এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • রাগ দরবারীঃ ১৬শ পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২০ জুন ২০২১ | ১৭৪০ বার পঠিত
  • এখন পর্য্যন্ত যা নমুনা দেখা গেছে তাতে মনে হচ্ছে ছোটে পালোয়ানের বংশটি বেশ খানদানি। ওর প্রপিতামহের নাম পর্য্যন্ত মনে আছে! আর সমস্ত খানদানি বংশের ছেলেদের মত ও নিজের পরিবারের গৌরবগাথা শোনাতে ভালবাসে। কখনও কখনও কুস্তির আখড়ায় সাথিদের কিসসা শোনাতে থাকেঃ

    ‘আমার পরদাদার নাম ভোলানাথ। কথায় কথায় রাগ; রাগলে পরে নাকের পাটা ফুলে উঠত। রোজ সকালে উঠে আগে নিজের বাপের সঙ্গে একটু করে তারপর মুখ ধুতে যেত। ওই উস্তুম-ধুস্তুমটি না হলে ওনার পেটখারাপ হয়ে যেত’।

    ছোটে পালোয়ানের বর্ণনায় পুরনো দিনের জন্যে এক ভালোলাগা ঝরে পড়ে। ওর কিসসা শুনতে শুনতে শ্রোতার চোখের সামনে ফুটে ওঠে একটি উনবিংশ শতকের গাঁইয়ের ছবি, যেখানে দরজার সামনে একগাদা গাইবলদ, গোবর ও চোনার ঝাঁঝালো গন্ধ, নিমের ছায়া আর যার নীচে খাটিয়ায় দুই মহাপুরুষ গড়াতে থাকে ও মাঝে মাঝে উঠে বসে গা’ থেকে নিমের পাতা ফুল ঝাড়তে ঝাড়তে একে অন্যকে এতক্ষণ শুয়ে থাকার অপরাধে গাল পাড়তে থাকে। ওই দুই মহাপুরুষের একজন বাপ, অন্যজন তার ব্যাটা। এরপর দুজন একে অপরকে মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার হুমকি দিতে দিতে খাটিয়া ছেড়ে উঠে দু’চারটে আলতু ফালতু বকবক করে – ‘যাও সবে নিজ নিজ কাজে’ হয়ে যায়। একজন বলদের লেজ মোচড়াতে মোচড়াতে নিজের খেতের দিকে রওনা হয়। অন্যজন মোষ চরাতে অন্যের খেতে চলে যায়।

    এরকম একটা গল্প শেষ করার পর ছোটে হরদম বলত, ‘বাপটা মরে গেলে ভোলানাথ দুঃখে ভেঙে পড়েছিল’।

    এই লাইনটা ছোটে ন্যাকামি করে বলত না। ভোলানাথ সত্যি সত্যি ছিভেঙে পড়েছিল। ওর বংশে এমনই রেয়াজ ছিল। ওদের খানদানে সব প্রজন্মেই বাপ-ব্যাটার সম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ হত। ওরা প্রেম করত শুধু নিজেদের মধ্যে, লাঠালাঠি? সেও ওই বাপ-ব্যাটার মধ্যে।ওদের ভেতরে ভালো-মন্দ, সুপ্ত প্রতিভা বা গুণ যাই থাকুক তার প্রয়োগ বাপ-ব্যাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত।

    বাবা ভোলানাথ নিজের বাপবুড়ো মরে গেলে সত্যি সত্যি বড় শোক পেয়েছিল। জীবনে এক নি:সংগতা এক শূন্যতা ছেয়ে গেল। সকালে উঠে কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে না পেরে ওর পেট গুড়গুড় করতে লাগল। চোখে মুখে জল দেয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেল।রাতদিন খেতে বলদের মত পরিশ্রম করেও খাবার হজম হচ্ছিল না। তখন ওর ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ এগিয়ে এল। লোকে বলে যে ছেলে হোল বুড়ো বয়সে চোখের জ্যোতি। তা’ গঙ্গাপ্রসাদ সতের বছর বয়সেই নিজে বাপ ভোলানাথকে এমন একখান লাঠির ঘা কষাল যে তিনি মাটিতে চিৎপটাং। তাঁর চোখের মণি কড়ির মত বেরিয়ে এল এবং চোখের সামনে ফুলঝুরি জ্বলতে লাগল।

    এরপর বাপ-ছেলের সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেল। ভোলানাথ সরে গেল ওর মৃত বাপের ভূমিকায়, ওর ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ চলে এল ওর জায়গায়। কিছুদিন গেলে হাত-পায়ের ব্যথার চোটে ভোলানাথের পেট ঠিক হয়ে গেল বটে, কিন্তু কানের মধ্যে সারাক্ষণ একটা সাঁই সাঁই আওয়াজ চলতে থাকে। এটা বোধহয় গঙ্গাপ্রসাদের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া গালির স্রোতের দান। যাই হোক, এবার সকাল বেলা ঘরের মধ্যে উস্তুম-ধুস্তুম করার আশায় গঙ্গাপ্রসাদের পেটের মধ্যে গুরগুর শুরু হোল।

    ছেলে কুশহরপ্রসাদ হল ছোটু পালোয়ানের বাপ। কুশহরপ্রসাদ একটু গম্ভীর স্বভাবের। তাই বাপের সঙ্গে খামোখা গালাগালি করে সময় নষ্ট করত না। এছাড়া রোজ সকালে খেতে কাজ করতে যাওয়ার আগে বাপের সঙ্গে ঝগড়া করার যে কয়েক পুরুষের অভ্যেস সেটাও ও ছেড়ে দিল। তার বদলে আরম্ভ হোল মাসিক দরে মারপিট। গঙ্গাপ্রসাদের ছোটবেলা থেকেই নোংরা ছ্যাঁচড় গালির জন্যে এত নাম হোল যে নওজোয়ান গঞ্জহা’র দল রোজ বিকেলে ওর আড্ডায় হাজিরা দিতে লাগল। ওর মৌলিক এবং শিল্পসম্মত গালিগুলো শুনে ওরা পরে নিজের নামে চালিয়ে দিত। গালাগাল এবং গেঁয়ো গানের পদরচনার কোন কপিরাইট তো হয় না। এভাবে গঙ্গাপ্রসাদের গালিগুলো হাজার কন্ঠে হাজার পাঠান্তরের সঙ্গে ধ্বনিত হতে থাকল। কিন্তু বাপের এই প্রতিভায় কুসহর আদৌ প্রভাবিত হলনা। ও চুপচাপ গালি শুনতে শুনতে বাপকে মাসে একবার দু-চারটে লাঠির বাড়ি কষিয়ে ফের নিজের কাজে চলে যেত। দেখা গেল, বদহজমের পারিবারিক অসুখটি সারাতে এই পদ্ধতি বেশ কাজের। কারণ, বদহজমের সমস্যাটি গঙ্গাপ্রসাদের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছল।

    কুসহরপ্রসাদের আরও দুটো ভাই ছিল-বড়কু আর ছোটকু। ওরা দু’জন শান্তশিষ্ট, নিরস্ত্রীকরণের ভক্ত। সারাজীবনে একটা কুকুরকেও লাঠিপেটা করেনি। বেড়াল আরামসে ওর রাস্তা কাটে, ও তাদের একটা ঢিলও ছোঁড়েনা। কিন্তু ওরা বাপের থেকে গালি দেয়ার শিল্পকলা শিখে ফেলেছিল। আর তার দৌলতেই ওরা রোজ সন্ধ্যায় সমস্ত পারিবারিক ঝগড়ার সমাধান বিনা মারপিট করে সেরে ফেলত। রোজ সন্ধ্যে হলে দুই ভাই আর তাদের দুই গিন্নি মিলে যে ‘কাঁও কাঁও’ শুরু হত সেই অধিবেশন শেষ হতে হতে রাত দশটা। এই অধিবেশনগুলোর তুলনা দেশের সুরক্ষা সমিতির বৈঠকের সঙ্গে কয়রা যেতে পারে। কারণ ওই বৈঠকগুলোতেও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অনেকক্ষণ ‘কাঁও কাঁও’ করে যুদ্ধের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কম করে ফেলে।

    এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কুশহরপ্রসাদ পরিবারের রোজকার হল্লাগুল্লাকে ঘৃণার চোখে দেখাটা প্রতিক্রিয়াবাদীর চিহ্ন, কিন্তু আশপাশের লোকজনের রাজনৈতিক চেতনা অতটা বিকশিত হয়নি যে, কী আর করা! ফলে যেই সন্ধ্যেবেলা ছোটকু ও বড়কুর গালি এবং হাহাকারের ধ্বনি গলির কুকুরের ভৌ ভৌকে ছাপিয়ে উঠে শিবপালগঞ্জের আকাশকে বর্শার খোঁচায় ফালাফালা করে ফেলে অমনই পড়শিদের টিপ্পনি শুরু হয়ে যায়ও।

    ‘এখন এই কুকুরহাও (ঘেউ ঘেউ) মনে হচ্ছে আদ্দেক রাত অব্দি চলবে’।

    ‘একদিন একটা ফাটা জুতো নিয়ে এদের উপর চড়াও হব, তবেই এরা শিখবে’।

    ‘এর জিভে ব্রেক ফেল হয়ে গেছে। চলছে তো চলছেই’।

    এই ‘কুকুরহাও’ শব্দটা গঞ্জহাদের তৈরি। কুকুরের দল নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি করে আর একটা আরেকটাকে উসকে দেয়ার জন্যে খানিকক্ষণ চেঁচায়, সেটাই ‘কুকুরহাও’। শব্দকোষের নিয়ম-টিয়ম দেখলে ছোটকু এবং বড়কুর আলাপকে ‘কুকুরহাও’ বলা বোধহয় উচিত হবেনা। আসলে এরা দুইভাই দুইবৌ যা করে সেটা হোল বান্দরহাও। এরা বাঁদরের মত খোঁ খোঁ করে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কোন রেফারির বাঁশি না বাজলেও নিজে থেকে পিছিয়ে আসে। যদি বাইরের কেউ মধ্যস্থতা করতে আসে বা ওদের শান্তির মহত্ত্ব বোঝাতে চাইবে তাহলে তক্ষুণি ওরা দুজনে এক হয়ে তৃতীয় ব্যক্তির উপর খোঁ খোঁ করে হামলা করবে। বান্দরহাও এর এই নিয়ম সব গঞ্জহা জানে। তাই ছোটকু-বড়কুর পারিবারিক অধিবেশনের সমালোচনা হয় লুকিয়ে চুরিয়ে, পেছনে আর ওদিকে ওদের ওই অধিবেশন মাঝরাত পর্য্যন্ত বাধাহীন চলতে থাকে।

    ছোটে পালোয়ানের বাপ কুশহরপ্রসাদ হোল কম কথার কাজের মানুষ। ও ছোট দু’ভায়ের বাগীশ্বরী প্রবন্ধাবলীর ব্যাপারটা কোনদিন বোঝেনি।ওর স্বভাব হোল খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ হঠাৎ হাত চালিয়ে দেয়া। এটা আবার অন্য ভাইদের জীবনদর্শনের সঙ্গে একেবারে খাপ খায় না। এইজন্যে ও বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মারা যাবার কয়েকবছর পরে ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। মানে, কোন কথা না বলে একদিন লাঠির জোরে ভাইদের বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিল। ওরা বাধ্য হোল একটা ক্ষেতের মধ্যে ঝুপড়ি বানিয়ে বাণপ্রস্থ-আশ্রম মেনে নিতে, আর নিজে পৈতৃক বাড়িতে জোয়ান ছেলের সঙ্গে ওদের বাপছেলের খানদানি ঐতিহ্যের সঙ্গে গৃহস্থ-আশ্রম চালাতে লাগল।

    মাসের মধ্যে অন্ততঃ একবার বাপকে লাঠিপেটা করে কুশহরের এমন অভ্যেস হয়ে গেছল যে বাপ মরে যাওয়ায় ওর হা্তে মাসে দু’চার দিন পক্ষাঘাতের মত হয়ে যেত। পক্ষাঘাতের ভয়ে ও একদিন আবার লাঠি তুলে নিল এবং ছেলে ছোটে পালোয়ানের কোমরে ত্যাড়া করে এক ঘা কষাল। ছোটে তখনও ছোট, পালোয়ান হয়নি, কিন্তু গাঁয়ের বাইরে রেললাইনের পাশে তার টানা বড় বড় লোহার স্তম্ভের উপর সাদা সাদা ইনসুলেটর ঢিল ছুঁড়ে ভাঙা অভ্যেস করছিল। ওর নিশানা ছিল অব্যর্থ। যেদিন কুশহরপ্রসাদ ছোটের কোমরে লাঠির ঘা কষাল মাত্র সেইদিনই ও রেললাইনের ফাঁকে বিছানো নুড়ির থেকে বেশ ক’টা তুলে নতুন একটা স্তম্ভের গায়ে লাগানো সবক’টা ইন্স্যুলেটর ভেঙে আবার লাইনের ফাঁকে বিছিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। লাঠির ঘা’ খেয়ে ও রেললাইনের দিকে বিশ পা দৌড়ে গিয়ে একটা নুড়ি তুলে বাপের মাথাকে ইন্সুলেটর ভেবে তাক করল। ব্যস্‌ সেদিন থেকেই ওদের পরিবারে বাপ-ছেলের মধ্যে বংশপরম্পরায় চলে আসা সনাতন ধর্ম প্রাণ পেয়ে জেগে উঠল। ব্যস্‌ আরকি! এরপর প্রায় প্রতিমাসে কুশহরের চেহারায় দু’একটা ছোট ক্ষত পার্মানেন্ট দেখা যেতে লাগল। এভাবে অল্প দিনেই ও অঞ্চলের রানা সঙ্গার (বাবরের সঙ্গে লড়াইয়ে আশিটা ঘা’ নিয়ে লড়ে যাওয়া মেবারের রাণা) টাইটেল পেল।

    ছোটে পালোয়ান জোয়ান হয়ে উঠলে পরে বাপ-ব্যাটার মধ্যে শব্দের আদানপ্রদান থেমে গেল। ওরা উঁচুদরের শিল্পীর মত নিজের ভাবনার প্রকাশ চিহ্ন, প্রতীক ও ইংগিতের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে শুরু করল। ওদের মধ্যে মারপিটের ঘটনাও কমে গেল। ওসব বড় বড় নেতাদের জন্মদিন পালনের মত ধীরে ধীরে এক বার্ষিক অনুষ্ঠানের রূপ নিল, যা জনতার দাবি হোক না হোক, নির্ধারিত সময়ে পালন করা হয়ে থাকে।

    কুশহরপ্রসাদ চলে গেলে রোয়াকের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ফুট কাটল - এই হোল কলিযুগ! বাপের সাথে ব্যাটার ব্যভারটা দেখলে!

    মাথার উপরের নীম গাছের ডালপালা সরিয়ে আকাশের দিকে চোখ তুলে লোকটা ফের বলে উঠল, ‘প্রভু তুমি কোথায়? কবে কল্কি অবতাত্রের রূপ ধারণ করে নেমে আসবে?

    উত্তরে কোন আকাশবাণী তো দুর, একটা কাকের আওয়াজও শোনা গেল না। কল্কি অবতারকে আহ্বান করা লোকটির মুখ কালো হয়ে গেল। কিন্তু কুড়ুলের বাঁট পরীক্ষায় ব্যস্ত শনিচর তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, ‘যাও, তুমিও কুসহরের সঙ্গে সঙ্গে যাও। সাক্ষী দিও, সিকি-আধুলি কিছু না কিছু ঠিক জুটে যাবে’।

    বদ্রী পালোয়ান মুচকি হেসে সায় দিল। রঙ্গনাথ দেখল কল্কি অবতারের বাতেলা করা লোকটি একজন পুরুতের মত দেখতে বুড়োমানুষ। চিমড়ে গাল, খিচুড়ি দাড়ি, বোতামহীন জামা, মাথায় একটা যেমন তেমন গান্ধীটুপি, তার পেছন থেকে টিকি এমনভাবে বেরিয়ে যেন আকাশ থেকে বাজ পড়লে আর্থিং এর কাজ দেবে। ওর কপালে লাল চন্দনের ফোঁটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।

    লোকটা সত্যি সত্যি কুশহরের পেছন পেছন চলে গেল। শনিচর বলল, 'ওই হোল রাধেলাল। সাক্ষী দেয়ার একনম্বর। কোন উকিল, যত নামজাদাই হোক, আজ অব্দি ওকে জেরা করে পেরে ওঠে নি।'

    শনিচরের পাশে একটা আমোদগেঁড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভক্তিভরে বলে উঠল, ’রাধে্লাল মহারাজের উপর কোন দেবতার ভর হয়। মিথ্যে সাক্ষী চটপট দিতে থাকে। উকিলের দল চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে। বড় বড় লোকের হাওয়া টাইট হয়ে যায়’।

    খানিকক্ষণ রাধেলালের তারিফ করে কাটল। শেষে শনিচর আর ওই আমোদগেঁড়ের মধ্যে তর্ক বেঁধে গেল। শনিচরের হিসেবে রাধেলাল বড্ড গোঁয়ার আর শহরের উকিলগুলো হাঁদারাম, নইলে ওকে জেরায় কাত করতে পারে না? উলটো দিকে আমোদগেঁড়ে এটাকে দেবতার আশীর্বাদ এবং বিভূতি প্রমাণ করেই ছাড়বে। যুক্তি আর বিশ্বাসের লড়াইয়ে বিশ্বাস যে ক্রমশঃ যুক্তিকে পেড়ে ফেলছে সেটা বলার দরকার নেই। ঠিক তখনই পাশের কোন একটা গলি থেকে ছোটে পালোয়ান উদয় হোল। বৈদ্যজীর দরজায় এসে এদিক সেদিক উঁকিঝুঁকি মেরে তারপর বলল, 'চলে গেছে'?

    শনিচর বলল, ‘হ্যাঁ গেছে। কিন্তু পালোয়ান, এই পলিসিটা মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে’।

    পালোয়ান দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘তোর মনুষ্যত্বের ইয়ে করি’।

    শনিচর কুড়ুল হাতে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচাল, ‘দেখো বদ্রী ভাইয়া! তোমার বাছুর আমাকে চাট মারছে! সামলাও’!

    বৈদ্যজী ছোটেকে দেখে উঠে পড়লেন। রঙ্গনাথকে বললেন, ‘এমন নীচপ্রবৃত্তির মুখ দেখাও পাপ! একে এখান থেকে ভাগাও’! এই বলে উনি ভেতরে চলে গেলেন।

    ছোটে পালোয়ান বৈঠকখানার ভেতরে ঢুকে পড়ল। চারদিকে রোদের খেলা। সামনের নীমগাছে একগাদা টিয়েপাখি টে-টে করে ওড়াউড়ি করছে। রোয়াকের উপর শনিচর কুড়ুল হাতে খাড়া। বদ্রী পালোয়ান এক কোণে চুপচাপ একজড়া মুগুরের ওজন পরীক্ষায় ব্যস্ত।রঙ্গনাথ বৈঠকে পড়ে থাকা একটা বইয়ের পাতা ওল্টানোয় ব্যস্ত। ছোটে টের পেল যে হাওয়ায় বারুদের গন্ধ। এর জবাবে ও ছাতি ফুলিয়ে রঙ্গগনাথের পাশে ধপ করে বসে পড়ল আর চোয়াল নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুখের ভেতর পুরে রাখা সুপুরির জাবর কাটতে লাগল।তারপর ছোটে রঙ্গনাথের দিকে এমন করে তাকাল যেন ও একেবারে নস্যি। তারপর তিরিক্ষি ভাবে বলল, ‘তাহলে এই ব্যাপার! আমি তো আমার বদ্রীগুরুর ঘর ভেবে এসেছিলাম, কিন্তু যদি তোমাদেরই মাতব্বরি চলে তো এখানে আর পেচ্ছাপ করতেও আসছি না’।

    রঙ্গনাথ হেসে পরিবেশ হালকা করতে চাইল। ‘আরে না না, পালোয়ান বসো দিকিনি! মটকা গরম হয়ে থাকে তো এক লোটা ঠান্ডা জল খাও’।

    ছোটের গলার স্বর আগের মতই কর্কশ, ‘জল খাবো? আমি এখানে ছোঁচানোর জন্যেও জল চাইব না। সবাই মিলে আমায় ইল্লি করতে লেগেছে’।

    বদ্রী এবার ছোটের দিকে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর একটা মুগুর নিয়ে বাঁহাতে খেলতে খেলতে মুচকি হেসে বলল, ‘রেগে যাওয়া দুর্বলকে শোভা দেয়। তুমি কেন নাক ফোলাচ্ছ? তুমি মানুষ না পায়জামা’?

    ছোটে পালোয়ানের সমর্থনের ইশারা বুঝতে দেরি হল না। আরও মেজাজ দেখিয়ে বলল,’ বদ্রী গুরু! আমার একটূও ভাল লাগছেনা। সবাই আমার পেছনে হাত ধুয়ে পড়েছে্‌, কাঠি করছে।খালি বলে-বাপের গায়ে কেন হাত তুলেছ? বাপকে কেন মেরেছ?যেন কুশহরপ্রসাদ শিবপালগঞ্জে সবার বাপ!আর আমিই খালি ওর শত্রু’।

    বলতে বলতে ওর রাগ আরও চড়ে গেল। বলল,’ দেখ গুরু, শালা একটা বাপের মত বাপ হত, তাও বুঝতাম’।

    খানিকক্ষণ সবাই চুপ।

    রঙ্গনাথ ছোটে পালোয়ানের বাঁকা ভুরু মন দিয়ে দেখছে। শনিচর এবার রোয়াক থেকে দরবারের ভেতরে এল। ও পালোয়ানকে বোঝাতে চাইল, ‘এমন সব কথা মুখে আনতে নেই। একটু মাটিতে পা ফেল, খামোখা আকাশের বুকে খোঁচা মেরো না। কুসহর তোমাকে জন্ম দিয়েছে, পালন-পোষণ করে এত বড় করেছে, এটা তো মানবে’?

    ছোটে কুড়কুড়িয়ে বলল, ‘আমি বুঝি স্ট্যাম্প লাগিয়ে দরখাস্ত পেশ করেছিলাম — আমাকে জন্ম দাও? ওরে আমার জন্মদেনেবালে রে’!

    বদ্রী এতক্ষণ চুপচাপ কথাবার্তা শুনছিল। এবার মুখ খুলল, ‘অনেক হয়েছে ছোটে, এবার ঠান্ডা হ দিকি’!

    ছোটে নিরুৎসাহ ভঙ্গিমায় বসে রইল। বোধহয় নিমগাছের মাথায় টিয়ে পাখির টে-টে কিচিরমিচির শুনছিল। শেষে এক লম্বা শ্বাস টেনে বলল, ‘তুমিও আমাকেই দোষী ঠাউরেছ গুরু! তুমি জাননা এই বুড়োটা কত বড় ব্জজাত! ওর জ্বালায় বৌ-ঝিরা আমাদের বাড়িতে জল ভরা বন্ধ করে দিয়েছে। আরও বলি? এরপর আর কী বলার থাকে? জিভ নোংরা হবে’।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২০ জুন ২০২১ | ১৭৪০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন