এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • নিউনর্মাল করোনাকালীন পর্ব উনচল্লিশ

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৪ জুলাই ২০২৩ | ১৬৩ বার পঠিত
  • টুপুর হাঁ করে মালবিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। মায়ের কী টেনশনে মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকী! বাবা হসপিটালাইজড। জ্বরটা কমেছে, সে তো প্যারাসিটামলের কেরামতি। সোয়াব টেস্টের রেজাল্ট প্রাইভেট নার্সিংহোমে আসতে অনেক দেরি। মানে কম করে তিনদিন। তার আগে কোভিডের কোনো ট্রিটমেন্ট হবে না। মানে যদি কোনো ক্ষতিই হয়, সেটা ভেতরে ভেতরে হতেই থাকবে।ফুসফুস তিনদিনের মধ্যে অনেকটা ড্যামেজ হতে পারে।
    এর মধ্যে মা টুপুরের বিয়ের কথা বলছে! পুরো কোভিড সিচুয়েশন। একটু কমেছে কী কমেনি, লোকজন বেমক্কা ঘোরাঘুরি করছে! মালবিকার দু' জন কলিগের মেয়েদের বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনেই। নিশ্চয়ই ওইসব ওয়েডিং কার্ডের ইমপ্যাক্ট! যাচ্ছেতাই।
    টুপুর খুব রেগে যাচ্ছে। বিরক্ত লাগছে। আবার মায়াও হচ্ছে মায়ের ওপর। কীরকম ছেলেমানুষি আবদার। বৈশাখে বিয়েটা করে ফেল। মামার বাড়ি!
    টুপুর যদি আগের টুপুর হত, মানে যখন রক্তিমের সঙ্গে যখন তুমুল সাপে নেউলে উদ্দাম প্রেম, হ্যাঁ, ওটাকে প্রেম বলবে টুপুর, কারণ তখন ওর রক্তিমকে দেখতে না পেলে কষ্ট হত, ফোন না পেলে কষ্ট হত, তখন ও দিনে তিন প্যাকেট সিগারেট, কখনো গাঁজা, কখনো না বলে উধাও, সেই টুপুর যদি হত সে আজ তবে অবশ্যই মালবিকার কপালে দুর্ভোগ ছিল।
    এখন ও অনেক শান্ত। অনেক সংযত। গভীর। নিজেই ভাবে। হেসে ফেলে নিজের প্রদত্ত বিশেষণে।
    মায়ের মুখে কী শান্তি। অবশ্যই সেটা ওষুধের ইফেক্ট খানিকটা। খানিকটা ত্রিদিবের আপাত স্থিতিশীল শারীরিক অবস্থা।
    থাক একটু শান্তিতে। কারণ কাল কী হবে জানা নেই। যা কিছু হতে পারে। টুপুর এই সামান্য সময়ের ছাতের পরিবেশটা বিগড়াতে দেবে না।
    - এই সময়ে তুমি বিয়ে করতে বলছো মা? এখন তো লোকজন ডেকে খাওয়ানোর স্কোপটাও নেই!
    - বেশি লোকজন ডাকতে হবে না। বুঝলি। অল্প লোকই ভালো।
    টুপুর জানে চাঁদের আলোর সঙ্গেই গড়িয়ে আসছে তার ভেঙে দেওয়া এনগেজমেন্টে তিনশো লোকের গ্যাঞ্জাম। শিয়ার  ওয়েস্টেজ অব মানি। কিন্ত মায়ের মনে খুব লেগেছিল। নাউ শি ক্যান ফীল ইট। কিন্ত টুপুর কীই বা করতে পারতো। রক্তিমের সঙ্গে কয়েকবছরের অভিজ্ঞতা ওকে সতর্ক করে দিয়েছিল। আর নয়। আর এগোলে লাইফলং ইমপ্রিজনমেন্ট।
    কিন্ত এখন মালবিকার স্ট্রেস ফ্রি থাকা দরকার।
    - আর বাকি সব কাজকর্ম?
    - সব হয়ে যাবে। এই বৈশাখেই। তোকে তো পার্লার থেকে এসে সাজাবে, না? আমার খুব শখ, তোকে কেমন দেখাবে কনে সেজে। আমার! কত শখ ছিল পার্লারে সাজার। আমাদের সময় তো বেশি পার্লার ছিল না। তাও দিল না কোনো বাড়ি থেকে। সেই পাড়ার দিদি, মাসি মিলে সাজালো।
    টুপুরের কিছুটা গা গুলিয়ে উঠল। কনের সাজ শব্দটা সে কিছুতেই নিতে পারছে না। কবে বিয়ে করবে, কেমন সাজবে সে নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। পারলে জিনস পরে রেজিস্ট্রি করবে। মা এখন এইসব ভ্যানত্যাড়া করছে কেন? তার মাথা গরম হচ্ছে। এমনিতেই ঐ একরকম পুতুলের মত মেকাপ দেখলে তার অসহ্য লাগে।
    - ঈশানকে আজকেই বলি? ও যদি রাজি থাকে ...
    দিস ইজ দ্য লিমিট! যেন বিয়েটা ঈশানের কনসেন্টের ওপর নির্ভর করছে! টুপুরের মত সেকেন্ডারি।
    টুপুর খুব শক্ত করে নিজেকে ধরে রেখেছে। কন্ট্রোল! কন্ট্রোল! মাথা গরম নয় আজ!
    - আপাতত তুমি একটু অন্য কথা বলো মা। আমি ভীষণ টায়ার্ড।
    মালবিকার আজ হঠাৎই খুব স্ট্রেস ফ্রি লাগছে। কাল রাত থেকে আজ সারাদিন যে বিশাল বোঝা ছিল সেটা কেটে গেলে যেমন হতে পারে।
    - আমাকে আরেক কাপ চা দিবি?
    শ্যামা উঠতে যাচ্ছিল। টুপুর থামালো। আমি যাচ্ছি শ্যামাদি। তুমি বসো।
    অন্তত কিছুক্ষণ মালবিকার বিয়েবাতিক থেকে রেহাই পেতে চায়। হুড়মুড় করে নেমে গেল নিচে।

    মালবিকার শখের চা একটা ক্যাবিনেটে থাকে। গোল্ডেন টিপস। সিলভার টিপস। নাদিদওয়ালা। ডলিজ। চা বানাতে বানাতে টুপুর ঘামছে।
    ডলিজ আর আগের মত নেই। মিসেস রায় যখন রাণীর মতো বসে থাকতেন। বইপত্র থাকতো তখন। টুপুর বেশ কিছু বই কিনেছে ওখান থেকে। আইসড পুদিনা টি আর প্রন কাটলেট। লকডাউনের পর গিয়ে দেখেছে বইয়ের পাট নেই আর। একটু ছড়ানো যেন সব। রাণীবিহীন রাজ্যপাট যেমন হয়।
    চা নিয়ে ওপরে এলো খুব ধীরে ধীরে। কিলিং টাইম।
    মালবিকা মন দিয়ে মোবাইল ঘাঁটছেন। অ্যামাজনে অর্ডার যাচ্ছে।
    ফিনাইল।
    স্যানিটাইজার।
    মাস্ক। সার্জিকাল। এন নাইন্টি ফাইভ।
    লাইজল।
    ডেটল।
    স্প্রে স্যানিটাইজার।
    আটা।
    সর্ষের তেল।
    মা আর সমবায়িকা যায় না। অ্যামাজনে অর্ডার করে বাড়ি বসে। ফিল্ম দেখতে সিনেমাহলে যায় না। সব মোবাইলে। অ্যামাজন মাসের প্রথম একসপ্তাহ অনেকটা ডিসকাউন্ট দেয়।
    মা আর মুদির দোকানের ফর্দ মেলায় না। ছোটবেলাতে টুপুর মালবিকার আঁচল ধরে মুদির দোকানে যেত। ড্যাবড্যাব করে দেখত সব। বিনিময় একটা ক্যাডবেরি।
    এখন আর বাচ্চাদের মুদির দোকানে যেতে হয় না। তাদের মায়েরা বাড়িতে বসে নেইলপলিশ পরা আঙুলে কয়েকটা নম্বর স্পর্শ করলেই সব জিনিস বাড়িতে চলে আসে সিল প্যাকড হয়ে। দাম বেশ কম। লাইনে দাঁড়ানো নেই। ডিসকাউন্ট আছে। প্রোডাকশন বেশি। কস্ট কম। কর্পোরেট তার অক্টোপাসের বাহু প্রসারিত করছে। এত বড় অক্টোপাস যে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না।কিন্ত অদৃশ্য শুঁড়গুলো এগিয়ে আসছে। হাতে ভাইরাস। মানুষকে বাক্সবন্দি করে দিতে হবে। ডিজিটাল স্লেভারি। মালবিকা ছাতে দোল খেতে খেতে সুদৃশ্য প্লান্টার অর্ডার করছেন। তাহলে করুণাদের হাতে তৈরি পোড়া মাটির প্লান্টারগুলো কারা কিনবে? কারা কিনবে শ্যামাদিদের  তৈরি মাস্ক? এই লোকগুলোর কী হবে যারা মুদিখানা চালায়? টুপুরের মনে হল মায়ের হাত থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। বাদুর ও সাপ হিসহিস করছে। ফিরে দাও আদিম অরণ্য। বাদুরের শরীরের ভাইরাস তৈরি হচ্ছে ল্যাবরেটরিতে। ওয়র্লড শুড বি লেস পপুলেটেড। কর্পোরেট সাম্রাজ্য তাই চায়। মানুষ না। প্রডাক্ট। অদৃশ্য ক্রীড়াণকদের হাতের পুতুল হয়ে যাওয়া, ফুটফুটে শিশুদের মায়েরা, বাবারা একটা ভাইরাসের আতঙ্কে ঘরবন্দি হয়ে সমানে মোবাইলে না হয় কম্পিউটারে আঙুল চালাচ্ছে।
    অটো ফিল।
    তোমার নামটাও আর লিখতে হবে না। আদ্য অক্ষর লিখলেই মোবাইল তোমার কাজ করে দেবে। তোমার শরীরের কলকব্জা নষ্ট হবে ধীরে ধীরে।
    মা কী মোবাইল অ্যাডিক্ট হয়ে গেল প্যান্ডেমিকে? নাথিং ওয়র্স্ট দ্যান দ্যাট।
    ভীষণ ভয় পেল টুপুর। চোখ ঝাপসা।
    ছাতের দরজাতে শব্দ তখন! কে এল?
    মালবিকা দৌড়ে গেলেন।
    বাবু!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৪ জুলাই ২০২৩ | ১৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন