এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • রাজরক্ত (রহস্য গল্প) : ৮ম পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ১৪ জুলাই ২০২১ | ২২২১ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮
    (৮) জবানবন্দী ২৯/০৩/২০০২ বিকেল ৩.৩০

    কোত্থেকে যে শুরু করব বুঝতে পারছি না। গত ৪৮ ঘন্টা, মানে পরশু বুড়ার স্টেশনে নামার সময় থেকে এখন অব্দি যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। এইটুকু বলে দিই যে ছিন্নমস্তা দেবীর পুজো তো নয় যেন দক্ষযজ্ঞ! তাতে বলি চড়েছে একাধিক প্রাণী। যেমন আমি, যেমন ওই দুই বাঙালি দিদি। আমাদের টিকিট ফিকিট গেছে চুলোয়। বুড়ার থানার ওসি’র নির্দেশে আমরা তিনজন আগামী আদেশ পর্য্যন্ত বুড়ারের বাইরে যেতে পারব না। বলতে গেলে একরকম নজরবন্দী। কারণ যুবরাজ বীরেন্দ্রপাল প্রতাপ সিংহ হত্যায় আমরা তিনজনই স্থানীয় পুলিশের সন্দেহের তালিকায়।

    হ্যাঁ, দেবী রাজরক্ত চেয়েছিলেন, সেটা ঝরেছে। বোম্বাগড়ের যুবরাজ এই তান্ত্রিক পূজোয় প্রথম বলি। সেদিন রাত্রি দুটো বেজে দশ মিনিটে যথাবিধি পূজো সম্পন্ন হয়েছে বীরাচারী মতে। কিন্তু যজমানের আসনে বসেছেন নিহত যুবরাজের বদলে তাঁর ছোটভাই কুমারসাহেব। তবে মেখলা কনখলার নৃত্য হয়নি আর ছিন্নমস্তা আবির্ভূতা হয়ে বোম্বাগড়ের রাজবংশকে বরাভয় প্রদান করেননি।

    আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বিপদের সংকেত দিচ্ছিল। দুই বাঙালি দিদিদের নিয়ে আমার আশংকা সত্যি হল। প্রতীকী অর্থে যদি তাঁদের মেখলা ও কনখলার অবতার ধরে নিই তাহলে তাঁরা পাথর হয়েই গেছেন। খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। বড়দি শৈবলিনী সারাক্ষণ ফোঁপাচ্ছেন, ছোড়দি কুন্দ ভাবলেশহীন পাথর। গেস্ট হাউসের সেই ঘরেই আটকে আছেন, কামরার সামনে একটা টুল আর বেঞ্চি পেতে ছ’জন থানার সেপাই, পাঁচজনের হাতে লাঠি, অন্যজনের বন্দুক।

    আমার বিলাসপুর জেলার এসপি’র সাইন করা লাইসেন্স কাজে এসেছে। আমি বুড়ার জনপদের চৌহদ্দীর মধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারি। আগামীকাল আমাদের বুড়ার সেশন্স কোর্টে পেশ করবে পুলিশ। তার আগে ফর্মাল অ্যারেস্ট মেমো বানাতে হবে। চালান কাটতে হবে। আজকেই হয়ে যেত; হয়নি তার কারণ আমার বস কোসলে স্যার, পুলিশের প্রাক্তন ডিএসপি। আমি পরশু রাত্তিরেই মোবাইলে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছিলাম। ফলে ওনার অনুরোধে বিলাসপুরের বর্তমান এসপি গতকাল ফোনে থানায় নির্দেশ পাঠিয়েছেন যে উনি আজকে আসছেন। ততক্ষণ যেন কাউকে ফর্ম্যালি গ্রেফতার না করা হয়।

    না; এভাবে হবেনা। বড্ড এলেমেলো বকছি। অনেকগুলো সূতোর গুলি একসঙ্গে খুলে দিয়েছি, জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ঠিক আছে, যেমন যেমন ঘটেছে সেভাবে বলি। এককাজ করি। গতকাল সকালে বুড়ার থানার থানেদার, মানে স্টেশন অফিসার ঈশ্বর পান্ডে আমাদের সবার এজাহার বা জবানবন্দী নিয়েছেন। আবার বিলাসপুর থেকে কোসলে স্যার নিজে আসছেন এবং ওঁর অনুরোধে এসপি মিঃ শ্রীবাস্তবও। দু’জনে প্রায় অনুপপুর অব্দি পৌঁছে গেছেন, ব্যস্‌ আর ঘন্টাখানেক। ওঁরা এসে গেলে আমাকে আর একপ্রস্থ রামকহানী শোনাতে হবে। তাই আগেভাগে একবার আপনাদের শুনিয়ে দিই, ভালকরে রিহার্সাল হয়ে যাবে।

    সৌরভ

    আমি সৌরভ বিশ্বাস, বিলাসপুরের লিংক রোডের ‘ওয়াচ অ্যান্ড সিকিউরিটিজ’ সংস্থায় সহায়ক ইনভেস্টিগেটর, আমার নিজস্ব রিভলবারের লাইসেন্স আছে। বিলাসপুর কলেক্টর অফিস থেকে জারি।

    আমি বোম্বাগড় রাজপরিবারের যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপ সিংহের বিলাসপুর থেকে বুড়ার পর্য্যন্ত ট্রেন যাত্রায় নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে সঙ্গী হয়েছিলাম। ফার্স্ট ক্লাস কোচে একই কেবিনে ছিলাম। এটি একটি বিজনেস বা সার্ভিস কন্ট্রাক্ট । আমাদের সংস্থা রেজিস্টার্ড, আয়কর দেয়। আমি এখনও আয়করের আওতায় আসি নি। তবে প্যানকার্ড সঙ্গে আছে।

    না, আমি নিহত যুবরাজ সাহেবকে আগে থেকে জানতাম না। টেলিফোনে বুকিং হয়েছিল। ওনার ড্রাইভার শান্তিরাম ট্রেনে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই দুটো টিকিট, আমার কাছেই রয়েছে।

    কী বলছেন? আমি অপদার্থ? যুবরাজকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি? না তো; আমার কন্ট্রাক্ট ছিল বিলাসপুর স্টেশনে ট্রেনে ওঠার পর থেকে বুড়ার স্টেশনে ট্রেন থেকে নামা পর্য্যন্ত। আমি ট্রেনে ওনার ড্রাইভার শান্তিরামের থেকে চার্জ নিই এবং বুড়ার স্টেশনে যুবরাজকে নিরাপদে নামিয়ে ওর কাছেই হ্যান্ড ওভার করি। মুঝসে কোই চুক নহীঁ হুই।

    না, দুই বাঙালি দিদিকে আমি আগে থেকে জানতাম না। ট্রেনে পরিচয় এবং ওঁরা আমার মতই বুড়ার গেস্ট হাউসে আমন্ত্রিত অতিথি। কী করে জানলাম? ওঁদের সেই চিঠি আমি দেখেছি এবং গেস্ট হাউসে ওঁদের জন্যে বুকিং ছিল।

    আচ্ছা, শান্তিরাম থাকতে রাজপরিবার কেন আমাকে ফি দিয়ে বুক করলেন? এটা ওদের জিজ্ঞেস করুন, আমি কী করে জানব?

    কাল রাত্তিরের ঘটনাটা একটু অদ্ভূত। সন্ধ্যেবেলা আমি ও দুই দিদি শান্তিরামের সঙ্গে ছিন্নমস্তা দেবীর মন্দির দেখতে গেছলাম। শান্তিরাম মন্দিরের কাছাকাছি এসে আগেই যুবরাজ সাহেবের প্রাসাদে চলে গেছল, ওষুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব না কী যেন! আমরা পূজারী মহারাজের কাছে দেবী মাহাত্ম্য শুনে খেতে যাবার জন্যে ফিরব এমন সময় দিদিদের মোবাইলে যুবরাজ সাহেবের মেসেজ ‘এল-কাম শার্প! যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপ’।

    কী করে জানলাম? আমি দিদির মোবাইলে মেসেজটি দেখলাম যে! কোন দিদি? ছোটজন - কুন্দনন্দিনী। তারপর ওঁরা প্রাসাদের দিকে প্রায় দৌড় লাগালেন। আমি পুকুরের কাছাকাছি পায়চারি করছিলাম। না, ওঁরা আমাকে অপেক্ষা করতে বলেননি। দুই মহিলা, নতুন জায়গায়, অন্ধকার রাত-তাই। না আমি আগে কখনো বুড়ারে আসি নি।

    তারপর মিনিট দশ হবে। একটা বীভৎস চীখ! একটা নয় পরপর দু-দুটো! আমি প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে প্রাসাদের দোরগোড়ায় হাজির হলাম। কিছু লোক, দীয়া আর হ্যাজাকের আলো। বারান্দার পর প্রথমটা ছেড়ে দ্বিতীয় কামরা। দু’জন লোক দু’পাশ থেকে দুইদিদিকে শক্ত করে চেপে রেখেছে। প্রথম চিৎকার নারীকন্ঠের সম্ভবতঃ দিদিদের কারও, কিন্তু দ্বিতীয় চিৎকারটা সম্মিলিত পুরুষ গলার। হয়ত ওই দুজন। আমার হাতে খোলা রিভলবার। সেই দেখে একজন বেশ হুকুমের সুরে বললেন - রিভলবার নামাও। আমরা শত্রু নই, দিদিদের কিছু হবে না।

    দুই দিদি আমাকে খেয়াল করছেন না। তাঁদের চোখ অনুসরণ করে আমিও চেঁচানোর কারণটা দেখতে পেলাম।

    খাটের সামনে কার্পেটের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন যুবরাজ সাহেব। পরনে পাজামা ও কুর্তা, তাঁর ঘাড়ের বাঁদিক থেকে একটা বড় ক্ষত, রক্ত কার্পেটের উপর চাপ বেঁধে রয়েছে। না, কাছাকাছি কোন হাতিয়ার দেখতে পাইনি। হ্যাঁ, তক্ষুনি বারান্দায় বেরিয়ে ঘড়ি দেখে বসকে ফোন করেছিলাম। রাত ৯:১০।

    উনি বলেছিলেন - আমি যেন ওই ঘর বা বারান্দা ছেড়ে কোথাও না যাই, মানে যতক্ষণ না পুলিশ আসে। এবং সবাইকে জোর দিয়ে বলি যে কেউ যেন কোন কিছুতে হাত না দেয়, বডিতে তো নয়ই।

    আমি ওই কর্তাব্যক্তিকে, যাঁকে সবাই কুমার সাহেব বলছিল, বসের বিলাসপুর থেকে আসা নির্দেশ জানিয়ে অনুরোধ করলাম বুড়ার থানায় খবর দিতে। কিন্তু উনি ধমক দিয়ে বললেন যে এরমধ্যেই থানায় লোক গেছে। আমি যেন নিজের চরখায় তেল দিই। আমার ওনার কথার টোন ভাল লাগেনি। কিন্তু শোকের সময়।

    ছোরাটা যখন পাওয়া গেল, আপনি তখন কোথায় ছিলেন?

    - ওই ঘর আর বারান্দার দরজার পাশে।

    ছোরাটা কে পেল? কোথায় পেল?

    - শান্তিরাম ড্রাইভার; ছোটি বহনের ব্যাগে।

    শান্তিরাম একজন মহিলার ব্যাগ খুলল কেন?

    - ওই ভদ্রলোক, মানে ওর বস কুমারসাহেব ওকে খুলে দেখতে বললেন, তাই। উনি বললেন ব্যাগে রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে।

    তুমি দেখেছিলে? ওই রক্তের দাগ?

    - আগে খেয়াল করিনি। পরে দেখেছি।

    তুমি ভাল করে ছোরাটা দেখেছ? কতবড়?

    - অন্ততঃ ছ’ থেকে সাত ইঞ্চি , রামপুরি।

    তুমি কী করলে?

    - আমি আমার পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে ওটা ওদের দিয়ে ছোরাটা আলগা করে ধরে যুবরাজ সাহেবের খাটের পাশে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখতে বললাম, যাতে হাতের ছাপ নষ্ট না হয়। কিন্তু কুমারসাহেব বললেন ওসব ওনারা জানেন, বেশি জ্ঞান না ফলাতে।

    ওঁরা তোমার কথা শুনলেন না?

    - শান্তিরাম আমার হাত থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে যেমন বলেছিলাম, তাই করল।

    উসকে বাদ?

    - উসকে বাদ আধে ঘন্টে কে ভিতর আপলোগ থানে সে আ গয়ে। অব --।

    কুন্দনন্দিনী

    আমি কুন্দনন্দিনী চট্টোপাধ্যায়, স্বামী সুমন্ত্র দাশগুপ্ত, বয়স ৩৩, পেশা আসানসোল সরকারি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, আমার দিদির সঙ্গে গতকাল বিকেলে বিলাসপুর থেকে ট্রেনে বুড়ারে এসেছিলাম। আমরা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে পড়াশুনো করেছি। সেখানে বোম্বাগড়ের যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে পরিচয়। কয়েকদিন আগে ওনাদের কুলদেবী ছিন্নমস্তার বিশেষ পূজো দেখার জন্যে নেমন্তন্ন চিঠি এবং ট্রেনের টিকিট পেয়ে আমরা দু’জন এখানে এসেছি। ওনার পাঠানো চিঠি এবং ট্রেনের টিকিট আমাদের সঙ্গে আছে, এই যে! ফেরার টিকিটের জন্যে ওনাদের ড্রাইভার শান্তিরামকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম।

    যুবরাজের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

    - কী বলব? ট্রেনে উনি আমাদের চিনতে পারেননি। বাজে ব্যবহার করেছেন। হ্যাঁ, আমাদের অবাক লেগেছে বললে কম বলা হয়। পরে শুনলাম ওঁর ইদানীং শরীর খারাপ যাচ্ছে, বেশ তিরিক্ষি মেজাজ। কে বলল? ঠিক মনে পড়ছে না। বোধহয় ওঁর সেক্রেটারি সৌরভ বিশ্বাস এবং শান্তিরাম।

    টিকিটের জন্যে ওঁর পিএ সৌরভকে রিকোয়েস্ট না করে ড্রাইভার শান্তিরামকে কেন বললেন?

    - প্রথমে সৌরভকেই বলেছিলাম। ও বলল, কয়েক মাস হোল চাকরিতে এসেছে, এখানে কিছু চেনে না। ওই বলল শান্তিরামকে বললে হয়ে যাবে, এসব ওর কাজ।

    এত রাত্তিরে যুবরাজের ঘরে গেছলেন কেন?

    - উনি আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ টেক্সট করে ডেকেছিলেন যে!

    কোথায় সেই মেসেজ?

    - এই যে!

    আপলোগ পড়িলিখি আচ্ছে ঘরকে। রাত কো অনজান জগহ মেঁ কিসী সে মিলনে কো চলি জায়েঙ্গী? সির্ফ মোবাইল মেঁ এক মেসেজ কে ভরোসে? বাতাইয়ে।

    (কুন্দনন্দিনী মাথা নীচু করে পায়ের আঙুল খুঁটতে থাকে। হাতের চেটোয় চাপ দিয়ে শরীরের কাঁপুনি আটকাতে চেষ্টা করছে। উত্তর দেয় এতক্ষণ চুপচাপ ফোঁপাতে থাকা বড় বোন শৈবলিনী, কাজ চালানো হিন্দিতে।)

    শৈবলিনী

    ইস সওয়াল ক্যা জবাব ম্যায়ঁ দুঙ্গী।

    আমি শৈবলিনী চট্টোপাধ্যায়, পিতা ঈশ্বর নিত্যধন চট্টোপাধ্যায়, বয়েস ৩৪, রায়পুর গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজে সংস্কৃতের অধ্যাপক। যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে আমাদের দুই বোনের শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় ভাল জান-পহচান ছিল। দশ-এগার সাল কে বাদ ইস আমন্ত্রণ! ভাল লেগেছিল, ভেবেছিলাম রাজবাড়ি কেমন হয় দেখব, ছিন্নমস্তা দেবীর মন্ত্র জানি, পূজো দেখব। কিন্তু ট্রেনে আমাদের চিনতে অস্বীকার করায় মন খাট্টা হয়ে গেছল। অপমানিত মহসুস কর রহী থীঁ।

    - সেই অপমানের বদলা নিতে যুবরাজ সাহাবকে মেরে ফেললেন?

    শৈবলিনী ফের ফুঁপিয়ে ওঠে।

    নহী, নহী; এইসা কুছ নহীঁ হুই। আমি শান্তিরামকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম যে - একবার উনসে মিলা দো। হম জাননা চাহতে হ্যায়, কি আখির মাজরা ক্যা হ্যায়? কেন ডেকে এনে চিনতে পারছেন না?

    - আপনাকে শান্তিরাম খবর দিয়েছিল?

    না, বোনের সেলফোনে হোয়াটস আপ মেসেজ এসেছিল।

    - আপনারা রাত্তিরে ওঁর ঘরে গেলেন। দেখা হোল?

    হম যব অন্দর ঘুসে তব তক যুবরাজ সাহাব গুজর গয়ে থে। উনকী হত্যা হুয়ী থী।

    - কী করে বুঝলেন মারা গেছেন বা হত্যা হয়েছে? গা ছুঁয়ে দেখেছিলেন?

    ইতনী খুন কালীন পর বিখরে হুয়ে। অঊর গর্দান পর – এত বড় একটা ক্ষত! ছুরে কা ঘাও!

    - কী করে চিনলেন যে ওটা ছোরার ক্ষত? আগে কখনও ছোরার আঘাত দেখেছেন?

    না; লেকিন হম চীখনে লগে। বাহর বারামদা মেঁ আকে চীখে। লোগবাগ আ গয়ে। ছোটে কুমার বলে — ভাইয়া কা হত্যা হো গয়া। কোই ছুরা মার দিয়া।

    - আর তারপর রক্তমাখা ছোরাটা আপনাদের হ্যান্ডব্যাগ থেকে বেরোল! এর কী জবাব দেবেন আপনারা? কোন নতুন ব্যাখ্যা?

    এবার ছোটবোন কুন্দনন্দিনী মুখ খোলেন, অনেকটা সামলে নিয়েছেন।

    - শুনুন, ওটা আমার ব্যাগ থেকে বেরিয়েছে। দিদির ব্যাগ আমাদের গেস্ট হাউসের কামরাতে রয়েছে। আমার ব্যাগটা বড়, তাই ওটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তাতে আমাদের দুটো শাল রাখা ছিল।

    আর শালের ভাঁজে ছোরাটা? কী, ঠিক বললাম তো?

    - না, ভুল বলছেন।

    ব্যাগটা সারাক্ষণ আপনার কাছে, আর তারমধ্যে রক্তমাখা ছোরা, কোথায় ভুল বলছি?

    - ব্যাগটা মন্দির যাওয়া পর্য্যন্ত আমার কাছে ছিল। কিন্তু যুবরাজ সাহেবের কামরায় ঢোকার আগে বারান্দায় একজন পাগড়ি পরা চৌকিদার আমাকে আটকায়। সে বলে যে যুবরাজ সাহেবের ঘরে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে ঢোকা যাবে না। সুরক্ষা নিয়ম। তখন ব্যাগটা ওর কাছে রেখে দিই। বাইরে এসে আতংকে দিশেহারা ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল যে ব্যাগটা বারান্দার এক কোণে বেঞ্চির নীচে মাটিতে পড়ে আছে। আমি তুলে নিলাম। কুমারসাহেব আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর যা হোল আপনারা জানেন।

    সেই সিকিউরিটি গার্ড তখন কোথায় ছিল?

    - জানি না; তাকে আর দেখিনি।

    শান্তিরাম

    আমি শান্তিরাম ওঁরাও, গত আটবছর ধরে রাজপরিবারের ড্রাইভার। বিলাসপুরের রাজবাড়ির ভেতরেই আমার থাকার ঘর, আমি একা। যুবরাজ সাহেবের শরীর বেশ কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে একটু উল্টোপালটা কথা বলতেন, বিনা কারণে রেগে যেতেন। এবার বড় রাজার দেহান্তের এক বছর পরে ওনার রাজ্যাভিষেকের আগে কুলদেবীর আশীর্বাদ নিতে এসেছিলেন। মাঝখানে শুনেছি জমিটমি নিয়ে কিছু বাহরি তত্ত্বের সঙ্গে গন্ডোগোল শুরু হয়েছিল। কিছু উড়োচিঠি পাচ্ছিলেন। তাই কুমারসাহাব, মানে ছোট কুমার আমাকে বললেন অন্য কামরায় উঠে নজর রাখতে আর ওনার কামরায় ওই বাঙালি সিকিউরিটি বডিগার্ড, লেকিন গুপচুপ তরিকে সে। উনি ভেবেছিলেন যুবরাজ সাহাবকে একা ভেবে যদি কেউ হামলা করে তাহলে ওরা কারা জানা যাবে।

    নেহি; ইন দোনোঁ বঙ্গালন বহন কো ম্যায় পহলে সে নহী জানতা থা। ওদের আমন্ত্রণ পত্র দেখিনি, কিন্তু যুবরাজ সাহাব ডেকেছেন, আমি কী বলব? হ্যাঁ, ওনার নির্দেশে আমিই গেস্ট হাউসে কেয়ারটেকারকে খবর দিয়েছিলাম।

    গত কয়েকবছর ধরে যুবরাজ সাহেবের শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। বেশি বেরোতেন না। তাই আমি কুমার সাহেবের গাড়িই বেশি চালাতাম। আজ আমি আগে চলে আসায় পরে কুমারসাহেব নিজে গাড়ি চালিয়ে এখানে আসেন। প্রতিবছর এই পারিবারিক পূজোয় এঁদের দু’ভাইকে আসতেই হয়। ট্রেনে একসঙ্গে কেন আসেননি? আমি বলতে পারব না। তবে রাণীসাহেবাকে কখনও ওনার জ্যেঠজি মানে যুবরাজ সাহেবের সঙ্গে একসাথে যাত্রা করতে দেখিনি। উনি নিজেও গাড়ি চালাতে ভাল বাসেন, কখনও কখনো ওঁরা দু’জন লম্বা কারড্রাইভে বেড়াতে যান, কখনও আমি সঙ্গে থাকি।

    - ওঁরা কখন পৌঁছে যান?

    এই সাড়ে সাতটা নাগাদ। আমার কাছে মেসেজ এল। গিয়ে এই রাজপ্রাসাদের আরেক মাথায় ওনার নির্দিষ্ট ঘরে দেখা করলাম।

    - তারপর?

    আমি গিয়ে যুবরাজ সাহেবকে কিছু ফল আর সরবত খাইয়ে দিলাম। কারণ, ওনাকে পুজোয় বসতে হবে। পূজো শেষ না হওয়া পর্য্যন্ত কিছু খেতে পারবেন না, তাই। আর দিদিমণিরা আমাকে বলেছিলেন যুবরাজ সাহাবের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করতে।

    - করেছিলে?

    সরবত খাওয়ার সময় বলেছিলাম। উনি পাত্তা দেননি। ওনার মনে তখন খালি দেবীপূজার চিন্তা।

    - সেকী? তাহলে উনি দুই বঙালন বহনকে মেসেজ করে ডাকলেন কেন?

    নহী পতা।

    - তারপর তুমি কোথায় গেলে?

    তারপর আমি কুমারসাহেবের কাছে গিয়ে এখানকার তৈয়ারির রিপোর্ট দিচ্ছিলাম। নও বাজনেওয়ালে, কুমারসাহাব বললেন — ভাইয়াকে তৈরি হতে বল। একসঙ্গে মন্দিরে যাব।

    - উসকে বাদ?

    আমি ওঁর ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে যুবরাজ সাহাবের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম, অচানক এক ডরাবনী চীখ সুনাই দিয়া।

    দেখি দুই দিদি চেঁচাতে চেঁচাতে যুবরাজের ঘর থেকে দৌড়ে বেরোচ্ছেন। আমি আর কুমার সাহেব গিয়ে ওঁদের আটকাই। হম পুছনে লগে - আখির হুয়া ক্যা?

    ওঁরা ঘরের ভেতরের দিকে আঙুল দেখান। কুমারসাহেব দৌড়ে ভেতরে গিয়ে ওই নজারা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন — খুন! ভাইয়াজি কা মার্ডার হো গয়া। উন দোনোঁ কো রোখো!

    কুমারসাহেব আর আমি ওদের অনেককিছু জিজ্ঞেস করি কিন্তু কোন ঠিকঠাক জবাব পাই না।

    শেষে কুমারসাহেবের চোখে পড়ে - ছোটি বহনের ঝোলার বাইরে রক্তের দাগ। উনি জোর করে ব্যাগ খোলালে ভেতর থেকে রক্তমাখা ছোরা বেরিয়ে আসে। তখন আমরা দুই বোনকে আটকে মেন গেটের চৌকিদারকে সাইকেলে করে থানায় খবর দিতে পাঠাই।

    যুবরাজ সাহেবের ঘরের সামনে সিকিউরিটি গার্ড? না,না; মেন গেটে একজন আছে। সে কেন ঘরের সামনে কাউকে আটকাবে? বাঙালি দিদিমনিরা কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

    কুমারসাহেব

    কুমারসাহেব, আপনাকে কী আর বলব? আপ তো হর সাল আতে হ্যাঁয়। হম সব আপকো জানতে হ্যায়। আপ সির্ফ এক স্টেটমেন্ট দে দীজিয়ে। মানে এবার এখানে কী উপলক্ষে এলেন, আসার পর কী দেখলেন, কী কী ঘটনা ঘটলো এইসব। তারপর সাইন করে দেবেন।

    বহোত দুখদ ঘটনা। এই শোকের সময়ে আমরা সব সরকারি কর্মচারি ও বুড়ার জনপদের বাসিন্দা রাজপরিবারের সঙ্গে আছি। ঈশ্বর আপনাদের পরিবারকে ইস দুখ সহনে কী শক্তি দে!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮
  • ধারাবাহিক | ১৪ জুলাই ২০২১ | ২২২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 68.184.245.97 | ১৪ জুলাই ২০২১ ১৯:৪৫495789
  • রঞ্জনদা, এই সিরিজটা আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। বসে থাকি কখন নতুন পর্ব আসবে। কিন্তু এই পর্বটা একটু রাশড লাগছে। আমার নিজের মনে হওয়া বললাম।

  • Ranjan Roy | ১৪ জুলাই ২০২১ ২০:১১495790
  • কেকে,


      মনে হয় ঠিকই বলেছেন। আমি কি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছিলাম?  দেখা যাক। খেয়াল রাখব।

  • গবু | 223.223.139.85 | ১৪ জুলাই ২০২১ ২০:৩৩495792
  • কেকের ফিলিং আমারও হলো।


    আর খুচরো জিনিস: ওপরে নাম্বারটা ৮ না হয়ে "8" হয়ে গেছে।

  • বিপ্লব রহমান | ১৫ জুলাই ২০২১ ১৩:২৩495803
  • সেকি থ্রিল! রাজ রক্ত এইভাবে ঝরলো! 


    অন্তত দুই পর্ব এক সঙ্গে দিন না স্যার! অপেক্ষা ভাল লাগে না :/

  • | ১৫ জুলাই ২০২১ ১৪:১৮495804
  • এহ ঝুলে যাচ্ছে রঞ্জনদা। আরো সময় নিয়ে তৈরী করুন। আগের পর্ব পর্যন্ত ঠিক ছিল। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন