এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    রবীন্দ্রনাথ - বেবী সাউ | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়অথচ, সেভাবে পাওয়া হলো না আপনাকে! যৌবন যখন শৈশব থেকে কৈশোরে ছুটে গেলপ্রৌঢ়ত্বের আকাশে ঘনিয়ে এলগোধূলি এগোতে এগোতে এক দীর্ঘ গভীর আফসোসের রেখা টানতে টানতে আপনার দিকে ছুটে গেছি বারবার...প্রেমে প্রত্যাখানে বিচ্ছেদেআদরে শিক্ষায় অশিক্ষায় কলঙ্কে অপমানে সম্মানেঅসম্মানে রাতের কান্নায় সকালের ঘাসফুলেসুন্দর যখন সুন্দরের চেয়েও সুন্দরএবং যাপন যখন একাকী অজান্তে, আপনি থেকে কখন যে তুমি'তুমি' হয়ে গেছ!কখন যে এ মন, এ সত্ত্বাএই অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব বোধ তোমাকে উপাস্য ভেবে সখা ভেবে আনন্দ ভেবে আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া পতঙ্গের মতো জড়িয়ে ধরেছে মুক্ত করেছে আকাশের দিকে শেকল ছিঁড়ে মাটির উপরভেসে গেছে বাতাসের মতো সহস্র অপমানেও সহজ থাকতে থাকতেমরতে মরতে মরতে মরতেবাঁচিয়ে দিয়েছ তুমি চোখের জলে ধুয়ে নিয়ে শিখিয়েছ আবার চোখের জলে ধন্য হতে আমার শ্রান্তি, ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছ বিচ্ছেদ, বিরহ আমি শূন্য হয়ে গেছিশুরুর থেকেই শুরু করেছি শেষ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি শেষে তোমার জন্য ঠাকুরসাহেবমুখ তুলে চেয়েছি আজযেমন প্রথম শিশুর চোখমুখ তুলে দাঁড়িয়ে একাকীত্বময় জীবনের একেকটি অন্দরমহল খুঁজতে গিয়েখুঁজে পেয়েছি নির্জন এক সৈকতআমার হাতের পোড়া দাগে চোখের নীচে বিষাদের অন্ধকারে উপাখ্যানের কাছে লোককথার মতোনত হয়ে আছি শুধুপ্রেমে কেননা, এত দুঃখের ভেতর দিয়ে না পুড়লে আমার মনকিছুতেই তোমাকে পেত না কিছুতেই তোমার গানের কাছে বাড়িয়ে দিত না সাহস কিছুতেই বুঝতে পারত না অতীত এবং আগামীকে ছেড়েক্ষণিকের জন্যও কীভাবে বেঁচে নেওয়া যায়! কীভাবে অসংখ্য কবরস্থান সরিয়ে শ্মশানের ছাই ঘেঁটে বের করে আনা যায় স্নিগ্ধ মধুর এক জ্যোতিকেআলোয় আলোয় ভরে যায়রাতের বালিশ অপমানের ছুরি আমার কাটা দাগনোনা ঘামুগ্ধ চোখে তোমাকে ভাবিতোমাকে দেখিচেয়ে থাকিআর ভাবিএবং ভাবি... কেন চেয়ে আছ গো মা ! নিপুণ তুমি নিষ্ঠুরনিজেকে সরিয়ে নিলে আমার কাছ থেকে স্পর্শসুখ থেকে রাতের গভীর একাকীত্ব থেকে... এই কান্নাএই বোধ এই সৌন্দর্যএই প্রেম আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ? শুধু, শূন্য এক খেয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে শূন্য হয়ে যাওয়া ছাড়া! কীভাবে পূর্ণ হবযদি এভাবে অপূর্ণ না-ই হই?
    কী আমাদের জাত আর ধর্মই বা কী! - প্রতিভা সরকার | এটি কোনো বইয়ের বিজ্ঞাপন নয়তথাকথিত নীচু জাতের নারীর সঙ্গে তথাকথিত উঁচু জাতের পুরুষের বিয়ে হলে তাদের সন্তানের জাত কী হবে সুপ্রিম কোর্টে এইরকম একটি কেস উঠেছিল(civil appeal no 654 of 2012, decided o January 18, 2012)সুপ্রিম কোর্টের অবজারভেশনের একটি অনুবাদ নীচে রইল।ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ যদি আদিবাসী এবং অ-আদিবাসীর মধ্যে হয়, তাহলে ধরে নেওয়া হয়, সন্তান পিতার কাস্টেই পরিচিত হবে।১ এই ধরে নেওয়াটা জোরদার হয়, যদি এইরকম বিয়েতে পুরুষটি উঁচু জাতের হয়। কিন্তু এই ধরে নেওয়া সিদ্ধান্ত হিসেবে কখনই অপরিবর্তনীয় নয়। এইরকম বিয়ের সন্তানের প্রমাণ করার স্বাধীনতা থাকবে যে সে শিডিউল কাস্ট/ ট্রাইবের মায়ের দ্বারা আজন্ম পোষিত হয়েছে। উঁচু জাতের পিতার সন্তান হয়ে সে জীবনে কোনো সুযোগ সুবিধেই পায়নি, উপরন্তু বঞ্চনা, অমর্যাদা, অপমান এবং বাধার সম্মুখীন হয়েছে, যেমনটি তার মায়ের কাস্টের লোকেরা হয়ে থাকে। তাছাড়াও সন্তানটি মায়ের কাস্টের লোকেদের দ্বারা তাদেরই একজন বলে বিবেচিত হয়েছে এবং সেই কাস্টের বাইরের লোকেরাও তার সম্বন্ধে একইরকম ভেবেছে।এই কেসে এপেল্যান্টের ট্রাইবাল সার্টিফিকেট কেড়ে নেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র সে ক্ষত্রিয় পিতার ঔরসজাত বলে।এই কারণে হাই কোর্টের এবং স্ক্রুটিনি কমিটির রায় যুক্তিযুক্ত নয়। এইজন্য স্ক্রুটিনি কমিটির কাছে দু পক্ষের প্রমাণ খতিয়ে দেখে নতুন সিদ্ধান্তের (fresh decision) জন্য কেসটি আবার পাঠানো হল।এক মেধাবী ছেলে, মাথায় ইঁট বয়ে, রাজমিস্ত্রির কাজ করে জেনেরাল কোটায় সুযোগ পেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছিল। মনুবাদী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বিরোধ বাঁধায় তাকে এবং আরও দুজনকে সাতমাস ধরে স্টাইপেন্ড বন্ধ করে রাখা হয়, যা ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। শুধু তাই নয়, হস্টেল থেকেও বিতাড়িত করা হয়েছিল তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছতলায় ধরনায় বসেছিল তারা অনেকদিন। কেউ ফিরেও দেখেনি।এত অপমান আর কষ্ট যে কারও জীবনকে অর্থহীন করে দেয়। মেধাবী ছেলেটি আত্মহত্যা করে। তার সুইসাইড নোট সবাই পড়েছে। যে হতে চেয়েছিল নক্ষত্রের সন্তান, তাকে হতে হয় অর্থহীন ভষ্ম। ছেলেটির মা ছিল দলিত সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র। সন্তানদের জন্ম দিয়েই খালাস ওবিসি পিতা তাকে ত্যাগ করে। ছেলেটির মা সিংগল মাদার হয়ে দলিত গ্রামে বাচ্চাটিকে বড় করে। জেলা প্রশাসন দলিতের সার্টিফিকেট দেয়। আজ আদালতের রায়ে বলা হচ্ছে ছেলেটি দলিত ছিল না। তখনকার ভিসি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সবাই বেকসুর খালাস! কংগ্রেস আমলে এই রায় বার হওয়া খুবই বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। দলিতরা বিরুদ্ধে চলে যাবে। কিন্তু এ মামলা আজকের নয়। সাত বছর ধরে চলেছে, কিন্তু রায় বেরোয়নি। আজ চার পাঁচমাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে গেল।২ রোহিত ভেমুলা নাকি দলিতই ছিল না। জাল সার্টিফিকেট যোগাড় করে সে পড়াশুনা করেছিল, তাই ভয়ে আত্মহত্যা করেছিল! সে যে জেনেরাল কোটায় সর্বত্র সুযোগ পেত, তার কাস্ট সার্টিফিকেটের দরকার পড়েনি, এটাও মহামান্য আদালত নিশ্চয়ই বিবেচনা করেছেন। তার মৃত্যুর আগে যেসব তার ওপর যেসব অত্যাচার হয়েছিল, (তখন কেউ কাস্টের কথাই তোলেনি) তাও বিবেচিত হয়েছে নিশ্চয়ই। যারা বলে দলিত না হলে দলিতদের নিয়ে লেখালেখি করা যাবে না, তাদের জয় হোক! বিচার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের জয় হোক!১ https://bit.ly/44yTUfN২ https://bit.ly/3QBdhz4
    সীমানা - ৪৬ - শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ছবি: সুনন্দ পাত্র ৪৬চেনা নজরুল, অচেনা নজরুলউনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের নতুন প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী বাংলা প্রদেশের প্রথম নির্বাচনের ফল নিয়ে নানা অঙ্ক নানা দর-কষাকষির পর কৃষক-প্রজা পার্টির ফজলুল হককে প্রধান মন্ত্রী, আর মুসলিম লীগের সেই সময়ের বাংলার নেতা সারাওয়র্দি-নাজিমউদ্দিনদের নানা মন্ত্রীত্বের পদ দিয়ে অবশেষে কৃষক-প্রজা পার্টি আর লীগের যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠিত হল সাঁইত্রিশের পয়লা এপ্রিল অল-ফূল্‌স্‌ ডে'র সন্ধ্যেবেলায়। প্রথম যে ছ'জন সর্বসম্মতিক্রমে মন্ত্রী হলেন, প্রধান মন্ত্রী ফজলুল হককে নিয়ে তাঁরা হলেন নলিনীরঞ্জন সরকার, স্যর নাজিমউদ্দিন, স্যর হবিবুল্লাহ্‌, স্যর বি-পি সিংহ আর ব্যারিস্টার সারাওয়র্দি। এরপর মুসলমানদের মধ্যে আরও দুজন আর হিন্দুদের তিনজন। নৌসের আলি আর সামসুদ্দিন মুসলমানদের, হিন্দুদের মধ্যে মহারাজ শ্রীশকুমার নন্দী, মুকুন্দবিহারী মল্লিক আর রায়কত। শ্যামাপ্রসাদ প্রায় মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছিলেন ছোটলাট অ্যাণ্ডারসন সাহেবের প্রভাবে, বাদ সাধলেন লীগের নেতারা। ঠারেঠোরে শ্যামাপ্রসাদের পিছনে হুমায়ুন কবিরদের সমর্থনের কথা ছোটলাট জানালেও পিছু হটলেন না নাজিমউদ্দিন-সারাওয়র্দিদের দল। অবশেষে মহারাজ শ্রীশকুমার নন্দীই হলেন কম্প্রোমাইজ চয়েস। আর জাত-ধর্মের দাঁড়িপাল্লাও দাঁড়াল যেমনটা অভিপ্রেত। রাজবংশীদের প্রতিনিধি রায়কত আর মুকুন্দবিহারী নমশূদ্রদের।সেই সাঁইত্রিশের এপ্রিলে সারা দেশের চটকল শ্রমিকরাও ধর্মঘট করল। বিপ্লবী সাম্যবাদী দল বা Revolutionary Communist Party (RCPI) সংগঠিত করলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই সৌম্যেন্দ্রনাথ যাঁর সঙ্গে কৃষ্ণনগর সম্মেলনে প্রথম পরিচয় নজরুলের। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের তিনি পৌত্র, নজরুলের তিনি কমরেড বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক পার্টিতে। ওই কৃষক-শ্রমিক পার্টিরই নজরুল পরিচালিত পত্রিকা লাঙলেই সৌম্যেন্দ্র-অনূদিত কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রথম প্রকাশিত হয়। আর ওই সাঁইত্রিশেই কিছুদিন আগে League against Fascism and War-এর সভাপতি হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। আন্দামান রাজবন্দীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলের জনসভাতেও যোগ দিয়েছেন তিনি।অথচ ঠিক সেই সময়টায় – এবং খানিকটা আগে থেকেই হয়তো – জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন রাজনীতিতেই নজরুলের কোন মতামত বা উৎসাহ নজরে পড়ে না। তার সময় কেটে যায় গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে, যে জায়গাটা তার অর্থস্বাচ্ছন্দ্যের উৎসভূমি! তখনো নজরুলের বিদ্রোহী কবি বা জাতীয় কবির পরিচয় মূলত তার কবিতার জোরে, কিন্তু কবিতা তার আর্থিক প্রয়োজনে তেমন কোন কাজে এসেছে কি? বিদ্রোহী শিরোনামে নজরুলের যে কবিতা – শুধুমাত্র একটি কবিতাই যা হাজারে হাজারে লাখে লাখে মানুষ পড়েছে নানা পত্র-পত্রিকায় পুনর্পুনর্মুদ্রণের সুযোগে – কবির কাছে তার অর্থমূল্য পৌঁচেছে কতটুকু? একটার পর একটা কাব্যগ্রন্থ বেআইনী ঘোষিত হয়েছে, খোলা বাজারের বাইরে হয়েছে তার মুদ্রণ – সে মুদ্রণ আইনী হোক বা বে-আইনীই – পুলিশের চোখের আড়ালে তার অভূতপূর্ব বিক্রিতে কোন অর্থলাভ তো হয়নি অন্তত কবির নিজের! বস্তুত, নজরুলের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর একটাও কি জীবিকা অর্জনে তাকে তেমন কিছু সাহায্য করতে পেরেছে? চালচুলো-জমিজায়গীর নজরুলের নেই একেবারেই, প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে খাদ্যবাসস্থানের সংস্থান কয়েকবছরের, আর নিম্নবর্গীয় ভারতীয় সৈনিকের যেটুকু বেতন বছর দু-তিন সে আয় করেছিল – এর বাইরে কোন অর্থসম্পদ নেই যে কবির, সে-আমলে যখন সৃষ্টিশীল রচনার অর্থমূল্য ছিল একেবারেই নগণ্য, তখন শুধুমাত্র লেখার জোরে তার জীবনধারণ সম্ভব ছিল কি? আমরা দেখেছি তার জীবনের প্রায় প্রথম ত্রিশ-বত্রিশ বছর কেটেছে কী নিদারুণ দারিদ্রে, কী অর্থকষ্টে, এবং দারিদ্রজাত কী শারীরিক অসুস্থতায়! এ-কথা তো ঠিকই, যে গ্রামোফোন কম্পানীর অর্থানুকূল্য নজরুলের পারিবারিক জীবনের মান অনেকটাই বদলিয়ে দিল! নিজের সৃষ্টিশীলতার দ্রুত রূপান্তর তখন সে ঘটিয়েছে নিশ্চিত অর্থপ্রাপ্তির শিল্পে। শ্যামাসঙ্গীত ইসলামি গান আর গজলের জনপ্রিয়তা তাকে অর্থ দিয়েছে। হতদরিদ্র নজরুলের তো অর্থের প্রয়োজন, প্রচুর অর্থের, এবং, এখন সে জানে প্রচুর অর্থ আয় করার উপায়টা তার প্রায় হাতের মুঠোয়! সে আয় করবে তার প্রতিভার বিনিময়ে, তাতে লজ্জা কোথায়!নজরুলের মনে পড়ে বিদ্রোহী কবিতা লেখার পরে আফজালের সঙ্গে তার বৌবাজারের ভীম নাগের দোকানে যাওয়ার দিনটা। কবিতাটা আফজাল ছাপাতে চেয়েছিল, সে বলেছিল, আপনাকে আজ মিষ্টি খাওয়াব, পেট ভরে। ভীম নাগের দোকানে বসেই সে কবিতাটা নকল করে দিয়েছিল আফজলকে। কাগজ কিনে এনেছিল আফজাল, নিজের ফাউন্টেন পেনটাও দিয়েছিল তাকে লেখবার জন্যে; কবিতাটা নকল করা হয়ে গেলে ফাউন্টেন পেনটা সে আর ফেরৎ নিতে চায়নি। নজরুল নেয়নি কিন্তু কলমটা, বলেছিল, তার মাথায় একটা বিশেষ আমেরিকান কলম আছে, সেটাই হবে তার প্রথম নিজস্ব কলম। অবাক হয়েছিল আফজাল, একটা দামী নাম করা আমেরিকান কলমের শখ যে নজরুলেরও থাকতে পারে, সে তা ভাবতেই পারে না। নজরুলকে সে ভীম নাগের দোকানে নিয়ে এসেছিল পেট ভরে সন্দেশ খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, এইমাত্র চোখের সামনে সেই পরম উপাদেয় দৈ-সন্দেশ সে শুধু পেট-ভরে নয়, আকণ্ঠ খেয়েছে! নিজের চোখে সেই দৃশ্য দেখার পর দ্ব্যর্থহীন ভাষা আর ভঙ্গিতে আফজাল প্রকাশও করে তার বিস্ময়: আপনার কি নামী দামী সবরকমের জিনিষেরই শখ আছে?নিশ্চয়ই, বলে নজরুল, বড়লোক হবার শখ আছে বৈকি। পাঁচিল-ঘেরা গেটওয়ালা বাড়ি, সামনে দারোয়ান, গ্যারেজে বিরাট বড় গাড়ি, এ সব শখ আছে তো। আপনি দেখবেন, এক দিন এ সবই হবে আমার।নজরুল। কাজি নজরুল ইসলাম। মাত্র কয়েকদিন আগেই যার কাছ থেকে মাত্র একশো টাকার বিনিময়ে তার প্রথম গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি অনায়াসেই কিনেছিল সে, সেই অপ্রস্তুত আফজল বলেই ফেলে, আপনাকে খুব ভালোভাবে চিনি, এরকম একটা অহঙ্কার আমার ছিল। আজ দেখছি চেনার অনেক বাকি আছে!আর আজ যখন সেই সমস্ত শখ নজরুলের সঙ্গীত-সৃষ্টির ক্ষমতায় এবং গ্রামোফোন কম্পানীর দৌলতে সহজেই আয়ত্ত, তখন ঠিক কোথায় থামতে হবে, সেই শখ মেটাবার জন্যে কত প্রিয় বস্তু আর অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, তার হিসেব করার আর প্রয়োজনও হয় না নজরুলের। সারাদিনের জন্যে বাড়ি থেকে নিয়ে-আসা খিলি খিলি পান আর কাপের-পর-কাপ শুধুমাত্র তরল চায়ের পুষ্টির উপর নির্ভর করে ক্লান্তিহীন সে রচনা করে চলে গানের পর গান; একই সঙ্গে সুরসংযোগ, আর চলে অনুজ গায়ক-যশপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রেকর্ডিঙের জন্যে তৈরি করে দেওয়া! মনের সূক্ষ্মকোন-একটা স্তরে মনের-মতো কাব্যরচনা করতে না-পারার অবদমিত বেদনাকে নীরব শাসনে রাতের পর রাতঘুমিয়ে-পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মাসিমা গিরিবালা, স্ত্রী প্রমীলা আর পালিতা কন্যা খুকুর সঙ্গে অর্থহীন তাস পেটাপিটিতেই কেটে যায় নজরুলের! জীবন ধারণের এই চক্রব্যূহ তৈরি করে নিয়েছে নজরুল স্বেচ্ছায়, সেখান থেকে মুক্তির কথা আর কি সে ভাবে?ভাবেই না বোধ হয়। অথবা হয়তো ভাবেও। তাই সুযোগ পেলেই সে নিজের অক্ষমতার কথায় ঘুরে ফিরে আসে বারবার। “...কোনো সাহিত্যিক উৎসবে আমার আমন্ত্রণ অপরাধ, হয়তো তার চেয়েও বেশি। কেননা আমি ধর্মভ্রষ্ট, সাহিত্য সমাজের পতিত। যখন সাদর আমন্ত্রণ আসে এই কবর থেকে উঠে ফেলে-আসা আনন্দ নিকেতনে ফিরে যাওয়ার, তখন খুব কষ্ট হয়, বড়ো বেদনা পাই। আমার মৃত সাহিত্যদেহকে যথেষ্টরও অধিক মাটি চাপা দিতে কসুর করিনি, তবু তাকে নিয়ে আমার বন্ধুরা টানাটানি করেন, কেউ কেউ দয়া করে আঘাতও করেন। উপায় নেই। মৃত লোক নাকি মিডিয়াম ছাড়া কথা বলতে পারে না। আজ যে কথা বলছি তা মিডিয়ামের মারফতই বলে মনে করবেন। অপরিমাণ শ্রদ্ধা নিয়ে সাহিত্যকে আমি বিসর্জন দিয়ে এসেছি। সেই বিসর্জনের ঘাটে এই প্রেতলোকচারীকে ডেকে যেন বেদনা না দেন, আজ বলবার অবকাশ পেয়ে বন্ধুদের কাছে সেই নিবেদন জানিয়ে রাখি।”এমনকি বুলবুলের মৃত্যুর পরও জীবনযাত্রার এই নতুন ছকটা – সকাল বেলাতেই রিহার্স্যাল রূমে হাজিরা দেওয়া, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা শুধুমাত্র কাপের পর কাপ চা আর খিলির পর খিলি পানের পুষ্টিতেই শরীরধারণ করে সঙ্গীতরচনা, সুরসংযোজন আর প্রশিক্ষণেই নিজেকে ব্যস্ত রেখে গভীর রাত পর্যন্ত – না, তাস খেলা আর নয় – এখন তার বদলে যুক্ত হয়েছে গুরুদেব বরদাচরণের নির্দেশে যোগাভ্যাস ও যোগসাধন – ছকটা কিন্তু বদলায়নি। যে যাই বলুন, লক্ষ্মীছাড়া উদ্দাম উদাসীন নজরুলের এখনকার জীবনযাত্রা কিন্তু বিবাহিত পারিবারিক জীবনের দাবির বিষয়ে সম্যক দায়িত্বপালনের একটা ছবিও ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে। বুলবুলের কনিষ্ঠ আরও দুটি – সব্যসাচী আর অনিরুদ্ধ – তার অবশিষ্ট এই দুটি পুত্রসন্তানকে মানুষ করে তোলবার দায় তো নজরুলের নিজেরই, সে তো তা অস্বীকার করেনি। আর এই দায় পালনে অর্থের ভূমিকা কি অস্বীকার করা যায়? এত কাজ তো তাদেরই জন্যে।গত কয়েক বছর ধরে যে বিষয়কে সে স্পষ্টতই অস্বীকার করে এসেছে – অন্তত স্বীকার করবার কোন প্রমাণকাগজে-কলমে রাখেনি সে – তা হল তার কৈশোর আর প্রথম-যৌবনের স্বঘোষিত আবেগ, যা কিছু আছে তার, দেশ আর জাতির জন্যে সবই বাজি রাখা। সেই যে উনিশশো উনত্রিশের ডিসেম্বরে তাকে জাতীয় কবি নামে সম্বর্ধিত করেছিলেন দেশের প্রধান প্রধান মানুষরা, সেই সময় সুভাষবাবু তার সম্বন্ধে বলেছিলেন, কবি নজরুল নিজে বন্দুক ঘাড়ে করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, কাজেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সব কথা লিখেছেন। এতেই বুঝা যায় যে নজরুল একটা জীবন্ত মানুষ। তিনি আরও বলেছিলেন, নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। এতেও বুঝা যায় যে, তিনি একটা জ্যান্ত মানুষ। সুভাষ বলেছিলেন, আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব – তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব। সুভাষ বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় নানা কবির রচিত জাতীয় সঙ্গীত শোনবার নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরুর মতো প্রাণ-মাতানো গান অন্য কোথাও শুনেছেন বলে মনে করতে পারেন না।কিন্তু, দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরুর মতো প্রাণ-মাতানো গান তার পরে আর একটাও লিখতে পারল না কেন নজরুল?নজরুলের মাঝে মাঝে কি মনে পড়ে সুভাষের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা? রবীন্দ্রনাথের ষষ্টীতম জন্মোৎসব সেদিন পালিত হচ্ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। প্রথম আলাপের কিছুক্ষণের মধ্যেই নজরুলকে সেদিন সুভাষ বাংলায় কংগ্রেস-প্রস্তাবিত দৈনিকের দায়িত্ব দিতে চাইল। শুধু তা-ই নয়, যখনই কথায় কথায় নজরুলের সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শোনে সুভাষ, তখনই তাকে কংগ্রেস ভলান্টিয়ার বাহিনীর একটা দায়িত্বও সে দিতে চায়। কিছুদিনের মধ্যেই নজরুলের কুমিল্লায় যাবার কথা, পবিত্রর মুখে সে কথা শুনে সুভাষ ভলান্টিয়ার বাহিনীর প্রস্তাবকে সেই সময়ের জন্যে মুলতুবী রেখে সতেরই নভেম্বর ব্রিটিশ যুবরাজের বোম্বাইয়ে পদার্পণের প্রতিবাদে দেশব্যাপী ধর্মঘটে কুমিল্লায় সাফল্যের দায়িত্ব নজরুলকে দিয়ে ওখানকার স্থানীয় কংগ্রেস নেতা বসন্ত মজুমদারকে চিঠিও লিখে দেয় একটা।কিন্তু বড়ই তাড়াতাড়ি ইতিহাস হয়ে গেল এইসব। উনতিরিশ সালে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-হেমন্ত সরকার-ফিলিপ স্প্রাট-আবদুল হালীমদের সঙ্গে বঙ্গীয় কৃষক লীগ স্থাপনের উদ্দেশে কুষ্ঠিয়ার সম্মেলনে তিন-চার দিনের জন্যে যোগ দেওয়া, সেখান থেকে ফিরে এসে হাওড়ায় শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিতে শ্রমিক বস্তিতে গান শোনাতে যাওয়া আরধাঙড়-মেথরদের সংগঠনে অংশ নেওয়াই নজরুলের শেষ সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। সে বছরেরই মার্চের শেষের দিকে মীরাট কম্যুনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত মুজফ্‌ফর গ্রেপ্তার হয়ে যায়। নজরুলের এতদিনের চলার পথটা ধীরে ধীরে এখানে এসে একটা গলিপথে শেষ হয়ে গেল। পানবাগান লেনের ভাড়া-বাড়িতে অনুজ-বন্ধু শান্তিপদ সিংহের সহায়তায় তখন তার বাস। বন্ধু নলিনী সরকারের যোগাযোগেই তখন গ্রামোফোন কম্পানীতে যাতায়াত-কাজকর্ম শুরু করেছে সে। সঙ্গীতই যে তার ভবিষ্যৎ, এ-কথা ততদিনে বুঝে গেছে নজরুল, পানবাগানের বাড়িতে তখন সে গ্রামোফোন কম্পানীর ট্রেইনার ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁ-য়ের নিয়মিত শাগরেদী করছে, খাঁ-সাহেবকে ওস্তাদ মেনে এই প্রিয়-শিষ্য ঠুংরি খেয়াল কাজরি শিখছে তাঁর কাছে।এই সময়ের পত্রপত্রিকায় নজরুল যে লেখে না তা নয়, কিন্তু যা সে লেখে মূলত সবই গান, যা দিনে দু-চারটে লিখতে সময়ই লাগে না তার। গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমের বাইরে সে যে কখনোই যায় না এমনও নয়। সারা বাংলার নানা জায়গা থেকে অনবরতই তার নিমন্ত্রণ আসে, বর্ষীয়ান সম্পাদক সওগাতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, নজরুলেরপ্রায়-অভিভাবকই তো তিনি, তিনি তো নানা আমন্ত্রণ-চিঠিপত্রের চাপে নজরুলের সেক্রেটারির দায়িত্বই নিয়ে নিয়েছেন প্রায়! যেখানে নজরুল যায়, সে শুধু গানই গায়, গান গাইতে গাইতে সময়ের ঠিক থাকে না, তবুও তার শ্রোতাদের চাওয়ার শেষ নেই!স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা আর কোন সভায় বলে না কবি, গান গায়। সারা ভারতের প্রায় সমস্ত প্রদেশে তখন পর্যন্ত যত কৃষক-শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথমটাই তো নজরুলের নিজের হাতে তৈরি, কৃষ্ণনগরের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময়। এবার সব প্রদেশের সংগঠন মিলিয়ে যে All India Workers and Peasants Party-র অধিবেশন হল কলকাতার অ্যালবার্ট হলে, তাতে তো নজরুল স্বাভাবিকভাবেই আমন্ত্রিত ছিল।আমন্ত্রিত 'বাঙালির কাজিদা' সেদিন কিন্তু সেখানে শুধু উদ্বোধন সঙ্গীতই গাইল। উদ্বোধন সঙ্গীত। ব্যস। আর-কিছু নয়।উনিশশো তিরিশের মে-মাসে মৃত্যু হল বুলবুলের। যে বাড়িতে এতদিন বাস করেছে নজরুল-পরিবার, সে বাড়ির সর্বত্র বুলবুলের স্মৃতি। সেখানে থাকা অসহ হয়ে পড়েছিল তাদের পক্ষে। তীব্র শোকে মুহ্যমান নজরুল প্রথমে বন্ধু নলিনী সরকারের গৃহে, পরে ওই অঞ্চলেই ঠিকানা-বদল করে আবার ফিরে গেল তার পুরোনো অভ্যাসে। সকাল থেকেই গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূম। এবার নলিনীর যোগাযোগে যোগগুরু বরদাচরণ মজুমদারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে সে, অতএব মাঝরাতে আর তাস নয়, এখন যোগাভ্যাস। এখনও ঘনঘন সারা বাংলা থেকে আমন্ত্রণ আসে নজরুলের। সে যায়, গানও গায় সে, এবং, ঠিক এই সময় থেকেই তার গানের সঙ্গে বোধ হয় আধ্যাত্মিকতা আর যোগের সূত্রে প্রাপ্ত নতুন এক রহস্যময়তাও শোনা যায় তার কণ্ঠে।এই রহস্যময়তাই কি নজরুলের নতুন অসুখ?আফজালুল হকের নতুন-কেনা লাইন-টানা কাগজে বিদ্রোহী কবিতা নকল করতে করতে কথায় কথায় তার কয়েকটা “শখ”-এর কথা নজরুল বলেছিল আফজালকে। বিশেষ কোন ব্র্যাণ্ডের একটা আমেরিকান ফাউন্টেন পেন ছাড়াও তারশখ-এর মধ্যে ছিল পাঁচিল-ঘেরা গেটওয়ালা একটা বড় বাড়ি, সামনে দারোয়ান, গ্যারেজে বিরাট বড় গাড়ি। দারোয়ান যে সে রেখেছিল একজন, সবাই জানে তা। বড় একটা ক্রাইসলার গাড়িও ছিল তার। বালিগঞ্জে জমি কিনেছিল নজরুল, ক্যাশ টাকার অভাব ছিল না তার গ্রামোফোন কম্পানীতে কপিরাইটের সূত্রে। অতএব অভিজাত এলাকায় পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি একটা তার নিশ্চয়ই হতে পারত। যে কলমটা সে নিয়মিত ব্যবহার করত তা ওই নির্দিষ্ট ব্র্যাণ্ডের আমেরিকান কলমই ছিল কিনা তা জানা যায় না, তবে সে যে প্রসাধনপ্রিয় ছিল, তার পালিতা কন্যার ভাষায় নিয়মিত স্নো-পাউডারের ব্যবহার এবং তাম্বুলচর্চাজনিত দন্তোষ্ঠকলঙ্ক নিবারণার্থে আমেরিকান মাউথওয়শও যে ব্যবহার করত সে, তা তো অনেকেই জানে। গত কয়েকবছরে অবিশ্যি যে-কথা সে একবারও উচ্চারণ করেনি, তা হল দেশ আর জাতিকে নিয়ে সেই সময় কী তার ভাবনা। এই দেশ এবং জাতিকে নিয়ে তার কী আবেগ, এক সময় নজরুল বারবার বুঝিয়েছে তা। এর পর গজল-গানের সাফল্যই তার জন্যে খুলে দিল গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমের দরজা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সন্ধান মিলে গেল তার; এবং সেই থেকে প্রায় ধর্মীয় গোঁড়ামির মতো অন্ধ-নিরুপায়তায় সে দেশ এবং জাতির বিষয়ে সবরকমের আলোচনা অনেক দিনের জন্যে এড়িয়ে গেছে।যখন বোঝা গেল, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থাগম হয়েছে, তখন নতুন করে হঠাৎ পুরোনো স্বাদেশিকতার ঝোঁক ফিরে এল তার। সে বহু অর্থ ব্যয় করল কলগীতির জন্যে। এত বিপুল অর্থব্যয় দেখে সঙ্কুচিত পিংলা তাকে জিজ্ঞেস করে, ধর, ব্যবসা তো, লোকসানই হল এতে, টাকাটা তোমার ডুবেই গেল, তখন কী করবে তুমি?ডুবে গেলে আবার আয় করব, গানের থেকেই আয় করে নেব আবার; সেটা কোন কথা নয়, বলেছিল নজরুল; কিন্তু, একটা কথা তোকে বুঝতে হবে, আমি তো ঠিক ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে যাব মনে করে এই ব্যবসাটায় নামছি না। এটা একটা আন্দোলন, আন্দোলনটা শুরু করতে চাইছি আমি। আর যথাসর্বস্বই যদি পণ না করি, তাহলে আমার কথা শুনবে কেন লোকে?এই যথাসর্বস্ব খোয়ানোর পরেও গ্রামোফোন রেকর্ডের কপিরাইটজনিত ক্রমবর্ধমান অর্থে আবার সে হয়তো ফিরিয়ে আনতে পারত তার পুরোনো আর্থিক অবস্থা – যা সে যথেষ্ট জোর দিয়ে বলেওছিল পিংলাকে – কিন্তু সবকিছু বদলিয়ে গেল প্রমীলার অসুস্থতায়। ক্যাশ প্রায় শেষ, গাড়ি ফেরৎ চলে গেছে, বরদাচরণের সলিসিটর-শিষ্য অসীমকুমার দত্তর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অতি দ্রুতগতিতে নজরুলের কপিরাইটের সমস্ত টাকা গিলে নিচ্ছে। অখ্যাত-অর্ধখ্যাত শিল্পী যশঃপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ বাবদ গ্রামোফোন কম্পানীর সামান্য মাসোহারা আর রেডিও কম্পানীর প্রোগ্রামভিত্তিক পারিশ্রমিক ছাড়া বস্তুত অর্থাগমের কোন রাস্তাই যখন নেই, তখন বোধ হয় আরেকবার বাইরের জগতের দিকে তাকিয়ে দেখল নজরুল। বরদাচরণের প্রভাবে ততদিনে দৃষ্টি অনেকটাই ঘোলাটে হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই সময়ের তোলপাড়-করা একটা ঘটনা ধীরে ধীরে তার চোখ খোলাতে শুরু করে। সুভাষবাবু য়্যোরোপ থেকে ফিরে এসেছেন সাঁইত্রিশে, তারপর বেশ কিছু দিন সরকার-জনতার টাগ-অব-ওয়রের পর অবশেষে মুক্তি মিলেছে তাঁর, এবং সেই বছরেই কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিশ্ব-জোড়া যুদ্ধের প্রস্তুতির মুখে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনোত্তর ভারতের গঠনমূলক প্রস্তুতির কাজ অতি বেগে শুরু করে দিয়েছেন সুভাষ। তাঁর প্রায়-অমানুষিক উদ্যম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নানা উদ্যোগ, বাম-ঘেঁসা সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের ধারণা আর ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় সরকারের তথাকথিত ফেডারেশনের কৌশলের প্রকাশ্য বিরোধীতা গান্ধীসহ দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসীদের কাছে সুভাষকে জাতিভ্রষ্ট – প্রায় অচ্ছুত – করে তুলল। আটত্রিশের সভাপতি সুভাষের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে অন্য কোন বামপন্থী নেতার অভাবে যখন দ্বিতীয়বার – উনচল্লিশেও – সুভাষ সভাপতির পদে নির্বাচিত হলেন, তখন কোনরকম লাজলজ্জার তোয়াক্কা না করে নির্বাচিত সুভাষের প্রকাশ্য বিরোধীতা শুরু করলেন মহাত্মা। দিব্যদৃষ্টিতে নয়, পাকিয়ে-ওঠা মহাযুদ্ধের পটভূমিতে ভারতের স্বাধীনতা আর যে বেশি দূরে নয় তা খোলা চোখে দেখতে পেয়ে এবং বুঝতে পেরে পদত্যাগী সুভাষ কংগ্রেস-সভাপতিত্ব ছেড়ে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ফিরে এসে প্রত্যক্ষ লড়াইতে প্রায় নেমে পড়লেন। সিরাজদ্দৌলা দিবস পালন এবং হলওয়েল মনুমেন্টের অপসারণের দাবি সুভাষের মাস্টারস্ট্রোক – একই দিনে ফরওয়র্ড ব্লকের হিন্দু কংগ্রেসী আর মুসলিম লীগের মুসলমান ছাত্রের দল হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ দিয়ে নেমে পড়ল লড়াইয়ে।এতদিন পর নজরুলের মনে পড়ে যায় বছর দশেক আগের এক শীতের দুপুরে রাজশাহিতে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মশায়ের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা। বোয়ালিয়া থানার লাগোয়া অক্ষয়কুমারের লোহার পিলার দেওয়া বাড়িতে নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হল। তখন বৃদ্ধ হয়েছেন মৈত্রেয় মশাই, সত্তর ছুঁই ছুঁই – অশক্ত শরীর। নজরুলের মনে আছে, প্রায়-তিরিশের যুবা নজরুলকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেছিলেন, আমরা অস্তমিত সূর্য, তুমি নতুন উদিত সূর্যের দীপ্তি নিয়ে এসেছ। আমি কল্পনা করিনি যে জীবনসায়াহ্নে তোমাকে এত কাছাকাছি কখনো পাব। প্রণাম করে নজরুল বলেছিল, যিনি অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন, যিনি সত্যকে সমাদৃত করতে পারেন তিনি মরতে পারেন না। দোয়া করুন আপনার চিন্তা ও চেতনাকে আমি যেন আমার কাব্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারি।সেই স্মৃতি তো ভুলতেই বসেছিল নজরুল। আজ সুভাষ নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন সে কথা। এবং সেই-কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে সুভাষের প্রস্তাবিত সিরাজদ্দৌলা দিবসের সমর্থনে মুসলিম লীগ-আকরম খাঁ-য়ের আজাদ পত্রিকায় বিবৃতি দিল। তার তখন আবার মনে পড়ে যায় সদ্য-যৌবনে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সে তার শৈশবের স্বপ্নের বিপ্লবের সন্ধানে মাষ্টারমশাই নিবারণচন্দ্র ঘটকের নির্দেশে ময়মনসিংহ হয়ে কুমিল্লায় পৌঁছিয়ে গান্ধীর আহ্বানে কী ভাবে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। সেই অসহযোগ আন্দোলন, যা ঘোষণা করবার আগে গান্ধী মাত্র এক বছরেই স্বাধীনতা এনে-দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এমনকি যুগান্তর-অনুশীলনের ছেলেদেরও তাঁর আন্দোলনে নিয়ে এসেছিলেন। অথচ চৌরিচৌরার একটা ঘটনাতেই এই বিশাল জননেতা একাই এতদিনের এতজনের এত কৃচ্ছসাধনকে তুচ্ছ করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা করে দিলেন! এবার অনেক অনেক বছর পর তেইশে ডিসেম্বর কলকাতার মুসলিম ইনস্টিট্যুট হল-এ ছাত্র-সমাবেশে নজরুলের বক্তৃতায় সেই স্মৃতি উচ্চারিত হল: “...জরার প্রধান ধর্ম হল – অতি সাবধানে পা টিপে টিপে বিচার করতে করতে চলা। এই অতি সাবধানীরা (ভীরু না-ই বললাম) অগ্রগমনের পথ পরিষ্কার না করে পশ্চাতে 'রিট্রিট' করার পথ উন্মুক্ত রাখতে চান। আগে-চলো-মারো-জোয়ান-হেঁইও বলে এগুতে এগুতে যেই এসে পড়ল চৌরিচৌরার দুটো খুনোখুনি, অমনি সেনাপতির কণ্ঠে ক্রন্দন ধ্বনিত হল – 'পিছু হটো, পিছু হটো।' গণ-ঐরাবতের পায়ে কাপাস-তুলো চরকাকাটা সুতোর পুঁটুলি বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও তার বিপুল আয়তনের জন্য দুটো চারটে লোক মারা গেল এইটাই সেনাপতির চোখে পড়ল – আর (ভারতের কথা ছেড়ে দিলাম) এই বাংলাদেশে যে কালাজ্বর আর ম্যালেরিয়ায় বছরে বছরে এগার লক্ষ করে লোক cold blooded murdered হচ্ছে সেদিকে একচক্ষু সেনাপতির দৃষ্টি পড়ল না।”উদ্দীপ্ত এই ভাষণের সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল নজরুলের নতুন অভ্যাসজাত রহস্যময়তাও: “মৃত্যুর ভয় যার হয়তো নিজের গেছে – কিন্তু অন্যের মৃত্যু দেখলে যার মৃত্যুযন্ত্রণা হয় ভয়ে কূর্ম-অবতার হয়ে যান – তিনি আর যাই করুন অমৃতসাগরের তীরে নিয়ে যাওয়ার সাধনা তাঁর নিষ্ফল হয়েছে। সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারের মধ্যে যিনি পরম নিত্যম, নিত্য পূর্ণম্‌ – তাঁকে যিনি উপলব্ধি করলেন না, তাঁর সংহারের রূপকে যিনি অস্বীকার করলেন, ভয়ের পশ্চাতে অভয়কে দেখলেন না, তিনি আর যাই পান – পূর্ণকে পাননি। তবু কাঠ পুড়ছে বলে, যে শুধু কাঠের ধ্বংসই দেখল, আগুনের সৃষ্টি দেখল না, তার দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন নয়। এঁর এক চোখে দৃষ্টি আছে আর বাকি যারা তারা একেবারে দৃষ্টিহীন অন্ধ। এঁরা হাতে বড়ো বড়ো মশাল জ্বেলে চলেছেন – কিন্তু অন্ধের হাতে মশাল যত না আলো দেয় তার চেয়ে ঘর পোড়ায় বেশি।”উনিশশো পঁয়ত্রিশের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সাঁইত্রিশের নির্বাচনের ফলে যখন হকসাহেবের প্রধানমন্ত্রীত্বে বাংলায় লীগ-হক মন্ত্রীসভার শাসন এল, বাংলার মুসলিম লীগ দলের পক্ষে সারা ভারতের নিরিখে সেই নির্বাচনের ফলই ছিল উজ্জ্বলতম, যদিও শুধুমাত্র নিজেদের বিজয়ী প্রার্থীদের জোরে মন্ত্রীসভা গঠনের মতো নয়। যে প্রদেশগুলোয় মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক বেশি নির্বাচিত হয়েছে, সেখানেও নির্বাচিত মুসলমানরা প্রায় সবাই জিতেছে কংগ্রেস-প্রার্থী হিসেবে, কংগ্রেসের টিকিটে; মুসলিম লীগ বা অন্য কোন মুসলিম সংগঠনের প্রার্থী হিসেবে নয়। কংগ্রেস আর হকসাহেবের কৃষকপ্রজা দলের মিলিত মন্ত্রীসভা গঠনের জোর গুজব তখন চলছিল বাজারে, শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস পিছিয়ে যাওয়ায়লীগ-হকের সমন্বয়।এমন অবস্থায়, মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌কে যদি সারা ভারতের প্রধানতম মুসলিম নেতা হয়ে উঠতেই হয়, তাহলে যে চার প্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যাই প্রধান – বাংলা, পঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত – পুরোপুরি সেই চার প্রদেশই না হোক, অন্তত বাংলা আর পঞ্জাবে জিন্নাহ্‌র প্রধান নেতা হয়ে ওঠা বড়ই প্রয়োজন। অথচ বাঙালি-মুসলমান-প্রধান বাংলায় সেই সময় একচ্ছত্র মুসলিম নেতা তো ফজলুল হক, আর সেই নেতৃত্ব তো দুয়েকদিনে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক শেষ হবার পর, সেই উনিশশো বত্রিশ সালে, বিলেতেই থেকে গিয়েছিলেন জিন্নাহ্‌ সাহেব, নতুন করে একটা পোলিটিকাল কেরিয়ার তৈরি করতে চাইছিলেন তিনি বিলেতে, চেষ্টা করে দেখছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টেই কোন আসন পাওয়া যায় কিনা।আর ফজলুল হক? পটুয়াখালির বড় জমিদার এবং প্রতিষ্ঠিত উকিলের তিনি পুত্র, কলকাতার শিক্ষিত সমাজে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব এবং পরিচয়। প্রেসিডেন্সিতে বিজ্ঞান পড়েছেন চার বছর, স্যর পি-সি রায়ের তিনি প্রিয় ছাত্র, কেমিস্ট্রির সঙ্গে সঙ্গে স্যরের মতো শেক্‌স্‌পীয়রও আবৃত্তি করতে পারেন অবিরাম, স্যর আশুতোষের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন হাই কোর্টে। বাংলা বলেন বরিশালের ভাষায় আর টানে, ইংরিজি আই-সি-এসদের মতো। আর সেই উনিশশো বত্রিশেই মুসলিম জমিদার, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আর কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের নিয়ে শুধুই নিখিল বঙ্গ মুসলিম সম্মিলনই করলেন না হকসাহেব, বৃহত্তর কলকাতা আর আশপাশের জেলাগুলোয় হরেকরকমের মুসলিম-প্রধান পেশায় নিযুক্ত যারা – দর্জি, কসাই, জাহাজের লশকর, ছোট-বড় দোকানদার – সবাইকে নিয়ে নিয়মিত মীটিং করতে লাগলেন। এর আগে দু'দফায় তিনি নবযুগ দৈনিক চালিয়েছেন, প্রথম দফায় তাঁর মূল সহযোগী ছিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ আর নজরুল, দ্বিতীয় দফায় মুজফ্‌ফর না-থাকলেও নজরুল তো তখনও ছিলেন কিছুদিন। কাজেই নানাসূত্রে বহুরকম মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। স্পষ্টতই স্বতন্ত্রভাবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আসন তৈরি করে যখন খানিকটা জমি ছাড়তে প্রস্তুত ব্রিটিশরাজ, তখন হকসাহেবই বাঙালি মুসলমানদের প্রথম জানালেন, এই প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে কিছু মর্যাদা তাদের প্রাপ্য। আর প্রাপ্য ঘোষণা করলেই কোন প্রাপ্তি যে হবে না, তা-ও স্পষ্ট করলেন হকসাহেব; আদায় করে নিতে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে। তেত্রিশ সালের অক্টোবরের বার তারিখে স্টেট্‌স্‌ম্যান-এ হকসাহেব লিখলেন, যে কোন বিচারকের সামনে যদি আমি প্রমাণ না-করতে পারি যে বাঙালি হিন্দুরা হল মূর্তিমান সাম্প্রদায়িকতা আর তার ভিত হল এই হিন্দুদের চূড়ান্ত স্বার্থপরতা – তাহলে আমি ফাঁসি যেতেও রাজি আছি।বহুদিন কংগ্রেসের সভ্যও ছিলেন হকসাহেব, আর মুসলিম লীগেরও তো বটেই। অর্থাৎ সে-সময়ের মুসলিম-রাজনীতিতে হকসাহেবকে এড়িয়ে যাওয়া চলতই না। এমনকি অত বড় যে কট্টর লীগপন্থী ব্যারিস্টার সারাওয়র্দি, তাঁকেও বাংলায় নেতৃত্বের সুযোগ তো হাতে-ধরে করে দিয়েছিলেন হকসাহেবই। মেদনীপুরের বাঙালি হলে কী হয়, বাংলা তো বলতেই পারতেন না সারাওয়র্দি সাহেব, অন্তত প্রকাশ্যে বলতেন না কখনও। সেই সারাওয়র্দিকে কলকাতায় খিদিরপুর ডকের বাঙালি লশকরদের ইউনিয়নের কাজে প্রায় হাতে-ধরে বসিয়ে দিয়েছিলেন হকসাহেব। আলিপুর কোর্টের উকিল মহম্মদ দাউদ তখন তার আদালতের যোগাযোগের জোরে কলকাতায় ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের বড় পাণ্ডা, অকংগ্রেসী অখিলাফতি দাউদ হকসাহেবেরও চেলা। ডক অঞ্চলের নানা বস্তিতে নতুন-গজিয়ে-ওঠা একদল দুষ্কৃতির দাপটে তখন কলকাতায়-নতুন-আসা জাহাজী লশকরদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ওকালতি ক্ষমতার জোরে এই দুষ্কৃতিদের শায়েস্তা করেছে দাউদ। এখন সে জাহাজ-শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করায় ব্যস্ত, ট্রামের শ্রমিকদেরও সে জোট বাঁধতে শেখাচ্ছে। হকসাহেবের অনুরোধে সারাওয়র্দিকেও ডক-অঞ্চলে জায়গা করে দিল দাউদ।ফলত একরকমের বাধ্যই হন অল-ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌ ফজলুল হককে সব সময়ই সামনে, অর্থাৎ নেতার আসনে, রাখতে। চল্লিশ সালের চব্বিশে মার্চ ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে মুসলিম লীগের সম্মেলনে প্রস্তাব দেওয়ানো হল হকসাহেবকে দিয়ে, আর আঠাশে মার্চ তাঁরই সরকারের তৈরি কলকাতা ম্যুনিসিপাল আইন (সংশোধন)-এর আওতায় ভোট হল কর্পোরেশনের। এই ভোটের সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস (সুভাষপন্থী)-র সঙ্গে সমঝোতা হল মুসলিম লীগের!আবার চল্লিশের ডিসেম্বরের প্রথম দিনেই, ১-লা ডিসেম্বর, ভেঙে গেল হক-লীগ মন্ত্রীসভা। ৪-ঠা ডিসেম্বর, ১৯৪০, হকসাহেব নতুন-করে-তৈরি-হওয়া প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির নেতা হিসেবে নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের দাবি জানান, যার দাবিদারদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদও আছেন, আবার আছেন সুভাষপন্থীরাও! অনেক টালবাহানা করে ব্যাপারটাকে ঠেকিয়ে রাখলেন ছোটলাটসাহেব হার্বার্ট যতদিন পর্যন্ত না লীগের নেতারা কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারেন। মুশকিলটা হচ্ছে, সুভাষবাবুর সমর্থনে আবার এদিকে কর্পোরেশনে রাজত্ব চালাচ্ছে লীগ!ব্যাপারটা যখন এরকমই, তারই মধ্যে মাঝে-মাঝেই লীগের নেতৃত্ব এমন একটা অবস্থা তৈরি করে যে সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে যায়, তখন নতুন একটা মতলব আসে হকসাহেবের মাথায়। মুসলিম-প্রধান বাংলায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুরাই বেশি, কিন্তু জনসংখ্যায় প্রধান মুসলমানরাই। এ-অবস্থায় মাথা-ঠাণ্ডা রেখে মুসলমানদের প্রাপ্য অধিকারের ব্যাপারটা সংখ্যালঘু হিন্দুদের যতদূর সম্ভব অসন্তুষ্ট না-করেও সামলাতে হলে, সূক্ষ্ম কূটনীতির প্রয়োগ প্রয়োজন।হকসাহেব লক্ষ্য করেছেন, সবরকমের পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যেও মুসলিম লীগ – বিশেষত ওই মুসলিম লীগের বাঙালি তরুণ নেতাকর্মীরা – সুভাষের বিশেষ অনুরাগী। এই তরুণ দলের উপর নজরুলের প্রভাবও যে কতটা তা-ও হকসাহেব জানেন ভালোমতই। নিজের নেতৃত্ব আর ভাবমূর্তি বজায় রাখবার জন্যে একটা খবরের কাগজের কথা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন হকসাহেব। নজরুলের কথা মাথায় আসবার পর আর একটু গভীর চিন্তা করেন তিনি। নজরুল নিজে প্রায় কট্টর সুভাষপন্থী। সুভাষের অত্যাশ্চর্য বেপরোয়া নিষ্ক্রমণের পর যখন বিড্‌ন্‌ স্কোয়্যারে সুভাষ দিবস পালন করল সুভাষপন্থী কংগ্রেস, অর্থাৎ ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা, সেই সময় সুভাষের নিজের পরিবারের ভয়-পেয়ে-যাওয়া সদস্যরা অনুপস্থিত থাকলেও অসুস্থ শরীর নিয়েও নজরুল কিন্তু এসেছিলেন সেই সুভাষ দিবস পালন করতে। হকসাহেব নিজেও সুভাষকে পছন্দই করেন, সে তো তাঁর কলেজের প্রাক্তনীও!হক সাহেব শুনেছেন, আর্থিকভাবে আজকাল একটু অসুবিধের মধ্যেই আছে নজরুল। হিন্দু-মুসলমান – বিশেষ করে দুই সম্প্রদায়েরই তরুণরা, তরুণরা অন্তত – তার বিশেষ অনুরক্ত। প্রধান সম্পাদক হিসেবে নজরুলের পরিচালনায় একটা কাগজ নিজের হাতে থাকলে জনসাধারণের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগটাও থাকে। আর নজরুল তো তাঁর পুরোনো বন্ধু। এর আগে – যত কম সময়ের জন্যেই হোক – দু-দুবার নবযুগ চালিয়েছেন তিনি। দুবারই নজরুল তাঁর সঙ্গে ছিল, যদিও কাগজে পরিচালক হিসেবে তাঁর নামই থাকত। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। আবার তিনি নবযুগ বের করবেন। এবার আর এক-পাতার কাগজ নয়। বাজারের আর-পাঁচটা কাগজের মতোই কাগজ হবে এবার। কাগজে-কলমেও প্রধান সম্পাদক এবার হবে কাজি নজরুল ইসলাম।দেরি করেন না হকসাহেব। উনিশশো একচল্লিশের অক্টোবরে নতুন করে প্রকাশিত হল দৈনিক নবযুগ, প্রধান সম্পাদক কাজি নজরুল ইসলাম। বেতন সাড়ে তিনশো টাকা, রেডিও আর গ্রামোফোন কম্পানীর কাজও প্রয়োজন মত চালিয়ে যাবার অনুমতিও দেওয়া হল তাকে।প্রথম দিন অফিসে এসেই একটা পোস্টকার্ডে পিংলাকে চিঠি লিখতে বসে নজরুল, “ভাই পিংলা, শেষ যেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলি, রোজ রোজ যত পারি বাংলা কবিতা লিখতে বলে গিয়েছিলি তুই। লেখা হয়নি, আর তোর উপদেশ মতো রেডিওতে কবিতার আসরের জন্যে দরবারও করা হয়নি। আজ থেকে হকসাহেবের নতুন দৈনিক নবযুগে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলুম। মনে করিস না সেই টার্ণার স্ট্রীটের দোতলা বাড়ির একতলার একটা ছোট্ট অংশে গোটা কয়েক চেয়ার-টেবিল-টুল-আলমারির অফিস। লোয়ার সার্কুলার রোডে শেয়ালদা স্টেশনের কাছাকাছি একটা বড়সড়ো গোটা বাড়ি যোগাড় করেছেন হকসাহেব। হক সাহেবকে বলে দিয়েছি, প্রত্যেক দিনই এই কাগজে আমার একটা কবিতা বেরোবে, যেদিন অন্য কবিতার মূড আসবে না সেদিন কোন একটা সম্পাদকীয় লিখব কবিতায়; বেশ হবে, না? এখানে বেশ গোছানো সম্পাদকীয় দপ্তর, মনে হচ্ছে কাজ করে আরাম পাব। তবে একটাই দুশ্চিন্তা, হকসাহেব কাজের স্বাধীনতা কতটা দেবেন। আমার মনে হয়, আমার সঙ্গে মুসলিম লীগের যুবকদের আর ছাত্র লীগের নেতাদের যে সম্পর্ক তারই জোরে এই চাকরিটা পেলুম, খোয়াতে কতদিন লাগবে জানিনা।শ্যামপুরে তোর কাজ তো ভালোই এগোচ্ছে খবর পেলুম। ভাবছিস, খবরটা পেলুম কোথা থেকে? তুই তো জানিসই, আমাকে যিনি খবর দেবেন তিনি দুনিয়ার সব খবরই রাখেন, আমার সঙ্গে তো তাঁর বন্ধুত্ব। আমার বন্ধু অবিশ্যি তোর সঙ্গেও বন্ধুত্ব করতে ব্যগ্র, কিন্তু কতদিনে তাঁর ডাক তুই শুনতে পাবি তা তো জানি না। যেদিন পাবি তার অপেক্ষায় আছি। ভালো থাকিস। –কাজিদাচিঠিটা প্রথমেই দুবার পড়ে ফেলল পিংলা, তারপর শেষ প্যারাগ্রাফটা বেশ কয়েকবার। ঘটনাটা কী যে ঘটছে কাজিদার মনে, বুঝতে পারে না সে। চিঠিটা পড়ে মন খারাপই হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চিঠি লিখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না সে। কাজিদাকে সে বলেনি, কিন্তু এখনও এধার-ওধার কাজিদার যেসব কবিতা-টবিতা ছাপা হয়, সুধাকান্তদাদার সহযোগিতায় সেগুলো পড়ে সে, যত পড়ে ততই মন খারাপ হয় তার। অগ্রনায়ক নামে তার সাম্প্রতিক একটা কবিতা তাকে দিয়েছিলেন সুধাকান্তদাদা, এ-কবিতা পড়ে কি সেই কাজিদাকে চেনা যায়? কোথায় সেই 'বিদ্রোহী' কবি, সেই যার কলম থেকে বেরত নতুন পথের যাত্রা পথিক             চালাও অভিযান উচ্চকণ্ঠে উচ্চার আজ              'মানুষ মহীয়ান।' চার দিকে আজ ভীরুর মেলা,         খেলবি কে আয় নতুন খেলা, জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা          বাইবি কি উজান? পাতাল ফেড়ে চলবি মাতাল          স্বর্গে দিবি টান। আঁধার ঘোরে আত্মঘাতী              যাত্রাপথিক সব এ উহারে হানছে আঘাত              করছে কলরব। অভিযানের বীর সেনাদল             জ্বালাও মশাল চল্‌ আগে চল্‌ কুচকাওয়াজের বাজাও মাদল          গাও প্রভাতের গান। ঊষার দ্বারে পৌঁছে গাবি              'জয় নব উত্থান।'?অথচ আজকের অগ্রনায়কের কবি লিখছে, অন্তরে যদি বিপ্লব নাহি আসে বৈশাখী ঝড় আসে নাকো ভৈরব-প্রলয়োল্লাসে। বক্তৃতা দিয়া মিছিল করিয়া ধুলি উড়াইয়া ভাবি: তুফান উঠেছে, এবার মিটিবে যত বিপ্লবী দাবি। বাঁকা তলোয়ার বাঁকা চোখে হাসে তেমনি পথের বাঁকে।... মৃত্যুশঙ্কা আসিলেই সব ডঙ্কা থামিয়া যায়; মুখের কথায় লঙ্কাকাণ্ড সকলে করিতে চায়। ****** সে-ই আল্লার শক্তি লভিয়া নিত্য শক্তিমান তারি মুখ দিয়া উদ্‌গত হয় আল্লার ফরমান। অন্তরে তার বহে দুরন্ত সদা বিপ্লব-ঝড়; বাহিরে থাকে সে শান্ত, করিয়া আল্লাতে নির্ভর। তিনিই ইমাম তিনিই অগ্রনায়ক সারথি তিনি জাগাইয়া ভূমিকম্প পাষাণে চেতনা জাগান যিনি। সর্বযুদ্ধে জয়ী হন ইনি আল্লার শক্তিতে এঁর সৈন্যরা সমবেত হয় প্রেম আর ভক্তিতে।নিজেকেই সান্ত্বনা দেয় পিংলা, এ হয়তো একটা সাময়িক অবস্থা, গত কয়েকবছর ধরে কাজিদার জীবনে তো কমঝড়-ঝাপটা গেল না! তবুও বুলবুলের মৃত্যুটাও সামলিয়ে নিয়েছিল সে, কিন্তু একই সঙ্গে বৌদির এমন একটা অসুখ, আর এমন আর্থিক অবস্থা! সব-কিছু কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে গেল। যা-ই হোক, নতুন চাকরিটা হয়ে ভালোই হয়েছে মনে হয়। রেডিও আর গ্রামোফোনের কাজও চলতে পারে – চাকরির এই শর্তটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক; আশা করা যায় কিছুদিনের মধ্যে আবার পুরনো কাজিদাকে ফিরে পাওয়া যাবে।চাকরিটা ভালোই, কিন্তু যে ব্যাপারটা আগে ভাবেইনি নজরুল তা হল, নবযুগকে কেন্দ্র করে যে আড্ডাটা গড়ে উঠেছিল প্রথমবারের নবযুগের সময়, সে আড্ডাটা তো এখানে নেই। কাজেই, বাইরে থেকে যতই বেশ গোছানো বলে মনে হোক দপ্তরটাকে, সেখানে মন লাগাতে সময় তো খানিকটা লাগবেই। অবিশ্যি নতুন নতুন যাদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে তারা সবাই কাজিদাকে পেয়ে খুশি। কাজিদার খ্যাতি এবং গত পনের-ষোল বছর ধরে সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীতের জগতে তার নানারকমের কাজ আর সাফল্যের কথা তো জানেই সবাই, তার সঙ্গে কাজ করতে পাওয়ার সুযোগ অনেকের কাছেই একটা অভাবনীয় পাওনা বলেই মনে হয়। তবুও আকুল হয়ে বন্ধুদেরই যেন ডাকে নজরুল: কবি ও শিল্পী হওয়া এই দেশে দুর্ভাগ্যের কথা, বেনে মাড়োয়ারি-ভুক্ত এদেশে বাঁচে না মাধবীলতা। জানি সংবাদপত্রের যারা মালিক তাহারা বেনে, অর্থের লোভে তারাই এ বিদ্বেষ আনিয়াছে টেনে।তাহাদেরই মেনে চলতে হবে কি? ঐ রাক্ষুসে লোভেদেশের জাতির অকল্যাণের কারণ হব কি সবে?...******পলাতক ছিনু ধরিয়া এনেছে নবযুগ পুনঃ মোরেতোমরা না এলে নবযুগ পুনঃ আসিবে কেমন করে?...আনন্দধাম বাংলায় কেন ভূত প্রেত এসে নাচে?দেশী পরদেশী ভূতেরা ভেবেছে বাঙালি মরিয়া আছে! এ ভূত তাড়াব; পাষাণ নাড়াব, চেতনা জাগাব সেথা,ভায়ের বক্ষে কাঁদিবে আবার এক জননীর ব্যথা।তোমরা বন্ধু কেহ অগ্রজ অনুজ সোদরসমপ্রার্থনা করি ভাঙিয়া দিও না মিলনের সেতু মম। এই সেতু আমি বাঁধিব আমার সারা জীবনের সাধ,বন্ধুরা এসো ভেঙে দিব যত বিদেশীর বাঁধা বাঁধ।এই কবিতার আহ্বানেও খুব বেশি পুরোন বন্ধু নবযুগে আড্ডা জমাতে এল না। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই কোন-কিছুই তো ফাঁকা থাকতে পারে না, এই সময় নজরুলের যারা প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াল, তাদের মধ্যে একজন হল নবযুগের সেই-সময়কার সহকারী সম্পাদক পূর্বতন বিপ্লবী অমলেন্দু দাশগুপ্ত। নজরুলের ঘনিষ্ঠ-সান্নিধ্যে অমলেন্দুও তখন একজন যোগশিক্ষার্থী। এ-ছাড়া ওই নবযুগেরই ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি আর কালীপদ গুহ। কালীপদ গুহর সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয় বহরমপুরের জেলে। সেই সময় নজরুলের লেখা একটা উচ্চকিত-কণ্ঠ কবিতা জেলখানার এক গার্ডের কাছে লুকোতে গিয়ে গোটা কাগজটাই নিমেষে গিলে ফেলেছিল কালীপদ। আজ এতদিন পর তার সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভারি খুশি নজরুল। এ ছাড়াও, নজরুলেরই প্রায় সমবয়েসী জুলফিকার হায়দার এবং তার স্ত্রী রাবেয়ার সঙ্গেও নজরুলের খুবই ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে সেই সময়ে। জুলফিকারও নজরুলের মতই স্কুলের শেষ পরীক্ষা না-দিয়ে যুদ্ধে চলে যায় উনিশশো সতেরয়। সেনাদলের প্রশিক্ষণের জন্যে নজরুলকে যেতে হয়েছিল পেশোয়ারে, আর জুলফিকার গিয়েছিল বোম্বাই। যুদ্ধ শেষ হলে ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জী কম্পানীতে জুলফিকার চাকরি করতে ঢোকে, আর সেই সুবাদে পৃথিবীর অনেক দেশেই যাবার সুযোগ হয়েছিল তার। কবিতাও লিখত জুলফিকার, সেই কবিতায় নজরুলের প্রভাব কম ছিল না।ধীরে ধীরে নবযুগে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল নজরুল। সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নানা খবরের পরিবেশন এবং বিশ্লেষণ ছাড়াও নতুন নতুন উৎসাহী পাঠক তৈরিতে বেশ খানিকটা সফল হল সে। মননে, বয়েসে, শিক্ষায়, পেশায়, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর পাঠকদের জন্যে তৈরি হল নির্দিষ্ট আলাদা-আলাদা বিভাগ। প্রতিদিনের কাগজের অষ্টম পৃষ্ঠা এই বিশেষ বিভাগগুলোর জন্যে নির্দিষ্ট। সোমবার ছোটদের পাতা, প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিল খোশরোজের মেলা, পরিচালনায় আতশবাজ। বেশিদিন এ-নাম ভালো লাগল না কবির নিজেরই, নাম বদলিয়ে করা হল “আগুনের ফুলকি,” সভ্যদের বলা হত ফুলকি, সঙ্গে থাকত সংখ্যা। অর্থাৎ যে-সব ছেলেমেয়েরা “আগুনের ফুলকি”র সভ্য হত, তাদের পরিচয় ফুলকি ১, ফুলকি ২ ইত্যাদি। নতুন নাম ঘোষণা করা হল নতুন কবিতার সঙ্গে; কবিতার নাম আগুনের ফুলকি ছুটে, লেখক কাজি নজরুল ইসলাম: আগুনের ফুলকি ছুটে       ফুলকি ছুটে! আগুনের ফুলকি ফুটে       নবযুগ-পত্রপুটে আগুনের ফুল কি ফুটে? ইত্যাদি।মঙ্গলবার মহিলাদের জন্যে নির্দিষ্ট বিভাগ, “মহিলা আসর,” পরিচালিকা শিরী।বুধে “লাঙ্গল ও হাতুড়ি,” শ্রমজীবীদের আসর, পরিচালক শ্রমসুন্দর।বৃহস্পতিবার “ব্যবসা ও বাণিজ্য,” পরিচালক সওদাগর।শুক্কুর বারে “বিশ্ব মুসলিম,” পরিচালক এব্‌নে খল্‌দুন।শনিবারে মঞ্চ ও ছায়াছবির জগৎ নিয়ে বিশেষ বিভাগ “রূপ ও ছন্দ,” সম্পাদক রূপকার।আর, অষ্টম পৃষ্ঠায় প্রতি রবিবার সাহিত্যবাসর “রসের জলসা।” স্বয়ং নজরুল ইসলাম যে পত্রিকার সম্পাদক, তাতে কি আর সাহিত্যবাসরে আলাদা করে কোন সম্পাদক লাগে?পয়লা ডিসেম্বর বিরাট খবর নবযুগে, আকর্ষক হেডলাইন: হক মন্ত্রিসভার পদত্যাগ: বাঙ্গলার মন্ত্রি-সঙ্কটের অনিবার্য্য পরিণতি/ সোমবার দ্বি-প্রহরে লাট-ভবন হইতে ইশ্‌তাহার/ গভর্ণরের সিদ্ধান্তসাপেক্ষে মন্ত্রিদিগকে স্ব স্ব কর্তব্য পালনের নির্দেশ/ বাঙ্গলার নূতন মন্ত্রিসভা গঠন সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা/ প্রগ্রেসিভ এ্যাসেম্বলী পার্টির সেক্রেটারীর বিবৃতি।এর পরের দিন স্পষ্টতই হক সাহেবের সমর্থনে সম্পাদকীয়। দায়ী কে? – এই শিরোনামে বেশ দীর্ঘ এই সম্পাদকীয়, তারই কয়েকটা লাইন: “......মন্ত্রিসভার যে কলহ বাধিয়াছিল, তার জন্যও হক সাহেব দায়ী ন'ন, এবং পরিণামে হক মন্ত্রিসভার যে পদত্যাগ করিতে হইল, তার জন্যও হক সাহেব দায়ী ন'ন। মন্ত্রিসভায় কলহ বাধিল কেন? যে-কোয়ালিশন চার বছর ধরিয়া ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণভাবে হক-মন্ত্রিসভার প্রত্যেক মন্ত্রীকে সমর্থন করিয়া আসিয়াছিলেন, সেই কোয়ালিশনের একটা বিরাট দল, যে-কোন কারণেই হোক, বলিলেন যে, অমুক মন্ত্রীর প্রতি তাঁদের আস্থা নাই, তিনি মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব সুষ্ঠুরূপে পালন করিতে পারিতেছেন না; কাজেই তিনি পদত্যাগ করুন। ভদ্রলোক যদি মন্ত্রিত্বের গদি কামড়াইয়া পড়িয়া না থাকিতেন, তিনি যদি কোয়ালিশনের ঐ বিরাট অংশের মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাইয়া মন্ত্রিত্বের লোভ ত্যাগ করিতেন, তবে পরের দিনই কোয়ালিশন দলের ঐক্য ও মুসলিম-সংহতি কায়েম হইয়া যাইত।“স্বার্থত্যাগ করিয়া মুসলিম সংহতি রক্ষার দরুণ উক্ত পদত্যাগী মন্ত্রী মুসলিম জনগণের চোখে ঊর্দ্ধে উঠিয়া যাইতেন। মুসলিম বাঙ্‌লার সামনে একটা ত্যাগের আদর্শও স্থাপিত হইত।“কিন্তু তিনি এই সব কিছুই করিলেন না। “মুসলিম সংহতি চুলায় যাউক, আমার মন্ত্রিত্ব থাকিলেই হইল” বলিয়া তিনি ছিনা-জোঁকের মত মন্ত্রীত্বের গদিতে মরণ-কামড় মারিয়া পড়িয়া থাকিলেন। অথচ হক সাহেব প্রধান মন্ত্রী হিসাবে কোয়ালিশনের লিডার হিসাবে ও গণনেতা হিসাবে কোয়ালিশনের ৪৭ জন সদস্যের সমবেত অভিমত উপেক্ষাও করিতে পারিলেন না। তিনিও, কাজেই, উক্ত মন্ত্রীকে পদত্যাগের জন্য প্রথমে অনুরোধ ও অবশেষে আদেশ করিলেন...।“...তাই দল বাঁধিয়া তাঁরা পদত্যাগ করিলেন। এতেই হক মন্ত্রিসভার পতন হইল।” এবং এই সম্পাদকীয়র শেষে নজরুলের 'আল্লা পরম প্রিয়তম মোর' শিরোনামে নাতিক্ষুদ্র এক কবিতা! এবং এটাই এখন নজরুলের সিগনেচার-ছাপ!আসলে, সাম্প্রতিক মুসলিম রাজনীতি ঠিকঠাক বুঝতে পারে না নজরুল। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি রক্ষার ব্যাপারে দেশবন্ধু, এবং তাঁর অকালমৃত্যুর পর সুভাষবাবু, যে উদারতার সঙ্গে সম্প্রদায়গত বিভেদের মোকাবিলা করবার চেষ্টা করেছেন, এমনটা আর কেউ করেছেন বলে নজরুলের জানা নেই। ছাব্বিশ সালের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময় নজরুল কৃষ্ণনগরে। সে বছর সে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির সভ্যও নির্বাচিত হয়েছিল। এই সম্মেলনের তিন বছর আগে চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ পার্টির নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জের অধিবেশনে যে হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট অনুমোদিত হয়েছিল, ছাব্বিশের সম্মেলনে, যখন চিত্তরঞ্জন আর নেই আর সুভাষ জেলবন্দী, তখন 'কংগ্রেস কর্মীসঙ্ঘ' নাম দিয়ে কংগ্রেসের এক শক্তিশালী উপদল প্যাক্ট ভেঙে দেবার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছিল কৃষ্ণনগরে। ওই প্যাক্ট আর তখন বাঁচিয়ে রাখার কোন উপায়ই ছিল না; দেখেশুনে নজরুল মজা করেই লিখেছিল বদ্‌না-গাড়ুতে গলাগলি করে, নব প্যাক্টের আশনাই, মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই!জল অনেকটা গড়িয়ে উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের নতুন প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী যখন সাঁইত্রিশে বিভিন্ন রাজ্যে প্রাদেশিক নির্বাচন হয় – জওহরলাল নেহ্‌রু যখন কংগ্রেস-সভাপতি – সেই নির্বাচনে, শুধুমাত্র শিডিউল্‌ড্‌ কাস্ট হিন্দুই নয়, মুসলমানদের জন্যেও সংরক্ষিত আসন থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস আশাতীত ভালো ফল করে। এমনকি নির্বাচিত মুসলমানদেরও একটা বড় অংশ – মুসলিম লীগ নয় – কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে জয়লাভ করে। সেই সময় জওহরলাল মন্তব্য করেন, ভারতের ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে পক্ষ কেবলমাত্র দুটিই, কংগ্রেস আর ব্রিটেন, অন্য কোন তৃতীয় পক্ষই নেই! জিন্নাহ্‌, সেই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, সারা ভারতে মুসলিম জনসংযোগ শুরু করলেন উলেমাদের সাহায্য নিয়ে। এর আগেই আলিগড় য়্যুনিভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষকদের একটা আন্দোলন তৈরি হচ্ছিল – সেটা অবিশ্যি অভিজাত মুসলমানদের আন্দোলন, একটু এলিটিস্ট। সাধারণ মুসলমানদের এড়িয়েই চলত তারা! কিন্তু উলেমাদের যোগদানের পর সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও খানিকটা অস্পষ্ট একটা মুসলিম নেশনহূডের ধারণা তৈরি হতে শুরু করল। উনিশশো উনচল্লিশের মধ্যেই মুসলিম লীগের সভ্যসংখ্যা ছাড়িয়ে গেল তিরিশ লক্ষ!উনচল্লিশে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিটিশরাজ ভারতের হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে অনেকেই, যেমন জওহরলাল, রাজাগোপালাচারি, মৌলানা আজাদ ইত্যাদি, আদর্শগত ভাবে এই যুদ্ধে ব্রিটেনেরই সমর্থক ছিলেন, কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে এমনকি পরামর্শও না-করে তাদেরই হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করার প্রতিবাদে কংগ্রেস সমস্ত মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করল। এই সুযোগ, নেহ্‌রুর 'কোন তৃতীয় পক্ষই নেই'-এর জবাব দিয়ে দিলেন জিন্নাহ্‌, এই আপৎকালীন অবস্থায় আমরা সরকারের পক্ষে আছি। তিনপক্ষের এক পক্ষ আমরা! ওয়ান আপন থ্রী! এখন কোন বিষয়ে আলোচনা-সিদ্ধান্ত আমাদের বাদ দিয়ে করা চলবে না; কংগ্রেসের বড়দাগিরি আমরা মানি না, আমরা কংগ্রেসের পদত্যাগে ডেলিভারেন্স ডে পালন করছি, মুক্তি দিবস!বাংলার প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব কখনো কখনো লীগ, কখনো তিনি কৃষক-প্রজা, কিছুদিন পর অবিশ্যি লীগে তাঁর সভ্যপদও কেড়ে নেবেন জিন্নাহ্‌, কিন্তু পরের কথা পরে! সে সময় বাংলায় মুসলিম লীগ প্রধানত অবাঙালি মুসলিমদের দল: আর তাই যদি হয়, তাহলে কোন্‌ নেশনভুক্ত বাঙালি মুসলমানরা? বাঙালি নেশন না মুসলিম নেশন?এই নেশনহূডের তোলপাড় যখন চলছে, তখন নজরুল রাজনীতি বা শাসন ব্যবস্থা তো নয়ই – এমনকি কবিতা নিয়েই বা কতটুকু মাথা ঘামায়? সে তখন হয়তো নভোচারী – মহাকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত কোন কল্পিত মধুর তিয়াস তার তখন!অনেক দিন আগে, করাচি থেকে কলকাতায় এসে নজরুল যখন নবযুগে কাজ করতে গিয়েছিল, তখন তো নবযুগ ছিল মুজফ্‌ফর আর তাদের নিজেদের আদর্শ প্রচারের মাধ্যম। দেশের ব্যাপারে, মানুষের ব্যাপারে, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদের একটা অস্ত্র। ফজলুল হক সাহেব তো নিজেই একটা পত্রিকা প্রকাশ করে ওদের সেখানে কাজ করতে ডাকেননি, তখন প্রয়োজনটা ছিল ওদের নিজেদেরই। ওরাই হক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে, নিজেদের যোগ্যতার বিষয়ে তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্বাস উৎপাদন করিয়ে তাঁকে দিয়ে নবযুগ চালু করালো। মাসিক বেতন কতো পাবে হক সাহেবের থেকে, তা নিয়ে মাথাই ঘামায়নি ওরা। যে-লেখা নজরুল তখন লিখেছে সেই নবযুগে, তা পড়ার জন্যে কলকাতার রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত মানুষ, হকার আসতে-না-আসতেই সব পত্রিকা বেমালুম ফাঁকা।আজ সাড়ে তিনশো টাকা বেতনের চাকর নজরুল সম্পাদকীয় লেখে মূলত হক সাহেবকে সন্তুষ্ট করার জন্যে। তার মানে এই নয় যে যা সে লেখে, সে নিজেই তাতে বিশ্বাস করে না। তার নিজের মনে হয় দেশের এবং মুসলমানের স্বার্থরক্ষার জন্যেই হক সাহেব কাজ করছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে লীগ যা বলছে তা শুনলে কেমন যেন সবকিছু ঘুলিয়ে যায় তার। তাই মাঝে-মাঝেই আল্লাহ্‌ বা ঈশ্বরের প্রশস্তি করে কবিতা লেখে নজরুল। যদি সে ভুল করে থাকে কোথাও, আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ্‌ তো ভালবাসেন নজরুলকে!উনচল্লিশের এই যুদ্ধ এতদিন চলছিল য়্যোরোপে, খানিকটা উত্তর আফ্রিকায়। এবার এশিয়ায় এমন যুদ্ধে নেমে পড়ল জাপান যে তোলপাড় হয়ে গেল সারা পৃথিবীতে। সাতুই ডিসেম্বর জাপান শুধুই যে ঘোষিতভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ঢুকে পড়লতা-ই নয়, সরাসরি আক্রমণ করে বসল আমেরিকার বন্দর ও সেনাবাস, পার্ল হার্বার। পনেরই ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ব্রিটিশ রাজশক্তির জাপানের কাছে আত্মসমর্পণ, পলায়ন বর্মা থেকে, আর সিঙ্গাপুরের পতন!সুভাষের সেই জানুয়ারি মাসের নিষ্ক্রমণের পর তাঁর আর কোন খবর নেই সাধারণ ভারতবাসীর কাছে। সুভাষ কোথায়? – কেউ জানে না। কলকাতায় জোর গুজব, সুভাষের বদলে এবার শরৎ বোসকেই গ্রেপ্তার করবে ব্রিটিশ সরকার। পয়লা ডিসেম্বরে লীগ-হক মন্ত্রীসভার পতনের খবর তো বেরিয়েই গেছে নবযুগে। তারপর প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পার্টির নেতা হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করে মন্ত্রীসভা গঠন করার প্রস্তাবও হক সাহেব দিয়েছেন ছোটলাট হার্বার্টকে। হার্বার্ট সাহেব – সম্ভবত লীগের নেতাদের পরামর্শেই – টালবাহানা করেই চলেছেন। এমন সময় হঠাৎ দিল্লী থেকে ভাইসরয় লিনলিদগোর জরুরি বার্তা আসে ছোটলাটের কাছে: এই মুহূর্তেই হককে মন্ত্রীসভা গঠন করতে বল। জাপানের থাপ্পড় ব্রিটেনের গালে লাগবার পর বর্মা-সিঙ্গাপুর থেকে দলে দলে উদ্বাস্তুরা আসবে এবার। জেনে রেখ, জন্মগতভাবে যারা ভারতীয় এবং বর্মী, পবিত্র ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিষয়ে কোনই আবেগ নেই তাদের। খুব সম্ভবত এদের মধ্যেই মিশে থাকবে পঞ্চম বাহিনীও। অনেকেই এরা বর্মার জঙ্গল পেরিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতিদের এলাকার মধ্যে দিয়ে মূল ভারতে আসবার চেষ্টা করবে। এখন আমাদের অস্ত্র হবে পোড়ামাটি নীতি; নৌকো-জাহাজ-সাইকেল-গাড়ি সব ধ্বংস করতে হবে, ধ্বংস করতে হবে যাবতীয় খাদ্যশস্য। কাজেই তোমার প্রয়োজন এখন একটা মন্ত্রীসভা, সেই মন্ত্রীসভাকে কাজে লাগিয়েই করা যাবেএ-সব। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর নয়, পারলে আজই মন্ত্রীসভা চাই!ছোটলাটের কাছ থেকে জরুরি খবর পেয়ে হক সাহেব আসেন। মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান পেয়ে তিন জনের নাম লিখে তিনি তৎক্ষণাৎ সাহেবের কাছে দেন: তাঁর নিজের নাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, এ-ছাড়া শ্যামাপ্রসাদ আর শরৎ বোস।শরৎ বোস? – আতঙ্ক ছোটলাটের গলায়। ওকে অ্যারেস্ট করার জন্যেই তো এত তাড়াতাড়ি! ও তো জাপানের গুপ্তচর। এক কাজ করুন, ছোটলাট বলেন, আপাতত আপনি একাই শপথ নিন, ওকে অ্যারেস্ট করুন, বাকি কাজ তারপর।হকসাহেব রাজি হলেন না, ফিরে গেলেন তিনি। ফিরে আসবার আগে সাহেবকে বললেন, ওই অ্যারেস্টের কাজটুকু আপনি নিজে করিয়ে, তারপর আমায় খবর দেবেন। তারপর মন্ত্রীসভা!শেষ পর্যন্ত এগারই ডিসেম্বর হকসাহেবের নেতৃত্বে প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পার্টির মন্ত্রীসভা – যা পরে শ্যামাহক মন্ত্রীসভা নামে পরিচিত হয়েছিল – শপথ নেয়। সেদিনই সকালে ঊডবার্ণ পার্কের বাড়ি থেকে শরৎকে ভারত রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, পাঠিয়ে দেয় দক্ষিণ ভারতে। (নিষ্ক্রমণের পর যখন সারা ভারতবর্ষ সুভাষের হালহকিকত নিয়ে চিন্তিত, সেই সময় কিছুদিনের মধ্যেই শরতের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে ফেলেন সুভাষ। একচল্লিশের ৩১শে মার্চ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে ভগৎ রাম নামে একজন কলকাতায় শরতের পুত্র শিশিরের সঙ্গে দেখা করে সুভাষের চিঠি এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে যায়। শান্তিময় গাঙ্গুলি নামে একজন বিপ্লবীর সঙ্গে ভগৎ রামের যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয় সেই দিনই। পরে অবিশ্যি নানা কারণে এই যোগাযোগ ছিন্ন করতে হয়।সুভাষ সেই সময় বার্লিনে ছিলেন। কলকাতার জাপানী দূতাবাস এবং টোকিওকে কাজে লাগিয়ে শরতের সঙ্গে সুভাষের যোগাযোগের ব্যবস্থা হয়। কলকাতার জাপানী কনসাল-জেনারাল কাতসুও ওকাজাকিকে গাড়ি চালিয়ে রিষড়ায় ওঁদের বাগান-বাড়িতে নিয়ে আসতেন শিশির, এভাবেই থাকত যোগাযোগ। ওকাজাকি বদলি হয়ে যাবার পর ওতা নামের আরেকজন আসেন তাঁর জায়গায়। ওতার স্ত্রী শাড়ি পরতে ভালোবাসতেন। এই শাড়ি-পরিহিতা স্ত্রীকে নিয়ে ওতাও বহুবার শিশিরের গাড়িতে রিষড়ায় এসেছেন। শাড়ি-পরা জাপানী মহিলা, সকলের তো চোখে পড়বেই! পুলিশও নিশ্চয়ই জানত এই সব ব্যাপার-স্যাপার, হয়তো চেষ্টাও করত কিছু-একটা করবার, কিন্তু প্রমাণের অভাবে করা যেত না কিছুই। কিন্তু একেবারেই অকস্মাৎ বার্লিনে জাপানের রাজদূতকে পাঠানো শরৎ-সুভাষের উনিশশো একচল্লিশের পয়লা সেপ্টেম্বরের কোন বার্তার উল্লেখ-করা জাপান-বিদেশ-মন্ত্রীর একটা টেলিগ্রাম ব্রিটিশ গোয়েন্দারা – যাকে বলে ইন্টারসেপ্ট – তা-ই করে ফেলে। এই টেলিগ্রাম সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখে পৌঁছোয় একেবারে চার্চিলের টেবিলে! হাতে-নাতে প্রমাণ, অতএব সেই পাঁচুই সেপ্টেম্বর থেকে যে-কোনদিনই শরৎকে গ্রেপ্তার করা চলত!)শরতের গ্রেপ্তার, এশিয়ায় জাপানের হাতে ব্রিটেনের উত্তমমধ্যম, উত্তর-পূর্ব ভারতে পোড়ামাটি নীতি প্রয়োগের পরিকল্পনা, রকমারি এইসব বিষয়ে খানিকটা যখন পর্যুদস্ত ব্রিটেন ফেব্রুয়ারির গোড়ায় তখন আর এক এশীয় দেশ – জাপান-আক্রান্ত চীন সরকারের! – প্রধানকে ভারত পরিদর্শনে ভারতস্থ ব্রিটিশ সরকার আহ্বান করেন। সস্ত্রীক মার্শাল চিয়াংকাইশেককে সংবর্ধনা দেওয়া হয় কলকাতায়। এই উপলক্ষে গ্রামোফোন কম্পানী নজরুলকে তাঁদের সম্বর্ধনার উপযুক্ত কোন গান লিখে সুরসংযোগ করবার দায়িত্ব দেয়। ইনিয়ে বিনিয়ে চীন-ভারত-ব্রিটেনের সখ্য নিয়ে গান গাইবেন নজরুল, এ-ই বোধ হয় ধারণা ছিল গ্রামোফোন কম্পানীর। তার বদলে নজরুল লিখলেন: চীন ও ভারতে মিলেছি আবার মোরা শত কোটি লোকচীন ভারতের জয় হোকঐক্যের জয় হোক সাম্যের জয় হোক।ধরার অর্ধ নরনারী মোরা রহি এই দুই দেশেকেন আমাদের এত দুর্ভোগ নিত্য দৈন্য ক্লেশে,সহিব না আর এই অবিচার খুলিয়াছি আজ চোখ।। প্রাচীন চীনের প্রাচীর ও মহাভারতের হিমালয়এই কথা যেন কয়মোরা সভ্যতা শিখায়েছি পৃথিবীরেইহা কি সত্য নয়?হইব সর্বজয়ী আমরাই সর্বহারার দলসুন্দর হবে, শান্তি লভিবে নিপীড়িত ধরাতল।আমরা আনিব অভেদ ধর্ম নব বেদগাথা শ্লোক।। আর গ্রামোফোন কম্পানীতে নজরুলের পরিচিতি তো নতুন নয়, কয়েকজন নতুন শিল্পীকে শিখিয়ে-পড়িয়ে তাদের গাওয়া এই গান অতি দ্রুত রেকর্ডও করিয়ে দিলেন নজরুল।এবং, গ্রামোফোন কম্পানীর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক শেষ হল এই ভাবেই!শরতের গ্রেপ্তারের পাঁচ মাস পর, উনিশশো বিয়াল্লিশের উনিশে ফেব্রুয়ারি, সুভাষের নিষ্ক্রমণের পর এই প্রথম অপ্রস্তুত ভারতবাসী শুনল সুভাষের কণ্ঠস্বর, রেডিওয়: সুভাষ বলছি – This is Subhas Chandra Bose speaking to you over the Azad Hind (Free India) Radio!সারা ভারতের রাস্তাঘাটে, অফিসেবন্দরে, বাসেট্রেইনে, স্কুলেকলেজে, সেদিন একজনকে নিয়েই আলোচনা আর উত্তেজনা: সুভাষচন্দ্র। নবযুগের সম্পাদকীয় অফিসেও যে একই উত্তেজনা তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নানা আলোচনায় যে যে-খবর বেরিয়ে এল তার সারাংশ করলে দাঁড়ায় এইরকম: সুভাষ তাঁর পূর্বপরিচয় বদলিয়ে নামে এবং বেশে মহম্মদ জিয়াউদ্দীন হিসেবে কলকাতা ছেড়ে প্রথমে পেশোয়ার, তারপর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ছাড়িয়ে কাবুল হয়ে নানা জায়গা এবং বহু বিঘ্ন অতিক্রম করে অবশেষে ওর্লাণ্ডো মাজোতা ছদ্মনামে ইতালিয় পাসপোর্টের সাহায্যে য়্যোরোপ পৌঁছোন। প্রধানত ইতালি এবং জর্মনিতে এইসব দেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে, বিশেষ করে মুসোলিনির সহায়তায়,ভারতীয়-জন্মের ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দীদের একত্র করে ইণ্ডিয়ান লীজিয়ন বা ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠনের কাজে তিনি আপাতত নিযুক্ত আছেন। য়্যোরোপে পৌঁছবার পর আজই প্রথম ওর্লাণ্ডো মাজোতা তাঁর ছদ্মনামের বদলে নিজেকে সুভাষ নামে পরিচয় দিলেন।আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে সুভাষ বলেন, জাপানের হাতে সিঙ্গাপুরের পতন স্পষ্টতই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ধ্বংস সূচিত করছে। অস্তমান ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অর্থই হল উদীয়মান স্বাধীন ভারতবর্ষ, ভারতের ইতিহাসে নবসূর্যোদয়। এবং এখান থেকেই শুরু হতে চলেছে এশিয়া তথা সমস্ত পৃথিবীর স্বাধীন মানুষ এবং মনুষ্যত্বের জয়যাত্রা। সুভাষ আরও বলেন, স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর দায়িত্ব এখন আরও বেড়ে গেল।উনিশে ফেব্রুয়ারিতে সুভাষের এই বক্তৃতা সব ভারতবাসীর মতো নজরুলের মনেও প্রবল উত্তেজনা তৈরি করে। সাধারণত যে-সময় সে অফিস যায় এখন সেই সময়টা এগিয়ে আসে, এবং অফিস থেকে বেরোবার সময়ও যায় পিছিয়ে।আড্ডা-আলোচনা – সবই যেন এখন এই একটাই বিষয়কে কেন্দ্র করে। গান্ধী ভারত-ছাড় ডাক তখনও দিতে পারেননি, কংগ্রেসে নানারকমের তর্ক-বিতর্ক চলছে; কে যেন সেদিন বলল, গান্ধী এখন বলছেন, উনচল্লিশে সুভাষের বক্তব্য তিনি নিজে ঠিক বুঝতে পারেননি। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিবর্তিত অবস্থা স্পষ্টই দেখিয়ে দিচ্ছে সুভাষের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি অনেকের, এমনকি তাঁর নিজের চেয়েও, অনেক তীক্ষ্ণ। যদিও খানিকটা দেরি হয়ে গেছে, এখন তিনি আর অপেক্ষা করতে রাজি ন'ন। এখনই ইংরেজকে তাড়ানো দরকার। তাড়াতেই হবে। গান্ধীর গলার সুর শুনে কেউ কেউ এমনটাও বলল যে, হিংসা-অহিংসা এখন আর গান্ধীর কাছে তেমন কিছু বড় ব্যাপার নয়!আজকাল বাড়ি ফেরার পরও নজরুল উত্তেজনা প্রায় ধরে রাখতে পারে না। গত কয়েকদিন রাতে তার যোগাভ্যাসেও ঠিকমতো মনোনিবেশ করতে পারছিল না সে। অফিসে এসেও কাজে মন লাগে না।যোগাভ্যাসে অনিয়ম হলে কেমন যেন শরীর খারাপ লাগে নজরুলের। সুভাষবাবুর বক্তৃতা শোনা গেল এখন থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে। তার পর থেকে ঘুমেও অসুবিধে হচ্ছে। এর আগেও কখনও কখনও এমনটা হয়েছে নজরুলের। ও দেখেছে, দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটিতে গিয়ে একা-একা চুপচাপ বসে থাকলে ও একটু শান্তি পায়।আজ নজরুল একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। তার দপ্তরে সে-ই তো প্রধান, কারোকে কিছু বলার প্রয়োজন হল না তার। দক্ষিণেশ্বরে যাবে সে।পরের দিন দুপুরে নজরুলের পুত্র সব্যসাচী হাজির নবযুগের অফিসে। বাবা কাল অফিস থেকে বাড়ি ফেরেনি। গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে, রেডিওতে, কলকাতার নানা থিয়েটারে, সওগাতের অফিসে, কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। নজরুলকে পাওয়া যাচ্ছে না – খবরটা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। শেষ পর্যন্ত হক সাহেবের কানেও উঠল খবরটা। তিনি স্বরাষ্ট্র-দপ্তরকে জানালেন, নজরুলকে পাওয়া যাচ্ছে না, খুঁজে বের কর তাকে।চব্বিশ ঘন্টারও বেশি অতিক্রান্ত হবার পর বেলঘরিয়া থানা থেকে খবর পাওয়া গেল, গত দু-দিন যাবৎ ওই থানাতেই তিনি আছেন, নিজের পরিচয় দেননি, এখনও একটা ঘোরের মধ্যেই আছেন তিনি। এখন নজরুলের খোঁজ শুরু হবার পর থানারই একজন কর্মচারি তাঁকে নজরুল বলে শনাক্ত করেছেন।থানার অফিসাররা বললেন, বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁরা জানতে পেরেছেন, দু-দিন আগে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির চত্বরে আসেন। সেখানে একটা গাছের নীচে একাই বসে ছিলেন, বিশেষ কেউ তাঁকে লক্ষ্য করেনি। বসে থাকতে থাকতে এক সময় ওই গাছের নীচেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝ-রাত্তিরে – ঠিক কত রাত্তিরে তা বোঝা যাচ্ছেনা – তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর তিনি মনে করার চেষ্টা করেন, কেন ওই গাছের নীচে তিনি বসেছিলেন, কিন্তু ঠিক ঠিক মনে করতে পারেননি।পুলিশ যখন তাঁকে রাস্তায় প্রথম দেখতে পায় তখন ভোর হয়ে আসছে। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ব্যারাকপুরের দিক থেকে কলকাতার দিকে তিনি আসছিলেন হেঁটে হেঁটে। এখন যুদ্ধের সময়, বড় বড় মিলিটারি ট্রাক রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে আসা-যাওয়া করছে। নজরুলের চলার ভঙ্গি খানিকটা মাতালের পদক্ষেপের মতো ছিল। যে-কনস্টেব্‌ল্‌ প্রথম তাঁকে দেখে, সে একজন মাতাল বলেই মনে করেছিল তাঁকে, এবং লোকটা যখন-তখন লরির ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কাতেই তাঁকে থামিয়েছিল। কথাবার্তা এতই অসংলগ্ন যে, কিছুই না-বুঝতে পেরে, আরও দুয়েকজনের সাহায্যে সে তাঁকে থানায় নিয়ে আসে।এই দু'দিন ধরে কথাবার্তার পর পুলিশ যা বুঝতে পেরেছে তা হল, প্রথমত, মাতাল তিনি ছিলেন না। যদিও ব্যারাকপুরের দিক থেকে তিনি আসছিলেন কলকাতার দিকে, প্রথমে নজরুল এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরেই, গাছের তলায় বসে বসে ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙার অনেকটা পরে তাঁর মনে পড়ে অরবিন্দ নামের কোন একজন মানুষের সঙ্গে তাঁর কিছু জরুরি কাজ আছে, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁকে অরবিন্দর কাছে পৌঁছোতে হবে। দক্ষিণেশ্বরের থেকে বেরিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করেন, এবং ব্যারাকপুরের কাছে এসে তাঁর মনে হয় তিনি রাস্তাটা ঠিক ঠিক চিনতে পারছেন না, এবং আবার উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেন। পুলিশের যে কন্‌স্টেব্‌ল্‌ তাঁকে থানায় এনেছে সে ওই অবস্থাতেই তাঁকে প্রথম দেখে।অরবিন্দ কোথায় থাকে? – পুলিশের এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে তিনি ঠিকঠাক কিছুই বলতে পারেননি। পরে মাঝে মাঝে বলেছেন পণ্ডিচেরি। এই পণ্ডিচেরি নাম শুনে পুলিশ ঘাবড়িয়ে যায়। পণ্ডিচেরি তো অনেক দূর। মাদ্রাজ-ফাদ্রাজ ছাড়িয়ে। হেঁটে হেঁটে সেখানে যাওয়া যায় নাকি! লোকটার কি মাথা খারাপ? নাকি, অন্য কোন পণ্ডিচেরির কথা বলতে চাইছিল সে? সে আবার বলছে, সেখানে নাকি দিলীপ নামেরও কেউ থাকে, তার ডাক-নাম মন্টু, সে এই নজরুলের বন্ধু। নজরুল বলেছেন, এই দিলীপ শুধু নজরুলেরই নয়, কোন এক সুভাষবাবুরও বন্ধু।সুভাষবাবু? সুভাষ নামটার সঙ্গে বাঙালি পুলিশ পরিচিত। কিন্তু কোন্‌ সুভাষের কথা বলছে এই পাগলটা? যে-সুভাষের নাম পুলিশ ভালোভাবেই জানে সে তো পুলিশকে বোকা বানিয়ে নিজের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে! তার সঙ্গে এই পাগলের যোগাযোগ? পুলিশরা নিজেদের কানকেও বিশ্বাস করে না। থানায় বসে বসে এই দু'দিনের মধ্যেও একা-একাই এই পাগল ভদ্রলোক গলা-ফাটিয়ে চিৎকার করে অরবিন্দর সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করছিলেন, এবং সফল না হতে পেরে খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। আরো একটা কথা ইনি বলছিলেন বারবার। সুভাষবাবুর কাছে এখন এক অরবিন্দই যেতে পারেন, আর যেতে তাঁকে হবেই। তা না হলে সব কিছুই নাকি ভেস্তে যাবে। কোন্‌ সুভাষ বাবুর কথা বলছেন? – জিজ্ঞেস করায় উনি কোন উত্তর দেননি, এবং মনে হল খুবই বিরক্ত হয়েছেন।পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হল, প্রথম প্রথম না-বুঝতে পারলেও কিছুক্ষণের কথাবার্তার পর পুলিশ বুঝতে পেরেছে যে উনি একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক, ওদেরই মধ্যে একজন তো কবি হিসেবেও নজরুলকে শনাক্ত করেছিল, হয়তো কোন পারিবারিক কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে একটু অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। নিজের নাম নিজের মুখে কিছুতেই বলছেন না। আর বলছেন না নিজের ঠিকানাও। এখন খাওয়া-দাওয়া করেছেন, শরীরও ভালো আছে। একা-একা বসে মাঝে মাঝে ধ্যানের মতো কিছু করছেনও।পুলিশের গাড়িতেই নজরুলকে ফিরিয়ে নিয়ে এল সব্যসাচী, কালীপদ গুহ আর জুলফিকার হায়দার। সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি সে। বাড়িতে ঢুকেই সব্যসাচীকে জড়িয়ে ধরে নজরুল, হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, যোগের শিক্ষা কিছুই হয়নি আমার। সেবার তো শ্রীঅরবিন্দ সূক্ষ্মদেহে প্রায় আধঘন্টা বসে থাকলেন আমার কাছে, কত কথা হল! এবার আর কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছি না তাঁর সঙ্গে। অথচ দেশের পক্ষে তো এখন জীবন-মরণ সমস্যা। সুভাষবাবু একা-একা বিদেশে, সেখানে তাঁকে সুরক্ষা দেবে কে? অরবিন্দ ছাড়া আর তো সুভাষবাবুর কাছে কেউ যেতে পারবে না! একমাত্র তিনিই পারেন সূক্ষ্মদেহে যেখানে-খুশি যেতে!ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    ভোটুৎসবে ভাট - যাকগে চলবে - সমরেশ মুখার্জী | হুজুগের ফিকির      দেখতে দেখতে এসে গেল বৈশাখ। ওড়িশার সুন্দরগড়ে গ্ৰীষ্মকালে গরম ভালো‌‌ই পড়ে। তবে অনেক প্রাচীন বড় বড় গাছপালা ও  ফাঁকা জায়গা থাকায় সৌমেন‌দের এলাকায় তখনো বিশেষ গরম লাগে না। পঁচিশে বৈশাখের তখন‌ও এক হপ্তা বাকি, এক রবিবার সন্ধ্যায় সৌমেনদের বাড়িতে তাসের আড্ডায় সুদীপ প্রস্তাব দেয়, 'চলুন বৌদি, আমরা এ বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করি।'      কবিতা আবৃত্তি, গীতিনাট্য, রবীন্দ্রসংগীত ইত‍্যাদিতে রমেনের বিশেষ আগ্ৰহ নেই। তবে সুন্দরগড়ে‌র মতো শান্ত জায়গায়, নিস্তরঙ্গ জীবনে একটু আনন্দ উচ্ছ্বাস করার হুজুগের গন্ধ পেয়ে রমেন‌ও বলে, 'হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ, বেশ হবে। তাহলে আপনাদের ছাদেই হোক। আপনাদের বাড়ি‌টা একানে, ছাদটা‌ও বেশ বড়। কিছু লোকজন, বাচ্ছাদের জমায়েতে হৈচৈ হবেই, তবে আপনাদের বাড়ি‌ওয়ালা‌ও বাঙ্গালী, মনে হয় আপত্তি করবেন না। তাহলে ছাদে লাইটিং করার দায়িত্ব আমার।'      মৌমিতা হাসে, 'তোমরা বাড়ি‌র কর্তার মত না নিয়ে নিজেরাই সব ঠিক করে ফেললে যে। এই যে কর্তামশাই, আপনি কিছু বলুন।'     সুদীপ হেসে বলে, 'সৌমেন‌দা আবার কী বলবেন? আমরা কী ভুলে গেছি কদিন আগে দোলের দিন কী হোলো। রঙ না মাখানো‌র খুব শর্ত টর্ত করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সৌমেন‌দাই তো দেবীবৌদিকে কষে রঙ মাখিয়ে দিলো মাথায় ঝড়াস করে ঢেলে এক বালতি জল। এবার‌ও হয়তো প্রথমে না, না, করে পরে দেখবো ওনার‌ই উৎসাহ সব থেকে বেশি।'    সৌমেন মুচকি মুচকি হাসে। ভুল বলেনি ছোঁড়া। বলে, 'তা বেশ তো, হোক না। তবে রবীন্দ্র‌জয়ন্তী শুনলেই আমার মৌয়ের ঠাকুর্দার ঘটনা‌টা মনে পড়ে।' যাকগে চলবে    শুনেই মৌমিতা‌ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে। গল্পের গন্ধ পেয়ে সুদীপ, রমেন দুজনে‌ই উদগ্ৰীব। চারজনে তাস খেলা হচ্ছিল শোয়ার ঘরে বড় খাটে বসে। রমেন হাতের তাস বিছানায় উল্টে রেখে ওর পেটেন্ট 'ওওও মুখার্জী‌দা‌আআআ' আওয়াজ ছেড়ে বলে,  'কী রকম, কীরকম। বলুন তো শুনি।'   সৌমেন বলে, 'শিবপুরে মৌয়ের ঠাকুর্দার চেম্বারের সামনে‌ ছিল একটা মাঝারি সাইজের খেলার মাঠ। ছিল মানে, এখন‌ও সে মাঠ আছে। কেবল  ঠাকুর্দা মারা যেতে সে চেম্বার‌ উঠে গেছে। ঐ মাঠটা ছিল একটা শরিকী জমি। বেদখল হ‌য়ে বারোয়ারী হয়ে গেছে। ওখানেই হয় শিবপুর সার্বজনীন দুর্গোৎসব। ছেলেরা বিকেলে ফুটবল পেটায়। স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলন হয়, এইসব হয় ওখানে। একবার তোমাদের মতো ওখানকার কয়েকটি কিশোরের মাথায় এসেছিল রবীন্দ্র‌জয়ন্তী করার। সেই মতো বেদী করা হয়েছে। নির্দিষ্ট দিন সকালে ফুল, মালা, ধূপ সব হাজির। কেবল কবিগুরুর ফটো নিয়ে যার আসার কথা, সেই বেপাত্তা।"   সুদীপ বলে ফ‍্যালে, 'যাঃ, তারপর?'- ঠাকুর্দা‌র চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা‌রত পেশেন্টের জন‍্য কক্ষে গুটিকয় চেয়ার ও একপাশে বড় একটা বেঞ্চ পাতা ছিল। কারুর শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে পড়ার জন‍্য। তার ওপরে দেয়ালে সার দিয়ে টাঙানো ছিল কয়েকজন মনীষীর ছবি। নেতাজী, গান্ধী‌জী, বিবেকানন্দ ইত‍্যাদি। পাড়ার একটি কিশোর এসে বলে, 'জেঠু একটা ফটো নিয়ে যাচ্ছি। একটু বাদে ফেরৎ দিয়ে যাবো।' চেনা ছেলে, তাই রোগী দেখা‌র মাঝে ঠাকুর্দা অন‍্যমনস্ক হয়ে‌ বলেন, 'ঠিক আছে নিয়ে যা, দেখিস, পাড়তে গিয়ে ফেলে ভাঙিস না যেন।'     রমেন বলে, 'ছেলেটা স্মার্ট আছে বলতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্ল‍্যান বি ছকে ফেলেছে।'    সৌমেন গম্ভীর মুখে বলছে কিন্তু মৌমিতা থেকে থেকে হেসে ফেলছে বলে ওরা কিঞ্চিৎ দিশেহারা। এতে হাসির কী হোলো! মৌ রমেনকে বলে, 'শেষ অবধি শোনো‌ই না কী হয়।'    সৌমেন বলে, 'ঘন্টা‌ দুয়েক বাদে, তখন কোনো পেশেন্ট নেই, ঠাকুর্দা একটু আড়মোড়া ভাঙতে চেম্বার ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে‌ছেন। দেখলেন ঐ ছেলেটা ফটোটা ফেরৎ দিতে আসছে। ডাক্তারীর ব‍্যস্ততায় ওনার মনেই ছিল না সেদিন রবীন্দ্র‌জয়ন্তী। ছেলেটাকে ফটো হাতে আসতে দেখে ঠাকুর্দার মনে পড়ে, তাইতো, কেন নিয়ে গেছিল সেটাই তো জানা হয়নি। তাই বললেন, 'হ‍্যাঁ‌রে, তো কী রাজকম্ম হোলো ফটো দিয়ে?'    সুদীপের আর তর স‌ইছে না। নড়েচড়ে বসে।   সৌমেন ভাবলেশহীন মুখে বলে, 'ছেলেটা বলে, 'জেঠু আজ আমরা রবীন্দ্র‌জয়ন্তী পালন করলাম। যার ফটো নিয়ে আসার কথা ছিল সে আসেনি বলে আপনার চেম্বার থেকে এটা নিয়ে গেছিলাম।' ঠাকুর্দা আঁতকে উঠে বলেন, 'বলিস কী রে!' ছেলেটা ভেবলে গিয়ে বলে, 'কেন? কী হোলো?'    মৌ এবার ফুলে ফুলে হাসছে। রমেন‌ বলে, 'এতে ওনার আঁতকে ওঠা‌র কী হোলো?' সুদীপ মাঝে মাঝে বোকার মতো তাকাচ্ছে হাস‍্যরতা মৌমিতার দিকে।   সৌমেন নির্বিকার মুখে ডেলিভারি দেয় ক্লাইম্যাক্স, 'ঠাকুর্দা কপাল চাপড়ে বলেন, 'ওরে হতভাগা, এটা তো ঋষি অরবিন্দ‌র ছবি! ওখানে তো রবীন্দ্রনাথের ফটো‌ ছিল‌‌ই না!'   এবার রমেন ও সুদীপ‌ও ভ‍্যাক করে হেসে ফেলেছে। মৌমিতা মুখে আঁচলচাপা দিয়ে হাসতে হাসতে হাত ইশারায় জানায়, ক্লাইম্যাক্সের এখোনো কিছুটা বাকি।  সৌমেন বলে, 'ছেলেটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে, 'এ্যাঁ, তাই নাকি! এঃ হে, তাহলে তো খুব ভুল হয়ে গেছে। তাই কে একজন বললো, ছবিটা তো ঠিক রবীন্দ্রনাথের মতো লাগছে না। তাতে আবার বিমল বিজ্ঞের মতো বললো, এটা ওনার অল্পবয়সে‌র ছবি। যাকগে চলবে। পরের বার খেয়াল রাখতে হবে।'     এবার আর রমেন, সুদীপের হাসি থামতে‌ই চায় না। রমেন খাটে চাপড় মেরে মেরে হাসছে আর বলছে, ' কী বললো ছেলেটা? যাকগে চলবে?'    সৌমেন বলে, 'আমি তো তাও ঠিকমতো বলতে পারলাম না। প্রথমবার বাপী এটা এমন ক‍্যারিকেচার করে রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলেন যে শুনে আমার‌ও তোমাদের মতোই অবস্থা হয়েছিল। তাই বলছি, দেখো, তোমরা‌ও যেন এরকম কিছু কেলোর কীর্তি ক‍রে ফেলো না।'
    দোলজ‍্যোৎস্নায় শুশুনিয়া‌য় - ৮ - সমরেশ মুখার্জী | অনুভবের উদ্ভব ঈশু বলে, "জেঠু তুই বলেছিলি তুই যা বলবি তা মূলতঃ তোর ভাবনা চিন্তা জীবনবোধ নির্ভর। তুই যে ভাবে ধাপে ধাপে এগোচ্ছি‌স ভালো লাগছে।"সুমন বলে, পাঠ‍্যবিষয়ের বাইরে‌‌ও বিভিন্ন বিষয়ে আমার আগ্ৰহ আছে কিন্তু তা নিয়ে বিশদে যথেষ্ট পড়াশোনা করার সামর্থ‍্য, সময় আমার নেই। কিছু ব‌ই পড়ে, সিনেমা দেখে, ঋদ্ধ‌জনের কথা শুনে, নানা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বা আত্মবিশ্লেষণ করে কিছু বিষয়ে নানা বিক্ষিপ্ত ভাবনা ক্রমশ একটা আকার পায়। যখন কোনো বিষয়ে কিছু বলতে যাই সেই দানা বাঁধা ভাবনা‌ই কথায় প্রকাশ পায়।  তখন কোথায় কী পড়েছি, দেখেছি, শুনেছি মনে থাকে না। আমি যা ভাবছি সেটাই যে সঠিক তেমন দাবি‌ও আমার নেই। সেই প্রসঙ্গে অন‍্য দৃষ্টি‌কোন থেকে কেউ কিছু বললে, তা মুক্ত‌মনে ভাবা‌র চেষ্টা করি। যুক্তি‌গ্ৰাহ‍্য মনে হলে তাও মনে থেকে যায়। এভাবেই মানুষের ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয় বলে মনে হয়।”ঈশু বলে, "আমি তোর কথা বুঝতে পারছি। আমরা পড়ছি কলাবিভাগে। কবিতা, নাটক, গল্প, উপন‍্যাস অর্থাৎ সাহিত‍্যের নানা শ্রেণীর উদ্ভব, বিবর্তন, প্রকরণ, প্রাচ‍্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শন, গ্ৰীসিয়ান, ভিক্টোরিয়া‌ন, রোমান্টিক  পিরি‌ওড এইসব নিয়ে তাত্বিক আলোচনা আমাদের ক্লাসে শুনতে হয়, পড়তে হয়, লিখতে হয়। তাই কলাবিভাগে মন দিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীর পক্ষে এভাবে আলোচনা করতে পারা প্রত‍্যাশিত। কিন্তু তুই পড়ছিস সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং যা একটা বিজ্ঞান ভিত্তি‌ক ফলিত বিষয়। তাই তোর থেকে মানুষের মনোবৃত্তি, আচরণগত প্রসঙ্গে এমন সুংসহত বক্তব্য আশা করিনি। বেশ লাগছে। তুই বল - আমরা শুনি"।সুমন বলে, "এভাবে গ‍্যাস খাইয়ে তুই আমায় লজ্জায় ফেলে দিলি ঈশু। যাক, এই অবধি আলোচনা‌য় কি আমি বোঝাতে পারলাম যে মানুষ নিজেকে যতই উন্নত, বুদ্ধিমান ভাবুক না কেন, এখনও সে অনেক ক্ষেত্রে পশু‌র মতো‌ই আচরণ করে, কিছু ক্ষেত্রে নিতান্তই প্রবৃত্তি‌র দাস মানুষ?" ওরা তিনজনে‌ মাথা নেড়ে সায় দেয়। যৌনতার পর্যালোচনাসুমন বলে, "বেশ, এবার তাহলে একটি প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি‌‌ পর্যালোচনা করে দেখা যাক যেটা রয়েছে আমাদের ঈশুমাসী বর্ণিত পুরুষের অবিচারের মূলে - অর্থাৎ যৌনতা। এ বিষয়ে কিছু প্রসঙ্গ কিন্তু অত্যন্ত স্পর্শ‌কাতর লাগতে পারে। ভেবে দ‍্যাখ তোরা এগোবি কিনা? মুখে মুক্তমনা বলে নাচতে নেমে ঘোমটা টানা আমি পছন্দ করি না।" ঈশু বলে, "জেঠু মনে হচ্ছে এখন ফুল ফর্মে। এবার ও আমায় তুলোধোনা করবে। এ্যাই, তোরা আছিস তো আমার সাথে?" চুনি মাথা নেড়ে সায় দেয়। তুলি বাইসেপ দেখি‌য়ে জানা‌য় যে সেও আছে ঈশুর সাথে।সুমন বলে, "ঘাবড়াস না ঈশু। আমি তোর সব কথা খোলামনে শুনেছি। যা যৌক্তিক মনে হয়েছে নির্বিবাদে মেনে নিয়ে‌ছি। এখন আমি যা বলতে যাচ্ছি তা পুরুষজাতের প্রতিনিধি হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রচেষ্টা বলে মনে করিস না। আমি যা বলবো তা মানুষের কিছু প্রাকৃতিক, প্রবৃত্তি‌গত আচরণ অনুধাবনের প্রচেষ্টা। দ‍্যাখ নারী পুরুষের সম্পর্কে জৈবিক ও প্লেটোনিক প্রবণতা নিয়ে বিগত বহু শতাব্দী ধরে কোটি কোটি শব্দ খরচ হয়েছে। ভবিষ্যতে‌‌ও হবে। নারী পুরুষের সম্পর্ক একটা ক‍্যানভাসে আঁকা ছবির সাথে তুলনা করলে তাতে কিছু নির্দিষ্ট রঙের সাথে কিছু ধূসরের শেড‌‌ও দেখা যাবে। কিছু রঙ অনায়াসেই চেনা যায়। ধাঁধা লাগে ধূসরে। তেমনই মানব জীবনে যৌনতা। এও এক ধূসর মেশানো রঙিন ছবি। আয়, আমরা খোলা মনে চেষ্টা করি ছবিতে ধূসর জায়গা‌গুলো অনুধাবন করতে।” সুমন ওদের মুখের দিকে ভালো করে তাকায়। না কোনো অস্বস্তি‌র চিহ্ন নেই। সুমন বলে, "প্রকৃতির নিয়মে যৌন ক্রিয়া‌র প্রাথমিক উদ্দেশ্য বংশরক্ষা। সেই স্বাভাবিক ক্রিয়া‌টিকে বিনোদনে (Recreational Sex) পরিণত করে পৃথিবী‌ব‍্যাপী বাণিজ‍্যের প্রসার মানুষের সৃজনশীল‌তা ও উদ‍্যমের পরিচয়। পশুদের মধ‍্যে ক্ষিদে বা ঘুমের মতো যৌনতা‌ও একটি স্বাভাবিক চাহিদা। পশু ঘুম  'পেলে' ঘুমোয়। ঘুমিয়ে উঠে এনার্জি 'পায়'। ক্ষিদে 'পেলে' খায়। পেট ভরলে তৃপ্তি 'পায়'। এক্ষেত্রে 'পেলে' হচ্ছে উদ্দীপক বা Stimulant যার জন‍্য পশু ঐ ক্রিয়া‌টি করে এবং 'পায়' হচ্ছে তার Outcome বা পরিণতি যা সুখকর হলে সেই স্মৃতি 'পেলে'র ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায‍্য করে। বোঝা গেল?”ওরা মাথা নেড়ে সায় দেয়‌।- "বেশ, যৌন ক্রিয়া‌র ক্ষেত্রে পুরুষ পশুটি তো ক্রিয়া‌টি করেই খালাস কিন্তু নারী পশুটিকে তার প্রতিক্রিয়ায় গর্ভধারণ ও প্রসব করতে হয়। দুটি অভিজ্ঞতা‌ই মোটেও সুখকর নয়। প্রথমটি দীর্ঘ অসুবিধার, দ্বিতীয়‌টি রীতিমতো কষ্টকর। আবার পুরুষ পশুটি যদি ঐ ক্রিয়া‌টি ক‍রে কোনো কষ্ট না পাক,  বিশেষ কোনো আনন্দ‌ও না পায় তাহলে সে খামোখা ঐ কর্মটি নিছক দাঁত মাজার অভ‍্যাসে নিয়ত করতেই বা যাবে কেন?  পশুরা অবশ‍্য দাঁত‌ও মাজে না। এটা কথার কথা। আবার ধর একবার ভুল করে বেলতলায় গিয়ে নারী পশুটির‌ যদি গর্ভধারণের অসুবিধা ও প্রসবযন্ত্রনার অভিজ্ঞতা হয়ে যায় তাহলে পুরুষ পশুটি পুনর্বার ক্রিয়া‌টি করতে গেলে সে তো খ‍্যাঁক করে তেড়ে উঠবে।"এ কথায় ভ‍্যাক করে হেসে ফেলে তুলি বলে, "তুই বেশ মজা করে বলছি‌স কিন্তু।"সুমন বলে, "এ তো আমি নিজের চোখে দেখেছি। একটা কুক্কুরির পিছনে একটা কুকুর খুব আগ্ৰহ নিয়ে গেছিল কিন্তু সে হঠাৎ এমন তেড়ে উঠলো যে কুকুর‌টা ল‍্যাজ গুটিয়ে পালালো। হয়তো কুক্কুরিটার তখন মুড ছিল না ওসবে। যাই হোক, যা বলছিলাম, এই নীল গ্ৰহে বংশবিস্তার প্রকল্পের নিয়ামক প্রকৃতিমাকে‌ ক্ষিদে বা ঘুমের মতো যৌন ক্রিয়া‌র ক্ষেত্রে‌ও 'পেলে' এবং 'পায়' গোছের কিছু ভাবতে হোলো। পুরুষ পশু‌দের ক্ষেত্রে এ নিয়ে ম‍্যাডাম‌কে বিশেষ ভাবতে হোলো না কারণ পুরুষ জাতটাই সোজাসাপ্টা। তাই কোম্পানির বিভিন্ন বিভাগের মতো জীবনচক্রেও ম‍্যাডাম এই গুরুদায়িত্ব ভাগ করে দিলেন দুটি বিভাগে। HR Dept এর কাজ যেমন লোকের যোগান বজায় রাখা সেরকম শরীরের অন্তক্ষরা গ্ৰন্থীর ওপর দায়িত্ব বর্তালো হরমোনের মাধ‍্যমে 'পেলে' বা Libidoর যোগান বজায় রাখা। সে ঐ দায়িত্ব পালনে বড়দার সাহায্য চাইলো"।চুনি বলে, "বড়দা‌টা আবার কে রে বাবা? জেঠু, তুই তো দেখছি ঠাকুরদার ঝুলির মতো গল্প ফেঁদে বসেছিস। মজা আ গ‍্যায়া ইয়ার"।সুমন হাসতে হাসতে বলে, "বড়দা মানে মগজ। বড়দা অন্তক্ষরা গ্ৰন্থীসমূহকে  বললো, ভাবিস না ছোটু, আমার একটা খুব চালু চ‍্যালা আছে, নয়ন। অধিকাংশ কাজ সেই করবে। আর শোনাশুনি, শোঁকাশুঁকি, ছোঁয়াছুঁয়ি, চাখাচাখির জন‍্য আছে আরো চারজন - কানু, নাকু, হাতু আর জিভু। আমি পাঁচজন‌কেই লাগিয়ে দেবো ডিউটিতে। তাছাড়া আমাদের সবার ওপরে তো মনদাদু আছেনই। তুই তোর ডিপার্টমেন্টের স্টাফেদের, মানে টেস্টোস্টেরন, ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, অক্সিটোসিন, ডোপামিন - সবাই‌কে লাগিয়ে দে কাজে। সাথে থাকবে আমার পাঁচটা চ‍্যালা। তবে ওরা সবাই মিলে বাস্তবে যা করবে তার ঢের বেশি মনদাদু‌ একাই ফ‍্যানটাসী‌র ফানুস উড়িয়ে তোর কাজ আসান করে দেবে। তো মা ষষ্ঠীর কৃপায় মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের পারফরম্যান্স যে এ্যাতো ভালো হবে, তা হয়তো প্রকৃতি ম‍্যাডাম‌ নিজেও ভাবেন নি। ফলে তাবৎ জীবজগতের নাভিশ্বাস উঠিয়ে, অনেকের জীবনদীপ নিভিয়ে পৃথিবী ক্রমশ মানুষময় হয়ে উঠলো।" সুমনের বলার ভঙ্গিতে ওরা সবাই হেসে‌ ফেলে। তুলি বলে, "ওঃ, তোর মাথাতেও আসে বটে"।সুমন বলে, "আমি বাপু ঈশুর মতো সিরিয়াসলি কথা বলতে পারি না। তাই একটু মজা করে বলি।  তো বাকি র‌ইলো 'পাওয়া'? অফিসে এটা সরল পদ্ধতি। কাজ করো, মাইনে নাও। অর্থাৎ Salary Section. ম‍্যাডাম ঠিক করলেন শরীর‌ও যৌনক্রিয়া‌ অন্তে পাবে একটি দিলখুশ 'পাওয়া' অর্থাৎ চরমসুখ বা Orgasm. পাবে তো বটে, কিন্তু দেবে কে? Pelvic floor muscle এর কুঞ্চন? G-spot এর শিহরণ?  নাকি সর্বঘটে কাঁঠালি কলা মস্তিষ্ক? তার মধ‍্যে‌ আবার সেটা Septal region নাকি hypothalamus - কোথা থেকে আসছে এসব নিয়ে পশু‌দের কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রকৃতি ম‍্যাডামের ব‍্যবস্থাপনা অনুযায়ী কর্ম করো, আনন্দ পাও ফুরিয়ে গেল। সে আনন্দ কীভাবে আসছে, কোথা থেকে আসছে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ।" "অবশ‍্য ঘামানোর মতো মাথাও ওদের নেই।  সেই মহান কর্মটির ঠিকা একমাত্র মানুষ‌ই নিয়ে রেখেছে। যেহেতু সে বুদ্ধিমান প্রাণী। তাই সে ঘামাতে শুরু করলো তার উর্বর মস্তিষ্ক। তবে অনেক ঘামিয়ে‌ও এর সঠিক হদিশ আজ অবধি পাওয়া গেল না। নানা মুনির নানা মত। আন্তর্জাতিক খ‍্যাতিসম্পন্ন দীর্ঘ‌দেহী এক বাঙালি চিত্র পরিচালক একবার বলেছিলেন, Orgasm বা চরম যৌনসুখ প্রকৃতির এমনই এক বিচিত্র লীলা যে সাধক সম্প্রদায়ের মুষ্টিমেয় মানুষ ব‍্যতীত সাধারণ, স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এর অমোঘ আকর্ষণ উপেক্ষা করা অসম্ভব।" তুলি বলে, "তুই কিন্তু খাসা বলছিস জেঠু। ডাক্তার‌রা যেমন নির্বিকার ভাবে রোগলক্ষণ আলোচনা করে, সেরকম। তাই ডাক্তারের সাথে আলোচনা করতে যেমন লজ্জা করে না, তোর কথা শুনেও করছে না। তবে ডাক্তার‌রা বলে টেকনিক্যাল টার্ম ব‍্যবহার করে, সিরিয়াস ভঙ্গিতে। তুই বলছিস ডালভাতের মতো সহজ ভাবে। সাথে আবার রসিকতার আচার মিশিয়ে স্বাদু ভঙ্গিতে। দারুণ লাগছে। একটু দাঁড়া জল খেয়ে আসি। ঈশু বলে, "একটা বোতল নিয়ে আসিস, আমার‌ও তেষ্টা পাচ্ছে।" সুমন বলে, "সে কী রে! সবে তো কলির সন্ধ‍্যে! তোদের এর মধ্যে‌ই গলা শুকিয়ে গেল? আমার তো আরো অনেক কিছু বলার ছিল?" তুলি যেতে যেতে বলে, "দাঁড়া, তোর একটা গাঁট্টা পাওনা র‌ইলো।"
    কেন্দ্রীয় বোর্ড - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | সিবিএসই অনুমোদিত ​​​​​​​স্কুলগুলোর ​​​​​​​নীতিমালা, ​​​​​​​যেটা ​​​​​​​২০১৮ ​​​​​​​সালে ​​​​​​​এসেছিল, ​​​​​​​কৌতুহলবশত পড়ছিলাম। পড়ে ​​​​​​​যা ​​​দেখলাম, সিবিএসইর শিক্ষকসংক্রান্ত ​​​​​​​এবং খরচাপাতি সংক্রান্ত ব্যাপারস্যপার ​​​​​​​এইরকমঃ ​​​​​​​১। শিক্ষকদের যোগ্যতাঃ ন্যাশানাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশনের বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা অনুসরণ করতে হবে। এছাড়াও সিবিএসইর নিজেরও একটা মাপকাঠি আছে। অথবা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, নবোদয় বিদ্যালয় কিংবা যথোপযুক্ত সরকারি মাপকাঠিও অনুসরণ করা যেতে পারে।২। শিক্ষক নিয়োগঃ স্কুলের নিজের একটা নির্দিষ্ট নিয়োগপদ্ধতি থাকবে। সেই অনুযায়ী নিয়োগ হবে। নিয়োগের দায়িত্ব এবং ক্ষমতা পুরোটাই ম্যানেজিং কমিটির। ৩। শিক্ষকদের মাইনেঃ পে-স্কেল যথোপযুক্ত সরকারি পে-স্কেলের সমতূল্য হওয়া উচিত। বাধ্যবাধকতা নেই ( ইংরিজিতে শুড-বি দিয়ে লেখা আছে)৪। খরচাপাতিঃ স্কুলের খরচা স্কুল নিজে তুলবে। খরচ মানে ঘরদোর থেকে শিক্ষক পর্যন্ত পুরোটাই। আয়ের কোনো অংশ অবশ্য কোনো ব্যক্তির পকেটে পাঠানো যাবেনা। ৫। ফিঃ ছাত্রদের কাছ থেকে ভর্তির জন্য ডোনেশন বা ক্যাপিটেশন ফি নেওয়া যাবেনা। ফি এর কাঠামো যথোপযুক্ত সরকারি নিয়মানুগ হতে হবে।৬। স্কুল কে খুলতে এবং চালাতে পারেঃ সোসাইটি, ট্রাস্ট বা কোম্পানি।  স্কুলের স্বীকৃতির জন্য বোর্ডকে তাদের টাকা দিতে হবে। অনুমোদনের জন্য দিতে হবে আড়াই লক্ষ টাকা। পুনর্নবীকরণের খরচ আলাদা। তা, এই পুরো ব্যাপারটা  যদি দেখেন, এর মধ্যে "শিক্ষা হল অধিকার" বা মানকল্যাণের কোনো জায়গা নেই। বোর্ড একটি অর্থকরী প্রতিষ্ঠান, তারা অনুমোদনের বিনিময়ে পয়সা নেয়। দেয়না। স্কুলও একটি অর্থকরী প্রতিষ্ঠান। তারা সম্পূর্ণ বেসরকারি। তারা টাকা তোলে ছাত্রদের কাছ থেকে। তার থেকে শিক্ষকদের মাইনে দেয়। নিয়োগও করে তারা এবং মাইনেও তারাই ঠিক করে। মাইনে ঠিক কী হবে, তার আইন নেই, কিছু উপদেশ আছে। ফলে সেটা কোম্পানির ইচ্ছে।  এক কথায় পুরোটাই ব্যবসা। কত ফি হবে, কত মাইনে হবে, সবশুদ্ধ। কোথাও কোনো নির্দিষ্টতা নেই। হ্যাঁ, কোম্পানির মালিক লাভের গুড় পকেটে নিয়ে বাড়ি যেতে পারবেননা। কিন্তু তাঁরা গুষ্টিসহ ডিরেক্টর হয়ে মোটা টাকা মাইনে নিলে সেটা সম্পূর্ণ বৈধ।উল্টোদিকে, পশ্চিমবঙ্গে অন্তত, স্কুলশিক্ষার দর্শনটাই আলাদা। আধাসরকারি স্কুলে অনুমোদনের জন্য বোর্ড পয়সা তো নেয়ইনা, বরং বামফ্রন্ট জমানা থেকেই শিক্ষকদের মাইনে জোগায় নির্দিষ্ট স্কেলে। ছাত্রদের ফি দিতে হয়না। নিয়োগও, অন্তত খাতায়-কলমে  হবার কথা সুষমভাবে। সেটা হচ্ছেনা বলেই এত কথা, চারদিকে। রাজ্যের আধাসরকারি স্কুলে চাকরি করা, চাকরিপ্রার্থীদের জন্য একটা অত্যন্ত দামী  কাজ, এই জন্যই। কেন্দ্রীয় বোর্ডের নামী স্কুলগুলো নিশ্চয়ই ভালো মাইনে দেয়, কিন্তু বাকিগুলোতে চাকরির কোনো গরিমা  নেই।শিক্ষার বেসরকারিকরণ নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেন, পশ্চিমবঙ্গে, তাঁদের তাই দুটো বক্তব্য হওয়া উচিত। এক, এই ব্যবসামূলক কেন্দ্রীয় বোর্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। দুই, রাজ্যসরকারি যে শিক্ষাব্যবস্থার দর্শন, তাকে ধ্বংস করার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রথমটা একদম হয়না, যেন স্পর্শ করা মহাপাপ। দ্বিতীয়টা খানিকটা হচ্ছে, তাও স্রেফ নিয়োগ ঘিরে। রাজ্য সরকার বহুক্ষেত্রে যে গোটা দর্শনটারই উল্টোদিকে যাবার চেষ্টা করছে, সে নিয়ে বিশেষ বক্তব্য নজরে পড়েনা। রাজ্য সরকার, যারা পর্ষদ চালায়, তাদেরও কেন্দ্রীয় বোর্ড নিয়ে কোনো ক্ষোভ বিক্ষোভ দেখা যায়না। রাজ্যের স্কুলগুলো যেন উঠে গেলেই বাঁচা যায়, এরকম একটা হাবভাব। কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয় বোর্ড চালায়, ব্যবসায় তাদের কোনো আপত্তি নেই, বোঝাই যায়। অন্য বিরোধীপক্ষের কিছু লোকও, বিশেষ করে কিছু উকিল যখন মামলা-মোকদ্দমা করেন, তাঁদেরও শিক্ষাব্যবস্থার দর্শন-টর্শন নিয়ে মাথাব্যথা নেই,  ব্যবস্থাটা উঠে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা চালু হলেই যেন খুশি হন। রাজ্য সরকারি স্কুলগুলো যেন দুয়োরানি। শিক্ষক না থাকলে উঠে যাবে, কেন্দ্রীয় বাহিনী এলে সেখানেই থাকবে,  কেন্দ্রীয় বোর্ডের স্কুলে কিন্তু হাত দেওয়া যাবেনা, ওসব স্বর্গ থেকে পড়েছে।এই যে অদ্ভুত ব্যাপার, এর একটা শ্রেণীবিভাজনের রাজনীতি আছে, গ্রাম-শহর-বিভাজনেরও রাজনীতি আছে। কিন্তু সে লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। এইটুকুই লেখা যাক, যে, রাজ্যসরকারি নিয়োগের যে দুর্নীতি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন সঙ্গত, হওয়া দরকার। একই  সঙ্গে কেন্দ্রীয় বোর্ডের বেওসা নিয়ে কথা বলা দরকার, যেটা নীতিগতভবেই শিক্ষাকে ধ্বংস করতে উদ্যত। এবং শিক্ষা যে স্রেফ নিয়োগ নয়, একটা দর্শন, সেটায় নজর দেওয়া দরকার। কেন ছাত্ররা ক্রমশ রাজ্য সরকারি ব্যবস্থা থেকে মুখ ঘোরাচ্ছে, অন্তত শহরাঞ্চলে, সেখানে নজর দিয়ে সমাধান করার জন্য চাপ দেওয়া দরকার। এই তিনটে জিনিস যুগপৎ না করলে বিনামূল্যে সরকারি সার্থক শিক্ষা, এই ব্যাপারটা অধরাই থেকে যাবে। এবং সরকারি ব্যবস্থাটা উঠে স্রেফ কেন্দ্রীয় সরকারি বেওসা চালু হবে।   নীতিমালার লিংকঃ https://saras.cbse.gov.in/saras/Affiliation%20Bye-Laws/Affiliation-Bye-Laws-English.pdf
  • জনতার খেরোর খাতা...
    পাগল প্রলাপ - পাগলা গণেশ | আজ পঁচিশে বৈশাখ।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন।তিনি নমস্য,শ্রদ্ধা এবং সম্মানের দাবিদার।আর তাকে তা না দেওয়ার কোনো কারণ নেই।কেন না তিনি বাঙালী তথা ভারতীয়দের যা দিয়েছেন তার জন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত।সবচেয়ে বড় যা দিয়েছেন তা হলো আত্মনিরীক্ষণ ও আত্মসমালোচনা।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা তাকে এত বেশি শ্রেয় দিয়ে ফেলি,যে অন্যরা ব্রাত্য হয়ে যান।তিনিই একমাত্র চিরন্তন ও অবিস্মরণীয় হয়ে রয়ে যান।তিনি মহীরুহ সন্দেহ নেই।কিন্তু তার ছায়াতেই যদি সবাইকে রোপণ করা হয়,তাহলে কি কেউ বাড়তে পারবে!সবাইকে কেন তার মতো হতে হবে,কেন সবাইকে তার ছায়ার লাশ দাঁড়াতে হবে!আমরা বড্ড একগুঁয়ে।কিরকম!আমরা সহজে কারো নতুন ধারণা স্বীকার করি না,স্বীকার করলে নড়ি না।আমরা তখন রবীন্দ্রনাথকে ততটাই সমালোচনা করেছিলাম নতুন ধারণার জন্য,এখন নতুন কেউ নতুন কোনো ধারণা ননিয়ে এলে ততটাই সমালোচনা করি।"উঁহু!উনি রবীন্দ্রনাথের থেকে ভালো,রবীন্দ্রনাথের থেকে বেশি জানেন।"কিন্তু যদি যুক্তি দিয়ে দেখা যায়,কোনোটাই ঠিক নয়,রবীন্দ্রনাথের থেকে ভালোও হওয়া যায়,বেশিও জানা যায়।কিন্তু আমার এই সমালোচনা,পর্যালোচনা আর হেয় করে যে কত সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ করেছি তার ঠিক নেই।কেউ কেউ বলবেন,"তাহলে রবীন্দ্রনাথ কেন বিনাশ হননি?তিনি নিশ্চয় মহান,যোগ্য।অন্যরা নয়,তাই হারিয়ে গেছে।"ব্যাপারটা ঠিক তা নয়।রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ছিল একথা ঠিক।দানবীয় প্রতিভা ছিল।কিন্ত আর যেটা ছিল সেটা হল অর্থ,ক্ষমতা,প্রতিপত্তি,সুযোগ ও সমর্থন।সেটা অন্যায় নয়।তার জন্য আমি তাকে দোষ দিই না।কারো কাছে যদি সাধন থাকে তা না ব্যবহার করা বোকামি।কিন্তু বাকিরা কেন ব্রাত্য হবে?তবে একথাও মানি,যদি কেউ হার না মেনে সমাজ ও পাঠকের কথা না মেনে লিখে যান,তিনি অবশ্যই একদিন রবীন্দ্রনাথকে পেরিয়ে যাবেন।পেরিয়ে যাওয়া কথাটাও ঠিক নয়,কারণ সে এক আলাদা দুনিয়া হবে।যেখানে তিনি একমাত্র রাজা।সবশেষে শিল্পীর কাজ শিল্প সৃষ্টি করা,গ্রাহকের মন জয় করা নয়।যদি গ্রাহক তা বর্জন করে,হতে পারে সেটা নিকৃষ্ট সৃষ্টি।কিন্তু সবক্ষেত্রে নয়।হয়তো গ্রাহক সেই সৃষ্টির স্বাদ গ্রহণের জন্য তৈরিই নয়।আমি প্রমান দেব না,উদাহরণও না।আমি কাউকে আমার মতে সম্মতি জানানোর জন্য রাজি করতে লিখিনি।আমি লিখেছি আমার মত।কেউ মানতেও পারে,আবার নাও পারে।ধন্যবাদ। পুনশ্চঃ-কেউ আবার ভাবতে পারেন,বিখ্যাত হওয়ার জন্য আমি বিখ্যাত লোককে নিশানা করছি।ব্যাপার এমন নয়।আমিও রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ ভক্ত।আমার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।আমার সমস্যা রবীন্দ্রনাথকে ঈশ্বর বানানোয়।তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে একথায় আমার ভীষণ আপত্তি।
    ঢেউ - PIJUS SARKAR |               ঢেউ          ---------------         পীযূষ কান্তি সরকার জীবনের আশা থমকে দাঁড়ালে সরিষা-দানায়বিপুলায়তন ঢেউ এসে যদি ভাঙে হতাশা-প্রাচীরহিসাবনিকাশের খাতা খোলা -- তখন কী আর মানায় ! 
    হেদুয়ার ধারে - ১২৯  - Anjan Banerjee |                  অভয় পালের মেয়ে চৈতালির মামলার ব্যাপারে অলোকেন্দু মিত্রের চিঠির জবাব এখনও আসেনি ও তরফ থেকে । এর মধ্যে সাগর একদিন দেখা করেছিল অলোকেন্দুবাবুর সঙ্গে । বলল, ' বটতলা থানায় এফ আই আর জমা করে দিয়েছি ... '---- ' রিসিভড কপি নিয়েছেন তো ? '---- ' হ্যাঁ নিয়েছি ... '----- ' আচ্ছা ঠিক আছে । আপনাদের আর কিছু করার দরকার নেই এখন । যখন দরকার হবে আমি বলব । আমি বারুইপুরে চৈতালি পালের শ্বশুরবাড়ি রিপ্লাই পাঠিয়ে দিয়েছি । এখন ওরা তিনটে কাজ করতে পারে । এক, এখন চিঠির ডিপোজিশান কমপ্লাই করে ওরা ঘরের বউকে নিতে আসতে পারে । দুই , তা না করে বরং অভয় পালদের এগেনস্টে কোর্টে মামলা তুলতে পারে চৈতালিকে অ্যাবডাকশান এবং ফোর্সফুল ডিটেনশানের ইস্যুতে । আর লাস্ট অপশান হল, কোন কিছু না করে চুপচাপ বসে ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ স্ট্র্যাটেজি নেওয়া । দেখা যাক কি করে  .... ওদের নেক্সট স্টেপের ওপর আমাদের নেক্সট স্টেপ কি হবে সেটা ডিপেন্ড করবে ... '----- ' আপনি যা ভাল বোঝেন ... আপনার হাতেই সব ছেড়ে দিয়েছি । মাস্তানি করতে এলে আমি সামলে নেব । সেটা অবশ্য আমি চাই না । যা হবার আইনের রাস্তাতেই হোক । তবে যে যে ভাষা বোঝে তাকে সেই ভাষাতেই জবাব দেওয়া উচিত ... ' সাগর বলল ।অলোকেন্দুবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ' একমত একমত ... 'সাগর বলল, ' আমি তা'লে উঠি স্যার । আপনার আর সময় নষ্ট করব না । যাবার সময় একবার চাচার হোটেলে ঘুরে যাব । অভয়চরণকে আর একবার অভয় দিয়ে যাই ।----- ' হ্যাঁ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই... আমার নামেও বলবেন ... বলবেন কোনও ভয় নেই।  আমরা আছি ... '      সাগর চাচার হোটেলে অভয় পালের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরে গেল ।মায়ের শরীরটা তেমন ভাল নেই  । ডাক্তার দেখাতে হবে । রাত্রিকে বলতে হবে একদিন এসে যদি মাকে একটু দেখে যায় । ওর সঙ্গে কথা বললে মার মন হয়ত ভাল হয়ে যাবে । সবসময়ে  নানারকম দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকে । হয়ত ছেলের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে চিন্তা । মায়ের চিন্তাটা একেবারে মিথ্যে নয় । সত্যিই তো তার জীবনটা কিভাবে কাটবে সে নিজেই জানে না । তার ওপর চারদিকে শত্রুরা ঘিরে আছে । সুযোগের অপেক্ষায় আছে সবসময়ে । এই নিয়ে সেদিন নিখিল স্যারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল । নিখিল স্যার বললেন, ' চিন্তা ক'র না ... বৈপ্লবিক কাজে শত্রু তৈরি হবেই  । শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে ভয়শূন্য হয়ে । শত্রু মানেই শ্রেণীশত্রু নয় । নিজের শ্রেণীর মধ্যে প্রচুর শত্রু রয়েছে ছদ্মবেশে । তাদের মোকাবিলা করাই সবচেয়ে কঠিন । কারণ তাদের চিহ্নিত করা যায় না সহজে । সবরকম শত্রু খতম করার জন্য আমাদের তৈরি রাখতে হবে প্রতিটি মুহূর্ত ... ' সাগর কথাগুলো শুনল গভীর মনোযোগ দিয়ে । নিখিল ব্যানার্জীর বলা প্রতিটি কথা সাগরের মনের গভীরে গেঁথে যেতে লাগল । কয়েক মুহুর্তের জন্য  যাবতীয় চিন্তাভাবনা ভাসিয়ে দিয়ে সাগরের শিরা উপশিরায় উন্মাদনার একটা শিহরণ বয়ে গেল ।সে অস্ফূটস্বরে বলল, ' হুঁ হুঁ .... তৈরি থাকতে হবে ... 'নিখিল স্যার বললেন, ' তোমাকে বুকে সাহস ধরে রাখতে বলা মানে তোমাকে অপমান করা । তাই সেটা আমি বলছি না । তবে , একটা কথা জানিয়ে রাখি ।  তোমার পাশে আমি সবসময়ে আছি । তুমিএকা থাকলেও আসলে তুমি একা নও ... 'নিখিল স্যার একটু চুপ করে থাকলেন । তারপর আবার বললেন , ' তুমি একা নও ... একা নও ... 'বলে সাগরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাগর অবাক হয়ে ভাবতে লাগল নিখিল স্যার একথা বলছেন কেন ? সে যে একা নয় এ তো সবাই জানে । কানু, মাণিক, শম্ভু , সন্তোষ দাস ... এরা তো আছেই ।  তাছাড়া কালীবাবুর মতোও কেউ কেউ আছে । সে একা হবে কেন !সে একটু চুপ করে বসে তারপর বলল, ' ঠিক আছে স্যার ...  আমি তা'লে এখন আসি ... অনেক বেলা হয়ে গেল ... '     রাত প্রায় বারোটা বাজে । বেলগাছিয়া ব্রিজের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে শ্যামবাজারের দিকে আসছিল । নির্জন , নিশুত , প্রায় অন্ধকার এলাকা।  গিয়েছিল বাঙুরে শতদল ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে । শতদলবাবুর বয়স হয়েছে । তিনি একসময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন । আন্দামানেও অন্তরীণ ছিলেন কয়েক মাস । তারপর নানা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক  ঘটনার সমাপতনের প্রতিক্রিয়ায়  ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ঘটে যায়  কয়েক মাসের মধ্যে । শতদলবাবু  এখনও রাজনীতি করেন , তবে সক্রিয় অংশগ্রহণ বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু নেই  । তিনি সাগরকে কয়েক বছর ধরে চেনেন এবং তার সঙ্গে বছর দুই আগে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল এই বাঙুর এলাকায় একটা  ঘটনার মাধ্যমে । ওই ঘটনায় দীর্ঘদিন ধরে মেয়েদের উত্যক্ত করার ঘটনায় সাগর এবং তার ছেলেরা যেভাবে কিছু রোমিওকে সবক শিখিয়েছিল সেটা শতদলবাবুর মনে গভীর রেখাপাত করে । চিরকাল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর আদর্শ অনুসরণ করে চলা শতদল ভট্টাচার্য মশায় এই আইনবহির্ভূত পেশীশক্তির সদর্থক প্রয়োগকে মনে মনে কুর্নিশ না জানিয়ে পারলেন না । লুম্পেনদের শায়েস্তা করার দিনই পুকুরের ধারে একটা ছোট মাঠে সাগরের সঙ্গে তার পরিচয় হয় । তারপর থেকে ওনার বাড়িতে মাঝে মাঝে সাগরের যাতায়াত ।শতদলবাবু রঙমহলের সামনে ক'টা ইভ টিজার লুম্পেনকে আড়াই ধোলাই দেবার ঘটনাটা লোকমুখে জেনে গেছেন এবং সাগর মন্ডলকে মনে মনে পুনর্বার কুর্নিশ জানালেন । তবে কাঁচাখেকো ছেলে তিনটে যে স্বরূপ খাঁড়ার পোষা সহচর তা জেনে তিনি বেশ উৎকন্ঠায় আছেন সাগরকে নিয়ে। সেটা আজকে বলেও ফেললেন -----' আমরা একই দল করি কিন্তু কবে আর দলে সবাই ভাল ছিল ? কিন্তু স্বাধীনতার পর বেনোজলে ভেসে রাজনীতির মহানদে অনেক বিষ্ঠা এসে জমা হয়েছে এটা হয়ত তুমি আন্দাজ করতে পার । স্বরূপ খাঁড়াও তেমনই একজন ... এক বিষাক্ত জীব । আমার ক্ষমতা থাকলে আমি এসব পচনশীল অস্তিত্বকে কেটে বাদ দিয়ে দিতাম । কিন্তু আমার হাতে কতটুকু ক্ষমতা তুমি জান । পার্টি এখন মাসলপাওয়ার এলিমেন্ট জড়ো করতে চাইছে পরোক্ষ মদত জুগিয়ে ... 'শতদলবাবু একটু থামলেন । বয়স হয়েছে অনেক, একটানা বেশিক্ষণ বলতে পারেন না ।সাগর বলল, ' হ্যাঁ দাদা ... এগুলো আমরা রাজনীতি না করেও বুঝতে পারি ... কিন্তু কিছু তো করার নেই দাদা ... এগুলো তো হতেই থাকবে । ক্ষমতা দখল করা এবং তা দখলে রাখা এখন আসল কাজ ... 'শতদলবাবু বললেন, ' হ্যাঁ অনেকটা ঠিকই ধরেছ ।পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি যত ভালই হোক , একটা সর্বাঙ্গসুন্দর নিখুঁত সিস্টেম তো নয় । এর  অনেক লুপহোল আছে । কিন্তু এর যথার্থ বিকল্পই বা কি ? .... '  তারপর আবার একটু বিরতি নিয়ে বললেন, ' স্বরূপ খাঁড়া কিন্তু খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ লোক । আমি ওকে ভালভাবে চিনি । ও কিন্তু ওৎ পেতে আছে  সুযোগ পেলেই তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য । এরা হল দেশের পোস্ট ইন্ডিপেন্ডেন্স  বাই প্রোডাক্ট ।  একটু সাবধানে থেক .... আর কি বলব ? আমার আর কি ক্ষমতা আছে .... তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে ... 'সাগর আর কি বলবে । সে বলল, ' চিন্তা করবেন না দাদা ... সব সামলে নেব ... 'শশধর ভট্টাচার্য একটা ছোট শ্বাস ফেলে বললেন, ' তাই যেন হয় ভাই ... '      ব্রীজ পেরিয়ে আর জি কর কলেজের সামনে এসে পড়ল সাগরের সাইকেল । অন্ধকার জনহীন রাস্তা । কয়েকজন মাতাল এদিকে ওদিকে টলমল পায়ে ঘোরাঘুরি করছে ।  বাড়িঘর , দোকানপাট, শ্যামবাজারের মেসবাড়ি সব ঘুমিয়ে পড়েছে ।সাগর ভাবল, এতটা দেরি করা উচিত হয়নি ।  অনেক আগেই বেরিয়ে আসা উচিত ছিল । সে কোন আর্মস নিয়ে বেরোয়নি । চারিদিকে শত্রু । এখানে অ্যাটাক হলে বেশ সমস্যা হবে । সাহায্য করার কেউ নেই  । স্বরূপ খাঁড়া কি এতদূর এসে অপারেশান চালাবে ? বিশ্বাস কিছু নেই  । শতদল ভটচাজ্জের কথাগুলোয় কোন ভেজাল নেই । একশ ভাগ সত্যি ।সাগর রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের দিকে সাইকেল ঘুরিয়ে নিল । দেশবন্ধু পার্কের সামনে দিয়ে ঝড়ের গতিতে প্যাডেল মারতে লাগল । তার হঠাৎ মনে হল পিছন দিক থেকে কয়েকটা সাইকেল আসছে ।সে ঝট করে একবার পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখল তিনটে সাইকেল আসছে । তার বুঝতে অসুবিধে হল না টার্গেটটা সে নিজেই ।  প্রায়  মাঝরাতে চেনা রাস্তাটা অচেনা ভুতুড়ে মনে হচ্ছে । গা ছমছম করা পরিমন্ডল । সাগর কিন্তু দিশাহারা হল না । ওটা তার স্বভাবে নেই  । মনে মনে হিসেব করে নিল , কোনরকমে মোড়টায় পৌঁছে বাঁ দিকে ঘুরে স্পীডে কিছুটা টেনে দিতে পারলে এলাকায় ঢুকে যাবে । শালাদের  ওখানে ঢোকার হিম্মত হবে বলে মনে হয় না ।কিন্তু তা হল না । কপাল খারাপ । এই  বিপদের মধ্যে আচমকা সাগরের সাইকেলের একটা টায়ার ফেঁসে গেল ।এবার সাগরের মতো লোকেরও মাথা গুলিয়ে যাবার মতো অবস্থা হল । সে মুখে আঙুল পুরে দুবার জোরাল সিটি মারল । কিন্তু তার মহল্লা এখান থেকে অনেকটা দূরে । সেখানে রাত্রে তার ছেলেরা তৈরি থাকে । অত দূরে তার শিষের শব্দপৌঁছল না খুব সম্ভবত । সাইকেল তিনটে এগিয়ে আসছে । একজনের হাতে একটা পিস্তল রয়েছে সাগর পরিষ্কার আন্দাজ করতে পারছে । বাকি দুজনের হাতে কি আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ।    সাগর এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা আড়াল খুঁজতে লাগল যার পিছনে গা ঢাকা দিয়ে  পিস্তলের গুলি ক'টা খরচ করিয়ে দেওয়া যায় । কিন্তু ভাগ্য এখানেও সহায় হল না । শরীর ঢাকা দেওয়ার মতো কোন আড়াল এ জায়গাটায় চোখে পড়ছে না । শুনশান শ্মশানের মতো । নিস্তব্ধ আশপাশ ।তিনটে ছেলে সাইকেল ছেড়ে দিল । ওগুলো ছ্যাং ছ্যাং করে একপাশে পড়ে গেল । ওরা কুড়ি মিটারের মধ্যে চলে এসেছে । সাগর খালি হাতেই লড়াই দেবার জন্য তৈরি হল । এরকম অনেকবার দিয়েছে সে । কিন্তু তাদের হাতে অস্ত্র ছিল না । সেটাই  আসল তফাৎ ।   সাগর টানটান হয়ে দাঁড়াল হয়ত বা শেষ লড়াই  লড়ার জন্য । ছেলেটা পিস্তল উঁচিয়ে ছুটতে আরম্ভ করল সাগরের দিকে । তার সঙ্গের দুই সঙ্গীও ছুটে আসছে । তাদের দুজনের হাতেই খোলা চকচকে ছুরি । ফাঁকা রাস্তায় তিনটে কুকুর হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল ওদের দিকে তাকিয়ে । নির্জন পরিবেশ উচ্চকিত করে তুলল কুকুরগুলো । ছেলেগুলো ছুটতে ছুটতে সাগরের কুড়ি ফুটের মধ্যে চলে এসেছে । পিস্তল হাতে ছেলেটা এবার ট্রিগারে আঙুল দিল ।  কুকুরগুলো সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে । ওই চিৎকারের মধ্যে ফটাস করে একটা টায়ার ফাটার আওয়াজ হল । পিস্তল বাগানো ছেলেটা রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল । বাকি ছেলে দুটো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নীচু হয়ে পড়ে যাওয়া ছেলেটার দিকে বিষ্ফারিত চোখে দেখছে ।  রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে ।  একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসাডার ওদের পাশ কাটিয়ে জোর গতিতে সাগরের সামনে যেন হ্যাঁচকা টানে থেমে গেল । গাড়ির ইঞ্জিন চালু আছে .... মাথায় মুখে কালো চাদর জড়ানো ড্রাইভারের সিটে বসা একজন দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, ' কুইক কুইক .... হারি আপ ... তাড়াতাড়ি উঠে এস ... 'তার ডান হাতে একটা পিস্তল তখনও ধরা আছে ।সাগর বাঁচবার তাগিদে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে ভদ্রলোকের পাশে বসে পড়ল । গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে খান্নার মোড়ের দিকে চালাতে থাকলেন তিনি । মাথার, মুখের চাদর সরিয়ে দিলেন ।সাগর অবাক হয়ে বলল, ' স্যার আপনি ! 'নিখিল ব্যানার্জী মানিকতলার দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, ' অস্ত্রাগারের মূল্যবান অস্ত্র রক্ষা করা হল অত্যাবশ্যক কর্তব্য । সেটাই হল ফার্স্ট স্টেপ । ফার্স্ট স্টেপটা আজ নিলাম । খতম ...  এটা হল শুরুর শুরু ... 'সাগরের মনে পড়ে গেল ---- ' তুমি একা থাকলেও ...  আসলে তুমি একা নও... 'নিখিল স্যার বিড়বিড় করে আপনমনে বললেন, ' শত্রু শুধু অন্য শ্রেণীতে থাকে না .... নিজের শ্রেণীর মধ্যেও থাকে ... 'সাগর কোন প্রশ্ন করল না । বোঝবার চেষ্টা করতে লাগল ।     ( চলবে )********************************************
  • ভাট...
    commentযদুবাবু | বেশ। ওটাই ধরি। অ্যাটেনবুড়ো বড়ো ভালো। 
    commentআর্ট ভাট  | আচ্ছা, এই সুযোগে বলে যাই - আর্ট ভাট টই অতি উত্তম হইল। 
    commentkk | ও দ'দি, তোমার কাছে একটা প্রশ্ন ছিলো। জেড-্লিব তো এখন পেইড মেম্বারশিপ করে দিয়েছে। তো পে করতে গেলে তো বলছে স্ক্রিল অথবা অ্যাজটেকো এইসব লাগবে। আমি এই জিনিষগুলো কখনো ইউজ করিনি। তাই একটু ঘাবড়ে মত যাই। এগুলো কি সেফ? 
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত