এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • মিলেনিয়াম মলঃ পর্ব দুই 

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২১ অক্টোবর ২০২৩ | ২৯৯ বার পঠিত
  • (৩)

    শহরের এই এলাকাটা মাত্র কয়েক বছর আগে গড়ে উঠেছে। দুটো রিং রোড, এক আর দুই -- এর মাঝে চাঁদের ফলার মতন যে নীচু জলাভূমি পড়েছিল, বছর পাঁচেক আগে দু-তিনটে কোম্পানির একটা কনসর্টিয়াম সেটাকে বুজিয়ে রাস্তা বানিয়ে গড়ে তুলেছে অনুপম নগর নামে একটি পশ কলোনি। এখনো সেখানে তেমন করে জনবসতি গড়ে ওঠেনি। কিছু ছাড়া ছাড়া বড় বাড়ি, খালি পড়ে থাকা শপিং কমপ্লেক্স। দু-একটা চায়ের দোকান, পান-সিগ্রেটের কিওস্ক, ব্যস। অটোরিকশা বা সাইকেল রিকশার কোন স্ট্যান্ড নেই। কিছু রাস্তায় সুরকি আর মোরাম ঢালা হয়েছে। পাকা হতে আরো দুটো বর্ষা পেরিয়ে যাবে। এখানে একটি ফাঁকা মাঠের পাশে ইংরেজি এল আকারের একটি সাদা বাড়ি, দোতলা।
    বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের চেনা সেই ছাইরঙা এস্টিম গাড়িটি। আর ঘন্টা দুই আগে এবাড়ির 'এল' এর ছোট ভাগে দোতলার স্যুট নম্বর 'ডি' তে ঠাঁই হয়েছে মিঃ সদাশিবনের। দস্তুরমত রেজিস্টারের পাতায় যথাবিধি নামগোত্র লিখে প্যান কার্ডের ফোটোকপি জমা দিতে হয়েছে। বাড়িটা গুলাবচন্দানি পরিবারের গেস্ট হাউস। কিন্তু রেজিস্টার দেখে সদাশিবন বুঝতে পেরেছেন যে এর অধিকাংশ স্যুট বছরের বেশির ভাগ সময় খালিই পড়ে থাকে।
    সাদামাটা বাড়িটার পেছন দিকে রয়েছে মস্ত বড় সবুজ ঘাসে ঢাকা লন। তাতে লুকনো ফোয়ারা আর আলোর ব্যব্স্থা রয়েছে। মাঝে মধ্যে সীমিত সংখ্যক লোকের জমজমাট পার্টি হয় বলে মনে হচ্ছে। একতলায় অতিথিদের জন্যে বড় ডাইনিং হল ও আলমারিতে সাজানো ক্রকারি দেখলে এই সিন্ধি ব্যবসায়ী পরিবারটির রুচির প্রশংসা করতেই হয়। পুরো বাড়িটার ব্যব্স্থাপনার দায়িত্ব রয়েছে রোশনলাল।
    চল্লিশ পেরনো রোশনলাল আদতে উত্তরপ্রদেশের আজমগড় এলাকার লোক। পাঁচবছর আগে এই গেস্ট হাউস তৈরির সময় থেকেই ও এর খানসামা, চৌকিদার ও গাড়ির শোফার। নীচের এক অংশে ও পরিবার নিয়ে থাকে। গোটা পরিবারের সদস্যরা বাড়িটির সাফ- সাফাই বাগান ও লনে জল দেয়া, গাড়ি সাফ করা, রান্নাঘর ও বাথরুমের আবশ্যক কাজ, স্যুট গুলির বিছানা, টিভি, এসি সবগুলোকে ব্যবহারযোগ্য করে রাখা --- সব কিছুতে যুক্ত থাকে।

    সদাশিবনের স্যুটটি মন্দ নয়। দুটো কামরা।পর্দা ঢাকা জোড়া জানালা। একজোড়া সামনের বারান্দার দিকে, আর একজোড়া পেছনের দেয়ালে খাটের কাছে। বাথরুমের গীজার, সিস্টার্ন, ঘরের ব্লু স্টার এসি সবই কাজ করছে। ফ্লোরের কার্পেট ও দেয়ালের ছবিগুলো খারাপ নয়।ওয়াড্রোবের ভেতরের ড্রয়ারে একখন্ড ভগবদগীতা রাখা। পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়ল একটি পংক্তি কেউ হলুদ হাইলাইটার দিয়ে দেগে দিয়েছেঃ
    "কর্ম্মণ্যেব্যধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন"।
    সদশিবনের ঠোঁটে একটু মুচকি হাসি ফুটে উঠল। বইটি রেখে দিয়ে পেছনের দেয়ালের জানলার পর্দা সরিয়ে তাকালেন। চোখে পড়ছে নীচের লন, পাশে রাত্তিরে গাড়ি রাখার গ্যারাজ, উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল, তার পেছনে একটি পুকুরের আভাস।
    সদাশিবন অভ্যস্ত পেশাদারি চোখে দূরত্বটা আন্দাজ করছিলেন, শোবার খাটটা অন্য কোণায় সরাবার দরকার আছে কি না ভাবছিলেন। কিন্তু বারান্দার দিক থেকে একটা হালকা খুটখাট আওয়াজে তাঁর মনোযোগ নষ্ট হল। পেছন ফিরে যা দেখলেন তা মস্তিষ্কে রেজিস্টার হতে ওনার দু'সেকন্ড সময় বেশি লাগল।
    সামনের বারান্দার দিকের জানলার পর্দা ফাঁক করে ঢুকে পড়েছে একটি বন্দুকের সরু নল, অন্ধের মত একটু এদিক ওদিক নড়ে যেন কিছু ঠাহর করার চেষ্টা করছে।
    দু'সেকন্ড।
    এর মধ্যে বহুবছরের ড্রিলে অভ্যস্ত শরীর মস্তিষ্কের কোষে ধরা বিপদের সিগন্যাল অনুধাবন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাটিতে, আর নিজেকে গুটিয়ে গড়িয়ে ঢুকে গিয়েছে খাটের নীচে। এবারে ঘরের সন্নাটা খান খান হয়ে গেল এক কৃত্রিম ধাতব র‌্যাট-ট্যাট-র‌্যাট -ট্যাট শব্দে সঙ্গে বিদ্যুতের চমক। সঙ্গে বিচ্ছিরি খ্যা-খ্যা-খ্যা-খ্যা হাসি।
    কিন্তু-- কিন্তু আওয়াজটা কেমন যেন! নাঃ হিসেব মিলছে না। কোন ধোঁয়া বা কর্ডাইটের গন্ধ নেই।
    আর পাঁচ সেকন্ড। খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে একঝটকায় উঠে পড়েছেন সদাশিবন আর তারপরেই দৌড়ে বেরিয়ে বারান্দায় এসে হতবাক।
    বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রায় বছর পনেরোর একটা ছেলে, জানলা দিয়ে একটি ফাইবারের খেলনা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দিয়ে ট্রিগারে আঙুল চেপে একটা গা-শিউরানো হ্যা-হ্যা করে হেসে চলেছে।
    সদাশিবন সংযম হারালেন।
    কিছু ভাবার আগেই ওঁর উল্টোহাতের চড় খেয়ে ছিটকে পড়েছে ছেলেটি। আর ওর খেলনা বন্দুক হয়ে গেছে দু'টুকরো।
    অবাক ছেলেটি বারান্দায় শোয়া অব্স্থাতেই ফোঁপাতে থাকে। তারপর হঠাৎ গলার স্বর চড়িয়ে চিলচিৎকার জুড়ে দেয়।
    -- “এ দাই ও! মোর দদা গ'। এ রাক্ষস মোলা মারিস্‌! মোর বন্দুক লা তোড় দিস্‌। মোর বন্দুক! মোর বন্দুক! এ দাদা গ', মোর বন্দুক লা!”

     ও মা, ও বাবা! দেখ এসে, এই রাক্ষসটা আমায় মেরেছে, আমার বন্দুকটা ভেঙে দিয়েছে। ও বাবা গো, আমার বন্দুক!

    সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। দৌড়ে উঠে এসেছে রোশনলাল, ওর স্ত্রী, আর ভাই।
    - “কা হইস সাহাব?”
    তারপর ছেলেটার ফোঁপানো কান্নার মাঝে ভাঙা ভাঙা কথা আর সদাশিবনের চেহারায় যুগপৎ রাগ ও অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে ও ব্যাপারটা বুঝে নেয়।
    --“ মাফি দেও সাহাব। গলতি মোর হবে, মোর বেটাকে নো হয়।”
    ( ক্ষমা করে দিন সায়েব, দোষ আমার, আমার ছেলের নয়।)
    -- “তোমার ছেলে?”
    -- “হ্যাঁ সায়েব, আমার একলৌতা বেটা, চমন। ওকে পাঠিয়েছিলাম আপনার সঙ্গে আলাপ করতে। বড়বাবুর নির্দেশ যে সব সময় আপনার ফাইফরমাশ খাটার জন্যে, ছোটখাট জরুরত দেখার জন্যে একজন লোক চাই। তা আমার ছেলেটা চটপটে , কথা শোনে। ভাবলাম ওকেই লাগিয়ে দিই। ছেলেটর সব ভাল।কিন্তু টিভি আর ভিডিও গেমস এর পোকা। সারাক্ষণ টিভিতে যত কমিক চ্যানেল-- ডোরেমন-পাকেমন আর কি কি সব দেখতে থাকে। ওর কোন বন্ধুটন্ধু নেই। ধাড়ি ছেলে খেলতেও যায় না। আর মনে মনে কখনো হী-ম্যান, কখনো ব্যাটম্যান হয়ে যায়। সিনেমা দেখবে তো ওইসব যুদ্ধ-টুদ্ধ। খালি বন্দুক-কামান, গোলাগুলি।”
    --- “তা বলে আমার জানলা দিয়ে অমনি করবে? আর বিকট আওয়াজ করে হাসবে?”
    --- “এটা ওর আপনার সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা। বন্দুকটা তিনবছর আগের জন্মদিনে ওর মা কিনে দিয়েছিল। আর হাসিটা ওই ব্যাটমান ফিল্মের ভাঁড়ের। ও কিন্তু ভালো নকল করতে পারে।“
    --- “কিন্তু আমার সঙ্গে আলাপ করতে এইসব করল কেন?”
    -- “আপনি যে যুদ্ধ করেছেন। মিলেট্রির লোক। বন্দুক-কামানের ব্যাপারে ভাল জানেন।”

    সদাশিবনের চোয়াল শক্ত হল।
    --- “ওকে কে বলেছে আমি যুদ্ধ করেছি? তুমিই বা জানলে কি করে?”
    --- “বড়বাবু বলেছেন। মানে বড়া মালিকের বড়া বেটা রমেশ গুলাবচন্দানীজি।”
    --- “ঠিক কী বলেছেন?”
    --- “বলেছেন, আপনি মিলিট্রির পুরনো লোক। আপনি সিকিউরিট ভাল বোঝেন। এখন এই যে মিলেনিয়াম মল তৈরি হচ্ছে আপনি তার সুরক্ষা দেখভাল করবেন। আর বলেছেন যাতে আপনার কোন কষ্ট না হয়। সাহেব, ওকে মাপ করে দিন। ছেলেটা একটু বিমার আছে। আমি মাঝে মাঝে ওকে মীরা দাতারের দরগায় ঝাড়ফুঁক করাতে নিয়ে যাই। কিন্তু ও দিল সে সাচ্চা!
    বাবুজিকে কিছু বলবেন না। তাহলে আমাদের সবার চাকরি যাবে। আমি সব ঠিক করে দেব।“

    সদাশিবন চুপ করে কিছু ভাবছেন।
    --- “সাহাবজি, আমি বলতে এসেছিলাম যে একঘন্টা পরে আপনাকে নিতে বড়বাবু নিজে আসবেন। মল দেখাতে নিয়ে যাবেন। তৈয়ার থাকতে বলেছেন। ফোন এসেছিল। আমাদের গুস্তাখি মাফ করে দিবেন সাহেব।”

    (৪)

    -- “আসল সমস্যা হল ওই ডোমটা কে ঠিকমত ব্যালান্স করে বসানো। এইটার জন্যে সময় লাগছে। কিন্তু বেঙ্গালুরুর সীমেক কোম্পানিকে বরাত দিয়েছি। খুবই প্রফেশনাল। স্কেডিউল ধরে কাজ করে। সময়মত কাজ তুলে দেবে। ডেডলাইন নিয়ে কোন সমস্যা হবে না।”
    রমেশ গুলাবচন্দানী ঘুরে ঘুরে প্রোজেক্ট সাইট দেখাচ্ছেন সদাশিবনকে। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে ।
    ছত্তিশগড়ের মত মাত্র এক দশক আগে জন্ম নেওয়া রাজ্যের পক্ষে এই প্রোজেক্ট অ্যামবিশাস বললে কম বলা হয় । তাই রমেশ গুলাবচন্দানীর উত্তেজনা স্বাভাবিক, কিছুটা বোধহয় সদাশিবনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কোথায় কিছু একটা চাপা অস্বস্তি, একটা কোন তরফের তার বেসুরো বাজছে। সেটা কি রমেশের অতি আত্মবিশ্বাসী ভাবভঙ্গি? সদাশিবন ধরতে পারছেন না ।
    --- “এখনও তো অনেক কাজ বাকি। গ্রাউন্ড ফ্লোর ও ফার্স্ট ফ্লোর মোটামুটি হয়ে গেছে। কিন্তু সেকন্ড ফ্লোরের ইলেক্ট্রিক্যাল কাজ শেষ হয় নি। আর থার্ড ফ্লোরের শপগুলোর তো মাত্র স্ট্রাকচার খাড়া হয়েছে। এটা অগাস্টের শুরু। আর আপনি চাইছেন নতুন বছরের প্রথম দিনে মুখ্যমন্ত্রীর হাত দিয়ে এই মিলেনিয়াম মলের উদ্ঘাটন করাবেন।”
    --- “মুখ্যমন্ত্রী রাজি হয়েছেন। তারিখ পাকা। কোন নড়চড় হবে না।”
    --- “বেশ, ওসব আপনার আর সীমেক কোম্পানির প্রফেশনাল প্রবলেম। কিন্তু আমাকে কেন আনা হয়েছে , মানে এই কর্মকান্ডের মধ্যে আমার কী ভূমিকা তা এখনো বুঝতে পারছি না।“
    --- “আপনি এই প্রোজেক্টের সিকিউরিটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবেন।”
    একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সদাশিবন বললেন — “আমিই কেন? আপনার বাবার বন্ধু ছত্তিশগড় রাজ্যের প্রাক্তন ডিজি বিক্রমজিত কেন ন'ন? গুলাবচন্দানী সাম্রাজ্যের কাজ পেয়ে গেলে ছত্তিশগড়ের যে কোন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার বর্তে যাবে।”
    -- “তিনটে কারণ। 
    প্রথমতঃ উনি আমার বাবার বন্ধু। সাধারণতঃ এ'ধরণের ক্রিটিক্যাল কাজে আমরা পারিবারিক বন্ধুদের যুক্ত করিনা। তাতে কাজ হয় না, উল্টে সম্পর্কে চিড় ধরে।
    দ্বিতীয়তঃ উনি শুধু পুলিশ অফিসার, আইপিএস। ওঁর অনার্স ছিল মডার্ন হিস্ট্রিতে। আপনি চেন্নইয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট, তায় ইলেক্ট্রিক্যাল। আমার প্রজেক্টে ইলেক্ট্রিক্যাল পার্টটাই খুব সেন্সিটিভ। ভুল হলে খুব বড় অ্যাক্সিডেন্ট হবে। আর স্যাবোটাজ হলে--!
    তৃতীয়তঃ আপনাকে এখানে কেউ চেনে না। ফলে স্থানীয় কোন ফ্যাক্টর আপনাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। বলা উচিত, আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ট হতে পারবে না।”

    সদাশিবন সামনে রাখা ড্রিংকসে দুটো বরফের কিউব ফেলে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। ঘন্টা দুই হল গুলাবচন্দানী পরিবারের 'বড়েবাবু' রমেশ গুলাবচন্দানী নিজে সঙ্গে করে গোটা মিলেনিয়াম মল ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। এবার এম জি রোডে ওঁর অফিসে বসে ওঁরা আলোচনায় মগ্ন।
    দু'সপ্তাহ আগে এক পুরনো বন্ধুর মাধ্যমে রমেশের সঙ্গে সদাশিবনের যোগাযোগ। কিছু কথাবার্তার পর রমেশ বললেন—“আপনি চলে আসুন। প্লেনের টিকেট আর পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। এসে সব দেখেশুনে তারপর কন্ট্র্যাক্ট সাইন করবেন। ইচ্ছে না হলে করবেন না। কিন্তু আমি ভরসা করছি আপনি হ্যাঁ করবেন ধরে নিয়ে। পাঁচ-ছ'মাসের ব্যাপার। থাকাখাওয়ার দায়িত্ব আমাদের কোম্পানির। দায়িত্ব নিলে প্রতিমাস দু'লক্ষ টাকা । সাইন করতেই দু'মাসের টাকা অগ্রিম অ্যাকাউন্টে জমা হবে। যিনি আপনার কথা বলেছেন তিনি জানেন এই লাইনে আপনার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মত কেউ নেই।”

    তোষামোদে কে না গলে?
    সদাশিবন দেখে আসতে ক্ষতি কী ভেবে চলে এসেছেন।

    এখানে এসে দেখলেন বিরাট ব্যাপার। ছত্তিশগড়ে গোটা চোদ্দ মল খুলেছে।কিন্তু রমেশ গুলাবচন্দানী যা করতে যাচ্ছেন তার ব্যাপ্তি বিশাল।

    কিন্তু এত লোক থাকতে সদাশিবন কেন? কোন চেনা লোকের সুপারিশ? ব্যস্‌? নাঃ, হিসেব মিলছে না।

    -- “আচ্ছা, ব্লু-প্রিন্ট দেখান। বেসমেন্টের লে-আউট ?। ইলেক্ট্রিক্যাল কনেকশনের লে-আউট? সার্কিট ডায়াগ্রাম? কর্পোরেশন, আরবান ডেভেলপমেন্ট অথরিটির নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট? ফায়ার ব্রিগ্রেডের রিপোর্ট? জমির টাইটেল ডীডের কপি? ত্রিশ বছরের ল্যান্ড রেকর্ডের সার্চ রিপোর্ট? সব আছে? ব্রোশার? আর্কিটেক্টের রিপোর্ট? সব আছে? বেশ, আমার এইসব রিপোর্ট, এই বিল্ডিংয়ের ছবি সব মিলিয়ে একটি সিডি চাই। আছে?”

    -- “এবার তাহলে সিকিউরিটির ওভার অল সুপারভিশনের কন্ট্র্যাক্ট সাইন করতে আপত্তি নেই তো? আমার লিগ্যাল ডিপার্টমেন্ট সব তৈরি করে রেখেছে। পড়ে নিন।”
    রমেশ একটি ফোল্ডার এগিয়ে দিলেন।
    সদাশিবন পাতা ওল্টাচ্ছেন কিন্তু ক্লজগুলো দেখছেন না।
    এবার মাথা তুলে সোজা তাকালেন।

    --- “মিঃ গুলাবচন্দানী! এসব তো হল। আমি সাইন করতে পারি। কিন্তু আগে একটি প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব চাই। নইলে এখানেই গুডবাই। আপনাকে কাল দিল্লি ফেরার টিকিট আনিয়ে দিতে হবে।”
    -- “প্রশ্নটা কী?”
    -- “আমাকে নিয়ে আপনার আগ্রহের পেছনে আপনি তিনটে কারণের কথা বলেচেন। কিন্তু আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে একটা চতুর্থ কারণও আছে। সেটা কী আমি জানিনা। জানলে তবে সাইন করার কথা ভাবব।”
    -- “সেটা হল আপনার অনেস্টি ও অন্যায়ের সাথে আপোষ না করা। আমরা জানি আপনার কিছু সেট অফ ভ্যালুজ আছে। আর সেসব নিয়ে আপনি বেশ রিজিড। কোন কম্প্রো তে রাজি হন না। এর জন্যে আপনি আগের কিছু চাকরি ছেড়েছেন। শেষে গত একদশক ধরে এই সিকিউরিটি কনসালট্যান্টের কাজ করছেন।”
    --- “আর কী জানেন?”
    -- “সবই। বা অধিকাংশ ঘটনা। যেমন, আপনি নব্বইয়ের দশকে আই পি কে এফ এর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এর মেজর হিসেবে শ্রীলংকায় দু'বছর ছিলেন। সেখানে মেডিক্যাল কোরের সার্জন মেজর বিজয়লক্ষ্মী চৌহানের সঙ্গে আপনার গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। দক্ষিণ জাফনায় একটি প্রত্যন্ত গ্রামে অপারেশনের পর যখন শ্রীলংকার সরকারি ফৌজ আপনাদের একটি অক্সিলিয়ারি টিমকে সঙ্গে নিয়ে ঢোকে তখন সেখানে সাধারণ তামিল গ্রামবাসী ও কিছু আহত ছাড়া কেউ ছিল না।
    “কিন্তু সরকারি ফৌজের চোখে সবাই ছদ্মবেশি লিট্টে গেরিলা। ওরা দশজন পুরুষ ও তিনজন মেয়েকে ওদের দিয়েই ট্রেঞ্চ খুঁড়িয়ে তাতে নামিয়ে গুলি করে মারে।
    আপনি বারণ করেছিলেন। সরকারি কম্যান্ডার শোনে নি।আপনাকে বলে যে এগুলো মিলিটারি ট্যকটিক্যাল ডিসিশন। এগুলো আপনার এক্তিয়ারের বাইরে।
    তারপর ডঃ বিজয়লক্ষ্মী দুজন গর্ভবতী তামিল মহিলার ক্ষতে ড্রেসিং করে ইঞ্জেকশন লাগাতে গেলে দু'জন সৈনিক বাধা দেয়। বলে এইসব দামী ওষুধ্পত্তর সহজে পাওয়া যায় না। এগুলো দুশমনের ঘরের বৌদের জন্যে খরচ করা চলবে না।
    অসহায় বিজয়লক্ষ্মী কেঁদে ফেলেন। তখন আপনি ওই লংকান সৈনিকটির সংগে কথাকাটকাটি ও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন।শ্রীলংকার মিলিটারি পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করে। আর ভারতীয় দূতাবাস আপনাকে দেশে ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়।
    তারপর আর্মি হেড কোয়ার্টার কোর্ট মার্শাল করে আপনাকে সাসপেন্ড করে।
    ছোটবেলা থেকেই আপনি একটু জেদি আর মেজাজি। পরের বছর ডঃ বিজয়লক্ষ্মীর সঙ্গে আপনার পুরনো সম্পর্কও শেষ হয়ে যায়।”

    --- “কথাটা শেষ করুন। আমার যা ক্যারেকটার তাতে তো আপনাদের সাম্রাজ্যে আমি পার্সোনা নন গ্রেটা !”
    ---“ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমার স্বপ্নের এই মিলেনিয়াম মলের মুখ্যমন্ত্রীজির হাতে উদ্বোধনের আগে আপনি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। প্রোজেক্টটি যাতে নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয় সেটা দেখা আপনার কাজ।”

    --- “অন্তর্ঘাতের আশংকা কোথায়? ভেতরে না বাইরে? মাওবাদী হামলা? বুবিট্র্যাপ?”
    --- “তেমন কিছু দেখছি না। খুলেই বলি।
    এই ডিজাইনটা দেখুন। এই ডোম। এবার এর আইসোমেট্রিক ভিউ দেখুন আর এখানে এই ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়ারিং এর লে-আউট ও এই ব্রেকার গুলোর সার্কিট ডায়াগ্রাম দেখুন।
    নববর্ষের দিন এই মলে খুব বড় কালচারাল নাইট হবে। বিশিষ্ট নিমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে নামকরা আর্টিস্ট দের নাচ-গান হবে। তার আগে মুখ্যমন্ত্রীজি ফিতে কেটে গ্রাউন্ড ফ্লোরের উদ্ঘাটন করবেন।সেন্সর দেয়া দরজাটা অতিক্রম করে ডোমের নীচে এসে যেই উনি একটি রিমোটের বোতাম টিপবেন ডোমের ওপরটা আস্তে আস্তে খুলে গিয়ে আকাশ দেখ যাবে আর ডোমের থেকে উড়ে যাবে একশ' বেলুন, তাতে মিলেনিয়াম মলের নাম লেখা।
    এই আইডিয়াটা যেমন নভেল তেমনি রিস্কি। বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী আছেন যখন। কোন কারণে কিছু হয়ে গেলে? আই জি রায়পুরের আপত্তি ছিল। কিন্তু আমি নিজের খরচায় দিল্লি থেকে
    আপনাকে নিযুক্ত করায় ওরা মত দিয়েছে।”
    --- “কিন্তু ভয়টা কোথায়?”
    --- “এই ফাইলটা নিন। নিজের রুমে গিয়ে পড়বেন। এতে সব আছে।”
    --- “এ তো দেখছি এক সুপুরুষ যুবকের ফাইল, রাজকুমার গুলাবচন্দানী।
    আপনাদের পরিবারের কেউ?”
    --- “আমার ভাই। অত্যন্ত মেধাবী, কূটবুদ্ধি, কিন্তু আস্ত শয়তান। আমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়েছি। আপনি মেফিস্টোফিলিসের নাম শুনেছেন? বা ফাউস্ট? শোনেন নি? আচ্ছা, নিদেনপক্ষে ছোটবেলায় 'ডঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড'? ছবিতে যা দেখছেন তা হল মুখোশ, আসল চেহারাটা ফাইলে আছে।”
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২১ অক্টোবর ২০২৩ | ২৯৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন