এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ভ্রান্তিপর্বত শান্তিতীর্থ - নন্দিনী সেনগুপ্ত | ৪এই মুহূর্তে বার বার একটা নাম শোনা যাচ্ছে। সোনাম ওয়াংচুক। অনেকেই হয়তো বলবেন যে লাদাখ নিয়ে নতুন রাজনীতির আবর্ত তৈরি হচ্ছে এই নামটিকে ঘিরে। কিন্তু যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেটা সফল হলে এবং বিভিন্ন জায়গায় আরও কয়েক দশক আগে শুরু হলে হিমালয়ের প্রকৃতি কিছুটা হলেও বাঁচত। হিমালয়ের সামগ্রিক ভূ-প্রকৃতি তথা বাস্তুতন্ত্র এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের সুতোয় ঝুলছে বহুযুগ ধরেই। যদি লাদাখের উদাহরণ ধরি, সেখানে কিছুদিন আগেও সেখানে বসবাসরত জনজাতিদের জীবিকা ছিল মূলত অল্প স্বল্প চাষাবাদ এবং গবাদি পশুপালন ইত্যাদি। ট্যুরিজম খুব জনপ্রিয় ছিল না ব্যাপক অর্থে। কারণ কঠিন আবহাওয়া। এই আবহাওয়ার কারণেই চাষাবাদ এবং পশুচারণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি খুব বেশি নয় লাদাখে। মাটির সবুজ অংশ বেশি নয়। স্নো লাইন শুরু হওয়া মাত্র সেখানে আর গাছপালা জন্মাবে না। অর্থাৎ যেটুকু সবুজ অংশ রয়েছে, সেখানেই করতে হবে চাষাবাদ এবং পশুচারণ। আবার এই অঞ্চলে স্নো-লেপার্ড যদি হ্রাস পায়, সেটার প্রভাব বাস্তুতন্ত্রে পড়বে। তাহলে গবাদি পশু অতিরিক্ত বেড়ে যাবে এবং তারা চারণভূমির সব সবুজ খেয়ে শেষ করে দেবে। এই সবুজ তৃণভূমির প্রতিটি তৃণখণ্ড, প্রতিটি গাছের শিকড় আবার পাহাড়ের মাটির ঢালের স্থিতিশীলতা ঠিকঠাক ধরে রাখবার জন্য ভীষণ জরুরি। অর্থাৎ এই অঞ্চলের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের এই সূক্ষ্ম সুতোটা ছিঁড়ে গেলে এই ভূ-প্রকৃতির ধ্বংস অনিবার্য। জনঘনত্বের তুলনায় এই ভূমিসম্পদ লাদাখের ক্ষেত্রে খুব বেশি এমন বলা যাবে না। কারণ ভূমির মধ্যে একটা বড় অংশ সবুজ নয়। এবার সবুজ জমির একটা অংশ যদি শক্তি উৎপাদনের জন্য সোলার প্যানেল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, সেই উন্নয়ন কিন্তু জনজাতির জন্য অর্থহীন। অনেকেই বলবেন যে সোলার প্যানেল তো পরিবেশবান্ধব শক্তির আকর। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করলে নদী যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এক্ষেত্রে অন্তত সেটা হবে না। আসলে উন্নয়ন বলতে সভ্য মানুষের মনে যে ধারণা রয়েছে, সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে হিমালয়ের উন্নয়নে যদি মানুষ ব্রতী হয়, তিনি হিমালয়ের বিরাট ক্ষতি করে দেবেন। হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা ছাড়াও বুঝতে হবে আঞ্চলিক মানুষ, জনজাতি তাদের প্রকৃত চাহিদা কী? উন্নয়নের ফলে যদি জনজাতির অস্তিত্বই ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে যায়, তাহলে সেই উন্নয়ন আসলে ঠিক কোন মানুষদের জন্য?অতীতে লাদাখে ট্যুরিজমের বাড়বাড়ন্ত ছিল না। হোটেল, গেস্ট হাউস ইত্যাদির সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। ফলে জীবিকা হিসেবে ট্যুরিজমের উপরে স্থানীয় অধিবাসীদের নির্ভরতাও ছিল না। সময় বদলাচ্ছে। অনেক বেশি মানুষ টুরিস্ট হিসেবে ভিড় জমাচ্ছেন লাদাখে। প্রতিকূল আবহাওয়াতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানুষ চলে যাচ্ছেন বেড়াতে, ট্রেকিং করতে। ফলে টুরিস্টদের থাকবার উপযুক্ত হোটেল তৈরি হচ্ছে জোরকদমে। পাহাড়ের ঢালে বিল্ডিং বানানোর ঝুঁকি থাকেই ধসপ্রবণ, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়। সেসব ঝুঁকি উড়িয়ে কাজ চলছে। ট্যুরিস্ট আগমন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ঘটছে অদ্ভুত কিছু সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল জল।জলের সমস্যা লাদাখে নতুন নয়। লাদাখ শুষ্ক অঞ্চল; বলা হয় ‘শীতল মরু’। ২০১০ সালে কুলুম অঞ্চলে মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ভয়াবহ বন্যা হয়। হিমবাহ-পুষ্ট নদীগুলি ফুলে ফেঁপে ভাসিয়ে দিয়েছিল গ্রাম। একদিন সরে গেল বন্যার জল। কিন্তু হিমবাহ অনেকটা সরে গেছে পিছনে। নদীগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। অবধারিত ফল খরা। ২০১২ সাল থেকেই দলে দলে মানুষ বেরিয়ে যেতে থাকে গ্রাম থেকে। জল ছাড়া মানুষ কী ভাবে বাঁচবে? ভারতের ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে, অর্থাৎ হিন্দুকুশ হিমালয়ে, বছরে প্রায় ১৫ মিটার করে হিমবাহ গলে গলে পিছিয়ে যাচ্ছে। আপার কুলুম সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। কোনো মানুষ সেখানে থাকে না। লোয়ার কুলুমে কয়েকঘর এখনও আছে। অল্পস্বল্প যে ফোরাতগুলো জীবিত আছে এখনও, সেই ফোরাত বা ঝর্নার জলে তারা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু সেটা কতদিন তারা করতে পারবে, সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে। এত সমস্যার মধ্যেও কিছুই কি আশার কথা নেই? আছে। ২০২২ সালে লাদাখবাসীরা সোনম ওয়াংচুকের দেখানো পথে কৃত্রিম হিমবাহ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। তবে সে কাজ অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইতে তারা সে কাজ করেছিল। কিন্তু এমন অবস্থায় সেই অঞ্চলে ট্যুরিস্ট বেড়ে যাবার অর্থ হল সেখানে জনসংখ্যার চাপ বেড়ে যাওয়া। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট জল লাদাখে পাওয়া মুশকিল। ট্যুরিস্টদের সঠিক পরিষেবা দিতে হলে স্বাভাবিক কারণেই সেখানকার অধিবাসীদের জন্য বরাদ্দ জলে টান পড়বে। সেখানকার অধিবাসীরা সেইজন্য খোলা মনে সব সময় ট্যুরিস্টদের স্বাগত জানাবেন, এমনটি না ভাবাই ভালো।লাদাখের আরেকটি যে সমস্যা বড় আকার ধারণ করতে চলেছে, তা হল দূষণ। অতীতে রাস্তা থাকলেও খুব বেশি গাড়ির আনাগোনা ছিল না। সীমান্ত সুরক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর গাড়ির যাতায়াত ছিল সেই পথে। এখন জায়গায় জায়গায় সেই পথ চওড়া করা হচ্ছে। বাড়ছে ট্যুরিস্টদের গাড়ির আনাগোনা। দূষণহীন যে ঝকঝকে আকাশ দেখা যেত লাদাখে, সেই নীলের গায়ে কি লাগছে ধূসরতা? হ্যাঁ, সেটা খুবই স্বাভাবিক। গাড়ির সংখ্যা বাড়লে সেই গাড়ির ধোঁয়া থেকে বাতাস দূষিত হবেই।এছাড়া যে সমস্যা লাদাখে বিশাল আকার ধারণ করছে, তা হল বর্জ্য। সুদূর অতীতে লাদাখের জনজাতি বর্জ্য রিসাইকেল করে ফেলত। অর্থাৎ প্রায় বর্জ্যবিহীন জীবন যাপন করত। আবহাওয়ার কারণে, জলের অপ্রতুলতার কারণে তাদের বর্জ্য সামলানোর পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ট্যুরিস্ট বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বর্জ্য বেড়েছে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সামলানোর পরিকাঠামো লাদাখে নেই বললেই চলে। গ্রীষ্মে ট্যুরিস্ট সিজনে অস্বাভাবিক বেড়ে যায় প্লাস্টিক বর্জ্য। সারা পৃথিবীর মানুষ এসে ভিড় জমাচ্ছে। জল খেয়ে যে খালি বোতলটা ট্যুরিস্ট জঞ্জালের বাক্সে ফেলে দিয়ে যাচ্ছেন, সেই একটা বোতলও যে হিমালয়ের পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী, এই বোধ কবে জাগ্রত হবে সভ্য মানুষের মনে? আসলে মানুষ নিজের কাঁধ থেকে দায় ঝেড়ে ফেলে বলে যে সরকার কেন সিস্টেম তৈরি করেনি বর্জ্য সামলানোর জন্য? একটা সিস্টেম গড়ে উঠতেও সময় লাগে এবং সেই সিস্টেম তো মানুষের দ্বারাই তৈরি। অলীক জাদুকাঠি লাগানো কোনো যন্ত্র এসে সব বর্জ্য ছুমন্তরে উড়িয়ে রাতারাতি হাওয়া করে দিতে পারবে না। শুধু তো পাহাড় নয়, পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানুষ থাকুক না কেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব দায় সে এড়িয়ে যেতে পারে না। তাহলে কি হিমালয়ের পরিবেশ বাঁচানোর জন্য সব উন্নয়ন বন্ধ করে দিতে হবে? না, সেটাও সঠিক কথা নয়। আসলে চটজলদি উন্নয়নের মোহের ফাঁদ এড়িয়ে চলতে হবে। যে উন্নয়ন হিমালয়ের প্রকৃতিকে নষ্ট করবে না, অথচ মানুষের জীবনের মান ভালো করবে, এমন সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি। প্রকৃতির হাত ধরতে হবে। রাজনীতির কারবারীদের মধ্যে চটজলদি কিছু করে দেখানোর নেশা থাকে, যাতে মানুষকে রাতারাতি প্রভাবিত করা যায়। সেও যে একরকম চালাকি, তাতে সন্দেহ নেই। হিমালয়ের প্রকৃতিতে এমন চালাকির কোনো জায়গা নেই। ফলে রাজনীতির পন্থা যেমনই হোক, তা যদি হিমালয়ের প্রকৃতি এবং চাহিদা বুঝে চলতে না পারে, সেই পথও বেশিদিন সুগম থাকবে না। ক্রমশ
    সিএএ-র ফাঁদে মতুয়ারা - শান্তনীল রায় | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়বাংলার উদ্বাস্তু প্রধান এলাকাগুলিতে কান পাতলেই শোনা যায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে নানা গুঞ্জন। চব্বিশের লোকসভা ভোটে এই অঞ্চলগুলিতে জিততে বিজেপির মাস্টার্স স্ট্রোক এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)।বিজেপি বারবার করে বলছে, সিএএ নাগরিকত্ব প্রদানের আইন, নাগরিকত্ব হরণের নয়। আর সেই আশাতেই বুক বেঁধেছে এক বিরাট সংখ্যক উদ্বাস্তু মানুষ। সিএএ-র বিষয়ে সম্যক ধারণা ছাড়াই। তবে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত সাহ দেশবাসীকে যেভাবে ক্রোনোলজি বুঝিয়েছিলেন, তা থেকে অতি সহজেই অনুমান করা যায় যে বিজেপির মনোবাসনা কেবল সিএএ -তে থেমে থাকবার নয়। প্রথমে সিএএ, তারপর এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জী)। আর যার পরিণতি হতে পারে উদ্বাস্তুদের জন্য ভয়ানক।উদ্বাস্তু মতুয়াদের নি:শর্ত নাগরিকত্বের দাবি আজকের নয়। বিজেপি ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে আসলে, ভিটে ছেড়ে একবার বে-নাগরিক হওয়া কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষের নাগরিকত্ব পুনরায় প্রশ্নের মুখে পড়ে। ২০০৪ সালে নাগরিকত্বের দাবিতে তারা সেসময় প্রথম আন্দোলনে নামে। নাগরিকত্বের ইস্যুতে মতুয়াদের প্রথম আন্দোলন ছিলো বিজেপির বিরুদ্ধেই। বাংলার সাম্প্রতিক রাজনীতিতে মতুয়া তথা নম:শূদ্র সম্প্রদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এই প্রান্তিক উদ্বাস্তু মানুষদের প্রতি সিপিআইএমের দীর্ঘ উদাসীনতাই মমতা ব্যানার্জিকে তাদের কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলো। তিনি বুঝেছিলেন, উদ্বাস্তু প্রধান অঞ্চলগুলিতে জিততে হলে প্রয়োজন ঠাকুরবাড়ির সমর্থন। এর জন্য তিনি দুটো কাজ করেন। এক, ঠাকুর বাড়ির সাথে যোগাযোগ বাড়ান; দুই, উদ্বাস্তু মতুয়াদের নাগরিকত্বের সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দেন। ফলস্বরূপ ঢেলে মতুয়া ভোট পায় তৃণমূল। কপিলকৃষ্ণ ঠকুরকে মন্ত্রী করা হয়। কিন্তু সমস্যা সমস্যা হয়েই থেকে যায়।এরপর মতুয়া ভোটকে কুক্ষিগত করতে কয়েক বছরের মধ্যেই মাঠে নামে বিজেপি। মতুয়াদের কাছে বিজেপির নানান প্রতিশ্রুতির মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে নাগরিকত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি। ২০১৯ -এর লোকসভা ভোটের আগে মতুয়া ভোটকে নিজেদের দিকে টানতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের ওরাকান্দিতে অবস্থিত মতুয়াদের মূল ধর্মীয় মন্দিরে ভ্রমণ করেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একাধিকবার জনসভা করেন ঠাকুরনগরে। বকলমে কথা দেন তাঁরা নাগরিকত্বের জট কাটাবেন। আর সেই আশাতেই এক বড়ো অংশের মতুয়া ভোট বিজেপির দিকে ঘুরতে থাকে। আশা একটাই -নি:শর্ত নাগরিকত্ব। কিন্তু সিএএ কি সত্যিই তাদের নি:শর্ত নাগরিকত্ব দেবে? উত্তর হলো – একেবারেই না। সিএএ শর্তসাপেক্ষ নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলে। দু-হাজার চোদ্দো সালের একত্রিশে ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্থান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারনে পালিয়ে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শরনার্থীদের বিভিন্ন শর্তে নাগরিকত্ব প্রদান করবে কেন্দ্র। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতবর্ষে এই প্রথম। নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের এই নির্বাচিত সহৃদয়তার আইনি স্বীকৃতি এক কথায় নজিরবিহীন। নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য চোদ্দো সালের একত্রিশে ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কারণ এরপর সে-সব দেশের সংখ্যালঘুদের উপর যে কোনো অত্যাচার হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিএএ -র অধীনে নাগরিকত্বের আবেদন করতে গেলে একজন উদ্বাস্তুকে প্রমান করতে হবে যে সে আদতেই বাংলাদেশ, পাকিস্থান বা আফগানিস্থানের নাগরিক। প্রমাণ হিসেবে দেখাতে হবে ওই তিনের কোনো একটি দেশের সরকার প্রদত্ত পরিচয় পত্র, পাসপোর্ট, জমির দলিল, স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট ইত্যাদির কোনো একটি। অথবা ভারতে প্রবেশের সময় বর্ডার থেকে দেওয়া বর্ডার স্লিপ। কিন্তু শরণার্থী মানুষদের বেশিরভাগেরই সেসব কাগজ নেই। কেনো নেই সে প্রশ্ন অবান্তর। তাছাড়া, অন্য দেশের সরকার প্রদত্ত সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, দলিল ইত্যাদির সত্যতা ভারত সরকার যাচাই করতে পারে কি? সেক্ষেত্রে সাহায্য নিতে হবে সেসব দেশের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে জানিয়েছে যে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে তাদের দেশের একজন নাগরিকও ভারতে আসেনি। তাহলে উদ্বাস্তুদের দ্বারা প্রদান করা কাগজের সত্যতা যাচাই হবে কীভাবে? উনিশ সালের সাতই জানুয়ারি জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি সিএবি (নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল) সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পার্লামেন্টে পেশ করেছিলো। ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো কমিটিকে জানিয়েছে, ৩১,৩১৩ জন শরণার্থী যারা ভারত সরকারের কাছে নাগরিকত্বের আবেদন করেছিলো এবং ভারত সরকার যাদের দীর্ঘ মেয়াদি ভিসা প্রদান করেছিলো, কেবলমাত্র তারাই এই আইন থেকে সুবিধা পাবে। তবে এই ৩১,৩১৩ জন আবেদনকারীর বেশিরভাগই বাংলার উদ্বাস্তু নয়। তাছাড়া গোটা দেশে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা কয়েক কোটি।সিএএ -র পোর্টালে করা আবেদনগুলি প্রথমে তদন্ত করবে নির্দিষ্ট জেলাস্তর কমিটির মাথায় থাকা ডেসিগনেটেড অফিসার। এরপর সে তার মতামতসহ আবেদনটিকে এমপাওয়ার্ড কমিটির কাছে পাঠাবে। কোনো ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কিনা সেটা ঠিক করবে এই এমপাওয়ার্ড কমিটি। সম্প্রতি উনচল্লিশ পাতার নাগরিকত্ব সংশোধনী নিয়মাবলি প্রকাশ করেছে কেন্দ্র। সেই নিয়ম অনুযায়ী, একজন উদ্বাস্তুকে এফিডেভিট করে রাষ্ট্রকে জানাতে হবে যে সে বাংলাদেশ, পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানের নাগরিক। ধরে নেওয়া যাক, কোনো ব্যক্তি সিএএ -র আবেদন করলো এবং এফিডেভিটের মাধ্যমে লিখে দিলো, সে ভারতের নাগরিক নয়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানের নাগরিক। এবং প্রমাণপত্রের অভাবে বা অন্য কোনো কারণে এমপাওয়ার্ড কমিটি তার নাগরিকত্বের আবেদন খারিজ করে দিলো। পরবর্তীতে কেন্দ্র এনআরসি নিয়ে আসলে ওই বে-নাগরিক হওয়া ব্যক্তির ভবিষ্যৎ কী হবে? বেশিরভাগ উদ্বাস্তু পরিবারেরই ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি রয়েছে৷ সিএএ এবং এনআরসি-র মাধ্যমে বেনাগরিক প্রমাণ হলে সে-সব যে বন্ধ করে দেওয়া হবে, তা বলাই বাহুল্য। অন্তত আসামের চিত্র তাই বলে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা অথবা রেশনের চালে সংসার চালানো মানুষদের কী হবে? নাকি ডিটেনশন ক্যাম্পই এদের আগামী ভবিষ্যৎ? প্রশ্নগুলো ঘিরে রয়েছে কেবলই ধোঁয়াশা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় ইতিমধ্যেই আত্মহত্যা করেছে বাংলার এক যুবক। তার পরিবারের লোক জানিয়েছে, সিএএ তে আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় ‘কাগজ’ না থাকায় ভয়ঙ্কর আতঙ্কে ছিল বছর একত্রিশের দেবাশিস সেনগুপ্ত। দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার ভয়েই আত্মহননের পথ বেছে নেয় সে। উদ্বাস্তুরা উপার্জন ও ব্যয় উভয়ই এই দেশে করে থাকে। ফলে ভারতবর্ষের জিডিপিতে তাদের সম্পূর্ণ অবদান রয়েছে। কিন্তু আগামীতে এই কোটি কোটি উদ্বাস্তুকে ডিটেনশন ক্যাম্পে কয়েদিদের মতো রাখলে, এক বিপুল অর্থের বোঝা দেশের উপর পড়বে – একথা বলাই বাহুল্য। সরকারি সার্টিফিকেট যেমন ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ইত্যাদির তৈরির ক্ষেত্রেই ভুরিভুরি ভুলের অভিযোগ ওঠে, সেখানে এত এত মানুষের নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে উক্ত কমিটির যে ভুল হবে না, তা বলা যায় না। আমরা আসামের মানুষের এনআরসি সংক্রান্ত তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা ইতিমধ্যেই জানি। সেখানে এনআরসির সর্বশেষ তালিকা বের হওয়ার পূর্বে দুটি ভুলে ভরা খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ তালিকাটিও যে নির্ভুল একথাও অনেকে বিশ্বাস করতে নারাজ। এমত অবস্থায় কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ প্রশ্নের মুখে। শিক্ষাহীন, মানহীন মতুয়া সমাজকে একসময় শিক্ষা ও সম্মানের জীবন দানের জন্য নিরলস আন্দোলন করেছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। বলতেন, “খাও না খাও, ছেলেমেয়েকে স্কুলে পড়াও”। ভরসা সেই ‘ঠাকুর’ পদবিতে। তাই শান্তনু ঠাকুরের কথাতেই আস্থা রেখেছিলো মতুয়া জনগোষ্ঠির বিপুল সংখ্যক মানুষ। এমনকি টাকার বিনিময়ে তিনি তাঁর স্বাক্ষর করা ‘মতুয়া কার্ড’ বিলি করেছিলেন মতুয়াদের মধ্যে। ওই কার্ড দেখালেই নাকি পাওয়া যাবে নাগরিকত্ব! সহজ, সাধারণ মানুষেরা সেটাই মেনে নিয়েছিলো।সিএএ -কে সামনে রেখে দু'হাজার উনিশ সাল থেকে বাংলার পাঁচটি উদ্বাস্তু প্রধান লোকসভা এবং সাতাশটি বিধানসভা আসনে বিজেপি ভালো ফল করে আসছে। আগামী লোকসভা ভোটও লড়বে এই ইস্যুকে সামনে রেখে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ও শান্তনু ঠাকুরকে বিশ্বাস করে মতুয়া সহ বাংলার অন্যান্য উদ্বাস্তুরা যে প্রতারিত হয়েছে, তাদের এই উপলব্ধি হওয়া এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। ************************তথ্যসূত্র: https://eisamay.com/west-bengal-news/24pargana-news/bjp-mla-asim-kumar-sarkar-opposes-new-matua-community-card-announced-by-mp-shantanu-thakur/articleshow/105538993.cmshttps://twitter.com/BanglaRepublic/status/1767893662539894828?t=qWkfn2RvaCfnrjjdqoHvSw&s=19https://bengali.abplive.com/videos/district/west-bengal-news-bjp-mla-asim-sarkar-himself-questioned-the-validity-of-matua-card-1027283https://bangla.hindustantimes.com/bengal/districts/citizenship-only-if-you-have-a-matua-card-shantanu-thakur-demand-resonates-with-tmc-bjp-31710407987896.html
    বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে…….. - সোমনাথ গুহ | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়মার্চ ও এপ্রিল পরপর দু মাসে দুজন স্বনামধন্য সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী দীর্ঘ কারাবাসের নরক-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। গত ৭ই মার্চ অধ্যাপক জি এন সাইবাবা প্রায় এক দশকের কারাবাসের পর নাগপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি পান। এর প্রায় এক মাস বাদে ভীমা কোরেগাঁও (বিকে) মামলায় ধৃত নারী ও দলিত অধিকার কর্মী, অধ্যাপক সোমা সেন জামিন পান। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এই দুজনের মুক্তি অবশ্যই স্বস্তিদায়ক, কিন্তু যা ঢের বেশি অস্বস্তিকর তা হচ্ছে তাঁদের গ্রেপ্তার, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের বিচার বা বিচার না-হওয়া পুরো বিচারব্যবস্থার স্বরূপকে নগ্ন করে দিয়েছে। সাইবাবার কাহিনি বহু চর্চিত, তবুও সেটাকে আমরা ফিরে দেখব এবং কোন কারণে অধ্যাপক সোমা সেন সহ ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ধৃত অন্যান্যদের এতো বছর কারাবাস করতে হল, এবং কয়েকজনকে এখনো করতে হচ্ছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করব। সাইবাবা আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কে সরব ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘অপারেশন গ্রীন হান্ট’ এর বিরুদ্ধে তিনি প্রবল ভাবে সোচ্চার হন। তাঁর বক্তব্য এই অভিযানের উদ্দেশ্য মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ আদিবাসী অঞ্চলের সম্পদ লুট করে তা কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। ২০১৪র মে মাসে মাওবাদীদের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রায় এক বছর বাদে শারীরিক কারণে জামিন দেওয়া হয়। ২০১৫-১৬ সালে এর পুনরাবৃত্তি ঘটে। পরের বছর সিপিআই, মাওবাদীদের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে ইউএপিএ নামক দানবীয় আইনের অধীনে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। সাইবাবা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রামলাল আনন্দ কলেজে ইংরাজির অধ্যাপক ছিলেন। ২০২১ সালে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। ২০২২ এর অক্টোবরে বম্বে হাই কোর্ট তাঁকে বেকসুর খালাস করে দেয়, বিচারপতিরা বলেন যে তাঁকে অভিযুক্ত করার জন্য যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কোর্ট সাইবাবা এবং তাঁর পাঁচ সাথিকে বেকসুর খালাস করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, মহারাষ্ট্র সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করে। এরপরে শীর্ষ আদালত যে ভাবে শনিবার, একটা ছুটির দিনে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে তাঁদের মুক্তির ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে তা এক কথায় বিস্ময়কর। আদালতের সময়সীমার বাইরে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণে বিশেষ বেঞ্চ মিলিত হওয়া কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সাংবিধানিক সংকট, ব্যক্তি স্বাধীনতা বা ফাঁসির আসামির আবেদন রদ করার শুনানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মধ্যরাতেও বিচারকরা মিলিত হয়েছেন। কিন্তু তথাকথিত একজন মাওবাদী, যিনি ৯০% প্রতিবন্ধি, যিনি ষোলোটি মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত, যাঁকে সামান্য দৈনন্দিন কাজ করতেও অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয়, তাঁর মুক্তি আটকাতে যেভাবে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাতে বিশিষ্ট আইনজ্ঞরাও স্তম্ভিত হয়ে যান। মাননীয় অধ্যাপকের আইনজীবী একটা অন্তিম চেষ্টা করেন, তিনি তাঁর মক্কেলের অসুস্থতার কারণে তাঁকে অন্তত কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী রাখার আবেদন করেন। আদালত তাতেও আপত্তি করে, যুক্তি দেয় ঘরে বসেও তিনি নাশকতা মূলক কাজকর্ম করতে পারবেন, ফোনে কর্মীদের নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রস্তাব দেওয়া হয় যে তাঁর ফোন বাজেয়াপ্ত করা হোক, নিষ্ঠুর আদালত তাতেও কর্ণপাত করতে অস্বীকার করে। এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিচারব্যবস্থা সাইবাবার মস্তিষ্ককে ভয় পায়। সেই অভুতপূর্ব স্থগিতাদেশের প্রায় ষোলো মাস পর সেই একই বম্বে হাই কোর্টের নাগপুর বেঞ্চ তাঁকে পুনরায় মুক্তি দেবার আদেশ জারি করে। আদালতের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়। তাঁরা বলেন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপ্রমাণিত অভিযোগ আনা হয়েছে এবং চক্রান্তের প্রস্তুতি হিসাবে তাঁর কাছে কোন নির্দিষ্ট উপাদান পাওয়া যায়নি। তাঁরা আরও বলেন কী ধরনের সন্ত্রাসবাদী কাজ তা ব্যাখ্যা না করার দরুন অভিযুক্তর বিরুদ্ধে মামলা দুর্বল। রাজ্য সরকার আবার শীর্ষ আদালতে আবেদন করে কিন্তু এবার তাঁরা স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করেন। আদালতের পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করছে যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ভুয়ো, সম্পূর্ণ মনগড়া যেটার ভিত্তিতে একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষকে অন্তত সাত বছর ব্রিটিশ আমলের অন্ডা সেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত বৃদ্ধা মাকে দেখার জন্য তাঁর জামিনের আবেদন বারবার নাকচ করা হয়েছে। মার মৃত্যুর পর শেষকৃত্যেও তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি, তখনো তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। এনআইএর মতে তিনি নাকি এতোই বিপজ্জনক যে কয়েক ঘণ্টার জন্য তিনি বাইরে এলেও তা রাষ্ট্রকে বিপন্ন করতে পারে। প্রক্রিয়াটাই যখন শাস্তিপ্রতিবাদী কন্ঠ দমন করার জন্য এটাই এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন বিচার ছাড়াই, শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে বছরের পর বছরের কাউকে কারাবন্দি করে রাখা। এর জন্য ইউএপিএ আইন হচ্ছে মোক্ষম হাতিয়ার যেটার লাগামছাড়া ব্যবহার হচ্ছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ এই আইনে ৮৩৭১ জন ধৃত হয়েছেন, সাজা পেয়েছেন মাত্র ২৩৫ জন, ৩% এরও কম! ২০০৮, ২০১২, ২০১৯, বিভিন্ন সময়ে এই আইনকে সংশোধন করে আরও কঠোর, দানবীয় করে তোলা হয়েছে। এই আইন এক উলটপুরাণ যেখানে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি দোষি নন এবং এই আইনে জামিন দেওয়া নিয়ম নয়, সেটা ব্যতিক্রম; বিচারক এবং সরকারি কৌঁসুলি যদি মনে করেন অভিযুক্ত আপাত ভাবে নির্দোষ শুধুমাত্র তবেই জামিন দেওয়া যেতে পারে। এর সেরা উদাহরণ দিল্লি দাঙ্গা মামলায় অভিযুক্ত উমর খালিদ। ২০২০র সেপ্টেম্বরে উনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারপর থেকে নানা অজুহাতে ওনার জামিনের শুনানি চোদ্দো বার মুলতুবি করা হয়েছে। ২০১৮র জুন মাসে অধ্যাপক সোমা সেন সহ আরও চারজন মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোমা সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নাকি সিপিআই মাওবাদী দলের সক্রিয় কর্মী, তিনি তাঁদের হয়ে তহবিল সংগ্রহ করতেন, হিংসাত্মক কার্যকলাপে ইন্ধন যোগাতেন এবং তিনি নাকি মাওবাদীদের বিভিন্ন ছদ্ম সংগঠনের সাথে যুক্ত। এছাড়া ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭ পুনের কাছে ভীমা কোরেগাঁও-য়ে জনতাকে তিনি হিংসায় প্ররোচিত করেছিলেন। সোমা সেন সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং জানান যে ২০১৭র শেষ দিনে কোরেগাঁও-য়ে তিনি উপস্থিতই ছিলেন না। ডিসেম্বর ১৩, ২০১৮ তিনি প্রথম বার জামিনের আবেদন করেন। এরপর তাঁর আবেদন, এমনকি অসুস্থতার কারণে আবেদনও উপরোক্ত সব কারণের দরুন খারিজ করা হয়। অথচ আজ প্রায় ছয় বছর বাদে সুপ্রীম কোর্ট বলছে তাঁর বিরুদ্ধে যা প্রমাণ আছে তাতে আপাত ভাবে (প্রাইমা ফেসি) তিনি কোন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে যুক্ত ছিলেন এটা প্রমাণিত হয় না। আদালত এটাও বলে তিনি কিছু সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং কিছু মহিলাকে সংগ্রামে উদ্দিপ্ত করেছেন বলেই তিনি মাওবাদী বা তাঁদের কোন ছদ্ম সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন এটাও প্রমাণিত হয় না। এছাড়া আদালত জানায় তৃতীয় কোন ব্যক্তির থেকে পাওয়া তথ্য বা উপাদান থেকে প্রমাণিত হয় না তিনি তহবিল সংগ্রহে যুক্ত ছিলেন। সোমা সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের যে কোন সারবত্তা নেই এই উপলব্ধিতে আসতে আদালতের প্রায় ছয় বছর লেগে গেল। ভীমা কোরেগাঁও বা দিল্লি ‘দাঙ্গা’ মামলায় এটাই হচ্ছে প্যাটার্ন! বছরের পর বছর অভিযুক্তদের কারাগারে বিনা বিচারে ফেলে রাখা হয়েছে, তারপর বহু টালবাহানার পরে কয়েকজনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে প্রাইমা ফেসি এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত নয়, এবং জামিন দেওয়া হয়েছে। বাকিরা তো এখনো জেলের ঘানি টানছেন। ছয় বছর হয়ে গেল বিকে মামলায় এখনো বিচারই শুরু হয়নি; শোনা যাচ্ছে চার্জশীটই নাকি ৫০০০ পাতা, ২০০ জন সাক্ষী। দিল্লি ‘দাঙ্গা’ মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কেউই পরিষ্কার নন। জামিনের শর্তাবলী এরপরেও আরও গল্প আছে। যাঁরা জামিন পাচ্ছেন তাঁদের মানমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকাই দুরূহ হয়ে পড়ছে কারণ জামিনের শর্তাবলী ভয়ঙ্কর! সোমা সেনের জামিনের শর্তাবলী দেখা যাকঃ (১) পাসপোর্ট জমা দিতে হবে, (২) বিশেষ আদালতের অনুমতি ছাড়া তিনি মহারাষ্ট্রের বাইরে যেতে পারবেন না, (৩) যেখানে বসবাস করবেন সেখানকার নিকটবর্তি থানায় তাঁকে চোদ্দো দিন অন্তর হাজিরা দিতে হবে, (৪) মোবাইল সব সময় অন রাখতে হবে এবং ব্যাটারিতে চার্জ থাকতে হবে, (৫) জিপিএস অন রাখতে হবে এবং নিকটবর্তি এনআইএ অফিসারের ফোনের সাথে সেটি লিঙ্ক রাখতে হবে। শর্ত পালনে কোন বিচ্যুতি ঘটলে তৎক্ষণাৎ জামিন বাতিল হয়ে যাবে। সোমা নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজির অধ্যাপক ছিলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি কি অবসরকালীন সুযোগ সুবিধাগুলি পাবেন? আদালত নীরব। একই ভাবে সাইবাবা কি তাঁর চাকরি ফিরে পাবেন? এসব ব্যাপারে আদালত কোন নির্দেশ ব্যক্ত করেনি। বিশিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ানিস্ট, আইনজীবী, সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ ২০২১ এর ডিসেম্বর মাসে বিকে মামলায় জামিন পান। তাঁর জামিনের ষোলোটি শর্ত আছে। সোমার ওপর যে শর্তগুলি চাপান হয়েছে সেগুলো তো আছেই আরও যা আছে তা হলঃ (১) তাঁকে মুম্বাই আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে থাকতে হবে এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া এই চৌহদ্দির বাইরে তাঁর যাওয়া নিষেধ (অথচ তিনি দিল্লির ‘ন্যাশানাল ল বিশ্ববিদ্যালয়’-এর অধ্যাপক ছিলেন। সেটা তাঁর কর্মক্ষেত্র, সেখানে না গেলে তিনি জীবিকা অর্জন করবেন কী ভাবে?) (২) রক্তের সম্পর্ক আছে এরকম তিনজন আত্মীয়ের বাড়ি ও কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা, ডকুমেন্ট সহ জমা দিতে হবে, (৩) মিডিয়ার কাছে তাঁর মামলা সংক্রান্ত কোন বক্তব্য রাখা নিষিদ্ধ, (৪) বিচারের সময় তাঁকে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে, তাঁর অনুপস্থিতির জন্য বিচার যেন বিলম্বিত না হয় (ছ বছরে বিচার শুরুই হয়নি!), (৫) বিকে মামলার অন্য সাথীদের সাথে যোগাযোগের কোন রকম চেষ্টা করবেন না, (৬) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা ছাড়া তাঁর বাড়িতে অন্য ব্যক্তিদের জমায়েত নিষিদ্ধ ইত্যাদি। জামিনের ওপর স্থগিতাদেশ এই জমানায় মুক্তির আদেশের পরেও যখন স্থগিতাদেশ হতে পারে, তখন জামিনের ওপর তো হবেই। মহেশ রাউত, টাটা ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের প্রাক্তনি এবং প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ উন্নয়নের ফেলো, জুন, ২০১৮ গ্রেপ্তার হন। ২০২৩ এর সেপ্টেম্বরে আদালত তাঁকে জামিন দেয়, বলে যে ইউএপিএ-তে তাঁর বিরুদ্ধে যা অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট উপাদান নেই। এনআইএ এর বিরুদ্ধে আবেদন করে এবং কয়েক দিনের মধ্যে আদালত নিজেদের রায়ের বিরোধিতা করে বলে তাঁর সাথে মাওবাদীদের যোগাযোগ পাওয়ার কারণে তাঁরা পুনর্বিবেচনা করে রায়ের ওপর এক সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিচ্ছেন। সেই এক সপ্তাহ এখনো চলছে! কোন না কোন অজুহাতে আজ পর্যন্ত সেই স্থগিতাদেশ বহাল আছে। একই ভাবে প্রসিদ্ধ মানবাধিকার কর্মী গৌতম নাভলাখা ডিসেম্বর ২০২৩ জামিন পান এবং প্রায় সাথে সাথেই এনআইএর আবেদনের কারণে আদালত জামিনের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ জারি করে। এর মধ্যে শারীরিক অসুস্থতার কারণে কারাগার থেকে সরিয়ে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে গৃহবন্দিত্ব বা হাউস এরেস্টের কোন কনসেপ্ট ভারতীয় আইনে স্বীকৃত নয়। যেহেতু গৌতম নিজে গৃহবন্দি হওয়ার আবেদন করেছিলেন, তাই আদালত শর্ত দেয় যে গৃহবন্দিত্বের খরচ (সিসিটিভি লাগান, যাঁরা প্রহরায় থাকবেন তাঁদের পারিশ্রমিক ইত্যাদি) অভিযুক্তকেই বহন করতে হবে। শেষ যা জানা গেছে সেই খরচ নাকি প্রায় দেড় কোটিতে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে এই খরচ নিয়ে এনআইএ এবং অভিযুক্তের আইনজীবীর মধ্যে দরাদরি চলছে। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে চূড়ান্ত ভাবে হেনস্থা করা, বারবার বুঝিয়ে দেওয়া নিপীড়িত শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতপাতের বিরুদ্ধে সরব হয়েছ তো তুমি শেষ। বনে জঙ্গলে খনন হচ্ছে, বড় বড় কর্পোরেট মাইনিং করছে সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার, সংগ্রামি আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানর কোন অধিকার তোমার নেই। সোমা, সুধা, মহেশ, গৌতম এঁরা তো সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, আর যাঁরা নন? ২০২২য়ে ইউটিউবে ফাদার স্ট্যান স্বামীর ওপর একটি ভিডিওতে পারাকালা প্রভাকর জানাচ্ছেন ওই বছরের মার্চ মাসে ইউএপিএতে অভিযুক্ত ১২২ জন ১৯ বছর কারাবাসের পর মুক্তি পেয়েছেন। ভাবা যায়! এতগুলো বছরে তাঁদের নিয়মিত আদালতে যেতে হয়েছে, জেল থেকে থানায় যেতে হয়েছে। অরুণ ফেরেরা, কার্টুনিস্ট, বিকে মামলায় অভিযুক্ত ২০০৭ থেকে ২০১২ কারাবাস করেছেন, ২০১৮য় পুনরায় গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং পাঁচ বছর বাদে মুক্তি পেয়েছেন। সেই মাওবাদী অভিযোগ, কিন্তু কোন কিছুই প্রমাণিত নয়। আমাদের রাজ্যে গৌর চক্রবর্তী সাত বছর ইউএপিএতে কারাগারে থাকার পর ২০১৬য় মুক্তি পেয়েছেন। এই তালিকার শেষ নেই, এই নরক-যন্ত্রণারও শেষ নেই।
  • হরিদাস পালেরা...
    বৈঠকি আড্ডায় ১৪  - হীরেন সিংহরায় | বৈঠকি আড্ডায় ১৪  ভোটাভুটি খরচাপাতি পর্ব ৬ শেষ নির্বাচন প্রচলিত প্রথা ভেঙ্গে নতুন চ্যান্সেলর আডলফ হিটলার তাঁর প্রথম ভাষণ দিলেন রাইখসটাগে নয়, আপন মনের কথা সরাসরি জার্মান জনতাকে জানালেন এক বেতার বার্তায়।  যুদ্ধে পরাজয়ের পরে দেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা, সামরিক অক্ষমতার জন্য পূর্ববর্তী সরকারগুলিকে দায়ী করে সবশেষে আবেদন জানালেন :“কমিউনিস্ট ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলি বিগত চোদ্দ বছরে দেশকে  লুট করে জার্মানিকে সার্বিক বিনষ্টির দিকে ঠেলে দিয়েছে।  চার বছর , আমাদের মাত্র চার বছর সময় দিন , তারপরে আমাদের বিচার করবেন।“যদিও নাৎসি পার্টি পেয়েছিল জনমতের ৩৩.১% ভোট কিন্তু জার্মান জাতীয় দল এবং সেন্টার পার্টির সমর্থনে চ্যান্সেলর অর্জন করলেন কার্যকরী গরিষ্ঠতা।  তিনি অবশ্য চান কার্যকরী নয়,  নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা ; আর  দুটো দলের সঙ্গে দশটা বৈঠক করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতন ধৈর্য তাঁর নেই ।  আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আইনের ঠেলায় পূর্ণ বহুমত পাওয়া শক্ত।  সেই কারণে দেশের  উন্নয়নের কাজ আটকে যায়- ভাইমার সংবিধানের সে আইন বদলানোর ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিরও নেই।   অগত্যা চ্যান্সেলর হিটলার আরেকবার জনতার সামনে যেতে চাইলেন, এবার ক্ষমতা সন্ধানী নাৎসি পার্টির নেতা নয়, দেশের চ্যান্সেলর হিসেবে ময়দানে নামবেন।  তিনি চান দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা নিয়ে সকল সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ স্বাধীনতা। প্রেসিডেন্ট পাউল ফন হিনডেনবুরগের সঙ্গে প্রথম মিটিঙে চ্যান্সেলর তাঁকে পরামর্শ দিলেন ভাইমার সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী নভেম্বর ১৯৩২ সালে নির্বাচিত পার্লামেন্টকে ডিসমিস করে নতুন ভোটের দিন ঘোষণা করা  হোক ।বছর বছর ভোট হয় -  এক এই ১৯৩২ সালেই  জুলাই , নভেম্বর দু বার - কোন সরকার টেকে না।  এই রণে ক্লান্ত হয়ে বৃদ্ধ সেনানায়ক বললেন তথাস্তু । নতুন নির্বাচনের ডাক দেওয়া হলো – ৫ই মার্চ , ১৯৩৩পয়লা লড়াইয়ে জিতে চ্যান্সেলরি ভবনে মিটিং ডাকলেন হিটলার । কেউ কিছু বলার আগেই ইওসেফ গোয়েবলস মুখ খুললেন  , মাইন ফুয়েরার , গত বছরে দুটো সাধারণ নির্বাচনে ট্রেনে বাসে গাড়িতে ঘোরাঘুরি করে, মিটিঙের মঞ্চ সাজাতেই আমাদের ট্যাঁক যে খালি হয়ে গেছে ( ডি কাসে ইস্ট লেয়ার )! পার্টির সদস্যদের চাঁদা আর  ধার দেনা করেই  পার্টির কাজ চলে । যদিও আমরা ক্ষমতায় এসেছি,  ভোট হবে  বলে সরকারি তহবিলে আমরা হাত দিতে পারি না !ফুয়েরার বললেন দু বছর আগে ডুসেলডরফের মিটিঙে হের থুসেন আমাকে , সাড়ম্বরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন , গত সপ্তাহে  প্রেসিডেন্টের কাছেও আমার পার্টির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন।   আজ আমাদের প্রয়োজনে তাঁরা শুধু পাশেই দাঁড়াবেন না , টাকাও দেবেন ।পাঁচ সপ্তাহ বাদে ভোট , শিগগির  ডাকুন তাঁদের।  লাগে টাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ই ফেব্রুয়ারি  ,১৯৩৩ প্রায় একই সময়ে চ্যান্সেলরের ব্যক্তিগত বার্তা বহন করে একটি টেলিগ্রাম পৌঁছুলো বার্লিন,  কলোন , ডুসেলডরফ,  এসেন, মিউনিক,  হামবুর্গের চব্বিশজন ধনী শিল্পপতির অফিসেঃ  চ্যান্সেলর আডলফ হিটলারের সঙ্গে একটি মুখোমুখি আলোচনা বৈঠক-বিষয় : বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোচনা স্থান            প্রাশিয়ান পার্লামেন্টের প্রধান , হ্যারমান গোয়েরিঙের বাসভবনকাল            সোমবার ২০শে ফেব্রুয়ারী , সন্ধ্যা ছটাআপনার উপস্থিতি একান্ত কাম্যভবদীয়আডলফ হিটলার , চ্যান্সেলর , জার্মানি১৬.২.১৯৩৩বার্লিনের কুয়াশা মোড়া শীতল ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় একটি বেলে পাথরের তৈরি প্রাসাদের গাড়ি বারান্দায় মহার্ঘ্য সেডান গাড়ি থেকে একে একে নামলেন  চব্বিশ জন সুসজ্জিত পুরুষ। তাঁদের কালো অথবা ব্রাউন ওভারকোট , ফেল্ট অথবা উলের টুপি সযত্নে সংগৃহীত রক্ষিত হলো একটি বিশেষ কক্ষে । প্রাসাদের বিশাল সোপান বেয়ে তাঁরা উঠলেন দোতলায় ।  প্রাশিয়ান পার্লামেন্টের অধ্যক্ষ ( স্পিকার)  হ্যারমান গোয়েরিং তাঁদের সাদর অভ্যর্থনা সহ নিয়ে গেলেন একটি সুসজ্জিত বিশ্রামগৃহে ।তাঁরা আসন গ্রহণ করার পরে এত অল্প সময়ের নোটিসে তাঁরা যে এসেছেন তার জন্য ধন্যবাদ জানালেন গোয়েরিং , তাঁর ডান পাশে রাইখসবাঙ্কের পূর্ব প্রধান হায়ালমার শাখট (পরে অর্থনীতি মন্ত্রী )  । চ্যান্সেলরের দেখা নেই ।প্রায় সাড়ে ছটার সময়ে হিটলার এলেন , সঙ্গে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অটো ভাগেনার ( অর্থনীতির স্নাতক, ঝটিকা বাহিনীর কর্মকর্তা , রুর অঞ্চলের এক বাণিজ্যিক মোগলের সন্তান , ঝটিকা বাহিনীকে একটি বিশেষ ব্রান্ডের সিগারেট বিক্রি করে বিশাল অর্থ উপার্জন করেন ) ।সকলের সঙ্গে করমর্দন শেষে হিটলার  একবার না থেমে কোন নোটের সাহায্য ছাড়াই প্রায় দেড় ঘণ্টার একটি বক্তিমে ছাড়লেন ( যদিও তার মূল টেক্সট পাওয়া যায় না , উদ্ধৃতি মেলে অনেক ) –যুদ্ধের পরে এই চোদ্দ বছরের অনিশ্চিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থী দলগুলি  অরাজকতা সৃষ্টি করার ফলে দেশের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠেছে । গণতন্ত্রের যুগে ব্যক্তিগত ধন সম্পত্তি রক্ষা করা সম্ভব নয় , এখন প্রয়োজন সবল নেতৃত্ব ও নতুন চিন্তা।  সেটা  আমি খুঁজে পেয়েছি জাতীয়তাবাদ এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক শক্তির ভেতরে । সামনের লড়াইটা বাম বনাম দক্ষিণের সম্মুখ সংগ্রাম । আমরা চাই ক্ষমতা দখল করে প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করতে কিন্তু এই লড়াই ততদিন স্থগিত রাখতে হবে যতদিন না আমরা একচ্ছত্র ক্ষমতা আয়ত্ত না করছি।  মনে রাখবেন বামপন্থীদের হাতে আপনাদের ধন সম্পদ জমি জিরেত কল কারখানা কিছুই সুরক্ষিত নয় , একবার সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে চেয়ে দেখুন!  অর্থনীতি বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে  যা কিছু বরণীয়  তা সম্ভব হয়েছে কোন দলীয় রাজনীতি নয় ,  একক ব্যক্তিত্বের  ভাবনা ও চিন্তায় , নির্বাধ শক্তি ও ক্ষমতার বলে।তেরো দিন বাদে, পাঁচই মার্চ সাধারণ নির্বাচন – ফলাফল যাই হোক না কেন, এটাই হবে জার্মানির শেষ নির্বাচন।  হয় ভাইমার সংবিধান মোতাবেক বহু দল মিলে সম্পূর্ণ অকর্মণ্য সরকার গড়বার চেষ্টা করতে গিয়ে দেশকে  ধ্বংস করবে অথবা পথে পথে সশ্ত্র লড়াই হবে ।ভদ্রমহোদয়গণ, আমার কথা  মনে রাখুন ,  এই  নির্বাচন জার্মানির শেষ নির্বাচন ।বিজনেস ম্যাগনেটরা আশা করেছিলেন হিটলার তাঁদের বিশেষ সমস্যা যেমন ট্রেড ইউনিয়ন,  শ্রমিক অশান্তি,  স্ট্রাইক  ইত্যাদির বিষয়ে নাৎসি পার্টির লাইন জানাবেন।  হিটলার সেদিকেই গেলেন না ।চ্যান্সেলর হিটলার জার্মান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৃত্যু ঘণ্টা বাজালেন।সমবেত ক্যাপটেনস অফ ইন্ডাস্ট্রি বিচলিত হন নি  । তাঁদের মনোনীত প্রতিনিধি  ইস্পাত ও অস্ত্র ব্যবসায়ী গুস্তাভ ক্রুপ ।  মিটিঙের অ্যাজেনডার কথা বিবেচনা না করেই হিটলারের সঙ্গে এই প্রথম সাক্ষাৎকারের মউকায় হের ক্রুপ একটি দীর্ঘ পলিসি নোট লিখে এনেছিলেন । কিন্তু হিটলারের ভাষণ শোনার পরে সেটি পুরো উপস্থিত করবার প্রয়োজন দেখলেন না ।জার্মানির বর্তমান পরিস্থিতির প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা পেশ করার জন্য ক্রুপ হিটলারকে ধন্যবাদ জানিয়ে  বললেন , “ জার্মানির বর্তমান অরাজক অবস্থার একমাত্র সমাধান একটি সবল রাষ্ট্র এবং তার প্রধান যার ছত্রছায়ায় বাণিজ্য ও অর্থনীতি দ্রুত অগ্রগতি করবে । “গুস্তাভ ক্রুপ এবং সমাগত বাণিজ্যিক প্রধানদের উপস্থিতির জন্য  ধন্যবাদ জানিয়ে  অন্য কাউকে  প্রশ্নোত্তরের সুযোগ না দিয়েই হিটলার বিদায় নিলেন।চব্বিশ জন এখনও ধন্দে – এই মিটিঙের আসল অ্যাজেনডা কি ?হিটলারকে প্রাসাদের দোরগোড়া অবধি পৌঁছে গাড়িতে তুলে দিয়ে বৃহৎ বপু গোয়েরিং সভাগৃহে  ফিরলেন।  এই হাঁটাহাঁটিতে হাঁপিয়ে পড়েছেন ; অন্যদিকে চব্বিশ জন শিল্পপতি বসে আছেন নিশ্চুপ । একটু দম নিয়ে গোয়েরিং বললেন , আমরা কোন অর্থনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট করতে আসি নি । আমরা মনে করি এই অরাজকতা প্রশমিত হলেই আমাদের সুদক্ষ শাসনে বর্তমান অর্থনীতি সঠিক মোড় নেবে । কিন্তু আমাদের হাতকে  শক্ত করতে হলে নাৎসি পার্টি ও তার সহযোগী জার্মান পিপলস পার্টিকে সামনের ইলেকশানে বিজয়ী হতে হবে।  এই দুই দল একত্রে এই ভোটে লড়বে ( জার্মান রাজনীতিতে প্রথম জোট  বন্ধন ) ।ভদ্রমহোদয়গণ,  এই নির্বাচনে জিততে গেলে খরচা আছে, অনেক খরচা।  গত বছরে পর পর দুটো নির্বাচনে লড়ে আমাদের তহবিল এখন প্রায় শূন্য । সদস্যদের চাঁদা আর কিছু ধার দেনা করে এ লড়াই চালানো যায় না – সরকারি তহবিলের টাকায় আমরা রাজনৈতিক প্রচার করতে পারি না , সংবিধানের নিষেধ।  আজ আপনারা নিজের স্বার্থ ভুলে আমাদের অর্থনৈতিক সাহায্য করুন,  পরবর্তী পথ আমরা একসঙ্গে হাঁটব- ভবিষ্যতে আপনাদের স্বার্থ রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি আজি দিলাম।  তবে এটাও মনে রাখবেন , এই  নির্বাচনী জয় হবে জার্মানির ইতিহাসে একটি নির্ণায়ক মোড়- আগামী একশো বছরে আর কোন নির্বাচন হবে না।অনেক ভণিতার পরে  হ্যারমান গোয়েরিং  ঝেড়ে কাশলেন এবং তৎক্ষণাৎ বিদায় নিলেন।সমবেত বাণিজ্যিক প্রধানগণ বাক্যিহারা । তাহলে এই জন্যেই ডাক পড়েছিল ?সভাগৃহে তখনও আসীন গুম্ফ শোভিত ডক্টর হায়ালমার শাখট , যিনি পরে আবার রাইখসবাঙ্কের প্রেসিডেন্ট এবং ইকনমি মন্ত্রী হবেন ।  তিনি এতক্ষণ কোন কথা বলেন নি । হিটলার এবং গোয়েরিং বিদায় নিলে তিনি মুখ খুললেন“ এই ভোট যুদ্ধ জিততে গেলে , পার্টির হিসেব অনুযায়ী আমাদের অন্তত তিরিশ লক্ষ রাইখসমার্ক দরকার ( আজকের হিসেবে দু কোটি ইউরো অথবা একশ আশি কোটি টাকা) । এবার আসুন ক্যাশ কাউনটারে !”বাঘের পিঠে সওয়ার যখন হয়েছেন তখন নেমে পড়ার প্রশ্ন ওঠে না। ক্রেডিট কার্ড অনেক দূরে , চেক বই কেউ সঙ্গে আনেন নি । কিন্তু কোম্পানির পক্ষ থেকে অঙ্গীকার করার অধিকার তাঁদের ছিল – তাঁরা বিশাল প্রতিষ্ঠানের মালিক বা শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত । একের পর এক শিল্পপতি  ডক্টর শাখটের চাঁদার খাতায় সই করলেনআপনার আমার চেনা কয়েকটি নাম ও চাঁদার পরিমাণ উল্লেখের দাবি রাখেদাতা                রাইখসমার্ক টেলিফুঙ্কেন         ৩৫,০০০অসরাম             ৪০,০০০ই গে ফারবেন       ৪,০০,০০০ ( এঁদের  আজ আমরা চিনি বায়ার এ জি , বি এ      এস এফ ইত্যাদি কেমিকাল কোম্পানির নামে  )ক্রুপ খনিজ গ্রুপ    ২,০০,০০০    এ ই জি               ৬০,০০০    ( ইলেট্রিকাল আজ এ ই জি টেলিফুঙ্কেন নামে পরিচিত )  ডয়েচেবাঙ্ক            ২,০০,০০০          সংযুক্ত ইস্পাত      ২,০০,০০০  ( লোহা ইস্পাত কয়লা মনোপলি )ওপেল               ১,০০,০০০    (গাড়ি )সাত দিনের মধ্যেই এঁরা সকলেই প্রতিশ্রুত চাঁদা জমা দিলেন ডেলব্রুইক শিকলার ব্যাঙ্কে , অ্যাকাউনটের নাম হায়ালমার শাখট ট্রাস্ট।গোয়েবলসের ডায়েরিএকুশে ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবারগোয়েরিং আনলেন খুশির খবর ! বিরাট ব্যাপার ! আমি এখুনি প্রচার দপ্তরকে খবরটা দিচ্ছি মহোৎসাহে আমরা নির্বাচনী প্রচারে নেমে পড়ব আজ কাজ করে আনন্দ আছে – টাকা এসে গেছে “।দু দিন আগে সেই ডায়েরিতে লিখেছিলেন , বড়ো খারাপ  অবস্থা পার্টির ফাণ্ডে টাকা নেই ।পরবর্তী ঘটনাক্রম নিম্নরূপ –ঠিক সাত দিন বাদে , ২৭শে ফেব্রুয়ারি  রাইখসটাগে আগুন লাগল – ফান ডের লুবে নামের এক ডাচ কমিউনিস্ট যুবক হাতে নাতে ধরা পড়ে – তৎক্ষণাৎ কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ও নেতারা জেলে নিক্ষিপ্ত হলেন । হিটলার প্রেসিডেন্ট হিনডেনবুরগের কাছে আবেদন জানালেন পার্লামেন্টের ওপরে এই আক্রমণ দ্বারা জার্মান জন জীবন এবং দেশের সুরক্ষা বিপন্ন হয়েছে অতএব নাগরিক স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখা হোক ।  হিটলারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হিনডেনবুরগ রাইখসটাগ আগুন ডিক্রি পাস করে নাগরিক অধিকার মুলতুবী ঘোষণা করলেন।পরের বহু বছর ক্রোল অপেরা হাউসে পার্লামেন্টের অধিবেশন হবে।বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির সৌজন্যে হিটলার প্লেনে ও হেলিকপ্টারে ঝটিকা ক্যাম্পেন করলেন (ইউরোপীয় রাজনীতির ইতিহাসে প্রথম) । অর্থের বন্যা বয়ে গেলো ।এত সত্ত্বেও পাঁচই মার্চের সাধারণ নির্বাচনে নাৎসি পার্টি পেলো ৪৩.৯% ভোট , সেন্টার পার্টি ( ১১.৭% ) ও পিপলস পার্টির (৮%) সমর্থনে হিটলার সরকার গড়লেন (নিষেধাজ্ঞা ও কারাদণ্ড সত্ত্বেও জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি পায় ১১.৭% ভোট)।২৩শে মার্চ পার্লামেন্টে পাস হলো অনুমোদন বিল ( এরমেখটিগুংসগেজেতস ) যার বলে “সাময়িক “ ভাবে সংবিধান , আইন পার্লামেন্টের সম্মতির প্রয়োজন  স্থগিত রেখে একচ্ছত্র  শাসনের অধিকার দেওয়া হলো হিটলারকে।  একমাত্র সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল এর বিরুদ্ধে ভোট দিলেন।  এই জরুরি অবস্থা কাগজে কলমে চার বছরের জন্য মঞ্জুর হলোভাইমার সংবিধানের পালা সমাপ্ত।এবার একনায়ক যা বলবেন যা করবেন সেটাই নতুন সংবিধান। ২ মে ১৯৩৩          ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ । নেতারা জেলে গেলেন ।১৪ জুলাই  ১৯৩৩ নাৎসি পার্টি ব্যতীত  অন্য সকল দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো২ আগস্ট, ১৯৩৪  প্রেসিডেন্ট পাউল ফন হিনডেনবুরগ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে সেই পদের জন্য নতুন নির্বাচন না করে চ্যান্সেলর হিটলার নিজেকেই   চ্যান্সেলর , রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈন্য বাহিনীর শীর্ষ নেতা বলে ঘোষণা করলেন- তিনি এবার সর্ব শক্তিমান ফুয়েরার কয়েক বছর বাদে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান।১৯৩৩ সালের বিশে ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যেয়  হিটলার যেমন বলেছিলেন-  পাঁচই মার্চের সাধারণ ভোট জার্মানির শেষ নির্বাচন প্রতিপন্ন হলো।পরের ভোট হবে ১৯৪৯ সালে।ঋণ স্বীকার অর্ডার অফ দি ডে           এরিক ভুইলার ( ল্য  অরদ্র দে  জুর )নাৎসি বিলিওনেয়ারস      দাভিদ দে  ইয়াংডায়েরি                          ইওসেফ গোয়েবলসসাক্ষ্য                   গিওরগ ফন শ্নিতসলার, ই গে ফারবেন -  নুরেমবেরগ                               যুদ্ধ অপরাধের  বিচারশালা  ১৯৪৬ পরিশিষ্ট হাজিরা তালিকা২০.২.১৯৩৩এরনসট ব্রান্ডি                ( রুর এলাকার মাইনিং কিং )কার্ল বুইরেন         (  বাদামী  কয়লা , ব্রিকেট )আউগুস্ত দিন                 ( পটাশ কিং )লুডভিগ গ্রাউয়ারট          ( বোর্ড মেম্বার রুর এলাকার নিয়োগকর্তা সমিতি)গুইন্থার হয়বেল               ( মাইনিং , বাদামী  কয়লার মনোপলি )গুস্তাভ ক্রুপ                    (লোহা ইস্পাত কামান অস্ত্রের কারবারি )হান্স লুইস ফারদিনান্দফন লোয়েনস্টাইন            (মাইনিং ম্যাগনেট )ফ্রিতস ফন ওপেল         (বাই সাইকেল দিয়ে শুরু করে মোটরগাড়ি-আজও                                সমান খ্যাত  )   গুইন্থার কোয়ানড            ( কেমিকাল কারখানা এবং বি এম ডব্লিউ গাড়িরপিতামহ ,  তাঁর  স্ত্রী মাগদা বিবাহ বিচ্ছেদের পরেগোয়েবলসকে বিয়ে করেন )ভলফগাং রয়টার            (স্টিল, হেভি ইন্ডাস্ট্রি – রাউরকেলা স্টিল প্লান্ট প্রতিষ্ঠার     অন্যতম  কাণ্ডারি  )আউগুস্ত রোসটারগ         ( ভিনটারশাল – সোডা পটাশ গ্যাস )হায়ালমার শাখট             রাইখসবাঙ্ক ( জার্মান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক )গিওরগ ফন শ্নিতস্লার       (বোর্ড মেম্বার ই গে ফারবেন- জার্মানির বৃহত্তম                                    কোম্পানি যাকে ভেঙ্গে বায়ার , বি এ এস এফ ইত্যাদি                                   নানান কোম্পানি গঠিত হয় – কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে                                       জিক্লন বি গ্যাসের সাপ্লায়ার )এডুয়ারড শুলটে              (দস্তা পটাশ খনির মালিক )ফ্রিতস স্প্রিনগোরুম         (স্টিল- হোয়েশ আ গে , অনেক হাত ঘুরে বর্তমানে টাটাস্টিল )হুগো স্টিনেস                   (মাইনিং , শিপিং , পেট্রলিয়াম )এরনসট টেঙেলমান        ( মাইনিং ম্যাগনেট , রুর ভ্যালি )আলবার্ট ফোয়েগল         (সি ই ও,  ভেরআইনিগটে স্টালভেরকে  -ইস্পাত কয়লালোহা  )লুডভিগ ফন ভিনটারফেলড             (বোর্ড মেম্বার , জিমেন্স )ভলফ দিয়েতরিখফন ভিতসলেবেন          ( প্রতিনিধি – কার্ল ফ্রিডরিখ ফন জিমেন্স)   নাৎসি পার্টির সঙ্গে জার্মান শিল্প বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কয়েক বছর আগেই  তাঁরা খুঁজছিলেন এক স্থিতিশীল সরকার যার সঙ্গে সমঝোতা করা যায় – আপনি আমার কেসটা দেখুন আমি আপনারটা দেখব।  বিশে ফেব্রুয়ারির  দান মেলা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নাৎসি পার্টির সঙ্গে বাণিজ্য মহলের যোগসূত্রকে দৃঢ় করার বাসনায় কিছু ধন কুবের কেপলার সার্কেল নামে একটি ক্লাবের স্থাপনা করেছিলেন।‘ ‘অস্ট্রিয়ান করপোরেল’কে দেশের কাণ্ডারির পদে  বসাবেন কিনা এই চিন্তায় যখন প্রেসিডেন্ট হিনডেনবুরগ দ্বিধান্বিত , সেই সময়ে (২৮/২৯ জানুয়ারি ১৯৩৩)   নাৎসি পার্টি ও আডলফ হিটলারের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়ে কেপলার সার্কেলের সদস্য সহ হিনডেনবুরগের কাছে যে ষোলোজন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী  চিঠি লিখেছিলেন তাঁদের কয়েকজনের নাম হয়তো উল্লেখযোগ্য –ফ্রিতস থুসেন                  বৃহত্তম ইস্পাত কোম্পানি ফেরআইনিগটে স্টালভেরকেরচেয়ারম্যানফ্রিডরিখ রাইনহার্ট           এ ই জি , বৃহত্তম ইলেকট্রিকাল কোম্পানির বোর্ড মেম্বার                                    কমেরতসবাঙ্কের সহ প্রধান, বার্লিন চেম্বার অফ কমার্সের                                    প্রেসিডেন্ট , কেপলার সার্কেল সদস্যকার্ল ক্রোগমান               হামবুর্গের ব্যাঙ্কের ও ভাক্সমুথ শিপিং লাইনের মালিক                                    ১৯৩৩-১৯৪৫ হামবুর্গের মেয়র হামবুর্গ চেম্বার অফ                                    কমার্সের প্রেসিডেন্ট ; কেপলার সার্কেল সদস্যএরিখ লুইবারট               সি ই ও দিভিদাগ ( Dywidag) , বৃহৎ পরিকাঠামোবানানোর  কোম্পানি ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান  এখনও স্বমহিমায় বিরাজিতএরভিন মার্ক                  হামবুর্গ কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের প্রধানফ্রিতস বাইনডরফ           পেলিকান এ জির মালিক , ডয়েচে ব্যাঙ্কের বোর্ড মেম্বারকুর্ট বারনফন শ্রোয়েডার                 প্রাইভেট ব্যাংকার , কলোন, কেপলার সার্কেল সদস্যকুর্ট ফন আইখবর্ণ সাইলেসিয়ার বৃহত্তম ব্যাঙ্কের মালিকইওয়াখিম ফন অপেন       প্রেসিডেন্ট ব্রানডেনবুরগ চেম্বার অফ কমার্সএভালড হেকার               প্রেসিডেন্ট হানোভার চেম্বার অফ কমার্স , কেপলারসার্কেল সদস্যফ্রান্তস ভিটয়ফট             চেয়ারম্যান কমারতসব্যাঙ্ক , কেপলার  সার্কেল সদস্যপু : সরকারি চাঁদা তোলার এই নাৎসি মহোৎসবটি অত্যন্ত গোপনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  নুরেমবেরগের যুদ্ধ অপরাধের বিচার সভায় ই গে ফারবেনের গিওরগ ফন শ্নিতস্লারের জবানবন্দী থেকে এটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে । এখন আমরা যা জানি তার সবটাই সেখানে উপস্থিত কিছু মানুষের স্মৃতিচারণা থেকে আহরিত।  ১৯১৮-১৯৪৫ , ইতিহাসের এই পর্বটি নিয়ে আমার নানান বিচ্ছিন্ন লেখাকে সঙ্কলিত করে একটি গ্রন্থ রচনার বাসনা আছে।একদিন ! 
    কিষেণজি মৃত্যু রহস্য - পর্ব ৬  - বিতনু চট্টোপাধ্যায় | লালবাজারে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। বলছিলেন নয়ের দশকের মাঝামাঝি মেদিনীপুর জেলার কেশপুরের পরিস্থিতি নিয়ে। ‘একদিন কেশপুর থানায় গিয়ে এলাকার ম্যাপ নিয়ে বসলাম। মোট ১৩-১৪টা পুলিশ ক্যাম্প করা হল। ঝাড়খন্ডি এবং সিপিআইএম প্রভাবিত গ্রামগুলোর মাঝে মাঝে এই ক্যাম্পগুলো করা হয়েছিল। এক একটা ক্যাম্পে হাবিলদার, কনস্টেবল এবং জওয়ান মিলে ৮-১০ জন করে পোস্টিং করা হল। কিন্তু কয়েক মাস পর দেখলাম, এই ক্যাম্প করেও গণ্ডগোল থামানো যাচ্ছে না। নিয়ম করে রোজ সংঘর্ষ হচ্ছে। ঠিক করলাম, ক্যাম্পগুলো ভিজিট করব। নিজে দেখব কী সমস্যা হচ্ছে। কাউকে কিছু না বলে একদিন বিকেলে মেদিনীপুরের অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা কেশপুরে চলে গেলাম। তারপর থানা থেকে ওসিকে সঙ্গে নিয়ে কেশপুরে আনন্দপুরের কাছে একটা ক্যাম্পের দিকে রওনা দিলাম। চারদিকের পরিবেশ ওপর থেকে শান্ত। কিন্তু থমথমে একটা ভাব। সেদিনও সকাল থেকে সাত-আটটা গ্রামে গণ্ডগোল হয়েছে। আনন্দপুরের কাছে গণ্ডগোলটা সেদিন বেশি হয়েছিল। সন্ধে নাগাদ আনন্দপুরের ক্যাম্পে পৌঁছলাম। আগে থেকে ক্যাম্পের কাউকে কিছু জানাইনি। ক্যাম্প বসার পর থেকে সেদিনই প্রথম কোনও সুপিরিয়র অফিসারের ভিজিট হল সেখানে। হেড কনস্টেবল, হাবিলদার দৌড়ে এলেন আমাদের গাড়ি দেখে। ক্যাম্পে ঢুকে বসলাম। কথা বলতে শুরু করলাম তাঁদের সঙ্গে। কী অবস্থা, ক্যাম্প কেমন চলছে, এই সব। হেড কনস্টেবল বললেন, ‘‘স্যার, শ’য়ে শ’য়ে লোক রোজ তীর-ধনুক, টাঙি, বন্দুক নিয়ে মারপিট করছে। আমাদের এত কম ফোর্স, কীভাবে থামানো যাবে?’’ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর হেড কনস্টেবলকে বললাম ক্যাম্পের সব আর্মস এবং গুলি নিয়ে আসার জন্য। আমরা থানা, আউট পোস্ট কিংবা ক্যাম্প ভিজিট করলে অনেক সময় আচমকাই আর্মারি চেক করতাম। লিস্ট মিলিয়ে দেখে নিতাম আর্মস, গুলি যা যা থাকার কথা সব ঠিকঠাক আছে কিনা। সেই সময় কেশপুরের এক একটা ক্যাম্পে ৭-৮টা করে রাইফেল দেওয়া হয়েছিল। হেড কনস্টেবলকে সব বন্দুক এবং গুলি আনতে বলার পর দেখছি, তিনি এই কথা-সেই কথা বলে বিষয়টা ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। একটু পরে আবার বললাম, আর্মস নিয়ে আসতে। দেখি তিনি উঠে গেলেন কাউকে চায়ের কথা বলতে। আর্মস আর আনেন না। একটা সন্দেহ হল। এরপর একটু কড়াভাবেই বললাম। তারপর চারটে রাইফেল আর গুলি নিয়ে এলেন হেড কনস্টেবল। আর্মসের লিস্ট মিলিয়ে দেখি, চারটে রাইফেল নেই। ৪০ রাউন্ড গুলিও কম আছে। ওই ক্যাম্পে আটটা রাইফেল দেওয়া ছিল।যতবারই জিজ্ঞেস করি, চারটে রাইফেল আর ৪০টা গুলি কোথায় গেল, কিছুতেই জবাব দেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। বাধ্য হয়ে বললাম, ঠিকঠাক উত্তর না দিলে ক্যাম্পের সবাইকে আলাদা আলাদা ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। আর হেড কনস্টেবল তো সাসপেন্ড হবেনই, তদন্ত শুরু হবে তাঁর বিরুদ্ধে। এর পর তিনি প্রায় কেঁদেই ফেললেন। বললেন, ‘‘স্যার, সিপিআইএম আর ঝাড়খন্ড পার্টির লোকরা নিয়ে গেছে চারটে বন্দুক। একটু পরেই দিয়ে যাবে।’’একটু পরে দিয়ে যাবে মানে? ওরা কি আমাদের বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করে নাকি? হেড কনস্টেবল তখনও আমতা আমতা করছেন। তার যা বললেন তা শিউরে ওঠার মতো।ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএমের লোকেরা মূলত তীর, ধনুক, টাঙি নিয়েই লড়াই করত। দু’দলের কাছে কিছু দেশি বন্দুকও ছিল। তবে সেগুলোর রেঞ্জ তেমন ভাল ছিল না। একদিন সিপিআইএমের বেশ কিছু লোক ওই ক্যাম্পে চড়াও হয়। পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। তারপর নরমে-গরমে হেড কনস্টেবলকে প্রভাবিত করে ফেলে। তারা পুলিশকে বলে, আপনাদের কিছু করতে হবে না। দু’তিনটে বন্দুক আমাদের দিন। আমরাই ঝাড়খন্ডিদের শায়েস্তা করে দেব। তারপর বন্দুক ফেরত দিয়ে দেব। হেড কনস্টেবল ভয়ে ভয়ে ছিলেন। কেশপুর থানার ওসি কিংবা কোনও সুপিরিয়র অফিসার আনন্দপুর ক্যাম্পে যেতেনও না। তারপর এটা রফা হয়। সিপিআইএম সকালে পুলিশ ক্যাম্প থেকে রাইফেল নিয়ে যাবে। তারপর আবার সন্ধেবেলা লড়াই শেষে ফেরত দিয়ে যাবে। এরপর ওরা গুলিও নিতে শুরু করে। এরকম কিছুদিন চলার পর ঝাড়খন্ড পার্টির লোকজনের সন্দেহ হয়। এতদিন দু’পক্ষই প্রায় সমান সমান ছিল। পুলিশের রাইফেল হাতে পেয়ে হঠাৎ সিপিআইএমের শক্তিবৃদ্ধি হওয়ায় সন্দেহ দেখা দেয় ঝাড়খন্ডিদের মনে। কারণ, রাতারাতি সিপিআইএমের ফায়ারিং পাওয়ার বেড়ে গিয়েছে। ঝাড়খন্ডিরা দেখে সিপিআইএম বাহিনী অনেক দূর থেকে গুলি চালাচ্ছে যা আগে পারত না। সিপিআইএম যে পুলিশ ক্যাম্প থেকে রাইফেল পেয়েছে এই খবর পেয়ে যায় ঝাড়খন্ডিরা। তারপর তারাও দল বেঁধে চড়াও হয় আনন্দপুর ক্যাম্পে। সিপিআইএমকে দিলে তাদেরও দিতে হবে রাইফেল। ব্যাস পুলিশ আর যায় কোথায়। ঝাড়খন্ডিরাও সেদিন থেকে রাইফেল নিতে শুরু করল পুলিশের। এমনই চলছিল। কোনওদিন সিপিআইএম বন্দুক নিয়ে যায়, তো কোনওদিন ঝাড়খন্ড পার্টির লোক। কোনও কোনও দিন দু’দলই নিয়ে যায়। কিন্তু দু’দলেরই কথার দাম আছে! দিনের শেষে আবার রাইফেল ফেরতও দিয়ে যেত ক্যাম্পে। যেদিন আমি গিয়েছিলাম, সেদিন দুই দলই সকালে এসে দুটো করে রাইফেল নিয়ে গেছে। তারপর আবার আমি থাকতে থাকতেই দু’দলের লোক এসে রাইফেল ফেরতও দিয়ে গেল।’‘কী বলছেন? পুলিশের বন্দুক দিয়ে দু’দলে যুদ্ধ চলছে, আর পুলিশ ক্যাম্পে বসে আছে? এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা শুনে জিজ্ঞেস করলাম প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কে। ‘এরপর কী করলেন?’‘কী আর করার আছে? প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম, ছোট ক্যাম্পগুলো তুলে নেব। এমনিতেও আট-দশ জনের ক্যাম্প রেখে কোনও লাভ হচ্ছিল না।  সিপিআইএম-ঝাড়খন্ডিরা তো বটেই গ্রামের সাধারণ মানুষও এই ছোট ক্যাম্পগুলোকে কয়েকদিন পরে আর ভয়-ডর পায় না। আনন্দপুর ক্যাম্প থেকে কেশপুর থানায় ফিরলাম। সেখান থেকেই জেলার পুলিশ সুপারকে ফোন করে জানালাম সমস্ত ক্যাম্প তুলে দেওয়ার কথা। তার বদলে পুরো কেশপুরে চারটে বড় ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ক্যাম্প থেকে সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ড পার্টির রাইফেল নিয়ে যাওয়ার কথা বিস্তারিতভাবে আর পুলিশ সুপারকে বললাম না। শুধু বলেছিলাম, ছোট ক্যাম্পে লাভ হচ্ছে না। তার বদলে বড় ক্যাম্প করলে ভালো হবে। কেশপুরে চারটে পয়েন্ট বেছে নিয়ে বড় ক্যাম্পের প্ল্যান করলাম। এক একটা ক্যাম্পে অন্তত ৪০-৪৫ জন করে পুলিশ পোস্টিং করলাম। পরদিনই কেশপুরে সব ছোট ক্যাম্প উঠে চারটে বড় ক্যাম্প বসে গেল। আর পরের দিন রাত থেকেই কেশপুরের সব উত্তপ্ত গ্রামে শুরু করা হল তল্লাশি অভিযান। ওখানে সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ড পার্টির যারা গণ্ডগোল করত এমন প্রায় দেড় হাজার লোকের তালিকা ছিল আমাদের কাছে। বেছে বেছে তাদের বাড়িতে রাতে রেইড শুরু করা হল। কেউ যাতে সারাদিন মারপিট করে রাতে বাড়িতে থাকতে না পারে। টানা এক মাস এই রেইড চালানোতে দারুণ কাজ হল,’ টানা বলে থামলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।  পুলিশ শাসক দলের হয়ে কাজ করে, অনেক শুনেছি। পুলিশ নিজেই শাসক দলের ভূমিকা পালন করেছে এমনও নিজের চোখে দেখেছি নন্দীগ্রামে। আবার, পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম সরকার আর থাকবে না, ২০০৯ লোকসভা ভোট পরবর্তী সময়ে এমন পরিবেশ তৈরি হওয়ার পর, অনেক পুলিশ অফিসারকেই দেখেছি, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কিংবা সিপিআইএমের কথা না শুনে বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু শাসক-বিরোধী দু’দলই পুলিশ ক্যাম্প থেকে রাইফেল, গুলি নিয়ে দিনের পর দিন যুদ্ধ করছে, এমন হওয়াও যে সম্ভব, তা আমার ধারণাতেই ছিল না।। ঘটনাটা শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। কী বিচিত্র এই সিপিআইএম জমানায় অবিভক্ত মেদিনীপুরের রাজনৈতিক লড়াই-সংঘর্ষের সব কাহিনী। এতবার অ্যাসাইনমেন্টে ঝাড়গ্রাম গিয়েছি, এত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি, সংবাদপত্রে এত খবর দেখেছি। কিন্তু কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের সন্ধানে না নামলে জানতেই পারতাম না আরও কত কিছু! ভাবতেও পারতাম না, যুযুধান দুই রাজনৈতিক পক্ষ পুলিশ ক্যাম্প থেকে সরকারি রাইফেল, গুলি নিয়ে গিয়ে লড়াই করে একে অপরের সঙ্গে। আবার লড়াই শেষে সেই রাইফেল ফেরতও দিয়ে আসে পুলিশের কাছে! তবে যত শুনছি, জানছি, ততই মনে প্রশ্ন আসছে, যা জানতে পারছি তাই বা আসল ঘটনার কতটা? এ কি হিমশৈলের চূড়া মাত্র?       দ্বিতীয় সাক্ষী: সিপিআইএম নেতা ডহরেশ্বর সেনডহরেশ্বর সেন। আগেও শুনেছি, কিন্তু ২০০৮ সালে লালগড় আন্দোলন শুরু হওয়ার পর একটা বিশেষ কারণে তাঁর নাম শুনলাম কয়েকবার। এই আন্দোলনের সময় লালগড়, বেলপাহাড়ি, বিনপুর, জামবনিসহ বিরাট এলাকার বহু সিপিআইএম নেতা, কর্মী মাওবাদীদের ভয়ে ঘড়ছাড়া হয়ে যান। বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছিলেন মেদিনীপুর শহরে। সেই সময় ঝাড়গ্রাম মহকুমায় গেলে শুনতাম, ডহরেশ্বর সেন অন্য ধরনের সিপিএম নেতা। সিপিআইএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, ঝাড়গ্রামের নেতা, অথচ মাওবাদীদের তীব্র প্রভাবের সময়েও ডহরেশ্বর সেন বিনা নিরাপত্তায় হাঁটাচলা করতে ভয় পেতেন না!       নিজে আদিবাসী নন। কিন্তু তফশিলি জাতিভুক্ত কিংবা আদিবাসীদের প্রতি বঞ্চনা এবং তাদের অধিকার নিয়ে খাঁটি সংবেদনশীল ডহরেশ্বর সেনকে জঙ্গলমহল থেকে মুজফফর আহমেদ ভবন চেনে ডহর সেন নামে। ১৯৬০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ডহর সেন। চার বছর বাদে পার্টি ভেঙে গেলে সিপিআইএমে যোগ দেন। আদিবাসীদের গ্রামে রাত কাটানো সিপিআইএম নেতা ডহর সেন বিশ্বাস করতেন, মানুষের সঙ্গে তাঁর দলের সম্পর্ক হওয়া উচিত মাছের সঙ্গে জলের সম্পর্কের মতো। মেলামেশাও করতেন বেলপাহাড়ি, জামবনির গরিব মানুষের সঙ্গে সেইভাবেই। মনে করতেন, ব্যক্তিজীবনের কিছু বিলাসিতা অন্তত ত্যাগ করে আদিবাসীদের আনন্দ, উৎসব, দুঃখ, যন্ত্রণায় শরিক হয়েই গরিব মানুষগুলোর হৃদয় জয় করা সম্ভব। কিন্তু গরিব প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ গড়ে তোলা ডহর সেন কালক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন নিজের দল থেকেই। কারণ, ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রভাবশালী সিপিআইএম নেতারা বুঝে নিয়েছিলেন, সংসদীয় রাজনীতিতে সাফল্যের ফর্মুলা শুধুমাত্র গরিব মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে লুকিয়ে নেই। বরং পেশি শক্তির সফল প্রয়োগ করতে পারলে চূড়ান্ত আধিপত্য বিস্তারে সময় ব্যয় করতে হয় কম এবং সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কম বিনিয়োগে বেশি রিটার্ন। ডহরেশ্বর সেনকে অবিভক্ত মেদিনীপুরের নেতা এবং সিপিআইএমের প্রভাবশালী জেলা সম্পাদক দীপক সরকার খুব একটা পছন্দ করতেন না। কারণ, ডহর সেন নিজের দলের কাজকর্মের সমালোচনা করতেন মাঝে-মধ্যে। ঝাড়খন্ডিদের হয়ে কথা বলতেন অনেক সময়। আর এর পুরস্কার হিসেবে পার্টি নেতৃত্বের কাছ থেকে ‘দল বিরোধী’ এবং ‘নকশাল’ তকমাও জুটেছিল তাঁর।       ২০১৫ সালের একদম শেষে ডহর সেনের সঙ্গে দেখা করলাম। কলকাতায় কিড স্ট্রিটে এমএলএ হস্টেলে। ডাক্তার দেখাতে কলকাতায় এসেছিলেন ঝাড়গ্রাম থেকে। এমএলএ হস্টেলে এক সিপিআইএম বিধায়কের ঘরে ছিলেন। কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের আমার দ্বিতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সিপিআইএম নেতা ডহরেশ্বর সেন।    ‘আপনি জানেন, সুভাষচন্দ্র বসুকে ঝাড়গ্রাম শহরে মিটিং করতে দেয়নি সেখানকার মল্লদেব রাজারা। আসলে ঝাড়গ্রামের রাজ পরিবার বরাবরই ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে। ঝাড়গ্রাম শহরে একবার মিটিং করবেন ঠিক করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু মল্লদেব রাজ পরিবারের আপত্তিতে বাধ্য হয়ে শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে দহিজুড়িতে সুভাষ বসুকে মিটিং করতে হয়েছিল। ঝাড়গ্রামে আদিবাসীদের অধিকাংশই ছিল রাজপরিবারের পাশে। নির্বিবাদী, শান্ত প্রকৃতির আদিবাসীদের কাছে তখন শাসক বলতে রাজ পরিবার। তারা ভাবতেই পারত না রাজার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। তাছাড়া আদিবাসীদের চাহিদাও এত কম, তারা লড়াই করবেই বা কেন?’ কথা শুরু করলেন সিপিআইএম নেতা ডহরেশ্বর সেন।   সত্যিই তো, যে নির্লোভ মানুষগুলোর কোনও দাবিদাওয়া ছিল না বাকি দুনিয়ার কাছে, নিজের সমাজের গণ্ডিতে আবদ্ধ যে পরিবারগুলো সামান্যেই খুশি হয়ে কাটিয়ে দিত তাদের সহজ এবং স্বল্প জীবন, তারাই কেন অস্ত্র ধরল হঠাৎ করে? কোন মন্ত্রে সিপিআইএম পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে আটের দশকে শুরু করল এমন জান কবুল লড়াই? এই শান্তিপ্রিয় আদিবাসী এলাকা কেনই বা একুশ শতকের গোড়ায় হয়ে উঠল সশস্ত্র মাওবাদী রাজনীতি অনুশীলনের এক পরীক্ষাগার? এ তো কার্যত, কিন্তু কার্যত কেন, এ তো যথার্থই নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। অথচ, ‘এই মানুষগুলোই রাজার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেও লড়াই করেনি তেমন,’ কানে বাজছে ডহরেশ্বর সেনের কথা। তিনি তো কারও থেকেই কম চেনেন না অবিভক্ত মেদিনীপুরের এই রুক্ষ এলাকার গরিব তফশিলি জাতি এবং আদিবাসী পরিবারগুলোর দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী। এবং ২০০৩ এর পঞ্চায়েত ভোটের সন্ধ্যায় জামবনির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতা এবং লোকাল কমিটির সম্পাদক বাসুদেব ভকতের খুন থেকে ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে কিষেণজির মৃত্যু, এই যে হত্যা এবং পাল্টা হত্যার অন্ধকার চোরাগলিতে প্রবেশ সিপিআইএম, ঝাড়খন্ড পার্টি এবং পুলিশের, তার তো যথার্থ কারণ থাকবে একটা। ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষটাই আলটিমেটলি কনভার্ট করে গেল মাওবাদীদের সঙ্গে সিপিআইএমের রক্তক্ষয়ী খুনোখুনিতে। কিন্তু ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষের শুরু হল কীভাবে এবং কেন? কবে থেকেই বা শুরু হল ঝাড়গ্রাম মহকুমায় এই সিপিআইএম-ঝাড়খন্ডি লড়াই, এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে ২০১৫ সালের শেষে আমি ডহর সেনের মুখোমুখি।   এবার আমাদের যেতে হবে অনেকটা পিছিয়ে। যাকে বলে কিনা ফ্ল্যাশব্যাকে। ১৯৬৫ সাল, দেশে এবং রাজ্যে কংগ্রেস সরকার। যদিও দু’জায়গাতেই কংগ্রেসের প্রভাব এবং দাপট কমতে শুরু করার সন্ধিক্ষণ তখন। সেই সময় কৈশোর কাটিয়ে সদ্য যুবক ডহরেশ্বর সেন।                     ‘আমি প্রথম ঝাড়গ্রামে গেলাম ১৯৬৫ সালে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। সেই সময় থাকতাম খড়গপুরে। ‘৬৫ সালের যুদ্ধ শুরু হতেই সিপিআইএম নেতাদের গ্রেফতার করা শুরু হল। অনেকেই আত্মগোপন করলেন। আমি তখন পুরোদমে পার্টি করছি। আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হই ১৯৬০ সালে। চার বছর বাদে পার্টি ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিপিআইএমে যোগ দিলাম। ’৬৫ তে যুদ্ধ শুরু হতেই আমাদের নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হল। পার্টি বলল, আত্মগোপন করতে। কোনওভাবে গ্রেফতার হওয়া যাবে না। অনেক ভেবে কিছুদিন বাদে চলে গেলাম ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রামের বিটি কলেজে ফ্রেশার হিসেবে ভর্তির জন্য আবেদন করে দিলাম। ভর্তি হয়েও গেলাম। থাকতে শুরু করলাম কলেজ হস্টেলে। মনে হয়েছিল, ওটাই সেই সময় আত্মগোপনের সবচেয়ে ভাল ঠিকানা। ছাত্র সেজে থাকলে কেউ সন্দেহও করবে না। এভাবেই চলছিল কয়েক মাস। কোনও ঝামেলা ছিল না। কলেজে কেউ জানতও না আমার রাজনৈতিক পরিচয়। কয়েক মাস কেটে গিয়েছে নিশ্চিন্তে। ঝাড়গ্রাম কলেজ হস্টেলে থাকছি আর ক্লাস করছি। ১৯৬৬ সালে শুরুর দিকে, একদিন সন্ধেবেলা হস্টেলে বসে আছি। সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে, হঠাৎ একজন এসে খবর দিল, হস্টেলের বাইরে প্রচুর পুলিশ। অধ্যক্ষ আমাকে অফিসে ডাকছেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, ধরা পড়ে গিয়েছি। আর লুকিয়ে থাকা যাবে না। পালানোরও কোনও পথ নেই। পুলিশ হস্টেল ঘিরে ফেলেছে। গেলাম অধ্যক্ষের অফিসে। স্যার বসে আছেন। সঙ্গে একজন কম বয়সী পুলিশ অফিসার। আমার থেকে বয়সে একটু বড় হবেন, কিংবা একও হতে পারেন। ঘরে আর কেউ নেই।অধ্যক্ষ বললেন, ‘‘তোমার বিরুদ্ধে দেশ বিরোধিতার অভিযোগ রয়েছে। তুমি খড়গপুর কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলে? তুমি কি পার্টি মেম্বার?’’চুপচাপ দাঁড়িয়ে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম।এরপর অধ্যক্ষ আমাকে দেখিয়ে ওই পুলিশ অফিসারকে বললেন, ‘‘ও তো ভালো ছেলে। আগে কী করত জানি না। কিন্তু এখানে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে।’’ তারপর আমাকে বললেন, ‘‘পুলিশ তোমাকে গ্রেফতার করতে এসেছে। উনি ঝাড়গ্রামের নতুন এসডিপিও। ফোর্স বাইরে রেখে একাই কলেজের ভেতরে ঢুকেছেন। তোমার বিরুদ্ধে তো এই সব দেশ বিরোধী কাজকর্মের অভিযোগ! আমি আর কী করব?’’আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। একবার স্যারের দিকে, তো একবার ওই আমারই বয়সী পুলিশ অফিসারের দিকে তাকাচ্ছি। অ্যারেস্ট হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। আমার বলারও নেই কিছু। আমি তখন সিপিআইএম সদস্য। সেই পরিচয় গোপন করে কলেজে পড়ছি। ঘরে কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপ। স্যার থামার পর ওই অফিসারও কিছু বলছেন না। কিছু ভাবছেন, আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন। ‘‘ঠিক আছে। তোমাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ আছে, কিন্তু আমি তা করছি না। রিপোর্টে লিখে দেব, ডহরেশ্বর সেনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু দিনেরবেলা এই এলাকায় সাদা পোশাকে পুলিশ ঘোরাফেরা করে। সেই সময় কলেজের বাইরে একদম বেরোবে না। যতটা সম্ভব হস্টেলেই থাকবে। সাদা পোশাকের পুলিশ একবার ধরলে আমার আর কিছু করার থাকবে না। ’’আমাকে, অধ্যক্ষ স্যরকে অবাক করে বললেন পুলিশ অফিসার। এমন অফিসারও হয়? স্যরের কাছে অনুমতি নিয়ে হস্টেলে ফিরলাম। তারপর থেকে আর হস্টেলের বাইরে বেরোতাম না বিশেষ। আরও এক বছর কেটে গেল। ১৯৬৭ সালে তৈরি হল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। গ্রেফতারের আশঙ্কা কেটে গেল। ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে ঝাড়গ্রামে তীব্র আন্দোলন শুরু করল সিপিআইএম। গোটা রাজ্যে সিপিআইএম তখন জোতদারদের বিরুদ্ধে হিসেব বহির্ভুত জমি, বেনামি জমি উদ্ধারের ডাক দিয়েছে। এই জমির আন্দোলনে উত্তাল হতে শুরু করেছে ঝাড়গ্রামও। হরেকৃষ্ণ কোঙার ঝাড়গ্রামে এলেন। ডাক দিলেন জোতদারদের জমি দখলের।’‘ছয়ের দশকে ঝাড়গ্রামে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিশ্চই খুব খারাপ ছিল। এখানে তেমন জমি ছিল মানুষের হাতে?’ আমার মাথায় ঘুরছে রামজীবনের কথা, তার বাবা-মা মহাদেব আর শান্তি মুর্মুর কথা। ডহর সেন যে সময়ের কথা বলছেন, তখন মা মরা রামজীবনের বয়স বছর সাতেক। ‘ঝাড়গ্রাম, বিনপুরে জনসংখ্যার মধ্যে তফশিলি, জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি ৮০ শতাংশের বেশি। তার মধ্যে ৯৯ শতাংশ মানুষ ছিল অত্যন্ত গরিব। তিন বেলা তো দূরের কথা, অধিকাংশ বাড়িতেই দুবেলা খাবার থাকত না। বেশিরভাগ পরিবার বছরে ছ’মাস একবেলা ভাত খেতে পেত। আদিবাসীদের মধ্যে কয়েক জনই মাত্র ছিল ল্যান্ড লর্ড। তারা হাতে গোনা দু’তিন জন। বড় ল্যান্ড লর্ড ছিল শ্যাম হেমব্রম এবং তাঁর ছেলে নিত্যানন্দ হেমব্রম। তাদের বাড়ি বেলপাহাড়ি ব্লকের শ্যামপুরে। আর এক জন বড় ল্যান্ড লর্ড ছিল শ্যাম মুর্মু। এই দুই পরিবারের হাতেই ছিল অনেক জমি। আর ছিলেন রাজা ধীরেন্দ্র বিজয় মল্লদেব। ঝাড়গ্রামে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক। ৯৯ শতাংশের বেশি আদিবাসীর হাতে এক আনা জমিও ছিল না। সিপিআইএমের জমি আন্দোলন এবং হরেকৃষ্ণ কোঙারের ঝাড়গ্রাম সফরে ভয় পেয়ে গেল এখানকার জোতদাররা। জমি হাতছাড়া হওয়ার ভয়। তারা বুঝে গেল, কোনও একটা উপায় বের করতে না পারলে গরিব আদিবাসীদের সামনে রেখে জমি দখল করে নেবে সিপিআইএম। ঝাড়গ্রামে তখন অদ্ভুত পরিস্থিতি। একদিকে, কংগ্রেস মদতপুষ্ট কয়েকজন জোতদার, যার নেতৃত্বে এখানকার রাজ পরিবার। তাদের সঙ্গে প্রশাসনের একটা বড় অংশ। অন্যদিকে, সিপিআইএম এবং হাজার হাজার গরিব মানুষ। এই অবস্থায় ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে মিটিংয়ে বসল কয়েকজন ল্যান্ড লর্ড। কীভাবে সিপিআইএমের হাত থেকে অতিরিক্ত এবং বেনামি জমি রক্ষা করা যায়। সেই মিটিংয়েই সিপিআইএমের জমি আন্দোলনকে ঠেকানোর এক কৌশল বের করল মল্লদেব পরিবার এবং কয়েকজন জোতদার। আর সেটা হচ্ছে, ঝাড়গ্রামের মানুষকে নিয়ে সিপিআইএম বিরোধী একটা রাজনৈতিক দল গঠন এবং পৃথক রাজ্যের দাবি।  আপনি জানেন তো, ব্রিটিশ আমলে একটা কমিশন তৈরি হয়েছিল। সাইমন কমিশন।  সেটা দুইয়ের দশক। ১৯২৮-২৯ সালে এই সাইমন কমিশনের কাছে ছোটনাগপুর, বাংলা এবং বিহারের একটা অংশ নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করেছিল ঝাড়খন্ড পার্টি। সেই সময় ছোটনাগপুর এলাকার ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা জয়পাল সিংহ। যদিও সাইমন কমিশন কিংবা ব্রিটিশ সরকার এই দাবিকে স্বীকৃতি দেয়নি। স্বাধীনতার পরে ছোটনাগপুর এলাকায় ঝাড়খন্ডিদের আলাদা রাজ্যের দাবি কয়েকবার উঠলেও, এরাজ্যে তার কোনও চর্চা ছিল না। সিপিআইএমের জমি আন্দোলনকে ঠেকাতে ঝাড়খন্ডিদের জাতি সত্ত্বার রাজনীতিকে সামনে আনার কৌশল নিল ঝাড়গ্রামের প্রভাবশালী রাজা এবং কংগ্রেসি পরিবার মল্লদেবরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিল আরও কয়েকজন কংগ্রেসি জোতদার, জমিদার। সেই সময়, মানে ১৯৬৭-৬৮ নাগাদ ছোটনাগপুরের ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা ছিলেন বাবুন সামরাই। ঝাড়গ্রামের মল্লদেবদের প্রত্যক্ষ মদত এবং পরামর্শে শ্যাম হেমব্রম, শ্যাম মুর্মু এবং আরও দু’চারজন ল্যান্ড লর্ড বাবুন সামরাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার কিছুদিনের মধ্যেই এখানে ঝাড়খন্ড পার্টি গঠিত হল। পৃথক ঝাড়খন্ড রাজ্যের যে দাবি, তার সলতে পাকানো শুরু হল এ’রাজ্যে।’ মানে, আপনি বলতে চাইছেন এখানে সিপিআইএমের সঙ্গে ঝাড়খন্ডিদের লড়াই-সংঘর্ষের সূত্রপাত প্রথম যুক্তফ্রন্ট আমলে জোতদারের জমি দখলকে কেন্দ্র করে?‘একেবারেই। তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার। হরেকৃষ্ণ কোঙারের ডাকে বাংলার বিভিন্ন গ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষ জোতদারদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়েছে। গরিব, জমিহীন মানুষের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা তীব্র ক্ষোভকে পুঁজি করে কৃষক সভা তখন বেপরোয়া আন্দোলন শুরু করেছে। কোথাও কোথাও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে জোতদাররাও। গুলি চলছে, আগুন জ্বলছে নানা জায়গায়। সেই সময় ঝাড়গ্রামে সিপিআইএমকে ঠেকাতে কংগ্রেসের মদতে গড়ে ওঠা ঝাড়খন্ড পার্টি স্লোগান তুলল, ‘‘আলাদা রাজ্য চাই।’’             ’ঝাড়খন্ড পার্টি তৈরি হওয়ার পর কংগ্রেস জোট করল ওদের সঙ্গে। আলাদা রাজ্যের দাবি নিয়ে ঝাড়খন্ড পার্টির আন্দোলনে সরাসরি যোগ না দিলেও কংগ্রেস পেছন থেকে ওদের সমর্থন করত। আদিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় দিশম গুরুদের খুব প্রভাব ছিল। দিশম গুরুরাও ফতোয়া দিল আলাদা রাজ্যের জন্য। দিশম গুরুদের এই ফতোয়া ঝাড়গ্রামের বিনপুর এলাকায় আদিবাসী সমাজের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলল। দিশম গুরুদের সামনে এবং কংগ্রেসকে পেছনে রেখে ১৯৭১ সালে নির্বাচনে লড়ল ঝাড়খন্ড পার্টি। এবং জিতেও গেল। ’৭১ সালে বিনপুর আসন থেকে বিধায়ক হলেন জোতদার শ্যাম মুর্মু। সিপিআইএম বিরোধিতাই তখন থেকে হয়ে উঠল ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ঝাড়খন্ড পার্টির মূল রাজনৈতিক স্লোগান। তখনও সেইভাবে সংঘর্ষ শুরু হয়নি, কিন্তু ঝাড়খন্ড পার্টির জোতদার, জমিদার নেতারা বুঝে গিয়েছিলেন, এই সব এলাকায় নিজস্ব জমি রক্ষা করতে গেলে সিপিআইএমের বিরোধিতা করতে হবে। এবং তার জন্য ঝাড়খন্ডিদের মধ্যে আলাদা রাজ্যের দাবি নিয়ে আন্দোলন জিইয়ে রাখতে হবে। এটাও মনে রাখা দরকার, সেই সময় নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। তার প্রভাবে মেদিনীপুর জেলার ডেবরা এবং গোপীবল্লভপুরেও জোতদার, জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে নকশালরা। কিন্তু সেই সময় ঝাড়গ্রাম, বিনপুরে নকশালদের কোনও প্রভাব ছিল না। ঝাড়গ্রাম, বিনপুরে শক্তিশালী ছিল সিপিআইএম। সব মিলে এই যে জোতদার, জমিদারদের হাজার-হাজার বিঘা জমি দখলের লড়াই শুরু হচ্ছে তখন সেটারই বিরুদ্ধে একজোট হল কংগ্রেস এবং ঝাড়খন্ড পার্টি। এই জোতদার-জমিদার পরিবারগুলো ঐতিহাসিকভাবেই কংগ্রেস করত। কিন্তু ঝাড়গ্রাম, বিনপুর, জামবনিতে এই জোতদার, জমিদারদের সঙ্গে তফশিলি জাতি এবং আদিবাসীদের মিলমিশটা ভাল হয়েছিল। কারণ, এই সব জায়গায় বড় জমির মালিকরাও ছিল আদিবাসী। ফলে আলাদা রাজ্যের দাবির আন্দোলনে ঝাড়গ্রাম, বিনপুর, জামবনির জমিদার শ্রেণি এবং দরিদ্র আদিবাসী জাতিগত, ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত কারণেই এক হয়ে যায়।  ‘তার মানে, ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের যে সংঘর্ষ, খুনোখুনি, তার প্রেক্ষাপট শুধুমাত্র কোনও রাজনৈতিক লড়াই ছিল না? কিংবা ছিল না কোনও শ্রেণি সংগ্রাম? প্রাথমিকভাবে এটা ছিল, জমিদার, জোতদারদের বেনামি জমি অবলুপ্তি এবং অপারেশন বর্গা কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে আপনাদের যে উদ্যোগ তার বিরোধিতা করা?’ প্রশ্ন করলাম ডহর সেনকে।‘দেখুন এর সূত্রপাত একেবারেই তাই। পরে যে আমাদের দল কোনও পর্যায়ে বাড়বাড়ি করেনি তা নয়। কিন্তু তা অনেক পরের কথা। একদম শুরুতে ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে আমাদের লড়াইটা ছিল জমি নিয়ে। রাজনৈতিক জমি নয়, জোতদার এবং রাজার জমি।’   এর মধ্যেই ১৯৭২ সালে রাজ্যে তৈরি হল কংগ্রেস সরকার। পুরো রাজ্যেই জমি আন্দোলন থমকে গেল। এই সুযোগে ঝাড়গ্রামের বিনপুর, বেলপাহাড়ি এলাকায় নিজেদের প্রভাব অনেকটাই বাড়িয়ে ফেলল ঝাড়খন্ড পার্টি। জমিদার, জোতদার কংগ্রেসি পরিবারগুলো আবার শক্তিবৃদ্ধি করল। পুলিশ এবং প্রশাসন যুক্তফ্রন্ট আমলেও কংগ্রেসি এবং জোতদারদের যথেষ্ট মদত করত। আর ’৭২ সালে কংগ্রেস সরকার গঠনের পর তো আর কোনও কথাই নেই। কংগ্রেসি, জোতদার, ঝাড়খন্ডি সব এক ছিলই। পুরো প্রশাসনই ওদের পাশে দাঁড়াল। আর পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে জাতি সত্ত্বার ব্যাপারটা ছিলই গরিব আদিবাসীদের মধ্যে। যেহেতু আমরা পৃথক রাজ্যের বিরোধিতা করেছিলাম কংগ্রেসি এবং ঝাড়খন্ডিদের প্রতি আদিবাসীদের সমর্থন দ্রুত বাড়তে শুরু করে এই সময়। সিপিআইএমের প্রকাশ্য কর্মসূচি তখন অনেকটাই কমে যায়।   ১৯৭৭ সালে ফের রাজ্যে নির্বাচন। প্রথমে লোকসভা, তারপর বিধানসভা। কংগ্রেসের অবস্থা তখন পুরো দেশেই খুব খারাপ। আর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যাওয়ার পর এরাজ্যে ওদের অবস্থা আরও খারাপ হল। ঝাড়গ্রামও তার বাইরে ছিল না। প্রকাশ্যে না হলেও তলায় তলায় আমাদেরও রাজনৈতিক কর্মসূচি চলছিল। ঝাড়গ্রাম মহকুমায় চারটে বিধানসভা আসনের মধ্যে তিনটেই জিতলাম আমরা। বিনপুর, ঝাড়গ্রাম এবং নয়াগ্রাম। গোপীবল্লভপুর আসনে জিতলেন নকশাল নেতা সন্তোষ রাণা। দশ বছর আগে শুরু হওয়া জমি আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব পড়ল সেই নির্বাচনে। ঝাড়গ্রাম মহকুমার চারটে আসনেই সাফ হয়ে গেল কংগ্রেস।  ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের পর ব্যাপকভাবে অপারেশন বর্গার কাজ শুরু হল ঝাড়গ্রামে। ফের সিপিআইএমের নেতৃত্বে শুরু হল বেআইনি জমি উদ্ধারের আন্দোলন, জোতদার প্রথার অবসান। এতেই ভয় পেয়ে গেল গোটা এলাকার জোতদার, জমিদাররা। এবং মূলত তাদেরই মদতে ঝাড়খন্ডিদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবি ফের সামনে নিয়ে এল কংগ্রেস। অবশ্য, একটা বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, এই পৃথক রাজ্যের দাবির মধ্যে আদিবাসীদের জাতিসত্ত্বা এবং আবেগ ছিল পুরো মাত্রায়।  ঝাড়খন্ডিদের জন্য আলাদা রাজ্য গঠন হলেই আদিবাসীদের নিজের ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি সুরক্ষিত থাকবে, এই দাবি উঠে গেল ঝাড়গ্রাম মহকুমাজুড়ে। এই এলাকার পুরনো নকশালরাও পৃথক রাজ্যের দাবিকে সমর্থন জানালেন। আর সঙ্গে কংগ্রেসের জমিদারদের সমর্থন তো ছিলই। এই রকম এক পরিস্থিতিতে ঝাড়গ্রাম মহকুমায় মোট আটটার মধ্যে ছ’টা ব্লকে অপারেশন বর্গার কাজ ঠিকঠাক এগোচ্ছিল, কিন্তু ধাক্কা খেল দুটো ব্লকে। বেলপাহাড়ি এবং বিনপুর, এই দুই ব্লকে অপারেশন বর্গার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলল ঝাড়খন্ড পার্টি। বাধা এল। এই দুই ব্লকে অপারেশন বর্গা কর্মসূচি একেবারেই সফল করা যায়নি। অন্যদিকে, গোপীবল্লভপুর ১ এবং ২, ঝাড়গ্রাম, জামবনি, সাঁকরাইল এবং নয়াগ্রাম ব্লকে জমি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। অপারেশন বর্গা অনেকটাই সফল হয়। কিন্তু বেলপাহাড়ি এবং বিনপুরে গ্রামে গ্রামে সিপিআইএমকে ঢুকতে বাধা দিতে শুরু করে ঝাড়খন্ডিরা। আটের দশকের শুরু থেকেই এই অপারেশন বর্গাকে কেন্দ্র করে ঝাড়খন্ড পার্টি এবং কংগ্রেসের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সিপিআইএমের লড়াই, সংঘর্ষ শুরু হল। তীব্র সংঘর্ষ। খুনোখুনি। জমি নিয়ে লড়াই। শেষমেশ এই লড়াইটাই রাজনৈতিক এলাকা দখলের লড়াইতে টার্ন করল। যা আর কোনও দিনই থামানো যায়নি। ১৯৯১ সালে ঝাড়খন্ড পার্টির নরেন হাঁসদা এমএলএ হলেন। এরপরেই সংঘর্ষ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। নরেন হাঁসদা এমএলএ হওয়ার পর সিপিআইএমের কাছে শুরু হয়ে গেল রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধারের লড়াই।’ টানা বলে থামলেন ডহর সেন। ডহর সেন যেভাবে কথা বলেন, সামনে বসে কেউ শুনলে তাঁর মনে হবে, সিনেমা দেখছেন। কঠিন, জটিল রাজনৈতিক ওঠা-পড়া সহজ সরলভাবে হাজির করার মুন্সিয়ানা আছে তাঁর। হয়তো আদিবাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করে এই বিশেষ দক্ষতা আয়ত্ত্ব করেছিলেন তিনি। আর এই সহজ-সরল থাকা, আদিবাসীদের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তোলাই শেষমেশ রাজনৈতিক জীবনে কাল হল ডহর সেনের। ’৭৭ সালে সিপিআইএম সরকার গঠনের পর ঝাড়গ্রাম মহকুমায় পার্টির একাধিক কাজকর্ম এবং তা করার পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে দলের নেতৃত্বের একটা অংশের সঙ্গে বিতর্ক বাধল ডহর সেনের। অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত ডহর সেন বারবারই দলের মধ্যে বলতেন, ‘ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থক আদিবাসীরাও সিপিআইএম সমর্থক আদিবাসীদের মতোই গরিব। গরিব মানুষের একতাকে জাতি সত্ত্বার রাজনীতি দিয়ে ভাঙা যেতে পারে, কিন্তু মারপিট করে, সংঘর্ষ করে তাকে জোড়া লাগানো যাবে না।’ তাছাড়া তখন সরকার হয়ে গেছে কয়েক বছর। সিপিআইএম আর রাজ্যে বিরোধী দল নেই। সে তখন শাসক। বিরোধীরা অনেক কিছুই করতে পারে, ভুল-ত্রুটিও করতে পারে দু’পাঁচটা। কারণ, বিরোধী দলের শাসকের মতো দায়িত্বশীল হওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকে না। কিন্তু সরকার যদি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে তবে তো অরাজকতা সৃষ্টি হয়। আর তাই হল ঝাড়গ্রামের বিনপুর, বেলপাহাড়ি, জামবনি ব্লকে। ১৯৭৭ সালের পর সরকার বিরোধী ঝাড়খন্ড পার্টি যখন আরও ঐক্যবদ্ধ বেপরোয়া লড়াইয়ে শপথ নিচ্ছে, তখন তার মোকাবিলায় সিপিআইএমের প্রয়োজন ছিল যথার্থ শাসকের ভূমিকা পালন করার। গরিব আদিবাসীদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করার বদলে হাতে অস্ত্র নিয়ে পালটা নেমে পড়ল শাসক দল সিপিআইএমও। শাসক দলই যখন অস্ত্র হাতে বিরোধীর মোকাবিলায় নেমে পড়ে, আর যদি তার পাশে এসে দাঁড়ায় প্রশাসন, মানে পুলিশ, তবে যা হয়, তাকেই এক কথায় বলে আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ঝাড়গ্রাম মহকুমা। একদিকে ঝাড়খন্ড পার্টি। তার পেছনে কংগ্রেস। সঙ্গে পুরনো নকশালপন্থীদের প্রত্যক্ষ সমর্থন। অন্যদিকে, সিপিআইএম। তার সামনে পুলিশ। ছ’য়ের দশকের শেষে যে লড়াই শুরু হয়েছিল জমি রক্ষার এবং দখলের, তাই ১৯৭৭ সালে রাজ্যে সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের কয়েক বছরের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক লড়াইয়ে কনভার্ট করে গেল। প্রথমে জমির লড়াই, তারপর রাজনৈতিক লড়াই, আর এই দুইয়ের যোগফলে শুরু হল হিংসার রাজনীতি। হত্যা-পাল্টা হত্যা। আর শাসক দল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে এমন এক রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটেরই হয়তো অপেক্ষায় ছিল মাওবাদীরা। সঠিকভাবে বললে, এমসিসি। মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার। তখনও মাওবাদী পার্টি তৈরি হয়নি। ঝাড়খন্ডিদের হাত ধরে এবং তাদের মধ্যে সিপিআইএম বিরোধী সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে গরিব আদিবাসীর অধিকার লড়াইয়ে নামল এমসিসি। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে লড়াই শুরু হল বাম এবং অতি বাম শক্তির মধ্যে। যে লড়াইয়ের এপিসেন্টার বেলপাহাড়ি, বিনপুর, জামবনির কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকার শাল, অর্জুনের জঙ্গলমহল। তখন নয়ের দশক শুরু হয়ে গেছে। উদার অর্থনীতির ঢাকে কাঠি পড়েছে নয়া দিল্লিতে। অযোধ্যায় ধুলিষ্যাৎ হয়েছে বাবরি মসজিদ। দেশজুড়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় নানান সমীকরণ গড়ে ওঠার সময় সেটা। যে সমীকরণগুলোও কয়েক বছরের মধ্যেই প্রভাব ফেলতে শুরু করল ঝাড়গ্রামের রাজনীতিতেও।      ক্রমশ...।
    দোলজ‍্যোৎস্নায় শুশুনিয়া‌য় - ৬ - সমরেশ মুখার্জী | বিবর্তনের ধারাসুমন বলে, "ধরতাইটা ভালো‌ দিলি। স্বীকার করছি যা আলোচনা করতে যাবো তা নিয়ে আমার একটু সংকোচ ছিল কিন্তু তোদের কথায় তা কেটে গেল। তবে আমি হয়তো তোর মতো অতো গুছিয়ে বলতে পারবো না, আমার পড়াশোনা‌র গণ্ডী‌ সীমিত। তবু চেষ্টা করছি আমি যেভাবে ভাবি - বলতে। "দ‍্যাখ এটা‌ স্বীকৃত সত‍্য যে বর্তমান মানুষ আদিমানবের রূপান্তরিত রূপ। সেই আদিমানব ছিল  প্রাইমেটসদের সমগোত্রীয়। ওরাংওটাং এবং শিম্পাঞ্জি‌ তাই বর্তমান মানুষের পূর্বপুরুষের নিকটতম প্রতিনিধি হিসেবে গণ‍্য হয়। ট্রেনিং দিলে এরা মানুষের হাবভাব অনেকটা অনুকরণ করতে পারে। তবে আদিমানব ছিল পশুর‌ই মতন। চার হাত পায়ে চলতো, কাঁচা মাংস, ফলমূল খেত। একদিন সে পেছনের দুপায়ে দাঁড়াতে শিখল। সামনের দুটো হাত শরীরের ভারবহন থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সৃজনশীল যন্ত্রে রূপান্তরিত হলো। তা আবিস্কার করলো আগুন, চাকা, লোহার ব‍্যবহার। এই তিনটি যুগান্তকারী আবিস্কার তাকে আর ফিরে তাকাতে দিল না। কয়েক কোটি বছরের বিবর্তনের পরে আজ‌‌‌ও গরু হাম্বা হাম্বা বা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলেছে কিন্তু মাত্র এক কোটি বছরের মধ‍্যে মানুষের অবিশ্বাস্য রূপান্তর হোলো। ফলে মানুষ যে কেবল পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকুল থেকে আলাদা হয়ে গেল তাই নয় তাদের ওপর কায়েম করলো নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রন‌। এতো অল্প সময়ে এহেন উত্তরণ কী ভাবে সম্ভব হোলো? বিবর্তনবাদে এই মিসিং লিঙ্ক বিশেষজ্ঞ‌দের গবেষণার বিষয়, তা আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে।"সুমন একটু থামে। এখন জোৎস্না উজ্জ্বল। তিনজন গভীর অভিনিবেশে তাকিয়ে আছে সুমনের দিকে। সুমন বলে চলে, "আদিমানবের আদিতেও ছিল কয়েক কোটি বছরের ক্রমবিবর্তনের ধারা। ফলে পশুসমাজের নানান প্রবৃত্তি‌গত বৈশিষ্ট্য‌ আদিমানবের মধ‍্যে‌ও সঞ্চারিত হয়েছিল। বহু কোটি বছরের সঞ্চিত প্রবৃত্তি‌গত বৈশিষ্ট্য বা instictive characteristics মাত্র এক কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে বিশেষ পরিবর্তিত হ‌ওয়া সম্ভব নয়। ফলে পশুসূলভ নানা প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত মানুষের মধ‍্যে‌ও সুপ্ত‌ ভাবে রয়ে গেল।""তবে বুদ্ধি ও যুক্তিবোধের বিকাশের ফলে মানুষ বুঝতে শিখলো  সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষ কেবল প্রবৃত্তি‌গত তাড়নায় পশুর মতো আচরণ করতে পারে না। তৈরী হোলো আইন কানুন, বিধি-নিষেধ, প্রথা, লোকাচার। ঘোষিত হোলো সমাজে গ্ৰহণযোগ‍্য আচরণের প্রেক্ষিতে বিচ‍্যূতির শাস্তি। ফলে সংখ‍্যাগরিষ্ঠ মানুষ সচেতন‌ বিবেচনাবোধ ও সংযমী অভ‍্যাসে সমাজস্বীকৃত আচরণ করতে শিখলো। তাই ক্ষিধে পেলে ভিক্ষা চাওয়া যেতে পারে কিন্তু কেড়ে খাওয়া উচিত নয়। তবে অবচেতন মনে রয়ে যাওয়া অবদমিত প্রবৃত্তি‌গত বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে কিছু আচরণ কখনো সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণে‌র বাইরে চলে যায়। আর তখনই হয় সমস‍্যা। কখনো তা বাহ‍্যিক‌ভাবে শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় প্রকাশিত হয়। কখোনো তা চিন্তা ভাবনাকে প্রভাবিত করে।"প্রবৃত্তি ও প্রবণতা চুনি বলে, "বাব্বা, জেঠু! লোহা, সিমেন্ট, বালি ঘাঁটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে‌ তু‌ই‌ও তো দেখছি ঈশুর মতো‌ গুছিয়ে কথা বলছিস! বিবর্তনের ফলে ক্রমশ তথাকথিত অর্থে উন্নত হয়েও মানুষের মধ‍্যে কেন কিছু পাশবিক প্রবৃত্তি রয়ে গেছে সেটা তো ভালো‌ই বললি। কিছু  উদাহরণ দিয়ে কী খোলসা করা যায়?"সুমন বলে, "ঠিক বলেছিস। যত‌ই আমরা তাত্ত্বিক আলোচনা করি না কেন, উদাহরণ তা বুঝতে সাহায্য করে। যেমন ধর প্রাণীদের মধ‍্যে লড়াই মূলত হয় প্রজননের জন‍্য সঙ্গিনী নির্বাচন, দলের ওপর আধিপত্য কায়েম এবং  এলাকার  ওপর নিয়ন্ত্রণ‌ রাখতে। মাংসাশী প্রাণীর শিকার করা লড়াই নয় কারণ তা কেবল ক্ষুধা‌র তাড়নায়। এছাড়া গোষ্ঠী‌বদ্ধ প্রাণী - যেমন হাতি বা সিংহ - দল থেকে বিতাড়িত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তেমনি সন্তানের বিপদের আশাঙ্কা‌য় মা পশু‌ও রক্ষণাত্মক কারণে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া পশুরা অহেতুক নিজেদের মধ‍্যে মারামারি, খেয়োখেয়ি করে শক্তি ক্ষয় করে না। একান্ত‌চারী শ্বাপদ, যেমন দুটো পুরুষ বাঘ‌ও যদি আচমকা জঙ্গলে মুখোমুখি হয়ে যায় তাহলে তাদের প্রথম প্রবৃত্তিগত প্রতিক্রিয়া হবে পরস্পর‌কে এড়িয়ে যাওয়া। অর্থাৎ LIVE AND LET LIVE. তবে এই আপ্তবাক‍্য তারা দর্শনশাস্ত্র, গেম থিয়োরী ইত‍্যাদি ঘেঁটে শেখেনি। শিখেছে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায়।" "এবার দেখা যাক বুদ্ধিমান মানুষ কী করে। ভীড় বাসে অজান্তেই পা মাড়িয়ে দেওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাতেও কথা কাটাকাটি থেকে খিস্তি খেউড়, হাতাহাতি হয়ে ব‍্যাপার‌টা হয়তো থানা পুলিশ অবধি গড়িয়ে গেল। তার ফলে হয়তো দুজনেই ভুগলো।" তুলি বলে, "কিন্তু জেঠু, এটা কী বুদ্ধি‌মান মানুষের  পশুর মতো প্রবৃত্তিগত তাড়নায় আচরণের উদাহরণ হিসেবে ঠিক হোলো? তু‌‌ই তো এইমাত্র বললি পশুরা ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি করে না।"সুমন বলে, "তুলি, তুই একটা মোক্ষম ক্লু দিলি। এক্ষেত্রে তুই‌ও একটি প্রবৃত্তি‌গত তাড়না, মানে কৌতূহল, দমন করতে পারিস নি। তাই আমি বক্তব্য শেষ করার আগেই পেশ করলি তোর প্রশ্ন। অবশ‍্য এ তাড়না‌ও দমন করা সহজ নয়।" তুলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, "ওঃ, হ‍্যাঁ, তাই তো। তুই তো সবে একটা উদাহরণ দিয়েছিস মাত্র। তার পশ্চাৎপট, পরিণতি কিছুই ব‍্যাখ‍্যা করিস নি। সরি, সরি, ভুল হয়ে গেছে।"সুমন বলে, "ঠিক আছে। ডোন্ট মাইন্ড। এই উদাহরণ বিশ্লেষণ করলে দেখবি এতে প্রকাশ পাবে কিছু পাশবিক প্রবৃত্তি‌গত আচরণ যা মানুষের মধ‍্যে‌ আজ‌ও সুপ্ত ভাবে রয়ে গেছে। আবার দেখবি এমন কিছু প্রবণতা যা একান্ত‌ভাবে মানুষের‌ মধ‍্যে‌ই দেখা যায়। তা আবার পশুদের মধ‍্যে নেই। এই প্রবণতা‌‌গুলি‌র কিছু ধনাত্মক - যা জ্ঞান, চেতনা, শুভবুদ্ধি‌র উন্মেষে‌র ফলে মানব চরিত্রে বিকশিত হয়েছে। কিছু প্রবণতা আবার ঋণাত্মক - যেগুলি‌ মানুষের নিজের জীবনে বা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব‌ ফেলতে পারে। কখনো আপাতদৃষ্টিতে ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্য‌র প্রভাব‌ও হতে পারে সৃজনশীল‌‌।  ফলে নানা পরিপ্রেক্ষিতে বিবিধ পরিণতি সৃষ্টি‌কারী প্রবণতা‌গুলি যথেষ্ট জটিল, কখনো বিতর্কিত। এগুলো‌কে এক ছাঁচে ফেলা খুব মুশকিল।ঈশু বলে, "এই মাত্র তুই যা বললি তা যেন loud thinking বা আত্মকথনের মতো লাগলো। মানে,  তোর মনে কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে যা তুই নিজের মনেই আওড়াচ্ছিস। একটু জটিল হয়ে যাচ্ছে জেঠু। একটু সহজ ভাবে বল না বাবা"।
  • জনতার খেরোর খাতা...
    ডুডু ও তামাক - Eman Bhasha | ডুডু ও তামাক দুর্নীতি খারাপ। সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ ভয়ঙ্কর। দুর্নীতিকে ব্যবহার করে সরকার পরিবর্তনের ইতিহাসটা অতি বিপদসঙ্কেতবাহী। রুমানিয়ার চেসেস্কু প্রথম উদাহরণ। মিথ্যা বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ। মেরে ফেলা হল বিচারের নামে প্রহসন করে। পরে জানা গেল, অত্যন্ত সৎ আদর্শবান এই কমিউনিস্ট নেতার নিজস্ব কোনো সম্পত্তি নেই। বিচারের সময় আধমরা করে দাঁড় করানো। কোনো উকিল থাকতে দেওয়া হয়নি।একা একা।পিটিয়ে মেরে দাঁড করিয়ে রাখা হয়েছিল ফায়ারিং স্কোয়াডে। পৃথিবীর একমাত্র ঋণহীন দেশ। একজন যৌনকর্মীকে ভাড়া করে কাঁদানো হয়েছিল এক মৃত শিশু কোলে। পরে জানা যায়, অনাথাশ্রমে  ১৫ জন শিশুর মৃতদেহ এনে কুচি কুচি করে কেটে চেসেস্কুর নৃশংসতার প্রমাণ তৈরি করা হয়েছিল।খবরটা এ এফ পি-র। ছেপেছিল কিন্তু বর্তমান। কমিউনিস্ট বিরোধী বর্তমান।রুমানিয়ার পতনের পর একে একে সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশের পতন ঘটে। কিউবা ছাড়া। চেসেস্কু গরবাচ্যভ বা মার্কিন প্রেসিডেন্ট কাউকে পাত্তা দিতেন না।১৯৮৬ থেকে ভারতে রাজীব গান্ধীর বোফর্স দুর্নীতি নিয়ে তুমুল চুমুল আন্দোলন শুরু হল। বাম অতিবাম অতিদক্ষিণপন্থী সব এক সুর।পরে প্রমাণিত, সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ।কিন্তু ফ্যাসিবাদী বিজেপি ২ থেকে ৮৯ আসন পেল। তাঁদের ও সরকারি বামপন্থীদের সহযোগিতায় কেন্দ্রে কংগ্রেস বিরোধী সরকার হলো। কিছুদিন পর সেই সরকার ফেলে দিয়ে বিজেপি হয়ে উঠল সরকারের নিয়ন্তা।এখন তো তাঁরাই প্রায় রাষ্ট্র।২০০৪ এ তাঁদের সরিয়ে দিল মানুষ।মনমোহন সিং সরকার কিছু ভুল সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেক জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেয়।দেশে আর্থিক বিকাশ ঘটে।মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা বাড়ে।গরিব কমে।২০১২ তে নির্ভয়া কাণ্ড ও পরে সংঘ পরিবারের পরিকল্পনায় আন্না হাজারে অরবিন্দ কেজরিওয়াল কিরণ বেদীদের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন।উত্থান হলো গুজরাট গণহত্যার কারিগর  মিথ্যা গুজরাট মডেল দেখিয়ে আম্বানি আদানি রাজ তৈরির মোদি সরকার।তাই ভয় করে, খারাপ তাড়িয়ে ভয়ঙ্করের আবাহনী চলছে না তো!বুঝে বা না বুঝে তাতে ব্যান্ডবাদক হচ্ছি না তো!স্কুল সার্ভিস কমিশনে দুর্নীতি হয়েছে। নিশ্চিত। চাকরি হচ্ছে না, তাও ঠিক।কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন নেই। এমনকী অভিযোগ নেই।রাজ্যে সব মিলিয়ে সরকারি চাকরি ৬ লাখ হবে না।কেন্দ্রীয় সরকার তো সাত লাখ পদ তুলে দিয়েছে। রেলে তুলে দিয়েছে ১৩ লাখ পদ।ব্যাঙ্কে নিয়োগ নাই।ইউ পি এস সি পরীক্ষা ছাড়াই সংঘ পরিবারের লোকেরা বড় বড় পদে যোগ দিচ্ছেন।সেই নিয়ে একটা বাক্য পর্যন্ত নেই।তামুক খাওয়া ভালো।ডুডুও।কিন্তু কে যে আসলে খাচ্ছে ।রুমানিয়া, ১৯৮৯ এবং ২০১৪-র ভারত ভয় পাইয়ে দেয়।এত সহজে নাচতে পারি না তো!পুনশ্চ:স্কুল সার্ভিস কমিশনে দুর্নীতি হয়েছে। নিশ্চিত। কিন্তু ১৯৯৮ এর আগে কী হয়েছে? কীভাবে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হতো? কোন নিয়মে। যতোই যোগ্য হোক, পার্টির চিঠিটা লাগতো।১৯৯৬ এর পর এস এস সি এবং কলেজ সার্ভিস কমিশন ৯৫ ভাগ নিয়োগ সঠিকভাবে করতো। কিন্তু পোস্টিং? পার্টির চিঠি না থাকলে খুব ভালো জায়গায় হতো না।পছন্দের জায়গায় মিলতো নি। ২০০৭-এ প্রথম স্ক্রিনে নিজের পছন্দ স্বচ্ছভাবে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো।SSC তে পোস্টিং দেবার জন্য  কাউন্সেলিং শুরু হয়েছিল ২০০৭ তে।২০১০-এ প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ সঠিকভাবে হয়েছে। পার্টির  তৈরি তালিকায় ছাড়া।তার আগে যতো যোগ্যই হোক পার্টির অনুমোদন লাগতো।বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিয়োগ সবাই জানেন ইন্টারভিউয়ের আগেই ঠিক হতো লোক।একাধিক শক্তিশালী দাবিদার জুটলে, ধান ফাউন্ড স্যুটেবল।যেটা এখন, ওবিসি (এ) তথা মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে।পিএসসি বাম আমলে স্বচ্ছভাবে নিয়োগ করতো।এরা সেই সুনাম নষ্ট করেছেন অনেকটাই।  কোনো পুরসভা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী অফিসার নিয়োগ পার্টির অনুমোদন ছাড়া হতো না। রেগে গেলেও সত্যি। যোগ্যতা থাকলেও সুপারিশ বা অনুমোদন লেগেছে।।মামলা হয়নি কেন?সামাজিক মাধ্যম ছিল না।বললে, ভিটে মাটি চটি উচ্ছেদ।কে করবেন মামলা?সূর্যোদয় সূর্যাস্ত তো নন্দীগ্রাম 'গণ'হত্যার ঘটনা না ঘটলে  এক বিশেষ নিয়মে হতো!প্রার্থী যোগ্য হলেও সুপারিশ লাগতোই।যে দল যে পুরসভায় তারাই সেটা করেছে‌। এটাও পড়তে পারেন:রাজ্য সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন অভিযোগ চলছে। ভালো।কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা নেই কেন?  কেন? রাজ্যের দুর্নীতির প্রতিবাদ হোক, কেন্দ্রীয় সরকারের এভারেস্ট প্রমাণ দুর্নীতি নিয়ে আন্দোলন কবে হবে?পি এম কেয়ার্সরেল নিয়োগইউ পি এস সি ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চ পদে সংঘী ক্যাডার নিয়োগ।একই কাজ করছে ক্ষমতায় থাকা সব রাজ্যে।দেশে চাকরি না থাকা।রেলের পরীক্ষার ফল প্রকাশ না করাবাংলার ছেলে মেয়েদের রেলের চাকরির পরীক্ষায় অন্ধ্রপ্রদেশ বা আরো দূরে আসন ফেলা।ত্রিপুরার ১০৩২৩ শিক্ষকের চাকরি কেড়ে নেওয়া । গুজরাটে স্কুল সার্ভিস কমিশন ছাড়াই সংঘ পরিবারের লোকদের চাকরি দেওয়া। আদানি আম্বানিদের কাছে ব্যাঙ্ক রেল বীমা বিমানবন্দর বেচে দেওয়া।চাকরি হবে কোথায়?সব বেসরকারি ও অটোমেশন হলে?সংখ্যালঘুদের বেনাগরিক করা ও তাঁদের উপাসনালয়গুলো কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। নীরব।দিল্লিতে গণহত্যার পর একদল ছাত্রছাত্রী ত্রাণশিবির খুলেছিলেন। তাঁদের একটা বড় অংশকে জেলে পাঠানো হয়েছে,  নানা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে রাখা হয়েছে।আসামে ১৮ মে এক প্রধান শিক্ষিকা নাকি গোমাংস এনেছেন স্কুলে এই অভিযোগে গতকাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁকে।কথা নেই।আরও একটা পরেশ অঙ্কিতা অধিকারী । ২০ মে ২০২২ লেখা। এখনও প্রাসঙ্গিক তাই দেওয়া। এটাও থাক #ফ্যাসিবাদ প্রধান শত্রুআবারও বলছি।৯০% মমতার বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে। ১০%ও মোদির বিরুদ্ধে নয়।বামপন্থীদের ভোট কাটার ক্ষমতা তৃণমূলের নাই।কাটছে বিজেপি। বা স্বেচ্ছায় অনুগমন করছে।একদল লোক মনে করছে, তৃণমূলকে জব্দ করতে বিজেপিই পারবে।নীচুতলায় বিজেপির সে রকম সংগঠন নাই। কিছু আর এস এস ক্যাডার আর সেবাশ্রম বা মিশনের লোক।কিন্তু ভোটটা করে দিচ্ছে ভোটে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাম বলে পরিচিত নেতা কর্মী।নানা কারণে। জব্দ করবো, পয়সা পাবো, সাম্প্রদায়িকতা, কেন্দ্রীয় দল ইত্যাদি কারণ।আর পোস্টাল ভোটে বিজেপির জয়জয়কার। কেন?সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী শিক্ষকদের বদ্ধমূল ধারণা, বিজেপি এলেই ডিএ সব দিয়ে দেবে।বেকারদের মধ্যে প্রচার, এলেই চাকরি। গ্রামে ধারণা, বাড়ি চাল সব মোদি দিচ্ছে।চীনের সৈন্য বেশি মরেছে।আর বিজেপি এলে দুর্নীতি বন্ধ হবে।অ্যাপ বন্ধ করে চীনের অর্থনীতি ধসিয়ে দিয়েছে।এর বিরুদ্ধে প্রচার কোথায়???আসাম ত্রিপুরার কথা সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী শিক্ষকদের দুর্দশার বলার কেউ নেই।।ডিএ দূরে থাক, সময়ে বেতন হয় না।।ত্রিপুরায় লক ডাউনে আট হাজার, হ্যাঁ আট হাজার শিক্ষক বদলি, অনলাইনে।‌ ক্লাস নেই। ছাত্র ছাত্রীদের চেনেন না। অনলাইনে ক্লাস নেবেন কী করে? আসামে শিক্ষাক্ষেত্রে ৫২ হাজার ছাঁটাই।ত্রিপুরায় ১০ হাজার স্থায়ী শিক্ষক ছাঁটাই।ঝাড়খণ্ডে ৫০ হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে বসিয়ে দিয়েছিল।ত্রিপুরায় বলে দেওয়া হয়েছে আর সরকারি চাকরি হবে না। ৫৫ বছরের বেশি বয়সীদের চাকরি থাকবে না। তালিকা হচ্ছে। ২০১৭ থেকে নিযুক্তদের পেনশন বন্ধ। ফেসবুকে লিখে চাকরি হারিয়েছেন ডাক্তার।গুজরাটে ২০ বছর ধরে শিক্ষক নিয়োগ নেই। সব চুক্তিভিত্তিক। পাঁচ বছরে একবার বেতন বাড়ে। ডিএ নেই। ইনক্রিমেন্ট নেই।আর এস এস ক্যাডার ছাড়া এই অস্থায়ী কাজও মেলে না।উত্তরপ্রদেশে একজন শিক্ষিকার নামে  ২৫ জায়গায় বেতন ওঠে।পরে জানা যাচ্ছে, ওই মহিলার মার্কশিট সার্টিফিকেট ব্যবহার করে এইসব কাণ্ড।আর অনেকে বেতন না পেয়ে আত্মহত্যা করছেন।এগুলো কারও মুখে শুনি না।দুর্নীতি?বিজেপির চেয়ে দুর্নীতিবাজ দল ভূভারতে নেই।।ক্যাগ রিপোর্টে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি।লোকে সারদা নারদা জানে। এসব জানেন?জানায় কেউ?পি এম কেয়ার্স তো একটা।ভেন্টিলেটর জাল।কিন্তু কটা সভা-সমাবেশ হয়েছে শুধু বিজেপির বিরুদ্ধে?নিজেই হিসাব করুন।অন্যদিকে সরকারি তৃণমূলের কিছু লোক তলে তলে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।ঠিক সময়ে পাল্টি খাবে।এখন ক্ষীর দুধ ননী খাচ্ছে। তোলা তুলছে। দুর্নীতি করে চলেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেও থামার লক্ষণ নাই।#দেখেশুনে ভয় লাগে।কাদের ডেকে আনছে-- এই বাংলায়।অনেকে মিলে।2020 এর জুলাইয়ের পোস্ট।এখনও প্রাসঙ্গিক@gaur kumar kar লিখেছেন এতদিনে একটু শান্তি পেলাম। আমার স্ত্রীর নাম ছিলো ( তখনো বিয়ে হয়নি, পরে শোনা)  কলেজসার্ভিস কমিশনের প্যানেলে, বেশ ওপরের দিকে, নেট এর পর। কয়েকটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেবার পর (অন্যান্য বিষয়ের) হঠাৎ কার ইচ্ছেয় জানা যায়নি, কোনো কেসটেসও হয়নি, পুরো প্যানেল বাতিল হয়ে গেল। মাসকয়েক পর যে পয়ানেল বেরোলো সেখানে ওর নাম নেই। ওর মতো বেশ কজনের। ১৯৯৩ নাগাদ গল্প। মফস্সলের কিছু মেয়ের সে সময় লড়ার ক্ষমতা ছিল না, তাই আর কিছু হয়ওনি। ছিলোনা সোশ্যাল মিডিয়া।৯৯ সাল নাগাদ দেখলাম, কি জানি কিসের জোরে, কিছু সহকর্মী যারা পরে পোস্টগ্রাজুয়েট করেছে, তারা আগে আরএমও থেকে এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হয়ে গেল। তখন ডিএমইকে একটা নরমগরম চিঠি দিয়েছিলাম  বঞ্চিত কয়েকজন। তাতে কাজ হল। যদিও চাকরীতে সিনিয়রিটিওয়াইজ পিছিয়ে গেছিলাম প্রায় নয় মাস!আর পোস্টিং? শাসকদলের শাখা ডাক্তারের সংগঠনের মাথায় বা গলায় যাঁরা থাকতেন...@nabarun Ghoshal লিখেছেনএই প্রথম একজনকে পেলাম, যিনি কমরেড চাউসেস্কু সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানেন। এই মহান নেতাকে আমেরিকানরা কদর্যভাবে চরিত্রহনন করে হত্যা করে। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী "ইন্টারন্যাশনাল" গেয়ে জীবন শেষ করেন। ❤️
    তন্দ্রাবিলাসিনীর পুস্তবালোকন - Pradhanna Mitra |        ২৫ শে বৈশাখের যত নিকটবর্তী হই, আমি নিজের অজান্তেই বড্ডো বেশি করে রবীন্দ্রঘেষা হয়ে যাই। এ যেন খানিকটা উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীর সূর্যের পরিভ্রমণ করার মতো। সারা বছরই রবীন্দ্রসূর্যের আলো মেখে থাকি বটে, তবে এই সময়টা যেন সূর্যালোকের আলোর অনেকখানি কাছে চলে আসা।       এইসময় হাতের কাছে যা পাই চোখ বোলাতে থাকি। তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখা হোক, কিম্বা তাকে নিয়ে লেখা হোক, কিম্বা তার জীবনী, কিম্বা তাকে দেখেছেন এমন কোন লেখক-লেখিকার স্মৃতিচারণ, কিম্বা তার প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন নিয়েও লেখা হাতের কাছে এলে পড়ে ফেলি, কিম্বা চোখ বোলাই।       সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজদাদা, তস্য পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তস্য পুত্র সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তস্য পুত্র সুপ্রিয় ঠাকুর। জন্ম ১৯৩৮–এ। ফলে তার কাছে কোন সরাসরি রবীন্দ্রস্মৃতি নেই। আছে অনেকখানি শান্তিনিকেতন স্মৃতি। জীবনের একটা বড়ো অংশ কাটিয়েছেন শান্তিনিকেতনে। এমনকি শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের অধ্যক্ষও ছিলেন। পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী কর্মসমিতি এবং ট্রাস্ট ডিভের সদস্য।        বিদ্বান ব্যক্তি। লিখেছেন ছেলেবেলার শান্তিনিকেতনকে নিয়ে। ১৪৪ পাতার বই। বিশ্বভারতীর বিখ্যাত ছাপাখানা থেকে বের হলে কত পাতার দাড়াত জানি না, তবে আনন্দ পাবলিকেশান বইয়ের সাইজ বর্গাকার করেছে, তেইশ লাইনের এক-একটা পাতার ফন্ট সাইজ বাড়িয়েছে বেধড়ক, যেন মনে হয়, এ বই মোটা চশমার বুড়োহাবড়াদের জন্য, সাথে কয়েক পাতার নির্দেশিকা যুক্ত করে এটাকে মোটামুটি দেড়শো পাতায় নিয়ে যেতে চেয়েছে, পারে নি, দাম করেছে মাত্র দেড়শো। বইটার মুদ্রণ ২০১২ সালের, জানি না, এখন এর দাম কতো।       আমি বিয়াল্লিশ ডিগ্রীর গরমের নিস্তব্ধ দুপুরে জানালাগুলোর ভারী পর্দা টেনে দিই। মাথার কাছে মাটির জালার ঠান্ডা জলের বোতল নিই। পাখা পুরোদমে চালানো থাকে। প্রার্থনা করি কারেন্ট যেন না যায়। বালিশে মাথা দিই। ছড়ানো চুল বালিশের বাইরে লুটোতে দিই। একটা পর্দা খুব অল্প সরিয়ে দিই। পাখীর ক্লান্ত ডাক শুনতে শুনতে বইটা পড়ি। পড়তে পড়তে ঝিমোতে থাকি। এবং এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ি।       এই তন্দ্রাবিলাসের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে, দিনে দিনে বইটাকে টেনে হিঁচড়ে পড়তে থাকি। কারা যেন আমার চোখের সামনে দিয়ে আসে আর চলে যায় --- ইন্দিরা দেবী, অভিজিৎ চন্দ, তেজেশদা, গোঁসাইজি, উমাদি, ধনপতিদা, জয়সিং, সত্যেনদা...       তারপর কি থেকে কি যেন একটা হয়ে গেল, বইটা আজ দুপুরে শেষ হওয়ার ঠিক এক পাতা আগেই একইভাবে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত্রে শেষ পাতার সাতটি লাইন পড়ে রিভিউ লিখছি। হায়! ঘুমানোর আগে যদি জানতাম যে বইটাকে মেরেই এনেছি, তাহলে রাত্রে অন্য একটা বই নিয়ে বসতে পারতাম!        বইটা কেমন? পড়েই বুঝতে হবে। আমার কেমন লেগেছে সেটা ঠিক বুঝতে পারি নি, এখন লেখার সময়েও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। নিস্তরঙ্গ একটি লেখা। সে লেখার অবশ্যই মাধুর্য আছে। সে মাধুর্য তন্দ্রাবিলাসের সুখে, না লেখনীর আন্তরিকতার মধ্যে তা ঠাহর কেউ করতে পারলে এ হতভাগিনীকে জানিয়ে দেবেন।       অগ্রিম ধন্যবাদ।=========================ছেলেবেলার শান্তিনিকেতনসুপ্রিয় ঠাকুরআনন্দ পাবলিকেশানমুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০ টাকাছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
    হেদুয়ার ধারে -- ১২৫ - Anjan Banerjee | সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ দিবাকর সুমনার পড়ার ঘরে ঢুকে বলল, ' ফুচা ... তোকে কে একজন ডাকছে ... বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সাগর মন্ডল না কি একটা নাম বলল ... 'সুমনা হুড়মুড় করে নীচে নেমে এসে দেখল হাতে একটা খাম নিয়ে গেটের বাইরে সাগর দাঁড়িয়ে আছে।----- ' আরে ... আসুন আসুন ... 'সাগর ভিতরে ঢুকল না। ওখান থেকেই বলল, ' এই ... একটা কেস ছিল ... অলোকেন্দু মিত্রের সঙ্গে একটু কথা বলতাম ... '----- ' ও আচ্ছা আচ্ছা ... আসুন আসুন ... 'সাগরকে নিয়ে দোতলায় উঠে ডানদিকে ঘুরে অলোকেন্দুবাবুর পাশে মক্কেলদের বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, ' দু মিনিট বসুন, আমি বলছি ... 'বসবার ঘর এই মুহুর্তে একদম ফাঁকা। সাগর বসল। সুমনা ফ্যান খুলে দিয়ে চেম্বারের দিকে চলে গেল।অলোকেন্দুবাবু এক মক্কেলের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সুমনা ঘরে না ঢুকে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে রইল।অলোকেন্দুবাবু কথা থামিয়ে সুমনার দিকে তাকালেন।----- ' কিছু বলবি ? '----- ' সুমনা ঘরে ঢুকে অলোকেন্দুবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মাথা ঝুঁকিয়ে নীচু গলায় তার বাবার প্রায় কানে কানে কি বলল। সামনে বসা মক্কেল শিষ্টতাসূচক ভঙ্গীতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল। সুমনা বেরিয়ে এসে সাগরকে গিয়ে বলল, ' পাঁচ মিনিট ... আমি এক্ষুণি আসছি ... ', বলে সেখান থেকে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে মক্কেল ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। সুমনা ফিরে এসে বলল, ' আসুন দাদা ... ' অলোকেন্দুবাবু বললেন, ' নমস্কার, আসুন ... আসুন ... বসুন ... 'সাগর অলোকেন্দুবাবুর উল্টোদিকের চেয়ারে বসল।সুমনা বলল, ' দাদা আপনারা কথা বলুন। আমি একটু পরে আসছি ... 'সুমনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।অলোকেন্দুবাবু সাগরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে বসে রইলেন।তারপর বললেন, ' সুমনাদের আপনি কিভাবে রেসকিউ করেছিলেন সব শুনেছি। আমি আপনার নাম শুনেছি অনেক কিন্তু এই প্রথম স্বচক্ষে দেখলাম আপনাকে। ওসব কথা পরে হবে। আগে আপনার কেসটা শুনি ... 'সাগর হাতের লেফাফাটা বাড়িয়ে ধরল অলোকেন্দুবাবুর দিকে।সব শুনে এবং উকিলের চিঠিতে চোখ বুলিয়ে অলোকেন্দুবাবু বললেন, ' ঠিক আছে অসুবিধে হবে না ... ছকে বাঁধা ফরম্যাট। ওদের অ্যাড্রেসটা... আচ্ছা ... এই যে ... পেয়েছি ... রিপ্লাইটা তৈরি করে কালকের মধ্যে পাঠাব ওদের অ্যাড্রেসে। কিন্তু ওদের এগেনস্টে একটা এফ আই আর করে রাখার দরকার ছিল বারুইপুরে লোকাল থানায়। সেটা তো করা হয়নি। আর এখন কেই বা করবে। যাকগে এখানকার বটতলা থানায় করে রাখা যেতে পারে। যদি দরকার হয় আমি যেতে পারি মেয়ের গার্ডিয়ানের সঙ্গে। এফ আই আর টা কেসটাকে স্ট্রং সাপোর্ট দেবে। আজ তো আর হবে না। কাল সকালে যদি থানায় যাওয়া যায় ... বেশিক্ষণ লাগবে না ... 'এই সময়ে সাগর বলল, ' আপনাকে থানায় যেতে হবে না স্যার ... ওটা আমিই করে নিতে পারব। আপনি শুধু বয়ানটা রেডি করে দিন .... '------ ' আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যখন আছেন অসুবিধে হবার কথাই নয়। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি লিখে দিচ্ছি। যদিও এসব লিখে নিয়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই। ওরা আপনাদের কাছ থেকে কমপ্লেন্টটা শুনে নিজেদের মতো করে নোট রেজিস্টার করে নেবে। তবু থানার সুবিধের জন্য একটা পিটিশন লিখে নিয়ে যাওয়া ভাল। মানে, প্লেনটিফ চৈতালি পাল(সরকার)- এর সঙ্গে কি কি দৈহিক এবং মানসিক টর্চার হয়েছে সেটা ডিটেলে লিখতে হবে। আমাদের কমন লইয়ার কাস্টম অনুযায়ী অনেকটা বাড়িয়ে লিখতে হবে। মানে, রেপ না হলেও বলতে হবে রেপ হয়েছে, অন্তত অ্যাটেম্পট টু রেপ হয়েছে ... এরকম আর কি ... এটা, ফর এগজাম্পল বললাম, বুঝতে পারছেন তো ...।---- ' হ্যাঁ হ্যাঁ .... বুঝতে পেরেছি। জানি এগুলো। এই সব লাইনেই তো ঘোরাঘুরি ... হাঃ হাঃ ... '----- ' তাছাড়া উপায় কি ? কাউকে না কাউকে তো জঞ্জাল সাফাইয়ের জন্য হাতে ঝাঁটা ধরতেই হবে ... '----- ' তাই তো ... আর একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে ...----- ' কি ? '----- ' আপনি আপনার জবাবি চিঠিতে কি লিখবেন ? '----- ' হ্যাঁ, এটা একটা সঙ্গত প্রশ্ন। আমি লিখব যে, আমার মক্কেলের অভিযোগ, সে শ্বশুরবাড়িতে থাকাকালীন নানারকম দৈহিক, মানসিক, এমনকি প্রাণসংশয়জনিত অত্যাচার এবং নারী সম্মানহানিকর কর্মে বাধ্য করার প্রচেষ্টার সম্মুখীন হয়েছে তার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কেন বধুনির্যাতনের ফৌজদারি ধারা লাগু হবে না, সবার আগে সে প্রশ্নের জবাব পেলে,তারপর আপনাদের বক্তব্য এবং দাবির বিষয়বস্তু নিয়ে আইনসঙ্গত আলোচনা করা যেতে পারে। সাতদিনের মধ্যে এ চিঠির জবাব না পেলে আমার মক্কেলের বক্তব্য ও দাবি যথাযথ বলে বিবেচিত হবে এবং ভারতীয় ফৌজদারি আইনের নির্দিষ্ট ধারা অনুযায়ী আপনার মক্কেলের বিরুদ্ধে আইনি মামলা শুরু করা হবে ... 'সাগর একদৃষ্টে অলোকেন্দুবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছিল।সে বলল, ' বুঝতে পারলাম। কিন্তু স্যার ... চৈতালির ওপর টর্চার ফর্চারের ব্যাপারগুলো প্রমাণ করা হবে কি করে ... '----- ওহ ইয়েস ... ইটস এ ভেরি পার্টিনেন্ট কোয়েশ্চেন। না প্যালপ্যাবল বা প্রাইমা ফেসি এভিডেন্স কিছু নেই। কিন্তু আই পি সি-র অনেক ধারাই রয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে মেয়েদের পক্ষে। শুধু তাদের জবানবন্দিই কেসটাকে তাদের ফেভারে নিয়ে আসার পক্ষে যথেষ্ট। 'সাগর বলল, ' হমম্ ... বুঝলাম ... 'একটুখানি ভেবে নিয়ে সাগর বলল, ' স্যার যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ?'অলোকেন্দুবাবু সাগরের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।সাগর বলল, ' না, তেমন কিছু না ... বলছি যে আপনি কি ক্রিমিনাল কেসও করেন ? '----- ' ও, এই কথা। হ্যাঁ, ক্রিমিনাল, সিভিল দুটোই করি ... ও ব্যাপারে চিন্তা করবেন না। আমার ট্র্যাক রেকর্ড আমার লাইনে সবাই জানে। 'এই সময়ে সুমনা ঘরে এসে ঢুকল।এসে বলল, ' হয়েছে ? 'সাগর বলল, ' হ্যাঁ ... সে তো হয়েছে ... কিন্তু অভয় তো গরীব মানুষ... তাই... যদি ... 'সুমনা বলে উঠল, ' আপনাকে ওসব নিয়ে ভাবতে কেউ বলেছে ? যদি বলে থাকে ... বলুন একবার ...'অলোকেন্দুবাবু ভীত ভঙ্গীতে বললেন, ' ওরে বাবা... কার বুকের অত বড় পাটা আছে ? আমি কিন্তু কিছু বলিনি সাগরবাবু .... 'সঞ্চারী সেদিন রাত্তিরে অমলের ঘরে ঢুকে বলল, ' দাদাভাই রাত্রির সঙ্গে তোর কিছু কথা হয়েছে ? '----- ' হ্যাঁ, মানে... সেদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিল ... শ্যামবাজার ট্রামডিপোর ওখানে ... আমি আসছিলাম ওখান দিয়ে ... ', অমল থতমত খেয়ে বলল।---- ' ও আচ্ছা ... ও নাকি তোকে কোথায় নিয়ে যাবে ... প্রফেসর নিখিল ব্যানার্জী বলে একজনের কথা বলছিল ... '----- ' হ্যাঁ ... সেদিন বলছিল ... কি একটা অর্গানাইজেশন... '----- ' হ্যাঁ ... সেটাই ... যাই হোক, কাল সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ তোকে দাঁড়াতে বলেছে। 'অমলের মনের সরোবরে টুপ করে একটা বটফল খসে পড়ল জলের ধার থেকে। জলের আকুল বৃত্ত ছড়িয়ে পড়ছে মৃদু তরঙ্গ এঁকে। অমল চুপ করে রইল, কি বলবে ভেবে না পেয়ে।একটু পরে তরঙ্গ থিতু হতে সে বলল, ' কোথায় ? '----- ' বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে। আমাকেও বলছিল যেতে ... আমি রাজি হইনি। দূর ... কি সব ... আমার ওসব ভাল লাগে না। রাত্রির এগুলো বড্ড বাড়াবাড়ি ... সব ব্যাপারে নাক গলানো চাই। তুই যদি না যেতে চাস তো বল, আমি কাল ইউনিভার্সিটিতে বলে দেব ওকে ... 'অমলের বুক ধড়ফড় করে উঠল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ' না না... ব্যাপারটা ইন্ট্রেস্টিং মনে হচ্ছে ... যাব যাব ... '----- ' ঠিক আছে, আমি তা'লে ওকে সেই কথাই বলে দেব ... বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে ... '----- ' হুঁ হুঁ ... 'অমল ভাবল, ভাগ্যবিধাতা বলে যদি কেউ থাকেতাকে অজস্র ধন্যবাদ যে সঞ্চারী নিখিলবাবুর ওখানে যেতে রাজি হয়নি।কাল সন্ধে আসতে এখনও প্রায় চব্বিশ ঘন্টা বাকি। কিন্তু সে স্বপ্নদোলায় দুলতে লাগল এখন থেকেই। পরে কি হয় কে জানে। ( চলবে )********************************************
  • ভাট...
    commentঅরিন | "The stigmatisation of Muslims will continue, and perhaps even sharpen, if Narendra Modi and the BJP win a third term in office. Another victory, especially if it comes with a comfortable majority in the Lok Sabha, will embolden Modi and his party to further tighten the screws on the media, further undermine the independence of the civil services, the judiciary, and public regulatory institutions, further make Central universities, IITs and IIMs centres of Hindutvapropaganda, and further weaken the structure of Indian federalism. The reallocation of Lok Sabha seats according to population will be set in motion such that the demographic advantage of the North, where the BJP is strong, will be converted into an enduring political subordination of the South, where the BJP is weak. The South is unlikely to submit meekly to its suppression; but Modi and the BJP may proceed with their plans regardless. In a book published in 2007, I characterised India as a “50-50”democracy. In updating the book a decade-and-a-half later, I downgraded this to a “30-70 democracy”. A third successive majority for Modi and the BJP will accelerate this decline, with damaging consequences for our social fabric, for our economic prospects, and for the viable future of generations of Indians yet unborn.
     
    Back in the 1970s, Indira Gandhi combined authoritarianism with a devotion to family rule; now, Narendra Modi combines authoritarianism with a devotion to Hindu majoritarianism. While parivarvaad is bad, bahusankhyavaad is surely even worse, as the fate of the countries in our neighbourhood that have been overtaken by varieties of Islamic or Buddhist majoritarianism demonstrates. There is no reason to believe that the outcome of Hindu majoritarianism will be any different.
    Authoritarianism crushes the spirit; majoritarianism poisons the mind and the heart. The hate and bigotry that it engenders spread like a cancer through the body politic, robbing individuals and society of civility, decency, compassion, of humanity itself. That is why its rise must be checked, by such democratic means as are still available to us. That is why this is the most important general election since 1977.
     
     
    এটাও থাক,
    comment&/ | চতুর্মাত্রিক, বৈকুন্ঠের মাসতুতো ভাই। উৎকন্ঠ মল্লিক। ঃ-)
    commentaranya | হাতে তুলে নিই তোমার ছিন্ন শির, তিমির - এইরকম একটা লাইন মনে পড়ছে @ সৈকত 
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত