এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • রাজরক্ত (রহস্য গল্প) : ১২শ পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ১৪ আগস্ট ২০২১ | ১৮৭৫ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮
    (২) সৌরভ ৬ এপ্রিল, শুক্রবার, সকাল ১১টা

    আমার বসের খুরে খুরে দণ্ডবৎ! ইনক্রিমেন্টের কথা তুললেই হয় তোতা-ময়না অথবা হাতেম তাইয়ের গল্প শুরু করে দেন, নয় তো সিমরনকে বলেন এক ফ্লাস্ক কফি বানিয়ে আনতে। ঢের হোল, আজ আমি কোমরবেঁধে এসেছি, সাইড লাইন দিয়ে বল নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেব না। পরশু বুধবার একটা অ্যাসাইনমেন্টে রাজনন্দগাঁও গিয়েছিলাম। কাল বিলাসপুর ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছল। আমাদের অফিসের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী আজ আমি ফার্স্ট হাফে ঘরে আরাম করতে পারি। সেকন্ড হাফে এসে রিপোর্ট নিয়ে কথা বললেই চলবে। অবশ্য আমি আগেই ই-মেইলে বসকে ব্রিফ রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছি।

    কিন্তু অফিসে ঢুকে আমার চক্ষু চড়কগাছ। কোসলে স্যার ভেতরে ওনার প্রাইভেট কামরায় বসে একা একা শতরঞ্চ খেলছেন! আমি যে এসেছি তা’নিয়ে কোন হেলদোল দেখলাম না। মন দিয়ে প্রতিপক্ষের চাল দেখছেন। নিজে কালো ঘুঁটি নিয়ে খেলছেন। সাদা প্রতিপক্ষও আসলে উনি নিজেই - কোসলে নম্বর দুই।

    তবে এর বেশি আক্কেল আমার নেই। আমরা ছত্তিশগড়ের গাঁয়ের ক্লাবে চেস খেলতাম নিজের বাস্তববুদ্ধি দিয়ে। শহুরে লোকেদের নানান বিলিতি চাল, নামধাম কিছুই জানতাম না। স্যার আমাকে শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। ইংরেজি ভালই পড়তে পারি দেখে রাশিয়ান চেস মাস্টারের লেখা এলিমেন্টারি বই এনে দিয়েছিলেন। সে এক উদ্ভট বই।

    বইয়ের গোড়াতেই ছিল অ্যাটাক, কী করে কিস্তিমাৎ করতে হয় তার নানান কম্বিনেশন, মন্ত্রী ও বোড়ে দিয়ে তিনচালে মাৎ কর বা দুটো হাতি একটা বোড়ে, বিপক্ষের ঘোড়া, বোড়ে ও গজ, মাৎ করার চান্স? সেগুলোর গালভরা নাম এন্ড গেম; এরপরে মিডল গেম, আর শেষ পাতে গেম কী করে শুরু করতে হয় বা বিগিনিং। সব চ্যাপটারের শেষে অনেকগুলো এক্সারসাইজ। ঠিক এনসিআরটির টেক্সট বইয়ের মতন কিন্তু উলটো পথে; যেন প্রথমে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক, তারপরে মিডল স্কুলের কোর্স, শেষে প্রাইমারি! যাই হোক, প্রথম প্রথম ভাল লাগছিল, কিন্তু আমার ওই স্বভাব। বেশিদিন একটা বিষয়ে লেগে থাকতে পারি না, নইলে কলেজ ছাড়তাম?

    তারচেয়ে বড় কথা স্যারের দিমাগ; গোড়াতেই বলেছি হাতির দেখানোর দাঁত আর চিবোনোর দাঁত আলাদা হয়। না, স্যারের মোটাসোটা ভুঁড়িওলা ভাব দেখে হাতির কথা বলছি না। বলছি মনের ভাব লুকিয়ে রাখার কথাটা। ওঁর ডানহাতের ব্যাপার বাঁহাত জানে না, এবং বাঁহাতেরটা ডানহাত। যেমন কিছু কিছু ব্যাপার অফিস সেক্রেটারি সিমরন জানে, কিন্তু আমি জানি না। আর কেসের টেকনিক্যাল ব্যাপারে যা আমি জানি তা সিমরন জানে না। শুধু এই নয়, কিছু কিছু জিনিস আমাদের অফিস বয় জানে যেগুলো আমি বা সিমরন কেউই জানি না। স্যারের এই মন্ত্রগুপ্তির ঠেলায় পিত্তি জ্বলে যায়।

    এই যেমন গত মঙ্গলবার দুপুরের আগে জানতে পারি নি যে সরকারি প্যানেলের দুধুভাতু উকিল দামলে হল আমাদের অফিস বয় দামলের আপন ভাইপো। এটাও জানতাম না যে ভাইপোর পাঁচবছর ল’ পড়ার খরচা স্যার নিজে দিয়েছেন, অবশ্য ধার হিসেবে। বলেছেন সুদ নয়, মূল টাকাটা তোর ভাইপো প্র্যাকটিস শুরু করার সেকন্ড ইয়ার থেকে মাসে মাসে শোধ করে দিক; অন্ততঃ পরের পাঁচ বছরের মধ্যে। আর দুই বাঙালি দিদির অ্যারেস্ট হওয়া এবং জামিন পাওয়া ও তার পরবর্তী ঘটনা যে অনেকটাই সাজানো বা ছক কষা সেটাও আগে টের পাই নি। আমার অভিযোগ - এগুলো স্যার আমাকেও কেন বলেন নি? আমার অভিমান দেখে উনি বললেন যে আমি বাঙালি, জানলে হয়ত দিদিদের সান্ত্বনা দিতে আগেই লীক করে দিতাম। তাহলে ব্যাপারটা পাঁচকান হত এবং ওদের বিপদ বেড়ে যেত।

    আমি খুব কনভিন্সড নই, ইল্লি আর কি! আর আমাকে কি উনি বাঙালি বলে এই কেস থেকে সরিয়ে দিলেন? আরে কেসটা তো আমিই এনেছিলাম! ইনক্রিমেন্টের চেয়েও এই ব্যাপারটা আমার বেশি লেগেছে।

    অবশ্য একটা ব্যাপার আমি ও সিমরন দুজনেই জানি। -- আসলে চারবছর কাজ করতে করতে আমিই জেনেছি, তারপরে সিমরনের সঙ্গে শেয়ার করেছি। ব্যাপারটা হল স্যার অফিসে বসে কখন একা একা দাবা খেলেন? যখন কোন সমস্যার জট খুলতে গিয়ে পেরে ওঠেন না। ওই দাবা খেলাটা হোল স্যারের নিজের সঙ্গে কথা বলা এবং ডামি বানিয়ে শত্রুপক্ষের সঙ্গে পাঞ্জা কষা বা বিপক্ষের মনের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করা। অন্যদিন স্যার লাঞ্চ আওয়ারে আধঘন্টার জন্যে বাড়ি চলে যান। কিন্তু এরকম সময়ে অফিস বয় ওঁর ঘরে গিয়ে ম্যাডামের থেকে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে আসে, তেমন হলে দু’বেলাই।

    আজ বোধহয় তেমনই কিছু হয়েছে। টেবিলের নীচে একটা এঁটোকাঁটা সমেত টিফিন ক্যারিয়ার যেমন তেমন করে নামিয়ে রাখা, মানে অফিস বয় দামলে এখনও ধুতে নিয়ে যায় নি।

    আমি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ি। মন দিয়ে বোর্ড দেখি।

    - স্যার, এটা কী রকম? কালো রাজার দিকে ক্যাসলিং করেছে, সাদা এখনও করেনি, তবে জায়গা বানিয়েছে। কালোর দুটো ঘোড়াই এগিয়ে এসেছে, কিন্তু সাদার ঘোড়াগুলো কেমন নড়ছে চড়ছে না!

    -- চিন্তা করিস না। সাদা এত দুর্বল নয়। মন্ত্রীর সামনের ঘোড়াটা ডানদিকে আড়াই ঘর গেলেই দেখবি ময়দানের চেহারা বদলে গেছে।

    আমি কিছুই বুঝি নি। তাই বিজ্ঞের মতন জানতে চাই যে এটা কি সিসিলিয়ান ডিফেন্স? না রাই লোপেজ ওপেনিং? আসলে আমি খুব বেশি নাম মনে রাখিনি। অন্য সময় হলে স্যার আমাকে দুই ধমক দিতেন ওপর চালাকির জন্যে। কিন্তু এখন উনি অন্য দুনিয়ায় আছেন।

    -- না না, এটা কিং’স ইন্ডিয়ান ডিফেন্স। দ্যাখ, ব্ল্যাক চাইবে সাদাকে সেন্ট্রাল কলামদুটো ক্রমশঃ ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘোড়াগুলোকে খেলাতে আর হাতির সামনের বোড়ে এগিয়ে দিয়ে রাণীকে এড়িয়ে পাশ দিয়ে সাদা রাজাকে আক্রমণ করতে। তবে তাড়াহুড়ো করে নয়, আগে সাদা ঘুঁটিগুলোকে লোভ দেখিয়ে গোটা ময়দানে ছড়িয়ে দেবে, ওকে ভেতরে টেনে আনবে, তারপর পাল্টা হামলা করবে।

    - সাদা কি হাল ছেড়ে দেবে?

    - একেবারেই না। ও অনেক কিছু করতে পারে। তবে আমার পছন্দ পেট্রোসিয়ান ভ্যারিয়েশন -- বিখ্যাত গ্র্যান্ড মাস্টার টাইগ্রান পেট্রোসিয়ানের নামে।

    - পেট্রোসিয়ান? কোন দেশের লোক? বিশ্বনাথন আনন্দের চেয়েও বড় প্লেয়ার?

    - আরে কোথাকার গোমুখ্যু? টাইগ্রান পেট্রোসিয়ান হলেন রাশিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার, আজ থেকে ধরে নে চল্লিশ বছর আগের কথা। সাতবছর ধরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন। আউর ফিলজফি মেঁ ডক্টরেট। পিএইচডি থিসিসটা কী ছিল জানিস? ‘দ্য লজিক্যাল থিংকিং অফ আ চেস প্লেয়ার’ – মজে কী বাত হ্যায় না?

    -- সেতো বুঝলাম স্যার। যেটা বুঝতে পারছিনা তা হল ওই বোম্বাগড় যুবরাজ মার্ডার কেসে সাদা ঘুঁটি কে চালছে আর কালোগুলো কে?

    হঠাৎ উনি যেন মেঘের থেকে এই ধরার ধূলোয় নেমে এলেন। চেসবোর্ডের ঘুঁটিগুলোর পজিশন অমনই রেখে ওটাকে সাবধানে টেবিলের একপাশে সরিয়ে দিলেন।

    - যা, সিমরনকে বল ভালো করে এক ফ্লাস্ক ব্ল্যাক কফি বানিয়ে জগন্নাথের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিতে। আর ব্যাটা এখনও এঁটো বাসনগুলো সরায় নি কেন? টুলে বসে ঘুমুচ্ছে নাকি? ও হ্যাঁ, এখন সিমরন কোন কল এলে যেন ফরওয়ার্ড না করে। মানে আমাকে আগে জিজ্ঞেস না করে। আমরা এখন একটু ব্যস্ত থাকব। তুই এসব সেরে এসে আমার সামনে বসে পড়, আর অবশ্যই প্যাড ও পেন নিয়ে।

    আমি যথারীতি মহাভারতের লেখক গণেশ হয়ে বসে পড়েছি। বস আলমারির চাবি ঘুরিয়ে ড্রয়ার টেনে বের করেছেন দুটো ফাইল। একটা আমার চেনা -- বুড়ারে নেওয়া সমস্ত জবানবন্দীর কপি। অন্যটায় একগাদা রিপোর্ট, কোন ল্যাব থেকে এক্সট্রা কপি এবং কিছু জেরক্স।

    উনি এখন নিজের মনে কথা বলবেন, বিড়বিড় করে নয়, জোরে জোরে। আমাকে কানখাড়া করে সব শুনতে হবে, কিন্তু মাঝখানে প্রশ্ন করা চলবে না। তাতে নাকি ওনার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায়! তবে উনি জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে হবে। কানখাড়া করে? হাতির মত? গণেশের কান আর কিসের মত হবে? কিন্তু এটাও জানি যে উনি মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মাঝখানে প্রশ্ন করে বসেন এটা দেখতে যে আমি কি সত্যিই শুনছি নাকি চোখ খুলে ঘুমুচ্ছি? ধরা পড়ে গেলে ভীষণ রেগে যান। আর আমাকে নিজের বুদ্ধিমত পয়েন্ট নোট করতে হবে। উনি কখনও ইশারা করলে বিশেষ নোটস নিতে হবে।

    - আচ্ছা, আমরা কোথায় আছি? লাশ পাওয়া গেছে, হত্যায় ব্যবহৃত ছোরা পাওয়া গেছে। ছোরার গায়ের রক্ত নিহত যুবরাজ সাহেবের - সেটা কনফার্মড হয়েছে। কিন্তু যেসব জানা যায়নি তা’হল -- ছোরাটা কার? খুনি কে? খুনের মোটিভ কী? নোট করেছিস? বেশ, এবার ফরেনসিক রিপোর্টের কপিটা বের কর। বল, ক’টা ঘা? কত গভীর? আর কোন কমেন্ট? দেখে বল, নিজের গল্প জুড়ে দিস না।

    -- স্যার, লিখে নিয়েছি।

    এবার আমি যা বলছি নোট করে নে, কিন্তু সামনের রিপোর্টগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে থাকবি। কোথাও যদি আমার কথা আর রিপোর্টে অসংগতি দেখিস তো আঙুল তুলবি।

    ১) ছোরাটার মালিক কে জানা যায়নি। তবে মৃতের বাঁদিকে ঘাড়ের পেছনে প্রায় ৩/৪ ইঞ্চির ক্ষত, একটা ইম্পর্ট্যান্ট শিরা কেটে গেছে। প্রচূর রক্তক্ষরণ, তার ফলে মৃত্যু। কমেন্টে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে যে আততায়ী পেছন দিক থেকে ছুরি চালায়, এবং সে বাঁহাতি। ডানহাতি লোক পিঠের বাঁ দিকে ছুরি চালালে ক্ষতটি সোজা এবং গভীর না হয়ে একটু ত্যাড়া মতন হত। হয়ত শিরা কাটা যেত না, তাহলে এতটা রক্ত বেরোত না। ফলে ভিকটিমের বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যেত।

    ২) মোটিভ, মানে, খুন করার উদ্দেশ্য? বলা কঠিন। আপাততঃ দুই বাঙালি বহেনজির একটা বদলা নেবার ব্যাপার চোখে পড়েছে, কিন্তু সেটা কতটা স্ট্রং? হ্যাঁ, মানুষ রাগের মাথায় খুব সামান্য কারণে খুন করতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে সহজে ধরা পড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি স্কোপ ছিল ড্রাইভারের। এতদিনের বিশ্বাসী ড্রাইভার। কেন করবে?কী লাভ? টাকাপয়সা? নারীঘটিত কোন মামলা? কোন কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট? টিম্বার মিল? ওর পিস্তল রাখার অজুহাত কতটা জেনুইন? ছোরাটা বোনেদের ব্যাগ থেকে ওই উদ্ধার করে অথচ আগে কোন ব্যাগ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেনি। হুম্‌

    সৌরভ, আজকে তোর অনেক কাজ। এসপি অফিসে ফোন করে জিজ্ঞেস করে বলবি - গত পরশু ওঁরা আমার রিকোয়েস্টে “শান্তিরাম ওঁরাও,পিতা সহসরাম ওঁরাও, গ্রাম হেড়সপুর, থানা বচেলী, জেলা সরগুজা”র ভেরিফিকেশনের জন্য এসপি অফিস জেলা সরগুজাকে একটা আর্জেন্ট রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন যাতে থানেদার বচেলী হেড়সপুর গাঁয়ে গিয়ে সরেজমিনে শান্তিরাম ওঁরাওয়ের ভেরিফিকেশন করিয়ে উত্তর পাঠায়। সেটার উত্তর এসে গেছে কি?

    ৩) আচ্ছা, কুমারসাহেবকে কী বেনেফিট অফ আউট দেয়া যায়? দেখা যাচ্ছে উনিই হলেন কুমার বীরেন্দ্রপ্রতাপ, এবং শান্তিনিকেতনে পড়েছিলেন। স্বীকার করেছেন যে দুই বাঙালী বোনেদের চিনতেন। অথচ ঘনিষ্ঠতার কথা সপাটে অস্বীকার! সত্যি বলছেন কি? মনে হয় না। বিপদে পড়লে মানুষ মিথ্যে বলে। ওঁর জায়গায় আমি হলেও বোধহয় সত্যিটা লুকোতাম। উনি ঠিক কোন সত্যিটা আড়াল করছেন?

    ৪) দুই বোনকে নেমন্তন্ন করল কে? চিঠিতে ছাপা রয়েছে যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপ, অথচ যিনি যুবরাজ, তাঁর নাম বীরেন্দ্রপাল আর কুমার সাহেব হলেন বীরেন্দ্রপ্রতাপ অথচ তিনি যুবরাজ নন। তাহলে চিঠিটা পাঠিয়েছিল কে? বীরেন্দ্রপ্রতাপ না বীরেন্দ্রপাল? কার লাভ? তারপর কেন অস্বীকার? যেই পাঠিয়ে থাকুক, সে দুইবোনের বর্তমান অবস্থা, পেশা, ঠিকানা সবই জানে। কে সে?

    দুই বোনেদের মোবাইল মেসেজ পাঠালো কে? যুবরাজ? আজ সেটা কী করে জানা যাবে? যুবরাজের মোবাইল পাওয়া যায়নি। কেন? একজন লোক মোবাইল বিলাসপুরে ফেলে আসবে? ক’টা মোবাইল ছিল ওঁর?

    ৫) দাদাকে মেরে ভাই বীরেন্দ্রপ্রতাপের লাভ? যুবরাজ ২৭ তারিখ রাজা হলেও কুমারসাহেবের গদি পাওয়া আজ নয় কাল নিশ্চিত। দাদা অসুস্থ, প্রায় সেনাইল। কিছুদিন পরে হয়ত বেশি অসুস্থ হলে তাঁকে আইনতঃ রাজত্ব থেকে রিটায়ার করিয়ে কুমারসাহেব গদিতে বসতে পারেন। তাহলে উনি কেন খামোকা মার্ডার করার রিস্ক নিতে যাবেন? এত বোকা তো উনি নন!

    স্টপ! আমি কী বলেছি? লাস্ট দুটো সেন্টেন্স? প্লীজ রিপিট!

    - “কিছুদিন পরে হয়ত বেশি অসুস্থ হলে তাঁকে আইনতঃ রাজত্ব থেকে রিটায়ার করিয়ে কুমারসাহেব গদিতে বসতে পারেন। তাহলে উনি কেন খামোকা মার্ডার করার রিস্ক নিতে যাবেন”? কেন, কী হল স্যার?

    -- না না, কিছু হয়নি। তুই তৈরি হয়ে নে। মানে একটা ব্রীফকেস গুছিয়ে নে। আমরা এখন বেরোব। নাঃ তার আগে কিছু কাজ আছে। নোট করে নে।

    শোন, এসপি অফিসের মাধ্যমে আমরা জানতে চাইব মৃত যুবরাজ বীরেন্দ্রপাল প্রতাপ সিং এর ভিসেরা রিপোর্ট রেডি হয়েছে কিনা। আইনতঃ পোস্ট মর্টেমের পনের দিনের মধ্যে ভিসেরা রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। গত মাসের ২৯ তারিখের মধ্যে পোস্ট মর্টেম হয়ে গেছল। তাহলে এপ্রিলের ১২ বা ১৩ তারিখের ভেতর ফর্মাল রিপোর্ট এসে যাওয়ার কথা। সেসব না হয় হবে, কিন্তু আজ ৬ তারিখ। অন্ততঃ ৯ বা ১০ তারিখ নাগাদ রিপোর্ট নিশ্চয়ই তৈরি হয়ে যাবে। আমি অনুরোধ করব যাতে এস পি নিজে চেক করে ভিসেরা রিপোর্টের মূল ফাইন্ডিংগুলো আমার সঙ্গে শেয়ার করেন। আর এগুলো ১০ তারিখের মধ্যে হয়ে গেলে ভাল হয়।

    -- কেন স্যার? ১০ তারিখে কী হবে?

    -- হবে আমার মাথা! কিছুই খেয়াল করিস নি? বীরেন্দ্রপাল মারা গেছেন ২৭ মার্চ রাত্তিরে, ধরে নে আটটা থেকে ন’টার মধ্যে। তাঁর পোস্ট মর্টেম হয়ে গেছে এবং তাঁর ভিসেরা মানে নাড়িভুঁড়ি, পিত্ত, পাকস্থল্‌ ফুসফুস, হার্ট সব প্যাকেট সীল করে বিলাসপুর সিমস হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, চারজন ডাক্তারের টিম এর বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট পাঠাবে।

    এদিকে পোস্ট মর্টেমের পরের দিন সেলাইকরা বডি বুড়ারে কুমারসাহেবকে সঁপে দেওয়া হয়েছে শেষকৃত্যের জন্যে, সেসব চুকেবুকে গেছে। এখন তেরোদিনের মাথায় শ্রাদ্ধ হবে, তারিখটা সম্ভবতঃ ৯ তারিখ। এরপর সবাই বুড়ার ছেড়ে বিলাসপুরে চলে আসবে। তারপর একমাত্র উত্তরাধিকারী কুমারসাহেবের সিংহাসন আরোহণের উৎসব। মানছি, যুবরাজের মৃত্যুর ফলে প্রজা এবং রাজপরিবারে শোকের ছায়া। তবু নমো নমো করে কিছু তো হবে। এইসব ঝুট ঝামেলায় অনেক প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমি শ্রাদ্ধের দিন বা সম্ভব হলে তার আগে একবার - ওই বোম্বাগড় নাকি বুড়ার - ভ্রমণ করিতে চাহি।

    - ডিএসপি স্যার? বস্‌, একটা কথা বলি? রাগ করবেন না?

    বস্‌ একগাল হেসে বললেন - না রে, রাগ করব কেন?

    (উনি কি আমার ‘ডিএসপি স্যার’ বলে তেল লাগানোটা খেয়াল করেছেন?)

    -- দেখুন, শ্রাদ্ধের দিন আপনি বুড়ার যেতে চান, ভালো কথা। কিন্তু ওরা আপনাকে ডেকেছে কি? না ডাকলে যাওয়া কি ঠিক হবে?

    - না আমাকে ডাকেনি, এসপি শ্রীবাস্তবকে ডেকেছে। তাতে কি, আমি যাব আমার ক্লায়েন্টের জন্যে। ওটা আমার ডিউটি।

    -- দেখুন, আমাদের ক্লায়েন্ট তো মারা গেছেন। না না, আমরা রাজপরিবারের ক্লায়েন্ট, থুড়ি ওই লোকটাই আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে কাজটা দিয়েছিল। সন্ধ্যেবেলায় শান্তিরামকে দিয়ে টিকিট ও ৫০০০ টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছিল। কিন্তু বহোত বদতমীজ। ধরাকে সরা জ্ঞান করে। আমার সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেছিল।

    -- বাকি টাকা দিয়েছে? দশহাজারের কথা ছিল না?

    -- দেয় নি বস্‌।

    - ঠিক আছে, তোর বদলা নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। শোন, তুই এক্ষুণি আমাদের অফিসের ল্যান্ডলাইন থেকে কুমার সাহেবকে ওর মোবাইল নম্বরে ফোন লাগা। আমি কিচ্ছু শিখিয়ে পড়িয়ে দেব না। দেখি, তুই কেমন করে পাওনা টাকা আদায় করিস। খালি একটা কথা মনে রাখিস, ও আমাদের ক্লায়েন্ট। বদতমীজির জবাব বদতমীজি হয় না।

    এবার লাগা ফোন আমার টেবিলের এক্সটেনশন থেকে, সিমরনকে বলে দে টক রেকর্ড করতে, আর স্পীকারে রাখ, যাতে দরকার পড়লে আমিও ইন্টারভেন করতে পারি।

    আমি কুমারসাহেবের নম্বর দেখে ল্যান্ডলাইন থেকে ডায়াল করলাম।

    তারপর যা হল তাকে স্থানীয় ভাষায় বলে- ‘না হিঙ লঙ, না ফটকিরি, ফির ভী রঙ চোখা’

    না হিং না লবঙ্গ, ফিটকিরিও পড়েনি, তবু রান্নার রঙ দেখ - ফাটাফাটি!

    খানিকক্ষণ রিং যাওয়ার পর কেউ ফোন ধরল - কিসসে বাত করনা হ্যায়?

    - কুমারসাহেব সে।

    - আপ কৌন? কহাঁ সে বোল রহেঁ?

    নারীকন্ঠ; অসম্ভব সুরেলা। এমন স্বর শুনলে ইচ্ছে হয় উত্তর না দিয়ে ফোন ধরে রাখি, যাতে উনি আরও খানিকক্ষণ কথা বলেন। কিন্তু কোসলে স্যার আমাকে কড়া চোখে জরিপ করছেন।

    -- হম ওয়াচ অ্যান্ড সিকিউরিটিজ; বিলাসপুর, লিংক রোড।

    - খানিকক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নেই। তারপর পরিচিত ভারী পুরুষালি স্বরে শোনা গেল-বাত ক্যা হ্যায়?

    গলার স্বরে অসম্ভব রুক্ষতা ও তাচ্ছিল্য।

    - নমস্কার কুমারসাহেব। ম্যায় আপকো বকায়া পেমেন্টকে লিয়ে ফোন কিয়া থা।

    -- কিস চীজ কা পেমেন্ট? কাহে কী বকায়া?

    -- মার্চ মাহিনাকে ২৭ তারিখকো আপকে ভাই যুবরাজসাহাবকে সাথ ট্রেন মেঁ এসকর্ট বনকর সহী সলামত বুড়ার পৌঁছা দেনেকে লিয়ে। দশহাজার রুপিয়া কা কন্ট্র্যাক্ট থা, আধা অ্যাডভান্স, আধা কাম হোনে কে বাদ। অ্যাডভান্স আপ টিকটকে সাথ ভিজওয়া দিয়ে থে; অব বাকি পাঁচহাজার—

    টেলিফোনে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন।

    -- শরম নহীঁ আতা তেরেকো? কুছ দীন ইমান হ্যায় কি নহীঁ? আপনা জাত কা নমুনা দিখা দিয়া না? কাম কা সত্যনাশ করকে ফির পয়সা মাঙ্গনা? তেরে ইয়ে হিম্মত?

    তোর লজ্জা করেনা রে! কিছু ধর্মবোধ কিছু ন্যায়নিষ্ঠা? নিজের জাতের নমুনা ঠিক দেখিয়ে দিলি! কাজের গুষ্টির তুষ্টি করে ফের পয়সা চাস? তোর আস্পদ্দা তো কম নয়?

    -- ইয়ে সব ক্যা বোল রহেঁ হ্যায় আপ? আমাদের দায়িত্ব ছিল বুড়ার স্টেশন অব্দি নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া। তা দিয়েছি। আমার দায়িত্ব শেষ। ওনার হত্যা হয়েছে রাত্তিরে রাজওয়াড়ায়, আপনার উপস্থিতিতে, আপনার সিকিউরিটি মজুদ থাকতে। এতে আমার কী গাফিলতি দেখলেন?

    - হরামজাদে! তু আপনে সাথ ও দোনো হত্যারিন বহনোঁ কো নহী লায়া? ও দোনো তেরে পহচানকে অউর অপনা জাতকে হ্যায় কী নহীঁ?

    ওরে হারামজাদা! তুই নিজের সাথে ওই দুটো খুনি বোনকে নিয়ে আসিস নি? ওরা তোর জাতের আর পুরনো চেনা নয়?

    এবার আমি হাল ছেড়ে দিই, বসের দিকে তাকাই। বাপ-মা তুলে গালি সহ্য করব না; যতই মাননীয় ক্লায়েন্ট হোক।

    কোসলে স্যার ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলে স্পীকারে বলেন — আরে কুমারসাহেব, ক্যা বাত হ্যায়? কাহে বচ্চোঁ কো গালি বক রহে হো?

    জবাবে কুমারসাহেব আমার আস্পর্দ্দা ও অপদার্থতা নিয়ে কিছু গরমাগরম বললেন।

    কোসলে স্যার খুব জোরে হেসে উঠে বলে দিলেন - ছোড়িয়ে সাহাব। কাম কে বাত করেঁ? আপনার আর বাচ্চাটার সব কথা আমাদের এখানে রেকর্ড হয়ে গেছে। আপনি মেনে নিয়েছেন যে টিকিট ও অ্যাডভান্সের কথাটা সত্যি। আপনার আপত্তি ওই দুই আসামীর সঙ্গে সৌরভের এক ট্রেনে এবং একই কোচে যাওয়া নিয়ে তাই তো?

    দেখুন, যদি পয়সা না দিয়ে আগে পাত্তি শো করতে বলেন তাতেও আমি রাজি। এখনই কিছু পাত্তি দেখাচ্ছি।

    এক, আমাদের নিয়ম হল টেলিফোনে ক্লায়েন্টের সঙ্গে সব বিজনেস টক রেকর্ড করে রাখা। আমি সেদিন, মানে গত মাসের ২৬ তারিখ অফিসে ছিলাম না। এসে ভয়েস রেকর্ড চেক করেছি। আপনি স্পষ্টাস্পষ্টি বলছেন যুবরাজ বীরেন্দ্রপালের সঙ্গে বুড়ার অব্দি যেতে হবে, দায়িত্ব শেষ। ফিরে এলে বাকি পাঁচ হাজার। এখন দেখুন, আপনার নাম বীরেন্দ্রপ্রতাপ, অথচ আপনি দাদা বীরেন্দ্রপালকে পাঠিয়েছেন বীরেন্দ্রপ্রতাপের নামের টিকিটে। কেন, সেটা আপনিই ভাল জানেন। ঘটনার ইন্ডিপেন্ডেন্ট সাক্ষী সেদিনের কোচের টিটি ও সৌরভ। সাক্ষী আপনাদের ড্রাইভার শান্তিরাম। যে টিকেট এবং টাকা দেওয়ার কাজ করেছে। ফলে রেলওয়ে আইন ভঙ্গের দায়ে আমরা আপনাকে এখনই বুক করতে পারি।

    দুই, ওই হত্যারিন বাঙালী বহেনজিদের সঙ্গে আপনারই পুরনো পরিচয় ছিল, শান্তিনিকেতনে পড়ার সূত্রে কয়েক বছর ধরে। তারপর ওই দু’জন এসেছে বীরেন্দ্রপ্রতাপের, মানে আপনার বাংলায় লেখা চিঠি পেয়ে। তাহলে হত্যার ষড়যন্ত্রে সামিল হবার চার্জেও আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি। এবার ভেবে দেখুন, মাত্র পাঁচহাজার টাকার জন্য এত বড় রিস্ক নেবেন? আর জাত তুলে গাল দেবেন?

    উরিত্তারা! যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল।

    কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থাকার পর কুমারসাহেবের আওয়াজ শোনা গেল। গলা একেবারে খাদে।

    -- মাথার ঠিক ছিলনা। বুঝতেই পারছেন, বাবা চলে যাওয়ার একবছরের মাথায় দাদাকে হারালাম, তাও ওইরকম ভাবে! শ্রাদ্ধের পর বিলাসপুরে ফিরে এসে টাকাটা দিয়ে দেব। আমি কারও টাকা মেরে দিই না। আর হ্যাঁ, আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট ওই বাবুমশায়কেও সরি বলছি, আমার মনের অবস্থা ভেবে এগুলো আপনারা ভুলে যান, প্লীজ!

    ************************************************

    সেদিন সন্ধ্যে ছ’টা

    আজকের দিনটা একেবারে অন্যরকম। কুমারসাহেবের সঙ্গে পঙ্গা নেওয়ার পর বস ঘরে চলে গেলেন। বললেন শরীরটা ভাল লাগছে না। সদর বাজারে ডাক্তারের কাছে চেক আপ করাতে যাবেন, আগে থেকে অ্যাপো নেওয়া আছে।

    আমাকে বললেন পরিহার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সংগে কাল দুপুরে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করতে। এই অভিজাত ফার্মটি বোম্বাগড় এস্টেটের অ্যাটর্নি।

    তারপর বললেন, এসপি মিঃ শ্রীবাস্তবের সংগে কথা বলেছি যে ড্রাইভার কাম বডিগার্ড শ্রীমান শান্তিরামের সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। বুড়ার থানাকে বলা হোক ওকে যেন তুলে নেয়, তারপর বিলাসপুরে এসপি অফিসে এসকর্টের সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়। এখানেই ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। তুই একটু ফলো আপ করিস, তোকে তো উনি চেনেন। একবার ওনার অফিসে চলে যাস। সময় চলে যাচ্ছে।

    হ্যাঁ, আরেকটা কাজ রয়েছে। ফরেনসিক অফিসে যেতে হবে। ওখানেই আগে যাস, তবে তার আগে ফোন করে যাস। শিপ্রা সাইনিকে। ও রাণীসাহেবার যে স্টেটমেন্ট বুড়ার রাজবাড়িতে থেকে চলে আসার দিন নিয়েছিল তার কপি আমরা পাইনি। শুধু এসপি অফিসে জমা হয়েছে। আমি বলে দিয়েছিলাম একটা এক্সট্রা কপি করিয়ে রাখতে, তুই গেলে দিয়ে দেবে। ওটা নিয়ে আসবি, আর কফি খেয়ে নিবি। শিপ্রা খুব ভাল কফি বানায়।

    আমি চোখ নামিয়ে ব্রিফকেস গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।

    বস্‌ বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন - শোন, ওই রিপোর্টটা নিয়ে বাড়ি চলে যাস। রাত্তিরে মন দিয়ে পড়ে নোটস নিস। তারপরে কাল সকালে তোর নোটস সমেত আমাকে দিস।

    ফরেনসিক অফিসটা বিলাসপুরের অরপা নদীর পুল পেরিয়ে ওপারে। সাউথ ইস্টার্ন কোলফিল্ডের কলোনি এলাকায়। প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে।

    শিপ্রা সাইনি এখন মিসেস, তাতে কী? বিয়ের জল গায়ে পড়ে চেহারা আরও খুলেছে। ব্যক্তিত্বে একটা অন্যরকম জৌলুষ এসেছে। হ্যাঃ ,আমিও কিরকম মানা ক্যাম্পের পাকাচুল খুড়িমা মামীমাদের মত লাইন ঝাড়ছি!

    এসব চিন্তা মন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে শিপ্রার দেওয়া বাদামি রঙা ফোল্ডার খুলে ফেলে ভেতরের কাগজগুলো বের করে আনি। চার পাতা স্টেটমেন্ট রাণীসাহিবা ইন্দ্রকুমারী দেবীর। বাবা, কী নাম! সঙ্গে ‘কুমারী’ না জুড়লে ছেলে না মেয়ে বোঝা দায়। তবে ইংরেজি সিগনেচারটি জবর। ‘আই’টা বেশ বড় এবং টেনে লেখা, খানিকটা ক্যালিওগ্রাফির মত। উনি কোন স্কুলে পড়েছেন? নিঘঘাৎ সেখানে ভাল করে কার্সিভ রাইটিং অভ্যেস করিয়ে তবে রেহাই দিত।

    শিপ্রা বোধহয় আমার চিন্তাটা অনুমান করে বলল-ভেতরে সব আছে, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া স্কুলের, এলিট ব্যাপার। কোন হেঁজিপেঁজি নয়। ওসব বাড়ি গিয়ে দেখে নেবেন। এখন কফি খান, এক্ষুণি বানিয়েছি। আর এই রিপোর্ট গুলো দেখুন। কোসলে স্যারের কাছেও গেছে। এগুলো এক্সট্রা কপি।

    আমি দেখতে থাকি; বুড়ারের রাজবাড়িতে শিপ্রার পাউডার ছড়িয়ে তোলা ইম্প্রেশন, ক্যামেরায় রেজোল্যুশন বাড়িয়ে প্রিন্ট করা হয়েছে।

    ছোরা, ছোরার বাঁট। বাঁটে ফিংগার প্রিন্ট, ছোরার ফলায় নেই, শুকনো রক্তের দাগ রয়েছে। কাঁচের গেলাস, ফল খাওয়ার রূপোর বাটি, পিরিচ পেয়ালা - সব সাফসুতরা। কোন ছাপটাপ নেই।

    ফাইল ফোল্ডার নিয়ে উঠে দাঁড়াই, ওরও অফিস বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। আমাকে বাড়ি ফিরে রান্না চড়াতে হবে। তার আগে এসপি অফিসের কাজ।

    সোজা শ্রীবাস্তব স্যারের কামরায় গেলাম। স্যারের লেখা চিরকুট দিলাম। উনি হাসিমুখে বললেন - কোসলে নিজে এল না কেন?

    যেই বললাম যে একটু চেক আপ করাতে ডাক্তারের কাছে গেছেন স্যারের চোখ একটু কুঁচকে গেল। জানতে চাইলেন কোন ডাক্তার? আমি বললাম ঠিক মনে পড়ছেনা। বোধহয় সদর বাজারের কোন সিনিয়র ডাক্তার।

    -- কাল আমাকে ফোন করতে বলবে। তবে ভিসেরা রিপোর্ট নিয়ে কথা দিতে পারছি না। ডাক্তারদের উপর বেশি জোর জবরদস্তি করা ঠিক নয়; তবু দেখব, কতদূর কী করা যায়। আর শান্তিরামের সঙ্গে কথা বলতে তুলে আনা কি জরুরি? গাঁয়ের লোকের সন্দেহ হবে না? রঙ মেসেজ যেতে পারে। যাহোক, তোমার বসকে বোল সময় বের করে এদিক পানে একবার আসতে। ভাল চা খাওয়াব।

    আমি বেরিয়ে গিয়ে আমার স্কুটারে কিক মারতে থাকি। পুরনো মান্ধাতার আমলের এলএমএল ভেস্পা। বোধহয় গোটা শহরে দু’তিনটেই দেখা যাবে। দ্বিচক্রযান একগাদা সাদা ধোঁয়া ছেড়ে গুঙিয়ে উঠে স্টার্ট নিল। কার্বোরেটরে কার্বন জমেছে, তেল এসে গেছে। কিন্তু আমার গিয়ার বদলানো হোল না।

    এসপি অফিসের সিকিউরিটি দৌড়ে আসছে, ইশারা করছে থামতে। হাঁফাতে হাঁফাতে এসে স্যারের চেম্বারের দিকে ইশারা করে বলল - আপকো বুলা রহেঁ। আপনাকে ডাকছেন।

    আমি কিচ্ছু ভাবি না। স্কুটার স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে দ্রুতপায়ে শ্রীবাস্তব স্যারের চেম্বারে ঢুকে যাই। উনি কোন কথা না বলে একটা প্রিন্ট আউটের কপি আমার দিকে এগিয়ে দেন। সরগুজা জেলার হেডকোয়ার্টার অম্বিকাপুরের এসপি অফিস থেকে মেসেজঃ

    পুলিস ভেরিফিকেশন রিপোর্ট

    বচেলী থানার থানেদার জানাচ্ছে যে “জনৈক শান্তিরাম ওঁরাও, পিতা সহসরাম ওঁরাও, বয়েস ৩৪, গ্রাম হেড়সপুর, থানা বচেলী, জেলা সরগুজা” পাঁচ বছর আগে টিবিতে মারা গিয়েছে। এসপি বিলাসপুরের অনুরোধ পালনে প্রেষিত।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮
  • ধারাবাহিক | ১৪ আগস্ট ২০২১ | ১৮৭৫ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ১৪ আগস্ট ২০২১ ১৭:০৮496762
  • অ্যাডমিন,


    নেট স্লো থাকায় তিনবার পোস্ট হয়ে গেছে। পরের দুটো উড়িয়ে দিন, প্লীজ!

  • :|: | 174.255.131.176 | ১৪ আগস্ট ২০২১ ২৩:২৫496771
  • সেকি! "জনৈক শান্তিরাম... পাঁচ বছর আগেই" প্রয়াত!? খুবই জমেছে।


    প্রথম থেকেই অবশ্যি ইন্দ্রকুমারীকে সন্দেহ করছি। হতে পারে বাণী বসুর "খারাপ ছেলে" উপন্যাসটা মন কখনও পুরো সরিয়ে ফেলতে পারেনি বলে। কিন্তু তাইতে আবার কেলভিন ক্লাইনের মেল পারফিউমের গন্ধটা মিলছে না। 


    যাগগে, পাঠক লেখকের এই অনুমানের খেলাটাও রহস্য গল্পপাঠের অন্যতম আকর্ষণ। সেটাও উপভোগ করতে পেরে ভালো লাগছে। 

  • বিপ্লব রহমান | ১৫ আগস্ট ২০২১ ১০:৩৩496790
  • যাহ! বুধো ব্যাটা আগেই মরেছে!? তাহলে উধোর পিণ্ডির কী হবে? 


    জলদি পরের পর্ব চাই :-P

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন