এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • নিউনর্মাল করোনাকালীন পর্ব একুশ

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০১ জুন ২০২৩ | ২৯৩ বার পঠিত
  • তিন পাহাড়ের দেশ। থাঙ্গাল। মুরুগান। কুরিসুমালা। এবার অনিল ও পলির সঙ্গে পলির মা, বোন এমিলি আর বাচ্চারাও এসেছে। বড়দিনের এই ট্যুর অনেকটাই নিশ্চিন্তির হওয়ার কথা ছিল। অনেকটাই প্রাপ্তির। অন্তত পলির মা, বোন এমিলি আর বাচ্চারা সেইরকম মুডেই এসেছে। বড়দিনের কুরিসুমালা অনন্য। সবুজের উৎসব। হাজার হাজার মানুষ আসেন কিন্ত ভিড় বলে মনে হয় না। নিঃশব্দ ভাবে হাঁটাচলা। বাতাসের শব্দ আর পাইনবনের আশ্চর্য মায়াময় বাতাস। সবমিলিয়ে এটি একটি প্রাকৃতিক উৎসব। অনিল সমস্ত শরীর মন দিয়ে এই প্রকৃতিকে গ্রহণ করছেন। পলিও। তবে অংশত। মনের কোন কোণাতে যেন একটা জ্বলন্ত কাঁটা বিঁধে আছে। খচখচ করে লাগে। একটা নরম বাদামি ত্বকের স্পর্শ। একটা শ্যামলা মুখ। কোঁকড়া চুল টানটান করে বাঁধা।
    নেই হয়ে যাওয়া একটি সহৃদয়তা।
    কুরিসুমালা। মাউনটেইন অব দ্য ক্রস। কোডোঙ্গালুরে এসে নোঙর ফেলেছিলেন সেন্ট থমাস। ইভান্জেলিক্যাল কাজকর্ম শুরু করেছিলেন এখান থেকেই।
    কিস ইট। প্রে অ্যাট কুরিসুমুন্ডি। তীর্থযাত্রীরা এইভাবেই এগিয়ে যান। এবার বড়দিনে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা অনেক কম। যে রাজ্য কোভিড নাইন্টিনকে আটকে দিয়েছিল সমূহ প্রত্যুৎপন্নমতিতায়, সে রাজ্য আবার কোভিডে ছেয়ে গেছে।
    বাচ্চাদের নিয়ে পলির মা থেকে গেছেন কটেজেই। অনিল, পলি আর এমিলি অতিক্রান্ত করছেন সেই দুরূহ পথ।
    পাহাড় বেয়ে ওঠা। বড় কষ্ট। আবার বড় আনন্দ। প্রভুর কাছে সমর্পণ করতে যাচ্ছেন। তীব্র ঠান্ডা বাতাসে গাল কেটে যায়। পায়ের গোছে টনটন করে ব্যথা। মাসলে টান ধরে। তবু চলা থামে না।
    পুন্নুম কুরিশু মুথাপ্পা/ পোনমালা কোট্টায়াম।
    ও পেট্রিয়ার্ক অব দ্য গোল্ডেন ক্রস/ ক্লাইম্ব উই শ্যাল/ দ্য গোল্ডেন হিল।
    সোনালী পাহাড়। তাঁদের হাতে, পিঠে কাঠের ক্রস। চারপাশে বিস্তৃত চা বাগান ।লেক।
    ভাগামান হাইটসে পৌঁছাতে আর কতদূর? ইন্দো সুইশ প্রজেক্ট ডেয়ারি ফার্ম বাঁ হাতে রেখে হেঁটে গেল দলটি। গাভী ও বাছুরের হাম্বাধ্বনি। আরেকটু পরেই দুধ দোয়ানো শুরু হবে। দুশো একর জমির ওপর ছড়ানো পাইনবন। কোনো লোকালয় নেই। তাই কোভিড হানা দিতে পারে নি। সরসর করে হাওয়া ওঠে পাইনের বনে। ছোট দলটি হেঁটে যায়। এগারোহাজার একশদশ ফিট উচ্চতার উদ্দেশ্যেই যায়। অন্য সময় হলে পলি ছেলেমানুষের মত পাইনের ফল কুড়াতেন। এবার যাচ্ছেন না। মনের মধ্যে একরাশ অন্ধকার। অদিতি। ক্ষমা কোরো। দেবরূপ। প্লিজ ফরগিভ আস। উই সাফার। ইচ অ্যান্ড এভরি মোমেন্ট উই সাফার। আমরা ঘুম থেকে উঠি ক্লান্তিতে। শুতে যাই বিবমিষাতে। খাদ্যে রুচি নেই। কাজ করি অভ্যাসে। কোভিড নাইন্টিন এ কী করে গেল!
    পলির চোখ দিয়ে জল পড়ছিল হু হু করে। এমিলি খানিক এগিয়ে।অনিল থমকে দাঁড়ালেন।
    - আর ইউ ক্রাইং পলি?
    - নোহ্। ঠান্ডায় চোখ দিয়ে জল পড়ছে। চলো। উঠে যাই।
    পলির গাঢ় চকোলেট রঙের কার্ডিগানে বিষাদের ছায়া। অনিল অনুসরণ করেন। দেবরূপ। প্লিজ ফরগিভ আস। বিড়বিড় করছেন। আমরা কী নিজেদের দায়ভার নিজেরাই নিতে পারতাম না? কী দরকার ছিল ছেলেটাকে বিব্রত করার। হোয়াই ডিড অদিতি কাম? হোয়াই?
    পাইন বনের হাওয়া কানের পাশ দিয়ে শনশন করে চলে যায়। বলে, ক্ষমা কোরো। ক্ষমা কোরো। এমিলি অনেকটা এগিয়ে গেছিল। দাঁড়িয়ে পড়েছে ওদের জন্য।
    চোদ্দটি সাংকেতিক চিহ্ন পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে। অনিল ভাবছেন, যে কোনো তীর্থস্থান কেন দুর্গম জায়গাতেই হয়। দুর্গম অথচ সুন্দর। অদ্ভুত সুন্দর। সুন্দর বা ক্ষমা সহজলভ্য নয় বলেই কী? অবশ্য ভাগামন হাইটসকে খুব দুর্গম বলা চলে না। এখনো কানে আসছে গরু, বাছুরদের গলাতে বাঁধা ঘন্টার মিষ্টি শব্দ। হাঁফ ধরে। দাঁড়িয়েছেন আবারো। বার বার। ক্রুশ বহন করার সময় খ্রাইস্ট দাঁড়িয়েছেন যেমন। অনিল আর পলি এসে দাঁড়িয়েছেন এনলাইটেনিং সানের নিচে। এখানে দাঁড়ালে নিচে পুরো উদার সবুজ উপত্যকা দেখা যায়। পার্থিব সব কিছু ফিকে পড়ে যায় এই অনন্ত উদারের কাছে। পাইন গাছের গাঢ় সবুজ পাতা। নিচে পাইনফল পড়ে আছে অজস্র। ধাপে ধাপে।
    অন্য সময় হল পলি, এমিলি বাচ্চাদের মত হুড়োহুড়ি করে পাইনের ফল সংগ্রহ করতেন। বাড়ি গিয়ে সাজিয়ে রাখবেন নালুকেতুর আশেপাশে ছড়ানো অজস্র গাছের পায়ে। সাবাই ঘাসের ট্রি প্লান্টার। অদ্ভুত একটা গন্ধ তাতে। ঘাসের। আজ পলি বা এমিলি কেউ পাইনের কৌণিক ফলগুলির দিকে চেয়েও দেখলেন না। তারা পড়ে রইল গাছের পায়ে।কালচে খয়েরি রঙের ফল সব।
    - আমি কী এখান থেকে একবার ত্রিদিবকে ফোন করব? বা মালবিকাকে? দেবরূপকে?
    - বাট হোয়াই?
    - জানি না। একবার ফোন করে বলতে ইচ্ছে করছে। প্লিজ ফরগিভ ফর হোয়াটেভার হ্যাপেন্ড।
    - কী লাভ?
    পলি পোশাক থেকে শুকনো শীতের বাতাসে উড়ে আসা এ ঘাস, খড় ফেলে দিচ্ছেন। জীবন থেকে যদি এমন করে সব গ্লানি ঝেড়ে ফেলা যেত !

    এবার কেরলে নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন হবে না। প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ড.এ. জয়তিলক পুলিশ চিফ এবং জেলা শাসকদের কাছে হুকুমনামা পাঠিয়েছেন এরমধ্যেই। যেটুকু যা হবে, রাত দশটার মধ্যে শেষ করতে হবে।
    নতুন ঢেউ আসছে কোভিডের। মহারাষ্ট্র ইতিমধ্যেই নাইট কার্ফ্যু জারি করেছে। সব জমায়েত বন্ধ। অনিলের খুব সমস্যা হচ্ছে। অনেকদিন ওয়র্ক ফ্রম হোম তো হল। কিন্ত এবার তাঁর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন। এক্সপোর্টে মন্দা  দেখা যাচ্ছে। কিন্ত একা বাইরে যাবার মানসিক জোর তাঁর এখনো হয়নি। কেমন অসহায় লাগে। নিজের জন্য যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি পলি ও সন্তানদের জন্য।
    - লাভ নেই হয়তো। বাট আই থিংক স্পিকিং উইল হেল্প।
    - কাকে? তোমাকে না দেবরূপ কে?
    অনিল বসে পড়ে একটা শ্বাস ছাড়লেন। এত সবুজের মধ্যে, সঙ্গতির মধ্যে শ্বাস নেওয়া বড় সহজ। এখানে সব কিছু বড় অরগানাইজড। নির্মল। সহজ। তাঁর চেঙ্গালার বাড়িতেও এমনি পরিবেশ। খানিকটা অন্তত। কিন্ত মুম্বাই। দুবাই। এইসব জায়গা, যেখানে তাঁর ব্যবসা ফ্লারিশিং, সেইসব জায়গার কথা ভাবলেই ভেতর থেকে কাঁপুনি আসে। তিনি দোষমুক্ত হতে চান। তিনি কী সত্যি কোনো অন্যায় করেছিলেন দেবরূপকে দুঃসময়ের সঙ্গী হতে বলে?
    পলি একটু পিছিয়ে এসে হাত ধরলেন।
    - ডোন্ট ফীল গিল্টি। হোয়াট হ্যাপেন্ড ওয়জ ডেস্টাইন্ড ফর হার।
    ডেস্টিনি। ভাগ্য। ঝর্ণার শব্দ কানে আসে। ভাগামন হাইটসে পৌঁছানোর দেরি নেই খুব।
    এখানে ডেস্টিনিকে মেনে নেওয়ার কোনো অসুবিধে নেই। কিন্ত মধ্যরাতের নিঃসঙ্গতা বা দ্বিপ্রহরের ওয়র্ক ফ্রম হোমের মাঝখানে, সন্তানের গালে চুমু খাবার সময়, সম্বরের উষ্ণ গন্ধে, এমনকী পলির সঙ্গে মিলিত হবার কালেও কানের কাছে কে ফিসফিস করে, ওয়জ ইট নেসেসারি টু ড্র্যাগ অদিতি টু মুম্বাই?
    আবার মন বলে, আমি তো দেবরূপকে ডেকেছিলাম। অদিতিকে তো ডাকি নি। সে স্বেচ্ছায় এসেছিল।
    - তুমি এগিয়ে যাও পলি। আমি আসছি। একটু বসি এখানে।

    ঘ্যানঘ্যান করে এসি চলছে। শীতকালেও এসি দরকার এখানে। ত্রিদিবের সামনে একটা চিনি দুধ ছাড়া  কড়া কালো কফি। একটা নিতান্ত গোবেচারা ভেজ স্যান্ডউইচ। খানিকটা চিজ কেতরে বেরিয়ে আছে। গ্রিল টা একটু কড়া হয়েছে।
    রিংগোর সামনে বেশ বড় একটা প্ল্যাটার। সে খেতে ভালোবাসে খুব। একটা গ্রিক চিকেন স্যালাড আর মিল্কশেক নিয়ে খুব ব্যস্ত সে। পাশে মোবাইল খোলা। তাতে গেম চলছে।
    রীণা রোগা হয়েছে আরো। কলার বোন স্পষ্ট। তাই জন্যই বোধহয় একটা ব্যাকলেস চোলি টাইপ জামা পড়েছে। খদ্দরের শাড়ি। দেখেই বোঝা যায় বেশ দামি। বুটিকের জিনিস। গলাতে একটা রূপোর হাঁসুলি টাইপ। শাড়ির আঁচলটা এমনভাবে পরেছে যে শরীর অনেকটাই দৃশ্যমান। শাড়ি এমনি এক পোশাক যা অফিসিয়াল ভাবে শালীন এবং আনঅফিসিয়ালি প্রচন্ড অশালীন হতে পারে। রীণা রোগা হয়েছে কিন্ত তার জৈব আকর্ষণ যেন আরো তীব্র।
    আরো উত্তেজক। ত্রিদিব এই মুহূর্তেই খুব কামার্ত বোধ করছেন। রীণাকে হাতের মুঠোতে নেবার জন্য শরীর চঞ্চল। ঠোঁট উদ্বেল। রিংগো না থাকলে রীণাকে দুরে কোথাও নিয়ে যাওয়া যেত। ত্রিদিব আবার তেত্রিশের উদ্দাম যুবক হয়ে উঠতে পারতেন। রীণা কী এইভাবে তাঁকে প্রলুব্ধ করছে? ইচ্ছে করে রিংগোকে নিয়ে এসেছে? যাতে ত্রিদিব ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ না পান? চুলগুলো স্ট্রেইট। কোমর ছাপানো। খোলা। কোমরে একটা গয়না পরেছে। ইদানীং মডেলিং শুরু করেছে রীণা। শুধু ব্ল্যাক কফি নিয়ে বসেছে তাই। কিন্ত অন্যমনস্ক কিছুটা।
    অত্যন্ত তাড়িত ও ব্যথিত ত্রিদিব জিজ্ঞেস করলেন
    - তুই কী বোর হচ্ছিল রীণা? আগে তো এত চুপচাপ ছিলি না?
    - আগের মত আর থাকা গেল না ত্রিদিবদা। তবে আগের চেয়ে ভালো আছি। এটুকু বলতে পারি।
    ত্রিদিবের কানে খট করে লাগল। রীণা তাঁকে ত্রিদিবদা বলল!
    এইসব কী পূর্ব প্রস্তুতি? রীণা যোশি। স্পষ্টতই দূরত্ব বাড়াতে চাইছে। বিয়ে করবে রীণা, শুনেছেন ত্রিদিব। বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ভাব। রীণা তাহলে চললো।
    - লকডাউন পিরিয়ডটা অনেককিছু শিখিয়ে দিল ত্রিদিবদা। আই হ্যাভ লার্ন্ট আ লট। আগেও অনেককিছু শিখেছি। কিন্ত এই কোভিডটাইমটা আমার দশবছর বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে।
    ত্রিদিব নিজেকে সামলাতে পারলেন না।
    - তাই বিয়ে করে ফেলবি ঠিক করলি?
    রীণা রাগ করল না। ফিকে হাসল। চুল ঠিক করলো বাঁ হাত দিয়ে। ঠিক যেভাবে ফ্যাশনদুরস্ত মেয়েরা চুল সরায়। ছোট ব্যাগ খুলে লিপ গ্লস লাগাচ্ছে।
    - একবার বিয়ে করে তো ঠকেছিস। আবার রিস্ক নিচ্ছিস? রিংগোর কথা ভাবলি না? ও মেনে নিতে পারবে?
    ত্রিদিব হঠাৎই যেন ভীষণ কনসার্নড অভিভাবক।
    রীণা স্পষ্ট চোখে চোখে তাকালো।
    - আমি বিয়ে করছি তোমাকে কে বললো? আমি তো বলি নি?
    - যারা তোকে আমাকে একসঙ্গে রেস্তঁরা বা আইনক্সে দেখে তাদেরই কেউ কেউ বলেছে।
    রীণা আবার হাসলো। শাড়ি গুছিয়ে নিল। রিংগোকে ছোট করে বলল, তাড়াতাড়ি খাও।
    - তোর তাড়া আছে নাকী রীণা?
    ত্রিদিবের কোনো তাড়া নেই। সারা সকাল অফিসের কাজ করেছেন। হেড অফিস ভিজিট করে মিটিং কমপ্লিট। বাড়িতে কেউ নেই। টুপুর ব্যস্ত। মালবিকা এই উইক এন্ডে আসেন নি। এলেও দুজনের কথা হয় না তেমন আর। বাড়িটা খা খা করে। শ্যামা সকালে একটা কাতলা মাছের ঝোল আর সুক্তো করে রেখে গেছে। রাতে আর সেটা খাওয়ার ইচ্ছে নেই ত্রিদিবের। ভেবেছিলেন রীণাকে নিয়ে ইকো পার্কের কটেজে চলে যাবেন। ডাব চিংড়ি দিয়ে ডিনার করে ফিরবেন। মালবিকা বাড়ি ছেড়েছেন পর থেকে ভালোমন্দ খাওয়া নেই। শ্যামাকে কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন মালবিকা। একদম ডায়াবিটিক ডায়েট ত্রিদিবের জন্য।
    রীণা লিপগ্লস লাগানো শেষ করে আবার হাসল।
    - একটু তো তাড়া আছেই ত্রিদিবদা। তুমি ঠিকঠাক শুনেছো। বিয়ে করছি। কিন্ত কোনো রিস্ক নেই জানো? কারণ আমার একটা চাকরি আছে। রিংগোর ফিউচার একদম সিকিউরড। আমার সেভিংস ওর জন্যই তো। আর প্রদ্যুম্ন নিজেই প্রোপোজ করেছে। ও রিংগোর সঙ্গে বেশ ফ্রেন্ডলি। বিয়ে করেছিল আগে। গট ডিভোর্সড। আর ও বিয়ে করছে শুনে ওর বাড়ির লোক খুব প্লিজড। কিন্ত মেয়েরা সেকেন্ড টাইম বিয়ে করলে তোমার মত ফ্যামিলি ম্যানরা এত আপসেট হয় কেন বলো তো? সমস্যাটা কোথায়? তুমি তো আমাকে বিয়ে করতে না অ্যাটলিস্ট। প্রদ্যুম্ন গেভ অ্যান অনারেবল প্রোপোজাল।
    - তুই বিয়েকে অনারেবল ভাবিস রীণা? এখনো? তুই যে বলেছিলি বিয়েতে আর বিশ্বাস নেই তোর?
    রীণা একটা টিস্যু দিয়ে রিংগোর মুখ মুছিয়ে দিল। চীজ লেগেছিল।
    - স্যান্ডউইচটা খাও। ল্যাতাপ্যাতা হয়ে যাবে এরপর। বলেছিলাম এককালে। এখন আর বলছি না। আই হ্যাভ চেঞ্জড।
    - ছেলেটি ভালো তো?
    রীণা হো হো করে হেসে ফেলল।
    - ছেলেসমেত মহিলাকে বিয়ে করতে চাইছে। তারপর আবার কর্পোরেট অফিসে কাজ করি। মডেলিং করি। মন্দ হবে কেন? আর অনেক মন্দ ভালো তো দেখলাম।
    তারপর একটু আনমনা হয়ে গেল রীণা।
    - রাগ কোরো না ত্রিদিবদা। তোমাকে আমিই টেনেছিলাম। তুমি তো নিজে থেকে আসেনি। খুব ভালনারেবল ছিলাম সেইসময়। বোকাও। ফূর্তি করতে চাইতাম খুব। তুমিও বোধহয় ঐটুকুই চাইতে আমার কাছে। ওসব ফুরিয়ে গেছে। লকডাউনে যখন জ্বর হয়ে পড়ে থাকলাম, তখন অনেক কিছু বুঝলাম। শিখলাম। আফটার অল, রিংগোকে বড় করতে হবে তো। আর আমার তো বাপের বাড়ির জোরটাও নেই।
    একটা ফোন বেজে উঠল। ত্রিদিবের। অনিল টমাস। ফোনটা নিলেন ত্রিদিব। আগে হলে হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে সুইচ অফফ করে দিত রীণা। এইসময়টা শুধু তোমার আর আমার তিনুদা। বলে একটা ছয়েলছবিলি হাসি হাসতো।
    আজ কিছুই রিঅ্যাক্ট করলো না। বরং রিংগোকে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

    - কেমন আছো? হাউ আর ইউ ত্রিদিব?
    কুরিসুমালা পর্বতমালা থেকে গলার স্বর ভেসে এলো। অনেকদিন বাদে অনিলের সঙ্গে কথা হচ্ছে।
    ত্রিদিব কফিতে চুমুক দিয়ে যা বলতে হয়, তাই বললেন,
    - আয়াম অ্যাবসলিউটলি ফাইন অনিল। ভালো আছি। চমৎকার।
    ত্রিদিবের সুদৃশ্য, সুশোভন, ঝকঝকে দোতলা বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে, অনিলকে সে কথা বলা হল না। ছাতবাগান শূন্য। শ্যামা জলটল দেয়। কিন্ত ফাঁকা। বলা হল না মালবিকা মন্ডল সেনগুপ্ত এখন আর ত্রিদিবের বাড়িতে থাকেন না। মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে। সে ঠিক কোথায় ত্রিদিব জানেন না। ছেলের গার্লফ্রেন্ড মারা গেছে। কী যেন নাম মেয়েটির? ত্রিদিব মনে করতে পারছেন না। ছেলে ট্রমাটাইজড হয়ে দিল্লিতে। বলা হল না। এইসব বলার মত জায়গা নয় এটা। বলার সময় নয়। মনটা আবার মুচড়ে উঠল। ভেবেছিলেন অনেকদিন বাদে। হয়তো রীণা নরম হয়েছে। অভিমান হয়েছিল। এখন সব ঠিকঠাক করে নেওয়া যাবে। নিছক একটি মেয়েশরীরের জন্য ছটফট করছেন ত্রিদিব। অথচ তিনি ব্রথেলগমনের জন্য প্রস্তুত নন। মালবিকাহীন বাড়ি যে এতটা ভয়াবহ হতে পারে ধারণা ছিল না। এখন বুঝতে পারছেন। ঠাকুমাও তেমন আসেন না আর। নেটফ্লিক্স দেখেন কাজের ফাঁকে। তাতে আরো উত্তপ্ত হন। ভেবেছিলেন ওয়েব সিরিজের নায়কের মত রীণাকে নিয়ে বাথটাবে ডুব দেবেন। সাবানের ফেনা, টো ম্যাসাজ আর ওয়াইন। ত্রিদিবের কাছে এটাই চূড়ান্ত রিল্যাক্সেশন। রীণাকে বলতে চাইলেন তিনি পারফেক্ট টো ম্যাসাজ দেবেন।ইট উইল ইভন গ্রেটার দ্যান সেক্সুয়াল প্লেজার। হল না। কিছু হল না। রীণা সবকিছুতে জল ঢেলে দিল। রিংগো মন দিয়ে মিল্ক শেক খাচ্ছে। রীণা এত মন দিয়ে দেখছে যেন এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য।
    - আই উইল কল ইউ লেটার অনিল। টুনাইট। ইফ পসিবল।
    রীণা উঠে দাঁড়িয়েছে। রিংগোর হাত ধরে টানছে।
    - চললাম গো। তুমি শরীরের যত্ন নিও। আমি একটু প্রদ্যুম্নর সঙ্গে বেরোবো। বেরিয়েছে যখন তখন শপিং করেই ফিরি।
    ত্রিদিব মন দিয়ে কেতরে যাওয়া স্যান্ডউইচ দেখছিলেন। ঠিক তাঁর নিজের মত। ভ্যাবলা। বিস্বাদ। হেরো। রীণা একটা সুগন্ধীর ঢেউ তুলে বেরিয়ে গেল।
    ত্রিদিবের গাড়ি একটু দুরে পার্ক করা আছে। শমিত সিগারেট খাচ্ছিল। তাঁকে দেখে সিগারেট ফেলে দিল। কোনো দরকার ছিল না। তিনি এমনিতেই একজন ব্যর্থ মানুষ।
    তবু শমিতকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন ত্রিদিব। অনেকদিন বাদে খেয়াল করে দেখছেন। খুঁটিয়ে। অথচ ও প্রায় রোজ আসে। মুখটা বুড়িয়ে গেছে অল্প বয়সে।
    - তোর ছেলে কেমন আছে রে?
    - ব্লাড লাগবে স্যর। প্লেটলেট আবার নেমে গেছে। তেত্রিশ। 
    শমিত বছর দশেক হল ত্রিদিবের গাড়ি চালায়। ওর ছেলের প্লেটলেট কাউন্ট কম। লকডাউনের পর ও আরো দুটো কাজ নিয়েছে।
    ত্রিদিবের এখন খুব কথা বলা দরকার। ফোনে না। জ্যান্ত মানুষ।
    - টাকা পয়সা আছে তো রে? ব্লাড জোগাড় হয়েছে?
    - দশ বোতল জোগাড় হয়েছে স্যর।
    শমিত নিজে থেকে কখনো নিজের সুবিধে অসুবিধের কথা বলে না। ত্রিদিব খেয়াল করেছেন। মালবিকা নিয়মিত খোঁজ নেন।
    - বাড়ি যাব স্যর?
    শমিত বাঁ দিকে টার্ণ নিল।
    ত্রিদিব আঁতকে উঠলেন।
    - না না। বাড়ি যাব না। রেড রোডের দিকে নিয়ে চল।
    রেড রোডে আধঘন্টা চক্কর দিল গাড়ি। আপাতত রীণার মুখটা ভুলে যাবার চেষ্টা করছেন ত্রিদিব। খিদে পাচ্ছে।
    - তোর বাড়িটা বাইপাসের দিকে না শমিত?
    - খালপারে স্যর। আগে মুকুন্দপুর ছিল।
    - তোর বাড়িতে নিয়ে যাবি? খুব খিদে পাচ্ছে।
    শমিত খুব লজ্জিত হল। স্যর তার বাড়িতে যাবে? খাবে? কী খাবে? ডিম আছে বোধহয় বাড়িতে।
    - খাবার কিনে নেব স্যর ? চাউ মিন? সামনে কৃষ্টাল বল আছে। চায়না হাট। থামবো?
    - ভাত খাব। ভাত। ডাল দিয়ে মেখে। একটা ভাজা হলেই হবে। অসুবিধে হবে?
    শমিত মনে করার চেষ্টা করল। আজকে মাছের চচ্চড়ি হয়েছিল। কিছুটা থাকার কথা। স্যারের কী হয়েছে? বৌদির এভাবে চলে যাওয়াটা ঠিক হয় নি। রীণা সম্পর্কে শমিতের একটা আবছা ধারণা আছে। যদিও রীণাকে নিয়ে বেরোলে ত্রিদিব ওলা বা উবের করতেন, তবু শমিত কয়েকবার গেছে বৈকি।
    শমিতের বাড়ির সিমেন্টের বারান্দার চৌকিতে গোল হয়ে বসে ভাত দিয়ে মুসুরির ডাল মেখে খেলেন ত্রিদিব। ছোটমাছের চচ্চড়ি। ত্রিদিবের জন্য স্পেশ্যাল ডিমভাজা। শমিতের বউ নীতা দিব্যি রেঁধেছে। বেশ হাসিখুশি। ছেলের অসুখটা মেনে নিয়েছে বোধহয়। নাকী মুখটাই ওরকম হাসিহাসি? শমিতের ছেলে ঘরে শুয়ে। জ্বর আছে। তার পাশে বসে আছে শমিতের মা। ত্রিদিবের মনে হল এখানেই শুয়ে যেতে পারলে যেন ভালো ছিল। কিন্ত সেটা হবে না। হয় না। একটু পরে বিশ্রী লাগবে। গন্ধ সহ্য হবে না। আরো অনেক কিছু।
    - আমি নিজে ড্রাইভ করে চলে যাবো শমিত। তোমাকে আর যেতে হবে না আজ। চাবিটা দাও।

    হস্টেলের ফ্ল্যাট খুব ছিমছাম। মালবিকার মনের মতি সাজ। ইক্কতের পর্দা। দেওয়ালে অমৃতা শেরগিলের ছবির প্রিন্ট । নরম আলো জ্বালিয়ে ফোন হাতে নিলেন মালবিকা। জনৈক নেতা বলেছেন, ভোটে জিতে গেলে পশ্চিমবঙ্গকে মির্জাপুর বানাবেন। মির্জাপুর ওয়েব সিরিজটা দেখে ফেলতে হবে। পঙ্কজ ত্রিপাঠি নাকি দারুণ অভিনয় করেছেন। কুলভূষণ খারবান্দা। সিরিজ ডাউনলোড করতে দিয়ে জল খাচ্ছিলেন মালবিকা। ফোন এল। মালবিকা গ্লাস নামিয়ে দেখলেন, ত্রিদিব। 
    কেমন বিরক্তিবোধ হল তাঁর।

    (চলছে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০১ জুন ২০২৩ | ২৯৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন