এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ভ্রান্তিপর্বত শান্তিতীর্থ - নন্দিনী সেনগুপ্ত | ৪এই মুহূর্তে বার বার একটা নাম শোনা যাচ্ছে। সোনাম ওয়াংচুক। অনেকেই হয়তো বলবেন যে লাদাখ নিয়ে নতুন রাজনীতির আবর্ত তৈরি হচ্ছে এই নামটিকে ঘিরে। কিন্তু যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেটা সফল হলে এবং বিভিন্ন জায়গায় আরও কয়েক দশক আগে শুরু হলে হিমালয়ের প্রকৃতি কিছুটা হলেও বাঁচত। হিমালয়ের সামগ্রিক ভূ-প্রকৃতি তথা বাস্তুতন্ত্র এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের সুতোয় ঝুলছে বহুযুগ ধরেই। যদি লাদাখের উদাহরণ ধরি, সেখানে কিছুদিন আগেও সেখানে বসবাসরত জনজাতিদের জীবিকা ছিল মূলত অল্প স্বল্প চাষাবাদ এবং গবাদি পশুপালন ইত্যাদি। ট্যুরিজম খুব জনপ্রিয় ছিল না ব্যাপক অর্থে। কারণ কঠিন আবহাওয়া। এই আবহাওয়ার কারণেই চাষাবাদ এবং পশুচারণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি খুব বেশি নয় লাদাখে। মাটির সবুজ অংশ বেশি নয়। স্নো লাইন শুরু হওয়া মাত্র সেখানে আর গাছপালা জন্মাবে না। অর্থাৎ যেটুকু সবুজ অংশ রয়েছে, সেখানেই করতে হবে চাষাবাদ এবং পশুচারণ। আবার এই অঞ্চলে স্নো-লেপার্ড যদি হ্রাস পায়, সেটার প্রভাব বাস্তুতন্ত্রে পড়বে। তাহলে গবাদি পশু অতিরিক্ত বেড়ে যাবে এবং তারা চারণভূমির সব সবুজ খেয়ে শেষ করে দেবে। এই সবুজ তৃণভূমির প্রতিটি তৃণখণ্ড, প্রতিটি গাছের শিকড় আবার পাহাড়ের মাটির ঢালের স্থিতিশীলতা ঠিকঠাক ধরে রাখবার জন্য ভীষণ জরুরি। অর্থাৎ এই অঞ্চলের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের এই সূক্ষ্ম সুতোটা ছিঁড়ে গেলে এই ভূ-প্রকৃতির ধ্বংস অনিবার্য। জনঘনত্বের তুলনায় এই ভূমিসম্পদ লাদাখের ক্ষেত্রে খুব বেশি এমন বলা যাবে না। কারণ ভূমির মধ্যে একটা বড় অংশ সবুজ নয়। এবার সবুজ জমির একটা অংশ যদি শক্তি উৎপাদনের জন্য সোলার প্যানেল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, সেই উন্নয়ন কিন্তু জনজাতির জন্য অর্থহীন। অনেকেই বলবেন যে সোলার প্যানেল তো পরিবেশবান্ধব শক্তির আকর। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করলে নদী যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এক্ষেত্রে অন্তত সেটা হবে না। আসলে উন্নয়ন বলতে সভ্য মানুষের মনে যে ধারণা রয়েছে, সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে হিমালয়ের উন্নয়নে যদি মানুষ ব্রতী হয়, তিনি হিমালয়ের বিরাট ক্ষতি করে দেবেন। হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা ছাড়াও বুঝতে হবে আঞ্চলিক মানুষ, জনজাতি তাদের প্রকৃত চাহিদা কী? উন্নয়নের ফলে যদি জনজাতির অস্তিত্বই ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে যায়, তাহলে সেই উন্নয়ন আসলে ঠিক কোন মানুষদের জন্য?অতীতে লাদাখে ট্যুরিজমের বাড়বাড়ন্ত ছিল না। হোটেল, গেস্ট হাউস ইত্যাদির সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। ফলে জীবিকা হিসেবে ট্যুরিজমের উপরে স্থানীয় অধিবাসীদের নির্ভরতাও ছিল না। সময় বদলাচ্ছে। অনেক বেশি মানুষ টুরিস্ট হিসেবে ভিড় জমাচ্ছেন লাদাখে। প্রতিকূল আবহাওয়াতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানুষ চলে যাচ্ছেন বেড়াতে, ট্রেকিং করতে। ফলে টুরিস্টদের থাকবার উপযুক্ত হোটেল তৈরি হচ্ছে জোরকদমে। পাহাড়ের ঢালে বিল্ডিং বানানোর ঝুঁকি থাকেই ধসপ্রবণ, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়। সেসব ঝুঁকি উড়িয়ে কাজ চলছে। ট্যুরিস্ট আগমন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ঘটছে অদ্ভুত কিছু সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল জল।জলের সমস্যা লাদাখে নতুন নয়। লাদাখ শুষ্ক অঞ্চল; বলা হয় ‘শীতল মরু’। ২০১০ সালে কুলুম অঞ্চলে মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ভয়াবহ বন্যা হয়। হিমবাহ-পুষ্ট নদীগুলি ফুলে ফেঁপে ভাসিয়ে দিয়েছিল গ্রাম। একদিন সরে গেল বন্যার জল। কিন্তু হিমবাহ অনেকটা সরে গেছে পিছনে। নদীগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। অবধারিত ফল খরা। ২০১২ সাল থেকেই দলে দলে মানুষ বেরিয়ে যেতে থাকে গ্রাম থেকে। জল ছাড়া মানুষ কী ভাবে বাঁচবে? ভারতের ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে, অর্থাৎ হিন্দুকুশ হিমালয়ে, বছরে প্রায় ১৫ মিটার করে হিমবাহ গলে গলে পিছিয়ে যাচ্ছে। আপার কুলুম সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। কোনো মানুষ সেখানে থাকে না। লোয়ার কুলুমে কয়েকঘর এখনও আছে। অল্পস্বল্প যে ফোরাতগুলো জীবিত আছে এখনও, সেই ফোরাত বা ঝর্নার জলে তারা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু সেটা কতদিন তারা করতে পারবে, সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে। এত সমস্যার মধ্যেও কিছুই কি আশার কথা নেই? আছে। ২০২২ সালে লাদাখবাসীরা সোনম ওয়াংচুকের দেখানো পথে কৃত্রিম হিমবাহ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। তবে সে কাজ অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইতে তারা সে কাজ করেছিল। কিন্তু এমন অবস্থায় সেই অঞ্চলে ট্যুরিস্ট বেড়ে যাবার অর্থ হল সেখানে জনসংখ্যার চাপ বেড়ে যাওয়া। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট জল লাদাখে পাওয়া মুশকিল। ট্যুরিস্টদের সঠিক পরিষেবা দিতে হলে স্বাভাবিক কারণেই সেখানকার অধিবাসীদের জন্য বরাদ্দ জলে টান পড়বে। সেখানকার অধিবাসীরা সেইজন্য খোলা মনে সব সময় ট্যুরিস্টদের স্বাগত জানাবেন, এমনটি না ভাবাই ভালো।লাদাখের আরেকটি যে সমস্যা বড় আকার ধারণ করতে চলেছে, তা হল দূষণ। অতীতে রাস্তা থাকলেও খুব বেশি গাড়ির আনাগোনা ছিল না। সীমান্ত সুরক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর গাড়ির যাতায়াত ছিল সেই পথে। এখন জায়গায় জায়গায় সেই পথ চওড়া করা হচ্ছে। বাড়ছে ট্যুরিস্টদের গাড়ির আনাগোনা। দূষণহীন যে ঝকঝকে আকাশ দেখা যেত লাদাখে, সেই নীলের গায়ে কি লাগছে ধূসরতা? হ্যাঁ, সেটা খুবই স্বাভাবিক। গাড়ির সংখ্যা বাড়লে সেই গাড়ির ধোঁয়া থেকে বাতাস দূষিত হবেই।এছাড়া যে সমস্যা লাদাখে বিশাল আকার ধারণ করছে, তা হল বর্জ্য। সুদূর অতীতে লাদাখের জনজাতি বর্জ্য রিসাইকেল করে ফেলত। অর্থাৎ প্রায় বর্জ্যবিহীন জীবন যাপন করত। আবহাওয়ার কারণে, জলের অপ্রতুলতার কারণে তাদের বর্জ্য সামলানোর পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ট্যুরিস্ট বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বর্জ্য বেড়েছে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সামলানোর পরিকাঠামো লাদাখে নেই বললেই চলে। গ্রীষ্মে ট্যুরিস্ট সিজনে অস্বাভাবিক বেড়ে যায় প্লাস্টিক বর্জ্য। সারা পৃথিবীর মানুষ এসে ভিড় জমাচ্ছে। জল খেয়ে যে খালি বোতলটা ট্যুরিস্ট জঞ্জালের বাক্সে ফেলে দিয়ে যাচ্ছেন, সেই একটা বোতলও যে হিমালয়ের পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী, এই বোধ কবে জাগ্রত হবে সভ্য মানুষের মনে? আসলে মানুষ নিজের কাঁধ থেকে দায় ঝেড়ে ফেলে বলে যে সরকার কেন সিস্টেম তৈরি করেনি বর্জ্য সামলানোর জন্য? একটা সিস্টেম গড়ে উঠতেও সময় লাগে এবং সেই সিস্টেম তো মানুষের দ্বারাই তৈরি। অলীক জাদুকাঠি লাগানো কোনো যন্ত্র এসে সব বর্জ্য ছুমন্তরে উড়িয়ে রাতারাতি হাওয়া করে দিতে পারবে না। শুধু তো পাহাড় নয়, পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানুষ থাকুক না কেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব দায় সে এড়িয়ে যেতে পারে না। তাহলে কি হিমালয়ের পরিবেশ বাঁচানোর জন্য সব উন্নয়ন বন্ধ করে দিতে হবে? না, সেটাও সঠিক কথা নয়। আসলে চটজলদি উন্নয়নের মোহের ফাঁদ এড়িয়ে চলতে হবে। যে উন্নয়ন হিমালয়ের প্রকৃতিকে নষ্ট করবে না, অথচ মানুষের জীবনের মান ভালো করবে, এমন সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি। প্রকৃতির হাত ধরতে হবে। রাজনীতির কারবারীদের মধ্যে চটজলদি কিছু করে দেখানোর নেশা থাকে, যাতে মানুষকে রাতারাতি প্রভাবিত করা যায়। সেও যে একরকম চালাকি, তাতে সন্দেহ নেই। হিমালয়ের প্রকৃতিতে এমন চালাকির কোনো জায়গা নেই। ফলে রাজনীতির পন্থা যেমনই হোক, তা যদি হিমালয়ের প্রকৃতি এবং চাহিদা বুঝে চলতে না পারে, সেই পথও বেশিদিন সুগম থাকবে না। ক্রমশ
    সিএএ-র ফাঁদে মতুয়ারা - শান্তনীল রায় | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়বাংলার উদ্বাস্তু প্রধান এলাকাগুলিতে কান পাতলেই শোনা যায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে নানা গুঞ্জন। চব্বিশের লোকসভা ভোটে এই অঞ্চলগুলিতে জিততে বিজেপির মাস্টার্স স্ট্রোক এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)।বিজেপি বারবার করে বলছে, সিএএ নাগরিকত্ব প্রদানের আইন, নাগরিকত্ব হরণের নয়। আর সেই আশাতেই বুক বেঁধেছে এক বিরাট সংখ্যক উদ্বাস্তু মানুষ। সিএএ-র বিষয়ে সম্যক ধারণা ছাড়াই। তবে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত সাহ দেশবাসীকে যেভাবে ক্রোনোলজি বুঝিয়েছিলেন, তা থেকে অতি সহজেই অনুমান করা যায় যে বিজেপির মনোবাসনা কেবল সিএএ -তে থেমে থাকবার নয়। প্রথমে সিএএ, তারপর এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জী)। আর যার পরিণতি হতে পারে উদ্বাস্তুদের জন্য ভয়ানক।উদ্বাস্তু মতুয়াদের নি:শর্ত নাগরিকত্বের দাবি আজকের নয়। বিজেপি ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে আসলে, ভিটে ছেড়ে একবার বে-নাগরিক হওয়া কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষের নাগরিকত্ব পুনরায় প্রশ্নের মুখে পড়ে। ২০০৪ সালে নাগরিকত্বের দাবিতে তারা সেসময় প্রথম আন্দোলনে নামে। নাগরিকত্বের ইস্যুতে মতুয়াদের প্রথম আন্দোলন ছিলো বিজেপির বিরুদ্ধেই। বাংলার সাম্প্রতিক রাজনীতিতে মতুয়া তথা নম:শূদ্র সম্প্রদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এই প্রান্তিক উদ্বাস্তু মানুষদের প্রতি সিপিআইএমের দীর্ঘ উদাসীনতাই মমতা ব্যানার্জিকে তাদের কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলো। তিনি বুঝেছিলেন, উদ্বাস্তু প্রধান অঞ্চলগুলিতে জিততে হলে প্রয়োজন ঠাকুরবাড়ির সমর্থন। এর জন্য তিনি দুটো কাজ করেন। এক, ঠাকুর বাড়ির সাথে যোগাযোগ বাড়ান; দুই, উদ্বাস্তু মতুয়াদের নাগরিকত্বের সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দেন। ফলস্বরূপ ঢেলে মতুয়া ভোট পায় তৃণমূল। কপিলকৃষ্ণ ঠকুরকে মন্ত্রী করা হয়। কিন্তু সমস্যা সমস্যা হয়েই থেকে যায়।এরপর মতুয়া ভোটকে কুক্ষিগত করতে কয়েক বছরের মধ্যেই মাঠে নামে বিজেপি। মতুয়াদের কাছে বিজেপির নানান প্রতিশ্রুতির মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে নাগরিকত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি। ২০১৯ -এর লোকসভা ভোটের আগে মতুয়া ভোটকে নিজেদের দিকে টানতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের ওরাকান্দিতে অবস্থিত মতুয়াদের মূল ধর্মীয় মন্দিরে ভ্রমণ করেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একাধিকবার জনসভা করেন ঠাকুরনগরে। বকলমে কথা দেন তাঁরা নাগরিকত্বের জট কাটাবেন। আর সেই আশাতেই এক বড়ো অংশের মতুয়া ভোট বিজেপির দিকে ঘুরতে থাকে। আশা একটাই -নি:শর্ত নাগরিকত্ব। কিন্তু সিএএ কি সত্যিই তাদের নি:শর্ত নাগরিকত্ব দেবে? উত্তর হলো – একেবারেই না। সিএএ শর্তসাপেক্ষ নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলে। দু-হাজার চোদ্দো সালের একত্রিশে ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্থান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারনে পালিয়ে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শরনার্থীদের বিভিন্ন শর্তে নাগরিকত্ব প্রদান করবে কেন্দ্র। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতবর্ষে এই প্রথম। নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের এই নির্বাচিত সহৃদয়তার আইনি স্বীকৃতি এক কথায় নজিরবিহীন। নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য চোদ্দো সালের একত্রিশে ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কারণ এরপর সে-সব দেশের সংখ্যালঘুদের উপর যে কোনো অত্যাচার হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিএএ -র অধীনে নাগরিকত্বের আবেদন করতে গেলে একজন উদ্বাস্তুকে প্রমান করতে হবে যে সে আদতেই বাংলাদেশ, পাকিস্থান বা আফগানিস্থানের নাগরিক। প্রমাণ হিসেবে দেখাতে হবে ওই তিনের কোনো একটি দেশের সরকার প্রদত্ত পরিচয় পত্র, পাসপোর্ট, জমির দলিল, স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট ইত্যাদির কোনো একটি। অথবা ভারতে প্রবেশের সময় বর্ডার থেকে দেওয়া বর্ডার স্লিপ। কিন্তু শরণার্থী মানুষদের বেশিরভাগেরই সেসব কাগজ নেই। কেনো নেই সে প্রশ্ন অবান্তর। তাছাড়া, অন্য দেশের সরকার প্রদত্ত সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, দলিল ইত্যাদির সত্যতা ভারত সরকার যাচাই করতে পারে কি? সেক্ষেত্রে সাহায্য নিতে হবে সেসব দেশের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে জানিয়েছে যে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে তাদের দেশের একজন নাগরিকও ভারতে আসেনি। তাহলে উদ্বাস্তুদের দ্বারা প্রদান করা কাগজের সত্যতা যাচাই হবে কীভাবে? উনিশ সালের সাতই জানুয়ারি জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি সিএবি (নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল) সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পার্লামেন্টে পেশ করেছিলো। ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো কমিটিকে জানিয়েছে, ৩১,৩১৩ জন শরণার্থী যারা ভারত সরকারের কাছে নাগরিকত্বের আবেদন করেছিলো এবং ভারত সরকার যাদের দীর্ঘ মেয়াদি ভিসা প্রদান করেছিলো, কেবলমাত্র তারাই এই আইন থেকে সুবিধা পাবে। তবে এই ৩১,৩১৩ জন আবেদনকারীর বেশিরভাগই বাংলার উদ্বাস্তু নয়। তাছাড়া গোটা দেশে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা কয়েক কোটি।সিএএ -র পোর্টালে করা আবেদনগুলি প্রথমে তদন্ত করবে নির্দিষ্ট জেলাস্তর কমিটির মাথায় থাকা ডেসিগনেটেড অফিসার। এরপর সে তার মতামতসহ আবেদনটিকে এমপাওয়ার্ড কমিটির কাছে পাঠাবে। কোনো ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কিনা সেটা ঠিক করবে এই এমপাওয়ার্ড কমিটি। সম্প্রতি উনচল্লিশ পাতার নাগরিকত্ব সংশোধনী নিয়মাবলি প্রকাশ করেছে কেন্দ্র। সেই নিয়ম অনুযায়ী, একজন উদ্বাস্তুকে এফিডেভিট করে রাষ্ট্রকে জানাতে হবে যে সে বাংলাদেশ, পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানের নাগরিক। ধরে নেওয়া যাক, কোনো ব্যক্তি সিএএ -র আবেদন করলো এবং এফিডেভিটের মাধ্যমে লিখে দিলো, সে ভারতের নাগরিক নয়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানের নাগরিক। এবং প্রমাণপত্রের অভাবে বা অন্য কোনো কারণে এমপাওয়ার্ড কমিটি তার নাগরিকত্বের আবেদন খারিজ করে দিলো। পরবর্তীতে কেন্দ্র এনআরসি নিয়ে আসলে ওই বে-নাগরিক হওয়া ব্যক্তির ভবিষ্যৎ কী হবে? বেশিরভাগ উদ্বাস্তু পরিবারেরই ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি রয়েছে৷ সিএএ এবং এনআরসি-র মাধ্যমে বেনাগরিক প্রমাণ হলে সে-সব যে বন্ধ করে দেওয়া হবে, তা বলাই বাহুল্য। অন্তত আসামের চিত্র তাই বলে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা অথবা রেশনের চালে সংসার চালানো মানুষদের কী হবে? নাকি ডিটেনশন ক্যাম্পই এদের আগামী ভবিষ্যৎ? প্রশ্নগুলো ঘিরে রয়েছে কেবলই ধোঁয়াশা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় ইতিমধ্যেই আত্মহত্যা করেছে বাংলার এক যুবক। তার পরিবারের লোক জানিয়েছে, সিএএ তে আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় ‘কাগজ’ না থাকায় ভয়ঙ্কর আতঙ্কে ছিল বছর একত্রিশের দেবাশিস সেনগুপ্ত। দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার ভয়েই আত্মহননের পথ বেছে নেয় সে। উদ্বাস্তুরা উপার্জন ও ব্যয় উভয়ই এই দেশে করে থাকে। ফলে ভারতবর্ষের জিডিপিতে তাদের সম্পূর্ণ অবদান রয়েছে। কিন্তু আগামীতে এই কোটি কোটি উদ্বাস্তুকে ডিটেনশন ক্যাম্পে কয়েদিদের মতো রাখলে, এক বিপুল অর্থের বোঝা দেশের উপর পড়বে – একথা বলাই বাহুল্য। সরকারি সার্টিফিকেট যেমন ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ইত্যাদির তৈরির ক্ষেত্রেই ভুরিভুরি ভুলের অভিযোগ ওঠে, সেখানে এত এত মানুষের নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে উক্ত কমিটির যে ভুল হবে না, তা বলা যায় না। আমরা আসামের মানুষের এনআরসি সংক্রান্ত তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা ইতিমধ্যেই জানি। সেখানে এনআরসির সর্বশেষ তালিকা বের হওয়ার পূর্বে দুটি ভুলে ভরা খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ তালিকাটিও যে নির্ভুল একথাও অনেকে বিশ্বাস করতে নারাজ। এমত অবস্থায় কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ প্রশ্নের মুখে। শিক্ষাহীন, মানহীন মতুয়া সমাজকে একসময় শিক্ষা ও সম্মানের জীবন দানের জন্য নিরলস আন্দোলন করেছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। বলতেন, “খাও না খাও, ছেলেমেয়েকে স্কুলে পড়াও”। ভরসা সেই ‘ঠাকুর’ পদবিতে। তাই শান্তনু ঠাকুরের কথাতেই আস্থা রেখেছিলো মতুয়া জনগোষ্ঠির বিপুল সংখ্যক মানুষ। এমনকি টাকার বিনিময়ে তিনি তাঁর স্বাক্ষর করা ‘মতুয়া কার্ড’ বিলি করেছিলেন মতুয়াদের মধ্যে। ওই কার্ড দেখালেই নাকি পাওয়া যাবে নাগরিকত্ব! সহজ, সাধারণ মানুষেরা সেটাই মেনে নিয়েছিলো।সিএএ -কে সামনে রেখে দু'হাজার উনিশ সাল থেকে বাংলার পাঁচটি উদ্বাস্তু প্রধান লোকসভা এবং সাতাশটি বিধানসভা আসনে বিজেপি ভালো ফল করে আসছে। আগামী লোকসভা ভোটও লড়বে এই ইস্যুকে সামনে রেখে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ও শান্তনু ঠাকুরকে বিশ্বাস করে মতুয়া সহ বাংলার অন্যান্য উদ্বাস্তুরা যে প্রতারিত হয়েছে, তাদের এই উপলব্ধি হওয়া এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। ************************তথ্যসূত্র: https://eisamay.com/west-bengal-news/24pargana-news/bjp-mla-asim-kumar-sarkar-opposes-new-matua-community-card-announced-by-mp-shantanu-thakur/articleshow/105538993.cmshttps://twitter.com/BanglaRepublic/status/1767893662539894828?t=qWkfn2RvaCfnrjjdqoHvSw&s=19https://bengali.abplive.com/videos/district/west-bengal-news-bjp-mla-asim-sarkar-himself-questioned-the-validity-of-matua-card-1027283https://bangla.hindustantimes.com/bengal/districts/citizenship-only-if-you-have-a-matua-card-shantanu-thakur-demand-resonates-with-tmc-bjp-31710407987896.html
    বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে…….. - সোমনাথ গুহ | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়মার্চ ও এপ্রিল পরপর দু মাসে দুজন স্বনামধন্য সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী দীর্ঘ কারাবাসের নরক-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। গত ৭ই মার্চ অধ্যাপক জি এন সাইবাবা প্রায় এক দশকের কারাবাসের পর নাগপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি পান। এর প্রায় এক মাস বাদে ভীমা কোরেগাঁও (বিকে) মামলায় ধৃত নারী ও দলিত অধিকার কর্মী, অধ্যাপক সোমা সেন জামিন পান। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এই দুজনের মুক্তি অবশ্যই স্বস্তিদায়ক, কিন্তু যা ঢের বেশি অস্বস্তিকর তা হচ্ছে তাঁদের গ্রেপ্তার, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের বিচার বা বিচার না-হওয়া পুরো বিচারব্যবস্থার স্বরূপকে নগ্ন করে দিয়েছে। সাইবাবার কাহিনি বহু চর্চিত, তবুও সেটাকে আমরা ফিরে দেখব এবং কোন কারণে অধ্যাপক সোমা সেন সহ ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ধৃত অন্যান্যদের এতো বছর কারাবাস করতে হল, এবং কয়েকজনকে এখনো করতে হচ্ছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করব। সাইবাবা আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কে সরব ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘অপারেশন গ্রীন হান্ট’ এর বিরুদ্ধে তিনি প্রবল ভাবে সোচ্চার হন। তাঁর বক্তব্য এই অভিযানের উদ্দেশ্য মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ আদিবাসী অঞ্চলের সম্পদ লুট করে তা কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। ২০১৪র মে মাসে মাওবাদীদের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রায় এক বছর বাদে শারীরিক কারণে জামিন দেওয়া হয়। ২০১৫-১৬ সালে এর পুনরাবৃত্তি ঘটে। পরের বছর সিপিআই, মাওবাদীদের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে ইউএপিএ নামক দানবীয় আইনের অধীনে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। সাইবাবা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রামলাল আনন্দ কলেজে ইংরাজির অধ্যাপক ছিলেন। ২০২১ সালে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। ২০২২ এর অক্টোবরে বম্বে হাই কোর্ট তাঁকে বেকসুর খালাস করে দেয়, বিচারপতিরা বলেন যে তাঁকে অভিযুক্ত করার জন্য যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কোর্ট সাইবাবা এবং তাঁর পাঁচ সাথিকে বেকসুর খালাস করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, মহারাষ্ট্র সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করে। এরপরে শীর্ষ আদালত যে ভাবে শনিবার, একটা ছুটির দিনে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে তাঁদের মুক্তির ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে তা এক কথায় বিস্ময়কর। আদালতের সময়সীমার বাইরে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণে বিশেষ বেঞ্চ মিলিত হওয়া কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সাংবিধানিক সংকট, ব্যক্তি স্বাধীনতা বা ফাঁসির আসামির আবেদন রদ করার শুনানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মধ্যরাতেও বিচারকরা মিলিত হয়েছেন। কিন্তু তথাকথিত একজন মাওবাদী, যিনি ৯০% প্রতিবন্ধি, যিনি ষোলোটি মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত, যাঁকে সামান্য দৈনন্দিন কাজ করতেও অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয়, তাঁর মুক্তি আটকাতে যেভাবে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাতে বিশিষ্ট আইনজ্ঞরাও স্তম্ভিত হয়ে যান। মাননীয় অধ্যাপকের আইনজীবী একটা অন্তিম চেষ্টা করেন, তিনি তাঁর মক্কেলের অসুস্থতার কারণে তাঁকে অন্তত কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী রাখার আবেদন করেন। আদালত তাতেও আপত্তি করে, যুক্তি দেয় ঘরে বসেও তিনি নাশকতা মূলক কাজকর্ম করতে পারবেন, ফোনে কর্মীদের নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রস্তাব দেওয়া হয় যে তাঁর ফোন বাজেয়াপ্ত করা হোক, নিষ্ঠুর আদালত তাতেও কর্ণপাত করতে অস্বীকার করে। এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিচারব্যবস্থা সাইবাবার মস্তিষ্ককে ভয় পায়। সেই অভুতপূর্ব স্থগিতাদেশের প্রায় ষোলো মাস পর সেই একই বম্বে হাই কোর্টের নাগপুর বেঞ্চ তাঁকে পুনরায় মুক্তি দেবার আদেশ জারি করে। আদালতের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়। তাঁরা বলেন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপ্রমাণিত অভিযোগ আনা হয়েছে এবং চক্রান্তের প্রস্তুতি হিসাবে তাঁর কাছে কোন নির্দিষ্ট উপাদান পাওয়া যায়নি। তাঁরা আরও বলেন কী ধরনের সন্ত্রাসবাদী কাজ তা ব্যাখ্যা না করার দরুন অভিযুক্তর বিরুদ্ধে মামলা দুর্বল। রাজ্য সরকার আবার শীর্ষ আদালতে আবেদন করে কিন্তু এবার তাঁরা স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করেন। আদালতের পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করছে যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ভুয়ো, সম্পূর্ণ মনগড়া যেটার ভিত্তিতে একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষকে অন্তত সাত বছর ব্রিটিশ আমলের অন্ডা সেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত বৃদ্ধা মাকে দেখার জন্য তাঁর জামিনের আবেদন বারবার নাকচ করা হয়েছে। মার মৃত্যুর পর শেষকৃত্যেও তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি, তখনো তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। এনআইএর মতে তিনি নাকি এতোই বিপজ্জনক যে কয়েক ঘণ্টার জন্য তিনি বাইরে এলেও তা রাষ্ট্রকে বিপন্ন করতে পারে। প্রক্রিয়াটাই যখন শাস্তিপ্রতিবাদী কন্ঠ দমন করার জন্য এটাই এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন বিচার ছাড়াই, শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে বছরের পর বছরের কাউকে কারাবন্দি করে রাখা। এর জন্য ইউএপিএ আইন হচ্ছে মোক্ষম হাতিয়ার যেটার লাগামছাড়া ব্যবহার হচ্ছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ এই আইনে ৮৩৭১ জন ধৃত হয়েছেন, সাজা পেয়েছেন মাত্র ২৩৫ জন, ৩% এরও কম! ২০০৮, ২০১২, ২০১৯, বিভিন্ন সময়ে এই আইনকে সংশোধন করে আরও কঠোর, দানবীয় করে তোলা হয়েছে। এই আইন এক উলটপুরাণ যেখানে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি দোষি নন এবং এই আইনে জামিন দেওয়া নিয়ম নয়, সেটা ব্যতিক্রম; বিচারক এবং সরকারি কৌঁসুলি যদি মনে করেন অভিযুক্ত আপাত ভাবে নির্দোষ শুধুমাত্র তবেই জামিন দেওয়া যেতে পারে। এর সেরা উদাহরণ দিল্লি দাঙ্গা মামলায় অভিযুক্ত উমর খালিদ। ২০২০র সেপ্টেম্বরে উনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারপর থেকে নানা অজুহাতে ওনার জামিনের শুনানি চোদ্দো বার মুলতুবি করা হয়েছে। ২০১৮র জুন মাসে অধ্যাপক সোমা সেন সহ আরও চারজন মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোমা সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নাকি সিপিআই মাওবাদী দলের সক্রিয় কর্মী, তিনি তাঁদের হয়ে তহবিল সংগ্রহ করতেন, হিংসাত্মক কার্যকলাপে ইন্ধন যোগাতেন এবং তিনি নাকি মাওবাদীদের বিভিন্ন ছদ্ম সংগঠনের সাথে যুক্ত। এছাড়া ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭ পুনের কাছে ভীমা কোরেগাঁও-য়ে জনতাকে তিনি হিংসায় প্ররোচিত করেছিলেন। সোমা সেন সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং জানান যে ২০১৭র শেষ দিনে কোরেগাঁও-য়ে তিনি উপস্থিতই ছিলেন না। ডিসেম্বর ১৩, ২০১৮ তিনি প্রথম বার জামিনের আবেদন করেন। এরপর তাঁর আবেদন, এমনকি অসুস্থতার কারণে আবেদনও উপরোক্ত সব কারণের দরুন খারিজ করা হয়। অথচ আজ প্রায় ছয় বছর বাদে সুপ্রীম কোর্ট বলছে তাঁর বিরুদ্ধে যা প্রমাণ আছে তাতে আপাত ভাবে (প্রাইমা ফেসি) তিনি কোন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে যুক্ত ছিলেন এটা প্রমাণিত হয় না। আদালত এটাও বলে তিনি কিছু সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং কিছু মহিলাকে সংগ্রামে উদ্দিপ্ত করেছেন বলেই তিনি মাওবাদী বা তাঁদের কোন ছদ্ম সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন এটাও প্রমাণিত হয় না। এছাড়া আদালত জানায় তৃতীয় কোন ব্যক্তির থেকে পাওয়া তথ্য বা উপাদান থেকে প্রমাণিত হয় না তিনি তহবিল সংগ্রহে যুক্ত ছিলেন। সোমা সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের যে কোন সারবত্তা নেই এই উপলব্ধিতে আসতে আদালতের প্রায় ছয় বছর লেগে গেল। ভীমা কোরেগাঁও বা দিল্লি ‘দাঙ্গা’ মামলায় এটাই হচ্ছে প্যাটার্ন! বছরের পর বছর অভিযুক্তদের কারাগারে বিনা বিচারে ফেলে রাখা হয়েছে, তারপর বহু টালবাহানার পরে কয়েকজনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে প্রাইমা ফেসি এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত নয়, এবং জামিন দেওয়া হয়েছে। বাকিরা তো এখনো জেলের ঘানি টানছেন। ছয় বছর হয়ে গেল বিকে মামলায় এখনো বিচারই শুরু হয়নি; শোনা যাচ্ছে চার্জশীটই নাকি ৫০০০ পাতা, ২০০ জন সাক্ষী। দিল্লি ‘দাঙ্গা’ মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কেউই পরিষ্কার নন। জামিনের শর্তাবলী এরপরেও আরও গল্প আছে। যাঁরা জামিন পাচ্ছেন তাঁদের মানমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকাই দুরূহ হয়ে পড়ছে কারণ জামিনের শর্তাবলী ভয়ঙ্কর! সোমা সেনের জামিনের শর্তাবলী দেখা যাকঃ (১) পাসপোর্ট জমা দিতে হবে, (২) বিশেষ আদালতের অনুমতি ছাড়া তিনি মহারাষ্ট্রের বাইরে যেতে পারবেন না, (৩) যেখানে বসবাস করবেন সেখানকার নিকটবর্তি থানায় তাঁকে চোদ্দো দিন অন্তর হাজিরা দিতে হবে, (৪) মোবাইল সব সময় অন রাখতে হবে এবং ব্যাটারিতে চার্জ থাকতে হবে, (৫) জিপিএস অন রাখতে হবে এবং নিকটবর্তি এনআইএ অফিসারের ফোনের সাথে সেটি লিঙ্ক রাখতে হবে। শর্ত পালনে কোন বিচ্যুতি ঘটলে তৎক্ষণাৎ জামিন বাতিল হয়ে যাবে। সোমা নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজির অধ্যাপক ছিলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি কি অবসরকালীন সুযোগ সুবিধাগুলি পাবেন? আদালত নীরব। একই ভাবে সাইবাবা কি তাঁর চাকরি ফিরে পাবেন? এসব ব্যাপারে আদালত কোন নির্দেশ ব্যক্ত করেনি। বিশিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ানিস্ট, আইনজীবী, সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ ২০২১ এর ডিসেম্বর মাসে বিকে মামলায় জামিন পান। তাঁর জামিনের ষোলোটি শর্ত আছে। সোমার ওপর যে শর্তগুলি চাপান হয়েছে সেগুলো তো আছেই আরও যা আছে তা হলঃ (১) তাঁকে মুম্বাই আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে থাকতে হবে এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া এই চৌহদ্দির বাইরে তাঁর যাওয়া নিষেধ (অথচ তিনি দিল্লির ‘ন্যাশানাল ল বিশ্ববিদ্যালয়’-এর অধ্যাপক ছিলেন। সেটা তাঁর কর্মক্ষেত্র, সেখানে না গেলে তিনি জীবিকা অর্জন করবেন কী ভাবে?) (২) রক্তের সম্পর্ক আছে এরকম তিনজন আত্মীয়ের বাড়ি ও কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা, ডকুমেন্ট সহ জমা দিতে হবে, (৩) মিডিয়ার কাছে তাঁর মামলা সংক্রান্ত কোন বক্তব্য রাখা নিষিদ্ধ, (৪) বিচারের সময় তাঁকে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে, তাঁর অনুপস্থিতির জন্য বিচার যেন বিলম্বিত না হয় (ছ বছরে বিচার শুরুই হয়নি!), (৫) বিকে মামলার অন্য সাথীদের সাথে যোগাযোগের কোন রকম চেষ্টা করবেন না, (৬) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা ছাড়া তাঁর বাড়িতে অন্য ব্যক্তিদের জমায়েত নিষিদ্ধ ইত্যাদি। জামিনের ওপর স্থগিতাদেশ এই জমানায় মুক্তির আদেশের পরেও যখন স্থগিতাদেশ হতে পারে, তখন জামিনের ওপর তো হবেই। মহেশ রাউত, টাটা ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের প্রাক্তনি এবং প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ উন্নয়নের ফেলো, জুন, ২০১৮ গ্রেপ্তার হন। ২০২৩ এর সেপ্টেম্বরে আদালত তাঁকে জামিন দেয়, বলে যে ইউএপিএ-তে তাঁর বিরুদ্ধে যা অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট উপাদান নেই। এনআইএ এর বিরুদ্ধে আবেদন করে এবং কয়েক দিনের মধ্যে আদালত নিজেদের রায়ের বিরোধিতা করে বলে তাঁর সাথে মাওবাদীদের যোগাযোগ পাওয়ার কারণে তাঁরা পুনর্বিবেচনা করে রায়ের ওপর এক সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিচ্ছেন। সেই এক সপ্তাহ এখনো চলছে! কোন না কোন অজুহাতে আজ পর্যন্ত সেই স্থগিতাদেশ বহাল আছে। একই ভাবে প্রসিদ্ধ মানবাধিকার কর্মী গৌতম নাভলাখা ডিসেম্বর ২০২৩ জামিন পান এবং প্রায় সাথে সাথেই এনআইএর আবেদনের কারণে আদালত জামিনের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ জারি করে। এর মধ্যে শারীরিক অসুস্থতার কারণে কারাগার থেকে সরিয়ে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে গৃহবন্দিত্ব বা হাউস এরেস্টের কোন কনসেপ্ট ভারতীয় আইনে স্বীকৃত নয়। যেহেতু গৌতম নিজে গৃহবন্দি হওয়ার আবেদন করেছিলেন, তাই আদালত শর্ত দেয় যে গৃহবন্দিত্বের খরচ (সিসিটিভি লাগান, যাঁরা প্রহরায় থাকবেন তাঁদের পারিশ্রমিক ইত্যাদি) অভিযুক্তকেই বহন করতে হবে। শেষ যা জানা গেছে সেই খরচ নাকি প্রায় দেড় কোটিতে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে এই খরচ নিয়ে এনআইএ এবং অভিযুক্তের আইনজীবীর মধ্যে দরাদরি চলছে। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে চূড়ান্ত ভাবে হেনস্থা করা, বারবার বুঝিয়ে দেওয়া নিপীড়িত শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতপাতের বিরুদ্ধে সরব হয়েছ তো তুমি শেষ। বনে জঙ্গলে খনন হচ্ছে, বড় বড় কর্পোরেট মাইনিং করছে সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার, সংগ্রামি আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানর কোন অধিকার তোমার নেই। সোমা, সুধা, মহেশ, গৌতম এঁরা তো সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, আর যাঁরা নন? ২০২২য়ে ইউটিউবে ফাদার স্ট্যান স্বামীর ওপর একটি ভিডিওতে পারাকালা প্রভাকর জানাচ্ছেন ওই বছরের মার্চ মাসে ইউএপিএতে অভিযুক্ত ১২২ জন ১৯ বছর কারাবাসের পর মুক্তি পেয়েছেন। ভাবা যায়! এতগুলো বছরে তাঁদের নিয়মিত আদালতে যেতে হয়েছে, জেল থেকে থানায় যেতে হয়েছে। অরুণ ফেরেরা, কার্টুনিস্ট, বিকে মামলায় অভিযুক্ত ২০০৭ থেকে ২০১২ কারাবাস করেছেন, ২০১৮য় পুনরায় গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং পাঁচ বছর বাদে মুক্তি পেয়েছেন। সেই মাওবাদী অভিযোগ, কিন্তু কোন কিছুই প্রমাণিত নয়। আমাদের রাজ্যে গৌর চক্রবর্তী সাত বছর ইউএপিএতে কারাগারে থাকার পর ২০১৬য় মুক্তি পেয়েছেন। এই তালিকার শেষ নেই, এই নরক-যন্ত্রণারও শেষ নেই।
  • হরিদাস পালেরা...
    কিষেণজি মৃত্যু রহস্য - পর্ব ৬  - বিতনু চট্টোপাধ্যায় | লালবাজারে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। বলছিলেন নয়ের দশকের মাঝামাঝি মেদিনীপুর জেলার কেশপুরের পরিস্থিতি নিয়ে। ‘একদিন কেশপুর থানায় গিয়ে এলাকার ম্যাপ নিয়ে বসলাম। মোট ১৩-১৪টা পুলিশ ক্যাম্প করা হল। ঝাড়খন্ডি এবং সিপিআইএম প্রভাবিত গ্রামগুলোর মাঝে মাঝে এই ক্যাম্পগুলো করা হয়েছিল। এক একটা ক্যাম্পে হাবিলদার, কনস্টেবল এবং জওয়ান মিলে ৮-১০ জন করে পোস্টিং করা হল। কিন্তু কয়েক মাস পর দেখলাম, এই ক্যাম্প করেও গণ্ডগোল থামানো যাচ্ছে না। নিয়ম করে রোজ সংঘর্ষ হচ্ছে। ঠিক করলাম, ক্যাম্পগুলো ভিজিট করব। নিজে দেখব কী সমস্যা হচ্ছে। কাউকে কিছু না বলে একদিন বিকেলে মেদিনীপুরের অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা কেশপুরে চলে গেলাম। তারপর থানা থেকে ওসিকে সঙ্গে নিয়ে কেশপুরে আনন্দপুরের কাছে একটা ক্যাম্পের দিকে রওনা দিলাম। চারদিকের পরিবেশ ওপর থেকে শান্ত। কিন্তু থমথমে একটা ভাব। সেদিনও সকাল থেকে সাত-আটটা গ্রামে গণ্ডগোল হয়েছে। আনন্দপুরের কাছে গণ্ডগোলটা সেদিন বেশি হয়েছিল। সন্ধে নাগাদ আনন্দপুরের ক্যাম্পে পৌঁছলাম। আগে থেকে ক্যাম্পের কাউকে কিছু জানাইনি। ক্যাম্প বসার পর থেকে সেদিনই প্রথম কোনও সুপিরিয়র অফিসারের ভিজিট হল সেখানে। হেড কনস্টেবল, হাবিলদার দৌড়ে এলেন আমাদের গাড়ি দেখে। ক্যাম্পে ঢুকে বসলাম। কথা বলতে শুরু করলাম তাঁদের সঙ্গে। কী অবস্থা, ক্যাম্প কেমন চলছে, এই সব। হেড কনস্টেবল বললেন, ‘‘স্যার, শ’য়ে শ’য়ে লোক রোজ তীর-ধনুক, টাঙি, বন্দুক নিয়ে মারপিট করছে। আমাদের এত কম ফোর্স, কীভাবে থামানো যাবে?’’ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর হেড কনস্টেবলকে বললাম ক্যাম্পের সব আর্মস এবং গুলি নিয়ে আসার জন্য। আমরা থানা, আউট পোস্ট কিংবা ক্যাম্প ভিজিট করলে অনেক সময় আচমকাই আর্মারি চেক করতাম। লিস্ট মিলিয়ে দেখে নিতাম আর্মস, গুলি যা যা থাকার কথা সব ঠিকঠাক আছে কিনা। সেই সময় কেশপুরের এক একটা ক্যাম্পে ৭-৮টা করে রাইফেল দেওয়া হয়েছিল। হেড কনস্টেবলকে সব বন্দুক এবং গুলি আনতে বলার পর দেখছি, তিনি এই কথা-সেই কথা বলে বিষয়টা ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। একটু পরে আবার বললাম, আর্মস নিয়ে আসতে। দেখি তিনি উঠে গেলেন কাউকে চায়ের কথা বলতে। আর্মস আর আনেন না। একটা সন্দেহ হল। এরপর একটু কড়াভাবেই বললাম। তারপর চারটে রাইফেল আর গুলি নিয়ে এলেন হেড কনস্টেবল। আর্মসের লিস্ট মিলিয়ে দেখি, চারটে রাইফেল নেই। ৪০ রাউন্ড গুলিও কম আছে। ওই ক্যাম্পে আটটা রাইফেল দেওয়া ছিল।যতবারই জিজ্ঞেস করি, চারটে রাইফেল আর ৪০টা গুলি কোথায় গেল, কিছুতেই জবাব দেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। বাধ্য হয়ে বললাম, ঠিকঠাক উত্তর না দিলে ক্যাম্পের সবাইকে আলাদা আলাদা ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। আর হেড কনস্টেবল তো সাসপেন্ড হবেনই, তদন্ত শুরু হবে তাঁর বিরুদ্ধে। এর পর তিনি প্রায় কেঁদেই ফেললেন। বললেন, ‘‘স্যার, সিপিআইএম আর ঝাড়খন্ড পার্টির লোকরা নিয়ে গেছে চারটে বন্দুক। একটু পরেই দিয়ে যাবে।’’একটু পরে দিয়ে যাবে মানে? ওরা কি আমাদের বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করে নাকি? হেড কনস্টেবল তখনও আমতা আমতা করছেন। তার যা বললেন তা শিউরে ওঠার মতো।ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএমের লোকেরা মূলত তীর, ধনুক, টাঙি নিয়েই লড়াই করত। দু’দলের কাছে কিছু দেশি বন্দুকও ছিল। তবে সেগুলোর রেঞ্জ তেমন ভাল ছিল না। একদিন সিপিআইএমের বেশ কিছু লোক ওই ক্যাম্পে চড়াও হয়। পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। তারপর নরমে-গরমে হেড কনস্টেবলকে প্রভাবিত করে ফেলে। তারা পুলিশকে বলে, আপনাদের কিছু করতে হবে না। দু’তিনটে বন্দুক আমাদের দিন। আমরাই ঝাড়খন্ডিদের শায়েস্তা করে দেব। তারপর বন্দুক ফেরত দিয়ে দেব। হেড কনস্টেবল ভয়ে ভয়ে ছিলেন। কেশপুর থানার ওসি কিংবা কোনও সুপিরিয়র অফিসার আনন্দপুর ক্যাম্পে যেতেনও না। তারপর এটা রফা হয়। সিপিআইএম সকালে পুলিশ ক্যাম্প থেকে রাইফেল নিয়ে যাবে। তারপর আবার সন্ধেবেলা লড়াই শেষে ফেরত দিয়ে যাবে। এরপর ওরা গুলিও নিতে শুরু করে। এরকম কিছুদিন চলার পর ঝাড়খন্ড পার্টির লোকজনের সন্দেহ হয়। এতদিন দু’পক্ষই প্রায় সমান সমান ছিল। পুলিশের রাইফেল হাতে পেয়ে হঠাৎ সিপিআইএমের শক্তিবৃদ্ধি হওয়ায় সন্দেহ দেখা দেয় ঝাড়খন্ডিদের মনে। কারণ, রাতারাতি সিপিআইএমের ফায়ারিং পাওয়ার বেড়ে গিয়েছে। ঝাড়খন্ডিরা দেখে সিপিআইএম বাহিনী অনেক দূর থেকে গুলি চালাচ্ছে যা আগে পারত না। সিপিআইএম যে পুলিশ ক্যাম্প থেকে রাইফেল পেয়েছে এই খবর পেয়ে যায় ঝাড়খন্ডিরা। তারপর তারাও দল বেঁধে চড়াও হয় আনন্দপুর ক্যাম্পে। সিপিআইএমকে দিলে তাদেরও দিতে হবে রাইফেল। ব্যাস পুলিশ আর যায় কোথায়। ঝাড়খন্ডিরাও সেদিন থেকে রাইফেল নিতে শুরু করল পুলিশের। এমনই চলছিল। কোনওদিন সিপিআইএম বন্দুক নিয়ে যায়, তো কোনওদিন ঝাড়খন্ড পার্টির লোক। কোনও কোনও দিন দু’দলই নিয়ে যায়। কিন্তু দু’দলেরই কথার দাম আছে! দিনের শেষে আবার রাইফেল ফেরতও দিয়ে যেত ক্যাম্পে। যেদিন আমি গিয়েছিলাম, সেদিন দুই দলই সকালে এসে দুটো করে রাইফেল নিয়ে গেছে। তারপর আবার আমি থাকতে থাকতেই দু’দলের লোক এসে রাইফেল ফেরতও দিয়ে গেল।’‘কী বলছেন? পুলিশের বন্দুক দিয়ে দু’দলে যুদ্ধ চলছে, আর পুলিশ ক্যাম্পে বসে আছে? এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা শুনে জিজ্ঞেস করলাম প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কে। ‘এরপর কী করলেন?’‘কী আর করার আছে? প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম, ছোট ক্যাম্পগুলো তুলে নেব। এমনিতেও আট-দশ জনের ক্যাম্প রেখে কোনও লাভ হচ্ছিল না।  সিপিআইএম-ঝাড়খন্ডিরা তো বটেই গ্রামের সাধারণ মানুষও এই ছোট ক্যাম্পগুলোকে কয়েকদিন পরে আর ভয়-ডর পায় না। আনন্দপুর ক্যাম্প থেকে কেশপুর থানায় ফিরলাম। সেখান থেকেই জেলার পুলিশ সুপারকে ফোন করে জানালাম সমস্ত ক্যাম্প তুলে দেওয়ার কথা। তার বদলে পুরো কেশপুরে চারটে বড় ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ক্যাম্প থেকে সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ড পার্টির রাইফেল নিয়ে যাওয়ার কথা বিস্তারিতভাবে আর পুলিশ সুপারকে বললাম না। শুধু বলেছিলাম, ছোট ক্যাম্পে লাভ হচ্ছে না। তার বদলে বড় ক্যাম্প করলে ভালো হবে। কেশপুরে চারটে পয়েন্ট বেছে নিয়ে বড় ক্যাম্পের প্ল্যান করলাম। এক একটা ক্যাম্পে অন্তত ৪০-৪৫ জন করে পুলিশ পোস্টিং করলাম। পরদিনই কেশপুরে সব ছোট ক্যাম্প উঠে চারটে বড় ক্যাম্প বসে গেল। আর পরের দিন রাত থেকেই কেশপুরের সব উত্তপ্ত গ্রামে শুরু করা হল তল্লাশি অভিযান। ওখানে সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ড পার্টির যারা গণ্ডগোল করত এমন প্রায় দেড় হাজার লোকের তালিকা ছিল আমাদের কাছে। বেছে বেছে তাদের বাড়িতে রাতে রেইড শুরু করা হল। কেউ যাতে সারাদিন মারপিট করে রাতে বাড়িতে থাকতে না পারে। টানা এক মাস এই রেইড চালানোতে দারুণ কাজ হল,’ টানা বলে থামলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।  পুলিশ শাসক দলের হয়ে কাজ করে, অনেক শুনেছি। পুলিশ নিজেই শাসক দলের ভূমিকা পালন করেছে এমনও নিজের চোখে দেখেছি নন্দীগ্রামে। আবার, পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম সরকার আর থাকবে না, ২০০৯ লোকসভা ভোট পরবর্তী সময়ে এমন পরিবেশ তৈরি হওয়ার পর, অনেক পুলিশ অফিসারকেই দেখেছি, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কিংবা সিপিআইএমের কথা না শুনে বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু শাসক-বিরোধী দু’দলই পুলিশ ক্যাম্প থেকে রাইফেল, গুলি নিয়ে দিনের পর দিন যুদ্ধ করছে, এমন হওয়াও যে সম্ভব, তা আমার ধারণাতেই ছিল না।। ঘটনাটা শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। কী বিচিত্র এই সিপিআইএম জমানায় অবিভক্ত মেদিনীপুরের রাজনৈতিক লড়াই-সংঘর্ষের সব কাহিনী। এতবার অ্যাসাইনমেন্টে ঝাড়গ্রাম গিয়েছি, এত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি, সংবাদপত্রে এত খবর দেখেছি। কিন্তু কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের সন্ধানে না নামলে জানতেই পারতাম না আরও কত কিছু! ভাবতেও পারতাম না, যুযুধান দুই রাজনৈতিক পক্ষ পুলিশ ক্যাম্প থেকে সরকারি রাইফেল, গুলি নিয়ে গিয়ে লড়াই করে একে অপরের সঙ্গে। আবার লড়াই শেষে সেই রাইফেল ফেরতও দিয়ে আসে পুলিশের কাছে! তবে যত শুনছি, জানছি, ততই মনে প্রশ্ন আসছে, যা জানতে পারছি তাই বা আসল ঘটনার কতটা? এ কি হিমশৈলের চূড়া মাত্র?       দ্বিতীয় সাক্ষী: সিপিআইএম নেতা ডহরেশ্বর সেনডহরেশ্বর সেন। আগেও শুনেছি, কিন্তু ২০০৮ সালে লালগড় আন্দোলন শুরু হওয়ার পর একটা বিশেষ কারণে তাঁর নাম শুনলাম কয়েকবার। এই আন্দোলনের সময় লালগড়, বেলপাহাড়ি, বিনপুর, জামবনিসহ বিরাট এলাকার বহু সিপিআইএম নেতা, কর্মী মাওবাদীদের ভয়ে ঘড়ছাড়া হয়ে যান। বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছিলেন মেদিনীপুর শহরে। সেই সময় ঝাড়গ্রাম মহকুমায় গেলে শুনতাম, ডহরেশ্বর সেন অন্য ধরনের সিপিএম নেতা। সিপিআইএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, ঝাড়গ্রামের নেতা, অথচ মাওবাদীদের তীব্র প্রভাবের সময়েও ডহরেশ্বর সেন বিনা নিরাপত্তায় হাঁটাচলা করতে ভয় পেতেন না!       নিজে আদিবাসী নন। কিন্তু তফশিলি জাতিভুক্ত কিংবা আদিবাসীদের প্রতি বঞ্চনা এবং তাদের অধিকার নিয়ে খাঁটি সংবেদনশীল ডহরেশ্বর সেনকে জঙ্গলমহল থেকে মুজফফর আহমেদ ভবন চেনে ডহর সেন নামে। ১৯৬০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ডহর সেন। চার বছর বাদে পার্টি ভেঙে গেলে সিপিআইএমে যোগ দেন। আদিবাসীদের গ্রামে রাত কাটানো সিপিআইএম নেতা ডহর সেন বিশ্বাস করতেন, মানুষের সঙ্গে তাঁর দলের সম্পর্ক হওয়া উচিত মাছের সঙ্গে জলের সম্পর্কের মতো। মেলামেশাও করতেন বেলপাহাড়ি, জামবনির গরিব মানুষের সঙ্গে সেইভাবেই। মনে করতেন, ব্যক্তিজীবনের কিছু বিলাসিতা অন্তত ত্যাগ করে আদিবাসীদের আনন্দ, উৎসব, দুঃখ, যন্ত্রণায় শরিক হয়েই গরিব মানুষগুলোর হৃদয় জয় করা সম্ভব। কিন্তু গরিব প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ গড়ে তোলা ডহর সেন কালক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন নিজের দল থেকেই। কারণ, ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রভাবশালী সিপিআইএম নেতারা বুঝে নিয়েছিলেন, সংসদীয় রাজনীতিতে সাফল্যের ফর্মুলা শুধুমাত্র গরিব মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে লুকিয়ে নেই। বরং পেশি শক্তির সফল প্রয়োগ করতে পারলে চূড়ান্ত আধিপত্য বিস্তারে সময় ব্যয় করতে হয় কম এবং সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কম বিনিয়োগে বেশি রিটার্ন। ডহরেশ্বর সেনকে অবিভক্ত মেদিনীপুরের নেতা এবং সিপিআইএমের প্রভাবশালী জেলা সম্পাদক দীপক সরকার খুব একটা পছন্দ করতেন না। কারণ, ডহর সেন নিজের দলের কাজকর্মের সমালোচনা করতেন মাঝে-মধ্যে। ঝাড়খন্ডিদের হয়ে কথা বলতেন অনেক সময়। আর এর পুরস্কার হিসেবে পার্টি নেতৃত্বের কাছ থেকে ‘দল বিরোধী’ এবং ‘নকশাল’ তকমাও জুটেছিল তাঁর।       ২০১৫ সালের একদম শেষে ডহর সেনের সঙ্গে দেখা করলাম। কলকাতায় কিড স্ট্রিটে এমএলএ হস্টেলে। ডাক্তার দেখাতে কলকাতায় এসেছিলেন ঝাড়গ্রাম থেকে। এমএলএ হস্টেলে এক সিপিআইএম বিধায়কের ঘরে ছিলেন। কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের আমার দ্বিতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সিপিআইএম নেতা ডহরেশ্বর সেন।    ‘আপনি জানেন, সুভাষচন্দ্র বসুকে ঝাড়গ্রাম শহরে মিটিং করতে দেয়নি সেখানকার মল্লদেব রাজারা। আসলে ঝাড়গ্রামের রাজ পরিবার বরাবরই ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে। ঝাড়গ্রাম শহরে একবার মিটিং করবেন ঠিক করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু মল্লদেব রাজ পরিবারের আপত্তিতে বাধ্য হয়ে শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে দহিজুড়িতে সুভাষ বসুকে মিটিং করতে হয়েছিল। ঝাড়গ্রামে আদিবাসীদের অধিকাংশই ছিল রাজপরিবারের পাশে। নির্বিবাদী, শান্ত প্রকৃতির আদিবাসীদের কাছে তখন শাসক বলতে রাজ পরিবার। তারা ভাবতেই পারত না রাজার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। তাছাড়া আদিবাসীদের চাহিদাও এত কম, তারা লড়াই করবেই বা কেন?’ কথা শুরু করলেন সিপিআইএম নেতা ডহরেশ্বর সেন।   সত্যিই তো, যে নির্লোভ মানুষগুলোর কোনও দাবিদাওয়া ছিল না বাকি দুনিয়ার কাছে, নিজের সমাজের গণ্ডিতে আবদ্ধ যে পরিবারগুলো সামান্যেই খুশি হয়ে কাটিয়ে দিত তাদের সহজ এবং স্বল্প জীবন, তারাই কেন অস্ত্র ধরল হঠাৎ করে? কোন মন্ত্রে সিপিআইএম পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে আটের দশকে শুরু করল এমন জান কবুল লড়াই? এই শান্তিপ্রিয় আদিবাসী এলাকা কেনই বা একুশ শতকের গোড়ায় হয়ে উঠল সশস্ত্র মাওবাদী রাজনীতি অনুশীলনের এক পরীক্ষাগার? এ তো কার্যত, কিন্তু কার্যত কেন, এ তো যথার্থই নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। অথচ, ‘এই মানুষগুলোই রাজার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেও লড়াই করেনি তেমন,’ কানে বাজছে ডহরেশ্বর সেনের কথা। তিনি তো কারও থেকেই কম চেনেন না অবিভক্ত মেদিনীপুরের এই রুক্ষ এলাকার গরিব তফশিলি জাতি এবং আদিবাসী পরিবারগুলোর দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী। এবং ২০০৩ এর পঞ্চায়েত ভোটের সন্ধ্যায় জামবনির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতা এবং লোকাল কমিটির সম্পাদক বাসুদেব ভকতের খুন থেকে ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে কিষেণজির মৃত্যু, এই যে হত্যা এবং পাল্টা হত্যার অন্ধকার চোরাগলিতে প্রবেশ সিপিআইএম, ঝাড়খন্ড পার্টি এবং পুলিশের, তার তো যথার্থ কারণ থাকবে একটা। ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষটাই আলটিমেটলি কনভার্ট করে গেল মাওবাদীদের সঙ্গে সিপিআইএমের রক্তক্ষয়ী খুনোখুনিতে। কিন্তু ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষের শুরু হল কীভাবে এবং কেন? কবে থেকেই বা শুরু হল ঝাড়গ্রাম মহকুমায় এই সিপিআইএম-ঝাড়খন্ডি লড়াই, এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে ২০১৫ সালের শেষে আমি ডহর সেনের মুখোমুখি।   এবার আমাদের যেতে হবে অনেকটা পিছিয়ে। যাকে বলে কিনা ফ্ল্যাশব্যাকে। ১৯৬৫ সাল, দেশে এবং রাজ্যে কংগ্রেস সরকার। যদিও দু’জায়গাতেই কংগ্রেসের প্রভাব এবং দাপট কমতে শুরু করার সন্ধিক্ষণ তখন। সেই সময় কৈশোর কাটিয়ে সদ্য যুবক ডহরেশ্বর সেন।                     ‘আমি প্রথম ঝাড়গ্রামে গেলাম ১৯৬৫ সালে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। সেই সময় থাকতাম খড়গপুরে। ‘৬৫ সালের যুদ্ধ শুরু হতেই সিপিআইএম নেতাদের গ্রেফতার করা শুরু হল। অনেকেই আত্মগোপন করলেন। আমি তখন পুরোদমে পার্টি করছি। আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হই ১৯৬০ সালে। চার বছর বাদে পার্টি ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিপিআইএমে যোগ দিলাম। ’৬৫ তে যুদ্ধ শুরু হতেই আমাদের নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হল। পার্টি বলল, আত্মগোপন করতে। কোনওভাবে গ্রেফতার হওয়া যাবে না। অনেক ভেবে কিছুদিন বাদে চলে গেলাম ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রামের বিটি কলেজে ফ্রেশার হিসেবে ভর্তির জন্য আবেদন করে দিলাম। ভর্তি হয়েও গেলাম। থাকতে শুরু করলাম কলেজ হস্টেলে। মনে হয়েছিল, ওটাই সেই সময় আত্মগোপনের সবচেয়ে ভাল ঠিকানা। ছাত্র সেজে থাকলে কেউ সন্দেহও করবে না। এভাবেই চলছিল কয়েক মাস। কোনও ঝামেলা ছিল না। কলেজে কেউ জানতও না আমার রাজনৈতিক পরিচয়। কয়েক মাস কেটে গিয়েছে নিশ্চিন্তে। ঝাড়গ্রাম কলেজ হস্টেলে থাকছি আর ক্লাস করছি। ১৯৬৬ সালে শুরুর দিকে, একদিন সন্ধেবেলা হস্টেলে বসে আছি। সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে, হঠাৎ একজন এসে খবর দিল, হস্টেলের বাইরে প্রচুর পুলিশ। অধ্যক্ষ আমাকে অফিসে ডাকছেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, ধরা পড়ে গিয়েছি। আর লুকিয়ে থাকা যাবে না। পালানোরও কোনও পথ নেই। পুলিশ হস্টেল ঘিরে ফেলেছে। গেলাম অধ্যক্ষের অফিসে। স্যার বসে আছেন। সঙ্গে একজন কম বয়সী পুলিশ অফিসার। আমার থেকে বয়সে একটু বড় হবেন, কিংবা একও হতে পারেন। ঘরে আর কেউ নেই।অধ্যক্ষ বললেন, ‘‘তোমার বিরুদ্ধে দেশ বিরোধিতার অভিযোগ রয়েছে। তুমি খড়গপুর কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলে? তুমি কি পার্টি মেম্বার?’’চুপচাপ দাঁড়িয়ে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম।এরপর অধ্যক্ষ আমাকে দেখিয়ে ওই পুলিশ অফিসারকে বললেন, ‘‘ও তো ভালো ছেলে। আগে কী করত জানি না। কিন্তু এখানে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে।’’ তারপর আমাকে বললেন, ‘‘পুলিশ তোমাকে গ্রেফতার করতে এসেছে। উনি ঝাড়গ্রামের নতুন এসডিপিও। ফোর্স বাইরে রেখে একাই কলেজের ভেতরে ঢুকেছেন। তোমার বিরুদ্ধে তো এই সব দেশ বিরোধী কাজকর্মের অভিযোগ! আমি আর কী করব?’’আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। একবার স্যারের দিকে, তো একবার ওই আমারই বয়সী পুলিশ অফিসারের দিকে তাকাচ্ছি। অ্যারেস্ট হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। আমার বলারও নেই কিছু। আমি তখন সিপিআইএম সদস্য। সেই পরিচয় গোপন করে কলেজে পড়ছি। ঘরে কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপ। স্যার থামার পর ওই অফিসারও কিছু বলছেন না। কিছু ভাবছেন, আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন। ‘‘ঠিক আছে। তোমাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ আছে, কিন্তু আমি তা করছি না। রিপোর্টে লিখে দেব, ডহরেশ্বর সেনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু দিনেরবেলা এই এলাকায় সাদা পোশাকে পুলিশ ঘোরাফেরা করে। সেই সময় কলেজের বাইরে একদম বেরোবে না। যতটা সম্ভব হস্টেলেই থাকবে। সাদা পোশাকের পুলিশ একবার ধরলে আমার আর কিছু করার থাকবে না। ’’আমাকে, অধ্যক্ষ স্যরকে অবাক করে বললেন পুলিশ অফিসার। এমন অফিসারও হয়? স্যরের কাছে অনুমতি নিয়ে হস্টেলে ফিরলাম। তারপর থেকে আর হস্টেলের বাইরে বেরোতাম না বিশেষ। আরও এক বছর কেটে গেল। ১৯৬৭ সালে তৈরি হল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। গ্রেফতারের আশঙ্কা কেটে গেল। ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে ঝাড়গ্রামে তীব্র আন্দোলন শুরু করল সিপিআইএম। গোটা রাজ্যে সিপিআইএম তখন জোতদারদের বিরুদ্ধে হিসেব বহির্ভুত জমি, বেনামি জমি উদ্ধারের ডাক দিয়েছে। এই জমির আন্দোলনে উত্তাল হতে শুরু করেছে ঝাড়গ্রামও। হরেকৃষ্ণ কোঙার ঝাড়গ্রামে এলেন। ডাক দিলেন জোতদারদের জমি দখলের।’‘ছয়ের দশকে ঝাড়গ্রামে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিশ্চই খুব খারাপ ছিল। এখানে তেমন জমি ছিল মানুষের হাতে?’ আমার মাথায় ঘুরছে রামজীবনের কথা, তার বাবা-মা মহাদেব আর শান্তি মুর্মুর কথা। ডহর সেন যে সময়ের কথা বলছেন, তখন মা মরা রামজীবনের বয়স বছর সাতেক। ‘ঝাড়গ্রাম, বিনপুরে জনসংখ্যার মধ্যে তফশিলি, জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি ৮০ শতাংশের বেশি। তার মধ্যে ৯৯ শতাংশ মানুষ ছিল অত্যন্ত গরিব। তিন বেলা তো দূরের কথা, অধিকাংশ বাড়িতেই দুবেলা খাবার থাকত না। বেশিরভাগ পরিবার বছরে ছ’মাস একবেলা ভাত খেতে পেত। আদিবাসীদের মধ্যে কয়েক জনই মাত্র ছিল ল্যান্ড লর্ড। তারা হাতে গোনা দু’তিন জন। বড় ল্যান্ড লর্ড ছিল শ্যাম হেমব্রম এবং তাঁর ছেলে নিত্যানন্দ হেমব্রম। তাদের বাড়ি বেলপাহাড়ি ব্লকের শ্যামপুরে। আর এক জন বড় ল্যান্ড লর্ড ছিল শ্যাম মুর্মু। এই দুই পরিবারের হাতেই ছিল অনেক জমি। আর ছিলেন রাজা ধীরেন্দ্র বিজয় মল্লদেব। ঝাড়গ্রামে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক। ৯৯ শতাংশের বেশি আদিবাসীর হাতে এক আনা জমিও ছিল না। সিপিআইএমের জমি আন্দোলন এবং হরেকৃষ্ণ কোঙারের ঝাড়গ্রাম সফরে ভয় পেয়ে গেল এখানকার জোতদাররা। জমি হাতছাড়া হওয়ার ভয়। তারা বুঝে গেল, কোনও একটা উপায় বের করতে না পারলে গরিব আদিবাসীদের সামনে রেখে জমি দখল করে নেবে সিপিআইএম। ঝাড়গ্রামে তখন অদ্ভুত পরিস্থিতি। একদিকে, কংগ্রেস মদতপুষ্ট কয়েকজন জোতদার, যার নেতৃত্বে এখানকার রাজ পরিবার। তাদের সঙ্গে প্রশাসনের একটা বড় অংশ। অন্যদিকে, সিপিআইএম এবং হাজার হাজার গরিব মানুষ। এই অবস্থায় ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে মিটিংয়ে বসল কয়েকজন ল্যান্ড লর্ড। কীভাবে সিপিআইএমের হাত থেকে অতিরিক্ত এবং বেনামি জমি রক্ষা করা যায়। সেই মিটিংয়েই সিপিআইএমের জমি আন্দোলনকে ঠেকানোর এক কৌশল বের করল মল্লদেব পরিবার এবং কয়েকজন জোতদার। আর সেটা হচ্ছে, ঝাড়গ্রামের মানুষকে নিয়ে সিপিআইএম বিরোধী একটা রাজনৈতিক দল গঠন এবং পৃথক রাজ্যের দাবি।  আপনি জানেন তো, ব্রিটিশ আমলে একটা কমিশন তৈরি হয়েছিল। সাইমন কমিশন।  সেটা দুইয়ের দশক। ১৯২৮-২৯ সালে এই সাইমন কমিশনের কাছে ছোটনাগপুর, বাংলা এবং বিহারের একটা অংশ নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করেছিল ঝাড়খন্ড পার্টি। সেই সময় ছোটনাগপুর এলাকার ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা জয়পাল সিংহ। যদিও সাইমন কমিশন কিংবা ব্রিটিশ সরকার এই দাবিকে স্বীকৃতি দেয়নি। স্বাধীনতার পরে ছোটনাগপুর এলাকায় ঝাড়খন্ডিদের আলাদা রাজ্যের দাবি কয়েকবার উঠলেও, এরাজ্যে তার কোনও চর্চা ছিল না। সিপিআইএমের জমি আন্দোলনকে ঠেকাতে ঝাড়খন্ডিদের জাতি সত্ত্বার রাজনীতিকে সামনে আনার কৌশল নিল ঝাড়গ্রামের প্রভাবশালী রাজা এবং কংগ্রেসি পরিবার মল্লদেবরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিল আরও কয়েকজন কংগ্রেসি জোতদার, জমিদার। সেই সময়, মানে ১৯৬৭-৬৮ নাগাদ ছোটনাগপুরের ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা ছিলেন বাবুন সামরাই। ঝাড়গ্রামের মল্লদেবদের প্রত্যক্ষ মদত এবং পরামর্শে শ্যাম হেমব্রম, শ্যাম মুর্মু এবং আরও দু’চারজন ল্যান্ড লর্ড বাবুন সামরাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার কিছুদিনের মধ্যেই এখানে ঝাড়খন্ড পার্টি গঠিত হল। পৃথক ঝাড়খন্ড রাজ্যের যে দাবি, তার সলতে পাকানো শুরু হল এ’রাজ্যে।’ মানে, আপনি বলতে চাইছেন এখানে সিপিআইএমের সঙ্গে ঝাড়খন্ডিদের লড়াই-সংঘর্ষের সূত্রপাত প্রথম যুক্তফ্রন্ট আমলে জোতদারের জমি দখলকে কেন্দ্র করে?‘একেবারেই। তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার। হরেকৃষ্ণ কোঙারের ডাকে বাংলার বিভিন্ন গ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষ জোতদারদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়েছে। গরিব, জমিহীন মানুষের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা তীব্র ক্ষোভকে পুঁজি করে কৃষক সভা তখন বেপরোয়া আন্দোলন শুরু করেছে। কোথাও কোথাও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে জোতদাররাও। গুলি চলছে, আগুন জ্বলছে নানা জায়গায়। সেই সময় ঝাড়গ্রামে সিপিআইএমকে ঠেকাতে কংগ্রেসের মদতে গড়ে ওঠা ঝাড়খন্ড পার্টি স্লোগান তুলল, ‘‘আলাদা রাজ্য চাই।’’             ’ঝাড়খন্ড পার্টি তৈরি হওয়ার পর কংগ্রেস জোট করল ওদের সঙ্গে। আলাদা রাজ্যের দাবি নিয়ে ঝাড়খন্ড পার্টির আন্দোলনে সরাসরি যোগ না দিলেও কংগ্রেস পেছন থেকে ওদের সমর্থন করত। আদিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় দিশম গুরুদের খুব প্রভাব ছিল। দিশম গুরুরাও ফতোয়া দিল আলাদা রাজ্যের জন্য। দিশম গুরুদের এই ফতোয়া ঝাড়গ্রামের বিনপুর এলাকায় আদিবাসী সমাজের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলল। দিশম গুরুদের সামনে এবং কংগ্রেসকে পেছনে রেখে ১৯৭১ সালে নির্বাচনে লড়ল ঝাড়খন্ড পার্টি। এবং জিতেও গেল। ’৭১ সালে বিনপুর আসন থেকে বিধায়ক হলেন জোতদার শ্যাম মুর্মু। সিপিআইএম বিরোধিতাই তখন থেকে হয়ে উঠল ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ঝাড়খন্ড পার্টির মূল রাজনৈতিক স্লোগান। তখনও সেইভাবে সংঘর্ষ শুরু হয়নি, কিন্তু ঝাড়খন্ড পার্টির জোতদার, জমিদার নেতারা বুঝে গিয়েছিলেন, এই সব এলাকায় নিজস্ব জমি রক্ষা করতে গেলে সিপিআইএমের বিরোধিতা করতে হবে। এবং তার জন্য ঝাড়খন্ডিদের মধ্যে আলাদা রাজ্যের দাবি নিয়ে আন্দোলন জিইয়ে রাখতে হবে। এটাও মনে রাখা দরকার, সেই সময় নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। তার প্রভাবে মেদিনীপুর জেলার ডেবরা এবং গোপীবল্লভপুরেও জোতদার, জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে নকশালরা। কিন্তু সেই সময় ঝাড়গ্রাম, বিনপুরে নকশালদের কোনও প্রভাব ছিল না। ঝাড়গ্রাম, বিনপুরে শক্তিশালী ছিল সিপিআইএম। সব মিলে এই যে জোতদার, জমিদারদের হাজার-হাজার বিঘা জমি দখলের লড়াই শুরু হচ্ছে তখন সেটারই বিরুদ্ধে একজোট হল কংগ্রেস এবং ঝাড়খন্ড পার্টি। এই জোতদার-জমিদার পরিবারগুলো ঐতিহাসিকভাবেই কংগ্রেস করত। কিন্তু ঝাড়গ্রাম, বিনপুর, জামবনিতে এই জোতদার, জমিদারদের সঙ্গে তফশিলি জাতি এবং আদিবাসীদের মিলমিশটা ভাল হয়েছিল। কারণ, এই সব জায়গায় বড় জমির মালিকরাও ছিল আদিবাসী। ফলে আলাদা রাজ্যের দাবির আন্দোলনে ঝাড়গ্রাম, বিনপুর, জামবনির জমিদার শ্রেণি এবং দরিদ্র আদিবাসী জাতিগত, ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত কারণেই এক হয়ে যায়।  ‘তার মানে, ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের যে সংঘর্ষ, খুনোখুনি, তার প্রেক্ষাপট শুধুমাত্র কোনও রাজনৈতিক লড়াই ছিল না? কিংবা ছিল না কোনও শ্রেণি সংগ্রাম? প্রাথমিকভাবে এটা ছিল, জমিদার, জোতদারদের বেনামি জমি অবলুপ্তি এবং অপারেশন বর্গা কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে আপনাদের যে উদ্যোগ তার বিরোধিতা করা?’ প্রশ্ন করলাম ডহর সেনকে।‘দেখুন এর সূত্রপাত একেবারেই তাই। পরে যে আমাদের দল কোনও পর্যায়ে বাড়বাড়ি করেনি তা নয়। কিন্তু তা অনেক পরের কথা। একদম শুরুতে ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে আমাদের লড়াইটা ছিল জমি নিয়ে। রাজনৈতিক জমি নয়, জোতদার এবং রাজার জমি।’   এর মধ্যেই ১৯৭২ সালে রাজ্যে তৈরি হল কংগ্রেস সরকার। পুরো রাজ্যেই জমি আন্দোলন থমকে গেল। এই সুযোগে ঝাড়গ্রামের বিনপুর, বেলপাহাড়ি এলাকায় নিজেদের প্রভাব অনেকটাই বাড়িয়ে ফেলল ঝাড়খন্ড পার্টি। জমিদার, জোতদার কংগ্রেসি পরিবারগুলো আবার শক্তিবৃদ্ধি করল। পুলিশ এবং প্রশাসন যুক্তফ্রন্ট আমলেও কংগ্রেসি এবং জোতদারদের যথেষ্ট মদত করত। আর ’৭২ সালে কংগ্রেস সরকার গঠনের পর তো আর কোনও কথাই নেই। কংগ্রেসি, জোতদার, ঝাড়খন্ডি সব এক ছিলই। পুরো প্রশাসনই ওদের পাশে দাঁড়াল। আর পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে জাতি সত্ত্বার ব্যাপারটা ছিলই গরিব আদিবাসীদের মধ্যে। যেহেতু আমরা পৃথক রাজ্যের বিরোধিতা করেছিলাম কংগ্রেসি এবং ঝাড়খন্ডিদের প্রতি আদিবাসীদের সমর্থন দ্রুত বাড়তে শুরু করে এই সময়। সিপিআইএমের প্রকাশ্য কর্মসূচি তখন অনেকটাই কমে যায়।   ১৯৭৭ সালে ফের রাজ্যে নির্বাচন। প্রথমে লোকসভা, তারপর বিধানসভা। কংগ্রেসের অবস্থা তখন পুরো দেশেই খুব খারাপ। আর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যাওয়ার পর এরাজ্যে ওদের অবস্থা আরও খারাপ হল। ঝাড়গ্রামও তার বাইরে ছিল না। প্রকাশ্যে না হলেও তলায় তলায় আমাদেরও রাজনৈতিক কর্মসূচি চলছিল। ঝাড়গ্রাম মহকুমায় চারটে বিধানসভা আসনের মধ্যে তিনটেই জিতলাম আমরা। বিনপুর, ঝাড়গ্রাম এবং নয়াগ্রাম। গোপীবল্লভপুর আসনে জিতলেন নকশাল নেতা সন্তোষ রাণা। দশ বছর আগে শুরু হওয়া জমি আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব পড়ল সেই নির্বাচনে। ঝাড়গ্রাম মহকুমার চারটে আসনেই সাফ হয়ে গেল কংগ্রেস।  ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের পর ব্যাপকভাবে অপারেশন বর্গার কাজ শুরু হল ঝাড়গ্রামে। ফের সিপিআইএমের নেতৃত্বে শুরু হল বেআইনি জমি উদ্ধারের আন্দোলন, জোতদার প্রথার অবসান। এতেই ভয় পেয়ে গেল গোটা এলাকার জোতদার, জমিদাররা। এবং মূলত তাদেরই মদতে ঝাড়খন্ডিদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবি ফের সামনে নিয়ে এল কংগ্রেস। অবশ্য, একটা বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, এই পৃথক রাজ্যের দাবির মধ্যে আদিবাসীদের জাতিসত্ত্বা এবং আবেগ ছিল পুরো মাত্রায়।  ঝাড়খন্ডিদের জন্য আলাদা রাজ্য গঠন হলেই আদিবাসীদের নিজের ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি সুরক্ষিত থাকবে, এই দাবি উঠে গেল ঝাড়গ্রাম মহকুমাজুড়ে। এই এলাকার পুরনো নকশালরাও পৃথক রাজ্যের দাবিকে সমর্থন জানালেন। আর সঙ্গে কংগ্রেসের জমিদারদের সমর্থন তো ছিলই। এই রকম এক পরিস্থিতিতে ঝাড়গ্রাম মহকুমায় মোট আটটার মধ্যে ছ’টা ব্লকে অপারেশন বর্গার কাজ ঠিকঠাক এগোচ্ছিল, কিন্তু ধাক্কা খেল দুটো ব্লকে। বেলপাহাড়ি এবং বিনপুর, এই দুই ব্লকে অপারেশন বর্গার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলল ঝাড়খন্ড পার্টি। বাধা এল। এই দুই ব্লকে অপারেশন বর্গা কর্মসূচি একেবারেই সফল করা যায়নি। অন্যদিকে, গোপীবল্লভপুর ১ এবং ২, ঝাড়গ্রাম, জামবনি, সাঁকরাইল এবং নয়াগ্রাম ব্লকে জমি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। অপারেশন বর্গা অনেকটাই সফল হয়। কিন্তু বেলপাহাড়ি এবং বিনপুরে গ্রামে গ্রামে সিপিআইএমকে ঢুকতে বাধা দিতে শুরু করে ঝাড়খন্ডিরা। আটের দশকের শুরু থেকেই এই অপারেশন বর্গাকে কেন্দ্র করে ঝাড়খন্ড পার্টি এবং কংগ্রেসের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সিপিআইএমের লড়াই, সংঘর্ষ শুরু হল। তীব্র সংঘর্ষ। খুনোখুনি। জমি নিয়ে লড়াই। শেষমেশ এই লড়াইটাই রাজনৈতিক এলাকা দখলের লড়াইতে টার্ন করল। যা আর কোনও দিনই থামানো যায়নি। ১৯৯১ সালে ঝাড়খন্ড পার্টির নরেন হাঁসদা এমএলএ হলেন। এরপরেই সংঘর্ষ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। নরেন হাঁসদা এমএলএ হওয়ার পর সিপিআইএমের কাছে শুরু হয়ে গেল রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধারের লড়াই।’ টানা বলে থামলেন ডহর সেন। ডহর সেন যেভাবে কথা বলেন, সামনে বসে কেউ শুনলে তাঁর মনে হবে, সিনেমা দেখছেন। কঠিন, জটিল রাজনৈতিক ওঠা-পড়া সহজ সরলভাবে হাজির করার মুন্সিয়ানা আছে তাঁর। হয়তো আদিবাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করে এই বিশেষ দক্ষতা আয়ত্ত্ব করেছিলেন তিনি। আর এই সহজ-সরল থাকা, আদিবাসীদের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তোলাই শেষমেশ রাজনৈতিক জীবনে কাল হল ডহর সেনের। ’৭৭ সালে সিপিআইএম সরকার গঠনের পর ঝাড়গ্রাম মহকুমায় পার্টির একাধিক কাজকর্ম এবং তা করার পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে দলের নেতৃত্বের একটা অংশের সঙ্গে বিতর্ক বাধল ডহর সেনের। অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত ডহর সেন বারবারই দলের মধ্যে বলতেন, ‘ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থক আদিবাসীরাও সিপিআইএম সমর্থক আদিবাসীদের মতোই গরিব। গরিব মানুষের একতাকে জাতি সত্ত্বার রাজনীতি দিয়ে ভাঙা যেতে পারে, কিন্তু মারপিট করে, সংঘর্ষ করে তাকে জোড়া লাগানো যাবে না।’ তাছাড়া তখন সরকার হয়ে গেছে কয়েক বছর। সিপিআইএম আর রাজ্যে বিরোধী দল নেই। সে তখন শাসক। বিরোধীরা অনেক কিছুই করতে পারে, ভুল-ত্রুটিও করতে পারে দু’পাঁচটা। কারণ, বিরোধী দলের শাসকের মতো দায়িত্বশীল হওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকে না। কিন্তু সরকার যদি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে তবে তো অরাজকতা সৃষ্টি হয়। আর তাই হল ঝাড়গ্রামের বিনপুর, বেলপাহাড়ি, জামবনি ব্লকে। ১৯৭৭ সালের পর সরকার বিরোধী ঝাড়খন্ড পার্টি যখন আরও ঐক্যবদ্ধ বেপরোয়া লড়াইয়ে শপথ নিচ্ছে, তখন তার মোকাবিলায় সিপিআইএমের প্রয়োজন ছিল যথার্থ শাসকের ভূমিকা পালন করার। গরিব আদিবাসীদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করার বদলে হাতে অস্ত্র নিয়ে পালটা নেমে পড়ল শাসক দল সিপিআইএমও। শাসক দলই যখন অস্ত্র হাতে বিরোধীর মোকাবিলায় নেমে পড়ে, আর যদি তার পাশে এসে দাঁড়ায় প্রশাসন, মানে পুলিশ, তবে যা হয়, তাকেই এক কথায় বলে আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ঝাড়গ্রাম মহকুমা। একদিকে ঝাড়খন্ড পার্টি। তার পেছনে কংগ্রেস। সঙ্গে পুরনো নকশালপন্থীদের প্রত্যক্ষ সমর্থন। অন্যদিকে, সিপিআইএম। তার সামনে পুলিশ। ছ’য়ের দশকের শেষে যে লড়াই শুরু হয়েছিল জমি রক্ষার এবং দখলের, তাই ১৯৭৭ সালে রাজ্যে সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের কয়েক বছরের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক লড়াইয়ে কনভার্ট করে গেল। প্রথমে জমির লড়াই, তারপর রাজনৈতিক লড়াই, আর এই দুইয়ের যোগফলে শুরু হল হিংসার রাজনীতি। হত্যা-পাল্টা হত্যা। আর শাসক দল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে এমন এক রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটেরই হয়তো অপেক্ষায় ছিল মাওবাদীরা। সঠিকভাবে বললে, এমসিসি। মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার। তখনও মাওবাদী পার্টি তৈরি হয়নি। ঝাড়খন্ডিদের হাত ধরে এবং তাদের মধ্যে সিপিআইএম বিরোধী সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে গরিব আদিবাসীর অধিকার লড়াইয়ে নামল এমসিসি। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে লড়াই শুরু হল বাম এবং অতি বাম শক্তির মধ্যে। যে লড়াইয়ের এপিসেন্টার বেলপাহাড়ি, বিনপুর, জামবনির কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকার শাল, অর্জুনের জঙ্গলমহল। তখন নয়ের দশক শুরু হয়ে গেছে। উদার অর্থনীতির ঢাকে কাঠি পড়েছে নয়া দিল্লিতে। অযোধ্যায় ধুলিষ্যাৎ হয়েছে বাবরি মসজিদ। দেশজুড়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় নানান সমীকরণ গড়ে ওঠার সময় সেটা। যে সমীকরণগুলোও কয়েক বছরের মধ্যেই প্রভাব ফেলতে শুরু করল ঝাড়গ্রামের রাজনীতিতেও।      ক্রমশ...।
    দোলজ‍্যোৎস্নায় শুশুনিয়া‌য় - ৬ - সমরেশ মুখার্জী | বিবর্তনের ধারাসুমন বলে, "ধরতাইটা ভালো‌ দিলি। স্বীকার করছি যা আলোচনা করতে যাবো তা নিয়ে আমার একটু সংকোচ ছিল কিন্তু তোদের কথায় তা কেটে গেল। তবে আমি হয়তো তোর মতো অতো গুছিয়ে বলতে পারবো না, আমার পড়াশোনা‌র গণ্ডী‌ সীমিত। তবু চেষ্টা করছি আমি যেভাবে ভাবি - বলতে। "দ‍্যাখ এটা‌ স্বীকৃত সত‍্য যে বর্তমান মানুষ আদিমানবের রূপান্তরিত রূপ। সেই আদিমানব ছিল  প্রাইমেটসদের সমগোত্রীয়। ওরাংওটাং এবং শিম্পাঞ্জি‌ তাই বর্তমান মানুষের পূর্বপুরুষের নিকটতম প্রতিনিধি হিসেবে গণ‍্য হয়। ট্রেনিং দিলে এরা মানুষের হাবভাব অনেকটা অনুকরণ করতে পারে। তবে আদিমানব ছিল পশুর‌ই মতন। চার হাত পায়ে চলতো, কাঁচা মাংস, ফলমূল খেত। একদিন সে পেছনের দুপায়ে দাঁড়াতে শিখল। সামনের দুটো হাত শরীরের ভারবহন থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সৃজনশীল যন্ত্রে রূপান্তরিত হলো। তা আবিস্কার করলো আগুন, চাকা, লোহার ব‍্যবহার। এই তিনটি যুগান্তকারী আবিস্কার তাকে আর ফিরে তাকাতে দিল না। কয়েক কোটি বছরের বিবর্তনের পরে আজ‌‌‌ও গরু হাম্বা হাম্বা বা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলেছে কিন্তু মাত্র এক কোটি বছরের মধ‍্যে মানুষের অবিশ্বাস্য রূপান্তর হোলো। ফলে মানুষ যে কেবল পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকুল থেকে আলাদা হয়ে গেল তাই নয় তাদের ওপর কায়েম করলো নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রন‌। এতো অল্প সময়ে এহেন উত্তরণ কী ভাবে সম্ভব হোলো? বিবর্তনবাদে এই মিসিং লিঙ্ক বিশেষজ্ঞ‌দের গবেষণার বিষয়, তা আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে।"সুমন একটু থামে। এখন জোৎস্না উজ্জ্বল। তিনজন গভীর অভিনিবেশে তাকিয়ে আছে সুমনের দিকে। সুমন বলে চলে, "আদিমানবের আদিতেও ছিল কয়েক কোটি বছরের ক্রমবিবর্তনের ধারা। ফলে পশুসমাজের নানান প্রবৃত্তি‌গত বৈশিষ্ট্য‌ আদিমানবের মধ‍্যে‌ও সঞ্চারিত হয়েছিল। বহু কোটি বছরের সঞ্চিত প্রবৃত্তি‌গত বৈশিষ্ট্য বা instictive characteristics মাত্র এক কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে বিশেষ পরিবর্তিত হ‌ওয়া সম্ভব নয়। ফলে পশুসূলভ নানা প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত মানুষের মধ‍্যে‌ও সুপ্ত‌ ভাবে রয়ে গেল।""তবে বুদ্ধি ও যুক্তিবোধের বিকাশের ফলে মানুষ বুঝতে শিখলো  সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষ কেবল প্রবৃত্তি‌গত তাড়নায় পশুর মতো আচরণ করতে পারে না। তৈরী হোলো আইন কানুন, বিধি-নিষেধ, প্রথা, লোকাচার। ঘোষিত হোলো সমাজে গ্ৰহণযোগ‍্য আচরণের প্রেক্ষিতে বিচ‍্যূতির শাস্তি। ফলে সংখ‍্যাগরিষ্ঠ মানুষ সচেতন‌ বিবেচনাবোধ ও সংযমী অভ‍্যাসে সমাজস্বীকৃত আচরণ করতে শিখলো। তাই ক্ষিধে পেলে ভিক্ষা চাওয়া যেতে পারে কিন্তু কেড়ে খাওয়া উচিত নয়। তবে অবচেতন মনে রয়ে যাওয়া অবদমিত প্রবৃত্তি‌গত বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে কিছু আচরণ কখনো সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণে‌র বাইরে চলে যায়। আর তখনই হয় সমস‍্যা। কখনো তা বাহ‍্যিক‌ভাবে শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় প্রকাশিত হয়। কখোনো তা চিন্তা ভাবনাকে প্রভাবিত করে।"প্রবৃত্তি ও প্রবণতা চুনি বলে, "বাব্বা, জেঠু! লোহা, সিমেন্ট, বালি ঘাঁটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে‌ তু‌ই‌ও তো দেখছি ঈশুর মতো‌ গুছিয়ে কথা বলছিস! বিবর্তনের ফলে ক্রমশ তথাকথিত অর্থে উন্নত হয়েও মানুষের মধ‍্যে কেন কিছু পাশবিক প্রবৃত্তি রয়ে গেছে সেটা তো ভালো‌ই বললি। কিছু  উদাহরণ দিয়ে কী খোলসা করা যায়?"সুমন বলে, "ঠিক বলেছিস। যত‌ই আমরা তাত্ত্বিক আলোচনা করি না কেন, উদাহরণ তা বুঝতে সাহায্য করে। যেমন ধর প্রাণীদের মধ‍্যে লড়াই মূলত হয় প্রজননের জন‍্য সঙ্গিনী নির্বাচন, দলের ওপর আধিপত্য কায়েম এবং  এলাকার  ওপর নিয়ন্ত্রণ‌ রাখতে। মাংসাশী প্রাণীর শিকার করা লড়াই নয় কারণ তা কেবল ক্ষুধা‌র তাড়নায়। এছাড়া গোষ্ঠী‌বদ্ধ প্রাণী - যেমন হাতি বা সিংহ - দল থেকে বিতাড়িত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তেমনি সন্তানের বিপদের আশাঙ্কা‌য় মা পশু‌ও রক্ষণাত্মক কারণে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া পশুরা অহেতুক নিজেদের মধ‍্যে মারামারি, খেয়োখেয়ি করে শক্তি ক্ষয় করে না। একান্ত‌চারী শ্বাপদ, যেমন দুটো পুরুষ বাঘ‌ও যদি আচমকা জঙ্গলে মুখোমুখি হয়ে যায় তাহলে তাদের প্রথম প্রবৃত্তিগত প্রতিক্রিয়া হবে পরস্পর‌কে এড়িয়ে যাওয়া। অর্থাৎ LIVE AND LET LIVE. তবে এই আপ্তবাক‍্য তারা দর্শনশাস্ত্র, গেম থিয়োরী ইত‍্যাদি ঘেঁটে শেখেনি। শিখেছে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায়।" "এবার দেখা যাক বুদ্ধিমান মানুষ কী করে। ভীড় বাসে অজান্তেই পা মাড়িয়ে দেওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাতেও কথা কাটাকাটি থেকে খিস্তি খেউড়, হাতাহাতি হয়ে ব‍্যাপার‌টা হয়তো থানা পুলিশ অবধি গড়িয়ে গেল। তার ফলে হয়তো দুজনেই ভুগলো।" তুলি বলে, "কিন্তু জেঠু, এটা কী বুদ্ধি‌মান মানুষের  পশুর মতো প্রবৃত্তিগত তাড়নায় আচরণের উদাহরণ হিসেবে ঠিক হোলো? তু‌‌ই তো এইমাত্র বললি পশুরা ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি করে না।"সুমন বলে, "তুলি, তুই একটা মোক্ষম ক্লু দিলি। এক্ষেত্রে তুই‌ও একটি প্রবৃত্তি‌গত তাড়না, মানে কৌতূহল, দমন করতে পারিস নি। তাই আমি বক্তব্য শেষ করার আগেই পেশ করলি তোর প্রশ্ন। অবশ‍্য এ তাড়না‌ও দমন করা সহজ নয়।" তুলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, "ওঃ, হ‍্যাঁ, তাই তো। তুই তো সবে একটা উদাহরণ দিয়েছিস মাত্র। তার পশ্চাৎপট, পরিণতি কিছুই ব‍্যাখ‍্যা করিস নি। সরি, সরি, ভুল হয়ে গেছে।"সুমন বলে, "ঠিক আছে। ডোন্ট মাইন্ড। এই উদাহরণ বিশ্লেষণ করলে দেখবি এতে প্রকাশ পাবে কিছু পাশবিক প্রবৃত্তি‌গত আচরণ যা মানুষের মধ‍্যে‌ আজ‌ও সুপ্ত ভাবে রয়ে গেছে। আবার দেখবি এমন কিছু প্রবণতা যা একান্ত‌ভাবে মানুষের‌ মধ‍্যে‌ই দেখা যায়। তা আবার পশুদের মধ‍্যে নেই। এই প্রবণতা‌‌গুলি‌র কিছু ধনাত্মক - যা জ্ঞান, চেতনা, শুভবুদ্ধি‌র উন্মেষে‌র ফলে মানব চরিত্রে বিকশিত হয়েছে। কিছু প্রবণতা আবার ঋণাত্মক - যেগুলি‌ মানুষের নিজের জীবনে বা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব‌ ফেলতে পারে। কখনো আপাতদৃষ্টিতে ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্য‌র প্রভাব‌ও হতে পারে সৃজনশীল‌‌।  ফলে নানা পরিপ্রেক্ষিতে বিবিধ পরিণতি সৃষ্টি‌কারী প্রবণতা‌গুলি যথেষ্ট জটিল, কখনো বিতর্কিত। এগুলো‌কে এক ছাঁচে ফেলা খুব মুশকিল।ঈশু বলে, "এই মাত্র তুই যা বললি তা যেন loud thinking বা আত্মকথনের মতো লাগলো। মানে,  তোর মনে কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে যা তুই নিজের মনেই আওড়াচ্ছিস। একটু জটিল হয়ে যাচ্ছে জেঠু। একটু সহজ ভাবে বল না বাবা"।
    শিক্ষা দুর্নীতি রায় - একটি সারসংক্ষেপ  - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | মান্থা আবার ৫০ হাজার চাকরি খেয়ে নেবেন বলেছেন। তাই আগের রায়টা একটু কষ্ট করেই পড়ে ফেললাম। গ্রুপ-সি গ্রুপ-ডি, বাদ দিয়ে স্রেফ শিক্ষকদের নিয়েই লিখছি। কোন কোম্পানি স্ক্যান করেছে, সরকারের কী ভূমিকা, অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ, এইগুলোও  বাদ। এটা খুবই ছোট্টো সারসংক্ষেপ। বহু জিনিস বাদ যাবে। আমার বিচারে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোই থাকছে। পুরোটা জানতে হলে অবশ্যই রায়টা পড়বেন, আমার মুখে ঝাল খাবেননা।  মামলার গোড়া থেকে আমার করা সারসংক্ষেপ এরকমঃ ১। অযোগ্যদের সরানো নয়, পুরো প্যানেল যে বাতিল (সেট অ্যাসাইড) করতে হবে, এবং আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে হবে, এই দাবীটা প্রাথমিক ভাবে তোলেন বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। (পাতা ৯২-৯৩) ২। পিটিশনারদের আইনজীবী আশিষ কুমার চৌধুরি, এরকম কোনো দাবী তোলেননি, অন্তত তুলেছেন বলে লেখা নেই। চৌধুরি বলেন, যে, দুটো অনিয়ম হয়েছে। এক, পার্সোনালিটি টেস্টের নম্বর বাকি নম্বরের সঙ্গে যোগ করা হয়নি। দুই, সিনিয়ারিটি বিবেচনা করা হয়নি। এছাড়াও তিনি কিছু খুচরো অনিয়মের কথা বলেন। সবকটাতেই র‌্যাঙ্ক বদলে যায়, ফলে প্রকৃত যোগ্য চাকরি নাও পেতে পারেন, বা পিছিয়ে যেতে পারে। (পাতা ৯৪) ৩। এ পর্যন্ত ওএমআর শিটে কোনো অনিয়ম থাকতে পারে সেটা আসেনি। সেটা নজরে আনে সিবিআই। তারা এসএসসির ডেটাবেস সিজ করে। এবং গাজিয়াবাদ থেকে ওএমআর শিট স্ক্যান করেছিল যে কোম্পানি, তার কর্মচারী, জনৈক বনশালএর কাছ থেকে তিনটি হার্ডড্রাইভ উদ্ধার করে। সেই হার্ডড্রাইভ গুলোতে ওএমআর শিটের স্ক্যানড কপি ছিল। ওএমআর শিটের হার্ড কপি পাওয়া যায়নি, কারণ, এক বছর পরে সেগুলো আর রাখা হয়না। এই হার্ডড্রাইভের ওএমআর এবং এসএসসির তথ্যে কিছু গরমিল পাওয়া যায়। তারা এসএসসিকে দেয় মূল্যায়ন করে ব্যবস্থা নিতে। (এটা অনেকগুলো পাতার সারসংক্ষেপ, সংখ্যা দেওয়া মুশকিল।)৪। গাজিয়াবাদ থেকে উদ্ধার হওয়া হার্ড ড্রাইভ যে আসল না ওটা সিবিআই ম্যানিপুলেট করেছে, এই নিয়ে প্রচুর বাকবিতন্ডা চলে। ম্যানিপুলেট না করে থাকলেও ওটাই যে আসল, এবং সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য কিনা, এ নিয়েও চলে। কিন্তু এই আলোচনায় তাতে ঢোকা হবেনা। ৫। এসএসসি, তাদের তথ্য এবং গাজিয়াবাদের তথ্য খতিয়ে দেখে কোর্টকে রিপোর্ট দেয়, কতগুলোয় গরমিল আছে তা নিয়ে। একাধিক রিপোর্ট পেয়েছি রায়ে, কোর্ট শেষমেশ যেটা বলেছে,  যে, বিশদ তুলনা করা হয়েছে (কারা কয়েছে লেখা নেই)। তার ফলাফল এরকমঃ  শিক্ষক (ক্লাস সিক্স থেকে বারো) দের মধ্যে গরমিল আছে ১৮৫৯ জনের। (গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডিতে গরমিল আছে, ৫০০০+ ।) (পাতা ২৪০)৬। এসএসসির সার্ভারে তথ্য থাকলেও কোনো ওএমআর ইমেজ ছিলনা। তারা আরটিআই এর  জন্য স্ক্যান কোম্পানির কাছ থেকে ইমেজ চেয়ে পাঠাত। তারা ওই ইমেজগুলোর সত্যতা মেনেও নেয়। সিবিআই এরও সেরকমই বক্তব্য। ( পাতা ২২৮) ৭। সব দেখে কোর্ট বলে, তার সামনে তিনটে জিনিস বেছে নেবার সুযোগ আছে। i) রিট পিটিশন বাতিল করা। ii) বেআইনী আর আইনী নিয়োগ আলাদা করে খুঁজে বার করা। iii) পুরো প্রক্রিয়াটাই বাতিল করা। ৮। কোর্ট তিন নম্বর জিনিসটাই বেছে নেয়। বেআইনী আর আইনী আলাদা করে খুঁজে বার করার চেষ্টা না করে। তার অনেকগুলো কারণ দেখায়। ক। যে কোম্পানিকে স্ক্যান করতে দেওয়া হয়, তারা সেটা সাবকন্ট্র‌্যাক্ট করেছিল। খ। এসএসসির সার্ভারে ওএমআর শিটের ইমেজ নাই। ইত্যাদি। যদিও সব পক্ষই একমত ছিল, যে, আসল ওএমআর শিট পাওয়া গেছে, এবং তা থেকে কোর্ট প্রতিটা গরমিল খুঁজেও বার করতে পেরেছে। সংখ্যাটা রায়েই আছে, আমিও ৫ নম্বর পয়েন্টেই লিখেছি। ফলে বেআইনী আর আইনী নিয়োগ বার করার কাজটা হয়েই গিয়েছিল, ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু তারপরেও পুরো প্রক্রিয়াটাই বাতিল করা হয়। কারণ, পুরো মেশিনারিটাই এমন করে বানানো হয়েছে, যাতে করে দুর্নীতি "খুঁজে পাওয়া না যায়, পেলেও প্রমাণ করা না যায়"। সিবিআই দুর্নীতি হয়নি বলেনি। তারা খুঁজে বার করেছে। এসএসসিও দুর্নীতি অস্বীকার করেনি। কতটা হয়েছে তার পরিমাপও সিবিআই করে দিয়েছে। সেই অনুযায়ী শিক্ষকদের মধ্যে ২ হাজারের চাকরি যাবার কথা, বা সরকারের গাফিলতি প্রমাণ হবার কথা। সরকারের জন্য এটাই যথেষ্ট লজ্জার। কিন্তু তাতে তো যথেষ্ট শক তৈরি হবেনা। পুরো রায়টাই দাঁড়িয়ে আছে শক থেরাপি জাতীয় একটা ধারণার উপর। আমি তো আইনের ছাত্র নই, তবে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার বলে একট প্রক্রিয়া আছে, আমরা জানি, যেখানে যা প্রমাণ হয়েছে, তার উপরে দাঁড়িয়েই বিচার হয়। যা খুজে পাওয়া যায়নি, প্রমাণ করা যায়নি, তার উপর দাঁড়িয়ে বিচার হয়, ক্রমশ জানছি। ২৬০০০ লোকের চাকরি খেয়ে তা নিয়ে উল্লাস করা যায় জানছি। এবং লোককে দিয়ে আট বছর খাটিয়ে মাইনে ফেরত চাওয়া যায় জানছি। এখন আইন-কানুন এই দিকেই চলেছে। মূল দাবীটা যার, সেই বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, কে যোগ্য কে অযোগ্য খুঁজে বার করা সম্ভব না। যারা টাকা দেননি, যোগ্য, তাঁদের আজকে সরকারকে প্রশ্ন করতে হবে, তোমরা দুর্নীতি কেন করেছিলে। এই প্রশ্নটা না করে তারা যদি প্রশ্ন করে, যে, সরকার দুর্নীতি করেছে বলে আমিই কেন শাস্তি পাব, সরকার দুর্নীতি করেছে বলে আপনার ওকালতি করার অধিকার কেড়ে নিলে কেমন হবে, তাহলে তিনি কি উত্তর দেন, জানার ইচ্ছে রইল। রায়ের লিংক - https://www.verdictum.in/pdf_upload/display-2024-04-22t130941416-1610751.pdf
  • জনতার খেরোর খাতা...
    হেদুয়ার ধারে -- ১২৫ - Anjan Banerjee | সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ দিবাকর সুমনার পড়ার ঘরে ঢুকে বলল, ' ফুচা ... তোকে কে একজন ডাকছে ... বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সাগর মন্ডল না কি একটা নাম বলল ... 'সুমনা হুড়মুড় করে নীচে নেমে এসে দেখল হাতে একটা খাম নিয়ে গেটের বাইরে সাগর দাঁড়িয়ে আছে।----- ' আরে ... আসুন আসুন ... 'সাগর ভিতরে ঢুকল না। ওখান থেকেই বলল, ' এই ... একটা কেস ছিল ... অলোকেন্দু মিত্রের সঙ্গে একটু কথা বলতাম ... '----- ' ও আচ্ছা আচ্ছা ... আসুন আসুন ... 'সাগরকে নিয়ে দোতলায় উঠে ডানদিকে ঘুরে অলোকেন্দুবাবুর পাশে মক্কেলদের বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, ' দু মিনিট বসুন, আমি বলছি ... 'বসবার ঘর এই মুহুর্তে একদম ফাঁকা। সাগর বসল। সুমনা ফ্যান খুলে দিয়ে চেম্বারের দিকে চলে গেল।অলোকেন্দুবাবু এক মক্কেলের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সুমনা ঘরে না ঢুকে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে রইল।অলোকেন্দুবাবু কথা থামিয়ে সুমনার দিকে তাকালেন।----- ' কিছু বলবি ? '----- ' সুমনা ঘরে ঢুকে অলোকেন্দুবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মাথা ঝুঁকিয়ে নীচু গলায় তার বাবার প্রায় কানে কানে কি বলল। সামনে বসা মক্কেল শিষ্টতাসূচক ভঙ্গীতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল। সুমনা বেরিয়ে এসে সাগরকে গিয়ে বলল, ' পাঁচ মিনিট ... আমি এক্ষুণি আসছি ... ', বলে সেখান থেকে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে মক্কেল ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। সুমনা ফিরে এসে বলল, ' আসুন দাদা ... ' অলোকেন্দুবাবু বললেন, ' নমস্কার, আসুন ... আসুন ... বসুন ... 'সাগর অলোকেন্দুবাবুর উল্টোদিকের চেয়ারে বসল।সুমনা বলল, ' দাদা আপনারা কথা বলুন। আমি একটু পরে আসছি ... 'সুমনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।অলোকেন্দুবাবু সাগরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে বসে রইলেন।তারপর বললেন, ' সুমনাদের আপনি কিভাবে রেসকিউ করেছিলেন সব শুনেছি। আমি আপনার নাম শুনেছি অনেক কিন্তু এই প্রথম স্বচক্ষে দেখলাম আপনাকে। ওসব কথা পরে হবে। আগে আপনার কেসটা শুনি ... 'সাগর হাতের লেফাফাটা বাড়িয়ে ধরল অলোকেন্দুবাবুর দিকে।সব শুনে এবং উকিলের চিঠিতে চোখ বুলিয়ে অলোকেন্দুবাবু বললেন, ' ঠিক আছে অসুবিধে হবে না ... ছকে বাঁধা ফরম্যাট। ওদের অ্যাড্রেসটা... আচ্ছা ... এই যে ... পেয়েছি ... রিপ্লাইটা তৈরি করে কালকের মধ্যে পাঠাব ওদের অ্যাড্রেসে। কিন্তু ওদের এগেনস্টে একটা এফ আই আর করে রাখার দরকার ছিল বারুইপুরে লোকাল থানায়। সেটা তো করা হয়নি। আর এখন কেই বা করবে। যাকগে এখানকার বটতলা থানায় করে রাখা যেতে পারে। যদি দরকার হয় আমি যেতে পারি মেয়ের গার্ডিয়ানের সঙ্গে। এফ আই আর টা কেসটাকে স্ট্রং সাপোর্ট দেবে। আজ তো আর হবে না। কাল সকালে যদি থানায় যাওয়া যায় ... বেশিক্ষণ লাগবে না ... 'এই সময়ে সাগর বলল, ' আপনাকে থানায় যেতে হবে না স্যার ... ওটা আমিই করে নিতে পারব। আপনি শুধু বয়ানটা রেডি করে দিন .... '------ ' আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যখন আছেন অসুবিধে হবার কথাই নয়। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি লিখে দিচ্ছি। যদিও এসব লিখে নিয়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই। ওরা আপনাদের কাছ থেকে কমপ্লেন্টটা শুনে নিজেদের মতো করে নোট রেজিস্টার করে নেবে। তবু থানার সুবিধের জন্য একটা পিটিশন লিখে নিয়ে যাওয়া ভাল। মানে, প্লেনটিফ চৈতালি পাল(সরকার)- এর সঙ্গে কি কি দৈহিক এবং মানসিক টর্চার হয়েছে সেটা ডিটেলে লিখতে হবে। আমাদের কমন লইয়ার কাস্টম অনুযায়ী অনেকটা বাড়িয়ে লিখতে হবে। মানে, রেপ না হলেও বলতে হবে রেপ হয়েছে, অন্তত অ্যাটেম্পট টু রেপ হয়েছে ... এরকম আর কি ... এটা, ফর এগজাম্পল বললাম, বুঝতে পারছেন তো ...।---- ' হ্যাঁ হ্যাঁ .... বুঝতে পেরেছি। জানি এগুলো। এই সব লাইনেই তো ঘোরাঘুরি ... হাঃ হাঃ ... '----- ' তাছাড়া উপায় কি ? কাউকে না কাউকে তো জঞ্জাল সাফাইয়ের জন্য হাতে ঝাঁটা ধরতেই হবে ... '----- ' তাই তো ... আর একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে ...----- ' কি ? '----- ' আপনি আপনার জবাবি চিঠিতে কি লিখবেন ? '----- ' হ্যাঁ, এটা একটা সঙ্গত প্রশ্ন। আমি লিখব যে, আমার মক্কেলের অভিযোগ, সে শ্বশুরবাড়িতে থাকাকালীন নানারকম দৈহিক, মানসিক, এমনকি প্রাণসংশয়জনিত অত্যাচার এবং নারী সম্মানহানিকর কর্মে বাধ্য করার প্রচেষ্টার সম্মুখীন হয়েছে তার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কেন বধুনির্যাতনের ফৌজদারি ধারা লাগু হবে না, সবার আগে সে প্রশ্নের জবাব পেলে,তারপর আপনাদের বক্তব্য এবং দাবির বিষয়বস্তু নিয়ে আইনসঙ্গত আলোচনা করা যেতে পারে। সাতদিনের মধ্যে এ চিঠির জবাব না পেলে আমার মক্কেলের বক্তব্য ও দাবি যথাযথ বলে বিবেচিত হবে এবং ভারতীয় ফৌজদারি আইনের নির্দিষ্ট ধারা অনুযায়ী আপনার মক্কেলের বিরুদ্ধে আইনি মামলা শুরু করা হবে ... 'সাগর একদৃষ্টে অলোকেন্দুবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছিল।সে বলল, ' বুঝতে পারলাম। কিন্তু স্যার ... চৈতালির ওপর টর্চার ফর্চারের ব্যাপারগুলো প্রমাণ করা হবে কি করে ... '----- ওহ ইয়েস ... ইটস এ ভেরি পার্টিনেন্ট কোয়েশ্চেন। না প্যালপ্যাবল বা প্রাইমা ফেসি এভিডেন্স কিছু নেই। কিন্তু আই পি সি-র অনেক ধারাই রয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে মেয়েদের পক্ষে। শুধু তাদের জবানবন্দিই কেসটাকে তাদের ফেভারে নিয়ে আসার পক্ষে যথেষ্ট। 'সাগর বলল, ' হমম্ ... বুঝলাম ... 'একটুখানি ভেবে নিয়ে সাগর বলল, ' স্যার যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ?'অলোকেন্দুবাবু সাগরের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।সাগর বলল, ' না, তেমন কিছু না ... বলছি যে আপনি কি ক্রিমিনাল কেসও করেন ? '----- ' ও, এই কথা। হ্যাঁ, ক্রিমিনাল, সিভিল দুটোই করি ... ও ব্যাপারে চিন্তা করবেন না। আমার ট্র্যাক রেকর্ড আমার লাইনে সবাই জানে। 'এই সময়ে সুমনা ঘরে এসে ঢুকল।এসে বলল, ' হয়েছে ? 'সাগর বলল, ' হ্যাঁ ... সে তো হয়েছে ... কিন্তু অভয় তো গরীব মানুষ... তাই... যদি ... 'সুমনা বলে উঠল, ' আপনাকে ওসব নিয়ে ভাবতে কেউ বলেছে ? যদি বলে থাকে ... বলুন একবার ...'অলোকেন্দুবাবু ভীত ভঙ্গীতে বললেন, ' ওরে বাবা... কার বুকের অত বড় পাটা আছে ? আমি কিন্তু কিছু বলিনি সাগরবাবু .... 'সঞ্চারী সেদিন রাত্তিরে অমলের ঘরে ঢুকে বলল, ' দাদাভাই রাত্রির সঙ্গে তোর কিছু কথা হয়েছে ? '----- ' হ্যাঁ, মানে... সেদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিল ... শ্যামবাজার ট্রামডিপোর ওখানে ... আমি আসছিলাম ওখান দিয়ে ... ', অমল থতমত খেয়ে বলল।---- ' ও আচ্ছা ... ও নাকি তোকে কোথায় নিয়ে যাবে ... প্রফেসর নিখিল ব্যানার্জী বলে একজনের কথা বলছিল ... '----- ' হ্যাঁ ... সেদিন বলছিল ... কি একটা অর্গানাইজেশন... '----- ' হ্যাঁ ... সেটাই ... যাই হোক, কাল সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ তোকে দাঁড়াতে বলেছে। 'অমলের মনের সরোবরে টুপ করে একটা বটফল খসে পড়ল জলের ধার থেকে। জলের আকুল বৃত্ত ছড়িয়ে পড়ছে মৃদু তরঙ্গ এঁকে। অমল চুপ করে রইল, কি বলবে ভেবে না পেয়ে।একটু পরে তরঙ্গ থিতু হতে সে বলল, ' কোথায় ? '----- ' বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে। আমাকেও বলছিল যেতে ... আমি রাজি হইনি। দূর ... কি সব ... আমার ওসব ভাল লাগে না। রাত্রির এগুলো বড্ড বাড়াবাড়ি ... সব ব্যাপারে নাক গলানো চাই। তুই যদি না যেতে চাস তো বল, আমি কাল ইউনিভার্সিটিতে বলে দেব ওকে ... 'অমলের বুক ধড়ফড় করে উঠল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ' না না... ব্যাপারটা ইন্ট্রেস্টিং মনে হচ্ছে ... যাব যাব ... '----- ' ঠিক আছে, আমি তা'লে ওকে সেই কথাই বলে দেব ... বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে ... '----- ' হুঁ হুঁ ... 'অমল ভাবল, ভাগ্যবিধাতা বলে যদি কেউ থাকেতাকে অজস্র ধন্যবাদ যে সঞ্চারী নিখিলবাবুর ওখানে যেতে রাজি হয়নি।কাল সন্ধে আসতে এখনও প্রায় চব্বিশ ঘন্টা বাকি। কিন্তু সে স্বপ্নদোলায় দুলতে লাগল এখন থেকেই। পরে কি হয় কে জানে। ( চলবে )********************************************
    রাজনীতি ও ভদ্রলোক - Pinaki Bhattacharya | …গুড়্‌ গুড়্‌ গুড়্‌ গুড়িয়ে হামা খাপ্‌ পেতেছেন গোষ্ঠো মামাএগিয়ে আছেন বাগিয়ে ধামা এইবার বাণ চিড়িয়া নামা- চট্‌!এই যা! গেল ফস্কে ফেঁসে- হেঁই মামা তুই ক্ষেপলি শেষে?ঘ্যাঁচ্‌ ক'রে তোর পাঁজর ঘেঁষে লাগ্‌ল কি বাণ ছট্‌‌কে এসে- ফট্‌?রাজনীতির আঙিনায় গোষ্ঠ মামার অভাব নেই। কতো রকমের গোষ্ঠোমামা। কতো বিচিত্র তাদের খাপ! কিন্তু স্বয়ং সুকুমার রায় দেখিয়ে দিয়ে গেছেন  খাপ পাতলেই পাখি ধরা পরে না। রাজনীতির আবহে, বলা ভালো ভোটের আবহে এই খাপ অতীব সুচারু রূপ নেয় সেকথা আমরা ভালই টের পাই। কিন্তু খাপ পাতলেই তো হলও না, যেকোনো সাফল্যের পিছনে  ইচ্ছা-সক্ষমতা-সুযোগের এক ত্র্যহস্পর্শ থেকে যায়। সেই মিলন না হলে সব বুমেরাং।এবার আসল কথায় আসি- বিগত নির্বাচনে  হিন্দুত্ববাদী সংগঠন তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলটি কে বাংলায় ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে এই তিনের মেলবন্ধন ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। ঠিক যেমনটি করছে এই লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে দলটিকে বাংলায় অন্তত আসনের নিরিখে প্রধান দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। যে প্রকার এবং পদ্ধতি তারা অবলম্বন করেছিল, অর্থাৎ ‘খাপ’পেতেছিল নির্দ্বিধায় বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তা ছিল অভিনব।কিন্তু এহেন প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখল না, কেন? খামতি কোথায় ছিল? ইচ্ছার খামতি বললে তো দলটির নিজের অস্তিত্বের দিকেই প্রশ্ন উঠে আসবে। তবে কি সক্ষমতা আর সুযোগ? উল্টোদিকে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল সরকারী সাহায্যের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করতে উদ্দ্যত। কিন্তু তার আড়ালে তৃতীয় রিপুর নগ্ন নৃত্য। খানিক লঘু ভাবে বলতে গেলে এদের রাজনৈতিক টিউন কখনই 'ভুপালী' রাগে বাঁধা যায় না কারণ ঐ রাগে 'মা' ,'নি' নাই। কিন্তু এই আবহে কি করছে বাঙালি ভদ্রলোক যাদের হাতেই একসময় রাজনীতির রাশ থাকতো। তারাও কি পাল্টে গেল?  ধর্ম এবং দুর্নীতির আবহে কেমন আছে তারা? রাজনীতির শেয়ার বাজার২০২১ এ বাংলায় ভোটের হাওয়া যত বইতে শুরু করল জনমানুষে প্রচার হতে লাগলো এবারের বাংলায় পরিবর্তনের পরিবর্তন হতে চলেছে। পাড়ার আড্ডা, চায়ের দোকান, অফিস-কাছারি,ট্রেন-বাস এমনকি বাড়ির হেঁসেল থেকে কলতলা সর্বত্র এক কথা, বাংলার মসনদে নতুনের আগমন এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। হাওয়া বলতে এখানে মানুষের ধারণাকে ধরে নেওয়া যেতে পারে।একে অপরের সাথে কথা বলে যে ধারনাটি উঠে আসছিল তাকেই পথ চলতি মানুষ হাওয়া বলে মেনেও নিচ্ছিল। কিন্তু যে মাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের বিরোধ করেছিলেন, কোন জাদু বলে সেই মাটিই বিভাজনের রাজনীতির কারিগরদের আহ্বান করবে?একি কোনও ম্যাজিক, নাকি এক রাজনৈতিক অসারতার ফলে সৃষ্ট ‘শূন্যস্থান পূরণ’এর আখ্যান। ভরত মুনি তার নাট্যশাস্ত্রে বলছেন একটি মাত্র রসে নাকি নাটক হয় না। রাজনীতির উত্থান পতনে  চূড়ান্ত নাটকীয় উপাদান থাকে, আর তাই তার চালিকা শক্তিও যে কখনো একটি রস বা প্রভাবক হবে না এটাই স্বাভাবিক। ভোট পূর্ববর্তী যত ধরনের সমীক্ষা আমরা দেখেছিলাম, তার বেশীরভাগের মধ্যে একটি অদ্ভুত প্রবণতা চোখে পড়ছিল, যেটি এই লোকসভা ভোটের আগেও দেখা যাচ্ছে। প্রবণতাটি এই যে, যেসমস্ত মানুষ রাজ্যের শাসক দলকে নিজের ভোট টি দেবে বলে মনস্থ করেছে, তাদের একটি অংশ কিন্তু মনে করছে শাসক দল নাও জিততে পারে। অর্থাৎ যে মানুষটি ভোট দিচ্ছে, সে নিজেও নিজের ভোটের কার্যকারিতা বিষয়ে সন্দিহান। অবশ্যই এটি পারিপার্শ্বিক কথা বার্তা এবং নিজের ইচ্ছার মধ্যে চলা এক দ্বন্দ্বর বহিঃপ্রকাশ। এই চিন্তার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে দোদুল্যমান ভোটার। কিন্তু এহেন perception এর খেলায়  ভোটার নিজের ভোটকে অকার্যকরী মনে করে তাকে পরিবর্তন করার কথা ভেবেও ফেলতে পারে, হাজার হোক ‘আমার যখন কোনও বাঁধাধরা দল নেই তখন আমি পরাজিতের দলে যাব কেন?’- এই মানসিকতা কে লক্ষ্য করে ভোট কুশলীরা গুটি সাজিয়ে চলেছে। বাংলার ভোট রাজনৈতিক ইস্যুর সাথে technical চালের মিশেল দেখতে পেল, হয়তো দ্বিতীয়টিই প্রকট হতে চাইছিল। রাজনীতি কে অরাজনৈতিক করে শেয়ার বাজারের রীতিতে চালানোর প্রচেষ্টা প্রকট হতে লাগলো, আর তার হাত ধরেই উঠে এলো বেশ কিছু শঙ্কা ও প্রশ্ন।  ইতিহাস বলছে বাংলা তার মসনদ রাজনৈতিক বা গণআন্দোলনের ঐতিহ্য ছাড়া কাউকেই ছেড়ে দেয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেসিদের একচ্ছত্র শাসনের পিছনে ছিল দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের ছায়া। ষাটের দশকে এই গতিধারা কে প্রথম প্রশ্নের মুখে ফেলে বামপন্থী আন্দোলন। বাংলার বামপন্থী আন্দোলন বিভিন্ন খাতে বইলেও মূল ধারার বামপন্থী দল গুলির সাতাত্তরে ক্ষমতায় আসার পিছনে এই আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। দুহাজার এগারো তে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবাংলায় বাম শাসনের অবসান ঘটাতে সেই গণআন্দোলনের পথই বেছে নিয়েছিল। সেই আন্দোলনের অভিমুখ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুই হতে পারে, কিন্তু এটা অস্বীকার করা যায় না যে আজকের ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় থাকার অন্যতম প্রধান কারণ সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলন। ২০২১ এর নির্বাচনে প্রথমবার এই ঘরানা যেন ধাক্কা খেতে চলেছিল। যে হিন্দুত্ববাদী দল ক্ষমতায় আসবে বলে আপামর জনসাধারণ মনে করছিল বাংলার প্রেক্ষিতে তাদের বৃহৎ আন্দোলনের কোনও ইতিহাস নেই। কিন্তু তবুও এই ধরনের চিন্তা সবার মনে আসার পিছনে কিছু কারণ অবশ্যই ছিল। অতীতে বাংলায় যত গণ আন্দোলন হয়েছে তার পিছনে যেমন সাধারণ মানুষ থেকেছে, তেমনি দেখা গেছে বাঙালি বুদ্ধিজীবী এবং বাঙালির একান্ত ভদ্রলোক সম্প্রদায়কে। ভদ্রলোক তার চরিত্রের মূল বীজটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে থেকে গেছে। দলের সাথে তার বিশ্বাসের সংঘাত হলে সে নিজেই সেখান থেকে সরে গেছে। সেই অপসারণ বা বিমুক্তিই তার রাজনৈতিক অবস্থান কে স্পষ্ট করে দিয়েছে। এর মধ্যে কিছু মানুষ দল বদল ও হয়তো করেছে। রাজনীতিতে দলবদল কোনও নতুন বিষয় নয়। দলবদল কিংবা দল ভাঙ্গার সাক্ষী বাংলা বহুবার থেকেছে। কিন্তু উপযোগীতাবাদের বিকৃত রূপ কে ঢাল করে দলে দলে দলবদল-২০২১ এ যার গালভরা নাম দেওয়া হয়েছিল ‘যোগদান মেলা’- ‘বইমেলা’ প্রিয় বাঙালির কাছে অনেকটাই নতুন। শেয়ার বাজারের গতি প্রাপ্ত শেয়ার কিনে কিছুদিনের মধ্যে ফাটকা টাকা রোজগারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই ‘যোগদান মেলা’ আসলে রাজনৈতিক ফাটকাবাজির নামান্তর। উদারীকরণে সিক্ত বাঙ্গালীর কাছে শেয়ার বাজার আজ কোনও নতুন বিষয় নয় বরং তার আকর্ষণ ক্রমবর্ধমান।সেই দিক দিয়ে বিচার করলে ‘ডেটা’ নির্ভর এই রাজনৈতিক ফাটকাবাজি সাধারণ মানুষ কে আকর্ষণ করবে। এখানেই ছিল প্রথম ভয়।রাজনীতি কি তার মূলগত চরিত্রকে বিসর্জন দিয়ে কেবল ‘টেকনিকাল’বিষয় হয়ে উঠতে পারবে?ভদ্রলোকের মেটামরফোসিসপঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনীতির - যার প্রায় গোটাটাই ভদ্রলোক সমাজ নিয়ন্ত্রন করত, যে সামাজিক উত্তরণের স্বপ্ন ছিল তা আজ অবলুপ্তির পথে। ভদ্রলোকের পিছুহাঁটা বস্তুত গত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে চেনা যায়। ক্রমশ রাজনীতিতে, সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে একটা নতুন ধরণের মেজাজ ফুটে ওঠে। স্বাধীনতা পরবর্তী দশকগুলিতে নানা খাতে ক্রমবর্দ্ধমান সরকারী ব্যয় ও পরে কৃষিক্ষেত্রে সেচ, উন্নতমানের বীজ ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগে গ্রামাঞ্চলে আস্তে ধীরে অবস্থা পালটাতে থাকে। বামফ্রন্ট শাসনের প্রতিষ্ঠার পর অপারেশন বর্গা ও পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের ফলে গ্রামীণ ক্ষেত্রে আগের থেকে বেশি সম্পদের আমদানি ঘটে। ফলে তৈরি হয় এক নতুন ধরণের উপভোক্তা। সরাসরি গল্প বলা, কোন জটিল শৈল্পিক ধুসর জায়গা নেই, বরং আছে  নাটকিয়তায় ভরপুর অভিনয় রীতি যার মূল ব্যবসা ছিল জেলায়, গ্রামে। এখানেই জন্ম নেয় নতুন উপভোক্তা যাদের তথাকথিত ভদ্রলোকেরা তাদের সঙ্গে সমাসনে বসাতে না চাইলেই তারাও চোখে চোখ রেখে বলে উঠেছে ‘ আমিও কিন্তু ভদ্র বাড়ির ছেলে/মেয়ে’। প্রাথমিক ভাবে   ভদ্রলোক হতে গেলে শিক্ষা ও পারিবারিক সম্পদ থাকতে হবে, কারণ এর সাথেই জুড়ে থাকে ভদ্র পেশা। আর যেহেতু পেশা এবং শিক্ষা দুটিই উচ্চ বর্ণের পরিবারগুলির মধ্যেই বেশি পাওয়া সম্ভব, তাই ভদ্রলোকের সঙ্গে জুড়ে গেল উঁচু জাতের তকমা। বাংলার বাইরে বাঙালির বহুদিন যাবত দুটি পরিচয় সর্বজনবিদিত।  বাঙালি নাকি স্বভাব বামপন্থী। চৌত্রিশ বছরের বাম জমানা এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে। বাংলার ভেতরে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে কে বড় বাম সে বিষয়ে তর্ক বিতর্ক চলতে থাকলেও, বাংলার বাইরের মানুষজন বাংলা কে বামপন্থীদের আঁতুড়ঘর হিসেবেই দেখে এসেছে। এই রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াও বাঙ্গালির একটি অন্যতম সামাজিক পরিচয়‘আনন্দ’সিনেমার ভাষায় ‘বাবুমশাই’। এই বাবুমশাই বাঙালির আদি বাবুসমাজের প্রতিভূ নয়, বরং দর্শনের দিক থেকে একে ভদ্রলোক বলাই শ্রেয়। চিন্তাশীল বাঙালি, সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি কিংবা অর্থের চেয়ে বিদ্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া বাঙালির ছবি এই ভদ্রলোকের মধ্যে ফুটে ওঠে। রাজনীতিতে ক্ষমতার কাছে থাকা এই ভদ্রলোকেরাই রাজনৈতিক ভাষ্যের সুরটি বেঁধে দিয়ে এসেছে। বহু দশক ধরে এই সুরটিই হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থী দলগুলির প্রসারের অন্তরায় ছিল। সঙ্গত কারণেই বাম ঘরানার রাজনীতিকে তারা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর বলেই মনে করতেন।হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি বাংলার সৃষ্টি ও কৃষ্টি বিষয়ে নিজেকে অত্যন্ত সজাগ দেখাতে গিয়ে অনুপ্রবেশের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে বাংলায় পরিচয়ের রাজনীতি কে আহ্বান করে বসেছে। পশ্চিমবঙ্গের সীমানা কেবল বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাই লঙ্ঘন করেনি, তাদের সাথে ওপার বাঙ্গালার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং বাংলার আরেকদিকে বিহার, ওড়িশার মত রাজ্যের লোকেরাও করেছে। তারা এখানে বসতি গড়ে তুলেছে।স্বভাবতই বহুদিন ধরে থাকার ফলে এই সকল মানুষের আচার বিচার সংস্কার বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এই প্রভাবের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আমরা আমাদের একান্ত নিজেদের অনুষ্ঠান কিংবা উৎসবেও পেয়ে থাকি।বাংলায় হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রভাব অ-হিন্দিভাষী এলাকাগুলির মধ্যে সর্বাধিক বললে অত্যুক্তি হয়না। একদিকে অবাঙ্গালী জনসমাগম এবং গণমাধ্যমের প্রভাবের ফলে হিন্দিবলয়ের সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে আমাদের অজান্তেই প্রবেশ করতে শুরু করে।এই পটপরিবর্তন শহর থেকে শুরু করে গা-সওয়া হতে হতে মফস্বলে প্রবেশ করার পর আমরা যেন এর একটা সার্বিক রূপ খুঁজে পেলাম।একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঙালির প্রিয় নেশা বলতে পান এবং  নস্যিকেই  বোঝান হতো। এমনকি শিবের উপাসক বাঙালি নেশা-ভাঙেও ওস্তাদ মানা যায়। কিন্তু সেই বাঙালি খৈনি খাওয়া শিখল কোথা থেকে? সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে যে কয়েকটি হিন্দি সিনেমা সারা ভারত কে উদ্বেলিত করেছিল তাদের মধ্যে একটি অন্যতম ছিল ‘শোলে’। এই সিনেমার অন্যতম চরিত্র গব্বর সিং এর হাতে থাকা ঐ অদ্ভুত খাদ্যটি বাঙ্গালীর নজর কাড়ে। বাঙালি প্রথম এক নতুন অভ্যাসের স্বাদ পায়, যা ক্রমে ক্রমে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। একটা সময় অবধি অবাঙালিদের কর্মকাণ্ড কলকাতা কেন্দ্রিক কিংবা বড় শহরগুলি মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গণমাধ্যম এর প্রভাবে নতুনের এই রূপ আমাদের মনে স্থান করে নিতে থাকে। উৎসবের ভুরিভোজ থেকে রূপসজ্জা কিংবা হাল আমলে বাঙালির পূজার বৈচিত্র্য এই প্রভাবের নামান্তর মাত্র। আবার এই গণমাধ্যমের মাধ্যমেই আশির দশকের শেষের দিকে বাঙালি রামায়ণ-মহাভারত দেখেছিলো। রামায়ণ মহাভারত বাঙ্গালির পরিচিত নাম। কিন্তু রামজন্মভুমি আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপের প্রাক্কালে এই ‘গণ-দর্শন’নিঃসন্দেহে ধর্মীয় রাজনীতির এক ভিত্তি ভূমি স্থাপন করতে সফল হয়েছিল। সেই সময়ে রবিবারগুলির সকালের চিত্র যে কোনও বন্ধের দিন কে হার মানাত। রবিবার ধর্মবারে রূপান্তরিত হয়ে গেল। শুধু ধর্ম কাহিনী নয় রাম এবং জাতীয়তাবাদ কে জড়িয়ে ক্রমাগত এক নতুন ভাষ্য তৈরি হতে লাগলো।কিভাবে রাষ্ট্র, পরিবার, ব্যক্তি একে অপরের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, কিভাবে রাষ্ট্র বাঁচলে পরিবার কে বাঁচানো সম্ভব কিংবা কোন পরিবারের মঙ্গল কেবলমাত্র রামের আশীর্বাদের উপর নির্ভর করে থাকে এগুলিই সিনেমার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে লাগলো। রোজা, মুম্বাই থেকে সারফারোশ' হয়ে হাম আপকে হ্যায় কৌন, বা হাম সাথ সাথ হ্যায় এর মতো সিনেমা তা দেখিয়ে দিয়েছে। চিত্র সমালোচক শিলাদিত্য সেন তার লেখায় দেখিয়েছেন এই জাতীয় চলচ্চিত্র কিভাবে আমাদের ভাবনায় ঘুরপথে ‘রামরাজ্য’কে প্রতিষ্ঠা করেছে বা ‘পাকিস্তান’ কে ক্ষণে ক্ষণে শত্রু ভাবতে সাহায্য করেছে। হিন্দি সিনেমা প্রিয় বাঙালি মনে হিন্দুত্ববাদী ভদ্রলোকচিত এজেন্ডার জেগে উঠতে থাকে।  আমাদের অজান্তেই আমাদের ‘ফিল গুড’ মগজ ধোলাই হতে থাকে।        পলিটিক্স বনাম পপুলিজমরাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা একমাত্রিক হতে নেই। তাই একদিকে যেমন গণেশের মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন, রাম সেতু কিংবা মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট খোঁজা চলতে থাকে, তেমনই তার বিপরীতে একই তালে চলতে থাকে ‘নরম হিন্দুত্ব’ এবং ফ্রাঞ্ছাইজি রাজনীতির মিশেল। ধর্ম ও দুর্নীতির দ্বৈরথে বাঙালী ভদ্রলোক এখানে অসহায়,কারণ ‘তর্কপ্রিয় বাঙালি’ এই ধরণের অ-রাজনীতি আগে প্রত্যক্ষ করেনি। এই অরাজনৈতিক চিন্তার রাজনীতি তথাকথিত বাঙালি ভদ্রলোককে বাক-রুদ্ধ করে ফেললেও আরেকটি শ্রেণি এই রাজনীতির প্রভাবে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বহুদিন ধরে বাঙালির ‘ভদ্রসংস্কৃতি’র চাপে যে জনগোষ্ঠী নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রকাশ করতে পারেনি, কিংবা তাদের চাহিদার কোন চটজলদি সমাধানের হদিশ করতে পারেনি, অথবা এতদিনের জমে থাকা ক্ষোভ রাখার কোন আধার খুঁজে পায়নি তারাই এই রাজনীতির অন্যতম বাহক হয়ে ওঠে। সৃষ্টি ও কৃষ্টির উপাদান এই শ্রেণীকে ভদ্রসমাজ  বাস্তবে  ছুঁতে না পারার ফলে রাজনীতির আঙিনায় এরা খুঁজে নিয়েছে এক স্বকীয় রাজনৈতিক ঘরানা।তথাকথিত বাম জামানার অবসানের নেপথ্যেও এই সমাজের ভূমিকা ছিল। কিন্তু একই সাথে সেই শক্তির হাত ধরে জন্ম নেওয়া সিন্ডিকেট বা ফ্রাঞ্ছাইজি রাজনীতি হিন্দুত্ববাদীদের নতুন করে জায়গা করে দিতে থাকে।রাজনীতিতে ব্র্যান্ডিং বিষয়টি  এতটা নগ্ন ভাবে আগে কখনো দেখা যায়নি। একটি বিক্রয় যোগ্য দ্রব্যকে যে ভাবে প্রচারের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়, সেই পথে রাজনীতির ভাষ্য ক্রমাগত এক ব্যক্তির কাল্পনিক কারিশমাকে কল্পরাজ্যের দিশারী হিসেবে তুলে ধরতে লাগলো। তবে এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ধারা নয়, এই প্রবণতা এই সময়ে সমস্ত বিশ্বেই অল্পবিস্তর দেখাযাচ্ছিল। বাংলায় এই জাতীয় রাজনৈতিক ভাষ্য বাঙালির কাছে অনেকটাই  চেনা, কিন্তু এই ভাষ্যে ছিল এক নতুনের স্বাদ। এই অরাজনৈতিক পূর্ণতা এবং রাজনৈতিক শূন্যতাই কি আগামীর চালিকা শক্তি?বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই জানে রসায়নাগারে বিক্রিয়ার মাধ্যম বিক্রিয়া সংগঠিত হওয়ার এক অন্যতম শর্ত। মাধ্যম আম্লিক থেকে ক্ষারীয় হয়ে গেলে যেমন বিক্রিয়ার ধরন পরিবর্তিত হয়ে যায়, ঠিক তেমনই বাংলার রাজনৈতিক বাতাবরণে ক্রমাগত বাড়তে থাকা ধর্মীয় বাতাবরণ অনেক মতের পক্ষেই শ্বাসরোধকারী হয়ে উঠতে থাকে।ধর্ম, জাতীয়তাবাদকে শিখণ্ডী করে লড়তে গিয়ে এই মৌলবাদী দল বারংবার অতীতের এক স্বপ্নের দেশের গল্প ফেঁদে বসে।মৌলবাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য সে কখনই মনে করে না যে জীবন্ত  সমস্যার সমাধান বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে হয়, বরং মৌলবাদ বলতে চায় অতীতের কোনও আকর গ্রন্থে এর সমাধান আছে।বাউম্যান এর কথায় এই হলও ‘Retrotopia’, দৃষ্টি পিছনে রেখে ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে চলা। এই পিছনে মুখ করে সামনে হেঁটে চলাকে যে বিরোধ করবে সে একই সাথে ধর্ম,জাতীয়তাবাদ এবং সুখস্বপ্নকে আঘাত করে ফেলবে।এই অবস্থায় এই রাজনৈতিক আবহ কে আঘাত করতে না পেরে যারা এই মাধ্যমের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে চাইল, তারা সকলেই  ধর্মীয় রাজনীতি জুতোয় পা গলিয়ে ফেলল। কোন দল রামনবমী করলে, তার পাল্টা হিসেবে হনুমান জয়ন্তীর বিশাল শোভাযাত্রা ক্রমে ক্রমে বাংলার রাজনীতির স্বভাব হয়ে উঠতে লাগলো।রাজনৈতিক দলের চলন বহুলাংশে তার পিছনে থাকা পুঁজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মৌলবাদ কে ইন্ধন জোগানো পুঁজি  উন্মাদনার পরিবেশ তৈরিতে বেশী আগ্রহী, ফলে ‘প্রাচীন’ভদ্রলোক এর জায়গা বিপন্ন হয়ে পড়লো।তার জায়গায় চলে এলো ‘বাস্তববাদী ভদ্রলোক’। যাদের  চাওয়া পাওয়ার সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি কখনোই সমালোচনার যোগ্য হবে না, বরং তাদের তথাকথিত বাস্তবমুখী অবস্থান সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকেই দৃঢ় করে তুলবে। এরাই হলেন ‘পোস্ট ট্রুথ ভদ্রলোক’। এই  খাদ মেশানো মূল্যবোধ বাংলার রাজনীতিতে তথাকথিত ভদ্রলোক কে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে গেছে।২০২১ এ হিন্দুত্ব-বাদীদের বাংলায় ক্ষমতা দখল ব্যর্থ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা বাংলার রাজনীতিকে তাদের শর্তে চালাতে সক্ষম হয়েছে। ধর্ম কে তারা নিশ্চুপে  থাকতে দেয়নি।রাজনীতিতে ধর্মের আবেশ চিরকালই ছিল। ডান, বাম কেউই সার্বিকভাবে নিজেকে এর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন দেখাতে পারবে না, কিন্তু সেই আবেশের কোনও তরঙ্গ প্রভাব (ripple effect) সমাজে ছিলনা। বিক্ষিপ্তভাবে যে দু একটি ঘটনা ঘটেছে তা তেমন ভাবে প্রচারের আলোতেও আসেনি এবং আমাদের প্রভাবিতও করেনি। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের ক্রমাগত ধর্মীয় রাজনীতি একদিকে যেমন ইচ্ছাকৃতই এই তরঙ্গ প্রভাব তৈরি করেছে, তেমনই তাদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে বিরোধীদের একটি বড় অংশ প্রতিক্রিয়ায় এক বিপরীত হিল্লোল কে চট জলদি সমাধান হিসেবে তুলে এনেছে। তাই হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিরোধের একটি বড় অংশ বিরোধীরা তাদেরই(হিন্দুত্ববাদীদের) তৈরি করা শর্তে নির্মাণ করে চলেছে। চৈতন্যদেবের বাংলায় রাজনীতির এই বিনির্মাণ আগামী দিনে কোন দিকে চলে সেটি দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। দক্ষিণপন্থী দলটি আসনের বিচারে প্রথম না হলেও রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণে  সেই যে প্রথম এবং, একশ শতাংশ সফল, তা বলাই বাহুল্য।‘গ্লোবাল ক্রাইসিস’ ও পোস্ট ট্রুথ ভদ্রলোকের জন্মপোস্ট ট্রুথের চলন দেখলে বোঝা যায় ‘সত্যি’ই সে আমাদের মনের অসহায়তার অক্সিজেনে জারিত। তার অন্যতম উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে একটি অবশ্যই উগ্র জাতীয়তাবাদ কে জন্ম দেওয়া এবং তাকে ধরে রাখার জন্য উপযোগী স্লোগান, চিহ্ন, গান আমজনতার অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়াও মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা, অর্থাৎ  সরকার এবং জনগণের মাঝে মানবাধিকার নিয়ম মেনে থাকবে, কিন্তু কাজ করবে না বরং তার প্রতি এক রকমের অবজ্ঞা থাকবে এই পরিবেশ তৈরি করাও তার অন্যতম কাজ। শত্রু ভয় ও দেশের নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে মানবাধিকার সামান্য লঙ্ঘন করা চলে এই চিন্তাই জনতার দরবারে আনা হয়। একইসঙ্গে দেশের সব সমস্যার জন্যে জনগণের কাছে একটা সাধারণ শত্রু তৈরি করা হয়। সেই শত্রু সচরাচর সংখ্যাগুরুর কেউ হয় না, তবে যদি কোনও সংখ্যাগুরুর ঐ দাগিয়ে দেওয়া শত্রুর প্রতি কোনও সহমর্মিতা দেখা যায়, সেইক্ষেত্রে তাকেও লিবারেল, কিংবা জঙ্গি নাম দিয়ে একই আসনে বসানো হয়। এই কাজগুলি কে পূর্ণ রূপ দেওয়ার জন্য চাই  গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ। মিডিয়ার কাজ হবে সরকারের ‘মনের কথা’ বলা।  সরকার বা গোষ্ঠী নির্মিত সত্যই কেবল প্রচার হবে। এই সকল কাজ সুচারু রূপে সম্পন্ন করতে ধর্ম আর রাষ্ট্রের মাখামাখি আবশ্যক। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সঙ্গে দেশের নিরাপত্তাকে এক করে, তার সাধারণ মানুষের মনে এক ভয়, এক অনাহুত ভবিষ্যতের ছবি সৃষ্টি করা এই জাতীয় প্রকল্পের এক অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু এই সকল বিষয় আলোচনার পরেও আমাদের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, পোস্ট ট্রুথ প্রকল্পের ‘বাজার’ এখন এতো রমরমা কেন?মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠন থেকে যদি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াও যায়, যে পোস্ট ট্রুথ এর মত দক্ষিণ-পন্থী প্রকল্পের বীজ আমাদের মনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে তবুও প্রশ্ন থেকে যায় why now?  আজ আমরা এই বিষয় নিয়ে এত ভাবিত কেন? মনুষ্যসমাজ তো রাতারাতি জ্ঞানগত পক্ষপাতে দুষ্ট হয়নি, কিংবা বিষয়টি এমনও নয় যে মনুষ্যসমাজ ইতঃপূর্বে কখনো সংশয়ের দোলাচলে পড়েনি। তাহলে এখন কেন?  এক কথায় এর উত্তর না থাকলেও, এটা বলা যেতেই পারে এর অন্যতম কারণ death of romanticism in politics, রাজনীতিতে রোমান্টিসিজিমের মৃত্যু, যার চূড়ান্ত রূপ সোভিয়েতের পতন, এবং একই সঙ্গে আমাদের চোখে দেখা ভদ্রলোকের কাঠামোর ইতি। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে আশির দশকের একদম শেষ থেকে একের পর এক ঘটে চলা ঘটনা, যেমন বার্লিনের প্রাচীরের পতন, তিয়েনান্মেন স্কোয়ারের বিক্ষোভের পাশাপাশি ফ্রান্সিস ফুকয়ামা লিখে ফেলেছেন The End of History। সময় যেন বলতে চাইছিল কোনও এক চূড়ান্ত পরিণতি আগত। নব্বই দশকের শুরুতেই সোভিয়েতের পতন ছিল কফিনের শেষ পেরেক।  প্রগতিশীল চিন্তার ধারক বাহকদের কাছে  এক ভয়ানক ধাক্কা। ভারতের দিকে তাকালেও দেখা যাবে নকশাল আন্দোলনের পরিণতি বেড়া ভাঙ্গার স্বপ্নের এক রকমের পরিসমাপ্তি সূচীত করে গেছে।তাৎপর্য পূর্ণভাবে এই ৯০ দশকের গোরার সময় দিয়েই ভারতবর্ষেও দক্ষিণ-পন্থী কার্যকলাপের সশব্দ প্রকাশ হতে থাকে। যতদিন রাজনৈতিক রোমাঞ্চ জাগ্রত ছিল, চোখে স্বপ্ন ছিল, ততদিন মনের সকল দ্বন্দ্ব দ্বিধার মাঝে জাগ্রত ছিল রোমাঞ্চর উত্তাপ।  কিন্তু সেই রোমান্টিকতার মৃত্যু আমাদের জীবনের সকল সংশয়কে একরকমের একাকীত্বর হাতে সপে দেয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রিয় মধুবন’ গল্পের সেই লাইনটি - “বিপ্লবের পথ কেবলই গার্হস্থের দিকে বেঁকে যায়! বনের সন্ন্যাসী ফিরে আসে ঘরে” – যেন আমাদের গ্রাস করতে চায়। যখন কোনও স্বপ্ন থেকে না তখনই নাকি স্বপ্ন দেখার সময়, কিন্তু একদিকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং একই সঙ্গে উদারীকরণের মাধ্যমে যে নতুন যাত্রা পথের সূচনা হল, সেখানে আর সংগ্রাম, প্রতিরোধ, যৌথ খামার, বেড়া ভাঙ্গার স্বপ্ন নয়, বরং আমার চারপাশে পড়েথাকা যাকিছু আছে তাকে নিয়েই ছোট পরিবার, সুখী পরিবার রচনাতেই  মন শান্তি খুঁজে নেয়।  নিজের পরিসর কে রক্ষা করার জন্য আমরা আবার সংশয় সন্দেহ পরিবৃত জীবনে প্রবেশ করি। সংশয়ের চোখে চোখ রেখে আক্রমণ নয়, বরং সেই সংশয়ের আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের আত্মরক্ষা ব্যূহ রচনা করাই এখন মুখ্য, আর আত্মরক্ষার প্রথম শর্ত সকল ভয়ের সম্ভাবনার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখা। এই নিরাপত্তাহীনতার হাত ধরেই পোস্ট ট্রুথের প্রবেশ।তবুও এই সকল বিষয় জানার পরে, যদি আবার নতুন করে মানসিক স্তরেও প্রতিরোধের ইচ্ছা জাগে, তবে  মিথ্যা খবরের দুনিয়ায়  একই সঙ্গে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং স্ব-তর্ক করতেও হবে। ডিজিটাইজেশনের হাত ধরে চকিতে তথ্য এক স্থান থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। সে তথ্য সঠিক ও হতে পারে বেঠিকও হতে পারে, এমনকি সেই তথ্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও হতে পারে। তাই এই সমস্যাটি মোকাবেলা করার জন্য আমাদের যেমন সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, একই সঙ্গে বুঝতে হবে ভিন্নতাই ‘সত্য’। কেবল সমাজ নয়, আমি নিজেও ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার সমাহার। আমাদের নিজেদের মধ্যেও যেমন প্রাপ্তি সুখ আছে, তেমনই অপ্রাপ্তির ছোঁয়াও রয়েছে। আমরা দিব্যি এই দুইকে নিয়ে এগিয়ে চলি। তাই  সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা  মিডিয়ার জটিলতায় পরিত্যাগ না করে, তথ্য তল্লাশের অভ্যাস বজায় রাখতে হবে।  ইকো চেম্বারের পাশে থেকেও নিজেকে ‘ইকো ফ্রেন্ডলি’ করে না তুলতে পারলে অচিরেই আমাদেরই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চেতনা  বহুমাত্রিকের বদলে নির্ধারিত একমাত্রিক রূপ পাবে, গণতন্ত্র তার ছন্দ হারাবে।  সেই কারণেই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজের আমাদের সাবধান করে বলেছেন “সচেতন নাগরিক ছাড়া গণতন্ত্র কার্যকরী হয় না” কারণ তিনি উপলব্ধি করেছেন  ডিজিটাল যুগে, এই গণতান্ত্রিক সচেতনতাই প্রশ্নের মুখে। আমাদের আদিম প্রবৃত্তি তথা জ্ঞানগত পক্ষপাতিত্বকে হাতিয়ার করে এক ‘না-বিশ্ব’গড়ে তোলার প্রকল্পকে ধাক্কা দিতে না পারি তবে  আগামী দিনের  জন্য  শক্তিশালী গণতন্ত্র কেবল অলীক স্বপ্নই থেকে যাবে।
    উৎসব - Sobuj Chatterjee | ইচ্ছে ডানাগুলো পুড়ে যায়অনেক দূরে স্ফটীকের মত অলক মেঘ নীলিমায় স্থবির-ঝঞ্ঝা মেঘের দেখা নেই;ইচ্ছে ডানাগুলো পুড়ে যাচ্ছে!বুঝি নিজেরই তাপে দগ্ধ,অতিষ্ঠ দিবাকরের রুদ্ররুপ;পালকে পুলক নেই, নেই মাতামাতি,বৃক্ষের সাড়া নেই,মাটিতে জল নেই,আরোগ্যের নাম নেই, -কার ও কোনো হুঁশ নেই!পাহাড়ে পাহাড়ে হাহাকার আছে মুখোশের প্রতিশ্রুতি আছে গনতন্ত্রের নাম আছে। -আর তারই কবচ রাম ও রহিম উৎসবে মেতে আছে।নিরঙ্কুশ ! নিরঙ্কুশ!ওদিকে পাখীদের অনুরোধের আসরে:মিঁয়া তানসেন মেঘমল্লারে আনবে বরিষণ -ইচ্ছে ডানাগুলো ভিজে সতেজ হবে-অজস্র ডানার ঝাপটে-কান পাতা দায় হবে ;-ঘরে ফেরার অনাবিল আনন্দের লক্ষ কলতান!তারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে সুদূর নীলেএক প্রশান্ত প্রদোষে ।-রেখে যাবে ফিরে আসার প্রত্যয়।।
  • ভাট...
    comment&/ | কিন্তু সত্যজিৎবাবু কোন সিনেমায় পাল্টি খেলেন?
    comment&/ | গুরুকূল বলে একটা ব্যাপার ছিল, আবাসিক বিদ্যালয়ের মতন। এইসব পাজি পশ্চিমী হুস্কুল লোপ করে দিয়ে সেই গুরুকূল আনলে কেমন হয়?
    commentaranya | 'বেঁচে থাক অসভ্য অর্বাচীন তাদের অশিক্ষা আর অস্বাস্থ্য নিয়ে।'
     
    -অস্বাস্থ্য প্রসঙ্গে - আমার ধারণা ছিল, আধুনিক বিজ্ঞান, বিশেষতঃ চিকিৎসা বিজ্ঞানের  সাহায্যে , ভারতের মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে, সেটা কি ভুল ধারণা ? 
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত