এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ক্যালিডোস্কোপে দেখি - মন বসানো - অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়কুচবিহারে সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি ছিল বিভিন্ন মেলায় যাওয়ার। প্রত্যেক মেলাতেই কিছু না কিছু খেলনা কেনা হত। একবার কর্কের ছিপির গুলি ছোঁড়ার একটা এয়ারগান কেনা হল। ঠিক মত ব্যবহার করতে না পারলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় হিসাবে এই ধরণের খেলনাগুলোয় আমার অগ্রাধিকার থাকত। আমার পরেই মেজভাইও প্রায় সমান সমান খেলার সু্যোগ পেত। সমস্যা হত সবচেয়ে ছোটটিকে নিয়ে। তাকে কি করে আমাদের সমান যোগ্যতার ভাবা যায়! অথচ, ঠিক সেইটিই তার দাবি। এবং, অবশেষে সমঝোতা করতেই হত। তা না হলে তিনজনেরই ক্ষতি।এই রকমই এক মেলায় গিয়ে কিনেছিলাম তিন আয়নাভরা নলের ক্যালিডোস্কোপ। খেলনাটা একটু করে ঘোরালেই তার ভিতরের অপূর্ব নক্সাদার ছবিটা টুক করে পাল্টে যায়, ক্রমাগত পাল্টে যেতে থাকে। পুরানো ছবি আর ফিরত না। জীবনের ক্যালিডোস্কোপেও ফেরে না। নানা টুকরো ছবির গড়ে ওঠা নকশায় পার হয়ে আসা জীবনকে দেখে নিই, যতটা পারি, যতটা মনে পড়ে। দমদম ক্যান্টনমেন্টের জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ছিল দত্তপুকুরে মামাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া। বেশির ভাগ সময় মায়ের সাথে আমরা তিন ভাই, কখনও কখনও বাবাও থাকত সাথে। মাত্রই কয়েকটা স্টেশান, কিন্তু আমার মনে হত, চলেছি ত চলেইছি। সেই যাত্রার যে কয়েকটি ছবি মনে পড়ে, গাড়ি ফাঁকা হোক কি ভীড়, মা সবচেয়ে ছোট ভাইটিকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মনে হয় সীট ফাঁকা না থাকলে কেউ না কেউ উঠে গিয়ে মাকে জায়গা ছেড়ে দিতেন। আমরা বড় আর মেজ দুই ভাই দুই সারি সীটের মাঝখান দিয়ে জানালার পাশে চলে যেতাম। বসে থাকা যাত্রীরা জায়গা করে দিতেন। বিনিময়ে তাদের কেউ না কেউ কথাবার্তা শুরু করে দিতেন। আমাদের কাছে কেউ অপরিচিত ছিলেন না। ‘স্ট্রেঞ্জার’-ধারণাটির সাথে আমাদের বা আমাদের অভিভাবকদের তখনও পরিচয় ঘটেনি। বিপরীতে যেই বাগধারাগুলিকে আমি শৈশবের দূরতম বিন্দুটি পর্যন্ত দেখতে পাই, তার একটি হচ্ছে, বসুধৈব কুটুম্বকম, এই দুনিয়ার সবাই আমার আত্মীয়। সহযাত্রীদের সাথে গল্প করতে করতে, মানে তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে, একটা-দুটো ছড়া শোনাতে শোনাতে দত্তপুকুর স্টেশান এসে যেত। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশানের বাইরে এসে যেমন দরকার, একটি বা দুটি রিক্সায় সওয়ার হয়ে যেতাম। স্টেশনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আমরা একটি আধা-শহর, আধা-গ্রাম জীবনের দিকে এগিয়ে যেতাম। পরবর্তীকালে পরিচিত হওয়া কল্পবিজ্ঞানের ধারণায় যেন বা একটি ছবির ভিতর দিয়ে একটু অন্য রকমের একটি জগতে ঢুকে যাওয়া। তারপর কয়েকটি দিন আনন্দের জোয়ারে কাটিয়ে আবার রিক্সা-ট্রেন, নিজের পাড়া, রোজকার জগৎ।উত্তরবঙ্গে কয়েকটি সপ্তাহ কাটিয়ে বুঝে গেলাম এইবারে এক সম্পূর্ণ আলাদা দুনিয়ায় এসে হাজির হয়েছি। এবং এখান থেকে আর আগের জগতে ফিরে যাওয়ার কথা বড়োরা কেউ ভাবছে না। মন বসাতে সময় লেগেছিল। তারপর একটু একটু করে সেই নতুন জগৎ আমায় ঘিরে নিল।আমাদের পাশের বাড়িতে একটি চমৎকার কুল গাছ ছিল। দুই বাড়ির মাঝে যে বেড়া ছিল, বাড়ির বাচ্চাদের সুকীর্তির ফলে মাঝে মাঝেই সেটার বাধা দেওয়ার ক্ষমতা বলে কিছু থাকত না। একদিন বেড়ার ফাঁক গলে ওপারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফলভরা কুল গাছ। গাছের সামনে মানুষ-জন। আমায় যে প্রশ্ন করা হল আমি তার অর্থ বুঝলেও নিশ্চিত হতে পারলাম না, চুপ করে থাকলাম। তারা আর আমায় বিব্রত না করে আঁজলা ভরে কুল দিয়ে দিল। আমি বাড়ি ফিরে এসে ঠাকুমার কাছে হাজির হতেই ঠাকুমা বলল– হাতে কি আনছ, কুল?– মনে ত হয়। কিন্তু, ওরা বলল বড়ই।ঠাকুমা একগাল হেসে বলল,– একঅই কথা।বুঝতে পারলাম না ‘বড়ই’ শব্দটা ঠাকুমার আগেই জানা ছিল কি না। নাকি প্রতিবেশীদের সাথে গপ্পো-গাছা করার সময় জেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমি শব্দটা শিখে গেলাম।একদিন ঠাকুমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হলাম এক পাড়ায়। সমস্ত বাড়িগুলি মাটির উঁচু ভিতের উপর টালির চাল মাথায় ধরা মাটির দেয়ালে গড়া। আমার প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার সেই ভিতে থাক কেটে বানানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ঠাকুমা গল্প জুড়ে বসল। আমার জন্য মুড়ি এল। ঠাকুমা এবং সমবেত মহিলারা আসর জমালেন পান-খয়ের-সুপারির। কিন্তু সেই সুপারি আমাদের বাড়িতে দেখা শুকনো সুপারি নয়। কাঁচা সুপারি। আর তাকে সুপারি বলেও না তারা, বলে – গুয়া। এক বিশেষ গন্ধ আছে তার। ছোটদের খেতে নেই তবে আমি চাইলে এই এত্তটুকু এক কুচি মুখে নিয়ে দেখতে পারি, রস গেলা চলবে না। আমি একবার দাঁতে কেটে আর মুখে রাখার উৎসাহ পাইনি। সেদিনের সেই আড্ডায় অংশ নেওয়া মহিলারা বাংলা ভাষাতেই গল্প করেছিলেন, কিন্তু ঠাকুমার একেবারে গা ঘেঁষে বসেও সেই সব আলাপের বেশির ভাগ আমি বুঝতে পারিনি, বেশ কিছু অচেনা শব্দ ছিল আর চেনা কথারও সুর অচেনা ছিল। আস্তে আস্তে এই রকমের অনেক শব্দের সাথে পরিচয় ঘটে গিয়েছিল যাদের অনেককেই আজ আর মনে পড়ে না। উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার পর আমার জীবনচর্যা থেকে এরা হারিয়ে গিয়েছে। বছর দশেক আগে সেই সময়ে অনলাইন লেখকদের জমজমাট সাহিত্য আড্ডার সমাবেশ ‘সচলায়তন’-এ, জনাব আব্দুল্লাহ এ.এম.-এর পোস্ট “আমাদের ভোটবর্মী ঋণ”-এ এই শব্দদের অনেককে ফিরে পেয়েছিলাম। অনেক কৃতজ্ঞতা তাঁকে। এই লেখাটির মধ্যে কোচদের থেকে আসা শব্দগুলিকে পড়ে মনে হয়েছিল পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেল। ঠাকুমাও হয়ত এই উত্তরবঙ্গের জীবনে ফিরে পেয়েছিলেন পুরনো বন্ধুকে, তাঁর আবাল্য পরিচিত ভাষাকে। বহুকাল বাদে তিনি যেন কথা বলার স্ফুর্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। এমনিতে আমার বাবা এবং ঠাকুমা বেশী কথা বলার মানুষ ছিলেন না। কিন্তু কোচবিহার বসবাসের ঐ তিন বছরে ঠাকুমাকে তার চারপাশের মানুষদের সাথে অনেক বেশী গল্প করতে দেখেছি। এমন হতে পারে যে সেখানে তিনি বেশ কিছু মানুষ পেয়েছিলেন যাঁদের সাথে তাঁর প্রাক-উদ্বাস্তুজীবনের মানুষদের জীবনচর্যার নানা মিল ছিল। আত্মীয়তার একটা টান অনুভব করেছিলেন তিনি। আর সেই টানের মধ্যে ভাষার টান-ও হয়ত একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল।টান এক মজার অনুভূতি। যে তিন বছর উত্তরবঙ্গে ছিলাম, যখন তখন ভাবতাম কবে আমাদের দমদম ক্যান্টনমেন্টের ভাড়াবাড়ির ঘরে ফিরব। আর উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার কয়েকবছর পর থেকে কি যে এক চোরাটান ছেয়ে থেকে অস্তিত্ব জুড়ে – সেই তোর্সাতীর-এর জন্য!অরণ্যষষ্ঠীর সকালে মা, আরো প্রতিবেশী কাকি-পিসী-মাসীরা দলবেঁধে নাইতে যেত তোর্সা নদীতে। সাথে নূতন কেনা তালপাতার পাখা, নানা রকম গোটা ফল, দুর্বা। আমি আর মেজভাইও যেতাম সাথে। আমরা জলে নামতাম না। মা-মাসীরা সবাই নামত। স্মৃতিজলে নানা ছবি থেকে থেকে ভেসে যায়, খুঁটিনাটি ডুবে যায় হামেশাই। তাই নিশ্চিত করে বলবার দাবি নেই কোন। কেউ কেউ স্নান করার সময়, না কি স্নান শেষে, গোটা আম, হয়ত অন্য ফলও, ছুঁড়ে দিত তোর্সার জলে। আমাদের-ই বয়সী কিছু দামাল ছেলে যারা ঐ সময় সর্বক্ষণ জলেই রয়েছে, ঝাঁপিয়ে ডুব দিয়ে তুলে নিত সেই সব ফল। নদীর সন্তান তারা, নদীতে উৎসর্গের ফলে তাদেরই অধিকার।স্নান সেরে ঘরে ফিরে মা এক এক করে, সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের তিন ভাইয়ের মাথায়, গায়ে ভেজা পাখা দিয়ে বাতাস করে দিত। সে পাখা ধরারও রীতি ছিল। ডাঁটিতে ধরা নয়। পাখা যেন থালা, তাতে ধান, দুর্বা আর গোটা গোটা ফলেরা বসে আছে। মা এক হাতে আঙ্গুলের চাপে সেই ঢেউখেলানো থালাকে ধারণ করে আছে নীচে থেকে, আরেক হাত রেখেছে ফলেদের উপরে যাতে তারা গড়িয়ে না যায়। তারপর সেই থালা উঠছে, নামছে, উঠছে, নামছে, আর বারি-বিন্দু-সিঞ্চিত আশীর্বাদী বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের শরীরে, মননে, শুদ্ধ হয়ে উঠছে তার সন্তানেরা, পূর্ণ হয়ে উঠছে। এই ছবি কি ঠিক এই রকম-ই ছিল? কি এসে যায়! আমার মনে এ ছবি এ ভাবেই আঁকা আছে। সকল আশীর্বাদ-এ আমাদের ভুবন ভরিয়ে দিয়ে জীবন নদীর পাড় ছেড়ে মা চলে গেছে একদিন। আমার কোন ঈশ্বর নেই, কোন প্রার্থনা নেই। শুধু আকাঙ্ক্ষা আছে, মা’র হাতের ঐ ঠান্ডা বাতাস যেন আমায় ঘিরে রাখে, যতদিন আমার স্মৃতি থাকে, যতদিন চেতনা থাকে। যেন শুনতে পাই, প্রায় নিজের ভিতর, নিজের অন্তরাত্মাকে শুনিয়ে আমাদের জন্য বিড়বিড় করছে, ‘বাঁইচ্যা থাকো, বড় হও, মানুষ হও’। বেঁচে আছি, বড় হতে হতে বুড়ো হয়ে আজকের যুগের মানুষের গড় আয়ুর থেকে এক দশকেরও কম দূরত্বে এসে গেছি। শুধু, কতটুকু যে মানুষ হতে পারলাম! কুচবিহারে আমাদের জীবন আজকের প্রেক্ষিতে বিচিত্র সব, হয়ত বা প্রান্তিক হতে হতে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন জীবনের সাথে জড়িয়ে ছিল। বিবিধ চর্চার সন্ন্যাসী, ফকির-দরবেশ, নাচুনী এবং সাদামাটা ভিখারী নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে আমাদের বাড়ি থেকে আমাদের সাধ্যমত প্রণামী/সিধে/প্রাপ্য/ভিক্ষে নিয়ে যেত। তাদের প্রত্যেকের কাছে নিশ্চয়ই মানুষ হওয়ার, মানুষ হিসাবে সফল হওয়ার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বোঝাত। তোমার ছেলে ফুলুস হবে মা। ফুলুস মানে পুলিশ। এই ছিল এক নাচুনীর কাছে মানুষের সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য আকাঙ্খার রূপ। কিছুদিন বাদ দিয়ে দিয়ে আসত সে। এসেই মাকে ডাকাডাকি শুরু করে দিত। মা এসে দরজা ধরে দাঁড়াত। আমরা ভাইয়েরা মা’র পাশ ঘেঁষে। তারপর সে কয়েক পাক ঘুরে ঘুরে তার নাচ দেখাত। চেহারায়, সাজ-পোষাকে কিছু অন্যরকম ছিল সে। তার নাচও ছিল এমন কিছু রকম যা আগে কখনো দেখিনি, অবশ্য কতটুকুই বা এ দুনিয়ার দেখেছি তখন! পরেও চাক্ষুষ দেখার সুযোগ ঘটেনি। প্রথমবার এই লেখা লিখতে বসে মনে হয়েছিল প্রযুক্তির সাহায্য নিলে কেমন হয়! ইউটিউবে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় পেয়ে গেলাম সেই নাচের ধারার দেখা। রাজবংশী। সে মেয়ে কি তবে নাচত সাইটোল নাচ, আমাদের জন্য ষষ্ঠী ঠাকরুণ কি মনসা দেবীর আশীর্বাদ আবাহন করে? নাচ শেষে মার কাছ থেকে কিছু পেয়ে বারে বারে দু’হাত তুলে সে প্রার্থনা জানাত তার ঈশ্বরের কাছে মা’র সন্তানদের সাফল্য কামনা করে। কিন্তু কেন সে পুলিশকেই জানত সর্বোচ্চ ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু হিসেবে? পুলিশ কি তাদের জীবনে ছিল কোন ভয়ানক নিয়ন্তার ভূমিকায়, তাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত নিয়ামক? হয়ত সমাজ তখনো অনেক সরল ছিল, ক্ষমতার আরো আধুনিক দাবীদার-রা হাজির হয়নি তখনো, অন্তত তাদের রোজকার জীবনে তাদের ছায়া এসে পড়েনি। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব হাঁক-ডাক-সুর ছিল তাদের অস্তিত্বের, তাদের উপস্থিতির জানান দেওয়ার জন্য। নিয়মিত সময়ে এদের কারো কারো দেখা না পেলে মা-ঠাকুমা-পাড়ার বয়স্করা উদ্বিগ্ন হত, কিছু হল কিনা কে জানে! ফিরে এলে খোঁজ নিত, আসেনি কেন এতদিন? আমাদের ছোটদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের ছিল ডুগডুগি আর বাঁশির আওয়াজ। প্রথমটি যার কাছ থেকে শোনা যেত তার সঙ্গে থাকত গলায় বা কোমরে দড়ি বাঁধা অন্তত দুটি বাঁদর এবং অনেক সময় আরেকটি বাঁদর বা টিয়া অথবা একটি ছোট ভালুক। আর দ্বিতীয় জনের সাথে থাকত বাঁকের দুপাশে ঝোলান, ঢাকনা-বন্ধ সাত-আটটি নানা মাপের বেতের ঝুড়ি, যাদের ভিতরে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে ফণাধর ও ফণাহীন সাপেরা। অসহায় প্রাণীগুলির বন্দিত্বের বিনিময়ে আমাদের বিনোদনে যে নিষ্ঠুরতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেটা বোঝার মত বয়স তখনো আসেনি। আমরা বড় হতে হতে এই পেশাগুলি যে বন্ধ হয়ে গেছে, মানুষ হয়ে ওঠার সামাজিক প্রক্রিয়ায় তার অংশভাগী হতে পেরে, ভালো লাগে। আবার ঐ পেশাগুলিতে যুক্ত মানুষেরা পাল্টে যাওয়া দিনে নিজের এবং পরিবার পরিজনদের বাঁচিয়ে রাখার কোন সুষ্ঠু উপায় পেয়েছিলেন এমন নিশ্চয়তার সন্ধান না থাকায় বিষণ্ণ বোধ করি। তার কাজে তার জেলার উচ্চ আধিকারিক হিসাবে উত্তরবঙ্গের সেই দিনগুলোতে বাবার জীবন অনেক জটিলতার আবর্তে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা তিন ভাই তার আঁচ তেমন করে টের পাইনি। আমরা আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছিলাম সেই না-শহর-না-গ্রাম-এর সহজ জীবনে। কলার ঝাড় কি কচুর বন কি ছাইয়ের গাদা – টপকে টপকে আমরা চলে যেতাম পাড়ার এ মাথা থেকে ও মাথা, এ বাড়ি ও বাড়ির উঠান পেরিয়ে। কোন উঠানে ধানের মরাই, ধান মাড়ানোর ঢেঁকি, আচার শুকাচ্ছে কোথাও, লম্বা কাপড়ের টুকরাতে বড়ি। কোন উঠানে শসার মাচা, কারো ঘরের টালির চালে পুরুষ্টু লাউয়ের ভরা সংসার, কারো ঘরের পাশটিতে সর্ষে গাছের ফুলে হলুদের ঢেউ খেলে যাচ্ছে।নিজের হাতে, নিজের বাড়িতে ফুল ফোটানো, ফল ফলানোর আবহে আমাদের বাসার উঠানেও কত কি যে হত! কোথাও নরম হলুদ রং-এর অতসী ফুল। আবার কোথাও ফুটে আছে নীল অপরাজিতা কি লাল রং-এর জবা। আর, গাঁদা ফুল-এর দিনে বারান্দার ধার ধরে ধরে উঠান জুড়ে রকমারী গাঁদাফুলের সমারোহে রং-এর বন্যা বইত! কখনো কোন এলাকায় ছোট ছোট, সর্বদা আকাশমুখী চকচকে কাঁচা লংকা, কখনো আবার কোথাও ধনে শাক, সর্ষে। লম্বা লম্বা ঢেঁড়স গাছে কচি কচি ঢেঁড়স। পেঁয়াজকলি এসেছে কোথাও। বিশেষ যত্ন নেওয়া জমিতে লাউ কি কুমড়োর বীজ থেকে গাছ বের হয়ে এসেছে। সে যে কি উত্তেজনার ঘটনা! তারপর সে গাছ যত্ন করে বড় করা। একসময় তাকে এগিয়ে দেওয়া রান্না ঘরের চালে। যাও বাছা, এবার ছড়িয়ে পড়ো মনের আনন্দে। তারপর তাতে ফল ধরে। ফল কাটা হয়, রান্না হয়। কি স্বাদ তার! এ বাড়ির লাউ ও বাড়ি যায়। ও বাড়ির কুমড়ো এ বাড়ি আসে। কোন একটা কি দুটো ফল আবার পাকানো হয় পুরোপুরি যাতে তার থেকে পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় বীজ – পরের ঋতুর জন্য। দু’বাড়ির বেড়ার গায়ে বইছে সীমের লতা, প্রতিবেশীর লাগানো, বইছে দু’পাশেই। ও পাশের ফল তাদের, এ পাশের ফল আমাদের।প্রথম অঘ্রাণের প্রথম রবিবার সন্ধ্যায় আমাদের পাশের বাড়ির উঠানে গিয়ে জড় হয়েছি। উঠানের মাঝখানে পূজার আয়োজন, নাটাই ব্রত। মেয়েরাই আয়োজক। এ বাড়ি ও বাড়ির কাকি, পিসী, মাসীমারা আর, আমরা – কুচোকাচারা। ব্রতকথা পড়া শুরু হত একসময়। চুপ করে শুনত সবাই। কি ছিল গল্প, এখন মনে পড়ে না। সম্ভবতঃ ফসলের কি জমির দেবতার অনুগ্রহ প্রার্থনা করে কোন গ্রামীণ লোককথা। ভারী মজার এক খাবার ছিল সে পূজার প্রসাদ-এ। ছোট ছোট পিঠা, চালের। নুন দেওয়া এবং নুন না দেওয়া। পরের রবিবারে আবার ব্রতকথায় হাজির। আজ অন্য ব্রত, সম্ভবতঃ সত্যনারায়ণের। গোটা অঘ্রাণ মাস জুড়ে প্রত্যেক রবিবারে পাল্টে পাল্টে নাটাই আর সত্যনারায়ণ। উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার পর সত্যনারায়ণের দেখা মিললেও নাটাই ব্রতকথার আর দেখা মেলেনি।আর একটি ব্রতকথাও সামনে থেকে বসে শোনা হয়েছিল সেই সময়, পরবর্তীকালে পাঠ্যবইয়ের বাইরে আর কোথাও তার দেখা মেলেনি আমার – মনসাব্রত। আমাদের বাড়ি থেকে একটি কি দুটি বাড়ি পরের প্রতিবেশীর বাড়িতে সাপের দেবির পূজার আয়োজন হয়েছিল। দেবীমূর্তির মাথার চারপাশে একাধিক সাপের ফণার উপস্থিতি মনে ভালই ভয় ধরিয়েছিল। আমাদের নিজেদের বাড়িতে একটিই পূজা আমার একেবারে ছোটবেলা থেকে মনে করতে পারি – লক্ষ্মীপূজা, প্রতি বৃহস্পতিবার এবং শরতের কোজাগরী পূর্ণিমায়। দ্বিতীয়টি বাবার পৌরহিত্যে হলেও প্রতি সপ্তাহের পূজাটি মা করত এবং সেটি ঐ ব্রতকথাগুলির মতই পাঁচালী পাঠ করে। সব কটি ব্রতকথাতেই একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল, দেবতাদের যার যতই ক্ষমতা থাক, মানুষের পূজা না পেলে তাদের মর্যাদা নেই। বিভিন্ন দেবতা বিভিন্ন কিছু পেলে সন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু নিয়মিত পূজা করতে না চাওয়া বা ভুলে যাওয়া মানুষকে যথেষ্ট পরিমাণ বিপদে না ফেলে এবং পূজা করা লোকেদের যাকে যতটুকু দিলে চলবে সেই মত পুরস্কার না দিলে তাদের থেকে ঐ পূজা পাওয়া নিশ্চিত হয় না। বয়স বাড়তে বাড়তে জানতে পারব, ক্ষমতা ধরে রাখার এইটিই মূল পদ্ধতি, দেবতা কি মানুষ যিনিই সেই ক্ষমতা ভোগ করুন। আর এইভাবেই আমাদের, সাধারণ মানুষদের জীবন গড়িয়ে চলে, এক বিপন্নতা থেকে আরেক বিপন্নতা, সাধ্যে কুলোলে কিছু নৈবেদ্য ধরে দেওয়া, যেই দেবতা, যেই ক্ষমতাধর যেমন পূজা দাবি করেন, কিছু প্রাপ্তি, প্রাপ্তির আশা …ক্রমশ...
    কাদামাটির হাফলাইফ - ইট পাথরের জীবন - ইমানুল হক | নামাঙ্কনঃ ইমানুল হক। ছবিঃ র২হকথা - ২৭আজ আর শৈশব বা কৈশোর নয় যৌবনের কাহিনি বলতে হচ্ছে, এই দুই মানুষের জন্য। আমার শরীরটাও আজকাল সাথ দেয় না। বলেই নিই।কামাল আহমেদ এবং রণো ভাই।কামাল আহমেদ বেড়ে উঠেছেন কলকাতায় পার্ক সার্কাস অঞ্চলে। পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা। দেশভাগের পর চলে গেছেন ঢাকায়। শিল্পী মানুষ। চাকরি বাকরি করেন নি। পোস্টার ডিজাইন করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। সচেতন বামপন্থী।পাঠান চেহারা। মন তেমনি উদার।তিনটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন তিনজন মানুষ। আমার প্রথমবার ঢাকা যাওয়ার সময়।পত্রলেখক সাংবাদিক সুধীর চৌধুরী ও কবি সাংবাদিক জিয়াদ আলী। প্রাপক একজনই। কামাল আহমেদ।১৯৯১। ফোনের যুগ নয়। চিঠিটি ভরসা। সস্তায় কোথাও থাকার ব্যবস্থা করার জন্য। আরেকটি লিখেছিলেন গড়পাড় রোডের অনিলবাবু। তাঁর এক বন্ধু নজরুল ইসলামকে।২০ ফেব্রুয়ারি যাই। ঢাকায় পৌঁছাই মাঝরাতে। চুরি ছিনতাই নাকি খুব হয়। তাই ভোর পর্যন্ত গুলিস্তানে এলাকায় বাসডিপোয় বসে থাকা।রাস্তায় আসার সময় দেখেছি শীতের রাতে খালি পায়ে হাতে ফুল নিয়ে চলেছেন কোথাও। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সবাই যাচ্ছেন শহিদ মিনার।‌ ২০ কিমি দূরে।অবাক।অবাক হওয়ার আরো অনেক বাকি ছিল।বয়স কম। চিরকাল ভয়ডর বেশি নয়।সম্বল কিছু ডলার। ২০ ডলার ভাঙিয়ে পেয়েছি ৮০০ টাকা।‌ ২০ ডলার কিনতে ভারতে লেগেছে ৩২০ টাকা। বাংলাদেশে পেলাম ৮০০ টাকা। ৪৮০ টাকা বেশি।রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বা এম এন দস্তুর থেকে ডলার নিতে হতো।রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্যান্টিনে ১৫ পয়সায় প্রচুর খাইয়েছেন সুদীপ্তদা । মাছ মাংস দই মিষ্টি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্যান্টিন তখন এমন সস্তা। এর আগে একবার সরস্বতী প্রেসের ক্যান্টিনে 'নতুন চিঠি' র জন্য সিসার তৈরি লাইনো (!) টাইপ কিনতে এসে খেয়েছি সাত পয়সায়। রাজকীয় খাবার।সারাদিন অবশ্য কাটাতে হয়েছিল ডলারের জন্য।তো ভোর ভোর পৌঁছে গেলাম তোপখানা রোডে ওয়ার্কার্স পার্টি দপ্তরে। সেখানে পরিচয় দিয়ে ব্যাগ রেখে গেলাম শহিদ মিনার। দুপুরে খেলাম তোপখানা রোডের এক হোটেলে। এখন দেখি সেটি নেই। কলকাতায় তখন মুসলিম হোটেলে মাংস ভাত তিন থেকে চার টাকা। ঢাকায় লাগলো ১৮ টাকা। এর আগে বেবি ট্যাক্সি/ মিশুক ভাড়া দিয়েছি দরাদরি করে ৬০ টাকা।বুঝলাম, খরচের শহর। কলকাতা নয়।দুপুর পর্যন্ত বিস্ময়ে কাটলো শহিদ মিনারে। আওয়ামি লিগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় দল, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি-- সব দলের ছাত্র যুব মহিলা শাখা আসছে গান গাইতে গাইতে বিশাল ফুলের তোড়া নিয়ে। সঙ্গে আবেগি শ্লোগান।হাঁটে না মিছিল। ছোটে।হাসিনা, খালেদা জিয়া তাঁদের দেখলাম।এ তো কলকাতায় কখনও দেখিনি।সব প্রতিপক্ষ একজায়গায়! এক অনুষ্ঠানে!রাস্তায় দেওয়ালে ছবি আলপনা।রাস্তায় আলপনা আগে এ-ভাবে দেখিনি।আমরা সরস্বতী পূজায় রাজ কলেজে দু' রাত জেগে ১০০ ফুটের আলপনা বানাতাম। ১৯৮৫-৮৮।ভাবতাম, কী না কী করেছি।এখানে ঘোর লেগে গেল। কিলোমিটারব্যাপী আলপনা দেখে।দুপুরে ওয়ার্কাস পার্টি দপ্তরে জিজ্ঞেস করলাম, কামাল ভাইকে পাবো কোথায়? একজন, শুনেই, বললেন, কামাল ভাই এখানেই আসবেন।অপেক্ষা করুন।কামাল ভাই এলেন। চিঠিটি একটু পড়লেন।তারপর জানতে চাইলেন কলকাতার খবর।জ্যোতি বাবু কেমন চালাচ্ছেন।আগেই বলেছি , যিনি বলেছিলেন, অপেক্ষা করুন, তিনি রণোভাই।খুব আড্ডা হলো।বিকেলে বের হলেন। বললেন, ব্যাগপত্তর এখানেই থাক। পাসপোর্ট সঙ্গে রাখুন।মনে মনে ভাবছি, কোথায় থাকবো, তাই তো ঠিক করা হলো না।কামাল ভাই কিছু একটা বুঝলেন, বললেন, চলেন, বাংলা একাডেমি ঘুরে আসি। বইমেলা চলছে।রাস্তায় দেখি কামাল ভাই এগোতে পারেন না।অজস্র চেনা মুখ।ঠেকা খেয়ে খেয়ে যাই।বই দেখি। গান শুনি অজিত রায়ের।হাজার হাজার মানুষ গণসঙ্গীত শুনছেন।ফিরে আসি ওয়ার্কার্স পার্টি অফিসে। আপনি বলছেন দেখে আমার খারাপ লাগছিলো। আপত্তি করলাম।ইতিমধ্যেই তুমি বলেছেন।চলো।কোথায়?আরে চলো না।রিক্সায় এলাম দুজনে মহম্মদপুর তাজমহল রোডে।বললেন, এটা আমার বাসা। এখানেই থাকবে।‌ সকালে খেয়ে বেরোবে। দুপুরে এখানে খেতে আসবে। কিন্তু এলে ছগুণ বেশি টাকা যাবে রিক্সায়। তার চেয়ে বাইরে খেয়ে নেবে। রাতে দুজনে একসঙ্গে ফিরবো।কোনোদিন কামাল লোহানীর শিল্পকলা একাডেমি, কোনদিন ওয়ার্কার্স পার্টি দপ্তর, কোনোদিন বইমেলা। এভাবেই ঠিক থাকে।রাস্তায় দেখি হরেক পোস্টার। কামাল ভাই দেখান কোনগুলো তাঁর ডিজাইন করা।আমি বেশ কিছু পোস্টার এনেছিলাম। এ-বাড়ি সে-বাড়ি করতে করতে হারিয়েছে সে-সব।কামাল ভাই দেখলাম অজাতশত্রু মানুষ। সব পক্ষের সঙ্গে মিত্রতা।ছোটো বড়ো সবার সঙ্গে মিত্রতা।প্রায় দিন রাতে কামাল লোহানী বা রণো ভাই গাড়ি করে এসে নামিয়ে দিয়ে যান।কামাল ভাই ২৭ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন ব্যবস্থা করে দিলেন একটা স্কুটারের। ঘুরতে সুবিধা হবে। চালক পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া এক যুবক।ভাগ্যান্বেষণে ঢাকা গেছেন।লোকে যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকা যায়--সেই জানলাম।এ-রকম চার পাঁচজনের সঙ্গে আলাপ হলো।কামাল ভাই তাঁদের জন্য কাজ খুঁজে দেন একে ওকে বলে।রিক্সাচালকরা ঢাকায় প্রচুর পয়সা চাইতো।কামাল ভাই রসিকতা করতেন।এই টাকা রিক্সাসমেত তো?রিক্সাচালকরাও রসিক।বাবু আমারেও লন।খাইখরচা দেবেন বিবি বাচ্চার।কামাল ভাইয়ের কাছে আশ্চর্য সব মানুষের আশ্রয় ছিল। সপরিবারে কামাল ভাই এমন একজন আনিস।যে খালি পায়ে ঘুরতো। রিক্সা বা মিশুক চাপতে চাইলে বলতো, তুমি কি মেয়ে মানুষ? রিক্সা চাপতে চাও।আনিস ছিল নামী আবৃত্তিকার।খেয়ালি।স্বপ্নপ্রবণ।বাংলাদেশের রাজনৈতিক জগতের সঙ্গে পরিচয় কামাল ভাই মারফৎ আর তরুণ শিল্পী সাহিত্যিকদের দলে মেশা হলো আনিসের মাধ্যমে।আগের দিন রাতে কামাল ভাই পরিকল্পনা করে দিতেন কোথায় কীভাবে যাবো।রাতে একসঙ্গে না খেলে রাগ করতেন।একবার কবি মজিদ মাহমুদের পাল্লায় এক কবিতার আড্ডায় সারারাত কেটে গেল।পরদিন বুঝলাম, কামাল ভাই অভিমান করেছেন।এত আপন করে নিতে পারতেন।ভাবিও ছিলেন রসিক মানুষ। কাজ করতেন ভোয়ায়।রিঙ্কি কামাল ভাইয়ের ছোটো মেয়ে।বাবার মতোই দিলদার।দুই ছেলে। তিন মেয়ে।কামাল ভাই মাঝে ফোন করেছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি যদি প্রকাশ করা যায় কলকাতা থেকে। তাঁর স্বপ্ন ছিল, একটা তথ্য চিত্র বানাবেন সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর।আমার কুড়েমিতে হলো না।মাফ করবেন কামাল ভাই‌।হায়দার আকবর খান রনো ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি তাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবী এবং লেখক। হায়দার আকবর খান রণোর জন্মও কলকাতায়। ১৯৪২ এর ৩১ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। রনোর পৈতৃক নিবাস অবশ্য পূর্ববঙ্গ। নড়াইলের বরাশুলা গ্রামে। তাঁর মা কানিজ ফাতেমা মোহসীনা বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সৈয়দ নওশের আলী তাঁর নানা। বাবা ছিলেন দেশের প্রধান প্রকৌশলী।রণোভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশ জমে গেল। আমার বাবার মতো দিলদরিয়া গোছের মানুষ। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে বললেন, কাল বাসায় আসুন ১২ টা নাগাদ। ধানমন্ডিতে বাড়ি। দেখলাম সবাই চেনেন বাড়িটি। কথা শেষ ঊঠছি। বললেন, আরে যাবেন কোথায়? খেয়ে যাবেন। একসঙ্গে বের হবো।তাঁর মা, স্ত্রী, ভাই, ভাইয়ের বৌ, মেয়ে রাণা, ভাইঝি পুতুল--সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। মেয়ে রাণা তখন দশম শ্রেণিতে পড়েন। আস্তে আস্তে অনুচ্চস্বরে টেলিফোনে কথা বলতেন। খাওয়ার টেবিল দেখি নানান খাবারে ভর্তি। এটা কিন্তু ঘোষিত দাওয়াত না। এত খাবার বাড়ির টেবিলে আগে দেখিনি। আমাদের এখানে তখন তো জামাইকেও আট দশ পদের বেশি খাওয়াতে দেখিনি। আইবুড়ো ভাত হলে আলাদা। ভাত, পোলাও, বিরিয়ানি, ইলিশ, কাঁচকি--সব আছে। এই প্রথম আমার কাঁচকি খাওয়া। খেতে ভালোবাসি। তাও সংকোচ হচ্ছিল। বললেন, আরে এই বয়সে এত ভেবেচিন্তে খেলে হবে, খান। আমার লেখা একটা উপন্যাস তাঁকে দিই। কলেজে ম্যাগাজিনে লেখা। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র রাজনীতির হাল হকিকত খানিকটা টের পাওয়া যেত সেই লেখায়। নাম 'উত্তরণ'। তখন তো আমি কবিতা গল্প আর উপন্যাসিকা লিখতাম। হায়দার আকবর খান রনো এরপর যেটা হল। রণোভাইয়ের বাসায় প্রায় দিন আমার উপস্থিতি। রণোভাই আমাকে প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র সম্যকভাবে বুঝিয়ে ছিলেন। একই সঙ্গে এরশাদ সম্পর্কে একটা বিচিত্র তথ্য দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটা অন্যরকম তথ্য তিনি দেন।তাঁর কথায় - বঙ্গবন্ধু বাকশাল গড়ছেন। এতে রেগে গিয়ে আমি আর রাশেদ খান মেনন একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই তাঁর ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে হাজির হই। নিরাপত্তারক্ষী ছাড়বেন না। আমরাও নাছোড়বান্দা। দেখা করবোই। চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে বঙ্গবন্ধু নিজেই নেমে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন। নিরাপত্তারক্ষীকে বললেন, রণো আমার পাড়ার ছেলে। ওঁর আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট কী?বললেন, বল কী বলবি?আমি আর মেনন বললাম, আপনি যে বাকশাল গ্রছেন, এতে কি গণতন্ত্র থাকবে?বঙ্গবন্ধু বললেন, শোন, আমি একটা বিপ্লবী স্মাজতান্ত্রিক দল গড়তে চাই। আমার দলে বহু খারাপ লোক ঢুকে গেছে। তোরা আয়। আমার সঙ্গে যোগ দে। আমাদের কাজের সুবিধা হবে। আমরা আমাদের অক্ষমতা জানিয়ে চলে এলাম। তার কিছুদিন পর তো তাঁকে হত্যা করা হল।এরশাদ সম্পর্কে একটা অদ্ভুত তথ্য দেন তিনি। বলেন, এরশাদের আমলে আমরা সবচেয়ে বেশি 'গণতন্ত্র' ভোগ করেছি। সেটা অদ্ভুত ধরনের। দুপুরে ডাকলেন আমাদের। কিছু কাজ নিয়ে আলোচনার জন্য। বিরিয়ানি খাওয়ালেন। গল্পগুজব করলেন। সন্ধ্যায় ফোন করে বললেন, আপনাদের জেলে যেতে হবে। যান ঘুরে আসুন।এরশাদের বেশিরভাগ কাজের সমালোচক ছিলেন। বিশেষ করে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণার। দুটি কাজের প্রশংসা করেন।এক, ওষুধনীতি। বাংলাদেশে আগে ব্রান্ড নেমে ওষূধ পাওয়া যেত। উনি চালু করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীদের সহায়তায় জাতীয় ওষুধ নীতি। তাতে জেনেরিক নামে ওষুধ পাওয়া যেতে লাগল। ওষুধের দাম কমল। পরে আমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি তখন আত্মগোপন করে থাকছিলেন।এরশাদের আরেকটা ভালো কাজ। তাঁর মতে ৬৪ জেলা গঠন। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন রণো-মেনন জুটি।কিন্তু একজন মার্কসবাদী হিসেবে তাঁর এই দ্বান্দ্বিক মূল্যায়ন আমার ভালো লাগে।আমরা দল করতে গিয়ে একপেশে মুলযায়ন শিখতাম। এটা আমাকে তার থেকে বের হতে সাহায্য করে। রণোভাইয়ের ছিল বিপুল পড়াশোনা। কিছু পেলেই পড়ে ফেলতেন। আমার উপন্যাসটিও পড়েন। না পড়লেই ভাল হতো।রণোভাইয়ের সঙ্গে মাঝে যোগাযোগ ছিল না। ১৯৯০এর মাঝামাঝি শেষবার যাই। তারপর ২০১৪। সেবার দেখা করতে যেতে পারিনি। ২০১৫তে দেখা হল। ২০১৮তে নিজেই চলে এলেন ফোন করে, বললেন, আজ বিকেলে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। আমি তখন একটা রেস্তোরাঁয় দাওয়াত খাচ্ছি। একগাদা বই দিলেন। তার মধ্যে স্মরণীয়, শতাব্দী পেরিয়ে। রাস্তাতেই দেখা হল।শেষ দেখা ২০২২। বাড়িতে গেলাম। পুরানো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন ফ্ল্যাট। বললেন, এবার আমার এখানেই উঠবেন। জমিয়ে আড্ডা হবে। আজকাল তো শরীরের জন্য তেমন বের হতে পারি না।ঘটনাচক্রে আমার খুব প্রিয় একটা খাবার জুটে গেল। চারাপোণা মাছের ঝোল। বললেন, রোগীর পথ্য। আপনার কেমন লাগবে জানি না।আমি বললাম, ঢাকায় এইটা কখনও খাইনি। শুনে খুশি হলেন। কলকাতার মানুষদের খবর নিলেন। বিমান বসু, শান্তনু দে, বিক্রমজিৎদের খবর নিলেন। বললেন, আমাকে তো আর ভিসা দেয় না। মাওবাদীদের সমর্থক ভেবে। কলকাতায় জন্ম, সেখানেই যেতে পারি না। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন হায়দার আকবর খান রণো গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট হন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তার সক্রিয় রাজনীতি শুরু। তিনি ১৯৬৯এর গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রণাঙ্গনের সৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও নেতা। ১৯৭২ সালে তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) গঠন করেন। ১৯৭৯ সালে দলের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নামকরণ করা হয়। ১৯৭৯-৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৮২-১৯৯০ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ও ১৯৯০ এর গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও নেতা ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তাকে চারবার কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল এবং সাতবার আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল।তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ২০১২ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হন'।(ক্রমশঃ)
    সীমানা - ৪৭ - শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ছবি: সুনন্দ পাত্র ৪৭নবযুগের দপ্তরেগিরিবালা দেবী আর প্রমীলা দুজনেই বললেন, নজরুলের সঙ্গে অরবিন্দর সূক্ষ্মদেহে দেখা হবার কথা নজরুল আগেও অনেকবার বলেছে। শুধু তাঁদেরই নয়, বলেছে আরও অনেককেই। কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। তাতে কিছুই আসে-যায়নি নজরুলের, তবে এবারের মতো এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েনি আগে।এবার এতটাই অসুস্থ নজরুল যে অফিসে যেতে পারল না বেশ কয়েকদিন। এদিকে কলকাতার য়্যুনিভার্সিটি থেকে ইন্টারমীডিয়েট পরীক্ষায় বাংলার পরীক্ষক নির্বাচিত করে তার কাছে একরাশ উত্তরপত্র আর পরীক্ষকের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী পাঠিয়ে দিয়েছে য়্যুনিভার্সিটি। নবযুগে নজরুলের সহকারী কালীপদ গুহ ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরীক্ষকের কাজ করেছে আগে। সে-ই উত্তরপত্র পরীক্ষায় নজরুলকে সাহায্য করতে শুরু করল। ফজলুল হক সাহেব নজরুলকে জানিয়েছেন, শরীর যতদিন সম্পূর্ণ ভালো না হয় ততদিন তার অফিসে আসার প্রয়োজন নেই। অমলেন্দু বা কালীপদদের ডাকিয়ে এনে বাড়িতে বসেই পত্রিকা সম্পাদনার কাজও চালিয়ে যেতে পারে সে। এই সুযোগে কালীপদ থাকতেই শুরু করল নজরুলের বাড়িতে, এখন নজরুলের যে অবস্থা তাতে ঘড়ি-ধরে কাজ করা তো সম্ভব নয় তার পক্ষে। চব্বিশ-ঘন্টায় যখনই কাজের মূড আসবে তখনই কাজ! সেই সময় কালীপদ সঙ্গে না-থাকলে কি চলবে?জানতে পেরে আপত্তি করেননি হকসাহেব, লীগ-হক মন্ত্রীসভা ভেঙে যাবার পর নজরুলের প্রয়োজন অনেকটাই বোধ হয় এখন কমে গেছে তাঁর কাছে। আসল কথা এই যে, যতই নবযুগের সম্পাদকীয়তে লীগ-হক মন্ত্রীসভার পতনের ব্যাপারে হক সাহেবের সমর্থনে নজরুল মুসলিম লীগের সমালোচনা করে থাকুক, ওই মুসলিম লীগেরই তরুণ কর্মীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার জন্যেই মূলত হক সাহেবের তাকে প্রয়োজন হয়েছিল। অফিসে বসে এক দঙ্গল ছাত্র-লীগের কর্মীদের সঙ্গে তার আড্ডা এখন আর তেমন পছন্দও হচ্ছে না হক সাহেবের। শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা এখন তো চলছে ভালোই। কাজি না-থাকলেও এখন দিব্যি চলবে নবযুগ। আর, এমনকি নবযুগ না-থাকলেও এখন দিব্যি চলবে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার!কিন্তু তবুও, এমন অসুস্থতার সময় কোন একটা বিকল্প ব্যবস্থা না-করে নজরুলকে নবযুগ থেকে সরিয়ে দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন না হক সাহেব। একটা সুযোগ এসে গেল। সেই সময় অল ইণ্ডিয়া রেডিওর ডিরেক্টর-জেনারাল ছিলেন আহ্‌মদ শাহ্‌বুখারী, নজরুলের প্রতিভার পরম ভক্ত তিনি। যুদ্ধের সময় সরকারি প্রচারের স্বার্থে সং পাবলিসিটি অর্গানাইজেশন নামের একটা সংগঠন তৈরির উদ্যোগ চলছিল তখন। স্বাভাবিক ভাবেই আহ্‌মদ শাহ্‌বুখারী সাহেবের মতামত মূল্যবান ছিল এ-ব্যাপারে। হক সাহেবও বুখারী সাহেবের সঙ্গে কথা বললেন। লোক-সঙ্গীতের কাজ; নজরুলকে নেওয়া হবে গীতিকার-সুরকার-পরিচালক হিসেবে, আর তাঁর সহকারী হবেন আব্বাসউদ্দীন। চাকরিটা কেন্দ্রীয় সরকারের, কিন্তু কলকাতার অফিস রাইটার্স বিল্ডিঙে। কাজটা পাওয়া এতটাই পাকা যে সরকারি দপ্তরের নানা লোকজন বাড়িতে এসে অসুস্থ কবিকে দিয়ে অনেকগুলো ফর্ম পূরণ করিয়েও নিয়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে রাইটার্সে অফিসেও গেল নজরুল; নিজে অফিসে বসে সারাদিন ধরে উশখুশ করল সে, কারো সঙ্গে একটাও কথা পর্যন্ত বলল না। প্রথম দিনের কাজই হল শেষ দিনের কাজ!কিন্তু এমনটা করল কেন নজরুল? তাহলে কি সরকারি পয়সায় সরকারের প্রচারের চাকরি তার পছন্দের নয়? যুদ্ধ চলছে, দখলদার ব্রিটিশ সরকার ভারতের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, সেই সরকারের অপকর্মের গুণপণা প্রচারের চাকরি? যে যুদ্ধ চলছে এখন, সে কি ভারতবাসীর যুদ্ধ? নজরুলের মনে পড়ে যায় সে একবার প্রচারমূলক একটা গান রচনা করে, তাতে সুরসংযোগ করে, শিল্পীদের শিখিয়ে-পড়িয়ে সেই গান রেডিওতে প্রচার করিয়েছিল। একেবারেই শিল্পকর্ম হয়ে ওঠেনিসে-গান। সে জানতও তা। বন্ধুবান্ধব-পরিচিতদের মধ্যে হাসাহাসিও হয়েছিল সেই গান নিয়ে। নজরুল পাত্তা দেয়নি সেই সমালোচনাকে। ও জানত, শিল্পী হিসেবে ওর যে প্রতিষ্ঠা, হয়তো তারই ওজনে – শিল্প হিসেবে যতই নিম্নমানের হোক – এই গান গাওয়ার উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত বুঝবে রেডিওর শ্রোতারা। ম্যালেরিয়া-পোষক কচুরিপানার বিরুদ্ধে এই গানের প্রচার একেবারেই উদ্বিগ্ন করেনি তাকে :       ধ্বংস করো এই কচুরিপানাএরা   লতা নয় পরদেশি অসুর-ছানা।।       ইহাদের সবংশে করো করো নাশ       এদের দগ্ধ করে করো ছাইপাঁশএরা   জীবনের দুশমন গলার ফাঁসএরা   দৈত্যের দাঁত রাক্ষসের ডানা।।এরা   ম্যালেরিয়া আনে আনে অভাব নরকএরা   অমঙ্গলের দূত ভীষণ মড়কএরা   একে একে গ্রাস করে নদী ও নালাযত   বিল ঝিল মাঠঘাট ডোবা ও খানা।।বন্ধুদের ঠাট্টার জবাবে তখন নজরুল বলেছে, আমার এই গান যদি কোন-একটা গ্রামের একটা মানুষকেও কচুরিপানার হাত থেকে তার গ্রামকে মুক্ত করার চেষ্টাতে এমনকি একটুও উদ্বুদ্ধ করে তাহলে আমি শ'য়ে শ'য়ে এরকম গান গাইতে রাজি আছি।আর, শেষ পর্যন্ত বাস্তব পৃথিবীর আক্কেলও ফিরল নজরুলের; অফিসে না-গিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে চলবে না। নজরুলের প্রয়োজন হয়তো প্রাথমিকভাবে ফুরিয়েইছে হক-সাহেবের; তাই সাময়িক ছুটি নয়, ভদ্রভাবে বোধ হয় তাকে তাড়াবারই মতলব করছেন তিনি। তাই কারো সঙ্গে কিছু আলোচনা না-করে হঠাৎই পরের দিন নজরুল দুপুর বেলা হাজির অফিসে। সাধারণত এই সময় রাইটার্সে থাকেন হক সাহেব, নজরুলকে দেখে বললেন, আরে কাজি যে, আছ কেমন? আপিসে আইলে ক্যান, ঘরে মন লাগে না?ঘর কেন, দেশেই তো মন লাগে না এখন, বলে নজরুল, রেডিও খুললেই এখন কেমন যেন সুভাষবাবুর গলা শুনছি বলে মনে হয়। কিন্তু তিনি তো ঘরের বাইরে, দেশের বাইরে। তবুও রেডিও খুললেই এখন তাঁরই কথা মনে পড়ে, মনে হয় যাই চলে এক ছুটে তাঁর কাছে।তা করে, তা করাডাই তো স্বাভাবিক, বলেন হক সাহেব, আমার এই বুরা-হারেও যে করে না তা কইতে পারি না। আর তোমরা তো প্রায় সমবয়েসীই হব, কে বড়? তুমি, না হ্যায়?উনিই বোধ হয় একটু বড়, নজরুল বলে, আমার জন্ম আঠেরশো নিরানব্বই-এর মে মাসে, আর সুভাষবাবুর বোধ হয় সাতানব্বই-এর জানুয়ারি।তাই কই, যে কষ্টডা হ্যায় করল, আর যে বীরত্ব আর বুদ্ধিডা দেখাইল এলগিন রোডের বাড়ি থেইক্যা পুলিশের চক্ষে ধুলা দিয়া দ্যাশের পর দ্যাশ পার হইয়া! কও, এক্কেরে বার্লিন! আরও কয়েকখান সুভাষের প্রয়োজন ছিল আমাগো এই দ্যাশের। তা, আজ আসছ যখন নিজের ডেস্কে গিয়া কাম কর, আমিও যাই রাইটার্সে। হক সাহেব বেরিয়ে যাবার পর নিজের সম্পাদকীয় দপ্তরে যায় নজরুল, সেখানে আরও কয়েকজনের সঙ্গে বসে কাজ করছিল অখিল নিয়োগী আর দেবনারায়ণ গুপ্ত। কাজিদার অফিসে আসার কোন খবর ছিল না তাদের কাছে, হঠাৎ কাজিদাকে দেখবে আশাও করেনি তারা, অশেষ কৌতূহল নিয়ে কাজিদার পেছন পেছন তার নির্দিষ্ট ঘরে ঢোকে ওরাও।বসতে বসতে কাজি বলে, তারপর, কী খবর, হালচাল কেমন দেখছ?দেবনারায়ণ বলে, কী আর দেখব কাজিদা, এখন তো এই-যুদ্ধ-লাগল এই-যুদ্ধ-লাগল ভাব চারদিকে। একদল রিফিউজি আসছে বার্মা-মালয় থেকে কলকাতায় রোজ, আর তার ঠিক উল্টোটা হচ্ছে কলকাতার লোকদের; দলে দলে এখান থেকে পালাচ্ছে লোকে। চারধারে ট্রেঞ্চ, রাস্তাঘাটের সব ল্যাম্পপোস্টে কালো ঠোঙা, টিমটিম-করা আলোয় শহরটাকে কেমন যেন ভুতুড়ে লাগে! আমরাও অফিসে এসে কত তাড়াতাড়ি পালাব সেই চিন্তাই করি শুধু। কেউ মুখে তেমন কিছু না-বললেও সবাইকেই মনে হয় আতঙ্কগ্রস্ত। আপনিও তো অফিসে এলেন না কতদিন, মাঝে মাঝে কালীপদদা কিছু এডিটোরিয়াল নিয়ে এসে প্রেসে দিয়েই চলে যায়, শুনি, আপনিই লিখে দিয়েছেন। সব মিলে, আমরা ভালো নেই কেউ।হুঁ, খবরের কাগজের অফিসে যদি আড্ডাই না বসে নিয়মিত, হেসে বলে কাজি, তাহলে আর অফিস কিসের! যাই হোক, আমি তো শেষ অফিসে এসেছিলুম সেই ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে, সুভাষবাবুর জার্মানী থেকে প্রথম রেডিও-বক্তৃতার পর বড় জোর আরও সপ্তাখানেক। তার পর থেকে তো বাড়িতেই বসে আছি। এক মাস হতে চলল প্রায়, এখন তো খবর পাই এতদিনে বার্মায় শুধু নয়, সাউদ-ঈস্ট এশিয়ায় কতো শহরই যে জাপানীদের হাতে পর্যুদস্ত হচ্ছে তার হিসেব ঠিকঠাক জানেনা বোধ হয় কেউই। এই-যে রোজ রোজ কলকাতায় রিফিউজিদের এত আগমনের ঘটা, সে তো আর এমনি-এমনি নয়। ব্রিটিশের হয়ে এত যে ভারতীয় লড়াই করছিল এতদিন, এখন যত ভারতীয় যুদ্ধে মরছে আর বন্দী হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যুদ্ধটা আমাদের দেশের ভেতরেই ঢুকে পড়ছে হুড়মুড় করে।আপনি তা-ই ভাবছেন কাজিদা, এবার কথা বলে অখিল, কিন্তু আমি তো একজনের কাছে শুনলাম যে এই যুদ্ধে সুভাষবাবুর বাংলাকেই উৎসর্গ করে দেবার মতলব সাহেবদের।বাংলাকেই উৎসর্গ? তার মানে? উৎসর্গ মানে কী? বাংলা মানেই সুভাষবাবুর বাংলা, এতে তো কোন তক্কো নেই, কিন্তু উৎসর্গ কথাটার মানে কী হল?মানেটা সহজ, বলে অখিল, এই উনিশশো বেয়াল্লিশে জাপানীরা যে অঞ্চলে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করে নাস্তানাবুদ করছে ওদের, সেখান থেকে পালাবে যারা তারা আর আসবে কোথায়? বাংলা ছাড়া? পরাক্রমী জাপান যদি ওদের মারতে মারতে এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এগোতে এগোতে ওরা আর আসবে কোথায়? বাংলাতেই শেষ পর্যন্ত, তাই না? তাহলে এখন যদি বাংলা ছেড়ে আরও পশ্চিমে পিছিয়ে যায় আমাদের প্রভু ব্রিটিশ সরকার উইদ ব্যাগ অ্যাণ্ড ব্যাগেজ, বীরবিক্রমে পশ্চাদ্ধাবনই করে যদি, তাদের তাহলে গন্তব্যস্থল তো বাংলা থেকে আরও পশ্চিমেই হবে, তাই না? তার মানে কী হল? ইংরেজের পক্ষে? বাংলাকে জাপানের হাতে উৎসর্গ করে দিয়ে বাকি ভারতে রাজত্ব চালানো, তাই না? বাকি ভারতে তো আর সুভাষবাবু নেই, নেই তাঁর চেলারাও। অতএব শান্তি, পরম শান্তি!নজরুল বলে, তা যা বলেছ। এই সুভাষবাবুর মতো মানুষ কী ভুলে যে এই ভীতু কর্তাভজাদের বাংলায় জন্ম নিলেন তারই কোন কিনারা পাই না। সুভাষবাবুকে কংগ্রেস-ছাড়া করবার পর অ্যাড-হক কংগ্রেস আর সুভাষপন্থী কংগ্রেসের নানা বচসা মারামারি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে যখন বড় বড় কাগজে অনেক লেখালিখি চলছে, সেই সময় হঠাৎ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে ওই যে বেলঘরিয়া না সোদপুরে কী যে এক আশ্রম আছে, সেই আশ্রম থেকে গান্ধীর এক চেলা রবীন্দ্রনাথকে সুভাষবাবুর সমর্থক ধরে নিয়ে এমন কদর্য ভাষায় এক চিঠি লিখলেন যে পড়ে আমরা সবাই হতবাক। গুরুদেব অবিশ্যি এই চিঠিকে কোনই গুরুত্ব দিলেন না! তাই মাঝে মাঝে ভাবি অকৃতজ্ঞ বাঙালিজ ডু নট ডিসার্ভ আ রিয়েল হীরো লাইক সুভাষ!খানিকটা উত্তেজিতই হয়ে পড়ে নজরুল এই সব আলোচনায়। এর কিছুদিন পরেই ষোলই এপ্রিলের নবযুগে সম্পাদকীয় স্তম্ভের ঠিক নীচে প্রকাশিত হল তার প্রবন্ধ, বাঙালির বাংলা। প্রবন্ধের প্রথম লাইনই “বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে – “বাঙালির বাঙলা” সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।”সেইদিনই অফিসে এসে নজরুল সকালবেলার কাগজে তার নিজের সদ্যপ্রকাশিত প্রবন্ধটাই পড়ছে, এমন সময় হাতে সেই দিনেরই রোল-করা কাগজখানা নিয়ে সোজা তার ঘরে ঢুকলেন হক সাহেব, তারপর নিজস্ব ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন, কী কর, নিজের লেহাডাই পড় নাকি?চেয়ারে বসতে বসতেই হক সাহেব বোঝালেন নজরুলের এই প্রবন্ধখানা তিনি মন দিয়েই পড়েছেন, এবং এইরকম তৎসমশব্দবহুল রচনাটা পড়ে প্রথমেই তাঁর মনে যে প্রশ্নটি এসেছে তা হল – অন্তত তা-ই তিনি বললেন – ও কাজি নজরুল, তুমি আবার ব্রাহ্মণ হইলে কবে? বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের লাগসই প্রয়োগের জন্যে যে বিশেষভাবে পরিচিত সেই নজরুলের এই দীর্ঘ প্রবন্ধে একবার মাত্র পানি, আজান একবার, এবং আল্লাহ্‌-র উল্লেখও ওই একটিইবার! তা ছাড়া পুরোটাই, যাকে বলা চলে বঙ্কিমী বাংলা খানিকটা আধুনিক বেশে! তা-ও, আল্লাহ্‌-র নাম এসেছে ধর্মবোধ প্রসঙ্গে ভগবানের নামের সঙ্গে একসঙ্গে, এবং আজানের কথা বলা হয়েছে যে বাক্যে সেই বাক্যটি হল – হেথায় গ্রামে হয় আজানের সাথে শঙ্খঘন্টার ধ্বনি! হস্তধৃত কাগজখানা টেবিলে মেলে ধরেন হক সাহেব এবং নজরুল লক্ষ করে, মুদ্রিত রচনাটি রক্তিমনিম্নরেখায় প্রায় সম্পূর্ণ রঞ্জিত! দুয়েকটি বাক্য বেশ জোর গলায় নাটকীয় ভঙ্গিতে হকসাহেব পড়েনও, যেমন, “এই হিমালয়ের গভীর হৃদয়-গুহার অনন্ত স্নেহধারা বাংলার শত শত নদ-নদীরূপে আমাদের মাঠে ঘাটে ঝরে পড়েছে”, অথবা “যাদের মাথায় নিত্য স্নিগ্ধ মেঘ ছায়া হয়ে সঞ্চরণ করে ফিরে, ঐশী আশীর্বাদ অজস্র বৃষ্টিধারায় ঝরে পড়ে, শ্যামায়মান অরণ্য যাকে দেয় স্নিগ্ধ-শান্তশ্রী, বজ্রের বিদ্যুৎ দেখে যারা নেচে ওঠে, – হায় তারা এই অপমান, এই দাসত্ব, বিদেশী দস্যুদের এই উপদ্রব, নির্যাতনকে কি করে সহ্য করে?” – পড়েই উচ্চকিত হো হো হাসিতে ছোট ঘরখানা ভরিয়ে তোলেন হক সাহেব, এ কি মুসলমানের লেখা হল, এতো শ্রীমৎ নজরুলানন্দ সাহিত্যসরস্বতীর রচনা!হাসে নজরুল, বলে, বাংলা ভাষার লেখককে তো একই সঙ্গে সাহিত্যসরস্বতী আর ডক্টর শহীদুল্লা হতে হয়। আর তার সঙ্গে ইংরিজি ফরাসী ওলন্দাজী ছাড়াও একটু-আধটু বৌদ্ধ দোহা – তা ছাড়াও আরও কতো রকমের যে মিশেল দিতে পারলে তবে দাঁড়ায় আমাদের বাংলা ভাষা! এ তো আমাদের কবির ভাষায় দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে। কিছু একটা লিখি যখন এই ভাষায়, তখন তো আর মাপ করে – এতটুকু যখন সংস্কৃত এসেছে, অতটুকু তাহলে আরবী বা ফারসি আসুক – এই ভেবে তো সাহিত্য করা চলে না। বাংলা ভাষা বাংলাই, তার চলনে তো সারা পৃথিবীর সুর। আর তারই মধ্যে তার নিজস্বতাও। লিখি যখন, তখন অবিশ্যি এত কিছু ভেবে লিখতে বসি না। যা স্বাভাবিকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত আসে কলমের ডগায় তা-ই লিখি।তোমার কলমের ডগায় যা আসে, লেখক তুমি লেখ তা-ই – এ কথা তো আমরা সকলেই জানি। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আমরা যারা লেখক নই, সেই আমরা যে কথা বলি সেও তো ওই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই; এই কথাটা ক'জন বোঝে বলতো। যে মুসলিম লীগ পার্টিটাই তৈরি হল বাংলায়, আজ তার ওয়র্কিং কমিটিতে একটা বাঙালিকেও রাখা গেল না, এভাবে কি শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে?আমরা তো তখনই প্রতিবাদ করেছিলুম আমাদের নবযুগে, বলে নজরুল, মনে আছে আপনার?মনে তো আছেই, হক সাহেব বলেন, তোমার সেই তিন লাইনের হেডলাইনখানা, বড় বড় হরফে পাঁচের পৃষ্ঠায়, বাঙালি মুসলমানের অবমাননা/ মিঃ হকের পরিবর্তে/ অবাঙালি মিঃ ইস্‌পাহানি লীগ ওয়র্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত – মনে নাই আবার? অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের খবর ছেপেছিলে তুমি, ভাষা ঠিক মনে নাই, তবে খানিকটা এইরকম: নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি মিঃ জিন্নাহ্‌ ঘোষণা করিয়াছেন, তিনি মিঃ ফজলুল হকের নাম কাটিয়া তাঁর স্থলে কলিকাতা হইতে মিঃ এইচ ইস্‌পাহানিকে লীগ ওয়র্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত করিয়া বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি নিয়োগ করিয়াছেন। কী, ঠিক বললাম? আর এই একজনকে বিয়োগ আর অন্য একজনের নিয়োগের ফলটাও, যতদূর আমার মনে পড়ছে, ওই লেখাতেই ব্যাখ্যা করেছিলে তুমি। মুখে না-বললেও মনে মনে হক সাহেব ভাবেন, নজরুলকে ছাড়া চলবে না। জিন্নাহ্‌-র মনোভাবটা সাধারণ বাঙালি মুসলমানকে বোঝাতে পারবে এক নজরুলের কলমই।কোন কথা না বলে কিছুক্ষণ নজরুলের দিকে তাকিয়ে থাকেন হক সাহেব। তার পর বলতে থাকেন, সেই সময় কলকাতার কর্পোরেশনেও ওই একই ইস্‌পাহানি নির্বাচিত হয়েছিল ডেপুটি মেয়র। তুমি লিখেছিলে, ইস্‌পাহানির বদলে কোন বাঙালি মুসলমানকে দাঁড় করালে সেই বাঙালি মুসলমানটি কিন্তু ডেপুটি নয়, পুরোপুরি মেয়রই হতে পারত। আমি বুঝি না কাজি, বলেই চলেন হক সাহেব, কেন যে এরা মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি-অবাঙালির ভাগাভাগিটা কমাবার চেষ্টা না-করে আরও বাড়িয়েই চলছে। একে তো ক্যাবিনেটে শ্যামাপ্রসাদ, আমাদের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ, আছেই। গতবছর শুধু ঢাকা নয়, পুব বাংলার আরও কয়েকটা জেলায় গিয়ে সেন্‌সাসে মাথা গলিয়ে সে যে দাঙ্গার অবস্থা তৈরি করে এল, তাতেও সাবধান হলাম না আমরা মুসলমানরা। এখন যদি আমরাও চালে ভুল করে বাঙালি মুসলমানদের পিছিয়ে রাখি, সেটা কি এই বাংলার পক্ষে ভালো হবে? নাকি মুসলমান-প্রধান বাংলার মন্দ হলে সারা ভারতের মুসলমানদের পক্ষে সেটাই ভালো?আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানেন হক সাহেব, নজরুল বলে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনটা শেষ পর্যন্ত নাহিন্দু-মুসলমানের লড়াই হয়ে দাঁড়ায়, আর সাহেবরা তারই সুযোগ নিয়ে দেশটাকে লুটপাট করে। এখন তো শুনতে পাই জাপানীদের কাছে সব জায়গায় হেরে গিয়ে বাংলাকে নাকি জাপানের হাতে ছেড়ে দিয়ে দেশটাকে অ্যাবান্‌ডন করে চলে যাবে ইংরেজ।কও কী, বাংলারে অ্যাবান্‌ডন! আরে না না! আসলে এই বেঙ্গল প্রভিন্সডা অগো কাছে গরম আণ্ডা; কামড়ানোও যায় না, ওগরানোও হেই একই জ্বালা। হেই কার্জনের আমল থেইক্যা শুরু। স্বদেশী আন্দোলন, আর তারপর বোমা-পিস্তলে আজ ফাঁসি তো পরের দিন আন্দামান! নিজে যাই নাই, তবে শুনছি অগো সেল্যুলার জেল-এর সব সেলই রিজার্ভ্‌ড্‌ ফর বেঙ্গলীজ। নো এন্ট্রী ফর ইণ্ডিয়ান্‌স্‌ ফ্রম আদার প্রভিন্সেস! কিন্তু তবুও, প্রভিন্সটা তো সোনার খনি, কইলকাতা শহরখানা সেকেণ্ড সিটি অব দি এম্পায়ার! কী আর করে কও। অ্যাবান্‌ডনের কোন কথাই নাই, ইংরাজের লোভ! ওরা ছাইরবে কইলকাতা!আসলে, বলতে থাকেন হক সাহেব, জাপানীরা টাইট তো দিসেই অগো। সিঙ্গাপুরের টাইটটা বড়ই চোট দিল। এই মার্চেই তো, জাপান বার্মা ইনভেড করার আগেই অগো পিটটানের প্ল্যান সারা। কয়, উইদ্‌ড্রয়াল। রেঙ্গুনে পৌঁছাইয়াই জাপান দ্যাহে রেঙ্গুন ফাঁকা, তহন এট্টু-আধটু বম্বিং কইরল কি না-ই কইরল, ও তেমন কিছু বড় কথা নয়। আর ব্রিটিশ বাহিনী? নিজগো খান দুই-চার অফিসার আর এক পাল ভারতীয় সেনা লইয়া ব্রিটিশ বাহিনী পেট্রল-খনিতে আগুন লাগাইতে লাগাইতে রাস্তাঘাটে-জলাশয়ে বিষ মিশাইতে মিশাইতে, ধান-চালের দফা শ্যাষ কইর‍্যা যঃ পলায়তি সঃ জীবতি! আসামে, নানা ট্রাইবাল এরিয়ায়, আর আমাগো বেঙ্গলে!তবে হ, ক্ষতি করছে আমাগো উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে। ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল-চট্টগ্রাম-নোয়াখালি। আর তা-ই বা কই ক্যান, পুরা পুব-বাংলাই ধর। কয়, ডিনায়াল। ধান-চালের বাজারে আর কিছু নাই। দশ-বারো লক্ষ মণ চাল অলরেডি কলেক্টেড। অ্যাতো কলেকশন ক্যান? সব মিলিটারির খাদ্য – ভবিষ্যতের, বুঝ? তুমি কও অ্যাবান্‌ডনিং বেঙ্গল। অ্যাবান্‌ডনিং বাই হু? এই লোভী ইংরেজরা? হঃ!এক দিকে ডিনায়াল, চেয়ারে একটু নড়ে চড়ে তারপর হেলান দিয়ে একটু আরাম করে বসে বলেন হক সাহেব, আর অন্য দিকে যাকে বলে স্কর্চড আর্থ পলিসি, পোড়ামাটি নীতি। জাপানীরা যদি ফিরে আক্রমণ করতে চায়ও আবার, তাহলে আসবে কোন্‌ রাস্তায়? সব শেষ, পেট্রলের খনিতে আগুন লাগানো হয়েই গেছে, যানবাহনের তেল পাবে না। পুব বাংলায় জলপথে আসবে? স্টীমার-জাহাজেও তেল লাগে। দাঁড়-বাওয়া নৌকো? পাবে না। আমি প্রভিন্সের প্রধানমন্ত্রী। আমার কথা শোন। শুধু বাখরগঞ্জেই বার হাজার নৌকো পোড়ানো হয়ে গেছে এর মধ্যে, আরও হবে। যা ছিল, সাইকেল ঠেলাগাড়ি সব শেষ। এই যে কলকাতায় রোজ এত রিফিউজি দেখ, এত ভিখিরি বাড়ছে, এরা কারা? সব ওই পুব বাংলার মানুষ, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে। কারো কোন আয়ের রাস্তা থাকবে না, এখনই নাই। কাদের আশ্রয়ে আর সহযোগিতায় থাকবে জাপানী শত্রু? অথবা ওদের বিবরণে, পঞ্চম বাহিনী?তোমাকে একটা কথা বলি, কাজি। আমাদের এই প্রোগেসিভ পার্টির দিন তো শেষ হতে চলল। বেয়াল্লিশেই আবার ইলেকশন। আমাদের প্রসপেক্ট ভালো নয়। মাঝে যতগুলো বাই-ইলেকশন হল সবকটাতে হেরেছি আমরা। বাঙালি মুসলমান এখন থরোলি মিসগাইডেড। কাজেই তোমার-আমার অনেক কাজ। নতুন উদ্যমে নামতে হবে ময়দানে। কিন্তু ইদানিং লক্ষ করছি তোমার যেন সবসময়ই মন খারাপ। কী যে কারণ আমি জানিনা। এই ইলেকশনে তোমার একটা বড় দায়িত্ব আছে।প্রায় ফিসফিস করে বলেন হক সাহেব, বঙ্গীয় মুসলমানের কিলার ইনস্টিঙ্কটা একটু নাড়াচাড়া দিতে লাগব, বাড়াইতে হব। আমার ওই একডাই চিন্তা, একডাই ভয়। বাঙালি মুসলমান ঠকেই যাব বোধ হয়। এখন চাই, তোমার ওই ওজস্বী ভাষা। তা নইলে, এবার যদি ঠকে, কয়েক জেনারেশন যাব হেই ভুল শোধরাইতে।হঠাৎ-আবার-জেগে-ওঠা এক লাইনের বরিশাইল্যা ডাইলেক্টের থেকে ফের সর্বমান্য বাংলায় ফিরে আসেন হক সাহেব। রেডিওতে মাঝে-মাঝেই হারামণি নামে একটা গানের প্রোগ্রাম তুমি কর। তুমি জান কিনা আমি জানিনা তোমার এই প্রোগ্রামটার আমি কিন্তু একজন ভক্ত। আর, আমি ভক্ত হলে অন্ধ ভক্ত যে হই না তাও তুমি জান। আগে থেকে খেয়াল থাকে যেদিনই, একটু অবসর পেলে সেদিনই তোমার এই প্রোগ্রামটা আমি শুনি। যখন শুনি, মন দিয়ে শুনি। তোমার গানের কথাগুলাও মনে রাখি। ইদানিং কিন্তু বেশ কিছুদিন হল এই প্রোগ্রামটা আর হচ্ছে না। শুরু কর না কেন আবার? ওই যে হারিয়ে-যাওয়া কোন রাগ নতুন করে উদ্ধার করে তার নাম দেওয়া, আর সেই নামটাই ওই রাগে তোমারনতুন-লেখা কোন গানের একটা কলিতে ঢুকিয়ে দিয়ে রাগটা চিনিয়ে দেওয়া; ধর, ওই যে মীনাক্ষী নাম দিয়েছ নতুন-করে উদ্ধার করা যে রাগটার, সেই রাগে তোমার লেখা-গানের প্রথম কলিই হল, কী জানি, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে – চপল আঁখির ভাষায় হে মীনাক্ষী কয়ে যাও – আর এসব নিয়ে সেদিনের প্রোগ্রামে যখন আলোচনায় মেতে গেলে তুমি আর তোমাদের রেডিওর ওই ভদ্রলোক – বোধ হয় সুরেশ চক্রবর্তী নাম – তাই না?– আহা! গানটা গাইয়েছিলে কাকে দিয়ে? বিজনবালা ঘোষ, ঠিক? ভারি জমে গিয়েছিল।আমি তাই একটা উপদেশ তোমাকে দিই কাজি। নবযুগের অফিসে আসাটা তোমার ইচ্ছাধীন, যেদিন মন কয় একবার অফিসে যাই, আসবে। কবিতা-টবিতা লেখা, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় যখন যা ইচ্ছে হবে, সব লেখ। কিন্তু রেডিওতে নিয়মিত আবার যাওয়াটা আর একবার চালু কর তো দেখি। ক্রিয়েটিভ কাজ করবে, দেখবে, মন তোমার ভালো হয়ে গেছে। তুমি তো বেসিকালি ক্রিয়েটিভ কাজেরই মানুষ, শুধুই খবরের কাগজে লিখলে কি তোমার মন ভালো থাকে? আর, মন ভালো না-হলে আবার লড়াই করবে কী করে, কাজি? সুভাষ তিন বছর আগেই বলেছিল এই যুদ্ধের ডামাডোলে চারদিকের চাপে বিধ্বস্ত ইংরেজকে ঠিক ঠিক চাপ দিতে পারলে স্বাধীনতার আর দেরি নাই। কংগ্রেস তখন বুঝল না, কিন্তু আজ গান্ধী তাঁর নিজের ভুল বুঝতে পারছেন। সকলের কাছে সোজাসুজি তা স্বীকার করবার সাহস তাঁর নাই, কিন্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজের কাগজেও সেই কথাই তিনি বারবার বলছেন। ব্রিটিশকে বলছেন তোমরা আজই আমাদের দেশ ছেড়ে পালাও নিজের দেশে, আমাদের দেশ আমাদের ফিরিয়ে দাও, তারপর তোমাদের যুদ্ধে কতটা কী করা যায় আমরা দেখব। তার আগে নয়। জওহরলাল-আজাদ-প্যাটেল সব বুঝেও বুঝছে না। জওহরলালের বন্ধু ক্রিপসকেও গান্ধী ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। দেখ, আমার মন বলে, স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নাই। বাঙালি মুসলমানকে যদি বাঁচাতে চাও, আর নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নাই।কথাগুলো শেষ করে হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান হক সাহেব। বলেন, তাহলে এই কথাই রইল কাজি, আমার অনেক কাজ আছে, এখন আমি যাই। যে চেয়ারে তিনি বসেছিলেন, তার ঠিক পেছনেই এই ঘরে ঢোকবার দরজাটা। হাট করে খোলা সেটা। কাজি বুঝতে পারে হন হন করে হক সাহেব বেরিয়ে গেলেন। খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে এতক্ষণ বাইরের ঘরটা থেকে কোন শব্দ আসছিল না, দরজাটা যে এতক্ষণ খোলা ছিল তা-ই বোঝা যাচ্ছিল না। এবার মৃদু গুঞ্জন শুনতে পায় কাজি। অর্থাৎ, হক সাহেবের সঙ্গে কাজির কথোপকথন এতক্ষণ ধরে এই-ঘরের-সঙ্গে-লাগোয়া-ঘরে বসে যারা শুনছিল – সম্ভবত মন দিয়েই শুনছিল যারা – তাদের মন্তব্য এখন শোনা যাচ্ছে। এটাই হক সাহেবের স্টাইল। খুব গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বার্তা সহজে ছড়িয়ে দেবার জন্যে মীটিং ডাকবার প্রয়োজন হয় না তাঁর। এবং ছড়িয়ে দেবার দায়িত্বও তাঁকে নিতে হয় না!নজরুল উঠে দাঁড়ায়। বাইরে বসে আছে চার-পাঁচ জন। তাদের একজনকে সে বলে, গত তিন-চার মাসের গান্ধীজির হরিজন পত্রিকাগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা কোরো তো।বেরিয়ে যায় নজরুল।ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    ভোটুৎসবে ভাট - চাও কি হতে আমার প্রেমিক? - সমরেশ মুখার্জী |  সন্ধ্যায় সোসাইটির মধ‍্যে আমাদের ব্লকে‌ই একজনের বাড়ি গেছিলাম একটু গল্পগুজব ক‍রতে। অনেকবার আসতে বলেছিলেন। গিয়ে দেখি টিভিতে এবিসি কোঁদল চ‍্যানেলে কোনো লাইভ ডিবেট হচ্ছে। অনুষ্ঠান‌ পরিচালনা‌য় কোট পরিহিতা যুবতি নোঙ্গর। বয়কাট হেয়ার। চোখে চশমা। স্মার্ট লুক। মনে পড়লো অনেকদিন আগেও তাকে একবার দেখেছি‌লাম কারুর বাড়িতে টিভিতে। তখন বেশ কমনীয় লেগেছিল। এখন একটু শ্রান্ত, শুষ্ক লাগলো। হয়তো নিত‍্য এইসব কূটকচালি অনুষ্ঠান পরিচালনা করার প্রভাব।আটটি ডিজিটাল পায়রার খোপে সাতটি মুখ। প্রতিটি খোপচার নীচে নাম ও কোন দলের প্রতিনিধি লেখা। উপরে বাঁদিকে‌র খোপে সঞ্চালিকার মুখ। সজনেখালি, স্টিং ভিডিও, গঙ্গা‌ধর কয়াল এমন কিছু শব্দাবলী উড়ে এলো। সঞ্চালিকা কাউকে প্রশ্ন করলে তিনি যখন কিছু বলছেন মাঝপথে তাকে ছাপিয়ে দু এক জন এক‌ই সাথে কথা বলতে শুরু ক‍রছেন। তিনজনে একসাথে কথা বললে যে কারুর কথাই শোনা যায় না সেই বোধ বা সহবৎ নেই। অথবা দলের নির্দেশ আছে অন‍্য‌কে কথা বলতে না দেওয়ার।২০১২ থেকে টিভি দেখিনা। কিছুক্ষণ এসব দেখে শুনে মাথা ফাতা ভোঁ ভোঁ ক‍রতে শুরু করলো। যার বাড়ি গেছি‌লাম তিনি কিন্তু বেশ আগ্ৰহ নিয়ে দেখছেন সেই আট শালিখের সম্মিলিত হৈচৈ। মিনিট পাঁচেক পর তাদের ছাপিয়ে সঞ্চালিকা তীক্ষ্ম স্বরে দর্শকদের বললেন - একটু পরেই আসছি ছোট্ট বিরতির পর - সঙ্গে থাকুন।বিরতির সময় তিনি মিউট করে বললেন, তার‌পর, কেমন আছেন? টিভি বন্ধ করলেন না দেখে বুঝলাম অনুষ্ঠান‌টি তার প্রিয়। বিরতির পর আবার আনমিউট করে দেখবেন। বুঝলাম ভুল সময়ে এসেছি। গা তুললাম। তিনি একটু অবাক হয়ে বলেন, কী হোলো, এই তো এলেন? এখনই উঠছেন? বলি, এক‌ই ব্লকে তো থাকি, আসবো আবার পরে। আসলে একটু হাঁটতে বেরিয়ে‌ছিলাম। বাড়ি আসার সময় বৌমণি ফোনে দুধ আনতে বলেছিল, একদম ভুলে গেছি। দেখি গিয়ে ডেলি নিডসে। দেরী হলে পাবো না।দুধ ফুদ ফালতু অজুহাত‌। ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে স্কালক‍্যান্ডি হেডফোন লাগিয়ে ইউটিউবে চালালাম একটা ধমাকাদার ভিডিও সং - যৌবনোচ্ছল প্রাণশক্তি‌তে ভরপুর মেলানি নেচে কুঁদে গাইছেন - চাও কি হতে আমার প্রেমিক? কোনো কারণে মুড ডাউন হলে আগেও এটা বহু‌বার শুদেছি - মানে যখন শোনার সাথে দেখাটা‌ও অপরিহার্য মনে হয়। এটা শুদে রিসিডিং এনার্জি রিচার্জ হয়ে যায়। ফেবারিট হিসেবে প্লে-লিস্টে সেভ করা আছে। গানের কথাও গায়িকার। ৬৭টে জন্ম তার সাউথ ক‍্যারোলাইনা‌তে। ছয় বছর বয়স থেকে ভোকালে প্রশিক্ষন নেওয়ার সাথে পিয়ানো, ক্ল‍্যারিওনেট বাজানো শিখেছেন। মেলানি‌র স্বপ্ন ছিল সংগীতশিল্পী হবে। ২৫ বছরে সে স্বপ্ন সত‍্যি হতে শুরু করে। কিন্তু ২৪শে নভেম্বর ২০০১, জার্মানির লাইপজিগ শহরে  লাইভ শো করে ফিরে আসার সময় এক বিমান দুর্ঘটনায় সে ২৪ জন যাত্রী‌র সাথে মারা যায়। তখন তার বয়স মাত্র ৩৪. এ গান যখন রেকর্ড হয়েছিল তখন সে ২৮ বছরের তরতাজা যুবতী।ইংরেজি ভাষায় গানে  কথা‌র থেকেও মেলোডি, বীট এবং গায়কীর মিলিত প‍্যাকেজ আমায় বেশী টানে। এখানে‌ও মেলানি যখন লাভারের শেষে র উড়িয়ে  “বি মাই লাভা‌আআআ” করে ভাসিয়ে দিচ্ছিল, সুরের ভেলায় ভেসে যাওয়া স্বরের সেই চমচমে লাস‍্যে অনুভব করি তার ছোটবেলা থেকে ভয়েস ট্রেনিংয়ের সার্থকতা। তবে কিছু পছন্দের গানের কথাও জানতে ইচ্ছে করে। দ্রুত লয়ের গানে বিদেশি উচ্চারণে কিছু কথা মিস হয় যায় বলে লিরিক ডাউনলোড করে দেখি। এটাও করে দেখলাম মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ইহলোকের ভালো‌বাসিবাসি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে মেলানি কাকে কীভাবে বলেছিল - চাও কি হতে আমার প্রেমিক?La da da dee da da, da daLa da da dee da da, da daBe my loverWanna be my loverLooking back on all the time we've spent togetherYou oughta know right now, if you wanna be my loverGo ahead and take your time, boy, you gotta feel secureBefore I make you mine, baby, you have to be sureYou wanna be my lover…. Ah ha yeah hey, wanna be my loverAh ha yeah hey, wanna be my lover…অতঃপর হতে চাওয়া হবু প্রেমিক বলিলেন:I must confess Girl yes, I want to be your loverTake a chance, my love is like no otherOn the dance floor getting downHold tight, I'll never let you downMy love is definitely the keyLike Boyz II Men, I'm on bended kneeLoving you, not like your brother, Ah yeah I want to be your loverএসব শুনে দেখে মেলানি বলেন:I hear what you sayI see what you doI know everything I need to know about youAnd I want you to know that it's telling meYou wanna be my loverLa da da dee da da, da daLa da da dee da da, da daগানের কথাগুলি গভীঈঈঈর  কিছু নয়, তবে সুর, তাল আর মেলানি‌র স্মার্ট গায়কী‌তে আমি গানটি‌তে মজেছি।
    বিজেপির মুসলিম-শূন্য সংসদের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় একটা হিন্দু সমস্যা - Sudipto Pal | বিজেপির প্রার্থী তালিকায় মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা:২০১৯এ ছিল ৬,২০২৪এ দাঁড়িয়েছে ১। ২০১৯এ ছয় জনের মধ্যে চারজনই ছিল ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে - কাশ্মীর উপত্যকায় তিন, আর লক্ষদ্বীপে এক। এর বাইরে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে পরীক্ষামূলক ভাবে দুজন মুসলিম প্রার্থী ওরা দাঁড় করিয়েছিল। এবার কাশ্মীরে ওরা কোনো প্রার্থী দেয়নি, জোটসঙ্গীও নেই। লক্ষদ্বীপ ছেড়ে দিয়েছে জোটসঙ্গীকে। পশ্চিমবঙ্গে ওরা বুঝে গেছে মুসলিম প্রার্থী দিলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। খালি কেরলে একজন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছে। আগের বার জোটসঙ্গীরা সারাদেশে তিনজন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছিল, এবারও সংখ্যাটা তিনেই সীমিত। আগেরবার একমাত্র এলজেপি থেকে একজন মুসলিম প্রার্থী জিতেছিল। এনডিএর সেই একমাত্র মুসলিম সাংসদ এখন বিরোধীপক্ষে যোগ দিয়েছে। বিজেপির এই মুসলিমশূন্য বা প্রায়-মুসলিমশূন্য প্রার্থীতালিকার কৌশল এতদিন সফল হয়ে এসেছে, তাই তারই পুনরাবৃত্তি ওরা করছে। এর সাফল্যের দুটো কারণ-এক, মাত্র একজন মুসলিম প্রার্থী দিলেও সেই রাজ্যের বিজেপি সমর্থকদের কাছে ভুল বার্তা যায় যে বিজেপি মুসলিম সহনশীলতা দেখানো শুরু করেছে।দুই, মুসলিমদের টিকিট না দিলে সেই জায়গাটা ব্যবহার করে বিভিন্ন হিন্দু কাস্টের প্রতিনিধিত্ব ভালভাবে করা যায়, যার ফলে দলিত ও ট্রাইবালদেরকে অসংরক্ষিত সিটেও টিকিট দেয়া যায় এবং প্রান্তিক ওবিসিদের (যাদের সংরক্ষণ নেই) প্রতিনিধিত্বও ভালভাবে করা যায়- যেটা কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধীরা করতে পারে না। যেরকম মালদা উত্তরের মত মুসলিম আসনেও বিজেপি হিন্দুকে জেতাতে পেরেছিল একজন প্রাক্তন বামপন্থী ট্রাইবাল নেতাকে টিকিট দিয়ে। এই ধরনের অসংরক্ষিত আসনে অন্য দলগুলো দলিত বা এসটি প্রার্থী সাধারণতঃ দেয় না। এই কৌশল স্বাভাবিকভাবেই বিজেপিকে ওবিসি, দলিত এবং ট্রাইবাল ভোটব্যাঙ্ক গড়তে সাহায্য করেছে। কিন্তু এবারের উত্তর প্রদেশের টিকিট বণ্টনে দেখা গেছে অনেক কাস্টই বিজেপির উপর অসন্তুষ্ট।  বিজেপি কিছুটা নিজের জালেই ফেঁসে গেছে। দেশে কয়েক হাজার কাস্ট- সবার প্রতিনিধিত্ব কোনো দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। ফলে উপরিউক্ত দুই নম্বর কারণ থেকে বিজেপি যে সুবিধা পাচ্ছিল সেটা একটা লিমিটের বেশি পাওয়া সম্ভব নয়। উত্তর প্রদেশে প্রথম তিন দফায় কম ভোট পড়ার কারণ মনে করা হয় যে তিনটি জাতির লোক- রাজপুত, ত্যাগী আর সৈনীরা ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে। এরা প্রত্যেকেই বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক, কিন্তু বিজেপি এই জাতিগুলো থেকে যথেষ্ট প্রার্থী দেয়নি বলে চটে আছে। একটা জাতি থেকে কতজন প্রার্থী হলে "যথেষ্ট" প্রার্থী হয়? সব জাতের মানুষই ভাবে তাদের প্রতিনিধিত্বটা মনে হয় কম পরিমাণে হচ্ছে। এছাড়া ব্রড কাস্ট গ্ৰুপিং অনেক সময় সাব-কাস্ট গ্ৰুপগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে না। উদাহরণ - ত্যাগীরা ব্রাহ্মণ, তবে তুলনামূলকভাবে প্রান্তিক গোষ্ঠীর ব্রাহ্মণ। বিজেপি প্রচুর ব্রাহ্মণ প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে ত্যাগী ব্রাহ্মণ যথেষ্ট না হওয়ায় ত্যাগীরা অসন্তুষ্ট। দেখা যাক বিভিন্ন হিন্দু জাতিগুলোর এই ছোট ছোট অসন্তোষগুলো নির্বাচনে কী প্রভাব পড়ে। বিজেপি যতই "বিরাট" হিন্দু জাতির গল্প বানাক না কেন, যখন সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন আসে- প্রত্যেকটা জাতিই বুঝতে পারে তারা আলাদা আলাদা একেকটা জাতি।
    কেকের অভিমত প্রসঙ্গে - সমরেশ মুখার্জী | ভাটিয়ালিতে ১৭৩৩৮ নম্বর পাতায় ১৮.৫.২৪ / ৫:২০ kk নিম্নোক্ত অভিমত পেশ করলেন :“৪-১৩ আর ৪-২২ এর পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে বলছি -- শুধু ফিল্টার করা প্রশংসামূলক মন্তব্যই আসবে সেটাই বা কেমন কথা? যদিও প্রচুর লেখার ক্ষেত্রে সেটাই হয় দেখেছি। তবু আমার মনে হয় ভালোলাগা, মোটামুটি লাগা, খারাপ লাগা সব রকমই না জানলে লেখকের তো স্ট্যাগনেশন অবশ্যম্ভাবী। অবশ্য "খ্যাঁক" ও দেখেছি কম না। টইয়ে 'মত' যেমন লিখেছেন, খোলাপাতার সব রকম সমালোচনা নিতে না পারলে খোলা পাতায় লেখা কেন? সেটা আমারও মনে হয়। খ্যাঁক, রাগ ইত্যাদি প্রসঙ্গে এটাই মনে হয় যে মানুষের ধৈর্য্য আরেকটু বেশি হলে, জাজ করার প্রবণতা আরেকটু কম হলে বড় ভালো হতো।” প্রসঙ্গটি ভাবালো তাই সেই প্রেক্ষিতে কিছু ভাবনা এখানে রাখছি। ভাটে লিখলে অবিরল বিভিন্ন মন্তব‍্যের সুনামিতে হারিয়ে যাবে। এখানে রাখলে এ নিয়ে কেউ কিছু বললে এক জায়গায় থাকবে। মানুষ লেখে কেন?  লেখার ওপর পাঠকের মন্তব্য প্রসঙ্গে আসার আগে প্রথমে দেখা যাক মানুষ লেখে কেন। সন্দীপন তাঁর একটি লেখা‌র মুখবন্ধের লিখেছেন:    "আপনি লেখেন কেন? এর উত্তরে লেখকরা নানা উত্তর দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, যশ বা অর্থের জন্য লিখি না। দেনায় জর্জরিত দস্তয়েভস্কি বলেছেন ‘আমি টাকার জন্যে লিখি’। আনাই নিন বলেছেন, আমি একটা নিজের জগৎ তৈরি করি আমার লেখা দিয়ে, যেখানে ছাড়া আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি না।    আসলে, সবিশেষ কারণ ছাড়াই যে কার্যগুলি সম্পন্ন হয়, তার মধ্যে একটা নিশ্চয়ই সাহিত্য — অন্তত লেখকের দিক থেকে। 'হােয়াই ডাজ ওয়ান রাইট’ নিবন্ধে প্রাইমাে লেভি লেখার যে ১১ টি কারণ দেখিয়েছেন, যথা : বিখ্যাত হবার ইচ্ছা, অন্যকে আনন্দ দেওয়া, অন‍্যকে শিক্ষিততর করা, ব্যক্তিগত ব্যথা বেদনা থেকে মুক্তি ইত্যাদি - তার সবকটাই মামুলি। বরং বলা যেতে পারে, এগুলি এমন সব কারণ, যার জন্যে লেখকরা লেখেন না। এগুলাে সবই লেখকের দ্বিতীয় চিন্তা।"  এখানে “মানুষ” বলতে প্রকৃত পণ্ডিত যারা তাঁদের অর্জিত জ্ঞান ভাবীকালের জন‍্য রেখে যেতে চান বা প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কথা বলছি না যাঁদের পিছনে গ্ৰন্থস্বত্ত্ব কেনার জন‍্য অর্থের থলি নিয়ে ঘোরেন প্রকাশক। নিজের পয়সায় ব‌ই ছাপানো মানুষের কথাও না। বলতে চাইছি সাধারণ মানুষের শখের লেখা‌লেখির তাগিদ প্রসঙ্গে। আমার এক অতীত বন্ধু প্রদীপের সাথে আমার বর্তমান সম্পর্ক কোমায়। আমার থেকে সিকি শতাব্দী ছোট ওর পুত্র‌ তপু‌কে তিন বছর বয়স থেকে চিনি। দুবার ডিভোর্স হয়ে তপুর কম্পাস ঘেঁটে গেছে। ও আমায় আঁকড়ায়। আমার সাথে সম্পর্ক সাবলীল। দুজনে কিছু বড় ভ্রমণে গেছি। আরো যাবো। ও আছে IT তে। সেদিন ও কেজো দিনে আমার সাথে হোয়া চ‍্যাট করছি‌ল। একটু পরে লিখলাম - 'আচ্ছা তুই কাজ কর। আমি‌ কিছু লিখি।' ও প্রতিপ্রশ্ন করে, 'তোমার কাছে লেখা কি অবশেসন? কতদিন কিছু না লিখে থাকতে পারবে?'    অজান্তেই তপু বুলস আইতে হিট করলো। আমার অধিকাংশ লেখা শুরু হয় ছোট্ট কোনো স্ফূলিঙ্গ থেকে। শেষ হয় রাস্তার কোনে ঝাঁটিয়ে রাখা কাগজ, প্লাস্টিকের গাদা‌য় লাগানো ছোট্ট আগুনে। কখনো তা হয়ে দাঁড়ায় বনবিভাগের লাগানো নিয়ন্ত্রিত গ্ৰাসফায়ার থেকে অনিয়ন্ত্রিত বুশফায়ার। তখন তা স্মৃতি, ভাবনা‌র অরণ‍্যে ছড়ানো বৃক্ষরাজি‌কে গ্ৰাস করে। dc যেমন বলেছেন - Eclectic style of writing. প্রথমে টানটা আসে ভেতর থেকে, তারপর লেখাটাই টেনে নিয়ে যায়।    অনেক মহিলা‌ মা হয়ে পড়েন বিনা আবাহনে এবং অসাবধানতায়। মাতৃত্ববোধের উদ্ভব হয় পরে।  বেশ কিছু পরিচিত‌জনের ক্ষেত্রে এটা দেখেছি। কিন্তু যখন দীর্ঘ প্রতীক্ষার অন্তে সন্তানের জন্ম হয় নারী‌র একান্ত কাঙ্খায়? সে খুব সুন্দর হবে, অনেকে তারিফ করবে এমন ভাবনা কী তেমন গর্ভধারণের প্রেরণা‌? মনে হয় না।      আমার অধিকাংশ লেখা‌ও তাই। কিছু লেখা কয়েকটি পত্রিকা‌য় প্রকাশ হয়েছে। এই ঢের। অযথা বিনয় আমার স্বভাববিরুদ্ধ। আমি বুঝি আমার লেখালেখি ব‌ই প্রকাশের উপযোগী নয়। আমার লেখা‌র মুখ‍্য প্রেরণা বুঁদ হয়ে নানা স্মৃতি, ভাবনা শব্দের কায়ায় গুছিয়ে ধরার নেশা - Engaging Cognitive Activity. পড়ে কে‌উ ভালো বললে আনন্দ হয়। সুচিন্তিত মন্তব্য পেলে ঋদ্ধ হ‌ই।     কৈশরে বন্ধুদের সাথে রোজ কয়েক ঘন্টা গঙ্গা‌য় দাপাদাপি না করলে আশ মিটতো না। এখন ভ্রমণপথে নানাস্থানে বিচিত্র‌রূপিনী নর্মদা, মিস্টি‌ক কালিসিন্ধ, থৈথৈ কুমারধারা, বেগবতী নেত্রাবতী বা জয়সমন্দ, ফয় সাগর, গোমতী সাগরের মতো বিশাল নির্জন হ্রদের তীরে চুপ করে বসে থাকলেও বেশ লাগে। জল দেখলেই স্নানের টান আর অনুভব করিনা। তার জন‍্য কোনো দুঃখবোধ‌ নেই কারণ আনন্দ অনুভবের প্রকরণ বদলে গেছে। তেমনি যতদিন উদ্দেশ‍্যহীন লেখালেখিতে আনন্দ পাবো লিখবো। ভবিষ্যতে লিখতে‌ ইচ্ছে না করলে - লিখবো‌ না। নিয়মিত লিখতেন আশুতোষ, তারাশঙ্কর, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ বসু, নারায়ণ সান‍্যাল, বুদ্ধ‌দেব গুহ‌র মতো উৎপাদনশীল লেখকরা। আমার কাছে লেখালেখি নির্বান্ধব জীবনে মানবসঙ্গে‌র জন‍্য লালায়িত না হয়ে আত্মমগ্ন থাকার আমেজী উপায়।  সেদিন আমি তপুকে এসব বলিনি, নিজের মনে নাড়াচাড়া করেছি। আনাই নিনের উক্তি‌টি আমার লেখা‌র তাগিদে‌র সাথে‌ মেলে।মানুষ লিখে নিজের কাছেই রাখে না কেন?এই প্রসঙ্গে -  আম লেখকদের ক্ষেত্রে - আমি সন্দীপন উল্লিখিত প্রাইমো লেভি বর্ণিত কিছু কারণসমূহের সাথে সহমত। কিছু লিখে নিজের কাছেই রেখে দেওয়া তো আত্মকথন - যেমন আ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী। কিছু এলেমদার লেখক আবার কিছু লেখা প্রকাশ করে বাকি লেখা বাক্সবন্দী করে চলে গেছেন - যেমন জীবনানন্দ। কাফকা‌ও তাঁর জীবদ্দশায় কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশ করে বাকি অপ্রকাশিত লেখা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ম‍্যাক্স ব্রডের জিম্মায় রেখে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর অবর্তমানে ওগুলি জ্বালিয়ে দিতে। ম‍্যাক্স বন্ধু‌র অনুরোধ রাখেন নি বলে দুনিয়া কাফকা‌কে পেয়েছে। কিন্তু কাফকা নিজে ঐ অপ্রকাশিত লেখাগুলি গোধূলি‌বেলায় জ্বালিয়ে দিলেন না কেন? এখানে‌ই লুকিয়ে আছে মোক্ষম কারণ। অসাধারন মানুষের কাছে‌ও নিজের রচনা সন্তান‌সম - তাকে কারুর জিম্মায় রেখে চলে যাওয়া যায় - কিন্তু নিজে হাতে হত‍্যা করা শক্ত। মুকুন্দ‌লাল ঘোষ সাধনা‌য় পরমহংস যোগানন্দ হয়ে লিখেছেন Autobiography of a Yogi. তাঁর বিশ্বাস ক্রিয়াযোগের প্রসারকল্পে ঐ আত্মজীবনী লেখা তাঁর গুরুদেব লাহিড়ী মহাশয় কর্তৃক পূর্ব‌নির্ধারিত ছিল। কিছু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে‌ও তাদের ভাবনা প্রকাশের তাড়না অদম‍্য। আমি‌ এই গোত্রের। তাই প্রায়‌শই লিখে চলি হাবিজাবি - তবে নিজের পাতায়। মন্তব্য করি কারুর লেখায়। কিন্তু ওয়াইড স্পেকট্রামে সেনসাস থেকে কনশাসনেস - হেন বিষয় নেই যা আলোচনা হয় না - সেই ভাটে‌ও দেখা যায় কিছু মানুষ অবিরল বহু বিষয়ে বিশদে মন্তব্য করে চলেছেন। তাদের আগ্ৰহের পরিসর এবং স্পেলাইজশনের গভীর‌তা বিষ্ময়কর। এ‌ও নিজস্ব জ্ঞান, বোধের প্রকাশের তাড়না এবং অন‍্যদের শিক্ষিততর করার বাসনা।  গুরুর কিছু বিদগ্ধ‌জন - যাদের লেখা মুগ্ধ করেছে - তাদের অনেকে ভাটে নীরব বা কালেভদ্রে কিছু বলেন। মানে বাক্সবন্দী জীবনানন্দ কেস। আমি ভাটে সক্রিয় ন‌ই কিন্তু মাঝেমধ্যে স্ক্রল থ্রু করে‌ও নানা মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া দেখে কিছু প‍্যাটার্ন বোঝা যায়।মানুষ মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া করে কেন?এই আলোচনা ভাটে চ‍্যাট প্রসঙ্গে নয়। সেখানে চিকের আড়াল থেকে বক্রোক্তি করা মানুষ কেউ নিকের আড়াল থেকে কটূক্তি করলে রেগে যায়। যদি বলি - Rule of the game should be same for all - তারা বলবে নিকের আড়ালে আমাদের আসল অস্তিত্ব  ‘অনেকের‌ই’ জানা কিন্তু যারা রক্তবীজের ঝাড়ের মতো ঘনঘন নিক বদলে কটূক্তি করে তাদের ঘাড় ধরে গুরু থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। এই ‘অনেকেই’ মানে গুরুতে যারা শুরু থেকে আছে। কিন্তু আমার মতো যারা হালে এসেছে এবং গুরুর ক্লোজ সার্কিটের বাইরে -  তারা তো বুঝবে না ¥ £ € % গোত্রের নিকরা কারা - কী তাদের প্রেক্ষাপট। বাংলালাইভে আমার দুটি ভ্রমণকাহিনী বেরিয়ে‌ছিল - একটি বাংলায় অন‍্যটি ইংরেজি‌তে। ওখানে লেখা‌র সাথে ছবিসহ সংক্ষিপ্ত লেখকপরিচিতি দিতে হয়। আমি দিয়েছিলাম এমন: এখানে আমার চালচিত্র নিয়ে ঢ‍্যাঁড়া পেটাইনি - পেটানো‌র মতো‌ও কিছু নেই‌। সামান্য পেশাগত এবং ভ্রামণিক সত্তার পরিচয় দিয়ে‌ছি। এমন প্রথা আরো কয়েক জায়গায় দেখেছি। সোজাসাপ্টা মানুষ বলে এমন বেবাক এ্যাপ্রোচ পছন্দ। তাই গুরুতে সৈকত বন্দোপাধ্যায়, কিশোর ঘোষাল, রঞ্জন রায়, অরিন্দম বসু, শিবাংশু, শুভদীপ ঘোষ প্রমূখদের স্বনামে, সপাট ছবিসহ আত্মপরিচিতি পছন্দ হয়েছে। সবাই উত্তম কুমার বা সুচিত্রা সেনের মতো সুদর্শন বা সুদর্শনা হবেন না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা এই ফোরামের সাথে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত এবং বেশ এ্যাকটিভ তারা নিজের নাম এবং মুখের সপাট ছবি দেন না।  অর্থাৎ গুরুর কোর ফিলজফি গোপনীয়তা। হয়তো সরকার বিরোধী বক্তব্য রাখা একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু গুরুর অধিকাংশ সদস‍্য তো উবের ইন্টেলেকচুয়াল। এখানে তো স্ট্রিটলেভেলের গালিগালাজ বাঞ্ছনীয় নয়। আকাশ ব‍্যানার্জী, রবিশ কুমার, আরফা খানুম শের‌ওয়ানির মতো শালীন ভাষাতেও তো শানিত সমালোচনা করা যায়।   তাতে সরকারের‌ও কিছু করার নেই। কারণ এখনো ভারত উত্তর কোরিয়া হয়নি। নিকের আড়ালের উদ্দেশ্য SMA (Social Media Activism), Alter Ego সদৃশ Alternative Identity বা যাই হোক  তাও সবার ক্ষেত্রে বজায় থাকে না যখন নিকেরা ভাটে নিজের ব‌ইয়ের প্রসঙ্গে লেখেন। বা অন‍্য কেউ যারা তাদের চেনেন তাদের ব‌ইয়ের কথা লেখেন। প্রকাশিত ব‌ইয়ের তালিকা থেকেও লেখকের আসল পরিচিতি প্রকাশ হয়ে যায়। ব‍্যতিক্রম দেখেছি কেকের বেলায়। তিনি ভাটে মলাটে এক। এটা ভালো লেগেছে কারণ দ্বৈতপরিচিতির প্রকট দ্বিচারিতার প্রদর্শন নেই। এখানে প্রতিক্রিয়া বলতে অন‍্যের লেখার ওপর পাঠকের মন্তব্যের ধরণ এবং কোন প্রবণতা থেকে মানুষ এমন মন্তব্য করতে পারে তাতেই  আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি। আমার ধারণা‌ ঠিক লাগলে তার পক্ষে কেউ কিছু সংযোজন, সংশোধন, পরিমার্জন করতে পারে‌ন। ভুল মনে হলে প্রতিযুক্তি সহকারে খণ্ডন করতে পারে‌ন। তবে শোভন আঙ্গিকে হলে রুচিশীল লাগে। ১. নিখাদ প্রশংসক - সুন্দর সকাল, মনোরম সূর্যাস্ত, ফুটফুটে শিশুর হাসি দেখে মনের মধ‍্যে অস্ফূটে  গুঞ্জরিত হয় - আহা! কিন্তু লেখা তো এমন স্বাভাবিক ঘটনা নয় - তার জন‍্য লেগেছে লেখকের নিষ্ঠা, প্রয়াস। তা ভালো লাগলে মুক্ত‌কণ্ঠে প্রশংসা করলে লেখক উৎসাহ পান। কিছু না লিখে ৪/৫ রেটিং দিলেও writer may get a quantitative idea about qualitative aspect of the write-up. আমি কোনো লেখা ভালো লাগলে বিশদে বা সংক্ষেপে মন্তব্য করি। রেটিং‌ও দিয়ে থাকি। ২. নৈর্ব্যক্তিক সমালোচক - এরা লেখা‌র বিষয়, শৈলী, সমাপন নিয়ে গঠনমুলক সমালোচনা করেন। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেন। ভিন্নমত পোষণ করলে‌ যুক্তি, তথ‍্য সহকারে পেশ করেন। এমন সমালোচনা পড়লে‌ বোঝা যায় লেখাটি পড়ে, আত্মস্থ করে তারপর তিনি অভিমত দিচ্ছেন। এদের আঙ্গিক কর্কশ, অশালীন, তাচ্ছিল্য‌সূচক নয়।৩. ছিদ্রান্বেষী - চাল বাঁশকাঠি হোক বা বাসমতী - এরা কাঁকড়ে বেশী আগ্ৰহী। লেখা‌র মূল প্রসঙ্গ, পার্শ্বপ্রসঙ্গ সম্পর্কে বিশেষ উচ্চবাচ‍্য না করে বানান ভুল, বিদেশী নামের সঠিক উচ্চারণ এনাদের মন্তব্যের USP. ৪. পাণ্ডিত‍্য জাহির - এনাদের মন্তব্যে লেখার ওপর আকর্ষণীয় আলোচনা‌র থেকেও ঐ সূত্রে নিজের পাণ্ডিত‍্য ও পড়াশোনা‌র ব‍্যপ্তি জাহিরের তাড়না চোখে পড়ে। এই প্রবণতা উদগ্ৰ। চেপে রাখা মুশকিল।৫. রমতা যোগী - পাঠমন্তব্য হিসেবে বাঞ্ছনীয় সেই লেখাটির ওপর আলোচনা। এই গোত্রের মন্তব‍্যকারীরা তা না করে বা সামান্য বুড়ি ছুঁয়ে ঐ প্রেক্ষিতে বা দুরসম্পর্কিত প্রসঙ্গে তাদের অতীত অভিজ্ঞতা পেশ করেন। কখনো তার ফলে ট্রিগার হয়ে যায় Domino Effect. তখন আরো অনেকে Anecdotal Accounts এর ঝাঁপি খুলে বসেন। লেখাটির ওপর ফোকাস‌‌ড্, বাঞ্ছিত আলোচনা মন্দির থেকে দুরে ছেড়ে রাখা চটির মতো পড়ে থাকে। মন্তব্যকারীর যোগ্য‌তাসংগীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, সাহিত্য এসবের ওপর সুচিন্তিত মন্তব্য করতে অন‍্য গোত্রের মানসিকতা এবং এলেম লাগে। একটা উদাহরণ দি‌ই। বৌমণি সারেগামা সংগীত অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক। আমি অনিয়মিত। ওখানে  যাঁরা বিচারক হয়ে আসেন তাদের প্রতিটি প্রতিযোগীর প্রতিটি গানের পরে মার্কিং দিতে হয়। সঞ্চালক আশা করেন বিচারকরা কিছু মন্তব্য‌ও করবেন। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, কুমার শানু, বাপ্পী লাহিড়ী গোত্রের বিচারকরা সচরাচর বিশেষ কিছু বলেন না। মার্কিং ৭ বা ১০ যাই দিন, অধিকাংশ সময় কেকে বর্ণিত কিছু প্রশংসা‌সূচক কথা বলেন।  কিন্তু শান্তনু মৈত্র, অভিজিৎ, সোনু নিগম মায় লারে লাপ্পা গানের জন‍্য বিখ‍্যাত দলের মেহেন্দিও একদম নিখুঁত‌ভাবে গায়কী‌র কোথায়, কী বিচ‍্যূতি হয়েছে উল্লেখ করেন। কখনো গেয়ে দেখিয়ে দেন। এতে প্রতিযোগী নিজের ভুল বুঝতে পারে‌ন। চেষ্টা করলে পরে সংশোধন করতে‌ও পারে‌ন। গুরুতে‌ও আমার এবং অন‍্যের কিছু লেখার ওপর কিছু মন্তব্যকারীর মন্তব্য মুগ্ধ করেছে। তা নিছক হাততালি নয়। তবে কমার্শিয়াল প্রোগ্রাম‌ই হোক বা উন্মুক্ত ফোরামে শখের লেখালেখি - তার ওপর এমন মন্তব্য‌কারীর সংখ্যা কম‌ই হয় কারণ তা করতে এলেম, সদিচ্ছা এবং সময় লাগে।কেকের মন্তব‍্যে তিনটি বাক‍্য প্রসঙ্গে১. খোলাপাতার সব রকম সমালোচনা নিতে না পারলে খোলা পাতায় লেখা কেন?২. খ্যাঁক, রাগ প্রসঙ্গে মনে হয় মানুষের ধৈর্য্য আরেকটু বেশি হলে ভালো হতো।৩. জাজ করার প্রবণতা আরেকটু কম হলে বড় ভালো হতো।এক নম্বর পয়েন্টে‌র সাথে আমি শর্তসাপেক্ষে সহমত। কী সেই শর্ত? ধরা যাক লেখাটিতে রাজনৈতিক রং আছে এবং সমালোচকের রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্ন। সেক্ষেত্রে লেখক যদি ব‍্যঙ্গ, বিদ্রুপ সহকারে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তার বক্তব্য পেশ না করে  থাকেন তাহলে বিরূদ্ধ সমালোচনার শৈলী‌ও তেমন‌ই হ‌ওয়া উচিত।  কিন্তু তাওযদি সমালোচক চাড্ডি, তিনো, মাকু জাতীয় বিকৃত লিংগোভঙ্গিতে কুৎসিত ভাষায় লেখককে আক্রমণ করেন তাহলে লেখকের দুটি অপশন থাকে।  এক - জাস্ট উপেক্ষা। বাস্তবেও আমরা রাস্তায় পিছন থেকে ঘেয়ো কুকুরের ঘেউ ঘেউ উপেক্ষা করে চলে যাই। (সচরাচর সামনাসামনি এরা আসে না)। দু‌ই, যদি একদম পিছনে এসে বিশ্রী‌ভাবে ঘে‌উঘে‌উ করে তাহলে হাতে ছাতা বা ওয়াকিং স্টিক থাকলে ঘা কতক কষিয়ে দেওয়া। তবে নর্দমা থেকে পাঁক মেখে উঠে আসা কুকুর ঠেঙিয়ে লাঠি, ছাতা নোংরা না করতে চাইলে তাও কিছু না করলেও‌ চলে। কারণ আমরা জানি একটি চিরন্তন সত‍্য - Barking dogs never bite. কিছুক্ষণ ভ‍্যাক ভ‍্যাক করে আপনি‌ই থেমে যাবে। যদি লেখাটি রাজনৈতিক বা কোনো ইজম ধর্মী না হয়ে অন‍্য কোনো বিষয়ে লেখকের অভিমত, ভাবনা অথবা অভিজ্ঞতা, স্মৃতি‌চারণমূলক হয় তাহলে লেখাটি ভালো না লাগলে‌ সমালোচনা হতে হবে অবশ‍্য‌ই শালীন।  মন্তব্য‌কারীর এই প্রাথমিক সৌজন্যবোধ না থাকলে খোলাপাতায় লিখেছেন বলে‌ অশোভন মন্তব্য‌ও লেখককে খোলামনে মেনে নিতে হবে -  এমন একপেশে মতবাদে আমি বিশ্বাসী ন‌ই। তবে এক্ষেত্রে‌ও ঋষি‌সূলভ প্রজ্ঞা‌র লেখক - “ছায়ায় (নিকের) সাথে যুদ্ধ করে গাত্রে হোলো ব‍্যাথা” - আপ্তবাক‍্য স্ম‍রণ করে তিক্ত সমালোচনা উপেক্ষা করতে পারেন। রাস্তায় সদ‍্য ঝরা শিউলি দেখলে কুড়োতে ইচ্ছে করে। বমি পড়ে থাকলে আমরা পাশ কাটিয়ে যাই। তেমনি।কেকের দুই নম্বর বক্তব্য আমার কাছে তখনই গ্ৰাহ‍্য যখন পাঠকের শালী‌ন, সুচিন্তিত বিরূদ্ধ সমালোচনা‌র ক্ষেত্রে‌ও লেখক অশোভন প্রতিক্রিয়া করেন। আমি গুরুতে এমন কম‌ই দেখেছি। সচরাচর কিছু নিক‌ই শুরুটা বক্রোক্তি দিয়ে করেন। সব লেখক ঋষিপ্রতিম স্থিতধী নন এবং  আগেই বলেছি, লেখকের কাছে লেখা সন্তান‌স্বরূপ। সেক্ষেত্রে, কটূক্তি‌তে লেখক‌ও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে ফেলেন। এতে আমি দোষ দেখিনা।  যেদিন Specially programmed AI bot গুরুতে নিক হিসেবে লেখা পোষ্ট করবে, সেদিন হয়তো এঁড়ে পাবলিকের বক্রোক্তি‌তেও bot nik কোনো প্রতিক্রিয়া করবে না। ঐ special coding টা হতে হবে - only to post - not to react.তবে মানুষের তৈরী সোফিয়ার মতো সেল্ফ লার্নিং সোশ‍্যাল রোবটের ক্ষেত্রে এসব চলবে না। সে মানুষের সাথে ক্রমাগত মিথস্ক্রিয়া‌র মাধ্যমে মানুষের প্রবণতা স্টাডি করে - যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল ফান্ডায় - চৌখশ উত্তর দিতে শিখছে। তাই এঁড়ে মন্তব্য দেখলে সোফিয়া‌ও হয়তো ছেড়ে কথা বলবে না। এ প্রসঙ্গে ছয় বছর আগে উইল স্মিথের সাথে সোফিয়ার ইন্টারভিউ‌টা দেখা যেতে পারে। এতোদিনে সোফিয়া লান হয়তো আরো অনেক বুদ্ধি‌মতী হয়ে গেছেন। সেদিন রোবট সম্পর্কে জোক করতে গেছি‌ল উইল। সোফিয়া শালী‌ন ভাষায় তীক্ষ্ণ মন্তব্যে মজা ছুটি‌য়ে দিয়েছে ওর। হলেই বা যন্ত্র‌মানবী, সেলেব প্রিভিলেজ নিয়ে প্রথম আলাপেই সোফিয়া‌কে কিস ক‍রতে গেছি‌ল উ‌ইল - তখন‌ও সোফিয়া উইলকে উইন্ক করে মিট্টি টিজ করেছে। ভিডিও‌টা থাকলো নীচে।তিন নম্বর প্রসঙ্গে কেকে লানকে কয়েকবার বিভিন্ন‌ভাবে বলতে দেখেছি। হয়তো তিনি ব‍্যক্তি‌জীবনে নানা কারণে, নানা ভাবে, নানাজনের কাছে জাজড্ হয়েছে‌ন। তাই এটা তার কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায়। আমার কাছে এটা আদৌ ভাবনার বিষয় নয়। কারণ আমি বুঝি ইঁট, বুলেট, লাঠির মতো অজীব বস্তুরাই জাজমেন্টাল নয়। Completely indifferent. তাই যারা তাদের যাদের গায়ে‌ই প্রয়োগ করুক না কেন - তারা তাদের বিচারবোধ প্রয়োগ  না করেই তাদের ওপর বর্ষিত হবে।  সজীব প্রাণীর মগজে সামান্য ঘিলু থাকলেই তারা নিজস্ব জ্ঞান,  বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার ভিত্তি‌তে বিচারপ্রবণ হতে বাধ‍্য। তবে পারিবারিক পরিমণ্ডল, জীবনে ঘাতপ্রতিঘাতের অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা, বিশেষ মানুষের সাহচর্য, দার্শনিক প্রজ্ঞা ইত‍্যাদি প্রভৃতি থেকে কিছু মানুষ উপলব্ধি করে সামাজিক মেলামেশা‌য় অনেক কিছু অনুভব করা গেলেও তার প্রকাশ বাঞ্ছনীয় নয়। সেটা তারা সজ্ঞানে অভ‍্যাস‌ করে। মনে করে এতে নিজের ঋদ্ধসত্তা ইমেজ বজায় থাকে। চেষ্টা করেও এটা আয়ত্ত করা সহজ নয়। তাই এটা অবশ‌্য‌ই এক ধরনের উত্তরণ। এটাকে‌ই অনেকে সময় অনেকের Non-judgemental approach বলে ভ্রম হয়।  তবে যাঁদের স্বভাবে এ জিনিস সচেতন প্রয়াস ছাড়াই স্বাভাবিক‌ভাবে বিরাজ করে -  তিনি সাধারণের ঊর্ধ্বে - তিনি আমার কাছে প্রণম‍্য। তাঁদের মধ‍্যে - অন‍্য কেউ জাজমেন্টাল হলেও - কোনো ক্ষোদোক্তি দেখা যায় না।
  • জনতার খেরোর খাতা...
    অকারণ - Sarthak Das | সুজাতা কাঁদে। কেন কাঁদে, জানে না। কাঁদার কি কারণ থাকতে পারে, কেঁদে কিই বা হবে, আদৌ কি এটা কান্না না কোনো নিশ্চুপ আর্তনাদ, সুজাতা জানে না। এটুকু জানে, মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। গলা শুকিয়ে আসে, নিঃশ্বাস স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে জল, কোনো কারণ ছাড়াই হয়তো। কান্না অত যুক্তি মানে না। সুজাতা কাঁদে। নিঃশব্দে। রাতের কোলে, সবার অলক্ষ্যে। পাশ ফিরে দেখে অতুল ঘুমোচ্ছে। সুজাতার ঘুম পায় না। তবু চোখ দুটো বন্ধ করে। কোনো কারণ ছাড়াই হয়তো। জল থামে না। পড়েই চলে অনবরত। সুজাতা কাঁদে। কেঁদেই চলে। নিঃশব্দে। ভোর হয়ে আসে। তবু সব অন্ধকার। সুজাতার চোখ বন্ধ। আর কান্না আসে না।
    বিবাহ বিচ্ছেদ। গল্প। - SANKAR HALDER | বিবাহ বিচ্ছেদলেখক :- শংকর হালদার শৈলবালা। ◆ রানাঘাট শহরের কোলাহল মুক্ত এক নিরিবিলি পরিবেশে চূর্ণী নদীর তীরে মনোরম পরিবেশ তৈরি বিনোদিনী পার্কের বৃক্ষের ছায়া তলে ঘাসের উপর একজন যুবতী বসে ভাবে, অনীশ এখনো আসছে না কেন! কোন বিপদ হয়নি তো? ◆ একজন যুবক কালো রঙের একটি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হেলতে দুলতে যুবতীর পিছনে এসে বলে :- ঊর্বশী; দেরি করে আসার জন্য দুঃখিত, ব্যক্তিগত মালিকের কোম্পানির চাকরি তো-নিজের ইচ্ছামত আসা যায় না। কয়েকদিন ধরেই অফিসে ভীষণ কাজের চাপ চলছে।  ◆ অনীশের হাত ধরে পাশে বসিয়ে উর্বশী বলে :- তোমার সাথে দেখা করার জন্য দত্তপুলিয়া থেকে রানাঘাট কলেজে ভর্তি হওয়া কিন্তু বাবু কাজের অজুহাতে এক ঘন্টা দেরি করে আসলেন। ◆ অনীশ বলে :- কয়েক বছর ধরে স্টেশনে পার্কে প্রেম করলাম কিন্তু এবার ভাবছি, কয়েক মাসের মধ্যে তোমার বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেলে কিন্তু একদম বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়বো।  ◆ দুজনে টয় ট্রেনে চেপে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির অপূর্ব সুন্দর্য উপভোগ করতে করতে অনীশের হাত ধরে ঊর্বশী বলে :- তোমাকে একান্তভাবে আরো কাছে পেতে চাই।  ◆ বড়বাজার থেকে চূর্ণী নদীর তারের ব্রিজের উপর দিয়ে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া কচুরিপানা ভর্তি চূর্ণী নদী কে দেখে অনীশ আফসোস করে বলে :- একদিন আমাদের রূপ যৌবন অহংকার বিনষ্ট হয়ে চূর্ণী নদীর মত হবে। ◆ ঊর্বশীর দুই দাদা বৌদি বিয়েতে রাজি না থাকার কারণে বিএ পাস করার এক মাস পর কোর্টের মাধ্যমে অনীশ ও উর্বশী রেজিস্ট্রি বিবাহ করে। সমাজের বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে অনীশ তার বগুলা গ্রামের বাড়িতে বিধবা মা ও নববধূকে নিয়ে নতুন সংসার শুরু করে। ◆ মধ্যবিত্ত পরিবার হিসেবে ঊর্বশী সংসারে খুশি ছিল। ধীরে ধীরে তার দাদা বৌদির বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে। ২০২০ সালে ভয়াবহ করোনা ভাইরাসে সারা পৃথিবী কেঁপে ওঠে আর অনীশ সহ হাজার হাজার মানুষের চাকরি হারাতে হয়। ঘর বন্দী হয়ে জমানো টাকা পয়সায় বসে বসে খাওয়া দাওয়া করতে করতে এক সময় শেষ হয়ে যায়। অভাব অনটনের তাড়নায় দিন দিন স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার মধ্যে ফাটল ধরতে থাকে। এক বছর করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকার পর করোনা ভাইরাসের থেকেও মারাত্মক ভাবে ঊর্বশী একদিন সংসারে বিস্ফোরণ ঘটায়। যা অনীশের সহ্য করা কঠিন হয়ে ওঠে। ◆ অনীশ বাজার থেকে খালি ব্যাগ নিয়ে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী ঊর্বশী কে বলে :- কোন ভাবেই টাকা-পয়সা জোগাড় করতে পারিনি আবার কোন দোকানদার আমাকে বাকিতে জিনিসপত্র দেবে না। সরকারের বিনামূল্যে দেওয়া খাদ্য সামগ্রী এখন আমাদের একমাত্র ভরসা। ◆ ঊর্বশী চিৎকার করে বলে :- ঐ রেশনের চাল আমি খেতে পারব না। রেশনের চাল আমার বাবার বাড়িতে হাঁস-মুরগি ছাগল খায়। ঘরে কোন চাল ডাল নেই কিন্তু আজ চাল ডাল সবজি না আনলে পিণ্ড রান্না করে দিতে পারব না। ◆ অনীশের মা ছুটে এসে বৌমার উদ্দেশ্যে বলে, মা; তুমি এ কেমন কথা বলছো। অনীশ কাজের চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু করোনার ভয়ে কাজ তো কেউ দিচ্ছে না। তোমাকে এক বেলা খেতে দিয়ে আমরা তো তিন বেলা খাচ্ছি না। ◆ ঊর্বশী চিৎকার করে বলে :- আপনি চুপ থাকুন। সংসার কিভাবে চলছে তা কখনো বোঝার চেষ্টা করেছেন? আপনার অপদার্থ ছেলেকে বিয়ে করায় আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাদা-বৌদি ঠিকই বলেছিল কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। বউ কে খেতে দিতে পারবে না, তাহলে বিয়ে করার কি দরকার ছিল? ◆ অনীশ বলে :- তুমি কিন্তু তোমার অধিকারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছো। তোমার ইচ্ছা না থাকলে কিন্তু জোর করে আমি তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসিনি। ◆ ঊর্বশী চিৎকার করে বলে :- কি করবে মারবে? মারো মারো মারো বলে অনিশের হাত নিয়ে নিজের গালে মারতে থাকে। ◆ অনীশ চিৎকার করে উঠে ঊর্বশীকে সরিয়ে দিতে গিয়ে ঊর্বশী পড়ে যায় আর শাশুড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে এসে বৌমার হাত ধরে উঠানোর চেষ্টা করে। ◆ শাশুড়ি কে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উর্বশী বলে :- আমাকে মেরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো কিন্তু তোমার সংসার আর করব না। তারপর শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার ছেলেকে একটি থালা আর ছেঁড়া জামা কাপড় পরিয়ে দেন, ভিক্ষা করে নিয়ে এসে বউকে খাওয়াবে। এই সংসারে এক বেলা ঠিকমত খাওয়া জোটে না আর শখ আহ্লাদ তো অনেক দূরের কথা। বিয়ের আগে তো বলেছিল রাজরানী করে রাখব। খেতে খেতে আমার গায়ের গয়না গুলো পর্যন্ত বিক্রি করে খেয়ে ফেলেছে তারা আবার বড় গলায় কথা বলে। ◆ অনীশ তার স্ত্রীকে শাসন করার জন্য দ্রুত ছুটে এসে গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলে :- আমাকে ভিখারি বলছে, প্রত্যেক মানুষই বর্তমানে পরিস্থিতির শিকার হয়ে রয়েছে।  ◆ অনীশের মা তার ছেলের গালে চড় মারতে মারতে বলে :- তোর এত সাহস বৌমার গায়ে হাত তুললি, তোর মত অপদার্থ ছেলে আমার দরকার নেই। বলে বৌমার কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে। ◆ ঊর্বশী কান্না করতে করতে শাশুড়ি কে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত বেগে ছুটে ঘরের মধ্যে গিয়ে একটি ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেগে ছুটতে থাকে। ◆ অনীশ তার স্ত্রীর পথ অবরোধ করে বলে :- আমার এই দুর্দিন চিরকাল থাকবে না, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে ভীষণভাবে ভালোবাসি কিন্তু রাগের মাথায় উত্তেজিত হয়ে চড় মেরেছি। ◆ ঊর্বশী কারোর কোন কথা গ্রাহ্য না করে দ্রুত বেগে হাঁটতে শুরু করে। অনীশ পিছন থেকে চিৎকার করে বলে, ঊর্বশী তুমি ফিরে এসো, ঊর্বশী তুমি ফিরে এসো, ঊর্বশী তুমি ফিরে এসো বলতে বলতে দ্রুত বেগে হাঁটতে থাকে। অনীশের মা বলে, বৌমা তুমি যেওনা, বৌমা তুমি যেওনা । বাসস্ট্যান্ডে থাকা দত্তপুলিয়া গামী চলন্ত বাসে ঊর্বশী দ্রুত বেগে উঠে পড়ে, অনীশের সামনে দিয়ে বাস চলতে শুরু করে। ◆ অনীশ পিছন থেকে চিৎকার করে আবার বলে, ঊর্বশী তুমি ফিরে এসো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ঊর্বশী তুমি ফিরে এসো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ঊর্বশী তুমি ফিরে এসো। ◆ ঊর্বশী তার দত্তপুলিয়া গ্রামে দুই দাদার সংসারে উপস্থিত হয়ে বাবার পাশে বসে দাদা বৌদির উপস্থিতিতে বলে :- আমি আর অনীশের সংসারে ফিরে যাবে না। ◆ বড় বৌদি সুনন্দা তার ননদ কে আদর করে বলে :- আমাদের কোন কথা না শুনে ভালবেসে বিয়ে করলি কিন্তু জানতাম একদিন ঐ দারিদ্র্যের সংসারে থেকে বিদায় নিতে হবে। একমুঠো ভাত খেতে তাও দিতে পারে না।  ◆ ছোট বৌদি তপতি বলে :- আমার কাকাতো ভাইকে বিয়ে করলে কিন্তু আজকের এই দুর্দিন দেখতে হতো না। শরীরে ময়লা ধরেছে কতকাল সাবান ব্যবহার করিস না। আমার ভাইকে বিয়ে করলে রাজরানী হয়ে সবার উপরে ছড়ি ঘুরিয়ে লাখ লাখ টাকা তোর পায়ের কাছে পড়ে থাকতো। ◆ বড় বৌদি সুনন্দা বলে :- তোকে আবার ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দেবো, চিন্তা একদম করবি না। ◆ ছোট বৌদি তপতি বলে :- আমার ভাই তো ঊর্বশীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, এখনো বিয়ে করেননি। বিদেশ থেকে বাড়ি এসেছে, আমি বললে না করতে পারবে না।  ◆ বড়দা অনিক বলে :- তাহলে তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।   ◆ ছোটদা আবির বলে :- বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করতে হবে। আর সেই টাকায় ধুমধাম করে তোকে বিয়ে দেবো। ◆ বড় বৌদি সুনন্দা বলে :- বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে ঊর্বশী রাজি আছে তো। ◆ ঊর্বশী বলে :- আমি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চাই। ◆ উর্বশীর অসুস্থ বাবা বিছানায় উঠে বসে তার মেয়ের হাত ধরে বলে :- দাদা বৌদির কথা শুনে বিবাহ বিচ্ছেদ করিস না। সংসারে দারিদ্রতা আসতে পারে কিন্তু তার জন্য স্বামীকে ত্যাগ করা অন্যায়। ◆ বড় ছেলে অনিক বলে :- বাবা; আপনি চুপ করে থাকুন। আমাদের বোনের ভালো-মন্দ আমরা বুঝবো।  ◆ ছোট বৌমা তপতি বলে :- বাবা; আপনি তো এখন জড় পদার্থে হয়ে গিয়েছেন, আর আমাদের দয়ার উপর আপনার চলতে হয়। আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলবেন না। ◆ বড় বৌমা সুনন্দা বলে :- বাবা ; ননদের আমরা সবাই ভালোই চাই, তার জন্যই বিবাহ বিচ্ছেদ করে অন্য জায়গায় আবার বিয়ে দেবো। ◆ ঊর্বশী তার বড় বৌদি কে বলে :- আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে, ওই বাড়িতে তো ঠিকমত পেট ভরে খেতে পারি না। ◆ উর্বশীর বড় বৌদি বলে :- আজ খাসির মাংস রান্না করেছি পেট ভরে ভাত খাবি।  ◆ উর্বশীর ছোট বৌদি বলে :- আরে আমার ঘরে খাবি, আজ ইলিশ মাছ আর ওল চিংড়ি রান্না করেছি।  উর্বশীর বাবা মনে মনে ভাবে :- মেয়েটাকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোন খেলা খেলতে চলেছে। ঊর্বশীর সর্বনাশ করেই ছাড়বে। আমি তো এখন দুই বৌমার ঘরের ভাগের শশুর। আমার কপালে ডাল ভাত আলু ভাজা। ◆ অনীশ পরের দিন তার শশুর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ঊর্বশী ঊর্বশী বলে ডাকতে থাকে। ◆ ঊর্বশী ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে :-এখানে কি করতে এসেছে? ◆ অনীশ বলে :- তোমাকে নিতে এসেছি, তুমি আমার সাথে বাড়িতে ফিরে চলো। মা তোমার জন্য ভীষণ ভাবে চিন্তিত। ◆ ঊর্বশীর দুই বৌদি উঠানে উপস্থিত হয়ে বলে :- আমার ননদ তোমার সংসার করবে না আর বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজপত্র শীঘ্রই পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ◆ অনীশ তার স্ত্রী হাত ধরে বলে :- আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি কিন্তু তুমি আমাকে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা বলতে পারো না। ◆ ঊর্বশীর বড় বৌদি অনীশের কাছে থেকে তার ননদকে ছিনিয়ে নিয়ে বলে :- ভদ্রভাবে এখান থেকে না গেলে কিন্তু মেরে ধরে বের করে দেবে। আমার ননদের গায়ে হাত তোলা বধু নির্যাতন মামলা করব। মা ছেলেকে জেলের ঘানি টানতে হবে। ◆ অনীশ দ্রুত বেগে ছুটে ঊর্বশীকে জড়িয়ে ধরে বলে :- তুমি আমার দাম্পত্য সঙ্গী, আমি জোর করে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো-কে তোমাকে যেতে দেবে না,তা দেখে নেবো। ◆ সেই মুহূর্তে ঊর্বশীর দুই দাদা উপস্থিত হয়ে অনীশ কে তাদের বোনের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে মারধর করতে করতে বলে :- তোদের দারিদ্র পরিবারে আমার বোন আর যাবে না। বোনকে নতুন করে বিয়ে দিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দেবো। ◆ অনীশ ইছামতি নদীর তীরে কিছু সময় বসে ভাবতে থাকে। প্রদীপ হালদারের পরামর্শে দত্তপুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কৃষ্ণা বিশ্বাসের সাথে দেখা করে তাদের দাম্পত্য জীবনের ঘটনা জানায়। প্রধান সবকিছু শোনার পর বলে, আজ বৃহস্পতিবার কিন্তু রবিবারের দিন দুপুর বারোটার সময় আপনার শ্বশুর বাড়িতে উভয় পক্ষের আলোচনা সভা বসানো হবে। ◆ পাকা বাড়ির উঠানে কয়েকটি চেয়ার পেতে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভার সঞ্চালক বাবুল সাধুখাঁ বলে, অনীশ ও ঊর্বশী দাম্পত্য জীবনের এমনকি ঘটনা ঘটলো যে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে হবে। উক্ত বিষয়ে উভয় পক্ষের থেকে আলোচনা শোনা হবে। ◆ মেম্বার আনন্দ সাহা বলেন :- অনীশ তোমার বক্তব্য শুরু করো। ◆ অনীশ বলে :- করোনা ভাইরাসের কারণে আমার চাকরি চলে যায় আর দারিদ্রতা ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে। দারিদ্রতার কারণে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া দিতে পারিনি, এই দারিদ্রতা নিয়ে মাঝে মধ্যে ঝগড়া অশান্তি হয়েছে। ঊর্বশী তার দাদা বৌদি প্রচারণায় বিচ্ছেদের কথা ভাবছে কিন্তু আমি কখনোই বিবাহ দিচ্ছে করতে চাই না। আমি ঊর্বশীকে ভীষণভাবে ভালোবাসি। ◆ ঊর্বশীর বড়দা বলে :- আমার বোনের উপর ভীষণভাবে মারধর সহ অত্যাচার নির্যাতন করেছে।তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বোন ঊর্বশী পালিয়ে আমাদের বাড়ি চলে এসেছে। ঊর্বশী চাই তার স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হোক। ◆ অনীশ বলে :- এইসব মিথ্যে কথা, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমি ঊর্বশীকে কখনোই মারধর করিনি। ঊর্বশী তুমি তো সত্যি কথাটা বলো। ◆ ঊর্বশীর বড় বৌদি বলে :- শুধু কি তাই! অনীশ মদ পান করে ঘরে এসে ঊর্বশীর উপর অমানবিক অত্যাচার করে। কথায় বলে, অভাবে স্বভাব নষ্ট- জুয়া লটারি খেলা করে। তারপর ঊর্বশীর বাম হাতের কাপড় সরিয়ে কনুই নিচের দিকে থাকা কাটা দাগ সবাই কে দেখিয়ে আবার বলে, দেখুন দেখুন কিভাবে ঊর্বশীর উপর অত্যাচার করেছে। ◆ মেম্বার আনন্দ সাহা বলেন :- যাকে কেন্দ্র করে আজকের আলোচনা সভা ডাকা হয়েছে, সেই ঊর্বশী কে বলার জন্য বলছি।  ◆ দুই বৌদির মাঝে থাকা ঊর্বশী কে দুদিক থেকে ইশারায় খোঁচা দিয়ে বলে, অনীশকে দোষী সাব্যস্ত করার উপযুক্ত সময় এসেছে কিন্তু আর চুপচাপ থাকলে হবে না। ◆ ঊর্বশী একবার অনীশের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে :- দাদা বৌদি যা বলেছে তা সত্য, অনীশ আমার উপর ভীষণ ভাবে অত্যাচার করেছে তার জন্যই-আমি বিবাহ-বিচ্ছেদ করতে চাই। ◆ অনীশ বলে :- না না সব মিথ্যা কথা, আমি কখনোই ঊর্বশীর উপর অত্যাচার করিনি, আর মদ্যপান ও জুয়া খেলা করি না। ঊর্বশী শেষ পর্যন্ত তুমিও মিথ্যা কথা বলে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলে, এই ভালবাসার প্রতিদান।  ◆ ঊর্বশীর বাবা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন :- জামাইয়ের নামে এরকম বদনাম না দিলেও হয়তো ভালো হতো। ঊর্বশী তাদের দাদা বৌদির কথা শুনে অনীশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ◆ ঊর্বশীর বড়দা তার বাবাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে :- বোন ঊর্বশীর উপর হওয়া অত্যাচারের চিহ্নগুলো তো আর আপনাকে দেখাতে পারবে না। মা বেঁচে থাকলে হয়তো চিহ্ন গুলো দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠতো। এই বিষয়ে আপনার নাক গলাতে হবে না। ◆ পঞ্চায়েত প্রধান কৃষ্ণা বিশ্বাস বলেন :- সাক্ষী প্রমাণ সহ স্বয়ং অত্যাচারিত হওয়া উর্বশী যখন বলছে, তখন অনীশ কে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। ◆ বাবলু সাধুখাঁ বলে :- তাহলে বিবাহ-বিচ্ছেদের দিকেই এগিয়ে যাওয়া যাক। উর্বশীর অভিভাবকদের দাবি দাওয়া কি আছে? ◆ ঊর্বশীর ছোটদা বলে :- মীমাংসিত বিবাহ বিচ্ছেদ হলে মাত্র দশ লাখ টাকা দিতে হবে। না হলে কোর্টে গিয়ে অনীশের নামে বধূ নির্যাতন মামলা করা হবে। ◆ অনীশ বলে :- আমার কোন কাজকর্ম নেই বর্তমানে এক টাকা দেওয়ার কোন ক্ষমতা নেই।  ◆ উর্বশী বলে :- অত্যাচার করার সময় মনে ছিল না, আমার ১০ লাখ টাকায় চাই। ◆ দীর্ঘ সময় আলোচনার পর অঞ্চল প্রধান কৃষ্ণা বিশ্বাস বলেন :- অনীশ; তুমি টাকা কোথায় পাবে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়, যদি মীমাংসা করার ইচ্ছা থাকে তাহলে আগামী ১০ দিন পর চার লাখ টাকা নিয়ে মেম্বার আনন্দ সাহার বাড়িতে উপস্থিত হবে।  ◆ অনীশ বলে :- আমাকে কয়েক মাস সময় দিতে হবে আর উকিল ধরে কোর্টের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে হবে। পঞ্চায়েতের বিচার ব্যবস্থা আদালতে কোন মূল্য নেই। ◆ ঊর্বশীর বড়দা বলে :- কোট কাচারি মামলা করার কোন দরকার নেই, পঞ্চায়েতের রায় অনুসারে কাজ হোক। ◆ আবার কিছুক্ষণ জল্পনা-কল্পনা করার পর মেম্বার আনন্দ সাহা বলেন :- কোর্টের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করা হবে। দুই পক্ষের একই উকিল ধরলে কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। বিচার সভা আজকের মত এখানেই শেষ করা হলো।  ◆ অনীশ বাড়িতে আসার পর মা ঘটনা শোনার পর বলে :- চার লাখ টাকা কোথায় পাবি। ◆ অনীশ বলে :- মা; বউয়ের কারণে শেষ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষের ভিটেবাড়ি বিক্রি করে তার ঋণ শোধ করতে হবে।  ◆ অনীশের মা তার স্বামীর উদ্দেশ্য করে বলে :- তোমার বংশধরদের রেখে যাওয়া ধন সম্পত্তি আমি রক্ষা করতে পারলাম না। এখন ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাব কোথায় থাকবো। ◆ অনীশ বলে :- মা; বিরাট পৃথিবীর মাঝে কোথাও না কোথাও, আমাদের থাকার জায়গা হয়ে যাবে। আমি দিনমজুর কাজ করে তোমার থাকা খাওয়া সহ সব রকম ব্যবস্থা করব।  ◆ অনীশের এক বন্ধুর পরামর্শে একজন উচ্চপদস্থ নেতার মাধ্যমে এলাকার বিধায়ক সমীর পোদ্দার মহাশয় কাছে উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে বলে :- আমার ভিটেবাড়ি আপনার কাছে বিক্রি করতে চাই। ◆ বিধায়ক সমীর পোদ্দার বলেন :- তোমার ভিটেবাড়ি ন্যায্য টাকা দেওয়া হবে কিন্তু পাঁচ বছরের মধ্যে যদি আমার সম্পূর্ণ টাকা বিনা সুদে শোধ করতে পারো, তাহলে তোমার ভিটেবাড়ি ফেরত দিয়ে দেবে। এলাকার বিধায়ক হিসাবে পাঁচ জনের সামনে প্রতিজ্ঞা করছি। মানুষের বিপদে তাদের পাশে থেকে সাহায্য করা আমার কাজ। ◆ অনীশ হাত জোড় করে বলে :- বিধায়ক মহাশয়; বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা যতদিন না মীমাংসা হচ্ছে, ততদিন আপনার ওই বাড়িতে আমাদের বসবাস করতে দিতে হবে। ◆ বিধায়ক সমীর পোদ্দার তার কয়েকজন কাছের মানুষের সাথে পরামর্শ করে বলেন :- বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা মীমাংসা হতে মাস ছয়েক লাগবে ততদিন ঐ বাড়িতে বসবাস করে। ◆ ঊর্বশী ও অনীশের বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পর ঊর্বশীর হাতে ৪ লাখ টাকা চলে আসে। বিছানায় বসে টাকাগুলো হাতে নিয়ে বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিগুলো স্মরণ করতে থাকে। ◆ ঊর্বশীর দুই দাদা ও দুই বৌদি ঘরে ঢুকে তার বড়দা ঊর্বশীর হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে বলে :- এতগুলো টাকা হাতে নিয়ে কি ভাবছিস! তারপর টাকাগুলো চারজনের মধ্যে ভাগ করতে থাকে। ◆ ঊর্বশী বলে :- আমার টাকাগুলো তোমরা ভাগ করে নিলে।  ◆ বড় বৌদি সুনন্দা বলে :- এক জায়গায় রাখলে যদি চুরি হয়ে যায় তাহলে সব টাকায় চলে যাব। সেই জন্য সবার কাছেই টাকা রেখে দিলাম।  ◆ ঊর্বশীর ছোটদা বলে :- ঊর্বশী ভীষণভাবে চিন্তিত ওকে নিরিবিলি থাকতে দাও, আর সবাই যার যার ঘরে চলে যাও।  ◆ ঊর্বশী ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে ভাবে :- অকারণে স্বামীর সাথে ঝগড়া করে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘাঁটানো ঠিক হয়নি।দাদা বৌদি অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে অনুভব করছি, স্বামীর থেকে আপন কেউ হয় না। যত ঝগড়া অশান্তি হোক না কেন! একজন আরেকজনের পরিপূরক। বড় বৌদির ছোট ভাই ধনঞ্জয় আমাকে ধর্ষণ করলো কিন্তু সব দোষ আমার ঘাড়ে দিয়ে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বৌদি মিলে নতুনভাবে অত্যাচার শুরু করল। বাবার তৈরি পাকা ঘরে আমার থাকার জায়গা নেই। বাড়ির পরিত্যক্ত একটি ঘরে আমার থাকার জায়গা আর বিবাহ বিচ্ছেদের পর আমি বাড়ি কাজের মহিলা। সবার জন্য বিভিন্ন পদে পদে রান্না করি কিন্তু পেট ভরে দুমুঠো ভাত খেতে দেয় না।   ◆ বড় বৌদি সুনন্দা উত্তেজিত হয়ে ঊর্বশীর থাকা ঘরে ঢুকে বলে :- মহারানী এখনো ঘুমাচ্ছেন, রাতের রান্না তোর মরা মা এসে করে দিয়ে যাবে। ঢং দেখে আর বাঁচিয়ে, বিবাহ বিচ্ছেদেরই মহিলা আবার শাখা সিঁদুর পড়ে সতী সাবিত্রী সেজেছে। ঘরে পুরুষ ঢোকালে হাজার হাজার টাকা আয় রোজগার হবে আবার যৌবন জ্বালা মিটে যাবে। বেশ্য মাগি আমার সরল সোজা ভাই কে তোর রূপের ফাঁদে জড়িয়ে বদনাম করলি। তোর ভাগ্য ভালো এখনো ঝেটিয়ে বিদায় করিনি। ◆ দীর্ঘ কয়েক বছর পর ঊর্বশী কৃষ্ণনগর শহরের ফুটপাতের রাস্তা দিয়ে চলার সময় একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি তার সামনে এসে বলে :- মা; আমি ক্ষুধার্ত আমাকে কিছু খেতে দেবে। ◆ বাবা বলে জড়িয়ে ধরে ঊর্বশী বলে :- তোমার এই অবস্থা কেন?  ◆ উর্বশীর বাবা তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে :- তুই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ৬ মাস পর আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ◆ ঊর্বশী বলে :- বাবা; দাদা বৌদি তাড়িয়ে দিলোও কিন্তু আমি তো তোমার মেয়ে। আমার সাথে চলো, এখন থেকে দুজনে একসাথে থাকবো। বাবা; আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে কখনোই ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেবো না। ◆ ভাড়া বাড়িতে আসার পর উর্বশীর বাবা খাওয়া দাওয়া করে সুস্থ হয়ে বলে :- বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে কোথায় ছিলি। ◆ আড়ংঘাটা বাসিন্দা মদন বিশ্বাসের সাথে ফেসবুকে প্রথম পরিচয় ঘটে তারপর হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভিডিও কলে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দাদা বৌদির অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে মদনের সাথে পালিয়ে নবদ্বীপ গঙ্গার ধারে একটি পাড়ায় ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু হয়। এক বছর সংসার করার পর মদনের গোপন অভিসন্ধি বুঝতে পারি। প্রতিদিন নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে বাড়িতে মদ পান করতে শুরু করে। মদন মদ পান করে তার বন্ধুদের সাথে শয্যাশায়ী হওয়ার জন্য বলে কিন্তু আমি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মারধর করতে থাকে। এক রাতে মদনকে মারধর করে আমি পালিয়ে গঙ্গার ধারে আত্মহত্যা করার জন্য উপস্থিত হয়। গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে যাবো, এমন সময় দায়িত্বশীল কর্তব্যরত একজন পুলিশ আমাকে বাঁচায়। সেই রাতে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। পুলিশ বিমল বাবু আমার কাছে সবকিছু শোনার পর মদন কে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়।  ◆ এরপর বিমল বাবু দিদি করুণাময়ী ভট্টাচার্য কৃষ্ণনগর জেলা আদালতের একজন উকিল। বি এ পাস জেনে তার অফিসে আমাকে কাজ দেয়। পরবর্তীতে আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার সহকর্মী হিসাবে রাখেন। বিমল বাবুর কাকা শশাঙ্ক বাবু একজন বড় পুলিশ অফিসার। তার সহযোগিতায় আট মাস আগে প্রশাসনের একজন মহিলা পুলিশ কর্মী হিসাবে নিয়োগ পায়। বর্তমান নদীয়া জেলার পলাশীপাড়া থানার অধীনে কর্মে আছি। আচ্ছা বাবা অনিশের কোন খবর জানো। ◆ উর্বশীর বাবা বলেন :- শুনেছি, সাত বছর আগে বিবাহ বিচ্ছেদের চার লাখ টাকা মেটানোর জন্য ভিটেবাড়ি বিক্রি করে বিবাহ বিচ্ছেদের পর গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে। অনীশের মতো ছেলে দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় না। ◆ ঊর্বশী বলে :- বাবা; দাদা বৌদির কথা শুনে নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে নিয়ে এসেছি। অভিভাবকহীন হয়ে বেঁচে থাকার জন্য সমাজের বুকে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। পদে পদে বিপদ তা আমার জীবনে অনুভব করেছি।  ◆ কয়েক মাস পর ঊর্বশী ছুটিতে বাড়ির বারান্দায় চেয়ারে বসে দৈনিক খবরের কাগজ পড়তে শুরু করে। কাজের মাসি চা বিস্কুট টেবিলের উপর রেখে তার কাজে চলে যায়। চায়ের চুমুক দিয়ে খবরের কাগজের এক জায়গায় চোখ আটকে যায়। কয়েকবার ঘটনা পড়ার পর বাবা বাবা বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকে।  ◆ ঊর্বশীর বাবা দ্রুত বেগে ছুটে এসে বলেন :- কি হয়েছে মা? চিৎকার করছিস।  ◆ ঊর্বশী খবরের কাগজ দেখিয়ে বলে :- জমি বাড়ি সংক্রান্ত ঝামেলায় ছোট দাদা, বড়দা কে শাবল দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলেছে। পুলিশ দাদা বৌদিকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেছে।  ◆ ঊর্বশীর বাবা কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন :- উভয়ের পাপের সাজা পেয়েছে। তোর টাকা পয়সা নিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছে আবার আমার দিয়ে জোর করে জমি বাড়ি লিখে নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি এরকম অপদার্থ ছেলে বৌমার মুখ দেখতে চাই না। ◆ ঊর্বশী বলে :- তবুও তোমার সন্তান, একবার দেখা করে তোমার কর্তব্য করে। মোবাইল হাতে নিয়ে ধানতলা থানায় কল করে কথা বলতে শুরু করে। ◆ নদীয়া জেলার কল্যাণী অনেক ব্যস্ততম শহর, পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় মহাশয় কল্যাণীকে আধুনিক শহরের রূপান্তরিত করেন। ঊর্বশী ব্যস্ততম রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটি বাচ্চা মেয়ে দ্রুত রাস্তা পার হচ্ছে আর পিছন দিক থেকে একটি প্রাইভেট গাড়ি ছুটে আসছে। ঊর্বশী দৌড়াতে দৌড়াতে বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে রাস্তার অপর পাশে গড়াগড়ি দিতে থাকে। হঠাৎ করে চলন্ত গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে পড়ে আর যানজটের সৃষ্টি হয়। পথচারী লোকজন ছুটে আসে। ঊর্বশীর শরীরে আঘাত লাগলো মেয়েটি অক্ষত আছে। মেয়েটির মা দ্রুত বেগে ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। ◆ মেয়েটির মা ঊর্বশীকে প্রশংসা করে বলে :- আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছে, আপনার দেহ থেকে রক্ত ঝরছে চলুন ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়।  ◆ ডাক্তার-খানা থেকে বেরোনোর পর মেয়েটির মা বলে :- পাশেই আমাদের বাড়ি চলুন একটু বেরিয়ে যাবেন। ঊর্বশী আলাপ পরিচয়ের মাধ্যমে জানতে পারে উদ্ধারকারী মেয়েটির মায়ের নাম ইন্দিরা।  ◆ ঊর্বশী কে সোফায় বসতে দিয়ে, কিছু সময় পর ইন্দিরা জলখাবার নিয়ে ফিরে আসে। ইন্দিরার স্বামী মেয়ের দুর্ঘটনার কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে এসে দরজা খুলে ঊর্বশী কে দেখেই থমকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।  ◆ মেয়েটি দ্রুত বেগে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে :- বাবা; এই মাসি আমাকে বাঁচিয়েছে। ◆ ইন্দিরা তার স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে বলে :- তুমি একদম চুপচাপ হয়ে গেলে কিন্তু তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে!  ◆ ঊর্বশীর উদ্দেশ্য করে অনীশ বলে :- দশ বছর পর আবার কোন মতলব নিয়ে এই বাড়িতে ঢুকেছে। আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। আমার সর্বস্বান্ত করে তবুও তোমার আশা মেটেনি। ◆ ইন্দিরা তার স্বামীর উদ্দেশ্য করে বলে :- তুমি এই ভদ্রমহিলাকে চেনো।  ◆ অনীশ রাগান্বিত হয়ে বলে :- আমার সর্বনাশকারীকে কখনোই ভুলতে পারি। ঊর্বশী এক সময় আমার স্ত্রী ছিল কিন্তু আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সমাজের বুকে দোষী সাব্যস্ত করে। বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করে চার লাখ টাকা আমার কাছ থেকে নিয়েছে, আমার চৌদ্দ পুরুষের ভিটে বিক্রি করে সর্বস্বান্ত যাযাবর হয়েছিলাম। সুখের মুখ দেখেছি তাই খোঁজখবর নিয়ে আবার সর্বনাশ করার জন্য উদ্ধার কর্তা সেজে বাড়িতে এসেছে। ◆ ঊর্বশী চোখের জল ঝরিয়ে বলে :- আমার অপরাধের সাজা আমি বহুদিন ধরে পেয়েছি। আমার অপরাধ তুমি ক্ষমা করে দাও। দাদা বৌদি প্রতারণার ফাঁদে পড়ে তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম কিন্তু একটি টাকাও ভোগ করতে পারেনি। দুই দাদা বৌদি সব টাকা জোর করে কেড়ে নিয়ে কিন্তু আমাকে বাড়ির কাজের মেয়ে বানিয়েছিল। নারীর জীবনে স্বামী ব্যতীত অন্য কোথাও সুখ নেই তা আমি পদে পদে উপলব্ধি করেছি।  ◆ হঠাৎ করে খোলা দরজা দিয়ে কয়েকজন পুলিশ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে, অনীশ ও ইন্দিরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে। অনীশ পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা আমার বাড়িতে। ◆ একজন পুলিশ উর্বশীকে সম্মান জানিয়ে বলে :- ম্যাডাম; আপনার দুর্ঘটনা ঘটেছে তা থানায় ফোন তো করে জানাবেন। তারপর অনীশের দিকে তাকিয়ে বলে, এই ম্যাডাম কে কল্যাণী থানায় কর্তব্যরত অফিসার পদে আজ যোগদান করার কথা ছিল। টহলরত পুলিশের মাধ্যমে খোঁজ নিতে নিতে এই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি।◆ ইন্দিরা ব্যস্ত হয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে :- আপনারা বসুন, চা জল খাবারের ব্যবস্থা করি। এই ম্যাডাম আজ আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছে।◆ পুলিশ কর্মীগণ বেরিয়ে যেতে অনীশ বলে :- তাহলে তুমি পুলিশের চাকরি কর। ◆ ইন্দিরা বলে :- দিদি; তাহলে দ্বিতীয় সংসারে ছেলে মেয়ে কয়জন। ◆ ঊর্বশী বলে :- আমার দ্বিতীয় সংসার বলে কিছু নেই, বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও অনীশ কে আমার স্বামী বলে জানি। চাকরির ক্ষেত্রেও স্বামী অনীশ নাম ব্যবহার করেছি, তার জন্যই আজও শাঁখা সিঁদুর ব্যবহার করে চলেছি। বোন ইন্দিরা; আমি তোমার সংসার ভাঙার জন্য আসিনি। বলে দ্রুত বেগে উঠে দরজা পেরিয়ে উঠানে রাখা পুলিশ গাড়িতে উঠে বসে।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~◆ রচনাকাল :- ৮ মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ। ◆ স্থান :- কমলেশ চক্রবর্তী বাড়ি মুড়াগাছা, বগুলা, নদীয়া। ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
    ARE YOU READY? - Debasis Sarkar | মাদাদায়ো (Not yet) উল্লিখিত জাপানি শব্দটির অর্থ - না, এখনই নয়। আপনি কি প্রস্তুত? "লুকোচুরি খেলা চলে ষাট ছুঁলে খেলা চলতেই থাকে প্রত্যেক মৃত্যুর সংবাদ ডেকে বলে, রেডি? লুকোতে লুকোতে সে বলে ওঠে,না, এখনো তো নই "....... মাদাদায়ো শব্দের অর্থ এটাই, না এখনই নয়। প্রতিবছর হায়াক্কেন উদিচা 'র ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রিয় শিক্ষকের সম্মানে জন্মদিনের একটা ছোটখাটো উৎসব পালন করতো। সমবেত কন্ঠে চিৎকার করে তারা জিজ্ঞেস করত, '' মাধাকাই? (আপনি কি প্রস্তুত?) এক গ্লাস বিয়ার নিঃশেষে শেষ করে পৌঢ় শিক্ষক উত্তর দিতেন, " মাদাদায়ো " (এখনও তো নই ) ষাটোর্ধ ব্যক্তিদের জন্যে।
  • ভাট...
    commentদীপ | "যেমন, এলেবেলে এক সময়ে লাগাতার ট্রোলড হয়েছেন (এখনও হন) কারন উনি বিদ্যাসাগর, রামমোহন ইত্যাদিদের নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন, সে নিয়ে গবেষণা করে বই লিখেছেন। ওনার ভিন্ন মত অনেকে হজম করতে পারেনি, অথচ এলেবেলের লেখার পাল্টা যুক্তিও দিতে পারেনি, তাই ট্রোল করে খার মিটিয়েছে।"
     
    এলেবেলে মহোদয়ের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা একাধিকবার তথ্য সহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। 
    মহাপণ্ডিতের ঘটে সেসব ঢোকেনি।
     
    বিবেকানন্দ সম্পর্কে একজনের জ্ঞান বিবেকানন্দ মাথায় উঠে মারা গিয়েছিল। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে জ্ঞান‌ও সেইরকম। 
    সে আবার জ্ঞান দিতে এসেছে! 
     
    commentdc | যদুবাবু, ব্যাপক! মেড মাই ডে laugh
    commentযদুবাবু | আমিও ইগ্নোর-ই করি। সেটা অবশ্য কিছুটা এই জন্য যে এর থেকে অনেক নোংরা খিস্তিটিস্তি খেয়েই বড়ো হয়েছি, আর কিছুটা এই জন্য যে +- থ্রি সিগমার বাইরে তক্কানোর জন্য প্রচুর এনথু লাগে। অত এনথু নেই। প্লাস হোয়া+ফেবু মিলিয়ে চাড্ডিদের থ্রেট-ফ্রেট-ও তো কম খাইনি। তার মধ্যে কেউ কেউ আবার নাড়ুপুরের ক্লাসমেট। (দীর্ঘশ্বাস!)  যাইহোক, "চিকেন পার্টি" শুনুন। অখাইদ্য গান, কিন্তু তাতে কী? আমার হেব্বি মজা লেগেছে। 
     
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত