬ শতাংশ)। এর ফলে রাজ্যে শিক্ষার মান খারাপ। রাজ্যের ৪৫ শতাংশ কর্মী নিরক্ষর বা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। উচ্চশিক্ষার মানও খারাপ বলে বেকার ইঞ্জিনীয়ার এবং বিজ্ঞান স্নাতকের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় রাজ্যের আয়ের ০.৮ শতাংশ (আদর্শ ৪-৬ শতাংশ)। প্রায় সমস্ত স্বাস্থ্য সূচকে গুজরাট দ্রুত নেমেছে। আজ কারো কারো পছন্দের মেডিক্যাল টুরিজিম-এর গন্তব্য গুজরাট। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮-র মধ্যে আমেদাবাদে ২০০টি প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। তবে ওই সময়কালে সরকারি হাসপাতালের বেড বেড়েছে মাত্র ২০০টি, চিকিৎসা সহায়কের অভাবের কথা বাদ দিলেও সরকারি ডাক্তারের ঘাটতিই হল ১২ হাজার। শিক্ষা ব্যবস্থার হালও একই রকম। প্রতি ১০০ জন প্রথম শ্রেনীর পড়ুয়ার মধ্যে কলেজ পর্যন্ত যায় ২০ জন। মোদীর বহু প্রচারিত উজ্জ্বলা যোজনা অনুযায়ী দাবি করা হয়, মাটির ঘরে জ্বালানি হিসাবে কাঠের ব্যবহার বন্ধ করে মানুষ গ্যাস ব্যবহার করছে। অসরকারি সংগঠন ‘দিশা’ উত্তর ও পূর্ব গুজরাটের আদিবাসী অধ্যুষিত জেলায় ১০৮০টি ঘরে সমীক্ষা করে দেখেছে ৯৫৩টি ঘরই দ্বিতীয় গ্যাস সিলিন্ডার না কিনে জ্বালানি হিসাবে কাঠের ব্যবহারে ফিরে গেছে। বিপদ হল গ্যাস ব্যবহারকারী হিসাবে নাম ওঠায় তারা রেশন দোকান থেকে কম দামে কেরোসিন তেল পায় না। অতুল সুদ সম্পাদিত ‘পভার্টি অ্যামিডস্ট প্রস্পারিটিঃ এসেস অন দ্য ট্রাজেক্টরি অফ ডেভেলপমেন্ট ইন গুজরাট’ বইটিতে রুচিকা রাণী এবং কালাইয়ারাসান তাদের গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন ২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে গুজরাটে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বৃদ্ধি হলেও উৎপাদন ও পরিষেবায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ছিল ঋনাত্বক। ওদিকে ২০০৩ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যেটুকু কর্মসংস্থান বেড়েছে বেশিটাই ঠিকা শ্রমিক এবং স্বনিযুক্তিতে। উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রে উঁচু জাতের হিন্দু এবং কম অনুপাতে তফশীলি জাতির (এসসি) নিয়মিত কর্মসংস্থানে হয়েছে। তফশীলি জাতির কর্মসংস্থান বেড়েছে ঠিকা কর্মী হিসাবে। ওবিসি, মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুরা পরম্পরাগত কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ফাঁক ভরিয়েছে। অর্থাৎ গুজরাটে বৃদ্ধি হচ্ছে শিল্প ক্ষেত্রে, কর্মসংস্থান বাড়ছে কৃষিক্ষেত্রে। বলা যায়, কৃষিক্ষেত্রে দুর্দশার অভিবাসন হচ্ছে। অর্থাৎ যে কাজে দুজন লোকই যথেষ্ট সেই কাজ তিনজনে করছে। এই অবস্থা কর্মসংস্থানে স্থবিরতার কথা বলে। বলবার মত উৎপাদন বৃদ্ধির পরও আয়, দারিদ্র ও অসাম্যের পরিমাপে গুজরাট গড়পড়তা জাতীয় গড়ের মধ্যেই ছিল, এবং নানা মাপকাঠিতে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার চেয়েও পিছিয়ে। আরেক গবেষক নিধি মিত্তাল জানিয়েছেন, কর্মসংস্থানের মাপকাঠিতে ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত গুজরাটের মানুষ যেমন ছিল, ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে ছিল তার চেয়ে খারাপ। অথচ এই সময়েই গুজরাটে উৎপাদন বৃদ্ধি ও ‘উন্নয়ন’ জোর কদমে হয়েছে। শহরাঞ্চলে বৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু ব্যায় বাড়লেও অসাম্য অনেক বেড়েছে। ওদিকে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০০৮ গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে গুজঅদিকেছিল ৬৯তম স্থানে, ছিল খাদ্য দাঙ্গার জন্য কুখ্যাত দেশ হাইতির সাথে 'আশঙ্কাজনক' বিভাগে। নরেন্দ্র মোদীর আমলে (তারপরও বিজেপীর আমলে) গুজরাটের শাসন বেসরকারি উদ্যোগের উপর নির্ভরশীল ছিল। সরকারি নীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগকারীর প্রয়োজন ও লাভের দিক খেয়াল রাখা হতো। উন্নয়নের মডেলের মানে দাঁড়িয়েছিল নির্বাচিত পুঁজি-নিবিড় উৎপাদন শিল্পের উন্নতি এবং চাকরিহীন উন্নয়ন, মোট আয়-এ মজুরির ভাগ কমা, কৃষিকে কর্পোরেটের অধীনে আনা, জমি ব্যবহারে আইনী পরিবর্তন করে জমিতে ফাটকা চালু করা, জনকল্যান ব্যায়ে অবহেলা করা, সামাজিক পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা কাটাতেও বেসরকারি উদ্যোগে নির্ভর করা।এছাড়া পরিকল্পিত ভাবে পুঁজিপতির মঙ্গল করা এবং সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি চরম অবহেলা করার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কুফল দেখা দিয়েছে। আঞ্চলিক বৈষম্য বেড়েছে, পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গ্রামজীবনের প্রতি করুণ অবহেলা করা হয়েছে, অন্যদিকে শ্রমিক, মহিলা, তফশীলিজাতি, মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের বেশি বেশি প্রান্তিকীকরণ হয়েছে। গুজরাতের উৎপাদন ক্ষেত্রে ঠিকাকর্মীর সংখ্যাই বেশি এবং তা বেড়েই চলেছে। রাজ্যে মজুরির হার ভারতের প্রধান রাজ্যগুলির তুলনায় বেশ কম, ২০০৭ সাল থেকেই কমেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য বৃদ্ধিও পুঁজি নিবিড় হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে গুজরাটের কৃষিতে বছরে ৯ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি হয়েছে, যা ভারতে সর্বোচ্চ। ২০১২ সালে সাংবাদিক বিনয় প্রভাকর ও মিতুল ঠক্করকে আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের (আইআইএমএ) সেবাস্টিয়ান মরিস বলেছিলেন, কৃষি পুনরুজ্জীবনের প্রধান কারণ হল গুজরাট গত ১০ বছরে বৃষ্টিপাতের বড় পরিবর্তন থেকে উপকৃত হয়েছে। তিনি বলেন, নর্মদা জুড়ে সর্দার সরোবর বাঁধ প্রকল্প রাজ্যের কৃষকদের সাহায্য করেছে। তাই মোদী যে বছর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন (২০০১) সেই বছরই সর্দার সরোবর বাঁধ চালু হওয়ার জন্য তা কৃষি বৃদ্ধিকে কতটা সাহায্য করেছে এবং কতটা তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য তা মাপা কঠিন।২০১৩ সালের শেষ থেকে ২০১৪ সালের শুরুতে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি পত্রিকায় উন্নয়নের গুজরাট মডেল নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। কয়েকজন গবেষক দেখিয়েছিলেন যে, মোদী শাসনের আগে ও পরে দেশের তুলনায় গুজরাটের বৃদ্ধির প্রবনতায় সামগ্রিকভাবে কোনও পার্থক্য নেই। তবে মোদির শাসনকালে গুজরাটে কৃষি বৃদ্ধির হার মোদী-পূর্ব যুগে ভারতের তুলনায় বেশি হয়েছিল। সর্দার সরোবর বাঁধ ছাড়াও ক্রমাগত ভাল বৃষ্টিপাত এবং উন্নত বীজ নিয়ে সরকারের নীতি, আধুনিক কৃষি পদ্ধতির জন্য এই সময়কালে গুজরাটের কৃষিতে উচ্চ বৃদ্ধি হলেও কম ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (চাষের খরচ অনেক বেশি), দুর্বল শস্য বীমা (এমনকি ভাল এলাকায় কভারেজ ১০-১২%) এবং বিনিয়োগ কমার জন্য কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া ওই বৃদ্ধি টেকসই নয়। কারণ সেচের প্রধান উৎস ভূগর্ভস্থ জল রিচার্জের পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই বলে জলতল দ্রুত কমছে। কৃষি শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার জন্য গুজরাটে কৃষি মজুরি সবচেয়ে কম। গুজরাটের সামাজিক সূচকে নব্বইয়ের দশকের পর খুব একটা উন্নতি হয়নি৷ তার কারণ অন্য রাজ্যের তুলনায় খুব কম কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক ব্যয় হ্রাস এবং শিল্পে বিনিয়োগ মূলধন-নিবিড় হওয়ার সাথে সম্পর্কিত। রাজ্যের ৪০-৪৫ শতাংশ পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে (চাষ, পশুপালন, দুধ, বনজসম্পদ, মাছ ধরা ইত্যাদি)। সম্পদের ক্ষয় ও অবনমন এবং প্রবল দূষণের সাথে উত্পাদনশীলতা এবং আয় কমেছে। গুজরাটের উন্নয়নে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়ে শহরের রাস্তায় বা গ্রামীণ এলাকায় কোনওরকমে তৈরি কুঁড়েঘরে বাস করতে বাধ্য হয়েছে। গুজরাট হাইকোর্ট তাই রাজ্য সরকারকে বার বার বলেছে, ভুলে যাবেন না যে তারাও রাজ্যের জনসংখ্যার একটি অংশ। উন্নয়ন যজ্ঞের নেট ফলাফল হল, জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বেঁচে থাকা। কেন্দ্র এবং রাজ্যের অনেকগুলো গরিব-সমর্থক কর্মসূচি থাকলেও তার বাস্তবায়ন তেমন হয় না। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে, গুজরাট মডেল নিয়ে খুব হই হই করা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যম গুজরাটকে বিনিয়োগের চুম্বকে পরিণত করার জন্য, বরাবর নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করেছে। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসের ‘ইন্ডিয়া টুডে’র সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের ২৪ শতাংশ পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীকেই চান বলে জানিয়েছিলেন। মোদীই ছিলেন এক নম্বরে। ছ’মাস আগের সমীক্ষার তুলনায় তা ছিল দ্বিগুণ। গুজরাট দাঙ্গার দশ বছর পূর্তির সেই বছর, ডিসেম্বর মাসে গুজরাটে তাঁর তৃতীয়বারের বিধানসভা নির্বাচন ছিল। ঘরের রাজ্যে হারার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। গুজরাট বিধানসভায় ভোটে ফের জিতলে ইমেজ আরও বাড়বে, হয়েছিলও তাই। সবাই জানতো পরের লোকসভা নির্বাচনে (২০১৪) মোদী প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার হতে হতে চান। আমরা দেখলাম নরেন্দ্র মোদী দশ বছর কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার পর দেশের যেমন উন্নতি হয়েছে গুজরাটে বারো বছর ক্ষমতায় থাকার পর একইরকম উন্নতি হয়েছিল। পুঁজিপতিদের পুঁজি এবং গরিব মানুষের হাহাকার বেড়েছে। এখন বলে বেড়াচ্ছেন যে তিনি ভগবান প্রেরিত জীব। মা যতদিন বেঁচেছিলেন, তিনি নিজেকে মায়ের সন্তান বলে মনে করতেন। তারপর মনে হল তা নয়, ঈশ্বর তাঁকে ইহলোকে পাঠিয়েছেন নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে। ঈশ্বর নির্দিষ্ট কাজ শেষ হবে ২০৪৭ সালে। কাজেই আমাদের তাঁকে সেই সময় দিতে হবে! এমন মানুষকে কি সাইকোপ্যাথ বলবেন না? আমেরিকার ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর অনেকটাই মিল আছে। ক্ষমতায় থেকে এতটা বাড়াবাড়ি ট্রাম্পও করেননি। তথ্যসূত্র:Vinod K Jose, The emperor uncrowned- the rise of Narendra Modi, The Caravan, Mar. 1, 2012 Binoy Prabhaakar, Mitul Thakkar, What works and what doesn't in Narendra Modi's Gujarat, The Economic Times, Jul. 2, 2012Binoy Prabhakar, How an American lobbying company Apco Worldwide markets Narendra Modi to the world, Economic Times, Dec. 9, 2012CAG blasts Narendra Modi govt for giving Rs 750 cr undue benefits to RIL, Essar, PTI, Indian Express, Apr. 3, 2013Spin doctors, propagandists and the Modi make-over, Kafila, Apr. 18, 2013Aditya Nigam, Spin doctors, propagandists and the Modi make-over, Kafila.online, Apr.18, 2013, Shipra Nigam, Gujarat and the illusion of development, Kafila.online, May 23, 2013Amartya Sen says Gujarat development model has weaknesses on social side, Indian Express, Jul. 26, 2013Christophe Jaffrelot, No model state, Indian Express, Sep. 6, 2013Poverty Amidst Prosperity: Essays on the trajectory of development in Gujarat, Edited by Atul Sood, Aakar Books 2013.Maitreesh Ghatak and Sanchari Roy, Modinomics: Do Narendra Modi’s economic claims add up, The Guardian, Mar. 13, 2014Megha Bahree, Doing big business in Modi's Gujarat, Forbes.com, Mar. 12, 2014Ashok Kotwal and Arka Roy Choudhury, Gujarat’s growth for growth’s sake, The Indian Express, Apr. 3, 2014Pramit Bhattacharya, The great Gujarat growth debate, Livemint.com, Apr. 11, 2014 Max Fishermax,The good, the bad, and the ugly of Narendra Modi, India's next leader, Vox, May 16, 2014Ajoy Ashirwad Mahaprashasta, 'Gujarat Model Is Nothing But a Jugglery of Words,' Says Former Gujarat CM, The Wire, Oct. 17, 2017Kingshuk Nag, With No Jobs in Sight, How Vibrant Is Gujarat Really? The Wire, Nov. 10, 2017Kiran Kumbhar, State's Tuberculosis Rampage Exemplifies the Failure of the 'Gujarat Model', The Wire, Nov. 27, 2017Maitreesh Ghatak and Sanchari Roy, Why So Many Economists Are Disillusioned With the 'Gujarat Model', The Wire, Nov. 29, 2017Indira Hirway, The Truth Behind the Gujarat Growth Model, The Wire, Dec. 8, 2017Nayanima Basu, Mega shows like Narendra Modi’s pet ‘Vibrant Gujarat’ do not bring investments or jobs, The Print, Jan. 19, 2019 Subodh Varma, Vibrant Gujarat: House of Cards, Newsclick, 19 Jan. 2019Damayantee Dhar, The Reality of Vibrant Gujarat Is Not as Vibrant, Newsclick, Jan. 22, 2019Hemant Kumar Shah, Why PM Modi no longer speaks of ‘Gujarat Model’: jobless in Gujarat expose his exaggerated claims, National Herald, April 19, 2019Andrew Adonis, Narendra Modi Is everything apart from what he seems, The Wire, Apr. 8, 2021What makes Modi unacceptable, Outlook Web Desk, Outlookindia.com, Feb. 4, 2022Narendra Modi:The architect of a modern state, MV Kamath and Kalindi Randeri, Rupa, 298 pages, review by Teesta Setalvad, sabrang.com Gujarat government’s debt and liabilities cross Rs 4.12 lakh cr, reveals CAG report, samachar.com, Mar.1, 2024v. অর্থাৎ ৯,৫৭০ কোটি টাকার নরম ঋণ – সেই সময় গুজরাটের বার্ষিক বাজেটের ২৫ শতাংশের কাছাকাছি এবং ওই প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে বিনিয়োগ ২,৯০০ কোটি টাকার ৩৩০ শতাংশ। vi. মোদী ন্যানো প্রকল্পের স্থানান্তর থেকে মাইলেজ পেয়েছিলেন ঠিকই, তবে ন্যানো প্রকল্প টাটা মোটরসের যন্ত্রনা হয়ে উঠেছিল। ন্যানো ১ লাখ টাকার গাড়ি হিসাবে চালু করা হলেও আসল খরচ ছিল বেশি। এছাড়া প্রযুক্তিগত কারণে ওই গাড়ি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ক্ষমতাচ্যুত টাটা মোটরসের চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রি ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বলেছিলেন যে, টাটা মোটরস ন্যানো উৎপাদনে প্রণোদনা বা ইনসেনটিভ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ‘প্রায় এক বছর আগে।’ অর্থাৎ ২০১৬ সালেই লোকসানে চলা প্রকল্পটি গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। vii. সম্ভবত এই টাকাই টাটাদের ক্রমপূঞ্জিত বকেয়া কর, যা সাংবাদিক বিনোদ জোস জানিয়েছিলেন যে, ১ শতাংশ সুদ সহ ফেরত দিতে হবে।viii. ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী রূপানি গুজরাট বিধানসভাকে জানান যে, ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে ভাইব্রেন্ট গুজরাট শীর্ষ সম্মেলন দুটিতে রাজ্য সরকার ১৫০.৯১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে৷ix. কিন্তু সিএমআইআই (সেন্টার ফর মিডিয়া অ্যান্ড ইন্সট্রাকশনাল ইনোভেশন, ইয়েল) প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকার ২২০টি প্রকল্পের তথ্য এবং বিবরণ খুঁজে পেয়েছিল। প্রস্তাবিত প্রকল্প সম্পর্কে সম্মেলনের ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত সরকারি তথ্যের সাথে তুলনা করলে খুঁজে পাওয়া প্রকল্পের সংখ্যা বেশ কম।x. ২০০২-০৩ থেকে ২০১১-১২ পর্যন্ত সময়কালে গুজরাট বৃদ্ধির হারে যে বড় লাফ দিয়েছিল, গুজরাট মডেল বলতে তাকেই বোঝায়।xi. তবে অমন রেকর্ডের পরও মোদী কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে কখনও গুজরাট থেকে লড়েননি! xii. আটটি বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে হওয়া মৌ (এমওইউ) থেকে পনেরো বা কুড়ি বছরে ১০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ কম কথা নয়। কিন্তু এর পর থেকে এক একটি বিনিয়োগ সম্মেলনেই যে অঙ্কের মৌ স্বাক্ষর করার কথা ঘোষণা করা হয় তার পরিমাণই প্রায় ২০ থেকে ২৭ গুণ বেশি!xiii. ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, রাজ্য সরকারের বাজেট নথি অনুসারে গুজরাটের ঋণ বেড়ে হয়েছিল ১,৯৮,‌০০০ কোটি টাকা। সিএজি রিপোর্ট অনুসারে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুজরাট সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪,১২,০০০ কোটি।
    নরেন্দ্র মোদীর গুজরাট মডেল - প্রথম পর্ব - প্রদীপ দত্ত | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে, ২০০২ সালে ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখে, অযোধ্যা থেকে ট্রেনে চড়ে ফেরার পথে গোধরায় ট্রেনের মধ্যে আগুনে পুড়ে ৫৯ জন কর সেবকের মৃত্যু হয়। কোনও তদন্ত ছাড়াই মোদী সেদিন জানান, মুসলমান জঙ্গিরা ট্রেনে আগুন লাগিয়েছিল। এরপর গুজরাটে পরিকল্পিত ভাবে যে ব্যাপক হিংসা ছড়িয়েছিল তাতে প্রায় ২০০০ জনের মৃত্যু হয়। দাঙ্গা (গণহত্যা) হলে, বিভাজন হলে বিজেপির ভোট বাড়ে। সেই থেকে ওই রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি কখনও হারেনি। গুজরাত দাঙ্গার সময় রাস্তায় উন্মত্ত হিন্দু গোষ্ঠীর লোকেরা শুধু স্থানীয় মুসলমানদেরই হত্যা করেনি, এক হাজারের বেশি ট্রাকও জ্বালিয়ে দিয়েছিল। জেনারেল মোটরস কারখানায় তৈরি জাহাজে পাঠানো ‘ওপেল অ্যাস্ট্রা’ গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে হেডলাইন হয়েছিল। এক হিসাবে দেখা যায় দাঙ্গায় গুজরাটের দু’হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। ওই সাম্প্রদায়িক হিংসা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ভীতিগ্রস্ত করে তোলে। শিল্পপতিদের ধারণা ছিল পরে গোলমাল আরও বাড়বে। সেই বছর সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে গুজরাতে ফরেন ডায়রেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) আসা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। সাংবাদিক বিনোদ কে জোস জানিয়েছেন, পরে ভারতের কর্পোরেট জগতের মাথারা প্রকাশ্যে দাঙ্গা বা গণহত্যার জন্য প্রধান প্রশাসকের প্রতি তাদের রাগ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের সিইও দীপক পারেখ বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতের মুখ পুড়েছে এবং গুজরাটে যা ঘটেছে তাতে তিনি লজ্জিত। ইনফোসিসের নারায়ণ মূর্তি এবং উইপ্রোর আজিম প্রেমজিও কড়া বিবৃতি দেন। গুজরাতের মুসলমানদের যন্ত্রণা নিয়ে ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে সিআইআই-এর জাতীয় বৈঠকে শক্তি সংস্থা থার্ম্যাক্সের সভাপতি অনু আগার আবেগদীপ্ত ভাষণের পর শ্রোতারা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন জানান। দাঙ্গার দশ মাস পর বিজেপি বিধানসভা ভোটে গুজরাটের মানুষের বিপুল সমর্থন নিয়ে জয়ী হলেওi মোদী একেবারে চাপ মুক্ত ছিলেন না। ভোটে জিতে এসেও তাঁকে শিল্পপতিদের কড়া সমালোচনা শুনতে হয়েছে, ওদিকে বিধ্বংসী হিংসার পর রাজ্যের অর্থনীতি ধুঁকছে। তবে তিনি জানতেন, দাঙ্গা হোক আর না হোক বড় শিল্পপতিদের কাছে গুজরাট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোদী তাঁর সরকারের (অপকর্মের) সমালোচনাকে গুজরাত এবং গুজরাতিদের উপর আক্রমণ বলে অভিযোগ করলেন। এরপর ২০০৩ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে উন্নয়নের ‘গুজরাট মডেল’ গড়ে তুললেন এবং দশের দশকের শেষ দিক থেকে তিনি রাজ্যের উন্নয়নের অলৌকিকতা নিয়ে প্রচার শুরু করলেন। এই কাজে তিনি বহু অর্থের বিনিময়ে পৃথিবীর প্রথম সারির মার্কিন কোম্পানি ‘অ্যাপকো ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ii -কে নিয়োগ করলেন। কর্মদক্ষ প্রশাসন, দ্রুত নির্মাণ ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নিয়ে সরকার মিডিয়াকে অবিরত অনুপ্রেরণামূলক কাহিনী সরবরাহ করা শুরু হলো। ইমেজ ফেরাতে দরবারবিনোদ কে জোস লিখেছেন, ভোটে জেতার পর মোদী তাঁর ইমেজ বদলাতে দিল্লী এসে কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিস (সিআইআই)-এর সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁর বিশেষ অনুরোধে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিআইআই দিল্লীর অডিটোরিয়ামে “মিটিং উইথ নরেন্দ্র মোদী, দ্য নিউ চীফ মিনিস্টার অফ গুজরাত” শিরোনামে এক বিশেষ অধিবেশন ডেকেছিল। স্টেজে মোদীর সঙ্গে সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল তরুণ দাস ছাড়া ছিলেন দুই বড় শিল্পপতি জামশিদ গোদরেজ এবং রাহুল বাজাজ। শিল্পপতিরা তাঁকে মোটেই বন্ধুত্বমূলক অভ্যর্থনা জানাননি। আগের মাসে গুজরাতের নির্বাচনে তাঁর বিজয় উদযাপন করতে মুম্বাইয়ের সভায় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক দাঙ্গা বা গণহত্যার জন্য তাঁকে অপদস্থ করেছিলেন। সেই ঘটনার সূত্রে গোদরেজ বলেন, মানুষের ভোটে তাঁর বিজয়ের রায়কে সম্মান জানিয়ে তিনি যেন সমস্ত গুজরাতির নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। বাজাজ ছিলেন আরও স্পষ্টভাষী। তিনি বলেন, গুজরাতের জন্য ২০০২ সাল হলো হারিয়ে যাওয়া বছর। শেষে মোদীর দিকে তাকিয়ে বলেন: কাশ্মীর, উত্তর-পূর্ব, উত্তরপ্রদেশ, বিহারে কেন বিনিয়োগ আসে না? শুধু পরিকাঠামোর অপ্রতুলতাই নয়, নিরাপত্তাহীনতার বোধও তার কারণ। আশা করি গুজরাতের ক্ষেত্রে তা ঘটবে না। বলেন, গত বছরের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা প্রবাহের জন্যই এসব কথা মনে পড়ছে। জানতে চাই আপনি কি মনে করেন? আপনি কিসের পক্ষে? কারণ নেতৃত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনার দল এবং গুজরাত সরকারের আপনি অবিসংবাদী নেতা। আমরা আরও ভাল করে আপনাকে জানতে চাই। আমরা সব ধরণের সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে তৈরি। কিন্তু সমাজের জন্য কোনটা ভাল, কোনটা তার পক্ষে কাজ করে তা নিয়ে আমাদের নিজেদেরও মতামত রয়েছে। মোদী ধৈর্য ধরে তাঁদের কথা শুনছিলেন, মন যতই শান্ত হোক। বললেনঃ এর উত্তর খুঁজতে হলে আপনি এবং আপনার ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষ বন্ধুরা গুজরাতে আসতে পারেন। রাজ্যের মানুষের সঙ্গে কথা বলুন, গুজরাত দেশের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত রাজ্য। উত্তেজনায় ঘর থমথম করছিল। গোদরেজ ও বাজাজের দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “গুজরাতকে কলঙ্কিত করায় অন্যদের কায়েমি স্বার্থ রয়েছে, কিন্তু আপনাদের স্বার্থ কী?” তাঁর মনের মধ্যে জমে ওঠা সেই ক্রোধ মোদী গুজরাতে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সিআইআইকে এক হাত নেবেন বলে তৈরি হলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই আদানি গোষ্ঠীর গৌতম আদানি সহ তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা একটি প্রতিযোগী সংগঠন তৈরি করলেন, যার নাম দেওয়া হল ‘রিসার্জেন্ট গ্রুপ অফ গুজরাত’ (আরজিজি)। মোদী এবং সমস্ত গুজরাতিদের সিআইআই অপমানিত করেছে বলে তারা সিআইআই থেকে তারা সরে আসে। আরজিজি প্রেস স্টেটমেন্টে জানায়, সিআইআই-এর গুজরাত চ্যাপটার সরে যাক, কারণ তারা রাজ্যের স্বার্থ রক্ষায় অপারগ। সেই সময় গুজরাতের একশোর বেশি কোম্পানি সিআইআই থেকে বেরিয়ে আসবে বলে পা বাড়িয়েছিল। তা যদি বাস্তবে হয় তাহলে পশ্চিম ভারতে সংগঠনের অস্তিত্বে সমস্যা দেখা দেবে। গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যেiii ওই শিল্পপতিদের এই বিদ্রোহে সিআইআইয়ের প্রধান পরামর্শদাতা তরুণ দাস বিচলিত হলেন। ওদিকে বিজেপি সরকার কেন্দ্রের মন্ত্রীদের কাছে সিআইআই-এর অ্যাক্সেস নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। তার ফলে শিল্পপতিদের হয়ে সরকারের কাছে তদ্বির করার সংগঠন হিসাবে সংগঠনের মূল উদ্দেশ্যে আঘাত লাগলো। তরুণ দাস মোদী ঘনিষ্ঠ কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অরুণ জেটলির দিল্লীর বাড়িতে ছুটে গেলেন। আড়াই ঘণ্টা আলোচনার পর জেটলি বললেন, কয়েকদিন পরই তাঁর বাড়িতে মোদীর ডিনারে আসার কথা রয়েছে। তখন তিনি বিষয়টি তুলবেন। সেই মত কিছুদিন পর জেটলি জানালেন, কাজ হয়েছে, তবে সিআইআইয়ের কাছ থেকে মোদী আনুষ্ঠানিক ভাবে দুঃখ প্রকাশের চিঠি চান। তরুণ যেদিন সেই চিঠি মোদীকে দিতে গেলেন, তাঁর স্ত্রী বললেন, তুমি এটা করতে পার না। তরুণ বলেন, চিঠি না দিয়ে তিনি পদ ছেড়ে দিতে পারেন, নইলে সিআইআই-এর সদস্যদের ভাল-মন্দ তাঁকে দেখতে হবে। দুঃখ প্রকাশের করে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, সিআইআইয়ের আমরা আপনার আঘাত ও যন্ত্রণার জন্য খুবই দুঃখিত। ৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লীর মিটিং থেকে যে ভুল বোঝাবুঝির শুরু হয়েছে তার জন্য আমি খুবই অনুতপ্ত। অনুতাপ কাটাতে সিআইআই তিন মাস পর জুরিখে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের পৃষ্ঠপোষকতায় বিনিয়োগকারীদের আন্তর্জাতিক সভার আয়োজন করে। পরের দশ বছরে মোদী শিল্প সমাজের সবাইকে কাছে টেনে নেন। প্রথমেই বাজাজ, গোদরেজ ও অন্য যারা তাঁর সমালোচনা করেছিলেন তাঁদের। এরপর যে গণহত্যায় প্রায় দু’হাজার গুজরাটির প্রাণ গেছে সেই অতীতকে চাপা দিয়ে ধীরে ধীরে মোদী নতুন ভাবমূর্তি নিয়ে রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ‘ফ্যাসিস্ট’, ‘গণহত্যাকারী’, ‘ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদী’ বিশেষণের বদলে তাঁরই পছন্দ অনুযায়ী তাঁকে বলা শুরু হয় ‘বিকাশ পুরুষ’। রতন টাটা, মুকেশ আম্বানি, লক্ষ্মী মিত্তাল আবেগদীপ্ত ভাবে মোদীকে ‘ভারতের পরবর্তী নেতা’, ‘এক স্বপ্নদর্শী’, ‘অপ্রতিরোধ্য ঘোড়া’, ‘দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারে যে সিইও’ ইত্যাদি শব্দে ভূষিত করেন। কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন মোদীর আমলে গুজরাটে বিনিয়োগ করা সবচেয়ে লাভজনক। মোদীর হাইপসাংবাদিক বিনয় প্রভাকর ও মিতুল থাকার বলেছেন, ২০০৫ সালের ২৫ জুন নরেন্দ্র মোদী তাড়াহুড়ো করে একটি প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন। সাংবাদিকদের মনে হয়েছিল যে, সেখানে তিনি কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করবেন। আগের তিন বছরে তাঁর নাটকীয় ঘোষণার ঝোঁক তাঁরা লক্ষ্য করেছেন। সেদিন তিনি তাঁদের নিরাশ করেননি। ঘোষণা করেন, শীর্ষ কোম্পানি গুজরাট স্টেট পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (জিএসপিসি) গ্যাসের সন্ধান হোঁচট খেয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে কৃষ্ণ-গোদাবরী অববাহিকায় ২০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস অন্বেষণ ছিল দেশে গ্যাস সন্ধানের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। আবিষ্কারটিকে প্রাসঙ্গিক রাখতে তেল ও গ্যাস বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে কী করবেন তা তিনি ভাবতে বলেন। এক টিসিএফ প্রাকৃতিক গ্যাস ১০,০০০ কোটি কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে, অথবা এক বছরের জন্য ১.২ কোটি প্রাকৃতিক-গ্যাস-চালিত যানবাহনের জ্বালানি হিসাবে যথেষ্ট। মোদী বিষয়টি নিয়ে অন্যরকম মোচর দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, কৃষকরা কল খুললে দেখবে জলের বদলে তেল আসছ। জনসভার বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন যে, গোয়ালারা এরপর দুধের পরিবর্তে পেট্রোল ও ডিজেলের প্যাকেট বিক্রি করবে। মোদীর ওই অবিশ্বাস্য কথাবার্তায় বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রক ডিরেক্টর জেনারেল অফ হাইড্রোকার্বন ভিকে সিবাল বলেন, একটি তেল কূপ পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ২০ টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কার বড় বেশি লম্বা দাবি বলে মনে হয়। জিএসপিসি-র প্রযুক্তিগত অংশীদার জিওগ্লোবাল রিসোর্সেস বলে যে, এখনই মজুত গ্যাসের পরিমাণ নির্ধারণ করার সময় আসেনি। দুবছর আগে গ্যাসের অনুসন্ধান হোঁচট খাওয়ার পরও, ২০০৭ সালের বেশিরভাগ সময় পর্যন্ত মোদী তাঁর দাবিতে অটল ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সংশয়বাদীদের কথাই সঠিক, জিএসপিসি ২ টিসিএফের বেশি গ্যাস খুঁজে পায়নি। সাংবাদিক বিনোদ কে জোস বলেছেন, ২০১০ সাল থেকেই মোদী বলতেন, গুজরাটে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। ‘গুজরাট মিরেকেল’ নিয়ে ‘বিজনেস টুডে’, ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’-এর প্রতিবেদনে সে কথা লেখা হয়। কিন্তু সঙ্ঘের কৃষক ইউনিয়ন দু’হাজার সাল থেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল যে তাদের বিদ্যুতের চাহিদা মিটছে না। সরকারি তথ্যেও দেখা গেছে যে ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যুতের চাহিদা ৪৩ থেকে কমে হয়েছে ২১ শতাংশ। তিন লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কৃষক ২০১২ সালেও সেচ পাম্পের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ পায়নি। নির্মার সিমেন্ট কারখানাবিনোদ কে জোস জানিয়েছেন, ২০০৩ সালে গুজরাতের নির্মা কোম্পানিকে সিমেন্টের কারখানা করার জন্য ৭০০ একর সরকারি জমি দেওয়া হয় (নির্মার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান কারসন প্যাটেল রিসার্জেন্ট গ্রুপ অফ গুজরাটের অন্যতম নেতা ছিলেন)। নির্মাকে দেওয়া জমির মধ্যে ৩০০ একর ছিল জলা এবং জলাধার, যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি স্থানীয় কৃষক চাষবাস ও পশুপালনের কাজে ব্যবহার করতেন। কৃষকরা ওই চুক্তিতে আপত্তি জানায়। সরকার ও নির্মা কোম্পানি সেই আপত্তিতে আমল দেয়নি। এরপর মাহুভার বিজেপি বিধায়ক কানুভাই কালসারিয়ার নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। এগারো হাজার কৃষক ওই চুক্তির বিরুদ্ধে রক্ত দিয়ে চিঠি লেখে। পাঁচ হাজার কৃষক প্রতিবাদ জানাতে ৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে আমেদাবাদে যায়। ‘নির্মা’ ও রাজ্য সরকার দাবি করে যে প্রভাবিত এলাকা হল জলাজমি। শেষে প্রতিবাদী কৃষকরা মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ফরেস্টের কাছে সিমেন্ট কারখানার বিরুদ্ধে আবেদন করলে তারা কৃষকের পক্ষে রায় দিয়ে কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র বাতিল করে। কালসারিয়া ছিলেন বিজেপির তিন দফার (১৯৯৭ থেকে ২০১২) বিধায়ক। পার্টি তাঁকে অনিয়মের অভিযোগে সাসপেন্ড করে, তাঁর উপর গুন্ডাদের আক্রমণ হয়। আজও তিনি গুজরাটের কৃষকদের মুখপাত্র। তাঁর অভিযোগ, মোদী সরকার কর্পোরেটদের স্বার্থে নাগরিকের অর্থ এবং জমির অপব্যবহার করছে। ২০১৪ সালে তিনি আম আদমি পার্টিতে যোগ দেন, ২০১৮ থেকে রয়েছেন কংগ্রেসে।আদানির জন্য মুক্তহস্তসাংবাদিক মেঘা বহরি জানিয়েছেন, মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আদানি গোষ্ঠী কচ্ছের মুন্দ্রায় সরকারের কাছ থেকে ৭৩৫০ হেক্টর (এক হেক্টর= ১০০০ বর্গ মিটার) জমি ৩০ বছরের জন্য ইজারা পেয়েছে। পেয়েছে নামমাত্র মূল্যে, প্রতি বর্গমিটারের দাম এক মার্কিন সেন্ট (বর্তমানে এক সেন্ট= ০.৭৫৩ টাকা)। সর্বোচ্চ দাম বর্গমিটার প্রতি ৪৫ সেন্ট। মুন্দ্রায় গড়ে উঠেছে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (স্পেশাল ইকোনমিক জোন বা এসইজেড)। পরিবর্তে আদানি সেই জমি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইন্ডিয়ান অয়েল সহ নানা কোম্পানিকে প্রতি বর্গমিটার ১১ ডলার (বর্তমানে ১ ডলার= ৮৩.৩ টাকা) হিসাবে ভাড়া দিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, শুধু ইজারা পাওয়া জমির ভাড়া থেকেই আদানিরা কি বিপুল লাভ করেছে! সেই জমি ছাড়াও, ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে আদানি গোষ্ঠী গ্রামবাসীদের ১,২০০ হেক্টর চারণভূমি দখল করেছে। ওই জমি দেওয়ার মালিক গ্রাম প্রধান। ২০১৪ সালে গ্রামবাসীরা ফোর্বসের সাংবাদিক মেঘা বহরিকে বলছেন যে, তাদের অজ্ঞাতে আগের গ্রাম প্রধানের স্বাক্ষরের বিনিময়ে ওই চারণভূমি আদানির এসইজেডের কব্জায় চলে গেছে। ২০০৫ সালে এবং তার আগে গ্রামবাসীরা সরকারের ওই দুষ্টু বুদ্ধির বিরুদ্ধে গুজরাট হাইকোর্টে একাধিক মামলা দায়ের করে। বেশ কয়েকটি মামলা ২০১৩ সালেও বিচারাধীন ছিল। ওই সব জমিতে আদানি তৈরি করেছে দেশের বৃহত্তম বন্দর এবং ৪,৬২০ মেগাওয়াট কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র। জমির মত দুর্লভ সম্পদ শিল্পপতি বা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে নামমাত্র মূল্যে কেন দেওয়া হয়? পুঁজিপতিকে ওই ভাবে জমি দিয়ে মোদী রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে বঞ্চিত করছেন। সরকারি কোষাগারকে দুর্বল হলে অসমতা মোকাবেলা করার জন্য রাষ্ট্রের কাছে পর্যাপ্ত সংস্থান থাকে না। সে কথা মোদীর অজানা নয়। হয়েছেও তাই (তবে পরে আমরা দেখব মোদীর গরীব এবং সাধারণ মানুষের কথা ভাবার ইচ্ছেও ছিল না)।মেঘা বলেছেন, সেখানে আজ মাইলের পর মাইল মসৃণ রাস্তা, মাঝে মাঝে গোলাপি, কমলা এবং সাদা রঙ্গের বুগেনভেলিয়া দিয়ে সাজানো। রাস্তা পরিষ্কার রাখার জন্য ক্রমাগত সুইপিং মেশিন ব্যাবহার করা হয়। আদানির বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) এমনই সুন্দর। আদানির বন্দরের কাছে রপ্তানি-কেন্দ্রিক সংস্থাগুলিকে রাখার জন্যই এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হয়েছিল। আদানি সেখানে ৪০ মাইল রেললাইন তৈরি করেছে, যা বন্দরটিকে জাতীয় রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করেছে। সেই সাথে তৈরি হয়েছে ১.১ মাইল লম্বা বেসরকারি এয়ারস্ট্রিপ। এসইজেড-এর ভাড়াটে কোম্পানিরা চার্টার্ড ফ্লাইটের জন্য তা ব্যবহার করতে পারে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২৩টি কোম্পানি সেখানে কেন্দ্র গড়েছে অথবা গড়তে চলেছিল। কচ্ছ বা গুজরাটের আর কোনও সংস্থা আদানির মতো এত কম দামে জমি না পেলেও, শিল্পপতিদের প্রতি মোদীর উদার ব্যাবহারে তারাও উপকৃত। আদানি গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। কিন্তু এর প্রকৃত উত্থান হয়েছে গুজরাটে মোদীর শাসনকালে। তখনই তারা দেশের সবচেয়ে বড় বন্দর ও বিদ্যুৎ কোম্পানির মালিক হয়েছে। এছাড়া ছিল সামগ্রী কেনাবেচার ব্যবসা, বেশিটাই গুজরাটে। এসইজেড নির্মাণ ছাড়াও দেশে তাদের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির জন্য কয়লার স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করতে ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায়iv খনি কিনেছিল, মুন্দ্রা বন্দরে এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা আমদানির টার্মিনাল চালু করেছিল। ২০০২ থেকে ২০১৩ সালের মার্চে ওই গ্রুপের আয় ৭৬.৫ কোটি ডলার থেকে বেড়ে হয় ৮৮০ কোটি ডলার। নেট লাভ বেড়েছে আরও দ্রুত। কচ্ছের ওই গ্রামগুলো বড় বড় সবেদা, খেজুর, নারকেল, ক্যাস্টর-এর জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন আর সেই অবস্থা নেই। তারা বলেছে, আদানি পাওয়ার এবং কাছাকাছি টাটা পাওয়ার প্ল্যান্টের ফ্লাই অ্যাশ এবং লবণাক্ত জল ফসল নষ্ট করেছে, মাটিকে চাষের অনুপযোগী করে তুলেছে। আগে সেখানে চাষিরা পর্যায়ক্রমে তুলা, বাজরা এবং ক্যাস্টর চাষ করেছেন। এমন লম্বা, সবুজ মাঠের কোনও তুলনা ছিল না। এখন প্রসারিত মাঠ ও খামার জুড়ে শুধু সাদা লবণের ছোপ দেখা যায়। সমুদ্রের লবণাক্ত জল মাটি নষ্ট করে দিয়েছে। জারাপাড়া খুব বড় গ্রাম। সেখানে ১৫,০০০ বাসিন্দার বাস। এক সময় সবেদার জন্য বিখ্যাত ছিল। মৌসুমে প্রতিদিন পাঁচ ট্রাক ভর্তি সবেদা ওই গ্রাম থেকে বাজারে যেত। এখন এক ছোট ভ্যান ভর্তি সবেদা বাজারে যায়। নোনা জল এবং আদানির তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ফ্লাই অ্যাশের জন্য উৎপাদন কমেছে, পরাগায়ন প্রক্রিয়াও নষ্ট হয়েছে এবং ভূগর্ভস্থ জল দূষিত হয়েছে। গাছের পাতা থেকে সকালে মাটিতে শিশির পড়লে কালো শিশিরের ফ্লাই অ্যাশ থেকে মাটি কালো হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে পরিবেশগত অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়ার পর, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক ২০১২ সালে, সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সুনিতা নারায়ণ কমিটি তৈরি করে। ২০১৩-র এপ্রিল মাসে ওই কমিটির প্রতিবেদনে গ্রামবাসীদের অভিযোগ ও আশঙ্কার কথাকে সমর্থন করা হয়। বলা হয় যে, আদানির এসইজেড তার বিশাল প্রকল্পের বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক সবুজ নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। যার মধ্যে ছিল ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা, খাঁড়ি ভরাট করা এবং ফ্লাই অ্যাশ জমা করে জমি ও জল নষ্ট করা। এরইমধ্যে সরকার আদানি এসইজেডকে বর্গমিটার প্রতি প্রায় পনের টাকা দরে জারাপাড়ার এক হাজার একর চারণভূমি বরাদ্দ করলে গ্রামবাসীরা মামলা দায়ের করে, যা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছিল। মামলা ফয়সালা হওয়ার আগে আদালতের বাইরেই মীমাংসা হয়েছিল। আদানি গোষ্ঠী দাবি করে, তারা গ্রামবাসীদের ৪০০ হেক্টর চারণভূমি ফিরিয়ে দিয়েছে। গ্রামবাসীরা বলে, কোনও জমি ফেরত পায়নি। ওদিকে নাভিনাল গ্রামের মানুষেরা বলেন, সরকার আদানির এসইজেডের জন্য গ্রামের প্রায় ৯৩০ হেক্টর চারণভূমি নিয়েছে। আদানি ওই জমি প্রতি বর্গমিটার (এক হেক্টর= ১০০০ বর্গ মিটার) পনের টাকার কম দামে পেয়েছে। ২০১১ সালে নভিনাল গ্রামের প্রধান সহ অন্যেরা এসইজেডের জন্য তাদের চারণভূমি হারিয়ে গুজরাট হাইকোর্টে মামলা করে। জানুয়ারি মাসে (২০১২) আদালত এসইজেডকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং সেখানে কারখানা স্থাপনকারী সংস্থাগুলিকে সমস্ত কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। তার কারণ পরিবেশগত ছাড়পত্র না পেয়েই এসইজেড-এর কাজ শুরু করা হয়েছিল। ইতিমধ্যেই সেখানে বহু কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, হাইকোর্ট ওই প্রকল্পটিকে বিলম্বিত পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া যায় কিনা জিজ্ঞাসা করে সেই সিদ্ধান্তের ভার কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। সামনেই লোকসভা নির্বাচন ছিল বলে কেন্দ্র দ্রুত সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবার জন্য কয়েক মাস সময় চায়। সুপ্রিমকোর্ট আদানির আবেদনে হাইকোর্টের রায় স্থগিত রাখেনি। তবে জানায় যে, এসইজেড-এ বিদ্যমান ভাড়াটেরা যেমন আছে থাকবে। পরবর্তীকালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এসে সেই প্রকল্পটিকে বিলম্বিত পরিবেশ ছাড়পত্র দিয়েছিল। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে পাইপলাইনের মাধ্যমে সমুদ্র থেকে জল টেনে এনে জলাধারে রেখে সেই জল থেকে বাষ্প তৈরি করে টারবাইন ঘোরানো হয়। কমিটি দেখেছে যে, ভূগর্ভস্থ জলকে দূষণ থেকে রক্ষা করার জন্য জলাধারটিতে কোনও আস্তরণ দেওয়া হয়নি। তাই ওই জল মাটির নীচের ভূগর্ভস্থ জলকে দূষিত করে। রিপোর্টে বলা হয়, বিষয়টি পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার শর্তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কমিটি সুপারিশ করেছিল যে আদানি জল গ্রহণ এবং পরিত্যক্ত গরম জল সমুদ্রে ফেরত পাঠানোর চ্যানেলের পুনর্গঠন করুক, সেই সাথে জলাধারটির নীচে এবং চারপাশে দুর্ভেদ্য আস্তরণ নির্মাণ করুক। সুপারিশ করার প্রায় এক বছর পরেও সংস্থাটি কিছুই করেনি। ইতিমধ্যে, আদানি গোষ্ঠী ৭,৩৫০-হেক্টর এসইজেডকে ১৮,০০০ হেক্টরে প্রসারিত করার কাজ শুরু করে। আদানি গোষ্ঠী জানায় যে, ভূগর্ভস্থ জলে লবণাক্ত হওয়া একটি স্থানীয় ঘটনা এবং তারা এমন পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেখানে কোনও ফ্লাই অ্যাশ থাকে না। তারা সুনিতা নারাইন কমিটির পর্যবেক্ষণকে অস্বীকার করে এবং বলে, যে কোনও বড় উন্নয়নের কাজ পরিবেশকে প্রভাবিত করে, তবে এর নেট প্রভাব ইতিবাচক। আদানির তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উপকূলরেখা বরাবর কয়েক মাইল দূরে টাটার মালিকানাধীন ৪,০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের অবস্থাও অনেকটা একই রকম। ২০১২ সালের মার্চ মাসে তা চালু হয়েছিল। মৎস্যজীবীরা মাছ না পাওয়ার জন্য কেন্দ্রটিকে দায়ী করে। প্ল্যান্টটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে পাইপের মাধ্যমে সামুদ্রিক জল গ্রহণ করার সাথে ছোট মাছও টেনে নেয় এবং মেরে ফেলে। ওদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের গরম জল সমুদ্রে ছেড়ে দেয়। তা তাৎক্ষণিক ভাবে জলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে আরও মাছ মেরে ফেলে। মেঘা লিখেছেন, ২০১৩ সালে গোয়াতে গৌতম আদানির ছেলের বিয়ে হয়। আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন দেশের সবচেয়ে ধনীরা-- বহু কোম্পানি ও ব্যাঙ্কের শীর্ষস্থানীয় এবং আমলারা। বেশির ভাগই যুগলকে আশীর্বাদ করে, রাতটা থেকে পরেরদিন বিয়ের আগেই চলে গেছেন। কিন্তু এক বিশেষ বন্ধু কয়েকদিন ধরে বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠানে ছিলেন। নিরুদ্বিগ্ন, প্রশান্ত, অমায়িক-- যেন পাত্রের প্রিয় জেঠু। তিনিই গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অন্য যে কোনও শিল্পপতির চেয়ে তিনি আদানির প্রতি বেশি উদার ছিলেন। তখনই আদানির সম্পত্তি দাঁড়িয়েছে ২.৮ বিলিয়ন ডলার, বিশ্বের বড়লোকদের মধ্যে ৬০৯ নম্বরে-- ভারতের বৃহত্তম বন্দর, একটি বিদ্যুৎ কোম্পানি এবং একটি পণ্য ব্যবসার ব্যবসা পরিচালনা করে। ব্যবসার বড় অংশই ছিল গুজরাটে।i. গুজরাটই ছিল হিন্দুত্বের পরীক্ষাগার, সেখানে আগে আশীর দশক থেকে অন্তত তিনটি দাঙ্গা বাধানো হয়েছে। তাতে কয়েকশো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিজেপী দেখেছে দাঙ্গা হলে বিভাজন বাড়ে, হিন্দু ভোট বাড়ে। অবশ্য সঙ্গে দরকার মুসলমানদের নিয়ে অপপ্রচার। ii. মোদি সরকার ২০০৯ সালে দুটি জনসংযোগ সংস্থাকে নিয়োগ করে - ওয়াশিংটনের ফার্ম ‘অ্যাপকো ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ বিশ্ব মিডিয়ার জন্য এবং ভারতীয় মিডিয়ার জন্য ‘মিউচুয়াল পিআর’। অ্যাপকো (এপিসিও) ওয়ার্ল্ডওয়াইডকে ভাইব্রেন্ট গুজরাট গ্লোবাল ইনভেস্টর সামিট ২০১১-এর জন্য অফিসিয়াল 'রিলেশনশিপ পার্টনার' হিসেবে নিয়োগ করেছিল। মোদীই ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রথম যিনি ইন্টারনেটের শক্তিকে মার্কেটিং মাধ্যম হিসেবে বুঝেছেন। টুইটার, ফেসবুক এবং ইউটিউবের মাধ্যমে প্রচার চালিয়েছেন। তিনি একজন ব্লগার। ভক্তরা আইফোন এবং অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মে নরেন্দ্র অ্যাপস ডাউনলোড করে। iii. বহু কাল ধরেই গুজরাত ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। সাংবাদিক বিনোদ কে জোস ক্যারাভন পত্রিকায় ‘দ্য এম্পেরর আনক্রাউন্ড’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন, পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন-মেজর ভাস্কো ডা গামাকে এশিয়ার সমুদ্রপথের আবিস্কর্তা বলা হয়, তবে যিনি তাঁকে ভারতে নিয়ে এসেছিলেন হলেন তিনি গুজরাটের বাসিন্দা কাঞ্জি মালাম। ১৪৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ দিয়ে তাঁকে কালিকটে নিয়ে এসেছিলেন। ওই ঘটনা একেবারেই কাকতালীয় নয়। কাঞ্জি মালাম কচ্ছের তুলো এবং নীল-এর বনিক ছিলেন। ওই সব সামগ্রীর বিনিময়ে সোনা ও হাতির দাঁত আনতে তাঁকে নিয়মিত আফ্রিকার তটে যেতে হত। গুজরাটিদের নাবিকবিদ্যা, সমুদ্রযাত্রা এবং ব্যবসার প্রতি টান কিংবদন্তিসুলভ। গুজরাতি বনিকরা পার্সিয়ান গালফ থেকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বাণিজ্যপথ প্রসার করেছিলেন। ইউরোপীয় অন্বেষকরা ভারতে পা রাখার কয়েক শতক আগে থেকে গ্রিস, আরব, আফ্রিকা ও চিন থেকে গুজরাটে এসেছেন। পর্তুগিজরা এদেশে আসার আগে দুই শতক ধরে গুজরাত ছিল পৃথিবীর দু্টো মূল বাণিজ্যপথের জংশন— সিল্ক রুট এবং স্পাইস রুট। তাই ছিল আফ্রিকা, আরব ও এশিয়ার বন্দর থেকে এই উপমাহাদেশে ঢোকা জিনিসপত্রের মূল বিতরণ কেন্দ্র। উপকূল থেকে অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যপথ পূর্বদিকে বিহার, উত্তরে মথুরা এবং আরেকটি পথ গিয়েছিল দক্ষিণে মারাঠাওয়াড়ে। গুজরাটের শিল্পোন্নতি এবং ভাইব্রান্ট গুজরাটের মহিমা বুঝতে গেলে এই অতীত মাথায় রাখা দরকার। গুজরাটের সফলতার কাহিনী সেই রাজ্যের উদ্যোক্তাদের পুরুষানুক্রমিক দক্ষতা এবং কৃষক, কারিগর, সমাজ সংস্কার ও কোঅপারেটিভ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। এই ইতিহাস এবং সঙ্গে সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থান গুজরাটের বৃদ্ধির ভিত গড়ে দিয়েছে। iv. ২০১১ সালে তারা অস্ট্রেলিয়ায় আরও প্রসারিত হয়, ২০০ কোটি ডলারে কুইন্সল্যান্ডের একটি কয়লা টার্মিনাল অ্যাবট পয়েন্ট কেনে। ওই বছর তাদের ঋণের পরিমান বেড়ে হয় ১৩০০ কোটি ডলার।(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
    মোবাইলে ‘না’ নির্বাচনে কমিশনের! - অর্ণব মণ্ডল | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়২০২৪ লোকসভা ভোটের তৃতীয় দফায় ভোট কেন্দ্রে এসেও ভোট দিতে পারলেন না রাজকোট লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার উর্বশী কাঁপারিয়া – কারণ তিনি সাথে ভোটার কার্ড আনেন নি। ভোট দিতে এসেও কেন ভোটার কার্ড আনেন নি, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানাচ্ছেন যে, সরকার স্বীকৃত ডিজি লকারে তাঁর সমস্ত ডকুমেন্টের কপি জমা করা আছে। প্রয়োজন মাফিক তিনি সেই ডিজিটাল কপিতেই সব জায়গায় কাজ চালান, কোথাও কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। এক্ষেত্রেও তিনি ডিজি লকারের ভরসাতেই সাথে কোনও ডকুমেন্ট না নিয়েই ভোটকেন্দ্রে চলে এসেছিলেন ভোট দিতে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কড়া নির্দেশ – ভোটকেন্দ্রে মোবাইল ফোন, ক্যামেরা বা অন্য কোনও বৈদ্যুতিন যন্ত্র নিয়ে ঢোকা যাবে না। ফলে এ যাত্রায় উর্বশী তাঁর হকের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাননি।বিএলও (বুথ লেভেল অফিসার) – এর তরফে প্রত্যেক ভোটারের জন্য যে ‘ভোটার তথ্য স্লিপ’ দেওয়া হচ্ছে তার পেছনে পরিষ্কার লেখা আছে – ভোট কেন্দ্রের ভেতরে মোবাইল ফোন ও ক্যামেরার মতো গ্যাজেট নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু কেন এই নির্দেশিকা? সম্ভবত, কোনও ভোটার যাতে পোলিং বুথে ঢুকে ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে না পারেন, সেই জন্যই মোবাইল ফোন, ক্যামেরা বা এই ধরনের কোনও রকম বৈদ্যুতিন যন্ত্র নিয়ে বুথে প্রবেশের ওপরে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু, ভিডিও বা ছবি তো নির্বাচনী স্বচ্ছতার জন্য আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরায় বুথের অভ্যন্তরের বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপের দৃশ্য ধরা পড়েছে। পোলিং অফিসারদের হুমকি দিয়ে সম্মিলিত ভাবে বুথ জ্যাম, দেদার ছাপ্পা – এসব ঘটনা তো আমাদের কাছে অতিপরিচিত। তাই বুথের ভেতরে যদি কেউ বা কয়েকজন মিলে গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করে, ভোটারদের কাছে ফোন থাকলে সেটার ছবি তোলা বা ভিডিও করা যাবে তৎক্ষণাৎ, যেটা পরে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করে অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রে সেগুলো কাজে লাগতে পারে। শুধু ইভিএম মেশিনে একজনের ভোটদানের দৃশ্য যাতে অন্য কেউ না তুলতে পারে, সে বিষয়ে কড়া নজর রাখতে হবে।তাছাড়া, ভোটকেন্দ্রে মোবাইল নিয়ে ঢুকে কোনও ভোটার নিজের ভোট দেওয়ার পদ্ধতি যদি ভিডিও করে এবং ইভিএম বা ভিভিপ্যাটের মধ্যে কোনও অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে, তৎক্ষণাৎ সেটার হাতে-নাতে প্রমাণ পাওয়া যাবে।ভোটারদের যদি মোবাইলে নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়, এবং ভিডিও বা ছবি তোলার ক্ষেত্রে কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকে, তাহলে ভোটের কাজে নিযুক্ত পোলিং অফিসাররাও নিজেদের কাজটি আরও ভাল ভাবে করার চেষ্টা করবেন, কারণ তাঁদের ত্রুটিগুলো ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকবে; এমনকি তাঁদের কাছেও এটা একটা বড় হাতিয়ার হতে পারে। ভোটকেন্দ্রের মধ্যে বুথ জ্যাম বা ছাপ্পা ভোটের মতো কোনও রকম অনাকাঙ্খিত ও অনৈতিক ঘটনা ঘটলে বা সেই সম্ভাবনা তৈরি হলে, যেহেতু যে কোনও ভোটারের সুযোগ থাকছে সেটার ভিডিও করার, ফলে পোলিং অফিসাররা আরও দৃঢ় ভাবে ও নির্ভয়ে সেই দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করে উক্ত পরিস্থতি সামলাতে পারবেন।এর পরেও যদি মোবাইল বা ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করার নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয়, তাহলে বুথের মধ্যেই ভোট প্রক্রিয়া এমন ভাবে ভিডিও রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা করা উচিত যাতে ইভিএমে মূল ভোটদানের অংশটুকু বাদে বাকি সবকিছুর যেন রেকর্ড থাকে। কারণ বুথ জ্যাম বা কোনও গণ্ডগোলের সময় পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনী অনেক ক্ষেত্রেই যে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকেন, সে দৃশ্য আমরা প্রায় সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দেখেছি বা শুনেছি।অনেকের আবার বিভিন্ন কারণে ফোন নিয়ে বেরোনোর বাধ্য-বাধকতা থাকে। তাই ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে এসে তাঁদের ফোন রাখার কোনও ব্যবস্থা না করে নির্বাচন কমিশনের এহেন নির্দেশিকা বড়ই বেমানান।যে বিষয়টি নিয়ে প্রবন্ধটি শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরি – ডিজি লকার। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরেই ২০১৫ সালের জুলাই মাসে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” পরিকল্পনা চালু করে। তারই একটা অংশ হিসাবে চালু হয় সরকার স্বীকৃত ডিজি লকার অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট। যে কোনও নাগরিক সেখানে তাঁর নিজের সব ডকুমেন্ট জমা করে রাখতে পারবেন, এবং যে কোনও সময় প্রয়োজন মাফিক সেই ডকুমেন্টগুলো ডিজিটাল কপি হিসাবেই যেকোনো জায়গায় ব্যবহার করতে পারবেন। সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে বহু মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের অনেকে ডিজি লকার ব্যবহার করে যেকোনো দরকারি নথির ডিজিটাল কপি দিয়েই বিভিন্ন জায়গায় কাজ মেটাতে শুরু করেন। কিন্তু মোবাইল ফোন নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করার সময় নির্বাচন কমিশনের এই নিষেধাজ্ঞা সরকারের ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ পরিকল্পনাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।এসবের মধ্যেই, ভারতীয় গণতন্ত্রকে একপ্রকার ‘নেতাতন্ত্রে’ পরিণত করা আমাদের দেশের “মহান” নেতাদের বদান্যতায় মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কেটে ওঠা একটা আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভোটকেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ করে ইভিএমের সামনে নিজের ভোটদানের ছবি তুলতে পারলে, কোনও ব্যক্তি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছেন তার প্রমাণ স্বরূপ ছবি তুলে আনার জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা অনৈতিক চাপ দিতে পারে, এমনকি সরকারি প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার হুমকিও দেওয়া হতে পারে।তবে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন অন্তত পকেটে নিয়েও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারির নির্দেশিকা ভোটারদের অনেকেরই তাঁদের ছাত্রজীবনে পরীক্ষার সময় ক্লাসরুমের বাইরে মোবাইল রেখে প্রবেশের কথা মনে করিয়ে দেবে। তবে পার্থক্য একটাই – এখন যাঁদের এই বিধিনিষেধ মানতে হচ্ছে, তাঁরা মোটেই পরীক্ষার্থী নন, বরং তাঁরাই পরীক্ষক।
  • হরিদাস পালেরা...
    ভোটুৎসবে ভাট - স্বপনে তাহারে (পুনশ্চ) - সমরেশ মুখার্জী | শিবাংশু‌র অতীতের লেখাটি পড়ে বর্তমান শিবের গাজন আমার দুই প্রাক্তন  বন্ধুর সাথে এক রসিক শিক্ষকের মিথস্ক্রিয়া আধারিত। পাঁচ থেকে বারো ক্লাস অবধি আমি পড়েছিলাম হাওড়ার এক মামূলী স্কুলে। কিন্তু আমার কিছু বন্ধু - উৎপল, অর্জুন, চন্দন, অমিতাভ, সুকুমার পড়তো এক ঐতিহ্য‌ময় স্কুলে - হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন। সে স্কুলে‌র অনেক প্রাক্তন ছাত্র পরে নানা উচ্চপর্যায়ের পদ অলঙ্কৃত করেছে।  তো সেই স্কুলে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন শ্রী বামন‌দেব চক্রবর্তী। সেকালে ইংরেজী গ্ৰামারে  নেসফিল্ড সাহেবের মতো সমাদর পেয়েছেন প্রফুল্ল কুমার দে সরকার। তেমনি বামনদেব চক্রবর্তীর বাংলা ব‍্যাকরণ‌ও ছিল এক প্রামাণ্য গ্ৰন্থ। ১৯৬৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়ে হালেও একবিংশতম পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পুনর্মুদ্রণ হয়েছে বহু‌বার। অর্থাৎ মূল প্রণেতার প্রয়াণের পরে‌ও কিছু কালজয়ী পুস্তক বাজারে চলতে পারে বহুদিন। সেকালে অনেক বাড়িতে‌ই পড়ার ঘরে থাকতো বামনদেব চক্রবর্তীর বাংলা ব‍্যাকরণ ও   পি.কে. দে-সরকারের ইংরেজী গ্ৰামার। আমি যদিও ও দুটোতে‌ই লবডংকা তবু দিদি ও দাদার দৌলতে আমাদের বাড়িতে‌ও ছিল ঐ দুটি ব‌ই। দাদা, দিদি জীবনের পথে ছড়িয়ে গেছে দূরে।  আমার কাছে রয়ে গেছে ব‌ই‌ দুটো - যত্ন সহকারে। ওটা‌ই আমি ভালো‌‌ পারি - সযত্নে সাজিয়ে রাখতে নানা অকিঞ্চিৎকর দ্রব‍্য। এবং স্মৃতি - তবে যাদের নিয়ে ঘেরা তা,  তাদের হয়তো মনে‌ও থাকে না তা।বন্ধুদের সাথে আড্ডায় শুনেছি ব‍্যাকরণের মতো নীরস বিষয় পড়ালেও এবং রাশভারী ব‍্যক্তি‌ত্বের অধিকারী হলেও অন্তঃসলিলা নদীর মতো বামনদেববাবুর অন্তঃকরণে‌ ব‌ই‌তো প্রচ্ছন্ন রসময়তা। তাই ব‍্যাকরণের পাঠ‍্যপুস্তক লিখলেও  তিনি লিখেছেন দুটি উপন‍্যাস‌ও। তাদের নামকরণে‌‌‌ও পাওয়া যায় তাঁর রসবোধের পরশ - "বিধিচক্রের অজ্ঞাত‌বাস" এবং "কহনে না যায়"।বামনদেব বাবুর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন ক্লাসে ছাত্রদের নামের বদলে পদবী ধরে ডাকা। তবে এক‌ই পদবী‌র অন‍্য ছাত্র থাকলেও যাকে উদ্দেশ করে ডাকা হচ্ছে সে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারতো। কারণ তিনি সম্বোধন করতেন তার দিকে দৃষ্টি‌ নিক্ষেপ করে। সাথে থাকতো তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে পদবী‌র আগে, পরে কিছু শব্দ সংযোজন। যেমন "ওহেএএ চাটুজ্জ‍্যে" বা "এই যেএএ ঘোষ মহাশয়"। তা শুনে এড়িয়ে যেতে চাইলেও যে মনকানা তার স‍্যারের দিকে না তাকিয়ে উপায় থাকতো না। ছাত্রদের মারধোর তিনি পছন্দ করতেন না। তাই বিচ‍্যূতি হলে তাকে বাংলামাধ‍্যমে সবার মাঝে সেঁকতেন। সেটা তিনি খুব উপভোগ‌ও করতেন। দুটি উদাহরণে তা পরিস্কার হবে। তার দ্বিতীয়‌টিতে থাকবে বর্তমান "স্বপন‌কুমার" প্রসঙ্গ।অমিতাভ ব‍্যানার্জী গৌরবর্ণ, দীর্ঘ‌কায়, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। সময়ের একটু আগে‌ই হরমোনের তৎপরতা‌য় তার মুখে দেখা গেছি‌ল দাড়ি গোঁফ। দশম ক্লাস পেরোতে ওর সমবয়সীদের ওপরোষ্ঠ, চিবুক বা গণ্ডদেশে যখন সবেমাত্র নবদূর্বার আভাসমাত্র দেখা দিচ্ছে অমিতাভ তখন থেকেই নিয়মিত সেলুনে যায়। ওর ঐ দাড়ি গোঁফের প্রাদুর্ভাব ও পরিপুষ্ট চেহারার জন‍্য ওকে ক্লাসের মধ‍্যে একটু  বড়ই লাগতো। কিন্তু মনটা তো সেই হারে পরিপক্ক হয়নি। তাই তখন‌ও ওর স্বভাবে রয়ে গেছিল কিছু কৈশোরোচিত কৌতূহলের রেশ।তো একদিন হয়েছে কী, বামনদেব বাবুর ক্লাসে অমিতাভ পিছনের দিকে তৃতীয় বেঞ্চে বসে বাঁদিকে‌র জানলা দিয়ে ক্ষণিক বা‌ইরে তাকিয়ে অন‍্যমনস্ক হয়ে গেছিল। বামনদেব বাবুর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তা এড়ালো না কিন্তু তিনি এক‌ই ভঙ্গিতে পড়িয়ে চললে‌ন। যেন কিছুই খেয়াল করেননি। কিন্তু আধ মিনিট বাদে‌ও অমিতাভ‌কে গভীর একাগ্ৰতায় বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি চুপ করে গেলেন। তাও অমিতাভর নজর ফিরলো না স‍্যারের দিকে। স‍্যারের দৃষ্টি অনুসরণ  করে প্রথম দিকের বেঞ্চের কিছু ভালো ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে চাইলো। কিন্তু অমিতাভ যেন সেই মুহূর্তে হয়ে গেছে অহল‍্যার কিশোর ভার্সন। জমে গিয়ে নিথর ভাবে তাকিয়ে আছে বাইরে।বামনদেব বাবু তাঁর ট্রেডমার্ক স্টাইলে বললেন, "ওহেএএ বাঁড়ুজ্জ‍্যে, বিচ্ছেদটা কিন্তু এদিকে হচ্ছে।"  অমিতাভ চমকে এদিকে তাকিয়ে বলে, "এ্যাঁ, কী বললেন স‍্যার? ঠিক বুঝতে পারলাম না।"  উনি ওনার পেটেন্টেড রসময় ভঙ্গিতে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, "এ্যাঁ নয়, হ‍্যাঁ। বিচ্ছেদ। মানে সন্ধি বিচ্ছেদের সূত্রগুলো এদিকে, মানে ক্লাসের ভিতরে বোঝা‌নো হচ্ছে। বাতায়নের বাহির হতে আকাশবাণী হচ্ছে না। তুমি বাইরে কী দেখছো বলো তো তখন থেকে?""স‍্যার, একটা প‍্যাঁ‌চা" কিঞ্চিৎ ভ‍্যাবাচ‍্যাকা খেয়ে বলে অমিতাভ।  "প‍্যাঁচা-আ-আ-আ!!!" মা লক্ষীর বাহনকে বিলম্বিত লয়ে টেনে, বিষ্ময়সূচক ধ্বনি সহকারে সম্বোধন করে অতঃপর তিনি অমিতাভ‌র উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত বাক‍্য সম্পূর্ণ করেন "দিনদুপুরে তুমি জানলার বাইরে তাকিয়ে পেচক দেখতে পাচ্ছো?""হ‍্যাঁ, স‍্যার, দেখুন আপনি, ঐ তো আমগাছের ডালে বসে আছে, সাদা একটা লক্ষীপ‍্যাঁচা। তাই তো আমি‌ও খুব অবাক হয়ে গেছি‌লাম স‍্যার।"     বামনদেববাবু জানলা দিয়ে আমগাছের দিকে তাকান। বেচারা অমিতাভ। তার আগে‌ই সে‌ই প‍্যাঁ‌চা বা প‍্যাঁ‌চানী ফুরুৎ করে উড়ে গেছে। তার নাম ধরে বামনদেববাবুর বেশ জোরে ডাকার জন‍্য‌ও হতে পারে, ওদের তো শ্রবণক্ষমতা খুব তীব্র।ঐদিকে পাশেই  ছিল একটি তিনতলা নিবাস। লক্ষীপ‍্যাঁচা উড়ে গেলেও, পুনরায় অমিতাভর দূর্ভাগ্যের ফলে‌ই হয়তো ঠিক তখন‌ই ছাদের পাঁচিলে কাপড় মেলছিল একটি ফুটফুটে সদ‍্যপরিণীতা লক্ষীমন্ত বৌ। বামনদেব বাবু আমগাছে যা খুঁজছিলেন না পেয়ে খানিক তাকিয়ে র‌ইলেন ছাদের দিকে। হয়তো মনে পড়লো তাঁর যৌবনের কথা। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে তিনি ফিরে এলেন ব্ল‍্যাকবোর্ডের সামনে।  অমিতাভ দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। তিনি উদাস ভঙ্গিতে বললেন, "আসলে তোমার কোনো‌ দোষ নেই বুঝলে বাঁড়ুজ্জ‍্যে। বয়সটা কুড়ি‌ পার হ‌ওয়ায় আগে‌ই তোমার মনটা করতে শুরু করেছে উড়ি উড়ি। তাই ভরদুপুরে প‍্যাঁ‌চা দেখতে পাচ্ছো। যাকগে এবার এদিকে একটু মন দা‌ও।" স‍্যারের বলার ভঙ্গিতে ক্লাশসুদ্ধ ছেলে মুখ টিপে হাসছে। অমিতাভ গালে দুদিনের না কামানো দাড়ি‌তে হাত বুলোতে বুলোতে তখন এক পাজি প‍্যাঁ‌চার প‍্যাঁ‌চে পড়ে অপ্রস্তুতের একশেষ। অকালে শ্মশ্রু গুম্ফের আধিক‍্যর জন‍্য ওর বন্ধু‌রা ওকে আদর করে ডাকতো 'দাদু' বলে। ঐ ঘটনার পর ছাদে ঐ বৌটি এলে ছেলেরা অমিতাভ‌কে ক্ষ‍্যাপাতো, "ঐ দ‍্যাখ দাদু, বৌমা এসেছে রে।" অমিতাভ হাসিখুশি ছেলে। এসবে রাগতো না বরং উপভোগ‌ই ক‍রতো।উৎপল ছিল ব‌ইয়ের পোকা। সবরকম ব‌ই পড়তো। তবে স্কুলে নিয়ে যেতো কেবল স্বপনকুমার। চটি ব‌ই। সুবিধা হোতো। নীরস ক্লাসের মাঝে ফাঁক পেলে ব‌ই পড়তো। সেদিন নিয়ে গেছিল কালনাগিনী সিরিজের ১৭ নম্বর চটি - মহাশুন‍্যে কালনাগিনী। এমনি‌তে টিফিন টাইমে পড়লে‌ও সেদিন এমন একটা জায়গায় সুন্দরী লাস্যময়ী দস‍্যুনেত্রী কালনাগিনী‌ আশমানে ঝুলন্ত যে তার‌পর কী হোলো জানার জন‍্য মনটা আঁকুপাঁকু ক‍রছে ওর। তখন কি আর নীরস ব‍্যাকরণের কচকচি শুনতে ভালো লাগে।  তাই বামনদেব বাবু কিছু বলছেন, মাঝে মাঝে বোর্ডে লিখছেন উৎপল পিছনের দিকে একটা বেঞ্চে বসে মনযোগী পড়ুয়া‌র মতো বামনদেব‌বাবু‌র‌ই মোটা ব‍্যাকরণ ব‌ইটা হাই বেঞ্চে রেখে, মাঝখানে চটি কালনাগিনী রেখে পড়ে যাচ্ছে। ভাবখানা যেন স‍্যার যা পড়াচ্ছেন সেটা‌ই ও ব‌ইয়ের পাতায় দেখছে। সেদিন তিনি যেভাবে অমিতাভ‌র অন‍্যমনস্কতা ধরতে পেরেছি‌লেন তা ছিল সহজ। কারণ ও তাকিয়ে ছিল বাইরে। আজ উৎপল ব‌ইয়ের ওপর মুখ ঝুঁকি‌য়ে থাকলেও অভিজ্ঞ শিক্ষকের মনে হোলো শরীর ক্লাসে থাকলেও উৎপলের মন পড়ে আছে অন‍্য কোথাও। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, "এ‌ই যে দত্তর পো, আজ কী পড়ানো হচ্ছে?"  উৎপলের বাংলাতে আগ্ৰ‌হ‌ এবং দখল‌ও আছে। তাই জানতো কী পড়ানো হচ্ছে, তা‌ই পত্রপাঠ বলে, "অলঙ্কার প্রসঙ্গে সমাসোক্তি নিয়ে স‍্যার।" বামনদেব বাবু বলেন, "আচ্ছা বলোতো আজ ক্লাসের শুরুতে ইংরেজী‌ গ্ৰামারে এর সাথে কার মিল আছে বলেছিলাম?"  উৎপল বলে, "Personification বা Metaphor এর সাথে স‍্যার।"  বামন‌দেব বাবু প্রফুল্ল হয়ে বলেন, "একদম ঠিক, আচ্ছা তুমি তো ব‌ই‌টা খুলেই রেখেছো, সমাসোক্তি‌র একটা উদাহরণ দিতে পারো?" উৎপল চালু ছেলে, এসব আগেই দেখে রেখেছে, ওর মনেও থাকে ভালো, তাই স‍্যারের ব‌ইয়ের‍‌ই একটা উদাহরণ ব‌ই না দেখেই পত্রপাঠ দিয়ে দিলো - "যতীন্দ্র‌নাথ সেনগুপ্ত‌র লোহার ব‍্যাথা, থেকে বলছি স‍্যার।"“রাত্রি গভীর হলাে, ঝিল্লীমুখর স্তব্ধ পল্লী, তােলাে গাে যন্ত্র তােলো। ঠকা ঠাঁই ঠাঁই কাঁদিছে নেহাই, আগুন ঢুলিছে ঘুমে, শ্রান্ত সাঁড়াশি ক্লান্ত ওষ্ঠে আলগােছে ছেনি চুমে, দেখ গাে হােথায় হাপর হাঁপায়, হাতুড়ি মাগিছে ছুটি ….।”  বামনদেব বাবু বলেন "থাক থাক, যথেষ্ট হয়েছে, খুব সুন্দর। আচ্ছা বলতো এটা সমাসোক্তি‌র উদাহরণ কেন?"  উৎপল বলে, "কারণ স‍্যার এখানে উপমানের কোনো সরাসরি উল্লেখ ছাড়াই কেবলমাত্র উপমেয়র দ্বারাই উপমান সম্পর্কে বলা হচ্ছে।" ব‍্যাকরণ রসে রসসিক্ত শিক্ষক ছাত্রের এহেন উত্তরে খুশি হয়ে বলেন, "উপমান ও উপমেয়‌ বলতে কী বুঝি আমরা?"  কবিতা লেখা‌য় হাত পাকাতে গিয়ে উৎপল এসব ইতোমধ্যে গুলে খেয়েছে, তাই বলে, "যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তা উপমান আর যার মাধ‍্যমে বলা হচ্ছে তা উপমেয়।" বামনদেব‌বাবু মজা পেয়ে গেছেন, এই না হলে ছাত্র, "তাহলে একটা সরল উপমা দিতে পারো যাতে উপমান ও উপমেয় দুটোর‌ই উল্লেখ আছে?"  উৎপল বলে, "যেমন স‍্যার, চাঁদের মতো সুন্দর মুখ। এখানে মুখ উপমান মানে যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে, আর চাঁদ উপমেয় মানে যার সাথে তুলনা টেনে উপমাটি দেওয়া হচ্ছে।" বামনদেব‌বাবু চমৎকৃত হয়ে বলেন, "তুমি এসব ব‌ই দেখে বলছো নাকি?"  উৎপল বলে, "না স‍্যার, ব‍‌ই‌টা আপনি যা পড়াচ্ছেন সেখানে‌ই খুলে রেখেছি বটে তবে এগুলো আগেই পড়া ছিল।"কিন্তু বেচারা জানতো না বামনদেববাবুর ঈগলের মতো তীক্ষ্ম দৃষ্টি‌কে ফাঁকি দেওয়া অতো সহজ নয়। তাঁর লেখা ব‌ইয়ের কোথায় কী আছে তা তাঁর নখদর্পণে। উৎপলের এই কথাতেই ওনার চোখে পড়ে ও যেভাবে মাঝ বরাবর ব‌ই‌টা খুলে আছে সেখানে অলংকার অধ‍্যায়টা থাকার কথা‌ই নয়। ওটা‌তো আছে ব‌ইয়ের শেষের দিকে। তাহলে কোথায় খুলে আছে ও ব‌ই‌টা?  আর কেন‌ই বা? ব‌ই‌তো বাড়িতে গিয়ে দেখা‌র জন‍্য। ক্লাসে যখন তিনি পড়াচ্ছেন তখন তো মন দিয়ে শোনা বা বোর্ডের দিকে নজর দেওয়ার কথা। উনি বলেন, "ব‌ইয়ের ঠিক ঐখানে আঙুল দিয়ে ব‌ই‌টা নিয়ে এদিকে এসো তো।"  এবার উৎপলকেও পাষাণী অহল‍্যার  ভূমিকা‌য় দেখা যায়। কিছু করার নেই। যেতেই হবে। উৎপল ভাবে স‍্যারের কাছে যাওয়ার আগে সর্প‌মুক্ত হয়ে যাওয়া‌ই ভালো। ওঠা‌র সময় ব‌ইয়ের মাঝখান থেকে আঙুলটা একটু কায়দা করে সরায়। বেঞ্চের ধারে‌ই বসে ছিল ও। কিন্তু দুর্ভাগ্য উৎপলের। ব‌ই‌টা দুটো বেঞ্চের মাঝে‌ পড়লো না, যেমনটা ও চেয়েছিল। বরং ঠকাস করে ব‌ই থেকে প‍্যাসেজে‌র মেঝেতে এসে পড়লো কালনাগিনী। তাই দেখে স‍্যার এগিয়ে এলেন। ব‌ই‌টা তুললেন। ঝকাস প্রচ্ছদ এবার সটান বামনদেব‌বাবুর মুখাভিমুখে। একটা বিমান গুলি খেয়ে সাদা ধোঁয়া ছেড়ে লাট খেয়ে নীলাকাশ থেকে ভূতলমুখী। আর হলুদ স্লিভলেসের ওপর জরিপাড় টকটকে লাল  বেনারসী পরা কালনাগিনী নগ্নপদে নৃত‍্যমূদ্রায় নামছেন প‍্যারাস‍্যূটে ঝুলে। মুখায়ববে এবং মুখভাবে দস‍্যুনেত্রী‌র কোনো ছাপ‌ই নেই বরং যেন অরুন্ধতী‌দেবীর আভিজাত্যের ছোঁয়া। তার নৃত‍্যময় শারীরভাষ‍্য দেখে হেমা মালিনী‌ও হীনমন্যতায় ভুগবে। প্রবল হাওয়ায় কালনাগিনী‌র উন্মুক্ত কেশদাম উড়ছে নাগিনী‌মূদ্রায় কিন্তু শাড়ি যে কে সেই।যেহেতু ক্লাসে বসে ব‌ইয়ের ফাঁকে কালনাগিনী গুঁজেও উৎপল ওনার সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে‌ছে তাই উনি সেদিন ওকে কিছু‌ই বললেন না। তবে পরবর্তী দেড় বছরে, যতদিন না ওরা উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে স্কুল ছেড়ে চলে গেছিল,  ক্লাসে তিনি উৎপলকে সম্বোধন করতেন, "এই যে কালনাগিনী, এটা বলতে পারো?" বলে। হয়তো সুরসিক শিক্ষকের ছাদের সেই লক্ষীমন্ত বৌটির মতো সুন্দরী কালনাগিনী‌কেও ভালো‌ লেখেছিল। আর মনযোগী ছাত্র উৎপলকেও।পুনশ্চঃ- বাস্তবে অমিতাভ ও উৎপল পর্ব ঠিক এভাবে ঘটে নি। বহুদিন আগে শোনা ঘটনার কেবল মূল দুটি উপাদান সত‍্য - প‍্যাঁ‌চা ও কালনাগিনী। তবে রচনাটি‌কে রসমালাই বানাতে পাশের ছাদে লক্ষীমন্ত টুকটুকে বৌ আমদানি - আমার মস্তিষ্ক‌প্রসূত।
    দিলদার নগর - Aditi Dasgupta | ঘরে এলে নাকি গেলে দেহলীটি ছুঁয়ে?নিশ্চিত না জানি।যেই পথে তুমি গেলে সাগরের ঢেউয়ে ---সেই পথে আমি তো উজানী ! হে মহাপ্রভু, এসেছিলে নাকি আসোনি? ছুঁয়ে গেছো তুমি এ নগর? নাকি চলে গেছ বিছানো শাটিকাটির প্রান্তটুকু চুমে? একশ বছর আগে, এক ভূমিপুত্রের লেখা পুঁথি, সহজ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিমায় বলে গেছে এ নগরে তোমার পরিক্রমার কথা। আবার দেখো, কোথাওবা উল্লেখই নেই এ মদিনার-- তোমার যাত্রাপথের আলোচনায়! আজকের  ট্যুর প্ল্যানের ধারণা নিয়ে কেমনেই বা মাপা যায় তোমার যাত্রাপথের প্রতিটা বিন্দু? আমরা মাপি স্থানগুলির ভৌগোলিক দুরত্ব দিয়ে, তারা মাপতো গম্য আগম্যের নিরিখে। পথের কষ্ট, চোর ডাকাতের উপদ্রব, যান বাহনের অভাব ---- কাছের পথকেও করে দিত দূরের! এই উপদ্রব, এই নিরিখ- আজও অপ্রাসঙ্গিক নয়। তবু, তখন ছিল তা বিবেচনার কেন্দ্রটিতে। তাই হাতে কড়ি , পায়ে বল ছাড়া শ্রীক্ষেত্র যাত্রী অচল। এদিকে নদী, খাল বিলগুলির নাব্যতা, পরস্পরের হাতধরাধরী ছিল অনেক বেশি।লোকের ভরসাও ছিল বুঝি তাদের উপর অনেকটাই। তাই জলপথে আনাগোনার চলটিও বেশ ছিল,ঘুরপথে খরচা বেশি হলেও।তবে জলদস্যুও ছিল। আর ছিল জলের ধার দিয়ে দিয়ে চলা। মানুষই পথ কাটে, এক এক অঞ্চলের মানুষ এক এক পথে। নীলাচলের পথও তাই এসেছে বিবিধ আঞ্চলিক ধারাগুলি ধরে।আন্দুল দিয়ে তখনকার নিমকির খাল পেরিয়ে সাঁকরাইল পাঁশকুড়ার রাস্তাটি অনেকটাই মিলে যায় বাস ছোটার চেনা পথটির সাথে। তবে সব পথই এসে,  মিলে যেতো শেষে,  বুঝি জনার্দন গড়ে --- নীলাচলের প্রবেশদ্বারে। তারপর বিল্বদহ , দণ্ডপাঠ, বারিদেব, কেশাধিপতি,হয়ে পথ মোটামুটি এখনকার চেনাজানা।  তোমার সেই পথটি ছিল দেখি তাম্রলিপ্ত ছুঁয়ে। আজকের ধুঁকতে থাকা হাজামজা আদিগঙ্গা তখন মূল গঙ্গা, তার পাশে পাশে কত গ্রাম নগর বন্দর ! ভাঙ্গাচোরা ঘাট,মন্দির দেউল,নামগুলি- ফিসফাস করে বলে সেই গঙ্গা হৃদি কথা! সেই নদী ধারের জঙ্গুলে পথ ধরে গেছো  তুমি,  কালীঘাট,গড়িয়া ছুঁয়ে, তখনকার   আঁটিসারা -আজকের বারুইপুর ধরে, ছত্রভোগ -জয়নগর -মজিলপুর - মথুরাপুরের  পথে পথে চিহ্ন রেখে রেখে।এইখান থেকেই সরাসরি নদী পেরিয়ে গেলে তাম্রলিপ্ত ? নাকি আরো দক্ষিণে হাজীপুরে,   যার সায়েবি নাম ডায়মন্ড হারবার? সেখানেই পেরোলে নদীটি তাম্রলিপ্ত পথে? দুটোই পাচ্ছিতো!  হাজীপুরের পথে যেতে যেতেই কি মথুরাপুর অঞ্চলে রেখে গেলে গল্পগুলি?  নদীটি কোথায় পেরোলে তাই নিয়ে যতটা না গোল, তার চেয়ে বেশি গোল বাঁধে তাম্রলিপ্ত নগর হতে জনার্দনগড়ে র পথটি নিয়ে !মথরাপুরী দাবিদার মদিনা নগরের নাম নেয়না, হাজিপুরী দেখায় মদিনা নগর হয়েই তুমি এগিয়েছ জনার্দনের পথে। দুটি র কোনোটিই উড়িয়ে দেওয়া যায়না! মথুরাপুরি পথটি বাম দিক ঘেঁষে চলে যায়,আর হাজীপুরী পথ  তাম্রলিপ্ত  থেকে ডান দিকে এগিয়ে এ নগরে হোসেনশাহী পথে এসে মেশে। সেখান থেকেই সে পা বাড়ায় জনার্দন এর দিকে । যাহা হোক,তাহা হোক। পথঘাট,জমি, কিংবা নদীর চলার পথ -চিরকাল কি একই রকম থাকে?তোমা নিয়ে লড়ালড়ি তোমাকে হারায়! হাঙ্গামা করে দেখি আজকাল বিস্তর লোক। অস্ত্রের ঝংকারে,স্বর্ণ মুদ্রার ঝনঝনায়, দেব- দেবালয়ের জাঁক জমকে -হরি আর আল্লাহ কে দেয় লড়িয়ে। যাকগে সেসব কথা। কি আসে যায় প্রভু--- ঘরে এসে বসলে,নাকি দুটো কথা কয়ে চলে গেলে দুয়ারে দাঁড়িয়ে? তোমার সুগন্ধই তো ভেসে বেড়ায় আকাশে বাতাসে--- এ নগরীর চারপাশে!  তবু থাকে কথা । থাকে অভিমান,ব্যথা ।  ছাপোষা গেরস্ত মনতো ! কোনো চলে যাওয়াই মানতে পারেনা! অতিথ এলেও তো বলি ,আর দুটো দিন থেকে যাওগো! আর তোমার ঘর ছাড়া? তাই নিয়ে তো ভাবের প্রলয়গো!  রাজনীতির কথাও বুঝি কানে আসে। আমজনও পারেনি বাঁচাতে তার ভাব, সংস্কার, সিদ্ধান্ত, ব্যক্তিঅনুভব---সে মহা বিস্তারিত বিপুল তরঙ্গের অভিঘাত হতে !  দেবদ্বিজে ভক্তি সামলিয়ে, ছাপোষা গেরস্ত মন সেদিনও তো পারেনি মেনে নিতে! সবার ই তো ঘরে ঘরে প্রায়, বৃদ্ধ পিতা মাতা --- সন্তানের মুখ চেয়ে, সীমন্তিনি গৃহিনীসচিব, ওষ্ঠের উপরে নীল তৃণরেখা নিয়ে কিশোর বালক, হয়তোবা নবনীত লাবন্য ছড়িয়ে ---আদরের কন্যাটি ---বিষ্ণুপ্রিয়া সম! সেই বালিকাটি,বাসরে ঢুকতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে রক্ত ঝর ঝর --- এলিয়ে পড়লো তব কোলে, প্রভু! সারাটি জীবন বুকেতে, মনেতে,জড়িয়ে রাখার আশ্বাসটি দিয়ে নিয়ে এসেছিলে তুমি তাকে !  আজ জোৎস্নায় মাখামাখি সেই কচি মুখ, লেপখানা একটু বুঝি সরে গেছে, আহা! ফেলে দিয়ে এলে তুমি তারে?একা বিছানাতে,এই ঠাণ্ডার রাতে? নবদ্বীপের ঘাট শুনশান, চলে গেলে কণ্টক দ্বীপে,ওই পারে।এই ঘাট আজও তাই নিদয়ার ঘাট হয়ে রয়ে গেল! সাধারণ সংসারী জনেই তো দেয় নাম--- প্রয়োজনে,ভালবেসে,অভিযোগে।সাধুর তো সকলই সমান। এই ঘাট তাই, রয়ে গেল তাহাদের অভিযোগ হয়ে তব প্রতি---হে রমাপতি । আর ‘মা’টি? মাটি --- ভূমি – ধরণী ! নিজেকে বিদীর্ণ করে জন্ম দেন  তিনি শস্য, তৃণ বৃক্ষরাজি,যাবতীয় প্রাণীকুল,এবং মানুষ। যতবার জন্ম দেন ততবার নতুন জন্ম হয় তাঁরও। তাঁর চেয়ে বড় ব্রাহ্মণ,আর কেউ আছে নাকি প্রভু ? কেন কাঁদিবেনা?   মিছামিছি কাঁদেছি আমোরা? পট চিত্র,যাত্রাপালা গানে,বসি কালাচাঁদ মন্দির চাতালে!সন্তানের নাম ধরি কাঁদিবার মাতৃ অধিকার ---তাও বুঝি ভাসি যায় ব্যথা নীল যমুনার জলে!দশ দশ বার ---বত্রিশ নাড়ি ছিঁড়ে দ্বিজ হওয়া জননীরে হায় ---এই সেদিনের কচি পুঅ,কুনকে মাপে দেয় গ সান্তনা ---“কৃষ্ণ বলি কাঁদ মা জননী, কেঁদোনি নিমাই বলে”!                                     প্রকৃতি জড়িয়ে বাঁচা সে প্রাকৃত জন,                  নারী,শূদ্র,আর আর আছো হে যাহারা,                  বল বল,আমাদের ভাব- অধিকার                  তবে কি অগ্রাহ্য হয় ব্রাত্যজন বলে?  প্রকান্ড শরীর ছিল নাকি তোমার, গৌর? কাষ্ঠ পাদুকা সেই মত? সে ভারী পাদুকাদুটি তুমি চাপিয়ে দিয়ে এলে ওই কচি মেয়েটির বুকে। প্রভু , চোদ্দ না পুরানো সব বেটাবিটি শিশু বলে ধরে এ সমাজ,এখন। আর সশরীরে যাদের সঙ্গ করলে কৃষ্ণ নাম সাথে নিয়ে,তারা সবাই তোমায় হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছিলতো? তুমিতো অপ্রকট হলে দারুব্রহ্মশরীরে? নাকি মন্দির প্রাচীরে?                   সমুদ্রেরও কথা তোলে কেউ---                   মূর্তিটিও দাঁড়িয়ে সে মতো ,                   স্বর্গদ্বারে পাব্লিকের ঢেউ!  সেতো চেয়েছিল তোমাকেই অনুসরণ করতে। দিলে আর কই? তোমার দায়িত্বগুলি দিয়ে বেঁধে রেখে গেলে! ফুলদানিটাই যদি ভেঙে যায় ঠাকুর,  বাগান থেকে তুলে আনা ফুলটি কি আর বাঁচে? সেতো শুধু সং সেজে সংসারে শুকিয়ে মরা! যাপন আর হয় কই? চোখের জলও শুকিয়ে যায়। যদিও ক্যালেন্ডারে আঁকা তার ছবিগুলি,  বাই ডিফল্ট ,ওভার ফ্লোয়িং। এক মানবীর যেন খালি কেঁদে যাওয়াটাই কাজ! কি অপচয়!কাঁদবো কি কাঁদবনা, কাঁদলে কখন কাঁদবো, কার জন্যেই বা কান্নাটি সিদ্ধ আর কার জন্য অসিদ্ধ --- এসব কি আর আমাদের হাতে? তোমরা যেমন চাও --- রুদালি কি পাষাণী!  ফিরে আসি মদিনায়। এই শহরে ঢোকার মুখে কেশব সামন্ত নাকি তোমায় সন্ন্যাস যাত্রায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল? এটুকুই জেনেছি, আর কিচ্ছু জানিনা। সন্ন্যাস থেকে ফেরানোর চেষ্টা মাত্রই কি অপচেষ্টা? তোমার সন্ন্যাস তো অনেক দুষ্টু লোকের শান্তির কারণ হয়েছিল! কী হতো, যদি তুমি ঐ আঠারো বছর ব্যয় করতে আমাদের জন্য? কত কথাইতো মনে আসে!              ভেসে আসা ভাঙ্গা হাল, ছইটি যেমন,              হারানো সে নাওটির দেয় সংকেত,              ছোট ছোট ঘটনা উল্লেখ ----              ইঙ্গিতে জানায় বুঝি ,              কালের সলিলে ডুবে যাওয়া---              ভুলে যাওয়া কোনো সূত্র, অস্ফুট অজানা অভিপ্রেত!  গহন দর্শনের তত্ত্বকথাতো বুঝিনা ঠাকুর, এই চোখে কানে, অনুভবে যতটুকু। আছে সমব্যথী মন , আর এক ঝুড়ি ‘যদি’ নিয়ে কল্পনাগুলি।        কার কিবা ক্ষতি তাতে? কীবা আসে যায়?           গৃহীত,স্বীকৃত ইতিহাস,            পুনঃ পুনঃ আবৃত্তির            নিইনি তো দায়!           তবু, যদি কেউ ব্যথা পাও---           ক্ষমা পাবো জানিগো নিশ্চয়। কল্পনা করিতে জাগে সুখদাঁড়াযে সে---স্পর্ধিত অনার্য হৃদয়,হয়তোবা, পূর্বজ বজ্রযান স্মৃতি,যার কাছে নারী নয় সাধনার কাঁটা,রমন সম্ভারে লোভনীয় ---ব্যাক্তিহীন কেবল ঘরণী!নারী তার ---দেহ থেকে দেহতীত সত্যের সন্ধান ---সহস্র পদ্মের মাঝি পরাণের প্রাণঅপরিহার্য সাধন সঙ্গিনী। কিবা ঠিক,  কিবা ভুল ---পাপ ---- পুণ্য ----আড়ালে কি অন্য কারণ?জীবনের অতি বাস্তবতা,সমাজ,সংসার রাজনীতি?কালের আবর্ত হতে উদ্ধার পেয়ে কী ভাবে প্রতিষ্ঠা হবে আজ?বিপ্লবী দেবতা ----তব শিলাময় রূপ মস্তকে চাপিয়া ধরি,তবু কেন খুব চেনা ঘরোয়া হৃদয়কেঁপে ওঠে থির থির?কী বিষাদে আসে এই লাজ?  দিলদার নগরে রাতে হাওয়া,অলিগলি করে আসা যাওয়া,আফসোস করে বলেঃ হায় !এ বিষাদ আমাদেরও দায় !রাখিতে পারিনি তারে, চলি গিলা সম্মুখ দিয়া !ক্ষমা করো এ নগরে --- নিজ গুণে,ক্ষমা কর মাগো,বিষ্ণুপ্রিয়া!                          
    চালচিত্র এখন - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | 'চালচিত্র এখন' দেখতে দেখতে  হঠাৎই মনে পড়ল, এই শহরে একদা সত্যজিৎ রায় বসবাস করতেন। সেই সত্যজিৎ, এক কলকাতা বিশেষজ্ঞ যাঁর কাছে দেশলাইয়ের ইতিহাস জানতে গিয়েছিলেন। দেশলাই নিয়ে সত্যজিৎ কেন? কারণ, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি বানাতে গিয়ে, হুঁকো কীকরে ধরানো হয়, জানার দরকার পড়েছিল সত্যজিতের। এবং উনবিংশ শতকে দেশলাই চালু হবার ইতিহাস নিয়ে রীতিমতো অনুসন্ধান করেছিলেন তিনি। স্রেফ একটা সিনেমার সামান্য একটা টুকরোর জন্য। ফালতু অত পরিশ্রম না করলে কীই বা হত। ১৮৫৬ সালে ফস করে শিপ দেশলাই জ্বালিয়ে হুঁকো কিংবা প্রদীপ ধরানো হচ্ছে দেখালে কিশোরকুমারপ্রিয় গোদা দর্শকদের আহা-উহু কিছু কম পড়তনা। এখন অমনটা হয়েই থাকে। ওটাই রীতি। এই কদিন আগেই ঘটিয়াখ্যাত অনুরাগ কাশ্যপ বুলবুল নামক একটা সিনেমার গুছিয়ে প্রশংসা করলেন। সেখানে নায়করা হালফ্যাশানের পোশাক পরে, নায়িকা দোল খেতে-খেতে এমন একখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, যা লেখা হয়েছিল সিনেমার সময়কালের অন্তত বছর কুড়ি পরে, এবং তাতে কিছু যায় আসেনি। চালচিত্র এখন সিনেমাটাও এই রীতি অনুসরণ করেই বানানো। যদিও অত পুরোনো না, এবং অত গভীর অনুসন্ধানেরও প্রয়োজন পড়তনা, কিন্তু সেটুকুও করার দরকার মনে হয়নি। এই সিনেমায় আশির দশকের কলকাতায় দিব্যি ল্যাজ তুলে ঘুরে বেড়ায় নীল-হলুদ বেসরকারি বাস, আশিতে সেসব বাস কেউ চোখে দেখেনি। শব্দ শোনা গেলে তারা হয়তো নিউটাউন-নিউটাউন বলেও হাঁক পাড়ত। দেখা যায়, সবুজ অটো। নায়কের বৌয়ের নাম মাঝেমধ্যেই মিতা থেকে বদলে গীতা হয়ে যায়। এবং মিতা ওরফে গীতা মিনার্ভা থেকে উত্তরপাড়া যেতে নিয়মিত শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরেন। শিয়ালদা থেকে উত্তরপাড়া ট্রেনে চড়ে যাওয়া একেবারে অসম্ভব কিছু না, কিন্তু সে তো নৈহাটি-ব্যান্ডেল হয়েও যাওয়া যায়, সাধারণভাবে সুস্থ লোকে ওই দিক দিয়ে নিয়মিত যায় না আর কি।না, ভাববেননা, সিনেমাটাকে গাল দেবার জন্য লিখছি। গাল অবশ্যই দিলাম, এবং এ তো শুধু কয়েকটা জিনিস,  এছাড়াও আরও বহু কিছু বার করা যায় যা লিখলাম না, কিন্তু তাতেও জিনিসটা বসে দেখা গেছে, এবং সত্যি কথা বলতে কি, গুরুত্বপূর্ণই লেগেছে। গুরুত্বপূর্ণ কেন? কারণ, সিনেমার প্রেক্ষাপট, মূলত আশির দশকের। সেটা বামফ্রন্ট জমানার প্রথম দিক। বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমা, দাদার-কীর্তির গামা সাফল্যের পর মোটামুটি মায়ের ভোগে যেতে বসেছে।সমান্তরাল সিনেমার দিকপালরা যদিও স্বমহিমায়। সত্যজিৎ রায়  হীরক-রাজার-দেশে বানানোর পর সাময়িক বিরতিতে। মৃণাল সেন কাজ করছেন, তিনিই তো এই সিনেমার উপজীব্য। তপন সিংহ, কয়েক বছর পর বানাবেন আতঙ্ক, যার 'মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি' বহুদিন ধরে মুখে-মুখে ফিরবে। ওই বছরই  চালু হবে 'সানন্দা', যাকে তখন মেয়েদের পত্রিকা, এবং পরে লাইফস্টাইল-পত্রিকা বলা হবে। এবং ক্রমশ উঠে আসবেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, যাঁর সিনেমা দেখে মনে হবে ঠিক যেন সানন্দার গৃহসজ্জা। পরিচালক হিসেবে উঠে আসবেন অপর্ণা সেন এবং অঞ্জন দত্ত স্বয়ং। উনুনের ধোঁয়া, বিচ্ছিরি দেখতে ঘেমো লোক, প্লাক-না-করা মেয়েছেলে, রঙচটা দেওয়াল, এরা সব  সিনেমা থেকে হাওয়া হয়ে যাবে ক্রমশ। গৌতম ঘোষ বা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তরা থাকবেন বটে, কিন্তু ততটা ফোকাসে না। তারও পরে আসবে এসভিএফ যুগ, যখন দু-চারটে ব্যতিক্রম ছাড়া, আর দেখে বোঝার উপায় থাকবেনা, যে কলকাতা নিয়ে সিনেমা হচ্ছে, সেটা সত্যিই পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা কিনা। এর কিছু সিনেমা দেখতে চমৎকার হবে, কিছু অখাদ্য, কিন্তু এগুলো যে বাংলা সিনেমা, বোঝার কোনো উপায় থাকবেনা। এবং তেরোখানা মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে এসব আর কেউ দেখবেনা।তপন সিংহর আতঙ্ক থেকে উনিশে-এপ্রিল বা যুগান্ত - এদের কালগত দূরত্ব কতই বা, বছর দশেক। কিন্তু স্থানগত দূরত্ব অসীম। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের রংচটা বাস্তব থেকে উচ্চাকাঙ্খী সিঁড়িভাঙা শাইনিং উচ্চমধ্যবিত্তের ডিজাইনার বাস্তবতা। সিনেমা হল থেকে মাল্টিপ্লেক্স। দোকান থেকে শপিং মল। ছোটোলোক থেকে আনন্দলোক। মাত্র দশ বছরে কী করে পুরোটা এভাবে বদলে যেতে পারে, তার নানারকম ব্যাখ্যা থাকা সম্ভব। কিন্তু চলচ্চিত্রকারদের ব্যক্তিগত যাত্রাপথটা সেভাবে লিপিবদ্ধ না। এই সিনেমাটাই প্রথম, যেটা, আমার দেখায়, পুরোটা খুলে দেখানোর চেষ্টা করল। সেই জন্যই সিনেমাটা গুরুত্বপূর্ণ। সিনেমায় গপ্পো বিশেষ নেই, তাতে সমস্যাও কিছু নেই, যা আছে, তা মূলত কলকাতার প্রেক্ষাপটে এক আধা-আমেরিকান তরুণের কথা। যে, গিটার বাজিয়ে ইংরিজি গান গায়, স্টেটসম্যানে ইংরিজিতে প্রবন্ধ লেখে, স্বপ্নে দেখে আলপাচিনোকে। সে দার্জিলিং ভালোবাসে, সম্ভবত তার কনভেন্ট ইশকুলকেও, কলকাতাকে অপছন্দ করে, জার্মান নাটক পড়ে, সাদের ইরোটিক লেখাকে মঞ্চে তুলে আনার চেষ্টা করে। মৃণাল সেনের পাল্লায় পড়ে সে ঢুকে পড়ে বাঙালি সংস্কৃতির বৃত্তে। নিম্নমধ্যবিত্ত এক বাঙালির চরিত্রে অভিনয় করে। গপ্পে এর চেয়ে বেশি কিছু নেই। ছেলেটি এর পরে একসময় বাঙালি সংস্কৃতির নেতৃস্থানীয় জায়গায় চলে আসনে, সেটাও না। কিন্তু গল্প তো শুধু কাহিনীরেখাটা নয়, কীভাবে বলা হচ্ছে, তাও গপ্পেরই অংশ, বা পরা-গল্প। সেই পরা-গল্পের সুতোটা যদি অনুসরণ করি, তো দেখব, সিনেমায় আছে শুধু আমেরিকা। ব্যাকগ্রাউন্ডে যতগুলি গান, সেখানে নিউ-অর্লিয়েন্স থেকে শুরু করে ক্যালিফোর্নিয়ার ছড়াছড়ি। এমনকি শেষে একখানা ইংরিজি গানও আছে, কারণ বাংলায় বোধহয় সবটুকু বলে ওঠা যায়নি। শুরুর দিকের যত সংলাপ, তার অর্ধেকের বেশি ইংরিজিতে। কাগজের নাম স্টেটসম্যান। নায়কের বৌ পড়ায় গোখেলে। নায়কের নাটকের দল ফরাসি বিপ্লব এবং সাদ নিয়ে ভাবে। ওইটাই জগৎ।  ওইটাই স্বপ্ন। তারপর সে থেকে যায় কলকাতায়। যীশু যেভাবে থেকে গিয়েছিলেন দুঃখের পৃথিবীতে, সেইভাবে। শ্রীচৈতন্য বা মহম্মদ না বলে যে যীশু বলা হল, সেটা ইচ্ছাকৃত। কারণ যীশু ইউরোপীয়, আর বাঙালির যীশু মোটের উপর ইংরেজ, যারা আবার প্রায় আমেরিকান। পরে এই ছেলেটি সেই যীশুর ভাষায় গানও গাইবে, মেরি-অ্যান মেরি-অ্যান। সেটা অবশ্য সিনেমায় নেই।সব মিলিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার। ১৯৮৬ থেকে ৯৬ - এই দশ বছরে, আমেরিকা-ইউরোপ থেকে ক্রমশ টপকে পড়েছে বাঙালি সংস্কৃতির নেতৃত্ব। তৈরি হয়েছে এক উচ্ছিষ্ট উপনিবেশ। তার আগে, বাংলা সিনেমার সত্তর বছরের যে বোঝা ছিল, তাকে তাই ছুঁড়ে ফেলা গেছে অতি সহজে। এখন বাংলা গান হয় মূলত আমেরিকান সুরে। বাংলা সিনেমা হয় আমেরিকান অন্তরাত্মা নিয়ে। খোলসটাই শুধু কলকাতার, বা বাংলার। তাই আশির দশকের বাস নীল হয়ে গেলেও কিছু আসে যায়না, আসল  কথা তো ডিটেলিং না, অন্তরাত্মাটুকু। শিয়ালদা দিয়ে উত্তরপাড়া যাওয়াও ভুল কিছু না। কলকাতার বাইরে যা উত্তরপাড়া, তাই উত্তরবঙ্গ, কলকাত্তাইয়া উচ্চবর্ণের কী আসে যায়। যিনি সিনেমার নাম দেন ম্যাডলি বাঙালি, তাঁর কাছে এসবে কিছু এসে যাবার কথা না। সমস্যাটা আমাদের, যারা বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম যুগটা দেখেছি, যারা অশোক-মিত্রকে দেখেছি, যারা নামসংকীর্তন, টপ্পা-ঠুংরি, জয়-বাবা-তারকনাথ, যাত্রাপালা, এইসব হাপ-মফস্বলী জিনিসকেও বাঙালিত্বের অভিজ্ঞান ভাবি। আপনারও যদি এইসব ঢপের খোঁয়াড়ি থেকে থাকে তো,  এই সিনেমা দেখুন বিদেশী সিনেমা দেখছেন ভেবে। বাংলা সিনেমায় প্রায়-ইংরিজি ডিলানের গান, বৌবাজারের মোড়ে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ঠিক করে গুঁজে দিলে তো মজাই লাগে। সেটাও আজকাল অবশ্য দেখা যায়না। সেদিক থেকে এটা সম্ভবত ভালই লাগবে, নইলে পুরোটা দেখতামও না, প্রতিক্রিয়াও দিতামনা। কেবল  মাঝে-মধ্যে মনে পড়ে যেতে পারে, এই সেই শহর, যেখানে একদা সত্যজিৎ রায় বসবাস করতেন। সেইটাই একটু ঝামেলা।   পুঃ ছবিটা সিনেমার নয়। মজা করে দেওয়া। 
  • জনতার খেরোর খাতা...
    আপনি কি আঁতেল? - Niladri Deb | একে তো স্বপ্ন দেখে বখে গেছেনতার উপর একদম নাস্তিকএমনকি অঙ্কে মোটামুটিNiladri Deb আঁতেল হতে পারলেননা। তাঁর পড়ার উপযুক্ত বইঃ মানুষখেকো শয়তাননির্ঘাত গুরুর বইও পড়েন। আপনিও দেখে নিন আপনার কপালে কী নাচছে
    আপনি কি দেশপ্রেমী? - Prodip Kumar Bhattacharjee | একে তো মহাবীর পুরুষোত্তমের নাম জানেননা, আপনি প্রাচীন ইতিহাসে পাতিহাঁস ভূগোলে গোলতার উপর দেশ যখন পোড়ে তখন বেড়ানো নিয়ে আদিখ্যেতা করেন এমনকি সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেশবিরোধী, শৌর্য দিবস কাকে বলে জানেন নাProdip Kumar Bhattacharjee আপনি দেশপ্রমী না কাজি নজরুল?নির্ঘাত গুরুর বইও পড়েন। আপনিও দেখে নিন আপনার কপালে কী নাচছে
    ময়ূর সিংহাসন বা তখতে তাউস - AR Barki | ময়ূর সিংহাসন বা তখত তাউস মোগল বাদশাহ শাহ জাহান কর্তৃক নির্মিত একটি সিংহাসন। একে দুনিয়ার সবচেয়ে দামী সিংহাসন হিসাবে দাবি করা হয়।  বাদশাহ শাহজাহানের সিংহাসনের সংখ্যা ছিল ৭টি এবং এগুলোর মধ্যে ময়ূর সিংহাসনই ছিল সবচেয়ে দামী ও জমকালো। প্রায় আট বছর ধরে তখনকার আট কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়।  আগ্রার তাজমহলের চেয়েও বেশী অর্থ ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় সিংহাসনটি। এটি ছিল স্বর্ণ, দুর্লভ হীরা ও মরকত মণিখচিত। বিশ্ব বিখ্যাত হীরা কোহিনুর এর গায়ে বসানো ছিল।  ১৭৩৯ সালে পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ভারত বর্ষ অভিযানকালে সিংহাসনটি লুট করে নিয়ে যান। সিংহাসনটি ইরানে থাকলেও কোহিনুর হীরা নানা হাত বদল হয়ে বর্তমানে ইংল্যান্ডে আছে। 
  • ভাট...
    comment | অজস্র অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা অরিন। এই ভয়ংকর আকালে এক টুকরো ঝিলিমিলি।  সফল হোক আপনার প্রোজেক্ট। অনেক মানুষের উপকার হবে।
    comment&/ | আরে অরিনবাবু করেছেন কী মশাই !!! অভিনন্দন অভিনন্দন অনেক অভিনন্দন 
    commentঅমিতাভ চক্রবর্ত্তী | অরিন | 2404:4404:1732:e000:e823:1436:9fc7:4a28 | ২৮ মে ২০২৪ ১১:২৮
    ওয়াও। খুবই দরকারি প্রচেষ্টা ডাক্তারবাবু। এ ত একেবারেই নতুন দুনিয়ার অ্যাডভেঞ্চার। এতে যে কোনরকম সাফল্যই দূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে, এমনকি বিফলতাও অনেক কিছু জানাবে। এই পথে চলাটাই এক বিরাট ব‍্যাপার। অনেক শুভেচ্ছা।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত