এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • নিউনর্মাল করোনাকালীন পর্ব বিয়াল্লিশ

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৭ জুলাই ২০২৩ | ৪০৫ বার পঠিত
  • এখন নীরবতা অভ্যেস করা ভালো। সুনন্দিতার এইরকম বোধ হচ্ছে। কথা যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে এই পরিস্থিতিতে। নিজেকে নিজে ভরসা দিতে পারছেন না। অন্যকে দূরের কথা। প্রবল ইনফেকশন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি তাঁর ভাশুরের মেয়ে নয়না। পরমপ্রতাপ তাঁর সমস্ত উদ্যোগ কাজে লাগিয়ে কোনোমতে আমেলিয়াকে সুস্থ করে তুলেছেন। অবশ্য আমেলিয়ার কোভিডের ইনফেকশন হয়নি। ভ্যাকসিনের ফার্স্ট ডোজের পর সেই বিপুল উত্তাপ তাঁকে গ্রাস করেছিল। সেই দিনগুলির কথা মনে পড়লেও হাত পা কাঁপে সুনন্দিতার। তার ঠিক পরপর বাবু চলে গেল কলকাতায়, ত্রিদিবের খবর পেয়ে। খুব ফাঁকা লাগছে বাড়ি। ছেলেটা ক' মাসে কেমন মায়ায় বেঁধেছে যেন। সুমন, সুনন্দিতার নিজের ছেলেটি ভীষণ সেল্ফ সাফিশিয়েন্ট। আত্মনির্ভর শব্দটা আর পারতপক্ষে ব্যবহার করেন না সুনন্দিতা। কেমন গা গুলিয়ে ওঠে। বন্ধুদের কাছে সুমন সম্পর্কে কিছু বলতে হলে বলেন, হি হ্যাজ রিয়েলি গ্রোন আপ। টেকস কেয়ার অব হিমসেল্ফ।
    সুমন এত বেশি ঝকঝকে, পার্টিকুলার যে তাকে নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবার নেই। তাঁর চিন্তা নিকিকে নিয়ে।নিকির অসুখ এবং ভীষণ ভঙ্গুর স্বাস্থ্য যেকোনো সময় ইনফেকশন ধরে নিতে পারে। সুনন্দিতা খুব একটা পুজোআর্চা করেন না। এই বাড়িতে সেই নিয়ে কোনও কড়াকড়িও নেই। তবু সুনন্দিতার বেডরুম লাগোয়া ছোট একটি অ্যান্টি চেম্বারে তাঁর একটি দেবতার আসন আছে।তাঁর মায়ের দেওয়া কিছু ঠাকুর দেবতার মূর্তি আছে। ভীষণ বিপন্ন বোধ করেন যখন, যখন আমেলিয়া ঘুমে, পরম বাইরে নিজের অফিসে, নিকি ল্যাপটপে মগ্ন, বিশাল মেহতা হাউসে দিনহাটার সেই ভীতু মেয়েটি কেমন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সুনন্দিতা তাঁর দেবতার কাছে গিয়ে বসতে চান।অথচ ভেতর থেকে কেউ বলতে থাকে, কোনো লাভ নেই, কোনো লাভ নেই।কিছু হবে না এতে। লক্ষ্মীর আসনে এক গৌরবর্ণা, পানপাতান্যায় মুখশ্রী। কোঁকড়া এলোচুলে স্বর্ণমুকুট দেবীর মুখে ইলেকট্রিক আলো চিকচিক করে। মনে হয় চন্দ্রালোক পিছলে পড়েছে। গণেশ মূর্তি আছে। হনুমানজি। শিব পার্বতী। মেহতারা হিন্দু ক্খত্রী। মেহতা। চিফ। প্রধান। মহৎ। এই বাড়িতে সেই অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট দেবদেবী বিরাজ করেন। আমেলিয়া সেই নিয়ে কোনোদিন আপত্তি বা আদিখ্যেতা কিছুই করেন নি। তাঁর পছন্দ ছিল পুতুল এবং আউটডোর লাইফ।
    সন্ধের পর সুমন ছাতে এক্সারসাইজ করে। এই ছেলেটিকে দেখে বোঝাই যায় না দুনিয়াতে করোনা বলে কিছু আছে। তার ফার্স্ট ওয়েভ, সেকেন্ড ওয়েভ আছে। সে কিছু ওয়েস্টার্ণ মিউজিক চালিয়ে ব্যায়াম করতে থাকে। স্কোয়াট। জাম্পিং জ্যাক। বেসিক স্ট্রেচিং। মাউনটেইন ক্লাইম্বিং। এইসব সামান্য বেসিক ব্যায়াম আধঘন্টা। তারপর তার ওয়েট লিফটিং শুরু হয়।একপাশে রাখা ট্রেডমিলে দৌড়ানো। আরো নানা যন্ত্র পাতি। সুনন্দিতা ভুলেও সেদিক মাড়ান না। তাঁর ঐসব যন্ত্র দেখলেই ভীষণ সাফোকেশন হয়।
    এই সন্ধেবেলা বাবুর সঙ্গে আড্ডা মারা অভ্যেস হয়ে গেছে। বাবু ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে স্নান সেরে ডাইনিং এ বসতো। সুনন্দিতা ক্লাস সেরে গা ধুয়ে চা, স্ন্যাকস নিয়ে বসতেন। একটু পরে আমেলিয়া।আরো কিছু পরে নিকি। বাবু না থাকাতে এই ফাঁকা ভাবটা সুনন্দিতাকে গিলছে।
    ইলেকশন ডিক্লেয়ার্ড হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। নিউজটা শোননে।কিন্ত কিছুক্ষণ পরেই বিরক্ত লাগে।
    সুনন্দিতা এটা ওটা করার ফাঁকে একবার দেবতার আসনের সামনে এসে চোখ বুঁজে কিছু একটা চাইবার চেষ্টা করেন। কিন্ত কনসেনট্রেট করতে পারছেন না কিছুতেই। দিনহাটার বাড়ি পাকা হয়েছে। কিন্ত মা একা আছেন। কোনোমতেই দাদার কাছেও যাবেন না। সুনন্দিতার কাছেও আসবেন না। মেহতা হাউসে স্পেসের অভাব নেই। ইচ্ছে করলেই সুনন্দিতার মা এসে থাকতে পারেন। কিন্ত পরম তো কোনোদিন নিজে থেকে বলেননি? চাপা অভিমানের বিজবিজ বাবল্স উড়ে বেড়ায়। সুনন্দিতা চোখ বুঁজে পাথরের মূর্তির সামনে দাঁড়ানোমাত্র একটু কিছু গাইতে চেষ্টা করেন।ঠিক সেই সময়ে ছাত থেকে তীব্র এক্সারসাইজের মিউজিক ভেসে আসে। নোর্মানির মোটিভেশন বা লিজোর গুড অ্যাজ হেল।কখনো স্কটের সিকো মোড।
    সুমন বলে, মিউজিক হেল্পস মি টু ফাইন্ড মাই রিদম। তারপর চালিয়ে দেয়, আই অব দ্য টাইগার।
    সুনন্দিতা বোঝেন না।কিন্ত নিচে দেবতার আসনের সামনে দাঁড়িয়ে, হ্যাঁ, দাঁড়িয়েই তাঁর সুবিধে হয় , সুমনের জিম মিউজিকের তালে তালে তিনি একপ্রকার নিরাপত্তার প্রবাহ ফীল করেন। বাবুও সেল্ফ সাফিশিয়েন্ট কিন্ত নরম ধাঁচের।  কিংবা কে জানে, বাঙালি বলেই হয়তো এতটা অ্যাফিনিটি তৈরি হয়েছে।
    আজ কী হল কে জানে, নিকি হুইলচেয়ার চালিয়ে হুড়মুড় করে আসছে। পড়ে না যায়। সুনন্দিতা দৌড়ে গিয়ে সামলালেন।
    - সামথিং স্ট্রেন্জ মা।
    সুনন্দিতার বুক ধ্বক করে উঠল। কী হল?
    নিকি হোয়াটস অ্যাপে একটা অডিও ক্লিপ পেয়েছে। বাংলায়। সে বাংলা যথেষ্ট ভালো বোঝে।লিসন মা।হোয়াট হি সেয়জ।
    সুনন্দিতার মভ রঙের কুর্তিতে বেসনগোলা পড়ে গেছে।কোনোমতে হাত মুছলেন।
    কোনো অজ্ঞাত কন্ঠস্বর বলে যাচ্ছে।যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গেই বলছে। ওয়ান ওয়ার্লড। ওয়ান নেশন।কতিপয় ধনকুবের যাঁদের সিলিওনেয়ার বলা হয়, তাঁরা নাকী একটা মাস্টারপ্ল্যান করেছেন। নিকি অত্যন্ত উত্তেজিত।সে মা' কে ধরে বসিয়ে গাফাম অর্থাৎ গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক, অ্যামাজন আর মাইক্রোসফট সম্পর্কে ভদ্রলোক যে প্রভূত জ্ঞান বিতরণ করছেন সেসব শোনাবেই।
    সুনন্দিতা অধৈর্য্য।চমৎকার গোল বেগুন কেটে হলুদ, তেল, চিনিতে মানিয়ে রেখেছেন। বেসনে ফেলে ভাজবেন। কুকিং ইজ দ্য বেস্ট ওয়ে টু ডাইভার্ট। নিকি ছাড়বেই না।
    প্লিজ শোনো। শোনো বলছে যে নেশন থাকবে না। স্টেট থাকবে না। কর্পোরেট স্টেট ফর্ম করবে। আন্ডারস্ট্যান্ড? বন্দনা শিভা তাঁর বইতে হিসেব করে অংক দেখিয়ে দিয়েছেন।
    আল্টিমেটলি ম্যান উইল বিকাম আ প্রোডাক্ট! ক্যান উই ইমাজিন দিস? প্রডাক্ট অব সফ্টওয়ের প্রোগ্রামস!
    দুর।সুনন্দিতার এইসব শুনতে ভালো লাগছে না। সেকেন্ড ওয়েভে নিকিকে খুব সাবধানে রাখতে হবে। এটাই তাঁর মাথায় ঘুরছে।
    আর এই মুহূর্তে মুচমুচে করে বেসন দিয়ে বেগুনভাজা। একটু চালগুড়ো দিলে মচমচ করবে। আতপচালের ভাত ঘি দেবেন জমজম করে। কাঁচালঙ্কা।
    দিনের শেষে একটা জিনিষ খুব ম্যাটার করে। খাওয়া।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৭ জুলাই ২০২৩ | ৪০৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন