এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • আমি ঠোঙাদাকে ভালোবাসি

    Sukanta Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২২ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৯১৫ বার পঠিত
  • প্রথম দৃশ্য

    হেমাঙ্গবাবু -হ্যাঁ গো ভুতো, তোমাকে যে আমার মেয়ের জন্য কবে থেকে একটা পাত্র দেখতে বলছি তার কি হল?

    ভুতো -আজ্ঞে দেখুন হেমাঙ্গবাবু, ওই যে কথায় আছে না “ঘর লেপ্যা মুছ্যা, আতুর ঘর বানাইয়া, মা ষষ্ঠীর কাছে বাচ্যা চাইলেই তো আর বাচ্যা পয়দা হয় না! তার জন্যি নয় মাস দশদিন অপেক্ষা করতে হয়!” তবে হ্যাঁ, কাজ আরম্ভ করে দিয়েছি।

    হেমাঙ্গবাবু -কাজ আরম্ভ মানে? একি জলা মাঠে বাড়ি হচ্ছে নাকি যে আগে মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে তবে কাজ শুরু করা যাবে?

    ভুতো -নিজের মেয়েকে তো আর ভালো করে বুঝলেন না! জলা মাঠ না হলেও ও জমি প্রায় কর্দমাক্ত-ই বলা যেতে পারে।

    হেমাঙ্গবাবু -কি বলতে চাইছো তুমি?

    ভুতো -তেমন কিছু না, তবে কিনা যা মেয়ে আপনার, সব দিক আগে থেকে বুঝে শুনে, আটঘাট না বেঁধে ময়দানে নামলে খেলা ভেস্তে যাবার সম্ভাবনাই বেশী। তাই একটু সময় নিচ্ছি – তা ছাড়া আপনার মেয়ে বলে কথা – যা তা সমন্ধ তো আর আনা যায় না! এই সব ভেবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি আর কি!
    হেমাঙ্গবাবু -সেটা কি রকম!

    ভুতো - এই দিকে দিকে চর লাগিয়েছি

    হেমাঙ্গবাবু -ভুতো, এটা কি কোন ঐতিহাসিক রাজ-রাজাদের ব্যাপার হচ্ছে নাকি যে তুমি চর লাগাচ্ছ?

    ভুতো - না, তাছাড়া কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছি – সব বহুল প্রচারিত বাংলা কাগজে। প্রতি রোববার বেরোবে।

    হেমাঙ্গবাবু -বটে। তা সেই বিজ্ঞাপনে কি লিখেছ শুনি? তুমি কি আমার মেয়ের বায়োডাটা জানো?

    ভুতো - সে আমি পাড়ার ছেলেদের থেকে জেনে নিয়েছি। আপনি জানলে গর্বিত হবেন যে পাড়ার ছেলেরা শুধু আপনার মেয়ের বায়োডাটাই নয়, তার বডি-ডাটাও বলতে এসেছিল। আমি অবশ্য শুনি নি!

    হেমাঙ্গবাবু -ফাজলামো থামাও – তুমি জানো আমার মেয়ে কি পারে, না পারে? হাইট কত? গান জানে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

    ভুতো - হেঃ হেঃ। আপনি আছেন কোথায় মশাই? এসব কি আর জানতে হয় নাকি আলাদা করে? গুল – সব বেবাক গুল দিতে হবে। নইলে আজকালকার যুগে আর মেয়ে পার করা যাবে না!

    হেমাঙ্গবাবু -সেকি! সব জেনে শুনে মিথ্যা কথা বলব?

    ভুতো - সে তো গীতাতেই আইনসিদ্ধ করা আছে! রণে, বনে, প্রেমে, জঙ্গলে, বিবাহে যেখানেই ফাঁসিয়া যাইবে, উদ্ধার পাবার জন্য মিথ্যা বলিতে দ্বিধা করিবে না।

    হেমাঙ্গবাবু -বল কি! গীতাতে এমন লেখা আছে নাকি?

    ভুতো - তবে আর বলছি কি। তাছাড়া, বিজ্ঞাপন বইতো আর নয়। বিয়ের বাজারে মুড়ি মিছরির এক দর! নবদ্বীপে তৈরী হওয়া সেন্ট কথার ঠেলায় হয়ে যায় ফ্রেঞ্চ পারফিউম। তার পর মশাই মেকআপের খেল – কালো মেয়ে হয়ে যায় অতীব ফর্সা। হাড় বের করা মেয়েকে বলা হয় তন্বী! ফ্যাশন চ্যানেল দ্যাখেন নাকি যখন বৌদি বাড়িতে থাকে না?

    হেমাঙ্গবাবু -থামো তো হে। তা কি লিখেছ বিজ্ঞাপনে? তুমি নিজে লিখেছ নাকি?

    ভুতো - আজ্ঞে না। সেই ভুল কি আর করি? বিজ্ঞাপন লিখে দিয়েছেন রমেন বাবু – ডবল এম।এ। বি টি।

    হেমাঙ্গবাবু -তা কি লিখেছে শুনি –

    ভুতো - দাঁড়ান। কাগজটা বার করি। লিখেছেন – রিটায়ার্ড ব্যঙ্ক অফিসারের একমাত্র কন্যা, অতীব সুন্দরী, বীরাঙ্গনা –

    হেমাঙ্গবাবু -থামো, থামো – এসব কি? মেয়ে কি বিয়ের পর যুদ্ধ করবে নাকি যে তাই বীরাঙ্গনা হতে হবে? তাছাড়া যদি দীর্ঘ-ই এর ফ্যাঁকড়াটা না পরে প্রিন্টিং মিসটেকে তাহলে কি হবে একবার ভেবে দেখেছ?

    ভুতো – কি হবে?

    হেমাঙ্গবাবু -আরে বীরাঙ্গনা থেকে আমার মেয়ে যে বারাঙ্গনা হয়ে যাবে! আর বারাঙ্গনা মানে জানো তো – লাইনের মেয়ে, মানে পতিতা – ইংলিশে যাদের আদর করে কল গার্ল ডাকা হয়।

    ভুতো – বলেন কি! এ্যতো কেস তো জানতুম না!

    হেমাঙ্গবাবু -তাই তো বলছি ওই বীরাঙ্গনাটা তুমি বাদই দাও। তারপর বল –
    ভুতো - তন্বী, হরিণনয়না, মধুরহাসিনী, শ্যামলশোভনা, সপ্রতিভ, দীর্ঘকেশী, সূচীশিল্পে পারদর্শী, চারূশীলা –

    হেমাঙ্গবাবু - এটার মানে কি?

    ভুতো - আজ্ঞে এটা উনিও বলতে পারলেন না!

    হেমাঙ্গবাবু - আশ্চর্য তো, মানে জানেন না অথচ লিখে দিয়েছেন!

    ভুতো - আসলে ফর্মে পরে গিয়েছে তো – এই আর কি! তারপর হল – সঙ্গীতজ্ঞা, সুশিক্ষিতা, গৃহকর্মে নিপুণা, মধুরস্বভাব, ৫ ফুট ৮, বি এ পাশ কন্যার জন্য সি এ, ডাক্তার, ব্যঙ্ক অফিসার, প্রফেসর – আচ্ছা ইঞ্জিনিয়ার দেবো?

    হেমাঙ্গবাবু - দাও, তবে মেটালার্জি, মাইনিং, সিভিল বাদ। মোটকথা সুপাত্র চাই। প্রফেসরও চলতে পারে।

    ভুতো - তবে রমেনবাবু একটা শ্লোকেই মেয়ের রূপের বর্ণনা সেরে দিয়েছেন। আহা, বড় মধুর বর্ণনা। বলব?

    হেমাঙ্গবাবু - বল, লিখেছেন যখন শুনেই ফেলি

    ভুতো - তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পক্কবিম্বধরোষ্ঠী মধ্যে ক্ষ্যামা চকিতহরিনী প্রেক্ষ্যণা নিম্ননাভি ভারাদলসগমণা স্তোকনম্না।।।

    হেমাঙ্গবাবু - থামো থামো। ছ্যাঃ ছ্যাঃ। তুমি এর মানে জান? এতো কালিদাস থেকে ঝাড়া। এটা কেউ দেয় বিয়ের বিজ্ঞাপনে? তুমি কি একটা আকাট মূর্খ?

    ভুতো - আজ্ঞে রমেনবাবু বললেন –

    হেমাঙ্গবাবু - তা তো বলবেনই। মেয়ে তো আর উনার নয়, আমার। ওনার নিজের মেয়ের বিয়ের সময় দিতে বলো। প্রথমটাই ভালো। বেশ হয়েছে। কি হল? আকাট বললাম বলে রাগ হল?

    ভুতো - না, না তা কেন? উচিত কথাই তো বলেছেন!

    হেমাঙ্গবাবু - তাহলে মুখের অবস্থা এমন কেন? পেচ্ছাপখানার দরজার মত? যাই হোক – তুমি তা হলে কাজ শুরু কর। পাত্রর সন্ধান পেলে আমাকে জানাবে। এখন তা হলে ওঠা যাক।

    ভুতো - হ্যাঁ হ্যাঁ – তাই জানাব এখন। চলুন ওঠা যাক।
    (দুজনার প্রস্থান)


    দ্বিতীয় দৃশ্য
    -------
    (পার্কে আরাধানা আর ঠোঙা বেড়াতে এসেছে)

    আরাধনা -কি হলো এখনো মেয়েটার শোক ভুলতে পারোনি বুঝি ? (খোঁপার জট ছাড়াতে ছাড়াতে আরাধনা জানতে চাইল)

    ঠোঙা -(চমকে উঠে) কই না তো! কিছু ভাবিনি তো – মাইরি বলছি!

    আরাধনা -তাহলে মুখটাকে অমন করে আছ কেন? মনে হচ্ছে যেন লোকাল ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের গায়ে আঠা দিয়ে পোষ্টার আটকানো রয়েছে!

    ঠোঙা -তোমার মুখের অবস্থাও তো।।। সেই থেকে রাগ রাগ মুখ করে বসে আছ। রিক্সাতে আসতে আসতে একটা কথাও বললে না। আমি না হয়।।।
    আরাধনা -তার পিছনে কারণ আছে গুরু। এমনি এমনি তো আর সেজেগুজে গোমড়ামুখো হইনি। সাধ করে কি আর শালা হয়েছি!

    ঠোঙা - সত্যি আগে তোমায় দেখে বুঝতে পারি নি যে তুমি এমন তৈরী মাল (পাতলা হেসে)। তা কারণটা নিশ্চয়ই খুব গুরুতর নয়। কি বলো?

    আরাধনা -চোপ্‌, আবার বলা হচ্ছে গুরুতর নয়! টেনে মারব – না, এখন মারব না, আগে তোমার কাছ থেকে শুনি। তারপর দেখাচ্ছি মজা। (কোমরে হাত দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে)।

    ঠোঙা - (কোনদিকে তাকাবে বুঝতে না পেরে চোখ বুজে ফেলল, কোন রকমে বলল) তুমি বড্ড ভয় দেখাও মাইরি। তোমার সঙ্গে আর খেলব না বলে দিচ্ছি।

    আরাধনা -তোমার বাবা খেলবে, তুমি তো কোন ছাড়! শোনো, আমার দিকে তাকাও। তুমি নাকি আজ স্টেশনে একটা মেয়ের সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলছিলে। আবার মুড়িমশলা কিনে সোহাগ দেখানো হয়েছে!

    ঠোঙা - তোমাকে কে বলল এসব কথা? (ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল এক লহমায়)

    আরাধনা - ভেবেছিলে চুপকে চুপকে পানি খাবে, আর আমি টেরটিও পাব না! আজ বাজারে হাবুল হাসতে হাসতে বললো, ‘কি দিদি, ঠোঙার সাথে কিছু হয়েছে বুঝি, ও তো দেখলাম স্টেশনে একটা মেয়েকে ঝালমুড়ি খাওয়াচ্ছে’। আমি শুনে থ! হাবুল বলে কি? এর বিন্দু বিসর্গ জানি না। কে বে ঠোঙা, তলে তলে তোর এ্যতো সব কাণ্ড?

    ঠোঙা - মাইরি তোমাকে বলতাম। ভয়ে পারিনি – আমি জানতাম তুমি শুনলেই খটাঙ্গধারিনি হয়ে –

    আরাধনা -তার মানে? তুমি কি করবে না করবে – আমি তা জানতে পারব না! ইল্লি আর কি? কে তোমাকে সাহস দিয়েছে অন্য মেয়ের সাথে গল্প করার। আর তার নাম কি? আমি শুনতে চাই।

    ঠোঙা - দূর মাইরি, তুমি শুধু শুধু রাগ কর। আরে ওসব কেউ নয়। যত্তসব বাজে রটনা। সুখে থাকতে ভুতে কিলোনো,

    আরাধনা -সাট আপ। কথা ঘোরানোর চেষ্টা হচ্ছে? আমার ছেলে যেন বলতে না পারে বাবা চরিত্রহীন ছিল – আই অ্যাম নট এ সন্‌ অব্‌ এ ঝাঁজরা পারসন্‌, বুঝেছো?

    ঠোঙা - (আরাধনার গলার আওয়াজেতেই ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ হয়ে গেল)।

    আরাধনা -শোনো, কোন মেয়ের সাথে যদি হেসে কথা বলেছ, তাহলে তোমার ঠ্যাঙ খোঁড়া করে দেব। বেড়াতে চাও ভালো কথা, তবে আমাকে সঙ্গে নিতে হবে।

    ঠোঙা - তাই হয় নাকি! একটু কনসিডার করতেই হবে ভাই!

    আরাধনা -ওসব ভাই ফাই ছাড়ো। আমি ওতে গলব না চাঁদু। আমি ফাইন্যালি বলে দিচ্ছি শুধু পার্কে তুমি আর আমি। ব্যাকগ্রাউণ্ডে টেপে বাজবে – ওপারে তুমি রাধে এপারে আমি, মাঝে নদী বহে রে!

    ঠোঙা - একটু মর্ডান গান হয় না – যেমন ‘গভীরে যাও, আরো গভীরে যাও’

    আরাধনা -শোনো এতদিন সাথে থেকে তুমি কতটা গভীরে যেতে পারবে আমার জানা হয়ে গেছে। আরো সময় আছে, দেখবে কত গভীরে তুমি ঢুকতে শিখেছ। আপাতত আমার ওই পুরানো গানই ভালো – বেশ একটা ব্যাপার আছে

    ঠোঙা - আর যদি তোমার কথা না শুনি।

    আরাধনা -শুনবে না মানে – শুনতে হবে। ইউ হ্যাভ নো চয়েসেস। না শুনলে তুলোধনা করে ছাড়বো। মনে রেখো আমার নাম আরাধনা।

    ঠোঙা - ওসব বাজে কথা ছাড় প্লীজ্‌। কতদিন পরে দেখা, কোথায় একটু আশনাই হবে তা নয়, সেই থেকে খালি তোড় করছ। চল একটু বসা যাক। অ্যাই কিছু খাবে? আইসক্রীম? (আরাধনা মাথা নেড়ে না বলে) – খাবে না? তাহলে দাঁড়াও মটর ভাজা কিনে আনি (মটর কিনে নিয়ে খানিক পরে ফিরল)।

    আরাধনা -এখন তো বেশ কুটুর কুটুর চিবাচ্ছো। কদিন পর যে আঙুল চুষতে হবে সে খেয়াল আছে?

    ঠোঙা - কেন কেন? আঙুল চুষব কেন? মা বলে কত কষ্ট করে আমায় নাকি আঙুল চোষা ছাড়িয়েছিল।

    আরাধনা -ওফফ্‌, আরে বাবা ওইদিকে আমার বিয়ের ঠিক করছে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। ছেলেদের ইন্টারভিউ আরম্ভ হল বলে।

    ঠোঙা - সে কি! ছেলেদের ইন্টারভিউ? এতদিনে শুনে এসেছি ছেলেরাই মেয়েদের ইন্টারভিউ নেয়। এযে আবার উলটো ব্যাপার দেখছি!

    আরাধনা -আসলে বাবা তো আমার মেজাজ জানে – তাই আমাকে হ্যান্ডেল করার মত ছেলে খুঁজছে। তাছাড়া এতো সম্পত্তি তো আর যার তার হাতে ছেড়ে দিতে পারে না!

    ঠোঙা - তাহলে তো আমার কোন চান্সই নেই!

    আরাধনা -তা কেন! তুমিও তো এম কম পাশ। তবে একটা কথা তোমার ওই ব্যবসা আর চলবে না, পাল্টাতে হবে।

    ঠোঙা - কেন? পাল্টাব কেন? ঠোঙার ব্যবসা করে তো বেশ দুপয়সা ঘরে আসছে।

    আরাধনা -আমার স্বামী ঠোঙাদার, লোককে বলতেও লজ্জা!

    ঠোঙা - তখন ঐ দেখেই তো মজেছিলে। দোকান পেরোবার সময় মুচকে মুচকে হাসি – চোখে চোখে ইশারা – হায়রে সেই সব দিন কোথায় গেল!

    আরাধনা -তখনকার ব্যাপার আলাদা। প্রেম আর বিয়ে এক জিনিস নয়। তাছাড়া বাবা এই ঠোঙা এখন একদম সহ্য করতে পারে না। বাবা এখন পলি প্যাকের দলে।

    ঠোঙা – সে তো হবেই! তোমার বাবা তো শুধু আমার শত্রু নয়, দেশের শত্রু। যত্ত সব নন-ডিগ্রেডেবল্‌ জিনিস নিয়ে কারবার।

    আরাধনা -মুখ সামলে। বাবার সমন্ধে তুমি কোন লুজ-টক করবে না। তাছাড়া জিনিস বলতে তুমি কি বোঝাচ্ছ?

    ঠোঙা - যেমন তুমি। একেবারে নন-রিয়্যাকটিভ – ভ্যাদা মাছ। এতদিন একসাথে ঘুরছি একদিনও মাইরি রিয়্যাকশ্যান করলে না!

    আরাধনা -অ, ওই জন্যই কি গভীরে যাও, গভীরে যাও গানটা মনে ভাসছে? এই তোমার গভীরে ঢোকার ভাবনা?

    ঠোঙা - না না, আমি পুরোপুরি এক্সোথার্মিক রিয়্যাকশন করার কথা বলছি না এখন। এই হালকা একটু আধটু

    আরাধনা -খালি মুখে বড় বড় কথা, কমার্সের ছেলে হয়ে তুমি এক্সোথার্মিক রিয়্যাকশন কি বোঝ? সে জানে আমার ছোটপিসির ছেলে, ব্রুনাইতে থাকে – বড় ইঞ্জিনিয়ার।

    ঠোঙা - কোথায় থাকে?

    আরাধনা -ব্রুনাই

    ঠোঙা - সেটা আবার কি?

    আরাধনা -আরে বাবা সেটা একটা দেশ। নাম শোননি নাকি?

    ঠোঙা - তা তোমার পিসির ছেলে বড় ইঞ্জিনিয়ার তো সেই দেশে থাকে কেন?

    আরাধনা -বড় ছোট জানি না – তবে দেদার কামাচ্ছে – ফ্ল্যাটের পর ফ্ল্যাট কিনছে কোলকাতায়। এই একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি যদি ওই দেশে যাওয়া যায়?

    ঠোঙা - কি করব আমি ওই দেশে গিয়ে? ওদেশের লোকেরা ঠোঙা ব্যবহার করে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখেছ?

    আরাধনা -যদিও দাদা বলছিল ওর কোম্পানিতে নাকি বাঙালি হলেই নিয়ে নেয় – মানে সেটাই নাকি প্রাইমারী ক্রাইটেরিয়া। তবে তোমার তো আবার কমার্স ডিগ্রী – সেই দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানিতে ঢোকানো একটু চাপ হয়ে যাবে মনে হয় ওদের বাঙালী ম্যানেজারের পক্ষেও। তবে ট্রাই করা যেতেই পারে। দাদা বলছিল যে ওদের মূল কাজ বিশেষ কিছু নেই – সেই সত্তর আশির দশকে যা বানানো হয়েছে, সেই থেকেই খালি কপি করা। তখন তো কম্পিউটার ছিল না তো, তাই সেই ছেঁড়া ফাইল দেখে কপি করা খুব চ্যালেঞ্জিং। তবে দাদা বড় ইঞ্জিনিয়ার বলছিলাম না – সব ম্যানেজ করে ফেলে।

    ঠোঙা - অন্য কোন বিজনেসের সুযোগ নেই?

    আরাধনা -ও হ্যাঁ আর একটা নাকি দারুণ বিজনেস ওখানে চলে – রাস্তার ধারে ঘাস কাটার কনট্রাক্ট নেওয়া। জল হচ্ছে রোজ, ঘাস বাড়ছে দেদার – গরু নেই তো ওদেশে তাই নিয়ম করে ঘাস কাটতে হয়। তোমার যা অবস্থা তাতে অবশ্য এখানেও তোমাকে ঘাসই কাটতে হবে ইমিডিয়েট আমাদের বিয়ে নিয়ে কিছু না করলে।

    ঠোঙা - হচ্ছিল রিয়্যাকশনের কথা – চলে এল ঘাস। এমনিতে তো আমি ঘাস পাতাই খাচ্ছি তোমার সাথে ঘুরে ঘুরে – মানে নিরামিষ আর কি। ওই রিয়্যাকশন –

    আরাধনা -আরে থামো থামো খালি রিয়্যাকশন। বলি এনার্জি আছে তোমার? অ্যাক্টিভেশন এনার্জি যাকে বলে –

    ঠোঙা - দেখাবো নাকি? আমার সাথে অ্যাক্টিভেশন এনার্জি মারিও না – দরকার হলে আমি সোডিয়ামের মত জলেতেও জ্বলতে পারি। শোনো, ওই সব কোন ব্যাপার নয়। আসল প্রবলেম হচ্ছে ঐ এনার্জি ব্যারিয়ার তোমার বাপ।

    আরাধনা -শোনো, তুমি তাড়াতাড়ি ওই ঠোঙা ছেড়ে নতুন একটা ব্যবসা শুরু কর না প্লীজ। তাহলে বাবাকে পটাতে সুবিধা হবে। আমার কিছু জমানো টাকা আছে সেই দিয়ে শুরু করতে পারো –

    ঠোঙা - কিন্তু এখনকার কম্পিটিশন মার্কেট – কি বিজনেস করি বল তো?

    আরাধনা -এ্যাই শোনো না – আমার জ্যাঠতুতো দিদির স্বামীর সাথে বড়বাজারের এক মাড়োয়ারীর চেনাশোনা আছে। তার মাথায় নাকি খালি মনোপলি বিজনেসের আইডিয়া ঘোরে। তোমাকে তার কাছে একদিন পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।

    ঠোঙা - ঠিক আছে, তুমি দিন ঠিক করে আমাকে জানিও। সন্ধে হয়ে গেছে – চলো ওঠা যাক।

    (দুজনার পার্ক থেকে প্রস্থান)


    তৃতীয় দৃশ্য
    ----------
    (এই দৃশ্যের বেশীর ভাগটাই আমি মৌলিক লেখা বলে দাবী করতে পারি না। এদিক ওদিক থেকে এককালে খাবলেছিলাম - কনসেপ্ট সহ অনেক ডায়লগ গুলোও। লেখকের নাম ঠিক মনে পড়ছে না তাই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারছি না সঠিক ভাবে। যখন টুকেছিলাম তখন লেখক আর গল্পের নাম নোট করে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে তখনও পিএইচডি করতে যাই নি, তাই প্লেজারিজম নিয়েও বেশী মাথা ঘামাতাম না ! যদি কেঊ লেখা পড়ে সেই মূল গল্প বা লেখকের নামটা সনাক্ত করতে পারেন, তাহলে প্লীজ জানাবেন - সুকি)

    জ্যাঠামশাই আর ভাইপো আরাধনাকে দেখতে এসেছে। আরাধনার বাবা হেমাঙ্গবাবু দরজার কাছে ছিলেন সঙ্গে ঘটক ভুতো। তাঁরা সবিনয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে বসালেন।

    হেমাঙ্গবাবু - আসুন, আসুন – কি সৌভাগ্য। আমি হলাম গিয়ে মেয়ের বাবা, হেমাঙ্গ মুখার্জী। আর একে তো (ভুতোর দিকে দেখিয়ে) আপনারা চেনেনই – ভুতো। সমন্ধটা ওই খুঁজে এনেছে।

    জ্যাঠামশাই -নামষ্কার। আমি ছেলের জ্যাঠামশাই। আমার ভাই, মানে ছেলের বাবা অনেকদিন আগে মারা যায়। তাই আমিই পরিবারের কর্তা বলতে পারেন। আর এ হল ছেলের বড়দা – এর বয়স বেশী দেখে ছেলের বয়স সম্পর্কে আইডিয়া করতে যাবেন না যেন। আসলে এরা ঠিক পিঠোপিঠি ভাই নয়। বয়সের বেশ তফাত আছে। ছেলের ডাইরেক্ট গার্জেন টাইপের ধরতে পারেন।

    কুশল প্রশ্নাদির পর যথারীতি চা ও জলখাবার আনা হল। জ্যাঠামশাই ও ভাইপো দ্বিরুক্তি না করে খাবারগুলি নিঃশ্বেষ করলেন। চা পানের পর -

    ভাইপো -এবার তা হলে মেয়েটিকে -

    জ্যাঠামশাই -দেখুন বেশী পাউডার-টাউডার মাখাবেন না। মানে আমরা সেকেলে লোক কিনা

    (হেমাঙ্গবাবু ও ভুতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খানিক পর বাড়ির ভিতর থেকে আরাধনা ও তার মা ঘরে এসে ঢুকলো)

    ভাইপো - বাব্বা, দুইজন পাত্রী নাকি! যাকে ইচ্ছা পছন্দ করতে পারি আমরা –

    মা - দেখুন আপনি ভুল বুঝছেন, আমি পাত্রীর মা!

    জ্যাঠামশাই -ভালো কথা – আপনাকে তো দেখে মনেই হয় না যে আপনার এতো বড় মেয়ে আছে (মা-এর চাপা গর্বসূচক হাসি) – একেবারে দুই বোন যেন। যাক আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল, পরে কথা হবে তা হলে

    মা -আমি তো এখন এখানেই থাকব মেয়ের সাথে।

    ভাইপো - মানে? এতো মেয়ে দেখতে গেছি, কিন্তু মেয়ের মা এসে বসেছে মেয়ের সাথে এমনটা তো কোথাও দেখিনি – ইন ফ্যাক্ট শুনিও নি!

    মা - মা আর মেয়েকে একই বয়েসি মনে হয় – এমন দেখেছেন কি?
    জ্যাঠামশাই -না, তা অবশ্য দেখি নি।

    মা - তা হলে আবার কি! আমরা মর্ডান ফ্যামিলি, পোষ্টমর্ডানও বলতে পারেন। আপনাদের যা জিজ্ঞাসা করার আমার মেয়েকে সেটা আমার সামনেই করতে পারেন। (মেয়েকে হালকা গুঁতো মেরে, নীচু গলায়) এই এঁদের প্রণাম কর।

    (আরাধনা দুইজনকে নমস্কার করে মাথা হেঁট করে বসে রইল)

    ভাইপো - বেঁচে থাকো মা। তা নামটি কি তোমার?

    আরাধনা - আরাধনা।

    জ্যাঠামশাই -বাঃ বেশ নামটি। সেকেলেও নয়, আবার একেলেও নয়!

    ভাইপো - কি পড়?

    আরাধনা - ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়ি।

    জ্যাঠামশাই -পাশ না অনার্স?

    আরাধনা - পাশ।

    ভাইপো -একটু এদিকে এসো তো মা, দেখি তোমার চুল।

    মা - আপনারা কি চুল দেখবেন নাকি? এসব আবার আছে নাকি আজকাল।

    জ্যাঠামশাই -আসলে আমরা একটু প্রাচীন পন্থী কিনা। আমাদের ফ্যামিলির একটা চেকলিষ্ট আছে – মেয়ে দেখতে গেলে আমরা সেই লিষ্ট থেকেই প্রশ্ন করি। অনেক মেয়ে দেখার পর আমরা এই লিষ্টের প্রশ্নের উত্তর দেখেই মেয়ে শর্টলিষ্ট করি। সব মেয়েকেই একটা ফেয়ার চান্স দেওয়া উচিত, তাই নয় কি? আমাদের বাড়ির কোন বউই এই প্রশ্নবানের হাত থেকে রক্ষা পায় নি! হেঁ হেঁ।

    মা - (আরাধনার চুল খুলে) এর খাসা চুল।

    ভাইপো - (একটা ফিতে বার করে ফিতে দিয়ে চুল মেপে)। লেখো, চুল – বিয়াল্লিশ ইঞ্চি।

    জ্যাঠামশাই -আচ্ছা মা, দেখি তোমার পা দুখানা।

    মা - (পায়ের উপর শাড়ির পাড়টা হাত দিয়ে সরিয়ে) এই দেখুন।

    ভাইপো - (ফিতে দিয়ে পা মেপে জ্যাঠার প্রতি)। লেখো পনেরো ইঞ্চি।

    জ্যাঠামশাই -পনেরো ইঞ্চি পা! বলিস কি!

    ভাইপো - আরে এ কে রে! পনেরো বর্গ ইঞ্চি – ছয় বাই আড়াই।

    জ্যাঠামশাই -তাই বল্‌! আচ্ছা মা, তুমি রাঁধতে পারো?

    আরাধনা - (ঘাড় কাত করে) হ্যাঁ।

    ভাইপো - কি কি রাঁধতে পারো বলো তো।

    আরাধনা - শুক্ত, ভাজা, চচ্চড়ি, ঘন্ট, ছ্যাঁচড়া, ডাল, মুড়িঘন্ট, কালিয়া, টক, চাটনি, ফ্রাই, চপ, কাটলেট, পোলাও, কোর্মা, লুচি, হালুয়া, রুটি, পরটা, খুচুড়ি, সন্দেশ, রসগোল্লা, গজা, নিমকি, সাবু, বার্লি ।।।

    জ্যাঠামশাই -থাক থাক, ওতেই হবে। আচ্ছা মা তুমি স্তব পাঠ করতে পার?

    আরাধনা - হ্যাঁ।

    ভাইপো - একটু শোনাও তো।

    আরাধনা -জবাকুসুম শঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্‌
    ধ্বান্তরিং সর্বপাপঘ্ন প্রাণতোহস্মি দিবাকরম্‌।

    জ্যাঠামশাই -বেশ। আচ্ছা বলো তো, পূজা করতে কি কি লাগে?

    মা - কুশাসন, জল, গোবর, কোশা-কুশি, ফুল, চন্দন, ধূপ

    ভাইপো - (জ্যাঠার দিকে তাকিয়ে) মা বলে দিচ্ছে তো

    জ্যাঠামশাই -এই তাইতো, আপনি বলছেন কেন? মেয়েকে বলতে দিন –

    আরাধনা - নৈবেদ্য, শঙ্খ, ঘন্টা, প্রদীপ, পুঁথি, পুরুত, দক্ষিণা, চরণামৃত, দই – এই সব।

    ভাইপো - বেশ বেশ। আচ্ছা বল তো উপাসনা করতে কি কি লাগে?

    আরাধনা - ছাপা চামড়ার স্যাণ্ডেল, ফরাসডাঙার ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি, গরদের চাদর, সোনার চশমা, কাঁচা-পাকা দাড়ি, টাক, একশত জন ছাত্র-ছাত্রী।

    জ্যাঠামশাই -আচ্ছা, তুমি সেলাই করতে পার?

    মা - হ্যাঁ পারে তো।

    ভাইপো - কি কি পার?

    আরাধনা - উলের কাজ করা আসন, কার্পেটের উপর উল দিয়ে লেখা কবিতা, ডি।এম।এস সূতা দিয়ে ফুল পাতা আঁকা রুমাল, এমব্রয়ডারী করা টেবিলক্লথ, সায়া, সেমিজ, উলের মাফলার, সোয়েটার, বালিশের ওয়াড়, জানালার পর্দা – ইত্যাদি।

    জ্যাঠামশাই -(অবাক হয়ে) আচ্ছা মা, এতটুকু বয়েসেই এত সেলাই শিখেছ?

    ভাইপো - আজকাল মেয়েরা ওসব শিখেই থাকে। আচ্ছা তুমি ছবি আঁকতে পারো?

    জ্যাঠামশাই -ছবি কি আর সবাই আঁকতে পারে রে?

    ভাইপো - আজকালকার মেয়েরা সব পারে।

    জ্যাঠামশাই -আচ্ছা, তা তুমি মা কি ছবি আঁকতে পার?

    আরাধনা - একটু একটু পারি। পেন্সিল আর জল রং দিয়ে অনেকগুলো ছবি এঁকেছি। এবার ভাবছি অয়েল পেন্টিংটা শিখব।

    ভাইপো - আচ্ছা, তোমার চিত্রকলার ভাবটা কি অবনেন্দ্রীয় নাকি নন্দদুলালীয়?

    মা - আমি যা দেখেছি মেয়ের আঁকা তাতে করে বলা যেতে পারে দু-টোই। আর তার সঙ্গে সঙ্গে একটু হেমেন্দ্রীয় আর একটু মকবুল ফিদিও ভাবো আছে।

    ভাইপো - বেশ বেশ। আচ্ছা তুমি মাটির কিংবা প্ল্যাস্টারের মূর্তি গড়তে পার?

    আরাধনা - অল্প অল্প পারি। পাল মশাইয়ের কাছে এক বছর কাজ শিখেছি।

    জ্যাঠামশাই -আচ্ছা তুমি কবিতা লেখ?

    আরাধনা - (একটু হেসে) কখনও কখনও।

    (মা উঠে গিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে একটা খাতা নিয়ে এলো, খাতাটি কবিতায় ভরা। জ্যাঠা খাতাটি খুলিয়া বলল, বাঃ মুক্তর মতন হাতের লেখা তো তোমার। ভাইপো খাতাটি নিয়ে উলটে পাল্টে দেখলো)।

    ভাইপো - আচ্ছা তোমার কাব্য ভাবটা কি রবীন্দ্রীয় নাকি সুনীল গাঙ্গুলীয় – মানে সেকালীয় নাকি একালীয়।

    মা - লেখা দেখেই তো বুঝতে পারছেন।

    ভাইপো - ঠিক ধরতে পারছি না। ভাষাটা প্রায় মাইকেলীয়, ভাবটা প্রায় রবীন্দ্রীয়, ছন্দ জীবনানন্দীয়, আর প্রেক্ষিত প্রায় সুনীল গাঙ্গুলীয়।

    আরাধনা - তা হবে।

    জ্যাঠামশাই -তোমাদের ওসব কাব্য কবিতার কথা থাক এখন। আচ্ছা মা তুমি গান গাইতে পার?

    আরাধনা - হ্যাঁ।

    ভাইপো - কি কি ধরণের গান গাইতে পার?

    আরাধনা - সাধারণ সব রকমই একটু একটু পারি। যেমন – ক্ল্যাসিক্যাল, মর্ডান, রবীন্দ্রীয়, রামপ্রসাদী, হিন্দী, গজল, সভা উদ্বোধনী, প্রাইজ ডিষ্ট্রিবিউশনি, চাঁদা আদায়ী –

    মা - জীবনমুখী টা বাদ দিলি কেন? তুই তো সুমন, নচি, অঞ্জন, মৌসুমী সবার গানই পারিস।

    আরাধনা - তাছাড়া, আমি ব্যাণ্ডের গানও পারি – মহীন থেকে চন্দ্রবিন্দু

    জ্যাঠামশাই -বেশ বেশ। আচ্ছা মা তুমি কীর্তন গাইতে পার?

    আরাধনা - হ্যাঁ, কীর্তন, হরিসংকীর্তন, সংকীর্তন, কালীকীর্তন এই সব

    ভাইপো - (জ্যাঠামশাই কে নীচুস্বরে) একটা কীর্তন আমাদের শোনাতে বলব নাকি?

    মা - ওর গলাটা এখন একটু খারাপ। তবে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে পারে।

    জ্যাঠামশাই -বেশ বেশ তবে তাই করুক।

    আরাধনা - সুখের লাগিয়াকলেজে পশিনু
    সকলি ব্যরথ হল
    হেদুয়া তড়াগে সিনান করিতে
    সরদি লাগিয়া গেল
    সখি, কি মোর করমে লেখি –
    সহজ ভাবিয়া আর্টস লইনু
    ভীষণ কঠিন দেখি
    বেথুন ছাড়িয়াস্কটিশে আসিতে
    পড়িনু পীড়ীতি জালে
    না পেনু অনার্স না হইনু পাশ
    এই কি ছিল রে ভালে
    যতন করিয়া পিছলি পড়িনু
    মোটর চাকার পাশে
    তবুও নিঠুর ফিরে না তাকাল
    বিলেত পালাল শেষে
    কত না আশায় দীরঘ দিবস
    হোষ্টেলে কাটিয়া গেল
    বুনিনু শুধুই স্বপনের জাল
    সফল নাহিকো হল।।

    জ্যাঠামশাই -বেশ। আচ্ছা, এগুলো কি তোমার নিজের কথা।

    মা - (তাড়াতাড়ি বলে ওঠে)। না, না কি যে বলেন। ও কি কখনো স্কটিশে পড়েছে নাকি?

    জ্যাঠামশাই -বাঁচালে মা বাঁচালে

    ভাইপো - আচ্ছা, তুমি কি কি বাজনা বাজাতে পার?

    আরাধনা - হারমোনিয়াম, এস্রাজ, সেতার, বেহালা, বাঁশি, ক্লারিওনেট, জলতরঙ্গ, তবলা, সানাই, কাঁসি, ঢাক, খোল, করতাল, পিয়ানো – এই সব।

    জ্যাঠামশাই -বেশ মা বেশ।

    ভাইপো - (জ্যাঠাকে নীচুস্বরে) নাচতে পারে কিনা – একবার জিজ্ঞাসা করো না।

    জ্যাঠামশাই -আচ্ছা মা, তুমি কি নাচ জানো?

    আরাধনা - হ্যাঁ

    ভাইপো - কি কি নাচ জানো?

    আরাধনা - বল, ব্যালেট, বাঈ, রবীন্দ্রীয়, প্রাচ্য, গুজরাটী, গুরুসদয়ী, ব্রতচারী, সাঁওতালী, মণিপুরী, মৈথিলী, কথাকলি, দ্রাবীড়ী, সিংহলী, উদয়শঙ্করী, ছউ – এই সব।

    মা - রিসেন্টলী যে বলিউডীয় ডান্সটা শিখছিস সেটা বললি না তো!

    জ্যাঠামশাই -(ভাইপোর প্রতি) নে সবই তো শুনলি। আর কিছু আছে তোর জিজ্ঞেস করার?

    ভাইপো - না, আর কি আছে জিজ্ঞেস করার – আচ্ছা তুমি সাঁতার কাটতে পার?

    আরাধনা - পারি।

    ভাইপো - সাইকেল চড়তে পার?

    আরাধনা - পারি।

    ভাইপো - আমি ধরেই নিচ্ছি যে তুমি গাড়ি চালাতে পার। তাই আর আলাদা করে জিজ্ঞেস করলাম না। আচ্ছা তুমি লাঠি খেলতে পার?

    জ্যাঠামশাই -লাঠি খেলা জেনে কি হবে?

    ভাইপো - তা আমি জানি না, তবে আমাদের ফ্যামিলির প্রশ্ন পত্রে আছে। পাঁচ পুরুষ ধরে চলে আসছে এই প্রশ্ন – আমি তো আর হঠ করে পাল্টাতে পারি না!

    আরাধনা - খুব বড় লাঠি হলে পারব না। টুকটাক শিখেছি

    ভাইপো - ছোরা?

    আরাধনা - অল্প অল্প পারি।

    জ্যাঠামশাই -নাও সবই তো হল – এবার ওকে ছেড়ে দে।

    ভাইপো - আচ্ছা, ঘোড়ায় চড়তে পার?

    আরাধনা - হ্যাঁ, দার্জিলিং-এ শিখেছি।

    জ্যাঠামশাই -আচ্ছা মা এবার এস।

    (আরাধনা একটা ছোট্ট নমস্কার করে ওর মায়ের সাথে ভিতরের দিকে পা বাড়াল। এমন সময় ভাইপো বলল)

    ভাইপো - দেখুন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে ভুল হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না।

    মা - না না, মনে করার কি আছে? বলুন কি জানতে চান?

    ভাইপো - আচ্ছা, তুমি সুপুরী কাটতে পার?

    আরাধনা - হ্যাঁ (এই বলে ঘরের দিকে পা বাড়াল)।

    ভাইপো - এই দেখুন, আরো একটা জিনিস বাকি থেকে গেল।

    জ্যাঠামশাই -আবার কি বাকি থেকে গেল তোর?

    ভাইপো - না মানে মেয়েটির নাকটা আর দাঁতগুলো দেখা হয় নি।

    জ্যাঠামশাই -সে কি – এই প্রশ্ন গুলো তো আমরা প্রথম দিকেই করি – লিষ্টের প্রথম দিকেই তো থাকে এগুলো। কি যে করিস তুই। যাক নাকটা মেপে নে।

    ভাইপো - (ফিতা দিয়ে নাকটি মেপে)। জ্যাঠা ১।৬ ইঞ্চি হল গো নাকটা।

    জ্যাঠামশাই -যাক, আমাদের আর কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই।

    (আরাধনা আর মা বাড়ির ভিতরে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হেমাঙ্গবাবু ও ভুতো প্রবেশ করল)।

    ভুতো - মেয়েটিকে কি আপনাদের পছন্দ হল?

    (জ্যাঠামশাই খুব উৎসাহের সঙ্গে বলতে যাচ্ছিলেন যে খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভাইপো বললে যে)

    ভাইপো - দেখুন, হঠাৎ করে তো আর মত দেওয়া যায় না। বাড়ি গিয়ে ভেবে চিন্তে দেখি, যদি আমাদের পছন্দ হয় তাহলে একদিন বাড়ির মেয়েরা দেখতে আসবেন। মেয়েদের সমন্ধে মেয়েরাই ভালো বোঝে, বুঝলেন কিনা। তার পর মেয়েদের যদি পছন্দ হয়, তখন ছেলে নিজে আসবে দেখতে। আজ তো আর ভালো করে দেখা হলনা – এটা একটা প্রিলিমিনারী দেখা – বুঝলে কিনা।
    (প্রস্থান)

    (আরাধনার মা আরাধনাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে)

    মা - দেখ, তোমার মেয়ে কেমন করছে। দেওয়াল থেকে ছবি, ক্যালেণ্ডার, আয়না সব টেনে টেনে ফেলে দিয়েছে। ব্যাপার দেখে সকলে ধরতে গেলে চড়, কিল লাথি দিয়ে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে।

    হেমাঙ্গবাবু - পাগল হয়ে গেল নাকি?

    আরাধনা - হ্যাঁ পাগল – কেন পাগল হব না? আমাকে তোমরা কি ভেবেছ? আমি কি হাঁস, না মূর্গি না খরগোশ, না ঘোড়া? আমার নাক মাপবে, চুল মাপবে

    ভুতো - সে তো শুনেছি বিউটী কম্পিটিশনে গেলেও নাকি করে ও সব

    আরাধনা - দেখুন ইয়ার্কি মারবেন না আমার সাথে – এর বড় ওদের আস্পর্ধা যে মাপামাপি করে? শুধু তোমাদের অপমানের ভয়ে চুপ করে ছিলুম। ফের যদি এমন ইডিয়টের দল বাড়িতে ডেকে আনতো, আমি আত্মহত্যা করব – মনে থাকে যেন।

    হেমাঙ্গবাবু - আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। সে এখন দেখা যাবে। তুই এখন ঠাণ্ডা হ তো। যা ঘরের ভিতরে যা।

    (আরাধনা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরে চলে গেল)

    মা - যাই বলো বাপু – ওই জ্যাঠামশাই আর তার ভাইপো যা শুরু করেছিল। আমি তো ছিলাম সাথে – আমারই তো রাগ হয়ে যাচ্ছিল।

    হেমাঙ্গবাবু - এবার থেকে আর মেয়ে দেখাব না। প্রথমা আমি আর ভুতো ছেলের ইন্টারভিউ নেব। তারপর পছন্দ হলে একদিন না হয় ওদের দুজনকে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেব। কি বলো ভুতো –

    ভুতো - আজ্ঞে, আমি তো তাই বলি। আশা করছি কদিন পরই কাগজের আপিস থেকে চিঠি এসে যাবে। তারপ্র বাছাই করা ছেলেদের আপনি ইন্টারভিউ নেবেন না হয় – আমিও সঙ্গে থাকব।

    হেমাঙ্গবাবু - সেই ভালো

    মা - হ্যাঁ গা, তোমার মেয়ের যা রকম দেখলাম ভিতর ভিতর কাউকে পছন্দ করে বসে নেই তো?

    হেমাঙ্গবাবু - কি যে বলো। আরে কি আর দেখেছ – এখন এমন একটু হয়ে ত্থাকে।

    ভুতো - তা যা বলেছেন। যৌবন হল জীবনের কোকিল। কুহু ডাকে ভরপুর। একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব। ছন্দ মিলুক না মিলুক, দু চার চরণ কবিতা আসবেই। যে কোন নাটক মঞ্চে একবার ঠেলে তুলবেই। পাখির যেমন পালক, বেড়ালের যেমন গোঁফ, চোখের যেমন পলক, যৌবনের তেমনি প্রেম। এ যুগে অবশ্যি বেশীর ভাগ প্রেমই ছাঁদনাতলায় গিয়ে শেষ হয় না।
    হেমাঙ্গবাবু - প্রেম আর সরকারি হাসপাতালের সার্জারি একই রকম প্রায় – সাফল্যের হার শতকরা পঞ্চাশ, ফিফটি – ফিফটি

    ভুতো - আমাদের যুগে ছিল মেডিসিন। দাওয়াই দিয়ে ব্যামো ছাড়াবার চেষ্টা চলত। প্রেম রোগের দাওয়াই ছিল আড়ং ধোলাই। গার্জেনদের মেজাজ ছিল বিদ্ঘুটে, দেঊরির ভোজপুরি দারোয়ানের মত। ইংরেজ পুলিস সার্জেন দের মত। মেয়ে যদিও বা প্রেমিক হল, মেয়ের পিতা যেন কুইনিন – কবিরাজী পাঁচন।

    হেমাঙ্গবাবু - একেবারে মনের কথা বলেছ ভায়া – আমার এনাকেই দেখ না

    মা - মরণ

    হেমাঙ্গবাবু - অবাক হয়ে ভাবতে ইচ্ছা করত অমন বাপের এমন মেয়ে হয় কি করে!

    মা - মরা মানুষটাকে নিয়ে আবার টানাটানি করছ!

    হেমাঙ্গবাবু - আরে তোমার প্রশংসাই তো করছি। তুমি তো ছিলে যেন দৈত্যকুলে স্ত্রীলিঙ্গ প্রহ্লাদ। বলছি কি সে যুগে শ্বশুর দেখলে বিয়ের ইচ্ছে মাথায় উঠত। তবে স্বাধীন হবার এতো বছর পর অবশ্য দেশ জুড়ে একটা প্রেমের বাতাবরণ তৈরী হয়েছে।

    ভুতো - বিজ্ঞানের যেমন উন্নতি হয়েছে, প্রেমেরও সেই রকম উন্নতি হয়েছে। সেকালের প্রেম ছিল জনডিস রোগের মত। ধরলে রুগী হলদে মেরে যেত। সবাই বুঝত কিছু একটা হয়েছে। তোড়ে কবিতা নামছে ড্যামফাটা জলের মত। সে যুগে প্রেম আর ভুত একই কায়দায় ছাড়ানো হত।

    হেমাঙ্গবাবু - একালে প্রেমের আর সেই জৌলুস নেই। দ্বাদশবর্ষীয় বালক বালিকারা বলছে – আমার লাভার! চার্মটাই নষ্ট হয়ে গেছে। গঙ্গার ঘাটে, মাঠে, পার্কে – ময়দানে জোড়ায় জোড়ায় দিবস রজনী কেজি কেজি চীনেবাদাম খেয়ে ফোঁস ফোঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ রেখে, পুলিশ আর ছিনতাই পার্টির তাড়া খেয়ে প্রেমকে ভয়ঙ্কর চিপ্‌ করে ফেলেছে।

    ভুতো - সেই টনটনে রোমান্স আর নেই। প্রেমের এখন ইংরাজী নাম হয়েছে ফ্রী সেকস্‌। মনের চেয়ে হুমদো দেহ বড় হয়েছে।

    মা - এই তোমরা বাজে কথা থামাবে এবার। শোন যত তাড়াতাড়ি পার পাত্র দেখা শুরু করে দাও। আমি হাওয়া ভালো বুঝছি না।

    ভুতো - আজ্ঞে, ওই কাগজের আফিস থেকে এলেই কাজ শুরু হবে। আজ তা হলে উঠি।


    চতুর্থ দৃশ্য
    ----------
    (এই লেখাগুলি বেশ বেশ কিছু বছর আগের যখন কপিরাইট বা প্লেজারিজম জিনিসটা ঠিক জানতাম না - আমার একটা খাতায় কোন একটা ছোট গল্প পড়ে সেখান থেকে কনসেপ্ট এমনকি অনেক ডায়লগও হুবাহু টুকে রেখেছিলাম - কিন্তু দূর্ভাগ্য বশতঃ গল্প বা লেখকের নাম লিখে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারছি না ঠিক করে - কেউ যদি গল্পের নাম ও লেখকের নামটা জানাতে পারেন তা হলে খুব ভালো হয় - সুকি)

    (ঠোঙা বড়বাজারে এসেছে চাঁদমল খেমকার সাথে দেখা করার জন্য)

    ঠোঙা -মরো এবার বড়বাজারের গোলকধাঁধায় ঘুরে। কি দরকার ছিল এই চাঁদমল হীরামল খেমকার কাছে আমাকে বুদ্ধি নিতে পাঠানোর। এই আরাধনার কাজকর্মই আলাদা – যত নষ্টের গোরা ঐ ব্যাটাই। ওর জামাইবাবু বলে “মনোপলি নিয়ে নামুন। আপনার অঞ্চলে যে বিজনেসের কথা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারে নি, সেটা নিয়েই নেমে পড়ুন। তেমন বুঝলে মাটির হাঁড়ি কলসীর দোকান দিতেও কসুর করবেন না যেন! ওখানে মাটির জিনিসের কোন দোকান না থাকলে আপনাকে আর পায় কে! পোড়ামাটি বেচে লাখপতি হয়ে যাবেন!” হুঁ, মনোপলি এতই সোজা? এ যুগে কেউ আর বোকা নেই। বললেই কি আর মনোপলি করা যায়? ধেই ধেই করে নাচলাম বটে তখন – কি যে হবে। ঠিকানাটাও মুখস্ত হয়ে গেছে। একুশ নাম্বার পর্তুগীজ চার্চস্ট্রীট। এই তো এসে গেছি -

    চাঁদমল -আইয়ে, পাধারিয়ে। আপনি কি বিকাশবাবু আছেন?

    ঠোঙা - কেন বিকাশবাবু কেন?

    চাঁদমল -না আসোলে এক বাঙালীবাবুর আসার কোথা ছিল আমার কাছে – তাই ভাবলাম

    ঠোঙা - (একটু ভেবে)। আরে, আমার নামই তো বিকাশ। ঠিকই ধরেছেন

    চাঁদমল -সে কি মোশাই – নিজের নাম নিজেই ভুলে যাচ্ছেন – আপনাকে দিয়ে কি বিজনেস হবে কে জানে!

    ঠোঙা - না আসলে, অনেক দিন আমাকে কেই বিকাশ বলে ডাকে নি তো, তাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আর কি!

    চাঁদমল -কেনো, ডাকে নি কেন?

    ঠোঙা - সবাই আমার ডাকনাম ধরে ডাকে কিনা! সে যাক – নমস্কার
    চাঁদমল -আরে বসুন বসুন। তা বোলেন, আপনার প্রোবলেমটা কি? পরতাপবাবু আমাকে ফোন সব জানালো। তবু আপনার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই।

    ঠোঙা - (কয়লার ইঞ্জিনের ধোঁয়া ছাড়ার মত ভস করে শ্বাস ছেড়ে)
    পুরোটাই প্রবলেম। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি বলুন তো!

    চাঁদমল -ধুর মশাই! ছোঃ ছোঃ জিন্দেগীতে কিছুই প্রোবলেম নেই। আপনাদের বাঙালীদের এই একটা দোষ আছে। লাইফে আপনাদের দর্দ না থাকলে জোড় করে আপনারা দর্দ ডেকে আনেন। বেফালতু স্যাডনেস্‌ ডেকে আনতে আপনাদের জুড়ি নেই। যেতো চিন্তা করবেন, তোতো সমস্যা। পরতাপবাবু আমাকে বলল কি আপনাকে মনোপলি বিজনেসের আইডিয়া বাতলে দিতে। তা আমি দোবে বিকাশবাবু। ডোন্ট ওরি –

    (ঠোঙা চোখেমুখে কৃতজ্ঞতা আর আশ্বস্ত হবার ভাব ফুটিয়ে ঘাড় নোয়ালো)।

    চাঁদমল -তা আপনার বিজনেস স্পটটা কোথায় আছে?

    ঠোঙা - আজ্ঞে কাশীপুর রোডে। এই আপনার অফিস ঘরের মতই বড় সাইজের দোকানঘর।

    চাঁদমল -লোকেশনটা ঠিক কি রকম আছে?

    ঠোঙা - লোকেশন ? (ঠিক বুঝতে না পেরে)

    চাঁদমল -মানে আমি বলছি কি আশে পাশে কি কি দোকান আছে, কেমন কেমন বাড়ি আছে, দোকানের পাশে স্কুল আছে নাকি খাটাল আছে, দোকান থেকে বাসস্টপ কতদূর – এই সব বলুন।

    ঠোঙা – (আমতা আমতা করে অনেকক্ষণ ভেবে) আপনার ওই গিয়ে নর্থ সুবারবান হাসপাতাল আছে না, সেটা ছাড়িয়ে আর একটু ডানহাতি গেলেই পড়বে দোকানটা।

    চাঁদমল -মাই গড্‌, আঁসপাতালের কাছে আপনার দোকানঘর! (নড়েচড়ে বসে)

    ঠোঙা - ঠিক পাশে নয় –

    চাঁদমল -ওই হল মশাই। আর কি আছে?

    ঠোঙা - গৃহস্থের বাড়ি আছে। দোকানপাট – কিছুটা দূরে বাজার।

    চাঁদমল -আরে আপনি তো ঠিক পারটিকুলারস ঠিক দিতে পারছেন না – পারটিকুলারস খুব দরকার। মাষ্ট বি টু দা পয়েন্ট। -- আচ্ছা, আগে পিছে কোন মদের দোকান আছে?

    ঠোঙা - মদের দোকান (থমকে গিয়ে)

    চাঁদমল -হ্যাঁ হ্যাঁ। এই ধোরেন দেশি দারুকা দুকান কিংবা বিলাইতি ওয়াইন – আছে?

    ঠোঙা - জানি না মশাই। যদি নাও থাকে, তাহলে কি আপনি কি আমাকে মদের ব্যবসায় নামাবেন? না, না – খেমকাজী – ওসব আমার দ্বারা হবে না। ছাপোষা মানুষ, এই ঠোঙাই যথেষ্ট – তার উপর আপনি কিনা মদের দোকান –

    চাঁদমল -আহা – আপনি ভেঙে পড়ছেন কেনো? আমি শুধু জিজ্ঞেস করছিলাম। সবদিক না দেখে আমি কি করে বাতলাবো বলুন তো! (হাত তুলে অভয় দিলেন)

    ঠোঙা - তা বলে মদের দোকান! আপনি তো ডেঞ্জারাস লোক মশাই। আমাকে আবগারির মামলায় জড়াতে চান নাকি?

    চাঁদমল -তা কেনো! তা কেনো! আপনি বাঙালি বাবু, ভদ্দরলোক আছেন। আপনাকে আমি ব্যাড রাস্তায় কেনো নিয়ে ফেলব? ওটা ভাববেন না (একটু থেমে)। কাশীপুরে একটা বার্ণিং ঘাট আছে না? পরমহংসজীর স্মৃতি আছে না কি যেনো

    ঠোঙা - হ্যাঁ, কাশীপুর শ্মশান। ঠাকুর রামকৃষ্ণকে ওখানেই দাহ করা হয়েছিল। আপনি ঠিকই জানেন। কিন্তু শ্মশানের কথা –

    চাঁদমল -ঘাটটা আপনার দোকানের আগে না পরে? (হঠ করে থেমে মুখটা কুঁচকে) – বাবুলাল (বাবুলালের উদ্দেশ্যে একটা ডাক দিল)
    (কোন উত্তর নেই)

    চাঁদমল -বাবুলাল – ওই বাবুলাল। বেটা বড় ফাঁকিবাজ হয়েছে। দরকারের সময় কুথায় যে যায়!

    ঠোঙা - তা বাবুলাল কি করবে? আমাকে বলুন না দরকারটা – যদি হেল্প করতে পারি।

    চাঁদমল -না আপনি হোলেন গেষ্ট – আপনাকে দিয়ে হোবে না! আসলে আমার একটা গ্যাস এসেছে –

    ঠোঙা - গ্যাস! তা বাবুলাল কি করবে?

    চাঁদমল -আহা, এ হল কি ইংরাজিতে যাকে বোলে ফার্ট! আমার তো এই শরীর দেখছেন – হেবী বডি আমি তাই পিছোনটা ঠিক তুলতে পারি না – বাবুলাল এসে আমার পাছাটা তুলে ধরে

    (শুনে ঠোঙা হাঁ হয়ে যায়)

    চাঁদমল -যাক, যা বলছিলাম - ঘাটটা আপনার দোকানের আগে না পরে?

    ঠোঙা - পরে। মানে আপনি উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে এলে, পরে পড়বে। নামকরা শ্মশান মশাই, মহাশ্মশান। আমার বাবাকে ওখানে পুড়িয়েছিলাম। আমাদেরও ওখানেই গতি হবে।

    চাঁদমল -বাস্‌ বাস্‌। আর বলতে হবে না। বিজনেসের আইডিয়া আমার মাথায় এসে গেলো। এবার আপনি শুরু করতে পারলেই হল – মোটা দাঁও। টাকা গিণতির লোক রাখতে হোবে।

    ঠোঙা - ধ্যাত মশাই, টাকার নিকুচি করেছে। ব্যবসাটা কি আগে সেটা বলবেন তো!

    চাঁদমল -স্রেফ খাটের! (স্মিত হেসে)

    ঠোঙা - খাটের! আপনি ফার্ণিচারের কথা বলছেন?

    চাঁদমল -ইয়েস খাট! বাট ইট ইস নট যে সে খাট। আই মিন, শোয়ার, বসার, কিংবা শাদির খাট নয়। এই খাটে লোকেরা লাইফে একবারই শুতে পারে। দিস ইজ দ্যা লাষ্ট পিসফুল বেড ফর আস!

    ঠোঙা - তার মানে মড়ার খাট! আমি মড়ার খাটের ব্যবসা করব!

    চাঁদমল -দি আইডিয়া। এই তো আপনি সমঝে গেছেন। ওই অঞ্চলের পক্ষে একমাত্র এটাই মনোপলি বিজনেস। মোষ্ট সুইটেবল। কেনো জানেন। আঁসপাতালে মারা গেলো, আপনার দোকানে খাট কিনলো। একেবারে সোজা হিসাব। সিধা পথ। আপনি খুবসে ভেওয়ে দেখুন। এছাড়া আর কোন বিজনেস ওখানে মার্কেট পাবে না।

    ঠোঙা - এ আমি পারব না মশাই। শেষে কিনা মড়ার খাট! ছ্যাঃ ছ্যাঃ। বাড়িতে গিয়ে চান করবে হবে।

    চাঁদমল -পারতেই হোবে। সব রকমের চৌপাই থেকে সিঙ্গেল খাট সাজিয়ে বসে পড়ুন দিকি। বেওসা জমবে না মানে! আপনি এই ওপারচুনেটি ছাড়বেন না মশাই। আগে হাসপাতাল, সামনে শ্মশান – মধ্যিখানে আপনার খাটের দোকান। ভাওতে পারছেন কি অবস্থা দাঁড়াবে! গরমেন্ট আঁসপাতালে ঘন্টায় ঘন্টায় পেশেন্ট মরে। এবার ভাওউন, প্রতি ঘন্টায় খাট ডিসপোজ হচ্ছে। আপনি চাইলে চউইস ঘন্টা দুকান খোলা রাখতে পারেন। ফার্ণিচার শপ – মর্ণিং টু মর্ণিং। ওঃ হাউ ইন্টারেষ্টিং। মনোপলি হো তো অ্যায়সা। বুঝলেন?

    ঠোঙা - (বুক চেপে উঠে পড়ে) ভেবে দেখি খেমকাজী। বুদ্ধিটা তো ভালোই দিয়েছেন। এখন কাজে লাগাতে পারব কিনা জানিনা।

    চাঁদমল -খুওব পারবেন। কাইন্ডলি আমাকে জানিয়ে দেবেন কি ঠিক করলেন। দরকার হলে আমি হেলপও করতে পারি।

    ঠোঙা - (নমস্কার জানিয়ে উঠে পরে, তারপর হঠাৎ করে মনে পড়ে যে খেমকাজী নিজে কিসের ব্যবসা করে সেটা তো জানা হল না!) আচ্ছা খেমকাজী, আপনার নিজের কিসের ব্যবসা?

    চাঁদমল -আমার বিজনেস গেণ্ডারের পিসাব লিয়ে।

    ঠোঙা - তার মানে?

    চাঁদমল -বুঝলেন না! আরে মশাই, আমি ইউরিন অব দ্যা রাইনোর ব্যবসা করি।

    ঠোঙা - অ্যাঁ, বলেন কি! গণ্ডারের মূত্র নিয়ে আপনার কারবার! এ নিয়ে আবার ব্যবসা হয়?

    চাঁদমল -কেনো হবে না? এই তো আমি করছি! ওই জিনিসটা যে কেতো কাজে আসে আপনার ধারণা নেই – মেডিসিন থেকে মেসমারিজম্‌ - সবেতে।

    ঠোঙা - আপনার পোষা গণ্ডার আছে বুঝি?

    চাঁদমল -আরে না না। নর্থ বেঙ্গল আর আসামের যত গেণ্ডার আছে তাদের পিসাব কালেক্ট করি। ওখানের গেণ্ডারগুলো আমাদের চিনে গেছে। আমার ইউরিন কালেক্টারের সামনে ছাড়া মুতে না। হ্যাঁ, শোনেন বিকাশবাবু, সারা ইন্ডিয়ায় একজনই এই ব্যবসা করে – সেটা হলাম আমি চাঁদমল হীরামল খেমকা!

    (ঠোঙা টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিল। খেমকাজী হাঁউহাঁউ করে চেঁচিয়ে উঠলেন – ওনাকে পাকড়ো, পাকড়ো)। 

    পঞ্চম দৃশ্য
    -----------
    (এই দৃশ্যটি শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা একটি গল্প অবলম্বনে – নাম যতদূর মনে পড়ছে “আমার সম্পাদক শিকার”)

    পাত্র পত্রিকা সম্পাদক

    পাত্র -নমষ্কার, আচ্ছা এখান থেকেই তো ইন্টারভিউয়ের চিঠিটা গিয়েছিল?

    ভুতো - নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমরা দুজন মিলে, মানে এই যে মেয়ের বাবা আর আমি – ছেলেদের ইন্টারভিউ নেব সারাদিন। সব টাইম দেওয়া আছে। আপনি তো দেখছি পুরো ঠিক সময়ে এসেছেন

    পাত্র - হ্যাঁ, সময়ের ব্যাপারে আমি খুব সজাগ। তা আপনি কে?

    (ভুতোকে জিজ্ঞাস করে)

    হেমাঙ্গবাবু - ইনি হলেন ভুতোবাবু। বিয়ের ব্যাপারে আমাকে হেল্প করছেন। তা নামটা কি তোমার বাবা?

    পাত্র - আমার নাম অরুণ কান্তি হালদার। বয়স ৩১।

    ভুতো - বয়স তো লেখাই রয়েছে দেখছি তোমার অ্যপ্লিকেশনে। তুমি কি তাহলে বুদ্ধিজীবি?

    পাত্র - তা বলতে পারেন। আসল আমি পত্রিকা সম্পাদক। তবে বুদ্ধি নিয়ে আমাদের কারবার বলে, আমাকে আমনি বুদ্ধিজীবিও বলতে পারেন।

    হেমাঙ্গবাবু - তা তো বটেই। তা তুমি কোন কাগজের সম্পাদক সেটা তো লেখোনি।

    পাত্র - আমি ‘কৃষিতত্ত্ব’ পত্রিকার সম্পাদক। আবার অনেকক্ষেত্র সমালোচনাও লিখে থাকি।

    হেমাঙ্গবাবু - কিসের সমালোচনা?

    পাত্র - বর্তমান কৃষিব্যবস্থার। কিছুদিন আগে সিঙ্গুর কেসটা এসে যাবার পর তো আমাদের আর দম ফেলার ফুরসত নেই। জমি কার – চাষ করবে কে – শিল্প না জমি। এই সব নিয়ে ভজকট অবস্থা।

    ভুতো - তা আপনি চাষ না শিল্প কার দলে?

    পাত্র - অফিসে যখন থাকি তখন আমি চাষের পক্ষে – কৃষকদের বন্ধু। কিন্তু একবার অফিস থেকে বেরিয়ে কফিহাউসে পৌঁছলেই আমি শিল্পের দলে।

    হেমাঙ্গবাবু - সে কি। তোমার তা হলে নিজের কোন আইডিওলজি নেই? রং বদলাও খালি?

    পাত্র - কেন? বাম জমানায় আপনাদের প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী চক্রবর্তী মশাই স্বামী হিসাবে স্ত্রীর সাথে মন্দিরে পূজা দিতে গেলে আর খানিক পরে মার্কসবাদী হিসাবে রাইটার্সে ঢুকে নাস্তিক হয়ে গেলে দোষ নেই, আর আমার বেলাতেই খালি দোষ!

    ভুতো - এ্যাই, এই সব রাজনৈতিক আলোচনা বাদ এখন। তা আর তুমি কিছু লেখ কি?

    পাত্র - হ্যাঁ, আমি নতূন পদ্ধতিতে চাষ আবাদ সমন্ধে অনেক গবেষণা মূলক প্রবন্ধ এবং সম্পাদকীয় লিখেছি।

    হেমাঙ্গবাবু - বাঃ বাঃ। তাহলে তুমি গ্রাম বাংলায় অনেক ভ্রমণ করেছ বলতে হবে। মানে বলতে চাইছি মাটির সাথে সরাসরি সম্পর্ক তোমার।

    পাত্র - কেন, মাটির সাথে আমার সরাসরি সম্পর্ক থাকতে যাবে কেন?

    ভুতো - আরে আমরা বলতে চাইছি যে, গ্রামে না থেকে, নিজে চাষ না করলে তুমি কি ভাবে চাষবাস সম্পর্কে জানবে?

    পাত্র - আপনারা কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। চাষ নিয়ে লেখার জন্য জমি চিনতে হবে কেন? গ্রামেই বা যেতে হবে কেন? আমাদের রাজ্যের পূর্বতন শাসকদলের মূখ্যমন্ত্রীরা কি তাঁদের সাদা পাড় নরুন ধুতিতে কাদা লাগিয়েছিলেন? কাদা না লাগিয়েও তো তাঁরা কৃষকনেতা বা সর্বহারাদের নেতা হয়েছিলেন!

    হেমাঙ্গবাবু - ভুতো, এতো মনে হচ্ছে মা-মাটি-মানুষ এর দলে গো। খালি লালদলের খুঁত ধরছে।

    ভুতো - এই, এখানে পার্টির আলোচনা হবে না – আপনি অন্য কোন উদাহরন থাকলে দিন।

    পাত্র - আর কত উদাহরণ দেব? আচ্ছা ধরুণ আমাদের নোবেলজয়ী বাঙালী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই যে বুভুক্ষু বাচ্চা, বস্তির বাচ্চাদের উন্নতি নিয়ে পরিকল্পনা দিয়ে বিশাল বই ফেঁদে বসলেন – তা তিনি নিজে কি কোনদিন বস্তিতে বাস করেছেন নাকি না খেয়ে থেকেছেন? বরং তিনি তো ছোটবেলায় শান্তিনিকেতনে মায়ের কোলে বসে আদর খেতে খেতে কবিগুরুর গান শুনতেন! তা আপনারা সেটা নিতে পারলেন – কিন্তু আমার বেলাতেই দোষ!

    ভুতো - ঠিক আছে, ঠিক আছে – উত্তেজিত হবেন না। তা হলে আপনি অন্তত চাষবাস নিয়ে পড়াশুনা করেছেন মানে ডিগ্রীলাভ করেছেন এটা ধরে নিচ্ছি।

    পাত্র - না, না আমার ব্যাকগ্রাউন্ড মোটেই চাষবাস নয়। আমি ম্যানেজমেন্ট লাইনের লোক – ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনা করেছি। তাই যে কোন বিষয়েই আমরা জ্ঞান দিয়ে থাকি – যে কোন প্রবলেমে আমাদের ডাকা হয়। তা সে মেগা থেকে ন্যানো, পুষ্টি থেকে কুষ্টি, বল থেকে ফল যাই হোক না কেন।

    ভুতো - বলেন কি! তা এবার বলুন আপনি তা হলে কতদিন হল সম্পাদক হয়েছেন?

    পাত্র - এই মাস চারেক হল।

    হেমাঙ্গবাবু - কাগজের অবস্থা কি আগের থেকে ভালো হয়েছে? মানে তুমি সম্পাদক হবার পর কি কাগজের বিক্রীবাটা বেড়েছে কমেছে?

    পাত্র - কি বলছেন? জানেন আমি যখন প্রথমে ঢুকি তখন বিক্রী ছিল ৫০০ কপি। আমি সেটাকে ২৫০০০ কপিতে নিয়ে গিয়েছি।

    ভুতো - বল কি! চারমাসে এতো উন্নতি!

    পাত্র - তা ছাড়া আমি কাগজকে সর্বশ্রেণীর পাঠ্য করে তুলেছি। প্রথমে আমাদের কাগজের গ্রাহক ছিল শুধু চাষীরা। এখন যত উকিল, ব্যারিষ্টার, ডাক্তার, মোক্তার, জজ, কলেজের প্রফেসর সব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমাদের কাগজের গ্রাহক।

    হেমাঙ্গবাবু - তাই নাকি? তোমার এত ক্ষমতা!

    পাত্র - নিজে মুখে বলতে নেই। কাগজে ঢুকে প্রথম সম্পাদকীয় আমি লেখার পর পাঠক বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০০-এ। কাগজ দু-বার করে ছাপতে হয়েছিল। দ্বিতীয় লেখার পর ১৫০০০, তারপর আস্তে আস্তে এখন ২৫০০০।
    হেমাঙ্গবাবু - তোমার সেই লেখাগুলো খুবই শুনতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু –

    পাত্র - আরে না, না কুন্ঠার কিছু নেই। আমি ডকুমেন্টেস সব সময় সঙ্গেই রাখি। আমার কাছে সব লেখার কপিই আছে।

    ভুতো - তাই নাকি? তা শোনান না সেই আপনার প্রথম লেখাটা – দেখি আপনার লেখার হাতটা কেমন।

    পাত্র - এই যে পড়ছি –
    “আমাদের দেশে ভদ্রলোকেদের মধ্যে কৃষি সমন্ধে দারুণ অজ্ঞতা দেখা যায়। এমন কি অনেকের এমন ধারণা আছে এই যে সব তক্তা আমরা দেখি, দরজা, জানালা, কড়ি বরগা, পেনসিল এই সবেতে যে সব কাঠ সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়, সে সমস্ত ধান গাছের। এটা অতীব শোচনীয়। তাঁরা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে ওগুলো ধান গাছের তো নয়ই, বরঞ্চ পাট গাছের বলা যেতে পারে। অবশ্য পাট গাছ ছাড়াও কাঠ জন্মায়। আম, জাম, কাঁঠাল, কদবেল প্রভৃতি বৃক্ষরাও তক্তাদান করে থাকে। কিন্তু নৌকার পাটাতনে যে কাঠ ব্যবহার করা হয় তা কেবল পাটের”।।।

    হেমাঙ্গবাবু - থামো, থামো। বেড়ে লিখেছেন। এত তাড়াতাড়ি পাঠক বাড়ার কারণ বোঝা যাচ্ছে। কি বলো ভুতো।

    ভুতো - সে আর বলতে! তা তোমার দ্বিতীয় লেখাটা কি ছিল?

    পাত্র - এটা আমি মুলো চাষ সম্পর্কে লিখেছি –

    “মূলো জিনিসটা পাড়ার সময় সর্তকতা অবলম্বন করা আবশ্যক। কখনই টেনে ছিঁড়ে ফেলা উচিত নয়। ওতে মূলো ক্ষতি হয়। তার চেয়ে বরং একটা ছেলেকে মুলো গাছের উপরে পাঠিয়ে দিয়ে ডালপালা নাড়াতে দিলে ভালো হয়। খুব কষে নাড়া দরকার। ঝাঁকি পেলেই টপটপ মুলো বৃষ্টি হবে, তখন সেই মুলো কুড়িয়ে ঝাঁকা ভরো”।।

    হেমাঙ্গবাবু - এর মানে কি আমি জানতে চাই!

    পাত্র - কেন? মানে তো স্পষ্ট! আপনি কি জানেন, কত হাজার হাজার, কত লাখ লাখ মুলো আধপাকা অবস্থায় টেনে ছিঁড়ে নষ্ট করা হয় আমাদের দেশে? তার চেয়ে মুলো গাছে যদি একটা ছেলেকে উঠিয়ে ।।

    ভুতো - নিকুচি করেছে গাছের। মুলো গাছেই জন্মায় না!

    পাত্র - কি! গাছে জন্মায় না? অসম্ভব – এ এখনও হতে পারে? মানুষ ছাড়া সবকিছুই গাছে জন্মায়, এমনকি বাঁদর পর্যন্ত।

    হেমাঙ্গবাবু - ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাহলে তোমার তৃতীয় লেখাটা –

    পাত্র - মুলোর বেলায় যেমন, আলুর বেলায় সেরকম করা চলবে না। গাছে ঝাঁকি দিয়ে পাড়লে আলুরা চোট খায়। সেই কারণেই আলু পচে আর তাতে পোকা ধরে। আলুকে গাছে বাড়তে দিতে হবে – যত খুশী বাড়ুক। সুযোগ পেলে এক একটা আলুকে তরমুজের মত বড় হতে দেখা গেছে। অবশ্য বিলেতেই দেখা গেছে কেবল – আমরা এ দেশে কেবল আলু খেতেই শিখেছি, আলুর যত্ন নিতে শিখিনি।

    ভুতো - বাহোবা – বলতে থাকুন

    পাত্র - তবে পেঁয়াজ আমরা আঁকশি দিয়ে পাড়তে পারি, তাতে বিশেষ কোন ক্ষতি হবে না। অনেকের ধারণা পেঁয়াজ গাছের ফল – বাস্তবিক কিন্তু তা নয়। বরং ওকে ফুল বলা যেতে পারে। ওর কোন গন্ধ নেই – যা আছে কেবল দূর্গন্ধ। ওর খোসা ছাড়ানো মানেই ওর কোরক ছাড়ানো – এনতার কোরক ওর। পেঁয়াজেরই অপর নাম শতদল।

    হেমাঙ্গবাবু - ব্যাস ব্যাস এতেই হবে –

    পাত্র - আরে আমার গবেষণার কাজ গুলোই তো এখনো বলা হল না। এছাড়া লিখেছি শামুক ওতি উৎকৃষ্ট সার, কিন্তু তাদের ধরা শক্ত। কচ্ছপেরা সঙ্গীতপ্রিয় – রাগ-রাগিণীর সামনে তারা মৌনী হয়ে থাকে – সেটা তাদের মৌন সম্মতির লক্ষণ। ঘোড়ামুগ ঘোড়ার খাদ্য, কলার বীচি থেকে কলাই হয়
    ভুতো - হাতে কলমে যে আপনার কৃষিকাজের কোন অভিজ্ঞতা নেই সেটা ভালোই মালুম হচ্ছে!

    হেমাঙ্গবাবু - আচ্ছা, তোমার কাগজের গ্রাহক চাষীরা কি বললে?

    পাত্র - কি বলবে? সব চিঠি লিখে কাগজ ছেড়ে দিয়েছে। তবে আমি তাতে পড়োয়া করি না। আর একবার এক ভদ্রলোক উস্কোখুস্ক চুল, পাগলের মত আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলে লেখাগুলো আমার কিনা। হ্যাঁ শোনার পর অজ্ঞান হয়ে গেল। ফিটের ব্যামো ছিল মনে হয়!

    ভুতো - আর বেশীক্ষণ থাকলে আমাদেরও মনে হয় ফিট হয়ে যাবে। আচ্ছা আপনি এখন আসুন। আরও অনেক প্রার্থী আছে। পরে খবর দিয়ে জানাবো।


    পঞ্চম দৃশ্য
    --------
    (‘ভেগোলজি” আইডিয়া ও কিছু ডায়লগ ধার করা – লেখকের ও রচনার নাম ভুলে গেছি)

    পাত্র সমাজ বিজ্ঞানী

    ভুতো - আসুন, আসুন। নমস্কার। ঠিক সময়ে এসে পড়েছেন

    পাত্র - নমস্কার, নমস্কার। আমি ওই বিয়ের ইন্টারভিউটার জন্য এসেছিলাম

    ভুতো - আরে সেটা তো বুঝতেই পারছি। ইনি মেয়ের বাবা আর আমি বিয়ের ব্যপারে উনাকে একটু হেল্প করছি বলতে পারেন। তা আপনার নামটা –

    পাত্র - আমার নাম শুভাশিস বোস।

    (ভুতো অ্যাপ্লিকেশনটা খুঁজে বের করে নামটা শুনে)

    ভুতো - তা আপনি লিখেছেন যে আপনি রিসার্চ করেন। তা বিষয়টা কি?

    পাত্র - ভেগোলজি।

    হেমাঙ্গবাবু - সেটা আবার কি জিনিস? জুলজি, বায়োলজি এসব তো শুনেছি। কিন্তু এটা আবার কি জিনিস!

    পাত্র - এটা সম্পূর্ণ একটা নতুন বিদ্যা। বাংলা ভাষায় একে অনুবাদ করা শক্ত। তবে সন্ধ্যাবিদ্যা কথাটি হয়তো মন্দ হয় না। কারণ বস্তুত এই বিদ্যা আলো-আঁধারি বিদ্যা। ভেগোলজি কথাটি ‘ভেগাস’ এবং ‘লোগোস’ এই দুই প্রাচীন শব্দের সমন্বয়ে উৎপন্ন।

    ভুতো - তা এর অ্যাপ্লিকেশন কি? এটা কি প্রসারিত হয়েছে?

    পাত্র - কিছু কাল পূর্বেও এর তেমন প্রচলন ছিল না। এখন এর আদর হয়েছে এবং সুখের বিষয় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বহু ব্যক্তি এই বিদ্যায় ক্রমশ আকৃষ্ট হচ্ছে। আপনি আমাকে যে কোন প্রশ্ন করতে পারেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজ, শিল্প – সব। আমি ভেগোলজির সাহায্য নিয়ে তার উত্তর দেব।

    ভুতো - যে কোন প্রশ্ন?

    পাত্র - অবশ্যই

    (ভুতো চাপা স্বরে হেমাঙ্গবাবুকে বলল)

    ভুতো - একটা শক্ত দেখে প্রশ্ন করুন তো। যেন আমাদের মান থাকে।

    হেমাঙ্গবাবু - আচ্ছা বলো তো বাবা, গ্রীক ভাষ্কর্য ও ভারতীয় ভাষ্কর্য – এ দুইয়ের মধ্যে তফাত কোথায়?

    পাত্র কিছুক্ষণ নীরব রইল।

    পাত্র - আচ্ছা ধরা যাক, এই হল গ্রীক স্কাল্পচার (এই বলে সে সামনের টেবিলে চক দিয়ে একটা লম্বা দাগ কাটল)। আর ধরা যাক এই হল ইন্ডিয়ান স্কাল্পচার (এবার আরেকটি রেখা টানল গ্রীক রেখাটির একটু নীচে। পরপর দুটি রেখা টেনে এবার ভুতো/হেমঙ্গবাবুর দিকে তাকাল)

    ভুতো - (আস্তে আস্তে হেমঙ্গবাবুকে) মনে হচ্ছে জ্যামিতিক নিয়মে প্রশ্নটি সমাধান করবে।

    পাত্র হঠাৎ টেবিলে চাপড়ে মেরে বলল

    পাত্র - আচ্ছা এই যে গ্রীক স্কাল্পচার (গ্রীকে রেখাটির দিকে আঙুল দেখিয়ে), আর এই যে ভারতীয় স্কাল্পচার (ভারতীয় রেখাটির দিকে আঙুল) – এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ কোথায়? এই আপনাদের প্রশ্ন তো?

    হেমাঙ্গবাবু - হ্যাঁ বাবা, সেটাই প্রশ্ন। তফাৎটা কোথায়?

    পাত্র একবার চোখ বুজে উপর দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে বলল

    পাত্র - বেশ, এখন কথা হচ্ছে কি জানেন? গ্রীক স্কাল্পচারে অর্থাৎ এইটাতে (উপরের লাইন দেখিয়ে) এমন একটি বস্তু আছে যা ইন্ডিয়ান স্কাল্পচারে অর্থাৎ এইটিতে (নীচের লাইনটী দেখিয়ে) নেই। বুঝলেন কিনা। আবার ইন্ডিয়ান স্কাল্পচারে অর্থাৎ এইটিতে (নীচের লাইনটী দেখিয়ে) এমন একটি জিনিস আছে যা গ্রীক স্কাল্পচারে অর্থাৎ এইটাতে (উপরের লাইন দেখিয়ে) নেই।

    হেমাঙ্গবাবু - (অবাক হয়ে) অপূর্ব, অপূর্ব।

    পাত্র - তবে কি জানেন, ভেগোলজী হল সঙ্কেতময়ী বিদ্যা। বিদ্যা কতখানি সহজ সরল হতে পারে তার উদাহরণ ভেগোলজি। এটাকে বুঝতে হলে আস্তিন গুটিয়ে কুস্তি করলে চলবে না। এর সাধনা পালোয়ানির উর্ধে।

    ভুতো - আচ্ছা, ভেগোলজি দিয়ে খেলাধূলা বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন?

    পাত্র - আরে আগেই তো বললাম, ডাং-গুলি থেকে গাঙ্গুলি সব বিষয়ই ব্যখ্যার ক্ষমতা রাখে এই ভেগোলজি।

    হেমাঙ্গবাবু - তাহলে একটা প্রশ্ন করব আমরা?

    পাত্র - হ্যাঁ একটা কেন! যত খুশী করুন না!

    হেমাঙ্গবাবু - না আপাতত এই বিষয়ে একটাই ঠিক আছে। ভুতো, একটা প্রশ্ন কর তা হলে – এবার তোমার পালা।

    ভুতো - আচ্ছা এই যে আমাদের ভারতীয় ক্রিকেট টিমে বীরেন্দ্র সেহবাগ আজকাল রান পাচ্ছে না, মানে ব্যর্থ হচ্ছে বলতে গেলে – তা সেই বিষয়ে ভেগোলজি কি বলে?

    পাত্র - ব্যর্থতা বলতে আপনি কি বলতে চাইছেন? আপনার কাছে যা সফল, তা অন্যের কাছে ব্যর্থ – আপনার কাছে যা ব্যর্থতা, তা হয়ত সেহবাগের কাছে সফলতা, তাই না? নিজের কাছে ঠিক থাকাটাই তো বড় কথা – সেটা তো স্বীকার করেন, নাকি?

    হেমাঙ্গবাবু - সে না হয় ঠিক আছে – কিন্তু সে যে রান পাচ্ছে না, অ্যাভারেজ খুব খারাপ - সেটার কি হবে?

    পাত্র - সেই ব্যাপারটাও দুইভাবে সলভ করা যায় – স্ট্যাটিসস্টিক্যালি আর সামগ্রিক অ্যপ্রোচ

    হেমাঙ্গবাবু - স্ট্যাটিসস্টিক্যালি কি ভাবে হবে?

    পাত্র - যে ইনিংসগুলোতে সেহবাগ আউট হয়ে যাচ্ছে, সেই গুলো হিসাবের মধ্যে ধরলে হবে না। তাহলেই তার রানের গড় বেড়ে যাবে, আর তাকে আপনারা ব্যর্থ বলতে পারবেন না। খুবই সিম্পল সমাধান –

    ভুতো - বাহবা – আর সামগ্রিক অ্যপ্রোচ টা কি হবে?

    পাত্র - সেই ক্ষেত্রে আপনাকে সমস্যার গোড়ায় যেতে হবে। রান পাচ্ছে না, কারণ সে আউট হয়ে যাচ্ছে। তা সেই আউট হওয়াটা বন্ধ করতে হবে।

    হেমাঙ্গবাবু - সে তো বটেই। তা সেই বন্ধটা হবে কি করে সেই বিষয়ে কিছু বল!

    পাত্র - দেখুন, আমরা তো আর চামচে করে গুলে খাইয়ে দিতে পারি না! সেটা তাকে নিজেকেই বের করতে হবে।

    হেমাঙ্গবাবু - আচ্ছা তাহলে টেকনিক নিয়ে তোমার কিছু বলার নেই!

    পাত্র - হ্যাঁ বলার তো আছেই! যে টেকনিকে রান আসবে সেই টেকনিকে ফিরে যেতে হবে।

    ভুতো - (অধৈর্য হয়ে) কিন্তু টেকনিকটা কি?

    পাত্র - বোকার মত প্রশ্ন করবেন না। আগেই তো বললাম - সেই টেকনিকে ফিরে যেতে হবে যাতে সে আউট হবে না। আর আউট না হলেই রান হবে। এই সহজ ব্যাপারটা যে কেন আপনারা বুঝতে পারছেন না কে জানে! আসলে আমারই ভুল – আগেই বলেছিলাম না, ভেগোলজী হল সঙ্কেতময়ী বিদ্যা। এ বিদ্যা বুঝতে হলে এলেম লাগে।

    ভুতো - (প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে) আচ্ছা এই যে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে, টিভি তে বিজ্ঞাপন দেয় চুলকানির মহৌষধ বিষয়ে, সেটা নিয়ে কিছু বলুন

    (হেমাঙ্গবাবু আহা – আহা করে থামাতে যান, কিন্তু পাত্র তার আগেই বলে ওঠে)

    পাত্র - (খুব উৎসাহিত হয়ে) এই তো আপনি আসল প্রশ্নে আসছেন – ওই সব খেলাধূলা নিয়ে ফালতু সময় নষ্ট না করে এই চুলকানির মত জাতীয় সমস্যা নিয়ে ভাবলে তো আমাদের আখেরে লাভ হবে

    হেমাঙ্গবাবু - কিন্তু –

    (পাত্র আবার তাঁকে থামিয়ে দিয়ে)

    পাত্র - দাদ-হাজা-চুলকানি এইগুলি ত্রিমাত্রিক একটা ব্যাপার। আপনি হাজা-চুলকানি-দাদ বলে দেখুন, ঠিক শোনাবে না – আবার দাদ-চুলকানি বলুন, সেটাও এক মাত্রা কম হয়ে যাবে। এই সব মিথোজীবিতা নিয়েই আমাদের লাইফ। এর মধ্যে চুলকানি আর হাজা কিন্তু আবার একটু আলাদা – চুলকানি যদি বিশেষ্য হয়, তাহলে চুলকোনো কিন্তু আবার ক্রীড়াপদ। হাজা থেকেও এইভাবে হেজিয়ে যাওয়া এসেছে। দাদ নিয়ে কিন্তু এমন কোন ক্রীড়াপদ নেই

    ভুতো - কেন দাদরা! ওই যে আছে না – “কাহারবা না দাদরা বাজাও”।।।

    হেমাঙ্গবাবু - এই থামো থামো – এই আলোচনা এখানেই শেষ। ভুতো, কি বুঝলে?

    ভুতো - বুঝলাম যে ভেগোলজির ভাষা খুবই সঙ্কেতময়ী – বুঝতে গেলে বহুকালেই কৃচ্ছসাধনের প্রয়োজন।

    হেমাঙ্গবাবু - আচ্ছা এই যে তোমাদের ভেগোলজি – এটা কি সমাজের কোন কাজে লাগবে? জানোই তো পশ্চিম বাংলার এই অবস্থা, ইন্ডাষ্ট্রী নেই, চাকুরী নেই। যেই এখানে শিল্প করতে আসেছে, প্রথম মিটিং য়ের পরেই ফিরে যাচ্ছে – আর এমুখো হচ্ছে না। এই বিষয়ে তোমরা কি বল?

    পাত্র - মানে ব্যাপারটা হল আপনারা এদিক থেকে এই করতে থাকুন। আর আমরা ওদিক থেকে ওই করতে থাকি। আপনারা যদি এটুকু করেন, তাহলে আপনাদের কাছ থেকে আমাদের এ-তে একটা সত্যিকারের সাহায্য হবে। মানে পশ্চিম বাংলার যে অবস্থা, বুঝতে পেরেছেন, এখন যদি আমরা এটা না করি তাহলে – মানে, এদের ব্যাপারটা তো বুঝতে পারছেন। এরা দেবে না। কিন্তু দেবে না বললেই তো আর আমরা এ করতে পারি না। আমাদের কেড়ে নিতে হবে। আর তাহলেই বুঝতে পেরেছেন, ওটা বিশেষ করে দরকার। তাই বলছিলাম, আপনার এদিক থেকে করতে থাকুন, আর আমরা ওদিক থেকে – মশাই ছেপে বের করব। হাজার, দুহাজার, দশ হাজার, দশ লাখ – যত লাগে। বুঝলেন?

    ভুতো - খুব বুঝেছি। এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছি আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এই ভেগোলজির-ই ছাত্র ছিলেন এককালে। মানে উনি ভেগোলজি দিয়েই রাজ্য চালাচ্ছেন বলতে পারেন –

    পাত্র - তার মানে কি? উদাহরণ ছাড়া বড় কোন ক্লেম বা বক্তব্য রাখবেন না।

    ভুতো - আর কত উদাহরণ দেব ভাই! রোজ সকালে পেপারটা খুললেই নিজেই দেখে নেবেন। এই ধরুণ, আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হল, আচ্ছা দিদি আমরা গুজরাতের মত হতে পারছি না কেন? ওরা এত উন্নতি করছে, আর আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। দিদি বললেন – “কে বলল গুজরাত এগিয়ে গেছে? ওদের রবীন্দ্রনাথ আছে? বিবেকানন্দ আছে? গুজবে কান দেবেন না। আর তা ছাড়া ওরা আগুনের পরশমণি গানটা জানে? গান না জানলে তো কিছু হবে না – এই আসুন তো সবাই মিলে একবার গানটা ঝালিয়ে নিই – আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে”।

    হেমাঙ্গবাবু - বেড়ে বলেছ ভুতো। তারপর ধর পার্কস্ট্রীটে মহিলাদের শ্লীলতাহানী হল – কিন্তু ভেগোলজি বলছে, পার্কস্টীটে তো আলো আছে, লাইট পোষ্ট আছে। তাই ওখানে শ্লীলতাহানী হতে পারে না – সব বিরোধীদের চক্রান্ত।

    পাত্র - তবে উনার কথার সত্যতাও কিছু আছে। কে বলল গুজরাত আমাদের ছাপিয়ে গেছে? গত বছর আমরা পশ্চিম বাংলা থেকে ৩৬০০ মেট্রিক টন রসগোল্লা রপ্তানী করেছি। গুজরাত এক পিসও রসগোল্লা রপ্তানী করতে পারে নি - তাহলে?

    ভুতো - আপনি সত্যই সমাজ বিজ্ঞানী। আচ্ছা অনেক কথা হল – আর সময় নেই হাতে। তা হলে আপনি এখন আসুন।

    পাত্র - তাহলে মেয়ে দেখার ব্যাপারটা

    ভুতো - শর্ট লিষ্টেড হলে ঠিক সময়ে লেটার পেয়ে যাবেন।


    পঞ্চম দৃশ্য
    -------
    পাত্র যাত্রাভিনেতা

    ভুতো - আরে আসুন, আসুন। তা আপনার নামটা কি? (আবেদন পত্র খুঁজতে খুঁজতে)

    পাত্র -আসল না নাকি ছদ্মনাম কোনটা বলব?

    ভুতো - আপনি কি পাড়ার মস্তান নাকি যে দুটো নাম থাকবে?

    পাত্র -মস্তান ছাড়া কি কারো দুটো নাম থাকতে পারে না?

    ভুতো - তা পারে বৈকি – আলবাত পারে। আসলে কি জানেন, ও পাড়ার গাঙ্গুলিবাবু শখ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন কৌস্তুভ। তা সে ছেলে এখন পদা-দা ছদ্মনামে পাড়া কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই বলছিলাম আর কি।

    পাত্র -শুনুন ওই সব বাজে কথা বলবেন না। আমি অভিনেতা।

    হেমাঙ্গবাবু - বল কি বাবা! তাতেই ছদ্মনাম। তা নামটা কি বাবাজীর।

    পাত্র -ছদ্মনাম হল প্রদীপকুমার। আর আসল নাম হারাধন পাকড়ে।

    ভুতো - ছ্যাঃ ছ্যাঃ। আসল নাম শুনে আজকালকার মেয়েরা আর তোমার গলায় মালা দেবার কথা ভাববে না। ঐ নকল নামই থাকুক। (আবেদন পত্র খুঁজে পেয়ে)। তা আপনি লিখেছেন চিৎপুরে যাত্রাদলে অভিনয় করেন।

    পাত্র -আজ্ঞে, আমি মুক্তমঞ্জরী অপেরায় আছি।

    হেমাঙ্গবাবু - তা তুমি কি নায়ক, ভিলেন, নাকি বিবেক, নাকি এক্সর্টা?

    পাত্র - এ আপনি কি বলছেন! আমি মুক্তমঞ্জরী অপেরার নায়ক।

    ভুতো - তা আপনি কতদিন ধরে যাত্রা লাইনে আছেন?

    পাত্র - লাইন মানে আমি কি মিন করতে চাইছেন? সম্মান দিতে শিখুন অভিনেতাদের। জানেন তাপস পাল যাত্রা করেছেন, চিরঞ্জিত যাত্রা করেছে, তারপর ধরুন –

    হেমাঙ্গবাবু - ঠিক আছে , ঠিক আছে। তা তুমি কতদিন যাত্রা জগতে আছ?

    পাত্র - সেই চোদ্দ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। আর এখন আটাশ। প্রথম প্রথম যাত্রা দলে রান্না করতাম। তার পর দেখে দেখে ক্রমশঃ অভিনয় শিখি। এখন নায়ক হয়েছি।

    ভুতো - যদি কিছু মনে না করেন – পড়াশুনা কখন করতেন? যাত্রাদলে তো শুনেছি শুধু ঘুরতে হয়।

    পাত্র -আপনাদের তো আর মিথ্যা বলতে পারি না – হোনেবালা আত্মীয় বলে কথা! পাঠশালের দিকেও পা মাড়াই নি কোনদিন। নাম সইটা করতে পারি কোনক্রমে। ছোটবেলাটা তো বাবার চায়ের দোকানেই কেটেছে।

    ভুতো - (হেমাঙ্গবাবুর দিকে তাকিয়ে)। আপনাকে বলেছিলাম না যে পড়াশুনা না করেও বড় হওয়া যায়, আর তা আপনি মানতেই চাইতেন না! এই বার দেখুন।

    হেমাঙ্গবাবু - কিন্তু আমার মেয়ে তো বি এ পাশ। তা সে কি আর তোমাকে বিয়ে করতে রাজী হবে?

    পাত্র -কেন, আপনি কি ডিগ্রীর সাথে বিয়ে দেবেন নাকি খ্যাতি, অর্থ ইত্যাদির সাথে?

    হেমাঙ্গবাবু - অর্থের প্রশ্ন উঠছে না, সে আমার যথেষ্ট আছে। আমার একমাত্র মেয়ে হিসাবে তা সবই ওর থাকবে। মেয়ের অন্ততঃ কোন অভাব হবার কথা নয়।

    পাত্র -আমার কত খ্যাতি – কত নামডাক। গ্রাম গঞ্জের সব লোক – বর্ধমান থেকে বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ থেকে মেদনীপুর সব লোকেরাই আমায় একডাকে চেনে।

    ভুতো –তা এবারে আপনাদের যাত্রাপালার নাম কি?

    পাত্র -এবারে আমরা একটা সুপারহিট রোমান্সে ভরা যাত্রাপালা উপহার দিতে চলেছি, ‘প্রেম কাঁদছে কচুবনে’।

    হেমাঙ্গবাবু - এ্যাঁ, কচু বনে? এত বন থাকতে কচুবনে? এটা কি রকম হল? ওটা ঝাউবন হলে কি ক্ষতি হত?

    পাত্র - আপনারা দেখছি পাবলিকদের মনস্তত্ত্ব কিছুই বোঝ না। নাম এমন হতে হবে যেন বুকে ধাক্কা লাগে। তবে তো লোকে মনে রাখবে! আর তা ছাড়া এ তো আর সিনেমা নয় যে সুইজারল্যাণ্ডে ঝাউবনের ধারে প্রেম হবে! গ্রাম গঞ্জে কচুবন একটা বিশাল ব্যাপার। প্রেম, বিরহ, মিলন সব ওইখানেই হয় –

    ভুতো - কিসের মিলন? মনের? অবশ্য দেহের হলেই বা দেখেছে কে? ওই জন্যই তো মশাই শহরে আজকাল তেমন প্রেমের তেমন রমরমা নেই – ঝোপঝাড় ছাড়া প্রেম হয়?

    হেমাঙ্গবাবু - তবে বাবা, যাত্রার নাম আমার মরার আগে অবধি মনে থাকবে। ধন্যি নাম। এখন অবশ্য এইরকমই হয়েছে। আগে ছিল ঐতিহাসিক পালা। চন্দ্রগুপ্ত, বাদশা আলমগীর, শাহাজান। কি চেহারা, দর্শক চোখের পাতা ফেলতে ভুলে যেত।

    পাত্র - এখন আর ও সব চলে না। পাবলিক নিচ্ছে না।

    ভুতো -নিচ্ছে না কেন?

    পাত্র - কেন আবার! – এই টিনের তলোয়ার নিয়ে লাফালাফি – ঢ্যাঁ ঢ্যাঁ করে স্টেজের উপর – তার পর ওই জবরজঙ পোষাক, মুখে পাওডারের জ্যাবরা – লোকে হাসছে।

    হেমাঙ্গবাবু - তা হলে তোমরা এখন কেমন যাত্রা করছ?

    পাত্র - এই সব ঘটনা জীবন থেকে তুলে আনছি। বেশীর ভাগই সাংসারিক, খাণ্ডারিনি শাশুড়ি, ভিলেন ভাসুর, ন্যালাখাপা স্বামী। তার মধ্যে থেকে মেয়ের জীবন সংগ্রাম শুরু। গ্রামের বড়লোক ছেলের লোভনীয় প্রস্তাব বানচান করে সতীত্ব বাঁচিয়ে রাখা। একটু ক্রাইম, একটু সাসপেন্স – ব্যস পালা হিট্‌।

    ভুতো - ইয়ে বলছিলাম আপনাদের পালায় আইটেম সং নেই?

    হেমাঙ্গবাবু - সেটা আবার কি জিনিস ভুতো?

    ভুতো - এ্যাই, একটু বুঝিয়ে দিন না একে –

    পাত্র - আইটেম নাম্বার মানে হচ্ছে ফুল মস্তি। বিষয়বস্তুর সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। একটু নেচে দেখালে কি সুবিধা হবে আপনার বুঝতে?

    হেমঙ্গবাবু - বল কি বাবা – বিয়ের সমন্ধ করতে এসে নাচা-নাচি করবে?

    পাত্র - ভুল করছেন, ব্যাপারটা নাচানাচির নয়। আসল ব্যপারটা হল পারফরমিং আর্ট!

    ভুতো -বাহবা, বেড়ে বলেছ। নাচো নাচো – একটু নেচে দেখাও। বহু বিয়ের সমন্ধ করেছি লাইফে, কিন্তু পাত্র কোনদিন নেচে দেখায় নি তার ভাবি শ্বশুরকে।

    পাত্র - আসলে আমরা আইটেম গানগুলো আর নিজেরা লিখি না। হিন্দী সিনেমা থেকেই নিয়ে চালিয়ে দিই। এইটা শুনুন। (মোবাইলে দাবাং-২ থেকে ‘ফেভিকল সে’ গানটা চালু করে, তারপর মোবাইলটা টেবিলে স্পীকার মোডে দিয়ে নাচ আরম্ভ করে)।

    হেমাঙ্গবাবু - (খানিকক্ষণ প্রচণ্ড অবাক হয়ে নাচ দেখে)। এতেই হবে, ব্যাস ব্যাস। আপনাদের যাত্রায় বিবেক নেই? মানে ওই যে একটা লোক বিভিন্ন দৃশ্যে গান গেয়ে বেড়ায় আর কি!

    পাত্র - না, না। ওসব দিকে ফালতু লোক পোষা। এখন আমরাই গায়ক – আমরাই নায়ক। দরকার হলে নায়িকার হাত ধরে আমরাই দুচারটে গান করে দিই।

    ভুতো - তা যদি আপনাদের যাত্রাপালার কোন একটা ডায়লগ আমাদের শোনান। মানে আপনার মত ব্যক্তিকে কাছে পেয়ে লোভ সামলাতে পারছি না আর কি।

    পাত্র - ডায়লগ তো আমি ভালোই জানি স্যার, মানে ওরিজিন্যাল ঘটি কিনা। ওতেই আমাদের ভবিতব্য, ওতেই আমাদের মোক্ষ। তা গতবারের পালার একটা ডায়লগ দিই?

    হেমাঙ্গবাবু - দাও দাও, তার সঙ্গে পালার নামটাও একটু বলবে।

    পাত্র - (যাত্রার ঢঙে)আদালতে বৌমা হাজির, পড়ল জোঁকের মুখে নুন
    স্বামী গেল জেল খাটতে, দেখুন ‘শ্বশুরের মুখ চুন’।।

    ভুতো - মানে! যাত্রার নাম কোনটা? ‘আদালতে বৌমা হাজির’ নাকি ‘জোঁকের মুখে নুন’?

    পাত্র - কি শুনলেন তা হলে? বললাম না দেখুন ‘শ্বশুরের মুখ চুন’?

    হেমাঙ্গবাবু - যাত্রার নাম ‘শ্বশুরের মুখ চুন’? বল কি! বেশ জমকালো নাম তো!

    ভুতো - তা এই যাত্রাটা কে লিখেছেন?

    পাত্র - বিশেষ কেউ নয়। আমরা সবাই মিলে লিখেছি আর কি!

    হেমাঙ্গবাবু – সেকি, সবাই মিলে যাত্রা লিখেছ?

    পাত্র - কি করব বলুন – সেই ভৈরববাবুর পর তো আর কেউ যাত্রা লেখাটাই শিখল না! তাই সবাই মিলে একটা চেষ্টা দিচ্ছি।

    ভুতো - বেশ বেশ। তা শোনান তা হলে ডায়লগটা।

    পাত্র - এটা দিলে ক্ল্যাপ থামত না যাত্রাতলায়। বলছি তা হলে (উঠে দাঁড়িয়ে ঠিক মত পোজ নিয়ে)। এটা আমাদের আগের পালায় খুব ইমপরটেন্ট একটা সিন ছিল। নায়ক নায়িকাকে বোঝাচ্ছে। নায়িকা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করতে রাজি নয়, আর নায়কের আরো কিছুদিন সময় দরকার।

    “কঙ্কা, তুমি শঙ্কা করো না। বিয়ে আমাদের হবেই। তোমার – আমার বন্ধন কত জন্মের। আমি রোমিও, তুমি জুলিয়েট, আমি মজনু – তুমি লায়লা, তুমি গ্যাস – আমি কয়লা। তুমি ছাড়া আমি নেই – আমি ছাড়া তুমি। আমি ছোবড়া – তুমি নারকেল, তুমি যদি হও ইঁট, আমি পাটকেল। আমি চাবি – তুমি তালা, এই বাঁধন যাবে নাকো খোলা। আগত পৃথিবীকে বুঝিয়ে দেব তোমার আমার প্রেমের জোর। তোমার ব্যারিকেড বাবা, ভিলেন ভাই, জাঁদেরল মাকে আমি ভালোবেসে জয় করব। পাড়ার মস্তান সেজে নয়, আমি তোমায় বিয়ে করতে আসব টোপর মাথায় পড়েই। তোমার ওই নাবি আলু জমিতে জল আমি পাওয়াবই। এবার একটু হাস – তোমার ওই কাজল চোখে মুছে ফেল মুক্তবিন্দু। আমার এই খাদিমের জুতো পায়ে আমি শপথ করছি, তোমার মুখে হাসি ফোটাতে আমি প্রাণও দিয়ে দেব”।

    ভুতো - একি শোনালেন – লা জবাব – মারহাব্বা -

    পাত্র - সবই সাধনার ফল বুঝলেন। তাও তো ঠিক ফিলিংস্টা আনতে পারলাম না – স্টেজ না হলে, আর পেটে না কিছু পড়লে ঠিক জমে না বুঝলেন!

    হেমাঙ্গবাবু - তবে বাবা, একটাই খটকা – খাদিমের জুতোর সাথে শপথের কি সম্পর্ক সেটাই ঠিক বুঝতে পারলাম না।

    পাত্র - আরে আপনারা দেখছি বেশ ব্যাকডেটেড। এখনকার হিন্দি সিনেমা দ্যাখেননি – নায়ক নায়িকারা কেমন কোক , পেপসি নিয়ে ঘুরছে । ওদের যেমন কোকা কোলা ,আমাদের তেমনি খাদিম – অফিসিয়াল স্পন্সর । প্রতি পালায় অন্তত দশবার করে খাদিম হাওয়াই এর নাম করার জন্যে মোটা টাকার চুক্তি হয়েছে ।

    ভুতো - এই জানেন তো আমারও না একসময় দারুণ যাত্রার নেশা ছিল। আপনাকে যখন কাছেই পেয়েছি তখন ভাবছি একবার আমার ফেলে আসা পোটেনশিয়ালটা যাচাই করে নিই।

    হেমাঙ্গবাবু - এ্যাই দ্যাখো – এ আবার কি শুরু করলে তুমি ভুতো।

    পাত্র - আহা, উনি বলুন না। একটা ডায়লগ শোনান তা হলে।

    ভুতো - শোনাচ্ছি তা হলে

    “এ তুমি কি বলছ শচীন দা , আমার ছেলে পাড়ার মেয়েদের পেছনে লাগছে? তাতে ক্ষতি কি হল , ও যদি ফাঁকা মাঠে গোল দেয় তাতে তোমার আপত্তিটা কোথায় ? ও , তোমার মেয়েও আছে এর মধ্যে ? থাকলে থাকবে – আমার ষাঁড় মাঠে খোলা ঘুরবে – তোমার গরু তুমি সামলাও । কটা মেয়ে তোমার ? একি আঙুল গুনছো কি ? নিজের কটা মেয়ে তাই তোমার খেয়াল নেই? – এসেছ আমার ছেলের নামে নালিশ করতে” -

    পাত্র - এটা কি হচ্ছে ? মানে এটা যাত্রা নাকি পাড়ার কোন্দল ?

    ভুতো - যাঃ বাবা । আপনিই তো বললেন যে সব ঘটনা জীবন থেকে তুলে আনতে হবে-

    হেমাঙ্গবাবু - ঠিক আছে, ঠিক আছে । ভুতো এতেই হবে । তোমার পোটেনশিয়াল যে আলাদা লেভেলের তা ও বুঝে গেছে।

    ভুতো - (লাজুক হেসে) হেঁ হেঁ। আমাকে আর কি দেখলেন। দেখতেন যদি আমাদের দেশের বাড়ির গঙ্গা পাঁজাকে। যা যাত্রা করে না ! লোকে পেচ্ছাপ বসতে যেতে ভুলে যায় । গ্রামের ব্যাপার বুঝতেই পারছেন সারারাত যাত্রা চলল । তো সেই সারারাত লোককে পেচ্ছাপ ভুলিয়ে বসিয়ে রাখা চাড্ডিখানি কথা নয় –

    পাত্র - তিনি কি দারুণ অভিনেতা?

    ভুতো - সে আর বলতে! কি দাপট। সকালে দেখবেন মাঠে খালি গায়ে গরু চরাচ্ছে, রাতে ডায়াসে উঠলেই অন্য লোক। একবার এক ঐতিহাসিক পালায় যুদ্ধের সিনে খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে প্রবেশ ছিল গঙ্গাদার। তা ছুটে ঢোকবার সময় গরু বাঁধার গোঁজটাতে হোঁচট খেয়ে স্টেজে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অন্য কেউ হলে সিন মাটি। কিন্তু গঙ্গাদা ২৫ বছর যাত্রা করছে। গা ঝেড়ে উঠে গমগমে গলায় বলে উঠল, “কেবা হেথা গাড়িয়াছে গোঁজ, তারে আমি দিব শাস্তি সমুচিত”। লোকে কিছুই বুঝতে পারল না!

    হেমাঙ্গবাবু - তা সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি সংসার করবে কি ভাবে? যাত্রা তো আজ এখানে কাল সেখানে –

    ভুতো - আপনি যাত্রা করতে যান কি ভাবে?

    পাত্র - কেন! আমার আর নায়িকা কাজলকুমারীর জন্য একটা গাড়ী বরাদ্দ আছে। আমরা ওতে করেই যাই। মাঝে মাঝে রাস্তায় কোন হোটেলে থাকি।

    হেমাঙ্গবাবু - বল কি! নায়িকার সাথে এক হোটেলে

    পাত্র - তাতে কি? এক ঘরে তো আর থাকি না!

    ভুতো - আর থাকলেই বা দেখছে কে? এ বিয়ে দিলে তো কদিন পরেই মেয়ের ডেডবডি আনতে হবে

    পাত্র - আপনি আমায় অপমান করছেন – আমার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তাতে কালিমা ছেটাচ্ছেন।

    হেমাঙ্গবাবু - থাক থাক, বাবা – এখন এস। পরে খবর দিয়ে জানাব।


    শেষ দৃশ্য
    -----
    পাত্র দেখার মাঝখানে আরাধনার মা দুরদার করে ঘরে ঢুকে পড়ল। চোখ মুখ ছলো ছলো।

    মা - এই দ্যাখো, তোমার মেয়ে কি চিঠি লিখেছে
    চিঠিটা হেমেঙ্গবাবুকে দিল। হেমাঙ্গবাবু পড়তে শুরু করলেন (ব্যাকগ্রাউণ্ড থেকে আরাধনার গলায়)

    “বাবা, আমি চললাম। তোমার পছন্দের উপরে আর ভরসা রাখতে পারলাম না। একবার দেখতে বসেই যা কাণ্ড হয়েছিল, তাতে করে আমি আর দ্বিতীয়বার বসার সাহস করতে পারলাম না। তুমি জেনে হয়ত দুঃখিত হবে যে আমি পাড়ার ঠোঙা-দার সাথে চললাম। কিন্তু কি করব। প্রেমের পথে অর্থনীতি কোনদিন বাধা হতে পারে নি। তুমি এবং মা হয়ত এত ভালো ভালো পাত্র ছেড়ে ঠোঙাদাকে বিয়ে করার জন্য আমাকে বোকা ভাবছ। আসলে প্রজাপতি তো আর সব দেখেশুনে জীবনে আসে না। তবে তোমার সম্মান রাখতে আমি ঠোঙা-দাকে মানুষ করে তুলবই। ইতিমধ্যে আমরা একটা দোকান খুলেছি। আমাদের বিয়ের পরের দিন তার উদ্বোধন হবে। সঙ্গে কার্ড পাঠালাম। অনুষ্ঠানে তোমরা না এলেও তোমাদের আশীর্বাদ যেন আমাদের সঙ্গে থাকে”। - ইতি আরাধনা

    চিঠিটা পড়ে হেমাঙ্গবাবু ভুতোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন

    হেমাঙ্গবাবু - দেখোতো কার্ডে কি লিখেছে। আর দোকানটাই বা দিল কিসের?

    ভুতো - দোকানের নাম হল গিয়ে “বলহরি ফার্ণিচার ও হবিষ্যি ক্যাটারার”। তলায় লিখেছেঃ

    “জীবনের শেষ খাটটি আমরা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সরাবরাহ করে থাকি। পরীক্ষা প্রার্থনীয়। কাষ্ঠের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা আমাদের বৈশিষ্ট। অর্ডারি দিলে খাঁটি চন্দন কাঠের পালঙ্কও প্রস্তুত করা হয়। আমরা আপনার শেষ যাত্রার পথের সাথী। তাছাড়া, এখানে সকল প্রকার অশৌচ পালন এবং পিতৃশ্রাদ্ধ, মাতৃশ্রাদ্ধ, আদ্যশ্রাদ্ধ ও বাৎসরিক শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে হবিষ্যান্নের ও পিণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়। প্রয়োজনে নিয়মভঙ্গের খাদ্যও আমরা সরাবরাহ করে থাকি। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে আমাদের সাহায্য গ্রহণ করুণ। আপনার আত্মীয় বিয়োগ শোক আমরা ভুলিয়ে দেব।
    প্রোপাইটর – আরাধনা ও বিকাশ চক্রবর্তী”।

    (যবনিকা)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২২ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৯১৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন