এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • রাজরক্ত (রহস্য গল্প) : ৯ম পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ১৮ জুলাই ২০২১ | ২১৮০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮

    (৯) আর এক দফা জেরার পালা ২৯/০৩/২০০২ রাত্রি ৯.০০


    বুড়ার গেস্ট হাউসে জায়গা নেই, কারণ দুটো মাত্র ঘর। সে দুটোয় আমি এবং দুই বাঙালি দিদি আগে থেকেই রয়েছি।  তাই আমার বস কোসলে স্যার আর বিলাসপুরের এসপি মিঃ শ্রীবাস্তব রাজবাড়িরই একটা ঘরে আস্তানা গেড়েছেন। ওঁরা সন্ধ্যেবেলা পৌঁছে আগে কুমারসাহেব এবং থানেদার ঈশ্বর পান্ডের সঙ্গে কথা বলে সব শুনে নিয়েছেন। জবানবন্দীর ফাইলের এক সেট কপি এখন ওনাদের কাছে। বডি রয়েছে বুড়ারের সরকারি হাসপাতালের মর্গে।  সেখানে পাঠানোর আগে থানেদার ঈশ্বর পান্ডে বডি যে অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিল তার ছবি তুলে নিয়েছেন। হাসপাতালের ডাক্তার রক্তের স্যাম্পলও নিয়েছে। এঁরা বডি দেখার পর কাল পোস্ট মর্টেম করার অনুমতি দিয়েছেন। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, এসেছেন ওঁরা তিনজন। তৃতীয়জনের এখন সিঁথিতে সিঁদুরের ছোঁয়া , কিন্তু আমার চিনতে ভুল হয়নি। সেই সাড়ে তিনবছর আগে মূলমূলায় গ্রামীণ ব্যাংকের নকল ডাকাতির কেসে পরিচয় হয়েছিল, ফরেন্সিক বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট শিপ্রা সাইনি। মুচকি হাসিতে বুঝিয়ে দিলেন উনিও চিনতে পেরেছেন। ওঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে রাণীসাহিবার পাশের কামরায়, ওটাতে একটা অ্যাটাচড বাথরুম আছে।


    এমনিতে কোন চিন্তা নেই। থানার যত পুলিস ছিল তার আদ্দেক এই রাজোয়ারায় পাহারা দিচ্ছে। ছ’জন গেস্টহাউসে দুই দিদির কামরা ঘিরে বসে আছে। আর থানেদার নিজে এসপি’র সামনে পেছনে ‘জো হুজুর’ ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্থানীয় পুলিশ এবং বুড়ার গ্রামবাসীরা নিশ্চিত যে ইয়ে দো বাঙালী বহন হ্যায় যুবরাজ কী হত্যারিন। কাজেই কড়া পুলিশ প্রটেকশন না দিলে ওদের উপর হামলা হয়ে যেতে পারে। এই এলাকায় লোকের বিশ্বাস বাঙালি মেয়েরা জাদুটোনা তুকতাক জানে।


     এসপি শ্রীবাস্তব আমার বসকে নিয়ে জিপসিতে চড়ে হাসপাতালে বডি দেখতে যাওয়ার আগে সাইনি ম্যামকে কিছু নির্দেশ দিয়ে গেলেন। আমাকে বস বললেন - শিপ্রার সঙ্গে সংগে থাকিস। ওর যেন কাজ করতে কোন অসুবিধে না হয়। দরকার হলে ফোন করবি। আর ফাইলগুলো তোর জিম্মায় রেখে গেলাম। বোর লাগলে ভাল করে সবার স্টেটমেন্টগুলো পড়। উদ্ভট কিছু চোখে পড়লে নোটস নিবি। আমি এসে পড়া ধরব।


    শিপ্রা কাজ শুরু করেছেন। প্রথমে একটা বড় ব্যাগ খুলে পলিথিনের কিছু প্যাকেট বের করে সাজিয়ে রাখলেন। তারপর ক্যারম বোর্ডের পাউডারের মত কিছু ছড়িয়ে দিলেন যুবরাজ সাহেবের সরবতের গ্লাসে, ফল খাওয়ার প্লেটে, রক্তের দাগ লাগা ছোরায়, কার্পেটে ও বিছানায়। তারপর সেসবের একের পর এক ফটো তুলতে লাগলেন নানান অ্যাংগল থেকে।


    আমি হাই তুলি, তারপর ফাইল খুলে পড়তে শুরু করি।প্রথমবার পড়ার পর একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিছু একটা চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে, কিন্তু ধরতে গেলে ফসকে যাচ্ছে। আরেকবার খুঁটিয়ে পড়তে থাকি। এটা কী দেখছি? আমার অজ্ঞাতসারে মুখ দিয়ে একট ‘ওঁক্‌’ করে শব্দ বেরোয়। শিপ্রা চমকে উঠে আমার দিকে তাকান।


    --কিছু বললেন?


    --কই, না তো।


    -শরীর ভাল আছে, বিশ্বাস?


    -আরে না না, সব ঠিক আছে; কিচ্ছু ভাববেন না।


    সেদিনই বুড়ার রাজবাড়ি ; রাত ৯টা।


    রাত্তিরে খাওয়ার পর ওঁদের কামরায় দুই বস একটা সোফায় জাঁকিয়ে বসেছেন। রাজবাড়ির নিজেদের কামরা থেকে কুমারসাহেব  সোফা, তিনটে চেয়ার ও একটা টেবিল পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সাইনিম্যামকে শুতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।


    যাদের জবানবন্দী গতকাল নেয়া হয়েছে, তাদের সবাইকে পাশের একটা ঘরে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। আমার দায়িত্ব একজন একজন  করে ডেকে পাঠানো। ফাইলের পাতা উলটে যাচ্ছেন কোসলে স্যার। প্রশ্ন করার দায়িত্ব আপাতত এসপি শ্রীবাস্তবই সামলাবেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, এঁরা প্রথমে আমাকেই জেরা করতে শুরু করলেন। মানে প্রশ্ন করছেন আমার বস, নোটস নিচ্ছেন আর এসপি সাহেব সিগারেটে টান দিতে দিতে শুনছেন। ছাই ফেলছেন চায়ের কাপে, এখানে অ্যাশট্রে নেই নাকি? সে যাকগে।


    - সৌরভ, রাজবাড়ি থেকে তোকে দায়িত্ব দেয়া হল যে যুবরাজ সাহেবের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে  ওঁর সঙ্গী হিসেবে তোকে এই বোম্বাগড় এস্টেটের রাজধানী বুড়ারে আসতে হবে। কিন্তু —


    -- স্যার, আমার কন্ট্রাক্ট শুধু ট্রেন জার্নির জন্যে ছিল। তারপরে তো শান্তিরাম বা এস্টেটের স্টাফের দায়িত্ব!


    আমার গলার আওয়াজ বোধহয় উত্তেজনায় সামান্য চড়ে গেছল। এস পি শ্রীবাস্তব চোখ কুঁচকে তাকালেন। সিগ্রেটের ছাই কার্পেটের উপর ঝরে পড়ায় বসে বসেই পা বাড়িয়ে সেটা মাড়িয়ে দিলেন।


    -- আরে আমিও তাই বলছি - ওদের আশংকা ছিল ট্রেনে কোন ঘটনা ঘটবে।


    -- হ্যাঁ বস, তাই। কিন্তু ট্রেন জার্নিতে তেমন কিছু ঘটেনি।


    - সত্যি কিছু ঘটেনি? মানে এমন কোন ঘটনা যা একটু অদ্ভুত, বা যাতে তোর মনে একটু খটকা লেগেছে? ভেবে বল।  তাড়াহুড়ো করিস না, চিন্তা করে দেখ কিছু মনে পড়ে কিনা!


    একটু ইতস্ততঃ করি, তারপর বলেই ফেলি।


    - দুটো ঘটনা, না না তিনটে।


    ওরা দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে, অপেক্ষা করছেন।


    - আমাকে বলা হয়েছিল যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে আসতে। টিকেটে এবং কোচের গায়ে স্লিপে বা কন্ডাক্টরের লিস্টে জি কেবিনে লোয়ার বার্থের যাত্রীর নাম বীরেন্দ্রপ্রতাপই বটে, কিন্তু যাত্রী মহোদয় নিজের নাম শুনে অমন খেপে উঠলেন কেন? কেন জিদ করতে লাগলেন যে ওঁর নাম বীরেন্দ্রপাল।  কিন্তু যুবরাজের নাম তো বীরেন্দ্রপ্রতাপ, সবাই জানে। মানে দিদিদের আমন্ত্রণ পত্রে ‘যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপ’ লেখা। দিদিদের মোবাইলে পাঠানো মেসেজেও “কাম শার্প, যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপ”, আমি নিজে দেখেছি। তাহলে উনি কে? উনি কি বীরেন্দ্রপ্রতাপ নন? তাহলে টিকিট বীরেন্দ্রপ্রতাপের নামে কেন কাটা হয়েছিল?


    দ্বিতীয় ঘটনা দুই দিদি। যুবরাজ কেন ওঁদের চিনতে পারেননি? কেন ওঁরা রাত্তিরে ওঁর সঙ্গে প্রাইভেট অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলেন? এত অপমানের পরেও?


    তিন, ছোটভাই কুমারসাহেব সপরিবারে গাড়িতে এলেন। পূজারীজি বলছেন - কুলদেবীর এই পূজোয় দু’ভাইকেই একসঙ্গে বসতে হবে।  তাহলে দু’জনে একসঙ্গে এলেন না কেন? দু’ভাইয়ের মধ্যে কি সম্পর্ক ভাল নেই?


    চার, তিনটে বলেছিলাম, কিন্তু আরও একটা প্রশ্ন। যুবরাজ সাহেবের উপর ট্রেনে হামলার আশংকা ছিল, কার বা কাদের থেকে? কুমারসাহেব অনেক কিছু চেপে যাচ্ছেন। এখন ওনার মুখ খোলা উচিৎ।


    আর একটা কথা!


    বস হেসে ফেলেন। আরও  কথা আছে?


    শ্রীবাস্তব স্যারের মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। আহা, বলে ফেলুক।


    -- ট্রেনে যে কালো কালো দানার বড়ি  যুবরাজ সাহেবকে খাওয়ানোর জন্যে আমাকে শান্তিরাম দিয়ে গেছল, ওগুলো বোধহয় আফিমের গুলি।


    - তুমি কী করে বুঝলে?


    -- আমি আগে দেখেছি। আমার জ্যেঠু মানা ক্যাম্পে খেতেন। ওনার নেশা ছিল।


    বস ও মিঃ শ্রীবাস্তব মুখ চাওয়া চাওয়ি করে শেষে হেসে ফেললেন। শ্রীবাস্তব বললেন - ভাল ট্রেনিং পেয়েছ। ব্র্যাভো! এবার যাও, কুমারসাহেবকে পাঠাও। আর শোন, আমাদের সঙ্গে কোন টাইপিস্ট নেই। তুমি চটপট কথাবার্তার মূল পয়েন্টগুলো নোট করবে। আর স্পষ্ট করে লিখবে। কারণ এজাহার দেয়ার পরে সবাই ওটা পড়ে নিয়ে দস্তখত করবে। এই নাও কাগজ আর পেন, এই রেজিস্টারের উপরে রেখে লিখবে, আর নীচে একটা কার্বন লাগাও, দুটো কপিতেই সাইন চাই। ঘাবড়াবে না, আমি চেক করে তবে পার্টির হাতে দেব।


    কুমারসাহেব


    কুমারসাহেব এসে সামনের একটি চেয়ারে বসলেন, একটু স্টিফ যেন। আমি মন দিয়ে দেখতে থাকি। সুপুরুষ, বয়স তিরিশের কোঠা ছাড়িয়েছে মনে হয়। মাথায় একটা লোমওলা ক্যাপ, যেমনটি বিলাসপুরে শীতের সময় তিব্বতি মেয়েরা বিক্রি করে। পরনে ড্রেসিং গাউন সত্ত্বেও সামান্য ভুঁড়ির ইশারা, চোখের তলায় সামান্য ক্লান্তির ছাপ। মনে হচ্ছে গত দু’রাত্তির ভাল করে ঘুমোননি, দু’দিনের না কামানো দাড়ি, স্বাভাবিক। অশৌচ শুরু হয়েছে। বস কিন্তু মুখ গুঁজে ফাইল পড়ছেন; এবার প্রশ্ন করলেন শ্রীবাস্তবজি।


    - কুমারসাহেব, আপনার স্টেটমেন্ট আমরা দেখেছি। তবে আমাদের কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।


    পুলিশের জিজ্ঞাসা থাকা স্বাভাবিক, আপনি নিঃসঙ্কোচে প্রশ্ন করুন।


    - যখন দুই বোন চিৎকার করতে করতে যুবরাজ সাহেবের ঘর থেকে বেরোল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?


    -আমি বারান্দার আরেক মাথায় আমার ঘরের দরজায়। কারণ পূজোর সময় হয়ে এসেছিল। ভাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে একসাথে যাব বলে তৈরি হচ্ছিলাম, আর শান্তিরামকে পাঠিয়েছিলাম ওনাকে তাগাদা দিতে, তখন এই কান্ড।


    - তারপর?


    - তারপর ওদের আর শান্তিরামের চীখ শুনে দৌড় লাগালাম। গিয়ে দেখি ভাইয়া কার্পেটের ওপরে পরে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে কার্পেট , ওঁর ঘাড়ের কাছে একটা বিশাল ক্ষত। তারপর শান্তিরামকে চেঁচিয়ে বললাম - দু’বোনকে আটকাও, ভাইয়া খুন হয়েছে।


    - শান্তিরাম তখন কোথায় ছিল?


    - ও বারান্দায় দুইবোনকে বলছিল ক্যা হুয়া?


    - বোনেরা পালিয়ে যাচ্ছিল, কি থেমে গেছল?


    - ওরা ভূত দেখার মত চেঁচাচ্ছিল। শান্তিরাম না আটকালে হয়ত পালাত।


    - কোথায়?


    - প্রথমে গেস্ট হাউসের দিকে, তারপর আমি কী করে বোলব?


    - আচ্ছা, একটা কথা। আপনাদের এস্টেটের আয় কেমন? তার সোর্স কী?


    -দেখুন, বেশির ভাগ আয় আসে বুড়ার শাহডোল এলাকায় জমির খাজনা আর মাইনর ফরেস্ট প্রোডাক্ট বিক্রি থেকে। যেমন শালবীজ, মহুয়া, লাক্ষা ইত্যাদি। এছাড়া কিছু জমি আমরা সরকারি তসর ফার্ম অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারকে লীজ দিয়েছি।  আর –


    -- আর?


    -- একটা টিম্বার মিল আছে শাহডোলে। তাতে আমরা দু’ভাই পার্টনার। আমরা ইমারতী লকড়ি নীলামে কিনে ফার্নিচার ও নানারকম কাজের জন্যে সাপ্লাই দিই। সব সরকারের পারমিট নিয়ে। সেটার ইনকামও ভালই।


    - আপনি তো বিলাসপুরে থাকেন। সেটা কে দেখাশুনো করে?


    -- আমি সপ্তাহে দু’দিন আসি। আর এখানকার সুপারভাইজার হোল শান্তিরাম।


    - শান্তিরাম? ও আপনাদের ড্রাইভার না?


    -- ও নানারকম কাজ জানে। আগে এখানে থেকে সব দেখাশুনো করত। বড়ে ভাইয়ার শরীর খারপ হওয়ার পর থেকে ও বিলাসপুরে চলে এসেছে, দরকার মত যাতায়াত করে। আপাতত ওর হেল্পার কলেশরাম গৌড় দেখছে।


    -- আপনার স্ত্রী মানে রাণীসাহেবাও তো এসেছেন। কিন্তু থানেদারের জবানবন্দীর ফাইলে তাঁর কোন স্টেটমেন্ট দেখছি না তো?


    এবার কুমারসাহেবের কপালে  ভাঁজ পড়ে। মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে।


    - কেন? ওঁর স্টেটমেন্ট নেওয়ার কী দরকার?


    এসপি শ্রীবাস্তব নির্বিকার। পুলিশ ক্লাবে কুমারসাহেবের সঙ্গে ব্রীজ বা রামি খেলার স্মৃতি যেন ধূসর অতীত। নিস্পৃহ প্রফেশনাল গলায় বলেন - কোন স্টেটমেন্ট দরকারি সেটা আগেভাগে কী করে বোঝা যাবে? আজ রাত্তিরে ওঁকে বিরক্ত করব না। আমরা কাল সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে যাব। তার আগে আমাদের  সঙ্গের মহিলা অফিসার মিসেস সাইনি কোয়েশ্চেনেয়ার নিয়ে ওনার ঘরে দেখা করবে। যা উত্তর দেবেন সেগুলো লিখে নিয়ে দস্তখত করিয়ে আমাদের জমা দেবে, ব্যস্‌।


    কুমারসাহেব উত্তেজিত। দাঁড়িয়ে পড়ে বলেন - বেশ, তাহলে আমি এখন আসতে পারি? রাত অনেক হল।


    -- ঠিক আছে। এই কাগজটা পড়ে সাইন করে দিন।


    আমার হাতের লেখা মাঝারি মানের, তবে বড় ডাক্তারদের প্রেসকৃপশানের মত নয়্, সহজে পড়া যায়। কুমারসাহেব একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সাইন করে দিলেন। তারপর উঠে ছোট একটু নড করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।


    -- একমিনিট, কুমারসাহেব! একমিনিট!


    ফাইল থেকে মুখ তুলেছেন আমার বস, ওঁর হাতে ওই কাগজটা।


    -- কী ব্যাপার? আপনিও জেরা করবেন নাকি? কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে --?


    কুমার সাহেবের গলায় ব্যঙ্গ ও তিক্ততা ।


    - না না, একটাই প্রশ্ন। আপনি থানেদারের কাছে দেয়া স্টেটমেন্টে  খালি আপনার সিগনেচার করেছেন, ব্যাংকে চেককাটার মত, এখনও তাই। নীচে ব্র্যাকেটে আপনার নামটা লিখবেন না?


    কুমারসাহেব পূর্ণদৃষ্টিতে কোসলে স্যারকে দেখেন; তারপর কলমটা তুলে ব্র্যাকেটের মধ্যে  নিজের নাম লেখেন।


    এবার কোসলে স্যারের পালা। উনি চোখ বুলিয়ে খুব জোরে হেসে ওঠেন — ভি পি সিং? আরে আমাদের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ? পুরো নামটা লিখুন না!


    এতে হাসির কী আছে বুঝলাম না। ভালো করে দেখুন - ভি পি পি সিং।  দুটো পি’ আছে। আমার পুরোনাম বীরেন্দ্রপ্রতাপ পৃথ্বীপাল সিং।  কাজের সুবিধের জন্যে সংক্ষেপে লিখি বীরেন্দ্রপ্রতাপ।  আমার স্বর্গীয় পিতৃদেবের নাম বিক্রমপ্রতাপ নরেন্দ্রপাল সিং। আর কিছু জানতে চান?


    কোসলে স্যারের হাত থেকে ফাইল পড়ে গেছে, উনি সেটা টের পেলেন না। শ্রীবাস্তবজির মুখ কেমন হাঁ হয়ে গেছে।


    - -আপনিই বীরেন্দ্রপ্রতাপ? মানে যুবরাজ? তাহলে উনি কে? যিনি সেদিন মারা গেছেন?


    -- আমি নই, যিনি মারা গেছেন, আমার বড়ে ভাইসাব, উনিই যুবরাজ। ওনার নাম বীরেন্দ্রপাল সমরপ্রতাপ সিং।


    --দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমার সিকিউরিটিজ সার্ভিসের সঙ্গে কন্ট্র্যাক্ট এবং বুকিং এসব তো আপনিই করিয়েছেন না?


    -- ও ইয়েস।


    - এবং এসপি শ্রীবাস্তব সাহেবের পরামর্শে?


    শ্রীবাস্তবজির ভুরু কুঁচকে ওঠে।


    -- ব্যাপারটা ঠিক ও’রকম নয়। কয়েকমাস আগে ক্লাবে রামির আড্ডায় আপনার কোম্পানির কথা উঠল। কোল মাফিয়াদের গুলিকান্ডের প্রবলেম সলভ করায় আপনারা পুলিশকে সাহায্য করেছিলেন। খবরের কাগজে আসেনি। কিন্তু এসপি সাহেব আপনার তারিফ করতে ছাড়েননি। আর সেই সময় কথা প্রসঙ্গে আপনার চ্যালা ওই বাঙালীবাবুর নাম  জানতে পারি, ওইটুকুই।


    - বেশ; দেখা যাচ্ছে যুবরাজ সাহেব নিজের সঠিক নাম রিজার্ভেশনে নেই দেখে বেশ ডিস্টার্বড ছিলেন।


    - হ্যাঁ, ভাইয়া নিজের নাম পদবি নিয়ে বেশ সেনসিটিভ ছিলেন।


    আমি সেদিনের সেই টিকিট কন্ডাক্টরের সঙ্গে নাম ঠিক করা নিয়ে ঝগড়াট যেন ছবির মত দেখতে পাই।  শেক্সপীয়র আওড়েছিলেন। অথচ এই দুদিনের মধ্যে অমন মানুষটা কেমন ‘আছেন’ থেকে ‘ছিলেন’ হয়ে গেলেন! বরাবরের মত।


    বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছলাম।


    কোসলে স্যার চাপা গলায় ব্ললেন — ঠিক মত নোটস নিচ্ছিস তো? সবারই খুব ঘুম পাচ্ছে, কুমারসাহেবকে আটকে রাখব না।


    তারপর গলা চড়িয়ে বললেন - তাহলে আপনি রিজার্ভেশনে ওনার নাম বদলে দিয়েছিলেন কেন? এটাই আমার অবাক লাগছে।


    কুমার সাহেব মুচকি হাসলেন। এই প্রথম মানুষটাকে হাসতে দেখলাম, অবশ্যি এখন হাসি পাওয়ার কথা নয়। হাসলে ওঁর গজদন্ত বেরিয়ে পড়ে, অন্যরকম লাগে।


    - এর মধ্যে কোন ধাঁধা কোন পহেলি নেই। আপনার অফিসকে বলেছিলাম ইদানীং যুবরাজের সঙ্গে কিছু লোক দুশমনি করছে। উড়ো চিঠিতে থ্রেট আসছে। তাই আমার নামে বুক করিয়েছিলাম, যাতে দুশমন মনে করে যে যুবরাজ সাহেব নয়, কুমারসাহেব যাচ্ছেন। যদিও ছ’ঘন্টার জার্নি, তবু ট্রিপল প্রটেকশন। আমার নামে বুকিং, সঙ্গে সিকিউরিটি সার্ভিসের লোক, পাশের কামরায় শান্তিরাম।


    -- কিন্তু এসব তো একটু পরে টের পাওয়া যায়। তাহলে?


    -- সার্টেনলি! কিন্তু শয়তানেরা টের পেয়ে প্ল্যান বদলাতে বদলাতে ভাইয়া বিলাসপুর থেকে আরও দূরে প্রায় বুড়ারের কাছাকাছি চলে যাবেন না? সেটাই তো আমার প্ল্যান। সেটাই প্রটেকশন।


    -- তাহলে দুশমন বিলাসপুরের? বুড়ারের নয় ? অথচ উনি প্রাণ হারালেন বুড়ারের রাজপ্রাসাদেই!


    - পর দোনোঁ বাঙালী খুনী তো বিলাসপুর সে হী ট্রেনমেঁ  সওয়ার হুই থী!


    রাগে ফুঁসে ওঠেন কুমারসাহেব। আর কোসলে এবার শ্রীবাস্তবজির সঙ্গে চোখাচোখি করে সশব্দে ফাইল বন্ধ করেন উঠে দাঁড়ান।


    -- ওকে কুমারসাহেব, গুড নাইট! কাল রওনা হবার আগে আর একবার দেখা হবে। এবং আমার মহিলা অফিসার  ঠিক সকাল সাড়ে সাতটায় রাণীমার কামরায় হাজির হবে।


    ছাড়া পেয়েও কুমারসাহেবের মুখের ভাবে অপ্রসন্নতার মেঘ কাটেনি, হয়ত কাল রাণীমা’র এজাহার নেওয়া হবে শুনে।


    কুমারসাহেব চলে যেতে আমিও টেবিল থেকে উঠে পড়ি। বড় ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু বস আমার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলেন—শান্তিরামকে ডাক!


     (১০)


    শান্তিরাম এসে দাঁড়ায় ভাবলেশহীন মুখে। এমনিতেই ওর মুখে দাড়িগোঁফ কম, যেন লালচে মোরাম মাটির উপর গজিয়ে ওঠা কিছু এলোমেলো কাঁটাঝোপ। বস ওকে বসতে বললেও  বসে না।


    --- তোমার পুরো নাম, বাবার নাম? আদি নিবাস?


    -- শান্তিরাম ওঁরাও, পিতা সহসরাম ওঁরাও, গ্রাম হেড়সপুর, থানা বচেলী, জেলা সরগুজা।


    -- বোম্বাগড় রাজপরিবারের চাকরিতে কতদিন ধরে রয়েছ?


    -- আট বছর।


    -- কী কাজ কর?


    - ড্রাইভার।


    -- কিন্তু কুমারসাহেব যে বললেন তুমি শাহডোলে ওনাদের টিম্বার মিলে সুপারভাইজার?


    -- ঠিক ও’রকম না। আমি রাজবাড়িরতে থাকি। আমার খাইখরচা  সব রাজবাড়ির হিসেবের খাতায় যায়।  আমি ড্রাইভারি করি; এছাড়া যখন যা কাজ বলা হয় সবই করি। কিছুদিন শাহডোলে মিল দেখেছিলাম বটে, এখন যুবরাজ সাহেবের শরীর খারাপ হওয়াতে বিলাসপুরে চলে এসেছি, ওনার সারাক্ষণ কেউ চাই।  মিলের কাজ কলেশরাম দেখছে।


    -- কতদিন আগে শরীর খারাপ হয়?


    - এই বছর চারেক হল।


    -- আচ্ছা, যুবরাজ সায়েবের অসুখটা কী ছিল?


    -- কুমারসায়েব ভাল বলতে পারবেন; বোধহয় কোন নার্ভের রোগ। উনি মাঝে মাঝে নার্ভাস হয়ে পড়েন। কখনও খিটখিটে, মোটা হয়ে যাচ্ছেন, চুল পড়ে যাচ্ছে।


    -- ওনার চিকিৎসা কে করে?


    -- ডাঃ প্রাণলাল মেহতা, বিলাসপুরের বড় ডাক্তার। কুমারসাহেব ওঁর কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে আসেন। আমাকে বুঝিয়ে দেন। আমি নিয়ম করে খাইয়ে দিই।


    -- পরশু দিন সন্ধ্যে বা রাত্তিরে কোন ওষুধ দিয়েছিলে? বা কোন খাবার।


    -- ওষুধ দিইনি।  বিকেলে একটা শরবত, কিছু ফল। পূজোর জন্যে উপোস করেছিলেন যে! রাত্তিরে একটা ঘুমের ওষুধ লাগে, সেটা আর দেয়ার সুযোগ হয়নি।


    -- যুবরাজকে সেদিন দুপুরে আফিমের গুলি খাওয়ানোর বুদ্ধিটা কার?


    শান্তিরামের চেহারায় কোন ভাবান্তর হল না। দু’সেকেন্ড চুপ করে থেকে ও জানাল যে যুবরাজের কিছুদিন ধরেই আফিমের নেশা। সেদিন রাত্তিরে পূজোয় জাগতে হবে, তাই ওনার নির্দেশেই দুপুরে আফিমের গুলি দেওয়া হয়েছিল।


    - আফিম ও অন্যসব ওষুধের বাকি যা আছে আমাদের কাছে জমা করে দাও। আর ওনার খাওয়ার প্লেট, বাটি, চামচ, গ্লাস?


    এবার আমি বলে উঠি — সাইনি ম্যাডামের কাছে, উনি তাতে পাউডার লাগিয়ে ফটো নিয়েছেন।


    বসের আঁখ যেন শঙ্করজীর ত্রিনয়ন!


    বুঝতে পারি — কোন গন্ডগোল করে ফেলেছি।


    শ্রীবাস্তবজী বলেন — শোন বাঙালীবাবু, কাল সকালে সাইনিকে বলবে - ওই বাসনকোসনগুলো যেন আলাদা করে প্যাক করে। বিলাসপুরে নিয়ে ল্যাবে পাঠাতে হবে।


    বস এবার অন্য প্রসঙ্গে এলেন।


    সেদিন রাতে তুমি কুমারসায়েবের ঘরে ছিলে। তারপর ওনার আদেশে যুবরাজকে ডাকতে গেলে। কুমারসাহেবের ঘর থেকে লম্বা করিডরটি কত পা’ হবে?


    - প্রায় পঁচিশ।


    - বেশ, তারপর সেখান থেকে বাঁদিকে মুড়ে যুবরাজ সাহেবের কামরা পর্য্যন্ত কত পা’, আন্দাজে বল।


    - বেশি নয়, দশ পা।


    -- তুমি হেঁটে যাচ্ছিলে, চিৎকার কখন শুনলে? মানে তখন কয়’পা বাকি?


    -- আদ্দেক দূরত্ব বাকি।


    -- কিন্তু দুই বোন যখন দৌড়ে বেরিয়ে এল তখন তুমি ওদের ধরলে কী করে? তোমার তো করিডরের মাথা পর্য্যন্ত পৌঁছনোর কথা নয়?


    -- চিৎকার কানে আসতেই আমি দৌড় লাগিয়েছিলাম। তাই যখন ওঁরা ঘর থেকে বেরিয়েছেন তখন আমি ওখানেই রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে।


    -- তুমি কি তখনই টের পেয়েছিলে যে ওরাই হত্যারিন? নইলে আটকালে কেন?


    -- না না, আমি শুধু রাস্তা আটকে ছিলাম, কী হয়েছে জানতে চাইছিলাম।


    -- কিন্তু সৌরভ যখন যুবরাজের ঘরের দরজায় পৌঁছল তখন দেখল যে তুমি ও কুমারসাহেব দুইবোনকে কষে ধরে রয়েছ?


    - ও দু’মিনিট পরে পৌঁছেছিল। এরমধ্যে কুমারসাহেব দৌড়ে ভেতরে গিয়ে অবস্থা দেখে আমাকে বললেন - ভাইয়া খুন হয়েছেন, ওই দুই আওরতকে আটকাও।


    - আচ্ছা, তুমি একা দুই বোনকে  একসঙ্গে আটকালে কী করে?


    -- আমি বড়বোনকে ধরেছিলাম। তাই দেখে ছোট দাঁড়িয়ে পড়ল। ওকে কুমারসাহেব ধরলেন।


    -- তোমরা কীভাবে ধরেছিলে? মানে জাপ্টে নাকি চুল ধরে?


    -- নহী সাব, এইসা কুছ নহী’। হম সির্ফ হাথ পকড়ে থে, পর কসকে।


    -- এবার একটু ভেবে বল, যখন দু’বোন চেঁচাতে চেঁচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এল তখন ছোটবোনের কাঁধে ব্যাগ ছিল? মানে যার থেকে পরে তুমি ছোরাটা পেলে?


    -- ঠিক বলতে পারছি না, বোধহয় কাঁধে ছিল।


    -- তাহলে কুমারসাহেব যখন ওকে ধরলেন তখন রক্তলাগা ব্যাগ ওর কাঁধেই ছিল। ধরার সময় ওটা খেয়াল ছিল না?


    -- আমি বড়দিদিকে আটকে ছিলাম, জানতাম একজনকে আটকালেই হবে।  ওটা কুমারসাহেব ভাল বলতে পারবেন।


    - ওরা বলছে, ব্যাগটা বারান্দায় বেঞ্চের পাশে পড়ে  থাকতে দেখে তুলেছিল, তারপর কুমারসাহেব ব্যাগ খুলতে বলে ওকে ধরেন। কী মনে হয়? এরকম হতে পারে।


    -- ইতনা নহী সোচা থা, হো ভী সকতা হ্যায়।


    -- গেটে যে দারোয়ান থাকে তার নাম কী?


    - পুসওরাম।


    -- ওই কি দিদির ব্যাগ জমা নিয়েছিল?


    -- মনে হয় না। পুসওয়ের ডিউটি গেটেই থাকে। তবে হতেও পারে।


    -- আচ্ছা, তুমি যখন বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলে তখন দুইদিদিকে গেট পেরিয়ে বারান্দায় উঠতে দেখনি? কোন চৌকিদার বা পুসওকে দেখেছিলে? ভেবে বল।


    -- না স্যার। কাউকে দেখিনি,  আমরা যখন চেঁচিয়ে লোক ডাকলাম তখন পুসও হ্যাজাক আর লাঠি নিয়ে দৌড়ে এল। দুইদিদি ওকে দেখে কিছু বলেননি তো?


    -- তুমি ছোটদিদির ব্যাগ খুলতে গেলে? উনি বাধা দেননি।


    -- খুব সামান্য; রক্তের দাগ দেখে আমার আক্রোশ বেড়ে গেছল। আমি প্রায় কেড়ে নিয়েছিলাম।


    -- ব্যাগের ভেতরে কী কী পেলে?


    -- সাহেব, রক্তমাখা ছোরাটা একটা শালের মধ্যে যেমন তেমন করে মুড়ে রাখা ছিল। ওটা বের করে নিই, আর কিছুতে হাত দিইনি।


    - আচ্ছা, ওই বেঞ্চটা, মানে যার নীচে মাটিতে ব্যাগ পড়ে ছিল বলে দিদি বলছে সেটা ঘরের থেকে কতদূরে? কয় পা?


    -- ওই দশ’ পা।


     - লম্বা করিডরের কোণা থেকে কয় পা?


    -- দুই পা’।


    --তাহলে তুমি তো আগেই বেঞ্চের কাছে পৌঁছে গেছলে? তোমার চোখে পড়েনি?


    - নহী স্যার। তখন তো নজর ছিল যুবরাজ সাহেবের ঘরের দিকে আর চেঁচাতে থাকা দিদিদের দিকে।


    -- আচ্ছা, তোমার গান লাইসেন্স আছে?


    এই প্রশ্ন শুনে আমি চমকে উঠি। শান্তিরামও কি একটু চমকাল? কিন্তু ও শান্ত ভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল।


    -- তুমি গাড়ির ড্রাইভার, তোমার গান লাইসেন্সে কী দরকার?


    -- সাহেব, আগেই বলেছি আমায় অনেক দায়িত্ব সামলাতে হয়। আমাদের এলাকায় অনেক বড় জঙ্গল রয়েছে, ইমারতী কাঠের মানে শাল-সেগুনের  বিশাল জঙ্গল। সব মালিকদের। এখান থেকে চোরাচালান হয়, এছাড়া জন্তুজানোয়ার আছে। টিম্বার মিলের দায়িত্বে থাকার সময় আমায় জঙ্গলে গিয়ে এসব সামলাতে হত। তাই কুমারসাহেব লাইসেন্স করিয়ে দিয়েছিলেন।


    -- ঠিক আছে, এখন তুমি যাও। কাল সকালে তোমার গান লাইসেন্স থানেদার পবন পান্ডের কাছে জমা করে দিও। আর হ্যাঁ, তোমার মোবাইলটি একবার দেখাও তো। হুঁ, এতে তো ডাবল সিমের জায়গা আছে। কিন্তু একটা সিম খালি কেন? – স্যার, আমার দুটো সিমের দরকার পড়েনা। এটা কুমারসাহেবের পুরনো হ্যান্ডসেট। আমায় দিয়েছেন, আমি আমার সিম ভরে নিয়েছি।


    -- সৌরভ, ওর মোবাইলের সিম নম্বর নোট কর, আর গত তিনদিন ধরে ওর মোবাইলের যত মেসেজ, ইন কামিং বা আউটগোয়িং সব আমার মোবাইলে ফরওয়ার্ড করে  সেটটা ওকে ফেরত দাও।


    এবার তুমি যেতে পার। কিন্তু আগামী নির্দেশ পর্য্যন্ত বুড়ারের বাইরে যাবে না। থানেদার পবন পান্ডে ডাকলে সব সময় হাজির হবে, কোঅপারেট করবে। ঠিক হ্যায়?


    সৌরভ, যা বাইরে গিয়ে বড় দিদিকে পাঠিয়ে  দে।


    শৈবলিনী এই দুদিনেই কেমন যেন হয়ে গেছেন। চেহারায় ভয় বা আতংক ছাপিয়ে জবুথবু বা কেমন একটা দিশেহারা ভাব। ফাগুন রাতেও এই জঙ্গল পাহাড় এলাকায় ভালই শীত। বড়দির গায়ে একটা শাল জড়ানো, পায়ে মোজা।  বসার কথা হলে একটু ইতস্তত করে একটা চেয়ারে সন্তর্পণে বসলেন, যেন এক্ষুণি কেউ ওটা খালি করতে বলবে।


    শুরু করলেন শ্রীবাস্তব স্যার।


    - আপনি বীরেন্দ্রপ্রতাপের চিঠি পেয়ে এখানে এসেছেন?


    শৈবলিনী সম্মতিতে মাথা নোয়ালেন।


    -- অথচ উনি আপনাকে চিনতে পারলেন না। কেন বলুন তো?


    -- আমি কি করে বলব? আমরা তো সেই কথাই ভাবছি। ডেকে এনে এ কী’রকম ব্যবহার?


    -- আমরা?


    -- হ্যাঁ, আমরা দু’বোনই ওর চিঠি পেয়েছিলাম। এটা কী’রকম রসিকতা? সেটা বোঝার জন্যেই তো দেখা করতে চেয়েছিলাম। ডাক পেতেই দৌড়ে গেলাম। কিন্তু এখন তো সব অর্থহীন হয়ে গেল।


    -- আচ্ছা, বীরেন্দ্রপ্রতাপকে কত ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন?


    ইতিমধ্যে সোলার লাইট নিভে গেছে। শান্তিরামের সঙ্গে দু’জন এসে হ্যাজাক বাতি আর দেওয়ালগিরি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। টেবিলের উপর সোঁ সোঁ করছে হ্যাজাক বাতি। বড়দি শৈবলিনীর মুখের একপাশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আরেক পাশ ছায়া ছায়া।


    -- শান্তিনিকেতনে পড়েছিলেন । উনি কেমিস্ট্রি নিয়ে, আমি সংস্কৃতে এমএ করে ডক্টরেট করছিলাম। অনেক ছেলেমেয়ে। তবু শেষ দু’বছর  ভালই বন্ধুত্ব হয়েছিল।


    - দুবোনের সঙ্গেই? মানে উনি দুজনকেই চিঠি দিয়েছিলেন, তাই বলছি।


    এবার শৈবলিনী খানিকটা সময় নিলেন, তারপর কথা না বলে মাথা ওপর নীচে দু’বার হেলিয়ে চুপ করে রইলেন।


    শ্রীবাস্তব স্যার আমার বসের দিকে তাকালেন।


    কোসলে স্যারের প্রশ্নগুলো অন্যরকম। এটাই  স্বাভাবিক। আমি যে ইতিমধ্যে যেসব পেরাইভেট দুই দিদি আমাকে বলেছিলেন তা বসকে জানিয়ে দিয়েছি। আমার কি সঙ্কোচ হয়েছিল? না, হয়নি।


     কারণ যুবরাজের মৃত্যুর পর আর কোন কিছুই পেরাইভেট থাকে না, থাকতে পারে না। ইনভেস্টিগেটরকো অব  দিল সে কম, দিমাগ সে জ্যাদা কাম লেনা হোগা।


    -- বীরেন্দ্রপ্রতাপ আপনাদের চিনতে পারেননি, বা চিনতে চাননি; কেমন? কিন্তু আপনারা কি চিনতে পেরেছিলেন? ভেবে বলুন। কত বছর পর আপনাদের দেখা সাক্ষাৎ?


    -- অন্ততঃ এগার বছর বা বারো বছর হবে। একটু গুলিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের মধ্যে নামটাম মিলিয়ে কোচের ভেতর গেলাম। ওর পিএ’র সামনে যাচ্ছেতাই অপমান করল, যেন ভিখিরি তাড়াচ্ছে। গেস্ট হাউসে থাকতে দিয়ে উদ্ধার করেছে। এখন মনে হচ্ছে না আসলেই ভাল হত।


    -- দেখতে কেমন লাগছিল আপনাদের পুরনো পরিচিত বীরেন্দ্রপ্রতাপকে?


    -- একটু বুড়ো, সামনের চুল অনেক পাতলা। আর আর —


    -- থামলেন কেন? বলে ফেলুন।


    -- না মানে, নাকের পাশে একটা আঁচিল, এটা আগে ছিল না। তা এগুলো গজায়, দশ-বারো বছরের ফারাক। অমন হতেই পারে।


    -- তাহলে আপনি যুবরাজকে জীবিত অবস্থায় শেষ কখন দেখেছিলেন? একটু ভেবে বলুন।


    --ট্রেনের মধ্যে, কোচ নম্বর জি’তে।


    -- তাহলে বুড়ার স্টেশনে নামার পর যুবরাজকে আর দেখেননি? মানে জীবিত অবস্থায়?


    -- না।


    -- শেষ প্রশ্ন, ভেবে বলুন। শান্তিনিকেতনের পাট চোকার পর যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে কবে দেখা হয়েছিল?


    -- বললাম তো, ওই ট্রেনে।


    - ঠিক আছে, আপনি এখন যেতে পারেন। গিয়ে আপনার ছোট বোনকে পাঠিয়ে দিন।


    ছোড়দি কুন্দনন্দিনী বেশ গম্ভীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন; আমাকে যেন দেখেও দেখলেন না। অগত্যা আমিই ওনাকে মন দিয়ে দেখতে থাকি।


    হুঁ, গায়ের রঙ দিদির তুলনায় শ্যামলা, কিন্তু চেহারায় একটা আলগা আকর্ষণ আছে। কুমারসাহেব কি তাতেই মজে ছোটবোনকে আগে আঙটি পরিয়েছিলেন? ধ্যেৎ, কীসব ভাবছি। একটা মার্ডার কেসের ইনভেস্টিগেশন চলছে। আমার কাজ চোখ কান খোলা রাখা, এবং নোটস নেওয়া। বস যদি জানতে পারেন এই মুহুর্তে ওঁর অ্যাসিসট্যান্ট  বাবুমোশায় সৌরভ কী ভাবছে!


    সম্বিৎ ফিরল বসের গলার আওয়াজে, ছোটবোনকে প্রশ্ন করার ঝামেলা কি বস সামলাবেন? মনে হচ্ছে উনি একটু গল্প করার মুডে আছেন।


    -- দেবীজি, রাত হয়েছে। এই পাহাড়-জঙ্গল এলাকায় মার্চ মাসের শেষেও বেশ শীত, ঠান্ডা হাওয়া চলছে। আপনি শুধু একটা কার্ডিগান চাপিয়েছেন? কোন চাদর-টাদর? আপনার দিদিতো শাল গায়ে দিয়ে এসেছিলেন।


    -- আমার শাল আপনাদের থানায় জমা আছে।


    - আচ্ছা, ওই রক্তমাখা শালটা? যেটা দিয়ে ব্যাগে ছোরাটা জড়ানো ছিল? ব্যাগটা তো আপনার বুঝলাম, কিন্তু শালটাও কি আপনার?


    -- হ্যাঁ, আমার।


    -- ছোরাটা? সেটাও?


    - না; ওটা কার জানিনা।


    - আপনার ব্যাগে আপনার শাল দিয়ে মুড়ে রাখা ছোরাটা আর কার হতে পারে?


    -- জানিনা। ব্যাগটা বাইরে মাটিতে পড়েছিল। অন্য কেউ রেখে থাকবে।


    - আচ্ছা, ব্যাগটার মধ্যে রক্তমাখা ছোরা ও দুটো শাল ছিল। কিন্তু আপনার ব্যাগ ও অন্য শালটা কেন পুলিশ নিজেদের জিম্মায় নেয়নি? শুধু আপনার শালটা?


    -- সেটা আপনাদের থানেদার পান্ডেজি ভাল বলতে পারবেন। তবে উনি যখন খবর পেয়ে পৌঁছেছিলেন তখন ওই ছোরা আর আমার শাল টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়ে টেবিলের উপর আলাদা করে রাখা ছিল, সেটাই পুলিশ নিয়ে গেছে।


    - এবার সেদিনের ঘটনাটা একটু ভাল করে বুঝতে চাই। আপনারা মোবাইলে একটা টেক্সট পেয়ে দৌড়ে গেলেন কেন?


    - দেখুন, ট্রেনে যুবরাজসাহেব আমাদের চিনতে অস্বীকার করলেন, যা তা ব্যবহার করলেন, যার মানে বুঝতে পারিনি। তাই আমরা প্রথমে সৌরভ, পরে শান্তিরামের থ্রু ওনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করি। শান্তিরাম বলেছিল উনি রাজি হলে মেসেজ আসবে। তাই যেই মেসেজ এল আমরা দেখা করতে গেলাম।


    -- কিন্তু শান্তিরাম বলছে যে উনি রাজি হননি, তাহলে মেসেজ কেন এল?


    -- নিশ্চয়ই যুবরাজ সাহেব পরে ভেবে মত পাল্টেছেন। নইলে কেন মেসেজ করবেন?


    -- কী করে জানলেন যে ওটা যুবরাজেরই মেসেজ?


    -- আর কার হবে?


    -- আপনার মোবাইলটা দিন তো! আচ্ছা, এই নম্বরটা , অর্থাৎ যার থেকে মেসেজটা এসেছে,এটা আপনার চেনা?


    -- নাতো।


    - তাহলে কী করে জানলেন যে ওটা ওনারই নম্বর?


    কুন্দনন্দিনী দিদি কি একটু থতমত খেলেন? তারপর সামলে নিয়ে জানালেন যে উনি সঠিক জানেন না, তবে আন্দাজ করেছিলেন।


    -- আচ্ছা, যখন মেসেজ এল তক্ষুণি আপনারা রওনা দিয়েছিলেন?


    -- হ্যাঁ, দেরি করিনি।


    -- টেক্সট দেখাচ্ছে যে মেসেজের টাইম রাত্তির ৮.৫০। আপনাদের রাজোয়ারায় পৌঁছতে কতক্ষণ লেগেছিল?


    -- বেশি করে ধরলে পাঁচ মিনিট।


    -- মেন গেটে দিয়ে কম্পাউন্ডে ঢুকলেন? কেউ আটকায়নি?


    -- না তো; বারান্দায় একজন আটকে দিয়েছিল, ব্যাগ জমা রাখতে বলেছিল। হতে পারে রাত্তিরে ঠান্ডার জন্য গেট ছেড়ে বারান্দায় উঠে গেছল।


    -- কিন্তু আপনি বলছেন তাকে আর দেখেননি, ঠিক বলছেন?


    -- হ্যাঁ, তবে একটা কথা। আধো অন্ধকারে মশালের আলোয় দেখা পাগড়ি পরা চেহারা পরে ভীড়ের মধ্যে দেখে চিনে নেওয়া মুশকিল। বিশেষ করে তখন আমাদের মনের অবস্থা এতসব খেয়াল করার মত ছিলনা।


    -- ঠিক আছে। তারপর?


    কুন্দনন্দিনী একটু এদিক ওদিক তাকালেন। কিছু একটা ভাবছেন। তারপর কোসলে স্যারের দিকে চোখ তুলে একটু একঘেয়ে টোনে বলা শুরু করলেন — আমরা গিয়ে দেখলাম দরজা বন্ধ।


    - বন্ধ? নাকি ভেজানো?


    -- ভেজানো; আমরা দরজায় নক করলাম। কোন সাড়া নেই। সামান্য অপেক্ষা করে আবার নক করলাম। এভাবে তিনবারেও কোন সাড়া না পেয়ে একটু গলা তুলে বললাম যে বীরেন্দ্রপ্রতাপজি, যুবরাজ সাহেব ! আমরা এসে গেছি। দরজায় কান পাতব ভাবতে ভাবতে দিদি দরজায় একটু চাপ দিল। দরজা খুলে গেল।


    কুন্দনন্দিনী আবার চুপ। কেন? কিছু ভাবছেন? পড়া মুখস্থ করে এসেছেন, হঠাৎ আটকে যাচ্ছে! একটা ‘কী ওয়ার্ড’ দরকার? এমন সময় কোসলে স্যারের কৃপায় জুটে গেল সেই ‘কী ওয়ার্ড’।


    ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছিল? কী সবটাই অন্ধকার?


    আলো ছিল, কিন্তু ঘরের অন্য কোণে। একটা কুলুঙ্গিতে টেমি মতন। তাতে দরজারর সামনের দিক বা খাটের দিকটা বেশ অন্ধকার মতন। খানিকক্ষণ লাগল চোখ সইয়ে নিতে। তারপর চোখে পড়ল।


    কী দেখলেন?


    উনি খাটের পাশে কার্পেটের ওপর উবুড় হয়ে পড়ে আছেন। আর খানিকটা রক্ত, চাপ চাপ রক্ত।


    কুন্দনন্দিনী শিউরে উঠলেন।


    বলছেন জায়গাটায় আলো কম ছিল, আর বডি উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। তাহলে কী করে চিনলেন যে বডিটা যুবরাজ সায়েবের।


    চেনার কথা নয়, ধরে নিয়েছি ওনারই, ওই সময়। মাত্র পাঁচ-সাত মিনিট আগে মেসেজ পেয়েছি। তাহলে আর কার হবে? আমরা খুব ঘাবড়ে গেছলাম, খুব ভয় পেয়েছিলাম। দৌড়ে বারান্দার দিকে আসছিলাম আর দিদি চেঁচাচ্ছিল। হেল্প ! হেল্প! বাঁচাও বাঁচাও বলে।


    শান্তিরাম আমাদের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পড়ল আর বলল - ক্যা হুয়া? বাতাইয়ে হুয়া ক্যা?


    আমরা কিছু ঠিক করে বলতে পারছিলাম না, খালি ঘরের দিকে আঙুল দেখাচ্ছিলাম। এই সময়ে একজন এসে দৌড়ে ঘরে ঢুকেই ছিটকে বেরিয়ে এল। আর বলল যে যুবরাজ সাহেব খুন  হয়েছেন।


    তখন বুঝলাম যে আমরা ঠিক বুঝেছি, বডি যুবরাজ সাহেবের। আর জানলাম যে গরম টুপি পরা ভদ্রলোক কুমারসাহেব, মানে ছোটভাই।


    কী করে জানলেন যে উনি কুমারসাহেব?


    উনি যে বললেন!


    কুমারসাহেব ঠিক কী বললেন?


    -ভাইয়াকো কোই ছুরা মার দিয়া।  ওই রকম কিছু একটা। আর – আর চিৎকার করে বলছিলেন ওদের আটকাও! ওই দুই বঙ্গালনকে!


    এরপর আবার ছোড়দি চুপ।


    ওঁরা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। দিদি কান্না চাপছিলেন।  শ্রীবাস্তবজি উসখুস করছিলেন। বলে উঠলেন — বাকিটা বলুন। রাত হয়েছে, আপনাকে বেশিক্ষণ আটকাবো না।


    -- আমি আমার  মাটিতে পড়ে থাকা ব্যাগটা দেখতে পেয়ে তুলে নিলাম। প্রায় তক্ষুনি ওই ভদ্রলোক, মানে কুমারসাহেব আমাকে চেপে ধরলেন আর শান্তিরাম দিদিকে। উনি শান্তিরামকে বললেন — ওর ব্যাগটা খোল, রক্ত লেগে আছে মনে হচ্ছে। আমি অবাক, ব্যাগটা দিচ্ছিলাম না। ওরা কেড়ে নিল। তারপর যা হোল সব আপনারা জানেন। একটা কথা। আমরা খুন করিনি। ছোরাটা কেমন করে আমার ব্যাগে এল বলতে পারবনা। যখন ব্যাগটা বাইরে পরে ছিল, তখন কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে।


    কিন্তু আপনারা ব্যাগ জমা রেখে  যুবরাজ সাহেবের ঘরের কাছে গেলেন, নক করলেন। শেষে ওই নজারা দেখে চেঁচাতে চেঁচাতে বেরিয়ে এলেন।  এতে সময় তো পাঁচ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। তাহলে কে আপনার ব্যাগে ছোরা রাখবে আর আপনারা টের পাবেন না? বলে ফেলুন, কে আপনার ব্যাগে ছোরা রাখতে পারে?


    মনে হয় যে খুন করেছে।


    সে কে? নামটা বলুন।


    তা জানিনা, তবে আমরা কেউ রাখিনি।


    কুন্দনন্দিনীর গলা এবার একটু কাঠ কাঠ শোনাল।


    কোসলে স্যার আর শ্রীবাস্তবজি চোখাচোখি করলেন।


    কোসলে স্যার শুরু করলেন - শান্তিনিকেতন ছাড়ার পর যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপকে শেষ কবে দেখেছেন?


    -- বিলাসপুর থেকে ট্রেনে উঠে।


    আশ্চর্য, এই প্রশ্নটা স্যার বড়দিকেও করেছিলেন। কেন?


    আপনার বিয়ে কবে হয়েছে?


    এই প্রশ্নে আমিও চমকে উঠলাম।


    দশ বছর আগে।


    ছেলেমেয়ে ক’টি?


    একটি ছেলে।


    ছেলের বয়েস?


    ফুঁসে ওঠে কুন্দনন্দিনী। যুবরাজের খুনের সঙ্গে আমার ছেলের সম্পর্ক কী?


    সেটাই তো বুঝতে চাইছি।  ঠিক আছে, এই প্রশ্নের জবাব এখন না দিলেও চলবে।


    আচ্ছা, আপনার কোন হাত চেপে ধরেছিলেন কুমার সাহেব?


    ছোড়দি এমন বেয়াড়া প্রশ্নে হতবাক। বস কিন্তু নির্বিকার। সোজা তাকিয়ে আছেন দিদির দিকে।


    - বাঁহাত।


    -- ব্যাগটা আপনি তুলে নিয়ে কোন কাঁধে লটকিয়ে ছিলেন?


    -- ডান কাঁধে ।


    - বেশ, আপনি এখন যেতে পারেন, খালি সৌরভের কাছে মোবাইলটা জমা করে স্টেটমেন্টটা সাইন করে দিন। আজ রাত্তিরে ঘর থেকে বেরোবেন না। অবশ্য বাইরে কড়া পাহারা থাকবে। আগামী কাল আমরা বিলাসপুরে ফিরে যাব। পরেও আপনার সহযোগিতা পাব আশা করি।


    কুন্দনন্দিনী আমার থেকে পেন নিয়ে সাইন করলেন। বস একদৃষ্টিতে ওঁকে দেখছেন।


    ছোড়দি আমাকে কলমটা ফেরত দিলেন, কিন্তু সবই করলেন বাঁ হাতে।    (চলবে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮
  • ধারাবাহিক | ১৮ জুলাই ২০২১ | ২১৮০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • উজ্জ্বল | ১৮ জুলাই ২০২১ ২০:৫০495929
  • "কুমারসাহেব পূর্ণদৃষ্টিতে কোসলে স্যারকে দেখেন; তারপর কলমটা তুলে ব্র্যাকেটের মধ্যে 'সাইন করেন'।" এখানে 'সাইন করেন' এর জায়গায় 'নাম লেখেন' হবে মনে হচ্ছে। সাইন তো উনি আগেই করেছিলেন। খুব রুদ্ধশ্বাসে পড়ছি, দারুণ।

     
  • Ranjan Roy | ১৮ জুলাই ২০২১ ২২:০১495933
  • ্ধন্যবাদ উজ্বল, শুধরে নিলাম।

  • বিপ্লব রহমান | ২১ জুলাই ২০২১ ০৭:১৪495971
  • ভীষন থ্রিল! রুদ্ধশ্বাসে পড়ছি, তারপর? 

  • Dishery Malakar | ২৩ জুলাই ২০২১ ১৬:৪৫496012
  • খুব ভালো লাগছে। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় আছি

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন